প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

৫.০১ ধান কাটার আগে – দেবেন্দ্র সত্যার্থী

ধান কাটার আগে – দেবেন্দ্র সত্যার্থী

সারিবদ্ধ কামানের মতো বাঙালিদের একটি দল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ওরা সংখ্যায় হবে খুব সম্ভব সাতজন পুরুষ, দশজন স্ত্রীলোক আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। পুরুষদের মধ্যে যুবক-বুড়ো- দুই-ই রয়েছে। সবার অবস্থাই এক– সকলেই ক্ষুধার্ত। কোলের শিশুরা শুকনো মাই চুষছে। অপেক্ষাকৃত বড়রা লাইন ভেঙে লঙ্গরখানার দুয়োরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জেদ ধরেছে। লঙ্গরখানার পরিচালকেরা পুরুষ আর মেয়েদের আলাদা লাইন লাগাবার কতই-না চেষ্টা করেছেন, ওরা কিন্তু তবু ভারি কামানের মতো– যার যার জায়গা ছেড়ে আদপেই নড়তে চায় না।

‘সত্যযুগ– সত্যযুগ!’ কান-ফাটা আওয়াজ আসছে লাইন থেকে।

জয়শ্রী ভাবে– জানি না, সত্যযুগ কবে আসবে। হয়তো আসতে পারে, হয়তো না-ও আসতে পারে। সত্যের পরে ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। আবার কলিযুগের পরে সত্যযুগ। সত্যযুগ কত বছরের হবে, কে জানে। কলিযুগের নির্দিষ্ট কালও কেউ বলতে পারে না। হ্যাঁ, স্মরণ হয় বটে, বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই বছরে ত্রেতা আর আট লক্ষ চৌষট্টি বছরে দ্বাপর। শাস্ত্র-পুরাণ ঘেঁটে পুরোহিত যা বলেন, তা ঠিকই বলে থাকবেন। কলিযুগের নির্দিষ্ট কালের খবর নাকি শাস্ত্রেও নেই। কে জানে, কলিযুগের অন্ত হবে কিনা। হয়তো কলিযুগ ত্রেতার চেয়েও দীর্ঘ হবে। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তো জয়শ্ৰী শুনে আসছে, পাপের বোঝা বেশি হয়ে গিয়েছে, তাই নৌকা এখন ডুবুডুবু।

জয়শ্রীর মানসপটে ভাসে অগণিত শকুনের দৃশ্য। সবগুলো শকুনই যেন একসঙ্গে তার ওপর ঝাঁপটা দিতে উদ্যত। সে বলে– সত্যযুগ আসুক চাই না-আসুক– শকুনগুলো আমাদের মতো কাঙালিদের বুঝি-বা গিলেই ফেলবে। আমরা যে আর বাঁচতে পারব না।… সব সহ্য করছি।

তার এই স্বগতোক্তিতে মনে হচ্ছে যেন তারা সবাই চোখের সামনে শকুন দেখতে পাচ্ছে।

রাখাল তার হাত টেনে বলে– মা, ক্ষিধে পেয়েছে, মা, ক্ষিধেয় প্রাণ যায়।

অন্য কোথাও হলে জয়শ্রী নিশ্চয় পালিয়ে যেত। এখন তার শরীরে আর এক ফোঁটাও শক্তি নেই। জয়শ্রী রাখালের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে ভাবে– আট বছর ধরে আমার কোলে ও মানুষ– এমন তো আর কোনোদিন নজরে পড়েনি। পেটটা একেবারে সেঁধিয়ে গেছে। শরীরের হাড় কটা যেন গোনা যায়। আহা, আজ যদি ওর বাবা বেঁচে থাকত, তাহলে লঙ্গরখানার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না। তার মজুরির কামাইয়ে দিন চলে যেত। আজকেও ডাল-ভাত কপালে জোটে কিনা কে জানে। এমন করে আমরা কি আর বেঁচে থাকব!

চোখের সামনে জয়শ্রী দেখতে পায়, ক্ষুধার্ত শকুনেরা উড়ে বেড়াচ্ছে- শকুনগুলো যেন রাখালের ওপর ঝাঁপটা দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে।

রাখাল মায়ের হাত ধরে বলে– আমরা ডাল-ভাত কখন পাব, মা– গরম গরম ডাল-ভাত?

–আমাদের পালা আসতে দাও, তবে তো।

জয়শ্রী রাখালের মুখে চুমু দিতে গিয়ে ভাবে– জানিনে, আমাদের পালা কখন আসবে, পালা আসার আগেই ডাল-ভাত শেষ হয়ে যাবে কিনা। বুঝি-বা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। তারপর অগণিত শকুনের দল ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলবে।… ক্ষিধের জ্বালায় পেটে যেন চিতা জ্বলছে। হায় রাম! এ ক্ষিধে কি আর মিটবে না! আমরা বোকা, আর শকুনগুলোও বোকা– কে কতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকবে! জানি না আর কত দেরি। কিন্তু ডাল-ভাত যে পাওয়া চাই-ই। লঙ্গরখানার মালিকরা কত দয়াবান– মৃত্যুর কবল থেকে ওরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।…

…জয়শ্রী ও জয়শ্রী…! গ্রাম থেকে বিদায় নেবার সময় তার স্বামী বলেছিল– আমারই আগে মৃত্যু হবে, জয়শ্রী। যতিদন আমি বেঁচে থাকব, যমদূত তোমায় দেখতেও পাবে না।

–এমন কথা মুখেও এনো না, পতিদেব। আমি আগে মরব। তুমি বেঁচে থাক, আমার রাখালও যেন বেঁচে থাকে।…

–রাখালের কথা ভেব না। ওর আমি এতটুকুও কষ্ট হতে দেব না।

জয়শ্রী ভাবে– কলিযুগের মানুষের মুখে এ যেন সত্যযুগের বাণী। হ্যাঁ, স্বামীর ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হয়েছে, সেই আগে মরেছে।… কাঙালি-জীবন কারই-বা পছন্দ হয়! এই কি জীবন! এ জীবন কি কারও কাম্য হতে পারে!… জীবন তো নয়, বোঝা।… জয়শ্রী, তুমি এত শুকিয়ে যাচ্ছ কেন? জয়শ্রী, তুমি গর্ভবতী! জয়শ্রী, সাত মাস পেরিয়ে গেছে, আর মাত্র দুমাস বাকি। বেটা ছেলে জন্ম নেবে। তখন আর কোনো দুঃখ-কষ্টই থাকবে না। কিন্তু যদি মেয়ে জন্মায়? না, না, না, মেয়ে চাই না। মেয়ের জীবনে অনেক কষ্ট। ছেলে চাই, ছেলে। যে ছেলে ক্ষেতে-জমিতে হাল চালাবে, বছর বছর ধান ফলাবে।… হায়রে আকাল!

জয়শ্রী রাখালের হাত ছাড়িয়ে নেয় ঝট্‌কা মেরে– যেন যত দোষ তারই। পরমুহূর্তেই আবার তার পিঠে হাত বুলোতে শুরু করে। বলে– রাখাল, সোনার চাঁদ ছেলে আমার। এক বুড়ো কাশতে কাশতে বলে– আমরা বড়লোকের দান খাচ্ছি। দান খেতে আমরা বাধ্য।

আরেকজন বলে– এমন আকাল তো সাত জন্মে দেখিনি, বাবা– শুনেছি বলেও তো মনে হয় না।

এক বুড়ি বলে– আগে বিষ্টি না-হলে আকাল হত, ধানের ফলন নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এবার এত ফসল ফলল, তবু এত আকাল! হায় ভগবান, এ আকাল কি শেষ হবে না!

একটা মেয়ে বুড়িকে আশ্বাস দিয়ে বলে– আমরা আবার গ্রামে ফিরে যাব, বুড়িমা। অন্য একজন বলে– যারা যাবার, তারা তো চলেই গেল; এখন দেখছি লঙ্গরখানার মালিকরা আমাদের মরতে দেবে না।

বুড়ি এ-কথার প্রতিবাদ করে ওঠে– তুমি যদি বাঁচতে চাও তো বেঁচে থাক, বাছা। ভগবানকে অনেক বলেছি, আমি আর বাঁচতে চাইনে।

জয়শ্রী তন্ময় হয়ে ওদের আলাপ-আলোচনা শোনে। ডান পায়ের ভর বাঁ পায়ের উপর দিয়ে রাখালের চিবুক স্পর্শ করে বলে– তোর বাবা আমাকে ছেড়ে গেছে, রাখাল। এখন তুই-ই আমার ভরসা। তুই আমার সোনার চাঁদ ছেলে, তুই আমার রাজপুত্তুর।…

এক কোণা থেকে একটা মেয়ে হঠাৎ বলে ওঠে– কিন্তু স্বর্গে তো আকাল নেই।

অন্যজন যোগ করে– ক্ষিধেয়, মহামারীতে ভুগে ভুগে আমাদের কত কষ্ট- দেবতাদের সে খবর জানা আছে কি?

চণ্ডিদাস ঠিকই বলেছেন।– বুড়ি তখন গুনগুন করে সুর ধরে গাইতে শুরু করে– সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল…।

হঠাৎ নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায় জয়শ্রীর। বাড়ি নয়, একটা কুঁড়েঘর। অনন্ত অভাবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও জয়শ্রী শুনতে পায় শঙ্খধ্বনি। শাঁখ বাজিয়ে কারা যেন দেবতাদের ঘুম ভাঙাচ্ছে। দেবতার বাস স্বর্গে, তবু তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। রাত্রিবেলা মন্দিরে তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। সকালে তাঁদের জাগিয়ে তোলা হয়। স্নানের পর নানারকমের ভোজ্য পরিবেশন করা হয় তাঁদের সামনে। জমিদারবাবুর প্রাসাদের কোনো বিশেষ জায়গায় তাঁদের জন্য খাবার রাঁধা হয়। সম্ভবত তাই দেবতারা জমিদারবাবুর ওপর এত খুশি। অন্যদিকে মহাজনেরাও দেবতাদের খুশি রাখে আর আমাদের জমিগুলো আত্মসাৎ করে ক্ষুদে জমিদার হওয়ার চেষ্টা করে।

.

পিছন থেকে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছে। জয়শ্রী রাখালকে তাড়াতাড়ি আগলে রাখে। আহা, লোকগুলোর কি লজ্জা-শরমও নেই গো।

কানের পাশ দিয়ে আওয়াজ ভেসে আসে– বলি, দেবে তো এক মুঠো ডাল-ভাত, তা-ও এত দেরি কেন, বাবা, কেন এত শাস্তি দেওয়া!

এ লোকটাও ধাক্কা খেয়েছে বুঝি। কাঁঠালগাছের আড়ালে না-থাকলে তার অর্ধোলঙ্গ শরীরের ওপর সূর্যের কিরণ এসে পড়ত। ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকেও লোকটা ঘামে চুপসে গেছে।

মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রেখে রাখাল জয়শ্রীর মুখের দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে।

–রাখাল, তুইও বুঝি ঘামে ভিজে গেছিস? রাজপুত্তুর, সোনার চাঁদ ছেলে আমার, তোর খুব ক্ষিদে পেয়েছে নারে? আজ আমার ভাগটাও তোকে দেব, কেমন?…

জয়শ্রী খুব জোরে জোরে মাথা চুলকাতে শুরু করে। মাথার মধ্যে উকুনগুলো রক্ত চুষছে।

পিছন থেকে বুড়োটা আবার মুখ খোলে– এখন গাঁয়ের অবস্থা কেমন?… আড়াই মাস হল গ্রাম ছেড়েছি। গাঁয়ের চাল নিয়ে এসে শহর ভরেছে। এখন গ্রাম না-ছেড়ে এসে তারা কিই-বা করবে। বুড়ো হয়েছি, অনেক দেখলাম।…

আগের মেয়েটি প্রশ্ন করে– তাহলে তোমরা আর কেউ গাঁয়ে ফিরবে না?

জয়শ্রী রাগ করে বলে– পোড়ামুখোরা এত চাল কোথায় নিয়ে গেল?

— ভগবান, তুমি কি দেখতে পাও না? তোমার কি চোখ নেই?

পিঁপড়ের মতো লাইনগুলো একটু একটু করে সামনে এগোয়। এখনো লঙ্গরখানায় পৌঁছাতে অনেক দেরি। পোয়া ঘণ্টা… আধ ঘণ্টা… এক ঘণ্টা… জয়শ্রী জানে না, কতক্ষণে লঙ্গরখানার দুয়ারে গিয়ে সে পৌঁছাবে। তখনো সে মাথা চুলকাচ্ছে।

মানুষের চিৎকার ক্রমেই বাড়তে থাকে। লঙ্গরখানায় গিয়ে একসঙ্গে সবাই হানা দেবার মতলবে বুঝি ষড়যন্ত্র করছে। পিছন দিকের চিৎকার ছড়াতে ছড়াতে সামনে গিয়ে পড়ে। দু-একজন ধ্বনি তোলে– হায় ডাল, হায় ভাত!… আর সারাটা লাইন দুলতে থাকে, ফুলতে থাকে।

এখানে জয়শ্রীর এইভাবে এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকা যেন অপ্রিয় দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্নের মতো। জীবন নয়, ভারি বোঝা। কে জানে, আর কতদিন টেনে বেড়াতে হবে এই ভারি বোঝাটা। জয়শ্রী বুড়োর দিকে চোখ মেলে তাকায়; বুড়ো যেন তাকে বলতে চাচ্ছে আমরা সব মড়া, সবাই আমরা শ্মশান থেকে উঠে এসে এখানে লাইন লাগিয়েছি; চল পাগলি, আবার আমরা শ্মশানে গিয়ে শুয়ে পড়ি।

…ক্ষুধার বন্যা, আকাল, দুর্ভিক্ষ, মহামারী…

রাখাল যেন বানরের মতো লাফ দিয়ে লঙ্গরখানায় ঢুকে পড়তে চায়। সে ভাবে– মায়ের অংশের সবটুকুই আজ সে খেয়ে ফেলবে। আজ তার অনেক ক্ষুধা।

ঘামের তীব্রগন্ধী উগ্রতা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।… জয়শ্রী ভাবছে তার গ্রামের কথা– গ্রামে কি আর কোনোদিন ফিরে যাওয়া চলবে তাদের? স্বামী নেই, কিন্তু রাখাল তো আছে। রাখালের চেষ্টাতে আবার তারা সব ফিরে পাবে। জমিদারের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনবে তাদের জমিজমা। রাস্তার ভিখারিদের সাথে রাখাল আর ঘুরে বেড়াবে না। গ্রামেই ফিরে যেতে হবে, গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো।

পিছনের মেয়েটি বলে– আমাদের সারাজীবনের ঘাম আজকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে।

বুড়ি বলে– ধনী, গরিব সবার গা থেকেই ঘাম ঝরছে, বাছা।

বুড়ো বলে– কিন্তু কেমন করে ঝরছে? পেটের মধ্যে একফোঁটা অন্ন নেই, জল নেই– তবু ঘাম ঝরছে কেমন করে?

তারপর জয়শ্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলে– পাগলি, তুমি কেমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছ? তোমার কি কিছুই বলতে সাধ যায় না?

জয়শ্রী একবার বুড়োর দিকে, একবার মেয়েটির দিকে তাকায়। কিন্তু কোনো কথাই বলতে পারে না সে।

সামনের ছোকরাটি ধ্যানস্থ চোখে মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে নিজে কৃষ্ণ, আর মেয়েটি তার রাধা। জয়শ্রী কিন্তু তাদের দুজনকেই মনে মনে ধ্যান করে রাধা-কৃষ্ণ ভেবে। সে নিজেও তো একদিন কৃষ্ণ পেয়েছিল, যদিও শূন্যপ্রাণ রাধিকা আজকে স্বামীর শেষ কটি দিনের স্মৃতির রোমন্থন ছাড়া আর কিছুই আগলে রাখতে পারছে না। স্বামীর মৃত্যুতে কতই-না কেঁদেছে সে। তারপরেই কান্না থেমেছে, যখন দেখেছে, তার বুকের মতোই বাড়িটাও শূন্য– মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থাটুকুও করা যাচ্ছে না। ভিক্ষা করেনি, ধার করেনি– থালা-বাসন বিক্রি করে তবে মড়া পোড়াবার ব্যবস্থা করেছে। চিতার ছাই এখন বাতাসে বাতাসে উড়ে না-জানি কোন তেপান্তরের মাঠে গিয়ে পড়ছে।…

জয়শ্রীর মন আবার গ্রামের পথে ফিরে যায়।… রাধা-কৃষ্ণের পালা হচ্ছে গ্রামে। গ্রামে যাত্রার দল এসেছে। চণ্ডিদাসের পদাবলির কীর্তন হচ্ছে প্রায়ই। শুকনো মনে কত দোলা লাগে, প্রাণে কত ফুর্তি জাগে। মনে পড়ছে, জয়শ্রীর হাতে টাকা-পয়সা থাকায় এসব আনন্দে অংশ নিতে কত সহজ প্রাণের সাড়া জাগত। মহাজনদের দোকানে সস্তা দরে ধান বিক্রি করে সে নগদ টাকা নিয়ে আসত ঘরে। মশাল জ্বালিয়ে যাত্রা হবে, তাই সে সাততাড়াতাড়ি পয়সা ফেলে দিত। একবার চাঁদা উঠেছিল তিনশো টাকা। পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলেন জমিদারবাবু একাই। কিন্তু… কিন্তু… সে টাকা কাদের! আমাদেরই ঘাম-ঝরানো পয়সা দিয়ে জমিদারের শখের লীলা। ভগবান, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ– ন্যায়-অন্যায়ের এই লীলার তুমিই একমাত্র দর্শক।… তবু মনে কোনো দুঃখ নেই। একটি টাকা চাঁদা দিয়ে জয়শ্রী তো তবু দেখেছে রাধা-কৃষ্ণের যাত্রা-গান। দেখে দেখে মন জুড়িয়েছে।…

দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ। জ্যোতির্ময় রাধা-কৃষ্ণের কথা ভেবে আর দুর্ভিক্ষকে আটকে রাখা যাবে না। আটকে রাখা যাবে না পেটের অনন্ত ক্ষুধাকে।…

ভাবতে ভাবতে জয়শ্রী লঙ্গরখানার দুয়ারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নিশ্বাসটুকুও পড়তে চায় না, গলার মধ্যে এসে আটকে যায়।

গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে জয়শ্রী আবার তন্ময় হয়ে ওঠে। মনে পড়ছে, চালের দাম যখন হু-হুঁ করে বাড়তে লাগল, গ্রামের লোকেরা তখন ভবিষ্যৎ না ভেবেই অন্ধের মতো তা বিক্রি করতে শুরু করল। মহাজনেরা আল্লাদে আটকানা, কারণ তাদের পোয়াবারো। তারা আরো বেশি করে ধান-চাল বিক্রি করার জন্যে চাষিদের উৎসাহ দিতে থাকে, তাদের বোঝায়– ধান-চালের দর বেশি থাকতে বিক্রি করে ফেল, আবার সস্তার সময় কিনে নেবে।

কিন্তু সস্তার সময়ও আর এল না, তাই কেউ আর ধান-চাল কিনতেও পারল না। যেন চিরস্থায়ী দুর্ভিক্ষের ঘূর্ণিজলে পড়ে তারা হাবুডুবু খেতে লাগল। আর মহাজনেরা এখন বলে– এককণা চাল সোনার চেয়েও দামি। আহা, এ কি কলিযুগ এল, মা গো!

পিছন থেকে বুড়ো আবার জয়শ্রীর গায়ে হাত দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। জয়শ্রী তার দিকে তাকায়। বুড়োর চোখে ফুটে উঠেছে অপূর্ব ভাষা। সে যেন বলতে চাইছে– দুনিয়া একটা পান্থশালা। পথে পথে, দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে আমরা এখানে ফিরেছি। বেশিক্ষণ এখানে থাকা চলবে না। আবার আমরা বেরিয়ে পড়ব। লঙ্গরখানার ডাল-ভাতই আমাদের সম্বল।

গ্রাম ছাড়ার কিছুদিন আগে জয়শ্রী এক বুড়োকে দেখেছিল বাজারের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের যুগলমিলনের মূর্তি বিক্রি করতে। সে বুড়ো যেন এই বুড়োরই প্রতিধ্বনি। না, প্রতিধ্বনি নয়, বরং খুব সম্ভব এই-ই সেই বুড়ো। পূর্বপুরুষের পুজোর মূর্তি পেটের দায়ে এখন বিক্রি হচ্ছে। জয়শ্রী ভাবে মূর্তি বিক্রি করার কথা বুড়োকে জিগ্যেস করবে কিনা। কিন্তু কী মনে করে বিরত থাকে সে।

জয়শ্রীর চোখের সামনে তারাপদের ছবিটা হঠাৎ ভেসে ওঠে। শহর থেকে যেসব দালালরা এসে মেয়েদের ফুসলিয়ে নিয়ে যেত, তারাপদ তাদের উদ্দেশে রচনা করেছিল ব্যঙ্গ-কবিতা। কবিতায় তাদের সে সম্বোধন করত ‘হারামি, শুয়োরের বাচ্চা, পাজি’ বলে। অথচ কী আশ্চর্য! তারাপদই অবশেষে দালালদের পাল্লায় পড়ে গ্রামের সব-সেরা সুন্দরী মেয়েদের ধরে ধরে বিক্রি করে ফেলত। কে জানে, সেই ‘হারামি, শুয়োরের বাচ্চা, পাজি’ লোকটা এখন কোথায়? তখন পর্যন্ত একটি নয়, দুটি নয়– সাত-সাতটি মেয়ে সে বিক্রি করেছে। কেন, কিসের জন্য?– পেটের জন্য। একমুঠো ভাতের জন্য। কিন্তু শুধু এক-মুঠো ভাত নয়– পেয়েছে সে রসগোল্লা, সন্দেশ আরো কত রকমারি মণ্ডা-মিঠাই। আমাদের মতো কষ্ট করে তাকে আর লঙ্গরখানার লাইনে দাঁড়াতে হয় না। সম্ভবত এখন সে পাকা দালান তুলেছে।…

জয়শ্রী আর রাখাল এখন লঙ্গলখানার দুয়ারের কাছেই পৌঁছে গেছে প্রায়। আহা, রাখালের মুখে আনন্দ আর ধরে না। এখন মায়ের হাত টেনে লঙ্গরখানার দিকে দৌড়াবার আর কোনো প্রয়োজন নেই। এখন গরম গরম ডাল-ভাত সে নিজেই নিয়ে খেতে পারবে। মা যদি তার কাছ থেকে হাজার ক্ষিধের দোহাই দিয়ে এতটুকুও চায়, তবু দেবে না– সবটুকু সে একাই খেয়ে সাবাড় করবে।

জয়শ্রী ভাবে– সাত দিন ধরে পুঁইপাতা খেয়ে বেঁচে থাকা; আর পারি না, পতিদেব। কিন্তু দু’দিন পরে তা-ও কি আর জুটবে! ওই এক টুকরো জমিই তো রেখেছিলাম রাখালের জন্য। মহাজন এসে মাত্র দুই সের চালের বিনিময়ে সেটা চাইল। ভাবলাম, কলিযুগের তো এই শেষ, আমারও শেষ। এরপর সত্যযুগ আসবে, রাখাল আবার জমি ফিরে পাবে।…

ঘোর অন্ধকার যে-রাত্রিতে ওরা পাড়ি দিয়েছিল, মহাজনের গাড়ি-ভর্তি চোরাই ধান-চালগুলোও সেই রাত্রিতেই শহরে এসেছে! সে কিছুই বোঝেনি, তবুও ভেবেছে– ভগবান, এত চাল কোথায় যাবে, কে খাবে।

ইতোমধ্যে ওরা লঙ্গরখানায় এসে পৌঁছে গেছে। জয়শ্রী দেখতে পায়, রাখাল তার নিজের অংশ এরই মধ্যে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে।

লোভাতুর দৃষ্টিতে মায়ের অংশের দিকে তাকিয়ে রাখাল বলে– মা, একেবারে ঠাণ্ডা।

জয়শ্রী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে– গরম কোথায় পাবে, বল, বাবা। আজকে এটাই খাও, কালকে আবার দেখা যাবে।

জয়শ্রী আর রাখাল এখন নদীর দিকে এগুতে থাকে। পিছন থেকে সেই মেয়েটি তাড়াতাড়ি এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলে– একটু আস্তে চল না, দিদি। আমার মাকেও আসতে দাও, ভাই। তা আমরা তো আর এক গাঁয়ের লোক নই; ভগবানের ইচ্ছা, তাই একসঙ্গে মিশেছি।

জয়শ্রী তার হাত ধরে বলে– হ্যাঁ বোন, আমরা যে সবাই দুঃখী।

মেয়েটির মা এসে রাখালের গালে চুমো খায়। বলে– তা বাছা, আমার থেকে ও কিছুটা ভাগ নাও না; বুড়ো হয়েছি, এত কি আর খেতে পারি!

কথা শুনে রাখাল লোলুপ দৃষ্টি মেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জয়শ্রী শিউরে উঠে বলে–না, না, তাই কি হয়! সবাইকেই তো বেঁচে থাকতে হবে।

কিন্তু আপত্তি সত্ত্বেও রাখাল কিছুটা ভাগ পায় আবার। নদীর ধারে পৌঁছে পেট ভরে জল খেয়ে নিয়ে সবাই জিরোতে থাকে। এদিকে অল্পক্ষণের মধ্যেই রাখালের পেট ফাঁপতে শুরু করেছে।

জয়শ্রী ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনায় পড়ে। তার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর নিয়ে লুটিয়ে পড়ে সে মাটিতে।

সেই সঙ্গে রাখালও পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করে। তার মুখের রং ঘন-ঘন বদলাতে থাকে। ক্রমেই সে রং পাংশুটে হয়ে আসে।

ওরা দুজন মা-মেয়ে যতখানি পারে তাদের যত্ন নেয়, সান্ত্বনা দেয়, অভয়বাণী শোনায়। জয়শ্রী উঠে বসে রাখালের পেটে হাত বুলাতে থাকে।

উদ্ভ্রান্তের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে জয়শ্রী মেয়েটিকে প্রশ্ন করে– জানিস বোন, সত্যযুগ আসতে আর কত দেরি?

–তা কেমন করে বলি বল। শহর থেকে ঝাণ্ডা হাতে যারা আমাদের গাঁয়ে মিটি করতে এসেছিল, তারাও তো জানে বলে মনে হচ্ছে না।

শুয়ে শুয়ে রাখাল পাশ ফেরে। পাতলা বাহ্যি হয় তার। রাখালকে পরিষ্কার করে নিয়ে জয়শ্রী তাকে অন্যত্র শোয়ায়। মাটি চাপা দিয়ে ময়লা ঢেকে ফেলে। জয়শ্রীর বুক আতঙ্কে তোলপাড় করতে থাকে। রাখালের পেটে মালিশ করতে থাকে সে।

জয়শ্রী প্রশ্ন করে– সত্যযুগ কি তবে আসবে না, বোন?

মেয়েটি বলে– তা কেমন করে বলি বল! তবে শহর থেকে মিটিং করতে এসে তারা বলেছিল, যারা হাল চালাবে, তারাই নাকি জমির মালিক হবে।

–তেমন দিন করে আসবে, বোন?

–ঝাণ্ডাধারীরা বলেছিল, এই যে ডাল-ভাত ওরা আমাদের খাওয়াচ্ছে, এ কিন্তু দয়ার দান নয়, এতে আমাদের অধিকার আছে। আমরা আমাদের পাওনা আদায় করে নিচ্ছি। একদিন আসবে, যখন আমরা আর চেয়ে খাব না, নিজেরাই আমাদের খাবার যোগাড় করে নিতে পারব।

জয়শ্রী তন্ময় হয়ে শোনে আর ভাবতে থাকে শুধু সত্যযুগের কথা। কিন্তু ভাবনার রেশ ছিঁড়ে যায় শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির শব্দ শুনে। যেন এক নতুন যাত্রাদল এসেছে। তীব্র মশাল হাতে নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ এগিয়ে আসছে আর থালায় পয়সা ফেলে দিচ্ছে। কেমন করে মানুষ আজ এত উদারপ্রাণ! তবে কি এ দেশে আর দুর্ভিক্ষ নেই। রাধা… রাধা…! কৃষ্ণ… কৃষ্ণ…!

রাখালের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হতে থাকে। জয়শ্রীর মনে উৎকণ্ঠার সীমা নেই। রাখালের মাথা কোলে রেখে জয়শ্রী ভাবে– আমার এই শেষ প্রদীপও কি তবে নিভে যাবে! কান্নার উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে জয়শ্রী।

মেয়েটি বলে– হতাশ হয়ো না, দিদি– রাখাল সেরে উঠবে।

কিন্তু জয়শ্রী মৃত্যুকে ভয় করে না। তার চোখের সামনে মৃত্যু এসে তাণ্ডব করলেও সে ভয় পাবে না। কিন্তু রাখাল যেন না-মরে। রাখালের বুকে হাত রেখে সে আকাশের দিকে তাকায়, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে, নীরব করুণ ভাষায় জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে রাখালের।

কিন্তু আবেদন যথাস্থানে পৌঁছাবার অনেক আগেই… জয়শ্রী রাখালের নাড়ি টিপে দেখে, নীরব হয়েছে সবকিছুই। সে ডুকরে কেঁদে উঠে বলে– সব শেষ হয়ে গেছে, বোন– সব শেষ।

.

মেয়েটি শহর থেকে খুঁজেপেতে ঝাণ্ডাধারীদের তিনজনকে নিয়ে আসে। সৎকারের ব্যবস্থার জন্য সে হাতের চুড়ি খুলে দিতে চায়। কিন্তু ওরা তা গ্রহণ করে না। অল্পক্ষণের মধ্যে চিতার কাঠের যোগাড় হয়ে যায়। জয়শ্রী তার বিচিত্র চাদর দিয়ে রাখালকে ঢেকে নেয়। চিতায় তুলে দেওয়া হয় মৃতদেহটাকে।

জয়শ্রী নিজের হাতে তাতে আগুন ধরায়।

গভীর অন্ধকার রাত্রি। জয়শ্রীর ভবিষ্যৎ যেমন অন্ধকার।

চিন্তার আগুন স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। জয়শ্রীর মনের চিতার ফুলিঙ্গ এ যেন।

আলোর চার পাশের অন্ধকার আরো জমাট বেঁধে ওঠে। জয়শ্রীর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেমন নিরাশায় জমাট বাঁধা।

ঝাণ্ডাধারীরা চলে যায়। জয়শ্রী শ্মশানেই শুয়ে পড়ে। ওরা দুজনাই তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে।

সারারাত্রি জেগে কাটে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জয়শ্রী শ্মশানের ছাই তুলে নিয়ে মাথায় মাখে। সে দেখতে পায়, মাথার উপর দিয়ে যেন অসংখ্য শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। তারাও যেন জয়শ্রীর মতো অনন্তকাল ধরে ক্ষুধার্ত। জীবন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপটা দেওয়ার চেষ্টায় তারা হন্যে হয়ে উঠেছে। এবং একদিন-না-একদিন ঝাঁপটা তারা দেবেই।

জয়শ্রী সেখানেই আবার লুটিয়ে পড়ে। ওদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে লঙ্গরখানার দিকে যেতে রাজি হয় না। যেন এখানেই পড়ে থেকে সে রাখালের অনুসারী হবে।

মেয়েটি বলে– তুমি যে পোয়াতি, তোমার একটু সাবধানে থাকা উচিত, বাছা।

মা বলে– বাছা, তোমার কিন্তু ছেলেই হবে।

জয়শ্রী ধড়মড় করে উঠে বসে। সে ভাবে– অনাগত শিশু সত্যযুগের মানুষ; নিজের ভাগ্য সে নিজেই গড়ে নেবে।

জয়শ্রী বলে– সত্যযুগ তাহলে আসবে। আমরা আবার জমি ফিরে পাব। নিজের জমিতে আমারই ছেলে হাল চালাবে। ভিখিরিদের মতো দুয়ারে দুয়ারে আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। লঙ্গরখানায় আর লাইন লাগাতে হবে না। পাপের নৌকা এবারে তাহলে ডুববে।

জয়শ্রী মাটিতে আসন পেতে বসে। সাত মাস পূর্ণ হয়েছে, আর মাত্র দুই মাস। তারপর আর কতদিন… আর কতদিন।

কিন্তু… কিন্তু…

কিন্তু কদিন ধরে পেটের মধ্যে বাচ্চাটার কোনো নড়নচড়ন নেই কেন?

তবে কি… তবে কি….

মা বলে– চাঁদের মতো ছেলে হবে, দেখো। তোমার আর ভাবনা কিসের!

.

জয়শ্রীর কানে কানে কে যেন মন্ত্র পড়ে যায়– জয়শ্রী, জয়শ্রী, তোমরা-যে সব জাত- কিষাণ, তোমাদের আর ভাবনা কিসের। যুগ পালটে যাচ্ছে। তোমাদের জমিদার আর কতদিন জমিদারি করবে। তোমাদের জমি তোমরাই আবার ফিরে পাবে। তোমার নতুন রাখাল এসে সে জমির তদারকি করবে। তোমাদের আর ভাবনা কিসের

কিন্তু পেটে এত ব্যথা উঠল কেন। আমি যে মরে যাচ্ছি।

জয়শ্রী পেটের ব্যথায় আর্তনাদ করে চেঁচিয়ে ওঠে। মেয়েটি কোত্থেকে খানিক শর্ষের তেল যোগাড় করে এনে জয়শ্রীর পেটে মালিশ করতে থাকে।

যথাসময়ের দু’মাস আগেই, এই এখানে শুয়ে শুয়েই জয়শ্রী একটি নবশিশুর জন্ম দেয়। জন্ম দেয় একটি মৃত সন্তানের।

মা জয়শ্রীকে সামলে নিয়ে বলে– বাচ্চাটাকে ঢেকে নাও, বাছা; ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে।

জয়শ্রী কিন্তু সচেতন হয়ে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।

একটুখানি চেতনা ফিরে পেয়েই সে উঠতে চেষ্টা করে। সত্যযুগের সন্তানকে সে দুহাত দিয়ে খুঁজতে থাকে।

মৃত সন্তানের মুখ দেখে আবার সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জয়শ্রীর চোখ দুটি ঘুমের নেশায় আস্তে আস্তে জুড়িয়ে আসে। কোনোদিনই আর ঘুম ভাঙে না জয়শ্রীর।

অদূর ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ইঙ্গিতকে যেন সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেই মেয়েটি বলতে থাকে– জয়শ্রী বলেছিল-না, মা : সত্যযুগ আসবে। পাপের নৌকা ডুবে যাবে। জয়শ্রী তার প্রাণ দিয়ে গেল, আর যাবার আগে কি সে পাপের নৌকা ডুবানোর জন্য শেষ ধাক্কাটা দিয়ে গেল না?

অনুবাদ : নজিরউদ্দীন চৌধুরী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *