পঞ্চম অধ্যায় – যুক্তিবাদীদের দৃষ্টিতে ধর্ম (Religion in the Eyes of Rationalists)
ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে অভিমত
এগারো শতকের ভারতীয় দার্শনিক উদয়ন আচার্য (Udayana) ঈশ্বর থাকার ‘প্রমাণ’ হিসেবে পাঁচটি বিষয়ের উল্লেখ করেছিলেন। আমরা সেগুলো বিবেচনায় আনতে পারি। প্রথমত, উদয়নের মতে আমাদের চেনা জানা বস্তুজগতের সবকিছুর পেছনে একটা কারণ আছে। তার মতে কউে না কেউ এই বস্তুজগত তৈরি করেছে।
সেই সত্ত্বাই ঈশ্বর। এখন আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জ্ঞানের সাপেক্ষে আমরা জানি, সবকিছুর পেছনেই কারণ থাকার ব্যাপারটি কোন দ্রুত সত্য নয়। পারমাণবিক পরিবৃত্তি (atomic transition), তেজষ্ক্রিয় ক্ষয়, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন প্রভৃতি ঘটনার উল্লেখ করা যায়, সেগুলো ‘কারণ বিহীন ঘটনা’ হিসেবে স্বীকৃত। আর তাছাড়া, সবকিছুর পেছনে যদি কারণ থাকেই, তাহলে ঈশ্বরের পেছনে কেন কোন কারণ থাকবে না, সেটাও তো পরিষ্কার করে বলা চাই।
ঈশ্বর থাকার দ্বিতীয় ‘প্রমাণ’ হিসেবে তিনি যা বলতেন তা আজকের দিনে তেমন একটা শোনা যায় না। বিষয়টা একটু প্যাচালো। উদয়ন বলতেন, সবকিছুই তৈরি হয়েছে পরমাণু দিয়ে, এবং বিভিন্ন পরমাণু মিলে বড় অণু তৈরি করে। কিন্তু সেই বন্ধন নিজে নিজে তৈরি করতে পারে না, সেই বন্ধন তৈরি হয় সজ্ঞাত সত্তার হস্তক্ষেপে। কিন্তু আজকের জ্ঞানের সাপেক্ষে আমরা জানি এটি মিথ্যা। আমরা জানি পরমাণুর মিথষ্ক্রিয়ার নানা সূত্রাবলী ( laws of atomic interactions ) রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠা পরমাণুর বন্ধনকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারে। বিজ্ঞানের যে শাখায় বিষয়গুলো আলোচনা করা হয় তার নাম— ‘রসায়ন’ (chemistry)। রসায়নের নিয়মনীতি অনুসরণ করে কীভাবে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি হয়, তা আজকের স্কুলের ছাত্র- ছাত্রীরাও বলতে পারবে।
তার তৃতীয় ‘প্রমাণ’টি ছিল পৃথিবীর শূন্যে ঝুলে থাকার সমাধান হিসেবে। উদয়ন তখনকার জ্ঞানের সাপেক্ষে ভাবতে পারেননি কীভাবে আমাদের এই পৃথিবীটা শূন্যে ঝুলে আছে। তিনি মনে করতেন কেউ না কেউ নিশ্চয়ই পৃথিবীটাকে ধরে রেখেছে। তিনিই ঈশ্বর। আজ আমরা জানি, মাধ্যাকর্ষণ সূত্র সহজেই পৃথিবীর এই শূন্যে ঝুলে থাকাকে ব্যাখ্যা করতে পারে; কোন অদৃশ্য সত্ত্বার দারস্থ হতে হয় না।
উদয়নের চতুর্থ ‘প্রমাণ’টি ছিল মানব দক্ষতার অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। এই ‘প্রমাণ’টি অনেকটা আজকের দিনে এরিক ফনস দানিকেনের ‘প্রমাণের’ মত। কেউ আমাদের না দেখিয়ে দিলে আমরা কিছু করতে পারতাম না। এই যে সভ্যতার অগ্রগতি— এটা এমনি এমনি ঘটেনি, কেউ না কেউ উপর থেকে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বলে দিয়েছে। কোন উপরওয়ালা ছাড়া মানব সভ্যতা এগোয়নি কিংবা এগুতে পারবে না এ ব্যাপারটা কে বলল? এটার বিরুদ্ধে এত যুক্তি দেওয়া যায় যে, আজকের দিনে এটা আদপে কোন যুক্তি নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
পঞ্চমত, উদয়ন হিন্দুধর্মগ্রন্থগুলোকে ঐশ্বরিক ভাবতেন। তিনি মনে করতেন বেদ এক প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ। কোন মানুষের পক্ষে বেদ লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আজকের দিনের জ্ঞানের সাপেক্ষে আমরা জানি, বেদ সেরকম কোন ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়, বরং সে সময়কার মুনি ঋষিদের চিন্তাভাবনার সংকলন বলা যেতে পারে। বেদের অনেক কিছুই আজকের জ্ঞানের সাপেক্ষে অবৈজ্ঞানিক। তারপর উদয়ন কিংবা তাঁর মত কেউ বেদ কিংবা অন্য ধর্মগ্রন্থকে ‘ঐশ্বরিক’ ভাবতে পারেন, কিন্তু তাতে করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হচ্ছে না।
উদয়নের উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে, আগেরকার দিনের চিন্তাশীল মানুষেরা বিভিন্ন যুক্তি সাজিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু সফল যে হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে এই ‘প্রমাণ’গুলো নিজে নিজেই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছে।
বিরুদ্ধবাদীরা এক কথায় ধর্মের প্রধান সমালোচক। কার্ল মার্কস (১৮১৮- ১৮৮৩খ্রি.) যিনি ছিলেন একজন স্বঘোষিত নাস্তিক তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বাস্তবে অসম্ভব। বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে তাদের অনুপ্রেরণা যোগান, ‘Religion is the sing of the oppressed creature, the sentiment of a heartless world….It is the opium of the people’ (Marx 1844 / 1964)। অর্থাৎ ‘বঞ্চিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস হচ্ছে ধর্ম, বিবেকহীন বিশ্বের আবেগ… এটা জনগণের আফিম।’ এর দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছেন নির্যাতিত শ্রমিকদের দিকে যারা ভোগান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধর্মের দিকে পালায় তাদের জন্য ধর্ম হচ্ছে এক ধরনের মাদকদ্রব্য যা তাদেরকে দুঃখ ভুলতে শেখায়। পরকালে শান্তির প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ম তাদেরকে বিদ্যমান ভোগান্তি থেকে তাদের চোখ ফিরিয়ে নেয়, এভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে অনেকাংশে অব্যবহিত করে।
যুক্তিবাদ বিকাশ : পাশ্চাত্ত্য ও প্রাচ্যের পারস্পরিক প্রভাব
প্রাচীন গ্রিসে সাধারণভাবে মুক্তচিন্তার প্রাধান্য থাকলেও মাঝে মাঝে রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তচিন্তকদের ধ্বংস করবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। নাস্তিক অ্যানাকসাগোরাস (৫০০-৪৮২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) বলেছিলেন যে, সূর্য একটা বিরাট আগুনের গোলা, দেবতা নয়। তিনি আরও বলতেন যে, বস্তুকণার সমাহার থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই অপরাধে তাকে এথেনস থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তার সমস্ত লেখা পুড়িয়ে ফেলা হয়। যে রাষ্ট্রীয় ধর্ম সূর্যপূজার প্রাধান্য স্বীকৃত ছিল, তার মূলে আঘাত করা এই আক্রমণের কারণ। দেবতার অস্তিত্ব নেই এবং মানবতাই শ্ৰেষ্ঠ আদর্শ, এই মতবাদ প্রচার করবার ফলে প্রোটোগোরাসকে ( ৪৮০-৪১০ খ্রিষ্টাপূর্বাব্দ) এথেনস থেকে প্রাণভয়ে পলায়ন করতে হয়। সক্রেটিসকে (৪৬৯- ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তার পেছনে ধৰ্ম-সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক কারণই ছিল প্রধান। কারণ সক্রেটিস শাসকশ্রেণির সদস্যদের অজ্ঞানতা, মূর্খতা, অকর্মণ্যতা এবং ভ্রষ্টাচার যুব সমাজের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকেরা অনেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে অভিজাত শ্রেণির অন্যান্য সদস্যদের অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করবার সময় বিচারকেরা তার বিরুদ্ধে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও এই ধর্মীয় অভিযোগ এনেছিল যে, তিনি নাকি পুরাতন দেবদেবীদের পরিবর্তে নতুন দেবদেবীর প্রবর্তন করেছিলেন, এমনকি তিনি নাস্তিক ছিলেন। সক্রেটিস অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন এবং ধর্ম-সংক্রান্ত দুটি অভিযোগের পরস্পরবিরোধিতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিচারকেরা তথাপি সব অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন।
প্রাচীন রোম ও রোমক সাম্রাজ্যেও রাষ্ট্র মুক্তচিন্তকদের দমন করবার কোন সাধারণ নীতি গ্রহণ করেনি। কিন্তু একটি বড় ব্যতিক্রম ঘটেছিল ১৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সে-সময়ে রোমে ভারতীয় তান্ত্রিকদের মত এক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল— যারা পঞ্চ মকার, স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যগীত এবং সহজিয়া যৌন-সম্পর্কে বিশ্বাস করত। প্রাচীন ভারতীয় তান্ত্রিকদের মতই তারা মাঝে মাঝে বড় বড় সমাবেশ করে পানভোজন, নৃত্যগীত এবং সহজিয়া যৌনসম্ভোগে প্রবৃত্ত হত। সে-বছরের রোমের সেনেট এরকম সাত হাজার মানুষকে ধরে এনে বিচার করে এবং তাদের মধ্যে অর্ধেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করে। সম্ভবত রাষ্ট্রীয় রোমক ধর্ম এবং রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে, অর্থাৎ শাসকশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে এদের ধর্মহীনতা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া ৩৯০ খ্রিষ্টাব্দে বিশপ থিওফিলাস ধর্মীয় কারণে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরির এক অংশ ধ্বংস করে। আবার ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গণিতজ্ঞ এবং নিওপ্লেটোনিক দার্শনিক হাইপেশিয়াকে প্রধান বিশপ সেন্ট সাইরিলের নেতৃত্বে একদল পাদরি নির্মমভাবে হত্যা করে।
প্রাচীন ভারতে যেমন ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রশক্তির যৌথ উদ্যোগে, অর্থাৎ রাজন্যশ্রেণী ও পুরোহিতশ্রেণির পারস্পরিক সমঝোতায় বেদবিরোধী ‘পাষণ্ডদের’ দমন করা হয়েছিল, মধ্যযুগের ইউরোপে তেমনি রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং রাজতন্ত্রের যৌথ উদ্যোগে খ্রিষ্টধর্মের প্রতিকূল সবরকম মতবাদকেই ধ্বংস করা হয়েছিল। যদিও গির্জাতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের যৌথ শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ সময়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ই সোচ্চার এবং সক্রিয় হয়েছিল, তথাপি এই আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য ছিল অ্যালবিজেনসীয়রা (Albigensian), যারা জোরোয়াশিস্ত্রীয় ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে চতুর্থ ল্যাটেরান কাউন্সিল (Lateran Council) এই ডিক্রি জারি করে যে, খ্রিষ্টধর্মকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সব ধর্মদ্রোহীকে হত্যা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই উদ্যোগকে আরো জোরদার করবার উদ্দেশ্যে ১২৩৩ খ্রিষ্টাব্দে সৃষ্টি হয় সেই ইনকুইজিশন (Inquisition) ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে অসংখ্য ধর্মদ্রোহীকে জীবন্ত দগ্ধ করে অথবা শারীরিক নির্যাতনে মাধ্যমে হত্যা করা হয়। মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টধর্মের তাত্ত্বিক দিকপাল সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-১২৭৪খ্রি.) ইনকুইজিশনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ‘খাঁটি ধর্মবিশ্বাস’ বাঁচিয়ে রাখবার জন্য ধর্মদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেন এবং রাষ্ট্রশক্তির ওপর এই বিধান বলবৎ করবার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৪৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবার স্পেনে আরেকটি ইনকুইজিশন চালু হয়, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সরাসরি রাষ্ট্রশক্তির হাতে। অগণিত মুক্তচিন্তক, অবাধ্য কিংবা বিদ্রোহী মানুষকে এভাবে ধর্মদ্রোহিতার নামে মধ্যযুগীয় ইউরোপে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছে অথবা ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই নৃশংস শারীরিক নির্যাতনের পরে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টধর্মের মত অন্য কোন ধর্মে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এত বড় নৃশংস এবং বর্বরোচিত আক্রমণ কখনো সংঘটিত হয়নি। কিন্তু আমরা এখানে প্রধানত ইনকুইজিশনের ভিতরে ও বাইরে কয়েকজন খ্যাতনামা মুক্তচিন্তক মানুষের ধর্মের নামে নির্যাতন নিয়েই কিছুটা আলোচনা করব।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে রাষ্ট্র যেসব মুক্তচিন্তক এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে ধর্মের নামে নির্যাতন করেছে তাদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রজার বেকন (১২১৪- ১২৯৪)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন এবং গবেষণাগারে অনেক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা করতেন। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেকনের এই বৈজ্ঞানিক তৎপরতাকে ধর্মবিরোধী জ্ঞান করেন। ফলে একটি গির্জার কারাগারে তাকে অনেক বৎসর বন্দি থাকতে হয়েছিল। অন্য ধরনের আরেকটি নির্যাতিত এবং নিহত অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম জোয়ান অফ আর্ক (১৪১২-১৪৩১)। শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের আগ্রাসনে পরাজিত ফরাসি যুবরাজকে সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্রধারণ এবং সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। তার মনে হয়েছিল যে এ কাজে পরলোক থেকে সেন্ট মাইকেল তাকে অনুপ্রাণিত করছেন। অনেকগুলো যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত করবার পর তিনি নিজে পাশে দাঁড়িয়ে ফরাসি যুবরাজকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু পরে একটি যুদ্ধে ইংল্যান্ডের মিত্ররাজ্য বুরগান্ডির কাছে পরাজিত ও বন্দি হন। বুরগান্ডি তাকে ইংল্যান্ডের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর তাকে যুদ্ধবন্দিরূপে গণ্য না করে একটি ধর্ম-আদালতের মিথ্যা বিচারে ধর্মদ্রোহী এবং ডাইনী বলে ঘোষণা করে পুড়িয়ে মারা হয়, মাত্র আঠারো-উনিশ বৎসর বয়সে।
পরবর্তী উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ইতালির জিওলারমো সাভানারোলা (১৪৫২- ১৪৯৮)। তখন ইউরোপে বৌদ্ধিক নবজাগরণ বা রেনেসাঁস আরম্ভ হয়ে গেছে, কিন্তু তথাপি ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধ শেষ হয়নি। সাভানারোলা নিজে ডোমিনিকানপন্থী ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্রমশ পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের কোর্টে যৌন-ব্যভিচারসহ অসংখ্য দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের তীব্র সমালোচক হয়ে দাঁড়ান। ফলে ১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পোপ তাকে ধর্মচ্যুত করেন। তারপর সরকারি আমলারা তাকে গ্রেপ্তার করে তার ওপর নৃশংস শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসি দেয়। এভাবেই সার্বভৌম জাগতিক ও ধর্মীয় অধীশ্বর পোপের সমালোচনার জন্য রাজন্যশ্রেণি ও পুরোহিতশ্রেণির যৌথ উদ্যোগে ধর্মাসুরদের এক নির্ভীক সমালোচককে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে হত্যা করা হয়।
বৌদ্ধিক নবজাগরণের ফলশ্রুতিরূপে মুক্তচিন্তা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার যুগ আরম্ভ হবার পর থেকে ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। এই সংঘাতের প্রথম বলি ইতালীয় দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক জিওরদানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)। জন্মসূত্রে ডোমিনিকানপন্থী রোমান ক্যাথলিক হলেও ব্রুনো ছিলেন ধর্মান্ধতাবিরোধী। তার দার্শনিক মত এই ছিল যে প্রত্যক মানুষই নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী পৃথিবীকে দেখে। জ্ঞান অন্তহীন এবং চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু নেই। খ্রিষ্টধর্মের ঈশ্বরতত্ত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধিতা করে চার্বাকের মত ব্রুনোও বলেন যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বস্তুকণা (monad) সমূহের সমাহারে প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবী এবং জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের ‘ধর্মবিরোধী’ স্বাধীন মতবাদ প্রচারের ফলে পোপের নির্দেশে এবং সরকারি আদেশে ভেনিস শহরে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালের দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তার ওপরে, বিশেষত স্পিনোজা এবং লাইবনিৎসের চিন্তাধারায় ব্রুনোর গভীর প্রভাব পড়েছিল।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কার ও চিন্তাধারা সৃষ্টি করেন পরবর্তী বৈজ্ঞানিক নিকোলাস কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)। এককথায় বলতে গেলে কোপারনিকাস প্রমাণ করেন যে, সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহতারারা পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে না, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। আর এ ধরনের অসংখ্য গ্রহতারা মহাবিশ্বে আছে। বাইবেল-এর সৃষ্টিতত্ত্ব, যাতে বলা হয়েছে যে, ইশ্বর স্থির পৃথিবী ও পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তারপর মানুষের মঙ্গলের জন্যই সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্র সহ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তা কোপারনিকাসের আবিষ্কারের ফলে একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মহাবিশ্বে মানুষ ও পৃথিবীর কেন্দ্রীয় গুরুত্ব তথা ট্রিনিটির তত্ত্ব, ঈশ্বরপুত্রের পৃথিবীতে আবির্ভাব, মানুষের পাপের জন্য জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত এবং কবর থেকে পুনরুত্থান প্রভৃতি খ্রিষ্টধর্মের অনেকগুলো মূল বিশ্বাস খুব জোর আঘাত পেল। ফলে কোপারনিকাসের মূল গ্রন্থ On the Revolutions of the Heavenly Bodies প্রকাশিত হবার পর খ্রিষ্টধর্মের জগতে মহা কলরব উপস্থিত হল। ক্যাথলিকেরা যে কোপারনিকাসের বিরোধিতা করবে তা ছিল এক রকম অবধারিত। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রোটেস্টান্টরাও পিছিয়ে রইল না। প্রোটেস্টান্টবাদের স্রষ্টা মার্টিন লুথার কোপারনিকাসকে তীব্র আক্রমণ করে বললেন: ‘এই মূর্খ জ্যোতির্বিদ্যাকে একেবারে উল্টে দিতে চাইছে। কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আমাদের বলছে যে যওয়া সূর্যকেই স্থির থাকবার আদেশ দিয়েছিল, পৃথিবীকে নয়।’ প্রোটেস্টান্টদের আরেক ধর্মগুরু ক্যালভিন ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ সম্বন্ধে একই মত প্রকাশ করে তারপর বলেন : ‘ঈশ্বরের কর্তৃত্বের ওপরে কোপারনিকাসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করবার দুঃসাহস কে দেখতে পারে?’ কিন্তু ব্রুনোর পরিণতি থেকে কোপারনিকাস রক্ষা পেয়েছিলেন মূলত দুটি কারণে। তিনি তার গ্রন্থটি লেখা হয়ে যাবার পরেও শাস্তির ভয়ে অনেক বৎসর পর্যন্ত সেটি প্রকাশ করেননি। ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে সেটি প্রকাশিত হবার অল্প পরেই তার মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়ত, তিনি বইটি পোপকে উৎসর্গ করেন এবং তার প্রকাশক একটি মুখবন্ধে বলেন যে কোপারনিকাসের তত্ত্ব শুধু একটি হাইপথিসিস বা প্রমাণসাপেক্ষ বক্তব্য মাত্র এবং এর পেছনে কোন প্রমাণিত সত্যের দাবি নেই।
কোপারনিকাসের তত্ত্বকেই যখন গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন, তখন কিন্তু তিনি ইনকুইজিশনের হাত থেকে অব্যাহতি পাননি। নিজের তৈরি টেলিস্কোপের সাহায্যে কোপারনিকাসের আবিষ্কারের সমর্থন এবং পরিবর্ধন ছাড়াও গ্যালিলিও বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহ, সূর্যের কলঙ্ক বা সানস্পট এবং চাঁদের পাহাড় আবিষ্কার করেন। এসব ছিল খ্রিষ্টধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। ফলস্বরূপ গ্যালিলিও ইনকুইজিশনের কবলে পড়লেন। ইনকুইজিশন রায় দিল যে, সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে না, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, আর পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, এসব তত্ত্ব মূর্খতাপ্রসূত, অসম্ভব, মিথ্যা এবং ধর্মবিরোধী। পোপের আদেশে গ্যালিলিও ইনকুইজিশনের সামনে হাজির হলে তাকে নির্দেশ দেয়া হয় এই স্বীকারোক্তি দিতে যে, তার তত্ত্ব ভ্রান্ত, আর আদেশ দেয়া হয় এসব তত্ত্ব লিখিতভাবে অথবা মৌখিকভাবে আর কখনো প্রকাশ না করতে। মাত্র ষোল বছর আগে ব্রুনোর জীবন্ত দগ্ধ হবার পটভূমিতে গ্যালিলিও ইনকুইজিশনের আদেশ এবং সব শর্তই মেনে নিলেন। আর পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই তত্ত্ব-সম্বলিত যাবতীয় পুঁথিপত্র নিষিদ্ধ করা হল। এর সাত বছর পরে তার এক ব্যক্তিগত কার্ডিন্যাল বন্ধু অষ্টম আরবান নাম নিয়ে পোপ হবার সুবাদে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে গ্যালিলিও একখানি বই লেখেন, যাতে তিনি খ্রিষ্টধর্মীয় স্থির পৃথিবীর তত্ত্ব আর কোপারনিকাসের বিপরীত তত্ত্বকে মহাবিশ্বের দুটি বিকল্প সিস্টেম হিসেবে নিরপেক্ষভাবে দেখাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই কৌশলেও অব্যাহতি পাওয়া গেল না। তার প্রাক্তন বন্ধু পোপ অষ্টম আরবান তার শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন এবং আবার ইনকুইজিশন বসল। গ্যালিলিওকে হাঁটু গেড়ে বসে ভুল স্বীকার করতে এবং ক্ষমাভিক্ষা করতে হল, আর বাইবেল-এ হাত রেখে শপথ করতে হল যে, তিনি জীবনে আর কখনো এসব মিথ্যা এবং ধর্মবিরোধী তত্ত্ব প্রচার করবেন না এবং কেউ এসব তত্ত্ব প্রচার করলে তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে ধরিয়ে দেবেন। তারপর তাকে গৃহবন্দি থাকবার এবং কোন আত্মীয় বা বন্ধুর সঙ্গে দেখা না-করবার আদেশ দেয়া হল। এভাবে পাঁচ বৎসর নিঃষঙ্গ গৃহবন্দি জীবনযাপনের পর ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মহাবিশ্ব এবং পৃথিবী সম্বন্ধে কোপারনিকাস-গ্যালিলিও তত্ত্বের সব পুঁথিপত্র রোমান ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা নিষিদ্ধ ছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীর আরেকজন ধর্মের শিকার ছিলেন স্পিনোজা (১৬৩২-৭৭)। তার পিতা স্পেনের অধিবাসী ইহুদি ছিলেন। ইনকুইজিশনের ভয়ে বাহ্যিকভাবে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও পরিবারের মধ্যে তারা ইহুদি ধর্মই পালন করতেন। পরে তিনি নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডাম শহরে চলে আসেন এবং সেখানে সফল ব্যবসায়ের মাধ্যমে স্থানীয় ইহুদিদের মধ্যে ধনী এবং গণ্যমান্য হয়ে ওঠেন I অ্যামস্টারডাম সে-সময়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে গড়ে উঠেছিল, আর সে-কারণে এখানকার অধিবাসীরা ধর্মবিষয়ে কিছুটা উদারপন্থী ছিল। জন্মগতভাবে ইহুদি হলেও স্পিনোজা ছিলেন বলিষ্ঠ মুক্তিচিন্তক। চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে পৈতৃক সম্পত্তি ত্যাগ এবং অন্যভাবে বিত্তলাভের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজ হাতে চশমার লেন্স তৈরি করে স্বাধীনভাবে জীবিকানির্বাহ করতেন। মহাবিশ্ব সম্বন্ধে তার নিজস্ব চিন্তার ফসল ছিল একধরনের প্রাকৃতিক অদ্বৈতবাদ। তিনি বলতেন যে, বিশ্বপ্রকৃতির বাইরে কোন ঈশ্বর নেই। বিশ্বপ্রকৃতিরূপী এক ও অভিন্ন সত্তা সর্বত্র বিরাজমান। বস্তু ও মন, জড় ও চেতন পদার্থ, মানুষ ও দৃশ্য মহাবিশ্ব, এ সবই একটি পূর্ণসত্তার বিভিন্ন রূপ মাত্র। মঙ্গল-অমঙ্গলের দ্বন্দ্ববোধ এবং সময়ের (time) ধারণা মানুষের সীমিত চৈতন্যের ফসল। বিশ্বপ্রকৃতি আদি- অন্তহীন, চিরন্তন এবং মঙ্গল-অমঙ্গল নিরপেক্ষ। পাপপুণ্য বলেও কিছু নেই। আদি অন্তহীন মহাবিশ্বে নিয়ম ও শৃঙ্খলা (order) আছে। বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মের উপলব্ধি এবং মহাকাল (eternity) চৈতন্যই মানুষের জীবন্মুক্তির উপায়। স্পিনোজা নানা যুক্তিবাদী প্রশ্ন তুলে বাইবেল-এর ঐতিহাসিক ভিত্তিকেও অস্বীকার করেছিলেন।
আরও অনেক বৈজ্ঞানিক এবং মুক্তচিন্তককেই পরবর্তীকালে ধর্ম ও রাষ্ট্রের শিকার হতে হয়েছিল। বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এদের মধ্যে যে- বৈজ্ঞানিকের উদাহরণ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), যিনি ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার Origin of Species নামক গ্রন্থে বিবর্তনবাদের উপস্থাপনা করেন। মানুষ ছয় হাজার বছর আগে একদিনের এক বেলায় ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হয়নি, লক্ষ লক্ষ বৎসরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে শেষ পর্যন্ত বানর জাতীয় প্রাণী থেকে ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে, ডারইউনের এই তত্ত্ব ছিল খ্রিষ্টধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের পুরোপুরি বিরোধী। অতএব ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মীয় নেতারা এবং কারলাইল, গ্ল্যাডস্টোন প্রভৃতি রক্ষণশীল রাষ্ট্রচিন্তকেরা ডারউইনের তত্ত্বকে ঈশ্বর, ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থবিরোধী বলে ঘোষণা করলেন। সৌভাগ্যবশত ততদিনে রেনেসাঁস, রিফরমেশন এবং শিল্পবিপ্লব ঘটে গেছে, রাজনীতিতে তথাকথিত উদারনৈতিক যুগের সূচনা হয়েছে, আর বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তাই ব্রুনো ও গ্যালিলিওর পরিণতি থেকে ডারউইন অব্যাহতি পেলেন। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের অভ্যন্তরে ডারউইন তত্ত্বের বিরোধিতা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং যা আজও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়নি।
আস্তিক কোন এক সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে সুখ-শান্তি পেতে চায়। আর নাস্তিক প্রকৃতিকেই সৃষ্টিকর্তা হিসেবে গণ্য করতে চায়। তবে আস্তিক যাকে সৃষ্টিকর্তা বলছেন, নাস্তিক তাকেই বলছেন প্রকৃতি। পার্থক্য শুধু এই যে, আস্তিকের স্রষ্টা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন— চিন্ময় পরিচালক, আর প্রকৃতিবাদী বলছেন, ‘জড় প্রকৃতির ভিতরই চিন্ময়ত্ব আছে।’ আস্তিক স্বর্গলোভে সৎকার্য করেন, নাস্তিক করেন ইহজাগতিক অমরত্বের আশায়। একই মূলগত জিনিসের শুধু নামগত পার্থক্য। ‘উভয়ে সৃষ্টিস্তরের বিভিন্ন সোপানের লোক। তবে অধিকাংশ আস্তিকের বিশ্বাস হৃদয়ে নয়, মুখে, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। তাই সংসারে এত পাপাচার। এ থেকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শক্তিমান পুরুষের যিনি অবিরাম চেতনা সঞ্চারিত করে রাখবেন।’
স্বর্গ-নরকে কিংবা বেহেশত-দোজখে বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সংসারে এত পাপাচার কেন, এটি বাস্তবিকই বড় আশ্চর্যের বিষয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অধিকাংশ লোকই মুখে বিশ্বাস করে, হৃদয়ে করে না। উত্তরাধিকার-সূত্রে পাওয়া ধনের যেমন প্রকৃত কদর হয় না, বিশ্বাসেরও তাই। আপন চেষ্টার দ্বারা, সাধনার দ্বারা আয়ত্ত না করলে কোন জিনিসই আমাদের নিজস্ব হয় না।
মানুষের উন্নতির মূলে স্বাধীন চিন্তার ভূমিকাই বেশি। ধর্মগ্রন্থ যেখানে মানুষকে নিশ্চল করে রাখে, স্বাধীন চিন্তা সেখানে মানুষকে এগিয়ে দেয়। শাস্ত্রগত ধর্মে স্বাধীন চিন্তার স্থান নেই। যতই বলা হোক ইসলামে জবরদস্তি নেই— এটা সত্য যে, বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন মতামত বরদাস্ত করা হয় না। আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। এর ওপর হস্তক্ষেপ যে কোন জাতির পক্ষে অশুভ লক্ষণ। তবে এই লক্ষণকে অতিক্রম করে ভলতেয়ার (Voltaire) বলে উঠলেন : ‘I may disapprove of what you say, but I shall defend to the death your right to say it.’
প্রায় দু’শ বছর আগে ভল্টেয়ার উদ্ধৃত কথাগুলি বলেছিলেন। এ দু’শ বছরে মানুষের চিন্তাজগতে ঘটেছে কল্পনীয় ওলটপালট। বহুযুগের লালিত অনেক বিশ্বাস আর প্রত্যয় ভেঙে হয়েছে চুরমার। এমনকি ধর্মীয় বিশ্বাসও নেই অবিচলিত কোথাও। ক্রমাগতই ভেতরে-বাইরে মানুষের রূপান্তর এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ রূপান্তরের জন্য দায়ী আকল বা বুদ্ধি তথা বিচার করে দেখার শক্তি। বুদ্ধি চিরগতিশীল আর স্বয়ংক্রিয়— বলা যায় তা একরকম ছাই-চাপা আগুন, সুযোগের হাওয়া লাগলে তো কথাই নেই, এমনকি সে হাওয়া না লাগলেও তা জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠাই তার ধর্ম। আলোকের অভিসারে বুদ্ধিই মানুষের একমাত্র দিশারী। এ বুদ্ধি আর বিচারের সাহায্যেই মানুষ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্মকর্ম, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এসবই তার ফলশ্রুতি।
সাধারণত আমরা যাকে ‘ধর্ম’ বলি তা হল মানুষের কল্পিত ধর্ম। যুগে যুগে মহাজ্ঞানীগণ এই বিশ্বসংসারের স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কী তা নির্ধারণ করবার প্রয়াস পেয়েছেন। ‘স্রষ্টার প্রতি মানুষের কী কোন কর্তব্য নাই? নিশ্চয়ই আছে’-এইরূপ চিন্তা করে তাঁরা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের কর্তব্য কী তা নির্ধারণ করে দিলেন। অধিকন্তু মানুষের সমাজ ও কর্মজীবনের গতিপথও দেখিয়ে দিলেন সেই মহাজ্ঞানীগণ। এইরূপে হল কল্পিত ধর্মের আবির্ভাব। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মনীষী বা ধর্মগুরুদের মতবাদ হল ভিন্ন ভিন্ন।
এতধিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের নিকট আপন আপন ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ, সনাতন ও ঈশ্বর-অনুমোদিত, মুক্তি বা পরিত্রাণের একমাত্র পন্থা। বলা বাহুল্য যে, এরূপ ধারণা প্রত্যেক ধর্মেই বিদ্যমান। কোন ধর্মে একথা এখনও স্বীকার করে না যে, অপর কোন ধর্ম সত্য অথবা অমুক ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, মুক্তি বা নির্বাণ ঘটবে। বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকেরা এই কথাই বলে থাকেন যে, তাঁদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, অন্য কোন ধর্মই সত্য নয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, পরিত্রাণ, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ ঘটবে না। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলেই আপন আপন দধি মিষ্টি বলে।
বর্তমান যুগে পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মই আস্তিক। বিশেষত একেশ্বরবাদী হিন্দুধর্মও মূলত একেশ্বরবাদী। তাই যদি হয়, অর্থাৎ জগতের সকল লোকই যদি একেশ্বরবাদী হয়, তবে তাদের মধ্যে একটি ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। কিন্তু আছে কি? আছে যত রকম হিংসা, ঘৃণা, কলহ ও বিদ্বেষ। সম্প্রদায়বিশেষে ভুক্ত থেকে মানুষ মানুষকে এত অধিক ঘৃণা করে যে, তদ্রূপ কোন পৃথিবীর প্রাণীতেও করে না। হিন্দুদের নিকট গোময় (গোবর) পবিত্র, অথচ অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্ৰ। পক্ষান্তরে ‘মুসলমানদের নিকট কবুতরের বিষ্ঠাও পাক, অথচ অমুসলমান মাত্রেই নাপাক। পুকুরে সাপ, ব্যাঙ মরিয়া পচিলেও উহার জল নষ্ট হয় না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছুঁইলেই তা হয় অপবিত্র। কেউ কেউ একথাও বলেন যে, অমুসলমানী পর্ব উপলক্ষে কলা, কচু, পাঁঠা বিক্রিও মহাপাপ। এমনকি মুসলমানের দোকান থাকতে হিন্দুর দোকানে কোন কিছু ক্রয় করাও পাপ।’ এই কি মানুষের ধর্ম? না ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা?
আরজ আলী মাতুব্বর ‘শয়তানের জবানবন্দি’ প্রবন্ধে মানুষের সকল শুভ কাজের প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে শয়তানের ভূমিকার অযৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছেন :
‘কোন মানুষের অকল্যাণ আমার কাম্য নয় এবং তা করিও না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে এমন কতোগুলো বিধি-নিষেধ রয়েছে, যা মানুষের অকল্যাণই করে এসেছে আবহমান কাল থেকে। তাই মানুষের কল্যাণ কামনায় সে সব বিধি-নিষেধ অমান্য করার জন্য আমি মানুষকে প্রেরণা দিচ্ছি। কেননা সেসব বিধি-নিষেধ লঙ্ঘন করার জন্য মানুষকে প্রেরণা দেওয়াই আমার কাজ। আর তারই ফল আধুনিক জগতে মানব জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ক্রমোন্নতি। তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলোতে আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য যাবতীয় তত্ত্বালোচনাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, ঘোষিত হয়েছে স্বর্গ ও নরক-তত্ত্ব, বিশেষভাবে।
মানুষ আজ সমুদ্রতলে বিচরণ করে, আকাশে পাড়ি জমায়, পরমাণুগর্ভে প্রবেশ করে এবং কতো অসাধ্য সাধন করে, কিন্তু এর কোনটাই ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে শিক্ষা দেয়নি, বরং নিষেধ করেছে বারে বারে। আমার কর্তব্য বিধায় ওসব আমিই শিক্ষার প্রেরণা দিয়েছি ও দিচ্ছি মানুষকে, আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু তাতে শুধু অধার্মিকরাই লাভবান হয়নি, ধার্মিকরাও ভোগ করছেন তার সুযোগ-সুবিধাগুলো পুণ্যার্জনের জন্য। জল, স্থল ও হাওয়াই যানের সাহায্য ছাড়া শুধু পদব্রজে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালনে হাজীদের সংখ্যা কতকজন হত, তা হিসেব করে দেখেছেন কি? বর্তমানে ওয়াজে, আজানে, পবিত্র কোরান তেলাওয়াতে, জানাজার নামাজেও মাইক, রেডিও, টেলিভিশন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে পুণ্যের মাত্রা নিশ্চয়ই বাড়ছে। সুতরাং শুধু পাপকর্মের দ্বারা দোজখে যাবার জন্যই নয়, পুণ্যকর্মের দ্বারা বেহেস্ত যাবার জন্যও আমি মানুষকে সহায়তা করছি না কি? এছাড়া আমি হামেশা আল্লাহকে স্মরণ করি, তাঁর হুকুম পালন করি, তাঁর এবাদত করি, কিন্তু দোজখ থেকে পরিত্রাণ বা বেহেস্ত লাভের প্রত্যাশায় তা করি না। কেননা দোজখের শাস্তি ও বেহেস্তের সুখ আমার কাছে অকেজো। যেহেতু নূরের তৈয়ারী দেহ আমার আগুনে জ্বলবে না এবং আহার-বিহার নিদ্রা ইত্যাদি না থাকায় (বেহেস্তের) সুখাদ্য ফল, সুপেয় পানীয়, স্বর্ণপুরী, সুন্দরী ললনা (হুর-গেলমান) ইত্যাদি আমার কোন কাজেই আসবে না। পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি জীবমাত্রেই আল্লাহর এবাদত করে থাকে। কিন্তু তারাও দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে তা করে না। অথচ মানুষ তা-ই করে থাকে। ধর্মের নিশানধারীদের মধ্যে হাজারে বা লাখে এমন একজন মানুষ মিলবে কি-না সন্দেহ, যিনি নিছক আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই পুণ্যকাজ করেন, যার সাথে বেহেস্ত-দোজখের সম্পর্ক নেই। যারা দোজখের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে পুণ্যকাজ করে, তারা আমার চেয়ে অধম, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট।
বলা হয় যে, আদমকে সেজদা না করায় আমি ঘৃণিত ও অধঃপতি হয়েছি এবং আদমকে গন্ধম ভোজন করিয়ে মানুষের শত্রু হয়েছি। বাস্তবে তা নয়। বরং পুরষ্কৃত হয়েছি ও পদোন্নতি লাভ করেছি এবং মানবকুলের বন্ধুর কাজই করেছি। আমার কথা শুনে আপনি একটু তাজ্জব হলেন বুঝি। এ বিষয়ে একটু বুঝিয়ে বলি।
ফেরেস্তারা নূরের তৈরি। তাই পাক-সাফ বটে, তবে ওদের বুদ্ধি নেহাত কম। নিজেরা কোন কাজই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম তামিল করা ছাড়া। ‘হাঁ হুজুর’ ছাড়া ‘না হুজুর বলার ওদের অভ্যাস নেই। তবে একদিন ‘না হুজুর’ বলেছিল, কিন্তু তা খাটেনি। আল্লাহর পৃথিবীতে মানবজাতি সৃষ্টির পরিকল্পনা ঠিক করে আদমকে বানাবার পূর্বে ফেরেস্তাগণের আক্কেল পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তাতে তারা আল্লাহকে বলেছিলেন, ‘আদমীরা আপনার হুকুম-আহকাম মানবে না বা এবাদত করবে না। সুতরাং আদম সৃষ্টি না করাই উত্তম।’ মানবজাতির পরম সৌভাগ্য যে, আল্লাহ ফেরেস্তাদের সে উপদেশ অগ্রাহ্য করে আদমকে বানালেন। কিন্তু আল্লাহ যদি ফেরেস্তাদের প্রস্তাব মেনে আদমকে না বানাতেন, তাহলে মানবজাতির এ দুনিয়াপ্রীতির কি দশা হত?
বলা হয় যে, আমি আদমের শত্রু, আদম জাতির শত্রু। কেননা গন্ধম ভক্ষণ করিয়ে আমি আদমকে বেহেস্তছাড়া করেছি। আসলে তা নয়। যৌনক্রিয়ায় নাকি মানুষ নাপাক হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বেহেস্ত হল চিরপবিত্র স্থান। সেখানে ওসব নাপাকীর কোন স্থান নেই। কাজেই আদম-হাওয়া বেহেস্তে থাকলে তাদের যৌনক্রিয়া আজীবন বন্ধ রাখতে হত। ফলে আদম থাকতেন নিঃসন্তান ও নির্বংশ। আদমের প্রেমাসক্তি সম্পূরণ ও বংশবৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ আদম-হাওয়াকে স্থান দিয়েছেন পৃথিবীতে তাদের বংশবৃদ্ধির গরজে।
বলা হয়, আল্লাহ দুনিয়ার সব কাজ করবার ক্ষমতাই মানুষকে দান করেছেন। কিন্তু হায়াত, মউত, রেজেক ও দৌলত, এ চারটি কাজ রেখেছেন নিজের হাতে। আবার এ কথাও বলা হয় যে, খুন-খারাবী, চুরি-ডাকাতি ও ব্যভিচারের উদ্যোক্তা শয়তান। তাই যদি হয় অর্থাৎ আমার দাগায় পড়েই যদি কোন এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে আহত ব্যক্তির জান কবজ করতে আজরাইল ফেরেস্তা সেখানে আসেন কার হুকুমে? সেই দিনটি মৃতব্যক্তির হায়াতের শেষ দিন নয় কি? কলেরা-বসন্তাদি রোগে অসংখ্য মানুষ মরে জীবাণুদের আক্রমণে। সেই জীবাণুদের দাগা দেয় কে?
সমস্ত জীবের রেজেক (খাদ্য) দান করেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। চোর-ডাকাতের রেজেক দান করেন কে? মানুষ জানে না যে, আল্লাহ কার রেজেক কার ভাণ্ডারে রেখেছেন। আল্লাহ যার রেজেক ও দৌলত যেখানে রেখেছেন, যে কোনও উপায়েই হোক সেখান থেকে এনে সে তা ভোগ করবেই। চোর চুরি করে বটে, কিন্তু আসলে সে তার আল্লাহর বরাদ্দকৃত খাদ্যই খায়। আমি যদি দাগা দিয়ে চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে একের রেজেক অন্যকে খাওয়াতে পারি, তাতে আল্লাহর গৌরব বাড়ে কি? অন্যান্য জীবের রেজেকও আল্লাহতালা’ই জোগান। গেরস্ত বাড়ির হাঁস-মোরগ ও খাদ্যাদি চুরি করে শেয়াল-কুকুরে খায়। তাদের দাগা দেয় কে?
বলা হয় যে, শয়তানের খপ্পরে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাতে আল্লাহর কোন সমর্থন নেই। যদি তাই হয়, তবে জারজ সন্তানের প্রাণদান করে কে? মানব সৃষ্টোত্তর কালে আল্লাহ যখন মানুষের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকেই তিনি জানেন যে, কোন প্রাণ কখন কোথায় জন্মাবে, কে কী কাজ করবে এবং অন্তিমে কে কোথায় যাবে, অর্থাৎ বেহেস্ত না দোজখে। তিনি এ-ও জানতেন যে, কে কার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে। তিনি ইচ্ছা করলে ব্যভিচারীদ্বয়কে দাম্পত্যবন্ধন দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে জারজ সন্তানদের জন্য প্রাণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। জারজ সন্তানদের প্রাণদান করেন আল্লাহ ইচ্ছে করেই। ব্যভিচার ঘটিয়ে আমি আল্লাহর সেই ইচ্ছাকেই পূরণ করি মাত্র (আরজ আলী মাতুব্বর/’শয়তানের জবানবন্দি’ )
বাঙালি সমাজের লৌকিক দার্শনিক হিসেবে খ্যাত আরজ আলী মাতুব্বর (১৯৯৯-১৯৮৫) জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসার যে চিত্র তাঁর লেখায় উপস্থাপন করেছেন, তাতে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধির পরিচয় মেলে। তাঁর লেখা সত্যের সন্ধান (১৯৯৩), সৃষ্টি-রহস্য (১৯৭৮) ও স্মরণিকা (১৯৮২) প্রভৃতি গ্রন্থে স্রষ্টা, সৃষ্টি সর্বোপরি ধর্মবিশ্বাস নিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। তাঁর সত্যের সন্ধান গ্রন্থের প্রারম্ভেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে,
‘জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যেসব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না।’
এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে বলা হয়, জগতের সকল বিষয়ে সমানভাবে দর্শন, বিজ্ঞান আর ধর্মকে কথা বলতে হয় না। এই তিনটি বিষয়ের আলোচ্য বস্তু ভিন্ন ভিন্ন। আরজ আলী মাতুব্বরের অভিযোগ,
‘এই যে জ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা, মনের অদম্য স্পৃহার আঘাত, আত্মার অতৃপ্তি, ইহারই প্রতিক্রিয়া মানুষের ধর্মকর্মে শৈথিল্য। এক কথায়— মন যাহা চায় ধর্মের কাছে তাহা পায় না। মানুষের মনের ক্ষুধা অতৃপ্তই থাকিয়া যায়। ক্ষুধার্ত বলদ যেমন রশি ছিড়িয়া অন্যের ক্ষেতের ফসলে উদার পূর্তি করে, মানুষের মনও তেমন ধর্ম ক্ষেত্রের সীমা অতিক্রম করিয়া ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য ছুটিয়া যায় দৰ্শন আর বিজ্ঞানের কাছে।’
এই অভিমতের ভিন্ন মত হল, মানুষ যে আদতে প্রকৃতির সব রহস্য ভেদ করতে পারবে না, তা এখনকার বিজ্ঞান অকপটে স্বীকার করে।
‘কাজেই যারা বিজ্ঞান চর্চা করে তারা ধরেই নিয়েছে আমরা যখন বিজ্ঞান দিয়ে পুরো প্রকৃতিটাকে বুঝে ফেলবো, তখন আমরা সবসময় সবকিছু সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবো। যদি কখনো দেখি কোন একটা কিছু ব্যাখ্যা করতে পারছি না, তখন বুঝতে হবে এর পেছনের বিজ্ঞানটা তখনো জানা হয়নি। যখন জানা হবে তখন সেটা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবো। এককথায়, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বা ভবিষ্যদ্বাণী সবসময়েই নিখুঁত এবং সুনিশ্চিত, কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞানের এই ধারণাটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন যে, প্রকৃতি আসলে কখনোই সবকিছু জানতে দেবে না। সে তার ভিতরের কিছু কিছু জিনিস মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। মানুষ কখনোই সেটা জানতে পারবে না। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, এটা কিন্তু বিজ্ঞানের অক্ষমতা বা অসম্পূর্ণতা নয়। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীরা একটা পর্যায়ে গিয়ে কখনোই আর জোরগলায় বলবেন না ‘হবে’, তারা মাথা নেড়ে বলবেন— ‘হতে পারে’। (মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, পৃ. ১০)।
যুক্তিবাদ বনাম ধর্মীয় ভাববাদ
যুক্তিবাদের বিপরীতে ভক্তিবাদ-ভাববাদ তথা অধ্যাত্মবাদের প্রবল সামাজিক প্রতাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই প্রাচীন সামাজিক-শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার শরণাপন্ন হন। ধর্মীয় সংস্কৃতির গভীর-ভিত্তি অচলায়তনের বিরাজমান প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। বিস্ময় জাগে, রবীন্দ্রনাথের মত উপনিষদবাদী-মানবিক ভক্তিবাদীও এ অচলায়তন ভাঙতে চেষ্টা করে সফল হননি। যদিও তিনি, তাঁর ভাষায়, মনের তাগিদে শিকল ধরে টান দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে বা অধিকতর আবেগে কাজী নজরুল ইসলাম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সামাজিক রক্ষণশীলতার ‘লৌহকপাট’ ভাঙার চেষ্টা করেছেন, পারেননি। পরিণামে জুটেছে উপহাস, অপবাদ, গালমন্দ, ধর্মীয় সংস্কৃতির সামাজিক ভাববাদী দর্শন উভয় সম্প্রদায়ের সমাজে এতটা জোরালো ও গভীরমূলীয় ছিল যে দুই শতকেও এর নির্বাণ ঘটেনি ডিরোজিও থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ কারো কারো যুক্তিবাদী চেতনা বা ইয়ংবেঙ্গলের স্ফুলিঙ্গপাত পরিবর্তন ও আধুনিকতার ধারায় সমাজের শিকড় ছুঁতে পারেনি। রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের সাধুপ্রচেষ্টা আইনি সহায়তা সত্ত্বেও সমাজমানসে ব্যাপক ও স্থায়ী প্রভাব গড়ে তুলতে পারেননি।
মানুষের উন্নতির মূলে স্বাধীন চিন্তার ভূমিকাই বেশি। ধর্মগ্রন্থ যেখানে মানুষকে নিশ্চল করে রাখে, স্বাধীন চিন্তা সেখানে মানুষকে এগিয়ে দেয়। শাস্ত্রগত ধর্মে স্বাধীন চিন্তার স্থান নেই। যতই বলা হোক ইসলামে জবরদস্তি নেই— এটা সত্য যে, বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন মতামত বরদাস্ত করা হয় না। আধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য চিন্তার স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। এর ওপর হস্তক্ষেপ যে কোন জাতির পক্ষে অশুভ লক্ষণ। তাই জ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্বাসের সংস্কার– সত্যের স্বরূপ উন্মোচনে সমকালীন ধারণার প্রামাণ্য প্রসঙ্গে যুক্ত হওয়া। কেননা বিশ্বাস একটি বিস্তীর্ণ সম্ভাব্যতার ক্ষেত্র। এখানে জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসের বিরোধ বাধলে, তার যৌক্তিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সত্যের সপক্ষে না পৌছলে বিশ্বাসও বিপর্যস্ত হয়।
এইজন্যই বদ্ধমূল বিশ্বাস প্রগতির অন্তরায়। কাজী মোতাহার হোসেনের (১৮৯৭- ১৯৮১) অভিমত, পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মসংস্থাপকের ইতিহাসই প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে বুদ্ধি, সাধারণ জ্ঞান, মুক্তদৃষ্টি এবং যুক্তির সংঘর্ষের ইতিহাস। তিনি আরও বলেন :
‘এখানেই ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধ; শুধু বিজ্ঞানের নয়, এখানে ধর্মের সহিত যুক্তিরও বিরোধ ঘটে। মুশকিল এখানে যে, জ্ঞান ও বিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তন পরিবর্ধনের ভিতর দিয়া যাইতেছে— কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের স্বাভাবিক অবস্থাই স্থিতিশীলতা। এইরূপ স্থিতিশীলতার একটি কারণ, সাধারণ লোকের নির্বিকার অনুকরণ-প্রবৃত্তি, চিন্তার নিষ্ক্রিয়তা এবং জ্ঞানের স্বল্পতা। কিন্তু ইহা ছাড়াও আর একটি প্রবলতর কারণ এই যে, ধর্ম-বিশ্বাসকে সচরাচর অপৌরুষেয়ত্বের গৌরবে ভূষিত করিয়া শাস্ত্রকে অপরিবর্তনীয় বলিয়া মনে করা হয়। মানুষ তাহার অতীতকে লইয়া গৌরব করিতে চায় বলিয়া মোহে পড়িয়া পুরাতনকে সনাতন বলিয়া বিশ্বাস করে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকবার এই অপবিবর্তনীয় ধর্ম বিশ্বাসও পরিবর্তিত হইয়াছে।’ (ধর্ম ও সমাজ, ১৯৩৭)।
বিশ শতকে বিশ্বব্যাপী বস্তুবাদী চিন্তার প্রসার এক আলোড়িত ঘটনা। এসব পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের যুক্তিবাদী চিন্তা দ্বারা এ উপমহাদেশের শিক্ষিত জনজীবনও স্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত হয়। এ সময় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ বস্তুবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অসাম্প্রদায়িক ও অখণ্ড ভারতের প্রত্যাশী মুক্তচিন্তক কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) তাঁর বাংলার জাগরণ (১৯৫৬) গ্রন্থে ব্যক্তিগত, সম্প্রদায়গত, দেশ ও জাতিগত ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার এক বিশেষ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। আবদুল ওদুদ সমকালে সমাজতন্ত্রের সপক্ষে না- থাকলেও যুক্তিবাদে ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক এবং সর্বমানবিক বোধে উজ্জীবিত মুক্ত পুরুষ। তিনি ছিলেন বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার সপক্ষে। যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসকে আবিষ্কার করেন নি। কারো কারো মতে, ‘এতে পুরানো বিশ্বাস যুক্তি-আশ্রয়ী হয়েছে মাত্র। ফলে বিশ্বাসও প্রমাণ পায়নি, যুক্তিও পথ হারিয়েছে’। (আহমদ শরীফ, ওদুদ চর্চা; পৃ. ১০৫)। কেননা ‘যেখানে জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তি অচল সেখানেই বিশ্বাসের জন্ম। এজন্যই যুক্তির পথ বেয়ে বিশ্বাসের তোরণে কখনো উত্তরণ ঘটে না। বিশ্বাসের অঙ্গিকারে যুক্তি প্রয়োগ কিংবা যুক্তির অনুগত করে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তাই বিড়ম্বনাকে বরণ করে মাত্র।’ (প্রাগুক্ত)
ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকের মুখ্য অভিযোগের একটি হল এই যে পাহারাওয়ালা এবং সৈন্যবাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি সাফল্যের সঙ্গে ধর্ম প্রতিষ্ঠানরা প্রতিষ্ঠিত অসাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখায় সাহায্য করে এসেছেন। সব সমাজেই কম বেশি অসাম্য, অত্যাচার, শোষণ এবং পীড়ন বর্তমান। তার ফলে যে বিক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক ক্ষমতাশালীরা তাকে দমন করার জন্য পাহারাওয়ালা এবং সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করবেন, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু গায়ের জোরে দমনের চাইতে মনের ভিতর থেকে বিক্ষোভকে সংবেশিত করা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কাছে ঢের বেশি কাম্য। এই কাজটি ধর্মের মারফৎ সব চাইতে সাফল্যের সঙ্গে করা চলে। ‘আদিম পাপ’-এর কিংবা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস যদি ব্যাপক এবং দৃঢ়মূল করা যায় তাহলে গ্লানিকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিরর্থ হয়ে পড়ে। যা আছে তা অসংগত নয় এটা যদি একবার মেনে নেওয়া যায়, তাহলে পরিবর্তনের জন্য আর কোন উদ্যোগ উৎসাহ প্রবল হতে পারে না। জিজ্ঞাসা সম্মোহিত হলে ধর্মবিশ্বাসীদের যেমন সুবিধা হয়, প্রতিষ্ঠিত অসাম্য এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ভিতর থেকেই ভোগবৃত্ত হলে সেই ব্যবস্থায় যাঁদের কায়েমী স্বত্ব আছে তাঁরা নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে না। এক্ষেত্রে ধর্মের ‘অবদান’ সুবিদিত।
এখন দিকে দিকে, দেশে-বিদেশে আমরা যা-কিছু দেখতে পাচ্ছি, যাকে সভ্যতা সংস্কৃতি সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞান কারিগরি প্রকৌশল ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করা হচ্ছে, যা সব সভ্যতারই মালমশলা আর বুনিয়াদ, এর কোনটাই স্বাধীন চিন্তা-বিরোধী তথাকথিত ‘শাস্ত্রনিষ্ঠ ধার্মিকে’র অবদান নয়। দ্রুত আর স্বল্প শ্রমে হজ্ব করে পুণ্যার্জনের সহায়ক যে হাওয়াই জাহাজ, বহু ধার্মিকের নিত্যসঙ্গী বৈদ্যুতিক পাখা, অবসর-বিনোদনের সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন, এমনকি তাবিজ দেওয়াও এখন যে ঝরণা কলমে লেখা হয় তাও কোন ‘শাস্ত্রনিষ্ঠ পরহেজগার’ মানুষের আবিষ্কার নয়, একথা মানুষ জানে। মুসলমানরাও এযাবৎ যা কিছু আবিষ্কার করেছে তাও স্বাধীন চিন্তার পথ বেয়েই। এমনকি যেসব কবি- সাহিত্যিক-দার্শনিকদের নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করে থাকি তারাও স্বাধীন আর মুক্তমনেরই ফসল। ধর্মজীবন মন্দ বা অবাঞ্চিত তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাচ্ছি ধর্মজীবনের সঙ্গে স্বাধীন চিন্তার যোগাযোগ না হলে পৃথিবী সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসার পর যে অবস্থায় ছিল, আজও সেই অবস্থায় থেকে যেত। কোনকরম আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন না করে বরং আরো এগিয়ে গিয়ে বলা যায়, কেতাবী কি অ-কেতাবী কোনরকম ধর্মে বিশ্বাস না করেও মানুষ এ মর্তজীবনে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে তার দেদার দৃষ্টান্ত পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) ইংল্যান্ডে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেন :
যেসব ব্যক্তি ধর্ম সম্বন্ধে কোন যুক্তিসঙ্গত তত্ত্বানুসন্ধানের উপযোগিতা অস্বীকার করেন, আমার মনে হয়, তাঁহারা যেন কতকটা স্ববিরোধী কাজ করিয়া থাকেন। যেমন খ্রীস্টানরা দাবি করেন যে, তাঁহাদের ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম; কারণ অমুক অমুক ব্যক্তির কাছে তাহা প্রকাশিত হইয়াছিল। মুসলমানরাও নিজেদের ধর্ম সম্বন্ধে একই দাবি জানান যে, একমাত্র তাঁহাদের ধর্মই সত্য, কারণ এই এক ব্যক্তির কাছে তাহা প্রত্যাদিষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বলেন, ‘তোমাদের নীতিশাস্ত্রের কয়েকটি বিষয় ঠিক বলিয়া মনে হয় না। একটা উদাহরণ দিই। দেখ, ভাই মুসলমান, তোমার শাস্ত্র বলে যে, কাফেরকে জোর করিয়া মুসলমান করা চলে; আর সে যদি মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হইতে না চায়, তবে তাহাকে হত্যা করা চলে; আর এরূপ কাফেরকে যে-মুসলমান হত্যা করে, সে যত পাপ, যত গর্হিত কর্মই করুক না কেন, তাহার স্বর্গলাভ হইবেই।’ মুসলমানরা ঐ-কথার উত্তরে বিদ্রূপ করিয়া বলিবে, ‘ইহা যখন শাস্ত্রের আদেশ, তখন আমার পক্ষে এরূপ করাই সঙ্গত। এরূপ না-করাটাই আমার পক্ষে অন্যায়। খ্রীস্টানরা বলিবে, ‘কিন্তু আমাদের শাস্ত্র এ-কথা বলে না। মুসলমানরা তাহার উত্তরে বলিবে, ‘তা আমি জানি না। তোমার শাস্ত্র-প্রমাণ মানিতে আমি বাধ্য নই। আমার শাস্ত্র বলে, সব কাফেরকে হত্যা কর। কোনটা ঠিক, কোন্টা ভুল, তাহা তুমি জানিলে কিরূপে? আমার শাস্ত্রে যাহা লিখিত আছে, নিশ্চয়ই তাহা সত্য। আর তোমার শাস্ত্রে যে আছে, হত্যা করিও না, তাহা ভুল। তাই খ্রীস্টান, তুমিও তো এই কথাই বলো; তুমি বলো যে, জিহোবা ইহুদীদিগকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই যথার্থ কর্তব্য; আর তিনি তাহাদিগকে যাহা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন, তাহা করা অন্যায়। আমিও তাহাই বলি; কতকগুলি বিষয়কে কর্তব্য বলিয়া এবং কতকগুলি বিষয়কে অকর্তব্য বলিয়া আল্লা আমার শাস্ত্রে অনুজ্ঞা দিয়াছেন; ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের তাহাই চূড়ান্ত প্রমাণ।’ খ্রীস্টানরা কিন্তু ইহাতেও খুশী নয়। তাহারা ‘শৈলোপদেশের’ (Sermon on the Mount ) নীতির সহিত কোরানের নীতি তুলনা করিয়া দেখাইবার জন্য জিদ করিতে থাকে। ইহার মীমাংসা হইবে কীরূপে? গ্রন্থের দ্বারা নিশ্চয়ই নয়, কারণ পরস্পর বিবদমান গ্রন্থগুলি বিচারক হইতে পারে না। কাজেই এ-কথা আমাদের স্বীকার করিতেই হইবে যে, এইসব গ্রন্থ অপেক্ষা অধিকতর বিশ্বজনীন কিছু একটা আছে। (স্বামী বিবেকানন্দ/’যুক্তি ও ধর্ম’)।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘ধর্মের প্রমাণ প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে আত্মার অভিব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন :
‘ধর্ম সম্বন্ধে একটি বড় প্রশ্ন হইল : কী কারণে ধর্ম এত অবৈজ্ঞানিক? ধর্ম যদি একটি বিজ্ঞান, তবে অপরাপর বিজ্ঞানের ন্যায় উহার সত্যতা অবধারিত নয় কেন? ঈশ্বর স্বর্গ প্রভৃতি সম্বন্ধে সমুদয় ধারণা-অনুমান ও বিশ্বাস মাত্র। ইহার সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা নাই, মনে হয়। ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হইতেছে। মন সর্বদা পরিবর্তনশীল প্রবাহ-স্বরূপ।’
আরজ আলী মাতুব্বর রামায়ণ মহাকাব্যে আর্য রাম ও অনার্য রাবণের প্রতিভার মধ্যে রাবণকে ঐশ্বর্যবান, সৌন্দর্যপ্রিয়, রুচিবোধসম্পন্ন, রাজনীতি বিশারদ ইত্যাদি গুণে বিভূষিত করেছেন। আর প্রজা-মনোরঞ্জন সীতার ‘অগ্নিপরীক্ষা’কে দেখেছেন কাপুরুষতার লক্ষণ হিসেবে। আরজ আলী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন :
রামচন্দ্রের কাহিনীকারের মতে চৌদ্দ বছর বনবাসান্তে রামচন্দ্র দেশে প্রত্যাবর্তন করে নির্বিঘ্নে সংসারধর্ম তথা রাজ্যশাসন করেছিলেন দীর্ঘ ২৭ বছর। অতঃপর প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। কেননা লঙ্কার অশোক কাননে বন্দিনী থাকাকালে রাবণ সীতাদেবীর সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন এবং অসতী সীতাকে গৃহে স্থান দেওয়ায় প্রজাগণ ছিল অসন্তুষ্ট। রামচন্দ্র সীতাদেবীকে গৃহত্যাগী করেছিলেন শুধু জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য, স্বয়ং তাঁকে নাকি ‘নিষ্কলঙ্কা’ বলেই জানতেন। এইরূপ পরের কথায় নিষ্কলঙ্কা স্ত্রী ত্যাগ করার নজির জগতে আছে কি? শ্রীরামের রাজপ্রাসাদে সীতা প্রসঙ্গে অতঃপর থমথমে ভাব বিরাজ করছিল কিছুদিন (২৭-২৮ দিন বা এক রজোমাস যাকে বলা হয় ২৭ বছর)। পরে সীতাদেবীর মাসিক পরিক্রমায় রামচন্দ্র যখন আসল খবর পেয়েছিলেন, তখনই তিনি অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীকে নির্বাসিতা করেছিলেন বাল্মীকির তপোবনে এবং সেখানে জন্মেছিল তাঁর যুগল সন্তান কুশ-লব।
সন্তান কামনা করে না, এমন কোন লোক বা জীবন জগতে নেই। কারো সন্তান না থাকলে তার দুঃখের অবধি থাকে না; বিশেষত ধনিক পরিবারে। আর রাজ্যেশ্বর রামচন্দ্রের বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পরে আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ সন্তান তাঁর ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের। আর সঙ্গত কারণেই সীতার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি তাঁর কোন মায়ামমতা ছিল না, বরং ছিল ঘৃণা ও অবজ্ঞা। তাই তিনি সীতা-সুতের কোন খোঁজখবর নেননি বহু বছর যাবৎ। বিশেষত ঋষি বাল্মীকির আশ্রম অযোধ্যা থেকে বেশি দূরে ছিল না, সে আশ্রম তিনি চিনতেন।
অতঃপর সীতাসহ কুশ-লব বিনা নিমন্ত্রণে (বাল্মীকির নিমন্ত্রণ ছিল) ঋষি বাল্মীকির সাথে শ্রীরামের অশ্বমেধ যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে যেদিন রামায়ণ কীর্তণ করে, সেদিন কুশ-লবের মনোরম কান্তি ও স্বরে-সুরে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র তাদের ‘দত্তক’রূপে গ্রহণ করেন। হয়ত তখন তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, ঘটনাক্রমে ফেলনা হলেও ছেলে দুটো (কুশ-লব) রাজপুত্র তো বটে।
কুশ-লবকে গ্রহণ করলেও সীতাকে গ্রহণ করেননি রামচন্দ্র সেদিনও। সীতাদেবী হয়ত আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্ন-সহ রাজপুরীতে এসে এবার তিনি সমাদর পাবেন। কিন্তু তা তিনি পাননি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যত অনাদর-অবজ্ঞা। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে হয়ত আত্মহত্যা করেছিলন। নারীহত্যার অপবাদ লুকানোর উদ্দেশ্যে এবং ঘটনাটি বাইরে প্রকাশ পাবার ভয়ে শ্মশানে দাহ করা হয়নি সীতার শবদেহটি, হয়ত লুকিয়ে প্রোথিত করা হয়েছিল মাটির গর্তে, পুরীর মধ্যেই। আর তাই প্রচারিত হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় সীতাদেবীর ভূগর্ভে প্রবেশ’ বলে। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হতে পারে না, সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হবে কিরূপে? যদিও বলা হয় যে, সত্য হবে একটি; তখন প্রশ্ন হবে কোনটি এবং কেন? অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি (Criterion of truth) কি? সত্যতা প্রমাণের উপায় (Test of truth) কি এবং সত্যের রূপ (Nature of truth) কি? (আরজ আলী মাতুব্বর/সত্যের সন্ধান)।
ধর্মদর্শনের যৌক্তিক বিশ্লেষক সুকুমারী ভট্টাচার্য বেদ প্রণয়নের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সভ্যতার অগ্রগতিতে বেদমান্যতার অসারতার যুক্তি উপস্থাপন করে প্রশ্ন রেখেছেন :
বেদ মানব কেন? বহুতর বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে বেদের এধরনের চর্চা বাঞ্ছনীয়ও নয়। এর আগে অবশ্যই বৈদিক জীবনযাত্রার ধারণাগুলি বুঝে নিতে হবে। বহু জীবনমুখী ধারণার সঙ্গে এমন কথাও আছে যে, পুরুষ খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেবে। বেদকে মানতে গেলে আজকের যুগে কোন স্ত্রী এই শর্তে স্বামীর সঙ্গে ঘর করবেন? এটা তো যুক্তি বুদ্ধিতেও মেনে নেওয়া যায় না। বলা আছে, ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য জামা, জুতো, ছাতা ভৃত্যকে দিতে হবে। এই শর্তেও কি কেউ আজ কাজ করতে রাজি হবেন? বেদের কথা অনুযায়ী, যে কোন নারীর পক্ষে একজন পুরুষই যথেষ্ট; অথচ একটি পুরুষের জন্যে অন্তত দু’জন নারীর প্রয়োজন। এই উদ্ভট যুক্তি নারীরা কোনভাবেই মেনে নেবেন না, এটা ভারতীয় সংবিধানেও আটকাবে। নারী আন্দোলনে তোলপাড় হবে দেশ। যেমন আর এক জায়গায় বলা আছে, ছুঁচো, কালো সাপ, শকুন, নারী এবং শূদ্র একই ধরনের অশুচি; এদের দেখলেও পাপ হয়। এদের মারলে একই প্রায়শ্চিত্ত—একবেলা উপবাস। বলা আছে, শিক্ষিতা বা ধনবতী নারী পুরুষের সমান। এই অধিকার একমাত্র পুরুষেরই। এমনকি নারীর দেহের উপরও তার কোন নিজস্ব অধিকার নেই। এসব মানলে তো ক্রমশ পিছিয়ে পড়বে সমাজ। আর মানতে যাবেই না কেন? (সুকুমারী ভট্টাচার্য, ‘এখন বেদ মানলে পিছিয়ে পড়ব’)।
কৃষ্ণা বসু ধর্মে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ করে রোকেয়ার মত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ধর্ম পুরুষের সৃষ্টি, ধর্মগ্রন্থও। ফলে ধর্মে ও ধর্মগ্রন্থে নারীর যে ভাবমূর্তি প্রকাশিত তা পুরুষের গড়া নারীর ভাবমূর্তি। নারী সেখানে কেবল পুরুষের অনুগত নয়; সমস্ত নির্যাতন বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার জন্য তাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলো নারীর স্বাধীন সত্তাকে স্বীকারই করেনি, তাকে অপমান করেছে নানাভাবে। বৌদ্ধ পর্যন্ত নারীকে নির্বাণের উপযুক্ত মনে করা হয়নি। বাইবেলে নারীকে সংসারগৃহে আবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে নারীর জীবনের কোন মূল্যই দেওয়া হয়নি। নারীকে পীড়নের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে পুরুষ। (কৃষ্ণ বসু, ‘ধর্ম ও নারী’)।
প্রবীর ঘোষ তার নানা প্রবন্ধে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য ঈশ্বরবাদীদের যৌক্তিকতা খণ্ডন করার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন ঈশ্বরবাদীরা যৌক্তিকতা দেখান :
বাবা’কে তো বিনা প্রমাণেই ‘জন্মদাতা’ বলে বিশ্বাস করেন, তাহলে ঈশ্বরের বেলায় খালি ‘প্রমাণ চাই’ ‘প্রমাণ চাই’ বলে চেচান কেন?
‘আমরা কজন নিজের প্রপিতামহকে দেখেছি? প্রায় কেউই দেখিনি। তবু আমরা প্রপিতামহের নাম তো বলি। তাঁকে না দেখলেও তিনি ছিলেন, এই বিশ্বাসেই বলি।
আমাদের বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে, আমরা মায়ের স্বামীর নামই উল্লেখ করি। তিনি যে বাস্তবিকই আমাদের জন্মদাতা বাবা, তার প্রমাণ কী? এখানেও তো আমরা আমাদের বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরি।
আমরা সম্রাট আকবরকে দেখিনি, গৌতম বুদ্ধকে দেখিনি। তবু বিশ্বাস করি ওরা ছিলেন। কোনও প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে যখন এমনি হাজারো কিছুর অস্তিত্বকে আমরা মেনে নিতে পারছি, তখন ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মেনে নেবার বেলায় কোন যুক্তিতে আমরা বিশ্বাসের উপর নির্ভরতার বিরোধিতা করব? ‘প্রমাণ ছাড়া মানছি না, মানব না; বলে হাঁক পাড়ব?’
যুক্তিগুলো আপাতভাবে জোরালো মনে হলেও, বাস্তবিকপক্ষে এগুলো কোনও যুক্তিই নয়। কেন নয়? এই প্রশ্নের প্রতিউত্তর হল :
প্রাচীন যুগ থেকেই পণ্ডিত মহল প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ বললেও প্রত্যক্ষ- অনুগামী বা পর্ব-প্রত্যক্ষ প্রমাণকে অবশ্যই স্বীকার করেছেন। চরক সংহিতা-য় প্রত্যক্ষ-অনুগামী তিন ধরনের অনুমানের কথা বলা হয়েছে। (১) বর্তমান ধূপ দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান। (২) বর্তমান গর্ভবতী মহিলা দেখে তার অতীত মৈথুনের অনুমান (৩) বর্তমান সুপুষ্ট বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন অনুমানের কথা বলা হয়েছে। অনুমানগুলো বর্তমান দেখে বর্তমান, বর্তমান দেখে অতীত এবং বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ বিষয়ে।
এই একই নিয়মে এখনও আমরা পুর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে অনুমান ও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি। আমার বর্তমান অস্তিত্ব থেকেই অনুমান করতে পারি, আমার প্রপিতামহের অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। প্রপিতামহের অস্তিত্ব ছাড়া আমার অস্তিত্বই সম্ভব নয়।
একইভাবে, আমার জন্মদাতা কোনও পুরুষের অস্তিত্ব ছাড়া আমার বর্তমান অস্তিত্ব অসম্ভব। আমার জন্মদাতা পুরুষটি তাত্ত্বিকভাবে মায়ের বিবাহিত জীবনসঙ্গী হতেও পারেন, নাও পারেন। প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রেই এই সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে আমরা সাধারণভাবে মায়ের বিবাহিত জীবন সঙ্গীকে ‘বাবা’ বলে থাকি। এটা রীতির প্রশ্ন, প্রমাণের প্রশ্ন নয়।
বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি, সম্রাট আকবরের বিভিন্ন দলিলের বর্তমান অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করেই আমরা তাঁদের অতীত অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। কিন্তু এ জাতীয় কোনও প্রমাণই আমাদের সামনে ঈশ্বর বিশ্বাসীরা হাজির করতে পারেননি, বা আমাদেরও নজরে আসেনি, যার দ্বারা আমরা অনুমান করতে পারি বা সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি— ঈশ্বর আছেন।
তবে যে-উপলব্ধির মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়— তা এসব স্থূল দৃষ্টান্তে প্রমাণিত হয় না। যে-উপলব্ধিতে আমরা ব্যথাবেদনা অনুভব করি, দুঃখকষ্ট সহ্য করি, আনন্দউৎফুল্লতায় উদ্ভাসিত হই— মনে প্রশান্তি অনুভব করি, তার ভারসাম্য কে পরিচালনা করে? প্রবীর ঘোষ আবার তাঁর স্থূল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে বলেন :
বিশ্বাস যে কী জিনিস, যে করে সে জানে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা শোনাই। আমাদের গ্রামে থাকত হানিফ। খেতে জন খাটত। ধান খেতের ধেড়ে ইঁদুর ধরে রান্না করে খাওয়ার রেওয়াজ আছে আমাদের গ্রামে। হানিফ এমনি একটা ধেড়ে ইঁদুর ধরতে গিয়ে ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে ইঁদুর পাওয়ার বদলে পেল ইঁদুরের কামড়। তার দিন কয়েক পর ইঁদুরটাকে ধরবে বলে ওই গর্তটা শাবল মেরে ভাঙতেই গর্ত থেকে বেরিয়ে এল একটা কেউটে। হানিফের বুঝতে বাকি রইল না, সেদিন ওকে কেউটেই কেটেছিল। এতদিন ইঁদুরে কাটার বিশ্বাসই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কেউটে দর্শনে সে বিশ্বাস ভেঙে যেতেই হানিফের সারা শরীরে কালীবর্ণ। মুখ থেকে গাজলা। হানিফকে বাঁচানো গেল না। সাপের কামড়কে ইঁদুরের কামড় বলে গভীর বিশ্বাস করলে বিষক্রিয়াও থেমে যায়।
এপার বাংলায় বা ওপার বাংলায় বিঘে প্রতি যে পরিমাণ ফসল হয়, তার বহুগুণ বেশি ফসল হয় ইউরোপের প্রতিটি দেশে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, এমন কি এই মহাদেশের জাপানেও। ওরা কেউই আল্লাহের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না। তবু আল্লায় বিশ্বাসী দু’বাংলায় মুসলিম চাষীদের চেয়ে বেশি ফসল ফলায়। এমন কি মজা হল এই যে, ইউরোপে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসহীন ব্যক্তিরা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও ওসব দেশে বিপুল সংখ্যক অনেক কম। এর কারণ, বিজ্ঞানকে ওসব দেশ কৃষিকাজে ও শারীরবিজ্ঞানে বেশি বেশি করে কাজে লাগিয়েছে। উৎপাদনহীনতা, অভাব, শোষণ, রোগ, মহামারি, এর কোনওটির জন্যই ঈশ্বরজাতীয় কোনও কিছুতে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সামান্যতম ভূমিকা নেই।
একবার এক হুজুরকে জিজ্ঞেস করি :
‘হুজুর সাহেব, আপনি মক্কায় গিয়েছেন?’
-‘হ্যা।’ হুজুর সাহেবের তৎপর উত্তর।
–’কীসে গিয়েছিলেন? জাহাজে না প্লেনে?’
–‘প্লেনে।’
– কেন, প্লেনে যেতে গেলেন কেন? আপনি আল্লাহর প্রিয় ভক্ত। আপনি আল্লাহে পরম বিশ্বাসী, কেন এই বিশ্বাস রাখলেন না, আপনি চাইলে চোখের নিমেষে আল্লাহ আপনাকে মক্কায় পৌঁছে দেবেন? বেশ তো, সেই সময় যদি অমন সোজা কথাটা মনে নাই পড়ে থাকে, এবার বাংলাদেশে ফেরার সময় আল্লাহর কাছে আবেদন রাখুন না, সপরিষদ আপনাকে চোখের নিমেষে ঢাকায় পৌঁছে দেবার। এতে বিশ্বাসের ক্ষমতার পরীক্ষা নেবার পাশাপাশি প্লেনের ভাড়া ও সময় দুই-ই বাঁচবে।’ (প্রবীর ঘোষ, ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’)।
এই যুক্তির অসারতা উন্মোচিত হতে পারে যদি কোন চিন্তাশীল সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে গভীর উপলব্ধিতে নিমজ্জিত হয়। কেননা স্রষ্টার অসীমত্ব ঐ স্থূল দৃষ্টান্তে খারিজ হয়ে যায় না। কেননা-
তিনি আছেন এবং তিনি সতত বিদ্যমান। কিন্তু কোন সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর আগমন বা অবস্থিতি ঘটেনি। তিনি অস্তিত্ববান কিন্তু তিনি অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে আসেননি। তিনি স্রষ্টা, কিন্তু শ্রমের দ্বারা নন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, কিন্তু তাঁর একত্ব গণনার দ্বারা নির্ণীত এককত্ব নয় যা বস্তুজগতে প্রযোজ্য। তিনি সকল কিছুর সাথেই আছেন, কিন্তু কোন বস্তুগত নৈকট্য নিয়ে নয়, তিনি সব কিছু থেকে ভিন্ন, কিন্তু তা বিরোধ ও ব্যবধানের মধ্যে দিয়ে নয়। তিনি কর্ম সম্পাদন করেন, এতে তাঁর কোন শ্রমের প্রয়োজন হয় না এবং তা দৃষ্টিগোচর নয়। তিনি একক কিন্তু একাকীত্ব বোধ করেন না। তাঁর কোন সঙ্গী নেই। তিনি কারো সঙ্গ কামনা করেন না অথবা কারো অনুপস্থিতি অনুভব করেন না। তিনি দৃশ্যমান না হয়েও পরিচিত, সুস্পষ্ট প্রমাণের কারণে সকলের চিত্তে জাগরিত। অন্তর দ্বারা মানুষ তাঁকে অনুভব করে, কিন্তু যে মন তাঁর অস্তিত্ব অনুভব করে সে মনও তাঁর সীমারেখা নির্ধারণ করতে পারে না। তাঁর নিকট সময় বা কাল বলে কিছু নেই। তাঁকে অতিক্রম করে সময়ের কোন গতিবিধি নেই, তাঁর কোন পরিবর্তন, হ্রাস, বৃদ্ধি নেই, তিনি গতির মুখাপেক্ষী নন কেননা তিনি সর্বত্র বিদ্যমান কিন্তু এই অবস্থান এক পদার্থের উপর অন্য পদার্থের অনুরূপ নয়। তাঁর সৃষ্টির সাথে তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই, কোন অনুভূতি দ্বারা তাঁকে স্পর্শ করা যায় না, কোন আবরণে তাঁকে আবরিত করা যায় না। কেননা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে, সীমাবদ্ধ ও সীমাহীনের মধ্যে, রক্ষিত ও রক্ষাকর্তার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সকল উদ্দেশ্যের মহত্তম উদ্দেশ্য তিনিই, তিনিই একমাত্র প্রতিশ্রুত অস্তিত্ব যেখানে সকল কিছু প্রত্যাবর্তন করবে। (জি. আর আহমেদ জামাল ইকবাল, সংশয়বাদী দর্শনের ভ্রান্তিসমূহ, পৃ. ২১৪-২১৫)।
প্রবীর ঘোষ দুই বাংলায় একজন জনগ্রাহ্য যুক্তিবাদী লেখক। কিন্তু তার যুক্তি দর্শন প্রজ্ঞাপূর্ণ নয়— স্রেফ দৃশ্যমান ঘটনার আলোকে তিনি সত্য উন্মোচনে আগ্রহী। তাই তিনি সবক্ষেত্র ঈশ্বরবাদীর অনুভব নাকচ করে দেন। তিনি মনে করেন যুক্তি হাজির করলেই ঈশ্বর ধারণা খতম হয়ে যায়। তাই তিনি আরো বলেন-
একথা আমরা জোরের সঙ্গেই বলতে পারি—এইসব ঈশ্বরবাদীর জোর আর কদ্দিন? চেতনায় যুক্তির ছোঁয়া পৌঁছলেই তো খেল খতম।
এতো ভাল দুশ্চিন্তায় পড়া গেল! সব কিছুর নিয়ন্তা ঈশ্বর কেন যুক্তিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না?
ঈশ্বর, আল্লাহ সব কিছুর নিয়ন্তা। সর্বশক্তিমান। তাঁর ইচ্ছে ছাড়া গাছের পাতাটি নড়ে না, মানুষের নিঃশ্বাস পড়ে না। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরই ভজনার জন্য। তাঁরই গুণ-কীর্তনের জন্য। তাহলে সমস্ত মানুষকে দিয়ে তাঁর গুণ-কীর্তন করাতে পারছেন না কেন? যুক্তিনিষ্ঠ মানুষগুলো ঈশ্বর, আল্লাহর গুণ-কীর্তন করা তো দূরের কথা বরং অস্তিত্ব নিয়েই টানা-হ্যাঁচড়া শুরু করেছে। ঈশ্বর এইসব যুক্তিবাদী মানুষদের কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না? কেন ওইসব বে- আক্কেলেদের মুখ থেকে ঈশ্বর-আল্লাহর ভজনা বের করতে পারছেন না? তবে কি যুক্তিবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের নেই? যুক্তিবাদীদের কাছে ঈশ্বরজাতীয়দের সব জারিজুরিই কি তবে নেহাতই ফক্কা?
বিভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসীদের মধ্যে একটি দৃঢ়বদ্ধ ধারণা আছে, তাঁদের ধর্মগ্রন্থ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ মানুষের রচিত নয়। অর্থাৎ ঈশ্বর-রচিত। ঈশ্বর-রচিত এসব ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে জানা যায়, ঈশ্বরের জাগতিক প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা আছে। উদাহরণ হিসেবে যে কোনও একটি তথাকথিত ঈশ্বর-রচিত গ্রন্থকে পাঠ করলেই এই বক্তব্যের সত্যতা বুঝতে পারবেন। বেদ-এ চোখ বোলান, দেখতে পাবেন বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে রয়েছে প্রার্থনা—আমাকে দীর্ঘ আয়ু দাও, আমাকে সুস্বাস্থ্য দাও, নারীদের বশ করার ক্ষমতা দাও, নারীসংগমে দীর্ঘ আনন্দ পেতে প্রচুর বীর্য দাও, অনেক খাবার দাও, অনেক গুরু-ঘোড়া-মেষের মাংস খেতে দাও, যুদ্ধে জয় দাও ইত্যাদি ‘দাও দাও’-এর মেলা। এই মেলা ‘দাও দাও’ প্রার্থনা করতে মানুষকে যেহেতু ঈশ্বর-ই নির্দেশ দিয়েছেন, তাই ধরে নিতেই পারি ঈশ্বরের এমনি হাজারো প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা আছে। ক্ষমতা না থাকলে, ‘আমার কাছে প্রার্থনা কর’ বলাতে যাবেন কেন? মিথ্যে প্রলোভন দেখাবেন কেন? (প্রবীর ঘোষ, ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’)।
প্রবীর ঘোষের আরো স্কুল অভিমত-
ঈশ্বর তোয়াজ পছন্দ করেন। চাটুকারিতা পছন্দ করেন। এরপর কিছু প্রশ্ন এসে হাজির হয়—
ঈশ্বর যা বলেন, তা সবই কি সত্যি? বাস্তবিকই কি ঈশ্বরের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা আছে? আদৌ কি সকলের প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা ঈশ্বরের পক্ষে থাকা সম্ভব? দুই শত্রুপক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের প্রার্থনা জানালে দুজনেরই জয় এনে দেওয়া কি ঈশ্বরের পক্ষে সম্ভব? আদৌ নয়।
যে ঈশ্বরের নির্ধারিত নীতি অমানবিক, যে ঈশ্বর মানুষে— মানুষে বিভাজনের স্রষ্টা, শোষণ ও নিপীড়নের পৃষ্ঠপোষক, সেই ঈশ্বরকে ‘ভাল’, ‘করুণাময়, ‘পূজনীয়’, ‘শ্রদ্ধেয়’, ইত্যাদি বিশ্লেষণে বিশেষিত করা কি মিথ্যা উক্তি নয়? এত মিথ্যাচারিতায় ভরা, নিষ্ঠুর, অমানবিক ধর্মগ্রন্থগুলো বাস্তবিকই যদি অপৌরুষেয় হয়, তবে বলতে হয় ঈশ্বর চাটুকার পরিবৃত হয়ে থাকতে চাওয়া এক অসৎ ও নিষ্ঠুর সাকার কিছু এবং একই সঙ্গে শোষক ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষক। ঈশ্বর যদি বাস্তবিকই দুর্নীতি ও অসতার মূর্ত প্রতিমূর্তি না হন, তবে একথাই স্বীকার করতে হয়, অসৎ ও নিষ্ঠুর শোষক-শাসকদের টিকে থাকার স্বার্থে এইসব ধর্মগ্রন্থগুলো বুদ্ধিজীবী, সুবিধাভোগী পুরোহিতরা ও ধর্মগুরুরাই রচনা করেছিলেন এবং ‘অপৌরুষেয়’ বলে প্রচার করেছিলেন। উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট-শোষক-শাসক-পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করা। (প্রবীর ঘোষ, ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’)।
অপরদিকে হুমায়ুন আজাদের অভিমত হল-
মানুষ যতো বিশ্বাস পোষণ করে, তার প্রথম প্রধান উৎস পরিবার; তারপর তার সমাজ, তার রাষ্ট্র; তার সভ্যতা। মুসলমান পরিবারে জন্ম নিলে প্রথম তার ভেতরে ঢুকবে মুসলমানের বিশ্বাসগুলো, পাশের বাড়ির হিন্দু পরিবারে জন্ম নিলে প্রথম তার ভেতরে ঢুকতো হিন্দুর বিশ্বাসগুলো; খ্রিষ্টান পরিবারের জন্ম নিলে ঢুকতো খ্রিষ্টানের বিশ্বাসগুলো, ইহুদি পরিবারে জন্মালে ঢুকতো ইহুদিরগুলো! বিশ্বাস কারো ভেতর থেকে সহজাতভাবে উঠে আসে না, বিশ্বাস সহজাত নয়; মানুষ নিজের ভেতর থেকে কোন বিশ্বাস অনুভব করে না, বিশ্বাস পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রিক; পরিবার তাকে যে-বিশ্বাসগুলো দেয়, সেগুলোকেই সে পবিত্র শাশ্বত ধ্রুব মনে করে; ভয়ে সে এগুলোকে আঁকড়ে ধরে, লোভে সে এগুলোকে জড়িয়ে ধরে। কোন বিশ্বাসই পবিত্র শাশ্বত ধ্রুব নয়, যদিও প্রত্যেকে তার বিশ্বাসকে তাই মনে করে। পবিত্র শব্দটিই নিরর্থক, এর কোন সর্বজনীন তাৎপর্য নেই; একজনের কাছে যা পবিত্র আরেকজনের কাছে তা ঘৃণার বস্তু হতে পারে, সাধারণত হয়ে থাকে; যেমন উগ্র ধার্মিকের কাছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের সব কিছুই ঘৃণ্য। ধার্মিক হিন্দু মুসলমানের পবিত্র গৃহ পোড়াতে দ্বিধা করে না, ধার্মিক মুসলমান অবলীলায় পদদলিত করে হিন্দুর পবিত্র দেবদেবীমূর্তি; খ্রিষ্টান- ইহুদিও নির্দ্বিধায় একই আচরণ করে। তাই পবিত্রতার বোধ সর্বজনীন নয়, পবিত্রতার বোধ উঠে আসে নিজের বিশ্বাস থেকে, ভয় থেকে। (হুমায়ুন আজাদ, ‘বিশ্বাসের জগত’)।
হুমায়ুন আজাদ আরো বলেন—
রবীন্দ্রনাথ করতেন রহস্যকরণ, তিনি কোন প্রথাবদ্ধ ধর্মের গীতিকার ছিলেন না; তিনি তাঁর বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতেন মহাজগতের সাথে। নজরুলে সেই রহস্যীকরণ নেই, তিনি স্থূলভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিশ্বাস বা উদ্দীপনা। নজরুলের বিশ্বাসও সন্দেহজনক, মনে হয় তিনি এক বিশ্বাসের সাথে আরেক বিশ্বাসের পার্থক্য বোঝেন না। বিধিবদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো কঠোর, একটি মানলে আরেকটি মানা যায় না, ইসলাম মানলে হিন্দুধর্ম মানা যায় না, একই সাথে কেউ হ’তে পারে না মুসলমান ও হিন্দু; কিন্তু নজরুল তাঁর এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আগের বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে। আমি বিস্মিত হই যিনি লেখেন ‘আল্লাহ্ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মোহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগত্ময়,’ তিনি কী ক’রে লিখতে পারেন ‘কালী কালী মন্ত্র জপি বসে লোকের ঘোর শ্মশানে’; ‘বল্ রে জবা বল্!/ কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল’; ‘তোর রাঙা পায়ে নে মা শ্যামা আমার প্রথম পূজার ফুল’ ও আরো এমন বহু পৌত্তলিক পদ। তিনি কি একই সাথে হ’তে পারেন খাঁটি মুসলমান, আর কালীভক্ত? অনেকে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন যে নজরুল দুই সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছিলেন; যদি তিনি তাই ক’রে থাকেন তাহলে তিনি মিলন ঘটিয়েছিলেন দুই খারাপের। আমি কি এমন মিলন ঘটাতে পারি? আমি কি আজ আল্লাহর স্তব লিখে কাল কালীমায়ের পায়ে সঁপতে পারি নিজেকে? নজরুলের কি কোন বিশ্বাস ছিল? না কি তিনি স্বতঃস্ফূর্ত উদ্গীরন করেছেন বিদ্রোহ; আর বাণিজ্যিক প্রেরণায় লিখে গেছেন একই সাথে হামদ, নাত, আর কালীকীর্তন? নজরুলের ইসলামি আর শাক্ত গানগুলো তাঁকে প্রচুর অর্থ এনে দিয়েছিল, আমরা জানি, আর ওই অর্থই হয়তো তাঁকে মাতিয়েছিল কুসংস্কৃত উদ্দীপনায়। (হুমায়ূন আজাদ, ‘বিশ্বাসের জগত’)।
যুক্তিবাদীদের যৌক্তিক ব্যাখ্যায় দেখা যে, ধর্ম মানুষের সৃষ্টি। মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের মধ্যে নিকৃষ্ট একটি হচ্ছে ধর্ম। পৃথিবী মানুষ সৃষ্টি করেছে বহু ধর্ম। প্রতিটি ধর্মই ‘ব্যাখ্যা করে বিশ্বসৃষ্টির রীতি এবং তৈরি করে সামাজিক বিধান।’ যে বিশ্বসৃষ্টির ব্যাখ্যার দায়িত্ব ধর্মগুলো নিয়েছে, তা কাল্পনিক ও অবৈজ্ঞানিক। ‘সব ধর্মেই নৈতিকতার ভিত্তি ভয়।’ বিধাতা হিংস ও ক্রুদ্ধ, অবিশ্বাসীদের শাস্তি দেয়া তার কাজ এবং বিশ্বাসীরাও এতে ভীত। তারা মহৎ কোন উদ্দেশ্যে ধার্মিক নয়, তাদের ধর্ম পালনের মূলে ভয়। স্বর্গের লোভও তাদের মধ্যে কাজ করে। অলৌকিকতায় বিশ্বাস ধর্মের এক বড় উপাদান। ধর্মগ্রন্থগুলো তাই অলৌকিক কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ, কিন্তু ওগুলো অলৌকিক নয়, মানুষের কল্পনার মোটা দাগের বিধিনিষেধে বাঁধা। সত্য সবসময় বাস্তব আর মিথ্যা কল্পনায় জড়ানো অবস্তাবতা, যেখানে মানুষ বেশি আকৃষ্ট হয়। ধর্মের বড় উপাদান অলৌকিকতা, অনুষ্ঠানিকতা। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলা চলে যার অস্তিত্ব খুঁজে চলে সারাক্ষণ। ধর্মের প্রয়োজন আছে তার সময় হয়েছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধর্ম সংস্কারের মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে। তাই ধর্মগুলোতে দেখা যায় ধর্ম সৃষ্টির সময় কালের উদাহরণ। আজ একবিংশ শতাব্দীতে যা সব সময় প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে।
বার্টান্ড রাসেল, আমি কেন খ্রিষ্টান নই বইতে বলেছেন—
‘সব ধর্মই ক্ষতিকর ও অসত্য।’ কোন অলৌকিক জগত থেকে কেউ ধর্ম পাঠায় নি, যদিও এটা বিশ্বাস করার নির্দেশ দিয়ে ভয় দেখানো হয়; কোন অলৌকিক জগত নেই, মানুষ নিয়ে কোন অলৌকিক সত্তার কোন উদ্বেগ নেই। মহাবিশ্বে মানুষ খুবই ক্ষুদ্র। ধর্ম অলৌকিক নয়—বিধাতার বা দেবদেবীদের প্রণীত নয়; ধর্ম লৌকিক— মানুষের প্রণীত, এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী ব্যাপার মানুষ উদ্ভাবনশীল; মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের একটি, ও সম্ভবত নিকৃষ্টটি, ধর্ম। ধর্মকে শাশ্বত সর্বজনীন মনে করার একটা চাপ রয়েছে; তবে ধর্ম শাশ্বত নয়, সর্বজনীনও নয়। কোন ধর্ম নেই, যা মানুষের শুরু থেকে চ’লে এসেছে, ও চিরকাল চলবে; কোন ধর্ম নেই, যাতে বিশ্বাস করে সবাই। অনেক সত্য আছে, যা সবাই শুধু বিশ্বাস নয়, স্বীকার করে; কিন্তু বিশেষ একটি ধর্ম ও তার বিধাতায় বিশ্বাস করে শুধু ওই ধর্মের মানুষ। অন্য ধর্মের মানুষের কাছে তা হাস্যকরও, অনেক সময়, ঘৃণার বিষয়। চারপাশে ধর্ম দেখে মনে হ’তে পারে যে মানুষ ধর্ম ছাড়া বাঁচতে পারে না; সত্য হচ্ছে ধর্মের মধ্যে মানুষ বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। মানুষ মর্মমূলে ধর্মবিরোধী, মানুষের পক্ষে বেশি ধর্ম সহ্য করা অসম্ভব;– ধার্মিকেরাও যতোটা ধার্মিক তার থেকে অনেক বেশি অধার্মিক মানুষের সৌভাগ্য মানুষ বেশি ধর্ম সহ্য করতে পারে না, তাই বিকাশ ঘটেছে মানুষের। বেশি ধর্মে মানুষ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, ধার্মিক মানুষ অসুস্থ মানুষ।
(হুমায়ূন আজাদ, ‘ধর্ম’)।
লালন ও রোকেয়ার মত হুমায়ূন আজাদও প্রশ্ন তুলেছেন-
বিধাতা যদি থাকেন, তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন? তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতে পারতাম। তিনি তা করেন নি কেনো? তবে কি তিনি একলা নন? ওই অলৌকিক জগতেও কি রয়েছেন বহু প্রতিদ্বন্দ্বী, যাঁরা মানুষের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যগ্র? তাঁদের কেউ হিন্দুর, কেউ ইহুদির, কেউ খ্রিষ্টানের, কেউ মুসলমানের, এবং কেউ ঙ-র, কেউ চ-র, কেউ ছ-জ-ঝর? যদি তিনি একলা, তাহলে এতো ধর্ম পাঠিয়ে কেনো তিনি বিভ্রান্ত করেছেন মানুষকে? শুধু বিভ্রান্ত ক’রেই তিনি সুখ পাচ্ছেন না; তিনি মানুষের মধ্যে তৈরি করেছেন— কাউকে করছেন ইহুদি, কাউকে খ্রিষ্টান, কাউকে মুসলমান, কাউকে হিন্দু। কেনো এদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন শত্রুতা, এবং লিপ্ত করেছেন পারস্পরিক হত্যাকাণ্ডে? আরো নানা প্রশ্ন জগতে পারে। তিনি কেনো শুধু এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন? তিনি কোন একজনের কাছে বাণী পাঠান? তিনি কেনো শুধু প্রাচীনকালেই দেখা দিতেন? কেনো তিনি দেখা দিচ্ছেন না আধুনিক কালে? আধুনিক কাল নিয়ে তাঁর বা তাঁদের কোন উদ্বেগ নেই? কেনো তিনি একদলকে গরু খেতে নিষেধ করেন, আরেক দলকে খেতে বলেন; কেনো তিনি একদলের জন্যে নিষিদ্ধ শক্তির প্রকাশ ঘটান না? তাঁর ক্রিয়াকলাপ কেনো এতো বিস্ময়কর, অস্বাভাবিক, এবং সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য? (হুমায়ূন আজাদ, ‘ধর্ম’)। অতঃপর হুমায়ূন আজাদ ধর্মের টিকে থাকা এবং এর অস্তিত্ব রক্ষায় জাগতিক লোভ-লালসার ভরসাই একমাত্র হাতিয়ার বলে চিহ্নিত করেছেন। পরকালের অলৌকিক কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির আশ্বাসও এক অলীক প্রবঞ্চনা বলে মনে করেন তিনি। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক বিশ্লেষণে হুমায়ূন আজাদ এই অভিমত পোষণ করেন যে-
সাধারণত রাষ্ট্রের ওপর ভর করে টিকে থাকে ধর্ম, রাষ্ট্রের ওপরও একজন বিধাতার দরকার। রাষ্ট্র আর বিধাতার যৌথ চেষ্টায় বেঁচে থাকে ধর্ম। ধর্মব্যবসায়ীরা জানেন, বাণী দেওয়া ছাড়া বিধাতার কোন কাজ নেই। আর বাণীকে কাজে পরিণত করতে গেলে দখল করতে হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। বিজ্ঞানের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের রয়েছে সুসম্পর্ক। পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুরুষের কামের সঙ্গেও এর সম্পর্ক নিবিড়। ফলে, ইহকালে যেমন নারীসম্ভোগের পথ তৈরি করে রাখা হয়েছে ধর্মে, পরকালে বিশ্বাসীদের জন্যেও অনন্তকাল কামসুখের লোভ দেখানো হয়েছে। কিন্তু স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই, যদিও মৃত্যু মানুষের কেন, যে-কোন প্রাণীর জন্য বড় এক সত্য। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। (হুমায়ূন আজাদ, ‘আমার অবিশ্বাস’)। অপরদিকে আরেকজন যুক্তিবাদী নিজস্ব অভিমতের আলোকে বলেন —
আমরা পৃথিবী নামক একটি গ্রহে জীবনস্রোতে আছি এটা প্রমাণিত সত্য। মৃত্যুর পরে আমাদের পরিণতি কী হবে তা আমরা জানি না। মৃত্যুর পরে আর কিছু নাই, মৃত্যু জীবনের কমপ্লিট যতিচিহ্ন— এই থিওরি প্রমাণিত সত্য নয়। আবার—মৃত্যুই আমাদের অন্তিম পরিণতি নয়, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরেক ধরনের জীবনচক্রে আমরা প্রবেশ করব— এই থিওরিটিও নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয়নি। এই দুইটি অপ্রমাণিত থিওরির মধ্যে কোনটা আমরা গ্রহণ করব? সাধারণ জ্ঞান বলে— যে থিওরিতে আমাদের জীবনজিজ্ঞাসার সঠিক জবাব মেলে সেটিই গ্রহণযোগ্য— তাই নয় কি? (মেজবাহউদ্দিন জওহের, ‘একজন আস্তিকের জবানবন্দী’)।
ঈশ্বর কী বা ঈশ্বর কে— এই প্রশ্নের জবাব মানুষের হাতে নেই। মানুষের অন্তহীন জিজ্ঞাসার বিশ্বাসভিত্তিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ধর্মে, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাভিত্তিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে দর্শনে। ঈশ্বরোপলব্ধির তাড়নায়ই মানুষ আত্মোপালব্ধিতে উৎসাহিত হয়েছে, আত্মার পথ ধরে পরমাত্মায় পৌঁছুতে চেয়েছে।
মুসলিম শাস্ত্রীয় মতবাদ অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মানুষের হেদায়েতের জন্য স্রষ্টা এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর প্রেরণ করেছেন। এঁদের মধ্যে যে আবার একশত চারখানা পবিত্র গ্রন্থও মানুষের জন্য সংবিধান করে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে তৌরাত, জবুর, ইঞ্জিল, কোরআন ব্যতীত অন্য একশত পবিত্র গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় না। মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী এ পর্যন্ত যে সকল নবীর নাম জানা যায় বিস্ময়করভাবে তাদের সকলেরই জন্ম দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় নবী নেই কেন? মুসলমানরা মানুক বা নাই মানুক নবী যদি পয়গম্বর বা পথ প্রদর্শক বা নেতা অর্থে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে ভারতবর্ষেও ধর্মের অস্তিত্ব রয়েছে অনেক, রয়েছে পবিত্র ধর্মগ্রন্থও।
মানবজাতির জন্য আল্লাহ পাক নবীদের মাধ্যমে ১০৪ খানা আসমানী কিতাব নাজিল করেছেন। কিন্তু কোরআন ব্যতীত বাকি কিতাবগুলি মানুষের হস্তক্ষেপে বিকৃত হয়েছে। আর ওই বিকৃতির কারণেই শেষ নবী হজরত মহম্মদ (স.) এর মাধ্যমে শেষ কিতাব কোরআন নাজিল করেছেন। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ যদি মানুষের হস্তক্ষেপে বিকৃত হয়ে থাকে তবে বর্তমান কিতাবে মানুষ হস্তক্ষেপ করবে না বা মানুষ বিপদগামী হবে না তার নিশ্চয়তা কি? তাহলে কি স্রষ্টার সিদ্ধান্ত মানবীয়বোধে ব্যাখ্যা অসম্ভব?
মূর্তিপূজা ইসলামে হারাম। তবে হিন্দুধর্মোনুসারীরা নানা দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করে সেই মূর্তিতে পূজা অৰ্চনা দেয়। কিন্তু ভগবতগীতায় বলা হয়েছে যাদের মন জড় কামনা বাসনার দ্বারা বিকৃত, তারা অন্য দেব দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে। তাই প্রতিমা পূজার মধ্যে ঈশ্বরকে তুষ্ট করার ধারণা সত্য নয়।
ইতিহাসতো এও সাক্ষ্য দেয় যে, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ যখন বিজয়ী হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন তখনও অন্যদের সাথে যিশু এবং ভার্জিন মেরীর ছবি কাবাগৃহের ভেতরের দেয়ালে দৃশ্যমান ছিল। তিনি শুধু ভার্জিন এবং যিশুর ছবিটি বাদে সকল ছবি মুছে ফেলতে আদেশ দিয়েছিলেন। এই বেঁচে যাওয়া ছবিটি সর্বশেষ ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দেও একজন প্রত্যক্ষদর্শী দেখেছেন, যখন ব্যাপকভাবে পুড়ে নষ্ট হওয়ার জন্য কাবাকে আবার পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছিল। কলকাতার সেন্টপলস কলেজের অধ্যাপক শেখ মকবুল ইসলাম Bhakti Yoga and Islam, Airabat Das, PhD. 1979, Bhakti – Vedanta Institute of Vedic Studies, Pg. – 49-এ লিখেছেন—
‘মহাত্মা হজরত মোহাম্মদ স্বয়ং মক্কা মন্দির অধিকার করার সময় মা মেরী ও যিশুর প্রতিকৃতি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। মোহাম্মদ স্বয়ং আদেশ দিয়েছিলেন কেউ যেনো এ মূর্ত নষ্ট না করে। শৈল্পিক দৃষ্টিতে দেখলে মূর্তিটির নিজস্ব একটি ভাষা আছে, ধর্মনিরপেক্ষ আবেদন আছে। যিশুকোলে মেরী-মায়ের মূর্তিতে চিরন্তন মাতৃত্বেই সত্য। ইসলামের আচার্য হজরত মোহাম্মদ অবশ্যই সেই সত্য অনুভব করেছিলেন। মা-মেরী ও যিশুর প্রতিকৃতি খ্রিষ্টধর্মের স্বীকৃত বিষয় ও বটে। তাই তিনি রক্ষা করেছিলেন মেরী-মাতা ও যিশুর মূর্তি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও যুক্তিবাদী লেখক বেনজীন খান এ প্রসঙ্গে বলেন—
এমনকি, পবিত্র ‘কোরআনের সুরা আম্বিয়ায় হজরত ইব্রাহিম কিছু মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন বলে বলা হয়েছে কিন্তু সেখানেও (কোরআন, ২১/৫৮) প্রধান মূর্তি ধ্বংস করা হয়নি।’ অর্থাৎ রাসুলের মৃত্যুর (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) পর ৪৮ বছর এই ছবি সম্বলিত কাবাঘরকে কেন্দ্র করে হাজিগণ যেমন হজ করেছেন, তেমনই মুসলমানগণ নামাজ পড়েছেন, সেজদা দিয়েছেন! তাহলে মূর্তি পূজা বিরোধী তত্ত্বের পরিণতি কি হলো?
আসলে আমার বিবেচনায় কোনও মানুষই মূর্তি পুজারী নয়—যখন সে বোঝে ‘মূর্তি’ প্রকৃত অর্থেই কি?
যখন সে বোঝে মূর্তি মানুষেরই সৃষ্টি; মানুষের সংস্কৃতির সৃষ্টি; মানুষের অনুভূতির প্রকাশ; মানুষের ভেতরে স্রষ্টা সত্তার প্রকাশ। (বেনজীন খান, ‘প্রসঙ্গ: পুজা’)।
অপরদিকে বাংলাদেশে আরেক যুক্তিবাদী লেখকের অভিমত-
স্বর্গ-নরক তথা বেহেশত ও দোজখ, পুণ্য পুরস্কৃত আর পাপ তিরস্কৃত অর্থাৎ লোভ এবং ভয় দেখিয়েই ধর্ম এখনও টিকে আছে। প্রায় সকল ধর্মেই বলা হয়ে থাকে ‘মানুষের মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম বা পুনরুত্থান হবে এবং ইহজগতে কৃতকর্মের বিচার শেষে মানুষকে তার প্রাপ্য স্থানে পাঠানো হবে।’ কিন্তু বিজ্ঞানমনস্করা মনে করে, ‘মৃত্যুর পর মানুষের পুনর্জন্ম শুধুই অতি ইন্দ্ৰিয় কল্পনা; হাশর বলে কিছু নেই। বেহেশত-দোজখ বা স্বর্গ-নরক এক অলীক ধারণা।’ দার্শনিকদের একটি অংশ মনে করে, ‘পুণ্য পুরস্কৃত এবং পাপ তিরস্কৃত হবে; এ বিশ্বাস অযৌক্তিক। এ ধারণা শৈশবকালীন কল্পনার ফলশ্রুতি বৈ-আর কিছুই নয় এবং একই সঙ্গে তা প্রাক্বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও মানসিকতার পরিচায়ক।’ প্রবন্ধকারের অভিমত হল, এই নতুন সমাজে এসে স্বর্গ, নরক, বেহেশত, দোজখ শুধুই ধৰ্মীয় বক্তব্য হয়ে রইল। যতটুকু সামাজিক শৃঙ্খলা টিকে আছে তা কেবল আইন এবং আইনের শাসনের কারণেই আর এর সাথে রয়েছে সামাজিক মূল্যবোধ ও তার সম্পর্ক। যদিও অনেকে মনে করে থাকে, ‘তা টিকে আছে ধর্মের কারণে!
মানব সমাজে প্রচলিত ধর্মগুলোর মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য হল সকল ধর্মই দাবি করে সে-ই সত্য ও সর্বোৎকৃষ্ট। তাকে অনুসরণ করলে অন্য কাউকে স্মরণ করার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ ‘যত মত তত পথ’-এর কথা বললেও সেখানেও আছে স্ববিরোধিতা। কেননা সত্য এক অখণ্ড, একই সময় একই সাথে পরস্পর বিপরীত দুটি কথা সত্য হতে পারে না। কেননা যুগপৎ সকল ধর্মের সত্য গ্রহণ করে তার অনুশীলন অসম্ভব। হিন্দুধর্মে ঘোষিত হয়েছে, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরোধর্ম ভয়াবহ।’ বিধর্মীর জন্য রয়েছে ‘রৌরব নরক’। অহিন্দু মাত্রই যবন, ম্লেচ্ছ, অচ্ছুৎ। ইসলাম ধর্ম একবাক্যেই সব ধর্মকে নাচক করে দেয়। কোরান বলছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম।’ স্বধর্মে আপোষহীন এসব বিশ্বাসনির্ভর ধর্মগুলিতে কোন সর্বমানবিক সমাধান নেই। ধর্মগুলো এ এক ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে’ আবদ্ধ এক ভ্রান্ত দুঃস্বপ্নে ভরপুর। (সৈকত চৌধুরী, ‘ধর্ম এক ভ্রান্ত দুঃস্বপ্ন’)।
যুক্তিবাদী বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের অভিমত হল –
ধর্মবিশ্বাস কোন যৌক্তিকতা মানে না। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’- সান্ত্বনা নিয়েই ধার্মিক জীবন। যুক্তিহীনভাবে অন্ধবিশ্বাসের পক্ষে সাফাই গাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। যদিও সভ্যতায় অনিবার্য গতি হল বিশ্বাসের বিপরীতে, যুক্তির অভিমুখে ধর্মানুসারী না হয়েও একজন নৈতিক মানুষ ভাল মানুষ হতে পারে। ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে একজন মানুষ সর্বমানবিক হওয়া অসম্ভব। একটা সময় ধর্মীয় নৈতিক বিধানগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। এইসব ধর্মীয় বিধিবিধানই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত। তবে সভ্যতার অগ্রগতি ও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে সুশাসন ও ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। (অভিজিৎ রায়, ‘অধার্মিকের ধর্মকথন’)। আহমদ শরীফ তাঁর ‘নাস্তিকের ধর্মচিন্তা’ প্রবন্ধে স্রষ্টার জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বলেছেন—
ঈশ্বর যদি এক এবং চিরন্তন হন, তাহলে তিনি জনবহুল ইউরোপে আফ্রিকার কালো মানুষের মধ্যে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের কাছে কিংবা চীন-জাপান- অস্ট্রেলিয়া-নিউগিনিতে নবী-অবতার পাঠনানি কেন, কেবল পুরনো কেনান তথা আধুনিক ইজরাইল থেকে সুয়েজ অবধি একটা বিরল বসতি অঞ্চলে এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই শুধু এক লক্ষ চব্বিশ/চল্লিশ কিংবা দুই লক্ষ চব্বিশ/চল্লিশ জন নবী পাঠালেন কেন? ভারতেই বা কূর্ম বরাহ নৃসিংহ ও রাম কৃষ্ণকে পাঠালেন কেন? মানুষের কাছে ঈশ্বরই যদি তাদের হিতার্থে আদেশ-নির্দেশ পাঠাতেন, তাহলে সে-বাণীর মধ্যে পার্থক্য ও বৈপরীত্য থাকত না। আর থাকত না সাময়িকতা। অন্তর্যামী ঈশ্বর কেন কালে কালে স্থানে স্থানে স্ববিরোধী বিপরীতমুখী বাণী পাঠাবেন মানুষের মধ্যে বিরোধ-বিবাদ-বিচ্ছেদ এবং নিত্যকালের সংঘর্ষ- সংঘাত ঘটানোর জন্যে? অজ্ঞ মানুষের কল্পনাপ্রসূন বলেই ঈশ্বর সাকার কি নিরাকার, নারী কি পুরুষ তা আজো নির্ণিত হয়নি। তিনি কেন কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন, বিশ্বজগৎ সে সম্বন্ধেও কেউ একমত নয়।
একই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন :
নাস্তিক শাস্ত্র নির্দেশে চালিত নয় বটে, তবে নাস্তিকমাত্রই ন্যায়-অন্যায়, ভালো- মন্দ, বিচার-বিবেচনা করেই কর্ম-আচরণ করে। আত্মরতি বশে পরের ক্ষতি করে না, জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তির আলোকে নৈতিক চেতনা নিয়ে সামাজিক, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ন্যায়ের অনুগত থাকে। নাস্তিক সমস্বার্থে সংযমে সহিষ্ণুতায় সহযোগিতায় সহাবস্থানের তত্ত্বে ও আবশ্যিকতায় আস্থা রাখে। Live and let other live নাস্তিক আদর্শে গুরুত্ব দেয়। যে-ক্ষতি যে-যন্ত্রণা যে-পীড়ন সে নিজের জন্য অনভিপ্রেত বলে জানে, বোঝে ও মানে, তা সে তার প্রতিবেশীর জন্যেও অকারণে কামনা করে না, কাজেই নাস্তিক যুক্তিবাদী আত্মপ্রত্যয়ী আত্মমর্যাদাসচেতন বলেই সে অন্যায়-অপকর্ম থেকে বিরত থাকে। পক্ষান্তরে শাস্ত্রে আস্থাবান আস্তিক ঈশ্বর অন্তর্যামী বলে জেনে-মেনেও করে না হেন অপরাধ-অপকর্ম-অন্যায় নেই। আস্তিকেরা কেবল সামান্য পরিমাণে বা মাত্রায় লোকনিন্দার ও রোষের এবং বহুলমাত্রায় সরকারি শাস্তির ভয়েই নানা অপকর্ম থেকে বিরত ও সংযত থাকার চেষ্টা করে মাত্র। তবু প্রলোভন প্রবল হলে সে আস্তিক মানুষ করে না হেন অপকর্ম জগতে নেই।’
আহমদ শরীফের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে তারই অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে আরো অনেক দাবি স্বীকার করতে হয়। ধর্মের যাঁরা প্রবর্তক এবং প্রচারক প্রমাণ-নিরপেক্ষ প্রাধিকারের সূত্রে অতিপ্রাকৃত যে কোন ঘটনাই তাদের ক্ষেত্রে সম্ভব। ফলে ভক্তদের কাছে বুদ্ধ হয়ে ওঠেন রহস্যবৃত এক জাদুকর, মোজেস অনুচরদের নিয়ে অনায়াসে হেঁটে সাগর পেরিয়ে যান, কৌমার্য অক্ষত রেখেই মেরী জন্ম দেন যিশুকে, মহম্মদ সশরীরে স্বর্গে ঘুরে আসেন, কৃষ্ণ একই সঙ্গে বহু নারীতে উপগত হন, রামকৃষ্ণ ভক্তকে বিশ্বরূপ দর্শন করান, অরবিন্দের মৃত্যুর পরে তাঁর নাভিকুণ্ড থেকে অলৌকিক জ্যোতি উৎসারিত হতে থাকে, সাঁইবাবা হাত ঘুরিয়ে আঙটি, ঘড়ি-জাতীয় নাড়ু দেখান। অতিপ্রাকৃত এবং আপ্তবাক্যকে মেনে নিলে তখন আর আভ্যন্তরীণ সংগতি কিংবা প্রতিষঙ্গের প্রশ্ন তোলা চলে না। অতি-প্রাকৃতের সমর্থনে কোন যুক্তি প্রমাণ মেলে না, এটাই ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে নাস্তিকের প্রধান দার্শনিক আপত্তি নয়; তাঁর প্রধান আপত্তি ধর্মবিশ্বাসের প্রশ্নোতার দাবি সম্পর্কে। জিজ্ঞাসার সূত্রে বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ; সেই জিজ্ঞাসাকে ধর্মবিশ্বাস রুদ্ধ করে বলেই নাস্তিকের বিচারে ধর্ম ক্ষতিকর। প্রকৃত বস্তু বা ঘটনায় অপ্রকৃতের আরোপ বা উৎপ্রেক্ষণ ধর্মমাত্রেরই বৃত্তি; এর ফলে সত্য-অসত্যের ভেদ অস্পষ্ট হয়ে আসে, প্রকল্পের বিচার ও পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে, জ্ঞানের বিকাশ ব্যাহত হয়।
অনেকের ধারণা ধর্মবিশ্বাস নৈতিকতার উৎস ও ধারক, এবং ধর্মবিশ্বাসে ভাঙন ধরলে ব্যক্তি এবং সমাজ-জীবনে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিতে বাধ্য। সব ধর্মেই নীতিনির্দেশ আছে এবং কোন কোন ধর্মবিশ্বাসীর জীবন নৈতিক বিচারে শুদ্ধার্থ, একথা লক্ষ করার পরও পূর্বোক্ত ধারণাকে তথ্যসমর্থিত বা যুক্তি সমৰ্থিত মনে হয় না। মোহান্ত, পুরুত, মোল্লা পীর, চার্চের বড়োছোটো কর্মকর্তা এবং প্রচারকদের মধ্যে যত দুর্নীতি অতীতে এবং বর্তমানে দেখা যায় তার তুলনা রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা, ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি, শ্রমিক-সংগঠনের সর্দার বা সন্তানদের মধ্যে মিলতে পারে। ধর্মবিশ্বাস ধর্মীয় মাতব্বরদের মধ্যে কিছু কম নয়; কিন্তু তার ফলে এঁদের বিবেকিতা কিছু দৃঢ় হয়ে ওঠেনি।
ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, শাস্ত্র গুরু, আচার-অনুষ্ঠান এসব বাইরের জিনিস, আসল ব্যাপার হচ্ছে এক ধরনের অপরোক্ষানুভূতি যা ধর্মের উৎস। এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ব্যাপারটি নাকি বড়ো গুহ্য, যাঁদের হয়েছে তাঁরাই শুধু জানেন, অন্যদের কাছে এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। একদা-প্রসিদ্ধ ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’ প্রবন্ধগ্রন্থের লেখক প্রয়াত কৌতুকী শিবরাম চক্রবর্তীর অনুসরণে আমিও বলতে পারতাম যে যা গুহ্য তা বরং গুহাতেই নিহিত থাক। কিন্তু আমি কৌতূহলী হয়ে আমার চেনাজানার মধ্যে ঐসব বিশ্বাসীদের শুধিয়েছি, আপনার কি সেই অপরোক্ষানুভূতি হয়েছে? অথবা আপনার? না, অন্তত আমার পরিচিতদের মধ্যে কেউই ব্রহ্মাস্বাদের দাবি করেন নি। তবে বলেছেন যাঁদের হয়েছে তাদের কথা নাকি তাঁরা জানেন। কিন্তু আমার না জানা এবং তাঁদের জানা এইসব মহাত্মাদের যেটুকু বিবরণ গ্রন্থাদি ও পরিচিত ব্যক্তিদের সূত্রে পেয়েছি তা থেকে অনুমান করি অধ্যাত্মজ্ঞান বলে কিছু থাক নাই থাক এইসব তুরীয়মার্গীরা সকলেই সম্মোহন বিদ্যায় পারঙ্গম এবং ভেলকি বাজিতে ওস্তাদ।
ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকের আর একটি প্রধান অভিযোগ হল, প্রতিষ্ঠিত অসাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থকাকে টিকিয়ে রাখতে ধর্ম প্রতিষ্ঠান খুব সাহায্য করে। এ ক্ষেত্রে ধর্মের সফলতা সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি। ধর্মের কেন্দ্রে যে প্রত্যয়গুলো রয়েছে তার অনেকটাই নীতিমূলক যা বিশ্বাসীদের কাছে উচিত-অনুচিতের মানদণ্ড। কিন্তু এতে অনেক স্ববিরোধিতা রয়েছে। সন্ত্রাসরোধ এবং তা থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা।- মানুষের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে ধর্ম ভিত্তি করে আছে। এখানেই ধর্ম মানুষের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
জন্মলব্ধ ধর্ম মানুষের মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় পরিচয় মানুষের সমাজে সৃষ্টি করে বিভাজন আর ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদসহ অনেক সংকট-সংঘাতের জন্ম দেয়, যা মানুষের মুক্তিচিন্তার পথে এক বড় বাধার সৃষ্টি করে। মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের পথ এতে রুদ্ধ হয় পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও রাষ্ট্রশক্তির যৌথ উদ্যোগে এমনটি ঘটে। এর মূলে রয়েছে শ্রেণিস্বার্থ—ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী লোকদের বিত্ত-বৈভব ও আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখতে ধর্মকে এভাবে কাজে লাগানো হয়।
‘জগতের প্রায় সকল ধর্মই স্রষ্টাকে অদ্বিতীয়, নিরাকার ও সর্বব্যাপী বলে। কিন্তু, যখন হিন্দুরা বলে, সৃষ্টি পালনের উদ্দেশ্যে স্রষ্টা মাঝে মাঝে সাকার হয়ে অবতাররূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন’। খ্রিষ্টানদের মতে, পরম সত্তা, “ঈশ্বর, মসীহ, পরমাত্মা’ এই ত্রীত্বে প্রকাশ পায়, এবং মুসলিম ধর্মযাজকগণ বলে “খোদা তাআলা আরশে ‘কুরছি’র উপর বসে রেজওয়ান ফেরেস্তা দ্বারা বেহেস্ত, মালেক ফেরেস্তা দ্বারা দোজখ, জিব্রাইল ফেরেস্তা দ্বারা সংবাদ ও মিকাইল ফেরেস্তা দ্বারা খাদ্য বন্টন করেন, তখন নানা প্রশ্ন জাগে। যেমন— নিরাকার সর্বশক্তিমান স্রষ্টার সৃষ্টি পালনে সাকার হওয়া বা অবতার রূপ ধারণের প্রয়োজন কি? অদ্বিতীয় স্রষ্টার মহত্ত্ব প্রকাশে ত্রীত্বের আবশ্যক কি? সর্বব্যাপী স্রষ্টার স্থায়ী আসনে অবস্থান কিরূপ এবং বিশ্বজগত পরিচালনায় ফেরেস্তার আবশ্যক কি?
‘আল্লাহ তাআলা তো অন্তত দয়াময়। এ অবস্থায়, শাস্তি প্ৰদান, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিপন্থি। তাঁর অসীম অস্তিত্বের সম্মুখে আমরা প্রায় অস্তিত্বহীন বা তাঁর সাপেক্ষে আমাদের অস্তিত্বের কোন তুলনাই হয় না। এমতাবস্থায় আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর চিন্তা করারই কথা নয়, বা আমাদের ভুল-ত্রুটি সবকিছুই তো তাঁর অসীম দয়া বা ক্ষমতার সামনে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে যেহেতু আমাদের এসব কাজ তাঁর কোন উপকার বা অপকার করতে পারে না। তাছাড়া, সাজা দেয়ার বা শাস্তির স্পৃহা জাগরিত হয় সাধারণত, দুটি কারণে। প্রথমত, প্রতিশোধ স্পৃহা। দ্বিতীয়ত, ভীতি প্রদর্শন যার উদ্দেশ্য সংশোধন এবং যাতে অপরাধী পুনরায় এরূপ অপরাধের প্রতি অনুরক্ত না হতে পারে বা হবার সাহস না দেখায়। কারণ তাঁর অসীম সত্তায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের অপরাধের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগাটা বোধগম্য নয়। মানুষের মধ্যেও কোন কোন সাধক ব্যক্তির চরিত্র প্রতিশোধ স্পৃহামুক্ত বলে কখনো কখনো প্রতীয়মান হয়। আর আল্লাহ’র মর্যাদা তো এর অনেক উপরে। আবার শাসন বা ভীতি প্রদর্শনের স্পৃহাও বোধগম্য নয়। কারণ আখেরাতে চূড়ান্ত শাস্তি নির্ধারিত হবার পর পরবর্তীকালে এমন কোন সুযোগই তার ঘটবে না যে সে অতীত জীবনের কার্যকলাপ ক্ষতিপূরণ করে নিতে পারে যা শাস্তি প্রাপ্তির দ্বারা সৃষ্ট ভীতির কারণে পুনরায় পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, কারণ পারলৌকিক জীবনের পর আর কোন জীবন নেই।
‘স্রষ্টা কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক?’ ‘নিয়মতন্ত্র’ মানে কোন নির্ধারিত বিধান বা নিয়ম মেনে চলা এবং এটা উপেক্ষা করাই হচ্ছে ‘স্বেচ্ছাচারিতা’। তিনি স্বেচ্ছাচারী হলে তাঁর মহত্ত্বের লাঘব হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক হলে তিনি তাঁর ভক্তদের অনুরোধ রক্ষা করেন কিরূপে। ‘সুপারিশ’–রক্ষার অর্থ হচ্ছে, আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করা। অর্থাৎ স্বয়ং যা করতেন না তা করা। তিনি কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুরোধে বা সুপারিশে আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করবেন কিনা?
‘বিচারকার্যে আল্লাহ ন্যায়বান নাকি দয়ালু? বিচার ক্ষেত্রে দয়া ও ন্যায় এর একত্র সমাবেশ অসম্ভব। কেননা দয়া করলে ন্যায়কে উপেক্ষা করতে হয়। এবং ন্যায়কে বজায় রাখতে হলে দয়াকে উপেক্ষা করতে হয়। এমতবস্থায় আল্লাহ একই সঙ্গে কিরূপে ন্যায়বান ও দয়ালু হন?’
‘বেহেশতে আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে দর্শন দান করবেন বলে শোনা যায়। যিনি চির অনন্ত, চির অসীম; তিনি কি চির নিরাকার নন? তাহলে তিনি নূর বা আলোরূপে কিভাবে দর্শন দিবেন? বিজ্ঞানীদের মতে, স্থুল বা সূক্ষ্ম, যে রূপেই হোক না কেন; কোন রকম পদার্থ না হলে তা দৃষ্টিগোচর হয় না। ‘আলো’ একটি পদার্থ। এর গতি আছে এবং ওজনও আছে। নিরাকার আল্লাহ যদি বিশ্বাসীদের দর্শন দানের জন্য নূর বা আলো রূপ গ্রহণ করেন তবে হিন্দুদের ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন রূপ তথা অবতারে দোষ কি?”
তাহলে সবই কি মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ?
আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, রবীন্দ্র চেতনায় বিশ্বাসের ভিত্তি ও যুক্তির অভিব্যক্তি ভিন্ন প্রকৃতির। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতায় কবি বলেছিলেন—
প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নতুন আবির্ভাব
কে তুমি?
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল।
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল
পশ্চিম সাগর তীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়— কে তুমি?
পেল না উত্তর।
অসুস্থ কবি মুখে মুখে কবিতাটি উচ্চারণ করেছিলেন, অন্যেরা তা লিখে নিয়েছিল। কবি দীর্ঘ দিনেও তাঁর ‘সত্তার’ সত্য পরিচয় লাভ করতে পারেননি। তার দুদিন পরে, মৃত্যুর একদিন আগে কবি মুখে মুখেই আরও একটি কবিতা বলে যান। এবং এটিই তাঁর দীর্ঘ কবি-জীবনের শেষ কবিতা। কবিতাটির নাম, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’। কবি বলেন-
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা-জালে
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত
তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্কতারে
যেপথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চির স্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চির সমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল সে যে অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিলম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না প্রবঞ্চিতে।
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।
আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ তথা ‘পুজা পর্যায়ের গান’ গুলিই তাঁর মানব উপলব্ধির মহত্তম সৃষ্টি। গীতাঞ্জলি (১৯০৬-১৯১০), গীতিমাল্য (১৯০৯- ১৯১৪), গীতালি (১৯১৪) পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের অরূপসাধনা এবং সীমা- অসীমের মিলন সাধনার মৌলিক অভিপ্ৰায়। এর পূর্ববর্তী পর্যায়ের ব্রহ্মসঙ্গীতগুলিতে আধ্যাত্মিকতা, পরম ব্রহ্মের ঐশ্বর্যমূর্তি ও আনন্দমূর্তি অনুভব এবং অনন্তের প্রকৃতিঘনিষ্ঠ রূপের স্তবগাঁথা রচিত হয়েছে। গীতাঞ্জলি কোন অধ্যাত্মভাবনার কাব্য নয়। এই রবীন্দ্রনাথের দুটি পৃথক সত্তার মধ্যে মানস-মিলন- বিরহলীলা। একটি তাঁর ‘আমি’-সত্তা, ‘তুমি’-সত্তার সঙ্গে পূর্ণ মিলনের জন্য অধীর— অথচ কাঙ্ক্ষিত মিলন হচ্ছে না। কবির ‘আমি’-সত্তার এই ভাব-বিরহে বেদনার্ত। এ এক ধরনের রাবীন্দ্রিক অস্তিত্ববাদ, যা পাশ্চাত্ত্য ‘অস্তিত্ববাদ’ (কিয়ের্কেগার্ড, সাত্র, কামু প্রভৃতির (existentialism) থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।
রবীন্দ্রনাথের এই উপনিষদীয় উপলব্ধির বাইরেও কৃষ্ণ, বুদ্ধ, খ্রিষ্ট, কনফুসিয়াস, কবীর, নানক প্রমুখ ধর্মীয় প্রবক্তাদের নিয়ে নানা প্রবন্ধ ও নিবেদিত কবিতা রচনা করেছেন। এমনকি লালন শাহ, হাছন রাজা প্রমুখ মরমী সাধকের মানবতাবোধও রবীন্দ্রনাথের মানববোধে অঙ্গীভূত করেছেন। মনুষ্যধর্মে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের কোন কোন কর্মপ্রণালী, প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থাযন্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল না। জীবনের উপান্তে এসেও ‘কালান্তর’ ‘সভ্যতার সংকট’ প্রভৃতি বিখ্যাত প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শুধু তার স্বভাবজাত মানবধর্মে বিশ্বাসেরই পরিচয় দিয়েছেন।
একজন মানুষের কাছে তার একমাত্র পথ প্রদর্শক হচ্ছে তার বিবেক— তার মরণোত্তর খ্যাতির একমাত্র ধর্ম হচ্ছে তার সততা এবং তার আচরণের আন্তরিকতা। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ছিল মানবকেন্দ্রিক— সর্বোপরি বিশ্ব মানবিক। মানুষই তাঁর চেনা জগতের কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের নানা দুর্বলতার দিক মনে রেখেও তিনি আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ (‘সভ্যতার সংকট’)।
রবীন্দ্রনাথের উপনিষদীয় বাণী উপলব্ধির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়েও বলা যায় ধর্ম সম্পর্কে তিনি কোন শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। কেননা কোন ‘মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে’ তিনি পা দেন নি। জীবন-সায়হ্নে রচিত ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কিংবা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ কবিতায় কবি তাঁর মানবিক বিশ্বাসকেই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করে গেছেন। কারণ তিনি জানেন— ‘ধৰ্ম ছলনা মাত্র।’ এই ধর্মের প্রবঞ্চনা দিয়ে মানুষ তার ‘মহত্ত্বকে’ চিহ্নিত করে চলেছে। ‘গর্ব- গৌরব’ করছে এবং অবশেষে মানব-শান্তিকে বিঘ্নিত করছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এসব মিথ্যা। বরং কবির নিজের অন্তরে সহজ-বিশ্বাসে যে-পথ দেখিয়ে গেছে, সে-পথেই তাঁর বিধাতাকে তিনি লাভ করে ধন্য হয়েছেন—আপন অন্তরের আলোকে ধৌত নিজস্ব সরল বিশ্বাসটিকেই তিনি তাঁর ‘বিধান’ বা ‘ধর্ম’ বা ‘রিলিজিয়ন’–যা কিছুই লোকে বলে, পেয়েছেন এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে বিধাতার শেষ পুরস্কাররূপে সেটিই তাঁর আপন-ভাণ্ডারে জমা হয়ে আছে। এবং তিনি আরো বিশ্বাস করেন যে, বিধাতার কাছে শান্তি লাভের জন্য এই ‘বিশ্বাসই’ তাঁর অক্ষয় অধিকার।
আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, ভারতীয় দর্শনের মৌলিক সুর অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর বিশ্বাসের জগৎ। বিশেষত উপনিষদ-এর নিগূঢ় ব্রহ্মতত্ত্বেই তাঁর ব্রহ্মজ্ঞানের মূল অনুবীজ অঙ্কুরিত।
কেউ কেউ মনে করেন, সক্রেটিসের মৃত্যুবরণ নির্বুদ্ধিতাজনিত এবং মৌহূর্তিক বীরত্ব মাত্র। মনে রাখতে হবে অনুরূপ বিপাক আমন্ত্রণ করে তাঁর প্রিয় শিষ্য প্লেটো দেশত্যাগ করেছিলেন, গোপনে, পালিয়ে। মৃত্যুবরণে নয়, সক্রেটিসের প্রকৃতি মহত্ত্ব নিহিত তাঁর অ-জনপ্রিয় তথা বাজে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হবার নির্ভয় উপেক্ষার ভেতর। সক্রেটিসের হাতে হেমলকের পাত্র তুলে দেয়া হয়েছিল এজন্য যে তরুণ সম্প্রদায়ের সর্বনাশ তাঁর বক্তব্যে ছিল, তৎকালীন মূৰ্খ ধর্মযাজক ও শাসক সম্প্রদায় অন্তত তাই মনে করতেন। কীভাবে এই সর্বনাশ করছিলেন স্বীয় প্রিয়শিষ্য ও অনুসারীদের? না, তিনি কিছু বিশ্বাস করতে চাইতেন না। তাঁর অস্থির মন অবিশ্বাস ও সংশয়জাত। তিনি দাবি করেন, দেবমন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হোক। অবশ্য দেবমন্দির বিনষ্ট করা হোক এমন কোন দাবি তিনি তোলেন নি। শুধু বলেছিলেন প্রচলিত দেবদেবী শ্রেণির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা কাড়ে না। কারণ এই দেবদেবীর অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। অপ্রমাণিত অনুমিত অস্তিত্বের প্রতি অনুগত্যশীল হওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কিংবা তাঁর দেবদেবী বা বিগ্রহ বিনষ্টির কর্মসূচি ছিল প্রতীক মূল্যের। তিনি বুঝেছিলেন বিশ্বাসের ফাঁদ আছে; এই ফাঁদে পা দিলে ভেদবুদ্ধি অতলে তলায়।
শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ সমীকরণের সরলতা ও বাস্তবতা
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) যত মত তত পথ। সকল ধর্মই সত্য। যেমন কালীঘাটে নানা পথ দিয়ে যাওয়া যায়। ধর্মই কিন্তু ঈশ্বর নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম আশ্রয় করে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়।[১৭]
[১৭. Is it at all possible that contradictory statements of various religions can be true at the same time? If it is not possible, then all varieties of religions can not also be true at the same time. In Hindu religion on the one hand we find worship of deities of gods and goodesses, plants and trees, beasts and serpents and on the other we also see worship of the formless Bramha. In Hindu faith God appears in various incarnations at different epochs. According to Islam, the last prophet or incarnation had appeared and there will be no next prophet. But in Bahai religion, a sect of Islam prophets had indeed appeared after Muhammad. Buddhism indicates that man has to take rebirth time and again according to his deed in his former life. According to Christianity and Islam, every person after death has to be present in the court of God for the last judgement and there is no question of rebirth. It is only in religion where we come across such contradictory truths which are beyond all human logic.
Now, which truth of religion will man believe? Belief in which truth will make God happy? Which religion is true and acceptable and which is not, who will decide? Neither religion nor God can help man to take this crucial decision. It appears to be left only to capricious choice of man. (Samiran Majumdar, Fifty Questions On Religion; ‘Is It Possible for All Religions to be True Simultaneously?)]
‘নদী সব নানা দিক দিয়ে আসে, কিন্তু সব নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেখানে সব এক।’
‘ছাদে নানা উপায়ে ওঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি আর একটা দড়ি দিয়েও উঠা যায়! তবে উঠবার সময় একটা ধরে উঠতে হয়— ‘দু-তিন রকম সিঁড়িতে পা দিলে উঠা যায় না। তবে ছাদের উঠবার পর সব রকম সিঁড়ি দিয়ে নামা যায়, উঠা যায়।
‘তাই প্রথমে একটা ধর্ম আশ্রয় করতে হয়। ঈশ্বর লাভ হলে সেই ব্যক্তি সব ধর্ম পথ দিয়ে আনাগোনা করতে পারে; যখন হিন্দুদের ভিতর থাকে, তখন সকলে মনে করে হিন্দু; যখন মুসলমানদের সঙ্গে মিশে, তখন সকলে মনে করে মুসলমান। আবার যখন খ্রিষ্টানদের সঙ্গে মিশ্র, তখন সকলে ভাবে ইনি খ্রিষ্টান!
‘সব ধর্মের লোকেরা এক জনকেই ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম কেউ হরি, কেউ গড, কেউ আল্লা, কেউ ব্রহ্ম। নাম আলাদা, কিন্তু একই বস্তু।
‘একটা পুকুরে চার ঘাট আছে। এক ঘাটে হিন্দুরা রূপ থাকে, তারা বলছে ‘জল’। আর এক ঘাটে মুসলমান, তারা বলছে ‘পানি’। আর এক ঘাটে খ্রিষ্টান তারা বলছে ‘ওয়াটার’। আবার এক ঘাটে কতগুলো লোক বলছে aga (সকলের হাস্য)। বস্তু এক-জল, নাম আলাদা। তবে ঝগড়া করবার কী দরকার? সকাল এক ঈশ্বরকে ডাকছে ও সকলেই তাঁর কাছে যাবে।
একজন ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)– যদি অন্য ধর্মে ভ্রম থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ–তা ভ্রম কোন্ ধর্মেই নাই? সকলেইর বলে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে। কিন্তু কোন ঘড়িই একেবারে ঠিক যায় না। সব ঘড়িকেই মাঝে মাঝে সূর্যের সঙ্গে মিলাতে হয়।
‘ভুল কোন ধর্মে নাই? আর যদি ভুল থাকে, যদি আন্তরিক হও, যদি ব্যাকুল হয়ে তাকে ডাক, তাহলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।’
“মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে— ছোট বড়। সকলেই ‘বাবা’ বলতে পারে না। কেউ বলা ‘বাবা’, কেউ বলে ‘বা’, কেউবা কেবল ‘পা’। যারা ‘বাবা’ বলতে পারলে না, তাদের উপর বাপ রাগ করবে নাকি? (সকলের হাস্য)। না, বাপ সকলকেই সমান ভালোবাসবে।”
‘লোক মনে করে, আমার ধর্মই ঠিক; আমি ঈশ্বর কি বস্তু বুঝেছি, ওরা বুঝতে পারে না। আমি ঠিক তাঁকে ডাকছি, এরা ঠিক ডাকতে পারে না; অতএব ঈশ্বর আমাকেই কৃপা করেন, ওদের করেন না। এসব লোক জানে না যে, ঈশ্বর সকলের বাপ মা, আন্তরিক হলে তিনি সকলকেই দয়া করেন।’ (শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)।
রবীন্দ্রনাথের এক চিঠিতে এ প্রসঙ্গটি আরো স্পষ্ট হয় এভাবে :
শ্রদ্ধাস্পদেষু
রামকৃষ্ণ পরমহংস যেদিন আমাদের বাড়িতে পিতৃদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম কিন্তু তাঁদের পরস্পরের সাক্ষাৎকারের স্থলে উপস্থিত ছিলাম না। নিবেদিতার মুখের ভাবে অনুভব করেছিলুম তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি পরমহংসদেবকে যথোচিত শ্রদ্ধা করেননি সেটা অসম্ভব নয়। কেননা তিনি একেবারেই বিগ্রহ মানতেন না, এবং উপনিষদের অনুশাসন অনুসারে তাঁর চিরজীবনের সাধনা ছিল শান্ত সমাহিত আত্মসংযতভাবের। ভক্তিপ্রেমের যে আবেগ তাঁর মধ্যে ছিল তার একমাত্র পরিতৃপ্তি তিনি পেয়েছিলেন পারসিক সুফী কাব্যগ্রন্থে। আমাদের দেশের শাক্ত বা বৈষ্ণব ধর্মে যে ভাবোন্মাদের আলোড়ন আছে তাকে তিনি দূরে পরিহার করেছিলেন তার প্রধান কারণ এ নয় যে ধর্মবিশ্বাসে তাঁর মনে একটা আভিজাত্যবোধ ছিল, আমার বিশ্বাস তার প্রধান কারণ ঐ দুই ধর্মমতের সঙ্গে যে সকল মূর্তি ও কাহিনী জড়িত তাকে তিনি আধ্যাত্মিক দিক থেকে নির্মল ও নিরাময় মনে করতেন না। সেই কাহিনিগুলিতে রূপকের মূলগত ভাব-প্রধানতা অতিক্রম করে অতিবাস্তবের ভাববিরোধী স্থূলত্ব প্রকাশ পেয়েছে বলে তার প্রতি তাঁর চিত্ত নিরতিশয় বিমুখ ছিল। ধর্মসাধন সম্বন্ধে তাঁর একটা অত্যন্ত শুচিত্ববোধ ছিল, সেই শুচিত্ব খৃস্টান ধর্মে স্থূল মতবাদকেও সহ্য করতে পারত না। রামমোহন রায়ের মধ্যে একেশ্বরবাদের একটা প্রবল ঐকান্তিকতা ছিল, যে জন্য আজও ভারতবর্ষে তাঁকে প্রসন্ন মনে স্বীকার করতে পারেনি— আমার পিতা বাল্যকালেই সেই অতি বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদের আদর্শ রামমোহন রায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন— সেই কারণে বিগ্রহপূজার সংস্রবমাত্র যেখানে আছে সেখানে তাঁর মন আঘাত পেয়েছে। কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করেছিলেন খ্রিষ্টধর্মের সিংহদ্বার দিয়ে— এই জন্যে আত্মউপলব্ধির বিশুদ্ধ আত্মসমাহিত আনন্দের সাধনা তাঁর ছিল না— শান্ত বৈষ্ণবধর্ম থেকে হৃদয়াবেগ মন্থন করে নেওয়া এবং আত্মার আন্দোলনে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া তাঁর [পক্ষে] সহজ ছিল। যাই হোক আমার এই মত আপনাকে জানালুম এ প্রকাশ করাবার জন্যে নয়। (শান্তিনিকেতন, ২১ নভেম্বর ১৯২৯)।
আরেক চিঠিতে দেখা যায় :
কল্যাণীয়াসু,
তুমি আমাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছ তার উত্তর দিতে আমি সঙ্কোচ বোধ করছি। একটি কথা তুমি নিশ্চয় জেনো ব্রাহ্ম পরিবারে যদিও আমার জন্ম তবু ঈশ্বর উপাসনা সম্বন্ধে আমার মন কোন সংস্কারে আবদ্ধ হয়নি। তার একটা কারণ, অতি শিশুকালেই আমার মধ্যে কবিপ্রকৃতি অত্যন্ত প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল-আমি আমার কল্পনা নিয়েই সর্বদা ভোর হয়ে ছিলুম-ধর্ম প্রভৃতি সম্বন্ধে কে কি বলে বাল্যকালে তা আমার কানেও যায়নি।
তারপরে আমার বয়স যখন ১৩/১৪ তখন থেকে আমি অত্যন্ত আনন্দ ও আগ্রহের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করেছি—তার ছন্দ রস ভাষা ভাব সমস্তই আমাকে মুগ্ধ করত। যদিও আমার বয়স অল্প ছিল তবু অস্ফুট রকমেও বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের মধ্যে আমি প্রবেশ লাভ করেছিলুম।
এই বৈষ্ণবকাব্য এবং চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি কাব্য অবলম্বন করে চৈতন্যের জীবনী আমি অনেকসময় পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এমন কি, আমাদের সমাজের ধর্মালোচনার সঙ্গে আমি বিশেষ যুক্ত ছিলুম না–সম্পূর্ণই উদাসীন ছিলুম। তার পরে আমার স্বদেশ অভিমানও বাল্যকাল থেকে অত্যন্ত প্রবল। সেজন্যও, যা কিছু আমাদের দেশে তাকে ভালভাবে গ্রহণ করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত ছিলুম—বরঞ্চ প্রতিকূল কিছু শুনলে জোর করে নিজের বিশ্বাসের বিরুদ্ধেও তার প্রতিবাদ করা আমার স্বভাব ছিল।
এই সকল নানাকারণে ব্রাহ্মসমাজ আমাকে ঠিক ব্রাহ্ম বলে গ্রহণ করেন নি এবং আমাকে তাঁরা বিশেষ অনুকূল দৃষ্টিতে কোনদিন দেখেন নি। (বোলপুর, ৪ জুলাই ১৯১০)
অতএব নানা অভিজ্ঞতার আলোকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, ‘সব ধর্মমতই সঠিক’– এটি একটি অবাস্তব কথা। কেননা কোন ব্যক্তি একইসাথে বহুধর্মমত ধারণ করতে পারে না। পালন করা তো সম্ভবই নয়— স্বীকার করাও বিপরীত ধর্মানুসারিকে খুশি করতে গিয়ে স্বধর্মানুসারিদের কাছে বিরাগভাজন হওয়া ছাড়া আর কিছুই না। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) বলেন, ‘সব ধর্ম সত্য, এটি একটি শিথিল চিন্তা মাত্র। তার চাইতে সব ধর্মের ভেতরেই যথেষ্ট মিথ্যায় বা অসার্থক ভাবনা রয়েছে, মানুষকে সে সব কাটিয়ে উঠতে হবে, এই চিন্তারই সত্যকার মর্যাদা।’ (বাংলার জাগরণ, ১৯৫৬)
বিশ্বাসের অমোঘ শক্তি
বিশ্বাস জাতপাতহীন একটি অসাম্প্রদায়িক অমোঘ শক্তি। স্রষ্টার একত্বে অবিচল আস্থা এবং সর্ব অবস্থায় স্রষ্টায় সমর্পিত ব্যক্তি এই শক্তির সাক্ষাৎ পান। এখানে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের অনুকূলে উত্থাপিত বুদ্ধি-বৃত্তিক কোন যুক্তিই কার্যত সফলতা দেয় না। যদিও যুক্তি দৃশ্যমান বাক্-বিতণ্ডায় সাময়িক কিছু স্বস্তি প্রদান প্রদান করে তবুও তা অদৃশ্য সত্যের মহিমায় পরিণামে ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। যুক্তি ও দ্বান্দ্বিক মন হেরে যায় বিশ্বাসের শক্তির কাছে। বিশ্বাসের শক্তি যার কাছে দৃশ্যমান হয় না তিনি যতই ধার্মিক হোন না কেন তিনি কোন ইনসানে কামিল বা সিদ্ধপুরুষ নন। বিশ্বাস যে কতটা জাতপাতহীন এবং বিশ্বাসীর সপক্ষে সঠিক সময়ে কতটা সক্রিয় হয়ে ওঠে তার একটি ঘটনা বলি : জয় ও বিজয় নামে দুই কিশোর সহপাঠী স্কুলে সরস্বতী পুজোর দিনে ধর্ম বিশ্বাসের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। জয় মুসলিম পরিবারের সন্তান আর বিজয় হিন্দু পরিবারের। জয় বিজয়কে তিরস্কারের ছলে জোড়ালো কণ্ঠে বলল, তোদের সরস্বতীর বিদ্যাদানের কোন ক্ষমতা নেই। সরস্বতীকে পূজা করা একটি শেরেকি কাজ। তবে তোদের বিদ্যাদেবী সরস্বতী আমার ছোট খালার মত খুব সুন্দরী, দেখতে ভালো লাগে। আর তোরা যে ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বল, এতে কী লাভ হয়? হরির কি কোন শক্তি আছে? কোন বিপদ-আপদ ঠেকানোর শক্তি কি হরির আছে? বিজয় বলে, অবশ্যই আছে। জয় বলে, তবে বাজি হোক। তুই এই স্কুল-দালানের দোতলা থেকে ‘হরিবোল’ বলে ঝাপ দিবি, এতে যদি তোর হাত-পা না ভাঙে, তুই অক্ষত থাকিস, তবে তুই বাজি জেতার জন্য একশ’ টাকা পাবি। আর আমি ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ঝাপ দিব, তাতে যদি আমি অক্ষত থাকি, আমার যদি কিছু না-হয়, তা হলে হেরে গিয়ে তুই আমাকে একশ’ টাকা দিবি। তোর ‘হরিবোল’-এ কেমন শক্তি দেখি। প্রস্তাবিত বাজিতে বিজয় রাজি হয়। দুই কিশোরের এই বাজি ধরার রেশারিশী দূর থেকে ওদের মুসলিম ধর্মশিক্ষক শুরু থেকেই শুনছিলেন। তিনি তার মুসলিম ছাত্র কিশোর জয়ের পরাজয় হোক এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি একটু কৌশল করে হিন্দু কিশোর বিজয়কে আগে ঝাপ দিতে বললেন। কেননা ‘হরি বোল’ ধ্বনিতে যদি বিজয়ের হাত-পা ভাঙে তবে জয়ের আর ঝাঁপ দেয়ান প্রয়োজন হবে না। ধর্ম শিক্ষকের এই সাম্প্রদায়িক মনোভাবে ‘বিশ্বাস’ বিচলিত হল। কেননা বিশ্বাসের ধারক যে-সম্প্রদায়ের হোক না কেন ‘বিশ্বাস’ স্বরূপে শক্তি উদ্ভাসনে ব্ৰিত হয় না। ধর্ম শিক্ষকের প্ররোচনায় হিন্দু কিশোর বিজয় ‘হরিবোল’ বলে ঝাপ দিল। সবাই বিস্ময়বোধে দেখল, বিজয়ের হাত-পা কিছুই ভাঙলো না। জয় নিজেও বিস্মিত ও বিভ্রান্ত হল। সে এই ভাবনায় নিমজ্জিত লে যে, ‘হরিবোল’-এরও কী তা হলে শক্তি আছে? বিজয়ের এই অবিশ্বাস্য সাফল্যে জয়ের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মনের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অমীমাংসিত অবস্থায়ই জয় সম্বিত ফিরে দেখল, ধর্ম শিক্ষক ইশারা করছেন তাকে ঝাপ দেয়ার জন্য, এবার তার পালা। বাজি অনুযায়ী জয় দ্বিধাগ্রস্ত মনে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ঝাপ দেয় এবং জয়ের হাত-পা ভাঙে!
এই ঘটনায় কী প্রমাণিত হল? এই ঘটনায় প্রমাণিত হল— ‘বিশ্বাস’ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের একক সম্পদ নয়। সৃষ্টি জগতের যে-কেউ অবিচল আস্থা নিয়ে স্রষ্টায় সমর্পিত হলে ভক্তচিত্তের হৃদয়ে এই বিশ্বাস উদ্ভাসিত হয়। তখন ম্লান হয়ে যায় ভক্তের বংশ গৌরব, বিলুপ্ত হয় জন্ম পরিচয়, ছিন্ন হয় সাম্প্রদায়িক আচ্ছাদন। ভক্তের বিশ্বাসের অমোঘ শক্তিতে ভেঙে পড়ে স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের পাটাতন। (Mohammad Abdul Hye, The Fire of Faith) ।
বিশ্বাসের অগ্নিদাহ ও আল কোরআনে ঈমান প্ৰসংগ
বিশ্বাস একটি শক্তি। এই শক্তি সঞ্চারিত হতে পারে সুস্থিত প্রজ্ঞাপ্রসূত পরিচালনার দ্বারা। বিশ্বাসের শক্তিদ্বারা মানুষ বিশ্ব প্রকৃতির সকল অবিনাশী শক্তির বিনাশ ঘটাতে পারে। রূপান্তরিত করতে পারে প্রকৃতির বিবর্তন ধারা। পরিবর্তন করতে পারে বস্ত্রধর্মের প্রবাহমানতার ধারা, নিস্তেজ করতে পারে পদার্থের মৌলিক শক্তির সকল উৎসধারা। বাধ্য করতে পারে বিশ্বাসীর কাঙ্ক্ষিত চিত্তবিগ্রহের অনুকূলে প্রকৃতির সকল শক্তি সঞ্চারিত করতে। পদার্থের মৌলিক শক্তি ও সকল গুণাগুণ তখন ধাবিত হয় বিশ্বাসের উৎসমূলে। একজন প্রজ্ঞাবান নিষ্কলুষ বিশ্বাসীর বিশ্বাস এতটাই শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে যে, বিশ্বাসীর প্রত্যাশা পূরণে এই বিশ্ব প্রকৃতির মহান পরিচালক স্রষ্টার নির্দেশেই তখন বস্তুধর্মের শক্তির প্রবাহমানতার রূপান্তর ও পরিবর্তন করে দেন। এই বিশ্বাসের শক্তিতেই ক্রান্তদর্শী বলতে পারেন: ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’– তখন তাঁর প্রজ্ঞাপ্রসূত প্রার্থনার হাত উত্তোলিত হয় বিপদকে জয় করার জন্য, বিপদের ভয়ের চেয়েও শক্তিশালী আরেক আত্মশক্তির আশ্রয়ে। আর এই আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটে আত্মবিশ্বাস থেকে। এই জগতের সকল শক্তির উৎস বিশ্বাস।
আবার বিশ্বাসের ভিত্তি বা বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস তিনটি স্তরে নিষ্পন্ন হতে পারে। আল কোরআনে এই তিনটি স্তরের বিশ্বাসকে যিন্যাস করা হয়েছে যথাক্রমে-
১. ইলমুল ইয়াকীন (যুক্তিমূলক বিশ্বাস),
২. আইনুল ইয়াসিন (পর্যবেক্ষণমূলক বিশ্বাস)
৩. হাককুল ইয়াকীন (অভিজ্ঞতামূলক বিশ্বাস)
আগুনের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার বিশ্বাস স্থাপনের ৩টি স্তরের উদাহরণ উপস্থাপনের আলোকে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে এভাবে :
১. আমরা দূর হতে ধোঁয়া দেখে তার নিচে আগুন থাকার ধারণা করি। আগুন সম্বন্ধে আমাদের এই ধারণার বিশ্বাস যুক্তিমূলক।
২. ধোঁয়ার নিকটে গিয়ে ওর নিচে যখন আমরা আগুন স্বচক্ষে দেখি, তখন
আগুন সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হয়। আরো উন্নত ধরনের বিশ্বাস জন্মে। এই স্তরটি পর্যবেক্ষণমূলক বিশ্বাস।
স্বয়ং আমরা যখন আগুনের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে অগ্নিদগ্ধ হই, তখন আমাদের আগুন সম্বন্ধে যে বিশ্বাস জন্মে এবং বিশ্বাস সুদৃঢ় হয়, তা অভিজ্ঞতামূলক বিশ্বাস।
আগুনের স্বরূপ সম্বন্ধে জানার ও মানার যেমন উল্লিখিত তিনটি স্তর আছে, তেমনি স্রষ্টাকে জানার ও তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপনেরও ৩টি স্তর আছে।
প্রথম পর্যায়ে আমরা যুক্তি দিয়ে খোদার অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে এবং তাঁর উপর বিশ্বাস আনতে পারি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে যাঁরা স্রষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন এবং যাঁদের মাধ্যমে তাঁর শক্তি ও মহিমার প্রকাশ পেয়েছে, তাঁদের সাথে আমরা দ্বিতীয় স্তরের জ্ঞান ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারি।
পরবর্তী ধাপে আমরা স্বয়ং স্রষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্বন্ধ স্থাপন করে তাঁর সম্বন্ধে শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত জ্ঞান ও বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে পারি। এই স্তরে পৌঁছে আমাদের সকল প্রশ্নের অবসান হয়ে যায়।
অতপর কুরআন অব্যাহত ও অব্যর্থভাবে ‘সৎ কাজের’ সাথে ‘বিশ্বাস’কে সুসংবদ্ধভাবে (foundation of faith) সন্নিবেশ করার অপরিহার্যতার যে-গুরুত্ব আরোপ করেছে (২:৬২)-তা গভীরভাবে জীবনে সঞ্চারিত করতে হবে। কুরআনে যেমন বলা হয়েছে— সত্য সন্ধানের ক্ষেত্রে অনুমানের কোনও মূল্য নেই (৫৩:২৮)। তাই সকল অনুমান অতিক্রম করে এবং সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যুক্তিবাদীকে শেষমেশ বিশ্বাসের কাছেই ফিরে আসতে হয়। এটা কোন প্রজ্ঞার পরাজয় নয়- এ এক প্রেমময় মহাশক্তির সঞ্চারণ! এই বিশ্বাসের শক্তি (force of faith) সম্পর্কে ‘ইসলামের নবজাগরণের চিন্তাবিদ’ মহাকবি ইকবাল তাঁর ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন (১৯৩৪) গ্রন্থের ভূমিকায় জোর দিয়ে বলেছেন—
বিশ্বাস ইব্রাহিমের মতো অগ্নিকুণ্ডে বসে থাকার শক্তি যোগায়;
বিশ্বাস হলো ঈশ্বরের মাদকতা, স্ব-বিসর্জনশীল :
কোনও, আধুনিক সভ্যতার প্রাচীনপন্থীরা—
বিশ্বাসের অভাব দাসত্বের চেয়েও খারাপ।
বর্তমান অধ্যায়ে বাঙালি সমাজে যুক্তিবাদের দৃষ্টিতে যাঁরা ধর্মকে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের যৌক্তিক জিজ্ঞাসামূলক চিন্তাশীল বক্তব্যসমূহ এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগরের ধর্মদেশনার বৈপরীত্যের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সহনীয় ও সমন্বিত অভিমতও পাশাপাশি যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি আস্তিক্যবাদী চিন্তাবিদদের নানা জিজ্ঞাসা ও যুক্তির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের উপলব্ধি অনুভবে সহায়ক বক্তব্যও সংকলিত হয়েছে। যেমন শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, আরজ আলী মাতুব্বর, সুকুমারী ভট্টাচার্য, কৃষ্ণা বসু, তসলিমা নাসরীনদের ধর্ম সম্পার্কিত চিন্তাধারা ধর্ম সহিষ্ণুদের অনুকূলে না থাকলেও তাঁদের চিন্তার যৌক্তিকতা ও সারবত্তা নিয়েও এখানে আলোচনা আছে। বর্তমান অধ্যায়ের শিরোনামের সহায়ক চিন্তার বক্তব্য সমূহই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। বর্তমান অধ্যায়ের চারিত্র অনুযায়ী উদ্ধৃতিগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে। কারো ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। শুধু ভিন্নমতের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজ চিন্তার যৌক্তিকতা ও যথার্থতা নিরূপনে সহায়ক ভাবনা থেকেই বর্তমান অধ্যায়ের শিরোনাম করা হয়েছে ‘যুক্তবীদের দৃষ্টিতে ধর্ম”। এই দৃষ্টি আমার নিজস্ব দৃষ্টি নয়, এ দৃষ্টি স্ব স্ব লেখকদের। তবে আমার নিজস্ব যুক্তিও প্রাসঙ্গিক স্থানে উপস্থাপন করেছি। সেই সাথে ‘বিশ্বাসের অমোঘ শক্তি’ শীর্ষক একটি বাস্তব ঘটনার আলোকে বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছি। বর্তমান অধ্যায়ের আলোচনা উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, বিদ্যাসাগর সোসাইটি, মুক্তচিন্তা, এবং ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রভৃতি সংগঠনের সহযোগিতা কৃতার্থচিত্তে স্মরণ করছি।
নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি
B. R. Bapuji, R. Venkateswara Rao, Ari Sitaramayya and C. Padmaja (Trans.) Rangangyakamma Ramayan : The Poisonous Tree, Sweet Homes Publications, Hyderabad, India, 1980
Allama Dr. Muhammad Iqbal, The Reconstrution of Religious Thoughts in Islam, Islamic Academy, East Pakistan, 1957 (2nd Edition) Islamic Foundation, Bangladesh, 1981
Cattherine Judelson (ed), A Dictionary of Believers and Nonbelievers; Progress Publishers, Moscow, 1985
E. Abrams (ed), The Influence of Faith : Religious Groups & US. Foreign Policy; Lanham: Rowman and Littlefield Publishers, 2001 Samiran Majumdar, Fifty Questions on Religion; Anish Sanskriti Parishad, Kolkata, 2005
Rechard Dawkins, The God Delusion, Houghton Mifflin Harcourt, North America, 2০০8
প্রবীর ঘোষ, পিনাকী ঘোষ, অলৌকিক নয় লৌকিক (৩য় খণ্ড), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯২।
বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, নীতি যুক্তি ও ধর্ম (কাহিনী সাহিত্যে রাম ও কৃষ্ণ); আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লিমিটেড, কলকাতা বৈশাখ, ১৩৯৫
হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭
এ. কে. নাজমুল করিম, স্মারকগ্রন্থ; রেজিস্ট্রার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৮৪, পুনঃমুদ্রণ ২০০০
জি. আর আহমেদ জামাল ইকবাল, সংশয়বাদী দর্শনের ভ্রান্তিসমূহ; ক্যাবকো প্রকাশনা সংস্থা, টাঙ্গাইল, প্র. প্র. ২০০১
প্রবীর ঘোষ ও ওয়াহিদ রেজা (সম্পা.) দুই বাংলার যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্ম; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০২
সুকুমারী ভট্টাচার্য, ধর্ম এই সময়ে: চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, 2008
সা’দ উল্লাহ, ঈশ্বর, সৃষ্টি ও ধর্ম; দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭
অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর সম্পাদিত, অবিশ্বাসের দর্শন; শুদ্ধস্বর, ঢাকা, দ্বিপ্ৰে. ২০১১
প্রবীর ঘোষ ও সুমিত্রা (সম্পাদনা) সেরা যুক্তিবাদী: দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা. প্র. প্র. ২০১১
প্রবীর ঘোষ, যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১২
ড. মঞ্জুলা চৌধুরী (সম্পা.) মনুসংহিতা (সপ্তমাধ্যায় : রাজধর্ম) শিকড়, ঢাকা, ২০১২
অজয় রায় ও অন্যান্য সম্পাদিত, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান: চারদিক (মুক্তমনা ও শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ), ঢাকা দ্বি. স. ২০১৫
ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক, হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সমালোচনার জবাব; বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা, প্র .২০১৭
প্রবীর ঘোষ ও মনীষ রায় চৌধুরী, যুক্তিবাদীদের কথা; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা প্র. প্র. ২০১৮
আহমদ রফিক, সংস্কৃতি কথা; যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা: অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৮
রামেন্দ্র চৌধুরী, অবোধের ধর্মবোধ; জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮
আল্লামা ডক্টর মুহাম্মদ ইকবাল, ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন; প্রথমা সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৮
অধ্যাপক সৈয়দ নূরুল ইসলাম, আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও রাসূল (সাঃ)-এর নুবুয়্যতের সত্যতা; বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা, দ্বি. প্র.২০১৮