রক্ত-চিকিৎসার প্রস্তুতি সম্পন্ন।
বড় মামার ঘরে কোকের বোতলের এক বোতল রক্ত ঢেলে এসেছি। বোতলে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। গরম পানি দিয়ে ঝাঁকিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তিন জায়গায় রক্ত ঢালা হয়েছে–মামার টেবিলে, মেঝেতে, বাথরুমের বেসিনে। বাথরুমের বেসিনের রক্ত সবচেয়ে ভালো ফুটেছে। ধবধবে সাদা বেসিনে টকটকে লাল রক্ত। বিছানায় খানিকটা ঢালার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বিছানার চাঁদরটা মেরুন রঙের, রক্ত ফুটবে না।
বাসায় সবাই আছে, শুধু বড় মামা নেই। উনি ঘরে ঢুকলেই খেলা শুরু হবে। আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম। বড় মামার অবস্থা কী হয় তা দেখার জন্যে ছটফট করছি।
মা রান্নাঘরে, মোরগপোলাও রান্না করছেন। সকিনা তাকে সাহায্য করছে। বাবা টিভি ছেড়েছেন, ফুটবল খেলা দেখছেন। ফুটবল খেলার দর্শক হিসাবে বাবা আদর্শ। তিনি কোনো দলকেই সাপোর্ট করেন না। সবাইকে গালাগালি করেন। বাবার গালাগালি আমার কাছে ফুটবল খেলার চেয়েও ইন্টারেস্টিং লাগে।
এই মুহূর্তে বাবা চেঁচাচ্ছেন, সবাই মিলে এটার পাছা বরাবর লাথি দেয় না কেন? বদের বাচ্চা। খেলা জানস না খেলতে আসছস কী জন্য? বাড়িতে গিয়ে ছাগলের দুধ খা বদমাইশ!
গালাগালির এই পর্যায়ে বড় মামা বাড়িতে ঢুকলেন। তালা খুলে নিজের ঘরে দাখিল হলেন। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বড় মামা কি রক্তের বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন? নাকি এখনো তাঁর চোখে পড়ে নি। টেনশনে আমার শরীর কাঁপা শুরু হয়েছে। একবার কি উঁকি দিয়ে দেখব?
হঠাৎ করেই মামার বিকট চিৎকার শুরু হলো।
ফরিদা কোথায়? ফরিদা! এই, কে আছে বাসায়? এই এই এই?
আমরা সবাই হুড়মুড় করে বড় মামার রুমে ঢুকলাম। বড় মামা বাবার দিকে। তাকিয়ে হুঙ্কার দিলেন, এইসব কী? ভাবটা এ রকম যেন, ঘটনা বাবা ঘটিয়েছেন।
বাবা বললেন, রক্ত নাকি? রক্ত কোত্থেকে এল?
রক্তের কথা শুনে সকিনা ও আল্লাগো, মাইনষের রক্ত! বলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করল।
বাবা বললেন, ন্যাকামি করিস না। রক্ত কোনোদিন দেখস নাই? ফুটবল প্লেয়ারের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিস! তোকে কেউ ল্যাং মেরেছে?
বড় মামা বাবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, রক্ত কোথা থেকে এসেছে সেটা নিয়ে কথা বলো। খামাকা চেঁচাচ্ছ কেন?
বড় মামার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ভাইজান, বাথরুম ভর্তি রক্ত। মাবুদে খোদা! এইসব কী?
পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। বাবা তার বন্ধু ও বস আহসান সাহেবকে ডেকে এনেছেন। তিনি গম্ভীর মুখে রক্ত দেখে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিতে চাপা হাসি এবং কিছুটা আনন্দ।
আহসান সাহেব আমাকে বললেন, লিপি, আমি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করছি। তুমি এক কাপ চা নিয়ে ওপরে আসো।
আমি বললাম, জি আচ্ছা চাচা।
আহসান সাহেব থতমত খেলেন। এই প্রথম আমি তাঁকে চাচা ডাকলাম।
আমি চা নিয়ে নিজে গেলাম না। সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম। আমি নিজের কোর্টে বল নিয়ে আসতে শুরু করেছি। আমি জানি আহসান সাহেবের আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা করছে। আমাকে না দেখে সেই ইচ্ছাটা আরও বাড়বে। আমি এর ভেতর দিয়ে গিয়েছি। আমি জানি।
সকিনা ফিরে এসে বলল, বড় স্যার আপনেরে টেলিফোন করতে বলেছে।
আমি টেলিফোন করলাম না। উনার এখন অপেক্ষার পালা। আমার অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে।
আমার প্রেম যদি বাছুর প্রেম হয়, তারটা তাহলে কী? বৃদ্ধ গরু প্রেম? বৃদ্ধ গরু প্রেমও কি বাছুর প্রেমের মতো কঠিন? দেখা যাক। আমি টেলিফোন না করলে উনি আমাকে করতে পারবেন না। কারণ আমার নম্বর তিনি জানেন না। কোনোদিন জানার আগ্রহ দেখান নি।
সাত দিন আগের কথা। অনেক ঘ্যানঘ্যানানির পর বাবা আমাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন। চার হাজার তিন শ টাকা দাম। মোবাইল ফোন নিয়ে প্রথমেই আহসান সাহেবের কাছে গেলাম। আনন্দে খলবল করতে করতে বললাম, এই যে আমার মোবাইল ফোন।
উনি বললেন, বাহ্ সুন্দর তো! মোবাইলে কম্যুনিকেশন কীভাবে হয় জানেন?
আমি বললাম, না।
কমুনিকেশন হয় মাইক্রোওয়েভে। এখন বলল, মাইক্রোওয়েভ কী?
আমি জানি না মাইক্রোওয়েভ কী।
জানতে চাও?
না, চাই না। আমি আর্টস-এর ছাত্রী, শুধু শুধু সায়েন্সে যাব না। কম জানা যেমন খারাপ, বেশি জানাও খারাপ।
তিনি বিরক্তির মতো ভঙ্গি করলেন।
আমি বললাম, আপনার মোবাইল নম্বরটা দিন।
উনি অবাক হওয়ার মতো করে বললেন, কেন?
আপনাকে টেলিফোন করব।
আমাকে কেন টেলিফোন করবে? তুমি টেলিফোন করবে তোমার বন্ধু বান্ধবকে। আর তোমার সঙ্গে তো আমার দেখা হচ্ছেই। যদি অনেক দূরে কোথাও যাও তখন নম্বর নিয়ো। আমার নম্বর কাউকে দেই না। প্রয়োজন হলে আমি টেলিফোন করি।
আপনি টেলিফোন করলেই তো নম্বর উঠে যাবে।
আমারটা উঠবে না। আমার ক্ষেত্রে উঠবে Private Number, বুঝেছ?
জি।
আচ্ছা এখন যাও।
আমি চোখভর্তি পানি নিয়ে চলে এলাম। তখনই ঠিক করলাম পাশা খেলব। আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম। যে আমার সঙ্গে দাবা খেলায় পারে না সে পাশা খেলাতেও পারবে না।
.
বড় মামার ঘরে দ্বিতীয় দফায় ভৌতিক আক্রমণ হলো চার দিন পরে। এবার মোস্তফা ভাই রক্ত এনে দেন নি। আমি ব্যবস্থা করেছি। এক বোতল রুহ আফজা ঢেলে নিয়েছি। এই সিরাপ খুব ঘন। রক্তের মতো লাল। নাটকে-সিনেমায় রুহ্ আফজা রক্ত হিসেবে ব্যবহার করে।
এবার প্রথমবারের মতো হইচই হলো না। সবাই ঝিম মেরে গেল। শুধু আমার ছোট ভাই রুবেল তার গাড়ি নিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে চেঁচাল–অক্ত, অক্ত, অক্ত। সে রক্ত বলতে পারে না। নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, উবেল।
মামার ঘর বন্ধন দেওয়া হয়েছে। ঘরের চারকোনায় চারটা তাবিজ ঝুলছে। মা তার মহিলা পীরের কাছ থেকে মাটির সরায় কী সব লিখে এনেছেন। এই মাটির সরা রাখা হয়েছে বড় মামার বাথরুমে। মহিলা পীর বলেছেন, রক্ত-বিষয়ক কর্মকাণ্ড জ্বিনদের কারণে ঘটছে। কাজেই মাটির সরায় বাথরুম শুদ্ধি। জ্বিনরা নাকি বাথরুমে থাকতে পছন্দ করে।
জ্বিনের বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন হুজুরকেও আনা হয়েছে। হুজুরের মুখভর্তি সাঈদীর মতো লাল দাড়ি। তাঁর গা থেকে সস্তা আতরের বিশ্রী গন্ধ আসছে। তিনি আবার জর্দা দিয়ে পান খান। আতরের গন্ধের সঙ্গে জর্দার গন্ধ মিলেমিশে ভয়ঙ্কর এক গন্ধ তৈরি হয়েছে। এই গন্ধেই জ্বিন-ভূতের পালিয়ে দেশান্তরি হওয়ার কথা।
হুজুর বড় মামার ঘরে পা দিয়েই বললেন, সর্বনাশ!
বড় মামা বললেন, সর্বনাশ কেন?
যে জিনিস এই ঘরে আশ্রয় নিয়েছে তার নাম গাইলান। গাইলান হলো জ্বিনদের জাদুকর। একে দূর করতে হলে আজান দিতে হবে।
বড় মামা বললেন, আজান দিতে হলে আজান দিন। আজান দিতে তো নিষেধ নাই।
হুজুর বললেন, এখন আজান দিয়ে লাভ নাই। গাইলান উপস্থিত নাই। আজান দিতে হবে তার উপস্থিতিতে।
বড় মামা বললেন, গাইলান গেছে কোথায়?
হুজুর বললেন, সেটা তো জনাব আপনাকে বলতে পারব না। গাইলান আমাকে তার ঠিকানা দিয়ে যায় নাই। তার মোবাইল নম্বরও আমার কাছে নাই।
বাবা বললেন, আমাদের করণীয় কী সেটা বলেন।
গাইলান দেখলেই আজান দিবেন। অজু করে পবিত্র হয়ে আজান দিবেন।
আমি বললাম, হুজুর, আজানের ক্যাসেট নিয়ে এসে সারা দিন এই ঘরে বাজালে কেমন হয়?
হুজুর কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েছেলের এইসব আলাপে থাকা ঠিক না। গাইলানের প্রধান দৃষ্টি থাকে মেয়েছেলের দিকে।
আমি হুজুরের সামনে থেকে চলে এলাম। রক্তের বদলে রুহ আফজা দেওয়ায় ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেল। বড় মামার ঘর ভর্তি হয়ে গেল পিঁপড়ায়। সাধারণত কালো পিঁপড়া যেখানে থাকে, সেখানে লাল পিঁপড়া থাকে না। বড় মামার ঘর ভর্তি হয়ে গেল সবধরনের পিঁপড়ায়।
বড় মামা হতাশ গলায় বললেন, এই ঘরের কী সমস্যা কিছুই তো বুঝতে পারছি না। গাইলান-ফাইলান সব ফালতু বাত।
বাবা বললেন, ঘটনা ঘটছে কীভাবে?
বড় মামা বললেন, তা জানি না। আমি পুলিশে খবর দিব। পুলিশ এসে গাইলানকে কানে ধরে নিয়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে বড় মামা আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমাকে সন্দেহ করছেন না তো?
লিপি!
জি বড় মামা।
ঠিক করে বলো তো, পুরো ঘটনায় তোমার ভূমিকা কী?
আমি বললাম, মামা! আমার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বড় মামা বললেন, বলো শুনি। এটা কি কোনো প্রাকটিক্যাল জোক?
আমি বললাম, গাইলানের তরফ থেকে প্রাকটিক্যাল জোক হতে পারে। আমার তরফ থেকে না। আমি একজন দর্শক। সায়েন্সের ভাষায়–Ovserver.
বড় মামা বললেন, একটু আগে বলেছ তোমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখন কেন পিছিয়ে আসছ?
আমি বললাম, মামা, পিছিয়ে আসছি। Ovserver-এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে Ovserver ছাড়া কোনো ঘটনাই ঘটবে না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আহসান চাচুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মামা কিছু না বলে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম। সন্ধ্যাবেলা মোস্তফা ভাই উপস্থিত। তাকে একটা গরুর পায়ের রক্তমাখা হাড় আনতে বলেছিলাম। তিনি বড় পলিথিনের ব্যাগে করে হাড় নিয়ে এসেছেন। জায়গায় জায়গায় মাংস ও রক্ত লেগে আছে। আমি এক ফাঁকে সকিনার ঘরে মশারির ভেতর রেখে দিলাম। সকিনা তার ঘরে সারাক্ষণ মশারি টাঙিয়ে রাখে। ফুরসুত পেলেই মশারির ভেতর ঢুকে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আসে। এবার যখন ঘুমুতে যাবে তখন খবর হয়ে যাবে।
আমি ভেবেছিলাম খবর হতে সময় লাগবে। রাত দশটা-এগারটা বেজে যাবে। তা হলো না। রাত আটটার দিকেই সকিনা ষাড়ের মতো চেঁচাতে লাগল। সকিনা বলছে, টাটকা মানুষ মাইরা তার পায়ের হাড্ডি আমার মশারির ভিতরে থুইছে। ও আল্লাগো! আমি কই যাব গো!
বড় মামা, বাবা এবং মা–এই তিনজনই মনে হলো অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই।
আমিই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বললাম, আমার ধারণা গাইলান বড় মামার ঘরে শুরুতে ভর করেছিল, এখন ভর করেছে সকিনার ঘরে। মনে হয় গাইলান দুজনের ওপর কোনো কারণে অসন্তুষ্ট।
বড় মামা খড়খড়ে গলায় বললেন, গাইলান কি তোমাকে এই খবর দিয়ে গেছে?
আমি বললাম, না। এই থিওরি নিজে নিজে চিন্তা করে বের করেছি।
বড় মামা বললেন, থিওরি কপচানোর বয়স এবং অভিজ্ঞতা তোমার এখনো হয় নি। কাজেই চুপ করে থাকবে।
জি আচ্ছা মামা।
বড় মামা বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, গাইলান ফাঁইলান কিছু না। আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যে ষড়যন্ত্র করছে তার জানা উচিত যে আমি ফিডার খাওয়া লোক না। সব বের করে ফেলব। তদন্তের ভার দেব ডিবি পুলিশকে। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে ডিবির ইন্সপেক্টর। নাম খসরু। তাকে বললেই সে চব্বিশ ঘণ্টায় থলের বিড়াল বের করে তার গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিবে।
মামা কঠিন মুখ করে ঘর থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মনে হয় ডিবি ইন্সপেক্টর খসরু সাহেবের কাছে যাচ্ছেন। আমি বললাম, বড় মামা, আমরা কি হাড্ডিটা ফেলে দিব, না রেখে দিব ডিবি পুলিশের দেখার জন্যে?
বড় মামা জবাব দিলেন না।
রাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। আহসান সাহেব রাত দশটায় গিফট র্যাপে মোড়া একটা প্যাকেট পাঠালেন। সঙ্গে চিঠি। চিঠিতে লেখা–
Hello friend,
শুভ জন্মদিন। খুব দামি উপহার তোমাকে কখনো দিয়েছি বলে মনে করতে পারছি না। এবার দিলাম, কারণ তুমি ষোলতে পড়েছ। Sweet sixteen.
উপহারটা হচ্ছে, আমেরিকার অ্যাপল
কোম্পানির wonder toy, ipad 2. এক হাজার গান আমি এই খেলনায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। চিরায়ত সাহিত্যের বেশ কিছু বইও আছে। নানান ধরনের খেলা আছে।
এই অপূর্ব খেলনার উদ্ভাবকের নাম স্টিভ জবস। বেচারা এই খেলনা আবিষ্কারের পরপরই ক্যানসারে মারা
যান।
এখন বলো তুমি কেমন আছ? মেয়েদের সবচেয়ে রহস্যময় বয়স হচ্ছে
ষোল, এটা কি জানো? এই বয়সেই মেয়েরা সচেতনভাবে তার সঙ্গী খুঁজতে
শুরু করে।
Who you looking
for What was his name
You can probably find him
At the grand chess game
চিঠির এইখানেই সমাপ্তি।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল রাত এগারটায়। বড় মামা মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় বাড়িতে ঢুকে বমি করে সব ভাসিয়ে দিলেন। যে বিকট গন্ধ বের হলো এতে গাইলান জ্বিন দৌড়ে পালিয়ে যেত। আমার অতি ভালো মা অনেক রাত জেগে নিজে সেই বমি পরিষ্কার করলেন।
সকিনাকে পরিষ্কার করতে বলা হয়েছিল। সে বলেছে, পুলাপানের বমি আমি পরিষ্কার করি। বুড়া মাইনষের বমি পরিষ্কার করি না। লাখ টেকা দিলেও না।
.
গত সাত দিনে আহসান সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। তাঁকে টেলিফোনও করি নি। অষ্টম দিনে ছাদে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। আমি জানি উনি ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। তারপরেও ভান করলাম–তাকে দেখতে পাই নি। ছাদে শুকাতে দেওয়া আচার আনতে গেছি। আমি যখন চলে আসছি তখন তিনি ডাকলেন, লিপি!
আমি ভয়ঙ্কর চমকে যাওয়ার ভাব করলাম। চমকানোর অভিনয় খুব ভালো হলো। কারণ চমকে আমি হাত থেকে আচারের বোতল ফেলে দিলাম। দুটা বোতলই ভেঙে চুরমার।
তিনি বললেন, সরি, তোমাকে চমকে দিয়েছি। পা কাটে নি তো?
আমি বললাম, মনে হয় কেটেছে। কিছু হবে না।
তিনি বললেন, কিছু হবে না মানে? দাঁড়াও, ডেটল নিয়ে আসছি।
উনি ডেটল আনতে ঢুকলেন, এই ফাঁকে আমি বাসায় চলে এলাম। কল্পনায় দেখছি, উনি ডেটল নিয়ে ফিরে এসে আমাকে না দেখে ধাক্কার মতো খেয়েছেন।
ব্যাকুল হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন।
তিনি অনেক খেলা আমার সঙ্গে খেলেছেন।
আমি এখন তার খেলা তাঁকে ফেরত দিচ্ছি। আমাকে নিয়ে তার প্রধান এক খেলার কথা বলি। তিনি গাড়ি থেকে নামছেন, আমি স্কুলে যাচ্ছি। আমাকে দেখে বললেন, লিপি, স্কুল কখন ছুটি হবে?
আমি বললাম, চারটায়।
আমার সঙ্গে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে?
আমার বুক ধক করে উঠল। আমি বললাম, অবশ্যই যাব।
তিনি বললেন, কোথায় যেতে চাও বলো।
আমি বললাম, আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানে যাব।
আমি যেখানে নিয়ে যাব সেখানে যাবে?
হুঁ।
সাভারের বাগানবাড়িতে যাবে? সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে দাবা খেলা। রাজি আছ?
হুঁ।
রাতে যদি থেকে যেতে বলি থাকবে?
হুঁ।
তারপর বাবা-মার কাছে কী জবাব দিবে?
আমি বললাম, কিছু-একটা বলব, সেটা আপনার না জানলেও চলবে।
তিনি বললেন, তাহলে স্কুল ছুটির পর অপেক্ষা কোরো। আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
আমি বললাম, আচ্ছা।
স্কুলে কীভাবে আমার দিন কাটল আমি বলতে পারব না। প্রবল এক ঘোর। সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। অংক মিস বললেন, লিপি, তুমি এরকম করছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ করছে?
আমি বললাম, জি আপা।
তিনি বললেন, শরীর খারাপ নিয়ে ক্লাস করতে হবে না। বাসায় চলে যাও।
আমি বললাম, আপা! আমি এখন বাসায় যেতে পারব না। বাসায় এখন কেউ নাই। চারটার সময় আমাকে নিতে গাড়ি আসবে।
অংক মিস বললেন, তাহলে এক কাজ করো। কমনরুমে যাও। সোফায় শুয়ে থাকো। তোমাকে দেখে তো ভয় লাগছে, চোখ টকটকে লাল।
আমি কমনরুমের সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যেই নোংরা এক স্বপ্ন দেখলাম। আহসান সাহেব এবং আমি গাড়িতে করে যাচ্ছি। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আমরা পেছনের সিটে। আমি তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। হঠাৎ তিনি বললেন…। না, এই স্বপ্নটা বলা যাবে না।
চারটায় স্কুল ছুটি হলো। আমি স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। পাঁচটা বাজল, সাড়ে পাঁচটা বাজল। ছটার সময় আহসান সাহেবের গাড়ি নিয়ে বাবা উপস্থিত। বাবা বললেন, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? স্কুল ছুটি হয়েছে। বাসায় যাবি না? তোর মা চিন্তায় অস্থির। তোর কী হয়েছে?
এই ঘটনার দুদিন পর আহসান সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। আমি এমন ভাব করলাম যেন কিছুই হয় নি। আহসান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, লিপি, তোমার বয়স কত?
আমি বললাম, পনের।
তিনি বললেন, পনের বছর বয়েসী একটি মেয়ে কারও কথায় বেড়াতে চলে যাবে না। সে নিজেকে রক্ষা করবে। মনে থাকবে?
আমি বললাম, জি।
তিনি বললেন, ছাদে আজ টেলিস্কোপ ফিট করছি। মঙ্গল গ্রহ দেখা হবে। দেখতে চাও?
আমি বললাম, চাই।
মঙ্গল গ্রহের চাঁদ কয়টা বলো। তোমাকে আগে বলেছি।
দুটা।
নাম জানো?
না।
নাম শিখে রাখো। একটির নাম ডিমোস, আরেকটির নাম ফিবোস। মনে থাকবে?
থাকবে।
গুড গার্ল। তোমার বান্ধবী প্রতিমাকে খবর দাও। সেও দেখুক, আনন্দ পাবে। ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দাও।
আমি বললাম, যা দেখার আমি একা দেখব। কারও সঙ্গে শেয়ার করব না।
তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। মনে হচ্ছে তিনি খুব মজা পেয়েছেন।
তিনি আমাকে যার ভেতর দিয়ে নিয়েছেন, আমি তাঁকেও সেই গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব। আচারের বোতল আমার পায়ে পড়েছিল, কিন্তু পা কাটে নি। পা কাটার কথা বলেছি তাঁর রিঅ্যাকশান কী হয় তা দেখার জন্যে। তাঁর রিঅ্যাকশান দেখে খুশি হয়েছি।
ডেটল নিয়ে এসে আমাকে না দেখে তিনি কী করেছেন তা দেখতে পেলাম না। সামান্য আফসোস। সেই আফসোসও দূর হলো যখন বাবা বললেন, আচারের বোতল পড়ে তোমার নাকি পা কেটেছে?
আমি বললাম, হুঁ।
উনি তোমার জন্যে তুলা-ডেটল আনতে গেলেন, আর তুমি পালিয়ে চলে এলে? উনি টেনশন নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এক্ষুনি যাও পা দেখিয়ে আসো।
আমি বললাম, যাব না।
বাবা বললেন, অবশ্যই যাবে। একজন কেউ মমতা দেখালে তার মূল্য দিতে হয়। এই বিষয়ে একটা সহি হাদিস আছে।
আমি বললাম, উনার কাছে যাচ্ছি। তোমাকে হাদিস কপচাতে হবে না।
আহসান সাহেব আমাকে দেখেই ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, তুমি কোথায় পালিয়ে গেলে?
আমি বললাম, ভয়ে পালিয়ে গেছি।
কিসের ভয়?
ডেটল দিতে গিয়ে যদি আপনি আমার পায়ে হাত দেন সেই ভয়ে।
তিনি একটু থতমত খেলেন। আমি বললাম, বাসায় এসে দেখি পা কাটে নি। আচারের লাল তেল রক্তের মতো দেখাচ্ছিল।
তোমার জন্মদিন উপলক্ষে তোমাকে একটা গিফট পাঠিয়েছিলাম। গিফট দেখে খুশি হয়েছ? গিফট পছন্দ হয়েছে?
আমি বললাম, প্যাকেট খুলি নি তো। তাই জানি না কী গিফট।
প্যাকেট খোল নি কেন?
বাসায় অনেক ঝামেলা হচ্ছে তো, এইজন্যে খোলা হয় নি।
আহসান সাহেব বললেন, তোমাদের বাসার অবস্থা কী?
আমি বললাম, গাইলানের ভয়ে সবাই অস্থির।
গাইলান কী?
খারাপ ধরনের জ্বিন। জ্বিনদের জাদুকর। এই জ্বিন আজান দিয়ে তাড়াতে হয়। এমনিতে যায় না।
মনে হচ্ছে তোমার উপন্যাস লেখার প্লট পেয়ে গেছ?
হ্যাঁ। গাইলানের অংশটা লিখেছ?
না।
লিখছ না কেন?
আমার আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।
উনি অবাক হয়ে বললেন, কেন ইচ্ছে করছে না?
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার বাছুর প্রেম চলে গেছে তো, এইজন্যে।
তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, বাছুর প্রেম শেষ?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
বাছুর প্রেম শেষ, লেখালেখিও শেষ?
হুঁ।
কীভাবে শেষ হলো?
জানি না কীভাবে শেষ হলো। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম…। থাক বলব না।
বলবে না কেন?
শুনলে আপনার হয়তো খারাপ লাগতে পারে।
আমার খারাপ লাগবে না, তুমি বলো।
হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করে না, আপনার সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না।
তুমি বলতে চাচ্ছ হঠাৎ লক্ষ করলে আমি একজন বিরক্তিকর মানুষ হয়ে গেছি?
জি।
আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং! তোমার বিয়ের কী হলো? ঐ যে দর্জি। আলাপ আলোচনা চলছে?
জানি না। আমি নিজ থেকে তো আর বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না, বাবা, আমার বিয়ের আলাপের কতদূর কী হলো।
আহসান সাহেব কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিলেন। তিনি সিগারেট খুব কম খেতেন। ইদানীং কি সিগারেট খাওয়া বেড়েছে? সবসময় তাঁর হাতে সিগারেটের প্যাকেট।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট গলায় বললাম, চাচা যাই?
তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। ধোয়া ছেড়ে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু বলবেন বলে ঠোঁট ফাঁক করলেন, কিছু বললেন না। আমি চলে এলাম। আমার চাচা ডাক নিশ্চয়ই তাঁর মরমে বিধেছে।
আমি তাঁর খেলাই
তাঁকে ফেরত পাঠাচ্ছি।
What you looking for
What was her name
You can probably find her
At the grand chess game
মামা ঠিক করেছেন এই বাড়িতে থাকবেন না। তিনি কলাবাগানের এক হোটেলের সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা করেছেন। হোটেলের নাম ব্লু হাউস।
মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ভাইজান, সত্যি চলে যাবেন?
বড় মামা বললেন, এখনই তো যাচ্ছি না। বুধবার যাব। বুধবার থেকে হোটেল বুকিং নিয়েছি। মাঝে মধ্যে এসে এক দুই রাত থাকব।
মাঝে মধ্যে এসে এক দুই রাত থাকব বলার সময় চট করে মামা একবার সকিনার দিকে তাকালেন। বিষয়টা অন্য কেউ লক্ষ করল না। লক্ষ করার কথাও না। আমি লক্ষ করলাম।
বাবা বললেন, জিনিসপত্র কি সব নিয়ে যাবেন ভাইজান?
প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাব। বাকি সব থাকবে। বড় ট্রাংকটা নিয়ে যাব। সেখানে কিছু জরুরি কাগজপত্র আছে।
বড় মামা জানেন না ট্রাংকে তাঁর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কিছুই নেই। সব আমি সরিয়ে ফেলেছি। চাবিওয়ালা বড় ট্রাংকের চাবি বানিয়ে দিয়েছে। সেই চাবি আমার পড়ার ড্রয়ারে লুকানো।
ট্রাংকে আমি একটা দলিল দেখে আনন্দ পেয়েছি। এক শ টাকার স্ট্যাম্পে মা লিখেছেন, জমিতে মায়ের যে অংশ তা তিনি বড় মামাকে লিখে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই বড় মামা মাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এই দলিল করিয়েছেন। মা এত বোকা কেন বুঝলাম না। সাধারণত দেখা যায়, স্ত্রী বোকা হলে স্বামী চালাক হয়। আমার বাবা-মা দুজনই বোকা। বাবা বোকা হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে। তাঁর চিন্তা চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বাইরে কিছু নেই। তিনি যতটা বোকা তাঁর স্ত্রী ঠিক ততটাই বোকা। তাদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে নাম হতো বোকাবুকির সংসার।
বড় মামার দশতলা দালানের ব্যাপারটা এখন স্পষ্ট হয়েছে। ট্রাংকের বাকি কাগজ এখনো দেখা হয় নি। ধীরে ধীরে দেখব। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যখন জানবেন তখন কী নাটক হয় কে জানে! নাটকটা দেখতে ইচ্ছে করছে। মার কাছে বড় মামা ও সকিনার বিষয়টা বলতে চাচ্ছি। আমি সকিনাকে ভোররাতে মামার ঘর থেকে বের হতে দেখেছি।
মা আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে না। সবচেয়ে ভালো হয় সকিনা যখন মামার ঘরে তখন হঠাৎ বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দেওয়া।
বড় মামা বুধবারে চলে যাবেন। আজ রবিবার। হাতে দুদিন মাত্র আছে। এই দুদিনের ভেতর কি ঘটনা ঘটবে? হে আল্লাহপাক, যেন ঘটে।
.
আহসান সাহেব আমার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন। কয়েকবার খবর পাঠিয়েছেন যেন আমি দেখা করি। আমি দেখা করি নি। এই কিছুক্ষণ আগে বাবাকে দিয়ে স্লিপ পাঠিয়েছেন। মুখবন্ধ খাম বাবা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আহসান তোমাকে দিতে বলল। খাম খুলে দেখি ইংরেজিতে লেখা– need to talk to you.
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, কী লেখা?
আমি বললাম, আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
বাবা বললেন, যাও কথা বলে আসো। না গেলে রাগ করবে। আহসানের মেজাজ কী কারণে জানি খুব খারাপ।
তোমাকে অপমান করেছেন, তাই না?
তুমি কীভাবে জানলে?
অনুমান করছি।
বাবা বললেন, তোমার অনেক বুদ্ধি। অনুমান ঠিক আছে।
আমি বললাম, তিনি সবার সামনে তোমাকে ইডিয়ট বলেছেন। তাই না?
বাবা ক্ষীণ গলায় বললেন, সবার সামনে না। ক্যাশিয়ার সাহেবের সামনে। ইডিয়টও বলে নাই। বলেছে বেয়াকুফ।
তুমি কী বললে?
আমি আবার কী বলব? আমি তো আর তাকে বেয়াকুফ বলতে পারি না। তবে মনে কষ্ট পেয়েছি।
আমি বললাম, বাবা, চাকরিটা ছেড়ে দিলে হয় না?
বাবা চমকে উঠলেন। আমি বললাম, তিনিই তোমাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেবেন। কাজেই আগেভাগেই চাকরি ছেড়ে দেওয়া ভালো।
বাবা বললেন, চাকরি ছেড়ে দিলে থাকব কোথায়?
আমি বললাম, রাস্তায় থাকব। হিমু-পরিবার হয়ে যাব।
বাবা বললেন, হিমু-পরিবার আবার কী?
যে পরিবারের সব সদস্য শুধু পথে পথে হাঁটে, সেই পরিবারকে বলা হয় হিমু পরিবার।
বাবা হতাশ গলায় বললেন, তোমার কথা আগেও বুঝতে পারতাম না, এখনো পারি না।
আমি বললাম, তুমি যদি রবীন্দ্রনাথ হতে তাহলে এখন বলতে, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
বাবার সবকিছু জলাঞ্জলির সময়ে এসে গেছে, তিনি বুঝতে পারছেন না।
.
আহসান সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। লিখে পাঠিয়েছেন—l need to talk to you. পরপর দুটা to, বাজে ইংলিশ। l need to talk লিখলেই হতো। কথা শোনার জন্যে আমি আহসান সাহেবের কাছে গেলাম না। স্লিপের উত্তর স্লিপ দিয়ে দিতে হয়, কাজেই আমিও একটা স্লিপ লিখে সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম। সেখানে লেখা–
“রাক্রিমখ নাফনা
কুরেৎ সি ঝিনা। ৫৩০১ ফ্রেং।”
সাংকেতিক কোনো চিঠি না। হাবিজাবি লেখা, কিন্তু তিনি ভাববেন সাংকেতিক চিঠি। অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালাবেন। অর্থ উদ্ধার করতে পারবেন না। অতিবুদ্ধিমান হওয়ার কারণে হালও ছাড়বেন না। বিপদে অতিবুদ্ধিমানরাই পড়ে। সাধারণরা পড়ে না।
মামা অতিবুদ্ধিমান বলেই বিপদে পড়বেন। শিং মাছ যেমন ছাই দিয়ে ধরা হয়, মামাকেও আমি ছাই দিয়ে ধরব। ধরব বলা ঠিক হবে না, ধরে ফেলেছি। পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কে সাহায্য করবে? কে আবার? বোকা সকিনা।
সকিনা
রে সখিনা।
তোর রঙ্গ দেখে বাঁচি না।
ধুর! ভুল বললাম, রঙ্গ সকিনার না–রঙ্গ আমার মামার। তার রঙ্গ দেখে আমি বাঁচি না। রঙ্গ অবশ্যি আহসান সাহেবও দেখাচ্ছেন। এবং আরও দেখাবেন।
আহসান সাহেবের সাম্প্রতিক রঙ্গের একটি ঘটনা বলি।
চারটার সময় স্কুল ছুটি হয়েছে, আমি প্রতিমার সঙ্গে গেট দিয়ে বের হয়ে দেখি আহসান সাহেবের ড্রাইভার। সে বলল, স্যার, আপনাকে নিতে এসেছেন। গাড়িতে বসে আছেন।
আমি গাড়ির কাছে গেলাম।
আহসান সাহেব বললেন, সাভারের বাগানবাড়িতে সেনচুরিয়ান গাছে ফুল ফুটেছে। অসাধারণ দৃশ্য। দেখতে যাবে?
আমি কিছু বলার আগেই প্রতিমা বলল, আমি যাব। কাকু, আমি যাব।
আমি বললাম, আপনি প্রতিমাকে নিয়ে যান। প্রতিমা ফুল খুব পছন্দ করে।
আহসান সাহেব বললেন, তুমি যাবে না?
আমি বললাম, না। আমি ফুল পছন্দ করি না।
বলেই বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আহসান সাহেব ডাকলেন, লিপি। এই লিপি।
আমি ফিরেও তাকালাম না।
সন্ধ্যার পরপর আহসান সাহেব আমাদের বাসায় উপস্থিত। এই কাজ তিনি কখনো করেন না। বাবার সঙ্গে তার নাকি জরুরি আলাপ। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেললাম তিনি কী জন্যে এসেছেন। তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলতে আসেন নি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন, মাধ্যম হলেন বাবা। তিনি ধরে নিয়েছেন তাদের কথাবার্তা আমি আড়াল থেকে শুনব।
অন্যের কথা আড়াল থেকে শোনা অপরাধ, শুধু লেখকদের ক্ষেত্রে এটা অপরাধ না। কথাটা মার্কিন লেখক মার্ক টুয়েনের। আমাকে বলেছেন আহসান সাহেব। লেখকদের প্রধান কাজ শুনে যাওয়া। প্রকাশ্য কথা অপ্রকাশ্য কথা–সব শোনা। আমি তা-ই করলাম। তাদের কথাবার্তার সময় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
আহসান সাহেব : আজ সকালের ঘটনাটার জন্য আমি লজ্জিত। টেনশনে আছি তো, টেনশনে মাথা এলোমেলো হয়ে আছে।
বাবা : কোন ঘটনার কথা বলছ?
আহসান : তোমাকে বেয়াকুফ বলেছি।
বাবা : বেয়াকুফকে বেয়াকুফ বলার মধ্যে দোষের কিছু না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কমান্ডার আমাকে সব সময় বলতেন বুরবাক। আচ্ছা ওই প্রসঙ্গ থাক। তোমার টেনশন কী নিয়ে সেটা বলো।
আহসান : বিয়ে করব কি করব না, এই নিয়ে টেনশন। তুমি তো জানো, আমার আগের বিয়েটা ওয়ার্ক আউট করে নি। যার প্রথম বিয়ে ওয়ার্ক আউট করে না, তার দ্বিতীয়টাও করে না। তবে তৃতীয়টা করে।
বাবা : জানতাম না তো!
আহসান : এই স্ট্যাটিসটিকস আমেরিকানরা বের করেছে। তিন বিয়ে চার বিয়ে তো ওদের কাছে ডালভাত। ইছামতি উপন্যাসে বিভূতিভূষণ এক যুবককে তিন বোনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং যুবক অসম্ভব সুখী হয়েছিল। এই গল্পটি আহসান সাহেব আমাকে শোনানোর জন্য বলেছেন। তিনি ইছামতি উপন্যাসটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।
বাবা : তিন বোন বিয়ে করে সুখী? ভালো তো। হা হা হা।
[বাবা অকারণে হাসছেন। হাসির কিছু ঘটে নি। তিনি হাসছেন প্রমাণ করার জন্যে যে, আহসান সাহেবের কথা শুনে তিনি মজা পাচ্ছেন। ঘরজামাই যেমন শ্বশুরের মান রেখে চলে, একজন আশ্রিতও আশ্রয়দাতার মান রেখে চলে।]
বাবা : আমার মতে তোমার উচিত একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করা। শেষ বয়সে সেবাযত্নের প্রয়োজন আছে।
আহসান : আমার সেবাযত্নের জন্যে স্ত্রী প্রয়োজন নেই। আমার কাছে স্ত্রী হলো কম্পেনিয়ন। সাথী।
বাবা : ও আচ্ছা সাথী। অবশ্যই সাথী।
[বাবা জ্ঞানীর মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছেন, যেন সাথী বিষয়টা তিনি বুঝে ফেলেছেন।]
আহসান : ডাকাতের সঙ্গে তার যে বন্ধু ডাকাতি করতে যাচ্ছে সেও কিন্তু ডাকাতের সাথী।
বাবা : আরে তাই তো! Valid Point। বিষয়টা সেইভাবে আগে চিন্তা করি নাই। তুমি বলায় সব ক্লিয়ার হয়ে গেল।
[বাবার কাছে কিছুই ক্লিয়ার হয় নি। সব জট পাকিয়ে আছে। বন্ধুকে খুশি করার চেষ্টায় আছেন।]
আহসান : এক কাপ চা খাব। লিপিকে চা দিতে বলো। চায়ে আমি কতটুকু চিনি খাই লিপি জানে।
আহসান সাহেব ভেবেছিলেন চা নিয়ে আমি ঢুকব। তিনি এই ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। যন্ত্রণাদায়ক অপেক্ষা। এই ধরনের অপেক্ষার ভেতর দিয়ে আমি নিজেও গিয়েছি। আমার সব অপেক্ষা শেষ হয়েছে অবহেলায়। আমি চা বানিয়ে সকিনাকে দিয়ে পাঠালাম।
আহসান সাহেব চলে যাওয়ার পর বাবা আনন্দিত গলায় জানালেন, রাতে আহসান আজ আমাদের সঙ্গে খাবে। তার বাবুর্চি আসে নি।
আমি বাবাকে বললাম, খেতে এসে তিনি যদি আমার খোঁজ করেন তাহলে বলবে, আমি শুয়ে আছি। আমার জ্বর।
বাবা কপালে হাত দিয়ে বললেন, কপাল তো ঠান্ডা।
আমি বললাম, কিছু কিছু জ্বর চামড়ার ভেতরে থাকে। গায়ে হাত দিয়ে সেই জ্বর বোঝা যায় না।
বাবা বললেন, এই অদ্ভুত কথা তোমাকে কে বলেছে?
আমি বললাম, আহসান চাচু বলেছেন।
বাবা বললেন, তাহলে ঠিক আছে। তাকে আমি চিনি তো, সে ভুল কথা বলার মানুষই না।
আমি বললাম, উনি ভুল কথা বলার মানুষ না?
বাবা বললেন, No never.
আমি বললাম, তোমার বন্ধু তাহলে মহাজ্ঞানী?
বাবা বললেন, Yes.
তিনি উত্তেজিত হয়ে গেলে ইংরেজি বলেন। বেশির ভাগ সময় ভুলভাল ইংরেজি। একবার আমার ওপর রাগ করে বলেছিলেন, You girl very naughty.
আমি বললাম, ভুল ইংরেজি বলবে না বাবা।
বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললেন, কোথায় ভুল করলাম? ইংরেজির প্রফেসর এসেছে! আমাকে ইংরেজি শেখায়! থাপড়ানো দরকার।
উত্তেজনায় বাবার ইংরেজি আরও জড়িয়ে গেল। তিনি ক্রমাগত বলতে লাগলেন, 1 drop window you. এর অর্থ তিনি আমাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেবেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাবার ভুলভাল ইংরেজি শুনতে আমার ভালো লাগে। এই অদ্ভুত মানসিকতার কারণ কী কে জানে! আহসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যায়। উনি নিশ্চয় জানেন।
একটা সময় আসবে যখন আমি উনার মতোই জানব। শব্দ খেলায় প্রতিবার উনাকে হারাব। শব্দ খেলাটা হচ্ছে–শব্দের মানে বলা। ডিকশনারি দেখে উনি আমাকে পাঁচটা শব্দের মানে জিজ্ঞেস করবেন। প্রতিটি ঠিক উত্তরের জন্যে আমি এক পয়েন্ট করে পাব।
তারপর আমার পালা। আমি ডিকশনারি দেখে তাঁকে পাঁচটা প্রশ্ন করব।
আহসান সাহেব বলেছিলেন বাংলায় অনেক শব্দ আছে যা শুধু ডিকশনারিতে পাওয়া যায় বাস্তবে ব্যবহার নেই। যেমন,
দুশ্চর : যেখানে যাওয়া দুঃসাধ্য।
দৃষ্টরজা : প্রাপ্ত যৌবনা। যেমন, তুমি।
এই বলেই তিনি খুবই লজ্জা পেয়ে গেলেন। তাঁর লজ্জা দেখে আমি পেলাম আনন্দ।