৫. রবিবার সকাল

রবিবার সকাল। অভিজিৎ বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিল, এমন সময় টেলিগ্রাম পিয়োন এল। টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে অসীম, বেনারস থেকে। পরশুরাতে তার মা মারা গেছেন। আরও দু সপ্তাহের ছুটি চেয়েছে।

টেলিগ্রামটা অফিসে না পাঠিয়ে বাড়িতে পাঠাল কেন? সম্ভবত আজ রবিবার বলে। তা ছাড়া অসীম একসময় প্রায়ই এবাড়িতে আসত। সেইজন্যেই বোধ হয় খবরটা ব্যক্তিগতভাবে অভিজিৎকে জানাতে চেয়েছে।

ছেলেটা মাকে খুবই ভালোবাসত। এখন একেবারে একা হয়ে পড়ল। অভিজিৎ ছেলেবেলাতেই মাকে হারিয়েছে বলে অসীমের জন্যে খানিকটা দুঃখ বোধ করল।

এত বড়ো একটা আঘাত পাওয়ার পরও অসীমকে আর একটা আঘাত পেতে হবে। মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকিয়ে অফিসে জয়েন করার পরই সে, বরখাস্তের চিঠি পাবে। আর তাকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। মিস্টার রক্ষিত এক মাস সময় দিয়েছিলেন–এর মধ্যে আর কিছুই করা যাবে না। সেদিনের সেই গোলমালের পর অভিজিৎ আর বাদল কিংবা নিখিলের সঙ্গে দেখা করেনি। তবে বাদল ফোন করে জানিয়েছে যে, রতনলাল চাড্ডা শিলিগুড়ি চলে গেছে, এক সপ্তাহের মধ্যে আসবে না।

অসীমের বরখাস্তের চিঠিটা অভিজিৎকে সই করতে হবে। সে তো অফিসটার মালিক নয়, কারুকে ছাঁটাই করার অধিকারও তার নেই। তবু এইসব চিঠিতে তাকেই সই করতে হবে কেন? ভাবনাটা অভিজিতের মনে খচ খচ করে বেঁধে। তার পক্ষে এখন সবচেয়ে ভালো উপায়, এই চাকরিটা ছেড়ে ন্যাশনালে যোগ দেওয়া। লোকে তো ভালো সুযোগ পেলে এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরি নেয়ই। এতে কেউ তাকে দোষ দেবে না। তাদের আপিসটার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ফুটো নৌকো ছেড়ে সবাই পালাতে চায়!

পরপর ক-দিন অভিজিৎ ঠিক সময় বাড়ি ফিরছে। একটুও মদ্যপান করে না। সুমিত্রা প্রথম দু-দিন অভিজিতের সঙ্গে কথা বলেনি। দু-একদিনের ব্যাপারে মোটেই বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু অভিজিৎ আর ভুল করেনি। সুমিত্রার মান ভাঙিয়ে সে বলেছে, আমাকে আর একটিবার সুযোগ দাও–অন্তত একবার।

সুমিত্রা সেই সুযোগ দিয়েছে। ক-দিন তার মনটা খুশি আছে।

সুমিত্রা এসে জিজ্ঞেস করল, কার টেলিগ্রাম?

অভিজিৎ নিঃশব্দে লাল কাগজটা এগিয়ে দিল সুমিত্রার দিকে।

সুমিত্রার মুখে স্পষ্ট একটা দুঃখের ছায়া পড়ল। সেও চেনে অসীমকে বলল, আহা! বেশি তো বয়েস হয়নি!

অভিজিৎ নির্লিপ্তভাবে বলল, এর চেয়েও বেশি দুঃখ অসীমের কপালে আছে।

কেন?

অভিজিৎ পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল সুমিত্রাকে।

সুমিত্রার নরম মন। সমবেদনায় তার মুখটা কুঁকড়ে গেল প্রায়। সে কাতর গলায় বলল, ইশ! এমন অন্যায় মানুষের ওপর মানুষ করে? এই সময়ে ওকে আরও সাহায্য করা উচিত

অভিজিৎ গ্রীবা উঁচু করে বলল, এখন আমার কী করা উচিত বলতে পারো?

 সুমিত্রা চট করে উত্তর দিতে পারল না।

অভিজিৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার নিজের বাঁচার রাস্তা আছে। আমি অনায়াসে কালই চাকরি ছেড়ে দিতে পারি। আমাকে বেকার বসে থাকতে হবে না। দু-তিন জায়গা থেকে আমার অফার আছে। সেসব জায়গায় আমি আর ম্যানেজার থাকব না অবশ্য, কিন্তু মাইনে একই থাকবে, কিছু বাড়তেও পারে।

সুমিত্রা বলল, ম্যানেজার না থাকাই ভালো। ম্যানেজারের যখন এত দায়িত্ব

ঠিক। তাহলে ন্যাশনাল থেকে তো আমাকে প্রায়ই ডাকাডাকি করছে, সেইখানেই ঢুকে পড়ি?

ন্যাশনাল তো এ বাড়ির থেকে আরও একটু কাছে–সেটাও ভালো হবে।

 তাও ঠিক, প্রত্যেকদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব। এটাই নিয়ে নিই, কী বলো?

নাও-না।

অভিজিৎ অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল জোরে। সে হাসি থামতেই চায় না। হাসিটা সে একা একা উপভোগ করছে। সুমিত্রা কিছুই মানে বুঝতে পারল না।

পৃথিবীতে কতরকম মজা আছে। আমি যদি ন্যাশনালে যোগ দিই আমার দায়িত্ব কমবে কিন্তু মাইনে বাড়বে। আমি রোজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব। আর মদ খেয়ে মাতলামি করব না। সবাই বলবে অভিজিৎ আজকাল ভালো হয়ে গেছে। তুমিও খুশি হবে। কিন্তু কেউ জানতে পারবে না, পুরোনো অফিসে আমার জন্যেই চারটে ছেলের চাকরি গেছে। অন্তত আমি চেষ্টা করলে তাদের চাকরি বাঁচাতে পারতাম।

এজন্য আমাকে কেউ দোষ দেবে না, কী বলো?

সুমিত্রা তখনও ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, তোমায় দোষ দেবে কেন? তোমার কি কোনো হাত আছে?

না নেই। কোম্পানিটা আমার নয়। ওদের চাকরি যাওয়ার জন্য আমি দায়ী নই। কিন্তু আমি এখনও চেষ্টা করলে ওদের চাকরি বাঁচাতে পারি।

তুমি সত্যিই ওঁদের চাকরি বাঁচাতে পারো?

 হয়তো পারি। সেজন্যে আমাকে জোগাড় করতে হবে নতুন কনট্রাক্ট। তার জন্যে আবার আমাকে গিয়ে ধরাধরি করতে হবে, কয়েকটা চোর আর বদমাশকে। তোষামোদ করে পায়ে তেল দিতে হবে অনেকদিন। কোনটা ভালো বলতে পারো?

সুমিত্রা স্তম্ভিত হয়ে রইল।

অভিজিৎ নিষ্ঠুরের মতন বলল, তুমি পারো না। তুমি আমাকে পথ দেখাতে পারো না। তুমি শুধু চাও আমি ভালো হয়ে উঠি, কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা কত নিষ্ঠুর জান না। ভালো হওয়া মানে স্বার্থপর হওয়া, তাই না? একটু আগে তুমি অসীমের জন্যে দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলে। তারপর আমি যেই আমার অন্য চাকরির কথা বললাম, তখন আর অসীমের কথা তোমার মনেও রইল না।

সুমিত্রা আস্তে আস্তে বলল, আরও তো কত লোক চাকরি করে, সবাইকে কি তোমার মতন এরকম খারাপ লোকের তোষামোদ করতে হয়? তাদের সঙ্গে বাধ্য হয়ে মদ খেতে হয়?

আমাকে বাধ্য হয়ে মদ খেতে হয় না। অনেক সময় আমি ইচ্ছে করেই মদ খাই। যখন আমি কোনো সমস্যার উত্তর খুঁজে পাই না। খুব কষ্ট হয়, তখন মদ খেতে ভালো লাগে। কষ্ট হলে তোমরা মেয়েরা কাঁদো, কেঁদে নিজেদের খানিকটা হালকা করো, আমি তো তখন কাঁদতে পারি না।

সব চাকরিতে এত সমস্যা থাকে?

জিনিসটা এড়িয়ে যেয়ো না। আমি এখন শুধু আমার সমস্যার কথাটা বলছি, এই ছেলেচারটির ভবিষ্যৎ নষ্ট করে আমি বাঁচতে পারি, বাঁচতে পারতাম, যদি আমার বিবেক বলে একটা-কিছু না থাকত! সারাজীবন আমার বিবেক খচ খচ করবে। রাস্তায়-ঘাটে অসীম কিংবা বাকি তিন জনের সঙ্গে কখনো দেখা হলে আমাকে পালিয়ে যেতে হবে!

এই সময় দরজায় বেল বাজল। সুমিত্রাই দরজা খুলে দিল। এবং অচেনা লোক দেখে বসতে বলে সে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, অভিজিৎ তাকে ডেকে বলল, সুমিত্রা যেয়ো না, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, ইনি প্রকাশ রায়চৌধুরী, ন্যাশনাল সি-ডি-পি-র ম্যানেজার। আর প্রকাশদা, এই আমার স্ত্রী। আপনি তো আগে কখনো আসেননি আমার বাড়িতে।

প্রকাশ রায়চৌধুরী হাত তুলে সুমিত্রাকে নমস্কার করে বলল, এসেছিলাম এদিকে, তোমাদের এই রাস্তার মোড়েই মিসেস সোম থাকেন–তারপর ভাবলাম তোমার এখানেও একটু ঢুঁ মেরে যাই।

সুমিত্রার দিকে ফিরে বলল, কফি খাব কিন্তু। চিনি দেবেন না। রসগোল্লা সন্দেশ আনবেন না, এমনকী বিস্কুটও আমি খাচ্ছি না। শুধু কফি।

প্রকাশ রায়চৌধুরীর বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, দারুণ মোটা চেহারা, প্যান্টের সঙ্গে বেল্ট পরেন, তবু বেল্ট ছাপিয়ে ভুড়ি বেরিয়ে আসছে। এরকম চেহারা হওয়া সত্ত্বেও চলাফেরায় বেশ একটা দ্রুততা আছে, সারাদিন ধরে অক্লান্তভাবে কাজ করতে পারেন। চুলে কলপ, বড়ো জুলপি, রঙিন জামা ছাড়া কিছু পরেন না।

সোফায় শব্দ করে বসে পড়ে বললেন, তুমি কাজ ছেড়ে দিচ্ছ তাহলে?

অভিজিৎ ভুরু তুলে বলল, প্রকাশদা, আপনি কি অন্তর্যামী। কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করছি বটে, কিন্তু আমার স্ত্রী ছাড়া কারুকেই বলিনি এপর্যন্ত। আপনি জানলেন কী করে?

হাহা করে হেসে প্রকাশ রায়চৌধুরী বলল, অন্তর্যামীই বটে। আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম। আর তুমি নিজেই ফাঁস করে দিলে!

আমি ভাবলাম, আপনি বোধ হয় এতক্ষণ আমাদের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের সব কথা শুনছিলেন।

ওটাই বাকি আছে এখনও। পরের বাড়ির দরজায় উঁকি মারার। তোমার কোম্পানির অবস্থা তো বেশ খারাপ শুনছি।

কিছুদিন একটু খারাপ চলছে।

বেশ তো, ওটা ছেড়ে তুমি ন্যাশনালে জয়েন করো, তোমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পোস্ট দেওয়া হবে।

আর দু-চারদিন ভেবে দেখি।

 শোনো, আমি নিজে মালিকদের কাছে তোমার নাম প্রস্তাব করেছি। মালিকরা অবশ্য তোমায় চেনে। এককথায় তারা রাজি হয়েছে। টাকাটা তুমি এখানে অনেক বেশি পাবে– সুতরাং তোমার আর আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না।

প্রকাশদা, তবু আমি একটু ভেবে দেখতে চাই!

আর ভাবাভাবির কিছু নেই। চলে এসো। রতনলাল চাড্ডার ওপর তোমার নাকি খুব হোল্ড আছে। ওদের নতুন কাজটা তুমি যদি আমাদের কোম্পানিতে আনতে পারো

অভিজিৎ প্রকাশ রায়চৌধুরীর মুখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল। প্রকাশদা ধানাই পানাই পছন্দ করেন না। প্রথমেই এসে কাজের কথা তুলেছেন। বিয়ার কোম্পানির কাজটার খোঁজ উনিও পেয়ে গেছেন। অভিজিৎকে দিয়ে সেই কাজটা ন্যাশনালের জন্যে বাগাতে চান। এদের কাছে সব খবরই চট করে পৌঁছে যায়।

অভিজিৎ বলল, প্রকাশদা, আমি পাবলিসিটি লাইনটাই ছেড়ে দেব ভাবছি।

কেন?

এটা আমার আর পোষাচ্ছে না। এরমধ্যে এতরকম নোংরামি

কোথায় নোংরামি নেই?

ভাবছি নিজেই কোনো ছোটোখাটো ব্যবসা-ট্যাবসা

তোমার দ্বারা হবে না। ব্যবসা যারা করে, তারা আলাদা ধাতুর লোক। তুমি কক্ষনো পারবে না। ওসব বাজে কথা ছাড়। পাবলিসিটি লাইনে যারা একবার ঢোকে, তারা আর কখনো বেরুতে পারে না।

আমাকে বেরুতেই হবে। এ জীবন আর আমার সহ্য হচ্ছে না।

তুমি আর অন্য কিছু পারবে না।

আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছি।

বেশ করছ। এখন ওঠো, জামাটা পরে নাও।

কেন?

আমার সঙ্গে বেরুবে। বড্ড গরম পড়েছে, চলো কোথাও বসে বিয়ার খেতে খেতে কথা হবে।

প্রকাশদা, আজ আর বেরুব না ভাবছি।

বেশ তো, তাহলে এখানেই বিয়ার আনাও। তোমার বউ আপত্তি করবে নাকি?

প্রকাশদা, আমি সত্যি মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।

বুঝেছি। মাঝে মাঝে এরকম মিডল-ক্লাস মরালিটি খোঁচা মারে। মিডল-ক্লাসের তো আর কিছুই নেই–শুধু কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ এই নিয়ে মাথা ঘামায়–এটা এক ধরনের বিলাসিতা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই বড়ো কথা–যে যত ভালোভাবে আর আরামে বাঁচতে পারে, সে সেই চেষ্টাই করে। এটাই নিয়ম। তবে কিছু লোক থাকে, যারা নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কথাই শুধু ভাবে না।

আলবাত আছে, সেরকম লোক। যেমন সাধুসন্ন্যাসী। তুমি সন্ন্যাসী হতে পারবে! শুধু মদ ছাড়লে কী হবে, তুমি খাও দামি সিগারেট, খুব আধুনিক ধরনের জামাকাপড় ছাড়া তোমার চলে না, ভিড়ের ট্রামে-বাসে তুমি কক্ষনো চড়ো না, গাড়ি কেনোনি কিন্তু কথায় কথায় ট্যাক্সি –এসব তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে। এইসব কিছু তুমি একসঙ্গে ছাড়তে পারবে? চেষ্টা করে দেখো, কত শক্ত। আর যদি সত্যিই পারো, আমি তোমাকে মহাপুরুষ বলে মানব।

চেষ্টা করতে অন্তত দোষ কী।

ফলাফলের কথা ভেবে, তবেই মানুষ চেষ্টা করে। শোনো, আমি জানি, তোমার এইসব মহৎ চিন্তা বড়োজোর এক-দিন-দু-দিন থাকবে। খুব বেশি হ্যাংগ-ওভার হলে এরকম হয়। নিশ্চয়ই দু-একদিনের মধ্যে খুব বেশি মাতলামি করেছ বাড়ি ফিরে! এ-হচ্ছে তারই অনুশোচনা। দু-একদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে–আবার সব আগের মতন। তুমি দু একদিনের সময় নাও, তারপর আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে? রতনলাল চাড্ডার কাজটা বাগানো দরকার।

না।

অভিজিৎ এমন তীব্রভাবে না বলল যে, প্রকাশ রায়চৌধুরী একটু চমকে উঠল। একটুক্ষণ অভিজিতের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করল।

তারপর বলল, না মানে?

ও কাজ আপনারা পাবেন না।

আপনারা মানেই বা কী? তুমি তো ন্যাশনালে আসছ, তাহলে ওটা তো আমাদের কাজ।

 আমি ন্যাশনালে যাচ্ছি কে বলল? আমি তো কথা দিইনি!

না আসার কী আছে? এখানে তুমি টাকাটা অনেক বেশি পাচ্ছ।

 প্রকাশদা টাকাটাই কি সব?

দু-দিন মদ খাওনি বলে কি, বোকা হয়ে গেলে? টাকার জন্যেই তো চাকরি–নইলে চাকরি করতে কার ভালো লাগে? সেইজন্যেই যেখানে বেশি টাকা পাওয়া যায় লোকে সেখানে চাকরি নেয়। অভিজিৎ, এটা তুমি বড্ড গোঁয়ারের মতন কথা বলছ।

সবাই জানে, আমি গোঁয়ার।

প্রকাশ রায়চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বেশ। তোমার মন আবার পালটালে আমাকে খবর দিয়ো। আজ তুমি হাই স্ট্রাং হয়ে আছ, দেখতেই পাচ্ছি।

দরজার দিকে এক পা বাড়িয়েও প্রকাশ রায়চৌধুরী আবার বসে পড়ে বলল, কফি! তোমার বউয়ের কাছে কফি খেতে চেয়েছি।

কিছুক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ রায়চৌধুরী পা দোলাতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকা তার স্বভাব নয়। একটু বাদেই আবার বলল, তুমি তাহলে ওই অফিসেই থাকছ? তোমাদের রাউরকেল্লার কাজটা নাকি মার খেয়েছে?

অভিজিৎ রুক্ষ গলায় বলল, প্রকাশদা, আজ রবিবার। ছুটির দিনে বাড়িতে বসে আমি অফিসের কথা আলোচনা করতে ভালোবাসি না।

প্রকাশ রায়চৌধুরী এবার সত্যিই অপমানিত বোধ করল। পাবলিসিটি মহলে সে একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক। তার সঙ্গে কেউ এরকমভাবে কথা বলে না।

সুমিত্রার হাত থেকে কফির কাপটা নিয়ে নিঃশব্দে পান করে বেরিয়ে গেল।

সুমিত্রা বলল, উনি রেগে চলে গেলেন মনে হচ্ছে? তুমি কিছু বলেছ।

অভিজিৎ হাসতে লাগল। অনেকটা পাগলের মতো হাসি। আজকাল মাঝে মাঝে এরকমভাবে একা একা হাসে। হাসতে হাসতেই বলল, ন্যাশনালেও আর চাকরি হবে না। সে-সুযোগটাও আমি ইচ্ছে করে নষ্ট করলাম।

কেন?

 সে তুমি বুঝবে না। সে তোমাকে বোঝানো যাবে না।

 সারাদিন অভিজিৎ বাড়ি থেকে বেরোল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সস্তা ইংরেজি রহস্য কাহিনি পড়ল। সন্ধ্যের দিকে সুমিত্রাকে নিয়ে সিনেমায় গেল। তারপর বাইরের দোকানে চীনে খাবার খেল। এমন দোকানে ঢুকল, যেখানে মদ নেই। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। সুমিত্রা ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেকক্ষণ তার ঘুম এল না। মাথার মধ্যে সব-সময়েই সেই এক চিন্তা। রতনলালের কাছ থেকে কাজটা আদায় করতেই হবে। ন্যাশনাল যেন কিছুতেই না পায়। এটা একটা চ্যালেঞ্জ অথচ কাজটা আদায় করতে তার গায়ে কতখানি ময়লা লাগবে?

পরদিন অফিসে যাওয়ার সময় সে শেলি দত্তকে আবার দেখতে পেল। মেয়ের হাত ধরে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হয়, মা আর মেয়ে দু-জনেই একসঙ্গে বাসে উঠবে।

শেয়ারে ট্যাক্সি ছিল না বলে অভিজিৎ সেদিন আলাদা একটা ট্যাক্সি নিয়েছে। ওদের কাছে এসে সে ট্যাক্সিটা থামাতে বলে শেলি দত্তকে ডাকল, আসুন, চটপট উঠে পড়ুন।

শেলি দত্ত চমকে গেল, কিন্তু দ্বিধা করল না। মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়ল। অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়ের ইস্কুল কোথায়?

এই তো, এলগিন রোডে।

অভিজিৎ মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কোন ক্লাসে পড়ো?

মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। চট করে উত্তর দিল, ক্লাস থ্রি।

বা:! বেশ উঁচু ক্লাসে পড়ো তো! তোমার নাম কী?

 অসীমা মজুমদার।

অভিজিৎ মুচকি হাসল। শেলি দত্তের মেয়ের নাম অসীমা মজুমদার। বেশ! সে আগেই বুঝেছিল যে, শেলি দত্ত নামটা ছদ্মনাম। শেলি দত্তও অভিজিতের হাসির কারণটা বুঝতে পেরেছে সে মুখ ফিরিয়ে রইল অন্যদিকে।

এলগিন রোড না আসা পর্যন্ত অভিজিৎ আর কোনো কথা বলল না। মেয়েটি স্কুলে নেমে যাওয়ার পর শেলি দত্তকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোন দিকে যাবেন?

আমাকে একটু ধর্মতলায় নামিয়ে দিয়ে যেতে পারবেন?

পারব! আপনার আসল নাম কী?

নাই বা জানলেন।

বাড়িতে আর কে আছে?

আমার আর একটি ছেলে আছে, মা আছেন, একটি ছোটোবোন।

 আপনার স্বামী?

 উনি পাগল।

শেলি দত্তের শরীরে যৌবন আছে, মুখখানি সুশ্রী, তার এরকম দুর্ভাগ্য প্রাপ্য ছিল না। বাড়িতে রোজগারের কেউ নেই বোঝা যাচ্ছে। পাগল স্বামীকে নিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাট, এর চেয়ে লোকটি মরে গেলেও বোধ হয় ভালো ছিল।

অভিজিতের মুখ দিয়ে আর একটা প্রশ্ন এসে যাচ্ছিল, আপনি চাকরি করতে পারেন না? কিন্তু সেটা বলল না। এর উত্তরেই যদি মেয়েটি বলত, আপনি একটা চাকরি দেবেন? তাহলে সে কী উত্তর দিত?

শেলি দত্তের মুখে একটা দুঃখ ও অপরাধবোধ আছে। বোঝা যায়। সে একটা সাধারণ সুস্থ জীবনই চেয়েছিল। রতনলাল চাড্ডার চাপড় মারার জন্যে সে নিজের ঊরু ব্যবহার করতে দিতে সহজে রাজি হয়নি নিশ্চয়ই। অনেক অন্ধকার পথ তাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে। এ মেয়েটি ঠিক কেতকীর মতন নয়। কেতকী যেরকম জীবন পেয়েছে তাতেই সে বেশ খুশি। কিন্তু শেলি দত্ত খুশি নয়। এখনও হয়তো সে সুযোগ পেলে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু কে তাকে সেই সুযোগ দেবে?

অভিজিতের মনে পড়ল প্রকাশদার কথাটা। এসব মিডল-ক্লাস সেন্টিমেন্ট। মিডল ক্লাসই ভালো আর মন্দ নিয়ে বড়ো বেশি চিন্তা করে। পাগল স্বামী আর ছেলে-মেয়ে সংসার নিয়ে শেলি দত্ত ঘোর বিপদের মধ্যে পড়েছে। সে যদি সতী থাকার জন্য ছেলে-মেয়েকে না খাইয়ে রাখত–সেটা ভালো হত? তার যখন কোনো উপায় নেই, তখন মাঝে মাঝে ঊরু ভাড়া দেওয়া এমন আর দোষের কী? সতীত্ব জিনিসটাই তো মাত্র কয়েকশো বছরের তৈরি একটা সংস্কার। তাও পৃথিবীর অনেক দেশেই সেটা এখন উঠে যাচ্ছে আবার।

শেলি দত্তের ওপর কোনো রাগ হয় না অভিজিতের। সেদিন কেতকীর ওপরেই বা সে অত রেগে গিয়েছিল কেন? বার বার তাকে খুন করার কথা বলছিল, কোনো মানে হয় না! তবে, রাগ হয় রতনলালের মতন মানুষদের ওপর। টাকা আছে বলেই সে, একটা মেয়ের ঊরু চাপড়াবার অধিকার পাবে?

হঠাৎ অভিজিতের একটা কথা মনে পড়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, রতনলাল কবে কলকাতায় ফিরবে বলতে পারেন?

তিন তারিখ, তার মানে পরশু।

রাত্তিরে?

না, সকালের প্লেনে।

রাত্তিরে ওর ফ্ল্যাটে আপনার যাওয়ার কথা আছে?

হ্যাঁ।

আপনি কি ওর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করেন?

না, উনি কলকাতায় থাকলে আমি রোজই যাই।

অভিজিৎ চুপ করে গেল। তবু শেলি দত্ত নিজের থেকেই বলল, তবে আর বেশিদিন বোধ হয় আমাকে যেতে হবে না।

কেন?

আমার যে ছেলেমেয়ে আছে, উনি বোধ হয় জেনে ফেলেছেন। উনি কুমারী মেয়ে ছাড়া পছন্দ করেন না। আর, একটি মেয়েও খুব ঘোরাঘুরি করছে।

অভিজিৎ হেসে উঠল, তার সেই পাগলাটে ধরনের হাসি। শেলি দত্তের মুখের ওপর স্থিরদৃষ্টি রেখে সে হাসতে থাকে। তারপর হাসি থামিয়ে সে বলল, আর একটি মেয়ে বুঝি আপনার কাছ থেকে আপনার মক্কেল কেড়ে নিতে চাইছে? আপনাদের লাইনেও খুব কম্পিটিশান আছে!

শেলি দত্ত লজ্জা পেল না। বরং তিক্ত গলায় বলল, তা তো হবেই, আমার মতন অভাবী মেয়েও তো কম নেই এদেশে।

অভিজিৎ একথাটা মন দিয়ে শুনল না। সে অন্য কথা ভাবছে। প্রকাশদাও তো কাল এসেছিল রতনলালকে হাত করার জন্যে। প্রকাশদাও চাইছে অভিজিতের কোম্পানির বদলে ন্যাশনালের জন্যে রতনলালকে কেড়ে নিতে। অন্য দুটি বেশ্যার চেয়ে তার আর প্রকাশদার তফাত কী? ব্যাপারটা তো একই।

অভিজিৎ মনে মনে হাসতে লাগল।

ধর্মতলায় শেলি দত্তকে নামাতে গিয়ে অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, আপনার কি খুব তাড়া আছে? চলুন না, কোথাও বসে একটু চা খাই।

শেলি দত্ত একটু চিন্তা করে বলল, বেশ, চলুন।

অভিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে বলল, না থাক। আজ নয়, অন্য একদিন।

শেলি দত্তের সঙ্গে চা খাবার একটুও ইচ্ছে তার নেই। সে শুধু দেখতে চাইছিল মেয়েটি রাজি হয় কি না।

শেলি দত্ত ট্যাক্সি থেকে নেমে, অভিজিৎকে শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। তার ভুরু থেকে এখনও বিস্ময়ের চিহ্ন মেলায়নি।

অভিজিৎ একবার চা খাওয়ার কথা বলেও আবার মন বদলে ফেলল কেন, সে সেটা বুঝতে পারেনি। সে ধরেই নিয়েছিল, অভিজিৎ যখন তাকে ট্যাক্সিতে লিফট দিয়েছে, তখন তার বদলে কিছু চাইবে।

কোনো রেস্টুরেন্টের কেবিনে বসে অন্তত কিছুক্ষণ জড়াজড়ি–পুরুষমানুষের কাছ থেকে সে এইরকম কিছু আসা করে।

যতক্ষণ দেখা যায়, অভিজিৎ জানলা দিয়ে শেলি দত্তের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি এ সময় এ পাড়ায় কোথায় গেল? সে কি কোনো চাকরি করে? মনে তো হয় না। চাকুরে মেয়েদের হাঁটার ভঙ্গি আলাদা হয়। শেলি দত্ত হাঁটছে খুব অলসভাবে যেন আর কোনো তাড়া নেই। সে কি দিনের বেলাতেও আরও কোথাও কোথাও তার ঊরু ভাড়া দেয়?

অভিজিতের আবার মনে হল, এই মেয়েটির একটা সুস্থ সুন্দর জীবন প্রাপ্য ছিল। ও কেন রতনলালের কাছে যাবে? একদিন ওর মেয়ে বড় হয়ে যদি এসব কথা জানতে পারে? ওকে এখনও ফেরানো যায় না?

অভিজিৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এসব মৌখিক চিন্তা! শেলি দত্তকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই তার নেই। সে কি অসীমদের চাকরি বাঁচাতে পারবে?

অফিসে এসে অভিজিৎ কাজে মন বসাবার চেষ্টা করল! মিস্টার রক্ষিত দিল্লি গেছেন, দিন দশেক বাদে ফিরবেন। তারপরেই অফিসে অনেক ওলটপালট হবে! অফিসে তার ঘর আলাদা। উলটো দিকের বড়া হলঘরটার বেশিরভাগ কর্মী বসে। তারই এক পাশে আর্ট ডিপার্টমেন্ট। অসীমের খালি চেয়ারটার ওপর বারবার চোখ পড়ে অভিজিতের। এ ছাড়া, রঞ্জন, নিশীথ আর সুকুমার। ক-দিন ধরে একটু বেশিই যেন দেখা হচ্ছে ওদের সঙ্গে। কাজের জন্য ওরা ঘন ঘন আসছে অভিজিতের ঘরে। ওরা কি কিছু সন্দেহ করে?

সুকুমার তার ঘরে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি কি এখন খুব ব্যস্ত আছেন?

 অভিজিৎ ভয় পেয়ে গেল। কী বলতে এসেছে সুকুমার?

শুকনো ভাবে সে বললে, না তেমন ব্যস্ত নয়, কী ব্যাপার?

সুকুমার ভেতরে ঢুকে বলল, আপনি শুনেছেন বোধ হয়, আমরা বই ঠিক করে ফেলেছি।

অভিজিৎ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, কিছুই মানে বুঝতে পারল না। বই ঠিক করেছি মানে? তারপর তার মনে পড়ল, থিয়েটার। স্টাফেরা প্রতি বছরই একটা থিয়েটার করে। সেই সম্পর্কে কিছু বলতে এসেছে।

অভিজিৎ একটু বিরক্ত হল, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আছে, আরও তো অফিসার আছে, তবু সব ব্যাপারেই এরা তাকে বলতে আসে কেন?

সুকুমার বলল, আমরা হল ভাড়া করেছি, আর মাত্র চোদ্দো দিন সময়, তাই অন্তত দু ঘণ্টা রিহার্সাল না দিলে

বেশ তো!

কাজ তো এখন বেশি নেই, তাই চারটে থেকে যদি রিহার্সাল শুরু করি

অভিজিৎ এবার কঠোরভাবে বলল, না। পাঁচটার আগে নয়।

তাতে বড্ড দেরি হয়ে যায়। দু-একজনকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে হয়।

তা হোক। পাঁচটার আগে ওসব কিছু চলবে না। অফিসের একটা ডিসিপ্লিন আছে তো। বাইরে থেকে হঠাৎ একজন লোক এলে ভাববে কী? অফিসের মধ্যে নাটক হচ্ছে!

সুকুমার কাঁচুমাচু মুখে তবু দাঁড়িয়ে রইল। অভিজিৎ তাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বলল, সামনের সপ্তাহে তো দুটো ছুটির দিন আছে, তখন বেশি সময় পাবে।

সুকুমার চলে গেল। সে একটু আদুরে ধরনের ছেলে, প্রায়ই নানারকম আবদার করতে আসে। নাটকের ব্যাপারে ওরই বেশি উৎসাহ। কয়েকদিন বেশ হইচই হয়। এ-অফিসে কোনো মেয়ে-কর্মী নেই, তাই অভিনেত্রী ভাড়া করে আনতে হয় বাইরে থেকে তাদের সঙ্গে খানিকটা ফষ্টিনষ্টি…

সুকুমার জানে না তার মাথার ওপর কীরকম খাঁড়া ঝুলে আছে। নাটক নিয়ে মত্ত, অথচ ক-দিন বাদেই চাকরি যাবে, সুকুমার কাজ খুব ভালো শেখেনি, অন্য কোথাও চাকরি পাওয়া তার পক্ষে বেশ শক্ত হবে।

কী একটা উপলক্ষ্যে যেন সুকুমারদের বাড়িতে একবার নেমন্তন্ন খেতে যেতে হয়েছিল অভিজিৎকে। সুকুমারের বাড়ি ব্যারাকপুর, ট্রেনে যাতায়াত করে। সুকুমারের একগাদা ভাই বোন, ওর বাবা একটা সামান্য চাকরি করে। সুকুমার প্রায় সাড়ে সাত-শো টাকার মতন পায়, হঠাৎ সেই আয় বন্ধ হয়ে গেলে কী করে চলবে ওদের সংসার?

একসময় নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠল অভিজিৎ। অন্যের সংসার কী করে চলবে, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা কেন? সে ওরা বুঝবে, আরও তো কত লোকের চাকরি যায়, সেজন্যে অভিজিৎ কি দায়ী!

তিন-চারদিন ধরে মদ খাচ্ছে না বলেই বোধ হয় অভিজিতের মাথায় এইসব চিন্তা আসছে। রাত্তিরে খুব বেশি মদ্যপান করলে পরদিন সকালে অনেকক্ষণ পর্যন্ত মাথা টলটলে হয়ে থাকে। সেই অবস্থাটা কাটতে না কাটতেই আবার মদ খাওয়ার সময় চলে আসে, তখন আর অন্যের ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় থাকে না। এখন অভিজিতের মাথাটা পরিষ্কার, তাই ঘুরেফিরে মাথায় নানারকম চিন্তা আসছে।

অনেক চেষ্টা করেও অভিজিৎ তার মাথা থেকে ওই চার জনের কথা তাড়াতে পারল না। মিস্টার রক্ষিত দিল্লি থেকে ফিরলেই অভিজিৎকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এদেশে আরও চার জন বেকারের সংখ্যা বাড়বে। অভিজিতের কিছু করার নেই। অভিজিৎ তো আর ওদের ভাগ্য বদলাতে পারে না।

কিংবা পারে। জীবনে এই প্রথম অভিজিৎ এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছে, যেখানে অনেকটা তার ওপরেই চার জন পুরুষমানুষের ভালো-মন্দ নির্ভর করছে। সে রতনলালের কাজটা জোগাড় করতে পারলে ওদের চাকরি বাঁচবে। তার জন্যে রতনলালকে তোষামোদ করতে হবে। অভিজিৎকে অনেকটা নীচে নামতে হবে। ছেলে-মেয়ের মুখ চেয়ে শেলি দত্তকে যেমন অসতী হতে হয়েছে। শেলি দত্ত যদি পারে, অভিজিৎ-ই বা কেন পারবে না?

পার্ক সার্কাসের একটা বারে ঢুকে অভিজিৎ ঠিক তিন পেগ হুইস্কি খেল। এর বেশি আর খাবে না, সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল। এইটুকু দরকার তার শরীরটাকে চাঙ্গা করার জন্যে। সাহস আনার জন্যেও বটে।

তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে সে চলে এল কেতকীর ফ্ল্যাটে। বেল বাজাবার পর দরজা খুলে দিল একটি বাচ্চা চাকর। ভেতরে বসবার ঘরে সোফার ওপরে আধশোওয়া অবস্থায় রয়েছে নিখিল, গেঞ্জি আর পাজামা পরা। গভীর মনোযোগ দিয়ে সে কিছু কাগজপত্র দেখছে।

অভিজিৎকে দেখে সে খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। শুকনোভাবে বলল, কী রে, অভিজিৎ? খবর ভালো? কেতকী তো নেই। যেন অভিজিৎ কেতকীকেই খুঁজতে এসেছে। নিখিল একথা ভাবল কী করে? সে একা কেতকীর সঙ্গে দেখা করতে আসবে?

তবু ওর কথার উত্তরে বলল, কেন, কোথায় গেছে?

নিখিল বলল, কী যেন ওর মাসি না ফাসি কার বাড়িতে গেল! বলেছিল তো সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরবে! তুই বোস, ও ফিরল বোধ হয়।

তুই বম্বেতে কবে ফিরবি?

 ঠিক নেই।

ছুটি নিয়েছিস অফিস থেকে?

 অফিস! ওঃ হ্যাঁ, লম্বা ছুটি নিয়ে রেখেছি–বোধ হয় অফিসটা ছেড়েই দেব।

তোকে এবার যে-কাজে ব্যস্ত দেখছি, তার সঙ্গে তোর আগেকার অফিসের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই।

তা ঠিক। তুই তাহলে বোস, আমি এই জরুরি কাগজগুলো একটু দেখে নিই।

 নিখিল, আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আমার সঙ্গে? কী কথা বল!

তুই আমার ওপর চটে আছিস মনে হচ্ছে? সেদিন একটু বেশি মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম

সে কিছু নয়। তুই কিছু বলবি আমাকে?

আমার জানতে ইচ্ছে করছে, সে-দিন সেই যে রাস্তায় তোদের সঙ্গে হঠাৎ আমার দেখা হল, সে-দিন প্রায় জোর করেই তুই আমাকে রতনলালের ফ্ল্যাটে হঠাৎ নিয়ে গেলি কেন?

তোকে দেখে আমার একটা কথা মনে পড়েছিল। আমরা একটা বড়ো প্রোজেক্টে হাত দিয়েছি। এর থেকে তোকে কিছু কাজ পাইয়ে দেওয়া যায়। আমাদের তো পাবলিসিটি করতেই হবে। পুরোনো বন্ধুকে কি মানুষ সাহায্য করে না?

কিন্তু নিখিল, আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন ছিলাম খানিকটা আদর্শবাদী ধরনের, সৎ মানুষ। এখন আস্তে আস্তে আমরা কোথায় চলে যাচ্ছি? টাকাপয়সা রোজগারের জন্যে আমরা বোধ হয় এখন নরকেও নামতে রাজি।

তুই টাকাপয়সা চাস না?

 চাই, কিন্তু

সন্ধে বেলা তুই কি আমাকে রামকৃষ্ণদেবের বাণী শোনাতে এসেছিস? কাজের কথা বল!

কাজের কথাই বলতে এসেছি। তোদের ওই কাজটা আমার চাই।

তবে ওদের আদর্শ-ফাদর্শের কথা বলছিলি কেন? টাকাপয়সা নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে, তারা সবাই এক-একটা বাস্তুঘুঘু। অনেক চেষ্টা করে ওদের কাছ থেকে ছিটেফোঁটা আদায় করা যায়। আদর্শ-ফাদৰ্শর কথা তুললেই ওরা তোর ঘাড় মটকাবে। ইফ ইউ কানট বিট দেম, জয়েন দেম! এই হচ্ছে আমার মোটো। তুই কী চাস, আগে মত ঠিক কর।

নিখিল, তুই আগে অন্যরকম ছিলি। এখন অনেক বদলে গেছিস!

তার মানে, খারাপ হয়ে গেছি?

তুই এখন যেসব লোকের সঙ্গে মিশিস-যারা তোর বন্ধু, তারা তো সব ভয়ংকর লোক।

আমার তো ভয়ংকর মনে হয় না। তা ছাড়া সবাই বদলায়। তুই বদলাসনি? যে-অভিজিৎ এককালে ছিল কত শান্তশিষ্ট, সে যে এ-রকম মাতাল হবে, কে ভেবেছিল? যাই হোক, তুই তাহলে ওই কাজটা করতে পারবি না?

আমি ওই কাজটা চাই। আমাকে পেতেই হবে!

 কিন্তু দুর্বল লোক হলে আমাদের কোনো কাজ হবে না। তুই মাঝে মাঝে এত উলটোপালটা কথা বলিস কেন? ওখান থেকে দুটো গেলাস নিয়ে আয়।

আমি মদ খাব না।

খানিকটা তো খেয়ে এসেছিস দেখছি, গন্ধ পাচ্ছি।

সে সামান্য একটু।

 ভয় পাবার কিছু নেই। যতটা ইচ্ছে হয় খাবি। কিন্তু এত আউট হয়ে যাস কেন? তখন বড্ড আজেবাজে কথা বলিস!

সেইজন্যেই তো কম খাব। তুই যা বলবি তাই শুনব।

 নিখিল নিজেই উঠে গিয়ে গেলাস নিয়ে এল। দু-টি গেলাসে হুইস্কি ঢালল। তারপর বলল, তোর মুখটা এত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন রে অভিজিৎ? কী হয়েছে, শরীর খারাপ?

না তো!

 তবু কীরকম যেন দেখাচ্ছে।

অভিজিতের ঠোঁটে ও চোখে অভিমান জমে উঠল। নিখিল তার পুরোনো বন্ধু। কিন্তু আজ নিখিল তার সঙ্গে কথা বলছে হুকুমের সুরে। কোনো বন্ধুবান্ধবই আগে এভাবে অভিজিতের সঙ্গে কথা বলার সাহস করেনি। তবু অভিজিৎকে সব মেনে নিতেই হবে, কারণ সে কাজের উমেদার হয়ে এসেছে।

মদের গেলাস সে স্পর্শও করল না। আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, রতনলাল আজ কলকাতায় ফিরবে শুনেছি–আজ তার সঙ্গে দেখা করা যায়?

কার কাছ থেকে শুনেছিস?

সে-দিন যে-মেয়েটিকে ওখানে দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আজ সকালে রাস্তায় দেখা হল, সে-ই বলল

রতনলালের মেয়েদের সঙ্গে তুই কি আলাদা করে বাইরে দেখা করছিস নাকি?

না না, এমনি হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

ওদের কোনো কথায় বিশ্বাস করবি না।

রতনলাল তাহলে আজ ফিরছে না?

হ্যাঁ, আজ ফিরবে। কিন্তু আজ আর আমি ওখানে যাব না। কাল-পরশু গেলেই হবে। আমি মুম্বাই থেকে একটা টেলিগ্রামের জন্যে অপেক্ষা করছি।

বাবুভাই লোকটা কে রে নিখিল?

একজন বড়ো ব্যবসায়ী। এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের ব্যবসা।

একইসঙ্গে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট?

 হ্যাঁ, সহজ ভাষায় যাকে বলে স্মাগলিং।

আর রতনলাল তার শাকরেদ?

 হ্যাঁ। কেন, তুই ভয় পাচ্ছিস?

বিবর্ণ মুখখানাতে জোর করে হাসি ফুটিয়ে অভিজিৎ বলল, না না। ভয় পাব কেন? আমার হচ্ছে কাজ নিয়ে কথা। আচ্ছা নিখিল, ওই কাজটার ব্যাপার আজ পাকা করে ফেলা যায় না। নইলে আমাদের অফিসে মহাগোলমাল হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি, যা কমিশন পাব, তোকে তার অর্ধেক দিয়ে দেব।

নিখিল হাসতে হাসতে বলল, তুই কি আমাকেও ঘুস দিতে চাইছিস নাকি? আমি নিজেই তো তোকে কাজটা দেওয়ার জন্যে নিয়ে গেলাম। আমি নিজের স্বার্থের কথা ভাবিনি, তোর উপকারই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এত তাড়াহুড়োর কী আছে?

এক্ষুনি একাজটা না পেলে আমাদের অফিসে ছাঁটাই শুরু হয়ে যাবে।

তোর চাকরির ভাবনা কী? তুই ঠিক কাজ পেয়ে যাবি।

 আমার জন্যে নয়।

শোন, ফ্যাক্টরিটা আমরা স্টার্ট করে ফেলছি সামনের মাসেই কিন্তু প্রোডাকশন শুরু করে বাজারে মাল ছাড়তে অন্তত একবছর লেগে বাবে। তখন দরকার হবে পাবলিসিটির। মাসে আড়াই লাখ টাকা বাজেট ধরেছি, আর একটু বাড়তে পারে, কিন্তু এক্ষুনি তাড়াহুড়ো করার তো কিছু নেই।  

এবার অভিজিতের বুকের মধ্যে একটা ঘা লাগল! এক বছর! কাজ শুরু হবে এক বছর পরে! তাহলে আর অসীমদের চার জনকে বাঁচানো গেল না! আর চেষ্টা করেও লাভ নেই।

প্রায় শুকনো গলায় সে বলল, এতদিন দেরি হবে?

ইতিমধ্যে প্ল্যান-প্রোগ্রাম তৈরি হতে থাকুক। একটা বড়ো কাজ, হুট করে তো শুরু করা যায় না।

অভিজিৎ মনে মনে ভাবল, দুর ছাই! এতদিন পর একাজ পেয়ে তার লাভটা কী? সব। আশা শেষ হয়ে গেল।

একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অভিজিৎ আবার মন বদলাল। এই কাজটা জোগাড় করা চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ন্যাশনাল যাতে না পায়। কাজটা এলে, পরে আবার অসীমদের ডেকে চাকরি দেওয়া যেতে পারে। সে বলল, তবু আমার কোম্পানিই যে কাজটা পাবে, তার একটা পাকা কথা হওয়ার দরকার। বাজারে আরও অনেক কুমারী মেয়ে আছে।

কুমারী মেয়ে? তার মানে? কী বলছিস তুই?

ও, ভুল করে বলে ফেলেছি। আসলে বলছিলাম, বাজারে আরও কোম্পানি আছে।

নিখিল হো হো করে হেসে উঠল। এতক্ষণ বাদে সে আন্তরিকভাবে বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, তোর কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? নে, খাচ্ছিস না কেন?

আমি খাব না।

তুই এত কী ভাসছিস বল তো! এত চিন্তার কী আছে?

কিছুই ভালো লাগছে না আমার। এই কাজটার ওপর আমি অনেকখানি ভরসা করেছিলাম। এমন একটা সমস্যায় পড়েছি, তোকে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না–সেইজন্য আমি অনেক নীচেও নামতে রাজি ছিলাম রতনলালকে তোষামোদ করেও যদি

নিজের গেলাস শেষ করে নিখিল উঠে দাঁড়াল। বলল, চল, রতনলালের কাছেই যাই। তুই যখন এত ছটফট করছিস।

রতনলালের ফ্ল্যাটে শেলি দত্ত এরমধ্যেই এসে গেছে। বাদল আর একজন অচেনা লোক রয়েছে। অচেনা লোকটির নাম ধনরাজ সরোগি। ওরা সবাই মিলে তাস খেলছিল। রতনলাল ওদের দেখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আরে আসুন আসুন। কী খবর? সব ভালো তো?

অভিজিৎকে বলল, সেদিন আপনি চলে গেলেন, কোনো কথাই তো হল না।

অভিজিৎ বিনীতভাবে বলল, সেইজন্যেই আজ এলাম।

 ধনরাজ হাতের তাস ফেলে দিয়ে বলল, লিন, এবার আপনোক খেলুন, আমি তাস খেলা জানি না, তবু রতনলাল আমাকে জোর করে খেলাবে।

রতনলাল বলল, নিখিলবাবু এসে গেছে, এবার অন্য খেলা হবে। আসুন আগে কাজের কথাটা সেরে নিই।

নিখিল রতনলালের সঙ্গে পাশের ঘরে চলে গেল। নিশ্চয়ই ওদের কোনো গোপন কথা আছে।

আজ বসবার ঘরের একপাশেও স্তূপ করা জামাকাপড়ের প্যাকেট। অভিজিৎ সেদিকে একবার কৌতূহলী চোখে তাকাল। এগুলির মধ্যে কী রহস্য আছে কে জানে? বাদলকে সে বলল, আমি কেতকীর ওখানে গিয়েছিলাম।

বাদল সে ব্যাপারে কোনো কৌতূহল দেখাল না। কেতকী একা ছিল কি না, অভিজিৎ সেখানে কতক্ষণ কাটিয়েছে, সে-সম্পর্কে ওর কোনো ঔৎসুক্যই নেই! ও শুধু বলল, কেতকীকে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতিস! ও এল না?

না, ও নেই। মাসির বাড়ি গেছে!

ওর আবার মাসি এল কোথা থেকে? যতসব।

শেলি দত্ত মন দিয়ে ওদের কথা শুনছে। অভিজিতের চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিল।

শেলি দত্তর এখন অন্যরকম চেহারা। ঝলমলে শাড়ি পরেছে, ঠোঁটে লিপস্টিক, মাথায় মস্ত বড়ো খোঁপা। কিন্তু সে যে কুমারী মেয়ে নয়, তার দুটি সন্তান আছে, একথা জেনে গেছে রতনলাল।

নিখিল আর রতনলাল ফিরে এল। সোফার বদলে মেঝের কার্পেটে বসে পড়ে রতনলাল বলল, আসুন, তাস খেলা যাক। তারপর শেলি দত্তর দিকে ফিরে ধমক দিয়ে বলল, বাবুজিকে এখনও হুইস্কি দাওনি? নিয়ে এসো গ্লাস।

অভিজিৎ বলল, থাক দরকার নেই। আমি খাব না।

আরে খান খান। ভালো স্কচ আছে!

 যেন অভিজিৎ জীবনে স্কচ খায়নি, তাই তাকে লোভ দেখানো হচ্ছে। সে একটু দৃঢ় গলায় বলল, না, আজ খাব না।

আমরা খাচ্ছি আপনি খাবেন না? আপনি বুঝি বেশিদিন বাঁচতে চান?

অভিজিৎ দেখল নিখিল তার দিকে চোখ টিপে ইশারা করছে। তখন তার মনে পড়ল। বাদল বলেছিল, রতনলালকে সবসময় তোষামোদ করতে হবে। তার মুখের ওপর কিছুতেই না বলা যাবে না।

অভিজিৎ তক্ষুনি গলার স্বর পালটে, মধুরভাবে বলল, ঠিক আছে। আপনি যখন বলছেন, তখন কি না খেয়ে পারি, তা ছাড়া এত ভালো স্কচ

টেস্ট করে দেখুন। এত ভালো জিনিস সহজে পাওয়া যায় না।

অভিজিৎ বলল, সে তো বটেই, এত ভালো জিনিস কি সহজে পাওয়া যায়?

আপনি থ্রি কার্ডস জানেন?

থ্রি কার্ডস মানে তিন তাস। হোস্টেলে থাকার সময় অভিজিৎ এই খেলা শিখেছিল। খেলাটা সে ভালোই জানে। কিন্তু এখন তাস খেলতে বসলে কাজের কথা হবে কখন? তবে রতনলাল যখন তাস খেলার কথা বলছে তখন খেলতেই হবে। বলল, হ্যাঁ, জানি।

তাহলে আসুন বসে যাই। আমরা চার জন। আসুন নিখিলজি।

তাস বিলি করা হল, এক টাকা করে পয়েন্ট। অভিজিতের কাছে শ-দেড়েক টাকা আছে, ওই দিয়েই চালাতে পারবে।

শেলি দত্ত তার ভরতি গেলাস রাখল। একটা চুমুক দিয়েই অভিজিৎ ভাবল, চেষ্টা করলে কী হবে, এইসব পরিবেশে সে মদ খাওয়া কমাতে পারবে না। ইফ ইউ কানট বিট দেম, জয়েন দেম–নিখিলের এই কথাটা ঠিক। বার বার সে সুমিত্রার কাছে কথা দিয়ে আসে, বার বার সে শপথ ভাঙতে হয়। রতনলালকে তোষামোদ না করলে, কাজটা জুটবে না। সুতরাং রতনলালের অনুরোধে তাকে মদ খেতেই হবে।

প্রথম পর পর চার বার অভিজিৎ হারল। রতনলাল বেশ চালু খেলোয়াড়।

 সাবধানে খেলতে হবে ওর সঙ্গে। তার টাকা এরমধ্যেই ফুরিয়ে এসেছে। হঠাৎ সব ফুরিয়ে গেলে বোকা বনে যেতে হবে। পরের দু-বার জিতে গেল অভিজিৎ! কিন্তু বাদল আর নিখিল দু-জনেই বোকার মতন হারছে।

ধনরাজ চুপচাপ বসে আছে। তার ভালো লাগার কথা নয়। সে একসময় বলল, রতনলালজি, আমি তবে আজ উঠি। কাজকামের কথা পরে হবে?

রতনলাল তাকে নমস্কার জানিয়ে বলল, আচ্ছা ধনরাজজি, নমস্তে। আপ ঘর যাইয়ে। দয়া করে যে এখানে এসেছেন…আপকা মেহেরবানি! কাল আমি টেলিফোনে আপনার সঙ্গে বাতচিত করব, আচ্ছা…গুডনাইট।

ধনরাজ বেরিয়ে যেতেই রতনলাল বলল, শালা একনম্বর হারামি!

বাদল বলল, যা বলেছেন।

নিখিল বলল, মুখ দেখলেই বোঝা যায়!

অভিজিৎ অবাক হল না। সে ভাবল, ধনরাজ সম্পর্কে সে-ও একটা খারাপ কথা বলবে কিনা, ঠিক মতন মনে এল না।

পরের খেলায় অভিজিৎ একসঙ্গে জিতে গেল দু-শো টাকা। সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। জুয়ায় জিতলেই গা গরম হয়ে যায়। রতনলালের দুর্বলতা সে ধরে ফেলেছে। আজ বেশ কিছু টাকা জিতে নিতে হবে

উৎসাহের চোটে সে একচুমুকে গেলাস শেষ করল। শেলি দত্ত পরের বার ভরতি গেলাস নিয়ে এসে অভিজিতের হাতে দেওয়ার সময় তার আঙুলটা টিপে দিল। কী যেন ইঙ্গিত করছে। অভিজিৎ চমকে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। শেলি মাথা নেড়ে ইশারা করল। অভিজিৎ মানে বুঝতে পারল না।

অভিজিৎ রতনলালকে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ফ্যাক্টরির কাজ তো শুরু হয়ে যাচ্ছে– সে পাবলিসিটির ব্যাপারটা

হবে। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে–এই তো আমি মুম্বাই যাচ্ছি পরশু, ফিরব এক মাস বাদ, তখন আপনার সঙ্গে বসব একদিন। আপনি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করুন।

একটা পাকাকথা হয়ে গেলে হত না?

এই তো পাকাকথা।

না মানে, একটা লিখিত কনট্রাক্ট, আমি কনট্রাক্ট টাইপ করিয়ে এনেছি—

কনট্রাক্ট? ঠিক আছে। কনট্রাক্ট হবে–এটা তো জুন মাস, ডিসেম্বরে হবে।

নিখিল অভিজিতের পিঠে একটা গুঁতো মারল। এইভাবে রতনলালের সঙ্গে কথা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না! তবু অভিজিতকে একটা কিছু ঠিক করতেই হবে। সে আবার বলল, তবু যদি পড়ে দেখতেন, টার্মস ঠিক আছে কি না।

রতনলাল যেন খুবই অবাক হয়ে বলল, টার্মস? আপনি কাম করবেন, আমি টাকা দিব। এরমধ্যে আবার টার্মস কী?

অভিজিৎ বলল, তবু ধরুন, কাজের ভলিউম, ডিসপ্লে, লে আউট–আপনারা অ্যাপ্রুভ করবেন না, তারপর মোড অব পেমেন্ট

রতনলাল হাতে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলল, পরে হবে ওসব কথা, নিন, খেলুন, ব্লাইণ্ড দেবেন না তাস উঠাবেন?

অভিজিৎ আরও দু-দান নিঃশব্দে খেলে গেল। তবু তার মনের মধ্যে খচ খচ করছে। শুধু মদ খেয়ে আর তাস খেলে সময় নষ্ট করলে কী চলবে? চারটে ছেলের মাথার ওপরে খাঁড়া ঝুলছে। আজই একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার।

সে আবার বলল, রতনলালজি, আমাদের কোম্পানির সঙ্গে আপনারা একটা কনট্রাক্ট যদি অন্তত করে রাখতেন

রতনলাল বলল, কাজের কথা আজ একদম ভালো লাগছে না। মুম্বাই থেকে ফিরে আসি। আপনি তারপর একদিন আসবেন–কাগজপত্র আপনার বন্ধুকে দেখান।

নিখিল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি দেখে দেব। উনি তো বলছেনই মুম্বাই থেকে ফিরে এসে কথা বললেন। কাজটা তো একরকম ঠিকঠাক হয়ে গেল। মুখের কথাতেই এখানে সব কাজ চলে।

মুখের কথা! কিন্তু অভিজিতের অফিসের মালিক তো এই মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। চার জন ছাঁটাই হবেই। অভিজিৎ অসহায় বোধ করল। তার কি আর কিছু করার আছে? এত চেষ্টা করেও কিছুই হল না।

হঠাৎ অভিজিতের মনে হল, এইসব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে গেলে কেমন হয়? হঠাৎ তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। রূপনারায়ণ নদীর ধারে একটা খোলা মাঠ, সদ্য বৃষ্টি হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো ঘাস, ঠিক সবুজ মখমলের মতন–নদী থেকে হু-হু করে ছুটে আসছে হাওয়া…। ছেলেবেলায় অভিজিৎ দেউলটি গ্রামে অনেকদিন ছিল, সেখানকার দৃশ্য। ওখানে যদি আবার ফিরে যাওয়া যেত। সুমিত্রা রাজি হবে না? প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের সব টাকা তুলে…

কী রে, খেলছিস না?

 হ্যাঁ হ্যাঁ খেলছি।

 রাগে দাঁতে দাঁত চাপল অভিজিৎ। খেলায় এদের দেখিয়ে দিতে হবে। দেখবে সে আজ রতনলালের কত টাকার জোর আছে। বাদল আর নিখিলটা তো কিছু জানে না, তবু খেলছে কেন? শুধু শুধু হেরে মরছে?

পরের বার অভিজিৎ হারল। সব টাকা পেল রতনলাল। নিখিল বলল, রতনলালজি, ব্লাইণ্ডেই আপনার এত ভালো লাক।

বাদল বলল, ওনার টেকনিকই দারুণ। প্রত্যেকবারই নতুনরকম।

অভিজিৎ মনে মনে বলল, হু টেকনিক না ছাই! ভালো তাস পেলে কেউই হারে না। ওকে আমি এবার ব্লাইণ্ড খেলার টেকনিক শেখাচ্ছি।

এরপর প্রত্যেক দানে অভিজিৎ জিততে লাগল।

আর একবার গ্লাস ভরে দেবার সময় শেলি দত্ত আবার ইচ্ছে করে অভিজিতের আঙুল স্পর্শ করল। অভিজিতের চোখে চোখ রেখে ভুরু নাচাচ্ছে। অভিজিৎ এবারও বুঝতে পারল না। কী বলতে চায় মেয়েটা? কিছু একটা ব্যাপারে যেন নিজের করতে চাইছে অভিজিতকে। কোন ব্যাপার? অভিজিৎ তো দোষের কিছু করেনি।

অথবা মেয়েটা কি চাইছে, অভিজিতের সঙ্গে আলাদা কোনো সম্পর্ক পাতাতে? রতনলাল জেনে গেছে যে, সে কুমারী নয়–তাই কি সে অন্য খদ্দের ধরার আশায় অভিজিতের দিকে… অভিজিতের হাসি পেল।

শেলি বসেছে রতনলালের গা ঘেঁষে। সে নিজেও হুইস্কি খাচ্ছে। একটু একটু করে নেশা হয়েছে গেছে তার। বাড়ি ফিরে ছেলে-মেয়েদের কাছে সে কী কৈফিয়ত দেয়? সে অভিজিতের দিকে কীরকম যেন ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে।

পরের বারের তাস বাদলকে দিতে অনুরোধ করে অভিজিৎ বলল, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।

সঙ্গে সঙ্গে নিখিল উঠে এল তার পেছনে পেছনে। বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে সে চাপা গলায় বলল, ব্লাডি ফুল। এইভাবে তুই কাজ পাওয়ার আশা করছিস?

অভিজিৎ বলল, কেন? কিছু দোষ করেছি? বেশি মদ খাইনি তো?

মদ যত ইচ্ছে খা-না! কিন্তু তুই তাস খেলায় রতনলালকে হারাচ্ছিস কেন, ইডিয়েট! আমরা কি খেলা জানি না? হেরে গেলেই রতনলাল চটে যায়।

তুই ইচ্ছে করে হারছিস?

 নিশ্চয়ই। তুই কেন বেশি কেরদানি দেখাতে যাচ্ছিস। রতনলালের মুখ থমথমে হয়ে গেছে, একটু পরেই সাংঘাতিক কান্ড করবে।

খেলায় তো হারজিৎ আছেই।

 চুপ কর! কাজটা চাস কিনা বল?

এখন তো কিছুই হবে না। সেই ছ-মাস পর–তখন আর লাভ কী?

 নিখিল পকেট থেকে অনেকগুলো এক-শো টাকার নোট বার করে বলল, এতে দু-হাজার টাকা আছে। তুই বসে বসে এই টাকাটা হার গিয়ে! পরে এর পাঁচগুণ টাকা ওর কাছ থেকে আদায় করা যাবে।

তা বলে ইচ্ছে করে এতগুলো টাকা হারব? ওর তো অনেক টাকা–এটুকু জিতেই বা লাভ কী?

জেতার আনন্দ। ও যে ভালো খেলে, এটা প্রমাণ করার আনন্দ! যা বলছি তাই কর। পরে এর পাঁচগুণ টাকা ওর কাছ থেকে আদায় করা যাবে। ও চটে গেলে মুশকিল।

দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ একটা সিগারেট ধরালো। তারপর নিখিলের একটা হাত চেপে ধরে বলল, শোন নিখিল, এইরকম জিনিস আমার কতদিন চালাতে হবে রে?

নিখিল বলল, তার মানে?

 এইরকমভাবে রতনলালের তোষামোদ কতদিন ধরে করব? একটা কাজ পাওয়ার জন্য কতদিন ধরে আমাকে এইরকম করতে হবে?

কোনো ঠিক নেই। যতবার তোকে এখানে আসতে বলবে, ততবারই। ওকে খুশি রাখতে হবে সবসময়। ও একবার চটে গেলে এককথায় সব ক্যান্সেল করে দিতে পারে। এদের কাছে কনট্রাক্ট-ফনট্রাক্টের কোনো মূল্য নেই, সব মুখের কথায়–

ধোঁয়া ছেড়ে অভিজিৎ বলল, অর্থাৎ খেলায় আমরা আর সবাই হেরে যাওয়ার ভান করব, ও একলা জিতবে, এই তো?

হ্যাঁ! যদি কাজটা চাস

তাই হল, ফিরে এসে অভিজিৎ ইচ্ছে করে তাসগুলো নষ্ট করতে লাগল। ভালো তাস পেলেও প্যাক করে দেয়। নিখিল আর বাদল আবার অভিনয় করে মাঝে মাঝে বলছে, ইস, একটুর জন্যে এবার পেলাম না। রতনলালজি, আপনি এমন বুদ্ধি খাটালেন।

রতনলালের মুখের থমথমে ভাবটা কেটে গেছে। উৎসাহের চোটে সে প্রায়ই শেলি দত্তর ঊরুতে চাপড় মারছে। শেলির বুকের আঁচল ফেলা, সে-দিকে রতনলালের চোখ নেই, তার মনোযোগ শুধু ঊরুতে। অদ্ভুত স্বভাব!

অভিজিৎ এখন বেশি মদ খাচ্ছে। খেলায় যখন মাথা খাটানোর ব্যাপার নেই, তখন মদ খাওয়া ছাড়া আর কী করবার আছে? সব টাকাটা হেরে গেলেই সে উঠে পড়বে।

শেলি দত্তর দিকে বার বার তার চোখ যাচ্ছে। তার মনে হল, মেয়েটিকে এখানে মানায় না। ও কেন একটা সুন্দর সুখী সংসার পেল না? ঊরুটা ছড়িয়ে রতনলালের গায়ে বুক ঠেকিয়ে বসে আছে।

অভিজিৎ হঠাৎ যেন, একটা মাংসের গন্ধ পেল। পচা মাংস। শেলির গা থেকেই গন্ধটা বেরোচ্ছে। সেইসঙ্গে হুইস্কির গন্ধ আর সিগারেটের ধোঁয়া। রতনলালের বীভৎস হাসি…। মনে হল এটাই তো নরক।

তার চোখে আবার ভেসে উঠল সেই দৃশ্যটা। রূপনারায়ণ নদীর ধারে সবুজ ঘাসেভরা মাঠ। হু-হু করা হাওয়া। ওখানে আর ফেরা যাবে না? ওই ঘাসে গড়াগড়ি দিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে…সুমিত্রা যদি রাজি হয়–ওখানে কিছু জমি কিনে এখানকার সব কিছু ছেড়ে

কী-খেলছেন না?

 হ্যাঁ, খেলছি খেলছি।

সে বাদল আর নিখিলের মুখের দিকে তাকাল। ওরা বেশ মেনে নিয়েছে। এইরকমভাবে সবসময় একজন জিতবে, আর সবাই হারবে। তাকেও এটা মেনে নিতে হবে। দিনের পর দিন।

সে একটু জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, নিখিল, তা হলে ওই কাজটা আমি ঠিক পাব তো?

নিখিল বলল, হ্যাঁ পাবি! পাবি! ছ-মাস পরেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।

অভিজিৎ প্রায় কেঁদে ওঠার মতন করে বলল, ছ-মাস যে বড্ড দেরি। অতদিন কি আমি টেনে নিয়ে যেতে পারব? যদি না পারি? আমার যে বড় দরকার? ছ-মাস ধরেই এই নরকে…

রতনলাল এক ধমক দিয়ে বলল, আরে মশাই খেলেন তো? শুধু কাম আর কাম। জানেন, সবসময় কাম আর রুপিয়া কামাবার ধান্দা করলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে একটু খেলা আর ফুর্তি দরকার, যাকে বলে রিলাকসেশান।

এই বলে সে শেলি দত্তর ঊরুতে আর একটা চাপড় বসাল।

আবার খেলা চলল। অভিজিতের কখন নেশা ধরে গেছে সে টের পায়নি, মাঝে মাঝে সে হা-হা করে হাসছে, আর সেই পাগলাটে হাসি। একবার সে ট্রায়ো তুলল। দশের ট্রায়ো। হেভি স্টেকসে ট্রায়ো ভোলা জুয়াড়িদের স্বপ্ন। কিন্তু অভিজিৎ তো জিততে পারবে না, সে জিতলে রতনলাল রেগে যাবে যে। হা-হা করে হেসে সে নিজের তাস প্যাক করে দিল।

একটু বাদে রতনলাল নিজেই কিন্তু কাজের কথা তুলল। সদ্য জেতা টাকাগুলো নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে সে বলল, তাহলে শিলং-এর ফ্যাক্টরি কবে থেকে চালু হচ্ছে, নিখিলজি?

নিখিল বলল, আপনি মুম্বাই থেকে ঘুরে আসুন, তারপর শিলং-এ গিয়ে নিজে সাইট দেখবেন। বেশ ভালো একটা বাড়ি পাওয়া গেছে, সঙ্গে গোডাউন আছে–তিন-চার মাসের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।

বাদল বলল, কাঁচামালের সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটাও আমি পাকা করে ফেলেছি।

 রতনলাল নিখিলকে বলল, ফ্যাক্টরির স্টাফের জন্যে বিজ্ঞাপন তো দিয়েছেন, আমার একটা কথা, বাঙালি নেবেন না। আপনি বাঙালি, আমি নিজেও ভি বাঙালিই হয়ে গেছি, তবু বলছি বাঙালি ছোকরা নিলে গন্ডগোল, ইউনিয়ন-ফিউনিয়ন, জানেন তো?

হঠাৎ অভিজিতের মাথায় রাগ চড়ে গেল। মাতালের রাগ বেশি সাংঘাতিক হয়। সে চোখ তুলে তাকাল। রতনলাল কথা বলতে বলতেই শেলি দত্তের ঊরু রীতিমতো খিমচে ধরে আছে। লোকটা বাঙালি ছোকরাদের পছন্দ করে না। কিন্তু বাঙালি মেয়ে খুব ভালোবাসে। তাই আয়েসে চটকাচ্ছে। আর সহ্য করা যায় না।

সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, না।

সবাই চমকে উঠল।

 নিখিল জিজ্ঞেস করল, কী বলছিস? তুই আর খেলবি না?

 বাদল তাড়াতাড়ি বলল, আর খেলার দরকার নেই, উঠে পড়া যাক। চল অভিজিৎ, আমি তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি।

অভিজিৎ আবার নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, না না, খেলা চলুক না। এই তো এখনও টাকা রয়েছে। আমাকে সব হারাতে হবে তো! সব না হেরে কী করে উঠব?

রতনলাল বলল, অত জোরে চেঁচাবেন না। বেশি চেল্লামেল্লি শুনলে আমার মাথা ধরে যায়।

 অভিজিৎ আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, চোপ!

নিখিল বলল, এই অভিজিৎ, কী করছিস। তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

অভিজিৎ রতনলালের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, কেন আমি সবসময় হারব? আমরা কি জিততে জানি না?

রতনলাল বলল, খেলা শিখুন, তবে তো জিতবেন।

নিখিল বলল, ওঠ অভিজিত, উঠে পড়!

অভিজিৎ জড়ানো গলায় বলল, তুমি ওই মেয়েটার গায়ে হাত দিচ্ছ কেন? হাত সরাও শুয়ার কাঁহাকা

রতনলাল বলল, বেশি নেশা চড়ে গেছে। একে ভাগান!

 হাত সরাও আগে!

শেলিই ঝংকার দিয়ে বলল, আপনি সে-কথা বলবার কে? আপনি চুপ করুন।

অভিজিৎ বলল, ছি: শেলি! তোমার দুটো ছেলে-মেয়ে আছে, কী ফুটফুটে তোমার মেয়েটা, ওরা ওদের মাকে সম্মান করবে না।

আপনি চুপ করুন! শেলি ধমক দিল।

রতনলাল এবার কড়া গলায় নিখিলকে বলল, এ নিখিলবাবু, একে ভাগান এক্ষুনি! এসব বাজেলোককে আমরা এখানে থাকতে দিই না! এদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না।

কী বললে মানিক?

আমি বাজেলোককে আমার এখানে থাকতে দিই না!

আমি বাজেলোক! হাত সরাও আগে–

বাড়ি যান, বাড়ি যান।

 যাব, তোমাকেও নিয়ে যাব।

 নিখিল এসে অভিজিতের হাত চেপে ধরতে গেল। অভিজিৎ এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল তাকে, তার গায়ে যেন এখন অসুরের মতন শক্তি। সে রতনলালের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তোমাকে এবার একটা নতুন খেলা দেখাব!

বাদল বলল, অভি, তুই নিজের সর্বনাশ করছিস।

 অভিজিৎ বলল, সেটাই তো নতুন খেলা।

রতনলাল বলল, এসব হারামি লোককে কোনোদিন আমার এখানে আসতে দেবেন না। এই তু নিকাল হিয়াসে।

অভিজিৎ হা-হা করে হেসে বলল, যাচ্ছি!

অভিজিৎ হুইস্কির বোতলটার গলা ধরে তুলল। সবাই ভাবল, সে বুঝি ঢক ঢক করে চুমুক দিয়ে কাঁচা হুইস্কি খাবে। তার বদলে, বোতলটা ঘুরিয়ে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে সে মারল রতনলালের মাথায়।

রতনলালের মুখ দিয়ে আর একটাও কথা বেরোল না। সে ঢলে পড়ে গেল শেলির বুকের ওপর। হুইস্কির সঙ্গে মিশে গেল তার রক্ত।

অভিজিৎ ভাঙা বোতলটা হাতে নিয়ে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। একমাত্র শেলি দত্তই তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল একবার, তারপর ফোঁপাতে লাগল। নিখিল আর বাদল একটাও শব্দ করল না। তাদের চোখ দুটো বিস্ফারিত।

অভিজিৎ বিশ্বাস করতে পারছে না। রতনলালকে মেরেছে? একেবারেই মরে গেছে লোকটা? অনেকখানি রক্ত এসে ছিটকে লেগেছে অভিজিতের জামায়। খুব নোংরা লাগছে।

নিখিল ঘোর ভেঙে বলল, এ কী করলি অভিজিৎ? এখন তোকে কে বাঁচাবে?

বাদল লাফিয়ে উঠে বলল, ডাক্তার? এক্ষুনি ডাক্তার ডাকতে হবে।

সে দরজার দিকে ছুটে যেতে নিখিল বলল, পালাচ্ছিস? বাদল তুই পালাচ্ছিস। এখন পালিয়ে গেলে আরও বোকামি হবে।

বাদল থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কই পালাচ্ছি না তো।

তাহলে ডাক্তারকে টেলিফোনে ডাক!

অভিজিৎ মুখটা ঘোরালো শেলি দত্তর দিকে। শেলি দত্ত তখনও রতনলালের মাথাটা চেপে ধরে আছে। কান্না থামিয়ে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, মরে গেছে! আর রক্ত বেরোচ্ছে না– গা ঠাণ্ডা।

অভিজিৎ খুব শান্তভাবে বলল, ওকে তোমার কোল থেকে নামিয়ে দাও। ও আর তোমাকে টাকা দেবে না!

শেলি দত্ত বলল, আপনি নিজে তো ডুবলেনই, আমাদেরও ডোবালেন—

অভিজিৎ তবু শান্তভাবে বলল, তুমি বাড়ি যাও–বাড়িতে তোমার ছোটো ছেলে-মেয়ে আছে, তুমি কেন এই নোংরা জায়গায় থাকবে।

এই সময় নিখিল উঠে দাঁড়াতেই অভিজিৎ বলল, খবরদার কেউ আমার কাছে আসবে না!

মেঝেতে ছড়ানো রক্ত। সে-দিকে তাকিয়ে অভিজিতের গা গুলিয়ে উঠল। তাকে এখন পালাতে হবে। তাকে বাঁচতে হবে। সে আর এখানে থাকবে না–সে চলে যাবে নদীর ধারে সেই, সবুজ ঘাসেভরা জমিতে–খোলা হাওয়ায়

ভাঙা বোতলটা অস্ত্রের মতন তুলে ধরে অভিজিৎ বলল, খবরদার কেউ আমাকে ছোঁবে না।

নিখিল বলল, বাদল, ওকে ধর। ও পালালে আমাদের নামে দোষ পড়বে সব!

বাদল সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে উত্তর দিল, না না, অভিজিৎ, আমি তোকে ধরব না!

ভাঙা বোতলটা হাতে নিয়েই অভিজিৎ ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাইরে এসে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল! এখন তার একটাই চিন্তা, তাকে বাঁচতে হবে। সে চলে যাবে নদীর ধারে সেই সবুজ মাঠে

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নীচে নেমে এসে সে ভাঙা বোতলটা ফেলে দিল। ছুটে রাস্তায় এসেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। তার জামায় রক্ত, কিন্তু রাত্তির বেলা এই ফাঁকা রাস্তায় কেউ দেখবে না।

অভিজিৎ ঠিক করল, এক্ষুনি বাড়ি ফিরে সুমিত্রাকে নিয়ে, এই ট্যাক্সিতেই আবার বেরিয়ে পড়বে। আজই তাকে চলে যেতে হবে। এই নরকে সে আর কোনোদিন ফিরবে না।

কিন্তু সুমিত্রা যদি এক্ষুনি যেতে না চায়? ব্যাংকের লকারে সুমিত্রার গয়না, ডায়িং ক্লিনিং-এ জামাকাপড়–সেসব ছেড়ে কি সুমিত্রা যাবে? সুমিত্রা যদি জিজ্ঞেস করে, কেন তার জামায় রক্ত, তার মুখে এত মদের গন্ধ–কেন সে পালাতে চায়? তা হলে সুমিত্রাকে কি সে সত্যি কথা বলবে, না মিথ্যে? সত্যি কথা সুমিত্রা সহ্য করতে পারবে? আর যদি মিথ্যে বলতে হয়

-ক-টা মিথ্যে? এক-শোটা, হাজারটা?

যে যদি বাড়ি পৌঁছে দেখে, তার আগেই পুলিশ এসে গেছে? বাদল আর নিখিলের টেলিফোনে।

অভিজিৎ তখন বুঝল, পৃথিবীতে সেরকম নদীর ধারে সবুজ নিরিবিলি প্রান্তর কোথাও নেই, যেখানে সে আর সুমিত্রা গিয়ে থাকতে পারে। না, সেরকম জায়গা আর কোথাও নেই। সে পালাতে পারবে না। তা ছাড়া কেনই-বা সে পালাবে? সে তো কোনো অন্যায় করেনি। সে একটা খেলায় জিতেছে মাত্র।

ঝুঁকে পড়ে সে, ট্যাক্সিওয়ালার ঘাড়ে একটা টোকা দিয়ে বলল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। এখানকার থানায় চলুন।

থানায় ঢুকে ওসির টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব শান্ত গলায় বলল, আমি এইমাত্র একটি জানোয়ারকে খুন করে এসেছি।

থানায় লক আপে পরদিন সকালে যখন সুমিত্রা দেখা করতে এল, তখন অভিজিৎ তাকে খুব সহজ গলায় বলল, তুমি দুঃখ পেয়ো না। আমি এখন একদম ভালো হয়ে গেছি। বিশ্বাস করো, আমি সত্যি ভালো হয়ে গেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *