৫. সন্ধ্যা ঘনায়মান

৩১.

সন্ধ্যা ঘনায়মান। গাছে গাছে পাখির জটলা। হাওয়া মাতাল গাছের ডালে পাখিগুলি স্থির হয়ে বসতে পারছে না। এ গাছ থেকে ও গাছে, এ ডাল থেকে ও ডালে ঝংকার তুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। দিন শেষের শেষ খেলা।

ফরাসডাঙার আকাশ রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে। তার ছায়া পড়েছে গঙ্গার জলে। রক্ত রেখায়িত ঠোঁটের মতো রক্তিম বাঁকা স্রোতের ঢল নেমে চলেছে সমুদ্রের দিকে।

বাতাসের শোঁশোঁ, তেসুতিকলের চাপা পড়া গোঁ-গোঁ ধ্বনি সেনপাড়া-জগদ্দলের আকাশ ভরে রয়েছে। সে শব্দ গ্রাম্য নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন দূর সমুদ্রের কল্লোলে বাজছে।

রাত্রি নামছে। শেয়ালের দল বেরিয়েছে গ্রামের পথে। তেসুতিকলের ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। ওয়াল্টারের সন্ধানী চোখ ফিরছে সতর্ক প্রহরায়। যন্ত্র ছেড়ে কেউ না পালায়।

সেনবাড়ি। নিঝুম প্রাসাদপুরী। আলসেয় খিলানে ফাল্গুন হাওয়া শাঁ শাঁ করছে। বাতি দেখা যায় না কোথাও। শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের কোলে শিকারি ভোঁদড় ঘুরছে। গেঁড়ি শামুক খাচ্ছে খোল ছাড়িয়ে। সিং দরজার ভাঙা পাল্লা আধো উন্মুক্ত। অবাধে ঢুকেছে শেয়ালের পাল। বাগানের জঙ্গল দিয়ে গেছে। রান্নাবাড়ির দিকে। রিক্ত শ্রীহীন বাগানে ঘন জঙ্গল। কয়েকটা বাতাবি কাগজি লেবু গাছে ফুল ধরেছে। তার হালকা গন্ধ হাওয়ায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাড়ির শূন্য প্রকোষ্ঠে। শিকল ঝনঝনার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে কয়েদখানার একতলা ঘরে। দেয়ালে গাঁথা শিকল। খ্যাপা বন্দিকে ওই শিকলে বেঁধে মারা হত। খোলা দরজা দিয়ে হাওয়া ঢুকে শিকল নড়িয়ে দিচ্ছে। থেকে থেকে পায়রা ডেকে উঠছে বক বকম।

দক্ষিণের অলিন্দে রেলিং-এর উপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সেনকর্তা। যুবক কর্তা। সামান্য ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে আছেন গঙ্গার ওপারের দিকে। কীসের চিন্তায় মগ্ন। চোখ মেলে আছেন। কিন্তু দেখছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

মাস দুই আগে ঠাকমা নাতিতে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল। সেই সাহেব অভ্যর্থনার ব্যাপার নিয়ে। মনোমালিন্য আর কী। নাতি কথা বলতে পারেননি কয়েকদিন ঠাকমার সঙ্গে। অভিমান হয়েছিল। কেন ঠাকমা বলেছিল তাকে দেওয়ান সাজতে। অবুঝ পৌত্র! ঠাকমার প্রাণেই কি কম লেগেছিল। ঠাকমার নয়, সে যে দেওয়ান-গিন্নির প্রাণ। কত অল্প দিনের মধ্যে তিনি কত বড় জিনিস ধ্বংস হতে দেখেছেন। তাঁর আঘাতের কাছে পৌত্রের এই অভিমান তো একটি ছোট্ট নিশ্বাসও নয়।

সেনকর্তা হৃদয়নাথ সে সব ভাবছিলেন না। ভাবছিলেন অন্য কথা। এমন সময় সেনগিন্নি এল। অষ্টাদশী সেনগিন্নি বকুল। ফরাসডাঙার রক্তাভ আকাশ কালো হয়ে উঠছে। অলিন্দে ঘনিয়ে উঠেছে অন্ধকার। হালকা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল বকুলের সর্বাঙ্গ। সে নীলাম্বরী পরতে ভালবাসে। সন্ধ্যাকালের নিরালা বাগানে চাপা হাসিতে উদ্ভাসিত আধফোঁটা গোলাপের মতো শুধু জেগে রইল তার মুখ। হৃদয়নাথ দেখতে পাননি। সেই সুযোগে বকুল লুকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। কয়েক মুহূর্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে গুটিকয়েক অলীক মতলবভাঁজা হল। কীভাবে একটু চমকে দেওয়া যায়। এত বিভোর হয়ে কী ভাবছেন উনি। হঠাৎ ঈষৎ ছায়া ঘনিয়ে এল বুকলের চোখে। ক্ষণিকের ছায়া।

পিছন থেকে এসে চোখ টিপে ধরল স্বামীর। সেনকর্তা একটু হেসে নিজের হাত দিয়ে স্ত্রীর হাত চেপে ধরলেন। বললেন, দেওয়ান-গিন্নি।

বউ অমনি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ফের? ওনাম আমার নয়।

–তবে সেন-গিন্নি।

–না, তাও নয়।

–তবে?

 একটু চুপ করে থেকে হেসে বউ বলল, যে নাম তুমি রেখেছ।

 ডার্লিং?

 বউ শিউরে উঠল। সোহাগের সঙ্গে লজ্জার শিহরন–ছি ছি, ওটা কেন?

তবে, মাই লভ?

না গো, ও সব ইংরাজি নাম একদম নয়।

ও! তবে বুঝি প্রাণেশ্বরী?

এবার অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠল। খুনসুটির অভিমান। সোহাগের আর একটি রকম। মুখ ফিরিয়ে বলল, যাঃ কিছু নয়। আমার নাম বকুল।

সেনকর্তা বললেন, সে তো সকলেই জানে। আমি তো জানি না।

না জানো, না-ই জানলে।

আমি কিন্তু আর একটা নাম জানি।

 বকুল নীরব। পাতার আড়ালে দেওয়া গোলাপের মতো মুখ ফিরিয়ে হৃদয়নাথ বকুলের সুঠাম কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে ডাকলেন, সই! বকুলফুল!

এবার বকুলের ঠোঁটের কোণে ঝিলিক হানল একটু হাসি। ওই সই ডাকটি শুনতে তার ভাল লাগে। কপট অভিমানও সে জন্যেই। অন্যান্য সময় যখন হৃদয়নাথের কোনও কারণে রাগ হয়, মন খারাপ থাকে, তখন তিনি ছোট বউ বলে ডাকেন তার বকুলকে। সে ডাক শুনলে বকুল বুঝতে পারে, মহাশয়ের রাগ হয়েছে কোনও কারণে। তখন বকুলও মুখ ভার করে জবাব দেয়। তাতে সেনকর্তার রাগ আরও বাড়ে।

ডাকাডাকি তো শুধু কাছে কাছেই। চিৎকার করে তো বউকে ডাকা যায় না। বউ অন্য ঘরে থাকলে, তখন চাকরের ডাক পড়ে। রুষ্ট গলা শোনা যায়, বেদো, এই বেদো।

বেদো ছুটে আসে। সেনকর্তা হুকুম দেন, ছোট বউরানিকে ডেকে দে।

ছোট বউরানি আসেন। কর্তা তখন মুখ না ফিরিয়েই গম্ভীর গলায় কথা বলেন, ছোট বউ, আমার এটা কোথায় গেল, সেটা কোথায় গেল?

অন্য সময় সই ছাড়া নাম নেই।

এখন সই ডাক শুনেও, বকুল মুখ ফেরাল না। রাগ হয় না বুঝি তার? খালি বাজে বাজে নাম ধরে ডাকা। মাই লভ, ডার্লিং, ও সব বলে বুঝি আবার বউকে কেউ ডাকে। হৃদয়নাথের মুখেই তো হুগলি কলেজের ছাত্রদের কত কীর্তি শুনেছে বকুল। তারা অনেকেই মদ খায়, কত অ-স্থানে যায়। তাদের স্বর্গ নাকি চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ, চুঁচুড়ার শুড়িপাড়া। সেখানকার অধিবাসিনীদের ওই সব নামে ডাকে কলেজের পড়োরা। প্রাণেশ্বরী বলেও ডাকে। আগেকার দিনে স্বামীরা স্ত্রীদের ডাকত। এখন সে সব সেকেলে হয়ে গিয়েছে।

হৃদয়নাথ সহসা যেন চমকে উঠে বললেন, সই, ঠাকমা আসছে।

যেমন বলা, বকুল পড়ি মরি করে ছুটতে গেল। হাত ছাড়াতে গেল হৃদয়নাথের। কিন্তু হৃদয়নাথের আলিঙ্গন শক্ত হল না শুধু। বকুলের ত্রস্ততার ফাঁকে, মাথা নুইয়ে চুমো খেলেন বকুলকে।

ততক্ষণে বকুল বুঝেছে, ঠকেছে সে। হতচকিত বিস্ময়ে ও ভয়ে অস্ফুট আর্তনাদের পরিবর্তে, রাগ করে ঝংকার দিল, ছিঃ!

তবু রাগ করতে গিয়ে, হেসে উঠে হৃদয়নাথের বুকে ধুপধুপ করে কিলিয়ে দিল বকুল। রুদ্ধশ্বাসে বলল, মিথ্যুক কোথাকার!

হৃদয়নাথ বললেন, কিন্তু এর ইংরাজিটা কী জান?

ভ্রূ কুঁচকে বকুল বলল, কীসের?

 হৃদয়নাথ বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আবার চুমো খেলেন। বললেন, এর?

ঠোঁট মুছে, কপট কোপে, ভ্রূ কাঁপিয়ে বলল বকুল, আহা! ছিঃ!

হৃদয়নাথ বললেন, এর ইংরেজি হল, কিস, বুঝলে? আর প্রতিদিনের ইংরেজি কী জান?

-এভরিডে।

–আর টাইম মানে?

 বকুল বললে, কী হবে ও সব জেনে?

–শোনো না। টাইম মানে হল সময়, বুঝেছ? আর বডি মানে শরীর অর্থাৎ দেহ। আজকে কলেজ থেকে একটা নতুন গান শিখে এসেছি, তোমাকে শোনাব।

–খারাপ গান বুঝি?

-না না, এ সব নাকি বাবাদের আমলের গান। আমার চুঁচড়োর এক বন্ধুর বউকে তার দিদিমা শিখিয়ে দিয়েছে। তার কাছ থেকে আমি শিখেছি। তোমাকেও শেখাব।

বকুল সন্দিগ্ধ কৌতূহলে বলল, শুনি?

হৃদয়নাথ বললেন, ঝাঁপতাল, সুর হবে কাংড়া।

–ওসব বুঝিনে, তুমি গাও।

হৃদয়নাথ গাইলেন,

কী হইবে প্রাণনাথ এভ্রিডে কলেজে গেলে
প্রেম-প্রাইজ পাবে সখা রমণীর টাইম হলে।
 ঘরে আছে ইয়ে লেডি, মিছে কর এ বি সি ডি
কি কর গো আমার বডি, ডাকো মাই ডিয়ার বলে।

 গান শেষ হবার আগেই বকুল বলে উঠল, এ মা! ছি ছি ছি! ও গান আবার কেউ শেখে না কি!

হৃদয়নাথ খুব দৃঢ় নয়, বরং বকুলের ধিক্কারের নমুনা দেখে একটু বিব্রত সুরে বললেন, কেন ভাল গান তো।

ঠোঁট কুঁচকে বলল বকুল, ভাল না ছাই। কলেজে গিয়ে পড়া হচ্ছে না, খালি এ সব খারাপ খারাপ গান শেখা হচ্ছে। ঠাকমাকে এবার আমি বলে দেব।

-বললে কী হবে। ইংরাজিতে যে সব বই পড়ানো হয়, তার মধ্যে এর থেকেও খারাপ খারাপ কথা আছে।

বকুল বলল, ইস! বইয়েতে কখনও ওর চেয়ে খারাপ কথা আবার লেখা থাকে নাকি? সেগুলো তো বই। খালি ভাল কথাই ওতে লেখা থাকে, জানিনে বুঝি?

হৃদয়নাথের মুখে ঘনিয়ে এল ঈষৎ ছায়া। বলল, কিছু জান না তুমি। বায়রন শেলি… ঠোঁট ফুলিয়ে বলল বকুল, না না আমি শুনতে চাই না। আমার ভয় করে।

–ভয়?

–হ্যাঁ।

হৃদয়নাথ চুপ হয়ে যান। বকুলও।

অন্ধকার তখনও ঘনিয়ে আসেনি পুরোপুরি। ফরাসডাঙার কালো রক্ত আকাশে ক্রমেই শুধু কালিমা ছড়াচ্ছে। তবু এখনও গভর্নরের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। একটি একটি করে বাতি জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে, অলিন্দে, জানালায়। এখনও দেখা যায় লোজন, ঘাটের নীলকুর্তা প্রহরী। প্রহরীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, বাজপাখির মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে এদিকে ওদিকে। কেন না, এই তো সময়, ফরাসডাঙার সস্তা মদ আর রেশম চুরি করে ইংরেজ এলাকায় নিয়ে যাবার। এখনও দু-একটা পাখি পারাপার করছে, গঙ্গার ছায়া-ঘন কালো জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। মদ নয়, রেশম নয়, শুধু পোকা মাকড় আর কুটোকাটির জন্যেই, পাখির জগতে এপার ওপারের সন্ধি। বারোদাঁড়ি পশ্চিমা নৌকা যায় একটা জোয়ারের উজান ঠেলে ঠেলে। আর জোয়ারে গা ভাসিয়ে যাচ্ছে দুটি জেলেদের নৌকা।

অস্পষ্ট হলেও, বকুল নিজেও ভাবে, কীসের ভয় তার?

অনেক ভয়, বড় ভয় বকুলের। এক জমিদারির ভাঙা হাটের অন্দরমহল থেকে সে এসে উঠেছে এক দেওয়ানির ভাঙা হাটের অন্তঃপুরে। সে দেওয়ানি নেই, কিন্তু দেওয়ানির সাধ মরেনি। বাসনা এখানে অশরীরী ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবখানে সবকিছুতে, কয়েদখানার আবর্তিত বাতাসে মরচে পড়া ছেঁড়া শেকলের ঝনঝনায়, মজলিশ ঘরের মেরজা ওস্তাদের লখনউয়ি ইংরি গজলের উৎকর্ণ অপেক্ষায়, বাইজির কটাক্ষ ও গুরু নিতম্বের সাপিনী খেলার তৃষ্ণায় আর বাগদি সেপাইয়ের হুংকারের, তেজে, দেওয়ানি ভূত ছায়াহীন পা টিপে টিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুরনো মদের মতো রক্তধারায়। পুরো দেওয়ানির জমজমাট আসরের চেয়ে, ভাঙা হাটের ভয় যে সবসময়েই বেশি। সেখানে শুধু আবর্জনা, এঁটো পাতা আর শেয়াল কুকুরের ভিড়, মধ্যাহ্নের জমাটি হাটের স্বপ্ন।

বড় ভয় করে বকুলের। বাপের বাড়ির ভাঙা হাটে নিজের ভাইদের সে দেখে এসেছে। পুরনো দিনের কথা স্মরণ করে, সর্বস্ব বিকিয়ে সেখানে নির্লজ্জ ভোগের লীলা চলেছে। যেন প্রকাণ্ড একটা জেদ, তারা পচবে এবং মরবে। শুধু দাদারা নয়, বউদিরাও কেউ কেউ তালে তাল রেখেছে। বড় ভয়ে ভয়ে দিন কেটেছে তখন বকুলের। তার ইজ্জতটুকুও থাকে কিনা সন্দেহ। কেন না পিয়ারপুরের জমিদারের অন্দরমহলে তখন নগদ টাকার কারবারি মহাজনদের অবাধ মেলামেশা।

এখানে ভাঙা হাটের নায়ক তার স্বামী। এখনও নিষ্পাপ। তবু দেওয়ানির স্বপ্ন তো আছে। সেই স্বপ্নকে জিইয়ে রাখতে চান ঠাকমা। আর হৃদয়নাথের কাছে বাইরের জগৎ। সেখানে প্রতিটি কথা বকুলকে তিনি শোনান। ভয় করবে না বকুলের? হুগলি কলেজ থেকে ফেরার সময়, প্রতিদিন গঙ্গার ধারের জানালায় অধীর হয়ে থাকে বকুল। ভয় তার, কোনদিন দেখবে, সেনকর্তা নৌকা থেকে নামছেন মদমত্ত হয়ে। কিংবা ফিরে আসেননি। আর যদি বা ফিরেছেন তবে কাকে যেন নিয়ে এসেছেন। তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন মজলিশ ঘরে।

তবু একটি রক্ষা, দেওয়ান-গোষ্ঠীতে লেখাপড়ার রেওয়াজ এসেছে। বকুলের তাতে শ্রদ্ধা হয়। তবু এক বিজাতীয় ভয়-মেশানো মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে পিরিলি ব্রাহ্মণ মজুমদার, চক্রবর্তীদের বাড়ির দিকে। সেই বাড়িগুলিও কানা হয়ে আসছে। অনেকেই কলকাতায় চলে গেছে। আরও দূরে, দিল্লি-লখনউ-এলাহাবাদে যাচ্ছে বড় বড় সরকারি চাকরি নিয়ে। দিনরাত্রি তাদের লেখাপড়ার চর্চা। যারা এখনও এই জগদ্দল-সেনপাড়ায় পড়ে আছে, তারাও প্রতিদিন কলকাতায় যাওয়া আসে করে, গাদা গাদা বই নিয়ে পড়াশোনা করে। বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে নাকি মেয়েরা। মুখ বেঁকিয়ে বলে সবাই, পিরিলি কেরেস্তানদের বউয়েরাও বই মুখে দিয়ে বসে থাকে। প্রায়ই কলকাতা থেকে তাদের আচার্যরা আসেন, উপাসনা হয়।

ওখানকার হাট যেন বেশ জমজমাটি। জগদ্দল-সেনপাড়ায় সেটা এক নতুন হাট। বকুলের মনে হয়, সেখানে যেন অনেক আলো, অনেক হাসি। কলকাতা থেকে সেনপাড়া পর্যন্ত তাদের পরিসর। কত বড়, কত ছড়ানো। হৃদয়নাথও এই রকমই আন্দাজ করেছেন। তার প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে থাকা বকুলের ব্যক্তিত্ব বড় একটা চোখে পড়ে না, কিন্তু বুদ্ধির ধারটুকু অনুভব করেন। নিজেও বোঝেন, বকুলের ভয়ের মধ্যে হয়তো কোথাও একটি সত্য অদৃশ্য কীটের মতো রয়ে গিয়েছে। সে কীট দেওয়ানি, দেওয়ানির স্বপ্ন। নিজেও জানেন না, নব্য বাংলার ধ্যান আর ইংল্যান্ডের ইতিহাস তার বুদ্ধিকে সজাগ রাখছে এক অদৃশ্য প্রহরীর মতো। আধুনিক চিন্তা তাকে ধরে রেখেছে মজলিশ ঘরের দরজায় কাঁটা দিয়ে। হৃদয়নাথও মজুমদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন। ব্রাহ্ম বিষয়ের বই পড়াশোনা করেন।

বকুলের কাঁধে হাত রাখলেন। বকুল ফিরে বলল, রাগ করলে?

হৃদয়নাথ তাকে কাছে টেনে বললেন, না। রাগ করিনি। তবে একটা কথা বকুলফুল, ভয় কোরো না তুমি। বলো তো, তুমি আমাকে কেমনটি দেখতে চাও?

বকুল লজ্জায় মুখ ঢাকল হৃদয়নাথের বুকে। সোহাগ অস্ফুট গলায় বলল, তা আমি কী জানি।

হৃদয়নাথ দু হাতে বকুলকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেন লেখাপড়া শিখছি, শিখে আমি কী হব, কী তোমার ইচ্ছে, সেটা বলল।

কুল চুপ।

–বলো।

 বকুল চুপ, তবু যেন কিছু একটা বলবার জন্যে হৃদয়নাথের বুকে মুখ ঘষছে।

-বলো।

 বকুল ফিসফিস করে বলল, হালদারদের ন ছেলের মতো ম্যাজিস্ট্রেট হবে তুমি।

 হৃদয়নাথ বিভ্রান্তের মতো বললেন, ম্যাজিস্ট্রেট।

–হ্যাঁ, সরকারের হাকিম গো।

 হৃদয়নাথ নীরব। কী যেন শুনলেন কান পেতে। বললেন, কীসের শব্দ শোনা যাচ্ছে?

-কোথায়?

–ওই যে, ঠনঠন, ঝনঝন—

–ও মা, ও তো কয়েদখানার শেকল।

—-ও!

গঙ্গার ধার থেকে শেয়াল ডেকে উঠল। অন্ধকার নেমেছে এবার সর্বগ্রাসী হয়ে। গঙ্গার হিলিবিলি স্রোতে ফরাসডাঙার বড়সাহেব অর্থাৎ গভর্নরের বাড়ির আলো কাঁপছে।

অলিন্দে আলোর রেশ পড়ল। বেদোর ডাক শোনা গেল, কর্তা, ছোট কর্তা।

 হৃদয়নাথ জবাব দিলেন, কী রে বেদো?

বেদো সামনে এল না। জানে, বউঠাকুরানি আছেন কর্তার কাছে। আড়াল থেকেই বলল, গোঁসাইদের লায়েব মোশাই এসেছেন, বসে আছেন কাছারিবাড়িতে। কী নাকি দরকার, একবার দেখা করতে চান। হৃদয়নাথ বললেন, যাচ্ছি। আলোটা রেখে যাস ওখানে।

–আচ্ছা!

হৃদয়নাথ ফিরে বললেন, বকুলফুল! ম্যাজিস্ট্রেট না হতে পারি, সুখে দুঃখে না হয় তোমার কাছেই থাকব, না হয় সবাই সেনকর্তা বলেই ডাকবে, তাতে তোমার দুঃখ হবে না তো?

বকুল বুকে মুখ রেখেই বলল, একটুও না!

তারপর অলিন্দের এক দিক দিয়ে অদৃশ্য হল বকুল। বাতি যে ঘরে ছিল, সেই ঘরে গেলেন হৃদয়নাথ। পাশের ঘর দিয়ে সিঁড়ি পথে যাবার আগেই দেখলেন, ঠাকমা দাঁড়িয়ে আছেন ঝুঁকে। গলার ঝুলেপড়া চামড়া কাঁপছে থরথর করে। বললেন, নায়েবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস নাকি?

-হ্যাঁ।

-না, যেতে হবে না। বেদোকে দিয়ে আমি খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, দেখা করতে হলে যেন দিনে আসে, এটা দেখা করবার সময় নয়।

হৃদয়নাথ থেমে গেলেন। দেখলেন, বৃদ্ধা সেনগিন্নি অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আদেশ দিয়ে অপেক্ষা করছেন, দেখছেন, আদেশ পালিত হয় কি না।

পালিত হবেই। ঠাকমাকে অতিক্রম করার সাহস এখনও ভাঙা হাটের দেওয়ানের হয়নি।

 বৃদ্ধা সেনগিন্নি একটু পরে বললেন, আর আর শরিকেরা গেছল দেখা করতে। লুভিষ্টিরা গেল ল্যা ল্যা করে, যদি গঙ্গার ধারের টুকরোটাকরা দিয়ে দু-চার পয়সা পাওয়া যায়। নায়েব মুগুর কষছে ভালই। পয়সা নয়, জমিদারের অনেক পাওয়ানা হয়েছে দেওয়ান গোষ্ঠীর কাছে, তারই হিসেব-নিকেশ। ওরা যখন তখন যেতে পারে, তুমি পারো না ভাই। কাল দেখা কোরো।

তারপর হঠাৎ একটি নিশ্বাস ফেলে বললেন, দেওয়ানেরা মাটি করেনি, বরাবর গোঁসাইদেরই প্রজা থেকে গেল। এইবার দেওয়ানির আসল শোধ চাইবে গোঁসাইয়েরা।

হৃদয়নাথ দেখলেন, পুরনো দেওয়ালে ঠাকমার কোমর-ভাঙা মূর্তির ছায়া। আর সেই ছায়ার কোলে আঁধার ঘেঁষে বকুল তাকিয়ে আছে তার দিকে অপলক চোখে।

.

৩২.

সেই সন্ধ্যারাত্রে, সেনপাড়ার দেওয়ানি রক্তে যদি কোথাও সত্যিকারের দোলা লেগে থাকে, তবে তা রুদ্ধশ্বাস, ধুলাচ্ছন্ন, নিরঙ্কুশ পোকার রাজ্য, সেনবাড়ির মহাফেজখানা সংলগ্ন কাছারিবাড়িতে। দেওয়ানি ইন্ধনে যদি কারুর সাড়া পড়ে থাকে তবে তা, সেনবাড়ির দুই হিসাবরক্ষকের। কেবল দুটি ভূতের কাণ্ড দেখে মনে মনে হেসে মরল গোঁসাইদের নায়েব।

গোঁসাইদের নায়েবকে দূর থেকে দেখেই দুজনে চকিতে একবার চোখাচোখি করল। পরমুহূর্তে দুজনে চামচিকের চেয়েও নিঃশব্দে পাশের ঘরে গেল দৌড়ে। ছেঁড়া কামিজ দুটি চাপাল দুজনের গায়ে। শুকনো দোয়াতদানে ডোবাল পালকের কলম। বারোশো পঞ্চাশ সালের খাতা রয়েছে খোলা সামনে। পুরনো বৈভবের স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া যা দিয়ে আর কোনও কাজ হয় না এখন।

নায়েবকে দেখেই চোখ তুলল দুজনে, হাত তুলল কপালে। গোঁসাইদের নায়েব ততোধিক নম্র। নমস্কার করে হেসে বলল, চিনতে পারলেন না বোধহয়?

দুজনেই অমায়িকভাবে হাসতে গেল। হাসলও বোধহয়। কিন্তু সেটা যে হাসি, অপরের পক্ষে তা বোঝা কঠিন। দুজনেই হয়তো একসঙ্গে বলতে যাচ্ছিল, কী যে বলেন! কিন্তু দুজনেই ঘাড় দুলিয়ে শুধু হাসল। যে হাসিতে বোঝা যায়, তা আর চিনিনে? কী যে বলেন।

তারপর দুজনেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একজন বলল, চাকরটা যে কোথায় যায়!

কাছারিবাড়ির দেয়ালটারই হেসে উঠবার কথা। চাকর? চাকর কোথায় কাছারিবাড়িতে। কাছারিবাড়ির শেষ চাকর ছিল পিতলা! বিরাশি বছর বয়সে মারা গেছে এই কাছারিবাড়িতেই।

দেয়াল নয়, মনে মনে হাসলেন গোঁসাইদের নায়েব। হালের মানুষ। বয়সও বেশি নয়। আর গোঁসাইবাড়ির আনাচে কানাচেই বাস করেন। হাল আমলের ভাল মন্দ দেখেছেন অনেক, সেকেলে নন। তা ছাড়া এখানকার আমিন গোমস্তাদের কাছে সেনবাড়ির সব কাহিনীই শুনেছেন। এই গোমস্তার চাকর খোঁজাখুঁজি দেখে হাসি পাবে বইকী।

নায়েব বললেন, থাক না, চাকর-বাকরের দরকার কী?

দুজনেই আবার চোখাচোখি করল। বক্তব্য বোধহয়, নায়েবটা কি আমাদের চালাকি ধরতে পারছে নাকি?

একজন বলল, দরকার মানে, একটা

আর একজন বলল, বসবার জায়গাটায়গা

নায়েব চৌকি দেখিয়ে বললেন, এই তো বসবার জায়গা রয়েছে।

ততক্ষণে দুজনেই পাশের ঘরে চলে গিয়েছে। সেখানে দুটি রয়েছে। একটি বেশ বড়, আর একটি ছোট। দুজনেই চোখাচোখি করল এবং চোখে চোখেই বলাবলি হল, বড় চেয়ার না ছোট চেয়ার? গোঁসাইদের নায়েব, ম্যানেজার তো নয়। আগের দিনে অবশ্য নায়েবই বড় ছিল। হাল আমলে নায়েবের উপরেও একজনকে রাখেন জমিদারেরা, তার নাম ম্যানেজার। সুতরাং, নায়েব যখন, তখন ছোট চেয়ারটাই দেওয়া হোক। দুজনেই ধরাধরি করে আনল চেয়ারটা। কেন না, সেটাও যথেষ্ট রাজকীয় এবং ভারী।

নায়েবও তাড়াতাড়ি হাত বাড়ালেন এগিয়ে গিয়ে।–আহা হা, এ সবের কী দরকার ছিল?

তবু নায়েব মশাইকে বসতেই হল। কিন্তু চেপে নয়, একটু আলগোছেই বসতে হল। ধুলো আছে, গদি-কাটা পোকা আছে। ছারপোকা হয়তো নেই। থাকলে নিরস্তু উপবাস ছাড়া আর কী জুটবে এই আসনে।

আবার চোখাচোখি করল দুজনে।

 নায়েব এবার নতুন কোনও কায়দা কানুনের ভয়ে বিরক্ত হয়েও হাসলেন মনে মনে। বললেন, কাবরদারকে খুঁজছেন বোধহয়?

হাসতে গিয়ে চমকে উঠে দুজনেই আবার চোখাচোখি করল। লোকটা কি তাদের চেয়ে ধূর্ত? ঠাট্টা করছে, না, সত্যি সত্যি বলছে? হুঁকাবরদার সেনবাড়িতে কয়েক যুগ ধরেই নেই।

একজন বলল, হ্যাঁ, কোথায় যে যায় লোকগুলোন।

আর একজন যোগ করল, আর ঠিক কাজের সময়।

 দুজনেরই চোখে চোখে তাকিয়ে মনে হল, সত্যি কথা বলছে তারা।

দেওয়ানি বৈভব। তার তেজ ও বীর্য। তাদের চোখের সামনে সে সব মিলিয়ে গেল ভোজবাজির মতো। শুধু তার ছায়াটা পার হয়ে যেতে পারেনি দুজনে। মাকড়সার জালে যেমন পোকা মরে ঘুরে, সেইরকম আটকা পড়ে গিয়েছে। এখন বোধ গিয়েছে ভোঁতা হয়ে। নিজেদের ধূর্ত ভেবে খুশি হয়। সেনবাড়ির ভাতে পেট না ভরলেও ক্ষুধার অনুভূতি তেমন কষ্ট দেয় না। বয়সও হয়েছে। অম্বল অগ্নিমান্দ্যে এমনিতেও মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ঢেকুর ওঠে, বুক জ্বলে, চোখ জ্বালা করে। এখনও যে এত কথার কারসাজি, সে কি এই কাছারিঘরের দেওয়ানি ভূতটাকে খুশি করার জন্যেই, না গোঁসাইনায়েবকে সত্যি সত্যি আপ্যায়িত করার জন্যেই সেটাও ঠিক ধারণা নেই যেন। নায়েবের ঠোঁটের কোণে একটি তিক্ত হাসির সূক্ষ্ম বাঁকা হুলের মতো রেখা ফুটল। বললেন, ব্যাটারা যায় আর কোথায়, বুঝলেন, নরকে। ওরা দুজনেই হাসবার চেষ্টা করলে, যে হাসিতে একটি কথা-ই বোঝা যায়, যা বলেছেন।

নায়েব তাড়াতাড়ি বললেন, যে জন্য এসেছিলুম, সেই কাজের কথাটাই সেরেনি। তামাক খাওয়া আর একদিন হবে।

দুজনেই চোখাচোখি করে হাসল। তা কি হয়। কিন্তু কাদানে পাঁচটা হুঁকো আছে। কোনটাতে নায়েবকে দেওয়া যায়। রুপো বাঁধানো দুটো হুঁকো এখনও আছে। যদিও রুপো বলে তাকে আর চেনা যায় না। চেনার দরকার হয় না। যেটা সবচেয়ে বড়, সেটা নায়েবকে দেওয়া যেতে পারে না। সারি সারি হুঁকোর মধ্যে যেটিকে মেজো বলে মনে হচ্ছে, সেটাতেইনায়েবকে দিতে হবে। এইটিই তারা স্থির করল দুজনে চোখে চোখে চেয়ে। কিন্তু ধুয়ে জল পুরতে হবে। কেন না, ওই হুঁকোয় বড় একটা তামাক খাওয়া হয় না। খোলের মধ্যে বিছে কিংবা কাগজ কাটা পোকা নিদেন দু-একটা ঢুকে আছে নিশ্চয়। একজন কলকে নিয়ে তামাক সাজতে বসল, আর একজন আরম্ভ করল হুঁকোয় জল ভরতে।

বিরক্ত হলেও মনে মনে খুশি না হয়ে পারলেন না নায়েব। লোক দুটি তাকে সম্মান দেখাতে চাইছে, খাতির করছে। কিন্তু টমাস ডাফ কোম্পানির কথা ভুললে চলবে না। গোঁসাইদের কল্যাণে নায়েবের অভাব নেই। গঙ্গার এপারে ওপারে কিছু জমিজমা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। দুখানি বাড়ি আছে। চটকল কোম্পানির নজর যখন পড়েছে এই অঞ্চলের দিকে, তখন নায়েব মশাইয়ের উপরও নজর পড়বে। লিটিজং না কী, যে সাহেব এসেছে সিরাজগঞ্জের কোম্পানি থেকে, সে খুব তাড়া লাগাচ্ছে। কারখানার ভিত পত্তনে আর দেরি করলে চলবে না তাদের। ওদিকে টমাস ডাফও জমির জন্য হাত পেতে আছে। এস্টেটের ম্যানেজার খাতা কলমে দেখেন! কিন্তু নায়েব মশাইয়ের আঙ্কিক দৃষ্টির সামনে, কোন জমির কোন ভাগে একটি পেঁপে গাছ আছে, সব জানা আছে। সুতরাং কোম্পানিকে কিছু করতে হলে, নায়েব ছাড়া গতি নেই। কাঁকিনাড়ায় জার্ডিন কোম্পানি, উপকারীর ঋণ হিসাবে ভাল হাতেই শোধ দিয়েছে নায়েবমশাইকে। অবিশ্যি তার উপরেও কিছু দাঁও মেরেছে শ্রীকান্ত ভটচায়। বৈদিকটার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। সেই কোনকালের একটা পচা পরচা নিয়ে, বিঘে তিনেকের একটা দাগ নম্বর নিয়ে হাজির হয়েছিল জার্ডিনের এজেন্ট সাহেবদের কাছে। সাহেবদের এখন মাথা খারাপ। প্রতিযোগিতা লেগেছে ভারতের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের, ডান্ডির সঙ্গে বারাকপুর মহকুমার। কান্ত ভটচাযের সঙ্গে কথা কাটাকাটি না করে, করকরে, নগদ টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়েছে এজেন্ট সাহেব। কেবল টিপসই দিয়ে একটা প্রাপ্তিস্বীকার করিয়ে, পচা পরচাটা কিনে নিয়েছে। আরও দু-চারজন মেরেছে ছোটখাটো দাঁও। আর সেগুলি নায়েবের পক্ষে রোধ করা সম্ভব হবে না। কেন না, তিনি নিজেও পুরোপুরি হকদারদের হক মেনে চলছেন না। তামাক খেলেন নায়েব মশাই। খেতে খেতে আর একটু রসিকতা না করে পারলেন না, আপনাদের কাজকর্মের চাপ কেমন আজকাল?

হিসাবরক্ষীরা হঠাৎ যেন বোকা হয়ে গেল। কাজকর্ম? কীসের কাজকর্ম? বহু, বহুদিন ধরে তো তাদের এধরনের কথা কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কাজকর্মের হিসেব তলবদার তো নেই-ই। কাজকর্ম কাকে বলে, সে সব তারা নিজেরাও ভুলে গিয়েছে বোধহয়।

আজ যেন বহুদিন পরে দুটি প্রেতাত্মা তাদের পুরনো কাজ ব্যস্ত ভঙ্গিটা ফিরিয়ে আনতে চাইল।

–তা, কম নয়।

–হ্যাঁ, বুঝতেই তো পারছেন।

 বুঝতে পারছেন নায়েব মশাই। ঋণের হিসেব রাখার দিনও বোধহয় শেষ হয়েছে।

মনে মনে হাসলেন নায়েব মশাই। তাকেও ঋণের হিসেব রাখতে হয়। পাঁচ-দশ জন লোক মিলেও হিসেব সামলে উঠতে পারেন না। তবে, সে ঋণ জমিদার গোঁসাইদের নয়। গোঁসাইরা পাওনাদার।

কিন্তু নায়েবের হাসি সামলানো দায় হল তখন, যখন সেনবাড়ির দুই হিসাবরক্ষীর একজন জিজ্ঞেস করল তাকে, আপনার কাজকর্ম কী রকম এবার বলুন। নায়েব মাথা নেড়ে বললেন, খারাপ, খুব খারাপ।

-কেন?

–আর কেন কি মশাই। দেখছেন না, খালি নিলামের মামলা করতে হচ্ছে। এতদিন বাদে হুজুরদের টনক নড়েছে, প্রজাদের ঋণের হিসেব নাও। বারাসত আর বারাকপুর করে করেই মলুম। যেখানে হাত দিই সেখানেই গণ্ডগোল। এতদিন তবু চলেছে একরকম, এখন কাড়াকাড়ি করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তা ছাড়া কর্তাদের কড়া হুকুম হয়েছে, এত দূরের জমি রক্ষা করা কঠিন, ভাল নজরানা পেলে, একজন মধ্যবর্তীকে এদিককার মৌজা সব বন্দোবস্ত দিয়ে দেওয়া হবে। হুকুম নিয়ে এলাম হুজুরের, কাজ তো করতেই হবে। কিন্তু যত দোষ, নন্দ ঘোষ। প্রজারা সব শাপ শাপান্তর করছে। দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে।

নায়েবের অন্তরে অন্তরে হাসির ঘূর্ণি, মুখের উপরে গাম্ভীর্যের নিস্তরঙ্গ মুখোশ। হিসাবরক্ষীরা করুণ মুখে, চোখ পিটপিট করে। ভাবটা, তাই তো বটে। একজন জিজ্ঞেস করল, মধ্যবর্তী কে হলেন?

নায়েব বললেন, সেরকমভাবে মধ্যবর্তী কেউ নয়, তবে মনে হচ্ছে চিটেরাই আর দুদিন বাদে হালিশহর পরগনার অর্ধেকের মালিক হয়ে বসবে।

হিসাবরক্ষীরা বোবার মতো শুন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গঙ্গায় জল যায়, শুধু পাড়ের উপর মাটির ঢিবিটা যেমন অনড় অচল হয়ে থাকে, তেমনি তারা দুজন। তারা দুটিতে এখানে বসে আছে। সেনবাড়িতে ভাটা পড়েছে, জোয়ার এসেছে কোনও অপরিচিত মহলে। এই দুজনে শুধু দেখছে। চিটে হল ভাটপাড়ার সদগোপ পালেরা। কবে একদিন তারা চিটেগুড়ের ব্যবসা শুরু করেছিল। সঙ্গে হোগলা সুপুরিও ছিল। দেখতে দেখতে, এক ঘাট থেকে, কয়েক ঘাটে, গঙ্গার ধারে আড়ত খুলে বসল তারা। আতপুরের ঘাটেও এক আড়ত খুলছে। লোকে তাদের চিটে বলেই জানে। সামনে পাল, আড়ালে চিটে। পালেরা তাতে নিজেদের ছোট বলে মনে করে না।

কিন্তু কথায় বলে, জমি নেই যার, বুকের ছাতি নেই তার। চিটের ব্যবসায় টাকা পাওয়া গেছে, কিন্তু টাকা রাখা যায় কোথায়? জমিতে। পিতৃপিতামহেরা লাঙল ঠেলেছে, চিরদিন স্বপ্ন দেখেছে জমির। আদিগন্ত মাঠ, তার আর শেষ নেই। চিটের টাকায় সেই স্বপ্ন আজ সফল হতে চলেছে।

টাকা নিয়ে বসে আছে গোঁসাইদের কাছারিতে। বারাসতের এজলাসে। নায়েব মশাই হাতে আছেন। আর হাতে আছে কোর্টের কর্মচারী। নিলামের ডাক পড়ছে। টাকা ফেলেছে চিটেরা, জমি কিনছে। আতপুরের গঙ্গার ধার, ওদিক আরও পুবে, কাউগাছি, উচ্ছেগড় পর্যন্ত ধাওয়া করে চলেছে। খালি তো গোঁসাইদের প্রজাদের জমি নয়। কলকাতায় পাথুরেঘাটার ঠাকুরদের জমিও আছে। দিনকাল দেখে মনে হচ্ছে চিটেদেরও এবার একটি কাছারিবাড়ি চাই। নায়েব গোমস্তা রাখতে হবে।

নায়েব বললেন, হ্যাঁ এবার কাজের কথায় আসা যাক। কথা কি আপনাদের সঙ্গেই হবে?

দুজনেই টেনে টেনে হাসল, হেঁ হেঁ!

যার অর্থ দাঁড়ায়, আপনার অভিরুচি। কিন্তু ইতিপূর্বে নায়েব সেনেদের অন্যান্য শরিকের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছেন। এবারে বড় তরফ। বড় তরফ এখনও ছেলেমানুষ, শুনেছেন হুগলি কলেজে পড়তে যায়। দেখা যাক নেড়েচেড়ে। বললেন, স্বয়ং দেওয়ানজির সাক্ষাৎ পেলে বাধিত হতাম। সে ভাগ্য কি হবে?

নিশ্চয়! লাফ দিয়ে উঠল একজন। সন্ধ্যার প্রায় অন্ধকারে অদৃশ্য হল খবর দিতে। ফিরে জানাল, খবর গেছে।

নায়েব মশাই এদিক ওদিক তাকিয়ে, মাঝে মাঝে চমকে উঠলেন। কীসের শব্দ হচ্ছে ঝনঝন করে? বাতাসে পোডড়াবাড়ির সঙ্গে মিশেছে হালকা সন্ধ্যামণির গন্ধ। মান্ধাতা আমলের একটা বাতি জ্বালাল এক হিসাবরক্ষী। চিমনিতে কালি পড়েছে। গোলবাতিতে পড়েছে ঝালাইয়ের পলেস্তারা। তবু বোধহয় তেল চোঁয়ায়, তাই মাটির সানকির উপর বাতি বসানো। বাতির তেল কম, কিংবা সলতে ছোট, বোঝার উপায় নেই, ঝাঁজরা ফুটো রাজকীয় বাতি নিভু নিভু। সেই নিভু নিভু স্বপ্নালোকে কী এক রহস্য যেন কাঁপে থরথর করে। হিসাবরক্ষী দুটির হাসতে গেলে ঠোঁট ব্যথা করে, তবু হাসে। নায়েবের মনে হয়, যেন দুটি যক্ষ বসে আছে যখ দিয়ে। অস্বস্তি হয়, চুপচাপ থাকা যায় না যেন।

জিজ্ঞেস করলেন, কীসের শব্দ হচ্ছে?

কোথায়?

কান পেতে বলে ওঠেন নায়েবমশাই, ওই, ওই যে, শুনতে পাচ্ছেন না?

একজন বলল, জেলখানায় বাজছে।

–কী বাজছে?

আর একজন বলল, শেকল।

শেকল!

–হ্যাঁ, শেকল। ছেঁড়া শেকল। কয়েদিদের বেঁধে রাখা হত শেকলে। আর একজন বলল, পুকুর ঘাটের বড় কড়াগুলিও ঠংঠং করে বাজে। কড়ার সঙ্গে শেকল আছে কিনা জলে ডুবনো।

নায়েব বললেন, কেন?

একজন বলল, জানি নে। বোধহয় কিছু ডুবিয়ে রাখা হত।

আর একজন জুড়ে দিল, শুনেছি, অবাধ্য অসৎ লোকেদের ডুবিয়ে মারা হত। কথা কেড়ে নিয়ে আবার বলল একজন, তলায় নাকি ঘর আছে।

অন্যজন বলে উঠল, শুনেছি, বাঁধা কলসিতে মোহর আছে।

অপরজন যোগ করল, যখ দেওয়া আছে।

কথা শেষ করল আর একজন, কে নাকি সেই মোহরের কলসিতে হাত চালিয়ে ঝনঝন করে বাজায়। শব্দটা নাকি তারই।

নায়েব হাসতে গিয়ে, বুকের মধ্যে অন্য শব্দ শুনতে পান। ঠাট্টা করছে নাকি ভূত দুটো। কিন্তু না, দুজনেই যেন উদ্দীপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে। বোধহয় স্বপ্ন দেখছে পুকুরের নীচে সেই মোহরের ঘড়ার।

নায়েব প্রসঙ্গ বদলালেন। বললেন, কত বছর বয়সে এ বাড়িতে এসেছিলেন?

কত বছর? হিসাবরক্ষীরা মুখোমুখি তাকায়। কত বছর বয়সে, কোনখান থেকে তারা এসেছিল, সে কথা আজ আর তাদের স্পষ্ট মনে পড়ে না যেন। তাদের নিয়ে চার কিংবা পাঁচ পুরুষের কাজ। তার আগে কারা ছিল, সে খবর জানা নেই। বাড়ি ছিল বোধহয় খুলনায়। চোখে চোখে তাকিয়ে দুজনে নিঃশব্দেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। হ্যাঁ খুলনায়। পাশাপাশি বাড়ি, এক গ্রামে বাস। সমবয়সি ছিল দুজনে। দুজনেরই বাপ তখন এই দেওয়ানবাড়ির হিসাবরক্ষক। গুরুমশায়ের কাছে তখন তাদের শিক্ষা চলছিল গাঁয়ে। বাংলা লেখা আর টাকা আনা কড়া ক্রান্তির হিসেব। কত বয়স তখন, যখন তাদের পিতৃদেবরা গিয়ে নিয়ে এল তালিম দেবার জন্যে? চোদ্দো বছর বয়স। চোদ্দো বছর বয়স থেকে সেনবাড়ির হিসেব রাখার কাজে বহাল হয়েছিল।

নায়েব বললেন, চোদ্দো বছর! বাঃ, আপনাদের কালে বেশ অল্প বয়সেই সংসারে ঢোকা যেত। আর এখন বয়স কত হল?

এখন? কত হল? দুজনেই চোখে চোখে তাকায়। হিসেব কষে মনে। বারাকপুর সেপাইদের হাঙ্গামা হয়েছিল কত বছর আগে? ছাব্বিশ বছর হল বোধহয়? তার সঙ্গে আরও বছর তিরিশ-বত্রিশ, পৌঁছুতে হবে। তা হলে কত হল? সাতান্ন-আঠান্ন বছর বয়স হল বোধহয়।

নায়েব বললেন, দেখে মনে হয়, সত্তর পার হয়ে গেছেন। বয়সের চেয়ে বেশি দেখায়। আপনাদের পুত্র পরিবার?

লোক দুটি স্তব্ধ। যেন তাদের গালে কেউ ঠাস করে চড় মেরেছে। পুত্র পরিবার মানে? বিয়ে, বউ ইত্যাদি? ছেলেমেয়ে? বহুদিন তাদের জীবনে এই সব আলোচনার অবকাশ আসেনি। জিজ্ঞেসও করেনি কেউ। বুড়ো চাকর পিতলা যতদিন বেঁচে ছিল, সে জিজ্ঞেস করত। এখন আর কেউ নেই। তারা নিজেদেরও নিজেরা জিজ্ঞেস করে না আর। কিন্তু তাদের দুজনের মনে আছে দুটি বউয়ের কথা। সেপাইদের হাঙ্গামার প্রায় বারো তেরো বছর আগের কথা। যশোরের কোনও এক গ্রামে যেন একজনের বিয়ে হয়েছিল, আর একজনের খুলনাতেই। মনে পড়ছে, তখন তারা বছর বছর বাড়ি যেত। নৌকোয় করে যেত। ইটিস্তে হয়ে কয়েকবার গিয়েছে বোধহয়। তখন তারা অন্যরকম মানুষ ছিল। তাদের একটি বউ ছিল, আর প্রতিবছর তাদের ছেলেমেয়ে হত। চব্বিশ পরগনার এই সেনবাড়ি থেকে যতবার তারা দেশে গিয়েছে, ততবারই দেখেছে, একজনের জায়গায় দুজন, দুজনের জায়গায় তিনজন। সেই সব নতুন আগন্তুকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত অবাক হয়ে। ভয়ে লুকোত মায়ের আঁচলে। তারপর সেনবাড়ির জৌলুসে জল আছড়া পড়ল। কাজ কমল, রোজগার কমল। কমতে কমতে এখন পেট-ভাতায় এসে ঠেকেছে। ভাগ্য ভাল, রাঁধুনি বামনি চাল নিতে এখনও ভুলে যায় না। গাঁয়ে সামান্য জোত জমি ছিল, তাই দিয়ে স্ত্রীপুরে চলছে। তারা দুজন রয়ে গেছে। কেন রয়ে গেছে, তারা জানে না। বোধহয় দেওয়ানি মহিমার দায়িত্বটা ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে রয়েছে তাদেরই। পনেরো বছরের মধ্যে আর যাওয়া হয়নি বোধহয়, এই ঘরকে, এই কাছারি, মহাফেজখানা, ধুলো, পোকা তারা ভালবেসেছে। এইখানেই তারা পুরনো খাতা খুলে স্বপ্ন দেখার মতো দেওয়ানদের পুরনো বৈভবের হিসাব পড়ে। স্ত্রীপুত্রের কোনও টান নেই তাদের।

সেনেদের সেজো শরিকের ঝি চপলা, আর বড় শরিকের মুক্ত তাদের সই হয়ে গিয়েছে।

বয়স হয়েছে তাদেরও। তাদেরও মন পড়ে গেছে, এদেরও মন পড়ে গেছে। সব মিলিয়ে কী এক বিচিত্র নেশায় যেন তারা রয়ে গেল এখানেই। খুলনা থেকে এখন আর খবর আসে না, তারাও দেয় না। সেনকর্তারা তাদের থাকতে বলেন না, যেতেও বলেন না। পৃথিবীতে কী ঘটেছে তারা জানতে চায় না, মাঝে মাঝে পৃথিবী নিজে এসেই হয়তো নানান বেশে জানিয়ে যায়। তারা অবাক হয়। অবিশ্বাস করে চোখ বুজে থাকে। চপলা আর মুক্ত এসে তাদের আদর করে, ভালবাসে, ঝাড়ফুঁক ঠাকুরদেবতা, যাত্রা সঙের গল্প বলে। তারা ডাঁটা চিবানো রসের উদগার তুলে সেই সব কাহিনী শোনে। শুনতে শুনতে ওদের নেশা প্রতিদিনই জমে। ভাবে তারা একেবারে শেষবার দেশে যাবে, আর ফিরবে না।

কেবল আশেপাশে যখন কেউ মরে, কান্নার রোল ওঠে, হরিধ্বনি শোনা যায়, তখন তাদের মনটা আনচান করে। দেওয়ানি হিসেবের নেশার খোয়ারি কাটিয়ে চমকে ওঠে তারা। যেন দেশে ফিরে যাবার ডাক শুনতে পায়। মুখে আগুন দেবার কেউ নেই তাদের এখানে।

দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বলল, আছে, পুত্র পরিবার সবাই আছে। ছাড়া পেলেই চলে যাবে। ছাড়াই পায় না যে!

তা বটে। মহাকালের যে বিচিত্র খাঁচাটায় তারা বাঁধা পড়েছে, সেখান থেকে আর কোনওদিন বোধহয় তারা ছাড়া পাবে না।

নায়েবের ভ্রু কুঁচকে উঠল, গোঁপের পাশে ফুটল চাপা হাসি। বলল, এতদিনের লোক আপনারা, পাকা হিসেবি। এখানে আর বসে আছেন কেন? চিটেদের কাজেই লেগে যান না। মাস গেলে টাকা দশেক করে নিশ্চয় পাবেন, খোরাক পোশাকও পাবেন।

দুজনেরই চোখ দুটি চকচক করে উঠল। আবার নিবে গেল। চিটেদের গোমস্তা হবে! এই ঘর ছেড়ে, এই কাছারি চৌহদ্দি পেরিয়ে? খুচরো জমির জোড়া লাগানো হিসাব, মন বসবে কেন? দুজনেই মিটিমিটি হাসে। তাতে অনিচ্ছাটাই প্রকাশ পায়।

নায়েব আবার বললেন, আর এক কাজ করুন না হয়। দু-এক পাতা ইংরাজি-টিংরাজি পড়ুন। চটকল কোম্পানি লোকের জন্যে হাঁপাচ্ছে। দুমাস রেওয়াজ করলেই, মাস গেলে পনেরো টাকা, উপরি ষোলো আনা?

এইবার দুজনেরই যেন টনক নড়ে। বলে, ইংরেজি?

–হ্যাঁ। কলুর বলদও মশাই রোজগার করছে, আপনারা বসে থাকবেন? একখানা বই আনিয়ে নিন, সব বাংলা করে লেখা আছে।

পারব?

 –খুব পারবেন। আমিও পড়ি। বলেন তো বইও দিতে পারি। বইয়ের নাম ওয়ার্ডবুক।

দুজনেই নায়েবের কাছে ঘন হয়ে আসে। আবার বলে, পারব?

-খুব পারবেন। সায়েবদের একবার বোঝাতে পারলেই হল, ব্যস, কোম্পানির চাকরি পাকা।

দুজনেই স্বপ্ন দেখতে দেখতে কথা বলতে ভুলে যায়।

এমন সময় এল বেদো। বলল, কত্তা আজ আর নীচে নামবেন না, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপনার কাল সকালে আসার হুকুম হয়েছে।

নায়েবের চোখ দুটি ছোট হয়ে, ভ্রু কুঁচকে উঠল। হুকুম? দেওয়ানি হুকুম? হিসাবরক্ষীদের দিকে ফিরে বললেন, নুই খাই একজনের, আর একজনের হুকুমবরদার হই কেমন করে? কাল তো আমার আসা হবে না।

হিসেবরক্ষীরা চুপ, বেদোও তাই। নায়েব একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, তা হলে আপনারাই কালকে একবার আমাদের কাছারিতে আসবেন। দু-চারদিনের মধ্যেই অনেকগুলো মামলা উঠবে। সামনাসামনি হলে একবার হিসেবনিকেশ করা যেত, আমার দোষ থাকত না। আর সব শরিকের সঙ্গেই মোটামুটি রফা হয়ে গেছে, এই তরফ বাকি রয়েছে। যা ভাল বোঝেন করবেন।

নায়েব চলে গেলেন, কিন্তু একটা ক্রুর বিদ্রুপে গোঁফজোড়া রইল বেঁকে। বেদো আলো দেখাল দেউড়ি পর্যন্ত। তারপর ছুটে গেল বুড়ি সেনগিন্নির কাছে। সব কথা বলতে হবে, শোনবার জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি।

হিসাবরক্ষীরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। চোখের সামনে তাদের ইংরাজি অক্ষর হিজিবিজি কাটতে লাগল। ইংরাজি শিখবে তারা? ইংরাজি? চাকরি পাবে কোম্পানির?

চপলা আর মুক্ত ছাড়া সে কথা বলার কেউ নেই। সবাই ঘুমোলে পরে, সব, সব কাজের শেষে তারা আসবে।

.

৩৩.

দুই মাসের মধ্যেই, নায়েবের কেরামতি দেখা গেল। উদ্বাস্তু হয়ে গেল প্রায় গোটা দুলে পাড়াটা। গঙ্গার ধারে, সেন-দেওয়ানদের অনেক জমি নিলাম হয়ে গেল। বৈশাখ মাসে, প্রায় প্রতিদিন বারাসত কোর্টের পিয়াদাকে আসতে দেখা গিয়েছে। ডোমপাড়ার কচা ডোম ঘাড়ে ঢাক ঝুলিয়ে এসে, ঢ্যাটরা পিটেছে রোজ আর সরকারি লাল নিশান পোঁতা হয়েছে কোর্টের নোটিশসহ দখলি জমিতে।

মজুমদার চক্রবর্তী-হালদারেরা একেবারে নির্বিকার দর্শক থাকতে পারল না। তাদেরও জমিজমা কিছু ছিল গঙ্গার ধারে। সে সব সামলাতে ব্যস্ত হল তারা।

ভাটপাড়ার চিটেরাও দেখল, এই সুযোগ। কথায় বলে, একবার যখন মড়ক শুরু হয়, তখন সে সব সাবাড় করে দিয়ে যায়। জমি নিয়ে খেলাটাও শুরু হল তেমনি। নিলাম, উচ্ছেদ, বে-দখল স্বত্ব, জবরদখল, এ সবের হিড়িক পড়ে গেল একটা। এই মড়ক-রাক্ষসের মুখ থেকে উপছে পড়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়াতে লাগল চিটেরা। কলকাতায় খবরের কাগজ বেরোয়। বড় বড় দেশীয় লোকের নাম শোনা যায়, যাঁরা সরকার বাহাদুরের সঙ্গে ওঠাবসা করেন, খানাপিনা করেন। দেশের জন্য মাথা ঘামান বিদ্বান পণ্ডিতেরা। কিন্তু জগদ্দল-সেনপাড়ার রায়তের মুখ চাইবার লোক পাওয়া গেল না। সদগোপ চিটেদের দেখলে সবাই মাটিতে মাথা ঠেকায়। চিটেরা নাকি জমিদার হতে চলেছে এ দেশের।

প্রজারা আইনের মারপ্যাঁচ বোঝে না। দলিলের লেখা বোঝে না। একটিমাত্র অধিকার তার আছে, টিপসই সে দেবে না। কিন্তু জমিদার থেকে শুরু করে, সবাই কাগজ বাড়িয়ে রয়েছে, টিপসই দাও। ভয়ে ও ত্রাসে দিতেই হয়। তারপর দেখা যায়, যার ধন তার ধন নয়, সেই প্রবাদের নেপো লোকটি দই খেয়ে যাচ্ছে। স্ব-ইচ্ছেয় জমি বিক্রি করেও দেখা যায়, টাকা উশুল করে অন্য লোকে।

জমির দাম বাড়ছে প্রতিদিন। বিদেশিরা যখন সাত-সাগর পেরিয়ে এসে নতুন নতুন কোম্পানির নামে কারখানা খুলতে ব্যস্ত, তখন বাঙালিরা ব্যস্ত জমিদারি খেতাব আদায়ে। যার ঘরে দু পয়সা আছে, সে দু ছটাক জমির স্বপ্ন দেখছে। যার কিছু নেই, সে হাহাকার করছে, জমি, জমি, জমি।

ঝনঝন করে কাঁচা টাকা বাজিয়ে ফিরতে লাগল নগিন ঘোষ। সে জমি চায় না। টাকা চায়। সুদ চায়। নগদ টাকার কারবার ছাড়া কারবার নেই তার। সে স্বপ্ন দেখছে মহাজনির। কলকাতায় ব্যবসা করবে সে। শিয়ালদহে গিয়ে দেখে এসেছে, হাওড়া যাবার সোজা পশ্চিমের রাস্তায় কাতার দেওয়া গোরুর গাড়ি। মাল নামাতে না নামাতে বিক্রি। ছাঁকা নগদ টাকা ঘরে তোলে ব্যবসায়ীরা। কলকাতায় ব্যবসা করবে নগিন ঘোষ। কিস্তিবন্দি সুদে সে টাকা ধার দিচ্ছে সবাইকে। সবাইকে নয়, যাদের ছিটেফোঁটা জমি আছে আতপুরে, রেললাইনের ওপারে। সেনপাড়া থেকে যারা উচ্ছেদ হচ্ছে, যাদের নতুন ঘর তুলতে হবে। নতুন করে সংসার পাতবে, তাদের টাকা দিচ্ছে নগিন। কিস্তি আর সুদ বাকি পড়লেই, জমি দখলের প্রশ্ন নেই। এক ডাকে বিক্রি। ক্রেতা চিটেরা খাড়া আছে এক পায়ে। নগিন তাদের দোসর।

দুলেপাড়া থেকে প্রথম বাস তুলল হরি দুলে। এসে উঠল আতপুরের ঘরামিপাড়ায়। যে দিন থেকে হরি দুলে রব তুলেছিল সেনপাড়া ছেড়ে যাবার, সেইদিন থেকে কথা বন্ধ হয়েছে লখাইয়ের সঙ্গে। নায়েব ডেকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন হরি দুলেকে, বেশি জবরদস্তি করলে, জমি শুধু বে-দখলই হবে না, শুধু ফাঁকি যাবে না পাওয়ানা কড়ি। কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করে, জলে বাস করার গোঁয়ারতমি করলে, সপরিবারে ধ্বংসই শুধু হতে হবে। কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। বারাসত কোর্টের ছায়া দেখতে হয়েছে যে-রায়তকে, সে আবার কবে সুখে ঘর করেছে?

হরি দুলে যেদিন ভিটে ছাড়ল, সেইদিন গোটা দুলেপাড়া বুঝল, শেষদিন ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু হরির আশা আছে, খেসারত পাবে। বাকি সকলের তাও নেই।

হরি দুলের মা গঙ্গার ঘাটে বসে থাকে। দুলেপাড়ার দিকে তাকিয়ে, সেনবাড়ির দিকে তাকিয়ে বুড়ির বুকের মধ্যে কাঁপে থরথরিয়ে। কাউকে কাছে পেলে, ডেকে বলে ফিসফিস করে, সেই যে সায়েব এয়েছিল পেখমদিনে, পাড়া মাপজোক করে গেল, মনে আছে? মনে আছে, শ্যাম দিগরের ব্যাটা মধু খলখল করে হাসলে? তখুনি বুইছিলুম সব্বোনাশ হবে, সব্বোনাশ হবে।

.

সর্বনাশেরই করাল ছায়া পড়েছে সেনবাড়ির সর্বত্র। লখাই সেইটাই তাকিয়ে দেখছে যেন অভাবিত বিস্ময়ে ও যন্ত্রণায়। তারও বুকের মধ্যে কীসের এক দারুণ ভয় এসেছে নেমে। স্তব্ধ তটস্থ হয়ে সে দেখছে, দেওয়ানের ঋণের শোধ কেমন করে তুলছেন নায়েব মশাই।

সেন-দেওয়ান হৃদয়নাথ শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ঠাকমার দিকে। কখনও রাগ হয়, অভিমান হয় কখনও। অন্যান্য শরিকেরা যখন নায়েবের সুনজরে থেকে, সাহেব কোম্পানির প্রসাদপুষ্ট হচ্ছে, তখন তাকে দেওয়ানি মহিমা আগলাতে হচ্ছে। পুরোপুরি না হোক, হৃদয়নাথের কিছুটা মোহভঙ্গ হয়েছে, পৌষ মাসের সেইদিনই, যেদিন সাহেবরা এসেছিল। এখন সেই সাহেবরা প্রায় প্রতিদিন আসছে সেনপাড়ায়। কিন্তু সেনবাড়িতে নয়, গোঁসাইদের কাছারিবাড়িতে।

একদিন সে না বলে পারেনি বৃদ্ধা দেওয়ান-গিন্নিকে, নায়েবের সঙ্গে দেখা না করে ভাল করিনি ঠাকমা।

দেওয়ান-গিন্নি সোজা হতে পারেন না। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী করলে ভাল হত ভাই?

হৃদয়নাথও থমকে গিয়েছিলেন। গলা শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন, তার সামনে আর ঠাকুরমা নেই, প্রাচীনা দেওয়ান-পত্নী।

সে বলেছিল, নায়েবের সঙ্গে দেখা করলে, এতগুলো জমি বোধহয় বেহাত হত না। রোজ রোজ নোটিশ, রোজ ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছে ঘরের পাশ দিয়ে। তাই বলছিলুম, বিবাদ না করলেই বোধহয় ভাল হত।

–বিবাদ তো করিনি। তা বলে মান খোয়াতে তো পারিনে।

মান খোয়ানোর কী আছে। এ সব থেকেই বা কী হবে? ওই সব জমি নিয়ে তো আর চিরদিন বাস করতে পারব না। তবু কিছু টাকা পাওয়া যেত।

–কেমন করে?

–আমাদের সব শরিকেরাই তো দেখছি, একটা জমিই চারবার করে বিক্রি করছে কোম্পানির কাছে।

কথাটা যে মিথ্যে নয়, তা জানতেন সেনগিন্নি। নায়েবের বুদ্ধিতে ও শলাপরামর্শে, সবাই নানারকম দলিল দস্তাবেজ নিয়ে গিয়ে হাজির হয় সাহেবের কাছে। সে সব দলিল পরচার কোনও মা-বাপ নেই। কোম্পানি কল করতে এসে টাকা রোজগারের যেন এক নতুন কল খুলে দিয়েছে। সরকারি স্ট্যাম্পমারা কাগজ দেখালেই টাকা। কখনও ছেলে যাচ্ছে, বাপ যাচ্ছে কখনও, আত্মীয়স্বজন যাচ্ছে, ঘোমটা টেনে মায় ঘরের ঝি বউ পর্যন্ত পাঠাচ্ছে অনেকে। একই জমির উপর সকলে দখল দেখায়, টাকা আদায় করে। কোম্পানি মুক্ত হস্ত, যদিও চিৎকার চেঁচামেচি হয়। বাদ প্রতিবাদ হয়। কিন্তু উপায় নেই। সাহেবরা হাত পা বাঁধা, কেরানিবাবু আর খাজাঞ্চিমোয়রা অন্ধকারে অনেকগুলি হাত পেতে রেখেছেন। অনেকগুলি করে পকেট করেছেন তাঁরা কামিজের। সে সব পকেট সাহেবরা দেখতে পায় না। সেই পকেট ভরে উঠছে। তারা ঘাড় কাত করে সায় দিচ্ছেন, সাহেবরা মুক্ত হস্ত হয়ে করে কী?

সেনবাড়ির শরিকেরা ঘরের মেয়েদের পাঠিয়ে বেলেল্লা করেনি ঠিকই। কিন্তু যে জমি খাস জমিদারের হাতে গিয়ে উঠেছে, সেই জমিও বিক্রি করেছে তারা। পারত না, যদি নায়েবের বুদ্ধি তাদের সাহায্য করত। তারা পারে, কিন্তু হৃদয়নাথকে এ কাজে কেমন করে সম্মতি দেবেন দেওয়ান-গিন্নি। তিনি জানেন, চোখের সামনে দেখছেন, উছুপ্রবৃত্তি ছাড়া আজকের দিনে আর টাকা পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁর রক্তে এখনও দেওয়ানি মহিমার খেলা। তাঁর ভবিষ্যৎ নেই, আছে শুধু অতীত। শুধু রোমন্থন, সেই পিছনের আবর্তেই শুধু পাক খাওয়া। গোঁসাই নায়েবের ডাকে কেমন করে ছুটে যাবে তাঁর নাতি? দেওয়ান আবার হাত বাড়িয়ে কেমন করে খোশামোদ করবে একটা নায়েবকে? কেমন করে মান সম্মানহীন একটা ছিঁচকে লোকের পরামর্শে নাম ভাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলে, কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করবে?

রক্ত বুঝি নেই আর শরীরে, তাই, দারুণ উত্তেজনাতেও মুখে রক্ত ছুটে আসে না সেনগিন্নির। যেন আরও সাদা হয়ে গিয়েছিলেন। কেবল গলার কাছে গলকম্বলের মতো ঝুলেপড়া চামড়াটা নিশ্বাসের সঙ্গে দুলে দুলে উঠেছিল। দিন যে শুধু শেষ হয়ে আসছে, তাই বোঝেননি। অস্তাভার রক্তরশ্মিও বিদায় নিয়েছে সেনবাড়ি থেকে।

রাত্রি নামছে। অনাগত সেই রাত্রির অন্ধকারকে নামতে দেখছিলেন তিনি। তবু গলায় জোর না থাক, বিষ ছিল। শান্ত বিদ্রুপে বলেছিলেন, কোম্পানির টাকায় তোমার লোভ হচ্ছে বুঝি? তা বেশ ভো, তোমাকে তো আমি ধরে বেঁধে রাখিনি। যাও গোঁসাইদের কাছারিতে, বেদোকে বলছি, সঙ্গে যাবে ভেট নিয়ে দিয়ে এসো নায়েবকে।

হৃদয়নাথ আর কথা বলেননি। সেই থেকে ঠাকুরমা নাতিতে কথা বন্ধ। হৃদয়নাথ ভাবছিলেন, তার কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু বৃদ্ধা ভাবছিলেন, সব দোষ তাঁর নিজের। তিনি তো জানেন, নাতির ভবিষ্যৎ আছে। নাতবউ এ মাসেই গর্ভবতী হয়েছে। বংশবৃদ্ধি হবে। অন্যান্য শরিকের মতো করতে গেলে দেওয়ানি মহিমা থাকে না। দেওয়ানি মহিমা দেখতে গেলে, দেওয়ানি মহিমার সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে বাঁচা ছাড়া কোনও উপায় নেই। তিনি না পারেন পেছুতে, না পারেন এগোতে। পিছনে আগল ভাঙা রিক্ততা। সামনেটা আরও খারাপ, কুৎসিত আর নোংরা, আশাহীন, সন্দেহের অন্ধকারে ঢাকা। ভাগ্যের উপর দোষারোপ করে, নীরবে শয্যা নিয়েছেন তিনি। শুধু নাতবউকে বলেন, সব দেখেছি, সব পেয়েছি ভাই, এবার আমার আসল দোসরটি এলে বাঁচি।

অনভিজ্ঞা নাতবউ জিজ্ঞেস করে, সে কে মা?

 দেওয়ান-গিন্নি বলেন, আমার মরণ!

বকুলের কান্না পায়। বলে, মরবেন কেন ঠাকুমা, আমরা কার কাছে থাকব?

ঠাকমা বলেন, আমার কাছে থাকবার দিন ফুরিয়েছে তোদের। আর যে কোনও পথ দেখতে পাচ্ছিনে। এই বেলা না মরলে, বিষ খেয়ে মরতে হবে যে। চেয়ে দেখব কেমন করে এ সব।

চারদিকে শুধু ভাঙন। এই ভাঙনকে আর বেঁচে থেকে প্রত্যক্ষ করতে চান না দেওয়ান-গিন্নি।

.

লখাই দেখছে, সেনদের গঙ্গার ধারের একটি একটি করে টুকরো জমি বেদখল হচ্ছে। কিন্তু কোনও প্রতিবাদের লক্ষণ নেই। বোধহয় উপায় নেই। এতদিনে দেওয়ানবাড়িটাকে সত্যি পোডড়াবাড়ি বলে মনে হয় তার। মনে হয়, ভূতুড়ে বাড়িটায় মানুষ নেই।

বারাসতের কোর্ট থেকে সমন এসেছে লখাইয়ের। হাজিরা নোটিশ এসেছে। প্রমাণ করতে হবে ধর্মাবতারের কাছে, হকের জমি ভোগ করছে সে। কীসের হক, কার হক? কার ধর্মাবতার?

লখাই জানে, নিজের হাতে সে তার সর্বনাশ করে এসেছে। কয়েক দিন আগে, দেওয়ানদের কাছারিবাড়িতে তাকে ডাক করিয়েছিল দুই গোমস্তা মশায়। দুজন তাকে চোখ কপালে তুলে, চুপি চুপি বলেছে, গোঁসাইদেরনায়েবের কথায় যা বুঝলাম, মতলব খুব খারাপ। তোমাকে না যজিয়ে ছাড়বে না। আমাদের কাছে এসে তোমার নামের দানপত্রের দলিল দেখতে চেয়েছিল। আমরা বলেছি, তার খোঁজ করা দায়। দরকারটা বলুন। নায়েব তো বলেনি, কিন্তু আমরা তো বুঝেছি। তাই মতলবও ঠিক করে রেখেছি। নাও, তাড়াতাড়ি টিপ সই দাও দিকিনি।

কীসের টিপ সই গোমস্তা মশায়? জিজ্ঞেস করেছে লখাই। হিসাবরক্ষীরা একখণ্ড কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে, আহা, তোমাকে যে নিষ্কর দান দেয়া হয়েছিল, সেটা তো দেবোত্তর নয় হে। তোমার খাজনা এতাবৎ দেওয়ানেরা উশুল দিয়ে এসেছেন। তাতে তোমার নাম তো আলাদা করা নেই। এখন তালে গোলে কর্তাদের জমির ফেরে পড়ে তুমিও কেন হাফিজ হবে? সময় থাকতে ওটা কাগজে পত্রে আলাদা করে রেখে দিই। তারপর কার পেছুতে লাগবি, লাগ?

লখাই অবিশ্বাস করেনি। চিন্তিত হয়েছিল। বলেছিল, এতকাল কিছু হল না, গোঁসাইদের লায়েব কি দিনকে রাত করে ফেলবে?

ফেলবে হে, তাই ফেলবে। সে দিনকাল আর নেই। এখন সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।

তা বটে। হাসি পায় লখাইয়ের। সে দিনকাল আর নেই। থাকলে, দেওয়ানদের গোমস্তারা কি মিথ্যে কথা বলে টিপ সই নিতে পারত তার। কাছারিবাড়ির ওই নেড়ি দুটো? যে কোনও মুহূর্তে লখাই গিয়ে যাদের গলা টিপে নিকেশ করে দিয়ে আসতে পারে? তিক্ত ভয়াবহ হাসিতে লখাইয়ের মুখ ভয়ংকর দেখায়। কদিন ধরে চোখের সামনেই গোমস্তা দুজন সারাদিন গোঁসাইদের কাছারিবাড়িতে বসে আছে। দেখে শুনে মনে হয়, ওরা দেওয়ানদের কর্মচারী নয়। গোঁসাইদের পোষা লোক।

লখাই-এর হাসি পেয়েছিল তখনই, যখন হরি দুলে এসে অবাক হয়ে বলেছিল, হ্যাঁ লখাই, গোঁসাইদের আমিন বললে, তুমি নিকি তোমার দান পাওয়া জমি সাত সন আগে সেনেদের কাছেই বেচে দিয়ে বসে আছ?

লখাইয়ের বুকটা ধক করে উঠেছিল। বাকরোধ হয়েছিল তার। পরমুহূর্তেই বুকের ভিতরটা পুড়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল গোমস্তা দুজনের মুখ। আর তার শেষ বিশ্বাস পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সে হেসে উঠেছিল। হরি সভয়ে তাকিয়েছিল।

ধর্মাবতারের কাছে প্রমাণ। ইংরেজ আর তার পোষণ জমিদারের ধর্ম! লখাই একলা আপন মনে বসে বসে হাসে।

সে হাসি দেখে ভয় পায় সারদা। বলে, অমন থেকে থেকে কী ভাব, আর হাস?

লখাই বলে, তোমার ঠাকুর যুগলকিশোরের বিচার দেখছি সই। কোট নোটিশ দিয়েছে। রামদাস বাডুজ্জামশায়ের কাছে গিছলুম সব বলতে। ঠাকুরও বললেন, যেমন করেই হোক, দখলি জমির হক পেমাণ করতে হবে। নইলে লড়াই হবে না। তাই হাসি।

সারদা বলে, তা বেশ তো। দানপত্তরের দলিল নিয়ে যাবে বারসতে, দেখিয়ে পেমাণ করে আসবে।

লখাই বলে, তাই তো বলছিলুম গো, তোমার যুগলকিশোরের বিচার দেখছি। কার কাছে পেমাণ করব? কে আমার ধম্মের অবতার? কোম্পানির মহারানি আর তার মহারানির ম্যাজিস্টর? কিছু কি বুঝলে না সারদা, সেনেদের গোমস্তারাই আমার হাত ভেঙে দিয়েছে। যাদের জোরে বড় করে ভেঙেছে, সেই জমিদারের নায়েব আর কোম্পানি আজ দেওয়ানদেরই পিছমোড়া করে বেঁধে মারছে। একবার গিয়ে যে বুড়ি গিন্নির সামনে দাঁড়িয়ে নালিশ জানাব, সে সাহসটুকুও নেইকো। একি শোনানো যায়? শুনলে কি আর বাঁচবেন? এ সব থাক, কোটে ফোটে আর যাব না সই। তা চে চলো, তোমার যুগলকিশোরের কাছেই যাই, সেখানে গে পড়ে থাকি।

সারদার দু চোখে আলো চিকচিক করে ওঠে। সে তাই চায়। বোষ্টমি সে। পরের হাতে ঠাকুরের সেবার ভার দিয়ে তারও ভাল লাগে না। শুধু লখাই আর হীরার জন্যেই তার এখানে পড়ে থাকা। নিজের সংসারে কার না মন টানে? সে বলে, তাই চলো, সে-ই ভাল।

কিন্তু যেতে পারে না লখাই।

স্মৃতিহীন অসুস্থ শ্যামদাদা। একেবারে চুপচাপ কালী বউঠান। এদের ফেলে সে কোথায় যাবে? মধু সেই যে গিয়েছে, আজও ফেরেনি। কাকপক্ষীর মুখেও তার কোনও সংবাদ নেই।

সেই একই কথা থেকে থেকে বলে ওঠে শ্যাম, মধু এলি!

কালী যায় শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী কালীবাড়িতে। মানত করে সেখানে। মানত করে জঙ্গলপীরের দহে। কাঠুরেপাড়ার আঁটকুড়ি, বিধবা ডাইনি, গা-ময় শ্বেতী, বুড়ি বামির কাছে যায় অদৃশ্য ভবিষ্যৎ গোণাতে। বামি হারানো জিনিসের খোঁজ দিতে পারে গুণে গেঁথে। নিরুদ্দেশের বার্তা দিতে পারে মন্ত্র পড়ে। গুণতুক জানে। ভাল করতে পারে, মন্দ করতেও পারে।

কোথায় আছে কালীর মধু?

বামি বলে, জায়গার নাম বলা যায় না। দিক বলা যায়। আছে দক্ষিণে। আসবে, ফিরে আসবে। কেন? না, ছেলেটার নাকি মন মায়ের জন্যে।

কালীর চোখে জল আসে। হেই মাগো ভগবতী, ডাইনিটার কথা যেন মিথ্যে না হয়। মধুর মন টাটায় তার মায়ের জন্যে, এত সৌভাগ্য কালীর?

-কেমন আছে মধু? ভাল না মন্দ?

ভাল। ভাল আছে, ভোগে আছে। তবে কি না মায়াবিনীর গুণে মজে আছে, আসতে পারছে না। সুযোগ পেলেই চলে আসবে।

কবে? কবে সে সুযোগ আসবে?

বছর পুরলে আসবে। পোষে গেছে, তাই। যেতে নেই। বছরের ভোগান্তি কাটলে আবার আর এক পোষে আসবে।

কালীর মন মানে না। ফেরবার সময় যায় আবার আতপুরের গণেশ চক্রবর্তীর কাছে। একটু গুণে বলুন ঠাকুরমশাই, ছেলেটার বিত্তান্ত কী? চক্রবর্তী বলে, ভোরবেলা আসবে, বাসি মুখে বলব।

ঠাকুরের বাসিমুখের কথা-ই নাকি অব্যর্থ।

তা-ই যায় কালী। চক্রবর্তী বলে, ভাল আছে, পশ্চিমে আছে। কিন্তু ফিরে আসার কোনও লক্ষণ দেখিনে।

কালী দক্ষিণে তাকায়। পুব-উত্তরেও তাকায় চমকে চমকে। চমকায় কুটুম পাখির টি-হি টি-হি ডাকে, বাড়ির দিকে কোনও লোককে আসতে দেখলে। তারও অবস্থা প্রায় শ্যামের মতোই। প্রকৃতপক্ষে এখানে সংসার দেখছে সারদা। কেমন করে সারদাকে নিয়ে চলে যাবে লখাই এখান থেকে?

মাঝে মাঝে বিমর্ষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে হীরার জন্য। দিনরাত্রি আনচান করে ফেরে সারদাও। কালী একলা একলাই যায় তেসুতিকলের মাঠে। বিনু মুচিনির তাড়ির আড্ডায়। হীরা তাড়ি খায় না। গোলাম খায়। গোলামের কাছে যায় হীরা।

কালী তেসুতিকলের কারখানা ঘরে ঢুকে যায়। পাট ঘরের মেয়েরা ডেকে কথা বলে, যেন গাঁয়ের পুকুরঘাটে কথা বলে বাসন মাজতে মাজতে। বয়লার ঘরে যায় হীরাকে খুঁজতে। ওয়াল্টার চিনতে পারে না। মজুরনি ভেবে ধমকায় কালীকে, হেই মাগিটা, আপনা কাম পাকড়ো, ঘুরাফিরি কেননা করছ?

কালী এক গলা ঘোমটা দিয়ে পাশ কাটায়। মনে মনে বলে, আ মলো মুখপোড়া।

তবু ওয়াল্টার সাহেবকে সবাই অলটার বলে জানে। লোকটার নাকি স্বভাব চরিত্র ভাল। মেয়েমানুষের দরকার হলে ফরাসডাঙার গঞ্জে যায়। কলকাতায় যায়, বা নিয়ে আসে। কারখানার মেয়েমানুষ ধরে টানাটানি করে না। আর একটি সাহেব আছে, বয়সে ছোকরা। তার বড় নোলা। চলতে ফিরতে মেয়েদের গায়ে হাত না দিতে পারলে তার ভাল লাগে না।

সে মুখপোড়ার সামনেও কালীকে পড়তে হয়। তবে মানুষ বুঝে চাল। কালীর সঙ্গে ও সব মশকরা চলে না। তা ছাড়া বয়সও তো হয়েছে।

কিন্তু কালীর মনটা থমকে যায় বারে বারে। ভাবে, জমিতে সারা বছরের খাবার জোটে না। এবার তো আরও ভরাডুবি। মধু কবে আসবে, তাতে গুণিনদেরও মতোভেদ। মধুর বাপকে কালী খাওয়াবে কেমন করে? তার চেয়ে কলে কাজ নিলে কেমন হয়? কত লোকে নিয়েছে। কত মেয়েমানুষ, রাড়ি বুড়ি গুঁড়ি। সবাই আর কিছু অধরা নয়, অধরার ছেলের বউ নয়। পোষবার কেউ না থাকলে, নিজেকে নিজে ছাড়া কে পুষবে?

ভাবে, আবার ভুলে যায়। লখাই ঠাকুরপো থাকতে তা কোনওদিন হবে না। কিন্তু মধু? গালে হাত দিয়ে বসে থাকে আবার কালী। মনে মনে বলে, ওরে মরণ মধু! তুই মধু আমার মরণ, সবার মরণ।

লখাই বুঝতে পারে, কোথায় বউঠানের যাতনা। না, কোথায় যাবে সে এই সব ফেলে? যেতে হলে সবাইকে নিয়ে যেতে হবে। মৃত্যু লখাইয়ের অনেকদিন আগে হয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহ যে দিন ইংরেজের কামানের গোলায় চুরমার হয়েছে, সেই দিনই ঘটেছে তার মৃত্যু। কিন্তু একটি অতৃপ্ত আত্মা আজও প্রেতের মতো চেপে আছে তার ঘাড়ে। এই দেহের পিঞ্জর নিশ্চিহ্ন না হলে সে আত্মা ধ্বংস হবে না।

তার ইতিহাস বোধ নেই। আজকের দেশ কাল-পাত্র, তার নিত্য নতুন অদল বদল, লখাইয়ের বুদ্ধির অগম্য। তার বিশ্বাস, তার দেশের রাজা বেইমান। তার পুঁজিপাটা বলতে আছে বিস্ময় আর ক্রোধ। ক্রোধও আর নেই। অক্ষম ও অসহায় চোখের জলে কবেই সে ক্রোধ নিভে গিয়েছে। এখন শুধু এই ভাঙন দেখার জন্যেই তার বাঁচা। তার বিচার বুদ্ধিহীন মন নিয়ে যে ভাঙনকে সে দেখছে ভগবানের অভিশাপের মতো অনিবার্য।

সে দেখেছে, রামদাস বাঁড়ুজ্জে মশাই শান্ত। তাঁর ফরাসডাঙার বসিন্ধু নীরব। আগেকার মতো আর মাতামাতি নেই সেই কাগজ নিয়ে। শোনা যায়, এখন ধর্ম বিষয়ে খুব বেশি লেখালেখি করেন কাগজে। পিরিলি মজুমদার আর চক্রবর্তীদের উপর তাঁর রাগ। সনাতন ধর্ম নিয়ে মেতেছেন।

.

৩৪.

সেনপাড়ার পথে পথে ঘোরে লখাই। সেনপাড়া নয়। সাহেবরা বলে আজকাল জগদ্দল। তাই লোকেও বলে আজকাল জগদ্দল। নতুন দলিল দস্তাবেজে লেখা হয় মোং জগদ্দল-সেনপাড়া। জগদ্দল-মুসলমানপাড়া। জগদ্দল। জগদ্দল।

কেন এই নাম? কোন জায়গাটার নাম জগদ্দল।

কেউ বলতে পারে না। হরির মা কালো দুলেনি বলে, গঙ্গার ঘাটে বসে বসে। মস্ত এক পাতর ছেল এই ঘাটে। গঙ্গার জলে, টানে টানে সেই পাতর এয়েছেল। কোত্থেকে এয়েছেল, তা জানিনেকো। তাপর, সে পাতর ঠেকে গেছল এ ঘাটে। না বাপু, মিছে কেন বলব, সে আমি চোখে দেখিনিকো। শুনিচি। শুনিচি, সে পাতরে ঠাকুর ছেল, ধম্মঠাকুর। সে পাতর নিকি সাক্ষাৎ ধম্ম ছেল। ভৈরবও নিকি থাকতেন সেই পাতরে। তা মিছে বলব না, একখানা পতরের মুত্তি পাওয়া গেছল একবার ঘাটে। মজুমদারের কত্তারা নে গেছলেন সেই মুত্তি, তাপরে আর জানিনে।

এখনও বলে কালো দুলেনি, তা সাখক নাম হয়েছে গো দেশটার। কী? না জগদ্দল! বুকে যেন চেয়ে বসেছে গো।

বুড়ি আতপুরের ঘরামিপাড়ায় থাকতে পারে না। রাত পোহালেই চলে আসে দুলেপাড়ায়। মার জন্য হরির যেন আর ভাবনা নেই। সেও কেমন এক রকম হয়ে গিয়েছে। বয়স হয়েছে। তার উপরে, জমিদারের দৌরাত্ম্য, বাপ পিতামহের ভিটে ছাড়তে হল।

.

আর একটা বড় দাগা দিয়েছে অখিল। ভাইপো বউটিকে নিয়ে চলে গেছে কাঁকড়ায়। মতির যে ছেলে বউ রেখে ঘর ছেড়েছিল, সেই। বড় ভাল বউ ছিল। এতদিন ধরে কোনও আকথা কুকথা শোনা যায়নি। সাচ্চা মেয়ে, বাড়ির বার হত না। এসেছিল আট বছর বয়সে, ষোলো বছর ঘর করেছে এক রকম ভাবে। হরি তার জ্যাঠাশ্বশুর। চিরকালই চাষবাসের দুঃখ ছিল না। একলা পেটের জন্যে সে বউ কখনও তেসুতিকলে কামাতে যাবার কথা ভাবেনি।

কিন্তু যাকে বলে নটঘট তা-ই ঘটে গেল অখিলের সঙ্গে। এ যে কেমন করে ঘটে তা জানে না। দুজনের কারুরই আগে থেকে দুর্নাম ছিল না। কলঙ্ক অঙ্গের ভুষণ না হোক, দুলেনি মেয়ে বউয়েরা কোনও কালেই মনের উপরে সমাজকে বসায়নি। তার জন্য কাটাকাটি হয়, মারামারি হয়, মরতেও হয়। হরির ভাইপো ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর, আশেপাশে পুরুষ অনেক ছিল। ফোঁসলানি, হাতছানি কিছু কম ছিল না। কিন্তু যায়নি।

সামলাতে পারল না অখিলকে দেখে। মন পুড়ল যে! জোয়ান পুরুষ, চোর নয়, জোচ্চোর নয়, জমিদারের সঙ্গে বিবাদ করে জেল খেটে এল। এসে দেখল, বউ পালিয়েছে অপরের কাছে। দুঃখ ধান্দা করে থাকতে পারত হয়তো স্বামীর জন্য। কিন্তু আশা হারালে মানুষের আর কী থাকে? অখিলের বউ আশা হারিয়েছিল। তাই চলে গিয়েছে।

কিন্তু অখিলকে দেখে মরল খাঁটি দুলে বউটা। মরেছেও খাঁটি খাঁটি। সেখানেও কোনও সংশয় রাখেনি। জ্যাঠাশ্বশুরের মুনিষ বটে, তবু গাঁয়ের লোক তো! স্বজাতের মানুষ, তাকে কখনও মুনিষ ভাবতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে কবে একদিন দুটি ব্যর্থ প্রাণের মিলন হয়েছে।

কালো দুলেনি বুড়ি হয়েছে, ছানি পড়েছে চোখে। তবু এখনও বাজপাখির নজর। হঠাৎ একদিন ভয়ে ডুকরে উঠে জিজ্ঞেস করেছে, হ্যাঁ লা লাতবউ, এদিকে আয় দিনি।

-কেন?

বুড়ি চোখ কুঁচকে, নজর উঁচিয়ে, গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, আ মরণ, পেট উঁচু দেখাচ্ছে কেন তোর? চোখের কোল বসা, গা গমগম লাগে।

বুকের কাপড় সরিয়ে বলেছে, তাই তো বলি, বুক জোড়া ভার ভার, বোঁটায় কালি লেগেছে। এতদিন তো টের পাইনি?

বউ বলেছে, তা না পেলে কী করব বলল। যেচে তো আর বলতে পারিনে।

আ মরণ মুখপুড়ি, আইঢাই করে, কাতরে বমি-সমি করতেও তো দেখিনি। কতদিন?

 ছ মাস।

 –ছ মাস? হেই গো মা ভগমতী। কে? কার?

 –যার হতে পারে, তারই। আর তোমাদের বাড়ি আছে কে?

–অখলে?

হুঁ।

সোজা কথা, সহজ করেই বলেছে।

সেই গর্ভবতী বউ নিয়ে চলে গিয়েছে অখিল কাঁকড়ায়; কাজ নিয়েছে গলায় দড়ের কলে। জার্ডিনস্কিনারের কাঁকড়ার কারখানাকে সবাই গলায় দড়ের কলই বলে। ওখানে একজন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল একটা গাছে। আগে বলত লোকে গলায় দড়ের ঘাট। এখন বলে কল। কারখানা প্রায় শেষ, মেশিনপত্র বসছে। লোক ডাকাডাকি করছে কোম্পানি।

অখিল সেইখানে গিয়েছে।

 সেনপাড়ার চেয়ে আতপুরেই যা একটু আলোচনা হয়েছে অখিলের ব্যাপার নিয়ে।

ঘরামিপাড়ায়, কয়েক ঘর ঘরামি আগে থেকেই ছিল। বাগদিও ছিল কয়েক ঘর। আরও কয়েক ঘর আসছে। পুবের মাঠ থেকে, রেল লাইনের ধার থেকে, গোরুর গাড়ি বোঝাই মাটি আসছে। উঁচু পোতা ঘর উঠেছে নতুন নতুন।

গঙ্গার ঘাটে ঘাটে, নাবি-দেশ দক্ষিণ থেকে মাঝিরা এ সময়ে দল বেঁধে আসে নৌকা বোঝাই গোলপাতা নিয়ে। নাম গোলপাতা। কিন্তু পাতা লম্বা লম্বা, খড়ের মতই। তবে খড়ের চেয়ে তার শক্ত একটু আঁশ আছে, তাই আয় বেশি। নোনা জলের বড় বড় ঘাস। সুন্দরবনের নদীর কোল ঘেঁষে গোলপাতা হোগলার অরণ্য। বাঘের রাজত্ব। সেইখান থেকে গোলপাতা নিয়ে আসে মাঝিরা। বর্ষার আগে পর্যন্ত তাদের আনাগোনা, যখন গৃহস্থেরা ঘর সারায়, নতুন ঘর তোলে। আর তাবৎ চব্বিশ পরগনা-যশোরের মানুষেরা পুরু করে গোলপাতায় ঘর ছাইতে ভালবাসে।

মাঝিরা সংবাদও রাখে। একজন নৌকা খালি করে ফেরার পথে একজনকে সংবাদ দেয়, আতপুরের ঘাটে যাও, পাতার খোঁজ করছে লোকে।

আতপুরের ঘাটে এবার গোলপাতার অনেক নৌকা এল। ঘরামিপাড়ায় নতুন ঘর উঠছে। সেনপাড়া, দুলে বাগদিপাড়ার বাগদিরাই বেশি আসছে এখানে। তাই এর মধ্যেই সবাই বলতে আরম্ভ করেছে, নয়া বাগদিপাড়া।

নয়া বাগদিপাড়ায় বাগদি আর ঘরামিরা ঘর বাঁধতে বাঁধতে, মেয়েরা জোড়া-পুকুরের ঘাটে বসে বাসন মাজতে মাজতে আলোচনা করল, অখিলের চলে যাবার ব্যাপার নিয়ে। বললে, এ সব আপদ হরি দুলে সেনপাড়ায় সেরে এলেই পারত। আতপুরের কুল মজানে কেন বাপু। পরপুরুষের সঙ্গে পালানো নাকি বড় ছোঁয়াচে রোগের মতো। দেখাদেখি আবার এখন কে কী করে বসে তাই দেখ।

আতপুর, সেনপাড়া, খিরপাড়া দুলে বাগদিপাড়ায় এ নিয়ে নানান কথা হল। হরি দুলে একটা মোড়ল মানুষ, তাই। নইলে এত কথাও হত না। কিন্তু হরি দুলে কোন্ ছার। দেওয়ানি গেল রসাতল। আতপুরের চাতরার রাজার রাজবাড়ির ইটে ধরছে নোনা। শ্যামনগরের রাজা পিরিলি ঠাকুরদের দবদবা গিয়ে কোণঠাসা হচ্ছে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটে। তাদের নিয়েই কারুর মাথাব্যথা নেই আর।

কয়েক ঘর সদগোপ এখন উঠতির মুখে। চিটেরা নাকি খুলনার দিকেও নতুন মৌজা কেনার অভিযান চালিয়েছে। সুরেরা সুন্দরবনের বাদা অঞ্চলে বন্দোবস্ত নিচ্ছে। সেখানে বন কেটে নতুন বসতি চলছে। নোনা জলের বুকে ভেড়ি দিয়ে সোনার ফসল ফলাবার নতুন স্বপ্ন দেখা দিয়েছে সেখানে।

আর এখনও রং আছে আতপুরের তরফদারদের। দেওয়ান যায়, রাজা যায়, তরফদার এখনও গোঁফে আতর দিয়ে, হাওদায় চড়ে বেড়ায়। কয়েক পুরুষের নবাবি খেতাবের রেশ এখনও আছে। এখনও তলানি চেটেপুটে, আয়ানের বংশধরেরা তরফদারি করে।

বাগদিপাড়ায় পশ্চিমে তরফদারদের বাড়ি। একতলা বাড়ি। বাড়ির দক্ষিণে সরোবর, উত্তরে আলাদা ঠাকুরবাড়ি। ঠাকুরবাড়িতে এখনও ঠাকুর আছেন রাধাকৃষ্ণ। আর সরোবরের ধারে কদম গাছে শেকল দিয়ে বাঁধা আছে রম্ভা। তরফদারদের হাতি।

রাজা মরে, দেওয়ান মরে, গোপসুত তরফদার খুব খুশি। তরফদার মরে না। কোথায় সাহেব এল, কোথায় কোম্পানি এল, কোথায় উচ্ছেদ হল, কোথায় নিলাম হল, সে খবর রাখে না তরফদার। সেনপাড়ার কোন হালদার এলাহাবাদে গিয়ে সরকারের কালেক্টর হল, মজুমদারদের কে ম্যাজিস্ট্রেট হল, সে খবর জানতে চায় না তরফদার। তরফদারির রেস্তো আসে পুব অঞ্চল থেকে। কিছু আসে উত্তর অঞ্চল থেকে। খতিয়ানের হিসাব সামনে ধরে দিলে, তরফদার জুতো পেটা করে। লেখাপড়ার ধার দিয়ে যায়নি কোনওকালে। ক অক্ষর গোমাংস। হিসাবের দলিল দস্তাবেজ তার সামনে ধরলে সেটা ঠাট্টারই সামিল হয়। ঠাট্টা করলে, জবাবও সেই রকম। সুতরাং কোন মৌজা বাঁধা পড়ছে, কোন পরগনা বিক্রি হচ্ছে, ও সব হিসাবের ব্যাপারে তরফদার নেই।

বাপের খেতাব আছে, বাপের আমলের যুবতী হস্তিনী রম্ভা আছে, বাটা ভরা সন্দেশ আছে, কুলুঙ্গিতে ফরাসডাঙার মদ আছে, রাত্রি হলেই নতুন মেয়েমানুষ আসার প্রতিশ্রুতি আছে কিংবা ফরাসডাঙার গঞ্জে সারা রাত ফুর্তি করবার জন্যে টাকা আছে ঘরে, গোটা কয়েক যুবতী ঝি আছে। নিদেন শিরিষ সরকারের রাঁড় মুক্তর মতো মেয়ে আছে আশেপাশে। পুণ্যি করার জন্যে বাড়িসংলগ্ন ঠাকুরবাড়ি আছে। কাছে বামুনবাড়ি আছে, পাদোদক খেতে পাবার আশা আছে।

তরফদারি মরে কেমন করে?

তবু ভিতরে ভিতরে বড় ত্রাস। সিংহ শিকার ধরে, খেতে খেতে যখন টের পায় দূর আকাশে বনাগ্নির লেলিহান শিখা দেখা দিয়েছে, সেও তাড়াতাড়ি শিকার শেষ করে। তরফদারও সেইরকম অনুভব করেছে অন্তরে অন্তরে, দাবানলের ধোঁয়ার রেশ দেখা দিয়েছে। আগেভাগে সেরে নিতে হবে সব। দুর্ভিক্ষ পীড়িতের মতো, তলানিটুকুও চেটেপুটে তাড়াতাড়ি সাবাড় না করলে, জীবনে সেটুকুও ফাঁকি থেকে যাবে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। অনেকদিনের সাধ, ছোট কালে মায়ের বুকে থাকতে থাকতে বাপের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে স্বপ্ন দেখেছে, তরফদার হবে, হাওদায় চেপে বেড়াবে, মেয়েমানুষ রাখবে, ফুর্তি করবে।

কিন্তু ভাঁড়ার তলানি দেখে চোখ ছানাবড়া। পূর্বপুরুষেরা প্রায় নিকেশ করে রেখে গেছে। যেটুকু আছে, সেটুকু নিয়েও টানাহেঁচড়া। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি। ফুরিয়ে বুঝি যায়, নিঃশেষ বুঝি হয়। একে তেল নেই, তায় বড় বাতাস। প্রদীপ নিভু নিভু করে।

সুতরাং তরফদার কোনওদিকে চেয়েও দেখে না। খেয়াল নেই, জোয়ারের মুখেই রক্তে ভাটা লেগেছে। তার আলোড়ন বেশি, শব্দ বেশি। রক্তে পচন ধরেছে, তাই তার জ্বালা বেশি, গাঁজলা উঠছে।

জগদ্দল আতপুরের চাষি-জেলে-ছুতোররা অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে তরফদারের তরফদারি। উঠতি সদগোপরা বাজার মাঠ কিনে, নিজেদের জমিদার বলছে আর তরফদারকে দেখে ঠোঁট মুচকে হাসছে। চিটেরা কাছারিবাড়ি ফাঁদছে আতপুরে। তরফদারকে দেখে প্যাঁচ করে থুথু ফেলছে, দাঁতে দাঁত চেপে হাসছে আড়ালে।

নগিন ওত পেতে আছে। তরফদারের কানের কাছে মহারানিমার্কা রুপোর টাকা বাজিয়ে ফিরছে ঝনঝন্ করে। যেন ময়ূরীকে, ফাঁদ পাতছে, যদি ধরা দেয়।

তরফদার মনে মনে বলে, লাগ ভেলকি লাগ। নগিন ঘোষ ব্যাটা মহাজনি দেখাচ্ছে আমাকে।

বামুন কায়েত সদগোপ, যারা ইংরেজি শিখছে, সরকারি কিংবা কলকাতার মার্চেন্ট অফিসে কাজ করছে, তারা এ সব নিচু জাতের মূর্খদের দেখে জাকুটি হানছে।

রম্ভার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে শুড় বেয়ে। পেট পুরে খাবার নেই, কিন্তু হাওদার বোঝা ঠিক আছে। রাস্তা দিয়ে চলার সময় যখন তার গলার ঘণ্টা বাজে ঠুং ঠুং করে, তখন রাজবাড়ির বৃদ্ধা হস্তিনী পবনপেয়ারি আর লক্ষ্মীপেয়ারি গা দুলিয়ে-দুলিয়ে তাদের গলার ঘণ্টার শব্দ করে সাড়া দেয়। বাতাসে বাতাসে শুড় দিয়ে শুঁকে শুঁকে নিঃশব্দে কথা বলে তারা।

বলে, কোন অরণ্যের প্রাগৈতিহাসিক যুগের বংশধর তারা! হিমালয়ের পাদদেশের তরাইয়ের কোন অঞ্চল থেকে তাদের এই সভ্যতার আলোয় ধরে আনা হয়েছে? প্রাগৈতিহাসিক পশুর বংশধর তারা, এ কোন ইতিহাসের বোঝা বহন করছে? এই লক্ষ্মীপেয়ারি কিংবা পবনপেয়ারির সঙ্গে কি রম্ভার কোনও সম্পর্ক ছিল? উত্তর তরাইয়ের কোনও গহন অরণ্যের নিরালা ছায়ায়, রম্ভার মায়ের সঙ্গে কি পবনপেয়ারিদের সখী পাতাপাতি হত? কেমন দেখতে ছিল তরাইয়ের স্রোতস্বিনী নদী? কত মিষ্টি ছিল সেই অরণ্যের কচি কচি পাতা? এখনও কি সেখানে তাদের বংশধরেরা বিচরণ করে? লড়াই। করে প্রেমের জন্য? যূথবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে?

তারা জানে না। একশো বছর না পুরতেই তাদের গায়ের চামড়া গেছে বুড়ো মানুষের মতো কুঁচকে। গায়ে তাদের মাংসাশী মানুষের গন্ধ। তারাও দেখছে, গঙ্গা ছোট হয়ে আসছে। রাজা ফতুর হচ্ছে। দেওয়ান চাকুরে হচ্ছে। তরফদার তলানি ওগরাচ্ছে।

শুধু এতবড় দেহে তাদের ছোট দুটি চোখ, সেই চোখে জল গড়ায় কি না, কেউ দেখতে পায় না। তাদের এতবড় জঠর কতটুকু ভরে, কেউ খবর রাখে না। বয়সের ভারে তারাও নুজ হচ্ছে, বাতে ধরছে। পেশি ও হাড়ের কোনও শ্রম নেই, অক্ষম মানুষের মতো তারাও বাতিলের পর্যায়ে।

তাদের সারা গায়ে বিধ্বস্ত ইতিহাসের চিহ্ন। নয়া ইতিহাসের লিখন তাদের অন্তরে ক্ষুধা ও মৃত্যুর মতো প্রতীক্ষা করছে।

গোপসুত তরফদার হাওদায় চেপে বেড়াচ্ছে গান করে করে। রম্ভাবতীর দাঁত কাটা কষে লালা আবর্তিত হয়। ক্ষুধা, বড় ক্ষুধা।

রাজা–দেওয়ান তরফদারের দেশ। দূর জায়গা থেকে লোকে আসে এখানে হাতি দেখতে। সেই মানুষরা আর নেই। এখন উঠতি সদ্গােপেদের গোঁফে চাড়া।

কিন্তু তাদেরও কানে বড় বেশি শব্দ করে বাজছে কাঁকড়ার জার্ডিনস্কিনারের কারখানা ইমারতের ঢেউটিনের ঝনঝনা। ডান্ডিওয়ালা স্কচের বিদেশি চিৎকার।

.

৩৫.

গারুলিয়ার টমাস ডাফ কোম্পানির এক্কা ছুটেছে আতপুরের দিকে। গাড়িটি যদিও টমাস ডাফ কোম্পানির, লোকে জানে, ওটা ওয়ালিকেরই সম্পত্তি। যেমন নাকি, কোম্পানি তাদের কারখানার নাম দিয়েছে শ্যামনগর জুট মিলস, কিন্তু কারখানা হয়েছে গারুলিয়ার গঙ্গার ধারে। লোক বলে, গারুলিয়ার চটকল।

সেই গাড়িটিই, গদি আঁটা আসনের পিছনে যার রুপোর মিনে করা পাতে মহারানি ভিক্টোরিয়ার মূর্তি আঁকা রয়েছে। রাজভক্ত প্রজা, রানির ছবি মাথায় বহন করতে ভালবাসে। রোদ ঠিকরে পড়া বাদামি রঙের দানবতুল্য ঘোড়া দেখলেই লোকে বুঝতে পারে, অলিক সাহেবের গাড়ি আসছে। অলিকের সঙ্গে আজ আবার সেই নতুন সাহেব। অর্থাৎ লিটলজন।

ওয়ালিকের মতো লিটলজনের মুখ এখনও তামাটে হয়নি। তার চামড়া এখনও ভারতীয় রোদে ট্যান হয়নি। তাই তার শোলা হ্যাট কপাল অবধি টেনে নামানো। চোখ দেখা যায় কি না যায়। এদেশের রোদের প্রতি একটা অলৌকিক ভয় ও ঘৃণা সে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিশ্চিতভাবেই সে জানে, এ রোদের মধ্যে কোনও ইভিল স্পিরিট আছে। দেহে স্পর্শমাত্র সহস্র ছুঁচের জ্বালা অনুভূত হয়। পোশাক ভিজতে থাকে, আর পিপাসা পায় ঘন ঘন।

তা ছাড়া, একটা আভিজাত্য তো আছেই। স্কটল্যান্ডের শক্ত পাথরের দেশ থেকে সে আসেনি। এই গাদাখানেক স্কচের ভিড়ে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য একমাত্র সেই বহন করছে। লিটলজনের মতে, সেটা বোধহয় ক্লাইভ হেস্টিংসের ঐতিহ্য। ডান্ডির কোনও দাড়িওয়ালা গোঁয়ারগোবিন্দ অশিক্ষিত স্কচ ওভারসিয়ার সে নয়। যদিও ক্লাইভ হেস্টিংসের আমল একশো বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু লিটলজন বিংশ শতাব্দীর দরজায় কড়া নাড়া ইংলিশম্যান। ইংল্যান্ডের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হওয়ার আশা নিয়ে সে এসেছে। ডান্ডির বেগ-ডানলপের ম্যানেজিং এজেন্টের কর্তার সঙ্গে, মাতুলবংশের ছিটেফোঁটা সম্পর্কের সূত্র ধরে তার ভারত আগমন। তা বলে মাতুলবংশের সূত্র ধরে, পাহাড়ি সভ্যতা তার ধাতস্থ হবে না কোনওদিন।

ডানিয়েলের ইন্ডিয়ান ল্যান্ডস্কেপ দেখে, ভারতবর্ষে আসার স্বপ্ন সে দেখেছিল। কিন্তু সে ভারতবর্ষ এই চব্বিশ পরগনার শ্যামনগর-আতপুর-জগদ্দল নয়। মুঘল এম্পায়ারের ভগ্নাবশেষ, লন্ডন নগরীর মতো মুর্শিদাবাদ, নবাব বাদশাদের পোষা হস্তীযুথ, বুলবুলির লড়াই আর মধ্য এশিয়ার ভারতবাসিনী রূপসি ফুলকুমারীদের বাইজিনাচ তার মনকে ঘিরেছিল।

কিন্তু এখানে হোম-পিপল বলতে স্কচ, কাজ বলতে জুট, বাদবাকি অসভ্য পশু জাতীয় কালো কালো কতগুলি মানুষ জাতীয় প্রাণী।

কিন্তু টাকা আছে। ধৈর্য ধরে লিটলজন যদি তার ইংলিশ ইনস্টিংক্ট নিয়ে থাকতে পারে, লন্ডনের লর্ড স্ট্রিটের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কে তার টাকা জমবে। ইংলন্ডের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে চিরদিন লর্ড স্ট্রিটে যাবার স্বপ্ন দেখে। লিটলজনও দেখছে। লিটলজন লম্বার্ড স্ট্রিটে যাবে। এ কালের বাকিংহাম প্যালেস নয়, লর্ড স্ট্রিটের ইমারতে, লোহার সিন্দুকে আধুনিক রাজপুত্রের মনভোমরা থাকে। লিটলজন লর্ড স্ট্রিটে যাবে। যেখানে একদিন কুড়ি পাউন্ডের নোট থাক দিয়ে জমা থাকত, নেবার লোক ছিল না, আজ সেখানে পঞ্চাশ আর একশো আর হাজার পাউন্ডের করকরে নোটের খসখসানি শুনে কান গরম হয়ে ওঠে।

গোটা ব্রিটিশ এম্পায়ারের সোনা গিয়ে জমে লম্বার্ড স্ট্রিটে।

লিটলজন লর্ড স্ট্রিটে যাবে।

কিন্তু সে ওয়ালিক হতে পারবে না। জগদ্দলের স্পিনিং মিলের ওয়াল্টার হতে পারবে না সে। অর্থাৎ সে অলিক কিংবা পাগলাসাহেব হতে পারবে না। গায়ে হাত দিয়ে কালো নেটিভকে আদর সে করতে পারবে না, বাড়ি গিয়ে মিস্তিরির খোশামোদ করতে পারবে না। কান ধরে, থাপ্পড় মেরে শাসনও করতে চায় না সে।

তাই, এখন এই সেনপাড়া-জগদ্দলে যাওয়াটাও তার মনঃপুত নয়। যদিও সেটা নেটিভদের কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু যে জন্যে যেতে হচ্ছে, সেই কারণটা লিটলজনের মেজাজের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খেতে চাইছে না।

কিন্তু বেগ-ডানলপের নতুন পত্তন হতে যাচ্ছে। কোম্পানি সকলের সঙ্গে সখ্যতা চায়। টমাস ডাফের আতিথ্য নিয়েছে সে। ফোর্ট গ্লাস্টারের স্পিরিট অব বিজনেসের সঙ্গে মিষ্টি মুখেই কথা বলতে হবে তাকে। নিজেকে গিয়েই আলাপ করতে হবে। কারণ, সেটা পলিসি অব বিজনেস।

ফোর্ট গ্লাস্টারের মি. রিচার্ড ম্যাকলিস্টার বাউরিয়া থেকে আসছে তাদের জগদ্দলের থ্রি প্লাই স্পিনিং কারখানায়। ওয়াল্টার তাদের নিমন্ত্রণ করেছে। তাই ওয়ালিকের সঙ্গী হতে হয়েছে লিটলজনকে।

তা ছাড়া আরও একজন আসতে পারে। পুরনো বোর্নিও কোম্পানির, অর্থাৎ চটকলের ডাণ্ডি-এজেন্ট জর্জ হেডারসন অ্যান্ড কোম্পানিরও একজন আসতে পারে। বরানগর জুট মিলের লোক সে। পাইওনিয়ার অব ইন্ডিয়ান জুট ইন্ডাস্ট্রিজ বলা হয় বরানগর মিলের প্রতিষ্ঠাতা কর্মীদের।

ওয়ালিক শিস দিচ্ছে। শিস দিয়ে গান করছে আর হাতের চাবুকও শিস্ দিয়ে উঠছে থেকে থেকে। হাফ প্যান্ট আর শর্ট জামা তার গায়ে। হাত পায়ের অধিকাংশই উন্মুক্ত। বুকেও বোম আঁটা নেই। তামাটে শরীরে মোটা মোটা নীল শিরা উপশিরা স্ফীত হয়ে উঠেছে। পাংশু লোম দেখা যাচ্ছে। মাথায় ঘাসের টুপি। শক্ত স্কচ শরীরে, লোকটার শ্রমের চিহ্ন পরিস্ফুট।

সে হিসেবে লিটলজনের টাইয়ের বন্ধনীসহ প্রায় আপাদমস্তক ঢাকা। সে ভেবে পাচ্ছিল না, মে মাসে ভারতের এই কুৎসিত রৌদ্রে, কী সুখে শিস দিচ্ছে ওয়ালিক। এটা কি স্কচ ইনস্টিংক্ট? না, নেটিভ অসভ্যতা আয়ত্তকরণ! ওয়ালিকের ঠোঁটের কোণে ঠিক তার চাবুকের মতোই একটি অস্পষ্ট হাসির ঝিলিক চিকচিক করে উঠছে। বিস্ফারিত ঠোঁটে, দাঁত বের করে সে শিস দিচ্ছে। এ শিস্ দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরোয়, ছুঁচোলো ঠোঁটের ছিদ্র দিয়ে নয়। শিস্ দিচ্ছে ওয়ালিক, কিন্তু হাসিটুকু একেবারে অস্পষ্ট নেই তাতে। তার বাদামি চোখের কটা মণি দিয়ে আড়ে আড়ে দেখে নিচ্ছে লিটলজনকে। আর লিটলজনের মনের কথাগুলি সে পরিষ্কার পড়ে নিচ্ছে তার বিকৃত কোঁচকানো মুখ থেকে। তাই হাসি পাচ্ছে এই খাঁটি ইংলিশম্যানের বিরক্তি ও রাগ দেখে। উনবিংশ শতাব্দীর নবম দশকে এসেছে লিটলজন। নেটিভদের বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘায়ের মানে এখনও শেখেনি সে।

ওয়ালিক লক্ষ করেছে, প্রথম আসার পর যে প্রসন্নতা ছিল লিটলজনের, ক্রমেই তা হারিয়ে যাচ্ছে, রুক্ষ হয়ে উঠছে ক্রমেই। নেটিভদের সঙ্গে তার ব্যবহার এত খারাপ,সকলের চোখেই কটু লাগে। একটা কুকুরকে বোধহয় মানুষ আর একটু করুণার চোখে দ্যাখে। যদিও টমাস ডাফের ডাডনির নেটিভ আয়ার সঙ্গে ইতিমধ্যেই শুয়েছে সে। আয়াটি কলকাতা থেকে আমদানি। সাউথ ইন্ডিয়ার রবার প্লান্টার গর্ডনের সঙ্গে মেয়েটি এসেছিল কলকাতায়। দীর্ঘদেহ, স্বাস্থ্যবতী কালো চোখ মেয়েটি প্রায় ফরসা। ধর্মে খ্রিস্টান। জন্মের পর থেকেই প্রায় বিদেশিদের কাছে মানুষ। কাজকর্ম জানে বেশ ভাল-ই। গর্ডন হঠাৎ মারা যায়। মিসেস গর্ডন হোমে চলে যাবার সময় আয়াটিকে মিসেস ডানিকে দিয়ে যান।

একটি চালু মেয়ে পেয়ে, মিসেস ডাডনি হাঁফ ছেড়েছিল। কিন্তু মেয়েটি গর্ভবতী হলে সমূহ বিপদ। লিটলজন সেটা বিচার করেনি। খানসামাকে দিয়ে ডাকিয়ে, মেয়েটিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রেপ করেছে সে। মিসেস ডানির কাছে মেয়েটি সব কথাই ফাঁস করেছে।

লিটলজন মেয়েটিকে ঘৃণা করে। কিন্তু পেটে খাঁটি ইংলিশ পানীয় পড়লে, মেয়েটিকে তার চাই-ই। চাই। এটাও বোধহয় লিটলজনের ইংলিশ ইনস্টিংক্ট। আর ব্যাপারটা এখন খোলা চোখেও না দেখার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে কারখানা কুঠি-মহলে। কারণ, ডানির বিশ্বাস, ইট নীডস। অর্থাৎ লিটলজনের এটা দরকার। সকলেরই দরকার। সুতরাং চম্পা, সেই আয়াটি, তাকে লিটলজন যে-কোনও সময়েই চাইতে পারে। চম্পাও যেতে বাধ্য থাকবে।

ঘটনা নতুন নয়। অনেকেই নেটিভ মেয়েদের সঙ্গে ইনভলবড। এদেশে চটকল শুরু থেকে অনেকেই নেটিভ মেয়েদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে নানানভাবে। মেয়েদের ইচ্ছে থাক বা না থাক। অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। কিন্তু লিটলজনের ব্যাপারটা আলাদা।

চম্পা কাজ করে ডাডনির, দরকার হলে শুতে যায় লিটলজনের কাছে।

অথচ চম্পা একদিন লিটলজনের দিকে তাকিয়ে দিনের বেলা হেসেছিল বলে, সে হাতের ছড়ি দিয়ে মেয়েটিকে মেরে পাট পাট করেছিল। আর একদিন দিনের বেলা, সকলের সামনে লিটজনের সামনে পড়েছিল চম্পা। সেটাও একটা চাতুরীপূর্ণ ঔদ্ধত্য নিশ্চয় কালো শক্ত সুন্দর কুকুরীটার। তাই গালে থাপ্পড় মেরেছিল।

কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সমাজ নীরব।

 বাঙালিরা মেয়েটার ভাষা বোঝে না। মেশামিশিরও সুযোগ নেই। সুতরাং তারাও চুপচাপ। জানলেও সাহেবের খেয়াল-খুশির ব্যাপারে তারা মাথা গলাবে না।

ওয়ালিকের খারাপ লাগে, কিন্তু গায়ে লাগে না। সেও একই গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু মনে মনে লিটলজনকে সে শ্লেষ না করে পারে না। একটি রুগ্ন ছেলের বিরক্তি ও গোঁয়ারতুমি দেখে, একটি সুস্থ ছেলে যেমন মনে হাসে সেইরকম।

সকলেই মেয়ে চায়। কোথাও না কোথাও জড়িয়ে পড়ে, কিংবা পড়তে চায়। কিন্তু ওয়ালিক নিজে? ওয়ালিকের গলার শির ফুলে উঠল। শিস শোনা গেল আরও জোরে, কেঁপে কেঁপে উঠে, শিসের শব্দ আতপুরের চৈত্র-শেষ বাতাসের টানে গেল হারিয়ে। ওয়ালিক যেন নিজেকেই চুপি চুপি বলে উঠল, চুপ, চুপ, চুপ! ওরে গাধার বাচ্চা, চুপ! তোর বোঝা উচিত, নীরব মনের কথা শোনবার কানও থাকতে পারে পৃথিবীতে। বিশেষ করে তোমার হোম পিপলদের।

কিন্তু চাপা খুশির একটি শব্দ সে কিছুতেই চাপতে পারল না। হেসে উঠল।

 লিটলজন বলল, কী ব্যাপার?

ওয়ালিক হেসেই বলল, ম্যাকলিস্টারের কথা ভাবছি। আপনি জানেন ম্যাকলিস্টার আটলান্টার একগাদা অপরাধী বহিষ্কৃত মেয়েকে বাউরিয়ায় এনেছে কাজের জন্য?

লিটলজন বলল, না তো?

ওয়ালিক হাসতে হাসতে বলল, লোকটা একটা এনভেরনমেন্ট তৈরি করেছে বটে বাউরিয়ায়।

 লিটলজন মানেটা ঠিক বুঝল কি না বোঝা গেল না। সে জিজ্ঞেস করল, এই ম্যাকলিস্টার কি বিবাহিত?

প্রশ্ন শুনে ভীষণ হাসি পেল ওয়ালিকের। কিন্তু হাসি চেপে বলল, ঠিক জানিনে। তবে এখানে তার স্ত্রী আছে বলে শুনিনি।

লিটলজন বোধহয় সন্দেহ করল, ওয়ালিক মনে মনে হাসছে। কিন্তু হাসির আভাস না দেখে ঠোঁট কুঁচকে বলল, আমি ভেবে পাইনে, একটা ইয়াংকি কী করে ফোর্ট গ্লাস্টারের স্পিরিট অব বিজনেস হতে পারে।

ওয়ালিক বলল, সেটা বোধহয় ওর স্কচ ইনস্টিংক্ট।

–স্কচ?

–নয়? অল ম্যাকস আর ফ্রম স্কটল্যান্ড। ম্যাকিলিস্টার অ্যাংলো আমেরিকান।

লিটলজন বলল, আমি শুনেছি, ফিলাডেলফিয়ার একটা স্ট্রিট বেগার ছিল লোকটা।

–না, স্ট্রিট বেগার নয়, বাস কন্ডাক্টর।

 লিটলজন বিদ্রূপ করে বলল, কিন্তু বাসের মালিক নয়।

ওয়ালিক বলল, তাতে কী? ম্যাকলিস্টার অ্যাম্বিশাশ আর ক্লেভার লোক। লোকটার একটা ভীষণ গোঁ আছে। যা ধরে, তা সহজে ছাড়ে না।

–তাতে সে একটা ইয়াংকি রেসলার হতে পারত।

–কিন্তু টুডর আইস কোম্পানি তাকে আঠারো শো আটষট্টিতে এ দেশে চাকরি দিয়ে পাঠিয়েছিল।

–তারপরেই লোকটা তার ইয়াংকি প্রবৃত্তি নিয়ে, ট্যুডর বরফ কারখানা ছেড়ে, চটপট একটা মতলব খাড়া করে ফেলল, না?

-হ্যাঁ।

হ্যাঁ, সোনার পিঠে (Golden pie) ভাগ করে খাবার লোভ হয়েছিল লোকটার।

চেষ্টা করেছিল তাই। বাউরিয়ার কটন মিল স্টেটটা ম্যানেজ করেছিল সে। আঠারো শো আঠারোয় প্রথম বাউরিয়ার কটন মিল চালু হয়েছিল। বছর দশেক বাদেই মার খেতে শুরু করে। খেতই। ঠিক যে কারণে এ দেশের তাঁতিরা লোপ পেয়েছিল, কটন মিলেও সেই দুর্দশা।

–মানে?

–মানে, ম্যাঞ্চেস্টারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। ম্যাঞ্চেস্টারের চিপ প্রাইস আর নামমাত্র ইমপোর্ট ট্যাকস এ দেশের কটন ইন্ডাস্ট্রিজকে প্রায় গিলে খেয়ে ফেলেছে।

–সে তো হোম ইন্ডাস্ট্রিজ।

–ফ্যাক্টরিও। আর সে ফ্যাক্টরি শ্বেতাঙ্গের হলেও, উপায় নেই। তাই বাউরিয়া কটন মিল স্টেট পড়েই ছিল। সেইটি প্রথম কাজে লাগাল চতুর ম্যাকলিস্টার। একটা সিন্ডিকেট খাড়া করে, প্রথম কটন মিল। দু বছর পরেই কটন মিলকে জুট মিল তৈরি করল ম্যাকলিস্টার।

ওয়ালিক যখন ম্যাকলিস্টারের কথা বলছিল, তখন তার কথার সুরে প্রশংসা ফুটে উঠছিল। সেটা লিটলজনের অপছন্দ। ওয়ালিককে সে মুখ ফুটে বলতে পারছে না, স্কচ আর ইয়াংকি মিশ্রণে মানুষ কখনও সৎ হতে পারে না। ম্যাকলিস্টার তার কাছে একটা জুয়াড়ির সামিল। ভবঘুরে, মাতাল, বাস কন্ডাক্টর নইলে কী আশায় দূর হিন্দুস্থানে আসার মতলব করতে পারে। তার নিজের কোনও মূলধন নেই। ডান্ডির সঙ্গে যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিনের। স্পিরিট অব বিজনেস হবার বুদ্ধি এবং অধিকার কোনওটাই ম্যাকলিস্টারের থাকতে পারে না। কেবল দুর্জয় লোভ লোকটাকে ছুটিয়ে এনেছে। আর কিছু করতে পারুক না পারুক, পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে বেড়াতে পারলেই এদেশে বড় হওয়া যায়।

ম্যাকলিস্টারও নিশ্চয় লম্বার্ড স্ট্রিটে যেতে চায়!

সামনেই একপাল গোরু রাস্তার উপরে এসে পড়েছে। ওয়ালিক লাগাম টেনে ধরে, মাথার উপর চাবুক ঘুরিয়ে চিৎকার করে উঠল, হেই।

লিটলজনের কানে প্রায় তালা লেগে গেল।

বোধহয় সাহেব এবং সাহেবি সাজের মস্ত ঘোড়া দেখেই, গোরুগুলি ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুতি শুরু করেছে। একটু ছায়া পাবার আশায় জানোয়ারগুলি গঙ্গার ধারের মাঠ থেকে এসেছে রাস্তায়। আর রাখাল হয়তো ইতিমধ্যেই কোনও ছায়াতলে চোখে গামছা চাপা দিয়ে নাক ডাকাচ্ছে।

রাস্তায় লোকজন নেই। চৈত্রের স্তব্ধ দুপুরে ওয়ালিকের চিৎকারটা ডাকাত পড়ার মতো শোনাল। রাইটার নিবারণ ঘোষের অফিস পেরিয়ে এসেছে। নইলে সে আর সেপাইরা বেরিয়ে এসে গোর সরিয়ে দিত। নিবারণের কথা মনে আছে ওয়ালিকের। হি ইজ কায়েত ঘোষ বাট নট মিল্কম্যান ঘোষ। হাসি পেল ওয়ালিকের। আর যদিও সে জানে, লিটলজনের কানের পরদা ফেটে যাচ্ছে তার চিৎকারে, তবু আবার সে হেঁকে উঠল, হেই।

গোরুগুলি রাস্তা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। লোকজনও বেরিয়ে এসেছে দু-একজন। অলিক সাহেবের গাড়ি দেখে, গোরু তাড়াতে লেগে গেল তারা।

বাতাসে এখন অনবরত ধুলো ওড়ে। তার উপরে গোরুর পাল ধুলো উড়িয়ে প্রায় ধোঁয়ার সৃষ্টি করে গেল। লিটলজন অনেক আগেই নাকে রুমাল চেপেছে।

ওয়ালিক একটা সুন্দর গন্ধ অনুভব করছিল বাতাসে। বাংলাদেশে এ সময়ে সবখানেই আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অনেকদিন এই দেশে থাকার দরুন, এ সব টের পায় সে এখন। জানে, গন্ধটা কচি কচি পাতা এবং নানান রকম ফুলের।

লিটলজন জিজ্ঞেস করল, এই স্পিরিট অব বিজনেসটি জগদ্দলে আসছে কেন?

ওয়ালিকের ঠোঁটের কোণে আবার চোরা হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। এতক্ষণে আসল কথাটি বলেছে বেগ-ডানলপের প্রতিনিধি। জুয়াড়ি মাতাল ভবঘুরে, যা খুশি মনে করা যেতে পারে ম্যাকলিস্টারকে। তবু এই দারুণ প্রতিযোগিতার সময়ে, ম্যাকলিস্টারকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়।

বেগ-ডানলপের প্রতিনিধির আসলে একটিই দুর্ভাবনা, ফোর্ট গ্লাস্টারের ঘুঘুটা জগদ্দলে কোনও নতুন কারখানা ফাঁদবার মতলব নিয়ে আসছে না তো!

ওয়ালিক বলল, ঠিক জানিনে, কেন আসছে। বোধহয় ওদের থ্রি প্লাই স্পিনিং মিলটা দেখতে আসছে।

অর্থাৎ জগদ্দলের তেসুতি কল।

লিটলজন বলল, তা হলে ভালই। নতুন কারখানার মতলব নিয়ে এলে লোকটা মারা পড়বে। বাউরিয়া এস্টেটের একশো টাকার শেয়ারের দাম তো এ বছর দশ টাকায় নেমেছে। আর সেটা এই স্পিরিট অব বিজনেসেরই কীর্তি।

কথাটা মিথ্যে নয়। ম্যাকলিস্টারের খুবই দুঃসময় যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বাউরিয়া চটকলের শেয়ারের দামের অবনতি একটা বিভীষিকা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আঠারোশো তিয়াত্তরে, বাউরিয়া শুরুর সময়, ম্যাকলিস্টার ভেলকি লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই কথাটি বলল ওয়ালিক। বলল, হ্যাঁ, ঠিকই ম্যাকলিস্টারের এখন দুরবস্থা। কিন্তু জানেন বোধহয়, শুরুর প্রথম বছরেই ম্যাকলিস্টার কুড়ি পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড পে করেছিল। ডান্ডিকে অবাক করে দিয়েছিল সে।

লিটলজন বিদ্রূপ করে বলল, ডান্ডিকে অবাক করে দেবার জন্যে ম্যাকলিস্টার নিশ্চয় সেটা তার পকেট থেকে দিয়েছিল। গ্যাম্বলাররা তাদের সুদিনের স্বপ্ন এমনি করেই দ্যাখে।

ওয়ালিক হা হা করে হেসে উঠল। এটা আবার প্রভুর কোনও নতুন ইঙ্গিত কিনা, ভেবে ঘোড়াটা কান খাড়া করল।

লিটলজন বলল, হাসলেন যে?

ওয়ালিক হাসতে হাসতেই বলল, ম্যাকলিস্টারের ওপর আপনার রাগ দেখে। সেল অ্যান্ড ইমপোর্টের পেনি ফার্দিং হিসেব করে, তবেই না ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ম্যাকলিস্টার। পকেট থেকে দেবার যোগ্যতা তার একেবারেই ছিল না। ট্যুডর আইস কোম্পানির একজন কর্মচারীর পক্ষে অত টাকা ব্যয় করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া, এটাও আপনাকে মনে রাখতে হবে, ফোর্ট গ্লাস্টারের অস্তিত্ব আজও ম্যাকলিস্টারের জন্যই টিকে আছে। তাদের এজেন্ট কেটলিওয়েল, বুলেন অ্যান্ড কোম্পানি তো হোমে গুটিয়ে বসে আছে। বার্ড কোম্পানির হাতে সবকিছু ছেড়ে দিচ্ছে তারা আস্তে আস্তে। আর, এটাও ঠিক, বাউরিয়া এস্টেট আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কাটিয়ে উঠছে সমস্ত দুর্যোগ।

লিটলজন প্রতিবাদ করবার জন্য কী একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু গাড়ি তখন ফোর্ট গ্লাস্টারের তেসুতি কলের প্রাঙ্গণে ঢুকছে।

ওয়ালটার, অর্থাৎ দেশীয় লোকদের পাগলা সায়েব শপ থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল, হেল্লো মি. ওয়ালিক, গুডমর্নিং। গুডমর্নিং মি. লিটলজন।

লিটলজনের ঠোঁট বেঁকে উঠল প্রথমেই ওয়াল্টারের উচ্চারণে। ওয়াল্টার ড কে দ আর ট কে ত বলে। সুতরাং লিটলজন তার মুখে লিতলজন।

প্রতি নমস্কারের পর অবতরণ ও করমর্দন।

শপ থেকে মেয়ে পুরুষেরা সবাই উঁকি মেরে দেখল ওয়ালিক আর লিটলজনকে। গারলের অলিক সায়েব আর সেই লতুন সায়েবটা এসেছে। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া অফিসঘর থেকে বাবুরাও উঁকিঝুঁকি মারলেন। না, ম্যাকলিস্টার নয়। চেনা মুখ ওয়ালিক আর লিটলজন। বড়বাবু জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্য খুবই ব্যস্ত। ওয়াল্টারের আদেশ, ম্যাকলিস্টার যেন খাতাপত্র দেখে খুশি হন। বড়বাবুর ইজ্জত যেন নষ্ট না হয়। হিসাবের গরমিল হবার কোনও উপায়ই নেই। ওয়াল্টারের কোথাও ফাঁকি নেই। জীবনকৃষ্ণেরও ফাঁকি নেই কোনওখানে। একটু আধটু যা পাট কেনার সময়ে দরের কম বেশি লেখা হয়। সে খুব সামান্য। নানানরকমের পুকুর চুরির সংবাদ পাওয়া যায় অন্যান্য কারখানায়। গৌরীপুরে, শ্যামনগরে, চাঁপদানিতে। সেখানে পুকুর আছে, তাই চুরি হয়। তেসুতিকারখানা সে হিসেবে ডোবা।

ওয়ালিক জিজ্ঞেস করল, ম্যাকলিস্টার আসেননি এখনও?

ওয়াল্টার বলল, না। আসবার সময় হয়ে এল বলে মনে হচ্ছে। আমাদের লাঞ্চ প্রায় রেডি। চলুন, কোয়ার্টারে যাওয়া যাক।

কুঠির দিকে যেতে যেতে ওয়ালিক আবার জিজ্ঞেস করল মুচকে হেসে, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কোথায়?

ওয়াল্টার বলল ঠোঁট উলটে, সে নিশ্চয়ই তার নিজের তালে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *