৫. ভারতীয়দের অনুবাদে গীতা

. ভারতীয়দের অনুবাদে গীতা

গীতা-লহরী – কালিদাস রায়

গীতার কাব্যানুবাদে অনেক বাঙ্গালী কবিকেই প্রয়াসী হতে দেখা গেছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন নবীনচন্দ্র সেন, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। কবিশেখর কালিদাস রায়ও গীতার পদ্যানুবাদ করেছেন। কবিরা গীতার কাব্যানুবাদে যে মনোযোগী হয়েছিলেন তার মূল কারণ গীতার পদ্যানুবাদে কবিরা একদিক থেকে নিজেদের ছন্দনির্মিতি নৈপুণ্যকে যাচাই করে নিতে চেয়েছিলেন। গীতা মূলতঃ তত্ত্বনির্ভর রচনা। সেই তত্ত্বকে গদ্যে অনুবাদ করা যতটা সহজ, ততটাই কঠিন ছন্দে উপস্থাপিত করা। যাঁরা পদ্যে গীতার অনুবাদ করেছেন সেইসব কবিরা প্রায় সকলেই ছিলেন ঈশ্বরবিশ্বাসী, বিশেষত শ্রীকৃষ্ণ, নির্ভর, বৈষ্ণবভাবাপন্ন। স্বভাবতঃই তাই গীতার অনুবাদে এঁরা মনোযোগী হয়েছিলেন। কবিশেখর কালিদাস রায় ভূমিকায় তাঁর গীতার কাব্যানুবাদ প্রকাশের আরও একটি কারণ দর্শিয়েছেন :

আমাদের ছাত্রগণের মনেও গীতার প্রতি অনুরাগ জন্মাইবার চেষ্টা করা উচিত। যাহাতে তাহাদের মনে সেঅনুরাগ প্রবুদ্ধ হয়, সেই উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থখানি রচিত হইল। সেজন্য যতদূর সম্ভব ভাষাকে প্রাঞ্জল ও বিশদ করিবার চেষ্টা করিয়াছি, প্রয়োজনমত টীকা—টিপ্পনী সংযোগ করিয়াছি এবং চিত্তাকর্ষক করিবার জন্য কেবল পয়ারের আশ্রয় না লইয়া বিবিধ ছন্দের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছি।

মূলতঃ ছাত্রপাঠ্য করার দিকে শিক্ষক-কবি মনোযোগ দিলেও বর্তমান গ্রন্থটি সকল পাঠকেরই আস্বাদনগম্য হয়েছে। এখানেই অনুবাদ-কর্মটির সার্থকতা।

আমরা প্রথমে অনুবাদ-কর্মটির বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করব—

ক. কবি আক্ষরিক অনুবাদে যত্নবান হননি। গুরুত্বপূর্ণ শ্লোকের বা বক্তব্যের আক্ষরিক অনুবাদ করলেও আনুপূর্বিক সমগ্র গীতার আক্ষরিক অনুবাদ করেন নি, তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ পাঠককুলের কথা বিবেচনা করে। সেক্ষেত্রে রচনা অহেতুক গুরুভার হত, হত স্ফীতকায়।

খ. কবি অনুবাদে নৈর্ব্যক্তিক থেকেছেন। নিজ ব্যাখ্যা যুক্ত করেন নি। এমনকি কোনও প্রাসঙ্গিক মন্তব্যকেও সন্নিবিষ্ট করেন নি। বোঝা যায়, কবি এক্ষেত্রে যথেষ্ট সংযমশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। প্রলুব্ধ হননি কোনমতেই।

গ. শব্দ চয়নে সতর্ক থেকেছেন, অহেতুক দর্জ্ঞেয়, দুরূহ শব্দনিচয় ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছেন।

ঘ. ক্ষেত্রবিশেষে পাদটীকায় কবি কিছু কিছু প্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী যুক্ত করলেও পাদটীকা টীকা-টিপ্পনিতে কণ্টকিত হয়নি।

ঙ. কবি ছন্দ ব্যবহারে বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন, নিছক মধ্যযুগীয় কাব্য রচনার রীতি মেনে পয়ারকেই শিরোধার্য করেন নি। কয়েকটি দৃষ্টান্ত—

১. ভীষ্ম দ্রোণ পুরোভাগে

যথাদিষ্ট স্থানে রথ

করিয়া স্থাপন,

কহিলেন শ্রীকৃষ্ণ, তখন

সমবেত কুরুসেনাগণে

কর পার্থ, নিরীক্ষণ আপন নয়নে। ১ (১ম অধ্যায়)

২. সংসার অশ্বত্থ তরু (ক) ঊর্ধ্বে তার মূল

অধোদিকে শাখা তার তাহে ফল ফুল,

ত্রিবেদ তাহার পত্র—এর পরিচয়

যেবা জানে বেদজ্ঞ সেজেনো ধঞ্জয়।

সত্ত্বরজস্তমোরূপ সলিল সম্পদে

পরিপুষ্ট শাখা তার ছুটে ঊর্ধ্বে অধে। ২ (পঞ্চদশ অধ্যায়)

৩. চিত্ত সংযমন করি, ফলকাম পরিহরি

কর্ম করি যাও পার্থ, ভীত হও কেন?

অভ্যাসের বড় জ্ঞান জ্ঞান হতে বড় ধ্যান

ধ্যান হতে কর্মে ফলত্যাগ শ্রেষ্ঠ জেনো। ৩ (দ্বাদশ অধ্যায়)

৪. অনাসক্ত গর্বশূন্য শুভাশুভ, ফলাফলে নির্বিকার ধীর,

উৎসাহী আরব্ধ কর্মে, তাহারে সাত্ত্বিক কর্তা জেন পার্থবীর। ৪ (অষ্টাদশ অধ্যায়)

কবি চেয়েছিলেন ছাত্রদের গীতার বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত করাতে। তিনি কদাপি চাননি ছাত্রদের তাত্ত্বিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে, কিংবা কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগে দীক্ষিত করতে। এমনকি ছাত্রদের অধ্যাত্মজগতে নিয়ে আসাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। ভারতীয় ঐতিহ্য ও পরম্পরার প্রতীক গীতা সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে উঠুক ছাত্রদের—কবির এই বাসনা তাঁর কাব্যানুবাদের প্রেক্ষিতে সার্থক হয়েছে।

এবারে মূলের সঙ্গে কাব্যানুবাদের সঙ্গতি রক্ষার ক্ষেত্রে কবির নৈপুণ্যের কিছু হদিস নেওয়া যেতে পারে—

ক. দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২২নং শ্লোকটি হল—

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোপরাণি।তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা— ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।। ২/২২

কবিশেখর-কৃত অনুবাদটি হল—

জীর্ণ বসন তেয়াগি যেমন

মানব নূতন বসন পরে,

জীর্ণ দেহটি তেয়াগি আত্মা

তেমনি নূতন শরীর ধরে।

ঐ একই অধ্যায়ের ২৩ সংখ্যক শ্লোকটি হল—

নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।

এবারে কালিদাস-কৃত অনুবাদ—

শস্ত্র তাহারে নারে ছেদিবারে

বহ্নি তাহারে কভু না দহে,

সলিলে কখনো হয় না সিক্ত

অনিলে কখনো শুষ্ক নহে। ২৩

খ. তৃতীয় অধ্যায়ের ২২ ও ২৩ সংখ্যক শ্লোকদ্বয় হল—ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।

নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।। ২২

যদি হ্যহং ন বর্তেয়ং জাতু কর্মণ্যতন্দ্রিতঃ।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যা: পার্থ সর্বশঃ।। ২৩

এবারে কাব্যানুবাদ প্রসঙ্গ—

দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, পার্থ দেখ না আমারে

কর্তব্য আমার, কিছু নাই এ সংসারে

কিছুই অলব্ধ কিংবা লভ্য ধন কভু

নাহি মোর এ ত্রিলোকে, কর্ম করি তবু। ২২

২২ নম্বর শ্লোকের অনুবাদে কবি ‘দৃষ্টান্ত-স্বরূপ’ যোগ করেছেন, মূলে এই বক্তব্যটি নেই। ২৩ নম্বর শ্লোকে কবি ‘জড়’ শব্দটিকে এনেছেন।চতুর্থ অধ্যায়ের ৭ম ও ৮ম শ্লোকদ্বয় হল—

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম। ৭

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম।

ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। ৮

এবারে কাব্যানুবাদ—

যখনই ধর্মের গ্লানি মর্ত্যলোকে পুণ্যহানি

অধর্মের জয় অভ্যুদয়,

আপনারে সৃষ্টি করি নব নব রূপ ধরি

অবতীর্ণ হই সেসময়। ৭

সাধুদের ত্রাণ হেতু দুষ্কৃতির নাশ হেতু

হে ভারত, বারবার নামি

ক্ষীণ পুণ্য মর্ত্যলোকে ধর্ম-প্রতিষ্ঠার তরে

যুগে যুগে জন্ম লভি আমি।। ৮

৭ নং শ্লোকে ‘নব নব রূপ ধরি; এবং ৮ম শ্লোকে ‘ক্ষীণ পুণ্য মর্ত্যলোকে’ কবির সংযোজন।

একাদশ অধ্যায়ে ধৃত বিশ্বরূপ দর্শনের বর্ণনা—

অনেকবপনয়ন মনেকাদ্ভুতদর্শনম।

অনেকদিব্যাভরণং দিব্যানেকোদ্যতায়ুধম।। ১০

দিব্যমাল্যাম্বরধরং দিব্যগন্ধানুলেপনম।

দিবি সূর্য সহস্রস্য ভবেদ যুগপদুত্থিতা।

যদি ভা: সদৃশী সা স্যাদ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।। ১২

কাব্যানুবাদে বলা হল—

অনেক বদন তাহে অনেক নয়ন,

বহু আভরণযুক্ত অদ্ভুত দর্শন,

অনেক উদ্যত শস্ত্র শোভা পায় করে,

দিব্যমাল্য দিব্যবস্ত্র শোভে কলেবরে।

দিব্য-গন্ধ-লিপ্ত দেহ বিস্ময়-নিবাস,

চতুর্দিকে বক্র তার অনন্ত প্রকাশ।

সহস্র ভাস্কর যদি জাগে এককালে

যে বিরাট জ্যোতি: জ্বলে গগনের ভালে।। (১০-১২)

লক্ষ্য করার, কবি মূল বর্ণনাকে এখানে যথাযথভাবেই প্রকাশ করেছেন। অথচ একমাত্র বf ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো দুরূহ শব্দ ব্যবহার করা হয় নি। অতএব অনুবাদে কবির কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত

অনুদিত গ্রন্থটি প্রাণাধিকা ইন্দিরা দেবীর করকমলে স্নেহ উপহার হিসাবে অর্পিত।

লেখক বলেছেন :

এ অনুবাদে আমি মধ্যপথ অবলম্বন করিয়াছি; যাহাতে মূল সংস্কৃতের রস ও সৌন্দর্য ও গরিমার অপচয় ও ব্যতিক্রম না ঘটে অথচ বঙ্গভাষার প্রকৃতিগত সৌন্দর্য ও লালিত্য রক্ষিত হয়, তদ্বিষয়ে বিশেষ যত্নশীল হইয়াছি।

লেখকের মতে তাঁর পূর্বসূরীদের মধ্যে মহেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ভাবার্থ অনুবাদ করেছেন, অন্যগুলি শব্দার্থ অনুবাদ। নবীনচন্দ্রের রচনা শব্দ, ছন্দ ও সর্বপ্রকারে এত মূল সংস্কৃত-ঘেঁষা যে, স্থানে স্থানে অর্থবোধ দুরূহ ঠেকে। কুমার নাথের অনুবাদ সরল বাংলায় অতীব হৃদয়গ্রাহী, কিন্তু তাতে মূল সংস্কৃতের ওজস্বিতা ও গাম্ভীর্যের অভাব।

উপক্রমণিকায় লেখক জানিয়েছেন, ঈশ্বর-প্রণীত গ্রন্থের যে সব লক্ষণ প্রত্যাশিত, তা গীতায় সর্বাংশে বিদ্যমান আছে বলে তিনি স্বীকার করেন না। তাঁর দ্বিতীয় অভিযোগ, কৃষ্ণ যদি সত্য সত্যই গীতার রচনাকর্তা হন, তবে গীতাকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সমসাময়িক বলতে হয়। কিন্তু তাঁর মতে কুরু-পান্ডবের যুদ্ধ গীতা রচনার বহু পূর্বে সংগঠিত হয়েছিল, গীতা শ্রুতি নয়, স্মৃতির মধ্যে গণ্য। লেখকের মতে গীতার জন্ম বৈদিক সময়ের অনেক পরে। কোথাও কৃষ্ণের ঈশ্বরত্বের নিদর্শন নেই—না ছান্দোগ্য উপনিষদে, না শতপথ ব্রাহ্মণে না পাণিনিতে।

লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, রণক্ষেত্রেই যদি এরূপ ধর্মালোচনা চলে থাকে, তবে সেখানে ত ব্যাসদেব উপস্থিত ছিলেন না, তিনি কেমন করে সবটা শুনলেন। লেখকের অভিমত, গীতা কৃষ্ণের রচিত নয়, অন্য কারো দ্বারা রচিত। গীতা পঞ্চম শতাব্দীরও পূর্ববর্তী। উপনিষদের অথর্ব ভাগ মহাভারতের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের, গঠনকাল যা গীতার রচনাকাল তাই বৈদিক ও পৌরাণিক যুগের মধ্যবর্তী। লেখকের মতে গীতার সূচনা হয়েছে জ্ঞানযোগে, শেষ হয়েছে কর্মযোগে। প্রশ্ন উঠেছে গীতায় জ্ঞান ও কর্ম এ দুয়ের মধ্যে প্রাধান্য কার? বিভিন্ন শ্লোক উদ্ধার করে লেখক দেখিয়েছেন জ্ঞানযোগেরই প্রাধান্য—

দূরেণ হ্যববং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ ধনঞ্জয়

বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণা: ফলহেতবঃ। ২/৪৯

বুদ্ধিযোগ থেকে কর্ম অনেক নিকৃষ্ট, তাই জ্ঞানযোগের শরণ নাও। সকাম কর্মী নিকৃষ্ট।

তত্ত্বজ্ঞান লাভ করাই মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য, কর্ম তার সাধন। তত্ত্বজ্ঞান কী, না যার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান পরাবিদ্যা, যে বিদ্যার দ্বারা অবিনাশী সত্য স্বরূপকে জানা যায়। লেখকের মতে নিষ্কাম কর্মানুষ্ঠান দ্বারা চিত্তশুদ্ধি না হলে সেই জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। কর্ম যে সাধন, তার স্বপক্ষে বেশ কয়েকটি শ্লোকের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন লেখক—

আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্মকারণমুচ্যতে

যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে।। ৬/৩

যে মুনি জ্ঞানযোগে আরোহণ করতে ইচ্ছুক কর্মই তাঁর সহায়, যিনি যোগারূঢ় হয়েছেন নিবৃত্তিই তাঁর সহায়। কিংবা—

নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে

ত্বৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি। ৪/৩৮

ইহলোকে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র বস্তু আর নেই। যোগসিদ্ধ পুরুষ কালক্রমে সেই জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞানেতেই কর্মের পরিসমাপ্তি। অথবা—

শ্রেয়ান দ্রব্যময়াদ যজ্ঞাজ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ

সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে। ৪/৩৩

দ্রব্যময় যজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞান যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানেতে সকল কর্মের পরিসমাপ্তি। পুনরায়—

যথৈধাংসি সমিদ্ধোগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতের্জুন

জ্ঞানাগ্নি: সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা। ৪/৩৭

যেমন প্রজ্বলিত হুতাশন, কাষ্ঠরাশি ভস্মাবশেষ করে, তেমনি জ্ঞানাগ্নি সমুদয় কর্ম ভস্মসাৎ করে। এখানেই বলা হল যে জ্ঞান লক্ষ, আর কর্ম হল সোপান। নিষ্কাম কর্মানুষ্ঠানে চিত্তশুদ্ধি করে জ্ঞানমঞ্চে আরোহণ করতে হয়। প্রশ্ন কিরূপে জ্ঞানলাভ হবে? গীতা বলেছেন, যিনি শ্রদ্ধাবান নিষ্ঠাবান, সংযতেন্দ্রিয় তিনিই এই জ্ঞান লাভ করেন। ভক্তি ব্যতিরেকে জ্ঞানের সার্থকতা নেই, যথার্থ জ্ঞানী ভগদ্ভক্ত না হয়ে পারেন না। এজন্য গীতায় ভগবান ভক্তের মধ্যে, জ্ঞানীকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা করেছেন।

চুতব্বিধা ভজন্তে মাং জনঃ সুকৃতিনোর্জুন

আর্তো জিজ্ঞাসু রর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে

প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ। ৭/১৬-১৭

চতুর্বিধ পুণ্যাত্মা আমাকে ভজেন—দুঃখার্ত, অর্থপ্রার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী। এদের মধ্যে অনন্য ভক্তিপরায়ণ যোগযুক্ত জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। আমি জ্ঞানীর একান্ত প্রিয়, জ্ঞানীও আমার প্রিয়।

লেখকের মতে গীতা জ্ঞানমার্গাবলম্বী বৈদিক কর্মকান্ডের পক্ষপাতী নন। জ্ঞানবাদীরা কর্মকান্ডময় বেদের বিরোধী। কারণ কর্ম বন্ধনকারক, দোষের আকর। গীতাও কর্মাসক্তির নিন্দা করেছেন, লেখকের বর্ণনায়—

অবোধ যে বেদবাক্যে দৃঢ় বাঁধি হিয়া,

আর কিছু নাই বলি’ রহে আঁকড়িয়া;

স্বর্গসুখ একমাত্র পুরুষার্থ জ্ঞান,

স্বর্গ কামনায় সব বাহ্য অনুষ্ঠান;

বহুক্রিয়া কর্মকান্ড করিয়া সাধন,

ভোগৈশ্বর্য প্রলোভনে হয় নিমগন;

কর্মফল জন্মবন্ধ নাহি ঘুচে যার,

নানামতে ভ্রান্তমত করয়ে প্রচার।

গীতায় পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে নির্দ্বন্দ্ব হবার, মান-অপমান, সুখ-দুঃখ দ্বন্দ্বভাব থেকে রহিত হওয়ার। সত্ত্ব- গুণাশ্রিত হতে হবে। যোগক্ষেম রহিত অর্থাৎ উপার্জন, রক্ষণ ভাবনাদি পরিত্যাগ করতে হবে।

ভেদাভেদ নাহি জানে শত্রু-মিত্র পক্ষে,

মান অপমান তুল্য যাহার সমক্ষে।

সর্বকর্ম পরিত্যাগী হইবে যখন,

তখন ত্রিগুণাতীত জানিবে সেজন।

অনন্য ভকতিযোগে যেজন সেবে আমায়,

হয়ে সর্বগুণাতীত ব্রহ্মভাব সেই পায়।

ত্রিপদীতে বলা হল—

সকল কামনা বিষয়-বাসনা

ত্যজে সব তুচ্ছ গণি,

আপনি আপনে রহে তুষ্ট মনে

স্থিরবুদ্ধি সিদ্ধ মুনি।

দুঃখে নহে ক্লিষ্ট, নহে সুখে হৃষ্ট,

স্পৃহাশূন্য নিরময়,

কামনাবিহীন, ভয়-ক্রোধহীন,

স্থিরবুদ্ধি তারে কয়।

লেখক দ্বৈত-অদ্বৈতবাদের দ্বন্দ্বে নিজেকে জড়ান নি। তিনি আস্থা স্থাপন করেছেন, ‘যে যথা মাং প্রপদ্যতে তাংস্তথৈব ভজাম্যহং’ শ্লোকে। যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে তাকে আমি সেইভাবেই তুষ্ট করি। সাকার ও নিরাকার দুই উপাসনাই তুল্যমূল্য। কোনোটিই নিষ্ফল নয়। লেখকের দৃঢ় প্রত্যয় ‘গীতার ধর্ম ভক্তিপ্রধান ধর্ম’; লেখক গীতার ধর্মকে ঈশ্বরবাদ বলার পক্ষপাতী।

গীতার ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ আলোচনাকালে লেখক বলেন :

আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য জ্ঞান, প্রেম ও কর্মোদ্যম, মানুষের আত্মা এই তিনটি অবয়বের সুসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। এই হেতু গীতা জ্ঞান ও কর্মযোগের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তিযোগের মাহাত্ম্য প্রদর্শন করিয়াছেন

গীতায় একদিকে জ্ঞান ও কর্ম অন্যদিকে প্রেম ও ভক্তি। লেখক স্বীকার করেছেন গীতায় জ্ঞানীর উচ্চ আসন স্বীকৃত, কিন্তু ভক্তের প্রতি ভক্তবৎসল ভগবানের বিশেষ অনুগ্রহ ও প্রেম। দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, গীতা থেকে এর স্বপক্ষে—

যোগিনামপি সর্বেষাং মদগতেনান্তরাত্মনা।

শ্রদ্ধাবান ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।। ৬/৪৭

ভক্তের প্রতি ভগবান সদাই প্রসন্ন। ভক্তের বিনাশ নেই। তিনি সবসময়ে তার সঙ্গে থাকেন ও রক্ষা করেন। ভক্তের লক্ষণ লেখকের ভাষায়—

নাহি দ্বেষ কোন জনে বাঁধে সর্বে মৈত্রী গুণে,

সর্বজীবে সকরুণ প্রাণ;

নির্মল নিরহংকার, সুখ-দুঃখ সম যার,

শত্রুকেও সেই ক্ষমাবান।

যো মাং পশ্যতি সর্ব সর্বং চ ময়ি পশ্যতি।

তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।

নাহি শোক, হর্ষ, দ্বেষ নাহি অহঙ্কার লেশ,

শুভাশুভ না করে বিচার

আমাতে অচলা ভক্তি, আমায় অনন্যাসক্তি,

সেই ভক্ত, প্রিয় সেআমার।

লেখক কর্মযোগ নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা করেছেন। প্রথমেই বলে নিয়েছেন ‘জ্ঞান ও কর্ম, এ উভয়ের যোগেই মানুষের মনুষ্যত্ব।’ তিনি বিশ্বাস করেন জ্ঞান ও কর্ম থেকে বিযুক্ত হলে তা কখনই শ্রেয়স্কর হয় না।

গীতায় কথিত হয়েছে—

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যে দকর্মণং।। ৩/৮

নিয়ত কর্ম কর, কর্ম অকর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ। অকর্মে শরীর নির্বাহ হবার নয়।

অর্জুন স্বজনদের দেখে যুদ্ধবিমুখ হলে কৃষ্ণ বলেছেন—

সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ

ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্সসি। ২/৩৮

সুখ-দুঃখ, লাভালাভ, জয়-পরাজয় তুল্য জ্ঞান করে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হও, তোমার এতে কোনো পাপ নেই।

কৃষ্ণের বক্তব্য, কর্মত্যাগ অসম্ভব, তবে কর্ম যাতে মঙ্গলকর হয় সেদিকে নজর রাখা চাই। তাছাড়া ফলাকাঙ্খা পরিত্যাগপূর্বক কর্তব্যবুদ্ধিতে কর্ম করা চাই।

কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়। ফলাকাঙ্খা করে কোনো কাজ করা উচিত নয়। সকাম যেমন দোষের, কর্মত্যাগও তেমনি দোষের। যোগস্থ হয়ে কর্ম করা চাই অর্থাৎ আসক্তিশূন্য হয়ে। তাছাড়া কতৃত্বাভিমান শূন্য হয়েও কাজ করতে হবে। তৃতীয়ত, ঈশ্বরে ফলাফল সমর্পণ করে কর্ম করতে হবে।

কর্মাসক্তি যেমন দোষের, কর্মত্যাগও তেমনি দোষের। পঞ্চম অধ্যায়ের শুরুতে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণ জানিয়েছেন কর্মযোগ ও সন্ন্যাস—ঐ দুয়ের মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ, কর্মযোগ ব্যতীত সন্ন্যাস দুঃখের, তবে দুইয়েই মুক্তিলাভ ঘটে।

জ্ঞানবাদীদের সঙ্গে কর্মবাদীদের দীর্ঘদিনের বিরোধ। জ্ঞানবাদীরা কর্মকান্ডের বিরোধী। উপনিষদের আচার্যরা ছিলেন জ্ঞানবাদী। মীমাংসকেরা কর্মবাদী। লেখক গীতাকে এই বিরোধের নিষ্পত্তি করতে দেখেছেন—

ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম প্রাহুর্মনীষিণঃ।

যজ্ঞদানতপঃ কর্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে।। ১৮/৩

কেউ বলেন কর্ম দোষাবহ, কারো মতে যজ্ঞ, দান, তপঃ, কর্ম দোষের নয়, গীতায় বলা হল—

যজ্ঞদানতপঃকর্ম ন ত্যাজ্যং কার্য্যমেব তৎ।

যজ্ঞোদানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম।।।

এতান্যপি তু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত ফলানি চ।

কর্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমং।।

নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্মণো নোপপদ্যতে

মোহাৎ তস্য পরিত্যাগস্তামসঃ পরিকীর্তিতঃ।। ৫/ ৬-৭

আসক্তি ও ফলকামনা করে যজ্ঞ, দান, তপস্যা ইত্যাদি কাজের অনুষ্ঠানের পক্ষে কৃষ্ণ মত দিয়েছেন, তবে অবশ্যই আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করে। নিত্য নিয়মিত কর্মত্যাগ বিধেয় নয়। মোহবশত এইসব কর্মত্যাগ তামস বলে বিবেচিত হয়।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, অনাসক্ত চিত্তে কর্ম করলে, কর্তব্যবুদ্ধির প্রেরণায় কাজ করলে কর্ম কখনই বন্ধন হয়ে ওঠে না। লেখকের মতে, ‘গীতা যদিও জ্ঞানবাদী, তথাপি তিনি কর্মসন্ন্যাসের অনুমোদন করেন না।’

গীতার আদর্শ যোগী কর্ম করেও কর্মে পদ্মপাতার জলের মত নির্লিপ্ত, সংসারে থেকেও সাংসারিক সুখ-দুঃখে অবিচলিত, সর্বভূতে সমদর্শী, সর্বভূতহিতে রত, জিতেন্দ্রিয়, ব্রহ্মনিষ্ঠ ও ক্রিয়াবান।

দি ভাগবদগীতা

রমেশ এস. বালশেখর

এই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে লেখক ভাগবত গীতার নির্বাচিত কয়েকটি অধ্যায়ের নির্বাচিত কিছু শ্লোকের ইংরেজি অনুবাদ তৎসহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লেখকের ব্যাখ্যাগুলিতে কিছু অভিনবত্বের সন্ধান মেলে। লেখক ৩য় অধ্যায়ের ৫নং শ্লোকের ব্যাখ্যায় বলেছেন কর্মের ফল নির্ভর করে এমন কিছুর ওপর যার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। লেখক বলেছেন—The energy within the body-mind organism will continue to produce activity in accordance with the natural characteristics with which the organism was conceived and created.

লেখক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, কারো কি D.N.A’-র ওপর অথবা যে পরিবেশে জীবসত্তার উদ্ভব তাকে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব?

৬নং শ্লোকের লেখক কৃত-ব্যাখ্যা হল কিছু কিছু কাজ থেকে আমরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারি এটা সম্ভব, কিন্তু কষ্টকর হল এমন কাজ করার চিন্তা থেকে মুক্ত রাখা মনকে, লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

It is the energy within the body-mind organism that produces actions according to the natural characteristics of the organism.

লেখক জীবসত্তার ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর একটি প্রশ্ন লেখক তুলেছেন, একই অধ্যায়ের ২৭ ও ২৮ সংখ্যক শ্লোকের ব্যাখ্যায়—‘সাধারণ মানুষ যেটিকে তার কৃতকর্ম বলে মনে করে আসলে তা reaction produced by the brain in response to the senses when they meet their respective objects.’

চতুর্থ অধ্যায়ের ১০ নং শ্লোকের ব্যাখ্যায় লেখক পরামর্শ দিয়েছেন, যে কেউ যে কোনো পথকেই অবলম্বন করুক, নিজেকে কোনভাবেই কর্মসম্পাদনকারী রূপে বিবেচনা করবে না—‘not getting involved in attachment, fear and anger.’

জ্ঞানযোগের ১৮ সংখ্যক শ্লোকের ব্যাখ্যায় জ্ঞানী কে তা নিরূপণে বলেছেন যিনি কর্মে অকর্মকে প্রত্যক্ষ করেন, নিষ্কর্মকে প্রত্যক্ষ করেন কর্মে—the inaction that is in action, and the action that is non- action, is wise among men.

একই অধ্যায়ের ২৪ সংখ্যক শ্লোকের ব্যাখ্যায় লেখক প্রতিটি কর্মেই যিনি ব্রহ্মকে প্রত্যক্ষ করেন তিনি ব্রহ্মেই লীন হন বলে বলেছেন :

If in every action, a man recognizes Brahman, he will verily be absorbed into Brahman.

ভক্তিযোগের দ্বাদশ সংখ্যক শ্লোকের প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য একাগ্রতার তুলনায় অনেক বেশি কাম্য হল সারাটা দিনে ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন থাকা।

You should keep Him in your heart always; a true conviction that all there is God or totality, which prevails all the time.

অহংবোধকে নির্মূল করা চাই আমি ঈশ্বর-আরাধনা করছি, কি কোনো কাজ করছি এ বোধ বিসর্জন দেওয়া চাই।

দি ভাগবদগীতামোহিনীমোহন চ্যাটাজী

মোহিনীমোহন চ্যাটার্জী রচনা করেছেন The Bhagavad Gita or The Lord’s lay, প্রকাশকাল জুলাই ২০, ১৮৮৭। অর্থাৎ গ্রন্থটি এখন থেকে প্রায় ১২৫ বছর পূর্বেকার। গীতার শ্লোকগুলি লেখক ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। ভূমিকায় লেখক তুলনামূলকতার নিরিখে বিস্তারিতভাবে শঙ্করাচার্য, রামানুজাচার্য এবং মাধবাচার্যের ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

লেখক কর্মযোগের শ্লোকগুলির ইংরেজি অনুবাদ করে কর্মযোগের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সূত্রাকারে সন্নিবিষ্ট করেছেন।

i) Action is indispensable for all but the spiritually wise.

ii) Even they may at their chyice act for the benefit of the world.

iii) The unwise are bound by the desire for the fruits of action.

iv) The wise are freed by knowing that the Ego is distinct from quality and action page-70

গ্রন্থশেষে সন্নিবিষ্ট Synopsis-এ লেখক তাঁর নিজের মত করে কর্মযোগের ব্যাখ্যা করেছেন, বলেছেন :

A life of right action is the means of purifying the heart for the reception of true spiritual consciousness by which the life of darkness and evil, our common human nature is ended.

……. the performance of right action consists in the fulfilment of duties to God and man, accepting duties as the commands given by God for the well-being of man and doing them for the love of God alone and not for the purpose of any personal gain. (page-271)

জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বললেন :

The ‘fire of knowledge’ destroys ignorance, which produces the idea that ‘I am the actor’ consequently in the absence of the consciousness of being the actor no action can take place, nor can affect of past actions persist after their basis is thus removed. This is how knowledge removes sins, which cannot exist disconnected with the agent, the personality. (page-91)

ভক্তিযোগপ্রসঙ্গে লেখকের অভিমত হল :

Those who realize that the Deity is in the veriest reality the true Ego are his very self. Among the rest, those who lose themselves in Him through the power of all absorbing love are the best devotion whose spirituality is lower than what has been described; by keeping these they can by degrees attain to perfect devotion and find God. (page-274)

মোহিনীমোহন গীতার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, দার্শনিক ব্যাখ্যায় যান নি। তাছাড়া তিনি যে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যে ভক্তিযোগকেই গুরুত্বদানে অধিক তৎপরতা দেখিয়েছেন, তা তাঁর মন্তব্যেই স্পষ্ট :

Human nature is one, God is but one, and the path of salvation, though many in appearance, is really but one. (page-274)

মোহিনীমোহন গীতার শ্লোকগুলির আক্ষরিক অনুবাদ করেন নি, ঝোঁক দিয়েছেন ভাবানুবাদে। দু’একটি দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হল—

i) By far action is inferior to knowledge (page-64)

ii) The same man cannot be devoted to pure spiritual knowledge and also to action. (page-64)

iii) Proper action is made up of religious and mortal duties and our bodily voyage is the fulfilment of the purpose of existence. (page-66)

iv) My devotee is never destroyed. (ix/31)

v) Of thou the wise men … is the best. (vi-17)

vi) If thou wert the greatest evil-doer among all unrighteous thou shalt cross over all sins, even by the back of knowledge. (iv/36)

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

নবীনচন্দ্র সেন

রঙ্গমতী রচনার পর নবীনচন্দ্র ঝুঁকেছিলেন একই ধারায় কতকগুলি কাব্যরচনার দিকে। রচনা করলেন যীশু খ্রিস্টের জীবনী অবলম্বনে ‘খ্রিস্ট’ (১২৯৭), বুদ্ধের জীবনী অবলম্বনে ‘অমিতাভ’ (১৩০২), চৈতন্যজীবনী অবলম্বনে ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯), এছাড়াও পদ্যানুবাদ করলেন ভগবদগীতার (১৮৮৯) এবং মার্কন্ডেয় চন্ডীর (১৮৯৪)। অর্থাৎ নবীনচন্দ্র এই পর্যায়ে উপজীব্য করেছিলেন অবতার-মহাপুরুষ-জীবনী কিংবা ধর্ম, সংক্রান্ত বিষয়কে। আমাদের আলোচ্য গীতা। নবীনচন্দ্র মাত্র পাঁচ বৎসরের ব্যবধানে ভগবদগীতা ও মার্কন্ডেয় চন্ডীর পদ্যানুবাদ করেন। প্রথমে গীতার অনুবাদ, তারপর চন্ডীর। শ্রীমদ্ভগবদগীতার মুখবন্ধে কবি লিখেছেন :

আমি মূর্খ, ভগবদগীতার মর্ম কী বুঝিব? গীতা জগতের অদ্বিতীয় ধর্ম গ্রন্থ। …… জগতের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থরাশি এই গীতা সাগরে বিলীন হইয়া যায়। ইহার অভিনেতা স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভারতের অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর অর্জুন।

কবির এই মন্তব্যে স্পষ্ট ভগবদগীতার অদ্বিতীয়ত্বে কবির সীমাহীন আস্থা ও বিশ্বাস, তাঁর বিচারে গীতা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ। গীতার উদ্দেশ্য কবির চোখে যা ধরা পড়েছে তা হল :

অনন্ত জ্ঞানসিন্ধু মন্থন করিয়া মানবজাতির জন্য পরম ধর্মামৃত বা চরম মনুষ্যত্ব উদ্ভাবন …..।

নবীনচন্দ্র গীতার কাব্যানুবাদ করেন নি, করেছেন পদ্যানুবাদ যদিও তিনি স্বীকার করেছেন :

কাব্যাংশেও গীতা অতুলনীয়।

প্রশ্ন, কেন কবি গীতার কবিত্বকে শিরোধার্য করলেও নিজে কাব্যানুবাদে প্রয়াসী হলেন না? কারণ দ্বিবিধ, কবি গীতাকে উপজীব্য করে কাব্য রচনা করতে চাননি। তিনি সম্যকরূপে অবগত ছিলেন কাব্য এবং ধর্মগ্রন্থের রূপগত পার্থক্য বিষয়ে। কিন্তু তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল :

প্রকৃত মনুষ্যত্ব শিক্ষা দেওয়াই উভয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য।

অর্থাৎ রূপগত ভাবে কাব্যের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের পার্থক্য থাকলেও উভয়ের একদিকে সাযুজ্য তা হল উদ্দেশ্যের নিরিখ, তা হল মনুষ্যত্বের শিক্ষাদান। কবির দৃষ্টি এই বিষয়েই নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু আমরা দ্বিবিধ কারণের উল্লেখ করেছি, তাহলে দ্বিতীয় কারণটা কী? সেটি হল, গীতা বিষয়ে কবির গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তাই পরম যত্নে তিনি গীতার শ্লোকগুলির যথাসাধ্য আক্ষরিক অনুবাদে মনোযোগী হয়েছিলেন। গীতার আক্ষরিক অনুবাদে যিনি নিবিষ্ট-চিত্ত, তাঁর পক্ষে কবিত্বের দিকে দৃষ্টিপাত সহজ ছিল না। কবি কোনভাবেই তাঁর মনোযোগকে দ্বিধাবিভক্ত হতে দেন নি। যদি কবি অন্যান্য অনেকের মত গীতার ভাবানুবাদে ব্রতী হতেন, সেক্ষেত্রে কবিত্বমন্ডিত অনুবাদ মিলত। কবি আক্ষরিক অনুবাদ করাতেই গীতার কাব্যানুবাদের পরিবর্তে পদ্যানুবাদে প্রয়াসী হয়েছিলেন। লক্ষ্য করা যায়, কবি ছন্দোবৈচিত্র্য আনয়নে যত্নবান ছিলেন কিন্তু কাব্যের খাতিরে স্বীকার করতে হয় অমিত্রাক্ষর পয়ারে কবি কাঙ্ক্ষিত উৎকর্ষ দেখাতে পারেন নি। শুধু তাই নয়, মিত্রাক্ষরেও কবি তেমন কোনো বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর রাখেন নি। আমরা এইবার কবির অনুবাদের কিছু নিদর্শন গ্রহণ করব।

ক. ন কর্মণামনারম্ভা ন্নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোশ্নুতে।

ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি।। ৪।। ৩য় অধ্যায়

নাহি আরম্ভিলে কর্ম না পায় নৈষ্কর্ম্য নর,

কেবল সন্ন্যাসে সিদ্ধি না হয়, বীরবর।

খ. নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈগুণে:।। ৫।। ৩য় অধ্যায়

অকর্মা থাকিতে কেহ নাহি পারে কদাচিত,

প্রাকৃত গুণেতে সবে হয় কর্মে নিয়োজিত।

গ. যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোন্যত্র লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ।

তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।। ৯।। ৩য় অধ্যায়

যজ্ঞার্থ করিবে কর্ম,

অন্যকর্ম মানুষের বন্ধন কারণ,

অতএব হে কৌন্তেয়!

অনাসক্ত হয়ে কর্ম কর আচরণ।

ঘ. তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।

অসক্তো হ্যাচরণ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।। ১৯।। ৩য় অধ্যায়

অনাসক্ত কর্ম তুমি কর সদা আচরণ

অনাসক্ত কর্মচারী পুরুষ লভে পরম।

ঙ. যথৈধাংসি সমিদ্ধোহগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতের্জুন।

জ্ঞানাগ্নি: সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা।। ৩৭।। ৪র্থ অধ্যায়

প্রজ্বলিত যথা কাষ্ঠ করে ভস্ম হুতাশন,

সর্ব কর্ম ভস্মসাৎ জ্ঞানাগ্নি করে তেমন।

চ. ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে।

তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।। ৩৮।। ৪র্থ অধ্যায়

জগতে কিছুই নাই পবিত্র জ্ঞানের মত।

যোগসিদ্ধ যথাকালে আত্মাতে হয় বিকিত।।

ছ. শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ।

জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাবিগচ্ছতি।। ৩৯।। ৪র্থ অধ্যায়

তৎপর সংযতেন্দ্রিয়, শ্রদ্ধাবান, লভে জ্ঞান।

লভি জ্ঞান, পায় শীঘ্র পরম শান্তি নিদান।।

জ. সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সর্বত্র সমবুদ্ধয়।

তে প্রাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতা:।। ৪।। ১২শ অধ্যায়

সংযমি ইন্দ্রিয়গণ, সমবুদ্ধি সমুদায়।

সর্বভূতহিতে রত, তারাই আমাকে পায়।।

ঝ. সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।

ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।। ১৪।। ১২শ অধ্যায়

ক্ষমী, সদাতুষ্ট, যোগী, দৃঢ়ব্রতী, জিতেন্দ্রিয়,

মদর্পিত-মন-বুদ্ধি যে ভক্ত, সেমম প্রিয়।

ঞ. যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ।

হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ।। ১৫।। ১২শ অধ্যায়

না দেয় উদ্বেগ লোকে, নহে সেউদ্বেগনীয়,

হর্ষ ক্রোধভয়োদ্বেগমুক্ত যে, সেমম প্রিয়!

ট. যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি না শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।

শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান যঃ স প্রিয়ঃ।। ১৭।। ১২শ অধ্যায়

নাহি হর্ষ দ্বেষ যার; নাহি শোক বাঞ্ছনীয়

শুভাশুভ পরিত্যাগী ভক্তিমান, মম প্রিয়।

এই প্রেক্ষিতে সমালোচক যখন বলেন :

এই অনুবাদ আক্ষরিক হইলেও আদৌ সুখপাঠ্য নহে, ভাষা ও ছন্দে তিনি নিন্দনীয় অবহেলা দেখাইয়াছেন।১

তখন সেই মন্তব্যকে আমরা এককথায় নাকচ করে দিতে পারি না। তথাপি কবির অনুবাদটির একাধিক সংস্করণ প্রমাণ করে যে, এটি সেকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা ও মান্যতা লাভ করেছিল।

দি ভাগবদগীতা

এ. মহাদেব শাস্ত্রী

A. Mahadeva Shastri-র শঙ্করাচার্যের গীতা-ভাষ্যের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৯৭ সালে। কর্মযোগ- সংক্রান্ত তথ্যাদি হল এইরকম-জ্ঞানযোগ হল সন্ন্যাসীদের জন্য। কর্মের প্রতি নিষ্ঠা এবং জ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠা বিপরীতমুখী। তাই কোনো একজনের পক্ষে একই সময়ে একসঙ্গে এই দুয়ের পথ অবলম্বন করা সম্ভব নয়। প্রতিটি পথেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব, স্বতন্ত্রভাবে, আপাতভাবে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। আসলে কর্মে নিষ্ঠা হল লক্ষ্যে উপনীত হবার একটি মাধ্যম মাত্র। তাও প্রত্যক্ষভাবে নয়, জ্ঞানযোগে উপনীত হতে তা সহায়তা করে মাত্র। কিন্তু জ্ঞানযোগে নিষ্ঠা যা নাকি কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে প্রাপ্তি ঘটে, তা প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্যে উপনীত হতে সহায়তা করে।

কর্মযোগ হল মাধ্যম যার সাহায্যে কর্ম থেকে অব্যাহতি লাভ ঘটে।

Devotion to action is the means of attaining freedom from activity. (page-94)

আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে কর্মযোগ জ্ঞানযোগে উপনীত হতে মাধ্যমরূপে কাজ করে। কর্মযোগ আত্মোপলব্ধি ঘটাতে মাধ্যমরূপে ভূমিকা নেয়। জ্ঞানযোগ ছাড়া নিছক কর্মত্যাগে কখনই শ্রেষ্ঠত্বে উপনীত হওয়া সম্ভব নয় :

Nobody can attain perfection, freedom from activity, or devotion in the path of knowledge by mere renunciation, by merely abandoning action, without possessing knowledge. (page-95)

কর্মই বন্ধনের কারণ এ ধারণা ভ্রমাত্মক। ঈশ্বরের জন্য কৃত কর্ম কখনই বন্ধনের কারণ হতে পারে না। আসক্তিহীন হয়ে কাজ করতে হবে।

কর্মযোগ অজ্ঞানদের অন্য নির্দিষ্ট। সেই পর্যন্ত কর্মযোগের শরিক থাকতে হবে যে পর্যন্ত নিজের সম্পর্কে জ্ঞান না হয়। বলা হয়েছে :

the man who knows not the self and is therefore qualified (for action only) should resort to Devotion to action as a means of attaining Devotion to knowledge …. who knows not the self and is (therefore) qualified for action should perform it. (page-102)

জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গে বলা হল প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা যেমন জ্বালানিকে ছাইয়ে পরিণত করে তেমনি জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্মকে ছাইয়ে পরিণত করে। বাস্তবে কি এমনটা ঘটে? বলা হল :

The fire of wisdom cannot indeed literally reduce action to ashes as fire reduces fuel to ashes. (page-150)

তাহলে আসল বক্তব্য কী দাঁড়াল?

right knowledge is the cause which renders all actions important. But the actions by which their body has been brought into existence will come to an end only when thus effects will have been fully worked out; for, those actions have already commenced there effects. (page-150)

তাহলে জ্ঞান কী করে?

wisdom can destroy only such actions as have not yet begun to produce their effects, whether they are actions done in this birth before the rise of knowledge and along with knowledge, or those done in the many previous births. (page-150)

বিশ্বাসী মানুষই জ্ঞানার্জন করে। এই জ্ঞানার্জনের গতি শ্লথ হতে পারে কিন্তু জ্ঞানার্জন হবেই, he should ever be intently devoted to the means of obtaining wisdom ….। যে মানুষের বিশ্বাস আছে, ভক্তিও আছে, সেযে ইন্দ্রিয়গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম, এমনকি নাও হতে পারে, তাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, he should withdraw his senses away from thus engrossment in objects, মোদ্দা কথা হল, জ্ঞানার্জন তারই পক্ষে সম্ভব যার বিশ্বাস আছে, ভক্তি আছে আর আছে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ—such man of faith, devotion and self-control is sure to obtain wisdom. (page-151)

ভক্তিযোগে বলা হয়েছে, সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিই শান্তিলাভের অধিকারী যিনি কর্মযোগের শরিক হয়েও কর্মফল ত্যাগ করেন। কর্মযোগের সঙ্গে যোগ অজ্ঞানতার। কর্মযোগ কখনই অক্ষরের উপাসক হতে পারে না —Knowledge is not meant for the worshipper of the Akshara, যিনি অক্ষরের উপাসক তিনি ঈশ্বর এবং নিজের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পান না। কর্মযোগীর পক্ষে অক্ষরের উপাসনা অসম্ভব। অক্ষরের উপাসনা স্বতন্ত্র, কৈবল্য লাভের প্রেক্ষিতে। ঈশ্বর এঁদেরই পরিত্রাণ করেন—‘for them I become the deliverer’.

দি হিন্দু ফিলজফি অফ কনডুয়েল বিয়িংএম. রঙ্গাচার্য

১৯১৪ সালে এম. রঙ্গাচার্য রচনা করলেন The Hindu Philosophy of Conduel Being, যেটি আসলে ভাগবত গীতা সংক্রান্ত তাঁর বক্তৃতা। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক তিনটি মার্গের বিষয়ে আলোচনাপ্রসঙ্গে প্রতিটি মার্গেরই অনন্যতা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং বলেছেন সকলের জন্য সব মার্গ আদর্শ নয়। ব্যক্তি-বিশেষের মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নির্দিষ্ট করে দেয় কার জন্য কোন মার্গ আদর্শ।

……each marga has its own adhikarin, that is, each of these three paths has its specially worthy and qualified aspirant. The man of thought is generally seen to be unfit to be characterised either by highly accentuated emotion or by very energetic action, since both emotion and action are very often apt to act as hindrances in relation to calm meditation and deep thought. Similarly, the man of emotion cannot easily manage to be either a man of thought or a man of steady and purposeful action. And the man of action is generally so taken up with what he has to do, that he finds next to no time to bestow on thought or to spend in experiencing of any emotional excitement. Therefore, each of these typical religious pilgrims must have his own road for travelling towards the common goal of salvation and God attainment; and we have now been assured that there are such special roads meant for the use of such special pilgrims. (iv, page-352)

লেখক বিস্তারিতভাবে কর্ম মার্গের আলোচনা করেছেন। রঙ্গাচার্যের দৃষ্টিতে কর্ম মার্গ বৈদিক অনুষ্ঠান মাত্র। যাঁরা বৈদিক ক্রিয়া কর্মে তন্বিষ্ট তাঁরা ব্যক্তিগত বাসনা তাড়িত এঁদের পক্ষে প্রকৃতির প্রভাবমুক্ত হওয়া সম্ভব নয় :

The other meaning of Karma-marga as the path of vedic ritualism has also to be taken into consideration. Is that also a path which is capable of leading men to the goal of God attainment?

…… those who follow this path of ritualism (vedic path of ritualism) and more or less full their lives with the performance of Vedic sacrifices, are persons that are actuated by selfish desire aiming at the enjoyment of pleasure and prosperity and cannot therefore rise above the influence of the three qualities of Nature so fully as to become fit at once for securing the salvation of self-realization and God attainment. The Vedic path evidently seemed to Him to be not quite worthy of being adopted by aspirants after the salvation of Moksha. (page 352)

কর্মমার্গ হল :

the path of duty done for duty’s sake with path of religious ceremonilism.

লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বৈদিক যাগ-যজ্ঞ-বলিদানের মাধ্যমে ঈশ্বরারাধনা আসলে আনুষ্ঠানিক কৃত্য ব্যতীত কিছুই নয়। বৈদিক আচার লেখকের মতে ব্যক্তিস্বার্থকে শুদ্ধতা দানের প্রয়াস মাত্র।

Vedic ritualism merely trends to sanctify sclfishness, so to say….

লেখকের দৃঢ় প্রত্যয়, স্বার্থপর মানুষ সহজে নি:স্বার্থপর হতে পারে না। মানুষের অন্তরকে আগে মুক্ত করতে হবে wishfulness of the will থেকে।

জ্ঞানযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য হল কেবল ‘Saintly philosopher’-রাই এই পথের পথিক হতে পারেন। চিন্তার পবিত্রতা রক্ষার্থে নিয়মিত অভ্যাস ও অনুশীলন আবশ্যক :

the way of knowledge … requires the practice of what we have called the austerity of thought.

ভক্তিযোগ সম্পর্কে লেখক বললেন :

The second is the way of loving devotion, and requires the aspirants’ rapture of ecstatic Love of God to be so intense as to make it impossible for him to consider anything other than God to be worthy of his love and attachment.

লেখক তিনটি পথের সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত ব্যাখ্যা করেছেন, তিনটি পথের বৈশিষ্ট্য উল্লিখিত হয়েছে মাত্র কিন্তু কোনটি শ্রেষ্ঠ সেসম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি।

শ্রীমদ্ভগবদগীতোপনিষদ

ক্ষীরোদনারায়ণ ভুঁয়া দাস

শ্রীমদভগবদগীতোপনিষদ, লেখক ক্ষীরোদনারায়ণ ভুঁয়া দাস, তৃতীয় অধ্যায়টির রচনাকাল ১৩৩৩, কৃষ্ণভাবিনী ব্যাখ্যাযুক্ত। লেখক জীবিকায় ছিলেন হাইকোর্টের উকিল।

লেখকের কৃতিত্ব গীতার্থ ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে সেই সেই বিষয়ে উপনিষদাদির ধারাসমূহ উপস্থিত করেছেন। অনুক্রমণিকায় গীতার ভাব ভাগবতে কেমন প্রপূর্তি লাভ করেছে তা দেখিয়েছেন। লেখক নিজ মতানুসারে এই টীকা রচনা করেছেন, প্রচলিত ভাষ্য ও টীকাসমূহের সঙ্গে আলোচ্য গীতার তাৎপর্য বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ঐকমত্য স্থাপিত হয়নি। সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যামুক্ত। ‘হিতবাদী’র মন্তব্য, ‘গীতার প্রকৃত কর্ম ভুঁয়া মহাশয় নিজে ভক্তের মত বুঝিয়াছেন, জ্ঞানীর মত বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।’ গীতার সামঞ্জস্য বিধান দুরূহ উপলব্ধি করে লেখক মহাভারতের নানা স্থান অনুসন্ধান করে গীতার প্রকৃত ব্যাখ্যাদানে সচেষ্ট হয়েছেন। পুরাণ শাস্ত্রে এঁর অধিকারের প্রমাণ পাই। টীকা প্রণয়নে গ্রন্থকারের শ্রমের স্বাক্ষর বিদ্যমান।

লেখক তৃতীয় অধ্যায়টিকে কর্মযোগ বলে স্বীকার করেন নি, তাঁর মতে এটি হল ‘স্বধর্মপালনযোগ’।

চতুর্থ অধ্যায়টির প্রকাশকাল ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ। লেখকের মতে এটি জ্ঞানযোগ নয়, কৃষ্ণভক্তিপ্রাপ্তি যোগ। জ্ঞানযোগে জ্ঞানের দ্বারা অবিশ্বাসকে ভেদ করার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানরূপ অসি, জ্ঞান অসির দ্বারা সংশয় ছেদন করতে হয়। কর্ম বিষয়ে জ্ঞান অগ্নির মত কাজ করলেও, কর্মকে দগ্ধ করলেও সংশয় বিষয়ে কিন্তু জ্ঞান সেরূপ কার্য করে না। অর্থাৎ মূলে অজ্ঞানতা থেকেই যায়। এই অজ্ঞানতা দূরীকরণে মায়ার অতীত হতে হয়। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, জ্ঞানের নিত্য সহচর দম্ভ। অহমিকা জ্ঞানের মজ্জাগত কলঙ্ক। একমাত্র ভগবৎ-জ্ঞান লাভ করলে এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।

দ্বাদশ অধ্যায়টির প্রকাশকাল ১৩৪০ বঙ্গাব্দ। এই অধ্যায়ের আলোচনায় লেখক বললেন মহাত্মা ও কৃষ্ণভক্ত অভিন্ন নন। জ্ঞানী ও কৃষ্ণভক্ত এক নন। অন্য দেবভক্ত ও কৃষ্ণ ভক্ত অভিন্ন নন। তত্ত্ববিদদের মতে কৃষ্ণ ব্রহ্ম, কারো মতে তিনি পরমাত্মা, কারো মতে তিনি ভগবান। ত্রিবিধ কৃষ্ণ ভক্তের মধ্যে তর তম আছে কি? কৃষ্ণ দ্বাদশ অধ্যায়ে বলেছেন ব্রহ্মোপাসকের কথা, বলেছেন পরমাত্মারূপী কৃষ্ণোপাসকের কথা, কিন্তু নরবপু: কৃষ্ণের উপাসক বিষয়ে বললেন এঁরাই সর্বোত্তম ভক্ত।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

শ্রীধরস্বামী

শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১ম খন্ড, প্রকাশকাল ১৩৪০ বঙ্গাব্দ। মূল শ্লোক, অন্বয় শ্রীধরস্বামীকৃত টীকা, তার অনুবাদ সহ যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর আধ্যাত্মিকা দীপিকা-সম্বলিত ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল কতৃক আধ্যাত্মিকা দীপিকা বিশদভাবে ব্যাখ্যাত। ভূমিকা লিখেছেন গোপীনাথ কবিরাজ।

গ্রন্থে লেখক বলেছেন জীবের কল্যাণের জন্য ভগবান তিনটি উপায়ের কথা বলেছেন—জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম। বলেছেন, এই তিনটি পথ ব্যতিরেকে মোক্ষর অন্য পথ নেই। গীতায় এই তিনটি পথই সম্যকরূপে আলোচিত। বলা হয়েছে, কারো কর্মে অধিকার, কারো বা ভক্তিতে এবং কারো বা জ্ঞানে অধিকার। কিন্তু লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রত্যেককেই কমবেশি এই তিনটি পথই অবলম্বন করতে হয়, অবশ্য নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী বিশেষ একটি মার্গের প্রাধান্য থাকে। একটি পথ অবলম্বিত হলে অন্য দুটি যে অস্বীকৃত হবে এমন নয়।

অধিকাংশেরই জ্ঞানে অধিকার থাকে না, কারণ বৈরাগ্য ব্যতীত জ্ঞানপথে অধিকার হয় না, অথচ বিষয়ে বৈরাগ্য খুব কম লোকেরই দেখা যায়।

লেখক বলেছেন :

ভগবদ-বিষয়ক জ্ঞান দ্বারা যাহাদের সেই বৈষম্যবোধক অজ্ঞান নষ্ট হইয়াছে, আদিত্য যেরূপ তমোনাশ করিয়া নিখিল বস্তু প্রকাশিত করেন, সেইরূপ সেই আত্মজ্ঞান তাঁহাদের অজ্ঞান নাশ করিয়া পরিপূর্ণ ঈশ্বর স্বরূপকে প্রকাশিত করে।….. তাঁহাতেই যাঁহাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি আছে, তাঁহাতেই যাঁহাদের আত্মভাব অর্থাৎ মন লাগিয়া থাকে, তাঁহাতেই যাঁহাদের নিষ্ঠা অর্থাৎ প্রযত্ন তিনিই যাঁহাদের পরমাশ্রয়, এবং তাঁহার প্রসাদলব্ধ আত্মজ্ঞান দ্বারা যাঁহারা নিরস্ত পাপ, তাঁহারই অপুনরাবৃত্তি অর্থাৎ মুক্তিলাভ করেন।

জ্ঞানলাভের জন্য আবশ্যক অসংমূঢ়তা ও স্থিরবুদ্ধি। কিন্তু সত্য হল অত্যল্প লোকই এই অবস্থা প্রাপ্ত হন। অথচ জ্ঞান ব্যতীত যখন মোক্ষলাভ হয় না, তখন জ্ঞানলাভের জন্য সকল সাধককেই প্রয়াসী হতে হয়। এই জ্ঞানস্বরূপকে লাভের জন্য হৃদয়ে যে ঐকান্তিক অনুরাগ তাই হল দ্বিতীয় পথ অর্থাৎ ভক্তিযোগ। ভক্তিযোগ কাদের পক্ষে উপযুক্ত? যে পুরুষ অত্যন্ত বিরক্তও নয় আবার অত্যন্ত আসক্তও নয় তাঁদের পক্ষে। ভক্তিযোগ থেকেই উদ্ভব হয় জ্ঞানযোগের।

নিষ্কাম কর্মযোগের সাধনাই হল আত্মক্রিয় বা যোগাভ্যাস। এই ক্রিয়াযোগের কথা অভিব্যক্ত হয়েছে গীতার বিভিন্ন অধ্যায়ে। এই ক্রিয়াযোগ কি জ্ঞানী, কি ভক্ত কি কর্মী সকলের পক্ষেই একান্ত প্রয়োজনীয়। এটিই হল প্রকৃতপক্ষে কর্মযোগ, এই কর্মের দ্বারাই সমস্ত কর্ম ব্রহ্মার্পণ হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন ঠিকই কিন্তু সেই জ্ঞানলাভের উপায় হল যোগাভ্যাস।

লেখকের অভিমত ‘সাধক সেই আত্মজ্ঞান যোগ সংসিদ্ধি দ্বারা যথাকালে আত্মাতে স্বয়ংই লাভ করেন। কিন্তু কর্মযোগ ব্যতীত তাহা প্রাপ্ত হওয়া যায় না।’

কর্মযোগের অভ্যাস করতে হয়, তবেই আত্মবিষয়ক জ্ঞানের উৎপন্ন হয়। যোগাভ্যাসের দ্বারা যোগ্যতা অর্জন সম্ভব, যোগ্যতাপ্রাপ্তি ঘটলে অনায়াসেই জ্ঞানলাভ করা যায়। লেখকের সুস্পষ্ট অভিমত :

যোগী তপস্বী হইতে শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী হইতেও শ্রেষ্ঠ এবং কর্মী হইতেও শ্রেষ্ঠ।

ঈশ্বরের আরাধনা করতে হবে স্ব স্ব কর্মের দ্বারা। কোনো কর্মই নিষ্ফল বা হেয় নয় যদি তা ঈশ্বরার্পিত চিত্তে সাধিত হয়। ঈশ্বরার্পিত চিত্তে কর্ম সম্পন্ন করলে কোনো কর্মবন্ধন হয় না। ভগবান সর্বাত্মক, তাই আমরা যা কিছু করব, তা এমনভাবে করতে হবে যাতে তা ব্রহ্মে সমর্পিত হয়।

কর্ম সম্পাদনের অধিকার সকলেরই। কিন্তু জীবমাত্রেই স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে। লেখকের পরামর্শ :

যাহারা নি:স্বার্থভাবে কর্ম করতে পারে না, তাহারা স্বার্থবুদ্ধিতেই কর্ম করুক, তবুও তাহারা অলস ও কর্ম বিমুখ ব্যক্তিদিগের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

গীতা অধ্যয়ন

বিনয়েন্দ্রনাথ সেন

গীতা অধ্যয়ন, রচয়িতা বিনয়েন্দ্রনাথ সেন, প্রকাশকাল ১৯৩৪। পুস্তিকাটির ভূমিকা লেখক মহেন্দ্রনাথ সরকার। বিনয়েন্দ্রনাথ নববিধান মন্দিরে প্রতি সপ্তাহে গীতার ক্লাস করাতেন তাঁর প্রদত্ত মাত্র চারটি বক্তৃতাকে গ্রন্থমধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে। বিনয়েন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য হল দর্শন ও ইতিহাসের আলোয় গীতার ব্যাখ্যা, মহেন্দ্রনাথ সরকার বিনয়েন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন :

ঈশ্বরকে জীবনের ভিতর দিয়া, সমাজের ভিতর দিয়া, মৌন যোগের ভিতর দিয়া, জ্ঞানের সূক্ষ্ম বিচারের ভিতর দিয়া, প্রেমের নিত্য নবীন মধুরিমার ভিতর দিয়া পাওয়া ছিল তাঁহার মতে পূর্ণ রূপে পাওয়া।

বিনয়েন্দ্র জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ দুয়েরই আলোচনা করেছেন। জ্ঞানানুশীলনকে অবজ্ঞা করেন নি, কিন্তু ভক্তিযোগকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছেন। জ্ঞানের লক্ষ্য কী? না বহুকে একের দিকে নিয়ে যাওয়া। যিনি বহুর অতীতে এক, তাঁকে যার সাহায্যে জানা যায় তাই জ্ঞান। এ চর্চাতেও আছে আনন্দ, আছে আকর্ষণ, অপরদিকে ধর্ম ছাড়া ভক্তি হয় না। লেখক জ্ঞান ও ভক্তিযোগের পার্থক্য আলোচনা করেছেন :

জ্ঞানচর্চায় খালি পুঁথির সঙ্গে সম্বন্ধ, তার সংসার চাইনে, কর্মের ভেতরে তার কোনো আকর্ষণ নেই। অনেক বড় বড় লোক যাঁরা এই পথ ধরেছেন, তাঁদের খালি পুঁথি নিয়ে, আপনার ভেতরে আপনাকে নিয়ে সম্বন্ধ।

কিন্তু ভক্তির পথে মানুষের সঙ্গে মেলা চাই, সংসারের কর্ম আনন্দ জানা চাই। সংসারের নানা অবস্থার ভিতরে, সুখ-দুঃখের পেষণের মধ্যে, অবসাদ আনন্দের ভেতরে এই ভক্তিকে পাওয়া যায়। ভক্তি কী? লেখকের মতে :

এই সমস্ত অবস্থা, কর্মের ভেতর থেকে, এই কর্ম ভগবানে ন্যস্ত করা, ভগবানকে দিয়ে দেওয়া। শুধু যে কর্ম তাঁকে দেওয়া, তা নয়, সুখ আসুক, দুঃখ আসুক, আনন্দ আসুক, অবসাদ আসুক এ সমস্তই ভগবানকে দেওয়া।

লেখক গীতা ও st.Paul-এর বক্তব্যগত মিলের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তে এসেছেন :

কেউ কার কাছ থেকে সেটি পায়নি। এখানে যার যে আদর্শ সেটি প্রকাশ পেয়েছে, যদিও এ দুটি জিনিসে অনেক মিল দেখা যায়, কিন্তু এই দুটিকে প্রকাশ করবার ভাব (tone) আলাদা। (পৃ-৩৮)

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল

ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল কতৃক রচিত ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র ২য় খন্ড, প্রকাশকাল ১৩৪২।

লেখক মূল শ্লোক, অন্বয়, শ্রীধর স্বামী-কৃত টীকা ও তার বঙ্গানুবাদসহ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর আধ্যাত্মিক দীপিকা- সম্বলিত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।

দি ভাগবদগীতা

রামানন্দ প্রসাদ

ড. রামানন্দ প্রসাদ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, তিনি খড়গপুরের আই আই টির ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক। ইউনিভার্সিটি অফ টরেণ্টোর এম.এস. এবং Illinois বিশ্ববিদ্যালয়ের পি.এইচ. ডি.। তিনি আমেরিকান সোসাইটি অফ গীতার প্রতিষ্ঠাতা।

ড. প্রসাদের বইটি নানা বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত। মূল সংস্কৃত পাঠসহ সংস্কৃত শ্লোকগুলিকে রোমান হরফে উপস্থাপিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ২২৭টি শ্লোকের বিস্তারিত টীকা সন্নিবিষ্ট হয়েছে, প্রতিটি শ্লোকের ইংরেজি গদ্যানুবাদ ত আছেই। ১৩৩টি শ্লোক লাল হরফে মুদ্রিত করে দেওয়া হয়েছে গীতার প্রথম পাঠকদের জন্য। এই শ্লোকগুলি পাঠ করার পরেই সমগ্র গীতা অধ্যয়ন করার পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে। গীতার শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখক বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলির সাধু-সন্তদের শিক্ষা সেইসঙ্গে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, স্মৃতি, রামায়ণ, মহাভারত, ভক্তিসূত্র, ব্রহ্মসূত্র, যোগসূত্র তৎসহ বাইবেল, ধম্মপদ, কোরাণ থেকেও প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার করে দিয়েছেন। লেখকের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মমতের ঐক্যটিকে সন্ধান করা ও প্রতিষ্ঠা দান। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৪৪, প্রকাশস্থল ক্যালিফোর্ণিয়া।

লেখক দেহকে তুলনা করেছেন রথের সঙ্গে, রথের আরোহী হল ব্যক্তির আত্মা, রথের যাত্রা হল আধ্যাত্মিক যাত্রা, লক্ষ্য হল পরম ধর্মে উপনীত হওয়া যেখানে ভগবানের অধিষ্ঠান। রথের দুটি চাকা হল যথাক্রমে কর্তব্য এবং ত্যাগ। কৃষ্ণপ্রেম হল রথচক্রের অক্ষদন্ড। পথ হল সেবা, পথনির্দেশক হল স্বর্গীয় গুণাবলী, মন্ত্র হল অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীকরণের উজ্জ্বল আলো। রথের পাঁচটি ঘোড়া, তারা হল পঞ্চেন্দ্রিয়। বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনরা হল সহ পথিক। মননশীলতা হল রথের চালিকাশক্তি বা চালক।

কর্মযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বলেছেন, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে থেকে মানুষকে কাজ করতে হবে। আধুনিককালে মানুষকে দেবারাধনার জন্য কিংবা সাধনার জন্য বনে-জঙ্গলে যেতে হবে না, আধুনিক সমাজ- জীবনে কর্মযোগের মাধ্যমেই মানুষ তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে সক্ষম।

Karma-Yoga is the only austerity and penance in this age by which any one can reach God while living and working in the modern society without going to the mountains and jungles of the Himalayas. (page-54)

ঈশ্বরের জন্যই কাজ করতে হবে, তাতেই প্রত্যেকে উপকৃত হবে, লেখক তুলনা দিয়ে বললেন :

Everybody benefits if work is done for the Lord, just as every part of the tree gets water when water is put at the root of the tree rather than an individuals leave. (page-54)

জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বললেন জীবন, যেন প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা প্রতিমুহূর্তে সেখানে যজ্ঞের অনুষ্ঠান চলছে। প্রতিটি কাজকেই বিবেচনা করতে হবে যজ্ঞরূপে, পূত কর্মরূপে। স্মরণ করিয়ে দিলেন, everything is not Brahma, but Brahma is the root or basis of everything. মানুষ কখন মুক্তি পায়, কখন ব্রহ্মে বিলীন হয়?

When a person perceives Brahma in any action, and the things one uses as the reflection of Brahma and realizes that the every process of all actions is also Brahma. (page-69)

সবশেষে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। ভক্তিযোগ কী? Bhakti or devotion is the highest love for God. প্রকৃত ভক্তি কী? Real Bhakti is seeking God’s grace, and serving with love to please Him. লেখকের মতে, ভক্তি আসলে সেবা Bhakti is seva or doing one’s duty with love for Krishna in one’s heart …. Bhakti is granted by the grace of God. Loving relationship with God is easily developed through a personal God. (page-193)

অধিকাংশের পক্ষেই ভক্তির পথ সহজ কিন্তু এই ভক্তির জন্য প্রয়োজন কিছু গুণের বা শর্তের— Bhakti does not develop without a combination of personal effect, faith and the grace of God. (page-200)

সমূল-পদ্য গীতামৃত

পন্ডিত নিবারণচন্দ্র পাল

সমূল-পদ্য গীতামৃত, পন্ডিত নিবারণচন্দ্র পাল রচিত, প্রকাশকাল ১৩৫২ বঙ্গাব্দ।

জ্ঞানযোগের অন্তর্গত যদা যদা হি ধর্মস্য – শ্লোকের অনুবাদ —

যখনি যখনি ধর্মের গ্লানি অধর্মের হয় অভ্যুদয়,

নিজেরে সৃজন করিয়া তখন মম আগমন এখানে হয়। ৭

৮ নং শ্লোকের অনুবাদ (পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় …. )

সাধুসমূহেরে ত্রাণ করিবারে দুরাচারীদের বধিতে সবে,

ধর্মেরে পুনঃ সংস্থাপিবারে যুগে যুগে আমি জন্মি ভবে।

৩৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ—(শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং)

বিজিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবান যে গুরুর প্রতি,

পেয়ে মুক্তা হয়ে সেমহান লভয়ে মোক্ষ শীঘ্র অতি। ৩৯

৩য় অধ্যায়ের ২১ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ-(যদ যদাচরতি )

যাহা যাহা করে শ্রেষ্ঠ মানব সেগুলিই করে অন্যজন,

শ্রেষ্ঠ যা মানে প্রামাণিক বলে করে লোকে তারি অনুসরণ।

৫ নং শ্লোকের অনুবাদ—(ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি)

কদাচ কেহই কর্ম না করি ক্ষণমাত্রও স্থির না থাকে,

প্রকৃতিজ গুণ করিয়া অবশ কর্মে সবারে নিরত রাখে। ৫

৬ নং শ্লোক—(কর্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরণ)

বশে রাখি সব কর্মেন্দ্রিয়ে স্মরে যে মানসে বিষয় চয়,

সেবিমূঢ়াত্মা সাধক মিথ্যা কপটাচার যে তাহারে কয়। ৬

একাদশ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোক—(পশ্য মে পার্থ)

দেখ হে পার্থ! দিব্য বিবিধ শত সহস্র রূপ যে মম,

বহুল বর্ণ আকৃতি-পূর্ণ দেখ দেহ মোর বিশালতম। ৫

১৭ সংখ্যক শ্লোক—(কিরীটিনং গদি নং)

কিরীটী চক্রী গদাধারী তোমা হেরি সর্বতো দীপ্তিময়,

দীপ্ত-অনল-সূর্য-সদৃশ তব তেজোরাশি চোখে না সয়। ১৭

১৯ সংখ্যক শ্লোক—(অনাদি মধ্যান্তমনন্ত বীর্য ….)

শশী ও সূর্য নেত্র তোমার বদনে দীপ্ত অনল এযে,

আদি-শেষ-হীন-শক্তি-অসীম তাপিছ বিশ্ব বিষম তেজে। ১৯

২৫ সংখ্যক শ্লোক—(দংষ্ট্রা করালানি চ তে মুখানি … )

দংষ্ট্রা-করাল কালানল সম যত মুখ তব হেরিয়া হরি,

দিশে হারা আমি হে জগন্নিবাস! হও প্রসন্ন এ দাসোপরি।

মূল গীতার সংস্কৃত শ্লোকসহ অনুবাদ সম্পন্ন করা হয়েছে। পদ্যানুবাদ করা হয়েছে। মূলের সঙ্গে আক্ষরিক মিল বজায় রাখা হয়েছে। শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ কবিকে ‘গীতাকন্ঠ কবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

গীতায়ন

করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

গীতায়ন শীর্ষক পুস্তিকাটি শ্রীমদ্ভগবদগীতা অবলম্বনে রচিত (১৯৪৯)। তাই বলে এটি হুবহু গীতার অনুবাদ নয়। নিবেদনে অধ্যাপক তারাচরণ বসু বলেছেন :

গীতায় মনুষ্যের জন্য যে পরম সান্ত্বনা আছে, সেই দিব্যবাণীকেই ‘অণু’-রূপে আশ্রয় করিয়া, উহার ‘বাদ’টিকেই কবি আপন অন্তরের উপলব্ধিতে নূতন প্রতিরূপ দান করিয়াছেন . . . ।

পুস্তিকায় সংকলিত হয়েছে অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন, শ্রীকৃষ্ণের উক্তি দিব্য বাণীমালা, গীতায়ন, সাধন কথা, (পুনরায়) শ্রীকৃষ্ণের উক্তি, অর্জুনের প্রণতি, গীতা-লোকে এই কয়টি কবিতা। দীর্ঘতম রচনাটি হল ‘সাধন কথা’। ‘শ্রীকৃষ্ণের উক্তি’ শিরোনামায় একাধিক রচনা সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে।

‘গীতা-লোকে’ কর্মবাদের প্রতিফলন লক্ষণীয়—

কর্মে তাঁরে করিলে প্রীত হবে গো তাঁর প্রিয়,

যা কিছু কর, ফলের সনে তাঁরেই সমর্পিয়ো;

‘কর্মণ্যবোধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচনে’র অনুসরণ এখানে স্পষ্ট। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কে কে তাঁর প্রিয় তা বলেছেন—গীতায়নে তার কথঞ্চিৎ আভাস দেখি—

সমান যদি মানিতে পারো নিন্দা-নমস্কার,

মুনীরও মনোজয়ী যে, সেই মনোজও মানে হার,

মাণিক-সোনা-মৃৎ-পাষাণে রও উদাসী তুল্য জ্ঞানে

বিকার হেতু সন্নিধানে রহিবে অ-বিকার।

কবি হুবহু গীতার শ্লোকের অনুবাদে যত্নবান হননি। গীতার উপদেশের Spirit-কেই তিনি তাঁর মত করে রূপায়িত করেছেন ‘তুল্য নিন্দা স্তুতী মৌনী সন্তষ্ট যেন কেনচিৎ’—এর কাছাকাছি বক্তব্য পেশ করতে দেখা গেছে নিন্দা নমস্কারকে সমানভাবে গ্রহণ করার পরামর্শে, কিন্তু মাণিক-সোনা-মৃৎ-পাষাণ সবকিছুতেই উদাসীন থাকার বিষয়টি গীতায় কথিত হয়নি, এ হল কবির নিজস্ব সংযোজন।

‘অর্জুনের প্রণতি’ শীর্ষক কবিতায় অর্জুনের পরিবর্তিত রূপ প্রকাশ পেয়েছে, যে অর্জুন প্রিয়জনদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সম্মত হচ্ছিল না, কৃষ্ণের পরামর্শে ও বিশ্বরূপ দর্শনে তার সকল ভ্রান্তির নিরসন ঘটে। পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য সেপ্রস্তুত হয়। অর্জুন বলেছে—

তোমারি দেব-দেহের মাঝে, দেখিনু ব্রহ্মান্ড রাজে,

‘পৃথিবী-পদ্ম-কর্ণিকায় ধ্যানস্থ চতুরানন’।

অর্জুনের স্বীকারোক্তি—

মোহ আমার হল নষ্ট, সন্দেহ নাই আমার,

স্বীকার করেছে সে—

বলেছিনু ভ্রান্তি বশেই—রণরঙ্গে নাইক মন,

স্বজন বধি পাপের ভাগী হওয়ার চেয়ে ভিক্ষা মাগি,

খাওয়াই ভাল, চাইনে আমি ত্রৈলোক্যের সিংহাসন।

এখানেও মূল শ্লোকের আক্ষরিক অনুবাদের প্রয়াস করেন নি কবি, কিন্তু গীতার Spirit-এর ব্যত্যয় ঘটান নি। ভাষা ব্যবহারে কবি তাঁর স্বাধীনতা নিয়েছেন, সেইসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে গীতার উপদেশের ব্যাখ্যাও করেছেন কবি নিজের মত করে।

কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনে বিমূঢ় অর্জুন কৃষ্ণের কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেছে—

বিশ্বমূর্তি দেখার আগে প্রণয় তরে পরিহাস

করেছি কৌতুকচ্ছলে—‘কৃষ্ণ’, ‘যাদব’, ‘সখা’, বলে

ক্ষম মাধব মোর অপরাধ, ক্ষম তিরস্কার আভাস।

এ পর্যন্ত গীতার বক্তব্যের অনুকৃতি লক্ষণীয়। কিন্তু ক্ষমার প্রসঙ্গটিকে কবি বিস্তারিত করলেন যখন, তখন তাঁর স্বাধীন কবিচিত্তের প্রকাশ লক্ষ করা গেল—

পিতা যেমন পুত্রে ক্ষমে, সখা যেমন সখায় তার

প্রিয় ক্ষমে প্রিয়তমায়, তেমনি ক্ষমা কর আমায়,

প্রদর্শিলে ঐশ্বর রূপ—করি তোমায় নমস্কার।

‘শ্রীকৃষ্ণের উক্তি’ শীর্ষক কবিতায় কবি খোলাখুলি ভক্তিমার্গকে সমর্থন জানিয়েছেন—

যোগীগণের মধ্যে যিনি, মদগত প্রাণ, শ্রদ্ধাবান,

তিনিই শ্রেষ্ঠ, যুক্ততম,—অভিমত এই তো মম,

কর্মী কিংবা জ্ঞানীর চেয়ে, তিনিই অধিক কৃপা পান।

অবশ্য গীতার অনুসরণে এখানেও শ্রীকৃষ্ণ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নিছক ভক্তির পথেই নয় কর্ম কিংবা জ্ঞান- যে কোনো পথ অবলম্বন করেই তাঁর কাছে উপনীত হওয়া যায়—

চতুর্বিধ ভক্ত আছে, যে কোনরূপ ভক্ত হও,

কিছুই তাহে না যায় আসে, পৌঁছে সবাই আমার পাশে,

আত্ম—সমর্পণ ব্যতীত পৌঁছিতে সমর্থ নও।

গীতায় বলা হয়েছে—‘সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’। কবির কৃষ্ণও বলেছেন—

নানাবিধ ধর্ম শাসন বর্জিয়া মোর শরণ লও—

বেদোক্ত পুষ্পিত বাক্যে কেন তোমায় ভুলিয়ে রাখে?

আমি ছাড়া অপর কাম্যে কেন গো প্রলুব্ধ হও?

‘সাধন-কথা’য় গীতার সেই বহুশ্রুত অভয় বাণীর প্রতিফলন দেখি—

নবতনু ধরি তিনি আসেন মোদের উদ্ধারিতে,

দিব্য জন্ম, দিব্য কর্ম, অলৌকিক গূঢ় মর্ম,

ধর্ম-সংস্থাপনের তরে, দুষ্কৃত সব বিনাশিতে

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

অধর্মের অভ্যুত্থানে, সাধুগণের পরিত্রাণে,

ধর্ম-যুদ্ধ ঘোষিবারে, অবতীর্ণ হন ধরায়।

‘পরিত্রাণায় সাধূনাং, বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম, ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে’র একেবারে আক্ষরিক অনুবাদ। অথচ কবির রচনা এতখানি সজীব, সাবলীল যে মনে হয় বুঝিবা তাঁর এটি মৌলিক সৃষ্টি।

এই রচনাতেও কবি শ্রীকৃষ্ণকে লাভের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট বাদকে মানেন নি—

কেউ তাঁরে পান কর্ম-যোগে, কেউ বা ব্রহ্মে লভেন জ্ঞানে

একই আত্মা জানেন সবাই, এক বিনা তো আর কিছু নাই।

কর্মবাদকে বন্ধনের কারণ বলে মনে করেন কেউ কেউ। কবি বর্ণনা করেছেন সেই বন্ধনের কারণ—

কর্মের ফল নারায়ণে অর্পিত না হয় যখন,

সেই কর্মের ফল সহিতে, পুনর্জন্ম হয় মহীতে,

কেবল কৃষ্ণ প্রণামীরাই এড়ায়ে যান জীবন মরণ।

কর্ম করেও না করা হয় ব্রহ্মে সমর্পিলে ফল,

কর্মে যিনি ব্রহ্মদর্শী, তাঁরেই কহি পরমর্ষি

ব্রহ্ম হরি: স্রক-স্রবাদি, ব্রহ্মই তাঁর হোম-অনল।

‘শ্রীকৃষ্ণের উক্তি’তে কবি বলেছেন—তাঁর কিছুই আর পাওয়ার নেই, তবু তিনি বিরামহীনভাবে কর্মরত। কারণ সংসারে সাধারণ মানুষ শ্রেষ্ঠদের অনুসরণ করেন কৃষ্ণ যদি অলস হয়ে বসে থাকেন, অন্যান্য সকলেই তাঁরই আচরণ অনুসরণ করবে—

শ্রেষ্ঠ লোকে যাহা করেন অনুসরে সর্বজনা

কর্মযুক্ত হোক সকলে, কর্মযজ্ঞে সিদ্ধি মেলে,

কারেও কভু দিও নাকো কর্মত্যাগের মন্ত্রণা,

না পাওয়া নাই কিছু যে মোর, কিছুই আমার নাই চাওয়া,

প্রকৃতি রক্ষণের লাগি, অতন্দ্রিত আছি জাগি,

কর্মে আমার নাই বিরতি, নাই কো দাবী নাই দাওয়া।

কবি করুণানিধানের এই রচনাগুলির সবই তিন পংক্তিতে আবদ্ধ এক একটি স্তবকের সমষ্টি। ছন্দ ব্যবহারে কোনো নতুনত্বের স্বাক্ষর রাখেন নি। কবির ভক্তিবিনম্র চিত্তের ছায়াপাত সহজেই অনুভব করা যায়।

গীতারঞ্জন

করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

‘শনিবারের চিঠি’তে ধারাবাহিকভাবে ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় গীতারজন।

গীতারঞ্জন গীতার আক্ষরিক অনুবাদ নয়, তবে বক্তব্যে ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে। ‘গীতায়নে’র মত এটিও বিচ্ছিন্ন কতকগুলি রচনার সংকলন। সূচনা হয়েছে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শনের বর্ণনা দিয়ে—

জ্বলৎ অনল অর্কদ্যুতি, ভো প্রচন্ড বীর্য ধর,

নভঃস্পর্শী দীপ্ত দেহ দুর্নিরীক্ষ্য অপ্রমেয়,

সূর্য চন্দ্র নেত্র তব নমস্ত্রিভুবনেশ্বর।

বিকৃতমুখ দংষ্ট্রাকরাল হে লোক-সংহর্তা কাল,

প্রলয়াগ্নি-তুল্য-বদন প্রতি পক্ষে কর নিধন,

হোক পলাতক রাক্ষসেরা চক্রবালের অন্তরাল।।

ভীষণ দন্ত-সন্ধি-মাসে তোমার বদন-গহ্বরে

হেরি ধার্তরাষ্ট্রগণ-দুর্যোধন-কর্ম দ্রোণ

জয়দ্রথ-ভীষ্ম-আদি চূর্ণিত শির গ্রাস করে।।

এই রচনায় কবি গীতার কঠিনতম বর্ণনাকে প্রকাশ করেছেন সাবলীলভাবে, তবে কবিত্বশক্তি বর্জিত অংশটি। অর্জুন যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছে, কেননা তা না হলে কুল ক্ষয় হবার সম্ভাবনা।

স্বজন নাশি সুখ না পাব,—কুলক্ষয় সেভয়ঙ্কর।

তার জিজ্ঞাসা—

যাদের নিয়ে রাজত্ব ভোগ তারা হলে নিধন,

কি ফল বলো বেঁচে থেকে? জাগ্রতে দুঃস্বপ্ন দেখে,

কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দিয়েছেন—

যুদ্ধ করাই ধর্ম হেথায়, না করা ঘোর অধর্ম,

অতএব—

ত্যজ মোহ ত্যজ ক্লৈব্য, সংগ্রামে পলায়মান

হয় কবে ক্ষত্রিয় জাতি;

গীতারঞ্জনে অর্জুন প্রার্থনা জানিয়েছে—

কভু কর্ম, কভু বা জ্ঞান, দুটি পথই প্রদর্শিলে,

কল্যাণকর কোনটি মম কও মোরে পুরুষোত্তম

সন্দেহ দূর কর আমার, কোন সাধনে সিদ্ধি মিলে? (পৃ-৩)

অর্জুন আরো বলেছে—

চাই না কুলের হন্তা হতে বুঝতে নারি কিবা শ্রেয়,

চাই না রুধিরাক্ত অর্থ রইব আমি অপ্রমত্ত,

যুদ্ধে মানি ধর্ম-হানি, দূর কর মোর এ সন্দেহ।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

চাই না বিজয়, চাই না রাজ্য, নহি সুখের অভিলাষী,

হত যদি হই, হইব, প্রতিযুদ্ধ না করিব,

না দেখি মঙ্গল হে কৃষ্ণ আত্মীয়-স্বজনে নাশি।।

শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতে বলা হয়েছে—

কর্ম না করিলে কেহই লভে না নৈষ্কর্ম জ্ঞান,

কর্মত্যাগীর সিদ্ধি নাই,—ত্রিগুণেরই বশে সবাই,

বাধ্য হয়ে কর্ম করে, কর কর্ম অনুষ্ঠান।। (পৃ-৫)

কর্মযোগের কথা পাই এখানে। কৃষ্ণ আরও বলেছেন—

কর্ম কর ঈশ্বরার্থে, হও সমত্ব-বুদ্ধিমান,

সুকৃত-দুষ্কৃতের ভোগী না হন কভু কর্মযোগী,

স্বর্গ-সুখ বা নরক – ভয়ে করেন না কর্মানুষ্ঠান।।

কৃষ্ণ কর্মের পদ্ধতিরও উল্লেখ করেছেন—

‘আমি কর্তা’ এই ভাবনা করেন না তাই যোগীগণ,

কর্মফলাসক্তি হারা হলেই নাশে জন্মধারা,

হত্যা করেও অহন্তা রন আত্মজ্ঞানী হন যে জন।

কৃষ্ণ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—

যুদ্ধ করাই ধর্ম হেথায়, না করা ঘোর অধর্ম,

কৃষ্ণের বক্তব্য—

প্রকৃতি-রক্ষণের লাগি অ-তন্দ্রিত আজি জাগি

ফলে-অনাসক্ত, তবু কর্মে মন নাই বিরতি। (পৃ-১০)

‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরহোপরানি তথা শরীরানি’—এই বিখ্যাত শ্লোকের কাব্যানুবাদ করেছেন কবি এইরকম—

জীর্ণ সেচীর ছাড়ি নরে যেমন নূতন বস্ত্র পরে,

মৃত্যু নবীন দেহ গ্রহণ, বিবেকী তায় কাতর নয়।।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

জীবন-মৃত্যু-সন্ধিক্ষণে ধরেন দেহী অন্য কায়,

ছাড়ি জীর্ণ দেহাবরণ নূতন দেহ করেন ধারণ

আত্মা না হন হন্তা, হত, কেন মুগ্ধ হও মায়ায়। (পৃ-১৫)

আত্মার ধ্বংস নেই, কেবল দেহেরই ধ্বংস আছে। কৃষ্ণ জানিয়েছেন—

কর্মত্যাগী সন্ন্যাসী নন, না হন যদি আসক্তিহীন

বিনা কর্ম-অনুষ্ঠান জন্মে না নৈষ্কর্ম্যজ্ঞান।

তাই পরামর্শ—

জ্ঞান-তরীতে যাত্রা করো পেরিয়ে যাবে পাপ-পাথার

কৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন—

যজ্ঞমাত্র ব্রহ্মময়, জ্ঞানযোগেই সমুদয়।

কর্মের সমাপ্তি ঘটে, কর্মে জ্ঞানে নাই বিবাদ।।

আমাদের শুধু কর্মেই অধিকার, ফলে নয়—

কর্মণ্যবোধিকারস্তে না ফলেষু কদাচন।

গীতারঞ্জনে দেখি বলা হল—

না হয়ো ফলার্থী তুমি, কর্মে কেবল অধিকার,

যখন হবে নিরদ্বন্দ্ব টুটবে তোমার কর্মবন্ধ,

জানিলে নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম রয় না কোনই কর্ম তার। (পৃ-৪৭)

আসক্তি থাকিলে ফলে সেকর্মে রয় বদ্ধভয়। (পৃ-৪৭)

কৃষ্ণের জন্ম বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে কবিত্বময় ভাষায়—

এসেছিলে দ্বাপর শেষে চাঁদ ঢাকা এক বাদল রাতে,

উদয় হলে কারাগারে পৌঁছিলে কালিন্দী-পারে,

মা-যশোদার নীলমণি ধন নন্দরাজার আঙিনাতে।। (পৃ-৫২)

(চিত্র) সেদিন তোমায় চিনত না কেউ, গোষ্ঠে যেতে ধেনু নিয়ে,

রাখাল সখাগণের সাথে নাচিতে পাঁচনি হাতে,

বেরিয়ে যেতে দধিভান্ডে চুরি করে চুমুক দিয়ে।

পুনরায় কবিত্বময় প্রকাশ দেখি—

শরতে ফুটত মল্লিকা নাচিতে রাসমন্ডপে

গোপীরা যমুনাজলে বরণমালা ভাসিয়ে দিলে,

হে নটবর রসিক-শেখর দোদুল হত তোমার গলে। (পৃ-৫২)

আপাতদৃষ্টিতে আমরা কাজ করলেও, কর্মরত হলেও কার্যের সম্পাদনা আমরা করি না, প্রকৃতিই আমাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়—

জানিবে জীব কোনমতেই কোন কর্মের কর্তা নয়,

প্রকৃতিকেই সাঙ্খ্য জ্ঞানী গেছেন কর্মকর্ত্রী মানি,

জ্ঞানেই ঘুচায় দুঃখবেদন, কর্মেই চাঞ্চল্য ভয়।। (পৃ-৫৮)

তাঁকে কেউ লাভ করেন কর্মযোগে, কেউ লাভ করেন জ্ঞানে—

কেউ তাঁরে পান কর্মযোগে, কেউ বা ব্রহ্ম লভেন জ্ঞানে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতাবিবেকভারতী গোস্বামী

শ্রীমদ্ভগবদগীতা, বিবেকভারতী গোস্বামী কতৃক সম্পাদিত, প্রকাশকাল ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ। সম্পাদক মূল শ্লোক, অন্বয়, কতিপয় বাংলা প্রতিশব্দ, বঙ্গানুবাদ, বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর টীকা উপস্থাপিত।

বিবেকভারতী তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোককে কেন্দ্র করে জানিয়েছেন ‘কর্মী’ এবং ‘জ্ঞানী’ এ দুইয়ে পার্থক্য কেবল নামে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কর্মীরাই কর্ম দ্বারা শুদ্ধচিত্ত জ্ঞানীতে রূপান্তরিত হন। আবার জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভক্তির দ্বারা মুক্ত হন।

চতুর্থ অধ্যায়ের ১৯ সংখ্যক ব্যাখ্যায় জ্ঞানযোগের সারকথাটি অভিব্যক্ত হয়েছে, বলা হয়েছে। যিনি ফলাকাঙ্ক্ষা- শূন্য হয়ে সব কাজ করেন, নিষ্কাম কর্মযোগ লব্ধ জ্ঞানাদি দ্বারা তাঁর বিহিত ও নিষিদ্ধ সকল কাজই দগ্ধ হয়। তিনিই জ্ঞানাগ্নিদগ্ধ কর্মী।

দ্বাদশ অধ্যায়ের প্রেক্ষিতে ভক্তিযোগ সম্পর্কে বলা হল—জ্ঞাণীগণ অপেক্ষা সকল প্রকার ভক্তই শ্রেষ্ঠ, আবার ভক্তদের মধ্যে গুণযুক্ত ভক্তরা প্রশংসিত। শুদ্ধা ভক্তিই শীঘ্র ভগবৎপ্রাপ্তির উপায়। ভক্তির দ্বারাই ভগবানকে সন্তুষ্ট করা যায়, কেবল গুণলাভের দ্বারা তা করা যায় না। ভক্তের ভক্তিফলে যাবতীয় গুণ স্বভাবতঃই উদিত হয়।

বৈজ্ঞানিকের চক্ষে গীতা

পুলিনবিহারী হালদার

‘বৈজ্ঞানিকের চক্ষে গীতা’ গ্রন্থটির প্রথম খন্ডের প্রকাশকাল ১৩৬০ বঙ্গাব্দ। রচয়িতা পুলিনবিহারী হালদার। নানা সমস্যায় জর্জরিত মানবসমাজকে তথা দেশকে উদ্ধারের নিমিত্ত লেখকের এই গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা। সত্যপ্রিয় ও রসময় এই দুটি চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে গীতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সমালোচনা উত্থাপিত হয়েছে, অন্যদিকে সেইসব অভিযোগ খন্ডন করা হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থটির বিষয় প্রথম দুটি অধ্যায়ের শিরোনামেই বিধৃত গীতার সমন্বয় এবং সমাধান প্রচেষ্টা। এতদ্ব্যতীত লেখক গীতা ও গায়ত্রী, পরিবর্তন, অভিব্যক্তি ও গীতা, বিশ্বরূপ দর্শন ইত্যাদি অধ্যায়গুলিতে গীতার নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন।

কবিতায় শতশ্লোকী গীতা

পুষ্প দেবী

কবিতায় শতশ্লোকী গীতা, রচয়িত্রী পুষ্প দেবী, প্রকাশকাল ১৩৬২ বঙ্গাব্দ। এ দেশের যেসব মহিলারা শিক্ষাভাবে গীতার মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম, তাদের বোধগম্য করে গীতার ১০০টি নির্বাচিত শ্লোকের বঙ্গানুবাদ উপস্থাপিত এই গ্রন্থে। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীকুমারবাবু অনুবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—‘সহজ ও সুখপাঠ্য বাংলা কবিতায় গীতার ধর্মতত্ত্বকে প্রকাশ করা খুব দুরূহ কার্য এবং এই কার্যে সফলতা লাভ করা সামান্য কৃতিত্বের পরিচয় নয়।’

লেখিকার কৃতিত্ব একই সঙ্গে গ্রন্থে নির্বাচিত শ্লোকের শব্দার্থ, অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন। দু’একটি নিদর্শনস্বরূপ উল্লিখিত হল—

এ জগতে সাধুদের পরিত্রাণ তরে,

পাপীদের বিনাশিতে আসি বারে বারে

ন্যায় সত্য ধর্ম এইভাবে রক্ষা করি,

একারণে যুগে যুগে হেথা অবতরি।

ছন্দোবদ্ধ পদে ব্যাখ্যাও উপস্থাপিত—

যখনি পাপের ভারে পূর্ণ ধরা একেবারে

তখনি তাঁহার জেনো হয়েছে উদয়

শুধু দশ অবতার নহে জেনো শেষ তার

মহামানবের মাঝে তাঁরে মূর্ত হয়।

দ্বাদশ সর্গের—যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি। এই শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করেছেন কবি—

যার মনে হর্ষ নাই দ্বেষ নাহি যারশোক ও আকাঙ্খাহীন হৃদয় যাহারশুভ ও অশুভ কর্মে নাহি অনুষ্ঠানহেন ভক্ত প্রিয় মোর সেই ভক্তিমান।

ব্যাখ্যায় কবি বললেন—

হর্ষ নাই মনে যার ত্যাজে অহিংসা অহংকার

শোকের কালিমা যারে স্পর্শ নাহি করে

পুণ্য পাপে ত্যাজে যেই মনেতে কামনা নেই

ঐকান্তিক ভক্তি যার শুধু হরি পরে, ইত্যাদি।

শ্রীমদভগবদগীতা

যতীন্দ্র রামানুজাচার্য

যতীন্দ্র রামানুজাচার্য ‘শ্রীমদভগবদগীতা’ প্রণয়ন করেছেন ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে। আসলে এটি শ্রীমদভগবদগীতার রামানুজ ভাষ্য ও তার বঙ্গানুবাদ।

কর্মযোগের প্রসঙ্গে লেখক বললেন, বিষয়বুদ্ধি-রহিত, আত্মবিষয়ে নিষ্ঠাবান যারা সেই সাংখ্যপুরুষদের নিষ্ঠা জ্ঞানযোগের দ্বারা সিদ্ধ হয়। অপরপক্ষে যেসব সাধকদের বুদ্ধি বিষয় সঙ্গে মলিন, সেই কর্মযোগাধিকারী যোগী পুরুষদের নিষ্ঠা নিষ্কামকর্মরূপ কর্মযোগের দ্বারা সিদ্ধ হয়। জ্ঞাননিষ্ঠা এবং কর্মনিষ্ঠার অধিকারীরা দুটি স্পষ্ট বিভাগে বিভক্ত। সাংখ্যযোগীদের স্থিতি জ্ঞানযোগে, কর্মযোগীদের স্থিতি কর্মযোগে। সংসার-বিষয়াসক্ত লোকের জ্ঞাননিষ্ঠা হওয়া দুষ্কর। সাংসারিক ফলমুক্ত হয়ে ভগবৎসেবা বুদ্ধিতে শাস্ত্রবিহিত কর্ম করতে করতে ক্রমশঃ চিত্ত নির্মল হলে তবেই জ্ঞাননিষ্ঠা লাভ ঘটে।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অকর্মরূপ জ্ঞাননিষ্ঠার তুলনায় কর্মই শ্রেষ্ঠ। লেখক কর্মযোগের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। বললেন, ‘জ্ঞাননিষ্ঠা অপেক্ষা কর্মনিষ্ঠাই শ্রেষ্ঠ। কারণ, কর্মযোগরূপ কর্মানুষ্ঠানের সময় আত্মার যথার্থ স্বরূপ জ্ঞানের অনুসন্ধান অনিবার্য। কর্মযোগের মধ্যেই আত্মচিন্তারূপ জ্ঞাননিষ্ঠা অন্তর্নিহিত আছে।

জ্ঞানযোগের আলোচনাপ্রসঙ্গে লেখক স্মরণ করালেন যে, কর্মযোগে ক্রিয়াংশ এবং জ্ঞানাংশ এই দুই প্রকার অংশ থাকে। দ্রব্যসংগ্রহ এবং আত্মজ্ঞানচিন্তারূপ নিষ্কাম কর্মের দ্রব্যময় অংশের তুলনায় জ্ঞানময় অংশই শ্রেষ্ঠ। কারণ, সমস্ত কর্মের দ্রব্যসংগ্রহাদি অনুষ্ঠান এবং তার অতিরিক্ত অন্য যা কিছু ভাল সেসমস্তই পাপক্ষয় এবং চিত্তশুদ্ধি উৎপাদন করে আত্মবিষয়ক জ্ঞানে পর্যবসিত হয়। সাধক উপলব্ধি করেন আত্মজ্ঞান নিষ্কাম কর্মেরই অন্তর্ভুক্ত। এই বোধই তাঁকে সিদ্ধদশা লাভে সহায়তা করে।

পূর্বের মত দেহ এবং দৈহিক বস্তুতে অহংকার এবং মমতা অভিমানরূপ অজ্ঞানতা কিংবা মোহত্ব প্রাপ্তি থেকে মুক্তি ঘটে জ্ঞান লাভ ঘটলে। প্রকৃত জ্ঞান হলে জ্ঞানীপুরুষ দেবমনুষ্যাদি জীবের দেহাভ্যন্তরস্থিত সমস্ত আত্মবস্তু নিজ আত্মাতেই দর্শন করেন।

ভক্তিযোগের ব্যাখ্যায় রামানুজ ভাষ্যের প্রেক্ষিতে লেখক বললেন, যদি সহসা ঈশ্বরের প্রতি চিত্ত সমাধানে সক্ষম না হয়, তবে সেক্ষেত্রে অভ্যাসযোগের আশ্রয় নিতে পারা যায়। স্বভাবতঃ অনন্ত, অতিশয় সৌন্দর্য, সৌহার্দ্য, বাৎসল্য, কারুণ্য, মাধুর্য, গাম্ভীর্য, ঔদার্য, শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম, সত্যকামত্ব, সর্বজ্ঞত্ব, সত্য সর্বেশ্বরত্ব, সর্বকারণত্ব ইত্যাদি অসংখ্য কল্যাণ গুণসার এবং অখিল হেয়গুণগন্ধলেশরহিত পরমেশ্বর আমার প্রিয়, আমার বিষয়, নিরতিশয় প্রীতিপূর্ণ বারংবার এইরূপ চিন্তা বা স্মৃতির অভ্যাসে ঈশ্বরে চিত্ত স্থিরভাবে স্থিত হয় এবং ভক্তের ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে।

দি ভাগবদগীতা

নটরাজ গুরু

নটরাজ গুরুর The Bhagavad Gita’র প্রকাশকাল ১৯৬১। গীতার আঠারটি অধ্যায় নিয়েই লেখক আলোচনা করেছেন। সুদীর্ঘ ৭০ পৃষ্ঠার ভূমিকা গ্রন্থটির সম্পদ।

কর্ম বলতে সব ধরনের কাজকে বোঝালেও গীতায় বিশেষ করে যজ্ঞের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে (sacrificial ritualism)। সেইসঙ্গে লেখক মনে করেন মানুষের অতীতের কর্ম তার ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে। তাঁর মতে :

The doctrine of Karma or action refers to this relation between the past and the future in individual life and the theory of reincarnation comes in as a corollary of the doctrine of Karma.

কিন্তু এদের সঙ্গে আচার-সম্পৃক্ত কর্মকে যুক্ত করার বিষয়ে লেখক সতর্ক করিয়ে দিয়েছেন।

অনেকে যে কর্মযজ্ঞের সঙ্গে নিষ্কাম কর্মের অভিন্নতা ঘোষণা করেছেন কিন্তু লেখক এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। এমনকি সামাজিক কার্যাবলীকেও লেখক কর্মযজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধী।

গীতা বৈদান্তিক রচনা, তাই এর সঙ্গে কখনই সামাজিক কর্তব্যকে যুক্ত করা চলে না। Action বলতে লেখক বুঝেছেন, সমগ্র মানবজাতিকে যা নাকি আবদ্ধ করে। কর্মের এই মানবিক বন্ধনের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে লেখক আলোচনা করেছেন :

The Ashvattha tree has shoots that spread upwards and downwards in this human world, and is described as having Karmanu bandhani (a binding consequence through action). Necessary action binds the whole of humanity.

Absolute wisdom-এর প্রতিনিধিরা সংখ্যায় অল্প। লেখকের মতে Cosmological brahman এবং Psychological atma (self) অভিন্ন। লেখক জ্ঞান ও কর্মের সম্পর্ক নিয়েও আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, এ দুয়ের পার্থক্য নিছক যান্ত্রিক বৈপরীত্যের নয়। যখন জ্ঞান বিজয়ী হয়, কর্ম অন্তর্হিত হয় যখন, ‘the question of action ceases to arise when wisdom shines in its fullest glory’; তাই বলে যদি কেউ মনে করে যে, জ্ঞানের সংশোধনী ক্ষমতা নেই, তবে ভুল হবে। লেখক জ্ঞানের তাত্ত্বিক দিক এবং যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক দিক নিয়েও আলোকপাত করেছেন। যদি এমনটি হয় একজন যোগাভ্যাস করল কিন্তু পরিণামে তার জ্ঞানলাভ হল না, সেক্ষেত্রে সেযোগানুশীলনে বিভ্রান্তির শিকার মানতে হবে। যিনি জ্ঞানলাভ করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তিনি যোগের সমস্ত অনুকূল ফল লাভ করেন।

সাংখ্যের জ্ঞান এবং যোগক্রিয়াকে ভারতীয় দর্শনে একইভাবে দেখা হয়, গীতায় কিন্তু তা করা হয়নি পরিবর্তে each is revalued in terms of the other, আর এইভাবেই কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের দ্বৈততাকে উড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস করা হয়েছে। শান্তি এই দুইয়ের মিলনেই সম্ভব। পরিশেষে লেখক যথার্থই বলেছেন :

The sword of wisdom is to be found in the self and the doubt is found in the heart, i.e, they are both located at two poles within the psychological makeup of the person. A change of heart is affected by a dose of wisdom….

ভক্তিযোগের ব্যাখ্যায় লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গীতার ভক্তিযোগ নিছক ধর্মীয় অর্চনা মাত্র নয়, তারও বেশি কিছু, ‘contemplative discipline’। গীতায় ভক্তিযোগ এক ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে, এখানে ভক্তি ব্যক্তিবিশেষের পছন্দের দেবতাতে সীমাবদ্ধ নয় :

The Gita being a revaluation of both orthodox and heterodox tendencies in spirituality, covering both the rational and the emotional aspects, has to make it clear what importance it gives to the role of devotion in the spiritual progress of the aspirant to wisdom. (page-511)

ভক্ত বলতে আমরা বুঝি নিরাসক্ত আবেগমুক্ত ব্যক্তিকে, যাঁর কাছে লক্ষ্য উন্নততর জ্ঞান লাভ। প্রথাগতভাবে ভক্তির সঙ্গে পূজার্চনার যোগ। ভারতে তাঁকেই ভক্ত বলা হয় যিনি পৌরাণিক দেবদেবীর পূজায় রত থাকেন। গীতায় কোনো আতিশয্যকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। যদিও সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ভক্তিকে দেখেছেন প্রথাগত দৃষ্টিতে :

emphasizes humility, obedience, readiness to serve compassion and gentle love, as the devotee longs to surrender himself, renounce self-will, and experience passivity, it is said to be more feminine in character.

আমাদের লেখক কিন্তু এই মত সমর্থন করেন নি। তাঁর মতে :

the Gita discountenances them, লেখকের মতে একজন যথার্থ ভক্ত তিনিই যিনি effaces his personality to such an extent that he leaves no mark on his surroundings, and the surroundings on their parttake no notice of him. (page-525)

ভক্তিযোগ সম্পর্কে লেখকের সার্বিক মূল্যায়ন হল :

Gita gives to the men of philosophic vision even a higher place than to those who conform to the requirements of devotion in their attitudes and ways. (page-529)

গীতার তাৎপর্য

ভক্তিবিলাস ভারতী

‘গীতার তাৎপর্য’ রচয়িতা ভক্তিবিলাস ভারতী, প্রকাশকাল ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ। লেখক এই গ্রন্থে ‘গীতা’ শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন, গীতা পাঠের অধিকারী কে, গীতার তাৎপর্যসার, গীতার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়, গীতারসর্বগুহ্যতম উপদেশ, গীতায় বিভিন্ন মার্গের উপদেশের তাৎপর্য ইত্যাদি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। লেখকের মতে গীতা মহাভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং স্বয়ং বেদব্যাস কতৃক লিখিত। গীতা মোটেই প্রক্ষিপ্ত নয়। অনেকে মনে করেন গীতার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আসক্তিহীনভাবে কর্ম সম্পাদন প্রসঙ্গ, কিন্তু লেখক তা মনে করেন না, তাঁর সিদ্ধান্ত ‘শ্রীকৃষ্ণাসক্তি যোগই গীতার প্রতিপাদ্য।’ এমনকি গীতায় যে সর্বগুহ্যতম উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে তাও কৃষ্ণাসক্তিরূপা ভক্তি, এর হদিস মিলবে গীতার প্রতিটি অধ্যায়ে, তা সেকর্মের উপদেশই হোক, কিংবা সাংখ্যযোগের উপদেশ অথবা রাজযোগের উপদেশই। মোদ্দা কথা, গীতার প্রতিপাদ্য হল কর্ম হোক জ্ঞান মিশ্রা ভক্তি। গীতার উপসংহারেও বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণ ভজনে প্রবৃত্তিদানই গীতার একমাত্র উদ্দেশ্য।

কর্ম ও জ্ঞানের প্রসঙ্গও লেখক এনেছেন। বলেছেন, কর্মের দ্বারা জীবের বন্ধন হয়। আরও বললেন, কর্মত্যাগ জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর মতে কপট কর্মাচারীর তুলনায় ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য শাস্ত্রবিহিত কর্মকারীই শ্রেষ্ঠ। যিনি আত্মাতেই প্রীত,আত্মাতেই তৃপ্ত, ভগবৎচরণে শরণাগত, তাঁর আর কোনো কর্তব্য থাকে না। তথাপি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের আদর্শস্বরূপ কর্মাচরণ করেন। সেই পর্যন্ত কর্ম সম্পাদন কর্তব্য যে পর্যন্ত নির্বেদ উপস্থিত না হয়। কিংবা ভগবৎকথায় রুচি জাগে। ভক্তি পরিত্যাগপূর্বক ব্রহ্মলাভের প্রয়াস ক্ষতিকারক, এতে পতন অনিবার্য বলে লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস। জ্ঞানের প্রয়োজন কেন? না শোকাদি বিঘ্নহেতু হরিভজনে প্রবৃত্তি হয় না, এজন্যই জ্ঞানের অপেক্ষা। কিন্তু সেইসঙ্গে এই সতর্ক বাণীও উচ্চারিত হয়েছে :

ভক্তি নিরপেক্ষা, তাহা জ্ঞানের অপেক্ষা যুক্তা নহে, বরং জ্ঞান ও বৈরাগ্য অনেক সময় ভক্তির প্রতিকূলই হয়, ….।

আর্লি বুদ্ধিইজম অ্যাণ্ড দি ভাগবদ গীতা

কাশীনাথ উপাধ্যায়

Early Buddhism and the Bhagavad Gita গ্রন্থটির রচয়িতা Kashinath Upadhyay, রচনাকাল ১৯৭১। ভাগবত গীতার ওপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, অথবা বৌদ্ধধর্মের ওপর ভাগবত গীতার প্রভাব নিয়ে বেশ কয়েকটি আলোচনা হয়েছে। আলোচনা করেছেন বিদগ্ধ পন্ডিত ও মনীষীরা।

বালগঙ্গাধর তিলক মন্তব্য করেছেন :

The elements of the B.G. are not borrowed from the Buddhist religion.

ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্বীকার করেছেন :

some of the views of the Gita are like those of Buddhism.

যেমন বৌদ্ধধর্মে কথিত ‘নির্বাণ’ শব্দটির উল্লেখ গীতায় লভ্য। এই প্রেক্ষিতে ড. রাধাকৃষ্ণনের মন্তব্য :

This does not show any borrowing from Buddhism, since it is not peculiar to it.’

Senart আবার মনে করেন :

Buddhism is undoubtedly the borrower.

জার্মান পন্ডিত Garbe মনে করেন :

Buddhist influence might be regarded as very much doubtful.

Telang-এর মন্তব্য :

B.G. being an earlier thought, cannot be conceived to have been influenced by Buddhism.

তাঁর মত :

Either the Gita and Buddhism were alike the outward manifestation of one and the same spiritual upheaval which shook to its centre the current religion, the Gita being the earlier and less thorough-going form of it, or Buddhism having already begun to tell on Brahmanism, the Gita was an attempt to bolster it up, so to say, as its least weak points, the weaker ones being altogether abandoned.

প্রশ্ন হল গীতা এবং বৌদ্ধধর্মে নানা বিষয়ে একাত্মতার সন্ধান পাই। যেমন ‘রাগ’ এবং ‘দ্বেষ’ গীতায় যেমন পালিতেও একই রকমভাবে উল্লিখিত হয়েছে। উল্লিখিত হয়েছে নির্মম, নিরাশী, নিরাশ্রয়, নিরাহার, নৈষ্ক্রম্য, সমদুঃখ, সুখ, তুল্য নিন্দাস্তুতি। তাছাড়া ক্রোধ, মদ, দম্ভ, অতিমানিতা, অসূয়া, জ্ঞানযজ্ঞ, নরাধম এবং অন্যান্য বহু শব্দ অথবা শব্দের অনুরূপ অর্থবহ শব্দনিচয়ের ব্যবহারগত সাযুজ্য চোখে পড়ে। লেখক ভাগবত গীতা ও পালিতে রচিত একই রূপ পংক্তি বা শ্লোকের ব্যবহারের বহু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অন্যদিকে বৈসাদৃশ্যমূলক ভাব ও ভাবনার উল্লেখও এই দুই বিষয়ে নেহাৎ কম নয়। যেমন, অসুরেন্দ্র বেপাচিত্তির সঙ্গে সুরেন্দ্র শক্রের কথোপকথনের সঙ্গে অর্জুন ও কৃষ্ণের কথোপকথনের তুলনা। অসুরেন্দ্র বেপাচিত্তি বা মাতলিপ্রদত্ত যুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে কৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে জয় করার উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত যুক্তির সাযুজ্য লক্ষিত হয়। এই প্রেক্ষিতে লেখকের সিদ্ধান্ত :

it may not be unreasonable to say that early Buddhism endeavours to lift up the mundane man to the super mundane level, whereas the B.G. tries to meet the super mundane on the mundane plane; in the one. We have the unwavering delegiance to the ideal, pure and perfect, whereas the other seeks a compromise with the average world. In other words, the former embodies the purest ideal of the recluse life, whereas the latter represents the ideal of the household life at its best.

হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক উপাধ্যায় আলোচ্য গ্রন্থে তাঁর গভীর মননশীলতা ও তৎসহ বহু পঠনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

হরিচরণ ঘোষ

জনমানসের দৃষ্টিতে শ্রীমদ্ভগবদগীতা, রচয়িতা হরিচরণ ঘোষ। প্রকাশকাল ১৯৭২। প্রকাশক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থটি সম্পর্কে ড. কালিদাস ভট্টাচার্যের মূল্যায়নটি স্মর্তব্য :

কি সহজভাবে একজন প্রাচীনপন্থী হিন্দু সুস্থ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিতে পারেন, অথবা কি সহজভাবে একজন নব্যপন্থী আধুনিক সুস্থ প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করিতে পারেন, এই গ্রন্থে তাহা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করিয়া পাঠক পরম পরিতোষ লাভ করিবেন।

লেখক মনে করেন শ্রীমদ্ভগবদগীতা একটি Synthetic whole সুসমন্বয়ী তত্ত্বের প্রচার করা হয়েছে। তাঁর আরও বক্তব্য, শ্রীকৃষ্ণ জীবের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীবিভাগ করে প্রত্যেকের কর্ম করার স্বভাব প্রকৃতির কথা বলেছেন। প্রত্যেকের প্রকৃতি পৃথক, তাই এদের কর্ম করার পদ্ধতিও পৃথক জীব সম্পর্কে লেখক মনে করেন কৃষ্ণ তিনটি শ্রেণীর কথা বলেছেন—শুদ্ধচেতা, বিদ্বান এবং সাধারণ জীব। গীতায় আপাতভাবে যে বৈষম্যের সন্ধান পাই এই তিন শ্রেণীর জীবের প্রেক্ষিতে দেখলে এই বৈষম্য থাকবে না।

লেখক গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে ফলত্যাগপূর্বক কর্মাচরণ কর্মযোগীদের পক্ষে প্রশস্ত। কৃষ্ণ বিদ্বান এবং অজ্ঞান ব্যক্তির কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতির পার্থক্য দেখিয়েছেন। বিদ্বান ব্যক্তি যেখানে আসক্তি ত্যাগপূর্বক কর্ম সম্পাদন করেন, সেখানে সাধারণে ফলপ্রত্যাশী হয়ে কর্ম করে। লেখক নিজস্ব একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন তা হল—

জীবের প্রকৃতির গুণানুযায়ী ইন্দ্রিয়াদি তাহার mechanism-এর প্রাকৃতিক গঠনের অনুযায়ী কাজ করিবে, শক্তি (energy) যোগাইবেন জীবাত্মা—যিনি তাঁহারই সনাতন অংশ, জীবলাকে জীব হইয়া প্রকৃতিস্থিত মন ও পঞ্চেন্দ্রিয়কে সংসারে (অর্থাৎ এই দেহে) আকর্ষণ করেন। (পৃষ্ঠা-৬৯)

জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বলেন, শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানযোগের বিশেষ কোনো সংজ্ঞাদানে বিরত থেকেছেন। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ অপেক্ষা শ্রেয়ঃ। তৃতীয়ত, জ্ঞানী কিরূপে শ্রেষ্ঠ শান্তি লাভ করেন? লেখকের ভাষায় :

যিনি আত্মজ্ঞান লাভের উপায় ভূতযোগ দ্বারা কর্মফল সকল আত্মাতে অর্পণ করিয়েছেন এবংআত্মবোধ জ্ঞান দ্বারা যাঁহার সংশয় ছিন্ন হইয়াছে, কর্মসকল সেই ব্রহ্মতে ব্যক্তিকে আবদ্ধ করিতে পারে না। আর তিনিও অবিলম্বে শ্রেষ্ঠ শান্তি প্রাপ্ত হন। (পৃষ্ঠা-৮৩)

ভক্তিযোগের আলোচনায় লেখক জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়কে লক্ষ্য করেছেন। কেননা সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার পথের জ্ঞানই শ্রেষ্ঠজ্ঞান। এই প্রেক্ষিতে ভক্তিবাদীদের অনুসৃত পন্থাই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম। কৃষ্ণ যে ফ্যাসীবাদের প্রবর্তক ছিলেন না লেখক তা ব্যাখ্যা করেছেন। কৃষ্ণ জোর দিয়েছেন সুপ্রতিষ্ঠিত সদাচারে ও নীতি অনুযায়ী কাজে। এই ক্ষেত্রেই তাঁকে দৃঢ়তার সঙ্গে নির্দেশ দিতে দেখা গেছে। যাঁরা কৃষ্ণকে ডিক্টেটররূপে ভাবেন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ভুল প্রমাণে লেখকের যুক্তি :

শ্রীকৃষ্ণ এক নায়কের ন্যায়, Dictator-এর ন্যায় ধর্মাধর্ম না মানিয়া তাঁহার আজ্ঞানুশীলন করিতে বলেন নাই। যাহাতে বহু সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট না হয়, যাহাতে নানা লৌকিক ও বৈদিক অর্থবাদ শ্রবণে অর্জুনের বুদ্ধি বিক্ষিপ্ত না হয়, যাহাতে ‘বিষমে সমুপস্থিতে’ অর্জুন ধীর, স্থির থাকিয়া স্বকীয় কর্তব্য পালন করিতে সমর্থ হন, তন্নিমিত্ত কৃষ্ণ বাসুদেব প্রকৃত উপদেষ্টারই কাজ করেন। (পৃষ্ঠা-২০৬-২০৭)

শ্রীমদভাগবতম

কমলা সুব্রামানিয়াম

কমলা সুব্রামানিয়াম প্রণীত ‘Srimad Bhagabatam’-এর প্রকাশকাল ১৯৭৯। সুবিশাল গ্রন্থ। মোট ২৯৩টি অধ্যায়ে লেখিকা নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। আমরা কয়েকটি মাত্র অধ্যায় প্রসঙ্গেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব যে অধ্যায়গুলিতে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ আলোচিত।

২৮৮ অধ্যায়ে (The three paths) লেখিকা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন মোক্ষলাভের জন্য তিনটি মাত্র পথ কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি—‘There is no fourth path way to salvation.’

কর্মযোগের পরিণাম কী?

action leads to nothing but sorrow and the results of one’s actions lead one to further entanglement.

জ্ঞানযোগের তাৎপর্য কী?

Jnana Yoga grants freedom easily since they have already travelled a great distance towards the realisation of Truth.

লেখিকা তিনটি যোগের মধ্যে ভক্তিযোগকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছেন :

A man who practises Bhakti Yoga has me and my image in his mind always and so, all other desires get destroyed on their own accord without any strenuous attempt on the part of the man.

ভক্তির দ্বারাই সকল কিছু আয়ত্ত করা সম্ভব এমনকি কর্মের দ্বারা যা আয়ত্ত হয়, ভক্তিতেও তা আয়ত্ত হয়। তাই :

He should learn Bhakti and Vairagya and he will surely reach the Coveted liberation from bondage.

ভক্তিযোগের সুবিধা হল একজন সাধারণ মানুষও ভক্তিযোগের সাধনা করতে সক্ষম :

Even an ordinary man can be trained to develop Bhakti in me.

ভক্তি মানুষের সকল পাপকে বিনষ্ট করে। ভক্তি সর্বোত্তম, কারণ ঈশ্বর এতেই সর্বাধিক সন্তুষ্ট হন :

The practice of Yoga, knowledge of Sankhya, the practice of Dharma, knowledge of the Vedas … none of these will charm me and enslave me as Bhakti will.

মধুসূদন সরস্বতীর টীকার অনুবাদ

ভূতনাথ সপ্ততীর্থ

ভূতনাথ সপ্ততীর্থের মধুসূদন সরস্বতীর টীকাকৃত শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা-সম্বলিত গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৮৬। মধুসূদন সরস্বতী-কৃত টীকার বৈশিষ্ট্য হল এতে মূল শ্লোকের প্রত্যেক পদের, প্রত্যেক অক্ষরের সার্থকতা ও তাৎপর্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। লেখক গ্রন্থের তাৎপর্য বোঝাবার জন্য মূলোক্ত সিদ্ধান্ত যুক্তিবলে স্থাপন করার জন্য যেখানে শাস্ত্রান্তরের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন সেখানে শাস্ত্রান্তরের সিদ্ধান্ত সুনিপুণভাবেই দেখিয়েছেন, দৃঢ়তর বিচারের দ্বারা মূল সিদ্ধান্ত স্থাপন করেছেন। ফলে টীকার অংশ স্থানে স্থানে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। মধুসূদন ছিলেন বেদান্তের একনিষ্ঠ সেবক। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল অদ্বৈত বেদান্ত। মধুসূদন একাধারে পন্ডিত তত্ত্বনিষ্ঠ, জ্ঞানী এবং তত্ত্বদর্শী। তাঁর মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ ছিল না। সেইজন্যই শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যে তিনি জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ দেখেন নি, দেখেছিলেন জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয়। মধূসূদন সরস্বতী-কৃত গীতার টীকার নাম ‘গূঢ়ার্থ দীপিকা’। মধুসূদন কেন গীতা। ব্যাখ্যায় উদ্বুদ্ধ হন? কারণ এতে তিনি তাঁর প্রাণের বিষয়ের সন্ধান পান, গীতায় তিনি জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করেন। মধুসূদন গীতা-সংশ্লিষ্ট সমস্ত প্রকার বিরোধের সুমীমাংসা করেছেন। নিষ্কাম কর্মকে মূল বলে বর্ণনা করেছেন। তত্ত্বজ্ঞান ভক্তি বিনা লাভ করা সম্ভব নয় বলে তাঁর প্রতীতি জন্মেছিল। ভক্তি-বিবর্জিত শুষ্ক বিচারাত্মক জ্ঞান কখনই বেদান্তের প্রতিপাদ্য জ্ঞান নয়। মনেপ্রাণে তাঁর বিশ্বাস ছিল ভক্তির সাহায্যেই পরম তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানলাভ সম্ভব। ভক্তি বলতে তিনি বুঝতেন পরম তত্ত্বের প্রতি শুদ্ধ চিত্তের যে আকর্ষণ তাকে। তিনি জানতেন চিত্তে সত্ত্বোৎকর্ষ না হলে কখনই জ্ঞানলাভ হয় না। মধুসূদনের কৃতিত্ব তিনিগুরুগম্ভীর বিষয়কেও যথাসম্ভব সরলভাবে আলোচনা করতে সক্ষম ছিলেন। আলোচ্য গ্রন্থটি মধুসূদনের টীকার বঙ্গানুবাদ। নিছক আক্ষরিক বঙ্গানুবাদই প্রদত্ত হয় নি। প্রত্যেক শ্লোকের টীকায় আবশ্যকীয় বিশদ ও বিস্তৃত তাৎপর্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। মধুসূদন যোগদর্শনের অধিকাংশ সূত্রগুলির আলোচনা করেছিলেন। সূত্রগুলিকে তিনি পর পর সাজিয়ে যোগদর্শনের তাৎপর্য চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বেদান্তের পূর্বমীমাংসার, সাংখ্যদর্শনের এবং ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের প্রধান বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। আলোচ্য গ্রন্থেও সেসব বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে।

আমরা এবারে এই গ্রন্থানুসারে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের ব্যাখ্যা কিরূপ তা দেখব। প্রথমেই কর্মযোগপ্রসঙ্গ।

জ্ঞানের দ্বারাও মোক্ষলাভ সম্ভব, কর্মনিষ্ঠার দ্বারাও মোক্ষলাভ সম্ভব। কিন্তু যেহেতু জ্ঞাননিষ্ঠা উৎকৃষ্ট এবং কর্মনিষ্ঠা নিকৃষ্ট, তাই জ্ঞাননিষ্ঠার দ্বারা যে প্রয়োজন সাধিত হয় কর্মনিষ্ঠার দ্বারা তা হয় না। উভয়ের ফলে তারতম্য ঘটবেই। অন্যদিকে কর্ম ও জ্ঞান বিকল্পিতভাবে মোক্ষের সাধন বলে যদি স্বীকার করে নেওয়া হয়, তাহলে স্বীকৃত হয় যে, কর্ম থেকেও মোক্ষ হয়, জ্ঞান থেকেও মোক্ষ হয়। তবে এই দুইয়ের মোক্ষে তারতম্য ঘটবে।

জ্ঞান কর্মের বিকল্প হতে পারে না। জ্ঞাননিষ্ঠার এবং কর্মনিষ্ঠার অধিকারী যদি ভিন্ন হয় তাহলে একই ব্যক্তির প্রতি দুটির উপদেশদান সঙ্গত নয়, আর যদি একই ব্যক্তি তাদের অধিকারী হয় তাহলে পরস্পরবিরুদ্ধ জ্ঞান ও কর্মরূপ দুটি বিষয়ের সমুচ্চয় হতে পারে না। সকলেই জ্ঞাননিষ্ঠার অধিকারী হতে পারেন, কেবল যাঁরা শুদ্ধান্তঃকরণ, তাঁরাই সাংখ্যশাস্ত্রনির্দিষ্ট জ্ঞাননিষ্ঠার অধিকারী, অপরপক্ষে যাঁরা অশুদ্ধান্তঃকরণ, তাঁরাই কর্মনিষ্ঠার অধিকারী। কর্মসন্ন্যাস হলেই কিন্তু মোক্ষলাভ হয় না। চিত্তশুদ্ধি ব্যতিরেকে নিছক কর্মত্যাগের কারণে মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। যদি চিত্ত শুদ্ধ হয় তাহলে স্বতঃই নৈষ্কর্ম আসে। শুদ্ধচিত্তের জন্য প্রয়োজন সাংখ্যজ্ঞানের।

জ্ঞানীরা প্রকৃতির গুণের দ্বারা চালিত হন না, তাই তাঁদের দ্বারা কর্মত্যাগ সম্ভব। অন্যদিকে যারা অজ্ঞানী তাদের কর্মসম্পাদন খুবই প্রয়োজন। যে পর্যন্ত জ্ঞানারূঢ় না হওয়া যায়, সেপর্যন্ত কতৃত্বাভিমান এবং কর্মপ্রবৃত্তি থাকে। চিত্তকে সঙ্কুচিত করে কেবল স্বার্থপর কর্ম। অন্যদিকে পরার্থপর কর্ম চিত্তকে উদার করে তোলে।

কর্মের মূলে কী? কর্মের মূলে বেদ। বেদ-উদ্ভূত ব্রহ্ম থেকে ব্রহ্ম সর্বব্যাপক, তাই কর্মের মধ্যেও ব্রহ্মেরই অবস্থান। অজ্ঞানী যে সেঅসক্ত চিত্তে কর্ম করে, জ্ঞানীর উচিত অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন। কর্মেই বন্ধন এ ধারণা যথার্থ নয়। বন্ধনের হেতু হল আসক্তি। জ্ঞানী জানেন আত্মা অকর্তা। কোনো কর্মের দ্বারাই আত্মা স্পৃষ্ট হন না। অজ্ঞানীর যে চিত্তের অশুদ্ধি তা কর্ম ব্যতিরেকে অন্য উপায়ে দূরীভূত হবার নয়। যতদিন না কর্ম দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয় ততদিন এই কতৃত্বাভিমান জীবকে কাজ করিয়ে নেয়, ক্রমে ক্রমে তার অশুদ্ধির নিরসন হয়। নিষ্কাম কর্ম কীভাবে সম্ভব? সৎ বুদ্ধি বা বিবেক বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়ে কর্ম করলেই নিষ্কাম কর্ম সম্ভব। নিজ নিজ প্রকৃতি অনুযায়ী সকলে কাজ করে। সকলের সব কর্ম সম্পাদন উচিত নয়। যে যেমন স্তরে আছে, কাজ করা চাই তদনুযায়ী। নিম্নস্তরে থেকে উচ্চস্তরের কর্ম সম্পাদন অকর্তব্য। চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন লেখক—সাণ্ণি পাতিক বিকার রোগীর পক্ষে বিষ অমৃতের কাজ করে, কিন্তু সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে ঐ বিষ প্রাণনাশক।

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। শ্রী ভগবানের জন্ম ও কর্মের তত্ত্ব সকলের বোধগম্য নয়। এজন্য প্রয়োজন বুদ্ধিকে তত্ত্বাবগাহিনী করা। জ্ঞানতপস্যার দ্বারা শুদ্ধচিত্ত হতে হয়, ভগবৎধ্যানে মগ্ন থাকতে হয়। তত্ত্বজ্ঞান থেকেই ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে। মানুষ যে পর্যন্ত ফলাভিলাষী, সেপর্যন্ত ক্ষুদ্র দেবতা ভজনা করে। যখন মানুষ কামনার দ্বারা চালিত না হয়ে বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়ে কর্ম করে, তখনই সেভগবানকে ভজনা করে। সাত্ত্বিক কর্তার ভূমি প্রাপ্ত হলে কর্মজনিত বন্ধনের মোচন হয়। অজ্ঞানই কর্ম, অপরপক্ষে জ্ঞানই অকর্ম। জ্ঞানভূমিতে অবস্থিত হয়ে করা যে কাজ তা অকর্ম। জ্ঞানভূমিতে কোনো কাজই কামনার দ্বারা চালিত হয় না। এক্ষেত্রে কর্ম ফল সঙ্কল্প হতে প্রসূত হয় না। কতৃত্বাভিমান রূপ সঙ্কল্পও এক্ষেত্রে থাকে না।

যদি গৃহস্থ জ্ঞানে অবস্থান করে সম্যকরূপে আসক্তিশূন্য হয়ে শ্রীবিষ্ণুর প্রীতিতে সর্বকর্মের অনুষ্ঠান করেন তাহলে তাঁর কর্মও অকর্ম হয়। জ্ঞানে অবস্থিত হলে সব ব্রহ্মময় হয়ে যায়। তখন আর ক্রিয়াভেদ থাকে না। সর্বত্রই ব্রহ্মদৃষ্টি হয় বলে জ্ঞানীর ব্রহ্ম প্রাপ্তি ঘটে। জ্ঞানযজ্ঞ ব্যতীত অন্য সব কর্মন, একমাত্র জ্ঞানযজ্ঞই আত্মা যে অকর্তা এই বোধে প্রতিষ্ঠিত।

সবশেষে ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে, যারা মনকে একাগ্র করতে অক্ষম, তাদের স্থূল সাধনার প্রয়োজন, প্রয়োজন শ্রবণ, কীর্তন, ব্রত, উপবাসের মাধ্যমে ভগবানের আরাধনা। সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনা হল ফলত্যাগ। যিনি শ্রদ্ধাচিত্ত, যিনি মৎ পরমা, অর্থাৎ অক্ষরস্বরূপ ভগবান বাসুদেব যাঁর পরম প্রাপ্তব্য, তাঁরা মৎ পরম, এরূপ ভক্ত নিরুপাধিক ব্রহ্মের উপাসনা করেন, এঁরা ভগবানের নিরতিশয় প্রিয়।

গীতা এনলাইটেণ্ড

যোগী মহাজন

এই গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৮৬। লেখক বলেছেন, গীতানুসারে ঈশ্বর সকল মানুষের মধ্যেই অবস্থানরত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মানুষ সেবিষয়ে অবহিত নয়। কিন্তু ঈশ্বরের উপস্থিতি মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম। এই উপলব্ধি হলে মানুষ তখন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে :

When he awakens to this reality, he is enlightened. In such a state he becomes one with the Divine’. (page-1, Dharma)

ঈশ্বরপ্রাপ্তির নানা পথ, নানা মত। কোন পথ বা মত সত্য সেনিয়ে তর্ক অর্থহীন। প্রশ্ন একটাই, শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়া সম্ভব হল কিনা, ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা সম্ভব হল কি না। একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন লেখক :

one enters the room from the left and the other from the right. The introvert enters through the door of the emotions while the extrovert enters through the door of physical, mental action. They both meet inside the room and join hands. The question is not which approach is better. The room where they meet in is the wisdom they realise…’ (Lighting the path; page-45)

কর্মযোগ নিয়ে লেখক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। গীতার বক্তব্যকেই তিনি সম্প্রসারিত করেছেন এক্ষেত্রে :

It is not possible to exist without breathing. Breathing is an action. You can not help but act. The heart cannot help but beat, the eyes cannot help but see, the ears cannot help but listen, the mind cannot help but chatter. Nature compels man to feed and protect the body. It is an inborn function. It can be limited but not eliminated, for action is the mantra that mokes the body tick.

শারীরতত্ত্বের প্রেক্ষিতে লেখকের ব্যাখ্যা :

Man’s body is an energy field, the energy releases and recycles in physical action. Inaction causes lethergy and disease. Therefore, in his own interest man has to perfrom action. Nor can he go against the current of his nature.

অতএব, man has no choice but to act. Action is his inherent nature, hence he should perfrom it to the best of his abilities. One can never be inactive even for a moment. (Lighting the Path; page-47)

অহং যত নষ্টের মূল, কর্মকে কলুষিত করে এই অহং। আমিই কর্তা, আমার দ্বারা বিশেষ কাজটি সম্পাদিত এটাই হল অহংবোধ। কিন্তু যদি সেই অহংবোধই না থাকে তাহলে কর্তারও অস্তিত্ব থাকে না—Where there is no ego then there is no doer. আবার, when there is no doer then there can be no Karma, for there is no reactor or receptor that registers or responds to the action.

কর্মের ভূমিকা কি? The inevitable cycle of birth and death is propelled by Karma.

কর্মের পিছনের শক্তি কি? Karma is caused by the magnetic pull of the ego and its desires. লেখকের সিদ্ধান্ত—When there is no ego, there can be no Karma.

Karma belongs to the ego and accumulates around a person as long as he is attached to the action. অহং অন্তর্হিত হলে তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না যার সঙ্গে নাকি কর্মকে সংশ্লিষ্ট করা যায়—When the ego disappears then there remains nothing to which the Karma can be attached. (Lighting the path, page-52)

জ্ঞানযোগের আলোচনায় লেখক কুন্ডলিনীর প্রসঙ্গ এনেছেন। যথার্থ জ্ঞান তখনই আয়ত্ত করা সম্ভব যখন কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করা সম্ভব হয়।

জীবনের লক্ষ্যই হল বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। জ্ঞান আচ্ছ্বাদিত থাকে মানসিক স্তরের দ্বারা।

আমরা যখন মাটিতে বীজ বপন করি তখন কোন উদ্দেশ্যে তা করি? উদ্দেশ্য হল বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানো, ক্রমে তা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হলে ফলে ফুলে পূর্ণতা পাবে, তেমনি মানবজীবনের পূর্ণতা কি? ‘enlightenment is the human fulfilment.’-এর জন্য লেখক ধ্যানের সুপারিশ করেছেন—Meditation is the path to achieve this end.

কুন্ডলিনীর ভূমিকা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে :

the Kundalini comes up and waters the brain, the whole tree of life is drenched in the Divine Bliss and pure Knowledge. (The highest attainment, page-70)

লেখক ভক্তিযোগেরও ব্যাখ্যা করেছেন। যখন মানুষের সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, মানুষ দুঃখ-ভারাক্রান্ত চিত্তে তখন ভগবানের দিকে মুখ ফেরায়। এটাই তখন তার শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে মানুষ সংকটের মোকাবিলা করে।

When there is no other place to turn, the faith in the Divine helps him to overcome the crisis and he surrenders to the Divine Will.

মানুষ যখন তার অহংকে সমর্পণ করে বসে, তখনই সেঈশ্বরের সান্নিধ্য পায়। ‘Only when the ego is surrendered can this method work. When you are not, He is. This is the path of Bhakti Yoga.’ (Worship; page-128)

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

স্বামী বিষ্ণুপুরী

স্বামী বিষ্ণুপুরী ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ প্রণয়ন করেছেন ১৩৯৪ বঙ্গাব্দে। এই গীতা সন্দীপনী টীকা সম্বলিত। লেখক সমগ্র গীতার সমস্ত শ্লোকের অন্বয়ার্থসহ বঙ্গানুবাদ উপস্থাপিত করেছেন। সংখ্যাযোগীদের জন্য জ্ঞাননিষ্ঠা আর যোগীদের জন্য কর্মনিষ্ঠা প্রশস্ত। চিত্তের বৃত্তি নাশের দুটি উপায়-কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ। যোগ্যতার তারতম্যেই এই দুটি নিষ্ঠার বিভাজন। যোগে চিত্তের বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়, জ্ঞানে আসে সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন। সাংখ্যাধিকারীগণের জন্য জ্ঞানযোগ, যোগনিষ্ঠাগণের জন্য নিষ্কাম কর্মযোগ বিধেয়। আবার এই দুইও সম্পর্কান্বিত। কী রকম? কর্মানুষ্ঠান ব্যতিরেকে কোন নিষ্ঠাই ফলবতী হয় না, এমনকি জ্ঞাননিষ্ঠাও সম্ভব নয়।

কর্মযোগের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—আলস্য রহিতহয়ে বেদোক্ত স্বকীয় কর্ম নিষ্কামভাবে সম্পাদনের নামই কর্মযোগ। লেখক গীতাতত্ত্বের সঙ্গে বাইবেলের পার্থক্য দেখিয়েছেন। বাইবেলে অশুভ কর্মে প্রণোদিতকারী কর্মেন্দ্রিয়গুলির বিনাশসাধনের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে, কিন্তু গীতায় তা বলা হয়নি, মনকে কেবল সংযত করার পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে। বাসনামুক্ত হয়ে ঈশ্বরপ্রীত্যর্থে কর্ম করার কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে এতে বন্ধন আসে না। মনে রাখা দরকার, কর্মচক্র থেকে কেউই মুক্ত নয়। কর্মচক্রের উপরেই এই জগৎ সংস্থিত। জ্ঞানলাভের জন্যও প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

লেখক বলেছেন :

দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ। কারণ জ্ঞানেই সর্ব কর্মের পরিসমাপ্তি। জ্ঞান হল পবিত্রতম, আর অজ্ঞানতা হল অপবিত্র। শ্রদ্ধাহীনের জ্ঞানাধিকার নেই, কিন্তু পাপীরও জ্ঞানাধিকার আছে। জ্ঞানলাভের উপায় হল শ্রদ্ধা, তৎপরতা এবং ইন্দ্রিয়সংযম।

আসক্ত, ভক্ত এবং জ্ঞানীর কর্মাচরণের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন লেখক। ভক্ত নিজেকে ঈশ্বরের যন্ত্রী বলে মনে করেন, ঈশ্বর তাঁকে দিয়ে কর্ম সম্পাদন করান। ভগবৎ শরণাগতিই মোক্ষলাভের উপায়। সবকিছু ত্যাগ করে কৃষ্ণ ভজনা করা কর্তব্য। গীতায় জ্ঞান ও ভক্তিকে অবিরোধীরূপে দেখা হয়েছে। বীতরাগ ভয় ক্রোধ হয়ে জ্ঞান তপস্যায় পবিত্র চিত্ত যে ঈশ্বরের শরণাগত সেই তাঁর স্বরূপতা লাভের অধিকারী। ভগবানের প্রতি শরণাগতিই মোক্ষলাভের উপায়।

দি ভাগবদ গীতা

এস. তত্ত্বভূষণ

S. Tattvabhushan-এর ‘The Bhagavad Gita’র প্রকাশকাল ১৯৮৭। লেখক বলেছেন, সঙ্গতভাবেই জ্ঞান ও কর্মকে সমন্বিত করা যায়। জ্ঞানযোগীরা ভাবেন কাজ ব্যতিরেকেই বুঝিবা তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছবেন। কিন্তু সেটা অসম্ভব। কেবলমাত্র শুদ্ধ পবিত্র আত্মার যিনি অধিকারী তাঁর পক্ষে জ্ঞানার্জন সম্ভব। পবিত্রতা কখনই কর্ম ব্যতিরেকে অর্জন করা সম্ভব নয়। এমনকি যখন অন্তর বিশুদ্ধ এবং জ্ঞানার্জনের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে তখনও কর্মের প্রয়োজন থেকে যায়। এক মুহূর্তের জন্যও কারো পক্ষে কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। কেউ যদি কাজ করতে অনিচ্ছুক হয়ও, তথাপি গুণের দ্বারা তাড়িত হয়ে সেকাজ করে। গুণ হল প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য যখন আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিষ্ক্রিয় রাখি, তখন মন কিন্তু কাজ করে এবং যেসব বস্তু আমাদের কাছে উপাদেয় সেগুলির চিন্তা করে। যদি কাজ করা অনিবার্যই হয়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজন ইন্দ্রিয়গুলিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে, অন্যগুলিকে মনের নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করা। কেবল যেগুলি আমাদের কর্তব্যকর্ম সেগুলিকে মনের নিয়ন্ত্রণ রেখে কাজ করা। কেবল যেগুলি আমাদের কর্তব্যকর্ম সেগুলিই করা চাই। কর্তব্যকর্ম সম্পাদনেও যজ্ঞের মানসিকতা রক্ষা করা চাই। এর নাম পূজা। যে কোনো কাজ যদি এই মানসিকতা ব্যতিরেকে করি তবে তা আত্মকে পৃথিবীমুখী করে তোলে। আমরা কাজ করি পৃথিবীকে রক্ষার জন্য। এবং অন্যের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে। জ্ঞানীলোকদের এমনটাই করা কর্তব্য। প্রকৃতির গুণই কাজ করায় কিন্তু মানুষ ভাবে তারাই কাজ করে, আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করে। প্রতিটি মানুষের এক ধরনের প্রকৃতি তদনুযায়ী তার কাজ কর্ম, প্রকৃতিগত ভাবে যে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় মানুষ, তেমন কাজটিই তার করা উচিত।

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। ঈশ্বর প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই প্রকাশিত। আমাদের মধ্যে বিশ্বজনীনতার উপস্থিতি আমাদের পৃথিবীকে objective reality—রূপে জানতে সাহায্য করে। একই কারণে প্রেয়ার থেকে শ্রেয়ার পার্থক্যও বুঝি আমরা। লেখকের মতে :

That the realisation of union, with the Absolute is not the monopoly of the so-called ‘Incarnation of God’…..

কাজকে ভগবানের করে তুলতে হবে। কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব?

it is only when god has been known as the all comprehending self of the world and the self of our finite selves that Karma-Brahmarpana, offering all actions to God become possible. All work then becomes God’s work, self-will appears to have no place and is merged in God’s will and if interest in work continues, it is identical with interest in the whole world, and that whole is god.

লেখক একেই নিষ্কাম কর্ম বলে অভিহিত করেছেন। নিষ্কাম কর্মকেই তিনি কর্ম-ব্রহ্মার্পণ বলেছেন। সকল কর্মের প্রেরণা হল প্রত্যক্ষ ঈশ্বরানুভূতি। এই প্রেরণাই আমাদের সকল কর্মে পথ নির্দেশ করে।

সাধনার নানা স্তর, আধ্যাত্মিক প্রয়াস যার সঙ্গে অনেকে একাত্ম হতে অক্ষম, কিন্তু এরই কাছে মানুষ তার নানা ধরনের অর্চনা ও আহুতি দেয়।

সবশেষে ভক্তিযোগ। ঈশ্বরের আরাধনাই ভক্তের মূল লক্ষ্য। মনে রাখতে হবে—‘mere pietists and sentimentalists that this cannot be reached without work—work done in the spirit of worship “madartham”, for me’—কিন্তু এও অসম্ভব সর্ব কর্ম ফলত্যাগ ব্যতিরেকে, ‘renunciation of the fruits of all action.’ পরিণতি হল ঈশ্বরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক মিলন। মাধ্যম কী? গুরুত্বের নিরিখে ত্যাগ, কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান এবং অভ্যাস। আপাতভাবে লেখক কর্মকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হবে, আসলে কিন্তু তা নয়, তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন ভক্তির উপরেই।

শ্রীমদভগবদগীতা

শ্রীমৎ স্বামী বিজ্ঞানানন্দ সরস্বতী

শ্রীমৎস্বামী বিজ্ঞানানন্দ সরস্বতী প্রণীত শ্রীমদভগবদ গীতার (২য় সংস্করণ) প্রকাশকাল ১৯৯০। লেখক শ্রীমদ- ভগবদ গীতার পদ্য অনুবাদ করেছেন। বামপার্শ্বে মূল text রেখে দক্ষিণপার্শ্বে অনুবাদ সন্নিবিষ্ট করেছেন। অনুবাদ মূলানুগ, একাদশ অধ্যায় থেকে কিছু অনুবাদের নিদর্শন গৃহীত হল—

অনন্তবীর্য ও বাহু আদি মধ্য

অন্তহীন শশী সূর্য নেত্র।

স্বীয় তেজে বিশ্বতাপে দেখিতেছি

দীপ্তিমান তব বহ্নিবক্ত।। ১৯

স্বর্গ মর্ত অন্তরীক্ষ সর্ব দিক

একমাত্র তোমাতে বেষ্টিত।

অত্যদ্ভুত তব এই উগ্ররূপ

নেহারিয়া ত্রিলোক ব্যথিত।। ২০

তব দেহে প্রবেশিছে দেবগণ

কেহ কেহ ভজে করজোড়ে।

কেহ ভয়ে স্বস্তি বলে সিদ্ধ ঋষি

মহর্ষিগণ দিব্য স্তুতি করে।। ২১

রুদ্রাদিত্য, বসু সাধ্য বিশ্বদেব,

সিদ্ধ পিতৃ যক্ষ অগণিত।

অশ্বিনীকুমারদ্বয় অসুরাদি

মরুদগণ হেরিয়া বিস্মিত।। ২২

বহুমুখ নেত্র বাহু উরুপদ

বহুদর দন্ত ভয়ঙ্কর।

বিভীষণ রূপ দেখি মহাবাহো

মোরা সবে ভয়েতে কাতর।।

কর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যায় লেখক বললেন :

যার যেমন গুণ তার তেমনি কর্ম।

কর্মের ছোট বড় কিছু নেই কিংবা কর্মের কারণে কেউ ছোট-বড় হয় না। কারণ? কর্ম ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত। লেখক বিশ্বাস করেন, ‘যার যা নির্ধারিত কর্ম তা করে গেলে সমাজ-রাষ্ট্র-সমষ্টিজীবন ব্যষ্টিজীবন সুখময়, মধুময়, শান্তশীল, শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়। ঘড়ি এবং দেহের দৃষ্টান্তে লেখক চতুর্বর্ণের কর্মের গুরুত্ব দেখিয়েছেন। বলেছেন :

কাহাকেও হীন দীন বলে মনে করা বা ঘৃণা করা কর্তব্য নহে এবং কর্ম না করে বসে থাকাও কাহারো সঙ্গত নহে। কর্ম একই সঙ্গে বন্ধন ও মুক্তির হেতু। ব্যবহার গুণেই কেউ বাঁধা পড়েন আবার কেউ মুক্তি- লাভ করেন।

লেখকের ভাষায় :

কর্মকে কুশলীকৃত করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করলে তা হয় মুক্তির হেতু।

জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় লেখক জ্ঞান ও বিজ্ঞান দুইয়ের প্রসঙ্গই টেনেছেন। জ্ঞান হল ব্রহ্মবিদ্যা। ব্রহ্মবিদ্যা কী না ঈশ্বরানুভবী জ্ঞান বা আত্মজ্ঞান। জ্ঞান হল ক্ষেত্র তথা ক্ষেত্রজ জ্ঞান, ঈশ্বর-সম্পর্কিত জ্ঞান। অন্যদিকে বিজ্ঞান হল ঈশ্বরকে জানার উপায়। অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞান হল প্রকারান্তরে সাধ্য ও সাধন।

লেখকের মতে গীতায় প্রাধান্য পেয়েছে ভক্তিযোগ। ভগবান ভক্তাধীন। ভক্তি :

ভক্ত ও ভগবানের মাঝখানে থেকে ভক্তকে এক হাতে আর ভগবানকে অন্য হাতে ধরে উভয়ের মিলন ঘটিয়ে দেন।

মৌমাছি যেমন ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়, ‘ভগবান কোথায় ভক্তি আছে তাই অনুসন্ধান করেন।’ লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

অন্য চিন্তা ত্যাগপূর্বক যে ব্যক্তি একান্তচিত্তে এক ভক্তি দ্বারা (অনন্যচিত্তে) ভগবানের স্মরণ করে ভগবানকে সর্বান্তঃকরণে আশ্রয় করে এমন যে নিত্যযুক্ত ব্যক্তি তার তিনি সকল অভাব দূর করেন। ভক্তির প্রধান লক্ষ্যগুলি লেখক বর্ণনা করেছেন। সেগুলি হল—স্মরণ, মনন, কীর্তন, অনন্যশরণ, কর্মার্পণ, আত্মনিবেদন ও অহংকারকে সমর্পণ।

আরও বলা হল, ভক্তিপথের পথিক হতে কারো কোনো বাধা নেই। সকলের এতে অধিকার :

স্ত্রী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-চন্ডাল প্রভৃতি জাতিবর্ণ নির্বিশেষে এই ভক্তি ধর্মের মাধ্যমে সকলেই ভগবানের আরাধনা করতে পারে বা সকলেরই উহাতে অধিকার বিদ্যমান।

ভক্তিমার্গের অনন্যতা হল :

জ্ঞানাদি মার্গে উহার বিপরীত আচরণ দেখা যায়। ভক্তিমার্গ ব্যতীত অন্য মার্গে বহুবিধ অনধিকার বিচার- বিবেচনা করা হয়। ভক্তিমার্গে এসবের বালাই নেই।

লেখকের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত :

ভক্তির পাল্লাই ভারী হয়েছে কর্মজ্ঞান যোগ অপেক্ষা। (পৃষ্ঠা-৩৮৩)

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

শান্তিরাম সাধু

ড. শান্তিরাম সাধু ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ প্রকাশ করেছেন ১৪০০ বঙ্গাব্দে। গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য হল একই সঙ্গে গীতার কাব্যানুবাদ ও গদ্যানুবাদ স্থান পেয়েছে। সঙ্গে গীতার মূল text-টিও রয়েছে। গদ্যানুবাদটি সাধুভাষায় রচিত। বিশ্বরূপ দর্শন যোগের কবি-কৃত অনুবাদের কিয়দংশ নমুনাস্বরূপ উদ্ধৃত হল—

অনেক উদর, বাহু, নেত্র ও বদলহেরিতেছি সবখানে, অন্তহীন রূপ।অন্ত নাই, মধ্য নাই, নাই তার আদি,বিশ্বের ঈশ্বর, হেরি – তব বিশ্বরূপ।। ১৬কিরীট-শোভিত শিরে, গদাচক্রধারী,উদ্ভাসিত তেজোপুঞ্জ – তোমার বিভূতি।অতি কষ্টে, দেখা যায়, প্রদীপ্ত অনল—সৌরকর-সম, তব অবিচ্ছিন্ন দ্যুতি।। ১৭

তুমি অক্ষর ব্রহ্ম, সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান,তুমিই, এ জগতের, পরম আশ্রয়।তুমি, নিত্য সনাতন ধর্মের রক্ষক,চিরন্তন আত্মা তুমি, মোর মনে হয়।। ১৮

দি গীতা

সুনীলকুমার সরকার

সুনীলকুমার সরকারের গীতার পদ্যানুবাদ (ইংরেজিতে) প্রকাশিত হয় ১৯৯৬খ্রিস্টাব্দে। অনুবাদগ্রন্থ হলেও লেখক গ্রন্থের মুখবন্ধে এবং ভূমিকায় গীতা সম্পর্কে কিছু সাধারণ আলোচনা করেছেন। মুখবন্ধে লেখক গীতার সমন্বয়বাদের ওপরই গুরুত্ব দিয়েছেন :

The Lord, nevertheless, preaches a syncretic approach to the God head–a synthesis of the fourfold paths, for, one of the necessarily leads to the other and neither is superior to the rest.

পাশ্চাত্যদেশের মানুষ গীতার গদ্যানুবাদের সাহায্যেই মূলতঃ গীতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। লেখক সঙ্গতভাবেই মনে করেছেন মূল সংস্কৃত জানা না থাকলে গীতার পদ্যানুবাদ সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে না, বিশেষত গীতার কবিত্ব ও নাটকীয়তার কারণে। এই প্রেক্ষিতেই লেখকের গীতার পদ্যানুবাদ ইংরেজিতে প্রকাশ করা, যাতে ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ গীতার অনন্যতা উপলব্ধি করতে পারেন :

The English-speaking world will never be able to well appreciate the entailing poetry and drama of the Gita without going through its original Sanskrit. The rendering of the Gita into English Verses may help to a little extent the English-speaking world in imaging about the poetic nuances, dramatic turns and linguistic beauty of the Gita.

লেখক গীতার ইংরেজি পদ্যানুবাদে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন কৃত ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল হয়েছেন।

I have specially followed the interpretation of the Gita by Professor Sarvepalli Radha Krishnan. In this versification I have taken the chapters. Heading of this Gita, from the Bhagavad Gita by Radha Krishanan.

লেখকের দাবী গীতার ইংরেজি পদ্যানুবাদে তাঁর প্রয়াস দ্বিতীয়, কিন্তু তাঁর এ দাবী যথার্থ নয়। গীতার ইংরেজিতে পদ্যানুবাদ অনেকেই করেছেন। লেখকের পূর্বেই।

ভূমিকায় লেখক অন্যান্য নানা বিষয়ের সঙ্গে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। প্রকৃতিগতভাবেই আমরা কর্মে নিযুক্ত থাকি। নিষ্কর্মা থাকার তুলনায় কর্মক্ষম থাকা শ্রেয়ঃ, কাজ করতে হবে ভগবানের জন্য, তা না হলে তা বন্ধনের কারণ হয়ে উঠবে। যে মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট তারই কেবল কাজের দায় থাকে না। সেক্ষেত্রে তার কাজ আনন্দ অথবা দুঃখ, পুরস্কার কিংবা শাস্তি কিছুই দেয় না।

We are forced by nature to remain active. To work therefore is better than remaining inert, idle, for in that case we are going against our inherent nature and thereby causing pains to ourselves …… one must do work only for the sake of God, and that the work must be done as a sacrifice to God otherwise the work will lead one to bondage ……… only that person needs not work who is satisfied with himself. If such a person works then his works do not bring him either pleasure or pain, reward or sins. বোঝা যায়, লেখক গীতার কথাই বলেছেন নিজের মত করে।

এবার জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গ।

লেখক প্রথমেই বলে নিয়েছেন The Gita lays equal emphasis on all the three ways or methods of achieving liberation, the Karma-yoga, the Jnana-yoga and the bhakti-yoga.

জ্ঞানযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য :

We can achieve liberation by acquiring wisdom (and not Knowledge) of the ultimate reality or, which is the same thing, of the absolute or of the supreme self. Jnana or wisdom, here, does not mean acquisition of information of the temporal world, for instance, acquisition of scientific facts.

লেখক জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় মূলত নির্ভর করেছেন রাধাকৃষ্ণনের ব্যাখ্যার ওপর।

ভক্তিযোগের প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য : নিরাকার ভগবানের সাধনা খুবই দুরূহ। মানুষ অবয়বহীন কিছু ভাবতে পারে না, এইজন্যই জ্ঞানযোগ দুরূহ :

it is very difficult to worship formless and attributeless Brahman or the Absolute, for human being can hardly think of imageless beings, …. in Jnana-yoga one is to comprehend the formless and imageless Brahman.

কর্মযোগও কঠিন কেননা এতে মানুষ ইচ্ছামুক্ত বা ফলপ্রাপ্তির আশা ব্যতিরেকে কিছু করতে পারে না। এ দুই যোগের তুলনায় ভক্তিযোগ সহজতম :

Comparatively, bhakti-yoga or the way of worshipping the personal Lord, is much easier than both jnana-yoga and karma-yoga. In bhakti yoga. One is to imagine the absolute and imageless Brahman as the personal Lord with (anthro pormorphic) forms and ideal and absolute attributes, such as absolute power, absolute knowledge, absolute compassion, etc.

আমরা এবার লেখক-কৃত পদ্যানুবাদের কিছু নিদর্শন গ্রহণ করব—

i. Action’s better than inaction;

So do thy allotted work.

Even to maintain thy body,

Thou must act, mark. (৩য় অধ্যায় / ৮ সংখ্যক শ্লোক)

ii. Do thy Job, so, with no

Attachment, and know

Man attains to the highest

Through the way best. (৩য় অধ্যায় / ১৯ সংখ্যক শ্লোক)

iii. The Nature only acts;

But he whose soul

Is bewildered by

Senses, thinks it is ‘I’. (৩য় অধ্যায় / ২৭ সংখ্যক শ্লোক)

iv. The fire of wisdom will

Works to ashes, burn.

With fire, Arjuna,

Fuel to ashes turn. (৪র্থ অধ্যায় / ৩৭ সংখ্যক শ্লোক)

v. Nothing on earth purer

Than wisdom is,

One knows this but

In yogic bliss. (৪র্থ অধ্যায় / ৩৮ সংখ্যক শ্লোক)

vi. Cut off doubt of ignorance born,

With wisdom’s sword ascender torn.

Get thee wise with Yoga and,

Arjuna, up thou stand. (৪র্থ অধ্যায় / ৪২ সংখ্যক শ্লোক)

vii. Some for me work

And are on Me intent,

Mediate on Me they

With devotion deep. (১২শ / ৬ সংখ্যক শ্লোক)

viii. Knowledge better than practice be ;

Meditation than knowledge is ;

But renunciation the best,

That bestows instant peace. (১২শ / ১২ সংখ্যক শ্লোক)

ix. Who rejoices not, nor hates,

Neither desires nor grieves,

Good and evil who has renounced,

To Me, know, he is dear (১২শ / ১৭ সংখ্যক শ্লোক)

লেখক ছন্দ ব্যবহারে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনুবাদ হয়েছে মূলানুগ এবং সচ্ছল।

শ্রীমদভাগবদগীতা

সুরেন্দরনাথ লাল

‘Srimad Bhagavad Gita’-র অনুবাদ করেছেন Surender Nath Lal গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৯৭। গ্রন্থটিতে একদিকে যেমন মূল সংস্কৃতে রচিত গীতার text টি আছে, তেমনি প্রতিটি সংস্কৃত শ্লোকের রোমান হরফে উপস্থাপন আছে। এরপর হিন্দীতে গীতার কাব্যিক অনুবাদ প্রদত্ত হয়েছে, প্রদত্ত হয়েছে গীতার ইংরেজি অনুবাদও। অনুবাদকের অনুবাদকর্মের কিছু পরিচয় গ্রহণ করা যেতে পারে।

ক. Even when one’s own dharma(caste duties) is devoid of merit it is preferable to other to people’s well-performed dharma. It is good to die practicing one’s own dharma. To follow other people’s dharma is frighthening (৩য় অধ্যায় ৩৫ সংখ্যক শ্লোক)

খ. There is no greater purifier in the world than knowledge. This true knowledge is experienced in time by an accomplished Yogi within himself. (৪র্থ অধ্যায়, ৩৮ সংখ্যক শ্লোক)

গ. Arjun! There are four kinds of good people who worship Me; those who desire earthly gains, those who are suffering, those who seek knowledge and those who possess wisdom. (৭ম অধ্যায়, ১৬ সংখ্যক শ্লোক)

ঘ. I am the supreme Lord of all beings but fools do not know this and being ignorant of my divine nature look down upon me as a mere human being. (৯ম অধ্যায়, ১১ সংখ্যক শ্লোক)।

Humility, look of ostentation, non-violence, forgiveness, purity, reverence towards teachers, cleanliness, stability, self-control, renunciation of earthly pleasures, modesty, contemplation of life, death, old age, disease, weaknesses and suffering, disenchantment with wife, children and home, neutrality, disinterestedness and treating good and bad equally.

এসেন্স অফ ভাগবতগীতা

এ. এস. রমানাথন

A.S. Ramanathan-এর Essence of Bhagavad Gita’-র প্রকাশকাল ১৯৯৯। লেখক কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ এই তিনেরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কর্মযোগ বলতে লেখক বুঝিয়েছেন বৈদিক ঐতিহ্যসূত্রে যেসব কর্তব্যপালনের কথা বলা হয়েছে সেগুলিকে। কর্মযোগের অন্তর্ভুক্ত সকল রকমের বৈদিক এবং ঘর-গৃহস্থালী সম্পৃক্ত কাজ যা ব্যক্তিবিশেষের অনুষ্ঠান করা বিধেয়। এইসব কর্তব্যকর্ম পালনের দ্বারা ব্যক্তি একদিকে যেমন সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত কিছু সুবিধাও ভোগ করে যেমন, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ্য ব্যক্তির জন্য এবং তার পরিবারের জন্যও। লেখকের ভাষায় :

The Karma Kanda is a compendium of various Karmas or rituals that are ordained for mankind for achieving various benefits, and covers rituals which ensure all types of benefits and comforts in this world as well as in the other world after death.

লক্ষণীয়, কর্ম শুধু এ জীবনেই সহায়ক তা নয়, মৃত্যুর পরে অন্য জগতেও তা সহায়কের ভূমিকা পালনে সক্ষম। কিন্তু যেমন তেমন করে কাজ করলেই হবে না, কাজ করার নিয়মকানুন সঠিকভাবে জানা চাই নতুবা কাজ করেও ফললাভ ঘটবে না। তাই কর্মসূত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণ আনুকূল্য লাভের ক্ষেত্রে লেখকের পরামর্শ :

in order to achieve maximum results from Karma, we should not only identify man individually for the presence of a particular Virya but also identify families or divisions in society in which a large number of people exhibit a particular Virya in a highly developed condition.

আমরা সকল সময়ই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকি, এই কাজগুলি কখনও আমাদের সহায়তা করে, আবার কখনও আত্মার ক্ষেত্রে প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে। লেখক এই কর্মকে বাসনা কর্মের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমাদের মুনিরা তাই পরামর্শ দিয়ে গেছেন যেন কখনই তেমন কাজ না করি যা নাকি মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিকে সেই কাজই করব যা আমাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম :

In order that we indulge only in such Karmans which produce favourable effects on us.

তাই প্রভাবের কথা জেনে তবেই কাজে হাত দেওয়া উচিত :

We should engage ourselves in Karma only after knowing its upanishad and its effects on us.

লেখক বললেন, যারা মৃত্যুর পর পিতৃস্বর্গ বা দেবস্বর্গে যেতে চান, তাদের উচিত প্রতিটি কর্ম সম্পাদনের পূর্বে তার সম্পর্কে পুরো জ্ঞানার্জন করা :

Those who want happiness in life in this world, through indulgence in worldly matters or happiness in pitrisvarga or Devasvarga after death, should gain full knowledge of every Karma and its effects before undertaking the Karma.

জীবনের প্রথম পর্বে সকল কাজে জ্ঞান এবং কর্মকে একত্র নিয়ে চলা উচিত :

Jnana and karma should go together in every activity one undertakes during the first part of his life.

পরবর্তীতে এই কর্মগুলিই বিনা ফললাভের আশায় সম্পাদিত হয় এজন্যই জ্ঞানের খুব প্রয়োজন। পঞ্চাশ ঊর্ধ্বে একজনের উচিত সংসারের দায়িত্ব তরুণতরদের উপর ন্যস্ত করে সস্ত্রীক অথবা স্ত্রীবিযুক্ত অবস্থায় বনে গমন এবং এখানে এমন সব কর্মে নিযুক্ত থাকতে হবে যা একজনকে জ্ঞানী হতে সহায়তা করে। এখানে শুধু সেই কর্মই তিনি করবেন যা তাকে আত্মজ্ঞানের পথে নিয়ে যাবে। লেখকের মতে কর্ম দ্বিবিধ—পাপ কর্ম ও পুণ্য-কর্ম। লেখক কর্মকে দুই শ্রেণীতে বিভাজন করেছেন।

i. সৎ কর্ম যা স্বাচ্ছন্দ্য আনে, একে পুণ্যকর্মও বলা যায়।

ii. বিকর্ম বা পাপকর্ম, যার ফল ক্ষতিকারক.

iii. ব্যক্তির ঐশ্বর্যলাভের বিরুদ্ধে কৃতকর্ম।

iv. প্রায়শ্চিত্ত, ইতিমধ্যে যেসব পাপকর্ম করা হয়েছে সেগুলির কুফল দূরীকরণে কৃতকার্য।

v. অকর্ম, এটি পাপকর্ম, ব্যক্তিবিশেষের সমৃদ্ধির কারণস্বরূপ যা তার প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে।

vi. অতীতের ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টিকারী কর্মের নিরসনে কৃতকর্ম।

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। লেখক স্পষ্ট করে বললেন, কর্মের বাস্তবায়নে জ্ঞানের প্রয়োজন। কর্মই জ্ঞান সৃষ্টি করে। এভাবে কর্ম ও জ্ঞান পরস্পরের সহায়ক। কর্ম দ্বিবিধ—প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি। প্রবৃত্তি আমাদের বন্ধনের কারণ, বাসনা জাগ্রত করে। নিবৃত্তি বাসনার নিরসন ঘটায়। প্রবৃত্তি কর্মজ্ঞানের সাহায্যে সম্পাদিত হয়। এর আদিতে রয়েছে জ্ঞান। আর নিবৃত্তি কর্ম? Nivritti Karma results in knowledge of a superior type.

নিবৃত্তি কর্ম জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায়, জ্ঞানের যত বিকাশ ঘটে ততই ‘Karma gets destroyed’.

জ্ঞান মানে কী? লেখকের মতে জ্ঞানের অর্থ হল নৈষ্কর্ম সিদ্ধি অর্জন। একেই বলা হয়েছে জ্ঞানযোগ। জ্ঞান মানুষকে মুক্তি দেয়। কর্ম থেকে রেহাইয়ের অর্থও হল মুক্তি। সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াও মুক্তি। সকল বাসনা থেকে মুক্ত হওয়ার নামও মুক্তি। জ্ঞান কর্মের বিরোধিতা করে।

All attachments to worldly things which bind the individual are removed by the strength of Jnana.

সবশেষে ভক্তিযোগ। বৈদিক সাহিত্যের উপাসনা কান্ডের মূল উদ্দেশ্যই হল ভক্তিযোগ। লেখক বললেন :

where Jnana and Kriya are combined there, one becomes bhakti (organ) of the other …. Combining both Jnana and Karma, we can devise a method of worshipping and that has resulted in Upasana Kanda. This Karma involves only well-known procedures but ultimately it results in our attaining the highest knowledge (paramarthika Jnana).

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

স্বামী সন্তদাস বাবাজী মহারাজ

স্বামী সন্তদাস বাবাজী মহারাজের ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র প্রকাশকাল ১৯৯৯। উপক্রমণিকায় লেখক গীতার ঐতিহাসিক তত্ত্ব, গীতায় উপদিষ্ট ব্রহ্মতত্ত্ব, শ্রুতি অনুসারে ব্রহ্মস্বরূপের বর্ণনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তারপর গীতার আঠারটি অধ্যায়ের প্রতিটি শ্লোকের অন্বয়, বঙ্গানুবাদ সন্নিবিষ্ট করেছেন। বিস্তারিতভাবে পরিশিষ্টে শ্লোকসূচী ও শব্দসূচী প্রদত্ত হয়েছে।

উপক্রমণিকায় বিস্তারিতভাবে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ আলোচিত হয়েছে। লেখক বলেছেন, ভগবান আমাদের কর্ম করার অধিকার দিয়েছেন। কর্মের ফল কোনোপ্রকারে আমাদের অধীন নয়। তাই ফলকামনা-বর্জিত হয়ে বিহিত কর্মাদি সম্পাদন করা কর্তব্য, এতে বন্ধন ঘটে না। কেন কর্মের কারণে মানুষ আবদ্ধ হয়? না ফল- কামনাপূর্বক কর্মে প্রবৃত্ত হলে ফলাসক্তি মানুষকে ফলভোগের নিমিত্ত সংসারে আবদ্ধ করে। তাই ফলাসক্তি-শূন্য হয়ে কেবল ঈশ্বর প্রীত্যর্থে তৎপ্রচারিত শাস্ত্রবিহিত কর্মসম্পাদন কর্তব্য।

মোক্ষলাভের ক্ষেত্রে দুটি পথ খোলা—সাংখ্যমার্গীয় জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিমার্গীয় কর্মযোগ। এই উভয়ের ফলেই মোক্ষপ্রাপ্তি সম্ভব। কর্মযোগী এবং জ্ঞানী উভয়কেই কর্মে ও কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করতে হয়।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, জ্ঞানযোগ সিদ্ধ হয়ে জ্ঞানে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও কর্ম একেবারে পরিত্যাগ করা যায় না। জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন যে, ভগবৎশক্তি ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিই সকলকে কার্যে নিযুক্ত করে। তাই তিনি সমস্ত কর্মই ঈশ্বরে অর্পণ করেও অনাসক্তভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হন।

জ্ঞান সম্পন্ন হলে ঈশ্বরে সমস্ত ভূতগ্রামকে এবং সমস্ত ভূতে ঈশ্বরকে দর্শন করা যায়। সর্ববিধ সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে তমোভাব পরিত্যাগ করে কর্মযোগ অবলম্বনের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে।

যাঁরা সগুণরূপে দেবতার উপাসনা করেন তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যোগবিৎ। অক্ষর উপাসকগণও তাঁকে লাভ করেন। যাঁরা তাঁর সগুণমূর্তির উপাসনা করেন ভক্তিসহ, তাঁরা শীঘ্র সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেন। চিত্ত একেবারে যদি সমাধিযুক্ত না হয় তবে ক্রমশ অভ্যাসশীল হতে হয়। তাও সম্ভব না হলে ঈশ্বরের যোগকর্মে নিযুক্ত হতে হয়। এও সম্ভব না হলে ঈশ্বরে কর্মার্পণ করে ফলকামনা ত্যাগ করা বিধেয়।

শ্রীমদভগবদগীতা

অরুণকুমার মজুমদার

শ্রীমদ ভগবদগীতা, সংকলক অরুণকুমার মজুমদার, প্রকাশকাল ২০০০। গ্রন্থটিকে অনুবাদ ও ঋষিবাক্য সংকলন- রূপে অভিহিত করা হয়েছে। সংকলক এই গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব মতামত বা ব্যাখ্যা সন্নিবিষ্ট করেন নি। তিনটি কারণে গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। প্রথমত সন্ধিবিচ্ছেদসহ গীতার মূল শ্লোকগুলির অনুবাদ সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। ফলতঃ সংস্কৃতে যাঁদের ব্যুৎপত্তি নেই, তাঁদের পক্ষে গ্রন্থটি সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃত থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করার পর লেখক সরল বাংলায় সম্ভবমত মূলকে অনুসরণ করেছেন। তৃতীয়ত, গীতার বক্তব্যকে অধিকতর পরিস্ফুট করার জন্য কথামৃত, শ্রীমা, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্তের রচনা থেকে উদ্ধৃতি প্রদত্ত হয়েছে। সংকলকের বহুপঠনশীলতার পরিচয় লভ্য।

শ্রীমদভগবদগীতা

শ্যামল ব্যানার্জী

Srimad Bhagavad Geeta, রচয়িতা শ্যামল ব্যানার্জী, প্রকাশকাল ২০০২। মূল গীতার text দিয়েছেন, সংস্কৃত শ্লোকগুলিকে রোমান হরফে প্রকাশ করেছেন, তারপর ইংরেজিতে প্রতিটি শ্লোকের অনুবাদ করেছেন। যুক্ত করেছেন Paraphrase এবং notes। লেখক গীতার ইংরেজি অনুবাদে Blank Verse-কে আশ্রয় করেছেন। গীতার কাব্যিক ধর্মকেই লেখক সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে :

The Geeta is a Kaleidoscope. It is a diamond that dazzles. লেখক গীতার সমন্বয়বাদকে স্বীকার করে নিয়েছেন। লেখক বিশ্বাস করেন, Karma Yoga …. is the main theme and thesis of the whole of the Geeta.

কর্মযোগ কী? লেখকের মতে কর্মযোগের দুটি শিক্ষা :

one must desist from desires. Work must be pure worship. দ্বিতীয় শিক্ষাটি হল—The Karma Yogin must have faith and must have knowledge that he, his Ego-self is not the doer; it is not the master.

কর্মযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানসিক অবস্থা—a mental condition in which the mind is stilled and withdrwn from the world of senses. লেখক বিশ্বাস করেন কাজ এবং পূজা অভিন্ন—work and worship are the same.

সোজা কথায় কর্মযোগ হল unattached works. অস্যার্থ, All works done by the Yogin are freed from all perceptions of fruits of works.

জ্ঞানযোগ লেখকের মতে path of light and sublime consciousness. যে অবস্থায় মন শান্ত এবং পার্থিব জগৎ থেকে মন সম্পূর্ণ পৃথক থাকে সেই অবস্থার নাম জ্ঞান। লেখকের মতে—The realizations of the Reality which is beyond the world of works and whose duel image is the world of Nature.

জ্ঞানযোগে যোগী নিমজ্জিত হন Ocean of bliss-এ, ভোগ করেন Supreme joy and light.

সবশেষে ভক্তিযোগ :

The Yogin is possessed of an agonizing love for the beloved Lord. It is all and total self-effacing, incessant pining for the attainment of the Lord. Bhakti Yoga demands that the Bhakta must dissolve him slelf into his beloved Lord.

রামপ্রসাদ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ এঁদের ভক্তিযোগী বলে উদাহরণ দিয়েছেন। বলেছেন এঁরা :

Got into trance with the very name of Mother Kali or of Krishna. This stage of the mind is only achieved when one is totally lost to the world of senses and desires.

ভক্তির কাছে পার্থিব জয়, আনন্দ-দুঃখের কোন মূল্য থাকে না, সর্বত্র তিনি তাঁর প্রিয় ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেন। ঈশ্বরের সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাছে অসহনীয়—there is no joy and bliss except the joy of re-union— ঈশ্বরের সঙ্গে তিনি বিলীন হতে চান, এই বিলীন হওয়াতেই তাঁর সর্বোত্তম আনন্দের অনুভূতি।

দি ভাগবদগীতাআর. আর. ভর্মা

R. R. Varma রচিত ‘The Bhagawat Gita’-র প্রকাশকাল ২০০২। মূলতঃ এটি গীতার গদ্যানুবাদ। কিন্তু গ্রন্থের দীর্ঘ ভূমিকায় লেখক নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা করেছেন। কর্মযোগ সম্পর্কে লেখকের বিস্তারিত আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, কৃষ্ণ ত’ ইচ্ছা করলেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের রক্তবন্যা তাঁর অনৈসর্গিক ক্ষমতায় বন্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। কেন? লেখক এর উত্তর দিয়েছেন :

God never interferes in anybody’s Karma ….. God never changes individual Karma and fate. God has granted free will to all. Therefore everyone has to reap the harvest of his Karma.

লেখক কর্ম কী তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন :

Karma means action and effects of action. It is an action-reaction series—a cause effect nexus.

অর্থাৎ লেখক কর্ম বলতে তার সঙ্গে তার ফলকেও বুঝিয়েছেন, কার্য-কারণ সম্পর্কই হল কর্ম। বস্তুত লেখকের বক্তব্য, গীতার মূল প্রতিপাদ্যই হল কর্ম। কিন্তু এই কর্মের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট চিন্তা এবং বাক্যও। লেখক কর্মের বিচারে গুরুত্ব দিয়েছেন প্রকৃত কৃত্যকে :

The acid test of Karma lies not in its theoretical understanding but in its actual performance.

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কর্মই আমাদের মুক্তির কারণ আবার কর্মই আমাদের বন্ধনের কারণ :

Our Karma alone will take us either to liberation or bondage……. All actions that we perform are Karma and lead to bondages only Akarma (moral and spiritual action) leads to liberation.

তাহলে কর্তব্য হল কর্মকে অকর্মে রূপান্তরিত করা।

To convert Karma into Akarma is the need.

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ‘When we perform all our actions with devotion and detachment as Nishkam Karma for the good of others.’

এবারে আসা যাক জ্ঞানযোগ প্রসঙ্গে। ‘Gyan Yoga is an inquiry in to the self. He sees his own self in the self of all others, which is why a Gyan Yogi loves all others like his own self.’ জ্ঞানযোগ হল আত্মানুসন্ধান। জ্ঞানযোগী নিজের সত্তাকে অন্যদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেন, তাই জ্ঞানযোগী সকলকেই নিজের মত ভালবাসেন। মূলতঃ চারটি প্রশ্ন জ্ঞানীদের তাড়িত করে। আমি কে? কোথা থেকে আমি এসেছি? আমার উৎস কী এবং আমার গন্তব্যই বা কী? জ্ঞানযোগীর যাত্রা নেতিবাচকতা থেকে ‘Neti is the process of a Gyan Yoga.’ আত্মাকে যিনি আবিষ্কার করেন তিনি খুব সাধারণ মানুষ নন। লেখক তাঁদের super Einstein-এর মর্যাদা দিয়েছেন। লেখক মনে করেন :

Great quest of such a super mind must have pushed him into the bottomless well of the deep and dark mind. It is only after crossing the receding horizons of the seek conscious mind that the super conscious is felt and the self is realized.

Knowledge মানে কী? ব্রহ্ম জ্ঞান। ব্রহ্ম জ্ঞানের অর্থ knowing God, through the self. লেখক মনে করেছেন :

Gyna Yagya is essentially an analytical approach, a deep self analysis. জ্ঞানযোগে কোন কোন স্তর অতিক্রম করতে হয়? Shravana, Manana, Darshana and Nidhi. Dhayasana are the impaortant steps to be followed and observed in the persuit of this Knowledge.

ভক্তিযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্যে প্রথমেই ভক্তির ব্যাখ্যা পাই :

Bhakti means love of God and Bhakti Yoga means discovering God through love.১০

ভক্তির অমোঘ শক্তি ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে লেখক বললেন :

Its magnet draws souls from across continents and the God Himself from the farthest heaven. But such pure and true love is rare. No wonder great Bhaktas are so rare, Tulsi Dass, Meera, Christ, Chaitanya Mahaprabhu, Kabir, Nanak etc are the few names who drew God to them with the magnet of their pure love.১১

আমাদের প্রত্যেকেরই ভাললাগার মানুষ আছে, জিনিস আছে, প্রাণী আছে। কারও সৌন্দর্যের কারণে, কারও বা গুণের কারণে আমরা তাকে ভালবেসে ফেলি। ভক্তিযোগের সাধকের করণীয় হল ‘to shift the center of his focus to God.’১২

লেখক প্রতিটি শ্লোকের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ইংরেজিতে তৎসহ প্রতিটি শ্লোকের ইংরাজিতে গদ্যানুবাদ সন্নিবিষ্ট করেছেন। আমরা কতিপয় দৃষ্টান্তের উল্লেখ করি

i. By me two paths have been given to the world as I have explained earlier, the path of Gyan Yoga (Brahman Knowledge) to the intellectually orientated and the path of Karma Yoga (Nishkaam Karma) to the action orientated. (chap 3, sloke 3)

ii. A man cannot attain the state of actionlessness (Sanyasa) without performing action and by merely withdrawing from action also none can attain perfection. (chap 3, sloka 4)

iii. All actions performed in this world lead to bondage. Therefore, perform action as Yagya. By performing action as Yagya there is no bondage. (chap 3, sloka 9)

iv. Free from attachment, fear and anger, trusting me taking refuge in me and purified by knowledge gained through penance, many people have become like Me or entered Me. (chap iv, sloka 10)

v. A man who is desireless and designless, who has abandoned all possessions, with controlled mind needing nothing, and merely working with the body, such a man incurs no sin (chap iv, sloka 21)

vi. Even if you are the worst of sinners, yet the boat of knowledge will safely steer you clear of the sin. (sea of sins). (chap iv, sloka 36)

vii. Fix your mind on Me alone and concentrate fully your mind and intelligence on Me. Thus you will surmount the body (consciousness) and dwell in Me. (chap xii, sloka 8)

viii. Knowledge is better than Abhyasa Yoga (practice of Yoga). Meditation is better than knowledge. Abandoning the fruit of action is better than meditation because that is followed by peace. (chap xii, sloka 12)

ix. Always happy (contended) regular in meditation, self-controlled and full of determination, mind and intelligence firmly fixed on Me. Such a man is My devotee and is dear to Me. (chap xii, sloka 14)

দি গীতা ফর দি টুয়েণ্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি

সত্য পি. আগরওয়াল

২০০৩ সালে সত্য পি. আগরওয়াল প্রকাশ করেন The Gita for the Twenty First Century। মোট আন্ঠারটি অধ্যায়ে গ্রন্থটি বিন্যস্ত। অধ্যায়গুলি হল Facing the crisis, No Escapicism, Practising Equal Vision, Seeing God in all, Ethical leader, Looking for unity in diversity ইত্যাদি।

আসক্তিহীনভাবে অনুষ্ঠিত কর্মের কারণে বন্ধন আসে না। যে কর্মযোগীর আত্মা বিশুদ্ধ, যিনি নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন, যাঁর আত্মা সকলের আত্মায় রূপান্তরিত তিনি কর্ম করলেও বন্ধনের কারণ হন না।

আত্মশুদ্ধির সর্বোত্তম মাধ্যম হল জ্ঞান। জ্ঞানের সারাৎসার হলো সব মানুষের মধ্যে একই আত্মার উপস্থিতির অনুভূতি। লেখক বললেন, যিনি কর্মযোগে চরমোৎকর্ষ লাভ করেন তিনি জ্ঞানের অধিকারী হন। এই জ্ঞানোন্মেষ হয় যথাসময়ে ভিতর থেকে।

নিষ্কাম কর্মের মতো নিষ্কাম ধর্মও রয়েছে। বস্তুত নানা ধরনের অর্চনার মধ্যে নিষ্কাম ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নিষ্কাম ধর্মের ব্যাখ্যায় বলা হল :

While the worship of others is prompted by their needs or desires the worship or one possessing knowledge being free from selfishness, has the quality of constancy. Such a person loves God more than any one else.

নিষ্কাম কর্মের সঙ্গেই লেখক নিষ্কাম ভক্তিকে স্থান দিয়েছেন। সকল শ্রেণীর ভক্তই উন্নত মনের এবং ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ হন কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রম রয়েছে :

the person with knowledge becomes one with God—due to niskam karma and niskam bhakti, he or she attains God while still living.

গীতা ফর সাকসেস ইন মডার্ন লাইফ ফ্রমবেসমেণ্ট টু বোর্ডরুম

আর. এস. গর্গ

গ্রন্থটির প্রকাশকাল ২০০৩। এটি একটি অন্য ধরনের বই। লেখক ভূমিকায় বলছেন :

If the modern busy man with a scientific temperament concentrates simply on different aspects and requisition of Karma Yoga (Yoga of action) alone, leaving out Jnana Yoga (Yoga of Knowledge), Bhakti Yoga (Yoga of devotion) and Karma-Sannyasa Yoga (Yoga of renunciation) as well as metaphysical aspects of the Gita, it would appear as if the Gita has been written for him and for this modern age.

আধুনিক মানুষ যদি বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে গীতার কেবল কর্মযোগে মনোনিবেশ করে, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতিকে যদি আপাতভাবে বাইরে রাখে, দেখা যাবে গীতা যেন আধুনিককালের মানুষের জন্যই রচিত।

স্বভাবতঃই লেখক কর্মযোগের আলোচনাতেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সমসাময়িক প্রেক্ষিতে গীতার প্রাসঙ্গিকতা অধ্যায়ে লেখক গীতার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। গীতায় মূলতঃ কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের কথা আছে। লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন এক একজন মানুষের প্রবণতা, অভিপ্রায় এমনকি তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা ভিন্ন। ফলে, একই পথ কখনও সকলের পক্ষে সুগম হতে পারে না। দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখক বুঝিয়েছেন, একই ডাক্তার একই রোগে আক্রান্ত রোগীদের একইভাবে চিকিৎসা করেন না, অনুরূপভাবে গীতা ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে লক্ষে উপনীত হতে ভিন্ন ভিন্ন পথের সন্ধান দিয়ে থাকে।

The Gita offers the various above-mentioned paths to help men arrive at the same goal. To some, the path of knowledge is more appealing and suitable, while to others it may be the path of devotion.

কিন্তু অধিক সংখ্যক মানুষের কাছেই কর্মযোগের গ্রহণযোগ্যতা সঙ্গত কারণেই অধিক :

all are engaged in work or action whether out of choice or necessity. (page-15)

লেখক সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, জ্ঞানযোগকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে কি কর্মযোগ অনুসরণ সম্ভব?

a Karma Yoga (follower of the path of action) needs to imbibe Jnana (knowledge) also to some degree because thought being the seed for many action, right thought is necessary. Thus, a Karma Yoga is essentially a Jnana Yoga also. (page-15)

অধিকাংশ মানুষকে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক কর্মযোগের অনুসারী হতে হয়।

The large number of members of society and the inevitability of their engaging in some form of action either of their own choice or as a result of circumstances in which they find themselves at different stages of life would justify that path of work (Karma Yoga) should receive maximum attention in any discussion of the Gita (page 15-16)

কর্ম থেকে কারো অব্যাহতি নেই, কিন্তু প্রশ্ন হল, কী ধরনের কাজ করা কর্তব্য এবং কি ধরনের কাজ এড়িয়ে যাওয়া উচিত, এ প্রসঙ্গে লেখক একটি সঙ্গত প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। ভাল লোকেরা যদি জীবনে উদ্দেশ্যহীন হয়ে অথবা জীবনের অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে বিবাগী হয়ে হিমালয়ে কিংবা অন্যত্র গমন করেন তাহলে পরিণামটা কী হবে?

Gradually, it would lead to a decline in the number of good people and a corresponding increase in that of evil people in the world. (page-18)

তুলনা দিয়েছেন লেখক, এ যেন খারাপ অর্থনীতিকে আনয়নের জন্য উত্তম অর্থনীতিকে বিতাড়ন—It will be a case of bad currency chasing out good currency in the spiritual economics. (page-18)

পরিণামে খারাপ লোকেদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটবে। এ হল সেইসব খারাপ লোক যারা ক্ষমতাপ্রিয়, ক্ষমতার জন্য তারা অন্যায়কে মেনে নিতেও পিছপা হবে না। কিন্তু সমাজ ত’ এদের চায় না, এদের দিয়ে সমাজের কোন মঙ্গল হয় না।

society needs good currency in sufficient quantity to stay in circulation. When a big quantity of bad currency gets into circulation, not only does it endanger the economy, but it also unduly exercise the minds of the people because they are always worried lest they should be affected personally for holding bad currency mistakenly. (page-19)

লেখক বলেছেন, মহাভারতের সময়ে যেমন এখনও তেমনি অর্জুনদের সক্রিয় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। অর্জুনদের অস্ত্রত্যাগ কখনই মেনে নেওয়া যায় না। কারণ এক্ষেত্রে দুর্যোধনদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটবে। এই প্রেক্ষিতেই গীতার কর্মযোগের গুরুত্ব। কি সেগুরুত্ব—

It offers a value system, a practical philosophy of life which aims at meeting, an individual’s needs as an individual, as a householder and as a social being. (page-19)

গীতার একটি লক্ষ্য হল—to check their shift of focus in society from active worldly life to renunciation, from action to inaction. (page-19)

গীতার গুরুত্ব একাধিক ইন্দ্রিয়সংযম এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সঠিক কর্ম সম্পাদন। ভালো মানুষের পতন কে রক্ষা করে এবং উত্তরণে সহায়তা দান, যারা সঠিক জীবনযাত্রায় আগ্রহী, কর্মযোগীরূপে তাদেরও সহায়তা করে। কীরূপে?

The Gita for a Karma Yoga is about, self-improvement, self-growth, reconstructing this very life, harmonizing the action with body-mind-intellect apparatus, provided by nature. (page-22)

গীতার মূখ্য আদর্শ লেখকের মতে :

‘Live not Leave’ is the message of the Gita.

গীতায় তিনটি যোগের কথাই ব্যক্ত হয়েছে, যথা, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ। কিন্তু লেখকের মতে :

The most popular and pragmatic is Karma Yoga—Yoga of action. (page-197)

শারীরিক দিক দিয়ে সক্ষম কর্মী যারা তাদের বৃহদংশই কর্মযোগের অনুসারী। কেননা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শারীরিক শ্রম অত্যাবশ্যক। চিন্তাশীল, ধ্যানপরায়ণ ও অধ্যয়নশীলদের জন্য আদর্শ হল জ্ঞানযোগ। ওপর ওপর বিষয়ে তারা সন্তুষ্ট হন না, তাঁরা গভীরে যেতে চান। এঁরা study করতে চান, শাস্ত্রের যাথার্থ যাচাই করতে চান। এঁদের জন্যই আদর্শ হল জ্ঞানযোগ, তবে জ্ঞানযোগের পথ অবলম্বনের আগে কর্মযোগের আশ্রয় গ্রহণ প্রয়োজন, অন্তত লেখক তাই মনে করেন। জ্ঞানযোগ স্বাভাবিক কারণেই অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য উপযোগী। প্রকৃত ভক্তি হল মানসিক ব্যাপার, এর সঙ্গে বাহ্যিক ব্যাপারের সম্পর্ক নেই—

All forms of true devotion or worship is a matter of the mind, not of the external physical body. It is turning and turning into within. (page-85)

ভক্তিযোগের অনুসারী যিনি তাঁর কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত লেখক তার উল্লেখ করে দিয়েছেন :

non-attachment to the fruits of action single-minded concentration; non-doership; selfless work for the higher purpose, with faith in higher power etc. are necessary value for the state of mind of the traveller on the path of devotion also. (page-88)

দি গীতা ফর অল

ভগবতী শরণ মিশ্র

২০০৪ সালে ভগবতী শরণ মিশ্রের ‘The Gita for all’ প্রকাশিত হয়। গীতার আঠারটি অধ্যায় নিয়েই লেখক আলোচনা করেছেন। প্রতিটি শ্লোকের অর্থ এবং সেই সম্পর্কিত মন্তব্য উপস্থাপিত।

কর্মযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বললেন, একদল মানুষ আছেন যাঁরা জীবন, প্রকৃতি, মানুষ এবং ভগবান-সম্পর্কিত রহস্যের উন্মোচনে ব্যস্ত। অন্য একদল মানুষ আছেন যাঁরা কর্মী। এই সূবাদেই কর্মযোগের প্রসঙ্গ এসেছে। কর্মযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য :

Karma-Yoga where the intelligence is so applied to the day to day work that the work does not become be all and end all of life. It is done because it is essential for existence and it is done with utter detachment, so that the doer is free from the effects of Karma (work) which are bound to follow in an ordinary course.

কর্মযোগে ইন্দ্রিয়াদির সাহায্য আবশ্যক কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলিকে বিশেষভাবে কাজে লাগাতে হবে ‘in an unattached way’.

আধুনিক প্রেক্ষিতে লেখক কর্মযোগের ব্যাখ্যা করেছেন। কী রকম?

A doctor is to act as doctor and an engineer as an engineer. Both should consider their duties no less important than others.

কৃষক কৃষির কাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং একজন ব্যবসায়ীর তুলনায় তার সন্তুষ্টি কোন অংশে কম হবার নয়। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করা উচিত। কোনো কাজই অন্য কাজের তুলনায় হীন নয়। নিষ্কামভাবে কেউ যদি তার কর্ম করে চলে তবে তার দুটি লাভ :

one will not only ensure his survival but will also reach his spiritual goal. One day he will be one with the supreme. (page-74)

জ্ঞানযোগের আলোচনাপ্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য— মানুষ মস্তিষ্ক এবং দুটি হাতের অধিকারী। তাই মানুষের কর্তব্যই হল কর্মসম্পাদন। কিন্তু প্রশ্ন হল, what is really worth doing and what is not worth doing?

The Lord proposes to tell the worth doing and this will free the doers from the bondage of action (page-97).

প্রকৃত কাজ কী তা জানতে প্রয়োজন action, inaction and wrong action কী, প্রয়োজন এই তিনের তুলনা। তাহলেই প্রকৃত কর্মের সন্ধান মিলবে। কোনো কাজই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে কোনো কাজের ফলই সেই কাজ যে সম্পাদন করে তার হাতে থাকে না। লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে না। লেখকের ভাষায় :

It is for the circumstances or Lord to decide what is going to be the out come of the action you have embarked upon. (page-99)

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, একজন কর্ম করা থেকে বিরত থাকবে। লেখক বললেন :

You will, but without having in mind any desire for fruits. If you act in such a way even the wisest of the wise will call you the real wise. This is the truth of existence in the world and if you know this you are certainly wise and at the same time powerful which the Gita wants you to be ….. (page-99)

মূল উদ্দেশ্য হল কর্মজনিত বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করা। মোক্ষ কী? Liberation is the natural outcome of acting without attachment.

জ্ঞান কী? ‘Certainly to see the real nature of things and happiness, their transitory nature, the futility of success and failure. (page-102)

কাজ করব কেন? one is to act for charity, for the welfare of others. (page-102)

ভক্তিযোগপ্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য : The devotion to the Lord gets the upper hard.

ঈশ্বর-আরাধনার সহজতম পথ কী? The easiest path is to be devoted to the Lord who is mainfest. মূর্তিপূজাতেই লেখক অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন—the superiority of worshipping the manifest over the unmanifest. (page-228)

যোগগীতাহরপ্রসাদ রায়

হরপ্রসাদ রায়ের ‘যোগগীতা’র প্রকাশকাল ২০০৫। দুটি খন্ডে বিন্যস্ত। মূল text, তৎসহ text-এর অন্বয়, বঙ্গানুবাদ ও সংস্কৃত শ্লোকগুলির যৌগিক ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। লেখক তাঁর যৌগিক ব্যাখ্যায় আশ্রয় করেছেন যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গীতাভাষ্যকে। লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন যোগসাধনাকে :

মূলত মানবদেহের যোগচেতনার তাৎপর্য নিহিত আছে, … গীতা ব্রহ্মবিদ্যা ও যোগশাস্ত্র। … গীতার তত্ত্বগুলি যেহেতু যোগলব্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই যোগানুরাগী যে ব্যক্তি মন, প্রাণ ও দেহকে আত্মময় করে তুলতে পারবে, তার অন্তর জগতের মানসলোকে গীতার সনাতন জ্ঞান ও অনুভূতি যেমন একদিকে উত্তরোত্তর প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, অন্যদিকে গীতার নীতিগুলি দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে দুঃখ-কষ্ট, হতাশ এমনকি আনন্দের মাঝেও নির্দেশিকা হয়ে ন্যায়, নির্ভীক ও আত্মসচেতন হয়ে চলতে সাহায্য করবে।

বিশ্বচৈতন্য দেহাতীত অসীম ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে মহাজাগতিক ধ্বনি, জ্যোতি ও স্পন্দনের অবিরাম গতি ও ছন্দে বিশ্বব্রহ্মান্ডের গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ও নক্ষত্ররাজি প্রভৃতিদের পরিচালনা করছেন, তেমনি ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ডস্বরূপ দেহের মধ্যে দেহীরূপে প্রতি অঙ্গ কোষ, রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে ক্রিয়ারত আছেন। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক :

যেক্ষেত্রে ধর্ম আছে, সেটা কুরুক্ষেত্র তথা কর্মক্ষেত্র।’ পান্ডব ও কৌরব পক্ষ আসলে কী? আসলে এরা ‘প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি’।

লেখকের মতে শরীর হল ‘ক্ষেত্র’। ধর্মক্ষেত্র ও কুরুক্ষেত্র দুটিরই সমান অবস্থান মানবশরীরে।

হরপ্রসাদ রায় তামাম গীতার ব্যাখ্যা করলেও আমাদের আলোচ্য তাঁর কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের ব্যাখ্যা। কৃষ্ণের কথায় অর্জুন বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, কারণ শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে জ্ঞান ও কর্মের কথা মিশিয়েছিল। লেখকের মতে দুটিরই প্রয়োজন, পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। তিনি বিশ্বাস করেন কর্ম ও জ্ঞানানুশীলন দুটি আসলে যোগধর্মেরই অংশ। দুটি পৃথক সাধনা নয়। কর্মযোগে হয় চিত্তশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি ব্যতিরেকে জ্ঞানলাভ হয় না। কর্মযোগ জ্ঞানযোগের সাফল্যকে ত্বরান্বিত করে।

কর্মযোগের সাধনা যৌগিক মতে কী? নিয়মিত সুষুম্না পথে ছয় চক্রের মধ্যে প্রাণকে নিয়ে গিয়ে তাতে মন রেখে আত্মকর্মের একনিষ্ঠ প্রয়াস। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যোগসাধনার দ্বারা আত্মকর্মে ব্রতী হলে তবেই অন্তর থেকে ইন্দ্রিয়ের প্রভাব অন্তর্হিত হয়।

অর্জুনের সংশয় দূর করতেই শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানযোগের সূচনা করেন। জীবই ব্রহ্মস্বরূপ, ব্রহ্মই সবকিছুর মূল উৎস। এই বোধই হল প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞান আহরণ সম্ভব বিধিপূর্বক আসন ও মুদ্রাসহ প্রাণায়াম সাধনার দ্বারা।

যোগী যোগসাধনা করেন, লাভ করেন আত্মজ্ঞান, উপলব্ধি করেন আত্মার নির্লিপ্ততা, পরিণামে কোনো কর্মে আর আবদ্ধ হতে পারেন না। আত্মতত্ত্বতে মানুষই কেবল কর্মে নিস্পৃহ থাকেন, শুধু কর্মই কর্মবন্ধনের কারণ নয়, কর্মবন্ধনের কারণ কর্মের সঙ্গে যুক্ত কামনা-বাসনা ও কতৃত্বাভিমান। তাই কর্ম কেমন করে অকর্ম হয়, অকর্ম কখন কর্মের মত হয় এ বিষয়ে জ্ঞান আবশ্যক, নতুবা সুকর্ম করতে গিয়েও কুকর্ম হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

প্রাণযজ্ঞের পূর্ণাহুতিতে মন প্রবেশ করে ব্রহ্মনাড়ীতে, তখন জ্ঞান ও জ্যোতির বিকাশ ঘটে, যোগী সমদৃষ্টি সম্পন্ন হন সবকিছুর মধ্যেই তখন তাঁর ব্রহ্মদর্শন ঘটে। পূর্ণ একত্বের এই জ্ঞানের ফলে সব ভেদবুদ্ধির অপসারণ সম্ভব হয়। সর্ববিধ কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি সম্ভব একমাত্র ব্রহ্মার্পণে। যোগী অনুভব করেন ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোনো সত্তা নেই। সকল কর্মই ব্রহ্মকর্ম।

প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ কীরূপে সম্ভব? লেখক বললেন :

যোগসাধনার মাধ্যমে প্রাণায়ামরূপ তপস্যার দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হলে পাপসমূহ বিনষ্ট হয়। … তপোযজ্ঞ দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলেই জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়। জ্ঞানযজ্ঞের ফলে ক্রিয়া পরাবস্থা ধীরে ধীরে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মন সঙ্কল্পশূন্য অবস্থায় উপনীত হলেই যোগীর অন্তরে প্রকৃত জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। (পৃষ্ঠা-১৩৩)

ভক্তিযোগের প্রথম পর্যায় হল প্রাণায়াম সাধনার দ্বারা সুষুম্নায় প্রাণকে স্থির করে সমস্ত ইন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, বুদ্ধিকে সংযত করা এবং সকলের হিতে রত হওয়া।

প্রাণক্রিয়ার সুষ্ঠু অনুশীলনে মন, প্রাণ, বুদ্ধি সংযত ও স্থির হয়। এরপর সাধনার দ্বারা আসক্তিহীন, দয়াবান ও অবিচল থেকে ইচ্ছারহিত স্তরে উন্নীত হতে হয়। মনপ্রাণ সহস্রারে প্রবেশ করলে চিত্ত অমৃতরসে সিক্ত হয়, দিব্যজ্ঞানের সঙ্গে পরমানন্দ তথা ব্রহ্মানন্দে মগ্ন হয়।

শ্রীমদ্ভাগবদগীতাঅমূল্যপদ চট্টোপাধ্যায়

অমূল্যপদ চট্টোপাধ্যায় রচনা করেছেন গীতার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তাঁর ‘শ্রীমদ্ভাবদগীতা’ শীর্ষক গ্রন্থে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ২০০৫। শ্রীমদ্ভাবদগীতার মূল শ্লোকসমূহের উল্লেখে লেখক সেগুলির বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছেন।

লেখক জ্ঞান ও কর্মযোগের তুলনামূলক আলোচনায় ব্রতী হয়ে বলেছেন :

জ্ঞান ও কর্ম আলোক ও অন্ধকারের ন্যায় বিপরীত।

তাঁর মতে :

কর্মই অজ্ঞান। জ্ঞান ও কর্ম এতদুভয়ের মধ্যে জ্ঞানই মুক্তির হেতু, কর্ম মুক্তির হেতু নহে। কর্মের কোনো অপেক্ষা না রাখিয়াই, কেবল জ্ঞানদ্বারা মুক্তি লাভ হয়।

নিষ্কাম কর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। বলেছেন, নিষ্কাম কর্মের প্রথমাবস্থায় কর্মটিই মুখ্য। নিষ্কাম কর্মী প্রতিটি কর্মেই ঈশ্বরকে স্মরণ করেন, এভাবে যখন ঈশ্বর স্মরণের দিকটি প্রবল হয় তখন কর্ম নিজের থেকেই শিথিল হয়ে যায়। তাঁর বক্তব্য :

নিষ্কামকর্মী ভক্ত হয়ে পড়ে ঈশ্বরপ্রসাদে আত্মজ্ঞান (সাংখ্য জ্ঞান) লাভ করিয়া মুক্ত হন।

লেখকের ঝোঁক কর্মযোগের তুলনায় জ্ঞানযোগেই অধিকতর।

প্রতিটি বস্তুই প্রতিটি মুহূর্তে বিনাশের দিকে অগ্রসরমান। পরিবর্তনশীলতা প্রতিটি বস্তু বা প্রাণীরই লক্ষণ। তবে অল্প সময়ের মধ্যে যে পরিবর্তন তা আমাদের বোধগম্য হয় না সবসময়ে। পশু, পাখী, কীট, পতঙ্গ, মন, বুদ্ধি, চন্দ্র, সূর্য সবকিছুই গতিশীল এমনকি ব্রহ্মলোক পর্যন্তও। জগতের যে স্থিতি তা ত’ আপেক্ষিক। জগৎ কর্মময়। কিন্তু গতির পিছনে থাকা চাই একটা স্থিতি নতুবা গতি দাঁড়াতে পারে না। লেখকের এই প্রসঙ্গেই মন্তব্য :

স্থির ক্যানভাসের উপরই বায়োস্কোপের ছবির নৃত্য। …. স্থির মহাকাল (পুরুষ) বক্ষ পাতিয়া দিয়াছেন বলিয়াই তাঁহার উপর কালীর (প্রকৃতির) নৃত্য। জগতের মূলে যে স্থিতি, যার উপর জগতের গতি, তিনি আত্মা বা ব্রহ্ম আত্মা কর্মশূন্য। যিনি জ্ঞানী, তিনি আত্মাকেই নিজ স্বরূপ বলিয়া জানেন, সুতরাং তাঁর কতৃত্বাভিমান নাই।

জ্ঞানী যিনি তিনি চঞ্চল জগতের মধ্যে একমাত্র স্থির আত্মাকে দেখেন। কর্ম ও বিকর্মের মধ্যে তিনি অকর্মকেই দেখেন। যিনি জ্ঞানী তিনি কর্ম, অকর্মাদির তত্ত্ব অবহিত। তিনি আত্মাতেই যুক্ত। জ্ঞানী আরও জানেন বিশ্ব প্রপঞ্চ-ময় ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নেই। জ্ঞানের উদয়ে আত্মাই সত্য হয়ে দেখা দেয়। জগত প্রপঞ্চ স্বপ্নদৃষ্ট মিথ্যা বলে বোধ হয়। জ্ঞানী দেখেন :

একমাত্র আত্মার স্বরূপ আমিই আছি, আমি শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত। …. জীবত্ব ও ঈশ্বরত্ব আমার উপর কল্পিত। সকলের মূলে অধিষ্ঠানরূপে আমিই আছি।

লেখক ভক্তিযোগের ব্যাখ্যায় ‘মৎকর্মপরম’ অবস্থা এবং ‘অভ্যাস যোগ’ ইত্যাদির ব্যাখ্যা করেছেন। লোকসেবা- সহ স্ত্রী-পুত্রাদি পালনরূপ কার্যাদি শাস্ত্রমত সম্পন্ন করতে হবে, তবে প্রথমে ফলার্পণ করতে হবে ভগবানের উদ্দেশে। অন্যদিকে যখন সাংসারিক কাজের ভার ভগবানের উপর ন্যস্ত করে কেবল ভগবানের কীর্তন বন্দনাদি রূপ কার্যে নিরত থাকা হয় তাকেই বলা হয় মৎকর্মপরম অবস্থা। এরই পরবর্তী স্তর অভ্যাস যোগ। কর্মীর অবস্থা থেকে মৎকর্মপরম অবস্থায় উত্তরণ, তারপর চিত্ত অধিকতর শুদ্ধ হলে ভক্তচিত্তকে অন্য সকল বিষয় থেকে প্রত্যাহৃত করে ভক্তিসহ বাইরে অথবা ভিতরে প্রণব কিংবা ইষ্টমূর্তি অবলম্বনে পুনঃপুনঃ চিত্তকে একাগ্র অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তোলে। পরিণতিতে ইষ্টমূর্তির সাক্ষাৎ লাভ ঘটে।

শ্রীমদভাগবদ গীতাপঞ্চানন মন্ডল

পঞ্চানন মন্ডল ‘শ্রীমদ ভাগবত গীতা’র পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন ২০০৫এ। শ্রীমন্ডল অনুবাদে কুশলী। একদিকে তিনি মূলানুগ, অন্যদিকে ছন্দনির্মিতি কৌশলেও তাঁর অনবদ্যতা। বামপৃষ্ঠায় মূল সংস্কৃত শ্লোক রেখে ডানদিকের পৃষ্ঠায় সেই শ্লোকের অনুবাদকে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। নমুনা হিসাবে আমরা কয়েকটি অনুবাদের উল্লেখ করছি।

১০ অধ্যায়ের ৬ষ্ঠ শ্লোকটির অনুবাদ করা হয়েছে গদ্যে, সঙ্গত কারণেই The seven great hermits including Bhrigu and before their birth the four other great Hermits and the Manus were born out of My Mind. So they are called my ‘Manasa Putra’, all these creatures ie the mankind have been born out of My Manasa in this world.

একাদশ অধ্যায়ের ১৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ এইরকম –

Thou art infinite with power I see,

Without beginning, middle or end,

The sun and the moon both Thine eyes

For blazing fire Thy mouth radiant.

(Besides Thine numorous arms and burning fire are hearing the whole universe with Thy rediance.

অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৪৪ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ—

Farming, cattle tending and business,

Qualities of Vaishya are professional base.

The Sudras have been born of their nature;

They serve all three castes with the labour.

(They are fond of the above tendencies of works)

দি ভাগবদগীতাবিবেক দেবরায়

বিবেক দেবরায় একজন প্রতিষ্ঠিত অর্থনীতিবিদ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে, দিল্লী স্কুল অফ ইকনমিকসে এবং কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তাঁর পড়াশুনা। কর্মসূত্রে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন যেমন কলকাতা ও পুনে বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যানেজমেণ্ট ইনস্টিটিউটস (ইন্ডিয়ান ইন্সস্টিটিউট অফ ফরেন ট্রেড), ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাপ্লায়েড ইকনমিকস রিসার্চ, রাজীব গান্ধী ইনস্টিটিউট ফর কনটেমপোরারি স্টাডিজ ইত্যাদি। অর্থনীতি নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতাও। পত্র-পত্রিকার নিয়মিত লেখক। কিন্তু এহেন একজন অর্থনীতিবিদের অন্য একটি পরিচয় আমাদের অনেকেরই অজানা। তিনি তাঁর সহধর্মিণীর সঙ্গে রামায়ণ এবং মহাভারত নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, চারটি বেদের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, এগারটি মুখ্য উপনিষদ এবং উনিশটি প্রধান পুরাণের অনুবাদও করেছেন। ভারততত্ত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকশিত হয়েছে Annals of the Bhandarker oriental Research Institute-এ। সেই বিবেক দেব রায় ভাগবত গীতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। পেঙ্গুইন প্রকাশিত গ্রন্থটির ভারতীয় সংস্করণের প্রকাশকাল ২০০৫।

দীর্ঘ ভূমিকায় এই কৃতী গবেষক ভাগবত গীতার অনুবাদ করার কারণ উল্লেখ করেছেন। অনুবাদ নিয়ে তিনি যে দীর্ঘ তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন, তাতে বিবেক দেবরায়ের অন্যবিধ এক পরিচয়কে স্পষ্ট করেছে। এককথায় তিনি গীতার একজন সফল সার্থক অনুবাদক। বিবেক দেবরায় গীতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে, কোনোভাবেই তিনি গীতার ব্যাখ্যা করেন নি অথবা রচনা করেন নি গীতার ভাষ্য। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য হল বামপৃষ্ঠায় গীতার মূল শ্লোক সংস্কৃত হরফে প্রকাশিত হয়েছে, ডানপার্শ্বে তিনি ইংরেজি অনুবাদ সন্নিবিষ্ট করেছেন। উদ্দেশ্য, কৌতূহলী পাঠক যেন মূল শ্লোকের সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদকে মিলিয়ে নিয়ে পড়তে পারেন। বিবেক দেবরায় আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন এবং অপরিচিত সংস্কৃত নাম, বিশেষণ কিংবা বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারণা সম্বলিত শব্দগুলিকে এড়িয়ে না গিয়ে সেগুলির যথাযথ অর্থ প্রদান করেছেন। পরিশিষ্টে প্রতিটি দুরূহ শব্দ ও বিষয়গুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। অনুবাদটি করা হয়েছে মহাভারতের প্রেক্ষিতে।

আমরা এই কৃতী অনুবাদকের কিছু অনুবাদের নমুনা প্রকাশ করছি যথাক্রমে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ থেকে।

No one can ever exist, even for a short while, without performing action. Because the qualities of Nature force everyone to perform action, (3rd chap / 5)

The ignorant person who exists by controlling his organs of action, while his mind remembers the senses, is said to be deluded and is a hypocrite. (3rd chap / 6)

Whatever a great man does, ordinary people also do that. Whatever he accepts as duty, others also follow that. (chap 3 / 21)

One’s own dharma, even if followed imperfectly, is superior to someone else’s dharma, even if followed perfectly. It is better to be slain while following one, own dharma. Some one else’s dharma is linged with fear. (3rd / 35).

I have no birth, I am indestructible. I am the lord of all beings. But ever then, through existing in my own nature, I come into existence through my own resolution. (chap 4 / 6)

O descendant of Bharata ! Whenever dharma goes into a decline and adharma is on the ascendance, then I create myself. (chap 4 / 7)

To protect the righteous and to destroy the sinners and to establish dharma, I manifest myself from Yuga to Yuga. (chap 4 / 8)

He who perceives inaction in action and perceives action in inaction, he is wise among men, has Yoga and has the right to all action. (chap 4 / 18)

Without attachment, control in mind and senses, having discarded all ownership and performing action only through the body, he does not attain the bondage of sin. (chap 4 / 21)

O great soul ! O infinite ! O lord of the gods ! O refuge of the Universe ! You are greater than Brahma and the original agent. Why should you not be saluted ? The manifest and the unmanifest and the indestructible that is beyond is also you. (chap 11 / 37)

With many mouths and eyes, with many miraculous things to see, adorned in many resplendent ornaments, with many divine weapons raised. (chap 11 / 10)

With divine garlands and clothing, anointed with divine fragrances, extremely wonderful everywhere, resplendent, infinite, with faces in every direction. (chap 11 / 11)

উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যাবিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা

উপনিষদ রহস্য বা গীতার যৌগিক ব্যাখ্যা, (২য় খন্ড), বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মা প্রণীত, প্রকাশকাল ৪র্থ সংস্করণ, ২০০৫। এই খন্ডে লেখক বিস্তারিতভাবে কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে :

জ্ঞানের ভিতর কর্ম প্রবিষ্ট করাইয়া এবং কর্মের ভিতর জ্ঞানকে অন্তর্নিবিষ্ট করিয়া তিনি কৌশলে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ কার্যত উভয়ই যে এক, সেই শিক্ষার পূর্ব সূচনা করিয়াছেন।

লেখকের মতে সমগ্র গীতায় এই উদ্দেশ্য চরিতার্থতা লাভ করেছে :

বস্তুতঃ জ্ঞান ও কর্মযোগ যে একই, যোগ অর্থে—কি জ্ঞানে কি কর্মে আত্মস্বরূপ ভগবানে যুক্তভাবে অবস্থান করা মাত্র এবং এই জ্ঞানকর্ম সমুচ্চয় যে যোগের মুখ্য উদ্দেশ্য, এই মহাকাব্যটি তাহা বুঝাইয়াছেন।

জ্ঞান ও কর্মের অভিন্নতার কথা লেখক বারংবারই উল্লেখ করেছেন :

জ্ঞান ও কর্ম দুইটি বিভিন্ন শক্তি নহে। একই শক্তি যখন মাত্র অন্তঃকরণকে পরিচালিত করে এবং বাহ্য কর্মের সহায়তা না লইয়াও অনুভূতির বিকাশ করিয়া লয়, তখন উহা জ্ঞানপদবাচ্য। আবার সেই শক্তি যখন বাহ্যকরণে উদ্রিক্তা হইয়া বাহ্য কর্ম সাহায্য অবলম্বন করিয়া হৃদয়ে পূর্বোক্তরূপ অনুভূতি ফুটাইয়া তোলে তখন উহা কর্ম।

লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠাকে এবং জ্ঞাননিষ্ঠা কর্মনিষ্ঠাকে সাহায্য করে। পরস্পর পরস্পরের পোষণের কারণ। জাগরণ ও সুষুপ্তি বা কর্মযোগ-জ্ঞানযোগ উভয় দিকই সমানভাবে জীবমাত্রেরই লক্ষ্য। প্রচলিত ধারণা জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন তা কিন্তু নয়। এই দুইয়ের বাহ্যিক লক্ষণে কিছু পার্থক্য থাকলেও অন্তরঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই।

কর্ম যে ব্রম্ভোদ্ভব লেখক বিস্তারিতভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন। কর্মের দ্বারাই নৈষ্কর্ম লাভ করতে হয়। গীতায় অনাসক্তভাবে কর্তব্যকর্মের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু লেখকের বক্তব্য :

অনাসক্ত হইয়া কর্ম করা যায় না। পরম পদ লাভ করিবার আসক্তিও থাকে এবং উহাও আসক্তিপদবাচ্য।

জীব জগতের তিনটি স্তর। মনুষ্য, মনুষ্যেতর প্রাণী এবং দেবতা। একমাত্র মানুষই কর্মপ্রধান। কর্ম সম্পাদনের দুটি পথ-জ্ঞানের দ্বারা বিবেচিত শ্রেয়ঃ সম্পাদনের ইচ্ছা, প্রাণের তাড়নায় বিচারের অপেক্ষা না রাখা। লেখক বললেন, ‘প্রথম প্রকারের করণীয়গুলিই কর্তব্যপদবাচ্য।’

লেখক জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে :

জ্ঞানের দ্বারা যে উপায়ে কর্ম জ্ঞানে পরিণত হয়—যে উপায়ে কর্ম জ্ঞায়ময় হইয়া পড়ে—যে উপায়ে ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র সাধারণ কর্ম ব্রহ্মজ্ঞানে পরিণমিত হয় বা ব্রহ্মত্ব লাভ করে।

জ্ঞানযোগে বলা হয়েছে, কর্মকে কীরূপে অনুসরণ করতে হবে, কোন জ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। জ্ঞানযোগে বর্ণিত হয়েছে কর্ম করেও মানুষ কেমন করে নিষ্ক্রিয়ভাবে অবস্থান করতে সমর্থ হতে পারে।

লেখক বলেন :

মা জ্ঞানরূপে আসেন, জ্ঞানময়রূপে আসেন। মানুষ যখন অবিদ্যার শিকার হয়, দুঃখ-ক্লেশে পীড়িত হয়, অনুতাপে দগ্ধ হয়, তখনই মা আসেন জ্ঞানরূপে। মা কী? না প্রত্যেক কার্যের ফলস্বরূপ আমরা যে জ্ঞান লাভ করি তাই মা।

শ্রীমদভগবদগীতাযুধিষ্ঠির গোপ

যুধিষ্ঠির গোপ রচনা করেছেন শ্রীমদভগবদগীতা, প্রকাশকাল ১৪১৩। সমগ্র গীতার শ্লোকগুলি বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়েছে। প্রতিটি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ প্রদত্ত হয়েছে। শ্লোকগুলির ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে ‘অধ্যাপনা’ শিরোনামায়।

কর্মযোগের আলোচনায় লেখকের বক্তব্য হল ইহলোকে নিষ্ঠা দ্বিবিধ। যাঁরা সাংখ্য যোগী তাঁদের জন্য জ্ঞান নিষ্ঠা অন্যদিকে যাঁরা যোগী তাঁদের জন্য কর্মনিষ্ঠা। এখন প্রশ্ন হল কোনটি শ্রেয়তর জ্ঞানযোগ না কর্মযোগ, লেখক বললেন, ‘জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগের প্রাপ্তব্য স্থান একই।’

চিত্তবৃত্তি নিরোধের দুটি উপায়—যোগ এবং জ্ঞান। যোগে নিরুদ্ধ হয় চিত্তবৃত্তি, আর জ্ঞানে হয় সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন। যাঁদের অন্তর্লোক গভীর আত্মিক ভাবনায় নিমগ্ন তাঁদের জন্য আদর্শ হল জ্ঞানযোগ, আর যাঁরা কর্মপ্রিয় তাঁদের জন্য কর্মযোগ। জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগ দুইই উপযোগী। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগ দুই-ই সমান উপযোগী। এই দুই পথের একটিকে গ্রহণ করলে অপরটি বর্জনীয় নয়, বরং দুটি পথই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। মূলতঃ পথ একই, ভিন্ন ভিন্ন অংশমাত্র। জ্ঞান ও কর্ম পরস্পরবিরোধী বা বিসংবাদী নয়। জীব আবদ্ধ হয় কিসে? কর্মে না কর্মফলে, উত্তর হল কর্মফল। তাই প্রয়োজন হল কর্মত্যাগ নয়, স্বার্থপর বাসনা ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। কর্ম সম্পাদন করতে হবে এমনভাবে যাতে তা বন্ধনের কারণ না হয়। লেখক গীতায় কর্মযোগের প্রাধান্য লক্ষ্য করেছেন, তাঁর মতে :

শ্রী গীতার সর্বত্রই নিষ্কাম কর্মযোগের কথাই আছে।

যে কর্মের সঙ্গে অহংবোধ যুক্ত, তাছাড়া দেশের হিতার্থে কৃত কিংবা সমাজকল্যাণে কৃত কর্মও নিষ্কাম নয়, একমাত্র তখনই নিষ্কাম কর্ম সম্ভব, যখন কেউ উপলব্ধি করেন সর্ব কর্মের নিয়ন্তা ঈশ্বর, প্রথম ঈশ্বরের দ্বারাই মানুষ চালিত হয়, এই বোধের উদয় হলে কর্ম আর বন্ধনের কারণ হয় না। লেখকের পরামর্শ তাই ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে কর্তব্যবোধে লোক স্বার্থে কর্মসম্পাদন কর্তব্য। লেখক মনে করেন কর্মপ্রেরণা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল। এককালে ভারত যে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছিল তার মূলে ছিল ভারতবাসীর কর্মবল। সকলেই কর্মের অপরিহার্যতার পক্ষে ওকালতি করেছেন। কর্মবলে বলীয়ান না হলে জ্ঞানার্জনও অসম্ভব।

অজ্ঞানীদের করা কাজ আর জ্ঞানীদের করা কাজে পার্থক্য কোথায়? অজ্ঞানী কর্ম করেন আসক্ত চিত্তে, সকাম ভাবে, জ্ঞানীরা কাজ করেন নিষ্কাম ভাবে, অনাসক্ত চিত্তে, লোকশিক্ষার্থে, জগতের হিতার্থে।

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। বৈদিক যজ্ঞ যখন ব্যয়বহুল ও জটিল আকার ধারণ করল তখন বলা হল ‘জ্ঞানাৎ মুক্তি’। যিনি জ্ঞানী তিনি জানেন বাসনাযুক্ত কর্মবন্ধনের কারণ। তাই তিনিই জ্ঞানী যিনি সকল কর্মই ঈশ্বরে সমর্পণ করেন, আত্মাও ঈশ্বরের, জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞানের দ্বারা সর্ববিধ সংশয়কে ছিন্ন করেছেন। সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত হয়ে যিনি সকল কর্মফল ত্যাগ করেছেন, যিনি জ্ঞানের দ্বারা সকল সংশয়ের মূলোচ্ছেদ করেছেন, সর্ববিধ সন্দেহমুক্ত যিনি আত্মনিষ্ঠ, তিনিই জ্ঞানী।

ভক্তিযোগের প্রসঙ্গে লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, যেভাবে ঈশ্বরের উপাসনা করবে, সেসেইভাবেই তাঁকে লাভ করবে। ভক্তিমার্গই স্বল্পায়াসসাধ্য সাধন মার্গ। জ্ঞানের তুলনায় ভক্তি উৎকৃষ্ট। আবার নিষ্কাম কর্ম ভক্তির তুলনায় উৎকৃষ্টতর। যিনি ভক্তির আশ্রয় নেন তাঁর কাছে জ্ঞান ধ্যান সবই নিকৃষ্ট বলে মনে হয়। ভক্তির দ্বারাই ভক্তি উৎপন্ন হয়। ভক্তা ‘সজ্ঞাতয়া ভক্ত্যা’ যখন কেউ পরমেশ্বরকে সকল বস্তুতে সর্বত্র দেখে তখন তার চিত্তে সাম্যলাভ ঘটে, স্বার্থ কামনা থেকে তার মুক্তিলাভ ঘটে। এইসব গুণের উদয় হলে ভক্তির পূর্ণতা আসে। আত্মজয়ী হতে হবে, চিত্তকে সংযত করতে হবে, সমদর্শী হতে হবে, পরহিতে রত হতে হবে। ঈশ্বরকে সর্বদা অন্তরে বিদ্যমান বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে, চরিত্রকে করতে হবে ঈশ্বরানুরূপী। ভক্তির দ্বারা সমস্ত চরিত্র শাসিত হওয়া চাই। সমস্ত চিত্তবৃত্তি ঈশ্বরমুখী করে তোলা চাই।

গীতার কথাগোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়

গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ‘গীতার কথা’ প্রকাশ করেন (৫ম সংস্করণ) ২০০৬ সালে। নিবেদনে লেখক যথার্থই বলেছেন :

একদিন এই দেশেই পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য যখন সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, তখন এই গীতাই স্বদেশ-আত্মার উদ্ধারে প্রেরণা যুগিয়েছে, দেশের নেতাকে পথ দেখিয়েছে, সঠিক পথে পরিচালনা করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো ধর্মগ্রন্থের এরকম সার্বজনীন প্রভাব ও প্রয়োগ আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।

লেখক গীতার কর্মযোগের গুরুত্ব বিষয়েই বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন :

গীতার পরম মন্ত্র তাই একটিই, আপন আপন কর্মেতে অভিরত হও, নিখুঁতভাবে নিরলস হয়ে আপন কর্মটি সম্পাদন করো, কর্তব্যটি পালন করো—তাতেই তোমার সংসিদ্ধি। ‘গীতা পূজা-অর্চনা’, জপ-তপ করার কথা বলে না, বলে তোমার কর্ম দিয়ে তাঁর অর্চনা করো (পৃ-খ)।

লেখক গীতার আঠারটি অধ্যায় নিয়েই সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। তাঁর ভাষার প্রসাদগুণ এবং সহজ সরলভাবে উপস্থাপিত বক্তব্য সহজেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কর্মযোগের ব্যাখ্যায় লেখক গীতানুসরণে নিরাসক্তির উপর জোর দিয়েছেন। বললেন :

দেহেন্দ্রিয়ের খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে রেখে সক্ত বা আসক্ত হয়ে কর্মটি করছ তুমি, এইজন্যই তো বাঁধা পড়ছ। অসক্ত হয়ে অর্থাৎ আসক্ত না হয়ে ‘আ’ উপসর্গটি বাদ দিয়ে শুধু ‘অ’ যোগ করে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে যদি অসক্ত হয়ে কর্ম করতে পার তাহলেই মুক্তসঙ্গ হবে।

কামনা ধীরে ধীরে সবকিছুকে পরিপূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে। তাই কামনা দূরে সরিয়ে রেখে কাজ করতে হবে। কৃষ্ণ অর্জুনকে কর্ম করার জন্য উৎসাহিত করেছেন সেই রহস্যের প্রতি লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

জ্ঞানযোগের ব্যাখ্যায় লেখক বললেন, কর্মের দ্বারা কামকে নির্মূল করতে পারলেই জ্ঞানলাভ ঘটবে। কিন্তু কী সেজ্ঞান? না কামশূন্য কর্মীর সব ব্রহ্মস্বরূপ হয়ে যায়। লেখক কর্মের সঙ্গে জ্ঞানের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। জীবনের যা কিছু কর্ম একলক্ষ্যে একের উদ্দেশে নিবেদন করে এগোতে হবে তাতে ভোগের মালিন্য দূরীভূত হয়ে জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত হবে।

ভক্তিযোগে আলোচিত হয়েছে মানুষের শান্তিলাভের প্রসঙ্গ। লেখকের মতে ভারতবর্ষের সনাতন বাণী, ত্যাগ ব্যতিরেকে মানুষ কদাপি শান্তি পেতে পারে না। ত্যাগ করতে হবে নিজের ক্ষুদ্রতাকে সংকীর্ণ অহংবোধকে। কামনা-বাসনার জাল থেকে মুক্ত হয়ে কর্মস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হবে, তাতেই ঘটবে শান্তিলাভ। বর্তমান অবস্থার মধ্যেই যে গভীর শান্তিলাভ সম্ভব সেবিষয়ে লেখকের দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশিত।

লেখকের ভাষায় :

সমস্ত কামনার স্রোত যখন আমার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আমাতেই মিলিয়ে যায় আমার মনের গভীর অতলে, যখন তারা কেউ কোনোরকম আলোড়ন, কোনকরম কম্পন সৃষ্টি করতে পারে না, তখনই আমি শান্তি- লাভের অধিকারী হই।….. সমস্ত কামনার স্রোত যখন আমার হৃদয়ের অতলে মিলিয়ে নিতে পারব, তখনই আমি শান্তিলাভ করব। এরই নাম হল—ত্যাগাৎ শান্তি।

ভক্তিযোগে কৃষ্ণ অর্জুনকে এই ত্যাগের পথই শিখিয়েছেন।

নিত্যপাঠের শ্রীমদ্ভগবদগীতাসুরেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ

পন্ডিত সুরেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ কতৃক সম্পাদিত এবং বেণীমাধব শীল কতৃক পরিমার্জিত। প্রথম প্রকাশ ২০০৭। প্রথমেই গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ করি। মূল শ্লোকসহ সন্নিবিষ্ট হয়েছে শ্রীধর স্বামীর অনুসরণে করা বঙ্গানুবাদ, সেইসঙ্গে বৈষ্ণবীয় তন্ত্রশাস্ত্রোক্ত গীতামাহাত্ম্য। গোলকপতি আচার্য রচিত গীতা-তত্ত্বসার গ্রন্থশেষে উপস্থাপিত। সুরেন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ কোনো ভূমিকা রচনা করেন নি, কিংবা গীতার দর্শন নিয়েও কোনো মন্তব্য করেন নি।

শ্রীমদ্ভগবদগীতাকালীকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়

কালীকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রকাশকাল ২০০৮। মূলতঃ লেখক গীতায় প্রদত্ত উপদেশগুলির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সমগ্র গীতা ধরেই লেখক তাঁর কাজটি সম্পাদন করেছেন। কর্মযোগের আলোচনায় লেখকের বক্তব্য হল—ব্রহ্মনির্বাণ অর্জনের জন্য উচ্চাকাঙ্খী যোগীর সামনে দুটি মাত্র পথ—একটি জ্ঞানযোগ, অপরটি কর্মযোগ। জ্ঞানাধিকারিদের জন্য জ্ঞানযোগ, নিষ্কাম কর্মীদের জন্য কর্মযোগ। নিরাসক্ত এবং নির্লিপ্তভাবে জ্ঞানযোগ সাধনার দ্বারা আত্মা সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব, পরিণতিতে ব্রহ্মনির্বাণ লাভের পথ উন্মোচিত হয়। অন্যদিকে যে যোগী আকাঙ্ক্ষামুক্ত চিত্তে ঈশ্বরচরণে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে সমর্পণ করে সদা নিষ্কাম কর্ম করেন তিনিও ব্রহ্মনির্বাণ লাভের পথ পেয়ে যান।

যে ব্যক্তি অনাসক্তভাবে ঈশ্বরের উদ্দেশে তাঁর প্রীতির জন্য সর্বদা নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান করেন তিনি দ্রুত জ্ঞান দ্বারা আলোকিত হয়ে ব্রহ্মনির্বাণের পথে অগ্রসর হন। নদী যতক্ষণ সাগরে না মেলে ততক্ষণ তার পৃথক অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সমুদ্রে মিশে গেলে তার আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি মন যখন আত্মারূপ সাগরে মেশে, তখন মন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন আর কোনো কর্মে রত হতে হয় না। নিষ্কাম কর্ম সকলের দ্বারা সম্পাদিত হয় না, হওয়া সম্ভব নয়, কেবল জ্ঞান দ্বারা যিনি আলোকিত হয়েছেন তাঁর পক্ষেই নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন সম্ভব। লেখকের ব্যাখ্যাতেই স্পষ্ট যে কর্মযোগ জ্ঞানযোগের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। দুটিকে পৃথক করা যায় না। আবার ভক্তিযোগের সঙ্গেও এই দুয়ের সম্পর্ক। কীরকম? যাঁর ঈশ্বরের প্রতি সীমাহীন ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঈশ্বর ব্যতিরেকে সংসারে তাঁর আর কিছুই নেই, এরূপ ভক্তের অচিরেই ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে এবং প্রকৃত জ্ঞানে তিনি পূর্ণ থাকেন। প্রকৃত জ্ঞান হলে তবেই কর্মে নিযুক্ত থেকেও তাঁর কাছে কর্ম অকর্ম বলে প্রতীতী জন্মে।

জ্ঞানযোগী ব্রহ্মনির্বাণ প্রাপ্তির পর অচিরেই ব্রহ্মের সঙ্গে বিলীন হন, জ্ঞানযোগী কর্ম করলেও তাঁর কর্ম অকর্মই, কারণ কর্মের ফলোৎপাদিনী শক্তি ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা বিনষ্ট হয়। লেখক যথার্থই বলেছেন যে, জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়, আর অজ্ঞানতা দূরীভূত হলে যোগীর কাছে সবকিছুই পরিস্ফুট হয়। অস্যার্থ, নি:স্বার্থভাবে নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বনে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া যায় এবং জ্ঞানের পরিপূর্ণতায় দুর্জয় সংশয় দূরীভূত হয়, স্বীয় আত্মাকে সম্পূর্ণরূপে অবগত হওয়া সম্ভব হয়।

ভক্তিযোগের মূল কথা হল যাঁরা যত্নসহ মোক্ষদায়ক ধর্মের সাধনা করেন তাঁরাই পরমেশ্বরের অতীব প্রিয়। ঈশ্বর ভক্তের অতীব প্রিয়, ভক্তই ঈশ্বরের আত্মা। ভক্তি ও শ্রদ্ধার আবির্ভাবে ধর্মজীবন উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতামহামহোপাধ্যায় কালীপদ তর্কাচার্য

মহামহোপাধ্যায় কালীপদ তর্কাচার্যের শ্রীমদ্ভগবদগীতার প্রকাশকাল ১৪১৫ বঙ্গাব্দ। গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছেনঅশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থে সংস্কৃত শ্লোকগুলিতে ব্যবহৃত শব্দনিচয়ের গূঢ় শব্দার্থ, অধ্যায়সার সন্নিবিষ্ট হয়েছে। কিন্তু যেজন্য গ্রন্থটির গুরুত্ব তা হল সমগ্র গীতার অমিত্রাক্ষর ছন্দের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন মহামহোপাধ্যায় তর্কাচার্য স্বয়ং। আমরা কিছু নিদর্শন নেব।

দ্বাদশ অধ্যায়ের ১৭, ১৮, ১৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ—

ইষ্টলাভে হর্ষ নাই যার

নাহি যার অনিষ্টে বিদ্বেষ,

ইষ্টনাশে নাহি দুঃখ,

অপ্রাপ্ত বস্তুর লাভে নাহি ইচ্ছা আর,

সেইজন অতিপ্রিয় মোর। ১৭

শত্রু-মিত্র মান-অপমান,

শীত-উষ্ণ সুখ-দুঃখে সব ভাব যার,

যেইজন আসক্তি-বর্জিত,

নিন্দা স্তুতি সমান যাহার,

আছে যার বাক্যের সংযম,

যাহা পায় তাতেই সন্তোষ,

নাহি স্থির বাসস্থান যার,

স্থির মতি যেই ভক্তজন,

সেইজন অতিপ্রিয় মোর। ১৮-১৯

একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপ দর্শনের অংশবিশেষ । (১৯-২৩)

নাহি আদি মধ্য নাহি অন্ত তব,

তোমার অনন্ত বীর্য বাহু সীমাহীন,

চন্দ্র-সূর্য নয়ন তোমার,

তা বক্তের দীপ্ত হুতাশন,

নিজ তেজে এই বিশ্বে করিছ তাপিত,

এই ভাবে দেখিতেছি তোমা। ১৯

স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে এই শূন্যতল,

সুবিশাল সর্ব দিক আর,

একা তুমি রয়েছ ব্যাপিয়া,

মহাত্মন। তব এই অতি ভয়ঙ্কর,

অত্যদভূত রূপ নেহারিয়া

ত্রিভুবন ভয়ে নিমগন। ২০

ঐ সব দেবতা নিকর

প্রবেশিছে তোমার ভিতর

কেহ কেহ ভীত হয়ে কৃতাঞ্জলি পুটে,

জয় জয় রক্ষ রক্ষ,

এই বলি করিছে প্রার্থনা।

সিদ্ধ আর মহর্ষি সমাজ,

স্বস্তি এই ক্ষেমবাক্য করি উচ্চারণ,

নানাবিধ স্তোত্র তব করিছে স্তবন। ২১

একাদশ রুদ্র আর আদিত্য দ্বাদশ,

অষ্ট বসু সাধ্য দেবগণ,

বিশ্বদেব অশ্বিনীকুমার

মরুদগণ উষ্মপায়ী পিতৃগণ যত,

গন্ধর্ব অসুর যক্ষ সিদ্ধ সঙঘ আর

বিস্মিত হইয়া সবে দেখিছে তোমাকে। ২২

মহাবাহু হে মধুসূদন!

বহু বক্তের বহু নেত্র,

বহু বাহু অসংখ্য চরণ,

অনেক উদর আর,

বহু দন্তে অতীব ভীষণ,

তব এই মহারূপ করিয়া দর্শন,

সর্ব লোক সহ আমি,

হইয়াছি ভীত অতিশয়। ২৩

কালীপদ বাবু-র কৃতিত্ব তিনি মূলকে অবিকৃত রেখে অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল।

সুধাময়ী পদ্যগীতাদীন ভক্তদাস

দীন ভক্তদাস কতৃক রচিত। প্রকাশকাল ১৪১৫ বঙ্গাব্দ।

শ্রীমদ্ভাগবদগীতার মূল সংস্কৃত শ্লোক, অন্বয়, বঙ্গানুবাদ পদ্যাকারে এ পর্যন্ত অনেক লেখকই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থটির অভিনবত্ব দুটি কারণে। প্রথমত এ পর্যন্ত যাঁরাই পদ্যাকারে গীতার অনুবাদ করেছেন, সবই পয়ার ছন্দে। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থে আনুপূর্বিক গীতা ত্রিপদী ছন্দে অনূদিত হয়েছে। দ্বিতীয় অভিনবত্ব হল পদ্ম মহাপুরাণের উত্তর খন্ডে শ্রীমদ্ভাগবদগীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের প্রতিটিতে একটি করে কাহিনীমূলক মাহাত্ম্য আছে, লেখক প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে এমনি কাহিনি সন্নিবিষ্ট করেছেন। কাহিনীগুলি অবশ্য অবিমিশ্র ত্রিপদীতে রচিত হয়নি, লেখক ত্রিপদীর সঙ্গে পয়ারেরও সহায়তা নিয়েছেন। গ্রন্থশেষে লেখক কিছু দুরূহ শব্দের উল্লেখ করেছেন। আমরা লেখকের ত্রিপদী ব্যবহারের কিছু নমুনার উল্লেখ করব।

কামনা মমতা আর শোক করি পরিহার

কর্মার্পণ করি ভগবানে।

করিতেছ কর্ম তাঁর মনে রাখি অনিবার

হে অর্জুন রত হও রণে।। ৩০

যাঁরা শ্রদ্ধাবান হয় পরশ্রীকাতর নয়

মম মত করে সমর্থন।

তাঁরা কর্মের বন্ধনে মুক্ত রহে সর্বক্ষণে

সদা সত্য আমার বচন।। ৩১

অনুবাদ যথাযথ এবং ত্রিপদী ব্যবহারে লেখক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা

অবিনাশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

অবিনাশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বারা অনূদিত এবং সম্পাদনা অধরচন্দ্র চক্রবর্তীর। প্রকাশকাল ২০০৮। মূল শ্লোক, অন্বয়, অনুবাদ এবং শ্রীধর স্বামী কৃত টীকা সন্নিবিষ্ট। অনুবাদ প্রাঞ্জল এবং সাধুভাষায় রচিত। গ্রন্থটির অতিরিক্ত প্রাপ্তি শ্রীধর স্বামীর টীকা। গ্রন্থশেষে বৈষ্ণবীয় তন্ত্রসার অনুসারে গীতামাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।

অনুবাদক কিংবা সম্পাদক গ্রন্থারম্ভে তেমন কোন ভূমিকা সংযোজিত না করলেও দীর্ঘ ১৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী সূচীপত্রে বর্ণমালার ক্রমানুযায়ী প্রতিটি শ্লোক যে অধ্যায়ের অন্তর্গত সেই অধ্যায় তৎসহ শ্লোক সংখ্যাটি উল্লিখিত হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকের পক্ষে নির্দিষ্ট শ্লোকটির সন্ধানলাভ এতে সহজতর হয়েছে।

এসো পড়ি সর্বশাস্ত্রময়ী শ্রীমদ্ভগবদগীতা

তপনকুমার ষটতীর্থ

তপনকুমার ষটতীর্থের ‘এসো পড়ি সর্বশাস্ত্রময়ী শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র প্রকাশকাল ১৪১৬ বঙ্গাব্দ। ‘কথামুখে’ লেখক যদিও স্বীকার করেছেন :

গীতার প্রধান শিক্ষা হল কর্মযোগ, কর্মই পূজা, তবে কর্মযোগই শেষ নয়।

তবে আরও বলেছেন :

‘কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান’, পৃথক পদবাচ্য হলেও চরমে সব পথই এক তত্ত্বে মিশে যায়।

তপনবাবু গীতার শ্লোকগুলিকে ছন্দোবদ্ধ পদে প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাব্যানুবাদের কিছু নিদর্শন আমরা গ্রহণ করব। গীতার ৩য় অধ্যায়ের ৩০, ৩১, ৩২ সংখ্যক শ্লোকগুলির অনুবাদ করেছেন লেখক নিম্নরূপে—

আমাতেই মন ভর

দাস্য ভাবে কর্ম কর।

মায়া-মোহ শূন্য মনে

যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে।।

ঈর্ষাশূন্য শ্রদ্ধাবান

শুদ্ধমতি বুদ্ধিমান।

হেন কর্মে মতিমান

কর্মে মুক্ত বদ্ধ নন।।

যারা ঈর্ষাপরায়ণ

কভু নহে শ্রদ্ধাবান।

জ্ঞানহীন হেন জন

বিনষ্ট হয় তখন।।

গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১৭, ১৮ সংখ্যক শ্লোকদ্বয়ের অনুবাদ—

ভবে আছে তিন কর্ম

কর্ম অকর্ম বিকর্ম

দুর্জ্ঞেয় কর্মের গতি

জেনো পার্থ শুদ্ধমতি।।

কর্মে অকর্ম বিকর্ম

যে বা জানে তত্ত্ব মর্ম।

জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ সেইজন

কর্মাতীত কর্মীহন।।

দ্বাদশ অধ্যায়ের ১৭ – ১৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ—

হর্ষদ্বেষশূন্য মন

শুভাশুভে সম হন।

ইষ্টানিষ্টে শোকশূন্য

ভক্ত মোর প্রিয় ধন্য।।

কিবা মান অপমান

সুখ-দুঃখে তুল্য জ্ঞান।

শত্রু-মিত্রে ভেদ নাই

শীত-উষ্ণ সম তাই।।

স্তুতি-নিন্দা সম ভাবে

অনাসক্ত যিনি ভবে।

স্থিরমতি সেইজন

ভক্তিমান প্রিয় হন।।

প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে লেখক ঐ অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ যুক্ত করেছেন। কর্মযোগ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য হল—কর্ম এমন হওয়া চাই যেন তা কোনক্রমেই বন্ধনের কারণ না হয়। কখন কর্মে সিদ্ধি আসে? যখন সর্ব কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হয়, ফলাকাঙ্ক্ষাবর্জিত হয়ে, কতৃত্বাভিমান ত্যাগ করেন কর্ম সম্পাদক, তখনই সিদ্ধি আসে। সকল কাজই ভগবানের এমন ভেবে কাজ করা চাই। কর্ম ঈশ্বরে সমর্পিত হলে আত্মজ্ঞান জন্মায়। তখনই দূর হয় সকল সংশয়। অজ্ঞানসম্ভূত জ্ঞানকে জ্ঞান খড়্গে ছেদন করতে হয়, তৎপর হতে হয় নিষ্কাম কর্মে। জ্ঞানী ব্যক্তি কখনই কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হন না।

সগুণ উপাসনা হল ভক্তিমার্গের সাধনা। এটিই সাধারণ মানুষের পক্ষে আদর্শ উপাসনা। একাগ্র মনে আসক্তি- হীন হয়ে কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কর্ম করাই হল ভক্তিমার্গের সাধনা।

শ্রীমদভগবদগীতা

সুনীল জানা

সুনীল জানা বিরচিত শ্রীমদভগবদ গীতার প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০১০। সুনীলবাবু গীতার কাব্যানুবাদ করেছেন। তাঁর উপলব্ধিতে, ‘গীতা এক অনুপম কাব্য . . . শুধু কাব্য না বলে বরং বলা ভালো কাব্যনাট্য।’

লেখকের কৃতিত্ব যথাসম্ভব মূলানুগ অনুবাদ করেছেন। তবে সংস্কৃত ভাষার যে ধ্বনিগাম্ভীর্য এবং ওজস্বিতা বাংলায় তাকে প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। লেখক তাঁর গ্রন্থে প্রতিটি মূল শ্লোকের বাংলা অনুবাদের পাশাপাশি পরিবেশন করেছেন সমান্তরাল শ্লোকের আকারে তার বাচ্যার্থ ও ব্যঙ্গার্থ। লেখকের কাব্যানুবাদের কিছু নিদর্শন গৃহীত হল—

কর্তব্যের কথা যদি ভাবো, তবে বিচলিত কেন?

ধর্মযুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের একমাত্র মঙ্গলজনক। ৩১

ভাগ্যবান যে ক্ষত্রিয়, যারা পায় এমন সুযোগ,

এমন যুদ্ধের ফলে স্বর্গদ্বার, পার্থ, খুলে যায়। ৩২

যদি তুমি পরাঙ্খুখ হও এই ধর্মযুদ্ধে, তবে

তোমার ধর্ম ও কীর্তি ম্লান করে হবে পাপভাগী।। ৩৩ (২য় অধ্যায়)

নিজের নির্দিষ্ট কর্ম না করে কিছুতে মুক্তি নেই,

কর্ম পরিহার করে কেউ সিদ্ধি পেতেই পারে না। ৪

অকর্মার মতো কেউ থাকতে পারে না এক তিলও,

প্রকৃতিগত যে ধর্ম, তাই তাকে কর্ম করায়। ৫

কর্মে জলাঞ্জলি দিয়ে যে ব্যক্তি গোপনে মনে মজে,

ইন্দ্রিয়-সুখের কথা ভাবে, সেতো ভন্ড, মিথ্যাচারী। ৬ (৩য় অধ্যায়)

অকমর্ণ্যতার চেয়ে কর্মরত থাকা ঢের ভালো,

নাহলে জীবনযাত্রা হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ অচল। ৮

ঈশ্বর-প্রীতির জন্য কর্ম ছাড়া অন্য কর্ম যত

মোহ আনে, হে কৌন্তেয়, করবে নিষ্কাম কর্ম তুমি।। ৯

অহংকারী মানুষেরা ভাবে, আমি সব কাজ করি। ২৭

গুণ কর্ম বিভাগের বিধান যে জানে, মহাবাহু,

আমি করি—বলে কিন্তু সেকখনো মনেও করে না। ২৮ (৩য় অধ্যায়)

সব কর্মফল সঁপে আমাকে, ঈশ্বর সাক্ষী মেনে

নিরাশ নির্মল হয়ে শ্লোক ভুলে, ওঠো যুদ্ধ কর। ৩০ (৩য় অধ্যায়)

ভয়-ক্রোধ-কামহীন মনে নিয়ে আমার শরণ

পবিত্র জ্ঞানের দ্বারা অনেকেই আমাতে বিলীন। ১০ (৩য় অধ্যায়)

যে ভাবে যে চায়, পার্থ, সেভাবেই আমাকে সেপায়,

প্রতিটি মানুষ হয় আমার পথের অনুগামী।। ১১ (৪র্থ অধ্যায়)

না আমি কর্মেতে লিপ্ত, না আমার স্পৃহা কর্মফলে,

এ সত্য যে জানে, তাকে কোনো কর্ম বাঁধতে পারে না। ১৪ (৪র্থ অধ্যায়)

কর্ম বা অকর্ম, যিনি সব কিছু সমান দেখেন,

সমস্ত করেন, তিনি মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান। ১৮

সমস্ত কর্মেই যিনি কামনা-সংকল্প হীন, তাঁর

কর্মফল জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ হয়, তিনিই মনীষা।। ১৯

কর্মফলে নিরাসক্ত, নিত্য তৃপ্ত, নিরপেক্ষ যিনি,

কর্মে রত থাকলেও তার নেই কর্মের বন্ধন।। ২০ (জ্ঞানযোগ / ৪র্থ অধ্যায়)

আগুনে পোড়ায় সব কাঠকুটো যেমন, অর্জুন,

জ্ঞানের আগুনে তেমনি সব কর্ম হয় ভস্মসাৎ। ৩৭

জ্ঞানের সমান কিছু পবিত্র জগতে নেই আর,

কর্মযোগে সিদ্ধ হলে এ জ্ঞান, তখন লব্ধ হয়।। ৩৮ (জ্ঞানযোগ / ৪র্থ অধ্যায়)

সমস্ত কর্মের ফল আমাকেই সমর্পণ করে

একান্ত ভক্তিতে রত যে আমার ধ্যানে অর্চনায়। ৬

আমাতে নিমগ্ন চিত্ত, তাকে পার্থ, অচিরেই আমি

মৃত্যু সমাকীর্ণ এই সংসার-সাগরে, ত্রাণ-করি। ৭

আমাতেই মন দাও, বুদ্ধি কর আমাতে নিবেশ,

ঊর্ধ্বলোকে আমাকেই পাবে, কোনো সংশয় রেখো না। ৮ (ভক্তিযোগ)

কর্মে অনুরক্ত হও, তাহলেই তুমি সিদ্ধি পাবে। ১০

তাও যদি না পারো তো, আমার শরণাগত হয়ে

সংযত হৃদয়ে সব কর্মফল ত্যাগ কর তুমি। ১১

অভ্যাসের চেয়ে জ্ঞান, জ্ঞানের চেয়ে ধ্যান শ্রেয়,

কর্মফল ত্যাগ শ্রেয়, সবচেয়ে, শান্তি আসে তাতে। ১২ (ভক্তিযোগ)

হর্ষ, ক্রোধ, ভয়, উদ্বেগ থেকে মুক্ত, সেপ্রিয় আমার। ১৫

নিস্পৃহ, পবিত্র, দক্ষ, নিরপেক্ষ, বেদনাবিহীন,

সমস্ত উদ্যমত্যাগী যেই ভক্ত, সেআমার প্রিয়। ১৬

কিছুতে আনন্দ নেই, দ্বেষ নেই, না আকাঙ্খা, না অনুশোচনা

শুভাশুভ-পরিত্যাগী, ভক্তিমান, সেপ্রিয় অীমার। ১৭

শত্রু-মিত্র, শীত , উষ্ণ, দুঃখ-সুখ, মান-অপমান,

সকলই সমান যার, যে সম্পূর্ণ আসক্তিরহিত। ১৮

নিন্দা-স্তুতি সমতুল্য, যে সদা সন্তুষ্ট, মিতবাক,

অনিকেত, অচঞ্চল, ভক্তিমান, সেআমার প্রিয়। ১৯ (ভক্তিযোগ)

লেখকের অনুবাদ স্বচ্ছ, আড়ম্বরহীন, নিরাভরণ, সরল ও বোধগম্য।

শ্রীমদভগবদগীতাএন. ভি. থাডানি

N. V. Thadani Srimad Bhagavad Gita প্রকাশ করেন ২০১২-য় (পরিমার্জিত সংস্করণ)। মূলতঃ গীতার কাব্যানুবাদ এটি। সেইসঙ্গে মূল সংস্কৃত শ্লোকগুলি প্রদত্ত হয়েছে রোমান হরফে, প্রদত্ত হয়েছে প্রতিটি অধ্যায়- সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা। লেখক জ্ঞান ও কর্মের ওপরেই অধিক গুরুত্ব দান করেছেন। সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, বেদান্ত প্রভৃতির দৃষ্টিতে লেখক কর্মের ব্যাখ্যা করেছেন। সাংখ্য বলে :

all actions, of whatever kind, must be renounced, and knowledge alone is our end.

ন্যায়ের মতে :

necessary action must be performed as a sacrifice, but the end of life is knowledge still.

আবার বৈশেষিক বলে :

necessity of action still more, but to maintain that knowledge is the ultimate goal.

বেদান্তর মতে :

we must act for ever and can never desist from actions but all our actions should be sacrifice.

বেদান্ত আরো বলে :

knowledge and actions are but twin aspects of the same energy of life, …….so it stresses the necessity of performing action as a secrifice of all times without end.

যতই আমরা কর্মে অস্বীকৃত হব এবং জ্ঞানকে আমাদের জীবনের লক্ষ্য করব, ততই আমরা সাংখ্যের অনুসারী হব এবং ঈশ্বরে অস্বীকৃতিকে মেনে নেব।

সাংখ্য কর্মকে স্বীকার করলে এটাও স্বীকৃত হয় যে, প্রকৃতি থেকেই ক্রিয়ার জন্ম। আমরা কেউই কর্ম ত্যাগ করতে পারি না তবে যেটা পারি তা হল কর্মের ফলকে এড়াতে পারি। যদি আমরা কর্মকে যজ্ঞরূপে সম্পন্ন করি। কেননা সমস্ত কর্মই বন্ধনকে সুনিশ্চিত করে, কেবল ব্যতিক্রম যেগুলি যজ্ঞরূপে সম্পাদিত হয়। যজ্ঞের নিরিখে আমরা সাংখ্য থেকে ন্যায়দর্শনে পৌঁছাই। কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন এই জগৎটা ঈশ্বরের দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছে, এভাবেই যজ্ঞের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় থেকে যাওয়া যাক বৈশেষিকে। ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে ব্রহ্ম হলেন সর্বোত্তম দেবতা। বৈশেষিক থেকে আমরা উপনীত হই যোগে, বেদান্তর যা প্রথম অভিব্যক্তি। জ্ঞান ও কর্ম তাহলে দুটি অবিসংবাদিত পক্ষ হল প্রাণের। কর্ম ও জ্ঞানের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক all Action culminates in knowledge, as all knowledge in Action.

বেদান্তে শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসাবে বলা হয়েছে কৃষ্ণকে, কিন্তু বৈশেষিক, ন্যায় এবং সাংখ্যের ঝোঁক অপ্রকাশিত, অস্পষ্ট প্রকৃতির দিকে। নিরাকারের চিন্তা কঠিন, তুলনায় দেবতাবিশেষের ধারণা ও তাতে মনোযোগ দান সহজতর। লেখক বলেছেন, এটা সম্ভব concentration বা মনোযোগ, practice বা অভ্যাস এবং application বা প্রয়োগ দ্বারা। অথবা ঈশ্বরের নামে কার্য সম্পাদন দ্বারা, অথবা কর্ম ফলকে অগ্রাহ্য করা।

আমরা এবারে লেখকের অনুবাদকর্মের সামান্য কিছু পরিচয় গ্রহণ করব—

I have said before that in this world

There are two paths, O sinless one;

Knowledge for those who follow Sankhya,

Action for those who follow Yoga. (chap iii; sloka 3)

Therefore, ever unattached,

Perform all necessary acts

Performing actions unattached,

A person gains the Goal Supreme. (chap iii; sloka 20)

As all attached, O Bharata,

Their action unwise men perform :

So should the wise one, unattached,

Desiring what preserves the world. (chap iii : sloka 26)

From fear, attachment, anger free,

On me depending, full of me,

By fire of knowledge purified,

So many have attained to me. (chap iv; sloka 11)

Howsoever men come to me,

E’en so I grant them their desire ;

For ‘tis my path, O Pritha’s son,

That all men follow every way. (chap iv; sloka 12)

One has to know what action is,

Improper action needs to know;

And needs to know in actions too;

The truth of action’s hard to find. (chap iv; sloka 18)

Who think of me with fixed minds,

And worship me devotedly;

And full of highest faith, — I deem,

The best of all in Yoga are they. (chap xii; sloka 2)

But those who make me as their Goal,

Renouncing all their deeds to me;

And worship me alone with Yoga,

Thinking of nothing else besides. (chap xii, sloka 6)

So do thou fix mind on me,

And place the Buddhi in me there ;

And so wilt those without a doubt,

Abide in me for evermore (chap xii, sloka 8)

শ্রীমদভগবদগীতা

ধনপতি হালদার

পুরাণভারতী ধনপতি হালদার সম্পাদিত। প্রকাশকাল অনুলিখিত। গীতার পাঠবিধি, ধ্যান, মূলশ্লোক, সেগুলির বঙ্গানুবাদ, গীতাসার, বৈষ্ণবমুখী গীতা ও ভাগবত, প্রেম ও ভক্তি ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনায় সমৃদ্ধ। গ্রন্থটির দুটি অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য উল্লেখনীয়। ছন্দবদ্ধ পদে লেখক গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের প্রতিটি শ্লোকের পরিচিতি দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসার সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে।

গীতা রত্নামৃত

শ্যামাচরণ কবিরত্ন

শ্যামাচরণ কবিরত্নের শ্রীমদ্ভাগবদগীতার সরল পদ্যানুবাদ এটি। আদ্যন্ত পয়ার ছন্দে রচিত। এটির জনপ্রিয়তার প্রমাণ গ্রন্থটির চতুর্বিংশ মুদ্রণ। প্রকাশকাল অনুল্লিখিত রয়ে গেছে। অনুবাদকের কিছু অনুবাদশৈলীর নমুনাস্বরূপ উদ্ধৃত হল কয়েকটি পংক্তি—

অভ্যাস হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ অতিশয়।জ্ঞানের অপেক্ষা ধ্যান প্রধান নিশ্চয়।।কর্মফল পরিত্যাগ সর্বশ্রেষ্ঠ হয়।ত্যাগেই পরম শাস্তি ওহে ধনঞ্জয়।। ১২হিংসা নাই দ্বেষ নাই অন্তরে যাহার।সকলের সঙ্গে যার বন্ধুত্ব অপার।।হৃদয় করুণ যার নাহি অহঙ্কার।দুঃখে-সুখে সমজ্ঞান নির্মম আচার।।(দ্বাদশ অধ্যায়, ভক্তিযোগ)

শ্রীগীতা

প্রসন্নকুমার কাব্যতীর্থ

প্রসন্নকুমার কাব্যতীর্থ সম্পাদিত ও ধনপতি হালদার কতৃক পরিদৃষ্ট ও পরিমার্জিত, সংশোধিত। সম্পাদক মূল শ্লোকের সঙ্গে শব্দার্থ এবং তারপর বঙ্গানুবাদ সন্নিবিষ্ট করেছেন। গীতার পদ্যাংশও সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে টিপ্পনী যুক্ত করা হয়েছে।

লেখক মনে করেন :

শ্রীগীতায় জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির কথা বলা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, গীতা একটি বিশেষ মার্গের জন্য। কেহ বলেন গীতা ভক্তিশাস্ত্র, কেহ বলেন গীতা কর্মযোগ শাস্ত্র, গীতাকে কেহ কেহ বলেন ব্রহ্মবিদ্যা।

লেখক শেষ পর্যন্ত গীতার সমন্বয়বাদের কথাই বলেছেন। গীতাকে সমন্বয়বাদের নিদর্শন যাঁরা বলেন তাঁরা জীব ব্রহ্মস্বরূপ ও মোক্ষতত্ত্বের আধ্যাত্মিক বিচারকেও মনে রাখেন। লেখক বলেছেন, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগে কোনো বিরোধ নেই। তিনটিই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তাছাড়া জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিনটি মার্গের সমন্বয়ে একটি মার্গই স্পষ্ট হয়েছে।

তিনটি আপাতভাবে পৃথক হলেও যুক্তির খাতিরে সত্যের অপলাপ না ঘটালে প্রমাণিত হত :

জীবের যে অস্ফুট সদভাব তার প্রকাশ তার কর্মে, সুতরাং তার কর্ম ঈশ্বরমুখী হয়ে সমত্বপ্রাপ্ত হলেই জ্ঞানযোগ। ভগবান ভক্তদের উদ্দেশে যেসব উপদেশ দিয়েছেন, তা হল জ্ঞানী হও, ভক্ত হও, কর্মী হও এবং নিষ্কামতা দ্বারা কর্মের বন্ধন ঘুচিয়ে তাকে মোক্ষদায়ক আমার কর্মে ভাগবত কর্মে পরিণত কর।

.

শ্রীমদ্ভগবদগীতা / সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত:

১. উপক্রমণিকা; পৃ – ২

২. ঐ পৃ – ২

৩. ঐ পৃ – ২

দি গীতা / সুনীলকুমার সরকার:

১.  Preface; page-vi

২.  Preface; page-vii

৩.  Preface; page-vii

৪.  Preface; page-vii

দি ভাগবদগীতা / আর. আর. ভর্মা:

১.  Introduction; page-8

২.  Introduction; page-11

৩.  Introduction; page-11-12

৪.  Introduction; page-12

৫.  Introduction; page-12

৬.  Introduction; page-29

৭.  Introduction; page-29

৮.  Introduction; page-29

৯.  Introduction; page-30

১০.  Introduction; page-32

১১.  Introduction; page-38

১২.  Introduction; page-33

দি গীতা ফর দি টুয়েণ্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি / সত্য পি. আগরওয়াল

১.  The Gita for the twenty first century ; (2003), page – 64

২.  The Gita for the twenty first century ; (2003), page – 64

শ্রীমদভগবদগীতা / এন. ভি. থাডানি:

১.  Introduction; page-15

২.  Introduction; page-15

৩.  Introduction; page – 15

৪.  Introduction; page – 15

৫.  Introduction; page – 15

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *