০৫.
মীনা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দিদি তুমি কী করছ? তোমার বিয়ে কবে হবে? মীনাকে অস্পষ্ট ভাসা ভাসা জবাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে কথা এখন থাক। আমি শুধু এইটুকু ওকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমার জন্য যেন ও না ভাবে। আমার জন্য যেন ও নিজের বিয়ে আটকে না রাখে। বাবা এখনও চুপ করে আছেন। কিন্তু আমি জানি, অতীনের সঙ্গেই মীনার বিয়ে হবে। বাবা শেষপর্যন্ত তা-ই দেবেন। আর তো চিন্তা ময়নাকে নিয়ে। মনে হয়, সে চিন্তাও বাবাকে করতে হবে না, ময়নাও হয়তো একদিন মীনার মতো নিজের কথা ঘোষণা করবে।
না, বাবার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। সবদিক থেকেই বাবা এখন তৃপ্ত মানুষ। আমার মাঝে মাঝে শুধু এইটুকু জানতে ইচ্ছা করে, অনঙ্গবাবুর বিষয়ে বাবা কী ভাবেন। তার মনটা কী বলে। সে কথা আমার। জানবার উপায় নেই। কিন্তু মাকে আমার একটু অদ্ভুত লাগে। মাকে আমি খুব একটা উৎফুল্ল না দেখলেও, আগে হাসিখুশি দেখেছি। আগে সারা দিন মায়ের গলার স্বর শোনা যেত। সেটা খুবই স্বাভাবিক। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে থাকলে, তাদের পিছনে সবসময় কথা বলতেই হয়। সারা দিন মাকে অনেক কাজ করতে হত। সবই ছিল একা হাতে।
আজকাল মাকে যখন যেটুকু দেখছি, কেমন যেন চুপচাপ। ধীর স্থির। মা যে বাড়িতে আছে, সেটা যেন বোঝাই যায় না। এখন মাকে সে রকমভাবে সংসারের কাজ করতে হয় না। সর্বক্ষণের ঝি আছে। চৌদ্দ-পনেরো বছরের একটি ছেলেও কাজ করে, বাড়িতে থাকে। এখনও দু বেলা মা নিজের হাতে রাঁধে। নিজের হাতে কেবল বাবাকে খেতে দেয়। আর সবাইকে সেই ছেলেটিই খেতে দেয়। আজকাল আর মাকে হাসিখুশি দেখি না।
অথচ এখনই তো মায়ের অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল। ঝাড়া হাত-পা মানুষ। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের জন্য যাকে বলে হ্যাঁপা’ তা আর পোহাতে হয় না। বড়ছেলে বড় চাকরি করে, বউ আসবে ঘরে। মেয়েদের বিয়ের জন্যও ভাবনা নেই। অন্তত আর্থিক দিক থেকে তো কোনও ভাবনা নেই। এখন মা সম্পন্ন সুখী বয়স্কা গিন্নির মতো, আয়েশ করবে, বেড়িয়ে বেড়াবে, সবসময় হাসিখুশি থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা দেখিনি। মায়ের আজকাল চশমা হয়েছে। রান্নাবান্নার কাজ না থাকলেই দেখি, চশমাটি পরে, মা তার নিজের ঘরে খাটের কোণে বসে বসে বই পড়ছে। নীচের তলায় মা ও বাবার ঘর পাশাপাশি। মাঝখানের দরজাটা সারাদিন বন্ধই দেখেছি। রাত্রেও খোলা হয় কি না, জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠেও কোনও দিন খোলা দেখিনি। অবিশ্যি আমি আর কদিন কতটুকুই বা দেখতে পাই। তবু দু-একদিন গিয়ে যখন কৃষ্ণনগরে থাকি, তখন তা-ই দেখেছি।
বাবার সঙ্গে মায়ের কথাবার্তাও খুব কম। তাও বাবাই বেশি বলেন। এক-এক সময় সন্দেহ হয়, বাবা-মায়ের মধ্যে বুঝি কথাবার্তাও নেই। তাদের বোধ হয় ঝগড়া হয়েছে। মা কী বই পড়ে, তাও দেখেছি। সবই গল্প উপন্যাস। তার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের বইও আছে। আবার এ যুগের সাহিত্যিকদের বইও আছে। এমন না যে, মা এ বয়সে চোখে চশমা এঁটে, শ্রীমদভাগবতে মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন। কেবল গল্প উপন্যাস। শুনেছি, মা শ্যামবাজারের কোনও বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইট অবধি পড়েছিল। তারপরে আর পড়া হয়নি। ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তখন মায়ের বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না। তবু কোথাকার দত্ত বলে নাকি দাদামশায়দের নাম-ডাক ছিল। এখন অবিশ্যি সবই বদলে গিয়েছে। সেই শ্যামবাজারের বাড়ি নেই। দাদামশায় দিদিমা নেই। তাদের আমি কখনও চোখে দেখিনি। যাঁকে দেখেছি, তিনি রমেশ দত্ত, আমার মামা। মায়ের একমাত্র ভাই, মায়ের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়।
সে যাই হোক, মোটামুটি বাংলা বই পড়বার মতো শিক্ষা মায়ের ছিল। আমি কখনও কখনও জিজ্ঞেস করেছি, এ সব বই পড়তে তোমার ভাল লাগে মা?
মা একটু হেসে বলেছে, এ সবের মধ্যে অনেক গল্প কাহিনী থাকে। পড়তে পড়তে সময় কেটে যায়।
মা এখন শুধু সময় কাটাবার জন্য বই পড়ে। অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ঘুরে বেড়ানো, সিনেমায় যাওয়া, কিছুই করে না। মা বাড়ি থেকেও বেরোতে চায় না। দু একবার বলেও ফেলেছি, মা,
তুমি যেন আজকাল কেমন হয়ে গেছ।
মা ভুরু কুঁচকে হেসে বলেছে, কেমন আবার হয়েছি!
কেমন যেন চুপচাপ থাক, বিশেষ কথাবার্তা বলো না।
কী কথাবার্তা বলব বল। বুড়ো হয়েছি, ঘরের কোণে বসে থাকি।
মা বলে বয়স হয়েছে। আমি হিসাব করে দেখেছি, মায়ের বয়স সাতচল্লিশ। এ বয়সকে বুড়ো হওয়া বলে না। মাকে এমন কিছু বয়স্কাও দেখায় না। একটিও চুল পাকেনি, দাঁত পড়েনি, মুখে তেমন ভাঁজ পড়েনি। আগের থেকে একটু শীর্ণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফরসা রং একটুও চাপা পড়ে যায়নি, সেইরকমই উজ্জ্বল আছে। মায়ের চোখমুখও সুন্দর, শান্ত আর শ্রীময়ী। শ্রীময়ী বলতে আমি বোধ হয় স্নিগ্ধ বোঝাতে চাইছি। স্নিগ্ধতা সকলের মুখে থাকে না। যাকে বলে, কেমন একটা নরম টলটলে ভাব। যেটা আমার নেই। আমার চোখেমুখে নাকি একটা তীব্রতা আছে কিন্তু না, আমার কথা থাক। আমি মাকে হেসে বলেছি, তুমি কোনখানটায় বুড়ো হয়েছ মা! কলকাতা দূরে থাক, এই কৃষ্ণনগরেই তো দেখি, তোমার বয়সি মহিলারা ঠোঁটে রং মেখে, চোখে কাজল দিয়ে ঘুরে বেড়ান। তুমি মোটেই বুড়ো হওনি।
আমার কথা শুনে মাও হেসেছে। বলেছে, বুড়ো তো আর বয়সে হয় না, মনে হয়। তোরা আমার এতগুলো ছেলেমেয়ে, তোরা সব বড় হয়ে উঠলি। আমার আর বুড়ো হবার বাকি কী।
আমরা বড় হয়েছি, তাই মা বুড়ো হয়েছে। হয়তো সেটাই মায়ের সত্যি কথা। কিন্তু তা-ই কি সব সত্যি কথা! মায়ের কাছ থেকে আমি যেন আমার কথার ঠিক জবাব পাইনি। মা যে কেমন নিস্পৃহ হয়ে গিয়েছে, অনেক নির্বিকার হয়ে গিয়েছে, সে কথার কোনও জবাব পাইনি। শহরের নতুন বাড়ির বিষয়ে মাকে কখনও কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখিনি।
মাকে আমি আজকাল আর ঠিক বুঝতে পারি না। মাও বোধ হয় আমাকে বুঝতে পারে না। আমরা মা বাবা ভাই বোন, কেউ-ই বোধ হয় আজকাল আর কারোকে বুঝতে পারি না। যত দিন ছোট থাকা যায়, তত দিন বোঝা যায়। অথবা তখন বোঝাবুঝির কিছু থাকে না। কিন্তু যতই আমরা বড় হয়ে উঠতে থাকি, ততই সরে সরে যেতে থাকি। ততই যে যার নিজের মতো হয়ে যেতে থাকি। আলাদা হয়ে যেতে থাকি, মনগুলো সব নানানভাবে বদলে যেতে থাকে। আমরা তখন একজন আর একজনকে ঠিক চিনে উঠতে পারি না।
এক দিন মাকে বলেছিলাম, মা, আমাদের গ্রামের বাড়িটার কথা আমার খুব মনে পড়ে।
মা বলেছিল, পড়বেই তো। ওখানে জন্মেছিস, বড়ও হয়েছিস।
বলেছিলাম, সেখানকার কথা ভাবতে আমার ভাল লাগে।
আমারও লাগে।
বলেই মা হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলেছিল। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, তখন সবকিছুই ভাল লাগত।
মায়ের সেই কথাটা আমি ভুলি না। তখন মায়ের সবকিছুই ভাল লাগত। এখন লাগে না। কী আশ্চর্য, সত্যি মাকে আমি সবটা বুঝতে পারি না।
.
কিন্তু যে কথা বলছিলাম। কলকাতায় এসেছিলাম, অভাবের দায়ে না। অনাদরেও না। মামা আমাকে নিজে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, তাই এসেছিলাম। মামা মাকে বলেছিলেন, রুণু, (আমার মায়ের ডাক নাম) তোর বিন্দুকে আমাকে দিয়ে দে।
মা বোধ হয় প্রথমটা বিশ্বাস করেনি, ঠাট্টা ভেবেছিল। বলেছিল, তা নাও না।
সত্যি সত্যি বলছি কিন্তু। অনেক দিনই ভেবেছি, তোদের বলব। তোরা আবার কী ভাববি, সেজন্য বলিনি।
মা বলেছিল, কী আবার ভাবব। বিন্দু তোমাদের কাছে কলকাতায় গিয়ে থাকলে কি খারাপ থাকবে? ভালই থাকবে।
মামা বলেছিলেন, সে ভাল-মন্দের কথা না। আসলে কী হয়েছে জানিস রুণু, বিন্দুকে আমার বড় ভাল লাগে। তোর বউদিরও। তা ছাড়া বাড়িতে একটা মেয়ে না থাকলে যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
মা মামার কথা শুনে হাসলেও, তখন গলার স্বর বদলে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি সত্যি বলছ দাদা?
মামা হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁ, মিথ্যে বলব কেন। তোর বউদিও বলছিল। তবে বুঝিস তো, এ ভাবে চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। তা ছাড়া নবীনের (বাবার) একটা মতামত আছে। তোরা আবার কথাটাকে কীভাবে নিবি!
এ সব কথা আমার সামনে হয়নি। পরে আমি সবই শুনেছিলাম। মামার এ কথা শুনে, মা হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারেনি। একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, বেশ তো, তোমার ভগ্নিপতির সঙ্গে কথা বলে দেখো না। আমার কোনও আপত্তি নেই।
মামা বলেছিলেন, সেটাই সবথেকে কঠিন। নবীনকে কেমন করে কথাটা বলা যায়, তাই ভাবছি।
যেমন করে আমাকে বললে, তেমন করেই বলবে।
অতটা সহজ নয়।
অসহজের কী আছে? ও আসুক দোকান থেকে, আমিই না হয় কথা পাড়ব।
আমার মনে আছে, পুকুর থেকে এক গোছা বাসন মেজে, আমি মামার সামনে দিয়েই রান্না ঘরে যাচ্ছিলাম। আমার গায়ের ফ্রকটা ভিজে গিয়েছিল। হাতে পায়েও জল। মামাকে আগেই দেখেছি, ঘণ্টাখানেক আগে এসেছেন। এক মাস দু মাস অন্তর মামা নিজে গাড়ি চালিয়ে কলকাতা থেকে আসতেন। সেদিনও রবিবার ছিল। মামার সামনে দিয়ে যাবার সময় ডেকে বলেছিলেন, বিন্দু, বাসনগুলো রেখে আমার কাছে এক বার আয়।
বলেছিলাম, আসছি।
মনে আছে, নিজেকে নিয়ে আমি একটু বিব্রত বোধ করছিলাম। ভেজা ফ্রকটা গায়ে থাকায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। মামার সামনে যেতে লজ্জা করছিল। তখন বাড়ির মধ্যে, ফ্রকের ভিতরে কিছুই ব্যবহার করতাম না। কিন্তু ইস্কুলে যাবার সময় পরতাম। সেই বছর থেকে মা পরিয়ে দিয়েছিল। সবদিক থেকে তার দরকারও ছিল। এমনিতেই তেরো বছর বয়সটা খুব কম কিছু না। তা ছাড়া, আমার গড়ন একটু বাড়ন্ত ছিল। বড় জ্বালা ছিল আমার সেই বাড়ন্ত গড়ন নিয়ে। বাড়ন্ত গড়নের অনেক অপরাধ। অনেকটা সন্ধিক্ষণের ছেলেদের মতো অবস্থা। সন্ধিক্ষণের ছেলেরা, ছেলেমানুষি করলে মনে হয় ন্যাকামি করছে, বড়দের মতো ব্যবহার করতে গেলে, এঁচোড়ে পাকা লাগে। অথচ সেই বেচারির তখন দু দিকেই টান। তার বড় হতে ইচ্ছা করে। অথচ ছেলেমানুষিটাও ছাড়িয়ে উঠতে পারে না। এমনকী তখন তার গলার স্বর পর্যন্ত বিরক্তিকর মনে হয়। কখনও সরু কখনও মোটা। সেটা তার অপরাধ নয়। মেয়েদের বাড়ন্ত গড়নও অনেকটা সেই রকম। বয়সের তুলনায় শরীর বেড়ে উঠলে, সব ব্যাপারটা কেমন বেমানান হয়ে পড়ে। মায়ের চোখে তো এক-এক সময় স্পষ্টই বিরক্তি লক্ষ করতাম। যেন আমিই কোনও অপরাধ করেছি। তখন যে আমার কী অস্বস্তি হত। এমনকী, আমার চোখে পড়ত, বাবাও যেন তার মেয়ের দিকে সোজাসুজি ভাল করে তাকাতে পারতেন না। হয়তো ইস্কুলে যাবার পথে, বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবা চোখ ফিরিয়ে নিতেন। রাস্তার লোকদের তো কথাই ছিল না। তাদের চোখের দৃষ্টি যে এক এক সময় কত বিশ্রী হতে পারে, ভাবা যায় না। একটু বড় হয়ে উঠলে, সব মেয়েই তা বুঝতে পারে। সব মেয়েই জানে।
এ কথা এখন থাক, বাড়ন্ত গড়ন, তেরোর মন কী, সে কথা পরে বলব। রান্নাঘরে বাসনগুলো রেখে, আমি অন্য ঘরে যাচ্ছিলাম জামা বদলাবার জন্য। মা বলে উঠেছিল, আবার কোথায় যাচ্ছিস বিন্দু, মামা ডাকছেন যে।
বলেছিলাম, জামাটা বদলে আসি।
মা বলেছিল, আর জামা বদলাতে হবে না। মামা কী বলছেন, শুনে যা। তারপরে একেবারে চান করে, জামা পরিস।
আমার অস্বস্তির কথা মাকে বোঝাতে পারিনি। মামাও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে স্নেহের হাসি চিকচিক করছিল। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে, আমার কোনও সংকোচ হচ্ছিল না। অস্বস্তি আমার নিজের ভিতরে ছিল। মামা ডেকেছিলেন, শোন বিন্দু, এখানে আয়।
আমি মামার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। মামা বলে উঠেছিলেন, একী, তোর জামা ভেজা নাকি? শরীর খারাপ করবে যে। যা যা বদলেই আয়।
মা বলেছিল, কিছু শরীর খারাপ করবে না। কাজকর্ম করতে গেলে ও রকম ভেজা থাকে। পুকুরে গিয়ে কঘণ্টা ঝপাই ঝোড়ে, তা জানো না তো।
মামার চোখে সেই মিষ্টি স্নেহের হাসি। বলেছিলেন, জানব না কেন, নিজের চোখেই তো কবার দেখেছি। তবু তো ও সাঁতার জানে। আমার ছেলে দুটো তো তাও শিখল না।
বলে আমার পিঠে হাত দিয়ে, আর একটু কাছে টেনে বলেছিলেন, হ্যাঁরে বিন্দু, আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবি? আমাদের বাড়ি গিয়ে থাকবি।
কথাটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। মায়ের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখেছিলাম। মা আমার দিকেই তাকিয়েছিল। মায়ের মুখেও হাসি ছিল। মা আর মামার মুখের গড়ন, ভাবভঙ্গি, হাসি, অনেকটা এক রকম। আমি কী জবাব দেব, ভেবে পাইনি। কথাটা কেন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তা-ই প্রথমে বুঝতে পারিনি।
মামা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রে, যাবি কলকাতায়?
অবাক হলেও, আমার লজ্জা করছিল। বলেছিলাম, তা আমি কী জানি!
সত্যি, আমি কী জানতাম। মামা আমাকে কলকাতা যাবার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি যাব কি না, সে কথা আমার জানা ছিল না।
মা বলেছিল আমাকে, তোর যেতে ইচ্ছে করলে বল, মামা তোকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছেন।
অবাক লাগছিল, খুশিও হচ্ছিলাম, লজ্জাও করছিল। কিন্তু আমার কী ইচ্ছা, তখন তা আমার জানা ছিল না। প্রস্তাবটা শুনে আনন্দ হচ্ছিল। কলকাতায় আমি তার আগেও গিয়েছি, আরও অনেক ছেলেবেলায়। আমার সাত বছর বয়সে শেষ গিয়েছিলাম। আর যাওয়া হয়নি। যত দিন মায়ের বাপের বাড়ি যাবার পাট ছিল, তত দিন গিয়েছি। তেরো বছর বয়সে সেই স্মৃতি তখন অস্পষ্ট। তাও কবারই বা গিয়েছি, কত দিন করেই বা থেকেছি! বেশি দিন কখনও থাকিনি। কলকাতায় ঘুরে বেড়াইনি। শ্যামবাজারের আশেপাশের রাস্তা দেখেছি। দাদুর বাড়ির ঝিয়ের সঙ্গে বাগবাজারের গঙ্গায় চান করতে গিয়েছি। দাদু দিদিমা, বুড়ো বুড়ি, তাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবার কোনও কথাই ওঠে না। মামা তো তখন। সারা দিন বাইরে বাইরেই থাকতেন। অনেক সময় জানতেই পারতাম না, রাত্রে কখন বাড়ি ফেরেন। রমুদা, দীপু, ওরা বাইরে যেত। আমাকে কোনও দিন নিয়ে যেত না। আমার দাদা ওদের সঙ্গে যেত। ওরা শ্যাম স্কোয়ারে গিয়ে খেলা করত। আমি দেখতে গিয়েছি, কিন্তু ওদের খেলায় আমাকে কোনও দিন নেওয়া হত না। মামিমা তো বাড়ির কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। তবু, মামিমাকে তখন খুব শৌখিন লাগত। বিশেষ করে আমার মায়ের তুলনায়। মামিমা ইস্কুল পেরিয়ে কলেজেও ঢুকেছিলেন। বেশি দিন পড়তে পারেননি। তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মামিমা সাবান ছাড়া চান করতেন না। গায়ে পাউডার মাখতেন। মাথায় গন্ধতেল। মামিমার সারা গা থেকে সুগন্ধ বেরোত। মামিমা পান খেতেন না। তাঁর দাঁত ছিল ঝকঝকে সাদা।
অস্পষ্টভাবে এইসব মনে আছে। মনে আছে, আমাকে খুব ভালবাসতেন। বিশেষ করে, আমাকে সাজাতে। চোখে কাজল পরিয়ে ঠোঁট রাঙা করে দিয়ে, কপালে নানা রঙের টিপ পরিয়ে দিতেন। তখনকার সময়ে, কলকাতার সবথেকে হাল ফ্যাশানের ফ্রক কিনে পরিয়ে দিতেন। পরে আমার নিজেকে দেখতে খুব ভাল লাগত। রাস্তায় বেরিয়ে গর্ব বোধ করতাম। মা আর মামিমার সঙ্গে, দাদুর বাড়ির কাছেই, দু বার সিনেমা দেখেছি। তখন অবিশ্যি সিনেমাকে বই’ বা বায়স্কোপ’ বলা হত। কিন্তু মামিমা সিনেমা’ বলতেন।
মা আর মামার কথা শুনে, সেই সাত বছর বয়সে দেখা, শ্যামবাজারের অস্পষ্ট ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। আমার যেতে ইচ্ছা করছিল। তবু সে কথা মুখ ফুটে বলতে পারিনি। মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার বলেছিলাম, আমি কী জানি!
মা বলেছিল, তোর যেতে ইচ্ছে আছে কি না, সেটা বল।
মামা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি কোনও জবাব দিইনি। মামা বলেছিলেন, যাবি কি না বল বিন্দু। গেলে কিন্তু যখন-তখন কৃষ্ণনগরে আসতে পারবি না। আমাদের কাছে থাকবি, ইস্কুলে পড়বি। আর কী করবি–আর যখন কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করবে, মামিমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি।
কলকাতার ইস্কুলে পড়ব! ভাবতে ভীষণ আনন্দ আর উত্তেজনা বোধ করছিলাম। মামিমার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়াও মজার ব্যাপার। খুব যেন জড়োসড়ো হয়ে বলে ফেলেছিলাম, যাব।
মা ও মামা চোখোচোখি করেছিলেন। মামা আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, তখন আবার এখানকার জন্য মন কেমন করবে না তো?
জবাব দিয়েছিলাম, তা কী জানি!
শুনে মা আর মামা, দুজনেই হেসে উঠেছিলেন। আমি লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি, আমার তখন জানা ছিল না, এখানকার জন্য আমার মন কেমন করবে কি না। তবে এ কথা ঠিক, তখন আমার বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হয়েছিল। গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা হয়েছিল। তার কারণ একেবারে আলাদা। সে কথা বলব, আমার বাড়ন্ত গড়ন, তেরোর মনের কথার সময়। কিন্তু তেরো বছর বয়সে, তখন আমার বার বার মনে হয়েছিল, মামাকে কি ভগবান পাঠিয়ে দিয়েছে, আমাকে নিয়ে যাবার জন্য! অথচ আমি তো ভগবানকে এক বারও ডাকিনি। আমার মনে ভয় ছিল, বিতৃষ্ণা ছিল, ঘৃণা ছিল, রাগ ছিল। যে সাপের মাথায় মণি, সে সাপ যেমন অতি সাবধানে চলাফেরা করে, ভিতরে ভিতরে হিংস্র হয়ে থাকে, কেউ তার মণিতে হাত দিলেই বিষের ছোবলে শেষ করে দেবে, আমি তখন সেইরকম সাবধান হয়ে থাকতাম। সচকিত হয়ে থাকতাম। আমার মনের অবস্থা তখন সেইরকম ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতে পারত না। কারোকে কোনও দিন একটি কথাও বলিনি। মাকেও না। ভাইবোনদের তো নয়ই। বাবাকে বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না।
কিন্তু এখানকার জন্য আমার মন কেমন করবে কি না, তা আমার জানা ছিল না। মামা বলেছিলেন, খুব বেশি যদি করে, তবে না হয় ফিরেই আসবি।
মা বলেছিল, মন কেমন করার কী আছে। তোমার আর বউদির কাছে ভালই থাকবে। রমু দীপু আছে, ওদের সঙ্গে ভালই কেটে যাবে।’
মামা বলেছিলেন, দেখি এখন মিত্তির মশাই কী বলেন?
সেই সময়ে হঠাৎ আমার সাত বছর আর পাঁচ বছরের দুটি ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া মারামারি লেগে গিয়েছিল। কান্নাকাটি চেঁচামেচি শুরু হয়েছিল। মা বলেছিল, দ্যাখ তো বিন্দু, ও দুটো আবার কী শুরু করেছে। তারপরে তুই চান করে, জামাটা ছেড়ে ফ্যালগে।
আমি উঠোনের দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। একপাশে, আম গাছের তলায়, ওরা দুজন মারামারি শুরু করেছিল। আমি গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে রন্টুকে (সবথেকে ছোট) আড়াল করেছিলাম। মন্টু তবুও ওকে মারবার চেষ্টা করছিল, আর চেঁচাচ্ছিল, ও আমার একটা গুলি নিয়ে নিয়েছে।
রন্টু বলেছিল, আমি নিইনি। ও হারিয়ে ফেলেছে।
মন্টুর চিৎকার, তুই হারিয়েছিস।
বলে আবার রন্টুকে মারবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমি হাত দিয়ে আটকাতে, ঠিক বাঁদরের মতো খ্যাক করে আমার হাতে কামড়ে দিয়েছিল। তেমন কিছু না, তবু আমি আর্তনাদ করে উঠেছিলাম, উহ।
মন্টু তাতেই ঢিটআমাকে আর্তনাদ করতে শুনেই, অন্য দিকে দৌড় দিয়েছিল। মার খাবে, সেই ভয়ে।
রন্টু আমার হাত টেনে বলেছিল, দেখি তো রে দিদি।
বলেছিলাম, তোকে আর দেখতে হবে না। ছুটে মায়ের কাছে চলে যা।
রন্টু দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। আমি কবজির কাছে দেখেছিলাম, একটু দাঁতের দাগ পড়েছে মাত্র। ও রকম অনেক দাগ অনেক দিন পড়েছে। কার দাঁতের দাগ পড়েনি! মীনা ময়না মন্টু রন্টু, সকলেরই। ওরা আমার ছোট, কিন্তু দাদাকে আমি কোনও দিনই কামড়াইনি। বরং ওর হাতে পড়ে পড়ে মারই খেয়েছি। মারামারি চেঁচামেচি রোজই ছিল। এক দিনও বাদ যেত না। তখন তাতে কিছুই মনে হত না। মারামারি চেঁচামেচি হাসি খেলা গান, সবই একটার পর একটা ঘটত। বোধ হয় পৃথিবীর সবখানে সব ঘরেই ঘটে।
কিন্তু তখন আমার মনে কলকাতার চিন্তা। মনের মধ্যে ভাবনা যতই অস্পষ্ট থাক, ধারণার মধ্যে যতই দ্বিধা থাক, ভেতরে ভেতরে কেমন যেন খুশি হয়ে উঠেছিলাম। মাথায় তেল মাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। বাড়ির পিছনে, পুকুরের দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। আমাদের পুকুর না, রায়েদের পুকুর, তাই রায়পুকুর বলা হত। কেউ কেউ রাইপুকুরও বলত। দুদিকে দুটি বাঁধানো ঘাট। অনেক দিনের পুরনো, অনেক জায়গায় ভেঙে গিয়েছে, ফাটল ধরেছে। শ্যাওলায় ভীষণ পিছল। সাবধানে নামতে। হয়। কিন্তু তখন এমনই অভ্যাস ছিল, সাবধান হওয়ার দরকার হত না। তরতর করে নামতাম, ঝাঁপ দিতাম, কোনও দিন পড়ে যাইনি।
তখন বেলা প্রায় এগারোটা। ঘাটে দুটি বউ চান করছিল। অন্য ঘাটে আমার এক বন্ধু, ফ্রকের উপর গামছা জড়িয়ে, সিঁড়ির পৈঠায় বসে, জলে পা ডুবিয়েছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকেছিল, বিন্দু।
আমি হাত তুলেছিলাম। চারপাশে গাছপালা, পুকুরের জলে রোদ আর ছায়া। আমি দুটি বউয়ের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ডুব সাঁতারে অনেকখানি গিয়ে, পানকৌড়ির মতো মাথা তুলেছিলাম। শুনতে পেয়েছিলাম, ঘাটের বউয়েদের মধ্যে কে যেন বলে উঠেছিল, ভারী দস্যি মেয়ে।
আমি ফিরে তাকাইনি। অন্য ঘাটের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করেছিলাম। ঘাটে পৌঁছে, শরীর অর্ধেক জলে ডুবিয়ে, সিঁড়িতে বসেছিলাম, হাঁপাচ্ছিলাম। দূরত্ব কম না, পুকুরটা বেশ বড়। মা ঘাটে থাকলে, কোনও দিনই পারাপার করতে দেয় না।
আমার বন্ধুও জলে নেমে এসেছিল। আমার পাশে বসেছিল। ওর শুকনো মুখে মাথায় জল ছিটিয়ে দিয়েছিলাম। ও হাত তুলে চিৎকার করেছিল, আহ্, বিন্দু ভাল হবে না বলছি।
তবু দিয়েছিলাম। তখন ও আমার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়েছিল। দুজনেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিলাম। খেলা একটু থামতে, আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, কলকাতা থেকে তোর মামা এসেছে, না?
হ্যাঁ ।
তোদের বাড়ির সামনে মোটর গাড়িটা দেখেই বুঝেছি। তোর মামা খুব বড়লোক, না?
হ্যাঁ।
কথাটা বলতে আমি বেশ গর্ববোধ করেছিলাম। শহরের সীমায়, আমাদের গ্রামে, কারোর আত্মীয়ই মোটর গাড়ি নিয়ে আসত না। আমার কলকাতা যাবার কথাটা কিছুতেই চাপতে পারছিলাম না। তবে হেসে চেঁচিয়ে বলিনি। ভেজা খোলা চুলগুলো, মাথার পিছনে জড়ো করে বাঁধতে বাঁধতে, গম্ভীরভাবে বলেছিলাম, আমি বোধ হয় কলকাতা চলে যাচ্ছি।
বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, বেড়াতে?
না, কলকাতাতেই থাকব, সেখানে থেকেই ইস্কুলে পড়ব।
সত্যি?
বন্ধুর চোখ দুটো বিস্ময়ে আর কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলেছিলাম, যা, মামা নিয়ে যেতে চাইছেন।
বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল, আর কখনও আসবি না?
আসব না কেন–যখন ছুটি পড়বে, তখন আসব।
বন্ধুর চোখে তখন একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, কলকাতায় তোর ভাল লাগবে?
বলেছিলাম, লাগবে না কেন। কলকাতার মতন শহর।
ভয় করবে না?
ভয় করবে কেন?
কী জানি, আমার কেমন ভয় লাগে ভাবলে। একলা একলা ইস্কুলে যেতে পারবি, এখানে যেমন যাস?
তা আমি জানি না, একলা যাব কি না। মামা জানেন। তবে আমার ভয় করবে না।
আমার বন্ধু চুপ করে একটু ভেবেছিল। তারপরে, কলকাতায় যেতে ওর ভয় করে, তবু বলেছিল, বিন্দু, তোর বেশ মজা।
সেটা আমি বলতে চাইনি। বলেছিলাম, মজা আবার কী। এখানে না থেকে কলকাতায় পড়ব, সেখানে থাকব।
কথাগুলো বলতে বলতে, হঠাৎ মনে হয়েছিল, আমার মন কেমন করবে। এখানকার কথা মনে। পড়লেই, আমার মন কেমন করবে। যদিও তখন আমার তেরোর মন বিষিয়েছিল, তবু বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মন কেমন করবে। এখন বুঝতে পারি, সেটাই স্বাভাবিক। যেখানে জন্মেছি, মাঠে খেলা করেছি, পুকুরে সাঁতার কেটেছি, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে আমার মন জড়িয়ে ছিল। কত বন্ধু, কত হাসি ঝগড়া খেলা। সে সব মনে পড়লেই, আমার মন খারাপ করবে।
সেই সময়ে ওপারের ঘাট থেকে মীনা চিৎকার করে ডেকেছিল, দিদি, তোকে মা ডাকছে।
বন্ধুকে বলেছিলাম, যাচ্ছি ভাই।
জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সাঁতার কেটে ওপারে গিয়ে, বাড়িতে ঢুকেছিলাম। মামাকে দেখেছিলাম বাড়ির ভিতর উঠোনে পায়চারি করতে। আমি ছুটে ঘরে গিয়েছিলাম। জামা ইজের, ভিতরের জামা, গামছা নিয়ে রান্নাঘরের পিছন দিকে, কুয়োর ধারের ঢাকা চত্বরে চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মুছে জামা পরে, আবার ঘরে এসে চুল আঁচড়েছিলাম। মা তখন রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। আমাকে ডেকে বলেছিল, ওদের সবাইকে চান করে নিতে বল।
ওদের মানে, ভাইবোনদের। তখন আর চান করিয়ে দিতে হয় না, রন্টুকে ছাড়া। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে চান করানো আমারই কাজ। সবাইকে ডেকে ডেকে এনে, কুয়োতলায় নিয়ে গিয়েছিলাম। মীনা পুকুরে যেতে চেয়েছিল। মায়ের ভয় দেখিয়ে যেতে দিইনি। সকলেই চান করে নিয়েছিল। রন্টুকে আমি চান করিয়ে দিয়েছিলাম। মামা বাড়ির ভিতরের উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। এক বার আমাকে বলেছিলেন, তুই তো বিন্দু মেলাই কাজ করিস দেখছি।
আমি হেসেছিলাম। মা রান্নাঘর থেকে বলেছিল, না করলে চলে কী করে। কে আছে যে করবে! আমি তো কেবল সে কথাই ভাবছি।
মামা হেসে বলেছিলেন, সেটি হবে না। তোমার সংসারের কাজের জন্য, মেয়েকে আটকে রাখতে পারবে না।
মা কোনও জবাব দেয়নি। রান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তখন কথাটা তেমন করে ভাবিনি, আমি চলে। গেলে মায়ের কতখানি দুর্গতি হবে। আমি ছাড়া মায়ের কিছুতেই চলত না। সংসারে, মায়ের সঙ্গে আলাদা কোনও কাজের লোক ছিল না। মায়ের জন্য, আমার তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠা দরকার ছিল। বেলা বারোটা নাগাদ বাবা এসেছিলেন। মামাকে দেখে বললেন, বাইরে গাড়ি দেখেই বুঝেছি, দাদা এসেছেন। কখন এলেন!
বেশ সকাল সকালই। ভোরবেলা কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছি।
চান-টান করেছেন?
কলকাতা থেকেই সেরে এসেছি।
ভালই করেছেন। এখানকার কুয়োর জল আপনার তো সহ্য হয় না।
মা বাবাকে রান্নাঘরে ডেকেছিল। কী কথা হয়েছিল, শুনতে পাইনি। শুনতে পেয়েছিলাম, বাবা রান্নাঘর থেকে বলতে বলতে বেরিয়েছিলেন, সত্যি নাকি দাদা, বিন্দুকে আপনি কলকাতায় নিয়ে যেতে চান?
মামা বলেছিলেন, চাই তো৷ তোমরা রাজি থাকলেই হয়।
বাবা উঠোনে দাঁড়িয়েই গায়ের জামা খুলেছিলেন। আমাকে ডেকে বলেছিলেন, বিন্দু, জামাটা ঘরে রাখ, তেলের বাটিটা দে।
গ্রীষ্ম বর্ষা শীত, সব ঋতুতেই বাবা গায়ে তেল মাখতেন। আমি তেলের বাটি দিয়ে, জামা নিয়ে গিয়েছিলাম। বাবা বলেছিলেন, তা নিয়ে যান। আপনাদের কাছে থাকলে খারাপ থাকবে না।
তারপরে হেসে বলেছিলেন, দাদা, আপনি এখন মস্ত বড়লোক মানুষ। কলকাতায় নিজে একটা বাড়ি করেছেন, গাড়ি করেছেন। আমাদের সবাইকেও নিয়ে চলুন না। একেবারে কৃষ্ণনগরের পাট তুলে দিয়ে যাই।
মামাও হেসে জবাব দিয়েছিলেন, সেই সৌভাগ্য কি করেছি নবীন, তোমাদের সবাইকে নিয়ে গিয়ে রাখব! তেমন দিন এলে না হয় তা-ই হবে।
বাবা বলেছিলেন, এমনি বললাম।
তা জানি।
বাবা আমগাছের ছায়ায় পঁড়িয়ে, তেল মাখতে মাখতে বলেছিলেন, নিয়ে যান বিন্দুকে। আমার এখান থেকে, আপনার ওখানে অনেক ভালভাবে মানুষ হবে।
মামা বলেছিলেন, সেই চেষ্টা তো থাকবেই। আসলে কী জান নবীন, বাড়িতে একটা মেয়ে না থাকলে যেন ভাল লাগে না। আর রুণুর বউদির কোনও সন্তানও হবে না, সে আশাও নেই।
বাবা বলেছিলেন, হ্যাঁ, সে কথা শুনেছি।
সে কথা পরে আমিও শুনেছিলাম, মামিমার আর কোনও সন্তান হবে না। রমুদা দীপু দুজনেই, মামিমার পেট কাটা সন্তান। ডাক্তারেরা মামিমার আর সন্তান হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ, তাতে মামিমার জীবনসংশয় ছিল। কিন্তু মামা মামিমা, দুজনেই, একটি মেয়ে চেয়েছিলেন। সেইজন্যই আমাকে আরও বিশেষ করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
সেই দিনই আমি মামার সঙ্গে কলকাতায় যাইনি। স্থির হয়েছিল, পরের রবিবার, মামা মামিমা একসঙ্গে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। মামা বিকেলে ফিরে যাবার পরেই, আমার ছোট ঘোট ভাইবোনেরা আবার পিছনে লেগেছিল। ওরা করুণ মুখ করে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রীতিমতো আমার জামা টেনে ধরে, আঁচড়ে, মেরে বারে বারে বলেছিল, কেন তুই কলকাতায় যাবি, কেন?
ওদের কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছিল। বলেছিলাম, বা রে, আমাকে ও রকম করছিস কেন। মা বাবাকে গিয়ে বল না।
তা ওরা বলতে যায়নি। আমার পিছনেই লেগেছিল। মীনা তো আমার পিঠে গুন্ গুন্ করে কি মেরেছে আর বলেছে, কেন যাবি কলকাতায়। কেন তোকে মামা নিয়ে যেতে চাইছে।
আমার হাসি ছাড়া আর কিছু পায়নি। রন্টু বারে বারে জিজ্ঞেস করত, আর কখনও আসবি না?
বলতাম, আসব না কেন! ইস্কুল ছুটি হলে আসব।
গোটা একটা সপ্তাহ ধরে এই রকম চলছিল। তখন বুঝতে না পারলেও, এখন বুঝতে পারি, আসলে আমার ভাইবোনদের রাগটা, রাগ ছিল না। রাগের বেশে, এটাই ওদের কষ্ট আর অভিমান। কিন্তু সবথেকে অদ্ভুত লেগেছিল মাকে। মা যেন আমার ওপর কেমন রেগে গিয়েছিল। সারা সপ্তাহটা আমার সঙ্গে ভাল করে কথা বলেনি। যেটুকু বলেছে, গম্ভীর মুখে, যেন আমি কোনও অপরাধ করেছি। রোজই প্রায় এক বার করে বলত, মনে কোরো না, কলকাতায় গিয়ে তোমার দশটা হাত পা গজাবে।
কেন যে বলত, কিছু বুঝতাম না। অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মা আরও বলত, সাবধান, কোনও বেচালের কথা যেন না শুনি। তা হলে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসব।আবার এক এক সময় বলত, নেহাত দাদা বউদি বলছে, তাই কথা ঠেলতে পারলাম না। মনে হয়েছিল, মা যেন। আমাকে হিংসা করছে। আবার এক এক সময় নরম সুরে বলত, সাবধানে থাকবি, মামা মামির অবাধ্য হবি না। কলকাতা শহর বলে কথা। বড় ভয় লাগে।
অথচ মাও কলকাতা শহরেরই মেয়ে। সেখানেই তাঁর জন্ম। সেই কলকাতা শহরকেই মা ভয় পাচ্ছিল। আমি কিছুই বলতাম না। কেবল শুনে যেতাম। বাবাকে কিছুই বলতে শুনিনি। আমার কলকাতা যাবার বিষয়ে, বাবা যদি কিছু বলতেন, তা হলে মায়ের কাছেই বলতেন। আমি তা শুনতে পাইনি।
এক সপ্তাহ পরে, রবিবার বেলা দশটা নাগাদ মামা এসেছিলেন। মামিমা আসেননি। বলেছিলেন, মামিমার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হওয়ায়, আসতে পারেননি। দুপুরবেলা খাওয়া শেষে, ঘণ্টাখানেক পরেই। রওনা হয়েছিলাম। আসবার আগে আমি বাবা-মাকে প্রণাম করেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, ভালভাবে থাকিস।
মা শুধু বলেছিল, থাক। কিন্তু আমার চিবুকে হাত ঠেকিয়ে, ঠোঁটে চুঁইয়েছিল। মা আমার দিকে। তাকায়নি। দাদা একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেছিল। মীনা আর ময়না আমার গায়ের কাছে লেগে ছিল। মন্টু রন্টুও তা-ই। রন্টুটা কেঁদেছিল। আমি রন্টুর হাত ধরে গাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলাম। গাড়িতে মামার পাশেই বসেছিলাম। মামা ড্রাইভারের সিটে বসেছিলেন। গাড়ি ছাড়বার সময়, সবাই যখন দাঁড়িয়ে, তখন হঠাৎ আমার চোখে জল এসে পড়েছিল। মা বলেছিল, এ সময়ে কাঁদতে নেই বিন্দু।
মামা আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন। আমি একটু সামলে উঠতে, গাড়ি স্টার্ট করেছিলেন। কিছুদূর যাবার পরে, মামা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী রে বিন্দু, খারাপ লাগছে?
মাথা নেড়ে জানিয়েছিলাম, না।আমি তখন রাস্তার দুপাশে দেখছিলাম। আকাশে মেঘ ছিল, রোদও ছিল। গাড়ি ছাড়বার আগে গরম লাগছিল। ছাড়বার পরে বাতাস লাগছিল। সব মাঠেই প্রায় কাজ হচ্ছিল। অধিকাংশ মাঠেই ধানের চারা রোয়ার কাজ হচ্ছিল। অনাবাদী মাঠে গোরু ভেড়া চরছিল। মামা বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, বৃষ্টি এসে পড়লেই মুশকিল। যেতে যেতে বলেছিলেন, তোর মামিমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে, আসতে পারেনি বলে। আমাকে বলে দিয়েছে, তোকে তাড়াতাড়ি করে নিয়ে যেতে। রমু-দীপুও তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।
শুনে আমার লজ্জা করছিল, ভালও লাগছিল। গাড়ি চালাতে চালাতে মামা আরও অনেক কথা বলেছিলেন। ওঁদের শ্যামবাজারের বাড়ির কথা, ছেলেবেলার কথা। মা তার থেকে ছ বছরের ছোট, কিন্তু ছেলেবেলায় মায়ের নাকি খুব দাপট ছিল। দাদুর খুব আদুরে মেয়ে ছিল মা। এ সব কথা আমার জানা ছিল না। দাদু খুব গরিব মানুষ ছিলেন। তার সারাজীবন আফসোস ছিল, মেয়ের জন্য তিনি কিছুই করতে পারেননি।
দাদুর মুখটা অস্পষ্টভাবে আমার মনে পড়েছিল। সাত বছর বয়সে তাকে আমি শেষ দেখেছি। তারপরে তিনি মারা যান। দিদিমা আগেই মারা গিয়েছিলেন। তারপরে তো সবই বদলে গিয়েছিল। মামা নিজের চেষ্টায় ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছিলেন। যদিও তাঁর সে অবস্থা দাদু দেখে যেতে পারেননি। তিনি শুধু মামার অমানুষিক পরিশ্রম দেখে গিয়েছেন। গাড়িতে যেতে যেতে মামা নিজেই আমাকে বলছিলেন এ সব কথা বলেছিলেন, তোর দাদু এ সব কিছুই দেখে যেতে পারলেন না। মরবার সময় সেটাই তার দুঃখ, আমি তখনও ভালভাবে দাঁড়াতে পারিনি। এখন যাহোক একটু দাঁড়ানো গেছে। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে।
কথাগুলো মামা ঠিক আমাকেই বলছিলেন কি না জানি না! সামনের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন। আমি শুনছিলাম। দাদু মারা যাবার পরে, মায়ের কলকাতা যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপরে প্রায় তিন বছর, মামার সঙ্গে আমাদের কোনও যোগাযোগ ছিল না। মাঝে মধ্যে এক-আধটা চিঠি পাওয়া যেত। আমার দশ বছর বয়সের সময় থেকে, মামার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
কলকাতার যত কাছে আসছিলাম, মেঘ ততই বাড়ছিল। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা, তারপরে অঝোরে বৃষ্টি। এত বৃষ্টি, ওয়াইপার দুটো চলা সত্ত্বেও, মামা প্রায়ই একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে কাঁচ মুছে। দিচ্ছিলেন। কখন যে হঠাৎ কলকাতায় ঢুকেছিলাম, বুঝতেই পারিনি। দোতলা বাস আর দাঁড়িয়ে থাকা ট্রামগাড়ি দেখে, বুঝতে পেরেছিলাম, কলকাতায় ঢুকেছি। দারুণ বৃষ্টি। রাস্তায় নোকজন বিশেষ দেখা যাচ্ছিল না। অনেক গাড়ি রাস্তার দু পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথার ওপরে ঢাকা আছে, এ রকম সমস্ত পেভমেন্টের ওপরে গাদা গাদা লোক। মাঝে মাঝে কেবল বড় বড় দানব বাসগুলো গর্জন করে চলে যাচ্ছিল। জল ছিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের গাড়ির গায়ে। রাস্তার যেখানে যেখানে জল জমেছিল, মামা সেখানে খুব আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, এক বার থেমে গেলে নাকি আর গাড়ি চলবে না। হঠাৎ হেসে উঠে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, যা রে বিন্দু, তুই কি বাদুলে মেয়ে নাকি? কোন মাসে তোর জন্ম?
বলেছিলাম, শ্রাবণে।
মামা আরও জোরে হেসে উঠে বলেছিলেন, তাই বল। তোর নাম যমুনা রেখেছিল কেন শ্রাবণী রাখা উচিত ছিল। কবে তোর জন্মদিন?
সাতাশে শ্রাবণ।
এখনও কয়েক দিন দেরি আছে। ভালই হয়েছে। শ্রাবণে তোর জন্ম, শ্রাবণেই কলকাতায় এলি। সেইজন্যই আজ এত বৃষ্টি।
মামার সেই কথার মধ্যে, আমার জীবনের কোনও ইঙ্গিত ছিল কি। মামা কিছু ভেবে বলেননি, আমিও তখন কিছু ভাবিনি। আজ মনে হচ্ছে, মামার সেই কথার মধ্যে যেন একটা ইঙ্গিত ছিল। পূর্ণ তেরো বছরে, শ্রাবণ মাসে, কলকাতায় আমার আর এক নতুন জন্ম হচ্ছিল। দুরন্ত বৃষ্টিতে কলকাতা ডুবছিল; আমি কলকাতায় ঢুকছিলাম। কিন্তু কলকাতা ডোবে না। কলকাতা ডোবে, আবার ভাসে। কলকাতা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সেই ইঙ্গিতই ছিল, ভেসে যাওয়া কলকাতায়।
.
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, মামা গাড়ির হর্ন বাজালেন। বাড়ির সামনে রাস্তায় জল জমেনি। দোতলার জানালা খুলে গেল। মামিমাকে এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম। তিনি মামাকে হাত নেড়ে কী যেন। বললেন। একটু পরেই, নীচের দরজা খুলে, বারান্দা পেরিয়ে, ছোট গেট খুলে, একটি লোক এল ছাতা মাথায় দিয়ে। তার হাতে আর একটি আলাদা ছাতা। মামা আমাকে বললেন, বিন্দু, তুই আমার এই দরজা দিয়েই নেমে আয়। তোর সুটকেস এখন গাড়িতেই থাক। হরি পরে নিয়ে যাবে।
মামা নেমে গেলেন। ছাতা হাতে লোকটি এগিয়ে এসে মামার মাথায় ছাতা ধরল। আমি স্টিয়ারিং হুইলের গা ঘেঁষে, গাড়ি থেকে নামলাম। কী বৃষ্টি! মামার ছাতার তলায় যেতে না যেতেই ভিজে গেলাম। মামা আমাকে এক হাত দিয়ে তার গায়ের কাছে টেনে নিলেন। লোকটি আর একটি ছাতাও মেলে ধরল। মামা আমাকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দায় তখন আলো জ্বলে উঠেছে। মামিমাও নীচে নেমে এসেছেন। দু হাত বাড়িয়ে আগে আমাকে ধরলেন। মামাকে বললেন, আমি তো ভাবলাম, তোমরা পথের মাঝেই কোথাও আটকে পড়বে। সেই কখন থেকে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে।
মামা বললেন, যা অবস্থা, তাতে আটকা পড়ে যাবারই কথা। বিন্দুর ভাগ্যেই বোধ হয় তা পড়তে হয়নি।
মামিমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার চোখ দুটি হাসিতে চিকচিক করছে। গা থেকে একটি সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। কাপড় জামা একটু কোঁচকানো, কিন্তু ফরসা। ঠোঁটে রং নেই, তবু লাল দেখাচ্ছে। চোখে কাজলের আভাস। পায়ে স্যান্ডেল। মায়ের সঙ্গে কোথাও মেলানো যায় না। অথচ, মামিমা তো মায়ের থেকে একটু বড়ই হবেন। দেখলাম, ঘোমটা নেই, মাথার চুলগুলো রুক্ষু মতো। চোখের কোলদুটো যেন একটু ফোলা ফোলা। আমি মামিমাকে প্রণাম করলাম। মামিমা আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে, চিবুকে হাত দিয়ে আমার মুখ তুলে বলে উঠলেন, বিন্দু, তুই কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে!
আমি যেন লজ্জায় মরে গেলাম। পারলে মামিমার গায়েই মুখ লুকোই। মুখটা নামিয়ে নিলাম। মামা বলে উঠলেন, আর বাইরে দাঁড়িয়ে নয়, আগে ওপরে চলল।
মামিমা বললেন, হ্যাঁ চলো।
মামিমা আমার হাত ধরে নিয়ে চললেন। দুই ঘরের মাঝখান দিয়ে গিয়ে ভিতরের বারান্দা। নীচে কটা ঘর, দেখতে পেলাম না। বাঁ দিকের সিঁড়ি দিয়ে মামিমা আমাকে ওপরে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। সে ঘরে, মাঝখানে ফাঁক রেখে দুদিকে দুটো খাট। এক দিকে ড্রেসিং টেবিল, দুটো স্টিলের আলমারি। একটার গায়ে আয়না লাগানো। ড্রেসিং টেবিলের কাছেই, একটি গদিমোড়া চেয়ারের ওপর মামিমা আমাকে বসিয়ে দিয়ে বললেন, বোস।
আমার বসতে কেমন লজ্জা করল। তবু বসে রইলাম। মামিমা বললেন, হ্যাঁ রে, আমি যেতে পারিনি বলে ঠাকুরঝি কিছু মনে করেনি তো?
বললাম, মা জানে, আপনার শরীর খারাপ করেছে।
মামিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বিন্দু, তুই আমাকে আপনি করে বলেছিস কবে? বরাবর তো তুমি বলেছিস।
আমি আরও লজ্জা পেয়ে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না। মামিমা বললেন, বুঝেছি, অনেক দিন বাদে হঠাৎ দেখে, তোর সব গোলমাল হয়ে গেছে।
বললাম, সত্যি মামিমা, সব ভুলেই গেছি।
মামিমা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঘরে দীপু ঢুকল। একটা ডোরাকাটা কাপড়ের পায়জামা আর সেই কাপড়েরই জামা ওর গায়ে। সব কোঁচকানো, চুলগুলো উশকোখুশকো, কপালের ওপর এসে পড়েছে। চোখে মুখে কেমন একটা দুষ্টুমির হাসি। আমার দিয়ে চেয়ে চেয়ে হাসছে, কিছু বলছে না। মামিমা বললেন, চিনতে পারছিস বিন্দু, ও দীপু। তোরই সমবয়সি।
বললাম, পারছি।’ দীপুর দিকে চেয়ে হাসলাম। দীপু আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মামিমাকে বললে, মা, ও কী রকম বড় হয়ে গেছে দ্যাখো।
মামিমা বললেন, বড় আবার কোথায় দেখছিস!
দীপুর কথা শুনে আমার একটু লজ্জা লাগল। দীপু আমার চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়াল। চোখে চোখ পড়তে হাসল। আমার এক পাশের বিনুনিতে হাত দিয়ে বলল, এত চকচক করছে কেন, কী মেখেছিস?
অবাক হয়ে বললাম, কেন, নারকেল তেল।
দীপু বলল, বিচ্ছিরি চকচক করছে।
মামিমা ধমকের সুরে বললেন, হয়েছে, তোকে আর এত দেখতে হবে না।
দরজায় রমুকে দেখা গেল, রমুদা। ওকে বেশ বড় দেখাচ্ছে। দীপু তো প্রায় আমার মাথায় মাথায়। আমি খুব ছোটখাটো নই। সেই তুলনায়, রমুদাকে আরও লম্বা দেখাচ্ছে। ওর চোখ দুটোও হাসিতে চিকচিক করছে, কিন্তু দীপুর মতো দুষ্টু ভাব ঠিক নেই। ওকে যেন কেমন বড় বড় লাগছে। ওর পরনে সাদা পায়জামা আর একটা রঙিন শার্ট। হাতের কবজিতে ঘড়ি। পনেরো বছরের ছেলের হাতে আগে আমি ঘড়ি দেখিনি। সেজন্য রমুদাকে আরও বড় মনে হল। ওর চুলও অগোছালো। ভাবভঙ্গি একটু অন্য রকম। ভুরু নাচিয়ে হাসল আমার দিকে চেয়ে। কাছে এগিয়ে এসে বলল, চিনতে পারছিস?
বললাম, রমুদা।
রমুদা মামিমার দিকে ফিরে বলল, মা, আমি ওর থেকে তো অনেক বড়, না?
মামিমা বললেন, অনেক বড় আবার কী। তোরা পিঠোপিঠি, দু বছরের ছোট বড়।
ও আমাকে পেন্নাম করবে না?
মামিমা কৌতুকে হেসে বললেন, পেন্নাম করবে না হাতি করবে!
রমুদা জোর গলায় হেসে উঠল। দীপুও। রমুদা বলল, খুব লাভলি দেখতে হয়েছে, না?
এই সময়ে মামা ঢুকলেন। তার হাতে আমার সুটকেসটা। ঘরে ঢুকে, বাঁ দিকে একটা টেবিলের ওপর সেটা রেখে, আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে, সব মিলেছে এক সঙ্গে? বেশ। যাও, তোমাদের ঘরটা বিন্দুকে দেখিয়ে নিয়ে এসো।
রমুদা বলল, বিন্দু নামটা মোটেই ভাল না। তোর ভাল নাম কী?
যমুনা।
আরও খারাপ। একেবারে সেকেলে।
মামা বলে উঠলেন, তোমাদের নামই বা কোন একেলে রাখা হয়েছে। রমেন্দ্র আর দীপেন্দ্র। যমুনা নাম তো বেশ সুন্দর নাম।
রমু বলল, তোমাদের কাছে। চল যমুনা, আমাদের ঘরে চল।
দীপু আমার হাত ধরে টানল। মামার সঙ্গে রমুদার কথাবার্তা শুনে আমার খুব অবাক লাগল। দাদাকে কোনও দিন বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে শুনিনি। মামিমা বললেন, বিন্দু কোন ঘরে থাকবে, সেটাও দেখিয়ে দিস।
রমুদা আর দীপুর সঙ্গে ওদের ঘরে এলাম। বেশ বড় ঘর। দু দিকে দুটো খাট। তার ওপরে মাথার বালিশ আর পাশবালিশ এলোমেলো ছড়ানো। দু দিকে দুটো টেবিল আর চেয়ার। দুটো আলাদা চেয়ারও রয়েছে। টেবিলের ওপর বই-খাতাপত্র। একপাশে কাঠের একটা চকচকে বড় আলমারি। এ ঘরেও বড় আয়না, টেবিলের ওপর রাখা। এক পাশে মস্তবড় রেডিওগ্রাম। বন্ধ ডালার ওপরে, অ্যালুমিনিয়ামের ডিসকের বাক্স। পরে জেনেছি, এগুলো তা-ই। তাই ওটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি দেখে, দীপু বলল, ওটা রেডিওগ্রাম। গান শুনবি?
রমুদা বলল, এখন না, পরে হবে। এ ঘরে আমি আর দীপু থাকি। চল, তোর ঘরটাও দেখিয়ে নিয়ে আসি।
ওদের দুজনের সঙ্গে আমি আর একটা ঘরে গেলাম। দীপু আলো জ্বেলে দিল। এ ঘরটাও বড়। একটা খাট আর বিছানা রয়েছে। মামিমার ঘরের মতো বড় না হলেও, এ ঘরেও একটা ড্রেসিং টেবিল। একটা কাঠের আলমারিও রয়েছে। দীপু ঘরের মধ্যেই, একটা দরজা খুলে দিয়ে বলল, এটা বাথরুম। বলেই বাথরুমের আলো জ্বালিয়ে দিল। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকেই বাথরুমের ভিতরটা মোটামুটি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভাবতে পারছি না, এ রকম একটা ঘরে আমি একলা থাকব। ঘরের মধ্যে বাথরুম আমি আগে আর দেখিনি। শ্যামবাজারে দাদুর বাড়িতেও এ রকম ব্যবস্থা ছিল না। কৃষ্ণনগরে, আমাদের শোবার ঘরটা আমার মনে পড়ল। গতকাল রাত্রেও যেখানে শুয়েছিলাম। তক্তপোশের ওপর, একটা বিছানায় আমি, মীনা, ময়না আর মন্টু শুতাম। গাদাগাদি পাশাপাশি। বাইরে যেতে হলে, নিঝুম রাতে সেই কুয়োতলায় যেতাম। একলা যেতাম না, মীনাকে ডেকে তুলতাম। তাও অনেক কষ্টে। ওদের দরকার হলে, আমাকেই সবসময়ে ডাকত। সেই সব অন্ধকার বা জ্যোৎস্নাভরা, ঝিঁঝি ডাকা, জোনাকি ঝিলিক দেওয়া, বর্ষার ব্যাঙ-ডাকা রাত্রির সঙ্গে, এ ঘরকে কোথাও মেলানো যায় না। আমি যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
দীপু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল জানালার দিকে। রমুদা জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম সামনেই রাস্তা। মামার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। এখনও বৃষ্টি পড়ছে। অথচ রাস্তাটা আলোয় ভরা। অল্প দু-একজন লোক, ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করছে।
শুনতে পেলাম, রমুদা বলছে, আচ্ছা, ওকে কেমন দেখতে বল তো?
মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, রমুদা আর দীপু দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দীপু বলে উঠল, কিম্ নোভাকের মতো?
রমুদা মাথা নাড়ল, না।
তবে? মনরো, না?
না, এলিজাবেথের মতো।
ওরা কী ভাষায় কথা বলছিল, আমি যেন বুঝতেই পারছিলাম না। রমুদা বলল, আয় তোকে একটু আদর করে দিই।’
বলেই রমুদা আমার গালে একটা চুমো খেয়ে দিল। আমি চমকে আর্তনাদ করে উঠলাম, আহ, একী! আমার বুকের মধ্যে ধক ধক করছে, কাঁপছে। আমি বিস্ফারিত চোখে রমুদার দিকে তাকালাম। রাগ এবং ভয়, দুইয়ে মিলে একটা উত্তেজনা আমার মধ্যে। আমি এ রকম একটা ভয়ংকর অঘটন যেন ভাবতে পারি না। অথচ রমুদা অবিকৃত অবাক মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হল?
বলে, রমুদা দীপুর দিকে তাকাল। দীপুও যেন অবাক চোখেই আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি খুঁসে ওঠার মতো বললাম, কেন আমাকে চুমো খেলে?
রমুদা যেন আরও অবাক হয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম, ছি! কেন খাবে?
আমি হাত দিয়ে জোরে জোরে আমার গাল ঘষলাম। রমুদা, মাত্র পনেরো বছর, ওকে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। কত খারাপ, তা বলতে পারছি না। একটা বড় খারাপ মানুষের মতো খারাপ। অথচ ও আর দীপু তেমনি অবাক চোখে, নিজেদের মধ্যে তাকাল, আমাকে দেখল। রমুদা বলল, তুই এটাকে খারাপ ভাবছিস?
আমি ঘাড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, এটা তো খারাপই, খুব খারাপ।
রমুদা কেমন যেন গুটিয়ে গেল, ওর ফরসা মুখটা গম্ভীর আর লাল হয়ে উঠল। বলল, আচ্ছা, যা, আর তোকে কোনও দিন আদর করতে যাব না।
রমুদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দীপু আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরে বলল, তুই খুব রাগ করেছিস?
বললাম, এতে বুঝি রাগ হয় না? একি ভাল?
দীপু যেন আমার কথা ঠিক বুঝতে পারল না। আমার মুখের দিকে তেমনিভাবে তাকিয়ে রইল। দরজার কাছে মামিমার ডাক শোনা গেল, বিন্দু, আয় একটু খেয়ে নিবি।
মামিমা ডাক দিয়ে চলে গেলেন। আমি পিছনে পিছনে গেলাম।