৫. সর্দার গুরদীপ সিংএর বাড়ী

প্রবাল হেসে বললো, সেদিন বিকেলেই উনি আমাদের সর্দার গুরদীপ সিংএর বাড়ী নিয়ে গেলেন আর ওদের বললেন, এরা তোমাদের বেটা-বহুর মতই থাকবে।

মিঃ সোম শুনেও খুশি হন।

সত্যি আমরা ও বাড়ীর ছেলে পুত্রবধূ হয়ে গেছি।

ওখানে কতদিন ছিলে?

বাণী বললো, এখনও তো ওদের কাছেই থাকি। ওরা কিছুতেই বাসা ভাড়া নিতে দেন না।

প্রবাল বললো, চাকরি পাবার আগে পর্যন্ত ওরাই আমাদের খাইয়েছেন।

মিঃ সোম প্রশ্ন করেন, ওরা তোমাদের মাইনে দিতেন না?

হ্যাঁ, একশ টাকা দিতেন।

বাণী বললো, এই পরিবারের দেখা না পেলে বোধহয় আমরা বাঁচতে পারতাম না। ওদের ওখানে যাবার মাস দুই পরে হঠাৎ একদিন আমার শরীর খুব খারাপ হলো।

মিঃ সোম জানতে চাইলেন, তারপর?

খুব লজ্জা করলেও মাতাজীকে না বলে পারলাম না।…

খবরটা শুনেই মাতাজী রেগে লাল, এ খবর এতদিন আমাকে বলোনি কেন? এ কথা কেউ লুকিয়ে রাখে?

মাতাজী ডাক্তারকে খবর দিলেন। ডাক্তারবাবু এলেন। বাণীকে দেখেশুনে ওষুধ দিলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, না, চিন্তার কিছু নেই। বাচ্চা ভালই আছে।

প্রবাল একটু হেসে বললো, এই বাচ্চা হওয়ার ব্যাপারে আমাকে কিছু করতে হয় নি। সবকিছু মাতাজী করেছেন।

এবার বাণী মিঃ সোমের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি কিভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন, সেসব কথা মাতাজীকে বলেছি।…

সবকিছু?

হ্যাঁ। মাতাজীকে আমরা সবকিছু বলেছি।…

ভালই করেছ।

মাতাজী বার বার করে বলেছেন, আপনাকে একবার জব্বলপুর যেতে।

মিঃ নোম একটু হাসেন।

প্রবাল বলে, না, না, হাসির কথা নয়। আপনাকে আসতেই হবে।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে।

বাণী বললো, আপনি আমাদের বিয়ে দিয়েছেন আর আপনি আমাদের সংসার দেখতে আসবেন না?

ঠিক বলেছ। তোমাদের সংসার একবার দেখে আসা উচিত। মিঃ নোম একটু থেমে বলেন, ফিরে যাবার আগে একদিন সৌভাগ্য বাবুকে দেখিয়ে নিয়ে যেও।

বাণী বললো, নিশ্চয়ই আসব।

দিন আসে, চলে যায়। সবারই জীবনে তাই হয়। মিঃ সোমেরু জীবনও ব্যতিক্রম নয়।

কেউ কেউ বিয়ের নোটিশ দিতে আসেন, কেউ কেউ আসেন প্রস্তাবিত বিয়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে; আবার কেউ কেউ আসেন বিয়ে করতে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের দিন এইভাবেই কাটে।

ব্যতিক্রমও হয়। হঠাৎ প্রবীর বা সুবীর, সুমিত্রা বা নন্দিতা জুটে যায়। আবার এদের সবাইকে ম্লান করে দেয় ঐ একটা ছোট্ট শিশু তুতুল। ম্যাথুজ-কান্তাম্মাও একটা নতুন সুর। সে সুরের রেশ মন থেকে মুছে যায় না।

মাঝে মাঝে মিঃ সোম আনমনা হয়ে বসে থাকেন। মনে মনে ভাবেন, কত শত শত মেয়ে-পুরুষ তার কাছে এসেছেন কিন্তু কজন তার মনে রেখাপাত করতে পেরেছেন? না, বেশী না; মাত্র কজন। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠেন। অত বড় আকাশে কত হাজার-হাজার লক্ষ লক্ষ তারা আছে কিন্তু সবাই কী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে?

না সবাই অনন্য-অনন্যা হতে পারে না।

না হোক অনন্য-অনন্যা; তবু, মিঃ সোম প্রত্যেকটি ছেলেমেয়েকে মনে করার চেষ্টা করেন। শুক্ল এয়োদশী-চতুর্দশীর আবছা চাঁদের আলোয় হঠাৎ অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ওর সামনে ভীড় করে। স্পষ্ট চিনতে না পারলেও অপরিচিত মনে হয় না। উনি এক মনে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তারপর হঠাৎ পুর্ণিমার আলোয় ভরে যায় ওর স্মৃতির অরণ্য। সামনের প্রত্যেকটি মূর্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিঃ সোম বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেন, ওরা সবাই শুধু পরিচিত নয়, ওরা সবাই ওর আপনজন, একান্ত প্রিয়জন।

ওদের প্রত্যেককে ভাললাগে মিঃ সোমের। ওদের প্রত্যেকের সুখ দুঃখের আনন্দ-বেদনার অনুভূতিতে ওর মন ভরে যায়। নিজের মনে মনেই ওদের প্রশ্ন করেন, তোমরা সবাই ভাল আছো তো? তোমরা সবাই সুখী হয়েছে? কি বললে? দুঃখ-কষ্ট? ও কিছু নয়। ও কালবৈশাখী ঝড়ের মত ভয় দেখাবার জন্য হঠাৎ আসে-যায়। তোমরা তত ভালবাসতে জানো; তোমাদের কোন ভয় নেই। ভালবাসার কাছে এ সংসারের সব দুঃখ-কষ্ট হেরে যায়।

মিঃ সোম একলা থাকলেও কখনো নিঃসঙ্গ থাকেন না। কোন না কোন ছেলেমেয়ে, কোন না কোন ঘটনা সব সময় মনে পড়ে। পড়বেই। পুরানো খাতাপত্তর দেখলে আরো কতজনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে কত বিচিত্র কাহিনী।

পুরাণণা দিনের বহু স্মৃতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎ অচিন্ত্য মুখার্জীর কথা মনে হতেই মিঃ সোম অবাক হয়ে যান। বহু বিচিত্র ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা আর হয় নি। বোধহয় হবেও না।

.

নমস্কার।

নমস্কার।

আমার নাম অচিন্ত্য মুখার্জী। এবার সে মেয়েটিকে দেখিয়ে বললো, এর নাম প্রিয় ব্যানার্জী।

এরপর অচিন্ত্য পরিচয় করিয়ে দেয় প্রিয়ার বাবা মুরারীবাবুর সঙ্গে।

মিঃ সোম জানতে চান, বলুন, আমি কী করতে পারি?

মুরারীবাবু অত্যন্ত দ্বিধা ও সঙ্কোচের সঙ্গে অচিন্ত্যকে বললেন, যা বলার তুমিই বলল বাবা।

অচিন্ত্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সঙ্কোচ না করে বললো, আমি একজন কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। বরোদায় চাকরি করি। ছুটিতে এসে শুনলাম, আমার বাবা-মা প্রিয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।

আচ্ছা?

হ্যাঁ। আশীর্বাদও হয়ে গেছে কিন্তু বাবা-মা আস্তে আস্তে এমন সব দাবি করছেন যা প্রিয়ার বাবার ক্ষমতার বাইরে।

কী আশ্চর্য!

অচিন্ত্য হেসে বললো, ছেলেকে যখন এঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন। তখন তা সুদে-আসলে তুলে নেবার অধিকার তাদের আছে বলেই আমার বাবা-মা মনে করেন।

এবার মুরারীবার মুখ কাচুমাচু করে বললেন, আমি পোর্ট কমিশনারের গরীব কেরানী। যথাসর্বস্ব দিয়ে তিনটি মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছি।…..

মিঃ সোম এবার প্রিয়াকে দেখিয়ে প্রশ্ন করেন, প্রিয়াই কী আপনার বড় মেয়ে?

এ আমার ছোট মেয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।

একে কতদূর পড়িয়েছেন?

বাংলায় এম. এ. পাস করেছে।

বাঃ।

এ ছাড়া রবিতীর্থে পাঁচ বছর গান শিখেছে। এবার মুরারীবাবুর মলিন মুখ একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলেন, রবিতীর্থের এক অনুষ্ঠানে ওকে দেখে ও গান শুনেই তো অচিন্ত্যর মামা-মামী এই বিয়ের সম্বন্ধ করেন।

তাই নাকি? খুশির হাসি হেসে মিঃ সোম বলেন।

মুরারীবাবুও হেসে জবাব দেন, হ্যাঁ।

এবার অচিন্ত্য বললো, আনুষ্ঠানিকভাবেই বৈশাখে আমাদের বিয়ে হবে কিন্তু যদি বাবা-মার জন্য কোন গণ্ডগোল দেখা দেয় তাই মামা-মামীর পরামর্শে আপনার কাছে এসেছি।

মিঃ সোম সরাসরি প্রশ্ন করেন, আপনারা কী সিভিল ম্যারেজ করতে চান?

স্পষ্ট জবাব দেয় অচিন্ত্য, হ্যাঁ। একটুও না থেমে সঙ্গে সঙ্গে বলে, আপনার দেওয়া সাটিফিকেটটা পকেটে থাকলে বাবা-মাকে স্পষ্ট বলতে পারব…..

আজ অনেক দিন পর হঠাৎ অচিন্ত্যর কথা মনে পড়তেই মিঃ সোমের হাসি পায়। ওর দেওয়া একটা সার্টিফিকেটের ভয়ে অচিন্ত্যর বাবা-মা কোন দাবি-দাওয়া না করেই প্রিয়াকে ঘরে এনেছিলেন।

বিয়ের তৃতীয় বার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে প্রিয়া মিঃ সোমকে লিখেছিলেন–আজ আপনাকে মনে না করে পারছি না। আপনার কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে বেশ একটু অভিমান, একটু আহত মন নিয়েই আমি নতুন জীবন শুরু করি। আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর ধারণা হয়েছিল, আমি বা আমাদের পরিবারের কেউ কোনক্রমে তাঁদের একমাত্র পুত্রকে প্রভাবিত করেছি। মামা-মামী দুজনেই ওদের অনেক বুঝিয়েছেন কিন্তু তবু ওরা আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি।…

বিয়ের সপ্তাহখানেক পরেই অচিন্ত্য বরোদায় ফিরে যায়। প্রিয়া কলকাতায় শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে থেকে যায়। সে সময় শাশুড়ী মাঝে মাঝেই নানা কথার পর জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি তো আর এখন পর নও; এখন একটা সত্যি কথা বলবে?

মুরারীবাবু গরীব কেরানী হলেও মেয়েদের সুশিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রিয়া কোনদিনই মিথ্যা কথা বলে না। তাই শাশুড়ীর এ ধরনের প্রশ্নে অত্যন্ত দুঃখ পায়, অপমানিত বোধ করে। রাগও হয়। তবু নিজেকে সংযত রেখে বলে, যা ইচ্ছে জিজ্ঞাসা করুন; আমি সব সত্যি বলব।

বিয়ের আগে কি তোমাদের দুজনের অনেকবার দেখাশুনা হয়েছে?

প্রথম দিন বাবার সঙ্গে সোমবাবুর বাড়ীর সামনে পৌঁছে দেখি, আপনার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।…..

সে তো জানি।

দ্বিতীয় দিন মামা-মামী আমাদের বাড়ী এসে আমাকে নিয়ে সোমবাবুর ওখানে নিয়ে যান।

এ ছাড়া আর কত দিন দেখা হয়েছে?

এই দুবার ছাড়া বিয়ের আগে আর আমাদের দেখা হয় নি।

শাশুড়ী ঠাকরুণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, না হলেই ভাল কিন্তু সবার ধারণা তোমার সঙ্গে মেলামেশা করেই আমার ছেলের মাথা ঘুরে রায়।

প্রিয়া স্তম্ভিত হয় শাশুড়ীর কথা শুনে কিন্তু প্রতিবাদ করে না।

আরো কত অপমান, কত দুঃখ, কত তিক্ত অভিজ্ঞতা সহ্য করতে হয় প্রিয়াকে।

প্রিয়া লিখেছে, তারপর আস্তে আস্তে মেঘ কেটে যায়। এখন শ্বশুর-শাশুড়ী আমাকে যে–কি ভালবাসেন, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমার শ্বশুর আমার বাবাকে বলেন, বেয়াই মশাই, বহু জন্মের পুণ্যফলের জন্য প্রিয়াকে আমাদের ঘরে আনতে পেরেছি। এ যুগে ওর মত মেয়ে সত্যি দুর্লভ। আমার প্রতি আমার স্বামীর এত বেশী দুর্বলতা যে সে বেশী দিন আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই বাবা-মার কাছে থাকা বিশেষ হয়ে ওঠে না। শাশুড়ী সবই বুঝতে পারেন। তাই উনি নিজে উদ্যোগী হয়ে বাবা-মাকে দুবার এখানে আনিয়েছেন। আজ আমি সত্যি সুখী। আশা করি আপনাদের শুভেচ্ছায় ও আশীর্বাদে আমাদের আগামী দিনগুলিও আনন্দে ভরে উঠবে।

এমনি আরো কতজনের কথা ভাবতে ভাবতে বিভোর হয়ে যান মিঃ সোম।

সেদিন সাবিত্রীর জন্মদিন। ছোটবেলায় মা আশীর্বাদ দিয়ে মুখে পায়েস দিতেন। বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে একটা নতুন শাড়ী পান, আর কিছু নয়। এবার সুমিত্রার উৎসাহে বেশ ভাল ভাবেই সাবিত্রীর জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। প্রবীরবাবু অফিস যান নি। সুমিত্রা আগের দিন চলে এলেও উনি সেদিন ভোরেই এসেছেন। সুবীর ও নন্দিতা আর তুতুলকে নিয়ে খুব সকালেই এসেছে।

মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, উদ্যোগ-আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, আজ সাবিত্রীর বিয়ে।

সাবিত্রী একটু মুচকি হেসে বললেন, এরা ভালবেসে আমাকে এত সম্মান দিচ্ছে বলে কি তোমার হিংসে হচ্ছে?

প্রবীরবাবু সঙ্গে সঙ্গে ওদের দুজনের দুখে দুটো কড়া পাকের সন্দেশ গুঁজে দিতেই সব থেমে গেল।

সুমিত্রা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আমার রান্না প্রায় শেষ। দাদা, স্নান করতে যান।

সুমিত্রার পরামর্শ উপেক্ষা করার সাহস মিঃ সোমের নেই; তাই দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি বাথরুমে ঢুকলেন। তার মিনিট খানেক পরেই কলিংবেল বেজে উঠল।

প্রবীরবাবু দরজা খুলেই দেখলেন, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে আর তার ছোট্ট বাচ্ছা।

মেয়েটির করুণ, ম্লান মুখেও হঠাৎ একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল বললো, প্রবীরদা, তুমি?

প্রবীরবাবু ওর মুখের দিকে একটু ভাল করে তাকিয়েই বললেন, অর্পি, তুই? উনি এক নিঃশ্বাসেই বললেন, তোর বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাও হয়েছে?

অর্পিতা খুব জোরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো, আমার আরো অনেক কিছু হয়েছে।

প্রবীরবাবু তাড়াতাড়ি ওর বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, আয়, আয়, ভিতরে আয়।

অর্পিতা ভিতরে আসতেই প্রবীরবাবু সবাইকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর অর্পিতাকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, আমার ছোটবেলার সব চাইতে প্রিয় বন্ধু দেবব্রতের ছোট বোন। অপি যেদিন হয়, সেদিন আমি আর দের সারা রাত হাসপাতালে কাটিয়েছিলাম।

হঠাৎ একটা নতুন আনন্দ, উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল সারা বাড়ীতে।

একটু পরে প্রবীরকে একটু আলাদা পেয়ে অর্পিতা ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা প্রবীরদা, এটা মিঃ সোমের বাড়ী না?

ওর প্রশ্ন শুনেই প্রবীরবাবু যেন চমকে উঠলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কী ওর কাছে এসেছিস?

হ্যাঁ।

কেন?

পরে বলব।

আমি তো ভেবেছিলাম, তুই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিস।

আমি ওর কাছেই এসেছি কিন্তু তোমাকে এতদিন পর দেখে খুব ভাল লাগল।

যাক বৌদির জন্মদিনে এসে ভালই করেছিস।

না প্রবীরদা, আজ আমি না এলেই বোধ হয় ভাল হতো।

তোর কথাবার্তাগুলো কেমন যেন বেসুরো লাগছে।

শুধু কথাবার্তা না, আমার সমস্ত জীবনটাই বেসুরো হয়ে গেছে।

একটু পরেই অর্পিতা চলে যায়।

কয়েক দিন পরে অর্পিতা আবার, এলো। মিঃ সোম আদর করে ওকে আর ওর বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

অর্পিতা চেয়ারে বসেই বলল। দাদা, আজ কিন্তু আমি জরুরী কাজে আপনার কাছে এসেছি।

বলো দিদি, কী কাজ?

আজ থেকে চার-পাঁচ বছর আগে নিখিল ঘোষাল বলে কেউ আপনার এখানে বিয়ে করেছে?

দাঁড়াও, দেখছি।

মিঃ সোম তালা খুলে আমার খুলে মোটা খাতা বের করে দেখতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে খাতার উপর দিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতেই উনি জিজ্ঞাসা করলেন, দিদি ইনি তোমার কে হন?

পরে বলব।

মিঃ সোম আর কোন প্রশ্ন করেন না। আবার মন দিয়ে খাতার পাতায় নানাজনের নাম দেখেন। আরো আধ ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে জিজ্ঞাসা করলেন, দিদি, তিনি অন্য কোন ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে যান নি তো?

যতদূর জানি তিনি আপনার কাছেই এসেছিলেন।

দশ-পনের মিনিট পরে মিঃ সোম বললেন, হ্যাঁ, দিদি, পেয়েছি।

অর্পিতা প্রায় চিৎকার করে উঠল, পেয়েছেন?

মিঃ সোম মুখ না তুলেই মাথা নাড়লেন।

উনি তাহলে সত্যি সত্যি বিয়ে করেছেন?

হ্যাঁ। এবার মিঃ সোম খাতা দেখতে দেখতে বলেন, ঠিক সাড়ে পাঁচ বছর আগে সাতই আগস্ট উনি…

উনি সুপর্ণাকেই বিয়ে করেছিলেন?

হ্যাঁ।

অর্পিতা আপন মনেই বললেন, চমৎকার।

মিঃ সোম আবার ওকে প্রশ্ন করলেন, দিদি, ইনি তোমার কে?

ইনি আমার পতিদেবতা।

তোমার স্বামী?

অর্পিতা একটু হেসে বললো, হ্যাঁ দাদা, এই মহাপুরুষই আমার স্বামী।

ক বছর তোমার বিয়ে হয়েছে?

চার বছর।

তুমি ঠিক জানো উনি ডিভোর্স না করেই তোমাকে বিয়ে করেছেন?

অর্পিতা একটু অদ্ভুতভাবে সে বললো, ডিভোর্স! ও ডাইনীর হাত থেকে ওর নিস্তার নেই।

তোমাদের বিয়ে কিভাবে হয়েছে?

সম্বন্ধ করে।

বিয়ের আগে কিছু জানতে না?

না। অর্পিতা একটু হেসে বললো, এই সৎপাত্রের জন্য আমার বাবাকে সবকিছু বাদ দিয়ে দশ হাজার টাকা নগদ দিতে হয়েছিল।

কি আশ্চর্য।

এইটুকু শুনেই আশ্চর্য হচ্ছেন? তাহলে সবকিছু শুনলে তো আপনি মুছ। যাবেন।

সবকিছু মানে?

আমার পতিদেবতা রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় মহারানীকে সঙ্গে আনেন। ওরা এসেই বেডরুমে লুটিয়ে পড়েন আর আমাকে ওদের জলখাবার, রাতের খাবার মানে সবকিছু সে ঘরে পৌঁছে দিতে হয়।

ঐ ভদ্রমহিলা কী তোমার ওখানেই থাকেন?

রোজ সন্ধ্যের পর দু-চার ঘণ্টা কাটান। কোন কোন দিন থেকেও যান।

মিঃ সোম মুখ নীচু করে থাকেন।

অর্পিতা বলে, আমার পতিদেবতা আমাকে বাইরে বের করে দিয়ে ঐ ডাইনীকে নিয়ে ফুর্তি করে।

তুমি আপত্তি করো না?

না।

কেন?

আপত্তি করলে যে শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়, তা আর–

চুপ করো দিদি।

একটু চুপ করে থেকে, কাঁদতে কাঁদতে অর্পিতা বললো, আপনি শুনলে অবাক হবেন, লেবার পেন উঠলে আমি ঝিকে নিয়ে নিজে হাসপাতালে গেছি। হাসপাতালে থাকার সময় উনি একদিনও আমাকে বা ছেলেটাকে দেখতে আসেন নি।

তোমার শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা এই জানোয়ারটাকে সায়েস্তা করতে পারেন না?

শ্বশুর-শাশুড়ী ভাসুর-ননদ কারুর সঙ্গেই ওর কোন সম্পর্ক নেই।

তোমার বাড়ীর সবাই এসব জানেন?

কিছু কিছু জানেন কিন্তু সব কথা জানাতে পারি না।

কেন?

সব কথা জানলে বাবা আর বাঁচবেন না।

কিন্তু দিদি, তুমি একা একা এ অত্যাচার কতকাল সহ্য করবে?

অর্পিতা মাথা নেড়ে বললো, জানি না।

তুমি ডিভোর্স কর না কেন?

কী লাভ?

মিঃ সোম এতকালের অভিজ্ঞ ম্যারেজ অফিসার হয়েও জবাব দিতে পারেন না।

দাদা, মাসে মাসে কটা টাকা পেলেই কি আমি বাঁচতে পারব? তাও তত স্বেচ্ছায় দেবেন না, জোর করে…

এখন কি উনি স্বেচ্ছায় তোমাদের খেতে পরতে দিচ্ছেন?

তা ঠিক, কিন্তু—

কিন্তু কী?

দাদা, যদি আবার বিয়ে করতে পারতাম তাহলে হয়ত ডিভোর্স করতাম, কিন্তু তা তো পারব না। অর্পিতা একটু থেমে বললো, স্বামীর সোহাগ পাবার লোভ আর আমার নেই।

একটু পরেই ঘুমন্ত শিশুটাকে কোলে নিয়ে অর্পিতা উঠে দাঁড়াল।

একি দিদি, উঠলে কেন? তোমার বৌদিকে আসতে দাও।

না দাদা, আজ উঠি।

এখন কোথায় যাবে? বাড়ী?

অর্পিতা হেসে উঠল। বললো, হ্যাঁ, আমার স্বামীর বাড়ী যাব।

কেন? তাড়া আছে?

হ্যাঁ দাদা, খুব তাড়া আছে।

অর্পিতা বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।

মিঃ সোম ওকে বাধা দিলেন না, দিতে পারলেন না। কিন্তু হঠাৎ যেন একটা অমঙ্গলের ইঙ্গিতে উনি ভয়ে কুকড়ে গেলেন।

পরের দুটো দিন সব কাজই করলেন, তবু মনের মধ্যে অস্বস্তি থেকেই গেল। সাবিত্রী দু-একবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি কিছু হয়েছে?

না, না, কিছু হয়নি।

মনে হচ্ছে সব সময় কী যেন ভাবছ।

মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে বললেন, আমি আবার কী ভাবব?

পরের দিন সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়েই মিঃ সোম চিৎকার করে উঠলেন, সাবি, অর্পিতা আত্মহত্যা করেছে।

ঐ খবরের কাগজখানা সামনে নিয়েই মিঃ সোম পুরো একটা দিন বোবা হয়ে বসে রইলেন। সাবিত্রী বার বার এলেন কিন্তু কিছুতেই সমবেদনা জানাতে পারলেন না। বিকেলের দিকে প্রবীরবাবু আর সুমিত্রা এলো, কিন্তু তারাও ওর সামনে গিয়ে বোবা হয়ে গেল।

খবর পেয়ে পরের দিন সকালে সুবীর নন্দিতা আর তুতুলকে নিয়ে হাজির হলো। ওরাও মিঃ সোমকে দেখে ভয়ে সরে এলো। শেষে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল তুতুল। মিঃ সোমের মুখখানা ধরে তুতুল বললো, নতুন দাদু, তুমি আমাকে ট্রামে চড়াবে না?

মিঃ সোম তুতুলকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি আর ম্যারেজ অফিসারের কাজ করব না। এখন থেকে রোজ আমি তোমাকে নিয়ে ট্রামে চড়ে বেড়াব।

পরের দিন সকালেই রেজেস্ট্রী করে মিঃ সোম ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিলেন। তারপর একদিন সরকারী অফিস থেকে সে ইস্তফাপত্র গৃহীত হবার খবরও এলো।

মিঃ সোম সুমিত্রাকে বললেন, দিদি, তোমাদের মত ভাইবোন, সুবীর-নন্দিতার মত ছেলেমেযে আর তুতুলের মত নাতি পেয়ে বোধহয় মনে মনে আরো লোভ হয়েছিল। তাই অর্পিতা আমাকে চরম শিক্ষা দিয়ে গেল। উনি খুব জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না দিদি, ভগবান আমাকে অনেক দিয়েছেন। আর আমি কিছু চাই না।

.

সেদিন রবিবার। ওরা সবাই এসেছেন। ভিতরের ঘরে চা খেতে খেতে খুব জোর আড্ডা চলছে। হঠাৎ খুব জোরে কলিং বেল বাজতেই নন্দিতা উঠে গেল। ফিরে এসে মিঃ সোমকে বললো, মিঃ ম্যাথুজ এসেছেন।

ম্যাথুজ।

মিঃ সোম প্রায় ছুটে বাইরের ঘরে গেলেন। পিছন পিছন ওরা সবাই এলেন। ম্যাথুজ একা আসেন নি, সঙ্গে কান্তামা আর ছেলেও আছে।

হলো নিঃ সোম। মিঃ ম্যাথুজ ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি বলেছিলাম না হনিমুনে গিয়েই কান্তামা প্রেগন্যান্ট হবে?

ম্যাথুজের কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *