৫. সেপ্টেম্বর ১৯৬৬

৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ শনিবার

নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। একজন ভাল কর্মী, বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। ১/২ খাতায় রেখেছে। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বলেছি একটু ভাল জায়গায় রাখতে। কিছুদিন পূর্বে মাহমুদউল্লাহ সাহেব, মোস্তফা সরোয়ার, হাফেজ মুছা, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী এবং রাশেদ মোশাররফকে সরকার মুক্তি দিয়েছে।

 

৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ বুধবার

রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, সে আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেটাকে পছন্দও করেছে। ছেলেটা সিএসপি। আমি রাজবন্দি হিসেবে বন্দি আছি জেনেও সরকারি কর্মচারী হয়েও আমার মেয়েকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দিয়াছে। নিশ্চয়ই তাহার চরিত্রবল আছে। মেয়েটা এখন বিবাহ করতে রাজি নয়। কারণ আমি জেলে, আর বিএ পাশ করতে চায়।

আমি হাচিনাকে বললাম, ‘মা আমি জেলে আছি, কতদিন থাকতে হবে, কিছুই ঠিক নাই। তবে মনে হয় সহজে আমাকে ছাড়বে না, কতগুলি মামলাও দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে চলেছে। তোমাদের আবারও কষ্ট হবে। তোমার মা যাহা বলে শুনিও। রেণুকে বললাম, “আর কি বলতে পারি? আবার বললাম, ‘১০ তারিখে মামলা আছে। আকরাম ও নাছেরকে পাঠাইয়া দিও। বাচ্চারা কেমন আছে জানাইও।

 

৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ বৃহস্পতিবার

আজ চার মাস পূর্ণ হলো আমি জেলে এসেছি। ডিপিআর-এর বন্দি আমি। এ দুঃখ রাখার জায়গা নাই।

 

১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ শুক্রবার

বৃষ্টি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। গতকাল সারাদিন ও সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। দেশের অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। বৎসরে দুইবার বন্যা, তারপর আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শুনলাম, ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়াছে। আমি যে ঘরটাতে থাকি এটা বোধহয় দুইশত বৎসরের পুরানা। সমস্ত জায়গা দিয়েই বোধহয় পানি পড়ে। গত রাতটা কোনোমতে কাটাইয়াছি। সামান্য একটু জায়গা প্রায়ই ফাক আছে, যেখান দিয়ে পানি পড়ে না। ঘরটার ভিতরে পানির ঢেউ খেলেছে সারাদিন। তিনজন লোক সারাদিন আমার জিনিসপত্র রক্ষা করতে ব্যস্ত রয়েছে। বিছানা থেকে নামার উপায় নাই। খবর পেয়ে জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব ও জমাদার সাহেবরা এসেছিলেন। বললেন, ‘কি করে এখানে থাকবেন? পাশেই নতুন ২০ সেলের একটা চার সেলের ব্লক আছে, সেখানে থাকুন।’ বললাম, ‘সেলের ভিতর, তার উপর পায়খানা-প্রস্রাবখানা নাই, কেমন করে থাকব? একটা টিন দিয়ে দিবেন ওতে আমার চলবে না। আমাকে ভাল জায়গা দিতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে, কি বলেন? রাতে ঘুমাব না, তাতে কি হবে? জীবনে অনেক দিন না ঘুমাইয়া কাটাইয়াছি। যদি স্বায়ত্তশাসন ও ৬ দফা আদায় করে নিতে পারি নিব। তবে আমরা রাজবন্দিরা তো খুনী, ডাকাত, একরারীর থেকেও আজকাল খারাপ! দেখুন পুরানা ২০ সেলে রণদা সাহেব বার-এ্যাট-ল’, বাবু চিত্ত সুতার ভূতপূর্ব এমপিএ, আবদুল জলিল এডভোকেট, দুইজন ছাত্র-একজন এমএ পরীক্ষা দিবে নূরে আলম সিদ্দিকী, আর একজন বিএ পরীক্ষা দিয়েছে কামরুজ্জামান। আরও আছে শংকর বাবু, পুরানা রাজনৈতিক কর্মী বাড়ি রংপুর, আরও কয়েকজনকে রেখেছেন। তাদের অবস্থা কি? উপর দিয়ে পানি পড়ে। দরজা দিয়ে পানি ঢােকে, একটা করে টিনের পায়খানা। ৭ সেল অনেক ভাল। সেখানে রেখেছেন একরারীদের, আরও অনেক জায়গা ভাল আছে সেখানেও রাখতে পারেন, কিন্তু রাখবেন না। কষ্ট দিতে হবে। আপনারা আমাদের বাধ্য করেছেন মোকাবেলা করে দাবি আদায় করতে।

বিশ্বাস বোধহয় অনেকেই করবেন না, কিন্তু সত্য কথা রতন নামের আট বৎসরের ছেলে ডিপিআর আইনে জেলে বন্দি আছে, আজও ছাড়া হয় নাই। কুমিল্লা জেলায় বাড়ি। রতনের বাবা চলে গেছেন ত্রিপুরা রাজ্যে। দুই কাকা পাকিস্তানে আছে, বর্ডারে বাড়ি। ভারতে আবার কষ্ট হলে ওর বাবা মা কাকাদের কাছে পাঠাইয়া দেয়। যুদ্ধ বেঁধে গেলে ওর কাকাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। ওরা খবর নিয়ে জানল ওর বাবা ভারতে থাকে, তাই ওকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে এল কাকার সাথে। কাকা ‘পাকিস্তানি’ বলে মুক্তি পেয়েছে। রতন ‘ভারতীয়’ তাই মুক্তি পায় নাই, জেলেই আছে। ওকে আমাকে একজন কয়েদি দেখাল। কোলে করে বলল, সার ডিপিআরএ বন্দি আজ দশ মাস হলো, আর কতকাল থাকতে হয়! এই দুধের বাচ্চার কে আছে? এমন আশ্চর্য ঘটনা অনেক ঘটছে এই দেশে।

 

কারাগারে সাক্ষাৎ

জেল কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই তাহারা বুঝতে পারে না সেটা কি বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে। কয়েদিরা সপ্তাহে একদিন দেখা করতে পারে আত্মীয়-স্বজনের সাথে। সকাল বেলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দরখাস্ত করতে হয়। তারপর জেল কর্তৃপক্ষ দরখাস্তগুলি দেখে নেয় এবং সাক্ষাতের অনুমতি দেয়। গেট থেকে বিকালে যে যে দেখা পাবে তাদের নাম ধরে জেলের ভিতর যেয়ে চিৎকার করে কয়েদি পাহারারা ডাকতে থাকে এবং অনুমতিপত্র দিয়ে যায়। দূর দূর থেকে আত্মীয়-স্বজন ভোর বেলা থেকে জেল গেটের বাইরে বসে থাকে-ছেলেমেয়ে, বুড়া-বুড়ি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে। তারপর বেলা ৩টা থেকে নামডাকা শুরু হয়। এক সাথে ১০-১২ জন। একই জানলা দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। ভিতরের দিকে কয়েদিরা বাইরের দিকে তাদের আত্মীয়-স্বজন মধ্যখানে লোহার জালের বেড়া ভাল করে চেহারাও দেখা যায় না। দুই চার মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করতে হয়। দেখাও শেষ করতে হয়। ছেলেকে দেখতে আসে বৃদ্ধা বাবা-মা, বাবাকে দেখতে আসে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে দেখতে আসে স্বামী, স্বামীকে দেখতে আসে স্ত্রী। শুধু চিকার ও কান্না। দূরে সরে আসে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে কয়েদি। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চলে যায়। হতভাগাদের আত্মীয়-স্বজন বহু দূর থেকে আসে, কেহ বা বরিশালের পটুয়াখালী বা ভোলা থেকে, কেহ বা ময়মনসিংহ বা ফরিদপুর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। তবুও আসে দেখতে কেমন আছে তাদের আপনজন।

এই সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে। অনেক সময়ে কিছু টাকা খরচ করে ভিতরে গেটে এসেও কয়েক মিনিট দেখা করে থাকে কিছু কিছু লোক। না দেখলে বা না ভুগলে কেউই বুঝবে না যখন সাক্ষাৎ হওয়ার পরে ছাড়াছাড়ি করতে হয় তখনকার অবস্থা। সিপাহি ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এদের দুঃখ দেখে দুঃখিত হয়। তারপর আস্তে আস্তে তারাও মেশিনের মতো শক্ত হয়ে যায়।

আমরা যারা রাজবন্দি তারা আধ ঘণ্টা থেকে একঘণ্টা সময় পাই। পাশাপাশি বসে আইবি অফিসারদের শুনিয়ে কথা বলে থাকি। দুঃখ হয় যখন বৃদ্ধা মা-বাবা, স্ত্রী এবং ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বিদায় নেয়, কেহ বা কাঁদতে কাঁদতে, কেহ বা মুখ কালো করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *