সারাটি রাস্তা মহীতোষ চুপ করে রইলেন। সুমিতা শূন্যদৃষ্টিতে দেখছিল দুপুরের ভিড়হীন রাস্তা। আর থেকে থেকে, লুকিয়ে দেখছিল মহীতোষকে। যেন এক মহা দুর্দৈবের পর, নতুন করে আবার সবটুকু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যালোচনা করার সময় এসেছে।
ট্রাম মেডিকেল কলেজ ছাড়াতেই দেখা গেল পুলিশ ভ্যান রয়েছে দাঁড়িয়ে মির্জাপুর স্ট্রিটের মধ্যে। কোমরে রিভলবার খুঁজে দুজন অফিসার দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কোয়ারের রেলিং-এর কাছে। পুলিশবাহিনী রয়েছে একটি আলাদা গাড়িতে। হেলমেট রাইফেল রীতিমতো যুদ্ধের সাজ তাদের সর্বাঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্য রকম অলস চাউনি তাদের চোখে। যেন তন্দ্রালু, অথচ অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে দেখছে স্কোয়ারের দিকে! মুখগুলি ভাবলেশহীন। কেবল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অফিসার দুজনকেই যা একটু বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। সেটাও বুদ্ধি ঠিক নয়, ক্রোধের দীপ্তি। দুজনেই তাকিয়ে আছে স্কোয়ারের ভিড়ের দিকে।
সবই দেখা হয়ে গেল চোখের পলকে স্কোয়ারের ছাত্রছাত্রীদের জটলা। মিটিং হচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কোনও উত্তেজনা নেই। উত্তেজনা যেটুকু, সেটুকু রাইফেল হেলমেটেই সীমাবদ্ধ। এখন আর এ সব দেখে ভয় বিস্ময়, কিছুই হয় না। ট্রাক, ট্যাঙ্ক, কামান, কনভয়ের সারি, সৈন্যবাহিনী পুরনো হয়ে গেছে। গতবছর গোড়ার দিকে সারা কলকাতার অলিতে গলিতে গুলিবৃষ্টি হয়েছে। আগে দাঙ্গা উপলক্ষেও পুলিশ মিলিটারি অবরোধ করে রেখেছিল কলকাতা। এখন মুখ না খুলতেই এরা হাজির হয়।
ভয় নয়, দুর্ভাবনা হচ্ছে। স্কোয়ারের ওই ভিড়ের মধ্যে মেজদি রয়েছে। হয়তো কলেজে এলে, সুমিতাও পায়ে পায়ে চলে যেত ওখানে। কিন্তু এখানে এই চলন্ত ফাঁকা ট্রামে অশেষ বেদনায় নির্বাক দুজনের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া এল ঘনিয়ে। কিছুই বলার নেই। যার জন্যে দুশ্চিন্তা, সেই মেজদিকে ডেকে আনা যাবে না কোনওক্রমেই।
তারপর বাগবাজারের মোড়ে নেমে দুজন হেঁটে এসে দাঁড়াল সেই বাড়িটির সামনে। আজ আর মহীতোষ কোথাও যাবার জায়গা খুঁজে পাননি, এ বাড়ি ছাড়া। সুমিতা আরও কয়েক বার এসেছে এ বাড়িতে।
এখানে কলকাতার আর এক রূপ, আর এক রস, আর এক গন্ধ। গত শতাব্দীর নির্জীব ভাঙা জীর্ণ কলকাতা বুড়ো চোখে তাকিয়ে আছে এখানে। দক্ষিণের নতুন কলকাতা এখানে এসে করুণা ও বিতৃষ্ণা বোধ করে। কেমন যেন হতশ্রী, রূঢ় এখানকার পরিবেশ। এখানকার বাড়ি, এখানকার রাস্তা, দোকানপাট, লোজন, রকের আড্ডা, ভ্রাম্যমাণ ষাঁঢ়, সবকিছুর মধ্যে একটি ভিন্ন চরিত্রের ছাপ রয়েছে। অন্তত তার বাইরের বেশ দেখে তাই মনে হয়। এখানে মানুষ বাস করে চেঁচিয়ে হেঁকে ডেকে। পুরনো বাঙালির আস্তানা এখানে। অথচ শহুরে জীবনের বাঁধনটি আছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
এখানেই মানুষ হয়েছে মহীতোষ, এ পাড়াতেই বড় হয়েছে। যে বাড়িতে ঢুকবেন, জন্মেছেনও সেই বাড়িতেই। তবে সে বাড়ি এ বাড়িতে এখন অনেক তফাত হয়ে গেছে। তখন এত নতুন ছোট ছোট ঘর উঠে ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি, এত লোকের বাস ছিল না। এখন দিনের বেলায় আলো জ্বালিয়ে না রাখলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায় না। নীচের উঠোনটার দিকে তাকাতেও ভয় করে। প্রচুর ভাড়াটের ভিড়। তাদের ব্যবহৃত সমস্ত জল দিনরাত্রি অন্ধকার উঠোনটিকে ভয়াবহ রকম পিছল করে রেখেছে। তেতলার ঘেরাও থেকে এখানে আলোটুকু এসে পৌঁছুবার আগেই অন্ধকার জাঁকিয়ে বসে মুখ ভেংচায় আকাশটাকে। অনেক লোক, তাই অনেক গণ্ডগোল, চিৎকার। সবসময়েই ভিড়ের মধ্যে বাস।
বাড়ির মালিক যারা, মহীতোষের ভাইপো, তারা থাকে তেতলায়। তারা এ সব ভিড়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আছে অনেকখানি। সেটুকু সহ্য করতে হয়, সেটুকু আয়ের কথা চিন্তা করে করতেই হয়। সব মিলিয়ে মাসে তিনশো টাকা ভাড়া পায়।
সুমিতা ভেবে পায় না, মানুষের নিজের এত বড় বাড়ি থাকতে কেন তারা আকাশের টংএ পায়রার খোপের মধ্যে থাকে গাদাগাদি করে।
দুজনে তেতলায় এসে দাঁড়াতেই একটি বছর দশেকের ছেলে উঠল চিৎকার করে, ঠাকমা, বালিগঞ্জের দাদু এসেছে।
বলেই, খালি গা ছেলেটি চকিতে একবার বাপ-মেয়েকে দেখে উধাও হল। মহীতোষের মৃত দাদার বড় ছেলে নবগোপাল আর রামগোপালের ছেলেমেয়েদের কাছে বালিগঞ্জের দাদু বলেই তাঁর পরিচয়। আশেপাশে নড়বার জায়গা নেই। রেলিং-এ, বারান্দায়, সর্বত্র কাপড় কাঁথা শুকোচ্ছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুখদা। মহীতোষের বউঠান, সুমিতার জ্যাঠাইমা। বয়স প্রায় মহীতোষের মতোই। দু-এক বছর বেশিও হতে পারে। দেখায় আরও বুড়ি। কিন্তু এখনও বেশ চলাফেরা করতে পারেন। ছ্যাঁচা পানের দলা মুখে পুরে, বলিরেখাবহুল ঠোঁটের কষ রেখেছেন রক্তাক্ত করে। একটু চাপা গলাতেই বললেন, কী ভাগ্যি। ঠাকুরপো যে, একেবারে মেয়ে নিয়ে। এসো ভাই, এসো।
সুমিতার বড় অদ্ভুত লাগে বাবা আর জ্যাঠাইমার এই সম্পর্ক। বাবার সঙ্গে বড়দি মেজদির যেমন বন্ধুত্ব আছে, এখানে ঠিক তেমনটি নয়। তবু যেন জ্যাঠাইমার সঙ্গে বাবার কেমন এক রকমের একটি বন্ধুত্ব আছে।
জ্যাঠাইমার চাপা গলা শুনে বাবা একটু বিস্মিত হলেন মনে মনে। বললেন, এসে তোমাদের বিব্রত করলুম না তো বউঠান?
জ্যাঠাইমা ওঁর কুঞ্চিত গাল কাঁপিয়ে, ঘোলা চোখদুটি কুঁচকে বললেন, ও মা! কী যে সাহেবিপনা কর ঠাকুরপো। ঘরের ছেলে ঘরে আসবে, তার আবার ও সব কী বলছ।
কিন্তু বাবার মুখের বেদনা-ভার-গাম্ভীর্য জ্যাঠাইমা তাকিয়ে দেখেননি এখনও। সুমিতার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আয়রে, আয়। কী নাম বাপু তোদের, আমার আবার মনেও থাকে না।
অন্যদিন হলে মহীতোষ জবাব দিতেন, নেহাতই বাংলা নাম বউঠান। সুজাতা, সুগতা, সুমিতা।
কিন্তু আজ কিছু বললেন না। সুমিতার হঠাৎ মনে পড়ে গেল অনেক দিন আগের একটি ঘটনা। প্রায় দু বছর আগের কথা। কলকাতায় ফিরে বাবা বড়দি মেজদি আর ওকে নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়িতে। বড়দি মেজদিকে শিখিয়ে রেখেছিলেন জ্যাঠাইমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। তখন সুমিতা অনেক ছোট। ইচ্ছে হয়েছিল, বড়দি মেজদিকে নকল করে প্রণাম করবে জ্যাঠাইমাকে। কিন্তু সেরকম কোনও অনুমতি বা নির্দেশ ছিল না ওর প্রতি।
এ বাড়িতে ঢুকলে যেমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তেমনি মানুষগুলিকেও খুব একটা নিজের বলে ভাবতে পারে না সুমিতা। সবাইকেই কেমন যেন একটু গায়ে পড়া গায়ে পড়া লাগে। পরিচয়ের অপেক্ষা না করেই ছেলেমেয়েগুলি কাছ ঘেঁষে আসে ওর। সুমিতার সামনেই হয়তো সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনা আরম্ভ করে দেয় বাড়ির লোকেরা। ছেলেমেয়েরা চেঁচিয়ে খেতে চায়, ঝগড়া করে। বাপ মা ছাড়া বাকি সবাইকে করে তুইতোকারি। কেমন যেন অভব্য রুক্ষ বেয়াড়া মনে হয় সবাইকে। তবু কী মনে হল, সুমিতা আজ হঠাৎ ওর জ্যাঠাইমাকে একটি প্রণাম করে বসল।
জ্যাঠাইমা একটু চমকে উঠে পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন, আহা, মা আমার সোনা মানিক! এসো মা, এসো।
মহীতোষও এক মুহূর্তের জন্যে কেমন বিমূঢ় হয়ে গেলেন। ভাবতেই পারেননি, রুমনি এমন একটি কীর্তি করে বসবে। সেই লজ্জাতেই সুমিতা বাবার দিকে আর তাকাতেই পারলে না। কিন্তু জ্যাঠাইমার আহা, সোনা মানিক শুনে হঠাৎ যেন জল এসে পড়ল ওর চোখ ফেটে। বুকের মধ্যে উঠল টনটনিয়ে। জ্যাঠাইমার এই সুরের মধ্যে কী যেন আছে, যা এ বাড়ির এই পরিবেশ ও জীবনধারণের উর্ধ্বে একটি মায়ার সঞ্চার করে রেখেছে। অন্যদিন হলে এ কথা শুনে হয়তো হেসেই ফেলত সুমিতা। বড়দি মেজদিরও হাসি পেয়েছিল একদিন। কিন্তু আজ ওর নিজের ঘরের অন্ধকার থেকে এসে, এই স্নেহ আপ্যায়নের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল যেন। কতকাল ধরে যেন এই অপরিচিত আদরের তৃষ্ণা ছিল বুকে।
অথচ এ ব্যাপারের জন্যে একটুও তৈরি হয়ে আসেনি। হঠাৎ ওর ছ বছরের একটি নিরুদ্ধ আকাঙ্ক্ষার শোধ নিয়ে নিল এমনি করে। শুধু এইটুকু বুঝল না, ওকে এমনি করে প্রণাম করতে দেখে, অনেক বেদনার মধ্যেও বাবা কতখানি বিচলিত হয়ে উঠলেন। সেটুকু বিরক্ত নয়, রাগও নয়, ছোট মেয়েটির জন্যে হঠাৎ বাবার মন চিন্তা ব্যাকুল হয়ে উঠল। কী হয়েছে রুমনিটার!
তারপর ঘরের মধ্যে। কী ঘর! তেতলার ঘর, তবু যেন অন্ধপুরী। তিনটি এমনি ছোট ছোট ঘর। ছোট বড় নিয়ে পনেরোটি মানুষ থাকে। তেলচিটে তোশক গুটানো। ছেলেমেয়েগুলি খালি তক্তপোশে মেঝেয় ছুটোছুটি গড়াগড়ি করে। বিছানা-মাদুরগুলি ময়লা শ্রীহীন। দু-তিনখানা চেয়ার ছড়ানো এদিকে ওদিকে। ছেলেপুলেরাই কখন টানাহেঁচড়া করে রেখে দিয়েছে। আয়না আছে, টেবিল আছে। সবকিছুই যেন কী রকম। এ সব দেখে বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা যখন বিরক্ত হয়, মেয়েরা বলে, তা কী করা যাবে। ছেলেমেয়ের ঘর কত সাজিয়ে রাখা যায়।
মহীতোষ এখানে এসে অবশ্য সংকোচ না করারই চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন, যেখানে হোক এক জায়গায় বসে সুখদার সঙ্গে দু-চারটি কথা বলতে।
সুখদা বললেন তেমনি একটু চাপা গলায়, বসো ভাই ঠাকুরপো, একটু পা ছড়িয়ে তক্তাপোশে বসো।
সুমিতাকে বললেন, তুই একটা চেয়ার টেয়ার টেনে বোস মা।
এ ঘরের থেকে পাশের ঘরে যাওয়ার দরজায় একরাশ ছেলেমেয়ে রয়েছে ভিড় করে। সঙ্গে নবগোপালের স্কুলাঙ্গী স্ত্রীও রয়েছেন। অর্থাৎ সুমিতার বউদি। মহীতোষকে দেখেই, একটু ঘোমটা টেনে এসে প্রণাম করল। মহীতোষ এখন এ সব বিষয়ে একটু বিব্রতই বোধ করেন। তাড়াতাড়ি নিজেও কপালে হাতটি ঠেকিয়ে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা—
এ বেলা আর সুমিতার খেয়াল নেই যে, প্রণাম করলে, গুরুজন সবাইকেই প্রণাম করতে হয়। সেটাই রীতি।
পাশের ঘরে পুরুষের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। বড় ছেলে নবগোপালের কণ্ঠই বিশেষ করে। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত উৎকর্ণ থেকে সুখদা ওঁর লোলচর্ম গালে একটি অপূর্ব হাসি ফুটিয়ে মহীতোষের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। ফিসফিস করে বললেন, আজ আমাদের শিবানীকে দেখতে এসেছে।
দেখতে এসেছে! কথাটির সঙ্গে একটি অস্পষ্ট পরিচয় আছে সুমিতার। কোনওদিন চাক্ষুষ দেখেনি। শিবানীকে কে দেখতে এসেছে!নবগোপালদার বড় মেয়ে শিবানী। বাবার নাতনি, আর সুমিতাকে ডাকে ছোট পিসি বলে। সুমিতারই সমবয়সি হবে। ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিল স্কুলে। ওকে দেখতে এসেছে।
ভাবতেই বুকের মধ্যে ছটফট করে উঠল সুমিতার, পাশের ঘরে যাবার জন্যে। সে যেন কোনও এক নতুন জীবনের রংমহল। কী এক বিচিত্র ঘটনা-ই না জানি ঘটছে ওখানে।
কিন্তু কিছু না বলে কয়ে হঠাৎ ও ঘরে যাওয়াটাই বা কেমন দেখায়। কেউ না বললে যায় কেমন করে। হয়তো যাওয়াই রীতিবিরুদ্ধ।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলি পড়েছে মহাফাঁপরে। ওদের মনের যত টান পাশের ঘরে, তত টান এ ঘরের বালিগঞ্জের দাদু আর ছোট পিসির দিকে। ওদের কাছে এ দু তরফের প্রতিই এক অনাস্বাদিত লোকের আকর্ষণ আছে।
এমন সময় কীকরে নবগোপাল খবর পেল মহীতোষের আসার কথা। অমনি ভারী আপ্যায়িত হয়ে, প্রায় চিৎকার করতে করতে ছুটে এল এ ঘরে। যেন মহীতোষের পায়ে কিছু ছিল, এমনি করে চোখের পলকে হাত দিয়ে পা ছুঁয়ে বলল, কখন এলেন কাকাবাবু।
বোঝা যাচ্ছে, এসময়ে এসে পড়ে মহীতোষও অস্বস্তি বোধ করছেন। বললেন, এই তো আসছি।
সুমিতার মনে হল, নবগোপালদাদা যেন প্রায় বাবার বয়সি। জার্ডিন কোম্পানিতে ক্লার্কের চাকরি করে। এর মধ্যেই মাথার চুলে ধরেছে পাক। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতগুলি দেখাচ্ছে ক্ষয়াটে লাল। গায়ে একটা গেঞ্জি, পরনে ধুতি, কিন্তু একটি আন্ডারওয়্যারও পরেনি। বাবার সঙ্গে কথার এক ফাঁকেই সুখদাকে কানে কানে বলল, বোধ হয় পছন্দ হয়েছে, জানলে?
সুখদা বললেন, ভগবান যদি মুখ তুলে চান।
সুমিতা যতই দেখে, ততই দুর্বোধ্য বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখে সব। আর আড়ষ্ট হয়ে থাকে শরীর ও মনের মধ্যে। এরা কী কথা বলছে, কখন কেন যে হাসছে, সহসা সব ধরে উঠতে পারে না।
নবগোপাল বলল, চলুন কাকাবাবু, আপনি একটু ও-ঘরে চলুন।
সুমিতা দেখলে, বাবা একেবারে লাল হয়ে উঠেছেন। বললেন, আর থাক না নবগোপাল। এমনি হঠাৎ এসে পড়েছিলুম, বউঠানের সঙ্গে একটু দেখা করে যাব বলে। আমি আর ওখানে গিয়ে কী করব।
নবগোপাল পান-খাওয়া দাঁতে, একটি বিচিত্র ধরনের আবদারের হাসি হেসে বলল, তা বললে হবে কাকাবাবু। আজ আমার কী ভাগ্য, আপনি এসে পড়েছেন। আপনি থাকতে শিবানীকে আমি একলা বসে দেখাব, এটা হয় না। বাবা থাকলে আজ নাতনিকে বসে দেখাতেন। বাবার হয়ে আজ আপনি রয়েছেন।
সুখদা বলছেন, হ্যাঁ, তুমি যাও ভাই এক বার ঠাকুরপো, মনে মনে নাতনিটাকে একটু আশীর্বাদ করো, যেন মেয়েটার একটা গতি হয়ে যায়।
মহীতোষ চকিতে এক বার সুমিতার দিকে তাকালেন। সুমিতাও তাকিয়েছিল। মেয়েটার গতি আবার কী! ওর মনে হচ্ছিল, বাবা নিশ্চয়ই এক বার এদিকে তাকাবেন। আর কার দিকে এখন তাকাবেন। বড়দি মেজদি তো কাছে নেই, যাদের দিকে তাকান অসহায় হয়ে। বাবার অস্বস্তি দেখে, সুমিতাও বিব্রত বোধ করল। কিন্তু এখানে তো ওর বলার নেই কিছু।
মহীতোষকে যেতে হল। সুখদা যেটুকু ভাবেননি হয়তো, সুমিতাও ভাবেনি, হয়তো মহীতোষও সম্যক ধারণা করতে পারেননি, সেটুকু হল নবগোপালের এক নিগূঢ় সম্মানবোধেআজকে নিজের বাবা নেই বলেও যেমন সে মহীতোষকে পেয়ে খুশি হয়েছে, তেমনি এত বড় একজন অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে আত্মীয়কে পেয়েও বুক ফুলে উঠেছে তার। যেন তার মেয়েকে পছন্দ করার ব্যাপারে ছেলেপক্ষ একটি নতুন আলো পাবে।
সুমিতা বেচারির কী দুর্দশা! ওকে তো কেউ যেতে বলছে না। একটি আলগা চেয়ারে প্রায় আলগা হয়ে বসে ও ধৈর্যের বাঁধটাকে ঠেকিয়ে রেখেছে। দেখছে, জ্যাঠাইমা কেমন এক স্বপ্নঘোরে কান পেতে আছেন পাশের ঘরে। তারপরে হঠাৎ নজরে পড়ল সুমিতাকে। বললেন, যাবি ও-ঘরে?
অমনি টুক করে ঘাড় নেড়ে দিল সুমিতা, হ্যাঁ যাবে।
বলেই কিন্তু জ্যাঠাইমাকে নিমেষের জন্যে চিন্তিত দেখাল। বুঝল না, জ্যাঠাইমা ওর দিকে চেয়ে ভেবে নিচ্ছেন, ছেলে-পক্ষ ওকে দেখে না আবার শিবানীকেই নাকচ করে দেয়। বোধ হয় পরমুহূর্তেই মহীতোষের মেয়ে ভেবে লজ্জায় মরে গেলেন অন্তরে অন্তরে। ও যে সাহেবের ছোট্ট মেয়ে! বললেন, যা না, যা। বড় বউমা, ওকে একটু যেতে দাও তো ও-ঘরে।
চার জন ভদ্রলোকের সামনে সেজেগুজে জড়সড় হয়ে বসেছে শিবানী। সুমিতাকে দেখেই বেচারির লজ্জারুণ মুখখানি আর এক দফা লাল হয়ে উঠল। মেয়ে দর্শকেরাও সকলে একযোগে এক বার তাকিয়ে দেখল সুমিতাকে। বোধ হয় একটু অবাক হয়েই দেখল। এ বাড়িতে এ মেয়েকে বড় বেমানান লেগেছে। এ আসরে সবচেয়ে বেমানান লাগছে মহীতোষকে। এ সব যেন ওঁর গত জন্মের ব্যাপার।
সুমিতা দেখছে আর শুনছে। নাম কী মা? কদ্দূর পড়েছ? কী রান্না জান? গান গাইতে পার? নামটি নিজের হাতে লিখে দাও তো। লজ্জাভরা গলায় সবই জবাব দিচ্ছে শিবানী। যা বলছে, তাই করছে।
হঠাৎ কেমন যেন বড় রাগ হতে লাগল সুমিতার, লোকগুলির ওপর। কী বিশ্রী! ওর কোনও আদর্শ নেই, নীতিও নেই, ওই বিষয়ে কোনও শিক্ষাও নেয়নি নিজেদের সমাজের কাছ থেকে। সমস্ত ঘটনাটির মধ্যে ওর বিরক্তি ও বিস্ময় বাড়ল। আর বড় দুঃখ হতে লাগল শিবানীর জন্য। নিজের অবচেতন মনে যেমন বড়দির সচেতন দীপ্ত বহ্নি ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখানে শিবানীর এই দীপ্তিহীন নিস্তেজ বাধ্যতা ততখানি রুষ্ট করে তুলেছে।
লোকগুলি মহীতোষকে হঠাৎ বড় খাতির করতে আরম্ভ করেছে। মহীতোষও যেন সে বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছেন।
কিছুক্ষণ পর মেয়ে দেখার পালা চুকল। মিষ্টিমুখ করে বিদায় হল বাইরের লোকেরা। মহীতোষ বললেন সুখদাকে, এবার চলি বউঠান।
সুখদা বললেন, এখুনি কী? যেয়ো, বসো; তোমার সঙ্গে কথা আছে। বলেই প্রায় চিল-গলায় হাঁকার দিলেন, এই দস্যিগুলো, গেলি এ ঘর থেকে? সঙ্গে সঙ্গে নবগোপাল চেঁচিয়ে উঠল।
বেচারিরা বালিগঞ্জের দাদুকে দেখার লোভ সংবরণ করে পালাল। গিয়ে জুটল পাশের ঘরে। সেখানে রয়েছে শিবানী আর সুমিতা।
দুজনের কেউই তখনও কোনও কথা বলেনি। ভিড় দেখে শিবানী বলল সলজ্জ গলায়, চলো ছাদে যাই।
দুজনে সিঁড়ির দিকে যেতেই, ছোটরা পিছন নিল। ধমকে উঠল শিবানী, দেখবি, ডাকব বাবাকে? যা বলছি।
আজকে দিদির হুকুম মানতে হবে, এটাই ছিল ওদের বিশ্বাস। অগত্যা থামতে হল। দুজনে ওরা উঠে এল ছাদে। কিছুক্ষণ সময়ের জন্যে। সুমিতার আজকের ভয়-বেদনা আড়াল হয়ে রইল। মাঘের ঢলে পড়া সূর্যের চিকন রোদে ভরা ছাদে এসে দাঁড়াল দুজনে। শিবানীর চোখে মুখে, সাজাগোজা, সব কিছুতেই একটি বিচিত্র লজ্জা যেন রোদের মতোই ঝিকমিক করছে। আলাপ আছে দুজনেরই কিন্তু কেউ-ই কথা বলতে পারছে না। সুমিতার খোলা চুলে পড়েছে রোদ। বড় বড় চোখে অবাক বিস্ময়ে দেখছে শিবানীকে। এ যেন সেই আগের শিবানী নয়। যে শিবানী ওকে সভয়ে সসংকোচে জিজ্ঞেস করে পড়ার কথা, কলেজের কথা, দাদু অর্থাৎ মহীতোষের কথা, সুজাতা আর সুগতা, বড় আর মেজ পিসির কথা। এমনি জিজ্ঞেস করে, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সুমিতাকে। যেন ওর এই সচকিত কিশোরী প্রাণের কোথায় একটি দীর্ঘশ্বাস জমা হয়ে ওঠে ছোট পিসিকে দেখে। এই দেখার মধ্যে, শিবানীর প্রতি কেমন একটু মমত্ব বোধ এসে পড়ে সুমিতার। এ সংসারে, ওর নতুন কথা শোনাবার পাত্রী শিবানী। ছোট পিসি ডাকের মধ্যে যেমন একটু অস্বস্তি মেশানো খুশি অনুভব করে, তেমনি নিজেকে শিবানীর সামনে একটু বড় বড় লাগে। অথচ বয়সে ওরা সমান।
কিন্তু আজ শিবানীকে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। ওর জন্যে যে সুমিতা এত দুঃখ পাচ্ছিল খানিকক্ষণ আগে, তার কোনও চিহ্ন তো এ মুখে নেই। এ তো আলাদা শিবানী। ওর ঠোঁটের এই হাসি, নত চোখের ওই চাউনি, অন্য বেশে, অন্য কোথায় দেখেছে সুমিতা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সেই প্রথম গিরীনদার আবির্ভাবে বড়দি হেসেছিল এমনি করে। মৃণালের সামনে দু-একবার এরকমভাবে হাসতে দেখেছে মেজদিকে। আজ সমবয়সি শিবানীও হাসছে এমনি করে। একে তো এই আধা-চেনা পরিবেশ, তার ওপরে এ ব্যাপার দেখে একেবারে নির্বাক হয়ে রইল। নিজের মুখ নিজে দেখতে পায় না সুমিতা। জানে না, এমন হাসি কোনওদিন ফুটেছিল কি না ওর মুখে।
শিবানী বলল অস্ফুট লজ্জায়, এই ছোট পিসি, কিছু বলছ না যে?
নিজেকে কী রকম অসহায় মনে হল সুমিতার। বলল, কী বলব?
শিবানী বলল হাসির নিক্কণে, কী আবার। এই…মানে…ওই সব।
ওই সব? এক বার মনে হল সুমিতার, বুঝি বড়দির কথা বলতে বলছে শিবানী। কিন্তু তারপরেই মনে হল, না, তেমন কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ তো নেই মুখে। এত দিন সুমিতা এসেছে অন্য রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে। শিবানী দেখেছে এবং শুনেছে। আজ শিবানীর মধ্যে আর এক রাজ্যের বিপুল বিস্ময়, সেখানে থই পাচ্ছে না সুমি। বলল, কোন সব বলল তো?
শিবানী হেসে উঠে তাকাল সুমিতার মুখের দিকে। কী এক বিচিত্র ছটায় চকমক করছে ওর চোখ দুটি। বলল কেন, এই যে দেখলে এতক্ষণ, এই সব দেখা টাকা, সে কথা।
সহসা যেন সংবিৎ ফিরে পেল সুমিতা। সত্যি, কিন্তু কী বলবে? চকিত মুহূর্তে এক বার ওর সেই অদৃশ্য লতার অনধিকারের ভয় হল।
তারপর বলল, এবার তোমার বিয়ে হয়ে যাবে তো?
শিবানীকে লাল দেখাচ্ছে রোদে। বলল, যদি পছন্দ হয়।
সুমিতা: কাদের পছন্দ। ওই লোকগুলোর?
বুঝল না, ওর গলার সামান্য অশ্রদ্ধার সুরটুকুও ব্যথা দিচ্ছে শিবানীকে। বলল, হ্যাঁ।
সুমিতা: তারপর?
শিবানী: তারপর? তারপর ওই যা বললে, তা-ই হয়ে যাবে।
সুমিতা বলল, বিয়ে হয়ে যাবে? তোমার যদি সেই লোকটিকে ভাল না লাগে?
সেই লোক, অর্থাৎ বর। শিবানী অবাক লজ্জায় বলল, যাঃ!
শিবানীর এ বিচিত্র অভিব্যক্তিতে আরও বেশি অবাক হল সুমিতা। বলল, ভাল লাগবেই?
শিবানীর লজ্জার চেয়ে এখন যুক্তিটাই বড় হয়ে উঠল। বলল, নয় কেন?
আশ্চর্য! একটি লোককে ভাল না লাগার কত কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে আবার কেন কীসের? তারপর কী যে হল সুমিতার, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল, ধরো, তার যদি আর কেউ থাকে?
শিবানী অবাক হয়ে বলল, আর কেউ? মানে–
বেচারি ঢোঁক গিলছে। বুঝতে পেরেছে ছোট পিসি আর কেউ বলতে কী বোঝাতে চাইছে। সুমিতা বুঝল না, কী তীব্র ব্যথার কষাঘাত করছে শিবানীর নতুন দেখা স্বপ্নে। অভিমানের সুরে বলল, ইস!
কিন্তু সুমিতা বেচারিরও বুকখানি ফুলে ফুলে উঠছে কান্নায়, কৌতূহলে। ওই কথাটি জানতে চায় ও এখন। বলল, তখন তুমি কী করবে?
শিবানীর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল। বলল, কী আবার? তা হবে কেন। তা হবে না।
শিবানীর দৃঢ়স্বর শুনে একটু থতিয়ে গেল সুমিতা। বলল, কেন?
শিবানী আবার লজ্জিত হয়ে উঠল। অনেক কষ্টে বলল, আমাকে তো সে ভালবাসবে।
কথাটি বলে এবং শুনে দুজনেই একেবারে চুপ হয়ে গেল। সুমিতার অন্তস্রোতের একমুখো গতিটিকে হঠাৎ আর এক পথে ভাসিয়ে দিলে শিবানী। যেন ওর বরের ভালবাসার কাছে আর কিছু থাকা না থাকা সব তুচ্ছ হয়ে গেল। বড়দি গিরীনদা, কাউকেই স্পষ্ট খুঁজে পেল না এখানে।
সোনা-চিকন রোদ রক্তিম হয়ে উঠেছে। ছাদের পরে ছাদ, উঁচুনিচু বন্ধুরতার মধ্যেও কোথায় একটি কংক্রিট ইট কাঠের সামঞ্জস্য রয়েছে। কোথাও জলের ট্যাঙ্ক, রেডিয়ো এরিয়ালের আকাশ খোঁচানো সরু বাঁশ। নীচে ও দূরে কোলাহল শহরের।
আর এখানে, দুই ভিন্ন মনের দুই কিশোরী দুটি ঝুঁটি পায়রার মতো দাঁড়িয়ে রইল মুখোমুখি। এই বিস্ময়কর রক্তিমাভার মধ্যে ওদের দুজনেরই, মন কোন সুদূরে, কোন অতলে, কোন আলোতে, কোন অন্ধকারে, কোন আনন্দে ও বেদনায় গেল হারিয়ে। সুমিতার অদৃশ্য লতায় কোথায় আজ একটি নতুন কুঁড়ির সন্ধান পেল ও নিজে।
নীচের ঘরে সুখদা আর মহীতোষ তখন বসে আছেন গম্ভীর মুখে। নবগোপালের সময় নেই, সে গেছে বাজারে। রামগোপাল তো অফিস থেকেই আসেনি। নীচের থেকে ধোঁয়া উঠতে আরম্ভ করেছে। ওপরে।
সুখদা তখন বলছেন, ঠাকুরপো, তোমার মেয়েকে তুমি মানুষ করেছ। তুমিই তাকে চেন ভাল। কীসে তোমাদের ভাল, কীসে মন্দ, তাও ছাই বুঝিনে আমি। চিরকাল জানি, তুমি সাহেবসুবো মানুষ। তোমাদের দেখে ভেবেছি, আমরা তোমার কাছে কিছু নই। লোকের কাছে বলেছি, আমার দেওর এত বড়।
মহীতোষ বেদনার মধ্যেও বিব্রত হয়ে বললেন, কী যে বলো বউঠান।
না ভাই, সত্যি বলছি। তা সে যাক। সে এক কথা, কিন্তু আমার এই সংসার দেখছ তো? তোমাদের সঙ্গে কোনও মিল নেই, বুঝিওনে। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে যে বড় অশান্তি হচ্ছে।
মেয়েটা অর্থাৎ সুজাতা। মহীতোষ বললেন, কিন্তু এ ছাড়া আর কী করার ছিল বউঠান?
সুখদা–তা-ই কি ছাই জানি। তবে তোমার জামাই ছিল মস্ত বড়লোক। টাকা পয়সা ঘর বাড়ি, অটুট লক্ষ্মী ঘরে। মিটমাট করে ফেলতে পারলেই ভাল হত।
মহীতোষ–তা তো হল না বউঠান। উমনোকে তো তুমি চেন। ওরা লেখাপড়া শিখেছে, বড় হয়েছে, তার ওপরে বড় জেদি মেয়ে। গিরীন হার মানলে না তো, উমনোও মানলে না।
সুখদার মুখের আঁকাবাঁকা রেখাগুলি যেন জায়গা বদল করে বসল। বলল, না ঠাকুরপো, তোমার মেয়েকে আমি চিনি, তা ঠিক নয়। যত দূর শুনেছি, উমনোকে বিয়ে করার আগে স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না জামায়ের। বিয়ের পরে কেমন ছিল তা জানিনে। জানিনে, কত অপমান উমনো সয়েছে। অপমান আমরা তার চেয়ে ঢের সয়েছি।
মহীতোষ বললেন, বিয়ের পরেও গিরীনের চরিত্র কেমন ছিল সেটাই তো পরিষ্কার হল না। সেটাই তো সংশয় থেকে গেল। তবে উমনো তার সঙ্গে ঘর করেছে, সে-ই বুঝেছে সবচেয়ে ভাল। পুরুষ যদি অন্যায় করে, তাকেও হার মানতে হয় বউঠান।
সুখদা হার মানে বইকী! তার একটা সময় আছে ঠাকুরপো। সেই জন্যেই তো বলছি, তোমাদের সমাজের কথা আমি বুঝিনে, কিছু বলতেও পারিনে। কিন্তু একটি কথা বলে যাও ঠাকুরপো, তোমার মেয়ে এখন কী করবে?
মহীতোষ সহসা চমকে উঠলেন। বললেন, কেন, আমি তো মরিনি এখনও। তা ছাড়া মেয়েদের তো আমি কারুর গলগ্রহ করে তৈরি করিনি বউঠান যে, তাকে বাপের হাতে, স্বামীর হাতে, তারপর ছেলের হাতে ফিরে বেড়াতে হবে।
সুখদা ওঁর ঘোলাটে চোখে সুদূরে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কে জানে, মহীতোষের কথার অন্তর্নিহিত খোঁচাটুকু ওঁর নিজেরই লেগেছে কি না।
বললেন, তা ঠিক ঠাকুরপো। তবে, তুমি মরোনি, মরবে তো বটেই। তোমার মেয়েও হয়তো চাকরি করে খাবে, লাখ টাকা তো তুমি রেখে যাবে না। তারপর?
তারপর কী বউঠান?
ঠাকুরপো, উমনো তোমার সন্তান, তার ওপরে মেয়েমানুষ। সে কী নিয়ে থাকবে? তার কি শরীর নেই, মন নেই, তার কি সাধ নেই, আহ্লাদ নেই।
আচমকা বৃশ্চিকদংশনে পাংশু হয়ে উঠলেন মহীতোষ। সন্তান, সন্তান। ঠিক ঠিক, বড় ঠিক কথা বলেছেন বউঠান। আজ যদি সুজাতার হিন্দু বিয়ে না হয়ে রেজিষ্ট্রি বিয়েও হত, মেয়ের জন্যে এ কথা তো না ভেবে পারতেন না। সুজাতা যদি আর একটি বিয়েও করবার আইনত অধিকার পেত, তবু মহীতোষের পিতৃমনের উৎকণ্ঠা বেদনা তো দূর হত না। সে যে ওঁর সন্তান, মেয়ে। তাকে তো উনি কোনও অনাচারের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন না।
যে কথা ছিল মনের অন্ধকারে, তাকেই সুখদা সামনে টেনে দিলেন প্রকাশ্যে। সবই হবে, কিন্তু সাধ আহ্লাদ, জীবনে সুষ্ঠু সুশৃঙ্খলভাবে বেঁচে থাকা। সব পিতৃমনই চায় তার সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে। সেইটিই যে আসল বেদনা ও ভয় মহীতোষের।
বিদায় নিলেন উনি। যাবার সময় সুখদা বললেন, যদি পার তো এক দিন বড় মেয়েকে নিয়ে এসো ঠাকুরপো।
সুমিতা শিবানীর কাছে বিদায় নেওয়ার সময় কোনও কথা বলতে পারলে না। ওরা শুধু পরস্পরের হাতে হাত দিয়ে বিদায় নিল। প্রায় সন্ধ্যার মুহূর্তে বাপ-মেয়ে হেঁটে চলল ট্রাম স্টপেজের দিকে।