৫. রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর

[৫]

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘তোপ্‌সে, কী মনে হচ্ছে। বল তো?’

আমি বললাম, ‘কীসের কী মনে হচ্ছে?’

‘এই যে-সব ঘটনা ঘটছে-টটছে।’

‘বারে বা, সে তো তুমি বলবে! আমি আবার কী করে বলব? আমি কি ডিটেকটিভ নাকি? আর সন্ন্যাসীটা কে, সেটা না জানা অবধি তো কিছুই বোঝা যাবে না।’

‘কিন্তু কিছু কিছু জিনিস তো বোঝা যাচ্ছে। যেমন, সন্ন্যাসীটা বাথরুমে ঢুকে আর বেরোল না। এটা তো খুব রিভিলিং।’

‘রিভিলিং মানে?’

‘রিভিলিং মানে যার থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়।’

‘এখানে কী বোঝা যাচ্ছে?’

‘তুই নিজে বুঝতে পারছিস না?’

‘আমি বুঝতে পারছি যে ওয়েটিংরুমের দারোয়ানটা অন্যমনস্ক ছিল।’

‘তোর মুণ্ডু।’

‘তবে?’

‘সন্ন্যাসী বেরোলে নিশ্চয়ই দারোয়ানের চোখে পড়ত।’

‘তা হলে? সন্ন্যাসী বেরোয়নি?’

‘সন্ন্যাসীর হাতে কী ছিল মনে আছে?’

‘আমি তো আর…ও হ্যাঁ হ্যাঁ—আটাচি কেস।’

‘সন্ন্যাসীর হাতে অ্যাটাচি কেস দেখেছিস কখনও?’

‘তা দেখিনি।’

‘সেই তো বলছি। ওটা থেকেই সন্দেহ হয়।’

‘কী সন্দেহ হয়?’

‘যে সন্ন্যাসী আসলে সন্ন্যাসী নন। উনি প্যান্ট শার্ট কি ধুতি-পাঞ্জাবি পরা আমাদের মতো অ-সন্ন্যাসী, আর সেই পোশাক ছিল ওই অ্যাটাচি কেসে। গেরুয়াটা ছিল ছদ্মবেশ। খুব সম্ভবত দাড়িগোঁফটাও।’

‘বুঝেছি। সেগুলো ও বাক্সে পুরে নিয়েছে, আর অন্য পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছে। তাই দারোয়ান ওকে চিনতে পারেনি।’

‘গুড। এইবার মাথা খুলেছে।’

‘কিন্তু আজ সকালে তা হলে কে তোমার গায়ে কাগজ ছুঁড়ে মারল?’

‘হয় ও নিজেই, না হয় ওর কোনও লোক। স্টেশনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। আমি যে একে-তাকে সন্ন্যাসীর কথা জিজ্ঞেস করছি, সেটা ও শুনেছিল—আর তাই হুমকি দিয়ে গেল।’

‘বুঝেছি। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও রহস্য আছে কি?’

‘বাবা, বলিস কী! রহস্যের কোনও শেষ আছে নাকি? শ্রীবাস্তবকে স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে কে ফলো করল? সেও কি ওই সন্ন্যাসী, না অন্য কেউ? গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে চারমিনার আর পান খেতে খেতে কে ওয়াচ করছিল? পিয়ারিলাল কোন ‘স্পাই’-এর কথা বলতে চেয়েছিলেন? বনবিহারীবাবু হিংস্র জানোয়ার পোষেন কেন? পিয়ারিলালের ছেলে বনবিহারীবাবুকে আগে কোথায় দেখেছে? সে আংটির ব্যাপার কতখানি জানে?’…

* * *

রাত্রে বিছানায় শুয়ে এই সব রহস্যের কথাই ভাবছিলাম। ফেলুদা একটা নীল খাতায় কী যেন সব লিখল। তারপরে সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়ল, আর শোবার কিছুক্ষণ পরেই জোরে জোরে নিশ্বাস। বুঝলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে।

দূর থেকে রামলীলার ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। একবার একটা জানোয়ারের ডাক শুনলাম—হয়তো শেয়াল কিংবা কুকুর, কিন্তু হঠাৎ কেন জানি হাইনার হাসি বলে মনে হয়েছিল।

বনবিহারীবাবু যে হিংস্র জানোয়ার পোষেন, তাতে ফেলুদার আশ্চর্য হবার কী আছে? সব সময় কি সব জিনিসের পিছনে লুকোনো কারণ থাকে? অনেক রকম অদ্ভুত অদ্ভুত শখের কথা তো শুনতে পাওয়া যায়। বনবিহারীবাবুর চিড়িয়াখানাও হয়তো সেই রকমই একটা অদ্ভুত শখের নমুনা।

এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, আর কখন যে আবার ঘুমটা ভেঙে গেছে তা জানি না। জাগতেই মনে হল চারিদিক ভীষণ নিস্তব্ধ। ঢাকের বাজনা থেমে গেছে, কুকুর শেয়াল কিচ্ছু ডাকছে না। খালি ফেলুদার জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দ, আর মাথার পিছনে টেবিলের উপর রাখা টাইম পিসটার টিক্ টিক্ শব্দ। আমার চোখটা পায়ের দিকের জানালায় চলে গেল।

জানালা দিয়ে রোজ রাত্রে দেখেছি আকাশ আর আকাশের তারা দেখা যায়। আজ দেখি আকাশের অনেকখানি ঢাকা। একটা অন্ধকার মতো কী যেন জানালার প্রায় সমস্তটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘুমের ঘোরটা পুরো কেটে যেতেই বুঝতে পারলাম সেটা একটা মানুষ। জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আমাদেরই ঘরের ভিতর দেখছে।

যদিও ভয় করছিল সাংঘাতিক, তবু লোকটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। আকাশে তারা অল্প অল্প থাকলেও ঘরের ভিতর আলো নেই, তাই লোকটার মুখ দেখা অসম্ভব। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে তার মুখের নীচের দিকটা—মানে নাক থেকে থুতনি অবধি—একটা কালো কাপড়ে ঢাকা।

এবার দেখলাম লোকটা ঘরের ভিতর হাত ঢুকিয়েছে, তবে শুধু হাত নয়, হাতে একটা লম্বা ডান্ডার মতো জিনিস রয়েছে।

একটা মিষ্টি অথচ কড়া গন্ধ এইবার আমার নাকে এল। একে ভয়েতেই প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল, এখন হাত-পাও কী রকম যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল।

আমার মনে যত জোর আছে, সবটা এক সঙ্গে করে, শরীরটা প্রায় একদম না নাড়িয়ে, আমার বাঁ হাতটা আমার পাশেই ঘুমন্ত ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলাম।

আমার চোখ কিন্তু জানালার দিকে। লোকটা এখনও হাতটা বাড়িয়ে রয়েছে, গন্ধটা বেড়ে চলেছে, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।

আমার হাতটা ফেলুদার কোমরে ঠেকল। আমি একটা ঠেলা দিলাম। ফেলুদা একটু নড়ে উঠল। নড়তেই ক্যাঁচ করে খাটের একটা শব্দ হল। আর সেই শব্দটা হতেই জানালার লোকটা হাওয়া!

ফেলুদা ঘুমো ঘুমো গলায় বলল, ‘খোঁচা মারছিস কেন?’

আমি শুকনো গলায় কোনওরকমে ঢোক গিলে বললাম, ‘জানালায়।’

‘কে জানালায়? ঈস্‌—গন্ধ কীসের?’—বলেই ফেলুদা একলাফে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কিছুক্ষণ একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে থেকে ফিরে এসে বলল, ‘কী দেখলি ঠিক করে বল তো!’

আমি তখনও প্রায় কাঠের মতো পড়ে আছি। কোনওমতে বললাম, ‘একটা লোক…হাতে ডান্ডা…ঘরের ভেতর—’

‘হাত বাড়িয়েছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘বুঝেছি। লাঠির ডগায় ক্লোরোফর্ম ছিল। আমাদের অজ্ঞান করবার তালে ছিল।’

‘কেন?’

‘বোধহয় আরেক আংটি-চোর। ভাবছে এখনও আংটি এখানেই আছে। যাক্‌গে—তুই এ ব্যাপারটা আর বাবা কাকাকে বলিস না। মিথ্যে নার্ভাস-টার্ভাস হয়ে আমার কাজটাই ভেস্তে দেবে।’

* * *

পরদিন সকালে বাবা আর ধীরুকাকা দুজনেই বললেন যে আর বিশেষ কোনও গোলমাল হবে বলে মনে হচ্ছে না। আংটি উদ্ধারের ভার পুলিশের উপর দিয়ে দেওয়া হয়েছে, ইনস্পেক্টর গর্‌গরি কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

পুলিশে আংটি খুঁজে পেলে ফেলুদার উপর টেক্কা দেওয়া হবে, আর তাতে ফেলুদার মনে লাগবে, এই ভেবে আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম পুলিশ যেন কোনওমতেই আংটি খুঁজে না পায়। সে ক্রেডিটটা যেন ফেলুদারই হয়।

বাবা বললেন, ‘আজ তোদের আরও কয়েকটা জায়গা দেখিয়ে আনব ভাবছি।’

ঠিক হল দুপুরে খাওয়ার পর বেরোনো হবে। কোথায় যাওয়া হবে সেটা ঠিক করে দিলেন বনবিহারীবাবু।

আমরা সবে খেয়ে উঠেছি, এমন সময় বনবিহারীবাবু এসে হাজির। বললেন, আপনাদের বাড়ি দিনে ডাকাতির খবর পেয়ে চলে এলাম। একটা ভাল দেখে হাউন্ড পুষলে এ-কেলেঙ্কারি হত না। সাধুবাবার উদ্দেশ্য সাধু না অসাধু, সেটা বুঝতে একটা ওয়েল-ট্রেনড জেতো হাউন্ডের লাগত ঠিক পাঁচ সেকেন্ড। যাক চোর পালানোর পর আর বুদ্ধি দিয়ে কী হবে বলুন।’

বনবিহারীবাবু সঙ্গে কাগজে মোড়া পান নিয়ে এসেছিলেন। বললেন, ‘লখ্‌নৌ শহরের বেস্ট পান। খেয়ে দেখুন। এক বেনারস ছাড়া কোথাও পাবেন না এ জিনিস।’

আমি মনে মনে ভাবছি, বনবিহারীবাবু যদি বেশিক্ষণ থাকেন তা হলে আমাদের বাইরে যাওয়া ভেস্তে যাবে, এমন সময় উনি নিজেই বললেন, ‘বাড়িতে থাকছেন, না বেরোচ্ছেন?’

বাবা বললেন, ‘ভেবেছিলাম এদের নিয়ে একটা কিছু দেখিয়ে আনব। ইমামবড়া ছাড়া তো আর কিছুই দেখা হয়নি এখনও।’

‘রেসিডেন্স দেখোনি এখনও?’ প্রশ্নটা আমাকেই করলেন ভদ্রলোক। আমি মাথা নেড়ে না বললাম।

‘চলো—আমার মতো গাইড পাবে না। মিউটিনি সম্বন্ধে আমার থরো নলেজ আছে।’

তারপর ধীরুকাকার দিকে ফিরে বললেন—‘আমার কেবল একটা জিনিস জানার কৌতূহল হচ্ছে। আংটিটা কোত্থেকে গেল। সিন্দুকে রেখেছিলেন কি?’

ধীরুকাকা বললেন, ‘সিন্দুক আমার নেই। একটা গোদরেজের আলমারি খুলে নিয়ে গেছে। চাবি অবিশ্যি আমার পকেটেই ছিল। বোধহয় ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলেছে।’

‘শুনলাম বাক্সটা নাকি রেখে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ভেরি স্ট্রেঞ্জ! বাক্স দেরাজে ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘দেরাজ ভাল করে খুঁজে দেখেছেন তো?’

‘তন্ন তন্ন করে।’

‘কিন্তু একটা জিনিস তো করতে পারেন। আলমারির হাতলে, বাক্সটার গায়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট আছে কি না সেটা তো…’

‘থাকলে সবচেয়ে বেশি থাকবে আমারই আঙুলের ছাপ। ওতে সুবিধে হবে না।’

বনবিহারীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘খাসা লোক ছিলেন বাবা পিয়ারিলাল। আংটিটা ইনসিওর পর্যন্ত করেননি। আর যাঁকে দিয়ে গেলেন তিনিও অবশ্যি তথৈবচ। যাক—হাড়ের ডাক্তারের এবার হাড়ে হাড়ে শিক্ষা হয়েছে।’

* * *

এবার আর আমাদের টাঙ্গায় যাওয়া হল না। বনবিহারীবাবুর গাড়িতেই সবাই উঠে পড়লাম। ফেলুদা আর আমি সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলাম।

ক্লাইভ রোড দিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন বনবিহারীবাবু আমাদের দুজনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তোমরা এখানে এসে এমন একটা রহস্যের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে ভেবেছিলে কি?’

আমি মাথা নেড়ে না বললাম। ফেলুদা খালি হিঃ হিঃ করে একটু হাসল।

বাবা বললেন, ‘ফেলুবাবুর অবিশ্যি পোয়া বারো, কারণ ওর এ সব ব্যাপারে খুব ইন্টারেস্ট। ও হল যাকে বলে শখের ডিটেকটিভ।’

‘বটে?’

বনবিহারীবাবু যেন খবরটা শুনে খুবই অবাক আর খুশি হলেন। বললেন, ‘ব্রেনের ব্যায়ামের পক্ষে ওটা খুব ভাল জিনিস। তা, রহস্যের কিছু কিনারা করতে পারলে ফেলুবাবু?’

ফেলুদা বলল, এ তো সবে শুরু।’

‘অবিশ্যি তুমি কোন রহস্যের কথা ভাবছ জানি না। আমার কাছে অনেক কিছুই রহস্যজনক।’

ধীরুকাকা বললেন, ‘কী রকম?’

‘এই যেমন ধরুন—সন্ন্যাসী গোদরেজের আলমারির চাবি পেল কোত্থেকে। তারপর বাড়িতে চাকর-বাকর থাকতে সে-সন্ন্যাসীর এত সাহসই বা হবে কোত্থেকে যে সে একেবারে আপনার বেডরুমে গিয়ে টুকবে। তা ছাড়া একটা ব্যাপার তো অনেকদিন থেকেই খটকা লেগে আছে।’

ধীরুকাকা বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘শ্রীবাস্তবকে সত্যিই পিয়ারিলাল আংটি দিয়েছিলেন, না শ্রীবাস্তব সেটা অন্য ভাবে—’

ধীরুকাকা বাধা দিয়ে বললেন, ‘সে কী মশাই, আপনি কি শ্রীবাস্তবকেও সন্দেহ করেন নাকি?’

‘সন্দেহ তো প্রত্যেককেই করতে হবে—এমন কী আমাকে আপনাকেও—তাই নয় কি ফেলুবাবু?’

ফেলুদা বলল, ‘নিশ্চয়ই। আর যেদিন সন্ন্যাসী আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, সেদিন তো শ্রীবাস্তবও এসেছিলেন—ওই বিকেলেই। তারপর আমাদের না পেয়ে বনবিহারীবাবুর বাড়িতে এলেন।’

‘এগ্‌জ্যাক্টলি!’ বনবিহারীবাবু যেন রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

এবারে বাবা যেন বেশ থতমত খেয়েই বললেন, ‘কিন্তু শ্রীবাস্তব যদি অসদুপায়ে আংটি পেয়ে থাকেন, তা হলে তিনি সেটা আমাদের কাছে রাখবেনই বা কেন, আর রেখে সেটা চুরিই বা করবেন কেন?’

বনবিহারীবাবু হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘বুঝলেন না? অত্যন্ত সহজ। শ্রীবাস্তবের পেছনে সত্যিই ডাকাত লেগেছিল। ভিতু মানুষ—তাই ভয় পেয়ে আংটিটা আপনাদের কাছে এনে রেখেছিলেন। এদিকে লোভও আছে ষোলো আনা, তাই তিনি নিজেই আবার সেটা চুরি করে চোরদের ধাপ্পা দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন।’

আমার মাথার মধ্যে সব কেমন জানি গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। শ্রীবাস্তবের মতো এত ভালমানুষ হাসিখুশি লোক, তিনি কখনও চোর হতে পারেন? ফেলুদাও কি বনবিহারীবাবুর সঙ্গে একমত, নাকি বনবিহারীবাবুর কথাতেই ওর প্রথম শ্রীবাস্তবের ওপর সন্দেহ পড়েছে?

বনবিহারীবাবু বললেন, ‘শ্রীবাস্তব অমায়িক লোক তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন—লখ্‌নৌ-এর মতো জায়গা—এমন আর কী—সেখানে স্রেফ হাড়ের ব্যারামের চিকিৎসা করে এত বড় বাড়ি গাড়ি বাগান আসবাবপত্র—ভাবতে একটু ইয়ে লাগে না কি?’

ধীরুকাকা বললেন, ‘ওর বাপের হয়তো টাকা ছিল?’

বনবিহারীবাবু বললেন, ‘বাপ ছিলেন এলাহাবাদ পোস্ট আপিসের সামান্য কেরানি।’

এই সময় ফেলুদা হঠাৎ একটা বাজে প্রশ্ন করে বসল—

‘আপনার কোনও জানোয়ার কখনও আপনাকে কামড়েছে কি?’

‘নো নেভার।’

‘তা হলে আপনার ডান হাতের কবজিতে ওই দাগটা কী?’

ও হো হো—বাঃ বাঃ, তুমি তো খুব ভাল লক্ষ করেছ—কারণ ও দাগটা সচরাচর আমার আস্তিনের ভেতরেই থাকে। ওটা হয়েছিল ফেন্‌সিং করতে গিয়ে। ফেন্‌সিং বোঝো?’

ফেলুদা কেন—আমিও জানতাম ফেন্‌সিং কাকে বলে। রেপিয়ার বলে একরকম সরু লম্বা তলোয়ার দিয়ে খেলাকে বলে ফেন্‌সিং।

‘ফেন্‌সিং করতে গিয়ে হাতে খোঁচা খাই। এটা সেই খোঁচার দাগ।’

রেসিডেন্সিটা সত্যিই একটা দেখবার জিনিস। প্রথমত জায়গাটা খুব সুন্দর। চারিদিকে বড় বড় গাছপালা—তার মাঝখানে এখানে ওখানে এক একটা মিউটিনির আমলের সাহেবদের ভাঙা বাড়ি। গাছগুলোর ডালে দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁদর। লখ্‌নৌ শহরের বাঁদরের কথা আগেই শুনেছি, এবার নিজের চোখে তাদের কাণ্ডকারখানা দেখলাম।

কতগুলো রাস্তার ছেলে গুলতি দিয়ে বাঁদরগুলোর দিকে তাগ করে ইট মারছিল—বনবিহারীবাবু তাদের কষে ধমক দিলেন। তারপর আমাদের বললেন, ‘জন্তুজানোয়ারের ওপর দুর্ব্যবহারটা আমি সহ্য করতে পারি না। আমাদের দেশেই এ-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।’

ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহের কথা পড়েছি, রেসিডেন্সি দেখার সময় সেই বইয়ে পড়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল।

একটা বড় বাড়ির ভিতর আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি, আর বনবিহারীবাবু বর্ণনা দিয়ে চলেছে—

‘সেপাই মিউটিনির সময় লখ্‌নৌ শহরে নবাবদেরই রাজত্ব। ব্রিটিশরা তাদের সৈন্য রেখেছিলেন এই বাড়িটার ভেতরেই। স্যার হেনরি লরেন্স ছিলেন তাদের সেনাপতি। বিদ্রোহ লাগল দেখে প্রাণের ভয়ে লখ্‌নৌ শহরের যত সাহেব মেমসাহেব একটা হাসপাতালের ভিতর গিয়ে আশ্রয় নিল। কদিন খুব লড়েছিলেন স্যার হেনরি, কিন্তু আর শেষটায় পেরে উঠলেন না। সেপাই-এর গুলিতে তাঁর মৃত্যু হল। আর তার পরে ব্রিটিশদের কী দশা হল সেটা এই বাড়ির চেহারা দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারছ। স্যার কলিন ক্যাম্পবেল যদি শেষটায় টাটকা সৈন্য সামন্ত নিয়ে না-এসে পড়তেন, তা হলে ব্রিটিশদের দফা রফা হয়ে যেত। …এ ঘরটা ছিল বিলিয়ার্ড খেলার ঘর। দেয়ালে সেপাইদের গোলা লেগে কী অবস্থা হয়েছে দেখো।’

বাবা আর ধীরুকাকা আগেই রেসিডেন্সি দেখেছেন বলে মাঠে পায়চারি করছিলেন। আমি আর ফেলুদাই তন্ময় হয়ে বনবিহারীবাবুর কথা শুনছিলাম। আর দুশো বছরের পুরনো পাতলা অথচ মজবুত ইটের তৈরি ব্রিটিশদের ঘরবাড়ির ভগ্নাবশেষ দেখছিলাম, এমন সময় ঘরের দেয়ালের একটা ফুটো দিয়ে হঠাৎ কী একটা জিনিস তীরের মতো এসে ফেলুদার কান ঘেঁষে ধাঁই করে পিছনের দেয়ালে লেগে মাটিতে পড়ল। চেয়ে দেখি সেটা একটা পাথরের টুকরো।

তার পরমুহূর্তেই বনবিহারীবাবু একটা হ্যাঁচকা টানে ফেলুদাকে তার দিকে টেনে নিলেন, আর ঠিক সেই সময় আরেকটা পাথর এসে আবার ঘরের দেয়ালে লেগে মাটিতে পড়ল। পাথরগুলো যে গুলতি দিয়ে মারা হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

বনবিহারীবাবুর বয়স হলেও এখনও যে কত চটপটে সেটা এবার বেশ বুঝতে পারলাম। উনি এক লাফে দেয়ালের একটা বড় গর্তের ভেতর দিয়ে গিয়ে বাইরের ঘাসে পড়লেন। আমি আর ফেলুদাও অবিশ্যি তক্ষনি লাফিয়ে গিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছলাম। আর গিয়েই দেখলাম যে-দিক দিয়ে পাথর এসেছে, সেই দিকে বেশ খানিক দূরে, একটা লাল ফেজটুপি আর কালো কোট পরা দাড়িওয়ালা লোক দৌড়ে পালাচ্ছে।

ফেলুদা আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সোজা লোকটার দিকে ছুটল। আমি ফেলুদার পিছনে পিছনে যাব বলে পা বাড়িয়েছিলাম, কিন্তু বনবিহারীবাবু আমার জামার আস্তিনটা ধরে বললেন, ‘তুমি এখনও স্কুলবয় তপেশ; তোমার এ সব গোলমালের মধ্যে না যাওয়াই ভাল।’

কিছুক্ষণ পরে ফেলুদা ফিরে এল। বনবিহারীবাবু বললেন, ‘ধরতে পারলে?’

ফেলুদা বলল, ‘নাঃ। অনেকটা ডিস্‌ট্যান্স। একটা কালো স্ট্যান্ডার্ড গাড়িতে উঠে ভেগেছে লোকটা।’

বনবিহারীবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘স্কাউড্রেল!’ তারপর আমাদের দুজনের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ‘চলো—আর এখানে থাকা ঠিক হবে না।’

একটু এগিয়ে গিয়ে বাবা আর ধীরুকাকার সঙ্গে দেখা হল। বাবা বললেন, ‘ফেলু এত হাঁপাচ্ছ কেন?’

বনবিহারীবাবু বললেন, ‘ওর বোধহয় গোয়েন্দাগিরিটা বেশি না করাই ভাল। মনে হচ্ছে ওর পেছনে গুণ্ডা লেগেছে।’

বাবা আর ধীরুকাকা দুজনেই ঘটনাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন।

তখন বনবিহারীবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। আমি রসিকতা করছিলাম। আসলে পাথরগুলো আমাকেই লক্ষ্য করে মারা হয়েছিল। ওই যে ছোকরাগুলোকে তখন ধমক দিলুম এ হচ্ছে তারই প্রতিশোধ।’

তারপর ফেলুদার দিকে ঘুরে বললেন, ‘তবে তাও বলছি ফেলুবাবু, তোমারও বয়সটা কাঁচাই। বিদেশ-বিভুঁয়ে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়বে সেটা কি খুব ভাল হবে? এবার থেকে একটু খেয়াল করে চলো।’

কথাটা শুনে ফেলুদা চুপ করে রইল।

গাড়ির দিকে হাঁটার সময় দুজনে একটু পেছিয়ে পড়েছিলাম—সেই সুযোগে ফেলুদাকে ফিস ফিস করে বললাম, ‘পাথরটা তোমাকে মারছিল, না ওঁকে?’

ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ওঁকে মারলে কি উনি চুপ করে থাকতেন নাকি? হল্লাটল্লা করে রেসিডেন্সির বাকি ইট কটা খসিয়ে দিতেন না?’

‘আমারও তাই মনে হয়।’

‘তবে একটা জিনিস পেয়েছি। লোকটা পালানোর সময় ফেলে গিয়েছিল।’

‘কী জিনিস?’

ফেলুদা পকেট থেকে একটা কালো জিনিস বার করে দেখাল। ভাল করে দেখে বুঝলাম সেটা একটা নকল গোঁফ, আর তাতে এখনও শুকনো আঠা লেগে রয়েছে।

গোঁফটা আবার পকেটে রেখে ফেলুদা বলল, ‘পাথরগুলো যে আমাকেই মারা হয়েছে, সেটা ভদ্রলোক খুব ভাল ভাবেই জানেন।’

‘তা হলে বললেন না কেন?’

‘হয় আমাদের নার্ভাস করতে চান না, আর না হয়…’

‘না হয় কী?’

ফেলুদা উত্তরের বদলে মাথা বাঁকিয়ে একটা তুড়ি মেরে বলল, ‘কেসটা জমে আসছে রে তোপ্‌সে। তুই এখন থেকে আর আমাকে একদম ডিস্টার্ব করবি না।’

বাকি দিনটা ও আর একটাও কথা বলেনি আমার সঙ্গে। বেশির ভাগ সময় বাগানে পায়চারি করেছে, আর বাকি সময়টা ওর নীল নোটবইটাতে হিজিবিজি কী সব লিখেছে। ও যখন বাগানে ঘুরছিল, তখন আমি একবার লুকিয়ে লুকিয়ে বইটা খুলে দেখেছিলাম, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারিনি, কারণ সেরকম অক্ষর এর আগে আমি কখনও দেখিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *