৫. সব আগের দিন

সব আগের দিন

নাম তার কল্যাণকুমার সোম। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের জলহাওয়ার গুণে তাঁর ইংল্যাণ্ডস্থিত বাঙালি বন্ধুরাও তাঁকে সোম বলে ডাকে। তার বাল্যবন্ধু প্রভাত তার বছরখানেক আগে ইংল্যাণ্ডে এসেছে, সেই এক বছর বন্ধুর নাম ভুলিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট, তাই স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে এসে প্রভাত তাকে সম্বোধন করেছে, ‘এই যে, সোম।’ কাজেই সেও প্রভাতকে ডাকছে দাশগুপ্ত বলে।

দিন কয়েক আগে ইস্টারের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু লণ্ডন ছাড়তে সোমের মায়া করছে। লণ্ডনকে সে ভালোবেসেছে, সেটা একটা কারণ। রোজ সন্ধ্যায় সোহো অঞ্চলে না গেলে তার খেয়ে সুখ হয় না। সেখানে নানাদেশের রকমারি লোকের সঙ্গে তার দোস্তি হয়। ওয়েট্রেসের সঙ্গে সকলের মতো সেও ইয়ার্কি দেয়। মাঝে মাঝে ফ্লার্ট করবার মতো বান্ধবীও পায়। তবে সোম হুঁশিয়ার ছেলে। দশটার আগে বাসায় ফিরবেই, এবং বারোটা অবধি বই-খাতা নিয়ে বসবেই।

সকাল সকাল কলেজে যেতে হয় বলে ঘুমের ঘোরে যেটুকু ফাঁক পড়ে সেটুকু শনিবারে রবিবারে বুজিয়ে দেয়। রাত বারোটার থেকে বেলা বারোটা অবধি ঘুম। শনি ও রবি এই দু-টি বারের নাম ‘কুম্ভকর্ণ day’।

সম্প্রতি ইস্টারের ছুটি হয়ে এমন হয়েছে যে প্রত্যেক দিনই ‘কুম্ভকর্ণ দিন’। তাতে সোমের তো আনন্দ, কিন্তু তার ল্যাণ্ডলেডির আপত্তি। ল্যাণ্ডলেডি যেদিন থেকে তার আন্টি হয়েছে সেদিন থেকে মায়ের চেয়ে দরদি হয়েছে। সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট না খেলে যে শরীর টিঁকবে না অর্থাৎ ল্যাণ্ডলেডির পক্ষে ব্রেকফাস্টের বাবদ কিছু অর্থপ্রাপ্তি শক্ত হবে সেই জন্যে আন্টি সোমের শোবার ঘরের বাইরের করিডর দিয়ে খট খট করে দু-শো বার চলাফেরা করে তবু ভাগ্নের ঘুম ভাঙে না বারোটার আগে।

সোম রোজই ভাবে ঘুম থেকে উঠে সোজা কোনো রেস্তোরাঁতে গিয়ে লাঞ্চ খাবে, কিন্তু রোজই আন্টির আবদার—‘সোম, তোমার ব্রেকফাস্ট কখন থেকে টেবিলের উপর পড়ে। তোমার আজকাল হল কী! বুধ বৃহস্পতিবারকে তুমি শনিবার করে তুললে। তোমার জন্যে তিনবার চায়ের জল গরম করেছি, পরিজ-এর দুধ গরম করেছি, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেবেছি এইবার তুমি উঠবে।’

সোম বলল, ‘ধন্যবাদ, আন্টি! কিন্তু কেন এত কষ্ট করলে!’

‘করব না? তুমি সকাল বেলাটা উপোস দেবে, তাতে তোমার শরীর টিঁকবে? দুষ্টু ছেলে। থাকত যদি তোমার মা এখানে তোমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলত।’

তারপর বুড়ির আদর শুধু ব্রেকফাস্ট খাইয়ে তৃপ্তি মানে না। বুড়ি বলে, ‘অবেলার ব্রেকফাস্ট। রোসো, কিছু রোস্ট কিংবা স্টু দিয়ে যাই। পেটভরে খাও। আর বাজারের লাঞ্চ খেয়ে কাজ নেই।’

অতএব সোমের আর বাইরে গিয়ে লাঞ্চ খাওয়া, আলাপ করা, ফ্লার্ট করা হয়ে ওঠে না। সে কোনোদিন সিনেমায় কোনোদিন আর্ট গ্যালারিতে অপরাহ্ণটা কাটিয়ে দেয়। কোনোদিন বাস-এর মাথায় চড়ে শহর দেখে বেড়ায়।

লণ্ডন ছাড়তে তার মায়া করে।

কিন্তু যেদিন গুডফ্রাইডে এল সেদিনকার ওয়েদারটি হল নিখুঁত। যেন ভারতবর্ষের বসন্ত দিন। সোমের শোবার ঘর রৌদ্রে ঝলমল করল। সোম চোখ বুজে থাকতে পারল না। বাঁ-হাতের রিস্টওয়াচটাতে দেখল তিনটে বেজে দশ মিনিট। কানের কাছে নিয়ে বুঝল, বন্ধ। বেলা যে কটা হতে পারে আন্দাজ করা কঠিন। যেমন রৌদ্র উঠেছে, মনে হয় বারোটা বেজে একটা বেজে গেছে। সোম ঘড়িটাকে বার দুই নাড়া দিল। হাই তুলতে তুলতে বিছানার উপর উঠে বসল।

তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নীচে নেমে এসে দেখল আন্টি কুকুরসেবা করছে। ওটা তার প্রাতঃকালের প্রথম কর্ম। সোমকে দেখে বলল, ‘এ কী অনাসৃষ্টি ব্যাপার! সাড়ে ছ-টার সময় পোশাক পরে কোথায় চললে?’

সোম বলল, ‘মোটে সাড়ে ছটা! তোমার ঘড়ি ঠিক চলছে তো আন্টি?’

আন্টির ঘড়ি অবশ্য সর্বদা আধ ঘণ্টা পেছিয়ে চলে। ওটা আন্টির পলিসি। ঠিক সময়ে খাবার দিতে পারে না, ঘড়ি দেখিয়ে বলে, ‘আমার অপরাধ কী! ঘড়িতে এখনও ঠিক সময় হয়নি।’ তখন সোম বলে, ‘তা হলে কাল থেকে আমাকে আধ ঘণ্টা আগে খাবার দিয়ো।’ তার ফলে বুড়ি ঘড়িটাকে এক ঘণ্টা পেছিয়ে রাখে। সোম বলে, ‘আন্টি, রক্ষা করো। যদি বলি কাল থেকে আরও আধ ঘণ্টা আগে খাব তা হলে তুমি ঘড়িটাকে আরও আধ ঘণ্টা পেছিয়ে দেবে। শেষে একদিন আটটার সময় উঠে দেখব তোমার ঘড়িতে দুটো বেজেছে, আড়াইটে না বাজলে তুমি খাবার দেবে না।’ অগত্যা সোম আধঘণ্টা আগে উঠতে ও উঠে বুড়িকে তাড়া দিতে অভ্যাস করল।

এ গেল ঘড়ির ইতিহাস।

বুড়ি বলল, ‘সাড়ে ছটার সময় কাজের দিনেও তোমার ঘুম ভাঙে না, এই ছুটির দিনে তুমি চললে কোথায়?’

সোম চট করে বানিয়ে বলল, ‘তোমাকে বলিনি বুঝি, আন্টি? অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে তোমার লোকসান হবে না। আমি যে পনেরো দিন বাইরে থাকব সে ক-দিনের বাসা ভাড়া ঠিক এমনি দিতে থাকব।’

বুড়ি উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘যাচ্ছ বাইরে পনেরো দিনের মতো। না খেতে পেয়ে রোগা হয়ে ফিরবে সাবধান করে দিচ্ছি, সোম।’

সোম বলল, ‘ব্রেকফাস্টের দামও যেমন দিচ্ছিলুম তেমনি দেব, আন্টি।’—বুঝতে পেরেছিল কী নিগূঢ় কারণে বুড়ি উত্তেজিত।

মোটে সাতটা বেজেছে। কুকুর-সেবা শেষ হলে বুড়ি ব্রেকফাস্টের উদ্যোগ করবে। সোম ততক্ষণ কুকুরের সঙ্গে বল নিয়ে লোফালুফি খেলতে থাকল।

কোথায় যাবে সে-কথা সোম বুড়িকে বলেনি। কারণ, সে নিজেই জানে না। একটা হাতব্যাগে গোটা কয়েক জিনিস পুরে বেরিয়ে পড়ল। আগে পথ, তারপরে পথের চিন্তা। চলতে চলতে চলার লক্ষ্য স্থির করা যাবে।

অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে মার্বল আর্চ পর্যন্ত এল। তারপর হাইড পার্কে ঢুকল। তখন ইচ্ছা হল সার্পেনটাইনে কিছুকাল বোটিং করে। যেখানে বোট ভাড়া করতে হয় সেখানে ভিড় জমেছে। যারা আগে এসেছে তাদের দাবি আগে। সোম ভিড়ের পিছনে ভিড়ে গেল। মিনিট কয়েকের মধ্যে দেখা গেল পাশের লোকের সঙ্গে তার ভাব হয়ে গেছে।

তারা দু-জনে মিলে একটি বোট ভাড়া করল। সার্পেনটাইনে নৌকা চালিয়ে সুখ নেই যদি না নৌকাতে কোনো বান্ধবী থাকে। তবু সুখ না হোক, অর্ধ সুখ, যদি নব পরিচিত বান্ধব থাকে ও সামনে দাঁড় টানে। ঘণ্টা দুই দাঁড় টেনে যখন রীতিমতো শ্রান্ত হল তখন পথিকবন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে সোম আবার পথ ধরল।

হাঁটতে হাঁটতে কখন একসময় ভিক্টোরিয়ায় এসে পড়ল। স্টেশন দেখলেই মনটা বিবাগী হয়ে যায়। বিশেষত ভিক্টোরিয়া স্টেশন, সেখান থেকে ফ্রান্স জার্মানি ইটালি অভিমুখে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ট্রেন ছাড়ছে।

সোমের পকেটে যে টাকা ছিল তাতে প্যারিসে গিয়ে দশ দিন থাকা যায়, সুইটজারল্যাণ্ডে গিয়ে ছ-দিন, ভিয়েনাতে তিন দিন। কিন্তু বুড়িকে বলেছে পনেরো দিনের জন্যে যাচ্ছে। ইংল্যাণ্ডের কোনো পল্লিতে দিন পনেরো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবার নির্ঝঞ্ঝাট আরাম তাকে প্রলুব্ধ করছিল। লণ্ডন থেকে দূরে নয়, অথচ বেশ নিরিবিলি। এমন কোনো জায়গা পাওয়া যায় কি না তল্লাশ করবার জন্যে সাদার্ন রেলওয়ে কোম্পানির গাইড বই চেয়ে নিয়ে স্টেশন রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ খেতে বসল।

গিল্ডফোর্ড নামটি ভালো, ঐতিহাসিক স্মৃতিতে মুখর। ওই স্থানটিকে রাত্রিকালের কেন্দ্র করে প্রতিদিন নতুন পথে নিষ্ক্রমণ করা যাবে। কোনোদিন Waverly Abbey, কোনোদিন Holt Forest, কোনোদিন Leith Hill.

মানচিত্র খুলে দেখল গিল্ডফোর্ড থেকে দিকে দিকে রাস্তা বেরিয়ে গেছে।

সোম মনস্থির করে ফেলল। গিল্ডফোর্ডের টিকিট কিনল। যে প্ল্যাটফর্ম থেকে গাড়ি ছাড়ে ও যে সময়ে ছাড়ে সেসব কথা স্টেশনে উত্তোলিত ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ছিল, কিন্তু এতগুলো নাম পাশাপাশি ছিল যে সোম ভুল পড়ল। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবার সময় টিকিট দেখে রেলের কর্মচারী বলল, ‘গিল্ডফোর্ড? এ গাড়ি তো সোজা গিল্ডফোর্ড যাবে না। এক কাজ করতে পারেন। Woking-এ নেমে অন্য ট্রেন ধরতে পারেন।’

সোম বলল, ‘ধন্যবাদ।’

তখন ট্রেন ছেড়ে দেবার মুখে। লোকটি বলল, ‘দৌড়োন। আধ মিনিট বাকি।’ সোম দৌড়োল। কিন্তু যে কামরায় ঢুকতে যায় সে কামরায় গুডফ্রাইডের জনতা। ট্রেন ফেল করতে তার অনিচ্ছা ছিল না, আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার ট্রেন আছে। কিন্তু একবার প্ল্যাটফর্মে ঢুকে বিফল হয়ে বেরিয়ে যাওয়া বড়ো লজ্জার কথা! সোম হাঁপাতে হাঁপাতে ইঞ্জিনের কাছের কামরাগুলোকে লক্ষ করে ছুটল। তখন গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।

সোম হাঁ করে দাঁড়িয়ে সেই বৃহৎ সরীসৃপটির গতিলীলা নিরীক্ষণ করছে এমন সময় একটি দরজা খুলে দিয়ে একটি তরুণী হাতছানি দিল। সোম কালক্ষেপ না করে হাতব্যাগটা ট্রেনের ভিতর ছুঁড়ে ফেলল এবং দুই হাতে দুই পাশের লোহার শিক ধরে করিডরের উপর লাফ দিয়ে পড়ল। সেই বগিটিতে একটি কামরায় একটি জায়গা খালি ছিল। তরুণীটির পশ্চাদনুসরণ করে সোম সেই জায়গার সন্ধান ও অধিকার পেল। তখনও তার হৃৎকম্পন রহিত হয়নি। একটু বেকায়দায় পড়লে কাটা পড়ত। যাক একটা ফাঁড়া গেছে।

মেয়েটি সোমের সম্মুখের সারিতে বসেছিল। একটি ব্রাউন রঙের হ্যাট তার মাথায়, একটা ব্রাউন রঙের ওভারকোট তার গায়। নীল নয়ন, উন্নত নাসা, নিটোল গাল, রক্তিম অধর। ত্বক এত পাতলা যে তুলনা দিতে হয় আঙুরের সঙ্গে। সে আঙুর সাদা হওয়া চাই—রক্তাভ শুভ্র।

ইংরেজরা যাকে blonde বলে মেয়েটি তাই। আমরা যাকে ফর্সা কিংবা সুন্দর বলি তা নয়। তার কারণ আমরা ফর্সাই হই আর শ্যামলাই হই আমাদের গায়ের রং আমাদের চামড়ার নীচের রং নয়, চামড়ার উপরের রং। অর্থাৎ সূর্যদেব আমাদের চামড়ার উপর রং মাখিয়েছেন, সে রং দুধে-আলতাই হোক আর হাঁড়ির কালিই হোক। অপরপক্ষে ইংরেজের গায়ের রং তার চামড়ার নীচের রং। তার চামড়া হচ্ছে জলের মতো আলোর মতো বর্ণহীন। তাই চামড়া ফুটে রক্ত মাংসেরই রং বাইরে থেকে দেখা যায়।

মেয়েটি তার বয়সের মেয়েদের তুলনায় গম্ভীর। নতুবা হাসত কিংবা হাসির ভান করত কিংবা হাসির ছল খুঁজত। হাতে মুখ রেখে চুপ করে কী যেন ভাবছে, মাঝে মাঝে একবার সোমকে চুরি করে দেখছে। চোখাচোখি হয়ে গেলে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সোমের হাসি পাচ্ছে, সোম সে হাসি চাপছে। সোমের গাম্ভীর্য মেয়েটির গাম্ভীর্যকে খোঁচা দিচ্ছে।

কামরাটিতে আরও অনেক স্ত্রী-পুরুষ ছিল, কিন্তু কেউ কারুর সঙ্গে আলাপ শুরু করতে সাহস পাচ্ছিল না। বোবার মেলা। সোম জানত একবার যদি একজন একটি কথা বলে সকলের মৌন ভঙ্গ হয়। কিন্তু সেই প্রথম কথাটি কে কাকে সাহস করে বলবে?

একজন আমতা আমতা করে বললে, ‘আমার মনে হয় আজ বৃষ্টি হবে না।’

আরেকজন তার উত্তরে বললেন, ‘আমার তো মনে হয় না। আপনার?’ (তৃতীয় একজনের প্রতি)।

তৃতীয় জন বললেন, ‘বলা ভারি কঠিন। কখন কোথা থেকে একখানা মেঘ উড়ে আসবে—’

একজন বৃদ্ধা কথাটিকে সমাপ্ত করবার ভার নিলেন। বললেন, ‘আর এমন সুন্দর দিনটা মাটি করে দেবে।’

কামরার সবাই একে একে কথাবার্তায় যোগ দিল; দিল না কেবল সেই মেয়েটি ও সোম। তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে কখন একসময় চাপা হাসি হাসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল কামরার অন্য সকলের ভাব দেখে। কামরার সকলেই তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি এ যুগের বয়ঃকনিষ্ঠদের প্রচ্ছন্ন উপহাস ও অনুকম্পা যেকোনো দু-জন অপরিচিত বয়ঃকনিষ্ঠকে নিকট করে তোলে। যেন ওই কামরাটিতে দু-টি দল—বয়োজ্যেষ্ঠদের ও বয়ঃকনিষ্ঠদের।

মজা হল যখন জ্যেষ্ঠদের একজন সোমকে বললেন, ‘আরেকটু হলেই আপনি ট্রেনটা মিস করছিলেন, না?’

সোম বলল, ‘শুধু ট্রেনটা নয়, প্রাণটাও’। (সোম সেই মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসল।)

যাঁরা সোমকে লাফ দিতে দেখেছিল তারা শিউরে উঠল। যারা দেখেনি তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

সোম বলল, ‘আমি ভাবছি ভগবানকে ধন্যবাদ দেব, না ব্যক্তিবিশেষকে ধন্যবাদ দেব।’ (মেয়েটির বুকের রক্ত মুখে সঞ্চারিত হওয়ায় তাকে রক্ত গোলাপের মতো দেখাল।)

তখন সকলের দৃষ্টি পড়ল মেয়েটির উপরে। এতক্ষণ তার অস্তিত্ব সকলে অবচেতনার মধ্যে অনুভব করছিল, একটি ছোটো কামরায় আটজন থাকলে যেমন হয়ে থাকে। আমরা ক-জনা একসঙ্গে আছি, মনকে এ সত্য হয় তো রাঙায় না, কেননা অনেকের মন সুদূরস্থিত প্রিয়জনের সঙ্গ পেতে থাকে। কিন্তু দেহের নৈকট্য দেহের ফোটোপ্লেটের উপর ছাপ রাখবেই। যদিও সে ছাপকে অনেকে ডেভেলপ করে না, সে সম্বন্ধে সচেতন হয় না।

একসঙ্গে সকলের দৃষ্টি তার উপরে পড়ায় মেয়েটি অপ্রতিভ হয়ে সোমের উদ্দেশে বলল, ‘ব্যক্তিবিশেষটি যদি আমি হয়ে থাকি তবে ধন্যবাদটা আমাকে দিয়ে কাজ নেই। বরঞ্চ নিজেকে দিন শিম্পাঞ্জির মতো লাফ দিতে পারেন বলে।’

মেয়েটির প্রথম সম্ভাষণ এই। প্রথম সম্ভাষণেই তাকে শিম্পাঞ্জির সঙ্গে তুলনা করায় সোমের ভারি রাগ হচ্ছিল। কিন্তু Woking-এর দেরি নেই, এখুনি নেমে যেতে হবে। সোম মনে মনে অনেকগুলি জবাব তৈরি করতে লাগল। কিন্তু কোনোটাই যথেষ্ট কড়া অথচ রসালো হয় না। তাই সোম রাগটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না।

সোম এক অদ্ভুত সংকল্প করে বসল। Woking-এ নামবে না। মেয়েটি যে স্টেশনে নামবে সেই স্টেশনে নামবে। এ জন্যে যদি ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণ পশ্চিমের শেষ সীমায় যেতে হয় তবু সোম যাবে। মেয়েটিকে সে সহজে ছাড়বে না। মনকে জিজ্ঞাসা করল, কী শাস্তি দিলে শোধবোধ হয়? মন বলল, শাস্তির সেরা শাস্তি চুম্বন। কিন্তু বহু ধৈর্যে বহু ভাগ্যে সম্ভব হয়। সোম বলল, পনেরো দিনেও সম্ভব হয় না? মন বলল, হয়। যদি তোমার মান অপমান অভিমান বোধটা কম হয়। যদি বুলডগের মতো গোঁ থাকে তোমার।

Woking-এ সোম নামল না। জন দুয়েক নেমে গেল ও জন দুয়েক তাদের জায়গা দখল করল।

তারপরেই সোম পড়ল মুশকিলে। টিকিটচেকার এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাঁকল, ‘টিকিট! টিকিট।’

মেয়েটি কোন স্টেশনে নামবে সোম যদি তা জানত তবে নির্ভাবনায় বলত, ‘মত বদলেছি। গিল্ডফোর্ড যাব না। অমুক স্টেশনের ভাড়া নিয়ে রসিদ দাও।’ ইংল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে জরিমানা দিতে হয় না, ১০ মাইলের টিকিট কিনে ১০০ মাইল গেলে ৯০ মাইলের অতিরিক্ত দাম দিলেই গোলমাল চুকে গেল।

সোম ভাবল, জিজ্ঞাসা করি ওঁকে কোন স্টেশনে উনি নামবেন। কিন্তু চরম অভদ্রতা হবে।

টিকিটচেকারকে বলল, ‘শোনো। আমি গিল্ডফোর্ড যাব না ঠিক করলুম, কিন্তু কোথায় যে যাব ঠিক করিনি। দরকার হলে Penzance-ও যেতে পারি, আবার কাছেই কোথাও নেমে পড়তেও পারি। তুমি এক কাজ করো, তুমি আবার যেখানে চেক করতে আসবে সেইখানকার ভাড়া নিয়ে রসিদ দাও।’

চেকার বলল, ‘সে অনেক দূর। Axminster.’

সোম বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই।’

চেকার বলল, ‘আচ্ছা, আপনার জন্যে আমি মাঝখানে দু-একবার আসব। আপাতত ভাড়া দিতে হবে Whitchurch পর্যন্ত।’

সোম বলল, ‘তথাস্তু।’

বিদেশি মানুষের কাছে অদ্ভুত কিছু সকলেই প্রত্যাশা করে। সোমের কান্ড দেখে সকলেই একবার গম্ভীরভাবে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কাশল। সেই মেয়েটিও।

সোম খুশি হল এই ভেবে যে মেয়েটি তার গোপন সংকল্প টের পায়নি। পরে যখন এক স্টেশনে দু-জনে নামবে তখন মেয়েটিকে সোম চমকে দিয়ে অনুরোধ করবে, ‘আমাকে একটা হোটেলের সন্ধান দিতে পারেন?’ তারপরে বলবে, ‘কাল যদি আমার হোটেলে একবার পায়ের ধুলো দেন?’

এইসব কাল্পনিক কথোপকথন বানাতে বানাতে সোমের সময় বেশ কেটে যাচ্ছিল, তার মুখে হাসি ফুটে উঠছিলও। সোম মাঝে মাঝে মেয়েটির চোখে চোখ রেখে তার মনের কথা ধরবার চেষ্টা করছিল। এখন আর মেয়েটি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল না, বরঞ্চ সকৌতুকে সোমকে অধ্যয়ন করছিল, যেন সোম চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জি।

সোমের যতই রাগ হচ্ছিল ততই জেদ বাড়ছিল। এতগুলো লোকের সাক্ষাতে অপরিচিত মেয়েকে ফস করে জিজ্ঞাসাও করতে পারে না যে কেন আমাকে গাড়িতে উঠতে ইঙ্গিত করলেন? শিম্পাঞ্জির সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমোদ পাবেন বলে।

Whitchurch এল। সেই সঙ্গে এল সোমের পূর্বপরিচিত টিকিটচেকার। বলল, ‘কী ঠিক করলেন, স্যার?’

সোম লক্ষ করল মেয়েটি নামবার উদ্যোগ করছে না। তার সুটকেস নামানো হয়নি, ওভারকোটের বোতাম আঁটা হয়নি। সোম বলল, ‘কিছুই ঠিক করিনি, চেকার। তুমি যা বলবে তাই হবে।’

চেকার আপ্যায়িত হয়ে তাকে সলসবেরির রসিদ দিল। তখন সোম লক্ষ করল মেয়েটির মনের চমক মুখে ব্যক্ত হল। তবে কি মেয়েটি সলসবেরি যাচ্ছে? সোম ভাবল, যেখানেই যাক আমাকে এড়াবার জো নেই। শিম্পাঞ্জিকে শেষপর্যন্ত সাথিরূপে পাবে।

এখনও মেয়েটি সোমের সংকল্প অনুমান করতে পারেনি ভেবে সোমের হাসি চেপে রাখা শক্ত হচ্ছিল। সে আরেকবার মনে মনে রিহার্সাল দিতে লাগল মেয়েটির পিছন পিছন নেমে গিয়ে কী ভাষায় ও কেমন ভদ্রতার সঙ্গে সে তার অনুরোধটি জানাবে। মৃদু হেসে বলবে, Excuse me, এখানকার কোনো হোটেলের সঙ্গে কি আপনার জানাশোনা আছে?…আছে?…ধন্যবাদ। কী নাম বললেন? অমুক হোটেল?…কিছু না মনে করেন যদি তো একটি অনুরোধ পেশ করবার অনুমতি প্রার্থনা করব।…অনুমতি মঞ্জুর করেছেন? ধন্যবাদ। কাল যদি আপনার সময় ও সুবিধে থাকে আমার সঙ্গে চা খেয়ে আমাকে অনুগৃহীত করবেন কি?…না? বড়ো দুঃখিত হলুম! অন্য কোনোদিন? অন্য কোনো সময়?…অত্যন্ত সুখী হলুম।

এমনি ভাবতে ভাবতে সলসবেরি এল। তার আগেই মেয়েটি সুটকেস নামিয়েছিল। একবার কোটটা ঝেড়ে নিয়ে চুলটা ঠিক করে নিয়ে মুখের উপর দু-বার রুমাল বুলিয়ে মেয়েটি করিডরে গিয়ে দাঁড়াল এক জানালা দিয়ে দূর থেকে সলসবেরির ক্যাথিড্রাল অন্বেষণ করল।

সোম নামছে। টিকিটচেকারের সঙ্গে মুখোমুখি। ‘কী স্যার, এইখানে নামছেন?’

‘এইখানেই নামছি।’

‘অত তাড়াতাড়ি কীসের? একটু গল্প করা যাক। সলসবেরি এই প্রথম দেখবেন?’

‘এই প্রথম দেখব। (সোমের ভারি অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। মেয়েটি অনেক দূর চলে গেছে। এদিকে এ লোকটাও ছাড়ে না।) ভালো কথা, চেকার। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই শিলিংটি তার নিদর্শন।’

সোম জানত লোকটা হঠাৎ গল্প করবার জন্যে এতটা উদগ্রীব হল কেন। শিলিংটা পেয়ে তার গল্প করবার সাধ মিটল। সে সেলাম করে সরে গেল।

সোম মেয়েটির গতিবিধির খেই হারিয়ে ফেলেছিল। চেকারকে অভিশাপ দিতে দিতে দৌড়োল। আরেক গেরো স্টেশনের গেট-এ। সেখানে ওরা সোমের রসিদ দুটোকে ও টিকিটটাকে বারংবার উলটেপালটে দেখে। গিল্ডফোর্ডের যাত্রী সলসবেরি এসেছে, ব্যাপারটা যেমন অদ্ভুত তেমনি সন্দেহাত্মক।

কোনোমতে ছাড়া পেল। কিন্তু কোথায় সেই মেয়েটি? সোম দু-হাতে ট্যাক্সিওয়ালাদের ঠেলে সরিয়ে নিরাশ হয়ে মেয়েটির সন্ধানে চারিদিকে চাউনির চর পাঠাল।

অকস্মাৎ দেখল মেয়েটি একটা ট্যাক্সিতে বসে তারই দিকে চেয়ে আছে। সোম তিরের মতো ছুটে গেল মেয়েটির কাছে। সোমের রিহার্সাল দেওয়া ভূমিকার সমস্ত গোলমাল হয়ে গেছল। সে বলল, ‘আমাকে কোনো একটা হোটেলে পৌঁছে দিতে পারেন?’

মেয়েটি বলল, ‘আসুন। আমিও একটা হোটেলে যাচ্ছি।’

সোম ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেল। মেয়েটির পাশে জায়গা করে নিল। বলে ফেলল, ‘ইস! আপনাকে কত খুঁজেছি।’

মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আমাকে।’

‘হ্যাঁ, আপনাকেই। আপনার জন্যেই তো সলসবেরি আসা।’

‘সত্যি?’

‘আশ্চর্যের কী আছে; ছুটি কাটাতে বেরিয়েছি। আমার পক্ষে গিল্ডফোর্ড যা, সলসবেরিও তাই। অধিকন্তু সলসবেরিতে একজন চেনা মানুষ পাব, যে মানুষ ট্রেনে উঠতে সাহায্য করেছেন, যাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

মেয়েটি নীরব রইল। সোম এক নিঃশ্বাসে কত কথা বলে চলল। সমস্ত পথ সে যত কিছু ভেবেছে ও মনে মনে বলেছে, সেইসব। কিন্তু ট্যাক্সিটা বেরসিকের মতো দশ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেল।

হোটেলের অফিসে গিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আমার বন্ধু ক্যাথরিন ব্রাউন আসতে পারেননি। আমার এই বন্ধুটি তাঁর বদলে এসেছেন।’

মেয়ে-কেরানি বলল, ‘কী নাম?’

মেয়েটি সোমের মুখের দিকে তাকাল।

সোম বলল, ‘সোম।’

তখন মেয়ে-কেরানি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার নাম মিস পেগি স্কট। কেমন ঠিক তো?’

মেয়েটি বলল, ‘ঠিক’।

তখন সোমকে ও মিস স্কটকে নিজ নিজ ঘরের চাবি দিয়ে একটি চাকরের সঙ্গে উপরতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হল।

হোটেলটি প্রথম শ্রেণির। পরন্তু ঐতিহাসিক। সোম এমন হোটেলে স্থান পেয়ে খুশি হয়েছিল। এই হোটেলে অন্তত এক শতাব্দী ধরে কত লোক এসেছে গেছে, সম্ভবত তারই ঘরে বাস করেছে। কত পুরুষ, কত নারী।

সোম মুখ-হাত ধুয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। ঠিক Lady-killer না হোক সুপুরুষ বটে। বেশ একটু কালো। ভালোই তো। সাদা মানুষের দেশে সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এই যে মিস স্কট আজ তাকে ট্রেনে উঠবার ইঙ্গিত করলেন, কোনো সাদা মানুষকে তা করতেন কি?

দেশে থাকবার সময় গোঁফ কামাতো। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে এসে দেখল, সকলেই গোঁফ কামায়। তখন সোম অতি যত্নে গোঁফের চাষ করল, জার্মান কাইজারকে হার মানাবার মতো স্পর্দ্ধাব্যঞ্জক গোঁফ। ভাবছিল দাড়িও রাখবে, কিন্তু কাইজার-মার্কা গোঁফের সঙ্গে কেমন দাড়ি মানায় সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণা ছিল না, কেননা, স্বয়ং কাইজারের দাড়ি নেই। আর জার্মান দার্শনিক কাইজারলিং-এর দাড়িটা চটকদার বটে, কিন্তু কাইজারলিং-এর দাড়ি রামছাগলের দাড়ির মতো।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সোম তার গোঁফের প্রসাধন করল। তার ভয় হচ্ছিল চেহারাটা ক্রমশ টিপু সুলতানের মতো হয়ে উঠছে মনে করে। ইংল্যাণ্ডে বেশ আছে, কিন্তু দেশে তো একদিন ফিরতেই হবে, তখন আত্মীয় বন্ধুরা ছি ছি করবে। গোঁফটি যতই পুষ্ট হচ্ছে চুলগুলি ততই খাটো হচ্ছে। প্রায় জার্মানদের মতো। ইংল্যাণ্ডে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার সেটাও একটা সংকেত।

চায়ের জন্য সোম নীচের তলায় নেমে এল। দেখল মিস স্কট তখনও আসেননি। তিনি যে আসবেনই সে-কথা সোমকে বলেননি। বস্তুত তিনি হোটেলে উঠে অবধি সোমকে একটিও কথা বলেননি। ট্যাক্সিতে ও ট্রেনে যা বলেছিলেন তা এত স্বল্প যে সোমের মুখস্থ হয়ে গেছিল।

তবু সোম tea for two ফরমাস করল। এবং চাকরকে বলল, ‘যাও দেখি, আমার বন্ধুনিটিকে খবর দাও।’ তারপর ভাবল চাকরের কাছে ‘বন্ধুনি’ বলাটা কি সঙ্গত হয়েছে; ‘বন্ধুনি’ কথাটিতে কত যে রহস্য, কথাটি কত যে aesthetic, নিম্নশ্রেণির লোক তার কীই-বা বুঝবে? বরঞ্চ একটা moral প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে কতকটা বুঝত। ‘Friend’ না বলে বলা উচিত ছিল ‘fiancee’ অর্থাৎ ভাবী বধূ।

মিস স্কট চায়ের আয়োজন দেখে বললেন, ‘আমি তো চা দিতে বলিনি।’

সোম বলল, ‘আপনার হয়ে আমি বলেছি ধরে নিন।’

‘অন্যায়! বড়ো অন্যায়!’

‘সেজন্যে আমার উপর অবসর মতো রাগ করবেন, কিন্তু এখন দয়া করে mother হোন দেখি।’ (ইংরেজ পরিবারে মা সবাইকে খাবার বেঁটে দেন। সেই থেকে mother কথাটার এক্ষেত্রে অর্থ, যিনি চা তৈরি করে দেন।)

মিস স্কট সোমের পেয়ালা টেনে নিয়ে বললেন, ‘চিনি খান?’

‘খুব খাই। না, না, দুটোতে আমার কুলোবে না, চারটে দিন। ও কী! পাঁচটা—সাতটা! (মিস স্কটের হাত চেপে ধরে) মাফ করবেন। সত্যি এত চিনি আমি খাই নে।’

মিস স্কট হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোমের পেয়ালার ভিতর চামচ পুরে গোটা তিন চিনির ঢেলা তুললেন ও কেটলি থেকে পেয়ালায় চা ঢালতে লাগলেন।

সোম বলল, ‘থাক, থাক, ওই থাক। আধ পেয়ালা চা আধ পেয়ালা দুধ। হাসছেন? কিন্তু কখনো খেয়ে দেখেননি কী উপাদেয় পানীয়। অবশ্য লোকে এ জিনিসকে চা বলে না। সেইজন্যে আমি এর নাম দিয়েছি, ‘Tilk’। তার মানে Tea আর Milk; ব্যাকরণ মানি নে, হয়ে গেল ‘Tilk’ কেমনে তা জানি নে।’

মিস স্কট বললেন, ‘যেমন Joynson-Hicks থেকে Jix!’

দু-জনে হাসতে লাগল!

সোম বলল, ‘আপনি চিনি নিলেন না?’

মিস স্কট বললেন, ‘আমার চিনির দরকার করে না।’

‘সে-কথা সত্যি। যে নিজে মিষ্টি তার পক্ষে মিষ্টি বাহুল্য।’

মিস স্কট কোনো দিকে না চেয়ে আপন মনে মৃদু হাসলেন।

সোম তাঁর দিকে রুটি মাখন কেক ইত্যাদি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ্ঞা করুন।’

তিনি তেমনি মৃদু হেসে একখানি crumpet নিলেন ও ছুরি দিয়ে সেটিকে কাটলেন। বললেন, ‘ধন্যবাদ, মিস্টার সোম।’

সোম বলল, ‘আমার নাম কী করে জানলেন?’

মিস স্কট বললেন, ‘আপনার নিজ মুখে শুনে।’

‘আপনি বেশ মনে রাখতে পারেন।’

‘আপনি বেশ compliment দিতে পারেন।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। চা খাওয়া এগোতে লাগল। কিন্তু চুপ করে থাকা সোমের স্বভাবে নেই। সোম বলল, ‘Trumpet খানা কেমন লাগছে?’

মিস স্কট সবিস্ময়ে বললেন, ‘Trumpet!’

সোম বলল, ‘Crumpet-কে আমি Trumpet বলি।’

‘ওঃ!’

আবার নীরবতা। সোম বাক্যালাপের উপলক্ষ খুঁজল। বলল, ‘আরেকখানা Trumpet নিন।’

মিস স্কট বললেন, ‘ধন্যবাদ।’ তার মানে, ‘না।’

সোম একটু আহত বোধ করল। তখন তার মনে পড়ে গেল মান অপমান অভিমান বোধটা এরূপ ক্ষেত্রে কম থাকা ভালো। কেননা মেয়েরা পুরুষদের ইচ্ছে করে কষ্ট দিয়ে থাকে। বাজিয়ে নিতে ভালোবাসে।

সোম নকল হাসি হেসে বলল, ‘Trumpet ভালো লাগল না। তবে কিছু Kiss-Fake নিয়ে দেখুন।’

মিস স্কট আসল নামটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। কিন্তু সোম যখন জিনিসটা বাড়িয়ে দিল তখন জোরে হেসে বললেন, ‘ওঃ! বুঝেছি! Fish-Cake। হা হা হা।’

সোম বলল, ‘এই যে Fish-Cake-কে বললুম Kiss-Fake এ ধরনের উলটোপালটা কথাকে বলে Spoonerism। ডক্টর স্পুনারের গল্প শুনেছেন?’

মিস স্কট সকৌতূহলে বললেন, ‘কই? নাঃ।’

‘তবে শুনুন। ডক্টর স্পুনার তাঁর Well-oiled bicycle চড়ে কলেজে পড়াতে যেতেন। ছেলেরা একবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আপনি কীসে করে কলেজে আসেন?’ তিনি অন্যমনস্ক ছিলেন। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আমার একটি Well boiled icicle আছে’।’

মিস স্কটের উচ্চহাস্য।

সোম বলল, ‘তখন থেকে ছেলেরা মজার মজার কথা বানিয়ে তাঁর নামে চালাতে থাকল। ‘Three cheers for the dear old Queen’ বলতে গিয়ে তিনি নাকি বলেছিলেন, Three cheers for the Queen old Dean.’

মিস স্কটের উচ্চতর হাস্য। সোমের যোগদান।

যে ঘরে বসে তারা চা খাচ্ছিল সে-ঘরে অনেকে ছিল। হাসির শব্দ শুনে তারা কালো মানুষটির দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল। সোম জানত ওটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য। কৌতূহলকে চেপে রাখার নামান্তর। কিন্তু মিস স্কট সম্ভবত ভাবলেন যে কালো মানুষের সঙ্গে ইয়ার্কি দেওয়াটা সাদা মহাপ্রভুদের পছন্দ হচ্ছে না।

তিনি তাঁর মুখের হাসির সুইচ টিপে দিলেন। তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। পাছে সোম কিছু মনে করে এই বিবেচনায় বললেন, ‘আরেক পেয়ালা দিই?’

সোম বলল, ‘ধন্যবাদ।’ অর্থাৎ, ‘না।’ সোমও ‘না’ বলতে জানে।

এরপরে মিস স্কট উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘যাই। আমাকে একখানা চিঠি লিখতে হবে।’

সোম নাছোড়বান্দার মতো সঙ্গে সঙ্গে চলল। বলল, ‘আমাকেও।’

লাউঞ্জে চিঠি লেখার সরঞ্জাম ছিল। মিস স্কট ও সোম দু-জনেই কিছু খাম ও কাগজ নিয়ে কলম কামড়াতে লাগল। চিঠি লেখা শেষ করে উঠতে তারা ঘণ্টাখানেক সময় নিল। সোম লিখল তার বন্ধু প্রভাতকে। মিস স্কটের সঙ্গে তার পরিচয় ও সম্বন্ধকে বাড়িয়ে লিখল। যেন সে ইস্টারের ছুটিতে দিগবিজয়ে বেরিয়েছে। প্রথম দিনেই একটি রাজ্যজয়।

মিস স্কট লিখলেন তাঁর বন্ধুনি ক্যাথরিনকে। কী লিখলেন বোঝা গেল না। কিন্তু লিখতে লিখতে হাসছিলেন। তাই দেখে সোমের মনে হচ্ছিল সোমের মুখ থেকে শোনা হাসির কথাগুলি টুকছিলেন। কিংবা হয়তো লিখছিলেন একটি শিম্পাঞ্জি আমার সঙ্গ নিয়েছে।

মিস স্কট বললেন, ‘এবার চিঠি দু-খানা ডাকে দিয়ে আসা দরকার। দিন, আমি দিয়ে আসি।’

সোম বলল, ‘ধন্যবাদ! চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে চিঠির বাক্সটা চিনে রেখে আসি।’

চিঠি দু-খানা হোটেলের চাকরকে দিলেই চলত। কিন্তু তারা একটু বেড়িয়ে আসতে উৎসুক হয়েছিল। নতুন শহরে এসে পায়ে হেঁটে বেড়াতে ভারি ইচ্ছে করে। মিস স্কট উপরে গেলেন তাঁর হ্যাট ও কোট পরে আসতে। সোম ততক্ষণ নীচের তলায় পায়চারি করতে থাকল।

চিঠির বাক্স কাছেই ছিল, তবু তারা ডাকঘরের বাক্সে চিঠি দেবে স্থির করে এগিয়ে চলল। শহরটিতে একটি ছোটো খালের মতো নদী—ইংল্যাণ্ডের বহুতর নদীর মতো এরও নাম Avon। শহরটি ছোটো, রাস্তাগুলির কাটাকুটি শহরটিকে দাবা খেলার ছকের মতো করেছে।

সোম খুশি হয়ে বলল, ‘লণ্ডনে থেকে আমার হাঁফ ধরে গেছে, মিস স্কট—যদিও লণ্ডন আমার কাছে স্বদেশের মতো প্রিয়। সলসবেরিতে যদি আমার বাড়ি থাকত, আমি রোজ ডেলি-প্যাসেঞ্জার হয়ে লণ্ডন যাতায়াত করতুম।’

মিস স্কট বললেন, ‘আমি হলে পারতুম না। বড্ড সকালে উঠতে হত।’

‘বেশি রাত করে ঘুমোতে যান বুঝি?’

‘না, এগারোটায়।’

‘তা হলে আরেকটু সকাল সকাল ঘুমোতেন।’

‘সলসবেরিতে থাকলে? হা হা। বাড়ি পৌঁছোতেই ন-টা বাজত। কাজ আর কাজ করতে যাওয়া, আর কাজ করে ফেরা। নিজের বলে একটু সময় থাকত না।’

‘খুব খাটুনি বুঝি?’

‘খুব। কিন্তু খাটতে আমার ভালোই লাগে। আবার মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে পালাতেও সাধ যায়। কিন্তু রোজ ট্রেনে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ঘেন্না ধরে যাবে বুঝি!’

‘আজকেও ঘেন্না ধরে গেছে বুঝি!’

‘বিলক্ষণ। ক্যাথরিনটা এমন করে দাগা দেবে কে জানত, বলুন। একসঙ্গে আসার সমস্ত ঠিকঠাক। আমি এলুম সলসবেরি, ও গেল ব্ল্যাকপুল।’

‘বড়ো ভাবনার কথা বটে!’

‘ঠাট্টা করছেন।’

‘কে, আমি? না। আমি ভাবছিলুম আপনি কেন ব্ল্যাকপুল গেলেন না। সেও তো একসঙ্গে যাওয়া হত।’

‘বা রে, আমি কী করতে ওদের সঙ্গে যাব?’

‘বুঝেছি। ক্যাথরিন নেহাত নিঃসঙ্গ ছিল না। মাঝখান থেকে আপনিই নিঃসঙ্গ হলেন। কেমন?’

মিস স্কট এর উত্তরে নতমুখী হলেন। বললেন, ‘আজ তো নিঃসঙ্গ নই। কাল কী হবে বলা যায় না।’

সোম কোমল কন্ঠে বলল, ‘বলা যায়। কালও নিঃসঙ্গ হবেন না।’

মিস স্কট নীরব। সোম বলল, ‘ভালো কথা, আপনার উপর আমি রাগ করেছি।’

(চমকে উঠে) ‘কেন?’

‘অনুমান করুন।’

‘করতে পারছি নে। সত্যি বলছি।’

‘আমাকে শিম্পাঞ্জি বলেছেন।’

‘শিম্পাঞ্জি বলেছি। কখন?’

‘মাত্র একটিবার আপনি কথা বলেছেন ট্রেনে। মনে পড়ে না?’

‘সত্যি আমার স্মরণশক্তি ভালো নয়। যদি ওকথা বলে থাকি তো ক্ষমা চাইছি।’

‘আপনি বড্ড ভালোমানুষ। আমি হলে ক্ষমা চাইতুম না, বলতুম, শিম্পাঞ্জির মতো লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠা মানুষের পক্ষে প্রশংসার কথা।’

‘বাস্তবিক। আপনার সাহসের সুখ্যাতি করতে হয়।’

‘আবার ভালোমানুষি করলেন! আমি হলে সুখ্যাতি করতুম না। বলতুম ওটা একটা বেআইনি কাজ। চোর-ডাকাতের যোগ্য।’

‘তাই তো। অন্যায় করে ফেলেছেন।’

‘অন্যায় কীসের? প্ল্যাটফর্মে ঢুকবার সময় আমাকে একমিনিট আটকে রেখেছিল কেন? তারপর আমাকে দৌড়োতে বলেছিল কেন? ট্রেনেরই উচিত ছিল আমার জন্য দাঁড়ানো।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’

‘কিন্তু তাতে অন্যান্য যাত্রীদের সময় নষ্ট হয়। তারা punctual হয়েও পস্তাবে, এটা কি ন্যায়সংগত?’

‘না, ন্যায়সংগত নয়।’

‘ন্যায়সংগত না হলেও ভদ্রতার খাতিরে মাঝে মাঝে এক আধটা ব্যতিক্রম মন্দ নয়। ধরুন আমি যদি একজন স্থূলকায়া মহিলা হয়ে থাকতুম।’

মিস স্কট ভীষণ হাসতে লাগলেন। সোম তাঁকে আরেকটু হাসাবার জন্য বলল, ‘কিংবা ধরুন সত্যিকারের শিম্পাঞ্জি।’

মিস স্কট ক্লান্ত হয়ে বললেন, ‘Oh, dear!’

ডিনারের পরেই কেউ শোবার ঘরে যায় না। অতএব ওরা বসবার ঘরে গিয়ে তাসখেলা দেখতে বসল। ওরাও খেলায় যোগ দিত, কিন্তু মিস স্কট ভালো খেলতে পারেন না বলে রাজি হলেন না এবং সোম এত ভালো খেলতে পারে যে খেলা জিতে অনেক টাকা পেত—সেটাও একজন বিদেশির পক্ষে ভালো দেখায় না।

কাজেই তারা নিঃশব্দে অন্যান্যদের ব্রিজ খেলার দর্শক হল। সোম একজনের হাত চেয়ে নিয়ে দেখলে ও তাঁর পরামর্শদাতা হল। মিস স্কট যে মেয়েটির dummy হয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে প্রবৃত্ত হলেন।

খেলার সময় সময়জ্ঞান থাকে না। সোমের নেশা লেগে গেছিল। সে মিস স্কটের উপস্থিতি বিস্মৃত হয়েছিল। প্রতিপক্ষের হাতে ক-টা ও কোন কোন রং আছে সেই কল্পনায় সে বিভোর। পরামর্শগ্রহীতার উৎসাহকেও তার উৎসাহ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তাঁর হার-জিত যেন তার নিজের হার-জিতেরও বেশি। তিনি হারলে সোমের মুখ দেখানো কঠিন হয়, সে যে পরামর্শ দিয়েছে। তিনি জিতলে সোম সবাইকে সিগারেট বাড়িয়ে দেয়। বলে, ‘নিতে আজ্ঞা হোক।’

অবশেষে একসময় খেলার ব্যবধানে মিস স্কট সকলকে একসঙ্গে বললেন, ‘গুড নাইট।’ সকলে সবিনয়ে বলল, ‘গুড নাইট।’ দুটো একটা ভদ্রতার কথাও বলা হল। যেমন, ‘কালকে তো আপনাকে আমরা এই হোটেলে পাচ্ছি।’

মিস স্কট বিশেষ করে সোমকে ‘গুড নাইট’ না বলে চলে গেলেন। এটা সোমের মর্মে বিঁধল। তার আর খেলায় মন বসল না; রাত্রে মিস স্কটের সঙ্গে এই শেষ দেখা, একথা ভাবতে তার মন কেমন করছিল। অথচ সাড়ে দশটা বেজে গেছে, দেখা হবার সুযোগও আর ঘটবে না!

কিছুক্ষণ যাব কি যাব না করে সোমও বিদায় নিল। তার পরামর্শগ্রহীতা তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং প্রতিপক্ষের ভদ্রলোক ও মহিলা বললেন, ‘কাল আপনাকে সম্মুখ সমরে নামতে হবে কিন্তু।’ আর সেই যে মহিলাটি dummy হয়েছিলেন তিনি বললেন, ‘শুধু আপনাকে নয়, আপনার বন্ধুনিকেও।’

আমার বন্ধুনি! সোম দুঃখের হাসি হাসল! উপরে গিয়ে কাপড় ছাড়ল, মুখ হাত ধুলো, চুলে বুরুশ লাগাল, পা মুছল। তারপর বিছানায় উঠে আলোটা নিভিয়ে দিল, অত্যন্ত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিল বলে তার বেশ ঘুম পেয়েছিল।

সোম চোখ বুজে ঘুমের প্রতীক্ষা করছে। হঠাৎ শুনল কে যেন টোকা মারছে—টুক টুক টুক। দরজায়, না দেওয়ালে? দেওয়ালে। কোন দেওয়ালে? সোম কান খাড়া করল। বিছানার পাশের দেওয়ালেই। টুক টুক টুক।

ওপাশের ঘরটা মিস স্কটের। মিস স্কট এখনও ঘুমোননি। দুষ্টু মেয়ে। আমাকে ফেলে পালিয়ে আসার কী দরকারটা ছিল! এতক্ষণ বুঝি আমার জন্যে জেগে থাকা গেছে?

সোম উত্তর দিল—ঠক ঠক ঠক। তার তো মেয়েমানুষের হাত নয়। তার আঙুলের আওয়াজ ঠক ঠক ঠক।

তার উত্তরে দেওয়ালের ওপরে শুধু যে টুক টুক টুক বেজে উঠল তাই নয়, দরজার ফাঁক দিয়ে হাসির শব্দ এল, খিল খিল খিল!

দুষ্টু মেয়ে। সারাদিন মুখে রা ছিল না। কী কপট গাম্ভীর্য! ট্রেনে সেই যে শিম্পাঞ্জি বলা তার পরে আর কথা নেই। হোটেলে ও পথে আমি যত কথা বলেছি উনি তার সিকিও বলেননি।

সোম কী উপায়ে আনন্দজ্ঞাপন করবে ভেবে পেল না। কতবার ঠক ঠক ঠক করতে থাকবে? জোরে হেসে উঠতে তার সাহস হচ্ছিল না। কেননা তার ঘরের একদিকে যেমন মিস স্কটের ঘর অপরদিকে তেমনি কোনো এক অপরিচিত জনের। মিস স্কটের ঘরটাই হোটেলের এই দিকের শেষ ঘর বলে মিস স্কটের ভয় ছিল না।

বিছানা ছেড়ে মিস স্কটের দরজায় টোকা মেরে তাঁকে ডাকবে? করিডরে কিছুক্ষণ পায়চারি করবে তাঁকে নিয়ে?

হায় রে দুর্ভাগ্য! সোম ড্রেসিং গাউন আনেনি। এই কাপড়ে বাইরে যাওয়া যায় না, বেড়ানো যায় না। মিস স্কট দেখলে নেহাত যদি মূর্ছা না যান একেলে মেয়ে বলে, তবু অন্য লোক দেখে ফেললে কী ভাববে, ভেবে ‘দুর’ ‘দুর’ করে তাড়িয়ে দেবেন।

বিছানার থেকে জানালা খুব কাছেই। এঘরের জানালা থেকে ওঘরের জানালাও খুব কাছে। সোম বিছানা ছেড়ে জানালার চৌকাঠের উপর বসল। বসে মিস স্কটের জানালার কাচের গায়ে টোকা মারল।

মিস স্কট ধড়ফড়িয়ে জানালার কাছে এলেন। সভয়ে বললেন, ‘কে?’

উত্তর হল, ‘শিম্পাঞ্জি।’

‘শিম্পাঞ্জি? লাফ দিয়ে আসবেন না তো?’

‘যদি আসি?’

‘না, না’ (মিনতির স্বরে)

‘ভয় নেই, আমি চেষ্টা করলেও পারব না।’

মিস স্কট নীরব।

সোম ডাকল, ‘মিস স্কট?’

উত্তর হল, ‘ইয়েস?’

‘পালিয়ে এলেন কেন?’

‘ঘুম পাচ্ছিল বলে।’

‘ঘুম আসেনি কেন?’

‘ভাবছিলুম বলে।’

‘কী ভাবছিলেন?’

‘একজনের কথা।’

‘ক্যাথরিনের কথা?’

‘না।’

‘আপনার boy-এর কথা?’

‘Boy আমার নেই।’

‘তবে কার কথা?’

‘শিম্পাঞ্জির।’

‘শিম্পাঞ্জির এত ভাগ্য!’

‘ভাবছিলুম আজকের দিনটা কী অদ্ভুত।’

‘আমিও তাই ভাবছিলুম।’

‘আপনি খেলা ছেড়ে উঠে এলেন কেন?’

‘আপনি উঠে এলেন কেন?’

‘ওই যে বললুম ঘুম পাচ্ছিল।’

‘আমারও। আমি আজ ভোরে উঠেছি কিনা।’

‘আপনার কোথায় যেন যাবার কথা ছিল?’

‘গিল্ডফোর্ড।’

‘গেলেন না কেন?’

‘আপনিই বলুন।’

‘সলসবেরিতে নামলেন কেন?’

‘আপনাকে ওকথা ট্যাক্সিতে বলেছি?’

‘আপনি ভারি খারাপ লোক।’

‘আমাকে আপনার ভয় করছে?’

‘কারুকে আমার ভয় করে না।’

‘ধরুন যদি আমি লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকি?’

‘চীৎকার করে পাড়া মাথায় করব।’

‘যদি মুখ চেপে ধরি?’

‘কামড়াব।’

‘তবে তো আপনি শিম্পাঞ্জিকেও ছাড়িয়ে যান।’

‘আমি সব পারি।’

‘লাফ দিয়ে এঘরে আসতে পারেন?’

‘পারি। কিন্তু তার দরকার নেই।’

‘তবে আর রাত জাগেন কেন? ঘুমোতে যান।’

‘তাই যাই।’

‘যাবার আগে একবার হাতটা বাড়িয়ে দিন, বিদায় ঝাঁকুনি দিন।’

মিস স্কট হাত বাড়িয়ে দিলেন। সোম খপ করে মুখের কাছে টেনে নিল। সোম চুম্বন করতেই মিস স্কট অগ্নিপৃষ্ঠের মতো ঝপ করে কেড়ে নিলেন।

সোমের সংকল্প অক্ষরে অক্ষরে পূরণ হল। সে মেয়েটির সঙ্গে শেষপর্যন্ত এল, মেয়েটিকে প্রকারান্তরে চুম্বনও করল। সে আজ উঠে কার মুখ দেখেছিল? তখন কি ভাবতে পেরেছিল দিনটি এমন সুখের হবে? সোম সাধারণত যা করে না তাই করল। সেই ভগবানকে স্মরণ করল যিনি সুখীর ভগবান, সার্থকের ভগবান। দুঃখের দিনে আমিই আমার বন্ধু, সুখের দিনে তিনি আমার অতিথি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *