৫. ভোর হলেও

০৫.

ভোর হলেও দরজা খুলে বাইরে বেরোতে ঠিক সাহস পেল না অনীশ। বলা যায় না প্রাণীটা হয়তো এখনও খোলা আছে। দরজার বাইরেই হয়তো বা সে ঘাপটি মেরে বসে আছে অনীশের জন্য। ঘরের ভিতর থেকে অনীশ বার কয়েক ডাকল ভাইমারের নাম ধরে। কিন্তু বাইরে থেকে কোনও সাড়া মিলল না। বন্ধ ঘরে বসে তার কী করা উচিত তা ভাবতে লাগল অনীশ।

সময় এগোতে লাগল। বেলা আটটা নাগাদ তখন বাইরে বেশ একটু রোদ উঠেছে, সে সময় অনীশ বাইরের চত্বর থেকে যেন বেশ কিছু লোকজনের গলার শব্দ, ঘোড়ার ডাক এ সব শুনতে পেল। সাহস করে এবার সে দরজা খুলে ফেলল। সে দেখতে পেল চত্বরের ওপাশে কাঁটাতারের বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একদল লোক। কিছু পশুও আছে তাদের সঙ্গে। ভাইমারকেও দেখতে পেল অনীশ। বাড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনি এগোচ্ছেন দরজা খোলার জন্য।

দরজা খুলে দিলেন ভাইমার। হুড়মুড় করে পশুদের নিয়ে বরফ ঢাকা চত্বরে প্রবেশ করল লোকগুলো। জনা সাতেক ছোটখাটো চেহারার লোক। তাদের পরনে লম্বা ঝুলের নোংরা পোশাক, পায়ে লোহার বেড়ি লাগানো হাই হিল বুট, মাথায় চামড়ার টুপি। তাদের সঙ্গে পাঁচটা পশু। তবে তারা ঘোড়া নয়, ছোটখাটো চেহারার ভারবাহী খচ্চর। তাদের পিঠে চাপানো পেট ফোলা চটের বস্তা। রসদ এসে গেছে সম্ভবত। চত্বরের ভিতরে ঢুকে এক জায়গাতে জটলা বেঁধে দাঁড়াল তারা। ভাইমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। অনীশ এবার বারান্দা থেকে নেমে বরফের মধ্যে দিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল তাদের সামনে।

লোকগুলোর সঙ্গে অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছিলেন ভাইমার। ভাষাটা হয়তো বা চাইনিজ হবে। কারণ লোকগুলোর গড়নে, মুখমণ্ডলের মধ্যে লিয়ান ছাপ স্পষ্ট। ভাইমারও বলেছিলেন রসদবাহী লোকেরা ওপারের।

অনীশ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কথা থামিয়ে তার দিকে তাকালেন ভাইমার। তার মুখ গম্ভীর, চোখে-মুখে রাত্রি জাগরণের স্পষ্ট ছাপ। অনেকটা শুষ্কভাবেই তিনি বললেন সুপ্রভাত।

অনীশ গতকালের ব্যাপারটা এ লোকগুলোর সামনে বলা ঠিক হবে কিনা ভেবে একটু চুপ করে রইল। সম্ভবত ভাইমার তার মনের ভাব পাঠ করে বলে উঠলেন, কথা বলতে পারেন। এরা চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা বোঝে না।

অনীশ বলল, কাল রাতে একটা নেকড়ে আমার ঘরে হানা দিয়েছিল। দরজার কাঠের প্যানেল ভেঙে ঘরের ভিতর মাথাও গলিয়ে ফেলেছিল। আমি বাতিটা ছুঁড়ে কোনওরকমে তাকে আটকাই। আর একটু হলেই..

তার কথা শুনে ভাইমার বললেন, তাই নাকি! তবে সেই বড় ধূসর নেকড়েটা। কাল কীভাবে যেন খিদের জ্বালায় খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। শেষ রাতে তাকে খাঁচায় ফেরানো হয়। ঠান্ডা ও খিদের জ্বালায় হিংস্র হয়ে উঠে সম্ভবত সে ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এই লোকগুলো যদি গতকাল বিকালে আসতে পারত তবে গত রাতে কোনও দুর্ঘটনাই ঘটত না। এখন অবশ্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

অনীশ এরপর বলল, গ্রামবাসীদের চিঠিটা আর আপনার সঙ্গে তাদের চুক্তিপত্র দুটোই তৈরি করে ফেলেছি। একবার দেখে নেবেন নাকি?

তার কথা শুনে ভাইমার কেন জানি মৃদু চমকে উঠে বললেন, আপনি এখন গ্রামে যাবেন নাকি?

অনীশ বলল, কেন? তেমনই তো কথা ছিল। নরবুর নাতির ফিরে আসার কথা। সেটা সে দেখার পর গ্রামের লোকেরা সেটায় স্বাক্ষর করবে। চুক্তিপত্রটাও আপনাদের উভয়পক্ষকে দিয়ে স্বাক্ষর করাতে হবে।

ভাইমার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রথমে বললেন, যে-কোনও সময় কিন্তু আবার আকাশের গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে পারে, আবার তুষারপাত শুরু হতে পারে। তাই বলছিলাম আর কী।

একথা বলার পর তিনি কেমন যেন নিস্পৃহভাবে বললেন, আমাকে এখন কাগজগুলো দেখাবার দরকার নেই। আগে গ্রামে যান, দেখুন ওরা কী বলে? ওরা সই করে দিলে আমিও সই করে দেব। আপনি তো এখানে ফিরবেনই।

এরপর আর কথা বাড়ালেন না ভাইমার। তিনি এগোলেন বাড়ির পিছন দিকে যাবার জন্য। পশুদের নিয়ে তাকে অনুসরণ করল সেই চীনাদের দলটা। অনীশ ঘরে ফিরে এল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল তার কাগজপত্র নিয়ে। বাড়ির পিছন দিক থেকে লোকজনের গলার শব্দ ভেসে আসছে। দরজা খুলে কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে এসে পাইনবনের ভিতর দিয়ে সে রওনা হল গ্রামের দিকে। হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছিল তার। পাইনবনের ভিতরেও তুষার জমা হয়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে বরফে। কিন্তু সেই বরফ ভেঙেই একসময় সে পৌঁছে গেল গ্রামে।

গ্রামটা যেন ধীরে ধীরে বরফের তলাতেই চলে যাচ্ছে। অনেক বাড়ির অর্ধেক দরজা বরফে ঢেকে গেছে। ঘরের বাইরে ভিড়ও তেমন নেই। গ্রাম প্রধান নরবু আর কিছু পুরুষ মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল অনীশের জন্য। তাদের সঙ্গে ড্রাইভার পবনও ছিল। অনীশ গ্রামে ঢুকতেই এদিনও নরবু তার হাতে কাঠগোলাপের স্তবক তুলে দিল। তবে তার চোখে মুখে কেমন যেন একটা চাপা উৎকণ্ঠার ভাব। ফুলটা সে অনীশকে দিল ঠিকই কিন্তু তাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে বসাল না। অনীশ নরবুর উদ্দেশ্যে বলল, কাগজ তৈরি করে এনেছি। তোমার নাতি কোথায়? তাকে ডাকো?

নরবু জবাব দিল, সে এখনও ফেরেনি। তার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা।

ফেরেনি! বিস্মিত ভাবে বলল অনীশ।

নরবু বলল, না, এখনও ফেরেনি। গতকাল সন্ধ্যার আগেই তার ফেরার কথা ছিল। পায়ে হেঁটেই ফেরার কথা তার। গ্যাংটক থেকে গাড়ি তাকে ওপরে পাসের মুখে পৌঁছে দিয়েছিল। সে যে পাসে ঢুকেছিল সে খবরও পেয়েছি। কিন্তু তারপর আর তার কোনও খবর নেই। সে না এলে কিছু হবে না।

এর জবাবে অনীশ বলল, তোমরা চাইলে লেখাটা আমি পড়ে শোনাতে পারি।

নরবু প্রত্যুত্তরে স্পষ্টভাবে বলল, আপনি এখন ফিরে যান। নাতিটার না ফেরা নিয়ে আমরা সকলে খুব চিন্তায় আছি। সে ফিরে এলে আমরা আপনাকে খবর দেব।

সমস্যায় পড়ে গেল অনীশ। পরদিনই তো তাকে ফেরার পথ ধরতে হবে। তার মধ্যে যদি নরবুর নাতি না ফেরে? অনীশ পবনকে বলল, তুমি একটা কাজ করো। আমাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে, সেটা নিয়ে তুমি পাসে গিয়ে, সম্ভব হলে পাসের একটু ভিতরে গিয়ে তার। সন্ধান নিতে পারো। কিন্তু মুশকিল হল তুমি তাকে চিনবে কীভাবে?

পবন বলল, আমি তাকে চিনি স্যার। এর আগে যখন গ্রামে এসেছিলাম তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

অনীশ আর তার ড্রাইভারের কথোপকথন শুনে নরবু ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখো তাকে খুঁজে পাও কিনা। এমনও হতে পারে কোথাও সে তুষারপাতে আটকে পড়েছে। তোমরা তাকে খুঁজে না পেলে আমরা গ্রামের লোকরা মিলে আশেপাশের জায়গাগুলোতে তাকে খুঁজতে বেরোব।

অনীশ এরপর আর সেখানে দাঁড়াল না। পবনকে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে পবন বলল, ছেলেটা না ফেরায় এখন ওদের মনে অন্য ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

অনীশ প্রশ্ন করল, কী ভয়?

পবন বলল, গতকাল সন্ধ্যায় খামার থেকে ক্ষুধার্ত নেকড়ের ডাক ভেসে আসছিল গ্রামে। ওদের মনে একটা আশঙ্কা দানা বাঁধছে যে…।

পবন তার কথা শেষ না করলেও তার সম্পূর্ণ বক্তব্য বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না অনীশের। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। সেজ বাতির আলোতে দরজার ফোকর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই নেকড়েটা! তার সেই লোলুপ ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, লাল জিভ, চোয়ালের তীক্ষ্ণ দাঁত! সেই নেকড়েটাই কোনওভাবে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটায়নি তো?

অনীশের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মুখে সে শুধু বলল, তেমন কিছু ঘটলে ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর হবে।

পবন বলল, হ্যাঁ, সাহেব, নেকড়ে সমেত খামারে আগুন লাগিয়ে দেবে ওরা।

 বাকিটা পথ তারা দু-জন কেউ কোনও কথা বলল না। আশঙ্কা দানা বাঁধছে দুজনের মনেই। বন পেরিয়ে ঢাল বেয়ে বড় রাস্তায় নামল তারা। ক্যাম্পের দিকে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আর্মি গাড়িটা তাদের পাশে এসেই দাঁড়াল। চালকের পাশের আসনেই বসে আছেন লেফটানেন্ট ছেত্রী। পবনকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি অনীশকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাচ্ছেন এখন?

অনীশ বলল, আমি এখন ক্যাম্পেই ফিরছি। তবে আমার ড্রাইভারকে পাঠাচ্ছি পাসের মুখটাতে। শহর থেকে একটা ছেলের ও পথ ধরেই গতকাল গ্রামে ফেরার কথা ছিল। সে ফেরেনি। তাই আমার ড্রাইভার তার খোঁজে ওদিকে যাচ্ছে।

ছেত্রী এরপর বললেন, শুনলাম আপনি নাকি কিছুদিনের জন্য ওই ক্যাম্পেই থাকছেন? এখন ফিরছেন না?

অনীশ বিস্মিতভাবে বলল, আমার তো কালই ফিরে যাবার কথা। এ খবর আপনাকে কে দিল?

লেফটানেন্ট বললেন, আমাকে নয়, আমার এক সৈনিককে কথাটা বলেছেন ভাইমার। গতকাল সন্ধ্যায় যখন তুষারপাত হচ্ছিল তখন টহল দিয়ে ফিরছিল আমার এক সৈনিক। ক্যাম্পের গেটের মুখে তার সঙ্গে ভাইমারের দেখা হয়। গত কয়েকমাস ধরে আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলতেন না তিনি। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় নিজেই সেই সৈনিককে ডাকেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। কথা প্রসঙ্গে তিনিই তাকে ব্যাপারটা বলেন।

অনীশ বলল, না না, আমার তেমন কোনও কথা হয়নি ভাইমারের সঙ্গে।

অনীশের জবাব শুনে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল লেফটানেন্টের মুখ। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, থাকুন বা নাই থাকুন আপনি কিন্তু গতরাতের মতো বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। সীমান্ত অঞ্চল। রাস্তা চিনতে না পেরে ওদেশে ঢুকে পড়লেই পিপিলস আর্মির হাতে গুপ্তচর সন্দেহে বলি হবেন। এভাবে অনেক নিরীহ মানুষ বন্দি হয়েছে ওদের কাছে।

এবার তার কথা শুনে আরও অবাক হয়ে গেল অনীশ। সে বলল, আমি কাল ঘরে ঢোকার পর বাইরে বেরোইনি তো!

লেফটানেন্ট ছেত্রী বলল, কিন্তু আমাদের এক গার্ড নাইট ভিশন ফিল্ড গ্লাসে আপনাকে দেখতে পেয়েছিল বলল। তার তো ভুল দেখার কথা নয়!

অনীশ এবার বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, হ্যাঁ, সে ভুল দেখেছে। আমি বাইরে যাইনি।

দু-পাশে মাথা নাড়লেন ছেত্রী। যেন তিনি বুঝতে পারছেন না সেই গার্ড নাকি অনীশ, কে সত্যি বলছে। এরপর তিনি আর কথা বাড়ালেন না। তার ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করলেন গাড়ি এগোবার জন্য।

লেফট্যানেন্ট চলে যাবার পর ক্যাম্পের দিকে এগোল তারা দু-জন। গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল তারা। পবনকে অনীশ বলল, ছেলেটার খোঁজ জেনে সঙ্গে সঙ্গে জানিও আমাকে।

পবন বলল, আচ্ছা স্যার।

সে গাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর কিছুটা হেঁটে তার কাঁটা ঘেরা ক্যাম্পের ভিতর প্রবেশ করল অনীশ। বরফ ঢাকা চত্বরটার ঠিক মাঝখানে তাবু খাটাচ্ছে চীনাগুলো। তাদের ভারবাহী পশুগুলো অবশ্য সেখানে নেই। হয়তো তারা বাড়ির পিছনের দিকেই রয়ে গেছে। ভাইমারকেও দেখতে পেল না অনীশ। ঘরে ঢুকে হঠাৎ তার খেয়াল হল ফুলের বোকেটা বাইরে ফেলা হয়নি। জানলাটা বন্ধ। একটু পরে সেটা ফেলে দিলেও চলবে। সেটা টেবিলের ওপর রেখে জিরিয়ে নেবার জন্য খাটের ওপর বসল অনীশ।

হঠাৎ তার চোখ পড়ল দরজাটার সেই ভাঙা জায়গার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল গত রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতি। খুব জোর বেঁচে গেছে সে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই তার খেয়াল হল ঘরে বাতি নেই। নেকড়ে আর আসবে না ঠিকই কিন্তু বাতি ছাড়া চলবে কীভাবে? ভাইমারের কাছ থেকে একটা বাতি জোগাড় করার জন্য খাট ছেড়ে নেমে ঘরের বাইরে বেরোল অনীশ। বাইরে বেরিয়েই সে দেখতে পেল বারান্দার অন্যপ্রান্ত থেকে এগিয়ে আসছেন ভাইমার। অনীশও এগোল তার দিকে।

ভাইমার তাকে মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, কখন ফিরলেন?

অনীশ বলল, এই মাত্র। তবে কাজ এগোয়নি। নরবুর নাতির গ্রামে ফেরার কথা ছিল, সে ফেরেনি। সে না ফিরলে কী হবে বুঝতে পারছি না। কাল তো আমাকে ফিরতে হবে।

অনীশের কথা শুনে এ ব্যাপারে ভাইমার খুব বেশি উদ্বিগ্ন হলেন বলে মনে হল না। প্রথমে তিনি বললেন, চলে যেতে হলে যাবেন। তারপর যেন একটু মজা করার ঢঙেই বললেন, আমি তো ভাবছিলাম আপনি হয়তো এখানেই থেকে যাবেন। এই পাহাড়, এই প্রকৃতি, এই। সুন্দর সুন্দর প্রাণীগুলোকে ছেড়ে আপনি যাবেন না।

অনীশের মনে পড়ে গেল লেফটানেন্ট ছেত্রীর কথা। তাহলে হয়তো সত্যিই ভাইমার মজা করে হলেও এ কথাটা বলেছেন সেই সৈনিককে। অনীশ হেসে ভাইমারকে বলল, এমন সুন্দর জায়গাতে থাকতে পারলে ভালোই হত। কিন্তু তার কি আর উপায় আছে।

ভাইমার নিঃশব্দে হাসলেন তার কথা শুনে।

অনীশ এরপর বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। গতকাল বাতিটা ভেঙে গেছে। একটা বাতি লাগবে।

ভাইমার বললেন, তেলের বাতি নেই। একটা মোমবাতি দিচ্ছি। আর তো মাত্র আজকের রাতের ব্যাপার। খুব অসুবিধা হবে না আশাকরি।

এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মোম নিয়ে ফিরে এলেন ভাইমার। সেটা তিনি অনীশের হাতে দিয়ে বললেন, আমি এই চীনাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকব। সম্ভবত আজ আর আপনার সঙ্গে দেখা হবে না আমার। তাই আগাম শুভরাত্রি জানিয়ে রাখলাম আপনাকে।

আকাশটা আবার কেমন যেন পালটাতে শুরু করেছে। তুষারপাত শুরু হবে আবার। মোমবাতিটা নিয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়ল অনীশ।

বিকাল পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে আবার বাইরে বেরোল সে। তুষারপাত হচ্ছে। চীনাদের তাবু খাটানো হয়ে গেলেও তারা বাইরে তুষারপাতের মধ্যেই বসে আছে। ঝিরিঝিরি তুষারপাত তাদের পোশাককেও সাদা করে দিয়েছে। অনীশ হঠাৎ দেখতে পেল কাঁটাতারের বাইরে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার গাড়িটা। পবন ফিরে এসেছে। বারান্দা থেকে নেমে চীনাদের জটলাটার পাশ কাটিয়ে অনীশ গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পবন বলল, পাসের ভিতরে ঢুকেও অনেকটা খুঁজে এলাম স্যার। তার দেখা মেলেনি। তবে একজন খচ্চরঅলা বলল যে গতকাল অন্ধকার নামার পর ওই বয়সেরই একটা ছেলে নাকি পাস দিয়ে আসছিল।

অনীশ বলল, পেলে না যখন তখন আর কী করা যাবে! তুমি তবে গ্রামে ফিরে যাও। কাল আটটা নাগাদ চলে এস। ফেরার জন্য রওনা হতে হবে।

পবন বলল, হ্যাঁ, সার। আমি ঠিক সময় চলে আসব।

ছেলেটাকে যখন পাওয়া গেল না তখন সম্ভবত আর কিছুই করার নেই অনীশের। ভাইমার। যদি গ্রামবাসীদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে পারেন ভালো, নইলে তার ক্যাম্পের ভাগ্যে যা আছে তা হবে। বিষণ্ণ ভাবে সে পিছু ফিরল ঘরে যাবার জন্য। চীনাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে একবার থমকে দাঁড়াল। বরফের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে আগুন জ্বেলে বসে আছে তারা। অনীশ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই তাদের একজন তাকে দেখিয়ে কী যেন বলল। কথাটা শুনে অন্য চীনারাও তাকাল অনীশের দিকে। তারপর দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলতে বলতে হাসাহাসি শুরু করল নিজেদের মধ্যে। অস্বস্তি বোধ করল অনীশ। সে এগোল ঘরের দিকে।

বাইরে অন্ধকার নামার পর মোমের আলোতে তার টুকিটাকি জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিল অনীশ। সকালবেলা বেরিয়ে অনেকটা পথ ফিরতে হবে তাকে। বাইরে তুষারপাত আর বাতাস ক্রমশ বাড়ছে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। বেশ অবসন্ন বোধ করছে অনীশ। তার আসাটা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হল। পরদিন বেরোতে হবে বলে রাত আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল সে।

বাইরে অবিশ্রান্ত তুষারপাত আর বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

কিন্তু এদিনও মাঝরাতে অনীশের ঘুম ভেঙে গেল। খটখট শব্দে কঁপছে দরজাটা। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে লাফিয়ে নামল অনীশ। বাইরে বাতাসের প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। তাতেই কি দরজাটা কাঁপছে, নাকি গতকালের নেকড়েটা ফিরে এসেছে?

পকেট হাতড়ে দেশলাই বার করে মোম জ্বালাবার চেষ্টা করল অনীশ। কিন্তু দরজা জানলার ফাঁক গলে আসা বাতাসে কাঠি নিভে যাচ্ছে। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় দেশলাই দিয়ে মোম জ্বালাতে সমর্থ হল অনীশ। মোমের শিখাটা কাঁপছে, হয়তো বা এখনই সেটা নিভে যাবে। তবু তার আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। সেই আলোতে দরজার নীচের ফাটলের দিকে তাকিয়ে হৃৎস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল অনীশের।

দরজার ফাটল গলে ঘরের ভিতর উঁকি দিচ্ছে একটা নেকড়ের মাথা! এ নেকড়েটা গতকালের নেকড়েটার চেয়ে আরও বড় আরও প্রকাণ্ড! তার ধবধবে সাদা রং দেখে অনীশ বুঝতে পারল এটা সেই দলপতি নেকড়েটা। অদম্য জিঘাংসা জেগে আছে তার চোখদুটোতে। মোমের নরম আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে তার হিংস্র স্বদন্তগুলো।

ভাইমার তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে গতকালের ঘটনাটা নিছকই দুর্ঘটনা বলে। তবে?

প্রাণীটা গতকালের নেকড়েটার মতোই মাথা দিয়ে ঠেলে ভাঙার চেষ্টা করছে দরজার ওপরের প্যানেলটা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনীশ তাকিয়ে রইল তার দিকে। থরথর করে কাঁপছে দরজাটা। নেকড়ের মাথার চাপে মচমচ্ করে শব্দ হচ্ছে পুরোনো আমলের কাঠের দরজা থেকে। বাইরে বাতাসের শনশন শব্দ। মোমবাতির শিখাটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি নিভে গেল সেটা।

এ নেকড়েটা অন্য নেকড়েদের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শক্তিধর। তার বিশাল মাথার চাপে সত্যি একসময় খসে গেল আর একটা প্যানেলও। বেশ বড় একটা ছিদ্র তৈরি হল দরজার নীচের অংশে। মুহূর্তের জন্য একবার থমকে অনীশের দিকে তাকাল শ্বাপদটা। তারপর প্রথমে সামনের পা দুটোকে দরজার এ পাশে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে গুঁড়ি মেরে ঘরের মধ্যে ঢুকতে শুরু করল।

প্রাণীটা তখন প্রায় তার দেহের অর্ধেক অংশটা ঢুকিয়ে ফেলেছে ঘরের মধ্যে, ঠিক সেই সময় হুঁশ ফিরল অনীশের। যেভাবেই হোক আটকাতে হবে নেকড়েটাকে। কিন্তু কীভাবে? তার কাছে তো তেমন কিছুই নেই। প্রাণীটা ক্রমশ ঢুকে আসছে ঘরের মধ্যে। মানুষ যখন প্রচণ্ড বিপদে পড়ে তখন খড়কুটো ধরেও বাঁচার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক সময় ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলেও সেটাই সত্যি।

টেবিলের ওপরই রাখা ফুলের বোকেটা তুলে নিয়ে সেটাই সে ছুঁড়ে মারল নেকড়েটাকে লক্ষ্য করে। প্রাণীটার কাঁধে গিয়ে পড়ল বোকেটা। কিন্তু তাতেই এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। ফুল নয় যেন কেউ কোনও একটা ভারী কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করেছে অথবা যেন তাকে আগুন ছুঁড়ে মেরেছে এমনভাবে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠল নেকড়েটা। তারপর কোনওরকমে তার দেহটা হাচোড়-প্যাচোড় করে দরজার বাইরে বার করে নিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আক্রোশে গর্জন করতে লাগল প্রাণীটা। অনীশও বুঝে উঠতে পারল না যে ব্যাপারটা কী ঘটল? সে চেয়ে রইল দরজার ফাটলটার দিকে। বোকে থেকে ফুলগুলো খসে পড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে। দরজার ওপাশে গর্জন করেই চলেছে প্রাণীটা। কী রক্তজল করা তার ডাক! যেন অনীশকে নাগালের মধ্যে পেলেই সে তার কুঁটি ছিঁড়ে নেবে।

সময়ের পর সময় কেটে যেতে লাগল। দরজার দু-পাশে দাঁড়িয়ে রইল অনীশ আর নেকড়েটা। শেষ রাতের দিকে ধীরে ধীরে কমে এল নেকড়ের ডাকটা। তার ক্রুদ্ধ গর্জন দরজা ছেড়ে দূরে চলে যেতে লাগল। কতক্ষণ এভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল তা নিজেরও খেয়াল ছিল না অনীশের। একসময় সে দেখল দরজার ফোকর দিয়ে যেন আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। ভোর হচ্ছে বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *