৫. রূপাই বিলের ঘটনা

রূপাই বিলের এ ঘটনা ঘটেছিল দু বছর আগে। যদুর তখন আঠারো বছর বয়স। গদাধর নারকেল গাছের নীচে বসে যখন বলল, গোপদের আর তার প্রাণীদের পদে পদে বিপদ। কখন কোথায় সে কেমন কইরে মইরবে, সে কথা কেউ বলতে পারে না।’গদাধরের কথা শোনার পর, যদুর মনে পড়ছিল রূপাই বিলের ঘটনা। সে-মৃত্যুর রূপ এক রকম। জটা মরেছে নিজের পাপে। কিন্তু দুর্গা কেন ওই রকম। কাঁদছে? ও কেন মরতে চায়?

যদু গোয়ালের ভিতরে বসে ছিল চুপচাপ। গঙ্গার চরে যাবার সময় এখনও আছে। যাবার আগে কিছু লুড়া উপড়ে নিয়ে যেতে হবে। গদাধর তখনও বসে ছিল নারকেল গাছের তলায়। হুঁকা টানছে। গদাধরকে ঘিরে তখনও জনা তিনেক বসে আছে। বলছিল, ক্যানে, সেই সুজাদিয়া বিলের মাঠে সুদেবের ভাই বদ্যিনাথের কী হইয়েছিল মনে নাই?

মনে নাই আবার?’ নিতাই ঘোষের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল, কেবল কি বদ্যিনাথ? তার সঙ্গে তিনটি পেরানি! অই বাবা, মনে কইরলে গায়ে কাঁটা দেয়। মনে আছে খালি একটা কী ঝলক মাইরলে, চখ দুটো ঝইলসে দিলে। আওয়াজ পাবার আগেই।

নিতাই ঘোষ কথা শেষ করতে পারল না। গদাধরের মোটা ভুরু জোড়ার নীচে চোখ দুটো অন্যমনস্ক। যদু ছিল তখন দু বছরের শিশু। বড় হয়ে ঠাকুরদার মুখে সুজাদিয়ার মাঠের সেই ভয়ংকর ঘটনা শুনেছিল। সেই ভয়ংকর দিনটিতে, বাথান বিকালে গিয়ে পৌঁছেছিল সুজাদিয়ার মাঠে। বৈশাখ মাস। মাঠে পৌঁছেই প্রাণীরা ছুটে গিয়েছিল সুজাদিয়ার বিলে মুখ ডুবিয়ে তৃষ্ণা মেটাতে। বাথানদারেরাও গিয়েছিল। সকলেরই তৃষ্ণা। গায়ের জ্বালা জুড়াতে জল ছিটানোর ইচ্ছা। দোহন পর্ব শুরু হবার সময়। প্রাণীরা ড্যারায় ফিরে আসছিল বিলের ধার থেকে। সূর্য অস্ত যায়। বাছুর বাঁধা, দোহনের তাড়াহুড়া। নৈঋত কোণে তখন কালো মেঘ দ্রুত বিশাল হয়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল। ঝড় বৃষ্টি তখনও শুরু হয়নি। ঘন ঘন বিজলি হানছিল। বাজ ডাকছিল। ভেড়ার পাল ডাকাডাকি শুরু করেছিল। সুজাদিয়ার মাঠ বিল গাছপালা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। স্তব্ধ নিঝুম।

বদ্যিনাথ বিলের ধার থেকে তিনটি প্রাণীকে তাড়া করে ড্যারায় আসছিল। হঠাৎ একটা ঝলক, মাঠ বিল সকল প্রাণীর চোখ ঝলসে দিয়েছিল। বাজের আচমকা ডাকে সকলের কানে তালা। বদ্যিনাথ আর তিনটি প্রাণী চোখের পলকে ঝলসে গিয়েছিল। বদ্যিনাথ আর তিনটি প্রাণীরই শরীর পোড়া কালো রং হয়ে গিয়েছিল।

তা বইলে কি সুজাদিয়ার মাঠ ঠ্যাকারের মাঠ?’ গদাধর মাথা নাড়াল, না, সুজাদিয়ার মাঠ বল, রূপাই বিলের মাঠ বল, কোনওটাই ঠ্যাকারের মাঠ লয়। ঠ্যাকারের মাঠ হল মুড়াগাছার মাঠ। সে বারে। কেবল গোমড়ক হয় নাই। আমার জ্যাঠা, হরি ঘোষের বাপও সেই মড়কে মইরেছিল। সে বার আমি মুড়াগাছার মাঠে রোজ আত্তিরে আলেয়া দেইখতাম। শুইয়ে শুইয়ে দেইখতাম, মাঠের দূর দিয়ে একটা আলো জ্বইলচে নিবচে, জ্বইলচে নিবচে, আর চইলে যাইচ্ছে দূরে। ক্যানে জানি না, আজও আমার মনে হয় আলেয়া দেখা ভাল লয়, ওতে অমঙ্গলের লক্ষণ। গো মড়কে চল্লিশ পেরানি মইরেছিল। কিন্তু ঘোষের দুধেল গাইয়ের বাঁট দাঁড়াস সাপে চুষে, ফুটো কইরে দেচিল। আমরা সেই মাঠে আর কোনদিন যাই নাই। তা না যাই, আমাদের আর আমাদের পেরানিদের জেবনে পদে পদে বিপদ। মরণ যে কোথায় ওত পেইতে বইসে আছে কেউ বইলতে পারে না। সেই এক বার মনে আছে? বেশি দিনের কথা নয়, দশ বছর হবে, সে বার আমরা গেচিলাম মাজদে কুঠিপাড়ামাঠে।

আমার মনে আছে বাবা। শ্রীবাস হাসল, পোঙা সরু, পেটা শক্ত কালো শরীল, নেংটি পরা মানুষগুলান তীর ধনুক লিয়ে আমাদের তেড়ে এইসেছিল। কী অক্তাঅক্তি কাণ্ড!

হাঁ, যদু সে ঘটনাও শুনেছে। দশ বছর আগে, যদু তখন বাথানে যায়নি। বাথান গিয়েছিল মাজদিয়া কুঠিপাড়ার মাঠে। সেটাও ছিল অগ্রহায়ণ মাস–মাসের শেষ। মাঠে তখনও বেশ কিছু পাকা ধান ছিল। পেরানির মতিগতির কথা কেউ বলতে পারে না। বাথানদারেরাও নিশ্চয় অসাবধান ছিল। কিছু গোরু মহিষ পাকা ধানের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যাকে বলে একেবারে পাকা ধানে মই। কেউ সহ্য করে? বাথানদারেরা লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল প্রাণীদের ফিরিয়ে আনতে। তার আগেই সাঁওতালরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লাঠি নিয়ে। সব কটা যেন বুনো দাতাল। পেরানিদের এমন পিটিয়েছিল, দু-একটার শিং ভেঙে গিয়েছিল। আর একটা নাক মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে গিয়েছিল। ধান ক্ষেতেই মরেছিল। তা তোমরা যে-ই হও, তোমরা পেরানিদের খুন করতে পার, এত তোমাদের রাগ! বারে বারে গোপেরা হাত জোড় করে বলেছিল, ক্ষতিপূরণ করবে। তা কার কথা কে শোনে। আর গোপ যদি দেখে, তার প্রাণীকে চোখের সামনে কেউ পিটিয়ে মেরে ফেলছে, সে সইবে না। অল্পবিস্তর পিটিয়ে তাড়াও সেটা একটা কথা। ফলে, প্রাণীরা মার খেয়ে পালালেও গোপেরা সাঁওতালদের ওপর লাঠি চালিয়েছিল। সাঁওতালরা গোপেদের লাঠির সঙ্গে পারবে কেন? মার খেয়ে ফিরে গিয়ে, তীর ধনুক নিয়ে ছুটে এসেছিল। বাথান ঘিরে তীর ছুঁড়তে আরম্ভ করেছিল। অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছিল, বাবারা থাম। তোদের যা ক্ষতি হয়েছে, কড়ায় গণ্ডায় শোধ দেওয়া হবে। কথা শোনবার লোক তারা ছিল না। গোপেরা চোখের সামনে দেখেছিল, প্রাণীদের গায়ে লোহার চোখা তীর বিধে রক্তপাত হচ্ছে। বিশু ঘোষের একটা চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কত তীর আছে তোদের? গোপদেরও রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল। তীর ধনুকের পরোয়া না করে, লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল। সে এক যুদ্ধক্ষেত্র। সামনা সামনি হতেই, তীর ছোঁড়ার অসুবিধা হয়েছিল। তীর দিয়ে গায়ে বিধিয়ে দিয়েছিল। গোপেরাও কয়েক জনের মাথা ফাটিয়েছিল।

খবর চলে গিয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জ থানায়। পুলিশ এসে না পড়লে, দু-চারটে খুন হয়ে যেত। মার খেয়েছিল বেশি গোপেরাই। ক্ষতিও কম হয়নি। একটি গাভি মরেছিল। চার-পাঁচটি প্রাণীর গায়ে তীর বিধেছিল। বাথানের সঙ্গে এগারো জন গোপের সকলেই কম বেশি আহত হয়েছিল। এক জনের চোখ গিয়েছিল। সেই তুলনায় সাঁওতালদের তিন জনের মাথা ফেটেছিল। অন্তত কাঠা পাঁচেক জমির ধান নষ্ট হয়েছিল। আশেপাশের গ্রামের মাতব্বরেরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিল। পুলিশ কোনও মামলা করেনি। সাঁওতালরাও মামলা চায়নি। মৃত গাভিটিকে দেখে, পুলিশ সাঁওতালদের ক্ষতিপূরণ বন্ধ করে দিয়েছিল। সেদিনই বাথান নিয়ে গোপেরা চলে গিয়েছিল। মালীঘাটার মাথাভাঙা নদীর ধারে।

হ্যাঁ, গোপেরা বাথান নিয়ে, গোচারণে পথে পথে ফেরে। প্রাণীদের জন্য মরে বাঁচে। প্রাণীরাও মরে। প্রাণীদের সঙ্গে তাদের মরণ জড়াজড়ি। কিন্তু জটা সেই কারণেই মরেনি। যদু মানুষ মারেনি। শেয়াল মেরেছে। যে শেয়াল ওর বোনকে ভেড়ার বাচ্চার মতো ছিঁড়ে খুঁড়েছে। তবু দুর্গা কেন মরতে চায়?

যদু দেখল, মা খুড়ি ঘোমটায় মুখ ঢেকে বাড়িতে ঢুকছে। ও উঠে পড়ল। লুড়া উপড়ে তুলে, প্রাণীদের স্নান করাতে যাবে গঙ্গার চরে। হীরা তোপা খেতে আসবে।

শ্রাবণের আকাশ মেঘে থমথম। বড় গুমোট। বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে দু দিন। মেঘ এখনও আকাশ ছেয়ে আছে। রোদ নেই, তবু বেলা বোঝা যায়। বেলা এখন বড়। খাওয়ার পাট মিটেছে কিছুক্ষণ আগে। হীরা তোপার সঙ্গে পঞ্চাননও চরার মাঠে গিয়েছে। মা খুড়ি দুর্গা সবে এঁটো বাসনপত্র মেজে ধুয়ে ফিরল জগত পুকুর থেকে। ভূপা আর পানু এখনও স্কুলে যায় মাঝের গ্রামে। দুর্গা বাড়ি থেকে বেরোয় না। কাজকর্ম করে, খায়দায়। কিন্তু যদু দেখেছে, দুর্গা মাত্র সাত দিনেই কেমন বদলে গিয়েছে। সাত দিন আগে জটা-হত্যা হয়েছে।

দুর্গা আগে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াত। ধীরে সুস্থে কাজ করতে জানত না। এ-ঘরে ও-ঘরে গোয়ালে, খিড়কিতে ছুটে দৌড়ে কাজ করত। ফঁক পেলেই এক-আধবার বাড়ি থেকে পাড়া ঘুরে আসত। পাড়া ঘোরাটা বিকালেই ছিল। জেঠি খুড়ি কেউ চুল বেঁধে দেয়। বড় চুলে খোঁপায় ওকে দেখায় ভাল। গা ধুয়ে এসে আলতা পরে, ধোয়া শাড়ি গায়ে বামুন পাড়ার অন্ন না হয় জটার বোন পূর্ণিমার কাছে যাওয়া। ওরাও আসে। আর হাসি। দুর্গার কোনও কারণে এক বার হাসি শুরু হলে থামে না। বাড়িতে এখন ও একমাত্র মেয়ে। সকলের আদরের। তবু ওর হাসি শুনলে খুড়ি মুখ ঝামটা দেয়, মরণ! ও কি হাসি? পাগলের মতন?’

গদাধর মাঝে মাঝে ফোড়ন দেয়, পেতনির মতন।

দুর্গা এত বড় জিভ বের করে গদাধরকে ভেংচে দেয়। চোখে মুখে ওর কথা। ভূপা পানুর সঙ্গে এখনও ঝগড়া লাগে। মারামারিও। বাড়িময় ছুটোছুটি পড়ে যায়। খুড়ি চটে ফেঁজে ওঠে, ওকী হইচ্ছে, অ্যাঁ। দু দিন বাদে যার বে হবে, সে মেয়ের এ কেমন ধিঙ্গিপনা। মাইরব চ্যালাকাঠের বাড়ি, তকন। বুইঝবি। …দুর্গারও মায়ের মুখে মুখে কথা, খালি আমার দোষ দেইখচ। নিজের ছেলের দোষ দেইখতে পাও না।’…

সেই দুর্গা হাসে না। দৌড় ঝাঁপ করে না। বাড়ি থেকে বেরোয় না। বামুন বাড়ির অন্ন দু দিন ঘুরে গিয়েছে। পূর্ণিমা এক দিনও আসেনি। না আসবারই কথা। বাড়িতে এত বড় একটা সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে। এখনও শোকের গ্রাসে বাড়িতে নিঃশব্দ হাহাকার। জটার লাশ তিন দিনের মাথায় রাত্রে আনা হয়েছিল। দাহ করা হয়েছিল গঙ্গার ধারের গোপদের নির্দিষ্ট শ্মশানে। জটার শরীরটা নাকি পুলিশের ডাক্তার ছিঁড়ে কেটে দেখেছিল। বলেছিল, জটাকে কেউ আচমকা ফাঁস দিয়ে মেরেছে। পুলিশের ডাক্তার এত সব বলতে পারে? আরও বলেছিল, খুনি জটার পিঠে পা চেপে ধরেছিল, ওকে উপুড় করে ফেলে মেরেছিল। মিথ্যা বলেনি।

মা বা খুড়ি দুর্গার চুল বেঁধে দেয় বিকালে। দুর্গা জগত পুকুরে গা ধুয়ে আসে। মা খুড়ি বললেও, আলতা পরতে চায় না। বকে ধমকে পরাতে হয়। সাত দিনের মধ্যেই মুখ যেন শীর্ণ। চোখের কোল বসা। গদাধর শ্রীবাস মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করে, মেয়েটার হইয়েচে কী? খোড় ব্যামো গোরুর মতন, শুকয়ে যাইচ্চে?

যদুর মা জবাব দেয়, সে তোমরা বুইঝবে না। আমরা বুঝি, ওষুধ খাওয়াইচ্চি।

যদু একলা, খালি গোয়ালে বসে হুঁকা টানচে। গদাধর পুবের ঘরের দাওয়ায় চাটাইয়ের ওপর কাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। অধর খড় কাটছে। অসুস্থ গাভি এখন সুস্থ। সকলের সঙ্গে গঙ্গার চরার মাঠে গিয়েছে। শ্রীবাস বলরামকে নিয়ে হিসাবে বসেছে। সবই দুধের পাওয়ানা গণ্ডার হিসাব। তারপরে দুজনেই যাবে তাগাদায়। ফিরে আসবে দোহনের আগে। যদু দেখল, মা গোবরের গাদার কাছে গিয়ে বসেছে, পিছনের নিচু গোয়ালের কাছে। একটা ছেঁড়া চাটাইয়ের ওপর ঘষি সাজাচ্ছে। খুড়ি গেল মায়ের কাছে। মায়ের দু হাত ব্যস্ত। খুড়ি মায়ের মুখে পানের খিলি গুঁজে দিল। খুড়ি কী বলল। মা ভুরু কুঁচকে তাকাল। তারপরে একটু হেসে মাথা নেড়ে, কিছু বলল।

কই গো পিসে, কোতায় ছিবাস?’ উত্তরের বেড়ার আগল ঠেলে ঢুকল নিমদহের মহাদেব। সঙ্গে ছোট ভাই ভবতারণ।

শ্রীবাস বলরামকে নিয়ে দক্ষিণের দাওয়ায় হিসাবে বসেছিল। হিসাবের কাগজপত্র সরিয়ে নেমে এল উঠোনে, মা’দেব দাদা যে! ভবতারণ এইসেচ? এইস এইস। খবর সব ভাল ত? কোতায় গেইলে গো তোমরা? অ দুগ্না, বাড়িতে কুটুম এইসেচে, বইসতে দে।

যদু দেখল মহাদেব আর ভবতারণের গায়ে ধোয়া পরিষ্কার জামা কাপড়। গলায় পাট করা নতুন গামছা। দুজনের মুখেই হাসি। ভাল খবরের লক্ষণ তাদের পোশাকে, চোখেমুখে। মা তাড়াতাড়ি চলে গেল পশ্চিমের ডোবায়। খুড়ি এক গলা ঘোমটা টেনে ঘরে গিয়ে ঢুকল। দুর্গা এক বার উঁকি দিয়ে দেখে, পুবের দাওয়ায় দুটি আসন এনে পেতে দিল। ওর নিজের হাতে তৈরি, চটের ওপর রঙিন সুতোর কাজ করা আসন। শ্রীবাস ডাকল, এইস এইস মা’দেবদাদা, এইস ভাই ভবতারণ, বইস।’

আহা, এত ব্যস্ত ক্যানে?’ মহাদেব বলেও, ব্যস্তভাবে বসল, পিসে তো দেইখচি নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্চে।

গদাধর তখনই ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। কথা কানে গিয়েছে। ঘুম চোখে, অবাক দৃষ্টি। উঠে বসল, মা’দেব? খবর কী?

ভাল। উঠে গিয়ে গদাধরের দু পা ছুঁয়ে কপালে ঠেকাল।

ভবতারণও গদাধরকে প্রণাম করল। গদাধর দুজনের মুখের দিকে তাকাল, মনে হইচ্চে, সুখবর কিছু আছে?

তা আছে পিসে। মেয়ের বে, আমার বড় মেয়ে উমার। মহাদেব হাসল। কাঁধের গামছা গলায় জড়িয়ে, হাত জোড় করল, বাড়ির সব্বাইকে যেতে হবে। বউ ঝি ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি, কেউ বাদ থাইকলে চইলবে না।’

যদু গোয়ালের ভিতর আড়ালে। সব কথাই শুনতে পাচ্ছে। হুঁকাটা নামিয়ে মাটির দেওয়ালে ঠেকিয়ে রাখল। গলায় ফাঁস লাগেনি। বুকে যেন কাটারির কোপ পড়ল। শরীরটা অসাড় বোধ হল। চোখের। সামনে উমির মুখ ভাসছে। জামালপুরের দিঘির জঙ্গলের ধু ধু মাঠের ধারে বুকে ওর দাঁত বসিয়েছিল উমি। কোপটা সেখানে পড়েছে। দেখছে, ওর বুকে উমির মুখ। দু চোখ জলে ভাসছে। দেখছে, বেলের। হাটের ভাঙা বাড়ির পোড়োয়। উমির সদ্যোত বুক, জামার বাইরে। যদুর কোলে শুয়ে। বলছে, তুমি আমাকে কলঙ্ক দাও–আইবুড়ো মেয়ের কলঙ্ক।..

গদাধর হা হা শব্দে হাসল, তা যা বইলেচ মা’দেব। ঘরগুষ্টির সবাই তোমার মেয়ের বে’-তে যাই, আর আমার ঘরের জ্যান্ত ধন অতনরা শুঁকে মরুক। বলে আবার হাসল, যাব যাব, যতজন পারি, ততজনই যাব। তা মেয়ের বে’ কোতায় ঠিক হল? কবে?

আর বল ক্যানে পিসে, দিন এসে পইড়ল। মহাদেবের স্বর চিন্তিত, ঝট কইরে কথা পাকা হয়ে গেল। এই মাসের শেষাশেষি, উনতিরিশে শাওন। আমার শালা দাশু সম্বন্ধ দেইখেচে। ছেলের বাড়ি বেলগাছি!’

গদাধর মাথা ঝাঁকাল, ভাল ভাল। উঁচু উঁচু এলেকানিদের মতনই। বর্ষা বন্যায় ভাইসবার ভয় নাই। তা ছেলের বাড়ি কি তোমাদের–।

হ্যাঁ, চাষবাস আছে, অবস্থা ভালই। মহাদেব গদাধরের কথার মধ্যেই বলল, ছেলেরা তিন ভাই, পাঁচ বোন। বোনদের বে’ হয়ে গেছে। জামাই হবে বড় ছেলে। ইস্কুলের উঁচু কেলাস অবদি পইড়েচে। খাই একটু বেশি। আংটি তো আছেই। ঘড়ি আর সাইকেল চেইয়েছিল। দাশুর কথায় সাইকেলে রফা হইয়েচে। ঘড়ি বাদ। আজকাল সব ছেলেই সাইকেল চায়।’

তা তোমাদের আছে, দেবা না ক্যানে। গদাধর হাসল, কইগো, তোমরা কোতায় গেইলে? দুগ্ন, পান তামুক দে দিনি। মা খুড়িকে বল, কুটুম এইসেচে, মুড়ি দুধ খাওয়াবে।’

না, না, আবার মুড়ি দুধ ক্যানে?’ মহাদেব সহবতে হাসল, ছিবাস তোমার বউকে ডাক। সে এখন বাড়ির বড় গিন্নি, তাকে আলাদা করে না বইললে হবে না।

ভবতারণও কাঁধের গামছা গলায় জড়িয়েছে। দু হাত এখনও জোড় করা। মুখে হাসি। মহাদেব কথা বলছে। সে ঘাড় কঁকিয়ে সায় দিচ্ছে। না বললে, নাথা নাড়ছে। অধর খড় কাটা রেখে, কোমরের গামছা কাঁধে ফেলে সকলের সামনে এসে দাঁড়াল, ভাল তো মা’দেবদাদা? ভবদাদা ভাল?

সব ভাল তখন হবে অধর, যখন বে’-তে যাবে। মহাদেবের মুখে খুশির হাসি।

যদুর মা এক গলা ঘোমটা টেনে, পুবের দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। শ্বশুরকে মুখ না দেখিয়ে মহাদেবকে দেখিয়ে হাসল। কিন্তু কথা বলল পরিষ্কার, আত্তিরে থেইকে খেইয়ে যেইতে হবে।

ওরে বাবা!’ মহাদেব হাত জোড় করল, ক্ষ্যামা দাও গো ছিবাসগিন্নি। সেই কখন বেইরেচি। এপারে তোমাদের বাড়িই আগে এইসেছি। এখান থেকে যেতে হবে ভবতারণের শউড় বাড়ি মাটিয়ারি। আজ বাদে কাল বে’, এখন কি কুটুমবাড়ি থাকা খাওয়ার সোময় আছে? আইসব, পরে আইসব, খাব থাইকব।

যদুর মা জিজ্ঞেস করল, উমির মা খুড়ি ছেলেমেয়েরা সব ভাল ত?

সব ভাল ছিবাস গিন্নি, কিন্তু মহাদেবের একটা বড় নিশ্বাস পড়ল, যার বে’ তারই শরীলটা কেমন ভেঙে পইড়েচে। মেয়ে ত আমার বাড়ন্ত গড়ন, শরীলটা ভাল নাই। তোমরা আত্মকুটুম মানুষ, তোমাদের বলা যায়। উমির মাঝে মধ্যে মুচ্ছো দেখা গেছে। কথা নাই বার্তা নাই, মেয়ে হঠাৎ কইরে ফিট। জামালপুরের বুড়ারাজের চরণামেত্ত খাইয়েচি। সেবাইত বাড়ির পেসন্ন ঠাকুর মাদুলি দিয়েছে, বইলেচে, বে’ হলে ভাল হয়ে যাবে।’

যদুর চোখের সামনে উমি। শরীর ক্যানে ভেঙেছে? মুচ্ছো ব্যায়ো ক্যানে তোমার? শুইনলে যে মন খারাপ করে। তোমার চখে বুকে আমার প্রাণ। চেরকাল থাইকবে। তুমি হাইসবা, সুখে থাইকবা, ওতে আমার মন ভরা থাইকবে। যদু যেন উমিকে সামনে দেখেই মনে মনে কথাগুলো বলল, ভাবলে অবাক লাগে, কদিন ধরেই ওর মন করছিল, কারোকে কিছু না বলে, একদিন নিমদহে ঘুরে আসবে। না, মহাদেব ঘোষের বাড়ি যেত না। নিমদহে গিয়ে, সেখান থেকে জামালপুরে যাবে। উমির দেখা পাবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় ছিল। ভেবেছিল, সোমবারের ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বে। নিমদহের পথ দিয়ে জামালপুরে বুড়োরাজের থানে যাবে। জটা হত্যার পর থেকেই মনটা আঁকুপাঁকু করছিল। গ্রামে ঘরে মন টিকছিল না। কেবল নিমদহে যেতে ইচ্ছা করছিল। আর সে-যাওয়া হবে না। হ্যাঁ, বড় কোপ পড়েছে বুকে। অসাড় শরীর। মন মোচড়াচ্ছে। যদুর কুড়ি বছরের বুকে একটাই তো দাগ। পুরুষ মানুষ। উমি আর এক পুরুষের বুকে মুখ রাখবে। মন মোচড়াবে না? বুকের পাঁজরে আখ মাড়াই হচ্ছে। আইবুড়ো মেয়ের কলঙ্ক চেয়েছিলে। এত তোমার সাহস। সাহস না। ছেউটির বুকে তখন কুলনাশা প্লাবন জেগেছিল। কিন্তু কেউ ভেসে যায় নাই। আর কেউ ভাসবেও না। স্বামীর ঘরে যাওয়া, সংসারের পথে নতুন গড়ার ঠাই। কুলনাশা প্লাবন জীবনে এক বারই আসে। ভাসলে তো ভাসলে। না ভাসলে কূলের সংসারে থাকো।

অই রে যদু, ভূতের মতন গোয়ালে বইসে আছিস? মা এসে দাঁড়াল পিছনের খোলা গোয়ালের জমিতে, মা’দেব ঘোষ তোর খোঁজ কইরচে যে? আয়।

যদু অন্যমনস্ক চোখে মায়ের দিকে তাকাল। যেন চিনতে পারছে না। স্থান কাল জ্ঞান নেই। মায়ের মুখে ছায়া ঘনিয়ে এল। চোখে চকিত ব্যথার চমক। মা গোয়ালে উঠে, যদুর সামনে দাঁড়াল। ডাকল, যদু।

অ্যাঁ?’ যদুর চোখে তখনও অন্যমনস্কতা।

মা যদুর সামনে বসল। যদুর খোলা বুকে হাত রাখল। মা ছেলে পরস্পরের দিকে তাকাল। যদুর চোখের অন্যমনস্কতা কাটল। হাসল। যদুর মুখের হাসি দেখে, চিরদিন মায়ের মনটা ভরে যায়। সবাই বলে, ছেলের হাসিটি বড় সুন্দর। কিন্তু এখন যদুর হাসি দেখে, মায়ের চোখ ভিজে উঠল। ফিসফিস করে বলল, সোমসার কী কঠিন ঠাই, সে কথা তোকে আর আমি কী বুঝাব বাবা?’

বুঝাবা ক্যানে মা?’ যদু হাসল, আমি বাথান আখাল। চল যাই। ও উঠে দাঁড়াল। মা চেয়ে রইল। ও গোয়ালের বাইরে এল।

এই যে যদু, এস এস। মহাদেব দু হাত বাড়াল। তোমার কথা আমাদের বাড়ি রোজ হয়।

যদু দু হাত দিয়ে মহাদেব আর ভবতারণের পা স্পর্শ করে, কপালে হেঁয়াল। গদাধর শ্রীবাস অধরকেও প্রণাম করল। তখন জটা হত্যার আলোচনা শেষ। সামনের কার্তিক মাসে গো-দ্বিতীয়া আর গোবর্ধন পূজার কথা উঠেছে। গদাধর বলল, গো-দ্বিতীয়া তো তোমরা আর কর না, আমরা করি। ত্যাখন আইসতে হবে। নিমদেয় গিয়ে নেমন্তন্ন কইরে আইসব।

আইসব গো পিসে, আইসব। মহাদেব দু হাত তুলে বলল, বড় মোচ্ছব তখন তোমাদের গাঁয়ে। নতুন ধুতি জামা পইরবে, পূজা হবে, গোরু মোষদের সাজাবে, খিলাবে। আইসব না ক্যানে?

.

গো-দ্বিতীয়া–গোবর্ধন পূজা। গোপদের সব থেকে বড় উৎসব। দিসারা গ্রামে দুর্গা পূজা হয় দুটো। একটা ব্রাহ্মণ পাড়ার চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর বাড়ির পূজা। অনেক কালের পূজা। আর একটি বারোয়ারি দুর্গোৎসব। গাঁয়ের সবাই চাদা দেয়। মুসলমান পাড়ার মুসলমানরাও দেয়। বারোয়ারি পূজা হয় গ্রামের দক্ষিণের মাঠে। মাঠও বারোয়ারি। গ্রামের যাবৎ হিন্দু পুজোয় নতুন জামাকাপড় পরে। গোপেরা ছাড়া। গোপেরা নতুন ধুতি পরে গো-দ্বিতীয়ায়। কিছু না হোক, একটি নতুন ধুতি আর গামছা চাই পুরুষদের। ছোট হোক বড় হোক। মেয়ে বউ ঝিদের নতুন শাড়ি।

গোপ পাড়ায় সে দিন রমরমা। যদুদের বাড়ির গোবর্ধন পূজায় আসেন স্বয়ং চন্দ্রকান্ত। গোপ যজমানদের মধ্যে গদাধর তার সবথেকে প্রিয়। দুজনেই সমবয়সি। ছেলেবেলা থেকে বন্ধুত্ব। বামুন গোয়ালায়ও বন্ধুত্ব হয়। গদাধর চিরকাল বাথান নিয়ে দেশে দেশান্তরে ঘঘারে। চন্দ্রকান্ত লেখাপড়া শিখেছেন নবদ্বীপে। দুধ খেতে হলে গদাধরের কাছে। এখনও চন্দ্রকান্তর বাড়িতে রোজ এ বাড়ির দুধ যায়।

কার্তিকী অমাবস্যায় কালী পূজা। চন্দ্রকান্ত পাঁজি নিয়ে আসেন কালী পূজার রাতেই। পূজার ক্ষণ নির্ণয় করেন, বুইঝলি রে গদাধর, অমাবস্যে গত হবে, শুক্ল পক্ষ পইড়তেই গোবদ্ধন পূজা সাইরতে হবে। প্রতিপদের চাঁদ যদি এক বার চখে পড়ে, তবে পূজা নাস্তি।

হ্যাঁ, ও কথাটা আর কত বার বইলবা হে চন্দর ঠাউর?’ গদাধর হাসে, অমাবস্যে গত হবে, পিতিপদ পইড়বে। সেই পিতিপদে যদি আকাশে চাঁদ দেখা যায়, তা হলে পুজো নাই। কইরলে প্রাণীরা মইরবে, গোপ শালার বংশ ধ্বংস হইয়ে যাবে। তাই নিশাভাগে পূজা সাইরতে হবে।

চন্দ্রকান্ত হাসেন, তুই ত বামুনের বাড়া হইয়ে গেছিস। তা বল ত, কোতায় গিরি গোবদ্ধনের পূজা নাই?

মথরোয়।’গদাধরও হাসে, তুমি ঠাউর নিজে ছেলেবেলা থেনে আমাকে শিখয়েচ, আমি কি ভুইলে। গেচি? ওই দ্যাখ, আমার ছেলে নাতিরা গোময় গিরি তৈয়ের কইরে ফেইলেচে।

হ্যাঁ, ওই কাজটিতে যদুর ছেলেবেলা থেকে উৎসাহ। সেই যে ইন্দ্রের শাপে বৃন্দাবনের গোপদের আর প্রাণীদের হত্যা করার জন্য ঝড় জলে মরবার অবস্থা হয়েছিল, কৃষ্ণ তখন এক আঙুলে পর্বত তুলে ধরেছিলেন। গোপেরা তাদের নিজেদের প্রাণ নিয়ে, গোধন সহ সেই পর্বতের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল। গোময় গিরি সেই পর্বতের প্রতীক। উঠোনের পুব দিকে মুখ করে গোময় গিরি তৈরি হয়। গোবরের পাহাড়। গোপদৈর পাড়ায় বাড়ি বাড়ি গোময় গিরি নিয়ে রেষারেষি। কে কত বড় গোবরের পাহাড় তৈরি করতে পারে।

কালী পূজার দ্বিতীয়ায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। প্রতিপদে গো-দ্বিতীয়া। গদাধরের ব্রত পালন চলছে। দশ বছর হয়েছে। আর দু বছর বাকি। ব্রত পালন করলে বারো বছর করতে হয়। কালী পুজোর ঢাক বাজে মহানিশায়। গ্রামে কালী পূজা হয় বেশ কয়েকটি। চন্দ্রকান্তর নিজের বাড়িতে কালী পূজা নেই। কিন্তু অন্যের বাড়িতে তাঁকে পূজা করতে হয়। সেই পূজা সেরেই তিনি গদাধরের বাড়ি চলে আসেন। গোপদের কালী পূজা নেই। তাদের রাত্রি জাগা গোবর্ধন পূজার জন্য। শেষ রাত্রেই পূজা সারতে হয়। গদাধর নতুন ধুতি পরে, পাট করা গামছা কাঁধে নিয়ে পূজায় বসে। সারা রাত্রি, আর প্রতিপদের পুরো দিন উপবাস। সকলের না, কেবল তার। চন্দ্রকান্ত তার আসনে বসেন। বাঁ দিকে গদাধরের আসন। গোময় গিরি ঘিরে প্রদীপ জ্বলে। ফল মিষ্টির নৈবেদ্য সাজানো হয়। চন্দ্রকান্ত আগে নিজে পূজা করেন। গিরি অর্চনা করে, মন্ত্রজপাদি সেরে, ফুল চন্দন দেন। তারপরে গদাধরকে বলেন, বন্ গদাধর, পষ্ট কইরে বইলবি, ভুল হলে কান মুইলে দেব।

বাড়ির সবাই তখন ঘিরে বসে পূজা দেখে। ঠাকুরের কথা শুনে হাসে। গদাধর সংসার বাথান করতে যেমন কথাই বলুক, মন্ত্র উচ্চারণে ভুল নেই। প্রথম প্রথম হত। উচ্চারণ করতে পারত না। এখন পারে। চন্দ্রকান্ত মন্ত্র বলেন, গদাধর প্রতিধ্বনি করে, হে গোবর্ধন! হে ধরাধর! হে গোকুলোদ্ধারক! তুমি হরির বাহুতে অধিষ্ঠিত হইয়া ছায়া প্রদান করিয়াছিলে। আমাকে কোটি গো অর্পণ কর।’… ।

এই পর্যন্ত বলে, চন্দ্রকান্ত নির্দেশ দেন, এবার গোপূজা মন্ত্র। বল, যিনি লোকপালবর্গের লক্ষ্মীস্বরূপিণী, যিনি ধেনুরূপে সংস্থিতা, যিনি যজ্ঞার্থে ঘৃত বহন করেন, তিনি শমনপাশ ছেদন করিয়া দিউন। মদীয় পুরোভাগে গোগণ অবস্থান করুন, মদীয় পশ্চাতে গোগণ অধিষ্ঠিত থাকুন, পার্শ্বভাগে গোগণ অবস্থান করুন, আমি গোসমূহ মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকি।..

গদাধর যখন মন্ত্র উচ্চারণ করে, তখন তার চোখ জলে ভাসতে থাকে। অথচ মুখে হাসি, গলার স্বর গদগদ। মন্ত্রের পর, ফুল চন্দন দিয়ে গোময় গিরির অর্চনা করে। প্রণাম করে সাষ্টাঙ্গে। উঠে, আবার প্রণাম করে চন্দ্রকান্তকে। নগদ দক্ষিণা বাবদ একটি টাকা পায়ের কাছে রাখে। তা ছাড়া ধুতি গামছা তো থাকেই। চন্দ্রকান্ত হাসেন, হ্যাঁরে গদাধর, মন্ত্র বইলবার সোময় তুই কাদিস ক্যানে?

কঁদিনা হে ঠাউর।’ গদাধর বলে, ওই যে মন্তরগুলান বলি না, গোগণ তোমরা আমার আগু পাছুতে থাক, আমার পাশে থাক, আমি তোমাদের মধ্যে থাকি, ত্যাখন আমি নিজেকে বাথানের মধ্যে দেইখতে পাই। মনে সুখ পাই। সুখে জল আইসে চখে। বুইঝলা হে চন্দর ঠাউর।

চন্দ্রকান্ত হাসেন, তা আর বুঝি না? তুমি ব্যাটা গোপ, আশি বছর না হলে বুদ্ধি হয় না। সাধে কি আর তোদের গঙ্গার ধ্যেরে ভূত বলে?

হাসির ধুম পড়ে যায়। চন্দ্রকান্তর কথায় বিষ নেই, ছোট করেন না। বন্ধুকে ঠাট্টা করেন। তারপরে বলেন, গদাধর, তুই জাত গোপ, তাই মন্ত্র বইলবার সোময় নিজেকে বাথানের মধ্যে দেইখতে পা। গিরিরাজ তোকে হাজার হাজার গো-ধন দিন।

গদাধর আবার প্রণাম করে চন্দ্রকান্তকে। চন্দ্রকান্ত গদাধরকে বুকে জড়িয়ে ধরে, এ বার আয়, দুজনে দূতক্রীড়া করি। পাশা-টাশা ত নাই। গোলকধাম পেইতে বস, কড়ি লিয়ে আয়।

হ্যাঁ, ভোর রাত্রেই শুরু হয়ে যায় নানা রকমের জুয়া খেলা। পয়সা দিয়ে খেলতে হবে। এই দিনে জুয়া খেললে পাপ নেই। বরং পুণ্যি। কিন্তু সময় কোথায় হে জুয়া খেলার? চন্দ্রকান্তর সঙ্গে গদাধর গোলকধাম পেতে বসে। বাকিদের তখন সত্যিকারের গো-দ্বিতীয়ার কাজ শুরু।

এই দিনে দোহন নিষেধ। বাছুরেরা প্রাণভরে মায়ের বাটে মুখ লাগিয়ে দুধ খাবে। সবাই প্রাণীদের নিয়ে গঙ্গায় স্নান করায়। ফিরিয়ে নিয়ে এসে, সবথেকে সুন্দর দুধেল গাভিটির পা ধোয়াবে গদাধর নিজে। তখন আবার পূজা। মন্ত্র নেই। গলায় নতুন ঘণ্টার সঙ্গে নতুন কড়ি বা পুঁতির মালা পরাবে। শিঙে মাখবে তেল সিঁদুর। কপালে হলুদ। বলবে, আমরা তোমাদের সেবা করি জমে জমো। তোমরা আমাদের অক্ষে কর জমমো জমমো।

কেবল একটি গাভিকে না। সমস্ত প্রাণীকে এই দিন শিংয়ে তেল সিঁদুর, কপালে হলুদ মাখাবে। গাভিন মহিষীদের কপালেও সিঁদুর মাখানো হয়। যার যেমন ক্ষমতা, সেই রকম পুঁতি পাথরের মালা পরাবে। গলায় বাঁধবে নতুন ঘণ্টা। ভেড়ার পালও বাদ যাবে না। দোহনের যত পাত্র, সব সাফসুরত করা হয়। গাড়ি চালানো নিষেধ। এই দিনে গোরু মহিষের গাড়িও ভাল করে ধোয়া হয়। তেল সিঁদুর মাখিয়ে, এদেরও পূজা করতে হয়। তারপর নিয়ে চল বকনা গাই মইষীদের দক্ষিণের মাঠে। বিশেষ করে যারা ডাকতে আরম্ভ করেছে। গ্রামের যত ষণ্ড, তারা নিজেরাই সেখানে যাবে। তারপরে খেলা শুরু। মাঠ ভরে যায় লোকে। গোপেরা ষণ্ডদের ক্ষেপিয়ে তোলে নানা চিৎকারে, হি যা যা, ধর। ওরে ওটার কাছে। যাইচ্চিস ক্যানে? ও বেটি দুবলা। আমারটার কাছে আয়।

বকনারা ছুটতে থাকে। ষণ্ডরাও ছুটতে থাকে। গলার ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং। ধুলা ওড়ে আকাশে। সবাই চায়, তাদের বকনাগুলোর কাছে ষাঁড় থাকুক। সবাই হাই হাই চিৎকার করে। বৃষকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য, যে সব কথা উচ্চারিত হয়, তা অতি মাত্রায় মৈথুন ক্রিয়ার প্রাকৃত বর্ণনা। হাসাহাসির ধুম পড়ে। মেয়েরা মুখে লজ্জার ছটা নিয়ে, মুখ ফেরায়। বউয়েরা ঘোমটা টানে।

ওরে মদ্দ, আমার মইষীটাকে দ্যাখ, গাইটাকে দ্যাখ। অমন ভরাট পাছা আর পাবি না। হাদ্যাখ দ্যাখ, কেমন কোমর দুলিয়ে চইলচে। ঘুড়ির …খানা দ্যাখ। আ অইলো মেয়ে, তুই যাইচ্চিস কোতায়? মদ্দর..তলায় যা, ভাল কইরে…খাবি।’ …এই সব নানান কথার চিৎকার।

গো-দ্বিতীয়া, গিরি গোবর্ধনের পূজা আর গোবর্ধন যজ্ঞ এইভাবেই পালিত হয়। গদাধরের বারো বছর ব্রত পালন হলে, তার মানত আছে, একটি গাভিকে সে সোনার শিং গড়িয়ে দেবে। রুপোর খুর দেবে। আসলে, সামান্য এক চিমটি সোনা গাভির শিঙের ডগায়, স্যাকরা লাগিয়ে দেবে। খুরেও যৎসামান্য রুপো দেবে।

গোপদের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান গো-দ্বিতীয়া। আত্মীয় কুটুম্বদের নিমন্ত্রণ থাকে। গদাধর সেই কথাটাই মহাদেবকে স্মরণ করিয়ে দিল।

.

যদু উমির বিয়েতে যায়নি। বাবা শ্রীবাসও যায়নি। আর যায়নি দুর্গা। বাকি সবাই গিয়েছিল। মহাদেব অনেক করে যদুকে যেতে বলেছিল। যদুর মনও খুব টেনেছিল। উমিকে এক বার কনের বেশে দেখে আসবে। তারপরে বুঝেছিল, মনের সে-শক্তি নেই। দুর্বল বল, অক্ষম বল, যদু যেতে পারেনি। মনে হয়েছিল, ওই মার সে সহ্য করতে পারবে না। মরেই ছিল। তার ওপরে, উমিকে দেখলে সেটা খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কিছু হত না। বাড়ির সকলের যাত্রার সময় ও সবাইকে নৌকায় তুলে দিয়েছিল। মনে মনে বলেছিল, সুখে থেইক। দিসারার এই দাগি প্রাণটাকে ভুইলে যেইও।…কিন্তু শ্রীবাস কেন যায়নি? যদু তো একলাই একশো। প্রাণীদের দেখাশোনা খাওয়ানো চরানো বাদ যেত না। অন্য বাড়ির লোক ডেকে দোহন কাজ করত। না, শ্রীবাস যায়নি। কারোকে কোনও কৈফিয়ৎও দেয়নি।

দুর্গার কী হয়েছে, যদু বুঝতে পারে না। জটা হত্যার পর পাঁচ সপ্তাহ কেটেছে। মা খুড়ি ওকে কী ওষুধ খাইয়েছে, যদু জানে না। দুর্গার শীর্ণতা কমেছে। চোখের কোলে কালি নেই। কিন্তু ও আর আগের মতোটি নেই। বাড়ির বাইরে কোথাও যায় না।

যদু গঙ্গার ধারে, প্রাণীদের মাঝে ছিল। ভাদ্রের গঙ্গা আরও বড় হয়েছে। চরার ঘাস জমি ডুবিয়ে, এখন গেরুয়া রুদ্র ভৈরবী শালি ধানের চাষ জমির কূল ছুঁয়েছে। প্রাণীদের সরিয়ে আনতে হয়েছে চওড়া রাস্তার ওপরে। রাস্তায় ঘাস নেই বলতে গেলে। পাক কাদা, গোরুর গাড়ির গভীর দাগ। খানাখন্দে ভরা।

যদু চাষ জমির ধারে দাঁড়িয়ে ভৈরবী গঙ্গাকে দেখছে। ভাদ্রের মেঘলা ভাঙা রোদে বড় জ্বালা। কখনও রোদ, কখনও মেঘ। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। চাপের নৌকাগুলি কদিন বেকার। ওপারে গাড়ির যাতায়াত নেই। খর নদীর স্রোতকে সকলের ভয়। খেয়া পারাপার কমে গিয়েছে। খেয়ার ঘাটদারের খোছড়া ঝুপড়ি এখন চরার জলে ডুবে আছে। আছে কি না বলা শক্ত। টানে ভেসে যেতে পারে। উঁচু চাষের জমি ঘেঁষে, আলগা চালা খুঁটির ভারে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গার ওপর দেখা যায় না, এত বেড়েছে। রোজ বাড়ছে। দেখলে ভয় লাগে।

যদুর লক্ষ মৎসজীবীদের নৌকার দিকে। তারা নদীকে বোঝে, সাহস আছে। কাছের এক নৌকার মাঝিকে ডাকল ও, কেমন বুঝ গো নুরুল খুড়ো?’

ভাল না। জবাব এল, কাল থেনে জালে একটা মাছ আইসচে না। মনে হয়, সব তলায় ডুব মেইরেচে।

যদুর মন চমকায় ত্রাসে। মাছেরা জলের তলায় ডুব মেরেছে? এ লক্ষণ ভাল না। ভেসে যাবার ভয়। পেলেই, মাছেরা যতটা সম্ভব তলার গভীরে চলে যায়। ভেসে যাওয়ার ভয় মানেই, জলের তোড় বাড়বে। গঙ্গা ভয়ংকরী হয়ে উঠবে। যদু আকাশের দিকে তাকাল। মেঘে থমথম। মাঝে মাঝে মেঘ ফেটে যাচ্ছে। রোদ ঝলকে উঠছে। মাছ কেন উঠছে না জালে? সত্যি কি ওরা তলায় চলে গিয়েছে?

তিন দিন পরে অঝোরে বৃষ্টি নামল। সে বৃষ্টির আর ধরন নেই। প্রাণীদের বাইরে যাওয়া বন্ধ। গোয়ালেই সর্বক্ষণ। ভেড়ার পাল এক জায়গায় গাদাগাদি। গদাধর চিন্তিত চোখে আকাশের দিকে দেখছে। প্রাণীদের আচরণ লক্ষ করছে। তৃতীয় দিনে এই বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের লক্ষণ দেখা দিল। বাজ বিজলি বাতাস বৃষ্টি। তৃতীয় দিনের শেষ রাত্রি থেকে এই বিপজ্জনক পরিবর্তন। ভোরবেলা প্রথম মা চিৎকার করে উঠল, অই ওগো, দ্যাখ এইসে, মেয়ে কী সব্বনাশ কইরেচে।

মায়ের চিৎকারে, কান্নায়, সবাই পুবের ঘরে গেল। খড়ের চালের বাঁশের সঙ্গে দুর্গা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। অঘটন ঘটেছে, শেষ রাত্রে সবাই দোহনে ব্যস্ত। যদু দেখল, দুর্গার গলায় গোরু বাঁধা পাটের শক্ত দড়ির ফঁস। ঝটিতি কাটারি নিয়ে, লাফ দিয়ে, দড়িতে কোপ দিল। মাটি থেকে দু হাত উঁচুতে ছিল দুর্গার শরীর। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। যদু ফাঁস খোলবার চেষ্টা করল। পারল না। গলায় এঁটে বসেছে। দুর্গার। চোখ আধ বোজা। নাকের ছিদ্র দিয়ে রক্তের ধারা নেমে এসেছে। যদু দা দিয়ে সাবধানে গলার দড়ি। কাটল। দুর্গার খোলা মুখ থেকে ফস করে একটা শব্দ বেরোল। তখনও দুর্গার শরীরে তাপ আছে। যদু চিৎকার করে ডাকল, দুগা…।’

দুর্গা আর কোনও দিন সাড়া দেবে না। গলায় ফাঁস আটকাবার পরে, শেষ বারের আর্ত চিৎকারটা হাওয়ার শব্দে বেরিয়ে এল। খুড়ি মেয়ের শরীরের ওপর কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অরে দুগগা, তুই মিছা কথা বইলেছিলি। তোর ঋতু দশশন হয় নাই।

চুপ সেজ বউ। মা খুড়ির মুখ চেপে ধরল, যদুর বাপ, ছেলেমেয়েগুলানকে নিয়ে অন্য ঘরে যাও।

ছোট ভাইবোনগুলো মড়াকান্না জুড়েছে। গদাধর দাওয়ায় বসে ছিল। সেখান থেকে উঠে ঘরে ঢুকল না। কেবল বিড়বিড় করে বলল, ছিবাসের মা, এ কি পাপ আমার ঘরে?’…

শ্রীবাস, অধর ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ল। একজন গেল সুরীন মোড়লের কাছে। আর একজন চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর বাড়িতে। যদুর কানে তখনও খুড়ির কথা বাজছে, …তোর ঋতু দশন হয় নাই। জটা তা হলে দুর্গাকে মেরেই রেখে গিয়েছিল। জটার সেই লাশ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। দুর্গা মা-খুড়িকে সত্যি কথা বলতে পারেনি। শরীরের মাসিক আবর্তনের যে ক্রিয়া নারী অঙ্গে ঘটে, দুর্গার তা ঘটেনি। দুর্গার মিথ্যা কথায় মা-খুড়ি নিশ্চিন্ত ছিল। আর নিমদহের মেয়ে, এই কলঙ্ক চেয়েছিল যদুর কাছে। সে হয় তো কূল ভাসাত। দুর্গা গলায় দড়ি দিয়ে মরল।…কিন্তু জটা নিধন কি অন্যায় হয়েছে? যদুর মনের ভিতরটা ঘন অন্ধকারে ভরে যাচ্ছে। ও গোয়ালে প্রাণীদের মাঝখানে চলে গেল।

চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর নির্দেশে, সুরীন মোড়লকে নিয়ে শ্রীবাস আর অধর ছুটল থানায়। হাঁটা পথ ছাড়া রাস্তা নেই। থানা বেথুয়াডহরি স্টেশনের কাছে। থানায় গিয়ে, নাম ধাম পরিচয় দিয়ে, জানাল, তার অবিবাহিতা মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। হত্যা না আত্মহত্যা, পুলিশের সেটাই নিরূপণ প্রয়োজন। জিজ্ঞাসাবাদ অধরকেই করা হল। আত্মহত্যার কোনও কারণ জানা নেই। কিছু লিখে রেখে যাওয়া সম্ভব ছিল না, মেয়ে লেখাপড়া জানত না। লুকিয়ে গর্ভধারণ করেনি তো? মেয়ের স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? না কি তোমরাই মেয়েকে খুন করে, বাঁশে লটকে দিয়েছ?

অধর চোখে জল নিয়ে জানাল, মেয়ের স্বভাব চরিত্র কোনও কালে খারাপ ছিল না। সুরীন মোড়ল সায় দিল। নিজেদের হাতে মেয়ে খুন করার কোনও প্রশ্নই নেই। তবে গর্ভবতী হয়েছিল কি না, কেউ জানে না।

পুলিশ বলল, গাঁয়ের লোকজনদের যদি বিশ্বাস হয়, সম্মতি দেয়, মড়া পুড়িয়ে দাও। পুলিশ কোনও কেস লিখবে না।

.

ছ দিনেও বৃষ্টির ধরন হয়নি৷ ছ দিনের শেষরাত্র থেকে প্রাণীরা গোয়ালে ডাকাডাকি দাপাদাপি শুরু করে দিল। গলার দড়ি ছেঁড়বার আপ্রাণ চেষ্টায় ছটফট করতে লাগল। গঙ্গা তখন উঁচু রাস্তা ডুবিয়ে, গ্রামে ঢুকেছে। নুরুল খুড়া ভুল বলেনি। মাছেরা জলের গভীর তলায় যেতে শুরু করেছিল আগেই।

সারা গোপ পল্লীতে হাক ডাক শুরু হয়ে গেল। যদু ঘরের বাইরে এসে দেখল, উঠোনে জলের স্রোত। বাবা খুড়া ভাই সবাই মিলে নীচের গোয়ালের প্রাণীদের ওপরের গোয়ালে তুলে দিল। কিন্তু সেখানে সকলের জায়গার অভাব। গদাধর ঘেঁকে নির্দেশ দিল, জীব পেরানিদের বাঁধন খুইলে দে। উত্তরে তাড়া করে নিয়ে যা। ভেড়াগুলানকে বের করে ঘাটের নৌকায় নিয়ে গিয়ে তোল। আমি লৌকোয় যাইচ্চি।

তুমি নাই গেইলে বাবা। শ্রীবাস প্রাণীদের বাঁধন খুলতে খুলতে চিৎকার করে বলল।

গদাধর তখন ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, ঘরে থাইকতে এমনিতেই মন নেই। পেরানিদের ছেড়ে থাইকতে পাইরব না।’

সমস্ত গোপ পাড়ার যাবৎ প্রাণীরা তখন নিজেরাই উত্তর দিকে ছুটে চলেছে। হীরা বলরাম গদাধরের সঙ্গে ভেড়ার পালকে তাড়া করে নিয়ে ছুটল গ্রামের পুবের প্রান্তে, ঘাটের কাছে। সেখানে খেয়া পারানির আর মাছ ধরার কটা নৌকা ছিল। সকলের ভেড়ার পালকে নৌকোয় তোলা হল। বাছুরদেরও নৌকায় তোলা ছাড়া উপায় ছিল না। আড়াইশোর ওপরে প্রাণী। গোটাকয়েক অসুস্থ ছিল। কিন্তু নৌকায় আর জায়গা ছিল না। স্রোতের উজানে নৌকা, লগি দিয়ে ঠেলে চালানো কষ্ট। তবু যতটা পারা যায়, শেষ চেষ্টা। গোপদের যত ছাতা ছিল, সব ভেড়াদের মাথায়।

বাকি প্রাণীরা উত্তরে ছুটতে ছুটতে, এক সময়ে গভীর জলের টানে পড়ল। সকলের লক্ষ্য ওপারের পশ্চিমে, পূর্বস্থলীর উঁচু ভূমিতে। যদুর সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রাণীদের সঙ্গে, লাঠি হাতে জলে ঝাঁপ দিল। সবাই হাঁক ডাক চিৎকার করছে, সামাল সামাল। জলে বড় টান।

প্রাণীরা চোখ বড় করে, নিঃশব্দে সাঁতার কেটে চলেছে। তাদের চোখে উদ্বেগ ভয়। সহদেব চিৎকার করে উঠল, আমার একটা গাই ভেইসে যাইচ্চে, ধর ধর।

যদু দেখতে পেল, উত্তাল ঢেউ আর স্রোতের টানে একটা গাভি ভেসে যাচ্ছে। ও সাঁতার কেটে, লাঠি উঁচিয়ে দুরন্ত বেগে ভেসে গেল। কিন্তু ও কাছে পৌঁছবার আগেই, গাভি জলের তলায় তলিয়ে গেল। আর আশা নেই। আবার আর একজনের হাক শোনা গেল। ভেইসে যাইচ্চে, আমার মইষী। ভেইসে যাইচ্চে।

এ ভেসে যাওয়া বড় নিদারুণ ভেসে যাওয়া। প্রাণীর শরীরে যতক্ষণ বল থাকে, সে ভেসে থেকেও সাঁতার কাটে, যখন ভেসে যায়, জানবে, তার শরীরে আর শক্তি নেই। সে কেবল ভেসে যায় না, আস্তে আস্তে ডুবে যায়। হারিয়ে যায় জলের বুকে চিরদিনের মতো। মহিষীকেও বাঁচানো গেল না। সহদেব সাঁতার কাটতে কাটতে কাঁদছে। বাঁকার মহিষী শেষ চেষ্টায়ও বাঁচল না। দুরন্ত প্লাবনের জলে ওর চোখের জল ধুয়ে যাচ্ছে। যদু ওর কাছে কাছে, স্রোত ঠেলে নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছে। সাদা কালো, শত শত মাথার ওপরে প্রাণীদের শিং জেগে আছে। জল প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। ভৈরবী গঙ্গার শরীর উথাল পাথাল, খর স্রোতে অধরা হয়ে উঠছে। যেন জগতের কোনও ভুমির কাছে সে ধরা দেবে না। গ্রাস করে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। তার সঙ্গে বাজ বিজলি বাতাস।

নৌকার গতি ঠিক রাখা যাচ্ছে না। হাল মচমচ করছে। বেঁকে যাচ্ছে। ছাতার নীচে ভেড়ার পাল সমানে ডেকে চলেছে।

কোন কালে, কোন মানুষ দৈবের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে? সে-দৈব শুভ অশুভ যা-ই হোক। দৈবের সঙ্গে, মানুষ তার আপন শক্তিতে, দুইয়ের হাত ধরাধরি করে চলে। দৈবের সঙ্গে লড়াই নেই। দৈব তোমার অধীন না। তোমার অধীন তোমার প্রাণের শক্তি। চরিতার্থতার দৃঢ় ইচ্ছা তোমার শক্তি। দৈব সহায় হলে, তোমার শক্তির সঙ্গে তার প্রেম হয়। এই যুগল প্রেমে তোমার জয়।

বন্যার বাথানে আয়োজনের সময় থাকে না। কী নেবে কী ফেলবে, ভাববার সময় নেই। আগে প্রাণীদের নিয়ে নিরাপদ অঞ্চলে চল। তারপর ভাববে তোমার অন্নবস্ত্রের কথা। ঘর সংসারের কথা।

চার ঘণ্টার চেষ্টায় প্রাণীরা পূর্বস্থলী ছাড়িয়ে, আরও দক্ষিণের ডাঙায় উঠল। সমুদ্রগড়ের কাছে। সেখানেও নিচু চরা ভেসে গিয়েছে। কিন্তু উঁচু জমি আছে, রেল লাইন আছে। ভেড়াদের চিৎকার, ঝড়বৃষ্টি বাজের শব্দ ছাপিয়ে উঠছে। কয়েকজন ওদের নিয়ে আগে আগে উঠল। লক্ষ্য সমুদ্রগড় রেল স্টেশন। ওরা যত জলে ভিজছে, তত দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওরা রোদ শীত সইতে পারে। জল বৃষ্টি পারে না। বাকি প্রাণীরাও ভেড়ার পালের পিছনে পিছনে উঠতে লাগল। তখন তারাও বাছুরদের ডাকাডাকি করছে। বাছুররাও ত্রাসে ও ক্ষুধায় ডেকে ছুটে আসছে। আজ আর দোহন নেই।

যত উঁচুতে ওঠা, তত আর এক দিকে সাবধান। শালি ধানের চাষ চারদিকে। প্রাণীদের সামলে নিয়ে চলতে হয়।

সমুদ্রগড় স্টেশনের ছাউনির তলায় ভেড়ার পাল নিজেরাই ছুটে গেল। প্রাণীদের রেল লাইন পার করিয়ে একটু নিশ্চিন্ত। গদাধর সবাইকে ডেকে বলল, এ দিনটা এখানেই থাইকব। কাল পূর্বস্থলী যাব।’ শ্রীবাস অধরকে নির্দেশ দিল, তোরা লৌকো লিয়ে গাঁয়ে ফিরে যা। বউ ছেলে মেয়েরা রইয়েছে, তাদের বাঁচাতে হবে। পুরুষশূন্য ঘর থাইকবে না।

যদু শুনল। আর মনে মনে বলল, ঠাকুদ্দা, বইললে বটে ছেলে মেয়েরা রইচে। কিন্তু আমাদের ঘরে আর মেয়ে নেই। তিন দিন আগে মেয়েকে, এই বিষ্টিতে আধপোড়া কইরে গঙ্গায় ভাইসে দেচি।

পরের দিন বৃষ্টির ধারা একটু কম। বাতাস বিজলি বাজও একটু যেন স্থির হয়েছে। সমুদ্রগড়ে দোহন পর্ব কোনও রকমে সারা হল। আশেপাশের গৃহস্থদের কাছ থেকে পাত্র চেয়ে দুধ পাত্রস্থ হল। বিক্রিও হয়ে গেল। এখন কেউ ভাত-তরকারি খাবার প্রত্যাশা করে না। মুড়ি চিড়ে বাতাসা যথেষ্ট। দুধ তো আছেই। কারোর গায়ে একটির বেশি বস্ত্র নেই। ভেড়ার পালকে কয়েকজনের সঙ্গে স্টেশনেই রাখা হল। বাথান যাত্রার আগে বলা হল, বৃষ্টি একেবারে ধরে গেলে, ভেড়ার পাল নিয়ে পূর্বস্থলীতে যাবে। এ বান বন্যাকে বিশ্বাস নেই। আরও উঁচু জায়গায় যেতে হবে। বাথান যদি অন্য কোথাও যায়, পূর্বস্থলীর লোকমুখেই জানতে পারবে। ভেড়ার পাল নিয়ে সেখানে যাবে। দু দিন পরে বাথান পূর্বস্থলী হাজির হল। উঁচু জায়গা, থানার সামনে বড় মাঠও আছে। কিন্তু থানা সেখানে ড্যারা করতে দিল না। বাথান। আবার চলল উত্তরে। আরও দু দিন পরে, বাথান এল বেলগাছিতে। আকাশের মুখ ভার, কিন্তু বৃষ্টি নেই। জায়গা উঁচু, ড্যারা করার মতো বড় মাঠ আছে। এ সময়ে সকলের জমিতেই শালি ধানের চারা মাথা তুলে উঠেছে। শস্যের মাঠে জায়গা নেই। গদাধর বলল, এখেনেই ড্যারা কর।

বেলগাছির মাঠে ড্যারা? যদু গ্রামের বাইরে, বারোয়ারি মাঠের বুকে দাঁড়িয়ে বেলগাছি গ্রামের দিকে তাকাল। দশ দিন পরে, আজ প্রথম পশ্চিমের আকাশে লাল রং দেখা গেল। মেঘ পাতলা হয়েছে। মাঠে দুটি গাছ। গাছতলায় ড্যারা হল। কিন্তু রান্নার হাঁড়ি কড়া সরঞ্জাম নেই। কাঠ ঘাষি কিছু নেই উনোন জ্বালবার মতো।

বন্যার বাথান নতুন কিছুনা। যদু ওর জীবনে এই তিন বার দেখল। গদাধর যদু আর বাঁকাকে ডাকল, চল, গাঁয়ে যাই। হাঁড়ি কড়া চাইলে পাব। এসে দুধ দুইব। তোরা বাছুরগুলানরে বেঁধে ফ্যা’

বাথানে সর্বজ্যেষ্ঠ গদাধর। তার নির্দেশ সবাই মানবে। কিন্তু যদু বলল, আমি যাব না, বলাকে লিয়ে যাও।’

গদাধর ভুরু কুঁচকে যদুকে দেখল, ক্যানে, তোর কী হল?

আমি যাব না। যদুর স্বর গম্ভীর নির্বিকার, আমি দোয়া শুরু কইরচি। হাঁড়িকুঁড়ির সঙ্গে, দুধের বড় পাত্র পাও ত লিয়ে এইস।

গদাধর বিরক্ত মুখে বাঁকা আর বলরামকে নিয়ে চলে গেল। যদু বেলগাছি গ্রামের দিকে তাকাল। এই গ্রামে উমি আছে। কী কপাল, বাথানের ড্যারা হল এখানে।

পরের দিন রোদ যেন সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। মেঘলা ভাঙা আকাশে ক্ষণে রোদ, ক্ষণে ছায়া। তবে আকাশ দেখলেই বোঝা যায়, মেঘ সরছে উত্তর-পশ্চিমে। বিকালে শ্রীবাস চরণ ভূপতি এল। সঙ্গে শুকনো জামা কাপড়ের ঝোলা বোঁচকা। রান্নার হাঁড়িকুঁড়ি ডেয়ো ঢাকনা। দুধের বড় ক্যানেস্তারার পাত্র। তিন জনের মাথায় কাঁধে বোঝা। সংবাদ দিল, ঘর-দরজার ক্ষতি কিছু হয়েছে। তবে একেবারে ভেঙে ভেসে যায়নি। জল নামতে শুরু করেছে। গদাধর বলল, তা’লে হপ্তাখানেক বাদে গায়ে ফিরতে পারব। ভাদ্র মাসের মধ্যে ঘরে ফিরতে পাইরলে মঙ্গল। ভাদ্দরে বাইরে থাইকতে নাই।

দু দিনে আকাশের রং বদলে গেল। শীতের গঙ্গায় সাদা গাভির দলের মতো মেঘ উড়ে চলেছে উত্তর-পশ্চিমে। মহাভাদ্রের প্লাবনের পর, রৌদ্রচকিত ভাদ্র মাসের আকাশ, ভূমি গাছপালা জল ঝরিয়ে শুকোচ্ছে। এই মাসে, আকাশ রোদ, সকাল দুপুর বিকাল যেন কেমন গম্ভীর, নীরব।

যদু ভোরবেলা, দোহন পর্বের পর বাথানের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে বিকালে। বাথানে ফিরতে ফিরতে, দুপুরে মনে হয় কোথায় যেন কী একটা গম্ভীর সুরের বাজনা বাজে। ক্যানে?

কোনও দিন তো যদু এমন কিছু শোনেনি। কোতায় বাজে। কে বাজায়। যেন তারের ছড়ে কেউ ঝংকার দেয়।

বেলগাছি থেকে বাথান ড্যারা তোলবার আগের দিন, ভোরবেলা একজন একটা সাইকেল চালিয়ে এল। বাথান তখন যাত্রার জন্য প্রস্তুত। সাইকেল চালিয়ে লোকটি এসে পড়ল ড্যারায়, এখেনে গদাধর ঘোষ এসেছে? এ কি দিসারার বাথান?

গদাধর অবাক চোখে তাকাল, হ্যাঁ। আমি গদাধর। তুমি কে বাবা?

সাইকেলওয়ালার বয়স যদুর থেকে দুই-চার বেশি হতে পারে। ধোয়া ধুতির ওপরে একটা গেঞ্জি গায়ে। কোমরে গামছা বাঁধা। খালি পা। মাথার চুলে তেল চুকচুক করছে। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে গদাধরের দু পা ছুঁয়ে, কপালে ছোঁয়াল, আজ্ঞা আমি নিমদের মা’দেব ঘোষের জামাই কেষ্টপদ।

অই অই, হাঁ, তোমাকে ত দেইখচি বটে। গদাধর দু হাতে কেষ্টপদকে জড়িয়ে ধরল, তুমি নিমদের জামাই, আমিও তাই। তা তোমাদের খবর সব ভাল ত?

কেষ্টপদ এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বলল, আজ্ঞা। আপনার বড় নাতি যদু কে? এসেছে?

 যদু কিছু দূরে দাঁড়িয়ে কেষ্টপদকে দেখছিল। গদাধর হাসল, এইসেচে। ওই–ওই ত যদু।

 সে ডাকল, যদু শোন এদিকে আয়।

যদুর মনে হল, ওর পা নড়ছে না। কেষ্টপদই তার কাছে এগিয়ে গেল, আমার বউ তোমাকে ডেকেচে, এক বারটি যেতে হবে।

কেষ্টপদর কথার উচ্চারণ অন্য রকম। যদু হাসতে চেষ্টা করল, ক্যানে, আমি গিয়ে কী কইরব?’

তা জানি না। কেষ্টপদ হাসল, সে বলেছে, তোমাকে বলতে, উনি তোমাকে ডেকেচে।

ক্যানে উনি? আর ক্যানে মারবে এই গরিবকে? তোমার বে-তে যাই নাই, দেইখবার শক্তি ছিল না। আজ তুমি ডাইকচ। এ যে বড় মার। হাঁ, সইতে হবে। যদু হাসল, চল।

সাইকেলের পেছুতে উঠে বসতে পারবে? কেষ্টপদ জিজ্ঞেস করল।

যদু লজ্জিত হাসল, না কোন দিন বসি নাই। পইড়ে যাব।’

তবে চল, হেঁটে যাই।’ কেষ্টপদ সাইকেল টেনে এগুল।

যদু এক বার শ্রীবাস আর গদাধরের দিকে তাকাল। গদাধর বলল, যা, ঘুইরে আয়।

যদু গেল কেষ্টপদর সঙ্গে। বড় বড় দুটি ঘর। ছোট ঘর দুটি। উঠোন বেশ বড়। উঠোনের এক পাশে ধানের মরাই দুটো। নতুন করে খড় চাপানো হয়েছে। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। সব লেপা-মোছা তকতকে। কেষ্টপদ সাইকেলটা উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখল। একজন খালি গা প্রৌঢ় এগিয়ে এল। কেষ্টপদ যদুকে বলল, আমার বাবা।

যদু প্রৌঢ়ের দু পা ছুঁয়ে নমস্কার করল। প্রৌঢ়র মুখে হাসি, থাক বাবা, থাক। তোমাদের বাড়ির খবর সর্ব ভাল?

আজ্ঞা না। যদুর মুখে করুণ ছায়া, ক’দিন আগেই খুড়াত বোনটি মারা গেল। তা পরে এই বান ঝ্যা।

প্রৌঢ় গম্ভীর মুখে মাথা ঝাঁকাল, তবে ত বড় দুর্দিন যাচ্ছে। তা সবই ভাগ্যের লিখন। যা কেষ্ট একে ঘরে নিয়ে যা।

এস। কেষ্টপদ একটি বড় ঘরের দাওয়ায় উঠল।

যদুও গেল। ঘরের দরজা খোলা। কেষ্টপদ ভিতরে ঢুকল, ডাকল, এস।

যদু ঘরের মধ্যে ঢুকল। বাইরে ঝকঝকিয়ে উঠেছে ভোরের প্রথম রোদ। ঘরেও তার আলো। যদু দেখল, হলুদ রং লাল পাড় শাড়ি পরা বউ পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় তার ঘোমটা। শুধু আলতা পরা পা দুটি দেখা যাচ্ছে। কেষ্টপদ ডাকল, এই যে, শোন, যদু এসেচে।

বউ ফিরল না। নড়ল না। কথা বলল না। কেষ্টপদ অবাক চোখে তাকাল, কী হল, এই যে, যদুকে ডেকে নিয়ে এসেছি।

বইসতে দাও।’ ঘোমটা পরা উমির অস্ফুট স্বর শোনা গেল।

কেষ্টপদ অবাক হেসে যদুর দিকে তাকাল, এই দেখ ত ভাই কেমন কথা বলে। ডেকে আনতে বললে তুমি। বসতে দেব আমি?

যদু অসাড় শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাসতে পারছে না। কথাও বলতে পারছে না। দেখছে ঘরে একটা বড় তক্তপোশ। এক পাশে গোটানো বিছানা। আলনায় কাপড় জামা। কুলুঙ্গিতে আয়না, আরও কী সব কৌটোবাটা। কেষ্টপদ যদুর দিকে তাকিয়ে হাসল,’ বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছে। এস, চৌকিতে বস।

উমি সামনের দিকে ফিরল। ঘোমটা খসে গেল। সেই মুখ, একটু শীর্ণ। বয়স যেন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। সিথায় সিঁদুরের দাগ। হাতে চুড়ি শাখা লোহা। নাকে নাকছাবি। ধনুক ভুরুর নীচে সেই টানা চোখ। যদু দেখছে, তার প্রাণ ওই চোখ জোড়ায় ডুবে আছে। চোখ কি ভেজা? মোছা? জিজ্ঞেস করল, দুগগা মারা গেচে? কী হইয়েছিল?

গলায় দড়ি দিয়ে মইরেচে। যদুর মুখে ক্ষণেকের গাম্ভীর্য। তারপরে হাসি, ভাল আছ?

উমির চোখে তখনও হতবাক বিস্ময়। দুর্গার গলায় দড়ির সংবাদে নিশ্চয়ই। ও অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে যদুর মুখের দিকে, ক্যানে, গলায় দড়ি ক্যানে?

জানি না। যদু চোখ সরিয়ে নিল, উমি কি বোঝে না, পরের স্ত্রীর চোখে নিজের প্রাণ দেখতে কষ্ট হয়? বলল, আমি যাই।

কেষ্টপদ অবাক চোখে উমি আর যদুকে দেখছে। গলায় দড়ি দেওয়ার কথাটা তাকেও খুব অবাক করেছে। উমি যদুর কাছে এগিয়ে এল, তবে ত তোমার মন খুব খারাপ। দুগ্না-থাক সে কথা। জানি, ভোরে বাথান নিয়ে বেরিয়ে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি পাঠিয়েচি। না বইসলে, কেমন কইরে কথা বলি? খবরাখবর নেব ত। তুমি বাথানে না গেইলে চইলবে না?

না। যদু হাসল। মনকে বলল, শক্তি দাও।

কিন্তু আর এক জনও যে সেই শক্তি চাইছে, যদু কি তা বোঝে না? পুরুষ তুমি, যদু তুমি উমিকে বোঝ না? সে স্বামীকে দিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। তুমি বোঝ না? তার চোখ শুকনো, ঠোঁট অকম্পিত। তুমি বোঝ না? উমি জানু পেতে বসল। দু হাত দিয়ে যদুর দু পা স্পর্শ করল। হাত কপাল অবধি তুলতে পারল না। বুকের কাছে ঠেকে রইল। জানু পেতে বসে থেকেই বলল, তবে এস। বাথানে যাও। যদি কোন দিন মন চায়, এইস।

হ্যাঁ, এস। কেষ্টপদ সহজ অমায়িক স্বরে বলল, গঙ্গা পেরিয়ে এলে আর কতটুনি দূর?’

যদু উমির মুখের দিকে তাকাল। উমিও যদুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। হাসল। এমন হাসি উমির মুখে যদু কোনও দিন দেখেনি। এ সেই হাসি না, বুকে তোমার তুফান তুলে বলবে, গঙ্গার ধ্যেরে ভূত। ও ঘরের বাইরে চলে গেল। কেষ্টপদ সঙ্গে, সত্যি চলে যাচ্ছ, একটু কিছু মুখে দেবে না?

ভোরেই খেইয়েচি। যদু বাড়ির বাইরে গেল।

কী একটা পাখি যেন ডাকছে। সেই তারের ছড়ে ঝংকার দেওয়া গম্ভীর টানা স্বর।

পরের দিন ভোরবেলা বাথান ঘরমুখো চলল। কেউ গাইছে না, অথচ যদু শুনতে পাচ্ছে গান, ওরে অ বাথানের আখাল/তোর সামনে ধু ধু জাঙ্গাল/জাঙ্গাল জাঙ্গাল চল রে আখাল।/সুকাল আকাল আইসবে যাবে/ঘর গেরস্তি যে যার দেইখবে/তুই চল রে আখাল জাঙ্গাল জাঙ্গাল।’ …যদু এক বার পিছন ফিরে বেলগাছি গ্রামের দিকে দেখল। কদিনের ভেজার পরে, পথেঘাটে ধুলা জমেছে। প্রাণীদের গলায় ঘন্টা বাজছে। ভোরের লাল রোদে ধুলা উড়ছে।

যদুর চোখে ভাসছে দুর্গার মুখ। জটার নিহত মুখ। আর উমি উমির মুখের সঙ্গে সেই বিষাদ গম্ভীর সুর।