ললিতার মুখের হাসি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মুখটা শক্ত হয়ে উঠল তারপরেই কেমন অসহায় আর করুণ ছায়া নেমে এল। বলল, দরকারে ঘরের কাজে আমি গাঁয়ের কুথায় না যাই? বাজারে দোকানেও যাই। আপনি ই বাড়িতে থাকেন, আমি ই বাড়ির মেয়ে বটে। আপনার কাজে কুথাও গেলে লজ্জা করবে ক্যানে?
কিন্তু আমি তো তোমাদের ঘরের লোক নই, আমার দরকারে তোমার কোনও কাজেরও দরকার নেই। শংকর গেলাসটা নামিয়ে রেখে, তক্তপোশের কাছে এগিয়ে এল। বালিশের তলা থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাল।
ললিতা মাথা নিচু করল হঠাৎ কোনও জবাব দিল না। তারপরে আবার যখন মুখ তুলল, তখন ওর মুখে আবার হাসি ফিরে এসেছে। কিন্তু এ হাসি কান্নার থেকেও অধিক, ব্যথা ও বিষণ্ণতায় ভরা। যদিও চোখে জল নেই। কথার স্বর যেন ভেজা ও গভীর, আমার ভুল হইচে মাস্টারবাবু, ভুলে যাই আপনি আমাদের ঘরের লোক নন বটে। রেগে গেইচেন, বুঝি, ই ঘরে আমার আসা যাওয়া আপনার ভাল লাগে নাই। যদি বুলেন, ত আর আসব নাই।
শংকর এক মুখ ধোয়া ছেড়ে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারল না। অনেক সময়েই সে ললিতাকে বিরক্ত হয়ে, ফেঁজে কথা বলেছে। ললিতার মুখের হাসি কখনও নেভেনি। বরং জলের হাঁসের মতোই, পাখা ঝাপটা দিয়ে, শংকরের বকুনিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। দশটা কথা বলে, হেসে, শংকরকেই চুপ করিয়ে দিয়েছে। অবিশ্যি, সে সব প্রসঙ্গ খুবই হালকা। ওর নিজেরই মনে হল, আজকের মতো কঠিন কথা আর বোধ হয় কখনও বলেনি। অন্তত আর যা-ই বলে থাকুক, নির্লজ্জ কখনও বলেনি। এখন মনে হচ্ছে ললিতা যা বলেছে, তা ওর নিজের মতোই বলেছে। ওর পক্ষে শংকরের জন্য বোস বাড়িতে বা ইস্কুলে যাওয়াটা তেমন বিচিত্র ব্যাপার কিছু না। ও যে সংসারের মেয়ে সে-সংসারের কাজে ওকে ঘরের বাইরে সর্বত্রই যেতে হয়। শংকরের জন্য যেতে হলে, ওর উৎসাহ বাড়ে ছাড়া কমে না। কিন্তু শংকর সবটা মেনে নিতে পারে না। না পারলেও, রেগে ঝেঁজে কথাগুলো না বললেও হত। ললিতাকে ও একেবারে চেনে না, বোঝে না, এমন না। ওর মনে অনুশোচনা জাগল, বিব্রতও হল।
নিজের মনটা নিজে বুঝি নাই মাস্টারবাবু।ললিতা আবার বলল, আপনার ভাল লাগে নাই জানি, তবু ক্যানে না এস্যে থাকতে পারি নাই, ইয়ার কারণটা জানি নাই।
শংকর হাসবার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে আসতে বারণ করব কেন? তুমি যেমন আস, তেমনি আসবে। কিন্তু আমি তোমাকে দিয়ে সব কাজ করাতে পারি না, এটা বোঝবার চেষ্টা করো।
মাস্টারবাবু, সংসারে জোর খাটাবার লোকের বড় অভাব।’ ললিতা পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে বলল, যাইচি।
শংকর কিছু বলবার আগেই, ললিতা ওর গেলাসটা হাতে নিয়ে, দ্রুত ঘরের বাইরে গেল। রক থেকে নেমে, আটচালার উঠোনের পাশ দিয়ে চকিতে অদৃশ্য হল। শংকর দরজার দিকে কয়েক পা অগ্রসর হল। ওর মুখেও করুণ আর গম্ভীর ছায়া নেমে এল।
আমি তা হলে ইবারে ঘরটা ল্যাপা মোছা করি বাবা?’রুকুবুড়ি দাওয়ার ওপর উঠতে উঠতে বলল।
শংকর ঘরের বাইরে দাওয়ায় বেরিয়ে বলল, হ্যাঁ করো।
এ সময়েই মনতোষ এলেন হন্তদন্ত হয়ে। মুখে ব্যস্ত উৎকণ্ঠা, কই হে শংকর মাস্টার কোথায়?
আসুন।’ শংকর তাড়াতাড়ি হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা নীচে ফেলে, স্যান্ডেলের তলায় চাপা দিল। দেখল, মনতোষের পিছনে গজাননও দেখা দিয়েছে।
.
গজানন যে মনতোষের সঙ্গে আসেনি, বোঝা গেল, ঠাকুর দালানের কাছাকাছি তার থমকে দাঁড়ানো দেখে। এই শীতের সকালে, তার গায়ে সেই মান্ধাতা আমলের পুরনো জীর্ণ তেলচিটে গরদের একখানি বস্ত্র। অর্ধেক কোমরে, অর্ধেক গায়ে জড়ানো। তার ওপরে অবিশ্যি একটি শুকনো মোটা গামছা আছে। হাতে নারায়ণ শিলা। কয়েক ঘর যজমানের বাড়ি প্রাত্যহিক পূজা করে ফিরছে। মনতোষ চাটুয্যেকে দেখে থমকে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক। তার কাছে চাটুয্যেরা এখনও জমিদার। মনে আছে ভয় আর সম্ভ্রম, কৃপা-প্রার্থীও বটে। কৃপা জুটুক না জুটুক, গাঁয়ের অবস্থাপন্ন যে কোনও লোকের কাছেই সে জোড় হাতে নতশির। কিন্তু যে কোনও গরিবের কাছেই সে গজানন মুখুজ্জে, শক্ত মানুষ। আপাতত তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি শংকরের দিকে।
হরির মুখে আর নতুন করে কী শুনব?’ মনতোষ বলতে বলতে শংকরের কাছে এগিয়ে এলেন। পোশাকে-আশাকে তিনি কখনওই তেমন ফিটফাট নন। মোটা ধুতি পাঞ্জাবির ওপরে বেশ কিছুদিনের ব্যবহৃত শাল জড়ানো। পায়ে পুরনো পামশু। মুখে দুদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের দৃষ্টিতে উদ্বেগ। বললেন, আমি তো কাল রাতে দেখেই বুঝে নিয়েছি, তোমার অবস্থা সুবিধের না। চখ-মুখের ছিরিই বদলে গেইচে। উদিকে হরির কথা শুন্যে, চঁদুর মা, ন’ বউ, সব্বাই ব্যস্ত হয়ে পড়েচে।
শংকর বলল, ব্যস্ত হবার কিছু নেই, সামান্য একটু জ্বর আর গায়ে যৎসামান্য ব্যথা। আসুন, ঘরে বসবেন আসুন।
না না, এখন আর ঘরে বসব না।মনভোষ ব্যস্ত হয়ে বললেন, এখন কথা হল্য–
শংকর বাধা দিয়ে বলল, তা হলে ঘর থেকে বসবার কিছু নিয়ে আসি।
হুঁ হুঁ, ঠাকুর দালানের উপর একখান আসন পেত্যে দিতে বুলচি। গজানন এগিয়ে এল, আর তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ললি, অ ললি, একটা আসন লিয়ে আয়।
মনতোষ ভ্রূকুটি চোখে গজাননের দিকে ফিরে তাকালেন। গজানন নারায়ণ শিলাসহ দু হাত কপালে ঠেকাল। মনতোষ ধমক দিয়ে বললেন, তোমার চেঁচামেচি থামাও ত হে, আমি ইখ্যানে বসতে আসি নাই। এখনই এক বার হাসপাতালে যেয়ে ডাক্তারকে খবরটা দিতে হবে। কিন্তু মাস্টার, এখন কথা হল্য, এই খারাপ শরীর লিয়ে তোমার ত এ ঘরে একলা থাকা চলবে নাই।
আমি তো একেবারে শয্যাশায়ী হইনি, দেখতেই পাচ্ছেন। শংকর হেসে বলল, এ ঘরে একলা থাকতে আমার কোনও কষ্টই হবে না।
মনতোষ তার স্বভাবসিদ্ধ ধমকের সুরে বেঁজে উঠলেন, তা খাবার পথ্যি-টথ্যিও কি নিজের হাত পুড়িয়ে রাঁধবে নাকি? উ সব আস্তাবাড়ি কথা রাখ।’ তিনি এক বার ঘরের ভিতর দিকে চোখ তুলে দেখলেন, হরির মুখে শুনলাম, অনেক বেলা অব্দি বিছানায় পড়ে ছিলে। এখন নেহাত ঘর নিকাই। হইছে, তাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েচ, ইয়ার পরেই ত আবার যেয়ে বিছানায় শুবে। বুঝি নাই নাকি, অ্যাঁ?’
কথাখানি ঠিক বুল্যেচেন গ বাবাঠাকুর। শংকর কিছু বলবার আগেই রুকুবুড়ি গোবর মাখা দু হাত জোড় করে, ঘরের বাইরে দাওয়ায় এসে দাঁড়াল, মাস্টের বাবাকে আজ তক কুন দিন এত বেলা ইস্তক বিছানায় পড়ে থাকতে দেখি নাই। লাতিন বামনি বাবার গায়ে হাত দিয়ে দেখ্যেচে, জ্বর রইচে। সে নিজে মুখ ধুবার গরম জল করে, চা করে খাইয়ে গেল। যমেরা কী মার মেরেচ্যে, বাবার মুখোনি ফুল্যে কেমন হয়ে গেইচে। ই শরীল লিয়ে, একলা ঘরে কখনও পড়ে থাকা যায়?
মনতোষের ভ্রুকুটি চোখের সঙ্গে গোঁফ জোড়াও যেন খাড়া হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করলেন, লাতিন বামনিটি আবার কে?
আজ্ঞে আমার দাদার বিটি ললি। গজানন আরও কয়েক পা এগিয়ে এল।
শংকর রুকুবুড়ির কথায় বিরক্ত বোধ করলেও, রাগ করতে পারল না। জানে, রুকুবুড়ি অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কিছু বলেনি। সে যা দেখেছে এবং বুঝেছে, সে কথাটাই সরল মনে বলেছে। ওর অস্বস্তির কারণ, ললিতার এ ঘরে আসা, শংকরের জন্য চা করা, মনতোষের হয়তো ভাল লাগবে না। অকারণ একটা জটিলতার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা।
মনতোষ বললেন, অ, কার্তিকদার মেয়্যে? তা, চা করে খাইয়েচে, বেশ করেছে। এ শরীরে যে নিজে ও সব করতে যাও নাই, ভালই করেছ। তারপরেও আবার বলছ, তুমি এ ঘরে একলা থাকবে?
ললিতা সকলের কথার মাঝখানেই, একটি হাতে-বোনা চটের আসন নিয়ে এগিয়ে এল। শংকরের ঘরের দাওয়ায় পেতে দিয়ে, মনতোষের দিকে ফিরে বলল, মাস্টারবাবুর অই রকম কথা। মুখের অবস্থা অই রকম, গায়ে জ্বর, ব্যথা। দেখবার কেউ নাই। সেজকাকা, আপনি ওঁয়াকে আপনাদের ঘরে লিয়ে যান।
মনতোষের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই নরম হয়ে এল, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, ঠিক বুল্যেচ। লোক নাই, জন নাই, এ ভাবে রুগি মানুষকে একলা ঘরে ফেলে রাখা যায়? বাড়ি থেকে আমাকে সে কথাই বুল্যে দিয়েছে।
আমি তালে নারাণশিলা ঘরে রেখ্যে, একটা রিকশা ডাকা করে লিয়ে আসি। গজানন বলল, মাস্টারবাবু না থাকলেও ঘর দরজা দেখবার লোকের অভাব হবে নাই।
শঙ্কর অস্বস্তিতে হাসল। গজাননকে বলল, রিকশা তোমাকে ডাকতে হবে না। নারায়ণ শিলা রেখে এসো, তোমাকে আমার চিঠি নিয়ে এক বার ইস্কুলে যেতে হবে। তার আগে বোস বাড়িতে একটা খবর দিতে যাবে, আমি আজ যেতে পারব না। দেরি করো না, তাড়াতাড়ি এসো।’ ও মনতোষের দিকে মুখ ফেরাল, সেজদা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার একলা থাকতে কোনও কষ্ট হবে না। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, খেয়ে নিয়েছি। জ্বর বলতে গেলে নেই। আজকের দিনটা উপোস দেব, তা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল দেখবেন, একেবারে ঝরঝরে হয়ে উঠেছি। বউদিদের ভাবতে বারণ করবেন।
শংকরের নির্দেশ মতো গজানন বাড়ির দরজার দিকে দ্রুত চলে গেল। মনতোষ ভ্রূকুটি অবাক চোখে, ললিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, শুন্যেচ মাস্টারের কথা!
মাস্টারবাবু তো অইরকমই বলেন। ললিতা শংকরের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে, ঠোঁটের কোণে হাসল, আপনি ধরাপাকড় করে লিয়ে যান।
শংকর জানে, ললিতার হাসিতে বিদ্রুপের কাঁটা, কথাগুলো আন্তরিক না। শংকরের চাটুয্যে বাড়িতে যাওয়াটা ওর আদৌ ভাল লাগার বিষয় না। তথাপি মনতোষকে উৎসাহী করে তোলার অর্থ, এক রকমের উসকে দেওয়া। উদ্দেশ্য শংকরকেই অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলা। কিন্তু শংকর মনে মনে নিজের সিদ্ধান্তে অধিকতর অটল হয়ে ওঠে। মনতোষ ঝেঁজে বললেন, তুমি কি নিজের ডাক্তারি নিজে করচ মাস্টার? ডাক্তার কি তোমাকে উপোস দিতে বুল্যেচে?
ডাক্তার বলেনি, আমি নিজেই শরীরের অবস্থা বুঝে বলছি। শংকর হেসে বলল, একটা দিন উপোস করলে শরীরটা ভালই থাকবে।
মনতোষ গায়ের শালটা খুলে এক বার ঝাড়া দিয়ে আবার জড়ালেন। ওটি তাঁর উত্তেজনার লক্ষণ। বললেন, তুমি কী বুঝেচ, উ সব আমি জানতে চাই না। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, সে উপোস দিতে বুল্যে কি না, শুন্যে আসি। তোমার একটা দোষ কি জান শংকর? তোমার অই মিটিমিটি হাসি আর আস্তে আস্তে কথা, কিন্তু আসলে তোমার ঘাড়ের একটা রগ একেবারে খাড়া। এক বার না করলে, আর হাঁ করান যায় নাই। অই রগটা বঁটি দিয়ে কেটে দিতে হয়।
তিনি ফিরে যাবার উদ্যোগ করে, আবার দাঁড়ালেন। আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, তারপরে বাড়িতে যেয়ে বউদের যা বুলবার বুলচি। তারা যা বুঝবে, তাই করবে, তোমার যা করবার তাই করবে। বলে হনহন করে ঠাকুর দালানের পাশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ললিতা মনতোষের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মুখে আঁচল চেপে হাসছিল। নিঃশব্দ হাসিতে ওর শরীর কাঁপছিল। তারপর শংকরের দিকে তাকিয়েই, হাসি থামিয়ে, দাওয়ার ওপর থেকে আসনটা টেনে নিয়ে, বাড়ির দরজার দিকে পা বাড়াল। শংকরের চোখে বিরক্তি। ও কিছুনা বলে, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল। ললিতা কয়েক পা গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠল, অই গ যা, এমন কথা কুনদিন শুনিনাই। ঘাড়ের রগ খাড়া, উটি বঁটি দিয়ে কেটে ফেল্যে দিতে হয়!’ হাসতে হাসতেই ভিতর বাড়িতে যাবার দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল, জ্বর গায়ে রোদে থাকতে আরাম লাগে বটে, কিন্তু রোদে না থাকা ভাল। উয়াতে জ্বর বাড়ে।বলেই বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
শংকরের মুখ গম্ভীর। কিন্তু সেও মনে মনে হাসছিল। ললিতার হাসির সংক্রামণ না, মনতোষের ঘাড়ের রগ কেটে ফেলার কথায় ওরও হাসি পাচ্ছিল। মনতোষ যথার্থই রেগে উঠেছিলেন। যদিও সন্দেহ নেই, সে রাগ স্নেহসঞ্জাতও বটে। কিন্তু নিজের ঘর ছেড়ে, অপরের ঘরে গিয়ে আশ্রয় ও শুশ্রষার মতো অসুস্থ সে হয়নি। এ রকম তুচ্ছ কারণে, চাটুয্যে বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তবে উপোস করে থাকার কথাটা সেও ভাবেনি। তবে কেবল কিছু খাবার জন্য, চাটুয্যে বাড়িতে যাওয়াটা, একটা ঘটা করার মতো ব্যাপার। সে সিগারেট ঠোঁটে চেপে দেশলাই ধরিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল। আরতি আর মল্লিকার মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল।
.
বুলেন, কী করিতে হবে। গজানন তার হাঁটুর ওপর ধুতি আর সুতির ময়লা চাদর জড়িয়ে এসে দাঁড়াল।
ললিতার সাবধানী বাক্য, শংকরের কানে লেগে আছে। কথা মিথ্যে বলেনি। জ্বর গায়ে রোদে থাকতে আরাম লাগে। বিশেষ এই শীতে। কিন্তু রোদ লেগে জ্বর বাড়ারই সম্ভাবনা। জ্বর তেমন বেশি না। হলে, সিগারেট বিস্বাদ লাগত। ও উঠোন ছেড়ে, ঘরের দিকে যেতে যেতে গজাননকে বলল, ভেতরে এসো।
ঘরের ভিতরে ঢুকে, যথাস্থানে রাখা, কাগজ কলম নিয়ে তক্তপোশে বসল। গজানন ঘরের মধ্যে ঢুকে, মাটির মেঝেয় বসে, আপন মনেই বকবক করতে লাগল, সেজকত্তা যে ভাবে এল্যেন, ভাবলাম, আপনাকে ওঁয়াদের ঘরকে না লিয়ে ছাড়বেন না। মেজাজটাও দেখলাম, বেশ গরম হয়্যা রইছে।…
শংকর সে সব কথার কোনও জবাব না দিয়ে, আগে স্কুলের হেডমাস্টারের উদ্দেশে অসুস্থতার কথা জানিয়ে, তিন দিনের ছুটির দরখাস্ত লিখল। বোস বাড়ির কর্তার নামেও একটি চিঠি লিখল। বসে বসে চিঠি লিখতেই, নিজেকে অসম্ভব ক্লান্ত মনে হল। চোয়ালে মাথায় যন্ত্রণাটা বাড়ছে ছাড়া কমছে না। শিয়রের পাশেই একটা মাটির প্রদীপ রাখা আছে, সিগারেটের ছাইদানি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। সিগারেটটা তার মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল, গজানন, এই চিঠি দুটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। আগে যাও বোস বাড়িতে। এই নাও, এটা হল বোস বাড়ির চিঠি।
গজানন তক্তপোশের সামনে এসে, শংকরের হাত থেকে বাঁ হাতে চিঠি নিয়ে, বলল, বাঁ হাত বোস বাড়ি।
বেশ, এ বার ডান হাতে স্কুলের চিঠি৷ শংকর আর একটা চিঠি গজাননের হাতে দিয়ে বলল, গুলিয়ে ফেলো না।
গজানন দু হাতে দুটো চিঠি নিয়ে, সামনের দিকে বাড়িয়ে বলল, উটি আর বুলতে হবেক নাই মাস্টারবাবু। বাঁ হাত বোস বাড়ি, ডান হাত ইস্কুল। আগে বাঁ হাত খালাস, উয়ার পরে ডান হাত।
হ্যাঁ, ইস্কুলে গিয়ে হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে যাবে। হেডমাস্টার কে জানো তো?
কী বল্যেন গ মাস্টারবাবু, হেডমাস্টারকে জানি নাই?’ গজানন তার কালো মুখে, মোটা বোঁচা নাক ফুলিয়ে হাসল, রাখাল রায়, এমেলে।
এম. এল. এ.র ওটাই উচ্চারণ। শংকর বলল, হ্যাঁ, কিন্তু উনি এখন কলকাতায় আছেন, ওঁকে পাবে না। নারায়ণবাবুকে পাবে।
বুইচি, লারাণ পিতরি ত?
হ্যাঁ, নারায়ণ পত্রী। শংকরও ইচ্ছা করেই গজাননের পিরি পদবিটার উচ্চারণকে শুধরে দিল। যদিও অর্থহীন, কারণ নারায়ণ পত্রী সকলের মুখেই লারাণ পিরি। কী করে পত্রী পিতরি হয়, ভাষাতত্ত্বের এ রহস্য ওর অজানা। বলল, নারায়ণবাবু হেডমাস্টারের ঘরে না-ও থাকতে পারেন, হয়তো ছেলেদের পড়াবার জন্য ক্লাসে থাকবেন। তুমি খোঁজ করে দেখবে, কিন্তু ক্লাসের ভেতরে যেয়ো না। উনি বেরিয়ে না আসা ইস্তক অপেক্ষা করবে। বাইরে এলে চিঠিটা দেবে। কোন চিঠিটা স্কুলে দেবে?
ডান হাতেরটা। গজানন ডান হাত বাড়িয়ে বলল, ভুল হবেক নাই গ মাস্টারবাবু, নিশ্চিন্ত থাকেন। তা হলে খাবার জলটা ফিরে এস্যে আনা করব।
শংকর বলল, হ্যাঁ, তাই করো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুমি বেরিয়ে পড়ো৷
হ, যাই। যেন যেতে গিয়েই হঠাৎ মনে পড়েছে, এ রকম একটা ভঙ্গি করে, গজানন ফিরে দাঁড়িয়ে, কুণ্ঠিত হাসল।
শংকর উঠতে যাচ্ছিল। ভুরু কুঁচকে গজাননের দিকে তাকাল, কী হল? পয়সা? এখন সকালবেলা পয়সার কী দরকার?
আর বুলেন ক্যানে মাস্টারবাবু। গজাননের কুণ্ঠিত হাসি মুখে তৎক্ষণাৎ বিরক্তি ফুটে উঠল, ঘর থেকে বেরতে যাইচি, বউ বুলল্যে, দুপুরের ভাতের পাতে দেবার মতন কিছু নাই। ত, ভাবলাম চারগণ্ডা পয়সা হলে, যা হক কিছু লিয়ে আসতাম। ডাল তো পাব নাই, চারগণ্ডা পয়সায় ডাল দিতে চায় না। শীতের বাজারে, এখন একটা ফুল বা বাঁধাকপিটপি মিলতে পারে।
শংকর কথা না বাড়িয়ে, বালিশের তলা থেকে খুচরো পয়সা ঘেঁটে, একটা সিকি বাড়িয়ে দিল, নাও।
গজানন ডান হাত বাড়িয়ে বলল, ইস্কুলের হাতেই দ্যান।
এক সিকি মানেই চারগণ্ডা পয়সা। শংকর সিকিটা গজাননের হাতে দিয়ে, তক্তপোশ থেকে নেমে ঘরের একপাশে গেল। মাথাটা আবার টলে উঠল। কোণের দিকে রাখা, একটা নড়বড়ে টেবিলের সামনে গিয়ে, সেটা ধরে দাঁড়াল। টেবিলের ওপরে এলোমেলো ছড়ানো এবং থাক করে রাখা একগাদা ইংরেজি বই। সব বইগুলোই ওর প্রিয়, বাছাই করে, অর্ডার দিয়ে, কলকাতা থেকে আনানো। তার মধ্যে মাকুসের বইটিও মাত্র কয়েক দিন আগে এসে পৌঁছেছে, এখনও উলটে দেখা হয় নি। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ও নিজেকে একটু সামলে নিল। জ্বরটা বাড়ছে কিনা, বুঝতে পারছে না। চোখ খুলে, বইটি টেনে নিয়ে, আস্তে আস্তে তক্তপোশের ওপর একেবারে কাত হয়ে পড়ল। পায়ের কাছে রাখা কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে, বইটা চোখের সামনে তুলে ধরল। কিন্তু পাতা ওলটাবার আগেই মনে হল, চোখ দুটো যেন জুড়ে আসছে। বইটা পাশে রেখে, চোখ বুজল।
.
কতক্ষণ সময় কেটেছে, শংকরের খেয়াল নেই। ওর হাতটা কেউ টেনে ধরতেই চোখ মেলে তাকাল। দেখল সুজিত ডাক্তার ওর নাড়ি দেখছে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গেল। সুজিত বলল, উঁহু, উঠবেন না। পালস বিট প্রায় একশোর কাছে। জ্বর রয়েছে, তবু কতটা এক বার দেখি। আজ আর চিতির ধারে যান নি তো?’ সে নিচু হয়ে, তার বাকসোটা তুলে নিল তক্তপোশের ওপর।
শংকর বলল, না চিতির ধারে যাইনি বটে, তবে এক বার যাওয়া দরকার মনে হচ্ছে।
মনে হলেও আজ আর এতটা পথ হেঁটে যাওয়া চলবে না। সুজিত বাকসো খুলে, থার্মোমিটার বের করে, শংকরের মুখের মধ্যে জিভের নীচে গুঁজে দিল, প্রাকৃতিক কাজটা আজ আশেপাশেই সেরে নেবেন।
শংকর থার্মোমিটার মুখে নিয়েই ঠোঁট টিপে হাসল। শালচিতি গ্রামে আসার পরে, কোনও দিনই যে আশেপাশে গড়া অর্থাৎ ডোবার ধারে ঘন আঁকুড় ঝোপে প্রাকৃতিক কাজ সারতে যেতে হয়নি, এমন না। কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই এত আদিম, চক্ষুলজ্জার বালাই বলে কিছু থাকে না। রক্ষা করাও সম্ভব না। তবু ভাগ্য ভাল, মেয়েদের আর পুরুষদের আলাদা সীমানা আছে। পাইখানা বলতে গেলে, তথাকথিত সাধারণ ভদ্র গৃহস্থের কারোরই নেই। বাউরি যা অন্যান্য পাড়ার তো কথাই আসে না। বিশেষ সম্পন্নশালী দু-চার গৃহে, কুয়ো পাইখানার ব্যবস্থা আছে। স্যানিটারি পাইখানার ব্যবস্থা চাটুয্যে বাড়ি ছাড়া আর কোথাও আছে কি না, শংকরের জানা নেই। সে বাড়িতে অবিশ্যি শহরের সব ব্যবস্থাই আছে। নলকূপের সঙ্গে পাম্প বসিয়ে বিদ্যুতের সাহায্যে ছাদের ওপর ট্যাঙ্কে জলও সঞ্চিত থাকে। বেসিন আর। ট্যাপ-এর ব্যবস্থাও আছে।
সুজিত থার্মোমিটারটা শংকরের মুখ থেকে টেনে বের করে, তুলে দেখল। ভুরু কুঁচকে বলল, হু, জ্বর প্রায় একশো। ব্যথা কী রকম বোধ করছেন?
খুব একটা কিছু না, তবে আছে। শংকর বলল, আসলে দেখছি, কিছু চিবোতে গেলে লাগছে।
সুজিত বলল, তা একটু লাগবে। গালের হাড়ে চোট তো ভালই লেগেছে। চিবোতে গিয়ে চোয়ালে চাপ পড়লেই ওখানে টান পড়ছে। সে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, শুনুন, আপনি থার্মোমিটারটা একটু জল দিয়ে ধুয়ে দিতে পারবেন?
শংকর শোয়া অবস্থায় ঘাড় ফেরাবার আগেই ললিতার গলা শুনতে পেল, পারব।
ললিতা ঘরে ঢুকে এগিয়ে এসে, সুজিতের হাত থেকে থার্মোমিটার নিতে নিতে এক পলক শংকরের মুখের দিকে দেখে নিল।
সুজিত আবার বললে, আর একটা কাজ করতে পারলে ভাল হয়। চট করে একটু–এই এক কাপ মতো জল গরম করে দিতে পারবেন?
পারব।’ ললিতা ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলল, আপনার রুগিটি আবার রাগ করবেন কি না, সিটি এক বার জিজ্ঞেস করে লিবেন।
সুজিত আবার জিজ্ঞাসু চোখে শংকরের মুখের দিকে তাকাল। শংকর হেসে নিচু স্বরে বলল, ওকে সকালের দিকে একটু বকে ছিলাম। জল গরম দিয়ে কী হবে?
একটা ইনজেকশন দেব। সুজিতও একটু হাসল, স্টেথিস্কোপটা গলার থেকে কানে লাগিয়ে, শংকরের গায়ের কম্বল টেনে নামিয়ে, বুক এবং পাঁজর দেখল। স্টেথিসকোপ কান থেকে নামিয়ে বলল, না, কনজেশন নেই, তবু একটু সাবধানে থাকবেন, ঠাণ্ডা একেবারেই লাগাবেন না। সকালের ওষুধগুলো খেয়েছিলেন তো?
শংকর বলল, খেয়েছি।
ললিতা থার্মোমিটার জলে ধুয়ে, সুজিতের হাতে তুলে দিল। দ্রুত সরে গিয়ে, কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে একটা ধোয়া অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে জল বসিয়ে দিল। সুজিত ইনজেকশনের অ্যামপিউল আর সিরিঞ্জ বের করল বাকসো থেকে। শংকর জিজ্ঞেস করল, কটা বেজেছে?
সুজিত কোটের হাত সরিয়ে কবজির ঘড়ি দেখে বলল, এগারোটা।
মাত্র?’ শংকর অবাক হাসল, আমি ভেবেছিলাম, অনেক বেলা হয়েছে। তা আপনি হঠাৎ এলেনই। যখন, এত তাড়াতাড়ি এলেন কেন? এ সময় তো আপনার হাসপাতালে প্রচুর রুগির ভিড়।
সুজিত বলল, হঠাৎ না, আমি এক বার আসতামই। আপনার জ্বর হতে পারে, এ রকম একটা অনুমানও করেছিলাম। তার মধ্যেই মনতোষবাবু গিয়ে হাজির।
সেটা এখানে এসে শুনিয়েই গেছেন, উনি আপনার কাছে যাবেন। শংকর বিব্রত সংকোচে বলল, অকারণ আপনাকে ব্যস্ত করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু ওঁকে বোঝানো যায় না।
সুজিত বলল, অকারণ ব্যস্ত হইনি, তবে মনতোষবাবু একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে গিয়ে ভালই করেছেন, জ্বরের খবরটা তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলাম। হাসপাতালে মোটামুটি আমি সামলে এসেছি, আবার এখুনি যাব। তারপরে আর এক বার বেরোতে হবে।
ললিতা গরম জলের বাটিটা আঁচলে চেপে ধরে তক্তপোশের কাছে এগিয়ে এল, কুথাকে রাখব?
এখানেই রাখুন। সুজিত তার বাসোটা একটু সরিয়ে রাখল।
ললিতা গরম জলের বাটি রেখে, আর এক বার শংকরের মুখের দিকে দেখে, দরজার কাছে সরে গেল। সুজিত গরম জলে সিরিঞ্জ ডুবিয়ে সূঁচে কয়েকবার জল টেনে ঢালল, ফেলল। গোটাটা খুলে, জল ঝেড়ে শুকিয়ে নিল। অ্যামপিউলের মুখ কেটে সিরিঞ্জে ওষুধ ভরতে ভরতে হেসে বলল, থানার বড়বাবু আমার ওপর খুবই চটেছেন, সেই সঙ্গে অঞ্চল প্রধান আর মাতব্বররাও। শুনলাম, আজ সকালেই বাঁকুড়ার ডি. এম. ওর কাছে ওরা লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তার মানে, আপনার রিপোর্টটা যাতে কাজে না লাগে।শংকর হেসে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনার। রিপোর্ট কি পাঠিয়েছেন?
সুজিত বলল, নিশ্চয়ই। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর ডিস্ট্রিক্ট মেডিকেল অফিসার দুজনের কাছেই আমার রিপোর্ট আজ সকালেই পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কাজ আমি করেছি, এখন কর্তারা যা করেন। সে তুলোয় স্পিরিট ভিজিয়ে, শংকরের বাঁ হাতটা টেনে নিল। নিজেই ওর পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে বলল, মাসল শক্ত করবেন না। সঁচ ঢুকিয়ে ইনজেকশন দিয়ে আবার গরম জলে সিরিঞ্জ পরিষ্কার করতে করতে বলল, আমি তো ব্যাপারটাকে হোমিসাইডাল বলিনি, কিন্তু এফ আই আর পর্যন্ত করা হল না, এটা কী রকম ব্যাপার? তা ছাড়া, এই অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে ড্রাইভারের অপরাধী মনোভাব তো চাপা থাকে নি। তা হলে আপনার এ অবস্থা হত না। সে সিরিঞ্জ বাকসোর মধ্যে রেখে উঠে দাঁড়াল, এক সময়ে গ্রামের মানুষের সেবার খুবই উৎসাহ ছিল। গ্রাম সম্পর্কে ধারণাও অন্য রকম ছিল। এখন দেখছি, জীবনের ধারণাগুলো খুবই অবাস্তব। সে এক বার দরজার কাছে ললিতার দিকে দেখল, যাই হোক, এখন এ সব কথা আলোচনার সময় নেই। আশা করি জ্বরটা আর বাড়বে না। ওবেলা যদি পারি, এক বার ঘুরে যাব।
না, না, ওবেলা আর আসতে হবে না। শংকর উঠে বসল, এক মিনিট দাঁড়ান, আপনার
ভিজিট?’ সুজিত হাসতে হাসতে বাকসো নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, পরে দেবার অনেক সময় পাবেন। এখন শুয়ে থাকুন। ওষুধগুলো সময় মতো খাবেন।
ললিতা জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারবাবু, মাস্টারবাবু কি আজ উপোস দিবেন? উপোস দেবেন কেন?’ সুজিত ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়ল, ভাত না খেলেই ভাল। তবে শক্ত কিছু তো খেতে পারবেন না। দুধ খই বা পাতলা গরম খিচুড়ি চলতে পারে। উপোস দেওয়া মোটেই উচিত হবে না।
ললিতা বলল, মাস্টারবাবু বুলছিলেন, একটা দিন উপোস দিলেই নাকি সব সেরে যাবে।
না, এটা তো সে রকম জ্বর নয়। সুজিত হেসে বলল, তবে মনতোষবাবুই বোধ হয় সে ব্যবস্থা করবেন। উনি হাসপাতালে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। ওঁর কাছেও শুনলাম, শংকরবাবু উপোসের। কথা বলেছেন। সে শংকরের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখল, উপোস করবেন না, দুর্বল হয়ে পড়বেন। ওষুধগুলো একটু কড়া ডোজের আছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শংকর দেখল, সুজিতের সাইকেল রকের গায়ে ঠেকিয়ে দাঁড় করানো। সুজিত নেমে সাইকেল নিয়ে, আটচালার আড়ালে চলে গেল। ললিতা তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। শংকর মুখ ফিরিয়ে আবার আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল।
আপনার ছাত্তর ছাত্তীর আপনাকে দেখতে আইচিল। ললিতার স্বর শোনা গেল, অই কি নাম উয়াদের, চাঁদু আর বিবি, সেজোকাকার ছেলে মেয়ে। আমার বুলবার কথা লয় বটে, ত চখে দেখলাম, তাই না বুল্যে পারলাম না।
কখন এসেছিল?’ শংকর মুখ না তুলে জিজ্ঞেস করল।
ললিতা বলল, হরিদার সঙ্গে ইস্কুলকে যাবার পথে আইচিল, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন। উয়ারা আর ডাকাডাকি করে নাই।
হু!’ শংকর শব্দ করল, তুমি যেন আমার ওপর মিছিমিছি রাগ করে থেকো না।
শংকর জবাবের প্রত্যাশা করেও, কোনও জবাব না পেয়ে খানিকক্ষণ পরে বালিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে দেখল। ললিতাকে দেখতে পেল না। কিন্তু ললিতা যে চলে যায়নি, তাও ও বিলক্ষণ জানে। সারা দিনই আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে। সুজিত আসার সময় ললিতা নিশ্চয় কাছেপিঠেই ছিল। এবং না থাকলে, থার্মোমিটার পোয়া বা জল গরম করে দেওয়া, এ সব সুজিত নিজেই করত। শংকরকে উঠত দিত না। সুজিতকেও। ওর বিলক্ষণ জানা আছে।
শংকরের ঘুম ঘুম ভাবটা ছিলই। ও আবার চোখ বুজল, এবং আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল। আচ্ছন্নতার মধ্যে ঘুম নেমে এল একটু পরেই। আবার এক সময়ে ঘরের মধ্যে লোকের চলাফেরার শব্দে, চোখ মেলে তাকাল। দেখল, হরি এসেছে। মেঝেয় নামানো একটি টিফিন কেরিয়ার। জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
পাতলা গরম খিচুড়ি লিয়া আইচি, মায়েরা পাটিয়ে দিল্যে। হরি বলল, আমি মেঝেয় ঠাই করে দিছি, গরম গরম একটু খেয়্যে ল্যান। ডাক্তারবাবু বুল্যে দিইচেন। শংকর আস্তে আস্তে উঠে দরজার দিকে তাকাল। আশা করেছিল, ললিতাকে দেখতে পাবে। কিন্তু দেখা গেল না। চাটুয্যে বাড়ি থেকে এ রকম কিছু আসবে; এটাও সে অনুমান করেছিল। যেমন তার অনুমান, ললিতা আশেপাশেই কোথাও আড়াল থেকে সব কিছু দেখছে। ও কোনও রকম মন্তব্য না করে, তক্তপোশ থেকে নেমে, বাইরের রকে গিয়ে হাত ধুয়ে ফিরে এল। হরি আসন পেতে থালা সাজিয়ে প্রস্তুত। শংকর বসে পড়ল। হরি টিফিন কেরিয়ার খুলে, গরম পাতলা খিচুড়ি পাতে ঢেলে দিল। গন্ধটা নাকে গিয়ে, শংকরের মনে হল, খিদে পেয়েছে। কিন্তু আর একটা বাটিতে দুধ দেখে বলল, ওটা আর চলবে না, ফিরিয়ে নিয়ে যাও। খিচুড়িতেই আমার হয়ে যাবে।
দুধ না খেলে, বল পাবেন নাই মাস্টারবাবু, মায়েরা বুল্যে দিইচেন। হরি বলল।
শংকর বলল, মায়েদের বলো, আমার বল যথেষ্ট আছে।
খাওয়ার শেষে, শংকর হরিকে বিদায় দিয়ে, রকে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। এ বার আর এক প্রস্থ ওষুধ। খেয়ে নিয়ে, সিগারেট ধরাল। খুব বিস্বাদ লাগছে না। শরীরটা ঘেমে, একটু যেন হালকা লাগছে। গালে কপালে ব্যথাও কম বোধ হচ্ছে। ও মাকুসের বইটা টেনে নিল।
সন্ধ্যার আগেই গজানন এসে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দিল। সেই সঙ্গে দুটো ধূপকাঠি। পুব মুখো হয়ে। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বোধ হয় কিছু প্রার্থনা বা মন্ত্র আউড়াচ্ছিল। এই সময়ে, দরজার কাছে ছায়া পড়ল। শংকর চোখ তুলে দেখল, আরতি-চাটুয্যে বাড়ির সেজোবউ। হ্যারিকেনের আলোয় তার ঘোমটা ঢাকা মুখের অনেকখানিই দেখা যাচ্ছে। পিছনে যে মল্লিকা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
শংকর ব্যস্ত হয়ে তক্তপোশ থেকে নামতে গেল। আরতি ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, থাক, নামতে হবে না। পিছন ফিরে ডাকল, আয়।
.
রকের ওপর উজ্জ্বল হ্যারিকেন হাতে হরিকেও দেখা গেল। দরজার কাছে হ্যারিকেন রেখে সে ঘরে ঢুকল। তার অন্য হাতে একটি মুখ ঢাকা হিন্ডেলিয়ামের ঝকঝকে পাত্র, এবং মুখ বন্ধ টিফিন কেরিয়ারের একটি বাটি। দুটোই সে ঘরের একপাশে রেখে ঘরের বাইরে গিয়ে আড়ালে চলে গেল। গজাননের দু চোখ ভরা বিস্ময়। যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না, এমন ভাবে হাঁ করে ধূপকাঠি হাতে নিয়ে আরতি আর মল্লিকার দিকে তাকিয়ে রইল।
আরতির কথা রাখা শংকরের পক্ষে সম্ভব হল না। ও তক্তপোশ থেকে নেমে দাঁড়াল। আরতি আর মল্লিকার এখানে আসা, ওর কাছেও একান্ত অপ্রত্যাশিত। অবাক হয়ে বলল, আপনারা এখানে, এই সন্ধেবেলায়?
তা বটে। সেঁজের বেলা ঘরের বউকে চৌকাঠ ডিঙাতে নাই।আরতি মল্লিকার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। নাকছাবির হিরের ঝিলিক দিল, শাস্ত্রে বলেছে, সেঁজের বেলা পুরুষের মোহন রূপ ধরে, অপদেবতা হাতছানি দেয়। আমাদেরও বোধ হয় সে রকম কেউ হাতছানি দিয়ে ঘরের বার করে নিয়ে এসেছে। মল্লিকা ঘরে ঢুকে, দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আরতির কথায়, গায়ের লাল রঙের ফুল তোলা শাল তুলে মুখে চাপা দিল।
অপদেবতার মুখে ছাই। সেজো বউঠান, আপনারা হলেন ঘরের লক্ষ্মী ঠাকরুন, উ শালার কী ক্ষ্যামতা আছে, আপনাদিগে হাতছানি দিবেক?’ গজানন কথা বলতে বলতেই কয়েক বার জ্বলন্ত ধূপকাঠি কপালে ছোঁয়াল।
আরতি এ বার চমকে উঠে কুটি চোখে গজাননের দিকে দেখল। তারপর শংকরের দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। শংকর বলল, এ হল গজানন–গজানন মুখুজ্জে, এ বাড়ির বাসিন্দা।
সেজদা ন’দা সবাই আমাকে চিনে। গজানন আরতি আর মল্লিকার উদ্দেশে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিগলিত হেসে বলল, মাস্টারবাবুর ঘর দরজা আমিই দেখি, চাবি আমার কাছকে থাকে। খাবার জল কাউকে আনতে দিই না, আমি নিজে আনা করি।
আরতি শংকরের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখে মুখে রুদ্ধ হাসির ছটা, বলল, তা সন্ধে বাতি দেখিয়ে ধূপ জ্বেলেই কি শেষ? শাঁখ বাজানো হবে না?
অই অই কথাটি কে বুলবেন গ সেজো বউঠান! গজানন বিশেষ উৎসাহে বলে উঠল, মাস্টারবাবুকে কত দিন বুলা করিচি–
শংকর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, গজানন, তুমি বরং এখন এসো।
গজানন থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে মাটির একটি ধূপদানে, কাঠি দুটি খুঁজে দিল। শংকর বালিশের তলা থেকে একটি আধুলি বের করে, হাত বাড়িয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও।
গজাননের কালো মুখে লজ্জার হাসি ফুটল। হাত বাড়িয়ে আধুলিটি নিয়ে, আরতি আর মল্লিকার উদ্দেশে আবার দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বেরিয়ে গেল। আরতি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তা মাস্টার ঠাকুরপোর দেখাশোনা করার লোকটি জুটেছে ভাল। এর কথা আপনার মুখেই শুনেছি, আজ চোখে দেখা হল। কিন্তু এখন পয়সা দিলেন কীসের?
চার আনা আট আনা পয়সা রোজই দিয়ে থাকি। শংকর বলল, পয়সাটা বেশির ভাগ দিনই বোধ হয় বাউরিপাড়ায় খরচ করে আসে। না চাইলে কোনও দিনই দিই না। আজ না চাইতেই দিলাম। কিন্তু সে কথা থাক। আপনারা দুজনে হঠাৎ এ ভাবে এ সময়ে এখানে আসতে গেলেন কেন? সেজদা জানেন?
আরতি মল্লিকার দিকে ফিরে তাকাল। তার লালপাড় সাদা শাড়ির ওপরে কালো রঙের গরম শাল অনেকটাই স্খলিত। চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে ন’ তোর সেজো ভাসুর জানে তো, আমরা যে এখানে এসেছি?
তিনিই তো আমাদের আসতে বললেন। মল্লিকা শংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, এবং কয়েক পা এগিয়ে এসে আরতির পাশে দাঁড়াল, অবিশ্যি সেজদি আগেই আসবার কথা বলেছিল।
আরতি শংকরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, আমি মুখ ফুটে বলেছি, কিন্তু আপনার মল্লিকার একদম আসার ইচ্ছে ছিল না।
শংকর মল্লিকার দিকে তাকাল। মল্লিকা হেসে চোখ নত করল। শংকর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, দাঁড়িয়ে কেন, আপনারা বসুন’ সেজো বউদি।
আরতি বলল, বসছি, অসুখ শরীর নিয়ে পঁড়িয়ে না থেকে আগে আপনি বসুন।’ সে ঘরের চারদিকে এক বার চোখ বুলিয়ে, তক্তপোশের কাছে এগিয়ে এল, এখন আছেন কেমন?
ভাল। শংকর বলল, জ্বরটা হয়তো আছে, তবে সে রকম কিছু না।
আরতি তক্তপোশের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ডাকল, আয় ন’ এ তক্তপোশে বসার সুযোগ আর কোনও দিন হয়তো পাবি নে।
শংকর ম্লান হেসে বলল, গরিবের বিছানা, আপনাদের বসতে কষ্ট হবে।
তা বটে! বড় ঘরের বউ তো আমরা।আরতি চোখে ঝিলিক হানল, তবু মাঝে মাঝে এমন গরিবের বিছানায় বসাটা ভাগ্যে না থাকলে হয় না। আমার না, ওর ভাগ্যের কথা বলছি। মল্লিকার দিকে আঙুল তুলে দেখাল। শংকরের দিকে তাকিয়ে হুস করে একটা নিশ্বাস ফেলে আবার বলল, এ ঘরটা দেখবার জন্যে আমারও অনেক দিনের সাধ ছিল। এ বিছানায় বসাটা আমারও ভাগ্য, তবে বলি কী করে? ন’ বউয়ের হিংসে হবে।
মল্লিকা শংকরের দিকে তাকিয়ে হাসল। আরতিকে বলল, কত হিংসে হবে, সে তুমি ভালই জানো সেজদি। কিন্তু শংকরদা বসছেন না।
সত্যি, এ সব লোককে আমি একটুও সহ্য করতে পারি নে। আরতি অসংকোচে হাত বাড়িয়ে শংকরের একটা হাত টেনে ধরল, বসুন তো। ভয় নেই, গায়ে গা ঠেকিয়ে বসব না।
শংকর অস্বস্তি আর বিব্রত বোধ করল। তক্তপোশের এক ধারে বসল। আরতি একটু সরে গেল। মল্লিকা এসে তার পাশে বসল। কয়েক মুহূর্ত কারোর মুখেই কোনও কথা নেই। মল্লিকা আরতির দিকে তাকাল। আরতিও তাকাল। এবং বলল, তুই বল না।
মল্লিকা শংকরের দিকে তাকাল। মুখে লজ্জা, চোখে কুণ্ঠা, বলল, শংকরদা, এ শরীর নিয়ে একলা এখানে থাকাটা ঠিক নয়। কয়েকটা দিন আমাদের বাড়িতে থাকবেন চলুন।
এ বিষয়ে যা বলবার, সেজদাকে ওবেলাই বলে দিয়েছি। শংকর হেসে বলল, কিন্তু ওর মনটা শক্ত হয়ে উঠল, আমাকে ভুল বুঝো না তোমরা। কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। ওবেলা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছ, সেটা ঠিক আছে। হয়তো এ বেলাও কিছু খাবার নিয়ে এসেছ। কিন্তু তোমার আর সেজো বউদির এ ভাবে আসাতেও আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
কেন?’ আরতি ভ্রূকুটি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল, একটা অসুস্থ লোককে দেখতে আসব না?
শংকর হেসেই বলল, এমন কিছু অসুস্থ হইনি যে, আপনাদেরও এভাবে দেখতে আসতে হবে। সেজদা এসেছিলেন। হরি তো আসছেই।
তার মানে কী রে ন’? আমাদের কি তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নাকি? আরতির স্বরে ক্ষোভের সুর।
শংকর হাত জোড় করে বলল, ছি ছি, তা কী করে হয়? আপনাদের আসাটা ভাগ্যের কথা, সেইজন্য চোখেও পড়ে বেশি। আসলে আমার লজ্জা করে।’
এ তো আশ্চর্যের কথা।’আরতি বলল, নিজেদের আপনজনের অসুখ করলে দেখতে আসব, এতে লজ্জাটা কীসের?
শংকর তৎক্ষণাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না। এক রকম অসহায় ভাবে হাসল। তার পক্ষে মুখ। ফুটে বলা সম্ভব না। শালচিতির চাটুয্যে বাড়ির আপনজন হয়ে ওঠা তার পক্ষে এক রকমের অনুচিত। বিষয়টি এক দিক থেকে জটিল এবং বিভ্রান্তিকর। বিশেষ করে, শংকরের অসুস্থতার জন্য, দেবতোষ। এবং মনতোষ চাটুয্যের স্ত্রীদের দেখতে আসা, গ্রামবাসীর পক্ষে বহু প্রশ্ন ও অনুমানের বিষয়। এতে আর যাই হোক, নিতান্ত গৃহশিক্ষকের ভূমিকাটা যেন ঠিক বজায় থাকছে না। তার থেকে অধিকতর কিছু। অথচ বিষয়টিকে এ চোখে যাদের দেখবার কথা, তারা তা দেখছে না। ভাবতে হচ্ছে শংকরকে। এবং ও জানে, যে-পরিপ্রেক্ষিতে এই যুক্তি ও ভাবনাগুলো ওর মনে আসছে, তা নিতান্ত লোকচক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিক পটভূমিতে মানুষকে দেখা। হৃদয় এবং মনের বিষয়টি এখানে অনুপস্থিত। মনতোষ ওকে নিতান্ত গৃহশিক্ষক মনে করেন না। গ্রাম সমাজের কোনও বিতর্কিত বিষয়েই যে নেই, এমন এক প্রবাসী শিক্ষিত যুবকের প্রতি তার মনে স্নেহের অনুভূতি আছে। সেই অনুভূতিটিকে আরতি নিশ্চয় গভীর করেছে, কারণ শংকরের প্রতি তার প্রীতি ও ভালবাসা অনেকটা বন্ধুর মতো। অপরের বিবাহিতা। স্ত্রী হয়েও, মল্লিকার অতীতের মুগ্ধতা, এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তাকে যেন জীবনের প্রথম প্রেমের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ সেই প্রেম এক বন্ধ ঘরের আর্তি ছাড়া আর কিছু না। তার কোনও গতি ও বিকাশের অবকাশ নেই। এ প্রেমের জন্ম কেবল অন্ধ জটিল আবর্তে মাথা খুঁড়ে মরবার জন্য। এবং তা উভয়ত।
শংকর অমানুষ বা অতিমানব না। সংসারে সকলের মন রেখে চলা যায় না, এটাও ও বিলক্ষণ জানে। মানুষের নিঃস্বার্থ ভালবাসা পাওয়া দুর্লভ, এবং ভাগ্যের বিষয়। শালচিতির চাটুয্যে বাড়ি এবং আরও যাদের স্নেহ প্রীতি ভালবাসা ও পেয়েছে, সেজন্য ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু ও যাদের কাছে অপ্রীতিভাজন, তাদের কাছে ওর সবথেকে বড় অপরাধ, চাটুয্যে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। এর সঙ্গে সমাজ আর রাজনীতি জড়িয়ে আছে। থাকলেও, শংকর চাটুয্যে বাড়ির সঙ্গে যুক্তিসঙ্গত যোগাযোগ ছিন্ন করেনি। ও গ্রাম সমাজকে অতিক্রম করেনি। রাজনৈতিক বিরুদ্ধতাকে প্রশ্রয়ও দেয়নি। হৃদয়ের গভীরে যা কিছু ঘটেছে, সে যন্ত্রণা মল্লিকার সঙ্গেও ভাগাভাগি করা যায় না। তার যা কিছু কষ্ট ও যন্ত্রণা, তা নিতান্তই ওর একার। সেখানে বাইরের কারোর প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু আরতি আর মল্লিকার সন্ধ্যাবেলা এই। অপ্রত্যাশিত আগমন, পরিস্থিতিকে কেবল জটিল আর ঘোলা করবে। হয়তো, কিছুটা বিষাক্তও করে। তোলা হবে। শংকরের অস্বস্তি সেখানেই।
কী হল, একেবারে চুপ করে রইলেন যে?’ আরতি জিজ্ঞেস করল।
শংকর হেসে বলল, জবাব দেবার তো তেমন কিছু নেই সেজোবউদি। আপনি তো ভুল বা অন্যায় কিছু বলেননি। কিন্তু আপনারা যত সহজে আমাকে আপনাদের আপনজন করে নিয়েছেন, লোকেরা তত সহজে সেটা মেনে নিতে চায় না।
লোকেরা কী চায় না চায়, তা দিয়ে আমাদের দরকার কী?’ আরতি জাকুটি বিরক্ত মুখে বলল, আমরা এসেছি আপনাকে দেখতে। লোকেদের যদি ভাল না লাগে, না লাগবে।
শংকর হেসে চুপ করে রইল। আরতির এত স্পষ্ট কথার সামনে সহজে কিছু বলা যায় না। কিন্তু মল্লিকা ওর নম্র স্বরে হেসে বলল, সেজদি, শংকরদার কথাটা তুমি বুঝতে পারোনি। তুমি আমি লোকের কথা না ভাবলেও, শংকরদাকে ভাবতে হয়, সে কথাটাই উনি আমাদের বুঝিয়ে দিতে। চাইছেন।
আরতি ভ্রূকুটি জিজ্ঞাসু চোখে শংকরের দিকে তাকাল। শংকর তাকাল মল্লিকার দিকে। মল্লিকা দ্বিধার সঙ্গে বলল, ভুল বলেছি শংকরদা?
শংকর জবাব দেবার আগে একটা সিগারেট ধরাল, বলল, হয়তো তোমার কথাই ঠিক।
মল্লিকা আরতির দিকে এক বার দেখে, শংকরের কথার জবাবে বলল, হয় তোনয়, আমার কথাটাই একশো ভাগ সত্যি। যদি এতদিনে আপনার মন কিছু বুঝে থাকি। আর একথাও বলব, আপনার দিক। থেকে এ রকম ভাবাটাই স্বাভাবিক।
আরতির ভুরু কুঁচকে উঠল। স্ফীত হল নাসারন্ধ্র। মল্লিকাকে বলল, তুই দেখছি মাস্টার ঠাকুরপোর সাপুটি করছিস। কিন্তু কোন দুঃখে লোকের কথা ভাবতে যাব, তা তো ছাই বুঝতে পারছি না? এমন না যে ঘর বরকে লুকিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তাতে যদি লোকে মন্দ কিছু ভাবে, ভাববে। আমাদের কী যায় আসে?
আমাদের কিছু যায় আসে না। মল্লিকা শংকরের দিকে চোখ রেখেই বলল, শংকরদার যায় আসে। শংকরদাকে তো গায়ের সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে।
শংকর জানে, মল্লিকার কথার মধ্যে ওর প্রতি বিশেষ একটি খোঁচা আছে। যদিও কথাগুলো শোনাচ্ছে, শংকরের প্রতি সমর্থনের মতোই। কিন্তু মল্লিকার খোঁচাও নিরর্থক। গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলার একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। সেটাকে কোনও রকমেই লোকের মন জুগিয়ে চলা বলা যায় না। ও মল্লিকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, এ প্রসঙ্গ তো চুকে গেছে, এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে আর লাভ কী?’ ও আরতির দিকে তাকাল, সংসারটা মোটেই সহজ জায়গা না, এটা হল মোদ্দা কথা। ভুল বলেছি সেজো বউদি? আপনিই বলুন, এ সংসারে কে কার মন বুঝতে চায়? যাদের বোঝাবুঝি আছে, তাদের আছে, অন্যের কাছে তার কানাকড়ি দাম নেই। স্নেহ-ভালবাসা যে মানুষের সকল বৃত্তির সার, এ কথাটাও সহজে কেউ মেনে নিতে চায় না। চায় কী?
আরতি মল্লিকার দিকে এক বার দেখল। তার মুখের হাসিতে নেমে এল স্নানতা। বলল, কথাটা ভুল বলেনি মাস্টার ঠাকুরপো। সংসারটা বড় ঘোরপ্যাঁচের জায়গা। তবে আমার সোজা কথা। আমার মন মজেছে যাহার সনে, প্রাণ চাহে তারে। তারপরে তোরা হাদ্দ্যাখ মোর কলাটা।
আরতির কথার ভঙ্গিতে ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দর্শানোয় শংকর হেসে উঠল। মল্লিকার ঠোঁটে ঈষৎ হাসি, দৃষ্টি আরতির দিকে, কিন্তু আসল কথাটার কোনও জবাব মিলল না।
হ্যাঁ, আমাদের বাড়িতে যাবার কথাটা। আরতি বলল। সেটার তা হলে কী হবে?
শংকর বলল, এত কথার পরে, ওটার জবাব তো আর নতুন করে কিছু দেবার নেই? কোনও দিন যদি সে রকম অবস্থা হয়, তা হলে নিশ্চয়ই যাব। আপাতত তার কোনও দরকার নেই।
আরতি মল্লিকার দিকে তাকাল। মল্লিকা তার দিকেই তাকিয়ে বলল, অবুঝের মতো জোর করব না, করলেও সে-জোর খাটবে না।
শংকর মল্লিকার দিকে তাকাল। মল্লিকাও তাকাল, এবং হঠাৎ বলল, বুঝেছি। আপনাকে কিছু বলতে হবে না।
চোখে চোখে কথা, কিছু বুঝতে পারিনে বাপু!’ আরতি নিশ্বাস ফেলল, আসলে কি জানেন মাস্টার ঠাকুরপো, আমরা মেয়েমানুষরা রক্তমাংস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালবাসি–মানে মানুষ নিয়ে। কথাটা শুনলে লোকে কী ভাববে, কে জানে? আবার সেই লোকের কথাই আসছে ছাই। কিন্তু কথাটা বুঝতে হলে, মেয়েমানুষের শরীর আর মন চাই। নিজের মতন করে কারোকে যদি ঘাঁটাঘাঁটি না করতে পারি, তবে সব যেন কেমন ফাঁকা লাগে। আরতি আরও কিছু বলতে গিয়ে, মল্লিকার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
শংকর জানে, আরতি প্রকৃতপক্ষে মল্লিকার কথাই বলতে চাইছে। মল্লিকার জীবনের শূন্যতার কথা। নারী চরিত্রের এটাও কি একটা বৈশিষ্ট্য, যখন অন্য নারী তার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় থাকে না, তখন তার সমর্থনে, সমাজ নীতি সবই অগ্রাহ্য করতে চায়? অথবা তার নিজের মধ্যেই কোনও শূন্যতা বোধ, তাকে সচেতন বা অবচেতন প্ররোচিত করে? আরতির রক্তমাংস বা মানুষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে অসুবিধে হয় না। সেই সব মানুষেরা স্বামী পুত্র স্নেহের ও ভালবাসার পাত্র পাত্রী। সেই দিক থেকে, আরতিকে শূন্যতায় হাতড়ে বেড়াতে হয় বলে মনে হয় না। মনতোষকে সে ভালবাসে। সন্তানদের প্রতি আছে তার প্রকৃতিগত স্নেহ ও সজাগ দৃষ্টি। কিন্তু নিজের দেবর দেবতোষের প্রতি কি তার কোনও আত্মিক আকর্ষণ নেই? দেবতোষের সঙ্গেও তার সম্পর্ক বন্ধুর মতোই। অথচ শংকরের প্রতি মল্লিকার দুর্বল স্থানটিকে সে কেবল লালন করে না। স্পষ্টতই প্রশ্রয় দেয়। পরিণামের কথা কি এক বারও মনে হয় না? এ সমবেদনার স্বরূপ কী?
এ সমবেদনার স্বরূপ, নারীর আত্যন্তিক প্রবৃত্তিজাত চেতনা। শহরের শিক্ষিতা আর গ্রামের তথাকথিত অশিক্ষিতা, এ ক্ষেত্রে নারীর মধ্যে কোনও প্রভেদ নেই। আরতির রক্তমাংস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার কথাটার অর্থ এক দিক থেকে অতি গভীর ও অর্থব্যঞ্জক। যা হয় তো সে নিজেও প্রকৃত জ্ঞাত না। পুরুষের কাছ থেকে সে বীজ গ্রহণ করে। সেই বীজকে সে গর্ভে ধারণ করে, এবং নিজের রক্ত দিয়ে মাংসের মূর্তি তৈরি করে। তার শরীরের রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়েই, সেই মাংসের জীবটিকে পৃথিবীর মাটিতে জন্ম দেয়। রক্ত হল জীবের আদি প্রবাহের ধারা। আর নারী তার নারীত্বের প্রথম দিনটি থেকেই, এই রক্তের সঙ্গে মাখামাখি করে আছে। রক্তমাংসের এই প্রকৃতি লক্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তি অন্ধ। স্নেহ প্রেমে বিগলিত হয়ে, এই প্রবৃত্তির প্রবাহে সে সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে। বাঘিনীর মতো নির্দয় নিষ্ঠুরও হতে পারে। সমাজে এর শুভ দিকটাই প্রতিফলিত হয় বেশি। অশুভ দিকটা যখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখন সে ভয়ংকরী। প্রবৃত্তিকে সেই কারণেই মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে, চিরকাল ধরে একটা নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছে। আর মানুষের বিশ্বজোড়া সভ্যতার বুকের ওপর এটাই বোধ হয় সব থেকে বড় সংকট, নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি কখনওই সে পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারেনি।
শংকর নিজের মধ্যে সেই প্রবৃত্তির তাড়না বোধ করে। তাকে নিঃশেষে নির্মূল করা সম্ভব না। তথাপি এই জাগতিক জীবনের অনুভূতি দিয়ে তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতেই হয়। সে ক্ষেত্রে, মল্লিকার প্রতি আরতির প্রশ্রয় ও সমর্থন, প্রবৃত্তি চালিত মূঢ়তা ছাড়া আর কিছু না। সংসারে সে বুদ্ধিমতী সজাগ দৃষ্টি গৃহিণী, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মল্লিকা আর শংকরের ক্ষেত্রে, সে নিতান্তই নারী প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত। নিজের সুখের কারণে, করুণাবশত মল্লিকার প্রতি যদি এই সমবেদনার জন্ম হয়ে থাকে, তার একটা সীমারেখাও থাকতে হবে। অন্যথায় বিপর্যয়কেই টেনে আনা হবে। এ কথাটা মল্লিকাকেই হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। না করতে পারলে, শংকরকেও বিপর্যস্ত করে তোলা হবে।
সব মানুষ তার প্রার্থিত সকল শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে পারবে, পৃথিবীতে এমনটি ঘটে না। অনেক শূন্যতাকে, তার বুকের রক্ত নিংড়ে পূর্ণ করতে হয়। তার আর কোনও গত্যন্তর নেই। শংকর এটাকে অমোঘ বলে জেনেছে। ও ব্যস্ত হয়ে, তক্তপোশ থেকে উঠে দাঁড়াল, সেজোবউদি, এমন দিন হয়তো আর কোনও দিন আসবে না। আজ আপনারা আমার অতিথি। অনেক দিন বলেছেন, আমি নিজের হাতে কেমন চা তৈরি করি, আপনাদের চেখে দেখার খুব ইচ্ছে। আজ আমি আপনাদের চা করে খাওয়াব।
আরতি তক্তপোশ থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলল, রক্ষে করুন ভাই ঠাকুরপো, এই শরীর নিয়ে আপনি চা করবেন? আর আমরা তাই খাব?
কেন, আপত্তিটা কীসের? শংকর হেসে বলল, যতটা দুর্বল ভাবছেন ততটা নই। জল গরম করে একটু চা করতে কোনও কষ্ট হবে না।’ ও ঘরের একপাশে চলে গেল।
আরতি অবাক চোখে মল্লিকার দিকে তাকাল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিস কী রে ন’?
কী করব বলো সেজদি?’ মল্লিকা উদাস স্বরে বলল, অসুস্থ বলে যাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে এলাম, তার কাছে আমরা এখন অতিথি। হার যখন মেনেছি, তখন এটুকুই বা বাকি থাকে কেন?
আরতি ঝামটা দিয়ে বলল, মুখপুড়ি, তোর মুখে ছাই। সে দ্রুত পায়ে শংকরের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, অসময়ে আমরা চা খাই না।
শংকর বলল, চা খাবার আবার সময় অসময় আছে নাকি?
আপনার নেই, আমাদের আছে। আরতি চোখের তারা ঘুরিয়ে বলল, অন্য কিছু থাকে তত বের করুন, গেলাস ভরে নিয়ে টানব।
শংকর অবাক চোখে আরতির মুখের দিকে তাকাল। আরতি মল্লিকার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। মল্লিকা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, সে বস্তু নিশ্চয়ই তোমার মাস্টার ঠাকুরপোর ঘরে নেই।
সত্যি, এ লোক কোনও কম্মের নয়।আরতি শংকরের বিভ্রান্ত জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকাল, ঘরে একটু বিলিতি মদ রাখতে পারেন না? একটু না হয় নেশা করেই যেতাম।
শংকর ভ্রুকুটি অবাক চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে, হেসে উঠল। আরতির মুখে মদ্যপানের প্রসঙ্গটি আগেও কয়েক বার শুনেছে। বিলিতি মদ বলতে, ভারতীয় ফরেন লিকার বলতে যা বোঝায়, তাই। ওর চোখের সামনে পানের আসর কোনও দিন চাটুয্যে বাড়িতে বসেনি বটে। তবে মনতোষ দেবতোষ, দুজনেই বাড়িতে মদ্যপান করে। আরতি আর মল্লিকার কথা থেকে, অনুমান করেছে, সেই আসরে, তাদের অংশ থাকে। আরতি নিজের মুখেই বলেছে, কালীপুজো বা বিশেষ বিশেষ দিনে, পানের মাত্রা বেশি হওয়ায় সে কয়েক বার মাতালও হয়েছে। বমি করে অসুস্থ হয়ে, স্বামী আর দেবরকে উদ্বিগ্ন ব্যতিব্যস্ত করেছে। তবে সে সব ঘটনা নিতান্তই অন্দরমহলের। বাইরের লোকের কতটা অজানা, তাও স্থির করে বলা যায় না। অন্দরমহলে দাসী ভৃত্যের অভাব নেই।
শংকর বিব্রত হল না, বিনীত হেসে কৌতুক করে বলল, সত্যি, আমি কোনও কর্মের নই। ও বস্তুটি আমার কাছে থাকে না।
আরতি মদ্যাসক্ত না। শুচিবায়ুগ্রস্তও না। স্বামীর প্রশ্রয়েই কখনও সখনও খেয়ে থাকে। হিন্দু গৃহস্থ বধূ, তাও আবার গ্রামের অন্দরমহলে, বিষয়টি বিস্ময়কর বটে। অন্তত শংকর যখন প্রথম শুনেছিল, বিশ্বাস করতে পারেনি। ওর নিজের একটা অতীত আছে। কলকাতার আরবান, মধ্যবিত্ত সমাজের চেহারাটা ওর ভাল জানা আছে। সেখানে মেয়েদের মদ্যপান ধূমপান কিছু অবাক হবার মতো ঘটনা না। গ্রামের শ্রমজীবী, দরিদ্র, নিচু জাত বলে যাদের পরিচয়, তাদের মদ খাওয়াও একটা অনায়াস অনাড়ম্বর বিষয়। অনেক মেয়েকেই মাতাল অবস্থায়ও দেখা যায়। কিন্তু গ্রামের কিছু পরিবারের বধূর মদ্যপানের সংবাদটা খুবই চমকপ্রদ লেগেছিল। পরে মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা এমন কিছু চমকপ্রদ না। বিস্ময়েরও না। এ ব্যাপারে শহর গ্রামের মধ্যবিত্তের নীতিবোধে খুব একটা ফারাক নেই। সংস্কার যেমন শহরে আছে, গ্রামেও তেমনি আছে। যাদের নেই, তাদের কোথাও নেই। কেবল চিত্রটা একটু ভিন্ন রকম।
আরতি বলল, এ বার থেকে আনিয়ে রাখবেন। ব্যাটাছেলে একটু নেশাভাং করবে না, এ আবার কেমন কথা?
কথাটা ব্যাটাছেলে নিয়ে হয়নি। আমরা মেয়েছেলে।মল্লিকা বলতে বলতে তক্তপোশের একপাশ দিয়ে, শংকরের কাছে এগিয়ে এল, যান, আপনারা দুজনে গিয়ে বসুন, আমি সব দেখে শুনে চা করছি। শংকর ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি কী করে করবে? চা চিনি কোথায় কী সব আছে, তুমি জানো না।
জানলে খুঁজে নিতে আমার অসুবিধে হবে না। মল্লিকা নিচু হয়ে থোয়া কেতলিটা তুলে নিল। ঢাকনা খুলে দেখল। চোখ ফিরিয়ে জলের কুঁজোটা দেখে, সে দিকে গেল।
শংকরের দু চোখ ভরা অসহায় অস্বস্তি। আর এ মুহূর্তে ওর নিজেকে দুর্বলও বোধ হল। তাকাল আরতির দিকে।
আরতি হেসে, আবার অসংকোচে শংকরের একটা হাত টেনে ধরে বলল, আজ আপনার ঘরে ডাকিনী পড়েছে। আসুন, চুপচাপ বসুন। ন’ চা করুক। সে শংকরকে টেনে এনে তক্তপোশে বসিয়ে দিল।
শংকর বাইরে অন্ধকারে তাকাল। স্পষ্ট কিছু না দেখতে পেলেও, সেখানে যে ললিতা, গজাননের স্ত্রী এবং হয়তো আরও কেউ কেউ আড়াল থেকে এ ঘরের ঘটনা অতি কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে, তা অনুমান করতে পারছে।
মল্লিকা ইতিমধ্যে অনায়াসেই চা চিনি গেলাস দুধ সব জোগাড় করে, স্টোভের সামনে জড়ো করেছে। সেখানে মাটির মেঝেয় বসে হাত বাড়িয়ে বলল, দেশলাইটা দিন।
শংকর দেশলাইটা ছুঁড়ে ছিল। মল্লিকা এ ঘরের মাটির মেঝেয় বসে, স্টোভে চা করছে, এ দৃশ্য ওকেও অবাক করল। কিন্তু এতে খুশি হওয়া যায় কি না, এ চিন্তাটাই একটা সংকটজনক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল।
শংকর জানে, মল্লিকার চা করতে বসে যাওয়ার ব্যাপারে খুশি হওয়া যায় না, এ সংকটজনক প্রশ্নের নিরসন এখনই সম্ভব না। এ প্রশ্ন কতটা ব্যাপক আর দুরধিগম্য, তার পরিমাপও এখনই সম্ভব না। অতএব, এ সংকটজনক প্রশ্ন নিয়ে আপাতত আর এক মানসিক সংকটে আবর্তিত হওয়া অর্থহীন।
মল্লিকা অনায়াসেই স্টোভ ধরিয়ে জল ভরা কেতলি বসিয়ে দিল। আরতি জিজ্ঞেস করল, দেখতে পাচ্ছিস তো ন’?
পাচ্ছি৷’ মল্লিকা সামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসল, নে, তুমি কি ভাবছ, বিজলি বাতি ছাড়া আমি দেখতে পাইনে?
আরতি শংকরের দিকে চোখের কোণে তাকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল, এ ঘর অন্ধকার হলেও তুই সব দেখতে পেতিস। ঘরের মাহাত্ম নাই।
শংকর তক্তপোশ থেকে নেমে, হ্যারিকেনটা মল্লিকার দিকে এগিয়ে দিল, আমারই বোঝা উচিত ছিল, এত কম আলোয় তোমার অসুবিধে হবে। এ কষ্ট করার কোনও দরকার ছিল না, কিন্তু?
শংকর কথা শেষ না করে, এক রকম অসহায় ভাবে হাসল। মল্লিকা বলল, ওই কিন্তু পর্যন্তই থাক। চা তো আপনাকে এই প্রথম খাওয়াচ্ছি না। আজকের খাওয়ানোটা অবিশ্যি অন্য রকম। আমাদের নিজেদের খাওয়াটাও। তবু একটু একঘেয়েমি কাটল।
পা যখন বাড়িয়েছিস ন’, মাঝে মাঝে এসে এ রকম খাইয়ে যাস।আরতি শংকরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। মল্লিকার দিকে তাকিয়ে চোখের তারা ঘুরিয়ে বলল, আর নিজেও খেয়ে যাস।
মল্লিকা হেসে বলল, পা কতটা বাড়ানো যায়, তার হিসেব কষা বড় কঠিন সেজদি। তবে যদি উপায় থাকে তোমার সঙ্গেই আসব।’
আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?’ আরতি কপট মুখঝামটা দিল। নাকছাবিতে ঝিলিক দিয়ে, তৎক্ষণাৎ আবার নিশ্বাস ফেলে বলল, যেখানে আমার ভাগ নেই, সেখানে ভাগ বসাতে চাইনে। আর সাক্ষীই বা থাকতে যাব কোন দুঃখে।
মল্লিকা সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, শংকরের মুখের দিকে এক বার দেখল। তারপর স্টোভের দিকে ফিরে, ফুটে ওঠা জলের কেতলি আঁচল দিয়ে ধরে নামাল।
মল্লিকার এই শাড়ির আঁচল দিয়ে ধরে কেতলি নামানোর আটপৌরে ভঙ্গিটি শংকরকে অবাক করল। উদ্বেগও বোধ করছিল। এ সব দরিদ্র গৃহস্থ বউ-ঝিদের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু মেয়েরা কখন কোন পরিস্থিতিতে যে কী করতে পারে, তা সহজে বুঝে ওঠা যায় না। তবু তাঁতের নীল শাড়ির ওপরে, লাল পশমি শাল যে ভাবে মেঝের ওপর এলিয়ে পড়েছে, আর মল্লিকার নড়াচড়ায় স্টোভের আগুনের শিখার সামনে আঁচল আর শাল মাঝে মাঝেই ঝাপটা খাচ্ছে, উদ্বেগ বোধ না করে পারছে না। ও বলল, মল্লিকা, এ বার তুমি উঠে এসো, বাকিটা আমি করছি।
আপনি বরং সেজদির সঙ্গে কথা বলুন। মল্লিকা আঁচল দিয়ে ধরেই কেতলির ঢাকনা খুলে, চায়ের পাতা ঢেলে দিল। তারপর কেতলির মুখ বন্ধ করে বলল, আপনার এত ভয়টা কীসের? আমরা কি বাড়িতে হাত-পা গুটিয়ে পটের বিবি সেজে বসে থাকি? সে ঢাকনা দেওয়া দুধের বাটি স্টোভের ওপর বসিয়ে দিল।
আরতি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, আমার সঙ্গে কথা আর কী আছে ন’? মাস্টার ঠাকুরপো নিশ্চিন্তে বসতেও পারছে না। তার চেয়ে বরং তোর কাছে নিয়ে বসা, তাতেই উনি স্বস্তি পাবেন।
শংকর বিব্রত হেসে আরতির দিকে তাকাল। আরতির মুখ তো সবসময় খোলাই আছে। এখানে এসে আজ মল্লিকার মুখও যেন কিঞ্চিৎ বেশি আগল খোলা। শংকর আরতির কাছে গিয়ে, তক্তপোশের ওপর বসল। ও জানে, এই দুই রমণীর কথাবার্তার মুখ্য ভূমিকা হয়তো ওরই, কিন্তু বলার কিছু নেই। তবু বলল, আমার ভয়টা আগুনের। দেখছেন তো, আপনার জা’ জ্বলন্ত স্টোভের সামনে কী ভাবে লাল শাড়ি ছড়িয়ে বসেছে।
সেই ভয় পাচ্ছেন মাস্টার ঠাকুরপো! আরতির কৌতুক ঝলকানো চোখ বড় হয়ে উঠল। শংকরের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ও তো মরেইছে, না হয় এ বার আগুনে পুড়বে। মরলে তো আগুনেই পোড়াতে হয়, জানেন না?
শংকর এ কথার জবাব দিতে পারে না। এ পরিহাসের জবাব ওর জানা নেই, এবং জবাবের প্রত্যাশাও নিশ্চয় আরতির নেই। মল্লিকা ইতিমধ্যে দুধের বাটি নামিয়ে, স্টোভ নিভিয়ে দিয়েছে। কেরোসিনের ধোঁয়ার গন্ধে ঘর ভরা। ও গেলাসে গেলাসে চিনি দিয়ে, কেতলি থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তা বলে, এ ঘরটাকে আমার শ্মশান করতে চেয়ো না সেজদি। একটু আগে যে তুমি বলছিলে, এ ঘরের মাহাত্ম্য আলাদা?
বালাই ষাট, এ ঘর কেন শ্মশান হবে? আরতি শংকরের দিকে চোখ রেখেই বলল, গায়ে তোর আগুন লাগলে, ঘরের বাইরে ফেলে দিয়ে আসব।
মল্লিকা চা ভরা দুটি ধূমায়িত গেলাস দু হাতে নিয়ে এগিয়ে এল। ডান হাতের গেলাসটা আগে শংকরের দিকে বাড়িয়ে দিল। শংকর গেলাস নিল। মল্লিকা আর একটা গেলাস ডান হাতে নিয়ে আরতির দিকে বাড়াল। আরতি গেলাস নেবার আগে, মল্লিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ন, এই মাঘের শীতেও তোর নাকের ডগায় চিবুকে ঘামে জেল্লা দিচ্ছে। মুখোনি যে তোর এত সুন্দর, আগে যেন কখনও দেখি নি! ঘাম তেল মাখা প্রতিমার মতন।
মল্লিকার মুখে লাল ছটা লেগে গেল। চকিতে এক বার শংকরের দিকে দেখল, আর ছটা লাগা মুখে সহসাই যেন কেমন একটা বিষণ্ণ ছায়া নেমে এল। বললে, গেলাসটা নাও সেজদি।
আরতি চায়ের গেলাস নিল। মল্লিকা গায়ের থেকে শালটা খুলে, কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে নিল। সরে গেল স্টোভের দিকে। নিজের গেলাসটা হাতে নিয়ে, মুখ না ফিরিয়ে বলল, বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠতেই যা দেরি।
সে কথা ভেবে বলি নি রে মুখপুড়ি। আরতি মল্লিকার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে শংকরের দিকে তাকাল, তোর রূপের কথা বলেছি। মেয়েদের রূপ এমনিতে দ্যাখতাই যেমনই হোক, সময়ে তার আর এক রকম খোলতাই হয়। তোর সেই খোলতাই রূপটাই দেখলাম।
আরতি মন্তব্য করে, অথচ তার চোখের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি শংকরের দিকে। কিন্তু শংকর জানে, আরতির ওর কাছ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশা নেই। রমণী হৃদয়ের এও এক মনের খেলা। বস্তুত, তার কথার উদ্দিষ্ট মানুষ শংকর, এবং শংকরের প্রতিক্রিয়া তার লক্ষের বিষয়।
শংকর চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, চমৎকার!
মল্লিকা আর আরতি পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি করল। আরতি মুখ টিপে হেসে শংকরকে জিজ্ঞেস করল, আগে বুঝি কখনও ওর হাতে এমন চমৎকার চা খান নি?
অনেক বার খেয়েছি। শংকর হেসে বলল, কিন্তু এ ঘরের চা আর আপনাদের বাড়ির চা তো এক রকম না তবু তৈরির গুণে চমৎকার।
আরতি শংকরের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, প্রাণ খুলে বলুন না, বিশেষ হাতের গুণে চমৎকার। আমি কিছু মনে করব না। বরং গুণের হাতটি নিয়ে যদি একটু সোহাগ করতে চান, তাও করতে পারেন।
চুপ করো সেজদি। মল্লিকা শংকরের দিকে এক বার দেখে নিল, মানুষকে অকারণ অস্বস্তিতে ফেলো না।’ও চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে, গেলাস নামিয়ে রাখল। চা চিনির কৌটো আর দুধের বাটি যথাস্থানে তুলে রাখল।
শংকর বলল, ওগুলো তোমার না করলেও চলত, এর পরে যেন গেলাসগুলো ধোবার চেষ্টা কোরো না।
তা বললে তো হয় না মাস্টার ঠাকুরপো। আরতি চোখের ভঙ্গি করে বলল, সব কাজেরই শুরু আর শেষ আছে। কোনও কাজই আধাখাচড়া করে ফেলে রাখা যায় না।
শংকর জানে এখানে তর্ক প্রতিবাদ সবই বৃথা। তবু বলল, চাটুয্যে বাড়ির বউয়েরা এ ঘরের এঁটো গেলাস ধোবে, সেটা লোকে দেখলেই বা কী বলবে? আমারও তো একটা নজর বলে কথা আছে। আপনারা এ ঘরে এসেছেন, নিজের হাতে চা করে খাইয়েছেন, সেটাই অনেকখানি। যা নিজের বাড়িতে করেন না, তা এখানেও করতে হবে না।
এই সময়ে দরজার বাইরে থেকে হরির গলা শোনা গেল, গেলাস আমি ধুয়ে দুব গ মায়েরা। উয়ার লেগ্যে ভাবতে হবেক নাই।
ঘরের মধ্যে তিনজনেই চমকে উঠল। বিশেষ করে আরতি আর মল্লিকার চমকিত বিস্ময় দেখে বোঝা গেল, তারা তিন ছাড়াও যে কাছে পিঠে আরও লোক থাকতে পারে, সেটা তারা বিস্মৃত হয়েছিল। কিন্তু শংকর যেন লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। প্রায় আহত বিস্ময়ে বলে উঠল, ইস, হরি যে বাইরে বসে আছে, সেটা খেয়ালই ছিল না। আমরা দিব্যি ঘরে বসে চা খাচ্ছি।
তা উয়াতে কী হইচে গ মাস্টারবাবু৷’ হরির নিরীহ স্বরে সম্ভ্রমের সুর, আপনাদিগের সঙ্গে আমাকে ক্যানে চা খাইতে হবে? আর এই সময়তে আমি চা খাই না, মায়েরা জানেন।
আরতি চায়ের শূন্য গেলাস তক্তপোশের ওপর রেখে, ব্যস্ত হয়ে বলল, আমাদেরও যাবার সময় হল, আর দেরি করা যায় না। কিন্তু নতুই যে বলছিলি, মাস্টার ঠাকুরপোকে খাইয়ে যাবি?
দোহাই সেজো বউদি। শংকর গেলাস সুদ্ধ দুহাত জোড় করে, তক্তপোশ থেকে নেমে দাঁড়াল, ওটি আর করতে যাবেন না। এই মাত্র চা খেলাম। ঠিক মতো আমি খাবার খেয়ে নেব।
হরি ঘরের মধ্যে ঢুকে এল, কই, গেলাসগুলান দেখি, ধুয়ে লিয়ে আসি।
না, তার দরকার হবে না হরি। শংকর স্পষ্ট বাধা দিয়ে বলল, তুমি তো জানোই, রাত পোহালেই রুকুবুড়ি আসবে। এখন যা যেমন আছে, তেমনই থাকুক, সকালে ধোয়াধুয়ি হবে।
মল্লিকা আর আরতি পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। মল্লিকা শূন্য গেলাস মেঝেয় নামিয়ে, এগিয়ে এসে শংকরকে বলল, তা হলে দুধটা গরম করে নেবেন। এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। টিফিন কেরিয়ারের বাটিতে কিছু পাতলা সুজি আছে। ও আরতির দিকে ফিরে তাকাল।
আরতি ইতিমধ্যে কালো শালটি গায়ে জড়িয়ে, মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে। বলল, সামনে বসে খাইয়ে যেতে পারলি নে বলে, আমাকে দোষ দিস নি যেন ন’। চায়ের পাট করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। এর পরে হয়তো তোর সেজদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে।
সামনে বসে চা তো খাওয়া হয়েছে। শংকর হেসে বলল, সেজদা যদি সত্যি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন, সে ভারী বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। আপনারা বেরিয়ে পড়ুন।
আরতি হাত তুলে, ভ্রু কুঁচকে বলল, ও রকম তাড়া দেবেন না তো। যাবার কথা তো নিজের মুখ ফুটেই বলেছি। মল্লিকার দিকে ফিরে বলল, ও রকম বোবা হাবার মতন তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস না ন’। মাথায় ঘোমটা দে, শালটা গায়ে জড়া।
মল্লিকা দ্রুত হাতে আরতির নির্দেশ পালন করল। শংকরের দিকে এক বার দেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আরতি পা বাড়াবার আগে বলল, কাল কী হয় দেখি।
হরি দরজার বাইরে গিয়ে হ্যারিকেন হাতে তুলে নিল। মল্লিকা আর এক বার শংকরের দিকে তাকিয়ে পিছন ফিরে ঘরের বাইরে চলে গেল। আরতি তখন ঘরের বাইরে, তার স্বর শোনা গেল, আপনি আর বাইরে আসবেন না।
শংকরের মনে হল, দুজনের আসাটা যেমন একটা চমক লাগানো ঝলকের মতো লেগেছিল, বিদায়ের মুহূর্তটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। মল্লিকা আরতির কারোর মুখেই হাসির ছোঁয়া আর রইল না। যদিও আরতি আগামীকালের বিষয়ে একটি অস্পষ্ট ইঙ্গিতও দিয়ে গেল। যার অর্থ, আগামীকাল রাতেও এখানে হানা দিতে পারে। তবু পরিহাসের সেই প্রসন্নতা ছিল না যাবার মুহূর্তে। ও ঘরের ভিতর থেকেই দেখল, ভাঙা আটচালার পাশ দিয়ে আরতি আর মল্লিকার ছায়ার মতো শরীর আড়ালে চলে গেল। সেই সঙ্গে আলোও অদৃশ্য। কিন্তু অন্ধকারে অস্পষ্ট কয়েকটি ছায়াকে আটচালার উঠোনের সামনে জড়ো হতে দেখা গেল।