০৫. ললিত প্রথম ফোন করল

পাঁচ

ললিত প্রথম ফোন করল মানস নামে একটি ছেলেকে তার অফিসে। বড়পিসির পাশের বাসায় থাকে ছেলেটি। ললিত যে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছে সে-খবরটা পিসিকে দিয়ে দেবে।

দ্বিতীয় ফোন করল আদিত্যকে। তাকে পাওয়া গেল না। কোনও দিন পাওয়া যায়ও না। বরাবর তার পাশের টেবিলের কালীনাথ উঠে এসে ফোন ধরে, আর সেই একই কথা বলে, না, উনি তো টেবিলে নেই, সকাল থেকেই দেখছি না।…না, না, এসেছেন দেখছি, এসেই তারপর… আপনার নামটা বলুন, বলে দেব।

আজও নাম বলল ললিত।

কালীনাথ পরিচয়ের হাসি হাসল, ওঃ হোঃ, আপনি! অনেক দিন আর ফোন করেননি তো আদিত্যবাবুকে। কেমন আছেন?

ইতস্তত না করেই ললিত বলল, ভাল। আপনি?

এই চলছে।

ওকে বলবেন যেন বিকেলে আমার বাসায় আসে।

বিকেলে! একটু চিন্তিত শোনাল কালীনাথের গলা, আমাদের একটা মিটিং আছে আজ, ময়দানে। আচ্ছা, ঠিক আছে, বলে দেব।

আদিত্য কি মিটিংয়ে যাচ্ছে?

কালীনাথ হাসে, যেতে চায় না তো কখনও। আজ জোর করে নিয়ে যেতুম। আপনাদের কি জরুরি দরকার?

ললিত একটু ভেবে বলল, খুব জরুরি নয়। আমার একটা অসুখ হয়েছিল, আদিত্য জানে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি, একটু খবরটা দেবেন। দেখা হলে ভাল হত, কিন্তু সে কাল হলেও হবে।

আপনার কী অসুখ হয়েছিল?

ও পেটের একটা ব্যাপার।

পেট! পেট নিয়ে আমিও ভুগছি। আমারটা ক্রনিক। আপনার কী হয়েছিল?

আমারটাও ক্রনিক। সারবে না মনে হচ্ছে।

আলসার?

ও-রকমই। আচ্ছা, আদিত্যকে বলবেন।

আচ্ছা। বাংলাদেশটা মশাই পেটের জন্য গেল। আপনি একটা কাজ করবেন, বুঝবেন। কাঁচা পেঁপে আর থানকুনির ঝোল খাবেন রোজ, আর সকালে উঠে এক গ্লাস জলে আস্ত একটা কাগজি লেবুর রস, জলটা খুব খাবেন। কলের জল নয় কিন্তু, কলকাতার কলের জল পয়জন, টিউবওয়েলের জল খাবেন, বুঝলেন!

আচ্ছা। বলে ফোন রাখল ললিত। কালীনাথের ছোটখাটো বোগা ক্ষয়া কালো চেহারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল সে। তার ওপর কালীনাথ একটা ঝকঝকে রোল্ডগোল্ডের ফ্রেমের চশমা পরে, আর বারো মাস ধুতি আর সাদা শার্ট। রোল্ডগোল্ডের ফ্রেমের চশমা পরলে যে-কোনও লোকেরই দু’-দশ বছর বয়স বেড়ে যায়। আর ওই সাদা পোশাক বারো মাস! ভয়ংকর একঘেয়ে। কালীনাথের সঙ্গে রোজ অনেকক্ষণ কাটাতে হলে যে-কোনও লোকেরই মানসিক ক্লান্তি আসতে পারে। কে জানে আদিত্য কালীনাথের পাশের টেবিলে বসতে হয় বলেই টেবিল-ছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় কিনা! তা ছাড়া তার পেটের অসুখের গল্পগুলোও আদিত্যর সহ্য না হওয়ারই কথা।

তৃতীয় কোনটা ললিত করল সঞ্জয়কে।

ফোন রেখে আপনমনে একটু হাসল ললিত। সঞ্জয়! তার বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী আর সচ্ছল সঞ্জয়। সবচেয়ে কম লেখাপড়া জানা। সেটা অবশ্য বোঝা যায় না, তুখোড় ইংরিজি বলতে পারে সে, হালফিল দুনিয়ার খবর রাখে। আর আছে একরোখা স্বভাব। অনেক দিন আগে একবার তারা পাঁচ-সাতজন বন্ধু ফুটবলের একটা চ্যারিটি খেলা দেখতে গিয়েছিল। পরের দিন খেলা, তারা আগের দিন রাতে খাওয়ার পর গিয়ে লাইন দিয়েছিল। রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা, দুটো ছাতা আর দুটো গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে ওপরে চাদর টাঙিয়ে তার তলায় বসে টর্চ জ্বেলে তাস খেলেছিল, অশ্লীল গল্প করেছিল, গান গেয়েছিল। তখনও তাদের আগে মাত্র কুড়িজনের মতো লোক ছিল লাইনে, সারা রাতে তাদের সঙ্গেও হয়েছিল বন্ধুত্ব আর পরস্পরের সিগারেট কিংবা জলের বোতলের জল খাওয়া-খাওয়ি। পরদিন বেলা বাড়ছিল আর সামনের লাইনের লোকসংখ্যাও ক্রমে ক্রমে কীভাবে যে বেড়ে যাচ্ছিল! কুড়ির জায়গায় যখন প্রায় তিনশো লোকের পিছনে পড়ে গেল তারা তখন বুঝতে পারল সামনের লোকেরা জায়গা বিক্রি করছে। আট আনায় এক টাকায়। ক্রমে সে রেটও বাড়ছিল। যারা জায়গা বিক্রি করছে তাদের ফোটো আগের দিন তুলে নিয়ে গেছে খবরের কাগজের লোকেরা, নাম পরিচয় লিখে নিয়ে গেছে। কাগজে ছাপবে, এঁরা কত বড় ধৈর্যশীল। বস্তুত ধৈর্যটা যে কেন তা কেউ জানে না। ধৈর্য টাকা এনে দেয়। সঞ্জয়কেও দিয়েছে। ঘোড়সওয়ার পুলিশ যখন এল তখন তাদের একটা লাইনের জায়গায় চার-পাঁচটা লাইন তৈরি হয়ে গেছে, কোনটা আসল কে বলবে। সেই সব লাইন ভেঙে একটা লাইন করার জন্য পুলিশ ঘোড়া চালাল, আর তখন কোথা থেকে যে কোথায় চলে গেল তারা! ধূ ধূ দূরে সরে গেল মাঠে ঢোকার গেট, হাজার লোক এসে গেল তাদের সামনে। ফিরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না, লাভও নয়। কিন্তু সঞ্জয় কেবল তার না-খাওয়া না-ঘুমোনো চোয়াড়ে মুখ শক্ত রেখে বলল, তোরা যা, আমি খেলার শেষে ফিরব। তাই ফিরেছিল সঞ্জয়, খেলা দেখেই। কী করে যে কে জানে। জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলেছিল, কেউ কখনও দয়া করে আমাকে কিছু দেয়নি। তা ঠিক! ললিত জানে। ধৈর্য, সম্ভবত ধৈর্যই সঞ্জয়কে সবই দিয়েছে, আর ওই লেগে থাকার ক্ষমতা। একটা সময় ছিল, বা এক-একটা সময় আসে যখন সঞ্জয়কে নিজের থেকে নিচু মনে হয় ললিতের, সেটা ওর লেখাপড়ার অভাবের জন্যই। মনে হয় চেষ্টা করলে, সামান্য একটু উদ্যোগী হলেই ও-রকম বা ওর চেয়ে উঁচু জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যেত।

কিন্তু যাওয়া যায়নি। এম এ পাশ করার পর সহজেই স্কুলের চাকরিটা পাওয়া গেল। আপাতত এটাই করা যাক, যতদিন বড় সুযোগ না আসছে, এ-কথা ভেবে চাকরি নিল ললিত। তারপর সাত বছর রয়ে গেল স্কুলে, বড় সুযোগ আর এল না। না, ভেবে দেখলে কোনও দিনই খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না ললিতের, সেই ছেলেবেলা থেকেই নয়। পরীক্ষার খাতায় পাশ নম্বর ওঠার মতো লেখা হয়ে গেলে তার আর লিখতে ইচ্ছে করেনি কোনও দিন। অনর্থক মনে হত। তাই এই স্কুল ছেড়ে পড়াটাও তার বরাবর পণ্ডশ্রম মনে হয়েছে। অনেক ছুটি, স্ট্রাইক, ফাঁকি এবং কামাইয়ের স্বাদ পেয়ে ক্রমে আরও অলস, উদ্যমহীন এবং আড্ডাবাজ হয়ে গেছে সে, দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কী করে লোকে চাকরি করে তা ভাবতেও সে শিউরে ওঠে। তাই মাঝে মাঝে সঞ্জয়ের শ্রমটাকেও পণ্ডশ্রম মনে হয় ললিতের। কিন্তু কখনও রাস্তার শো-কেসে দামি জিনিস দেখলে, কিংবা বন্ধুরা খুব দূরে বেড়াতে যাচ্ছে শুনলে, বা মা মাঝে মাঝে তাকে বাড়ি তৈরি করার কথা বললে তার মনে হয়, টাকা থাকলে মন্দ হত না। অনেক অপব্যয় অন্তত করা যেত। কিংবা সমাজের খুব উঁচু একটা জায়গায় পৌঁছুলে ক্ষতি কী ছিল। সে মাঝে মাঝে ভেবে দেখে, কখনও কিছু হওয়ার জন্য সে চেষ্টা করেনি, কিন্তু চেষ্টা করলে সে কি পারত?

আপনমনে মাথা নাড়ল ললিত। না, পারত না। বড় হওয়ার অনেক ঝামেলা। নির্ঝঞ্ঝাটে সে বেশ আছে। তা ছাড়া ভেবে দেখলে এ-রকমই সবচেয়ে ভাল হয়েছে। সে আর-একটু পয়সাওলা হলে, এমনকী অধ্যাপক হলেও সম্ভবত এতদিনে সে বিয়েটিয়ে করে ফেলত। কে জানে, বাচ্চাও হত হয়তো। তখন?

স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার মুখে অঙ্কের সতীশ হালদার ধরল তাকে। একটা ফর্ম বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একটা লটারির টিকিট কিনুন।

ললিত হাসল, কত প্রাইজ?

এক লাখ দশ হাজার।

দ্যুৎ ওটুকুতে আমার কী হবে?

অন্তত সিগারেটের খরচটা চলে যাবে তো? মাত্র তো একটা টাকার টিকিট। লিখুন।

এটা সতীশ হালদারের সাইড বিজনেস, বোধহয় কুড়ি টিকিটে টাকা ছয়েক লাভ থাকে তার। ললিত অবহেলায় তার নাম লিখল।

সতীশ হালদার ফর্মটা নিয়ে নম্‌-ডিপ্লুমটা দেখে হাসল, কোনও মেয়ের নাম?

হ্যাঁ

বেশ ঘরোয়া নাম। মিনু।

টাকাটা পেলে মিনুকেই দিয়ে দেওয়া যাবে। না, পুরোটা মিনুকে নয়। অর্ধেকটা মা’র। তারপর ভেবে দেখল ললিত, দূর! অর্ধেক দিয়েই বা মিনু কী করবে; তার অনেক আছে, হয়তো নেবেই না তার লটারির টাকা। সে সতীশ হালদারকে ডেকে বলল, নামটা পালটাব।

কী লিখবেন?

একটু ভেবে ললিত বলল, ধৈর্য। পেশেন্স।

সতীশ হালদার লিখে নিল। তারপর হেসে বলল, লোকে নাম নিয়ে ভাবে। আসলে নামে কিছু যায় আসে না। যে-কোনও নামেই পাওয়া যায়, ভাগ্যে থাকলে।

চলে আসতে আসতে হঠাৎ ললিতের মনে হল সতীশ হালদার তার অসুখের খবর জানে তো! জানলে ললিতকে এ-রকম টিকিট বিক্রি করাটা কি ঠিক হয়েছে তার?

দুপুরে খাওয়ার পর মাকে ডেকে ললিত বলল, আমি যখন থাকি না তখন তুমি সারা দুপুর কী করো মা?

কী আর! এই এ-বাড়ি ও-বাড়ি সে-বাড়ি একটু যাই, কি ওরাই আসে আমার বাড়ি, লুডো কি তাস টাস একটু খেলা হয়, পাঁচটা কথা এসে পড়ে। কোনও দিন হয়তো বা একটু ঘুমোই।

তুমি খুব আড্ডাবাজ, না?

কেমন ছেলের মা, একটু হব না?

ও! তা হলে তোমার কাছ থেকেই আড্ডার স্বভাবটা পেয়েছি আমি! বাবার কাছ থেকে নয়।

মা হাসে, তোদের বংশই আড্ডাবাজদের বংশ। বসে খেতে পারলে আর কিছু করতে চাইবে না। ভাশুরঠাকুরকেও দেখতুম…

পুরনো কথা এসে পড়ার আগেই ললিত বলল, তোমার লুডোটা বের করো তো! পর পর কয়েক গেম হারিয়ে দিই তোমাকে!

খেলবি! একটু অবাক হয় মা।

হুঁ। মা, তুমি কি এ-পাড়ার লুডো-চ্যাম্পিয়ন?

শিশুর মতো হাসে মা, আমার হাতে খুব দান পড়ে, জানিস!

সত্যি! তবে আজ তোমার চ্যাম্পিয়নি কেড়ে নিই, এসো।

সে তোকে আমি এমনি দিলুম।

সে হবে না। খেলে দাও, দয়া করে না।

পাগলা। বলে মা মেঝেতে শতরঞ্জি বিছায়, লুডোর ছক পাতে। আঁচলে ভারী চশমাটা মুছে নেয়। বলে, তুই একটু শুয়ে থাকলে পারতিস, রোদ্দুরে অত ঘোরাঘুরি করে এলি!

সে-কথায় কান না দিয়ে ললিত কাঠের ছোট্ট চালুনিটার মধ্যে খটাখট শব্দে ছক্কাটাকে নাড়ে। দান ফেলে বলে, দেখো মা, ছক্কা!

ইস! চোখে দেখি না ভেবেছিস। পাঞ্জা!

তবে আর একবার কাল দাও, এটা ট্রায়াল।

নে।

চালতে গিয়ে হাসে ললিত, নেব কেন! আমি কি উইক খেলোয়াড় নাকি!

মার একটা পোয়া পড়ল। হেসে গড়াল ললিত, এই তোমার ভাল দানের হাত!

ললিতের অবশেষে ছয় পড়ল। পর পর দু’বার। দেখে মা’র মুখ শুকিয়ে গেল, দেখিস, সাবধানে চালিস, তিন ছক্কা না হয়। হলে পচা।

আবার ছয় পড়ল। তিন ছক্কা। মা একটু ঝুঁকে বলল, পাঞ্জা, না? দুই ছয় পাঁচ তা হলে।

ললিত মাথা নাড়ে, না। তিন ছক্কা। পচা। তুমি দেখেও দেখছ না।

মা রাগ করে, ভাল করে চাল। চালুনিটা অত জোরে নাড়িস কেন? অলক্ষুণে অভ্যাস!

ললিতের এবার পোয়া পড়ল। মা একটুও খুশি হল না।

তুমি চালো এবার। বলে চালুনি এগিয়ে দিল ললিত।

মা’র পড়ল ছয়। দুই ছয়। দম বন্ধ করে দেখছিল ললিত। তিন ছয় না হয়। না, দুই ছয় তিন। মা’র দুটো গুটি বেরিয়ে গেল। ‘বাক আপ’ বলে চেঁচাল ললিত, এগিয়ে যাও মা, এগিয়ে যাও।

মা হাসে, তুই ভাল করে চাল। আমি ফাঁকা মাঠে এগিয়ে কী করব তুই সামনে না থাকলে!

আহা, সারা খেলায় আমার যদি ছয় না পড়ে আর!

দূর, তাই হয় নাকি!

হবে না কেন! এটা তো চান্সের ব্যাপার, না-ও পড়তে পারে।

তা হয় না। ছয় পড়বেই। ঠিক করে চাল।

পড়বেই! ছয় পড়বেই! গুনগুন করল ললিত। দেখল তার দানে পড়েছে দুই।

মা’র দানের হাত সত্যিই ভাল। অনিচ্ছায় চালছিল মা তবু ছক্কা-পাঞ্জার ছড়াছড়ি হতে লাগল। ললিত বলল, তোমার কপট পাশা— না কপট লুডো মা! তুমি মন্ত্র করে রেখেছ।

মা হাসে। খেলা এগোয়। পাঁচ-ছয়-তিন-দুই-চার-পোয়া।

মা’র একটা চাল দেখে ললিত চেঁচাল, তিনের মুখে আমার গুটিটা খাও মা।

ইস! মা মৃদু হাসে, ললিতের গুটি না খেয়ে অন্য গুটি চালে মা, বলে, গুটি খাব কেন! আমি আমার পাকা গুটি ঘরে তুলব।

হতাশায় ললিত দু’ হাত ওপরে তুলে বলে, এই তুমি পাকা খেলুড়ি? খাওয়ার গুটি খাচ্ছ না!

নিজের গুটি পাকাতে পারলে অন্যের গুটি কে খায়!

আমি কিন্তু খাব। ছাড়ব না।

খা না! খেতেই তো দিচ্ছি। তুই এগিয়ে যা তোর তো দানই পড়ছে না। ভাল করে চাল দেখি!

ললিতের গুটি খাওয়ার ঘরে পেয়েও এড়িয়ে যাচ্ছে মা, অন্য গুটি চালছে। নিজের গুটি এগিয়ে দিচ্ছে ললিতের গুটির মুখে মুখে। আমার গুটি খা ললিত, তুই এগিয়ে যা। তুই সামনে না থাকলে ফাঁকা মাঠ। ধু-ধু মাঠ। আমি কার দিকে এগোব, কোন ঘরের দিকে!

খেলা তাই জমে না। হেলা-ফেলা করেও মা-ই এগিয়ে যায়। ললিত পিছনে পড়ে। হাসে। বলে, খেলা জমছে না, মা।

তোর দান আমি চেলে দিই ললিত? আমার দানের হাত ভাল।

দূর। তাই হয় নাকি! খেলা খেলাই, যার দান তার দান। তুমি ফেললে দান তোমার হয়ে গেল।

মা লজ্জা পেয়ে হাসে। যখন মা’র বয়স আরও কম ছিল তখন মা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইত। রামপ্রসাদি। সে-সব গানের এক-আধটা ললিতের প্রিয় ছিল। সে তার মা’র মুখে শোনা প্রিয় একটা লাইন গুনগুন করছিল, মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা মা, ডিক্রি হবে এক সওয়ালে…

একটি-দু’টি করে পাড়ার বুড়িরা দরজায় দেখা দিতে লাগল, কী হচ্ছে গো, ললিতের মা!…ওমা, তুই যে আজকাল বড় লক্ষ্মী হয়েছিস ললিত!…মায়ে পুতে খেলা, জবর খেলা গো, হারজিত আছে, না নেই?

ললিত ঝুঁকে মা’র কানে কানে বলে, মা, তুমি হচ্ছ এ-পাড়ার সব বুড়িদের মধ্যে হিরো। হিরো-বুড়ি। তোমাকে না দেখে দেখো সব দলে দলে আসছে।

ঘরে বুড়িদের জটলা হয়ে গেল। মাঝপথে খেলা ভেঙে উঠে পড়ল ললিত, বলল, এবার তোমরা খেলো, মা।

তুইও বোস না।

আমি একটু খোলা হাওয়ায় যাই।

কোথায় যাবি আবার! দুপুর রোদ এখন।

গলির মধ্যেই। একটু পায়চারি করি।

অন্য বুড়িরা কাছে থাকলে মা’র সামনে সিগারেট খায় না ললিত। তার ধারণা তাতে মাকে অপমান করা হয়। সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বালিশের খাঁজ থেকে তুলে নিয়ে সে গলিতে বেরিয়ে আসে। দরজা থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখে ছয়-সাতজনের ভিড়ের মধ্যে মা বসে আছে। হিরো-বুড়ি। তোমার দলে তুমি হিরো মা, আমার দলে আমি কিন্তু হিরো নই। বাক আপ মা, আপনমনে হাসল ললিত। তুমি এগিয়ে যাও তো! দেখি কেমন আমাকে ছাড়া পারো।

ঘন ছায়ায় ঠান্ডা হয়ে আছে গলিটা। গলির মুখেই তেজি রোদ। ছুরির মতো ধারালো হয়ে আছে রোদ ও ছায়ার সীমারেখাটুকু। সেই রেখাটার ধারে দাঁড়াল ললিত। চোখ বুজে ভাবল সে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রহ্মপুত্র নদী— তাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে যা বয়ে যেত। না, দেশের কথা তেমন মনে নেই ললিতের। সে তখন ছোট, মা তখন এত বুড়ি নয়, আর বাবা বেঁচে আছে তখনও। মনে পড়ে সে তখন সাঁতরে গাঙ পার হত, গাছে উঠত। আশ্চর্যের বিষয়, কলকাতায় এসে তার কোনও দিন গঙ্গায় নামতে তেমন তীব্র ইচ্ছে হয়নি। দেশগ্রামের সঙ্গে সঙ্গেই যে যেন তার সাঁতার আর গাছে-ওঠাও ফেলে এসেছে অনেক দূরে, ভিন দেশে। সেইখানে ফিরে গেলে আবার এক বার ফিরে পাওয়া যেতে পারে সেই সাঁতার কিংবা সেই কাঠবেড়ালির মতো গাছ-বাওয়া! দেশ ভাগের পর একদিন দূরের স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য শেষ রাতে তারা গ্রাম ছেড়ে এল। খুব বেশি কিছু মনে নেই ললিতের, শুধু মনে আছে ঘুমচোখে শেষরাতের অন্ধকারে পা ফেলতে গিয়ে সে তাদের উঠোনে বিষ-পিঁপড়ের ঘর ভেঙেছিল। বিদ্যুৎ চমকের মতো তার পায়ের পাতা থেকে ঊরু পর্যন্ত উঠে এসেছিল পিঁপড়ের কামড়। বিষ-যন্ত্রণা। চিৎকার করে কেঁদেছিল সে, আর বাবা চাপা গলায় কাকুতি মিনতি করে বলছিল ‘চুপ কর ললিত, চুপ কর।’ আর হাত ধরে জোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে। তখনও ঘুমচোখ, মাথায় স্বপ্নের বাসা, দিকহীন শেষরাতের আবছা অন্ধকারে বাবার হাত ধরে কোন পথে কোথায় যে যাচ্ছিল ললিত!

ক্রমে ক্রমে আর সবকিছুই আবছা হয়ে গেছে। এখন আর ঠিকঠাক সব মনে পড়ে না। কেবল মনে আছে পায়ের পাতা থেকে ঊরু পর্যন্ত সেই বিষ-পিঁপড়ের কামড়। সেই বিষ-যন্ত্রণা। এত স্পষ্ট যে আজও হঠাৎ মনে পড়লে তার ভিতরকার এক ছোট্ট ললিত যন্ত্রণায় মোচড় খেয়ে ওঠে। ওই উঠোনে কত দাপিয়ে বেড়িয়েছে ললিত। কোনও দিন পিঁপড়ের ঘর নজরে পড়েনি। সেদিন তবে তাদের চেনা উঠোনে কোথা থেকে এসেছিল সেই পিঁপড়ের বাসা? কোথা থেকে?

কে জানে?

মা কেবল গল্প করে। নদী, নৌকো আর গাছগাছালির গল্প। মাছ, ধান আর পিঠে-পায়েসের গল্প। একঘেয়ে, তবু মাঝে মাঝে কান পেতে শোনে ললিত। মায়ের গলায় জল-মাটির নোনা আর সোঁদা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যায়। তবু সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে সেই পিঁপড়ের কামড়, শেষরাত্রির আবছায়া ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যে এক অলৌকিক নিরুদ্দেশ যাত্রা।

ছয়

সিগারেটটা তখনও শেষ হয়নি, মোড় পেরিয়ে আদিত্যকে আসতে দেখল ললিত। ব্যাটা অফিস কেটে এসেছে। ওর পিছনে কালো মতো একটা মেয়ে আসছিল। প্রথমে ললিত ভেবেছিল যে পথ-চলতি মেয়ে। কিন্তু কাছে আসতে বোঝা গেল সে আদিত্যর সঙ্গে আসছে।

এই যে লোলিটা। বলে হাসল আদিত্য। রোগা-ফরসা আদিত্য, ঝাঁকড়া চুল— মোটা ঠোঁটের আদিত্য, বেঠিক পোশাকের আদিত্য। কলকাতার বনেদি ঘুঘু ওদের বরিবার, বাগবাজারে ওদের প্রকাণ্ড একটা বাড়ি আছে যার ভিতর-মহলে যাওয়া এখনও বারণ, আর ওর বাবার এখনও একজন রক্ষিতা আছে শোভাবাজারে, যাকে আদিত্য এবং তার ভাইরা রাঙা-মা না কী-যেন-মা বলে ডাকে। বাইরের চাকরি-বাকরি, আড্ডা সেরে বাড়িতে ঢুকলেই ওরা দেড়শো বছরের পুরনো একটা জগতের মধ্যে চলে যায়, যেখানে এখনও রয়েছে দেড়শো বছরের পুরনো বাসন-কোসন, বিছানা, সেজবাতি, আলমারি, পুতুল এবং আচরণ।

আয়। বলে একটু বিব্রত মুখে হাসল ললিত, বলল, ঘরে এক দঙ্গল বুড়ির ভিড়। কোথায় যে তাদের বসাব!

আদিত্য মেয়েটার দিকে ফিরে বলল, এই হচ্ছে ললিত। কাঠ বাঙাল। তারপর ললিতের দিকে ফিরে বলল, বুঝলি লোলিটা, সতীর এক মেসোমশাইয়ের ক্যান্সার হয়েছিল। অপারেশনের পর বেঁচে গেছে!

ললিত হাসল, তাই নাকি!

মেয়েটিকে এক পলকেই দেখে নিল ললিত। সম্ভবত আদিত্যর প্রেমিকা। কালোর মধ্যে মিষ্টি মুখখানা, সুন্দর বড় একজোড়া চোখ। দেখে মনে হয় প্রাণে দয়ামায়া আছে, হৃদয় আছে। চালু নয় খুব। কিন্তু রোগা নরম ধরনের শরীরটিতে মা-মা ভাব। একনজরেই ভাল লাগে। আদিত্যর কপাল ভালই। কিন্তু মেয়েটার?

ললিত মৃদু গলায় বলল, চলুন, আপনাকে আমার মা’র কাছে নিয়ে যাই। আমরা দুই বন্ধু গলিতে দাঁড়িয়ে গল্প করব।

আদিত্য বাধা দিল, তুই ওকে লজ্জা পাস না ললিত। মাইরি, তোর যা লজ্জা! পরিচয় করে নে, এ হচ্ছে শাশ্বতী ব্যানার্জি, আমি সংক্ষেপে সতী বলে ডাকি। আমাদের শিগগিরই বিয়ে হবে। কালীনাথের কাছে তোর ফোনের খবর পেয়েই কলেজে গিয়ে ওকে ধরলুম। তোর কথা ওকে অনেক বলেছি, তাই বললুম, চলো দেখে আসবে, আর তোমার মেসোমশাইয়ের গল্পটাও শুনিয়ে দিয়ে আসবে ওকে। ব্যাটা সাহস পাবে তা হলে।

ললিত আবার মেয়েটিকে বলল, ঘরে চলুন।

মেয়েটি দ্বিধায় পড়ে বলল, থাক না, আমি বরং এইখানেই দাঁড়িয়ে গল্প করি।

আদিত্য বলল, সেই ভাল। মাসিমা একা থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু পাড়ার বুড়িদের চোখ কটকট করবে। মাসিমাকে পরে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবে হয়তো। থাকগে। ললিত মাইরি তুই হাসপাতালে থেকে একটু লালটু হয়েছিস।

তুই তো এক দিনও যাসনি দেখতে হাসপাতালে!

মাইরি, তুই রাগ করেছিস? আমার ভাই কোনওকালে হাসপাতাল-টাতাল সহ্য হয় না, ওষুধের গন্ধ, মড়া-ফড়া, রোগের জীবাণু সব মিলিয়ে কেমন গা গুলোয়, বমি পায়, মাথা ধরে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হয় কেমন একটা ভয় ঢুকে যায় মাইরি, মনে হয় আমিও মরে যাব। রাতে ঘুম হয় না। আমাদের সাতপুরুষের কেউ হাসপাতালে যায়নি, বাড়ির বাঁধা ডাক্তারের হাতে মরেছে। তুই তো জানিস।

ললিত হাসল, ঠিক আছে, তোকে ফাঁড়া কাটাতে হবে না। ললিত মেয়েটিকে বলল, আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি গায়ে একটা জামা দিয়ে আসি। পাড়ায় একটা চায়ের দোকান আছে। বাজে দোকান। সেখানে বসেই একটু গল্প করা যাবে। কেমন!

মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।

ঘরে ঢুকে যখন জামা নিচ্ছিল ললিত তখন মা বলল, বেরোচ্ছিস?

না। চায়ের দোকানে যাচ্ছি।

কেবল চা আর চা।

বেরিয়ে এল ললিত।

গণেশের দোকান। বাইরের দিকে কাচের বাক্সে ছানার মিষ্টি সাজিয়ে রাখে, ভিতরে ঘিঞ্জি জায়গায় একখানা বেঞ্চি আর লম্বা একটা টেবিল, অনেকটা স্কুলের হাইডেস্কের মতো। সকাল বিকেল পাড়ার বখাটে ছেলেরা আড্ডা দেয় এখানে। দুপুর বলে কেউ নেই। গণেশ তার শিয়রে কাঠের ক্যাশ বাক্স তার মুখের ওপর মাছির জন্য আধময়লা গামছা ফেলে রেখে ঘুমোচ্ছিল। ডাকতে যাচ্ছিল ললিত, আদিত্য বাধা দিয়ে বলল, দে না ঘুমোতে বেচারাকে। আমরা নিরিবিলিতে গল্পগাছা করি, ও যখন উঠবে, উঠবে।

শাশ্বতী মৃদু গলায় বলল, সেই ভাল।

তিনজনে পাশাপাশি বসল। মাঝখানে আদিত্য; দু’ পাশে শাশ্বতী আর ললিত।

আদিত্য বলল, দ্যাখ, মাইরি, আমি বড় মুশকিলে পড়ে গেছি। জীবনে একটা মাত্র প্রেম করলুম, তাও বাঙাল মেয়ের সঙ্গে।

বাঙাল! ললিত ঝুঁকে শাশ্বতীর দিকে তাকাল, কোথায় বাড়ি ছিল আপনাদের?

যশোরে, কপোতাক্ষতীরে।

কপোতাক্ষতীরে!

শাশ্বতী হাসল, সাগরদাঁড়ি থেকে আমাদের গ্রাম খুব দূরে ছিল না। আমি অবশ্য দেশ দেখিনি, আমার জন্ম কলকাতায়, দেশ ভাগের পরে। তবু লোককে বলার সময়ে বলি আমরা মাইকেল মধুসূদনের প্রতিবেশী ছিলাম।

আদিত্য করুণ মুখে বলল, হ্যাঁ দ্যাখ, শাশ্বতী পুরোপুরি বাঙালও নয়, কলকাতার লোকেদের চেয়েও ভাল কলকাতার কথা বলে, ওর বাড়ির লোকেরাও তাই, কিন্তু আমার বাড়ির লোকেরা কিছু বুঝবে না। বাঙালের গন্ধ পেলেই কুরুক্ষেত্র লেগে যাবে। মাইরি দ্যাখ, আমার বেশির ভাগ বন্ধু বাঙাল, তুই, তুলসী, সঞ্জয় আরও অনেক, নিজের পাড়ায় আমার বন্ধু নেই, তবু দ্যাখ বিয়ের সময়ে বাড়ি থেকে ঠিক করবে আর-এক ঘূণধরা বনেদি পরিবারের মেয়ে— যার গায়ে রোদ লাগেনি।

কী করবি এখন! হেসে ললিত বলে।

আমি আলাদা হয়ে যাচ্ছি বাড়ি থেকে। বলে আদিত্য শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে হাসল, বুঝলি লোলিটা, সতী বলেছে যে, ও আমাদের পরিবারে ঢুকে একটা বিপ্লব ঘটাবে। মা’কে ট্যাক্সি করে নিয়ে সিনেমায় যাবে। বাবাকে ষোলো ইঞ্চি ঘেরের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরিয়ে নিয়ে যাবে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে। মাইরি, সতী, তোমার আয়ুটা গণৎকার দিয়ে দেখানো উচিত। আমি ও-সব রিস্‌ক-এর মধ্যে নেই। আমি আলাদা বাস করছি।

ললিতের ইচ্ছে হল একবার জিজ্ঞেস করে যে, তা হলে কী করে ওদের চলবে! আদিত্য চাকরি করে সরকারের, বড় কেরানি। তবু ললিত জানে চাকরিটা ওর কিছু নয়, ওর আসল অস্তিত্ব ওর বাগবাজারের বাড়ি আর বাবার ব্যবসা। নিজের বাড়িকে যতই গাল দিক আদিত্য, তবু ললিত জানে ওই বাড়ি আছে বলেই আদিত্যকে অনেক কিছুই সইতে হচ্ছে না, ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে বাইরের পৃথিবীর নানা রকমের মার সে সইতে পারবে কি! ভাবল ললিত, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। সুখী ছেলে আদিত্য, খুব পুরু বিছানায় শোয়, কেওড়া দেওয়া জল খায়, শ্বেতপাথরের ওপর হাঁটে।

আদিত্য শাশ্বতীকে বলছিল, আমার বাবা এক্কেবারে খ্যাপা, বুঝলে! বাবা না মাইরি, একটা লোককে কামড়ে দিয়েছিল। বলে ফিরে ললিতের দিকে চেয়ে বলল, তুই তো জানিস! সেই শরিকের ঝগড়া, বাবার জ্যাঠতুতো ভাই আমাদের অস্তুকাকুকে বাবা দিনেদুপুরে কামড়ে দিল…

গল্প বলার এমনই একটা বৈঠকি চাল আছে আদিত্যর যে, যে-কোনও গল্পকেই সে সকলের শোনার মতো করে তোলে। আর-একটা গুণ— ও নিজের কিছুই গোপন রাখে না। সব বলে দেয়, মনে যা আসে সব।

গল্পটা বলতেই যাচ্ছিল আদিত্য, শাশ্বতী নিচু গলায় ওকে কিছু বলল। আদিত্য— ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বলে ললিতের দিকে চেয়ে বলল, দ্যাখ মাইরি নিজের সমস্যা নিয়ে এমন মেতে আছি, তোর খোঁজই নেওয়া হচ্ছে না।

ললিত জিজ্ঞেস করল, তোরা কবে বিয়ে করছিস?

দেখি। শিগগিরই করব। তুই একটা বাসা খোঁজ— বলেই আবার সামলে গেল আদিত্য, তোর তো আবার অসুখ! শালা, এ-বয়সে কোথা থেকে বাগালি রোগটাকে! মাইরি, পারিস তুই মানুষকে চমকে দিতে! তারপর গলা নিচু করে বলল, হ্যাঁরে লোলিটা, মরে-ফরে যাবি না তো! মাইরি, মরিস না, ভীষণ ভেঙে পড়ব রে, শালা আর বাঁচতেই ইচ্ছে করবে না। কথা দে—

কী কথা?

মরবি না।

ললিত হাসল প্রাণ খুলে। তারপর বলল, এখন আর কিছু দিতেই আপত্তি নেই। যা, দিলাম তোকে কথা।

দিলি! তা হলে মরবি না। বরং সতীর কাছে ওর মেসোমশাইয়ের গল্পটা শুনে নে।

শাশ্বতী ঝুঁকে ললিতের দিকে চেয়ে বলল, আমার মেসোমশাইয়ের গল্পটা কিন্তু সত্যি। উনি এখনও বেঁচে আছেন, চাকরি করছেন।

তাই নাকি! ললিত হাসল।

শাশ্বতী গলায় যথেষ্ট দৃঢ়তা আনার চেষ্টা করে বলল, দেখবেন, আপনি সেরে যাবেন।

হঠাৎ ললিত খুব নিষ্ঠুরের মতো শাশ্বতীকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে হেসে বলল, আপনারা তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলুন। আমি যেন দেখে যেতে পারি।

বলেই দেখল শাশ্বতীর মুখ ম্লান হয়ে গেল। আদিত্য তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল শালা যমের জান লিয়ে লিব, দেখে লিস।

বিকেলের মুখে মুখে ওরা উঠল। তুলসী আর সঞ্জয় আসবে, কিন্তু সে-খবর আদিত্যকে দিল না ললিত। তা হলে আদিত্য থাকতে চাইবে। না, ওরা বরং এখন ময়দান বা গঙ্গার ধারে বা দোকানে গিয়ে বসুক, কিংবা হাঁটুক রাস্তার সুন্দর দোকানের আলোগুলোর ভিতর দিয়ে। কথা বলুক। শাশ্বতীকে তার কাছে এনে ভাল করেনি আদিত্য। সুন্দর মেয়েটা এমন একজনকে দেখে গেল, যে আর কিছুদিন পরে মারা যাবে। হয়তো এখন নানা দিনের মধ্যে মাঝে মাঝে সে দুঃখিতচিত্তে ললিতের কথা ভাববে। সভয়ে প্রতীক্ষা করবে আদিত্যর কাছে একদিন তার মৃত্যুসংবাদ শোনার। ললিত বোধ হয় আজ মেয়েটার বিকেল মাটি করে দিল, হয়ে রইল রাতে ওর মাথা ধরার বা কম খাওয়ার কারণ।

যশোরে কপোতাক্ষের তীরে ছিল ওর বাড়ি। সাগরদাঁড়ি থেকে খুব দূরে নয়। গলির মুখে দাঁড়িয়ে আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে সে কবিতাখানা মনে আনবার চেষ্টা করছিল— দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে…কবিতাটা কতবার ক্লাসে পড়িয়েছে ললিত। আশ্চর্য, তবু মুখস্থ হয়নি!

সাত

সারা সকাল মৃদুলাকে একা পাওয়া গেল না। বাইরের ঘরে বাচ্চাদের পড়াচ্ছে একটি অল্প বয়সের কলেজের ছাত্রী। মাঝখানের ঘরটাতে বিছানায় খবরের কাগজ বিছিয়ে সারা সকাল দাদা বসে আছে। ভিতরের ছোট্ট বারান্দায় রান্নার জায়গা— সেখানে বউদি। বাসাটা জুড়েই দাদার সংসার। সে আর মৃদুলা দুটো ফালতু লোক বাস করছে এখানে— এ-রকমই মনে হয় তুলসীর।

বারান্দার কোণে বসে চা খাচ্ছিল তুলসী, আর একটা চোর-বেড়ালের মতো আড়চোখে চেয়ে দেখছিল, ধপধপে সাদা পরিষ্কার একটা লালপাড়ের শাড়ি পরে মৃদুলা খুব নরম হয়ে বসে পিতলের গামলা কাত করে চাল-ধোয়া জল হাতের আঁজলায় ছেঁকে নিচ্ছে। সকালে চুল আঁচড়ে সিঁদুর পরেছে সে, নোয়ানো মাথায় লাল ধুলোর পথের মতো অনেক দূর চলে গেছে, রেখাটি, শান্ত শরীর মায়ের মতো নিষ্কাম হয়ে আছে সকালের আলোয়।

সকালের দিকেই সুন্দর সুন্দর কথা মনে আসে তুলসীর। কিন্তু মৃদুলাকে বলা হয় না। সারা দিন পর যখন রাতে মৃদুলাকে একা পায়, তখন তুলসীর মাথার ভিতরটা হিজিবিজি হয়ে যায়, একটাও তেমন সুন্দর কথা মনে পড়ে না। তখন মনে হয় সারা দিন ধরে জরাজীর্ণ এক পৃথিবীর ধুলো-ময়লা গায়ে মেখে সে বিছানায় এসে বসেছে। তখন কেবল ব্যর্থতা আর অপমানগুলি মনে পড়ে— হেডমাস্টার কেমন অবহেলার সঙ্গে কথা বলেছিল, শিবকালী ঘোষ করেছিল বদ একটা রসিকতা, ক্লাস টেন-এর লম্বা কালো মতো একটা ছেলে সারা ক্লাস ‘বেঞ্চে ছারপোকা সার’ এই কথা বলে আর ইয়ারকি দিয়ে তাকে জ্বালিয়েছিল; কিংবা মনে পড়ে, ট্রেনে একটা অচেনা লোক ভিড়ের মধ্যে তার দিকে কেমন স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তাই তখন সুন্দর কথাগুলি মনে পড়ে না কিছুতেই। কেবল সকালবেলাতে তার মন স্মৃতিশূন্য থাকে, ফাঁকা ঘরে পাখির মতো উড়ে আসে চমৎকার সব কথা। কিন্তু মৃদুলাকে একা পাওয়া যায় না।

সকালবেলার সুন্দর কথাগুলো মৃদুলাকে বলা হয় না। ওদিকে বয়স বেড়ে যায়।

দাদার সংসারে অনেককাল থাকা হয়ে গেল তার। চুয়াল্লিশ সালে বাবা মারা গেল, তার সাড়ে তিন বছর পর মা, তারপর থেকে দিন শেষে বাসায় ফেরার সময়ে কোনও দিন তার মনে হয়নি, বাসায় ফিরছি। এখন মাঝে মাঝে তার নিজের বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে। নিজের বাসা। যেখানে সকালবেলা সুন্দর কথাগুলো সে অনর্গল শোনাবে মৃদুলাকে, সেখানে সকালে মাস্টারনি এসে বাচ্চাদের পড়াবে বলে তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরের বিছানা ছাড়তে হবে না, যতক্ষণ খুশি উদোম হয়ে শুয়ে থাকবে তুলসী, ইচ্ছে হলে সারা ঘর ঘুরে চোর-চোর খেলবে মৃদুলার সঙ্গে, কিংবা চেঁচিয়ে বলবে, আমি তোমাকে ভালবাসি।

কত কিছুই ইচ্ছে করে তুলসীর। হয় না। চা শেষ করে একটু বিষণ্ণ অন্যমনস্ক মনে তুলসী বাজারে বেরোল। কয়েক দিন আগে স্কুলে বেরোবার সময়ে মৃদুলাকে একটু একা পেয়েছিল সে। মৃদুলা বাইরের ঘরে মাস্টারনির এঁটো চায়ের কাপ নিতে এসেছিল, সেই সময়ে দরজার আড়ালে টেনে নিয়ে এক পলকে মৃদুলাকে একটা চুমু খেয়েছিল সে। আর, ঠিক সেই মুহূর্তেই দু’ ঘরের মাঝখানের দরজার পরদা সরিয়ে বড় ভাইঝিটা ব্যাপার-স্যাপার দেখে ফেলল। বাপারটা হঠাৎ হয়ে-যাওয়া কিনা কে জানে! বড় ভাইঝি পিতু বারো বছর বয়সেই ঝানু পেকে গেছে। ফ্রকের তলা থেকে ঠেলে উঠছে বুক, চোখে চিকন কাজ দেখা যাচ্ছে তার, ছাদ থেকে পশ্চিমে ঘোষালদের যে ছাড়া জমিটা দেখা যায় সেখানে এক দঙ্গল ছেলের আড্ডা। তারা ঘুড়ি ওড়ায়, সিগারেট ফোঁকে, বদ মতলবে ভাঙা ইটের টুকরো জড়ো করে। ছাদের আলসে থেকে পশ্চিমে পিতুকে অনেকবার সন্ধেবেলায় ঝুঁকে থাকতে দেখেছে তুলসী। তা ছাড়া মৃদুলার কাছে শুনেছে যে, পিতু গোপনে মৃদুলার সুটকেস হাঁটকায়, খুঁজে দেখে কাকা কাকিমাকে গোপনে কিছু শাড়ি-টাড়ি দিল কি না। তা ছাড়া মৃদুলাকে মাঝে মাঝে নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করে, রাত্রিবেলা তোমাদের ঘরে অত শব্দ হয় কেন? কাজেই পিতুর মতো পাকা মেয়ে সেদিন, সেই চুমু খাওয়ার দিন যে কাকা-কাকিমার ব্যাপারটা দেখার জন্য ওত পেতে ছিল না, তা কে বলতে পারে!

যেদিন ললিতকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিল তুলসী সেদিন হঠাৎ তার শম্ভুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, এবার ললিতরা না থাকলে ওদের বাসাটা শম্ভুরা কতয় ভাড়া দেবে। এ-রকম নৃশংস চিন্তা কেন তার মাথায় এসেছিল তা সে বুঝতে পারেনি তখন। পরে ভেবেছে যে, আসলে সেটা ছিল তার অবচেতন মনেরই ব্যাপার। আর খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে, সেদিনই বাসায় ফিরে সে দেখল, দাদা বউদি বাচ্চারা কেউ বাসায় নেই, অন্ধকার বাসায় বাইরের ঘরের মেঝেয় বসে মৃদুলা কাঁদছে। তুলসী রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? মৃদুলা বলল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। তুলসী জিজ্ঞেস করল, কী কথা? মৃদুলা বলল, তুমি আলাদা বাসা করো। আমি এখানে থাকব না। ভীষণ চমকে গেল তুলসী, বাসা। বাসা কেন? মৃদুলা গলায় ঝাঁঝ দিয়ে বলল, এখানে আমি মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারছি না। আমি চিরকাল লেখাপড়া শিখেছি, গান গেয়েছি, তাই ঘরের কাজ শিখিনি, সেটা কি খুব দোষের? আমার হাতে রুটি ফোলে না, পিরিচ ভাঙে, ঘর ঝাঁট দিলে কোন কোনায় ময়লা থেকে যায়— তাই আমি অলক্ষ্মী? দরকার হলে দিদি শিখিয়ে নিক, বড়রা নেয় না? তা না করে দিদি সকলের কাছে আমার অকাজের কথা বলে বেড়ায়। আবার দেখো, দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি না গিয়ে পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম বলেও কথা উঠেছে। দিদির কোন এক ভাই যেন আমাদের পাড়ায় থাকে, সে বোধ হয় বিভুর ব্যাপারটা কিছু বলেছে দিদিকে, তাই দিদি আজকাল শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আজকালকার মেয়েদের ফ্রক না ছাড়তেই ভালবাসা, পিরিতের কাপ্তানরা সব রাস্তায় ঘাটে বসে থাকে, এখন বাপের বাড়ি যাওয়ার পথ বন্ধ, লজ্জায় মরে যাই। এই সব নোংরা কথা। তুমিই বলো, আমার দোষ ছিল? তা ছাড়া দিদির নিজের মেয়ে কী? ওই পিতু! স্কুল-রাস্তায় পিতুর জন্য কাপ্তানরা দাঁড়িয়ে থাকে না? ওর বইয়ের বাক্স খুঁজলে চিঠি পাওয়া যাবে না? অত বড় মেয়ে ফ্রক পরে বুক দেখিয়ে বেড়ায়, হুট হাট সিনেমায় যাচ্ছে, ফাংশন দেখে রাত করে ফিরছে, দিদি দেখেও দেখে না। তারপর দেখো পরশুদিন দুপুরে খাওয়ার পর বাথরুমে গিয়ে বমি করেছি সন্ধেবেলা সেটা দাদাকে শুনিয়ে দিদি বলল, দেখো বিয়ের মাস থেকেই বেঁধে গেল, একটুও আঁট নেই, বেহায়া আর কাকে বলে! কেন বলবে ও-কথা? আমি কি আঁটকুড়ি যে আমার বাচ্চা হবে না? আজ আমার বাবা এসেছিল, দিদি তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, মেয়েদের গান-বাজনা, লেখাপড়া শেষ পর্যন্ত কাজে লাগে না; ও-সব বড়লোকে বড়লোকে চলে। আমাদের সাধারণ ঘরে লক্ষ্মীরই কদর বেশি, সরস্বতীর তেমন নয়। ঘুরিয়ে বলা, কিন্তু বাবা তো বোকা নয়, তাই আমাকে আড়ালে ডেকে বকে গেল, কাজকর্ম করবি। তুলসীর বাবা-মা নেই, দাদা-বউদিই ওর বাপ-মার মতো। ওঁরা যেমন চালায় তেমনই চলবি। আমি বাবাকে কিছু বললুম না, কিন্তু বলো, দুঃখ হয় না? বাবা কোনও দিন আমাকে বকে না, জানো? তাই আজ বিকেল থেকে আমি কাঁদছি। তা ছাড়া দেখো, আজকাল দিদি আমাকে একা রেখে দুপুরে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বেড়াতে চলে যায়, বলে, এতকাল আমি ঘর আগলে থেকেছি, এবার তুমি আগলাও, আমি একটু হাঁফ ছেড়ে আসি। তুমিই বলো, এ বয়সের নতুন বউকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক? দুপুরের কলকাতা ডেঞ্জারাস নয়? কত ঠগ, জোচ্চোর, খুনে এখানে ফিরিওয়ালার সাজ পরে আসে, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সেজে আসে, ডাকপিয়ন হয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। তা ছাড়া কে জানে বিভুর দলবল এখনও তক্কে তক্কে আছে কি না! তুমি সন্ধের আগে ফেরো না, কখনও বা বন্ধুর অসুখ দেখতে যাও, একা একা আমার ভয় করে। আমি এখানে থাকব না। তুমি বাসা না করলে ঠিক বাপের বাড়ি চলে যাব। বাবা আজ বলে গেল, এখনও বিভুর দলবল বাসায় ঢিল ছোড়ে, বেয়ারিং ডাকে বেনামা চিঠি দিয়ে শাসায়, গেলে হয়তো অ্যাসিড বালব ছুড়বে, ছোরা বসাবে, বোমা মারবে, কিংবা জোর করে টেনে নিয়ে যাবে…

অত কথা একসঙ্গে সঠিক বুঝতে পারেনি তুলসী। বুঝবার দরকারও ছিল না তুলসী জানে বাংলাদেশে সেই পুরনো আমল আর নেই, যখন দুটো আহ্লাদি বেড়ালের মতো দাঁত নখ লুকিয়ে মা আর জেঠিমা এক পাতে গন্ধলেবুর পাতা দিয়ে মেখে পান্তাভাত খেতে বসত। মেয়েতে মেয়েতে কোনও দিনই ঠিক ঠিক ভাব হয় না, পুরুষদের যেমন হয়। তবু কী করে যেন মা আর জেঠিমা কেউ কাউকে সহ্য না করেও বিশ বছর একসঙ্গে ছিল। তবু বাংলাদেশে সেই পুরনো আমল আর নেই, মানুষের সহ্যশক্তি অনেক কমে গেছে। তুলসী অন্য কথা ভাবে। স্কুল থেকে সে নিয়মিত বেতন পায় না, ছাত্ররা গ্রামের গেরস্থ কিংবা চাষার ছেলে, নিয়মিত মাইনে দেয় না, যা দেয় তাই তারা সবাই ভাগ করে নেয়— কোনও মাসে পঞ্চাশ, কোনও মাসে ষাট। ন’ মাসে ছ’ মাসে সরকারি সাহায্যের টাকা আসে। তাই তার অভাবের মাসগুলো দাদাই চালিয়ে নেয়। আলাদা বাসা করলে কীভাবে চলবে? তা ছাড়া মৃদুলাকে আলাদা বাসায় ফেলে রেখে কী করে অত দূরে যাবে তুলসী! যখন দুপুরের কলকাতা ভয়ংকর! যখন বিভুর দলবল হাল ছাড়েনি।

শান্ত মনে সকালের ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বাজারে যাচ্ছিল তুলসী। মাথার মধ্যে এ-সব হিজিবিজি চিন্তা ঘুলিয়ে উঠতে লাগল।

সকালে প্রায়দিনই বাজারে একটা মোটাসোটা আধবুড়ো লোককে ঘুরে বেড়াতে দেখে তুলসী। বড় নিরীহ, ভিতু-চেহারা, দেখলেই মায়া হয়। লোকটা বিষণ্ণ চোখে চারদিকে দেখতে দেখতে যায়, এ-দোকান সে-দোকানে একটু দরদস্তুর করে, কেনে খুব অল্পই, কিন্তু বাজারের চত্বরে অনেকক্ষণ তাকে থাকতে দেখেছে তুলসী। কোনও দিনই খুব খেয়াল করে দেখে না। আজ দেখল, নাকফুল কানফুলের মতো ছোট ছোট ফুলকপি নিয়ে যে বেচুনি মেয়েছেলেটা অহংকারে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, তারই মুখোমুখি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। কোনও দরকার ছিল না, কেবলমাত্র মাথায় হিজিবিজি চিন্তাগুলোকে তাড়ানোর জনাই তুলসী হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে একটু হেসে লোকটাকে বলল, ফুলকপি নিলেন?

তার দিকে চেয়ে একটু ম্লান হাসল লোকটা, না। বাবার কথা ভাবছিলাম। বাবা বড় ভালবাসতেন।

ওঃ হোঃ। বলে বুঝদারের মতো হাসল তুলসী।

আমি ফুলকপি খাই না। তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে লোকটা লাজুক গলায় বলল, বাবা খেয়ে যেতে পারেনি। সেদিন এই ফুলকপি, মুলো দিয়ে মটরের ডাল, বেগুন ভাজা রান্না হয়েছিল দুপুরবেলায়। ছুটির দিন ছিল, সারা সকাল বিছানায় পুরনো প্রবাসী পড়েছে লোকটা, তারপর বোধ হয় ঢুলুনি এসেছিল একটু। স্নান-খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে মা দেখল, লোকটা ঘুমোচ্ছে যেন— খোলা প্রবাসীর ওপর যত্নে রাখা চশমা-জোড়া, দু’ পায়ে আঁকড়ে-ধরা কোলবালিশ, নাকের ওপর জমে আছে সেই চিরকালের ঘামের ফোঁটা, তবু লোকটা নেই।

আহাঃ! তুলসী বলল।

বাপ মা’র মতো জন হয় না। লোকটা ধীর শান্ত গলায় বলে, আমার বাবা লোকটা ছিল গরিবজন, ছোট দোকানের দোকানদার, এক-আধদিন ভাল-মন্দ খেতে পেত। বেঁচে থাকতে কোনও দিন মান্যগণ্য করতাম না। কিন্তু এখন! এখন কেবল সেই খোলা প্রবাসীর ওপর ডাঁটি-ভাঙা চশমা-জোড়া মনে পড়ে। বড় আশায় আশায় আমার দিকে চেয়ে আছে। বলতে বলতে লোকটা তুলসীর দিকে অন্যমনে তাকায়, কিন্তু তুলসীকে বোধ হয় সঠিক দেখে না, ম্লান একটু হেসে বলে, বাবা মরে যাওয়ার অনেক পরে আমি বাপ হয়েছিলাম। একটাই ছেলে ছিল আমার অসৎ, বখা, গুন্ডা। অতি আদরে বাঁদর। সামলাতে পারতাম না। তখন বুঝতে পারতাম তেমনই এক গরিব বাপ আমি, ছোট চাকরি করে খাই, ঘরে বাইরে কেউ কোথাও পাত্তা দেয় না, লোকের নজরে পড়ি না, এমনই ছোট। তখন যেন বাবার সেই ডাঁটি-ভাঙা চশমা-জোড়াই আমার চোখে, জুল জুল করে চেয়ে থাকি, আশায় আশায়। তখন বুঝি বাপ হওয়া কেমন, বাপ কেমন জন। ছেলেটা মিশত বদ, দাঙ্গাবাজ, হারামজাদা ছেলেদের সঙ্গে। উনিশ বছর বয়সে হাতে বোমা ফেটে মারা গেল। অত বড় শরীরটার আর কিছুই ছিল না।

আঃ! তুলসী বলে।

না, আমি আর ফুলকপি, মটরের ডাল, মুলো, বেগুন খাই না, ছেলেটা ভালবাসত মাছ মাংস ডিম, ঝাল লঙ্কা, পেঁয়াজ, রসুন, এঁচোড়ের ডালনা। আমরা সে-সব ছেড়ে দিয়েছি। আমরা বুড়োবুড়ি এখন আর সত্যিই কোনও খাবারের স্বাদ পাই না। লোকটা আবার একটু ম্লান হাসে, বাজার করতে বড় ভালবাসতাম। মা-বাপ, বউ-ছেলে— এদের কার কোনটা স্বাদের জিনিস তা মনে করে, খুঁজে-পেতে, দরদস্তুর করে সেরেক-এ চার-আট আনা কমিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কত আনন্দ ছিল। বাজারও ছিল অন্য রকম। এখন দেখুন বেশি দাম, কম ওজনের বাটখারা, দোকানদারদের তিরিক্ষি মেজাজ, গায়ে গায়ে ব্যস্ত খদ্দেরের ভিড়, বাজারে আর সেই আনন্দ নেই। তবু আসি। চল্লিশ বছর ধরে বাজার করে আসছি— সকালবেলায় এইখানে এই যে এক ঢল সবুজ দেখা যায়, এর বড় নেশা। তাজা তরিতরকারি, শাকপাতা, ঝকঝকে মাছ ঘুরে ঘুরে দেখি। কত কথা মনে পড়ে যায়! মাঝেমধ্যে দর করি, একটু কিনি, কিনি না। শেষ বাজারে বেছে-গুছে সেইসব জিনিস একটু করে নিয়ে যাই, যা আমার বাপ পছন্দ করত না, ছেলে খেত না।

মাছ-বাজারের সামনে লোকটার কাছ থেকে বিদায় নিল তুলসী, বলল, আবার দেখা হবে।

লোকটা একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসে, কত কথা বলে ফেললাম! হ্যাঁ, দেখা হবে। তবে বেশিদিন আর না। চাকরির আর কয়েকটা বছর, তারপর গাঁয়ের দিকে চলে যাব। আমরা আসলে গ্রামেরই লোক মশাই, সাধারণ লোক।

লোকটা তুলসীর মুখের দিকে চেয়ে রইল একটু, তারপর ‘আচ্ছা…’ বলে উদাসীন চোখ ফিরিয়ে নিল। সবজি বাজারের ভিতর দিয়ে ভিড় ঠেলে আস্তে আস্তে চলে গেল। তুলসী দেখল, লোকটার ডান হাতে সাদা শূন্য বাজারের থলিটা হাওয়ায় লটপট করছে।

ব্যাপারটা কিছুই না, তবু বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একটা শান্টিং ইঞ্জিন হঠাৎ গুপ করে ধাক্কা মারে। এখনও বাপ হয়নি তুলসী, কিন্তু মৃদুলার পেটে বাচ্চা এসেছে। অন্যমনস্কভাবে কেনাকাটা করছিল তুলসী, আর দু’-তিনটি কথা তার মাথার মধ্যে মাছির মতো ঘুরেফিরে বসতে লাগল। বাপ কেমন জন…গরিব বাপ আমি সাধারণ মানুষ…আসলে আমরা গ্রামেরই লোক। কথাগুলোর মধ্যে কিছু একটা আছে, যা সে স্পষ্ট ধরতে পারছিল না। অনেকক্ষণ ধরে ভাবল তুলসী। তারপর হঠাৎ লোকটার শেষ কথাটা ভেবে তার মনে হল, গ্রাম! গ্রামে চলে গেলে কেমন হয়! ভাবতেই যথেষ্ট উত্তেজনা বোধ করে তুলসী, মাথার হিজিবিজি কেটে যায়। এতকাল গ্রামে গিয়ে বসবাস করার কথা তার মনেও হয়নি। বরং সে বৃথা তিন বছর ধরে কলকাতায় চাকরি খুঁজেছে। পায়নি। অথচ গ্রামের সেই ভাঙাচোরা স্কুলটাই এতকাল ধরে খাওয়াচ্ছে তাকে। তবে সে কেন কলকাতার কাছে ভিখিরিপনা করবে?

লোকটাকে ঈশ্বর-প্রেরিত বলেই মনে হল তুলসীর। গ্রামে গেলেই এখন সব দিক দিয়ে ভাল হয় তার। লোকটা অত কথার মধ্যে এই কথাটারই ইঙ্গিত দিয়ে গেল না? সেখানে মৃদুলা নিরাপদ, বাসাভাড়া কম, ভালই থাকবে সে। ভাবতে ভাবতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল, সে যেন গ্রামীণ গৃহস্থ-তুলসী, চারধারে ধানের মরাই, সবজিখেত, পোষা গোরু-ছাগল।

এ-কথা ঠিক যে, কলকাতাতেই তার জান পোঁতা আছে। এখানেই চায়ের দোকানে, বন্ধুদের আড্ডায় কেটেছে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। একটা বড় কলকাতা আছে— যার পার্ক স্ট্রিটে রেস্টুরেন্ট, ক্যামাক স্ট্রিটে বাড়ি, কিংবা গ্র্যান্ড হোটেল, সে কলকাতাকে চেনে না তুলসী। সে চেনে জগার দোকান, কফি হাউস, নাইট শোর সিনেমা, মেয়েছেলে দেখা, বেকার ঘুরে বেড়ানো কিংবা সময় নষ্ট করার কলকাতাকে। তবু কলকাতার আত্মাই তার বুকের মধ্যে ধকধক করছে। গ্রামে চাকরি করতে যায় তুলসী, গাঁয়ের লোকের সঙ্গে কথা বলে, গাঁয়ের ছেলেদের পড়ায়, আর সবসময়ে তার মনে হয় ‘আমি এদের চেয়ে উঁচুদরের লোক’। কেন মনে হয় ও রকম কথা কে জানে! হয়তো কলকাতায় বাস করলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে ও রকম অহংকার তৈরি হয়ে যায়। আর অহংকারী হওয়া মানেই নিজেকে না জানা, অন্যকেও না জানা। এখন ওই ঈশ্বর-প্রেরিত লোকটার কথারই প্রতিধ্বনি সে তার মনের মধ্যে শুনতে পায়। এক গরিব জন আমি— সাধারণ মানুষ। কোটি কোটি মানুষের একজন মাত্র। দেশ-গ্রামের সঙ্গে তার নাভির যোগ, কলকাতা সেই নাড়ির বন্ধন ছিঁড়ে রেখেছে বহুকাল ধরে। এবার গ্রামেই চলে যাবে তুলসী।

বাজার থেকে ফিরে সারা সকাল মৃদুলাকে এই কথাটা বলার সুযোগ খুঁজল তুলসী। পেল না।

স্কুলে যাওয়ার পথে রেল গাড়ির কামরায় সে মানুষজনের দিকে চেয়ে রইল। গাড়ির মেঝেয় বসে দুটো লোক পোনামাছের চারা-ভরতি-জলের হাঁড়িতে থাবড়া দিতে দিতে চলেছে, খালি ঝুড়ি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে কয়েকজন ব্যাপারী, দুই বেঞ্চের মাঝখানে গামছা বিছিয়ে ব্রিজ খেলছে তারা, গাড়িতে উঠে হাঁকডাক শুরু করেছিল; একজন চিরুনি অন্যজন হাতকাটা তেলের ফিরিঅলা, বিক্রিবাটা মন্দা দেখে এখন তারা নিবিড় হয়ে বসে গল্প করছে। সাধারণ মানুষ সব, দুঃখী মানুষ। এদেরই একজন সে! ভাবতে ভাবতে আনন্দে শিউরে উঠল তুলসী। কলকাতায় থাকতে থাকতে এতদিন এ-কথাটা তার মনেই হয়নি। তার মনে পড়ল কতবার রাস্তায়-ঘাটে মানুষজন তার কাছ থেকে বিড়ি-সিগারেট ধরাতে আগুন চেয়ে নিয়েছে, কত লোক জিজ্ঞেস করেছে ঘড়িতে ক’টা বাজল, কত লোক দুঃখের কথা বলতে চেয়েছে তাকে। তুলসী ভাল করে তাদের মুখও দেখেনি। কলকাতায় থাকারই মুদ্রাদোষ ওটা। হ্যাঁ, এবার গ্রামীণ-গৃহস্থ হয়ে যাবে সে, খেত-খামার করবে, ও-গ্রাম সে-গ্রামের লোকেদের চিনে বেড়াবে, খালি পায়ে হাঁটবে মাটির ওপর।

স্টেশন থেকে স্কুলে যাওয়ার দুটো রাস্তা। একটা জাতীয় সড়ক, সেটা ঘুরপথ। আর একটা ধানখেতের মধ্য দিয়ে, আলপথ। আলপথেই যায় তুলসী। মাইল খানেক রাস্তা। অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল সে। হঠাৎ দেখতে পেল সামনে একটা পতিত জমির ওপর দিয়ে দৌড়ে এসে একটা লোক আলের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে। হাঁটুর ওপর কাপড়, খালি গা, মাথায় গামছা জড়ানো। কাছাকাছি হতেই লোকটা তুলসীর দিকে চেয়ে হঠাৎ হাত তুলে জমিনটার দিকে দেখিয়ে বলল, ওই যে দেখেন!

তুলসী দাঁড়িয়ে পড়ল, কী?

ওই যে! লোকটা আঙুল দিয়ে দেখালে, দেখছেন?

তুলসী দেখল। এবড়ো-খেবড়ো জমি, মাটির ঢেলা, আর ঘাসের মধ্যে প্রথমটায় ভাল দেখা যায়নি, তারপরই দেখা গেল জমির ঠিক মাঝখান দিয়ে কোনাকুনি সাপটা চলে যাচ্ছে। ছাইরঙা শরীর, রোদে চকচক করছে গায়ের আঁশ— একটা বড় মাটির ঢিবি— সাপটা ঢেউ খেলে পেরিয়ে যাচ্ছে। গতি দেখলে মনে হয় একটু আগে এই আলপথটাই পার হয়ে গেছে।

গা ঘিনঘিন করে উঠল তুলসীর, বলল, কী সাপ?

লোকটা হাঁফাচ্ছিল, সাধুভাষায় বলল, বিষ ধরে মশাই, গোখরো। এটা অপরাধী সাপ, ও-চলন দেখলেই আমি চিনতে পারি। এইমাত্র কাউকে কেটে এল…ওই দেখুন, চলনটা দেখুন…দেখছেন? হুঁ, অপরাধী সাপ মশাই।

ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে আর-একটা ঘাসের আড়ালে চলে যাচ্ছিল অপরাধী সাপ। বাতাস কাটার একটা হায়-হায় শব্দ করছে। চলনটা ঠিক বুঝল না তুলসী, তবু তার মনে হল সাপটা চোরের মতো পালাচ্ছে। কোনও দিকেই ওর নজর নেই৷ আলপথ পার হয়ে ধান খেতের পাশ দিয়ে ক্ষীণ মসৃণ একটি জলধারার মতো নেমে গেল সাপটা পিছনে শূন্য জমিটাকে ভীতিকর করে রেখে দিয়ে গেল। লোকটা সাপটার গতি নিরীক্ষণ করে বলল, শালা নদীর দিকে যাচ্ছে। নদী পার হয়ে গেলেই ফতে। রুগিকে বাঁচায় কে! ওর চলন আমি চিনি মশাই।… বলতে বলতে লোকটা উলটো দিকের খেতের মধ্যে নেমে পড়ল, মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, আশপাশের গাঁয়ে কোথাও কেটে এসেছে শালা! যদি নগেন ওঝাকে সময়মতো ধরতে পারি…বলে দৌড়তে থাকল লোকটা। কচি ধান গাছের ওপর দিয়ে তার বেপরোয়া মাথাটা মাতালের মতো টলতে টলতে দূরে চলে যাচ্ছিল।

ওঁক করে একটা বমির ভাব উঠে এল তুলসীর পেট থেকে। গা পাকিয়ে উঠল, শিরশির করে ওঠে হাত-পা। গা ঘিনঘিন করে। সামনের দিকে ধুতির অংশটা হাতে তুলে প্রথমে কয়েক পা দৌড়য় তুলসী, তারপর জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। সাপটা পশ্চিম বারে গেল। ও দিকে নদী মাইল দুই দূর। লোকটা বলছিল সাপ নদী পার হলে রুগি বাঁচবে না, সত্যি কি! সাপটা নদী পার হওয়ার আগে লোকটা ওঝাকে পাবে কি না কে জানে।

স্কুলের কমন-রুমে পৌঁছতে হাঁফ ধরে গেল তার। হাতের প্লাস্টিকের ফোলিও-ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, সাপ!

সবাই তার দিকে তাকাল, কোথায় সাপ?

তুলসী হাঁফাতে হাঁফাতেই সেই লোকটাকে নকল করে বলল, বিষধর সাপ মশাই, গোখরো। অপরাধী সাপ চেনেন কেউ?

হ্যাঁ, অনেকেই চেনে।

কোথায় দেখলেন। কাকে ঠুকে এল?

তুলসী ঘটনাটা বলতেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। সবাই চেনে নগেন ওঝাকে, তুলসী বুঝতে পারছিল। যে-লোকটা সাপটাকে দেখিয়েছিল সেও সকলেরই চেনা, রাজেন। তারপর যা হয়— আস্তে আস্তে সাপের গল্প শুরু হয়ে গেল। প্রতি পিরিয়ডের ফাঁকে ফাঁকে এসে তুলসী কমনরুমে সাপের গল্প শুনে যাচ্ছিল। বিচিত্র গল্প সব বিচিত্র সব সাপের। বেনাচিতি, কেউটে, গোখরো, দাঁড়াশ, লাউডগা, জিংলাপোড়া। থার্ড পিরিয়ডের লেজারে এসে সায়েন্স-এর মাস্টার আদ্যিকালের বি এস-সি বুড়ো হরনাথ ঘোষালের গল্পটা শুনল। ঘোষাল বিজ্ঞান পড়তে পড়তে প্রথম যৌবনে ধর্ম-টর্মের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল। সেই সময়ে তারা দুই বন্ধু একসঙ্গে পইতে পুড়িয়েছিল একটা পাঁজিতে আগুন জ্বেলে, সেই আগুনে। ঘোষালের বাড়িতে এটা নিয়ে বিরাট হইচই হল, তার গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী বাপ তাকে বেরও করে দিল ঘর থেকে, কিন্তু ঘোষাল পইতে নিতে রাজি হল না। এক বন্ধুর বাড়ির কাছারি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিল ঘোষাল, সেখানেই থাকতে লাগল। বিজ্ঞান ছাড়া জগতের অন্য কোনও রহস্যকেই সে তখন স্বীকার করত না, প্রবল মনোবল ছিল তার, সে অটল রইল। সে সময়ে একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে ঘোষাল টের পেল তার বুকের ওপর বেশ ভারী একটা ওজন, বাঁ কাঁধ থেকে বুক জুড়ে ডান দিকের কোমর পর্যন্ত পিছল, ঠান্ডা, ভারী কী এক বস্তু আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। তন্দ্রার ভাব ছুটে যেতেই লাফিয়ে উঠল ঘোষাল। সাপটা ততক্ষণে নেমে গেছে প্রায়। কেবল লেজের শেষ অংশটা তখন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে তার কোমর থেকে। টর্চ জ্বেলে এই দৃশ্য দেখল সে, প্রকাণ্ড জাত-গোখরো তার শরীর সাপটে ছিল এতক্ষণ। যদিও সাপটা তখনও তার কোনও ক্ষতি করেনি, তবু ভয় পেয়ে চিৎকার করে সে অজ্ঞান হয়ে গেল। কাছারি-ঘরটায় লোক শুত অনেক। তারা উঠে বাতি-টাতি জ্বেলে মেরে ফেলল সাপটাকে। কিন্তু তারপর থেকেই— ঘোষাল বলল, আমার বাঁ কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত কেবল একটা শিরশিরে ভাব— গা ঘিনঘিন্‌ করে, কিচ্ছু খেতে পারি না, উলটে চলে আসে প্রথম পোয়াতির মতো, রাতে ঘুম হয় না, নিজের গা থেকে নোংরা আঁশটে গন্ধ নাকে আসে। সবসময়ে ভয়-ভয় ভাব। আমার আত্মবিশ্বাস কমে যেতে লাগল। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, যুক্তিবাদী, তা ছাড়া আমি গাঁয়ের ছেলে, সাপের গতিবিধি আমি জানি। তব দেখুন দিনরাত আমার মনে হত নরক থেকে, নোংরা জঘন্য বিশ্বাসঘাতক হীন একটা প্রাণী এসে আমাকে ছুঁয়ে গেছে, শত স্নানেও নিজেকে পবিত্র লাগত না। আর মশাই, সারাদিন ধরে বাঁ কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত এই যে জায়গাটা যেখান দিয়ে গিয়েছিল সেই জঘন্য জীব, সেই জায়গাটায় সারাদিন শিরশির ঝিরঝির একটা অবশ ভাব। ডাক্তার এসে মনের শক্তির জন্য ওষুধ দিল, কিছু হল না। আস্তে আস্তে পৃথিবীটা আমার কাছে নিরানন্দ বিষাদময় হয়ে যাচ্ছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিকে চাই, লোকের কথা বুঝতে পারি না, কাউকে কিছু বোঝাতেও পারি না। ও গুণিনরা এসে ঝাড়ফুঁক করে গেল অনেক। কিছু হল না। তারপরই একদিন আমাদের কুলগুরুকে নিয়ে বাবা হাজির হলেন, আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন, প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে গলায় পইতে পরিয়ে দিলেন। তখন হঠাৎ খেয়াল হল পইতে যেখানে থাকে আমাদের, বুকের ওপর কাঁধ থেকে আড়াআড়ি, ঠিক সেই জায়গা দিয়েই গিয়েছিল সাপটা। ওই কথাটা মনে হতেই অসুখ অর্ধেকটা সেরে গেল। তারপর শুরু করলাম গায়ত্রী জপ। সারাদিন জপ করি। চোখ বুজে বিভোর হয়ে জপ করি। আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে এলাম আমি। অবিশ্বাস-টবিশ্বাস কোথায় উড়ে গেল আমার!

এটা কি সাপের গল্প হল? কে একজন বলল, এ তো পইতের মহিমা-কীর্তন! আর এর সাপটাও যে প্রতীক!

একজ্যাক্টলি, হরেনবাবু সামনের দিকে ঝুঁকে বললেন, একজ্যাক্টলি। পূর্বপুরুষদের বহুকালের তপস্যায় এবং আচরণে অর্জিত ধর্মীয় সংস্কারগুলিকে ত্যাগ করলে অবিশ্বাস, বঞ্চনা এবং মহাভীতি আমাদের আলিঙ্গন করে। তবু দেখুন আমি সত্যিই কিন্তু পঞ্জিকায় আগুন জ্বেলে পইতে পুড়িয়েছিলাম, আর আমার বুকের ওপর দিয়ে সাপও হেঁটেছিল, দুটোই সত্যি।

টিফিনেই খবর চলে এল, পুবপাড়ায় সত্যিই একজনকে সাপে কামড়েছে।

সিক্সথ পিরিয়ডে ক্লাস সেভেনে ক্লাস নিচ্ছিল তুলসী। ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে দেখতে পেল পিছনের বেঞ্চের ছেলেরা পাশের জানালা দিয়ে মাঠের দিকে চেয়ে আছে। ওদের মধ্যে খুব উত্তেজনা। কী রে? বলে হাঁক দিতেই একটা ছেলে বলল, স্যার নগেন ওঝা যাচ্ছে, কাউকে বোধ হয় সাপে কেটেছে। শুনে জানালার কাছে এসে দেখল তুলসী, মাঠের মধ্যে দু’-চারটে লোক আগে চলেছে, পিছনে খুব লম্বা, মিশমিশে কালো একটা লোক, পরনে লাল ডগভগে কাপড়, লাল ফতুয়া। লোকটা যেন অনেকটা স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে চলেছে, এমনই ধ্যানমগ্ন তার ভঙ্গি। দেখলে মনে হয় একটা অপ্রাকৃত আবহাওয়া লোকটাকে ঘিরে আছে। নগেন ওঝার সঙ্গে খালি-গায়ে রাজেনকেও দেখতে পেল তুলসী। ওরা গেল পুবপাড়ার দিকে। নগেন ওঝাকে দেখার পর ক্লাস আর বাগে থাকছিল না। ছেলেরা গুনগুন শুরু করে দিল। পুবপাড়ার দিকে যে-বাড়িতে সাপে কামড়েছে সে-বাড়িতে গিয়ে এখন তুক করবে নগেন ওঝা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুমারীদের হাত থেকে ভিক্ষে নেবে, সেই চালের ভাত রান্না করবে একজন কুমারী, সম্পূর্ণ বিবস্ত্রা হয়ে। নগেন ওঝার অনেক তুক। ছেলেরা তাই আর ক্লাসে থাকতে চাইছে না।

নগেন ওঝার জন্যেই কিনা কে জানে সিক্সথ পিরিয়ডের পর ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল। পুবপাড়ার দিকে ছুটতে লাগল ছেলের পাল।

তুলসী কমন-রুমে এসে শুনল, তখনও সাপের গল্প হচ্ছে। হাতঘড়িতে দেখল সাড়ে তিনটে। তিনটে সাতচল্লিশের ট্রেনটা পাওয়া যেতে পারে। টেবিল থেকে প্লাস্টিকের পোর্টফোলিও ব্যাগটা তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। ফেরার সময়ে আলপথ ধরল না সে, সুন্দর জাতীয় সড়ক দিয়ে ঘুরপথে গেল স্টেশনের দিকে। হঠাৎ তার খেয়াল হল, রাজেন বলেছিল সাপটা নদীর দিকে যাচ্ছে, নদী পেরোতে পারলেই ফতে। কে জানে সাপটা অবশেষে নদী পেরোতে পেরেছিল কি না!

না, নদী পেরোতে পারেনি সে। তখন ধানগাছের গোড়ায় গোড়ায় গত বর্ষার জল, সাপটা তাই উঁচু-নিচু আলপথের ওপর উঠে এল। একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল, অনেকটা পথ সে পার হয়ে এসেছে। সামনের দিকে চেয়ে, দেখল, অনেকটা পথ এখনও বাকি। কিন্তু সে কোথায় চলেছে তা তার সঠিক জানা ছিল না। খোলা জায়গার ওপর দিয়ে চলছিল সে। সামনেই আলপথের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল নিয়তি-নির্ভর কয়েকজন মানুষ, সাপটা ঘাসের মধ্যে শরীর নামিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করল একটু। সামনেই অনেকটা পতিত জমি। মানুষগুলি সরে গেলে সাপটা আস্তে আস্তে নেমে এল জমিতে। খোঁটায় বাঁধা একটা গোরু চরছে। তার পিছনের পায়ের কাছ দিয়ে সে চলে যাচ্ছিল। গোরুটার পায়ে পোকা বসেছিল, পা নাড়তে গিয়ে সাপটাকে দেখল সে, স্থির হয়ে রইল। যেখান দিয়েই সে যাচ্ছিল সেখানেই স্থির হয়ে যাচ্ছিল ঘাস, তৃণ, থেমে যাচ্ছিল পোকামাকড় ব্যাঙের শব্দ। কোনও দিকেই তার মনোযোগ ছিল না। অনেক বয়স হয়ে গেছে তার, বুড়ো একটা সাপ সে৷ ক্লান্ত। তবু জাতীয় সড়কের পাশে ঢালু জমি বেয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে এল ওপরে। রোদে চকচক করছে কালো চওড়া রাস্তা। লরি যাচ্ছে, সাইকেল চলেছে। তার চোখের খুব কাছ দিয়ে চলে গেল গোরুর গাড়ির চাকা। এখানে বিপদ, সে বুঝতে পারল। আবার মুখ ঘুরিয়ে নেমে এল নিচু নাবাল জমিতে। জাতীয় সড়কের সমান্তরাল অনেক দূর চলে গেল সে, তারপর কালভার্টের তলা দিয়ে ও পারে যাওয়ার পথ পেল। জলের পাশ দিয়ে আলগা পাথরগুলোর ওপর সে তার শরীরে ঢেউ তুলে পেরিয়ে গেল। একবার জলে জিভ ছুঁইয়ে নিল। নদীর ঠান্ডা সুগন্ধ বাতাস সে টের পায়। তবু নদী এখনও অনেকটাই দূরে। পিড়িক করে একটা শব্দ হয়। কে? তীব্র ফণা তলে সে ঘুরে দেখে। চড়ুই। আবার মাথা নামিয়ে নেয়, ক্লান্তভাবে চলে। বয়স হয়ে গেছে। পৃথিবীতে তার আয়ুষ্কাল কখনও খুব নিরাপদ ছিল না, বিনা বাধায় কোনও বাদ্য পায়নি সে, নির্ভয় হৃদয়ে কোথাও বাস করেনি, তার চলা মানে কেবলই পালানো। এবার তার দীর্ঘ শরীর আস্তে আস্তে অসাড় হয়ে আসছে। নদীর ধারে এসে সে থেমে যায়। মুখ তুলে দেখে— স্রোত, স্রোতের ওপারে আবার দীর্ঘ পথ। কোথায় পোঁছবে সে। জলের ধারে সে নেমে আসে, লম্বা ঘাসের বন হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। সে সেইখানে আরামদায়ক কুণ্ডলী পাকিয়ে নেয়। ঘুমিয়ে পড়ে। শব্দ! সে চোখ খোলে। ব্যাঙ লাফিয়ে গেল। সে দিন দুয়েক কিছুই খায়নি। খিদে টের পায়। আবার শরীর খুলে নেয়। শরীর চলতে থাকে। ঘুরে ফিরে জাতীয় সড়কের কাছেই চলে আসে আবার। উঁচু ঢালু জমিটার ওপরে উঠে দেখে, কালো চওড়া রাস্তা, লরি যাচ্ছে। সে আবার নামতে থাকে। একটা ব্যাঙ লাফিয়ে গর্তের মধ্যে পিছনের অংশটা ঢুকিয়ে দিল, তারপর তাড়াতাড়ি ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তার মোটা শরীর, সহজে ঢুকছিল না। সকৌতুকে সাপটা এই দৃশ্য দেখল। বোকা ব্যাঙটা। সে তার শরীর বুক পর্যন্ত শূন্যে তুলে ঘুরিয়ে আনল। বোকা ব্যাঙটা প্রচণ্ড চেষ্টা করছিল ঢুকে যেতে, সাপটা আস্তে তার মাথার ওপর নেমে এল। মুখে তুলে নিল তাকে। ‘কঁ— ক্‌’ করে কেঁপে উঠল ব্যাঙটা। তার সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি লাগল। বুড়ো হয়ে গেছে সে, বড় ক্লান্ত। ঝাঁকুনিটা তার ভাল লাগল না। ‘কঁ— ক্‌’ আবার পা ছোড়ে ব্যাঙটা। ঝাঁকুনি লাগে। ক্লান্ত বোধ করে সে। ব্যাঙটার শরীর মোটা, থলথলে, তার সমস্ত মুখ ঠেসে বন্ধ করে রেখেছে। সে অপেক্ষা করে। ক্লান্তি লাগে বড়। ব্যাটা আবার কেঁপে ওঠে। তার শরীর অসাড় হয়ে আসে। সে দেখতে পায় জাতীয় সড়কের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে। সে টের পেল তার বুকের নীচে দুর দুর করে কাঁপছে মাটি, লরি চলে যাচ্ছে পথ বেয়ে। সে অনেক পথ ঘুরেছে সারা জীবন। তার ক্লান্তি লাগে। চোখ বুজে আসে। ব্যাঙের প্রকাণ্ড শরীরটা চোয়ালে আর-একবার চেপে ধরতে চেষ্টা করে, পারে না। আলগা হয়ে আসে মুখ। দুর্বল লাগে। ব্যাঙটা চেপে বসে আছে তার মুখে। মোটা প্রকাণ্ড ব্যাঙটা। সে হাঁফিয়ে যায়। ঝাঁকুনি লাগে। আবার ঝাঁকুনি। না, আর কোনও চেষ্টাই করতে পারে না সে। আস্তে আস্তে তার স্থবির শরীর অসাড় হয়ে আসে, চোখ চেয়ে সে এবার তার দীর্ঘ জীবনের একটা অর্থ বুঝবার ক্ষীণ চেষ্টা করে। তারপরই হঠাৎ তার শ্বাস রোধ করে ব্যাঙটা ঠেলে আসে মুখের ভিতরে। চোখ অন্ধকার হয়ে যায় তার। তখনও মুখে তার আধমরা ব্যাঙ, তার মৃত শরীরটা ঢালু বেয়ে সামান্য গড়িয়ে যায়। তারপর একটা ছোট্ট পাথরে আটকে দড়ির মতো ঝুলতে থাকে।

জাতীয় সড়ক ধরে যেতে যেতে তুলসী শুনল সাপের ব্যাঙ ধরার আওয়াজ। সে খুব তাড়াতাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে গেল।

আট

রাস্তায় পায়চারি করতে করতে ললিত দেখল তার মাথার ওপর মশার ঝাঁক। মুখ তুলে ‘উম্‌-ম-ম্‌-ম্‌’ শব্দ করছিল সে, মশার বৃত্তটা আস্তে আস্তে নেমে আসছিল, মাথার ওপর নাকে কানে চোখে পিড়পিড় করছিল।

ফরসা প্রকাণ্ড চেহারার বুড়ো লোকটি রায়বাবু, বারান্দার ইজিচেয়ারে আধশোয়া, ডান হাতে বই, মলাটের ওপর দিয়ে দেখা যায় তাঁর চশমাজোড়া, হাতের বইটি সরিয়ে ললিতকে লক্ষ করলেন, কী ললিত?

ললিত হাসে, মশা।

হ্যাঁ, বড্ড মশা। আমার বাঁ দিকটায় কামড়ায়। খুব চালাক মশা।

বাঁ হাত নড়ে না, বাঁ পা নড়ে না, বাঁ চোখের পাতা পড়ে না, লোকটার বাঁ দিকটা জড়। করোনারির দুটো আক্রমণ গেছে, এখন তৃতীয়টার অপেক্ষা। দুপুরে খাওয়া ছেঁচাপানের রস বাঁ দিকের কষ বেয়ে ফতুয়াটার বুক ভাসিয়েছে। ছোরা-খাওয়া কিংবা গুলিবিদ্ধ একজন মানুষ যেন। হাতের বইয়ের মলাটে ছবিটা দেখে ললিত বড় অবাক হল। অবিকল একই রকম একটা ছবি— জাহাজের ডেক-এর ওপর গুলি খেয়ে এই রকম রক্তাক্ত বুকে মরে যাচ্ছে একটা লোক, অদূরে রিভলভার হাতে মুখোশ-টুপি-ওভারকোট পরা একজন। বারান্দার রেলিঙের ও-পাশে রায়বাবুর তখন অবিকল গুলি-খাওয়া লোকটার চেহারা।

কী বই ওটা?

রায়বাবু মলাটটা উলটে দেখে নিয়ে বললেন, দস্যু ওয়াং ও ঐতিহাসিক হীরা।

ললিত হাসে।

তুমি আমাকে বই এনে দিয়ে ললিত।

দেব।

দিয়ো, এখন আর কেউ বই এনে দেয় না।

গল্প মনে থাকে না, খেই হারিয়ে যায়।

একবারের দেওয়া বই দু’বার-তিনবার দিয়ে দেখেছে ললিত, লোকটা নির্বিচারে আবার পড়ে যায়। রায়বাবুকে বই দেওয়া সোজা।

তুমি কেমন?

ভাল।

অসুখটা কী যেন?

ওই পেটের একটা ব্যাপার।

পেট! রায়বাবু চিন্তিতভাবে তাকিয়ে রইলেন।

ক্লাবঘরটা বন্ধ। জলের কলে অনেক লোক আর মেয়েছেলে। শম্ভুদের ছাড়া জমিটায় লাটাইয়ে হাত্তা দিতে দিতে পিছিয়ে যাচ্ছে একটি ছেলে। ক্লাবঘরের দরজা পর্যন্ত যার ললিত, আবার ফেরে। মিত্রদের দোতলার জানালা খোলা— একটা পালঙ্কের কোণ, স্ট্যান্ডে টাঙানো মশারি আর দেয়ালে ছবি দেখা যায়। গণেশের দোকানে ক্যালেন্ডারে এক দুর্দান্ত যুবতী হাওয়ায় নড়ছে, তার পরনে নিকারবোকারই হবে বোধ হয়। রায়বাবুর মাথার ওপরকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিরুনি থেকে ছাড়ানো চুলের দলা থুথু দিয়ে বাইরে ছুড়ে ঘরে গেল নমিতা। এই সব ছবি ভেঙেচুরে অলক্ষে একটা জাহাজ চলছে। জাহাজ ঢেউ খায়। জাহাজ দোলে। দস্যু ফেরারি ওয়াং তার সামুদ্রিক দূরবিন তুলে চেয়ে থাকে। বিশাল সমুদ্র, মহান আকাশ। দস্যু ওয়াং ফিরেও দেখে না। কোথায় কোন মুলুকে কার কাছে গচ্ছিত রয়েছে সেই ঐতিহাসিক হীরা! পাপী ওয়াং সমুদ্র পার হয়, দ্রুতগামী মোটরে চলে যায়, দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, নিরপরাধ লোককে খুন করে, বিদেশি বন্দরে রহস্যময় রেস্তরাঁয় চিহ্নিত লোকের সঙ্গে সাংকেতিক কথাবার্তা বলে। জমজম করে তার জীবন।

গল্পটা জানে না ললিত। দরকারও নেই। তবু টের পায় জাহাজ চলেছে। জাহাজ ঢেউ খায়। জাহাজ দোলে। দস্যু ফেরারি ওয়াং তার সামুদ্রিক দূরবিন তুলে চেয়ে থাকে। রায়বাবুর ডান দিকটা বই পড়ে উত্তেজিত হয়, বাঁ দিকটা স্থির থাকে। সংসারী মানুষের মতোই।

ললিত হাসে।

ওই যাচ্ছে অবিনাশ। পরনে ময়লা পায়জামা আর শার্ট, হাতে কাগজ-ঠাসা ডায়েরি, রোগা ছোট্ট চেহারা। উদ্‌ভ্রান্ত মুখচোখ।

ললিত অবিনাশকে ডাকে।

আরে ললিত! কী খবর?

কোথায় চলেছ অবিনাশ?

সাড়ে ছ’টায় একটা মিটিং আছে। দেরি হয়ে গেছে। চলি।

ললিত হাসে। বরাবর অবিনাশের মিটিং থাকে রোজ। দেখা হলেই সেই এক কথা, একটা মিটিং আছে। দেরি হয়ে গেল। চলি ভাই! অবিনাশের চাকরি নেই, বাইরে থেকে অনেকগুলো কারখানার ট্রেড-ইউনিয়ন চালায়, পার্টি থেকে পায় পঁচাত্তর টাকা। উদ্‌ভ্রান্ত দেখায় তাকে। তার পার্টি কী বলতে বা করতে চায়, তা বোধহয় সঠিক জানে না অবিনাশ। ভাসাভাসা যেটুকু জানে সেটুকুকেই সে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। মিটিঙে যায়, কিন্তু সেখানে সকলের সব কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না! তবু উত্তেজিত হয়ে ফিরে আসে। কী চাও অবিনাশ? মানুষের মুক্তি। কী ভাবে মুক্তি আসবে? সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র কাকে বলে? অবিনাশ থতিয়ে যায়— সমাজতন্ত্র! হ্যাঁ, সমাজতন্ত্র…তার মানে সকলের জন্য সকলের হয়ে ওঠা, ক্ষুধা থেকে মুক্তি, অভাব থেকে মুক্তি, শ্ৰেণীবৈষম্য থেকে মুক্তি, এইরকম কত কী বলে যায় অবিনাশ। মোটা সব বই নিয়ে নাড়াচাড়া করে, হাতে নিয়ে বসে থাকে, কিন্তু সঠিক বুঝতে পারে না। তবু মনে হয়, এর মধ্যে একটা কিছু আছে। একটা কিছু, যা এইসব বই কিংবা মিটিঙের মতো নীরস নয়। কিংবা কে জানে সত্যিই মিটিংগুলো অবিনাশের কাছে নীরস কি না। কোনও দিনই কেউ অবিনাশকে পাত্তা দেয়নি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে তাকে। আশৈশব ওই রোগা চেহারা, আর বুদ্ধির অভাব তাকে মূল্যবান হতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু ওইসব মিটিংগুলোতে সে কথা বলার সুযোগ পায়, তার দলের নেতাদের কাছাকাছি যেতে পারে, একটা ধর্মঘটের কারণ হয়ে ওঠে সে, একটা মিছিলের সবার আগের লোকটি হয়ে এগিয়ে যেতে পারে। তখন নিজের মহত্ত্বকে টের পায় অবিনাশ। হ্যাঁ, বোধহয় সমাজতন্ত্রের মানে, নিজেকে তুচ্ছ ভাবার হাত থেকে মুক্তি।

সন্ধের মুখে বাসায় ঢুকে ললিত দেখল, মরা-মরা তুলসী গাছটার গোড়ায় প্রদীপ জ্বেলে মা প্রাণপণে শঙ্খে আওয়াজ তুলবার চেষ্টা করছে গাল ফুলিয়ে, কিন্তু ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। শাঁখের শব্দ হচ্ছে না। তাকে দেখে মা বলল, দেখ তো, একটু ফুঁ দিয়ে, পারিস কি না। আমার আর আজকাল হয় না।

মায়ের এঁটো শাঁখটা মুখে তুলল ললিত। দু’-তিনবার চেষ্টা করল সে, পেটের সেই জায়গাটায় শক্ত একটা ডেলা পাকিয়ে উঠল। তবু ছাড়ল না, খুব কষ্ট করে তিন-তিনবার ভোঁ বাজিয়ে দিল সে।

কত দিন পর শাঁখ বাজল এ-বাসায়। বলে মা শাঁখ ধুয়ে ঘরে নিয়ে গেল।

সন্ধেবেলা শম্ভুদের ছাদে উঠল ললিত। উঠতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। কিন্তু ছাদে সুন্দর হাওয়া দিচ্ছিল। ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছিল। কয়েক মুহূর্তেই জুড়িয়ে গেল শরীর। একটা চাদর নিয়ে গিয়েছিল ললিত। সেইটে পেতে কিছুক্ষণ শুয়ে নিঝুম আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আজকের আকাশে সপ্তর্ষি ছিল, ছায়াপথ ছিল না। ছায়াপথই ললিতের বেশি প্রিয়। ধুলারাশির মতো আকীর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ বিপুল একটি অনির্দিষ্ট পথের মতো পড়ে থাকে, ওখানে রোজ ঝড় ওঠে, ঝড়ো হাওয়ায় নক্ষত্রের গুঁড়ো উড়ে সমস্ত আকাশ ছড়ায়। আজ ছায়াপথ ছিল না। ললিত সপ্তর্ষি দেখছিল। সপ্তর্ষির চেহারা শান্ত। প্রশ্নচিহ্নের মতো। ব্যক্ত ও অব্যক্ত জগতের সীমায় বসে আছেন সাতজন শান্ত-সমাহিত ঋষি। কিন্তু এর চেয়ে বিছের উপমাটাই বোধ হয় ভাল। সপ্তর্ষিকে আসলে একটা বিছের মতোই দেখায়। ললিতের মনে পড়ল, তার রাশি বৃশ্চিক। বৃশ্চিকের শেষ জীবন খুব সুখের হয় না। শেষ জীবন পর্যন্ত অবশ্য পৌঁছনো গেল না। ললিত চেয়ে রইল। টের পেল সপ্তর্ষির আলো এসে তার গায়ে পড়েছে, স্নেহে লেহন করছে তাকে। তার রাশিচক্র বলছে, এইসব গ্রহ-নক্ষত্রের সঙ্গে, চাঁদ কিংবা সূর্যের সঙ্গে তার রহস্যময় যোগাযোগ রয়েছে। তার বিশ্বাস হয় না। বরাবরই সে এ-সব বিশ্বাসের বিরোধী ছিল। এখনও সে চায় না মৃত্যুর পরে কোনও চেতনাকে, কিংবা চায় না আরও একবার জন্ম নিতে। কেবল ইচ্ছে করে চার পাশে নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝখানে আকাশ জুড়ে শুয়ে থাকতে। মহান একটি ঘুম, তার বেশি কিছু না। ছেলেবেলায় খেলার শেষে ফাঁকা মাঠে শুয়ে থেকে কত দিন আকাশ দেখেছে সে। দেখতে দেখতে কোন শূন্যতায় সে পৌঁছে যেত। পার্থিব কোনও কিছুই আর মনে থাকত না, বিপুল আকাশ-চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখত তাকে, শূন্যের বিষণ্ণতায় ডুবে থাকত। সে-কথা মনে করে আজ একটু হাসল ললিত। তখন আকাশে থাকতেন দেবতারা, মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতেন। আজ তাঁরা কেউ নেই— না মনে, না আকাশে তবু আজও কিছুক্ষণ সপ্তর্ষির অদৃশ্য আলো সে তার শরীর আর চেতনায় অনুভব করল। আকাশ থেকে মহৎ এক বিষণ্ণতা হনহন করে হেঁটে আসছে তার দিকে, টের পেল। কিন্তু আচ্ছন্ন হল না। আজ তার চারপাশের বিষণ্ণতা বয়স-হওয়া ললিতকে শক্ত মুঠিতে ধরেছে, আকাশের বিষণ্ণতা আজ আর তেমন একটা কিছু নয়।

উঠে পড়ল ললিত। ছাদের রেলিঙের ধার ঘেঁষে বেড়াতে লাগল।

দেখতে পেল বড় রাস্তার দিক থেকে ছোট্ট সাদা একটা মোটর গাড়ি আস্তে আস্তে এসে তাদের গলির মুখে থামল। আবার পিছন ফিরে মুখ ঘোরাল, আবার পিছিয়ে এসে থামল। মুখ ঝুঁকিয়ে ললিত দেখল গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভারের সিট থেকে সঞ্জয় নামছে। সঞ্জয়ের গাড়ি দেখে একটু অবাক হল ললিত, এত তাড়াতাড়ি ওর গাড়ি হয়ে গেল!

ললিত ছাদ থেকেই উঁচু গলায় বলল, সঞ্জয়, ঘরে যা। আমি আসছি।

সঞ্জয়, ওপর দিকে তাকাল, রাস্তার আলো থেকে হাতে চোখ আড়াল করে ললিতকে দেখার চেষ্টা করে বলল, তুই ওপরে? আমিও আসব?

ছাদটা শম্ভুদের। এখানে বাইরের লোক সঞ্জয়কে আনা ঠিক হবে না। তাই ললিত বলল, না, তুই ভিতরে যা।

ললিত নীচে এসে দেখল, সঞ্জয় তখনও গলির মুখে দাঁড়িয়ে, চেন-এ বাঁধা গাড়ির চাবিটা বোঁ বোঁ করে ঘোরাচ্ছে। তাকে দেখে হাসে সঞ্জয়, ক’ দিনের নোটিস রে! নাকি জামিনে খালাস আছিস, সময় ফুরোলে ধরে নিয়ে যাবে।

ললিত হাসে, শালা, পাষণ্ড!

বাহবা! টেলিফোনে তোর গলা শুনে ভেবেছিলুম যে, এসে শুনব তুই বিছানায় পড়ে চিনচিন করে ‘বিদায় দে মা’ গাইছিস। তা তো নয়, এই তো দিব্যি মুখ ফুটছে।

চোখের ইঙ্গিতে গাড়িটা দেখিয়ে ললিত বলল, তোর?

পোষা কুকুরের গায়ে লোকে যেমন আদরের থাপ্পড় দেয়, তেমনই গারিটার গায়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে সঞ্জয় বলে, না রে। এখনও আমার নয়, তবে মনে হচ্ছে আমার হয়ে যাবে।

কী রকম!

এক মাড়োয়ারি পার্টির গাড়ি। নতুন, মাত্র হাজার ছয়েক মাইল চলেছে। পাঁচ হাজার টাকায় দিয়ে দেবে। আজ বিকেলে এসে কয়েক দিন ট্রায়ালে রাখতে দিয়ে গেল।

জলের দর।

তুই বুঝবি না রে, অন্য দিকে পুষিয়ে না নিলে জলের দরে দেয়! পুষিয়ে নিচ্ছে। কেনা-বেচার ব্যাপার তুই কী বুঝবি বে?

তুই উন্নতি করে ফেললি।

সঞ্জয় হাসে, উন্নতির এখনই কী দেখলি? রচনা বইতে পড়েছিলুম, ‘এক কোটি টাকা পাইলে আমি সব ভাত গুড় দিয়া খাইব।’ এখনও গুড় দিয়ে সব ভাত খাওয়া হয়নি। গাড়ি হয়েছে, বাড়ি হবে, মেয়েমানুষ পুষব, গ্রীষ্ম কাটাতে যাব সুইজারল্যান্ড। দেখিস, গরিবের রোগেও আমি মরব না। আমাশা, শোথ, উদুরি— দূর দূর। মরতে হয় তো মরব ক্যান্সার কিংবা সেরিব্র্যাল স্ট্রোকে— ভিয়েনা কি আমেরিকার নার্সিং হোমে। শম্ভুনাথ, নীলরতনের জেনারেল বেডে নয়। বুঝলি বে!

তোর শেষ দেখতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে।

দেখে যা কাইন্ডলি, তোর মাস্টারির চাকরির কাজে লাগবে। ছাত্রদের দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝাতে পারবি, অধ্যবসায়ের পরিণাম।

জুতো ছেড়ে ঘরে ঢোকার কথা সঞ্জয় এখনও ভোলেনি। ললিত দেখল ঘরে ঢোকার আগে এক পায়ে দাঁড়িয়ে কুঁজো হয়ে সঞ্জয় জুতো ছাড়ছে।

ললিত বলে, জুতো নিয়েই আয় না!

দূর! মাসিমার ঠাকুর দেবতারা ঘর ছেড়ে পালাবে না?

ঘরে ঢুকেই সঞ্জয় চেঁচাল, মাসিমা, ও মাসিমা!

রান্নাঘর থেকে মা’র ক্ষীণ গলা শোনা গেল, কে রে! সঞ্জয়! কতকাল আসিস না!

সঞ্জয় ঘরে বসল না, সোজা চলে গেল মোজা-পায়ে রান্নাঘরের দরজায়। ললিত শুনল, সঞ্জয় চেঁচিয়ে বলছে, আপনি একটুও বুড়ো হননি তো মাসিমা। তারপর নিচু গলায় গুনগুন করে কথা বলতে লাগল মা’র সঙ্গে।

ছাদের সিঁড়ি দিয়ে বড় তাড়াতাড়ি নেমেছে ললিত। শরীর অবশ লাগছে। বিছানায় বসে আধশোয়া হল সে।

সঞ্জয় রান্নাঘর থেকে এসে চৌকিতে বসে বলল, তুলসী-মড়াটা কোথায়! সেটারও তো আজ আসার কথা। আর, আদিত্য?

আদিত্য আসবে না। ওর কাজ আছে। তুলসী আসবে ঠিক।

হেগে মরুক গে আদিত্য। তুলসীটা আসুক, আজ ওকে রগড়াব।

কেন?

ও মড়াটা দিন দিন আরও মরে যাচ্ছে। কী একটা বউ যে হয়েছে ওর ত্রি-ভুবনসুন্দরী, বুকের মধ্যে সেই বউয়ের দোলমঞ্চ নিয়ে ব্যাটা ঘুরে বেড়ায়। কিছুদিন আগে মাস্টারদের অবস্থান ধর্মঘটে গিয়েছিল এসপ্ল্যানেড ইস্টে, সেখান থেকে এসেছিল আমার অফিসে। যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ কোথায় পুরনো দিনের পাইজ্যামি বদমাইশির কথা বলব, তা না কেবল বউয়ের কথা, শালা এমন বেহায়া, বলে কিনা বিয়ে করে অনাস্বাদিতপূর্ব সুখে ডুবে আছি, বউ বড় সুখী করেছে আমাকে, ঠিক ওই রকম বইয়ের ভাষাতেই বলেছিল। অফিস না হলে পাছায় একটা লাথ কষাতুম। এদিকে দেখ, বলছে সুখে আছে অথচ চোখে মুখে মরকুটে ভাব, কাঠ-কাঠ হাসি, চোখ ম্যাট ম্যাট করছে। অনেক ধানাই পানাই করে বলল, সঞ্জয়, তোর হাতে ভাল গুন্ডা আছে? চমকে উঠে বললুম, কেন রে! বললে, একটা লোককে একটু ঢিট করতে হবে। জিজ্ঞেস করলুম, কে! কিছুতেই বলে না। বললুম, গুন্ডাই যদি লাগাবি, তবে আমাকে লাগা, জানিস তো আমি কেমন হারমাদ ছিলুম, এখনও ওটা আমার সাইড-বিজনেস। শুনে এলোমেলো কী-সব বলল, বুঝলাম না। চা-চা খেয়ে বিরস মুখে চলে গেল। মাইরি, ও শালাকে আজ আমি রগড়াব, তুই দেখিস। ওর উইক পয়েন্ট আমি বের করেছি।

ললিত হাসছিল, কী সেটা!

ওর বউ।

হবেও বা। ললিত ঠিক জানে না। নিজের ব্যথা-বেদনা-ব্যাধি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, কাউকেই এ ক’দিন ভাল করে লক্ষ করা হয়নি। হঠাৎ মনে পড়ল, তুলসীর বউকে এখনও দেখাই হয়নি। এককালে পরস্পরে বিয়ে নিয়ে কত জল্পনাকল্পনা ছিল তাদের। ঠিক ছিল তুলসীর বিয়ে হবে খুব দূরে কোথাও, নাগপুর কানপুর বা ও-রকম দুরে, তারা দল বেঁধে বরযাত্রী যাবে। আর ললিতের বিয়ে হবে এমন জায়গায়, যেখানে যেতে নৌকো লাগে। সঞ্জয়েরটা ঠিক ছিল বিলেতে, মেমসাহেবের দিকেই বরাবর ঝোঁক সঞ্জয়ের, তাই ওর বিয়েতে এরোপ্লেনের বন্দোবস্তই ঠিক হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তুলসীর বিয়েতে যাওয়াই হল না, হারামজাদা বিচ্ছিরি একটা সময় বেছে বিয়ে করল।

সঞ্জয় বলল, আদিত্য এলে আজ তুলসীর পেছনে লাগাতুম। জিরাফের মতো লম্বা গলা উঁচু-নিচু করে, চোখ বুজে দু’ হাতের কাচকলা নেড়ে গাইত ‘তুলসী গাছেতে, কুকুর মোতে-তে-এ।’ শালাটা এল না কেন? কী এনগেজমেন্ট ওর?

বলতেই যাচ্ছিল ললিত। ইতস্তত করে সতর্ক হয়ে গেল; শাশ্বতীর কথাটা মুখে এল না। বোঝা যাচ্ছে আদিত্য আর শাশ্বতীর ব্যাপারটা এখনও সঞ্জয় জানে না। তাই, ওই নরম সুন্দর শ্যামলা মেয়েটিকে সঞ্জয়ের পালিশ-করা মুখের সামনে এগিয়ে দিতে মায়া হল তার। বললেই সঞ্জয়ের মুখ ছুটবে।

বলল, কী জানি!

জানিস না?

না।

সাড়ে সাতটায় বিষণ্ণ মুখে তুলসী এল। ঘরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই সঞ্জয় ওর পিছনে লাগল, আয় তুলসী, আমরা বউ বদল করে ফেলি। আমারটা আমার কাছে পুরনো হয়ে গেছে, তোরটা তোর কাছে। পালটে ফেলি।

তুলসী মৃদু হাসে, আমারটা পুরনো হয়নি। কোনও দিন হবেও না।

সঞ্জয় ললিতের দিকে তাকায়, শুনছিস ললিত?

তারপর গলা নামিয়ে বলে, পুরনো না হলেই বা, তোরটা তো কুচ্ছিত! আমার মতো সুন্দর বউ? একে সুন্দর, তার ওপর যা সাজগোজ করে থাকে না। বলতে বলতে হঠাৎ জিভ কাটল সঞ্জয়, যাঃ মাইরি, একদম ভুল হয়ে গেছে।

ললিত বলে, কী?

সাজগোজের কথায় মনে পড়ল, রিনি লিপস্টিক নিয়ে যেতে বলেছিল। গোলাপি স্বপ্ন না কী যেন নাম! ইয়াঃ, রোজি ড্রিম। ভুল হয়ে গেল রে! বলতে বলতে ঘড়ি দেখল সঞ্জয়, নাঃ, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, বেরোতে বেরোতে আটটা হয়ে যাবে। দোকান খোলা পাব না।

তুলসী বলে, তুই কেটে পড় না।

আমি কেটে পড়লে খুব সুবিধে, না? পিছনে লাগার কেউ থাকবে না, তুমি ললিতের মুখোমুখি দাবা-খেলুড়ির মতো মুখ নিয়ে বসে থাকবে! তা ছাড়া, বউয়ের লিপস্টিকের অজুহাতে কেটে পড়লে তোরা আমার নিন্দে করবি না? বলবি, দেখ, ওই সঞ্জয়টা লেখাপড়া শেখেনি, চায়ের দোকানে বয়গিরি করত, আর এখন শালা বউয়ের লিপস্টিক কেনার জন্য অসুস্থ বন্ধুকে ছেড়ে চলে গেল। শালা আদেখলা, চালবাজ। বলবি না?

বললেই বা! তুই কার তোয়াক্কা করিস! তুলসী বলে।

ঠিক। আমি কারও তোয়াক্কা করি না। একমাত্র বয়স ছাড়া। সঞ্জয় বলে, বয়স! বুঝলি! এই যে লিপস্টিকের কথা ভুল হয়ে গেল, এই গেঁতো অলস আরামপ্রিয় হয়ে যাচ্ছি, চুরিটুরি করছি, টাকাপয়সা ভাল লাগছে, এ-সবের মূলে ওই বয়স। বাইরে গলির মুখে একটা সাদা গাড়ি দেখে এলি না তুলসী? ওটা আমার। হিংসে হচ্ছে না?

দূর। তুলসী ঠোঁট ওলটায়।

হলে ভাল লাগত, বুঝলি! আজকাল লোকে হিংসে করলে ভাল লাগে। আরও দেখ, এখন আর অনিশ্চয়তা নেই, ছোটাছুটি নেই, বসে বসে টাকা এসে যায়। আমার স্পিড কমে যাচ্ছে। জবুথবু হয়ে যাচ্ছি। শরীরে চর্বি ঠেকাতে পারছি না। কেবল মনে হয় বয়স হয়ে যাচ্ছে।

আর কী, এবার বুড়ি বেশ্যার মতো কপালে ফোঁটা কাটো, আর হরিনাম নাও। তুলসী বলে, ব্যাটা পাপিষ্ঠ!

সঞ্জয় হাসে, তুই বুঝবি না রে, তুই হচ্ছিস প্রলেটারিয়েট— ল্যাংটা মানুষ, বউকে একখানা গয়না দিতে তোর কোমর বেঁকে যায়। আমি তোর চেয়ে একটু বেশি দেখি।

তোর চেয়ে আমি মহৎ। তুই তো কোম্পানিকে ফাঁক করছিস।

সঞ্জয় হেসে তুলসীর পিঠে হাত বোলায়, ঠিক রে ল্যাংটাভোলা, ঠিক। তুই সুখী মহৎ, কারণ তোর অভাব তো এইটুকু, না? ঠিক, তুই মহৎ। কারণ, তুই ক’টা ভাল বাড়িতে ঢুকেছিস? ক’টা ভাল আসবাবপত্র দেখেছিস! সত্যিকারের দামি গাড়িতে চড়েছিল কোনও দিন? না, দেখেছিস তেমন সুন্দরী মেয়েছেলে? ভাল খাবার কী খেয়েছিস আজ পর্যন্ত, বাঙালি-বিয়ের নেমন্তন্ন ছাড়া?

তুলসী চিড়বিড়িয়ে ওঠে, তাতে কী?

তাতেই তুই মহৎ! কারণ, তুই বেশি দেখিসনি। আমি দেখি। শালা কত টাকা, কত খাবার, কত সুন্দরী মেয়েছেলে দুনিয়াভর, কত গাড়ি-বাড়ি,— এত ভোগ করার ক্ষমতাই নেই আমার। এই তো মাত্র পঞ্চাশ ষাট সত্তর বছরের আয়ু, এতে কী হয়? কিছু না। দুনিয়া ফিনিশ করতে হলে লাখবার জন্মাতে হবে। বুঝলি রে ল্যাংটা মানুষ, কেন বয়সের কথা ভাবি!

ললিত হাসছিল। সঞ্জয় তার দিকে ফিরে বলল, তুলসীকে খ্যাপানোর জন্য বলছি বটে, কিন্তু আমার মধ্যে সত্যিই কী একটা হচ্ছে। আজ সকালে হঠাৎ রমেনের কথা মনে পড়ে গেল। সেই যে বউ পালানোর পর সব ছেড়েছুড়ে চলে গেল রমেন, আর ফিরলই না। এত কীসের দুঃখ হয়েছিল ওর? এত ভোগসুখে ছিল, দু’ হাতে টাকা ওড়াত, বউয়ের জায়গায় দশটা মেয়েমানুষ পুষতে পারত, তবে সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসী হওয়ার মানে কী? আজ সারাদিন রমেনের কথা ভাবছি আর নার্ভাস লাগছে। সারা জীবন কষ্ট করে আমি সদ্য একটু সুখের মুখ দেখেছি, এখন শালা এখন যদি কোথা থেকে হঠাৎ ভুতুড়ে কোনও দুঃখ এসে কাঁধে চেপে বসে, আর অত কষ্টের তৈরি করা সবকিছু যদি হঠাৎ বিস্বাদ লাগে! যদি সব ছেড়েছুড়ে আমিও লম্বা দিই? ভাবতেই ভয় করে যে। দুপুরে তোর ফোন পেলাম, তোর অসুখের কথা জানতাম, তবু কেন ভয়ংকর চমকে উঠলাম বল তো! ফোন রেখে দেওয়ার পর দেখি হাত দুটো কাঁপছে।

তুলসী আর ললিত দু’জনেই নিবিষ্টভাবে চেয়ে ছিল তার দিকে। সঞ্জয় হঠাৎ লজ্জা পেল। তুলসীকে বলল, আজ তোর বউয়ের কাছে তোর প্রেস্টিজ খুব বেড়ে যাবে। আজ তোকে আমার গাড়িতে একটা লিফট দেব।

ললিত মাকে দেখতে পেল, ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আঁচলে হাত মুছছে। ফোকলা মুখে একটু হাসি।

মা বলল, ও সঞ্জয়, আমার ললিতকে একটা ভাল চাকরি দে। তোর হাতে এখন কত ক্ষমতা!

ললিত ধমক দেয়, আঃ মা!

মা হাসে, তাতে কী! সঞ্জয় আমার ছেলের মতো।

ঠিকই তো! বলে সঞ্জয় উঠে গিয়ে মা’র হাত ধরে নিয়ে আসে, সকলের মাঝখানে বিছানায় বসায়, বসুন মাসিমা।

মা তুলসীকে বলে, ও তুলসী! আমাকে তোর বউ দেখালি না?

ললিত হাত ছুড়ে বলে, ইস মা, তোমার যে কত ডিমান্ড!

সেদিকে খেয়াল না করে বুড়ি আবার সঞ্জয়কে বলে, তোর গাড়িতে একদিন দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যাবি, একদিন তারকেশ্বর। নিবি না?

বলে মা ফোকলা মুখে হাসে। দুটো ঠোঁট কাঁপতে থাকে।

মা’র জন্য অস্বস্তি বোধ করে ললিত, বলে, তুমি যাও না, মা। ওদের জন্য কিছু করে দাও।

দিই। চায়ের জল চড়িয়ে এসেছি, চিঁড়ে আর পাঁপড় ভেজে দেব।

আঁচলে নাক মুছে মা উঠে দাঁড়ায়।

মা চলে গেলে আবার সহজ লাগে তাদের।

সঞ্জয় হঠাৎ ঝুঁকে ললিতের বুকে আঙুলের দুটো টোকা দিয়ে বলে, তোর মনোবল চমৎকার আছে। এইজন্য তোকে আমি হিংসে করি।

বাচ্চা ছেলের মতো লজ্জায় হাসল ললিত। এতদিন কথাটা তাকে কেউ বলেনি। সকলেই তাকে ভোলাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার দরকার ছিল না। তার মন চাইছিল কেউ এ-রকম একটা কিছু বলুক যে, সে সাহসের সঙ্গেই মুখোমুখি হচ্ছে সবকিছুর। ললিত তাই লজ্জায় হাসল।

সঞ্জয় বলে, আমি একগুঁয়ে, জেদি, কোনও কিছুর শেষ না দেখে ছাড়ি না। তবু দেখ শেষ পর্যন্ত আমি দুর্বল। একটা ঘটনার কথা বলি শোন। কিছুদিন আগে আমি একটা পাখা কিনেছিলাম। সিলিং ফ্যান। কিনে এনে নিজেই সেটাকে টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে ফিট করলাম। তারপর রাত্রে পাখাটার ঠিক নীচে মেঝেয় মাদুর পেতে রিনিকে নিয়ে শুলাম। এভাবে তিন-চারদিন কেটে গেল, পাখার নীচে শুই, হাওয়া খাই, রিনিকে ভালবাসার কথা বলি; তারপর একদিন অফিসের শেষে এক পার্টির সঙ্গে রেস্তরাঁয় গেছি। বিজনেসের নানা রকম কথা হচ্ছে, তারই এক ফাঁকে আমি সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকালাম। একই কোম্পানির পাখা। চোখটা একটু আটকে গেল। তারপর কথা বলি আর বারবার পাখাটার দিকে চেয়ে দেখি। যতবার তাকাই ততবারই একটা অস্বস্তি হতে থাকে। ওইভাবে বারবার দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল একটা ছোট স্ক্রু-র ওপর। পাখাটা যে-রড়টায় ঝোলানো থাকে, সেই রড আর পাখার জয়েন্টে একটা ছোট্ট স্ক্রু লাগানো। স্ক্রুটা দেখতে দেখতে আমি বিজনেসের কথা বলছি, আর মনে মনে বুঝতে চেষ্টা করছি ওই স্ক্রুটা আমি দেখছি কেন! পাখাটা যাতে রডের প্যাঁচ কেটে পড়ে না যায় তার জন্যই ওই স্ক্রুটা লাগানো, এ তো আমি জানি! তবে দেখছি কেন! ঠিক এই সময়ে আমি একটা শব্দ শুনলাম। হয়তো রাস্তায় গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ, কিংবা পেয়ালা পিরিচের ভেঙে যাওয়ার শব্দ, কীসের শব্দ তা আমি বলতে পারব না। কিন্তু ওই শব্দটাই আমার মাথার মধ্যেকার ধোঁয়া কাটিয়ে দিল। হঠাৎ মনে পড়ল আমার পাখাটার ওই স্ক্রু লাগানো হয়নি! সঙ্গে সঙ্গে আমি লাফিয়ে উঠলাম, দৌড়ে বেরোলাম দোকান থেকে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম, ভিড়। আমি পাগলের মতো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা ট্যাক্সি থামালাম। সে-ট্যাক্সিতে সোয়ারি ছিল, আমি তার প্রায় পায়ের ওপর পড়ে বললাম, বড় বিপদ, আমাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিন। প্লিজ। ট্যাক্সিতে বসে আমি উন্মাদের মতো অস্থির ছিলাম। সারা দুপুর-বিকেল ঠিক পাখাটার তলায় মাদুর পেতে রিনি ঘুমোয়, ওর বুকের কাছে থাকে পিকলু। চার-পাঁচ দিন ঘুরেছে পাখাটা, ওই স্ক্রু ছাড়া। আলগা প্যাঁচের ওপর রডের সঙ্গে লাগানো! ভাবাই যায় না— ওইভাবে ওই পাখা আমিই লাগিয়েছি। আমি— যে-আমি ছিলাম মেকানিক, কতজনের বাসায় পাখা ফিট করে দিয়ে এসেছি! পাখা লাগানোর সব কিছুই আমি জানি। এ আমার অধীত বিদ্যা। তবু ভুল! ছোট্ট একটা মারাত্মক স্ক্রু আমি লক্ষই করলাম না! কে জানে বাসায় গিয়ে দেখব, ভাঙাচোরা রিনি আর থ্যাঁতলানো পিকলুর ওপর জগদ্দল পাখাটা মুখ থুবড়ে আছে। ট্যাক্সির লোকটা জিজ্ঞেস করল, আপনার কী বিপদ? আমি কেবল বললাম, একটা স্ক্রু, একটা স্ক্রু! লোকটা না বুঝে ভয় পেয়ে চুপ করে গেল। বাসার সামনে নেমে আমি এক দৌড়ে ভিতরে গিয়ে দেখলাম— সঞ্জয় হাসে, কী দেখলাম বল তো?

তুলসী রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করে, কী?

পাখাটা চলছে, আর তাতে স্ক্রু লাগানো আছে ঠিকমতোই। ভুল হয়নি।

তুলসী হাসল, ট্রাজি-কমেডি!

কিন্তু মাইরি, তারপর থেকেই আমি বুঝে গেছি যে, নিজেকে আর বিশ্বাস করা যায় না। শালা, কোথায় নাট-বল্টুর ভুল করে রেখে দিয়েছি কে জানে! একদিন নিজের ফিট করা সংসার-টংসার হুড়মুড় করে নেমে যাবে। আর নয়তো ফুর্তি করতে করতে হঠাৎ বেমক্কা লাফিয়ে উঠে একটা স্ক্রু একটা স্ক্রু বলে ছুট লাগাব। নিজের ওপর আর কিছুতেই নির্ভর করা যাবে না! মাইরি, ললিত, তোর চেয়ে আমি অনেক দুর্বল। কেবলই মনে হয়, কোথায় কোন গোলমাল করে রেখেছি, সব ভেঙেচুরে যাবে।

ললিত হাসে।

সঞ্জয় বলে, আমার মনে হয় রমেনটারও এ-রকমই একটা কিছু হয়েছিল। ছোট্ট একটা ভুল ছিল কোথাও, হঠাৎ ধরতে পেরেছিল রমেন। নইলে ওর হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে যাওয়ার মানে কী? অ্যাঁ! দু’জনে একসঙ্গে কত বদমাইশি করেছি বল তো! ট্রাফিক পুলিশের মাথা থেকে টুপি তুলে নিয়ে ছুট লাগিয়েছি, দোকানে খেয়ে পয়সা দিইনি, বদলে আফ্রিকান নাচ দেখিয়ে ছাড়া পেয়েছি, সিনেমা হল-এ মারপিট করে নতুন বইয়ের প্রথম শো দেখেছি— কী স্পিড ছিল রমেনের! তবু ওর হল কী? আজ সারাদিন আমার রমেনটার কথা মনে পড়ছে।

রমেন! ললিত তার ডান দিকে তাকটার দিকে তাকাল। ওখানে অনেক ধুলো-পড়া পুরনো কাগজপত্র। ওর মধ্যে খুঁজলে রমেনের কয়েকটা চিঠি পাওয়া যাবে। আর, ঠিকানা। বড় সুন্দর ছেলে ছিল রমেন, ময়মনসিংহের সেই জমিদারের ছেলেটা। কখনও-সখনও নাম সই করত, রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।

ললিত বলল, আমার কাছে রমেনের ঠিকানা আছে। নিবি?

না। মাথা নাড়ল সঞ্জয়, থাকগে। যে যার মনে থাকুক। বলে খুব চালাক-হাসি হাসল সঞ্জয়, বললে, ও শালা আমার কাছে হাজার দুয়েক টাকা পায়! সেটা আমার ব্যবসায় ডুবেছে।

তুলসী বলে, পাপিষ্ঠ।

সাড়ে আটটা নাগাদ সঞ্জয় আর তুলসী উঠল। দরজা থেকে তুলসী হঠাৎ বলল, আজ আদিত্যকে দেখলাম।

সঞ্জয় বলে, কোথায়!

গড়িয়াহাটায়। ডবল ডেকারের দোতলা থেকে দেখলাম আদিত্য চিনেবাদাম খেতে খেতে দক্ষিণমুখো চলেছে। সঙ্গে একটা কালোমতো মোটাসোটা মেয়েছেলে।

শুনে সঞ্জয় চেঁচিয়ে হাসল। আর, ললিত চমকে উঠল।

ললিতের মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। অমন সুন্দর, শ্যামলা মেয়েটি— শাশ্বতী আদিত্যর ও-পাশ থেকে ঝুঁকে বার বার ব্যাকুল হয়ে বলছিল, আমার পিসেমশাই এই রোগ থেকে সেরে উঠেছেন। দেখবেন, আপনারও সেরে যাবে। তুলসীটার রুচি নেই, চোখও না। কালোমতে, মোটাসোটা মেয়েছেলে! কেমন বিশ্রীভাবে বলল! তুলসী ওকে ঠিকমতো দেখেইনি।

গলির মুখে দাঁড়িয়ে ললিত অন্যমনস্কভাবে শুনল, সঞ্জয় তুলসীকে বলছে, শালা গাঁইয়া, এখনও গাড়ির দরজা ঠিকমতো বন্ধ করতে শিখিসনি!

গাড়ির মধ্যে অন্ধকারে ওরা দু’জন ঝুঁকে একসঙ্গে সিগারেট ধরিয়ে নেয়। পিছন থেকে মা চেঁচিয়ে বলে, বউকে নিয়ে একদিন আসিস সঞ্জয়। তোর ছেলেটাকে দেখিনি। আর, আমাকে নিয়ে যাস তোর গাড়িতে। তুলসী, তোর বউ আনিস।

আসব… আসব… ওরা চেঁচিয়ে বলে, চলি রে, ললিত।

ললিত মাথা নাড়ে।

পিছন ফিরে গলির অন্ধকারের মুখোমুখি হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় ললিত। মেয়েটি, ওই শ্যামলা সুন্দর শাশ্বতী, আজ রাতে হয়তো তার কথাই ভাবছে।

হঠাৎ তীব্র একটা আনন্দ বোধ করে ললিত। পরমুহূর্তেই মনে হয়, এটা গর্হিত আনন্দ।

নয়

বাবার যে পুরনো ছবিটা দেয়ালে টাঙানো আছে তার পিছন থেকে দেয়াল বেয়ে পেট-মোটা একটা টিকটিকি ললিতের মুখোমুখি নেমে এল। গত কয়েক দিন ধরেই ললিত লক্ষ করেছে, মাঝে মাঝে টিকটিকিটা দেয়াল থেকে ধুপধাপ টেবিলের ওপর, মেঝের ওপর পড়ে যায়, আবার দেয়াল বেয়ে ওঠে, বাবার ছবিটার আড়ালে চলে যায়। সেই পুরনো টিকটির্কিটাই কি, যেটা মায়ের সব কথায় সায় দিয়ে বরাবর ডেকে উঠত, টিকটিক টিকটিক? সে-কথাগুলো প্রায় সময়েই ছিল তার বিয়ে করার ঘর-সংসার করার কথা, কিংবা বাড়ি তৈরির জন্য তাগাদা। বরাবর টিকটিকিটা সায় দিয়ে গেছে। ও পরিষ্কার মায়ের দলে। মা কথা শেষ করে টিকটিকির ডাক শুনে মেঝেয় টোকা দিয়ে বলেছে, ওই শোন, তিন সত্যি। ললিত উত্তর দিতে গিয়ে কান পেতে থেকেছে, টিকটিকিটা ডাকেনি। সেই পুরনো টিকটিকিটাই কি না তা লক্ষ করার জন্য টেবিল ল্যাম্পের আলোটা ঘুরিয়ে ওর গায়ে ফেলে ললিত। লক্ষ করে টিকটিকিটার পেট বেঢপ মোটা। প্রায় কাচের মতো স্বচ্ছ সেই পেটের মধ্যে কালচে মতো কী যেন দেখা যাচ্ছে। আরও একটু কাছে চোখ নিয়ে সে দেখল পিছনের পায়ের কাছাকাছি পেটের মধ্যে দু’ ধারে নিখুঁত গোল দুটি ডিম। এত স্পষ্ট যে, ললিত চমকে ওঠে। ডিম দুটো ঢাকা দেওয়ার কোনও বন্দোবস্ত নেই ওর শরীরে। খুব অল্প যন্ত্রপাতি দিয়েই ওর শরীর তৈরি হয়েছে, ওইটুকু স্বচ্ছ শরীরের মধ্যেই ওর বুদ্ধি, হজমশক্তি, ভয় এবং সন্তান। বরাবরই ও ললিতের বিপক্ষে ছিল, মায়ের দলে। ললিত এখন দেখল, ও মাথা তুলে কালো জ্বলজ্বলে দু’খানা পুঁতির মতো চোখ দিয়ে তাকে দেখছে। বুঝি বা ললিতকে জানাচ্ছে গর্ভধারণের কষ্ট। কেন যে এটা বরাবর মায়ের সঙ্গে তার বিপক্ষে জোট বেঁধেছে তা এখন ললিত বুঝতে পেরে হাসে। ছাদ পর্যন্ত মসৃণ সাদা দেয়ালটার কোথায় ও ডিম পাড়বে! নিখুঁত গোল দু’টি ডিমকে গড়িয়ে পড়া থেকে কী করে বাঁচাবে ও? চিন্তিতভাবে টিকটিকিটার চোখে চোখ রেখে ভাবছিল ললিত। আপন মনে বলল, তোমার বেশ বিপদ, বুঝলে টিকটিকি-মা! তারপর সে ভেবে দেখল কখনও টিকটিকির ডিম মেঝেয় পড়ে ভাঙতে দেখেনি সে। ওরা ঠিক কোথাও-না-কোথাও এক আধটা খাঁজ খুঁজে পায়। প্রত্যেকের জন্যই এক-একটা বন্দোবস্ত আছে পৃথিবীতে। বাবার ছবিটার দিকে চেয়ে সে একটু হাসল। ছবিটার পিছনেই বোধ হয় টিকটিকিটার বাসা। ছবিতে মোক্তারের পোশাক পরা লোকটা এককালে পুববাংলায় দাপটে ফুটবল খেলোয়াড় ছিল। ঢোলা প্যান্ট পরে খালি পায়ে সাহেবদের বুট-পরা পায়ের সঙ্গে টক্কর দিয়েছে। সাহেব-রেফারিরা যে-সব গোল নাকচ করেছিল সেগুলো ধরলে সে-আমলে শ’ দেড়েক গোল দিয়েছিল লোকটা। প্রতিটি গোলেরই আলাদা আলাদা গল্প ছিল। রোমাঞ্চকর সে-সব গল্প। উইয়ে খাওয়া একটা ফটোগ্রাফ ছবির ফ্রেম থেকে খুলে মা সযত্নে ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছে। ছবিটায় আছে প্রকাণ্ড একটা শিল্ডকে ঘিরে একটা পুরনো আমলের ফুটবল টিম। শিল্ডটার বাঁ বারে মাটিতে বসে বাবা— সামনে দু’খানা পা পরস্পরের সঙ্গে আড়াআড়ি করে রাখ, নাকের নীচে মোটা গোঁফ, মাথার মাঝখানে সিঁথি, মোটাসোটা নাদুসনুদুস শরীর, গায়ে জার্সি না থাকলে খেলোয়াড় বলে মনেই হত না। লোকটার বরাবর গর্ব ছিল, আমরা ‘হায়ারে’ খেলতাম। মাকে ছেলেবেলায় বলতে শুনেছে ললিত বে, ফুটবলের ডিমে তা দিয়েই লোকটা অর্ধেক জীবন কাটিয়ে দিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার উৎসবের সময়ে গ্রামে নবীনদের সঙ্গে প্রবীণদের একটা খেলা হয়েছিল। সেই শেষবার প্রবীণদের দলে বাবাকে খেলতে দেখেছিল ললিত। অফসাইডের জন্য বাবার দেওয়া একটা গোল নাকচ হল। ললিত কাঁদো-কাঁদো হয়েছিল ক্ষোভে, আক্রোশে। সান্ত্বনার মধ্যে রেফারিটা ছিল চশমা চোখে। সেই বিকেলেই হল ‘কেদার রায়’ নাটকের অভিনয়। শেষ দৃশ্য: কার্ভালো বুকে পিস্তল দেগে আ…আ…গু-উ-ড বাই বে-ন্‌-গো-ও-ল’ বলে ঢলে পড়ছে। চোখের জল শার্টের ঝুলে মুছে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিল ললিত, চেঁচিয়ে সবাইকে ডেক বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওই লোকটা, ওই কার্ভালো তার বাবা! তার বাবা! পিছনের দুটো লোক চেঁচিয়ে বলেছিল, বসে পড়ো খোকা, তোমার বাবা সত্যিই মরে নাই।

মোক্তারের পোশাক পরা লোকটার ছবির দিকে চেয়ে একটু হাসল ললিত, মনে মনে বলে, টিকটিকির ডিমে তা দিচ্ছো, বাবা? তারপর গম্ভীর হয়ে আবার হাসল, দাও। হায়ারেই খেলছ কিন্তু এখনও!

টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজপত্র, পুরনো চিঠি। সেগুলো ধুলো-টুলো ঝেড়ে দেখছিল ললিত। তাকে চিঠি লেখার লোক কম। তাই চিঠি বেশি জমেনি। কিছু চিঠি হারিয়ে গেছে, কিছু বা উনুন ধরানোর কাজে লাগিয়েছে মা। তবু এর মধ্যেই রমেনের কয়েকখানা চিঠি পাওয়া গেল। অনেক দিন আগে লেখা। রমেনের সঙ্গে চিঠি চালাচালি বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। তার কথা ভুলেই গিয়েছিল ললিত। সঞ্জয় আজ না বললে মনেই পড়ত না, মনে পড়ে ভাল হয়েছে। তিন-চার শ’ টাকা দেনা আছে রমেনের কাছে। সেটা শোধ দেওয়া দরকার। টাকাটার কথা হয়তো রমেনের মনেও নেই। কত লোকের কাছে রমেনের কত টাকা পড়ে আছে। জড়ো করলে কয়েক হাজার হবে। তার হিসেব রমেন রাখত না। রমেনের কাছ থেকে যারা টাকা নিয়েছে, তারা কোনও দিনই বোধ হয় সেটা শোধ দেওয়ার কথা ভাবেনি, রমেন নিজেই ভাবতে দেয়নি। তারপর এখন রমেন বোধ হয় সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসিই কিছু হয়ে গেছে, বিহারের ছোট শহরে এক আশ্রমে বাস করছে। সেই আশ্রমের ব্যাপার-স্যাপার ললিত জানে না। তবে মনে হয় তারা এতদিনে রমেনকে গেরুয়া-টেরুয়া পরিয়ে, মাথা কামিয়ে একটা আধ্যাত্মিক চেহারা দিয়েছে। সে হয়তো এখন আর টাকা-ফাকা ছোঁয় না, যে-কোনও মেয়েছেলেকে মা বলে ডাকে, কীর্তন-টীর্তন করে। এখন আর তার টাকা শোধ দেওয়ার মানেই হয় না। তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় ললিত। রমেনের কথা মনে না পড়লে টাকাটার কথাও মনে পড়ত না, কিন্তু দৈবক্রমে যখন মনে পড়েই গেছে তখন শোধ করে দেওয়াটাই ঠিক হবে। কোনও দিন যদি রমেনের স্বার্থবুদ্ধি ফিরে আসে, তখন যেন ললিতের প্রতি তার কোনও আক্রোশ না থাকে। মরার পরও যদি ললিত কিছুদিন তার চেনা লোকজন, আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের স্মৃতিতে থেকে যায় তবে সে-থাকাটা যেন ঋণমুক্ত, হিংসা-দ্বেষহীন এবং ভারশূন্য হয়।

রমেনের ঠিকানাটা পাওয়া গেল সহজেই। সোজা ঠিকানা। শুধু নাম, আর পোস্ট-অফিস। এতেই চিঠি চলে যায়। চিঠির কাগজে কেবল ‘ভাই রমেন’ এটি পাঠটুকু লিখে ললিত এর পরে কী লিখবে তা ভাবছিল, এমন সময়ে শম্ভু এসে ডাকল, ললিতদা।

কী রে!

একটু বাইরে আসুন।

একটু দরকার আছে।

ললিত বাইরে এসে দেখল গলির মুখে পাড়ার কয়েকজন ছেলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় কথা বলছে। তাকে দেখে সিগারেট লুকোল। শম্ভু গলির মধ্যে তাকে এনে বলল, আপনি বিমান রক্ষিত নামে কাউকে চিনতেন?

ললিত একটু ভেবে বলল, কেমন চেহারা বল তো! কোথায় থাকে?

শম্ভু বলল, এ-পাড়ারই লোক। নতুন এসেছে। ফরসা রোগা চেহারা, দেখলে মনে হয় অসুখবিসুখ আছে, ভাসা-ভাসা চোখ…

ললিতের মনে পড়ল না। বলল, উঁহু। দেখলে হয়তো চিনব। কিন্তু কী ব্যাপার?

শম্ভু তার দলের একটা ছেলেকে ডাকল। সুবল। সুবল এগিয়ে এসে বলল, লোকটা এ-পাড়ায় নতুন। পশ্চিমের বস্তিবাড়ির কাছেই একটা খোলার ঘরে থাকে। কয়েক দিন আগে রাত্রিবেলা কিছু লোক এসে লোকটাকে খুব মেরে-ধরে গেছে। আমরা কিছু জানতাম না। পরদিন সকালে খবর পেয়ে আমরাই ভাক্তার-টাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু মার খাওয়ার পর থেকেই লোকটা কেমন পাগল-পাগল হয়ে গেছে। একা একা কান্নাকাটি করে। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। গতকাল থেকে সে আপনার নাম বলছে। বলছে যে, আপনার সঙ্গে নাকি কলেজে এক ক্লাসে পড়ত। আমরা ভদ্রলোকের মার-খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজখবর করছি, কিন্তু কিছুই বের করা যাচ্ছে না। পুলিশেও খবর দেবে না, হাসপাতালেও যাবে না। লোকটা রোগা, কিন্তু ভীষণ গোঁয়ার। আমরা খুব চাপাচাপি করায় গতকাল হঠাৎ বলল, ঠিক আছে, এ-পাড়ায় ললিত ভট্টাচার্য থাকে, সে আমার কলেজের ক্লাস-মেট, তাকে ডেকে দিন, তার কাছে বলব। আপনার অসুখ বলে আপনাকে আমরা প্রথমে খবর দিইনি, কিন্তু এখন দেখছি আপনাকে না হলে ব্যাপারটা কিছুই জানা যাবে না।

শম্ভুর দলবলের অধিকাংশ ছেলেই বেকার। তাদের সময় কাটতে চায় না। পাড়ায় কোনও ঝামেলা-ঝঞ্জাট হলে খুশি হয়, সেইটে নিয়ে কিছু দিন মেতে থাকে। অচেনা একটা লোক রহস্যময় কারণে বেপাড়ার কিছু লোকের হাতে মার খেয়েছে, এর গুপ্ত রহস্য ভেদ না করলে শান্তি নেই।

কিন্তু ললিত কিছুতেই মনে করতে পারল না। যে-কলেজে সে পড়ত সেটা কলকাতার একটা বড় কলেজ। আসলে সেটা ছিল গোয়ালঘর। এক ঘরে আড়াই শ’ ছেলে গাদাগাদি করে বসে তারা জেনারেল ক্লাস করত। প্রায় সবসময়েই রোল কলের পর পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বাইরের করিডোরে সিগারেট ফুঁকত, কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা জমাত। সেই আড়াই শ’ ছেলের মধ্যে কে যে রোগা ফরসা চেহারার ভাসা-ভাসা চোখের বিমান রক্ষিত তা কে বলবে! সে, রমেন আর আদিত্য পড়ত এক ক্লাসে, তুলসী পড়ত এক ইয়ার নীচে। এরা ছাড়া আর যারা ক্লাসের বন্ধু ছিল তাদের মধ্যে কাউকেই বিমান রক্ষিত বলে মনে হল না তার। সে মাথা নাড়ল, না রে সুবল, মনে পড়ছে না। চল, একবার দেখেই আসি ছেলেটাকে।

ঘরে গিয়ে জামা নিয়ে বেরিয়ে এল ললিত। চেঁচিয়ে মাকে সদর বন্ধ করতে বলল, তারপর আর মায়ের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করল না।

পশ্চিমের বস্তি খুব দূরে নয়। মিনিট তিনেক যেতে হয়। পাড়ার রাস্তা থেকে একটা শ্যাওলা-পড়া কাঁচা মেটে রাস্তা গিয়ে বস্তিতে শেষ হয়েছে। বস্তি থেকে একটু আলগা ঘরখানা। ওপরে খোলার চাল, কিন্তু দেয়াল আর মেঝে পাকা। ঘরে ইলেকট্রিক বাতিও রয়েছে। সুবল বলল, এই ঘর। ভদ্রলোক বাইরের ঘরে থাকেন, ভিতর দিকটা বাড়িওলার।

সুবল এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের লোকজন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল। খালি গায়ে লুঙ্গিপরা একটা লোক এসে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। লোকটা বিমান রক্ষিতের বাড়িওয়ালা। রাস্তার আলোয় তার মুখে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা দেখতে পেল ললিত। লোকটা তাকে চেনে। এ-পাড়ায় এখনও ললিতের খানিকটা দাপট আছে। লোকটা তাকে দেখে নমস্কার করল; বলল, একটা কিছু সমাধান করে যান দাদা। শুনেছি আপনার বন্ধু, ঘরখানা ছেড়ে দিতে বলেন। বড় অশান্তি হচ্ছে।

দরজায় অনেকক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পর দরজা খুলল। দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা একটা লোক। রাস্তার ম্লান আলোতেও হঠাৎ লোকটার দুটো চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠল। লোকটা বলল, কী ব্যাপার?

অসম্ভব সুন্দর ভরাট গলা লোকটার। একবার শুনলেই মন আকৃষ্ট হয়। পরনে পায়জামা, ওপর-গায়ে একটা তোয়ালে জড়ানো।

সুবল বলল, ললিতদাকে নিয়ে এসেছি।

শুনে লোকটা তাদের কয়েকজনের দিকে একটু অনির্দিষ্টভাবে চেয়ে থেকে বলল, আসুন।

ঘরে পঁচিশ কি চল্লিশ পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে। সেই অস্পষ্ট আলোয় ঘরের ভিতরটা দেখল ললিত, চারদিকে কেবল বই আর বই। নোংরা বিছানা, ময়লা মশারি নিচু করে টাঙানো, ঘরের এধার-ওধার জুড়ে টাঙানো দড়িতে রাজ্যের জামাকাপড়। বিমান রক্ষিত যে জামা-কাপড় ধোপাবাড়ি দেয় না তা একনজরেই বোঝা যায়। দড়ি থেকে গামছা ঝুলছে, পায়জামা শুকোচ্ছে। এক উদাসীনতা ছাড়া ঘরটার আর কোনও চরিত্র নেই। এই হতদরিদ্র ঘরে চকচকে নতুন দামি মলাটের ইংরিজি বইগুলি খুবই বেমানান লাগছিল।

দরজা খুলে দিয়েই লোকটা আবার বিছানায় গিয়ে বালিশে পিঠ দিয়ে আধশোয়া হয়েছে। তাকে দেখে বলল, এসো ললিত, বিছানায় বোসো।

কাছ থেকে ললিত মুখখানা দেখল। ব্যান্ডেজের তলায় কপাল ঢাকা পড়েছে, নাকটা ফুলে লাল হয়ে আছে, বাঁ চোখ থেকে ডান দিকের থুতনি অবধি একটা প্রকাণ্ড কালশিরার দাগ, ঠোঁট ফাটা, তাতে রক্ত জমে আছে। গা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা, তাই সেখানকার ক্ষতগুলো দেখা গেল না। স্বাভাবিক মুখখানা হয়তো বা চিনতে পারত ললিত। কিন্তু এখন এই ফোলা-কাটা-ফাটা মুখখানা কিছুতেই চেনা গেল না। তার দিকে অপ্রতিভ তাকিয়ে লোকটা একটু হাসবার চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে ফাটা ঠোঁট দিয়ে রক্ত ফুটে বেরোল। ‘আপনি’ না ‘তুমি’ কী বলবে ঠিক করতে না পেরে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল ললিত। হঠাৎ খেয়াল হল লোকটা একটু আগেই তাকে ‘তুমি’ বলেছে। সে বলল, কথা বোলো না, তোমার ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে।

তোয়ালে দিয়ে ঠোঁটটা একটু চেপে ধরে লোকটা সেই ভরাট সুন্দর গলায় বলল, আমি তোমাকে চিনি। তোমার বোধহয় আমাকে মনে পড়ছে না!

ললিত একটু হাসল।

শম্ভুরা ঘরের মধ্যে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে, জানালা দরজা দিয়ে উঁকি মারছে কৌতূহলী লোক। লোকটা এই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ মুখে চুপ করে রইল। চোখে-মুখে খানিকটা ঘাবড়ে যাওয়া ভাব।

ললিত শম্ভুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা এখন যা, আমি একটু কথা বলি।

শম্ভু মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছনে গেল ওর দলবল। ললিত উঠে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখল ওরা দরজার বাইরে জটলা করছে। সুবল গলা বাড়িয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, চিনতে পারছেন তো? না কি শালা চারশ’ বিশ!

ললিত বলল, চিনেছি। তোরা চলে যা। কাল সকালে দেখা করিস।

দরজা বন্ধ করল ললিত, জানালা ভেজিয়ে দিল। তারপর সিগারেটের প্যাকেট মাঝখানে রেখে লোকটার মুখোমুখি বিছানায় বসল।

বোঝা যায় ভাসা-ভাসা দুটো চোখের তলায় অনেক কথা জমা হয়ে আছে। লোকটা ভ্রূ জড়ো করে তার দিকে একটু তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, তুমি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছ?

ললিত একটু দ্বিধা করে বলল, ঠিক মনে পড়ছে না।

লোকটা চোখ খুলল, আমাকে খুব কম ছেলেই চিনত। আমি কারও সঙ্গেই মিশতে পারতাম না।

বলে একটু থেমে বলল, কলেজ-জীবনে তুমি ছিলে আমার হিরো। তোমাকে আমার খুব মনে আছে। তুমি ছাত্র ইউনিয়ন করতে। চমৎকার বক্তৃতা দিতে পারতে, অনেক ভোটে জিতে তুমি হয়েছিলে কলেজ-ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি। সব ঠিক বলছি তো?

ললিত মাথা নাড়ল, ঠিক।

লোকটা আবার বলল, তুমি ছিলে ছাত্রমহলে ভীষণ পপুলার। যে-কেউ মুশকিলে পড়লে তোমার কাছে ছুটে যেত। তুমি কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেক লড়াই জিতেছিলে। প্রায়ই দেখতাম ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তোমাকে ঘিরে জটলা হচ্ছে। ছেলেরা তোমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কখনও করিডরে, কখনও কলেজের সামনে রাস্তায়, কখনও চায়ের দোকানে। তুমি কড়া মেজাজের প্রিন্সিপালের ঘরে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারতে, ভাইস-প্রিন্সিপালকে মেজাজ দেখিয়ে আসতে পারতে, প্রফেসররা তোমাকে ভয় পেত। তুমি ছাত্রদের অনেক ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করেছ। ঠিক বলছি না?

ললিত মাথা নাড়ে, ঠিক।

আমার খুব হিংসে হত ভাই! বলে লোকটা আবার হাসল। তার ফাটা ঠোঁট দিয়ে রক্তবিন্দু ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে আসছে, আর সে তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মুছে কথা বলছে, আমি ভেবেই পেতাম না ছেলেরা তোমার সঙ্গে এত কী কথা বলে! তাদের সঙ্গে তোমারই বা কী এত কথা থাকতে পারে! কথার অভাবে আমার কোনওকালে তেমন বন্ধু জোটেনি। দু’-চারটে কথার পরই আমার কথা ফুরিয়ে যায়, বলার মতো কিছুই আমি আর খুঁজে পাই না, অসহায়ভাবে আমি চুপ করে থাকি। ছেলেবেলা থেকেই এইরকম আমার কপাল। যতবার বন্ধু পাতাতে গেছি ততবারই টের পেয়েছি আমার বলার মতো তেমন কিছু নেই। অথচ চিরকাল দেখেছি আমার সমবয়সি বন্ধুরা ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে, খেলতে খেলতে কথা বলছে, খেলার শেষে কথা বলছে, স্কুলে যেতে যেতে, স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে দল বেঁধে, জোট বেঁধে কথা বলছে। আমার ইচ্ছে হত আড়াল থেকে আড়ি পেতে ওদের কথাগুলো মুখস্থ করে রাখি, তারপর সেই কথাগুলোই আমার কথা করে তুলি। কিন্তু শুনতে গিয়ে দেখেছি সেই কথাগুলো একেবারেই তুচ্ছ সামান্য সব কথা, যার তেমন কোনও মানে নেই। তবু সবাই ওইরকম আজেবাজে কথা দিয়েই পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখছে। আমি ও-রকম আজেবাজে কথা বলার চেষ্টাও করে দেখেছি, আমার হয় না। বন্ধুরা বরাবর আমাকে এড়িয়ে গেছে। তাই ক্রমে ক্রমে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার কথাবার্তা খুব কমে যেতে লাগল। নিজের কথার অভাব সম্বন্ধে আমি এত সচেতন হয়ে উঠছিলাম যে, মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ খুব কমে যেতে লাগল। সকলের মধ্যেই ঘুরি ফিরি, কিন্তু কারও সঙ্গেই সাহস করে কথা বলি না। এটা আমার এমন একটা রোগের মতো হয়ে দাঁড়াল যে, আমার উপস্থিত-বুদ্ধি পর্যন্ত কমে যাচ্ছিল। রাস্তার অচেনা লোক কোনও ঠিকানা বা রাস্তার খোঁজ করলে আমি খুব ঘাবড়ে যেতাম, ঘড়িতে ক’টা বাজে জিজ্ঞেস করলে দিশেহারা হয়ে নিজে হাতঘড়ির দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও সঠিক সময়টা বুঝতে পারতাম না। প্রায়ই আমি লোককে ভুল ঠিকানা কিংবা ভুল সময় বলে দিয়েছি। আমাদের বাড়িতে কোনও আত্মীয়-স্বজন এলে, কিংবা কেউ বেড়াতে এলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম। আমি অন্য কারও বাড়িতে পারতপক্ষে যেতাম না। ট্রামে-বাসে কেউ আমার পা মাড়িয়ে দিলে আমি বলতে পারতাম না, পা-টা সরিয়ে নিন মশাই, দোকানদার ভুল পয়সা ফেরত দিলে বলতে পারতাম না যে, পয়সা ভুল হয়েছে, ওজনে কম দিলে বলতে পারতাম না, তোমার দাঁড়িপাল্লার ফেরটা একটু দেখি হে! এক বার বাসে আমার চোখের সামনে দেখলাম, একটা ছোকরা পকেটমার এক বুড়ো লোকের পকেট থেকে ব্যাগ তুলে নিল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। এক বার ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে গ্যালারির ওপর থেকে আমি সিগারেটের জ্বলন্ত শেষ অংশটুকু ফেলে দিয়ে লক্ষ করলাম সেটা গ্যালারির কাঠের ফাঁক দিয়ে নীচে পড়ল। সেখানে একটা লোক উবু হয়ে বসে পেচ্ছাব করছিল, তার ঘাড়ের শার্টের কলারে গিয়ে আটকে গেল টুকরোটা! লোকটা টের পায়নি, ওদিকে তার শার্টের পিছন দিকটা ধরে গিয়ে ধোঁয়া উঠছিল। আমি একদৃষ্টে সভয়ে সে-দৃশ্যটা দেখলাম, কিন্তু লোকটাকে ডেকে ব্যাপারটা বলতেই পারলাম না।

আবার ঠোঁটে তোয়ালে চাপা দিল লোকটা। বলল, তুমি এটা ঠিক বুঝবে না। কারণ, তোমার কখনও কথার অভাব হয়নি। তুমি বরাবর অনায়াসে কথা বলেছ। শুনে তোমার একটু অদ্ভুত লাগছে না?

হাসল ললিত। বলল, বলো, থেমো না।

তোমার একটা সিগারেট খাই। বলে লোকটা সিগারেট ধরাল। খুব কষ্টে ফাটা ঠোঁটে সিগারেট আটকে অল্পস্বল্প টান দিল। তারপর বলল, স্কুলে বা কলেজে যে-সব ছাত্র জনপ্রিয় ছিল, তাদের সবাই ছিল আমার হিরো। তুমিও ছিলে। তোমাকে খুব লক্ষ করতাম আমি। ছিপছিপে ফরসা শরীর, চোখা নাক, চাপা গাল, তুমি চুপ করে থাকলেও তোমার ধারালো মুখখানা কিন্তু নীরবে কথা বলত। তুমি কখনও কাউকে অগ্রাহ্য করতে না, এবং নিজের জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে তুমি সচেতন ছিলে। আমার ধারণা হত যে, একদিন তুমি দেশের নেতা-টেতা গোছের কিছু হয়ে উঠবে। কলেজের ফাংশনে একবার তোমাকে দেখেছিলাম কলকাতার মেয়রের সঙ্গে কথা বলতে, আর-এক বার দেখেছিলাম এক সুন্দরী বিখ্যাত গায়িকার সঙ্গে। আমার বিশ্বাস ছিল তোমার ক্ষমতা এত বেশি যে, তুমি হয়তো একদিন ওই বিখ্যাত গায়িকাকে বিয়ে পর্যন্ত করতে পারবে। তোমাকে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বড় চমৎকার মানিয়েছিল। তোমাকে আমি হিংসে করতাম, কিন্তু মনে মনে সবসময় চাইতাম তুমি যেন অপরাজেয় হয়ে থাকো, সামনের ইউনিয়ন ইলেকশনে কেউ যেন তোমাকে হারাতে না পারে, কলেজ কর্তৃপক্ষ যেন কখনও তোমাকে উপেক্ষা না করে, তোমার সম্ভাব্য বিয়ের প্রস্তাব যেন কখনও প্রত্যাখ্যান না করে সেই বিখ্যাত সুন্দরী গায়িকা। দেখো, তোমাকে আমি কতটা মনে রেখেছি।

হাসল লোকটা, রক্তের ফোঁটা ফুটে উঠল ঠোঁটে, তোয়ালে চাপা দিয়ে বলল, কিন্তু আসলে আমার দুর্বলতা থেকে তোমাকে আমি যতটা বড় মনে করতাম তুমি হয়তো ঠিক ততটা বড় নও। তুমি যা, তার চেয়ে তোমাকে আমি বহু গুণ বাড়িয়ে দেখেছিলাম। না?

ললিত মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, ঠিক।

আমি যে সত্যিই তোমার সঙ্গে পড়তাম তার আরও একটা প্রমাণ দিই। সে সময়ে তুমি কলেজের ম্যাগাজিনে একটা প্রবন্ধে লিখেছিলে, ‘ভারতে সাম্যবাদ এবং কয়েকটি অসুবিধা’— ঠিক বলছি না? সেই প্রবন্ধে তুমি লিখেছিলে যে, ভারতবর্ষে ধর্মই হচ্ছে সাম্যবাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। অথচ এ-ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কারণ, ধর্মই ভারতবর্ষের সভ্যতাকে তৈরি করেছে, ধর্মই চিরকাল ধরে নিয়ন্ত্রণ করেছে এ দেশের ইতিহাস। একটা পুরো জাতি ধর্মে শৃঙ্খলিত। সাম্যবাদের প্রথম আঘাতটি যখন এর ওপর এসে পড়ে তখন ঠিক অনুরূপ একটি প্রত্যাঘাতও লাভ করে। কারণ, এ দেশের লোক ধর্মের নামেই পারত্রিক দুঃখগুলি ক্লেশে বহন করে, কর্মফল স্বীকার করে বাস্তব পৃথিবীর আঘাতগুলি অনায়াসে গ্রহণ করে। তুমি আরও লিখেছিলে: আর আশ্চর্যের বিষয় যে, এখনও কোনও কোনও মন্দির বা দেবস্থানে হত্যা দিয়ে বা মানসিক করে লোকের কিছু কিছু মনস্কামনা পূরণ হয়। কোনও ধর্মগুরু বা যাজক এখনও লোককে কিছু কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করান, যার ফলে মানুষের ধর্মবিশ্বাস ভাঙনের মুখে এসেও আবার জোড়া লেগে যায়। তোমার প্রবন্ধটা এ-রকমই ছিল, না?

ললিত মাথা নাড়ে, ঠিক।

তুমি এই সাম্যবাদ এবং ধর্মের একটা সমাধান দিয়েছিলে। তুমি লিখেছিলে: এ দেশে ধর্মের অসারতা প্রমাণ করতে হলে সাম্যবাদের প্রতিটি প্রচারককেই হাতেকলমে ধর্মের প্রতিটি বিধি এবং আচারকে মানতে হবে। মনুর অনুশাসনকে শিরোধার্য করে নিয়ে লোকের সামনে সমস্ত বিধিগুলি পূর্ণ করে দিয়ে দেখতে হবে যে, এগুলো আসলে ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। এদেশে ধর্মকে হাতেকলমে অপ্রমাণ না করতে পারলে এর ভিত নড়ানো যাবে না।

সিগারেটটা শেষ করে ঘরের একধারে না দেখে ছুড়ে ফেলল লোকটা, বলল, তোমার সমাধানটা আমার অদ্ভুত লেগেছিল।

বলতে বলতে হঠাৎ হো-হো করে হাসল লোকটা, খুব অদ্ভুত। ধর্মকে অস্বীকার করার জন্য সাম্যবাদীরা ফোঁটা তিলক কেটে বোষ্টম হচ্ছে, কাপালিক হয়ে শ্মশানকালীর পুজো করছে, কিংবা সাধু হয়ে চলে যাচ্ছে হিমালয়ে, কীর্তন করে ফিরছে সারা দেশ—ভাবাই যায় না।

লজ্জায় ললিত একটু লাল হল। বাস্তবিক ও-রকমই একটা অস্বাভাবিক প্রস্তাব সে করেছিল সেই প্রবন্ধটায়। ঠিক।

লোকটা একটু স্থির হয়ে, রক্তাক্ত হাসিমুখে তার দিকে চেয়ে বলল, তুমি কি এখনও সেই প্রস্তাবে বিশ্বাস করো?

ললিত মাথা নাড়ল, না।

কেন করো না?

ললিত চুপ করে রইল।

লোকটা হঠাৎ বলল, আমি বিশ্বাস করি। তুমি ঠিকই লিখেছিলে।

টিকটিক করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। লোকটা লক্ষ করল না, কিন্তু ললিত শুনল।

বেশ কষ্ট এবং কসরত করে লোকটা উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, চা খাবে?

ললিত বলল, না।

আমি একটু খাব।

বলে লোকটা উঠল। ঘরের একধারে রান্নার জন্য কিছু অ্যালুমিনিয়মের বাসনপত্র আর কেরোসিন স্টোভ ছিল। লোকটা স্টোভ জ্বেলে কেটলি চাপিয়ে আবার এসে চৌকিতে বসে একটু হাঁফাল। তোয়ালেটা গা থেকে বেখেয়ালে সরে যেতেই লোকটার খুব রোগা শরীর দেখা গেল। বুকের খাঁচাটা সরু একটা নলের মতো গোল। ললিত স্থির চোখে লোকটাকে দেখছিল। সুবলের সন্দেহ, মার খেয়ে লোকটা পাগল-পাগল হয়ে গেছে। তাই হবে।

লোকটা বলল, এ-পাড়ায় এসে আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেই চিনেছিলাম। না, তোমার চেহারা সেই আগেকার মতো ধারালো নেই, একটু ভোঁতা হয়ে গেছে। আমি তোমার সঙ্গে আলাপ করলাম না। কারণ, আমি জানতাম তুমি আমাকে ঠিক চিনবে না। আমাকে খানিকটা চিনত তোমার বন্ধু রমেন।

রমেন?

লোকটা মাথা নাড়ল। বলল, তোমাকে এ-পাড়ায় দেখে খুব হতাশ হলাম। দেখলাম, আমি যা ভেবেছিলাম তুমি তার কিছুই হওনি। অলস সময় কাটিয়ে দিচ্ছ। তারপর শুনলাম, তোমার অসুখ। তারপর আর তোমার সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল হয়নি।

ললিত মৃদু একটু হেসে বলল, আমার কথা বাদ দাও। আমার নিজেরও আর কৌতূহল নেই। তুমি নিজের কথা বলো।

লোকটার মাথায় বা কোথাও কোনও যন্ত্রণা হচ্ছিল। খানিকক্ষণ মুখখানা বিকৃত করে যন্ত্রণাটা সহ্য করল। তারপর একটু ঝিম মেরে রইল। বলল, আমি কি খুব এলোমেলো কথা বলছি?

না তো!

ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছি?

নিশ্চয়ই।

লোকটার ঘোলাটে চোখ চিকমিক করে উঠল। তেমনই ধীর ভরাট গলায় বলল, আমার বাবা উকিল ছিল, বাবার ইচ্ছে ছিল আমিও উকিল হই। কিন্তু আমার রকমসকম দেখে বাবা সে-আশা ছেড়ে দিল। আমি যা ইচ্ছে পড়তে লাগলুম। প্রথমে বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট, তারপর বি কম, মাঝপথে বি কম ছেড়ে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি এ অনার্সের ক্লাসে তোমার বন্ধু রমেনের সঙ্গে আলাপ।

আলাপ?

লোকটা হাসল, আলাপ শুনে হাসছ? বাস্তবিক আলাপটা হঠাৎ হয়নি। রমেনকে তুমি বোধ হয় খানিকটা চেনো, সে খুব কৌতুহলী ছেলে। কোনও বিষয়ে একবার সে কৌতূহলী হলে তাকে ঠকানো মুশকিল। আমার চুপচাপ অসহায় ভাব লক্ষ করে সে আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। আমার কথা আসতই না, দু’-একটা কথা বলেই আমি থেমে যেতাম। কিন্তু রমেন আমার শেষ দেখবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল।

লোকটা হঠাৎ মুখ বিকৃত করে বলল, যাক গে, সে বিস্তর কথা। বি এ পাস করে আমি দর্শনের এম এ-তে ভরতি হলাম, তুমি পড়তে ইংরিজি নিয়ে। তখনও তোমাকে আমি দেখেছি। শেষ পর্যন্ত আমার আর পড়া হয়নি।

কেন?

লোকটা হাসল। তারপর অকপটে বলল, আমি কিছু দিনের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *