পঞ্চম খণ্ড – প্রথম অধ্যায় – প্রথম পাদ: ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরের প্রভাব
কেশব-প্রমুখ ব্রাহ্মগণের ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের আচার্য শ্রীযুক্ত কেশবচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ হইবার পরে কলিকাতার জনসাধারণ ঠাকুরের কথা জানিতে পারিয়াছিল। গুণগ্রাহী কেশব প্রথম দর্শনের দিন হইতেই যে ঠাকুরের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন, এ কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। পাশ্চাত্যভাবে ভাবিত হইলেও তাঁহার হৃদয় যথার্থ ঈশ্বর-ভক্তিতে পূর্ণ ছিল এবং অমৃতময় ভক্তিরসের একাকী সম্ভোগ করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সুতরাং ঠাকুরের পুণ্যদর্শন ও অমৃতনিঃস্যন্দিনী বাণীতে তিনি জীবনপথে যতই নূতন আলোক দেখিতে লাগিলেন, ততই ঐ কথা মুক্তকণ্ঠে জনসাধারণকে জানাইয়া তাহারা সকলেও যাহাতে তাঁহার ন্যায় তৃপ্তি ও আনন্দ লাভ করিতে পারে, তজ্জন্য সোৎসাহে আহ্বান করিতে লাগিলেন। সেইজন্য দেখা যায়, পূর্বোক্ত সমাজের ইংরাজী ও বাংলা যাবতীয় পত্রিকা, যথা – ‘সুলভ সমাচার’, ‘সানডে মিরর্’, ‘থিইস্টিক্ কোয়ার্টার্লি রিভিউ’ প্রভৃতি এখন হইতে ঠাকুরের পূত চরিত, সারগর্ভ বাণী ও ধর্মবিষয়ক মতামতের আলোচনায় পূর্ণ। বক্তৃতা এবং একত্র উপাসনার পরে বেদী হইতে ব্রাহ্মসঙ্ঘকে সম্বোধনপূর্বক উপদেশ-প্রদানকালেও কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্ম-নেতাগণ অনেক সময়ে ঠাকুরের বাণীসকল আবৃত্তি করিতেছেন। আবার অবসর পাইলেই তাঁহারা কখনও দু-চারিজন অন্তরঙ্গের সহিত এবং কখনও বা সদলবলে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত সদালাপে কিছুকাল অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন।
ঠাকুরের ব্রাহ্মগণের সহিত সপ্রেম সম্বন্ধ
ব্রাহ্মনেতাগণের ধর্মপিপাসা ও ঈশ্বরানুরাগদর্শনে আনন্দিত হইয়া যাহাতে তাঁহারা সাধনসমুদ্রে এককালে ডুবিয়া যাইয়া ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ-দর্শনরূপ রত্নলাভে কৃতার্থ হইতে পারেন, তদ্বিষয়ে পথ দেখাইতে ঠাকুর এখন বিশেষভাবে যত্নপর হইয়াছিলেন। তাঁহাদিগের সহিত হরি-কথা ও কীর্তনে তিনি এত আনন্দ অনুভব করিতেন যে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া প্রায়ই মধ্যে মধ্যে কেশবের বাটীতে উপস্থিত হইতেন। ঐরূপে উক্ত সমাজস্থ বহু পিপাসু ব্যক্তির সহিত তিনি ক্রমে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হইয়াছিলেন এবং কেশব ভিন্ন কোন কোন ব্রাহ্মগণের বাটীতেও কখনও কখনও উপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগের আনন্দবর্ধন করিতেন। সিঁদুরিয়াপটির মণিমোহন মল্লিক, মাথাঘষা গলির জয়গোপাল সেন, বরাহনগরস্থ সিঁতি নামক পল্লীর বেণীমাধব পাল, নন্দনবাগানের কাশীশ্বর মিত্র প্রভৃতি ব্রাহ্মমতাবলম্বী ব্যক্তিগণের বাটীতে উৎসবকালে এবং অন্য সময়ে তাঁহার গমনাগমনের কথা দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লিখিত হইতে পারে। কখনও কখনও এমনও হইয়াছে যে, বেদী হইতে উপদেশপ্রদানকালে তাঁহাকে সহসা মন্দিরমধ্যে আগমন করিতে দেখিয়া শ্রীযুত কেশব উহা সম্পূর্ণ না করিয়াই বেদী হইতে নামিয়া আসিয়াছেন এবং তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহার বাণীশ্রবণে ও তাঁহার সহিত কীর্তনানন্দে সেই দিনের উপাসনার উপসংহার করিয়াছেন।
ঠাকুর তাঁহাদিগের মতের লোক – ব্রাহ্মদিগের এইরূপ ধারণা হইবার কারণ
স্ব স্ব সম্প্রদায়স্থ ব্যক্তিগণের সহিতই মানব অকপটে মিলিত হইতে এবং নিঃসঙ্কোচ-আনন্দানুভব করিতে সমর্থ হইয়া থাকে। সুতরাং তাঁহাদিগের সহিত তাঁহাকে ঐরূপভাবে মিলিত হইতে এবং আনন্দ করিতে দেখিয়া ব্রাহ্মনেতাগণ যে ঠাকুরকে এখন তাঁহাদিগের ভাবের ও মতের লোক বলিয়া স্থির করিবেন, ইহা বিচিত্র নহে। হিন্দুদিগের শাক্ত-বৈষ্ণবাদি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁহাকে তাঁহাদিগের প্রত্যেকের সহিত ঐরূপে যোগদান ও আনন্দ করিতে দেখিয়া অনেক সময়ে ঐরূপ করিয়াছেন। কারণ সর্বভাবের উৎপত্তি এবং সমন্বয়ভূমি ‘ভাবমুখ’-এ অবস্থিত হইতে সমর্থ হইয়াছিলেন বলিয়াই যে ঠাকুর ঐরূপ করিতে পারিতেন – এ কথা তখন কে বুঝিবে? কিন্তু তিনি যে তাঁহাদিগের সহিত নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের ধ্যান ও কীর্তনাদিতে তন্ময় হইয়া তাঁহাদিগের অপেক্ষা অধিক আনন্দ অনুভব করিতেছেন এবং তাঁহারা যেখানে অন্ধকার দেখিতেছেন সেখানে অপূর্ব আলোক সত্য সত্য প্রত্যক্ষ করিতেছেন, এ বিষয়ে ব্রাহ্মসমাজস্থ ব্যক্তিগণের বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তাঁহারা এ কথাও বুঝিয়াছিলেন যে, ঈশ্বরে সর্বস্ব অর্পণ করিয়া তাঁহার ন্যায় তন্ময় হইতে না পারিলে ঐরূপ দর্শন ও আনন্দানুভব কখনও সম্ভবপর নহে।
ব্রাহ্ম সাধকদিগকে ঠাকুরের সাধনপথে অগ্রসর করা
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজস্থ অনেকগুলি ব্যক্তির সত্যানুরাগ, ত্যাগশীলতা এবং ধর্মপিপাসা প্রভৃতি সদ্গুণনিচয় দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাদিগকে নিজ জীবনাদর্শে ধর্মপথে অগ্রসর করিয়া দিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। ঈশ্বরানুরাগী ব্যক্তিগণ যে সম্প্রদায়ভুক্তই হউন না কেন, তিনি তাঁহাদিগকে চিরকাল পরমাত্মীয় জ্ঞান করিতেন এবং যাহাতে তাঁহারা নিজ নিজ পথে অগ্রসর হইয়া পূর্ণতা প্রাপ্ত হন, তদ্বিষয়ে অকাতরে সাহায্য প্রদান করিতেন। আবার যথার্থই ঈশ্বরভক্ত সকলকে ঠাকুর এক পৃথক জাতি বলিয়া সর্বদা নির্দেশ করিতেন এবং তাঁহাদিগের সহিত একত্রে পান-ভোজন করিতে কখনও দ্বিধা করিতেন না। অতএব কেশব এবং তাঁহার পার্ষদগণ, যথা – বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, চিরঞ্জীব শর্মা, শিবনাথ শাস্ত্রী, অমৃতলাল বসু প্রমুখ ব্যক্তিগণকে তিনি যে এখন পরম স্নেহের চক্ষে দেখিয়া আধ্যাত্মিক সহায়তা করিতে উদ্যত হইবেন এবং তাঁহাদিগের সহিত একত্র পান-ভোজনে সঙ্কুচিত হইবেন না, এ কথা বলা বাহুল্য। পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ভাব-সহায়ে ইঁহারা যে জাতীয় ধর্মাদর্শ হইতে বহুদূরে বিচ্যুত হইয়া পড়িতেছেন এবং অনেক সময়ে সমাজ-সংস্কারকেই ধর্মানুষ্ঠানের চূড়ান্ত জ্ঞান করিয়া বসিতেছেন, এ কথা বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হয় নাই। তিনি সেজন্য তাঁহাদিগের ভিতরে যথার্থ সাধনানুরাগ প্রবুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং সমাজ তাঁহাদিগের সহিত ঐ পথে অগ্রসর হউক বা না হউক, একমাত্র ঈশ্বর-লাভকেই তাঁহাদিগকে জীবনোদ্দেশ্যরূপে অবলম্বন করাইতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। ফলে, শ্রীযুত কেশব সদলবলে তৎপ্রদর্শিত মার্গে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন – মধুর মাতৃনামে ঈশ্বরকে সম্বোধন ও তাঁহার মাতৃত্বের উপাসনা সমাজে প্রচলিত হইয়াছিল এবং উক্ত সমাজের সাহিত্য, সঙ্গীত প্রভৃতি সকল বিষয়ে ঠাকুরের ভাব প্রবিষ্ট হইয়া উহাকে সরস করিয়া তুলিয়াছিল। শুদ্ধ তাহা নহে; কিন্তু ভ্রম ও কুসংস্কারপূর্ণ ভাবিয়া হিন্দুদিগের যে আদর্শ ও অনুষ্ঠানসকল হইতে ব্রাহ্মসমাজ আপনাকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথক করিয়াছিল, সে-সকলের মধ্যে অনেক বিষয় ভাবিবার এবং শিখিবার আছে – উক্ত সমাজের নেতাগণ এ কথাও ঠাকুরের জীবনালোকে বুঝিতে পারিয়াছিলেন।
ব্রাহ্মগণকে ‘ল্যাজা-মুড়ো’ বাদ দিয়া তাঁহার কথা গ্রহণ করিতে বলিবার কারণ
পাশ্চাত্যভাবে ভাবিত কেশব ও তাঁহার সঙ্গিগণ তাঁহার সকল প্রকার ভাব ও উপদেশ যে যথাযথ বুঝিতে পারিবেন না এবং যাহা বুঝিতে পারিবেন তাহাও সম্যক গ্রহণ করা তাঁহাদিগের রুচিকর হইবে না – এ বিষয় ঠাকুর পূর্ব হইতেই হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে উপদেশপ্রদানকালে কোন কথা বলিবার পরে ঐ বিষয় স্মরণ করিয়া তিনি সেজন্য প্রায়ই বলিতেন, “আমি যাহা হয় বলিয়া যাইলাম, তোমরা উহার ‘ল্যাজা-মুড়ো’ বাদ দিয়া গ্রহণ করিও।” আবার ব্রাহ্মসমাজভুক্ত অনেক ব্যক্তির নিকটে সমাজসংস্কার এবং ভোগবাসনার তৃপ্তিসাধন জীবনোদ্দেশ্যের স্থল অধিকার করিয়াছে – এ কথা তাঁহার বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। ঐ বিষয় তিনি অনেক সময়ে রহস্যচ্ছলে প্রকাশও করিতেন। বলিতেন –
ঠাকুরের রহস্যচ্ছলে শিক্ষাপ্রদান
“কেশবের ওখানে গিয়াছিলাম। তাঁহাদের উপাসনা দেখিলাম। অনেকক্ষণ ভগবদ্-ঐশ্বর্যের কথাবার্তার পরে বলিল – ‘এইবার আমরা তাঁহার (ঈশ্বরের) ধ্যান করি।’ ভাবিলাম কতক্ষণ না জানি ধ্যান করিবে! ওমা! দু-মিনিট চোক্ বুজিতে না বুজিতেই হইয়া গেল। – এইরকম ধ্যান করিয়া কি তাঁহাকে পাওয়া যায়? যখন তাহারা সব ধ্যান করিতেছিল, তখন সকলের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম। পরে কেশবকে বলিলাম, ‘তোমাদের অনেকের ধ্যান দেখিলাম, কি মনে হইল জান? – দক্ষিণেশ্বরে ঝাউতলায় কখনও কখনও হনুমানের পাল চুপ করিয়া বসিয়া থাকে – যেন কত ভাল, কিছু জানে না। কিন্তু তা নয়, তাহারা তখন বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছে – কোন্ গৃহস্থের চালে লাউ বা কুমড়োটা আছে, কাহার বাগানে কলা বা বেগুন হইয়াছে। কিছুক্ষণ পরেই উপ্ করিয়া সেখানে গিয়া পড়িয়া সেইগুলি ছিঁড়িয়া লইয়া উদরপূর্তি করে। অনেকের ধ্যান দেখিলাম ঠিক সেইরকম!’ সকলে শুনিয়া হাসিতে লাগিল।”
ঐরূপে রহস্যচ্ছলে শিক্ষাপ্রদান তিনি কখনও কখনও আমাদিগকেও করিতেন। আমাদের স্মরণ আছে, স্বামী বিবেকানন্দ একদিন তাঁহার সম্মুখে ভজন গাহিতেছিলেন। স্বামীজী তখন ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করেন এবং প্রাতে ও সন্ধ্যায় দুইবার উক্ত সমাজের ভাবে উপাসনা ও ধ্যানাদি করিয়া থাকেন। “(সেই) এক পুরাতন পুরুষ নিরঞ্জনে চিত্ত সমাধান কর রে” ইত্যাদি ব্রহ্মসঙ্গীতটি তিনি অনুরাগের সহিত তন্ময় হইয়া গাহিতে লাগিলেন। উক্ত সঙ্গীতের একটি কলিতে আছে – “ভজন-সাধন তাঁর, কর রে নিরন্তর”; ঠাকুর ঐ কথাগুলি স্বামীজীর মনে দৃঢ়মুদ্রিত করিয়া দিবার জন্য সহসা বলিয়া উঠিলেন, “না, না, বল – ‘ভজন-সাধন তাঁর, কর রে দিনে দুবার’ – কাজে যাহা করিবি না, মিছামিছি তাহা কেন বলিবি?” সকলে উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল, স্বামীজীও কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইলেন।
ব্রাহ্মগণকে শিক্ষাপ্রদান – ঐশ্বর্যজ্ঞানে ঈশ্বরকে আপনার করা যায় না
আর এক সময় ঠাকুর উপাসনাসম্বন্ধে কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মগণকে বলিয়াছিলেন, “তোমরা তাঁহার (ঈশ্বরের) ঐশ্বর্যের কথা অত করিয়া বল কেন? সন্তান কি তাহার বাপের সম্মুখে বসিয়া ‘বাবার আমার কত বাড়ি, কত ঘোড়া, কত গরু, কত বাগ-বাগিচা আছে’ এই সব ভাবে? অথবা, বাবা তাহার কত আপনার, তাহাকে কত ভালবাসে, ইহা ভাবিয়া মুগ্ধ হয়? ছেলেকে বাপ খাইতে পরিতে দেয়, সুখে রাখে, তাহাতে আর কি হইয়াছে? আমরা সকলেই তাঁহার (ঈশ্বরের) সন্তান, অতএব তিনি যে আমাদের প্রতি ঐরূপ ব্যবহার করিবেন তাহাতে আর আশ্চর্য কি? যথার্থ ভক্ত সেইজন্য ঐসকল কথা না ভাবিয়া তাঁহাকে আপনার করিয়া লইয়া তাঁহার উপর আবদার করে, অভিমান করে, জোর করিয়া তাঁহাকে বলে, ‘তোমাকে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করিতেই হইবে, আমাকে দেখা দিতেই হইবে।’ অত করিয়া ঐশ্বর্য ভাবিলে, তাঁহাকে খুব নিকটে, খুব আপনার বলিয়া ভাবা যায় না, তাঁহার উপর জোর করা যায় না। তিনি কত মহান, আমাদের নিকট হইতে কত দূরে, এইরূপ ভাব আসে। তাঁহাকে খুব আপনার বলিয়া ভাব, তবে তো হইবে (তাঁহাকে পাওয়া যাইবে)।”
ঈশ্বরের স্বরূপের অন্ত নির্দেশ করা যায় না
ঈশ্বরলাভের জন্য সাধন-ভজন ও বিষয়বাসনা-ত্যাগের একান্ত প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা করা ভিন্ন ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিয়া কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মগণ অন্য একটি বিষয়ও জানিতে পারিয়াছিলেন। পাশ্চাত্যের ধর্মপ্রচারকগণের মুখে এবং ইংরাজী পুস্তকাদি হইতে তাঁহারা শিক্ষা করিয়াছিলেন, ঈশ্বর কখনও সাকার হইতে পারেন না, অতএব কোন সাকার মূর্তিতে তাঁহার অধিষ্ঠান স্বীকার করিয়া পূজোপাসনাদি করায় মহাপাপ হয়। কিন্তু “নিরাকার জল জমিয়া সাকার বরফ হওয়ার ন্যায় নিরাকার সচ্চিদানন্দের ভক্তিহিমে জমিয়া সাকার হওয়া”, “শোলার আতা দেখিয়া যথার্থ আতা মনে পড়ার ন্যায় সাকারমূর্তি-অবলম্বনে ঈশ্বরের যথার্থ স্বরূপের প্রত্যক্ষজ্ঞানে পৌঁছানো” – ইত্যাদি প্রতীকোপাসনার কথা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়া তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন, ‘পৌত্তলিকতা’ নামে নির্দেশ করিয়া তাঁহারা যে কার্যটাকে এতদিন নিতান্ত যুক্তিহীন ও হেয় ভাবিয়া আসিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে বলিবার ও চিন্তা করিবার অনেক বিষয় আছে। তদুপরি যেদিন ঠাকুর, ‘অগ্নি ও তাহার দাহিকাশক্তির ন্যায় ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তির প্রকাশ বিরাট-জগতের অভিন্নতা’ কেশবপ্রমুখ ব্রাহ্মগণের নিকটে প্রতিপাদন করিলেন, সেদিন যে তাঁহারা সাকারোপাসনাকে নূতন আলোকে দেখিতে পাইয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাঁহারা সেদিন নিঃসংশয়ে বুঝিয়াছিলেন যে, কেবলমাত্র নিরাকার সগুণ ব্রহ্মরূপে নির্দেশ করিলে ঈশ্বরের যথার্থ স্বরূপের একাংশমাত্রই নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন, ঈশ্বর-স্বরূপকে কেবলমাত্র সাকার বলিয়া নির্দিষ্ট করায় যে দোষ হয়, কেবলমাত্র নিরাকার সগুণ বলিয়া উহাকে নির্দেশ করিলে তদ্রূপ দোষ হয়। কারণ, ঈশ্বর সাকার-জগৎরূপে ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছেন, নিরাকার সগুণ-ব্রহ্মস্বরূপে জগতের নিয়ামক হইয়া রহিয়াছেন, আবার সর্বগুণের অতীত থাকিয়া ঈশ্বর জীব, জগৎ প্রভৃতি যাবতীয় ব্যক্তি ও বস্তুর নামরূপযুক্ত প্রকাশের ভিত্তি-স্বরূপ হইয়া সতত অবস্থান করিতেছেন। “ঈশ্বর-স্বরূপে ইতি করিতে নাই – তিনি সাকার, তিনি নিরাকার (সগুণ) এবং তাহা ছাড়া তিনি আরও যে কি, তাহা কে জানিতে বলিতে পারে?” ঠাকুরের এই সামান্য উক্তির ভিতর ঐরূপ গভীর অর্থ দেখিতে পাইয়া কেশবপ্রমুখ সকলে সেদিন স্তম্ভিত হইয়াছিলেন।
ভারতবর্ষীয় সমাজের রূপ-পরিবর্তন
ঐরূপে সন ১২৮১ সালের চৈত্র মাসে, ইংরাজী ১৮৭৫ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে, ঠাকুরের পুণ্যদর্শন প্রথম লাভ করিবার পর হইতে তিন বৎসরের কিঞ্চিদধিককাল পর্যন্ত কেশব-পরিচালিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ পাশ্চাত্যভাবের মোহ হইতে দিন দিন বিমুক্ত হইয়া নবীনাকার ধারণ করিতে লাগিল এবং ব্রাহ্মগণের মধ্যে অনেকের সাধনানুরাগ সাধারণের চিত্তাকর্ষণ করিল। পরে সন ১২৮৪ সালে, ইংরাজী ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দের ৬ মার্চ তারিখে, শ্রীযুত কেশব তাঁহার কন্যাকে কুচবিহার প্রদেশের মহারাজের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিলেন। বিবাহকালে কন্যার বয়সের যে সীমা ব্রাহ্মসমাজ ইতঃপূর্বে স্থির করিয়াছিল, কেশব-দুহিতার বয়স তদপেক্ষা কিঞ্চিন্ন্যূন থাকায় উক্ত বিবাহ লইয়া সমাজে বিষম গণ্ডগোল উপস্থিত হইল এবং পাশ্চাত্যানুকরণে সমাজসংস্কারপ্রিয়তারূপ শিলাখণ্ডে প্রতিহত হইয়া এখন হইতে উহা ‘ভারতবর্ষীয়’ ও ‘সাধারণ’-নামক দুই ধারায় প্রবাহিত হইতে লাগিল। ব্রাহ্মসমাজের উপর ঠাকুরের প্রভাব কিন্তু ঐ ঘটনায় নিরস্ত হইল না। তিনি উভয় পক্ষকে সমান আদর করিতে লাগিলেন এবং উভয় পক্ষের পিপাসু ব্যক্তিগণই তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া পূর্বের ন্যায় আধ্যাত্মিক পথে সহায়তালাভ করিতে লাগিল।
ঠাকুরের আবিষ্কৃত তত্ত্বের কিয়দংশ গ্রহণপূর্বক কেশবের ‘নববিধান’ আখ্যাপ্রদান ও প্রচার
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মদলের নেতা শ্রীযুত কেশব এখন হইতে দ্রুতপদে সাধনমার্গে অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং ঠাকুরের কৃপায় তাঁহার আধ্যাত্মিক জীবন এখন হইতে সুগভীর হইয়া উঠিয়াছিল। হোম, অভিষেক, মুণ্ডন, কাষায়ধারণাদি স্থূল ক্রিয়াসকলের সহায়ে মানব-মন আধ্যাত্মিক রাজ্যের সূক্ষ্ম ও উচ্চ স্তরসমূহে আরোহণে সমর্থ হয়, এ কথা হৃদয়ঙ্গম করিয়া তিনি ঐসকলের স্বল্পবিস্তর অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। বুদ্ধ, শ্রীগৌরাঙ্গ, ঈশা প্রভৃতি মহাপুরুষগণ জীবন্ত ভাবময় তনুতে নিত্য বিদ্যমান এবং তাঁহাদের প্রত্যেকে আধ্যাত্মিক রাজ্যে এক এক বিশেষ বিশেষ ভাবপ্রস্রবণ-স্বরূপে সতত অবস্থান করিতেছেন, এ কথা বুঝিতে পারিয়া তাঁহাদিগের ভাব যথাযথ উপলব্ধি করিবার জন্য তিনি কখনও একের, কখনও অন্যের ধ্যানে তন্ময় হইয়া কিয়ৎকাল যাপন করিয়াছিলেন। ঠাকুর সর্বপ্রকার ‘ভেক্’ ধারণপূর্বক সকল মতের সাধনা করিয়াছিলেন শুনিয়াই যে কেশবের পূর্বোক্ত প্রবৃত্তি হইয়াছিল, ইহা বলা বাহুল্য। ঐরূপে সাধনসমূহের স্বল্পবিস্তর অনুষ্ঠানপূর্বক ‘যত মত, তত পথ’-রূপ ঠাকুরের নবাবিষ্কৃত তত্ত্বের বিষয় শ্রীযুত কেশব যতদূর বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহাই কুচবিহার-বিবাহের প্রায় দুই বৎসর পরে ‘নববিধান’ আখ্যা দিয়া জনসমাজে প্রচার করিয়াছিলেন। ঠাকুরকে তিনি উক্ত বিধানের ঘনীভূত মূর্তি জানিয়া কতদূর শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন তাহা প্রকাশ করিতে আমরা অসমর্থ। আমাদিগের মধ্যে অনেকে দেখিয়াছে, দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পদপ্রান্তে উপস্থিত হইয়া তিনি ‘জয় বিধানের জয়’, ‘জয় বিধানের জয়’ এ কথা বারংবার উচ্চারণ করিতে করিতে তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিতেছেন। ‘নববিধান’ প্রচারের প্রায় চারি বৎসর পরে তিনি ইহলোক হইতে প্রস্থান না করিলে তাঁহার আধ্যাত্মিক জীবন ক্রমে কত সুগভীর হইত, তাহা কে বলিতে পারে?
ঠাকুর কেশবকে কতদূর আপনার জ্ঞান করিতেন
ঠাকুর শ্রীযুত কেশবকে এতদূর পরমাত্মীয় জ্ঞান করিতেন যে, এক সময়ে তাঁহার অসুস্থতার কথা শুনিয়া, তাঁহার আরোগ্যের নিমিত্ত শ্রীশ্রীজগদম্বার নিকটে ডাব-চিনি মানত করিয়াছিলেন। পীড়িতাবস্থায় তাঁহাকে দেখিতে যাইয়া অতিশয় কৃশ দেখিয়া নয়নাশ্রু সংবরণ করিতে পারেন নাই; পরে বলিয়াছিলেন, “বসরাই গোলাপের গাছে বড় ফুল হইবে বলিয়া মালী কখনও কখনও উহাকে কাটিয়া ছাঁটিয়া উহার শিকড় পর্যন্ত মাটি হইতে বাহির করিয়া রোদ ও হিম খাওয়ায়। তোমার শরীরের এই অবস্থা মালী (ঈশ্বর) সেইজন্যই করিয়াছেন।” আবার তাঁহার শেষ পীড়ার অন্তে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তাঁহার শরীর-রক্ষার কথা শুনিয়া অভিভূত হইয়া ঠাকুর তিনদিন কাহারও সহিত কথাবার্তা না কহিয়া শয়ন করিয়াছিলেন এবং পরে বলিয়াছিলেন, “কেশবের মৃত্যুর কথা শুনিয়া আমার বোধ হইল, যেন আমার একটা অঙ্গ পড়িয়া গিয়াছে!” শ্রীযুত কেশবের পরিবারবর্গের স্ত্রী-পুরুষ সকলে ঠাকুরকে বিশেষ ভক্তি করিতেন এবং কখনও কখনও তাঁহাকে ‘কমল কুটির’-এ লইয়া যাইয়া এবং কখনও বা দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া তাঁহার শ্রীমুখ হইতে আধ্যাত্মিক উপদেশাবলী শ্রবণ করিতেন। মাঘোৎসবে তাঁহার সহিত ভগবদালাপ ও কীর্তনাদিতে একদিন আনন্দ করা কেশবের জীবৎকালে নববিধান সমাজের অবশ্যকর্তব্য অঙ্গবিশেষ হইয়া উঠিয়াছিল। ঐ সময়ে শ্রীযুত কেশব কখনও কখনও জাহাজে করিয়া সদলবলে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হইতেন এবং ঠাকুরকে উহাতে উঠাইয়া লইয়া ভাগীরথী-বক্ষে পরিভ্রমণ করিতে করিতে কীর্তনাদি-আনন্দে মগ্ন হইতেন।
ঠাকুরের প্রভাবে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মত-পরিবর্তন ও ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগ
কুচবিহার-বিবাহ লইয়া বিচ্ছিন্ন হইবার পরে শ্রীযুত বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শিবনাথ শাস্ত্রী ‘সাধারণ’ সমাজের আচার্যপদ গ্রহণ করিয়াছিলেন। শ্রীযুত বিজয় ইতিপূর্বে সত্যপরায়ণতা এবং সাধনানুরাগের জন্য কেশবের বিশেষ প্রিয় ছিলেন। আচার্য কেশবের ন্যায় ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভের পরে বিজয়কৃষ্ণেরও সাধনানুরাগ বিশেষভাবে প্রবৃদ্ধ হইয়াছিল। ঐ পথে অগ্রসর হইয়া স্বল্পকালের মধ্যেই তাঁহার নানা নূতন আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসকল উপস্থিত হইয়াছিল এবং ঈশ্বরের সাকার প্রকাশে তিনি বিশ্বাসবান হইয়া উঠিয়াছিলেন। আমরা বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি, ব্রাহ্মসমাজে যোগদানের পূর্বে বিজয় যখন সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করিতে কলিকাতায় আগমন করেন, তখন দীর্ঘ শিখা, সূত্র এবং নানা কবচাদিতে তাঁহার অঙ্গ ভূষিত ছিল; সত্যের অনুরোধে বিজয় সেইসকল একদিনে পরিত্যাগ করিয়া ব্রাহ্মদলে যোগদান করিয়াছিলেন। কুচবিহার-বিবাহের পরে সত্যের অনুরোধে তিনি নিজ গুরুতুল্য কেশবকে বর্জন করিয়াছিলেন। আবার সেই সত্যের অনুরোধে তিনি এখন তাঁহার সাকার বিশ্বাস লুকাইয়া রাখিতে না পারিয়া ব্রাহ্মসমাজ হইতে আপনাকে পৃথক করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। উহাতে তাঁহার বৃত্তিলোপ হওয়ায় কিছুকালের জন্য তাঁহাকে অর্থাভাবে বিশেষ কষ্ট অনুভব করিতে হইয়াছিল। কিন্তু তিনি উহাতে কিছুমাত্র অবসন্ন হয়েন নাই। শ্রীযুত বিজয় ঠাকুরের নিকট হইতে আধ্যাত্মিক সহায়তালাভের কথা এবং কখনও কখনও অদ্ভুতভাবে তাঁহার দর্শন পাইবার বিষয় অনেক সময় আমাদের নিকটে স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু তিনি তাঁহাকে উপগুরু অথবা অন্য কোনভাবে ভক্তিশ্রদ্ধা করিতেন, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, গয়াধামে আকাশগঙ্গার পাহাড়ে কোন সাধু কৃপা করিয়া নিজ যোগশক্তি-সহায়ে তাঁহাকে সহসা সমাধিস্থ করিয়া দেন ও তাঁহার গুরুপদবী গ্রহণ করেন, এ কথাও আমরা তাঁহার নিকটে শ্রবণ করিয়াছিলাম। ঠাকুরের সম্বন্ধে কিন্তু তাঁহার যে অতি উচ্চ ধারণা ছিল তাহাতে সংশয় নাই এবং ঐ বিষয়ে তাঁহার স্বমুখ হইতে আমরা যেসকল কথা শুনিয়াছি, তাহা গ্রন্থের অন্যত্র প্রকাশ করিয়াছি।1
1. গুরুভাব, উত্তরার্ধ, ৫ম অধ্যায় দেখ।
বিজয় অতঃপর সাধনায় কতদূর অগ্রসর হইয়াছিলেন
ব্রাহ্মসমাজ হইতে পৃথক হইবার পরে বিজয়কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক গভীরতা দিন দিন প্রবৃদ্ধ হইয়াছিল। কীর্তনকালে ভাবাবিষ্ট হইয়া তাঁহার উদ্দাম নৃত্য ও ঘন ঘন সমাধি দেখিয়া লোকে মোহিত হইত। ঠাকুরের শ্রীমুখে আমরা তাঁহার উচ্চাবস্থার কথা এইরূপ শুনিয়াছি – “যে ঘরে প্রবেশ করিলে লোকের ঈশ্বরসাধনা পূর্ণত্ব লাভ করে তাহার পার্শ্বের ঘরে পৌঁছিয়া বিজয় দ্বার খুলিয়া দিবার নিমিত্ত করাঘাত করিতেছে!” – আধ্যাত্মিক গভীরতালাভের পরে শ্রীযুত বিজয় অনেক ব্যক্তিকে মন্ত্রশিষ্য করিয়াছিলেন এবং ঠাকুরের শরীররক্ষার প্রায় চৌদ্দবৎসর পরে ৺পুরীধামে দেহরক্ষা করিয়াছিলেন।
‘শিব-রামের যুদ্ধ’ কথায় কেশব ও বিজয়ের মনোমালিন্য দূর হওয়া
কুচবিহার-বিবাহের পরে ভারতবর্ষীয় ও সাধারণ ব্রাহ্মদলের মধ্যে বিশেষ মনান্তর লক্ষিত হইত। এক দলের সহিত অন্য দলের কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। উভয় দলের সাধনানুরাগী ব্যক্তিগণ কিন্তু পূর্বের ন্যায় সমভাবে দক্ষিণেশ্বরে আসিতেন, এ কথার আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি। কেশব ও বিজয় উভয়েই একদিন এই সময়ে নিজ নিজ অন্তরঙ্গগণের সহিত সহসা ঠাকুরের নিকটে উপস্থিত হইয়াছিলেন। এক দল অন্য দলের আসিবার কথা না জানাতেই অবশ্য ঐরূপ হইয়াছিল এবং পূর্ববিরোধ স্মরণ করিয়া উভয় দলের মধ্যে একটা সঙ্কোচের ভাব দৃষ্ট হইয়াছিল। কেশব এবং বিজয়ের মধ্যেও ঐ সঙ্কোচ বিদ্যমান দেখিয়া ঠাকুর সেদিন তাঁহাদিগের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া দিবার উদ্দেশ্যে বলিয়াছিলেন –
“দেখ, ভগবান শিব এবং রামচন্দ্রের মধ্যে এক সময়ে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইয়া ভীষণ যুদ্ধের অবতারণা হইয়াছিল। শিবের গুরু রাম এবং রামের গুরু শিব – এ কথা প্রসিদ্ধ। সুতরাং যুদ্ধান্তে তাঁহাদিগের পরস্পরে মিলন হইতে বিলম্ব হইল না। কিন্তু শিবের চেলা ভূত-প্রেতাদির সঙ্গে রামের চেলা বাঁদরগণের আর কখনও মিলন হইল না। ভূতে-বাঁদরে লড়াই সর্বক্ষণ চলিতে লাগিল। (কেশব ও বিজয়কে সম্বোধন করিয়া) যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, তোমাদিগের পরস্পরে এখন আর মনোমালিন্য রাখা উচিত নহে, উহা ভূত ও বাঁদরগণের মধ্যেই থাকুক।”
ঠাকুরের প্রভাবে ব্রাহ্মসঙ্ঘ ভাঙ্গিয়া যাইবে বলিয়া আচার্য শিবনাথের দক্ষিণেশ্বর-গমনে বিরত হওয়া
তদবধি কেশব ও বিজয়ের মধ্যে পুনরায় কথাবার্তা চলিয়াছিল। শ্রীযুত বিজয় নিজ অভিনব আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষসকলের অনুরোধে সাধারণসমাজ পরিত্যাগ করিলে উক্ত দলের মধ্যে যাঁহারা তাঁহার উপর একান্ত বিশ্বাসবান ছিলেন, তাঁহারাও তাঁহার সহিত চলিয়া আসিলেন। সাধারণ-সমাজ ঐ কারণে এইকালে বিশেষ ক্ষীণ হইয়াছিল। আচার্য শ্রীযুত শিবনাথ শাস্ত্রীই এখন ঐ দলের নেতা হইয়া সমাজকে রক্ষা করিয়াছিলেন। শিবনাথ ইতঃপূর্বে অনেক বার ঠাকুরের নিকট আসিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে বিশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা করিতেন। ঠাকুরও শিবনাথকে বিশেষ স্নেহ করিতেন। কিন্তু বিজয় সমাজ ছাড়িবার পরে শিবনাথ বিষম সমস্যায় নিপতিত হইয়াছিলেন। ঠাকুরের উপদেশ-প্রভাবেই বিজয়কৃষ্ণের ধর্মভাব-পরিবর্তন এবং পরিণামে সমাজ-পরিত্যাগ – এ কথা অনুধাবন করিয়া তিনি এক্ষণে ঠাকুরের নিকটে পূর্বের ন্যায় যাওয়া-আসা রহিত করিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই সময়ের কিছু পূর্ব হইতে সাধারণ-সমাজে যোগদান করিয়াছিলেন এবং শিবনাথ প্রমুখ ব্রাহ্মগণের বিশেষ প্রিয় হইয়া উঠিয়াছিলেন। ঐরূপে সাধারণ-সমাজে যোগদান করিলেও কিন্তু স্বামীজী মধ্যে মধ্যে শ্রীযুত কেশবের এবং দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে গমনাগমন করিতেন। স্বামীজী বলিতেন, আচার্য শিবনাথকে তিনি এই সময়ে ঠাকুরের নিকটে না যাইবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছিলেন, দক্ষিণেশ্বরে তিনি ঘন ঘন গমন করিলে তাঁহার দেখাদেখি ব্রাহ্মসঙ্ঘের অন্য সকলেও ঐরূপ করিবে এবং পরিণামে উক্ত দল ভাঙিয়া যাইবে। স্বামীজী বলিতেন, ঐরূপ ধারণার বশবর্তী হইয়া শ্রীযুত শিবনাথ এই সময়ে তাঁহাকে দক্ষিণেশ্বরে গমন করিতে বিরত হইবার জন্য পরামর্শ দিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন, ঠাকুরের ভাবসমাধি প্রভৃতি স্নায়ুদৌর্বল্য হইতে উপস্থিত হইয়াছে! – অত্যধিক শারীরিক কঠোরতার অনুষ্ঠানে তাঁহার মস্তিষ্কবিকৃতি হইয়াছে! ঠাকুর ঐ কথা শুনিয়া শিবনাথকে যাহা বলিয়াছিলেন, আমরা তাহার অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি।1
1. গুরুভাব, উত্তরার্ধ, দ্বিতীয় অধ্যায় দেখ।
ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরের প্রভাব সম্বন্ধে আচার্য প্রতাপচন্দ্রের কথা
সে যাহা হউক, ঠাকুরের প্রভাবে ব্রাহ্মসঙ্ঘে যে সাধনানুরাগ প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহার ফলে ‘নববিধান’ এবং ‘সাধারণ’ উভয় সমাজের ধর্মপিপাসু ব্যক্তিগণ ঈশ্বরকে যাহাতে প্রত্যক্ষ করিতে পারেন, এরূপভাবে জীবনগঠনে অগ্রসর হইয়াছিলেন। আচার্য প্রতাপচন্দ্র মজুমদার এক সময়ে দক্ষিণেশ্বরে আগমন করিয়া ঠাকুরের সঙ্গলাভের পর, সমাজে আধ্যাত্মিক ভাব-পরিণতি কিরূপ ও কতদূর হইয়াছে তদ্বিষয়ে আমাদিগের দ্বারা জিজ্ঞাসিত হইয়া বলিয়াছিলেন, “ইঁহাকে দেখিবার আগে আমরা ধর্ম কাহাকে বলে, তাহা কি বুঝিতাম? – কেবল গুণ্ডামি করিয়া বেড়াইতাম। ইঁহার দর্শনলাভের পরে বুঝিয়াছি যথার্থ ধর্মজীবন কাহাকে বলে।” শ্রীযুত প্রতাপের সঙ্গে সেদিন আচার্য চিরঞ্জীব শর্মা (ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল) উপস্থিত ছিলেন।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে ঠাকুরের প্রভাব
নববিধান-সমাজে ঠাকুরের প্রভাব বিশেষ পরিলক্ষিত হইলেও বিজয়কৃষ্ণ যতদিন আচার্য-পদবীতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত সাধারণসমাজেও উহা স্বল্প দেখা যাইত না। বিজয়ের সহিত অনেকগুলি ধর্মপিপাসুর সমাজপরিত্যাগের পর হইতে উক্ত সমাজে ঐ প্রভাব হ্রাস হইয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে উহা আধ্যাত্মিকতা হারাইয়া সমাজ-সংস্কার, দেশ-হিতৈষণা প্রভৃতির অনুষ্ঠানেই আপনাকে প্রধানতঃ নিযুক্ত রাখিয়াছে। হ্রাস হইলেও উক্ত প্রভাব যে একেবারেই লুপ্ত হয় নাই, তাহার নিদর্শন সমাজস্থ ব্যক্তিগণের মধ্যে কাহারও কাহারও যোগাভ্যাসে, বেদান্ত-চর্চায় এবং প্রেততত্ত্বাদির (Spiritualism) অনুশীলনে দেখিতে পাওয়া যায়। উচ্চাঙ্গের কর্তাভজা-সম্প্রদায়ের বৈদিক মতের অনুশীলনও যে সাধারণসমাজস্থ কোন কোন ব্যক্তি করিয়া থাকেন এবং ধ্যানাদি-সহায়ে শারীরিক ব্যাধি-নিবারণের চেষ্টা করেন, এ বিষয়েও আমরা জ্ঞাত হইয়াছি।
ব্রহ্মসঙ্গীতে ঠাকুরের প্রভাব
নববিধান-সমাজের আচার্য চিরঞ্জীব শর্মা ব্রহ্মসঙ্গীতের বিশেষ পুষ্টিসাধন করিয়াছেন, এ কথা বলিতে হইবে না। কিন্তু অনুসন্ধানে জ্ঞাত হওয়া যায়, ঠাকুরের নানাপ্রকার দর্শন, ভাব ও সমাধি প্রভৃতির সহিত পরিচিত হইয়াই তিনি তাঁহার শ্রেষ্ঠ ভাবোদ্দীপক পদগুলি রচনায় সমর্থ হইয়াছেন। ঐরূপ কয়েকটি পদের1 প্রথম অংশ মাত্র আমরা নিম্নে উল্লেখ করিতেছি –
(১) নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে অরূপরাশি।
(২) গভীর সমাধি-সিন্ধু অনন্ত অপার।
(৩) চিদাকাশে হ’ল পূর্ণ প্রেম-চন্দ্রোদয় রে।
(৪) চিদানন্দ-সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।
(৫) আমায় দে মা পাগল করে।
সুকবি আচার্য চিরঞ্জীব শর্মা ঐরূপ পদসকল রচনা দ্বারা সমগ্র বঙ্গবাসীর এবং দেশের সাধককুলের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন, ইহা নিঃসন্দেহ। কিন্তু ঠাকুরের ভাবসমাধি দেখিয়াই যে তিনি ঐসকল পদ সৃষ্টি করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, ইহাতেও সংশয় নাই। আচার্য চিরঞ্জীব সুকণ্ঠ ছিলেন। তাঁহার সঙ্গীতশ্রবণে আমরা ঠাকুরকে অনেক সময় সমাধিস্থ হইতে দেখিয়াছি।
1. নববিধান-সমাজের সঙ্গীত-পুস্তকসকলে পাঠক পদগুলি দেখিতে পাইবেন।
ব্রাহ্মধর্ম ঈশ্বরলাভের অন্যতম পথ বলিয়া ঠাকুরের ঘোষণা
ঐরূপে ব্রাহ্মসমাজ এইকালে ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব আধ্যাত্মিক প্রভাবে অনুপ্রাণিত হইয়াছিল। ঈশ্বরের নিরাকার স্বরূপের উপাসনা উক্ত সমাজে যে ভাবে প্রচারিত হয়, তাহাকে ঠাকুর কখনও কখনও ‘কাঁচা নিরাকার ভাব’ বলিয়া নির্দেশ করিলেও1 যথার্থ বিশ্বাসের সহিত ঐ ভাবে উপাসনা করিলে সাধক ঈশ্বরলাভে সমর্থ হয়েন – এ কথা তাঁহার মুখে আমরা বারংবার শ্রবণ করিয়াছি; কীর্তনান্তে ঈশ্বর ও তাঁহার সকল সম্প্রদায়ের ভক্তগণকে প্রণাম করিবার কালে তিনি ‘আধুনিক ব্রহ্মজ্ঞানীদের প্রণাম’ বলিয়া ব্রাহ্মমণ্ডলীকে প্রণাম করিতে কখনও ভুলিতেন না। উহাতেই বুঝা যায়, ভগবদিচ্ছায় ঈশ্বরলাভের জন্য জগতে প্রচারিত অন্য সকল মত বা পথের ন্যায় ব্রাহ্মধর্মকেও তিনি এক পথ বলিয়া সত্য সত্য বিশ্বাস করিতেন। তবে পাশ্চাত্য ভাব হইতে বিমুক্ত হইয়া ব্রাহ্মমণ্ডলী যাহাতে যথার্থ আধ্যাত্মিক মার্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েন, তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ আগ্রহ ও চেষ্টা ছিল; এবং সমাজসংস্কারাদি কার্যসকল প্রশংসনীয় ও অবশ্যকর্তব্য হইলেও ঐসকল কার্য যাহাতে তাঁহাদিগের সমাজে মনুষ্যজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া ঈশ্বরলাভের জন্য সাধনভজনাদি হেয় বলিয়া বিবেচিত না হয়, তদ্বিষয়ে তিনি তাঁহাদিগকে বিশেষভাবে সতর্ক করিতেন। ব্রাহ্মসমাজই ঠাকুরের অদৃষ্টপূর্ব আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম অনুশীলন করিয়া কলিকাতার জনসাধারণের চিত্ত দক্ষিণেশ্বরে আকৃষ্ট করিয়াছিল। ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে বসিয়া যাঁহারা আধ্যাত্মিক শক্তি ও শান্তিলাভে ধন্য হইয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেকে ঐ বিষয়ের জন্য ‘নববিধান’ ও ‘সাধারণ’ উভয় ব্রাহ্মসমাজের নিকটেই চিরঋণে আবদ্ধ। বর্তমান লেখক আবার তদুভয় সমাজের নিকট অধিকতর ঋণী। কারণ, উচ্চাদর্শ সম্মুখে ধারণ করিয়া যৌবনের প্রারম্ভে আধ্যাত্মিকভাবে চরিত্রগঠনে তাহাকে ঐ সমাজদ্বয়ই সাহায্য করিয়াছিল। অতএব ব্রহ্ম, ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মমণ্ডলী বা সমাজরূপী ত্রি-রত্নকে স্বরূপতঃ এক জ্ঞানে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাভরে আমরা পুনঃপুনঃ প্রণাম করিতেছি এবং ব্রাহ্মমণ্ডলীর সহিত মিলিত হইয়া ঠাকুরের আনন্দ করা সম্বন্ধে যে দুইটি বিশেষ চিত্র স্বচক্ষে দর্শন করিবার সুযোগ লাভ করিয়াছিলাম, তাহাই এক্ষণে পাঠককে উপহার দিতেছি।
1. গুরুভাব, পূর্বার্ধ, দ্বিতীয় অধ্যায় দেখ।
পঞ্চম খণ্ড – প্রথম অধ্যায় – দ্বিতীয় পাদ: মণিমোহন মল্লিকের বাটীতে ব্রাহ্মোৎসব
ঘটনার সময় নির্ণয়
আমাদের বেশ মনে আছে সেটা হেমন্তকাল; গ্রীষ্মসন্তপ্তা প্রকৃতি তখন বর্ষার স্নানসুখে পরিতৃপ্তা হইয়া শারদীয় অঙ্গরাগ ধারণপূর্বক শীতের উন্মেষ অনুভব করিতেছিলেন এবং স্নিগ্ধ শীতল নিজাঙ্গে সযত্নে বসন টানিয়া দিতেছিলেন। হেমন্তেরও তিন ভাগ তখন অতীতপ্রায়। এই সময়ের একদিনের ঘটনা আমরা এখানে বিবৃত করিতেছি। ঠাকুরের পরমভক্ত আমাদিগের জনৈক শ্রদ্ধাস্পদ বন্ধু1 সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; এবং তাঁহার প্রথামত পঞ্জিকাপার্শ্বে ঐ তারিখ চিহ্নিত করিয়া ঐ কথা লিখিয়া রাখিয়াছিলেন। তদ্দর্শনে জানিয়াছি, ঘটনা, সন ১২৯০ সালের ১১ অগ্রহায়ণ, সোমবারে, ইংরাজী ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ নভেম্বর তারিখে উপস্থিত হইয়াছিল।
1. বাগবাজার-নিবাসী শ্রীযুত বলরাম বসু।
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের সহিত পরিচয়
তখন কলিকাতার ‘সেন্ট জেভিয়ার্স’ কলেজে আমরা অধ্যয়ন করি এবং ইতঃপূর্বে দুই-তিনবার মাত্র দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পুণ্য দর্শনলাভ করিয়াছি। কোন কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা1 ঐ দিবস অপরাহ্ণে ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইব বলিয়া পরামর্শ স্থির করিয়াছিলাম। স্মরণ আছে নৌকাযোগে দক্ষিণেশ্বরে যাইবার কালে আরোহীদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি আমাদিগের ন্যায় ঠাকুরের নিকট যাইতেছেন শুনিয়া তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া জানিলাম তাঁহার নাম বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল; আমাদিগের ন্যায় অল্পদিন ঠাকুরের দর্শনলাভে ধন্য হইয়াছেন। এ কথাও স্মরণ হয়, নৌকামধ্যে অন্য এক আরোহী আমাদের মুখে ঠাকুরের নাম শ্রবণ করিয়া তাঁহার প্রতি শ্লেষপূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করিলে বৈকুণ্ঠনাথ বিষম ঘৃণার সহিত তাহার কথার উত্তর দিয়া তাহাকে নিরুত্তর করেন। যখন গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হইলাম তখন বেলা ২টা বা ২৷৷টা হইবে।
1. কুমিল্লানিবাসী শ্রীযুত বরদাসুন্দর পাল এবং চব্বিশ-পরগণার অন্তর্গত বেলঘরিয়ানিবাসী শ্রীযুত হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় (স্বামী বিজ্ঞানানন্দ)।
বাবুরামের সহিত প্রথম আলাপ
ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ করিয়া তাঁহার পদপ্রান্তে প্রণাম করিবামাত্র তিনি বলিলেন, “তাইতো, তোমরা আজ আসিলে; আর কিছুক্ষণ পরে আসিলে দেখা হইত না; আজ কলিকাতায় যাইতেছি, গাড়ি আনিতে গিয়াছে; সেখানে উৎসব, ব্রাহ্মদের উৎসব। যাহা হউক, দেখা যে হইল ইহাই ভাল, বস। দেখা না পাইয়া ফিরিয়া যাইলে মনে কষ্ট হইত।”
ঘরের মেজেতে একটি মাদুরে আমরা উপবেশন করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “মহাশয়, আপনি যেখানে যাইতেছেন সেখানে আমরা যাইলে কি প্রবেশ করিতে দিবে না?” ঠাকুর বলিলেন, “তাহা কেন? ইচ্ছা হইলে তোমরা অনায়াসে যাইতে পার – সিঁদুরিয়াপটি মণি মল্লিকের বাটী।” একজন নাতিকৃশ গৌরবর্ণ রক্তবস্ত্র-পরিহিত যুবক ঐ সময় গৃহে প্রবেশ করিতেছেন দেখিয়া ঠাকুর তাঁহাকে বলিলেন, “ওরে, এদের মণি মল্লিকের বাটীর নম্বরটা বলিয়া দে তো।” যুবক বিনীতভাবে উত্তর করিলেন, “৮১নং চিৎপুর রোড, সিঁদুরিয়াপটি।” যুবকের বিনীত স্বভাব ও সাত্ত্বিক প্রকৃতি দেখিয়া আমাদের মনে হইল তিনি ঠাকুরবাড়ির কোন ভট্টাচার্যের পুত্র হইবেন। কিন্তু দুই-এক মাস পরে তাঁহাকে বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পরীক্ষা দিয়া বাহির হইতে দেখিয়া আমরা তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া জানিলাম, আমাদের ধারণা ভুল হইয়াছিল। জানিয়াছিলাম, তাঁহার নাম বাবুরাম; বাটী তারকেশ্বরের নিকটে আঁটপুরে; কলিকাতায় কম্বুলিয়াটোলায় বাসাবাটীতে আছেন; মধ্যে মধ্যে ঠাকুরের নিকটে যাইয়া অবস্থান করেন। বলা বাহুল্য, ইনিই এক্ষণে স্বামী প্রেমানন্দ নামে শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘে সুপরিচিত।
অল্পক্ষণ পরেই গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল এবং ঠাকুর বাবুরামকে নিজ গামছা, মশলার বটুয়া ও বস্ত্রাদি লইতে বলিয়া শ্রীশ্রীজগদম্বাকে প্রণামপূর্বক গাড়িতে আরোহণ করিলেন। বাবুরাম পূর্বোক্ত দ্রব্যসকল লইয়া গাড়ির অন্যদিকে উপবিষ্ট হইলেন। অন্য এক ব্যক্তিও সেদিন ঠাকুরের সঙ্গে কলিকাতায় গিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে জানিয়াছিলাম তাঁহার নাম প্রতাপচন্দ্র হাজরা।
ঠাকুর চলিয়া যাইবার পরেই আমরা সৌভাগ্যক্রমে একখানি গহনার নৌকা পাইয়া কলিকাতায় বড়বাজার ঘাটে উত্তীর্ণ হইলাম এবং উৎসব সন্ধ্যাকালে হইবে ভাবিয়া এক বন্ধুর বাসায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। নবপরিচিত বৈকুণ্ঠনাথ যথাকালে উৎসবস্থলে দেখা হইবে বলিয়া কার্যবিশেষ সম্পন্ন করিতে স্থানান্তরে চলিয়া যাইলেন।
মণি মল্লিকের বৈঠকখানায় অপূর্ব কীর্তন
প্রায় ৪টার সময় আমরা অন্বেষণ করিয়া মণিবাবুর বাটীতে উপস্থিত হইলাম। ঠাকুরের আগমনের কথা জিজ্ঞাসা করায় এক ব্যক্তি আমাদিগকে উপরে বৈঠকখানায় যাইবার পথ দেখাইয়া দিল। আমরা তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম ঘরখানি উৎসবার্থে পত্রপুষ্পে সজ্জিত হইয়াছে এবং কয়েকটি ভক্ত পরস্পর কথা কহিতেছেন। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম মধ্যাহ্নে উপাসনা ও সঙ্গীতাদি হইয়া গিয়াছে, সায়াহ্নে পুনরায় উপাসনা ও কীর্তনাদি হইবে এবং স্ত্রীভক্তদিগের অনুরোধে ঠাকুরকে কিছুক্ষণ হইল অন্দরে লইয়া যাওয়া হইয়াছে।
উপাসনাদির বিলম্ব আছে শুনিয়া আমরা কিছুক্ষণের জন্য স্থানান্তরে গমন করিলাম। পরে সন্ধ্যা সমাগতা হইলে পুনরায় উৎসবস্থলে আগমন করিলাম। বাটীর সম্মুখের রাস্তায় পৌঁছিতেই মধুর সঙ্গীত ও মৃদঙ্গের রোল আমাদের কর্ণগোচর হইল। তখন কীর্তন আরম্ভ হইয়াছে বুঝিয়া আমরা দ্রুতপদে বৈঠকখানায় উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলাম তাহা বলিবার নহে। ঘরের ভিতরে-বাহিরে লোকের ভিড় লাগিয়াছে। প্রত্যেক দ্বারের সম্মুখে এবং পশ্চিমের ছাদে এত লোক দাঁড়াইয়াছে যে, সেই ভিড় ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করা এককালে অসাধ্য। সকলেই উদ্গ্রীব হইয়া গৃহমধ্যে ভক্তিপূর্ণ স্থিরনেত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিয়াছে; পার্শ্বে কে আছে না আছে তাহার সংজ্ঞা-মাত্র নাই। সম্মুখের দ্বার দিয়া গৃহে প্রবেশ অসম্ভব বুঝিয়া আমরা পশ্চিমের ছাদ দিয়া ঘুরিয়া বৈঠকখানার উত্তরের এক দ্বারপার্শ্বে উপস্থিত হইলাম। লোকের জনতা এখানে কিছু কম থাকায় কোনরূপে গৃহমধ্যে মাথা গলাইয়া দেখিলাম – অপূর্ব দৃশ্য!
ঠাকুরের অপূর্ব নৃত্য
গৃহের ভিতরে স্বর্গীয় আনন্দের বিশাল তরঙ্গ খরস্রোতে প্রবাহিত হইতেছে; সকলে এককালে আত্মহারা হইয়া কীর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হাসিতেছে, কাঁদিতেছে, উদ্দাম নৃত্য করিতেছে, ভূমিতে আছাড় খাইয়া পড়িতেছে, বিহ্বল হইয়া উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করিতেছে; আর ঠাকুর সেই উন্মত্ত দলের মধ্যভাগে নৃত্য করিতে করিতে কখনও দ্রুতপদে তালে তালে সম্মুখে অগ্রসর হইতেছেন, আবার কখনও বা ঐরূপে পশ্চাতে হটিয়া আসিতেছেন এবং ঐরূপে যখন যেদিকে তিনি অগ্রসর হইতেছেন, সেই দিকের লোকেরা মন্ত্রমুগ্ধবৎ হইয়া তাঁহার অনায়াস-গমনাগমনের জন্য স্থান ছাড়িয়া দিতেছে। তাঁহার হাস্যপূর্ণ আননে অদৃষ্টপূর্ব দিব্যজ্যোতি ক্রীড়া করিতেছে এবং প্রতি অঙ্গে অপূর্ব কোমলতা ও মাধুর্যের সহিত সিংহের ন্যায় বলের যুগপৎ আবির্ভাব হইয়াছে। সে এক অপূর্ব নৃত্য – তাহাতে আড়ম্বর নাই, লম্ফন নাই, কৃচ্ছ্রসাধ্য অস্বাভাবিক অঙ্গবিকৃতি বা অঙ্গ-সংযমরাহিত্য নাই; আছে কেবল আনন্দের অধীরতায় মাধুর্য ও উদ্যমের সম্মিলনে প্রতি অঙ্গের স্বাভাবিক সংস্থিতি ও গতিবিধি! নির্মল সলিলরাশি প্রাপ্ত হইয়া মৎস্য যেমন কখনও ধীরভাবে এবং কখনও দ্রুত সন্তরণ দ্বারা চতুর্দিকে ধাবিত হইয়া আনন্দ প্রকাশ করে, ঠাকুরের এই অপূর্ব নৃত্যও যেন ঠিক তদ্রূপ। তিনি যেন আনন্দসাগর – ব্রহ্মস্বরূপে নিমগ্ন হইয়া নিজ অন্তরের ভাব বাহিরের অঙ্গসংস্থানে প্রকাশ করিতেছিলেন। ঐরূপে নৃত্য করিতে করিতে তিনি কখনও বা সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িতেছিলেন; কখনও বা তাঁহার পরিধেয় বসন স্খলিত হইয়া যাইতেছিল এবং অপরে উহা তাঁহার কটিতে দৃঢ়বদ্ধ করিয়া দিতেছিল; আবার কখনও বা কাহাকেও ভাবাবেশে সংজ্ঞাশূন্য হইতে দেখিয়া তিনি তাহার বক্ষ স্পর্শ করিয়া তাহাকে পুনরায় সচেতন করিতেছিলেন। বোধ হইতেছিল যেন তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া এক দিব্যোজ্জ্বল আনন্দধারা চতুর্দিকে প্রসৃত হইয়া যথার্থ ভক্তকে ঈশ্বরদর্শনে, মৃদু-বৈরাগ্যবানকে তীব্রবৈরাগ্যলাভে, অলস মনকে আধ্যাত্মিক রাজ্যে সোৎসাহে অগ্রসর হইতে সামর্থ্য প্রদান করিতেছিল এবং ঘোর বিষয়ীর মন হইতেও সংসারাসক্তিকে সেই ক্ষণের জন্য কোথায় বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছিল। তাঁহার ভাবাবেশ অপরে সংক্রমিত হইয়া তাহাদিগকে ভাববিহ্বল করিয়া ফেলিতেছিল এবং তাঁহার পবিত্রতায় প্রদীপ্ত হইয়া তাহাদের মন যেন কোন এক উচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরে আরোহণ করিয়াছিল। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আচার্য গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণের তো কথাই নাই, অন্য ব্রাহ্ম-ভক্ত-সকলের অনেকেও সেদিন মধ্যে মধ্যে ভাবাবিষ্ট ও সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পতিত হইয়াছিলেন। আর সুকণ্ঠ আচার্য চিরঞ্জীব সেদিন একতারাসহায়ে ‘নাচ্ রে আনন্দময়ীর ছেলে, তোরা ঘুরে ফিরে’ – ইত্যাদি সঙ্গীতটি গাহিতে গাহিতে তন্ময় হইয়া যেন আপনাতে আপনি ডুবিয়া গিয়াছিলেন। ঐরূপে প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক কাল কীর্তনানন্দে অতিবাহিত হইলে, ‘এমন মধুর হরিনাম জগতে আনিল কে’1 – এই পদটি গীত হইয়া সকল ধর্মসম্প্রদায় ও ভক্ত্যাচার্যদিগকে প্রণাম করিয়া সেই অপূর্ব কীর্তনের বেগ সেদিন শান্ত হইয়াছিল।
আমাদের স্মরণ আছে, কীর্তনান্তে সকলে উপবিষ্ট হইলে ঠাকুর আচার্য নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ‘হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাত রে’2 – এই সঙ্গীতটি গাহিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন এবং তিনিও ভাবাবিষ্ট হইয়া উহা দুই-তিনবার মধুরভাবে গাহিয়া সকলকে আনন্দিত করিয়াছিলেন।
অনন্তর রূপরসাদি বিষয় হইতে মন উঠাইয়া লইয়া ঈশ্বরে অর্পণ করিতে পারিলেই জীবের পরম শান্তিলাভ হয়, এই প্রসঙ্গে ঠাকুর সম্মুখস্থ লোকদিগকে অনেক কথা কহিতে লাগিলেন। স্ত্রীভক্তেরাও তখন বৈঠকখানাগৃহের পূর্বভাগে চিকের আড়ালে থাকিয়া তাঁহাকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে নানা প্রশ্ন করিয়া উত্তরলাভে আনন্দিতা হইতে লাগিলেন। ঐরূপে প্রশ্ন সমাধান করিতে করিতে ঠাকুর প্রসঙ্গোত্থিত বিষয়ের দৃঢ় ধারণা করাইয়া দিবার জন্য মার (শ্রীশ্রীজগদম্বার) নাম আরম্ভ করিলেন এবং একের পর অন্য করিয়া রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি সাধক-ভক্তগণ-রচিত অনেকগুলি সঙ্গীত গাহিতে থাকিলেন। উহাদিগের মধ্যে নিম্নলিখিত গীত কয়েকটি যে তিনি গাহিয়াছিলেন ইহা আমাদের বেশ স্মরণ আছে –
(১) মজল আমার মন-ভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে।
(২) শ্যামাপদ-আকাশেতে মন-ঘুড়িখান উড়তেছিল।
(৩) এসব খ্যাপা মায়ের খেলা।
(৪) মন বেচারীর কি দোষ আছে।
তারে কেন দোষী কর মিছে॥
(৫) আমি ঐ খেদে খেদ করি।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি॥
1. গীতটি আমাদের যতদূর মনে আছে নিম্নে প্রদান করিতেছি –
এমন মধুর হরিনাম জগতে আনিল কে।
এ নাম নিতাই এনেছে, না হয় গৌর এনেছে,
না হয় শান্তিপুরের অদ্বৈত সেই এনেছে।
2. হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাত রে।
(একবার) লুটয় অবনীতল হরি হরি বলে কাঁদ্ রে।
(গতি কর কর বলে)
গভীর নিনাদে হরি হরি নামে গগন ছাও রে।
নাচ হরি বলে দুবাহু তুলে হরিনাম বিলাও রে।
(লোকের দ্বারে দ্বারে)
হরি-প্রেমানন্দরসে, অনুদিন ভাস রে।
গাও হরিনাম, হও পূর্ণকাম,
(যত) নীচ বাসনা নাশ রে।
(প্রেমানন্দে মেতে)
বিজয় গোস্বামীর সহিত ঠাকুরের রহস্যালাপ
ঠাকুর যখন ঐরূপে মার নাম করিতেছিলেন তখন গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণ গৃহান্তরে যাইয়া কতকগুলি ভক্তের নিকটে তুলসীদাসী রামায়ণের পাঠ ও ব্যাখ্যায় নিযুক্ত ছিলেন। সায়াহ্ন-উপাসনার সময় উপস্থিতপ্রায় দেখিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উক্ত কার্য আরম্ভ করিবেন বলিয়া তিনি এখন পুনরায় বৈঠকখানাগৃহে উপস্থিত হইলেন। বিজয়কে দেখিয়াই ঠাকুর বালকের ন্যায় রঙ্গ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “বিজয়ের আজকাল সঙ্কীর্তনে বিশেষ আনন্দ। কিন্তু সে যখন নাচে তখন আমার ভয় হয় পাছে ছাদসুদ্ধ উলটে যায়! (সকলের হাস্য)। হাঁগো, ঐরূপ একটি ঘটনা আমাদের দেশে সত্য সত্য হয়েছিল। সেখানে কাঠ-মাটি দিয়েই লোকে দোতলা করে। এক গোস্বামী শিষ্যবাড়ি উপস্থিত হয়ে ঐরূপ দোতলায় কীর্তন আরম্ভ করেন। কীর্তন জমতেই নাচ আরম্ভ হলো। এখন, গোস্বামী ছিলেন (বিজয়কে সম্বোধন করিয়া) তোমারই মতন একটু হৃষ্টপুষ্ট। কিছুক্ষণ নাচবার পরেই ছাদ ভেঙে তিনি একেবারে একতলায় হাজির! তাই ভয় হয়, পাছে তোমার নাচে সেইরূপ হয়।” (সকলের হাস্য)। ঠাকুর বিজয়কৃষ্ণের গেরুয়া বস্ত্রধারণ লক্ষ্য করিয়া এইবার বলিতে লাগিলেন, “আজকাল এঁর (বিজয়ের) গেরুয়ার উপরেও খুব অনুরাগ। লোকে কেবল কাপড়-চাদর গেরুয়া করে। বিজয় কাপড়, চাদর, জামা মায় জুতা জোড়াটা পর্যন্ত গেরুয়ায় রাঙিয়েছে। তা ভাল, একটা অবস্থা হয় যখন ঐরূপ করতে ইচ্ছা হয় – গেরুয়া ছাড়া অন্য কিছু পরতে ইচ্ছা হয় না। গেরুয়া ত্যাগের চিহ্ন কিনা, তাই গেরুয়া সাধককে স্মরণ করিয়ে দেয়, সে ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগে ব্রতী হয়েছে।” গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণ এইবার ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং ঠাকুর তাঁহাকে প্রসন্নমনে আশীর্বাদ করিলেন, “ওঁ শান্তি, শান্তি, প্রশান্তি হউক তোমার।”
ঠাকুরের ভক্তের প্রতি ভালবাসা
ঠাকুর যখন মা-র নাম করিতেছিলেন, তখন আর একটি ঘটনা উপস্থিত হইয়াছিল। উহাতে বুঝিতে পারা যায়, অন্তৰ্মুখে সর্বদা অবস্থান করিলেও তাঁহার বহির্বিষয় লক্ষ্য করিবার শক্তি কতদূর তীক্ষ্ণ ছিল। গান গাহিতে গাহিতে বাবুরামের মুখের প্রতি দেখিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন, সে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হইয়াছে। তাঁহার অগ্রে সে কখনই ভোজন করিবে না এ কথা জানিয়া, তিনি নিজে খাইবেন বলিয়া কতকগুলি সন্দেশ ও এক গেলাস জল আনয়ন করাইয়াছিলেন, এবং উহার কণামাত্র স্বয়ং গ্রহণপূর্বক অধিকাংশ শ্রীযুত বাবুরামকে প্রদান করিয়াছিলেন। অবশিষ্ট উপস্থিত ভক্তসকলে প্রসাদরূপে গ্রহণ করিয়াছিল।
বিজয় প্রণাম করিয়া সায়াহ্নের উপাসনা করিতে নিম্নে আসিবার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরকে আহার করিতে অন্দরে লইয়া যাওয়া হইল। তখন রাত্রি নয়টা বাজিয়া গিয়াছে। আমরা ঐ অবকাশে শ্রীযুক্ত বিজয়ের উপাসনায় যোগদান করিবার জন্য নিম্নে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম উঠানেই একত্রে উপাসনার অধিবেশন হইয়াছে এবং উহার উত্তরপার্শ্বের দালানে বেদিকার উপরে বসিয়া আচার্য বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্মভক্তসকলের সহিত সমস্বরে ‘সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম’ ইত্যাদি বাক্যে ব্রহ্মের মহিমা স্মরণপূর্বক উপাসনা আরম্ভ করিতেছেন। উপাসনাকার্য ঐরূপে কিছুক্ষণ চলিবার পরে ঠাকুর সভাস্থলে উপস্থিত হইলেন এবং অন্যসকলের সহিত একাসনে উপবিষ্ট হইয়া উহাতে যোগদান করিলেন। প্রায় দশ-পনর মিনিট তিনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। পরে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। অনন্তর রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছে বলিয়া তিনি দক্ষিণেশ্বরে ফিরিবার জন্য গাড়ি আনয়ন করিতে বলিলেন। পরে হিম লাগিবার ভয়ে মোজা, জামা ও কানঢাকা টুপি ধারণ করিয়া তিনি বাবুরাম প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া ধীরে ধীরে সভাস্থল পরিত্যাগপূর্বক গাড়িতে আরোহণ করিলেন। ঐ সময়ে আচার্য বিজয়কৃষ্ণ বেদী হইতে ব্রাহ্মসঙ্ঘকে সম্বোধন করিয়া যথারীতি উপদেশপ্রদান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। উক্ত অবকাশে সভাস্থল পরিত্যাগ করিয়া আমরাও গৃহাভিমুখে অগ্রসর হইলাম।
মণি মল্লিকের ভক্ত-পরিবার
ঐরূপে ব্রাহ্মভক্তগণের সহিত মিলিত হইয়া ঠাকুর যেভাবে আনন্দ করিতেন তাহার পরিচয় আমরা এই দিবসে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। মণিবাবু আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম ছিলেন কি না তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু তাঁহার পরিবারস্থ স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যে তৎকালে ব্রাহ্মমতাবলম্বী ছিলেন এবং উক্ত সমাজের পদ্ধতি অনুসারে দৈনিক উপাসনাদি সম্পন্ন করিতেন, ইহা আমরা সবিশেষ অবগত আছি। ইঁহারই পরিবারস্থ একজন রমণী উপাসনাকালে মন স্থির করিতে পারেন না জানিতে পারিয়া ঠাকুর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “কাহার কথা ঐ কালে মনে উদিত হয় বল দেখি?” রমণী অল্পবয়স্ক নিজ ভ্রাতুষ্পুত্রকে লালনপালন করিতেছেন এবং তাহারই কথা তাঁহার অন্তরে সর্বদা উদিত হয় জানিতে পারিয়া, ঠাকুর তাঁহাকে ঐ বালককেই বাল-শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি জানিয়া সেবা করিতে বলিয়াছিলেন। রমণী ঠাকুরের ঐরূপ উপদেশ কার্যে পরিণত করিতে করিতে কিছুকালের মধ্যেই ভাবসমাধিস্থা হইয়াছিলেন। এ কথা আমরা ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এর অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি।1 সে যাহা হউক, ঠাকুরকে আমরা অন্য এক দিবস কয়েকজন ব্রাহ্মভক্তকে লইয়া অন্যত্র আনন্দ করিতে স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিলাম। সেই চিত্রই এখন পাঠকের সম্মুখে ধারণ করিতে প্রবৃত্ত হইব।
1. গুরুভাব, পূর্বার্ধ – প্রথম অধ্যায় দেখ।
পঞ্চম খণ্ড – প্রথম অধ্যায় – তৃতীয় পাদ: জয়গোপাল সেনের বাটীতে ঠাকুর
জয়গোপাল সেনের বাটী
সিঁদুরিয়াপটির মণিমোহনের বাটীতে ঠাকুরের কীর্তনানন্দ ও ভাবাবেশ দেখিয়া আমরাই যে কেবল আধ্যাত্মিক রাজ্যে অদৃষ্টপূর্ব নূতন আলোক দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলাম তাহা নহে, বন্ধুবর বরদাসুন্দরও ঐরূপ অনুভব করিয়াছিলেন এবং আবার কবে কোথায় আসিয়া ঠাকুর ঐরূপে আনন্দ করিবেন, তদ্বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার ঐরূপ চেষ্টা ফলবতী হইতে বিলম্ব হয় নাই। কারণ, উহার দুই দিবস পরে ১৩ অগ্রহায়ণ, ইংরাজী ২৮ নভেম্বর, বুধবার প্রাতে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবামাত্র তিনি বলিলেন, “আজ অপরাহ্ণে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কমল-কুটিরে কেশববাবুকে দেখিতে আসিবেন এবং পরে সন্ধ্যাকালে মাথাঘষা পল্লীর জয়গোপাল সেনের বাটীতে আগমন করিবেন, দেখিতে যাইবে কি?” শ্রীযুত কেশব তখন বিশেষ অসুস্থ, এ কথা আমাদিগের জানা ছিল। সুতরাং আমাদিগের ন্যায় অপরিচিত ব্যক্তি কমল-কুটিরে গমন করিলে বিরক্তির কারণ হইবার সম্ভাবনা বুঝিয়া আমরা সন্ধ্যায় শ্রীযুত জয়গোপালের বাটীতেই ঠাকুরকে দেখিতে যাইবার কথা স্থির করিলাম।
মাথাঘষা পল্লী বড়বাজারের কোন অংশের নাম হইবে ভাবিয়া আমরা সেখানেই প্রথমে উপস্থিত হইলাম এবং জিজ্ঞাসা করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া ক্রমে শ্রীযুত জয়গোপালের ভবনে পৌঁছিলাম। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। মণিমোহনের বাটীতে উৎসবের দিনের ন্যায় আজও বৈকালে এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল। কারণ, বেশ মনে আছে, রাস্তায় কাদা ভাঙিতে ভাঙিতে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়াছিলাম। এ কথাও স্মরণ হয় যে, মণিমোহনের বাটীর ন্যায় জয়গোপালবাবুর ভবনও পশ্চিমদ্বারী ছিল এবং পূর্বমুখী হইয়া আমরা উক্ত বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিলাম। প্রবেশ করিয়াই এক ব্যক্তিকে দেখিতে পাইয়া আমরা ঠাকুর আসিয়াছেন কি না জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম এবং তিনিও তাহাতে আমাদিগকে সাদরে আহ্বান করিয়া দক্ষিণের সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া পূর্বের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্রশস্ত বৈঠকখানায় যাইতে বলিয়াছিলেন। দ্বিতলে উক্ত ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম ঘরখানি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সজ্জিত; বসিবার জন্য মেঝেতে ঢালাও বিছানা বিস্তৃত রহিয়াছে এবং উহারই একাংশে ঠাকুর কয়েকজন ব্রাহ্মভক্ত-পরিবৃত হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। নববিধান-সমাজের আচার্যদ্বয় শ্রীযুত চিরঞ্জীব শর্মা ও শ্রীযুত অমৃতলাল বসু যে তাঁহাদিগের মধ্যে ছিলেন, এ কথা স্মরণ হয়। তদ্ভিন্ন গৃহস্বামী শ্রীযুত জয়গোপাল ও তাঁহার ভ্রাতা, পল্লীবাসী তাঁহার বন্ধু দুই-তিনজন এবং ঠাকুরের সহিত সমাগত তাঁহার দুই-একটি ভক্তও তথায় উপস্থিত ছিলেন। মনে হয়, ‘হুট্কো’ বলিয়া ঠাকুর যাঁহাকে নির্দেশ করিতেন, সেই ‘ছোটগোপাল’ নামক যুবক ভক্তটিকেও সেদিন তথায় দেখিতে পাইয়াছিলাম। ঐরূপে দশ-বারোজন মাত্র ব্যক্তিকে ঠাকুরের নিকটে সেদিন উপস্থিত থাকিতে দেখিয়া আমরা বুঝিয়াছিলাম, অদ্যকার সম্মিলন সাধারণের জন্য নহে এবং এখানে আমাদিগের এইরূপে আসাটা সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত হয় নাই। সেজন্য সকলকে আহার করিতে ডাকিবার কিছু পূর্বে আমরা এখান হইতে সরিয়া পড়িব, এইরূপ পরামর্শ যে আমরা স্থির করিয়াছিলাম, এ কথা স্মরণ হয়।
গৃহে প্রবেশ করিয়াই আমরা ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরের শ্রীপদপ্রান্তে প্রণাম করিলাম এবং “তোমরা এখানে কেমন করিয়া আসিলে” – তাঁহার এইরূপ প্রশ্নের উত্তরে বলিলাম, “সংবাদ পাইয়াছিলাম আপনি আজ এখানে আসিবেন, তাই আপনাকে দেখিতে আসিয়াছি।” তিনি ঐরূপ উত্তরশ্রবণে প্রসন্ন হইলেন বলিয়া বোধ হইল এবং আমাদিগকে বসিতে বলিলেন। তখন নিশ্চিন্তমনে উপবিষ্ট হইয়া আমরা সকলকে লক্ষ্য করিতে এবং তাঁহার উপদেশ-গর্ভ কথাবার্তা শুনিতে লাগিলাম।
ঠাকুরের উপদেশ দিবার প্রণালী
ঠাকুরের পুণ্যদর্শন ইতঃপূর্বে অল্পকালমাত্র লাভ করিলেও তাঁহার অমৃতময়ী বাণীর অপূর্ব আকর্ষণ আমরা প্রথম দিন হইতেই উপলব্ধি করিয়াছিলাম। উহার কারণ তখন হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিলেও এখন বুঝিতে পারি, তাঁহার উপদেশ দিবার প্রণালী কতদূর স্বতন্ত্র ছিল। উহাতে আড়ম্বর ছিল না, তর্কযুক্তির ছটা, অথবা বাছা বাছা বাক্যবিন্যাস ছিল না, স্বল্পভাবকে ভাষার সাহায্যে ফেনাইয়া অধিক দেখাইবার প্রয়াস ছিল না, কিংবা দার্শনিক সূত্রকারদিগের ন্যায় স্বল্পাক্ষরে যতদূর সাধ্য অধিক ভাব প্রকাশ করিবার চেষ্টাও ছিল না। ভাবময় ঠাকুর ভাষার দিকে আদৌ লক্ষ্য রাখিতেন কি না বলিতে পারি না, তবে যিনি তাঁহার কথা একদিনও শুনিয়াছেন, তিনিই লক্ষ্য করিয়াছেন অন্তরের ভাব শ্রোতৃবর্গের হৃদয়ে প্রবেশ করাইবার জন্য তিনি কিরূপে তাঁহাদিগের জীবনে নিত্যপরিচিত পদার্থ ও ঘটনাসকলকে উপমাস্বরূপে অবলম্বন করিয়া চিত্রের পর চিত্র আনিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে ধারণ করিতেন। শ্রোতৃবর্গও উহাতে তিনি যাহা বলিতেছেন, তাহা যেন তাঁহাদিগের চক্ষের সমক্ষে অভিনীত প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহার কথার সত্যতায় এককালে নিঃসন্দেহ ও পরিতৃপ্ত হইয়া যাইতেন। ঐসকল চিত্র তাঁহার মনে তখনি তখনি কিরূপে উদিত হইত, এই বিষয় অনুধাবন করিতে যাইয়া আমরা তাঁহার অপূর্ব স্মৃতিকে, অদ্ভুত মেধাকে, তীক্ষ্ণ দর্শনশক্তিকে অথবা অদৃষ্টপূর্ব প্রত্যুত্পন্নমতিত্বকে কারণস্বরূপে নির্দেশ করিয়া থাকি। ঠাকুর কিন্তু একমাত্র মার (শ্রীশ্রীজগদম্বার) কৃপাকেই উহার কারণ বলিয়া সর্বদা নির্দেশ করিতেন; বলিতেন, “মায়ের উপরে যে একান্ত নির্ভর করে, মা তাহার অন্তরে বসিয়া যাহা বলিতে হইবে, তাহা অভ্রান্ত ইঙ্গিতে দেখাইয়া বলাইয়া থাকেন; এবং স্বয়ং তিনি (শ্রীশ্রীজগদম্বা) ঐরূপ করেন বলিয়াই তাহার জ্ঞানভাণ্ডার কখনও শূন্য হইয়া যায় না। মা তাহার অন্তরে জ্ঞানের রাশি ঠেলিয়া দিয়া সর্বদা পূর্ণ করিয়া রাখেন; সে যতই কেন ব্যয় করুক না, উহা কখনও শূন্য হইয়া যায় না।” ঐ বিষয়টি বুঝাইতে যাইয়া তিনি একদিন নিম্নলিখিত ঘটনাটির উল্লেখ করিয়াছিলেন –
দক্ষিণেশ্বর কালীবাটীর উত্তর পার্শ্বেই ইংরাজ-রাজের বারুদ-গুদাম বিদ্যমান আছে। কতকগুলি সিপাহী তথায় নিয়ত-পাহারা দিবার জন্য থাকে। উহারা সকলে ঠাকুরকে নিরতিশয় ভক্তি করিত এবং কখনও কখনও তাঁহাকে তাহাদিগের বাসায় লইয়া যাইয়া ধর্মবিষয়ক নানা প্রশ্নের মীমাংসা করিয়া লইত। ঠাকুর বলিতেন, “একদিন তাহারা প্রশ্ন করিল, ‘সংসারে মানব কিভাবে থাকিলে তাহার ধর্মলাভ হইবে?’ অমনি দেখিতেছি কি, কোথা হইতে সহসা একটি ঢেঁকির চিত্র সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত। ঢেঁকিতে শস্য কুটা হইতেছে এবং একজন সন্তর্পণে উহার গড়ে শস্যগুলি ঠেলিয়া দিতেছে, দেখিয়াই বুঝিলাম, মা বুঝাইয়া দিতেছেন, ঐরূপে সতর্কভাবে সংসারে থাকিতে হইবে। ঢেঁকির গড়ের সম্মুখে বসিয়া যে শস্য ঠেলিয়া দিতেছে, তাহার যেমন সর্বদা দৃষ্টি আছে, যাহাতে তাহার হাতের উপর ঢেঁকির মুষলটি না পড়ে, সেইরূপ সংসারের প্রত্যেক কাজ করিবার সময় মনে রাখিতে হইবে, ইহা আমার সংসার বা আমার কাজ নহে, তবেই বন্ধনে পড়িয়া আহত ও বিনষ্ট হইবে না। ঢেঁকির ছবি দেখিবামাত্র, মা মনে ঐ কথার উদয় করিয়া দিলেন এবং উহাই তাহাদিগকে বলিলাম। তাহারাও উহা শুনিয়া পরম পরিতুষ্ট হইল। লোকের সহিত কথা বলিবার কালে ঐরূপ ছবিসকল সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়।”
তাঁহার উপদেশপ্রণালীর অন্য বিশেষত্ব
ঠাকুরের উপদেশ দিবার প্রণালীতে অন্য বিশেষত্ব যাহা লক্ষিত হইত, তাহা এই যে – তিনি বাজে বকিয়া কখনও শ্রোতার মন গুলাইয়া দিতেন না। জিজ্ঞাসু ব্যক্তির প্রশ্নের বিষয় ও উদ্দেশ্য ধরিয়া কয়েকটি সিদ্ধান্ত-বাক্যে উহার উত্তর প্রদান করিতেন এবং উহা তাহার হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্য পূর্বোক্তভাবেই উপমাস্বরূপে চিত্রসকল তাহার সম্মুখে ধারণ করিতেন। উপদেশ-প্রণালীর এই বিশেষত্বকে আমরা সিদ্ধান্ত-বাক্যের প্রয়োগ বলিয়া নির্দেশ করিতেছি; কারণ প্রশ্নোক্ত বিষয় সম্বন্ধে তিনি যাহা মনে জ্ঞানে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিয়াছেন তাহাই কেবলমাত্র বলিতেন, এবং ঐ বিষয়ের অপর কোনরূপ মীমাংসা যে হইতে পারে না, এ কথা তিনি মুখে না বলিলেও তাঁহার অসঙ্কোচ বিশ্বাসে উহা শ্রোতার মনে দৃঢ়মুদ্রিত হইয়া যাইত। পূর্ব শিক্ষা ও সংস্কারবশতঃ যদি কোন শ্রোতা তাঁহার সাধনালব্ধ মীমাংসাগুলি গ্রহণ না করিয়া বিরুদ্ধ তর্কযুক্তির অবতারণা করিত, তাহা হইলে অনেক স্থলে তিনি “আমি যাহা হয় বলিয়া যাইলাম, তোমরা উহার ল্যাজা-মুড়ো বাদ দিয়া নাও না”, বলিয়া নিরস্ত হইতেন। ঐরূপে কখনও তিনি শ্রোতার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপপূর্বক কাহারও ভাবভঙ্গে উদ্যত হইতেন না। ভগবদিচ্ছায় শ্রোতা উন্নত অবস্থান্তরে যতদিন না পৌঁছিতেছে, ততদিন প্রশ্নোক্ত বিষয়ের যথার্থ সমাধান তাহার দ্বারা হইতে পারে না, ইহা ভাবিয়াই কি তিনি নিবৃত্ত হইতেন? – বোধ হয়।
আবার তাঁহার সিদ্ধান্ত-বাক্যসকল হৃদয়ঙ্গম করাইতে ঠাকুর পূর্বোক্তভাবে কেবলমাত্র উপমা ও চিত্রসকলের উত্থাপন করিয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না, কিন্তু প্রশ্নোক্ত বিষয়ের তিনি যে মীমাংসা প্রদান করিতেছেন, অন্যান্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাধকেরাও তৎসম্বন্ধে ঐরূপ মীমাংসা করিয়া দিয়াছেন, এ কথা তাঁহাদের রচিত সঙ্গীতাদি গাহিয়া এবং কখনও কখনও শাস্ত্রীয় দৃষ্টান্তসকল শ্রোতাকে শুনাইয়া দিতেন। বলা বাহুল্য, উহাতে উক্ত মীমাংসা সম্বন্ধে তাহার মনে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিত না এবং উহার দৃঢ় ধারণাপূর্বক সে তদনুসারে নিজ জীবন পরিচালিত করিতে প্রবৃত্ত হইত।
উপলব্ধি-রহিত বাক্যচ্ছটায় ঠাকুরের বিরক্তি
আর একটি কথাও এখানে বলা প্রয়োজন। ভক্তি ও জ্ঞান উভয় মার্গের চরমেই সাধক উপাস্যের সহিত নিজ অভেদত্ব উপলব্ধি করিয়া অদ্বৈতবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়, এ কথা ঠাকুর বারংবার আমাদিগকে বলিয়া গিয়াছেন। “শুদ্ধা ভক্তি ও শুদ্ধ জ্ঞান এক (পদার্থ)” – “সেখানে (চরম অবস্থায়) সব শিয়ালের এক রা (একই প্রকারের উপলব্ধির কথা বলা)” – ইত্যাদি তাঁহার উক্তিসকল ঐ বিষয়ে প্রমাণস্বরূপে উপস্থাপিত হইতে পারে। ঐরূপে অদ্বৈতবিজ্ঞানকে চরম বলিয়া নির্দেশ করিলেও তিনি রূপরসাদি বিষয়ভোগে নিরন্তর ব্যস্ত সংসারী মানব-সাধারণকে বিশিষ্টাদ্বৈত-তত্ত্বের কথাই সর্বদা উপদেশ করিতেন এবং কখনও কখনও দ্বৈতভাবে ঈশ্বরে ভক্তি করিবার কথাও বলিতে ছাড়িতেন না। ভিতরে ঈশ্বরে তাদৃশ অনুরাগ এবং উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থাসকলের উপলব্ধি নাই, অথচ মুখে অদ্বৈত বা বিশিষ্টাদ্বৈতের উচ্চ উচ্চ কথাসকল উচ্চারণ করিয়া তর্কবিতর্ক করিতেছে, এরূপ ব্যক্তিকে দেখিলে তাঁহার বিষম বিরক্তি উপস্থিত হইত এবং কখনও কখনও অতি কঠোর বাক্যে তাহাদিগের ঐরূপ কার্যকে নিন্দা করিতে তিনি সঙ্কুচিত হইতেন না। আমাদিগের বন্ধু বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “পঞ্চদশী-টশী পড়েছ?” বৈকুণ্ঠ তাহাতে উত্তর করেন, “সে কার নাম মহাশয়, আমি জানি না।” শুনিয়াই তিনি বলিয়াছিলেন, “বাঁচলুম, কতকগুলো জ্যাঠা ছেলে ঐসব পড়ে আসে; কিছু করবে না, অথচ আমার হাড় জ্বালায়।”
সংসারে থাকিয়া ঈশ্বর-সাধনা সম্বন্ধে ঠাকুরের উপদেশ
পূর্বোক্ত কথাগুলি বলিবার প্রয়োজন, অদ্য শ্রীযুত জয়গোপালের বাটীতে ঠাকুরকে এক ব্যক্তি ‘সংসারে আমরা কিরূপে থাকিলে ঈশ্বর-কৃপার অধিকারী হইতে পারিব’ – এইরূপ প্রশ্নবিশেষ করিয়াছিলেন। তিনি উহাতে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর মত তাহাকে উপদেশ করিয়াছিলেন এবং তিন-চারিটি শ্যামাবিষয়ক সঙ্গীত মধ্যে মধ্যে গাহিয়া ঐ কথার উত্তর প্রদান করিয়াছিলেন। ঠাকুরের কথার সারসংক্ষেপ আমরা নিম্নে প্রদান করিতেছি।
মানব যতদিন সংসারটাকে ‘আমার’ বলিয়া দেখিয়া কার্যানুষ্ঠান করে, ততদিন উহাকে অনিত্য বলিয়া বোধ করিলেও সে উহাতে আবদ্ধ হইয়া কষ্ট ভোগ করিতে থাকে এবং ইচ্ছা করিলেও উহা হইতে নিষ্কৃতির পথ দেখিতে পায় না। ঐরূপ বলিয়াই ঠাকুর গাহিয়াছিলেন, “এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে; ব্রহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য, জীবে কি তা জানতে পারে” ইত্যাদি। অতএব এই অনিত্য সংসারকে ভগবানের সহিত যোগ করিয়া লইয়া প্রত্যেক কার্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে – এক হাতে তাঁহার পাদপদ্ম ধরিয়া থাকিয়া অপর হাতে কাজ করিয়া যাইতে হইবে এবং সর্বদা মনে রাখিতে হইবে, সংসারের সকল বস্তু ও ব্যক্তি তাঁহার (ঈশ্বরের), আমার নহে। ঐরূপ করিলে মায়া-মমতাদিতে কষ্ট পাইতে হইবে না এবং যাহা কিছু করিতেছি, তাঁহার কর্মই করিতেছি, এইরূপ ধারণার উদয় হইয়া মন তাঁহার দিকেই অগ্রসর হইবে। পূর্বোক্ত কথাগুলি বুঝাইতে ঠাকুর গাহিলেন, “মন রে কৃষিকাজ জান না” ইত্যাদি। গীত সাঙ্গ হইলে আবার বলিতে লাগিলেন, “ঐরূপে ঈশ্বরকে আশ্রয় করিয়া সংসার করিলে ক্রমে ধারণা হইবে, সংসারের সকল বস্তু ও ব্যক্তি তাঁহারই (ঈশ্বরের) অংশ। তখন সাধক পিতা-মাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরীজ্ঞানে সেবা করিবে, পুত্র-কন্যার ভিতর বালগোপাল ও শ্রীশ্রীজগদম্বার প্রকাশ দেখিবে, অপর সকলকে নারায়ণের অংশ জ্ঞান করিয়া শ্রদ্ধাভক্তির সহিত ব্যবহার করিবে। ঐরূপ ভাব লইয়া যিনি সংসার করেন, তিনিই আদর্শ-সংসারী এবং তাঁহার মন হইতে মৃত্যুভয় এককালে উচ্ছিন্ন হইয়া যায়। ঐরূপ ব্যক্তি বিরল হইলেও একেবারে যে দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহা নহে।” পরে, ঐরূপ আদর্শে উপনীত হইবার উপায় নির্দেশ করিয়া ঠাকুর বলিলেন, “বিবেক-বুদ্ধিকে আশ্রয় করিয়া সকল কার্যের অনুষ্ঠান করিতে হয় এবং মাঝে মাঝে সংসারের কোলাহল হইতে দূরে যাইয়া সংযত চিত্তে সাধন-ভজনে প্রবৃত্ত হইয়া ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতে হয়; তবেই মানব পূর্বোক্ত আদর্শ জীবনে পরিণত করিতে পারে।”1 ঐরূপে উপায় নির্দেশ করিয়া ঠাকুর নিম্নলিখিত রামপ্রসাদী গীতটি গাহিয়াছিলেন, ‘আয় মন বেড়াতে যাবি, কালীকল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি।’ আবার, ‘বিবেক-বুদ্ধি’ কথাটি প্রয়োগ করিয়াই ঠাকুর উহা কাহাকে বলে, সে কথা বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন যে, ঐরূপ বুদ্ধির সহায়ে সাধক ঈশ্বরকে নিত্য ও সারবস্তু বলিয়া গ্রহণ করে এবং রূপরসাদির সমষ্টিভূত জগৎকে অনিত্য ও অসার জানিয়া পরিত্যাগ করে। ঐরূপে নিত্য বস্তু ঈশ্বরকে জানিবার পরে কিন্তু ঐ বুদ্ধিই তাহাকে বুঝাইয়া দেয় যে, যিনি নিত্য তিনিই লীলায় জীব ও জগৎরূপ নানা মূর্তি ধারণ করিয়াছেন এবং ঐরূপ বুঝিয়াই সাধক চরমে ঈশ্বরকে নিত্য ও লীলাময় উভয়ভাবে দেখিতে সমর্থ হয়।
1. ঠাকুরের অদ্যকার কথার সারসংক্ষেপের কিয়দংশের জন্য আমরা শ্রদ্ধাস্পদ ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-কারের নিকট ঋণী রহিলাম।
কীর্তনানন্দ
অনন্তর আচার্য চিরঞ্জীব একতারা-সহায়ে “আমায় দে মা পাগল করে” সঙ্গীতটি গাহিতে লাগিলেন এবং সকলে তাঁহার অনুসারী হইয়া উহার আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। ঐরূপে কীর্তন আরম্ভ হইলে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া দণ্ডায়মান হইলেন। তখন অন্য সকলেও ঠাকুরকে ঘিরিয়া দণ্ডায়মান হইয়া কীর্তন ও নৃত্য করিতে লাগিলেন। ক্রমে ঐ গানটি সাঙ্গ করিয়া শ্রীযুত চিরঞ্জীব “চিদাকাশে হ’ল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় রে” গানটি আরম্ভ করিলেন এবং অনেকক্ষণ পর্যন্ত উক্ত গীতটি গাহিতে গাহিতে নৃত্য করিবার পর, ঈশ্বর ও তাঁহার ভক্তবৃন্দকে প্রণাম করিয়া সেদিনকার কীর্তন শান্ত হইল ও সকলে ঠাকুরের পদধূলি গ্রহণ করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। এই দিনেও ঠাকুর মধুরভাবে নৃত্য করিয়াছিলেন, কিন্তু শ্রীযুত মণিমোহনের বাটীতে তাঁহার যেরূপ বহুকালব্যাপী গভীর ভাবাবেশ দেখিয়াছিলাম, অদ্য এখানে ততটা হয় নাই। কীর্তনান্তে উপবেশন করিয়া ঠাকুর শ্রীযুত চিরঞ্জীবকে বলিয়াছিলেন, “তোমার এ গানটি (‘চিদাকাশে হ’ল’ ইত্যাদি)1 যখন প্রথম শুনিয়াছিলাম, তখন কেহ উহা গাহিবামাত্র (ভাবাবিষ্ট হইয়া) দেখিতাম, এত বড় জীবন্ত পূর্ণিমার চাঁদের উদয় হইতেছে!”
অনন্তর শ্রীযুত কেশবের ব্যাধি সম্বন্ধে শ্রীযুত জয়গোপাল ও চিরঞ্জীবের মধ্যে পরস্পর কথাবার্তা হইতে লাগিল। আমাদের স্মরণ আছে, শ্রীযুত রাখালের2 শরীর সম্প্রতি খারাপ হইয়াছে, এই কথা ঠাকুর এই সময়ে এক ব্যক্তিকে বলিয়াছিলেন। শ্রীযুত জয়গোপাল আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম ছিলেন কি না বলিতে পারি না, কিন্তু ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্রকে যে বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি করিতেন এবং ব্রাহ্মসঙ্ঘের সকলের প্রতি বিশেষ প্রীতিসম্পন্ন ছিলেন, এ কথা নিঃসন্দেহ। কলিকাতার নিকটবর্তী বেলঘরিয়া নামক স্থানে ইঁহার উদ্যানে শ্রীযুত কেশব কখনও কখনও সদলবলে যাইয়া সাধন-ভজনে কালাতিপাত করিতেন এবং ঐ উদ্যানে ঐরূপ এক সময়ে ঠাকুরের সহিত প্রথম সম্মিলিত হইয়াই তাঁহার জীবনে আধ্যাত্মিকতা ক্রমে গভীরভাব ধারণ করিয়া উহাতে নববিধানরূপ সুরভি কুসুম প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিয়াছিল। জয়গোপালও ঐদিন হইতে ঠাকুরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবান হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং কখনও দক্ষিণেশ্বরে তাঁহার নিকট গমন করিয়া, কখনও বা নিজ বাটীতে তাঁহাকে আনয়ন করিয়া ধর্মালাপে পরম আনন্দ অনুভব করিতেন। আমরা শুনিয়াছি, ঠাকুরের কলিকাতায় আসিবার গাড়িভাড়ার অনেকাংশ শ্রীযুত জয়গোপাল এক সময়ে বহন করিতেন। তাঁহার পরিবারস্থ সকলেও ঠাকুরের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন ছিলেন।
অনন্তর রাত্রি ক্রমে অধিক হইতেছে দেখিয়া আমরা ঠাকুরের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া ঐদিন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছিলাম।
1. চিদাকাশে হ’ল পূর্ণ প্রেম-চন্দ্রোদয় রে
(জয় দয়াময়! জয় দয়াময়! জয় দয়াময়!)
উথলিল প্রেমসিন্ধু, কি আনন্দময়।
(আহা) চারিদিকে ঝলমল, করে ভক্ত-গ্রহদল,
ভক্তসঙ্গে ভক্তসখা লীলারসময়। (হরি)
স্বর্গের দুয়ার খুলি, আনন্দ-লহরী তুলি,
নব-বিধান বসন্ত-সমীরণ বয়;
(কিবা) ছুটে তাহে মন্দ মন্দ, লীলারস প্রেমগন্ধ,
ঘ্রাণে যোগিবৃন্দ যোগানন্দে মত্ত হয়।
ভবসিন্ধু-জলে, ‘বিধান’-কমলে,
আনন্দময়ী বিরাজে;
(কিবা) আবেশে আকুল, ভক্ত-অলিকুল,
পিয়ে সুধা তার মাঝে।
দেখ দেখ মায়ের প্রসন্ন বদন, ভুবনমোহন চিত্তবিনোদন,
পদতলে দলে দলে সাধুগণ, নাচে গায় প্রেমে হইয়া মগন;
(কিবা) অপরূপ আহা মরি মরি, জুড়াইল প্রাণ দরশন করি,
প্রেমদাসে বলে সবে পায়ে ধরি, গাও ভাই মায়ের জয়। (রে)
2. স্বামী ব্রহ্মানন্দ নামে এখন যিনি শ্রীরামকৃষ্ণভক্তসঙ্ঘে পরিচিত আছেন।