৫
একটা চ্যাটানো চওড়া পাথরে সুখনের পাশে পা ঝুলিয়ে বসেছিল মহুয়া। একটা একলা টিটি পাখি টিটির—টি—টিটির—টি করে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের গভীরে উড়ছিল।
ওরা কতক্ষণ যে অমন করে বসেছিল তা ওদের দুজনেরই হুঁশ ছিল না কোনো।
অনেকক্ষণ পর যেন স্বপ্নোত্থিতের মতো মহুয়া বলল, ‘শুনুন।’
সুখন বলল, ‘উঁ…।’
—এখানেই থাকা হবে?
—থাকুন। আপনি তো বললেন চিরদিন থাকবেন।
—বলেছিই তো!
—জানি।
—কী জানেন?
—বলেছিলেন যে, সে কথা।
—আপনার কী এখনও সন্দেহ আমাকে?
—আপনাকে? না, না। আপনাকে সন্দেহ নয়।
—তবে?
সুখনের মনে এখন বড় প্রশান্তি। এত সুখ এত শান্তি ও জীবনে আগে কখনও জানেনি। পৃথিবীর সব অশিক্ষিত পয়সাওয়ালা গাড়ি—চড়া খদ্দেরদের ও ক্ষমা করে দিল। এই মুহূর্তে সুখন বড় উদার, মহৎ; সুখী মানুষ।
মহুয়ার প্রশ্নের উত্তরে সুখন বলল, ‘আমাকে আমি চিনি না।’
—আমি চিনি।
—চেনেন? ভাবতে ভালো লাগছে যে, আমাকে কেউ, অন্তত একজনও চেনে। তারপরই বলল, ‘চলুন। ক’টা বাজে বলুন তো?’
—আটটা। রেডিয়াম দেওয়া হাতঘড়িতে দেখে বলল মহুয়া।
তারপর বলল, যেতে ইচ্ছে করছে না।
ও উঠে দাঁড়াতেই কালুয়া পাথরের আড়াল থেকে কুঁই—কুঁই করে ডেকে উঠল।
সুখন মহুয়ার শাড়ি থেকে বালি ঝেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘দেখেছেন, কালুয়াটার কীরকম ঈর্ষা। মেয়েরা, মানে মেয়ে মাত্রই ঈর্ষাকাতর।’
মহুয়া বলল, ‘আমি কী শুধু কোনো কুকুরীরই ঈর্ষার পাত্র?’
সুখন হাসল। বলল, ‘যেমন আপনার রুচি। সুখন মিস্ত্রিকে যার ভালো লাগল তাকে ঈর্ষা করবে আর কে?’
মহুয়া উমম—মম করে একটু মিথ্যে আপত্তি জানাল।
সুখন বলছিল, নিজের মনেই—তুমি বড় সুন্দর মহুয়া। সত্যিই তোমার মতো সুন্দর কিছুই আমি দেখিনি জন্মের পর থেকে।
দেখতে দেখতে ওরা শাকুয়া—টুঙ—এ উঠে এল।
সুখন বলল, ‘জানেন, আমি মিস্ত্রিদের বলি যে, আমি মরলে এখানে আমাকে কবর দিয়ে রাখতে। ওরা বলেছে দেবে। ভাবছি, এখন থেকেই এ জায়গাটাতে অনেকগুলো মহুয়া গাছ লাগিয়ে রাখব।’
মহুয়া রাগত গলায় বলল, ‘থাক অন্য কথা বলুন।’
সুখন বলল, ‘হ্যাঁ, যা যা কথা আছে বলে ফেলুন। সময় খুব কম। সময় বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।’
মহুয়া আবার বলল, ‘আশ্চর্য, আপনি এখনও আমাকে সিরিয়াসলি নিলেন না? আরও কিছু কী চান আপনি আমার কাছে?’
বাইরে থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে সুখন বলল, ‘কিছু না। যা দিয়েছেন, সেটুকুর দামই দিতে পারব না এ জন্মে। আর কী চাইব?’
মহুয়া চুপ করে রইল।
মনে মনে বলল, যে—দানের কথা সুখন বলছে তার দাম কিছুই নয়। যা ওকে মহুয়া সত্যিই দিয়েছে তার দাম কী ও কখনও বুঝবে?
ওরা শাকুয়া—টুঙ—এর টিলা ছেড়ে নীচের শালবনে নেমে এল। তারপর পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
সুখন মহুয়ার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল।
বলল, ‘আপনার হাতের আঙুলগুলো কী সুন্দর! আপনার সব সুন্দর।’
মহুয়া জবাব দিল না। বলল, আমি একটা কথা ভাবছি।
—কী কথা? বলুন?—সুখন মুখ তুলে বলল।
মহুয়া অনেকক্ষণ দ্বিধা করল। তারপর বলল, ‘যদি কিছু হয়?’
সুখন প্রথমে বুঝতে পারেনি মেয়েলি কথাটা। বুঝতে পেরে বলল, কিছু হবে না।
—আহা। আপনি যেন সব জানেন!
—সব জানি না। তবে আমার মন বলছে, কিছুই হবে না।
—তবুও যদি কিছু হয়ে যায়!
—আপনার এখন ভয় করছে বুঝি? খারাপ লাগছে?
—ভয় নয়। খারাপ তো নয়ই। কীরকম অবাক লাগছে।
—স্বাভাবিক। কী করে যে হঠাৎ ব্যাপারটা ঘটে গেল, আমিও বুঝে উঠতে পারছি না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি কী চান?
—মানে?
—মানে, কী—ছেলে না মেয়ে?
—মহুয়া লজ্জা পেল। মুখ ঘুরিয়ে নিল।
সুখন অবাক হল।
মেয়েদের সত্যিই বোঝা মুশকিল। কীসে যে লজ্জা পায়, আর কীসে যে পায় না!
একটুক্ষণ পর মহুয়া লাজুক গলায় বলল, ছেলে।
তারপরই বলল, ‘ঠিক আপনার মতো।’
সুখন স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘যদি ছেলে হয় তার নাম রাখবেন পলাশ।’
—পলাশ? মহুয়া মুখ তুলে তাকাল।
—পলাশ ভালো না?
—ভালো। খুব ভালো। মহুয়া বলল।
—আর যদি……? মহুয়া শুধোল।
—মেয়ে হলে তার নাম রাখতে পারেন—টুঁই!
—টুঁই?
হ্যাঁ। টুঁই। টুঁই পাখি দেখেননি? টিয়ার মতো। কিন্তু খুব ছোট্ট পাখি—নরম কোমল কচি—কলাপাতা—সবুজ তার গায়ের রং, চিকন গলায় ডাকে, টিঁ—টুঁই—টুঁই—টিঁ—টুঁই টিঁ—টুঁই। প্রাণে ভরপুর। গাছের চারায়—চারায় উড়ে বেড়ায়—ছটফটে—মিষ্টি। কোথাও একদণ্ডর বেশি স্থির হয়ে বসে না।
—বাঃ বেশ নাম তো!
জঙ্গলটা পেরিয়ে আসতেই দূরের বড় রাস্তায় চোখ গেল ওদের।
আলো—জ্বালা একটা বাস হু হু করে চলে গেল রাঁচীর দিকে।
—এই রে!—বলল সুখন।
তারপর বলল, কপালে খুব গালাগালি আছে আপনার বয়—ফ্রেন্ডের কাছে।
‘কেন?’ সন্ত্রস্ত চোখে মহুয়া তাকাল।
—মনে হচ্ছে বাস স্ট্রাইক মিটে গেছে। সকাল থেকে আমি উধাও। শাকুয়া—টুঙে চলে না গেলে এতক্ষণ তো আপনাদের গাড়ি ঠিক করে দেওয়া যেত। তাহলে আর আপনাদের এতক্ষণ কষ্ট করে ফুলটুলিয়ায় থাকতে হত না। এতবড় একটা দুর্ঘটনা থেকেও হয়তো বেঁচে যেতেন আপনি।
মহুয়া প্রথমে জবাব দিল না কথার। তারপর বলল, ‘দুর্ঘটনা বলছেন কেন?’
না। এমনিই বললাম।—সুখন বলল।
একটু পর মহুয়া বলল, আমরা কী একসঙ্গে বাড়ি ফিরব?
এই কথাটার সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণের এই কয়েক ঘণ্টার পরজ—বসন্ত আবহাওয়াটা উধাও হয়ে গেল। কেমন বেসুর, বেতাল। ওরা দুজনেই একই সঙ্গে বুঝত পারল যে, ওদের ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় হয়েছে। জঙ্গলে অনেক কিছু হয়, কিন্তু শহরে হয় না। জঙ্গলের সত্য এখানে মিথ্যা। সব মিথ্যা।
সুখন বলল, ‘একসঙ্গে বাড়ি ঢুকতে আমার আপত্তি নেই, ভয়ও নেই। তবে আপনার দিক থেকে বোধহয় সেটা ঠিক হবে না। জঙ্গলের জাদুর বশে জংলি লোকের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছেন, এই লোকালয়ে, আপনার বাবার সামনে, বয়—ফ্রেন্ডের সামনে তো তেমন করলে চলবে না। জঙ্গলের গন্ধ জঙ্গলেই থেকে যাবে। সেই জঙ্গলের মধ্যের ঝরনার বুকের মহুয়া, আর যে—মহুয়া সকালে চলে যাবে সে তো এক নয়!’
মহুয়া মুখ ঘুরিয়ে একবার সুখনকে দেখল। তারপর বলল, ‘আমরা একসঙ্গেই যাব।’
না। আমরা একসঙ্গে যাব না—সুখন বলল।
ততক্ষণে ওরা দহটার পাশ দিয়ে বাঁধের উপরে এসে পৌঁচেছে। পিছনে ফেলে—আসা জঙ্গলের শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ সমস্তই সেই চন্দ্রালোকিত রাতে এক মোহময় স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।
সুখন জানে যে, সেই স্বপ্নে সে আবার ফিরে যাবে। রোজই ফিরে যাবে। কারণ জঙ্গলের মধ্যেই তার জীবন, তার জীবনের অঙ্গ এই স্বপ্ন। কিন্তু মহুয়া আর কখনও এখানে ফিরবে না। ফিরতে পারবে না। কালি পোকা যেমন আলোর দিকেই ওড়ে, তেমনই শহুরে পরিবেশের কাছাকাছি এসে মহুয়া ওর ভিতরে নিশ্চয়ই একটা প্রবল প্রত্যাবর্তনের তাগিদ অনুভব করছে। বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের এক ক্ষণিক খুশির খেয়ালে সুখন মিস্ত্রিকে তার ভালো লেগেছিল, জঙ্গলের আবেশে তার নেশা ধরেছিল, শহরে ফিরলেই সে যে সমাজের লোক সেই সমাজে পৌঁছলেই পুরো ব্যাপারটাকে—মহুয়া ”আ গ্রেট ফান, অর অ্যান অ্যাকসিডেন্টাল এপিসোড” ছাড়া অন্য কিছুই হয়তো ভাববে না।
এই মুহূর্তে সুখনের বুকে ভারী একটা চাপা কষ্ট হচ্ছিল। সুখন জানে যে, এই কষ্টটা বেশ কিছুদিন তাকে পেয়ে বসবে; চেপে থাকবে বুকে ভারী পাথরের মতন। একটা গভীর ক্ষতর মতো দগদগ করবে অনেকদিন। যখনই বাতাসে মহুয়ার গন্ধ পাবে ও, তখনই এই রক্তমাংসের নরম মিষ্টি এক—কোমর চুলের, দীঘল—কালো চোখের মহুয়ার কথা মনে পড়বে। তারপর একদিন সবই ঠিক হয়ে যাবে। রুখু বাতাসে, টান আবহাওয়ায়, ক্ষতটা একদিন শুকিয়েও যাবে। যদি তাড়াতাড়ি না শুকোয় তখন বোতল বোতল মহুয়ার মদ ঢালবে গলায়—বিশল্যকরণী। তবু সুখন এও জানে যে, ক্ষত শুকোলেও ক্ষতর দাগটা থেকেই যাবে।
সুখন মহুয়ার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল যে, মেয়েরা যত সহজে সব কিছু ভোলে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের প্রয়োজনে—পুরুষরা অত সহজে পারে না।
সুখন ওর জীবনে বেশি মেয়ে দেখেনি; কিন্তু যে—ক’জনকে দেখেছে, গভীরভাবে, মনোযোগের সঙ্গে, অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছে। তাদের দেখে সুখনের এই ধারণাই হয়েছে যে, যাযাবর বৃত্তিতে মেয়েদের কাছে বেদেরাও লজ্জিত হয়।
ঘোর কাটিয়ে সুখন বলল, ‘মহুয়া, একটু দাঁড়ান।’
মহুয়া ওর দিকে ফিরে দাঁড়াল।
সুখন ওকে বুক টেনে নিল। নিয়ে চুমোয় চুমোয় ভরে দিল। ওর সুন্দর পাহাড়ি—ঘুঘুর মতো বুকের সন্ধিস্থলে নাক ডোবাল। মহুয়ার চোখ দুটি বড় সুন্দর। এমন আবেশ—ভরা দৃষ্টি সুখন কখনও দেখেনি; হয়তো আর দেখবেও না।
মহুয়া আবেশে চোখ বুজে রইল। তারপর সুখনের দাম সুখনকে ফিরিয়ে দিল। সুখনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, সাধ মিটেছে?
সুখন হাসল। বলল, সাধ কী মিটবার?
তারপরই কেজো—গলায় বলল, আপনি এইদিক দিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠুন। তারপর সামনে দিয়ে বাড়িতে ঢুকুন কোনো ভয় নেই। তবুও আপনি ভয় পেতে পারেন বলেই আপনাকে লক্ষ রাখব। আপনি বাড়ি ঢুকে যাবার একটু পর আমি যাব—পিছনের দরজা দিয়ে। কেমন?
মহুয়া সামনের দিকে পা বাড়াল। সুখন তার ডান হাতটি নিজের ডান হাতে তুলে নিয়ে চুমু খেল। নরম গলায় বলল, ‘আসুন মহুয়া।’
মহুয়া থমকে দাঁড়াল। মুখ নামিয়ে নিল। বলল, আসি।
সুখন দেখতে পাচ্ছিল টর্চ হাতে কারা যেন এদিক—ওদিক ঘেরাফেরা করছে। হয়তো সান্যাল সাহেবরা। ওঁদের পক্ষে চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক।
মহুয়া চাঁদ—ভেজা অসমান জমি বেয়ে নিজস্ব পা ফেলার অভিজাত ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে বড় রাস্তার দিকে। লতানো হাতে জড়িয়ে খোঁপাটা বেঁধে নিয়েছে। ওর ছিপছিপে শরীর একটা আলতো সুগন্ধি ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে—দূরে—ক্রমাগত দূরে; অন্য ছায়াদের গভীরে।
কালুয়াটা সুখনের পায়ের কাছে বসে মহুয়ার দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল।
সুখন সিগারেট ধরিয়ে একদৃষ্টে সেই অপস্রিয়মাণ ছায়াটির দিকে চেয়ে রইল।
পিছনের খোওয়াই—এর উপরে একটা একলা টিটি পাখি ডেকে ফিরছিল।
সুখন মিস্ত্রি জীবনে কখনও এত দুর্বল বোধ করেনি এর আগে। এত মঙ্গলকামনায়, এত শুভভাবনায় ভরপুর হয়ে চলে—যাওয়া কারও পথের দিকেই এমন করে আর তাকায়নি সে।
হঠাৎ সুখন অনুভব করল তার চোখের কোল ভিজে গেছে।
সুখন এক ঝটকায় সিগারেটটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল—এই মিস্ত্রি। হচ্ছে কী? এটা কী হচ্ছে? শালা। বাঁদর হয়ে চাঁদে হাত। চল শালা, আর্মেচারে তার জড়াবি। ডিস্ট্রিবিউটারের কার্বন পরিষ্কার করবি!
জীবনে এই প্রথমবার সুখনের মনে হল, ওর মনের ডিস্ট্রিবিউটরেও বড় ময়লা জমেছে। ভালো করে খুলে ওটাকে একদিন পরিষ্কার করতে হবে। প্লাগগুলো থেকেও ঘষে ঘষে কার্বন তুলতে হবে।
ও জানে যে, রোম্যান্টিকতার রঙবাজি সুখন মিস্ত্রিকে মানায় না। মানাবে না কোনোদিনও।
৬
কুমারের যখন ঘুম ভেঙেছিল, তখন বেলা পড়ে এসেছিল।
ঘরথেকে বারান্দায় এসে মোড়ায় বসল কুমার।
ওকে উঠতে দেখে মংলু চা বানিয়ে দিল, সঙ্গে হালুয়া আর পাপড়ভাজা।
এইসব হালুয়া—মালুয়া দিশি খাবার পছন্দ করে না কুমার। কেমন পিছলে—পিছলে যায়। যখনই ও হালুয়া খেয়েছে—এই হালুয়ার সঙ্গে ‘লে হালুয়া’ কথাটার কী সম্পর্ক ও ভাববার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ভেবে পায়নি।
চা খেতে খেতে একটা বিলিতি লম্বা সিগারেট ধরাল কুমার। মংলুকে শুধোল, এই ছোকরা, তোর ওস্তাদ কোথায়?’
মংলু বলল, জানি না।
—দিদিমণি কোথায়?
—বেড়াতে গেছেন।
—আর বুড়ো বাবু?
—উনিও বেড়াতে গেছেন।
—একই সঙ্গে দু’জন?
—না। আলাদা, আলাদা। আগে, পরে।
কুমারের মাথার মধ্যে ‘লে হালুয়া’ কথাটা ফিরে এল।
তারপরই আবার ও মংলুকে জেরা করল, একই দিকে?
‘জানি না। দেখিনি।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল মংলু।
কুমার আর সময় নষ্ট করল না। পায়জামা পরে শুয়েছিল। ছেড়ে ফেলে, জামাকাপড় পরে নিল। ইমপোর্টেড হলুদ কাপড়ের ট্রাউজার আর ঘন বেগুনি—রঙা গেঞ্জি। পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়াল।
মনে মনে বলল—এমনই মিস্ত্রি, ঘরে একটা ভদ্রগোছের আয়নাও রাখতে পারেনি। অবশ্য কীসের জন্যেই বা রাখবে? অমন চাঁদবদন দেখার আর কী আছে?
আয়নার সামনে দাঁড়াতে খুব একটা পছন্দ করে না কুমার। ওর চেহারাটা দিন—কে—দিন গুড়ের হাঁড়িতে পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো গুড়—চুক—চুক অথচ পাকানো হয়ে যাচ্ছে। এত পরিমাণে মদ্যপান করছে প্রতিদিন যাতে গায়েগতরে একটু লাগে, কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হচ্ছে না। অফিসে ওর যত ভার বাড়ছে, পদ বাড়ছে, ওর শরীরের ভার যেন ততই কমছে। এ—একটা প্যারাডক্স। কিছুই করার নেই।
কুমার বেরিয়ে, মহুয়া যেদিকে গেছে বলে জানিয়েছে মংলু, সেদিকে হাঁটতে লাগল রাস্তা ধরে।
রাস্তায় যানবাহন কিছু নেই। কাঁচা লাল ধুলোর রাস্তা। সামনেই একটা নালা। তার উপর কজ—ওয়ে। গাছগাছালির বুনো—বুনো গন্ধ, পাথর—মাথর; রাজ্যের বোগাস জিনিস।
একটা মোষের গাড়ি চলেছে ক্যাচোর—কোঁচর করতে করতে। মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হয় আওয়াজে।
মনে মনে বিরক্তির পরাকাষ্ঠা ঝরিয়ে কুমার ভাবল, এমনই জায়গা যে, একটা তেমন পানের দোকানও নেই যেখানে সোডা পাওয়া যায়। আজ রাতে তো করার কিছুই নেই। বৃদ্ধ ভাম তো মেয়ে সামলে সামলেই গেল। একমুহূর্ত চোখের আড়াল করে না মহুয়াকে। এখানে মানে কলকাতার বাইরে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মহুয়ার সঙ্গে একটা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন। আনলেস শী ইজ গুড ইন বেড, মহুয়াকে বিয়ে করবে না কুমার। ওসব মন—ফন, আজকের মেট্রিক সিস্টেমের দিনে কনডেমড ব্যাপার। এখন শরীরম আদ্যম। এ—ব্যাপারে মিল না হলে খামোখা বিয়ে—ফিয়ের ঝামেলার মধ্যে যাবে না ও। তারপরই ভাবল, সত্যিই কী যাবে না?
কুমার ভাবছিল, মেয়েটাও যেন কেমন। পদি—পিসি পদি—পিসি ভাব। এ নিয়ে কীসের এত ফাসস করা তা এরকম নেকু—পুষু—মুনু মেয়েরাই জানে।
হঠাৎ কুমার দেখল যে, সান্যাল সাহেব উলটোদিক থেকে আসছেন হন্তদন্ত হয়ে। বিয়ার টেনে টেনে তলপেটটা তরমুজের মতো করেছে বুড়ো।
কুমার ওঁকে দেখে কজ—ওয়েটার উপরে দাঁড়াল। মোষের গাড়িটা হেভি ধুলো উড়োচ্ছে। এগিয়ে যাক ওটা। তাছাড়া মোষেদের গায়ে একটা বোঁটকা গন্ধ। বুড়ো চান করে বেরোবার পর বাথরুমে এরকম একটা গন্ধ পেয়েছিল কুমার।
সান্যাল সাহেবের হাতে একটা বাঁশের লাঠি। খাকি শর্টস। গায়ে শাদা কলারওয়ালা গেঞ্জি। অনেকখানি হাঁটতে, ঘামে কপাল মুখ সব ভিজে গেছে।
সূর্য হেলে গেছে পশ্চিমে, অথচ এখনও পাথর থেকে গরমের ঝাঁজ বেরোচ্ছে। হরিবল জায়গা।
সান্যাল সাহেব কাছে এসেই বললেন, বড় চিন্তার কথা হল।
কুমার ঠান্ডা, ইমপার্সোনাল গলায় বলল, কী?
—মহুয়া কি ফিরেছে?
না তো।—কুমার বলল।
—সেই বিকেলে নাকি বেরিয়েছে। কোথায় গেল, কোনদিকে গেল, কিছুই বলে যায়নি। প্রায় দু’ আড়াই ঘণ্টা হতে চলল। এখুনি সন্ধে হয়ে যাবে। কী করি বলো তো?
সান্যাল সাহেবের গলায় চিন্তার রেশ ছড়িয়ে পড়ল।
কুমার বলল, সেই মিস্ত্রি ব্যাটা কোথায়?
—সে তো তুমি গালাগালি করার পরই বেপাত্তা। ওই ছোকরা চাকরটা বলল যে, ও নাকি খেতেও আসেনি।
‘ওরই কনসপিরেসি নয় তো! মহুয়ার যা সফট—কর্নার দেখছিলাম ওই মিস্ত্রির জন্যে।’ চিবিয়ে চিবিয়ে কুমার বলল।
—আহা! কী যা—তা বল কুমার। উ্য শুড নট ফরগেট দ্যাট আফটার অল শি ইজ মাই ডটার। তুমি এমন কথা বলছ বা ভাবছ কী করে?
কুমার বলল, ‘আমি কিছুই ভাবছি বা বলছি না। আপনাকে ভাবতে বলছি। আফটার অল সি ইজ ইয়োর ডটার। আমার কে?’
কথাটা বলে, এবং বুড়োকে আরও একটু দুশ্চিন্তায় ফেলে, কুমার খুশি হল। ও লক্ষ করেছে চিরদিনই যে, লোককে আঘাত করে ও ভীষণ আনন্দ পায়। বাক্যবাণে লোককে বিদ্ধ করার আর্টটা ও দারুণ রপ্ত করেছে। সত্যি কথা বলতে কী, ওর ইচ্ছে আছে যে, এই আর্টটা ও কমপ্লিটলি মাস্টার করে ফেলবে।
চিন্তান্বিতভাবে সান্যাল সাহেব আগে আগে এবং কুমার পিছনে পিছনে আবার সুখনের ডেরায় ফিরলেন।
সান্যাল সাহেব খুব আশা করছিলেন যে, ফিরে এবারে মহুয়াকে দেখতে পাবেন। দেখবেন মহুয়া গা—টা ধুয়ে শাড়ি বদলে বারান্দায় বসে বই পড়ছে। মেয়েকে সান্যাল সাহেব বড় ভালোবাসেন। তাছাড়া স্ত্রীর বিকল্পও বটে। মানে, ওঁর অত বড় ফ্ল্যাটে একজন নারীর বিকল্প। মহুয়ার জন্যে যত বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন তিনি, তত বেশি করে বুঝতে পারেন মহুয়াকে তিনি ঠিক কতখানি ভালোবাসেন।
উঠোনে পৌঁছেই তিনি শুধোলেন, ‘কী রে? আসেনি এখনও দিদিমণি?’
নাঃ। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল মংলু।
এই উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মংলুর মুখেও চিন্তার ছাপ দেখা দিল। দিদিমণি এতখানি দেরি করবে বলে বুঝতে পারেনি মংলু। যদি কোনো বিপদ—আপদ হয়, সাপে কামড়ায়, ভাল্লুকে খোবলায়, দায়িত্ব পড়বে মংলুর ঘাড়ে। যদি কেউ দেখে থাকে যে মংলুর সঙ্গে দিদিমণি শাকুয়া—টুঙের দিকে গেছে, তাহলে গুঞ্জার দারোগাবাবু এসে নির্ঘাৎ ওকে হাত—কড়া লাগিয়ে থানায় নিয়ে যাবে, তারপরে মারের চোটে বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেবে।
সুখনের কারখানায় রঙের কাজ করে যে মিস্ত্রি, তার বাড়ি কারখানার কাছেই। সান্যাল সাহেবের পীড়াপীড়িতে মংলু তাঁকে নিয়ে তার বাড়ি গেল।
কুমার বলল, ‘আমি এখানেই থাকি। যদি মহুয়া এসে পড়ে, তবে ও একা পড়ে যাবে। তাছাড়া আমি একটু ভেবে দেখি যে, কী করা যায়; কী করা উচিত। একটা অ্যাকশান প্ল্যান।’
সান্যাল সাহেব দিশাহারা হয়ে গেছেন। রাত অনেকক্ষণই হয়ে গেছে। যদিও চাঁদের আলো আছে ফুটফুটে, তবুও অচেনা—অজানা বুনো জায়গা। কোথায় গেল? কী হল মেয়েটার?
রঙের মিস্ত্রি সবে জামাকাপড় ছেড়ে গামছা পরে, লুঙি আর গোলা—সাবান নিয়ে কুয়োতলায় যাচ্ছিল, এমন সময় মংলুর সঙ্গে সান্যাল সাহেব গিয়ে হাজির।
সব শুনে মিস্ত্রি বলল, ‘এখানে তো ভয়ের কিছু নেই, তবে জঙ্গলের দিকে সাপের ভয় আছে। গরমের দিনে মহুয়ার সময় ভালুকের ভয়ও আছে। কিন্তু—দিদিমণি জঙ্গলে যাবেনই বা কেন একা একা? খারাপ লোকের ভয় এখানে নেই। আজ হাটবারও নয়। হাটের দিনে লোকে একটু মহুয়া—টহুয়া পচানিটচানি খায়—তখন অনেক সময় মাতাল হয়ে মেয়েদের উপর হামলা—টামলা করে। কিন্তু আজ তো হাটবারও নয়।’
তারপর আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘যাই হোক বাবু, আপনি যান, আমি তো বাড়িতেই আছি। রাত দশটা পর্যন্ত না ফিরলে আমাকে খবর দিবেন। থানায় নিয়ে যাব আপনাদের।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘যাবে কীসে করে? বাস তো স্ট্রাইক! এখানে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে?’
‘বাস স্ট্রাইক তো বিকেল চারটেয় মিটে গেছে। বিকেলে বাস গেল দেখলেন না আপনারা?’
অবাক গলায় সান্যাল সাহেব শুধোলেন, মিটে গেছে? আশ্চর্য।
তারপর বললেন, তাহলে তো আমরা আজই গাড়ি সারিয়ে চলে যেতে পারতাম।
রঙের মিস্ত্রি বলল, ‘তা পারতেন। কিন্তু আপনার সঙ্গের বাবু ওস্তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেন বলে ওস্তাদ রাগ করে চলে গেল। উনি থাকলে তো সবই হয়ে যেত। ওই বাবু খারাপ ব্যবহার করেছে শুনে মিস্ত্রিরা বলছিল বাবুকে মারবে। তা ওস্তাদই ওদের বকল। বলল, একদিনের মেহমান; ক্ষমা করে দে।’
সান্যাল সাহেব একমুহূর্ত মহুয়ার কথা ভুলে গিয়ে বললেন, তা তোমার ওস্তাদ গেলেন কোথায়?
—কে জানে কোথায়? ওস্তাদের কথা! পড়েলিখি আদমি। মিস্ত্রি হলে কী হয়। মাথায় অনেক পোকা আছে। বোধহয় শাকুয়া—টুঙে বসে পড়া—লিখা করছে।
—সেটা আবার কী?
—ওই টিলার উপরে ওস্তাদের আস্তানা আছে একটা। চলে যায় সেখানে রাগ—টাগ হলে ছুটিছাটার দিনে।
সান্যাল সাহেব মহা বিপদেই পড়লেন। ফেরার পথে সান্যাল সাহেব মংলুকে শুধোলেন, ‘এই শাকুয়া—টুঙটা কোনদিকে রে? তুই চিনিস?’
রঙের মিস্ত্রির কথা শুনে এমনিতেই মংলুর টাগরা শুকিয়ে গেছিল। এবার আরও শুকোল।
বলল, ‘চিনি। কিন্তু ওস্তাদ ওখানে যাননি।’
—কী করে জানলি যে, যাননি?
—গেলে আমি জানি, গেলে আমাকে বলে যান, জিনিসপত্র নিয়ে যান।
‘অ…।’ বললেন সান্যাল সাহেব।
ডেরার কাছে এসে অনেকক্ষণ এ—পাশে ঘুরে ঘুরে তারস্বরে মহুয়া, মহুয়া বলে ডাকলেন।
চাঁদনি রাতের বন—পাহাড় সে ডাককে ফিরিয়ে দিল বারে বারে গভীর স্বরে সান্যাল সাহেবের ক্লিষ্ট বুকে; কিন্তু মহুয়া সাড়া দিল না।
বারান্দার সামনে এসে সান্যাল সাহেব দেখলেন যে, কুমার টুলের উপর হুইস্কির বোতল রেখেছে—নিজেই কোথা থেকে জলটল জোগাড় করে একা একা বসে হুইস্কি খাচ্ছে।
অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় উনি বললেন, ‘তুমি হুইস্কি খাচ্ছ? ভাঙা গাড়িতে আমাদের ভুল রাস্তায় এনে এমন বিপদ ঘটিয়ে, আমার মেয়েটার এমন সর্বনাশ করে এখন তুমি কোন আক্কেলে হুইস্কি খাচ্ছ?’
কুমার আরেকটা মোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসুন, বসুন।’ বলেই একটা বড় হুইস্কি ঢেলে ওঁকে দিয়ে বলল, ‘আরও একটু দেখুন। তারপর যা করার করতে হবে। একটা সার্চ পার্টি অর্গানাইজ করে চারদিকেই বেরোনো যাবে। এখনও তার সময় হয়নি। তাছাড়া নিন—এটা এক গাল্পে শেষ করুন—উ্য উইল ফিল বেটার।
তারপর একটু থেমে বলল, ”দেয়ারস নো পয়েন্ট ইন ট্রায়িং টু ডু সামথিং, হোয়েন দেয়ারস নাথিং টু বী ডান”, ডক্টর চেসারের একটা বইয়ে পড়েছিলাম। ‘নিন, হ্যাভ অ্যানাদার ওয়ান। কুইক।’
সান্যাল সাহেব দিশেহারা, হতাশ অবস্থায় কুমারের কথামতো পর পর দুটো বড় হুইস্কি খেয়ে ফেললেন।
তারপর বললেন, তোমার কী মনে হয় কুমার?
কুমার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় আর আধ ঘণ্টার মধ্যে মহুয়া ফিরে আসবে। তার একটু পরেই সুখন মিস্ত্রি। আর আমার যা মনে হয়, তা ঠিকই মনে হয়। চিরদিনই।’
তারপর সান্যাল সাহেবকে অভয় দিয়ে বলল, ‘আপনি হুইস্কি খান, হুইস্কি খেতে খেতে দেখুন মহুয়া আসে কী না।’
সান্যাল সাহেব উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইলেন।
কুমার সান্যাল সাহেবকে প্রায় জোর করেই একটার পর একটা হুইস্কি খাইয়ে যেতে লাগল। কিন্তু নিজে অতটা খেল না। কুমারের মাথার মধ্যেপুঞ্জীভূত রাগ এবং প্রতিশোধের স্পৃহা একটা সামুদ্রিক কাঁকড়ার মতো দাঁড়া নাড়তে লাগল।
হঠাৎ উঠোনের দরজায় আওয়াজ হল। সান্যাল সাহেব, কুমার, মংলু সকলে একই সঙ্গে মুখ তুললেন ও তুলল।
মহুয়া দাঁড়িয়েছিল। চুল এলোমেলো, শাড়ি ক্রাশড। টিপ ধেবড়ে গেছে। মুখের মধ্যে অপরাধ ও ভয় মেশানো একটা আনন্দের ছাপ।
কুমারের মনে হল, আনন্দের ছাপটাই প্রধান।
সান্যাল সাহেব এতক্ষণ মেয়ের শোকে পাগল হয়েছিলেন। ভাবছিলেন, মহুয়া ফিরলে মহুয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু মহুয়া তাঁর চোখের সামনে এসে দাঁড়াতেই বহু বহু বছর আগে দেওঘরের শালবনের মধ্যে ভরদুপুরে দেখা একটি মেয়ের মুখ তাঁর মনে পড়ে গেল। সান্যাল সাহেবের বুঝতে ভুল হল না যে মহুয়া সেই মায়েরই মেয়ে। একই রক্ত বইছে এরও শরীরে। এরা শিকল—কাটার দলে। পায়ে শিকল রাখে না এরা। কোনো শিকলই।
সান্যাল সাহেব রেগে প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
—বেড়াতে গেছিলাম বাবা।
—বেড়াতে? এত সময়? তোর চেহারা এরকম হয়েছে কেন?
মহুয়া হাসল। এক দারুণ বিশ্বজয়ী হাসি।
তারপর বলল, ‘সে অনেক গল্প বাবা, দারুণ ইন্টারেসিটং। পরে তোমাকে বলব। কিন্তু আই অ্যাম স্যরি যে, তোমাকে এতক্ষণ ভাবিয়েছি। রাগ কোরো না প্লিজ। সোনা বাবা।’
এতক্ষণ কুমার চুপ করেছিল। হুইস্কি সিপ করতে করতে মহুয়ার দিকে তাকাচ্ছিল।
হঠাৎ কুমার বলে উঠল, ‘সময়টা ভালোই কাটল। কী বলো, তাই না?’
মহুয়া সোজা সর্পিণীর মতো ফণা তুলে তাকাল কুমারের দিকে—তারপর হাসল—আবার সেই হাসি। তারপর চোখে আগুন ঝরিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস।’
কুমার এক ঢোকে গেলাসটা শেষ করে বলল, ‘সার্টেনলি। আই নো দ্যাট। ইট ইজনট। থ্যাঙ্ক উ্য।’
কুমারের কথা শেষ হতে না হতেই দরজা ঠেলে এসে দাঁড়াল সুখন।
সুখন অন্য কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই বলল, ‘টাকাটা দিলে ভালো হয়। তিনশো টাকা।’
কুমার ওকে দেখে যেন ক্ষেপে গেল; তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ‘এতক্ষণ তুমি কোথায় ছিলে মিস্ত্রি? বিকেল চারটেয় স্ট্রাইক মিটে গেল—এতক্ষণে আমরা গাড়ি সারিয়ে চলে যেতে পারতাম বেতলা—কিন্তু তুমি ছিলে কোথায়? তুমি কী মনে করো যে, তোমার এই ফাইভ—স্টার হোটেলে আমরা চিরজীবন থেকে যাব আর তুমি আমাদের যেমন খুশি তেমন ট্রিট করবে? তুমি ভে—ভে—ভে—ভে—বেছ কি!’
কুমারের মুখ দিয়ে একটু থুথু ছিটল। কুমার অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ায়, তোতলাচ্ছিল।
সুখন ওর দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘যতখানি উত্তেজনা আপনার সয়, শুধু ততখানিই উত্তেজিত হওয়া উচিত। বেশি নয়। সেটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কার্ডিয়াক অ্যাটাক হতে পারে।’
হোয়াট? হোয়াট? বলেই, কুমার সিঁড়ি দিয়ে নেমে সুখনের দিকে তেড়ে গেল। বলল, ‘স্কাউনড্রেল—সব জিনিসের সীমা থাকা দরকার। উ্য হ্যাভ সারপাসড অল লিমিটস। বলেই, কেউই যা ভাবতে পারেনি, যা কারও পক্ষেই, এমনকি কুমারের নিজের পক্ষেও ভাবা সম্ভব ছিল না, হয়তো একমাত্র অন্তর্যামী হুইস্কিই যা জানত, তাই করে বসল কুমার।
ঠাস করে এক চড় মেরে বসল সুখনকে।
গুলি—খাওয়া বাঘের মতো প্রথমে রুখে দাঁড়াল সুখন। সান্যাল সাহেবের মনে হল আজ কুমারের কুমারত্বর আখরী দিন। আর কিছুই করার নেই।
কিন্তু পরমুহূর্তেই গায়ে জল—পড়া মেনি বিড়ালের মতো নিজের থেকেই সম্পূর্ণ অজানা কারণে সুখন নিজেকে নেতিয়ে, গুটিয়ে নিল।
যেন বললও আদুরে গলায়, মিঁয়াও।
কুমার ওর সামনে তখনও দাঁড়িয়েছিল ছাতের কার্নিসে ঘাড়ের লোমফোলানো লেজ—ওঠানো হুলো বেড়ালের মতো এক অদ্ভুত হাস্যকর ভঙ্গিতে।
হঠাৎ মহুয়া সুখনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি কী মানুষ? আপনার গায়ে কী রক্ত নেই? যে যা বলবে, বা করবে তা আপনি মুখ বুজে সহ্য করবেন? চুপ করে মার খেতেই পারেন—আপনি মারতে পারেন না?’ বলেই মহুয়া কেঁদে ফেলল।
সুখন একবার মহুয়ার দিকে আর একবার কুমারের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে আশ্চর্য এক হাসি হাসল। তারপর বলল, ‘আমি কাপুরুষ। আমি বীরপুরুষ নই।’ বলেই, বেরিয়ে গেল।
বেরিয়ে যেতে যেতে উঠোনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সান্যাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, টাকাটা মংলুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন।
কুমার যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেইখানেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
এক সময় স্বগতোক্তির মতো কুমার বলল, কিন্তু মহুয়াকে শুনিয়ে—’লম্বা চওড়া পাঠানের চেহারা থাকলেই বীরপুরুষ হয় না। পুরুষত্ব অন্য ব্যাপার। ফুঃ।’ বলেই, হুইস্কির বোতল থেকে অনেকখানি হুইস্কি ঢালল গলায়।
৭
টাকাটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছিল কুমার মংলুকে দিয়ে।
মংলু চলে যাবার পরই সান্যাল সাহেব কুমারকে বললেন, তোমার কী এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরার ইচ্ছে নেই?
কুমার বলল, ‘পৃথিবীতে আমার প্রাণের এনট্রান্সও যেমন আমার ইচ্ছাধীন ছিল না, একজিটও নয়।’ কিন্তু এ প্রশ্ন কেন? কুমার শুধোল।
কুমার ও সান্যাল সাহেব দুজনেই বেশি হুইস্কি খাওয়ার দরুন ”হাই” হয়েছিলেন। কুমার কম। সান্যাল সাহেব বেশি।
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘রঙের মিস্ত্রির কাছে শুনলাম যে, সকালে তুমি সুখনবাবুকে গালাগালি করার জন্যেই মিস্ত্রিরা বলেছিল মারবে তোমাকে। সুখনই নাকি তাদের থামিয়েছিল। আর এখন তুমি সুখনকে থাপ্পর মেরেছ জানলে তো আমাদের ঘরসুদ্ধ আগুন দিয়ে মারবে।’
কুমার বলল, ‘তা আর কী করা যাবে? আপনার অত ভয় লাগলে নিজের ইজ্জৎ রুমালে—মোড়া সিকনির মতো পকেটে ভরে আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান কোথাও। আমি একাই থাকব।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আহা। সে কথা নয়; সে কথা নয়।’
এর পর বেশি কিছু কথা—টথা হল না। কথা বলার মতো অবস্থা বা মনের ভাব মহুয়া, তার বাবা বা কুমার কারোই ছিল না।
রাতেও মুরগির মাংস আর পরোটা বানিয়েছিল মংলু। সান্যাল সাহেব ও কুমার খেলেন। মহুয়া কিছুই খেল না। খাওয়া—দাওয়ার পর ওরা শুয়ে পড়লেন।
সান্যাল সাহেব বললেন, আমার বড় গরম লাগবে ঘরে—আমি বারান্দাতেই শুচ্ছি।
দরজার পাশে বারান্দায় তাঁর চৌপাই বের করে দিল মংলু।
উনি কুমারকে বললেন, ‘দরজাটা ভেজিয়ে শুয়ো, আর মহুয়াকে দেখো। আমি তো দরজার সামনেই রইলাম। ভয় নেই। তোমাকে কেউ মারতে এলে আমাকে মেরে তারপর তোমাকে পাবে।’
মংলু যখন কারখানায় গেল টাকাটা নিয়ে, তখন সুখন কারখানাতেই ছিল। মংলু মুখ নীচু করে টাকাটা দিল সুখনের হাতে। মংলুর চোখ জ্বলছিল। বলল, ‘ওস্তাদ, তুমি ছেড়ে দিলে কেন ওই লোকটাকে?’
সুখন হাসল। বলল, ‘দূর, ইঁদুর মেরে কী হবে! তুই কিন্তু ওদের যত্ন—টত্ন করিস ভালো করে। টাকা ফুরিয়ে গেলে টাকা চেয়ে নিস আমার কাছ থেকে। আশা করি কাল দুপুর নাগাদ গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। দুপুরেই ওরা চলে যেতে পারবে যেখানে যাবার।’
মংলু বলল আপদ বিদেয় হবে।
সুখন আবার শুধোল, ওরা সকলে খেয়েছে রে?
—হ্যাঁ, কিন্তু দিদিমণি খাননি।
তাই বুঝি? স্বাভাবিক গলায় বলল সুখন।
মংলু শুধোল, আপনি ঘরে যাবেন না?
নাঃ—সুখন বলল।
মংলুর মনে হল ওস্তাদ ‘না’—টাকে ওর দিকে ছুঁড়ে দিল যেন।
মংলু আবার শুধোল, খাবার নিয়ে আসব এখানে?
—দূর। আবার কী খাব? দুপুরে অত খেলাম। তুই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়। আমার ঘর থেকে একটা বালিশ আর চাদরটা দিয়ে যাস। আজ কারখানাতেই শোবো।
কিছুক্ষণ পর বালিশ আর চাদর বগলে কারখানায় ফিরে এসে মংলু দেখল যে কারখানার শেডের নীচে, অনেকগুলো নামানো ইঞ্জিন ও গিয়ার—বক্সের মধ্যে প্যাকিং—বাক্সের উপরে, পাঁচ লিটারের মবিলের টিন রেখে একটা টেবল—মতো বানিয়ে নিয়েছে ওস্তাদ। তারপর চৌপাইয়ে বসে, সামনে লন্ঠন রেখে, কাগজ কলম বাগিয়ে বসেছে।
মংলু যেতেই সুখন বলল, ‘একটু পান আর সিগারেট এনে দিবি মংলু? মিসিরজির দোকান কী খোলা আছে?’
খোলা না থাকলে খুলিয়ে আনব। উৎসাহের গলায় বলল মংলু।
ওস্তাদকে বড় ভালো লাগে মংলুর। আর ভালো লেগেছিল দিদিমণিকে। দিদিমণি যদি এখানে থেকে যেতে পারত, বড় মজা হত। আজ সকালে দিদিমণি ওর সঙ্গে লুডো খেলেছিল। কী মিষ্টি করে কথা বলে দিদিমণি। কী সুন্দর করে তাকায়! ভদ্রলোকদের সব মেয়েরাই কী এত ভদ্র এত ভালো?
মংলু রাস্তায় মিসিরজির দোকানে পান আনতে গেছিল। দোকান তখনও খোলা ছিল। একদিকের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলেও, হ্যাজাক জ্বলছিল দোকানে, হ্যাজাকের আলোর ফালি এসে পথে পড়েছিল। দোকানঘরের পাশে কতকগুলো সেগুন গাছ। হাওয়ায় সেগুনের বড় বড় পাতা থেকে সড় সড় আওয়াজ উঠছিল। হাতির কানের মতো দেখতে পাতাগুলো খসে যাচ্ছিল হাওয়াতে।
মহুয়া জানালায় দাঁড়িয়েছিল। ঘরে কোনো আলো ছিল না। ফিতে কমিয়ে—রাখা হ্যারিকেনটা বারান্দায় বাবার চৌপায়ার পাশে রাখা ছিল। দরজাটা আধভেজানো। দরজার দিকে কুমারের চৌপায়া। মহুয়ারটা ভিতরে।
বাবার উপর খুব রাগ হচ্ছিল মহুয়ার। এত বেশি হুইস্কি খাওয়ার কোনো মানে নেই। কুমারের সঙ্গে তাকে এক ঘরে দিয়ে নিজে বারান্দায় শোওয়ারও মানে নেই। বাবার মনের ইচ্ছেটা মহুয়া বুঝতে পারে, কিন্তু কী করবে; কুমারকে কলকাতায় যাও—বা ভালো লাগত, বাইরে এসে এ দুদিনেই একেবারে বিরক্ত হয়ে উঠেছে ও। কুমারকে বিয়ে করবার কথা ভাবতেও পারে না আজ মহুয়া। অ্যাপার্ট ফ্রম বিয়ে, ওর সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কের কথাও ভাবতে পারে না।
জানালায় দাঁড়িয়ে ফুটফুটে কাক—জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া পথ, প্রান্তর, কজওয়ের নীচের ঝিরঝির করে জল—বয়ে যাওয়া নালাটা দূরের পাহাড় সব দেখছিল মহুয়া।
ও ভাবছিল যে, সুখ শাকুয়া—টুঙ থেকে ফেরার সময় বলেছিল, আরও ক’দিন পরে এলে দেখতে পেতেন পাহাড়ে পাহাড়ে কেমন আগুনের মালা জ্বলে—মালা বদল হয়। পাহাড়দের বিয়ে হয়। কী আশ্চর্য অনাবিল স্বল্প চাহিদার সরল জীবন সুখের। চাহিদা নেই কিছু ওর, অথচ দেওয়ার ক্ষমতা কী অসীম। এ পর্যন্ত মহুয়া একাধিক পুরুষের সান্নিধ্যে এসেছে—কিন্তু কখনও এত ভালো লাগেনি ওর আগে। অবশ্য ওর সর্বস্ব দেয়ওনি আগে ও কাউকে এমন করে। সমস্ত শরীর কারও পরশ মাত্রই এমন মাধবীলতার মতো মুহূর্তের মধ্যে ফুলে ফুলে ভরে যায়নি। এই রুক্ষ অথচ ভীষণ নরম লোকটা কী যেন জাদু জানে।
মংলুকে দেখতে পেল মহুয়া। মংলু আলোর সামনে দাঁড়িয়ে পানওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে। হাসছে, কী যেন বলছে অপাপবিদ্ধ মুখে। বেশ ছেলেটা!
মহুয়া ভাবছিল, সুখন খেল কী না কে জানে? এখন আর শুধোনো যাবে না। বাবা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। কুমার ঘুমিয়েছে কী না তাও মহুয়া জানে না। কুমার ঘুমিয়ে পড়ার আগেই মহুয়া ঘুমিয়ে পড়তে চায়—নইলে এত কাছে কুম্ভকর্ণর নাকডাকার আওয়াজে ঘুম আসবে না কিছুতেই।
কিন্তু আজ কী মহুয়ার ঘুম আদৌ আসবে? ঘুম কী আসবে কিছুতেই? নাই—ই বা ঘুমোল এক রাত। এমন রাত। এমন সুখ—স্মৃতির; আবেশের রাত। কাল কী করবে ভাবতে হবে মহুয়াকে। ও কী সত্যিই থাকবে সুখের কাছে? পারবে? যদি নাই—ই পারবে, তাহলে এত বড় বড় কথা বলল কেন ও মুখে? সুখ কী আগেই জানত যে, ও থাকতে পারবে না, থাকতে চায় না, তাই—ই কী অমন করে হাসছিল তখন? যদি কিছু সত্যিই হয়, হয়ে যায়, তবে কী সুখের কাছে ফিরে আসবে মহুয়া—কোনো ভিক্ষা নিয়ে? সে যদি আসেই, সুখ কী তাকে চিনতে পারবে তখন?
জানে না, মহুয়া কিছুই জানে না। এই বন—জঙ্গল বড় খারাপ। ফিসফিস ফিসফিস করে কারা যেন কথা বলে, আড়ালে—আড়ালে; হাসে, কারা যেন গান গায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অভিশাপ দেয়। বিড়বিড় করে ডাইনির মতো—তাদের দেখা যায় না।
সুখকে প্রথম দেখাতেই সে সব দিতে রাজি ছিল, তবুও তার সংস্কার, তার শিক্ষা, তার সহজাত লজ্জা সব কিছু অত সহজে হারাত না ও, যদি না ভুল করে শাকুয়া—টুঙ—এ যেত। প্রকৃতির বুকের মধ্যে গিয়ে পড়তেই, এত বছরের শিক্ষা, শিক্ষার দম্ভ, রুচির অহংকার, লজ্জার আড়াল যেন একমুহূর্তে, কাচের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। প্রকৃতির মধ্যে এলে কোনো আড়ালই বুঝি থাকে না; রাখা যায় না। এখানে না এলে এ কথা জানতে পেত না মহুয়া।
এখনও পুরো ব্যাপারটা ভাবলে একটা স্বপ্ন বলে মনে হয়। দুঃস্বপ্ন নয়, একটা দারুণ সুন্দর স্বপ্ন; যে—স্বপ্ন বুঝি এ জন্মে আর কখনও মহুয়া দেখতে পাবে না। কিংবা পাবে হয়তো, কে জানে, যদি কখনও আবার অমন পাথরের উপর, নদীর সাদা বালিতে এমন চাঁদের আলোয় সুখের বুকে আশ্লেষে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ আসে।
বাইরের বাতাসে মহুয়ার গন্ধ ভাসে। মহুয়ার ভীষণ গর্ব হয়। ওর নামের জন্যে। কে যেন তাকে প্রথম এ—নামে ডেকেছিল? যখন ডেকেছিল তখন সে তো একটা ডাক মাত্র ছিল। আজ, এই চাঁদের রাতে, দোলপূর্ণিমার কাছাকাছি, হাওয়ায়—ওড়া এত সুগন্ধের মধ্যে ও ওর নামের মাহাত্ম্য খুঁজে পেল। নাম, সে যে—কোনো নামই হোক না কেন, সে তো শুধু একটা ডাক মাত্র নয়। সে—যে নিছক ডাকের চেয়ে অনেক বড়; হৃদয়ের অন্তস্তলে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে সে ডাক হাজার হাজার কুঁড়ি ফোটায় কুঁড়ি ঝরায়। মহুয়া ভাববার চেষ্টা করছিল। কে—কে প্রথম তাকে ডেকেছিল মহুয়া বলে?
মংলু পান আর সিগারেট দিয়ে চলে গেল।
সুখন টেবল ঠিক করে কারখানা থেকে বেরিয়ে কুয়োতলায় গিয়ে চান করল। তোয়ালে—টোয়ালে নেই। ভিজে গায়েই আবার ছাড়া জামাকাপড় পরল। আঙুলগুলোকে চিরুনি করে মাথা আঁচড়াল, তারপর কারখানায় এসে তার চৌপাইয়ে বসল।
ছোটবেলা থেকে সুখন লেখক হবার স্বপ্ন দেখেছিল। হয়েছে মোটর মিস্ত্রি। লেখার মধ্যে কলেজ ম্যাগাজিনে একটি গল্প লিখেছিল। একটি মাত্রই লেখা তার ছাপা হয়েছিল। সুখন পড়েছে, শুনেছে যে, অনেক বিখ্যাত লেখকের হাতে—খড়ি হয়েছে প্রেমপত্র লিখে। সে জীবনে প্রেমপত্র লেখেনি কাউকে। কলেজের একটি মেয়ে, যে তাকে চোখের ভালো—লাগা জানিয়েছিল, তার উদ্দেশে কবিতা লিখেছিল একটি, কিন্তু পৌঁছয়নি তার কাছে। এক বন্ধু চানাচুর কিনে সেই কবিতা মুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেছিল।
আর লিখেছে ডাইরি। অনেক। কিন্তু তার ডাইরি সে নিজে ছাড়া আর কেউই পড়েনি।
আজ সে জীবনে এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে প্রথম প্রেমপত্র লিখতে বসেছে। এ এক আশ্চর্য প্রেমপত্র।
প্রেমপত্রর উদ্দেশ্য সাধারণত প্রেমের পাত্রর কাছ থেকে প্রেম পাওয়া বা ঈপ্সিত প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পাওয়া। ওর জীবনের প্রথম প্রেমপত্র সে এমন একজনকে লিখছে যে, সে কিছু চাইবার আগেই যে তাকে সবই দিয়ে দিয়েছে কিছুই বাকি না রেখে। একজন মেয়ে কাউকে ভালোবেসে যা কিছু দিতে পারে তার প্রেমিককে সেই সব—ই। তার এই প্রেমপত্রর উদ্দেশ্য, কিছু পাওয়া নয়, বরং যা পেয়েছে সেই প্রাপ্তিকে স্বীকার করা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।
এই প্রথম এবং হয়তো বা শেষ চিঠি মহুয়াকে লিখতে বসার জন্যে সে মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। একটা দারুণ ভালোলাগা, এক সার্থকতার উষ্ণ বোধ তাকে অত্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। জীবনে কারও ভালোবাসা পায়নি সে এতদিন; কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে যে, কাউকে ভালোবাসা ও কারও কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া ব্যতিরেকে কোনো পুরুষের পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কুমারকে আজ ক্ষমা করে দিয়ে সে নিজেই নিজের কাছে প্রমাণ করেছে যে, ভালোবাসা মানুষকে বড় বদলে দেয়। হয়তো নিজের সত্যিকারের নিজত্বের চেয়ে কাউকে অনেক বড় করে; হয়তো বা ছোটও করে কাউকে। কিন্তু যে—কোনো মানুষের জীবনেই ভালোবাসার অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব যে তাকে প্রচণ্ডভাবে পরিবর্তিত করে—একথা সুখন এই কয়েক ঘণ্টাতেই নিশ্চিতভাবে বুঝেছে। ভালোবাসার জনের সুখে, তার আনন্দে, যে ভালোবাসে তার যে কত গভীর সুখ, সেই জনের জন্যে একটু কিছু করতে পারার মধ্যে যে কত ভালোলাগা, তা সুখন জেনেছে।
রাস্তায় বীরজু শাহ’র গদির কুকুরগুলো একসঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। শেয়াল—টেয়াল দেখে থাকবে কিংবা কোনো শুয়োরের দল। টাঁড় পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে বোধহয়।
চাঁদের আলোয় মশারির মতো রাত ঝুলে আছে বাইরে।
একটা পিউ—কাঁহা ডাকছে গুঞ্জার দিকের টাঁড়ে। চারদিকে এই চাঁদের রাতে এক চকচকে অথচ স্থির স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতা। করৌঞ্জ, শালফুল ও মহুয়ার গন্ধ ভাসছে সমস্ত আবহাওয়ায়। আঃ মহুয়া! তুমি বড় সুন্দর মহুয়া। তোমার মহুল ফুলের মতো ছিপছিপে শরীর, তোমার লাজুক—লতানো ব্যক্তিত্ব—তোমার সব, সব, সব। তোমার চোখ, চিবুক, তোমার ঠোঁটের তিল।
”মহুয়া”, ”মহুয়া” বলে কে যেন ডাকল মহুয়াকে।
মহুয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল যে তা নয়। কিন্তু কেমন একটা মদির আবেশে নিমগ্ন ছিল। চোখ খুলে, অন্ধকারেই মহুয়া দেখল, কুমার কখন তার চৌপাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাইরে বাবার গভীর ঘুমের নিশ্বাসের একটানা ওঠানামার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মহুয়া কিছু বলার আগেই কুমার তার ঠোঁটে হাত রাখল। তারপর এক হাত ওর মুখে চেপে, অন্য হাতে তার বাহু ধরে তাকে তুলে নিজের চৌপাইয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগল।
মহুয়ার মনে হয়েছিল, ওকে নিশিতে ডেকেছে। স্লিপ—ওয়াকিং করে পথটুকু চলে গেলে ওর আর কিছুই বাকি থাকবে না। মহুয়া আর মহুয়া থাকবে না।
তখনও সুখের সঙ্গে কাটানো সন্ধের, সেই শিরশিরানি সুখ তার শরীরে মনে মাখামাখি হয়েছিল—খুশবু আতরের মদিরতার মতো। ও তখন নিজের বশে ছিল না। কুমার যা—কিছু করতে চাইল তার কোনো—কিছুতেই মহুয়ার বিন্দুমাত্র সায় ছিল না। কিন্তু প্রথমে ও বাধা দিল না। ওর মনে হল কুমার যেন জন্মাবধি বুবুক্ষু কোনো মন্বন্তরের কাঙালি।
সুখের সঙ্গে একটুও মেলে না।
এককালীন ক্ষুধা, রুচিহীনতা, আদেখলাপনা ও অস্থির আনরোম্যান্টিকতার সঙ্গে কুমার মহুয়াকে কুৎসিতভাবে কুটুরে ব্যঙের মতো জড়িয়ে ধরল।
কুমারের এই জান্তব ব্যবহার মহুয়ার ভালো অথবা মন্দ কিছু লাগল না। ওর উদাসীনতায় ও ভরে রইল। ওর মনে হল সুখনের কোলেই যেন বনজ—গন্ধে ভরা পাহাড়ি নদীর খোলে ও শুয়ে রয়েছে এখনও, আর একটা শেয়াল তার শরীর শুঁকছে, কামড়ে খাচ্ছে। ও—যে ওর সুখের কাছেই আছে এই সুখময় বোধটুকু ছাড়া মহুয়ার আর কোনো বোধই ছিল না সে মুহূর্তে।
মহুয়া সেই মদির ঘোরের মধ্যে যেন পাশ ফিরে শুলো। তারপর হঠাৎ দু’হাত জোড়া করে আসুরিক শক্তিতে রোগা—পাতলা ও নেশাগ্রস্ত কুমারকে বুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
কুমার পড়ে গেল চৌপায়ার উপরে। চৌপাইটা নড়ে উঠল—হঠাৎ খুব জোর আওয়াজ হল তাতে।
বাইরে থেকে সান্যাল সাহেব ঘুম—ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলেন—প্লিজ, মেরো না, ওকে মেরো না, মাপ চাইছি বাবা আমরা, আমরা মাপ চাইছি।
মহুয়া দৌড়ে এল বাইরে। বলল, ‘বাবা, জল খাবে?’
সান্যাল সাহেব উঠে বসেছিলেন; সারা শরীর ভয়ে ঘেমে গেছিল ওঁর। মহুয়াকে দেখে উনি শুধোলেন, কুমারকে কী খুব মেরেছে ওরা? মেরে ফেলেছে?
মহুয়া ঘর থেকে জল এনে দিয়ে সান্যাল সাহেবের কপালে হাত দিয়ে বলল, কুমার তো ঘুমোচ্ছে বাবা! তুমি স্বপ্ন দেখছিলে!
তবে শব্দ? শব্দ কীসের হল ঘরে! সান্যাল সাহেব ঘুম জড়ানো গলায় বললেন।
কুমার ঘর থেকে বাইরে এসে বলল, ‘বেড়াল।’
মহুয়া কথা কেড়ে বলল, ‘একটা উপোসী হুলো বেড়াল ঘরে ঢুকেছিল।’
।৮
আধ—ফোটা ভোরের প্রথম বাসেই সুখন নিজেই রাঁচী যাবে। এমন জিনিসই ভাঙল গাড়িটার যা এ তল্লাটে পাওয়া অসম্ভব। চিঠিটা শেষ করল সুখন।
হাতঘড়িতে দেখল তিনটে বাজে। আর এক ঘণ্টার মধ্যেই আলোর আভাস জাগবে পুবে। মদনলাল কোম্পানির বাস ঠিক চারটে বেজে দশ—এ এসে দাঁড়াবে মিসিরজির দোকানের সামনে। তখন শেষ রাত। ঝিরঝির করে আসন্ন ভোরের গন্ধ—মাখা একটা হাওয়া ছেড়েছিল।
সুখন একটা বড় হাই তুলল। আড়মোড়া ভাঙল। পায়ের কাছে শুয়ে থাকা কালুয়া নড়েচড়ে বসল, ডান পা দিয়ে খচর—খচর করে ঘাড় চুলকোলো, তারপর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে সামনের দু’পায়ের উপর মুখটা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
একটা সিগারেট ধরাল সুখন। সারা রাত পান খেয়ে জিভটা ছুলে গেছে। জর্দাও বেশি খাচ্ছে আজকাল। মাঝে মাঝে বাঁদিকের বুকে ব্যথা করে। কেয়ার করে না ও। নিজেকে নিয়ে, নিজের শরীরকে নিয়ে কখনও বেশি মাথা ঘামায়নি ও। আবার একটা পান মুখে দিল। তারপর চিঠির পাতাগুলো একসঙ্গে করে চিঠিটাকে পড়বে বলে, চৌপাইতে এসে শুয়ে পড়ল। সারারাত সোজা বসে থেকে, কোমরটা ভীষণ ব্যথা করছিল। ঘুম না এসে যায়। মনে মনে নিজেকে বলল সুখন।
২৫শে মার্চ
ফুলটুলিয়া, গুঞ্জা
পালামৌ
তোমাকে মহুয়া বলেই ডাকতে পারতাম। কিন্তু তুমি চলে গেলে যে—ডাকে কেউই সাড়া দেবে না, সে ডাকে ডেকে লাভ কী?
তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব, জানি না আমি। ধন্যবাদ আদৌ দেওয়া উচিত কিনা তাও জানি না। কারণ ধন্যবাদ ব্যাপারটাই পোশাকি সৌজন্যের এবং তোমার বয়—ফ্রেন্ডের গাড়ির মতোই, ”ইম্পোর্টেড”। কোনোরকম পোশাক এবং পোশাকি ব্যাপারকেই যখন আমরা দুজনেই প্রশ্রয় দিইনি, তখন পোশাকি সৌজন্য আমাদের মানায় না।
এখন রাত গভীর। পায়ের কাছে কালুয়া শুয়ে আছে। কালুয়ার মন খুবই খারাপ। কালুয়া তোমাকে ভালো মনে নেয়নি। ও ওর স্বাভাবিক সারমেয়—স্বভাবে ভেবেছিল, চিরদিন ও একাই আমার মালকিন থাকবে। কেউ একদিনের জন্যে এসে আমার উপর এমন জবরদখল নেবে তা ওর ভাবনার বাইরে ছিল।
আমার ধারণা, তুমি কালুয়ার মুখের দিকে ভালো করে একবারও তাকাওনি। কালুয়া বড় সুন্দরী। সাধারণত সব কুকুরের মুখশ্রীই অত্যন্ত সুন্দর। পথের কুকুরের মুখেও যে বুদ্ধিমত্তা এবং চোখে যে ব্যক্তিত্বময় ঔজ্জ্বল্য দেখা যায় তা অনেক মানুষের মুখেও দেখিনি। অনুরোধ, যাওয়ার আগে আমার কালুয়ার মুখে একবার ভালো করে চেয়ো এবং ওকে একবার আদর করে যেয়ো।
তোমার সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না। তবু, আমি হারিয়ে যেতে চাই না। পালাতে তো নয়ই। তাছাড়া, আমার পালাবার মতো কোনো জায়গাও নেই। সুখন মিস্ত্রি এই ফুলটুলিয়া বস্তিতেই থাকবে আমৃত্যু। তোমাদের মতো গতিবেগসম্পন্ন মানুষদের গতি যাতে অব্যাহত থাকে, তা দেখাই আমার কাজ। অথচ আমরা নিজেরাই গতিমান নই; অনড়, স্থাবর।
যা ঘটে গেছে, তার জন্যে আনন্দরও যেমন সীমা নেই আমার, দুঃখেরও নয়। তোমার মতো একজন উচ্চবংশের, শিক্ষিতা অভিজাত মেয়েকে আমি কোনোরকম বিপদেই ফেলতে চাইনি। আশা করি যা ঘটে গেছে তার দায়িত্ব তুমি আমার সঙ্গে সমানে ভাগ করে নেবে।
মনে কোনো পাপবোধ রেখো না এ বাবদে। যে মিলনে আনন্দ নেই, সে মিলন অভিপ্রেত নয়। আনন্দই যেন থাকে, আর আনন্দের স্মৃতি। এ নিয়ে আমার অথবা তোমার মনে কখনও যেন কোনো অনুশোচনা না হয়। তা হলে এই পরম প্রাপ্তির সব মিষ্টত্ব তেতো হয়ে যাবে চিরদিনের মতো।
তবে স্বীকার কর আর নাই—ই কর, তুমি বড়ই ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষ বলেই তুমি এখনও অপাপবিদ্ধ, মহৎ। পৃথিবীর নীচতা, দৈনন্দিন জীবন—জাত ব্যবসায়ীসুলভ সাবধানতা এখনও তোমার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেনি। সে—কারণেই তোমার পক্ষে অত সহজে সহজ হওয়া সম্ভব হয়েছিল। প্রার্থনা করি, তোমার এই সহজ—সত্তাকে চিরদিন এমনিই রাখতে পারো তুমি।
তুমি আমার জীবনটাকে, এই নিরুপায় মেনে—নেওয়া মিস্ত্রিগিরির জীবনটাকে, বড় নাড়া দিয়ে গেলে। আমার গর্ব ছিল যে, নিজেকে বইয়ের মধ্যে, কাজের মধ্যে, ডাইরি লেখার মধ্যে এবং আমার উৎসারিত আনন্দের উৎস এই প্রকৃতির মধ্যে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়ে দিয়ে আমি বুঝি একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ করতে পেরেছিলাম নিজেকে। যে নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজ এবং অকাজ নিয়েই এ যাবৎ ষোলো আনা খুশি ছিল, খুশি ছিল শাকুয়া—টুঙ—এর একাকী এবং একক অস্তিত্বে, বাইরের কোনো কিছুতেই তার প্রয়োজন ছিল না বলেই সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিল। জানো মহুয়া, শাকুয়া—টুঙের নির্জন নির্মোক প্রদোষে অথবা উষায় আমার প্রয়াই মনে হত, আমি বোধহয় স্বয়ংম্ভূ। শুধু তাই—ই নয়, আমি সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কিন্তু তুমি আমার এই মিথ্যে গর্বকে ভেঙে টুকরো করে দিয়ে গেলে। বুঝিয়ে দিয়ে গেলে যে, জীবনে ষোলো আনা প্রাপ্তিই সব নয়। ষোলো আনার উপরেও কিছু থাকে; যা উপরি, পড়ে পাওয়া, অথচ যার উপর জীবনের সার্থকতা দারুণভাবে নির্ভরশীল। তোমার চোখের পূর্ণ শান্ত দৃষ্টিতে, তোমার নম্র শান্ত ব্যবহারে, তোমার স্বচ্ছতোয়া শরীরের সুগভীর স্নিগ্ধ উষ্ণতায় তুমি আমাকে চিরদিনের মতো জানিয়ে দিয়ে গেলে যে, পৃথিবীর কোনো পুরুষই স্বয়ম্ভর নয়। হতে পারে না।
যতদিন অভাব পূরিত হয়নি, ততদিন অভাবটাকেই একমাত্র অমোঘ এবং অনস্বীকার্য ভাব বলে মেনে নিয়েছিলাম। সেই অবস্থাকেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা বলে সাংঘাতিক এক ভুল করেছিলাম। তুমি আমাকে এক আশ্চর্য আকাশতলের আনন্দযজ্ঞে ডাক দিলে। আমার প্রাণের কেন্দ্রের সব শূন্য পূরণ করে জানিয়ে গেলে বরাবরের মতো যে, পুরুষের শেষ এবং একমাত্র গন্তব্য, তার চরম চরিতার্থতা শুধু কোনো নারীতেই।
তোমরা যে আমাদের রুক্ষ, ধুলোমাখা জীবনের, আমাদের নির্বুদ্ধি সর্বজ্ঞতার, আমাদের দুর্মর দুর্দম পুরুষালি—বোধের উপর কিছুমাত্র নির্ভরশীল নও, তোমরা যে তোমাদের চোখ—চাওয়া, তোমাদের হাসি, তোমাদের ভালোবাসায় ঐরাবত—প্রবর স্থূল—গর্বসর্বস্ব পুরুষদের ইচ্ছেমতো ভাসিয়ে দিতে পারো অবহেলায়, এটা একটা দারুণ জানা।
মহুয়া, তোমাকে দিতে পারি এমন আমার কিছুমাত্র নেই। সত্যিই নেই। তোমার হয়তো প্রয়োজন কিছুতেই নেই; তবু আমার দেওয়ার আগ্রহটা তোমার প্রয়োজনের তীব্রতার উপর ডিপেন্ডেন্ট নয়। তোমাকে কিছু একটা, কোনো কিছু দেবার বড় ইচ্ছে ছিল—যাতে আমাকে কিছুদিন অন্তত তোমার মনে থাকে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে কিছুতেই ভেবে পেলাম না পার্থিব কোনো দানের কথা। কতটুকু আমার ক্ষমতা। আমার কী—ই বা আছে তোমাকে দেবার মতো। তোমার যে সবই আছে, সমস্ত কিছু।
হাতে করে কিছু দিই আর নাই—ই দিই, তুমি জেনো যে, তোমাকে এমনই কিছু দিয়েছিলাম যা আর কাউকেই দিইনি, হয়তো কখনোই দিতে পারবও না।
তুমি রানির মতো চলে যাবে কাল, আমাকে ভিখিরি করে। যা—কিছু আমার ছিল, এতদিনের, এতবছরের, যা—কিছু যত্ন করে রাখা—তার সবই তুমি নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে।
বিনিময়ে যা দিয়ে যাবে, তার সঙ্গে শুধু তুলনা চলে কোনো মহীরুহর বীজের। এই মুহূর্তে ভবিষ্যতের স্পষ্ট অনুমান ও কল্পনাও বুঝি সম্ভব নয়। আশাকরি, তোমার এই দান একদিন শাখা—প্রশাখা বিস্তার করে আমার মনের গভীরে এক সান্ত্বনা—দাত্রী ছায়ানিবিড় গাছের মতো প্রতিষ্ঠিত হবে। তোমার স্মৃতি বুকে করে বাকি জীবনটা সুখন মিস্ত্রির দিব্যি পান—জর্দা খেয়ে, গাড়ি মেরামত করে, হেসে— খেলেই চলে যাবে।
আমার আজকে মনে হচ্ছে, বারবার মনে হচ্ছে যে, জীবনে একজন মানুষ কত পায়, কতবার পায়; তাতে কিছুই যায় আসে না; কিন্তু সে কী পায় এবং কেমন করে পায় তাতে অনেক কিছুই যায় আসে।
যারা সাধারণ, তারা দস্তুরের দাগা বুলিয়েই বাঁচে। একজন আর্টিস্ট—এর সঙ্গে সাধারণ লোকের এখানেই তফাত। তুমি একজন উঁচুদরের আর্টিস্ট। তোমার জীবনটাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো রং—তুলির আঁচড় বোলাতে এবং এমনকী ইচ্ছেমতো জীবনের ইজেলটাকে ছিঁড়ে ফেলতেও বুঝি তোমার বাধে না। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তবু তোমাকে আমি এক বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছি; আমার মনে।
আমার মতো অখ্যাত লোকের মস্ত সুবিধে এই—ই যে, তাদের লেখা কোনো পত্র—পত্রিকায় ছাপা হবে না। খ্যাতি যেমন তার নেই, তেমন পাড়া—বেপাড়ার গণ্ডমূর্খদের তাকে সমালোচনা করার অধিকারও সে দেয়নি। বিখ্যাত লোকের বিচারক সকলেই, তাদের সে বিচারের যোগ্যতা থাক আর নাই—ই থাক। আমার বিচারের ভার রইল শুধু তোমারই হাতে। আমার মহুয়ার হাতে।
পরিশেষে, তোমাকে একটা কথা বলব। কথাটা হচ্ছে এই—ই যে, কুমারবাবু তোমারই শ্রেণীর লোক। তুমি এবং তোমার বয়সি অনেকেই হয়তো শ্রেণীবিভাগ মানে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই—ই যে তোমার কী আমার মানা—না—মানার উপর আজও শ্রেণীবিভাগের কালাপাহাড় অস্তিত্বর কিছুমাত্র যায় আসে না। তার শিকড় বড় গভীরে প্রোথিত আছে। তাই বলছি যে, কুমারবাবুকে বাতিল করার আগে দু’বার ভেবো।
ভেবে অবাক লাগছে যে, তোমার কারণেই কুমারবাবুর উপরে আমারও একটা দুর্বোধ্য দুর্বলতা জন্মে গেছে। নইলে সান্যাল সাহেবকে হয়তো তার লাশ নিয়ে ফিরতে হত এখান থেকে। সুখন মিস্ত্রি গাড়ির কাজ ভালো না জানলেও খুন—খারাবিটা খারাপ জানে না। আমার যা—কাজ, যাদের নিয়ে কাজ, তাতে আমার নিজেরই অজান্তে আমি অনেক বদলে গেছি। কখনও সুযোগ এলে কুমারবাবুকে বলো, তোমার খাতিরে সুখন মিস্ত্রি ছেড়ে দিলেও, অন্য অনেকে না—ও ছাড়তে পারে। তার নিজের মুখের টোপোগ্রাফি রক্ষার স্বার্থেই তাঁকে একটু ভদ্রতা শিক্ষা করতে বোলো।
চিঠিটা অনেক বড় হয়ে গেল। একসঙ্গে এত কথা মনের মধ্যে ভীড় করে আসছে যে, গুছিয়ে লিখতে পারা গেল না। আমার সমস্ত অস্তিত্বটাই বড় অগোছালো করে দিয়ে গেলে তুমি।
ভালো থেকো মহুয়া, সবসময় ভালো থেকো। নিঃস্বার্থভাবে মঙ্গল কামনা করার অন্তত একজন লোকও তোমার রইল, এটাকে বড় কম পাওয়া বলে ভেবো না।
যা করলাম, অথবা করলাম না, তা সবই তোমার ভালোর জন্যেই; এটুকু জেনো। তুমি যা বলেছিলে, যা করতে চেয়েছিলে, তা যে নিতান্তই ছেলেমানুষি, তা তুমি এখান থেকে চলে গেলেই বুঝতে পারবে। এই চলে—যাওয়ায় আমার প্রতি যেটুকু মমত্ববোধ জাগবে তোমার, হয়তো থাকবেও; সেটুকু আমার কাছাকাছি চিরদিন থাকলেও জাগত না। এটা সত্যি। বিশ্বাস কোরো।
যাকে কাছে রাখতে চায় কেউ, তাকে দূরে দূরে রাখাই বুঝি তাকে কাছে রাখার একমাত্র উপায়। বড় বেশি কাছাকাছি ঘেষাঘেঁষি বেশিদিন থাকলে ভালো লাগার, ভালোবাসার রঙটা ফিকে হয়ে যায়।
সবসময় আমাকে মনে পড়ার দরকার নেই। পড়বে যে না, সেও জানি। মাসান্তে কী বৎসরান্তে কোনো একলা অবসরের মুহূর্তে হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে—আসা জঙ্গলের বনজ গন্ধের মতো আমার কথা যদি মনে পড়ে তোমার, তাহলেই আমি ধন্য বলে জানব নিজেকে।
আমি জানি, তুমি চলে গেলে, বড়ই ফাঁকা লাগবে, আমি, কালুয়া, মংলু—আমাদের তিনজনের সংসার। পাগল—পাগল লাগবে—জানি আমি। কিন্তু কিছু করার নেই।
মহুয়া, আমার ঝড়ের ফুল; ভালো থেকো, সবসময় ভালো থেকো।
—ইতি সুখন মিস্ত্রি
চিঠিটা আরও একবার পড়ল সুখন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল।
অনেকক্ষণ ভেবে—টেবে, তারপর হঠাৎ কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলল চিঠিটাকে। মনে মনে বলল, দুসস, কী লাভ? লাভ কী?
চিঠিটা ছিঁড়ে মুঠো পাকিয়ে কাগজের কুচিগুলো কারখানার আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিল। তারপর একেবারে নিশ্চল রইল বহুক্ষণ।
সুখন খুব বিষণ্ণতার সঙ্গে ভাবল, ছিঁড়বেই যদি, তাহলে এত কষ্ট করে রাত জেগে এ চিঠি লিখল কেন? কী লাভ হল?
বিড়বিড় করে বলল, সব ফেলা গেল। তারপরই ভাবল, সত্যিই কী ফেলা গেল? জানে না সুখন এতসব। এমন করে কখনও ভাবেনি আগে। কখনও যে ভাবতে হবে, তাও ভাবেনি।
সুখন বলল আবার নিজেকে—যানে দেও মিস্ত্রি। তুমি যেখানে থাকার, এই পোড়া—মবিলের, ওয়েল্ডিং করার গ্যাসের গন্ধে, নানারকম যান্ত্রিক ও ধাতব শব্দের মধ্যে যেমন আছো, তেমনই থাকো। হঠাৎ—হাওয়ার ঝলকানিতে যেটুকু বাস পাও মহুয়ার সেটুকুই ঢের—এর বেশি আশা করোনা, ভুলেও চেয়ো না। ভুলে যেয়ো না যে তুমি শালা দুখন মিস্ত্রির ভাই সুখন মিস্ত্রি। যা পেয়েছ তার স্মতিটুকুই বুকে করে রেখো, রোমন্থন কোরো—গায়ের লোম—পড়া দহের পাঁকে গা—ডুবানো বুড়ো মোষ যেমন করে জাবর কাটে, তেমনি করে—এর বেশি কিছু এই পোড়া জীবন থেকে তোমার পাবার নেই।
৯
মনের মধ্যের সুখনজনিত লুকোনো অথচ তীব্র আনন্দটা মহুয়াকে আধো—ঘুমে আধো—জাগরণে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল, হাওয়ায় ভেসে যাওয়া সেগুন পাতাদের সঙ্গে।
কিন্তু মধ্য রাতে সেই আনন্দ যখন বিঘ্নিত হয়েছিল, হঠাৎ তলা—ফেঁসে যাওয়া নৌকোর মতো মনে মনে ও তলিয়ে গেল। পরক্ষণেই ফেঁসে—যাওয়াটা মিথ্যে এবং ভেসে—যাওয়াটাই সত্যি এ—কথা জানতে পেরে ও আবার আনন্দিত হয়েছিল।
কিন্তু ঘুম ভাঙতেই দেখল বেলা অনেক, শরীর মন সবই ক্লান্তিতে এবং আলস্যে ভরা।
হঠাৎ চোখ মেলে, শূন্য মস্তিষ্কে উপরে মাকড়সার জাল—ঝোলা টালির ছাদে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ বুঝতে পারল না যে, ও কোথায়? তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল; স—ব কিছু। মস্তিষ্কের শূন্যতা আস্তে আস্তে পাখির ডাকে, রান্নাঘরের শব্দে, লাটাখাম্বার জল ওঠার ক্যাঁচোর—কোঁচরে—এই সমস্ত টুকরো টুকরো শব্দের ঝুমঝুমিতে ভরে গেল। লাল—কালো কুঁচফলের মতো চোখের সামনে দেখতে লাগল গতকালের স্নিগ্ধ রঙিন মুহূর্তগুলিকে। স্যাকরার নিক্তির মতো, ও নিজের বিবেক—বুদ্ধি—বিবেচনার পাল্লার একধারে সেই সব উজ্জ্বল মুহূর্তগুলিকে বসাল আর অন্যদিকে বসাল তার একান্ত মেয়েলি বাস্তব ও সাংসারিক বোধকে। দেখল, গতকালের মুহূর্তগুলির সমষ্টির ঔজ্জ্বল্য চোখ—ভরানো, মন—ভরানো; কিন্তু তার ভার কম।
মহুয়া জানল যে, তাকে আজ কুমার ও তার বাবার সঙ্গে চলেই যেতে হবে।
সুখ বাসের জানলায় বসে বাইরে চেয়েছিল। মান্দার পেরিয়ে এসেছে। একটু পর রাতু হয়ে রাচী পৌঁছবে সুখন। ভোর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। বাইরে চেয়ে নিদ্রাহীন চোখে অনেক কিছু ভাবছিল ও।
ভাবছিল, কাল বিকেল ও রাতের কথা। ও জানে, এই ভাবনাটুকু ছাড়া তার নিজের বলতে আর কিছুই রইবে না। সবই চুরি হয়ে যাবে। ভাবনার মধ্যে একটি মুখ, একরাশ রেশমি চুল, দুটি দীঘল কালো চোখ, চিকন চিবুক, ঠোঁটের ছোট কালো তিলটি বারে বারে বহু দিন বহু বছর তার ঘুম কাড়বে; একটা চাপা অসহায় যন্ত্রণা বোধ করবে ও সব সময়। কাজের মধ্যে তাকে অন্যমনস্ক করে দেবে। হয়তো এমনি কোনো অন্যমনস্ক মুহূর্তেই বুকে ইঞ্জিনব্লক চাপা পড়ে তার দাদার মতো সুখনও মারা যাবে। কিন্তু তবুও ভাবনাটুকু ছাড়া তার আর কোনো কিছুই রইবে না থাকার মতো, তার নিজের বলতে।
মহুয়া মুখ—টুক ধুয়ে বারান্দায় এসে বসল।
মংলু চা দিয়ে গেছিল। রান্নাঘরের চালে বসে একটা কাক ডাকছিল।
চা—এর গেলাস হাতে নিয়ে বসে উদাস চোখে দূরে চেয়ে মহুয়ার মন এক বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল।
এখানে এসেছিল পরশু রাতের অন্ধকারে। আজ বোধহয় দুপুরেই চলে যাবে। সবসুদ্ধু আটচল্লিশ ঘণ্টাও নয়। অথচ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যেন চিরদিন এখানেই ও থাকত। এত সহজে, এত স্বল্প সময়ে এক একটা জায়গার উপর কী করে যে এমন মায়া পড়ে যায় তা ভাবলে আশ্চর্য লাগে।
মংলু এসে দাঁড়াল। হাসল একগাল। শুধোল, ‘নাস্তা কী হবে?’
মহুয়া চমকে উঠল। হাসি পেল ওর। যেন এ ওরই সংসার। নাস্তা কী হবে, দুপুরে কী হবে এসব যেন মহুয়া না বললে চলছিল না।
মহুয়া বলল, ‘মংলু, তোর ওস্তাদ কী কী খেতে ভালোবাসে রে?’
মংলু অবাক হল প্রথমটা—তারপর অনেক ভেবে—টেবে বলল, ‘ওস্তাদ কিচ্ছু, ভালো—টালো বাসে না।’ তারপরই বলল, ‘এঁচড়ের তরকারি।’
মহুয়া হেসে ফেলল ওর বলার ধরন দেখে। তারপর শুধোল, ‘এখানে এঁচড় পাওয়া যায়?’
—রঙের মিস্ত্রির বাড়ি একটা কাঁঠাল গাছ আছে। তবে ভালো হয় না এখানে কাঁঠাল। যদি বলেন তো খোঁজ করতে পারি এঁচড় ধরেছে কিনা।
মহুয়া উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘যা না এক দৌড়ে; দেখে আয়।’
— এখন? মংলু দ্বিধায় পড়ে বলল।
—কেন, এখন যেতে অসুবিধা?
—না। তবে বাবুরা বেড়াতে গেলেন—ফিরে এসেই তো নাস্তা করবেন, নাস্তার বন্দোবস্ত করতে হবে তো।
—সে আমি করছি। তুই যা না।
মংলু চলে গেলে মহুয়া ভাবল—যেমন বাবা, তেমন কুমার। সব সময় কী ভাবে, কেমন করে খাবে এই ভেবেই দিন কাটিয়ে দিল।
রান্নাঘরে গিয়ে অনেকগুলো ডিম একসঙ্গে ভেঙে ওমলেট বানাবে বলে কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, আদা কুঁচি এসব কেটে ফেটিয়ে রাখল। চিজ থাকলে চিজ ওমলেট বানাতে পারত। গতরাতের মুরগি ছিল কিছু; মহুয়া ও সুখন কেউই খায়নি। দুটো ঠ্যাং থেকে মাংস ছাড়িয়ে কিমা মতো করে নিয়ে ও ঠিক করে রাখল। আটা মেখে রেখেছিল মংলু—লেচি বানিয়ে রাখল মহুয়া। তারপর আলু আর কুমড়ো কাটল একটি ছেঁচকি মতো বানাবে বলে। তারপর সব ঢেকে—ঢুকে রেখে সুখনের ঘরে এল।
সত্যি! ঘর না যেন একটা কী! একেই বোধ হয় বলে ব্যাচেলারস ডেন।
কাল সন্ধেয় সুখনের রোমশ বুকে শুয়ে থাকার সময় ও যেমন একটা উগ্র অথচ মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিল, সারা ঘরে সেই গন্ধই ছড়িয়ে আছে। হাওয়ায় ভাসছে। বাঘের মতো প্রত্যেক পুরুষের গায়েই বোধ হয় একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। বাবার গায়ের গন্ধ মহুয়া চেনে। বাবার ছাড়া—জামাকাপড় ধোপাবাড়ি পাঠাতে, কাচতে দেবার সময় সে গন্ধটা চিনেছে মহুয়া। কিন্তু সুখনের গায়ে অন্যরকম গন্ধ। বুনোফুলের মতো; ঝাঁঝালো।
মহুয়া ঠিক করল চলে যাবার আগে আজ নিজে হাতে সুখনের ঘরটা মনোমতো সাজিয়ে দিয়ে যাবে। ফুলদানির বিকল্প, সুখনের ঘরের ভাঙা কাচের গেলাসে ফুলসুদ্ধ একটা মহুয়ার ডাল আনিয়ে রেখে যাবে। মহুয়া চলে যাবার পরও যেন ওর গন্ধ থেকে যায় সুখনের গন্ধের সঙ্গে।
সুখনের খাটের উপর বসল মহুয়া। বুকের মধ্যে ভারী একটা চাপা কষ্ট বোধ করতে লাগল। বাবাকে বলে সুখনের জন্যে কলকাতায় একটা চাকরির বন্দোবস্ত যে করতে পারে না মহুয়া তা নয়, কিন্তু প্রথমত সুখন তা গ্রহণ করবে না বলেই মহুয়ার বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত—এই পরিবেশে থেকে—এই শাকুয়া—টুঙ, পলাশ, টুঁই পাখিদের এলাকা থেকে সুখনকে উপড়ে নিয়ে গেলে সুখন আর এই—সুখন থাকবে না। তা করে কোনোই লাভ নেই।
মহুয়া ভাবছিল সুখন কী চিঠি লিখবে ওকে? যদি না লেখে? চিঠি লিখবে না সুখ? তাহলে এই হঠাৎ—নামা, হঠাৎ—থাকা হঠাৎ—ঘটা ঘটনাগুলো ঘটার কী দরকার ছিল?
কাঁচা রাস্তা ধরে গুঞ্জার দিকে বেড়াতে গেছিলেন সান্যাল সাহেব ও কুমার। বেরিয়েছিলেন অনেকক্ষণ। এখন ফিরে আসছেন।
সান্যাল সাহেব বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, তোমাকে যা বলছিলাম; মাঝে মাঝে এ—রকম কষ্ট করা ভালো। এ—রকম ভাঙা টালির ঘর, নোংরা আন—অ্যাটাচড বাথরুম, নানারকম অসুবিধা—এতে পারসপেকটিভটা অনেক ব্রডার হয়।’
কুমার চুপ করে ছিল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ছোটোবেলার কথা। বস্তির মধ্যে ওদের ঘর। দাওয়ায় বসে মুড়ি—খাওয়া।—টু হেল উইথ পারসপেকটিভ!
কুমার কথা ঘোরাল। বলল, ‘যাক, আপনি তখন ঠিকই বলছিলেন; রাফিং হয়ে গেল জবরদস্ত। এখন দেখুন সে ব্যাটা মিস্ত্রি আজও ডোবায় কিনা। এদিকে বেতলাতে ঘর পাওয়া গেলে হয়। এতদিন কী আর ওরা আমাদের জন্যে ঘর রেখে দিয়েছে?’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আরে চলো, বন্দোবস্ত একটা হবে।’
কুমার বলল, ‘হ্যাঁ, যেখানেই হোক এর চেয়ে অন্তত ভালো অ্যাকোমোডেশান পাওয়া যাবে।’
সান্যাল সাহেব স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘যতই ভাবছি, ব্যাপারটা খুবই অবাক করছে আমায়।’
‘কোন ব্যাপারটা?’ কুমার শুধোল।
—এই মহুয়ার ব্যাপারটা।
‘কোনটা?’ তাড়াতাড়ি শুধোল কুমার। একটু ভয়ও পেল।
বুড়ো কী রাতে জেগেছিল নাকি?
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘মহুয়ার এই এডাপ্টেবিলিটির ক্ষমতা।’
তারপর বললেন, ‘মেয়ে যে আমার এমন সুন্দর মানিয়ে নেবে তা কল্পনারও অতীত ছিল। ওর মধ্যে খুব একটা শিক্ষার জিনিস দেখলাম। জীবনে সব কিছু মানিয়ে নিয়ে, মেনে নিয়ে তার মধ্যে থেকে আনন্দ নিংড়ে নেবার ক্ষমতাটা একটা দারুণ গুণ।’
কুমার বলল, ‘তা যা বলেছেন। তবে আপনি ইনডায়রেক্টলি আমাকে যাই—ই বলার চেষ্টা করুন না কেন, আমি ওই ভাঙা গেলাসের কেলে ও পুরোনো—মোজার গন্ধের চা, ছারপোকা—ভরা মোড়ায় বসা—এ—সবই মানিয়ে নিতে রাজি আছি, মানিয়ে নিয়েওছি; কিন্তু ওই অ্যারোগ্যান্ট মিস্ত্রিকে মানিয়ে নিতে বলবেন না আমায়।’
সান্যাল সাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘জানো কুমার যত লোক আমরা দেখি তারা কেউই খারাপ নয়। এমনকী অন্ধকারতম চরিত্রের মধ্যেও একটা আলোকিত জায়গা থাকে। আসল কথাটা হচ্ছে, এই আলোকিত জায়গাটা আবিষ্কার করা। আবিষ্কার করে ফেলতে পারলে দেখবে যে, পৃথিবীতে সকলেই তোমার বন্ধু, বশংবদ; শত্রু তোমার কেউই নয়। কোনোই গুণ নেই এমন মানুষ কী কেউ আছে? আর দোষ নেই এমনও তো কেউ নেই। দোষগুলো ভুলে গুণ দেখলেই যে—কোনো মানুষের মধ্যেই একটা চমৎকার মানুষকে আবিষ্কার করা যায়।’
কুমার মনে মনে বলল, মাই ফুট। বৃদ্ধ—ভাম আবার জ্ঞান দিতে শুরু করেছে।
কুমারের নীরবতাকে সম্মতি ভেবে ভুল করে সান্যাল সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘সেদিন আমার বন্ধু ভ্যাবলা রায়, ভ্যাবলা রায়কে চেনো তো? ইনকাম—ট্যাকসের বাঘা অ্যাডভোকেট, আমাকে একটা বই পড়তে দিয়ে গেছিল। জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তির লেখা। বইটা পড়ে আমি রীতিমতো চমকে গেছি। উনি বলছেন যে, আমরা সকলেই হয় ভবিষ্যতের জন্যে বাঁচি অথবা অতীতের স্মৃতি মন্থন করে, কিন্তু বাঁচা উচিত শুধু বর্তমানে। কারণ বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তের মালা গেঁথেই জীবন।’
কুমার মনে মনে বলল, খেয়েছে। আবার মালা—ফালা গাঁথতে লেগেছে বুড়ো। সকাল থেকেই মনে হচ্ছে আজ দিনটা খারাপ যাবে।
একটা লোক একটা হাঁড়ি মাথায় নিয়ে টাঁড় পেরিয়ে যাচ্ছিল। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার জন্যে প্রায় বেপরোয়া হয়ে কুমার হঠাৎ তাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘হাঁড়িমে কেয়া হ্যায় তাড়ি?’
‘নেহী বাবু’।—লোকটা অনিচ্ছাসহকারে বলল। তারপরেই সাহেবি পোশাক পরা দুজন লোককে আসতে দেখে আবগারি অফিসার—টফিসার ভেবে টাঁড় পেরিয়ে ভোঁ—দৌড় লাগাল। দৌড় লাগাবার আগে বলে গেল, ‘কুচ্ছু নেহী, ইসমে কুচ্ছু নেহী হ্যায়।’
কুমার তার বাঁশপাতার মতো শরীর থেকে একটা বাজখাঁই আওয়াজ বের করে বলল, ‘অ্যাই। ইধার আও! ইধার আও।’
লোকটা ততক্ষণে ওধারে চলে গিয়ে উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার করেছেও হয়তো বা কুমারকে সান্যাল সাহেবের হাত থেকে।
কুমার বলল, ‘একটু খেজুরের রস পেলে খাওয়া যেত।’
—কোথায় আর পাবে!
‘তাই—ই তো ভাবছি’, কুমার বলল।
মহুয়া সুখের ঘর গোছাতে লাগল। দেখতে দেখতে সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলল ঘরটা। বিছানার চাদর, জামা—কাপড় সব বের করে বারান্দায় রাখল। আজ নিজে—হাতে কেচে দেবে যাওয়ার আগে। সুখ ওকে অনেক সুখ দিয়েছে; মনের সুখ, শরীরের সুখ। ওর জন্যে এইটুকু না করলে, না করে যেতে পারলে বড়ই ছোট লাগবে নিজেকে।
সান্যাল সাহেব ও কুমার বেড়িয়ে ফিরলেন। মংলুও ফিরল হাতে একটা এঁচড় নিয়ে। কুমার দেখেই আঁতকে উঠল। ‘এ কি, এঁচড়? এঁচড় কী ভদ্রলোকে খায়? আজ কী এঁচড় রান্না করবে নাকি তুমি?’ বলেই মহুয়ার দিকে তাকাল।
মহুয়ার আজ সকাল থেকেই ইচ্ছে করছিল যে, কুমারের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। কিন্তু কুমার কোনো সুযোগ দিচ্ছে না।
মহুয়া বলল, ‘ছোটলোকরাই না—হয় খাবে, ভদ্রলোকরা না খেলেই তো হল।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘এই যে মংলু; তাড়াতাড়ি নাস্তা লাগাও তো বাবা। বহুত ভুক লাগা হ্যায়।’
তারপর কুমারের দিকে ফিরে বললেন, ‘জায়গাটার গুণ আছে—জল হাওয়া খুবই ভালো—দেড়—দিনেই কেমন বেটার ফিল করা যাচ্ছে, তাই না?’
কুমার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘হ্যাঁ। জল আর হাওয়া ছাড়া আর কিছুই তো এখানে নেই। তাই জল—হাওয়াও যদি ভালো না হত তবে তো বিপদের কথা ছিল।’
কিছুক্ষণ পর ওরা মুখ—হাত ধুয়ে বারান্দায় বসেই নাস্তা করছিল। মহুয়া ও মংলু তদারকি করছিল। কুমার বলল, ‘এ—রকম প্রিমিটিভ হাউসওয়াইফের মতো শেষে খাওয়ার মানে নেই। বসে পড়ো আমাদের সঙ্গে, বসে পড়ো।’
মহুয়া বলল, ‘ঠিক আছে। আপনারা খান না। সামনে বসে খাওয়াতে ভালো লাগে আমার।’
কথাটা বলতে বলতেই, মহুয়ার চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে এল। কাল বিকেলে, তার সামনে মাটির দাওয়ায় আসন—পিঁড়ি হয়ে বসে—থাকা একজন পূর্ণবয়স্ক শিশুর কথা মনে পড়ল।
কথাটা শুনে কুমারের ভালো লাগল। ও ভাবল, কাল রাতের পরই মহুয়া ওর সঙ্গে খুবই অ্যাটাচড ফিল করছে। ইট ওয়াজ আ গ্রেট এক্সপিরিয়েন্স—যদিও একতরফা।
কুমার চোখ তুলে মহুয়ার চোখে তাকাল। বলল, উ্য আর রিয়েলি গ্রেট।
মহুয়া কুমারের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল।
কাল ঘরের মধ্যে ঘুমের ঘোরের গ্লানি, লজ্জা এবং হয়তো ঘৃণাও তার মনে ছেয়ে এল। ওর মনে হল, সুখ হচ্ছে গিয়ে ডাকাত; আর এটা একটা ছিঁচকে চোর। লুণ্ঠিতই যদি হতে হয়, তাহলে ডাকাতের হাতে হওয়াই ভালো।
হঠাৎ কুমার বলল, ‘মংলু, যা তো একবার দেখে আয় তোর ওস্তাদ এল কি না। গাড়িটা যে কখন ঠিক হবে তার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।’
মংলু চলে যেতেই, কুমার বলল, ‘আমাদের হাবভাব দেখে মিস্ত্রি ভাবছে আমাদের এখান থেকে নড়ার ইচ্ছে নেই—কী যেন মধু পেয়েছি আমরা—এমনই মধু যে দু’ বেলা বারান্দায় কাঙালিভোজনের মতো করে চেটেপুটে খেয়ে আমরা দিব্যি আনন্দে আছি—আমাদের যেন ফ্রন্ট গিয়ার, রিভার্স গিয়ার সবই অকেজো হয়ে গেছে। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা।’
একটু পর মংলু এসে বলল, ‘ওস্তাদ ফিরে এসেছে। গাড়ির কাজ শুরু হয়েছে। ওস্তাদ নিজে তো আছেই, আরও চার—পাঁচজন মিস্ত্রি হাত লাগিয়েছে। বেলা একটার মধ্যেই গাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।’
কুমার চেঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘থ্রী চিয়ারস ফর মংলু। হিপ—হিপ—হুররে, হিপ—হিপ—হুররে, হিপ—হিপ—হুররে।’
পরক্ষণেই খুশি—খুশি গলায় হিন্দিতে বলল, ‘মংলু, গরম গরম পরোটা লাও।’
সান্যাল সাহেবকেও খুশি খুশি দেখাল। এই দেড় দিনের গতিহীনতা তাঁর মধ্যে কেমন একটা স্থবিরত্ব এনে ফেলেছিল। আবার গাড়ির সামনের সিটে বসবেন, আবার হাওয়া লাগবে চোখে—মুখে, কত নূতন পথ, মোড়, পাহাড়, বন—ভালো—লাগা। সবচেয়ে আশ্বস্ত হলেন তিনি মনে মনে এই ভেবে যে, এই সুখন মিস্ত্রির খপ্পর থেকে মহুয়াকে উদ্ধার করে নির্ভাবনায় এবার কুমারের জিম্মায় দেওয়া যাবে। সুখন মিস্ত্রির উপর রাগ কুমারের যতটা না ছিল, তাঁর ছিল তার চেয়েও বেশি। আসলে কুমারের খুব অ্যাডমায়ারার হয়ে গেছেন তিনি কাল রাতে সুখনকে চড় মারার পর। ছোকরার বাহাদুরি আছে। লিকপিকে হলে কী হয়, মেরে তো দিল চড়! ওই চড়টা মারবার ইচ্ছে ছিল তাঁরই। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অন্তর ও বাহিরের মধ্যে একটা ব্যবধান রচনা করে এসেছেন তিনি। মনে যাই—ই থাক, মুখে কিছু বলেননি কখনও; কাউকেই। মন আর মুখ এক করা ব্যাপারটা তিনি মূর্খামি ও ব্যাড স্ট্রাটেজি বলেই চিরদিন বিশ্বাস করে এসেছেন।
সুখনকে কিছু বলতে পারেননি, পাছে মহুয়া তাঁকে বুঝে ফেলে। মহুয়ার চোখের সামনে তাঁকে সব সময় একটা নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে থাকতে হয়েছে। সান্যাল সাহেব জানেন যে, অভিনয়টা তিনি ভালোই বোঝেন এবং কুমার যতই লাফাক—ঝাঁপাক না কেন, বুদ্ধির জোরে তিনি কুমারকে ট্যাঁকে করে নিয়ে এক হাট থেকে অন্য হাটে গিয়ে বিক্রি করে আসতে পারেন। ”শো অফ এমোশনস” কোনো বুদ্ধির লক্ষণ নয়। সেন্টিমেন্ট, এমোশন এসব বাজে বোধ তাঁর কখনও ছিল না। ঠান্ডা মাথায় দাবার চাল চেলে এসেছেন তিনি সব সময়—অনেক হাতি ঘোড়া নৌকো উলটেছেন আজ অবধি।
পরোটাতে ওমলেট জড়াতে জড়াতে ভাবছিলেন সান্যাল সাহেব যে, একমাত্র একটা চালেই তিনি ভুল করেছিলেন জীবনে। সে শ্যামলীকে দেওয়া চাল। শ্যামলী, একমাত্র সে—ই, তাকে বড় বোকা বানিয়ে দিয়েছিল এ জীবনে। শোধ তোলার উপায়ও নেই আর।
মহুয়াকে তিনি ভালোই বোঝেন। এই জেনারেশানের ছেলেমেয়েদের জানতে তাঁর আর বাকি নেই। সুখন মিস্ত্রিকে মহুয়াই যে নাচিয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কালকে মহুয়ার অন্তর্ধানের মানে সান্যাল সাহেব বিলক্ষণ বুঝেছিলেন; প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন। মহুয়া সারা সন্ধে ওই মিস্ত্রির সঙ্গেই ছিল, সে বিষয় কোনো সন্দেহই নেই সান্যাল সাহেবের। মিস্ত্রির সঙ্গে মহুয়ার একটা অ্যাফেয়ার যে হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু ঠিক কতখানি গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে তা উনি জানেন না—তবে কুমার যা বলেছিল তা ঠিকই। সময়টা নিশ্চয়ই খারাপ কাটেনি মহুয়ার।
এইসব কারণে, গাড়ি সারানো হচ্ছে, গাড়ি একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, এই খবরে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন তিনি। জীবনে পরের বউ ভাগিয়ে এনে এক স্ক্যান্ডাল করলেন। তারপর সেই বউ অন্য লোকের সঙ্গে চলে গিয়ে আর এক স্ক্যান্ডাল করল। তার উপর মেয়ে মোটর—মিস্ত্রির সঙ্গে চলে গেলে সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি। সেদিক দিয়ে শ্যামলী তার মুখোজ্জ্বলই করেছে বলতে হবে। পালিয়েছে তো কোম্পানির ফরাসি ডিরেকটরের সঙ্গে। চলে যাওয়ার পরে লোকে বলেছে—শ্যামলীর তাহলে রূপ—গুণ কী একবার ভেবে দেখো! সে মেয়ে যে একদিন তোমার সঙ্গে ছিল এই—ই তো যথেষ্ট সম্মান তোমার।
কিন্তু সেই পরিপ্রেক্ষিতে মহুয়া যদি সুখন মিস্ত্রির সঙ্গে এখানে থেকে যেত, তাহলে কী যে হত ভাবতেই পারেন না সান্যাল সাহেব। স্ক্যান্ডাল বড় ভয় করেন তিনি। ঘোমটার নীচে খ্যামটা নাচো। জানছে কে? লোকসমাজে না জানিয়ে যা খুশি করো না! আপত্তির কোনো কারণ দেখেন না তিনি। কিন্তু এ সব কী?
মহুয়ার দিকে চেয়ে নরম গলায় সান্যাল সাহেব বললেন, ‘এবারে চান—টান করে তাহলে তুই খেয়ে নে মা।’
তারপরেই কুমারের দিকে ফিরে বললেন, কখন বেরোবে ঠিক করেছ কুমার?
কুমার বলল, একটায় গাড়ি ঠিক হলে, তখনই বেরিয়ে পড়া যাবে।
‘বেতলা এখান থেকে ক’ঘণ্টা?’ সান্যাল সাহেব শুধোলেন।
‘মিস্ত্রি তো বলছিল দু—আড়াই ঘণ্টার রাস্তা।’ কুমার বলল।
—তা হলে তো দুপুরটা রেস্ট করে বিকেল বিকেল বেরোলেই হয়।—মহুয়া কী বলিস?
মহুয়া নীচু, অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘আমার কিছু বলার নেই। তোমরা যা বলবে।’
কুমার খাওয়া শেষ করে বলল, ‘মহুয়া, তুমি চান—টান করো। ততক্ষণে আমরা গিয়ে গাড়ির কাজ একটু তদারকি করি। যা ঢিলে লোক—ওর উপর ছেড়ে দিলে আবার কী ঘটবে কে জানে?’
সান্যাল সাহেব ও কুমার কারখানার দিকে চলে গেলেন। মহুয়া মংলুকে রান্নাঘরের বারান্দায় খেতে বসাল। মহুয়া মংলুকে ভালো করে আদর করে খাওয়াচ্ছিল। মংলু অভিভূত হয়ে পড়েছিল। এরকম আদর—যত্নে ও অভ্যস্ত নয় মোটেই।
মহুয়া বলল, ডিমটা নে আর একটু।
মংলু বলল, আপনি না খেলে আমি খাব না।
মহুয়া ধমক দিল। বলল, ‘আমি বড় না তুই বড়? কথা শুনতে হয়।’
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তোর ওস্তাদ রাতে কিছু খেয়েছে?
—নাঃ। জর্দা পান শুধু।
—একটু পরে গিয়ে ওস্তাদকে ডেকে আনবি। তোর ওস্তাদ খেলে তবে আমি খাব।
মংলু বলল, ‘আমি যেতে পারব না। আমাকে মারবে ওস্তাদ। তার উপর তোমাদের সঙ্গের ওই বাবু থাকবে তো সঙ্গে—কে যাবে ওর সামনে?’
‘আমি চিঠি দিয়ে দেব তোর ওস্তাদকে। আমার চিঠি পেলে নিশ্চয়ই আসবে।’—আত্মবিশ্বাসের গলায় বলল মহুয়া।
মংলু বলল, ‘তা আসবে। আপনি আসতে বললে আসবে।’
একটু পর মংলু বলল, দিদিমণি, আপনি থেকে যান না এখানে?
মহুয়া বলল, এ কথা বলছিস কেন?
মংলু বলল, ‘আপনাকে খুব ভালো লেগেছে বলে। আর জানেন দিদিমণি, আপনার কথা ওস্তাদ যা শোনে আর কারও কথাই তেমন শোনে না। আপনি থাকলে ওস্তাদ আর সকলের উপর ওস্তাদি করতে পারবে না। ওস্তাদেরও একজন ওস্তাদ হবে।’
মহুয়া চোখ দিয়ে হাসছিল, বলল, ‘আমি কোথায় থাকব?’
—কেন? তোমরা যে ঘরে আছো এখন, সে ঘরে। তুমি দেখো তোমার কোনো অযত্ন করব না আমরা। দুপুরে রোজ আমি আর তুমি লুডো খেলব। খুব মজা হবে, তাই না?
‘হু।’ মহুয়া বলল। তারপর বলল, ‘থাকতে পারলে বেশ হত।’
মংলুর খাওয়া হয়ে গেলে, মহুয়া সুখের ঘর থেকে কাগজ আর ডট পেন নিয়ে একটা ছোট্ট চিঠি লিখল—
”সুখ,
আপনার জন্যে খাওয়ার নিয়ে বসে আছি আপনার ঘরে। একবার এখুনি আসবেন।
—মহুয়া”
মংলু মুখ—টুখ ধুয়ে চিঠিটা নিয়ে কারখানায় চলে গেল। তারপর ওস্তাদকে ডেকে নিয়ে চিঠিটা দিল।
সুখন চিঠিটা পড়েই ছিঁড়ে ফেলল। সুখনের না—কামানো খোঁচা—খোঁচা দাড়ি রোদে মাটিতে ধুলোতে ঘামে বিচ্ছিরি চেহারা, রাত—জাগা লাল—লাল চোখ দেখে মংলু ভয় পেল।
সুখন বলল, ‘এখন সময় নেই কোথাও যাবার। আগে গাড়ি সারাব; তারপর অন্য সব। বলে দিস গিয়ে।’
মংলু আর কথা বাড়াল না। মহুয়াকে এসে সব বলল।
মহুয়া ভীষণ ক্ষুব্ধ হল। মহুয়া ভেবেছিল তার নিজের হাতের লেখা চিঠি এবং নিরিবিলিতে তারই একা—ঘরে আমন্ত্রণ জানাবার মানে বুঝবে সুখ। মহুয়া অনেক কিছু কল্পনাও করে নিয়েছিল। কল্পনা করছিল যে, সুখ ঘরে ঢুকেই তার সবল হাতে ওকে জড়িয়ে ধরবে, আদর করবে; মহুয়া ভালো—লাগায় মরে যাবে।
খুব রাগ হল মহুয়ার।
মংলু শুধোল, ‘যাবেন না দিদিমণি? চলুন, আপনার খাবার দিই।’
মহুয়া বলল, ‘না। কিছু খাব না আমি। আমাকে এক কাপ চা করে দে তো মংলু।’
একা ঘরে, সুখনের ঘরময় পায়চারি করতে করতে অভিমানে মহুয়ার দু’ চোখ জলে ভরে এল। লোকটা সত্যিই জংলি, অভদ্র; মেয়েদের সম্মান করতে জানে না।
চা—টা খেয়ে, মহুয়া এক সময় এঁচড়ের তরকারিটা নিজে হাতে রাঁধবে বলে রান্নাঘরে গেল। ঠিক করল তরকারি রেঁধে তারপর ভিজানো কাপড়গুলো কেচে দেবে।
সুখন ও আরও তিনজন মিস্ত্রি কাজ করছিল। মিস্ত্রিরা যত তাড়াতাড়ি পারে হাত চালিয়ে কাজ সারছিল। কারখানার মধ্যে নিমগাছের ছায়ায় একটা ভাঙা মাডগার্ডের উপর বসে কুমার তদারকি করছিল কাজের।
একটা ছোকরা মিস্ত্রি বনেটের উপরে রাখা রেঞ্জটা তুলে নেবার সময় হাত ফসকে সেটা বনেটের উপর পড়ে যেতেই সেখানের রঙটা সামান্য চটে গেল এবং একটা টোল মতো পড়ে গেল।
কুমার এক লাফে এগিয়ে এলে বলল, ‘করছ কী? এটা কী হল? এই যে কলকাতার মির্জার গ্যারেজ থেকে রং করিয়ে নিয়ে এলাম সদ্য, আর রং যে চটালে বড়? যত সব গেঁয়ো উজবুক—বুড়বাকের দল।’
ছোকরা মিস্ত্রিটা লাল চোখে একবার তাকাল কুমারের দিকে, কিন্তু কিছু বলল না। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সেই মিস্ত্রির হাত থেকে আবারও রেঞ্জটা বনেটের উপর পড়ল।
কুমারের মনে হল মিস্ত্রিটা যেন ইচ্ছা করে এবং আছাড় মারার মতো জোরে ওই ভারী রেঞ্জটাকে ফেলল। রেঞ্জটা পড়তেই একটা বড় টোল পড়ল বনেটে।
কুমার দৌড়ে এসে বলল, ‘বাস্টার্ড!’
কথাটা বলতেই, ছোকরা মিস্ত্রিটা এক লাফে চিতাবাঘের মতো এসে পড়ল কুমারের ঘাড়ে। তারপর এক বেদম চড় কষাল কুমারের গালে।
চড় কষাতেই কুমার থতোমতো খেয়ে পিছিয়ে গেল। সমস্ত কারখানার মিস্ত্রিরা কাজ থামিয়ে ওইদিকে চেয়ে রইল। দু’—একজন এগিয়েও এল।
ছোকরা মিস্ত্রি বলল, ‘আর একটা কথা বলেছ তো পেঁয়াজি বার করে দেব। শালা তেল দেখাতে এসেছ এখানে? দু’দিন ধরে তেল দেখাচ্ছ। এ জায়গার নাম ফুলটুলিয়া। এ তোমার কলকাতা নয়। এখানে মেরে, গুঁড়িয়ে, তোমার অ্যাশ ধরিয়ে দেব বুড়োর হাতে। কোথায় থাপ খুলতে এসেছ জানো না?’
মিস্ত্রিদের সকলের মুখ—চোখের অবস্থা দেখে কুমার নিজের দামি টেরিকটের প্রিন্টের শার্টের মধ্যে ধুকপুক—করা কলজেটাকে গুটিয়ে নিল।
ওর মুখ শুকিয়ে গেছিল। চড়টা বড় জোর মেরেছে ছোকরা। মনে হচ্ছিল ওর গালে কেউ লংকাবাটা লাগিয়ে দিয়েছে, এমনই জ্বলছিল গালটা।
ছোকরা মিস্ত্রি আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় সুখন জলদগম্ভীর গলায় বলল, ‘এ রামলাল, মেরে তোর খুপরি খুলে নেবো। কারখানার মধ্যে দাঁড়িয়ে খদ্দেরের গায়ে হাত? তোরা ভেবেছিস কী? আমি কী মরে গেছি?’
তারপরই কুমারের দিকে ফিরে কালিমাখা হাত দুটো জোড়া করে বলল, ‘মাপ করে দেবেন। আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। রেঞ্জটা ওর হাত থেকে অ্যাকসিডেন্টালি পড়ে গেছিল। যাই—ই হোক, আমি ক্ষমা চাইছি।’
সান্যাল সাহেব এতক্ষণ ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে এগিয়ে এসে সেই ছোকরা মিস্ত্রিটির কাছে গিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘তুমি বড় ছেলেমানুষ ভাই। অত সহজে মাথা গরম করে?’ তারপর কুমারের দিকেও ফিরে বললেন, ‘উ্য আর ভেরী আপসেট। এসো, এসো। বসে একটা সিগারেট খাও, কুমার। ডোন্ট গেট একসাইটেড। যা হবার তা হয়ে গেছে।’
কুমার সরে আসতে আসতে বলল, ‘আই উইল টিচ দিজ বাস্টার্ডস আ গুড লেসন—’
কুমারের কথা শেষ হবার আগেই সেই ছোকরা—মিস্ত্রিটি আবার মুহূর্তের মধ্যে উড়ে এসে কুমারের পেছনে কষে এক লাথি লাগাল। লাথি লাগিয়েই বলল ‘শালা তোর মাকে ডাক। এ জন্মের মতো চারদিকে দেখে নে ভালো করে—নাক ভরে মহুয়ার গন্ধ শুঁকে নে—তোর আজই শেষ দিন।’
সুখন এবার দৌড়ে গিয়ে ওদের মধ্যে পড়ল। পড়ে, ওকে টেনে আনল জামার কলার ধরে। বলল, ‘বড় রঙবাজ হয়েছিস তো তুই! আমি বারণ করা সত্ত্বেও তুই এমন করছিস?’
ছোকরা বলল, ‘তুমি ঠিক করছ না ওস্তাদ। আমরা কী মানুষ নই? ও শালা যা—তা গালাগালি করছে কেন ফের?’
সান্যাল সাহেব দেখলেন, পরিস্থিতিটা এমন হয়ে যাচ্ছে যে তাঁর মতো বিচক্ষণ মাথাঠান্ডা লোকের পক্ষেও এটা নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তিনি হাত জোড় করে থিয়েটারি কায়দায় দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘ভাই সব, আমি এর হয়ে ক্ষমা চাইছি। রাগের মাথায় একটা অন্যায় কথা বলে ফেলেছে। এর মাথা খারাপ হতে পারে, আমার তো হয়নি—আমি একে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’ বলেই তিনি কুমারকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন।
যেতে যেতে সান্যাল সাহেবের হাত—ধরা অবস্থাতেই কুমার আবারও চিৎকার করে হাত নাড়িয়ে গিলে—ফেলা অপমানটার হজমি দাওয়াইয়ের মতো বলল, ‘আমি তোমাদের দেখে নেব স্কাউন্ড্রেলস—পুলিশ না এনেছি তো আমার নাম নেই। এই ওস্তাদ সমেত সবগুলোকে আমি জেলে….।’
কথা শেষ করার আগেই সান্যাল সাহেব কুমারের মুখ চেপে ধরলেন।
কিন্তু মুখ চাপার আগেই মুখনিঃসৃত আওয়াজ মিস্ত্রিদের কানে পৌঁচেছিল। পৌঁছতেই একই সঙ্গে চার—পাঁচজন মিস্ত্রি ওদিকে দৌড়ে গেল। পুরোভাগে সেই ছোকরা মিস্ত্রিটি। তার হাতে একটা বড় রেঞ্জ—যে রেঞ্জ নিয়ে সে এতক্ষণ কাজ করছিল।
সুখন বিদ্যুৎবেগে তাদের আগে গিয়ে পৌঁছল। বলল, ‘কী করছিস রামলাল, কী করছিস; ছেড়ে দে ছেড়ে দে।’
কিন্তু সুখনের কথা শেষ হবার আগেই রামলালের ডানহাতটা রেঞ্জ সমেত ডান কাঁধের উপরে উঠে গেছিল। ততক্ষণে সুখন কুমারের পাশে গিয়ে পৌঁচেছে।
রামলালের হাতটা যখন প্রচণ্ড জোরে নেমে আসতে লাগল কুমারের মাথা লক্ষ্য করে, কুমার কুকুরের মতো ভয় পেয়ে বিদ্যুৎগতিতে মাথাটা নীচু করে সুখনের দু’ হাঁটুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
মুহূর্তের মধ্যে রেঞ্জটা এসে পড়ল সুখনের কপালে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে লাগল। দেখতে দেখতে রক্তে সুখনের মাথা, চোখ—মুখ, জামাকাপড় সব ভিজে গেল। সুখনের মাথার রক্ত দেখেই রামলাল রেঞ্জটা ফেলে দিয়ে সুখনকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনুতপ্ত গলায় বলল, ‘হা রাম, ম্যায় কা কিয়া ওস্তাদ, ম্যায় ক্যা কিয়া।’
সুখনের চোটটা মারাত্মক হয়েছিল। সুখন প্রায় অজ্ঞানাবস্থায় রামলালের কাঁধে ভর করে ঝুঁকে পড়ল। নইলে মাটিতে পড়ে যেত ও। সঙ্গে সঙ্গে অন্য মিস্ত্রিরা সুখনের সেই ছ্যাকরা গাড়িটা বের করে নিয়ে তাকে চত্তকের কম্পাউন্ডার বাবুর কাছে নিয়ে যাবে বলে বেরোল।
রামলালও সঙ্গে গেল। শেষ মুহূর্তে সান্যাল সাহেবও দৌড়ে এসে সার্কাসের ক্লাউনের মতো গাড়ির পা—দানিতে উঠে পড়লেন।
স্ট্র্যাটেজিক এবং টাইমলি মুভ।
গাড়িটা ছেড়ে দিতেই রামলাল জানালা দিয়ে মুখ বের করে কুমারকে বলল ‘ফিরে আসছি। তোমাকে শেখাব ফিরে এসে।’
সুখন গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘গাড়ির কাজ যেন বন্ধ না হয়—ও গাড়ি যত তাড়াতাড়ি পারো রেডি করো; আমি আসছি।’
মংলু গোলমাল শুনে কারখানায় দৌড়ে এসেছিল। মহুয়াও কাপড়—কাচা ছেড়ে এসে ভিজে কাপড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। মংলু এক দৌড়ে আবার ফিরে গিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে মহুয়াকে সব বলল।
কুমার ভয় ও আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে টলতে টলতে ফিরে এসে ঘরের মধ্যে দিনদুপুরেই হুইস্কির বোতল খুলে বসল।
মহুয়া খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে। চিড়িয়াখানায় লোকে যেমন গরাদের ফাঁক দিয়ে জংলি জন্তু দেখে, তেমন চোখে পূর্ণদৃষ্টিতে কুমারকে দেখল অনেকক্ষণ ধরে। মুখে কোনো কথা বলল না। তারপর ফিরে গিয়ে আবার কাপড় কাচতে লাগল।
কারখানার মিস্ত্রিরা বলল—এটা অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু ওস্তাদ যেমনভাবে বারবার অন্যায়কে সমর্থন করছিল, ওস্তাদকে মিস্ত্রিরা সকলে মিলেই এক সময় মারতে বাধ্য হত। আজ রামলালের হাত দিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে ভালোই হয়েছে। ওস্তাদ ভবিষ্যতে অন্যায়কে আর মদত দেবে না।
একজন বয়স্ক মিস্ত্রি বলল, ‘আরে ওস্তাদের ভীমরতি ধরেছে। অনেক ব্যাপার আছে।’ বলেই, এদিক ওদিক চেয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘ওই সুন্দরী বাঙালি মেয়েটার সঙ্গে ওস্তাদ ফেঁসে গেছে। শ্বশুরালের লোকের সঙ্গে লোকে কী খারাপ ব্যবহার করে? না করতে পারে?’
সেই মিস্ত্রির কথা শেষ হতে না হতে অন্য মিস্ত্রিদের মধ্যে চার—পাঁচজন সমস্বরে বলল, ‘এই গফুর, সাবধানে কথা বল। আমরা তোর মুখ ভেঙে দেব। শালা নেমহারাম। ওস্তাদ না থাকলে এতদিন যক্ষ্মায় মারা যেতিস, এই তোর কৃতজ্ঞতাবোধ! তুই শালা এক নম্বরের নেমকহারাম।’
কম্পাউন্ডার ইঞ্জেকশন দিয়ে ভালো করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘বেশ সাবধানে থাকতে হবে। কাজকর্ম ক’দিন বন্ধ। কোনোরকম স্ট্রেইন নয়। একেবারে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে দিনকয়েক।’ সঙ্গে আরও কীসব ওষুধ—টষুধ দিলেন খাওয়ার জন্যে।
সুখন যখন ফিরে এল কারখানায়, তখন রামলালও গাড়ি থেকে নেমে কানে হাত দিয়ে নিজের থেকেই ওঠ—বোস করল। বলল, ‘ওস্তাদ, মাপ করে দাও ওস্তাদ।’
সান্যাল সাহেব কম্পাউন্ডারবাবুকে টাকা দিতে যাচ্ছিলেন; কিন্তু মিস্ত্রিরা দিতে দেয়নি। এখন কারখানায় ফিরে এসে সান্যাল সাহেব বেশ কিছুক্ষণ মিস্ত্রিদের সঙ্গে থাকলেন। এমনকি কখনও যা করেন না তাই করলেন। এক মিস্ত্রির দেওয়া দুটো পান টিপিক্যাল কেরানির মতো খেলেন। একজনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে বিড়িও খেলেন একটা। যখন ওঁর মনে হল অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত তখন উনি বাড়ি যাবেন বলে পা বাড়ালেন। চলে যাবার আগে সুখনকে বললেন কাঁধে হাত দিয়ে, আপনি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়বেন চলুন।
সুখন গাছতলায় মাটিতে বসেছিল। বলল, আমি ঠিক আছি। তারপর বলল, ‘আপনি যান। আমাকে থাকতে হবে। আপনাদের গাড়ির কাজ শেষ হয়নি এখনও।’
সুখনের মুখ দেখে মনে হল ওর খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে ওর।
সান্যাল সাহেব বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
কুমার চান—টান করেনি। অপমানটা তখনও হজম হয়নি ওর। সান্যাল সাহেব চান করে নিলেন। মহুয়াও আগেই চান করেছিল। রান্নাও হয়ে গেছিল। ওরা খেতে বসবে, এমন সময় সান্যাল সাহেবের হুঁশ হল যে মহুয়া ঘরে নেই। মংলুও নেই।
মহুয়া আর মংলু দুজনেই সুখনকে ধরে নিয়ে আসবার জন্যে কারখানায় গেছিল। সুখন পা ছড়িয়ে, নিমগাছে হেলান দিয়ে বসে খুব মনোযোগের সঙ্গে গাড়ি মেরামতির কাজ দেখছিল।
হঠাৎ সমস্ত মিস্ত্রির কাজ—থামানো দেখে ওদের চোখ অনুসরণ করে সুখন দেখল যে, মহুয়া আর মংলু বেড়ার কাছে দাঁড়িয়েছে এসে।
সুখন মহুয়াকে দেখে হাসল।
হাসতে ওর কষ্ট হচ্ছে, পরিষ্কার বোঝা গেল।
মহুয়া এগিয়ে এসে আদেশের স্বরে বলল, আপনার এখন ঘরে যেতে হবে।
এই আদেশের স্বরে সুখন অভ্যস্ত নয়। ও জানে, ওর মধ্যে একটা জানোয়ার বাস করে, যে কখনোই কারও আদেশেরই ধার ধারেনি। আদেশের গলায় কেউ কথা বললেই ওর রক্ত মাথায় চড়ে যায়। সে যেই—ই হোক।
সুখন ইশারায় মিস্ত্রিদের কাজ করতে বলল। মাথায় রক্ত ফুটে—ওঠা ব্যান্ডেজ—বাঁধা সুখনের সে চেহারা দেখে মহুয়ার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল!
সুখন মংলুর হাত ধরে উঠে, বেড়ার বাইরের একটা শিশুগাছের তলায় এসে দাঁড়াল। বলল, ‘মংলু, একটু চা করে নিয়ে আয় আমার জন্যে; দৌড়ে যা।’
মংলু চলে যেতেই মহুয়া আবার বলল, আপনাকে এখন ঘরে যেতেই হবে।
সুখনের মনে হল, মহুয়ার গলার স্বরে একটা গর্ব ঝরে পড়ছে। সুখনের জীবনে বোধ হয় ওর আগে ভালোবেসে আদেশ করার মতো কোনো লোক আসেনি। মনে মনে ক্ষমা করে দিল সুখন মহুয়াকে।
সুখন বলল, ‘ঘর মানে কী শুধুই একটা টালির ছাদ? ঘর মানে তো তার চেয়ে অনেক কিছু বেশি। ঘর মানে, ঘর মানে…।’
তারপর একটু থেমে বলল, ‘এই—ই আমার ঘরবাড়ি, এই—ই আমার সব; এই কারখানা আর মিস্ত্রিরা।’
মহুয়া অভিমানের গলায় বলল, ‘সকালে আসতে বলে চিঠি লিখে পাঠালাম, এলেন না কেন? কাল দুপুর থেকে খাননি। তার উপর এমন কাণ্ড। —কী যে করেন, ভালো লাগে না। আপনার দিকে তাকাতে পারছি না আমি। বাঁচাতে গেলেন কেন এমনি করে অন্যকে?’
তারপরই বলল, ‘না। আমি কোনো কথাই শুনব না। আপনাকে এখন আমার সঙ্গে যেত্তেই হবে। আমি নিজে—হাতে আপনার জন্যে এঁচড়ের তরকারি রান্না করেছি। আপনার আসতেই হবে। খেতেই হবে। রান্না কখন হয়ে গেছে। খেয়েদেয়ে ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতে হবে। এই বলে দিলাম।’
যেতেই হবে? সুখন বলল। তারপর একটু হেসে বলল, কীসের এত জোর আপনার আমার উপর?
—তা আমি জানি না। কিন্তু আমি জানি যে, আমার অনুরোধ আপনি ফেলতে পারবেন না।
সুখন অদ্ভুত হাসি হাসল। বলল, ‘জানেন? জানেনই যদি, তাহলে এত দ্বিধা কেন নিজের সম্বন্ধে?’
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘যান, লক্ষ্মী মেয়ে ফিরে যান, রোদ লেগে আপনার সুন্দর মুখটা লাল হয়ে গেছে। আর চলে যাওয়ার আগে চুপ করে এখানে একটু দাঁড়ান দেখি। কথা বলবেন না, নড়বেন না একটুও; আপনাকে শেষবারের মতো ভালো করে দেখি একবার।’
মহুয়া লজ্জা পেল, খুশি হল এবং খুব দুঃখিতও হল। বলল, তাহলে আপনি আসছেন না?
নাঃ।—বলল সুখন। বলেই মহুয়ার চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল।
হেরে—যাওয়া অপমানিত হওয়া মুখে চোখ—নামিয়ে মহুয়া বলল, আমরা একটু পরেই চলে যাব কিন্তু।
সুখন বলল, জানি।
—তবুও আসবেন না? আমার ঠিকানা নেবেন না আপনি।
না।—কাটাভাবে বলল সুখন।
—আপনি ভীষণ খারাপ, পচা আপনি। আপনি বড় দাম্ভিক, অবাধ্য।
সুখন নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, হয়তো তাই।
মহুয়ার চোখ ছলছল করে উঠল।
আবারও বলল, আপনি সত্যিই আসবেন না?
—না। এখন যেতে পারি না। অনেক কাজ। যাওয়া সম্ভব নয়।
মহুয়া বলল, আমি চললাম তাহলে। আর কিন্তু দেখা হবে না।
সুখন বলল, দাঁড়ান।
হঠাৎ ওর গলার স্বরটা কেমন কেঁপে গেল। সুখন বলল, ‘অমন করে যেতে নেই। একটু হাসুন তো দেখি। এই হাসি আবার কবে দেখতে পাব—পাব কিনা তাই—ই বা কে জানে? লক্ষ্মীটি, একবার হাসুন শেষবার।’
মহুয়া বলল, ইয়ার্কি, না? বলেই, হেসে ফেলল। এবং সঙ্গে সঙ্গে কেঁদেও ফেলল। ওর গাল গড়িয়ে জলের ফোঁটা নামল।
সুখনের বুকের মধ্যেটা হুহু করে উঠল। কিন্তু এখন কিছুই করবার নেই। মহুয়া ছেলেমানুষ হতে পারে, কিন্তু ও ছেলেমানুষ নয়। এখন দিনের সুস্পষ্ট আলো, কত লোকজন; বুদ্ধিবিবেচনা চারদিকে। কাল জঙ্গলের নির্জনতায় চাঁদের আলোয় যে ছেলেমানুষি ভুল করেছিল, আজ তার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। ও যে মহুয়াকে এক দারুণ ভালোবাসা বেসে ফেলেছে। সুখন যে মহুয়ার ভালো চায়।
সুখন চুপ করে মহুয়ার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মহুয়ার দু’চোখ জলে ভরে এল। মহুয়া আর দাঁড়াল না। বলল, ‘অসভ্য! আপনি একটা জংলি।’ বলেই মহুয়া চলে গেল।
যতক্ষণ না মহুয়া বেড়ায় আড়ালে চলে যায়, ততক্ষণ সুখন তার সুন্দর চলার ভঙ্গির দিকে চেয়ে রইল। মহুয়ার প্রতি মঙ্গল—কামনায়, ভালো—লাগায়, ভালোবাসায়, তার সুস্থ, বয়স্ক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মন কাণায় কাণায় ভরে উঠল এবং সেই সঙ্গে ওর মনের মধ্যে যে ছেলেমানুষটা বাস করে সেই মানুষটা ধুলোর মধ্যে পা—ছড়িয়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সে কান্না শোনা গেল না।
কুমার চান করে উঠেও ঘরে বসে হুইস্কি খাচ্ছিল। সান্যাল সাহেব মানা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এই গরমে কী করছ এসব? এখন মানে মানে এখান থেকে রওয়ানা হওয়া গেলেই বাঁচা যায়। আবার হুইস্কি খেয়ে কাকে ঘুষি মেরে বসবে, তখন আর প্রাণ বাঁচানোর কোনো উপায়ই থাকবে না।’
হুইস্কির দয়ায় কুমারের হারানো বিক্রম আবার ফিরে পেয়েছে ও। কুমার বলল, ‘প্রাণ যাওয়া অতই সোজা কিনা? নেহাত মেয়েছেলে সঙ্গে আছে নইলে দেখে নিতাম এদের।’
সান্যাল সাহেব মনে মনে বললেন, এ যাত্রা মহুয়া সঙ্গে আছে বলেই বেঁচে গেলে, নইলে তোমাকে কে বাঁচাত তাই—ই দেখতাম। মুখে বললেন ‘সব তো মিটে গেছে, আর তো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। আর পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা কেন?’
মহুয়া ফিরে আসতেই সান্যাল সাহেব বললেন, কোথায় গেছিলি?
—এই একটু দেখে এলাম গাড়ির কতদূর।
মহুয়ার চোখ ভেজা—বৃষ্টির পরের জঙ্গলের মতো। সান্যাল সাহেব ঘাঁটালেন না ওকে। বললেন, কী দেখলি?
—প্রায় হয়ে এসেছে।
বলেই মহুয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সুখনের ঘরের দিকে চলে গেল।
তাহলে তো এবার বিল—টিল মিটিয়ে দিতে হয়। গোছগাছ করে নে মহুয়া—এখুনি রওয়ানা হব।—সান্যাল সাহেব বললেন।
ততক্ষণে মহুয়া সুখনের ঘরে ঢুকে গেছে। কুমার বলল, ‘এখনি পালাবার কী হয়েছে? আমরা কী ভয় পেয়েছি নাকি?’
কুমারের গলার স্বর শুনে পরিষ্কার বোঝা গেল যে, সে বিলক্ষণ ভয় পেয়েছে।
কুমার আবার বলল, ‘খেয়ে—দেয়ে রেস্ট নিয়ে এক কাপ করে চা খেয়েই বেরোনো যাবে। তা ছাড়া অ্যাট দ্য মোমেন্ট আই অ্যাম নট ফিজিক্যালি ফিট টু ড্রাইভ।’
মহুয়া সুখনের ঘরে ঢুকেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। বাইরে দড়িতে কেচে—দেওয়া সুখনের জামাকাপড়, বিছানার চাদর, টেবল—ক্লথ সব শুকোচ্ছিল। যা কড়া রোদ—একটু পরেই তুলে নেওয়া যাবে। ভাবল মহুয়া। সব তুলে এনে সুখনের ঘরটা সুন্দর করে আবার সাজিয়ে দিয়ে চলে যাবে ও।
মহুয়া ভাবছিল যে, ও এই ঘরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে চেয়েছিল, যদি সুখন তাকে একটু জোর দিত। লোকটা অদ্ভুত। নিজে ভালোবাসতে জানে ভীষণ, অথচ অন্যের ভালোবাসা নিতে জানে না। সমস্ত সুখ তার নিজের ভালোবাসার ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, অন্যকে ভালোবাসতে দিতে জানে না। তাকে ভালোবেসে, তার জন্যে কিছু করে অন্যের যে সুখ, সেই সুখ থেকে সে বঞ্চিত করতে চায় অন্যকে। বড় দাম্ভিক লোকটা। স্বার্থপরও হয়তো বা। কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত লোককেই বা ওর এমন করে ভালো লেগে গেল কেন?
কিছু ভালো লাগে না মহুয়ার। মহুয়ার কিছুই ভালো লাগে না।
এত করে যত্ন করে রান্না করল, মুখের উপর বলে দিল যে আসবে না; খাবে না। কপাল দিয়ে এখনও রক্ত চোঁয়াচ্ছে—তবুও বলল আসবে না।
মহুয়া নিজের মনে, জল—ভেজা চোখে অঝোরে বলে চলল—তুমি যে ঘর চাও সে ঘর তোমাকে কেউ দিতে পারবে না সুখ। তোমার চিরজীবন এমনি একাই থাকতে হবে। সুখী হতে হলে সাধারণ হতে হয়, আত্মসম্মানজ্ঞানহীন লোভী হতে হয়, কুমারের মতো; ছোট্ট মাছরাঙা পাখির মতো। বারে বারে জলে ছোঁ মেরে মেরে সুখের ছোট ছোট মাছ কুড়িয়ে এনে জড়ো করে সুখের ডালি ভরাতে হয়। তুমি সমস্ত সুখকে একবারে কবজা করতে চাও, তাই—ই তো তোমার আঁজলা গলে সব সুখই গড়িয়ে যাবে। কোনো মহুয়াকেই ধরে রাখতে পারবে না তুমি। হয়তো ধরে রাখতে চাও—ও না। জানি না। বুঝলাম না তোমাকে।
মহুয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুখনের বিছানায় নড়েচড়ে শুয়ে মনে মনে বলল—তোমাকে আমি সব সুখ দিতাম সুখ, স—ব সুখ; কিন্তু তুমি মহুয়াকে দাম দিলে না। দম্ভ ভরে তাকে ফিরিয়ে দিলে। ঠিক আছে। তুমি নিষ্ঠুর হৃদয়হীন হতে পারো, আর—আমিই কী পারি না? তুমি দেখো যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করব না। সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে যখন দেখবে, ঘরময় আমার হাতের ছাপ, মহুয়ার গন্ধ, চারদিকে আমি, টুকরো টুকরো আমি, তখন দেখব, তুমি কাঁদো কী না আমার জন্যে। দেখব তখন।
আমি তোমাকে স—ব দিলাম। আর তুমি আমার শেষ অনুরোধের দামটুকুও দিলে না! জংলি।
১০
গোছগাছ করার বিশেষ কিছুই ছিল না। যা নামিয়েছিল, সেগুলোই স্যুটকেসে ভরে নেওয়া। চটিটি তো পিছনের সিটের পায়ের কাছেই রাখা যাবে।
মহুয়া দুপুরে ঘুমোয়নি। খাওয়নি। খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড। তবুও খায়নি। না—খাওয়ার আর কোনোই কারণ ছিল না। শুধু একমাত্র কারণ ছিল, জেদি, একগুঁয়ে লোকটা রাতে ফিরে এসে জানতে পারবে মংলুর কাছে যে, সে নিজে না খেয়ে মহুয়াকেও অভুক্ত রেখেছিল। লোকটাকে বড় দুঃখ দিতে ইচ্ছা করে, কাঁদাতে ইচ্ছা করে; যেমন করে সে কাঁদাল ওকে।
বাবা ও কুমার তখনও ঘুমোচ্ছিলেন। সত্যি, ঘুমোতেও পারেন! আর এই কুমারের মতো লোকরা কেন যে বাইরে আসে তা মহুয়ার জানা নেই। শুধু খেতে, হুইস্কি খেতে; আর দরজা বন্ধ করে তাস খেলতে। বন্ধ দরজার বাইরে যে এমন একটা দারুণ সুন্দর মর্মরধ্বনি তোলা পৃথিবী পড়ে রয়েছে তার দিকে এদের চোখ নেই। এদের চোখ হয়তো আছে, কিন্তু দেখার শক্তি নেই। চোখের লেন্সে ক্যামেরার লেন্সের মতো অব্যবহারে ফাঙ্গাস পড়ে গেছে। এদের কানে ট্রাম—বাস—গাড়ির শব্দ তালা লাগিয়ে দিয়েছে। অলস মন্থর হাওয়ায় পাথরের উপর শুকনো পাতা গড়ানোর চলমান ছবি এদের চোখে পড়বে না। দূর থেকে ভেসে আসা মৌটুসি পাখির চিকন গলার স্বর এদের কানে কখনও পৌঁছোবে না।
এই স্নিগ্ধ মধুর অপরূপ পটভূমিতে তাই—ই তো ওই আশ্চর্য লোকটা এমন করে আকৃষ্ট করেছিল তাকে, অমন শিহর ভরে পুলক তুলে ডাক দিয়েছিল তার বুকে, তার প্রাণের প্রাণে, তার শরীরের কেন্দ্রবিন্দুতে সে লোকটা সমস্ত সুখও কেন্দ্রীভূত করেছিল।
বাইরে হাওয়ার বেগ কমে এসেছে। রাস্তার ওপারের টাঁড় থেকে তিতির ডাকছে ক্রমাগত। শালবন থেকে টিয়ার ঝাঁকের চমকে—দেওয়া ট্যাঁ ট্যাঁ রব ভেসে আসছে।
বড় উদাস, বিধুর এই সময়টা। এই বিধুর ভাবটা মহুয়ার মনের মধ্যে এসে বাসা বেঁধেছে। এখন মহুয়া প্রস্তুত। শরীরে; মনেও।
যাওয়ার সময় হয়েছে। সুখনের ঘর গোছানো শেষ। মংলুকে দিয়ে মহুয়ার ডাল ভাঙিয়ে নিয়ে এসে ঘরে রেখেছে। রাতে এ ঘর মহুয়ার উগ্র গন্ধে ভরে যাবে। সুখনের গায়ের গন্ধ উগ্র। মহুয়া চেয়েছিল ওর নিজের স্নিগ্ধ সত্তার হালকা বাস রেখে যাবে সুখনের জন্যে।
মহুয়া ফুলের গন্ধের সঙ্গে মানবী মহুয়ার শরীর—মনের গন্ধের মিল নেই।
মহুয়া জানে, এ ছাড়া সুখের জন্যে রেখে যাবে এমন কিছুই ওর নেই। তবুও ও জানে, জাগতিক কিছু রেখে যাবে না বলেই ও অনেক কিছু রেখে যাবে এখানে। ওর জীবনের এক আশ্চর্য সুরেলা সুখ ও বিষণ্ণ অভিজ্ঞতার স্মৃতি।
বাইরে হাওয়াটা সারা দুপুর পাতা উড়িয়ে, পাতা ঝরিয়ে মন্থর হয়ে এসেছে। বেলা পড়ে আসছে।
না। লোকটা সত্যিই এল না। গাড়ি সারানোর পর কোথায় যেন চলে গেছে। শাকুয়া—টুঙে? কে জানে? এখন শাকুয়া—টুঙ থেকে সামনের উপত্যকাটা কেমন দেখাচ্ছে? একদিকে চাতরার জঙ্গল, সোজা অন্যদিকে সীমারীয়া—টুটিলাওয়া—হাজারীবাগের জঙ্গল আর বাঁয়ে আদিগন্ত পালামৌ। কী আশ্চর্য ভালো—লাগা জায়গাটাতে।
কে একজন মিস্ত্রিমতো লোক এসে দরজায় দাঁড়াল। মহুয়া বাবাকে ডাকল। তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দিল বাবার হাতে।
সান্যাল সাহেব কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন, একি? তাঁর গলায় অবাক হওয়ার সুর। কুমারও পাশে এসে দাঁড়াল।
কাগজটা একটা ক্যাশমেমো। একটা মোটরপার্টসের দোকানের। লেখা তিনশো পনেরো টাকা। সঙ্গে একটা চিঠি। সুখন লিখেছে—
সবিনয় নিবেদন,
তিনশো টাকা দিয়েছিলেন, তার ক্যাশমেমো।
বেশি যা লেগেছে তা আর দিতে হবে না আপনাদের। মেরামতির কোনো বিল করিনি। কুমারবাবুকে বলবেন আমার যা—কিছু অপরাধ ক্ষমা করে দিতে। আপনারা আপনার জনের মতো আমার পর্ণকুটিরে উঠেছিলেন—এতেই আমি বড় খুশি। আমার আপনার জন বলতে বিশেষ কেউই নেই। এখানে বাঙালির মুখও খুব বেশি দেখি না।
আপনাদের এ দুদিন বড়ই কষ্ট হল। আশা করি, এই কুঁড়ে ছেড়ে গিয়ে বেতলার বাংলোয় আপনারা সুখেই থাকবেন। এই কষ্টর কথা ভুলে যাবেন। ইতি—
বিনীত
সুখরঞ্জন বসু
ফুলটুলিয়া, গুঞ্জা
২৭।৩।৭৫
কুমার চুপ করে ছিল।
সান্যাল সাহেব মিস্ত্রিকে শুধোলেন, সুখনবাবু কোথায়?
মিস্ত্রি বলল, ‘জানি না। গাড়ি ঠিক করেই চলে গেছেন।’
—কোথায় গেলেন? তাঁর না ঘরে শুয়ে থাকবার কথা?
মিস্ত্রি বলল, ‘আমরাও বলেছিলাম। ওস্তাদ কারও কথা শোনেই না।’
সান্যাল সাহেব বললেন, দ্যাখো তো কী অন্যায়!
কুমার বলল, ‘আমাদের একটা ধন্যবাদ দেওয়ারও সুযোগ দিল না মিস্ত্রি। কিন্তু গাড়ি সারাবার পয়সা না হয় নাই—ই নিল, কিন্তু খাওয়া—দাওয়ার? এটাও এক ধরনের অপমান করা।’
মিস্ত্রি নমস্কার করে চলে গেল। বলে গেল যে, গাড়ি ধুয়ে—টুয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখে গেছে ওস্তাদ কারখানার বাইরে শিশুগাছতলায়।
মিস্ত্রি চলে গেলে কুমার আবার বলল, ‘বিনি পয়সায় তো আমি কারও খাবার খাইনি। আর খাবোই বা কেন? জোর করে নুন খাইয়ে গুণ গাওয়াবার ব্যবস্থা। কায়দাটা ভালোই।’
মহুয়া একবার চোখ তুলে তাকাল কুমারের দিকে। তারপর চুপ করে রইল।
মংলু চা করে নিয়ে এসেছিল। চা খেতে খেতে সান্যাল সাহেব ও কুমার জামাকাপড় পরে নিলেন।
দেওয়ালে—ঝোলানো ফ্লাস্কটা সবার অলক্ষ্যে হাতে নিয়ে মহুয়া রান্না ঘরে গেল। মংলুকে বলল, ‘এটা তোর ওস্তাদের জন্য রেখে দিস মংলু। যখন শাকুয়া—টুঙে যাবেন তখন চা বানিয়ে দিস। আর এই লুডোটা তোর জন্যে দিয়ে গেলাম। এই টাকাটা রাখ—মিষ্টি খাবি।’—বলেই কুড়িটা টাকা গুঁজে দিল মংলুর হাতে।
মংলু আপত্তি জানাল টাকাটা নিতে। বলল, ওস্তাদ রাগ করব।
মহুয়া বলল, ‘আর না—নিলে আমি যে রাগ করব? তোর ওস্তাদকে বলিস যে রাগ আমিও করতে পারি। আর বলিস যে, তোর ওস্তাদ বড় অসভ্য।’
মহুয়া চলে আসছিল রান্নাঘর ছেড়ে। কেন জানে না, তার চোখ জলে ভরে গেছিল। তার অভিমান, রাগ, তার উষ্মা যে দেখাবে সে সুযোগও লোকটা তাকে দিল না। এ যেন হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা; আর ক্লান্ত হওয়া।
সান্যাল সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাইপে তামাক ভরছিলেন। বললেন, কই রে মৌ, হল তোর?
মহুয়া আসি বলে, বাইরে এল।
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘মংলু, বাবা, মালগুলো এক এক করে তোলো এবার গাড়িতে।’
তারপর বললেন, ‘কুমার যাও, বুটটা খুলে দাও গাড়ির।’
কুমার বারান্দায় বেরিয়ে মংলুকে ডাকল। বলল, ‘এই ছোঁড়া এদিকে আয়, তুই অনেক করেছিস আমাদের জন্যে, তোকে একটু বকশিশ দিই।’
মংলু বলল, ‘না, না। নেব না।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘সে কি? নিয়ে নে, বাবা, নিয়ে নে।’
কুমার ভীষণ গর্বভরে দু’ পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে একটা এক টাকার নোট বের করে মংলুকে দিল সবাইকে দেখিয়ে।
মহুয়ার সমস্ত অন্তর কুমারের দীনতায় কুঁকড়ে গেল। এই এক ধরনের লোক। এরা দেখিয়ে দান দেয়। এবং এমন দান যে, সে বলার নয়। এরাই গ্রান্ড হোটেলে খেয়ে উর্দি—পরা বেয়ারার সেলাম প্রত্যাশা করে দশ টাকার নোট ফস করে বের করে। ফাইভ—স্টার হোটেলের পেজবয়কে কিছুই না করার জন্যে পাঁচ টাকার নোট ছুঁড়ে দেয়। যেহেতু মংলু মংলু, যেহেতু এই দানের সাক্ষী শুধু তারাই আর কুমারের নীচ অন্তঃকরণ, তাই—ই এমন জায়গায় তার হাত দিয়ে শুধু এক টাকার নোট বেরোয়।
এরপর কুমার আরও এক কাণ্ড করল। দুটো দশ টাকার নোট বের করে মংলুকে দিয়ে বলল, ‘তোর ওস্তাদকে দিয়ে দিস—আমাদের খাওয়ার টাকা।’
সান্যাল সাহেব হইহই করে উঠলেন, বললেন, ‘একি করছ কুমার? সুখনবাবু তো খাওয়ার টাকা চাননি? এ দিলে তাঁকে অপমান করা হবে। তাছাড়া টাকার কথাই যদি বলো, উনি বোধহয় আমাদের জন্যে এক এক বেলাতেই কুড়ি টাকার বাজার করেছেন। তাছাড়া টাকাটাই তো সব নয়।’
তারপর মহুয়ার দিকে চেয়ে বললেন, ‘যে আদর—যত্ন, আন্তরিকতা উনি দেখিয়েছেন তার দাম কী টাকায় দেওয়া যায়?’
কুমার টাকাটা পার্সে রাখতে রাখতে ভুরু তুলে বলল, ‘টাকায় দাম দেওয়া যায় না, এমন কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে? বেশ তো কুড়ি টাকা না হয়, দুশো টাকাই নেবে—দুশো টাকাই দিচ্ছি।’
সান্যাল সাহেব বললেন, না, না! এতে আমি রাজি নই। উনি নিজে থাকলেও বা কথা ছিল, খাওয়ার টাকা এভাবে মংলুর হাতে দেওয়া যায় না।
মহুয়া বলল, ‘বাবা, তোমার একটা কার্ড দিয়ে যাও মংলুকে। আর ওঁর ঠিকানা তো আমরা জানিই। তুমি কলকাতায় ফিরে ওঁকে একটা চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়ো।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘কলকাতা কেন? বেতলা থেকেই লিখব। তুই ভালোই বলেছিস।’
বলেই সান্যাল সাহেব তাঁর বাড়ি ও অফিসের ঠিকানা লেখা একটা কার্ড মংলুকে দিলেন।
মহুয়া খুশি হল। সে নিজে থেকে তার ঠিকানা দিতে চেয়েছিল। সুখ নেয়নি, কিন্তু বাবার কার্ড থাকলে ঠিকানাও রেখে যাওয়া হল আবার তার নিজের সন্ধানও রইল।
মংলু মালপত্র তুলে দিয়েছিল। ওরা ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বেলা পড়ে গেছিল। এখন রোদ নেই, তবে আলো আছে। থাকবে এখনও আধঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টা।
বারান্দা ছেড়ে নেমে আসবার সময় মহুয়ার বুকের মধ্যেটা মুচড়ে উঠল। গাড়ির খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একবার শাকুয়া—টুঙের দিকে চাইল শেষবারের মতো। পশ্চিমাকাশে নীল শান্তির ছবি হয়ে সন্ধ্যাতারাটা সবে উঠেছে। অনেক রকম পাখি ডাকছে শাকুয়া—টুঙের দিক থেকে।
মংলুর গাল টিপে দিয়ে একবার আদর করে মহুয়া গাড়িতে উঠল। সান্যাল সাহেব একটা দশ টাকার নোট মংলুর হাতে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লেন। দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। ইঞ্জিন গুমরে উঠল।
ধুলো উড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে গাড়িটা বড় রাস্তার দিকে চলল।
মংলু দাঁড়িয়েছিল। লাটাখাম্বায় কে যেন জল তুলছিল। তার ক্যাঁচোর—কোঁচর শব্দে এই আসন্ন সন্ধ্যার নিস্তব্ধ বিষণ্ণতা আরও ভারী হয়ে উঠেছিল।
কাঁচা রাস্তাটা বন—জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে। বাঁদিক দিয়ে একটা নালা বয়ে চলেছে রাস্তার সমান্তরালে। ওরা আধ মাইলটাক এসেছে।
কুমার বলল, ‘সব নিয়ে আসা হয়েছে তো? ফ্লাস্কটা? ফ্লাস্কটা তো দেখলাম না।’
তারপর পিছনে মুখ ঘুরিয়ে মহুয়ার দিকে চেয়ে বলল, আছে?
মহুয়া বলল, ‘এ মাঃ। একদম ভুলে গেছি। রান্নাঘরে ছিল—আনতে মনে নেই।’
কুমার বলল, ‘রান্নাঘরে কেন? আমি তো বিকেলেও দেখলাম আমাদের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল।’
ছিল বুঝি? কই আমি দেখিনি তো?
মহুয়া মিথ্যে কথাটা সত্যি মতো করে বলল।
কুমার বলল, ‘ওই ছোঁড়া ঝেড়ে দিয়েছে। ওস্তাদের চেলা তো! আর কত হবে? তারপরই বলল, ব্যাক করব নাকি?’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘ছাড়ো, ছাড়ো; ফ্লাস্কের শোকে এত উতলা হওয়ার দরকার নেই। ফেরার ঝামেলা কোরো না।’
রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে, বাঁক নিয়েই পাকা রাস্তা। একটা মোড়। দু’তিনটে কাঁচা—পাকা রাস্তা এসে মিশেছে ওখানে, কিন্তু গন্তব্য—নির্দেশক কোনো বোর্ড—টোর্ড নেই।
কুমার গাড়ির গতি কমিয়ে বলল, ‘অ্যাই মরেছে! এখন কোনদিকে যাই? আবার রাস্তা ভুল করলেই তো চিত্তির। একবারেই যা নাজেহাল।’
মোড়টার কাছেই রাস্তার ডানদিকে অনেকগুলো বড় বড় কালো ন্যাড়া পাথর। জায়গাটায় শুধুই মহুয়া গাছ—পত্রশূন্য শাখা—প্রশাখা বিস্তার করা বহু পুরোনো সব মহীরুহ। ধুলো, শুকনো গাছাগাছালি, আর শেষ বিকেলের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মেশা মহুয়ার গন্ধে জায়গাটা ম—ম করছে।
গাড়িটা ঐখানে থামাতেই হঠাৎ মহুয়ার চোখে পড়ল একটা তিন—পেয়ে কালো কুকুর পাথর বেয়ে উপর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসছে গাড়ির দিকে। কালুয়া।
একি! বলেই কুমার থেমে গেল।
ওর গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল, শালা খাওয়ার—টাকা নেবার জন্যে পথে দাঁড়িয়ে আছে!
সান্যাল সাহেব চাপা গলায় বললেন, কী হচ্ছে কুমার?
কালুয়ার পিছু পিছু মাথায় ব্যান্ডেজ—বাঁধা সুখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিল নীচে। ওকে দেখে মহুয়ার মনে হচ্ছিল যে, তার সুখ বড় বুড়ো হয়ে গেছে একদিনেই। অভুক্ত, বড় ক্লান্ত, শ্রান্ত।
মনে হচ্ছিল, এইটুকু আসতেই ওর একযুগ লাগবে।
মহুয়া মনে মনে বলল—লাগুক; এক যুগই লাগুক। তবু তুমি নেমে এসো সুখ, তুমি কাছে এসো।
কাছে আসতেই দেখা গেল সুখনের হাতে একটা মহুয়ার বোতল। আগে বোধহয় আরও খেয়ে থাকবে। ধীর পায়ে নামার এও একটা কারণ।
মাঝপথে থেমে দাঁড়িয়ে সুখন মিস্ত্রি বোতলটাকে মুখে তুলে, মাথাটাকে পিছনে হেলিয়ে ঢকঢক করে আবার খেল অনেকখানি। গেঞ্জির হাতায় জংলির মতো মুখ মুছল। তারপর কাছে এগিয়ে এল।
কুমার ফিসফিস করে বলল, অ্যাবসলুটলি ড্রাঙ্ক।
মহুয়া মনে মনে বলল—মহুয়া খেলেই ড্রাঙ্ক, আর হুইস্কি খেলে ড্রাঙ্ক নয়! বাঃ!
কুমার বলল, তুমি গাড়ি থেকে নেমো না মহুয়া। খুব সাবধান। ব্যাটা বেহেড মাতাল। তোমার গায়ে—টায়ে হাত দিয়ে বসতে পারে।
সান্যাল সাহেব গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিমধ্যেই। সুখন কাছে আসতেই বললেন, ‘আরে আসুন, আসুন। আমরা তো ভাবলাম আর দেখাই হল না বুঝি। কী যে লজ্জায় ফেললেন না আপনি আমাদের।’
ততক্ষণে মহুয়াও দরজা খুলে নেমে সান্যাল সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সুখন সত্যিই মাতাল হয়ে গেছে বলে মনে হল মহুয়ার। ওর দিকে তাকিয়ে এক অপ্রকাশিতব্য কষ্টে মহুয়ার বুক ভেঙে যেতে লাগল।
কালুয়া ওর পায়ের কাছে দৌড়োদৌড়ি করে একবার রাস্তায় যাচ্ছিল, একবার গাড়ির কাছে আসছিল। সুখন জড়ানো গলায় ওকে ধমক দিয়ে বলল, ‘এদিকে আয় কালুয়া। একটা পা তো গেছে, তোর কী গাড়ি চাপা পড়ে মরার ইচ্ছা হয়েছে?’ একটু পর আবার টেনে টেনে বলল তুই ছাড়া….।
যে লোকটা সুস্থ অবস্থায় দৃঢ়, শক্ত, অন্যের দয়া ও ভালোবাসার প্রতি উদাসীনতায় মুখ ফেরান, সেই লোকটা মাতাল অবস্থায় যেন শিশু হয়ে গেছে; বড় দুর্বল, অসহায় হয়ে পড়েছে।
সুখন কাছে এসে বোতলসুদ্ধ হাত তুলে বলল, নমস্কার। তারপর আবার জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, নমস্কার সান্যাল সাহেব, নমস্কার কুমার সাহেব।
মহুয়ার কথা যেন ভুলেই গেছিল এমনিভাবে মহুয়ার দিকেও জোড়হাত তুলে বলল, নমস্কার।
সান্যাল সাহেব বললেন, আপনি এখানে কী করছেন?
আমি? কিছু না। কী আবার করব? তারপরেই বলল, ও না। হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি কী যেন একটা করতে এসেছিলাম এখানে। অ্যাই—এইবার মনে পড়েছে।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এখানে আপনারা রাস্তা ভুল করতে পারতেন। আপনাদের আগেই বলে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু মনে ছিল না। ভুল রাস্তায় গেলে সন্ধের পর ডাকাতির ভয় আছে এদিকে। তাই এলাম। ভাবলাম, রাস্তা বাতলে দিয়েই আমার ছুটি। ঠিক রাস্তা। ঠিক রাস্তায় আপনারা সব ভালোমতো চলে গেলেই ছুটি।’
সান্যাল সাহেব উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘সে কী? মাথায় এত বড় একটা উন্ড নিয়ে এতখানি হেঁটে এসেছেন? আপনার না বিছানায় শুয়ে থাকার কথা? কী করে আবার এতটা ফিরবেন? চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
সুখন হাসল। মাতালের অপ্রকৃতিস্থ হাসি। তারপর বলল, বিছানাও আছে। ওই যে। বলেই পাথরগুলোর দিকে দেখাল। বলল, ওইখানেই শুয়েছিলাম।
কুমার এতক্ষণে গাড়ি থেকে বেরিয়েছে। কুমারও দরদ দেখিয়ে বলল, ‘সে কী? ওখানে বিছে আছে, সাপ আছে, গরমের দিন।’
সুখন হাসল। বলল, ‘বিছে তো কতই কামড়াল। কই? কিছু হল কী? কী কুমার সাহেব, হল কিছু?’
কুমার দ্ব্যর্থক কথাটার মানে বুঝতে পেরেই মনে মনে বলল—শালা। এখন তোমাকে একা পেয়েছি মাতাল অবস্থায়। গাড়ির জ্যাক বের করে মাথায় মারলে এখানেই তোমাকে চিরতরে শুইয়ে দিয়ে যেতে পারতাম—কিন্তু সঙ্গে সব মিস্ত্রি—দরদি সাক্ষী থেকেই গড়বড় হয়ে গেল।
কুমার উত্তর দিল না। তারপর শুধোল, আমরা কোনদিকে যাব?
সুখন হাত তুলে বলল, বাঁয়ে—সোজা বাঁয়ে চলে গেলেই ঠিক যাবেন।
মহুয়া কী করবে, কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ও বুঝছিল যে, ওর কিছু একটা বলা উচিত। আর কিছু বলার সুযোগ আসবে কী না কে জানে? তাছাড়া ওর এই নীরবতায় বাবা ও কুমার সন্দেহ করতে পারেন কিছু।
মহুয়া হঠাৎ বলল, ব্যথা কেমন আছে?
সুখন চমকে উঠল গলার স্বরে শুনে। বলল, ব্যথা?
ব্যথার কথা যেন ভুলেই গেছিল। তারপর যেন মনে পড়ায় বলল, ‘ও, ব্যথা একটু আছে। থাকবে কিছুদিন। তারপর চলে যাবে। ভাববেন না।’
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আপনি যে কী করলেন না! গাড়ি সারাবার টাকা নিলেন না, দু’দিন খুব খাওয়ালেন সব নিজের খরচে—সত্যি, আপনার ঋণ শোধবার নয়। আমরা তো আপনার খদ্দের বই আর কিছুই নই; আমরা আপনার কে যে আমাদের জন্যে নিজের এমন ক্ষতি স্বীকার করলেন?’
সুখন একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর যেন অনেক দূর থেকে বলছে, যেন অন্য কেউ বলছে, এমন গলায় বলল, বলার আগে একবার মহুয়ার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিল; বলল: ‘কী জানেন সান্যাল সাহেব, জীবনে কিছু কিছু ক্ষতি থাকে—তা পূরণ হওয়ার নয়—তা চিরদিন ক্ষতিই থেকে যায়। সে সব ক্ষতি শুধু স্বীকারই করার।’
তারপর বলল, ‘মনে করুন এও সেরকম কোনো ক্ষতি। তাছাড়া, যে ক্ষতি স্বীকার করে, সেই স্বীকার করার সুখটা তারই একার তাকে। সে কারণে যাদের জন্যে অন্যের ক্ষতি হয়, তারা নিজেরা লাভবান হয় বলেই সুখের ভাগটা কিছু পায় না।’
কুমার মনে মনে বলল—শালা হেভি যাত্রা করছে তো। শালা বহুরূপী!
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আপনার কথা শুনে কেউই বলবে না যে, আপনি মোটরগাড়ির মিস্ত্রি।’
সুখন হাসল। বলল, ‘সেইটিই দুঃখ। খদ্দেররাও স্বীকার করে না; আমার মিস্ত্রিরাও নয়। আমার মেরামতির গুণ কেউই স্বীকার করল না।’
পরক্ষণেই বলল, অন্ধকার হয়ে এল। আর দেরি করা ঠিক নয় আপনাদের। এবার রওয়ানা হয়ে পড়ুন, আবার কখনও এদিকে এলে, গাড়ি খারাপ হলে সুখন মিস্ত্রিকে খবর দেবেন—দুখন মিস্ত্রির ভাই সুখন মিস্ত্রিকে। আর কী বলব?’
মহুয়ার পা দুটো মাটি আঁকড়ে ছিল। ওর মুখে আসছিল যে, আমি যাব না। আমি আপনার কাছে থাকব। আমাকে আপনি কেড়ে নিন, জোর করুন আমার উপর, আপনার জোর দেখান। পরক্ষণেই ওর মনে হল, বড় দাম্ভিক তুমি সুখ। তুমি নিজে দুঃখ পাবে, অন্যকে দুঃখ দেবে। তুমি এরকমই।
সান্যাল সাহেব বললেন, ‘আপনি এরকম করেন কেন? এরকম মহুয়া—ফহুয়া খাওয়া খারাপ। এরকম করবেন না।’
সুখন হাসল। বলল, ‘এই—আমি এরকমই। আমি ভালো না।’
কুমার ছটফট করছিল। বলল, এবার এগোনো যাক।
সান্যাল সাহেব কিছু বলার আগেই, কুমারকে উদ্দেশ্য করে সুখন বলল, ‘ওহোঃ, ভুলেই গেছিলাম। আপনার জন্যে একটা জিনিস এনেছিলাম।’
বলেই পকেট থেকে একগাদা পলাশ ফুল বের করে কুমারকে দিল সুখন।
কুমার স্মার্টনেস দেখিয়ে নাকের কাছে তুলল ফুলগুলোকে।
সুখন বলল, ‘নাকের অত কাছে নেবেন না—এতে পিঁপড়ে থাকে—কামড়ে দেবে।’
তারপর বলল, ‘আরও একটা জিনিস দেবো ভেবেছিলাম—একটা পাখি—টুঁই পাখি। কিন্তু এত অল্প সময়ে জোগাড় করা গেল না।’
—সেটা আবার কী পাখি?
দেখেননি? ছোট্ট, মিষ্টি পাখি—সবুজ সবুজ—লেজ—ঝোলা—উড়ে উড়ে ডাকে টিঁ—টুঁই—টিঁ—টিঁ—টুঁই….।
কুমার এই পলাশ ও টুঁই পাখির ব্যাপারটা বুঝল না।
তবে এটুকু বুঝল যে, এর পেছনে কোনো রহস্য আছে। শালা হেভি খচ্চর।
কুমার বলল, ‘চলুন, সান্যাল সাহেব, এবার যাওয়া যাক।’
বলেই কুমার গাড়িতে গিয়ে বসল ড্রাইভিং—সিটে।
তারপর সান্যাল সাহেবও সুখনকে নমস্কার করে উঠে বসলেন। মহুয়া উঠল শেষে।
সুখন মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল একটু। হঠাৎ মহুয়ার হাত দুটো দু’ হাতে ধরে বলল, ‘নমস্কার দিদিমণি। অনেক কষ্ট করে গেলেন এখানে। সুখন মিস্ত্রিকে মনে থাকবে না, জানি আপনাদের কারোই; কিন্তু আপনাদের সবাইকেই মনে থাকবে সুখন মিস্ত্রির।’
মহুয়া মুখ নামিয়ে নিল। চোখটা ভারী হয়ে এল মহুয়ার। গলার কাছে কী যেন একটা চাপা কষ্ট দলা পাকিয়ে এল। মহুয়া বলল, চলি।
সুখন দরজাটা নিজের হাতে বন্ধ করে দিল। তারপর বলল, ‘চলি বলতে নেই, বলতে হয় আসি। এও জানেন না?’ তারপর আবার নমস্কার করে বলল, এদিকে এলে আবার আসবেন দিদিমণি।
ইঞ্জিনটা স্টার্ট করেই আবার বন্ধ করে দিল কুমার। কুমার ডাকল সুখনকে। বলল, এই যে এদিকে শুনুন।
সুখন অবাক হয়ে ওদিকে যেতে যেতে বলল, ‘কী ব্যাপার? আপনি তো সুখন মিস্ত্রিকে তুমি করেই বলতেন। হঠাৎ অধমের এ উন্নতি কেন?’
সান্যাল সাহেব ও মহুয়া অবাক হয়ে কুমারের দিকে তাকিয়ে ছিল। কুমার কেন ডাকল, ওরা বুঝল না।
সুখন সামনের ডানদিকের দরজার কাছে গেলে কুমার হিপ—পকেট থেকে পার্স বের করে দুটো একশো টাকার নোট ফট করে বের করে সুখনের হাতে দিয়ে বলল, আমাদের খাওয়া—দাওয়ার খরচা।
সুখন কুঁজো হয়ে গাড়ির জানালার কাছে মুখ নামিয়ে এনেছিল। টাকাটা হাতে নিয়ে ওইভাবেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, এটার কী খুবই দরকার ছিল?
কুমার বলল, এটা না নিলে আমার খুব ছোট লাগবে নিজেকে।
সুখন আশ্চর্য হবার মতো মুখ করে থাকল অনেকক্ষণ। যেন ও বোবা হয়ে গেছে। তারপর বলল, ‘আপনারও তাহলে ছোট লাগে নিজেকে কখনও কখনও? আশ্চর্য!’
কুমার রাগত গলায় বলল, মানে?
সুখন জবাব না দিয়ে, মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই যাঃ, একদম ভুলেই গেছিলাম। আপনার জন্যেও একটা জিনিস এনেছিলাম। গরিব মিস্ত্রি—আর তো কিছুই দেওয়ার নেই’—বলেই পকেট হাতড়ে একমুঠো চকচকে বল—বিয়ারিং বের করল সুখন।
বের করে, জানালা গলিয়ে হাত ঢুকিয়ে মহুয়ার হাতে দিল।
প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশিক্ষণ মহুয়ার হাতে হাত ছুঁইয়ে রাখল ও। তারপর বলল, আপনি এখনও বড় ছেলেমানুষ আছেন দিদিমণি।
সান্যাল সাহেব বললেন, তা যা বলেছেন।
সান্যাল সাহেবও চাইছিলেন যে এবার এগোনো যাক। টাকাটা দিয়ে ফেলে কুমার এখন কী নতুন বিপত্তি বাধাল কে জানে? কুমারটা একটা স্কাউন্ড্রেল। সব জিনিসেরই সীমা থাকা উচিত। ওর অভদ্রতার কোনো সীমা নেই।
কুমার আর কিছু না বলে এঞ্জিনের সুইচ ঘোরাল। গাড়িটাকে গিয়ারে দিল।
সুখন তখনও গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল। সুখন বলল, ‘এক সেকেন্ড। আর আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। একটা কথা বলে নিই।’
তারপর একটু থেমে বলল, ‘কুমার সাহেব, টাকা—বড় বেশি টাকা চিনেছেন আপনি। তাই না? জিন্দগীতে টাকার চেয়েও বড় বহত বহত জিনিস আছে। এখনও বয়স আছে, দিন আছে; সেসব চিনুন।’
তারপর বলল, এই নিন। বলেই, একশো টাকার নোট দুটোকে ফসস ফসস করে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কুমারের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে সুখন বলল ‘এই জঙ্গলে পাহাড়ে এমন লক্ষ লক্ষ শুকনো পাতা এই চোত—বোশেখে হাওয়ায় ওড়ে।’
তারপরই মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল, যান, স্টার্ট দিন।
কুমারকে বলতে হল না আর। অ্যাকসিলারেটর পুরো দাবিয়ে দিয়ে স্টিয়ারিং সোজা ধরে বসেছিল কুমার। ক্লাচে পা রেখে। ক্লাচ থেকে হঠাৎ পা সরাতেই গোঁ—গোঁ আওয়াজ করে ভয়—পাওয়া শুয়োরের মতো লাফিয়ে গেল গাড়িটা সামনে।
কুমার ভয় পেয়ে গেছিল। মনে মনে বলল, এ শালাকে বিশ্বাস নেই। টাকা ছিঁড়েও হয়তো শান্তি হয়নি, এবার দৌড়ে এসে হয়তো মেরেই বসবে।
সুখন ওইখানেই দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল। সান্যাল সাহেব জানালা দিয়ে। মহুয়া পেছনের কাচ দিয়ে। একটু পরেই রাস্তা বাঁক নিল।
সুখনকে আর দেখা গেল না। আবছা অন্ধকার, কালো পাথর, ঝোপ—ঝাড়, জঙ্গল, এ—সবের মধ্যে সুখনের দাঁড়িয়ে থাকা, হাত—নাড়া চেহারাটা হঠাৎই হারিয়ে গেল।
মহুয়া পিছনের সিটে হেলান দিয়ে আধশোয় ভঙ্গিতে বসেছিল।
তার দু’গাল ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।
গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছিল কুমার। ড্যাশবোর্ডের আলোতে ও হেডলাইট ইন্ডিকেটরের সবুজ আলোতে ড্যাশবোর্ডের উপরে রাখা একগুচ্ছ পলাশের লাল রঙে কেমন সবুজ আভা লেগেছে।
মহুয়া হাতের মধ্যে বলবিয়ারিংগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। অনেকক্ষণ হাতের মধ্যে থাকায় গরম হয়ে উঠেছে ওগুলো।
হঠাৎ সান্যাল সাহেব বললেন, টুঁই পাখিটা কী পাখি?
কুমার তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, ‘আপনিও যেমন! ব্যাটা মিস্ত্রি নিশ্চয়ই মন—গড়া নাম দিয়ে দিয়েছে কোনো পাখির। আজব চিজ একটি। সুখন মিস্ত্রি!’
তারপরই পিছনে মুখ ঘুরিয়ে খুশি খুশি গলায় কুমার বলল, ‘মহুয়ার কী হল? চুপচাপ কেন! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে বেতলা পৌঁছোব আমরা।’
মহুয়া জবাব দিল না। সান্যাল সাহেব বলল, কী রে মৌ?
মহুয়া বলল উঁ।
—কী হল তোর?
মহুয়া বলল, কিছু না।
—তবে, চুপ করে কেন?
মহুয়া উত্তর দিল না অনেকক্ষণ।
তারপর অস্ফুটে বলল, ভাবছি….।