৫. রোদ একটু পড়লে

রোদ একটু পড়লে কালু ও সোমরাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারবাবু যখন বেরোচ্ছিলেন, তখন পুষি সঙ্গ নিল, “আমি কি ঘরে বসে থাকতে এতদূর এসেছি? আমিও আপনার সঙ্গে জায়গাটা দেখতে যাব।”

ডাক্তারবাবু পুষির কথাটা উপেক্ষা করলেন। মেয়েটি হয়তো ইচ্ছে করে ‘আপনাদের সঙ্গে’ না-বলে ‘আপনার সঙ্গে’ বলেনি। এ নিয়ে কথা বললে ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। তিনি তিনজনকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। বৃদ্ধা যেভাবে এতোয়ারিকে আঁকড়ে ধরেছেন, তাতে এখন ওকে নিয়ে আসা ঠিক হত না।

এখন বিকেল হয়ে এলেও রোদের তেজ মরেনি। রাস্তায় মানুষ নেই। রোদ্দুরে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ পুষি চেঁচিয়ে আঙুল তুলে পেছন দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ডাক্তারবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি ধীরে-ধীরে আসছে। ওঁরা অপেক্ষা করলেন গাড়িটার জন্যে। সামনে এলে হাত তুলে থামিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি আমাদের নিয়ে একটু ঘুরে জায়গাটাকে দেখিয়ে দেবে? এর জন্যে যা ভাড়া চাও আমরা যদি দিতে পারি নিশ্চয়ই দেব।”

লোকটা মাথা নাড়ল। তারপর যে-ভাষায় কথা বলল, তা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল পুষি। তার মুখ থেকে অনর্গল ওই ভাষায় কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। ঘোড়ার গাড়ির চালক বেশ অবাক হয়ে গেল। তারপর মাথা নেড়ে ডাক্তারবাবুকে ইশারা করল উঠে বসতে।

ডাক্তারবাবু চালকের পেছনের আসনে উঠে বসলেন। দু’জন পুরুষ পেছনের দাঁড়ানোর জায়গায় উঠে দাঁড়াল কিন্তু পুষি পাদানিতে পা রেখে উঠে সামনের চালকের পাশে বসে পড়ল। তার মুখ থেকে কথা যেন উপচে পড়ছিল। দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকার কারণে চা-বাগানের মুন্ডা, ওরাওঁ, মদেশিয়া শ্রমিকদের মুখের ভাষা ধীরে ধীরে অনেকটা মিলমিশ হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির চালকের ভাষা তা থেকে কিছুটা আলাদা হলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। পুষি একটু চেষ্টা করেই সেই ভাষায় কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু ডাক্তারবাবু লক্ষ করলেন চালক মাঝে-মাঝেই পুষিকে আড়চোখে দেখছে। ও যে খুব বিস্মিত তাতে সন্দেহ নেই।

বেশির ভাগই শুকনো মাঠ, তারপর নদীটাকে দেখা গেল। কাছে গিয়ে বোঝা গেল ওটা নদী নয়, কোথাও নিশ্চয়ই নদী রয়েছে, সেখান থেকে খাল কেটে জলের ধারা আনা হয়েছে। জলে স্রোত আছে। কিছু লোক সেই জল যাতে জমির মাটি ভেজাতে পারে, তার ব্যবস্থা করছে। লোকটার সঙ্গে কথা বলে পুষি মুখ ফিরিয়ে বলল, “এই জল নদী থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে দু’পাশের জমিতে বছরে অন্তত দু’বার ফসল ফলাতে পারে। কী ভাল, তাই না? এখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা থাকত। আমার তো মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।”

ডাক্তারবাবু কথা বললেন না। এই আবেগ যে ক্ষণস্থায়ী, তা তিনি জানেন।

অনেকটা ঘোরার পর যেখানে ঘোড়ার গাড়ি এল, সেখানে চালাঘরগুলো প্রায় শূন্য। কয়েকটি মানুষ খালিগায়ে নিম্নাঙ্গে কাপড় জড়িয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। ডাক্তারবাবু বললেন, “ধর্মশালা কোথায়?”

চালক একটি চালাঘরের সামনে ঘোড়া থামাল। নিচু গলায় পুষিকে বলল, “এই হল ধর্মশালা। এখন কেউ নেই বলে মনে হয়।”

ডাক্তারবাবু চারপাশ দেখে আবার গাড়ি চালাতে বললেন। পুষি জিজ্ঞাসা করল, “এবার কোনদিকে যেতে বলব?”

“গ্রামের দিকে যেতে বলো।”

পুষি পাশ ফিরে চালককে কথাটা বললে সে অবাক হল। পুষি হাসল, “আমরা শুধু একটু ঘুরে বেড়াব।”

কপালে ভাঁজ পড়ল লোকটার। পুষির কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল না সে। পুষি ততক্ষণে রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। চালক পেছন ফিরে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে ভঙ্গিতে বোঝাল সে পুষির কথা বুঝতে পারছে না। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি মদেশিয়া?”

দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল চালক। তারপর বলল, “আমি একটু একটু হিন্দি বুঝতে পারি। এই মেয়েটা যখন হিন্দিতে কথা বলছিল তখন বুঝতে চেষ্টা করছিলাম, এখন যা বলল তা বুঝতে পারলাম না।”

“ও বলল তোমাদের গ্রাম দেখতে চায়,” হিন্দিতে থেমে থেমে বললেন ডাক্তারবাবু। মাথা নেড়ে সামনের দিকে ফিরে ঘোড়া ছোটাল চালক। ডাক্তারবাবুর মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিলেন, মানুষ যখন তার জন্মস্থান ত্যাগ করে পরবাসে যেতে বাধ্য হয়, তখন ধীরে ধীরে নতুন দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসে রপ্ত হয়ে ওঠে। পরের প্রজন্ম পূর্বপুরুষের ভাষা একটু একটু করে ভুলতে শুরু করে। তার পরের প্রজন্ম নতুন দেশের ভাষায় স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠে, তবে পূর্বপুরুষদের ভাষার কিছু শব্দ তাদের বলা বাক্যে থেকে যায়, অজান্তেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে। এই চালক লোকটি এবং তার আত্মীয়রা এখন যে-ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষায় পুষির পূর্বপুরুষরা কোনও এককালে কথা বলত। পুষি হয়তো বাবার কাছ থেকে শোনা দু’-তিনটি শব্দ বলে চালককে বিস্মিত করেছে। অথবা এই ঘোড়ার গাড়ি চালানোর সুবাদে চালক ভাঙা ভাঙা হিন্দি বলতে কোনওরকমে পারছে।

অনেকটা খোলা জমি পার হওয়ার পর দূরে বেশ কিছু একতলা চালাঘর দেখা গেল। চালক তার হাতের চাবুক উঁচিয়ে সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “গ্রাম।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “আমরা ওই গ্রামে যাব।”

গাড়ি এগিয়ে চলল। সামনে চাষের খেত। তারপর মাঠের ধার ঘেঁষে মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি দেওয়া একতলা ঘরগুলোর সামনে বাচ্চারা খেলা করছে। ডাক্তারবাবুর অনুরোধে গাড়ি দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু নীচে নামতেই পুষিও লাফিয়ে নামল। বাকি দু’জন গাড়ির পেছনে যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। ইশারায় চালককে নীচে নামতে বলে বাচ্চাদের দিকে এগোলেন ডাক্তারবাবু। ততক্ষণে বাচ্চারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে অবাক চোখে আগন্তুকদের দেখছে। সম্ভবত এমন অভিজ্ঞতা আগে ওদের হয়নি। আরও একটু এগোতেই বাচ্চারা চিৎকার করতে করতে যে যার ঘরের দিকে ছুটল। তারপর অনেক মানুষ বেরিয়ে এল সেই সব ঘর থেকে। প্রত্যেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে চালককে কিছু জিজ্ঞাসা করল। প্রশ্নের কিছু শব্দ পরিচিত মনে হলেও সবগুলো নয়। তবে ডাক্তারবাবু বুঝলেন। চালককে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তারা কারা, কী কারণে এসেছে?

চালক হাত নেড়ে কিছু বলে পুষির দিকে তাকাল। ভাঙা হিন্দিতে বলল, “ওদের সঙ্গে কথা বলুন!”

পুষি হাসিমুখে যা বলল, তাতে বাসিন্দাদের কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ডাক্তারবাবু চালককে বললেন, “ওদের জিজ্ঞাসা করো, বহু বছর আগে জল আর খাবারের কথা বলে যাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের কথা ওরা শুনেছে কি না!” চালক ওই কথাগুলো দিশি ভাষায় বলামাত্র অতিবৃদ্ধরা প্রায় একসঙ্গে কথা বলা শুরু করল। চালক বলল, “ওরা বলছে এসব কথা ওরা শুনেছে।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “ওদের জিজ্ঞাসা করো, পূর্বপুরুষেরা যে-দেশে গিয়েছে সেই দেশে ওরা যেতে চায় কি না?”

চালকের মুখ থেকে প্রশ্ন শুনে অনেকগুলো মাথা একসঙ্গে দু’পাশে দুলতে লাগল, যার অর্থ ওরা যাবে না। তারপরেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। বয়স্ক মানুষেরা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। চালক বলল, “চলুন।”

সন্ধে নামছিল। ডাক্তারবাবুর অনুরোধে চালক তাদের যেখান থেকে তুলেছিল, সেখানে নামিয়ে দিল। ডাক্তারবাবু পকেট থেকে টাকা বের করতেই লোকটি হেসে কোনও কথা না-বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। খুব অবাক হয়ে গেলেন ডাক্তারবাবু। তাদের জন্যে অনেক সময় নষ্ট করেছে লোকটা। কিন্তু টাকা না-নেওয়ার পেছনে একটাই কারণ অনুমান করতে পারছেন তিনি। এখানে তাঁদের আসার কী উদ্দেশ্য তা বুঝতে না-পারায় নিজেকে দূরত্বে রাখতে চাইছে চালক। এইসময় পুষি বলল, “লোকটার ভাষা ঠিক আমাদের মতো নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা কি ওর মতো কথা বলত!”

চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে মোড়া। শুধু পাঁচিলে ঘেরা দোতলা বাড়ির ভেতরে যে-আলো জ্বলছে, তা জানলার কাচের দিকে তাকালে বোঝা যায়। সদর দরজা ভেতর থেকে তালা বন্ধ। কয়েকবার আওয়াজ করার পর সেই প্রৌঢ় লোকটি হারিকেন নিয়ে এসে আলো মাথার ওপর তুলে পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। ডাক্তারবাবুর পরিচয় পেয়ে সে দরজা খুলে দিল।

লোকটি বলল, “অন্ধকারে বাইরে থাকলে বিপদ হতে পারে। সাপ তো আছেই, বন্য জন্তুও চলে আসে। আসুন।”

যে যার ঘরে ঢুকে দেখতে পেল আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পরে এতোয়ারি একটা থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে রাখল। ডাক্তারবাবু বললেন, “বাঃ, ওদের সাহায্য করছ দেখে ভাল লাগছে। আমরা অনেকটা ঘুরলাম। একটা গ্রামে গিয়ে এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাও বললাম। কিন্তু ওদের ভাষা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না। বহু বছর আগে যারা এদেশ ছেড়ে গিয়েছিল, তাদের ভাষায় অন্য ভাষা একটু একটু করে মিশে এমন বদলে গিয়েছে যে, মূল ভাষার সঙ্গে আর মিলছে না। কিন্তু ওদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম, যে-দেশে ওদের পূর্বপুরুষরা গিয়েছে, সেই দেশে যেতে ইচ্ছে আছে কি না, তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। ওরা খুব ভয় পেয়ে যে যার ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।”

চোখ বড় করে শুনছিল এতোয়ারি। কথা শুনে মাথা নিচু করে ঘর থেকে চলে গেল। মেয়েটির ব্যবহার এত শীতল যে, ডাক্তারবাবু কিছু বুঝতে পারলেন না।

আধঘণ্টা পরে প্রৌঢ়া মহিলা দরজায় এসে বললেন, “আপনাকে একবার ওপরে আসতে হবে। উনি ডাকছেন।”

ডাক্তারবাবু প্রৌঢ়ার সঙ্গে ওপরের ঘরে ঢুকে দেখলেন বৃদ্ধা বিছানার ওপরে উঠে বসেছেন। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন আছেন?”

“অনেক ভাল, আপনি খুব ভাল ওষুধ দিয়েছেন। ওই ওষুধ আর কতদিন খেতে হবে?”

“মনে হয় আর দু’দিন খেলেই হবে।”

“বাঃ,” একটু ভেবে বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা আজ কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন? কিছু দেখা হল?”

খানিক ইতস্তত করে ডাক্তারবাবু তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বিস্তারিত জানালেন। সব শুনে হাসলেন বৃদ্ধা, “আমি এই ভাঙা হিন্দি মেশানো ইংরেজি শিখেছি আমার স্বামীর কাছ থেকে। আমার স্বামী ছিলেন খাঁটি ইংরেজ। কিন্তু এই দেশটাকে ভালবেসেছিলেন। চার্চে গিয়ে বিয়ে হয়েছিল আমাদের।”

“আপনার বাবা-মা কি খ্রিস্টান ছিলেন?”

“না, না। ওঁকে বিয়ে করব বলেই আমি খ্রিস্টান হয়েছিলাম,” বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করলেন। যেন অতীতের কথা ভাবলেন।

ডাক্তারবাবু বললেন, “কিছু মনে করবেন না, আমার সঙ্গে অন্য যে-মেয়েটি এসেছে, সে মদেশিয়া, অথচ এখানকার মানুষের সঙ্গে ওর ভাষার অনেক পার্থক্য আছে। এতোয়ারিও আপনার সব কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে না, তাই তো?”

“ঠিক। কিন্তু এই মেয়েটি এত চুপচাপ যে মনের কথা বুঝতে দেয় না। তবে আমার সঙ্গে এখানকার মেয়েদের অনেক তফাত হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পর আমি আর আত্মীয়দের কাছে ফিরে যাইনি। স্বামীর ভাষা শিখে নিয়েছি একটু একটু করে। স্বামী হিন্দি বলতেন ভাঙা ভাঙা। সেই ভাঙা হিন্দি বলতেও আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার গায়ের রং কালো হলেও স্বামীর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার সবকিছু এমন বদলে গেল যে, লোকে আমাকে কালা মেম বলে আড়ালে কথা বলত,” বুড়ি হাসলেন। বেশ গর্বিত দেখাচ্ছিল ওঁকে। জানেন, “এতু আজ আমার হাত-পা-মাথায় এত সুন্দর হাত বুলিয়ে দিয়েছে যে, খুব আরাম হয়েছে।”

“এতু?”

“ও হো! আপনার সঙ্গে যে মেয়েটি এসেছে, আমার সঙ্গে আছে।”

“ও,” হেসে ফেললেন ডাক্তারবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি বিয়ের পর থেকেই আর আগের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি?”

“না। কী করব বলুন! প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হত। কিন্তু আমার স্বামীর ওই একটাই নিষেধ ছিল। তিনি চাইতেন আমি মেমসাহেব হয়ে থাকি, মা-বাবার ভাষায় যেন কথা না-বলি,” হাসলেন বৃদ্ধা, “প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, কিন্তু স্বামীর ভালবাসা সেই কষ্টকে ভুলিয়ে দিয়েছিল।”

“কিছু মনে করবেন না, আপনার স্বামীর মৃত্যুর পরে আবার গ্রামের আত্মীয়দের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়নি?”

“নাঃ। আমি নিজেই অনেক বদলে গিয়েছিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পরে সরকার আমাকে যে-ভাতা দেয়, তাতে দিব্যি চলে যায়। স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে নিয়ে ওঁর দেশে যাওয়ার। কিন্তু সাহস পাননি। আমার চামড়ার রংকে ওঁর দেশের আত্মীয়রা মেনে নেবেন না বলে ওঁর ভয় ছিল।”

উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবু, “আপনি এখন বিশ্রাম করুন।”

“একটা কথা বলব?”

“নিশ্চয়ই, বলুন!”

“আপনি যে-উদ্দেশ্যে এসেছেন, সেটা সফল হবে বলে আমার মনে হয় না। আজ থেকে দু’পুরুষ আগে যারা খাবারের লোভে এই মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের সম্পর্কে যারা থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল, তাদের বংশধরদের কোনও আগ্রহ নেই। খবর তো চাপা থাকে না। ওদের সেই পুর্বপুরুষদের খ্রিস্টান করা হয়েছিল, মৃত্যুর পরে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পোড়ানো হত না— এই সব খবর কিছু লোক এখানে প্রচার করেছে।”

“কিছু লোক? ওখান থেকে কেউ এসেছে বলে শুনিনি।”

“তারা আসেনি কিন্তু এই দেশের যেসব ছেলে ইংরেজদের তাড়াতে চাইছে, তারা এইসব খবর রটিয়ে দিয়েছে। আমি খ্রিস্টান হওয়ার পর থেকে ওরা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমার এখানে যারা কাজ করে, তারা বারবাকানার মানুষ। ধর্মে মুসলমান,” বৃদ্ধা বললেন।

নমস্কার জানিয়ে নীচে নেমে এলেন ডাক্তারবাবু। তাঁর মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা যতটা সরল হবে বলে ভেবেছিলেন, ততটা নয়। ঘরের কাছে এসে দেখলেন পুষি বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তাঁর ঘরে ঢুকতেই পুষি দরজায় এসে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওই দু’জন কোথায়? কী করছে এখন?”

“ঘুমাচ্ছে,” গম্ভীর গলায় বলল পুষি।

“সে কী? এই অসময়ে?”

“খুব ভয় পেয়েছে বোধহয়,” হাসল পুষি।

ডাক্তারবাবু তাকালেন, “ও! কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?”

“আপনার অনুমতি নেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।”

“কীসের অনুমতি?”

খুব মিষ্টি হাসি হাসল পুষি, “বলতে সাহস পাচ্ছি না, যদি ভরসা দেন তা হলে বলব।”

“বেশ, বলো।”

“চা-বাগান থেকে একটা জিনিস এনেছিলাম। খাওয়ার জিনিস। আজ সেই জিনিসটা খেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আপনি যদি অনুমতি না দেন তা হলে…”

“কী সেই খাবার জিনিস?”

ছুটে বেরিয়ে গেল পুষি। কিন্তু ফিরে এল অল্প সময়ের মধ্যে। হেসে বলল, “এটা চা-বাগান থেকে এনেছি। খুব ভাল হাঁড়িয়া।”

“সর্বনাশ!”’ চোখ বড় হল ডাক্তারবাবুর, “তুমি ওটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ? না না, ওটা খেয়ে মাতলামি করলে…”

“না না, আমি মাতলামি করি না, যারা আমায় দেখে তারাই মাতাল হয়,” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষি।

“তুমি কি রোজ হাঁড়িয়া খাও?”

“কী করব! না-খেলে সবাই মনখারাপ করে। তবে সবাই বলে খাওয়ার পর আমি কখনও মাতাল হইনি,” চোখ ছোট করল পুষি, “একটু খাই?”

“আমি তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি না, কিন্তু কেউ যদি তোমার বিরুদ্ধে নালিশ না-করে, তা হলে আমার কিছু বলার নেই।”

শোনামাত্র এক মুহূর্ত না-দাঁড়িয়ে পাশের ঘরে চলে গেল পুষি।

ডাক্তারবাবুর একবার ইচ্ছে হল কালু এবং সোমরা কী করছে তার খোঁজ নেওয়ার। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে শেষপ্রান্তের ঘরের খোলা দরজার সামনে পৌঁছে গান শুনতে পেলেন। দুটি পুরুষকণ্ঠ বেসুরো গলায় যিশুর ভক্তিগীতি যা চার্চে ফাদার গেয়ে থাকেন, তাই চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছে। ডাক্তারবাবু ওদের বিরক্ত করলেন না।

সকালে প্রৌঢ়া মহিলার অনুরোধে এতোয়ারির এনে দেওয়া রুটি আর আলুর তরকারি খেয়ে ডাক্তারবাবু বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এতোয়ারি বলল, “উনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন। ওঁর ঘুম আসছিল না। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখন কি ডাকব?”

ডাক্তারবাবু বললেন, “না, না। থাক। তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমরা বেরিয়ে যাব।”

এতোয়ারি কথা বলল না, দাঁড়িয়েই রইল।

প্রৌঢ়া বলল, “ওকে এখন না-নিয়ে গেলে কি অসুবিধে হবে?”

অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। বললেন, “কেন?”

উনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে আমরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু এই মেয়ে এসে যেভাবে সেবাযত্ন করল, সেরকম তো আমরা করতে শিখিনি। ওর সেবায় উনি এখন কিছুটা ভাল হয়ে উঠেছেন। আর কিছুদিন থাকলে একদম ভাল হয়ে যাবেন। যদি ওকে না-নিয়ে গেলে হয়…” প্রৌঢ়া কথা শেষ করল না।

ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকালেন। মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন এই প্রস্তাবে ওর আপত্তি নেই। তিনি সম্মতি জানালেন। তারপর এই বাড়ির প্রৌঢ় পরিচারককে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন বাকি তিনজনের সঙ্গে।

অনেক ঘোরাঘুরির পর একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি জোগাড় করে দিয়ে প্রৌঢ় ফিরে গেল। ভাড়া ঠিক করে চালককে যা বললেন, তা যে ওর বোধগম্য হল না, তা বুঝতে পেরে হতাশ হলেন ডাক্তারবাবু। ওই প্রৌঢ় পরিচালককে সঙ্গে রাখলে ভাষার সমস্যা হত না। পরিচারক লোকটাকে তিনটে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল। একটু আপত্তি করে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল চালক। প্রৌঢ় চলে যাওয়ার আগে ভাড়া বাবদ কী দিতে হবে জানিয়ে গিয়েছিল।

চালকের পাশে বসে পুষি কিছুক্ষণ বকবক করেও কোনও সাড়া না-পেয়ে মুখ ফিরিয়ে ডাক্তারবাবুকে বলল, “ও কথা বলছে না কেন?”

ডাক্তারবাবু বললেন, “একটু আগে ওই প্রৌঢ়ের সঙ্গে ও অন্যরকম ভাষায় কথা বলছিল। বোধহয় তোমার ভাষা বুঝতে পারছে না।”

পুষি খুব হতাশ হয়ে সামনে তাকাল।

দূরে একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে বিকট শব্দ করে এগিয়ে আসছে। সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেল। ডাক্তারবাবু দেখলেন ওই গাড়ির ড্রাইভার এদেশীয় মানুষ। পেছনে সাদা চামড়ার মধ্যবয়সি পাইপ থেকে ধোঁয়া ছাড়ছেন। দরজা খুলে ভদ্রলোককে নামতে দেখে ডাক্তারবাবু নেমে দাঁড়ালেন।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, “আমি যার সঙ্গে কথা বলছি তার নিশ্চয়ই ইংরেজি ভাষাটা জানা আছে।”

“নিশ্চয়ই,” ডাক্তারবাবু বললেন, “ডাক্তারি পড়তে হলে এদেশে ইংরেজি ভাষা শেখাটা আবশ্যিক। তাই শিখতে হয়েছিল।”

“আই সি’ তুমি তা হলে একজন ডাক্তার। গুড। কিন্তু আগে যখন তোমাকে এই এলাকায় দেখিনি তখন জানতে পারি কি এই লোকগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?” কাঁধ নাচালেন সাহেব, “আমার একটা বদ অভ্যেস হল অন্যকে সাহায্য করা। তোমার কোনও সাহায্য দরকার আছে?”

ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, “আমি এখানকার আদিবাসীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি। আমার সঙ্গে যাদের দেখছেন তাদের পূর্বপুরুষরা এখানেই থাকতেন। চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের ডুয়ার্স অসমের চা-বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা এসেছে পূর্বপুরুষের দেশ দেখতে।”

“বাঃ! খুব ভাল,” ভদ্রলোক গাড়ির ওপরে বসে থাকা পুষির দিকে তাকিয়ে কিছু বললেন। ডাক্তারবাবুর মনে হল এটা অবশ্যই কোনও আদিবাসী ভাষা, কিন্তু চেনা চেনা লাগলেও পুরোটার অর্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি দেখলেন পুষি বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে আছে। ডাক্তারবাবু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “উনি কী বললেন বুঝতে পারছ না?”

পুষি দু’পাশে মাথা নাড়ল। তারপর পেছন ফিরে গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনকে জিজ্ঞাসা করল তারা কথার অর্থ বুঝছে কি না। ওরা মাথা নেড়ে না বলল।

সাহেব হাসলেন, “ডক্টর, আমাদের বন্ধুরা যারা ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছে, তারা একটাই অভিযোগ শোনে, তাদের উচ্চারণ নাকি পালটে গিয়েছে। আর এদের পূর্বপুরুষ তো বহু বছর আগে চলে গিয়েছেন। তাই শুধু উচ্চারণ নয়, ভাষাও বদলে গিয়েছে অনেকটা। অচেনা তো লাগবেই। আমার মনে হয় এভাবে ওদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করে লাভ হবে না। আপনি বরং আমার অফিসে আসুন। সেখানে কয়েকজন আদিবাসী কর্মচারী কাজ করে। তাদের সঙ্গে কথা বললে আর কষ্ট করতে হবে না।”

সাহেবকে অনুসরণ করে ভাড়ার ঘোড়ার গাড়ি তিন মাইল দূরের লোকালয়ে এল। সেখানে পাঁচিল দেওয়া গেটের দরজায় পাহারাদার রয়েছে, যে কপাল থেকে হাত নামাচ্ছে না। গাড়ি বাইরে রেখে নীচে নামতেই ডাক্তারবাবু দেখলেন, পুষিও নেমে পড়েছে। তিনি ভেতরে পা বাড়ালে সে-ও সঙ্গ নিল। ডাক্তারবাবু তাকে নিষেধ করতে গিয়েও থেমে গেলেন। যদি কারও ভাষা পুষি বুঝতে পারে!

সাহেব বললেন, “এসো ডাক্তার। এবার তোমাকে আমার পরিচয়টা দিই। আমি এই এলাকার কালেক্টর। তবে আর বেশিদিন নেই। সামনের মাসে আমাকে বদলি হয়ে রেঙ্গুনে যেতে হবে। ওসব কথা থাক,” বলে তিনি টেবিলে রাখা কলিং বেলের বোতামে চাপ দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে একজন উর্দিপরা লোক ছুটে ভেতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সেলাম জানাল। সাহেব বললেন, “কল অল স্টাফ, কুইক।”

কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘরে জনা দশেক মানুষ এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল। এরা সকলেই আদিবাসী শুধু একজন ছাড়া। তার পরনে ধুতির নীচে শার্ট গোঁজা, ওপরে টাইট কোট। এগিয়ে এসে লোকটা বলল, “ইয়েস স্যার?”

ডাক্তারবাবু লক্ষ করছিলেন কর্মচারীদের সাহেব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। তিনি যে-চেয়ারে বসেছেন, তার সামনে একটা ছোট বেতের টেবিল, দ্বিতীয় চেয়ার নেই। অতএব দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

সাহেব বললেন, “এই ন’জন জাতে মদেশিয়া এবং মুন্ডা। যদি কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকে তা হলে করতে পারেন।”

ডাক্তারবাবু লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বহু বছর আগে আপনাদের পূর্বপুরুষদের কাজ করার জন্যে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, জানেন তো?”

লোকগুলোর মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কিন্তু যেই ধুতিপরা বাবু হাত তুলে তাদের থামিয়ে গড়গড় করে কিছু বলতে শুরু করলেন, একটু থেমে দ্বিতীয়বার অন্যরকম ভাষায়, তখনই মানুষগুলো গুনগুন করে উঠল। ধুতিপরা বাবু ওদের সঙ্গে কিছু কথা বলে ভাঙা ইংরেজিতে শুরু করলেন, “ইয়েস স্যার অ্যান্ড নো স্যার। ইয়েস স্যার মানে দে নো। দেয়ার ফাদার টোল্ড, ফাদার্স ফাদার টোল্ড দেয়ার ফাদার। বাট নো লাভ ফর দেম। অন্য কিছু?”

ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। ধুতিপরা বাবু ইশারা করতেই লোকগুলো পড়ি কি মরি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সাহেব বললেন, “বাবু, ইউ মে গো।”

সঙ্গে সঙ্গে কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বাবু বেরিয়ে গেলেন। সাহেব হাসলেন, “এরা অপরিচিতদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। এদের পূর্বপুরুষদের অধিকাংশই চলে গেছে রাঁচি, বারকানায়। কুলির কাজ, ভৃত্যের কাজ করে তারা। খুব অনুগত কর্মী। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় যে-ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, তার প্রভাব এখনও এদের ওপর পড়েনি। পড়লে কী হবে জানি না,” কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন সাহেব। তারপর পাশে এসে বললেন, “তুমি তো চা-বাগানে ডাক্তারি করো। তোমার কোম্পানি নিশ্চয়ই ব্রিটিশ কোম্পানি?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“তারা তোমাকে কয়েকজনকে সঙ্গে দিয়ে এখানে পাঠিয়েছে দেখে অবাক হয়েছি। তোমার ম্যানেজার নিশ্চয়ই ব্রিটিশ?”

“হ্যাঁ স্যার।”

“মিছিমিছি টাকা এবং কাজের সময় নষ্ট করেছে তোমাদের এখানে পাঠিয়ে। আমার নাম জন স্মিথ। তাকে বোলো কথাটা আমি বলেছি।”

মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন ডাক্তারবাবু।

সময় যে বিরাট ফারাক তৈরি করে দিয়েছে, তা বুঝতে পারলেন ডাক্তারবাবু। চা-বাগান তৈরির সময়ে স্থানীয় লোক না-পেয়ে এই অঞ্চল থেকে যেসব ক্ষুধার্ত মানুষদের জল এবং খাবারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের বংশধরদের সঙ্গে যারা তখন এখানে পড়ে ছিল তাদের বংশধরদের জীবনযাপন, ধর্মাচরণের কোনও মিল নেই। ঘোড়ার গাড়িতে চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে তাঁর মনে হল, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলের মাটিরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। খাল কেটে জল নিয়ে আসা হয়েছে, মাঝে-মাঝেই কুয়োর সামনে জল তুলতে আসা দেহাতি মহিলাদের দেখা যাচ্ছে।

সমস্যা হল, এইসব গল্প চা-বাগানের বড়সাহেবকে তিনি ফিরে গিয়ে বলতে পারলেও দু’জন স্বামী-স্ত্রীকে কিসের লোভ দেখিয়ে চা-বাগানে নিয়ে যাবেন? সেরকম দম্পতিকে পাবেনই-বা কোথায়?

দুপুর নাগাদ ফিরে এসে ঘোড়ার গাড়ির চালককে আরও কিছু বকশিশ দিয়ে ছেড়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল আর এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। বাড়ির সদর দরজা খুলতেই কানে গুলির আওয়াজ এল। সঙ্গীরা ভেতরে ঢুকতেই তিনটে ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখলেন। কিন্তু ওরা কাছাকাছি আসতেই আবার গুলির আওয়াজ এবং চারজন অশ্বারোহী পুলিশকে চিৎকার করতে করতে আসতে দেখামাত্র, ওই তিনজনের একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার সঙ্গীরা অতিদ্রুত চোখের আড়ালে চলে যেতেই, অশ্বারোহীরা পড়ে থাকা যুবকের পাশে চলে এসে ছেলেটিকে দ্বিতীয়বার গুলি করল। শরীরে গুলি ঢুকলেও ছেলেটি একটুও নড়ল না। একজন সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে মৃত ছেলেটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে আবার ঘোড়ার পিঠে উঠে, ওরা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে ফিরে গেল।

সমস্ত দৃশ্যটা পাঁচিল এবং বন্ধ গেটের পাশে লুকিয়ে থাকা ডাক্তারবাবু এবং পুষি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখলেন। বাকি ছেলে দুটো চলে গিয়েছিল পাঁচিলের আড়ালে।

পুলিশগুলো মৃতদেহ নিয়ে ফিরে গেলে পুষি কথা বলল, “ওরা ছেলেটাকে মেরে ফেলল? কেন? কী করেছে ও?”

ডাক্তারবাবু মেয়েটিকে দেখলেন। ওর মুখটা এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, “ভেতরে চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।”

পুষি জিজ্ঞাসা করল, “ছেলেটা কি চোর বা ডাকাত?”

ডাক্তারবাবু জবাব দিলেন না।

ঘরে ঢোকামাত্র সেই প্রৌঢ় কর্মচারী সামনে এসে বলল, “খুব ভাল সময় এসে পড়েছেন। এরকম সময় পুলিশকে বিশ্বাস করা যায় না।”

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “ওরা গুলি করে মারল কেন?”

লোকটি একটু ইতস্তত করল। বাড়িতে ঢোকামাত্র চা-বাগান থেকে আসা দু’জন পুরুষ তাদের জন্যে বরাদ্দ ঘরে ঢুকে গিয়েছিল আশ্রয়টি নিরাপদ ভেবে। কিন্তু পুষি দাঁড়িয়েছিল ঘরের কোণে।

শেষপর্যন্ত প্রৌঢ় বলল, “এখন খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। অল্পবয়সি ছেলেরা সাহেবদের দেশ থেকে হঠাতে চাইছে। আজ সকালে নাকি পুলিশের সাহেবের আর্দালিকে ছুরি মেরেছে। আমাদের এখানে পুলিশ আসবে না। আমাদের সাহেবকে সবাই সম্মান করত। তাঁকে কবর দেওয়ার সময় এই জেলার অনেক সাহেব সঙ্গে হেঁটেছিলেন। কিন্তু দিন তো সবসময় এক থাকে না,” কথাগুলো বলে প্রৌঢ় চলে যাচ্ছিল কিন্তু পুষি তাকে ডাকল, “আচ্ছা, এই ছেলেগুলো সাহেবদের দেশ থেকে হঠাতে চায় কেন?”

প্রৌঢ় বলল, “আমি অত কথা জানি না। তবে শুনেছি, সাহেবরা কালাপানি পার হয়ে জোর করে আমাদের এই দেশ দখল করে আছে। এতদিন এদেশের মানুষরা কিছু বলেনি, এখন কেউ কেউ বলছে।”

প্রৌঢ় চলে গেলে পুষি গালে আঙুল দিল, “আরেব্বাস! এতসব কথা চা-বাগানের লোকরা কি জানে? না, না জানে না। এখানে আসার আগে একজনকে পুলিশ ধরতে চাইছিল যে, সাহেবদের তাড়াতে চাইছিল! কিন্তু আন্দোলন করছে বলে আমাদের বাগানের কাউকে পুলিশ খুন করেনি। গুলি লাগার পর ছেলেটা কেমন পড়ে গিয়েই মরে গেল! আচ্ছা, ওর বাবা-মা জানতে পারবে যে ও মরে গিয়েছে?”

একটু অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। পুষির মতো মেয়ের মুখে এইরকম কথা শুনে বললেন, “ঠিক আছে। আমরা অনেক দূর থেকে এখানে ক’দিনের জন্যে এসেছি। এসব নিয়ে বেশি কথা বলার দরকার নেই।”

“কিন্তু…,” তাকাল পুষি, “একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”

“বলো।”

“আচ্ছা, আমরা যেখানে থাকি আর এই জায়গাটা কি দুটো আলাদা দেশ? এক দেশ না?” পুষি জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ। একই দেশ।”

“সর্বনাশ!” পুষি গালে হাত রাখল।

“কী হল?”

“তা হলে তো চা-বাগানের ছেলেদেরও পুলিশ গুলি করে মারতে পারে! আচ্ছা, এখানে শুধু ছেলেরাই সাহেবদের তাড়াতে চায়, না মেয়েরাও তাদের সঙ্গে আছে?” পুষি জিজ্ঞাসা করল।

“এইসব জেনে তোমার কী লাভ হবে?”

চট করে জবাব দিল না পুষি। গালে হাত দিয়েই দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তারবাবু বললেন, “কী হল? তোমার ঘরে যাও।”

এবার পুষি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু খুব অবাক হলেন। আজ সকালে বেরোনোর সময়েও পুষিকে বেশ চপলা দেখাচ্ছিল। এই বাংলোয় ফিরে এসে চোখের সামনে একটি তরুণকে পুলিশের গুলিতে মরে যেতে দেখার পর ওর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেল। চাপল্য উধাও, খুব গম্ভীর হয়ে গেছে পুষি। চোখের সামনে আচমকা কাউকে মরে যেতে দেখলে ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পুষির ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া শুধু ধাক্কার কারণে নয়, আরও গভীর মনে হচ্ছিল ডাক্তারবাবুর।

এভাবে একদম অপরিচিত এক মহিলার বাড়িতে দু’বেলা পাঁচজনে মিলে খাওয়া এবং থাকা অশোভন। আজ দুপুরের খাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার জন্যে বৃদ্ধার কাছে এলেন ডাক্তারবাবু। বৃদ্ধা বসেছিলেন। এতোয়ারি তার পা টিপে দিচ্ছিল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন আছেন? দেখে মনে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক ভাল।”

বৃদ্ধা হাসলেন, “এই মেয়েটার সেবা পেয়ে ভাল লাগছে।”

“আচ্ছা, আপনাকে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানি না,” ডাক্তারবাবু বললেন, “আমাদের তো এখন অনেক জায়গায় ঘুরে খোঁজাখুঁজি করতে হবে, তাই একটু পরে বিদায় নিতে চাই। আপনাকে কখনও ভুলতে পারব না।”

বৃদ্ধা বললেন, “ডক্টর, আপনাকে আমার দুটো কথা রাখতে হবে।”

“নিশ্চয়ই, বলুন কী করতে হবে!”

“এখন এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো আপনাদের পক্ষে নিরাপদ নয়। আজ যখন আপনারা এলাকা দেখতে বেরিয়েছিলেন, তখন পুলিশের দু’জন অফিসার এই বাড়িতে এসে আমার কাছে আপনাদের সম্পর্কে খোঁজখবর করেন। তারপর একটা ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। এখন পুলিশ আরও অ্যাকশন নেবে। তাই এখানে থাকা আপনাদের পক্ষে নিরাপদ নয়,” বৃদ্ধা বললেন।

“আমরা আজই এখান থেকে চলে যাব।”

“এখান থেকে মানে এই এলাকা থেকে অন্য কোথাও ট্রেনে চড়ে চলে যান।”

বৃদ্ধার কথায় মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, “বুঝতে পেরেছি। আর-একটা কিছু আপনি বলতে চেয়েছিলেন!”

“ও হ্যাঁ। দুটো ছেলে এই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে চায়। না-যেতে পারলে পুলিশের গুলিতে ওদের মৃত্যু হতে পারে। আপনারা যে-ট্রেনে চড়ে এখান থেকে চলে যাবেন, সেই ট্রেনে ওই দু’জনকে যদি সহযাত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন, তা হলে হয়তো ওরা পুলিশের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আপনি রাজি না-হলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু যেহেতু ওরা ইন্ডিয়াকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখছে, তাই ওদের সাহায্য যদি করতে পারেন, তা হলে ভাল হয়,” বৃদ্ধা ইশারা করলে এতোয়ারি জলের গ্লাস এনে দিল। জল খেলেন তিনি।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন বৃদ্ধা।

“আপনার স্বামী একজন ব্রিটিশ ছিলেন, যাঁকে তাঁর স্বজাতিরা শ্রদ্ধা করতেন বলে মৃত্যুর খবর পেয়ে সবাই এসেছিলেন। সেই আপনি দু’জন ইংরেজবিরোধী বিপ্লবীকে সাহায্য করতে চাইছেন, কেন? আমি জানি না পুলিশ যাদের খোঁজ করছে, আপনি তাদের আশ্রয় দিয়েছেন কি না!” বেশ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন ডাক্তারবাবু।

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধা। হেসে বললেন, “আমার ইংরেজ স্বামীকে আমি ভালবাসতাম আর যারা স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করছে তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। মনে হয় উত্তরটা আপনি পেয়েছেন। ও হ্যাঁ, আপনাদের ট্রেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। যদি অনুরোধ রাখেন, তা হলে অন্তত আধঘণ্টা আগে স্টেশনে পৌঁছে যাবেন,” কথা শেষ করে দুটো শীর্ণ হাত এক করলেন বৃদ্ধা।

ডাক্তারবাবু নমস্কার জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই এতোয়ারি উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কিছু বলবে নাকি,” এতোয়ারি মাথা নিচু করেছিল, এবার উঁচু-নিচু করল।

“বেশ, বলো।”

“আমি যদি এখন চা-বাগানে ফিরে না যাই…”

“সে কী! না-ফিরে গিয়ে এখানে থেকে কী করবে?” ডাক্তারবাবু অবাক। বৃদ্ধাকে ইশারায় দেখিয়ে এতোয়ারি বলল, “মায়ের কাছে থাকব!”

বৃদ্ধা বললেন, “কাল থেকে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ও কিছুতেই ফিরে যেতে চাইছে না। বলছে, আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন ও আমার কাছে থাকবে। তারপর না হয় চা-বাগানে ফিরে যাবে। আপনি ওকে বোঝান।”

ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, “চা-বাগানে তোমার মা আছে বাবা আছে…”

তাঁকে থামিয়ে এতোয়ারি বলল, “আমাকে তো শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই কিছুদিন আমি না-থাকলে কারও অসুবিধে হবে না।”

ডাক্তারবাবু বৃদ্ধার দিকে তাকালেন, “আপনি কী চাইছেন?”

বৃদ্ধা হাসলেন, “ও থাকলে আমার খুব সুবিধে হবে। তবে আমার মৃত্যুর পরে ও যদি চলে যেতে চায় তার ব্যবস্থা আমি করে রাখব।”

ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, “ঠিক আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে এতোয়ারি ডাক্তারবাবুর পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করল। করে হাসিমুখে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

প্রৌঢ় লোকটি ঘোড়ার গাড়ি ডেকে এনেছিল। ওরা চারজন গাড়িতে উঠে পেছন ফিরে দেখল দোতলার জানলায় বৃদ্ধা কালো মেমসাহেবের পাশে এতোয়ারি দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাদের দেখছে। তারপর স্পষ্ট দেখা গেল, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলাচ্ছে।

প্ল্যাটফর্ম আজ জনশূন্য। সঙ্গী তিনজনকে এক কোণে বসিয়ে ডাক্তারবাবু স্টেশন মাস্টারের ঘরে গেলেন। গিয়ে শুনলেন ভদ্রলোক অসুস্থ হওয়ায় স্টেশনে আসেননি। সহকারী টিকিট তৈরি করে দিয়ে বললেন, “এই তো এলেন, এখনই চলে যাচ্ছেন! অবশ্য চলে যাওয়াই ভাল। এখানে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে বিদেশিরা বিপদে পড়তেই পারে।”

“বিদেশি?”

“আপনারা তো এখানকার লোক নন। তাই না?”

কথা না-বাড়িয়ে টিকিট নিয়ে বাইরে এসে চারপাশে তাকিয়েও সঙ্গী তিনজন ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলেন না।

ঠিক সময়ে ট্রেন এল। একদম ফাঁকা ট্রেন। ট্রেন থেকে নেমে ট্রেনের গার্ড এবং টিকিট চেকার সহকারী স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা বললেন। সহকারী হাত তুলে ডাক্তারবাবুদের দেখিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওরা এগিয়ে এল। কালো চামড়ার গার্ড ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, “আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ?”

নিঃশব্দে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন ডাক্তারবাবু।

“গো ইন দিস কম্পার্টমেন্ট। লক দ্য ডোর। ডোন্ট ওপেন। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মাই ইংলিশ?”

“শিয়োর।”

“ও মাই গড। ইউ নো ইংলিশ?”

“আই অ্যাম আ ডক্টর।”

“অ। গো ইনসাইড। লক দ্য ডোর,” বেশ ভদ্রভাবে এবার এই কথাগুলো বলল গার্ড।

ডাক্তারবাবু তিনজনকে নিয়ে ট্রেনে উঠলে, ওরা যে যার জায়গায় চলে গেল। ট্রেন চলতে শুরু করলে ওপাশের বন্ধ দরজায় শব্দ শুরু হল। ডাক্তারবাবু এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দুটি ছেলে ভেতরে ঢুকে হাতজোড় করে একপাশে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবু বুঝলেন এদের কথাই বৃদ্ধা তাঁকে বলেছিলেন। তিনি ইশারায় ওদের বসতে বলে খানিকটা দূরে গিয়ে বসলেন। দেখলেন তাঁর সঙ্গে আসা ছেলেদুটো জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখছে। পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এসেছে এইসময়। পুষি উলটোদিকে বসে উঠে আসা ছেলেদের দেখছে। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বলল, “আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?”

“কী কথা?”

“এমনি এমনি।”

ডাক্তারবাবু উত্তর না-দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। একটু ইতস্তত করে পুষি উঠে ছেলেদুটোর সামনে গেল, “আমার নাম পুষি, তোমাদের নাম কী? ট্রেনে কি আগেই উঠেছিলে না চলন্ত ট্রেনে উঠলে?”

ছেলেদুটো পুষির দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিলে নিল, কথা বলল না। পুষি নাছোবান্দা, “আমার কথা কি তোমরা বুঝতে পারছ না?”

ছেলেদুটোর কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। ওরা এবার জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতে লাগল। বেশ হতাশ হয়ে পুষি ওদের উলটোদিকের বেঞ্চে বসে পড়ল। তার মনে হচ্ছিল ওরা ওর ভাষা বুঝতে পারছে না। দ্বিতীয়বার সে ভাঙা হিন্দিতে কথা বলেছে। তাও ওরা বোঝেনি। এই ছেলেদুটোর সঙ্গী যে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে, তাতে পুষির কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ওদের সঙ্গীকে যারা খুন করল, তাদের শাস্তি না-দিয়ে এখান থেকে ওরা চলে যাচ্ছে কেন? নিজেই মাথা নাড়ল পুষি, তখন রুখে দাঁড়ালে ওদের দেহও লাশ হয়ে যেত। ছেলেগুলো তার সঙ্গে কথা বলছে না। কেন? তাকে নিশ্চয়ই ওরা বিশ্বাস করছে না। ওরা দেশ থেকে সাহেবদের, সাদা চামড়ার সাহেবদের তাড়াতে চায়। তার জন্যে ওরা প্রাণ দিতেও রাজি আছে।

চা-বাগানের লাগোয়া জমিতে থাকলেও, তার বাবা, ঠাকুরদা, মা তো একসময় চা-বাগানে কাজ করত বলে কুলি লাইনেই থাকত। সে চা-বাগানের কাজ থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে আছে। তার শরীর যতদিন ছেলেদের মুগ্ধ করবে, ততদিন খাওয়ার অভাব হবে না। তার কাছে যারা আসে, তাদের কাছেই সে অনেক রকম খবর পায়। শৈশব থেকে সে বাবা-মায়ের কাছে শুনে এসেছে সাহেব হল চা-বাগানের ভগবান। কেউ অন্যায় করলে সাহেব তাকে চাবুক মারতে মারতে মেরে ফেললেও পুলিশ কিছুতেই নাক গলাবে না। এখানে আসার আগে সে শুনেছিল, পুলিশ একজনকে খুঁজছে, পেলেই মেরে ফেলবে। এই চা-বাগানের মানুষরা শুনতে পেল সেই ছেলে নাকি ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে চায়। অন্যদের মতো পুষিও বিশ্বাস করেনি। এ কখনও সম্ভব! কিন্তু সে চোখের সামনে ওরকম একজনকে পুলিশের গুলি খেয়ে মরে যেতে দেখল। যেসব পুলিশ গুলি করছে তাদের কারও গায়ের চামড়া সাদা নয়, তবু গুলি করল।

বাইরে এখন রাত নেমেছে। বেরোনোর আগে এতোয়ারি নীচে এসে একটা প্যাকেটে রুটি আর তরকারি দিয়েছিল। ডাক্তারবাবুর কাছে রাখা সেই প্যাকেট খুলে পুষি দেখল অনেকগুলো রুটি আর আলুর তরকারি রয়েছে ভেতরে। ডাক্তারবাবুকে খাবার দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “ওরা বোধহয় না-খেয়ে আছে, একটু দিতে পারি।”

ডাক্তারবাবু এমনভাবে অন্যদিকে তাকালেন যেন শুনতেই পাননি। একটু ইতস্তত করে চারটে মোটা রুটি আর তরকারি কাগজের মোড়কে নিয়ে ওই ছেলেদুটোর কাছে গিয়ে বলল, “খেয়ে নাও।”

ছেলেরা বাইরে তাকিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হাত বাড়িয়ে খাবার নিল। ঠোঁটে চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। পুষি ফিরে এসে সঙ্গী দু’জনকে খাবার দিয়ে নিজেরটা নিয়ে খেতে লাগল।

একটু পরেই ট্রেনের গতি কমে আসতে লাগল। পুষি দেখল, ওই ছেলেদুটো খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওরা যেদিক দিয়ে কামরায় ঢুকেছিল সেদিকের দরজা খুলে ফেলল। দু’জনেই ঝুঁকে বাইরে তাকাল। একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে খুব ধীরে ট্রেন যাচ্ছে এখন। হঠাৎ ছেলেদুটো বাকি চারজনের দিকে তাকিয়ে ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি চিৎকার করে বলে দরজার বাইরে লাফিয়ে পড়ল। পুষি ছুটে এল সেই দরজায়। নদীর ওপরের ব্রিজে কোনও রেলিং নেই। ছেলেদুটো অন্ধকারেই নদীর জলে নেমে গিয়েছে। হাতল ধরে অনেকটা ঝুঁকেও তাদের হদিশ পেল না পুষি। রাতের নিবিড় অন্ধকারে নদী মুখ ডুবিয়ে থাকে।

দরজা বন্ধ করে ফিরে আসতে আসতে পুষির নজর পড়ল ব্যাগটার ওপর। ছেলেদুটো যেখানে বসেছিল সেখানে পড়ে আছে। ওরা কি ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে গেল? এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে কথাটা বলল পুষি। ডাক্তারবাবু উঠলেন। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটাকে তুলে ভেতরে নজর দিতেই তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর দরজা খুলে যতটা সম্ভব দূরে ছুড়ে ফেললেন। ট্রেন ততক্ষণে ব্রিজ পেরিয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে কোথায় ব্যাগটা পড়ল দেখা গেল না কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে পরপর কয়েকবার বোমা ফাটার তীব্র শব্দে যেন ট্রেনটাও কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটার গতি কমে এলেও থামল না। বরং গতি বাড়ল।

ট্রেন থামল পরের স্টেশনে। চিৎকার চেঁচামিচি শুরু হয়ে গেল। জানলা দিয়ে ডাক্তারবাবু দেখলেন বন্দুকধারী পুলিশরা দৌড়োদৌড়ি করছে। সম্ভবত ট্রেনটাকে পরীক্ষা করছে ওরা। ডাক্তারবাবু চাপা গলায় সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। ছেলেরা আদেশ মান্য করল, কিন্তু পুষি নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রেখে জানলার তলা থেকে প্ল্যাটফর্মটাকে দেখতে লাগল। তারপর যখন ট্রেনটা আবার চলা শুরু করল, তখন বেঞ্চের ওপর শরীর এলিয়ে দিল। পরিবর্তনটা লক্ষ করছিলেন ডাক্তারবাবু। যে-পুষি চা-বাগান থেকে এখানে এসেছিল, তার সঙ্গে এখনকার পুষির যেন একটুও মিল নেই। সেই লাস্যভাব, স্বদেশি সহযাত্রীদের এড়িয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গ পাওয়ার যে-চেষ্টা ওর মধ্যে ছিল, তা আর ওর মধ্যে নেই। চোখের সামনে ছেলেটাকে মরতে দেখে ও যেন খুব ঝাঁকুনি খেয়েছে। ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে হাসলেন। তিনি কল্পনা করতে পারছিলেন না চা-বাগানে ফিরে গিয়ে পুষি কী করবে! এই আগুন জ্বললে কি সহজে নিভে যেতে পারে!

শিলিগুড়ি স্টেশনে নামতেই একজন পরিচিত মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ ডাক্তারবাবুকে দেখে এগিয়ে এলেন, “আরে! আপনি বাইরে গিয়েছিলেন নাকি? কোথায় কলকাতায়?”

ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, “না। মহুয়ামিলনে।”

“সেটা আবার কোথায়? এরাও সঙ্গে গিয়েছিল নাকি?”

“ওই আর কী। আপনি ভাল আছেন?”

“আর ভাল! বিপ্লবীরা যেরকম খুনখারাপি করছে, তাতে আর কী করে ভাল থাকা যায়! চা-বাগানের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্রিটিশ ম্যানেজারকে তো…”, বলেই যেন মনে পড়ে গেল এমন ভঙ্গিতে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালেন ভদ্রলোক, “আরে, উনি তো আপনাদের বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন, খবর পাননি?”

অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। বললেন, “কী হয়েছে?”

“পরশুদিন পুলিশ একজন বিপ্লবীকে গুলি করে মারে। লোকজন যে ওই ঘটনায় একটুও খুশি হয়নি, তা ম্যানেজাররা বুঝতে পারেননি। কাল চা-বাগানের রাস্তায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার গাড়ি চালিয়ে যখন আসছিলেন, তখন কয়েকজন শ্রমিক তাঁকে আটকে পিটিয়ে মেরে ফেলে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শুনলাম খুব ধরপাকড় চলছে! এতদিন চা-বাগান খুব শান্তির জায়গা ছিল, লোকজন হঠাৎ স্বাধীন হওয়ার জন্য খুনখারাপি করা শুরু করল কেন! আরে, স্বাধীন হলে যে দেশটা ভিখিরি হয়ে যাবে!” খুব বিরক্ত হয়ে কথা বললেন ভদ্রলোক।

শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ির তিস্তা নদী পার হয়ে বাসে চেপে চা-বাগানে আসতে বিকেল গড়িয়ে এল। কপালে কয়েকবার হাত ঠুকে পুরুষ সঙ্গীরা চা-বাগানের গলিপথে দৌড়ে চলে গেল যে যার লাইনে।

ডাক্তারবাবু দেখলেন চা-বাগানের লাগায়ো হাটের সবক’টা দোকান বন্ধ। একটাও মানুষ নেই। পেছন থেকে পুষির গলা ভেসে এল, “ডাগদারবাবু, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে!”

অবাক হলেন ডাক্তারবাবু, “আনন্দ হচ্ছে? কেন?”

“আমাদের দেশের একজনকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে, তা আমি চোখের সামনে দেখেছি। এখানে এসে শুনলাম ওদের একজনকে আমাদের দেশের মানুষ পিটিয়ে মেরে তার বদলা নিয়েছে,” বেশ খুশি খুশি গলায় বলল পুষি।

“এসব কথা এখানে দাঁড়িয়ে না-বলে বাড়ি চলে যাও,” বেশ কড়া গলায় বললেন ডাক্তারবাবু।

যেন অবাক হল পুষি। তারপর চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। ওই পথে গেলে বাড়ি ফিরতে কম হাঁটতে হবে। আর তখনই গাড়ির আওয়াজ কানে এল। একটা নয়, দু’-দুটো গাড়ি। ওরা আসছে ফ্যাক্টরির দিক থেকে। সামনের গাড়িটি পুলিশের ভ্যান, পেছনের গাড়িতে চা-বাগানের প্রধান সহকারী ম্যানেজার। ডাক্তারবাবু রাস্তার মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াতেই গাড়ি দুটো থেমে গেল।

দ্বিতীয় গাড়ি থেকে নেমে এলেন সহকারী প্রধান ম্যানেজার। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এখানে? তার মানে তুমি যাওনি?”

“গিয়েছিলাম, আজ ফিরছি!” ডাক্তারবাবু বললেন।

“তুমি, তুমি গাড়িতে ওঠো।”

“কেন?”

“অতদূর থেকে এসেছ, নিশ্চয়ই টায়ার্ড,” বলেই সামনের গাড়ি থেকে নেমে আসা পুলিশের অফিসারকে বললেন, “ওকে অ্যারেস্ট করুন অফিসার। ও ক্রিমিন্যালকে অপারেশন করে বাঁচিয়েছে। অ্যারেস্ট হিম।”

প্রধান সহকারী ম্যানেজারের চিৎকার শুনে পুলিশ অফিসার একজন সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মাত্রই পাশের চা-বাগান থেকে একটা পাথর তীব্র বেগে উড়ে এসে প্রধান সহকারী ম্যানেজারের মাথায় আঘাত করল। তাঁর মুখ থেকে শব্দ পুরোটা বেরোনোর আগেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পুলিশ অফিসার দিক বদল করলেন। ডাক্তারবাবুর দিকে না-গিয়ে যেদিক থেকে পাথর উড়ে এসেছিল, সেদিকে বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে যেতেই তাঁর কাঁধে আর-একটা পাথর আছড়ে পড়ল। তিনি ‘ওরে ব্বাবা’ বলে বসে পড়তেই বাকি পুলিশরা তাঁকে কোনওরকমে গাড়িতে তুলে নিল। প্রায় নিমেষের মধ্যে গাড়ি দুটো চা-বাগানের বাইরের পিচের রাস্তার দিকে তীব্র গতিতে ছুটে গেল।

ডাক্তারবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন মাঝরাস্তায়। গাড়ি দুটো চোখের বাইরে চলে যাওয়ার পরেও বুঝতে পারছিলেন না চা-বাগানের ভেতর থেকে পাথর দুটো কে অত জোরে ছুড়ে মারল! তিনি চা-বাগানের ওপর নজর রাখলেন। কোথাও কোনও মানুষের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। শেডট্রিগুলোয় পাখিরা দিব্যি ডেকে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাক্তারবাবুর মনে হল, ওই পাথর দুটো পুষি ছুড়ে মারেনি তো?

নিজের বাড়ির সামনে এসে অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। সদর দরজায় তালা ঝুলছে। একটু দূরে পাতিবাবুর বাসস্থান। সেদিকে কয়েক পা যেতেই ভদ্রলোক জানলায় এলেন, “আপনার ওয়াইফ বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। ডাক্তারবাবু, আপনি সেখানেই চলে যান,” বলে জানলা বন্ধ করে দিলেন ভদ্রলোক।

কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। তবু ডাক্তারবাবু চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে এলেন হাসপাতালের সামনে। স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন হাসপাতালের ঢোকার দরজায় তালা ঝুলছে। খুব অবাক হলেন ডাক্তারবাবু। এভাবে তালা ঝুলিয়ে দিলে অসহায় গরিব মানুষগুলো তো বেঘোরে মারা যাবে।

“ডাগদারসাব?”

গলা শুনে পেছন ফিরে হাসপাতালের চৌকিদারকে দেখতে পেলেন তিনি। লোকটি করুণ মুখ করে বলল, “আপনি এখন এখানে থাকবেন না সাব। পুলিশ অনেককেই ধরে নিয়ে গিয়েছে। বাগান এখন একদম বন্ধ।”

আর ম্যানেজারের অফিস যাওয়ার সাহস পেলেন না ডাক্তারবাবু। কিন্তু বড়রাস্তা দিয়ে আর না-হেঁটে বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল। তিনি যে বাগানে ফিরে এসেছেন, তা ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গিয়েছে। নিশ্চয়ই বড়সাহেবের কানে খবরটা পৌঁছে যাবে। এখান থেকে কীভাবে বাইরে যাওয়া যায়? স্ত্রী এখন কোথায়? সে তো কোনও অন্যায় করেনি। পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে ধরেনি।

মত পালটালেন ডাক্তারবাবু। আবার পিছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করলেন।

প্রায় তিরিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হল। বড়সাহেবের বাংলোর সামনে তিনজন বন্দুকধারী পুলিশ। দু’জন চৌকিদার যারা ডাক্তারবাবুকে চেনে, তাদের একজন ভেতরে গিয়ে খবরটা দিয়েছিল।

তিরিশ মিনিট পরে ডাক এল।

আরামকেদারায় বসে আছেন বড়সাহেব। পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বন্দুকধারী। ম্যানেজার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে? ওখানে কি অসুবিধে হয়েছে?”

“অসুবিধে হয়নি কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব বেড়ে যাওয়ায় থাকাটা নিরাপদ নয়,” বললেন ওখানকার প্রশাসক।

“যাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে তাদের দেখা পেয়েছ?”

“হ্যাঁ স্যার। আমার সঙ্গে যারা গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ওদের কোনও মিল নেই। ভাষাও বদলে গিয়েছে।”

“তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওখান থেকে দু’জনকে এখানে নিয়ে আসতে। তার বদলে যাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে, তাদের একজনকে শুনলাম ফেরত আনোনি। এর কী ব্যাখ্যা দেবে?”

“সে নিজে থেকেই সেখানে থাকতে চেয়েছে, আমি নিষেধ করিনি,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ওদের ওখানে নিয়ে গিয়ে বিশেষ একটা কাজ করিয়ে আনা। তুমি দায়িত্ব পালন করোনি। তোমার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ আছে। তোমাকে সেই কারণে আপাতত সাসপেন্ড করলাম। তোমার সম্পর্কে এনকোয়ারি শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তুমি বাগানে ঢুকবে না। তুমি এই জেলার বাইরেও যাবে না,” বড়সাহেব এমনভাবে হাত নাড়লেন যেন তিনি শার্টে লাগা ময়লা সরাচ্ছেন।

বাইরে এসে নদীর পাশে দাঁড়িয়ে একটু ভাবলেন ডাক্তারবাবু। কিছুদিন ধরে তাঁর স্ত্রী বলছিলেন চাকরি থাকতে থাকতে চা-বাগানের বাইরে একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে। অবসরের পর সেখানে থাকা যাবে। বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিনি অলস হয়ে ছিলেন। বাড়ি করে রাখলে এখন সেখানে যাওয়া যেত! আপাতত তাঁর মনে হল স্ত্রীর সন্ধানে যাওয়াই প্রথম কাজ। তিনি হাঁটা শুরু করলেন।

একপাশে কুলিলাইন, অন্যপাশে ছোট্ট নদী, ডাক্তারবাবু হাঁটতে হাঁটতে চিৎকারটা শুনতে পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হলেন। পুষি দৌড়োতে দৌড়োতে এগিয়ে আসছে। সামনে পৌঁছে পুষি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আপনি তাড়াতাড়ি আসুন। ছেলেটার পেটে গুলি লেগেছে।”

“কোন ছেলে? কে গুলি করেছে?”

“আর কে!” খুব বিরক্ত হল পুষি, “তাড়াতাড়ি চলুন। এখন তো যারা স্বাধীনতা দেবে না, তারা গুলি করে মারে আর যাহা স্বাধীনতা চায়, তারা গুলি খেয়ে মরে। তাড়াতাড়ি চলুন,” ব্যস্ত হয়ে হাত নাড়ল পুষি।

ডাক্তারবাবু অনুসরণ করলেন। পুষির দ্রুত চলার সঙ্গে তাল রাখতে হচ্ছিল তাঁকে। হঠাৎ মনে হল, ওদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান দেখাতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এখন পুষি তাঁকে পথ চেনাচ্ছে।

হঠাৎ বহু দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকার কানে এল। আরও একটু এগোলে শব্দগুলো স্পষ্ট হল, ‘ভারতমাতা কি জয়!’ অনেকগুলো কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে।

একটা ভাঙা খড়ের ঘরের মধ্যে ঢুকে পুষি থমকে দাঁড়াল। ঘরে একটি লোক শুয়ে আছে। একটি কিশোর তার পাশে বসে। ডাক্তারবাবু লোকটির পাশে বসে নাড়ি দেখলেন। শরীর প্রাণহীন।

ওপাশের চিৎকার করা লোকগুলো কাছাকাছি এসে গেছে। আচমকা গলার শিরা ফুলিয়ে পুষি চিৎকার করে উঠল, ‘ভারতমাতা কি জয়!’ কিশোর সশব্দে কেঁদে উঠল।

ডাক্তারবাবু অতীত এবং আগামীকালকে দু’হাতে ধরে রাখলেন। শক্ত করে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *