৫. মালপোয়া

৫. মালপোয়া 

ভোর থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার অনেক আগেই। অন্ধকার ঘরটায় শুয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনছিলেন ইন্দুবালা। অল্প অল্প বাতাসে দুলছিল জানলার হালকা পর্দাগুলো। তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল একটু একটু করে ফর্সা হতে থাকা মেঘলা আকাশ। একতলায় ভাতের হোটেলের ওপরে তাঁর এই ঘরটা ছোট্ট হলেও বেশ খোলামেলা। অন্তত এই বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলোর থেকে তো বটেই। ঘরের চারিদিক বরাবর বেশ কয়েকটা জানলা। সামনের দিকে এগিয়ে গেলে ছেনু মিত্তির লেন। হরেক মানুষ, গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত, সার সার বাড়ি। আর পেছন দিকটা শাশুড়ির আমলের ছোট্ট বাগান। সিঁড়িঙ্গে নারকেলগাছ। উঠোনের আমগাছের ডালপালা আরও কয়েকটা জানলায় ছড়ানো ছিটানো। এই ঘরটা আসলে ছিল ইন্দুবালার স্বামী মাস্টার রতলনাল মল্লিকের আমোদের জায়গা। তিনি তাঁর ইয়ার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসে এই ঘরেই তুলতেন। দিন রাত তাস পেটা চলতো। তার সাথে গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি আর সোডা। ঘরখানায় ঢুকলে তখন মনে হতো কেউ যেন সক্কালের আঁচ ধরিয়েছে। ঝাঁট দিয়ে জড়ো হতো রাশিকৃত পোড়া সিগারেট, বিড়ি, আরও কত কী। শাশুড়ি উঠতে বসতে খোঁটা দিতো বউয়ের গতর নিয়ে। যে গতরে তাঁর বাহিরমুখো ছেলে অন্দরে মন বসাতে পারলো না। যে গতর দেখে তিনি ভিসা পাসপোর্ট করে ওপার বাংলা থেকে ছেলের জন্য বাঙাল বউ নিয়ে এলেন। অথচ যে গতর বিলিয়ে সংসারে নাতি নাতনির অভাব হলো না মোটেও। তিন তিনটে সন্তানকে রেখে মাস্টার রতলনাল মল্লিক যখন ইহ জীবনের মায়া ত্যাগ করলেন তখন ইন্দুবালা ভেতরের ঘর থেকে বাইরের এই ঘরে এসে থাকতে শুরু করলেন। শুধু কি অনেক আলো, হাওয়া, বাতাসের জন্য? না, তা মোটেই না। এই ঘরে থাকলে তিনি নীচের হোটেলের রান্নাঘর থেকে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি টের পেতেন। সিঁড়ির মুখ থেকে এই ঘরের দিকে নজর রাখা যেত খুব সহজে। আর এই ঘরটায় এলেই যেন ইন্দুবালার কলাপোতার বাড়ির দাওয়াখানা মনে পড়ে যেত। চারিদিকে সবুজের চাঁদোয়া। 

ইন্দুবালা পাশ ফিরলেন। এই এত বয়সেও স্মৃতিগুলো কেন এলোমেলো হয়ে যায়? ভুলেও তো যেতে পারে মানুষ অনেক কিছু? অনেকে ভুলেও যায়। শুনেছেন তিনি। এমনকি নিজে কে ছিল। নাম কী। বাড়ির লোকজন পর্যন্ত সবাইকে ভুলে যায়। কিছু নাকি আর মনে থাকে না রোগটা হলে। চারপাশটাকে তখন কি আরও নতুন লাগে? পুনর্জন্মের মতো? কে জানে? আয়নার সামনে এই যে নিজেকে দেখে না চেনার বিড়ম্বনা। কিংবা নতুন আমিকে চিনে নেওয়া। সেটা কি আরও যন্ত্রণাদায়ক নয়? হয়তো। কিন্তু প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের এই স্মৃতির বোঝা টানা আরও কষ্টকর ইন্দুবালার কাছে। নিয়তিকে দোহাই দেন ইন্দুবালা। হয় ভুলিয়ে দাও। না হলে ভুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। অদৃষ্টকে সাত গাল পাড়লেও অনেক কিছু ভোলা হয় না ইন্দুবালার। ভাগ্যিস ভোলা হয় না। তাই তো আনাজের চুবড়ি থেকে, সূঁচ সুতোর কৌটো থেকে, ভাতের হাঁড়ির সুবাস থেকে বেরিয়ে আসে কত কত গল্প। ইন্দুবালা চোখ বন্ধ করে আবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলেন। ঠাম্মা সন্ধ্যেবেলায় আফিম খেতো। ছোটো ছোটো কালো কালো গুলি করা থাকতো পিতলের কৌটোতে। বাবা খুলনা শহরের বড় এক আড়তদারের কাছ থেকে নিয়ে আসতেন। ফুরিয়ে আসতে থাকলেই ঠাম্মার মাথা যেত খারাপ হয়ে। একটানা আবদার চলতো তার। ধুয়ো টেনে টেনে ঠাম্মা বলে চলতো, “ও ব্রজ, নিয়ে আয় না বাবা। শেষ হয়ে গেল যে গুলি”। সেই কাতর চাহনি এখনও যেন মনে পড়ে ইন্দুবালার। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের চাহনির সাথে তার কি কোনো মিল ছিল? ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। শাশুড়ির কথা মনে পড়ে। স্বামীর কথাও। মৃত মানুষের চাহনি ইন্দুবালাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ঘিরে ধরে এক বৃষ্টি ভেজা সকালে। 

মুকুলে ভরা আম গাছের তলায় শোয়ানো হয়েছিল দাদুকে। বসন্তের আগমনের আগাম জানান দিচ্ছিল দু একটা কোকিল দূরের কোনো গাছ গাছালির শাখায় বসে। ইন্দুবালা তখন খুব ছোটো। কিছুক্ষণ আগে ঠাম্মা ভাজছিলেন দাওয়া আলো করে নতুন গুড়ের মালপোয়া। গোটা গ্রামে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল গন্ধ। তেলের ছাঁক ছুক আওয়াজে উমনো ঝুমনোর পিঠে খাওয়ার গল্পটা আগাগোড়া বলে চলেছিল ঠাম্মা। হাঁ করে বসে শুনছিল ছোট্ট ইন্দুবালা। দাদু স্নান করতে যাচ্ছিল বোসদের পুকুরে। বাবা গিয়েছিল ধান বিক্রি করতে হাটে। মা ছিল শোওয়া। ভাই তখন পেটে। দাদুর ইচ্ছে হয়েছিল অসময়ে মালপোয়া খাওয়ার। মুখ ফুটে যে মানুষ কিছু চায় না কোনোদিন, সেই মানুষ যখন মালপোয়া খেতে চেয়েছে ইন্দুবালার ঠাম্মার আনন্দ আর গোপন থাকে না। নিজেই গম পিষিয়ে নতুন আটা বের করেছেন জাঁতি ঘুরিয়ে। চাল কুটেছেন ঢেকিতে। বেটেছেন শিলনোড়ায় মিহি করে। নতুন গুড়ের হালকা একটা রস করেছেন। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থেকেছেন নানা তরিজুতের ছোটোখাটো উপকরণ নিয়ে। আর ছোট্ট ইন্দুবালা ঠাম্মার আঁচল ঘিরে, কাপড় জড়িয়ে, কোলে শুয়ে সেই আখ্যানের অংশীদার হয়েছে। উমনো ঝুমনোর গল্প যখন ফুরিয়ে এসেছে, শেষ মালপোয়া যখন তেলের ওপর লাল হয়ে ফুলে উঠছে, মৌরির সুবাস যখন কলাপোতা গ্রামে ম ম করে উঠছে, দাদু স্নান সেরে এসে তুলসী প্রণাম করতে গিয়ে বসে পড়লেন দাওয়ায়। জীবনের শেষ প্রার্থনা আর তাঁর করা হলো না। একদিন কথা বন্ধ রেখে পরের দিন ভোরের সূর্য ওঠার আগে দাদু চলে গেলেন। আমতলায় শোয়ানো থাকলে তাঁর দেহ। হরিনাম সংকীর্তনের দল গোল হয়ে ঘিরে ঘিরে ইনিয়ে বিনিয়ে সুর তুললো। বাড়ি থেকে কেউ মরা কান্নার চিৎকার করলো না। ঠাম্মা বসে থাকলেন চুপ করে পাথরের মতো। বাবা কী করবে বুঝতে পারলো না। মায়ের তখন সবে প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে। ইন্দুবালা চুপি চুপি দাওয়ার পাশে ছোট্ট বেড়া দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে তখন। কাঁসার রেকাবিতে চাপা দেওয়া আছে গতকালের মালপোয়া। রসে ফুলে ততক্ষণে সেগুলো টইটম্বুর। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতে তুলেছিল সবে ছোট্ট মেয়েটা। গ্রামের কোন এক বউ দেখে ফেলেছিল। রে রে করে উঠে এসে ধরেছিল হাত। “অশৌচের বাড়িতে খেতে আছে কোনো কিছু? ফ্যাল হাত থেকে। ফ্যাল বলছি”। ইন্দুবালা ফেলতে পারেননি সেই মালপোয়া। গোটা রাত ধরে নতুন গুড়ের রসে ভাসতে ভাসতে সেগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল। হালকা গন্ধ বেরোচ্ছিল মৌরির। এতক্ষণ যে ঠাম্মা কারো সাথে কোনো কথা বলেননি, তিনি উঠে এলেন রান্নাঘরে। খুব শান্ত অথচ কঠিন গলায় বললেন, “ছেড়ে দাও ওকে পাঁচুর মা। ওর খাওয়া মানে ওর দাদুর আত্মার শান্তি পাওয়া। আত্মা না জুড়ালে মায়া কাটবে কী করে?” গপ গপ করে গোটা তিনেক মালপোয়া খেয়ে নিয়েছিলেন ইন্দুবালা। তাঁর হাতে মুখে লেগেছিল রস। ঠাম্মা গড়িয়ে দিয়েছিলেন জল। নিজে হাতে খাইয়েছিলেন নাতনিকে। মুখ হাত ধুইয়ে, মুছিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, “ভালো লেগেছে ইন্দু তোর?” একটা বড় হ্যায় মাথা নেড়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। ঠিক সেই সময় আঁতুর ঘর থেকে ভেসে এসেছিল নবজাতকের কান্নার শব্দ। ঠাম্মা নাতির মুখ দেখে বলেছিলেন, “সেই ফিরে আসতে হলো তো? কোথায় যাবে আমায় ছেড়ে?” তাঁর বিশ্বাস ছিল দাদু ফিরে এসেছেন আম, জাম, কাঁঠাল, মালপোর গন্ধ বুকে নিয়ে। বাবা ফিরেছিলেন শ্মশান বন্ধুদের সাথে বিকেলেরও পরে। ততক্ষণে ঠাম্মার সাদা থান পরা হয়ে গেছে। ছোট্ট ভাইটা হাঁ করে ঘুমোচ্ছে তার কোলে। এদের কারো মৃত মুখ দেখেননি ইন্দুবালা। ভাগ্যিস সেই চরম দুর্ভাগ্য হয়নি তাঁর। 

খাটের ওপর চিৎ হয়ে শোন ইন্দুবালা। পিঠের ব্যথাটা আরও বাড়ে। রাতের নেওয়া হট ওয়াটারের ব্যাগটা তখনও অল্প অল্প গরম। কাছে টেনে নেন। পিঠের কাছে রাখলে আরাম পান। যন্ত্রণা শুধু স্মৃতির নয় শরীরেরও। সব যন্ত্রণা শেষ হলে মানুষ মুক্তি পায়। তাই হয়তো সেই অন্তিম লগ্নে মুখের ওপর ছেয়ে থাকে পরম শান্তির ছায়া। এখনও কি জীবনে শান্তি নেই ইন্দুবালার? দিব্যি শান্তি আছে। না হলে নিজেকে এইভাবে জিইয়ে রেখেছেন কী করে? শুয়ে শুয়েই বুঝতে পারেন রাস্তার উলটো দিকে কর্পোরেশানের কলে জল নিতে আসছে টুকটাক করে বাজারের লোকজন। উঠতে ইচ্ছে করছে না। সারা দেহের অবসাদ আজ যেন মনে নেমে এসেছে। ঠাম্মার মৃত্যু সংবাদ যেদিন ভাই নিয়ে এসেছিল সেদিন ইন্দুবালার সাধ। বাড়ি ভরতি লোক বিয়েতেই হয়নি সাধে হবে ভাবাটাও বোকামো। নিজের বউভাতের রান্না যেমন ইন্দুবালাকে নিজেই করতে হয়েছিল ঠিক তেমনি সাধের রান্নাটাও। গোনাগুন্তি মাছের দাগা ছিল। চাল নেওয়া হয়েছিল মাথা গুনে। শাশুড়িকে খাইয়ে, স্বামীকে খাইয়ে যখন ইন্দুবালা নিজে খেতে বসতে যাবেন দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। ওই ভরা অবস্থায় রান্নাঘর থেকে উঠে এসে সদর খুলতে হলো তাঁকেই। শ্রাবণের চড়া রোদ আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইটা তাঁরই সামনে। কতদিন পরে। চোখে তখন দিদির কপোতাক্ষের টলটলে জল। ইচ্ছামতী গাল বেয়ে গড়াচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতে বলবেন কী! ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন যেন ইন্দুবালা এতদিন পরে ভাইকে দেখে। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা। গালে কচি ঘাসের মতো দাড়ি। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ঠিক যেন মনিরুল সেজে দাঁড়িয়ে আছে ভাই। “ভেতরে আসতে বলবি না? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো?” ইন্দুবালা ভাইকে জড়িয়ে ধরেন। ঝুপ করে যেন তাকে ছুঁয়ে ফেলে কলাপোতার গ্রামটা। বোসদের পুকুর। তেপান্তরের ধানক্ষেত। কতবেলের আচার। আর ভাই দেখে তার দিদি আরও সুন্দর হয়েছে। গা থেকে খসে গেছে অজ গাঁয়ের পুরোনো চাদর। নতুন মা হবার যাবতীয় সব কিছু যেন গা থেকে তেড়েফুঁড়ে বের হয়ে আসছে তার। ঠিক এই সময়েতো ইন্দুবালার থাকা উচিত ছিল গ্রামে। ঠাম্মা কী খুশি হতো! উঠোন ভরে উঠতো আচারের বয়ামে। মা বিশালাক্ষ্মী তলায় পুজো দিতো। আর বাবা? সবার বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি দিয়ে বলে আসতো, “এই যে শুনছো আমার ইন্দু মা হবে। তোমরা ওকে সবাই আশীর্বাদ করো। সব যেন ঠিক মতো হয়ে যায়। নাতনির সন্তান দেখার আশায় ঠাম্মা ছিলেন না। এত সৌভাগ্য তাঁর কপালে জুটবে না সেটা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন তাঁর এই শেষ শয্যায় মেয়েটা এসে একটু বসুক। বাবা চিঠি দিয়েছিলেন বেশ কয়েকটা। নিজেই আসতে পারতেন মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু তাঁর শরীরটা তখন ভালো নয়। ভাইটা পরীক্ষা দিচ্ছে। তার পক্ষে আসাও সম্ভব ছিল না। প্রত্যেকটা চিঠি আসার পরেই ইন্দুবালার শাশুড়ি মুখ ভার করে থাকতেন। এই বুঝি তাঁর ছেলেকে ফুসলে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় বউ। কিন্তু সেই আশার আগুনে জল পড়তো বারে বারেই। ছেলে দু দিন পর পর যাও বা বাড়ি ফিরতো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত সারাদিন। শাশুড়ির তখন ছেলেকে খাওয়ানোর ধুম লেগে যেত। ইন্দুবালাকে উনুনের সামনে বসিয়ে ফিরিস্তি মতো এটা সেটা রান্না করিয়ে নিতেন। ছেলেও তখন দিন কতক ঘুমিয়ে, রাশিকৃত গিলে, পাউডার সেন্ট মেখে বউয়ের গা থেকে যেকোনো একটা গয়না খুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়তো। সেই যে বেরোতো, টাকা না ফুরানো পর্যন্ত বাড়ি ফিরতো না। ছেলে না ফিরলে শাশুড়ির কাজও যেত কমে। একমাত্র বসে বসে দুশ্চিন্তা করা ছাড়া তখন আর তাঁর কিছু করার থাকতো না। এমনকি নাতিগুলো কী খেয়েছে না খেয়েছে সেসব দিকেও নজর থাকতো না তাঁর। ডালে চালে ফুটিয়ে চলে যেত সংসার। কোনো কোনো দিন লছমী এলে মাছ জুটতো বাচ্চাদের পাতে। এইসময় ইন্দুবালা সংসারের কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই চিঠিগুলো চোখের সামনে নিয়ে বসে থাকতেন। অক্ষরগুলোর গায়ে হাত বোলালে মানুষগুলোকে স্পর্শ করছেন বলে মনে হতো। কত কত রাত যে জেগে কাটিয়েছেন একা একা ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে, সঙ্গী থেকেছে তো এই স্মৃতিই। মনে মনে বুনে চলেছেন সেই কবে থেকে এক নক্সীকাঁথা। যতই অতীতকে গাল পাড়ুন না কেন সেই নক্সীকাঁথায় নিজেকে জড়ালে চার পাশে না থাকা মানুষগুলোর ওম পেয়েছেন ইন্দুবালা। ঠিক এখন যেমন পাচ্ছেন হট ওয়াটার ব্যাগের। এক বর্ষার ভোরে চোখে কেঁপে নামছে যেন সারা রাতের ঘুম। 

ভাইকে দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন শাশুড়ি। “বলি কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে তোমাদের? শুভ বাড়িতে অশৌচে এগোচো নাকি?” মাথা নেড়েছিল ভাই। শ্রাদ্ধ, নিয়মভঙ্গ সব কাজকর্ম মিটিয়ে তারপরে সে এসেছে। আরও বিরক্ত হয়ে বুড়ি বলেছিল “তাহলে আর কী! গেলাও কোটাও এবার ভাইকে।” খারাপ লেগেছিল ইন্দুবালার কথাটা শুনতে। ভাইয়েরও কি খারাপ লাগেনি? নিশ্চয়ই লেগেছিল। সে চলে যেতে চেয়েছিল তখনই। ইন্দুবালা বুঝিয়েছিলেন অনেক, “বয়েস হয়েছে তো। তাই এমন হয়ে গেছে মানুষটা। তুই রাগ করিস না ভাই। চট করে স্নানটা সেরে আয় দেখি”। ভাই চলে গেলে ইন্দুবালা খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই কতদূর থেকে তেতে পুড়ে এসেছে ছেলেটা। অমন ভাবে না বললেও হয়তো পারতেন শাশুড়ি। কিন্তু তিনি জানেন এই সংসারে একটা লোক বেশি খাওয়া মানে ভাঁড়ার ঘরে টান পড়া। ছেলের নেশা বেড়েছে। বাইরে মতি গতিও। কেমন যেন কঙ্কালসার হয়ে উঠছে বাড়ির চেহারাটা আস্তে আস্তে। বুড়ি সারাদিন তাই খিটখিট করেন। নিজের যা গয়না ছিল সেগুলো অনেক দিন আগেই গেছে। বউয়েরগুলো ছেলে নিচ্ছে। তাই এবার হাত পড়েছে বাসনের বাক্সে। ভারী ভারী সব গামলা, ঘড়া বিক্রি চলছে। এগুলো গেলে আর কিছু থাকবে না তাঁর আমলের। পাছে পোয়াতি বউয়ের অভুক্ত মুখটা দেখতে হয় তাই বুড়ি গিয়ে শুলো ওপরের বারান্দার ঘরে। আর এদিকে ইন্দুবালা আসন পেতে কাঁসার থালায়, বাটিতে সাজিয়ে দিলেন নিজের খাবারটুকু। পরম আদরে খাওয়ালেন ভাইকে। খুব ছোট্ট থেকেই ছেলেটা বড্ড আস্তে আস্তে খায়। তার খাওয়া নিয়েও ছিল নানান ঝামেলা। এটা খাবো না। ওটা খাবো না। মা বড় বড় দলা করে ভাতের গ্রাস গালের মধ্যে পুড়ে দিতেন। ঠাম্মা ওদিক থেকে চিৎকার করতো, “ও বউমা করো কী? মেরে ফেলবে নাকি দুধের বাচ্চাটাকে?” আর একটু বড় হলে এক থালায় ভাত নিয়ে স্কুলে যাওয়ার আগে ইন্দুবালা আর তার ভাই খেয়ে নিত। ভাইকে খাওয়াতে বড় ভালো লাগতো তাঁর। ছোটো ছোটো দাঁতগুলো আঙুলে ঠেকতেই কেমন যেন সুড়সুড় করে উঠতো হাত। সেই ভাই কী পরিপাটি করে আজ নিজে নিজেই খাচ্ছে। বসার ভঙ্গীটাও ঠিক বাবার মতো। বাবু হয়ে, সামনের দিকে মাথাটা বেশ খানিকটা ঝুঁকিয়ে। খাওয়ার সময় বাবা কথা বলতো না একটুও। ভাইও না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্দুবালা। যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হয়। ভাইয়ের মধ্যে ইন্দুবালা কাকে খুঁজছিলেন সেদিন? বাবাকে? মনিরুলকে? নাকি নিজের ফেলে আসা অতীতকে? চলে যেতে চেয়েছিল ভাই সেদিনই। কলেজ স্ট্রিট। সেখান থেকে কোনো এক বন্ধুর বাড়ি। এখানে আবার তোর বন্ধু হলো কী করে?” সন্দেহ হয়েছিল ইন্দুবালার। “বল থাকতে ভালো লাগছে না দিদির বাড়ি। আদর যত্ন হচ্ছে না একটুও।” ভাই মিটিমিটি হেসেছিল। “তুইও দেখছি কলকাতার মতো কথা বলতে শিখে গেছিস দিদি”। সেদিন ভাইয়ের আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বরং বলা ভালো যেতে দেননি ভাইকে ইন্দুবালা। “একটু ঘুমিয়ে নে ভাই। তারপরে বিকেলে না হয় কলেজ স্ট্রিটের দিকে বেরোস। চিনতে পারবি তো রাস্তা”। ভাই যতক্ষণ না ঘুমিয়ে পড়ে ইন্দুবালা ঠায় বসে থাকেন তার মাথার কাছে। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করেন। অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু কিছুই জানা হয় না। একটু কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত ভাই। দিদির কোলের কাছে তার মাথাটা। চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে কপালে। ঘুমিয়ে থাকা মুখের প্রশান্তি বড় ভালো লাগে ইন্দুবালার। এই প্রশান্তি কি তিনি দেখেননি স্বর্ণলতার মুখেও? পুকুরে ভাসছিল দেহটা। বউ সাজার বড় শখ ছিল তার। রিয়াজও ভালোবাসতো মেয়েটাকে খুব। স্বর্ণলতার ফুলে ওঠা দেহটাকে জল থেকে তোলা হয়েছিল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখটায়। বন্ধ করা চোখ দুটোয় ছিল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার শান্তি। ঠোঁটের কোনায় ছিল এক টুকরো হাসি। যেন জলের তলা থেকে ঘুমন্ত রাজকন্যেকে তোলা হলো এক্ষুনি। কথা ছিল রিয়াজ দাঁড়িয়ে থাকবে খেয়া ঘাটে। রাতের নৌকা তাদের পার করে দেবে সভ্য জনপদ। দূরে কোথাও তারা ভালোবাসার জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নেবে। যেখানে কেউ তাদের চেনে না। জানে না। ধর্মের পরিচয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে না। স্বর্ণলতা ঠিক পে ছৈছিল সময়েই। খেয়াও ছিল ঘাটে বাঁধা। শুধু রিয়াজ আসেনি। অনেক ভোরে আকাশ যখন সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে স্বর্ণলতা রিয়াজকে পেয়েছিল ধানক্ষেতের আলের ধারে। রিয়াজের কাছে সব কিছুই ছিল শুধু প্রাণটুকু ছাড়া। কারা যেন তার শ্বাসনালিটা কেটে দিয়েছিল এফোঁড় ওফোঁড় করে। এত রাগ ছিল তাদের রিয়াজের ওপরে, জানে মেরেও শান্তি পায়নি তারা। কুপিয়ে রেখে গিয়েছিল দেহটাকে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে স্বর্ণলতার তখন কান্নায়, দুঃখে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোথায় লুকোবে সে? যেখানেই যাবে ভালোবাসাহীন মানুষগুলো তাকে কুরে কুরে খাবে। তাই ডুব সাঁতার দিয়েছিল সে জলে। যখন ভেসে উঠেছিল তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। জালের মধ্যে ঘুমন্ত রাজকন্যেকে দেখার জন্য আশেপাশের গাঁ থেকে ভিড় করে এসেছিল মানুষ। খবরটা প্রথমে এনেছিল মনিরুল। ইন্দুকে বলার পর ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল মেয়েটা। সেদিনও যে সৰ্বর্ণলতা স্বপ্ন দেখতো সংসারের। রিয়াজের সাথে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে কোথাও। বলেছিল চিঠি দেবে ইন্দুকে। সংসার সাজিয়ে তার খুঁটি-নাটি নিয়ে লিখবে অনেক কথা। পুণ্যি পুকুর ব্রত করতে গিয়ে বিড়বিড় করে মানত করতে স্বর্ণলতা। রিয়াজের সাথে সংসার যেন হয় তার। কেউ কথা শোনেনি মেয়েটার। এমনকি ঈশ্বরও না। এর আগে কোনোদিন মনিরুল ইন্দুকে কাঁদতে দেখেনি। যদিও প্রথম চিঠিটা ততদিনে দেওয়া হয়ে গেছে দুজনের। সেখানে ভালোবাসার কথা কোথাও লেখা ছিল না। ছিল শুধু বাংলার মাঠ ঘাট সবজেটে রঙের জীবনের কথা। ছিল এক দিন দেখা না হলে অন্যদিনের অনেক না বলা দুঃখ, মন কেমনের কথা। সেটাই কি ভালোবাসা নয়? ছটফট করে ওঠেন ইন্দুবালা। তাহলে কি এতক্ষণ ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি মনিরুলের কথাই চিন্তা করছিলেন? উঠে পড়েন। পেটের ভেতর থেকে লাথি মারছে বাচ্চাটা। যেমন খিদে পেয়েছে তার মায়ের। তেমনি তারও। রান্নাঘরে এসে দেখেন চাল বাড়ন্ত। ভাত বসাবেন তার যোগাড়টুকু নেই। এই এত বেলায় কী খাবেন? নজরে পড়লো বেতের ঝুড়ি শালপাতায় মোড়া। ভাই এনেছে। তাকে এতক্ষণ যত্ন-আত্তি করতে গিয়ে সেদিকে নজরও পড়েনি। ভুলেই গিয়েছিলেন ইন্দুবালা। শালপাতায় বাঁধা টুকরিটা খুললেন। তার মধ্যে থরে থরে সাজানো আছে মালপোয়া। চোখ ফেটে জল এলো ইন্দুবালার। গোগ্রাসে খেতে থাকলেন তিনি। যেন কত জন্মের খিদে নিয়ে দাদু ঢুকে পড়েছেন তাঁর পেটে। ঠাম্মার হাতে না হোক গাঁয়ের ভোলা ময়রার দোকানের মালপোয়া খেতে চাইছে গোটা শরীর তোলপাড় করে। অনেকটা খাওয়ার পর যখন থামলেন ইন্দুবালা তখন জলতেষ্টা পেয়েছে খুব। কিন্ত জল গড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই হাতের কাছে। শুনেছিলেন ঠাম্মাকেও শেষ সময়ে জল খাওয়াতে পারেনি কেউ। গড়িয়ে পড়েছিল গালের পাশ দিয়ে সব জলটুকু। ঠিক তখনই সেই মুহর্তে বুক ছাপিয়ে, গলা কাঁপিয়ে কান্না পেলো ইন্দুবালার মৃত ঠাম্মার জন্য। পায়ের তলায় গোটা পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠলো হঠাৎ। চোখে অন্ধকার দেখলেন। যা খেয়েছিলেন উগড়ে দিলেন সব। রান্নাঘর ভেসে গেল সাধ না-খাওয়া নতুন মায়ের বমিতে। 

দরজা খোলার শব্দ পেলেন ইন্দুবালা। ধনঞ্জয় ঘর ঝাঁট দিতে এসেছে। নীচের রান্নাঘরে উনুনের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। “বাজার কিন্তু কিচ্ছুটি করা নেই মা। কী রান্না হবে?” ধনঞ্জয় জানতে চায়। ইন্দুবালা চুপ করে থাকেন। “কী গো বলল কিছু? শরীর খারাপ নাকি তোমার?” ইন্দুবালা তখন উনুনের ধোঁয়া দেখছেন। জানলার বাইরে সেই ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠছে। বাজারের লোকেরা এসে বলেছিল, “নিমতলার ইলেকট্রিক চুল্লীতে কাজ চলছে মা। বডি কাঠে পোড়াতে হবে।” তখনও শ্মশানে স্বামীর খাট ছুঁয়ে বসে আছেন ইন্দুবালা। দূরে লছমী ছেলে-মেয়েদের সামলাচ্ছে। “তোমরা যা ভালো বোঝো করো।” এইটুকুই বলতে পেরেছিলেন তিনি। মাস্টার রতনলাল মল্লিকের দেহ যখন চিতায় তোলা হলো তখনও ইন্দুবালা আঁচ করতে পারেননি কাঠে পোড়ানোর বীভৎসতা। মনের মানুষ ছিলেন না কোনোদিনই মাস্টার। কিন্তু যে মানুষটা চারপাশে ঘুরে বেড়াতো, এদিক ওদিক থেকে যন্ত্রণা দিতে; সময় নেই অসময় নেই ঘাড়ের ওপর চেপে বসতো; জোর করে সরিয়ে দিত শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, সেই মানুষটা আগুন পাওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন চড়বড় করে উঠতে শুরু করলো তেলে পড়া মাছের মতো। শরীর ছুঁড়ে বেড়িয়ে আসতে থাকলো জল। যেন সারা জীবনের হুইস্কি, সোডা এক্ষুনি এই জ্বলন্ত সর্বগ্রাসী চিতাকে নিভিয়ে দেবে। লছমী এসে মুখ ঝামটা দিয়েছিল। “কী করছিস কি এখানে দাঁড়িয়ে তুই? আমাদের কি এসব দেখতে আছে? চল মেয়েটাকে দুধ খাওয়াবি চল। বড় কাঁদছে যে।” শ্মশানের মধ্যে বসে মেয়েকে দুধ খাওয়ালেন। স্বামীর চিতাভস্ম ভাসালেন গঙ্গায়। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসে নিজেই ভাঙলেন শাঁখা পলা সব কিছু। জোরে জোরে ইটের বাড়ি মেরে। সাবান দিয়ে মাথা ঘষে তুলে ফেললেন সিঁদুর। সাদা থান পরে নিজেকে যখন দেখলেন আয়নায় আর সামলাতে পারলেন না। হাউ হাউ করে চিৎকার করে কাঁদলেন ইন্দুবালা। সে শোক মাস্টার রতনলাল মল্লিকের জন্য নয়। মনিরুলের জন্য নয়। নিজের মুখটায় তিনি অবিকল ঠাম্মাকে দেখতে পেলেন। 

ইন্দুবালা পাশ ফিরে শুয়ে ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “উনুন ধরিয়েছিস কেন? গ্যাস কি ফুরিয়েছে?” ধনঞ্জয় হাতের ঝাঁটাখানা মেঝেতে রেখে বলে “ওই দেখো। আজকের দিনটা কি ভুলে গেলে মা তুমি?” ইন্দুবালা হাতড়াতে থাকেন মনের মধ্যে। “আজকে আবার কী?” ধনঞ্জয় মাথায় হাত দিয়ে বলে “সত্যি এবার তোমার বয়েস হয়েছে মা। আজ যে রথ। কুমোরটুলিতে দুর্গার কাঠামোয় মাটি পড়বে। ইস্কনের লম্বা রথ বেরোবে। কত সাহেব সুবো নাচানাচি করবে। হোটেলের বোর্ডে তো গতকাল লিখে রেখেছো…।” উঠে পড়েন ইন্দুবালা এবার তাড়াতাড়ি করে। “কী লিখেছি রে?” ধনঞ্জয় উত্তর দেয়, “খিচুড়ি, পাঁপড় ভাজা, আনারসের চাটনি আর কাঁঠালের ক্ষীর”। বিড়বিড় করে জানতে চান ইন্দুবালা, “আর মালপোয়া? লিখিনি সেটা?” ধনঞ্জয় রে রে করে ওঠে। “না না ওইসব একদম কিছু লেখা ছিল না। হাঙ্গামা বাধিও না মা। চিনির দাম বড় বেড়েছে। আটা বাড়ন্ত। ময়দা বাড়ন্ত। গোল মরিচ আনা নেই।” ইন্দুবালা জানতে চান “আর মৌরি?” ধনঞ্জয়ের জবাবে জানা যায় সেটাও বাড়ন্ত। তাহলে সব কিছু এখনি আনতে হবে ফর্দ করে। ইন্দুবালা পাশ থেকে চশমা নেন। পেন খাতা নিয়ে বসে পড়েন ফর্দ করতে। আর একটু হলে কী মারাত্মক ভুলটাই না করতেন তিনি! মালপোয়া হবে না রথে তাও কি হয়? খাটনির বহরটার কথা একবার চিন্তা করে চিরকালের অভ্যেস মতো ধনঞ্জয় আবার কাকে যেন একটা গাল পাড়ে। সেই অদৃশ্য মানুষটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে ইন্দুবালার। যে ধনঞ্জয়ের গাল শুনেও মুখে রাটি কাটে না। 

অনেক রাতে কলেজ স্ট্রিট পাড়া ঘুরে বাড়ি ফিরে আসে ভাই। হাতে তার একখানি চটি বই। তিন পাহাড়ের স্বপ্ন। “বেড়াতে যাওয়ার বই বুঝি?” ইন্দুবালা জানতে চান। ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। “ধুর বেড়াতে যাওয়ার বই কেন হবে? খুলে দেখলেই বুঝতে পারবি”। এগিয়ে দেয় বইটা। ইন্দুবালা অবাক হন। “কবিতা পড়িস নাকি তুই আজকাল”? ঘাড় নাড়ে ভাই। “পড়ি তো। তুই আর মনিরুলদা যেমন পড়তিস”। কথা বাড়াতে চান না ইন্দুবালা। এরপর কথা বললে আরও অনেক কথা উঠবে। সেই কথা মনের মধ্যে হাওয়ার সাথে উথাল পাথাল হলে রাতে ঘুম হবে না। এই ভরো ভরো অবস্থায় মাস্টার রতনলাল মল্লিক তখন ঘুম না আসা বউকে আঁকড়ে ধরতে চাইবেন। দম বন্ধ হয়ে আসবে ইন্দুবালার। মাটিতে এখন তাই বিছানা। শরীরটাকে কোনোরকমে আড়াল করার চেষ্টা। “ওপরের ঘরে একা শুতে তোর ভয় করবে না তো?” অবাক হয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকায় ভাই। একদম মনিরুল যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ সরিয়ে নেন ইন্দুবালা। “ভয় করবে কেন? আমি তো এখন বাড়িতে একাই শুই মাঝের ঘরটায়। ঠাম্মার ঘরটা তো বন্ধই থাকে।” ইন্দুবালা জানতে চান, “ভয় করে না তোর?” ভাই বলে “ধুস…। ভয় করবে কেন? আমি কি এখনও ছোটো আছি নাকি?” ইন্দুবালা আদর করে ভাইয়ের নাক টিপে দেন। “থাক তোর আর বড় হয়ে কাজ নেই। দিদির সাথে কেমন আবার নাক ফুলিয়ে ফুলিয়ে কথা বলে।” ইন্দুবালার যখন বিয়ে হয় তখন ভাই তাঁর কাছে শুতে। জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে। কতটুকুনি ছিল তখন। মাঝে মাঝে ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যেত ঠাণ্ডায় শীত করতে বলে। উঠে দেখতেন গোটা খাট ভিজিয়ে ফেলেছে ভাই হিসি করে। সেগুলো সব আবার কাঁচতে হতো। শুকোতে হতো। ঠাম্মা মাকে বলতো, “দেখেছে বউমা আমার ইন্দু কেমন সব কিছু শিখে যাচ্ছে চটপট করে। একটা বাচ্চা মানুষ করা কি চাড়িখানি কথা দিদিভাই। মা যখন হবি বুঝবি”। ইন্দুবালা সেটা বুঝেছিলেন খুব কষ্ট করে। নিজেকে তার জন্যে তৈরী করেছিলেন আগাগোড়া। মা, ঠাম্মা শিখিয়েছিল সব হাতে ধরে। তাই এতো অভাবের সংসারেও মানিয়ে নিতে অসুবিধে হয়নি ইন্দুবালার। নতুন বউয়ের গলা পর্যন্ত শুনতে পেত না কেউ। ভাই আসায় কত দিন পরে যে এত কথা বলছেন ইন্দুবালা। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছেন তাই। “আর একদিন থেকে যা না…” মাথা নাড়ে ভাই। “নারে, এবার হবে না দিদি। কয়েক দিন পরেই পরীক্ষা। না গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আবার বাবার শরীরটাও..”। থেমে যায় ভাই। ইন্দুবালা জানেন তাঁর বাবার শরীর ভালো না। মাঝে মাঝে জ্বর হয়। কাশি হয়। মা লিখেছে কাশির সাথে রক্ত ওঠে। ভাই ঘুমিয়ে পড়ে। ইন্দুবালা টেনে নেন পাশে রাখা চটি বইখানা। কবে থেকে কবিতা পড়তে শুরু করলো তাঁর ভাই? ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ বইটার লেখক কে যেন এক বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এর কথাই বা সে জানলো কী করে? কলেজস্ট্রিটে গিয়ে একা একা কাদের সাথে যেন সে দেখা করেছে। মায়ের চিঠিতে জানতে পেরেছে ভাই আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছে নানা রাজনৈতিক কার্যকলাপে। ছোটো ছোটো দলে তারা নাকি ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে, জঙ্গলে। ভেবেছিলেন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইবেন সব। কিন্তু সময় পেলেন আর কোথায়? বইটাকে হাতে পেয়ে গন্ধ শুঁকলেন ইন্দুবালা। নতুন বইয়ের গন্ধ। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কোনো বইয়ের মুখ তিনি দেখেননি। এতবড় বাড়িতে কেবলমাত্র পাঁজি, লক্ষ্মীর পাঁচালি, নারায়ণের অষ্টোত্তর শত নাম আর গীতা ছাড়া কোনো বই নেই। কবিতার বই তো দূর অস্ত। বইটাকে একটু উলটে পালটে দেখতে ইচ্ছে করলো ইন্দুবালার। আর ঠিক তখনই ডাক পড়লো তাঁর। মাস্টার রতনলাল মল্লিক অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় অপেক্ষা করছেন যে। 

ইন্দুবালার শরীর বেয়ে পেঁচিয়ে উঠছে আরও একটা শরীর। বিষধর ফণা তুলে গ্রাস করছে যেন সে। মাস্টার রতনলাল মল্লিক বিছানার ওপরে তার পোয়াতি বউটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে তখন। বন্ধ হয়ে আসছে ইন্দুবালার শ্বাস প্রশ্বাস। পেটের ভেতরে দংশিত হয়ে বাচ্চাটা যেন কেঁদে উঠছে বারে বারে। ভাই চিলেকোঠার ঘর থেকে গড়গড় পড়ে চলেছে ছোট্ট চটি বইখানা। 

“ঘুমের মধ্যে শুনতে পেলাম 
শঙ্খ চূড়ের কান্না
‘এ আনন্দ অসহ্য বোন;
দিসনে লো আর, আর না।‘
জেগে উঠলাম; দেখতে পেলাম 
আর না দেবার সুখে
কেয়া ফুলটি ঘুমিয়ে আছে 
বিষধরের বুকে।” 

গলা বুজে আসছে ইন্দুবালার। কান্নায়। ঘেন্নায়। ভোররাতে উঠে ঠাণ্ডা জল মাথায় ঢালেন তিনি। একবার নয় বারবার। তারও অনেক দিন পরে ভাই যখন আর নেই, স্বামী যখন নেই, চারিদিক শূন্য খাঁ খাঁ; অনেক রাতে দরজা ধাক্কিয়ে খেতে এসেছিল কজন। তাদেরই কেউ হয়তো ভুলবশত ফেলে রেখে গিয়েছিল একটা কবিতার বই। পড়ে ফেলেছিলেন ইন্দুবালা কবির নামটা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখন কলকাতায় বোমা। রাস্তায় ঘাটে মৃতদেহের সারি। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েগুলো গঙ্গায় ভাসছে লাশ হয়ে। পরের দিন অনেক রাতে ছেলেটা আবার এসেছিল এক পেট খিদে নিয়ে। হ্যাঁ সেদিনটাও ছিল রথের দিন। মনে আছে ইন্দুবালা পাঁপড় ভেজেছিলেন। হিঙের গন্ধ মাখানো খিচুড়ি হয়েছিল। আর ছিল চুসির পায়েস। প্রথম দিন ইন্দুবালার সাথে অলোকের কোনো কথা হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় দিন অনেক কথা হলো। বইয়ের প্রচ্ছদের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সে একবার নিয়ে আসবে বলেছিল। “ওই শীর্ণকায় উজ্জীবিত কবি আপনাকে দেখলে যে কী বলবেন কমরেড ইন্দুবালা, ভেবেই আমি শিহরিত হচ্ছি…। উনি সবাইকে বলেছেন কবিতা লেখো। ঢেকে ফেল শহরের প্রাচীরগুলো কবিতায়..বিপ্লবে।” অলোক ফিরে আসেনি। কবিও না। কিন্তু বইটা রয়ে গেছে এখনও তাঁর কাছে। মাঝে মাঝে বইটা খুললে অলোক ভেসে আসে। তাকে অনেক দিন না দেখলে কষ্ট পান। ইন্দুবালা। 

.

তাড়াতাড়ি শিল নোড়া পেড়ে ফেলে ধনঞ্জয়। এই বেলা চাল না বেটে রাখলে বুড়ি নিজেই বাটতে শুরু করে দেবে। এই গুচ্ছের লোকের জন্য মালপোয়া বানানো কি মুখের কথা? এরই মধ্যে জলহস্তির ছানাগুলো ঘুরে গেছে। মানে সামনের হোস্টেলের ওই ছেলে মেয়েগুলো। ঠাকুমা দেওয়ালে কী লিখছে দেখতে এসেছে হুড়মুড়িয়ে। “কী গো সব পালটে দিচ্ছো নাকি? শুক্তো ভাত এই সব কিন্তু কিছু খাবো না আজকে”। ছোটো করে ছেলেদের মতো চুল ছাঁটা মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে। ধনঞ্জয়ের মনে হয় ঠাস করে গালে একটা ঠাটিয়ে থাপ্পড় দেয়। শুধু পাকা পাকা কথা। সেদিন আবার গলির মোড়টাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল মেয়েটা। দেখেছে ধনঞ্জয়। ইন্দুবালাকে বলতে এলে নিজেই ধাতানি খেয়েছিল বেশি। “কেন তুমি বিড়ি ফোঁকো না? তাও তো ওরা মনের সুখে দুটো টান দিতে পারে। আমরা কী পেয়েছি জীবনে?” ধনঞ্জয় কথা বাড়ায়নি আর। মাঝে মাঝে চিনতে পারে না ইন্দুবালাকে সে। মা যে কখন কী বলে বোঝা মুশকিল। এদের নিয়ে একটা কথা বলার জো নেই মায়ের কাছে। নিজের মনে গজগজ করে ধনঞ্জয়। বাবুই পাখির বাসার মতো চুল যে ছেলেটার সেটা আরও ধ্যাষ্টা। “কী গো? কী কী চেঞ্জ করছো দেখি?” এগিয়ে আসে সে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ইন্দুবালার কাছে। “তাই বলে কাঁঠাল ক্ষীরটা চেঞ্জ করো না প্লিজ। ওটার যে গল্পটা বলেছিলে সেটা কিন্তু আমি কালকে ফেসবুকে শেয়ার করেছি। ওখান থেকে অনেকে আসবে বলেছে খেতে”। মোটা ছেলেটা এরপর এগিয়ে আসে। খেয়ে খেয়ে একেবারে ঘাড়ে গর্দানে হয়ে গেছে। তাও থামার নাম নেই। “তোরা বড় ছটফট করিস। আগে দেখ না কী লেখে ঠাকুমা। ডিসটার্ব করিস না”। একরাশ ছেলে মেয়ে জড়ো হয় ইন্দুবালার আশেপাশে। সত্তর পেরোনো এক বুড়ি সাত সকালে ভাতের হোটেলের বোর্ডে চক দিয়ে লিখতে থাকে। খিচুড়ি, পাঁপড়ভাজা, আনারসের চাটনি, কাঁঠাল ক্ষীর তার নীচে বড় করে লেখা হয় মালপোয়া। ভিড়টা একসাথে হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে “ইয়া…”। জড়িয়ে ধরে ইন্দুবালাকে ওরা সবাই। কেউ তার মধ্যেই ফেসবুক লাইভ শুরু করে দেয়। “কাল যে আপনাদের কাঁঠাল ক্ষীরের গল্পটা বলেছিলাম আজ তার সাথে ইনক্লড হয়েছে মালপোয়া…”। গজগজ করতে করতে জোরে জোরে চাল বাটে ধনঞ্জয়। কারণ সে জানে এরপর স্নান সেরে এসে রান্নার ধুম পড়বে বুড়ির। একটা নেশার মধ্যে থাকবে সেই দুপুর পর্যন্ত। যতক্ষণ না শেষ রান্নাটুকু হয়, যতক্ষণ না শেষ মানুষটা খেয়ে চলে যায় হোটেল থেকে। 

.

নতুন সাইকেল কিনেছে মনিরুল। সেটা দেখাতে এসেছিল। ইন্দু জানে এটা একটা অছিলা। আসলে তারা আজ যাবে মোক্তার পাড়ায় রথের মেলায়। মাকে কী করে বলবে সে? সাইকেল শেখাটা খুব সহজ মিথ্যের রাস্তা। ছেলে মেয়ে দুটো বাড়ছে যেন তালগাছের মতো। মায়ের মন সায় দিতে চায় না। বাবাও যে পছন্দ করে তেমনটা নয়। কিন্তু কেন কে জানে সেদিন বাবা রাজি হয়ে যায়। “যাবি তো, যা না। সামনের বারে আর একটু বড় ক্লাসে উঠলে ইন্দুকেও কিনে দেবো সাইকেল। তখন দুজনে একসাথে স্কুলে যাবি চালিয়ে”। সে সৌভাগ্য হয়নি ইন্দুবালার। তার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর। স্বর্ণলতার আত্মহত্যা চোখ খুলে দিয়েছিল অনেক মায়ের। তারা কিছুতেই আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখতে চায়নি। বরং আগুনেই মেয়েকে বিসর্জন দিয়েছিল অনেকে। জ্বলে পুড়ে শেষ হয়েছিল মেয়েগুলো। কজন ইন্দুবালা হতে পেরেছিল? যাদের নিয়ে লেখা হয়েছিল খবরের কাগজে? ফেসবুকে? যাদের ঘিরে রেখেছিল অনেক অচেনা মানুষ নিজের মতো করে। সাইকেলের সামনের রডে বসতে লজ্জা করেছিল ইন্দুর। তবুও বসেছিল সে। হাওয়ার মতো উড়ছিল মনিরুলের সাইকেল কপোতাক্ষের তীর ধরে। হাতে হাত ঠেকে যাচ্ছিল দুজনের। শ্বাসে প্রশ্বাসে চরম উত্তেজনা। ওরা কাছ থেকে পাচ্ছিল দুজনের ওম। চোখ বন্ধ করেছিল ইন্দু। সে যেন কাঠের নাগরদোল্লা, ঘোড়ার দোল্লা, বুড়ির চুল, ঝাল ঘুগনি, পাঁপড় ভাজা, এইসব ছাপিয়ে মৌরির গন্ধ পাচ্ছিলো মনিরুলের গা থেকে। যে মৌরির গন্ধ পেয়েছে সে তার ঠাম্মার মালপোয়ায়। ভোলা ময়রার দোকানে। কিংবা তারও অনেক পরে রিভলবার নিয়ে খেতে আসা অলোকের কবিতার বইতে। স্নান সেরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ান ইন্দুবালা। কতদিন পর আজ তিনি মালপোয়া ভাজবেন! তাঁর চোখে মুখেও কি ফুটে উঠছে না এক প্রশান্তি? এটা কি মৃত্যুর বার্তাবহ? মনিরুলের মৃত মুখ তিনি দেখেননি। কিন্তু আন্দাজ করতে পারেন। শুনেছিলেন কলকাতা থেকে গোপনে ফেরত যেতে হয়েছিল তাকে। নিজের মা ছিলেন অসুস্থ। মাকে শেষবারের মতো দেখতে গিয়েছিল মনিরুল। পথে ধরা পড়ে সে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। শেষ পর্যন্ত নাকি লড়েছিল মনিরুল বীরের মতো। একটা ছোট্ট দেশি রিভলবার দিয়ে সে জয় করে নিতে চাইছিল স্বাধীনতার সবটুকু স্বপ্ন। ঝাঁঝরা হয়েছিল তার দেহ গুলির মালায়। আরও দিন তিনেক পরে তাকে পাওয়া গিয়েছিল কপোতাক্ষের চরে। পাশে পড়েছিল তার ব্যাগখানা। তার মধ্যে ছিল হাতের নক্সা ভোলা স্বাধীন বাংলাদেশের একটা জাতীয় পতাকা। যা মনিরুলকে দিয়েছিলেন ইন্দুবালা শেষবার দেখা করার সময়। আর মনিরুল কী দিয়েছিল তাঁকে? আলমারি খোলেন ইন্দুবালা। কাঠের ছোট্ট বাক্স থেকে বের করেন বাঁশিটা। কপোতাক্ষের মাটি মেখেছিল মনিরুল সারা দেহে। স্থির দৃষ্টিতে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল তার নিষ্প্রাণ দেহটা। ঠিক ওখান থেকেই পুব আকাশের জ্বলন্ত সূর্যটা উঠবে। যার আলো ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের দিকে দিকে। যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আজ মনিরুল মৃত। আর ইন্দুবালা? কী স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি? সে কথা কেউ কোনো দিন জানতে চায়নি তাঁর কাছে। আজও না। 

হইচই পড়ে গেছে গোটা অঞ্চল জুড়ে। ছেনু মিত্তির লেনে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে একেই ভিড় লেগে থাকে। আজ যেন আরও বেশি ভিড়। হাফবেলা অফিস করে কালেক্টার অফিসের কেরানিকুল চলে এসেছে খেতে। হোস্টেলের ছেলে-মেয়েগুলো হাজির হয়েছে। তার সাথে নিয়মিত বাজারের খদ্দেররাও আছে। আর আছে কিছু ফ্লাইং কাস্টমার। এর সাথে জুড়েছে রাজ্যের ফেসবুক ফ্রেণ্ডা। চারিদিকে শুধু কচিকাঁচাঁদের কলকলানি। মাথা খারাপ হবার অবস্থা ধনঞ্জয়ের। হোটেলটাও হয়েছে আজ দেখার মতো। যে যেখানে পেরেছে বসে গেছে। আর ধনঞ্জয়ের হয়েছে মুশকিল সে কোনো দিক থেকে কোনোভাবেই কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আজ যেন সব কিছুতেই তার প্রবেশ নিষেধ। ছেলে মেয়েগুলো নিজেরাই হাতে হাতে কাজ করে নিচ্ছে। কেউ জল দিচ্ছে। কেউ ক্যাশ সামলাচ্ছে। কেউ থালা পাতছে। কেউ পরিবেশন করছে। আর রান্নাঘরের দিকে তো যাওয়াই যাচ্ছে না। সেখানে আরও ভিড়। প্রায় সবাই ঝুঁকে পড়েছে তাদের মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে। সেই ছোট্ট স্ক্রিনে ফুলে ফুলে উঠেছে লাল হয়ে যাওয়া মালপোয়াগুলো। বড় ছাঁকনিতে তা সোজা চলে যাচ্ছে চিনির হালকা রসে। মৌরির গন্ধ, গোল মরিচের স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছে মেঘলা শহরের আকাশে বাতাসে। আর এসবের মধ্যে প্রশান্তি মাখা মুখ নিয়ে মালপোয়া ভেজে চলেছেন ইন্দুবালা। না এই মুহূর্তে কোনো মৃত্যুর স্মৃতি তাঁর আশেপাশে নেই। নেই খুলনা..কলাপোতা…ছেনু মিত্তির লেন। শুধু যে মানুষটি আজ উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন শিল্পী। যিনি নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় মেতে উঠেছেন। তাঁর বুড়ো ডালপালাগুলো চারিদিক থেকে যেন শুষে নিচ্ছে তারুণ্যের আস্বাদ। যে স্বাদে রয়ে গেছে নতুন করে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *