ছায়া দেবনাথের গবেষণা, কেস নং ৯
রোগীর নিজের জবানিতে জীবনের যেটি শ্রেষ্ঠ পর্ব সেখানে দেখি তার প্রতিপত্তি ও ক্রিয়াকলাপ প্রচুর। তা সত্ত্বেও মানুষটা ব্যক্তি হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কগুলি সবই গোলমেলে। যদিও পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান–সচরাচর মায়ের প্রিয় তবু মাতৃস্মৃতি অতি ভাসাভাসা। বরং মৈত্রেয়ীকে অনেকটা সে ভূমিকায় দেখা যায়। আর বাবা তো বিরুদ্ধপক্ষ। মজা হল যে মৈত্রেয়ীর জন্য বাহ্যত তার পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তার সঙ্গে সম্পর্কেও রয়েছে মস্ত ফাঁক। রোগী কখনওই এই ফাঁকটির উৎস বিশ্লেষণে যায় না। তার অন্য নারীসম্ভোগ, মৈত্রেয়ীর প্রতি নিষ্ঠার অভাব শুধু একটি দুটি লাইনে স্বীকারোক্তি। যেন কত স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত। বিস্তৃত বিবরণ নেই। কার কার সঙ্গে ঠিক কেমন ও কতদুর ঘনিষ্ঠতা। প্রতিক্ষেত্রেই কি শুধু হরমোনউদ্দীপিত উদগিরণ—নাকি তার উর্ধ্বে আর কিছু। সাদা বাংলায় অন্য কারো সঙ্গে ভালবাসাবাসি হয়েছিল কি না। এ সব প্রশ্নের ধারেকাছেই রোগী যায় না।
মৈত্রেয়ীর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? ঠিক কী ধরনের অনুভূতি বা বাধ্যবাধকতায় সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে অমলকুমারের ঘনিষ্ঠতা হতে দিত? ব্যাপারগুলো বাস্তবে কি একই বাড়িতে, এক ছাদের তলায়, নাকি একেবারে একই শয্যায় ঘটত? কোনটা স্বাভাবিক ব্যবহার কতটা অন্যরকম হলে বিচ্যুতি অস্বাভাবিকত্ব অসুস্থতার পর্যায়ে পড়ে? পৌরাণিক যুগে কুষ্ঠরোগগ্রস্ত স্বামীকে স্ত্রীর বেশ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া সতীত্বের পরাকাষ্ঠা ছিল, বিকারের প্রশ্ন ওঠেনি। তাহলে কি সুস্থ অসুস্থ স্বাভাবিক অস্বাভাবিক পরস্পর বিরোধী নয়? যে কোনও মূল্যবোধ একান্তভাবে স্থান-কাল-পাত্র নির্ভর? চিরন্তন বিশ্বজনীন মানদণ্ড বলে কিছুই নেই।
সভ্যতায়, মানুষের আস্থা বজায় রাখা মনোবিজ্ঞানীর পক্ষে বড় শক্ত।
.
ছায়া দেবনাথকে তো সব কথা বলা যায় না। আমাদের দেশে সাক্ষাৎকার কথোপকথন অমুকের সঙ্গে কিছুক্ষণ, তমুকের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা, সবই বাঁধাধরা গৎ। পাবলিকের জন্য। আমাদের ছোটবেলায় দেখা হিন্দি সিনেমায় নায়িকাদের বুকের আঁচল—আধখানা ঢাকা। আধখানা বের করা। ঠিক যতটুকু দেখাতে চাই ততটুকু দেখাই। সাজিয়ে গুজিয়ে ওপরে তুলে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু চোখা একটু বেশি নিটোল। সেটাই জীবন বা বাস্তব নামে চলে। একবার ট্রেনজার্নিতে হুইলারের স্টল থেকে দমিনিক লাপিয়েরের সিটি অফ জয় কিনে পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। হাওড়ার একবস্তিতে একজন সাহেবের বসবাসের অভিজ্ঞতা (এর থেকে কলকাতাকে কেন সিটি অফ জয় বলে বুঝতে পারি না, ঘটনাতো হাওড়ায়)। এটি পড়তে পড়তে প্রচুর জ্ঞানলাভ হল যেমন বস্তির অতটুকু ঘরে গাদাগাদি স্ত্রী-পুরুষ ছেলেমেয়েদের পারিবারিক জীবন প্রায় আদর্শ স্থানীয়। শিশুশ্রম নির্ভর বাবা-মা নেই, বদ্ধমাতাল, বেকার স্বামী বা বাপ নেই, নেই হিংসা জবরদস্তি নিষিদ্ধসম্পর্কে গমন। বড়জোর স্বামীটি বাইরে থেকে যৌনরোগ বয়ে আনে–সেটা ফরাসি লেখকের কাছে হাম বা চিকেন পক্সের সমগোত্রীয়। নৈতিকতা বা শরীরের শুদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কবর্জিত।
পড়তে পড়তে মনে হল গরিব হলেই যদি এমন পবিত্র সুসভ্য জীবন যেখানে একমাত্র সমস্যা খাটা কল-পায়খানা আর দেশে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাহলে সবাই গরিব হয়ে যাই না কেন? তাদের উন্নতিবিধান তো একেবারে উচিত হয়। অবস্থা ভাল হলে, তথাকথিত আধুনিক এবং যন্ত্র সভ্যতার সংস্পর্শে এলে তারা তো সব আমাদের মতো এক একটি হারামি হয়ে যাবে। একেই বলা হয় বাস্তবচিত্র! লেখকের দায়বোধ, সামাজিক দায়িত্বপালন ইত্যাদি ইত্যাদি। বাইরের লোকের কাছে আমাদের দেশে কোন্ মেয়েপুরুষ তাদের ঘরের কথা, বিছানার কথা মনের কথা প্রকাশ করে? কোন্ সাহেব বুঝতে পারবে তৃতীয়বিশ্বের বস্তিতে পাঁচবছরের মেয়ের মুখে ভাষা মানে খিস্তি? একদিকে পিছিয়ে পড়া মানুষের করুণা আর ভিক্ষা আদায়ের ধান্দা, অন্যদিকে সাহেব তথা লেখকের মাহাত্ম প্রচার। নিপীড়িত নিষ্পেষিত শহীদ হয় মধ্যবিত্ত লেখনীতে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দোভাষীর কাজ সম্মানজনক। সিনেমা-টিভি গল্প উপন্যাস সর্বত্র শোষিত গরিব নারী ও এদের দুঃখ-দুর্দশা নির্যাতন সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয়বস্তু। সত্যিকথা বলতে কেউ রাজি নয়। বাঙালি জাতটা যে পচে গলে গেছে সাহিত্যই তার প্রমাণ।
তবে আমিও বাঙালি। পুরো সত্যি বলব কেন। এই যে মৈত্রেয়ীকে আমি একটা মাদারফিগার হিসেবে দেখাতে চাইছি সেটা তো অর্ধসত্য মাত্র এবং যে কোনও অর্ধসত্যের মতো মিথ্যার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। মৈত্রেয়ীর অপার ঔদার্য অবাধ প্রশ্রয় যা অনেকটাই মাতৃসুলভ এবং বাঙালি লেখকের মাপকাঠিতে নারীত্বের মহিমায় ভূষিত এবং যা আমাকে বরাবর ক্ষিপ্ত করেছে, নীচে নামিয়েছে, তাই কি আমার প্রতি মৈত্রেয়ীর মনোভাবের সম্পূর্ণ পরিচয়? তার মধ্যে কি প্রেয়সী রমণীর অভিমান অন্তর্বেদনা কিছুই কখনও ছিল না?
সেই যে বিজয়া সম্মিলনীটা। কবে যেন, কোন্ সালে। সন তারিখ কিছুতেই মনে পড়ে। সেবারে পুজোতে একর বেশিরভাগ সদস্য বাইরে গিয়েছিল। লক্ষ্মীপুজো পার করে ফিরেছে। কোনও অনুষ্ঠানের প্ল্যানট্যান নেই। তবু কিছু তো করতে হবে। শেষে একটা গেট-টুগেদার ঠিক হল। ওবেরয় ভুবনেশ্বরে সুইমিং পুলের পাশে পানভোজন। ডিনারের জন্য যথারীতি চাদা, ড্রিংকে লাগবে কুপন। যেমনটি আমাদের অন্যান্যবার হোটলে গেট-টুগেদার হত। সেবারে পুজো দেরিতে ছিল। সন্ধেবেলা বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা। সুইমিংপুল এর ধারে বসার ব্যবস্থা। এক কোণে মিউজিক। হিন্দি ঝম্পর-ঝম্পর ছাড়া তো একতা র পার্টি ভাবা যায় না। দু-এক রাউন্ড ড্রিংকের পর প্রথমে বাচ্চা ও টিনএজার ছেলেমেয়েরা ও তারপর তাদের বাবামা-রা একে একে নাচতে উঠে গেল।
মৈত্রেয়ী অন্য সব পার্টিতে প্রথম থেকে শেষ অবধি ফ্লোর মাতিয়ে রাখে। ওর সঙ্গে দমে আমি তো ছাড় আমাদের হাঁটুর বয়সি রবিন সাহাও পারে না (যদিও রবিন ফ্রিস্টাইল নাচে এমনই ওস্তাদ যে শোনা যায় তার শরীরে হাড়গোড় নেই এবং তাই তার একতাদত্ত নাম রবার সাহা। ) মৈত্রেয়ী শুধু নিজেই নাচে না অন্যান্য মেম্বারদের, তাদের বউদেরও টেনেটেনে নাচতে নামায়। আজকে সেই মৈত্রেয়ী দায়সারাভাবে গা-হাত-পা দুলিয়ে দু চারবার নদের নিমাই পোজ দিয়ে ফ্লোর থেকে হাওয়া।
দেখি আধো-অন্ধকারে জলের ধারে টেবিলে বসে। মুখোমুখি বরুণদা। অর্থাৎ বরুণ সেন, ক্লাবের অন্যতম অ্যাডভাইসার, সে সময় ওড়িশা রাজ্যের অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। আমাদের থেকে একটু বয়সে বড়, হুল্লোড়-টুল্লোড়ে খুব একটা থাকেন না, তবে অন্যরা এনজয় করলে মাইন্ড করেন না। ফ্লোরে নিয়মরক্ষার জন্য ঘুরেও যান আমরা ওঁকে একটু সমীহ করি। বয়স ও পদমর্যাদার ভার তো আছেই। তার সঙ্গে আজ পুরো সন্ধেটা মৈত্রেয়ী বসে। আর একটার পর একটা হুইস্কি সাঁটিয়ে যাচ্ছে। আমার দেখে তো বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। এত তো ও সাধারণত খায় না। ফ্লোর থেকে কেটে পড়ে দু-চারবার কাছাকাছি ঘুরঘুর করছি। মৈত্রেয়ী নিজের মনে কী বলে যাচ্ছে–মঞ্চে স্বগতোক্তির মতো অর্থাৎ অন্যে যাতে শুনতে পায়। বরুণদা বিপন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। টুকরো টুকরো কথা যা কানে এল তাতে বোঝা গেল প্রেমের ওপর মৈত্রেয়ীর বক্তৃতা। নরনারীর সম্পর্কে নারী সর্বদা হেরো পার্টি। পৃথিবীর সব অল্পবয়সি তরুণী যে দ্বন্দ্বে তার প্রতিযোগী তাতে যুঝবার মতো কী বা অস্ত্র তার আছে। পুরুষের নাকি মন বলে কিছু নেই। আছে শুধুইয়ে। বরুণদার যথাবিহিত সানাদান রবি ঠাকুর আওড়ানো। ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না ওকে ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও।
লে হালুয়া। শেষকালে অমলকুমার দাস যে একসময় বাংলা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারত না যার সস করে কথা মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী লেগে লেগে প্রায় শুধরেছে তার হেপা সামলাতে কিনা আশ্রয় নিতে হয় সেই দাড়ির আলখাল্লায়। মৈত্রেয়ীও পাল্লা দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গ ীতের দু-চারটে কলি ফিট করে দিল। এদিকে একটার পর একটা হুইস্কি চার্জ। শেষে ফ্ল্যাট। তখন এই দশাসই লাস কে সামলায়। বরুণদা তো রাত এগারোটার বেশি কোনও পাটিতে থাকেন। তিনি তারটাইমমতো এজিট নিলেন। আর আমিরাত সাড়ে বারোটায় ওবেরয়ের দুজন বেয়ারাকে মোটা টিপসের লোভ দেখিয়ে ধরাধরি করে বডি গাড়িতে তোলালাম। ভয়ঙ্কর রাগ হয়ে গিয়েছিল। ওবেরয়-এর ম্যানেজমেন্টের কাছে আমার প্রেস্টিজ কী রইল। এর পরে একতার কোনও পার্টি এখানে এমন কম রেটে এত সেশানে করা যাবে?
আচ্ছা আমার রাগটা কি শুধু এই কারণেই?নাকি সেদিনের পার্টিতে আরেকজন অতিথির উপস্থিতি? মৈত্রেয়ীর ওই নারী সংগঠন মার্কা শোষিত বঞ্চিত ভূমিকা অভিনয়ের অপর দর্শক ওড়িশা সরকারের ডিরেক্টর অফ কালচার অনিলেন্দুপট্টনায়েক। সেরাতে সর্বভারতীয় একতার একমাত্র ভারতীয় অতিথি। ওড়িশায় দীর্ঘ বারো বছরের জীবনে স্থানীয় যে কজনের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল অনিলে তাদের মধ্যে প্রধান। বলতে গেলে প্রায় বন্ধু। এখনও মনের পর্দায় ভাসে তার সঙ্গে প্রথম আলাপের দৃশ্য।
সেক্রেটারিয়েটে গিয়েছিলাম কাজে। ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট-এ। অভ্যাসমতো কালচার অ্যান্ড ইনফরমেশানে ফুঁ মারতে উপস্থিত। শুনলাম নতুন ডিরেক্টর এসেছেন। ডঃ অনিলেন্দু পট্টনায়েক। তখন বেলা চারটে বেজে গেছে। সেকশানে কেরানিবাবুরা উসখুস করছে। কত তাড়াতাড়ি কাটা যায়। প্রাইভেট সেক্রেটারিকে ভাইদাদা সম্বোধনে ভিজিয়ে একতার আগামী অনুষ্ঠানে ফ্রি পাস দেবার প্রতিশ্রুতির পর নতুন বড় সাহেবের ঘরে প্রবেশাধিকার লাভ। নমস্কার ইত্যাদির পালা শেষ করে সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন একতার মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করছি। এমন সময় পিএ বাবুর প্রবেশ ও সবিনয়ে খবর পরিবেশন, ড্রাইভার অক্ষয় জানাচ্ছে গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছে। একটু গ্যারেজে দেখিয়ে আনতে হবে। ঘড়ি দেখে বিরক্ত মুখে অনিলেন্দু বলেন,
—এই তো ঝামেলা হল। সাড়ে চারটে বেজে গেছে। এখন গ্যারেজে নিলে কখন ফিরবে কে জানে। এদের তো সময়জ্ঞান নেই। ওদিকে জি এ ডির লোক অপেক্ষা করে থাকবে।
—কোথাও যাওয়ার কথা, স্যার? প্রশ্ন করি।
—আর বলেন কেন। নতুন একটা কোয়ার্টার অ্যালটেড হয়েছে। সেটা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল।
অমলকুমার দাস বরাবর ভাল ফিল্ডার, সামনে বল আসতে না আসতে লুফে নেয়।
—চলুন না স্যার আমার সঙ্গে। আমার গাড়িতে আছে। বাড়ি দেখা হয়ে গেলে যেখানে বলবেন ড্রপ করে দেব।
–বলছেন? তা বেশ। দুরঅবশ্য নয় এইসচিবালয় মার্গ দিয়ে ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের মোড় পেরিয়ে কটা বাড়ি পরেই। জি (জেনারেল) এ (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ডি (ডিপার্টমেন্ট) ওপি (পাবলিক) ডবলিউ (ওয়ার্কস) ডি (ডিপার্টমেন্ট) দুটোর লোকই মাথা খেয়ে ফেলছে বাড়িটা একবার দেখে আসতে। আজকে ওরা চাবি নিয়ে থাকবে পাঁচটার সময়।
গাড়িতে যেতে যেতে কথাবার্তা। এই কোয়ার্টারটি পাওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন অনিলেন্দু। সচিবালয় মার্গের ওপর টাইপ সিক্স বাড়ি ওঁর মতো স্টেট সার্ভিসের অফিসার বছর কুড়ি সিনিয়রিটিতে পায়ই না। ভাগ্যবশত ঠিক আগের বাসিন্দা ছিলেন এক ডেপুটি মিনিস্টার যিনি ক মাস হল নির্বাচনে হেরে গেছেন। ফলে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। এস্টেট অফিসার যাঁর হাতে ভুবনেশ্বরে সব সরকারি বাসস্থান, তিনি আবার অনিলের গাঁয়ের লোক। সেই জন্যই আউট অফ টার্ন অ্যালটমেন্ট করানো গেছে।
আসলে বাড়িটার ওপর অনিলেন্দুর বরাবর নজর। বেশ কবছর আগে বাড়িটাতে ছিলেন অনিলেন্দুর দাদা (না নিজের নয় জ্যাঠতুতো, নিজের জ্যাঠা নয় অবশ্য বাবার মাসতুতো ভাই) প্রিয়রঞ্জন পট্টনায়েক আই এ এস। সে সময় অনিলেন্দু অনেকবার বাড়িটিতে গেছেন। দেখেছেন কী অপূর্ব কোয়ার্টারটি। একটা বাড়তি অফিস রুম পর্যন্ত আছে, কোনও প্রাক্তন তালেবর বাসিন্দা পি ডবলিউ ডিকে ম্যানেজ করে তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়ি যখন ছাড়লেন ঘরখানা তো সঙ্গে যায়নি। পরবর্তী বাসিন্দার ভোগে লেগেছে। তাছাড়া ভুবনেশ্বরের শুকনো লাল মাটিতে ভদ্রলোক দূর থেকে প্রচুর ভাল মাটি ট্রাক বোঝাই করে এনে ফেলেছিলেন বাড়িটার সামনে পিছনে বিরাট জমিতে। গাছগাছালি ফুলফলশাকসবজি কী নেই সেখানে। অনিলেন্দু সোৎসাহে বর্ণনা করে যান, তাঁর ভাউজঅর্থাৎবউদির লক্ষ্মীমন্ত ভাড়ার সারি সারি লম্বাবেঁটে মাঝারি প্রচুর চ্যাপটা পেট মোটা সব রকম বোতল ভর্তি জ্যাম জেলি, গাছের আম, গাছের পেয়ারা থেকে। বড় বড় বয়মে তেঁতুল কঁচা আমের আচার। একেবারে দোকানের মতো টোমাটো সস কেচাপ। আমি শুনতে শুনতে মোহিত।
—আপনার ভাউজ তো দারুণ গিন্নি। খুব কাজের বলতে হবে। আমাদের বাঙালি সমাজে উচ্চমধ্যবিত্ত তো দুরের কথা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের গিন্নিরাও আজকাল ওসব বাড়িতে করার কথা ভাবতেই পারেন না। আমাদের মা-দিদিমার সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে ওসব করা-টরা।
-আরে আমার ভাউজ কি ভাবছেন মা-দিদিমার মতো বাড়িতে করেন? দূর। বড় বড় অফিসারদের সংসারের ধরনই আলাদা। গণ্ডা গণ্ডা কাজের লোক, সব সরকারি পয়সায়। পিয়ন অর্ডারলি মালি ড্রাইভার। দু-পা গেলে বিল্ডিং মারকেটের উল্টো দিকে, গভর্মেন্টের ফুড প্রসেসিং সেন্টার। সেখানে আমপেয়ারা তেঁতুল টমাটো সব নিয়ে যাও, সঙ্গে বোতল চিনি তেলমশলা। নামমাত্র চার্জে একদিনের মধ্যে রেডি। প্রিজারভেটিভ সেন্টারই দিয়ে দেয়। তারপর সারা বছর ধরে খাও।
–বাঃ দিব্যি সিসটেম তো আপনাদের। সরকার তো অনেক সুবিধা দেয় দেখছি এখানে। খুব ভিড় হয় নিশ্চয়?
–না না, ভিড় কোত্থেকে হবে। ওই তো দুচারটে বড় অফিসারদের লোক আর এক আধজন ছুটকে পাবলিক। এই দৈনিক কোটা।
—সে কি। আশ্চর্য! পাবলিকের উৎসাহ নেই?
–উৎসাহ থাকলেই বা কি। কজনের বাড়িতে এত কাজের লোক আছে যে একজনকে সারাদিন সেন্টারে আম টাম দিয়ে বসিয়ে রাখা চলে? কজনের বাড়িতে চাকরের জন্য ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা আছে? বড় অফিসারদের তো সরকারের দৌলতে অর্ডারলি পিয়নদের নামে একটি করে সাইকেল ইস্যু করিয়ে নেওয়ার সুবিধা আছে। ভুবনেশ্বরে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তো নেই বললেই চলে। তাই সাধারণ মধ্যবিত্ত গিন্নিরা ইচ্ছে বা সময় থাকলেও এখানে এসে কিছু করিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। কাজেই শেষমেষ আই এ এসদেরই ভোগে লাগে।
আমি চুপ করে থাকি। এই স্টেটে আসা থেকে দেখছি এক অদ্ভুত আই এ এস ম্যানিয়া। কলকাতায় আমি একজন আই এ এসকেও চিনি না। আমার গুষ্টিতে কেউ কখনও চিনত না। তারা কারা কোথায় কেমন থাকেন সে বিষয়ে জীবনে কাউকে এতটুকু উৎসাহ প্রকাশ করতে দেখি না। হ্যাঁ, তারা আছেন যেমন আর পাঁচটা চাকুরে থাকে। সচ্ছল বাঙালি মানে ব্যবসায়ী, বড় ব্যারিস্টার, বড় সার্জন। তাদের আর্থিক সাফল্যের ধারেকাছে কোনও চাকুরে আসেনা। ওড়িশাতে এসে দেখি বেশির ভাগের ধারনায় জীবনের সবকিছুর মাপকাঠি এবং সর্ববিধ সুবিধাভোগী আই এ এসরা। আমি কিছু মাথামুণ্ডু বুঝি না। বা বলা উচিত প্রথম প্রথম বুঝতাম না।
কথাবার্তা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম। গেটের সামনে হর্ন দিতেই বাগান পেরিয়ে বাড়ির পোর্টিকো থেকে জি-এডির লোক দৌড়ে এসে গেটটা খুলে দিল। অনিলেন্দু ও আমি নামি। কই চারিদিক তেমন সবুজ তো নয়। বরং কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া। এ রাস্তায় প্রতি বাড়িতে গাড়ি বারান্দার সামনে গোল লন চারিপাশে সুন্দর সমান করে ছাঁটা খয়েরি বা সাদাটে সবুজ হেজ অর্থাৎ বেড়ার গাছ। এখানে তো স্রেফ মাঠ তাও খাবলা খাবলা মাটি বেড়িয়ে আছে। হেজ-এর শক্তপোক্ত গাছগুলো পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। বাকিটা এলোমেলো যদৃচ্ছ বেড়ে থাকা আগাছায় ভর্তি। বাড়ির পাকা ছাদের ওপর একসময় সুন্দর ফলস্ খড়ের চাল ছিল–ভুবনেশ্বরের প্রচণ্ড গরম ঠেকাবার জন্য অতি কার্যকরী দিশি কৌশল। খড় পচে শুকিয়ে ঝরে গেছে। ভেতরে কাঠামোটা ন্যাড়া দাঁড়িয়ে। এখানে ওখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া খড় লেগে। অন্যান্য বাড়িতে গাড়িবারান্দাই দুদিক লতায় ছাওয়া। গোল্ডেন শাওয়ার বা হাল্কা সবুজের ভিতর রাশি রাশি গোলাপি সাদা মাধবীলতার গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। অতিথিকেরঙিন অভ্যর্থনা। দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। এখানে সব বর্ণহীন, শুন্য। গাড়িবারান্দার বাঁদিকের থামের এককোণে মাটিতে বাদামি গুঁড়ির মতো কী একটা জেগে আছে। অনিলেন্দু যেন কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন। এদিক ওদিক তাকান। কয়েক পা ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে আসেন। তারপর জিএড়ির লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেন।
—আরে সে সব গাছপালা ফুল-টুল সব কই? বাঁদিকে কোণে ভাইনা-র শখের রোজারিয়াম ছিল। স্পষ্ট মনে আছে। কত রঙের গোলাপ হত, খয়েরি, লাল, গাঢ় গোলাপি, কমলা, হাল্কা গোলাপি, হলুদ, সাদা। একটাও তো দেখছি না। অন্য দিকটায় ছিল সব ঝোঁপের গাছ। রঙ্গন-জবা-মর্নিংগ্লোরি। তাও সব কত রঙের। গোলাপি রঙ্গন পর্যন্ত ছিল। আর জবাতো অসংখ্য জাতের, কোনওটা লাল, কোনওটা গোলাপি, লংকা জবা থেকে পঞ্চমুখী সব। ওই তো কয়েকটা রয়েছে দেখছি। কিন্তু এ কী অবস্থা গাছগুলোর, ক্ষয়া মরা যেন কতকাল যত্ন হয়নি। ঝাড়াবাছাকাটা নেই। জলও পায়নি। এই তো পরগাছা জুটে গেছে। ডান দিকে বিশাল কালো জাম গাছটা এমন ছোট হয়ে গেল কী করে? ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল না কি? বাঁ দিকে চার-পাঁচটা পেয়ারা গাছ ছিল। মাটিতে গড়াগড়ি খেত পাকাঁপাকা পেয়ারা, এত ফলন। পাখির মেলা বসে যেত মরসুমে। ঐ যে আধখাচড়া ন্যাড়া ডালগুলো, ওগুলো কি কোনও পেয়ারা গাছনা কি? পেছন দিকে মস্ত তেঁতুল গাছ ছিল এজি কোয়ার্টার ঘেঁষে। হ্যাঁ। ঐ যে আধকাটা গাছটা কি? এ পাশে ডালিম গাছ ছিল একটা তার তো চিহ্নমাত্র নেই। পশ্চিমদিকে আমকাঁঠাল গাছগুলোর এরকম হাল কী করে হল? ওই যে ফাঁকা জায়গাটা ওখানে তো একটা বেশ ঝাকড়া পাতিলেবুর গাছ ছিল, আর একটু দূরে গোটা দুয়েক আতা গাছ। খুব বড় সাইজের আতা হত না কিন্তু খাওয়া যেত। ডালিম গাছটা ফুলে ফুলে চমৎকার দেখাত। ফল অবশ্য বিশেষ হত না। এই এতটুকু হয়ে ঝরে যেত। এত সব গাছ গেল কোথায়?
—গাছ কি আর স্যার আছে, সব ভেঙেচুরে কেটেকুটে শেষ। সখেদে উত্তর। আমি আর অনিলেন্দু এক সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠি।
—সে কি! এত ভাল ভাল ফলন্ত গাছ কেটেকুটে শেষ! ভ্যালিজম। ক্রাইম।
—আর কী আশা করেন স্যার। যারা এ বাড়িতে ছিল তারা কি আপনাদের মতো ভদ্র শিক্ষিত। যতসব অসভ্য জংলি। যারা চোদ্দো পুরুষ একটা গোলাপ গাছ লাগায়নি, একটা পেয়ারা কি আতার যত্ন নিতে শেখেনি, এতরকম ফল যে আছে তাই তারা কস্মিনকালে জানত না। বনের মধ্যে দুচারুট বুনোআমলা কি কচি গাব খালি দেখেছে, পেড়ে খেয়েছে, চাষবাস তো যেটুকু নেহাত না করলে নয়–কোনওক্রমে দুটো মোটা ধান জোয়ার কি এক আধটুকু তামাক, লংকা, হলুদ, ফলের মধ্যে কালো বুনো কমলা। কেমন করে ভাল চাষ হয়, রকমারি শাকসবজি ফলমূল করা যায় তা নিয়ে কখনও চিন্তা করেছে? ভাবনা চিন্তার তো ধারই ধারে না। এদের জীবনে খালি ওই নামমাত্র চাষ, শিকার মদ আর ফুর্তি।
–সেটা জঙ্গলে চলতে পারে। কিন্তু এটা তো ডেপুটি মিনিস্টারের বাড়ি। না বলে পারি না।
–কী আমার মিনিস্টার। মুখ ভেংচাল জিডির লোকটি। মিনিস্টার হোক আর অফিসারই হোক, আদিবাসী আদিবাসীই। তাছাড়া মিনিস্টার তো কোয়ার্টারে থাকতেনই না। শুধু অ্যাসেম্বলি সেশান চলার সময় আসতেন। এ বাড়িটা কনস্টিটিউন্সির লোকেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জনগণের হাতে পড়লে কী হয় জানেনই তো স্যার। তার ওপর আবার আমার মতো সাধারণ বামুন করণ খয়েৎ জনগণ নয়। আদিবাসী জনগণ। চলুন স্যার ভেতরে চলুন। দেখুন একবার এদের কীর্তিটা।
ততক্ষণে আমি বেশ ঘাবড়ে গেছি। অনিলেন্দুর মুখ দেখে মনে হল তারও অবস্থা তথৈবচ। জিডি-র লোকটির পেছন পেছন গাড়ি বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে লম্বাটানা খোলা বারান্দায় উঠি। সারি দিয়ে পরপর ঘর, সবকটির দরজা খোলে বারান্দার দিকে। স্পষ্টত ইটকাঠ সিমেন্টের এই সাবমেরিনটা যে স্থপতির নকশা তার অভিধানে নিরাপত্তা কথাটা ছিল না। তবে বাড়িটির স্থাপত্যের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া সম্ভব হল না। কারণ ঘরে ঢুকতে প্রবল প্রচণ্ড দুর্গন্ধে যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। চারিদিকে ছড়ানো মানুষের শরীরের সর্ববিধ ক্লেদ ময়লা আবর্জনার স্তূপ। খাওয়ার উচ্ছিষ্ট। মাছের আঁশ-মাংসের হাড়, কাঁচা তরিতরকারির পচাগলা অবশিষ্ট কী নেই। দেওয়ালে ছাপ ছাপ নোংরা দাগ, ঝুল ছাদের সব কোণে। কোনওক্রমে ঘরটা পেরিয়ে দরজা দিয়ে পিছনের বারান্দায় পৌঁছই। না একই দৃশ্য। এখানে মেঝেও খোঁড়া। মাঝেমাঝে ভাঙা। বাঁদিকে ইংরিজি এল অক্ষরটির আকৃতিতে বাড়িটির আরেকটি শাখা। রান্নাভাড়ার ইত্যাদি। দেওয়াল ছাদ লেপা কাঠের আগুনে রান্নার ঘন কালি। সামনে বিরাট বাঁধানো উঠোনে জায়গায় জায়গায় খোবলানো গর্ত। ইট দিয়ে উনোন করার চেষ্টা। ছাই গাদা হয়ে পড়ে আছে।
—ওখানে কী হত জানেন স্যার? একগাল হেসে জিএডির লোকটির প্রশ্ন এবং উত্তর,
—মদ রাঁধা হত।
—মদ আবার রাঁধা হয় নাকি। এত দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসা সত্ত্বেও অবাক হয়ে প্রশ্ন করি। অনিলেন্দু উত্তর দিল,
—ওই মদ তৈরিকেই এখানে মদরাধা বলে। ওটা তো আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অঙ্গ।
—শুধু কি আদিবাসীদের জন্য হত ভাবছেন নাকি স্যার? মোটেই না। এ বাড়িটাতো চুন্নুর আজ্ঞা ছিল। যতসব গুণ্ডা বদমাস, বাজারি লোক, নষ্ট মেয়ে
–থাক থাক হয়েছে, খুব বুঝতে পেরেছি। অনিলের মুখ বিতৃষ্ণা ঘৃণায় বিকৃত।
কোনওক্রমে নাক-চোখ-মুখ বুজে বেরিয়ে আসি দুজনে। নির্বিকার জিএডি প্রতিভূ বলে,
–এইজন্যই স্যার ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছিল আপনি নিজে এসে একবার বাড়ির অবস্থাটা দেখুন। জানেন তো তরুণ মহান্তি, সেক্রেটারি ইন্ডাস্ট্রিজকে বাড়িটা অ্যালফ্ট করা হয়েছিল? ওঁর মিসেস বাড়ি দেখতে এসে বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনি তো আর বাড়িটা নিলেন না। আই এ এসরা কেউ নিতে রাজি নয়। তাই তো স্যার আপনাকে দেওয়া হল। সাধারণ লোকেদের কী অসাধারণ চিমটিকাটার ক্ষমতা। আড়চোখে দেখি অনিলেন্দুর মুখ থমথমে।
—আমিও নেব না। এ বাড়ি পরিষ্কার ও মেরামত করতে যে টাকা দরকার তা কবে পি ডবলিউ ডি দেবে, কাজ হবে তারপর আমি ঢুকতে পারব কে জানে। একগাল হেসে সরকারের প্রতিনিধি মন্তব্য করে,
—সেতো নিশ্চয়ই সার। তাছাড়া স্ত্রীপুত্র নিয়ে সংসার করেন। ঘরে ঠাকুরদেবতা আছেন নিশ্চয়ই। এ বাড়িতে পোষায়। সেই ভাল স্যার, আপনি মানা করে দিন। তারপর ডিপার্টমেন্ট মিউনিসিপ্যালিটিকে খবর দিয়ে পরিষ্কার টরিষ্কার করুক।
গাড়িতে উঠে বড় খারাপ লাগল। সত্যি ভদ্রলোক বড় আশা করে এসেছিলেন। আর এমন একটা কদর্য অভিজ্ঞতা হল। আস্তে করে বলি,
—চলুন স্যার আমার বাড়ি। একটু হাতমুখ ধুয়ে চা-টা খাবেন। ফ্রেশ হয়ে তারপর বাড়ি যাবেন খন। আমার গাড়ি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে। অনিলেন্দু ক্লান্ত ভঙ্গিতে সায় দেন। দুজনেই চুপ। সচিবালয় মার্গ দিয়ে উত্তরদিকে চলছে গাড়ি। চওড়া রাস্তা। দুদিকে বিশাল বিশাল ঝকড়া গাছের সারি। কী নাম সব কে জানে। পড়ন্ত রোদ প্রত্যেকটির সবুজ সম্ভার ঝলমল করছে। কোথাও ঘন কালচে-সবুজ কোথাও বা হাল্কা-সাদাটে। আবার কেউ বা কচি কলাপাতা। সবুজের কত রকমফের। বড় বড় অফিস বাড়ি, অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল, সেক্রেটারিয়েট, স্টেট আরকাইভ। প্রতিটি বাড়ির সামনে বিস্তৃত সবুজ ঘাসের লন। এই গরমেও ফুল ফুটে আছে। হাল্কা গোলাপি সাদা। কী বলে ওগুলোকে পিটুনিয়া বা বেগগানিয়া। দেবদারুর সারি। সত্যনগরের দিকে চলেছি। অনিলেন্দু আস্তে আস্তে মুখ খোলেন।
–বুঝলেন, মিঃ দাস, এই হচ্ছে আমাদের দেশ। আমরা দু-চারজন এডুকেটেড হাইকাস্ট, বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত যা একটু গড়তে চেষ্টা করি একফালি গোলাপবাগান একটা মাধবীলতা, দুটো আমকাঠালের গাছ, সব ধ্বংস করে দেয় বর্বরের দল। তারা সব সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেজরিটি। আমাদের পূর্বপুরুষরা জ্ঞানী ঋষি ছিলেন। জঙ্গলের জীবকে জঙ্গলেই রাখতেন,বড়জোর সমাজের অর্থাৎগ্রাম বা শহরের প্রান্তে অস্পৃশ্য অচ্ছুৎ হিসেবে বেঁচে থাকতে দিতেন। যা কিছু সভ্যতা, সাহিত্য দর্শন শিল্পকলা সঙ্গীত এ দেশে হয়েছে সবই এদের বাদ দিয়ে। সভ্য মানুষের বসতির বাইরে এদের আটকে রেখে। আমাদের হাজার হাজার বছরের অস্তিত্বে সর্বনাশ করে গেল সাহেবরা, মগজে ঢুকল ওয়েস্টার্ন আইডিয়া, হিউম্যানিজম। যে এগিয়ে আছে তার কর্তব্য পিছিয়ে পড়দের কাঁধে তুলে নেওয়া। আরে বাপু, কতজনকে তুলব, কাধ কটাই বা। এখন সাহেবরা চলে গেছে, ভালুটি আমাদের ধরিয়ে দিয়ে। ভাল ধরানো জানেন তো? ওড়িয়াতে যত খারাপ কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে চাপা, নামানোর উপায় নেই।
কী সাংঘাতিক রিঅ্যাকশানারি এই অনিলেন্দু। আমি আঁতেল না হলেও বাঙালি তোত। নাইনটিন্থ সেনচুরির লিবেরালিজম আমাদের অস্তিত্ব। (এখানেই আটকে আছি। আবার সেই টাইম মেশিন আর কি) আমি নিজে বামুনকায়েতনই। জ্ঞানী ঋষিদের সনাতন হিন্দুধর্মে আমার ঠাকুরদা বাবা আমি কোথায় থাকতাম শুনি? সেই জমিদার মহাজন পুরুতের কানমলা আর হাঁটুতে কাপড়, বলদ ঠেঙিয়ে জমি চাষ। ইংরেজই আমাদের তুলেছে। শুধু আমাদের কেন সবাইকে। গল্প উপন্যাস বইইয়ের ধার ধারি না বটে, কিন্তু খবরের কাগজ ম্যাগাজিন তো পড়ি। কত বড় বড় বাঙালি লেখক পিছিয়ে পড়া মানুষ, আদিবাসী-টাদিবাসী নিয়ে কত মহৎ সাহিত্য রচনা করেছেন। আর এসব লেখার তো মার নেই, পুরস্কার বাঁধা। তাছাড়া শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। সাঁওতালরা দিব্যি পরিষ্কার। সকলের মুখে শুনি কত সরল সৎ। অতএব অনিলেন্দুর বিশ্বহিন্দু পরিষদ বিজেপি মার্কা কথাবার্তায় মৃদু আপত্তি না তুলে পারি না।
–বাড়িটার অবস্থার জন্য আদিবাসীদের ইন জেনারেল রেসপনসিবল ভাবাটা ঠিক কি। আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে সাঁওতালরা তো খুব ক্লিন, হার্ডওয়ার্কিং।
-আদিবাসী মানেই তো সাঁওতাল নয়। অজস্র জাতের আদিবাসী আছে। আর এ বাড়িতে যারা থাকত তারা যে অন্তত পরিশ্রমী নয় সে তত চোখের সামনেই দেখতে পেলেন। কংক্রিট ভিজিবল এভিডেন্স। তিক্ত ঝাঝালো উত্তর।
—আসলে এরা তো মডার্ন আরবান লিভিং-এ অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া গরিব, জলই তো পায় না, পরিষ্কার থাকবে কী করে
—কী যে বলেন মিঃ দাস। বাড়িটার উল্টোদিকেই তো বিরাট মাঠ পড়ে আছে। বাথরুম টাথরুম ব্যবহার না জানলে সেখানেই কম্ম করলে পারত। গরিব জল পায় না ওসব কথা বলবেন না। এটা টাইপ সিক্স, বাড়ি, চব্বিশ ঘণ্টা জল। কটা কল আছে জানেন? দুটো ভাল বাথরুমে তিনটে তিনটে ছটা, উঠোনের ভেতর ইন্ডিয়ান স্টাইলে দুটো, বাইরে আউট হাউসের কল-পায়খানায় দুটো, বাগানে জল দেওয়ার জন্য দুটো কল ও দুটো বিরাট চৌবাচ্চা। কটা হল?–চোদ্দোটা? ভুলে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে একটা ও উঠোনের ধারে আরেকটা কাপড় কাঁচা ইত্যাদির জন্য।
—অর্থাৎ সর্বমোট ষোলোটি কল। আমি ব্যাংকার মানুষ, গোনাগুনিতে সর্বদা আছি। .
—হ্যাঁ। তার মধ্যে অন্তত বারোটিতে চব্বিশ ঘণ্টা জল এবং বাকি চারটিতে দিনে বার তিনেক টাউন সাপ্লাই থেকে জল আসে। এ সত্ত্বেও বাড়িটি নরককুণ্ড এবং গাছগাছালি ঘাস খতম।
-দেখুন স্যার তর্কের খাতিরে আমি ধরে নিচ্ছি এরা অলস তাই নোংরা। কিন্তু ফলের গাছ নষ্ট করবে কেন? ফল ফললে তো নিজেরাই খাবে। তারপর ওই কী যেন আপনি বলছিলেন কাছেই ফুড প্রসেসিং সেন্টার, মিনিস্টারের তো সাইকেল টাইকেলের অভাব নেই। স্কোয়াশ-জ্যাম-জেলি-আচার-সস সব এরাও বানিয়ে রেখে সারা বছর ভোগ করতে পারে। গাছটাকে কেটে কী লাভ?
—অত বুদ্ধি যদি ঘটে থাকবে তাহলে আর আদিবাসী কেন। আপনারা বাঙালিরা সবাইকে একটা রোমান্টিক কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখেন। বাস্তবের সঙ্গে আপনাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আপনারা ভাবেন উন্নতি হচ্ছে একটা গিফ্ট। ইচ্ছেমতো যাকে তাকে দেওয়া যায়। তাতে নয়, উন্নতি হচ্ছে একটা প্রসেস, সাধনা। নিজেদের চেষ্টা। এই যে সাহেবরা আপনাদের কলকাতায় এমন সব চমৎকার বিল্ডিং করেছিল। চৌরঙ্গির কথা ভাবুন। আমি ছেলেবেলায় ফিফটিজ-এ গেছি। তখনও কী সুন্দর! আর এখন! ইন্ডিয়েনাইজেশান না বারবারাইজেশান। আচ্ছা আপনাদের নিজেদের কিছু মনে হয় না? দেশটাকে তো একেবারে তুলে দিয়েছেন অসভ্যদের হাতে।
আদিবাসী ছেড়ে বাঙালি নিয়ে পড়েন অনিলে, মেট্রোলাইটহাউসের অবস্থা–মা যাহা ছিলেন এবং যাহা হইয়াছেন। কথায় কথায় আমারও মনে কোথা থেকে যেন সাড়া আসে। সত্যি তো এইহটগুলো চৌরঙ্গির ফুটপাথে আমরা ছেলেবেলায় মানে ফিফটিজ এ যা দেখেছি এখন তার হাল এমন কেন! ভদ্রলোক পা দিতে পারেনা। রাস্তায় গেরস্তবাড়ির মেয়েদের হাঁটাচলা দুষ্কর। চারিদিকে ইন্ডিয়ান পাবলিক। অসভ্য বর্বর নোংরা। এবারে দুজনে হুইস্কি নিয়ে বসি। এক সিটিং-এই বন্ধুত্ব।
তারপর যখনই সেক্রেটারিয়েটে গেছি ওঁর ওখানে একবার ফুঁ মেরেছি। চা কফি খাইয়েছেন। একতার সব অনুষ্ঠান জমায়েতে ওঁর নিমন্ত্রণ বাঁধা। সব সময় এসেছেন অনিলেন্দু। আমার বাড়িতেও কবার ডেকেছি। দু-চার পেগ পেটে পড়ার পর নানা কথা আলোচনা। আমার ব্যাংকের ধার নিয়ে কটা ইন্ডাস্ট্রিজ কী করল না করল এবং তার জন্য আমার কত ঝামেলা। ওঁর কাছে শুনেছি অফিসে কতরকম রাজনীতি, সম্বলপুর অর্থাৎ পশ্চিম ওড়িশা বনাম কটক বা সমুদ্রকুল ওড়িশা, ব্রাহ্মণ বনাম করণ বা কায়স্থ। এছাড়া কে চিফ মিনিস্টারের সেক্রেটারির দলে কে নয় এবং তার জন্য কী কী সমস্যা।
ওঁর একমাত্র ছেলে যখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে ওড়িশায় কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেল কোথাও কিছু পেল না তখন অনিলেন্দু এসে আমাকে ধরে পড়লেন। কলকাতায় ডেন্টাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে। তখন বামপন্থী সরকার এবং আমার পরিবার ঘোর কংগ্রেসি। তবুও কিছু অসুবিধা হলনা। বাঙালি কম্যুনিস্টদের কাছেইন্ডিয়া তো আরেকটি সোভিয়েত। হেলথ মিনিস্টারের নিজের কোটাতে ছেলেটা ভর্তি হয়ে গেল। তার ভবিষ্যৎ এখন ছকে বাঁধা। ওপরে ওঠার রাস্তা খোলা। হ্যাঁ, অনিলেন্দু ডিরেক্টর অফ কালচার এবং একতা কালচারাল অর্গানাইজেশান যার আমি প্রেসিডেন্ট। কেউ ঘাস খায় না, সব ঠিক, তা সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার একটা রীতিমতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সেদিন রাতে ওবেরয়-এ ভদ্রলোক ডিনার অবধি ছিলেন, না খেয়ে তো আর যাবেন না। এবং তিনি নাচাকোঁদার পাত্র নন। পানভোজনেই তার উপভোগ। অতএব, বসে বসে দিব্যি মৈত্রেয়ী চক্রবর্তীর নারীবাদী নাটকটি তারিয়ে তারিয়ে দেখলেন। অস্বস্তি, বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। একতার ছোট গণ্ডিতে আমার ও মৈত্রেয়ীর সম্পর্ক সকলের জানা। তাতে কিছু আসে যায় না। সেটা তো পরিবারের মতো। ঘরের কথা ঘরেই থাকে। কিন্তু বাইরে অর্থাৎ যাদের সঙ্গে আমার চাকরিসূত্রে পরিচয়, যাদের সঙ্গে আমার কর্মক্ষেত্রে আদানপ্রদান যোগাযোগ তাদের কারও সামনে আমাদের সম্পর্ক এবং তার এমন নগ্নরূপ প্রকাশ কি উচিত?
অনিলেন্দু কোনওদিন মৈত্রেয়ীর নাম উচ্চারণ করেননি। ঠারেঠোরেও কোনও কিছু জানতে চাননি। কিন্তু সেই পার্টির পর থেকে যতবার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, ওঁর অফিসে একতার অনুষ্ঠানে, কেমন যেন একটা ঠাণ্ডাঠাণ্ডা ভাব। আগের সেই খোলামেলা সহজ ভঙ্গিটা আর নেই। অথচ এমন মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতো ব্যাপার তো কিছু নয়। আফটার অল আমি ব্যাচেলর এবং মৈত্রেয়ী ডিভভার্সি। এখানকার বড়লোক মন্ত্রীফন্ত্রিদের করকম ব্যাপার-স্যাপার থাকে সে কি আমি জানিনা। নাকি অনিলেই জানেনা। ওড়িয়াদের এই এক অদ্ভুত স্ববিরোধ, এক দিকে আকছার ব্যভিচার, বিবাহিত ক্ষমতাশালী পুরুষের একাধিক স্ত্রী রক্ষিতা, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় আমলা অধ্যাপক অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রচণ্ড ব্রাহ্ম মার্কা নীতিবাগীশ সংকীর্ণতা।
সেইজন্যই কি পরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিপ্রতিষ্ঠা নিয়ে যখন সমস্যা হল তখন অনায়াসে হাত খুলে অনিলেন্দু সেই মোক্ষম নোটটি ফাঁইলে লিখতে পারলেন?
সেই রাতে এরকম সম্ভাবনা অনাগত ভবিষ্যৎ। পরবর্তী আকর্ষণ বা শীঘ্র আসিতেছে গোছের অংশবিশেষ। কেলেঙ্কারিটাই ছিল মূল কাহিনী চিত্র ফিচারফিল্ম। পরদিন ধৌলিতে মৈত্রেয়ী ফিরে গেল কলকাতা। এ ঘটনার পর থেকে আর কখনও মৈত্রেয়ীর সঙ্গে অল্পবয়সি সহকর্মিনী দুরসম্পর্কের দুস্থ আত্মীয়া ভুবনেশ্বরে দেখা যেত না। উল্টে এমন ভাব করতে যেন কোনও দিনই কাউকে আনেননি। বরাবরই সে একা আসে।
মৈত্রেয়ী ফিরে যাওয়ার পর পরই ভুবনেশ্বরে আমার জীবনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করলেন আমার পিতৃদেব। হরিচরণ দাস বি এ বি এল হাওয়া বদলের জন্য এলেন কনিষ্ঠ পুত্রের কাছে। সেই একবারই তিনি আমার সংসারে পা রাখলেন এবং সেই শেষবার। ফিরে যাওয়ার অল্পদিন বাদে ম্যাসিভ স্ট্রোকে ডানদিক অসাড়,কয়েকমাস জীবস্মৃত অবস্থা ও একদিন প্রাণত্যাগ। যে সময়টুকু ভুবনেশ্বরে ছিলেন, একতার সদস্যদের সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতিবার প্রতিটি সাক্ষাতে প্রত্যেকের সঙ্গে আলাপে সমাপ্তি টানতেন একটি বিশেষ অনুরোধ।
—তোমরা পাঁচজন দেখেশুনে অমলের একটা বিয়ে দাও। বলাবাহুল্য মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী নামে যে কারও অস্তিত্ব তার পুত্রের জীবনে আছে সেটি সম্পূর্ণ অস্বীকার। মজা হল একতার সদস্যরা যাদের কাছে মৈত্রেয়ী আদরের দিদিভাই এবং যারা আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বিলক্ষণ জানে, তারাও দিব্যি এই খেলাটিতে সাগ্রহে অংশ নিতে শুরু করল। ? অমলদার জন্য পাত্রী চাই একতার প্রতিটি জমায়েতে বাঁধাধরা খেলা, যেন পার্টি গেমস্ কনসিকোয়েন্স, পাসিং দি পারসেল ইত্যাদি। সেই সুবাদে ঠাট্টাইয়ার্কি একটা স্থায়ী বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। আরও মজা, মৈত্রেয়ীর সর্বদা এসব আলোচনায় হাসিমুখে অংশগ্রহণ। সাধে কি আর বলে স্ত্রী চরিত্র দেবতারাও জানে না।
আচ্ছা মৈত্রেয়ী সম্বন্ধে একধরনের পরিহাস কখনও শোনা যেত না কেন? সেও তো আমারই মতো বাহ্যত একা। বিধবা বা স্বামীবিচ্ছিন্নার একাকীত্ব কি সমাজে এখনও স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়? হয়তো সকলের এই ধরে নেওয়ার জন্যই মৈত্রেয়ী পুরুষের অভাব তেমন তীব্রভাবে অনুভব করে না। স্কুলের টিচারদের ওপর কর্তৃত্ব ফলিয়েই তার তৃপ্তি। আগেকার দিনে একান্নবর্তী পরিবারের কর্তারা যেমন বিবাহিত জীবনের অনেকটা সময় বাইরের মহলে নিঃসঙ্গ শয্যায় কাটিয়ে যেতেন। সমস্ত পরিবারকে দোর্দণ্ড শাসনে রেখেই তাদের পরিতৃপ্তি। ফ্রয়েড কবে হার মেনে গেছেন। ক্ষমতালিপ্সা বোধহয় কামনার চেয়ে ঢের ঢের শক্তিশালী। এই যে আমার আর মৈত্রেয়ীর সম্পর্ক এতে কামনার স্বল্প ভূমিকা নিয়ে আহা-উঁহু সহজ। কিন্তু নিভৃতে ক্ষমতার যে প্রচণ্ড লড়াই প্রতিনিয়ত চলেছে তার প্রকাশ কোথায়? ওবেরয়ের ঘটনার পর একটা মেগাফাংশান, পুরো ওড়িশাকে তাক লাগানো অনুষ্ঠান আমার অস্তিত্বের পক্ষে এত জরুরি হয়ে উঠেছিল। মৈত্রেয়ীকে দেখাব আমার কেরামতি। একেবারে সুপারহিট মুকাবলা।
জীবজগতের নিয়মে পুরুষ চেষ্টা করে স্ত্রীকে আকৃষ্ট করতে। ময়ুর সাতরঙা পেখম ধরে নাচে ময়ুরীর জন্য। প্রকৃতি তাকে প্রোগ্রাম করে দেয় প্রজাতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। মানবমানবীর আকর্ষণ-বিকর্ষণের জটিল দ্বন্দ্ব কি প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে?নাকি সভ্যতার বিবর্তনে জৈবিক স্বভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে পিতৃতন্ত্র? হয়তো এসব কিছুই না। সময়, সেই কাস্তে হাতে ভীষণ দর্শন পুরুষ, আমাদের প্রেম ভালবাসা কর্মকীর্তি সব বিনাশ করে এবারে প্রকৃতিকে ধরেছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবজগতের নিয়মকানুন। এই তো কোথায় যেন খবরে দেখছিলাম একদল শকুন, যারা ভীরু ও শ্লথগতি হওয়ার দরুণ প্রাণী সমাজে মৃতপশু খাদক বা ঝাড়ুদার তারা হঠাৎ স্বভাব বদলে দল বেঁধে গৃহস্থের মাঠে-চরা জ্যান্ত ছাগলভেড়া আক্রমণ করছে, তাদের লম্বা চঞ্চঠুকরে ঠুকরে মেরে ফেলছেতৃণভোজীদের। মরা মাংসের যদিও অভাব নেই, সুও। হায় সময়। তোমার মতো ভয়ঙ্কর আর কী আছে। চিরন্তন প্রকৃতিরও তোমার কবল থেকে নিস্তার নেই। অমলকুমার দাস মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী তো কোন্ ছার।
এত সব ধানাই পানাই দর্শন তত্ত্ব, এর আড়ালে মোদ্দা কথাটা নেহাতই মামুলি। আমি যখন নিজেকে কেউকেটা মনে করে রোজ বিভিন্ন ক্লায়েন্টের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে হোটেল বেঁস্তোরা ক্লাবে লাঞ্চ ডিনার ককটেল করে বেড়াচ্ছি, বছরে একখানা মেগাফাংশান, গোটা তিনেক মাইনর ফাংশান স্টেজে নামাচ্ছি, লোকাল কাগজে নাম ছাপা হয়, সন্ধেবেলা টিভিতে স্থানীয় বিচিত্রাতে আমাকে সবাই দেখে একতা ক্লাবের প্রাণপুরুষ সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতি বক্তৃতা দিচ্ছে—(যার প্রতিটি লাইনের পরে মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী ইংরিজির ভুল ধরে) সব মিলিয়ে এমন একটা ভঙ্গি যেন সেই সময় কালের অবিরাম স্রোত থেকে পৃথক, বরাবরের মতো স্থির, ফ্রিজ শট; তখন হায় সময়, তুমি এদিকে তলায় তলায় আমার সর্বনাশের যোজনা, থুড়ি পরিকল্পনা করে চলেছে অধস্তনরা যেমন বেনামি নালিশ পাঠায় সিবিআই ভিজিলেন্সকে। আর আমি আমার সাময়িক বিজয়ের মোহে এমনই মুগ্ধ ময়ুরের মতো পেখম মেলে ময়ুরীর মন জোগাতে, তুমি যে সংগোপনে পিছন থেকে কখন পিঠের ওপর ছুরি তুলে ধরেছ টেরই পাইনি।
.
-এই যে, অমলবাবু, আছেন কেমন? আর কিছু মনেটনে পড়ল? সহাস্যমুখে ছায়া দেবনাথ সামনে দাঁড়িয়ে। বাঙাল তো, মেয়েটার হায়ালজ্জা কিছুই নেই।
–হ্যাঁ, মনে সবই আছে। অমল বেজার মুখে বলে, মনে থাকলেই তোমাকে বলতে হবে এমন কোনও মানে আছে।
—আহা, ধরেন না আমি আপনার স্টেনো।
—আমার স্টেনো বাপের জন্মে তোমার মতো ফাজলামি করতে সাহসই পেত না। গতকাল এই ছায়া দেবনাথের জন্য তাকে কী অপ্রস্তুতই না হতে পয়েছে। সকালে ডাক্তার বর্মন রাউন্ডে এলে অমল কথায় কথায় বলে ফেলে,
—সুগোক শহরটা আর আগের মতো নেই।
ডাক্তার বর্মন ভুরু কুঁচকে বলেন,
–সুগোক আবার কোন্ শহর?
অমল ভাবল বোধহয় তাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, আগে যেমন নিকটজনদের এনে ডাক্তার নার্সরা পাটপিট মুখে জিজ্ঞাসা করত,
-ইনি কে বলুন তো? মনে পড়ছে?
সে সবই ছিল পরীক্ষা। স্বাভাবিকত্ব প্রমাণের। তাই অমল ছায়া দেবনাথের দেওয়া ব্যাখ্যাটাই পুনরাবৃত্তি করে।
-কেন সুতানুটির সু, গোবিন্দপুরের গো আর কলিকাতারক। এটাই তো কলকাতার খাঁটি দেশি নাম।
ডাক্তারের মুখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা মিলিয়ে গেল। সঙ্গের নার্সকে নিচু গলায় বলেন।
-ওষুধের ডোজটা কত দেওয়া হচ্ছে? হ্যালোপেরিডলটা বাড়িয়ে দিন।
কলম খুলে লিখতে লাগলেন।
ওষুধপত্রের নাম, মাত্রা এতদিনে অমলের ভালভাবেই জানা। বুঝল তার উত্তরে কিছু একটা গুবলেট হয়েছে। ডাক্তার বর্মন দেখা শেষ করে বললেন,
–রোজ খবরের কাগজ পড়েন না? পড়বেন। নিয়ম করে। বাইরের জগতে কী হচ্ছে হচ্ছে জানা দরকার। ন্যাশনাল ডেইলি আসে তো? দিন তো সিস্টার কাগজটা। হ্যাঁ, এই যে, দেখুন কী লেখা আছে। কলকাতা সংস্করণ। ওসব সুগোক ফুগোক কী বলছিলেন?
–তার মানে কলকাতা কলকাতাই আছে? অমল সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
—দেখি কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই, সুর করে আবৃত্তি করেন ফ্লোর নার্সনমিতাদি। সকলে হেসে ওঠে।
মনে আছে ছোটবেলায় পড়া কবিতা? একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু…কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে? ওটাতো স্বপ্ন। বাস্তবে আসুন।
অমল জানে ডাক্তারদের ওই এক বাই বাস্তব বাস্তব বাস্তব। তাদের কাছে বাস্তব মানে এই মুহূর্তে যা ঘটেছে ঘরে বাইরে, যাকে বলে বহির্জগতে যে জগৎ পঞ্চ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যাকে দেখা যায়, শোনা যায়, ছোঁয়া যায়, চাখা যায়, শোঁকা যায়। ব্যাস। তার বাইরে আর কিছু নয়। বাকি সব অবাস্তব অলীক, খারাপ। অমল যে এই মুহূর্তে এখানে বাস করে না, করে সেই সময়ের স্মৃতিতে সেটাই তার দোষ, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুতির চিহ্ন।
না, সময় একটা মাত্রা যা অমলের সবকিছু রহস্যময় দুর্বোধ্য করে তুলেছে। তবে ছায়া দেবনাথ মেয়েটা যে এক নম্বরের ফাজিল ফোক্কড় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আজ ছায়া আসতেই অমল রাগে গরগর করে ওঠে। মেয়ের গায়েই লাগে না। হেসে উড়িয়ে দেয়।
-আপনার সঙ্গে একটু তামাসা করসিলাম। আপনি সর্বদা গম্ভীর মুখ কইর্যা থাকেন তো তাই। তারপর কী হইল বলেন। চিন্তাভাবনা রাখেন। খালি ভ্যাজর ভ্যাজর। ঘটনাটা কি?
–ঘটনা আবার কী? এমন কিছু অসাধারণ, নিয়মের বাইরে তো কিছু ঘটে না। সবই গতানুগতিক, প্রতিদিন প্রত্যেকের জীবনে কমবেশি যা ঘটে তাই। দৈনন্দিন নিত্যকর্ম।
–আহা, কাহিনীর একটা আগে-পরে ব্যাপার নাই? আগে এই ঘটেছিল, তারপর এই ঘটল। এইভাবেই তো কাহিনী এগোয়।
কে জানে, আমি তো আর উপন্যাস-গল্প লিখি না। জীবনের কথা বলতে পারি। তাও শুধু নিজের জীবনের কথা।
—আরে তাই তো বলসেন। তা সেটা সাজাইয়া লইয়া প্রধান প্রধান ঘটনা পর পর বলবেন তোত।
স্মৃতি তো স্ফটিক স্বচ্ছ খরস্রোতা নয়, তাকালেই স্পষ্ট, তার নুড়িপাথর সব দেখা যাবে। জীবনের স্মৃতি একটা সমুদ্র, তার গভীরে তো আলো পৌঁছয় না। কত কী অস্পষ্ট আবছা থাকে। বিচিত্র লতাপাতা উদ্ভিদ প্রাণী। সে এক অন্য জগৎ। কখনও কখনও সমুদ্রের ওপরে ভেসে ওঠে ইতস্তত। খাপছাড়া অসংলগ্ন টুকরো টুকরো।
যেমন সম্পূর্ণ অকারণে অমলের সেদিন মনে পড়ে গেল ভুবনেশ্বরে একটা ব্যাঙ্কে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। সে সময় কলকাতা থেকে অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধুনিক গানের অনুষ্ঠান আয়োজনে অমল ব্যস্ত। সাধারণত কলকাতা থেকে আর্টিস্ট এলে থাকা-খাওয়ার ঝামেলা বিশেষ নেই, ধৌলিতে দুপুরে ভুবনেশ্বরে পৌঁছে লাঞ্চ বিশ্রাম সন্ধ্যায় শো, রাত এগারোটায় জগন্নাথে তুলে দেওয়া সঙ্গে প্যাক করা ডিনার। পরিষ্কার হিসেব। পান্থনিবাস কি নালকোর গেস্ট হাউসে একটা ঘর হলেই চলে।
সেবার হল কি আর্টিস্ট খবর দিলেন তিনি সপরিবারে আসছেন। দিন তিনেক থাকার ব্যবস্থা চাই, পুরী-কোনারক যাবেন। ব্যবস্থা হল। তবে অমল তৎক্ষণাৎ দক্ষিণার অঙ্কটা কমিয়ে ফেলল। টাকা তো আর আকাশ থেকে পড়বে না একতা ক্লাবও ট্রাভেল এজেন্সি খোলনি। তাছাড়া একটা সমস্যাও দেখা দিল, তিন দিনের জন্য ডাবল বেড রুম কোথায় পাবে, অর্থাৎ প্রায় নিখরচায় কে দেবে। দিলীপের কোম্পানি একটা মাঝারি গোছের গেস্ট হাউস রেখেছে, সেখানে বলে-টলে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারই অন্তিম পর্যায়ে অমল দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে গেস্টহাউসের ঘরটর স্বচক্ষে দেখতে বেরিয়েছে। যদিও কলকাতার আর্টিস্ট তার হিসেবে নেহাতই সেকেন্ড ক্লাস, কেউ স্টার নয়, তবুও অতিথি বলে কথা। পুরনো ভুবনেশ্বরে দিলীপের বাড়ি থেকে তাকে তুলে নিতে দিলীপ বলল,
—দাদা আমার ব্যাঙ্কে না গেলেই নয়, পকেটের অবস্থা খুবই খারাপ, কদিন সমানে ভুলে যাচ্ছি। আজকেও যদি টাকা না তুলি তবে বউ বাড়ি ঢুকতে দেবে না।
-যাওয়ার পথে পড়বে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ। এই তো সামনে একটু যেতে হবে মেন রাস্তা থেকে। বি জে বি কলেজের মধ্যে ছোট্ট ব্রাঞ্চ। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।
বক্সি জগবন্ধু কলেজ ভুবনেশ্বরের তথা সমস্ত ওড়িশার এখন সেরা কলেজ। সব পরীক্ষায়, হায়ার সেকেন্ডারি বি এ বি এসসি বি কম-এ প্রথম বিশ জনের মধ্যে ষোলো জনই বি জে বির ছাত্রছাত্রী। তবে কলেজের চেহারা সেরকম কিছুই নয়। এটা নাকি বয়েজ হাইস্কুল হিসেবে করা হয়েছিল। অর্থাৎ সেরকম প্ল্যান করা দারুণ চেহারার প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউশন নয়। পাকেচক্রে কটকথেকে ভুবনেশ্বরে রাজধানী উঠে আসার পর ধীরে ধীরে এ শহর ওড়িয়া সমাজের ওপরতলার বাসিন্দাদের বাসস্থান হয়ে ওঠায়, তার আজকের এই রূপান্তর। বলাবাহুল্য ছেলেমেয়েদের রেজাল্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি অনুদান বাড়েনি। কাজেই বিল্ডিংও কম্পাউন্ডে চিরাচরিত সরকারি অবহেলার ছাপ। মেন বিল্ডিং-এর পেছনে গাছপালা আগাছার খুদে জঙ্গল, তার মধ্যে একপাশে কাটা তারের বেড়ার ধারে একটি একতলা বাড়ি যার একদিকে পোষ্টাফিস, মাঝখানে বেশিরভাগ সময় বন্ধ কলেজ ক্যান্টিন, আরেকদিকে স্টেট ব্যাঙ্কের একটি এক্সটেনশন কাউন্টার। প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা। খণ্ডগিরি উদয়গিরির প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের সঙ্গে তাল রেখেছে আরও অনেক ওড়িশা সরকার নির্মিত গৃহের মতো এই নির্মাণটিও। ভবিষ্যতে ট্যুরিস্টেদের কাছে এগুলি চিহ্নিত হবে ওড়িয়াদের অধীনে ওড়িশার স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শনরূপে।
দিলীপ খবর দিল ব্যাঙ্ক আগে বাড়িটার উত্তরদিকের একটি ঘরে ছিল। বর্ষায় প্রচুর জল ও তার সঙ্গে সাপ ঢাকায় দক্ষিণের ঘরে উঠে এসেছে। অমল চমৎকৃত। টাকাপয়সা দলিল ইত্যাদির যথোপযুক্ত সুরক্ষার কী ব্যবস্থা। সে প্রশ্ন ওঠেনা কারণ উপশাখাঁটিতে আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই থাকে না। প্রতিদিন স্টেট ব্যাঙ্কের বাপুজিনগরশাখা থেকে টাকা দরকারি কাগজপত্র সব বড় বড় ট্রাঙ্কে বন্দী হয়ে কর্মচারিদের সঙ্গে মারুতি জিপসিতে আসে। তখন উপশাখাঁটি ভোলা হয়। আবার ব্যাঙ্কের ঝাঁপ ফেলার সময় বাক্সবন্দী হয়ে বাপুজিনগর শাখায় ফেরত যায়। এমন ব্যাঙ্ক অমল বাপের জন্মে দেখেনি।
এবার ব্যাঙ্কে ঢোকা। মেঝের জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট চটা, দেওয়ালে ড্যাম্পের নীলচে নীলচে ছোপ। ছাদের পলেস্তারা খাবলা খাবলা খসে গেছে। দরজার সামনে সিঁড়ির প্রথম ধাপই ভাঙ্গা। প্রায় অন্ধকার ঘর, হয় লোডশেডিং বা অন্য কোনও কারণে বিদ্যুৎ নেই। প্রচণ্ড গরম, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ক্যাশের আধখানা চাঁদ ফোকরের সামনে বেশ কজনের লাইন। ডান দিকে ইংরিজি এল অক্ষরের মতো দুদিকে ছড়ানো কাউন্টারের ওপাশে একটি কেরানি ও পিয়ন গোছের কেউ। কাউন্টারের ভেতরে খোলা জায়গাটিতে একটি কাঠের টেবিল ও তিনটি চেয়ার। স্পষ্টতই সুপারভাইজার বা অফিসার ইনচার্জের বসার জায়গা, সামনে দুজন কাস্টমারের জন্য ব্যবস্থা। অমল ও দিলীপ ঢুকতে না ঢুকতেই শোনে চাপা গুঞ্জন অসন্তোষ। এত দেরি হচ্ছে কেন, কতক্ষণ লাগছে টাকা গুনতে ইত্যাদি। পেছন থেকে উঁচু গলায় মন্তব্য,
-যে থিলা সিকিউরিটি গার্ড সে হেইচি ক্যাশিয়ার। আউ কণ এক্সপেক্ট করুচ্ছত্তি। টেবিলের ওপাশ থেকে পিয়নটির প্রতি নির্দেশ এল।
—অন্তা, এ অন্তা, দেখি শলা কণ করুচি। ঘস্টে লাগি গলা কোড়ি হজার টংকা গোণিবাবু।
অনন্ত উঁকি মেরে দেখতে গেল কুড়ি হাজার টাকা গুনতে এক ঘণ্টা লাগছে কেন। লাইনের মাথায় ক্যাশের সামনে অপ্রস্তুত মুখ মহিলা। এতক্ষণে হাতে টাকাটা পেলেন। গুণতে সুরু করেন লাইন থেকে সরে গিয়ে।
অমল ঘরের চারিপাশে তাকায়। একজন ভদ্রলোক কাউন্টারে কেরানির সামনে একটি চেক রাখলেন। কেরানি চেকটিতে চোখ বুলিয়ে তৎক্ষণাত ভদ্রলোককে ফেরত।
—পাঁচ হজার টংকা। আউ এত্তে দেই হবনি। মাডাম পরা একাবেলে কোড়ি হজার টংকা নেই গলে।
অপ্রস্তুত মুখ মহিলা টাকা গোনা থামিয়ে সসংকোচে বললেন, কণ করিবি। পুঅটা জিদ্দি ধরিচি স্কুটার ন হেলে কলেজ আসিনি। আমে ওয়ার্কিং মাদার সবু বেলে সমস্তকু খালি হাত জোড়ি কিরি অছু। আপনমানে তো বুঝু নাহান্তি।
সকলে চুপ। ছেলের স্কুটার কেনার বায়না মেটানো চাকুরে মায়ের প্রতি কারও কিছুমাত্র সহানুভূতি দেখা গেল না। ভদ্রলোকও যেন কিছু শুনতে পাননি এমনভাবে মিনমিন করে বললেন।
—দেই হব নি? আইজ্ঞা, বড় দরকার থিলা।
–দরকার? টেবিলের ওপরে থেকে ইনচার্জের গলা।
–মদনা, আরে এ মদনা, দেখিলু কেত্তে অছি ক্যাশরে। বাবুকু দুই হজার দেই হব? অমল স্তম্ভিত। যেন জমিদারের তহবিল থেকে দয়া করে দুঃস্থ প্রজাকে দান খয়রাত করা হচ্ছে। অমল নিজে একটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, তাই না বলে পারে না।
—ভদ্রলোকের অ্যাকাউন্ট-এ টাকা আছে। দেবেন না মানে? বিদেশে এরকম কথা বললে ব্যাঙ্কে রান হয়ে যায়।
ইনচার্জ ভদ্রলোক সবিস্ময়ে উত্তর দেন,
—ব্যাঙ্কটা কণ ক্রিকেট খেল যে রন হব? আসস্তা কালি বাকি তিনি হজার নেই যিবে, এত্তে কণ অছিম।
যথেষ্ট উষ্ম কণ্ঠে, যেন কাস্টমারের টাকা তুলতে চাওয়াটাই অপরাধ। গ্রাহক তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন।
—হুঁ, হঁ। ঠিক অছি। টিকি এ অসুবিধা হব যে, তা চলাই দেবি। চেকটা শুধরে কেরানিকে দিয়ে টোকেন হাতে উল্টোদিকের লম্বা বেঞ্চে গিয়ে বসেন। তাঁর পালা আসতে অনেক দেরি।
সাধারণ বিশেষ করে একটু বয়স্ক ওড়িয়াদের এমন নির্বিকার স্থৈর্য অমলকে প্রথম প্রথম বিস্মিত করত। এখন ওড়িয়া জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখে। আরেকজন মাঝবয়সি ভদ্রালোক কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে গলা লম্বা করে ইনচার্জের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন।
—আইজ্ঞা। উত্তর নেই। -আইজ্ঞা, টিকিএ শুনিবে।
–কণ? গম্ভীরভাবে প্রশ্ন।
—আইজ্ঞা মু গোটি এ আকাউন্ট খোলিথান্তি সেভিংস।
—কেবে খোলিবে?
—আইজ্ঞা, আজি, যদি হেই পারিব।
—আজি! আজি পরা গুরুবার, আজি কিমিতি হব। অমলের খটকা লাগে। গুরু অর্থাৎ বৃহস্পতিবার অ্যাকাউন্ট না খোলার কোনও নির্দেশ আছে বলে তো তার জানা নেই। ভদ্রলোক কিন্তু সলজ্জ মুখে বললেন,
—সতরে। মোর তো খিআল না থিলা। আজি তা হেলে হেই পারিব নি। আচ্ছা, আসস্তা কালি—কথা শেষ হল না। ইনচার্জ হাহা করে উঠলেন।
—নাহি নাহি কালি আসন্তু নাই। কালি শুক্রবার মু টিকিএ বিজি থিবি। মোর পুরার মঙ্গন। যিবাকু পড়িব, কেত্তে বেলে আসিবি কেত্তে বেলে যিবি কিছি ঠিকানা নাই।
ইনচার্জের ভাইপো—তা আবার নিজের কি জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মাসতুতে পিসতুতো কে জানে—তার আইবুড়ো ভাত। সেজন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হবেনা, আশ্চর্য। আরও আশ্চর্য অ্যাকাউন্ট খোলা যার অভীষ্ট তার প্রতিক্রিয়া। হাসিহাসি মুখে ভদ্রলোক বললেন,
-ওহো, আপনংকর পুরার মঙ্গন। নিশ্চয় যিবে, নিশ্চয় যিবে। তা কণ করুচি পুতুরা? বাহা কোউঠি হউচি?
ভাইপোর যোগ্যতা চাকরি মাইনে, কন্যার রূপগুণ বংশমর্যাদা, বিয়েতে বিশাল খরচের নিশ্চিত সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে ক মিনিটের সাগ্রহ আলোচনা। লাইনে দাঁড়ানো বাকিরাও উৎসাহী শ্রোতা। অতঃপর ভদ্রলোক আবার আস্তে করে,
-আচ্ছা, তা হেলে শনিবার আসিবি কি?
—শনিবার হাফ ডে। আমর তো মেন অফিসরু আসু আসু দশটা পঁইতাল্লিশ এগারটা হেই যাউচি, বারোটারে বন্ধ। আউ কেত্তে বেলে আকাউন্ট খোলিবি কহিলে?
ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ মেনে নিলেন।
-হঁ, সে ভি গোটিএ কথা বটে। আচ্ছা, সোমবার আসিলে হওন্তা?
-দেখন্তু সোমবারটা মু মানে, সেদিন উপাস, সাদা খাইবা, শিবংকর পূজাপূজি। সোমবারটা কাইন্ডলি আসন্তু নাই। অমলের মেজাজ গরম হয়ে যায়। বাঃ শিবের পুজো সোমবার উপোস নিরামিষ খাওয়া অতএব ব্যাঙ্কের কাজ হবেনা। মামাবাড়ি নাকি। ভদ্রলোক কিন্তু অবিচলিত।
-হউক, সোম্বারটা যাউক। তাহলে মঙ্গলবার আসুচি?
ইনচার্জ ভদ্রলোক এতখানি জিভ কাটলেন।
—আরে ছি ছি। কণ এত্তে বয়স হেলা আপনংকর কিছি খিআল নাহি। প্রথম কথা মঙ্গলবার দিনটাহি খরাপ, তার উপর সেদিন পরা অমাবস্যা দিন যাক, জানি নাহান্তি কি? মঙ্গলবার অমাবস্যা আউ আকাউন্টটা খোলি দেবে! ভদ্রলোক এবারে ভারী লজ্জিত।
—বয়স হউচি বুঝিলে, কিছি মনে রহুনি। আপন মতে রক্ষা কলে। আচ্ছা বুধবার আসিলে?
—হুঁ। এইটা ঠিক কহিছন্তি। আসন্তা বুধবার আকাউন্ট খোলি দিঅন্তু। উদারহৃদয় জমিদার যেন দয়া করলেন। এক সপ্তাহ লাগে একটা সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে। ভদ্রলোক বিগলিত।
-হউক। নমস্কার আইজ্ঞা। কিছি খরাপ ভাবিবেনি।
এই আভূমিনত বিনয়, অসীম ধৈর্য, অবিচল শান্তি যা সাধারণ গড়পড়তা ওড়িয়া চরিত্রের লক্ষণ বলে মনে হয় তার সঙ্গে যুগযুগান্তের সামন্ততান্ত্রিক দাসত্বের ও শাসকভীতির সম্পর্ক আছে কিনা অমল ভাবছে এমন সময় গটগট করে হাতে দু চাকা বাহনের হেলমেট নিয়ে একটি সপ্রতিভ তরুণের প্রবেশ। কাউন্টারে হাজির।
—বালান্সটা, পাশ বই বাড়িয়ে দিল। কেরানি পাশ বইটা নিয়ে একতাড়া কাগজগুলো কী দেখে পাশ বইতে একটা এন্ট্রি করে ইনচার্জের টেবিলে রেখে বলে, সই। ইনচার্জ তখন ব্যাঙ্কের নবতম ক্লায়েন্ট হতে ইচ্ছুক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা শেষ করতে ব্যস্ত। অতএব, না দেখে তাতে একটা আঁচড় কাটলেন। কেরানি মারফত চলে এল সপ্রতিভ তরুণটির হাতে। তিনি সানন্দে বললেন,–বা বহুত জলদি হেই গেলা।
—সবুপরা কম্পিউটার হেই যাইচি। গম্ভীর সগৌরব জবাব। কাস্টমারের চক্ষু বিস্ফারিত।
–কম্পিউটার!
কাঁই কম্পিউটার? চারদিক অবলোকন। কেরানি তেমনই গম্ভীরভাবে জানায়,
–বাপুজী নগর মেন ব্রাঞ্চে।
ইতিমধ্যে তরুণটির পাশবই খুলে ব্যালান্স চেক করতে গিয়ে আর্তনাদ,
—এ কণ? গলা তিনি মাসর ট্রানজাকসন কই? আপন তো খালি আজির বালান্সটা লেখিলে।
–খালি আজির বালান্স পাইবে। কম্পিউটার পরা হেই যাইচি।
—কিন্তু ট্রানজকশান ন দেখাইলে কিমিতি হব? মোর পরা সেইটা দরকার। তিনিটা চেক বহারে পাঠাইছি পরা।
–বাপুজিনগর যায়। সেইটি ডিটেল পাইবে। নির্বিকার মুখে কেরানির উপদেশ।
-মানে? এই খরারে মু পুনি সেইঠি কহিকে যিবি। এইঠি মোর অ্যাকাউন্ট আর স্টেটমেন্ট পাই মতে অন্য কৌঠি যিবাকু পড়িব। আপনমানে কণ ঠট্টা করুছন্তি?
যাক, ওড়িশা জেগেছে। এতক্ষণে একজন দেখা গেল যার ব্যাঙ্কিং সম্বন্ধে অ আ ক খ জ্ঞান আছে। এত রং দেখাচ্ছে যখন নিশ্চয় বি জে বি কলেজের লেকচারার। তাদের হাতে তো ওড়িশার মাথা মাথা পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ, কাজেই মেজাজ তো হবেই। একটা ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট আর স্টেটমেন্টের জন্য অন্য ব্রাঞ্চে যেতে হবে তাও এই দুপুরের গরমে। অমলের এবারে মজা লাগে, মন দিয়ে দেখে। এদিকে সমান উঁচু ইনচার্জের গলা।
—এটা কণ ব্রাঞ্চ। এটা পরা এক্সটেনশন কাউন্টার। মেন ব্রাঞ্চে কম্পিউটার বসিচি। সেই সবু দিন সবু আকাউন্টর বালান্স আসে। আমে সেয়া দউ। আমকাম সেদ্ভিকি।
ব্যস খতম। কম্পিউটারাইজেশানের ফলে গ্রাহকদের সুবিধা হল কিনা কে খবর রাখে। কাজ তত বেড়েছে বই কমেনি। প্রতিদিন প্রতিটি অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স পাঠাতে হচ্ছে। অযথা কাগজ নষ্ট। এদিকে লেনদেনের রেকর্ড নেই। অতঃপর সপ্রতিভ তরুণটি রাগে গরগর করতে করতে বেরিয়ে গেল। ইনচার্জের মুখও থমথমে।
ইতিমধ্যে মধ্যবয়সি এক ভদ্রমহিলা তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে। চেহারা পোশাক-আশাকে উচ্চশিক্ষা ও ভাল অবস্থার ছাপ স্পষ্ট। হাতে ব্যাঙ্কের পাশবই চেকবই ও একটি কাগজ। তাঁর দিকে তাকিয়ে ইনচার্জের মুখের ভাব ভঙ্গি বদলে গেল। এখন ভদ্রতা ও বিনয়ে বিগলিত।
-নমস্কার মাডাম, বসন্তু বসন্তু, চেক জমা দেবে তো?
—নাহি। মু অসিছি অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করিবাকু।
–কাঁহিকি মাডাম ক্লোজ করিবে? পারলে যেন পায়ে মাথা রাখে এমন গদগদ ভঙ্গি।
–মু তো রিটায়ার কলি। ফ্যামিলি অছন্তি কলিকাতারে। ঘর সেইঠি, ভাবুছি সেইঠি সেক্স করিবি। অ্যাকাউন্টটা এইটি রখি কণ আউ হব? সেইঠি ট্রান্সফার কলে কাম দেব।
শুনতে শুনতে ইনচার্জের মুখে বিনীত নম্র ভাবটি অন্তর্হিত। ঘাড়ও যেন সোজা শক্ত হয়ে ওঠে। গম্ভীর মুখে বলেন,
—সে আপনংকর ডিসিসন। তেবে মু আগরু কহি দউচি কালকাটারে মাডাম ওয়ার্ক কালচার কিছি নাহি। পছরে কহিবেনি…
—এই যে দাদা, হয়ে গেছে। চলুন। বাব্বা, আজকেই এমন ভিড়। দিলীপ টাকা পেয়ে গেছে। দুজনে বেরিয়ে যায়।
সিনেমার দৃশ্যের মতো এখনও অমলের স্মৃতিতে পরপর ঘটে যায়। অথচ এই অকিঞ্চিৎকর ঘটনাটির সঙ্গে বাহ্যত তার জীবনের এই কাহিনীর কোনওই যোগ নেই। নেহাতই অবান্তর। তবু এত জ্বলজ্বল করে কেন? অফিসার ইনচার্জ ভদ্রলোকের মুখের অভিব্যক্তি এত বছর পরেও স্পষ্ট, মনের পর্দায় একেবারে সেভেন্টি এম এম স্ক্রিনের ক্লোজ আপ। কানে গমগম করছে স্টিরিওফোনিক সাউন্ডে কালকাটারে ম্যাডাম ওয়ার্ককালচার কিছিনাহি নাহি নাহি। আস্তে আস্তে মুখটা ছোট হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠছে পর্দায় লোকটার বাকি শরীর টেবিল চেয়ার অন্য লোকজন ব্যাঙ্কের কাউন্টার। একটা লং শট। আবছা হয়ে আসে। ফেড আউট। এরপরে লেখা থাকার কথা সমাপ্ত। সেটাই শুধু নেই।
.
কারণ বাস্তব তো সিনেমা নয়, সেখানে সমাপ্ত হয় না কোনও কাহিনী। টি ভি-র সোপ সিরিয়েল-এর মতো অনন্তকাল ধরে চলে স্টার প্লাস-এর দ্য বোল্ড অ্যান্ড দ্য বিউটিফুলবা সান্টা বারবারা। এমন কি ডি ডি সেভেন-এ জন্মভূমি পর্যন্ত। কাজেই ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যেতে যেতে দিলীপ যে খবরটা দিল সেটাও আজ অমলের মনে আছে।
—শুনেছেন দাদা পশ্চিমবঙ্গ সরকার নাকি এখানে বঙ্গ সংস্কৃতি সন্ধ্যা করছে?
–তাই নাকি? কোথায় কবে? কই কোনও বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন দেখিনি তো।
–ওইরবীন্দ্র মণ্ডপে আবার কোথায়। কাল রবিবার সন্ধেবেলা। আপনার বন্ধু অনিলেন্দু পট্টনায়েক ডিরেক্টর অফ কালচার। তার সঙ্গে আমার বস্ নিত্যানন্দ মহান্তির আত্মীয়তা আছে তো, তা বস্ গতকাল আমাকে বলছিলেন।
—টিকিট না কার্ড?
—রবীন্দ্রমণ্ডপে আপনাকে আমাকে সবাই চেনে। তাছাড়া পট্টনায়েক আপনার এত বন্ধু সে একটা ব্যবস্থা করবে না?
করল। অমল ও দিলীপ যথাসময়ে হাজির রবীন্দ্রমণ্ডপে। এত অল্প সময়ের নোটিসে একতার অন্যান্যদের জন্য ব্যবস্থা করা যায়নি। অতএব শুধু তারা দুজন। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। মঞ্চ জমজমাটি। কলকাতা থেকে বেশ বড় দল এসেছেন। সঙ্গে এক জাঁদরেল মন্ত্রী। নামকরা সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক অনিল বন্দ্যোপাধ্যায়, অত্যন্ত বিখ্যাত ও অগ্রণী কয়ার গ্রুপ, মুক অভিনেতা সোমেশ দত্ত আরও অনেকে। সামনে রবীন্দ্রমণ্ডপের ওপর তলায় নীচে সারি সারি আসন। সব শূন্য। হল এত খালি যে মাইকের কথা গান প্রতিধ্বনি হতে লাগল। ফার্স্ট রোতে কজন দর্শকশ্রোতা, সকলেই অমলের চেনা। জনা তিনেক বাঙালি আই এ এস সপরিবারে, নামী ওড়িয়া কবি সাহিত্যিক আমলা মিলিয়ে জনা আষ্টেক। একবার একটা বিখ্যাত অ্যাবসার্ড ড্রামার কথা অমল শুনেছিল—দ্য চেয়ার্স। সেখানে দর্শকের বদলে পর পর চেয়ার বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ নাটকের মর্মার্থ হল যা বলতে চাই যা দেখাতে চাই তা শোনবার কেউ নেই। অমলকে বুঝিয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের ভাল ছেলে ওয়াই অর্থাৎ সৌম্যেন। অমল অবশ্য নাটকটার কোনও মাথামুণ্ডু পায়নি। আজকে চোখের সামনে দেখল। গাইয়ে বাজিয়ে বলিয়ের দল একের পর এক নিজেদের যা করণীয় স্বভাবসিদ্ধ নিপুণতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করে গেলেন। শোনার দেখার কেউ নেই।
ভাগ্যে ছিল না। প্রধান অতিথি সি পি এম মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে তার দীর্ঘ ভাষণে প্রচুর ব্যাখ্যা করলেন। ওড়িশা ও বাংলার দীর্ঘদিনের প্রীতির সম্পর্ক, দুই রাজ্যের একই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি। তারপর ঘোষণা করলেন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের নেতৃত্বে শিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটতে যাচ্ছে, তার ফলে হাজার হাজার নতুন চাকরির সংস্থান হবে এবং সেগুলির সুযোগ গ্রহণ করবার জন্য ওড়িশা থেকে দলে দলে কর্মপ্রাথীকে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে পশ্চিমবঙ্গে আমন্ত্রণ জানালেন।
অমলের পাশে বসা অশোক ঘোষ আই এ এস বাগবাজারের ছেলে। মন্ত্রীর ভাষণ শেষ হলে বলে ফেললেন,
–লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছেলে বেকার। স্টেট তাদের চাকরি দিতে পারে না, স্টেটের বাইরে তাদের জায়গা নেই। আর তুমি শালা সি পি এম এখানে এসে ইন্ডিয়া মারাচ্ছো।
কংগ্রেসি হয়েও সেদিন অমল বামফ্রন্ট সরকারের অপূর্ব কর্মকুশলতার প্রশংসা না করে পারেনি। ভাগ্যে সিট সব খালি ছিল। ভাগ্যে এই উদার ভারতীয় আহ্বান ওড়িয়া বেকারদের কানে পৌঁছয়নি। এদিকে তারা তো এমন পরিষ্কারভাবে উচ্চারিত বামপন্থী স্বাগত অভ্যর্থনা ছাড়াই লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় হোয়াইটকলার কালার সবরকম কাজ করে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দিব্যি করে খাচ্ছে। মাস গেলে মানিঅর্ডার পাঠায় কটক বালেশ্বর ঢেনকানলে। অমল কটি বাঙালি মজদুর, বাঙালি নার্স, বাঙালি ডাক্তার ওড়িশায় দেখেছে? তবে তার এত মাথাব্যথাও নেই। এসবকথা ভাববে সরকার রাজনৈতিক দল। সে ব্যাঙ্কার, তাছাড়া বাঙালি জাতটার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তবুও আজকের সন্ধ্যায় শূন্য হ-এ বঙ্গসংস্কৃতি চর্চায় উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান শেষে অশোক ঘোষকে জিজ্ঞাসা না করে পারে না।
—স্যার, এরকম একটা কেলেঙ্কারি ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট করলেন কী করে?
–সরকারের হাতে কালচার এইরকমই হয়।
—না স্যার, এটা আমি মানতে পারি না। ওড়িশা সরকার বাইরে কোনও স্টেটে যদি ওড়িয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে বলে ভাবেন?
-ওয়েল। পারহ্যাপস্ নট। আপনাদের লেফটফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে ব্যুরোক্রেসির বোধহয় কোনও কম্যুনিকেশন নেই।
-ওসবকম্যুনিকেশান ফ্যুনিকেশান বড়বড় কথা। মোদ্দা জিনিস বেসিক এফিসিয়েন্সি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেটাই তো নেই। আচ্ছা স্যার আপনি আজকের এই ফাংশানের কথা আদৌ জানলেন কী করে? ভুবনেশ্বরে তো কেউ জানে না। আমি তো খবর পেয়েছি ওড়িশা সরকারের সূত্রে। একটা পাবলিক ফাংশান হতে যাচ্ছে কোনও ব্যানার নেই, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন নেই, লিফলেট বিলোয়নি। লোকে তো ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারবে না কারণ কেউ কিছু জানেই না। যদি পাবলিসিটি না দিতে পারে তো পাবলিক ফাংশান করা কেন?
–ওখানকার ডিপার্টমেন্ট অফ কালচার-এর সেক্রেটারি আমার ব্যাচমেট, প্রেসিডেন্সিতে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। আজ সকালে ও আমাকে টেলিফোন করে বলল এরকম একটা ফাংশান হচ্ছে, চলে আয়, আর আমাদের প্রেসিডেন্সির দু চারজন যারা এখানে পোস্টেড তাদেরও একটু খবর দিয়ে দে। ফ্যামিলিট্যামিলি নিয়ে যেন সব আসে। ওই যে সামনের বেঞ্চ-এ যে কজন বসেছিল সব তারাই।
–ওঁর নিশ্চয় খুব খারাপ লেগেছে। পাবলিক রেসপন্স তো নি।
–কিস্যু না। আমাকে এক্ষুনি বলল ও লিস্ট বার্ড। ওর বউ পুরী কোণারক দেখেনি তাই ভুবনেশ্বরে এই প্রোগ্রামটা করেছে।
.
অ্যাকদিন বাঙ্গালি সিলাম রে, গান গেয়ে ওঠে ছায়া দেবনাথ। সেই অসহ্য বাঙাল উচ্চারণে।
—আপনারা মানে ওয়েস্ট ব্যাঙ্গলের বাঙ্গালিরা অ্যাককেবারে মইর্যা গ্যাছেন গিয়া। কিনাই আপনাগোনা আছে কামকাজ, না আছে ভাষা। না আছে মানসম্মান জ্ঞান। খালি রাম-শ্যাম-যদু-মধুর পায়ে পড়তাসেন। দেখেন আমরা কত ইন্ডিয়ান, বিশ্বাস করেন আমরা শুধুই ইন্ডিয়ান।
অমল কোনও উত্তর দেয় না। থেকে থেকে কী যে তার হয়। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ইচ্ছে করে না। মরুক গে যাক ছায়া দেবনাথ।
—কী আবার চইট্যা গ্যালেন নাকি? আপনার সাথে কথা কওন যে কী ঝকমারি, আচ্ছা বাঙ্গালির কথায় আজ নাই। ন্যান্, আপনার আর মৈত্রেয়ীর কাহিনীটাই চলুক।
—অন্য দিন হবে। আজ আর ভাল লাগছে না।