৫. হেগে মুতে ফেলে

০৫.

হেগে মুতে ফেলে বলে ছেলেরা আর মাকে ঘরে থাকতে দেয় না। বারান্দায় হোগলার বেড়া তুলে ঘিরে দিয়েছে সেই বেড়ারও ওপর নীচে ফাঁক। শীতের হাড়কাঁপানো হাওয়া, বর্ষাবাদলা, ধুলো বালি, সাপ ব্যাঙ সবই ঢোকে। দরজা বলে কিছু নেই। খাঁ খাঁ করছে একটা দিক। বেড়াল কুকুর ঢুকে পড়ে অহহ। শরীরে নানা রোগভোগ নিয়ে বুড়ি একখানা নড়ে চৌকির ওপর পড়ে থাকে। এ একরকম ঘরের বার করে দেওয়া। একরকম বিদায় দিয়ে দেওয়া।

গ্যাঁড়াপোঁতায় দিদির বাড়িতে গেলে একবার করে যায় গোবিন্দ। বুড়ো মানুষদের ওপর তার এমনিতেই একটা টান আছে। পুরনো সব দিন যেন ঘিবে থাকে তাদের, কত গল্প শোনা যায়। তাদের কই গোবিন্দ ঠিক সইতে পারে না।

ভর ওপর এ হচ্ছে সম্পর্কে তার দিদিশাশুড়ি। নাতজামাই এ গাঁয়ে আসে জেনে বুড়ি বড় কাকুতি মিনতি করে ধরেছিল গোবিন্দর দিদি দিমিকে। নাতজামাই এলে যেন একবারটি চোখের দেখা দেখতে পায়। তারপর গোবিন্দ প্রায়ই যায়। মানুষকে মানুষের এত অপমান করার অধিকার নেই। থাকতে পারে না। বুড়িকে তার ছেলেরা যেভাবে লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিচ্ছে এরকমটা কিন্তু কোনও বুড়ো মানুষেরই সঠিক পালা নয়। গোবিন্দর ইচ্ছে করে রাগে ফেটে পড়ে খুব অপমান করতে এদের।

এসে সে একখানা মোড়া পেতে কাছেই বসে থাকে। রসগোল্লা বা সন্দেশ নিয়ে আসে বুড়ির জন্য। বুড়ির নোংরা বিনা বা কাপড় জামা, মুতের মেটে হাঁড়ি কিছুতেই সে ঘেন্না পায় না।

বুড়ি তার সাড়া পেলেই উঠে বসে। রোগা জীর্ণ চেহারা। রোগের যন্ত্রণায় চোখ মুখ বসে গেছে। তবু গোবিন্দ এলে ফোকলা মুখে খুব হাসে।

এসেছিস ভাই? তোকে দেখলে আমার প্রাণটা কেন ঠাণ্ডা হয় রে?

আমার ঠাণ্ডা হয়, আর আপনার অবস্থা দেখলে যে আমার মাথা গরম হয়।

এরকমই তো হওয়ার কথা। সংসার বড় জঞ্জাল।

 সংসার জঞ্জাল কেন হবে ঠাকুমা? সংসারকে জঞ্জাল বানালে তবেই তা জঞ্জাল হয়। আপনার ছেলেরা বড় অমানুষ।

বুড়ি ভয় খেয়ে বলে, ওরে, জোরে বলিসনি। শুনলে আমাকে খুব হেনস্থা করবে। একটু ওদের কথা কল, শুনি।

গোবিন্দ হাসে। ওদের কথা বলতে, বড় ছেলে আর তার সংসারের কথা। গোবিন্দ বলে, সে ছেলেও তো আপনাকে ছোলাগাছি দেখিয়ে কেটে পড়েছে। বলি নাতি নাতনি কাউকে চোখে দেখেছেন?

বুড়ি থোঁতা মুখ করে বলে, কোত্থেকে দেখব বল! কে দেখাবে? তারা কি আর আসে? তবে ভাল থাকলেই ভাল।

ভাল থাকবে না কেন? দিব্যি ভাল আছে। আপনার ছেলে শ্বশুরের পয়সায় হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে।

তোর বউটা কেমন হল? ভাল? যত্ন আত্তি করে?

এখনও ভাল করে ধরে আনিনি।

 ওমা! তা কেন রে?

ইচ্ছে হয় না। মেয়েটা বড্ড মুখরা। একটু তেল মজিয়ে নি।

ত্যাগ দিবি না তো!

গোবিন্দ হাসে, বিয়ে করার ইচ্ছেই ছিল না আমার। বিয়ে করলেই নানারকম ভজঘট্ট পাকিয়ে ওঠে। আপনার নাতনিটিও সোজা নয়। বিয়ের রাতেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল আলাদা বাসা করে থাকতে। সেই যে পিত্তি জ্বলে গেল, আর তা ঠাণ্ডা হল না।

তোর কিন্তু বড্ড রাগ ভাই। আমার নাতনিটাকে এনে একবার দেখাবি আমায়! তাকে দেখিনি তো কখনও। বড্ড দেখতে ইচ্ছে যায়। কবে মরে যাব, একবার মুখখানা দেখে রাখি। কেমন চেহারা রে? বাপের মতো মন পেয়েছে?

হ্যাঁ।

তা হলে দেখতে ভালই হবে। তোর পছন্দ তো?

 চেহারা খারাপনয়। আপনি তো তাদের কথা শুনতে চান, কিন্তু তারা কখনও আপনার কথা ভুলেও মুখে আনে না কেন ঠাকুমা? এটাই কি সংসারের নিয়ম?

বুড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুনেছি বিনাকি এবাড়িতে খুব কষ্টে ছিল বলে তার রাগ আছে। বিয়ে করে বিদেয় হওয়ার জন্য বড় অস্থির হয়েছিল। তা সে তার ছেলেপুলে নিয়ে সুখে স্বচ্ছন্দে থাকলেই হল। এই বুড়ো বয়সে একটা কথাই কেবল মনে হয়, যে কটা দিন আছি যেন শোকতাপ পেতে না হয় আর। ওইটাই ভয়ের ব্যাপার, বুঝলি? ছেলেপুলে নাতি নাতনি যখন অনেকগুলো হয়ে যায় তাই ভয় হয়, কোনটা পড়ল, কোনটা মরুল। বড় জ্বালা।

বুঝেছি ঠাকুমা।

 আর একটা হয়, সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বিষ্ঠুর তো দুই ছেলেও আছে। তারা কেমন?

আর পাঁচটা ছেলের মতোই।

 এই পোড়া চোখে তো আর দেখতে পাব না তাদের। তোর চোখ দিয়েই যেন দেখতে পাচ্ছি।

এত মায়া কেন বলুন তো ঠাকুমা। এত মায়া থাকলে যে শরীর ছাড়তে কষ্ট হবে।

বুড়ি একটু কেঁপে ওঠে, শরীর কি আর ছাড়তে চায় রে!

এত কষ্ট, তবু শরীর ধরে পড়ে আছি। পাপে মন তো, সহজে তাই মরতে দেয় না ভগবান। আরও অনেক ভোগাবে, তবে মারবে।

গোবিন্দ বসে বসে বুড়ির ঘরখানা দেখে। আদপে ঘরই নয়। একটা আৰু মাত্র। রাতের বেলায় ছেলেরা ঘরে দোর দিয়ে শোয়। বুড়ি বাইরে বেওয়ারিশ পড়ে থাকে। মানুষ যে কী করে এত হৃদয়হীন হয়।

শশুরবাড়ি থেকে পর পর শাশুড়ির চিঠি এল। কুসুমপুর থেকে যারা নাটাগড়ে আসে তাদের হাত দিয়েই চিঠি পাঠায় শাশুড়ি। একটাই বয়ান। মেয়েকে কবে ঘরে নেবে গোবিন্দ। সংসারে মন দিতে আর ইচ্ছাই হয় না গোবিন্দর। সংসার বড় নিমকহারাম জায়গা। তার ওপর ওই বারেই তো মেয়ে, তার আর কতটুকু মায়া দয়া হবে? তার চেয়ে একাবোকা বেশ আছে সে। তার বাড়ির লোক বউ আনার জন্য খুব গঞ্জনা দেয়, বিশেষ করে মা। তবে সে মাথা পাতে না। গড়িমসি করে।

গত সপ্তাহেও গ্যাঁড়াপোতা গিয়ে বুড়িকে দেখে এসেছে গোবিন্দ। মনে হয়েছে, আর বেশিদিন নেই। বুড়ি বালিশের তলা থেকে একখানা তোবড়ানো সোনার আংটি বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোর বউকে দিস।

এটা আবার কেন? এ আমি নেব না। আপনার শেষ সম্বল এসব।

 চুপ চুপ! গলা তুলতে নেই। আমার যা ছিল সব ওরা নিয়ে নিয়েছে। এটা অতি কষ্টে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। সম্বল বলিসনি, এ আমার শত্রু। অভাবের সংসারে গয়না ব অনেক আগেই গাপ হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ গাছা চুড়ি, দুটো ঝুমকো দুল, দুটি মাকড়ি আর তিনটে আংটি ছিল। এইটেই শেষ আংটি। টের পেলেই নিয়ে নেবে। এটা মুক্তির জন্য আমি রেখেছি।

কে রেখেছে কে জানে। তবে বুড়ি যার জন্য রেখেছে তার কাছে যে এই আংটির কোনও দাম হবে না তা গোবিন্দ ভালই জানে। মুক্তি তার বাপের একমাত্র মেয়ে বলে গয়নাগাটি মেলাই পেয়েছে। হরপ্রসন্ন নাকি নাতনিকে খুব ভালবাসতেন, বিয়ের গয়না তিনিও কিছু দিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তি এই তোবড়ানো আংটির আসল দাম বুঝতে চাইবে কি?

কিন্তু গোবিন্দ বোঝে, আংটিটা মাথায় ঠেকিয়ে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখে সে বলল, এ আংটির দাম লাখ টাকা।

সে তোর কাছে ভাই। তুই যে সোনার মানুষ।

এত চট করে সার্টিফিকেট দিয়ে বসবেন না। এখনও কিন্তু আপনার নাতনিকে নিয়ে ঘর করা শুরু করিনি। সংসারে পড়লেই কে কেমন বোঝা যায়।

তোদের সংসার কি আমি দেখতে যাব রে? এই যে তুই আমার কাছে আসিস এইতেই তুই সোনার মানুষ। বুড়োবুড়িদের কাছে কেউ আসতে চায় না রে ভাই, সারাদিন দুটো কথা কওয়ার লোক পাই না। আজকাল আরও কী হয়েছে জানিস, শুনলে হাসবি। আজকাল রাত বিরেতে বড় ভয় পাই।

কীসের ভয় ঠাকুমা?

 দাওয়ার উত্তর দিকে ওই লেবু গাছটা দেখছিস তো!

দেখছি।

ওদিকটায় বেড়া দেয়নি ওরা। নিশুতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পাই কারা যেন সব এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওখান থেকে দেখছে আমাকে।

কারা? চোর ছ্যাঁচড় নয় তো?

না রে ভাই। এ বাড়িতে চোর ছ্যাঁচড়েরও আসবার প্রবৃত্তি হয় না। মনে হয় তোর দাদার আসে, আমার এক ভাসুর, শাশুড়ি আরও সব কারা যেন তারা কেউ জ্যান্ত মানুষ নয়।

তা হলে ভূত। বলে খুব হাসে গোবিন্দ।

 বুড়ি হাসিটাকে গ্রাহ্য না করে বলে, তখন ভাই বড্ড ভয় করে। কত ডাকি ছেলেদের, বউদের, কেউ কোনও সাড়া দেয় না। হাতে পায়ে ধরে বলেছি, ওরে এদিকটাতে একটা বেড়া দিয়ে একটা ঝাঁপের দরজা করে দে। তাও কেউ গ্রাহ্য করে না।

ঠাকুমা, আমি যদি ভাল করে বেড়া দিয়ে ঘরখানা বেঁধে দিই তা হলে কী হয়?

কী জানি ভাই, তাতে বোধহয় আমার ছেলেদের আঁতে লাগবে। তোকে কিছু বলবে না, কিন্তু আমাকে দিনরাত ঝাঁপা ঝাঁপা করবে। কাজ কী তোর ওসব করতে যাওয়ায় মাঝে মাঝে যে এসে দেখে যাস সেই আমার ঢের। এখন একটা মানুষ এসে দুদণ্ড কাছে বসলে এত ভাল লাগে যে মনে হয় আর কিছু চাই না। কেউ যে আসেনা তাতেও দোষ দিই না কাউকে। হেগে মুতে ফেলছি, ঘরে নোংরা পড়ে থাকে, যোয় আসে না। হ্যাঁ রে, তোরও ঘেন্না করে, তাই না?

গোবিন্দ মাথা নেড়ে হেসে বলে, আমার ওসব ঘেন্নাপিত্তির বালাই নেই। আমার এক কাকার পেটে ক্যানসার হয়েছিল। বাহ্যের বার ব করে ডাক্তাররা পেটের বাঁ পাশে একটা কৌটো লাগিয়ে দিয়েছিল। তাইতে মল জমা হত, নিজে হাতে সেসব পরিষ্কার করেছি। রুগির সেবায় আমার খুব অভ্যাস আছে। আমাদের বাড়িতে কারও অসুখ বিসুখ হলে আমিই সব করি।

তবে কেন তুই সোনার ছেলে নোসল তো? তোকে দেখেই যে বুকটা জুড়িয়ে যায় আমার।

রুগির সেবা তো নাও করে। তারাও কি সব সোনার মেয়ে। ওটা কথা নয়, আমার ঘেন্নার ধাতটাই নেই।

একটু কাছে আয়। তোর মাথায় হাত দিয়ে একটু আশীর্বাদ করি।

আশীর্বাদের কোনও দাম আছে কিনা গোবিন্দ জানে না। কিন্তু বুড়ির রোগা হালকা দুখানা হাত যখন তার একরাশ চুলওলা মাথায় করে কাঁপছিল তখন গোবিন্দ মনে হল, বুড়ির প্রাণটাই যেন হাত বেয়ে আঙুল থেকে চুঁইয়ে তার ভেতরে ঢুকে আসতে চাইছে। আশীর্বাদের যদি কোনও অর্থ হয় তবে এর চেয়ে বেশি আর কী হবে?

সেই তোবড়ানো আংটিটা নিয়ে এসেছিল আজ গোবিন্দ। মুক্তি সেটা হাতে নিয়ে খুশি হল না, কিন্তু অবাক হল, এটা কীসের?

তোমার ঠাকুমা দিয়েছে। আশীর্বাদ।

হঠাৎ এটা দেওয়ার মানে?

 মানে কিছু নেই। আশীর্বাদের যদি কিছু মনে থাকে তবে এরও মানে আছে।

মুক্তি আংটিটা খুব হেলাভরে একটা দেরাজে রেখে দিয়ে বলে, তুমি বুঝি এখন খুব যাও ও বাড়িতে?

না। মাঝে মাঝে যাই। তুমি বোধহয় কখনওই যাওনি।

সেটা তো আর আমার দোষ নয়। ও বাড়ির সঙ্গে বাবারই সম্পর্ক নেই।

 গোবিন্দ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, সম্পর্ক যে কেন থাকে না সেটাই যে আমার মাথায় আসে না।

মুক্তি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে অন্য কথায় চলে গেল।

 রাগ গোবিন্দর সাথে হয় না। বুড়িটার লাঞ্চনা আর অপমান যে একেবারেই অকারণ, কতগুলি নির্মম বেআক্কেলে মানুষের চূড়ান্ত স্বার্থপরতাই যে তার কারণ, এটা ভেবে তার মাথা আর হয়ে যায়।

তার শ্বশুর বিষ্ণুপদ বোধহয় গোবিন্দর নীরব রাগ আর ঘেন্না টের পায়, তাই গোবিন্দ এলেই একটু তফাত হয়, লুকোনোর চেষ্টা করে। এমন কী একসঙ্গে খেতে অবধি বসে না।

তার দুই শালি, অর্থাৎ মুক্তির ছোট মামার মেয়েরা বিকেলে আলুকাবলি করবে, খাওয়ার নেম করেছিল। নইলে আগেই চলে যেতে পারত গোবিন্দ। শালা ছানু পাগলটাকে মেরে বসায় যাওয়া হয়নি। গোলমালে তালুকাবলিও মুলতুবি রেখে গোবিন্দ রওনা হওয়ার জন্য চুল আঁচড়াতে যখন ঘরে এল তখন শাশুড়ি খুব কাঁচুমাচু মুখে ঘরের দরজায় এসে বললেন, উনি কিন্তু এখনও ফিরলেন না!

কে? কার কথা বলছেন?

 তোমার শ্বশুর কখনও তো এত দেরি করেন না। আজ যে কী সব হচ্ছে।

 গাঁয়েই কোথাও গেছেন-টেছেন হয়তো।

চারদিকে লোক পাঠিয়েছি। যেখানে যেখানে যান তার কোথাও নেই।

 গোবিন্দ ঘড়ি দেখে নিল। বাস ধরবার জন্য মাত্র আধঘণ্টা সময় আছে। পা চালিয়ে হাঁটলে দশ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়। কাজেই খুব দেরি হয়ে যায়নি।

তুমি যাচ্ছ বাবা?

হ্যাঁ। শেষ বাস পাঁচটায়।

আজকাল তো কিছুতেই তোমাকে একটি দিন আটকে রাখতে পারি না। মুক্তির কী করবে কি ভেবেছ? বিয়ের পর তো অনেক দিন হয়ে গেল?

বলেছি তো, আরও কিছুদিন আপনাদের কাছে থাক। তারপর ভেবে দেখব।

ব্যাপারটা তো ভাল দেখাচ্ছে না। পাঁচজনে পাঁচকথা বলছে।

আপনার মেয়ের মন এখনও তৈরি হয়নি। আমাদের বেশ বড় পরিবার। মানিয়ে গুছিয়ে চলা খুব সহজ নয়। তাই মন তৈরি হোক।

পাপিয়া খুব সংকোচের সঙ্গে বলে, আসলে বড় আদরে মানুষ তো। অত কাজকর্মের মধ্যে গিয়ে পড়লে খেই হারিয়ে ফেলবে।

গোবিন্দ চিরুনিটা পকেটে খুঁজে রেখে বললে, তা বলে তো আমিও আর ঘর-জামাই থাকতে পারি না।

শাশুড়ি বিবর্ণ মুখে বলে, সেকথা কি বলেছি বাবা?

আপনার মেয়ে আমাকে আলাদা সংসার করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা কোনওদিনই সম্ভব না। আমরা মা বাপকে আস্তাকুঁড়ে ফেলতে শিখিনি।

গোবিন্দর হঠাৎ খেয়াল হল, তার গলা কিন্তু সপ্তমে পৌঁছে গেছে। এবং ভেতরে ভেতরে রাগের একটা ঝড় পাকিয়ে উঠছে। সে লজ্জা পেয়ে হঠাৎ চুপ করল। গুম হয়ে গেল।

তারপর গলা কয়েক পর্দা নামিয়ে এনে বলল, আপনি আর আমাকে চিঠি লিখে আনানোর চেষ্টা করবেন না।

পাপিয়া কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বলল, আলাদা থাকা কি ঘর-জামাই থাকা বাবা?

 তার চেয়ে খুব বেশি ভালও নয়। আমার আর সময় নেই। আমি যাচ্ছি।

আমার মনটা ভাল নেই বাবা, কী বলতে হয়তে কী বলেছি। তোমার শ্বশুরকে কিন্তু ঘরজামাই থাকতে আমিই বারণ করতাম। লোভে পড়ে হল, তার প্রায়শ্চিত্ত এখনও করতে হচ্ছে।

কান্না একদম সইতে পারে না গোবিন্দ। কেউ কাঁদলেই–তা সে কপট কান্না হলেও সে কেমন দ্রব হয়ে পড়ে। পাপিয়া দরজার কপাট দুহাতে আঁকড়ে ধরে তাতে মুখ গুঁজে কাঁদছিল।

দ্রব হলেও গোবিন্দ কখনও গলেও যায় না। সে গম্ভীর নিচু গলায় বলে, আপনি কাঁদছেন কেন? কান্নাকাটি দিয়ে তো এ জট খোলা যাবে না।

পাপিয়া তার হেঁচকি মেশানো কান্নার মধ্যেই বলে, তোমরা কি ভাব ওই লোকটা খুব সুখে আছে? একমাত্র বাবা ছাড়া প্রত্যেকে ওকে দিন রাত অপমান অবহেলা করেছে। আমাদের কাছেও সম্মান পায় না। নিতান্ত বেহায়া আর লোভী বলে বিষয় আঁকড়ে পড়ে থাকে।

ওঁর কথা টেনে আনছেন কেন? আমি তো আপনার মেয়ের কথা বলছিলাম।

তুমি তো ওঁকে দুচোখে দেখতে পারো না। ও সেটা টের পায় বলেই তোমার সামনে আসে না। বোধহয় তুমি আছ বলেই চৌপর দিন কোথায় গিয়ে না খেয়ে বসে আছে।

তা হলে তো আমার না আসাই ভাল।

আমার কপাল! যা বলি তার উল্টো অর্থ হয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম শ্বশুরকে অপছন্দ করো বলেই মুক্তিকেও তুমি সহ্য করতে পারো না।

আমি ওভাবে ভাবিনি। আপনারা যা খুশি হয় ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে আমার মনে হয়, চোখের জলটা আমার ওপর না খাঁটিয়ে আপনার মেয়ের ওপর খাটালে অনেক বেশি কাজ হত।

চোখের জলের কথা বলছ বাবা? আমার চোখের জল ধরে রাখলে এতদিনে সমুদ্র হয়ে যেত। বাকি জীবনটা কাঁদতে কাঁদতেই যাবে। আমি বলি কী, তুমি মুক্তিকে জোর করে নিয়ে যাও।

জোর করে মানে? চুলের মুঠি ধরে নাকি?

 দরকার হলে তাই করবে। নিয়ে গিয়ে বাসন মাজাও, কাপড় কাঁচাও, ঘর মোছাও, লাথি মারো, খুন করো, তবু ওকে নিয়ে যাও।

তার মানে আমরা ওসব করি নাকি? লাথি মারি? খুনও করি?

 পাপিয়া অসহায়ের মতো বিল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একরকম ছুটে পালিয়ে গেল।

একথা ঠিকই যে, গোবিন্দর একটা ক্ষ্যাপাটে রাগ আছে। সেই চরম রাগটা উঠলে তার ভেতরটা শুধু আগুন আর মাথায় মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ হতে থাকে। কিন্তু এই রাগটা আর কারও তত নয়, যতটা ক্ষতি করে তার নিজের। সে তখন কোনও কাজ করতে পারে না, ঘুমোতে পারে না, খেতে পারে না। শুধু ভেতরকার নিরুদ্ধ রাগে কাঁপতে থাকে।

সত্যিই হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল তার। একরকম টলতে টলতে মাতালের মতো সে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর চণ্ডীমণ্ডপ ডাইনে রেখে সোজা বাসরাস্তার দিকে হাঁটা দিল।

বাবু! বলি ও জামাইবাবু!

গোবিন্দ দাঁড়াল, পাগলটা না? সে তাকাতেই হাতছানি দিয়ে ডাকল। এখন পাগলটার কাছে কেউ নেই। ফাঁকা চণ্ডীমণ্ডপে একা বসে আছে।

যাবে না যাবেনা করেও গোবিন্দ গেল তার কাছে, কী বলছ?

কৃষ্ণকান্ত এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করে, বন্দোবস্তটা কীরকম হল? এই চণ্ডীমণ্ডপটা কি আমাকে দিয়ে দিলেন ঘরজামাই?

গোবিন্দ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, সে পাত্র পাওনি।

তা হলে কী হবে এখন?

 যতদিন পারো থাকবে। দুধটুধ খাওয়াতে পারে কয়েকদিন। গাঁয়ের থেকে চাপ দিলে থেকেও যেতে পারো।

কৃষ্ণকান্ত একটু বিরস মুখে বলে, পাকা কাজ হল না। বড্ড দোটানায় পড়ে গেলুম যে। আপনি তো ঘোড়েল লোক, একটা বুদ্ধি করতে পারেন না?

আমার তত বুদ্ধি নেই।

কৃষ্ণকান্তকে ভাবিত দেখাল। বলল, সুবিধের জায়গা নয়। মজা নেই। বড্ড ভ্যাভ্যাত করছে।

তাই নাকি? তবে ইচ্ছেটা কী?

এখানে পোষাবে না। আমার বাঁকা নদীর পোলই ভাল। ঘরজামাই যদি চণ্ডীমণ্ডপটা লিখে দিতে তা হলে বেশ হত। এটা বেচে দিয়ে জিলিপি খেতুম।

গোবিন্দ একটু ম্লান হেসে বলে, চলি হে। আমার আর সময় নেই।

একটু দাঁড়ান বাবু। মাজায় বড় ব্যথা, একটু ধরে তুলবেন?

উঠে কোথায় যাবে?

একটু কষ্ট করে আমাকে পোলের কাছে পৌঁছে দিন। সরকার বাহাদুর আমার জন্যই পোলটা বানাল। আমিই দেখিশুনি কিনা।

তাই বুঝি?

খুব মজা হয় সারাদিন। কত রগড় দেখতে পাই।

বলতে বলতে নিজেই উঠে পড়ল কৃষ্ণকান্ত। একটু ককিয়ে উঠল ব্যথায়।

 গোবিন্দ পাঁচটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললে, নাও, জিলিপি খেয়ো।

 টাকাটা ছেঁড়া জামার পকেটে রেখে নেমে এল কৃষ্ণকান্ত, দুর শালা? এটা একটা বাজে জায়গা, শতরঞ্চি বালিশ কি আমাদের পোয়? পোলের নীচে দিব্যিথাকি। বাবু, বিড়ি দেবেন একটা।

নেই রে।

বিড়ি ছাড়াও চলে কৃষ্ণকান্তর। বিড়ি পেলেও চলে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে গোবিন্দর পিছু পিছু এগোতে লাগল। গোবিন্দ মাঝে মাঝে তার দিকে ফিরে চাইছে। রাগটা কমে যাচ্ছে তার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *