মুনশির জন্যে অপেক্ষা করছি। এশার নামাজ শেষ করতে সময় লাগবে। মুনশি মানুষ, নামাজ শেষ করে জিকিরে বসবেন। তাতে সমস্যা নেই। আমার হাতে অনেক সময়। রান্না শেষ হতে দেরি হবে। আমার সম্মানে (!) খাসি জবেহ করা হয়েছে। রান্না শেষ হতে সময় লাগারই কথা। ডিজেলের সন্ধানে যে গেছে সে এখনো ফিরে নি। ফিরলেও লঞ্চ রাতে রওনা হবে না।
আমি মুনশির বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। গ্রামের মানুষ অতিরঞ্জন পছন্দ করে। তাদের কাছে কাউকে বৃহস্যময় মনে হলে তার উপর অতিরিক্ত বানানো রহস্যময়তা আরোপ করা হয়। আমাদের মধ্যে রহস্যময়তা নেই বলেই আমরা অন্যের উপর রহস্যময়তা আরোপ করতে পছন্দ করি।
প্রাইমারি স্কুলের জনৈক শিক্ষক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমাকে দেখে তিনি খুব হতাশ হলেন। তিনি শুনেছেন অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি নায়িকা নিয়ে এসেছেন। তার হতাশ হওয়ারই কথা। মুনশি-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হলো। তিনি সব প্রশ্নের জবাব দিলেন কঠিন সিলেটি ভাষায়। এই ভাষা বোঝার সাধ্য আমার নেই। ইন্টারপ্রেটার হিসাবে সর্পরাজ সাহায্য করল।
কথোপখন
আমি : মুনশি সাহেব লোক কেমন?
উত্তর : (দার্শনিক উত্তর পাওয়া গেল। গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত হোন বা অশিক্ষিত হোন, দার্শনিক কথাবার্তা বলতে পছন্দ করেন। মানুষের ভালোমন্দ বুঝা কঠিন। যে ভালো তার মধ্যেও থাকে মন্দ। যে মন্দ তার মধ্যে থাকে কিছু ভালো।
আমি : মুনশির ম্যাজিক দেখেছেন?
উত্তর : এক দুইবার দেখেছি। তবে দেখা ঠিক না। কুফরি কালামের সাহায্যে এইসব করা হয়। কুফরি কালাম যে ব্যবহার করে সে কবিরা গুনাহ করে। যে দেখে সেও কবিরা গুনাহ করে।
প্রশ্ন : যে কবিরা গুনাহ করছে তাকে মসজিদের ইমাম করে রেখেছেন কেন?
উত্তর; অত্যন্ত জ্ঞানীর মতো একটা প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব, নাম আবদুল খালেক। হজ করেছেন দুইবার। উনি মুনশিকে অত্যধিক পছন্দ করেন বিধায় কিছু করার উপায় নাই।
প্রশ্ন : অতিরিক্ত পছন্দ করেন কেন?
উত্তর : আছে ঘটনা। আপনি বিদেশি মানুষ। আপনার কাছে সব প্রকাশ করা ঠিক না। লোকমুখের রটনা—খালেক সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে মুনশির লটরপটর।
প্রশ্ন : মুনশি কি বিবাহ করেছেন?
উত্তর : আমার জানামতে না। তবে অনেকেই বলে এক পরীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে।
প্রশ্ন : ডানা আছে এ রকম পরী?
উত্তর : জ্বিনদের মধ্যে যারা নারী তাদেরকে পরী বলে। সে স্ত্রী-জাতীয় একটা জ্বিন বিবাহ করেছে। তার স্ত্রী মাঝে মধ্যে আসে, কিছুদিন থেকে চলে যায়।
প্রশ্ন : কেউ কি তাকে দেখেছে?
উত্তর : কয়েকজন দেখেছে। জিনের আনাগোনার কারণে আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই। গাছগাছালি থাকলেই পাখি থাকবে এটা জগতের নিয়ম। আমাদের অঞ্চলে কোনো পাখি নাই।
প্রশ্ন : আমি কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় প্রচুর পাখির ডাক শুনেছি।
উত্তর : দুই একটা পাখি ভুলক্রমে চলে আসে। যখন ঘটনা বুঝতে পারে তখন পালায়া যায়।
প্রশ্ন : পাখিরা জ্বিনদের ভয় পায়? উত্তর : জি। পাখির হাড় হলো জ্বিনের খাদ্য।
প্রশ্ন : ভাই, আপনার সঙ্গে কথা বলে অত্যন্ত আরাম পেয়েছি। এখন বাড়িতে যান। বিশ্রাম করুন।
স্কুলশিক্ষক আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বাড়িতে চলে যাব কেন? আরজু সাব (সর্পরাজ) আপনার সঙ্গে রাতের খানা খাওয়ার জন্য আমাকে দাওয়াত করেছেন।
আমি বললাম, তাহলে তো অবশ্যই থাকবেন।
সর্পরাজ বলল, স্যার চাঁদ উঠেছে। বাইরে বড়ই সৌন্দর্য। আপনি কি ডেকে বসে চাদের আলোর সৌন্দর্য দেখবেন?
আমি বললাম, না। তুমি মাস্টার সাহেবকে নিয়ে যাও। রাতে খেতে যখন দেরি হবে উনাকে চা-নাস্তা খাওয়াও।
সর্পারাজ বিদায় নেওয়ার পরপর নুহাশপল্লীর ম্যানেজার উপস্থিত হলো। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। চোখে সুরমা। হাতে তসবি।
আমি বললাম, তোমার সমস্যা কী?
ম্যানেজার বলল, মিলাদ হবে স্যার। মিলাদের পর শোকরানা নামাজ। তারপর দোয়া। হাজি একরামুল্লাহ সাহেব এসেছেন। দোয়া উনি পড়াবেন।
হাজি একরামুতুল্লাহ সাহেব কে?
বিশিষ্ট আলেম। ম্যাজিক মুনশি যেখানে যায় উনি সেখানে যান না।। আপনার কথা শুনে এসেছেন।
শুনে খুশি হলাম। সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয় সেটা দেখো। আমার প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা। আমি শুয়ে থাকব।
কেবিনে আমি এখন একা। মোমবাতি এবং খরিকেন জ্বলছে না। কেবিনের খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। লঞ্চটাকে এখন মনে হচ্ছে। অলৌকিক লঞ্চ।।
আমি আধশোয়া হয়ে মুনশির কথা ভাবছি। আমরা রহস্যময়তা পছন্দ করি কিন্তু অতিরিক্ত রহস্যময়তা পছন্দ করি না। আমরা ধরেই নেই অতিরিক্ত রহস্যময় মানুষ কৃষ্ণশক্তির (Dark Power) সাহায্য নেয়। এই শক্তি শুদ্ধশক্তি না বলেই নিষিদ্ধ।
১৬০৪ সাল ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন কিং জেমস (King James I)। তিনিই প্রথম বাইবেল ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। মানুষটা অন্ধ কালোশক্তির ভয়ে প্রচণ্ড ভীত ছিলেন। তিনি কালোশক্তি প্রতিরোধ করার জন্যে প্রথম Witch Craft Act প্রণয়ন করেন। এই আইনে যারা কালোশক্তি ব্যবহার করবে (যেমন ডাইনি, ম্যাজিশিয়ান) তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হবে।
ডাইনিদের ভয়ে তিনি এতই ভীত ছিলেন যে, বাইবেলের কিছু অনুবাদও নিজের ইচ্ছামতো বদলে দেন। বাইবেলে এক জায়গায় আছে—Thou shalt not sfier a boisorder to live. তিনি লিখলেন_Thou shalt no suffer a witch to live.
কিং জেমসের এই কারণে বহু নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হলো।
সারা ইউরোপ তখন ডাইনি খুঁজে বের করে হত্যা করা শুরু করে। Witch Craft Act-এ ডাইনিদের ফাঁসিতে হত্যা করার বিধান থাকলেও ইউরোপের ডাইনিদের আগুনে পুড়িয়ে মারা হতো। বিস্ময়কর ঘটনা হলেও সত্যি—জ্বলন্ত আগুনে ইউরোপের ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
নিরপরাধ মানুষদের বাঁচাতে Scot নামের একজন সাহসী ভূমিকা নেন। তিনি একটি বই লেখেন, নাম he Discovery of Vitch Craf, এই বইতে তিনি দেখান যে, সাধারণ কৌশল মানুষ কেটে জোড়া দেওয়া যায়, শূন্যে ভাসা যায়। এর জন্যে কৃষ্ণশক্তি বা শয়তানের সাহায্য লাগে না।
পুড়িয়ে মারা হয়েছে এমন একজন ডাইনির নাম আপনারা সবাই জানেন। তাকে পরে Saint হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তার নাম জোয়ান অব আর্ক (Saint Joan of Arc). তিনি চান্সকে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
আমেরিকার ম্যাসাচুয়েট রাজ্য ছিল ইংরেজদের উপনিবেশ। কিং জেমসের আইন সেখানেও চালু হলো। সেখানকার সালেস শহরে ১৯ জনকে ফাঁসি দেওয়া হলো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল নিতান্ত অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা। এইসব শিশুদের একজন পরিণত বয়সে স্বীকার করেছে তাদের অভিযোগ ছিল মিথ্যা। এরা সবাই নিরপরাধ ছি।
১৯৫১ সালে ব্রিটিশ পার্লা ন্ট কিং জেমসের আইন বাতিল করেন।
তার দুবছর পর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার হেনরি মিলার তাঁর বিখ্যাত নাটক Crucible লেখেন। এই নাটক ছিল ডাইনিদের অনুসন্ধান নিয়ে। ডাইনি ধরে পুড়িয়ে মারা Crucile নাটকের মূল বিষয়।
আর্থার মিলার প্রতীকী অর্থে নাটকটি লিখেছিলেন। ডাইনির অনুসন্ধান আসলে ছিল কমিউনিস্টদের অনুসন্ধান।
সাধারণ দর্শক নাটকটির Metaphor ধরতে পারল না। তাদের মধ্যে ডাইনি, ব্ল্যাক ম্যাজিক বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হলো। ডাইনি হওয়ার সাধনা শুরু হলো। ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা শুরু হলো।
আমেরিকায় ডাইনিরা এখন Legal rights পাচ্ছে। তাদের বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমেরিকায় যে-কেউ এখন ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চা করতে পারেন।
পাঠকদের কৌতূহল মেটানোর জন্যে ডাইনিদের একটি মন্ত্র লিখে দিচ্ছি। অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে এই মন্ত্র পাঠ করতে হয়। নিজের আধ্যাত্মিক শক্তিকে পাঠিয়ে দিতে হয় মোমবাতির শিখায়।
মন্ত্রপাঠের নিয়ম
ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ থাকবে। ঘরের ভেতর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় আসন করে বসতে হবে। একটা সাদা মুরগির মাথা টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে। মুরগির গা থেকে যে রক্ত বের হবে তা কপালে মাখতে হবে। খানিকটা জিভে ছোঁয়াতে হবে।
মন্ত্র ক্রমাগত পাঠ করে যেতে হবে। একসময় মন্ত্র পাঠ করতে করতেই মূত্রত্যাগ করতে হবে। ছেলেদের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে মোমবাতির চারপাশে চক্রের মতো।
পুরো বিষয়টায় যথেষ্ট নোংরামি আছে না?
নোংরামির এখানেই শেষ না, দলবেঁধে যখন কৃষ্ণশক্তির আরাধনা করা হয় তখন আরাধনা শেষ হয় নির্বিচার যৌনাচারে।
অনেকে এই লোভেও ডাইনি দলে নাম লেখান।
মন্ত্র
Loud is the message as the ravens cry
Send out this magick, send it high.
Make it work, mare it last,
Tell the Godess of this spell I have cast.
Have it happen without complexity:
This is my will so mote it be.
ডাইনিবিদ্যায় একজন ঈশ্বর থাকেন। তিনি অন্ধকারের ঈশ্বর। তার একজন স্ত্রী থাকেন। তিনিও অন্ধকারের। ডাইনিরা (রমণী এবং পুরুষ) যে ধর্ম পালন করে তার নাম Wicca. Wicca শব্দের অর্থ Wizard বা জাদুকর।
পশ্চিমা সভ্য দেশগুলি যখন ডাইনি হত্যা চালাচ্ছে তখন ভারতবর্ষের অবস্থা কী? আমরাও পিছিয়ে ছিলাম না। আমরা সতীদাহ নাম করে নিরপরাধ মেয়েগুলিকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় তুলে দিচ্ছিলাম। তবে ডাইনি বলে কিছু আমাদের দেশে ছিল না। কালো মন্ত্রের চর্চা ছিল, বান মারা ছিল। যারা এইসব করতেন তাদেরকে নিয়ে আমাদের সামান্য কৌতূহল ছিল, এর বেশি কিছু না।
এখন কৌতূহলও নেই। পুরাতন ঢাকায় আমি একটা টিনের ঘরে সাইনবোর্ড দেখেছিলাম। সাইনবোর্ডে লেখা—
জাদু টোনা করা হয়। বান মারা এবং বান কাটান দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের সপ্তধাতু তাবিজ আছে। হারানো বস্তু, গুপ্তধন গ্যারান্টি সহকারে অনুসন্ধান করি।
এত ক্ষমতার অধিকারীকে দেখলাম, লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বারান্দার একটা কাঠের চেয়ারে বিমর্ষ ভঙ্গিতে বসা। আমি বললাম, এতসব কীভাবে করেন?
তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, সোলেমানি জাদুর মাধ্যমে করি। আপনার কী লাগবে বলেন? বাজে কথার সময় আমার নাই।
এই ভদ্রলোককে দেখেই আমার মাথায় একটা গল্প তৈরি হয়। গল্পটি লিখেও ফেলি। গল্পের নাম গুনীন।
ডাইনি বিষয়ে আমরা কখনো উৎসাহী ছিলাম না বলে আমাদের সাহিত্যে ডাইনি নিয়ে কোনো গল্প নেই। ভুল বললাম, একটি গল্প লেখা হয়েছে। লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তার লেখা ডাইনী বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার মতো লেখা।
আগ্রহী পাঠকদের লেখাটি পড়তে অনুরোধ করছি।*
——–
* ঈদ সংখ্যা কালের কন্থে ম্যাজিক মুনশি ছাপা হওয়ার পর অনেকেই আমাকে জানান, ভারতবর্ষে অতীতে ডাইনি হত্যা হয়েছে এবং এখনো নাকি হচ্ছে। এই বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।