ছাঁটাই!
সন্ধ্যাবেলা সমস্ত বস্তিতে হট্টগোল। একদল গান জুড়েছে সীতার বনবাসের, কোন ঘরে সব-ভোলা রসিকের হারমোনিয়ামের পোঁ পোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে, কোনও কোনও দল নিছক গল্পে জমেছে। নর্দমার ধারের কোল আঁধারে ঘাপটি মেরে বসেছে কয়েকটা বাচ্চা।
এরই মধ্যে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে একটা বৈঠক ডেকেছে গণেশ। সেখানে বসেছে অনেকে। এ বৈঠক প্রায় প্রত্যহের ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এ বৈঠকে গোবিন্দ আসে। কথাও বলে। এবং তার কথা আরম্ভ হলে দেখা যায়, অনেকে ওদিকে ঝুঁকে পড়েছে।
গণেশ কিছুটা বিব্রত ও বিরক্ত বোধ করে। কোনও কোনও সময় নিজেই গোবিন্দকে বেমক্কা প্রশ্ন করে বসে।
গোবিন্দ হটে না, প্রত্যেকটি কথার সে এমন জবাব দেয় যে, এর পরে আর কোনও কথা ওঠে না।
দুলারী এ বৈঠকের প্রত্যহের একজন। সে কতখানি শশানে জানি না, গণেশ আর গোবিন্দের দিকেই তার নজর পড়ে থাকে।
গণেশ কিছু উত্তপ্ত, গোবিন্দ ঠাণ্ডা। গোবিন্দের আলোচনায় একটা ঘরোয়া সুর আছে। কিন্তু গণেশের কথায় ক্রোধ বেশি। সে নাগালের বাইরে, গোবিন্দ কাছে।
গণেশ গোবিন্দকে ধরে ধরে বাইরে অন্যান্য এলাকায় নিয়ে যায়। পরিচয় করিয়ে দেয় তার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে। তাদের দলের মধ্যেও এ ফোরটুয়েন্টির খাতির বেড়ে উঠেছে আজকাল। বিশেষ গোবিন্দ তাদের অনেক আগের চেনা মানুষ। অনেক পুরনো মানুষ তাকে চিনতে পারে।
জড়িয়ে ধরে বুক। বলে, আবার তুই? তারপর পুরনো দিনের কথা পেড়ে বসে। সাহেবের কথা, কারখানার কথা। কবে কখন তারা কী করেছে, সেদিন আর এদিনে তফাত হয়েছে কতখানি।
আজকের বৈঠকটা সবে বসেছে, এমন সময় নগেন এল প্রায় একটা ক্রুদ্ধ মোষের মতো ফুসতে কুঁসতে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন। নগেন কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা গোবিন্দের কাছে গিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ফোরটুয়েন্টি, সেল সায়েব শুয়োরের বাচ্চা আজ আমাকে শাসিয়েছে, সে নাকি আমাকে কোতল করবে। আমি জানের পরোয়া করি, না, কোতলের ভয় করি?
বলতে বলতে তার রক্তচক্ষু জ্বলে উঠল। সবাই এসে ভিড় করল সেখানে।
নগেন প্রায় কান্নার মতো করে চেঁচিয়ে উঠল, ফুলকির জার সেলসাহেব আমাকে পাছায় জুতোয় ঠোক্কর মেরেছে। বলেছে, আমি নাকি ফুলকিকে আমার রেন্ডি করতে চাই, তার পেছুতে লেগে থাকি। তাকে নাকি ফুলকি বলেছে। আর এই ফুলকিকে আমরা
বন্ধ হয়ে গেল তার গলার স্বর। তবুও বলল ফিসফিস করে, সকলের সামনে ফুলকি আমাকে বলে কিনা, কুকুরের আবার খাসির গোস্ত খাওয়ার নোলা।
ঠিক এ সময়েই ফুলকি ঢুকল হেলে দুলে। পিছনে তার কালো।
ফুলকির দুঃসাহস ও বেহায়াপনা এতই উগ্র যে, নগেনকে অপমান করেও সে আবার এখানে স্বাভাবিকভাবে এসে ঢুকেছে।
এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত। চকিতে নগেন প্রায় একটা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ফুলকির উপর। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকে।
পরমুহূর্তে দেখা গেল ফুলকি একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় ছুটোছুটি করছে, চিল্কার করছে ডাক ছেড়ে। আর তাকে ঘিরে রয়েছে যেন একদল বন্য উন্মাদ খেপার দল।
নগেন তার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, দেখা সবাইকে, সেল সায়েবের কাছে বিকোনো চেহারাটা সবাইকে দেখা। হঠাৎ কে পাঁক ছুড়ে দিল এক গাদা ফুলকির গায়ে, কেউ ধুলো, কেউ শুধু জল। জলার পেত্নির মতো দেখাচ্ছে ফুলকিকে।
নানান গলায় চিৎকার উঠছে, আমার পয়সা ও খেয়েছে। আমি না খেয়ে ওকে দিয়েছি।
আমি নিজের গাঁট থেকে ওকে দাবাই এনে দিয়েছি।
কেউ কেউ ফুলকির অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নাম করে করে সমালোচনা করছে।
আশ্চর্য! এতদিন এত রাগ কোথায় পোষা ছিল।
পাশের দোতলা বাড়িটার জানলায় উঁকি মেরেছে অনেকগুলো মুখ। হাসছে সব খিলখিল করে। শিশু গলায় চিৎকার ভেসে এল, একটা ন্যাংটো পাগলি রে!
গোবিন্দ একেবারে স্থাণুর মতো স্পন্দনহীন। কী যে ঘটেছে সে যেন বুঝতেই পারেনি। যে মুহূর্তে সে সম্বিত ফিরে পেল, সেই মুহূর্তে সমস্ত গণ্ডগোল ছাপিয়ে গলা ফাটিয়ে গর্জে উঠল, নগেন!
উঠোনের সবাই চমকে তার দিকে ফিরে তাকাল।
গোবিন্দ ছুটে এসে বলল, ফুলকি ঘরে যা।
সুযোগ পেয়েই ফুলকি লহমায় ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ দিয়ে চেঁচাতে লাগল একটানা নাকি গলায়।
গোবিন্দের এই মুহূর্তের মতো চেহারা বুঝি কেউ কোনওদিন দেখেনি।
নিষ্ঠুর, জ্বলন্ত একটা মস্ত কয়লার ড্যালা যেন। নগেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, শালা দুনিয়াভর তো রেন্ডি আছে, সে সবার পয়সায় খায়। তুই বাড়িওয়ালাকে বললি না কেন ওকে তাড়িয়ে দিতে।
বলেই সে আচমকা একটা ঘুষি বসিয়ে দিল নগেনের চোয়ালে। নগেন হতভম্ব, অত বড় জোয়ানটা চুপসে গেল। ঠোঁটের কষে রক্ত দেখা দিল তার। তোদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে যে শালা ফুর্তি করে সেল সায়েব তাকে ক-দিন এ রাগ দেখিয়েছিস! কুকুরের পেছনে তুই কুকুর হবি? বলে সে আবার নগেনের চোখে মুখে উপযুপরি কল কতকগুলি সাংঘাতিক ঘুষি।শালা, বড় হাত চালাতে শিখেছিস?
গণেশ এসে দু-হাতে জাপটে ধরলে গোবিন্দকে। দোস্ত, কী করছ?
বাড়িওয়ালা ডাকল, ফোরটুয়েন্টি!
নগেন হঠাৎ চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, হ আমাকে মেরে ফেলল,-খুন করে ফেলল,…বরবাদ করে দেও!
একটা প্রেতপুরীর নিস্তব্ধতা যেন নেমে এসেছে। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত চোখে গোবিন্দকে দেখছে। বাড়িওয়ালার দিকে ফিরে বলল গোবিন্দ, এখুনি তুমি হুকুম করো ফুলকিকে বেরিয়ে যেতে।
হুকুমের আগেই কাপড় পরে বেরিয়ে এল ফুলকি। আহা, কোথায় সাজগোজ, কোথায় বা অত দোলানি। ফুলকির মুখ যে এত কুৎসিত হতে পারে, এখন না দেখলে বোঝা যায় না। চোখে তার জল নেই, গজরাচ্ছে সে, আমি নিজেই যাচ্ছি, কারও পরোয়া করি না। এর শোধ যদি না তুলি, তোদের যদি না আমি সজুত করি তো আমি কুত্তিরও অধম।
গোবিন্দ তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল। তার পেছনে কালোও বেরিয়ে যাচ্ছিল! ফুলকি আচমকা পেছন ফিরে তার চোখে মুখে দু হাতে আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠল, কেন আসছিস মদ্দা কুত্তা? যা যা, যে নরক তোদের ঠাঁই, সেই নরকে গিয়ে থাক।
বলে সে উধাও হল। কিন্তু কালো যেমন যাচ্ছিল, তেমনি মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলে গেল।
কী রকম নিঝুম হয়ে গিয়েছে সারা বস্তিটা। নিঝুম কিন্তু শান্ত। যেন ওই ঝড়ের জন্য সবাই প্রতীক্ষা করছিল। আজ সেই ঝড় হয়ে গেল। এখানে সেখানে লক্ষ আর ফেঁসোর দলা জ্বলছে টিম টিম করে। বাড়িওয়ালা আর গণেশ নগেনকে খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে বসেছে তার পাশে।
গোবিন্দ যন্ত্রের মতো রান্নাঘরে রুটি সেঁকে চলেছে। উনুনের গনগনে আঁচে তার ঘর্মাক্ত শরীরটা রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে। অন্যান্য দিনের মতো এ-সময়ে আজ কারও খেতে চাওয়ার তাড়া আসছে না।–রুগ্ন ছেলেটা নীল শরীরে বসে আছে রকে। তার গলার স্বর আজকাল বন্ধ হয়ে আসছে। সুতো বাঁধা সেই কুন্দ গাছটার ফুল নেই, পাতা নেই, ঝাড়র কাটির মতো রয়েছে দাঁড়িয়ে। তার মাতাল বাবা ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে, নেশার ঝোঁকে গুটিসুটি হয়ে।
সেই বুড়োটে গম্ভীর গলা আজ গানের মতো বলছে :
দুনিয়ার সব জায়গা থেকে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এলে ঠাকুর, সবাই বললে, সবখানেই তোমাকে পাওয়া যায়, কিন্তু আজও তোমাকে পেলুম না!
মাদারি খেলওয়ালা, তার ড়ুগড়ুগিটার চামড়ায় থুতু দিচ্ছে, ঘষছে আর বিড়বিড় করছে, দিসিস ব্যাড, অলশালা খচ্চর।…ফুল, ইস্টাপেড…। তারপরেই একটা ঢোক গিলে বলে ওঠে নিস্তেজ গলায়, কখন যে খেতে দেবে…
রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দুলারী। গোবিন্দ একবার ফিরে দেখল, কিছু বলল না।
দুলারী হঠাৎ অশুরুদ্ধ গলায় বলে উঠল, এ দুখভোর জিন্দিগিতে যাদের কাছে গেছি তারা বাই এমনি,…তুফানের আগে তারা ছোটে, জান নিয়ে হোলি খেলে। আমার ঘর তোড়ফোড়, জান চৌপাট তবু তারা বিপদে পথ ছাড়বে না। কাহেকাহে?
তার ঘর-ভরানোর সব আশা গণেশ ধুলিসাৎ করেছে, বাইরের সংগ্রামী জীবনটাই তার একমাত্র জীবন। আর আজ গোবিন্দের মতো দোস্তকে সেই একই পথের শরিক দেখে কানা মানছে না দুলারীর।
রাত্রি কত ঠিক নেই। চারদিক স্তব্ধ, অন্ধকার।
হঠাৎ নগেন জেগে গেল। কে যেন তার গায়ে মুখে আস্তে আস্তে হাত বুলাচ্ছে। তার সারা মুখে ব্যথা, ফুলে গেছে।
কে?
একটুখানি নীরব, তারপর শোনা গেল, আমি ফোরটুয়েন্টি।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত আর কোনও কথা শোনা গেল না। দুটো বলিষ্ঠ বুকেই বুঝি নিশ্বাস একেবারে আটকে গেছে। নিথর নিকষ কালো রাত্রি। বোবা পৃথিবীর তলায় যেন শুধু জলের কলকল শব্দ।
নগেনের মুখের উপর রাখা হাতটা ভিজে গেল গোবিন্দের। সে ডাকতে গেল নগেনকে, স্বর ফুটল না। একটু পরে আবার বলল, নগেন…আমাকে মাপ করো ভাই।….
নগেন দু-হাতে গোবিন্দের হাতটা চেপে ধরে একেবারে ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে উঠল। গোবিন্দের হৃৎপিণ্ডটা ফুলে উঠল ফানুসের মতো। অনেকক্ষণ পর নগেন বলল, তোমাকে মাপ করবার মতো কেউ জন্মায়নি। তুমি আমাকে আজ বাঁচিয়েছ। বলে সে একটু চুপ করে থেকে আবার বলল ভাঙা গলায়, তুমি না থাকলে আজ আমি না জানি কী করতাম।…হয়তো সকলের সামনে..আমি ওকে…। হ্যাঁ, আমি তখন একটা রোখা কুত্তারও অধম হয়ে গেছলাম। ফোরটুয়েন্টি..আমরা জানোয়ার একেবারে, জানোয়ার।
জানোয়ার! খানিকক্ষণ চুপ করে গোবিন্দের মোটা গলায় একেঘেয়ে সুর শোনা গেল, ঘর নেই, দেশ নেই, শরীরটাও শালা বুঝি আপনার নয়। জানোয়ার আমরা।
বলে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে সে হঠাৎ তীব্র চাপা গলায় বলে উঠল, কিন্তু এ শালা আইনটা কোথাকার? আমরা কি ভাল হতে পারিনে? তোকে মারলুম কেন? না, তুই ফুলকিকে মারলি। তাতে কী হবে? শয়তানের সোহগে ওর সোহাগী গায়ের রোঁয়া ফুলে উঠেছে। কিন্তু কদিন? কালকেই আবার সেল সায়েব শালা ওকে কুকুরের মতো যাড়িয়ে দেবে, ও এসে আবার আমাদেরই দলে ভিড়বে। এখানে না তোক অন্যখানে। তখন? তাতে আমাদের কী ভালটা হল। আর সেল সায়েবের জুতোর ঠোক্কর বা বন্ধ হল কোথা? আমরা যদি খেয়োখেয়ি করি, আমাদের ব্যবস্থা করবে
কে? নাকি, জন্মোটা শালা ফালতু দিয়েছিল বাপ মা?
নগেনের মার খাওয়া ফোলা মুখটা অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। ফুলো মাংসের ভিতরে তার চোখ দুটো
যেন নবজাত শিশুর চোখের মতো উজ্জ্বল। তার সে চোখের দৃষ্টি গোবিন্দের সারা মুখে কী যেন খুঁছে আঁতিপাঁতি করে।
গোবিন্দ যেন বাপের মতো নগেনের দিকে আরও খানিক ঝুঁকে পড়ে বলল, মহামারী আসে মারতে, আমরা তাকে তাড়াই, মারতে আসে ঝড় আমরা ঘর বানাই আর এ জীবনটাকে পারি না মন্দ থেকে ভাল করতে? অনিয়মের নিয়ম চাই, এ সোজা কথাই বুঝি। মার তো খাচ্ছিই পড়ে পড়ে আবার নিজেরাও মারামারি করব?
না। শুধু এই একটি কথা বলে স্তব্ধ হয়ে গেল নগেন। অনেকক্ষণ পর বলল আবার, ফোরটুয়েন্টি, প্রাণটা মানেনি। কালো ওর পেছনে ঘোরে। আমি পারি না। কিন্তু ফোরটুয়েন্টি, যাকে সব দিয়েছি সেই ফুলকি এমন হল কেন তাই ভাবি।
রাত্রি পুইয়ে আসছে। পাশের বাড়িটার কলের জল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। গ্রীষ্মের ছোট।
রাতের অন্ধকার কেটে ফুটছে আলো। দেখা গেল বাড়িওয়ালা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে। বলল, ফোরটুয়েন্টি, এদিকে আয়।
কিন্তু গোবিন্দের মুখে কোনও কথা নেই, অনড়, নিশ্চল। কী এক ভাবে যেন সে বিভোর হয়ে শুন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উঠোনের দিকে।
সেই বুড়োর গলায় আপসোসের সুর ফুটল :
তবে কি গো দেখা হবে,
ভবের খেলা সাঙ্গ যবে?
ছাঁটাই!…সামাল! ঝড় এসেছে!…
দুপুরের খাবার সময়ে কেউ খেতে এল না। যে দু-একজন এল, তারা খেতে পারল না। সময় নেই, হারজিতের লড়াই লেগেছে। সেখানে চারদিকে পুলিশের বেষ্টনী, ভিতরে অভ্রভেদী ঘেরাওয়ের বৃহ। এতদিনের সমস্ত প্রস্তুতির পরীক্ষার ফল হাতে হাতে নিয়ে ফিরতে হবে। সমস্ত সংশয়ের মাথায় বাড়ি দিয়ে সে এসেছে। লৌহ ঘেরাও মাথা তুলেছে সংশয়হীন।
কারখানার থমথমানি বস্তিতে এসে পড়েছে। সমস্ত বস্তিটা যেন প্রতীক্ষা করে আছে ঝিম মেরে। বাড়ির ওপারে রাবিশ ফেলা রাস্তাটা আজ ফাঁকা, কর্ড রোডের ধারে গাছগুলো স্তব্ধ। আকাশ গুমোটা।
বাড়িওয়ালা খানিক বসে আর খাটিয়া এপাশ ওপাশ করে। গোঁফ মোচড়ায় আর বি টি রোডের বুকে মিশে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
গোবিন্দ রান্নার ফাঁকেই উধাও হয়ে যাচ্ছে আর ফিরে ফিরে আসছে।
দুলারী ছুটে ছুটে বাইরে যায়, আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। গোবিন্দকে বলে, কী অবস্থা?
ঠাওর পাচ্ছিনে। টেনে জবাব দেয় গোবিন্দ।
রুগ্ন ছেলেটার মা কাজ করছে আর বলছে, ভগবান…মুখ রেখো। কাজটা গেলে সবাই মরব।
সন্ধ্যার পর সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দূর থেকে ভেসে এল মিলিত গলার কোলাহল, ট্রাকের গোঙানি, হুইসলের সংকেতধ্বনি।
আচমকা বন্যার মতো পথে পথে জুটছে মানুষ। কী হল? কী হল?
গোবিন্দ ছুটে বেরুবার মুখে দেখল সমানে দাঁড়িয়ে নগেন…অভুক্ত ক্লান্ত।
কী হল নগেন?
সব ভেস্তে দিয়েছে।
কী করে?
নগেন ধাঁধা-ভরা চোখে বলল, শালা টেরই পেলাম না। আমরা ঠিক ছিলম..ম্যানেজার শালা। পেরায় কাত মেরেছিল, সেল সায়েবটা আমাদের পায়ে ধরতে অবধি এসেছিল, মাইরি। এর মধ্যে কে যে শালা পুলিশের গায়ে ঢিল মারলে, ব্যস অমনি পুলিশ লাঠি চালিয়ে দিলে।…তাজ্জব, কেউ পয়লা পালাচ্ছিল না, কতকগুলো ভরপোঁক এমন চেঁচামেচি করে ছুটতে লাগল—
নগেনের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল অনেকে ফিরে আসছে। জমজমাট হয়ে উঠেছে বস্তি।
দেখা গেল সর্বসাকুল্যে এগারোজন এ বস্তির ছাঁটাই হয়েছে।
দুলারী এর ওর পিছনে ছুটেছে, জিজ্ঞেস করছে, আমার আদমিটা…তাকে দেখেছ?
কে একজন বলে উঠল, আমি দেখেছি।
কোথায়?
কয়জনের সঙ্গে তাকে একটা জালের গাড়িতে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
আর একজন বলল, হ্যাঁ আমিও দেখিছি। তাকে আমি হাঁক দিলুম—
দুলারী তখন একটা চিৎকার করে বাইরের দিকে ছুটে গেল, আমি জানতুম–জানতুম!
গোবিন্দ গিয়ে তাকে ধরে ফেলল, দোকানি যেয়ো না এ ভাবে—যেয়ো না।
দুলারী হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য জোর করে কেঁদে উঠল, আমি থানায় যাব।
কে চেঁচিয়ে উঠল, গাড়িটা সদরের দিকে গেছে।
দুলারী মাটিতে মুখ দিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে উঠল, জানতুম জানতুম। এমনি করে আমার ঘর ভাঙবে—জানতুম।
গোবিন্দ তাকে জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। অনেক কথা বলল, কিন্তু দুলারীর কামার তোড়ে ভেসে গেল সব।
রাতভর বস্তিটা কাঁদতে লাগল যেন। কখনও চাপা গলায় কখনও হাউ হাউ করে, কখনও নিঃশব্দে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
ভোরলো গোবিন্দ দরজা খুলেই দেখল লোটাকম্বল হাতে নগেন দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ফোরটুয়েন্টি চললুম বেরাদার।
কোথায় যাকে? চমকে উঠল গোবিন্দ।
নগেন হেসে বলল, কাজের খোঁজে। এখানে পারলাম না, মার খেলাম। আর এক জায়গায় যাই। দেখি কতদিন এমনি পড়ে পড়ে মার খাই। একদিন কি…
তারপর হঠাৎ হাসিটা উবে গিয়ে মুখটা তার গম্ভীর হয়ে উঠল, ফোরটুয়েন্টি চলে যাচ্ছি, মনে কোনও দুঃখ রেখো না। আর…মাইরি বলছি, তোমাকে কোনওদিন ভুলতে পারব না। সম্বল নেই আধলা, কিন্তু কালরাতের তোমার কথাগুলোই আমার সম্বল।
বলে সে তাকাল গোবিন্দের দিকে। এখনও তার চোখে মুখে আঘাতের দাগ। আবার হেসে সে পিঠে ঝোলা নিয়ে চলতে শুরু করে হঠাৎ আবার দাঁড়াল। ফিরে এসে তাড়াতাড়ি বলল, জানো ফোরটুয়েন্টি, রাগটা শালা চণ্ডাল। ফুলকি যদি কখনও আসে তবে বলোবলতে বলতে হঠাৎ থেমে চকিতে পিছন ফিরে সে চলে গেল।
গোবিন্দ তাকে ডাকতে চাইল, স্বর ফুটল না গলায়। কেবল তার বুকের মধ্যে যেন কে হৃৎপিণ্ডটা দু-হাতে মুঠো করে টিপে ধরেছে, চেপে দিয়েছে কণ্ঠনালীটা।
ছাঁটাইয়ের ঘা দগদগে হয়ে উঠেছে! হরিশ-নন্দ বেকার হয়ে অবধি দিনে রাত্রে মারামারি আরম্ভ করেছে আবার। সেই রুগ্ন ছেলেটার বাপ দাপাদাপি করছে পাগলের মতো। সবাই ছুটোছুটি করছে জুটের কারখানায়, কাঠের গোলায়, রিকশা মালিকের দরজায়।
গোবিন্দের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই বাড়িওয়ালা বলছে, আমি কী করতে পারি?
অর্থাৎ বস্তির এ বিড়ম্বনার দায়িত্ব যেন অনেকখানিই তার।
দুলালী খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছে, সারাদিন পড়ে আছে ঘরে।
গোবিন্দ এসে ডাকল, দোস্তানি!
দুলারী মুখ তুলল। কান্নায় ফোলা মুখ।
গোবিন্দ কাছে এসে তার পাশে বসে বলল, দুখ কি জীবনভর থাকে?
কেন ঘর করল? ওর মনে যদি এই ছিল, তবে কেন আমার জান চৌপাট করল।
এলানো আঁচল, এলো চুল, সিন্দুরহীন কপালে দুলারী যেন যোগিনী হয়েছে।
গোবিন্দ বলল, গলতি সমাঝো না গণেশকে। সে হল আসল ঘরওয়ালা মানুষ, ওর প্রাণে যত মহব্বত, তা আর কার আছে? দোস্তানি, ওর কানে যে মন্ত্র পড়েছে, তাতে ও সিদ্ধির নেশায় পাগল হয়ে গেছে। জেল ফাঁসি সেখানে তুচ্ছ। তুমি আমিও একদিন ওর মতোই পাগল হয়ে ছুটে যাব। বলতে বলতে তার দৃষ্টি অসীম শূন্যে হারিয়ে গেল। সে চোখে সে ঝলমলিয়ে উঠল কীসের আলো।
দুলারী তাকাল গোবিন্দের মুখের দিকে। গোবিন্দের মাথাটা মস্ত বড় হয়ে উঠেছে চুলের ভারে। মুখটা শুকিয়ে যেন শিশুর মতো ছোট হয়ে গেছে। ক্ষীণজীবী হয়ে গেছে বড়। হঠাৎ তার বড় লজ্জা করে উঠল যেন নিজের কান্নার জন্য। সে গোবিন্দের হাত ধরে বলল, কী দেখছ তুমি?
আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল গোবিন্দ, কিছু না।
এরকম জবাব শুনে আবার কান্না আসে দুলারীর। বলল, জানি, তুমিও কোনও মতলব ভাঁজছ। দিনরাত তোমার পেছনে দুশমন, তুমিও আমাকে ছেড়ে যাবে।
দোস্তানি, আমরা সব একসঙ্গে যাব। দুলারী বলল, তা যদি হয়, তা হলে তো আমিও তোমাদের সাথী হতে পারব।
হাঁ দোস্তানি…তাই। বলে গোবিন্দ নিজের হাতে তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। দিয়ে কেমন যেন অবশ শরীরে সে দুলারীর গালে হাত রেখে নিঝুম হয়ে গেল। পরমুহূর্তে দুলারীর নিশ্বাসে চমক ফিরতেই, দুলারী জিজ্ঞেস করল, কী?
কিছু না। বলে বেরিয়ে গেল গোবিন্দ।