রেসকোর্সের জনসভায় গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে মতানৈক্য স্পষ্ট হয়। ছাত্রদের দাবি হচ্ছে ১১ দফা না মানিয়ে গোলটেবিল যাওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ সাহেব গোলটেবিলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক শুরু হলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ভাসানী, ভুট্টো, আজম খান এ বৈঠকে যোগ দেননি। বৈঠক ১০ মার্চ পর্যন্ত মুলতুবি হয়ে যায়।
রেসকোর্সের ২৩ ফেব্রুয়ারির জনসভা থেকে সকল পরিষদ সদস্য ও মৌলিক গণতন্ত্রীদের ৪ মার্চের ভেতর পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়েছিল। মার্চের প্রথম দিকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা শুরু হয়। সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১০ মার্চ ভাসানী ন্যাপ ও ভুট্টোর পিপলস পার্টি ১১ দফা সমর্থনের ঘোষণা দেয়। ৩ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়- (১) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা (2) জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা (৩) বিদেশ চুক্তি বাতিল।
১০ মার্চ গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যা সাম্যের বিরোধিতা করেন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচন দাবি করেন। ১১ মার্চ হতে সরকার সব ধরনের হুলিয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেয়। গোলটেবিল বৈঠকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবি আলোচিত না হওয়ায় ১৪ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বিক্ষোভ প্রকাশ করে। ১৬ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে মৌলবাদীরা মওলানা ভাসানীকে হত্যা করার চেষ্টা করে। বিক্ষুব্ধ জনতা লাকসাম থানার ওসিসহ ১৫ জনকে হত্যা করে। ১৮ মার্চ পার্বতীপুরে বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা হয়। কার্ফ জারি হয়। ২১ মার্চ মোনায়েম খানের পরিবর্তে ড. নূরুল হুদা গভর্নর নিযুক্ত হন।
২৫ মার্চ আইয়ুব খান এক ভাষণ দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। সংবিধান বাতিল করেন। পরিষদ বাতিল করেন। প্রধান সামরিক শাসক নিযুক্ত হন প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সারাদেশে সামরিক আইন জারি হয়। আইয়ুবের পতন হয়।
২৫ মার্চ ক্ষমতা নিয়ে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তাঁর লক্ষ্য। ৩০ মার্চ এক ফরমান জারি করে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘোষণার পর রাজনৈতিক মহলে আর এক দফা বিতর্ক শুরু হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন সংবিধানের অধীনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতায় আসার সময় আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করেছিলেন। সেই সংবিধানের পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংখ্যা সাম্য ছিল। পাকিস্তানকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই ইউনিটে ভাগ করা হয়েছিল। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বরবাদ করা হয়েছিল। এই সংবিধান রচনায় সহযোগিতা করেছিল আওয়ামী লীগ এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি)। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সংখ্যা সাম্য ও একই ইউনিটের বিরুদ্ধে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ব্যতিত সকল প্রদেশের মানুষই এক ইউনিটের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা এক ইউনিট সংখ্যা সাম্যের পক্ষে ছিল। অন্যান্য সকলের ধারণা ছিল সংখ্যা সাম্য ও এক ইউনিটের অর্থ হচ্ছে পাঞ্জাবিদের শাসন। এই পাঞ্জাবিদের শাসনের বিরুদ্ধেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আন্দোলনে নেমেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশের মানুষ। এই আন্দোলনের ফলে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হন। সংবিধান বাতিল হয় এবং প্রশ্ন দেখা দেয় কোন ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধানের প্রশ্নে প্রথম বিতর্ক তুললেন রাজনীতিতে নতুন আসা আসগর খান। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবনের দাবি করেন। পরবর্তীকালে কেএসপি, নূরুল আমীনের এনডিএফ, পিডিএম পন্থী আওয়ামী লীগ, নেজামী ইসলাম ১৯৫৬ সালের সংবিধান পুনরুজ্জীবনের দাবি সমর্থন করে। মাওলানা ভাসানী বলেন–শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে গণভোট করতে হবে। শেখ মুজিবর রহমান বলেন, ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হবে। কোনো দল বা ব্যক্তি নয়, জনগণই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এ হচ্ছে জুন মাসের কথা। এই জুন মাসের ২৭ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কাউন্সিলে গণ্ডগোল দেখা দেয়। নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল মান্নান খান বেরিয়ে যান। আল মুজাহিদী ও আবদুল মান্নান খানের নেতৃত্বে বাংলা ছাত্রলীগ গঠিত হয়। ২ জুলাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই নির্বাচন দেয়া হবে। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সম্পাদকসহ তাজউদ্দীন আহমদ ৭ জুলাই এক বক্তৃতা দেন। তিনি এ প্রশ্নে গণভোট দাবি করেন। পহেলা আগস্ট আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে ১১ দফা দাবি গৃহীত হয়। ১৫ আগস্ট ভাইস এডমিরাল আহসান ও নূর খানকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
ক্ষমতায় এসে সামরিক সরকার ছাত্র ও শ্রমিক অসন্তোষ কমাবার জন্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা হয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বেঁধে দেয়া হয়। নূর খান ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। অর্থাৎ সামরিক শাসন অনুধাবন করতে সমর্থন হয়েছিল ছাত্র এবং শ্রমিকদের হাত করতে না পারলে তাদের কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না।
এ সময় আমরা লক্ষ্য করতে থাকি, এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এবং শ্রমিক আন্দোলন নতুন করে মার খাবে। এছাড়া সমাজে তখন একটি নতুন ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। এ ধারাটি খুব ক্ষীণ হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ৬ দফা শেষ পর্যন্ত এক দফায় পরিণত হবে। এ ধরনের একটি ধারণা আস্তে আস্তে দানা বাঁধছিল। আমাদের ধারণা হচ্ছিল এ ব্যাপারে প্রথম থেকে সতর্ক
হলে শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের আন্দোলন আবার হারিয়ে যাবে। প্রচণ্ড ভাবাবেগে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই সবকিছু তছনছ করে দেবে। দেশ শাসিত হলেও আন্দোলনকে প্রার্ধিত পরিসমাপ্তি নিয়ে যাওয়া যাবে না। শ্রমিক কৃষকের দাবি পূরণ হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে আমাদের ব্যর্থতা ছিল পর্বতপ্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব আমাদের হাতেই ছিল। টঙ্গীতে কাজী জাফরদের কিছু সংগঠন থাকলেও চটকল এলাকায় আমাদের নেতৃত্ব ছিল অপ্রতিহত। কিন্তু সে নেতৃত্ব ছিল একান্তভাবেই দাবি দাওয়ার ক্ষেত্রে। আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি আদায় করেছিলাম। শ্রমিকদের বিশ্বাস ছিল আমাদের নেতৃত্ব কেনা যায় না। কিন্তু অর্থনৈতিক আন্দোলন করলেও আমরা শ্রমিকদের মধ্যে রাজনীতি দিতে পারিনি। রাজনৈতিক আদর্শ দিতে না পারায় আমরা লক্ষ্য করেছি, ৬ দফার আন্দোলনে আমরা বিপর্যস্ত হয়েছি। বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে শ্রমিকরা আমাদের কাছে এলেও রাজনৈতিক আন্দোলনে তারা ৬ দফা পন্থী। এই চেতনা থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নির্বাচনের পূর্বেই আমাদের রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলের ধরন কী হবে। কী হবে তার আও লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য? এ প্রশ্ন নিয়েও আমাদের কথা বলা এক ধরনের অপরাধ। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। আমরা আরএসপি-এর সদস্য ছিলাম। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানে কমরেড অমর ব্যানার্জিকে সম্পাদক করে দল গঠন করেছিলাম। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন কমরেড শওকত ওসমানি। তিনি এককালে লেনিনের সহযোগী ছিলেন। তিনি বম্বে শ্রমিকদের নেতা ছিলেন। ভারত বিভাগের পর তিনি করাচিতে চলে আসেন। কিন্তু আরএসপির মূল শক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর একের পর এক হামলায় আরএসপির অবস্থান তখন বিপর্যস্ত। বরিশালের আরএসপি অফিসে বোমা রেখে ১৯৪৮ সালের প্রথমেই ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে নেতাদের। নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে নির্বিচারে। দেশ বিভাগের জন্যে অনেক নেতা দেশান্তরী। এ পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে কাজ করা আদৌ সহজ ছিল না। তবুও ছাত্র ফ্রন্টের কাজ করার চেষ্টা হয়েছিল সকল ঝুঁকি মোকাবেলা করে। ১৯৫৩ সালে নতুন করে দল গঠনের চেষ্টা করা হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২(ক) ধারা জারি করার পর আবার সকলকে আত্মগোপন করতে হয়। ১৯৬৯ সালে এ পরিস্থিতি মনে রেখেই নতুন করে দল গঠনের কথা চিন্তা করতে হয়। এখন রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র আশ্রয় পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন।
আন্দোলন মারফত শ্রমিকদের চেতনা যে নিজস্ব রাজনৈতিক দল না থাকলে আন্দোলন সফল হবার নয়। তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে চটকল শ্রমিক ধর্মঘটের সময় সকল রাজনৈতিক দল তাদের মাথায় ভর করে ফায়দা লুটতে চেষ্টা করেছিল। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা ভাসানীও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। সুতরাং শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল রাজনৈতিক দল গঠনের।
ঠিক হলো আগস্ট মাসের মধ্যেই শ্রমিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। আদমজী নগরেই এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেই ভিত্তিতেই ১৯৬৯ সালের ২৮ আগস্ট আদমজী নগরে সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গঠিত হয়। সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন গঠনের সময় বাধা দেয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তাদের ধারণা হয়েছিল আদমজীতে আমাদের সম্মেলন হলে আদমজী আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের গোলমাল কাজে আসেনি। সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি হলেন মওলানা সাইদুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন রুহুল আমিন কায়সার।
এবার দল গঠনের পালা। বৈঠক বসল ঢাকায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী নেতা কুমিল্লার অতীন্দ্রমোহন রায় বৈঠকে এসেছেন। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার ভোলাচং গ্রামে। ঐ গ্রামে ১৯২৩ সালে গঠিত হয়েছিল হিন্দুস্থান রিপাবলিকান আর্মি। পরবর্তীকালে ঐ সংগঠনের নাম হয়েছিল হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি। এই সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছিলেন যোগেশ চট্টোপাধ্যায়, ভগৎ সিং, রাজনারায়ণ লাহিড়ী এবং আশফাঁক উল্লাহ প্রমুখ। অগ্নিযুগের বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতির নেতা প্রতুল গাঙ্গুলী লিখেছেন, অতীন নিজ হাতে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু কোনোদিন অতীন একথা কাউকে জানায়নি। এটাই ছিল অনুশীলন সমিতির শপথ।
যারা তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ উপন্যাস পড়েছেন তারা বীরভূমের ডেটিনিউ যতীনের কথা নিশ্চয়ই পড়েছেন। সেই ডেটিনিউ যতীনই হচ্ছেন আমাদের অতীনদা। ১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিহারের রামগড়ে আপোষবিরোধী সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেই সম্মেলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি গঠন করেছিল। সেই দল গঠনের অন্যতম নেতা অতীন দা। অতীন দার আকাঙ্ক্ষা ছিল মৃত্যুর পূর্বে পাকিস্তানে তাঁর স্বপ্নের রাজনৈতিক দলটি শক্তিশালী হোক। অন্তত মৃত্যুর পূর্বে একটি স্বপ্ন নিয়ে তিনি যেন মরতে পারেন। সেই অতীন দা এসেছিলেন আমাদের সম্মেলনে।
কিন্তু দলের নাম কী হবে। পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। সমাজতন্ত্র পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। আমরা সমাজতন্ত্র চাই। তাহলে কী নামে দল গঠন করব? শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো দলের নাম হবে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। আমরা সহজ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য বোঝাবার জন্যে দলের এ নামকরণ করেছিলাম। আমরা বলতে চেয়েছিলাম শ্রমিকের নেতৃত্বে কৃষকের মৈত্রীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদিত হবে। সেই অর্থেই দলের নাম শ্রমিক কৃষক। সমাজবাদী দল–আমাদের আদর্শ বিপ্লবী সমাজতন্ত্র।
দল গঠনের খবর প্রকাশিত হবার পর একটি অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন মহলে। রাজনৈতিক বন্ধুদের মুখে একই কথা, আপনারা এ সময় কেন এ ঝুঁকি নিলেন? সমাজতন্ত্রের কথা বলে টিকে থাকতে পারবেন কি? এদেশের মানুষ ধর্মভীরু। আপনাদের নাস্তিক বলে শেষ করে দেবে। আমাদের জবাব ছিল, রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে এবং থাকবে। তবুও সাহস করে কথা বলতে হবে। আর আমাদের নতুন করে নাস্তিক হবার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দল গঠন সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার বিরূপ মন্তব্য করে সম্পাদকীয় লিখেছিল। সবচেয়ে মজার কাণ্ড করলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। আমাদের দলের গঠনতন্ত্র রচনার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন কুমিল্লার কমরেড আমিরুল ইসলাম। এই খবরের প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি পাঠালেন। বিবৃতিতে তিনি বললেন, নবগঠিত শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই এবং উল্লেখিত আমিরুল ইসলামও তিনি নন।
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল গঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট। অবজারভার পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন করা হয়েছিল আর একটি দল কেন? এ ধরনের প্রশ্ন ছিল বিভিন্ন মহলের। বিশেষ করে বামপন্থী মহলের। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি, আরএসপি এবং ফরোয়ার্ড ব্লকই বামপন্থী দল বলে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর নির্যাতনের মুখে সকল দল বিপর্যস্ত হয়। পাকিস্তান সরকার এ দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল না। এ দলগুলো কমিউনিজমে বিশ্বাসী। সুতরাং নাস্তিক। পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে নাস্তিক অর্থাৎ কমিউনিস্টদের কোনো জায়গা নেই। তারা বামপন্থীদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করল। এ নির্যাতনের মুখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টিকে থাকল কমিউনিস্ট পার্টি। কোনো কিছু ঘটলেই পাকিস্তানের সরকারের অভিযোগ ছিল সব কিছুই কমিউনিস্টরা করেছে। এ অভিযোগ সাধারণ মানুষের মনে কমিউনিস্ট পার্টির একটি অস্তিত্বের আসন সৃষ্টি করে।
একথা সত্য, বামপন্থী রাজনীতিকরা আরএসপি সম্পর্কে খবর রাখতেন। তবে সাধারণ মানুষের কাছে বামপন্থী বলতে কমিউনিস্ট পার্টিকেই বোঝাত। সাধারণ মানুষ মনে করত একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আরএসপি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। অপর দিকে কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই তাদের তাত্ত্বিক আলোচনায় আরএসপি সম্পর্কে মন্তব্য করত। ঢালাওভাবে বলা হতো আরএসপি ট্রটস্কিপন্থী। তকালীন কমিউনিস্ট পার্টির একটি ভিন্ন প্রচারণাও ছিল। তাদের প্রচারণা হলো তারা একমাত্র সাচ্চা কমিউনিস্ট। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অন্যান্য সকল দাবিদাররাই সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট। মার্কিন দালাল। এ খেতাবে আমি বহুবার ভূষিত হয়েছি। আমার লজ্জাজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে যারা আমাদের ট্রটস্কিপন্থী বলতেন, তাদের শতকরা ৯৯ জনই ট্রটস্কি লিখিত কোনো বই পড়ে দেখেনি। এদের মুখোশ খুলে যায় ষাটের দশকে চীন-রাশিয়া দ্বন্দ্বের সময়। কমিউনিস্ট পার্টি চীনপন্থী এবং রাশিয়াপন্থী হয়ে ভাগ হয়ে যায়। এবং পরবর্তীকালে একে অপরকে গালিগালাজ করতে শুরু করে। উভয় পক্ষই নিজেদের মার্কস ও লেনিনের সঠিক উত্তরাধিকারী বলে দাবি করতে থাকে। সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এটা ছিল দু’টি দলের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে অন্ধ অনুকরণের ফল।
১৯৪০ সালে এই অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধেই আরএসপির জন্ম হয়। আরএসপির বক্তব্য ছিল লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সঠিক পথ অবলম্বন করেননি। আন্তর্জাতিক বিপ্লবের দায়িত্ব প্রহার করে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বার্থের নিরিখে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন স্ট্যালিন পরিচালনা করেছেন। ফলে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশ নীতির লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। এই লেজুড়বৃত্তির জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন সমর্থন করেনি। বলেছে, এটা বুর্জোয়া নেতৃত্বের আন্দোলন। আবার জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের পর ১৯৩৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি নির্দেশ দিয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশীয় বুর্জোয়াদের সমর্থন দিতে এবং এ পরিস্থিতিতেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি শেষ দিকে সুভাষ চন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে গান্ধীর নেতৃত্বই সমর্থন করেছে। আরএসপির সংগঠকরা একে সঠিক পথ বলে মনে করেনি। তাই ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল অর্থাৎ আরএসপি গঠন করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে আরএসপি কেন স্ট্যালিন বিরোধী। আরএসপি ট্রটস্কিপন্থী কিনা। আরএসপি দাবি করে আরএসপি লেনিনপন্থী। আরএসপির মূল্যায়ন হলো রাশিয়ায় বিপ্লবের পর স্ট্যালিন এবং ট্রটস্কি দুজনেই ভুল করেছেন। বিপ্লবের পর লেনিন বলেছিলেন, এক দেশে সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব নয়। অন্তত ইউরোপের শিল্পোন্নত কয়েকটি দেশে বিপ্লব না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লব ধরে রাখা যাবে না। তবে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজ শুরু করা যায়। আর এর সঙ্গে অন্য দেশের বিপ্লব করার দায়িত্ব এবং উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ট্রটস্কি বলেছিলেন, অন্যান্য দেশে বিপ্লব না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজও সফল হবে না। স্ট্যালিন প্রথম দিকে লেনিনের বক্তব্য সমর্থন করলেও পরবর্তীকালে ভিন্ন কথা বলেন। তিনি বলেন, সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ নয়, একটি দেশের সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়ও সম্ভব। তবে শর্ত হচ্ছে অন্য দেশে বিপ্লব নয়, অন্য দেশের শ্রমিকদের সহযোগিতায়ই সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিপ্লব সম্ভব হবে।
কিন্তু ক্ষমতা দখল না করে অন্য দেশের বিপ্লবের সহযোগিতা কী করে সম্ভব। এ প্রশ্নের জবাবে স্ট্যালিনের ব্যাখ্যা হচ্ছে এ ব্যাপারে শ্রমিক শ্রেণিকে কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কৌশল হচ্ছে তার নিজের দেশের সরকার যদি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আঘাত করে তবে সে দেশের শ্রমিক শ্রেণির দায়িত্ব হবে নিজস্ব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। অপরদিকে নিজের দেশের সরকারের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক অনুকূল থাকলে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে নিজের দেশের সরকারকে বিব্রত না করা।
এ অভিজ্ঞতা আমাদেরও আছে। আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুসম্পর্ক থাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। শেখ সাহেব খুন হয়ে যাবার পর জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করায় কমিউনিস্ট পার্টি আবার জেনারেল জিয়াকেও সমর্থন দিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রকৃত অর্থে পরিচালিত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশ নীতি দ্বারা।
আরএসপি সংগঠকরা মনে করেছে এ নীতিতে কোনোদিন সার্থক বিপ্লব হবে না। বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের বিদেশনীতির অন্ধ অনুসরণের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকবে। এ মূল্যায়নের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালে আরএসপি গঠিত হলেও দেশ ভাগ হবার পরে এ তত্ত্ব প্রচার খুবই কঠিন ছিল তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতান্ত্রিক শিবির শক্তিমান নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং স্ট্যালিন। পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টি নামেই টিকে থাকা মুশকিল। তারপরে স্ট্যালিনের নীতির বিরুদ্ধে বিকল্প কমিউনিস্ট ধারার আর একটি দল গড়ে সামনে এগুনো সহজ ছিল না। তাই আমাদের দল প্রকাশ্যে গঠন করতে হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির ২২ বছর পর ১৯৬৯ সালে। তাও আরএসপি বা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী নামে নয়। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল নামে।
তবু শুধু সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় নয়, অন্যান্য প্রশ্নে মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এছাড়া চীনের বিপ্লব নিয়ে আমাদের সঙ্গে মতানৈক্য ছিল। মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবী হয়েছিল। আমাদের দলের মূল্যায়ন ছিল একাধিক শ্রেণির নেতৃত্বে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবপরবর্তী সময়ে প্রতিবিপ্লবের জন্ম দেবে। কারণ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বিভিন্ন শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লব। এ বিপ্লব শ্রেণি সংগ্রামের বিপ্লব নয়, শ্রেণি সমন্বয়ের বিপ্লব। তাই আমাদের দলের মূল্যায়ন ছিল চীনের ন্যায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করা কঠিন হবে। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণ পর্যন্ত অন্তবর্তীকালীন নেতৃত্ব নিয়ে সঙ্কট দেখা দেবে। পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে তথাকথিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথ নিয়ে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই পটভূমিতে আমাদের সঙ্গে চীন বিপ্লব নিয়ে প্রথম দিকে থেকেই অর্থাৎ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কালেও মূল্যায়নে তফাৎ ছিল। তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের সাম্রাজ্যবাদের দালাল মনে করত।
পূর্ব ইউরোপের পূর্ব জার্মান, চেকোশ্লাভাকিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়ায় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবী সম্পর্কে আমাদের ভিন্ন মূল্যায়ন ছিল। আমাদের বক্তব্য ছিল এ সকল দেশে আদৌ কোনো বিপ্লব হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে বিজয়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ দেশে ফিরে যাবার আগে কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের সহযোগীদের দেশে দেশে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। এ বিপ্লবের সঙ্গে দেশের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিপ্লবও ভিন্ন শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত। এই তথাকথিত বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রশ্নে নেতৃত্বে মতানৈক্য আছে এবং ইতোমধ্যে হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানিতেও প্রতি- বিপ্লবের চেষ্টা করেছে। ১৯৪৮ সালেই যুগোশ্লাভ সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত কমিন-ফরম (কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো ১৯৪৩ সালে স্টালিন তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেবার পর কমিউনিস্ট আন্দোলন সময়ের জন্যে গঠিত) ছেড়ে গেছে। এ প্রশ্নে রুশপন্থী এবং পিকিংপন্থী অর্থাৎ উভয় গ্রুপের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ আরএসপির মতপার্থক্য ছিল স্পষ্ট।
এছাড়া আমাদের সঙ্গে, অর্থাৎ আমরা যারা এককালে আরএসপি করতাম তাদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির পার্থক্য ছিল বিপ্লবের স্তর নিয়ে। বিভক্ত হবার আগে পূর্ব কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য ছিল ১৯৪৭ সালে ভারতের বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্ধসমাপ্ত হয়েছে। এই অর্ধসমাপ্ত বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরের কথা বলতে থাকে। আর চীনপন্থী গ্রুপ চীনের টংয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতে থাকে। এরপরে নকশালবাড়ি আন্দোলন এলে বলা হয় কৃষি বিপ্লব। আর আমরা বলতে থাকি মেহনতি জনতার বিপ্লবের অঙ্গনে চারটি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠল-১। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর, ২। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর, ৩। কৃষি বিপ্লবের স্তর, ৪। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে–১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বুর্জোয়াদের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত হলেও এ যুগে বুর্জোয়াদের সে বিপ্লবকে সমাপ্ত করতে হবে সর্বহারা শ্রেণিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে মাধ্যমে। যেমন-ভূমি সংস্কার, গণতান্ত্রিক কায়দায়। অথচ নির্বাচন বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে করণীয় হলেও এ যুগে বুর্জোয়ারা এ অধিকার দেয় না। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে এর একাধিক উদাহরণ আছে। দাবি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে আদায় করতে হবে। তাই এ স্তরে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবির কথা বলেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বলতে হবে। অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই। তাই যারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেও বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল ভূমিকা আশা করেছেন, আমরা এ বক্তব্যকে সার্বিক মনে করি না।
কৃষি বিপ্লব সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে কৃষকদের নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লব করা যাবে না। কারণ কৃষকদের বিপ্লব ঠেকাতে যারা আসবে তারা ক্ষমতাসীন বুর্জোয়া সরকার। ঐ বুর্জোয়া সরকারকে উৎখাত না করে এককভাবে জোতদার, জমিদারদের উচ্ছেদ করা যাবে না। এ প্রশ্নে সংস্কারের আন্দোলন হতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে কৃষি বিপ্লব হতে পারে না।
এ বক্তব্য নিয়েই ১৯৬৯ সালে ২৯ আগস্ট শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল গঠিত হয়েছিল এবং আমাদের মূল্যায়ন যে সঠিক ছিল তা আজ আর ব্যাখ্যার অবকাশ নেই।
১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমাদের জন্ম হলেও ইতিহাসের আর একটি ধারার দিকে আমাদের কোনো নজর ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম সর্বহারাদের একটি দল না থাকায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান গণবিপ্লবে পরিণত হয়নি। এ জন্যে বিপ্লবে বিশ্বাসী একটি বিপ্লবী তত্ত্বের রাজনৈতিক দল প্রয়োজন।
আমরা ভাবিনি যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের একটি ধারার তীব্র আবেগ আছে এবং আবেগ সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে আর একটি সুযোগ আমরা হারাব। পাকিস্তানের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থান একই দেশের অধিবাসী হয়ে একটি ভিন্ন পরিচিতির জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানি পরিচয়ের চেয়েও বাঙালি, সিন্ধি, পুশতুন, বালুচ ও পাঞ্জাবি পরিচয় বড় হয়ে উঠছে। এ পরিচয়ের কামনা এবং বাসনার আন্দোলন শ্রেণির আন্দোলনকে ছাপিয়ে উঠছে। বড় হয়ে উঠছে আমি বাঙালি নয়, অবাঙালি। শোষক এবং শোষিতের বিভাজন গৌণ হয়ে উঠেছে। গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেছেন। সামরিক শাসন জারি করে নেতৃত্বে বসেছেন ইয়াহিয়া। ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।
কিন্তু সে নির্বাচনে কবে? এ নির্বাচনে কোনো ঐক্য হবে কিনা। ইতিমধ্যে নির্বাচন নিয়ে বামপন্থী শিবিরের নতুন কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসগুলো হয়েছে। ২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ব্যক্তি বিশেষের সংবিধান জারি করার কোনো ক্ষমতা নেই। ৯ অক্টোবর ছাত্রলীগের এক সমাবেশে তিনি ‘৫৯ সালের সংবিধানপন্থীদের কড়া সমালোচনা করেছেন। ইতিমধ্যে ন্যাপ এক ইউনিট বাতিলের দাবি জানিয়েছে। ২৯ অক্টোবর জামাত প্রধান মওদুদী বলেছেন, ৬ দফা পাকিস্তানের সংহতির বিরোধী। মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ববঙ্গ করতে চাচ্ছেন। ঢাকায় রাজধানী আনতে চাচ্ছেন।
নভেম্বরের প্রথমদিকে ঢাকায় বাঙালি-বিহারি সংঘর্ষ শুরু হয়। বিহারির উর্দু ভাষায় ভোটার তালিকা দাবি করে। নভেম্বরে তারা হরতাল ডাকে। সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হয়। ২৮ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। এক ইউনিট ভেঙে দেয়া হয়। বলা হয়, এক ব্যক্তির এক ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর বলা হয়, ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি হতে প্রকাশ্যে রাজনীতি করা যাবে।
ইয়াহিয়া খানের এ ঘোষণা নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। ইয়াহিয়া খান একটি নির্বাচনী আইনগত কাঠামো জারি করেন। এই নির্বাচনী কাঠামো নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ, মতিয়া ছাত্র ইউনিয়ন ও এনএসএফের একটি অংশ ইয়াহিয়ার ঘোষণা সমর্থন করলেও মেনন গ্রুপ এর বিরোধিতা করে।
১৯৭০ সালের পহেলা জানুয়ারি রাজনীতি শুরু হয়। আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শুরু হয় মিছিল আর মিছিল। আর ওই ৩১ ডিসেম্বর জেনারেল আইয়ুব রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে। ৩ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন নির্বাচনে বাধা দেয়া হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে ন্যাপের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে ঐক্যের প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু শেখ সাহেব সে প্রস্তাব বাতিল করে দেন। একই দিন করাচিতে এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন পিপলস পার্টি ক্ষমতায় গেলে তিনি মূল শিল্প রাষ্ট্রীয়করণ করবেন।
তখন একটি বৈপরীত্য দেখা দেয়। এই বৈপরীত্য হচ্ছে ৬ দফা ও ১১ দফা নিয়ে। ৬ দফা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মূল বক্তব্য। ছাত্র ইউনিয়নের কোনো গ্রুপই এককভাবে ৬ দফা সমর্থক নয়। ফলে প্রণীত হয় ৬ দফাঁকে ভিত্তি করে ১১ দফা। এই ১১ দফার ব্যাপারে শেখ সাহেব কিংবা আওয়ামী লীগ খুব দৃঢ় নয়। কারণ ১১ দফায় সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের কথা আছে। অপরদিকে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ, মোজাফফর ন্যাপ অর্থাৎ ওয়ালী ন্যাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু ওয়ালী ন্যাপ ৬ দফা সম্পর্কে একমত নয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, ১১ দফার ভিত্তিতে সংগ্রামের ডাক দেয়া হলে আওয়ামী লীগ তেমন উৎসাহ দেখায় না। অপরদিকে মোজাফফর ন্যাপ ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলনে ডাক দিলে ওয়ালী ন্যাপ উচ্চবাচ্য করে না। এই পরিবেশে ২১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী কাগমারিতে কৃষক সম্মেলন ডাকলেন। এই সম্মেলনে শ্লোগান উঠল, ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই। অপরদিকে ২০ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলাম পল্টন ময়দানে এক সভার আয়োজন করে। এই জনসভায় শেখ সাহেব ও ৬ দফার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করা হলে জনসভা ভেঙে যায় এবং এটাই বোধহয় জামায়াত নেতা মওলানা মওদুদীর পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনী জনসভা ছিল। এ সময় ভাসানীপন্থী শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় আর নির্বাচন নয়। বিরামহীন সংগ্রামই হচ্ছে মুক্তির একমাত্র পথ।
অর্থাৎ আন্দোলন তখন সুস্পষ্টভাবে তিনটি ভাগে বিভক্ত হতে থাকে। (১) আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়ার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে যাবার পক্ষে। (২) ভাসানী ন্যাপ নির্বাচনে যাবার বিপক্ষে। (৩) ওয়ালী ন্যাপ নির্বাচনে যাবার পক্ষে হলেও ৬ দফা ও ১১ দফার প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতান্তর আছে। অপরদিকে ইসলামপন্থী দল ও ভুট্টোর পিপলস পার্টি কঠোরভাবে ১১ দফা বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, ৬ দফা, ১১ দফার আন্দোলন বাড়তে দেয়া হলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হতে থাকে কোনোমতেই শেখ মুজিবরের হাতে ক্ষমতা নয়। সারা পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রভাব একটুও ক্ষুণ্ণ হোক সে প্রশ্নে সামরিক বাহিনী একেবারেই অটল। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ক্ষমতায় যেই আসুক না কেন পাকিস্তানের শাসনকর্তা হবে সামরিক বাহিনী। এ প্রশ্নে কোনো আপোষ নেই। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩১৩। যে কোনো উপায়েই হোক ৬ দফা বিরোধীদের অন্তত ১৫৬ আসন পেতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচনী বিধি বা কাঠামো জারি করেন। এই নির্বাচনী কাঠামোতে বলা হয়
(১) শাসনতন্ত্রে ইসলামী আদর্শকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
(২) ফেডারেল ইউনিয়ন হবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র।
(৩) গণতন্ত্র ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার থাকবে।
(৪) ফেডারেল শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে।
(৫) অর্থনৈতিক ও বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা থাকবে।
(৬) নির্বাচনী ও জাতীয় পরিষদ যে সংবিধানই রচনা করুন না কেন তাতে প্রেসিডেন্টের অনুমতি লাগবে। প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ব্যতীত কোনো সংবিধান বৈধ হবে না। নির্বাচনের ফলাফল গেজেট হবার ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচিত না হলে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতে পারবেন।
অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গণতন্ত্রের নামে সব ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর কুক্ষিগত করলেন। নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হলো, আইনগত কাঠামো ঘোষণার পর। এই আইনগত কাঠামো নিয়েই তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হলো। আমাদের দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের পক্ষে থেকে সুস্পষ্টভাবে বলা হলো, এই আইনগত কাঠামোর অধীনে নির্বাচন হলে কোনোদিনই ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে না। সংবিধানসম্মতভাবে ক্ষমতা পেতে হলেও রক্তাক্ত সংগ্রাম অনিবার্য। সুতরাং এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ অর্থহীন। আমরা বলেছিলাম আমরা নির্বাচনের বিরুদ্ধে নই। আমরা নির্বাচনকে সংগ্রামের হাতিয়ার বলে মনে করি। কিন্তু এই নির্বাচনী কাঠামোতে পাকিস্তানকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। ধর্মের নামে সকল গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো অবকাশ নেই।
প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা সব দলকেই বিপদে ফেলে দেয়। এই ঘোষণায় গণতন্ত্রের চিহ্ন ছিল না। সুতরাং প্রকাশ্যে এই শর্ত মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা খুবই কঠিন। সকল বামপন্থী দল প্রথমে এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ছিল, নির্বাচনে অংশগ্রণ করব। নির্বাচনে জয়লাভ করব। জয়লাভ করার পর সিদ্ধান্ত নেব ওই শর্ত আমরা মানব কিনা।
এ সময় এই শর্তের বিরুদ্ধে অগ্নিযুগের বিপ্লবী নেতা প্রয়াত ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ) একখানা পুস্তিকা লেখেন। এই বইয়ে তিনি দাবি করেন রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি সব সম্প্রদায়ের লোকদের জন্যেই খোলা রাখা উচিত। কিন্তু তার বক্তব্য কোনো কাজে আসেনি। ততক্ষণে জল অনেক দূর গড়িয়েছে। এখানে লক্ষণীয়, বামপন্থী কোনো দলই ভাবতে চেষ্টা করেনি যে ১৯৪৭ সাল, ১৯৭০ সাল নয়। এই ২৩ বছরে বাঙালি সমাজে সেনাবাহিনী থেকে সচিবালয় পর্যন্ত অনেক পেশাজীবী সৃষ্টি হয়েছে। তারা লক্ষ্য করেছে বাঙালি বলেই তারা বঞ্চিত। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে। সেকালে ভারতের মুসলমানদের ধারণা ছিল তারা মুসলমান বলেই বঞ্চিত। তাই মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান দরকার। আর ষাটের দশকের ধারণা হলো, বাঙালিদের জন্যে একটা কিছু করা দরকার। আমরা স্বাধীন হই বা না হই আমাদের এমন কিছু করতে হবে যার ফলে আমরা বাঙালি বলে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারি এবং সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারি। অবিভক্ত ভারতের ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন মুসিলম লীগ এ নির্বাচনকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল অবিভক্ত বাংলায়।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল সাধারণ নির্বাচনে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দেয়। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা শতকরা ৯৭টি আসন দখল করে। সেকালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালি নেতৃত্ব এ বিজয় ধরে রাখতে পারেনি। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের খপ্পরে পড়ে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। এই নেতারাই কেন্দ্রে পাকিস্তানের নেতৃত্বের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
পাকিস্তানকে দুই ইউনিটে ভাগ করে। ওই দুই ইউনিটের ভিত্তিতে শতকরা ৫০ ভাগ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সেকালের বাঙালি নেতৃত্ব আঁতাত করে। অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে বাঙালিরা ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং শেরে বাংলার নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক পার্টি দুই ইউনিট মেনে নেয়। বিক্ষুব্ধ বাঙালিদের তখন কিছু করার ছিল না। বামপন্থীরা সংগঠিত নয়। এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। ফলে ডান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে বিকল্প কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। সেকালে বিকল্প কোনো আন্দোলন গড়ে উঠলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নরকম হতো। বলা যায় রাজনৈতিক দিক থেকে তখন এক বিরাট শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালে বেসামরিক আমলাদের সহায়তায় সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসে। দেশে সামরিক আইন জারি হয়। এই সামরিক আইন প্রথম দিকে জনগণ উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও পরবর্তীকালে অনুভূত হতে থাকে যে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম না করলে ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি থেকে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। শুধু ব্যবসায়ী মহলে নয়, বাঙালি আমলা ও সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রতি পদে পদে এই কঠিন সত্য অনুভব করতে থাকে। তাই তারাই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসে। যার নেতৃত্বে ছিলেন নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ক্যাডার সার্ভিসের ফজলুর রহমান, রুহুল কুদুস প্রমুখ। এই সংগ্রামকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার জন্যেই শেখ মুজিবুর রহমানকে এই আন্দোলনে জড়ানো হয় এবং এঁদের সহযোগিতায়ই ১৯৬৬ সালে শেখ সাহেব ৬ দফা দাবি তোলেন।
৬ দফার এই পটভূমি সম্পর্কে বামপন্থীরা অবহিত থাকলেও সেকালের এক শ্রেণির বামপন্থীর মধ্যে আন্তর্জাতিকীপনার নিদারুন প্রভাব ছিল। তারা সব কিছুই সমাজতান্ত্রিক শিবির বনাম সাম্রাজ্যবাদী শিবিরে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করে। এককভাবে দেশীয় সমস্যার প্রতি তাদের ঝোঁক ছিল একান্তই গৌণ। সুতরাং তাদের কাছে শেখ সাহেবের দেয়া ৬ দফা ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একটি দলিল। তারা মনে করতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভাগ করতে চায়। সেই লক্ষ্যেই ৬ দফা প্রণীত হয়েছে। সুতরাং ৬ দফা পরিত্যাজ্য। এই ৬ দফার মধ্যে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণির আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন আছে সে কথা তারা আমলেই আনল না।
এই ভুল ব্রিটিশ আমলে ভারতের বামপন্থীরা করেছিল। তারা লাহোর প্রস্তাবকে শুধুমাত্র ব্রিটিশের ষড়যন্ত্র বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাবে যে এক শ্রেণির মুসলমানদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন আছে সে সত্যটি বামপন্থীরা এড়িয়ে গেল। সেদিন এই অপ্রিয় সত্যটি মেনে নিয়ে বামপন্থীরা সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে হয়তো উপমহাদেশের মানচিত্র অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু বামপন্থীদের ভুলের জন্য কংগ্রেস মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশের ষড়যন্ত্রই সফল হলো। ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় হাত রাঙিয়ে উপমহাদেশকে ভাগ করা হলো। ভাইয়ের রক্ত গেল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের বামপন্থীরা একই সঙ্কটে পড়েছিল ষাটের দশকে। আজ অনেকেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের সংগ্রাম পর্যন্ত মূল্যায়ন করতে গিয়ে অনেক কথা লিখছেন। অনেক তত্ত্ব দিচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ১৯৬৯ সালেও শেখ সাহেবকে হটকারী বলেছেন। মার্কিন দালাল বলেছেন। ৬ দফার বিরোধিতা করেছেন। অথচ নিজেরা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো বিকল্প পথের সন্ধান দিতে পারেননি। তাই ১৯৬৯ সালে ৬ দফার দাবিদার আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগই সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে। কেউ মনে রাখেনি ১৯৫৪ সালের পর এক ইউনিট ও সংখ্যা সাম্য মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। কেউই মনে রাখেনি যে আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহযোগিতা না করলে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের এত বঞ্চিত করতে পারত না। কারণ আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও জনতার আন্দোলনে ছিল। জনতার সঙ্গে থেকে সাধারণ মানুষের কথা বলেছে। আবার নিজের বিশ্বাসঘাতকতার কথা স্বীকার করে নিজেকে সংশোধন করেছে। জনতার নির্দিষ্ট দাবি নিয়ে জনতার সামনে এসেছে। ফলে ভালো ভালো কথা বলে এবং সঠিক যুক্তি দিয়েও বামপন্থীরা জনতার কাছে যেতে পারেনি। তাই সঙ্কটে পড়ে গেছে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ঘোষণা দেবার পর।
এ কথা সত্য, ইয়াহিয়া খানের দেয়া কাঠামোর মধ্যে নির্বাচনে যাওয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে গেলে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা নির্বাচনে যাবেন না বলছেন ঘটনা প্রবাহে তাদের কোনো গুরুত্বই থাকবে না। তাই দেখা গেল এক এক করে সব দলই নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। ভিন্ন বক্তব্য দিল পিকিংপন্থী ন্যাপ বলে পরিচিতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ভাসানী ন্যাপ। তখন পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে চাষিদের জমি দখলের লড়াই। এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে পিকিং বেতার। তাদের বক্তব্য হচ্ছে নির্বাচন বর্জনীয়। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। তাই পূর্ব পাকিস্তানে ভাসানী ন্যাপের দাবি হচ্ছে, ভোটের আগে ভাত চাই। অর্থাৎ ভাতের ব্যবস্থা হলেই ভোটে অংশগ্রহণ করা যায়। আর সকলের জন্যে ভাতের ব্যবস্থা করতে হলে বিপ্লব অনিবার্য। তাদের স্লোগান যখন তখনই বিপ্লবের। অথচ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ দলটি আদৌ কোনো শ্রেণিসংগ্রামের দল নয়। বিপ্লবের দল তো নয়ই। তবে শেষ পর্যন্ত এ দলটিকে বিপ্লব বা নির্বাচন-এর কোনোটাই করতে হয়নি।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূল এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়। লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ বক্তব্যের ভিত্তিতে মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন করেন। শেখ সাহেব হুমকি দেন, ঘূর্ণিঝড়ে আরো ১০ হাজার লোক মারা গেলেও ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন হবেই। কারণ তাঁর ভয় ছিল কোনো অজুহাত গেলে সামরিক বাহিনী নির্বাচন স্থগিত করবে। পাকিস্তানে কোনোদিন নির্বাচন হবে না। ক্ষমতা হস্তান্তর হবে না।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অনেকের ধারণা মাওলানা ভাসানী শেখ সাহেবের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল এবারের নির্বাচন নির্ধারণ করবে কে বাঙালির স্বার্থের পক্ষে আর কে-ই বা বাঙালির স্বার্থের বিপক্ষে। তাই এবারের নির্বাচনে বাঙালির ভোট বিভক্ত করা কঠিন হবে না। সবাই যাতে নৌকায় ভোট দেয় সে প্রস্তুতিই নিতে হবে। এ নির্বাচন নিয়ে আমরাও কম বিপদে পড়িনি। আমাদের শ্রমিক কৃষক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট। চারদিকে অভ্যুত্থানের পরিবেশ। আমরা দল গঠনের কোনো সুযোগ পেলাম না। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হলো ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। ইয়াহিয়ার ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। নীতিগতভাবে এ নির্বাচনে যাওয়ার কোনো পথই আমাদের কাছে খোলা ছিল না।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে ভিন্ন আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। আমরা তখন চটকল এলাকার একচ্ছত্র নেতা। আমরা ডাক দিলে সকল শিল্প এলাকা স্তব্ধ করে দিতে পারি। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্যে বিভিন্ন গ্রুপের বামপন্থী নেতারা আসছেন। আসছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশ। তাঁদের সকলের বক্তব্য হচ্ছে, জাতির সামনে দফা একটাই। দফা হচ্ছে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। আমরা দেশকে স্বাধীন করার প্রশ্নে তাঁদের সঙ্গে একমত হলাম। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শোষণমুক্ত সমাজ হবে কিনা। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছ থেকে এ গ্যারান্টি চাই। উপমহাদেশ এর আগেও ভাগ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। একবার হিন্দু-মুসলমান হিসেবে দেশ ভাগ হয়েছে। এবার বাঙালি হিসেবে দেশ ভাগ হওয়ার প্রস্তাব আসছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজ পরিবর্তনের কোনো কথা হচ্ছে না। আমরা স্বাধীনতার পক্ষে শক্তির কাছ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি চাই।
আর নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে-ইয়াহিয়ার দেয়া কাঠামোতে নির্বাচনে জয়ী হলেও ক্ষমতা পাওয়া যাবে না। কারণ সকল ক্ষমতাই প্রেসিডেন্টের হাতে। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া পাকিস্তানের সামরিক জান্তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। সুতরাং নির্বাচন বাদ দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়াই এ মুহূর্তে সময়ে দাবি। কারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রতিকূল হলে নতুন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করা কঠিন হবে। তখন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দাঁড়িয়েই সামরিক জান্তা বিশ্ব জনমতকে নিজের পক্ষে নিতে পারবে। আমাদের প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়, ইয়াহিয়া ঘোষিত নির্বাচনী কাঠামো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলাই এ মুহূর্তে দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এই কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন করলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমরা আমাদের এ বক্তব্যের ভিত্তিতে জনসভা করি। প্রচারপত্র ছাপাই এবং ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যে নির্বাচনে আমরা অংশ নিইনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর। উপকূল এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল ১২ নভেম্বর। এই ১২ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে আমার জীবনের কতগুলো বিশেষ ঘটনা আছে। আমি তখন দৈনিক পাকিস্তানের শিফট ইনচার্জ। আমি রিপোর্টার নই। আমার ঘূর্ণিঝড় এলাকায় যাবার কথাও নয়। কিন্তু আমি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলাম।
তখন দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক তোয়াব খান। তাঁকে বললাম, আমি ঘূর্ণিঝড় এলাকায় যাব। এ ধরনের ঘূর্ণিঝড় হয়তো আমাদের জীবনে আসবে না। তাই এর ক্ষয়ক্ষতি নিজের চোখে দেখা প্রয়োজন। দৈনিক পাকিস্তানের পয়সায় নয়, আমি নিজের খরচেই যাব। তোয়াব খান রাজি হলেন। ঘূর্ণিঝড়ের ১০ দিন পর অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর আমি পটুয়াখালী পৌঁছালাম। দৈনিক পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ এলাকায় গেলেন মনসুর আহমদ। ফটোগ্রাফার আকিল খান।
কাউকেই আমি পটুয়াখালীতে পেলাম না। তারা গলাচিপায় চলে গেছেন। কিন্তু গলাচিপায় কী করে যাব। কোনো লঞ্চ নেই। সকল পরিবহন সরকারি তত্ত্বাবধানে রিলিফ কাজে ব্যস্ত। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ঢাকা থেকে লঞ্চ ভাড়া করে রিলিফে গিয়েছে। এ ধরনের একটি লঞ্চ ভাড়া করে ন্যাপের নেতারা গিয়েছিলেন রিলিফের জন্যে। ঐ লঞ্চে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁদের লঞ্চে আমি গলাচিপায় গেলাম।
২৩ নভেম্বর আমি গলাচিপায় ঘুরছি। ইতোমধ্যে দেখলাম গলাচিপায় হইচই শুরু হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর একটি লঞ্চ এসেছে। নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাপ্টেন পাঞ্জাবি লেরা খান। দেখলাম এসেই লেরা খান খুব তৎপর হয়ে গেছেন। গলাচিপা বাজারে একটি পুল ভাঙা ছিল। লেরা খান থানা কর্তৃপক্ষকে ধমক দিয়েছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ধরে আনতে। বাধ্য করেছিলেন দু’ঘণ্টার মধ্যে পুলটিকে মেরামত করতে। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম লেরা খান ত্রাণ শিবিরগুলোর দিকে যাচ্ছেন। খোঁজ নিচ্ছেন দুর্গতরা রিলিফ পেয়েছে কিনা। দুর্গতরা কেঁদে কেঁদে তাদের অভিযোগ জানাচ্ছে। আমাদের ফটোগ্রাফার আকিল খান হিন্দি, উর্দু দুই ভাষায়ই ভালো কথা বলতে পারে। আমি আকিল খানকে বললাম, তুমি ঐ ক্যাপ্টেন-এর সঙ্গে কথা বলো। আমি তার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
সন্ধ্যার দিকে লেরা খানের সঙ্গে দেখা হলো। দেখলাম ক্যাপ্টেন খুব উত্তেজিত। ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছেন। তিনি বললেন, ১২ তারিখ ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। অথচ আমাদের এখানে আসতে খবর দেয়া হয়েছে ১৬ তারিখ। আমাদের আসতে বলা হয়েছে নৌপথে। আমরা সড়কপথে যশোর থেকে খুলনা এসেছি। খুলনায় আমাদের একটি লঞ্চ দেয়া হয়েছে। সে লঞ্চ এত ধীর গতিতে চলে যে আমাদের গলাচিপা আসতে এক সপ্তাহ লেগে গেছে। এখানে এসে দেখি অব্যবস্থা। সবাই লুটপাটে ব্যক্ত। তাই আজ থেকে আমরাই রিলিফের দায়িত্ব নিয়েছি।
একজন সাংবাদিক হিসেবে এটুকুই ছিল আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। একটি খবর পেলাম। খবরটি হলো উদ্রুত এলাকায় রিলিফের দায়িত্ব সামরিক বাহিনী গ্রহণ করেছে। আমি ব্যতীত কোনো সাংবাদিক সেদিন এ খবরটি পেল না। ক্যাপ্টেন ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আমি ডাকঘরে গিয়ে দৈনিক পাকিস্তানে তার করলাম। পরের দিন একমাত্র দৈনিক পাকিস্তানেই খবর হয়েছিল উদ্রুত এলাকায় রিলিফের দায়িত্ব সামরিক বাহিনী গ্রহণ করেছে।
কিন্তু সংবাদ গ্রহণ করতে গিয়ে আমি আমার যানবাহন হারিয়ে ফেললাম। ন্যাপের লঞ্চ ছেড়ে গিয়েছে। শুনলাম তারা দক্ষিণে গিয়ে কালাইয়ার দিকে যাবে। কিন্তু আমি যাব কোথায়। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আবার দেখা করলাম। বললাম, আমি তোমার সঙ্গে যাব। তুমি কোনদিকে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন কথা দিলেন। তাঁদের সঙ্গেই আমি যাব এবং রাতে লঞ্চেই থাকব।
লঞ্চে উঠে বিপদে পড়ে গেলাম। কী খাব? নদীর জলে মানুষ মরা গন্ধ। চারদিকে লাশ। একফোঁটা জল খাওয়া যায় না। কোনো কিছু খেতে গেলে বমি হয়। গভীর রাতে ক্যাপ্টেন এটা লক্ষ করলেন। বললেন–তোমাকে বড় এক। মগ চা করে দিচ্ছি। কিছু বিস্কুট নাও। সামরিক বাহিনীর বড় মগে চা আর বিস্কুট খেয়ে সে রাত কেটে গেল।
লঞ্চেই সঙ্গী জুটে গেল। সঙ্গীর নাম গফুর রানার। গফুর রানার গলাচিপা থেকে ডাক নিয়ে প্রতিদিন রাঙ্গাবালী যায়। ঘূর্ণিঝড়ের পর রাঙ্গাবালীতে ডাক যায়নি। গফুর রানার গলাচিপায় আটকে গেছে। এবার সামরিক বাহিনীর লঞ্চ পেয়ে গফুর রানার এলাকায় ফিরছে।
গফুর রানারের কথা ফুরায় না। আমি নির্বাক। গফুর রানার বলে এ লঞ্চ দক্ষিণে গিয়ে আগুনমুখা নদীতে যাবে। আগুনমুখা থেকে আরো দক্ষিণে গিয়ে এ নদী বঙ্গোপসাগরে গেছে। আগুনমুখায় গিয়ে বয়ে পানপট্টি হয়ে নদী যাবে কাজলের দিকে। আমরা সোজা যাব ডিক্রি নদীর ধরে গাবুনিয়ার দিকে। গাববুনিয়ার কাছে রাঙ্গাবালী, বাহিরদিয়া, নৌডুবি, ছোট বাইশদিয়া।
শৈশব থেকে আগুনমুখার নাম শুনেছি। শুনেছি আগুনমুখার তুফান ভারি। ঝড়ের মৌসুমে লঞ্চ বা স্টিমার এই এলাকায় গিয়ে যাতায়াত করে না। একমাত্র ওই এলাকার নৌকার মাঝি ব্যতীত কেউ আগুনমুখায় পাড়ি জমাতে সাহস পাবে না। সেই আগুনমুখা পাড়ি দিয়ে এক সময় ডিক্রি নদী ধরে আবার বায়ে গিয়ে আমরা গাবুনিয়ার কাছে আটকে গেলাম। নদীতে জল কম। লঞ্চ ঠেকে গেছে। এবার কী হবে? আমরা কি এগুতে পারব না। গফুর রানার বলল, ভয়ের কিছু নেই। আমরা নৌকা নিয়ে রাঙ্গাবালী চলে যাব। রাঙ্গাবালী থেকে কয়েক মাইল দূরে গফুর রানারের বাড়ি। সে বাড়িতে কেউ আছে কিনা গফুর রানার জানে না। ওই এলাকায় প্রতি ঘরে ঘরে মৃত্যুর কান্না। অনেক বাড়িতে ছায়া পড়বার মতো লোক নেই। নিঝুম ভুতুড়ে বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। গফুর রানারের ইচ্ছা আমি প্রতিটি বাড়িতে যাই। আমি সাংবাদিক। আমি গ্রামে গ্রামে গেলে এলাকার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। এলাকার মানুষ রিলিফ পাবে।
তখন ছিল রোজার মাস। ছোট এক নৌকায় চড়ে আমরা রাঙ্গাবালী পৌঁছালাম। রাঙ্গাবালী পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার ক্ষিধে পেয়ে গিয়েছিল। এক সময় গফুর রানারকে বললাম, আমাকে ভাত খেতে হবে। গফুর রানার যেন আকাশ থেকে পড়ল। রোজার মাসে আমি কেন ভাত খাব। এ প্রশ্ন তাকে বিপর্যস্ত করল। এক সঙ্গে দু’রাত থাকা সত্ত্বেও রানার কখনো আমার নাম জিজ্ঞাসা করেনি। নদীর জলে মানুষ মরা গন্ধ বলে সারাদিন তাদের সঙ্গে আমি না খেয়ে থেকেছি। সন্ধ্যার পর তাদের সঙ্গে বিস্কুট ও মগ ভর্তি চা খেয়েছি। ভাত খাইনি কোনোদিন।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর যেন গফুর রানারের চমক ভাঙল। সে কোনো কথা বলল না। আস্তে আস্তে তার ব্যাগটি কাঁধে নিল। আমার চোখের সামনে থেকে যেন নির্বিঘ্নে মিলিয়ে গেল। আমি বুঝলাম বড় বেশি আঘাত পেয়েছে গফুর রানার। আমি কোথায় জন্মেছি। কী আমার নাম। তা সে জানত না। আমাকে সে গভীরভাবে ভালোবেসেছিল। গফুর রানারের বয়স ৫০ পেরিয়েছে। সে কখনোই ভাবতে পারেনি আমার সঙ্গে তার এমন একটা ফারাক থাকতে পারে। সে বেদনায়, বিস্ময়ে মূক হয়ে গিয়েছিল। কথা ছিল আমি তার বাড়ি যাব। সকলের সঙ্গে পরিচিত হব। কিন্তু আমার এক মুহূর্তের পরিচয়ে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গেল।
আমি বিপদে পড়ে গেলাম। রাঙ্গাবালীতে কাউকে আমি চিনি না। গফুর রানারের আচরণ আদৌ আমাকে দুঃখ দেয়নি। আমাকে বিমর্ষ করেনি। এই উপমহাদেশে জন্মগ্রহণ করে এ ছবিই দেখেছি বছরের পর বছর। আমি ঘর পোড়া গরু হলেও সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পেতে ভুলে গেছি।
রাঙ্গাবালী বাজারে বসে আছি। কিছুক্ষণের জন্য একটি ব্রিটিশ হেলিকপ্টার ওখানে নামল। তাদের আমি আমার অবস্থান জানালাম। তাদের হেলিকপ্টারে বাড়তি আসন ছিল না। শুধু আশ্বাস দিল যে ওয়ারলেসে তারা আমার লঞ্চে খবর দেবে যে আমি আটকে গেছি। আমাকে যেন উদ্ধার করা হয়। হেলিকপ্টার চলে যাবার পর টিএন্ডটির একটি স্পিড বোট পৌঁছল রাঙ্গাবালীতে। ওরা আমাকে নিতে রাজি হলো না। ওরা বলল, ওদের একটি ইঞ্জিন বিকল। দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি দিয়ে চালিয়ে এসেছে। বাড়তি যাত্রী নিতে হলে স্পিড বোট চলবে না। এবার রাঙ্গাবালী বাজারে মানুষগুলো যেন ক্ষেপে গেল। তারা বলল, এই সাংবাদিক সাহেবকে না নিয়ে গেলে এই স্পিড বোট আমরা তুলে ফেলব। এখান থেকে যেতে দেব না। ওই স্পিড বোটে চড়েই আমি গলাচিপা হয়ে গভীর রাতে পটুয়াখালী পৌঁছেছিলাম। তবে কথা সত্য যে স্পিড বোটটির স্বাস্থ্য ভালো ছিল না। ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় পথের মাঝে আমাদের থামতে হয়েছে।
আমার সাংবাদিক জীবনের ইতিহাসে নিয়মিত লেখালেখি শুরু এই ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। এই ঘূর্ণিঝড় নিয়ে লেখালেখির এক পর্যায়ে একদিন গভীর রাতে একটি ফোন পেয়েছিলাম। ফোন করেছিলেন এক দম্পতি। তাঁদের আবেদন হচ্ছে আপনার কলম বন্ধ করুন। আপনার লেখা পড়ে প্রতিরাতে আমাদের কাঁদতে হয়। এই লেখা উল্লেখ করেই ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে কথাসাহিত্যিক শামসুদ্দিন আবুল কালাম ফোন করেছিলেন ইতালি থেকে। ফোনে বলেছিলেন, নির্মল, ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে তোর একটা লেখা ইতালির পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। লেখার শিরোনামহাশেম চৌধুরী একটি লাশ চায়।
হাশেম চৌধুরীর বাড়ি গলাচিপা থানার চরকাজল। চরকাজলে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের পরে। ঘূর্ণিঝড়ে তিন পুত্র আর এক কন্যা নিয়ে হাশেম চৌধুরী এক সময় জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। নিজে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারেননি একটি সন্তানকেও। সেই হাশেম চৌধুরীকে আমি দেখেছি নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে। হাশেম চৌধুরী অন্তত একটি লাশ চায়। সে লাশটি নিজের বাড়িতে কবর দেবে। ওই কবরকে কেন্দ্র করে স্মৃতি ধরে রাখবে তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানের।
জানি না হাশেম চৌধুরী কেমন আছে। ১৯৭০ সালের পর পটুয়াখালীর দক্ষিণে যাওয়া হয়নি। এই ঘূর্ণিঝড় ও মৃত্যুর পরিস্থিতিতেই ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন পাকিস্তান সামরিক শাসনকে বিপদে ফেলে দেয়। পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১৩। জঙ্গি সরকারের ধারণা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অথচ আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়ী হলো। এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী না করে উপায় ছিল না। অথচ জঙ্গি সরকারের হিসাব ছিল পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান মিলে আওয়ামী লীগ বিরোধীদলগুলো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। কিন্তু পরিস্থিতি হয়ে গেল বিপরীত।
অপরদিকে আওয়ামী লীগও সঙ্কটে পড়ে গেল। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ায় ক্ষমতায় যাওয়া ছিল নিশ্চিত। বাঙালিদের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ৬ দফা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ৬ দফা বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। ৬ দফার সামগ্রিক অর্থ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ কথা কারো অজানা ছিল না। কিন্তু সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ তখন স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পর্যায়ে ছিল না। প্রস্তুতিও ছিল না। তাই আওয়ামী লীগও সঙ্কটে পড়ে গেল।
ছাত্রলীগের একটি অংশের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো। এ প্রশ্নে ছাত্রলীগ দু’ভাগ হয়ে গেল। কোনোদিনই আওয়ামী লীগের সভায় দেশ স্বাধীন করার প্রস্তাব উঠল না। স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী নেতৃত্বে চরম বিরোধ। এ বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বেই সামরিক সরকারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিল। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সেনাবাহিনীর একটি অংশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অসম্ভব করে তুললেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তার চরম প্রতিক্রিয়া হলো। প্রকাশ্যেই স্বাধীনতার কথা বলা হতে লাগল। এ পরিস্থিতিতেই ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘোষণা করলেন। প্রতিবাদে শেখ সাহেবকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে হলো। রেসকোর্স ময়দানে তিনি ঘোষণা দিলেন—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” সেই জনসভায় আমিও ছিলাম। আমার মনে হলো, ইচ্ছে হলেও আওয়ামী লীগ বা শেখ সাহেবের পিছু হটবার পথ নেই। আজ হোক বা কাল হোক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই এবং সে সংগ্রাম হবে রক্তাক্ত। দীর্ঘস্থায়ী। আমি তখন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এ যুদ্ধে কে সাহায্য করবে! কাছাকাছি কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক গভীর। পাশে ভারত। এটি একটি পুঁজিবাদী দেশ। বাঙালি বলে পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার মানুষের আমাদের জন্যে সহানুভূতি থাকতে পারে না। কিন্তু তারপরও ভারত সরকার আমাদের সাহায্য করল।
আমার কাকীমার অসুখের খবর পেয়ে ৯ মার্চ আমি বাড়ি চলে গেলাম। বেতারে খবর পাচ্ছিলাম যে কোনো মুহূর্তে নাকি আপোষ হয়ে যেতে পারে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল আপোষ সমঝোতা করতে হলেও রক্তপাত হবে। সাধারণ মানুষকে ধারণা দেয়া হচ্ছে, এবার বাঙালির শাসন কায়েম হবে। কিন্তু ভোটে হলো না। তাই সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া আমাদের হাতে ক্ষমতা আসবে না। কিন্তু এ সংগ্রামের প্রস্তুতি কোথায়? এ সংগ্রামের নেতৃত্ব কে করবে? এ সংগ্রামে কে আমাদের সাহায্য করবে? সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট মীমাংসা হওয়ার পূর্বেই ২৬ মার্চ ভোরে ঢাকার বেতারে ভিন্ন কণ্ঠ শুনলাম। বুঝলাম সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে।
২৫ মার্চ বাড়ি ছিলাম। আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, ২৫ মার্চ এমন করে সংকটের গভীরতা বুঝতে পারিনি। আমার কাছে প্রশ্ন ছিল, এ যুদ্ধে জিতব কী করে–এ যুদ্ধে কে আমাদের সাহায্য করবে বা কেন করবে।
দুদিন পর বুঝলাম গ্রামে থাকা যাবে না। আমাদের মহকুমা গোপালগঞ্জ। আওয়ামী লীগ এখানে জনপ্রিয়। প্রতিপক্ষও কম শক্তিশালী নয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করায় এ মহল ভীত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা শুরু হওয়ায় এরা ঘুড়ে দাঁড়াল। নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করল। এদের প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়াল হিন্দুদের বাড়ি লুট করা। হঠাৎ করে গ্রাম গ্রামান্তরে একটি সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। পাকিস্তান সরকারের প্রচারণায় প্রথম দিকে বিভ্রান্ত হলো মানুষ। হিন্দুরা ভয় পেয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করল। ফলে সুবিধা হলো লুটেরাদের। এ লুটপাট যখন শুরু হলো তখন পাকিস্তান বাহিনী গ্রাম গ্রামান্তরে যায়নি। সুতরাং যে সকল ঐতিহাসিকেরা লুটপাটের জন্যে শুধুমাত্র পাকিস্তান বাহিনীকে দায়ী করেন, তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে আমরাই প্রথম লুটপাট শুরু করেছিলাম। একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করতে চেয়েছিলাম আমরাই। এ সত্যটি চেপে গিয়ে, এক সময় আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিলাম। আজ এত বছর পর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণ দেখে হা-হুঁতাশ করছি। ৭১-এর সংগ্রাম সম্পর্কে প্রথম থেকেই সঠিক মূল্যায়ন হলে আজকে এ হতাশা কোনোক্রমেই সৃষ্টি হতো না।
২৫ মার্চের পর একটি দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় গ্রাম-গ্রামান্তরে। সকলেই বিভ্রান্ত কে কোন দিকে যাবে? সাধারণ হিন্দুরা ভাবছে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করাই একমাত্র কাজ। এক শ্রেণির মুসলমান ভাবছে এটা কী হলো? এ পরিস্থিতি কেন হলো? এ সংকটের সমাধান কী?
এ সময় বিপদে পড়ল আরেক শ্রেণির মানুষ। এই মানুষগুলো শহরে ছিল। শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা হওয়ায় তারা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরেছে। পথে পথে তারা সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছে। তাদের খাবার দিয়েছে। বাড়িতে পৌঁছবার জন্যে অর্থ সাহায্য করেছে।
কিন্তু গ্রামে ফিরে এই শহরের মানুষগুলো বিভ্রান্ত হয়েছে। গ্রামে তখন লুটপাটের পরিবেশ। একদল মানুষ বুকে পাকিস্তানি পতাকা এঁকে অন্যের সম্পত্তি দখলের সংগ্রামে নেমেছে।
৭১ এর যুদ্ধের এই প্রথম দিকে আমি বাড়িতে ছিলাম। তখন আগরতলা বেতারে বাংলাদেশের কথা শুনতাম। মনে হতো ভারত সরকার আমাদের এ যুদ্ধে সহযোগিতা করবে। কিন্তু আমি স্থির নিশ্চিত ছিলাম না। একটি পুঁজিবাদী দেশ বাংলাদেশের সংগ্রামে সহযোগিতা করে যুদ্ধ করে দেবে, এ তত্ত্ব কোনোদিনই আমার বিশ্বাসে আসেনি। এ সময় থানা থেকে খবর দেয়া হলো আমার গ্রামে থাকা নিরাপদ নয়। আমি পরবর্তীকালে টুঙ্গীপাড়ায় গেলাম। টুঙ্গীপাড়ায় তখন শেখ সাহেবের বাড়ি আক্রান্ত। বরিশালে এলাম বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করতে। আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৪ জন সদস্যই তখন বরিশালে অবস্থান করছেন। তাঁদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হলো। সিদ্ধান্ত হলো তারা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাবেন। বলা হলো, এবারের যুদ্ধে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া এবং অস্ত্র সংগ্রহ করা। এ যুদ্ধকে মুক্তি সংগ্রামে পরিণত করতে হলে, এ যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
এ হচ্ছে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। বরিশালে আমির হোসেন আমুর সঙ্গে দেখা হলো। সে জানালো মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ১৮ বা ১৯ এপ্রিল বরিশালে বোমা বর্ষণ করা হতে পারে। আপনি এ শহর থেকে চলে যান। ১৯ এপ্রিল বাসে গৌরনদীর টরকী বন্দরে এলাম। টরকী থেকে মেদাকুল–হিন্দুপ্রধান গ্রাম। মেদাকুল গিয়েছিলাম টাকার জন্যে। আমার এককালীন ছাত্রদের বাড়ি। গিয়ে দেখলাম সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত। মেদাকুলেই বরিশালে বোমা হামলার কথা শুনলাম। সবাইকে গ্রাম ছেড়ে বিলের দিকে চলে যেতে বললাম। কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর বিলে পৌঁছানোর মতো কোনো যানবাহন নেই এবং সত্যি সত্যি পরবর্তীকালে হাজার হাজার মানুষ এই বিল এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে বেঁচেছিল। বিল এলাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনী।
২০ এপ্রিল আমি আবার বাড়ি ফিরলাম। ২০ মাইল হাঁটা পথে। বাড়িতে এসে দেখি ভয় আর ভয়। আমি বাড়ি ফিরে আসায় সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু কোথায় যাব? কয়েকদিনের জন্যে বিল এলাকায় ছিলাম। সে এলাকাও নির্ভয় নয়। এবার সঙ্গী জুটে গেল। ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়ার একটি পরিবার ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছে। আমি তাদের সঙ্গে রওনা হলাম নৌকায়। নৌকায় কোটালীপাড়া থেকে মাদারীপুর। মাদারীপুরে লঞ্চ পেতে হবে। লঞ্চে আসতে হবে ঢাকা। নৌকায় মোটামুটি নির্বিঘ্নে এসেছিলাম। কিন্তু বিপদ হলো মাদারীপুরে এসে। মাদারীপুরে লঞ্চ নেই। লঞ্চ ওপারে। কালিকাপুরে অসংখ্য যাত্রী। কিন্তু ঢাকা থেকে লঞ্চ আসছে না। সন্ধ্যার দিকে দুটি লঞ্চ এল। খবর হলো একটি লঞ্চ ছাড়ার পর মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার কাছে সামরিক বাহিনীর লোক ৪ জন যাত্রীকে নামিয়ে নিয়ে খুন করেছে। এর মধ্যে দু’জনের অপরাধ তারা হিন্দু। অপর দুজন আওয়ামী লীগ কর্মী। এ খবর শুনে অধিকাংশ যাত্রী বাড়ি ফিরে গেল। আর অনেক অনুনয় বিনয়ের পর একটি লঞ্চ ঢাকায় যেতে রাজি হলো। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ কিছুতেই আমাকে নিতে রাজি নয়। ইতিমধ্যে আমার পরিচয় সবাই জেনে গেছে। আমার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ-রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং পিতার নাম বাংলায়। অন্যান্য যাত্রীরাও আমার জন্যে উত্তষ্ঠিত। আমার সহযাত্রী বন্ধু এটি নিষ্পত্তি করলেন। নিস্পত্তি হচ্ছে পদ্মা পাড়ি দেয়ার আগে আমাকে লাউখোলায় নামিয়ে দেয়া হবে। তারপর আমার নিজ দায়িত্বে ঢাকা পৌঁছতে হবে। জীবনে লাউখোলার নাম শুনিনি। ওপথে কোনোদিন যাইনি। কিন্তু নিরুপায়। আমার সহযাত্রী বন্ধু বললেন, আপনি লাউখোলা থেকে হেঁটে জাজিরা যাবেন। জাজিরা থেকে পদ্মা পাড়ি দেবেন নৌকায়। লৌহজং থেকে যে কোনো উপায়েই হোক শ্রীনগর পৌঁছবেন। শ্রীনগর থেকে লঞ্চে সৈয়দপুর আসবেন। সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ড দাঁড়িয়ে থাকবেন। একা বাসে উঠবেন না। আমি সৈয়দপুর গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব।
সেদিন এ আশ্বাসে কতদূর সাহসী হয়েছিলাম আজকে মনে নেই। তবে তার অনুরোধ রেখেছিলাম। লাউখোলায় হোটেলে খেতে খেতে ৪ তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাদের নাম জিজ্ঞাসা করিনি। আজো তাদের চিনি না। তাদের সঙ্গে হেঁটে জাজিরা এসেছিলাম। প্রবল ঝড়ের মধ্যে নৌকায় পদ্মা পাড়ি দিয়েছিলাম। রাতে ছিলাম নাগেরবাজার এক বাড়িতে। ভোরে এসেছিলাম হলদি। হলদি থেকে শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে লঞ্চে সৈয়দপুর। তখন আমি একা। ওই ৪ তরুণ বাসে উঠে চলে গেছে। হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ডে। কিন্তু আমার সে বন্ধু আসছিল না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এক সময় মনে ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কেউ এক সময় চ্যালেঞ্জ করবে। তাই বাসে উঠলাম নিজ দায়িত্বে। কেরানীগঞ্জ পৌঁছে নৌকায় বুড়িগঙ্গা পার হলাম। সোয়ারীঘাটের পথ ধরে চকবাজারের দিকে এগুচ্ছি। জগন্নাথ কলেজের এক তরুণ অধ্যাপক আমাকে দেখে চিৎকার করে নাম ধরে ডেকে ফেলল। তারপর চুপসে গেল। এ সময় দেখলাম দূরে আমার সে বন্ধু দাঁড়িয়ে। আমি একা একা আসার জন্যে গালমন্দ করলেন। বন্ধুর নাম হারুন। সারাজীবন মুসলিম লীগের সদস্য। তার রাজনীতির প্রথম এবং শেষ নেতা খান এ সবুর। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। আর পরবর্তীকালে শুনেছি জগন্নাথ কলেজের সেই অধ্যাপক ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন।
৭১-এর এপ্রিলের ঢাকা। সে কাহিনী লিখতে হলে মহাভারত হবে। কোন বন্ধু কোথায় আছে জানি না। কেউ প্রত্যাশা করেনি, আমি ঢাকায় ফিরব। কারণ তখন সকলেই ঢাকা থেকে পালাচ্ছিল। বন্ধু রুহুল আমিন কায়সার রায়েরবাজার স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি নবাবগঞ্জের এক গ্রামে চলে গেছেন। আরেক বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান টিকে আছে ঢাকায়। আমার ঢাকায় আশ্রয় পাওয়া মুশকিল। চোখ-মুখে দেখে মনে হয় সবাই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আশ্রয় দিতে চায় না। সকলের মুখে একই প্রশ্ন, এ সময় ঢাকায় এলেন কেন? আপনার কি জীবনের ভয় নেই।
জীবনের ভয় আমার ছিল। কিন্তু কেউ জানি না, এ যুদ্ধে আমরা কী করব। সবাই জানি একটা যুদ্ধ আসছে। সবাই সমালোচনা করেছি শেখ সাহেবকে ৭ মার্চ সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা না দেয়ায়। অথচ কেউ কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করিনি। মনে হয়, শেখ সাহেব ঘোষণা দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যেতো। কিন্তু অদ্ভুত রাজনীতিক আমরা। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সকলেই ভেবেছিল, ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় শেখ সাহেব সুস্পষ্ট ভাষায় বলবেন-বাংলাদেশ স্বাধীন ঘোষণা করা হলো। শেখ সাহেব একই কথা বললেন ঘুরিয়ে। আমরা কেউ খুশি হলাম না। বিশেষ করে সমালোচনার ঝড় উঠলো বামপন্থী মহলে। আমরা তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করলাম, এ ধরনের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়া বুর্জোয়া নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন যুদ্ধ এসে গেল তখন অনুধাবন করতে পারলাম, তত্ত্ব দেয়া ছাড়া আমরা কোনো কিছুই করিনি। সংগ্রামের জন্যে নিজের দলকেও প্রস্তুত করিনি। শুধুমাত্র দলের নামের প্রথমে পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ প্রতিস্থাপন করেছি। আর দেখছি এ পরিস্থিতিতে ভারত সরকার এগিয়ে আসছে সহযোগিতা করতে। সুতরাং আমার পালাবার পথ কোথায়? আমাকে ঢাকা আসতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে বসতে হবে। বুঝতে হবে এ যুদ্ধ কোনদিকে গড়াবে। এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা কী হবে? এই চিন্তা থেকেই আমি বাড়ি থেকে ঢাকা এসেছিলাম। শুধু বাড়ির লোককে বলে এসেছিলাম, যত হামলাই হোক বাড়ি ছাড়া যাবে না। শত হামলার মুখে আমার স্বজনরা সে ভূমিকাই পালন করেছিল। যদিও পরবর্তী মাসগুলোতে আমি তাদের কোনো খবর রাখতে পারিনি। সাহায্য সহযোগিতাও করিনি।
ঢাকা এসে সিদ্ধান্ত হলো, নবাবগঞ্জে যেতে হবে। নবাবগঞ্জে রুহুল আমিন কায়সার আছেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। খবর পেলাম ইতিমধ্যে আমাদের কিছুসদস্য সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা ও কলকাতায় গিয়েছে। তারা যোগাযোগ করেছে আমাদের এককালীন রাজনীতিক বন্ধু বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপির নেতাদের সঙ্গে। আমাদের ছেলেরা কুষ্টিয়া সীমান্তে ভারতের মাটিতে প্রথম শিবির গড়ে তুলেছিল।
নবাবগঞ্জে সিদ্ধান্ত হলো আমাকে কোলকাতা যেতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু আমার যাওয়া তেমন সহজ ছিল না।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। আমার মা-ভাইবোন সকলেই ভারতে চলে যায়। ১৯৪৮ সালে আমি জেলে চলে যাই। জেল থেকে ফিরতে ফিরতে পাঁচ বছর। তারপর জেল আর আত্মগোপন করতে করতে ষাটের দশক এসে গেলো। আর ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৩ বছর পাকিস্তান সরকার কোনোদিন আমাকে পাসপোর্ট দেয়নি। ওই ২৩ বছর আমার সঙ্গে দেখা হয়নি মা-ভাই বোনদের। ২৩ বছর পর আমাকে বলা হচ্ছে, আমাকে এবার ভারত যেতে হবে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। সীমান্ত অতিক্রম করে। এই পালিয়ে যাওয়া নিয়ে আমার কাছে একটা মানসিক প্রশ্ন উঠেছিল।
ইতিমধ্যে আমি রায়েরবাজারে আশ্রয় পেয়েছি। আশ্রয়দাতা আমাদের নগর কমিটির সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন–সে এক অদ্ভুত মানুষ। তিনি আমাকে আশ্রয় দিলেন। তাঁর স্ত্রী পুত্র কেউই জানত না, আমি কে। লক্ষ্মীপুরের এক মওলানা সাহেব তার বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষা দেয়া ছিল তাঁর দায়িত্ব। এই মওলানা সাহেব এবার বাড়ি গেলেন। তাঁর পদে আমি নিযুক্ত হলাম। ধর্ম শিক্ষা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মোহাম্মদ হোসেনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি রাজনীতির গল্প করতাম। যাবার আগে মওলানা সাহেব বললেন, হুজুর আপনি তো আদৌ পড়াচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সারাদিন নকশালদের মতো গল্প করেন। এ পরিস্থিতিতে স্থির হলো আমি ভারতে যাব। আমার সঙ্গে যাবে আমাদের নরসিংদীর অন্যতম কর্মী কাজী হাতেম আলী।
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। একদিন দুপুরে মোহাম্মদ হোসেনের হোন্ডার পেছনে চড়ে আমি ডেমরার ওপারে তারাবো পৌঁছলাম। তারাবোতে নরসিংদীগামী বাস। তারাবোতে হাতেম আলীকে সঙ্গে নিয়ে এসে উঠলাম। লক্ষ করলাম বাসে সব যাত্রী আমাদের চেনা। আমাদের নামতে হলো মাধবদী।
মাধবদী থেকে মেঘনার পাড়। রাত কাটিয়ে পরের দিন করিমপুর। করিমপুর থেকে খানাবাড়ি হয়ে দুদিন পর নবীনগর। নবীনগর থেকে ভারত সীমান্ত। একদিন সন্ধ্যার আঁধারে আমি আর হাতেম আলী অচেনা আগরতলা শহরে পৌঁছলাম। হোটেলের সামনে নতুন এক দেখা দেখলাম। কে যেন লিখে রেখেছে হিন্দু হোটেলের সামনে হিন্দু মুসলমান বুঝি না, বাঙালি ছাড়া চিনি না। অর্থাৎ আগরতলা শহরের রূপান্তর হচ্ছে। অসংখ্য বাঙালি হিন্দু অধুষিত আগরতলা শহরের সীমান্তের ওপার থেকে অসংখ্য বাঙালি এসেছে। সবাই মিলে একাকার হয়ে গেছে। সবাই বাঙালি। সব হোটেলেরই দুয়ার খোলা। আমি এবং হাতেম আলী একটি মুসলিম হোটেলে গিয়ে উঠলাম। একজনের ঘুমাবার মতো এক চিলতে একটি খাট দুজনে ভাড়া করলাম। কারণ আমাদের সঙ্গে সীমিত টাকা। জানি না কে কীভাবে আমাদের সাহায্য করবে। এবার শুরু হলো ৭১-এর ভারতীয় জীবন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেক দৃশ্য। আরেক ছবি।
আগরতলায় পৌঁছে মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার দিন মনটা খারাপ ছিল। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে গেছে। আমরা ৭ জন সীমান্তে দাঁড়িয়ে। আমি, কাজী হাতেম আলী ও নরসিংদীর আরো ৫ জন তরুণ। সীমান্ত পাড়ি দেয়ার আগে আমার মনে হলো, এভাবে চোরের মতো পালিয়ে ভারতে যাব না। ২৩ বছর পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট দেয়নি। তবুও পাকিস্তানের ভয়ে চোরের মতো দেশ ছেড়ে পালাইনি। আমি প্রস্তাব করলাম, চলো আমরা ঢাকায় ফিরে যাই।
কিন্তু সঙ্গীরা রাজি হলো না। তারা বলল, কোথায় উঠবেন। কে আমাদের জায়গা দেবে? ইচ্ছে হলেই আবার নবীনগর হয়ে ঢাকা ফিরে যাওয়া সম্ভব কি? আমি বুঝতে পারলাম ওদের নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়া যাবে না। এবার সবাই মিলে একটা কাজ করলাম। বাংলাদেশের সীমান্ত পার হওয়ার আগে বাংলাদেশের কিছুটা মাটি সবাই পকেটে নিলাম। বললাম, যেখানেই মরি না কেন আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মাটি থাকবে। আজ এত বছর পরে মনে হচ্ছে কী ছেলেমিই না করেছি। বাস্তবের কঠিন আঘাতে সে ভাবাবেগ খান খান হয়ে ভেঙে গেল ভারতের মাটিতে।
আগরতলার মাটিতে কত স্রোত। কত লোক। কত মত। আজ হয়তো তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কিন্তু অনেকেই বারবার আমার লেখা পড়ে উন্মা প্রকাশ করেন। কারণ আমি বানিয়ে লিখতে পারি না। তাই বানিয়ে লেখার কাহিনীর সঙ্গে আমার মতানৈক্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে।
আগরতলায় গিয়ে প্রকৃতপক্ষে বিপদে পড়ে গেলাম। আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বিভাজন একান্তই স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের উপদলীয় কোন্দল এবং আওয়ামী লীগ বনাম অন্যান্য দলের কোন্দল সকলের কাছেই জানা ব্যাপার। আগরতলায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দফতরের নাম হচ্ছে জয়বাংলা অফিস। এ জয়বাংলা অফিসের দায়িত্বে একান্তভাবেই আওয়ামী লীগ কর্মী এবং নেতারা। অন্যান্য দলের অনুপ্রবেশ সেখানে কঠিন। সুসম্পর্ক না থাকলে জয়বাংলা অফিস থেকে অন্যান্য দলের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া আদৌ সম্ভব নয়।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব তাজউদ্দিনের নেতৃত্ব মানতে চাচ্ছে না। তাজউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে তারা বৈঠক করছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতা হয়নি। তাই ন্যাপকে আগরতলায় জনসভা করতে দেখেছি ঐক্যফ্রন্ট গঠনের দাবিতে।
এই মতানৈক্য ও ঝগড়াঝাটির মধ্যে দেখেছি হাজার তরুণকে আগরতলার রাস্তায় ভিড় জমাতে। ওরা গ্রাম থেকে এসেছে। ওরা জানে না কোথায় যাবে। কোথায় ট্রেনিং নেবে। কীভাবে যুদ্ধ করবে। কোনো রাজনৈতিক নেতার কৃপাদৃষ্টি না পড়লে এরা যে মুক্তিযুদ্ধ যেতে পারবে না, এ ধারণাও তাদের ছিল না। ফলে অনেক তরুণকেই যুদ্ধ না করে দেশে ফিরতে হয়েছে। হয়তো দেশে এসে তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেছে বা সীমান্তের ওপারে যাবার জন্যে গর্ব অনুভব করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই রাইফেলের বাট পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় পরবর্তীকালে এই শ্রেণির তরুণেরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যা করবার নয়, তাই করেছে।
তবে কাহিনী এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সীমান্তের ওপারে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিল। তাদের প্রশিক্ষণের প্রথম দিকে তাদের রাজনৈতিক প্রশ্ন তখন মুখ্য হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ১৯৭১ সালের মে মাসে আমি দেখলাম রাজনৈতিক প্রশ্ন তখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। ডানপন্থী বামপন্থী নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। বামপন্থী বলে পরিচিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তরুণদের ফ্রন্টে যেতে দেয়া হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত এদের অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের বা দলের উদ্যোগে বাংলাদেশে এসে ঢুকেছে। নিজের এলাকায় নিজের মতো করে, যুদ্ধ করেছে। আগরতলা পৌঁছবার পূর্বে এ দৃশ্য দেখবার ধারণা আমার ছিল না।
আরেকটি চিত্র দেখছি শরণার্থী শিবিরে। আগরতলায় শরণার্থীদের শতকরা ৯০ জনই হিন্দু সম্প্রদায়ের। যুদ্ধের কারণে সীমান্তের অসংখ্য মুসলমান পরিবারও আগরতলায় আশ্রয় নিয়েছে। লক্ষ্য করেছি অধিকাংশ শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধ বিগ্রহের কোনো খবর নেই। অধিকাংশ হিন্দু ধরে নিয়েছে। তাদের আর দেশে ফেরা হবে না। ১৯৪৭ সালের পরে বারবার তারা আক্রান্ত হয়েছে। পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিলেই তারা হয়েছে প্রথম শিকার। এবারও তারাই প্রথম বিপদে পড়েছে। তারা জানে না এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে। তারা জানে না বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হবে। শুধু এইটুকু জানে যে, তাদের পক্ষে সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে কোনোদিন ফিরে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। তাই তাদের স্থায়ী আশ্রয় খুঁজতে হবে। চাকরি খুঁজতে হবে। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। তাদের কাছে যুদ্ধ অনেক গৌণ। প্রতিদিনের সমস্যাই মুখ্য। লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন নিতে হবে। সরকারি সাহায্য নিতে হবে। ফলে দেখা গেল হিন্দু যুবকদের মধ্যে ভয়ভীতি আবেগ উচ্ছ্বাস থাকলেও যুদ্ধে তারা যোগ দিচ্ছে না। যদিও তাদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
অপরদিকে মুসলমান যুবকদের চোখে ভিন্ন চিত্র। তাদের বাড়ি ফিরতে হবে। সে বাড়ির নাম পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ না হলে তাদের দেশে ফেরা সম্ভব না। দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গেছে। যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ তাদের চোখের সামনে নেই। আগরতলায় পৌঁছবার পূর্বে এ ধরনের কথা মনে কোনোদিনই জাগেনি।
তাই আগরতলা পৌঁছে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। ভাবলাম তাহলে কী হচ্ছে? আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, দলীয় পরিচয় দিয়ে এখানে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া যাবে না। ব্যক্তি হিসেবে আমি পরিচিত বলে আমি হয়তো কিছু সুযোগ সুবিধা পাব। কিন্তু আমাদের দলের কারো পক্ষে সরাসরি রিক্রুট হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যাওয়া সম্ভব নয়। রিটের কালে রাজনৈতিক পরিচয় হবে বড় পরিচয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে প্রশিক্ষণের জন্যেও গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ পরিস্থিতিতে আর এক বিপদে পড়লাম কাজী হাতেম আলীকে নিয়ে। তার প্রচণ্ড জ্বর। আমি ভাবছি তখন কলকাতা যাবো। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে কথা বলব।
তবে আগরতলায় তখন আমরা একেবারে নিঃসহায় নয়। স্থানীয়ভাবে কিছুটা সাহায্য পাচ্ছিলাম ত্রিপুরার বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপির কাছ থেকে। এছাড়া ত্রিপুরার বাঙালিরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সকলকেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। তখন ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখ আর মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ। ওই ১৬ লাখ মানুষ আমাদের সর্বদা পাশে দাঁড়িয়েছিল। কারণ এদেরও একটা আবেগ ছিল। এরা পাকিস্তান সৃষ্টির পর বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রিপুরা এসে আশ্রয় নেয়। এদের একটা স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তারা বাঁচতে চায়। সেই স্মৃতি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ৭১-এর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই স্মৃতি তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। এ আবেগের জন্যে তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ লাখ বাঙালিকে তারা কোলে তুলে নিয়েছিল। যে কোনো কারণেই হোক এ সত্যতা কোনোদিন কারো কলমে আসেনি।
আমরা বারবার ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই ৭১-এর সহযোগিতার জন্যে। কিন্তু কেউই মনে করার চেষ্টা করি না যে, ত্রিপুরা পশ্চিমবাংলা এবং আসামের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাঙালিরা না। থাকলে আমাদের কী হতো। সে বাঙালি আমাদেরই লোক। এপারের বাঙালি ওপারে গিয়ে উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুর মর্মজ্বালা থেকেই তারা লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে জায়গা দিয়েছে। স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববাসীর কাছে কোটি কোটি বাঙালি উদ্বাস্তুর কথা বলেছেন। বলেছেন, এ সঙ্কটের কোনো সমাধান না হলে এই উদ্বাস্তুদের ভরণ-পোষণ তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি কোনোদিনই উল্লেখ করেননি, এই উদ্বাস্তুদের অনেকেই সাহায্য এবং সহযোগিতা পেয়েছেন তাঁদের নিজেদের স্বজনদের কাছ থেকে। ভারতবর্ষের সীমান্ত এলাকায়। বাঙালিরা না থাকলে অবস্থা কী দাঁড়াতে আজ বোধ হয় তা কল্পনা করা যায় না।
এ পরিস্থিতি আগরতলায় আমাকে বিব্রত করত। সেখানে আলাপ করার মতো তেমন কেউ ছিল না। আগরতলার খেলার মাঠে থাকতেন সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য। তিনি কোলকাতার দৈনিক যুগান্তরের প্রতিনিধি। এক সময় তিনি বাংলাদেশের খবরাখবরের মধ্যমণি হয়ে গেলেন। আগরতলা হয়ে যারা ভারতে ঢুকেছেন, তাঁরা সকলেই তাঁর বাসায় থেকেছেন। তাঁর বাসায় সকল দলের ভিড়। সকলেই সেখানে থাকতেন। আগরতলায় কোনো সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে হলে অনিল দা-ই ছিল একমাত্র ভরসা।
এমন সময় খবর পেলাম অতীন দা আগরতলায় এসেছেন। অতীন দা হচ্ছেন কুমিল্লার অতীন্দ্রমোহন রায়। অগ্নিযুগের বিপ্লবী। অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি আগরতলায় পৌঁছালেন প্রায় নিঃস্ব হয়ে।
অতীন দা’র একমাত্র পুত্র অসীম রায় চৌধুরী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের রসায়নের ডেমোনেস্ট্রেটর। একমাত্র কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। কুমিল্লার বাড়িতে পুত্র ও পুত্রবধু নিয়ে তিনি থাকতেন। পাকিস্তান বাহিনী হামলা শুরু করার পর অতীন দা’র বাড়ি আক্রান্ত হয়। তাঁর পুত্র অসীমসহ পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায় দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও। অসীম এবং ধীরেন বাৰু আর ফিরে আসেননি ক্যান্টনমেন্ট থেকে। অতীন দা’ চলে এসেছেন আগরতলায়। কুমিল্লায় রয়ে গেছে অজন্তা। তাঁর পুত্রবধূ। আমি অতীন দা’র সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দেখলাম অতীন দা’র কোনো পরিবর্তন নেই। কুমিল্লায় যে অতীন দাকে দেখেছি, সেই অতীন দা’কেই আগরতলায় দেখলাম। অতীন দা সম্পর্কে বিপ্লবী প্রতুল গাঙ্গুলীর একটি মন্তব্য আছে। প্রতুল গাঙ্গুলী ছিলেন অনুশীলন সমিতির প্রধান নেতা। তিনি লিখেছেন, অতীনের কাছ থেকে কথা বের করা খুবই মুশকিল। অনুশীলন সমিতির নীতি হচ্ছে, কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। অতীন দা তার জীবনে পার্টির নির্দেশে পুলিশের দুই সহযোগীকে খুন করেছিলেন, আমৃত্যু সে কথা কাউকে কোনোদিন বলেননি। দলের নেতা হিসেবে জানতেন প্রতুল গাঙ্গুলী। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে প্রতুল গাঙ্গুলী সে কথা লিখে গেছেন। আমিও কোনোদিন চেষ্টা করে অতীন দা’র কাছ থেকে সে কথা জানতে পারিনি। সেই নিপ নীরব অতীন দা’কে আবার আগরতলায় দেখলাম। আগ বাড়িয়ে তিনি আমাকে বললেন না যে, পাকিস্তানি বাহিনী অসীমকে ধরে নিয়ে গেছে। অসীম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসেনি।
আগরতলায় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আবদুল গাফফার চৌধুরী ও অধ্যাপক পুলিন দে’র সঙ্গে। গাফফার আমাকে বলেছিল, আপনি লুঙ্গি পরে দাড়ি রেখে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? আমি বলেছিলাম আমি প্রকাশ্যে ঘুরতে চাই না। আমি আমার বাংলাদেশে ফিরে যাব। গাফফার হেসেছিল।
পুলিন বাবু বললেন, চলো তোমাকে এক কংগ্রেস নেতার কাছে নিয়ে যাই। কংগ্রেস নেতার নাম সুখময় সেনগুপ্ত। তিনি পরবর্তীকালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সুখময় বাবুর সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা আমাদের সাহায্য করছেন কেন? পাকিস্তান ভারতের এক নম্বর শত্রু। সেই পাকিস্তানে সংঘর্ষ হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে মার খেয়েছে হিন্দুরা। তারপর মার খাচ্ছে সকল সম্প্রদায়। দুর্গত হিন্দুদের জন্যে আপনারা সীমান্ত খুলে দিলে তার একটা অর্থ হয়। সকল সম্প্রদায়ের জন্যে সীমান্ত খুলে দিলেন কেন? আমাদের আশ্রয় দিচ্ছেন এবং যুদ্ধের জন্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কেন?
সুখময় বাবু কিছুটা বিমর্ষ হলেন। হয়তো এ ধরনের প্রশ্ন আগরতলায় গিয়ে কেউ করেনি। পুলিন বাবুও কিছুটা হতবাক হলেন। সুখময় বাবু বললেন, এ প্রশ্নের জবাব একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীই দিতে পারেন। আপনি নয়াদিল্লি গিয়ে তাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন।
কথা জমল না। সুখময় বাবু আমার আত্মীয়-স্বজনের কথা জানতে চাইলেন। বললেন, আগরতলায় অভিজাত এলাকায় আমার নাকি অনেক আত্মীয় আছে। তিনি বললেন, আপনি হোটেল ছেড়ে তাদের বাসায় উঠুন। আমি রাজি হলাম না। পাকিস্তান হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তারপর ২৩ বছর কেটে গেছে। এই ২৩ বছরে আমি ভারতে যাইনি। অধিকাংশ সময় কেটেছে জেলে অথবা পুলিশ এড়িয়ে আত্মগোপন করে। কোনো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আর একাত্তর সালে আগরতলার সকল বাঙালিই বিপর্যস্ত। সকলের বাড়িতেই শরণার্থী। এই পরিবেশে কাউকে বিব্রত করার ইচ্ছে আমার ছিল না। তাই হোটেলে ফিরে গেলাম।
এবার সিদ্ধান্ত হলো, কোলকাতা যেতে হবে। আরএসপির পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত হয়ে আমাদের অনেক বন্ধু ভারতে ঢুকেছে। কে কোথায় আছে জানি না। সকলের খোঁজ নিতে হবে। সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যুদ্ধের জন্যে প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার কোলকাতায় যাওয়া একান্ত জরুরি।
কিন্তু কোলকাতায় যাওয়া আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ১৯৪৭ সালের পর আমার মা-ভাই-বোন সকলেই ভারতে। তাদের সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের বাড়িতে কাকা আছেন। তবে জেল আর পুলিশ এড়াতে গিয়ে আমার পক্ষে বাড়ি যাওয়া হয়নি। দেশের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটাই ক্ষীণ।
তাই পশ্চিমবঙ্গ গেলে আমাকে বিপদে পড়তে হবে। মা-ভাই-বোন হয়তো কেউই রাজি হবে না আমাকে আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে দিতে। অথচ আমাকে বাংলাদেশে ফিরতেই হবে। যুদ্ধের মধ্যেই বাংলাদেশে আসতে হবে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে। টাকা সংগ্রহ করতে। দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্যে ভারতে নিয়ে যেতে। তাই স্থির করলাম আমি পশ্চিমবঙ্গে যাব। কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা করব না। মার সঙ্গে দেখা হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে।
আগরতলা থেকে কোলকাতা যাওয়ার দু’টি পথ আছে। একটি বিমান। অপরটি সড়ক পথে। বিমানে যাওয়ার মতো টাকা ছিল না। তাই সড়ক পথেই যাত্রা শুরু করলাম। সড়ক পথ একান্তই দুর্গম। আগরতলা থেকে পাহাড়ি পথে ধর্মনগর ১২৮ মাইল। একদিনে পৌঁছানো যায় না। ধর্মনগর থেকে ট্রেন যায় লামডিং। লামডিং থেকে কলকাতার ট্রেন। কোনো পথেই আমার জানা ছিল না।
৩৬ ঘন্টায় আগরতলা থেকে ধর্মনগর পৌঁছলাম। লামডিং পৌঁছলাম পরদিন বেলা দুটায়। সামনে একটি ট্রেন পেয়ে উঠে পড়লাম। জানতাম না ট্রেনটি যাচ্ছিল দিল্লি। ট্রেনটি ছিল সামরিক বাহিনীর জন্যে রিজার্ভ। আমি ছাড়া কোনো বেসামরিক ব্যক্তি ওই ট্রেনে উঠল না। ট্রেনে দেখা হলো বিহার রেজিমেন্টের সদস্যদের সঙ্গে। তখন বাংলাদেশের মানুষের কোনো অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হতো না। জয় বাংলা শব্দটি শুনলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বিহার রেজিমেন্টের লোকেরা আমাকে লুফে নিল। সাংবাদিক জেনে সব কথা জানতে চাইল। গল্প করতে করতে রাত কেটে গেল। ওরাই আমাকে খাওয়াল। পরের দিন দুপুরের দিকে জিজ্ঞাসা করলো-তুমি তো কলকাতা যাবে। আর এ ট্রেনতো যাচ্ছে দিল্লি। তুমি নামবে কোথায়? এবার আমার সম্বিত ফিরল। আমাকে নামতে হলো বিহারের বাবঙ্গিনী স্টেশনে। বলা হলো, ওখানে হাওড়া যাওয়ার ট্রেন আছে। তুমি ওই ট্রেনে কলকাতা পৌঁছতে পারবে।
আমার মা আসানসোলে থাকতেন। আমার সিদ্ধান্ত ছিল আসানসোল এড়াতে হবে। আসানসোল হয়ে কলকাতায় যাওয়া যাবে না। এখন মার সঙ্গে দেখা করলে বাংলাদেশে ফিরতে অসুবিধা হতে পারে। অথচ আমি জানতাম
যে ট্রেনটায় আমি চেপেছি ওই ট্রেন আসানসোলে দাঁড়াবে। কোনো খবর না রেখেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ট্রেনটি নড়ছে না। স্টেশনের নাম আসানসোলে। মনটা কেমন হয়ে গেল। মা-ভাই-বোন সকলের কথাই মনে পড়ল। কিন্তু আমার নামা হলো না। কলকাতায় গিয়ে আরএসপি অফিসে উঠলাম।
কলকাতা এক ভিন্ন জগত। ১৯৪৮ সালে কলকাতা ছেড়েছি। ২৩ বছর পর আবার কলকাতায় এলাম। খুব একটা অচেনা লাগেনি। শুধু বিব্রত হয়েছি মানুষের প্রশ্নে। সকলেই বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়। শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছে এক কিংবদন্তী পুরুষ। বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের কাছে বোধগম্য নয়। তারা বুঝতে পারছে না কী করে এমন হতে পারে। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত একটি দেশের মানুষ কী করে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে সংগ্রামে নামতে পারে তাও মাত্র ২৩ বছরের মাথায়।
তবে এরপরেও কোলকাতার একটি ভিন্ন চিত্র আছে। বিরাট কোলকাতায় বাংলাদেশের যুদ্ধের কোনো ছাপ নেই। বাংলাদেশের যুদ্ধ আছে পত্রিকায় পাতায়, দেয়ালের প্রচারপত্রে, এককালের উদ্বাস্তুদের ঘরে ঘরে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরে। কলকাতা শহরে বাংলাদেশের সংগ্রাম অনুভব করা যায় না।
সেদিক থেকে আগরতলা অনেক ভালো। সীমান্তের কাছাকাছি আগরতলার অসংখ্য চেনা মানুষ আছে। মুক্তিবাহিনীর লোক আছে। আবহাওয়ায় একটি যুদ্ধের ছাপ আছে। আগরতলার আলোচনা একটিই–বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ। যুদ্ধ আর যুদ্ধ। বাংলাদেশ নিয়ে যুদ্ধ।
বুঝলাম কলকাতায় থাকা হবে না। যুদ্ধের কাছাকাছি যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে আগরতলায় আর বাংলাদেশে। সম্ভব হলে কলকাতার কিছু আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। যাওয়া যাবে না আসানসোলে।
এ কথা ভেবেই একদিন বিকেলে বড় বোনের বাসায় গেলাম। ২৩ বছর বড় বোন আমাকে চিনতেই পারলেন না। চিনল তার প্রথম সন্তান। আমাকে না জানিয়ে বড় বোন ট্ৰেলিগ্রাম করেছিল আসানসোলে। আরএসপি অফিসে এসে শুনলাম আসানসোল থেকে দুই ভাই এসেছিল আমাকে নিতে। শুনে গেছে আমি এই মুহূর্তে আসানসোল যাচ্ছি না। অনুনয় বিনয় করে গেছে আরএসপি নেতাদের কাছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
আমি তখন যুদ্ধের নেতাদের খুঁজছিলাম। মহাত্মা গান্ধী রোডে প্রয়াত ফণী ভূষণ মজুমদারের সঙ্গে এক হোটেলে দেখা হলো। এখানে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদও থাকতেন। শুনলাম আমাকে নাকি খোঁজা হচ্ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্যে। ফনী বাবু বললেন, তুমি একবার বালাগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাও। আমি রাজি হলাম না।
ইতিমধ্যে আমাদের দলের কিছু ছেলেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওরা কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া সীমান্ত ঢুকেছিল। সীমান্ত এলাকায়। ওখানে ওরা মুক্তিবাহিনীর শিবির গড়ে তুলেছে। ওটাই বোধ হয় ভারতের মাটিতে প্রথম মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। ওখান থেকে আমাদের কিছু কিছু ছেলে ট্রেনিং নেবার জন্যে বিহারের চাকুলিয়ায় গিয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে যুদ্ধ করার জন্যে। তবে পরবর্তীকালে এই ক্যাম্পটি নিয়ে একটি ভিন্ন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। এই ক্যাম্প সফরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও সেনাবাহিনী প্রধান ওসমানী এসেছিলেন। ছেলেদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা সরকার এই ক্যাম্পটিকে বাতিল করেন। কারণ এই ক্যাম্প বামপন্থীদের দখলে। ৭১ সালের এই ঘটনা আজকে অনেককে হয়তো অবাক করবে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা সেকালে অনেক ঘটেছিল। যা আজকে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আমি ঠিক করলাম আগরতলা ফিরব। আগরতলা হয়ে বাংলাদেশ। বন্ধুরা বলল একটু অপেক্ষা করুন। ২৯ জুন ইয়াহিয়া খান ভাষণ দেবে। ওই ভাষণে নতুন কিছু থাকতে পারে। ওই ভাষণের পরই আপনি দেশে ফিরে যেতে পারেন।
আমার সেদিন কৌতুক অনুভব হয়েছিল। আমরা যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করব। এটাই আমাদের শপথ ও প্রতিজ্ঞা। অথচ আমরা সবাই অপেক্ষা করছি ইয়াহিয়া খানের ভাষণের জন্যে। আমরা ভাবছি হয়তো বা একটা আপোষ হবে।
আমাদের কারো কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেই। কারো চোখের সামনে সুস্পষ্ট কোনো ভবিষ্যতের দৃষ্টি নেই। অথচ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। প্রাণ দেয়ার এবং নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম কোলকাতায় থেকে কোনো লাভই হবে না। ইয়াহিয়া খানের ২৯ জুনের ভাষণ শুনলাম। সে ভাষণে কিছুই ছিল না। আমি আগরতলা ফিরে এলাম। মা ভাই বোন কারো সঙ্গে দেখা না করেই।
ফিরে দেখি ভিন্ন পরিস্থিতি। শহরটা গিজগিজ করছে। আরো শরণার্থী এসেছে। এসেছে মুক্তিযোদ্ধা। আরএসপি আমাদের একটি থাকার জায়গা দিয়েছে মঠ চৌমুহনীতে। আরএসপির অঙ্গ সংগঠন প্রগ্রেসিভ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (পিএসইউ)। এই পিএসইউ অফিসে আমাদের জায়গা হয়েছে। ঘরটি খুব বড় নয়। নিজেদের রান্না করতে যেতে হয়। মেঝেতে ঘুমাতে হয়। শরণার্থীদের ভাগ থেকে কয়েকটি কম্বল পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে কয়েকটি মশারী। খাওয়া নিয়ে প্রায়ই গোলমাল হয়। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় আগরতলায় সব কিছুরই দাম বেশি। প্রায় সবকিছুর দাম কেজি প্রতি ১ টাকা ২০ নয়া। এই নয়া শব্দটি শুনলেই আমাদের ছেলেরা হাসে। তখন ভারতে নয়া পয়সা চালু হয়েছে। ৬৪ পয়সার এক টাকার পরিবর্তে চালু হয়েছে একশ’ পয়সার এক টাকার দশমিকের হিসাব। আমাদের ছেলেরা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ নয়। তাই বাজারে গিয়ে কখনো ঠকে কখনো জেতে।
আমাদের নিয়মিত খাবার ডাল, ভাত ও মিষ্টি কুমড়া। মাছ এবং ডিমের খুব দাম। সব কিছুই তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগরতলায় আমদানি। সীমান্তে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ডিম, মাছ, তারকারির দাম বাড়ে।
আমাদের হয়েছে ভিন্ন ধরনের বিপদ। আমরা আওয়ামী লীগ করি না। ন্যাপ কিংবা কমিউনিস্ট পার্টিও করি না। স্বাধীন বাংলা সরকারের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কম। আমাদের আগরতলার বন্ধুরা আরএসপি করে। তাদের সঙ্গে আগরতলার কংগ্রেসের সম্পর্কও ভালো নয়। তাই সেদিক দিয়েও আমাদের প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করতে হয়েছে।
আমাদের ঘরের পেছনে একটি পুকুর আছে। আমি ইচ্ছা করলেও ওই পুকুরে স্নান করতে পারি না। পুকুরের তিন দিকে আবাসিক এলাকা। পুকুরের ঘাটে ছেলে মেয়েদের ভিড় থাকে। আমাদের বন্ধু শ্রমিক নেতা মিসির আহমদ নির্বিঘ্নে ওই ঘাটে গিয়ে স্নান করে আসেন। কিন্তু আমার পক্ষে বিপদ। আমার পরনে লুঙ্গি এবং মুখ ভর্তি দাড়ি। একেবারে মাওলানা সাহেব। আমাকে কিছু দূর হেঁটে কলেজ টিলায় গিয়ে স্নান করে আসতে হয়।
আগরতলার একটি ভিন্ন রূপ আছে। এককালে রাজাদের শাসনে ছিল। সড়কগুলোর একটি ভিন্ন রূপ আছে। এই সড়কগুলোর নামের মধ্যে চৌমুহনী শব্দটি থাকে। যেমন আমরা ছিলাম মঠ চৌমুহনীতে। তেমনি নাম আছে কামান চৌমুহনী। আগরতলায় আমার বেশি কাজ ছিল না। নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা ছাড়া। দুশ্চিন্তা ছিল অনেক। দেশ থেকে লোক আসছে। কিন্তু ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে পারছি না। এর মধ্যে একদিন শ্রমিক লীগের আব্দুল মান্নান এবং আদমজীর সাদুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওদের সঙ্গে ওদের ক্যাম্পে চলে গেলাম। এক সময় এ দুজনই আমাদের দলের লোক ছিল। বলা যেতে পারে এদের রাজনৈতিক জীবন আমাদের হাতেই শুরু। আওয়ামী লীগ ৬ দফা দাবি পেশ করার পর এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শিথিল হয়। তবে ছিন্ন হয়নি। সাদু বলল, মুক্তিযুদ্ধে যেতে হলে আমাদের কাছে লোক পাঠাবেন। আমরা শ্রমিক লীগের কোটায় ভর্তি করাব। আপনার নাম করে কেউ এলে কোনো অসুবিধা হবে না।
সাদুদের ক্যাম্পে ভাত খেয়ে নিজের এলাকায় ফিরলাম। এরকম ভাত খাওয়ার বহু বাড়ি আমার ছিল। কিন্তু বন্ধুদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতাম না। খাবার সময় কোনোদিন ডিম জুটলে ভাবতাম খুব ভালো খেয়েছি।
একদিন রাস্তায় প্রকৌশলী মানিক গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কুমিল্লার অধিবাসী মানিক গাঙ্গুলীর প্রকৃত নাম তুষার গাঙ্গুলী, ওয়াপদা প্রকৌশলী। মানিক বাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার পরিচিতির পরিধি বাড়ল। দেখা হলো জগদীশ কুণ্ডের সঙ্গে। জগদীশ বাবুর স্ত্রী চিত্রা। শ্যালিকা উত্তরা। জগদীশ বাবুর শাশুড়ি আমরা বাঙালি সংগঠনের সদস্য। আমরা বাঙালি সংগঠন আগরতলায় খুব পরিচিত। ওরা বাংলা ছাড়া কোনো ভাষাকেই পাত্তা দেয় না। জানি না, বাঙালি রাজ্যের পত্তন করাই ওদের লক্ষ্য ছিল কিনা। আগরতলার এ কাহিনী ১৯৭১ সালে। তারপর ২৬ বছর কেটে গেছে। আগরতলা যাওয়া হয়নি। সেখানকার মানুষের নামগুলো মনে আছে। জানি না লোকগুলো কেমন আছে।
মঠ চৌমুহনীতে আমাদের ঘরের সামনে একটি সড়ক। সড়কের শেষে একটি হোস্টেল। সেই হোস্টেলে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের বন্ধুরা আছে। তাদেরও চা খেতে হলে আমাদের এলাকায় আসতে হয়।
আমি ভোর থেকেই দুয়ার খুলে পড়তে বসি। নিজেকে সড়কের পাহারাদার মনে হয়। সামনের বাড়িতে এক দম্পত্তি থাকে। ছেলেটি বাঙালি, মেয়েটি চাকমা। মাঝে মাঝে তাদের হাসতে এবং রাগতে দেখি। মঠ চৌমুহনীর মোড়ে প্রতিদিন ভোরের দিকে এক সুশ্রী তরুণী এসে দাঁড়ায়। বাসে সে কয়েরপুর যায়। আবার নির্ধারিত সময়ে বিকালে সে ফিরে আসে। শুনেছি সে মাস্টারি করে। আগরতলায় এভাবে কারো সম্পর্কে শুনতে এবং জানতে গেলে জানা যাবে এরা প্রায় সকলেই এককালের বাংলাদেশের লোক। প্রায় সকলেরই বাড়ি ছিল আখাউড়া বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এদের পেশা ব্যবসা, গাড়ি চালানো বা শিক্ষকতা।
তখন আগরতলা কেন্দ্রীয় শাসিত রাজ্য। নিজস্ব আয় দুই কোটি টাকা। বার্ষিক ব্যয় হচ্ছে ৪২ কোটি টাকা। ৪০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিত কেন্দ্রীয় সরকার। আগরতলায় কোনো মৌলিক শিল্প কারখানা নেই। শিক্ষকতা, সাধারণ ব্যবসা বা বাস ট্রাকের মালিক হওয়া বা মালিকের পরিবহনে শ্রমিক হওয়াই একমাত্র পেশা ছিল আগরতলায়। আমার চেনা জগদীশ বাবু চিত্রা কিংবা উত্তরা সকলেই শিক্ষক।
আজ ২৬ বছর পরেও দু’টি ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। তখন ঢাকায় প্রতিকাপ চা ছিল দুই আনা। আগরতলায় ৩০ পয়সা আমার চা খাওয়ার নেশা ছিল। কিন্তু পয়সা কোথায়। মঠ চৌমুহনীর মোড়ে দু’তিনটি চায়ের দোকান। ভাবলাম ওদের সঙ্গে ভাব করা যায় কিনা। আমি সারাদিন বই পড়ি বলে এলাকায় একটি পরিচিতি আছে। তাদের বিস্ময় যে একজন মাওলানা সারাদিন কী করে বই পড়ে। একদিন এক রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই একটি ছেলে বলল আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড মাস্টার? বুঝলাম ছেলেটির বুদ্ধির দৌড় সীমাবদ্ধ। তারপর প্রশ্ন হলো, আপনাদের আল্লাহতো আপনাদের রক্ষা করতে পারল না। আপনাদেরতো ইসলামিক রাষ্ট্র। আমি বললাম, তোমাদের কালীও কিছু করতে পারল না। শুনেছি গৌরনদী থানার বার্থি কালীবাড়ির কালীকে পাঞ্জাবিরা গুলি করেছে। তোমাদের কালী তাদের কিছুই বলেনি। ছেলেটি একটু মুষড়ে পড়ল। বললো ধর্ম নিয়ে আলোচনা ভালো নয়। আমি বললাম, আমি ধর্ম মানি না। ধর্ম বিশ্বাসও করি না। ছেলেটি বলল, আপনাকে একটি বই পড়তে দিবো। এই বই আমার গুরুদেবের। গুরুর নাম স্বামী স্বরূপানন্দ। তিনি সাক্ষাৎ দেবতা। পৃথিবীতে কী হতে পারে বা হবে সবকিছুই নাকি তাঁর বইতে লেখা আছে। আমি ছেলেটির কাছ থেকে স্বরূপানন্দের রচনাবলি নিলাম। ছেলেটি খুশি হলো। সে বলল, এবার প্রতি কাপ চায়ের জন্যে আপনাকে ৩০ পয়সা দিতে হবে না। ২০ পয়সা দিলেই চলবে।
আগরতলায় থাকতে এই একটি দোকানে ২০ পয়সায় চা খেতাম এবং লক্ষ করেছি স্বামী স্বরূপানন্দ হিন্দুদের মধ্যে বিশেষ পরিচিত। বিশেষ করে এককালের বাংলাদেশের অধিবাসীরা স্বরূপানন্দের অনুরক্ত। স্বামীজী লিখেছেন, এককালে বাংলাদেশ যাওয়া নাকি সহজ হবে। এটাই ওদের চরম পাওয়া। যারা এই চরম পাওয়ার প্রশ্নটি না বুঝছেন, তাঁদের পক্ষে স্বরূপানন্দের প্রতি এই গভীর অনুরাগের মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
আগরতলায় গিয়ে আমার নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে নতুন ধারণা হয়েছিল। আমার সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকত শহিদুল্লাহ। শহিদুল্লার বাড়ি ভোলা। এক সময় দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক পাকিস্তানে চাকরি করত। ১৯৭১ সালে শহিদুল্লাহ বারবার আগরতলায় যাতায়াত করেছে। আগরতলায় সে আমার সঙ্গে কলেজ টিলায় স্নান করতে যেত। একদিন আমি স্নান করতে যাইনি। শহিদুল্লাহ স্নান করতে গিয়ে ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। এসে বললো, স্যার তাজ্জব কাণ্ড। একেবারে অবাক কাণ্ড। একি দৃশ্য দেখলাম স্যার।
আমি শহিদুল্লাহর কথা তেমন বিস্মিত হলাম না। শহিদুল্লা সাধারণ ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে অনেক বিশেষণের আমদানি করে। ছোটখাটো ঘটনাকেও বড় করে তোলে। শহিদুল্লাহর কাহিনী হচ্ছে সে মঠ চৌমুহনী থেকে কলেজ টিলায় স্নান করতে যাচ্ছিল। কলেজ টিলায় যাওয়ার পথে সড়কের পাশে একটি প্রেস আছে। সড়ক থেকে দেখা যায় যে ওই প্রেসে কম্পোজিটররা কাজ করছে। আমরা নিত্যদিন ঐ ছবি দেখছি। কিন্তু শহিদুল্লাহ আজ ভিন্ন ছবি দেখেছে। শহিদুল্লাহ লক্ষ করেছে যে একজন মহিলা কম্পোজিটর কাজ করেছে। এমন তাজ্জব কাণ্ড শহিদুল্লাহ জীবনে দেখেনি। এ কথা শহিদুল্লাহ জীবনেও ভাবেনি।
২৬ বছর আগের কথা। আমাদের সমাজে তখন বোরখার একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। আর্থিক দুর্নীতি তখনো ঘরের মেয়েকে ঘরের বাইরে বের করেনি। ভারতে তখন ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা নেমেছে জীবনযুদ্ধে।
আগরতলায় প্রতিদিন কোনো রেস্টুরেন্টে বা কোনো বাসায় এক ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হতো। ওরা আমাদের গাড়ি দেখে অবাক হতো। আমাদের দেশের অনেক নেতা গাড়ি নিয়ে আগরতলা গিয়েছিল। জাপানি সুন্দর গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আগরতলার লোক বিস্মিত হতো। তাদের দেশ অর্থাৎ ভারতে তেমন গাড়ি নেই। তখন ভারতে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ ছিল। তকন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রণীত নীতি অনুসৃত হচ্ছিল। নেহরুর নীতি হচ্ছে কোনো আমদানি নয়। দেশে মূল, বৃহৎ শিল্প স্থাপন করো। নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করো। এ লক্ষ্য নেহরু নিয়েছিলেন বিশ্বের পরাশক্তির দ্বন্দ্বের কারণে। এই দ্বন্দ্বের ফলে পুলিশি এবং সমাজতন্ত্রী উভয় শিবিরই ভারতকে সাহায্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে যেত তার অবস্থান এবং জনসংখ্যার জন্যে। তাই ভারতে আলপিন থেকে গাড়ি পর্যন্ত সকলই ছিল নিজস্ব। আমদানি ছিল নিষিদ্ধ।
আগরতলার মানুষ প্রথম আমাদের গাড়ির বাহার দেখে চমৎকৃত হতো। তারপর তর্ক জুড়ে দিত। বলত, আমাদের নিজেদের বলে কিছু নেই। সবকিছু জাপানি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। আপনারা স্বাধীনতা যুদ্ধ করবেন কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়াবেন কী করে? এ প্রশ্নে আমি ভারতীয়দের একটি প্রচ্ছন্ন গর্ব দেখেছি। আর এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ভারত সীমান্তের একজন ভারতীয় জোয়ানের কথা। তিনি ভারত সীমান্তে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে আটক করেছিলেন। পরে শুনলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুনলেন তাঁর ঢাকায় বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। টেলিভিশন আছে। সেই অধ্যাপককে সসম্মানে ছেড়ে দিতে গিয়ে সেই জোয়ান জিজ্ঞাসা করেছিলেন–তা হলে আপনারা লড়াই করবেন কেন? কেন স্বাধীনতা চাচ্ছেন। আমাদের দেশের অধ্যাপকদের এতো সুযোগ-সুবিধা নেই। ভারতে বিপাকে পড়তাম ধর্মীয় চর্চা নিয়ে। রাস্তাঘাটে সর্বত্রই কোনো না কোনো আশ্রম বা পূজার ব্যবস্থা। আমাদের দেশে শনিবার হিন্দুরা শণিপূজা করে থাকে। কিন্তু কোথাও শণিতলা দেখিনি। আগরতলায় দেখেছি সড়কের পাশে কোনো একটি গাছ ঘিরে বেড়া দিয়ে শণিতলা বানিয়েছে। ওই এলাকা দিয়ে যেতে গেলে এদের দেখে পথচারিদের কাছে পয়সা চাইবে। না দিলে মস্তানদের মতো আচরণ করবে। ধর্মের এমন মাস্তানিরূপ এর আগে আমার কোথাও চোখে পড়েনি। তবে এই হামলা দেখে আমরা সাহস করে কথা বলতে পারলে মাফ পেয়েছি। বলেছি আমরা জয়বাংলার লোক। ব্যাস। সব সমস্যার সমাধান। জানি না এখনো আগরতলায় শণিতলার হামলা আছে কিনা।
জুলাই শেষ হতে চলেছে। আমাদের সংগ্রাম নিয়ে নানা কথা উঠেছে। একদিন সুখময় বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা শ্ৰীমতী গান্ধীকে, সমালোচনা করছেন বাংলাদেশে অভিযান না চালাবার জন্যে। কিন্তু আপনারা কি কথা দিতে পারেন যে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে আপনাদের জনগণ আমাদের মেনে নেবে? একদিন আমাদের আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে না তো? যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের মানসিকতা থাকবে কি? আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কোনোদিন ভালো ছিল না। একটি বিশেষ মানসিকতায় পরিবেশে দু’দেশের সাধারণ মানুষ ১৯৪৭ সালের পর বেড়ে উঠেছে। এ ইতিহাস বাদ দিয়েও ভারত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এতে ঝুঁকি অনেক।
এবার সুখময় সেনগুপ্তকে ভিন্ন মানুষ মনে হলো। এককালের কুমিল্লার একটি গ্রুপের নেতা তার প্রতিদ্বন্দ্বি গ্রুপের নেতা শচীন সিং এখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। আমার প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, সকল প্রশ্নের জবাব পেতে হলে নয়াদিল্লি যান। শ্রীমতী গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করুন। এবার তিনি নিজেই কথা বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, বাংলাদেশের মানুষ কথা বলুন। বলুন, তারা এ যুদ্ধ কিভাবে নেবে। এ যুদ্ধ একদিন আসবে। কিন্তু এর প্রভাব থাকবে দীর্ঘদিন।
আমি সেদিন সুখময় বাবুর কথার জবাব দিইনি। এ প্রশ্ন তেমন করে ভেবে দেখিনি। তবে শ্রীমতী গান্ধী কেন পাকিস্তানকে আক্রমণ করছেন না এ জন্যে তার সমালোচনা শুনেছি। ঢাকা এবং আগরতলায় হা-হুঁতাশ শুনেছি। ঢাকার খেদোক্তি শুনেছি, শ্ৰীমতী গান্ধী কি আমাদের মেরে ফেলতে চান?
তখন আমার কাছে এ প্রশ্নের জবাব ছিল না। পরবর্তীকালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্তের কথা আমার কানে বাজছিল। তাঁকে বললাম, আমি ঢাকা যাচ্ছি। ফিরে এসে জবাব দেব।
আমি ১৯৭১ সালের জুলাই মাস আগরতলা থেকে ঢাকা ফিরব শুনে সকলে অবাক। এ সময় তো সকল নেতাদের পালাবার কথা। বাংলাদেশ থেকে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আসার কথা। এছাড়া আমি সাংবাদিক। নাম নির্মল সেন। কেউ হাতে পেলে ছাড়বে না। আর পরিবারের যারা দেশে ছিল তারা এখনো গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আছে। বন্ধুরা রাজি হলেন না। তবে আমাকে আটকাবার সাধ্য কারো নেই। তাই জুলাই মাসে রওনা হলাম ঢাকার পথে। পরনে লুঙ্গি শার্ট। মুখে দাড়ি। সঙ্গে সঙ্গী জুটে গেল। তাদের কথায় পরে আসছি।
আগরতলা ছাড়বার আগে আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁদের তিনটি ছেলে বাংলাদেশে আসবে। আমরা এক সঙ্গে রওনা হলাম। ওই তিনটি ছেলের মধ্যে একজন হচ্ছে গজারিয়ার আতাউর। দ্বিতীয় শেখর নগরের দেলোয়ার। আর তৃতীয় ঢাকার শহিদুল্লাহ। আতাউর আর দেলোয়ার ঢাকায় ফিরছে। কসিম বেপারী ও কফিলউদ্দীন চৌধুরীকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। এরা দু’জনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তাদের ধারণা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকে বাংলাদেশে থাকলে ওরা আত্মসমর্পণ করবে। শহিদুল্লাহর এমন কোনো দায়িত্ব নেই। শহিদুল্লাহ মনমরা। সে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে, তাই তার আনন্দ আগরতলায় সে খুব কষ্টে ছিল। আগরতলায় আসাই তার নাকি ঠিক হয়নি।
জুলাই মাসের রোদ-বৃষ্টি ঝুঁকি নিয়ে আমরা বাসে সোনামুরায় এলাম। এখন হাঁটবার পালা। এবার পাহাড়ি সড়ক। চড়াই আর উত্রাই। মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামছে। আমাদের সঙ্গে কোনো ছাতা নেই। আমরা ভিজে যাচ্ছি। আবার রোদ উঠছে। আমাদের জামা কাপড় শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে তখন ভিন্ন চিন্তা। কোনো কিছু ঠিক করে দেশের পথে পা বাড়াইনি। আগরতলা এসেছিলাম ভিন্ন। পথে। কুমিল্লার নবীনগর হয়ে। এবার যাচ্ছি আর এক পথে। সম্পূর্ণ অপরিচিত পথ। বুড়িচং থানা দিয়ে সীমান্ত পার হতে হবে। রাতে কোথায় থাকতে হবে জানি না। ঢাকায় গিয়েও কোথায় উঠব স্থির করিনি। ঢাকায় অনেক চেনা মানুষ আছে। কিন্তু কারো বাসায় যাওয়া যাবে না। যেতে হবে রায়েরবাজারের জাফরাবাদ। ওখানে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মোহাম্মদ হোসেনের বাড়ি। তার বাড়ি থেকে মাস দুই আগে ভারত যাত্রা করেছিলাম। জানি না ওই বাড়িতে কেউ আছে কিনা বা কেমন আছে। ঢাকার অবস্থাও জানি না। শুধু জানি রুহুল আমিন কায়সার ছাড়া সবাই অখুশি হবে। ভয় পাবে। ভাববে, আমি আবার ঢাকায় এলাম কেন।
ভাবতে ভাবতে পথ চলছি। জানি না কখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদশে ঢুকেছি। সারাটা পথ দেলোয়ার কথা বলেছে। যতদূর মনে আছে বক্সগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি। সেদিন বক্সগঞ্জের হাট। রাস্তায় অনেক লোক। ওই লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে সন্ধ্যার দিকে গোবিন্দপুর পৌঁছলাম। মাইল খানেক দূরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। সন্ধ্যার আগে দোকান পাট বন্ধ। সর্বত্র একটা থমথমে ভাব। আমাদের ক্ষুধা পেয়েছিল। দীর্ঘদিন আগরতলায় ভালো কিছু খাইনি। ভাবলাম গোবিন্দপুর বাজারে ভালো কিছু খাবার পাওয়া যাবে। বাজারে একটি মাত্র দোকান খোলা। মাংস ভাত আর দুধ ছাড়া কিছুই মিলল না। ঐ সকল এলাকায় তখন সন্ধ্যার দিকে কেউ হাট বাজারে আসে না। আমাদের দেখে সকলের কৌতূহল হলো। লোক জমে গেল। বুঝতে পারলাম তারা ধরে নিয়েছে আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। আমাদের বলা হয়েছিল গোবিন্দপুর বাজারে গেলে আমরা আশ্রয় পাবো। এখানে আবদুল খালেক বলে আওয়ামী লীগের এক কর্মী আছে। তাকে খুঁজতে হবে।
আমাদের মধ্যে বেশি কথা বলে দেলোয়ার। সে দোকানীকে জিজ্ঞেস করল খালেকের কথা। তার প্রশ্নে সবাই চমকে গেলো। একজন বলে উঠল, খালেক ভারতে চলে গেছে। আমাদের প্রশ্নে ওব্রা নিশ্চিত হলো যে আমরা মুক্তিবাহিনীর লোক। মনে হলো ওরা ভয় পেয়েছে। বারবার আমাদের হাতের ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছে। আমি এই ভয়ের সুযোগ নিলাম। একজনকে দোকানের পেছনে নিয়ে বললাম-আমার ধারণা আপনি মুক্তিবাহিনীর লোক। আজকের রাতের জন্যে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। লোকটি চমকে গেল। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো বাজারের গুদাম ঘরে।
রাতে তেমন ঘুম হলো না। একের পর এক মুক্তিবাহিনীর দল আসছে। এক দলের নেতা আমার পাশেই শুয়ে পড়ল। ওরা নাকি ইলিয়টগঞ্জের সেতু ভাঙতে যাবে। ওরা জোরেশোরেই কথা বলছিল। আমার তেমন ভালো লাগছিল না।
এমনি করে ভোর হয়ে গেল। আমাদের প্রায় কেউই ঘুমায়নি। সড়কে উঠতে হলে আমাদের গোমতী পার হতে হবে। কিন্তু কোনো খেয়া নৌকা নেই। অতিকষ্টে একখানি ডিঙ্গি পাওয়া গেল। ডিঙ্গিতে আমরা চারজন। হঠাৎ দেখলাম এক মাওলানা সাহেব আমাদের সামনে হাজির। ছয়ফুট দীর্ঘ। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। তিনিও এসেছেন সেতু ভাঙতে। কিন্তু পথ চেনে না। তিনি রেকি করতে বেড়িয়েছেন। তিনি আমাদের সঙ্গী হলেন। তাঁকে সিঅ্যান্ডবি সড়ক পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে এলাম।
আজ ২৬ বছর পর সে ছবিও স্পষ্ট। যেন চোখের সামনে জলজল করছে। ভোরের বেলা শিশির তখনো শুকায়নি। আমরা কারো বাড়ির পেছন দিয়ে কারো বাড়ির সামনে দিয়ে এগোচ্ছি। আমাদের পিঠে ব্যাগ। বিপর্যস্ত চেহারা। রাস্তায় রাস্তায় ভিড় জমেছে। বাচ্চারা আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। গৃহবধুরা ঘরের বার হয়েছে আমাদের দেখতে। প্রবীণেরা আমাদের দেখে দূরে সরে যাচ্ছে। সর্বত্র একটা ভয়, আনন্দ, আশা এবং প্রত্যাশা। আর সেদিন পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে এটা বুঝি ভিয়েতনামের দৃশ্য। আমরা বুঝি ভিয়েতনামের পথ দিয়ে হাঁটছি।
হাঁটতে হাঁটতে দুপুরে আমরা দীঘিরপাড় পৌঁছলাম। দীঘিরপাড় চান্দিনা ও দেবিদ্বার থানার মাঝামাঝি এলাকায়। দীঘিরপাড় থেকে ক্যান্টনমেন্ট বেশি দূরে নয়। ৭১ এর যুদ্ধে দীঘিরপাড় একটি অভূতপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কুমিল্লার বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকেছে। কেউ এসেছে নৌকায়। কেউ এসেছে হেঁটে। সন্ধ্যার পর সবাই জমেছে দীঘিরপাড়ে। আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় সারাদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। সবাই মিলেছে দীঘিরপাড়ে। সন্ধ্যার পরে সেখানে যেন একটি মুক্তিযোদ্ধার বাজার। একটি মুক্ত এলাকা। আমরা সেখানে পৌঁছলাম দুপুরে। কিন্তু আমরা যাব কোথায়?
এবার দেলোয়ার পথ নির্দেশ করল। সে বলল, দীঘিরপাড় থেকে নৌকায় গৌরীপুর যেতে হবে। গৌরীপুরে নৌকা পাল্টাতে হবে। নতুন নৌকা নিয়ে মতলব থানার বেলতলি যেতে হবে। রাতে থাকতে হবে আবুল হোসেনদের বাড়িতে। আবুল হোসেন ব্যাংকে চাকরি করে ঢাকায়। ন্যাপ নেতা। এলাকায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত। দেলোয়ারের কথা অনুযায়ী আমরা দীঘিরপাড়ের নৌকা নিলাম। নৌকায় গৌরীপুর থেকে বেলতলী। বেলতলী পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
অবাক কাণ্ড। আবুল হোসেন বাড়িতে নেই। ঢাকা থেকে সেই বাড়ি হয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা যাচ্ছে সীমান্তে। ফিরছে ওই পথে। আবুল হোসেন কখনো আগরতলা যাচ্ছে। কখনো ঘুরছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। তবে সে বাড়িতে যেই আসুক না কেন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। আবুল হোসেনের বৃদ্ধ পিতা সন্তানের মতো সবাইকে স্নেহ করেন। বৃদ্ধের বড় আক্ষেপ। তিনি বলেছেন, সব বাপের পুতেরা এমন করে যুদ্ধে গেলে দেশটা স্বাধীন হয়ে যেত। আমরা বেলতলিতে রাত কাটালাম। ভোরবেলা লঞ্চে উঠে মুন্সিগঞ্জে হয়ে ঢাকা পৌঁছলাম।
ঢাকার অবস্থান আমি জানি না। এবার আমি একা। দেলোয়ার মুন্সিগঞ্জ থেকে গেছে। আতাউর আর শহিদুল্লাহ ঢাকায় এসে নিজের আশ্রয়ে চলে গেল। আমি একটি রিকশা নিলাম। সদরঘাট থেকে রায়েরবাজার। রায়ের বাজারের জাফরাবাদ। বাড়িটা যেন চিনতে পারছিলাম না। সবাইকে সন্দেহ হচ্ছিল। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার হাতে ব্যাগ। পরনে লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট। মুখে দাড়ি। ওপাড়ায় এককালে আমি বড্ড পরিচিত ছিলাম। অনেক খুঁজে জাফরাবাদের ৮০ নম্বর বাড়িতে পৌঁছলাম। মোহাম্মদ হোসেন আমাকে দেখে হেসে ফেললেন। বললেন, আইছেন ভালো কাজ হইছে। অনেক কথা আছে। ইন্ডিয়া কিছু করে না কেন কইতে পারেন। আমরা এখানে মৰুম নাকি।
জুলাই মাসে ঢাকায় পৌঁছলাম। ৭১ সালের জুলাই। আমি কেন ঢাকায় এলাম সে প্রশ্ন সবার মনে। কেউ তখন ঢাকায় আসে না। আমি আগরতলা ও কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঢাকা ফিরলাম। কারো বিশ্বাস হচ্ছিল না। তখন চারদিকে যুদ্ধ আর যুদ্ধ।
কেন চাকায় এলাম? ২৬ বছর পর সে প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। আমি পেশায় রাজনীতিক এবং সাংবাদিক। হয়তো সাংবাদিক মনের একটা চাহিদা ছিল। হয়তো ভেবেছিলাম জীবনে এই অভিজ্ঞতা আর হবে না। ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ের লোকগুলোকে দেখেছি। এবার ইচ্ছা হলো তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছবি দেখবার। কেমন আছে সে অবরুদ্ধ মানুষগুলো। কী করছে। কিভাবে বেঁচে আছে। তখন ঢাকায় থাকার যে কী বিপদ আমি ঢাকায় না এলে বুঝতে পারতাম না। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, হয়তো বা দেশের মানুষগুলোকে দেখার জন্যেই সাংবাদিক হিসেবে আমি ঢাকায় এসেছিলাম।
কিন্তু রাজনীতিক হিসেবেও আমার একটি অভিজ্ঞতা ছিল। সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ভারতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম সেনাবাহিনীতে আমার যোগ দেয়া সম্ভব হবে না। গ্রহণযোগ্য হবে না। যুদ্ধে যেতে হলে কতগুলো পদ্ধতি আছে। ওই পদ্ধতি মোটামুটিভাবে আওয়ামী, ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির দখলে। আমি ভারতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি আমি ভারতে পৌঁছবার আগে যে বামপন্থী তরুণেরা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল তাদেরকেও কোথাও যেতে দেয়া হচ্ছে না। আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আমাদের দলের কেউ সরাসরি কোথাও গিয়ে ভর্তি হতে পারবে না। ভর্তি হতে গেলে গোপনে ভর্তি হতে হবে। অথবা নিজের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ঢুকে নিজেদের বাহিনী গড়ে যুদ্ধ করতে হবে। সে অবস্থা তখন আমাদের ছিল না। দল গঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে ২৯ আগস্ট। যুদ্ধ শুরু হলো ১৯৭১ এর মার্চে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে দলের কাঠামো দেয়া সম্ভব হয়নি। সুতরাং ভিন্নভাবে বাহিনী গড়ে তোলাও মুশকিল। তাই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের মুক্তিযুদ্ধে ঢুকিয়ে দেয়া। দেশে এসে কিছু মানুষকে নিয়ে আবার ভারতে চলে যাওয়া। সম্ভব হলে প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব না হলে তাদের যে কোনো উপায়ে ৭১-এর সংগ্রামে যুক্ত করা। যুদ্ধের বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া। আমার লক্ষ্য ছিল তরুণদের চোখের সামনে একটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি এঁকে দেয়া। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের বুঝতে শেখানো যে এ যুদ্ধ কঠিন। এ যুদ্ধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং এ যুদ্ধে গেলে পেছনে তাকানো যায় না।
আর ব্যক্তিগতভাবে আমি ভেবেছিলাম লেখালেখি ছাড়া আমার করণীয় আর কিছু নেই। প্রয়াত ফনীভূষণ মজুমদার আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারে যোগ দিতে বলেছিলেন। সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা ছিল না। দেখেছিলাম, এতবড় সগ্রামেও কোন্দল আর দলাদলি এবং শেষ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন স্বাধীন বাংলা বেতারে। আমার পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এই পটভূমিতে আমি বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। আমাদের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন কায়সার চির অসুস্থ মানুষটি তখন ঢাকা ছেড়ে অনেক দূরে আশ্রয় নিয়েছেন। আমাদের আহ্বায়ক খান সাইফুর রহমান তখন বরিশালে। অনেকদিন তাদের কোনো খবর পাচ্ছি না। তাদের খবর পাওয়া দরকার। সকলকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরে আমাদের নেতৃস্থানীয় কেউ সক্রিয় ছিল না। যারা ছিল তারা দুরে সরে গিয়েছে। একমাত্র নগর আহ্বায়ক কমরেড মোহাম্মদ হোসেন সক্রিয় আছে সব ক্ষেত্রে।
ঢাকায় এসে যুদ্ধের তেমন কোনো খোঁজখবর পেতাম না। লুকিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসি ধরতে হতো। সেকালে যুদ্ধের কতোগুলো নাম আমার যেনো মুখস্তু হয়েছিল। উত্তরের ভুরুঙ্গামারী, দক্ষিণের মিয়াবাজার বিবিরবাজার ও সুয়াগাজী এবং সিলেটের সালুটিকার বিমানবন্দরের নাম। প্রায় প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতারের বুলেটিনে থাকত।
তবে যুদ্ধ সম্পর্কে আমার একটা নিজস্ব ভাবনা ছিল। আমার ধারণা হয়েছিল বছর শেষে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। বর্ষায় যুদ্ধ তীব্র হবে। ডিসেম্বরে গিয়ে চরম যুদ্ধ হবে। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ হলেও এটা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধও হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে ভারতকে বিশ্ব জনমত গড়তে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তি সমন্বয় ঘটাতে হবে। বিশ্ববাসীর কাছে এ যুদ্ধ অনিবার্য বলে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।
এ কাজ সময় সাপেক্ষ। আমি ঢাকা থেকে নবাবগঞ্জ গেলাম। রুল আমিন সাহেবকে নবাবগঞ্জে পেলাম। রুহুল আমিন সাহেব নবাবগঞ্জে থাকেন। তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হলো। আমরা একমত হলাম যে এ যুদ্ধের সুযোগে যতোদূর সম্ভব তরুণদের যুদ্ধে প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধে ঠেলে দেয়াই একমাত্র কাজ। এ যুদ্ধে গেলে তাদের একটি সংগ্রামী মানসিকতা গড়ে উঠবে। এছাড়া দলের আহ্বায়ক খান সাইফুর রহমানকে বরিশাল থেকে ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আমাকে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই ৩১ জুলাই-এর মধ্যে ত্রিপুরার উদয়পুরে পৌঁছতে হবে। ৩১ জুলাই উদয়পুরে ভারতের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের (আরএসপি) সাধারণ সম্পাদক কমরেড ত্রিদিব চৌধুরী উদয়পুরে আসবেন। তিনি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেই উদয়পুর আসছেন।
ঢাকায় এসে আমি সহজভাবে সকল কাজ করতে পারলাম না। এর মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। আমি ভারত থেকে ফিরে মোহাম্মদ হোসেনের বাসায় ঢুকতেই তাঁর স্ত্রী আমাকে বললেন, আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি। ভারতে যাবার আগে আমি তাদের বাসায় গৃহশিক্ষক হিসেবে ছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল রোজা নামাজ শেখাবার। আমি শুধু ঐ কাজটাই করতাম না। ছেলেমেয়েদের গল্পে গল্পে ভুলিয়ে রাখতাম। কিন্তু ভুল হলো ভারতে যাওয়ার সময়। মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রী আসামের অধিবাসী। তাঁর দু’ভাইয়ের নাম আলাউদ্দিন ও মতিন। তারা আসামের হুজাউ শহরে থাকে। আমি ভারত যাবার কালে মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রীকে বললাম, আমি হুজাউতে আপনার ভাইদের খবর দেব। ভদ্রমহিলা চমকে গেলেন। তিনি স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন। সাহেব, এ মওলানা সাহেব কে। তিনি কী করেন এবং শেষ পর্যন্ত আমার পরিচয় জেনে গেলেন। তাই ভারত থেকে এবার ফিরতেই তিনি এবার বললেন, আপনাকে কিন্তু আমি চিনি। এতে আমিও একটু স্বস্তি পেলাম। কারণ যে বাড়িতে থাকি সে বাড়ির গৃহকত্রীর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লুকোচুরি করা বেশ কঠিন। তাই এবার পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক হলো।
কিন্তু বিপদ হলো পরবর্তী শুক্রবার। রায়েবাজার মসজিদের ইমাম অসুস্থ। তিনি জুম্মার নামাজ পড়াতে পারবেন না। সুতরাং একজন ইমাম চাই। সকলেই জানে মোহাম্মদ হোসেনের বাড়িতে একজন মাওলানা আছেন। তাই সবাই মিলে আমার খোঁজে এলো। বিব্রত মোহাম্মদ হোসেন বললেন, এ মাওলানা সাহেব বিদেশী। তিনি পরহেজগার মানুষ। বাড়িতেই আল্লাবিল্লা করেন। বাইরে কোথাও যান না। সেদিনের ফাড়া কাটা গেল। দ্বিতীয় বিপদ হলো আমার এক ছাত্রকে নিয়ে। ১৯৫৪ সালে এসেছিলাম খুন মামলার ফেরারি আসামি হিসেবে। আমাকে পাঠিয়েছিল প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম মুহাম্মদ মোদাব্বের। দীর্ঘদিন তার বাসায় শিক্ষকতা করেছি। কিভাবে যেন খোঁজ করে বের করেছে আমার ঠিকানা। সে গাড়ি নিয়ে রায়েরবাজার হাজির। আমাকে তাদের বাসায় যেতে হবে। তার মায়ের নির্দেশ।
আমার অবস্থা তখন বিব্রতকর। পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাওয়াই শার্ট। মাথায় জিন্না টুপি। মুখ ভর্তি দাড়ি। আমি ঘর থেকে কোথাও যাই না। কিন্তু মন্টি আমাকে জোর করে নিয়ে গেল তাদের মগবাজারের বাসায়। তারা মোহাম্মদপুর থেকে বাসা পাল্টিয়েছে। মন্টির মা বললেন, তোমার জন্যে ভিন্ন ব্যবস্থা আছে। তুমি আর কোথাও যেতে পারবে না। আমার বলার কিছু ছিল না। মন্টির মায়ের চোখে জল দেখলাম। আমাকে বাঁচালেন মোদাব্বের সাহেব। বললেন, নির্মল মুক্তিযোদ্ধা নিতে এসেছে। টাকা সংগ্রহ করতে এসেছে। কততদিন তুমি তাকে আটকে রাখবে? ওকে আটকে রাখা যায় না।
দেখলাম মোদাব্বের সাহেব বড় ব্যস্ত। তিনি রেড ক্রসের নেতা। রেড ক্রসের সব সহায়-সম্পদ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে বললেন, মানিকগঞ্জের ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে একটি স্পিড বোট দিয়েছেন। তার এলাকা প্রায় মুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন আর বলছিলেন পাকিস্তানিদের নির্যাতনের কথা। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছিলাম। মাত্র কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী নিয়ে তাঁর সঙ্গে তুমুল বিতর্ক হতো। তিনি বলতেন–নির্মল তোমার যুক্তি আমি মানি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে সবকিছু মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। তুমি বিশ্বাস কর আর নাই কর পাকিস্তান আমাদের স্বপ্ন ভেঙে খান খান করে গেছে। আজকের মোহাম্মদ মোদাব্বের মুক্তিযুদ্ধের এক বড় সহায়ক। প্রকৃতপক্ষে তিনি এক বড় মুক্তিযোদ্ধা।
মগবাজারের বাসায় এক রাত থেকে রায়েরবাজার বাসায় ফিরলাম। সেখানে তখন আর এক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মে মাসে নরসিংদীর কাজী হাতেম আলী আমার সঙ্গে ভারতে গিয়েছিল। আমি জুলাই মাসে ফিরলাম। কিন্তু সে ফিরল না। হাতেম আলীর বাবা মা কারওয়ানবাজার থাকেন। তাদের ধারণা হাতেম আলী মারা গেছে। কিন্তু আমি কী করে প্রমাণ করব হাতেম আলী মারা যায়নি। তাদের দাবি হচ্ছে আমাকে হাতেম আলীর বাড়িতে যেতে হবে। তার বাবা মার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি না গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না হাতেম আলী বেঁচে আছে। আমার উপায় ছিল না। একদিন ভোরে মোহাম্মদ হোসেনের হোভার পেছনে বসলাম। চলে গেলাম কারওয়ানবাজার। কিছুক্ষণ হাতেম আলীর বাবা মা ভাই বোনদের সঙ্গে আলাপ করে ফিরলাম রায়েরবাজার। আমার এ যাওয়া আসা মোহাম্মদ হোসেনকে বিপদে ফেলল। আমি চলে যাবার পর সেনাবাহিনী দু’বার তার বাড়ি ঘেরাও করেছিল। কিন্তু মোহাম্মদ হোসেন এক সময় সামরিক বাহিনীতে ছিল বলে সে যাত্রায় বেঁচে গেল।
২৯ জুলাই আবার ভারত যেতে হবে। আমার সঙ্গে চিরপুরাতন শহিদুল্লাহ। শহিদুল্লাহ বলল, স্যার আপনার জিন্না টুপিটা ফেলে দেন। একটা কিস্তি টুপি পরেন। জিন্না টুপি পরলে আপনাকে বিহারী বিহারী লাগে। সেদিন নবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসার সময় সবাই আমাকে বিহারী ভেবেছে। লঞ্চ কেরানীগঞ্জ পৌঁছার আগেই সবাই ভয়ে ভয়ে নেমে গেছে। এবার ওই টুপি পরে গেলে বিহারী হিসেবেই হয়তো আমরা মার খাব।
এবার ঢাকা থেকে কোন পথে যাব? কাজী হাতেম আলীর বাসার সমস্যা শেষ করেছি। মোদাব্বের সাহেবের বাসার চিত্র ভাসছে চোখের সামনে। বড় ছেলে হোসেন জামাল লাকী পাকিস্তান টেলিভিশনে চাকরি করে। আটকা পড়েছে সপরিবারে করাচিতে। সেজ ছেলে হোসেন ফারুক সানি চাকরি করে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। সেও সপরিবারে আটকা পড়েছে পাকিস্তানে। বাড়িতে দুই ছেলে হ্যাপি-মন্টি। কন্যা শিরিন। এ নিয়েই তাদের সংসার। পাকিস্তানে ছেলেদের কথা ভাববেন, না মুক্তিবাহিনীর কথা ভাববেন। এ চিন্তা তাঁকে বিব্রত করছে। তখন ঢাকায় এ ধরনের অসংখ্য বিভক্ত পরিবার ছিল। তাদের ঝুঁকি ছিল দু’ধরনের। একদিকে দেশ স্বাধীন করবার সংগ্রাম। আর অন্যদিকে পাকিস্তানে আটকা পড়া সন্তান-সন্ততিদের জীবন হানি হওয়ার আশঙ্কা। যারা ঢাকায় ছিলেন না বা ৭১ সালে ঢাকায় আসেননি তারা এ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারবেন না। যারা কলকাতায় ছিলেন তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় সে কালের এ মানুষগুলোর নিত্যদিনের কাহিনী। এদের অনেকে ঘৃণা করেছে, সমালোচনা করেছে, সাপ সাপান্ত করেছে। কিন্তু বুঝতে চায়নি এদের অবস্থা। এরা তখন ঢাকা ফরিদপুর বরিশাল বা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থাকলে আমাদের এখানে এসে আশ্রয় পাওয়া সম্ভব হতো না। মুক্তিযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হতে প্রতি পদে পদে। আমরা যারা সেদিন শত ঝুঁকি নিয়েও ঢাকা এসেছিলাম একমাত্র আমাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল সেদিনের বাস্তবতা বোঝা।
এ পরিস্থিতিতে সকলের এক কথা, কবে ভারতীয় সৈন্য আসবে। কেন ইন্দিরা গান্ধী কিছু করছেন না। ইন্দিরা গান্ধী কি আমাদের মারতে চান? কী চান তিনি। মোহাম্মদ হোসেনও বললেন, আপনি কলকাতায় যাবেন। দিল্লি যাকেন। শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গে কথা বলবেন। বলবেন, বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে। নইলে আমরা কেউ বাঁচব না।
আমি ভাবছিলাম ভিন্ন কথা। অনেক দুঃখে আমার হাসি পাচ্ছিল। অতি বিপদে পড়ে আমরা ভারতের সাহায্য চাচ্ছি। কিন্তু আমরা ভারতকে সহ্য করতে পারবো কি? গত ২৩ বছব্রের ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। ১৯৪৭ সালের পর যাদের জন্ম, তারা ভারতকে শত্রু হিসেবে দেখেছে। তারা জেনেছে ভারতে দাঙ্গা হয়। মুসলমানরা নির্যাতিত হয়। মাত্র ৬ বছর আগে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে। আমি সে যুদ্ধের উন্মাদনা দেখেছি। আমাদের বন্ধু খালেকদাদ চৌধুরী প্রেস ক্লাবে এসে বলেছিলেন, ভাই, প্রতিদিন একটি আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর শুনছি ভারত আর পাকিস্তানের বেতারে। বাংলাদেশের প্রতিটি গাড়িতে CRASH INDIA নামে স্টিকার লাগানো হয়েছে। ওই স্টিকার ছিঁড়তে গিয়ে বিপত্তি হচ্ছে। আমি বিভিন্ন বাসায় পড়াতে গিয়ে দেখেছি আমার প্রিয়তম ছাত্র-ছাত্রীটি আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। আমি তখন দৈনিক পাকিস্তানে চাকরি করি। আমি ঝুঁকি নিয়ে সারারাত কাজ করি। তারপরও কেউ আমাকে বিশ্বাস করে না। সকলের ধারণা আমি ভারতের দালাল, রাতে দৈনিক পাকিস্তান থেকে ভারতে সকল খবর পাচার করে দিই। মাত্র ৬ বছর আগের কথা। সেই পাকিস্তানের মানুষ আমাকে বলছে দিল্লি যেতে। চাচ্ছে ভারতের হস্তক্ষেপ। আজকে তাদের ধারণা ভারতই শুধু তাদের বাঁচাতে পারে। আমি অবাক হয়ে ভেবেছি। সত্যি সত্যি ভারতীয় বাহিনী এলে কী হবে। এদেশের মানুষ কি তাদের মেনে নেবে? ক’দিন মেনে নেবে? আমাদের দীর্ঘদিনের মানসিকতা কি নয় মাসে কলুষমুক্ত হয়ে যাবে?
তবে আমার পক্ষে দিল্লি যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। ভারতের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমি চুনোপুটি মাত্র। আমি বড়জোর আগরতলায় বা কোলকাতায় নেতাদের বলতে পারি। কিন্তু নিজেই বিশ্বাস করি না যে, ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন মেনে নেবে। তবুও দেখলাম ঢাকায় যেন ভারতীয় বাহিনীর জন্যে উন্মাদনা। সবাই ভারতীয় বাহিনীর জন্যে উন্মুখ।
এ পরিস্থিতিতে ত্রিপুরায় যেতে হবে। কিন্তু কী করে যাব। এবার সড়ক পথে যাওয়া যাবে না। সর্বত্রই পাকিস্তানি বাহিনী। রাজাকার, আলবদর শান্তিবাহিনীর লোক। ঢাকা থেকে বের হওয়া খুবই কষ্ট। ঠিক করলাম সেই পুরনো পথে বেলতলী, গৌরীপুর হয়ে যাব। বিকেল ২টায় লক্ষ্মীপুর নামে একটি লঞ্চ মাছুয়াখালী যায়। মাছুয়াখালী লঞ্চে বেলতলী নামব। বেলতলীতে আবুল হোসেনের বাড়ি। আবার আবুল হোসেনের বাড়ি যাব। সেখানে রাত থেকে ভোর বেরায় নৌকায় গৌরীপুর। সেখান থেকে নৌকায় দীঘিরপাড়। দীঘিরপাড়ে রাত কাটাব। পরের দিন হেঁটে সীমান্ত যাব। সীমান্ত থেকে আগরতলার উদয়পুর।
কিন্তু ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল থেকে লঞ্চে উঠতে গিয়ে চমকে গেলাম। দেখলাম বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আর ফজল শাহাবুদ্দিন টার্মিনালে দাঁড়িয়ে। তাদের সঙ্গে বিরাট দাড়িওয়ালা কবি হাসান হাফিজুর রহমান। তিনিও আমার লঞ্চে যাচ্ছেন। তারা কেউ আমাকে চিনতে পারলেন না। লঞ্চে উঠে আমি দু’পয়সার বাদাম কিনলাম। চুপচাপ বসে থাকলাম বয়লারের কাছে। কিছুক্ষণ পর হাসান হাফিজুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনি যেন কাঁদছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন। তিনি আমাকে দেখে মলিন হাসি হাসলেন। বুঝলাম তিনি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর দাড়ি হিন্দু সন্ন্যাসীর মতো। বললাম, আপনার আমার মতো সুন্নত দাড়ি করা উচিত ছিল। এ ধরনের দাড়ি নিয়ে ধরা পড়ে যাবেন। কোথায় যাবেন আপনি?
এমন সময় তাঁর গাইড আমার কাছে এলো। মনে হলো তারা সীমান্তের ওপারে যাচ্ছেন না। কাছাকাছি কোথাও যাবেন। আমি বললাম প্রয়োজন হলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আমি সীমান্তের ওপারে যাব। হাসান সাহেবের গাইড আমার পরিচয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন। তার বক্তব্য হলো, একে তো হাসান হাফিজুর রহমান তার ওপর নির্মল সেন যুক্ত হলে আর উপায় নেই। তাঁরা কালারবাজার নেমে গেলেন।
আমার সঙ্গে তখন শহিদুল্লাহ। আমরা সন্ধ্যার দিকে বেলতলী নামলাম। নৌকায় আবুল হোসেনের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু আবুল হোসেন বাড়িতে নেই। আবুল হোসেন সালিশি করতে ছেঙ্গারচর গেছেন। রাতে ফিরবেন না। আমরা বিব্রত হলাম। কিন্তু উপায় আর নেই। আমাকে কিছুটা চেনেন আবুল হোসেনের পিতা। ইতোপূর্বে একবার ওই বাড়িতে গেছি। তিনি বললেন, বাইরের ঘরে শুয়ে থাক। ও বাড়িতে অসংখ্য লোকের ভিড়। কে কোথায় থাকবে, কে কোথায় ঘুমাবে কেউ জানে না। গভীর রাতে আবুল হোসেনের পিতা আমার ঘুম ভাঙালেন। তাঁর হাতে থালা ভর্তি ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল। বললেন, বাবা কত লোককে খাওয়াব। তুমি কার ছেলে জানি না। কোথায় কোনদিন মারা যাবে কেউ জানবে না। বাবা, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। সেদিন গভীর রাতে আমার চোখের জল নেমেছিল। সারা জনম বাপ তাড়ানো মা খেদানো ছেলে হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছি। কেউ কোনোদিন আমাকে এমন কথা বলেনি।
ভোরে ওই বুড়ো মানুষটা আমাকে নৌকা করে দিলেন। আমি আর শহিদুল্লাহ নৌকায় গৌরীপুর রওনা দিলাম। আজকের সড়ক পথে সে গৌরীপুর আর সেদিনের গৌরীপুর নয়। তখন বেলতলী থেকে নদী পথে পূর্বে গিয়ে ডানে মাঠে ওঠা যেত। মাঠে তখন জল ছিল। অনেক দূর ঘুরে ঢাকা, কুমিল্লা সড়কের কোনো একটি সেতুর নিচে দিয়ে নৌকায় যেতে হতো। সতর্ক থাকতে হতো ওই সেতুটি কোনো রাজাকার পাহারা দিচ্ছে কিনা।
চারদিকে ধান গাছ। মাঝখানে নৌকায় চলা ডাঙ্গা। সারাটা দেশ যেন নিস্তব্ধ। সড়কে গাড়ি দেখা যায় না। মাঝে মাঝে দু-একটা নৌকা। দূরে দূরে বিদ্যতের খুঁটি। বিদ্যুতের খুঁটির দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবি ওই খুঁটিগুলো এখনো অক্ষত কেন। কেন মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওই খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলেনি। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। মাঝে মাঝে বিপদ হতো নৌকার মাঝিদের নিয়ে। কেউ সন্দেহ করত। কেউ আবার ভালোবাসতো। এই সন্দেহ আর ভালোবাসার মধ্যে একদিন প্রায় ধরা পড়ে গেলাম গৌরীপুর।
গৌরীপুরে শহিদুল্লাহ ভাত কিনতে নেমেছিল। আমরা একটি নতুন নৌকা করেছিলাম। মনে হলো মাঝি কিছুটা ধর্মভিরু। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ শহিদুল্লাহর কোনো দেখা নেই। এক সময় শহিদুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে এল। গৌরীপুর বাজার তখন রাজাকারে ভরা। শহিদুল্লাহ ভোলার ভাষায় কথা বলে। তাই তাকে সন্দেহ করে দোকানদার জেরা শুরু করেন দেন। শহিদুল্লাহ ভাত না কিনেই চলে আসে। অন্য দোকান থেকে কিছু কলা ও রুটি কিনে নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে। অর্থাৎ সেদিন আমাদের আর ভাত মিলল না।
নৌকায় উঠে মনে হলো, আমাদের মাঝিও পাকিস্তানপন্থী। তবে আমার দাড়ি ও লুঙ্গি দেখে সে বেশ খানিকটা আশ্বস্ত। আমি তার সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কথা শুরু করে দিলাম। আমরা কখনো খাল, কখনো বিলের মধ্য দিয়ে চলছি। অসংখ্য নৌকা চলাচল করছে ওই পথে। কেউই সড়ক পথে সামরিক বাহিনীর ভয়ে যাই না। চারদিকে মাঠ আর মাঠ। কোথাও ধান, কোথাও শাপলা। কোথাও আবার জেলেরা মাছ ধরছে। আমি মাঝির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি। তাকে কলা ও রুটি খাওয়ালাম। বিকেল দিকে মনে হলো, মাঝি মানুষ ও আল্লাহর খাঁটি বান্দা। সন্ধ্যার দিকে দীঘিরপাড় বাজারে পৌঁছলাম। দীঘিরপাড় বাজারে তখন শত শত মুক্তিযোদ্ধা। দূর-দূরান্ত থেকে তারা সন্ধ্যার দিকে এই বাজারে আসে। তারপর বিভিন্ন এলাকায় অপারেশনে চলে যায়। শহিদুল্লাহকে বললাম, মাঝিকে নিয়ে দীঘিরপাড় বাজারে যেতে। মাঝিকে মাছ মাংস দুধ সব কিছু খাওয়াতে। কারণ তাকে হাতে রাখতে হবে। তার নৌকায় রাত কাটাতে হবে। সকালবেলা ছাড়া যাবার কোনো পথ নেই। শুনেছি কংসনগর, বলধাবাজার হয়ে সীমান্ত যাওয়া যায়। ওই পথ আদৌ আমার চেনা নেই। ওই পথ যেতে হলে গাইড প্রয়োজন।
শহিদুল্লাহ ও মাঝি নৌকায় ফিরে এলে আমি দীঘিরপাড় বাজারে গেলাম। বাজারের পুলের কাছে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। ওই রেস্টুরেন্টের মালিক মনে হয় আমাকে চিনত। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলো স্যার কোনো গাইড লাগবো কিনা। একা কী করে যাবেন। আমি বললাম, একজন গাইড আমার প্রয়োজন। শেষ রাতে যেন গাইড আমার নৌকায় যায়। ওই গাইডকে নিয়ে আমাকে বলধাবাজার যেতে হবে।
ভোররাতে গাইড এসে হাজির। গাইডের নাম ইয়াকুব। বাড়ি ঘোষপাতি। শেষরাতেই আমরা নৌকা হতে উপরে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। দেখলাম মাঝির চোখে জল। সে জানে না আমি কোথায় যাব। মাঝি ইয়াকুবকে বলল, আমি নাকি একেবারে সাক্ষাৎ আল্লাহর ওলি। আমাকে যেন সাবধানে নিয়ে যাওয়া হয়।
যাত্রা শুরুতেই বৃষ্টি। আমাদের কাছে কোনো ছাতা নেই। আমরা খালপাড় দিয়ে ছুটছি। দেখছি অসংখ্য মুক্তিবাহিনীর লোক রাইফেল মেশিনগান নিয়ে নৌকায় দীঘিরপাড়ের দিকে যাচ্ছে। তাদেরও ছাতা নেই। মাথায় বড় মানকচুর পাতা। এসময় যাওয়ার পথে আমাদের কিছু নাম মুখস্থ করে যেতে হলো। কারণ রাস্তায় যে কেউ আমাদের গ্রাম পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে পারে। সঠিক পরিচয় দিতে না পারলে বিপদ অনিবার্য। তাই প্রথম নাম মুখস্থ করেছিলাম ফুলতলির খালেক সরকারের। ফুলতলির পর কংসনগর। কংসনগরের পর গোমতি নদী। গোমতির ওপারে চণ্ডীপুর। সেখান থেকে বলধাবাজার। তাই পরিচয় দেওয়ার তেমন অসুবিধা ছিল না। কংসনগরে গোমতির ফেরি। ফেরিওয়ালা ছাড়া কেউ নেই। ফেরিতে আমরা মাত্র দুজন যাত্রী। স্বাধীন বাংলা বেতারে চরমপত্র শোনানো হচ্ছে। শুনেছিলাম আগের দিন ওই ফেরিতে পাকবাহিনী হানা দিয়েছিল। মারা গিয়েছিল অনেক। তাই কৌতূহলও ছিল এপথে যাবার। ফেরিওয়ালা বলল, তেমন কোনো বড় ঘটনা ঘটেনি। মাত্র তিনজন আহত হয়েছে।
চণ্ডীপুরে এসে বিপদে পড়ে গেলাম। চারদিকে পানি। হাঁটাপথে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। চণ্ডীপুর থেকে নৌকা যাচ্ছে বলধাবাজার। নৌকার মাঝি সিদ্দিক ও আলাউদ্দিন। কিন্তু নৌকা নিয়ে বেশি দূর এগুনো গেল না। দেখলাম বলধাবাজারের দিক থেকে নৌকা ফিরে আসছে। তারা বলছে ওপথে যাওয়া যাবে না। ভারতে যাবার শেষ পথ পাকিস্তানিরা বন্ধ করে দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীরা আটকা পড়ে গেছে। গোলাগুলি হচ্ছে। আপনারা সামনে যেতে পারবেন না।
কিন্তু আমার উপায় ছিল না। তখন বেলা দশটা বাজে। আমাকে চারটার আগে উদয়পুর পৌঁছতে হবে। উদয়পুরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে। কিন্তু মাঝি যেতে নারাজ। বলধাবাজারে গিয়ে ভিন্ন নৌকা নিলাম। বললাম, যত টাকা লাগে সীমান্তে যেতে হবে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হলো। নৌকার মাঝি কিছুতেই এগুতে রাজি নয়। শহিদুল্লাহ কান্নাকাটি শুরু করেছে। ইয়াকুবও যেতে রাজি নয়। এমনি করে নাঘির-এ পৌঁছলাম। একদল মুক্তিবাহিনীর ছেলে এল। ওরা আমাকে কিছুতেই এগুতে দিবে না। ওরা কেউ আমাকে চিনে না। তবুও আমার নৌকা ফিরিয়ে দিল।
নৌকা ফিরে এল বলধাবাজার। কিন্তু কোথায় যাব? এ এলাকায় কাউকে চিনি না। কিছুদূরে একটি স্কুলে কিছু হিন্দু শরণার্থী আছে। আর সব দিকে চুপচাপ। পথে এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হলো। বৃদ্ধ বলল, বাবা কোথায় যাবে? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজকেতো যেতে পারবে না। তোমরা আজকে আমার বাড়িতে থাকবে। কাল ভোরে চলে যাবে।
বুড়োর বাড়িতে আশ্রয় পেলাম। সন্ধ্যার পরে ছোট চিংড়ি ভাজা ও ভাত বুড়ো দিয়ে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর চমকে গেলাম একটি পোস্টার দেখে। ও বাড়ির চালায় একটি পোস্টারে লেখা আছে, যা করে আল্লায় ভোট দিবো পাল্লায়। এক খাটে আমি আর শহিদুল্লাহ শুয়ে আছি। আমাদের কাছে একটি কালো ব্যাগ। মনে হলো শহিদুল্লাহ ভয়ে ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ রাত ১২টার দিকে চারজন যুবক আমাদের ঘরে এসে ঢুকল। তারা কর্কষ ভাষায় জিজ্ঞাসা করল আপনারা কোথায় যাবেন? আমি বললাম, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আমরা কোথায় যাব। ওরা বলল, এ মুহূর্তে আপনারা ঘর থেকে বেরিয়ে যান। কারণ আমাদের মেহমান আছে। আমি বললাম, আমরাও আপনাদের মেহমান। আর এ কথাগুলো আপনাদের সন্ধ্যাবেলায় বলা উচিত ছিল। এই দুপুররাতে এখান থেকে আমরা কোথাও যাব না।
ওই চার যুবকের সঙ্গে সেই বৃদ্ধও দাঁড়িয়ে ছিল। আর হাতে ছিল একটি কেরোসিনের ল্যাম্প। তিনি ইশারায় আমাকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আপনি বুঝতে পারছেন না, তারা জামায়াতের লোক। আপনাদের বাইরে নিতে পারলে খুন করে ফেলবে। আপনারা এখান থেকে বেরিয়ে আসুন। আমি আপনাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। আমি ও শহিদুল্লাহ বুড়োকে অনুসরণ করলাম। বৃদ্ধ এক কৌশল করল। সে বেশ কিছুক্ষণ চারদিকে আমাদের ঘোরাল। পরবর্তীকালে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। তার দেয়াল ঘরের একপাশে কিছু কাঠ ছিল। সেই কাঠ সরিয়ে নিয়ে আমাদের একটি পাটি বিছিয়ে দিল। বলল, রাত শেষ হওয়ার আগে এখান থেকে চলে যাবেন। আমাদের ঘুম হলো না। রাত চারটার দিকে উঠে পড়লাম। বুড়োর সঙ্গে কথা না বলেই বলধাবাজারে এলাম। কিন্তু কোথায় যাব? আমাদের একমাত্র চেনা আগের দিনের নৌকার মাঝি সিদ্দিক ও আলাউদ্দিন সিদ্দিকের বাড়ি চণ্ডীপুরে। সে বাড়িও আমরা চিনি না। বলধাবাজারে এক মাঝিকে সিদ্দিকের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, আমাদের সিদ্দিকের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।
মাঝি রাজি হয়ে গেল। বলধাবাজার থেকে সিদ্দিকের বাড়ি এক ঘন্টা পথও নয়। কিন্তু সিদ্দিকের বাড়ি পর্যন্ত নৌকা পৌঁছাবে না। চারদিকে পাটক্ষেত। নৌকা থামিয়ে ওই পাটক্ষেতের মধ্যে দিয়ে সিদ্দিকের বাড়ি রওনা হলাম। কিছুদূর যেতেই সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে তো আমাদের দেখে অবাক। তার ধারণা আমি মুক্তিবাহিনীর মেজর জেনারেল। যে কোনো কারণেই হোক তাদের ওখানে এসেছি। একথা গোপন রাখতে হবে। সিদ্দিকের বাড়ি যাওয়ার পথে অনেকেই জিজ্ঞাসা করল আমাদের পরিচয়। সিদ্দিক বলল আমরা তাদের আলীর চরের আত্মীয়। এ পরিচয় দিয়েই সিদ্দিকের বাড়িতে ঢুকলাম।
সিদ্দিকের ঘর বলতে কিছু নেই। একখানা ঘরেই রান্না এবং শোওয়ার কাজ চলে। বাড়িতে স্ত্রী ও একটি বোন। ১৪/১৫ বছরের বোনটি অপূর্ব সুন্দরী। আমাদের দেখে তার আনন্দের সীমা নেই। মেয়েটি মুক্তিবাহিনীর লোকদের ভালোবাসে। আর আমার চিন্তা ছিল যাদের বাড়ি এলাম, তাদের খাবার সঙ্গতি আছে কিনা। সিদ্দিক নৌকা চালায়। সীমান্তে গোলাগুলি হওয়ার ফলে নৌকা চালানো বন্ধ। অর্থাৎ সিদ্দিকের কোনো রোজগার নেই। আমি শহিদুল্লাকে বাজারে পাঠালাম। চাল, ডাল, তেল সব কিনে আনবার জন্যে। এমনি করে প্রথম দিকে ভালোই কাটল। রাতে সিদ্দিকের বোন নাফিয়া চিৎকার করে। সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ। ও বলে এবার থ্রি নট থ্রি তারপরে এলএমজি। তারপরে এইচএমজি। তারপরে মর্টার, তারপর পাঞ্জাবরা সব শেষ। নাফিয়া গুলির শব্দ শুনেই যন্ত্রের নাম বলতে পারে।
কিন্তু আমি কী করবো? ভারতে যেতে পারছি না। ঢাকা আসাও সহজ নয়। যেখানে আছি সেখানে প্রতিদিন সন্দেহ বাড়ছে। নাফিয়া বলছে, ভাই তুমি বাইরের লোক সামলাও, আমি ঘর সামলাব। চারদিকে ছড়িয়ে গেছে, মুক্তিবাহিনীর একজন জেনারেল এখানে আছে। তাই বিভিন্ন এলাকার তরুণরা আসছে সারা দিনরাত। আর ভয় পাচ্ছে মানুষ। বাড়ির লোক রাজি হচ্ছে না আমাকে রাখতে।
এমন সময় নাফিয়াদের এক আত্মীয় এল আড়জঙ্গল থেকে। আড়জঙ্গল সীমান্ত এলাকায়। আড়জঙ্গল পার হতে পারলে আগরতলা যাওয়া যাবে। কিন্তু আড়জঙ্গল যেতে মাঠের পর মাঠ পানি। পাকবাহিনীর ভয়ে নৌকা চলাচল বন্ধ। সাঁতার কেটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাঁতার কেটে যেতে হলেও সীমান্তে একটি সেতু আছে। ওই সেতুতে রাজাকার পাহারা দেয়। সিদ্ধান্ত হলো, কৃষ্ণপক্ষের রাতে ওই সেতু পর্যন্ত সাঁতরে যাব। তারপর ডুব দিয়ে সেতু পার হব। কিন্তু রাজি হলো না শহিদুল্লাহ। সে কান্নাকাটি শুরু করল। তার কথা হচ্ছে ওখানে আপনি গুলিতে মারা গেলে লাশটা কোথায়ও নিয়ে যেতে পারব না। কেউ জানবে না আপনার মৃত্যুর কথা। আমরা কেউ ফিরতে পারব না। সুতরাং সে সিদ্ধান্ত বাতিল হলো।
এবার ঠিক হলো বুড়িচং থানার কাছে দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে। আমি আর সিদ্দিক রেকী করার জন্যে বের হরাম। ভাবখানা এমন আমরা কোথাও মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। রাস্তায় এমন ধরনের কথা বলেই এগুচ্ছিলাম। বুড়িচং যাওয়ার আগেই বুঝলাম কাজ হবে না। কারণ বুড়িচং সীমান্তে সেদিন মুক্তিবাহিনী বারো জন পাকবাহিনীকে মেরে ফেলেছে। তাদের কবর দেয়া হচ্ছে বুড়িচং-এ। আমরা এবার বলধাবাজার হয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ঢাকা ফিরতে হবে। ওই পথে আর সীমান্তে যাওয়া হচ্ছে না। আমরা চলে যাব। নাফিয়ার মোটেই ভালো লাগছিল না। তাই সে ঘুমে থাকতে ভোর রাতেই আমরা ঘর থেকে বের হলাম। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের কাছে কোনো ছাতা নেই। সিদ্দিক আমাদের গোমতীর পাড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। বলে গেল নাফিয়ার কথা। সে কাহিনীতে পড়ে আসছি।
কলকাতায় এসে বিপদে পড়ে গেলাম। আগেই লিখেছি কলকাতা আগরতলা নয়। আগরতলার পথে সারাদিন মুক্তিযোদ্ধাদের দেখা যায়। তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। বাংলাদেশের খবর পাওয়া যায়। খবর পাওয়া যায় ঢাকা শহরে। কলকাতায় সে সুযোগ নেই। প্রথম সংবাদপত্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। নইলে যেতে হয় মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে। সাতক্ষীরা সীমান্তে ৯ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর। সেখানে গেলে খবর পাওয়া যায়। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর এলাকা থেকে কোলকাতার তরুণরা আসে। আমি ৩৭ নম্বর রিপন স্ট্রিটে ক্রান্তি প্রেসে থাকি। ক্রান্তি প্রেস থেকে আরএসপির মুখপত্র গণবার্তা প্রকাশিত হয়। ওই প্রেসের ভবনেই আরএসপির কেন্দ্রীয় নেতারা থাকেন। সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে আছেন আরএসপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড ত্রিদিব চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড মাখল লাল, কেন্দ্রীয় নেতা ননী ভট্টাচার্য, মৃন্ময় চক্রবর্তী, প্রধান নেতা মনি চক্রবর্তী প্রমুখ। এরা এক সময় সকলেই অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। জেলখানায় তারা মার্কস ও লেনিনের বই পাঠ করেন এবং সাম্যবাদে দীক্ষিত হন। কিন্তু স্ট্যালিনের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাদের দ্বিমত ছিল। তারা মনে করতেন স্ট্যালিনের পথে ভারতবর্ষে বিপ্লব করা যাবে না। ত্রিশের দশকে জেলখানায় থাকতেই তারা নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এঁরা তখনো অনুশীলন সমিতির সদস্য হলেও প্লাটফর্ম হিসেবে কংগ্রেসের কাজ করতেন।
ত্রিশ দশকের শেষ দিকে কংগ্রেসের মহাত্মা গান্ধী বনাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বিরোধ দেখা দেয়। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পথে। সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, যুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশকে আঘাত করতে হবে। কংগ্রেসের অন্যান্য নেতৃত্ব রাজি হলেন না। কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত গান্ধীর প্রার্থীকে হারিয়ে সুভাষ বস জয়লাভ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন নিয়ে সুভাষ বসুর সঙ্গে গান্ধী গ্রুপের আবার মতান্তর হয়। এবার সুভাষ বসু ভোটে পরাজিত হন। সুভাষ বসুকে একমাত্র সমর্থন করেন ফরোয়ার্ড ব্লক এবং অনুশীলন সমিতির সদস্যরা (যারা পরবর্তীকালে আরএসপি গঠন করেন)। ভোটে নিরপেক্ষ থাকে জয় প্রকাশের সিএসপি ও কমিউনিস্ট পার্টি।
এই পরাজয়ের পর সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ বিহারের রামগড়ে আপোষ বিরোধী সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেরনে অনুশীলনের অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা যোগদান করেছিলেন। রামগড়ে অনুশীলনের বিপ্লবীরা নতুন দল গঠন করেন। দলের নাম Revolutionary Socialist Party R.S.P অর্থাৎ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল। তবে দল গঠনের পর তাঁরা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নেতৃস্থানীয় সকল সদস্যই গ্রেফতার হয়ে যান এবং এক নাগাড়ে ৫ থেকে ৬ বছর জেলে থাকেন। অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে থাকতে হয়।
ছাত্রজীবনে বরিশাল জেলার কলসকাঠি স্কুলে পড়তাম। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কলসকাঠি ডাকঘর ও স্টিমার স্টেশন পুড়িয়ে দেয়া হয়। মুখ্যত এ আন্দোলন পরিচালনা করেছিল আরএসপি। তখন থেকে তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। স্কুল জীবন শেষে বরিশালের বিএম কলেজে পড়তে এলাম। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। কোলকাতায় মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যায় রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায়। সেও ছিল আরএসপির ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরএসপির নেতারা মুক্তি পেতে থাকেন। তারা সবাই মুক্তি পান ১৯৫৬ সালে। তারপর ১৯৪৭ সাল। সংগঠন হিসেবে আরএসপির বিস্তার লাভের পূর্বেই দেশ ভাগ হয়ে যায়। অধিকাংশ নেতৃত্ব হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির হওয়ায় তারা প্রায় সকলেই দেশান্তর হয়। তাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতায়। আমি ঢাকায় ফিরে গ্রেফতার হয়ে যাই ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে। জেলখানা থেকে বের হতে হতে ১৯৫৩ সাল। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার আমাকে পাসপোর্ট দেয়নি। তাই ৭১-এর পূর্বে কলকাতার আরএসপির কোনো বন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
দেখা হলো ১৯৭১ সালের এপ্রিলে। সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা গিয়েছি। আগরতলা থেকে কলকাতা। আমার থাকার ব্যবস্থা হলো আরএসপির নেতাদের সঙ্গে ক্রান্তি প্রেসে। ক্রান্তি প্রেসে ঢুকে বুঝলাম বিপ্লব কথার কথা নয়। যাদের নিজের আচার আচরণে বিপ্লবের কোনো ছাপ নেই তাদের পক্ষে বিপ্লব করা সম্ভব নয়। ক্রান্তি প্রেসে ভাত খেতে গিয়ে বুঝতে পারলাম ভিন্ন জগতে এসেছি। খাবার সময় কমরেড মাখন পাল বললেন–কমরেড, খাবার পর থালা কিন্তু আপনাকেই ধুতে হবে। এখানে থালা ঘোয়ার জন্যে কোনো মানুষ নেই। সবাই এখানে স্বাবলম্বী। দেখলাম ত্রিদিব চৌধুরীসহ সকলেই থালা নিয়ে কলতলায় যাচ্ছেন। পরের দিন দেখলাম মাখন পাল ভোরবেলা উঠেই কাপড় কাঁচতে শুরু করেছেন। এখানে ক পড় পরিষ্কার করার সকল প্রক্রিয়া নিজেকে সম্পাদন করতে হবে। শুধুমাত্র ইস্ত্রি করার জন্যে কাপড় লন্ড্রিতে পাঠানো যায়। আমাদের ঘরে বাইরের কাউকে এক কাপ চা খাওয়াতে হলেও কোথা থেকে পয়সা আসবে তা আগে থেকে ঠিক করতে হয়। কারণ সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় রাজনৈতিক দল চলে। তাদের সাহায্য নিয়ে ব্যক্তিগত বিলাসিতার সুযোগ নেই। এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল প্রথমেই। প্রথমবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্রান্তি প্রেসে গিয়ে আমার তেমন অসুবিধা হয়নি। অন্তত বুঝতে পেরেছি এ রাজনীতির টাকা যেনতেনভাবে খরচ করা যায় না।
এছাড়াও একটি ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম এপ্রিল মাসে কলকাতায় গিয়ে। ক্রান্তি প্রেস থেকে বিকেলে লেনিন সরণিতে আরএসপির দফতরে গেলাম। সেখানে ত্রিদিব চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথায় কথায় শুনলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের নেতারা ইতোমধ্যে আরএসপি অফিসে এসেছেন। অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তবে সেসব কথা তেমন এগোয়নি। তারা সকলে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশের সঠিক পরিস্থিতি জানার জন্যে।
ত্রিদিব বাবুর কক্ষে ঢুকতেই তিনি আমাকে একটি অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের দেশে কি আত্মগোপনকারী চরমপন্থী কোনো দল আছে? গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলেও এরা প্রকাশ্যে আসে না। এরা চরম জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দেয়।
ত্রিদিব বাবুর কথা শুনে আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে এ প্রশ্ন কেন করছেন? তিনি বললেন, অধুনা তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। চরম জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিয়ে দল উপদল গঠিত হচ্ছে। এরা কিছুতেই প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে রাজি নয়। আমাদের খবর হচ্ছে এ ধরনের দল উপদল মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ-এর সৃষ্টি। দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন ব্যাহত করার জন্যে সিআইএ-এর ভূমিকা দীর্ঘদিনের।
তখন বাংলাদেশের অনেক ঘটনাই আমার মনে পড়েছিল। আমাদের দল গঠনের পর আমরা প্রথম জনসভা করেছিলাম ১৯৭০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই খবর এল প্রেস ক্লাবের সামনে পাকিস্তান কাউন্সিলে বোমা হামলা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর দৈনিক মর্নিং নিউজের একজন রিপোর্টার আমাদের জনসভায় এল। আমাকে দূরে নিয়ে গেল। বলল, জনসভা ভেঙে দিয়ে কোথাও পালিয়ে যাও। কারণ বোমা হামলা করতে গিয়ে যারা ধরা পড়েছে তারা তোমার নাম বলেছে। সুতরাং তুমি গ্রেফতার হয়ে যেতে পার। আমরা তাড়াতাড়ি জনসভা শেষ করলাম। কিন্তু। আমি আত্মগোপন করলাম না।
সাংবাদিক বন্ধুর কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। একথা সত্যি যে একটি আত্মগোপনকারী দল তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিল। তাদের একটি সম্মেলনের জন্যে আমি একটি ছোট বক্তব্য লিখে দিয়েছিলাম। সেই বক্তব্যের মধ্যে তিনটি শ্লোগান ছিল। স্লোগান তিনটি হচ্ছে–আমার নাম তোমার নাম–ভিয়েতনাম। আমার বাড়ি তোমার বাড়ি–নকশালবাড়ি। আমার দেশ তোমার দেশ–বাংলাদেশ।
ত্রিদিব বাবুর প্রশ্ন শুনে আমার এই কথাগুলো মনে হলো। তবে আমি সরাসরি ত্রিদিব বাবুর প্রশ্নের জবাব দিলাম না। শুধু বললাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন একান্তই বাস্তব। এর পেছনে কারো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা একান্তই গৌণ।
এ ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের কথা। জুন মাসে কলকাতা থেকে আগরতলার ফিরে গিয়েছিলাম। জুলাইয়ের প্রথম দিকে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে। আগস্টের শেষে বাংলাদেশ থেকে আগরতলায় ফিরেছি। অক্টোবরে আবার কোলকাতায়। আবার ক্রান্তি প্রেস। এবার ক্রান্তি প্রেসে অনেক বাংলাদেশের তরুণ দেখলাম। মুখ্যত এই তরুণরা এসেছে বরিশাল জেলা থেকে। বরিশালে এককালে আরএসপির শক্তিশালী সংগঠন ছিল। তরুণদের কাছে আরএসপির নাম পরিচিত। তাই ওরা খুঁজে খুঁজে আরএসপির প্রেসে এসেছে। আমার নাম করেছে। প্রেস থেকে ছাপিয়ে নিচ্ছে তাদের মুখপত্র।
১৯৭১ সালের সংগ্রামের কালে অসংখ্য সাপ্তাহিক বের হয়েছে সারা পশ্চিমবঙ্গে। এই পত্রিকাগুলো বের করত বাংলাদেশের তরুণরা। এতে মুক্তিযুদ্ধের খবর থাকত। বিপ্লবী বাংলাদেশসহ এ ধরনের অনেক সাপ্তাহিক ক্রান্তি প্রেসে ছাপা হতো। পত্রিকা ছাপার জন্যেই প্রতি সপ্তাহে তরুণদের ক্রান্তি প্রেসে আসতে হতো। আমার মনে হতো তারাই ছিল যুদ্ধের সঠিক সংবাদদাতা। তারা মুক্তিবাহিনীর তরুণদের মনের কথা জানত। শরণার্থীদের মনের কথা জানত। জানত বড় বড় নেতাদের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা।
বিপ্লবী বাংলাদেশের তরুণরা আসত বসিরহাটের টাকী থেকে। তাদের এলাকার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মরহুম এমএ জলিল। জলিল সাহেবকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তেমন পছন্দ করত না। পছন্দ করতেন না জেনারেল ওসমানী। বারবার তাঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জলিল সাহেব সরেননি। আমার যতদূর মনে হয় জলিল সাহেব কাউকে তোয়াক্কা করতেন না এবং তাঁর সেক্টরেই একমাত্র সংখ্যাধিক্য ছিল বামপন্থীদের। অন্যান্য সেক্টরে তখন বামপন্থীদের রিকুট প্রায় বন্ধ।
জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর। তিন মাসে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। এই তিন মাসের ঘটনার সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। জুলাইয়ে আগরতলা থেকে ঢাকায় চলে যাই। ঢাকায় যাওয়ার লক্ষ্য ছিল বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা। যুদ্ধের জন্যে লোক সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ এবং আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করা। ভেবেছিলাম আগস্টের মধ্যে ভারতে ফিরতে পারব। কিন্তু তেমনটি হলো না। ফিরতে ফিরতে সেপ্টেম্বর। এই তিন মাসের মধ্যে মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। আর ভারতে স্বাক্ষরিত হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি। ৭১-এর যুদ্ধের ইতিহাসে এ তিনটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মুজিববাহিনী গঠন সম্পর্কে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকের ধারণা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে না জানিয়ে। তাজউদ্দিনকে নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। অনেকের ধারণা তিনি বামপন্থী। মার্কিন বিরোধী। তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা নিয়ে ভারত সরকার চিন্তিত ছিল। ভারত সরকার কিছুতেই চাইবে না যে, তার পূর্বাঞ্চলে একটি বাম সরকার গঠন হোক।
এছাড়া প্রশ্ন ছিল পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে। পাকিস্তান থেকে শেখ সাহেব আদৌ ফিরবেন কি না, তা ছিল একান্তই অনিশ্চিত। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শেখ সাহেব কী ভূমিকা নেবেন তাও ছিল বিতর্কিত। এছাড়া প্রশ্ন উঠেছিল শেখ সাহেব যদি আদৌ না ফিরে আসেন তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির চিত্র কী হবে, নেতৃত্ব কে করবে। এদিকে বামপন্থী তাজউদ্দিন, অপরদিকে চরম কমিউনিস্ট বিরোধী তল্কালীন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব। অনেকের ধারণা, এই বিবেচনা থেকেই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে মুজিববাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আগরতলায় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছি। শুনেছি মুজিববাহিনীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছি মুজিববাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার, শান্তিবাহিনী এবং বামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করা। একথাটা এমনভাবে প্রচারিত ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক বামপন্থী নেতাকেই গা ঢাকা দিয়ে বাংলাদেশে ফিরতে হয়েছে। আমাদের দলের একমাত্র আমিই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সড়ক পথে দেশে ফিরেছি। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভিন্নপথে বাংলাদেশে ঢুকতে হয়েছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, মূলত মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বামপন্থীদের ঠেকাতে এবং আওয়ামী লীগের চিরাচরিত ডানপন্থী রাজনীতি অব্যাহত রাখার জন্যে। এ লক্ষ্যে ভারতের শাসক শ্রেণি ভারতে এই বাহিনী গড়ে তুলেছিল। আমি কলকাতায় গিয়ে একথাও শুনেছি যে, মুজিববাহিনী গঠনের বিরুদ্ধে তাজউদ্দিন প্রতিবাদ জানাবার পর নতুন রিক্রুট বন্ধ হয়ে যায়। এ ব্যাপারে ভিন্নমত আছে ভিন্ন মহলের। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২৬ বছর পরেও মুজিববাহিনী গঠন সম্পর্কে সঠিক কোনো মূল্যায়ন হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি।
এই সময়ে দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠন। এই উপদেষ্টা কমিটিতে আওয়ামী লীগ ব্যতিত আরো ৪টি দলের সদস্য ছিলেন। তাঁরা হলেন–ভাসানী ন্যাপের মওলানা ভাসানী, ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং এবং জাতীয় কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। এই কমিটি গঠনেই প্রতিভাত হয়, সব মহল মিলে একটি আপোষ করার চেষ্টা হয়েছে। সেকালে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ ছিল না। মোজাফফর ন্যাপও সোভিয়েতপন্থী বলে পরিচিত ছিল। সকলেরই ধারণা ‘৭১-এর যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের অন্যতম বড় সহায়ক শক্তি ছিল বলে তাদের প্রভাবেই কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপকে উপদেষ্টা কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। আমি শুনেছি ভারত সরকারের কাছেও প্রথমে এ প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদে শুধুমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থীদের প্রভাব তাদের চোখেও ভালো লাগেনি। তাই উপদেষ্টা কমিটিতে ভারসাম্য বিধানের জন্যেই নাকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উপদেষ্টা কমিটিতে মওলানা ভাসানী ও মনোরঞ্জন ধরের নাম প্রস্তাব করেন। অথচ ভারতে আমরা যারা ছিলাম আমাদের জানানো হয়েছিল, মওলানা ভাসানী নজরবন্দি আছেন। তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অনুমতি নেই। এ ব্যাপারে অনেক লেখালেখি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে।
একটি মহলের মতে, মওলানা ভাসানীকে নজরবন্দি রাখা হয়েছিল তাঁর নিরাপত্তার জন্যে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মহলের কাছে তিনি আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে অনেক ঘটনাই ঘটেছে যা আদৌ বাঞ্ছিত ছিল না। আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচকদের এ জন্যে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে। তুখোড় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক বলে কলকাতায় অনেকের জীবন বিপন্ন হয়েছে। এই মহলের মতে, এই বিবেচনায় মওলানা ভাসানীকে নিরাপত্তা দেয়া ছিল ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে কোনোকিছু ঘটলে তার সব দায়িত্বই ভারত সরকারকে বহন করতে হতো। তাই তাঁর ব্যাপারে উদাসীন থাকা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ হয়েছে তাঁকে উপদেষ্টা কমিটিতে নেয়ার পর।
আগরতলায় পৌঁছে এই কমিটি গঠনের সংবাদ পেয়ে আমার মনে হলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কোন্দল কিছুটা থামবে। ভারতের মাটিতে এটা স্পষ্ট ছিল, আমরা সকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হলেও আমরা এক রাজনীতির লোক নই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক তফাৎ আছে। ভারতের মাটিতে দেখেছি, মস্কোপন্থীদের যুফ্রন্ট গঠনের দাবিতে সভা সমাবেশ করতে। পিকিংপন্থীদের দেখেছি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ভিন্ন কমিটি গঠন করতে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদেরও নিজস্ব দলীয় ভূমিকা ব্যাখ্যা করার জন্যে কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়েছে। তবে উপদেষ্টা পরিষদ যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থামাতে পারেনি তার প্রমাণ হচ্ছে মুজিববাহিনী গঠন।
এ সময়ের তিন নম্বর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি। এ নিয়ে অনেক কথা আছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের পর। ৭১-এর সংগ্রামের সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার ছিলেন চরম ভারত বিরোধী। এই দুই ব্যক্তি সংগ্রামের সময় পাকিস্তানকে সকল প্রকার সাহায্য করেছিলেন। তার মাশুলও তারা আদায় করেছে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে।
তখন বিশ্ব রাজীতিতে মস্কো এবং পিকিং মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মস্কোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো পাকিস্তানের। আর চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তখন সবচেয়ে খারাপ। যোগাযোগই নেই। তাই নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সিদ্ধান্ত ছিল ৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থনের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের মারফত চীনের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা। এবং এ কাজটি ভালোভাবেই করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি পাকিস্তান সফরে এসে গোপনে চীনে চলে যান। চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে ফিরে আসেন। জানানো হয়, এ সফর ছিল সন্তোষজনক এবং এ আলোচনার ভিত্তিতেই চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে।
তবে এ সম্পর্কোন্নয়নের একটি ভিন্ন প্রেক্ষিত ছিল। সে কথাও সকলের কাছেই খুব স্পষ্ট ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়ন ভারত সরকারকে বিব্রত করে। আমাদেরকেও শঙ্কিত করে তোলে। কারণ তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ যুদ্ধে চীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণ করলে ভারত এবং বাংলাদেশের পক্ষে বিপদ। সুতরাং চীনকে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এ পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো দিল্লি সফরে আসেন। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন ২৫ বছরের শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়, কোনো তৃতীয় পক্ষ এই চুক্তিবদ্ধ দু’টি দেশের কোনো একটিতে আক্রমণ করলে এ দু’টি দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে আক্রমণ মোকাবেলা করবে। অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীন অংশগ্রহণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বসে থাকবে না। এই চুক্তির পর স্পষ্ট হয়ে উঠল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এ যুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
যদিও এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভারত সরকার কোনো উচ্চবাচ্য করছিল না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দাবি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু ভারত সরকার রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু কেন?
সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ৭১-এর যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই তিন মাসে যুদ্ধ তীব্র হয়েছে। আবার তীব্র হয়েছে ষড়যন্ত্র। এ মাসগুলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। ইতোমধ্যে অসংখ্য তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এক সময় ছিল যখন ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিতে হতো। অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার হতে হতো।
সে পরিস্থিতি এখন আর নেই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন বাহিনী গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশেই তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দেশে থেকেই তারা অস্ত্র সংগ্রহ করছে। গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছে শহরে গ্রামে গঞ্জে। এদের অনেকের সঙ্গে বাইরের কারো কোনো সম্পর্ক নেই। এদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বা সরকারিভাবে স্বীকৃতি মুক্তিবাহিনীর। অর্থাৎ ৭১-এর যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধে পরিণত হতে যাচ্ছিল। এর প্রতিক্রিয়াও হচ্ছিল বিভিন্ন মহলে।