৫. সমুদ্রের তীরে এমন একটি অপরাহ্নে

সমুদ্রের তীরে, এমন একটি অপরাহ্নে অপর এবং অন্যের কথা মনে ঠাঁই পাই না। প্রত্যহের কোলাহল—প্রতিদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে এখন আমি হাজার হাজার মাইল দূরে। মাইল না বলে কিলোমিটার বললেই ঠিক হবে বোধ করি—দুটির অবকাশ জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রাত্যহিক অপমৃত্যু থেকে পলায়ন ছাড়া আর কী?

আমার সামনে অনতিদূরে ওই উত্তাল সমুদ্র—আর চারিধারে ধূসর বালুর ধূধূ বিস্তার! তার মাঝখানে আমার ডেক চেয়ারে আমি আরামে সমাধিস্থ কল্পনা কখন ফিরবে সেই কল্পনাতেই বিভোর হয়ে রয়েছি মনে হয়।

স্বর্গদ্বারে তার এক সখীর সঙ্গে আলাপ করতে সেই যে উনি গেছেন, এখনো ওঁর দেখা নেই। অগত্যা আমি বেচারী কী আর করি? বিরহ-দুঃখে স্রিয়মান হয়ে মুহ্যমান হয়ে মশগুল হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছি।

সূর্যের ডুব দেবার খুব দেরি নেই। আমিও খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে। সমুদ্রে সূর্যাস্ত ওরফে সূর্যাস্তের সমুদ্র শুনেছি দেখবার মতো একটা জিনিস,—দৃশ্যহিসাবে অতিশয় বিরল বলে নাকি! প্রকৃতি-রসিকরাই বলে থাকেন।

কিন্তু কেন বলা যায় না, কাঁচা পেয়ারা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক ভালো জিনিসই আমার কাছে তেমন পেয়ারের নয়! ধাতে কেমন বরদাস্ত হয় না, কোথায় গিয়ে যেন কামড়ায়! অস্তাচলগামী সূর্যের পরাক্রমে পরাস্ত হয়ে, আত্মরক্ষার খাতিরে সমুদ্রকে আড়াল করে খবরের কাগজের আড়ালে আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

 

এই একটু আগে, এক জোড়া তরুণ-তরুণী আমার কাছাকাছি এসে কলহ জুড়ে দিয়েছিল—সূর্যাস্ত-দর্শনে তাদেরও সমান অরুচি দেখতে পেলাম—বকতে বকতে তাদের আলোচনার এবং আমার সীমান্তে এসে তারা পৌঁচেছিল। মুখে কাগজ চাপা দিয়ে আমি অকাতরে ঘুমোচ্চি তারা ধরে নিয়েছিল মনে হয়। ঘুমের ভাণ করে তাদের তর্ক করতে দেব, না, নড়ে চড়ে তাদের সতর্ক করে দেব–কোনটা ঠিক হবে সেই কথাই আমি ভাবছিলাম।

আবার তুমি না করচ! আমার নিজের চোখে দেখা। মেয়েটি বলছিল।

কিছুতেই তুমি দেখতে পারো না! প্রতিবাদ করে ছেলেটি : আমি ছিলামই না সে তল্লাটে! তোমার দিব্যি, তার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না।

আমি নিজের চোখে দেখেছি! বলছি আমি। মেয়েটির ধারালো অনু-যোগ!-–আমি কি মিথ্যে বলছি?

দ্যাখো হেনা, আমার মনে হয় ডাক্তারকে দিয়ে তোমার চোখটা একবার দেখানো দরকার ভালো করে। তুমি আরেকবার এইরকম ভুল করেছিলে মনে আছে বোধহয়? সেই যেবার তুমি এমনি নিজের চোখে দেখেছিলে তোমার কোন্ এক বন্ধুকে নিয়ে আমি লাইটহাউসে ঢুকছি। মিনতি না কি যেন তার নাম! নিউ মার্কেট থেকে ফেরার পথে এমনি নিজের চোখেই দেখেছিলে তো! অথচ তুমি বেশ ভালোই জানতে, একটা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সারা দুপুর সেদিন আমি মিউজিয়ামেই কাটিয়েছিলাম। তবুও লাইটহাউসে আমাদের প্রবেশলাভ দেখতে তোমার একটুও বাধা হয়নি।

হয়ই নি তো। সেদিনও আমি ভুল দেখিনি! হেনার বরফ-জমানো গলা: সেদিনের কথাও আমি ভুলব না কোনো দিন!

মিনতির সুরে আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি, কিন্তু হেনার এহেন জবাবের বফি-পাহাড়ে আটকে গিয়ে তার তুষার-গলানো আবেদন গলার মধ্যেই জমাট বেধে যায়।

খবরের কাগজের ম্যাজিনো-লাইন একটু ফাঁক করে যুধ্যমান দম্পতির দিকে একবার আমি উকি মারলাম। অগ্নিবর্ষিণী মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়—তম্বীও বটে, বহ্নিও বটে! রোষকষায়িত হওয়ায় আরো যেন সুন্দরীই দেখাচ্ছিল ওকে। শানানো ছুরিব মত চকচকে আর ধারালো! যে কোনো মেষশাবকই ওর তলায় গলা পাততে দ্বিধা করবে না। কাগজের আড়াল দিয়ে আড় চোখে সেই আরক্তিম শোভার দিকে তাকাচ্ছিলাম–রঙদার আকাশকে উপেক্ষা করে সামুদ্রিক সূর্যাস্তের দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে। সত্যি, অস্তায়মান সূর্যের ওপরেও টেক্কা মেরেছিলো মেয়েটা।

স্বামী হতভাগ্যের আর কী বর্ণনা দেব? রস, কষ, বর্ণ, গন্ধ যাওবা ছিল বেচাবীর, এই অভাবিত আকস্মিক আক্রমণে সমস্তই হাওয়া কোন দিক দিয়ে যে এই ব্লিংসক্রিগ ঠেকাবে, কোণঠেসা হয়ে খেই পাচ্ছে না! বিপন্ন বিপর্যস্ত জীবটির প্রতি অযাচিতই আমার সহানুভূতির উদ্রেক হতে থাকে।

তুমি সুমুদ্দুরে স্নান করতে গেছ সেজন্যে তোমাকে আমি কিছু বলছি না, আমাকে ফেলে একলা যাওয়ার জন্যেও না, কিন্তু কিন্তু অমন করে মিথ্যে কথা বানিয়ে আমাকে ঠকাতে চাওয়ার মানে?…

হেনার ভেতর থেকে চাড়ে-ভাঙা বরফের টুকরোগুলো ঠিকরে ঠিকরে বেরয়।

আমি তোমাকে একশো বার বলেছি, আবার বলছি, আজ আমি সমুদ্রের ধারে কাছেও যাইনি। স্নানই করিনি আজ! শপথ করে বলচি, সারা সকালটা আজ আমি শ্রীমন্দিরের কারুকার্য দেখে কাটিয়েছি,–তোমার তোমার শ্রীজগন্নাথের শপথ!

মনে মনে হাসলাম। সত্যি বলতে, আমি নিজেই আজ সমুদয় প্রাতঃকালটা মন্দির-গাত্রের সুচারু ফার্যে নিবিষ্ট ছিলাম এবং আমাদের—আমার এবং মন্দিরের এক মাইলের মধ্যেও এই মিথ্যাবাদীর টিকি আমার নজরে পড়েনি। অবশ্যি, মন্দির-পৃষ্ঠের কারু ভাস্কর্যের প্রতি ছেলেটির অরুচি থাকবার কথা নয়। ওই সব পৌরাণিক চারু-শিল্প থেকে আধুনিক কলানৈপুণ্য লাভের সুযোগ আছে। এমনকি, উভয়ের অনুত মিলও দেখা যায়। আধুনিকতা আর পৌরাণিকতা এই শ্রীক্ষেত্রে একই সঙ্গমে এসে অকেশে যেন মিশ খেয়েছে। এই কারণে পুরী এলে আর সুযোগ পেলে অনেকে আগে মন্দিরদান করে, এমনকি মন্দির দেখলে জগন্নাথদর্শন পর্যন্ত ভুলে যায়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব আর যত্নতত্ত্বের সেই মিলনক্ষেত্রে এই গরমিলের নায়কের শ্রীমুখ আমি দেখিনি।

তুমি বলচ যে সমুদ্রের ধারে-কাছেও যাওনি আজ! বেশ, এই চুপ করলুম, আর আমি জীবনে তোমার সঙ্গে কথা বলব না বলতে বলতে ভাবাবেগে আপনা থেকেই হেনার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।

দ্যাখো হেনা, সারা দুপুর আজ তুমি আমার সঙ্গে কথা কওনি, সমশুক্ষণ মুখ ভার করেছিলে তাতে আমি প্রাণে কী ব্যথা পেয়েছি, তুমি জানো না। তারপর সেই তখন থেকে, বিকেল থেকে, তুমি আমাকে কী না বলছ,যা নয় তাই বলছ কিন্তু সব আমি সহ্য করেছি। এরপর ফের যদি তুমি এ-জীবনে আমার সঙ্গে কথা না বলো—জীবনের মতো কথা বলা বন্ধ করে দাও—তাহলে আমি কতদূর মর্মাহত হবো——কিরকম ঘাবড়ে যাবো তা কি তুমি ভাবতে পেরেচ? হেনা, তোমার পায়ে পড়ি, অতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না।

স্বামীর সকাতর প্রার্থনায় হেনা তক্ষুণি তক্ষুণি প্রতিজ্ঞা ভাঙলো :

আমি তাহলে বানিয়ে বানিয়ে বলচি এই কথাই তুমি বলতে চাও?

হেনার মুখে ঘুরে ফিরে সেই এক কথা-শব্দভেদী একাঘ্নী! ছেলেটির কপালে পর পর অনেকগুলি রেখা পড়ে তুমি খালি খালি আমায় অবিশ্বাস করচ, হেনা! এই সমুদ্রের সামনে আমি দিব্যি গেলে বলচি, কক্ষণো আজ আমি ওর জলস্পর্শও করিনি, তোমার ওই সমুদ্দুর সাক্ষী!

কিন্তু এত বড়ো সাক্ষ্যেও হেনা অটল,–হেনা হেলে না : তুমি কী বলতে চাও শুনি? পোস্টাফিসের ফেরতা এই পথে যেতে যেতে নিজের চোখে আমি কী দেখলাম তাহলে? ঠিক ওইখানটায়, ওই অতো দূরে, উঁচু ঐ বালির গাদাটার কাছে তুমি, আর তোমার চার পাশে একপাল–কী বলবো? একপাল জন্তু!

ছিঃ, হেনা, নিজের স্বজাতির নিন্দে কোরো না। ছেলেটি একটু ক্ষুন্ন হয় : নারীজাতির অবমাননা করতে নেই।

জন্তু না তো কী! কী বলব তাদের? বেহায়া মেয়ে যতো। হি হি হি শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়েছি! দেখলাম গুচ্ছের ছুঁড়ির মাঝখানে স্বয়ং আমাদের মূর্তিমান! আর কী দাপাদাপি বাপরে। কী লাগিয়েছিল ওরা? নটির পূজা, না, ঘোড়ার নাচ!

এখান থেকে ওই বালির গাদাটা কতোটা দূর! এখান থেকে দেখলে কিছুতেই তুমি আমাকে চিনতে পারতে না আর আমিও তোমাকে দেখতে পেতুম—মানে–যদি সত্যি সত্যিই ওখানে আমি থাকতুম সেই কথাই বলছি–

সেটা ভগবানের দয়া, কাছেই এখানে একটি ভদ্রলোক দুরবীণ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,-সমুদ্রের সুষমা দেখছিলেন তাই যেন বল্লেন,—তার হাত থেকে যন্তরটা একটুখানির জন্যে চেয়ে নিয়ে তার ভেতর দিয়ে তাকালুম। দেখতে আর কিছুই বাকী রইলো না। বলি, সুষমা বলে কেউ ছিল না কি ওদের মধ্যে? যে মেয়েটিকে তুমি হাত কলমে সাঁতার শেখাচ্ছিলে তিনিই সেই সামুদ্রিক সুষমা নন্ তো!

জীবনে আমি কক্ষনো কোনো সুষমাকে সাঁতার শেখাইনি। ছেলেটি প্রতিবাদ না করে পারে না। মেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটা আমার অভ্যেস নয়!

উঃ, কী বাহাদুরী মাইরি! তুমি নিজে গায়ে পড়ে মেয়েটাকে সাঁতার শেখাতে গেলে। আর শেখানো বলে, শেখানো! ইস্!–

সাঁতারেব আমি কী জানি যে শেখাবো! ছেলেটি বাধা দিয়ে বলে! অসঙ্কোচে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে কিছুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না।

তাই তো বলচি, আশ্চর্য! আর শেখাতে গেলে সেই ধিঙ্গিকে যে তোমাকেই শিখিয়ে দিতে পারে! যে তার একটু আগেই আধখানা সমুদ্দুর সাঁতরে এসেছে!–

আমি বার বার বলচি আমি নই, আর কেউ। ছেলেটি মুখ চুণ করে জানায়ঃ তুমি কি বলতে চাও যে আমি ছাড়া আমার মতো লোক আর একটিও এই পৃথিবীতে নেই? তোমার মতো আর একটা হা! তোমার জোড়া আর একটি মিললে হয়!

এক বাক্যে মেয়েটি ওকে উড়িয়ে দেয়। ওর সুচিন্তিত প্রস্তাব সমেত ওকে।

বেশ বুঝতে পারছি আমি আর অদ্বিতীয় নই! যেমন, আমাদের হিটলারের থাকে মেনি আমারও হয়েছে। আমারও জীবন্ত প্রতিমূর্তি হবহু প্রতিচ্ছবি, এই পুবীবই কোনোখানে ঘাপটি মেরে আছে নিশ্চয়। সেই হতভাগাই আমার সর্বনাশ সাধন করেছে, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!—ছেলেটি দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে সাথে অবশেষে পরিত্যাগ করে তাকে দেখতে পেলে একবার আমি দেখে নিতাম।

তাই নাকি? হেনাও চলকে ওঠে: আমিও দেখতুম একবার।

 

হেনার বারংবার ছেলেটিকে হেনস্থা আমার হৃদয়ে—আমার অ্যানাটমির সব চেযে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানছিল। স্বামীজাতিসুলভ সমবেদনায় আমি কানায় কানায় ভবে উঠেছিলাম। ভাববা দিকি, এই ছেলেটি না হয়ে যদি আমি স্বয়ং কল্পনার খপ্পরে এভাবে ধরা পড়তুম–কী হতো তাহলে? কল্পনা করতেই আমি শিউরে উঠি।

জীবনে কদাচ কাউকে উদ্ধার করার সুযোগ পাইনি। আমার সামনে কেউ জলে ডুবে মরেনি, আমার কাছাকাছি বাড়িতে আগুন লাগেনি কখনো–আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। স্ত্রী-পীড়িত এই অসহায় গোবেচারিকে বাঁচানো যায় কিনা, ভেবে দেখি।

 

ওদের অলক্ষ্যে উঠে যাই। তারপর হাওয়া খাওয়ার ছলনায় এধারে ওধারে ঘুরে ফিরে বেড়াতে বেড়াতে, পায়চারির ফাঁকতালে ওদের কাছাকাছি এসে পড়ি—তখনো দুজনের মধ্যে ঘোরতর লড়াই।

সাহস সঞ্চয় করে নিই আমি। তারপর সহাস্য মুখ তুলি :

এই যে, এই যে। দিগম্বরবাবু যে! আমি উছলে উঠি অকস্মাৎ : ফের আমাদের দেখা হলো, আঁ?—বলতে না বলতে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি আমি–আজকেই আরেকবার। কী ভাগ্যি।

দিগম্বরের গলার ভেতরটা ঘড় ঘড় করে ওঠে।

আজ্ঞে—আজ্ঞে, মাপ করবেন। ছেলেটি বলে: আমি—আমি তো আপনাকে–আমার নাম দিগম্বর নয়।।

দিগম্বর নয়? সে কি মশাই, আজ সকালেই আপনি বললেন, আপনার নাম দিগম্বর? আর এর মধ্যেই নিজের নাম ভুলে গেলেন?

সকালে কখন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো? দিগম্বর যেন দিগন্ত থেকে পড়লো।

আলবৎ হয়েছে। ঐ যে ঐখানে—ঐ——ঐ বালির গাদাটার পাশে? মনে পড়ছে আপনার? একদম না।

একদম না। ঐ বিচ্ছিরি গাদাটার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না। দিগম্বর বিরসমুখে জবাব দেয়।

সে কি মশাই? এ-বেলায় ও-বেলায় ভুলে যানে। আমি সে-সময় মেয়েদের সাঁতার শেখাচ্ছিলাম, আপনি অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে আমার কাজে কতখানি সাহায্য করলেন। কেন মশাই, সেই মেয়েটিকে–সমুদ্রের সুষমাকে—আপনিই তো স্বহস্তে সাঁতার শেখালেন, বলতে গেলে।–

বলতে বলতে আমি আরো কাছে এগিয়ে যাই, আরো তীব্র দৃষ্টিতে তাকাই, আরো তীক্ষ্ণতর কটাক্ষে ভদ্রলোকের আগাপাশতলা বিদ্ধ করি।

হ্যাঁ, আপনিই তো। সুষমার সমুদ্রে আপনাকেই তো তলিয়ে যেতে দেখেছি। ভালো করে অবলোকন করে অবশেষে বিহ্বল হতে হয : আশ্চর্য।…আমার বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রের সঙ্গে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় কণ্ঠ সমান তালে পাল্লা দ্যায় : তাই তো। আপনি তো দিগম্বর নন। উঁহু, দিগম্বরবাবু তো নন আপনি! এখন দেখতে পাচ্ছি! স্পষ্টই দেখছি এখন! কিন্তু কী অদ্ভুত মিল মশাই! এমন বিস্ময়কর সৌসাদৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। আশ্চর্য!

দিগম্বর–না, কী ওর নাম—ওকে দেখলে মনে হয়, ও যেন দৈববাণী শুনছে। স্বকর্ণেই শ্রবণ করছে! ফেরারী সত্য যুগ ফিরে এল নাকি ফের? সেই যে-যুগ—যে কালে, আপনি আসিয়া ভক্তরণস্থলে সংগ্রাম করিত দেবতাগণ!–পুনরায় দেখা দিল। নাকি আবার?

আর হেনাকে দেখলে মনে হয়, অপ্রত্যাশিত এই আবির্ভাবে, এহেন অভাবিত সাক্ষীর অভ্যুদয়ে, ও যেন আস্তে আস্তে আমার ওপরে আস্থা স্থাপন করতে শুরু করেছে।

ওঁর মতো একটি লোককে ঐ বালির গাদাটার পাশে আপনি দেখেছিলেন আজ সকালে? হেনা জিজ্ঞেস করে আমায়।

অবিকল। আর, দেখা মানে? আমরা দুজনে একই সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েছি। একই সুষমাময় সমুদ্রে। সত্যিই, অবাক কাণ্ড। দুজনে একেবারে হুবহু। একটু দূর থেকে দেখলে আলাদা করার উপায় নেই। যাক, কিছু মনে করবেন না মশাই, সামুদ্রিক সুষমায় যিনি মত্ত হয়েছিলেন, তিনি আপনি নন। তিনি অপর কেউ। এখন দয়া করে নিজগুণে আমায় মার্জনা করুন।

ছেলেটি আমায় মার্জনা করে দিল অম্লানবদনে, তৎক্ষণাৎ! তার মুখ দেখেই আমি টের পেলাম।

 

হোলো তো। দেখলে তো। বলছিলুম না যে আমি নই—সে যেই হোক্, সে কখনো তোমার স্বামী নয়–

চলে যায় ওরা, মেয়েটিকে কাটা কাটা কথা শোনাতে শোনাতে যায় ছেলেটি : সেই লোকটাই আসল বদ। সেই হচ্ছে আসামী। আর দূরবীনধারী সমুদ্রের সেই সুষমাদর্শনকারী হতচ্ছাড়াটা হচ্ছে তার মাস্তুত ভাই। সে লোকটাও কম পাজি না। সেই তো যতো নষ্টের গোড়া। সেই হতভাগাটা যদি না তোমাকে দূরবীন দিতো—যাগ গে, দিগ গে, তাকে কী। এখন, তাকে কি, তার মাস্তুত ভাই সেই সন্তরণবিলাসীকে তোমার স্বামী বলতে চাও? ইচ্ছে হয়, বলতে পারো।… বলতে বলতে চলে যায় ওরা।

আমি হাসি। একখানা স্বর্গীয় হাসি হেসে দিই। দুঃখ-জৰ্জর পার্থিব কোনো জীবের একটুও উপকারে লেগেছি,—একটাও ক্ষণভঙ্গুর সুখনীড়কে ভগ্নদশা থেকে বাঁচাতে পেরেছি–অকিঞ্চিৎকর এই জীবনের যৎকিঞ্চিৎ যাতনাও করতে পারা গেছে—এই ভেবে বিজাতীয় আনন্দ হতে থাকে।

ফেরা যাক্ এবার।

ফিরতেই দেখি, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কল্পনা। মূর্তিমতী শ্রীময়ী স্বয়ং–

ঠোঁটে ঠোঁটে জমাট লেগে সারা মুখ সুকঠিন—দুই চোখে ওর গনগনে আগুন। একটু আগে হেনার মুখে যে-ছবি দেখেছিলাম তারই পুনর্মুদ্রণ। কিন্তু তার চেয়ে আরো ভয়াবহ।

এই বুঝি তোমার মন্দির দেখতে যাওয়া? আজ সকালে সারা বেলাটা—এই–এই বুঝি?…এই করেই বুঝি…?

দলিতা ফণিনীর মতো কল্পনা ফোস ফোস করে। গর্জে গর্জে উঠতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে।

আর আমি?…

কল্পনার কাছে এখনো কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *