সেরাত্রে কিন্তু মায়াও ঘুমোতে পারছিল না। বালিশে মুখ গুঁজে কোনরকমে কান্না রোধ করছিল।
রাত গভীর। কে জানে হয়তো একটা কি দেড়টা। হঠাৎ দরজায় টুকটুক করে শব্দ হতেই সে চমকে উঠল। কতক্ষণ পড়ে রইল কাঁপুনি-ধরা বুকে। তারপর একসময় চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল সমর। বাঁ-হাতে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি। ডান হাতের তর্জনীটা প্রসারিত করে রেখেছে। কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে ডগা থেকে। প্রথমটা সমর মায়ার দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারল না। এমন ভাবে রাতের পোশাকে কোন নারীকে সে বোধ করি দেখেনি। খোলা চুল, শিথিল বসন। পিছনের স্বল্পালোকিত ঘরখানা যেন এক স্বর্গরাজ্যের ইঙ্গিত। মুহূর্তের জন্য বুঝি স্বপ্ন দেখল সমর। এই স্বর্গরাজ্যে নীড় বাঁধা চলে—যে নীড় ভালবাসার উষ্ণতায় ঘেরা। যেখানে দেহ আর আত্মা পরিপূর্ণভাবে সমকামী হতে পারে।
কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে সে সহজ কণ্ঠেই বলল, কিছু মনে করবেন না, মিস দে। রাত দুপুরে আপনাকে বিরক্ত করলুম। আঙুলটা অনেকখানি কেটে গেছে। আইডিন দিয়ে যদি একটু বেঁধে দেন, ভাল হয়। কারণ নিজে কিছুতেই পারলুম না।
প্রাথমিক চিকিৎসার যা কিছু সরঞ্জাম বাইরের ঘরে থাকে। সেখানে এসে মায়া আঙুলের এই ক্ষতটা পরীক্ষা করল। তারপর তুলে দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল, কি করে কাটল?
দৃষ্টিটা তার মুখের ওপর থেকে সমর দূরেই সরিয়ে রেখেছিল। সেই অবস্থাতেই ছাড়া ছাড়া ভাবে জবাব দিল, কি জানি হয়তো ফ্রয়েড সাহেব বলতে পারেন। ত্যাগ, প্রায়শ্চিত্ত বা অন্য কিছু—অন্যমনস্কভাবে আমি অস্ত্রোপচারের ছুরি নিয়ে নাড়াচাড় করছিলম-উঃ! আস্তে, আস্তে, মিস দে। অতখানি নিষ্ঠুর না-ই বা হলেন—রাতে খেতে বসে আপনার সঙ্গে আমি ব্যবহারটা ভাল করিনি। আপনি তার শোধ তুলবেন না। সত্যি গিরমহল ছেড়ে যাবার কথা কোনদিন ভাবিনি আমি। আর যদি ভেবেই থাকি, আপনি তো জানেন, আপনাকে এখানে এভাবে ফেলে রেখে যেতে পারি না। আজ আমার কাছে আপনি মৌতাতের মত হয়ে উঠেছেন—আফিমই বলতে পারেন
মায়ার গালদুটো রক্তাভ হয়ে উঠল। আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধতে গিয়ে হাতটা বোধ করি একটু কেঁপেই উঠল। আরো খানিকটা সে ঝুঁকে পড়ল ধরে-থাকা সমরের হাতখানার ওপর।
.
গিরমহলের নিস্তরঙ্গ জীবন স্রোতে হঠাৎই একদিন ঘূর্ণি দেখা দিল।
অপরাহ্ন। সূর্য পাটে বসেছে। বাড়ির পশ্চিম দিকের ছাদে অজয় আর লীলা হাত ধরাধরি করে পায়চারি করছিল। জীবনপ্রাচুর্যে ভরা দুটি শিশু যেন।
ছাদের একটু নিচুতে পাহাড়ের দিকে খোলা ঝুল বারান্দা একটা ছিল। ফুট তিরিশেক নীচে পাহাড়েরই একটা অংশ যেন গা এলিয়ে রয়েছে। ছড়ানো গা-টা নেমে গেছে অনেক নীচে সমতল জমির ওপর। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, ঝুলবারান্দাটা অনেক উঁচু থেকে উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নগণ্য গ্রামখানার দিকে।
বেড়াতে বেড়াতে অজয় আর লীলা ঝুল বারান্দাটার কিনারে এসে পৌঁছল। দেখল দুটো চড়ুই পাখি আলসের ওপর বসে অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোয় ডানা মেলে দিয়েছে।
বড় কাছাকাছি বসে ছিল তারা। জীবন সম্বন্ধে যেন নিস্পৃহ। তবু মানুষের আবির্ভাব তারা সহ্য করতে পারল না। কিচমিচ করে বোধ করি প্রতিবাদ জানিয়ে উড়ে পালাল।
অজয়ের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে লীলা বলল, দেখলে?
অজয় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল। বিশেষ করে দেখবার মত কিছুই তার নজরে পড়েনি।
লীলা বলল, দুটো পাখিই পুরুষ।
কথাটা সত্যি। কারণ দুটো পাখিরই পালকে গাঢ় কালো এবং বাদামী রংয়ের খেলা—যেটা পুরুষ পাখিরই নিশ্চিত অভিজ্ঞান।
অজয়ের বুকের মধ্যে বিচিত্র এক অনুভূতি দেখা দিল। তার মনে পড়ে গেল গিরমহলের ইতিহাসের কথাটা।
সূর্য পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হল।
সারা দৃশ্যপটেরই রূপান্তর ঘটল।
অদ্ভুত মনে হচ্ছিল ঝুল বারান্দাটাকে। ওরা লোভ সামলাতে পারল না। ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে ঝুলবারান্দায় নেমে এল। লীলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, দেখছ, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখছ! গ্রামখানাকে এত কাছে মনে হচ্ছে, যেন এখান থেকে ঢিল ছুঁড়ে মারা যায়। অজয় সস্মিত মুখে বলল, এত যখন ইচ্ছে, তখন গাঁয়ের দিকে একবার বেড়িয়ে আসতে পারো। বাড়ি থেকে কতটুকুই বা পথ! হয়তো প্রথমেই দেখা হয়ে যাবে গাঁয়ের ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে।
হেসে উঠল সে। একটু বা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। পা বেধে গেল আলসেয়; টাল সামলাতে পারল না। লীলা আর্তধ্বনি করে ছুটে আসবার আগেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল নীচে-—অনেক নীচে।
লীলার আর্তধ্বনি আর একবার সারা বাড়িখানাকে উচ্চকিত করে তুলল। ছুটে গিয়ে সে আলসের কিনারায় ঝুঁকে পড়ল। দেখল, ফুট তিরিশেক নীচে অজয়ের নিস্পন্দ দেহটা পড়ে আছে।
কি ভাবে কোথায় দিয়ে সে নীচে নেমে এল, নিজেই জানে না। স্বামীকে পরীক্ষা করে দেখল, তার প্রাণকুটুই আছে, কিন্তু জ্ঞান নেই। মাথার পিছন দিকটা রক্তে মাখামাখি।
একা সে। সরকার ভজহরি কোথায় বেরিয়েছে যেন। দেহাতী ঠিক-ঝিটিও তার দিনের কাজ শেষ করে একটু আগেই নিজের ঘরে চলে গেছে।
উপায় নেই। এখানে এভাবে লীলা স্বামীকে মরতে দিতে পারে না। প্রাপপণ চেষ্টায় সে অজয়ের নিস্পন্দ দেহটা দুহাতে টেনে তুলল। তারপর একরকম টানতে টানতেই নিয়ে এল ছাদের ওপর। অমানুষিক পরিশ্রমে কপাল দিয়ে তার স্বেদধারা ঝরে পড়ল। বুকের ভেতরটায় যেন হাপর টানার মতই হাঁফ। নিজেকে আর সে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারল না, লুটিয়ে পড়ল সে অজয়ের অচৈতন্য দেহটার পাশে।
মিনিটের পর মিনিট কেটে যায় যেন এক দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে। তারপর কোনরকমে টানতে টানতে অজয়কে এনে যখন তার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিল, বাইরে তখন অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।
একসময় বাইরে পায়ের শব্দ পেতেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল। সামনে ভজহরিকে দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ডাক্তার—একজন ডাক্তার ভজহরিবাবু—গাঁ থেকে একজন ডাক্তার এখুনি ডেকে আনুন। যেমন করে পারেন, যে করেই হোক।
ভজহরি প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। পরে দুর্ঘটনার বিবরণটুকু শুনে বলল, কিন্তু মা, আমি গেলে এই রাত্রে হয়তো ডাক্তার আসবে না। তাছাড়া অন্ধকারে আমার ভাল ঠাহরও হয় না চোখে।
তাহলে আমি নিজেই যাব। লীলা ব্যগ্রভাবে ভজহরির হাত দুটো চেপে ধরে বলল, আপনি একটু ওঁর কাছে থাকুন। আমাকে যেতে দিন। এভাবে একলা ফেলে রেখে তো আমি যেতে পারি না।
উদগত বাষ্পটি চাপতে চাপতে সে ছুটেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
.
বাইরের ঘরে বসে সমর তখন মাসকাবারী খরচের হিসেব করছে। সামনে বসে মায়া ফর্দ দেখে তারিখ মিলিয়ে বলে বলে যাচ্ছে, চাল লিখেছেন? তেরো টাকা পঞ্চাশ নয়া পয়সা। আর ঘি দুকিলো তেরো টাকা হিসেবে ছাব্বিশ টাকা। নিন, যোগ করুন।
যোগটা সমর করল ঠিকই, কিন্তু মোট অঙ্কটা যা দাঁড়াল, সেটা দেখেই তার চোখে একটা কালো ছায়া নেমে এল! ম্লানভাবে হেসে বলল, সাতাত্তর টাকা চুয়াল্লিশ পয়সা। —হুঁ,—এ-মাসে মোট কত উপায় করেছি জানেন, মিস দে?
মায়া নিরীহের ভঙ্গিতে জবাব দিল, জানি, ডাক্তার রায়, সাত টাকা কুড়ি নয়া পয়সা।
হেসে উঠল সমর। হালকা সুরে বলল, তার মানে হচ্ছে, ঘাটতি সত্তর টাকা চব্বিশ
শুকনো ঠোঁট দুটো সে একবার জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, মনে হচ্ছে, এখানে সুবিধে হবে না, মিস দে। পুঁজিপাটা তো শেষ। সামনের মাসে যদি মোটামুটি উপায় না করতে পারি, তাহলে এই গাঁ ছাড়তে হবে।
কথাশেষে একবার তির্যক দৃষ্টিতে মায়ার মুখের দিকে তাকাল। বোধ করি তার প্রতিক্রিয়াটা একবার দেখতে। কিন্তু এ ভীতিপ্রদর্শনে মায়ার মুখে কোন রেখাপাত ঘটল না। শান্তমুখেই সে কাগজপত্রগুলো গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, এবার খাবেন কি?
ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেজানো বাইরের দরজাটা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলেন লীলাকে নিয়ে পাণ্ডে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই গিরমহল থেকে এই লেডি আপনার কাছে এসেছেন, ডাক্তার সাহেব।
লীলা তখন অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সমরকে চিনতে পেরেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল, সমরবাবু, আপনি?
সমর প্রথমটা তাকে ঠিক চিনতে পারেনি। পারল যখন, তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পাংশু মুখখানার ওপর যথাসাধ্য পর্দা টেনে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, বসুন, মিসেস সেন।
পাণ্ডে বোধ করি ইত্যবসরে অনেক কিছুই আন্দাজ করে নিলেন। আর একটি কথাও না বলে নিঃশব্দ পায়ে তিনি বেরিয়ে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলেন। মায়া ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল-দারুমূর্তির মতই।
লীলা কিন্তু বসল না। টেবিলের কিনারাটা চেপে ধরে আতঙ্ক বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সমরের মুখের দিকে।
সমর নিরুত্তাপ গলায় বলল, কিসের জন্য পদার্পণ ঘটল আমার এখানে জানতে পারি কি?
লীলা জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটো বারকয়েক ভিজিয়ে নিল। ভগ্নকণ্ঠে ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল, সমরবাবু—আমার স্বামী—মস্ত দুর্ঘটনা—ছাদ থেকে নীচে পাহাড়ে পড়ে গেছেন—অজ্ঞান হয়ে আছেন—একবার এখুনি যেতে হবে।
কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধতা। তারপর সমর পেশাদারী গলায় বলল, আঘাতটা কোথায় পেয়েছেন?
মাথার পেছন দিকে—মনে হচ্ছে খুবই গুরুতর—অন্তত তিরিশ ফুট নীচে পাথরের ওপর পড়েছেন—
সমরের চোখ দুটো কুঞ্চিত হয়ে উঠল। বলল, আপনি কি আমাকে কেসটা হাতে নিতে বলছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ডাক্তার রায়। আসুন আপনি। যত দেরি হবে ততই
সমর উঠে দাঁড়াল। সেই পেশাদারী গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, যাব বৈকি। আমি ডাক্তার, যেতে তো হবেই।
লীলা বোধ করি আর দাঁড়াতে পারছিল না। পাশের চেয়ারখানাতে বসে পড়ল। তার অবস্থা দেখে দ্রুত আসছিল সমর সাহায্য করবার জন্যে; কিন্তু তার আগেই লীলা আবার উঠে দাঁড়াল। অস্ফুট কণ্ঠে বলল, কিছু মনে করবেন না, ঠিক আছে। দয়া করে চলুন, দেরি করবেন না।
এবার সমর রূপান্তরিত হল পুরোদস্তুর চিকিৎসকে। গম্ভীর ভাবে বলল, না, আমি তৈরি—মায়া-মিস দে—আমার সার্জারি ব্যাগটা নিয়ে আসুন। আর যা কিছু দরকার একটা সুটকেসে ভরে নিন। কিন্তু মিসেস সেন, একজন নার্সেরও যে দরকার হবে?
নিশ্চয়ই, এ আর বলবার কি আছে।
তবে তুমিও তৈরি হয়ে নাও মায়া, যেতে হবে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মায়া নিজে তো তৈরি হয়ে নিলই, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে নিল একটা সুটকেসে। চোখ দুটোয় তখন তার এক বিচিত্র আলো ঝকঝক করছে। জীবনে এই প্রথম তাকে সমর নাম ধরে ডেকেছে, তুমি সম্বোধন করেছে।
সুটকেসটা মায়ার হাত থেকে নিয়ে সমর লীলার উদ্দেশে বলল, চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক, মিসেস সেন।
.
দীর্ঘক্ষণ ধরে সমর অজয়কে পরীক্ষা করল। মুখ তার ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠল। একসময় আচমকাই উঠে দাঁড়িয়ে সে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। লীলা তাকে অনুসরণ করে এসে দাঁড়াল সেখানে। কতক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শুধু নীরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। অবশেষে সমর মুখোশের মতই মুখে জানাল, জীবনের খুব বেশি আশা নেই। মাথার খুলিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
রক্তহীন বিবর্ণ মুখে লীলা আর্তনাদ করে উঠল, কোন আশা নেই!
খুব অল্পই। এভাবে পড়ে থাকলে বড়জোর আর বারো ঘণ্টা বাঁচতে পারে। তবে অপারেশন করতে পারলে
বেঁচে যাবেন?
একটু আশা করা যায়, যদিও খুব ক্ষীণ। খুলির হাড়গুলো বার করে নিয়ে আবার বসাতে হবে।
এখানে তার অসম্ভাব্যতা বুঝেই লীলা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, অপারেশন না করতে পারলে তাহলে বাঁচবার কোন আশা নেই বলছেন?
মনে হয় তাই।
তাহলে আপনিই করুন না কেন?
সমরের মুখে কোন রেখাপাত ঘটল না। ধীর কণ্ঠে সে বলল, অতখানি ঝুঁকি কাঁধে নেবার মত সাহস আমার নেই।
কি কি বলতে চান?
অপারেশন যদি করতেই হয়, তাহলে স্ত্রী এবং নিকট আত্মীয়া হিসাবে আপনাকে লিখে দিতে হবে যে, আপনার বিশেষ অনুরোধেই আমি অপারেশন করছি। অস্ত্রোপচারের সঙ্গে যে জীবনহানির আশঙ্কা আছে, সেটা জেনে শুনে অনুরোধ করছেন আমায়—এটাও লেখা থাকবে।
লীলা বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে সমরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনের ভেতর কি চিন্তা ক্রিয়া করে চলেছে, সেটাই পড়তে চায়। কিন্তু না, সমরের মুখ অপাঠ্য। অবসন্ন দেহে সে পাশের চেয়ারখানায়। বসে পড়ল। তারপর উদগত অশ্রু চাপতে চাপতেই লিখতে শুরু করল আমমোক্তারনামা।
সমর তার থেকে কাগজখানা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ল। তারপর সেখানা ভরে রাখল প্যান্টের পকেটের ভেতরে। তারপর লীলার দিকে যখন সে আবার ফিরে তাকাল, তখন তার চোখে ফুটে উঠেছে বিজয়ীর দৃষ্টি, ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের বাঁকা হাসি।
কিন্তু কতক্ষণই বা! শল্যচিকিৎসা বিশারদে রূপান্তরিত হতে তার বিলম্ব ঘটল না। কণ্ঠে ফুটে উঠল পেশাদার সুলভ গাম্ভীর্য : একটা টেবিলের দরকার– হ্যাঁ, এটাতেই কাজ চলতে পারে—গরম জল চাই- খুব বেশি করে- আপনাদের সরকার মশাই বোধ হয় সেটা করতে পারবেন—মোমবাতি আছে? মোমবাতি—অন্ত গোটা পঞ্চাশেক। পাশের ঘরে মায়ার উদ্দেশে হেঁকে বলল, মিস দে, তাড়াতাড়ি সব কিছু রেডি করে ফেলুন।
সেখান থেকে মায়া জবাব দিল, আমি তৈরি আছি, ডাক্তার রায়।
নিন মিসেস সেন, এবার টেবিলটা ধরুন দিকিনি, এটা ওঘরে নিয়ে যেতে হবে।
গায়ের কোটটা খুলে সে চেয়ারের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। পকেট থেকে রুমাল বার করে ভাল করে মুছতে লাগল টেবিলটা। লীলা কোমর বেঁধে নিল তাকে সাহায্য করতে।
.
ঘরের চারিদিকে অসংখ্য বড় বড় মোমবাতি জ্বলে উঠল। উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল ঘরখানা। না, তাতে অস্ত্রোপচারের বিশেষ কোন অসুবিধে ঘটবে না। ধরাধরি করে অজয়কে টেবিলের ওপর উপুড় করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। কামিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাথার চুলগুলো। মাথার যেসব জায়গায় চামড়াগুলো ফেটে ফেটে গিয়েছিল, সেগুলোয় তখন দলা দলা রক্ত।
পাশে আর এক টেবিলের ওপর অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম রাখা। পাশে দাঁড়িয়ে মায়া। ওপাশে লীলা দুহাত বুকে চেপে পাথরের মতই দাঁড়িয়ে। আর টেবিলের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে ভজহরি গরম জলের পাত্র হাতে। বিশেষ একটি ছুরিকা হাতে তুলে নিয়ে সমর লীলার দিকে তাকাল। মুখখানা তার কঠিন—ভয়াল।
লীলা শিউরে উঠে চোখ ফিরিয়ে নিতেই সমর হুকুমের সুরে বলল, না, আপনার এখানে দাঁড়িয়ে না থাকাই ভাল।
পাশের ঘরে এসে লীলা একখানা চেয়ারের ওপর অবসন্ন দেহে বসে পড়ল। চিন্তাসূত্রগুলো জট পাকিয়ে গেছে মাথার ভেতর। চোখের দৃষ্টি শুন্য।
এক কোণে টেবিল ল্যাম্প একটা জ্বলছিল। হঠাৎ তার মনে হল সাদা দেয়ালের ওপর দুটি দেবদূতী ছায়া নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। শিউরে উঠে সে দুহাতে মুখ ঢাকল।
কতক্ষণ পরে আবার মুখ তুলল, দেখল, ডানা মেলে দুটো পতঙ্গ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাতিদানটার আলোক-শিখায়। মনে পড়ে গেল তার বাড়ির ইতিহাসটার কথা। দুটো পতঙ্গ যেন সেই দুই অশরীরী বন্ধু। ঘরের মধ্যে নেচে বেড়াচ্ছে।
বিভীষিকাময়ী রাত্রিও এক সময় শেষ হল। দেখা দিল দিনের আলো। যেন নতুন প্রাণের সাড়া। অজয় বিছানায় শুয়ে ছিল। মাথায় ব্যাণ্ডেজ। গায়ে সাদা চাদর একখানা গলা পর্যন্ত টানা। জ্ঞান তখনও তার পুরোপুরি ফিরে আসেনি। তাই সমর বিছানার পাশেই একখানা চেয়ারে বসে পরম আগ্রহে তাকিয়ে ছিল বন্ধুর মুখের দিকে।
লীলা শক্ত মুঠিতে কাঠের বাজুটা চেপে ধরে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এই উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা আর বুঝি সে সহ্য করতে পারে না। দম যেন তার বন্ধ হয়ে আসে। পাশের ঘর থেকে দেওয়াল-ঘড়িটা শুধু টকটক করে আওয়াজ করেই যেতে লাগল।
অকস্মাৎ অজয়ের চোখের পাতা দুটো একটু একটু কেঁপে উঠতেই সমর অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল, এবার বোধ হয় জ্ঞান ফিরবে।
লীলা প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্বামীর মুখের ওপর।
সত্যিই অজয়ের জ্ঞান ফিরে এল। ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেলল সে। দৃষ্টিটা গিয়ে আটকে গেল সমরের মুখের ওপর। মৃদু অথচ জড়তাহীন কণ্ঠে সে বলল, কি রে সমর, স্বপ্নে আমি তোকেই দেখছিলুম।
সমর খুশি হল। মুখে তার জ্বলে উঠল হাজার বাতির আলো। বন্ধুর একখানা হাত চেপে ধরে বলল, অজয়কেও জয় করেছি তাহলে! লক্ষ্মী ছেলের মত আবার ঘুমিয়ে পড় দিকিন। তারপর যত ইচ্ছে স্বপ্ন দেখ!
বন্ধুর নির্দেশ অমান্য করতে পারল না অজয়। হাসিভরা মুখেই আবার চোখ বুজে ফেলল।