সিন্ধু সভ্যতার বৃত্তের বাইরের ভারতবর্ষ: গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাস
১ ভূমিকা
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে কিছু কিছু অঞ্চলে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির ভেতরেই পশুপালন এবং বন্য শস্য আহরণের ছাপ। শিলনোড়া জাতীয় পাথরের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করে যে বন্য শস্য এভাবে ভাঙা হত বা থ্যাঁতলানো হত। চোপানি-মান্ডোর শেষ পর্যায়ে তো বুনো ধানের চিহ্নই পাওয়া গেছে। পশুপালনের সূচনা হিসেবে আমরা বাগোর এবং আদমগড়ে অন্তত পরিষ্কারভাবে গৃহপালিত গবাদিপশু, ভেড়া ও ছাগল পাচ্ছি। সত্যি বলতে, এই ধরনের সাক্ষ্য থেকে সব মিলিয়ে যে চিত্রটি আমরা পাই তা আমাদের কাছে এখনও খুব পরিষ্কার নয়; তবে যতটুকু জানি তাতে মনে হয় খ্রি. পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দ এবং তার আগে থেকে ভারতবর্ষের অন্তরীপ অংশে কৃষিজীবন শুরু হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া গেছে বিন্ধ্যের পাদপ্রদেশে বেলান উপত্যকার কোল্ডিহাওয়া নামক কেন্দ্র থেকে। কোল্ডিহাওয়ার প্রথম পর্যায়ে ধাতুর ব্যবহার নেই; হাতে গড়া মৃৎপাত্র, চাষ করা ধানের চিহ্ন: সব মিলিয়ে নব্যপ্রস্তরযুগীয়। এই পর্যায়ের তারিখগুলির ভেতর দুটি তারিখের একটি খ্রি.পূ. অষ্টম সহস্রাব্দের, আর একটি ষষ্ঠ সহস্রাব্দের। গোলমাল হচ্ছে যে, এখান থেকে পাওয়া বাকি সব তারিখগুলিই অনেক পরের সময়ের। এটা কিছু নতুন নয়। অনেক কেন্দ্রেই রেডিওকার্বন তারিখের এই ধরনের অসঙ্গতি আছে। এই ধরনের অসঙ্গতি বহু কারণে হতে পারে; সব চাইতে সোজা কারণটি হচ্ছে যে নমুনার ওপর তারিখটি বিশুদ্ধ নয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে সঠিক তারিখ নির্ণয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সাহায্য করে। কোল্ডিহাওয়াতে পাওয়া কৃষিজীবনের চিহ্ন এত পুরনো আমরা যদি মানি তবে এও মানতে হয় যে, এখানে ধানচাষের চিহ্ন বহু পুরনো এবং ভারতবর্ষ, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো, ধানচাষের একটি আদি কেন্দ্র। যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন ভারতবর্ষে এই ধরনের আদি কেন্দ্র হতে পারে না তাঁরা কোল্ডিহাওয়ার এই সাক্ষ্যকে অস্বীকার করেন। দ্বিতীয়ত, যে প্রত্নতাত্ত্বিকের নেতৃত্বে কোল্ডিহাওয়ায় খননকার্য হয় তিনি তাঁর বিভাগে এবং অন্যত্র বিভিন্ন কারণে বহু শত্রু অর্জন করেছিলেন। তাই তিনি মারা যাওয়ার পরে তাঁর প্রায় সমস্ত কাজ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। ব্যাপারটি ভাল হয়নি; উচিত ছিল কোল্ডিহাওয়ায় আবার নতুন করে খননকার্য হওয়া এবং সযত্নে তারিখ নির্ণয় করা—রেডিওকার্বনের বাইরেও অন্য পদ্ধতি—যথা ‘থার্মোলুমিনেসেন্স’—প্রয়োগ করা। কোল্ডিহাওয়ার তারিখ যে প্রাচীন হতে পারে তার পক্ষে অন্তত দুটি কারণ আছে। প্রথমত, আমরা আগে দেখেছি যে এই অঞ্চলে দীর্ঘ প্রাগৈতিহাসিক বিবর্তনের চিহ্ন আছে—পুরাপ্রস্তর যুগ থেকে ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগ পর্যন্ত। কোল্ডিহাওয়ায় যা পাওয়া গেছে তা এই বিবর্তনেরই ফল এটা ধরে নিতে কোনও বৈজ্ঞানিক অসুবিধা থাকার কথা নয়। বিশেষ করে, বুনো ধানের প্রাচুর্য যখন কোল্ডিহাওয়া অঞ্চলে আছে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে এই অঞ্চল থেকে আরও পশ্চিমে মধ্যপ্রদেশের সিধি অঞ্চলে কুন্ঝুন্ নামক কেন্দ্রে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি একটি নব্যপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্রের অস্তিত্ব। এর সম্পর্কে এখনও বিশেষ কিছু জানি না, কিন্তু এর আদি তারিখ জানি। বিন্ধ্যের ভেতরে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি কৃষিকার্যের সঙ্গে পরিচিত নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি গড়ছে কী করে? উত্তর এখনও নেই। কিন্তু এই পুরো অঞ্চলটিতে একটি সুপ্রাচীন কৃষিজীবনের ইঙ্গিত মেলে। এই ধরনের ইঙ্গিত থেকে মনে হয় যে বিক্ষিপ্তভাবে, ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির বিবর্তনের ফসল হিসেবে, ভারতবর্ষের অন্তরীপভাগে, বিভিন্ন শস্যভিত্তিক কৃষিকার্যের সূত্রপাত হতে পারে। এই সূত্রপাতে হয়তো কৃষির অংশ কম ছিল; খাদ্যসংগ্রহ ও শিকারের মাত্রাই বেশি ছিল। লাঙলভিত্তিক চাষের কথাও আমরা বলছি না; কিন্তু লাঙল বাদ দিয়েও চাষ হয়, যেমন ঝুম চাষ। ভারতবর্ষের অন্তরীপভাগে এই ধরনের চাষের সূত্রপাত বোধহয় সুপ্রাচীন—অন্তত আমাদের এই মত। এই ধরনের চাষবাস যে প্রথমে একটি কেন্দ্রে শুরু হয়ে পরে অন্যান্য অঞ্চলে ছড়াবে এমন কোনও কথা নেই। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শস্যভিত্তিক চাষ পৃথক পৃথকভাবে পৃথক পৃথক সময়ে শুরু হতে পারে বইকি।
অন্তরীপভাগে চাষবাস শুরু হওয়ার আর একটি দিক আছে। খ্রি.পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা তার কিছু আগে থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত আমরা খুব দ্রুত একটা বিশাল অঞ্চলে গ্রামজীবনের ছবি পরিষ্কার হতে দেখি। বস্তুত, এই ছবিটিই বর্তমান অধ্যায়ের বিবেচ্য। কথা হচ্ছে যে, এই লম্বা সময়ের অনেকটা জুড়েই এই অঞ্চলের উত্তরদিকে আর একটি বিস্তীর্ণ ভূভাগে সিন্ধু সভ্যতা ছিল। অন্তরীপভাগে যে এই সভ্যতা একেবারে ছিল না তা নয়—গুজরাট তো অন্তরীপভাগের ভেতরেই। একদিকে গুজরাট ও অন্য দিকে দিল্লি-সাহারানপুর-মিরাট অঞ্চল—এদিকের সিন্ধু সভ্যতার উপস্থিতি আরও পূর্বদিকের খাদ্যসংগ্রাহক বা খাদ্য উৎপাদন ও পশুপালনের দিকে কিছুটা অগ্রসর সংস্কৃতিগুলির ওপর কোনওভাবেই প্রভাব বিস্তার করেনি—এটা হতে পারে না। সিন্ধু সভ্যতার কাঁচামালের চাহিদা এবং অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর সমসাময়িক সংস্কৃতিগুলির নিজস্ব প্রয়োজন—দুভাবেই একটা যোগসূত্র গড়ে উঠতে পারে। যাই হোক না কেন, অনুমান করা সঙ্গত যে, অন্তরীপখণ্ডে খ্রি.পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে কৃষি সংস্কৃতির যে ছবি পাই তাতে সিন্ধু সভ্যতার যথেষ্ট প্রভাব আছে। অন্তরীপখণ্ডের যে অঞ্চলগুলির সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কম সে সব অঞ্চলে লাঙলভিত্তিক কৃষিজীবনে উত্তরণ একমাত্র সিন্ধু সভ্যতার প্রভাবেই হতে পারে। গুজরাট ও দোয়াব অঞ্চলের ভেতর দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার স্রোত গঙ্গা উপত্যকা এবং অন্তরীপভাগের ভারতবর্ষে মিশে গিয়েছিল—ভৌগোলিকভাবে এটা তর্কাতীত। উত্তরের পার্বত্য বলয় বাদ দিলে আমরা অন্তরীপভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের যে সকল সংস্কৃতির কথা আলোচনা করব তাদের উৎপত্তির কারণ সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তাদের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর সংস্কৃতির মিলন। ভৌগোলিক দিক থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার ধারা অন্তরীপভাগের ভারতবর্ষে মিশে যাচ্ছে।
২ উত্তরের পার্বত্য বলয়
তিনটি অঞ্চলের কথা এখানে বলতে হয়। পেশোয়ার থেকে চিত্রল, কাশ্মীর ও লাডাখ এবং উত্তরপ্রদেশের হিমালয় বলয়। প্রথম অঞ্চলটির প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতি বিবর্তনের মূল সাক্ষ্য এসেছে গালিঘাই নামক একটি পার্বত্য গুহা থেকে। প্রথম পর্যায়ে—বোধহয় খ্রি. পূ. ৩০০০ অব্দ—হাতে গড়া মৃৎপাত্র, পাথর এবং হাড়ের তৈরি হাতিয়ার, আর জন্তুর ভেতর হরিণ ও শুয়োর। দ্বিতীয় পর্যায়ে চাকে গড়া মৃৎপাত্র—খননকারীর মতে সিন্ধু সভ্যতার প্রভাব লক্ষ করা যায়, আর তৃতীয় পর্যায়ে আবার হাতে গড়া মৃৎপাত্র, যার তলাতে চাটাইয়ের দাগ, পাথর এবং হাড়ের তৈরি হাতিয়ার। চতুর্থ পর্যায়ে কুমোরের চাকে গড়া মৃৎপাত্র আর অল্প তামার ব্যবহার। পঞ্চম থেকে সপ্তম পর্যায়কে বলা হয়েছে ‘গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি’র প্রথম, মধ্য ও শেষ তিনটি পর্যায়। শেষ পর্যায়টি ছিল খ্রি. পূ. দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক পর্যন্ত। ‘গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি’র নামকরণ হয়েছে পেশোয়ার চিত্রল অর্থাৎ প্রাচীন গান্ধার অঞ্চলে পাওয়া, বিশেষ করে স্বাত নদীর উপত্যকায়, এক ধরনের সমাধি থেকে। সমাধিতে শরীর পুরো শোয়ানো, তবে ভাঁজ করে—আবার সেই সঙ্গে দাহ করার পর দেহাস্থি পাত্রে রাখাও আছে। তামার ব্যবহার, পাথরের টুকরো সাজিয়ে বাড়িঘর, গম, যব চাষ, এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামালের ব্যবহার, যথা: সোনা, রূপা, আলাবাস্টার, কার্নেলিয়ান, জেড, লাপিস লাজুলি, ওনিক্স সার্পেনটাইন, ঝিনুক, হাতির দাঁত ইত্যাদি দেখা যায়। স্থানীয় গিরিবর্ত্মের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়া এই অঞ্চলের সংলগ্ন এবং কিছু দ্রব্যের সঙ্গে ওই অঞ্চলের সাদৃশ্য স্পষ্ট। এখনও এই দুই অঞ্চলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।১
কাশ্মীরের বারামুলা, অনন্তনাগ ও শ্রীনগর অঞ্চলে ৩০টির বেশি নব্যপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্র পাওয়া গেছে। দুটি কেন্দ্রে—বুরঝাহম২ ও গুফ্ক্রাল—খননকার্য করা হয়েছে। দ্বিতীয় কেন্দ্রটিতে একেবারে প্রথম পর্যায়ের কোনও মৃৎপাত্র পাওয়া যায়নি। অন্তত হাজার বছর ধরে এই সংস্কৃতিটি ছিল অনুমান করা যায়। বুরঝাহম-এর সূত্রপাতের তারিখ খ্রি. পূ. ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি হতে পারে। পাওয়া যায়: লম্বা গলার এবং তলাতে চাটাইয়ের ছাপ দেওয়া হাতে গড়া মৃৎপাত্র; পাথর এবং হাড়ের বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার; পরের দিকে অল্প তামার ব্যবহার; ৭-৮ একর বা একটু বেশি পর্যন্ত বসতির আয়তন, মাটিতে বড় আয়তনের গর্ত করে ওপরে খুঁটির ওপর আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি ঘর; গম, যব, মসুর ডাল চাষ, গৃহপালিত গরু, ভেড়া, ছাগল, বুনো ‘আইবেক্স’ (ibex) হরিণ; এ ছাড়া পাথরের পুঁতি ইত্যাদি জিনিস—সব নিয়ে কাশ্মীরের এই নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি। সমাধি পাওয়া গেছে এবং সমাধিতে কোথাও কোথাও নেকড়ে এবং আইবেক্স-এর কবর পাওয়া গেছে। পাথরের হাতিয়ারের ভেতর কুড়াল এবং সেই জাতীয় হাতিয়ারই বেশি। তবে লম্বা, আয়তাকার এবং ছিদ্র বিশিষ্ট একটি হাতিয়ার, যাকে মনে করা হয়েছে শস্য কাটার আয়ুধ বা কাস্তে, তা মধ্য এশিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া গেছে। এতে মনে হয় কাশ্মীরের এই সংস্কৃতির সঙ্গে হিমালয় পেরিয়ে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল।
আরও প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে লাদাখ থেকে।৩ লেহ্-র প্রায় ১০০ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে, প্রায় ৩৯০০ মিটার অথবা ১৩০০০ ফুট উচ্চ, সিন্ধুর একটি ছোট অপরিসর উপত্যকাতে কিয়ারি গ্রামে খননকার্য করা হয়। এই ধরনের উচ্চতার উপত্যকাতে এখনও পশুচারকেরা পশুর পাল নিয়ে আসেন গ্রামের মাঠগুলিতে, যখন নদীতীরে ঘাস পাওয়া যায়। এখানে খনন করে শিলনোড়া জাতীয় পাথর, পোড়ানো মাটির গোলা এবং আগুন জ্বালানো চুলার চিহ্ন পাওয়া গেছে; এ ছাড়া কিছু মৃৎপাত্র এবং গরু, ভেড়া ও ছাগলের হাড়। রেডিওকার্বন তারিখ (ঠিক করে নিলে) খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। গৈক বলে আর একটি জায়গা থেকে এই ধরনের অবশেষ পাওয়া গেছে।
কাশ্মীরের ব্যাপারে যা লক্ষণীয় এবং যার প্রমাণ গুফ্ক্রাল থেকে এসেছে তা হচ্ছে নব্য প্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির পর ‘মেগালিথিক’ (মেগা = বড়, লিথিক = পাথরের; বড় পাথর দিয়ে তৈরি সমাধি; কাশ্মীরে এই ধরনের সমাধির ওপর বড় লম্বা, স্তম্ভের মতো পাথর দাঁড় করানো—একে ‘মেনহির’ বলে) পর্যায়—এর একটি বড় বৈশিষ্ট্য লোহার ব্যবহার। গুফ্ক্রালে এই পর্যায়ের তারিখ খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। লোহার ব্যবহার বাদ দিয়ে অঞ্চলের গ্রামীণ ধারাতে যে বিশেষ পরিবর্তন এসেছিল তা মনে হয় না। ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত কাশ্মীরে এই নব্যপ্রস্তরযুগীয় ও লৌহ ব্যবহারকারী মেগালিথিক সংস্কৃতির ধারা চলেছে।
উত্তরপ্রদেশে হিমালয়ের সাক্ষ্য আলমোড়া অঞ্চলে।৪ এখানে কয়েক ধরনের ‘মেগালিথ’ সমাধি পাওয়া গেছে। কয়েকরকম মৃৎপাত্র, যার ভেতর লম্বা পা-লাগানো বাটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, পাওয়া গেছে গাগ্রি-গোল বলে একটি জায়গা থেকে; তারিখ খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। এখানে লোহার ব্যবহার পাওয়া যায়নি; তবে উলেরি বলে একটি জায়গা থেকে লোহা পাওয়া গেছে এবং সেখানে তারিখ খ্রি. পূ. ৮০০-১০০০ অব্দ।
তা হলে আমরা দেখছি যে, উত্তরে পার্বত্য বলয়ে অনেকটা জায়গা জুড়েই যথেষ্ট প্রাচীন কৃষিজীবন-পশুপালন জীবনের নিদর্শন পাচ্ছি। হিমালয় পেরিয়ে পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে এদের কিছু যোগাযোগ স্বাভাবিক এবং তা পাওয়াও যাচ্ছে। একেবারে পূর্বদিকেও একটু চিহ্ন আছে যদিও এখানে কোনও খনন হয়নি বা তারিখ বেরোয়নি। দার্জিলিং পাহাড়ে এবং সিকিমে পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে যে চাষ করা হয় সে ধরনের ক্ষেতে পাথরের নিড়ানি জাতীয় অনেক হাতিয়ার পাওয়া গেছে। কোনও খনন করার মতো কেন্দ্র এখনও আবিষ্কার হয়নি। পার্বত্য বলয়ের সাংস্কৃতিক ধারাটি বলয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে একই হবে এটা মনে করা যায় না। কিন্তু এই বলয়ে একটি সুপ্রাচীন কৃষি এবং পশুপালনের ধারা আছে এটা মনে রাখা প্রয়োজনীয়।
৩ দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান অথবা মেবার সমতল৫
এই অংশে আমরা যে সমস্ত আঞ্চলিক সংস্কৃতি বা প্রাচীন জীবনের ভিত্তি আলোচনা করব তার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। চাকে গড়া চিত্রিত মৃৎপাত্র— বিভিন্ন অঞ্চলে চিত্রণের তফাত আছে; তামার ব্যবহার—কোথাও কম, কোথাও অপেক্ষাকৃত বেশি—সঙ্গে পাথরের ‘মাইক্রোলিথ’ জাতীয় হাতিয়ার; দক্ষিণ ভারতের ‘নব্যপ্রস্তরযুগীয়’ কুড়াল এবং অন্যান্য হাতিয়ার মাইক্রোলিথ জাতীয় হাতিয়ারের তুলনায় বেশি—ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে এই ধরনের সংস্কৃতিগুলিকে ‘নব্যপ্রস্তরযুগীয় তাম্রপ্রস্তরযুগীয়’ সংস্কৃতি বলা হয়। একটা সময়ের পর অনেক অঞ্চলেই লোহার ব্যবহার শুরু হয়। রাজস্থানের মেবার অঞ্চলে বানাস, গাম্ভীরি, বেরাচ নদী—মূল উপত্যকা বানাস নদীর। ৯০টির বেশি কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে প্রধানত উদয়পুর, ভিলওয়াড়া ও চিতোরগড় জেলায়—ওদিকে অন্যান্য জেলার ভেতর আজমির, জয়পুর ও টঙ্ক পর্যন্ত কেন্দ্র আছে এবং সংলগ্ন মধ্যপ্রদেশের মান্দাসেরে। নদীর ধারে ধারে বসতি, ৫-১০ মাইল পর পর, ২ একর থেকে ১০ একর পর্যন্ত সাধারণ আয়তন। সবচাইতে বড় কেন্দ্র মনে হয় উদয়পুর শহরের প্রান্তে অবস্থিত, আহার (২৭.৫ একর), যার নাম অনুযায়ী এই সংস্কৃতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আহার সংস্কৃতি’। চিতোরগড়ের গিলুণ্ড কেন্দ্রে খননকার্য হয়, আর সম্প্রতি উদয়পুরের ৪০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে বালাথাল নামক কেন্দ্রে খননকার্য হয়েছে। বালাথালের আয়তন ৭-৮ একর এবং এখানে দুটো পর্যায়—তাপ্রস্তরযুগীয় এবং খ্রি. পূ. ৫ম শতক থেকে ঐতিহাসিক কাল। তাম্রপ্রস্তর যুগের সূত্রপাত নিয়ে এখানে দু-একটি কথা বলা যেতে পারে। ৪টি রেডিওকার্বন তারিখ, যা খননকারীদের রচনায় পাওয়া যায়, তা খ্রি. পূ. ২৪০০ থেকে ১৮৮০ অব্দ। খ্রি. পূ. ১৮৮০ অব্দ তারিখটি তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির শেষের দিকে বলা হয়েছে এবং সেই ভিত্তিতে এই সংস্কৃতির অবশেষে বালাথাল খ্রি. পূ. ১৮০০ অব্দ বলা হয়েছে। খ্রি. পূ. ২৪০০ অব্দের এবং তার কাছাকাছি তারিখগুলিকে মধ্য পর্যায়ের তারিখ বলা হচ্ছে। সংশোধন করলে এই তারিখগুলির সত্যকার তারিখ হবে খ্রি. পূ. ২৯০০ অব্দের কাছাকাছি। মধ্য পর্যায়ের যদি এই তারিখ হয় তার আদি পর্যায়ের কী তারিখ হবে? বিতর্কের ভেতর না গিয়েও স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে এই তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির সূত্রপাত খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ পাদে। নিশ্চিতভাবে এই সংস্কৃতি সিন্ধু সভ্যতার আদি, পরিণত ও শেষ পর্যায়ের সমসাময়িক। প্রাপ্ত তথ্য থেকে এ অনুমান করা যায় যে আহারের থেকে বালাথালে বসতি প্রাচীন।
সব মিলিয়ে সাংস্কৃতিক সাক্ষ্য নিম্নরূপ। পাথরের টুকরো সাজিয়ে ভিতের ওপর মাটির বা মাটি লেপা বাড়ি—দুরমুশ দিয়ে শক্ত করা মেঝে। গিলুণ্ডে পোড়া ইটের বড় দেওয়াল দেখা গেছে তবে অন্যত্র পাওয়া যায়নি। আহারে একটি বাড়ি প্রায় ৩৪ ফুট লম্বা এবং মাঝখানে মাটির দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা। মৃৎপাত্রের বিশদ বিবরণ এখানে অপ্রয়োজনীয়; কয়েকরকম মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। সব ধরনের মৃৎপাত্র কেন্দ্রেই তৈরি হয়নি। মৃৎপাত্রের কাদার সঙ্গে স্থানীয় এবং অন্য কেন্দ্রে ব্যবহৃত মৃৎপাত্রীয় কাদার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তুলনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেছে। গুজরাটের সিন্ধু সভ্যতা কেন্দ্রগুলির সঙ্গে একটা যোগাযোগ ছিল বোঝা যাচ্ছে। তবে ‘আহার সংস্কৃতি’র সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃৎপাত্র হচ্ছে ‘কালো ও লাল’ (Black and Red) রং-এর। ভেতরটা এবং কানার ও গলার কিছুটা কালো, বাকিটা লাল— হাঁড়িগুলিকে ভাটায় উলটো করে বসানোর ফল। কালোর ওপর সাদা জ্যামিতিক চিত্রণ আছে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণত ছোট ছোট রেখা ও বিন্দু দিয়ে। কৃষিজীবনের সাক্ষ্য ব্যাপক—বালাথাল থেকে গম, যব, দুই রকম বাজরা (‘সেটারিয়া’ ও ‘পানিকাম’ ‘মিলেট’), কয়েকরকমের ডাল (ছোলা, মুগ, মাষকলাই নিশ্চিত), এ ছাড়া বিভিন্ন উদ্ভিদের চিহ্ন। গৃহপালিত পশুর ভেতর গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, কুকুর; বন্যদের ভেতর হরিণ, ময়ূর, মোরগ, কাছিম, মাছ, কয়েকরকম শামুকের চিহ্ন। গুজরাটে এবং রাজস্থানের কিছু স্থানীয় গবাদিপশুর সঙ্গে বালাথাল থেকে পাওয়া গবাদিপশুর হাড়ের মিল পাওয়া গেছে। তামার হাতিয়ার কিছুসংখ্যায় সর্বত্রই আছে; আহারে স্থানীয়ভাবে তামা গলানো হত; রাজস্থানের এই অঞ্চলে তামার আকর যথেষ্ট; স্থানীয় এই তামাই নিশ্চয় ব্যবহৃত হত। ভিলওয়াড়া জেলায় আগুন্ছা নামক একটি জায়গায় বিস্তীর্ণ ও গভীর সিসা এবং তামার সংস্থান আছে; এখানে এই সংস্কৃতির কেন্দ্র আছে। ধাতুবিদ্যায়, আকর সন্ধানে এই সংস্কৃতির যথেষ্ট কৃতিত্ব ছিল মনে করা যেতে পারে। স্টিয়েটাইট, ঝিনুক, অ্যাগেট, জ্যাসপার, কার্নেলিয়ান ও লাপিস লাজুলি পাথরের পুঁতি এবং পোড়ামাটির পুঁতি এবং পুঁতি-জাতীয় জিনিস পাওয়া গেছে। কয়েকটি কার্নেলিয়ান পাথরের পুঁতিতে সাদাটে দাগ দেওয়া—এটি সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। লাপিস লাজুলিও বাণিজ্যের ইঙ্গিত করে। ঝিনুক গুজরাট উপকূল থেকে এসেছিল।
আহার নিয়ে আর একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করা দরকার। প্রসঙ্গটি নিয়ে বিতর্ক আছে কিন্তু আহারে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির তিনটি পর্যায়ের ভেতর মধ্য পর্যায় থেকে লোহা পাওয়া যাচ্ছে। তারিখ খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম পাদে (সংশোধন করে নিলে)। তবে, অন্যদিক থেকে সংস্কৃতির কোনও পরিবর্তন আসেনি—একই মৃৎপাত্র, একই সংস্কৃতির ধারা—শুধু এতে ‘লোহা’ সংযোজিত হয়েছিল।
৪ মালব অধিত্যকা৬
দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব জুড়ে মালব অধিত্যকা। অনেকটা বড় সমতল জায়গা—‘কালো তুলা-মাটি’র দেশ (Black Cotton Soil)—মাঝে মাঝে সম-মালভূমি। দক্ষিণ অংশ বিন্ধ্যে মিশে গেছে; ওপরের দিক রাজস্থানে। নর্মদা দক্ষিণদিকে —তা ছাড়া, চম্বল, কালি সিন্ধু, বেতোয়া ইত্যাদি। জমি উর্বর এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারতে যেতে গেলে এই অঞ্চলের ভেতর দিয়েই রাস্তা। ভারতবর্ষের একটি ইতিহাস-সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রাচীন বিদিশা, উজ্জয়িনী নগরী, সাঁচী স্তুপ, মান্ডু, ধার, বর্তমান ভোপাল—সব এই অঞ্চলে।
এই পর্যন্ত অনুসন্ধানের ফলে মালব অধিত্যকায় একশতর বেশি প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম কেন্দ্র পাওয়া গেছে। কায়থা এবং নভদাতোলি নামক দুটি কেন্দ্রের খ্যাতি বেশি কারণ এদের খননকার্যের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আছে। এ ছাড়া নাগদার কথা বলা যেতে পারে। কায়থা ও নভদাতোলির তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও এরও খননকার্যের পূর্ণ বিবরণ আছে। প্রথম বসতির পরিচয় উজ্জয়িনীর কাছে কালি সিন্ধু নদীর ওপর কায়থায়। তারিখ খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা একটু পরে। প্রথম পর্যায়ে অন্তত তিনরকম কুমোরের চাকে গড়া মৃৎপাত্র, কিছু তামার কুড়াল এবং বালা, মাইক্রোলিথ এবং ক্রিস্টাল, অ্যাগেট, কার্নেলিয়ান এবং স্টিয়েটাইট পাথরের পুঁতি। দ্বিতীয় পর্যায় ‘আহার সংস্কৃতি’র মৃৎপাত্র নিয়ে। পরিষ্কার বোঝা যায় দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানের এই সংস্কৃতি মালব অধিত্যকাতেও বিস্তৃত হয়েছিল। তৃতীয় পর্যায়ের নিদর্শনকে বলা যায় ‘মালব সংস্কৃতি’র অন্তর্ভূক্ত। এই মালব সংস্কৃতির বিশদ পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম নর্মদা তীরবর্তী নভদাতোলি নামক কেন্দ্রের খনন থেকে। প্রায় ৪০ একর আয়তনের একটি গ্রাম। সময় খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ। মাটি, গাছপালা দিয়ে বানানো গোলাকৃতি এবং চৌকো দুধরনের বাড়িঘর। গোলাকৃতি ঘরগুলির ব্যাস ১ থেকে ৪.৫ মি; ছোটগুলি শস্য রাখার জায়গা অথবা গোলা হিসেবে ব্যবহার হতে পারত। আর বড়গুলি থাকবার জায়গা হিসেবে। চৌকো বাড়িগুলি ৫-৬ মি. লম্বা। মেঝে এবং দেওয়াল চুন দিয়ে লেপা। বাড়িগুলির ছাদ অবশ্যই খড় জাতীয় জিনিস দিয়ে বানানো। বাড়িগুলির মাঝে কিছু ফাঁক ছিল; তা ছাড়া গ্রামটিকে ঘন-সন্নিবদ্ধ গ্রামই বলা যায়। মূল মৃৎপাত্র লালের ওপর কালো চিত্রিত। লম্বা পা-ওলা চিত্রিত বাটি, অনেকটা কোশাকুশির কোশার মতো দেখতে একটি চিত্রিত পাত্র এই সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য। চিত্রণ মূলত জ্যামিতিক ধরনের; মানব-মানবী মূর্তিরাও এখানে কাঠির মতো; কেউ কেউ লম্বা চুল নিয়ে। মাইক্রোলিথ প্রচুর। তামার ব্যবহার কিছু সীমিত তবে জিনিসপত্রের ধরন বেশ ছড়ানো—যথা কুড়াল, তার দিয়ে বানানো আংটি, বালা, মাছ ধরার বড়শি, নখ-কাটা/মসৃণ করার জিনিস, কাঠের মিস্ত্রীদের ব্যবহার করার বাটালি (চিজেল), মোটা পিন, আর মাঝখানে শিরদাঁড়া নিয়ে একটি তরোয়ালের টুকরো। এ ছাড়া আছে পাথরের শিলনোড়া, হাতুড়ির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন পাথর; মাটিতে গর্ত করে বীজ পোঁতার জন্য যে ছুঁচলো লাঠি ব্যবহার করা হয় তাকে ভারী করার জন্য, যাতে গর্ত করা সহজ হয় সেজন্য, গোল, ছিদ্রযুক্ত, এমন অনেক রকম পাথর। বহু জিনিস দিয়ে তৈরি পুঁতি পাওয়া গেছে; শুধু নভদাতোলিতেই আগেট, অ্যামাজনাইট কার্নেলিয়ান, চ্যালসিডোনি, ফেঁয়স, কাচ, জ্যাসপার, লাপিস লাজুলি, স্টিয়েটাইট, ঝিনুক ও পোড়ামাটির ব্যবহার পাওয়া গেছে পুঁতির জন্য। অনেকরকম শস্যের চাষ হত—নভুদাতোলিতেই দু ধরনের গম, তিসি, মসুর, কালো ও সবুজ চানা, মটর এবং খেসারি। ধানের শস্যও আছে তবে একেবারে প্রথমেই পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে নভদাতোলির দ্বিতীয় পর্যায় থেকে। এ ছাড়া আমলকির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতো বানাবার পোড়ামাটির ‘তকলি’, গবাদিপশুর মৃর্তি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এরান নামক একটি জায়গাতে খননকার্যে দেখা গেছে মালব সংস্কৃতি তিনদিক থেকে বীণা নদী দিয়ে ঘেরা; তবে চতুর্থদিকে একটি বড় ও চওড়া (প্রথমে ৩০.৪৮ মি. চওড়া; পরে ৪৫.৮২ মি.) মাটির প্রাকার এবং তার সঙ্গে একটি পরিখা। অন্যান্য সব নভদাতোলির মতোই, তবে এরানে মালব সংস্কৃতির সময়ে এই ধরনের প্রাকার ও পরিখার সংস্থান লক্ষণীয়। এরান থেকে এক টুকরো সোনাও পাওয়া গেছে। দাংওয়াদা বলে একটি জায়গাতে খনন করে মালব সংস্কৃতির স্তরে অগ্নিবেদি বা ‘যজ্ঞ-বেদী’র পরিচয় পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লিঙ্গ এবং ষাঁড় পূজার অস্তিত্বের অনুমান করা হয়েছে। নাগদাতে খননকার্যের একটি গুরুত্ব হচ্ছে এখানে লৌহ ব্যবহারের তারিখ; খ্রি. পূ. সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ। ‘মালব সংস্কৃতি’র বিশেষ কোনও পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না; শুধু লোহার ব্যবহার যুক্ত হয়েছিল।
মালব অধিত্যকায় কায়থা-আহার-মালব এই তিনটি কৃষি সংস্কৃতি পর্যায় ছাড়াও অন্য সাংস্কৃতিক পর্যায় থাকতে পারে, যার পরিচয় আমরা এখনও বিশদভাবে পাইনি। সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের চিহ্ন কয়েকটি জায়গায় পাওয়া গেছে।
তাপ্তি নদী পেরিয়ে মহারাষ্ট্রের দ্বারপ্রদেশে প্রকাশ এবং বাহাল-টেকওয়াড়া নামক দুটি জায়গায় খনন করে বোঝা গেছে যে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির প্রসার তাপ্তি উপত্যকাতেও হয়েছিল। তাপ্তি উপত্যকার এই অঞ্চল অবশ্য মহারাষ্ট্রের এবং মহারাষ্ট্রে এই যুগের সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক গবেষণা এবং প্রকাশনা হয়েছে।
৫ মহারাষ্ট্র৭
নাসিক-জরওয়ে, নেভাসা মহারাষ্ট্রে গোদাবরী-প্রবর (‘প্রবর’ গোদাবরীর উপনদী) উপত্যকার প্রসিদ্ধ তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র; তবে বর্তমান আলোচনার জন্য দাইমাবাদ এবং ইনামগাঁও খননকাযের বিবরণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দুটি কেন্দ্র থেকেই মহারাষ্ট্রে, তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া গেছে।
প্রথমে তাপ্তি ও গোদাবরীর মাঝে ‘সাভালদা’ সংস্কৃতি। তারিখ আনুমানিক খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে অথবা খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমে। কাওথে বলে একটি জায়গায় প্রায় ২০ হেক্টর এর একটি কেন্দ্র—৫০ একরের বেশি। ৫০ সে. মি. পুরু একটি সংস্কৃতিস্তর এই পর্যায়ের বলে অনুমান করা হয়েছে। এর বাড়িঘরের সঙ্গে স্থানীয় ধাঙর উপজাতির লোকেদের বাড়িঘরের ভাল মিল আছে; কিছু বাঁশ, কাঠ একসঙ্গে নিয়ে মাথার দিকটা বেঁধে নীচের দিকটা ভালভাবে ছড়িয়ে একটি গোলাকৃতি জায়গা করা এবং তারপর ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত লতাপাতা, খড় ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দেওয়া। বলা বাহুল্য, এটা ঝুপড়ি জাতীয় ব্যাপার। কাওথেতে ঘরের যে জায়গাটা ছেয়ে দেওয়া হত সেটা মাটিতে গর্তের মতো কেটে বানানো লেপা মেঝে; বর্তমানের ধাঙরদের বেলায় মেঝে গর্ত কেটে করে না অবশ্য। হাড়ের হাতিয়ার কাওথেতে অনেক; গরু মোষ, ভেড়া, ছাগল, শূয়োর, কুকুর পোষ মানানো; বন্যদের ভেতর কয়েক জাতের হরিণ ইত্যাদি। ঝিনুক, ‘ওপাল’, কার্নেলিয়ান এবং পোড়ামাটির পুঁতি; কয়েকরকমের ‘মিলেট’ বা জোয়ার বাজরা, চানা এবং মুগ ডাল। মৃৎপাত্র লালের ওপর কালো চিত্রিত, তবে চিত্রণশৈলী এবং মৃৎপাত্রের পোড়ানোতে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যাতে এই ধরনের মৃৎপাত্রকে সাভালদা সংস্কৃতির বলে চিহ্নিত করা যায়। কাওথের চাইতে এই সংস্কৃতির বেশি নিদর্শন পাওয়া দাইমাবাদে। এখানে পাওয়া গেছে আয়তাকার মাটির বাড়ি, তামা ব্যবহারের নিদর্শন, মাইক্রোলিথিক ব্লেড-ভিত্তিক হাতিয়ার সমূহ, বিভিন্ন হাড়ের এবং পাথরের জিনিস ও হাতিয়ার, ঝিনুক, কার্নেলিয়ান, স্টিয়েটাইট এবং পোড়ামাটির পুঁতি, আগেট পাথর দিয়ে বানানো একটি লিঙ্গ, গম, যব, এবং মসুর, মুগ, চানা ইত্যাদি ডাল। বাড়িগুলি কখনও কখনও বেশ বড়—একটি ক্ষেত্রে ৭×৫ মি.; একটির বেশি কামরা, একদিক খোলা, অর্থাৎ বেড়া নেই, উনুন, মৃৎপাত্র এবং শস্য রাখার গর্ত। ঘরের একদিক খোলা রাখার ব্যাপারটা ভারতবর্ষে কোথাও কোথাও এখনও আছে। কাওথেতে যে কয়েকটি সমাধি পাওয়া গেছে তাতে কোনও মৃৎপাত্র নেই পূর্ণ বয়স্কদের শরীর সোজা করে শোয়ানো, অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভাঁজ করে।
সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের বসতি নিদর্শনও তাপ্তি এবং গোদাবরীর মাঝে এবং এর প্রামাণিক সাক্ষ্য এসেছে দাইমাবাদ দ্বিতীয় পর্যায় থেকে। দুটি পোড়ামাটির গোল সিলমোহর এবং চারটি মৃৎপাত্রের টুকরো—এদের ওপর সিন্ধু সভ্যতার লিপিচিহ্ন উৎকীর্ণ আছে। প্রায় ২০ হেক্টর জায়গা নিয়ে বসতি, মাটির দেওয়ালের বাড়ি; এক ক্ষেত্রে বাড়িটির আয়তন ৬.৫× ৪.৩ মি। দেওয়ালগুলি ৩০-৫০ সে. মি. পুরু। বসতির ভেতরই একটি সমাধি পাওয়া গেছে—সমাধিটি কাঁচা ইটের তৈরি (সিন্ধু সভ্যতার কাঁচা ইটের অনুপাতে তৈরি ৪:২:১)—শরীর লতাপাতা দিয়ে জড়িয়ে সমাধি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মাইক্রোলিথ, তামা, মিহি পাথরের পুঁতি, হাতির দাঁতের পেনডেন্ট, পোড়ামাটির একটি ‘স্কেলের’ টুকরো, সিন্ধু সভ্যতার পোড়ামাটির কেক, বিভিন্ন পাথরের জিনিস, গম, যব, কয়েক রকম ডাল পাওয়া যায়। দাইমাবাদে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের ছবিটি এই। তবে দাইমাবাদে খুব সম্ভবত এই পর্যায় থেকেই পাওয়া একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়। চারটি তামার জিনিস, গ্রামের লোকেরা ঢিবির ওপর থেকে মাটি খোঁড়ার ফলে পান—কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে নয়। পরে ঠিক যে জায়গাটায় বেরিয়েছিল প্রত্নতাত্তিকরা সেখানে খনন করে পর্যায়টি ঠিক করার চেষ্টা করেন। বেশির ভাগ প্রত্নতাত্ত্বিকের মত যে এই আবিষ্কারটি দাইমাবাদ দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের। চারটে জিনিসের ওজন সব মিলিয়ে ৬০ কিলোগ্রাম বা একটু বেশি। বোঝাই যাচ্ছে প্রত্যেকটি জিনিসই খুব ভারি। প্রথমটি একটি গণ্ডার; চারটি চাকার ওপর দাঁড় করানো; সামনের এবং পেছনের দুটি করে চাকা একটি বড় ছিদ্রযুক্ত ‘রড’ দিয়ে জোড়া লাগানো। দ্বিতীয়টি একটি হাতি; এটি একটি ‘প্ল্যাটফরম’ বা বেদির ওপর, বেদিটির সামনে পেছনে ছিদ্র করা দুটি করে পা। তৃতীয়টি একটি মোষ—এটিও বেদির ওপর, তবে এখানে বেদিটি গরুর গাড়ির বা মোষের গাড়ির মতোই একভাবে দুটি করে চাকার সঙ্গে জোড়া লাগানো, চতুর্থটি দুটি ষাঁড় দিয়ে টানা একটি রথের ওপর দাঁড়ানো একটি মানুষ। এই চতুর্থ নমুনাটি মোট ৪৫ সে. মি. লম্বা, ১৬ সে. মি. চওড়া; মানুষটি ১৬ সে. মি. লম্বা; ৩২ সে. মি. লম্বা একটি দণ্ডের সাহায্যে রথটি ষাঁড় দুটির সঙ্গে জোড়া। এই ধরনের নিদর্শনের প্রাপ্তি আমাদের মনে করায়—এই যুগ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও কত সীমিত। অবশ্যই এই ধরনের তামার ভারী নিদর্শন শুধু অলংকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়নি; কোনও ধর্মীয় গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। সবকটি উদাহরণই উৎকৃষ্ট শিল্প এবং ধাতুবিদ্যা জ্ঞানের পরিচায়ক। দাইমাবাদের তৃতীয় সাংস্কৃতিক পর্যায়কে বলা হয়েছে ‘দাইমাবাদ সংস্কৃতি’। বসতির আয়তন একরকম: অর্থাৎ ২০ হেক্টর। খারাপ ভাবে পোড়ানো লাল হলদেটে ক্রিম রঙের ওপর কালো চিত্রিত মৃৎপাত্র এই সংস্কৃতির প্রধান লক্ষণ। সমাধি আছে— সাধারণভাবে গর্ত খুঁড়ে; দাহের পর দেহাস্থি মৃৎপাত্রে রেখে এবং যাকে বলা হয়েছে ‘রূপক সমাধি’, অর্থাৎ গর্ত আছে, আর কিছু নেই। মাইক্রোলিথ আছে; সেই সঙ্গে বিভিন্ন রকম পাথরের পুঁতি, তামা গলানোর চিহ, বিভিন্ন পাথর এবং পোড়ামাটির জিনিস, ঝিনুকের বা শাঁখের বালা, গম, যব, বিভিন্ন রকম ডাল।
দাইমাবাদের চতুর্থ পর্যায় মালব সংস্কৃতির। এই সময়ই মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে (বর্তমান নাগপুর যে অঞ্চলে অবস্থিত) গ্রাম গড়ে উঠতে থাকে। এই অঞ্চলের তুলজাপুর গঢ়ি নামক একটি কেন্দ্রে মালব সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। শুধু দাইমাবাদের নয়, ইনামগাঁও থেকেও এই সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া গেছে। ইনামগাঁও-তে ২০টির মতো বাড়ি খনন করা হয়েছে এই পর্যায়ে—বাড়িগুলি ঘন সন্নিবদ্ধ তবে মাঝে ১-২ মি. ফাঁক। সব কটাই বড় (৭×৫ মি.), আয়তাকার, প্রাচীর দিয়ে ভাগ করা, নিচু মাটির দেওয়াল; ছাদ কোণ করে করা। ভেতরে মাটিতে গর্ত করে উনুন, ১ মি. ব্যাস আর ১ মি. গভীর শস্য রাখার গর্ত, কোথাও গোল মাটির বেদির ওপর বেত, লতাপাতা দিয়ে ‘গোলা’। কেউ কেউ গোলাকৃতি ঘরে থাকত; কেউ কেউ মাটিতে গর্ত করে, ওপরটা খুঁটি দিয়ে ছেয়ে নিয়ে। সমাধিতে সাধারণভাবে কোথাও দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও দেহাস্থি মৃৎপাত্রে রাখা আছে। এ ছাড়া গম, যব, বাজরা, বিভিন্ন রকম ডাল; মাইক্রোলিথ; তামার ব্যবহার, পাথরের পুঁতি ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এই পর্যায়ে দাইমাবাদে ঘরের মধ্যে ‘যজ্ঞবেদি’র চিহ্ন অনুমান করা হয়েছে।
মহারাষ্ট্রে এর পরের পর্যায়ের সংস্কৃতিটির নাম জরওয়ে সংস্কৃতি; জরওয়েতে এটি প্রথম বেরিয়েছিল। নেভাসাতে খনন করে এর ব্যাপক চিহ্ন পাওয়া যায়; তবে ইনামগাঁওতে আরও বেশি। এখন পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে এই পর্যায়ের ২০০ বা আরও বেশি গ্রামের চিহ্ন আছে। দাইমাবাদে এ সময় ৩০ হেক্টর এর বসতি, তবে বেশির ভাগ জায়গাতেই বসতি ১ থেকে ৩ হেক্টর; কোথাও কোথাও অবাধ থেকে ১ হেক্টর। কোনও কোনও ছোট কেন্দ্র গ্রাম থেকে ২-৩ কি. মি. দূরে—এমন হতে পারে শুধু চাষের সময় মূল গ্রাম থেকে এখানে গিয়ে লোক থাকত। মহারাষ্ট্রে এই প্রথাটি এখনও আছে। ইনামগাঁও-এ এই সময়ের বাড়ির আয়তন ৫×৩ মি. এবং ৭×৫ মি. এর ভেতর; বড় বাড়িগুলি বেশিরভাগই প্রাচীর দিয়ে ভাগ করা। বাড়ির ভেতরে ছোট ডিম্বাকৃতি আগুন জ্বালাবার জায়গা। উনুন, কখনও কখনও (বাতাসের ঝাপটা এড়াতে) উঁচু করে দেয়াল দেওয়া; বাইরে আঙিনাতে প্রায় সর্বত্র একটি বড় উনুন (১ মি. ×.৫ মি.); হয়তো শিকার করা মাংস ঝলসানোর জন্য। প্রায় প্রত্যেকটি উনুনের মাঝখানে একটা ছোট চ্যাপটা মাটি-মাখানো পাথর রাখা—রান্না করার হাঁড়ি বসানোর সুবিধার জন্য। অনেক সময় ভেতরে এবং কখনও বাইরেও অর্থাৎ বাইরের আঙিনাতেও, ১ থেকে ২ মি. ব্যাসের এবং সমপরিমাণ গভীর, ভেতরে চুন লেপা শস্য রাখার গর্ত। এ ছাড়া ১.৫ মি. ব্যাসের আর ১০ সে. মি. উঁচু মাটির গোলাকার বেদি। যার ওপর এখনকার মতো গোলা বসানো হত। ঘরের মেঝে কাদা এবং বালি পর পর স্তরে রেখে দুরমুশ পিটিয়ে করা; বাইরের আঙিনাও ভালভাবে তৈরি করা হত। এই আঙিনার মাটিতে নাইট্রোজেন আধিক্য দেখে অনুমান করা যায় যে, এখানে গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল বাঁধা থাকত।
জরওয়ে সংস্কৃতির শেষ পর্যায়ে গোলাকার ঘরের সংখ্যা অনেক বেশি এবং কয়েকটি এরকম বাড়ি একসঙ্গে একটি আঙিনা নিয়ে অথবা একটি আঙিনার চারপাশে। এই পর্যায়ের আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, বসতির পশ্চিম দিকে ১১৮ মি. লম্বা, ৩.৫৩ মি. গভীর এবং ৪ মি. চওড়া একটি জলসেচের খাল তৈরি করা এবং সঙ্গে একটি ২.৪০ মি. চওড়া এবং ২৪০ মি লম্বা বাঁধ। হাত দিয়ে ঠেলা লাঙল এবং এক নাগাড়ে বীজ বোনার জন্য জিনিস—এই দুইটির ব্যবহার অনুমান করা হয়েছে। এই সব ছাড়া ইনামগাঁওতে এই পর্যায়ে আছে কুমোরের ভাটা, সোনার গয়না, তামা গলানোর চিহ্ন, চুন গলানোর ভাটা, পোড়ামাটির কিছু ছোট মূর্তি যা দেব-দেবী মূর্তি বলে অনুমান করা যায়; জন্তু এবং আগুন পূজার অনুমিত চিহ্ন, বড়দের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমাধি, ছোটদের পাত্রের ভেতর রেখে সমাধি ইত্যাদি। দেবদেবীর চিহ্ন বলে যা অনুমিত হয়েছে তার একটু বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে পোড়ামাটির মাতৃকামূর্তির কথা আসে—মাথা নিয়ে এবং মাথা বাদ দিয়ে। প্রথম শ্রেণীর ভেতর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ পাই নেভাসা থেকে। শরীরটিই মূল; মাথা, হাত, বুক, সহজে কাদা টিপে করা। তবু মাতৃকামূর্তি যে এতে সন্দেহ নেই। ইনামগাঁও থেকে পাওয়া দুটি উদাহরণ আকর্ষণীয়। একটি জরওয়ে সংস্কৃতির প্রথম দিকের বাড়ির মেঝেতে একটি ছোট গর্তের ভেতর লম্বা গোলাকৃতি অর্থাৎ ডিমের মতো একটি মাটির আধার পাওয়া যায়। এর ঢাকনা তুলে দেখা যায় যে ভেতরে প্রলম্ব বক্ষ বিশিষ্ট মাটির নারীমূর্তি; আর ঢাকনার ওপর একটি ষাঁড়ের মূর্তি আর সঙ্গে একটি মস্তক-বিহীন নারীমূর্তি। এই মূর্তিটির তলপেটে একটি ছোট ছিদ্র এবং ষাঁড়ের পেটের ওপরও তাই; একটি কাঠি দিয়ে দুটিকে জুড়ে দেওয়া যায় এবং তাতে ষাঁড়ের ওপর নারীমূর্তিটিকে আসীনা দেখা যায়। পরিষ্কার পরবর্তী কালের বাহনের ধারণার ছাপ এই উদাহরণটিতে বোঝা যায়। যেভাবে ঘরের কোণে গর্ত করে ছোট আধারের ভেতর সমস্ত জিনিসগুলি রাখা আছে—এতে আরও প্রমাণিত হয় যে, নারীমূর্তিদ্বয় হয়তো গৃহের দৈনন্দিন উপাসনার অংশ ছিল। ইনামগাঁওতেই এই পর্যায়ে উনুনের পাশে দুটি কাঁচা মাটির পুরুষ মূর্তি পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলের গ্রামে মানুষ এখনও আটা দিয়ে ওরকম পুরুষ মূর্তি তৈরি করে এবং তাদের গণেশ বলে পুজো করে। এই ধরনের কোনও বিশ্বাস তখনও কাজ করতে পারে।
মহারাষ্ট্রে জরওয়ে সংস্কৃতির মৃৎপাত্র লালের ওপর কালো চিত্রিত। মৃৎপাত্রগুলি অনেক ক্ষেত্রেই কানা তোলা; বদনার মতো নল-ওলা পাত্রও আছে; চিত্রণ-শৈলী সাধারণত জ্যামিতিক লম্বা লাইন টেনে। এই সংস্কৃতি খ্রি. পূ. ৭০০ অব্দ পর্যন্ত ছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। আরও অনুমান করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে শুষ্কতা চারপাশে বাড়ে এবং সেই কারণে এই সংস্কৃতির লোক কৃষিজীবী থেকে পশুপালক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়। এই অনুমান বিতর্কিত, অনেকে স্বীকার করেন না। যদিও প্রত্যক্ষ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, খ্রি. পূ. ৭০০ অব্দের ভেতর মহারাষ্ট্রের এই সংস্কৃতিতে লোহার ব্যবহার শুরু হয়ে যাওয়ার কথা।
৬ দক্ষিণ ভারত৮
আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা এখানে কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা ও অন্ধ্রের সাক্ষ্য একসঙ্গে দেখব। কেরালার কথা সহজেই সারা যেতে পারে। প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম সংস্কৃতির কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখনও কেরালাতে পাওয়া যায়নি। তামিলনাড়ুতেও সাক্ষ্য সীমিত। যদিও যথেষ্ট ইঙ্গিত আছে। কাবেরী অববাহিকায় কোনও প্রস্তরযুগীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি ছিল না এটা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে মানা শক্ত। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে মূল সাক্ষ্য কৃষ্ণা উপত্যকার ওপরের ভাগে সীমিত—অর্থাৎ বর্তমান কর্নাটকে কৃষ্ণা, তুঙ্গভদ্রা, ভীমার (নীচের অংশ) উপত্যকা নিয়ে, আর অন্ধ্রতেও এই অঞ্চলেই। উপত্যকা ছাড়া এই অঞ্চলের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমতলের ভেতর আলাদা আলাদা দাঁড়ানো পাহাড়; চূড়ায় অনেক ক্ষেত্রেই কিছু সমতল জায়গা আছে। মনে হয় এই অঞ্চলে প্রথম পর্যায়ের গ্রামীণ বসতি এই ধরনের পাহাড় চূড়ায় এবং ঢালে শুরু হয়েছিল। সাঙ্গানাকাল্লু নামক একটি জায়গায় এর সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। প্রথম পর্যায়ে আপাতদৃষ্টিতে পুরাপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার সমূহ; দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘মাইক্রোলিথ’ এর পর একটি মাটির স্তর, অন্য কিছু নেই; তারপর নব্যপ্রস্তরযুগীয় পাথরের হাতিয়ার, কুড়াল ইত্যাদি পাওয়া যায়। নব্যপ্রস্তরযুগে তামার ব্যবহার ছাড়াই একটি আদি পর্যায় থাকতে পারে, যে পর্যায়ে হয়তো শুধু হাতে গড়া মৃৎপাত্র ছিল। এ ছাড়া গোলাকৃতি ও চৌকো দু ধরনেরই মাটির, লতাপাতার বাড়ি। কোথাও কোথাও পাথরের চাঁই বসিয়ে ভিত। মৃৎপাত্র সাধারণত আস্তে ঘোরে এমন ‘চাকে’ করা, ধূসর রংয়ের, অচিত্রিত (তবে অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম আছে)। পাথরের কুড়াল জাতীয় হাতিয়ার বহু রকমের, তবে মাইক্রোলিথও আছে প্রচুর পরিমাণে। তামা (এবং ব্রোঞ্জ, অর্থাৎ তামা ও টিনের মিশ্রণ) আছে তবে কম পরিমাণে। বিভিন্ন পাথরের পুঁতি এবং সোনার কানের অলংকার পাওয়া গেছে। মনে রাখা উচিত যে, ভারতবর্ষের আকরিক সোনা মূলত কর্নাটক এবং অন্ধ্রে। তাই, এই ক্ষেত্রে সোনার অলংকার পাওয়া বিস্ময়কর নয়। চাষবাস সম্পর্কে বিশেষ জানা যায়নি, তবে ‘রাগি’ বাজরা পাওয়া গেছে। ওয়াটগাল নামক একটি কেন্দ্রে সুপারি, লম্বা শিং এর গরু/ষাঁড়-এর পোড়ামাটির মূর্তি প্রচুর আছে। গবাদিপশুর প্রসঙ্গে এই অঞ্চলে পাওয়া অনেক ‘ছাই ঢিবি’র কথা আসে। একই জায়গায় বহু শতাব্দী ধরে গবাদিপশুর গোবর রেখে এবং কখনও কখনও তা পুড়িয়ে দিয়ে ছাই করার ফলে ধীরে ধীরে এই ছাই জমে এরকম টিবি হয়েছে। এগুলির অনেক রকম ব্যাখ্যা আছে, তবে মোটামুটি এগুলি গবাদিপশু রাখার জায়গা ছিল এটা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রথমে মনে করা হত যে এই ঢিবিগুলি বসতির বাইরে; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে অনেক ক্ষেত্রে এই ঢিবিগুলির আশপাশে বসতি আছে। সংস্কৃতিটিকে সাধারণভাবে বলা হয় ‘দক্ষিণ ভারতীয় নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি’। সূত্রপাতের তারিখ হয়তো খ্রি.পূ. ২৭০০ অব্দ। অন্যদিকে খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি তো নিশ্চয়ই; খ্রি. পূ. ১২০০/১৩০০ পর্যন্ত থাকা স্বাভাবিক। সম্প্রতি ওয়াটগাল এবং বুদিহাল নামক দুটি কেন্দ্রে খনন করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে, যা খ্রি. পূ. ৩০০০ অব্দ এবং হয়তো তার পূর্বে, শুধু মাইক্রোলিথ পাওয়া যায়, যেমন সাঙ্গানাকাল্লুতে। দ্বিতীয় পর্যায়ের দুটি ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি খ্রি. পূ. ২৭০০— ২৩০০, আর দ্বিতীয়টি খ্রি. পূ. ২৩০০—২০০০। প্রথম ভাগটির বিশেষত্ব হচ্ছে শস্য রাখার জন্য গর্ত, সুপারির সাক্ষ্য এখান থেকে পাওয়া গেছে; তা ছাড়া মাটির পাত্রের ভেতর দেহাস্থি রেখে একটি সমাধি, আর ৫টি পাথর ঢাকা পুরো সমাধি (চিত করে শোয়ানো, দুটি হাত তলপেটের ওপর বা নীচে)। মাইক্রোলিথই পাথরের হাতিয়ারের ভেতর পাওয়া গেছে, তবে কিছু টুকরো থেকে মনে হয় পাথরের কুড়াল ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত। শিলনোড়া জাতীয় পাথরের টুকরো পাওয়া গেছে, দুটি সামুদ্রিক ঝিনুকের পুঁতি আছে। মৃৎপাত্র হাতে গড়া, তবে আস্তে ঘোরানো ‘চাক’ এর ব্যবহার থাকতে পারে। মৃৎপাত্রের গায়ে রঙের অসমতা ও ছোপছোপ দাগ দেখে মনে হয় খোলা ভাটাতে মৃৎপাত্র পোড়ানো হত। দ্বিতীয় ভাগে বেশি সমাধির উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে; তা ছাড়া শস্য রাখার গর্ত আছে, সমাধিতে এবার মৃৎপাত্র দেওয়া হচ্ছে, যা পূর্বের ভাগটিতে দেওয়া হয়নি। মাইক্রোলিথ এর সংখ্যা প্রায় ছয়গুণ বেশি এই ভাগে; পাথরের কুড়াল জাতীয় হাতিয়ারও অনেক। সামুদ্রিক ঝিনুক আছে স্টিয়েটাইট পাথরের পুঁতি আছে। মৃৎপাত্র এখনও মূলত হাতে গড়া, তবে ‘চাক’-এ গড়া মৃৎপাত্রও কিছু আছে। কাজ করা এবং কাজ না করা শঙ্খের টুকরোও আছে। তামার উদাহরণ নেই; তবে থাকা স্বাভাবিক। এক টুকরো ছোট লোহা পাওয়া গেছে; তবে মনে করা হয়েছে যে এটা ওপরের স্তর থেকে এসে পড়েছে। মৃৎপাত্রের ঘষা চাকতি আছে—বাচ্চাদের খেলার জিনিস। পোড়ামাটির গবাদিপশু এবং নারীর মূর্তি দুটিই রয়েছে, তবে বেশি নয়। তৃতীয় পর্যায়ে খ্রি. পূ. ২০০০ অব্দের পর, হয়তো খ্রি. পূ. ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত। শস্য রাখার গর্ত আছে। শস্যের ভেতর পাওয়া গেছে এক ধরনের বাজরা আর ঘোড়ার ছোলা/ চানা। সমাধি সংখ্যায় কম পাওয়া গেছে। অন্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন সংখ্যায় অনেক বেড়ে যাচ্ছে, যেমন মৃৎপাত্র, পাথরের হাতিয়ার (মাইক্রোলিথ, কুড়াল জাতীয় হাতিয়ার দুই-ই), পাথরের পুঁতি, সামুদ্রিক ঝিনুক, সবই। শঙ্খের গলার মালা, স্টিয়েটাইটের নকশা করা কর্ণাভরণ এই পর্যায়ের আকর্ষণীয় উদাহরণ। তামা আছে, সঙ্গে তিন টুকরো লোহাও; তবে এখানেও অনুমান করা হয়েছে যে এগুলি ওপরের স্তর থেকে এসে পড়েছে। পোড়ামাটির পশু এবং মানুষ (স্ত্রী, পুরুষ দুই-ই) মূর্তি সংখ্যায় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া একটি পোড়ামাটির চওড়া টুকরোর ওপর লালচে গেরুটিতে একটি দাঁড়ানো মানুষের নকশা আছে। এখানে বলা ভাল যে, এই ধরনের বসতির আশপাশে পাথর ঠুকে ঠুকে থেবড়ে মানুষ, গবাদিপশু এদের প্রতিকৃতি করা হয়েছে। এই শিল্পকলা দক্ষিণ ভারতীয় নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। রায়চুর জেলায় ওয়াটগালে মানুষের যে নকশা গেরুমাটিতে মাটির ওপর আঁকা পাওয়া গেছে তা এই ধরনের শিল্পের অংশ। ওয়াটগলের চতুর্থ পর্যায় নিঃসন্দেহে লৌহ ব্যবহারকারী এবং যাকে দক্ষিণ ভারতীয় ‘মেগালিথিক সংস্কৃতি’ বলা হয় তার অংশ। মৃৎপাত্রের শৈলীতে পরিবর্তন আসছে; তবে হাতে গড়া মৃৎপাত্রের ধারা শেষ হয়নি। কালো এবং লাল মৃৎপাত্র তৃতীয় পর্যায়েই শুরু হয়েছিল; তবে এখন বেশি। ওয়াটগাল খনন থেকে দুটি জিনিস পরিষ্কার হয়েছে। যাকে আমরা মেগালিথ বা বড় পাথর ব্যবহার করা কবর বলি তা নব্যপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়ের ভেতরই শুরু হয়েছে (প্রথম দিকের পাথর ঢাকা কবর) আর নব্যপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি শুরু হওয়ার পর থেকে সংস্কৃতি তার নিজস্ব ধারায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পরবর্তী যুগের দিকে এগিয়ে গেছে।
বুদিহাল কর্ণাটকেরই গুলবর্গা জেলায়। বুদিহালে ‘ছাই ঢিবি’ এবং বসতি দুই-ই একই বসতি অঞ্চলে পাওয়া গেছে। ছাই ঢিবির আশপাশে বসতি অঞ্চল (১.৩৪ হেক্টর আয়তনের)। এক জায়গায় চার্ট পাথরের হাতিয়ার বানানো হত, আর এক জায়গায় মৃৎপাত্র জড়ো করে রাখা হত। পাথরের টুকরো কাদায় গেঁথে গোলাকৃতি ঘর। কিছু শিশু সমাধি পাওয়া গেছে বসতি অঞ্চলেই; সোজা মাটিতে গর্তের ভেতর, নইলে মৃৎপাত্রের ভেতর রেখে গর্তের ভেতর। মাইক্রোলিথ আছে, নব্যপ্রস্তরযুগীয় পাথরের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে তৈরি হাতিয়ার আছে। গরুর অর্থাৎ গবাদি পশুর ব্যবহার খুব বেশি, সঙ্গে ভেড়া, ছাগল, মোরগও আছে। বিভিন্ন পাথরের পুঁতি পাওয়া যাচ্ছে। বসতির ভেতরই একটি অঞ্চলে শুধু পশুর মাংস কাটা এবং হাড়ের হাতিয়ার তৈরির জন্য জায়গা ছিল। একটি জায়গায় ছাই, কাদা, ছোট ছোট মৃৎপাত্রের টুকরো, হাড়, কাঠকয়লা জলে ভিজিয়ে দুরমুশ করে জমির ওপর একটা কাঁকুরে আস্তরণ তৈরি করা হয়েছিল। উদ্ভিদের ভেতর কুল, চেরি জাতীয় ফল, আমলকি ও ঘোড়ার ছোলা পাওয়া গেছে। বুদিহাল সূত্রপাতের তারিখ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি।
অন্ধ্রতে সিঙ্গানাপল্লি, রমাপুরম, পাতপাদু ইত্যাদি কেন্দ্রে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। যথা চিত্রিত চাকে তৈরি মৃৎপাত্র, তামার ব্যবহার, মাইক্রোলিথ ইত্যাদি। অন্ধ্রের এই পর্যায় সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তবে মহারাষ্ট্র, মালব ইত্যাদি অঞ্চলের মতোই ছবি হবে।
৭ ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম, ত্রিপুরা ও অন্যান্য উত্তরপূর্বীয় রাজ্য৯
অন্ধ্রের কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকার পূর্বদিকে, উপকূল ধরে উজিয়ে এসে ওড়িশার মহানদী-বৈতরণী অববাহিকা। এর পেছনে পূর্বঘাট পর্বতমালার বিভিন্ন নামে বিভিন্ন অংশ মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড় সমতলভূমি আর বস্তারের অরণ্যভূমির দিকে প্রসারিত। পূর্বের অংশটি মিশেছে সুন্দরগড়, কেওনঝার, আর ময়ূরভঞ্জ দিয়ে ছোটনাগপুর অধিত্যকার অংশ বিহারের সিংভূমে। ওড়িশার উচ্চ অঞ্চলে নব্যপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার, বিশেষ করে কুড়াল, প্রায় যত্রতত্র; ফুলবনি জেলার শংকরজঙ্গ অঞ্চলে এদের তারিখ খ্রি. পূ. নবম শতক নির্ণয় করা গেছে। কিন্তু সর্বত্র এরকম নির্ণয় সম্ভব হয়নি। পুরী জেলার গোলবাই শাসন কেন্দ্রে খনন করে কয়েকরকম মৃৎপাত্রের সঙ্গে (বোধ হয় সব কটিই চাকে গড়া) হাড়ের হাতিয়ার (এর মধ্যে আছে একটি ‘হারপুন’) এবং নব্যপ্রস্তরযুগীয় কুড়াল পাওয়া গেছে। তারিখ আদিতে খ্রি.পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের। ময়ুরভঞ্জ জেলার কুচাইতে—বহরাগোড়া দিয়ে যে রাস্তাটা ওড়িশার দিকে গেছে তা কিছু পরে ভুবনেশ্বর যাওয়ার জন্য মোড় নিয়েছে; সেই রাস্তায় বারিপাদার কিছু আগে কুচাই—সাক্ষ্য লোভনীয় কিন্তু এখানেও কিছু নিষ্পত্তি হয়নি। এখানে নব্যপ্রস্তরযুগীয় কুড়াল, মাইক্রোলিথ আর হাতে গড়া মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। যখন মনে করি যে এই অঞ্চলে পেছনে আদি পুরাপ্রস্তরযুগ পর্যন্ত বিবর্তন আছে, তখন মনে হয় যে কুচাইতে এই স্তরের তারিখ সুপ্রাচীন হতে কোনও বাধা নেই। এ ছাড়া বস্তারের কাছে জয়পুর অঞ্চলে বহু বুনো ধানের সমাবেশ আছে এবং সেই হিসাবে এই দিকে ধান-ভিত্তিক একটি প্রাচীন কৃষিসংস্কৃতির উদ্ভব স্বাভাবিক। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্য কিছু নেই; গবেষণাও হয়নি। নোকমুখে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় কালো-ও-লাল মৃৎপাত্র ছড়িয়ে থাকা টিবির কথা ওড়িশায় শোনা গেছে। তবে সম্বলপুর জেলার একটি কেন্দ্রের বাইরে কোথাও খনন হয়নি। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গের যুদ্ধ মনে করায় যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কলিঙ্গের লোকেরা মৌর্য শক্তির বিরোধিতা করতে পরান্মুখ হয়নি; এর পেছনে একটি সুদীর্ঘ গ্রামীণ জীবনের ইতিহাস স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গ আলোচনার আগে আমরা উত্তর-পূর্ব ভারতের ছবিটি দেখে নিতে পারি। এই অঞ্চল থেকে অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, কাছাড় পাহাড়, মেঘালয় ও ত্রিপুরা থেকে হাজার হাজার নব্যপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার পাওয়া গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে সেগুলি রক্ষিত আছে। কিন্তু নব্যপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার মানেই সেটা নব্যপ্রস্তরযুগের তা নয়; তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে আদি গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি প্রমাণ করতে গেলে খননকার্য প্রয়োজন। তার তারিখ প্রয়োজন। উত্তর কাছাড় পাহাড়ে দাওজালি হাডিং বলে একটি জায়গার ৩০ সে. মি. পুরু একটি স্তর থেকে বহু নব্যপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার এবং হাতে গড়া মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। এর তারিখ নির্ণীত হয়নি। মণিপুরে ২/১টি গুহা থেকে এই ধরনের উপকরণের সঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ তারিখটি শোনা যায়; কিন্তু বিশদ বিবরণ নেই। আরও বহু প্রাচীন তারিখ উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে পাওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু সুষ্ঠু গবেষণার অভাবে আমাদের জ্ঞান প্রায় শূন্য, বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের পাথরের হাতিয়ারের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে, কিন্তু তা দিয়ে ঐতিহাসিক জ্ঞান বোধ হয় এক পা’ও এগোয় না। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অঞ্চল সম্পর্কেও একই কথা খাটে। কালিম্পং, দার্জিলিং-এ পাহাড়ের ঢালের ক্ষেতে যতই নব্যপ্রস্তরযুগীয় পাথরের হাতিয়ার পাওয়া যাক না কেন তাদের সন-তারিখ এবং সাংস্কৃতিক পর্যায় সম্পর্কে আমরা একেবারে অজ্ঞ। অথচ, উত্তর-পূর্বের সীমান্ত অঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমান্ত অঞ্চল রয়েছে বর্মা (অধুনা মায়ানমার), চীন এবং তিব্বতের অধিত্যকার প্রান্ত ঘেঁষে। এদের সঙ্গে ঐতিহাসিক পর্যায়ে যোগসূত্রের কথা আমরা জানি, ঐতিহাসিক যোগসূত্রের একটি প্রাচীনতর পটভূমি থাকা স্বাভাবিক। এই পটভূমি এখনও সম্যকভাবে বোঝা হয়নি বা বোঝার পথে অগ্রসর হওয়া হয়নি। এখানে বর্তমান বাংলাদেশের কথাও বলা যেতে পারে। তাম্রপ্রস্তরযুগের কোনও কেন্দ্র এখনও বাংলাদেশে বেরোয়নি, যদিও ‘উত্তরবঙ্গে’ মহাস্থানগড় ইত্যাদি ঢিবির সবচেয়ে নীচের স্তরে এই পর্যায়ের নিদর্শন থাকতে পারে।
তাম্রপ্রস্তরযুগের নিদর্শন পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত, বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলে, অর্থাৎ বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলায়। অববাহিকা অণ্ডলে, যথা ভাগিরথী ও রূপনারায়ণ অববাহিকায়, এদের ইঙ্গিত আছে কিন্তু সাক্ষ্য এখনও স্পষ্ট নয়। এদের মূল প্রসার মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগিরথী প্রবাহের কাছে খেরুর বলে একটি কেন্দ্র থেকে বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমে মেজিয়া-শালতোড়া রাস্তার কাছে সরাগডিহি, বাঁকুড়ারই তারাফেনী নদীর ওপর কুমারডাঙা এবং মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের কাছে কংসাবতীর ওপর সিজুয়া পর্যন্ত। এদের মূল মৃৎপাত্র কালো-ও-লাল; সাদাটে জ্যামিতিক নকশা করা কোথাও কোথাও—এ ছাড়া উজ্জ্বল লাল প্রলেপ দেওয়া এবং কখনও চিত্রিত মৃৎপাত্র, বিভিন্ন ছাঁদের কালো মৃৎপাত্র এবং কিছুটা হলদেটে ধূসর এক ধরনের মৃৎপাত্র, সব কটিই কুমোরের চাকে বসিয়ে করা। কোশাকুশীর কোশার মতো এক ধরনের পাত্র আছে; লম্বা পা লাগানো বাটি, ইত্যাদি। তারিখ হয়তো খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাধের প্রথমার্ধে। তামার ব্যবহার, হাড়ের ‘মাইক্রোলিথ’ হাতিয়ার, গবাদিপশুর ব্যবহার, ধান চাষ এগুলি পরিষ্কার। আয়তনে ১ থেকে ৮/৯ একর, বেশির ভাগই কমের দিকে। সাধারণত চাষবাসের সুবিধার জন্য হয় নদীর পাড়ে নইলে কোনও নিচু জমির পাশে অবস্থান। ঢিবিগুলির ওপরে পাওয়া জিনিসপত্র দেখে অনুমান হয় যে জিনিসপত্রের আঞ্চলিক আদানপ্রদান ছিল; কখনও কখনও দূর থেকেও জিনিস আসত। রাঢ়ের নদী উপত্যকায় তামা নেই, অথচ তামার ব্যবহার থাকা মানে কোথাও থেকে তামা বা তামার জিনিস আসা। ছোটনাগপুর অধিত্যকার সিংভূম-হাজারিবাগ অঞ্চল তামার পক্ষে প্রকৃষ্ট জায়গা। বোলপুর থেকে পালিতপুরের রাস্তায় মুলুকের পর বাহিরী গ্রাম পড়ে। সেখানে শ্রী দেবপ্রসাদ চৌধুরী মহাশয়ের জমিতে বর্তমান লেখকের উৎখননে প্রাপ্ত একটি তামার তার দিয়ে বানানো আংটিতে টিনের সংমিশ্রণ ধরা পড়ে। টিনের সবচেয়ে কাছের সংস্থান গিরিডি জেলায়, অন্তত ৩০০ কি. মি. দূরে। প্রথম পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাগৈতিহাসিক গ্রামীণ সংস্কৃতি শুধু মাইক্রোলিথ, হাড়ের হাতিয়ার আর তামা ব্যবহারকারী। দ্বিতীয় পর্যায়ে, মনে হচ্ছে খ্রি. পূ. ১১০০-১০০০ অব্দে লোহার ব্যবহার শুরু। বস্তুত, চিত্রিত মৃৎপাত্র পেলেই বা সঙ্গে মাইক্রোলিথ ইত্যাদি পেলেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে তাম্রপ্রস্তরযুগের বলে চিহ্নিত করা সমীচীন হবে না; দ্বিতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রগুলিতে এদের সঙ্গে লোহাও থাকবে। লোহার জন্য অন্য কিছু পরিবর্তন দেখছি না। এ ছাড়া, এই সময়ের একটি বিশেষ চিহ্ন হরিণের শিং-এর ব্যবহার। টুকরো কাটা হরিণের শিং প্রচুর পাওয়া যায়—কী কাজে জানি না। বর্ধমানে পান্ডু রাজার ঢিবি নামক কেন্দ্রে প্রথম পর্যায়ে একটি কৃষিভিত্তিক স্তর ছিল; তাতে কোনও ধাতুর ব্যবহার পাওয়া যায়নি। এই স্তরটির কোনও তারিখ ঠিক হয়নি, বা এই স্তরটি অন্য কোথাও পাওয়াও যায়নি। এবিষয়ে খোঁজ করা দরকার। তাম্রপ্রস্তর ও পরে লৌহ ব্যবহারকারী সংস্কৃতিটিই ঐতিহাসিক যুগে মিশে গিয়েছিল।
৮ বিহার১০
বিহারের দুটি অংশ—একটি ছোটনাগপুর অধিত্যকা, পালামৌ, রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ-গিরিডি ও সাঁওতাল পরগণা নিয়ে। দ্বিতীয়টি তার উত্তরে গাঙ্গেয় পাললিকভূমি। এখানেও একটু পাহাড় আছে। খঙ্গাপুর পাহাড়—মুঙ্গেরের কাছে; কাইমুর পাহাড়ের সঙ্গে বোধ হয় কোনও যোগসূত্র আছে। কাইমুর পাহাড় যা সাসারাম অঞ্চল থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। আর, একেবারে উত্তরে বেতিয়া পেরিয়ে শিবালিক শ্রেণীর অল্প কিছুটা বিহারের ভেতর। নেপাল সীমান্তে, ছোটনাগপুর অধিত্যকায় প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ক্রম আছে তবে প্রাচীন কৃষি সংস্কৃতির অস্তিত্ব অনুমান করা গেলেও প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য মেলেনি। সিংভূম জেলায় বারুডি নামে সঞ্জয় নদীর ওপর একটি ঢিবিতে মাইক্রোলিথ, কালো-ও-লাল মৃৎপাত্র, নব্যপ্রস্তরযুগীয় কুঠার এবং লোহার জিনিস একই সঙ্গে পাওয়া গেছে। তারিখ খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় পাদ থেকে খ্রি. পূ. প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমপাদ পর্যন্ত। এ ছাড়া ছোটনাগপুর অধিত্যকায় তামার ভারী কুড়াল, বালা, দুদিকে কুড়ালের ফলা দেওয়া হাতিয়ার ইত্যাদি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বহু জায়গায় পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গেও সবং থানা এবং বাঁকুড়া মেদিনীপুরের অন্যত্র এই ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গেছে। এগুলিকে অনেকে তাম্রপ্রস্তরযুগের উদাহরণ মনে করেছেন। এ রকম মনে করার বিশেষ কারণ নেই। আমাদের মতে এগুলি ঐতিহাসিক যুগের—সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম দ্বিতীয় শতকের আগে নয় এবং খ্রিস্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর হওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ছোটনাগপুর অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের ইতিহাসে বিভিন্ন রকম কাঁচা মাল সংগ্রহের স্থান—বিভিন্ন ধাতু, পাথর, কাঠ ইত্যাদি। ভারতবর্ষে এই ধরনের অঞ্চল কোনওদিনই সমতলের অর্থনৈতিক জীবনের বৃত্ত থেকে বাইরে থাকেনি; তবে এদের স্বকীয়তাও রয়েছে। এখানকার অধিবাসীরাই কাঁচামাল সংগ্রহ করে সমতলের সঙ্গে আদানপ্রদান করত; কিছু সমতলের লোক প্রত্যক্ষভাবেও এই ধরনের আদানপ্রদানের জন্য ওখানে বসতি করত। আমাদের ধারণা বারুডির কেন্দ্রটি ওই অঞ্চলে সিংভূমে তামা সংগ্রহের জন্য ছিল। সিংভূমে বহু তামার প্রাচীন খনি পাওয়া গেছে। এগুলি নিয়ে প্রায় কোনও গবেষণাই হয়নি; তবে অনুমান করা যায় যে সিংভূমের তামার ব্যবহার এবং সংগ্রহ খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকেই শুরু হয়েছিল।
ছোটনাগপুর অধিত্যকায় প্রাচীন কৃষি কেন্দ্র না পাওয়া গেলেও বিহারের গাঙ্গেয় অঞ্চলে তা পাওয়া গেছে। যে কেন্দ্রগুলিতে ধাতুর ব্যবহার না করা তথাকথিত ‘নব্যপ্রস্তরযুগীয়’ গ্রামীণ নিদর্শন পাওয়া গেছে সেই জায়গাগুলির নাম সেনুয়ার, বুদ্ধগয়া, মনের, চিরন্ড ও চেচর-কুতুবপুর। এদের ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই এদের ব্যাপ্তি বোঝা যাবে। সেনুয়ার সাসারামের কাছে—একটা ছোট নদীর ধারে, তারপর টানা ক্ষেত, বেশ কিছু মাইল ধরে চলে কাইমুর পাহাড়ে শেষ হয়েছে। বুদ্ধগয়ার যে স্থানটিতে নব্যপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শন পাওয়া গেছে সেই স্থানটির নাম তারাড়ি। বড় মন্দিরের কাছেই—ওপরে পালযুগের বিহারের ধ্বংসাবশেষ; নীচে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন। মনের পাটনার কাছে; আরার দিকের রাস্তায়, অথবা সেই রাস্তার কাছে। গঙ্গার পুরনো খাতের ওপর ঢিবি। চিরন্ড গঙ্গা আর ঘাগরার সঙ্গমস্থলের কাছে; যেখানে খোঁড়া হয়েছে সেই জায়গাটা সোজা নদীর ওপর। চেচর-কুতুবপুর প্রায় পাটনার উলটোদিকে, নদীর ওপারে; হাজিপুর থেকে দক্ষিণে যেতে হয়, ওখানে একটা ঘাট আছে; প্রায় সেই ঘাটের সঙ্গেই নব্যপ্রস্তরযুগীয় বসতি। এদের সব কটি কেন্দ্রের তারিখ হয়নি ; একেবারে নীচের স্তরের তারিখ মনে হয় কোথাও থেকেই সংগ্রহ করা যায়নি। তবু, সব মিলিয়ে খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি না হওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। কোথাও এই পর্যায়ে তামার ব্যবহার পাওয়া যায়নি; সেই সুবাদে নব্যপ্রস্তরযুগীয়। মৃৎপাত্র কয়েক রকম; প্রায় সব ক্ষেত্রেই চাকে বানানো; তারাডিতে বেশির ভাগ হাতে গড়া; চিরন্ডে লাল, ধূসর, কালো রঙের মৃৎপাত্র; কোনওটাতে পোড়ানোর পর গেরুমাটিতে নকশা করা। সেনুয়ারে লাল, পালিশ করা লাল আর পালিশ করা ধূসর মৃৎপাত্র আর প্রচুর ‘মাইক্রোলিথ’ আছে; সেই তুলনায় অনেক কম পরিমাণে মসৃণ করা নব্যপ্রস্তরযুগীয় পাথরের হাতিয়ার এবং হাড়ের হাতিয়ার। এই প্রসঙ্গে বলা যায় চিরন্ডে প্রচুর হরিণের শিং পাওয়া গেছে। হতে পারে গর্ত ইত্যাদি করার জন্য গাঁইতির মতো ব্যবহার হত। বাড়িঘর কাঠকুটো, লতাপাতা দিয়ে, ওপরে মাটি লেপে তৈরি। বিভিন্ন পাথরের পুঁতি আছে, আর বাচ্চাদের খেলার জন্য মৃৎপাত্র ঘষে ঘষে চাকতি। চিরন্ডে পাওয়া গেছে গম, যব, ধান, মুগ, মসুর, সেনুয়ারে ধান, যব, মটর, মসুর এবং বাজরা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: নদীতীরে খ্রি.পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এরা করছিল কী? গ্রাম গড়ে ধান, যব, গম, বিভিন্ন রকম ডাল চাষ করছিল; গরু মোষ নিয়ে ছিল। এখনও যাঁরা এই অঞ্চলে বাস করেন তাঁরাও মোটামুটি এরকম গ্রামেই থাকেন; এরকম কৃষিই করেন। তা হলে দেখছি গঙ্গা উপত্যকা—শুধু উপত্যকা নয়, নদীতীর—চাষবাসে ভরে উঠছিল এত আগে থেকে—এমন সব অধিবাসীদের দিয়ে, যাঁরা তামার ব্যবহারও জানতেন না। এখন, এই সংস্কৃতির উৎপত্তি কোথায় বা এর আদি পর্যায় কোথায়? যে পর্যায়ে আমরা এদের দেখছি তা স্পষ্টতই আদি পর্যায় নয়, এরা পুরো চাষী গৃহস্থ, সমস্যাটা এখানেই। বিন্ধ্য পর্বতের বা কাইমুরের প্রান্তে, ছোটনাগপুর অধিত্যকায় কোথাও না কোথাও এর প্রাচীনতর উৎস আছে; আমরা এখনও ধরতে পারিনি।
বিহারে পরের পর্যায় কালো-ও-লাল মৃৎপাত্র ইত্যাদি নিয়ে। মূলত সংস্কৃতি বদলাচ্ছে না; শুধু তামার ব্যবহার দেখছি, আর কালো-ও-লাল এবং সঙ্গে অন্যকিছু মৃৎপাত্র। শস্যের সংখ্যা আরও বাড়ছে, পশ্চিমবঙ্গে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির যে পরিচয় পেয়েছি এখানেও তাই। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য এর আগের পর্যায়টি, যা বিহারে দেখেছি, তা এখনও পাওয়া যায়নি।
ধান মূল শস্য। বিহারের অনেক অঞ্চলেই এই তাম্রপ্রস্তরযুগীয় বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। একটি বসতির অবস্থান থেকে সমসাময়িক গ্রামজীবনের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। বর্তমান গ্রামটির নাম ওরিয়াপ; বিক্রমশিলা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ আছে কহলগাঁও-এর কাছে; তা পেরিয়ে গঙ্গাতীরের দিকে। এখানে বর্ষায় গঙ্গা বেগবতী ; শীতে, গ্রীষ্মে দুদিকে অনেকখানি জায়গা বের হয় জল শুকিয়ে ; লোকে গরু-মোষ চরায়, চাষ করে। তাম্রপ্রস্তরযুগীয় ওরিয়াপ গ্রাম যেখানে সেখান থেকে চাষবাস করতে গেলে কৃষিজীবন নিশ্চয় এখনকার ধারাতেই বইত; শীত ও গ্রীষ্মের গঙ্গার চর—স্থানীয় ভাষায় ‘দিয়ারা’—সেই জীবনে নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে ছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকার কৃষিজীবন নব্যপ্রস্তরযুগীয় ও তাম্রপ্রস্তরযুগীয় কালেই যথাযথ রূপ পেয়েছিল। একমাত্র মূঢ় ব্যক্তিরাই দাবি করতে পারেন যে, চাষবাসে লোহার প্রচলনের আগে গঙ্গা উপত্যকার কৃষিব্যবস্থা প্রসার লাভ করেনি।
তাম্রপ্রস্তরযুগীয় ধারা তারও আগে থেকে আসা ধারায় অন্য কিছুই পালটায়নি, শুধু লোহা যোগ হয়েছিল সম্ভবত। তারিখ খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষদিকে। প্রত্যক্ষ তারিখ বিহারে এই পর্যায়ে নেই; যে তারিখটি বলা হয় তা আমাদের অনুমান। প্রাগৈতিহাসিক এই সংস্কৃতির ধারা সোজাসুজি ঐতিহাসিক কালে গিয়ে মিশেছিল।
৯ উত্তরপ্রদেশ১১
এই সময়ের উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ চিত্র আমরা কয়েকটি খননকার্যের বিশদ বিবরণের ভেতর দিয়ে পেতে পারি—যথা, সরযূপাড় অঞ্চলের নারহান ও ইমলিডি; এলাহাবাদের অদূরে শৃঙ্গবেরপুর; আলিগড়ের কাছে দোয়াবে অত্রনজিখেরা; আর একটু ওপরে বুলন্দশহরের লালকিলা, সাহারানপুরের হুলাস। ইমলিডি ও হুলাসের বিশদ বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয়নি; তবে অন্যগুলির হয়েছে। নারহান সরযূনদীর পাড়ে; সরযূর ধার ধরে আরও কেন্দ্র আছে। সরযু বড় নদী; শীতে চরে চাষ হয়; বর্ষায় চারপাশ ভরে ওঠে; ক্ষেতে নীলগাই এখনও আছে। আর কদিন থাকবে জানি না। তীরে কোথাও মন্দির, কোথাও আমবাগান। নারহান শুরু হয় তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতি দিয়ে—সময় হয়তো খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। এরও আগে একটা স্তর আছে; নারহান-পূর্ব সংস্কৃতি বলে এটাকে উল্লেখ করা হচ্ছে। ইমলিডি বলে একটি কেন্দ্রে এর কিছু পরিচয় পাওয়া গেছে। ইমলিডি সরযূর পাড়ে নয়; কিছু মাইল ভেতরে। মূল মৃৎপাত্র হাতে গড়া; বেতে বোনার বা দড়ির মতো ছাপ দেওয়া এক ধরনের মৃৎপাত্র। অন্য বিশেষ কিছু ইমলিডিতে পাওয়া যায়নি। তবে ধান, দুধরনের যব, দুধরনের গম, জোয়ার এবং এক ধরনের বাজরা এবং ডালের ভেতর মসুর, দু-তিন রকম মটর, তিল, তিসি পাওয়া গেছে। কৃষি জীবনের ব্যাপ্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না। নারহানে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় মৃৎপাত্র কালো-ও-লাল জাতীয়। কখনও ওপরে ছোট ছোট সাদা লাইন ও ‘ডট’ দিয়ে চিত্রিত। এ ছাড়া, কালো প্রলেপ দেওয়া এক ধরনের মৃৎপাত্র আছে। লাল, ধূসর ইত্যাদি জাতীয় মৃৎপাত্রও আছে। এই পর্যায়ের সব জাতের মৃৎপাত্রই কুমোরের চাকে গড়া। শস্যের তালিকা ইমলিডির মতোই; তবে এখন খেসারি এবং আর এক জাতীয় গম পাওয়া যাচ্ছে। কাঁঠাল নিশ্চিতভাবে আছে। পশুর ভেতর গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া। বঁড়শি দিয়ে যে মাছ ধরা হত তার প্রমাণ একটি কাদার ঢেলার ওপর সুতো শুদ্ধ বঁড়শির দাগ। সুতোটি কীসের হতে পারে বোঝা গেছে—‘রামি ফাইবার’—যাই হোক না কেন মাছ ধরার পক্ষে খুব ভাল ‘সুতো’ বলা হয়েছে। বঁড়শি নিয়ে আর একটা ব্যাপার আছে— এর দাগে মরচে থাকায় এটি লোহার ছিল বলে বোঝা যাচ্ছে—এই তাম্রপ্রস্তরযুগীয় পর্যায়ের ওপর দিকে আরও দুটুকরো লোহা আছে। ঘষে তৈরি করা মৃৎপাত্রের টুকরোর চাকতি পাওয়া গেছে; কয়েকটিতে ছিদ্র করা এবং খেলনার চাকার মতো। পোড়ামাটির ঘটের মতো দেখতে পুঁতি আছে; ‘মাইক্রোলিথ’ নেই কিন্তু একটি মসৃণ করা পাথরের কুড়াল আছে; হাড়ের তৈরি তীর বেশ কিছু আছে। ফলের তালিকা কাঁঠালের বাইরেও আছে; কুল, আঙুর (বলা হয়েছে যে শুকনো আঙুরের বীজ); বেশ কিছু ক্ষেতের আগাছা; কাঠ বা গাছের ভেতর ঢাক (বিউটিয়া মনোস্পার্মা) করন্জি (পোঙ্গামিয়া পিন্নাটা), ঢেরা (ডায়সপাইরস মনতানা), মহুয়া (মধুকা ইন্ডিকা), আম (ম্যাঙ্গোফেরা ইন্ডিকা), বাবুল (অ্যাকেসিয়া), বাঁশ, তুত (মালবেরি), তুলসী (ওসিমাম এল), গনিয়ারি (প্রেমনা মুক্রোনাটা); শাল (শোরিয়া রোবাস্টা), কুচিলা (স্ট্রাইক্নস নাক্স-ভমিকা), তেঁতুল (টামারিনডাস ইন্ডিকা), ঝাউ (টামারিক্স ডায়ইকা), সেগুন (টেক্টনা গ্রান্ডিস), শিরীষ (এ্যালবিজ্জিয়া ডুরাজ্জ) এবং গিললাই বা গুর্চ (টিনোসপোরা কর্ডিফোলিয়া)। খননকার্যে পাওয়া কাঠকয়লার টুকরো থেকে এই সমস্ত গাছ সনাক্ত করা গেছে। শাল, সেগুন, আম, মহুয়া, ঢাক-পলাশ (?), তেঁতুল, শিরীষ, কাঁঠাল, বাঁশ, তুঁত, তুলসী, নাক্স ভমিকা, কুচিলা, ঝাউ, সব নিয়ে ওই সময়ের উদ্ভিদ আবরণ সরযূপাড়ের গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল।
ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় নারহানের তৃতীয় পর্যায়ে যাকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা উত্তরের কৃষ্ণ উজ্জ্বল/মসৃণ মৃৎপাত্র (নর্দার্ন ব্ল্যাক পলিশড ওয়ার; সংক্ষেপে ‘এন বি পি’) নাম দিয়েছেন। তারিখ খ্রি. পূ. ৭০০ থেকে ৬০০ অব্দর ভেতর। নারহানের দ্বিতীয় পর্যায়ও প্রাগৈতিহাসিক এবং একে বলা হয় ‘কালো মসৃণ’ (ব্ল্যাক পলিশড) মৃৎপাত্রের পর্যায়। মৃৎপাত্র বাদ দিলে, পোড়ামাটির গোল চাকা (ঘষা মৃৎপাত্রের টুকরোর চাকতি নয়) এসময় প্রথম দেখা যায়। হাড়ের তৈরি তীরের সংখ্যা অনেক— কোথাও কোথাও নকশা করা, কাচ, অ্যাগেট আর পোড়ামাটির পুঁতি, পোড়ামাটির গোলা এবং যা দিয়ে পিটিয়ে কুমোরেরা মৃৎপাত্রকে সঠিক আয়তনে আনেন, পোড়ামাটির তা; হাড়ের এবং পোড়ামাটির তৈরি পাশা, দাবার ঘুঁটির মতো পোড়ামাটির ঘুঁটি, হাড়ের তৈরি ‘পেনডেন্ট’, প্রচুর কাচের বালা, অল্প সংখ্যায় পোড়ামাটির মাতৃকামূর্তি ও ষাঁড়/নীলগাই এর প্রতিরূপ; ধাতু গলানোর পাত্র, প্রচুর লোহার ব্যবহার ইত্যাদি এই সময়ের পরিচয় বহন করে। উদ্ভিদের ভেতর নতুন দেখা যায় সূর্যমুখী (‘সান ফ্লাওয়ার’), শীষম বা শিশু গাছ (‘দালার্জিয়া শিসসু’), আমলকি আর জাম।
সরযূপাড়ের গ্রাম জীবনের ছবি নিঃসন্দেহে ব্যাপক তবে এত ব্যাপক ভাবে উদ্ভিদ জীবনের তথ্য অন্যত্র বিশ্লেষণ করা হয়নি। এলাহাবাদের উজানে শৃঙ্গবেরপুর গঙ্গার ওপর বড় ঢিবি। ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষ্য এখানে ব্যাপক। ‘এন বি পি’ পর্যায় বা ঐতিহাসিক পর্যায়ের সূত্রপাত এখানে খ্রি. পূ. ৭০০ অব্দে। বসতির শুরু এখানে মনে হয় খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষপাদে; যে মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে তাকে মনে করা হচ্ছে উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকার ‘গেরুয়া রঙের’ মৃৎপাত্র (‘ওকার কালার্ড পটারি’ বা ‘ও সি পি’)। এই মৃৎপাত্র ছাড়া অন্য কিছু বিশেষ পাওয়া যায়নি। আমরা পরে দেখব যে, এই ও সি পি-র সঙ্গে হরপ্পা অথবা সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং এই পর্যায়ে এক বিশেষ ধরনের তাম্রবস্তুসম্ভার (‘কপার হোর্ড’) পাওয়া যায়। ও সি পি’র পর কালো ও লাল, কালো মসৃণ ইত্যাদি মৃৎপাত্রের স্তর, সঙ্গে কয়েক টুকরো চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রও (পেন্টেড গ্রে ওয়ার বা পি জি ডবলু) পাওয়া যাচ্ছে। ‘পি জি ডবলু’ উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকার বিশেষত্ব। ‘এন বি পি’ পর্যায়ের পূর্বের শৃঙ্গবেরপুরে আর বেশি কিছু সাক্ষ্য বিশ্লেষিত হয়নি; শুধু কাঁচা ঘরবাড়ির কথা জানা যাচ্ছে।
উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকার অর্থাৎ দোয়াবের প্রাগৈতিহাসিক গ্রামীণ জীবনের ছবি রূপায়িত হয়েছে আলিগড় জেলার অনজিখেরার খননকার্যের বিবরণে। ঐতিহাসিক যুগ শুরু হচ্ছে ‘এন বি পি’ পর্যায় দিয়ে; তবে তার আগে আরও তিনটি পর্যায় আছে। একেবারে প্রথম পর্যায়টিতে ‘ও সি পি’, যা আমরা আগে শৃঙ্গবেরপুরে শুনেছি। এই নামের মৃৎপাত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনেকদিন জলে ডুবিয়ে রাখলে মাটির যেমন ওপরে হলদেটে গেরু ভাব হয়—ঘষলে উঠে আসে—তেমনি ভাব আর সেই কারণেই এই নামকরণ, ‘ওকার কালার্ড পটারি’, খড়, শন, লতাপাতা, কুটো ইত্যাদি দিয়ে দেওয়াল বানিয়ে দুদিকে মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া হত; এরকম দেওয়ালের মাটির পলেস্তারার টুকরো পাওয়া গেছে যার ভেতরের দিকে শন, খড়ের দাগ বসা। মাটির পলেস্তারাতে ধানের তুষ দেখা যায়। অর্থাৎ, ধানের তুষ মিশিয়ে কখনও কখনও দেয়ালে প্রলেপ দেওয়া হত। ঘরের খুঁটির কাঠ ছিল বাবুল, শীষম, শাল এবং (বিরলভাবে) চির পাইন। আলিগড়ের কাছে হিমালয় পাহাড়ের চির পাইন হতে পারে না; অবশ্যই দূর থেকে আনা হত। মৃৎপাত্রে কখনও কখনও কালো রঙে মোটা রেখা অলংকরণ হত। এই পর্যায়ে অত্রনজিখেরাতে অন্য কিছু পাওয়া যায়নি, কিন্তু ধান, যব, খেসারি এবং আর এক ধরনের চানা জাতীয় ডালের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।
এই পর্যায় সম্পর্কে আরও দুটি জ্ঞাতব্য বিষয় আছে। একটির ইঙ্গিত আমরা আগে করেছি। এটি হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক। সাহারানপুর হরিদ্বার অঞ্চলে অম্বাখেরি ও বাহাদারাবাদ নামক দুটি কেন্দ্রে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দোয়াবের উর্ধ্বভাগে খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে এবং তার অল্প আগে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র ছিল এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ‘ও সি পি’ স্তর একেবারে অবিকল সিন্ধু সভ্যতার স্তর নয়, যথেষ্ট প্রভাবিত স্তর। দোয়াবে সিন্ধু সভ্যতার যে স্তর পাওয়া গেছে তাই এর উৎস।
‘ও সি পি’ সম্পর্কে দ্বিতীয় জ্ঞাতব্য বিষয় ‘গাঙ্গেয় উপত্যকার তাম্রবস্তুসম্ভার’ (‘গ্যাঞ্জেটিক কপার হোর্ডস’)-এর সঙ্গে এর সম্পর্ক। কয়েকটি বিশেষ ধরনের তামার হাতিয়ার যথা, মানবসদৃশ ফলক, হারপুন, শিরদাঁড়া দেওয়া এবং দাঁড়ার মতো হাতলের তরবারি (দাঁড়া দুটো কাঠের বা অন্য কিছুর হাতলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হত)। এ ছাড়া, সাধারণ, চ্যাপটা ধরনের কুড়াল, মোটা বালা, ইত্যাদি পাওয়া যায়। ‘মানবসদৃশ ফলক’ আমরা যাকে বলছি—ইংরেজিতে ‘অ্যান্থ্রোপমর্ফ’ বলে যার উল্লেখ, অনেকটা তার মতো জিনিস ‘শনি’ বলে কলকাতার রাস্তায়ও পুজো হয়! এই ধরনের তাম্রসম্ভার হয়তো বহু শত উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কার হয়েছে। সম্প্রতি গুজরাটে এই জাতীয় কিছু নিদর্শন বেরিয়েছে এবং সেতুবন্ধ রামেশ্বর যে জেলায় অবস্থিত সেই রমানাথপুরম জেলাতেও বেরিয়েছে। মাঝে দাক্ষিণাত্যে কালুরে; মধ্যপ্রদেশে নভদাতোলিতে এবং মহারাষ্ট্রের চান্দোলিতে, এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশের বালাঘাটে গুনগেরিয়াতে পাওয়া গেছে। গঙ্গা উপত্যকায় অপর্যাপ্ত তামার জিনিস পাওয়া গেলেও এগুলি অন্য অঞ্চলে তৈরি হওয়া স্বাভাবিক; আমাদের মনে হয় এগুলি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে হরিয়ানা-রাজস্থানের তাম্র অঞ্চলের তৈরি—এই অঞ্চলের তাম্র উৎপাদন এবং বস্তু নির্মাণের প্রথম উদ্ভব সিন্ধু সভ্যতার আদি পর্যায়ে। মনে হয় বিভিন্ন যোগাযোগের সূত্রে, সুসংবদ্ধ রাস্তা ধরে, একদিকে গুজরাট, অপরদিকে গঙ্গা উপত্যকা এবং মধ্যপ্রদেশ-দাক্ষিণাত্যের ভেতর দিয়ে সুদূর দক্ষিণ পর্যন্ত এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও ঊনবিংশ শতক থেকেও এই ধরনের হাতিয়ার পাওয়া গেছে তবে যেহেতু কোনও বিশেষ পর্যায়ের সঙ্গে পাওয়া যায়নি—এমনি মাটি কাটতে গিয়ে পাওয়া গেছে—সেহেতু এদের তারিখ ও সাংস্কৃতিক পর্যায় নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। দোয়াবে সাইপাই নামক একটি জায়গায় ‘ও সি পি’র সঙ্গে এদের প্রাপ্তির পর এই বিতর্ক দূর হয়েছে। এখানে আবার উল্লেখ করা ভাল যে, পূর্ব ভারতের ‘তাম্ৰবস্তুসম্ভার’-এর সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। পূর্ব ভারতের বস্তুগুলি, আমাদের মতে, ঐতিহাসিক কালের এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকেরও হতে পারে।
অনজিখেরার দ্বিতীয় পর্যায় কালো-ও-লাল মৃৎপাত্রের। এর সঙ্গে আছে কালো প্রলেপ দেওয়া মৃৎপাত্র এবং লাল রঙের মৃৎপাত্র। মৃৎপাত্র ছাড়া পাওয়া গেছে ৩টি কার্নেলিয়ান এবং ১টি ঝিনুকের পুঁতি, ৪টি তামার জিনিস (১টি আংটি, ৩টি পুঁথি), ১টি হাড়ের চিরুনির টুকরো এবং পাথরের মাইক্রোলিথ জাতীয় ‘ব্লেড’। এই সঙ্গে আছে কয়েকটি ঘষা মৃৎপাত্র—চাকতি। ধান এবং যবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল, কাছিম, মাছ আছে; কিছু হাড় কাটা এবং পোড়ানো। কুকুরের অস্তিত্ব আছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে পূর্ব রাজস্থানে ভরতপুরের কাছে নোহ্-তে এই পর্যায়ে লোহার টুকরো আছে এবং সমস্ত সূত্র মিলিয়ে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে এই পর্যায়ে উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকায় লোহার সঙ্গে পরিচয় ছিল।
লোহার ব্যাপক ব্যবহার অত্রনজিখেরার তৃতীয় পর্যায়ে ‘চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র’ পর্যায়ে (‘পেইন্টেড গ্রে ওয়ার’ বা পি জি ডবলু)। বাড়িঘর কাঁচা দেওয়াল ও মাটির, উনুনের চিহ্ন আছে। বসতির ভেতর কুমোরের ভাটা এবং লোহা কামারের কাজের জায়গা। শস্যের তালিকায় গম যুক্ত হচ্ছে। পোড়ামাটির চাকতি (কোথাও নকশা করা) প্রচুর। তবে পোড়ামাটির মানুষ বা পশুর ছোট মূর্তি খুব কম। পাথরের পুঁতি আছে; এর ভেতর একটি কার্নেলিয়ান পাথরের, ওপরে সাদা নকশা করা। এটি সিন্ধু সভ্যতার। এই পুঁতিটি তাই ইঙ্গিত করে যে এই স্তরের তারিখ খুব পরের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
লোহার ব্যবহার ব্যাপক—তীর, বল্লম, সাঁড়াশি, কুড়াল, ছুরি, বালা ইত্যাদি, যদিও এতে হাড়ের তৈরি তীরের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। কাচ, ঝিনুক, হাড়ের জিনিস কিছু। মৃৎপাত্র ভালভাবে ছানা, মাটিকে ভালভাবে পোড়ানো, ওপরে কালো, জ্যামিতিক চিত্রণ। সাধারণত রেখা ছোট এবং কোথাও সরল, কোথাও আঁকাবাঁকা, ‘পি জি ডব্লু’ পর্যায়ের নীচের তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। ওপরের দিকে ঐতিহাসিক ‘এন বি পি’ পর্যায়ে মিশেছে। নীচে খ্রি. পূ. ১১০০-১২০০ অব্দ হওয়া অসঙ্গত নয়।
‘ও সি পি’, ‘বি আর ডবলু’ (ব্ল্যাক অ্যান্ড রেড ওয়ার) এবং ‘পি জি ডবলু’ পর্যায়ের বহু বসতি উর্ধ্বগাঙ্গেয় উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে। হরিয়ানা, পঞ্জাব ও রাজস্থানে সিন্ধু সভ্যতার পরই অনেক জায়গায় ‘পি জি ডবলু’ পাওয়া গেছে। দোয়াব, হরিয়ানা, পঞ্জাব, রাজস্থানে ঘগ্গর অববাহিকা ‘পি জি ডবলু’ অঞ্চল। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র জেলার ভগবানপুর আর পঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার দাধরী খননকার্য থেকে বোঝা যাচ্ছে চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের আগে একটা অচিত্রিত পর্যায় ছিল এবং সেই পর্যায়টি পরিষ্কার সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের অংশ—ওই অঞ্চলে। অনিশ্চয়তা যে একেবারে নেই তা নয়, তবে সব মিলিয়ে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার কথাই প্রথমে মনে আসে। আধুনিক দিল্লির ভেতর ‘পুরনো কিলা’তে ‘পি জি ডবলু’ পাওয়া যায়, আর উত্তর দিল্লিতে আজাদপুর মান্ডির সঙ্গে একটি ঢিবিতে ‘বি আর ডবলু’ ও পি জি ডবলু’ দুইটি পর্যায় দেখা যায়।
বুলান্দশহরের লাল কিলায় ‘ও সি পি’ পর্যায়ের আর একটু বিস্তারিত চিত্র পাওয়া যায়। এই কেন্দ্রটিতে এই পর্যায় ছাড়া অন্য কোনও পর্যায়ের অবশেষ নেই। মৃৎপাত্রের বৈচিত্র্য সম্পর্কে এখানে সম্যক ধারণা হয়। কুমোরের চাকে তৈরি ভালভাবে পোড়ানো লাল রঙের পাত্র—বিভিন্ন ধরনের—একটি ধরন কলসীর মুখে ঢাকনার—লাল প্রলেপ দেওয়া অন্তত একটি ক্ষেত্রে কালো রঙে সুন্দর একটি ষাঁড় আঁকা। এ ছাড়া কাঁচা অবস্থায় দাগ কেটে নকশা, কুমোরের নিশানা বা চিহ্ন আছে। তামার জিনিস, পোড়ামাটির মূর্তি-পোড়ামাটিরই একটি শিল্পসুষমাযুক্ত মানুষের মুখ ও শরীরের ঊর্ধ্বাংশ (সমগোত্রীয় কেন্দ্র দৌলতপুর থেকে) পোড়ামাটির চাকতি, বালা, গোলা, কর্ণালঙ্কার, সিলমোহর জাতীয় একটি জিনিস, পুঁতি, পাথরের শিলনোড়া, হাড়ের তীর, ইত্যাদি। বেশ কিছু ঘরের চিহ্ন; মেঝেতে আগুন জ্বালানোর চিহ্ন, সঙ্গে পোড়া হাড়। চাষের শস্যের ভেতর যব, গম, ধান; গৃহপালিত পশুর ভেতর গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর, ঘোড়া, কুকুর; বন্যের ভেতর নীলগাই। ঘরের বেড়ার ওপর লেপা মাটির চাকলাতে দাগ থেকে ‘সরকনদা’ এবং ‘পাটওয়ার’ নামক স্থানীয় শণ জাতীয় জিনিসের নিরূপণ করা গেছে। এখনও এগুলি প্রচুর দেখা যায়। উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এই থেকে দড়ি, মোড়া, ঘরের দেওয়াল, চাল অনেক কিছুই হয়। তামার কুড়ালের একটি টুকরো পাওয়া যায়। তা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, ঠাণ্ডা অবস্থায় পিটিয়ে তা তৈরি হয়েছিল।
১০ দক্ষিণ ভারতের মেগালিথ সমাধি প্রথা১২
এই অধ্যায়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের লোহার ব্যবহারের সূত্রপাতের কথা আমরা বিক্ষিপ্তভাবে বলেছি। যেমন, বালুচিস্তানে পিরক-এ, কাশ্মীরে গুফ্ক্রাল-এ, দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানে আহার-এ, মধ্যপ্রদেশে মালব অধিত্যকার নাগদা ইত্যাদি কেন্দ্রে, দক্ষিণ ভারতে ওয়াটগাল-এ এবং অন্যত্র, পশ্চিমবঙ্গে, বিহারে, উত্তরপ্রদেশে ‘পি জি ডবলু’ পর্যায়ে বা তার আগের পর্যায়ে। আলিগড়ের কাছে জখেরাতে কালো-ও-লাল মৃৎপাত্রের স্তর থেকে লোহার জিনিস বেরিয়েছে। নিঃসন্দেহে খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা তার আগে থেকে শুরু হয়ে খ্রি. পূ. ১০০০ অব্দ নাগাদ লোহার ব্যবহার ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মোট ছবি থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ভারতবর্ষে একের বেশি জায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে এর সুত্রপাত হয়েছিল। আমরা এ-ও বলেছি যে গাঙ্গেয় উপত্যকার গ্রামীণ সংস্কৃতি, চাষবাসের ধরন সবই লোহার ব্যবহারের সূত্রপাতের আগে গড়ে উঠেছিল।
এখানে দক্ষিণ ভারতের কথা আলাদা করে বলতে হয়। দক্ষিণ ভারতে লোহার ব্যবহারের সূত্রপাতের সঙ্গে ‘মেগালিথ’ প্রথা জড়িত। এই প্রথার প্রত্নতাত্ত্বিক বিচার এখনও সহজ নয়। প্রথমত, বড় পাথরের সঙ্গে জড়িত সমাধি প্রথা হিসাবে চরিত্রগতভাবে এক মেগালিথ পৃথিবীর বহু দেশে বহু সময়ে দেখা যায়। বিশেষ জাতি বা বিশেষ কোনও সাংস্কৃতিক যোগের সঙ্গে মিলিয়ে এই সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করার প্রবণতা এক সময় প্রবল ছিল। দ্বিতীয়ত, মেগালিথ প্রথার প্রাক্-লৌহ পর্যায়ও আছে; ওয়াটগালেই প্রাক্-লৌহ পর্যায়ে পাথর চাপা দিয়ে সমাধিতে মৃতদেহ শোয়ানোর প্রথা ছিল। এ ছাড়াও অনেকে ভারতবর্ষে মেগালিথের একটি প্রাক্-লৌহ পর্যায় দাবি করেছেন। তবে, যা অনস্বীকার্য তা হচ্ছে লোহার ব্যবহারের সঙ্গেই দক্ষিণ ভারতীয় মেগালিথ নির্মাণ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এর ব্যাখ্যা কী হবে আমরা এখনও জানি না। তৃতীয়ত, একদিকে দক্ষিণ ভারতীয় মেগালিথ বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্নভাবে তৈরি হয়ে এসেছে—খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা তৎপূর্ব কোনও সময় থেকে নিঃসন্দেহে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত (কোনও কোনও মেগালিথে রোমান বাণিজ্যের মাধ্যমে আসা রোমান মুদ্রা আছে)। তামিল সাহিত্য বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলেছেন যে, প্রথাটি মধ্যযুগ পর্যন্ত ছিল। অথচ, অন্যদিকে, মেগালিথে যে জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে (মৃতের সঙ্গে দেওয়া) তাতে কোনও পরিবর্তন নেই— একই ধরনের লোহার জিনিস, অন্যান্য ধাতুর জিনিস (তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা), মৃৎপাত্র (মূলত পালিশ করা কালো-ও-লাল) যা বলা যায় তাই। হঠাৎ মনে হয় থেমে থাকা একটা বিরাট সময়ের টুকরো। এতে প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে প্রথম যে গোলমালটি হয় তা হচ্ছে যে মেগালিথ দেখে বা তার জিনিস দেখে তারিখ বিচার করা প্রায় শিবের অসাধ্য। চতুর্থত, এই মেগালিথ প্রথার ব্যাপ্তি। আধুনিক কালেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর প্রথাটি আছে—পুরুলিয়ার ‘ভূমিজ’ সমাধিক্ষেত্র মেগালিথ সমাধিক্ষেত্র ছাড়া কিছু নয়। ভারতবর্ষে এমন অঞ্চল কম আছে যেখানে কোনও ভাবে মেগালিথ প্রথার সাক্ষ্যের কথা লিপিবদ্ধ হয়নি। সিন্ধুপ্রদেশ থেকে শুরু হয়ে প্রায় সর্বত্র। অনেক সাক্ষ্য নষ্টও হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। হঠাৎ দক্ষিণ ভারতে অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে লোহার ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে এটি এত ব্যাপকতা ও কালের গভীরতা পেল কেন? উত্তর এখনও নেই।
‘দক্ষিণ ভারত’ বলতে যে অঞ্চলটি আমরা এই প্রসঙ্গে বুঝি তা হচ্ছে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ থেকে একদিকে তিরুনেলভেলি জেলা আর দক্ষিণ কেরালা। অর্থাৎ, বিদর্ভ থেকে নীচে পুরো অঞ্চলটাই, কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত। মেগালিথ অনেক রকম। মূল রকমগুলি হচ্ছে: গর্ত সমাধি (‘পিট বারিয়াল’), কক্ষ সমাধি (‘চেম্বার বারিয়াল’), পা লাগানো বা না লাগানো মৃৎপাত্রে সমাধি। এ ছাড়া কিছু আছে যা মনে হয় স্মারক অর্থে করা। প্রত্যেকটিরই অনেক রকম ধরন আছে। যেমন প্রথমটিরই, অর্থাৎ সোজা গর্ত খুঁড়ে সমাধির, আট রকম আলাদা ধরন আছে। কক্ষ করে সমাধির ধরন ছ রকম। পা লাগানো বা না লাগানো পাত্রে রেখে সমাধির প্রকারভেদ সাত রকম। স্মারক জাতীয় মেগালিথের প্রকারভেদ পাঁচ রকম। সত্যি বলতে, শুধু ওপর থেকে দেখে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া, বলা মুশকিল কোনটা কোন ধরনের মেগালিথ।
ওপর থেকে যা দেখা যায় তাই মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। কোথাও বড় পাথর চাপা দিয়ে সমাধি; কোথাও এরকম পাথর চাপার নীচে, পাথরেরই অপেক্ষাকৃত পাতলা ও চ্যাপটা চাঁই কেটে তা দিয়ে দেয়াল সাজিয়ে ঘর, কোথাও চারপাশে গোল করে পাথর সাজিয়ে তার ভেতর এরকম সমাধি রাখা। কোথাও পাহাড় কেটে গুহা তৈরি করে সমাধি, কোথাও সমাধির ওপর ছাতার মতো পাথর বসানো; কোথাও সোজা পাথর দাঁড় করানো, কোথাও মাটির ওপরেই ‘ঘর’ করা; কোথাও এরকম ঘরের দেওয়ালে বড় ছিদ্র; কোথাও তা নেই।
সব রকম সাক্ষ্য মিলিয়ে কিছু সাধারণ সিদ্ধান্তে পণ্ডিতেরা পৌঁছেছেন। চাষবাসের ভিত্তি ছিল গম, যব, ধান, বাজরা এবং বিভিন্ন রকম ডাল চাষ। এর ভেতর আঞ্চলিক বৈচিত্র্য আছে। যেমন, বিদর্ভে গম, ধান, যব, ‘কোদো’ বাজরা এবং ডাল; মধ্য কৃষ্ণা উপত্যকা এবং অন্ধ্রের পাহাড়ে, যব, ধান, ‘কোদো’ বাজরা ও ডাল, দক্ষিণের অন্যত্র ধান, রাগি বাজরা, ‘কোদো’ বাজরা এবং ডাল। এ ছাড়া ব্যাপকভাবে গবাদি পশু পালন। গ্রামীণ জীবনের ভিত্তিতে আরও দেখছি যে মৃৎশিল্প, কাঠের কাজ ও ধাতুর কাজ যথেষ্ট সংবদ্ধ ভাবে ছিল। প্রায় ৩৯৯টি বসতি কেন্দ্রের কথা—সমাধি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে—জানা গেছে। আদান-প্রদান বা পারস্পরিক ব্যবসার তালিকায় লোহার জিনিসপত্র, তামা এবং সোনার গয়না, বিভিন্ন পাথরের পুঁতি ও মৃৎপাত্র আছে। বিদর্ভে মনে হয় লোহা, তামা, রূপা এবং পাথরের পুঁতি তৈরির কাজ বেশি হত; সেই রকম তেলেঙ্গানা, রায়ালসীমায়, গুলবর্গা, ধারওয়ার এবং বিজাপুর অঞ্চলে ছিল লোহা, তামা ও সোনার কাজের চল; আর বাঙ্গালোর, মেত্তুর-ভেল্লোর অঞ্চল ও কোয়েম্বাটোর অঞ্চলে লোহা, সোনা ও পাথরের কাজ হয়তো বেশি হত। ঐতিহাসিক কালের বাণিজ্য পথের ওপর অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে, কিছু বড় বড় মেগালিথ সমাধি ক্ষেত্র রয়েছে। এমন হতে পারে যেখানে এগুলি আছে সেই স্থানগুলি বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমাধি ক্ষেত্রের বিন্যাস দেখে মনে হয় এগুলি বিশেষ বিশেষ স্থানে একসঙ্গে কয়েকটি করে ছিল। এতে মনে হয়, একই জায়গা কয়েক শতাব্দী ধরে সমাধি ক্ষেত্রের জন্য ব্যবহার হয়েছে। আরও বোঝা যাচ্ছে যে এখানে সমাজের সবাইকে সমাধি দেওয়া হত না—সমাধি হয়তো পুরুষে একবার বা দুবার দেওয়া হত। মনে হচ্ছে সমাজের ওপরতলার লোকদেরই শুধু এই ধরনের সমাধি ক্ষেত্রে সমাধি দেওয়া হত। আরও দেখা আচ্ছে যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সংখ্যা মৃতের মধ্যে বেশি। এটি কি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সূচিত করে?
দক্ষিণ ভারতীয় মেগালিথ সম্পর্কে প্রশ্ন এবং সমস্যার অবধি নেই। তবে দক্ষিণ ভারতে এই পর্যায়ের ভিত্তির ওপরই ঐতিহাসিক যুগ গড়ে উঠেছিল। একদিক থেকে, আমাদের বোঝার যতই অসম্পূর্ণতা থাকুক না কেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই পর্যায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
১১ পরিশেষের মন্তব্য
গবেষণায় বহু অপরিপূর্ণতা আছে, তা হলেও সমস্ত উপমহাদেশ জুড়ে, একটি গ্রামজীবন গড়ে ওঠার ছবি এই অধ্যায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রাগৈতিহাসিক গ্রামজীবনই আমাদের ঐতিহাসিক কালের ভিত্তি। সত্যি বলতে, বর্তমান উপমহাদেশের গ্রামজীবনেরও ভিত্তি। আমরা বলেছি যে, খ্রি.পূ. তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দ জুড়ে সিন্ধু সভ্যতার বৃত্তের বাইরে এই যে গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাস, তাতে সিন্ধু সভ্যতার যোগসূত্র রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের এই কৃষিজীবনের বীজ হয়তো ক্ষুদ্রপ্রস্তর যুগেই রয়ে গেছে; কোথাও কোথাও সুপ্রাচীন অতীতেই কৃষিজীবন প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়ে থাকতে পারে; তবে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত ও শেষ পর্যায়ের সময় থেকেই এদের বিকাশ পরিষ্কার লক্ষ করা যায়। একদিকে গুজরাট-মহারাষ্ট্র আর অন্যদিকে দোয়াবের উপরের ভাগে সিন্ধু সভ্যতা, পরবর্তী এবং তার বৃত্তের বাইরের ভারতীয় সংস্কৃতিতে লীন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অধ্যায়ের গ্রাম গড়ার ইতিহাস থেকে সিন্ধু সভ্যতা বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।
এই গ্রাম গড়ায় নিসন্দেহে বৈচিত্র্য ছিল, কালের তারতম্য ছিল, ভৌগোলিক প্রভাব ছিল; তবু উপমহাদেশের পরবর্তীযুগের গ্রামের ভিত্তি এই অধ্যায়ের নাম না জানা কেন্দ্রগুলি। (যাকে আমরা নভদাতোলি বলছি তা তো এখনকার গ্রামের নাম! আমাদের প্রাচীন নভদাতোলি গ্রামের লোক তাদের গ্রামকে কী বলে উল্লেখ করতো তা তো জানি না।)
প্রথমত, গ্রাম বিন্যাসের কথা। পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা যায় তা হলে দেখব তাম্রপ্রস্তরযুগীয় এমন প্রাচীন কেন্দ্র কমই আছে যার অবস্থিতি বর্তমান গ্রামের চৌহদ্দির ভেতর নয়। বস্তুত, এটি একটি সর্বভারতীয় চিত্র। এর অর্থ একটাই, বর্তমান গ্রাম বিন্যাসের ভিত্তি আঞ্চলিক গ্রামজীবনের সূত্রপাতেই গড়ে উঠেছিল। এটা আরও বোঝা যায় যখন আমরা বাড়িঘর দেখি, শস্য ও গৃহপালিত পশুর তালিকা দেখি। স্থানীয় জিনিস ব্যবহার করে যেভাবে যে রকম ঘর বানানো হত এখনও বেশির ভাগ গ্রামবাসী সেইভাবেই ঘর বানিয়ে থাকেন। ঘরের ভেতর শিলনোড়া, উনুন, শস্য রাখার জায়গা, আঙিনাতে উনুন—এ সবই আমাদের বর্তমানের পরিচিত ছবি, শস্যের তালিকা যদি দেখি তা হলে বুঝব যে বিভিন্ন অঞ্চলের এই তালিকায় বর্তমান পর্যন্ত অল্পই নতুন শস্য স্থান পেয়েছে। এখনও আমাদের গ্রামের চাষি একই শস্য চাষ করে। নারহানের প্রসঙ্গে যে বড় উদ্ভিদের তালিকাটি পাওয়া গেছে তা আমাদের খুব পরিচিত—শাল, সেগুন, পলাশ, মহুয়া, আম, কাঁঠাল, জাম, তেঁতুল সব নিয়ে পরিচিত গ্রামাঞ্চল। গৃহপালিত পশুও একটিও আমাদের অপরিচিত নয়—গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর ইত্যাদি। হরিণের হাড় অবশ্য প্রাচীন কেন্দ্রগুলিতে প্রচুর পাওয়া যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বছর ৩০-৩৫ আগেও বিহার উত্তরপ্রদেশে গঙ্গাতীরের গ্রামে হরিণ আর নীলগাই দল বেঁধে চড়ে বেড়াত। চাষ করা মাঠে কৃষ্ণসার মৃগ-দলের ছুটে এসে চলন্ত ট্রেন দেখার কথা ঘুরে-ফিরে মনে আসে। অবশ্যই সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আমরা অনেক কম জানি। তবে যেহেতু কেন্দ্রগুলির শুধু আয়তনে অনেক সময় যথেষ্ট পার্থক্য আছে সেহেতু কোনও রকম সংবদ্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো অনুমান করে নেওয়া যায়। ধর্মীয় জীবনের প্রসঙ্গে আমরা মহারাষ্ট্রে যা দেখেছি তা স্থানীয়ভাবে অপরিচিত নয়। ‘অগ্নিবেদির’ কথা ঘুরে-ফিরে খননের বিবরণে আসে। বর্তমান হিন্দু ধর্ম তুলে বসিয়ে দেওয়া যায় না কিন্তু যতটুকু ধর্মীয় জীবনের পরিচয় পাই তাতে কিছু অপরিচিত নেই। গৃহদেবতার যে একটি ধারণা ছিল তা ইনামগাঁওতে ঘরে গর্ত করে মাটিরই কৌটোর ভেতর মাটিরই মূর্তি রাখার সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণিত হয়। ইনামগাঁওতে ‘মাতব্বরের বাড়ি’, ‘পুরোহিতের বাড়ি’ ইত্যাদি বলে জল্পনা-কল্পনা হয়েছে; সামাজিক অথবা অর্থনেতিক তফাত একটা ছিল—ঘরের আয়তনের তারতম্যে, জিনিসপত্রের সংখ্যার তারতম্যে তার ইঙ্গিত মেলে। এর বেশি কিছু বলা আরও অনেক বিশদ গবেষণার অপেক্ষা রাখে।
এমন মনে করার কারণ নেই যে গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। বাণিজ্য হতই—খনন কার্যে পাওয়া কাঁচামালের তালিকা করলেই এটা স্পষ্ট হবে। তামার জিনিস যদি পাওয়া যায় তবে তামাকে কাঁচামাল বলে ধরে তার উৎস সন্ধানের চেষ্টা সমীচীন হবে। এই জিনিস বিশ্লেষণ করে যদি দেখা যায় তাতে সিসা আছে কি টিন আছে কি আর্সেনিক আছে তবে সিসা, টিন ও আর্সেনিক কাঁচামাল হিসেবে কোথা থেকে এসেছে তার অনুসন্ধান দরকার। মুলুকের ডাঙ্গার পাশের গ্রাম বাহিরীতে যদি খ্রি.পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষে কি প্রথম সহস্রাব্দের গোড়াতে তামা আর টিন আসে, তবে তার উৎসের কথা চিন্তা করতে হবে, এবং সেই উৎস থেকে এতদূর এসে পৌঁছল কী করে ভাবলেই তখনকার গ্রামজীবন যে বদ্ধ ছিল না বোঝা যাবে। বাণিজ্য, জিনিসের আদান-প্রদান অনেকভাবেই হতে পারে। জঙ্গলের জিনিস যখন সমতলের গ্রামে পৌঁছায় তখন তা আনার জন্য গ্রামের লোককে সোজা জঙ্গলে যেতে হয়নি; জঙ্গল অঞ্চল থেকে নিয়ে আসার ব্যাপারি বা পাইকার আছে। জঙ্গলের লোকেরাই জিনিস সংগ্রহ করেন; ব্যাপারি নিয়ে আসে। তাম্রপ্রস্তর যুগের আদান-প্রদান বা বাণিজ্যের প্রক্রিয়া বা কাঠামো আমরা জানি না সত্য, তবে আধুনিক শিল্প জগতের বাইরে যে জীবনটা এখনও আমাদের দেশে আছে তার মাধ্যমেই অনুমান করে নিতে হয়।
অনেক কিছু কারিগরি জীবনের ভিত্তিও এই সময়েই গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার—খনি থেকে আকর আহরণ, তা গলিয়ে কাজে লাগার মতো ধাতু বের করা, এবং তারপরে সেই ধাতুর বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা। আকরিক খনি ওরা কী করে চিনত? খনিই বা করত কী করে? আর কীভাবে কোথায় গলাত? যাঁরা খনি থেকে আকর আহরণ করতেন তাঁরাই কি গলাতেন না গলাবার লোক অন্য ছিল? ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের যে সহস্র সহস্র বিভিন্ন ধাতুর জন্য করা খনি আছে তাদের ইতিহাস আমরা খুব কমই জানি। কম জানলেই তার গুরুত্ব চলে যায় না। গাঙ্গেয় উপত্যকায় যে অজস্র লোহার জিনিস, তার লোহাই বা এল কোথা থেকে? কোথা থেকে এসেছে অনুমান করা দুরূহ নয়, কিন্তু কী অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে এল? বাণিজ্য পথ ছিল? নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ছিল। বসতি বিন্যাস থেকে এটা অনুমান করা যায় ঐতিহাসিক কালের যে বাণিজ্য পথ আমরা দেখি প্রাগৈতিহাসিক গ্রামীণ পর্যায়েই তার সুদৃঢ় গোড়াপত্তন হয় এতে সন্দেহ নেই।
খ্রি. পূ. ষষ্ঠ কি সপ্তম শতাব্দীতে গাঙ্গেয় উপত্যকাতে ইতিহাসের আলো জোরালো হয়ে ওঠে। গৌতম বুদ্ধের নাম এই প্রসঙ্গে আসে। কিন্তু বুদ্ধের ভারতের ভিত্তি কী ছিল? তাম্রপ্রস্তরযুগীয় এবং পরবর্তীকালে লৌহ ব্যবহারকারী যে গ্রাম আমরা আলোচনা করেছি তাই। বুদ্ধগয়াতে তিনি যেখানে নির্বাণ লাভ করেছিলেন তার ২৫০/৩০০ গজ দূরেই তাঁর সময় থেকে অন্তত ১৫০০ বছরের পুরনো গ্রাম। উরুবিল্ব গ্রামের নাম তো এখনও উরুবিল্বই (প্রায়, তবু বর্তমান অপভ্রংশের আড়ালে উরুবিল্বকে চিনতে ভুল হয় না)। সুজাতা যে পায়েস নিয়ে এসেছিলেন তিনি এসেছিলেন ফল্গুর ওপার থেকে। বর্তমান বক্ৰোরে তাঁর বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেছে ; এক পালরাজা তার ওপর স্তূপ বানিয়েছিলেন; শিলালিপিতে লিখেছিলেন যে, স্তূপটি ‘সুজাতা গৃহ’তে বানানো। ফল্গু পেরিয়ে যদি সুজাতাকে আসতে হয় তবে এখনও গ্রামের লোক যে দুটি জায়গায় হেঁটে নদী পার হন, সে-দুটির একটিতে এসেছেন। যে প্রাগৈতিহাসিক গ্রামজীবনের কথা এই অধ্যায়ে আলোচিত হল তা এখনও লোপ পেয়ে যায়নি, আমাদের আশেপাশে আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বোধ হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় এটা। কারণ যে গ্রামীণ ভারতবর্ষ আমরা জানি, সেটা তখনকার গড়ে ওঠা। এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার কত প্রয়োজন তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
.
পঞ্চম অধ্যায়
১। জি স্টাকুল, ‘এক্সকাভেশন নিয়ার ঘালিগাই (১৯৬৮) অ্যান্ড ক্রোনোলজিকাল সিকুয়েন্স অভ প্রোটোহিস্টরিকাল কালচারস অভ দ্য স্বাত ভ্যালি’, ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ১৯ (১৯৬৯), পৃ. ৪৪-৯১। গান্ধার সমাধিক্ষেত্র সংস্কৃতির জন্য, সি এস, আনটোনিনি এবং জি স্টাকুল, দ্য প্রোটেহিস্টরিক গ্রেভইয়ার্ডস অভ স্বাত (পাকিস্তান), রোম, ১৯৭২; এ এইচ দানী, ‘তিমারগরহা অ্যান্ড গান্ধার গ্রেভ কালচার’, এনশেন্ট পাকিস্তান ৩ (১৯৬৭)।
২। বুরঝহম এর জন্য, আর এন ক’, ‘দ্য নিওলিথিক কালচার ইন কাশ্মীর’, এসেজ ইন ইন্ডিয়ান প্রোটোহিস্টরি (ডি পি অগ্রবাল ও ডি কে চক্রবর্তী স.), দিল্লি, ১৯৭৯, পৃ. ২১৯-২৮। গুফ্ক্রালের জন্য, ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি—এ রিভিউ ১৯৮০-৮১।
৩। এস বি ওতা, ‘এভিডেন্স অভ ট্রানসুমানস ফ্রম লাদাখ, হিমালয়েজ, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর, ইন্ডিয়া’ কারেন্ট অ্যাডভানসেজ ইন ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি, খণ্ড ১, আর কে গনজু ও এস বি ওতা স.) নাগপুর, ১৯৯৩, পৃ. ৯১-১১০।
৪। ডি পি অগ্রবাল এবং অন্যান্যরা, ‘সিসট বারিয়ালস অভ দ্য কুমায়ুন হিমালয়েজ’, অ্যানটিকুউটি ৬৯, ১৯৯৫, পৃ, ৫৫০-৪।
৫। এইচ ডি সাংকালিয়া এবং অন্যান্যরা, এক্সকাভেশনস অ্যাট আহার ১৯৬১-৬২, পুনা ১৯৬৯; রিমা হুজা, দ্য আহার কালচার অ্যান্ড বিয়ন্ড, অক্সফোর্ড ১৯৮৮; ভি এন মিশ্র এবং অন্যান্যরা, এক্সকাভেশনস অ্যাট বালাথল, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ২০ (১৯৯৫)।
৬। জেড ডি আনসারি অ্যান্ড এম কে ধাবালিকর, এক্সকাভেশনস অ্যাট কয়থা, পুনে ১৯৭৫; এইচ ডি সাংকালিয়া এবং অন্যান্যরা, দ্য এক্সকাভেশনস অ্যাট মহেশ্বর অ্যান্ড নভদাতোলি, ১৯৫২-৫৩, পুনা ১৯৫৮; চালকোলিথিক নভদাতোলি (এক্সকাভেশনস অ্যাই নভদাতোলি, ১৯৫৭-৫৮), পুনা, ১৯৭১।
৭। এস এ সালি, দাইমাবাদ, দিল্লি, ১৯৮৬ এম কে ধাবালিকর এবং অন্যান্যরা, এক্সকাভেশনস অ্যাট ইনামগাঁও, পুনা, ১৯৮৮; এম কে ধাবালিকর, দ্য ফার্স্ট ফারমারস অভ দ্য ডেকান, পুনা, ১৯৮৮।
৮। সম্প্রতিকালের লেখার উদাহরণ : ডি ভি দেবরাজ এবং অন্যান্যরা, ‘দ্য ওয়াতগাল এক্সকাভেশনস : অ্যান ইন্টেরিম রিপোর্ট’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, (১৯৯৫), সংখ্যা ২, পৃ. ৫৭-৭৪; কে পাদায়া এবং অন্যান্যরা, ‘এ নিওলিথিক অ্যানিমাল বুচারিং ফ্লোর ফ্রম বুদিহাল, গুলবর্গা ডিষ্ট্রিস্ট, কর্নাটক’, ওই পৃ. ২৩-৩১।
৯। সাম্প্রতিক আলোচনা, দিলীপ কে চক্রবর্তী, দ্য ইস্যুজ ইন ইস্ট ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি, দিল্লি, ১৯৯৮।
১০। সাম্প্রতিক আলোচনা, দিলীপ কে চক্রবর্তী এবং অন্যান্যরা, ‘প্রিলিমিনারি অবসারভেশনস অন দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অভ আর্কিওলজিকাল সাইটস ইন দ্য সাউথ বিহার প্লেইনস’, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ১১ (১৯৯৫), পৃ. ১২৯-৪৭; দিলীপ কে চক্রবর্তী এবং অন্যান্যরা, ‘ফ্রম পুর্নিয়া টু চম্পারন: দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অভ সাইটস ইন দ্য নর্থ বিহার প্লেইনস’, ওই ১২, (১৯৯৬), পৃ. ১৪৭-৫৮।
১১। পি সিং, এক্সকাভেশনস অ্যাট নারহান (১৯৮৪-৮৯), দিল্লি, ১৯৯৪; আর সি গৌড়, এক্সকাভেশনস অ্যাট অত্রনজিখেরা, দিল্লি ১৯৮৩; আর সি গৌড়, এক্সকাভেশনস অ্যাট লালকিলা, দিল্লি, ১৯৯৫।
১২। একটি সাম্প্রতিক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা, ইউ এস মূর্তি, মেগালিথিক কালচার অভ সাউথ ইন্ডিয়া, বারাণসী, ১৯৯৪।