৫. রাখু সরে দাঁড়াল

দরজা খুলে রাখু সরে দাঁড়াল। আগেকার দিনে মধুময় সোজা দো-তলায় উঠে যেত অমলের ঘরে। রাখু ভেবেছে, মধুময় সেইরকমই যাবে।

মধুময়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বলল, যান-না, ওপরে যান, দাদাবাবু একটু আগেই ফিরেছেন।

মধুময় আড়ষ্ট বোধ করল। সে শুনেছে যে, এরমধ্যে অমলের বিয়ে হয়ে গেছে। অমল তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করতেও গিয়েছিল, মধুময় তখন জেলে।

মধুময় বলল, না, আমি নীচের ঘরে বসছি, তুমি দাদাবাবুকে খবর দাও।

অমলদের পরিবার বেশ স্বচ্ছল। তা ছাড়া অমল পাশ-টাশ করে একটা চাকরিও পেয়েছে, তারপর বিয়ে করেছে, সে এখন সুখী মধ্যবিত্ত।

মধুময়ের যতদূর মনে আছে, এ পাড়ারই রীতা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে অমলের ভাব ছিল। অমল কি তাকে বিয়ে করেছে? অমল স্বপ্নাকেও চেনে।

অমল এল, বেশ খানিকটা দেরি করে।

এই শীতের মধ্যেও সন্ধ্যে বেলা স্নান করেছে অমল। পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর একটা সাদা শাল আলগা ভাবে জড়ানো। সারাগায়ে পাউডারের গন্ধ।

কী রে?

মধুময় কথা না বলে হাসল।

সোফার ওপর বসে পড়ে অমল পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, খাবি? এতদিন পর হঠাৎ মনে পড়ল?

অমল মধুময়েরও আগে থেকে সিগারেট ধরেছে। আগে অমলকে খুব লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট খেতে হত, এখন সে বিবাহিত সংসারী মানুষ বলে বসবার ঘরেই সিগারেট ধরাতে পারে। অমলের বাবা তো যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারেন এখানে।

মধুময় হাত বাড়িয়ে অমলের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বলল, কেমন আছিস?

 ভালোই। তোর খবর কী?

চলছে।

মাসিমা কেমন আছেন?

খুবই কাটা কাটা কথাবার্তা। মধুময়ের মনে হল, অমলের মুখে যেন অভিমানের ছাপ। মধুময় যে হঠাৎ এবাড়িতে আসা বন্ধ করেছিল সেইজন্য অমলের তো অভিমান হতেই পারে। বাবা-মায়েরা তো ওরকম একটু-আধটু বকাবকি করেন, তাবলে কি কেউ ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ত্যাগ করে? অমলের বাবা অমলের ছবিই ছিঁড়েছিলেন। মধুময়ের তো ছেঁড়েননি। তা ছাড়া মধুময় নিজেই এখন ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছে।

একটু পরেই মধুময়ের খেয়াল হল, সে নিজে থেকে দো-তলায় উঠে যায়নি, অমলও তাকে ওপরে যেতে বলল না। আগে তারা কখনোই বসবার ঘরে বসে গল্প করেনি।

অমল নিশ্চয়ই মধুময়ের কীর্তি কাহিনি সব জানে। মধুময়ের নামে যখন মামলা চলছিল তখন খবরের কাগজে সব ছাপা হয়েছিল। অমল নিশ্চয়ই খবরের কাগজ পড়ে। এমনিতেও এসব কথা লোকের মুখে মুখে ঠিক রটে যায়।

মধুময় জিজ্ঞেস করল, তুই কি রীতাকে বিয়ে করেছিস?

অমল চকিতে মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দরজার দিকে তাকাল। তারপর একটু বিরক্তভাবে বলল, রীতাকে? কেন, রীতাকে বিয়ে করতে যাব কেন? রীতার তো আগেই বিয়ে হয়ে গেছে।

বেশি দিনের তো কথা নয়, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধান, তবু যেন, মনে হয় এক যুগ পার হয়ে গেছে, ঘটে গেছে কত কিছু, মধুময় তার অনেক কিছুরই খবর রাখে না।  

তোর বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবি না?

দাঁড়া, ডাকছি।

সোফা থেকে উঠতে গিয়েও অমল আবার বসে পড়ে বলল, ও, ও তো বাড়ি নেই, আমার ছোটো বোনের সঙ্গে বেরিয়েছে। তুই আগে থেকে খবর দিয়ে আসিসনি, আর একদিন আয়।

মধুময়ের কেন যেন মনে হল, অমল মিথ্যেকথা বলছে। অমলের স্ত্রী বাড়িতেই আছে, কিন্তু অমল তার সঙ্গে মধুময়ের আলাপ করিয়ে দিতে লজ্জা পাচ্ছে। অমলের স্ত্রী যদি বলে, এই তোমার সেই বন্ধু, যে ট্রেনে ডাকাতি করেছিল? যে ধরা পড়েছিল একটা বেশ্যার বাড়িতে?

অমল ওর স্ত্রীকে নীচে ডাকতে যাচ্ছিল। তার মানে, অমল আর ওকে দো-তলার ঘরে নিয়ে যেতে চায় না।

মধুময়ের খুব ইচ্ছে হল একবার দোতলার সেই বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াতে।

মধুময় যদি ওপরে যেতে চায় আর ওপরে গিয়ে দেখে যে, অমলের স্ত্রী বাড়িতেই আছে, তাহলে অমল লজ্জা পেয়ে যাবে।

চা খাবি?

খেতে পারি।

অমল এবার উঠে গিয়ে ভেতরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, রাখু, রাখু—

রাখু এলে মধুময় কি জিজ্ঞেস করবে, বলো তো রাখু, তোমার দাদাবাবুর বউ বাড়িতে আছেন কি না?

মধুময়ের একটু হাসি পেল।

পরক্ষণেই তার মাথায় আর একটা উদ্ভট চিন্তা জাগল। অমলের কাছে কিছু টাকা ধার চাইলে কেমন হয়?

মধুময়ের টাকার দরকার নেই। দুটো মাস চালাবার মতন যথেষ্ট হাত-খরচ তার আছে। তবু সে অমলকে একটু পরীক্ষা করে দেখতে চায়। খুব বেশি নয়, শ-দুয়েক টাকা যদি চাওয়া যায়?

মধুময়ের মতন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে অমল নিশ্চয়ই দু-শো টাকা ধার দিতে পারে। কিন্তু মধুময় ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বলে অমল কি এখন টাকাটা ধার দিতে চাইবে না? ওর বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার মতন কথাটা ঘুরিয়ে দেবে?

এইসময় লোহার গেট ঠেলে দু-টি মেয়ে ভেতরে এল। একজন অমলের ছোটোবোন বনানী, অন্যজন বিবাহিতা। এই নিশ্চয়ই অমলের স্ত্রী। তাহলে তো অমল মিথ্যেকথা বলেনি।

অমল অবশ্য ওর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল না, অন্যমনস্কভাবে সিগারেট টানতে লাগল।

মধুময় যখন বনানীকে দেখেছে, তখন ও ফ্রক পরত, এখন শাড়ি পরে রীতিমতো মহিলা হয়ে গেছে। সে অমলের স্ত্রীর সঙ্গে ভেতরে চলে যাচ্ছিল। মধুময় ডেকে বলল, এই বনানী, কেমন আছিস?

বনানী ঘুরে দাঁড়িয়ে বিস্মিতভাবে হেসে বলল, ও মা, মধুদা! চিনতেই পারিনি। আমি ভাবলাম কোনো অচেনা লোক। এত বড়ো বড়ো চুল রেখেছ!

কিন্তু মধুময় খুব ভালোভাবেই জানে, বনানী তাকে আগেই চিনেছিল, ওর চাহনি দেখেই বোঝা যায়। চিনতে পেরেও কথা না বলে চলে যাচ্ছিল।

বনানী বলল, এসো বউদি, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মধুময়দা, দাদার খুব বন্ধু ছিল, একসময় খুব আসত আমাদের বাড়ি

মধুময় উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করে বলল, নমস্কার! আপনি আগে আমার কথা শোনেননি অমলের কাছে? আপনাদের বিয়ের সময় আমি আসতে পারিনি, তখন আমি জেলে ছিলাম।

অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল হঠাৎ। কেউ কোনো কথা বলল না একটাও।

মধুময় এবার একগাল হেসে বলল, আমি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলাম।

এবার অমল সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রতিবাদ করে বলে উঠল, মোটেই না, কেন ইয়ার্কি করছিস, মধু? সবাই জানে তুই কিছু করিসনি, পুলিশ তোর নামে কোনো কেস দিতে পারেনি। জজ তোকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।

বনানী বলল, আমরাও কাগজে তাই পড়েছি।

অমল বলল, ওকে মিথ্যে মামলায় জড়িয়েছিল। আজকাল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এমনই অপদার্থ।

বনানী বলল, ইস, তোমাকে অনেক দিন জেলে আটকে রেখেছিল, তাই-না মধুদা? রোগা হয়ে গেছ সেইজন্য!

অমলের স্ত্রী বেচারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কী বলবে বা কী করবে বুঝতে পারছে না।

মধুময় ভাবল, ওর তো এমন অবস্থা হবেই। কেননা নিশ্চয়ই মধুময়কে নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। মধুময় যে ট্রেনে ডাকাতি করেছিল তাতে ওদের কোনো সন্দেহ নেই। পুলিশ অনেকসময়ই এসব প্রমাণ করতে পারে না, সেইজন্যই তো বাঘা বাঘা উকিলরা রয়েছে। তা ছাড়া মধুময় কোথায় ধরা পড়েছিল, তাও তো কারুর আর অজানা নেই।

অমল যে জোর করে মধুময়কে নির্দোষ প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে, তার মানে ওর স্ত্রীকে জানাতে চায় যে, একজন ডাকাত অমলের বন্ধু নয়। তাও আবার বিচ্ছিরি ধরনের ডাকাতি। অনন্ত সিংয়ের দলে ভিড়ে কোনো রাজনৈতিক ডাকাতি করলেও তবু কিছুটা মান রক্ষা করা যেত।

অমলের স্ত্রী বলল, আপনি বসুন। চা-টা কিছু দেয়নি, আমি দেখছি।

দ্রুতপায়ে সে ভেতরে ঢুকে গেল।

এরপর চায়ের সঙ্গে মিষ্টিও এল। অমল জোর করে ছাত্ৰ-বয়েসের গল্প করতে লাগল। হেসে উঠল কয়েকবার। যেন মধুময়ের সঙ্গে তার আগের মতনই বন্ধুত্ব আছে।

কিন্তু মধুময় যেই বলল, এবার উঠি। অমল তার উত্তরে বলল, না আর একটু বোস। সে-ই, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।

বাইরের লোহার গেটটার কাছে এসে মধুময়ের মনের মধ্যে আবার বিড়বিড় করে উঠল। অমল তাকে একবারও দো-তলার ঘরে যেতে বলল না। অমলের বউ কিংবা বনানী আর ফিরে এল না তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য।

গেটটা খোলার জন্য হাত দিয়েও থেমে গিয়ে মধুময় বলল, তোরা বললি আমি নির্দোষ, পুলিশ আমায় মিথ্যে মামলায় জড়িয়েছিল, কিন্তু স্বপ্না সে-কথা বিশ্বাস করে না।

অমল বলল, স্বপ্নার সঙ্গে অনেক দিন দেখা নেই। কেমন আছে স্বপ্না?

আমার সঙ্গে দেখা হয় না।

ও!

একটু থেমে মধুময় বলল, জানিস অমল, আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই ট্রেনে ডাকাতি করেছিলাম।

একটুও না চমকে অমল তেতো গলায় বলল, কেন গিয়েছিলি! তোর কি এতই টাকার অভাব? মেসোমশাই তো এখনও চাকরি করছেন।

আমি কোনো চাকরি পেলাম না।

চাকরি না পেলেই কী, ভদ্রলোকের ছেলেরা ডাকাতি করে? এখন তোর একটা বাজে রেকর্ড হয়ে গেল, এখন কে তোকে চাকরি দেবে?

অমল তুই আমার একটা উপকার করবি? বিশেষ দরকার, তুই আমাকে দু-শো টাকা ধার দিবি?

যতটা চমকানো উচিত ছিল, ততটা চমকাল না অমল। সে যেন, এ-রকম কিছুরই প্রতীক্ষা করছিল। একটা-কোনো মতলব না থাকলে কি মধুময় হঠাৎ এমনি এসেছে এতদিন বাদে!

ভাবলেশহীন গলায় অমল বলল, কিন্তু আমার যে একদম হাত খালি ভাই। গত মাসে দার্জিলিং গিয়েছিলাম বাড়ির সবাইকে নিয়ে। তাতেই একেবারে ফতুর হয়ে গেছি।

কিছু দিতে পারিস-না? অন্তত শ-দেড়েক? বিশেষ দরকার বলেই বলছি।

খুব মুশকিলে ফেললি … গোটা কুড়ি-তিরিশ টাকা দিতে পারি বড়োজোর।

 আচ্ছা থাক।

গেট খুলে বেরিয়ে গেল মধুময়। হাসিমুখে বলল, চলি।

 মধুময় কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর অমল বলল, গোটা পঞ্চাশেক হলে যদি চলে, কিংবা সামনের সপ্তাহে

মধুময় বলল, না থাক, তার আর দরকার হবে না।

কিছু দূর যাওয়ার পর মধুময়ের মুখ থেকে হাসিটা আপনা-আপনি মুছে গেল। এ-রকমই তো হওয়ার কথা ছিল। মধুময় কি অন্যরকম কিছু আশা করেছিল? অমল তো এর থেকেও খারাপ ব্যবহার করতে পারত।

মন খারাপ–মন খারাপ–মন খারাপ–প্রতিপদক্ষেপে মধুময়ের মন খারাপ বাড়তে লাগল, তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

এই সবই বদলে দিতে পারে স্বপ্না। যদি স্বপ্না একবার এসে বলে, আমি তোমায় ভুল বুঝিনি–অমনি মধুময় অন্য মানুষ হয়ে যাবে। সে স্বপ্নার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে অগ্রাহ্য করবে পৃথিবীর আর সব কিছু।

অথবা, এক্ষুনি হাতে একটা ছুরি নিয়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে লাফিয়ে পড়লেও মধুময়ের মন খারাপ কেটে যেতে পারে।

মধুময়দের বাড়ির দরজাটা দিয়ে ঢুকেই একটা ছোটোমতন গলি। সেখানে ওদের চিঠির বাক্স। সদর দরজা প্রায় সারাদিন খোলা থাকে বলে চিঠির বাক্সে তালা দেওয়া।

পোস্টম্যান যখন চিঠি দিতে এসেছে, ঠিক সেইসময় মধুময় বেরোচ্ছিল। পোস্টম্যানের কাছ থেকে সে চিঠিগুলো নিয়ে নিল। ভাগ্যিস নিয়েছিল! নইলে এ-চিঠিটাও পড়ত বাবার হাতে।

সাদা শক্ত কাগজে লম্বা খামটা মধুময় চট করে ভরে নিল নিজের পকেটে, বাকি চিঠিগুলো ফেলে দিল বাক্সে।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এসে মধুময় পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে খুলল। মুম্বাই থেকে তার মামা প্রায়ই মধুময়কে তাড়া দিয়ে চিঠি লিখছেন। মধুময় যেন অবিলম্বে সেখানে চলে আসে। এই চিঠিখানা খুবই জরুরি।

বড়োমামা লিখেছেন যে, মধুময়ের জন্য তিনি একটি চাকরি প্রায় পাকা করে ফেলেছেন। একটা নাম-করা ওষুধ কোম্পানিতে অফিসার্স ট্রেইনি, এখন পাবে আট-শো টাকা। ছ-মাসের ট্রেনিং কমপ্লিট করতে পারলে বারো-শো থেকে আঠারো-শো টাকা স্কেলে পোস্টিং হবে, সঙ্গে আরও নানারকম সুযোগসুবিধে আছে। মুম্বাইতে বাড়ি ভাড়া পাওয়া খুব শক্ত। এই কোম্পানি ফ্ল্যাটও দেবে।

মধুময়ের যা যোগ্যতা, তাতে এর চেয়ে ভালো কাজ সে নিজে কখনো জোগাড় করতে পারবে না। এই চাকরিটা তার এক্ষুনি লুফে নেওয়া উচিত। এরপর থেকে সে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারে।

বড়োমামা লিখেছেন, এ মাসের সাতাশ তারিখে শুধু একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে। সব ঠিকঠাক হয়ে আছে যদিও, তবুও ওটা শুধু নিয়মরক্ষার জন্য। মধুময় যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুম্বাই চলে আসে।

মধুময় একবার ভাবল, চিঠিখানা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে রাস্তায় উড়িয়ে দেবে। পরে বড়োমামা বাবাকে কিছু জানালে মধুময় অনায়াসেই বলতে পারবে, কই, আমি তো সেরকম কোনো চিঠি পাইনি!

আবার একটু ভেবে, চিঠিখানা না ছিঁড়ে পকেটেই রেখে দিল। এ মাসের সাতাশ তারিখ, তার মানে এখনও আট দিন দেরি আছে। পঁচিশ তারিখে শেষ হচ্ছে মধুময়ের দু-মাসের ব্রত। যদি সে যাওয়া ঠিক করে, তাহলে পঁচিশ তারিখ রাত্তিরেও সে প্লেনে করে মুম্বাই পৌঁছে যেতে পারে।

যদি সে যায়! সে যাবে কিনা নির্ভর করছে স্বপ্নার ওপরে। স্বপ্না যদি তাকে ক্ষমা করে, তাহলেই শুধু সে সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনে ফিরে যাবে। মুম্বাইতে বড়ো কোম্পানির অফিসার, সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাট, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন।

স্বপ্না যদি না চায়, তাহলে এসব চাকরির কোনো মূল্যই নেই মধুময়ের কাছে। বারো- শো টাকা মাইনে? ফু:! ধনার প্ল্যান অনুযায়ী একটা গাড়ি মল্লিকবাজারে ডেলিভারি দিলেও দু হাজার টাকা হাতে আসবে।

বড়োমামা যখন কলকাতায় ছিলেন, তখন তাঁর গাড়িতেই মধুময় ড্রাইভিং শিখেছিল। সে ঝড়ের মতন উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে গাড়ি। ধনার সঙ্গে এক মাসে সে তিরিশখানা গাড়ি হাওয়া করে দিয়ে রোজগার করতে পারে ক্যাশ ষাট হাজার টাকা। সে আর কোনোদিন ছবি আঁকবে না। সে ধনা আর রতনদের মতন মুখ-খিস্তি করবে সবসময়। সে অন্য জীবন বেছে নেবে, যে জীবন অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।

তখন সবসময় কাছে একটা ছুরি রাখবে মধুময়। কিংবা রিভলবার। তখন কেউ তাকে ধরতে এলে আর বোকার মতন ধরা দেবে না সে।

স্বপ্না থাকলে একরকম জীবন, স্বপ্নাকে বাদ দিয়ে আর একরকম জীবন। স্বপ্নার কাছে তার আত্মার একটা টুকরো জমা রয়ে গেছে, যা আর কখনো ফেরত নেওয়া যায় না। স্বপ্না যদি একেবারে দূরে সরে যায়, তাহলে অর্ধেক আত্মা নিয়ে মধুময় দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠবে।

সেদিন স্বপ্নাকে মধুময় আবিষ্কার করল দুপুর বেলা মেট্রো সিনেমার সামনে। স্বপ্না চঞ্চলভাবে ঘড়ি দেখছিল। মধুময় একটু দূরে দাঁড়াল। যাতে স্বপ্না তাকে দেখতে না পায়, কিন্তু সে ঠিক নজর রাখতে পারে। স্বপ্না খুবই ব্যস্তভাবে ছটফট করছে।

ঠিক তিনটে বেজে দশ মিনিটে একটি ফিয়াট গাড়ি এসে থামল তার সামনে। একটি অতিরিক্ত ভালো পোশাক পরা যুবক তার থেকে নেমে প্রচুর ক্ষমা চাইতে লাগল দেরি হওয়ার জন্য।

স্বপ্নার ভুরু কুঁচকে ছিল, আস্তে আস্তে তা সরল হল। তারপর সে হাসল। একটু পরেই ওরা দু-জনে চড়ে বসল গাড়িতে। গাড়িটা ভোঁ করে বেরিয়ে গেল। মধুময় দাঁড়িয়ে ছিল মাত্র পনেরো-কুড়ি গজ দূরে। ওদের দুজনের কেউই তাকে লক্ষ করেনি।

ওই ছেলেটিকে চেনে মধুময়। কয়েকদিন ধরে স্বপ্নার সঙ্গে ওকে দেখছে। ছেলেটি একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়কের ছোটো ভাই। নিজেও গান-টান গেয়ে কিছু নাম করেছে। ওর নাম সুরজিৎ।

গাড়িতে ওঠবার সময় সুরজিৎ আর স্বপ্না এমন গাঢ়ভাবে তাকিয়ে ছিল পরস্পরের দিকে, যা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকারাই তাকায়।

মধুময় একটু হাসল। বিবাহিত পুরুষদের স্ত্রী মারা গেলে অন্তত দু-এক বছরের আগে তারা নতুন বিয়ে করে না। মেয়েদের বুঝি অত দেরি আর সয় না। স্বপ্নার কাছে এখন মধুময় মৃত কিনা কে জানে। তাহলে মাত্র এই ক-মাসের মধ্যেই সে আর একজনকে ভালোবেসে ফেলল।

চট করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মধুময় অনুসরণ করতে লাগল ফিয়াট গাড়িটাকে। আর কয়েক দিন বাদে, মধুময় যদি অন্যরকম জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কিছুদিনের মধ্যে সেও ও-রকম একটা ফিয়াট গাড়ি কিনে ফেলতে পারবে।

সামনের গাড়িটা চলল হাওড়ার দিকে। মধুময় ভেবেছিল ওরা ট্রেনে চেপে কোথাও যাবে। কিন্তু গাড়িটা হাওড়া স্টেশনে ঢুকল না, বাকল্যাণ্ড ব্রিজের ওপর উঠল।

মধুময় শুধু লক্ষ করছিল, ওরা কতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। স্বপ্না কতটা বদলেছে? সে কি তার নতুন প্রেমিকের সঙ্গে শরীর ছোঁয়াছুঁয়ি করতে রাজি হয়েছে? একটু নির্জন রাস্তায় সে কি সুরজিৎকে টপ করে একটা চুমু খাবার অনুমতি দেবে?

সে-রকম কিছু ঘটল না। স্বপ্না খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখেই বসে রইল আগাগোড়া। তবে সুরজিৎ নামের ছেলেটি বড়ো বেশি সিগারেট খায়। গাড়ি চালাতে চালাতে সে সিগারেট ধরাচ্ছিল, একবার স্বপ্না বুঝি তাকে বকল, তারপর নিজেই লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিল ওর সিগারেট।

গাড়িটা থামল শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে।

মধুময় অনেকটা যেন নিশ্চিন্ত হল। এই বাগানেও ইচ্ছে করলে চুমু-টুমু খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। সেই সুযোগ কি ওরা নেবে? মধুময় শুধু দেখে নিতে চায়।

আর মাত্র সাত দিন। তারপরেই স্বপ্নার মুক্তি। মধুময়েরও মুক্তি। স্বপ্নার কাছে তার আত্মার যে টুকরোটা জমা আছে, আর সাত দিন পরে মধুময় সেটার দাবি একেবারেই ছেড়ে দেবে।

ওরা বাগানের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার বেশ খানিকক্ষণ পর মধুময় ঢুকল। সে ওদের ঠিক খুঁজে নিতে পারবে। এই কয়েক সপ্তাহে মধুময় অনুসরণ করার ব্যাপারে পুলিশের গোয়েন্দাদের চেয়েও দক্ষ হয়ে উঠেছে।

ছুটির দিন নয়, তাই বেশি ভিড় নেই। যারা এসেছে, তারা সবাই প্রায় প্রেমিক-প্রেমিকা। মধুময়ের সঙ্গেও স্বপ্না দু-বার এসেছে এখানে। স্বপ্নার সেসব কথা মনে পড়ছে না? কিংবা স্বপ্না মন থেকে মধুময়কে একেবারেই মুছে ফেলেছে?

স্বপ্না আর সুরজিৎ প্রথমে খানিকটা ঘুরতে লাগল এলোমেলো। সুরজিৎ এক একবার স্বপ্নার হাত ধরতে চাইছে আর স্বপ্না ছাড়িয়ে নিচ্ছে হাত। কিন্তু তার মুখে হাসি। খুব নীচু গলায় গান গাইছে স্বপ্না। সুরজিৎ তো রীতিমতো গায়ক, কিন্তু সে গান গাইছে না।

একবার ওরা ঢুকল একটা অর্কিড হাউসে! ওখানে মধুময় যেতে পারবে না। তাহলে নির্ঘাত ওদের চোখে পড়ে যাবে। বাইরে থেকে লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে মধুময় চোখ রাখতে লাগল ওদের ওপর। সুরজিতের চুমু-টুমু খাওয়ার বেশ ইচ্ছেই আছে মনে হয়। সে মাঝে মাঝেই স্বপ্নার কাঁধে হাত রাখতে চাইছে, কিন্তু স্বপ্না ঠিক সুযোগ দিচ্ছে না।

মধুময় বেশ উপভোগই করছে ব্যাপারটা। সে কখনও রাস্তাঘাটে মেয়েদের পিছু নেয়নি। আর এই প্রায় দু-মাস সে প্রথম একটি মেয়ের পিছু পিছু ঘুরছে, যার সঙ্গে তার অন্তত দশ বছরের নিবিড় পরিচয়। যাকে সে মনে করত সবচেয়ে আপন। অথচ সে স্বপ্নার সঙ্গে একটাও কথা বলছে না।

স্বপ্না বেড়াতে ভালোবাসে। মধুময়ের সঙ্গেও সে প্রায়ই বেড়াতে যেত। কিন্তু তখন কি স্বপ্নাকে এত খুশি খুশি দেখাত? এখন যেন স্বপ্না বেশি উজ্জ্বল।

অর্কিড হাউস থেকে বেরিয়ে স্বপ্না আর সুরজিৎ গেল ঝিলটার ধারে। এখানে নৌকো ভাড়া পাওয়া যায়।

স্বপ্নাই বলল নৌকো চড়ার কথা। সুরজিতের খুব-একটা ইচ্ছে নেই মনে হচ্ছে। বোধ হয় সে সাঁতার জানে না। কিন্তু সে-কথাটা স্বপ্নার কাছে বলতেও লজ্জা পাচ্ছে।

শেষপর্যন্ত সুরজিৎ রাজি হল। দরাদরি হল নৌকোওয়ালার সঙ্গে। দু-জনে নৌকোয় উঠেও বসল। হঠাৎ সুরজিৎ পকেটে হাত দিয়ে বলল, সিগারেট দেশলাইটা গাড়িতে ফেলে এসেছি!

স্বপ্না বলল, থাক, সিগারেট খেতে হবে না।

অনেকক্ষণ খাইনি। দৌড়ে গাড়ি থেকে নিয়ে আসব।

স্বপ্না বলল, না।

সুরজিৎ নৌকোয় চড়ার নার্ভাসনেস কাটাবার জন্য সিগারেট ছাড়া থাকতে পারবে না। সে এবার বলল, মানি ব্যাগটাও রেখে এসেছি গাড়িতে। নৌকোর ভাড়া দিতে হবে না?

স্বপ্না বলল, আমার কাছে পয়সা আছে।

সুরজিৎ বলল, তাহলেও মানি ব্যাগটা গাড়িতে ফেলে রাখা মোটেই ঠিক হবে না প্লিজ, এক্ষুনি আসছি।

আচ্ছা, নিয়ে এসো।

নৌকো থেকে নেমে দৌড় শুরু করার আগে সুরজিৎ ঠাট্টা করে বলে গেল, দেখো, আবার একলা একলা ভেসে যেয়ো না যেন।

স্বপ্না কিন্তু নৌকোয় বসে রইল না। সুরজিৎ চলে যেতেই নৌকো থেকে নেমে দ্রুত পায়ে একটা ফুলগাছের ঝোপের এপাশে এসে মধুময়ের মুখোমুখি দাঁড়াল।

তুমি কী চাও?

মধুময় একটুও চমকে যায়নি। সে সদ্য একটা সিগারেট ধরিয়েছে। সে ভাবছিল, সিগারেটের প্যাকেটটা সে সুরজিৎকে উপহার দেবে কিনা। বেচারা অত দূরে গাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে যাবে আসবে!

কিছু চাই না তো।

বেশি রাগ হলে স্বপ্না কেঁদে ফেলে। মধুময় জানে সে-কথা।

এখনও স্বপ্না কাঁদেনি অবশ্য। কিন্তু চোখ ছলছল করছে।

তুমি কেন সবসময় দিনের পর দিন, আমার পেছনে পেছনে ঘুরছ? তুমি কী ভাব, আমি তোমাকে দেখতে পাই না?

আমি যদি তোমায় দূর থেকে দেখতে চাই, সেটাও কি অপরাধ? তুমি তো আমায় বারণ করেছিলে তোমাদের বাড়িতে যেতে। সেখানে তো আর যাইনি আমি। এমনকী তোমাদের পাড়াতেও আমি যাই না–

কিন্তু আমি বলেছিলাম, আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তবু তুমি কেন আমাকে জ্বালাতন করছ?

জ্বালাতন! আমি বুঝতে পারিনি।

দিনের পর দিন সবসময় বোঝা যায় একজন কেউ নজর রাখছে তার ওপর, কেউ সহ্য করতে পারে?… এ রকম করলে আমি পাগল হয়ে যাব।

নজর রাখার জন্য নয়, আমি শুধু দূর থেকে তোমায় দেখতাম।

সেদিন ডায়মণ্ড হারবারে ওপারে লঞ্চ থেকে নামবার সময় একটা লোককে তুমি ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে। আমি জানি। লোকটা যদি মরে যেত!

সেই ছেলেটা তোমাদের অপমান করেছিল, দরকার হলে আমি ওকে মেরেই ফেলতাম… কি ট্রেনে সেই মাতালটা

তুমি বুঝি আজকাল খুন জখমও শিখেছ? সে তোমার যা খুশি করো… কিন্তু তোমায় কে অধিকার দিয়েছে আমায় ওপর পাহারাদারি করবার? আমার কোনো দরকার নেই!

মধুময় দ্রুত ভেবে নিল, হ্যাঁ, সত্যিই এখন দরকার নেই। এখন তো স্বপ্নার সঙ্গে সুরজিৎ থাকেই। কিন্তু সুরজিৎও যদি স্বপ্নার অমতে স্বপ্নাকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করত, তাহলে মধুময় নিশ্চয়ই সুরজিতের মাথাটা ভেঙে দিত।

স্বপ্না বলল, আমি যখন যেখানে যাই, সিনেমায়, বন্ধুর বাড়িতে, গানের ক্লাসে, সবসময় তুমি আমার পেছন পেছন ঘোরো। কেন।

মধুময় চুপ করে রইল।

আজও এখানে ঢোকার পরই আমি তোমায় দেখতে পেয়েছি। সবসময় পেছন পেছন কেউ আসছে, এটা জানতে পারলে মানুষের বেড়াতে ভালো লাগে? তোমার জন্য কি আমি বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দেব?

উত্তর না দিয়ে মধুময় ভাবল, মেয়েদের মাথার পেছনেও চোখ থাকে, সেইজন্য তারা দেখতে পায়। স্বপ্না জানে যে মধুময় তাকে দেখছে, সেইজন্যই কি সে সুরজিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেনি গাড়িতে? সেইজন্যই কি সে সুরজিৎকে চুমু খেতে দেয়নি।

মধুময় উত্তর দিচ্ছে না দেখে স্বপ্না আরও রেগে গেল। সে বেশ উঁচু গলায় বলল, তুমি অর্কিড হাউসের গরাদের ফাঁক দিয়ে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে ছিলে আমাদের দিকে। কেন? তুমি কেন এ-রকম ব্যবহার করছ আমার সঙ্গে?

স্বপ্না বোধ হয় এবার কেঁদেই ফেলবে। মধুময়ের একটা-কিছু বলা উচিত।

মধুময় খুব বিনীত গলায় বলল, আমার ভুল হয়েছিল। আজই শেষ, আর কোনোদিন তুমি আমায় দেখতে পাবে না।

স্বপ্না বাঁ-হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল।

স্বপ্না, তুমি কেঁদো না। আমি আর তোমায় কষ্ট দেব না। আমি তোমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। এবার আমার অন্য জীবন শুরু হবে।

দয়া করে তুমি আমায় মুক্তি দাও।

কথা দিলাম, তুমি আমায় আর কোনোদিন দেখতে পাবে না।

স্বপ্না চঞ্চল হয়ে দূরের দিকে তাকাল। মধুময় জানে, যত জোর দৌড়েই যাক সুরজিৎ এরমধ্যে ফিরতে পারবে না।

মধুময় বলল, আকাশ মেঘলা, হঠাৎ ঝড় উঠতে পারে, বেশিক্ষণ নৌকোয় থেকো না।

স্বপ্না ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, তোমার তা ভাববার দরকার নেই। আমার জন্য তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।

আচ্ছা।

স্বপ্না ঘুরে যাচ্ছিল, মধুময় হাত তুলে বলল, দাঁড়াও, আর একটা কথা

কী?

জেল থেকে আমি তোমায় তিনখানা চিঠি লিখেছিলাম, তুমি কি সত্যিই সেগুলো পাওনি?

না।

 সেই চিঠিতে আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম তোমার কাছে। আমি জীবনে একবার ভুল করেছি। তার জন্য কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না?

ভুলের প্রশ্ন নয়। সে হলে অন্য কথা ছিল। তুমি আমাকে সাংঘাতিক অপমান করেছ।

অপমান?

নিশ্চয়ই! তুমি রেল-ডাকাতি করতে গিয়েছিলে। সেটাকেও না হয় আমি একটা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে মেনে নিতাম। কিন্তু তুমি আমাকে না জানিয়ে গোপনে একটা খারাপ মেয়ের বাড়িতে রাত কাটাতে যেতে… তুমি আমাকে মুখে ভালোবাসার কথা বলে একটা বাজারের মেয়ের কাছে… ছি, ছি, ছি–

মধুময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বলো, তুমি সত্যি করে বলল, তুমি সেই মেয়েটার বাড়িতে রাত কাটাওনি? পুলিশ সেখান থেকে তোমায় ধরেনি? বলো, তুমি সেখানে যাওনি?

হ্যাঁ গিয়েছিলাম।

তোমার লজ্জা করে না। তারপরেও তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো!

আর আসব না। তুমি মুক্তি চাইলে, মুক্তি দিলাম।

গেট বেশ অনেকটা দূর, তবু এর মধ্যে সেখান থেকে ফিরে এসেছে সুরজিৎ। দূর থেকেই সে দেখেছে স্বপ্নাকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে গেছে তার।

স্বপ্না সুরজিতের হাত ধরে বলল, চলো।

কয়েক পা এগিয়ে একবার পেছন ফিরে মধুময়ের দিকে তাকিয়ে সুরজিৎ স্বপ্নাকে জিজ্ঞেস করল, কী বলছিল লোকটা? তোমার আগে থেকে চেনা?

স্বপ্না বলল, হ্যাঁ।

কে?

এমনিই চেনা, আমাদের আগেকার পাড়ায় থাকত।

 মধুময় তারপরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। সুরজিৎ আর স্বপ্নার নৌকোয় ওঠা দেখল। স্বপ্নার মুখখানা লাল। এখনও সে ভেতরে ভেতরে রাগে গজরাচ্ছে নিশ্চয়ই।

মধুময় ভাবল, স্বপ্না ভালো সাঁতার জানে। নৌকোটা যদি উলটেও যায়, স্বপ্নাই বাঁচিয়ে দিতে পারবে সুরজিৎকে। মধুময়ের সাহায্যের দরকার হবে না।

নৌকোটা ছেড়ে যেতেই মধুময় ফিরল।

গেট পেরিয়ে এসে পকেট থেকে বের করল বড়োমামার চিঠিখানা। কোনো দ্বিধা না করে সেটাকে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিল হাওয়ায়। অস্ফুট গলায় বলল, বিদায়! বিদায় মুম্বাই! ওই জীবন আমার চাই না!

বাসে চেপে খানিকটা গিয়ে আবার নেমে পড়ল মধুময়। একটা রিকশা নিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে তারপর এসে নামল গলির মধ্যে একটা দোতলা বাড়ির সামনে। সদর দরজা খোলা। মধুময় উঠে এল দোতলায়। একটা বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিল দু-বার।

মুক্তো বোধ হয় ঘুমোচ্ছিল তখন। ঘুম-চোখের বিস্ময় অনেক বেশি দেখায়।

কী গো, তুমি? তুমি আবার এসেছ! তোমার সাহস তো কম নয়।

মধুময় গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি আমায় চিনতে পেরেছ?

কেন চিনব না? তুমি তো সেই নাড়ুগোপাল! এসো ভেতরে এসো।

মধুময় বলল, না, ভেতরে যাব না। আমি তোমার কাছে দু-একটা কথা জানতে এলাম।

 মুক্তো বলল, ভেতরে এসো না। দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কথা হয়?

মধুময় তবু সেখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, তুমি কোর্টে দাঁড়িয়ে কেন বললে, তুমি আমায় চেন না? তোমার বলা উচিত ছিল, আমি তোমার সঙ্গে বিছানায় রাত কাটিয়েছি। আমার সঙ্গে চোরাই মাল ছিল। তুমি একথা বললে আমার নির্ঘাত জেল হত। তুমি কেন সত্যি কথা বলনি?

কেন, খুব জেল খাটার শখ হয়েছে বুঝি?

আমার শাস্তি পাওনা ছিল।

 মুক্তো মধুময়ের হাত ধরে টেনে জোর করে ঘরের মধ্যে এনে বলল, একটু বোসো না বাপু! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার কথা কী? চা খাবে?

না। আমি এক্ষুনি চলে যাব।

আহা রে, তোমার মুখখানা এত শুকনো কেন গো? কেউ বুঝি তোমার মনে দুঃখ দিয়েছে?

মধুময় জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, না না, কে আবার দুঃখ দেবে! আমি সহজে দুঃখ পাই না।

মুক্তো তার শরীরটাকে গ্রাহ্যই করে না। শায়া ও ব্রেসিয়ারের ওপর একটা পাতলা শাড়ি জড়ানো। মাঝে মাঝে আঁচলটা খসে যাচ্ছে বুক থেকে, সে সম্পর্কে তার কোনো হুঁশ নেই। আবার প্রলোভন দেখাবারও যে কোনো চেষ্টা নেই, তাও বোঝা যায়।

মধুময় মুক্তোর চোখে চোখ রেখে বলল, তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি আমায় চেন না! তবু তুমি আমায় বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলে কেন?

শোনো ছেলের কথা! কেন আবার কী? আমার ইচ্ছে হয়েছিল তাই!

পুলিশ তোমার ওপর অত্যাচার করেছিল?

 দু-চার ঘা চড়-চাপড় দিয়েছিল। ওরকম মার খাওয়া আমাদের চের অভ্যাস আছে। দাঁড়াও, চা বানাই।

না থাক, আমি চা খাব না।

বিয়ার-টিয়ার খাবে? আনাব?

কিছু না।

ওরে বাবা, তুমি যে দেখছি একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ! তা হঠাৎ এতদিন বাদে এসব কথা?

মধুময় বলল, তোমার কাছে আর একটা কথা জানতে চাই। আমি যদি আবার কখনো হঠাৎ অসময়ে এসে পড়ি, তুমি কি আমায় থাকতে দেবে?

মুক্তো মধুময়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তোমাকে আমি একটা কথা বলব? তুমি ও সব গুণ্ডামি বদমাইশির লাইনে যেয়ো না। ওসব তুমি পারবে না। তোমার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তুমি ভালো ছেলে।

মধুময় চোয়াল শক্ত করে মুখখানাকে নিষ্ঠুরের মতো করে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমায় তখন থাকতে দেবে কি দেবে না?

মুক্তো হাসতে হাসতে দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বলল, না!

মধুময় উঠে দাঁড়াল।

অমনি রাগ হল বুঝি? চলে যাচ্ছ যে?

মুক্তো মধুময়ের মাথায় চুলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে বলল, তুমি যখন খুশি চলে এসো আমার কাছে.. টাকা থাক-বা না থাক। সেসব চিন্তা করতে হবে না… তোমার মন খারাপ হলেই আমার কাছে চলে আসবে কেমন?

মধুময়ের হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। কান্না লুকোবার জন্যই সে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

বিকেল বেলা সাংঘাতিক ধুলোর ঝড় উঠেছিল, তারপর থেকেই একটানা বৃষ্টি পড়ে চলেছে। বছরের এই সময়টা লোকে ছাতা নিয়ে বেরোয় না, তাই রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। ধনা আর মধুময় এসে দাঁড়াল লাইটহাউস সিনেমার সামনে। সন্ধ্যে সাতটা বাজে।

অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওরা ঘুরে ঘুরে পছন্দ করতে লাগল গাড়ি। ধনা আবার প্লেট দেখেও বুঝতে পারে কোন গাড়িটা কত নতুন। শুধু চকচকে চেহারা দেখলে বিশ্বাস নেই।

একটা কচি কলাপাতা রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি পছন্দ হল ওদের। ভেতরে ড্রাইভার নেই।

মধুময় পরে আছে একটা ক্রিম রঙের সুট, গলায় টাই। এই পোশাকে সে কয়েকবার চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল। আজও একরকম ইন্টারভিউ দিতেই এসেছে। ধনা পরেছে পাজামা আর একটা ধার করা সিল্কের পাঞ্জাবি। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা।

কোটের পকেট থেকে একতাড়া চাবি বার করে মধুময় প্রথম চেষ্টাতেই খুলে ফেলল দরজাটা। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার আগে সে দরজাটা খুলে কয়েক মুহূর্ত বসে রইল চুপ করে। দেখা দরকার, কেউ কোনো প্রতিবাদ করে কিনা। এখান থেকে পালাবারও সুবিধে আছে, দৌড়ে কোনোক্রমে নিউমার্কেটের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলেই হল।

কেউ কিছু বলল না।

ধনা গাড়িতে ওঠেনি। সে খুব সপ্রতিভভাবে বলল, ব্যাক কর, ব্যাক কর। পেছনে অনেকটা জায়গা আছে।

মধুময় গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ব্যাক-গিয়ার লাগাল। খুব সহজেই বেরিয়ে এল গাড়িটা। মধুময় ঘুরিয়ে নিল ডান দিকে। তারপর সামনের সিটের দরজাটা খুলে দিতে ধনা উঠে পড়ল চট করে।

মধুময় অ্যাকসেলারেটারে চাপ দিল। সাঁ করে এগিয়ে আবার ঘুরল ডানদিকে লিসে স্ট্রিট দিয়ে এসে চৌরঙ্গি, তারপর পার্ক স্ট্রিটের উলটোদিকে ময়দানের রাস্তা। ধনার চোখেমুখে উল্লাস ফেটে পড়ছে একেবারে।

 দেখলি তো, কত সোজা!

মধুময় সত্তর-আশি কিলোমিটার স্পিডে রেড রোড দিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িটার পিক আপ ভালো। চালিয়ে আরাম আছে।

গঙ্গার ধার দিয়ে ওয়াটগঞ্জের দিকে ঘুরে মধুময় আবার ফিরে এল ময়দানে।

 ধনা বলল, একটু অন্ধকার দেখে গাড়িটা একবার থামা।

কেন?

আমার ঝোলাতে দুটো ফলস নাম্বার প্লেট আছে, সেগুলো লাগিয়ে দেব, তাহলে আর কোনো শালা কিছু করতে পারবে না।

তার দরকার নেই।

হ্যাঁ, অবশ্য সিনেমা ভাঙতে ভাঙতে আমাদের ডেলিভারি হয়ে যাবে। তার আগে তো কেউ আর খোঁজ করবে না। এখন চল, মল্লিকবাজারের দিকে।

আমার একটু ঘুরতে ইচ্ছে করছে, অনেকদিন বাদে গাড়ি চালাচ্ছি তো!

তোর হাত দারুণ মাইরি!

আরও আধঘণ্টা গাড়িটা নিয়ে গঙ্গার ধারেই ঘুরপাক খেল মধুময়। পেট্রোলের কাঁটাটা নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর বেশি ঘোরা যাবে না।

গাড়িটা এক জায়গায় থামিয়ে মধুময় আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, কাজটা সত্যিই খুব সোজা।

ধনা অতিরিক্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, তোকে বলেছিলাম না? কোন রিস্ক নেই। কোনো শালা ধরতে পারবে না!

মধুময় বলল, এবার ফেরার পালা।

ধনা বলল, সার্কুলার রোড দিয়ে সোজা বেরিয়ে চল মল্লিকবাজার।

মধুময় বলল, আজ মল্লিকবাজার যাব না।

ধনা বলল, তার মানে? তাহলে কোথায় যাবি? তুই এখন বেশি দেরি করলেই বিপদ। আমি সব কথা বলে এসেছি। গাড়ি ডেলিভারি দিলেই

আমি এখন গাড়িটা ফেরত রেখে আসব।

কী পাগলের মতো কথা বলছিস!

আজ ট্রায়াল দিলাম। দেখলাম, পারা যায় কি না। দেখা হয়ে গেল, এখনও শো ভাঙেনি … এখন গাড়িটা ঠিক জায়গায় রেখে এলে গাড়ির মালিক কিছু টেরই পাবে না।

কিন্তু গাড়িটা ফেরত রেখে আসবি কেন? এক্ষুনি গাড়িটা ডেলিভারি দিয়ে এলেই তো ক্যাশ চার হাজার টাকা। তোতে-আমাতে সমান সমান।

তোকে আমি বলেছিলাম না আমার একটা ব্ৰত আছে … এক মাস তেইশ দিন বাদে আমার যা ঠিক করার করব। তার এখনও তিন দিন বাকি। আমি এ লাইনেই যাব, কিন্তু সেই তিনদিন কেটে না গেলে কাজ শুরু করব না, আজ শুধু ট্রায়াল দিতে এলাম।

দেখ মধু, ইয়ার্কি করিস না, গাড়ি ঘোরা।

না ইয়ার্কি না। মাত্র আর তিনটে দিন ওয়েট করতে পারবি না? বললাম-না, আমার একটা ব্রত আছে।

ব্ৰত আবার কী? তুই মেয়েছেলে নাকি যে ব্রত করবি!

সত্যি অনেকটা যেন মেয়েছেলের মতো হয়ে গেছি রে। যাক, আর তো মোটে তিনটে দিন। আমি এককথার মানুষ রে ধনা! আমি যখন-তখন মত বদলাই না।

তা বলে, তুই গাড়ি ফেরত দিতে যাবি? পাগল ছাড়া কেউ একথা বলে? গাড়িটা এখানেই ফেলে রেখে যা।

তার দরকার নেই, এখনও অনেক সময় আছে।

ধনা চিৎকার করে উঠল, আমায় নামিয়ে দে। আমায় শিগগির নামিয়ে দে তাহলে।

 ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামিয়ে মধুময় হেসে বলল, ভয় পাচ্ছিস? তাহলে নেমে যা!

 ধনা নেমেই ছুটতে লাগল এবং তক্ষুনি মিলিয়ে গেল মাঠের অন্ধকারে।

মধুময় ঘড়ি দেখল। আটটা বাজতে পাঁচ, এখান থেকে লাইটহাউস পৌঁছোতে দু-তিন মিনিট লাগবে।

গ্র্যাণ্ড হোটেলের পাশ দিয়ে লাইটহাউসের গলিতে ঢুকতেই মধুময় দেখল সামনে প্রচুর ভিড়।

মধুময়ের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। এত ভিড় কেন? সিনেমা কি ভেঙে গেছে? তা তো হতেই পারে না। ইংরেজি সিনেমা অনেকসময় তাড়াতাড়ি ভাঙে, কিন্তু ছবিটা অনেক বড়ো, শেষ হবে আটটা কুড়িতে। ধনা আগে থেকে খোঁজখবর নিয়ে গেছে।

মধুময় একটা দিক শুধু খেয়াল করেনি। ধনারও মনে পড়েনি একথা। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে সিনেমা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মিনিট পনেরো আগেই হল থেকে বেরিয়ে এসেছে লোক।

মধুময় মেল ট্রেনের চেয়েও দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। এখন সে কী করবে? এখান থেকে গাড়ি ঘোরাবার উপায় নেই। মধুময় পেছন দিকে তাকাল। পেছনে গাড়ি এসে গেছে, সে ব্যাক করেও পালাতে পারবে না। এগিয়ে যেতে হবে সামনেই। কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যে দিয়ে… সে ধরা পড়ে যাবে… সে ধরা পড়ে যাবে… মধুময় প্রচন্ড জোরে হর্ন বাজাল।

কিন্তু ভিড় সরে গেল না। মধুময়ের মনে হল, সমস্ত লোকজন যেন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। যেন এক হিংস্র জনতা, আর প্রত্যেকেরই হাতে অস্ত্র। মধুময়ের সমস্ত শরীর কাঁপছে, শিরাগুলো যেন ফুলে উঠেছে, চোখ দুটো জ্বলছে। স্টিয়ারিংটা জোরে চেপে ধরল মধুময়। সে ঠিক করল, সে থামবে না, সে এইসমস্ত লোককে চাপা দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

কিংবা গাড়িটা এরোপ্লেনের মতো লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে নেওয়া যায় না? মধুময় থামবে না, কিছুতেই থামবে না…

মধুময় দরজা লক করে দিল, কিন্তু কাঁচটা তোলার সময় পেল না, তার আগেই জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ল অনেকগুলো হাত। একজন হিন্দিতে চেঁচিয়ে উঠল, এহি আদমি…

মধুময় কোনো কিছু কথা বলার সুযোগ পেল না। তার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নামানো হল বাইরে। অন্যান্য গাড়ির ড্রাইভাররাই বেশি হিংস্রভাবে এগিয়ে এল তাকে মারবার জন্য। বিরাট একটা শোরগোল চেঁচামেচির মধ্যেও যেন খুব সরু গলায় দু-এক বার শোনা গেল, না –না–না–!

সকলেই তার মাথা লক্ষ করে মারতে চায়। মধুময় এক হাতে মুখ চাপা দিয়ে আর এক হাতে মার ঠেকাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু একসঙ্গে অনেকে মিলে কিল ঘুসি চালানোয় মধুময় পা সোজা রাখতে পারল না। পড়ে গেল মাটিতে।

দু-এক জন ড্রাইভার লোহার হ্যাণ্ডেলও হাতে নিয়েছে।

শুয়ে থাকা অবস্থায় বেশিক্ষণ পড়ে থাকলে মার খেতে খেতে ওখানেই মরে যেত মধুময়। কলকাতার মানুষ মারতে ভালোবাসে।

এইরকম সময় অনেকের মধ্যেই এসে যায় খুন করার নেশা। কত লোকের কত ব্যাপারে রাগ জমে থাকে, সেইসব রাগ একসঙ্গে দপ করে জ্বলে ওঠে আগুনের মতো। সবাই মিলে এক জনকে খুন করলে কারুর মনেই খুনের অপরাধ লাগে না।

কিন্তু সে কিছুতেই জ্ঞান হারাবে না। ওই অবস্থাতেও সে যেন জপ করার মতন বলতে লাগল, আমি মরব না–আমি মধুময়–আমি বেঁচে থাকব।

ঠিক কোনো আরণ্যক প্রাণীর মতো মধুময় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর গাছপালা ভেদ করার মতো সে মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুঁ দিয়ে ছুটল, দু-হাতে মুখ ঢাকা। কেউ আটকাতে পারল না তাকে। কয়েকজন তাড়া করে এল অনেকটা। কিন্তু তার আগেই সে নিউ মার্কেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

নিউ মার্কেটের মধ্যেও কত মানুষ। সবাই যেন মধুময়ের শত্রু। মধুময় মাথাখারাপ বেড়ালের মতো ঘুরতে লাগল এদিক-ওদিক। তারপর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে আবার ছুটল।

দৌড়োতে দৌড়োতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, পার হয়ে একটা ছোটো পার্কে ঢুকে পড়ে জিরোতে লাগল মধুময়। একটুক্ষণ দম নেওয়ার পর সে মিলিয়ে দেখতে লাগল তার শরীরের সব কটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক আছে কি না। দুটো চোখ, দুটো কান, একটা নাক, দুটো হাত, দুটো পা–সব ঠিকই আছে। তবে দাঁত নেই ক-টা, মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে তখনও। দামি কোটটা ধুলো-রক্তে মাখামাখি। ঠোঁট ফুলে গেছে, মাথার পেছন দিকটায় দারুণ ব্যথা।

ধনা ঠিকই বলেছিল, গাড়িটা ফেরত দিতে যাওয়া ঠিক হয়নি। মাঠের মধ্যে ফেলে রাখলেই হত। মানুষের উপকার করতে নেই। সিনেমা দেখার পর লোকটার বাড়ি ফিরতে অসুবিধে হবে, সঙ্গে হয়তো কেউ-টেউ আছে–এই ভেবেই …।

কিন্তু চোরাই গাড়ির ডেলিভারি ব্যবসায় নেমে এসব কথা ভাবতে নেই, বুঝলে মধুময়– মধুময় নিজেকে এই কথা বলল। আর কয়েকদিন পর আমি এসব আর একদম ভাবব না। প্রত্যেক দিন অন্তত দু-খানা করে গাড়ি হাওয়া করে দেব!

গাড়ি চুরি করা সহজ, ফেরত দেওয়া কঠিন। মধুময় আর কোনোদিন এইরকম পাগলামি করবে না। আজকের মার খাবার ঘটনাটা চেপে যেতে হবে, ধনা যেন জানতে না পারে।

কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল মধুময়। গলা থেকে টাইটাও খুলে ফেলল। এসব আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। পার্কের মধ্যের ছোটো পুকুরটায় নেমে বেশ ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে নিল সে, একটা চিরুনি থাকলে ভালো হত, আঙুলগুলোই চিরুনির মতো করে চালিয়ে দিল চুলের মধ্যে।

ওপরে উঠে এসে কলকাতা শহরটাকে উদ্দেশ্য করে সে বলল, আর দু-দিন অপেক্ষা কর, তারপর মধুময় দত্ত দেখিয়ে দেবে সে কী! কেউ তার চুলের ডগাও ছুঁতে পারবে না। সে সারা শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে।

মধুময় বাড়ি ফিরল রাত প্রায় এগারোটায়। দেরি হলে, খাবার ঘরে ভাত ঢাকা থাকে। সে ভেবেছিল অন্য সবাই শুয়ে পড়লে সে চুপি চুপি ঢুকে পড়বে নিজের ঘরে। কিন্তু মা জেগে বসে আছেন খাওয়ার ঘরে। একা।

মধুময়কে দেখেই মা উঠে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বললেন, তুই এত দেরি করে ফিরলি। এদিকে আমি চিন্তায় চিন্তায় মরছি।

মধুময় মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে আছে। যাতে মা তার ফোলা ঠোঁটটা দেখতে না পান! স্বপ্না সেই কখন থেকে বসে আছে তোর জন্যে—

 মধুময় চমকে উঠল। স্বপ্না? এত রাত্তিরে স্বপ্না? সে তো অনেক দিন বাড়িতে আসেই না। — স্বপ্না?

হ্যাঁ!

 ওর কী হয়েছে?

তা আমি জানব কী করে?

আমায় কিছুই বলছে না। কাঁদছিল। তারপর বলল, তোর সঙ্গে দেখা না করে ও কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।

ভুরুর কাছেও চোট লেগেছে, তাই ভুরু কোঁচকাতে গিয়ে মধুময়ের ব্যথা লাগল। মধুময় ভেবে পেল না, স্বপ্না কেন এসেছে। স্বপ্না কি কোনো বিপদে পড়ে তার সাহায্য চায়? অথচ, স্বপ্নাই সেদিন বলেছিল, সে আর মধুময়ের মুখ দেখতে চায় না। সে পছন্দ করে না মধুময়ের পাহারাদারি।

মধুময় তো আজ সারারাত বাড়িতে নাও ফিরতে পারত। তা হলে কি স্বপ্না তার জন্য অপেক্ষা করত সারারাত?

মধুময় নিজের ঘরের দিকে এগোতেই মা সঙ্গে এলেন। মধুময় বলল, তুমি একটু এখানে বোসো। আমি আগে একটু আলাদা কথা বলে দেখি।

মা এতক্ষণ পর মধুময়কে লক্ষ করে বললেন, তোর মুখের এ কী চেহারা হয়েছে?

ও কিছু না!

ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢুকল মধুময়। না, স্বপ্না এখন আর কান্নাকাটি করছে না। একটা বই খুলে বসে আছে চোখের সামনে।

মধুময়ের এখন আর বুক কাঁপছে না। স্বপ্নাকে সে মন থেকে মুছে ফেলেছে। তার জীবনে আর স্বপ্নার প্রয়োজন নেই।

কী খবর? তুমি এত রাত্তিরে?

স্বপ্না উঠে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

এটাও কি মধুময়কে চমকে দেওয়ার জন্য? বাড়ির লোক নিশ্চয়ই কিছু ভাববে। এত রাত্রে স্বপ্না মধুময়কে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। সেই নীতি-বাতিকগ্রস্তা স্বপ্না!

স্বপ্না বলল, আমি সন্ধ্যের শো-তে লাইটহাউসে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।

এবার মধুময়ের না চমকে উপায় নেই। স্বপ্না তাহলে নিজের কোনো প্রয়োজনে আসেনি? স্বপ্না খুবই অহংকারী, সে কোনো প্রয়োজনের জন্য মধুময়ের কাছে সাহায্য চাইতে আসবে না।

মধুময়ও স্বপ্নার কথায় গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য বলল, সেখানে আমি অবশ্য তোমায় অনুসরণ করে যাইনি! আমি কথা দিলে কথা রাখি।

স্বপ্না বলল, আমার নিয়তিই বোধ হয় আমাকে আজ সন্ধ্যে বেলা ওখানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

মধুময় ঠাট্টার সুরে বলল, তাই নাকি? আমি নিয়তি মানি না।

 তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দেবে?

বলো।

 তুমি সেদিন বলেছিলে, এরপর থেকে তুমি অন্য জীবন শুরু করবে। সে কি এই জীবন?

 একটুও দ্বিধা না করে মধুময় বলল, হ্যাঁ।

স্বপ্না হঠাৎ বসে পড়ল মধুময়ের পায়ের কাছে। মধুময়ের হাঁটু চেপে ধরে বলল, আর একটা কথা শুধু বলব… সুরজিৎ দু-বার আমাকে চুমু খেয়েছে। আমি বাধা দিইনি, সেজন্য তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?

আজ অনেকগুলো চমকাবার অস্ত্র নিয়ে এসেছে স্বপ্না। মধুময় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে একেবারে। এ তো অন্যরকম স্বপ্না! একে যেন মধুময় চেনেই না!

সুরজিৎ তোমায় ভালোবাসে, সে তো তোমায় চুমু খেতেই পারে। এতে দোষের কী আছে?

আমি ওকে ভালোবাসি না। আমি ভুল করেছি। একবার ভুল করলে কি ক্ষমা করা যায়? তোমার কাছ থেকে এর উত্তর না জেনে আমি ফিরবই না।

মধুময় বলল, এসব গোলমেলে কথা তুলে আর লাভ কী? তুমি মুক্তি চেয়েছিলে, আমি মুক্তি দিয়েছি তোমায়। আর তো ক্ষমা-টমার প্রশ্নই ওঠে না।

স্বপ্না বলল, আমি মুক্তি কাকে বলে জানি না। আমাকে মুক্তি দেওয়া মানে কি ভুল জায়গায় ঠেলে দেওয়া?

সুরজিৎ খুব ভালো ছেলে।

হোক ভালো। কিন্তু ওর কাছে তো আমার আত্মার কোনো অংশ জমা নেই।

আমার কাছে আছে নাকি?

 তুমি জানো না?

আমি যদি লাইটহাউস সিনেমায় না গিয়ে এলিট সিনেমায় যেতাম, তাহলে আর তুমি নিশ্চয়ই আজ আমার কাছে আসতে না। উঠে দাঁড়াও!

তুমি আগে বলো, আমায় ক্ষমা করবে কি না? বলো, বলো, বলো, বলো–

মধুময় ক্ষীণভাবে হাসল। তারপর নীচু হয়ে স্বপ্নার দু-হাত ধরে বলল, ওঠো। তুমি ঠিকই বলেছ, নিয়তিই বোধ হয় আজ সন্ধ্যে বেলা আমাদের দুজনকে এক জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *