মানুষ সুখে-দুঃখে যে ভাবেই থাক, সময় কখনও দাঁড়িয়ে থাকে না। মানুষ অলস কর্মহীন থাকলেও ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে প্রায় অলক্ষ্যেই এগিয়ে চলে। পচা ভাদ্দরের মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে থাকলেও সূর্য ঠিক সময়েই উদয় হয়, অস্ত যায়। শত সহয় মানুষের তর্জন-গর্জন বা চোখের জলে ফুল ফোঁটা মুহূর্তের জন্যও বিলম্বিত হয় না। সর্বত্যাগী উদার সন্ন্যাসীর মত সময় ও প্রকৃতি তাদের আপন সাধনায়, লীলাখেলায় মত্ত।
হঠাৎ একদিন অবলাকান্তের খেয়াল হল, প্রয়াগ ত্যাগ করে আসার পর এই শহরে অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। মন-মেজাজ ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। সব সময় ঐ এক চিন্তা, যে খবর পর স্ত্রী বা ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত জানতে পারেনি এবং ড্রাইভার বা দারোয়ান চাকর-বাকরদের পক্ষেও জানা অসম্ভব, সে খবর বাঙালীটোলায় ছড়িয়ে গেল কী করে? সর্বোপরি এ খবর কালেক্টর সাহেবের কাছে কে বা কারা পৌঁছে দিলেন?
কালেক্টর সাহেব অনুরোধ করলে উনি হাসতে হাসতে স্কুলের জন্য দশ হাজার কেন, বিশ হাজারও দিতে পারতেন কিন্তু এই কেলেঙ্কারী চাপা দেবার জন্য টাকা দিয়েছেন বলেই অবলাকান্তের দুঃখ। মনে বেদনা।
একবার তো উনি ভেবেছিলেন, সবার সামনেই বলবেন, যা করেছি, বেশ করেছি। আমি পুরুষ মানুষ তার উপর জমিদার। এবং স্বাস্থ্যবান ও অত্যন্ত সুদর্শন। সুতরাং যদি কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মহিলা স্বেচ্ছায় তাকে আনন্দদান করেন, তাহলে উনি কেন প্রত্যাখান করবেন?
যাকগে। এসব নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছেন এবং স্কুলের জন্য দশ হাজার টাকা দান করার পর বাঙালীটোলার বাসিন্দাদের ধারণা হয়েছে, সুধাদেবী ও তার হতচ্ছাড়া ডেপুটি স্বামী অবলাকান্তর কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা আত্মসাৎ করার জন্যই এই ধরনের একটা নোংরা গুজব ছড়িয়ে ছিলেন। যাইহোক কালেক্টর সাহেবের অশেষ কৃপায় সব ভাল ভালয় মিটে গেছে। শেষ পর্যন্ত উনি ডেপুটিকেও সাঁওতাল পরগণায় বদলী করে দিয়েছেন। তবুও আর এখানে ভাল লাগছিল না।
কামিনীরঞ্জন মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কাশীর বাঙালীটোলায় একটা বিরাট বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়িটি কারুরই বিক্রির অধিকার নেই। শুধু বসবাস করার অধিকার আছে সব ছেলেমেয়ে ও তাদের বংশধরদের। তীর্থে গেলে দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনরাও এখানে থাকতে পারবেন বলে কামিনীরঞ্জন উইল করে যান। বোধহয় কাশীর এই বাড়ির কথা ভেবেই অবলাকান্তের স্ত্রী বিন্দুবাসিনী দেবী বহুকাল ধরেই বলছিলেন, হ্যাঁগো, মোটরগাড়ি কেনার পর মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য দেওঘর-বৈদ্যনাথধাম যাওয়া ছাড়া আর তো কোথাও যাই না। চলো না, কিছুদিনের জন্য কোন তীর্থে ঘুরে আসি।
উনি একটু থেমেই আবার বলেন, এই ছোট্ট শহরে থাকতে থাকতে সত্যি হাঁপিয়ে উঠেছি।
অবলাকান্ত একটু হাসেন।
হাসছ যে? সত্যি, এই ছোট্ট শহরে কী করে যে এক নাগাড়ে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
সত্যি, অনেক বছর আমরা কোথাও যাই না।
বিন্দুবাসিনীদেবী বলেন, হতচ্ছাড়া শহরে না আছে একটা মন্দির, আছে একটা ভাল রাস্তা বা বেড়াবার জায়গা। তাছাড়া অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধ যে কোন অনুষ্ঠানেই যাই না কেন, সেই বাঙালীটোলার কয়েকটা পরিচিত মুখ ছাড়া একজন নতুন মানুষের মুখও এখানে দেখতে পাই না।
অবলাকান্ত একটু হেসে বলেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এখানে সব উৎসব-অনুষ্ঠানেই একই মানুষগুলোকে সব সময় দেখতে পাওয়া যায়।
এবার বিন্দুবাসিনীদেবী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সব চাইতে বড় কথা ছেলেমেয়েদের ঝামেলা আর সহ্য হচ্ছে না। খুব দূরে কোথাও একলা থাকতে পারলেই বোধহয় একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।
অবলাকান্তও দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলে পারেন না। বলেন, দুটো মেয়েকে বিয়ে দেবার পরও যে এত ঝামেলা সহ্য করতে হবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
তা ঠিক কিন্তু তোমার ছেলেরা যে এক একটি রত্ন তৈরি হয়েছে।
অবলাকান্ত মুখ নিচু করে মাথা নাড়েন, মুখে কিছু বলেন না।
সত্যি, ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এখানে আসার পরই ওঁরা ছেলেমেয়েদের পাদ্রীদের স্কুলে ভর্তি করেন। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জন্যই আলাদা আলাদা গৃহ-শিক্ষক নিয়োগ করলেন কিন্তু কোন ছেলেমেয়েই না নিয়মিত স্কুলে যাবে বা বাড়িতে পড়বে। বড় পাদ্রী নিজে কতবার অবলাকান্তকে বলেছেন, রাজাবাবু, আপনার চিলড্রেনরা বহুত কামাই করে। আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ওরা জমিদার বাড়ির ছেলেমেয়ে এবং আমরা ওদের স্পেশালী ট্রিট করি কিন্তু স্কুলের তো কিছু রুলস আছে।
হা ফাদার, আমি তা বুঝি।
আপনি প্লীজ ওদের বলবেন রেগুলারলি স্কুলে যেতে।
নিশ্চয়ই বলব।
থ্যাঙ্ক ইউ রাজাবাবু।
ওরা স্বামী-স্ত্রী বার বার বলেও কোন ফল হয় না। ছেলেমেয়েরা দুদিন স্কুলে গেলে তিনদিন যায় না। ভাগ্যক্রমে স্কুলে গেলেও মাথা ধরা, পেট কামড়ানোর অজুহাতে অনেকেই অনেক দিন পুরোস্কুল করবে না। গৃহ-শিক্ষকরাও সকাল-সন্ধেয় নিয়মিত আসাযাওয়া করেন, চা-জল খাবার খান কিন্তু তারা অধিকাংশ দিনই ছাত্র-ছাত্রীদের দর্শন পান না।
এইভাবেই বছরের পর বছর কেটেছে। অবলাকান্ত গোপনে গোপনে পাদ্রীদের স্কুলে প্রতি বছর কিছু দানধ্যান করে ছেলেমেয়েদের প্রমোসন ব্যবস্থা করেছেন। কী করবেন? সব ছেলেমেয়ে ফেল করলে ওর সম্মান থাকে কোথায়?
মোহনবাগানের শীল্ড জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বড় ছেলে সূর্যকান্ত অবলাকান্তকে বলল, বাবা, বাঙালীদেব ক্লাব মোহনবাগান সাহেবদের হারিয়ে শীল্ড জয় করেছে, সে খবর জানেন?
শুনেছিলাম বটে।
আমি কলকাতা যাব।
তার সঙ্গে মোহনবাগানের শীল্ড জয়ের কী সম্পর্ক?
ঠিক করেছি আমিও মোহনবাগানে খেলে সাহেবদের হারাব।
জ্যেষ্ঠপুত্রের কথাবার্তার ধরন দেখেই ওঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বলেন, সাহেবদের হারানো কী খুব মহৎ কাজ? নাকি জমিদারবাড়ির ছেলে হয়ে সাহেবদের বিরুদ্ধে খেলা খুব সম্মানজনক?
মিনিটখানেক চুপ করে থাকার পর সূর্যকান্ত বলে, কিন্তু আমি ফাইনালি ঠিক করেছি মোহনবাগানে খেলব।
অবলাকান্ত পুত্রের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে কী সেই খেলা দেখার নেমন্তন্ন করছ? নাকি আমাকেও খেলতে হবে?
না মানে…
কী বলতে চাও, চটপট বল। আমার অনেক কাজ আছে।
আমাকে টাকা দিতে হবে।
কেন?
টাকা না দিলে ওরা আমাকে খেলতে দেবে কেন?
অবলাকান্ত ভুরু কুঞ্চিত করে বড় কুমারকে জিজ্ঞেস করেন, ফুটবল গোল না চৌকো, তা তুমি জানো?
কী যে বলেন আপনি? ফাদার বারোজকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কী দারুণ ফুটবল খেলি।
আচ্ছা?
সূর্যকান্ত বেশ গর্বের সঙ্গেই বলে, হ্যাঁ, উনিই তো আমাকে বলেছেন, আমি মোহনবাগানে চান্স পাবই।
অবলাকান্ত একটু মৃদু হেসে বলেন, বাঃ! বড়ই আনন্দের কথা। এবার উনি নিজেকে দেখিয়ে বলেন, তাহলে এই বাঙালী ফাদারকে বিরক্ত না করে তোমার ঐ সাহেব ফাদারকেই বল টাকাকড়ি দিতে। প্রায় এক নিঃশ্বাসেই উনি বলেন, যাও, বিরক্ত কর না।
হাজার হোক কামিনীরঞ্জনের নাতি। যাও বললেই কী চলে যায়? কত ঝগড়া-বিবাদ চিৎকার-চেঁচামেচি জিনিসপত্র ভাঙাচুরো করে শেষ পর্যন্ত সূর্যকান্ত সত্যি সত্যি হাজার হাজার টাকা নিয়ে কলকাতা গেল। কলকাতায় যাবার পরও শান্তি কী আছে? শেষ পর্যন্ত কেচ্ছা কেলেঙ্কারী!
দ্বিতীয় পুত্র চন্দ্রকান্ত বেশ ভদ্র-সভ্য থাকলেও হঠাৎ একদিন তার মাথায় ভূত চাপল, উনি কবি হবেন। কার কাছ থেকে শুনেছিল, রবিবাবু পদ্মার উপর সুন্দর বাহারী নৌকায় বসে কাব্য রচনা করেন। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিতৃদেবের কাছে আবেদন পেশ করলে, বাবা, আমিও গঙ্গায় চাঁদনী রাতে বোটে বসে কাব্য রচনা করব।
অবলাকান্ত না হেসে পারলেন না। বললেন, অতি সাধু প্রস্তাব কিন্তু বাবা, চাঁদের আলো তো আমাদের বারান্দায়, বাগানেও ছড়িয়ে পড়ে। সে সব জায়গায় বসে কাব্য রচনা হয় না?
তাহলে আর রবিবাবু জোড়াসাঁকোর প্রাসাদ ছেড়ে পদ্মার বুকে ভেসে বেড়াতেন না।
অকাট্য যুক্তি! লুকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তা বাবা কতদিন তুমি গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়াবে?
যতদিন ভাল লাগে।
বাঃ! কিন্তু বাবা, আকাশে তো সব সময় চাঁদ থাকে না। চাঁদমামা পনেরো দিন ডিউটি দিয়ে পনেরো দিন ছুটিতে থাকেন। তখন তুমি কী করবে?
অত ভাবিনি।
অত না ভাবলে তো তোমাকে আমি রবিবাবু তৈরি করতে পারব না।
এবার ভাবী কবিও ফোঁস করে ওঠে। বলে, এই জমিদারীতে আমারও অংশ আছে।…
না, অবলাকান্ত আর সহ্য করতে পারেন না। দপ করে জ্বলে ওঠেন। বলেন, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। গলা টিপলে দুধ বেরুবে আর এরই মধ্যে উনি জমিদারীর অংশ নিয়ে কথা বলছেন।
ভাবী কবি মুহূর্তের মধ্যে অবলাকান্তের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেও কয়েক ঘণ্টা পর স্বয়ং কালেক্টর সাহেবকে নিয়ে ফিরে এল।
ছি, ছি, সে কী কেলেঙ্কারী! বিচক্ষণ কালেক্টর সাহেব পিতা পুত্র দুজনকেই অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন ফল হল না। শেষ পর্যন্ত নগদ বিশ হাজার টাকা, বেশ কিছু জমিজমার দলিল ও যথেষ্ট গহনাপত্র নিয়েই হবু কবি চন্দ্রকান্ত গৃহত্যাগ করলেন।
এখানেই নাটক শেষ হল না। পরদিন ভোরেই সারা বাঙালীটোলার ঘরে ঘরে আগুনের মত খবর ছড়িয়ে পড়ল, রাজবাড়ির গৃহ শিক্ষক আশু লাহিড়ীর মেয়ে লতাকে নিয়ে দ্বিতীয় কুমার সাহেব শহর ছেড়ে উধাও হয়েছে। এ দুঃসংবাদ অবলাকান্তর কানে পৌঁছতেই উনি আশুবাবুকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যা শুনছি তা কি সত্যি?
আজ্ঞে, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ন্যাকামী না করে সোজাসুজি বলুন, আপনার মেয়ে আমার ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে কিনা।
আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না মানে? সারা বাঙালীটোলার মানুষ যে কথা জানে আর আপনি…
আশুবাবু নিজে শিক্ষকতা করলেও ওঁদের বংশের সবাই ওকালতি করেন। জমিদার না হলেও প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক ওঁরা। ছোট খাট যুদ্ধ-বিগ্রহ করার অভ্যাস ভালই আছে। তাই উনি অবলাকান্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, আজ্ঞে বাঙালীটোলায় যে খবর রটেছে, তা ঠিকই কিন্তু আমার মেয়ে আপনার ছেলেকে নিয়ে উধাও হয়নি…
এবার অবলাকান্তর মুখ দিয়ে ইংরাজি গালাগালি বেরোয়, ননসেন্স।
আজ্ঞে আমাকে কথাটা শেষ করতে দিন। আসলে আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়েছে।
অবলাকান্ত অনেক তর্জন-গর্জন করলেও আশুবাবু বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হলেন না। অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে জমিদারবাবুকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ওসব বারেন্দ্র-রাঢ়ী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে লাভ নেই।
কেন? কেন?
ওরা আর হিন্দু নেই। ব্রাহ্ম হয়েই ওরা বিয়ে করেছে।
কথাটা শুনেই শান্তকাল বৈশাখীর মত অবলাকান্ত ফেটে পড়লেন কিন্তু হাতের পাখী বনে উড়ে গেলে কী আর ফিরে আসে?
শুধু সূর্যকান্ত ও চন্দ্রকান্তকে নিয়েই অশান্তি না। অন্য তিন পুত্র ইন্দ্ৰকান্ত, নিশিকান্ত ও শ্রীকান্তকে নিয়েও ওদের স্বামী-স্ত্রীর কম ঝামেলা বা অশান্তি সহ্য করতে হয়নি বা হয় না। এক একটি এক এক অবতার।
সৌখীন ইন্দ্ৰকান্ত যখন প্রথম সঙ্গীত চর্চায় আত্মমগ্ন হল, তখন বিন্দুবাসিনীই স্বামীকে বললেন, ম্যানেজারবাবু বলছিলেন, ওস্তাদজী বলেছেন, তোমার এই ছেলে গান-বাজনায় খুব নাম করবে।
আগে নাম করুক, তারপর বল। অনেক দুঃখে অবলাকান্ত একটু ম্লান হেসে বললেন, তুমি সত্যি রত্নগর্ভা!
এখন যত দোষ, নন্দ ঘোষ। তাই না? তোমার বাপ-ঠাকুর্দারা কী মহাপুরুষ ছিলেন, তা কী ভুলে গেছ? যে বাড়িতে বসে কথা বলছ, সে বাড়িটাও তো তোমার বাপের মেমসাহেব রক্ষিতার।
আঃ! চুপ কর।
দিন এগিয়ে চলে। বছরের পর বছর ঘুরে যায়। প্রিয় শিষ্যের সঙ্গীত বিদ্যায় অভূতপূর্ব উৎসাহ ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে ওস্তাদজী পাত তাড়ি গুটিয়ে রামপুর ফিরে গেছেন। কুমার ইন্দ্ৰকান্ত এখন নিজেই ওস্তাদ। বাঙালীটোলার কিছু রসিক ছোকরা তার একান্ত ভক্ত শিষ্য। রোজ সন্ধ্যেয় আসর বসে, চলে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। তবে খেয়াল-ঠুংরীর চর্চার চাইতে খামখেয়ালী করেই সময় কাটে। ওস্তাদজীর অনুপ্রেরণায় ও সক্রিয় সাহায্যে শিষ্যরাও একটু-আধটু পান করেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চা করতে হলে ওটা নাকি অত্যন্ত জরুরী। বাঙালীটোলায় শিষ্যদের বাড়িতে বাড়িতে চাপা গুঞ্জন, মৃদু প্রতিবাদ, মাঝে মাঝে অশান্তি কিন্তু কোন ফল হয় না। ওস্তাদজীর চাইতে শিষ্যদেরই বেশি উৎসাহ, উদ্দীপনা। কখনও কখনও ওস্তাদজীও শিষ্যদের বাড়িতে হাজির হয়ে নানা রাগ-রাগিণী নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। শিষ্যদের বাড়ির লোকজনও তাতে খুশি হন। না হবার কোন কারণ নেই। ইন্দ্ৰকান্ত যে কখনই খালি হাতে শিষ্যদের বাড়ি যান না। কিছু না হলেও এক ঝুড়ি ল্যাংড়া আর দুআড়াই সের রাজভোগ নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন। সম্ভব হলে আরও অনেক কিছু কিন্তু সেদিন ইন্দ্ৰকান্ত বৃন্দাবন মুখুজ্যের স্ত্রীর হাতে একখানি সুন্দর গরদের শাড়ি তুলে দিতেই উনি অবাক–একি বাবা? হঠাৎ আমাকে গরদের শাড়ি দিচ্ছ কেন? আপনি তো দিনের অর্ধেক সময় পূজার ঘরেই কাটান। তা..ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করে।
কিন্তু তাই বলে এত দামী গরদ?
না, না মাসিমা, এসব কথা বলে লজ্জা দেবেন না। সুধাময়ের মত আমিও তো আপনার এক ছেলে!
আহা হা! কি কথা! বৃন্দাবন-পত্নী আনন্দে গর্বে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কী! বলেন, সে তো একশ বার বাবা। তোমার মত ছেলে পেটে ধরতে পারলে তো ধন্য হয়ে যেতাম।
শুধু সুধাময়ের মা না, সব শিষ্যের মা-রাই এখন ইন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাভক্তি ও ব্যবহারে মুগ্ধ। ওদের সবার বাড়িতেই ইন্দ্রনাথের অবাধ গতি।
…এই যে শোভা, মুকুন্দ আছে?
এমন অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে শোভা চমকে ওঠে। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মুহূর্তের জন্য ইন্দ্ৰকান্তর দিকে তাকিয়ে বলে,
না, দাদা তো নেই।
ইন্দ্ৰকান্ত একটু গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করে বলে, একটু দরকার ছিল। আচ্ছা
আপনি চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, মাকে ডাক দিই।
আবার ওঁকে কষ্ট দেবার কী দরকার? তাছাড়া উনি নিশ্চয়ই কাজকর্মে ব্যস্ত আছেন।
না, না, আপনি বসুন। আমি মাকে ডাকছি। শোভা প্রায় দৌড়ে ভিতরে যায়।
এক মিনেটের মধ্যেই মুকুন্দর মা এসে বলেন, তুমি দাঁড়িয়ে কেন বাবা? আগে বসো।
মুকুন্দ যখন নেই…
সে নেই বলেই তুমি চলে যাবে? আমরা কী কেউ না?
সেই শ্রদ্ধা, বিনয়ের সঙ্গে ইন্দ্ৰকান্ত বলে, আমি তো তা বলিনি মাসিমা।
একটু মিষ্টিমুখ না করেই তুমি চলে যাবে, তাই কী হয়?
আবার মিষ্টিমুখ…
না, তুমি বাবা বসো। এবার উনি মেয়েকে বলেন, শোভা, ইন্দ্রকান্তকে বাতাস কর।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে চলে যান। শোভা ভিতর থেকে ঝালর দেওয়া একখানা হাতপাখা এনে বাস করতেই ইন্দ্ৰকান্ত একটু হেসে বলে, না না, হাওয়া করতে হবে না। তুমি বসো।
শোভা মৃদু প্রতিবাদ করে, না না, শুধু শুধু বসে থাকব কেন?
হ্যাঁ, তুমি শুধু শুধুই বসে থাকবে। আমি তোমাকে দেখব।
আনত নয়নে শোভা বলে, আমাকে আবার কী দেখবেন?
কী দেখব মানে? তোমার মত সুন্দরী মেয়ে এশহরে আর কে আছে?
শুনে আনন্দে গর্বে শোভার বুক ভরে উঠে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় সারা মুখ লাল হয়ে যায়। ওর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না।
ইন্দ্ৰকান্তই আবার কথা বলে, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে। ইচ্ছে করে তোমার সঙ্গে গল্প করি, তোমাকে গান শেখাই…
আমারও গান খুব ভাল লাগে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
বেশ তো, আমি তোমাকে শেখাব।
কিন্তু বাঙালীটোলার কোন মেয়ে তো গান শেখে না। আমি গান শিখলে যদি কিছু বলে?
ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তির মত বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, কী আর বলবে? তুমি তো চুরি করছ না?
না, তা না কিন্তু…
রবিবাবু যদি তার বীরভূমের আশ্রমে মেয়েদের গান শেখাতে পারেন, তাহলে তুমি আমার কাছে গান শিখলে দোষ কী?
অকাট্য যুক্তি।
এক থালা ফল-মিষ্টি নিয়ে মুকুন্দর মা ঘরে ঢুকতেই ইন্দ্ৰকান্ত বলল, মাসিমা, আমি শোভাকে গান শেখালে আপনাদের কোন আপত্তি নেই তো?
প্রস্তাব শুনেই উনি বিস্মিত হন। মুহূর্তের মধ্যে বাঙালীটোলায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে নেন কিন্তু সরাসরি প্রত্যাখ্যান, নাকচ করতে সাহস হয় না। বলেন, সে তো সৌভাগ্যের কথা কিন্তু বাবা, বাঙালীটোলার মানুষদের তো তুমি চেনো…
গান শেখা তো কোন অন্যায় না মাসিমা? তাছাড়া আমি তো কোন পেশাদারী গাইয়ে না।
সে কী আর আমি বুঝি না বাবা! তবু একবার ওর বাবার সঙ্গে কথা বলে নেব।
মেসোমশায়ের মতামত তো নিতেই হবে। তিনি অনুমতি না দিলে তো আমিও শেখাব না।
শোভাই প্রথম, কিন্তু বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই বাঙালীটোলার পাঁচ-ছটি ঘর থেকে হারমোনিয়ামের আওয়াজ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। শিষ্যরা মাঝে মাঝে অনুযোগ করে, ওস্তাদ! তুমি আজকাল আমাদের দিকে নজর দিচ্ছ না।
আমাকে পছন্দ না হলে তোমরা অন্য কোন ভাল ওস্তাদের কাছে শিখতে পারো।
ওরা সবাই এক সঙ্গে প্রতিবাদ করে, না না, ওস্তাদ, তোমার কাছে ছাড়া আর কারুর কাছে আমরা গান শিখব না।
ইন্দ্ৰকান্ত ওদের বিনোদন ব্যবস্থা আরও একটু উন্নত করতেই সব শিষ্যরা চুপ। তাছাড়া ইতিমধ্যে ইন্দ্ৰকান্ত শিষ্যদের নিয়ে মুঙ্গেরের বাঈজীর কাছে গিয়ে সারারাত ধরে ঠুংরী শোনার পর তো শিষ্যরা ওর গোলাম হয়ে গেল।
মেয়েদের গান শেখা নিয়ে বাঙালীটোলায় গুঞ্জন উঠলেও তা বাইরে আত্মপ্রকাশ করল না। তার একমাত্র কারণ ইন্দ্ৰকান্ত। সারা পাড়ার সব বাড়িতেই ওর যাতায়াত, সবার সঙ্গেই ওর ভাব। তাছাড়া গুরুজনদের প্রতি ও সব সময় শ্রদ্ধাশীল ও কথাবার্তায় অত্যন্ত বিনয়ী।
ইন্দ্ৰকান্ত অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলেই সব মেয়েকেই দু-একটা কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত শিখিয়েছিল। ওরা মাঝে মাঝে বুড়ো-বুড়ীদের সেসব গান শোনাত বলে সারা পাড়ায় ইন্দ্ৰকান্তর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেল।
একদিন মলিনা কথায় কথায় বলল, জানেন ইন্দ্ৰকান্তদাদা, সবাই আপনার প্রশংসা করে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মলিনা একটু থেমে বলে, আপনার প্রশংসা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।
কেন?
ও মুখ নিচু করে বলে, তা বলতে পারব না কিন্তু সত্যি আমার ভাল লাগে।
কিন্তু তুমি তো আমার প্রশংসা কর না।
মলিনা মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে বলে, আমি প্রশংসা করলে যে লোকে নানা কথা বলবে!
ন্যাকামি করে ইন্দ্রকান্ত জিজ্ঞেস করে, লোকে আবার কী বলবে?
বলবে মানে সন্দেহ করবে।
কী আবার সন্দেহ করবে?
মলিনা প্রথমে বলতে চায় না কিন্তু ইন্দ্ৰকান্ত কয়েকবার অনুরোধ করার পর অত্যন্ত দ্বিধা ও কুণ্ঠার সঙ্গে বলে, সবাই সন্দেহ করবে আমি আপনাকে ভালবাসি।
এবার ইন্দ্ৰকান্ত একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে খুব চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, কেন, তুমি আমাকে ভালবাসো না?
মলিনা শুধু মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।
ইন্দ্ৰকান্ত সঙ্গে সঙ্গে ডানহাত দিয়ে ওর মুখখানি আলতো করে একটু তুলে ধরে বলে, তোমাকেও আমার খুব ভাল লাগে।
আনন্দে গর্বে কৃতজ্ঞতায় মলিনা প্রায় আত্মহারা হয়ে যায়। মনে মনে একটু ভয়ও হয়, দ্বিধা করে। বলে, আমার মত সামান্য মেয়েকে আপনার কখনও ভাল লাগতে পারে না।
হঠাৎ ইন্দ্ৰকান্ত দুহাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, সত্যি মলিনা, তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে।
সে রাত্রে মলিনা দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। স্বপ্ন দেখে, সানাই বাজছে, রাজবাড়ি আলোয় আলো, কত শত-সহস্র অতিথির আগমন হচ্ছে, অসংখ্য দাস-দাসীর দৌড়াদৌড়ি, স্বয়ং অবলা কান্ত ওকে আশীর্বাদ করছেন, বিন্দুবাসিনী স্নেহচুম্বন দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন।
আরও কত কি ভাবে। রাত কাটতে না কাটতেই সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত তিথি, সেই অনুপম মাধুরী রাত। মদির দৃষ্টিপাতেই কী রোমাঞ্চ! স্পর্শে? আশ্চর্য শিহরণের ঢেউ বয়ে যাবে শরীর দিয়ে।
তারপর?
ধীরে ধীরে, তিলে তিলে মহানন্দে আত্মসমর্পণ। যৌবন-মানস সরোবরে দ্বৈত অবগাহন।
তোমার কী শরীর খারাপ?
মলিনা মাথা নেড়ে বলে, না।
ইন্দ্ৰকান্ত প্রশ্ন করে, তবে তোমাকে দেখে ক্লান্ত লাগছে কেন?
মলিনা মুখ নিচু করে একটু হেসে বলে, কাল সারারাত শুধু আপনার কথাই ভেবেছি। এক মিনিটের জন্যও দুটো চোখের পাতা এক করতে পারিনি।
এবার ইন্দ্ৰকান্ত একটু হেসে বলে, তুমি তো শুধু কাল সারারাত আমার কথা ভেবেছ কিন্তু আমি যে বহু রাত জেগেই তোমার কথা ভাবছি।
সত্যি?
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
না, না, তা কেন বিশ্বাস করব না? কিন্তু
কিন্তু কী?
আমার মত সামান্য মেয়েকে নিয়ে আপনার এত ভাবনা-চিন্তা করা কী ঠিক হচ্ছে?
ইন্দ্ৰকান্ত আবার একটু হেসে বলে, মলিনা, ভালবাসার এই তো বিপদ!
শুধু শ্রবণে বা গন্ধে-স্পর্শে কী কামিনীরঞ্জনের নাতির মন ভরে?
ঘরে ঘরে ইন্দ্ৰকান্তর সঙ্গীত শিক্ষার আসর সত্যি বড় বেশী জমে উঠেছিল কিন্তু হঠাৎ বনবিহারী মুখুজ্যের নাতনী যোগমায়ার সঙ্গে তার সঙ্গীত শিক্ষক ইন্দ্ৰকান্তর বিয়েতে সবাই চমকে উঠলেন। তাছাড়া বিয়ের দুদিনের মধ্যে নবদম্পতি সুদূর রাজপুতানায় চলে যাওয়ায় সারা বাঙালীটোলায় গুঞ্জন উঠল। কেউ কেউ সরাসরি বনবিহারীবাবুকেও জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার হে বনবিহার, হঠাৎ ওদের বিয়ে, হঠাৎ ওদের উধাও হয়ে যাওয়া কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
বনবিহারী গড়গড়া টানতে টানতে বলেন, ওরে বাপু, নাতনীকে দেখে হঠাৎ অবলাকান্তর পছন্দ হল বলেই হঠাৎ বিয়ে হল। এতে আর অবাক হবার কী আছে?
কিন্তু বিয়ের পর পরই ওরা এমন করে শহর ছেড়ে গেল বলেই নানাজনে নানা কথা বলছে।
বনবিহারীবাবু বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, যারা নানা কথা বলাবলি করছে তারা তো জানেন যে রাজপুতানাতেও ওদের অনেক সম্পত্তি আছে। তাছাড়া ওখানে এক ওস্তাদের কাছে নাতজামাই গান শিখবে।
পাড়ার লোকজন এই কৈফিয়ত শুনে ঠিক খুশি হয় না।
বনবিহারীবাবু বলেন, ওরে বাপু, ইন্দ্ৰকান্ত তো আমার নাতনীকে নিয়ে পালিয়ে যায়নি। রীতিমত বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে সাতপাক ঘুরে বিয়ে করেছে।
উনি একটু দম নিয়ে বলেন, আসলে নাতজামাইয়ের প্রতি অনেকেরই লোভ ছিল। আমার নাতনীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে অনেকেই তাই হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরছেন।
বনবিহারীবাবু যাই বলুন না কেন, বাঙালীটোলার সবাই বুঝলেন, কান কেলেঙ্কারী ধামাচাপার জন্যই এমন তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হবার পরই ওরা রাজপুতানা চলে গেছে।
নিশিকান্ত ও শ্রীকান্তকে নিয়েও অবলাকান্ত ও তার স্ত্রী বিন্দু বাসিনীর অশান্তির শেষ নেই। তাই তো কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্তে থাকার আশায় ওরা দুজনে একদিন কাশী যাত্রা করলেন।