০৫. যেরকম ভেবেছিলাম

পাঁচ

যেরকম ভেবেছিলাম তেমন কিছু না। বিকেলের দিকে একটি গাড়িতে ওঁরা এসে পৌঁছালেন। হুইটলি সাহেব, মিসেস হুইটলি, বোন জেসমিন এবং হুইটলি সাহেবের বন্ধু বেকার। সঙ্গে আমার জিপও এল। এতদিন পাঠাতে পারেননি এবং যেদিন পাঠানো হবে কথা ছিল, সেদিন পাঠানো সম্ভব হয়নি বলে সাহেব ভদ্রতা করে ক্ষমা চাইলেন।

যশোয়ন্ত আগে থাকতে হাজির ছিল। যা দেখলাম, সাহেবের সঙ্গে যশোয়ন্তের রীতিমতো তুই-তোকারি সম্পর্ক। পিঠে চাপড় দিয়ে কথা বলেন একে অন্যকে। যশোয়ন্তটা এত ক্ষমতাবান জানলে তো আগে ওকে আরও বেশি খাতির যত্ন করতাম। যাকগে যা ভুল হবার, হয়েছে। পরে শুধরে নেওয়া যাবে।

মিসেস হুইটলি চমৎকার মহিলা। রীতিমতো সুন্দরী। মধ্যবয়সী। অপূর্ব কথাবার্তা এবং সবচেয়ে আনন্দের কথা আমেরিকান হলেও, ইংরেজি শুনে ওয়েস্টার্ন ছবির কথা মনে পড়ে না। আর তস্য সহোদরার তো তুলনা নেই। এমন একটি আর্যকন্যাসুলভ মহিমা যে কী বলব। গায়ের রঙ গোলাপি। পরনে একটি ফিকে চাঁপারঙা গাউন। পোশাকের জন্য চেহারাটা বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে; না চেহারার জন্য পোশাকটা বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। মাথাভরা সোনালি চুল। হাসলে কেমন যেন মাদকতা। সব মিলিয়ে দিন তিন-চার একটু খিদমদগারি করতে হবে বটে এঁদের। তবে এই জঙ্গলে সঙ্গী বিশেষ করে সুন্দরী সঙ্গী পেলে খারাপ লাগার কথা নয়।

বেকার সাহেব, যাঁকে দুঁদে শিকারী বলে হুইটলি সাহেব পরিচয় দিয়েছিলেন, অত্যন্ত কদাকার, মাঝারি উচ্চতার তীক্ষনাসা ভদ্রলোক। চেহারা দেখলে মনে হয় না নড়াচড়া করবার শক্তি রাখেন। কী করে যে বড় শিকারী হলেন জানি না।

বাংলোর হাতায় চেরি গাছের তলায় চেয়ার পেতে বসে গল্প হচ্ছিল। যশোয়ন্তের ভাষায় ওর খুব ‘দিলখুশ্’। কারণ বিয়ারের বোতলের কম্‌তি নেই। বেকার সাহেব বললেন, আমি ওল্ড স্কুলের লোক। সানডাউন-এর পর হুইস্কি ছাড়া কিছু খাই না। গর্দান খাঁ, জুম্মান এবং অন্যান্যরা সাহেবেদের কাবাব ইত্যাদি জোগাতে ব্যস্ত। আজ বোধহয় দ্বাদশী কি ত্রয়োদশী হবে। চাঁদের জোর আছে। ভালই হবে। সন্ধের পর আমার মালিক-মালিকিনরা সবাই দিল খুশ্ করতে পারবেন।

যশোয়ন্ত আগামীকাল ভোরের প্ল্যান বোঝাচ্ছিল। একেবারে ভোরে ভোরে হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়া, সোজা বাগেচম্পার দিকে। কোয়েলের অববাহিকায়। মাচান বাঁধিয়ে রেখেছে যশোয়ন্ত। টাবড়ও তার ছুলোয়া করবার দলবল নিয়ে প্রায় রাত থাকতে হাজির থাকবে সেখানে। এখান থেকে ওখানে পৌঁছে আমরা মাচায় বসলেই ছুলোয়া শুরু হবে। যশোয়ন্ত যা বললে, তাতে নাকি একজোড়া বাঘ আছেই। বরাত থাকলে একজোড়াই মারা পড়বে। সবই নির্ভর করবে শিকারীদের ওপর।

মিসেস হুইটলি বললেন, দুটির মধ্যে একটি তো যশোয়ন্ত মারবে।

যশোয়ন্ত বলল, আমি একটিও মারব না। আমি স্টপার। আপনারা অতিথি, আপনারা মারবেন। তাহলেই আমার আনন্দ।

হুইটলি সাহেব আমার জন্য যে বন্দুক এনেছেন, কোম্পানির পয়সায়, সেটি যশোয়ন্ত নেড়েচেড়ে দেখল। ম্যান্টন্ কোম্পানির সাদামাঠা বন্দুক। আঠাশ ইঞ্চি লম্বা ব্যারেল, দো-নলা। যশোয়ন্ত ফিস্ ফিস্ করে বলল, চলো তোমাকে এবার চেলা বানাব। তারপর মিঃ বেকারকে বলল, দেখুন তো এ ছোকরাকে কনভার্ট করতে পারেন কি না। যদি পারেন তো বুঝব আপনার এলেম আছে। বেকার সাহেব সর্বসময় তৃষ্ণাগত প্রাণ। উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ঠিক আছে। বাজি রইল। যাবার আগে কনভার্ট করে যাব।

হুইটলি সাহেব আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, আমার মনে হয় তুমি জেসমিনের সঙ্গে কথা বলে আরাম পাবে। য়্যুনিভার্সিটিতে কী বিষয় নিয়ে পড়ছে জানো? তুলনামূলক সাহিত্য। আমরা অন্য যারা এখানে কী আছি, তারা তো বাঁশ ছাড়া কিছুই বুঝি না।

আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম শুনে জেসমিনও খুব অবাক হল। আমরা দু’জনে দুটো বেতের চেয়ার নিয়ে একপাশে বসে গল্প শুরু করলাম।

আমি বললাম, এই চাঁদ ভাল লাগছে না?

এই চাঁদই আমার অসুখ। আমাদের দেশেও তো চাঁদ কম সুন্দর নয়। বিভিন্ন পরিবেশে, রূপ আলাদা আলাদা বইকী। কেন জানি না, এ জায়গাটা ভারী ভাল লাগছে। সারা রাস্তা আমি তাই বলতে বলতে এসেছি। এখানে আসার আগে আমরা নেতারহাটে একরাত কাটিয়ে এলাম। ভারী চমৎকার জায়গা। সেখানে নেমে বানারি হয়ে পালামৌর গভীর অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এতটা পথ এলাম। জঙ্গল আমার ভীষণ ভাল লাগে। কেন জানি না, আমার মনে হয় আমাদের আধুনিক সভ্যতার একমাত্র আশা, প্রকৃতির সঙ্গে দৃঢ়তর সম্পর্ক।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আশ্চর্য, ঠিক এমনি কথাই আমি বোধহয় দু’দিন আগে আমার ডায়েরিতে লিখেছি। আপনার কথা শুনে ভারী আনন্দ হল।

তারপর শুধোলাম, চাঁদই আপনার অসুখ বললেন, সেটা কীরকম?

জেসমিন হাসল। সেই ফালি-চাঁদের আলোয় চেরি গাছের চিরুনি-চিরুনি পাতার ছায়ায় বসে রুমান্ডি পাহাড়ের পটভূমিতে, মেয়েটির হাসি ভারী ভাল লাগল। জেসমিনের মধ্যে এমন কিছু একটি আছে; ভাল বাজনার মতো, যা দেশকাল বা ভাষার বাধা মানে না।

জেসমিন বলল, পূর্ণিমা রাত হলেই আমার পাগলামি বাড়ে; মনটা যেন কেমন করে, কী যে চাই, আর কী যে চাইনা বুঝতে পারি না। কেবল সমস্ত মন জ্বালা করে। লুকিয়ে লুকিয়ে ‘জিন’ খাই। চাঁদের আলোর মতো ‘জিন’। আমার মা বলেন, The moon has got into your veins. And that’s my disease।

খুব মজা লাগল ওর কথা শুনে। চাঁদে পা-দেওয়া দেশের মেয়ে হয়েও চাঁদ নিয়ে এত কাব্যি!

জেসমিন পরীর মতো শ্বেতা হাতে ঢেউ তুলে ভরা-জ্যোৎস্নায় অনেক কথা অনর্গল বলে যেতে লাগল। আমি কল্পনার তুলি দিয়ে বসে বসে ওর কথার উপরে বুলিয়ে বুলিয়ে একটি মনের মতো ওর ছবি আঁকলাম। যা আমি দেখতে পারছিলাম, কিন্তু অন্য কাউকে দেখাতে পারছিলাম না।

মাঝে মাঝে যশোয়ন্ত আর হুইটলি সাহেবের উচ্চকণ্ঠের হাসি এসে কানে ধাক্কা দিচ্ছে। যত রঙ চড়ছে হাসির জোরও তত বাড়ছে। আর এদিকে জেসমিন আমার মনের কাছে একটি পায়রার মতো অনুচ্চে বকম বকম করছে।

জুম্মান এসে কানে কানে বলল, খানা লগা দিয়া সাব।

উঠে গিয়ে ওদের বললাম, এবার খেতে বসা যাক। কাল ভোরবেলা উঠতে হবে।

বেকার সাহেব আমাকে প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, বসুন বসুন, খাওয়া তো আছেই, যশোয়ন্ত এখন জোর গল্প জমিয়েছে বাইসন শিকারের।

কিন্তু যশোয়ন্ত সবচেয়ে আগে উঠে পড়ল এবং অর্ডারের ভঙ্গিতে তর্জনী দেখিয়ে বলল, এভরিবডি টু দি ডাইনিং রুম। ডিনার ইজ সার্ভড। দিস ইজ মাই শুট অ্যান্ড এভরিবডি শ্যাল ওবে মি। দেখলাম, সকলে বিনা বাক্যব্যয়ে সুড়সুড় করে খাওয়ার ঘরের দিকে চলল।

খাওয়া-দাওয়া সারা হতে হতে রাত দশটা বাজল। যশোয়ন্ত আমার তাঁবুতে শোবে আজ। কাল একসঙ্গে ভোরবেলা রওয়ানা হওয়া যাবে এখান থেকে। যশোয়ন্ত বলল, তাঁবুর ঝালর-ফালর বন্ধ করা হবে না; গরম লাগবে। আমি বললাম, তোমার তো গরম লাগবেই। গরম গরম জিনিস পান করেছ—কিন্তু আমি এই জঙ্গলে উদোম-টাঁড়ে শুয়ে থাকতে রাজি নই।

খাওয়ার পরে যশোয়ন্ত বলল, ফুঃ, সঙ্গে যশোয়ন্ত বোস আছে। কোনও জানোয়ারের ঘাড়ে একটার বেশি মাথা নেই যে, জেনেশুনেও এখানে আসবে।

ওর সঙ্গে তর্কে পারা ভার।

ভাগ্য ভাল। আকাশটা নির্মেঘ। ফুটফুটে স্বচ্ছ জ্যোৎস্না। তাঁবুর চারিদিক খোলা থাকাতে তাঁবুময় আলোর বন্যা। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। সুহাগী নদীর দিক থেকে নিচের উপত্যকায় একটা রাতচরা টি-টি পাখি, টিটির-টি টিটির-টি করে ডেকে বেড়াচ্ছে। হাওয়ায় মহুয়া এবং অন্যান্য ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। অবশ্য মহুয়া এখন প্রায় শেষ হয়ে এল। মে-মাসের শেষ।

সবিস্ময়ে দেখলাম, যশোয়ন্ত শুতে এল না পাশের ক্যাম্প খাটে। বাইরে জ্যোৎস্নায় ইজিচেয়ার নিয়ে বসল; এবং কোথা থেকে পেল জানি না, একটা মার্টিনির বোতল খুলে মিষ্টি গন্ধের পানীয় খেতে লাগল।

আমি বললাম, যশোয়ন্ত এটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে। অনেক হয়েছে, এবার শুয়ে পড়ো, কাল ভোরে উঠে শিকারে যেতে হবে না?

যশোয়ন্ত ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, এরকম বাঘ শিকার জীবনে অনেক করেছি লালসাহেব; তার জন্যে তোমার চিন্তার কারণ নেই। মেয়েটির সঙ্গে তো খুব ভাল জমিয়ে ফেলেছ—বেহেত্‌রীন্।

অন্ধকার থাকতে থাকতে ঘুম ভেঙে গেল। ড্রাইভারদের গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দ, খাবার ঘরের টেব্‌লে ব্রেকফাস্টের আয়োজন, রামধানিয়ার নাগরা জুতোর অনুক্ষণ ফটাস ফটাস ইত্যাদিতে ঘুমিয়ে থাকা আর চলবে মনে হল না। উঠে দেখি, যশোয়ন্ত যে শুধু ঘুম থেকে উঠেছে তাই নয়, চান করে, জামা-কাপড় পরে, রাইফেল পরিষ্কার করছে জ্যাকারাণ্ডা গাছের তলায় ঊষার আলোয়। আমাকে উঠতে দেখে বলল, এই যে মাখনবাবু, তাড়াতাড়ি করুন, বন্দুকটাও নিয়ে নিন। আজ মরা বাঘের উপর বউনি হবে।

বললাম, আমার নাম মাখনবাবু নয়।

যশোয়ন্ত হেসে বলল, রাগ করছ কেন দোস্ত। তুমি হলে গিয়ে কলকাতার বাবু। ননীর পুতুল। রোদ লাগলেই গলে যাও কি না। তাই নাম দিয়েছি মাখনবাবু।

ব্রেকফাস্ট সেরে রওয়ানা হতে হতে একটু দেরিই হয়ে গেল। সূর্য অবশ্য তখনও ওঠেনি। দুটি জিপে বোঝাই হয়ে আমরা রওয়ানা হলাম বাগেচম্পার দিকে। যশোয়ন্ত অনেকবার বলেছিল ওখানে নিয়ে যাবে। নিয়ে গিয়ে চাঁদনি রাতে বাইসনের দল দেখাবে। এ যাত্রায় তা যে হবে না বুঝতে পারছি।

চমৎকার রাস্তা। রুমান্ডিতে এসে সেই যে খুঁটি গেড়ে বসেছি, তারপর এতখানি দূরে আসা আমার এই প্রথম। বেশির ভাগই শাল আর সেগুনের বন, বাঁশও আছে অজস্র। রাস্তার দু-পাশে জীরহুল, ফুলদাওয়াই আর মনরঙ্গোলি সকালের শান্তিতে নিস্তেজ হাসি হাসছে। এখনও যৌবন-জ্বালা শুরু হয়নি। রোদের সঙ্গে সঙ্গে ওরা জ্বলতে থাকবে। আর জ্বালাতে থাকবে।

আমার বাংলো থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার রাস্তা। কোয়েল নদীর পাশে, বড় বড় ঘাসে ভরা একটি জায়গায় এসে আমরা থামলাম। মধ্যে অনেকখানি জায়গায় শুধু ঘাস। বড় জঙ্গলও আছে দু’পাশে। জিপগুলো একটা ঝাঁকড়া সেগুনের নীচে রাখা হল। ড্রাইভারদেরও ওখানেই থাকতে বলা হল এবং বলা হল ওরা যেন কথাবার্তা না বলে। চুপ করে গাড়িতে বসে থাকে। ভয়ের কারণ নেই।

যশোয়ন্ত আগে আগে চলল। কাঁধে রাইফেল ফোর-ফিফ্‌টি-ফোর হান্ড্রেড ডবল ব্যারেল। জেসমিনকে শিকারের জলপাই-রঙা পোশাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ওর হাতে একটি দো-নলা শট গান, ডবল ব্যারেল-চার্চিল। বেকার সাহেব ঘুমের সময় যা একটু বিরতি দিয়েছিলেন, ঘুম থেকে উঠেই আবার বিয়ার খেতে শুরু করেছেন। সারা পথ খেতে খেতে এসেছেন। এবং দেখলাম ট্রাউজারের পেছনের দুটো পকেটে (থলি বিশেষ) দুটি আমেরিকান বিয়ার ক্যান উঁকি মারছে। মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম। হাতে রাইফেল নিয়ে এই রকম বিয়ার-মত্ত অবস্থায় বাঘের সম্মুখীন হলে বাঘ কিংবা উনি ওদের মধ্যে কেউ না মরে, মরব হয়তো আমি। রাইফেল ঘুরিয়ে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় হয়তো আমাকেই দেগে দিলেন আর কী। ওঁরও গাঁট্টা-গোঁট্টা ফোর ফিফটি ফোর হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল জেফরিস। মিস্টার হুইটলির হাতে থ্রি সেভেন্টি-ফাইভ হল্যান্ড-অ্যান্ড হল্যান্ড ডাবল ব্যারেল। দেখলেই মনে হয় একখানা যন্ত্রের মতো যন্ত্র। হুইটলি সাহেব সুপুরুষ। তাঁর হাতে মানিয়েছেও ভাল। মিসেস হুইটলি নিজে শিকার করেন না। শিকার দেখেন। সঙ্গে কোমরে বাঁধা একটি বত্রিশ ওয়েবলি স্কটের রিভলবার। নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্যেই।

সেগুন গাছের নীচে জিপটা রেখে আমরা ঘাসের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা সুঁড়ি পথে যখন কোয়েলের ধারে এসে পৌঁছলাম, তখন সূর্য অনেকক্ষণ উঠে গেছে। কোয়েলে সে সময় জল সামান্যই আছে। নদীটি সেখানে রীতিমতো চওড়া। মাঝে মাঝে জলের ক্ষীণধারা আর শুধু বালি।

দেখা গেল তিনটি মাচা বাঁধা হয়েছে। নদীর ধার বরাবর অর্ধচন্দ্রাকারে। জঙ্গলের ভিতর থেকে ঘাসবনে হাঁকোয়া করে আসবে হাঁকোয়াওয়ালারা নদীর দিকে, এবং বাঘ নাকি নদীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকবে। নদীতে পৌঁছবার আগেই শিকারিরা বাঘ দেখতে পাবেন। আর কোনও কারণে সেখানে বাঘকে মারা না গেলে, বাঘ যখন নদী পেরোবে তখন বাঘকে পরিষ্কার দেখা যাবে। এবং প্রত্যেক অতিথির কাছেই রাইফেল আছে যখন, তখন তাঁরা গুলি করার সুযোগ পাবেন। এবং বলাও যায় না, তাঁদের নিক্ষিপ্ত দু’ একটি গুলি বাঘের গায়ে বিধেও যেতে পারে। ফিসফিস করে যশোয়ন্তকে শুধোলাম, বাঘ যে নদীতে নামবেই এমন কোনও গ্যারান্টি তো নেই। যশোয়ন্ত বলল নেহাৎ নিরুপায় না হলে বাঘ নদীতে নেমে অতখানি আড়াল-বিহীন জায়গা পেরোবার ঝুঁকি নেবে না। বরঞ্চ হয়তো রেগে ‘বিটারস্’ লাইনের মধ্যে দিয়ে দু’ একজনকে জখম করে কিংবা মেরে, আবার জঙ্গলে ফিরে যাবে, তেমন আশঙ্কা আছে বলে আমায় বিটারদের সঙ্গে থাকতে হবে।

এমন সময় মিসেস হুইটলি একটি খুব সময়োপযোগী প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা যশোয়ন্ত, বাঘ যে আছে, তার প্রমাণ কী? এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে বলা বাহুল্য, যশোয়ন্ত খুব হকচকিয়ে গেল। তারপর আমাদের নিয়ে গিয়ে নদীর বালিতে বাঘের টাটকা-পায়ের দাগ দেখাল। বোধহয় শেষরাতে কি ভোর ভোর সময় নদী পেরিয়ে এসে জঙ্গলে ঢুকেছে। বাঘের পায়ের দাগ আমি ওই প্রথম দেখলাম। প্রকাণ্ড থাবা। দেখতে বিড়ালের মতো, কিন্তু পরিধিতে অবিশ্বাস্য। বেকার সাহেব দাগ দেখে নাকি নাকি সুরে বললেন, ‘মাই গড, হি ইঁজ দ্যা ড্যাঁডি অফ অল গ্র্যাঁন্ড ড্যাঁডিজ।’

ভোরের জঙ্গলে বেশ একটি ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। ঝির ঝির করে হাওয়া দিচ্ছে। কে কোন মাচায় বসবে তা নিয়ে ফিসফিস করা আরম্ভ হল। হঠাৎ আমাদের হাতের কাছ থেকে কতকগুলো তিতির ভর-র্-র্-র্ করে মাটি খুঁড়ে উঠল। উঠে, উড়ে পালাল।

ঠিক হল বেকার সাহেব পশ্চিমের মাচায় নদীর কিনারায় বসবেন। মিস্টার ও মিসেস হুইটলি পুব-পশ্চিমের মধ্যে একটু উত্তর ঘেঁষে বসবেন। ওই মাচা থেকেই বাঘকে প্রথম দেখার সম্ভাবনা। ওঁরা যেহেতু প্রধান অতিথি, সেইহেতু বেকার সাহেব কিছুতেই ও মাচায় বসতে রাজি হলেন না। তা ছাড়া তিনি বসলেও কত যে বাঘ মারবেন সে আমি জানি। মাচায় উঠেই হয়তো ঘুম লাগাবেন; সব সময় বিয়ার খেয়ে খেয়ে চোখ-মুখের যা অবস্থা হয়েছে, তা আর কহতব্য নয়।

পুবের মাচায় আমি আর জেসমিন বসব। যশোয়ন্ত বলল, সেদিক দিয়ে নাকি বাঘের আসবার সম্ভাবনা খুব কম। কী করে যশোয়ন্ত এমন জ্যোতিষশাস্ত্র আয়ত্ত করেছে জানি না। কিন্তু তার জ্যোতিষীতে মোটে ভরসা পেলাম না। বাঘ তো ট্রাফিক পুলিশের উত্তোলিত হাত মানবে না; যেখানে খুশি সেখানে চলে আসবে। এসব জানোয়ারের কাছ থেকে যত দূরে দূরে থাকা যায় ততই ভাল। জেসমিনকে এবং আমাকে প্রথমত ইচ্ছে করে এক মাচায় বসিয়ে, পরে রগড় করবার অভিপ্রায়; এবং দ্বিতীয়ত বাঘকে কোনক্রমে আমাদের দিকে এনে ফেলে আমার চরম দুর্গতি সাধনের ইচ্ছা যশোয়ন্তের অত্যন্ত প্রবল বলে মনে হল। কিন্তু ওর উপর কথা বলে কার সাধ্যি। স্যান্ডারসন কোম্পানির বড় সাহেব পর্যন্ত ওর আদেশের ওপর ‘রা’ কাড়ছেন না—আর আমি তো কোন ছার।

ভগবানের নাম স্মরণ করে অতিকষ্টে মাচায় উঠলাম। লতা দিয়ে কয়েকটা ডাল বেঁধে সিঁড়ি তৈরি করেছে। তাও জেসমিন ওঠবার সময়েই দুটো লতা পটাং পটাং করে ছিঁড়ে গেল। চাকরি বজায় রাখতে এই পোড়া দেশে যে মালিকের সঙ্গে বাঘ শিকারেও বেরোতে হয়, তা কোনওদিন ভাবতে পারিনি। আজ দেখলাম সবই সম্ভব।

যাই হোক, হাতে এবার নতুন বন্দুক। মাঝে মাঝে সেন্ট-মাখানো রুমাল বের করে নলটা মুছছি। যশোয়ন্ত বলেছে, বন্দুকের যত্ন আত্তির কোন ক্রটি না হয়। নতুন স্ত্রীকেও আমার এই রাইফেলের মতো কেউ ঘন ঘন রুমাল দিয়ে মুছবে বলে মনে হয় না।

যশোয়ন্ত টাবড়দের সঙ্গে ওই শুঁড়িপথ ধরে জঙ্গলের গভীরে চলে গেছে। হাঁকোয়াওয়ালাদের সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে ও আসবে। মনে মনে যশোয়ন্তের ওপর ভক্তি বেড়ে যাচ্ছে! বড় পেছনে লাগে এই যা।

ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, ভয় পাবার মতো কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। আমি আছি। নতুন বন্দুকও। তাছাড়া সঙ্গে মেমসাহেব শিকারি আছেন, হাতে তিন-হাজারী বন্দুক নিয়ে। তবে, শেষে একজন নারী আমার প্রাণরক্ষয়িত্রী হবে, এই ভাবনাটা বেশ কাবু করে ফেলেছে। গলাটা খাঁকরে নিয়ে ফিস-ফিস করে বললাম,—আপনি এর আগে কী কী জানোয়ার মেরেছেন?

আমি? জেসমিন খুব অবাক এবং কিঞ্চিৎ ভীত হল। কোনও উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করে পকেট হাতড়ে চকোলেট বার করে বলল—নিন, চকোলেট খান। তারপর চকোলেট চিবোতে চিবোতে বলল, একটি মাত্র জানোয়ার এ পর্যন্ত মেরেছি। কুকুর। পোষা কুকুর; পাগলা হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া মানে…আর কিছু…|

সে কথা শুনে বুকের মধ্যে যে কী করতে লাগল, তা কী বলব।

এমন সময় অত্যন্ত অবিবেচক এবং নিষ্ঠুরের মতো জেসমিন আমাকে শুধলো, আপনি কী কী মেরেছেন? বাঘ-টাঘ নিশ্চয় মেরেছেন প্রচুর?

চকোলেট চিবুতে চিবুতে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত বুদ্ধিমত্তা দেখিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ প্রচুর। যশোয়ন্ত আর আমি তো একসঙ্গেই শিকার-টিকার করি।

জেস্‌মিন চকোলেট গিলে ফেলে বলল, বাঁচালেন। সত্যি কথা বলছি, আমার এতক্ষণ বেশ ভয় ভয় করছিল। আপনি আছেন, ভয়ের কী! কি বলুন?

আমার কি তখন বলবার অবস্থা? তবু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, আরে ভয়ের কী? আমি তো আছি।

‘ছুলোয়া’ শুরু হয়ে গেল। বহুদূর থেকে গাছের গায়ে কাঠ-ঠোকার আওয়াজ। মনুষ্য মুখ-নিঃসৃত বিভিন্ন ও বিচিত্র অশ্রুতপূর্ব সব আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে সেই সম্মিলিত ঐকতান এগিয়ে আসতে লাগল; উত্তেজনা বাড়তে থাকল, হাতের চেটো উত্তরোত্তর ঘামতে লাগল। ঘন ঘন রুমালে হাত মুছে নিতে থাকলাম। গলাটা শুকিয়ে আসতে লাগল।

এমন সময় আমাদের ঠিক সামনেই ঘাসের মধ্যে ভীষণ একটি আলোড়ন হল। তখন জেসমিন আর আমি উৎকর্ণ উন্মুখ এবং যাবতীয়—উঃ—। হঠাৎ আমাদের হকচকিয়ে প্রকাণ্ড ডালপালা সংবলিত শিং নিয়ে একটি অতিকায় মানে প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কালের শম্বর সামনে বেরিয়ে এল। তারপর প্রায় রোরুদ্যমান দু’জন বীর শিকারিকে বৃক্ষারূঢ় দেখতে পেয়েই গাঁক গাঁক আওয়াজ করে হাসতে হাসতে নদী পেরিয়ে চলে গেল ওপারে। লক্ষ করলাম, জেসমিনের বন্দুক পাশে শোয়ানো, কপালে এবং কপোলে স্বেদবিন্দু মুক্তোর মতো ফুটে উঠেছে। আর চাঁপার কলির মতো বাঁ হাতের পাতাটি আমার হাঁটুর ওপর অত্যন্ত করুণভাবে শোভা পাচ্ছে।

জেসমিন আমার দিকে ফিরে বলল, গুলি করলেন না কেন?

আমি ধমকের সুরে বললাম, মাথা খারাপ! মারলে তো এক গুলিতেই ভূতলশায়ী করতে পারতাম, কিন্তু আমরা তো বাঘের অপেক্ষায় আছি। এখন গুলি করব কী করে?

কথাটা যশোয়ন্তের কাছে শোনা ছিল যে, বাঘের শিকারে অন্য জানোয়ারের ওপর খামোকা গুলি করতে নেই।

জেসমিন হেসে বলল, তাই বলুন, আমি ভাবলাম কী হল, মারলেন না কেন?

মনে মনে বললাম, মারব ওই জানোয়ারকে! বাঘের মতো দাঁত নেই বটে, কিন্তু শিং তো আছে। আর সেই ভয়ঙ্কর পা। অন্য কিছু না করে পেছনের পায়ে একটি লাথি মেরে দিলেই তো সব শেষ।

সাঁই সাঁই ফর ফর করতে করতে একদল ময়ূর আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। অত বড় শরীর নিয়ে যে অমন উড়তে পারে, তা না দেখলে কল্পনা করা যায় না। উড়ে গিয়ে কোয়েল নদীর ওপারে পৌঁছেই কতগুলো নাম-না-জানা গাছে বসে কেঁয়া কেঁয়া করে ডাকতে লাগল। সমস্ত জঙ্গল যেন সেই ডাকে জেগে উঠল।

এদিকে হাঁকোয়াওয়ালারা আরও কাছে এসে পড়েছে। তাদের চিত্তচাঞ্চল্যকর চিৎকারে মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যান্য মাচাগুলো দেখা যাচ্ছে না আমাদের জায়গা থেকে। ওরাও নিশ্চয় আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। বিটাররা আরও কাছে এসে পড়েছে—আরও কাছে—এখন মাথার মধ্যে হাতুড়ির আঘাতের মতো সেই নিস্তব্ধ বনে বিচিত্র সব আওয়াজ এসে লাগছে।

এমন সময় পাহাড়বন কাঁপানো একটি গুডুম আওয়াজ কানে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে মেদিনী-কাঁপানো বজ্রনিনাদী চিৎকার। বাঘের আওয়াজ! বোধ হয় গায়ে গুলি লেগেছে। পরক্ষণেই মনে হল প্রলয় কাল উপস্থিত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি লাল কালোয় মেশানো উল্কাবিশেষ একটি ‘স্প্রিং’-এর মতো লাফাতে লাফাতে জঙ্গলের পাতা মচমচিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। মনে হল, অজ্ঞান হয়ে যাব। জেসমিন আমার গায়ে ঢলে পড়ল। মাচাটা থরথর করে কাঁপছে। ভগবান রক্ষা করলেন। বাঘটা কী মনে করে আমাদের থেকে পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে থাকাকালীনই দিক পরিবর্তন করে পশ্চিমমুখো ছুটল কিছুক্ষণ। তারপর নদীতে। নদীর সাদা বালি, নীল জল আর সকালের রোদে লাফাতে লাফাতে, জলবিন্দু ছিটোতে ছিটোতে, ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে, লাল কালো বাঘটা নদী পেরোতে লাগল।

ওপারের ময়ূরগুলো নতুন করে চেঁচিয়ে উঠল। কেঁয়া কেঁয়া কেঁয়া…। এমন সময় কোন দৃশ্য জায়গা থেকে জানি না, মেঘনাদের বাণের মতো সশব্দে একটি গুলি এসে বাঘটিকে ভূতলশায়ী করল। কিছুক্ষণ থরথর করে কাঁপল বালির ওপর, জলের ওপর। তারপর স্থির হয়ে গেল।

ততক্ষণে হাঁকোয়াওয়ালারা এসে পড়েছে প্রায় আমাদের কাছে।

সম্বিত ফিরে পেতে দেখলাম জেসমিন আমার গায়ে মাথা এলিয়ে তখনও মূৰ্ছিতার মতো পড়ে আছে। আর মাচার নীচেই দাঁড়িয়ে বাঘের চেয়েও ভয়াবহ যশোয়ন্ত।

জেসমিনকে দুবার নাম ধরে ডাকতেই স্বপ্নোত্থিতার মতো মাথা তুলে লজ্জিত এবং কুণ্ঠিত হয়ে একটু হেসে বলল, Oh, I am most awfully sorry.

যশোয়ন্ত দূরে গেছে কি না ভাল করে দেখে নিয়ে, আমি মরুব্বি শিকারির মতো বললাম, আরে তাতে কী হয়েছে—প্রথম প্রথম সকলেরই অমন হয়।

জেসমিন বলল, কী আশ্চর্য। বাঘটা আমাদের মোটেই দেখতে পায়নি। অথচ আমি কী ভয়ই না পেলাম।

আমি বললাম, তাতে কী হয়েছে, আমরা তো দেখেছি বাঘকে। বাঘ আমাদের নাই বা দেখল।

মেঘনাদের বাণের মতো অদৃশ্য বাণটি যে কে ছুঁড়লেন, তা বোঝা গেল না।

বাঘটিকে ঘিরে নদীর মধ্যে বিটাররা দাঁড়িয়ে আছে। উল্লাসে চেঁচাচ্ছে। হুইটলি সাহেব বেজায় খুশি। এই সময় একটি ইনক্রিমেন্টের কথা বলে ফেললে হয়। যাকগে থাক। প্রকাণ্ড বাঘ।

যশোয়ন্ত বলল, বাংলোয় ফিরে মাপজোক করা হবে। তবে মনে হচ্ছে ন’ ফিটের ওপর হবে।

জানা গেল, বেকার সাহেব বিয়ার খেয়ে ‘ব্যোম’ হয়ে ঘুমুচ্ছিলেন মাচার উপরে। হঠাৎ হুইটলি সাহেবের গুলির আওয়াজে এবং বাঘের চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেন নদীতে একটি বাঘ লঙজাম্প প্র্যাকটিশ করছে। অমনি রাইফেল ঘুরিয়ে দেগে দিলেন। একদম। আর দেখতে হল না। টাবড়ের ভাষায়, গোলি অন্দর, জান বাহার। যাই করুন না কেন, যশোয়ন্ত বলছিল, বেকার সাহেব সত্যিই ভাল শিকারি। উল্টোমুখে মাচা বাঁধা, ঘুমুচ্ছিলেন; তবু ঘুম থেকে উঠে শরীর ঘুরিয়ে মাচার পেছন থেকে হঠাৎ গুলি করে গতিমান বাঘকে ভূতলশায়ী করা সোজা কথা নয়।

বেকার সাহেব একটি পাথরের উপর বসে, ট্রাউজারের হিপ পকেট থেকে একটি বিয়ার ক্যান নিজে নিলেন, অন্যটা যশোয়ন্তকে বাড়িয়ে দিলেন। বুঝলাম, সকলেরই বিস্তর আনন্দ হয়েছে বাঘ মারা পড়েছে বলে। আমারও আনন্দ হয়েছে কম নয়; বাঘ আমাদের মারেনি বলে।

হাঁকোয়াওয়ালারা যশোয়ন্তের নির্দেশে দুটি ডাল কেটে আনল। তারপর দড়ি দিয়ে, লতা দিয়ে বাঘের চার-পায়ের সঙ্গে সেই দুটি ডাল লম্বালম্বি করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল জিপ অবধি। তারপর তাকে জিপের বনেটের উপর পাথালি করে শুইয়ে দেওয়া হল এবং বনেট-ক্লিপের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল। মিসেস হুইটলির সিনে-ক্যামেরা চলতে লাগল অবিরাম: কি-র্-র্-র্-র্—কু-র্-র্-র্-র্।

চামড়া ছাড়ানো আরম্ভ হতে হতে সেই বিকেল। দেখতে দেখতে রাত নেমে এল। ‘জ্যাকারান্ডা’ গাছের ডালে বড় বড় ‘হ্যাজাক’ ঝুলিয়ে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। বাঘটাকে চিৎ করে শোয়ানো হয়েছে। চারটে পা চারদিক দিয়ে বেঁধে টানা দেওয়া হয়েছে। গলা থেকে আরম্ভ করে বুক ও পেটের মাঝ বরাবর চামড়া কাটা হয়েছে। তারপর সাবধানে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে।

কর্ম এটাও একটি আর্ট। যে সে লোকের নয়। গুলিটা যেখানে লেগেছে, ঘাড়ে-

কর্ম এটাও একটি আর্ট। যে সে লোকের নয়। গুলিটা যেখানে লেগেছে, ঘাড়ে—সেখানে একটি গাঢ় কালচে লাল ক্ষত। চারপাশে অনেকখানি জায়গাও অমনি কালচে লাল এবং নীলাভ। বাঘের গায়ে মাংস বলে কিছুই নেই। সব পেশী। দড়ির মতো ফিকে লাল পাকানো-পাকানো পেশী; তার উপর বেশি। মেদ বলে যা আছে, তা সামান্য। পেটের কাছে বেশি এবং সারা শরীরেই যা আছে, তা একটি পাতলা আস্তরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাঘের সামনের পায়ের কিংবা হাতের পেশী দেখবার মতো। চামড়া না ছাড়ালে কোনও অনুমান করাই সম্ভব হত না যে সেই হাত দু’খানি কতখানি শক্তির অধিকারী। চোয়ালের পেশীও দেখবার মতো। চলমান বাঘ তাই যখন সুন্দর চামড়া-মোড়া চেহারায় হেলে-দুলে চলে, তখন কেউ তাকে দেখলে বুঝতে পারবে না যে, বিনা আয়াসে মুহূর্তের মধ্যে সে কী সংহার মূর্তি ধারণ করতে পারে।

বন্দুকটা সবে হাতে পেয়েছি। বনে পাহাড়ে বাহাদুরি করার আগে এই চামড়া ছাড়ানো বাঘের আসল চেহারাটা দেখার আমার প্রয়োজন ছিল, ভাবলাম আমি।

চারদিকে এখন ভিড়। কেউ বলছে বাঘের চর্বি চাই, তেল করবে, বাড়িতে বুড়ি মা আছে, বাত হয়েছে, বাত নাকি বাঘের চর্বির তেল ছাড়া সারবে না। আবার কেউ বলছে বাঘ-নখ চাই। বউয়ের গলার হার বানিয়ে দেবে।

গোঁফগুলো তো নেই-ই। কখন যে হাতে হাতে লোপাট হয়ে গেছে, তার পাত্তা নেই।

যে কারণে আসা, সেই বাঘই যখন মারা পড়ে গেল, তখন বোধ করি, এই জঙ্গলে পড়ে থাকতে সাহেবদের কারও আর ইচ্ছা রইল না। তবু জেসমিন আর মিসেস হুইটলির খুব ইচ্ছা ছিল আরও দিন-তিনেক থেকে যাবার। শুক্লপক্ষ বলেই ওঁদের উৎসাহটা বেশি। কিন্তু হুইটলি সাহেব বললেন, অনেক কাজ আছে কলকাতায়। অতএব পরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে মালিক-মালকিনরা রাঁচির দিকে রওনা হয়ে গেলেন গাড়িতে। অনেক হ্যান্ডশেক হল; অনেক থ্যাংক য়্যু, অনেক বাই-বাই-ও। তারপর লাল ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছুটল। উধাও।

স্বস্তির নিঃশ্বাস এবার। হাত পা ছড়িয়ে বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসলাম।

যশোয়ন্ত বলল, সাবাস দোস্ত। গুরু গুড়: চেলা চিনি। তুমি যে আমাকেও টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবে হে। তোমার প্রমোশন ঠেকায় কোন শালা।

ছয়

জুন মাস এসে গেল। পনেরোই জুন নাগাদ কাজ বন্ধ হবে জঙ্গলের। তারপর বৃষ্টি নামবে। কোয়েল, আমানত, ঔরঙ্গা, কান্‌হার তখন সকলেই সংহার মূর্তি ধারণ করবে। পথঘাট অগম্য হবে। অতএব কাজ আবার আরম্ভ হতে হতে সেই সেপ্টেম্বর। অতএব এই ক’ মাস ছুটি বলা চলতে পারে। অবশ্য স্টেশান থেকে ওয়াগনে মাল পাচার হবে। জঙ্গলেই শুধু কাজ বন্ধ থাকবে। তখন বাঁশ-কাঠের ঠিকাদারদের কলকাতায় কি মুঙ্গেরে কি পাটনায় গিয়ে বাবুয়ানী করার সময়। এই সময়টা এখানে কেউই পড়ে থাকে না। বরসাত হচ্ছে রইস ঠিকাদারদের ওড়বার সময়। তাঁরা তখন গেরোবাজ পায়রার মতো ওড়েন।

যশোয়ন্তের বিহার গভর্নমেন্টের চাকরি। ও ইচ্ছা করলে ওই সময়টা ছুটি নিতে পারে। কিন্তু ও আমাকে বলল, কোথায় যাবে? থেকে যাও। বর্ষাকালে ঘন জঙ্গলের আরেক চেহারা। একেবারে লা জবাব।

বললাম, আমার অবশ্য যাওয়ার কোনও জায়গাও নেই।

যশোয়ন্ত বলল, থেকে যাও, থেকে যাও।

মাঝে মাঝে চুপ করে বসে ভাবি, পালামৌ সম্বন্ধে অনেক জানবার শুনবার আছে। এ যেন ইতিহাস নয়, এ এক জীবন্ত বর্তমান, বেড়াতে বেড়াতে যেন পিছিয়ে পড়েছে। টাবড় মুনশি অনেক কিছু জানে। বসে বসে ওর গল্প শুনি।

বহু জায়গা থেকে আদিবাসীরা এসে এই পর্বতময় নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বসবাস আরম্ভ করে। খাঁরওয়ারেরা আসে, ওঁরাওরা আসে, চেরোরা আসে। রুমান্ডি পাহাড়ের নীচে যে বস্তি ‘সুহাগী’, সেটি ওঁরাওদের বস্তি। আমার টাবড় মুনশিও জাতে ওঁরাও। বহুদিন আগে খাঁরওয়ারেরা রোটাসগড়ের শাসক ছিল। রোটাসগড় শাহাবাদের দক্ষিণে সেই উঁচু মালভূমি, যেখান থেকে দাঁড়িয়ে শোন নদের সর্পিল পথরেখা চোখে পড়ে। সেই মালভূমিতে মস্ত দুর্গ ওদের। বিরাট দুর্গ। অনেক লড়াই করেছে তারা সেখান থেকে। সে জায়গা ছেড়ে, এগারো থেকে বারো খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওরা এসে এই জায়গায় বসবাস আরম্ভ করে।

ওঁরাওরা দাবি করে যে, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা নাকি রোটাসগড়ে শিকড় গেড়েছিলেন। কিন্তু ওদের আদি নিবাস কর্ণাটকে, সেখান থেকে নর্মদা নদ বেয়ে উঠে আসে ওরা। তারপর শোন নদের পারে, বিহারে নতুন ঘর বাঁধে। এরাও বলে রোটাসগড়ে এদেরও জবরদস্ত দুর্গ ছিল একটি। কিন্তু এক উৎসব-রাত্রে যখন প্রচণ্ড আনন্দোল্লাসের পর পুরুষেরা পানোন্মত্ত নেশায় অজ্ঞান হয়ে ঘুমুতে থাকে—তখন শত্রুপক্ষ এসে ওদের দুর্গ আক্রমণ করে। একজন পুরুষেরও নাকি তখন যুদ্ধ করার মতো অবস্থা নয়। কেবল মেয়েরাই প্রবল বিক্রমে লড়াই চালায়। এবং পরাজিত হয়।

সেই যুদ্ধে হেরে দুর্গ পরিত্যাগ করে ওঁরাওরা দু’দলে ভাগ হয়ে রোটাসগড় থেকে পালায়। এক দল চলে যায় রাজমহল পাহাড়ের দিকে, অন্যদল পুবে ঘুরে কোয়েল নদী বরাবর এগিয়ে এসে ছোটনাগপুর মালভূমির উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এসে আস্তানা গেড়ে বসে।

খাঁরওয়ার ও ওঁরাও ছাড়া চেরোরাও এমনই একটা গল্প বলে।

গল্পগুলো নাকি সত্যি। যশোয়ন্ত বলছিল এই জেলার নথিপত্রে এসব কথার সত্য নির্ধারিত হয়েছে।

যশোয়ন্ত একদিন ‘পালাম্যুঁ’ নামের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিল।

পালামৌ নামটার আসল উচ্চারণ ‘পালাম্যুঁ’। আসলে এ নামটির ব্যুৎপত্তি একটি দ্রাবিড় শব্দ থেকে। ঐতিহাসিকেরা বলেন, খুব সম্ভব ‘পালাম্যুঁ’ পাল্ আম্ম্ উঁ এই দ্রাবিড় শব্দ ক’টির বিকৃতি। পাল্ মানে দাঁত। আম্ম্ মানে জল এবং উঁ হল বিশিষ্ট বিশেষের বিশেষণ, যথা—গ্রাম, দেশ, জঙ্গল। ঐতিহাসিকদের এই অনুমান একেবারে হাওয়ায় ওড়া নয়। আদিবাসী চেরো প্রধানরা যে-গ্রামে থাকতেন, সে গ্রামের নাম ছিল পালাম্যুঁ। সেই গ্রামেই তাঁদের বহু সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। এই দুর্গবহুল দুর্গম গ্রামের ঠিক নিচ দিয়েই ঔরঙ্গা নদী বয়ে যেত। সেখান থেকে বসে বসে ঔরঙ্গা দেখা যেত। ওই গ্রামের প্রায় কয়েক মাইল ভাঁটিতে এবং উজানে ঔরঙ্গা নদীর কোল, বড় বড় কালো কালো পাথরে ভরা ছিল। বর্ষাকালে যখন নদীতে বান আসত, তখন পাথরগুলো সব দাঁতের মতো উঁচু হয়ে থাকত। তাইনদীর নাম হয়েছিল দাঁত-বের-করা নদী অথবা ‘পালাম্যুঁ’। সেই থেকে জায়গার নামও তাই।

এসব জানতে শুনতে বেশ লাগে। অতি গরিব, সরল হাসিখুশি কুচকুচে কালো ওঁরাও যুবক-যুবতী। ওরা যেন ইতিহাসের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আমাকে কোন দূরে হাতছানি দেয়। ইতিহাস যেন একটি কলরোলা নদী। কোয়েলের মতো। আজ থেকে ন-শো বছর আগে যখন ওরা শ্বেত মোরগ নিবেদন করে ধার্মেসের পুজো দিয়ে এই পালামৌতে এসে প্রথম বাসা বেঁধেছিল সেদিন আর আজকের মধ্যে, যেন বেশি ফাঁক নেই। ইতিহাসের নদী বেয়েই যেন ওরা চলেছে। চলেছে-চলেছে-চলেছেই।

রুমান্ডি পাহাড়ের নীচে যে সুহাগী নদী, সেও গিয়ে মিশেছে কোয়েলে। সুহাগীকে অবশ্য নদী বলা ঠিক নয়—পাহাড়ি ঝোরা বলা ভাল। পালামৌতে একমেবোদ্বিতীয়ম হচ্ছে কোয়েল।

ঔরঙ্গা, আমানত, কানহার এবং অন্যান্য সবাই গিয়ে মিশেছে কোয়েলে। এই সব কটি নদীই অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং সাঙ্ঘাতিক। শুধু যে বর্ষাকালে চকিতে বান আসে তাই নয়, এদের তটরেখায় ও তীরে কোথায় যে চোরাবালি আছে এবং কোথায় যে নেই, তা কেউ জানে না।

আরও কত কিছুর গল্প করত টাবড়। বাইরে হয়তো টিপ-টিপিয়ে বৃষ্টি পড়ত। ঘনান্ধকার বন পাহাড় থেকে কেয়া ফুলের গন্ধবাহী হাওয়া এসে নাকে লাগত। অসহ্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠত নীল জঙ্গলের ময়ূর: কেঁয়া-কেঁয়া। মনটা যেন কেমন উদাস লাগত। যা যা চেয়েছিলাম এবং যা যা পাইনি সেই সব চাওয়া-পাওয়ার দুঃখগুলো একসঙ্গে পুবের কালো মেঘের মতো মনের আকাশে ভিড় করে আসত। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, নিজেকে অত্যন্ত একলা এবং অসহায় মনে হত। মনে হত, এই বন-পাহাড়ের নির্জনতা, এর সুন্দর সত্তার মাঝে আনন্দ যেমন আছে, তেমন আছে দুঃখও। সে দুঃখটা বুনো জানোয়ারের ভয়জাত নয়। তা নিজেকে হারানোর।

হাজার হাজার বছর ধরে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে বিপরীতমুখী ছুটে, তার সঙ্গে লড়াই করে যে পার্থক্য অর্জন করেছি, তার গালভরা নাম দিয়েছি সভ্যতা। ওইসব নির্জন নিরালা মুহূর্তে আমার মনে হত, এই সভ্যতার সত্যিকারের আবরণটি এখনও যথেষ্ট পুরু হয়নি এই এত বছরেও। প্রকৃতির মধ্যে এলেই ঠুনকো আবরণটি খসে যেতে চায়। তখন বোধহয় ভিতরের নগ্ন প্রাকৃত ও সত্যি আমি বেরিয়ে পড়ে—যে সত্য রূপকে আমরা ভয় পাই।

মেলা বসেছে মহুয়াডাঁরে। মে মাসের শেষ থেকে মেলা চলবে সেই জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে লোক যাচ্ছে—নানা জিনিস কিনে আনছে। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী-পুরুষের কলকাকলিতে জঙ্গল-পাহাড়ের পথ মুখর হয়ে উঠেছে। এখানকার এরা হাসতেও জানে। কেবল মহুয়া আর বাজরার ছাতু খেয়ে থেকেও যে ওরা কী করে এত হাসে জানি না। সব সময় হি-হি-হা-হা করছে। কথাবার্তা বললেই বোঝা যায় যে ওরা খুব রসিক। সবচেয়ে আমার যা ভাল লাগে, তা ওদের সরলতা। ভণ্ডামি বলে কোনও শব্দ বোধ হয় ওঁরাওরা জানে না। হেসেই জীবনটাকে উড়িয়ে দিতে যেন শিখেছে বংশ-পরম্পরায়।

আগামীকাল ওদের জেঠ-শিকারি বা মৌসুমী শিকারের দিন। এই শিকার একটি সামাজিক উৎসব। আগে একদিন ছিল, যখন শিকারটাই ওঁরাওদের প্রধান জীবিকা ছিল। আজ আর তা নেই। ওরা খেতি করে, কৃপ কাটে, কেউ কেউ বা দূরে শহরে গিয়ে অন্যান্য নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। ওদের পোশাক-আশাক এবং সামাজিক বাঁধনটাও ঢিলে হয়ে গেছে। শহর-প্রত্যাগত কালো জিন্‌সের ইস্ত্রী-বিহীন ট্রাউজার আর তার উপরে ঘন লাল-রঙা শার্ট এবং হাতে ঘোরতর বেগুনি রুমাল-নেওয়া ওঁরাও যুবকও আজকাল এই জঙ্গুলে পাহাড়েও চোখে পড়ে। তবে পুরনো জীবনযাত্রা ও মূল্যবোধ এখনও পুরোপুরি ধুয়ে মুছে যায়নি।

শিকারে যাবার নেমন্তন্ন আমারও ছিল। টাবড় মুনশি এসেছিল, সঙ্গে মুনশির বড় ছেলে আশোয়াও এসেছিল। কিন্তু যশোয়ন্ত এখানে নেই। ডাল্টনগঞ্জে গেছে। নইহারে থাকলেও একটা খবর পাঠানো যেত। অতএব ওদের সবিনয়ে ‘না’ করে দিলাম।

লক্ষণটাও খুব খারাপ মনে হচ্ছে। দিনে দিনে যশোয়ন্তের সান্নিধ্য একটি সাঙ্ঘাতিক নেশার মতো আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার কল্পনা-রঙিন আরামপ্রিয়তার জগৎ থেকে বাইরের জগতে দূরত্ব-সূচক একটি পা ফেলতে গেলেও যশোয়ন্তের হাত ধরতে ইচ্ছা করে। ওর কর্কশ, চিৎকৃত, বেপরোয়া সঙ্গ, আমি আজকাল আমার প্রেমিকার শরীরের মতোই কামনা করি।

সন্ধ্যাবেলা টাবড়দের দলবল ফিরল শিকার থেকে। তীর ধনুক টাঙ্গি নিয়ে। বলল, একটি বড়কা দাঁতাল শুয়োর, একটি কোটরা এবং একটি শম্বর শিকার করেছে ওরা।

ওদের মধ্যে কেউ কেউ মাংস রোদে শুকিয়ে রেখে দেবে। তারপর টুকরো টুকরো করে কেটে যখন বীজ ছড়াবে ক্ষেতে, সেই ধান কিংবা বাজরা কি মাড়ুয়ার সঙ্গে মাংস দেবে মিশিয়ে। ওদের বিশ্বাস, তাতে ফসল ভাল হবে। শিকার জিনিসটাকে ওরা নিছক শখ বলে জানেনি, তার সাফল্য-অসাফল্যের উপর ওদের কৃষির সাফল্য-অসাফল্য নির্ভরশীল; এ কথা ওঁরাও চাষী আজও বিশ্বাস করে।

বেশ লাগে এই টাবড়দের। টাবড় আমাকে অনেকখানি হরিণের মাংস দিয়ে গেল শালপাতায় মুড়িয়ে। মেটে মেটে দেখতে। বলল, শম্বর খেতে ভাল না, আর শুয়োর হয়তো আপনি খাবেন না, তাই হরিণ দিয়ে গেলাম, জুম্মান রাঁধতে জানে। ভাল করে বেঁধে দেবে।

সেদিন বিকেলের দিকে মেঘ করে এল। সমস্ত পুব-দক্ষিণ এবং দক্ষিণের জঙ্গল পাহাড় সব নতুন করে চোখে ধরা পড়ল।

হঠাৎ মনে হল এদের চিনতাম না। মোটে চিনি না। কালচে আর নীলাভ মেঘে সমস্ত দিকচক্রবাল ভরে গেছে। আকাশ যে কোনও দিন সাদা কি নীল ছিল এখন তা দেখে চেনার উপায় নেই। সেই কালো পটভূমিতে গাছ-গাছালি এবং পাহাড়ের নিজস্ব রঙ বদলে গিয়ে তাদের অন্য রঙের বলে মনে হচ্ছে। যে দিকের জঙ্গলের কোনও নিজস্ব রঙের বাহার ছিল না; দিনের বেলায় যাদের পাটকিলে, ফ্যাকাশে বলে মনে হত, তাদেরও রূপ খুলে গেছে।

নইহারের পথে নয়াতালাও থেকে উড়ে-আসা একঝাঁক কুন্দশুভ্র বক মালার মতো সেই কালো আকাশে দুলতে দুলতে উড়ে চলেছে বুড়হা-করমের দিকে। কতগুলি শকুন, যারা চাহাল চুঙ্‌রুর দিকের মাথা পাহাড়টার নীচের ঘন উপত্যকার উপরে বাঘে-মারা কোনও জানোয়ারের মড়ি লক্ষ করে এতক্ষণ চক্রাকারে উড়ছিল, তারাও অনেক-অনেক উপরে উঠে গেছে। মনে হচ্ছে, ওরা বৃষ্টিকে পথ দেখিয়ে আমাদের রুমান্ডি পাহাড়ে আর সুহাগী নদীতে আনবে বলে মেঘ ফুড়ে উপরে উঠবার চেষ্টা করছে।

ঝাঁকে ঝাঁকে হরিয়াল, রাজঘুঘু, টিয়া, টুঁই মাথার উপর দিয়ে চঞ্চল পাখনায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। সুহাগী গ্রামে আসন্ন বৃষ্টির আগমন শব্দগুলো ঝুম ঝুম করে বাজতে শুরু করেছে। আর এই সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে দূর জঙ্গল থেকে ময়ূরের কেঁয়া-কেঁয়া রব এই আদিগন্ত বন পাহাড়ের বুকের, কেয়া ফুলের গন্ধবাহী বর্ষা বরণের আনন্দে অধীর একটিমাত্র সুর হয়ে, ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে।

কবে যেন শুনেছিলাম, ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া। এখন মনে হচ্ছে, সেই গানটি মেঘ হয়ে, সুহাগী নদীর সোহাগ হয়ে ধীরে ধীরে এই বর্ষা-বিধুর সান্ধ্য প্রকৃতিতে করুণ হয়ে বাজছে।

পৃথিবীতে যে এত ভাললাগা আছে, তা এই রুমান্ডি পাহাড়ে এই গোধূলির মেঘে ঢাকা আলোয় উপস্থিত না থাকলে জানতাম না। প্রকৃতিকে ভালবাসার মতো ব্যথানীল অনুভূতি যে আর নেই, তাও জানতাম না।

এসে গেল—এসে গেল, রুম-ঝুম রুম-ঝুম করে ঘুঙুর পায়ে, সাদা বুটি বসানো নীল ঘাঘরা উড়িয়ে শিলাবৃষ্টি এসে গেল। বর্ষারাণী এসে গেল।

বনের রঙ জলের রঙ মেঘের রঙ সন্ধ্যার রঙ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে চতুর্দিকে নরম সবুজে হলুদে সাদায় এমন একটি অস্পষ্ট ছবির সৃষ্টি হল, আমার বড় সাধ হল যে আবার আমার মায়ের গর্ভে ফিরে গিয়ে নতুন করে জন্মাই। নতুন করে ছোটবেলা থেকে এই রুমান্ডিতে একটি ওঁরাও ছেলের মতো বাঁশি বাজিয়ে বড় হবার অভিজ্ঞতা, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা, মোষের পিঠে চড়ে তিল তিল করে নতুন করে উপভোগ করি।

সাত

সেদিন খাওয়া-দাওয়া সেরে রওনা হওয়া গেল।

বাঁয়ে, দূরে মেঘ মেঘ নেতারহাটের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। মেঘলা আকাশে একটি মেঘস্তম্ভের মতো। প্রায় আধ ঘণ্টাখানেক চলার পর যশোয়ন্ত জিপ থামাল কুরুয়া বলে একটি ছোট গ্রামে। ওঁরাওদের গ্রাম। বেশি হলে পনেরো-কুড়ি ঘর লোকের বাস। এই গ্রামের মোড়লদের বাড়ির গোয়ালঘরে জিপটা ট্রেলার শুদ্ধু ঢুকিয়ে দিল যশোয়ন্ত।

জনাচারেক লোক তৈরি ছিল, তারা শিরিণবুরু থেকে এসেছে আমাদের নিয়ে যেতে। সবচেয়ে মজা লাগল একটি ছোট সুখে-ভরপুর ডুলি দেখে, এই ডুলিতে বৌদি যাবেন।

সুমিতা বৌদি ডুলি দেখেই তো খিল্‌খিল্ করে হাসতে লাগলেন। বললেন, মরে গেলেও এতে চড়তে পারব না। তোমাদের সঙ্গে হেঁটেই যাব। যশোয়ন্ত বলল, আপনি পাগল নাকি? এক মাইল পথ, সবটাই প্রায় চড়াই, হেঁটে যাওয়া সোজা কথা!

বন্দুক আর রাইফেল আমি নিজেই হাতে নিলাম। অন্য লোকের হাতে দেওয়ার জিনিস নয় এগুলো। তাছাড়া গুরু আমার সঙ্গে আছে। বন্দুকের অযত্ন করি, সাধ্য কী?

পাকদণ্ডী রাস্তা। কোথাও চড়াই কোথাও বা উৎরাই। বেশিটাই চড়াই, কখনো পথ গেছে সবুজ উপত্যকার উপর দিয়ে, কোথাও বা ঘন শাল বনের মধ্যে মধ্যে। শটিফুলের মতো কী একরকম রঙিন ফুল ফুটে আছে গাছের গোড়ায় গোড়ায়। নতুন জল পেয়ে ডালে ডালে কত শত কচি কলাপাতা-রঙা পাতা গজিয়ে উঠেছে। সমস্ত জঙ্গল পাহাড় সবে চান-করা সুন্দরী কিশোরীর মতো এই মেঘলা দুপুরে স্বপ্নাতুর চোখে চেয়ে আছে।

বৌদিকে শুধোলাম, কি বৌদি, কষ্ট হচ্ছে নাকি?

বৌদি বললেন, একটুও না।

বৌদি একটি ফিকে কমলা রঙা তাঁতের শাড়ি পরেছেন। গায়ে একটি হালকা সাদা শাল।

ঘোষদার বপু ক্ষীণ নয়। বেশ হাঁপিয়ে পড়েছেন, এবং কিছুটা গিয়েই বলছেন, দাঁড়াও তো ভায়া একটু। আমি আর ঘোষদা দাঁড়াচ্ছি, যশোয়ন্ত আর সুমিতবউদি এগিয়ে যাচ্ছেন। আবার ওঁরা গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন; আমরা ধরছি।

দেখতে দেখতে আমরা বেশ উঁচুতে উঠে এসেছি, বেশ উঁচু। দূরে, কোয়েলের চওড়া গেরুয়া সাদায় মেশানো আঁচল দেখা যাচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ও সবুজ জঙ্গল পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে।

নেতারহাটের পাহাড়টা যেন একেবারে নাকের সামনে। এক একবার নিঃশ্বাস নিলে মনে হচ্ছে যে বুকের যা কিছু গ্লানি সব সাফ হয়ে গেল।

আরও কিছুদূর উঠে একটি বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল একটি ছবির মতো ছোট গ্রাম, পাহাড়ের খাঁজের উপর শান্তিতে বিছানো রয়েছে। কিন্তু এখনও প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিটের রাস্তা।

এমন সময় বৃষ্টি নামল। ঝুপঝুপিয়ে না হলেও টিপটিপিয়েও নয়। দৌড় দৌড়। বৌদি বেচারীর দুরবস্থার একশেষ। শাড়ি-টাড়ি লাল হয়ে গেছে লাল মাটি লেগে। চুল ভিজে গেছে, নাক দিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। জামাকাপড় স্বচ্ছ। ভাগ্যিস শালটা ছিল। নইলে দেবরদের সামনে বউদিকে বেশ বিব্রত হতে হত। একটি ঝাঁকড়া মহুয়া গাছের নীচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা হল, কিন্তু সে গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে যা জমা জল পড়ছিল, তার চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা অনেক ভাল ছিল। ঘোষদা টাকে ঠাণ্ডা লাগাবার ভয়ে রুমাল জড়িয়েছেন। সকলেরই চুল ভিজে এলোমেলো, ঝোড়ো কাকের মতো অবস্থা।

সুমিতা বউদিকে কিন্তু ভেজা অবস্থায় সাধারণ অবস্থার চেয়ে বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে। গালের দুপাশে অলকগুলো ভিজে কুঁকড়ে আছে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চিবুক গড়িয়ে নাক বেয়ে জল নামছে। কোনো প্রসাধন নেই, কোনও আড়াল নেই। ঋজু শরীরে ভেজা পাইন গাছের মতো দেখাচ্ছে বৌদিকে।

আরও বেশ কিছুক্ষণ চলার পর যশোয়ন্ত হাঁক ছেড়ে বলল, পৌঁছ গ্যয়া। তাকিয়ে দেখলাম। আমি যে ভারতবর্ষেই আছি, অন্য কোনও বহুল প্রচারিত সুন্দরী দেশে নেই, তা বুঝতে কষ্ট হল। পরমুহূর্তেই বুঝলাম, আমি ভারতবর্ষেই আছি এবং একমাত্র ভারতবর্ষেই এই নিসর্গ সৌন্দর্য সম্ভব। অন্য কোনও দেশে নয়।

গ্রামের বাড়ি-ঘরগুলো সমতল জায়গায় ইতস্তত ছড়ানো। বাড়িগুলো চতুষ্কোণ নয়, কেমন বেঢপ। যশোয়ন্ত বলছিল, চতুষ্কোণ বাড়ি ওঁরাওদের মতে মাঙ্গলিক নয়। সব কটি বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে একটি দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বন বিভাগের বাংলো বুঝি। শালের খুঁটির উপর দোতলা বাংলো। উপরে টালির ছাদ। বৃষ্টি ধোওয়া কোমল নয়নাভিরাম লাল রঙ। কৃষ্ণচূড়া ও ইউক্যালিপ্‌টাসের সারির মধ্যে মধ্যে দেখা যাচ্ছে।

আমাদের সাদারঙা কাঠের গেট খুলে ঢুকতে দেখেই একটা ছাই-রঙা অ্যাল্‌সেসিয়ান লাফাতে লাফাতে ডাকতে ডাকতে আমাদের দিকে ছুটে এল।

সুমিতা বৌদি হাঁক দিলেন: মারিয়ানা, মারিয়ানা।

ডাকের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলোর বারান্দায় একটি মেয়েকে দেখা গেল। পরনে একটি হালকা সবুজ শাড়ি। ভারি সুন্দর গড়ন। বারান্দার রেলিং-এ একবার হাত দুটো ছুঁইয়েই, শরীরে দোলা দিয়ে আনন্দে কলকলিয়ে বলল, একি তোমরা এসে গেছ! পরক্ষণেই কাঠের পাটাতনে শব্দলহরী তুলে শরতকাশের দ্রুত শ্বেতা মেঘের মতো মারিয়ানা সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এসে সুমিতা বৌদিকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ঈস কী খারাপ। এতদিনে আসবার সময় হল?

সুমিতা বউদি হেসে বললেন, বেশ বাবা বেশ, আমি খুব খারাপ, নইলে এই বৃষ্টিতে কাকের মতো ভিজে, এই পোশাকে তোমাকে দেখতে আসি।

হুঁ। আমাকে দেখতে না আরও কিছু! এসেছ তো শিরিণবুরুর হাতি দেখতে।

যশোয়ন্ত কপট ধমকের সুরে বলল, আঃ মারিয়ানা আমরা এসে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই ঝগড়া শুরু করলেন, দেখছেন না, সঙ্গে নতুন অতিথি আছেন? বলে আমাকে দেখাল।

মারিয়ানা বোধহয় সত্যিই আমাকে লক্ষ করেনি, এখন যশোয়ন্ত বলাতে হঠাৎ নবাগন্তুকের প্রতি চোখ পড়ল। মারিয়ানা হাত তুলে নমস্কার করল, আমি প্রতিনমস্কার করলাম।

মারিয়ানা সুন্দরী নয়, কিন্তু তার চোখ দুটি ভারী সুন্দর লাগল। মানে এত সুন্দর যে, ওর চোখ ছাড়া অন্য কিছু না থাকলেও ক্ষতি ছিল না।

আট

তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। কাঠের দরজার গায়ের ছোট-বড় ফুটো দিয়ে ঘোলা রঙের আলোর আভাস এসে ঘরের অন্ধকারকে জোলো করছে।

বেশ শীত। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছি বাইরে জোর হাওয়া বইছে। কম্বলটা বেশ ভাল করে টেনে কাঁধ ও গলার নিচ দিয়ে জড়িয়ে যথাসম্ভব আরাম করে আর একটি জবরদস্ত ঘুম লাগাবার চেষ্টা করলাম, যতক্ষণ না ভাল করে সকাল হয়। এমন সময় যশোয়ন্ত ওর ঘর থেকে উঠে এসে আমাকে এক ঠেলা মারল। বলল, কেয়া সাহাব? চালিয়ে, জেরা শিকার খেলকে আঁয়ে।

আমি বললাম, এই সুখশয্যা ছেড়ে আমি কোনওরকম শিকারে যেতেই রাজি নই।

যশোয়ন্ত বিনা বাক্যব্যয়ে কম্বলটা একটানে মাটিতে ফেলে দিল এবং অর্ডার করল, দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নাও।

নিরুপায়।

যশোয়ন্ত ওর রাইফেলটা নিয়েছে। আমার হাতে নয়া বন্দুক। হিমেল আমেজ-ভরা হাওয়ায় পার্বত্য প্রকৃতি থেকে ভারী সুবাস বেরুচ্ছে। কোথায় শাল মুড়ি দিয়ে বসে কফি খেতে খেতে মেজাজ করব তা নয়, চলো এখন শিকারে।

ভাগ্যিস মনে মনে বললাম কথাটা। যশোয়ন্ত শুনতে পেলেই লাফিয়ে উঠত, বলত, ওরে আমার মাখনবাবু।

মনে হচ্ছে সুমিতা বউদিরা ওঠেননি এখনও কেউ। বাবুর্চিখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আহা-হা বড় শীত। এক কাপ চা কিংবা কফি খেয়ে বেরোতে পারলে বড় ভাল হত। বাবুর্চিখানার পাশ দিয়ে যেতে যেতে লোভাতুর দৃষ্টি ফেলতে লাগলাম। মনের সাধ মনেই রইল। এমন সময়ে আমাদের দুজনকে চমকে দিয়ে জানালা থেকে মারিয়ানা ডাকল। ওকি? আপনারা চললেন কোথায় এই সকালে?

যশোয়ন্ত বলল, কেন? আপনিই না কাল বললেন, হরিণ না মেরে আনলে খাওয়া নেই। এমনভাবে অতিথি সৎকার করেন, আগে জানলে কি আর আসতাম?

মারিয়ানা হেসে বলল, না না, ভাল হবে না। জল গরম হয়ে গেছে। অন্তত এক কাপ করে কফি খেয়ে যান।

যশোয়ন্ত অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে আকাশ এবং ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, তথাস্তু।

আমরা বাবুর্চিখানার বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি খেলাম। আগুনে একটু গরমও হয়ে নিলাম।

কফি খেতে খেতে বললাম, উইল ফোর্স বলে একটি কথা আছে তো! ইচ্ছার জোর যাবে কোথায়?

যশোয়ন্ত বলল, ভালর জন্যেই বলেছিলাম। খামোকা হয়রাণ হবে, শিকার মিলবে না দেরি করে ফেললে। যা মাখনবাবুর পাল্লায় পড়েছি।

মারিয়ানা একটি সাদা শাল জড়িয়েছে গায়ে, তাতে কালো কাশ্মিরী পাড় বসানো। আগুনের লাল আভা লেগেছে ওর গালের একপাশে, কপালে, অলকে, দুধ্‌লি রাজহাঁসের গায়ে প্রথম ভোরের সোনালি আলো যেমন ছড়িয়ে পড়ে। ও হেসে বলল, ভদ্রলোককে এমন করে নাজেহাল করছেন কেন?

সমবেদনা জানিয়ে মারিয়ানা আমাকে আরও অপ্রতিভ করে তুলল।

কফির কাপ নামিয়ে রেখে আমরা রওয়ানা হলাম। মারিয়ানা বলল, গাড়ুয়া-গুরুং-এর বাম ঢালে নিশ্চয়ই যাবেন কিন্তু। আমার ইনফরমেশান পাক্কা। হরিণ পাবেনই।

একটি পাকদণ্ডী রাস্তা বেয়ে যশোয়ন্ত নিয়ে চলল আমাকে। আঁকাবাঁকা পায়ে চলা পথ নেমে গেছে নীচে। দূরে নেতারহাটের মাথা-উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বহু নীচে কোয়েলের আঁচল বিছানো। পাখিরা সব জেগেছে। শ্বাপদেরা সবে ঘুমুতে গেছে রাতের টহল শেষ করে। আশ্বাপদেরা সবে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে সারারাত সজাগ থাকার পর। ময়ূর ডাকছে। মোরগ ডাকছে থেকে থেকে। ছাতারেদের সম্মিলিত চিৎকার আর বন-টিয়াদের কাকলি এই প্রভাতী হাওয়া মুখরিত করে রেখেছে। গাছে লতায় পাতায় তখনো শিরশির করে হাওয়া বইছে—তখনও জলে ভেজা ঝরা ফুল লতা-পাতায় পথপ্রান্তরে ছেয়ে রয়েছে।

আমরা বেশ অনেকদূর নেমে, একটি মালভূমির মতো জায়গায় এলাম। সেখানে বড় বড় গাছ আছে, কিন্তু বেশি নয়। শাল সেখানে কম। বহেড়া, পন্নন, পুঁইসার, গামহার, ইত্যাদি গাছের ভিড়ই বেশি। কুল ও কেলাউন্দার ঝোপও আছে। যশোয়ন্ত পথে নজর করতে করতে চলেছে, নানা জানোয়ারের পায়ের দাগ।

নরম ভিজে মাটিতে শম্বরের পায়ের দাগ। সজারুদের ছাপও চোখে পড়ল। এক জায়গায় অনেকগুলো সজারুর কাঁটা কুড়িয়ে পেলাম। তার মধ্যে কিছু কাঁটা ভেঙে বেঁকে গেছে। যশোয়ন্ত বলল, হয় এখানে বাঘে কোন সজারু ধরেছে, নয়তো স্থানীয় কোন শিকারী সজারু শিকার করেছে।

গাড়য়া-গুরুং-এর ঢাল যে কোন দিকে তা যশোয়ন্তই জানে।

একটি বাঁক ঘুরতেই আমরা একতাল ছোবড়া-সর্বস্ব হাতির পুরীষের সামনে উপস্থিত হলাম। আশেপাশের গাছের ডালপালা ভাঙা। যশোয়ন্ত বাঁ হাত দিয়ে সেই পুরীষে হাত ছুঁইয়ে দেখল। তারপর কেঁদ গাছের পাতায় হাত মুছতে-মুছতে বলল, এখনও গরম আছে দোস্ত, বেটারা একটু আগেই গেছে। বন-জঙ্গল ভেঙে নিজেদের রাস্তা নিজেরাই করে যেখান দিয়ে কোয়েলের দিকে নেমে গেছে হাতিরা, আমরা তার বিপরীত মুখে চললাম। কারণ, আমাদের আশু উদ্দেশ্য হরিণ শিকার। হাতির দলের সামনে গিয়ে পড়া নয়।

আরও কিছুদূর যেতেই যশোয়ন্ত বলল, বন্দুকে গুলি ভরো। ডানদিকে বুলেট, বাঁ দিকে এল-জি। চলো, আমার আগে আগে চলো, এমনভাবে পা ফেলো যাতে শব্দ না হয়, শুকনো ডাল বাঁচিয়ে, আলগা পাথর বাঁচিয়ে।

মিনিট পনেরো যাবার পর যশোয়ন্ত আমাকে মাটিতে বসে পড়তে বলল। গুরু-বাক্যানুযায়ী বসে পড়লাম। যশোয়ন্ত আমার পাশেই বসল। বসে, একটি ঘন কেলাউন্দার ঝোপের পাশ দিয়ে কী যেন দেখতে লাগল।

এমন সময়ে একটি অতর্কিত আওয়াজ হল, ব্বাক। মনে হল কোনও অ্যালসেশিয়ান কুকুর ডেকে উঠল। সেই সুহাগীর চড়ায় চড়ুই-ভাতির সময় যেমন শুনেছিলাম। ডাকটি অনেকটা সেই রকম। যশোয়ন্ত আঙুল দিয়ে আমাকে কাছে যেতে ইশারা করল। ওর কাছে গিয়ে দেখি, দু’টি ছাগলের চেয়ে বড় হরিণ পাহাড়ের উপরের ঢালে যেখানে কচি-কচি সবুজ ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সেখানে মুখ নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। দুটির মধ্যে একটি আমাদের বিপরীত দিকে পাহাড়ের খাদে কী যেন দেখছে আর ডেকে উঠছে।

যশোয়ন্ত ফিসফিসিয়ে বলল, এল-জি দিয়ে মারো।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে উত্তেজনার বশে, এক সঙ্গে দুটি ট্রিগারই টেনে দিলাম।

হরিণগুলো খুব বেশি দূরে ছিল না। তবু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, একটি হরিণ আমার মতো শিকারীর গুলিতেই সঙ্গে সঙ্গে ওখানেই পড়ে গেল।

আনন্দে অধীর হয়ে আমি লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, অমনি যশোয়ন্ত আমাকে হাত ধরে টেনে বসাল।

অন্য হরিণটি এক দৌড়ে পাহাড়ে উঠছিল। মাঝে-মাঝে গাছপালার আড়ালে আড়ালে তার শরীরের কিছু লালচে অংশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। সেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হরিণটি আমাদের থেকে প্রায় দেড়শ গজ দূরে পৌঁছে গেল এবং হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে কান খাড়া করে আমাদের দিকে চাইল। সেই মুহূর্তে আমাকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়ে যশোয়ন্ত ওর থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলটা এক ঝটকায় তুলল এবং গুলি করল। এবং কী বলব, হরিণটা সার্কাস করতে করতে ডাল-পালা ঝোপ ঝাড় ভেঙে প্রথম হরিণটা যেখানে পড়েছিল, প্রায় তার কাছাকাছি ডিগবাজি খেয়ে গড়াতে-গড়াতে পাহাড় বেয়ে নেমে এসে থেমে গেল।

লোকের মুখে শুনেছিলাম, যশোয়ন্ত ভাল শিকারি। আজ সত্যিকারের প্রত্যয় হল, কত ভাল শিকারি সে।

আমি বললাম, তোমার রাইফেল কি জাদু করা? ও বলল, আরে ইয়ার, জাদু হচ্ছে ভালবাসার জাদু। রাইফেলকে যদি তেমন করে ভালবাসো, তবে রাইফেলও ভালবাসবে তোমাকে।

ততক্ষণে পুবের পাহাড়গুলোর মাথার উপরের আকাশটায় একটু লালচে ছোপ লেগেছে। অবশ্য সামান্য জায়গায় মেঘও করেছে মনে হচ্ছে। যশোয়ন্ত ওর রাইফেলটা আমায় ধরতে দিয়ে, এগিয়ে চলল হরিণ দুটোর কাছে।

প্রথম বন্দুকে প্রথম শিকার করে অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল আমার। এবং হয়তো গর্বও।

হরিণগুলোর কাছে গেলাম। দেখলাম, আমার দুটি গুলিই লেগেছে। বুলেটটা বুকে লেগেছে—একটা রক্তাক্ত ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে বুকে। আর এল-জি দানাগুলো সারা শরীরে ছিটানো রয়েছে। যশোয়ন্ত যে হরিণটা মেরেছিল, তার কাছে গিয়ে দেখি রাইফেলের গুলি গলা দিয়ে একটি চার ইঞ্চি পরিধির গর্ত করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। জিভটা বেরিয়ে গেছে এবং মৃত হরিণটা জিভটা কামড়ে রয়েছে। দু’ চোখের কোণে দু’ বিন্দু জল জমে আছে। এই দৃশ্য দেখে এক লহমায় আমার শিকারের শখ উবে গেল। এত খারাপ লাগল যে কী বলব।

যশোয়ন্তকে বললাম, আমাদের খাবারের জন্যে একটি হরিণই তো যথেষ্ট ছিল তবু তুমি অন্যটাকে মারলে কেন?

ও ধমক দিয়ে বলল, নিজের পেট ভরালে তো চলবে না; গাঁয়ের লোকেরা বড় গরিব। ওরা বছরে একদিনও মাংস খায় কিনা সন্দেহ। ওরা খাবে। ওদের জন্যে মারলাম।

আমি তখন বেশ রেগে বললাম, তা বলে এরকমভাবে মারবে?

এবার যশোয়ন্ত আমার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, তবে কীরকমভাবে মারব? কসাইখানায় যখন পাঁঠা কাটে, তখন পাঁঠার এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট হয়। খাসিকে যখন আড়াই পোঁচ দিয়ে জবাই করা হয়, তখনও খাসির এর চেয়ে বেশি কষ্ট হয়। অষ্টমীর দিন ভোঁতা রামদা দিয়ে যখন আনাড়ি লোক মোষের গলায় কোপের পর কোপ মারে, তখনও মোষের এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট হয়। কষ্ট মানেটা কী? একটি প্রাণ শেষ হবে, আর কষ্ট হবে না। তবে আমরা যেভাবে মারলাম, এর চেয়ে কম কষ্ট দিয়ে জানোয়ার মারা সম্ভব নয়। যাদের এত কষ্টজ্ঞান, তাদের শিকারে আসা উচিত না এবং শিকারের মাংস খাওয়াও অনুচিত।

আমার বক্তব্যটা মোটে বুঝতে পারেনি, তদুপরি এতগুলো রূঢ় কথা বলল। চুপ করে থাকলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, আর কোনওদিন শিকারে যাব না ওর সঙ্গে।

যশোয়ন্ত কোমরে ঝোলানো ছোরাটা দিয়ে একটি শলাই গাছের ডাল কাটল। তারপর ছোরা দিয়ে যে হরিণটা আমি মেরেছিলাম, তার খুরের একটু উপরে চিরে দিল। সামনের দু পা এবং পেছনের পায়েও। তারপর পাতলা মাংসের ভেতর দিয়ে সেই ডালটা গলিয়ে দিল। ফলে হরিণটা চার পায়ে ঝুলে থাকল সেই ডালে। যশোয়ন্ত আমার রুমালটা চাইল এবং নিজের খাকি-রঙা রুমালটাও বের করল। হরিণটাকে ডালটির এক প্রান্তে ঝুলিয়ে তার আগে ও পিছনে রুমাল দুটি কষে বাঁধল, যাতে হরিণের পা হড়কে না যায়। তারপর অবলীলাক্রমে সেই তিরিশ সেরী হরিণটাকে কাঁধে উঠিয়ে বক রাক্ষসের মতো তরতরিয়ে পাহাড় বেয়ে নামতে লাগল। আমাকে অর্ডার করল, রাইফেল বন্দুকে গাছে-টাছে ধাক্কা না লাগে, আমার পেছনে-পেছনে পথ দেখে চলো।

আমরা সবাই ব্রেকফাস্টে বসেছি। মারিয়ানা ও সুমিতা বউদি যদিও আমাদের সঙ্গেই খেতে বসেছেন, তবু ওঁরা দুজনেই নিজেরা খাওয়ার চেয়ে আমাদের খাবারই তদ্বির করছেন বেশি।

ঘোষদাকে দেখলে মনে হয়, খাদ্যদ্রব্যের উপর লোভ থাকাতে অন্য অনেক জ্বালাময়ী রিপুর হাত থেকে উনি বেঁচে গেছেন।

যশোয়ন্ত এই এল হরিণের চামড়া ছাড়িয়ে। গাঁয়ের লোকদের পাঠিয়েছে গাড়ুয়া-গুরুং-এর ঢালে দ্বিতীয় হরিণটি নিয়ে আসতে। রাতে নাকি খুব জোর মহুয়া খাওয়া হবে এবং ভেজ্জা নাচা হবে।

যশোয়ন্ত আমার পাশে এসে বসল। তারপর চওড়া কব্জিওয়ালা হাত দিয়ে থাবা মেরে মেরে খেতে লাগল। ওর হাতে আমি হরিণের রক্তের গন্ধ পাচ্ছিলাম।

মারিয়ানাকে যশোয়ন্ত বলল, মাংসটাকে স্মোক করতে হবে। কাউকে বলুন না, বেশ কিছুটা শুকনো কাঠ এবং খড় পাঠিয়ে দিক। সরষের তেল আর হলুদ আমি মাখিয়ে রেখে এসেছি।

তা বলছি। আপনি আগে খেয়ে নিন তো, তারপর হবে। মারিয়ানা বলল।

সুমিতাবউদি বললেন, তাহলে লালসাহেব, হরিণ শিকার হল? গুরুর নতুন চেলা।

যশোয়ন্ত কোঁৎ কোঁৎ করে দুধ গিলতে গিলতে বলল, এমন চেলা হলে গুরুর জাত যেতে বেশি দেরি নেই। চেলা মরা হরিণ দেখে মেয়েদের মতো কাঁদে।

সুমিতাবউদি হি-হি করে হেসে লুটিয়ে পড়লেন। বললেন, এ মাঃ, তুমি কি সত্যি কেঁদেছ?

ঘোষদা বললেন, কাঁদবেই তো! কোনও ভদ্রলোক এমন করে নিরপরাধ পশুকে মারে?

যশোয়ন্ত বলল, মারিয়ানা, ঘোষদার পাতে আজ এক টুকরো মাংসও যদি পড়ে, তবে খুব খারাপ হবে কিন্তু।

ঘোষদা চটে গিয়ে বললেন, খাওয়ার সঙ্গে কী আছে? খাওয়ার জিনিস খাব না। তবে মারামারি আমি পছন্দ করি না।

মারিয়ানা কথা বলল না। ও শুধু আমার দিকে তাকাল একবার।

বাইরে তখন বেশ রোদ্দুর। কিন্তু এমন ঠাণ্ডা যে, বর্ষাকাল বলে মোটে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পৌষ মাস। বাইরে বেরিয়ে রোদ্দুরে আমরা দুজনে একটু চুপ করে দাঁড়ালাম।

হঠাৎ যশোয়ন্ত আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আজকে তোমার প্রথম শিকারের দিন। অত হতাশ বা দুঃখিত হয়ো না। পৃথিবীতে কারুকে না কারুকে দুঃখ না দিয়ে অন্য কারুকে আনন্দ দেওয়া সম্ভব নয়।

একটু থেমে যশোয়ন্ত বলল, তুমি জানো না লালসাহেব, আজকে রাতে এই শিরিণবুরু গাঁয়ের ভারী গরিব ছেলেমেয়েরা যখন ওই হরিণের মাংস খেয়ে আনন্দে গাইবে, ভেজ্জা নাচবে, কল-কল করে হাসবে, তখন তোমার মনে হবে, হরিণ মেরে ভগবানের কাছে কোনও পাপ যদি করেও থাক, সে পাপের প্রায়শ্চিত্তও করেছ। লালসাহেব, ন্যায়-অন্যায়টা রিলেটিভ ব্যাপার।

চুপ করে শুনছিলাম ওর কথা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, মারিয়ানা, সুমিতাবউদি এবং ঘোষদা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আমাদের দিকে আসতে লাগলেন। সুমিতাবউদি ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললেন, মহুয়াসিঁড়ি নদীর ধারে দুপুরে চড়ুইভাতি হবে নাকি?

যশোয়ন্ত আবার সেই পুরনো যশোয়ন্ত হয়ে হেসে বলল, নিশ্চয়ই হবে। আমি তোমাদের বাঁশপোড়া কোটরার কাবাব খাওয়াব।

মারিয়ানা বলল, আমি ভিনিগার দিয়ে ভিজিয়ে রেখে এসেছি কিছু মাংস, বিকেলে তোমাদের মাংসের চাটনি খাওয়াব।

তা তো হল; এখন হাতি দেখাবে না আমাদের?

তোমাদের হাতি দেখাতে হলে তো পর্বতের মতো হাতিকে মহম্মদের কাছে আসতে বলতে হয়। বলল যশোয়ন্ত।

মারিয়ানা বলল, ইস ভারী তো দেমাক আপনার। আপনি ছাড়া বুঝি আর কেউ এখানে নেই?

তারপর মারিয়ানা লিড করল। সকালে আমরা যে পথে গিয়েছি, সে পথে নয়, অন্য পথে। কিন্তু পথটা খাড়া চড়াই। মারিয়ানা একটি সাদা খরগোশের মতো তরতরিয়ে উঠতে লাগল। বেশ অনেকখানি খাড়া উঠলাম। আমাদেরই বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েদের হবারই কথা। কিন্তু উপরে উঠে যা দৃশ্য দেখলাম, তাতে চোখ জুড়িয়ে গেল। আমরা বোধহয় একটি পাহাড়ের একেবারে মাথায় উঠেছি। নীচে খাড়া খাদ এবং সেই খাদ গিয়ে কোয়েলের উপত্যকায় মিশেছে। মাইলের পর মাইল ঘন অবিচ্ছেদ্য জঙ্গল। দুটি শকুন উড়ছে আমাদের পায়ের নীচে চক্রাকারে। বাঘ কিংবা চিতা কোনও জানোয়ার মেরে রেখেছে বোধ হয় জঙ্গলে।

পুবে সূর্য উঠে এখন প্রায় মাথার কাছাকাছি আসব আসব করছে। সমস্ত বৃষ্টিস্নাত উপত্যকা কাঁচা রোদে ঝলমল করছে।

যশোয়ন্ত বলল, ডাইনে-বাঁয়ে ভাল করে নজর করো। কোনও কিছু নড়লে-চড়লেই বলবে। প্রায় মিনিট পাঁচেক আমরা নির্বাক সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনও কিছুই নজরে পড়ল না। হতাশ হয়ে নেমে যাব, এমন সময় প্রায় আমাদের পায়ের নীচের গভীর ও ঘনান্ধকার উপত্যকা থেকে মার্সিডিস ট্রাকের হর্নের মতো একটি আওয়াজ শোনা গেল। পরপর দুবার।

যশোয়ন্ত বলল, হাতির দল চরতে-চরতে একেবারে পাহাড়ের গোড়ায় চলে এসেছে। পাহাড়টা এদিকে এত খাড়া যে, হাতি যে উঠে আসবে সে সম্ভাবনা নেই। কাউকে না বলে, হঠাৎ যশোয়ন্ত দুটো বিরাট পাথর গড়িয়ে দিল উপর থেকে নীচে। পাথরগুলো কড়-কড় শব্দ করে নীচে গড়িয়ে যেতে লাগল। কিন্তু গাছপালার জন্যে নীচে অবধি পৌঁছল বলে মনে হল না। তারপর যশোয়ন্ত আর একটি পাথর ‘পুটিং দি শট’ ছোঁড়ার মতো করে নীচে ছুঁড়ল। এবং সে পাথরটা নীচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো-বা কোনও হাতির গায়েই পড়ে থাকবে, নীচের জঙ্গলে একটি আলোড়নের সৃষ্টি হল। তারপর যা দেখলাম তা ভোলার নয়। অত বড় বড় হাতি চার পা তুলে যে কত জোরে দৌড়য়, জঙ্গলে তা না দেখলে বিশ্বাস হত না। একটা ঘাসে ভরা মাঠ পেরুবার সময় দেখা গেল।

ঘোষদা বললেন, ইস কী ডেঞ্জারাস। ওদিকে না গিয়ে যদি এদিকে আসত? এসব খুনে লোকদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে বেরুনোও বিপদ।

হাতির দল প্রচণ্ড শব্দে দৌড়তে দৌড়তে চোখের নিমেষে গিয়ে আরও গভীর জঙ্গলে পৌঁছল। সেখানে তাদের আর দেখা যাচ্ছিল না।

মারিয়ানা বলল, কেমন? হাতি দেখালাম তো।

এবার নামার পালা। আমরা সবাই নামতে লাগলাম। হঠাৎ সুমিতাবউদি বললেন, এই তোমরা একটু এগোও, আমি এক্ষুনি আসছি।

আমরা সকলে এগিয়ে গেলাম। পরে বউদি এসে আমাদের ধরলেন।

যশোয়ন্ত বলে উঠল, এটা অত্যন্ত অন্যায়। একটুও ফ্র্যাঙ্ক হতে পারেন না? সুমিতাবউদি অবাক এবং কিঞ্চিৎ বিরক্ত গলায় শুধোলেন, কীসের ফ্র্যাঙ্ক? মানে বুঝলাম না তোমার কথার।

যশোয়ন্ত বলল, সে গল্প জানেন না? আমার হাজারিবাগী খুরশেদের গল্প। খুরশেদের সঙ্গে শিকারে গেছি। সে মেমসাহেবের গল্প বলছে, যে মেমসাহেব আগে নাকি ওখানে শিকারে এসেছিল। খুরশেদ ইংরাজি বলে, ‘টেক-টেক নো-টেক একবার তো সি’ গোছের। সে বলল, ক্যা কহে হুজৌর উ মেমসাব ইতনি ফ্র্যাঙ্ক থি। বেশক ফ্র্যাঙ্ক। শুধোলাম, মানে? সঙ্গে সঙ্গে খুরশেদ বলল, হামলোগ হিঁয়া বৈঠকে গপ কর রহা হ্যায় ঔর মেমসাব হুঁয়াই বৈঠকে হিসি কর রহি হ্যায়। কেয়া ফ্র্যাঙ্ক!

যশোয়ন্তের এই গল্প শুনে সুমিতাবউদি এবং মারিয়ানা দুজনে একসঙ্গে নাভি থেকে নিশ্বাস তুলে বললেন, ই-স-স কী-খারাপ! বলেই সুমিতাবউদি হাসতে লাগলেন। ঘোষদা ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। যশোয়ন্ত সেই হাসির তোড়ের মাঝে বলল, কই, আপনারা তো জঙ্গলে ফ্র্যাঙ্ক নন!

মারিয়ানা সত্যিই লজ্জা পেয়েছে। একবার একটু ফিক করে হেসে গম্ভীর হয়ে গেছে।

যশোয়ন্তটাকে নিয়ে একদম পারা যায় না। এমন অনেক পুরুষালি রসিকতা ও মজার কথা আছে যা পুরুষদের কাছে অবলীলাক্রমে বলা চলে, কিন্তু মেয়েদের সামনে ভুলেও বলা চলে না। কিন্তু কে বোঝাবে? এটা একটা জংলি। একেবারে আকাট জংলি। একে সভ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বেশ ভাল খাওয়া হল দুপুরে। মুরগির ঝোল আর ভাত। খাওয়ার পর সুমিতাউদি বললেন, আমি একটু জিরিয়ে নিচ্ছি ভাই, তোমরা কিছু মনে কোরো না। বড় খাড়া ছিল পাহাড়টা।

ঘোষদা আগেই গিয়ে বিছানা নিয়েছেন। যশোয়ন্ত একটি শালপাতার চুট্টা ধরিয়ে বারান্দায় পায়চারি করে বেড়ালো কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমিও একটু গড়িয়ে নিই, রাতে আবার ভেজ্জা নাচতে হবে। তারপরই শুধোলো, গাঁয়ে সেই সুন্দরী মেয়েটি আছে তো? না অন্য গ্রামে চলে গেছে বিয়ে হয়ে? কি মারিয়ানা? মারিয়ানা হেসে বলল, আছে। আপনি এসেছেন এ খবরও সে পেয়েছে। খবর পেয়েই হাসতে আরম্ভ করেছে। বলছে, পাগলটা আবার এসেছে।

আমি বললাম, হ্যাঁ পাগল না ন্যাকা-পাগল।

মারিয়ানা মুখ নিচু করে হাসতে লাগল।

যশোয়ন্তকে বলল, এমন চেলা বানিয়েছেন যে, গুরুর গুরুত্ব থাকলে হয়। যশোয়ন্ত বলল, ওসব কথা শোনেন কেন?

যশোয়ন্ত ঘরে গেল শুতে। আমি ইজিচেয়ারে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, চুপ করে বসে এই অপূর্ব শিরিণবুরুর একটি প্রশান্ত দুপুরকে ধীরে ধীরে বিকেলে গড়িয়ে যেতে দেখব। সেই আপাততুচ্ছ সম্পদ, সেই বিচিত্র, আনন্দময় দৃশ্যকে সকলে দেখতে পারে না। সকলের সে চোখ নেই। সিনেমাটোগ্রাফি অত্যন্ত সার্থক শিল্প, কারণ তাতে অডিও-ভিসুয়াল এফেক্ট আছে। কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি আমার রুমান্ডির বাংলোয় বসে প্রতিদিন রূপে-রসে-বর্ণে-গন্ধে ভরা যে সিনেমা রোজ দেখি, সেই পর্যায়ে কোনও দিন কোনও আর্ট পৌঁছবে কিনা জানি না। প্রকৃতি নিজের হাতে তুলি ধরে নিজের হাতে বাঁশি ধরে সেই ছবি রোজ আঁকেন, আবার রোজ মুছে ফেলেন। অথচ প্রতিদিনের ছবিই বিচিত্র। কোনও ছবিই অন্য কোনও ছবির প্রতিভূ নয়।

মারিয়ানা কোথায় গিয়েছিল জানি না, হঠাৎ বারান্দা আলো করে ফিরে এল। বলল, মশলা খাবেন? বললাম, দিন।

একটি ছোট জাপানি কাচের রেকাবিতে একমুঠো দারুচিনি-লবঙ্গ-এলাচ এনে মারিয়ানা হাত বাড়াল।

বলল, আপনি বুঝি দুপুরে ঘুমোন না?

আমি বললাম, মোটেই না। মানে, চেষ্টা করলেও পারি না।

ও হেসে বলল, আমার মতো।

আমি শুধোলাম, এখানে আপনার একা একা লাগে না? একদম একা একা থাকেন?

মাঝে মাঝে যে একা, খুবই একা লাগে না তা নয়, তবে বেশির ভাগ সময়ই লাগে না। স্কুল তো আছেই—তাছাড়া জোত-জমি দেখাশুনা করি, মুরগি ও গরুর তত্ত্বাবধান করি, একটু আধটু বাগান করি, তাতেই একসারসাইজ-কে একসারসাইজ এবং সময় কাটানো-কে সময় কাটানো হয়। বাদবাকি সময়ে পড়াশুনা করি। এবং পড়াই তা তো জানেনই।

আমার কিন্তু এই বন-পাহাড় ভাল লাগে। ছোটবেলা থেকেই ভাল লাগে।

আমি শুধোলাম, কীসের পড়াশুনা? কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে নিশ্চয়ই?

মারিয়ানা বলল, কোনও বিশেষ বিষয় নিয়ে নয়। যা পড়তে ইচ্ছা হয় তাই পড়ি। তবে বেশির ভাগই সাহিত্যের বই। ইদানিং একটু-আধটু ছবিও আঁকার চেষ্টা করি।

কী আঁকেন? ল্যান্ডস্কেপ?

না! না! আমি এমনি হিজিবিজি এলোমেলো রঙ বোলাই। বোলাতে বোলাতে কোনওটা বা কোনও ছবিতে দাঁড়ায়। ছবি মানে বিভিন্ন রঙের সুরুচিসম্পন্ন সমষ্টি মাত্র। আবার কোনওটা বা কিছুই হয় না। ছিঁড়ে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু আঁকতে পারি আর নাই পারি, নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য এত ভাল হবি আর কিছু নেই।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত গলায়, এত নতুন পরিচয়ে বলাটা সমীচীন হবে কি না ভেবে বললাম, ভোলাবার প্রয়োজনই বা কী নিজেকে?

মারিয়ানা একরাশ বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, হয়তো বা আছে প্রয়োজন। নিজেকে মাঝে মাঝে ভোলাবার প্রয়োজন কার না আছে? তারপর বলল, প্রায় হঠাৎই, চলুন আমার পড়ার ঘর এবং বাড়িটা আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাই।

চলুন।

কোন ব্যক্তির পড়ার ঘর বা স্টাডিতে যেতে আমার খুব ভাল লাগে। সেই ঘরটি যেন সেই বিশেষ লোকটির মনের আয়না। অবশ্য, যাঁরা সত্যিকারের সে ঘর ব্যবহার করেন। অনেকে লোক দেখাবার জন্যে যেমন ঘর সাজিয়ে রাখেন তেমন ঘর নয়। যে ঘর ব্যবহৃত হয়, সে ঘর দেখলেই বোঝা যায়। সে ঘরে তার ব্যক্তিত্বের অনেকখানি ছড়িয়ে থাকে।

মারিয়ানার দোতলা কাঠের বাংলোটির চারপাশে চওড়া ঘোরানো কাঠের বারান্দা। সামনে-পেছনে দুটি করে ঘর। পেছনে পশ্চিমমুখো একটি ছোট ঘর।

স্টাডিটি ছোট—আগে ওর বাবার ছিল। পুরো পশ্চিম দিকটাতে দেওয়াল নেই। কাচের জানালা। ভেতরে পরদা ঝুলছে। তবে সে পরদা পুরোটা সরানো। একটি টেবিল। বেতের কাজ করা একটি টেবিলবাতি। চতুর্দিকে দেওয়ালে বসানো আলমারিতে সারি সারি রাশি রাশি বই। মেঝেতে একটি সাদা মোটা গাল্‌চে পাতা। যে চেয়ারে বসে ও পড়াশুনা করে, সেই চেয়ারটির উপরে একটি হরিণের চামড়া পাতা। টেবিলের উপরেও ইতস্তত অনেক বই ও কাগজপত্র ছড়ানো। কালি কলম টেবিলের উপর। ঘরটা থেকে একটি মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে—হয় মারিয়ানা যে তেল মাখে মাথায়, সে তেলের গন্ধ, নয়তো যে আতর বা অন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে, তার সুবাস এই ঘরের আবহাওয়ায় ভরে রয়েছে। এই বুঝি মারিয়ানার মনের গন্ধ।

মারিয়ানা বলল, বসুন না, আমার চেয়ারে বসুন।

আমি অবাক হলাম। বললাম, কেন?

আহা, বসুনই না।

বসলাম। বসে যা দেখলাম, তা একেবারে হৃদয়-ভোলানো। পুরো কাচের জানালা দিয়ে আদিগন্ত যতদূর দেখা যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়, জঙ্গল আর জঙ্গল। বহুদূরে বেশ চওড়া একটি নদীর রেখা দেখা যাচ্ছে। মারিয়ানা জানাল, ঔরঙ্গা নদী, কোয়েলে গিয়ে মিশেছে।

সবুজের যে কত রকম বৈচিত্র্য, তা এই ঘরে বসে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা যায়। এই রকম একটি স্টাডি পেলে সারাজীবন আমি আনন্দে কাটাতে পারি—আর কোনও জাগতিক কিছুর উপর আমার লোভ নেই।

মারিয়ানাকে বললাম কথাটা। মারিয়ানা হাসল। বলল, বেশ তো, যখন খুশি আসবেন, এলেই আমি এই স্টাডি আপনাকে ছেড়ে দেব। যে ক’ দিন থাকবেন, সে ক’ দিন এ স্টাডি আপনার।

উত্তরে চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম, এ রকম ঘর তো মনেরই একটি কোণ, এতে কি দূর থেকে এসে কেউ বসতে পারে? না, এ ঘরে কাউকে কেউ বসাতে পারে?

মারিয়ানা অনেকক্ষণ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

স্টাডির দেওয়ালে, চেয়ারে বসে সামনাসামনি চোখে পড়ে এমন জায়গায় পাশাপাশি দুটি ফটো। একখানা ফটো কেমন ব্যথাতুর বিশীর্ণ মুখ, চশমা-চোখ ভদ্রলোকের। সমস্ত মিলিয়ে এক মনীষী-সুলভ পরিমণ্ডল। মারিয়ানা বলল, আমার বাবা। তার পাশে আর একখানা ফটো কমবয়স্ক এক ভদ্রলোকের। বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। পরনে সাহেবি পোশাক। মাথায় ঘন কোঁকড়া চুল উলটো করে ফেরানো। ভারি সুন্দর ও অভিব্যক্তিময় চোখ। যেন অনেক কিছু না-বলা কথা বয়ে নিয়ে বেড়ানো। মানে, এমন একটি মুখ, যা একশো লোকের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়বে।

মারিয়ানা বলল, সুগত রায়চৌধুরী। আর্কিটেক্ট। কলকাতায় চাকরি করেন। লেখেনও। ওঁর কোনও লেখা পড়েননি?

বাঃ ভারি ইমপ্রেসিভ চেহারা তো। না, লেখা পড়িনি।

ভদ্রলোক মারিয়ানার কে হন তা মারিয়ানা বলল না। আমিও জিজ্ঞেস করলাম না।

আমরা ফিরে এসে বারান্দায় বসলাম। হাওয়াটা বেশ জোরে বইছে। পাহাড়টার নীচে বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশটা আবার কালো করে এল। মারিয়ানা ঘর থেকে একটি পশমি শাল নিয়ে এল। জড়িয়ে বসল গায়ে।

বারান্দা থেকে বাঁদিকে চাইলে একটি বেশ উঁচু পাহাড়ের চুড়ো দেখা যায়। ঘন বনে ছেয়ে আছে সমস্ত পাহাড়। মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চুড়ো। আমি শুধোলাম, পাহাড়টার নাম কী?

মারিয়ানা ঘুরে বসে বলল, ওই তো মুচুকরানির পাহাড়। ওই পাহাড়ের নাম বহুরাজ। খাঁরওয়ারেরা ওখানে পুজো দেয়। মুচুকরানির নইহার বলে ওই পাহাড়টাকে।

বলুন না, কী করে পুজো করে? কী দেবতা মুচুকরানি?

সে তো অনেক কথা। অল্পের মধ্যে আপনাকে বলছি। মুচুকরানি খাঁরওয়ারদের সবচেয়ে প্রিয় দেবতা। অনেকে এঁকে দুর্যাগিয়া দেওতাও বলে। এখন আর তেমন হাঁক-ডাক নেই। খাঁরওয়ারেরা আজকাল অনেকে ক্রিশ্চান হয়ে গেছে। আমরা ছোটবেলায় এখানে মুচুকরানির যা বিয়ে দেখেছি, তা ভোলবার নয়। এখনও যে হয় না তা নয়, তবে সেই প্রাণ আর নেই।

কীরকম?

দেখতাম, বছরে তিনবার করে বিয়ে হত। ওই বহুরাজ পাহাড়ের ওপারে জুড়য়াহার গ্রাম। গ্রামের লোকেরা ভোরবেলা স্নান সেরে একটি দোলানী সুরের গান গাইতে গাইতে বহুরাজ পাহাড়ে উঠত। সঙ্গে উক্কামন্দ্ গ্রামের লোকেরাও জুটত। তারা হচ্ছে মুচুকরানির বাবার গ্রামের লোক। সেই দোলানী গানের সুর এখনও কানে ভাসে আমার। পাহাড়ে পাহাড়ে কেঁপে কেঁপে সকালের রোদ্দুরে সেই গান আমাদের শিরিণবুরুতে এসে পৌঁছত। ওরা গাইতে গাইতে বহুরাজ পাহাড়ের মাথায় উঠে যেত। ওই পাহাড়েরই গুহায় মুচুকরানির বাস। মুচুকরানির ছোট সুডৌল সিঁদুরচৰ্চিত মূর্তিখানি পুরোহিত নামিয়ে আনতেন। রানির মাথায় এক ফালি তসর সিল্কের পট্টি জড়িয়ে দেওয়া হত—বসানো হত একটি নতুন দোহরের উপর। তারপর একটি বাঁশের পালকিতে রানিকে চড়িয়ে তারা নেমে আসত পাহাড় বেয়ে।

পুরোহিত সবচেয়ে আগে নামতেন, নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে। রানিকে এনে একটি বিরাট বটগাছের তলায় রাখা হত জুড়ুয়াহারে। সেখান থেকে বরের বাড়ি উক্বামন্দে রওনা হত কনেযাত্রীরা রানিকে নিয়ে। উক্কামন্দে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক উপহার সামগ্রী এসে পৌঁছাত মুচুকরানির সামনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী চোখে চেয়ে থাকত। আমরাও যেতাম। বাবা আমাদের বহুবার নিয়ে গেছেন দেখতে। মারিয়ানা থেমে গেল, বলল, আর শুনতে আপনার ভাল লাগবে?

আমি বললাম, দারুণ লাগছে, প্লিজ বলুন।

উক্বামন্দের কণাদি পাহাড়ে থাকতেন মুচুকরানির বর। বরের বর্গ হচ্ছে অগোরা। তারপর সেই বটগাছের তলা থেকে আবার নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে ওরা সকলে উঠতো কণাদি পাহাড়ে। বরের গুহায় পৌঁছবার জন্য।

প্রবাদ ছিল যে, কণাদি পাহাড়ের সেই গুহার নাকি তল নেই। সমস্ত পাহাড়টারই নাকি মাঝখানে ফাঁপা। সুড়ঙ্গ নেমে গেছে কত যে নীচে, তার খোঁজ কেউ রাখে না। সেখানে পৌঁছে মুচুকরানিকে আবার পূজা দিয়ে পালকি থেকে নামানো হত। তারপর বর যেখানে বসে থাকতেন, গুহার ভেতরে একটি পাথরের খাঁজে, সেখানে তাঁকে বরের পাশে রেখে আসা হত। পুরোহিত একটি বড় পাথর নিয়ে সেই গুহায় গড়িয়ে দিতেন। সেই অতল গুহাতে পাথরটি ধাক্কা খেতে খেতে শব্দ করে গড়িয়ে চলত নীচে। তখন বাইরে সমবেত গ্রামবাসী নিঃশব্দে ও সভয়ে দাঁড়িয়ে সেই শব্দ শুনত।

গুহাটি এতই গভীর ছিল যে, বহুক্ষণ পর্যন্ত ওই শব্দ শোনা যেত। তারপর সব স্তব্ধ হয়ে গেলে, মনে করা হত যে, মুচুকরানি ও তার অগোরা বরের শুভবিবাহ সম্পন্ন হল। তখন ওরা সবাই আনন্দ করতে করতে পাহাড় থেকে নেমে আসত এবং সন্ধেবেলায় নেচে-গেয়ে বিবাহ উৎসব শেষ করত।

এই অবধি বলে মারিয়ানা চুপ করল।

মনে হল, মারিয়ানার গল্প যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। ওই জুডুয়াহার গ্রামের খাঁরওয়ারদের সঙ্গে আমিও যেন মারিয়ানার মতো কোনওদিন মুচুকরানির বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম। চোখের সামনে সব যেন সত্যি হয়ে উঠেছিল ওর গল্প শুনতে শুনতে।

এক সময় দেখতে দেখতে সন্ধে নেমে এল। সন্ধে হবার প্রায় পরেই মারিয়ানার বাংলোর গেট পেরিয়ে দু’জন চারজন করে মেয়ে-পুরুষ এসে জুটতে লাগল। বাংলোর হাতার পেছনে ও-পাশের খাদের দিকে একটা ঝাঁকড়া চেরি গাছের তলায় আগুনের ব্যবস্থা করা হয়েছে দেখলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেল থেকেই। তবে দমকা হাওয়াটা নানা রকম মিষ্টি সুবাস খাদ থেকে বয়ে এনে সমস্ত বাগানে উথাল-পাথাল করছে। আমরা একে একে জড়ো হলাম সেই গাছের নীচে। মারিয়ানা বেতের চেয়ার পাতিয়ে দিয়েছে। আগুনটাও বেশ গনগনে হয়ে উঠেছে। আমরা একেবারে ভি-আই-পি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছি। সকলেই বেশ আরামে বসে নাচ দেখার জন্যে তৈরি।

যশোয়ন্ত ওদের সঙ্গে নাচবে। ছেলেরা ও মেয়েরা সামনি-সামনি এক লাইলে দাঁড়াল। মেয়েদের পরনে শুধু শাড়ি। বুকের ওপর দিয়ে ঘোরানো। হাঁটুর নিচ অবধি শাড়ি। বেশির ভাগই সাদা হাতে-বোনা মোটা পাড়ের শাড়ি। লাল এবং সবুজ পাড়ই বেশি। মাথার চুলে ভাল করে তেল মেখেছে। ঘাড়ের এক পাশে হেলিয়ে খোঁপা বেঁধেছে। খোঁপায় নানা রকমের ফুল গুঁজেছে প্রত্যেকে। জংলি মেয়েদের গায়ে বাঘের গায়ের মতো কেমন যেন একটি নিজস্ব গন্ধ আছে। তেলের গন্ধ, চুলের গন্ধ, শারীরিক পরিশ্রমজনিত ঘামের গন্ধ, সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা বিজাতীয় ভাব। ওদের দূর থেকে দেখতে ভাল লাগে, মনে মনে কল্পনায় আদর করতে ভাল লাগে, কিন্তু ওদের কাছে গেলে, তখন ওরা যতই আমন্ত্রণ হাসি হাসুক না কেন, কেমন গা রি-রি করে। কেন হয়, জানি না।

যশোয়ন্তের কিন্তু ও-সব কোনও সংস্কার নেই। মনে-প্রাণে জংলি ও। সত্যি সত্যিই জংলি—সেটা ওর মুখোশ নয়।

একটি ভারী আমেজ-ভরা ঘুমপাড়ানি গানের সঙ্গে সঙ্গে ওরা নাচ আরম্ভ করল। ছেলেরা ও মেয়েরা একেবারে একে অন্যের কাছে চলে আসছে। আগুনের আভায় মেয়েদের মুখের লজ্জা ঢাকা থাকছে না। ছেলেরা দুষ্টুমিভরা চোখে হাসছে।

ওরা দুলে দুলে গান গাইছে, মাথা হেলাচ্ছে, ভঙ্গুর গ্রীবা-ভঙ্গিমায় গুনগুনিয়ে গাইছে।

দেখতে দেখতে সমস্ত জায়গাটার যেন চেহারা পালটে গেল। মাদলগুলো হয়ে উঠল পাগল। পায়ের তালে তালে, কোমর দোলানোর ছন্দে, আঁখির ঠারে ঠারে ওরা নাচতে লাগল।

যশোয়ন্ত কিন্তু ওর অলিভ গ্রিন ট্রাউজার ছেড়ে ওদের মতো ধুতি পরেছে। ও যে কতখানি সুপুরুষ, তা ওই ওঁরাও যুবকদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পটভূমিতেও প্রতীয়মান হচ্ছে। পায়ের মাংসপেশী থেকে আরম্ভ করে গ্রীবার গড়ন পর্যন্ত কোনও জায়গায় কোনও অসঙ্গতি নেই। যৌবনের চিকন চিতাবাঘের মতো ও সর্পিণী মেয়েগুলোর সঙ্গে নাচছে।

মারিয়ানা কানের কাছে ফিস্ ফিস্ করে গানের মানে বলছিল, এই নাচের নাম ভেজ্জা নাচ। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে এভাবে নাচলেই তাকে ভেজ্জা নাচ বলে। যে গানটি ওরা আজ গাইছে তার মানে হল:

এই দাদা, তুই আমাকে জামপাতা এনে দিলে,

তোর সঙ্গে আমি ভেজ্জা নাচব;

কানে জামপাতা পরব।

যদি আনিস্, তবে তোর সঙ্গে ভেজ্জা নাচব;

নিশ্চয় আনিস কিন্তুরে দাদা।

ঈস খারাপ।

ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা একসঙ্গে নাচে,

ঈস কী খারাপ—

যখন ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে নাচে,

তখন নাচতে নাচতে ভোর হয়ে এলে,

ছেলেদের কক্ষনও বিশ্বাস করতে নেই।

এই জুড়ি, অসভ্য।

আমার গা থেকে হাত সরাও না,

দেখছ না। নাচতে নাচতে আমার শাড়ি আলগা হয়ে গেছে।

তাই হোক, আলগা হয়ে খুলে পড়ুক,

নাচের সময় তো শেষই হয়ে এল।

ধীরে ধীরে নাচের বেগ আরও দ্রুত হতে লাগল। তারপর, সেই বর্ষণসিক্ত হিমেল রাতকে আর চেনা গেল না। মনে হতে লাগল, এ এক আলাদা রাত—অন্য কোন পৃথিবীর প্রাণের গল্প নিয়ে পিদিম জ্বেলে এ-রাত আমাদের জন্যে অনেক আনন্দের পশরা সাজিয়ে এনেছে।

“…ঈস কী খারাপ—ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে নাচে। ঈস কী খারাপ…। এই দাদা জামপাতা এনে দিবি? এই দাদা জামপাতা এনে দিবি?”

নাচে গানে মিলে, ছেলে-মেয়েদের মুখভরা হাসি আর চোখভরা প্রাঞ্জলতায় কেমন যেন নেশার মতো হয়েছিল। নেশায় বুঁদ হয়েছিলাম। এমন সময় ফটাং করে একটি বেরসিক আওয়াজ হল। যশোয়ন্ত নাচ ছেড়ে দৌড়ে এল। দৌড়ে এসে আগুন থেকে বাঁশের টুকরোটা বের করল। ওখানেই বেতের চেয়ারে বসে আমরা বাঁশ-পোড়া খেলাম। সত্যি! কোথায় লাগে কাবাব। জিভে দিতে না দিতে গলে যায়। দারুণ!

নাচ চলল প্রায় রাত ন’টা অবধি। এ নাচ তো আমাদের দেখানোর জন্যে। ওরা যখন গাঁয়ের মধ্যে সত্যি ভেজ্জা নাচে, তখন সারারাত তো বটেই, সকালের দু এক প্রহর অবধি নাচ গড়ায়।

চমৎকার কাটল সন্ধেটা। রুমান্ডির একাকিত্বে অভ্যস্ত মনটা অনেকদিন পর এত লোক, এত নাচ, এত হইচই দেখে আনন্দে চমকে চমকে উঠল।

সুমিতাবউদি যশোয়ন্তের শিরিণবুরুর প্রেয়সীকে ওঁর একটি শান্তিনিকেতনী ফুল-তোলা কাপড়ের শাল দিলেন। মেয়েটা হাসতেও পারে। বসন্তকালের হাওয়ায় দোলা-লাগা মাধবীলতার মতো কেবলই নুয়ে নুয়ে হাসে, পুষ্পভারাবনত স্তবকের মতো শরীরটা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে হাসে।

যশোয়ন্ত আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল, কী লালসাহেব, হরিণটা মারার জন্যে আমাকে ক্ষমা করেছ তো? বলো, একটি বীভৎস দৃশ্যের বিনিময়ে এতগুলো আনন্দোজ্জ্বল মুখ দেখতে পেলে কি না? ওরা বছরে ভাত এবং মাংস যে ক’বার খায়, তা গুনে বলা যায়।

সত্যি সত্যি ক্ষমা করতে পারলাম কি না জানি না, তবু মনে হল যশোয়ন্তই ঠিক। ওকে যেমন করে বলেছিলাম সকালে, তেমন করে বলা ঠিক হয়নি। তবে এটুকু বুঝলাম যে, সেই সকালের মৃত হরিণের রক্তাক্ত দুঃখে যদি কোনও ফাঁকি না থেকে থাকে, এদের আজকের সন্ধ্যার আনন্দেও কোনও ফাঁকি নেই।

নয়

ফিরে এসে রুমান্ডিতে আবার বেশ গুছিয়ে বসেছি। তবে আমরা এখান থেকে ফেরার পরদিনই যশোয়ন্ত টেলিগ্রাম পেল। ওর মার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটেছে। সুতরাং ওর চলে যেতে হল হাজারিবাগ। দেখতে দেখতে তিনটে দিনও কেটে গেল। অথচ কোনও খবর পাঠাল না। বেশ চিন্তায় আছি।

এদিকে কোয়েলে ঢল নেমেছে। অনেক মাছ ধরা পড়েছে। বাগেচম্পা থেকে প্রায়ই নানারকম ছোট বড় মাছ ধরে গ্রামের লোকেরা আমার জন্যে পাঠায়। দাম দিই। খুশি হয়ে নেয়। পাহাড়ি নদীর মাছের বড় স্বাদ।

টাবড়কে সেই যে বলেছিলাম শিকারে যাবার কথা, তা সে মনে করে রেখেছে। শিরিণবুরু থেকে ফিরে আসার পর থেকেই বার বার আমাকে বলছে, চালিয়ে হুজৌর, এক রোজ বরহা মারকে আঁয়ে।

গাঁয়ের লোকেরা শুয়োর বড় আনন্দ করে খায়। কিন্তু এদিকে আমার গুরু তো হাজারিবাগে। গুরু ছাড়া শিকারে যাই-ই বা কী করে। শেষে একদিন না থাকতে পেরে বলেই ফেললাম, যশোয়ন্ত না থাকলে শিকারে যেতে আমার ভয় করে। টাবড় তো হেসেই বাঁচে না। বলে, যশোয়ন্তবাবু বড় শিকারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, তা বলে টাবড়ই বা কম কীসে? তার এই মুঙ্গেরি গাদা বন্দুক দিয়ে সে মারেনি এমন জানোয়ার তো নেই জঙ্গলে, এক হাতি ছাড়া।

ভাবলাম, যাব তো শুয়োর মারতেই, ভয়ের কী? সে কথাটা কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করে বলতেই, বুড়ো তো মারে আর কী। বলে, ‘বরহা কৌন্‌সা ছোটা জানোয়ার হ্যায়’। শুয়োরকে ওরা বাঘের চেয়ে কম ভয় করে না। শুয়োর আর ভাল্লুক নাকি ওদের সব চাইতে বড় শত্রু। বিনা প্ররোচনায়, বিনা কারণে এরা যখন তখন আক্রমণ করে বসে। তাড়া করে মাটিতে ফেলে, মানুষের উরু থেকে আরম্ভ করে সোজা পেট অবধি ধারালো দাঁতে চিরে ফালা ফালা করে দেয় শুয়োর। সেরকমভাবে শুয়োর চিরলে মানুষকে বাঁচানোই মুশকিল হয়। আর ভাল্লুক তো আরও ভাল। যখন দয়া করে প্রাণে না মারে, তখন সে এক খাবলায় হয় কান, নয় ঠোঁট, নাক ইত্যাদি খুবলে নেয়। তাছাড়া নখ দিয়েও একেবারে ফালা ফালা করে দেয়।

এতদিনে বুঝলাম, এই জঙ্গলে পাহাড়ে, যেসব ভয়াবহ বিকৃত মূর্তি দেখি রাতে, যাদের আধো অন্ধকারে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠতাম প্রথম প্রথম, তারা সবাই ভাল্লুক-কবলিত হতভাগ্য মানুষ।

টাবড় বলল, নয়া তালাওর পাশের শুটি খেতে শুয়োরের দল রোজ সন্ধে হলেই নামে। ইয়া ইয়া বড়কা বড়কা দাঁতালো শুয়োর। গেলে নির্ঘাৎ মারা যাবে।

আমি বললাম, মাচা-টাচা বাঁধা আছে?

টাবড় বলল, মাচা কী হবে হুজৌর? মাটিতেই লুকিয়ে বসে মারব।

শুনেই তো অবস্থা কাহিল। বললাম, না বাবা, এই বৃষ্টি বাদলায় মাটিতে বসে শিকার-টিকার আমি করি না।

টাবড় মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে গেল।

ইদানিং কিন্তু সকালে বিকেলে একা একা বন্দুক হাতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এদিক-ওদিক যাই। তবে বড় রাস্তা ছেড়ে খুব একটা অন্যত্র ঢুকি না। গা ছম ছম করে। বড় রাস্তার আশেপাশে যা পাখিটাখি পাই, তাই মারি। যশোয়ন্ত বলেছিল, এই রকম শিকারকে বলে Pot hunting। খাদ্য সংস্থানের জন্যে।

সুহাগী নদীর রেখায় যশোয়ন্তের বসবার প্রিয় জায়গাটার কাছেই একটি বড় গাছে সন্ধের মুখে মুখে প্রচুর হরিয়াল এসে বসত। ওখানে গিয়ে প্রায়ই মারতে লাগলাম হরিয়াল। ভাল করে নিশানা করা যায় না—পাখিগুলো বড় চঞ্চল, এক জায়গায় মোটে বসে থাকে না, কেবলই এ ডাল থেকে ও ডালে তিড়িং তিড়িং করে লাফায় আর কিচির মিচির করে। তবে বড় ঝাঁক থাকলে এক গুলিতে আমার মতো শিকারিও তিন-চারটে ফেলে দিত। পাখিগুলোর ঘন সবুজ রঙ। বুকের কাছে যেন একটু হলদেটে সাদা। মাংস ভারী ভাল। আর আমার জুম্মান যা রোস্ট বানাত, সে কী বলব।

বন্দুকের ফাঁকা টোটার বারুদের গন্ধ শুকতে ভাল লাগত, মরা পাখির ঝপ করে গাছ থেকে পড়ার আওয়াজ ভাল লাগত। বুঝতে পারতাম যে, আরও কিছুদিন থাকলে আকৃতিগত পার্থক্য ছাড়া যশোয়ন্তের সঙ্গে প্রকৃতিগত পার্থক্য বলে কিছু থাকবে না। যাকে একদিন ঘৃণাও করতাম, সেই জংলির সঙ্গে একেবারেই একাত্ম হয়ে যাব।

যশোয়ন্ত চলে যাবার পরই আমার বাংলোর পেছনের পুটুস-ঝোপে একটি বড় খরগোশ মেরে তাকে যশোয়ন্তের মতো বাঁশ-পোড়া করে খেয়েছি। এমনি করে খরগোশের মাংসে যে একটা মেটে মেটে আঁশটে গন্ধ থাকে, সেটা এভাবে রান্না করলে একেবারে থাকে না। গুরুর অবর্তমানে আমি নিজের চেষ্টায় যে কতদূর এগিয়ে গেছি, ভাবলে নিজেরই আশ্চর্য লাগে। গুরু কবে ফিরবে এবং তাকে এসব গল্প করব, সেই ভাবনায় বিহ্বল হয়ে আছি।

শুয়োর মারতে পারমিট লাগে না। বছরের সব সময়েই মারা চলে। সেই জন্যেই তো এত বিপত্তি। ইতিমধ্যে আবার একজন লোককে ওই নয়া তালাওর কাছে শুয়োর ফেঁড়েছে। কাল আবারও এসে টাবড় বলল। বললাম, তুমি নিজে গিয়ে মারছ না কেন টাবড়? টাবড় বলল, আমার বন্দুক বিগড়ে আছে। ঘোড়াটা ঠিকমতো পড়ে না। তাই ওরকম বন্দুক নিয়ে অতবড় দাঁতাল শুয়োরের সামনে যেতে ভরসা পাই না। ভাবলাম, আমার বন্দুকটা টাবড়কে দিয়ে দিলেই তো কার্যসমাধা হয়, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল যশোয়ন্তের কথা। কলকাতার শিকারিরা এখানে এসে তাস খেলে আর বিয়ার খায়, এবং তাদের বন্দুক নিয়ে জংলি শিকারিরা শিকার করে। তারপর সেইসব জানোয়ারের চামড়া মাংস কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নিজেরা মেরেছে বলে জাহির করে, আর ড্রইংরুমে বসে ন্যাকা মেয়েদের কাছে রোমহর্ষক শিকারের গল্প করে। সুন্দরী মেয়েরা শোনে, আর উঃ, আঃ, উম—ম—ম—ম্ ইত্যাদি নানারকম গা-শিরশিরানো আওয়াজ করে।

অতএব বন্দুক দেওয়া যাবে না।

টাবড়কে বললাম, তবে চলো, কালই যাওয়া যাবে।

সকালে যশোয়ন্তের চিঠি এল হাজারিবাগের ছাপ মারা। লিখেছে, মায়ের নিউমোনিয়া হয়েছে। আরও সাত দিনের আগে আসতে পারছে না। একটু সুস্থ করে আসবে। আমি যেন অবশ্য অবশ্যই একদিন নাইহারে গিয়ে ওর বাংলোর তত্ত্ব-তল্লাশ করে ওর চাকরকে কিছু নির্দেশাদি দিয়ে আসি। খবর অবশ্য ওর অফিস থেকেও দেবে। তা ছাড়া দু’ রকম শম্বরের মাংসের আচার তৈরি করে রেখেছে ও। তারই একরকম যেন আমি নিয়ে আসি এবং অন্য রকম আচারটা যেন ঘোষদা সুমিতাবউদিকে ডালটনগঞ্জে পৌঁছে দিই। চাকরটা ওর ভাল্লুকের বাচ্চাটার ঠিকমতো যত্নআত্তি করছে কিনা তাও যেন দেখে আসি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

যেতে হবে একদিন যশোয়ন্তের নাইহারে। আগে কখনও যাইনি।

বেলা থাকতে থাকতে টাবড় এসে পৌঁছাল। বলল, চালিয়ে হুজৌর, আভ্‌ভি চল দেনেসে সামকো পইলে পইলে পৌঁছ যাইয়েগা।

আমি বললাম, এত তাড়াতাড়ির কী। জিপ নিয়ে গেলেই তো হবে। পরেই যাব।

টাবড় একগাল হেসে বলল, তুহর জিপোয়া না যালথু।

ভাবলাম, এমনই অগম্য জায়গা।

দুটো পৌনে তিন ইঞ্চি অ্যালফাম্যাক্স এল. জি এবং দুটি স্ফেরিক্যাল বল নিয়ে টাবড়ের সঙ্গে বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে রওনা হলাম। টাবড় নিজের বন্দুকটাও নিয়েছে। দেগে তো দেবে, তারপর ফুটুক চাইনা ফুটুক। আমি হেন বড় শিকারি তো আছিই। সঙ্গে চওথা বলে সুহাগী গ্রামের আর এক বুড়ো চলল, কাঁধে একটা ঝকঝকে টাঙ্গি নিয়ে।

শেষ বিকেলের সোনালি আলো বর্ষার চকচকে বন জঙ্গলে ঝিকমিক করছে। আমার বাংলো থেকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে রাস্তাটা বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। রোদ এসে পড়েছে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে। ধান হয়েছে জায়গায় জায়গায়। গাছের গোড়াগুলোতে একটু-আধটু জলও রয়েছে কোথায়ও কোথায়ও। পাহাড়ের ঢালের গায়ে খাঁজ কেটেও ফসল ফলিয়েছে ওরা।

পথে এক জায়গায় একসঙ্গে প্রায় একশো-দেড়শো বিঘা জায়গা নিয়ে আম বাগান। ডালটনগঞ্জের কোন জমিদার নাকি এখানে শখ করে আম লাগিয়েছিলেন। এখানের আমে পোকা হয় বেশ। গরমের দিনে ভাল্লুকের এটা একটা আড্ডাখানা হয়ে ওঠে সন্ধের পর। নয়া তালাও থেকে ফেরার মুখে কত লোক যে এই পথে এইখানে ভাল্লুকের মুখে পড়েছে, তার লেখাজোখা নেই।

‘আভভি বাৎচিৎ বিলকুল বন্ধ হুজৌর। হামলোঁগ পৌঁছচ চুকে হে’ বলল টাবড়।

অস্তগামী সূর্যের বিষণ্ণ আলোয় নয়া তালাওর উঁচু বাঁধ দেখা যাচ্ছিল। এক ঝাঁক হুইস্‌লিং টিল চক্রাকারে তালাওর উপর উড়ছিল শিস দিতে দিতে। একটি ধূসর জাঙ্গিল মন্থর ডানায় উড়ে চলেছিল রুমান্ডির দিকে।

তালাওটি খুব যে বড়, তা নয়। বর্ষার ঘোলা জলে ভরা। অনেকগুলো নালা এতে পাহাড়ের এদিক-ওদিক থেকে এসে মিশেছে। মধ্যেকার জল অপেক্ষাকৃত কম ঘোলা। পাশে পাশে নানা রকম জলজ উদ্ভিদ আছে। শরবনের মতো ছিপছিপে ডাঁটা গাছ, স্পাইডার লিলির মতো ছোট ছোট ফুল; হিঞ্চে কলমির মতো অনেক নাম-না-জানা শাক। অনেক রঙের।

তালাওর একটা পাশে আগাগোড়া শটি আর কচু লাগানো। টাবড় দেখাল, শুয়োরের দল গর্ত করে আর সেগুলো লাট করে আর কিছু বাকি রাখেনি। কচুবন আর শটিবনের গা ঘেঁষে বিরাট একটা বাজপড়া বট গাছ। আসন্ন সন্ধ্যার রক্তিম আকাশের পটভূমিতে প্রেতাত্মার মতো অসংলগ্ন ভঙ্গিতে আকাশের দিকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি আর টাবড় সেই গাছের গোড়ার ফোকরের মধ্যে ঢুকে বসলাম। প্রায় মাটির সমান্তরালে। বসবার আগে, টাবড় পাথর ছুঁড়ে তার ভিতরের শঙ্খচূড় কি গোখরো সাপ যে নেই, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল। চওথা বুড়োকে টাবড় তালাওর অন্য পারে পাঠাল। ওদিকের জঙ্গলের ভিতর কোনও গাছে উঠে বসে থাকতে বলল। গুলির শব্দ শুনলে যেন আসে।

একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে। সোঁদা মাটির গন্ধ উঠছে চারদিক থেকে। চারদিকে এমন একটা বিষণ্ণ শান্তি, এমন একটা অপার্থিব যে, কী বলব। শাল সেগুনের চারারা বর্ষার জলে একেবারে সতেজ সরল হয়ে পত্রপল্লব বিস্তার করেছে। একটা টি-টি পাখি, কোথা থেকে উড়ে এসে বেশ কিছুক্ষণ টিটিরটি-টিটিরটি করে জলের ধারে ধারে ডেকে বেড়াল। তারপর হঠাৎই ডুবন্ত সূর্যটাকে যেন ধাওয়া করে গিয়ে জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

এখন সম্পূর্ণ অন্ধকার। তবে শুক্লপক্ষ ছাড়া জঙ্গলে কখনও নিশ্চিদ্র অন্ধকার হয় না। বিশেষ করে জলের পাশে থাকলে তো অন্ধকার বলে মনেই হয় না। তা ছাড়া আজ অষ্টমী কি নবমী হবে। সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই এখানে যা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে সন্ধেতারা। অমন শান্তিতে ভরা, পান্নার মতো সবুজ, কান্নার মতো টলটলে তারা বুঝি আর নেই। দপ-দপ করে জ্বলবে। নিঃশব্দে কত কী কথা বলবে হাওয়ার সঙ্গে, বনের সঙ্গে। জলের পাশে কটকটে ব্যাঙগুলো ডাকতে লাগল কটর-কটর করে। ওপাশের জঙ্গল থেকে একটা হায়না বিকট অট্টহাসি হেসে উঠল। হঠাৎ আধো-অন্ধকারে দেখলাম, এক জোড়া অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো শেয়াল আমাদের থেকে বড়-জোর তিরিশ গজ দূরে চকচক করে জল খাচ্ছে। নিস্তব্ধ জলে সন্ধ্যাতারার ছায়াটা এতক্ষণ নিষ্কম্প ছিল; এখন জলে ঢেউ লাগতে, কাঁপতে কাঁপতে সবুজ ছায়াটা তালাওর মধ্যে চলে গেল।

এ জঙ্গলে অ্যালসেশিয়ান কুকুর কোত্থেকে আসবে? নিশ্চয়ই শিয়াল।

জল খেয়ে শিয়াল দুটো চলে গেলে টাবড় ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলল, ডবল সাইজকা থা হুজৌর।

আমি শুধোলাম, ক্যা থা?

ও বলল, হুন্ডার। অর্থাৎ নেকড়ে বাঘ।

আমি বললাম, ওগুলো যে নেকড়ে, তা আগে বললে না কেন? মারতাম।

টাবড় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে, ‘ছোড়িয়ে! উ মারকে ক্যা হোগা? দোগো শূয়ার পিটা দিজিয়ে, খানেমে মজা আয়গা।’

রাত প্রায় এক প্রহর হল। বেশ মশা। হাওয়ার বেগটা একটু কম হলেই মশার প্রকোপ বাড়ে। শুয়োরের বাচ্চাদের পাত্তা নেই। অন্ধকারে কচু গাছগুলোকে শুয়োর কল্পনা করে করে চোখে ব্যথা ধরে গেল। এমন সময় আমাদের পেছনে জঙ্গলের দিকে মাটিতে ঘৃণায় পদাঘাত করলে যেমন শব্দ হয়, তেমন আওয়াজ হল এবং একাধিক শক্ত পায়ের পদধ্বনি ভেসে এল।

টাবড় আমার গায়ে আঙুল চুঁইয়ে হুঁশিয়ার করে দিল। দেখতে-দেখতে প্রায় গাধার সমান উঁচু একটা দাঁতওয়ালা শুয়োর আমাদের সামনে বেরিয়ে এল জঙ্গল ছেড়ে। মাঝে-মাঝে থেমে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে এমন জোরে জোরে মাটিতে পদাঘাত করতে লাগল যে বলবার নয়। ফুলঝুরির মতো চারিদিকে ছিটকে পড়তে লাগল সেই মাটির গুঁড়ো।

শুয়োরের চেহারা দেখে আমার বড়ই ভয় হল। আমরা প্রায় মাটির সমান্তরালে বসে থাকাতে শুয়োরটাকে আরও বেশি বড় বলে মনে হচ্ছিল। তার পেছনে আরও চার-পাঁচটি শুয়োর দেখা গেল।

বড় শুয়োরটা আমাদের দিকে কোনাকুনি করে একবার দাঁড়াল। কানটা দেখা যাচ্ছে। ধীরে-ধীরে পুরো শরীরটা দেখা যাচ্ছে। পাশ থেকে। ভাবলাম এই মাহেন্দ্রক্ষণ। তারপর, গুরু যশোয়ন্তের নাম স্মরণ করে বন্দুক তুলে, বন্দুকের সঙ্গে ক্ল্যাম্পে লাগানো টর্চের বোতাম টিপেই ঘোড়া টেনে দিলাম।

সঙ্গে-সঙ্গে ধপ করে একটা আওয়াজ এবং গগন-নিনাদি এমন চিৎকার হল যে, বলার নয়। সেই চিৎকার চারিদিকের জলে জঙ্গলে পাহাড়ে বনে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল। সবিস্ময়ে ও সভয়ে দেখলাম যে, বড় দাঁতাল শুয়োরটি পড়ে গেছে মাটিতে এবং অন্য শুয়োরগুলো ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে তেড়ে ছুটছে জঙ্গলমুখো।

বেশ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ফোকর থেকে বেরিয়ে টাবড়ের সঙ্গে কথা বলতে যাব, এমন সময় অতর্কিতে সেই সেঞ্চুরিয়ান ট্যাঙ্কের মতো শুয়োর নিজ-চেষ্টায় অধঃপতিত অবস্থা থেকে উত্থিত হয়ে, প্রায় হাওয়ায় উড়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল। সে যে কী ভয়াবহ দৃশ্য, তা কল্পনা করা যায় না। প্রথমেই মনে হল, বন্দুকটা ফেলে দৌড়ে প্রাণ নিয়ে পালাই। কিন্তু সে সময়ই বা কোথায়? আমার এই মুহূর্তের চিন্তার মধ্যেই কানের পাশে কামান দাগার মতো একটা শব্দ হল। ‘বাবা-গো’ বলে ধপ করে বসে পড়লাম।

বেঁচে আছি যে, বুঝলাম সে সময়েই—যখন আমাদের পায়ের কাছে এসে এত বড় বরাহ-বাবাজি হুড়মুড়িয়ে মাটি ছিটকিয়ে গুচ্ছের কচু গাছ ভেঙে ধপাস করে আছড়ে পড়ল।

টাবড় বত্রিশ পাটি বিগলিত হয়ে বলল, ‘তুহর হাত তো বঁড়িয়া বা, একদ্দম কানপট্টিয়ামে লাগলথু।’

শুয়োরটার দাঁতটি বেশ বড়। দেখলে ভয় লাগে।

টাবড় শুয়োরটার কাঁধে উল্টো মুখে ঘোড়ার মতো বসে লেজটাকে আঙুলে তুলে উঁচু করে দেখাল। বেশ কালো পুরুষ্টু লেজ। ডগার দিকে খোঁচা-খোঁচা, বিচ্ছিরি দেখতে লোমের গুচ্ছ। টাবড় বুনো শুয়োর আর পোষা শুয়োরের পার্থক্য বোঝাল। পোষা শুয়োরের লেজ শোয়ানো থাকে আর জংলি শুয়োরের লেজ একটি জাজ্বল্যমান দুর্বিনয়ের প্রতীকের মতো উত্তুঙ্গ হয়ে শোভা পায়।

আমরা কথা বলতে বলতে চওথা বুড়ো অন্ধকারে টাঙ্গি ঘোরাতে ঘোরাতে কারিয়া-পিরেতের মতো জঙ্গল ফুঁড়ে বেরুল। শুয়োরটাকে দেখে তার সে কী আনন্দ। শুয়োরের মুখটাকে দু’হাতের পাতার মধ্যে নিয়ে প্রেমিক যেমন প্রেমিকাকে আদর করে, সে ঠিক তেমনিভাবে আদর করে দিল।

জানি না, কত দিন, আর কত দিন, যশোয়ন্তের কাছে শিকার করার বিপক্ষে বক্তৃতা করতে পারব। আমার বক্তব্যই ঠিক, কিংবা যশোয়ন্ত এবং যশোয়ন্তের সাগরেদ এই টাবড়, চওথা, এদের সকলের সরব ও নীরব বক্তব্যই ঠিক, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ ঘটেছে। সেই শিরশিরে হাওয়ায়, নয়াতালাওর ধারে, মৃত শুয়োরের পাশে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হল; আজ থেকে ক’ মাস আগে যে শহুরে ছেলেটি রুমান্ডি-র বাংলোয় এসে জিপ থেকে নেমেছিল, সেই ছেলেটিতে এবং আজকের আমি-তে যেন বেশ অনেকখানি ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে। তাকে যেন পুরোপুরি খুঁজে পাচ্ছি না আজকের আমার মধ্যে।

ভাল-মন্দ বিচার করবার যোগ্যতা বা ইচ্ছা আমার নেই। যশোয়ন্তের জীবনই ভাল, না যে-জীবনে আমি কলকাতায় অভ্যস্ত ছিলাম, সেই জীবনই ভাল, তার উত্তরও আমার কাছে নেই। শুধু বুঝতে পারছি যে, একটি জীবনের মধ্যে দিয়ে এসেছি এবং অন্য এক জীবনের চৌকাঠ মাড়িয়ে তাতে প্রবেশ করেছি। ভাল করলাম কি মন্দ করলাম; জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *