৫. ব্যক্তি, দাম্পত্য, যৌননৈতিকতা

ব্যক্তি, দাম্পত্য, যৌননৈতিকতা

সদ্ভাবশতক-এর এর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ৷ উনিশ শতকের ইংরেজিশিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ জনসমাজের প্রতিনিধি বলা যায় তাঁকে ৷ ১৮৬৮ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মকথা—ইতিবৃত্ত বা রা. সের ইতিবৃত্ত ৷ বইয়ের শুরুতেই বাল্যজীবনের কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র নিজের প্রথম যৌবনের অসংযমী চিত্তবৃত্তি, ইন্দ্রিয়পরতা ও শারীরিক সম্ভোগবাসনার বিবরণ দিয়েছেন ৷ সেই সঙ্গে বাসনা নিবারণে ব্যর্থ হবার ফলে উদ্ভুত পাপবোধের খোলাখুলি বর্ণনাও পাওয়া যায় এখানে ৷ কৃষ্ণচন্দ্রের ভাষায় :

ঈশ্বর তাঁহার শরীরে এই স্বভাব করিয়া দিয়াছিলেন ৷ তিনি কোন স্ত্রীলোকের চক্ষে ২ চাহিতে ও তাঁহাদিগের সম্মুখ দিয়া হাঁটিয়া যাইতে পারিতেন না ৷ বন্ধুগণের সহিত চলিতে ২ যেখানে স্ত্রীলোকালয় দেখিতেন, সেখানে শব্দ ও স্বরে উৎকর্ষ ও উচ্চৈস্থতা বিধানে সযত্ন হইতেন ৷ … গ্রীষ্মকালে কখন ২ রাত্রিতে ছাদের উপর বিষয় বৈরাগ্যোৎপাদক ও পরমেশ্বরের ভক্তিভাব প্রস্ফোটক সঙ্গীত করিতেন ৷ কিন্তু নিকটবর্তী বেশ্যালয়ের প্রশংসাবাক্যে তাঁহার মনঃসংযোগ থাকিত ৷… স্মৃতিতে কত কত স্ত্রীমূর্তি অভ্যুদিত করিয়া লইয়া কি অপবিত্র সুখই উপভোগ করিতেন ৷… কিন্তু মোহের আক্রমণ নিবারণের উপায় সুস্থির করিয়া স্বাধীনমনা হইতেন না ৷… তখন পাপ করিতে প্রতিজ্ঞা করিতেন ৷ কয়েক রাত্রি সুরাপান করিয়া বেশ্যালয় হইতে অমোদ-প্রমোদ করিয়া আসিলেন ৷ প্রভাতে এক অননুভূতপূর্ব অনুতাপের উদয় হইল ৷ একখানি পুস্তক পাঠ করিয়া তাহার পবিত্র ভাবে অনেক শান্তি পাইলেন ৷

জৈব বাসনা এবং বাসনামুক্তির আকাঙক্ষার এই দ্বন্দ্ব এক তীব্র যৌন উৎকণ্ঠার জন্ম দিচ্ছে ৷ দৈহিক বাসনা যদি হয় সহজাত প্রবৃত্তি, তবে তাকে অতিক্রম করে নিজেকে এক উত্তীর্ণ নৈতিকতার স্তরে স্থাপন করার প্রয়াসের ভিতরেই রয়েছে ‘আধুনিক’ ব্যক্তিমানুষের ‘আত্ম-র প্রযুক্তি’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া, যার দ্বারা ব্যক্তির আত্মকথনও এক ধরনের ‘ডিসকার্সিভ’ কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় ৷ এরপর কৃষ্ণচন্দ্র নিজের যৌননৈতিক স্খলনের যে ছবিটি আঁকছেন, তা রীতিমতো কৌতূহলপ্রদ ৷ তিনি মনে মনে নিজের অল্পবয়স্ক বিমাতাকে শারীরিকভাবে কামনা করতেন:

পাপের একটি গুরুতর ফল তাঁহার উপভোগ্য হইল ৷ এক সময়ে একটি তুচ্ছ প্রতীয়মানোৎক্ষেপণে তাঁহার মাতাকে তাঁহার আকাঙ্ক্ষিণী বোধ হইল ৷ কখন ২ যাঁহার পাবনী মূর্তির নীদিধ্যাসন পাপবিকারে ওষধি হইয়াছিল, তাঁহাকে দেখিলেই ঐ সংশয়ে তাঁহাকে বিষম অপবিত্র বোধ হইত ৷ ক্রমে ২ তাঁহার ঐ চিন্তা সচরাচর হইল ৷ তিনি অন্য কোন বিষয়ে অধিকক্ষণ অভিনিবিষ্ট থাকিতে পারিতেন না ৷ কখনো ২ ঐ অপবিত্র ভাবের ক্লেশে মৃত্যুও তাঁহার নিকট সুখের বোধ হইত ৷

অল্পবয়সে যৌন অসংযম ও তজ্জনিত মানসিক উৎকণ্ঠা এবং সেই স্খলন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বমান্য নৈতিকতার আদর্শ স্তরটিকে আয়ত্ত করা—উনিশ শতকের শিক্ষিত ‘অগ্রবর্তী’ ব্যক্তিদের আত্মজীবনীতে এই ছবিটি বারবার ফিরে এসেছে ৷ ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার রচিত আত্মজীবনী আশীষ-এর (প্রকাশ ১৯০৫) একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়ের শিরোনাম : ‘সংযম বিষয়ক’ ৷ ব্রাহ্ম প্রতাপচন্দ্র তাঁর নিজস্ব জীবনাদর্শের সাপেক্ষে ‘সংযম’-এর ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন :

ইচ্ছাপূর্বক অস্বাভাবিক কষ্ট বহন করিলেই যে মানুষ সংযমী নামের যোগ্য হয় তা মনে করি না ৷ তবে ভোগ বিষয়ে চিত্তশৈথিল্য ধর্ম্মজীবনের বিরোধী, ইহা স্বীকার করি এবং ঊর্ধ্ব হইতে প্রেরিত যে যাতনা তাহা অকিঞ্চনভাবে বহন করিলে চিত্তশুদ্ধি হয় এবং মুক্তিযোগ লাভ হয় ইহাও সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করি ৷

এরপর ‘প্রেমবলে রিপুসংহার’-শীর্ষক অধ্যায়েও দেখতে পাই ব্রাহ্ম আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রতাপচন্দ্র লিখেছেন, ‘মানুষের সহিত সপ্রেম সম্বন্ধ বিনা ও বিধাতার প্রতি প্রেমানুগত্য বিনা কি… নিজ প্রবৃত্তির উত্তেজনা অতিক্রম করিতে পারা যায়? কখনই না ৷… অতএব সার ধর্ম্ম রহস্য ও প্রেমসাধন রহস্য একই নিগূঢ় বিষয় ৷’ উত্তরণের কৌশলে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু যৌনতা একটি নঞর্থক রিপু, তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়াই ‘ব্যক্তি’ হিসেবে ‘সুগঠিত’, ‘সুসম্পূর্ণ’ এবং ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠার সোপান—উনিশ শতকীয় ‘আধুনিকতা’য় পূর্ণাঙ্গ ‘আত্ম’ গড়ে তোলার এই অন্তর্গত কৌশলটি প্রতাপচন্দ্রের লেখাতেও স্পষ্ট ৷ ইউরোপীয় এনলাইটেনমেণ্টের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল ব্যক্তির আচরণ, মানসিকতার বহিঃপ্রকাশকে সুনির্দিষ্ট কিছু নৈতিক ‘কোড’-এর আধারে প্রকাশ করা, যাকে স্টিফেন গ্রিনব্লাট ‘renaissance self-fashioning’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন ৷ জাক রুশো-র গণিকাগমনের বর্ণনার মতোই উনিশ শতকের বাঙালি অগ্রণী ব্যক্তিদের আত্মজীবনীতেও যৌননৈতিকতার এই বিশেষ প্রকাশভঙ্গিমাই খুঁজে পাই আমরা ৷

ব্যক্তির যৌননৈতিকতার এই মান্য গড়নটি প্রতিষ্ঠিত হবার ইতিহাস একটু বিস্তৃতভাবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন ৷ উনিশ শতকের ‘আধুনিক’ ভাবনায় কাল্পনিক জাতিরাষ্ট্রের একক ‘পরিবার’ এবং পরিবারের একক ‘ব্যক্তি’ ৷ কলোনির প্রজার চৈতন্যে ‘ব্যক্তি’ তথা আদর্শ জাতিরাষ্ট্রের ছাঁচটি গড়ে উঠেছে অনেকাংশেরই ইউরোপীয় এনলাইটেনমেণ্টের অনুকরণে ৷ ‘আলোকপ্রাপ্ত’ পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তির আদর্শের ছাঁচটি দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রগতি, স্বাভাবিকতা এবং ‘চরম পৌরুষে’র ধারণার সফলতম প্রয়োগের উপর ৷ ঔপনিবেশিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক শক্তি এবং যৌন পরিচয়ের এই সমীকরণটিকে শাসক/শাসিত—উভয়ের কাছেই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে, শাসক/শাসিত উভয়েই হয়ে ওঠে সমান নৈতিক শৃঙ্খলার অংশীদার ৷ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্থে পৌঁছে বাঙালি ভদ্রলোকের চৈতন্যে ‘ব্যক্তি’, ‘গার্হস্থ্য-পরিবার’, ‘দাম্পত্যসম্পর্ক’ এবং ‘জাতিরাষ্ট্র’ সংক্রান্ত ধারণাগুলি নতুন করে নির্মিত হতে শুরু করে ৷ এদের মধ্যে ‘আত্ম’, পৌরুষ ও নারীত্ব, শৈশব প্রভৃতি ধারণাগুলি অনেকাংশেই গড়ে ওঠে সমকালীন ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার আদলে ৷ এবং এই প্রতিটি ধারণারই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে যৌনতা, যৌনতার নিয়ন্ত্রণ ও অবদমন, যৌনতার উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার প্রভৃতি, যার সম্পর্কে মিশেল ফুকো বলেছিলেন : ‘যৌনতার ক্ষেত্রে অঙ্কিত বিচিত্র ধরনের কার্যকরী সীমান্তরেখা ৷’১০ ওই একই সাক্ষাৎকারে পরিবার, দাম্পত্য, শিশুপালনের সূত্র ধরে যৌনতা যে সামগ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর আওতায় ব্যক্তিকে নিয়ে আসছে, তাও দেখান তিনি ৷ পূর্বোক্ত আত্মকথন দুটিতে যৌন অসংযম থেকে উত্তীর্ণ হবার যে যৌক্তিক আকুতি খুঁজে পাওয়া যায়, তাকে অনায়াসেই খ্রিস্টীয় ‘কনফেশন’ পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে ব্যক্তির নৈতিক চেতনাই তাত্বিক এবং প্রায়োগিক আধারে এক সামগ্রিক যৌনতার ডিসকোর্স গড়ে তোলে ৷১১

কাল্পনিক ‘জাতিরাষ্ট্র’ এক বিশেষ ধরনের ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী নির্মাণ ৷১২ উনিশ শতকেই এই বিশেষ ভাবকল্পনা অত্যন্ত সচেতন প্রক্রিয়ায় আমাদের দৈনিন্দিন জীবনযাপনের পরতে পরতে ঢুকে পড়ে ৷ সমাজের শিক্ষিত, অগ্রসর অংশ সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী’ দর্শনের মৌলিক লক্ষ্যসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালান ৷ ফলত, ‘ব্যক্তি’র মান্য, আদর্শ ছাঁচটি যেমন লিখিত ন্যারেটিভের ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল, তেমনই নরনারীর দাম্পত্যসম্পর্ক, পরিবারভাবনা, পরিবারে নারীর অবস্থান ও ভূমিকা, শিশুর পরিচর্যা ও যথার্থ বিকাশ—সবই এক সার্বিক নজরদারির আওতাভুক্ত হল ৷ যৌনতার খোলাখুলি বহিঃপ্রকাশ ও অতিরেক, ‘ব্যক্তি’কে তার আদর্শ নৈতিকতার স্তর থেকে বিচ্যুত করবে—এই ভাবনার স্পষ্ট স্বীকৃতি এ যুগের অসংখ্য লেখালেখিতেই লভ্য ৷ এই যৌননৈতিকতা অনেকাংশেই ভিক্টোরীয় ‘পরিবার-দাম্পত্য-ব্যক্তি’র যৌন আদর্শের অনুকরণে গড়ে উঠেছে ৷ ইউরোপীয় প্রেক্ষিতেও দীর্ঘ দুই-তিনশ বছরব্যাপী ‘গার্হস্থ্য-পরিবার’-এর ধারণাটি নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় ৷ আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে আদর্শ ‘পরিবার’ কীরকম হওয়া উচিত তা বোঝাতে বেশ কিছু ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়েছিল ৷ তা থেকে বোঝা যায় সে যুগে ‘পরিবার’ বলতে বোঝাত এমন একটি গার্হস্থ্য-সংগঠন যা, ‘আত্মীয় বা অনাত্মীয় পরিজনদের সমবায়ে গঠিত ও একক কর্তাব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত’ এবং পরিবারের সদস্যদের অন্যতম কর্তব্য ছিল : ‘সহাবস্থান এবং কর্তৃত্বের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য ৷’১৩ এক্ষেত্রে, পরিবার যে একটি ‘অণুক্ষমতা’র একক—এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ৷ ভিক্টোরীয় যুগে পৌঁছে, পরিবারের ধারণাটি অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত হল স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যসম্পর্ক, শিশুর বিকাশে পিতামাতার ভূমিকা, পারিবারিক রোজগার এবং যথাযথ আয়-ব্যয়ের চেহারা ও সর্বোপরি পরিবারে যৌনতার ভূমিকা-সংক্রান্ত আলোচনায় ৷ ১৮৬৮ সালের জুন-জুলাই মাসে লন্ডনের Daily Telegraph পত্রিকায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের অসংখ্য চিঠি ছাপা হয়, যা ভিক্টোরীয় চৈতন্যের মতদ্বৈধের সঠিক চেহারাটি তুলে ধরে ৷ চিঠিগুলির বিষয়বস্তু ছিল, মূলতঃ Prostitution, its causes and cures, ideal and practical marriage, its joys, duties and costs… What is a proper marriage? How to balance income and expenditure? What are the ideal qualities of young women and men?… Marriage or Celibacy?’১৪ এই চিঠিগুলির পাশাপাশি যদি ঠিক সমসময়ে বাংলায় প্রকাশিত বামাবোধিনী, অন্তঃপুর, পরিচারিকা, বঙ্গমহিলা, মহিলা, সাধারণী—প্রভৃতি পত্রিকায় আদর্শ রমণী, নারীপুরুষের আদর্শ সম্পর্ক, পরিবার, দাম্পত্য এবং যৌনতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার-বিষয়ক লেখাগুলি মিলিয়ে পড়া যায়, তবে, ঔপনিবেশিক সমাজের ভদ্রলোকী চৈতন্যে ভিক্টোরিয়া মতাদর্শের সুগভীর ছাপটি স্পষ্টরূপে অনুধাবন করা যাবে ৷ ইংল্যান্ডের উঠতি বুর্জোয়া সম্প্রদায় সেদিন যে বিষয়গুলিকে বিতর্কের অন্তর্ভুক্ত করেছে, এদেশীয় পত্র-পত্রিকায় তারই অনুরূপ ধারণার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই আমরা ৷ বোঝা যায়, ইউরোপীয় সমাজের মতোই এখানেও ‘পরিবার’ ক্রমশই একটি ‘ডিসকার্সিভ’ ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে ৷ এই আলোচনায় ‘পরিবার’ ও ‘সমাজ’-এর সম্পর্ককে ‘জৈব সম্পর্ক’ হিসেবে দেখা হয়েছে ৷ যেমন, ‘মহিলা’ পত্রিকার আষাঢ়, ১৩০৯ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় বলা হয়েছে, ‘‘প্রত্যেকটি পরিবার সমাজের অঙ্গস্বরূপ ৷ শরীর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ন্যায় প্রত্যেক পরিবারের সহিত সমাজের সম্বন্ধ, প্রতি পরিবারের উন্নতিতে সমাজের উন্নতি ৷ আমাদের পরিবারগুলি যেরূপ ভাবে গঠিত হইবে সমাজও সেইরূপে গঠিত হইবে’’ ৷ শুধু তাই নয়, পরিবারের উন্নতির জন্য নারীর ভূমিকাও বিশাল ৷ ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-র ভাদ্র-আশ্বিন ১৩১৩ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলা হয়েছে, ‘‘স্বামীর সুখস্বাস্থ্য, সন্তোষ ও মনোরঞ্জনের প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হইবে; সন্তান প্রতিপালন করিতে হইবে ৷ গৃহের রান্নাবান্নার সুবন্দোবস্ত ও চাকর চাকরানীর কার্যের শৃঙ্খলার প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হইবে, অতিথির পরিচর্য্যা ও চিত্তবিনোদন এবং অনুষ্ঠানোপলক্ষে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদিগের প্রতি কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিতে হইবে; স্বামীর শ্রমোপার্জিত অর্থের যাহাতে অপব্যয় না হয়, অমিতব্যয়ের জন্য যাহাতে স্বামীকে ঋণগ্রস্ত ও অসুখী হইতে না হয়—এই সকল বিষয়েই মনোযোগী হইতে হইবে ৷ পারিবারিক সুশৃঙ্খলা রক্ষা করিতে এবং পারিবারিক সুখ ও শান্তি বর্ধ্বিত করিতে অনেক গুণের প্রয়োজন ৷ একমাত্র রান্নাবান্না ও গৃহস্থালীই পারিবারিক সুখের আদর্শ নয় ৷ শুধু রান্নাবান্না ও গৃহস্থালী একটি অশিক্ষিত মেয়েও করিতে পারে ৷ সুতরাং এই সকল কার্য্য অভ্যাস করিলে একজন শিক্ষিতা মেয়ে যে খুব ভাল করিয়াই গৃহকার্য্য করিতে পারিবেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই ৷ কিন্তু উহা ব্যতীত গৃহাদির সাজসজ্জা ও পারিপাট্য, দাসদাসীদিগের কার্যের শৃঙ্খলা, অর্থাদির সদ্ব্যবহার, অতিথি অভ্যাগতের মনোরঞ্জন, সন্তানদিগের শিক্ষা ও শাসন—ইহা তো উৎকৃষ্ট শিক্ষা ভিন্ন কিছুতেই উত্তমরূপে নিষ্পন্ন হইবার কথা নয়’’ ৷ হুবহু একই ধরনের আলোচনা সেদিন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের পত্রপত্রিকায় পাওয়া যাচ্ছিল ৷ পূর্বোক্ত Daily Telegraph পত্রিকার পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সেদিন আদর্শ দাম্পত্য, মাতৃত্ব, পরিবারে নারীর ভূমিকা সংক্রান্ত এই কথাগুলোই বিলিতি পটভূমিতে বিবৃত হয়েছে ৷ একটি লেখায় যেমন আদর্শ দাম্পত্যের মহিমা বোঝানো হয়েছে অপর একটি হতশ্রী দাম্পত্যের প্রেক্ষিতে, “here we see a tiny cottage, situated some miles out of London, It has only four rooms, including the kitchen, but it is as charming as it is small. This is where Tom and Susie live. Tom is an active young fellow, who has just set up in business for himself, and, although his income at this time amounts to only 150 pound, still he and Susie know that if he remains steady and industrious, it may amount to 200 pound by next year. Besides this, Susie has always been accustomed to live in small house, where she used to baking and ironing, so no serious doctor’s bill pull on her little income. She has only one assistant, and everything comes under her own eye is as it is bright, will make more than half the difference to their expenses. Tom and Susie will have as many joys as Cherlie and Clara have sorrows; but then look at the difference of their circumstances. পাশাপাশি, ‘পরিবার’ নামক পবিত্র ‘ক্ষেত্র’-টিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পুরুষকেও যে হয়ে উঠতে হবে অসংখ্য সদগুণের আকর, তাও বলা হয়েছে একটি লেখায়, ‘the follies and vices of fast life are too deep-rooted; they are a part of the very nature of man, and, unless early training be such as to correct the evil in him, he most undoubtedly grows up vain, self-indulgent, and autocratic; so, when he does marry, he seeks rather to exercise dominion over others than to bring his own passions and predilections under prescribed control. Men of this description often many from motives of public policy, for the sake of appearences only, it “looks” respectable to be a husband and family man; the wife’s robe of purity is made a cloak for the husbad’s immoralities; the sanctity which attaches to the idea of “home” screens many an impure deed”… আমরা এই অধ্যায়ের শুরুতে আত্মনির্মাণ ও আত্মগঠনের যে প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, খোদ উনিশ শতকীয় ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের ‘পরিবার’-ভাবনায় শুদ্ধচিত্ত পুরুষের সেই প্রয়োজনীয়তার কথাই একটু ঘুরপথে বলা হয়েছে ৷ ‘আত্ম’-র গঠন-সংক্রান্ত ভাবনার ক্ষেত্রে দুই স্থানিক পরিসরই এক হয়ে উঠছে ৷

কাম্য আদর্শ এবং সেই মান্যতাকে স্পর্শ করতে না পারা থেকেই জন্ম নেয় এক অনিবার্য ‘উৎকণ্ঠা’ ৷ ভিক্টোরীয় যৌনতার এক প্রধানতম লক্ষণ এই ‘উৎকণ্ঠা’, যা সেযুগের ইংল্যাণ্ডের ইতিহাসের উপাদান ঘাঁটলেই স্পষ্ট হবে ৷১৫ ১৮৪০-এর দশকে জনৈক অজ্ঞাতনামা রচিত Man and Woman in a State of marriage বইটিতে বলা হয়েছিল হস্তমৈথুন, অতিরিক্ত যৌনতা, যৌননিষ্ক্রিয়তা—সবই শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়ের ভিতর যৌন উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে কাজ করছে ৷১৬ যুবকদের মনে যৌন উৎকণ্ঠা এবং আধ্যাত্মিক পাপবোধ সমীকৃত হয়ে গিয়েছিল ৷ ১৮৩৯ সালে, হবু স্বামী চার্লস কিংসলের বিবাহ-পূর্ববর্তী মানসিক উৎকণ্ঠা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফ্যানি গ্রেনফিল লিখছেনঃ ‘He was then full of religious doubt, and his face, with its unsatisfied hungering look, bore witness to the state of his mind,’১৭ ভিক্টোরীয় মনস্তত্বের এই বিশেষ ধাঁচটি যে বাঙালি ভিক্টোরীয় মনেও অনুরূপ প্রভাব ফেলেছিল, তা বোঝা যায়, পূর্বোক্ত কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের আত্মকথার অংশ দুটি পড়লে ৷ ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত ড. অ্যাক্টনের লেখা Functions and Disorders of The Reproductive Organs নামক সুদীর্ঘ বইটিতেও যৌন উৎকণ্ঠাকে আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার বিষয়টি পরিস্ফূট হয় : ‘…in the acute attack resulting from this cause… religion forms a noted subject of conversion of delusion’১৮ ৷ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল-এর ১৮৫০ সালের ব্যক্তিগত নোটবইতেও অপবিত্র যৌনবাসনার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার আধ্যাত্মিক আকাঙক্ষা ও অনুতাপের সুর স্পষ্ট; ৭ জুন তারিখে তিনি লিখছেন : ‘But this long moral death, this failure of all attempts to cure. I think I have never been so bad as this last week’, আবার, ১ জুলাই তারিখে তিনি লিখেছেন, ‘I lay in bed and called on god to save me.”১৯

ব্যক্তি, পরিবার ও যৌনবাসনার এই উনিশ শতকীয় টানাপোড়ের সার্থক ছবি পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) এবং কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৮৩) উপন্যাস দুটিতে ৷ বেগবতী চিত্তবৃত্তি, বিশেষত যৌনকামনা, ‘ব্যক্তি’র জীবনের আদর্শায়িত রূপটিকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা বঙ্কিমের উপন্যাসের একটি প্রধানতম বিষয় এবং এক্ষেত্রে বঙ্কিম উনিশ শতকীয় যৌনতার জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সকেই তাঁর কথাসাহিত্যে এবং তাত্বিক ভাবনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ৷ তাত্বিক দিক থেকে, বঙ্কিমের মতে ইন্দ্রিয় ঈশ্বরপ্রদত্ত, তা অমঙ্গলকর বা অশ্রদ্ধেয় হতে পারে না ৷২০ তাঁর চোখে, ইন্দ্রিয়সংযমের অর্থ ইন্দ্রিয়ের উচ্ছেদ নয়, আতিশয্যই অধর্ম ৷২১ ধর্মতত্ব বইতে তিনি বলেন : ‘কামের ধ্বংসে মনুষ্য জাতির ধ্বংস ঘটিবে ৷ বৃত্তি নিকৃষ্ট হউক বা উৎকৃষ্ট হউক, উচ্ছেদমাত্র অধর্ম্ম’,২২ বঙ্কিমের ‘অনুশীলন তত্বে’র মূল কথা, সমস্ত বৃত্তির সামঞ্জস্য, ইন্দ্রিয়ের নিষ্পেষণ নয় ৷ কিন্তু উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র রক্তমাংসের চরিত্রদের আঁকতে গিয়ে বহুক্ষেত্রেই নীতিপ্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ৷ চন্দ্রশেখর উপন্যাসের (১৮৭৫) যোগীপুরুষ শৈবলিনীকে আত্মসংযমের মন্ত্রেই দীক্ষিত করেছে : ‘ইন্দ্রিয়ের পথ রোধ কর—ইন্দ্রিয় বিলুপ্ত কর’ ৷ বিষবৃক্ষ উপন্যাস তিনটি ভিন্নধর্মী দাম্পত্যসম্পর্কের ছবি অঙ্কিত হয়েছে ৷ প্রথমটি নগেন্দ্র-সূর্যমুখী, দ্বিতীয়টি শ্রীশচন্দ্র-কমলমণি, তৃতীয়টি দেবেন্দ্র-হৈমবতী ৷ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ‘পবিত্র দম্পতিপ্রীতি’ বনাম ‘রূপজমোহলালসা-‘জনিত অসংযমী নারী-পুরুষ সম্পর্কের দ্বন্দ্ব ৷ নগেন্দ্র-সূর্যমুখী এখানে ‘পবিত্র দম্পতিপ্রীতি’র আদর্শ উদাহরণ ৷ শ্রীশচন্দ্র-কমলমণি ও শিশুসন্তান সতীশচন্দ্রকে নিয়ে দাম্পত্যের যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, তা পুরোপুরি আধুনিক ‘ভিক্টোরীয়’ দাম্পত্যের আদর্শ চবির অনুরূপ, যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের যোগ্য সহচর এবং অর্ধাংশ, শিশুসন্তান এখানে ওই দাম্পত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ৷ বিপরীতে দেবেন্দ্র-হৈমবতীর সম্পর্ককে বলা যায়, তারা দেশীয় সমাজের পশ্চাৎপদ, ঐতিহ্যাগত স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের প্রতিনিধি, ‘আধুনিক’ জাতীয়তাবাদী পরিবার-দাম্পত্য-শিশুপালনের ‘নৈতিকতা’ যে সনাতন ‘অসম’ দাম্পত্য সম্পর্ককে নতুন ‘সান্দর্ভিক’ পরিসরের ভিতর আমূল রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল ৷ দেবেন্দ্র গার্হস্থ্য পরিসরে চূড়ান্ত অসুখী, তার ইংরেজিশিক্ষিত মন যে সঙ্গিনীকে খোঁজে, গৃহের ভিতর তাকে পাওয়া অসম্ভব ৷ ঔপন্যাসিকের ভাষায় :

হৈমবতীর অনেক গুণ ৷ সে কুরূপা, মুখরা, অপ্রিয়বাদিণী, আত্মপরায়ণা ৷ যখন দেবেন্দ্রর সহিত তাহার বিবাহ হইল, তখন পর্যন্ত দেবেন্দ্রের চরিত্র নিষ্কলঙ্ক ৷ লেখাপড়ায় তাঁহার বিশেষ যত্ন ছিল এবং প্রকৃতিও সুধীর ও সত্যনিষ্ঠ ছিল ৷ কিন্তু সেই পরিণয় তাঁহার কাল হইল ৷ যখন দেবেন্দ্র উপযুক্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেন, তখন দেখিলেন যে, ভার্য্যার গুণে গৃহে তাঁহার কোনও সুখের আশা নাই ৷ … বয়োগুণে দম্পতিপ্রণয়াকাঙ্খা জন্মিল—কিন্তু অপ্রিয়বাদিনী হৈমতবতীকে দেখিবামাত্র সে আকাঙক্ষা দূরীভূত হইত ৷ … কলিকাতায় পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইয়া দেবেন্দ্র অতৃপ্তবিলাসতৃষ্ণা নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন ৷২৩

উনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালির চেতনায় দাম্পত্যের এই ঐতিহ্যাগত ছবি কোনোভাবেই কাম্য নয় ৷ এই দাম্পত্যের ঠিক বিপরীতেই রয়েছে শ্রীশচন্দ্র-কমলমণির সম্পর্ক ৷ শ্রীশচন্দ্র ‘প্লন্ডর ফেয়ারলির বাড়ীর মুৎসুদ্দি’ হলেও বিষয়কর্মের অবসরে কমলমণির সঙ্গে তাঁর লঘু হাস্য-পরিহাস, ‘বাদলের বৃষ্টির মত’ ক্ষণে ক্ষণে তাঁদের ‘সন্ধি বিগ্রহ’, সর্বোপরি শিশুপুত্র সতীশচন্দ্রের অপূর্ব মধ্যস্থতা শ্রীশচন্দ্রের গার্হস্থ্যপরিসরটিকে শ্রীমণ্ডিত করেছে ৷ শ্রীশচন্দ্র ও কমলমণি যখন পরস্পরের প্রতি ‘অনিবার্য বৈষ্ণবাস্ত্র’ নিক্ষেপ করেন, কুরুক্ষেত্র সমরপ্রাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণের মতই সতীশচন্দ্র তখন ‘মহাস্ত্র সকল’ আপন বদনমণ্ডলে গ্রহণ করে ‘যুদ্ধের সমতা’ আনেন ৷ শিক্ষিত, সমমনস্ক, পরস্পরের পরিপূরক স্বামী-স্ত্রী ও শিশুপুত্রের মিলিত পারিবারিক বোধ—এই আদর্শ দাম্পত্যের ছবিটি সমকালীন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত সমাজেও সমানভাবেই মান্যতা পেয়েছিল ৷ পুর্বোক্ত Daily Telegraph পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে জনৈক বিবাহিত মহিলা লিখেছেন তিনি উপভোগ করেন : ‘The pleasure to be found in intellectual, social companionship between husband and wife’; ৷ অপর একটি চিঠিতে একজন বিবাহিত মহিলা তাঁর আদর্শ গার্হস্থ্যজীবনের যে ছবিটি আঁকছেন, বঙ্গীয় সামাজিক পরিসরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসহ শ্রীশচন্দ্র-কমলমণির অন্তঃপুরের ছবির সঙ্গে তা অনেকাংশে মিলে যায় :

My dear husband is lolling in an easy chair, reading the Daily Telegraph—this is his vacation, so he can take all things very easy … One of my little daughters, aged eleven years, is seated at the piano … another is playing with some pet white mice in the garden … and my baby girl is asleep in her bed. No, I am not slave or drudge. I am the happiest mother and wife in England.২৪

‘জগদীশ্বর’ নগেন্দ্রকে ‘সকল সুখের অধিপতি করিয়া পৃথিবীতে পাঠাইয়াছিলেন ৷ কান্ত রূপ, অতুল ঐশ্বর্য, নীরোগ শরীর, সর্বব্যাপিনী বিদ্যা, সুশীল চরিত্র, স্নেহময়ী সাধ্বী স্ত্রী’ ৷ পতিব্রতা, অনুগামিনী স্ত্রী সূর্যমুখী থাকা সত্বেও নগেন্দ্র অসংযমী প্রবৃত্তির বশে বিধবা কুন্দনন্দিনীর প্রতি আকৃষ্ট হলেন ৷ নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর দাম্পত্যপ্রণয় ও গার্হস্থ্যজীবনে বিষবৃক্ষের বীজ এভাবেই অঙ্কুরিত হল নগেন্দ্রর অসংযমী চিত্তবৃত্তির কারণে—‘লোভ সম্বরণ করিবার জন্য যে মানসিক অভ্যাস বা শিক্ষা আবশ্যক, তাহা তাঁহার হয় নাই ৷ এই জন্যই তিনি চিত্তসংযমে প্রবৃত্ত হইয়াও সক্ষম হইলেন না ৷’ বঙ্কিম ‘বিষবৃক্ষ কি’ পরিচ্ছেদে প্রবৃত্তিগত বাসনা ও চিত্তসংযমের যে তাত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকীয় ‘আধুনিক’ চৈতন্যে ব্যক্তি, পরিবার ও যৌননৈতিকতার মান্য ডিসকোর্সটিই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে :

বিষবৃক্ষের বীজ … সকলেরই গৃহপ্রাঙ্গণে প্রোথিত আছে ৷ রিপুর প্রাবল্য ইহার বীজ … কেহই এমন মনুষ্য নাই যে, তাঁহার চিত্ত রাগদ্বেষকামক্রোধাদির অস্পৃশ্য ৷ জ্ঞানী ব্যক্তিরাও ঘটনাধীনে সেই সকল রিপুকর্মে বিচলিত হইয়া থাকেন. ৷ … চিত্ত সংযমের অভাবই ইহার অঙ্কুর, তাহাতেই এ বৃক্ষের বৃদ্ধি ৷ ইহার ফল বিষময়; যে খায়, সেই মরে ৷ … চিত্তসংযমপক্ষে, প্রথমত চিত্তসংযমে প্রবৃত্তি, দ্বিতীয়ত, চিত্তসংযমের শক্তি আবশ্যক ৷ ইহার মধ্যে শক্তি প্রবৃত্তিজন্যা; প্রবৃত্তি শিক্ষাজন্যা ৷ প্রবৃত্তিও শিক্ষার উপর নির্ভর করে ৷ সুতরাং, চিত্তসংযমপক্ষে শিক্ষাই মূল ৷ কিন্তু, গুরুপোদেশকে কেবল শিক্ষা বলিতেছি না, অন্তঃকরণের পক্ষে দুঃখভোগই প্রধান শিক্ষা ৷

‘বিষবৃক্ষের ফল’ পরিচ্ছেদে নগেন্দ্র দত্তকে লেখা হরদেব ঘোষালের চিঠিটি এ-প্রসঙ্গে মূল্যবান ৷ ‘গুণজনিত প্রণয়’ এবং ‘রূপজ মোহ’-র যে বৈপরীত্য এবং পরিশেষে ‘গুণজনিত প্রণয়ে’র শ্রেষ্ঠত্ব এই চিঠিতে যেরকম প্রণালিবদ্ধভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাকে উনিশ শতকীয় দাম্পত্যভাবনা তথা নারী-পুরুষ সম্পর্কের ভিতর প্রবৃত্তি বা যৌন-আকাঙক্ষার মাত্রাগত ডিসকোর্স হিসেবে পড়া যেতে পারে :

রূপবতীর ভোগলালসা ভালবাসা নহে ৷ যেমন, ক্ষুধাতুরের ক্ষুধাকে অন্নের প্রতি প্রণয় বলিতে পারিনা, তেমনি কামাতুরের চিত্তচাঞ্চল্যকে রুপবতীর প্রতি ভালবাসা বলিতে পারি না ৷ সেই চিত্তচাঞ্চল্যকেই আর্য্যকবিরা মদনশর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন ৷ যে বৃত্তির কল্পিত অবতার বসন্ত সহায় হইয়া, মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করিতে গিয়াছিলেন, যাঁহার প্রসাদে কবির বর্ণনায় মৃগীরা মৃগদিগের গাত্রে গাত্রকন্ডুয়ন করিতেছে … সে এই রূপজ মোহমাত্র ৷ … কালিদাস, বাইরন, জয়দেব ইহার কবি—বিদ্যাসুন্দর ইহার ভেঙ্গান ৷ কিন্তু ইহা প্রণয় নহে ৷ প্রেম বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ৷ প্রণয়াস্পদ ব্যক্তির গুণসকল যখন বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা পরিগৃহীতা হয়, হৃদয় সেই সকল গুণে মুগ্ধ হইয়া তৎপ্রতি সমাকৃষ্ট এবং সঞ্চালিত হয়, তখন সেই গুণাধারের সংসর্গলিপ্সা, আসঙ্গলিপ্সা সফল হইলে সংসর্গ, সংসর্গফলে প্রণয়, প্রণয়ে আত্মবিসর্জন ৷ …নিতান্তপক্ষে স্ত্রী-পুরুষের ভালবাসা আমার বিবেচনায় এইরূপ ৷ …গুণজনিত প্রণয় … একেবারে হঠাৎ বলবান হয় না—ক্রমে সঞ্চারিত হয় ৷ কিন্তু রূপজ মোহ এককালীন সম্পূর্ণ বলবান হইবে ৷ তাহার প্রথম বল এমন দুর্দমনীয় হয় যে, অন্য সকল বৃত্তি তাহার দ্বারা উচ্ছিন্ন হয় ৷

নগেন্দ্রর জীবনে বিষবৃক্ষের ভয়াবহ ফল ফলেছিল ৷ তাঁর দাম্পত্যজীবন তছনছ হয়ে যায়, এক তীব্র মানসিক যন্ত্রমায় কাতর হয়ে অনুশোচনার জ্বালায় জ্বলতে থাকেন তিনি ৷ কাহিনির শেষাংশে পৌঁছে কুন্দনন্দিনীর মৃত্যু হয়, নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর পুনর্মিলন ঘটে ৷ কিন্তু নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর মিলনের মাঝখানেও রয়ে যায় অবহেলিত কুন্দনন্দিনীর আত্মাহুতির স্মৃতি ৷ প্রায় একই ধরনের ঘটনাক্রম পুনরাবৃত্ত হয়েছে কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসেও ৷ সেখনেও ভ্রমর-গোবিন্দলালের দাম্পত্যসম্পর্কের ভিতর প্রবেশ করেছে চতুরা, রূপৈশ্বর্যময়ী রোহিণী ৷ অস্বাভাবিক রূপজমোহ ও বাসনাজাত প্রবৃত্তির কারণেই গোবিন্দলাল তাঁর স্ত্রী ‘একটি ক্ষুদ্রশরীরা বালিকা’ ভ্রমরকে পেয়ে তৃপ্ত হননি ৷ উপন্যাসের গোড়ায় প্রভাত-সূর্যোদয়ের দৃশ্যে ভ্রমর পাশে এসে দাঁড়ালে ‘গোবিন্দলালও তাহার পানে চাহিয়া অতৃপ্তলোচনে দৃষ্টি করিতেছিলেন’ ৷ বারুণীতীরস্থ বাগানে ইউরোপীয় রুচিতে নির্মিত শ্বেতপ্রস্তর খোদিত অর্ধাবৃতা স্ত্রীমূর্তিগুলি গোবিন্দলালের খুবই প্রিয় ছিল, কিন্তু অপরিণত ভ্রমর সেগুলিকে ‘কালামুখী’ বলে গালি দিয়েছে ৷ বারুণীর জলে আত্মহত্যাপ্রয়াসী রোহিণীকে উদ্ধার করার পর তার মৃতবৎ দেহটি গোবিন্দলাল যখন আপন পালঙ্কে শোয়ালেন, তখনই প্রত্যক্ষভাবে প্রথমবার রোহিণীর অপরূপ সৌন্দর্য এবং করুণ পরিণতি গোবিন্দলালকে মথিত করে দেয় ৷ এরপর কৃত্রিম উপায়ে রোহিণীর শ্বাস পরিচালনা করতে গিয়ে গোবিন্দলাল যে মুহূর্তে ‘ফুলকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া—রোহিণীর মুখে ফুৎকার দিলেন’, তখনই তাঁর জীবনে গুরুতর পরিবর্তনের সূচনা ঘটল ৷ বিষবৃক্ষ-তে নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর পুনর্মিলন ঘটেছিল ৷ কৃষ্ণকান্তের উইল-এ ভ্রমরের অপমানিত নারীসত্তা বিশ্বাসঘাতক স্বামীকে ক্ষমা করেনি ৷ ভ্রমর স্বামীকে পরিত্যাগ করে ৷ গোবিন্দলালের মনে হয়, ‘আমার এ অসার, এ আশাশূন্য, প্রয়োজনশূন্য জীবন ইচ্ছামত কাটাইব ৷ মাটির ভাণ্ড যে দিন ইচ্ছা, সেই দিন ভাঙিয়া ফেলিব ৷’ মীমাংসার অতীত মানসিক যন্ত্রণা বহন করে গোবিন্দলাল গৃহত্যাগ করেন এবং রোহিণীকে নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসবাস করতে থাকেন ৷ সেদিন থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের ‘পাপবৈরাগ্য’ ৷ প্রবৃত্তির আগুনে দিশাহারা গোবিন্দলাল কক্ষচ্যুত গ্রহের মত রোহিণীর আকর্ষণে ধাবিত হয়েছিলেন ৷ কিন্তু রোহিণীকে পাবার পরই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন—ভোগে তৃপ্তি নেই, ভ্রমরের স্থান কখনোই অধিকার করার সামর্থ্য রাখে না রোহিণী ৷ কিন্তু একইসঙ্গে উপলব্ধি করলেন—যা তিনি হারিয়েছেন তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না ৷ ভ্রমরের প্রতি অবিচার করার আত্মগ্লানি এবং রোহিণীই সকল সর্বনাশের মূল—এই অনুভূতিজাত তীব্র বিতৃষ্ণাই গোবিন্দলাল কর্তৃক রোহিণী হত্যার নিহিত কারণ ৷ ভ্রমরের মৃত্যুর পর, ছন্নছাড়া, বিশুষ্ক, বারুণী পুষ্পোদ্যানে বিকারগ্রস্ত গোবিন্দলালের কাছে ‘ভ্রমর অপ্রাপনীয়া, রোহিণী অত্যাজ্যা—তবু ভ্রমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে … জগৎ ভ্রমর-রোহিণীময়’ হবার পর, একসময় গোবিন্দলাল রোহিণীর প্রভাবমুক্ত হয়েছেন:

‘সহসা রোহিণীমূর্তি অন্থকারে মিলাইয়া গেল ৷ তখন দিগন্ত ক্রমশ

প্রতিভাসিত করিয়া জ্যোতির্ময়ী ভ্রমরমূর্তি সম্মুখে উদিত হইল ৷’

উপন্যাসের শেষে বারো বছর অজ্ঞাতবাসের পর সন্ন্যাসীবেশী গোবিন্দলাল ফিরে আসেন, ‘ভগবৎপাদপদ্মে মনঃস্থাপন ভিন্ন শান্তি পাইবার আর উপায় নাই’—এই বিশ্বাসে পৌঁছে ‘ভ্রমরাধিক ভ্রমর’-এর সান্নিধ্যপ্রয়াসী গোবিন্দলাল আবার নিরুদ্দেশ হন ৷ পূর্বোক্ত হরদেব ঘোষালের চিঠি উনিশ শতকীয় ‘আধুনিক’ ব্যক্তির যৌননৈতিকতা ও প্রেমের আদর্শের যে ‘ডিসকার্সিভ’ ব্যাখ্যা দিয়েছিল, গোবিন্দলালের পরিণতি তারই প্রায়োগিক রূপ ৷ এই অধ্যায়ের সূচনায় উদ্ধৃত কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের ‘আত্মকথা’য় প্রকাশিত নৈতিকতার ধারণাকে নগেন্দ্র ও গোবিন্দলালের চরিত্র-চিত্রণের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যেতে পারে ৷

একটি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে ক্যারেন হার্ভি দেখিয়েছেন, কীভাবে আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে ‘প্রত্ন-আধুনিক’ ২৫(early modern) থেকে ‘আধুনিক’ (modern)—এই যুগপরিসরগত প্রতিসরণের মধ্য দিয়ে ‘যৌনতা’ হয়ে উঠছিল একটি নতুন আলোচনার ‘ক্ষেত্র’, যা ব্যক্তি, পরিবার, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, অন্তঃপুর প্রভৃতি বিষয়গুলিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছিল ৷ এর ফলেই ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠল ‘পরিবারের প্রাতিস্বিকীকরণ’-এর ধারণা ৷ নারীপুরুষের দাম্পত্য তথা শরীরী সম্পর্ককে নতুন তাত্বিকতার মোড়কে পরিবেশন করা হতে লাগল ৷ সাধ্বী স্ত্রীর এই আদর্শায়িত রূপটি হয়ে দাঁড়াল ‘একজন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত রমণী—এক গার্হস্থ্য-নির্ভর ব্যক্তিত্ব, যিনি গৃহাভ্যন্তরে স্থিত এবং মাতৃত্ব ও অ-যৌন গুণাবলি দ্বারা অলংকৃত’ ৷২৬ আমাদের উনিশ শতকের সামাজিক বাস্তবতায় যদিও ‘প্রত্ন-আধুনিক’ ও ‘আধুনিক’ জাতীয় পরিসরগত বিভাজন ততোটা প্রাসঙ্গিক নয়, তবু, ‘বাঙালি ভিক্টোরীয়’ ব্যক্তির জীবনে দাম্পত্য ও যৌননৈতিকতা, ‘উপভোগ’-কে সর্বদাই নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শিখিয়েছে, এক উন্নত, ঊর্ধ্বায়িত তত্বের কাঠামোয় অঙ্গীভূত করতে চেয়েছে ব্যক্তির যৌন আকাঙক্ষাকে ৷

২.

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমাদের সমাজের নারী-পুরুষের শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কের তিনটি পৃথক ধরন ছিল ৷ প্রথমটি ‘বৈধ’ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, দ্বিতীয়টি অবৈধ ‘পরকীয়া’ সম্পর্ক এবং তৃতীয়টি সর্বব্যাপী বেশ্যা-খদ্দের সম্পর্ক ৷ বৈধ স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ভিতর যৌনতা, শরীর, যৌন আনন্দ পরিতৃপ্তির অবাধ পরিসর সেদিন ছিল না ৷ বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, ‘অশিক্ষিত’ স্ত্রী এবং ‘শিক্ষিত’ স্বামীর ভিতর মানসিক সম্পর্কহীনতা—প্রভৃতি কারণে অধিকাংশ বিবাহই ছিল ‘অসম’ বিবাহ ৷ মানসিক সংযোগ ঘটার নূন্যতম সুযোগও সেদিন প্রায় থাকত না কোনো দম্পতির ৷ ফলত তারা খুব সহজেই একে অপরের ভিতর শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তির উপকরণ খুঁজে নেবে—এরকম সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে ৷ তাই পুরুষ তার স্বাভাবিক যৌনতৃপ্তির আকাঙক্ষা মেটাত হয় পরিবার-বহির্ভূত ‘অবৈধ’ সম্পর্ক দ্বারা অথবা গণিকালয়ের নগদ যৌনতা তার অতৃপ্ত কামনাকে শান্ত করত ৷ মেয়েদের অবস্থা ছিল আরও বেশি সমস্যাসঙ্কুল ও জটিল ৷ পুরুষের মতো অতি সহজেই বহির্গামী হবার সুযোগ তাদের ছিল না বলে অধিকাংশ মেয়েকেই অবদমিত, অতৃপ্ত কামনার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরতে হত সারাজীবন ৷ কঠোর রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের মানসিক চাহিদাগুলি যেমন বোঝেনি, তেমনই তাদের শারীরিক আকাঙক্ষারও কোনো খোঁজ রাখতে চায়নি বহুদিন পর্যন্ত ৷ অথচ বাল্যবিধবা, গৃহবধূ, অবিবাহিত গৃহস্থ মেয়েদের শারীরিক বাসনার সুযোগ নিয়ে তাদের যৌন উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতেও ছাড়েনি পুরুষেরা ৷ অনেক মেয়েকেই একারণে ‘কুলটা’ বলে চিহ্নিত করা হত এবং তাদের পক্ষে সংসারে টিকে থাকা অসম্ভব হওয়ায় কুলত্যাগ করতে বাধ্য হত তারা ৷ এদের অনেকেরই স্থান হত বেশ্যাপল্লিতে ৷ বস্তুত, উনিশ শতকের অসংখ্য কেচ্ছা পত্র-পত্রিকা ও প্রহসন-নকশা জাতীয় রচনায় বাঙালি সমাজে যৌন ব্যভিচারের যে ব্যাপক ছবি পাওয়া যায়, তা থেকে এটুকু অন্তত বোঝা যায় যে অবৈধ যৌনাচার সেদিনের একটা চালু পদ্ধতি ছিল ৷

কিন্তু যৌনবিচ্যুতির ছবি আঁকার আগে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ থেকে চলে আসা নারী-পুরুষের পারিবারিক তথা দাম্পত্যসম্পর্ক, শারীরিক/মনস্তাত্বিক সংযোগ অথবা সংযোগহীনতার মান্য চেহারাটি কেমন ছিল সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা প্রয়োজন ৷ রজতকান্ত রায়ের মতে প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামোর ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণ্য পিতৃতান্ত্রিক ‘ক্ষমতা’ যৌনতাকে একটি সম্ভাব্য বিপর্যয়মূলক শক্তি হিসেবেই ধরে নিয়েছিল এবং বাল্যবিবাহ, পরিবার কর্তৃক কঠোরভাবে বিবাহের পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, বাধ্যতামূলক অ-যৌন বৈধব্যজীবন, নারীর উপর কঠোর যৌন অবদমন চালালেও পুরুষের বহুগামিতায় বাধা না দেওয়া, কৌলীন্য প্রথার সূত্রে পুরুষের বহুবিবাহের রীতিনীতি বজায় রাখা, সর্বোপরি মেয়েদের বিবাহের বয়স যথাসম্ভব নিম্নপর্যায়ে বেঁধে রাখা—প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলেছিল ৷২৭ প্রাক-ঔপনিবেশিক সমাজে নারী-পুরুষের দাম্পত্য-সম্পর্কের সম্ভাব্য চেহারা ঠিক কীরকম ছিল, তার একটি কৌতুকপ্রদ বর্ণনা পাওয়া যায় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে ৷ ভবানন্দ মজুমদার বিদেশ থেকে ফিরে এলে তার দুই স্ত্রী চন্দ্রমুখী এবং পদ্মমুখী—দুজনেই শয্যাসঙ্গী হিসেবে স্বামীকে পেতে চাইল :

শুনি মজুন্দার বড় উম্ননা হইল ৷

কার ঘরে আগে যাবে ভাবিতে লাগিল ৷ ৷

যাইতে ছোটর ঘরে বড় মনোরথ ৷

বড় কৈল বাদহাটা আগুলিয়া পথ ৷ ৷

এক চক্ষু কাতরায়ে ছোট ঘরে যায় ৷

আর চক্ষু রাঙা হয়ে বড় পানে চায় ৷ ৷

এই সপত্নীসমস্যার সমাধান করলেন চতুর ভবানন্দ :

কামের করাতে ভাগ করি কলেবরে ৷

সমকারে রব গিয়া দুজনের ঘরে ৷ ৷

দুটায় মরিস কেন ডাকাডাকি করি ৷

তারি কাছে আগে যাব যে লইবে ধরি ৷ ৷

এত শুনি সাধী মাধী অন্তর হইল ৷

দুজনার ঘরে গিয়া দুজনা রহিল ৷ ৷

মজুন্দার কন প্রিয়ে এমন কি হয় ৷

চন্দ্র পদ্মে যে সম্বন্ধ কভু মিথ্যা নয় ৷ ৷

হাসি চন্দ্রমুখী মুখে ঝাঁপিলা অম্বর ৷

পদ্মমুখীমুখপদ্মে হৈলা মধুকর ৷ ৷

ভারত কহিছে ধন্য ধূর্ত মজুন্দার ৷

সমান রাখিলা মান জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠার ৷ ৷২৮

ভবানন্দের কাছে সমস্যাটা ছিল নির্বাচনের, নৈতিকতার নয় ৷ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের প্রধান সূত্র এখানে ভরণপোষণ ও কামক্রিয়ার, তার চেয়ে উচ্চতর কোনো নৈতিক আদর্শ এখানে প্রত্যাশিত নয় ৷ বস্তুত, বাঙালি সমাজে ‘মনুস্মৃতি’-অনুশাসিত বিবাহের ব্রাহ্মণ্য রীতিনীতিমূলক উদ্দেশ্যই প্রচলিত ছিল, যেখানে বিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল : পুত্রসন্তান উৎপাদন—‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ ৷ মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর পিতা দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন, কারণ হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে বিধর্মী পুত্রের দ্বারা আত্মার সদগতি অসম্ভব ৷ জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর পিতাও অনুরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করেন ৷ জনৈক ব্রাহ্ম মহিলা, হৈমবতী দেবীর অপ্রকাশিত স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তাঁর আশঙ্কার কথা—পুত্র অন্য ধর্মে বিবাহ করলে পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি ঘটে না ৷২৯ এমনকি, সম্পূর্ণ ইংরেজিশিক্ষিত, পাশ্চাত্য-প্রভাবিত ‘আধুনিক’ পরিবারেও প্রথম স্ত্রীর সন্তান না হলে দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণের রেওয়াজ চালু ছিল ৷৩০ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণীয় পরিবারেও বাল্যবিবাহই ছিল প্রথা, মেয়েদের বিয়ে হত তারা রজঃস্বলা হবার আগে, সর্ব্বোচ্চ আট থেকে দশ বছর বয়সের মধ্যে ৷ বাল্য-বিবাহের সপক্ষে সবচেয়ে জোরালো সমর্থনের কারণ ছিল নারীর তথাকথিত যৌনক্ষুধার প্রাবল্য (ধরে নেওয়া হত মেয়েদের যৌনক্ষুধা ছেলেদের চেয়ে আট গুণ বেশি) এবং সেই অপ্রতিরোধ্য ‘কাম’কে বাল্যবয়সেই কঠোর অনুশাসনে বেঁধে ফেলার ইচ্ছা ৷ স্ত্রীর যৌন ব্যভিচারের প্রবলতা যে স্বামী ও তার গোটা পরিবারের অমঙ্গলের কারণ—এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল ছিল ৷ প্রথমদিকে যেসব মেয়েদের বিধবাবিবাহ দেওয়া হয়, তাদের বয়স ছিল দশ থেকে বারো বছর ৷ তত্ববোধিনী পত্রিকা-য় বিধবাবিবাহের সমর্থনে যুক্তি দিতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও মেয়েদের এই ‘অনিয়ন্ত্রিত কাম’ সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেন :

যাহারা বাল্যকালে বৈধব্যদশায় পতিত হয়, তাহারা সকলেই যে চিরজীবন স্বভাবসিদ্ধ প্রবল রিপু একেবারে বশীভূত বা উৎসিন্ন করিয়া সতীধর্ম পালন করিবে ইহা কোনমতেও সম্ভব নহে ৷ ইহা সম্ভব হইলে বাঙলা দেশ বিধবা রমণীদের কলঙ্কে যেরূপ কলঙ্কিত হইয়াছে, তাহা কখনই হইত না ৷ স্ত্রীলোকের রিপুবিশেষ পুরুষদিগের অপেক্ষা অষ্টগুণ প্রবল বলিয়া এতদ্দেশীয় লোকের হৃদয়ঙ্গম আছে ৷৩১

‘বাল্যবিবাহ’ প্রথার অপর উদ্দেশ্য ছিল, গোত্র, কূল বা বর্ণব্যবস্থাকে বিবাহের মাধ্যমে অক্ষুণ্ণ রাখা ৷ যে-কারণে কৌলীন্য প্রথা দীর্ঘদিন অব্দি বজায় ছিল উনিশ শতকে ৷ বিবাহযোগ্যা কুলীন কন্যাকে ঘিরে উৎকণ্ঠা সেই সময়ের একাধিক প্রহসনেও ঠাঁই পেয়েছে ৷ পাশ্চাত্যে যেমন বিবাহ ও নারী-পুরুষের যৌনসম্পর্ককে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করত খ্রিস্টীয় চার্চ, আমাদের তেমন কোনো মান্য ধর্মীয় কর্তৃক না থাকায় দেশীয় সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্কের উপর নজরদারি প্রয়োগ এবং শৃঙ্খলারক্ষার দায়িত্ব ছিল মূলত স্মৃতিশাস্ত্রনির্দেশিত ‘দেশাচার’ ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠী পরিবৃত বৃহত্তর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের উপর ৷ এই সামগ্রিক শৃঙ্খলার চরিত্রটি ছিল পুরুষতান্ত্রিক ৷

হৈমবতী সেন-এর পূর্বোক্ত আত্মকথন বা রাসসুন্দরীর আমার জীবন পড়লে বৃহত্তর পারিবারিক কাঠামোয় বালিকাবধূর অঙ্গীভূত হয়ে যাবার বিষয়টি পরিস্ফুট হয় ৷ বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকলেও অন্তত ‘দেশাচার’ অনুসারে রজস্বলা হবার আগে নারীকে স্বামীসহবাসের উপযুক্ত বলে মনে করা হত না ৷ নারী ‘ঋতুমতী’ হবার পর ‘পুষ্পোৎসব’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নারীকে স্বামীসহবাসের অনুমতি দেওয়া হত ৷ কিন্তু, বাস্তব ক্ষেত্রে এই নিয়ম সকলেই সর্বদা মেনে চলত না ৷ অনেক ক্ষেত্রেই ঋতুমতী হবার আগেই স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হত মেয়েরা, কখনো কখনো শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হত তারা ৷ হৈমবতী সেন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন মাত্র দশ বছর বয়সে পঁয়তাল্লিশ বৎসের বছরের স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য হন তিনি ৷ যৌন উদ্দীপনা নয়, বরং, যৌন ভীতি, বিরক্তি, লজ্জা ও তীব্র অনিচ্ছাই তাঁর প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার প্রাপ্তি ৷ স্বামী জোর করে সম্ভোগ করতে চান তাঁকে ৷ এমনকি, এক রাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেলে স্বামীকে এক গণিকা রমণীর সঙ্গে সম্ভোগরত অবস্থায় দেখতে পান তিনি ৷ তবে সামগ্রিকভাবে মেয়েদের যৌন অভিজ্ঞতা আদৌ সুখকর ছিল কীনা, উনিশ শতকীয় মেয়েদের স্মৃতিকথা থেকে তা আদৌ বোঝা যায় না ৷

অবশ্য সাধারণভাবে, বৃহত্তর পারিবারিক কাঠামোয় স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব একান্ত দাম্পত্য সম্পর্কের অস্তিত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে ৷ স্ত্রী মূলত পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবেই গণ্য হত ৷ স্বামী ছিলেন দাম্পত্যজীবনের প্রান্তিক চরিত্র ৷ এমনকি দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রীর দেখা হওয়াও ছিল গর্হিত বিষয় ৷ চন্দ্রমুখীর উপাখ্যান-এ রেভারেন্ড—লালবিহারী দে লিখেছেন :

এতদ্দেশীয় বামাগণ রজনী ব্যতীত ভর্ত্তার সহিত নিশ্চিন্তে কথা বলিবার আর সুযোগ পান না ৷ দিবসে পাকাদি এবং গৃহকার্যে্য নিযুক্তা থাকেন আর অবসর পাইলেও লজ্জা-প্রযুক্তা স্বামীর সহিত একত্রে বসেন না ও অধিক কথাও কহেন না ৷ যে তরুণী দিবাভাগে পতির সহিত কথোপকথন করেন তাহাকে প্রতিবেশীরা বিশেষতঃ স্থবিরাগণ শিথিলা কহেন ৷৩২

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত একটি প্রহসনেও দেখা যায় শাশুড়ি পুত্রবধূকে ভর্ৎসনা করছেন দিনের বেলা স্বামীর সঙ্গে কথা বলার অপরাধে : ‘ও মা! এমন বেহায়া মেয়ে তো আমি কোথাও দেখিনি ৷ ও কি না স্বচ্ছন্দে বসে ভাতারের সঙ্গে গল্প কর্চ্ছে? ও মা, কি ঘেন্না ৷ আমার এই তিন কাল গেছে এক কালে ঠেকেছে, তাঁর সঙ্গে চোকাচোকি কতা কইতে আজও আমার লজ্জা করে ৷ অ্যা, এ কালে কালে হলো কি? কলি কি না ? কোথা থেকে এক বেবিশ্যের মেয়ে ঘরে এনেছেন…লজ্জা শরমের লেশ মাত্তোর নেই ৷’৩৩ সম্ভবত প্রচলিত দাম্পত্যসম্পর্কের এই চেহারা দেখেই বিদ্যাসাগর মন্তব্য করেছিলেন : ‘এই জন্যই অস্মদ্দেশে দাম্পত্য নিবন্ধন অকপট প্রণয় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভর্ত্তা স্বরূপ এবং প্রণনিয়নী গৃহপরিচারিকাস্বরূপ হইয়া সংসার যাত্রা নির্বাহ করে ৷’৩৪ এই ব্যবধানের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে, সমকালীন পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য লেখালেখি ছাপা হয়েছে ৷ তেমনই একটি লেখায় বলা হয়েছে : ‘স্ত্রী-পুরুষ প্রায় অধিক প্রণয় থাকে না… পুরুষ যদ্যপি গুণযুক্ত হয় তবে সে ব্যক্তি তাহার অগুণযুক্তা স্ত্রী সহিত কখনই আত্মিক প্রমোদ করিতে পারে না ৷ তবে কি করিবে, মন রাখিবার নিমিত্তে হা-হুতেই কাল ক্ষেপণ করে ৷’৩৫

এই অসম সম্পর্কের অনিবার্য ফল যৌন অনৈতিকতা ৷ পুরুষের তরফ থেকে এই যৌনস্খলন বেশ্যাগমন বা পরিবারের ভিতর অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলেও যৌন অবদমন সবচেয়ে কঠোরভাবে প্রয়োগ হত মেয়েদের উপর ৷ সমকালীন বেশ কিছু প্রহসনে বৈবাবিক সম্পর্কবহির্ভূত যৌন ব্যভিচারের কারণ হিসেবে অসম বিবাহ, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও বিধবাসমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, পাশাপাশি স্ত্রীলোকের ব্যভিচার-প্রবণতাও বিষয়বস্তু হয়েছে বহু প্রহসনের ৷ যে কারণে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছেন : ‘পাশ্চাত্য প্রভাব আসিবার পর এই প্রাচীন হিন্দু ধারণাকে (নরনারীর বিশুদ্ধ প্রণয়সম্পর্ক) পাশ্চাত্য প্রেমের ‘অ্যান্টিথিসিস’ হিসাবে দাঁড় করানো হইয়াছিল ৷ কামই যে নরনারীর সম্পর্কের মূল কথা ইহার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলা পূর্বযুগে আবশ্যক মনে হয় নাই ৷’৩৬ উনিশ শতকের পারিবারিক কাঠামোয় অন্তঃপুরের মেয়েরা যে খুব অল্পবয়স থেকেই যৌনতা, আদিরসাত্মক বাক্যালাপ প্রভৃতি সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠত, তার একাধিক সাক্ষ্য পাওয়া যায় ৷ দুটি সেক্স ম্যানুয়াল, ভারতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুশ্রুষা-প্রণালী (১৮৯৬) এবং কেদারনাথ সরকারের ঋতুরক্ষা (১৮৯১) বইতে মেয়েদের অন্তঃপুরের যৌনউদ্দীপক গল্পগুজবের ইঙ্গিত পাওয়া যায় ৷ একজন সমকালীন ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক বাঙালি অন্তঃপুরিকাদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন : ‘মুখের বুলি ফোটার পর থেকেই তাদের মন ধাবিত হয় যৌনতার প্রতি, এমনকি বহু ক্ষেত্রেই তারা স্বেচ্ছায় যৌনাঙ্গের ব্যবহারও শিখে নেয় ৷’৩৭ মেরিডিথ বোর্থউইকও একই মত পোষণ করেছেন ৷৩৮

বঙ্গীয় বিবাহপ্রথাই যে পরিবারের ভিতরে অসংখ্য যৌনবিচ্যুতির প্রধান কারণ, সে সম্পর্কে লেখালেখি উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রচুর পাওয়া যায় ৷ চন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য-র বঙ্গবিবাহ বইতে কৌলিন্যপ্রথার ফলে বাল্যবিবাহোত্তর জীবনে একটি মেয়েকে কী ধরনের যৌন অবদমনের সম্মুখিন হতে হত, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় :

সেই কন্যা ক্রমে বয়ঃপ্রাপ্ত হইতে লাগিল ৷ ক্রমে বিবাহের রসাস্বাদনের জন্য তাহার মন চঞ্চল হইতে লাগিল ৷ এ বিপদে কে রক্ষা করিবে? পতি ভিন্ন এ বিপদে কে সহায় হইবে? কিন্তু পতি কোথায়? তাহার জীবদ্দশায় দেখা হইবে কি না সন্দেহ ৷… সে দর্শনও অনেক সাধনের ফল ৷ … যেখানে আগমন, ভোজন ও শয়নের দক্ষিণা দিতে পিতামাতা অক্ষম, সেখানে কামিনীর ভাগ্যে পতিসহবাস ঘটিয়া ওঠে না ৷৩৯

নব্যভারত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় বলা হয় : ‘শুভ বিবাহে দারুণ গরল উৎপন্ন হয়, গৃহে অশান্তির আগুন জ্বলিয়া ওঠে ৷ স্বৈরিণীর দল পুষ্ট হয় ৷ লম্পটতার পঙ্কিল স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে ৷’৪০ আর্য্যদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একটি আত্মকথন : আমার জীবনের কথা, এটির কথক একজন নারী, (যার ছদ্মনাম শ্যাম), পাশ্চাত্য সাহিত্যে যেমন ‘গুপ্তকথা’ বা ‘secret life’-এর আদলে নিজের জীবনের অন্ধকার দিকটি সম্পর্কে কনফেশন-মূলক লেখা ছাপা হত, এটিও সেই ধরনেরই লেখা :‘ষোড়শ বর্ষে পদার্পণ করিলে যুবতী কখনই প্রকৃতাবস্থা থাকিতে পারে না ৷ … তাহার চারিদিকে অধঃপতন বহ্নি জ্বলিতেছে, ষোড়শী পতঙ্গের মত তাহাতে প্রবেশ করিতে কতই ব্যাকুল ৷ সেই অগ্নি কেমন সুন্দর ৷ … ক্রমশঃ আমি ষোড়শ বর্ষে পড়িলাম ও আমার সর্বনাশের দিন নিকটবর্তী হইল … বিবাহের পর আমার হৃদয় শান্তি কি তাহা একদিনের জন্যও জানে নাই…’৪১

তবে মোটের উপর যৌনতা-দাম্পত্য-পরিবার সম্পর্কিত পাশ্চাত্য ‘ডিসকার্সিভ’ ব্যাখ্যা উনিশ শতকীয় বাঙালি সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করার আগে পর্যন্ত বৃহত্তর পারিবারিক কাঠামোর ভিতর অবৈধ যৌনাচারকে যেমন নিন্দনীয় বলা হয়েছে, তেমনই কোনো-না-কোনো আবরণে সেগুলিকে সহনীয় হিসেবে মেনে নেবার পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল ৷ যৌনতার কারণে পদস্খলিত মেয়েদের যেমন কলকাতার বাইরে কাশীতে ভিন্ন পরিচয়ে আশ্রয় নিতে হত, তা জানা যায় হরিদাসের গুপ্তকথা-র সূত্রে ৷ বড়োবাবু হরিদাসকে বলেছেন :

তাই ত! কানাইবাবু তো সাধারণ লোক নয়!… কাশী বড় ভয়ানক স্থান ৷ কাশীতে ঐ রকমের জমিদার, ঐ রকমের পরিবার অনেক পাওয়া যায় ৷ … মাতুল কন্যা, পিতৃব্য-কন্যা, মাসী-পিসী, বিমাতৃ-কন্যা, এমন কি, যুবতী বিমাতা পর্যন্ত এখানে অনেক বাবুর পরিবার ৷ এখানকার সমাজে তাঁরা প্রকাশ্যরূপে বেশ চোলে যাচ্ছেন ৷৪২

রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা কুলীনকুলসর্ব্বস্ব নাটক-এ বিবাহ-ব্যবসায়ী কুলীন ব্রাহ্মণ অর্ধমরুচি মুখোপাধ্যায় পুরোহিত ধর্মশীলকে বলেছে তার সবকটি বউকে সে সবসময় সঙ্গদান করতে পারে না ৷ ফলত, তার বিবাহিতা স্বামীবঞ্চিতা কুলীন বধূরা প্রায়ই অন্য পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করে ৷ লোকনিন্দার ভয় এড়াতে তখন শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা খাইয়ে অধর্মরুচির মুখ বন্ধ করা হয় ৷

অধর্ম : আমার কুলীনের ছেলে, অনেকগুলো বে, সর্বত্র তো যাওয়া হয় না, তা যদি কোথাও বেঁধে যায়, আর নিকাশ প্রকাশ করা হয় না,—বুঝতে পেরেছেন কি?

ধর্ম : হাঁ, বুঝেছি তবে কি হয়?

অধর্ম : তবে তারা লোকনিন্দে ভয়ে এসে আমাদের নে যাওয়ার চেষ্টা করে, আমরাও ঝোপ বুঝে কোপ, মটকা মেরে বসে থাকি ৷ সুতরাং, তারা ১০/২০/৩০ টাকা দিয়ে লইয়ে যায় ৷৪৩

আর একটি চমকপ্রদ উদাহরণ দেওয়া যায় ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের ভ্যালারে মোর বাপ (১৮৭৬) প্রহসন থেকে ৷ নায়ক কলিরকাপ বৃদ্ধা সিঁদুরমাতাকে বলেছে, সে নিজে বেশ্যাবাড়ি যায় না, কিন্তু ঘরের বৌকে বেশ্যার মত সাজিয়ে অতৃপ্ত বাসনা পূরণ করেঃ

কলি :… আমি বেশ্যালয়ে যাইনে ৷ যারা বাউত্রে, তারাই খানকির বাড়ী গিয়ে টাকা নষ্ট করে ৷ ঠানদিদি! তোমাকে বলতে কি? তুমি কিচ্ছু কারো সাক্ষাতে বলতে যাবে না ৷ আমি আপিশ থেকে আসবার সময়ে বারেন্ডায় খানকি বেটিরে যেমন করে সেজে বসে থাকতে দেখি, ঘরে এসে তোমার নাতবৌকে ঠিক তেমনি করে সাজাই ৷

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, পাশ্চাত্য প্রভাব জনসমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত যৌনতা সম্পর্কে আপেক্ষিক সহনশীলতা বজায় ছিল ৷ অন্ত্য-আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সহজিয়া সাধনার মধ্য দিয়ে যৌনতাকে ধর্মীয় আবরণে ঢেকে ব্যবহার করা হত ৷ এমনকি, পাশ্চাত্য রোম্যাণ্টিক প্রেমের ধারণা ‘আধুনিক’ কবিতা-উপন্যাস-ছোটোগল্পের মধ্য দিয়ে বিকশিত হবার আগে পর্যন্ত দেশীয় সমাজের নিজস্ব নরনারীপ্রণয়ের একটি ধারাও বর্তমান ছিল ৷ যার একটি প্রধান উপাদান বাল্যপেম ৷ গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ হয় মাত্র এগারো বছর বয়সে ৷ বিবাহের কিছুদিন পর যখন তিনি বালিকাবধূর সঙ্গে সহবাসের সুযোগ পান, সেই অনবদ্য স্ত্রীসঙ্গের স্মৃতির বিবরণ এরকম:: ‘আমি যখন বাটী যাইতাম, সেই নতুন গৃহে উচ্চ-নীচ মৃত্তিকার উপর একটিমাত্র মাদুর পাতিয়া উভয়ে শয়ন করিয়া কত সুখে রাত্রি যাইত, তাহা মুখে বলিতে অক্ষম ৷ …এক্ষণে ৭০ বৎসর বয়সে বৃদ্ধাবস্থায় পীড়াপ্রযুক্ত সকল সুখে বঞ্চিত হইয়াছি ৷’৪৪—স্পষ্টতই, এখানে যে সুখের কথা আভাসে বলা হয়েছে, তা স্ত্রী-পুরুষের শারীরিক সম্ভোগজনিত সুখ ৷ বোঝাই যায়, সব দাম্পত্যেই অসুখী সম্পর্ক তৈরি হত না, প্রাক-ঔপনিবেশিক দাম্পত্যের ঘরানাতেও যৌনসুখ উপভোগের একটি নিজস্ব ধরন ছিল ৷

৩.

নারীপুরুষ সম্পর্ক এবং বৈবাহিক দাম্পত্য-বিষয়ক বহমান সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় ‘ছেদ’ নিয়ে আসে পাশ্চাত্য সংস্পর্শ, ইংরেজি শিক্ষা এবং ইউরোপীয় অনুকরণ ৷ এর ফলে স্ত্রী-শিক্ষা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, নীতিবোধ, চরিত্রগঠন, জীবনের মহৎ উদ্দেশ্যসাধন—এই দৃষ্টিকোণগুলি থেকে বাঙালি ভদ্রলোকের দাম্পত্যভাবনাকে পুনর্নির্মিত করার প্রয়োজন দেখা দিল এবার ৷

এই নতুন দাম্পত্যভাবনার প্রধান স্থপতি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা ৷ সমাজ থেকে ব্যভিচার, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, বহুবিবাহ, গণিকাসক্তি প্রভৃতি যদি দূর করতে হয়, তবে দাম্পত্য জীবনে এই সকল বাহ্যিক আকর্ষণের বিষয়বস্তু অপেক্ষা ‘উন্নত’ এবং অধিকতর আকর্ষণীয় এক বাতাবরণ তৈরি করা প্রয়োজন—এ হেন ভাবনা থেকেই এই নতুন দাম্পত্য-বোধের জন্ম ৷ এই ভাবনার মূল কথাই হল দাম্পত্য কেবল বাহ্যিক সম্পর্কে যুক্ত দুটি নরনারীর সহাবস্থান নয়, স্বামী ও স্ত্রীর পৃথক সত্তার অবলোপ ঘটিয়ে তাদের এক মন, এক আত্মা, এক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলাই হল বিবাহের মুখ্য উদ্দেশ্য ৷ নিছক বস্তুগত মিলন নয়, তারা এক উন্নত আদর্শবোধের তাগিদে গড়ে তুলবে এক অভেদাত্মক সম্পর্ক ৷ বামাবোধিনী পত্রিকায় বিনোদিনী সেনগুপ্তা-র একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছিল :

মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ধর্মসাধন ৷ বিবাহ দ্বারা মনুষ্য সেই ধর্ম্মসাধনের সহায়তা লাভ করে ৷ … বিবাহ দ্বারা দুইটি অপূর্ণ মানব পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়; উভয় মানবাত্মা একত্রীভূত হইয়া ধর্ম্মপথে অগ্রসর হইতে থাকে ৷ দম্পতির প্রেম পবিত্র হইলে, তদুপরি ব্রহ্মান্ড-পতির সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে ৷ নিত্য তাঁহারা একাত্মা হইয়া ভগবানের পূজায় আত্মসমর্পণ করেন ৷ … চরিত্রবতী স্ত্রীর জীবনস্রোত পতির জীবনস্রোতের সহিত মিলিত হইয়া ঈশ্বþরাভিমুখীন হইলে জগতে স্বর্গীয় জ্যোতি বিকিরণ করে ৷ ফলতঃ দাম্পত্য জীবন বিশুদ্ধ ও প্রেমপূর্ণ হইলে এবং দম্পতির প্রেম পবিত্র প্রেমের আধার প্রভু ভগবানের উদ্দেশে ধাবমান হইলে, জীবনে সুখ ও সৌন্দর্যের আর অবধি থাকে না ৷৪৫

নরনারী তাদের দাম্পত্যসম্পর্কের ভিতর নিছক শারীরিক বিনিময়ের সূত্রে নয়, তার চেয়েও উন্নত কোনো নৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা সংযুক্ত—এই ধারণার সূচনা হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্য থেকেই ৷ পিতৃনির্বাচিত বালিকাবধূকে জীবনসঙ্গিনী সিহেবে গ্রহণ করায় অনীহা জানিয়ে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠিতে মাইকেল লেখেন : ‘It harrows up my blood and makes my hair stand like quills on that fretful procupine’ ৷ অবশ্য নব্য-দাম্পত্যভাবনায় উদ্বুদ্ধ হবার পিছনে এদেশীয় সমাজ সম্পর্কে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ ও রাজকর্মচারীদের নিরন্তর সমালোচনাও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ৷ এদেশীয় সমাজে বাল্যবিবাহের কারণেই ভারতীয় পুরুষ শারীরিক/মানসিক বলবীর্যহীন ও মেয়েলি—এই মতটি ব্রিটিশ লেখকেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ এমনকি গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের মত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতও বাল্যবিবাহের কারণেই বীর্যের ঘনত্ব হ্রাস পায়—এই মত পোষণ করতেন ৷ ভিক্টোরীয় পরিবারভাবনার সাপেক্ষে বাঙালি ভদ্রলোকের জীবনেও ‘পাবলিক’/‘প্রাইভেট’—এই দুটি পৃথক পরিসরবিভাজন ঘটতে থাকে ৷ ‘পাবলিক’ পরিসরে যে পুরুষকে বিদেশি শাসকের তৈরি ‘ক্ষমতা’-কাঠামোয় নিতান্ত বাধ্য হয়ে পরাধীন প্রজার ভূমিকা পালন করতে হয়, গৃহাভ্যন্তরের ‘উন্নততর’ ‘প্রাইভেট’ পরিসরটি হয়ে উঠবে তার ভারসাম্যের ‘ক্ষেত্র’ ৷ ১৮৭০ সালে ইংল্যান্ড ভ্রমণের পর দেশে ফিরে কেশবচন্দ্র সেন দেশীয় ব্রাহ্মদের উদ্দেশে প্রদত্ত একটি ভাষণে বলেন: ‘ইংরেজ পরিবারের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা তোমাদেরও আদর্শ হওয়া উচিত ৷’৪৬ জনৈক ব্রাহ্ম লেখকের রচনায় ভিক্টোরীয় ‘পাবলিক’/‘প্রাইভেট’ পরিসরের অনুকরণে বাঙালির অন্তঃপুরেও সহানুভূতিশীল, সর্ববিষয়ে সাহায্যকারিণী স্ত্রীর প্রয়োজনীয়তা ঘোষিত হয়েছে ৷৪৭ বিদেশি লেখকেরা বাঙালি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা নিয়ে ক্রমাগত আক্রমণ শানাতেন ৷ এপ্রিল, ১৮৭৯-তে ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় জনৈক ব্রিটিশ রাজকর্মচারীও একই ধরনের যুক্তি প্রয়োগ করেন ৷৪৮

বামাবোধিনী, মহিলা, পরিচারিকা, অবলাবান্ধব, বঙ্গমহিলা, অন্তঃপুর প্রভৃতি ব্রাহ্ম পত্র-পত্রিকায় এধরনের অনেক লেখাই প্রকাশিত হয় এই পর্বে ৷ লক্ষণীয়, প্রায় সকল লেখক/লেখিকাই এই আদর্শ দাম্পত্যের প্রধানতম শর্তা হিসেবে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের প্রতি গৃহিনীর নিঃশর্ত আনুগত্যের কথাই উল্লেখ করেছেন বারবার ৷ এবং এক্ষেত্রে রক্ষণশীল হিন্দু মানসিকতার থেকে তাঁরা কোথাও আলাদা নন ৷ পাশ্চাত্য ধরনে ‘প্রেম’, ‘কোর্টশিপ’ প্রভৃতি ধারণার বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সতীত্ব ও পাতিব্রত্যকেও নতুন ভাবে তাত্বিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল সেদিন ৷ স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভক্তি আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত দাবি, কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকের লেখালেখিতে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভক্তি, আনুগত্য ও প্রেম এক নতুন তাত্বিক আদর্শায়নের ছাঁচে নির্মিত হয় ৷ নিছক ‘গৃহদাসী’ নয়, ‘গৃহিণী’র কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় সর্বগুণসম্পন্না হয়ে স্বামীকে যাবতীয়, প্রাত্যহিক স্থ²ল আকর্ষণ থেকে মুক্ত করা ৷

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন প্রকাশিত মহিলা পত্রিকায় ‘একটি সুপত্নী’ নিবন্ধে বলা হয়েছিল : ‘যিনি পতির ধর্ম্মপথে সহায়, তাঁহার চরিত্রের সমুন্নতিবিধান ও আধ্যাত্মিক কল্যাণসাধনে সর্বদা নিরত, বিপথগামী দুশ্চরিত্র স্বামীকে যিনি স্বীয় চরিত্র প্রভাবে ও ধর্ম্মবলে সংশোধিত করিয়া ভগবানের চরণতলে আনিয়া স্থাপন করেন, তাঁহাকে সুপত্নী বলা হয় ৷’৪৯ অপর একটি রচনায় বলা হয়েছিল :

স্ত্রী-পুরুষ পরিণয়সূত্রে গ্রথিত হইল—মনে প্রাণে, হৃদয়ে মিলিল, প্রণয় জন্মিল, উভয়েরই এক আশা, এক আকাঙক্ষা, এক ধ্যান, এক জ্ঞান, সকলই এক ৷ স্ত্রীতে স্বামী, স্বামীতে স্ত্রী মিলিয়া গেল ৷ দুইটি পৃথগাঙ্গ মিলিয়া এক নূতন ও প্রিয়দর্শন যুগলমূর্তি হইল ৷ এইরূপ পবিত্র মিলনের নামই দাম্পত্যপ্রণয় ৷৫০

এই নব্য দাম্পত্যভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যা গড়ে ওঠে তাকে বলা যেতে পারে রোম্যাণ্টিক প্রেমের ধারণা ৷ দেশীয় সামাজিক প্রেক্ষিতে পাশ্চাত্য ধাঁচের প্রাক-বিবাহ মেলামেশার অবাধ পরিসর ছিল না ৷ ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা অত্যন্ত খন্ডিতভাবে প্রাক-বিবাহ পাত্র-পাত্রীর পরিচয়পর্বের প্রচলন ঘটালেও তাকে রোম্যাণ্টিক প্রণয় বলা চলে না ৷ এমনকি ঠাকুরপরিবারের মতো অগ্রসর চিন্তাভাবনার অধিকারীরাও দেখে শুনে বিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন ৷ বিশ শতকের গোড়ার দিকেও মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স বারো বছর পেরোয়নি ৷ ফলত, বাংলা সাহিত্য তথা সমাজে বিবাহ-পরবর্তী রোম্যাণ্টিক প্রণয়ের আখ্যান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৷ এমনকি, উপন্যাসে বালিকা চরিত্রেরাও রোম্যাণ্টিকতার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে ৷৫১

কিন্তু এই নতুন দাম্পত্যে যৌনতার স্থান কতটা? ব্রাহ্মদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দু পরিবার থেকে যাবতীয় অপবিত্রতার অপসারণ ৷ তাই হাজারো অন্যায়, মেয়েদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন সত্বেও হিন্দু পরিবারে বৈধ-অবৈধ আকঁড়া যৌনাচার, যৌনতা-সংক্রান্ত কথাবার্তার যে প্রকাশ্য/গোপন অস্তিত্বটুকু ছিল, এই নতুন দাম্পত্যভাবনায় তার ছিটেফোটাও রইল না ৷ নব্য ভিক্টোরীয় নৈতিকতার প্রভাবে এই নতুন দাম্পত্যভাবনা থেকে যৌনতাকে যেন নির্বাসনে পাঠানো হল ৷ স্বামী-স্ত্রী দৈহিক সম্পর্ককে একধরনের নৈতিক সীমানার ভিতর আটকে রাখাই হয়ে দাঁড়াল এই সম্পর্কের প্রধানতম শর্ত ৷ কারণ, স্বামীকে উচ্চতর আদর্শের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যও স্ত্রীকেও ‘নীচ ইন্দ্রিয় সুখে’র কথা বিস্মৃত হতে হবে ৷ সমাজকে যৌন কলুষ থেকে মুক্ত করার প্রয়াসে সতীসাদ্ধী গৃহিণী নিজেকে শারীরিক স্পৃহাশূন্য হিসেবে গড়ে তুলবে, স্বামী-স্ত্রীর যৌনসম্পর্ক যেটুকু থাকবে তা-ও নিছক কর্তব্যের খাতিরে, মেয়েলি কথোপকথনের আদিরসাত্মক দিকগুলি সর্বদাই বর্জনীয়, এমনকি হিন্দু বিবাহবাসরে প্রচলিত রঙ্গ রসিকতাগুলিও অশ্লীলতার পর্যায়ভুক্ত ৷ স্বামীকে কর্তব্য সাধনের পথে এগিয়ে দেবার জন্য স্ত্রী নিজের শারীরিক সুখাভিলাষকে বর্জন করবে—এমনটাই ভেবে নেওয়া হতে থাকে ৷ অর্থাৎ শিষ্ট, শিক্ষিত সমাজে যৌনতা এক ঠান্ডা নৈঃশব্দ্যের এলাকায় স্থানান্তরিত হল ৷

পরিচারিকা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পতিব্রতা ও পাতিব্রত্য’ নামক রচনায় লেখক এই শারীরিক কামনাশূন্য আদর্শ গৃহিনীর স্বামীসেবার স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন—‘এই সেবার সঙ্গে যদি উচ্চ ধর্মের যোগ না থাকে, তাহা যদি শারীরিক ও সংসারিকভাবে হয়, তদ্দ্বারা পতির জীবনের উন্নতি ও কল্যাণ হওয়া দূরে থাকুক বরং প্রভূত অধোগতি ও অকল্যাণ হওয়ারই ভূয়সী সম্ভাবনা ৷ পত্নীর এরূপ সেবা-শুশ্রূষায় পতি অধিকতর সংসারাসক্ত ভোগানুরাগী ইন্দ্রিয়পরায়ণ হইয়া উঠিতে পারেন ৷’৫২

বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সহধর্ম্মিনী’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে ‘হিন্দুর যেমনি আহারে তেমনি বিহারে সেই ধর্ম্মকার্য্যই প্রধান কর্ম্ম হইয়া পড়ে ৷ তাই হিন্দুর বিবাহেও দাম্পত্য সুখ বা পতি-পত্নীর ইন্দ্রিয়সুখই প্রধান লক্ষ্য নহে—এবং হিন্দুপত্নীর প্রধান প্রতিশব্দ হিন্দুজাতি মধ্যে প্রণয়িনী নহে—সহধর্ম্মিনী ৷’৫৩ সমসাময়িক অপর একটি রচনায় বলা হয়েছে : ‘যাহার জীবনের মূলে ইশ্বরপ্রেম নাই, পবিত্রতা নাই, সাংসারিক বিলাসিতা ইন্দ্রিয়াভিলাষ অভিমানাদি জঘন্য ভাব বিরাজ করিতেছে, সে নারী পতিপরায়ণা হইলেও সতী নাম গ্রহণের কোনরূপ উপযুক্ত নহে ৷’৫৪

কিন্তু এইসব হাজারো লেখালেখি সত্বেও বাংলার সমাজের এক অতি ক্ষুদ্র শিক্ষিত অংশের বাইরে এই নব্য দাম্পত্য-আদর্শের প্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি ৷ বাঙালি সমাজের বিরাট অংশ তখনও পরিবার-গার্হস্থ্য-স্বামীস্ত্রী সম্পর্ক প্রভৃতি ক্ষেত্রে গতানুগতিক পুরোনো ধারাকেই বজায় রেখেছিল ৷ শতাব্দীর শেষদিকে পৌঁছেও তাই দেখা যায় বাবু কলকাতার গণিকাবিলাসে কোনো সাম্যন্যতমও ছেদ পড়েনি ৷ পরিবার এবং পরিবার-বর্হিভূত যৌনব্যভিচার কোনো অংশেই কমেনি ৷ সাধারণী পত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত ‘স্বামী বশীকরণ মন্ত্র’ রচনায় লেখক আক্ষেপ করেছেন : ‘লোকে স্ত্রী বর্তমানেও পরনারীর নিকট গমন করে কেন? বোধহয় বারবিলাসিনীদের নিকট যে সকল আমোদ লাভ করে স্ত্রীর নিকট তাহা পায় না বলিয়া ৷’৫৫ বস্তুত, শিক্ষিত অংশের মধ্যেও যে গৃহে সতীসাদ্ধী স্ত্রী রেখে (যাঁর সঙ্গে কেবল পুত্রার্থে মিলিত হওয়া যায়), ঘরের বাইরে কামকলা-পটিয়সী গণিকাসম্ভোগের বিপূল চল ছিল, তা এ সময়ের অসংখ্য নকশা-প্রহসন থেকে সম্যক বোঝা যায় ৷

এদিক থেকে এই নৈতিক দ্বৈতাচার ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডের নৈতিক দ্বিচারিতার সঙ্গে তুলনীয় ৷ একটি সমকালীন নাটকের চরিত্রের উক্তি : ‘স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপ সাতিশয় সুখোৎপাদক, কিন্তু পরনারী সম্ভোগ করে কোন ব্যক্তির স্ত্রী-সম্ভোগ ইচ্ছা করে?’৫৬ আবার কোনো কোনো রচনায় আদর্শ গার্হস্থ্য দাম্পত্য ও গণিকাবিলাসের ভিতর এক ধরনের সমন্বয় সাধনের ভাবনাও কাজ করেছে, বলা হয়েছে বারাঙ্গনা গমন করেও চারিত্রিকভাবে নিষ্কলঙ্ক থাকা যায় :

কোন কোন ব্যক্তির এইরূপ সংস্কার আছে যে, স্ত্রীবিয়োজিত বা অবিবাহিত পুরুষ যদি কাহারও নিষ্কলঙ্ক কুলে কলঙ্ক আরোপ না করিয়া বেশ্যালয় গমন করেন, তবে তাঁহার দোষ গ্রাহ্য হইতে পারে না ৷৫৭

—যদিও এধরনের যুক্তির গ্রহণযোগ্যতা, অন্তত তাত্বিক স্তরে খুব একটা ছিল না, তবু সামাজিক অভ্যাসের দিক থেকে দেখলে এটা ছিল এক ধরনের চালু যুক্তি ৷

শারীরিক কামনাবাসনাশূন্য দাম্পত্যের এক বিশিষ্ট নিদর্শন ব্রাহ্ম প্রকাশচন্দ্র রায় এবং অঘোরকামিনী দেবীর ‘দাম্পত্যের ব্রহ্মচর্য’ পালনের ইতিবৃত্ত ৷ এই সাধনার বিবরণ পাওয়া যায় অঘোরপ্রকাশ বইতে ৷ তিন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জন্মের পর, স্বামী-স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা আর শারীরিকভাবে মিলিত হবেন না ৷ কারণ, আর কোনো সন্তান তাঁরা চান না ৷ তার চেয়েও বড় কথা, অতিরিক্ত শারীরিক আসক্তি আধ্যাত্মিক দিক থেকেও মানুষকে বিচ্যুত করে ৷ তাঁরা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন, ৬ মাসের জন্য এক জন অপরজনকে স্পর্শ করবেন না ৷ কঠোর সংযমের মধ্য দিয়ে তাঁরা ওই দিনগুলিতে পারস্পরিক দৈহিক মিলন থেকে সফলভাবে দূরে থাকার পর সিদ্ধান্ত নেন, শারীরিক সংযমের এই প্রক্রিয়াটিকে সারাজীবন বজায় রাখবেন ৷ ১৮৯১ সালে তাঁরা ‘আত্মীয় বিবাহ’ বা আধ্যাত্মিক বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ হন ৷ শারীরিক সংযমের অভ্যাসকে দৃঢ় করতে তাঁরা আত্মপরীক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন ৷ স্বামী-স্ত্রী মস্তকমুন্ডন করে একত্রে ব্রহ্মচারীর জীবনযাপন করেন শেষ দিন পর্যন্ত ৷ প্রকাশচন্দ্র লিখেছেন :

আলিঙ্গন নিষিদ্ধ হইল ৷ গলা পর্যন্ত স্পর্শ বন্ধ হইল ৷ মুখ চুম্বনে সুখও হয় না, দুঃখও হয় না, এইরূপ হওয়া চাই ৷ অভ্যাসে ইহাও হইবে ৷৫৮

একই ধরনের যৌন সংযমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন মতিলাল রায় ৷ আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে স্ত্রী-সাহচর্য সবচেয়ে বড় অন্তরায়—এই বিশ্বাস থেকে তিনি নিজের স্ত্রীকে শারীরিকভাবে গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হতেন ৷ ১৯০৬ সালে মতিলাল চিরব্রহ্মচর্যের ব্রত গ্রহণ করেন কিন্তু শেষ অবধি সাফল্যলাভে ব্যর্থ হন, যদিও এই আচরণে তাঁর স্ত্রী আজীবন মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন ৷৫৯

৪.

আসলে, পরিবার-দাম্পত্য-গার্হস্থ্যভাবনার এই ‘ডিসকার্সিভ’ আলোচনা ও আদর্শায়ন-পক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকীয় ‘ভদ্রলোক’ সমাজে পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র নিজের সামাজিক ‘ক্ষমতা’ ও আধিপত্যকে জ্ঞান-যুক্তির আদলে, ‘আধুনিকতা’র মোড়কে পুনর্বিন্যস্ত এবং পুনঃস্থাপিত করেছিল ৷ ‘দাম্পত্য’-সংক্রান্ত লেখালেখির মধ্য দিয়ে আদর্শ স্ত্রীর যে মান্য চেহারা অঙ্কিত হয়েছে সেদিন, তা পুরোপুরি ‘লিঙ্গাত্মক’ দৃষ্টিকোণ এবং পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের ছাঁচে তৈরি ৷ এক্ষত্রে ব্রাহ্ম নব্যপন্থী এবং রক্ষণশীল হিন্দু—উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা যায় না ৷ উভয়েরই উদ্দেশ্য ছিল নারীর স্বতন্ত্র সত্তা ও বিশেষত যৌনসত্তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের রাখা ৷ ব্রাহ্ম পত্রপত্রিকায় আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য বিষয়ে মহিলা লেখকদের রচনাতেও অবিকল পুরুষতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হত ৷ বামাবোধিনী পত্রিকায় ‘নারীজীবনের উদ্দেশ্য’ শীর্ষক একটি ‘বামাগণের রচনা’য় বলা হয়েছে :

স্বামী কুরূপ, নির্গুণ, দরিদ্র যে প্রকারেরই হউন না কেন, স্ত্রীলোকের পূজনীয়; চিরকাল তাঁহার শুভাকাঙ্ক্ষীনী হইয়া আন্তরিক প্রীতিপূর্বক সেবা করতঃ কালাতিপাত করাই প্রধান কর্ম ও একান্ত প্রার্থনীয় ৷ পতিসেবাই গৃহকর্মের প্রধান অঙ্গ ৷ তাঁহার শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ কল্যাণ সম্পাদনার্থে সতত চেষ্টিত থাকিবে ৷ সতত ছায়ার ন্যায় অনুগামিনী হইয়া প্রিয়াচরণ দ্বারা তাহাকে সন্তুষ্ট করা আবশ্যক ৷৬০

এমনকি, ব্রাহ্ম পত্র-পত্রিকায়ও একান্নবর্তী যৌথ পারিবারিক ‘থাকবন্দে’র অঙ্গীভূত, পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিবেদিত-প্রাণ সতীসাধ্বী স্ত্রীর মহিমাকীর্তন করা হয়েছে ৷ আনন্দচন্দ্র সেনগুপ্তের লেখা গৃহিনীর কর্তব্য বইতে ‘পতির সুখ সন্তোষার্থে কি কি করিতে হইবে’, তার একটি বিস্তৃত ফর্দ পেশ করা হয়েছে ৷ বলা হয়েছে : ‘পতি কোন কারণে তোমার প্রতি রুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হইয়া ন্যায় কি অন্যায়রূপ তিরস্কার করিতে আরম্ভ করিলে, কিম্বা রাগত হইয়া কোনরূপ অন্যায় ব্যবহার করিলেও, তখন তাহা অম্লানবদনে সহ্য করিবে ৷’৬১ আর দাম্পত্যজীবনকে সুন্দর করে তুলতে, স্বামীকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে সহায়তা করার জন্য, আদর্শ স্ত্রীর নিজস্ব শারীরিক চাহিদাকে চিরতরে বিসর্ঝন দিতে হবে—ব্রাহ্ম লেখদের এই নৈতিক নির্দেশনামা এর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ৷

১৮৭২ সালের বিবাহ আইন মূলত ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে ও প্রয়োজনে পাশ হওয়ায়, বৃহত্তর হিন্দু জনসমাজে তার প্রভাব পড়েনি ৷ কিন্তু, ১৮৯১ সালে ‘এজ অব কলসেন্ট বিল’ পাশের মাধ্যমে মেয়েদের বিবাহের বয়স দশ থেকে সর্বনিম্ন বারো বছরে বেঁধে দেওয়া হলে হিন্দু সমাজ ব্যাপক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ৷ এমনকি ময়দানে জনসভা করে ইংলন্ডেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার কাছে এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় ৷৬২ ‘সহবাস সম্মতি’ বিল প্রত্যাহার করানোর জন্য যে যুক্তিগুলি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলি বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়, নারীর যৌনতার উপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া এবং নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার উৎকণ্ঠাই এর পিছনে কাজ করেছে ৷ হিন্দু সমাজে বিবাহিত মেয়েরা রজঃস্বলা হলে ‘গর্ভাধান’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের স্বামী সহবাসের অনুমতি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল ৷ কিন্তু, বাস্তবে বহু ক্ষেত্রেই এই রীতি মানা হত না, অর্থাৎ, প্রাক-রজোদর্শন পর্বে বহু বালিকাই স্বামীর দ্বারা ধর্ষিতা হত ৷ ১৮৯০ সালে ফুলমণি নামক একটি দশমবর্ষীয়া বালিকা তার স্বামী হরিচরন মাইতি দ্বারা ধর্ষিতা হবার ফলে মারা যায় ৷ এই ঘটনাই ‘সহবাস সম্মতি’ আইনকে বলবৎ করবার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছিল ৷ কিন্তু, হিন্দু লেখকেরা যুক্তি দেন রজঃস্বলা নারীকে যদি স্বামীসহবাসের জন্য দ্বাদশবর্ষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তবে হিন্দু ধর্মের বিশুদ্ধতা নষ্ট হবে ৷ এমনকি, সেক্ষেত্রে রজঃস্বলা মেয়েটির যৌন হিস্টিরিয়া, অসতীত্ব—প্রভৃতি বিপর্যয়মূলক ঘটনাও ঘটতে পারে ৷৬৩ শেষ অবধি ‘সহবাস সম্মতি’ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় পরিচালিত হয় এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক রাজনৈতিক বিক্ষোভের চেহারা পায় ৷৬৪ বলা হতে থাকে, স্বামী দ্বারা স্ত্রী ধর্ষণের প্রসঙ্গটাই অবান্তর, কারণ, বারো বছর বয়সের আগেই আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েই ঋতুমতী হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের ভিতর সেই ঋতুমতী মেয়েটির যৌনমিলন আমাদের দেশাচারে অতি সাধারণ ঘটনা ৷ ফুলমণির মত ব্যতিক্রমী ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনো সাধারণীকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না ৷

মেয়েদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, তা প্রায় সকল ব্রাহ্ম লেখকই মনে করতেন এবং এক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি হিন্দু রক্ষণশীলদের তুলনায় কিছুটা আলাদা হলেও সারবত্তায় এক ৷ যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবনরক্ষা (১৮৮৭), ভারতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুশ্রূষাপ্রণালী (১৮৯৬) প্রভৃতি সেক্স ম্যানুয়্যাল সূত্রে জানা যায়, ‘শিক্ষিত’ ব্রাহ্ম মেয়েদের তুলনায়, সনাতন হিন্দু পরিবারের ‘অন-আলোকপ্রাপ্ত’ মেয়েরা অনেক অল্প বয়সেই যৌনতা সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠত ৷ অন্নদাচরণ খাস্তগীর-এর পূর্বোক্ত বই থেকে জানা যায় হিন্দু মহিলাদের ভিতর হস্তমৈথুন একটি অতি সাধারণ অভ্যাস এবং এক্ষেত্রে তাঁরা ‘বার্ত্তাকু’ বা ‘বেগুনে’র মত সব্জি ব্যবহার করেন ৷ অন্নদারচণ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন মেয়েদের হস্তমৈথুনের কুফল এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে ৷ আসলে ব্রাহ্ম লেখকেরা সনাতন হিন্দু পরিবারকে ‘কলুষমুক্ত’ করার ঘোষিত উদ্দেশ্যেই যেন ভিক্টোরীয় ‘পিউরিট্যানিজম’ এবং ব্রাহ্মণ্য ব্রহ্মচর্যকে একত্র করে এক নতুন যৌননৈতিকতার জন্ম দিয়েছিলেন ৷ তাঁদের চোখে হিন্দুর সনাতন বিবাহপদ্ধতি এবং বৈবাহিক সম্পর্ক অনেক বেশি যৌন আসঙ্গলিপ্সা ও আসক্তিমণ্ডিত বলে মনে হয়েছিল ৷ প্রিয়দাস সরকার লিখিত একটি স্ত্রীপাঠ্য পত্রলিখনশিক্ষার বইতে সনাতন পরিবারে হিন্দু স্ত্রীর স্বামীকে লেখা চিঠিতে কামবাসনামূলক অংশগুলি বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং উপদেশ দেওয়া হয়, এধরনের পত্ররীতি সম্পূর্ণ পরিহার করার ৷৬৫ এভাবেই ব্যক্তি, পরিবার, দাম্পত্যের নব্য ডিসকোর্স একধরনের সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের আধারে ব্যক্তির স্বাধীন যৌন অভিব্যক্তি, বিশেষত মেয়েদের যৌন আচরণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে সেদিন ৷৬৬

৫.

অর্থাৎ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই, শিক্ষিত বাঙালির ‘ভদ্রলোক’ চৈতন্যে, ‘প্রাইভেট’/‘পাবলিক’ সংক্রান্ত ভিক্টোরীয় ধারণা কার্যকররি হতে শুরু করে ৷ এই ধারণাটিকে আমরা বলতে পারি জীবনযাপনের পদ্ধতি-সংক্রান্ত আদর্শায়িত নৈতিক ধারণা ৷ যৌননৈতিকতাও এই সদর-অন্দর বিভাজনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত ৷ এ পর্যন্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখাতে চেয়েছি গৃহাভ্যন্তরের যৌননৈতিকতা ও গৃহের বাইরের যৌন আচরণ/কাম্য আদর্শ-সংক্রান্ত মান্য বিধিসমূহ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই, অন্তত ‘ডিসকার্সিভ’ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হতে শুরু করে ৷ কিন্তু, ‘সান্দর্ভিক’ স্তরে আমরা বিষয়ের যে ব্যাখ্যা দিই, আর বাস্তবে সমাজ যে পথে চলে, তার ভিতর বিস্তর ফারাক থাকতে বাধ্য ৷ বিশেষত, উচ্চবর্গীয় ‘শিক্ষিত’ সমাজের মুষ্টিমেয় অংশকে বাদ দিলে বৃহত্তর জনসমাজে যৌনতার ‘ডিসকার্সিভ’ নৈতিকতার খুব একটা প্রভাব যে উনিশ শতকের শেষ অবধিও পড়েনি, তা বোঝা যায়, উনিশ শতকের তথাকথিত ‘শিষ্ট’ সাহিত্যের বাইরে অপেক্ষাকৃত বড়ো পরিসরে প্রচলিত সাহিত্য, অর্থাৎ, নাটক, নভেল, প্রহসন, সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত জনপ্রিয় চটি বই, প্রচারপুস্তিকা ইত্যাদি পড়লে ৷ আত্মদাম্পত্য/পরিবার, যৌননৈতিকতার সর্বমান্য গড়ন—ইত্যাদি সম্পর্কিত ‘উচিত, অনুচিত’ ক্ষেত্রবিভাজনের ধারণাটিকে বারবার ওলটপালট করে দিচ্ছে এইসব টেক্সট ৷ অন্ত্য-আঠারো শতক থেকে শুরু করে সমগ্র উনিশ শতকব্যাপী কলকাতা, ঢাকা সহ বাংলার শহর-মফসসলগুলিতে গণিকাবৃত্তি একটি সংগঠিত পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ৷ বেশ্যাসংস্কৃতি, বেশ্যা-ভদ্রলোক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক, উভয়ের সংযোগ, বিতৃষ্ণা, টানাপোড়েন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি মূল্যবান গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ৷৬৭ আলোচনার শেষাংশে আমরা এমন কয়েকটি রচনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করব যেখানে উনিশ শতকীয় যৌনতার বহিরাঙ্গিক উপাদানগুলি অন্তরঙ্গ পারিবারিক উপাদানের ভিতর মিলেমিশে রয়েছে ৷ এর মধ্য দিয়ে যৌনতার অন্দর/সদর পরিসরের পার্থক্যকরণ-সংক্রান্ত ধারণাটিও সমস্যায়িত হয়েছে ৷ ইতিহাসগতভাবে আমরা জানি, উনিশ শতকের কলকাতার গণিকাপল্লীতে এক বিরাট সংখ্যক মহিলা আসতেন উচ্চবর্ণীয় পরিবার থেকে ৷ বিশেষত, কৌলিন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি কারণে সেদিন সুস্থিত সামাজিক দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি হত না ৷ কুলীন পরিবারের মেয়েদের ব্যভিচারিণী হবার বাস্তব কারণ ছিল ৷ সমসাময়িক, অধুনা দুষ্প্রাপ্য একটি পত্রিকায় জনৈক কুলীন পরিবার থেকে আগত পতিতার বয়ান চিঠির আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ চিঠির শিরোনাম : ‘এদেশীয় স্ত্রীলোকের ব্যভিচারের কারণ’ ৷ এই চিঠির নীচে স্বাক্ষর : ‘কলিকাতা নিবাসিনী বেশ্যা’ ৷ চিঠির কিয়দংশ এই রকম :

আমি শান্তিপুর নিবাসী এক কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা ছিলাম, আমার শৈশবকাল বাল্যক্রীড়ায় অতিবাহিত হইয়া যৌবনের প্রারম্ভ হইল, তথাপি পিতা-মাতা বিবাহের উদ্যোগ করেন না; ইহাতে একদিন আমি প্রতিবেশিনী কোন রমণীর নিকট এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া অবগত হইলাম, যে তিন বৎসর অপেক্ষাও অল্প বয়ঃক্রমকালীন আমার বিবাহ হইয়াছে ৷ এই বাক্য শ্রবণমাত্র আমি একেবারে স্তব্ধ রহিলাম ৷ পরন্তু যখন আমার ষোড়শবর্ষ তখন কোন দিবস অপরাহ্নে পঞ্চাশবর্ষবয়স্ক একজন মানুষ আমাদিগের গৃহদ্বারে উপস্থিত হইলে এবং পরিচয় পর্ব দ্বারা জানা মাত্র অন্তঃকরণ কম্পিত হইল ৷ লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষোভ, সংশয় প্রভৃতি ভাবের এ-প্রকার অন্দোলন হইয়াছিল, যে আমি আর লোকসমাজে মিশ্রিত হইবার অভিলাষ একেবারে ত্যাগ করিয়াছিলাম ৷ তাঁহার কুৎসিত আকৃতি, গলিত অঙ্গ এবং পক্ককেশাদি দর্শন করিয়া আমি হতবুদ্ধি হইয়াছিলাম ৷ আমি জ্ঞানতঃ তাঁহাকে বরণ করি নাই, কদাপি তাহার সহিত কানাঘুষায় সাক্ষাৎ নাই, তাহার সহিত আমার মনের ঐক্য বা প্রণয়ের সঞ্চার হয় নাই অথচ তিনি আমার পতি, আমার সুখের মূলাধার, কি আশ্চর্য, তাঁহার মূর্তি যেমন কুৎসিত, রজনীতে তাঁহার ব্যবহারও তদ্রুপ প্রত্যক্ষ হইল ৷ যাহা হউক, তিনি পরদিন প্রাতঃকালে আমার পিতার নিকট কিঞ্চিৎ ধন সংগ্রহপূর্বক সেই যে প্রস্থান করিলেন, সেই পর্যন্ত আর দর্শন হয় নাই ৷ একে আমার যৌবনোদ্যম, তাহাতে এপ্রকার বিড়ম্বনা সকল সংঘটিত হওয়াতে যেরূপ যাতনা বোধ হইল বিশেষতঃ জীবনের সুখ যে পতিসম্ভোগ, তাহাতে এককালীন বঞ্চিত হইয়া অন্তঃকরণ যে প্রকার অস্থির হইল, তাহা কি বলিব ৷ মাসাবধি দিনরাত্রি কেবল ক্রন্দন করিয়াছি ৷ যদিও আমার নিতান্ত চেষ্টা ছিল সৎপথে রহিব এবং কুলধর্ম রক্ষা করিব কিন্তু অবশেষে জ্বালাতন হইয়া ব্যভিচারের পথকে অবলম্বন করিয়াছি এবং স্বাধীন মনে কলিকাতায় আগমন পূর্বক মেছোবাজার বাসিনী হইয়াছি ৷ … আমি এ স্থলে বসতি করিলে আমার কনিষ্ঠা ভগ্নীও স্বামীর সহিত অনৈক্য এবং বিবাদ করিয়া গত বৎসর আমার সহবাসিনী হইয়াছেন ৷ তদ্ব্যতীত আমার বাল্যকালের বিংশতি জন সঙ্গিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে তাঁহারা আমার ন্যায় কলিকাতার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অধিবাস করিতেছেন ৷৬৮

চিঠির নীচে ‘কলিকাতা নিবাসিনী বেশ্যা’-র স্বাক্ষর থাকলেও, আমাদের অনুমান, এটি আসলে কোনো ‘ভদ্রলোক’ ব্যক্তিরই লেখা ৷ আসলে এধরনের সামাজিক অনাচারের ছবি তুলে ধরার পাশাপাশি এই লেখাগুলির মধ্য দিয়ে দাম্পত্য-পরিবার-যৌননৈতিকতা সম্পর্কিত পূর্বোক্ত ‘ডিসকার্সিভ’ ব্যাখ্যাই উল্টোভাবে সমর্থিত হচ্ছে ৷ এই সামাজিক ছবিগুলিকে সর্বদাই দেখা হচ্ছে কাম্য নৈতিক কাঠামোর বিচ্যুতি হিসেবে ৷ পরবর্তী অংশে যে টেক্সটগুলি আলোচিত হবে, সেখানেও বিবিধ দাম্পত্য ও পারিবারিক যৌন অনাচারের ছবি থাকলেও, মনে রাখতে হবে এগুলি কোনোভাবেই শালীন ‘ভদ্রলোকী’ নৈতিকতায় অন্তর্ঘাত নয়, বরং এগুলি আসলে ওই বিদ্যমান, প্রতিষ্ঠাকামী যৌনতার ডিসকোর্সেরই সম্প্রসারণ, এগুলি ওই ‘ডিসকার্সিভ প্র্যাক্টিস’-এর যৌক্তিক প্রয়োজনীয়তাকেই জাহির করছে ৷

তারকচন্দ্র চূড়ামণি-র লেখা সপত্নী নাটক প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে ৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কৌলিন্যপ্রথা ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে, বিধবাবিবাহের সপক্ষে যে সামাজিক আন্দোলন শুর হয়, সেই পর্যায়ের ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায় এই নাটকে ৷ ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুলসর্ব্বস্ব প্রকাশের পর কৌলিন্যপ্রথা, সপত্নী-সমস্যা সংক্রান্ত সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে যে নাটকগুলি রচিত হয়েছিল তারকচন্দ্র চূড়ামণির নাটক তার অন্যতম ৷ এই নাটকে কুলীন ব্রাহ্মণ জয়শঙ্কর ও রমাকান্ত বিদ্যাবাগীশের অন্তঃপুর চিত্রিত ৷ জয়শঙ্করের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভূধর বাল্যবয়সে সৌদামিনীকে বিবাহ করেছিল, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী হয়ে উঠেছিল তার চক্ষুশূল ৷ তার এই মানসিকতায় ইন্ধন যুগিয়ে চলেছেন ভূধরের মা হরিপ্রিয়া ও পিতৃগৃহে বসবাসরতা কুলিন বিবাহিতা বোন হরমণি ৷ ভূধর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করতে চায় এবং স্ত্রীর মানসিক যন্ত্রণাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে ধূমধামের সঙ্গে আবার বিবাহ করে ৷ রামাকান্ত বিদ্যাবাগীশ নিজের কৌলিন্য বজায় রাখার জন্য নিজের তিন মেয়ে কাদম্বিনী, নিতম্বিনী ও চঞ্চলার বিবাহ দিয়েছেন এক বৃদ্ধ কুলিনের সঙ্গে ৷ ফলত, বিবাহিত হওয়া সত্বেও তিন বোন স্বামীসঙ্গবঞ্চিতা, তাদের অতৃপ্ত দৈহিক ও মানসিক বাসনা বারবার প্রকাশিত হয়ে পড়েছে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ৷ নাটকের শুরুতে তিন বোন সৌদামিনীর শয়নকক্ষে উঁকি মারে এবং ভূধর-সৌদামিনীর কথোপকথন শোনে ৷ ভূধরের কৃত্রিম প্রণয়বাক্য শুনে নিতম্বিনীর অতৃপ্ত হৃদয় বলে ওঠে :

বাবাকে আর বলবো কি? একটা পরমান্নচাটা বায়াত্তুরে নেশাখোরের হাতে পড়েও জন্মকালটা বৃথা নষ্ট করলাম বোন ৷ … যার লক্ষ্মীশ্রী না থাকে, সে কি কথন স্ত্রী কেমন সামগগিরি তা চিন্ত্যে পারে? দেখলি নে ভাই ৷ দাদার মুখখানি এককালে যে তুলসীপাত হয়ে গেলো না, যেন হেদিয়ে পড়ে গেলেন ৷৬৯

—এই কথার ভিতর অতৃপ্ত বাসনার ইঙ্গিত পেয়ে বোন চঞ্চলা ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে :

দিদি! শুনলি, নিতু যেন এককালে খেপ্যে উটলো মা, ওর আগুন জ্বল্যে উঠেছে ও আর থাকতে পারে না, ও মা! চেনা দায় ৷ নিতু তো সামান্যী মেয়ে নয় ৷ এখনি কি বলতে কি বলে, না জানি আবার কবে কি কত্তে কি কর্যে বসে দেখ ভাই! ছি ছি! ওমা! যাব কোথা মা! কি পোড়া? আর মর! ও ছুঁড়ি! ও গো! ও যে দাদা হয় লো! ও কি বলিস! দিনে কেন সিঁধ, না খেঁচকা ভারী, এ যে তুই তাই কল্লি লা!

কিন্তু কুলীন পরিবারগুলির ভিতরেই যে চলত যৌন ব্যভিচার, তা বোঝা যায় ওই তিন বোনের সঙ্গে পিতা রমাকান্তের ছাত্র কামদেবের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক এবং নিরুপায় পিতামাতার তাতে প্রশ্রয় দেবার মধ্য দিয়ে ৷ বিশেষত, ছোটোবোন চঞ্চলা যে একটু পুরুষর-ঘেঁষা স্বভাবের, তা প্রকাশ করে দেয় বড়ো বোন কাদম্বিনী :

বাপের বাড়ী, দিন রাত তো বাছ নেই ৷ সারা বেলা এ বাড়ী ও বাড়ী করে বেড়াস, কেবল রঙ্গ নিয়ে থাকিস বৈ তো নয়? সব হল সম্পক্ক ভাল, পাড়ার সব পুরুষগুলো, কেউ হলো দাদা, কেউ হলো ভাই, কেউ হলো জ্যেঠা, কেউ হলো খুড়ো, কেউ হলো ভগ্নীপোত, কেউ হলো ঠাকুরদাদা, হলো খুড়ো, কেউ হলো ভগ্নীপোত, কেউ হলো ঠাকুরদাদা, কেউ হলো মকর বাপ, কেউ হলো পড়ো দাদা, আর কতো বলবো… পাড়ার সকল ছোঁড়াগুলোও হলো এই রকম সম্পক্ক ভাল, কারু কাছে যেতে তো লজ্জা হয় না? কারু সঙ্গে কতা কইতে তো সরম কত্তে হয় না? নোকে দেখলেও তো কলঙ্কের ভয় নেই? তা, কি করে জ্ঞান শিখবে বলো, এত পুরুষঘেঁষা হলে তার আর কি আগঢাক থাকে, না ভাগ্যিস আছে?

সন্ধ্যের পর বাড়িতে ফিরে মেয়েদের দেখতে না পেয়ে রমাকান্ত বিদ্যাবাগীশের প্রতিক্রিয়া : ‘অন্ধকার রাত্রি পাইলে সন্ধ্যার পর মেয়েগুলোর আর টিকি দেখতে পাওয়া যায় না ৷’ তখন বাড়ির দোতলায় তাঁর তিন মেয়ে ‘পড়ো দাদা’র সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে ৷ ভ্রমবশত, রমাকান্ত মেয়েদের খোঁজে দোতলায় উঠতে গেলে গৃহিনী হরমোহিনী তাঁকে ভর্ৎসনা করেন :

আবার ওদিকে যাচ্ছ কোথা? আ মরণ! দেখ্যে দেখ্যে যে হাড় কালি হলো, জ্বল্যে জ্বল্যে মল্যেম, আর বাঁচিনি! … রোজ রোজ কি এই এক পোড়া, জেন্যেও কি জান না গো! না বল্যে না কয়্যে একটা ঢং করে উপরে যাচ্ছ কেন? এই এদিকে এসো, ঘরকন্না কত্তে গেলেই সব দিকে একটুকু আঁখচার কর্যে চলতে হয়, বিশেষে আমাদের কুলীনের ঘর ৷ … উপরে যে কামদেব ৷ … তার কি আর বাড়ী যাওয়ার জো আছে, এমন রাসনীলে আর কোথা পাবে বল?

সৌদামিনীর স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে আনলে স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে সে ৷ ইতিমধ্যে এক পারিবারিক গুরুদেব রসিককৃষ্ণ গোস্বামী তার ননদ ও শাশুড়ির প্রশ্রয়ে বাড়িতে আশ্রয় নেয় ৷ শাশুড়ি মন্ত্র নেবার অছিলায় বড়ো বছ সৌদামিনীকে গুরুদেবের কাছে পাঠায়, গুরুর শারীরিক লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য ৷ সৌদামিনী এই আচরণের বিরোধিতা করে এবং মনোদুঃখে বলে ওঠে : ‘উনি আজ চারদিন হলো আমাকে মন্তর দিয়েছেন … এখন আবার রোজ রোজই যে কত রকম মন্ত্র দেন, তা আর বলবার নয় ৷ আমি সব বুঝেছি মা! আমার অমন ধম্ম কম্মে কাম নি! … আমার হাতেমালা পোঁদে খোলা তো দিয়াছেনই, আবার কেন পরকালটি নষ্ট করতে বসলেন!’ নাটকের শেষে সৌদামিনী আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে ৷

কিন্তু সৌদামিনীর শাশুড়ি হরমণি ও ননদ হরিপ্রিয়া ওই পারিবারিক গুরুর কাছে শাস্ত্র অধ্যয়নের অছিলায় অতৃপ্ত কামনার জ্বালা মেটায় ৷ মা হরমণি এ বিষয়ে মেয়েকে সরাসরি পরামর্শ দেয় :

(গোঁসাইকে) দেখলে চক্ষু জুড়োয়! এই যে আমি তাঁকে নিয়ে কত রাত্রি পর্য্যন্ত কত মন্তর শিখি; কত উপকথা কই, তাঁর মুখের পানে চেয়েও কত শাস্তরের কথা শুনি; এত কি ভাঁড়ুয়ে থাকি? কর্ব্বো কি বল? ‘খাট ভাঙ্গিলেই ভুঁই শয্যা’ ডাকের কথাই পড়ে রয়েছে; তা হলেই কি এত ঢলাতে হয় গা! না, এত লোক হাসাতে হয়! আমরাও তো সব হলাম কুলীনের মাগ; স্বামী কেমন সামিগ্রী, কাল কি ধল ভাল করে চক্ষেও দেখি নে! আমরা কি আর পোঁদে কাপড় দিই না গা? না কাল কাটাই না!

প্রসন্নকুমার পালের লেখা বেশ্যাসক্তিনিবর্ত্তক নাটক প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে ৷ নাটকের নাম বেশ্যাসক্তিনিবর্ত্তক হলেও এটি বেশ্যাপল্লী বা বেশ্যা-ভদ্রলোক সম্পর্ককেন্দ্রিক কোনো নাটক নয় ৷ উনিশ শতকীয় পারিবারিক জীবনে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্যসম্পর্কহীনতা ও নারী-পুরুষ উভয়ের অবৈধ সম্পর্কের ক্ষতিকর পরিণাম প্রদর্শনকারী একটি নীতিশিক্ষমূলক নাটক এটি ৷ নাটকের শুরুতেই কাদম্বিনী ও শশিমুখীর কথোপকথন ৷ শশিমুখীর স্বামী একরাতও ঘরে থাকে না, বিবাহের পর থেকে স্ত্রীকে এক রাতও সঙ্গ দেয়নি তার স্বামী শ্যামাচরণ ঘোষ ৷ কাদম্বিনীর স্বামী, তারই জবানিতে, ‘কেশোরোগা বুড়াটি সে, আমার যে পতি/সারা নিশি কেশে কেশে, ওটা, বসা আছে ৷’ আর তাই কাদম্বিনীর আক্ষেপ : ‘এ পতির সহবাসে, কোন মতে সুখ?/একপাশে পোড়ে থাকি, ফেটে যায় বুক ৷/পতিকে দুর্বল দেখে দুরন্ত মদন ৷/কুসুমের শরাঘাতে করে জ্বালাতন ৷ ৷’৭০ ছিদামচাঁদ ঘোষের বিবাহিত কন্যা বিনোদিনী বাপের বাড়িতে থাকে ৷ পিতা জামাইষষ্ঠীতে আনতে চাইছেন জামাইকে ৷ অবশেষে জামাই মদনকৃষ্ণ এসে উপস্থিত হয় ৷ স্ত্রী বিনোদিনীকে সে এতটুকু পছন্দ করে না ৷ বিনোদিনী আবার শশিমুখীর ননদ ৷ জানা যায়, দীর্ঘদিন যাবৎ শশিমুখীর সঙ্গে ননদের স্বামী মদনকৃষ্ণের অবৈধ গোপন সম্পর্ক রয়েছে ৷ শশিমুখী মদনকে বলে : ‘জ্বলিতেছি দিবানিশি বিরহ দহনে ৷/দিন দিন তনু ক্ষীণ হতেছে সদনে ৷ ৷/… এ রোগের বৈদ্য নাই পাই কোনো জন ৷/হাতযশ কামরসে অতি বিচক্ষণ ৷ ৷’—একথা শুনে মদনের প্রত্যুক্তি :

ডিপ্লোমা পেয়েছি আমি মদনের কাছে ৷

বল দেখি মোর সম বৈদ্য কেবা আছে?

পিরীতি-নিদানে আমি হয়েছি পন্ডিত ৷

উত্তম ঔষধে সুস্থ করিব তুরিত ৷ ৷

এরপর মদন সিদ্ধান্ত জানায়—সে শশিমুখীকে ঘর থেকে বের করে মেছোবাজারে বাড়ি ভাড়া করে রাখবে ৷ শশির উন্মাদনার ভাব দেখে সখী কাদম্বিনী সব বুঝতে পারে ৷ শশি তাকে সব বলে ফেলে ৷ এদিকে মদন হর গোয়ালিনীর সাহায্য নেয় শশিকে বের করে আনতে ৷ হর গোয়ালিনীর বাড়িতেই গোপন মিলনস্থান নির্ধারিত হয় ৷ শশি অনুতাপ করে, তার স্বামী যদি কু-স্বভাব না হত, তবে তাকে এ দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হতে হত না ৷ কিন্তু, হর-র বাড়ি থেকে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে পালাতে গিয়ে শশিমুখী ও মদন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ও তাদের হাজতবাস হয় ৷ এ সময় শশির স্বামী শ্যামাচরণ ছিল বেশ্যা গোলাপের বাড়িতে, তাকে স্ত্রী হাজতবাসের খবর দেওয়া হল, সে বলে ওঠে :

যেতে দাও গে, য়্যাকটা রাঁঢ় বেড়েছে, আমি এখন এ গররা ছেড়ে যেতে পাল্লেম না ৷

—আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে শশিমুখী বলে সে স্বেচ্ছায় হর গোয়ালিনীর কৌশলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ৷ সে এও কবুল করে : ‘না সাহেব, আমি আর বাড়ি যাবো না, তা হলে আমাকে বড় যন্তন্না দেবে ৷’

প্রতিবেশী বলরাম ঘোষেদের অন্তঃপুরে তখন নিন্দামন্দ, কানাঘুষো চলছে—‘ও পাড়ার ঘোষেদের বৌ যে বেরিয়ে গ্যাছে ৷’ শশিমুখীর আচরণের অনুরূপ বাসনা যে আরও অনেক মেয়ের মনেই রয়েছে তা বোঝা যায় মোহিনীর উক্তিত :

একান্তই যদি তার ইচ্ছা হয়ে ছিল ৷

ঘরে বসে চুপি চুপি কেন না করিল ৷ ৷

কার ঘরে আছে বল, সতী সাধ্যা মেয়ে ৷

কে কোথা কি করে থাকে, কেবা দেখে চেয়ে ৷ ৷

আমরাও মেয়ে বটে, থাকি মোরা কুলে ৷

ভিতরে যেমন হোক, লোকে ভাল বলে ৷ ৷

বোঝা যায়, সমকালীন পরিবারগুলোয়, আরো অনেক শশিমুখীর অস্তিত্ব ছিল, প্রকাশ্যে বা গোপনে ৷ নাটকের শেষে, আমরা দেখি, শশিমুখী বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে ৷ এখন সে বিগতযৌবনা, কাইমুদ্দি মাঝি এসেছে তার সঙ্গ ভিক্ষা করতে ৷ শশিমুখীর খেদোক্তি :

যত দিন ছিল মম, এ যৌবন শশী ৷

মিষ্টভাবে অনেকে তুষতো, সদা আসি ৷ ৷

এখন হয়েছে সেই শশী অবসান ৷

মাঝি মাল্লা অবধিও, করে অপমান ৷ ৷

হরিশ্চন্দ্র মিত্র ওরফে ব্যোমকেশ বাঙ্গাল-এর ঘর থাক্তে বাবুই ভেজে-র প্রকাশকাল ১৮৬৩ ৷ এই ক্ষুদ্রায়তন প্রহসনটিরও ষিয়বস্তু পারিবারিক জীবনে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কহীনতা, অন্তঃপুরে স্বামীসঙ্গবঞ্চিতা স্ত্রীদের বিলাপ, ঘরের বউ ফেলে পুরুষদের বাহ্যিক আকর্ষণসম্পন্না বারাঙ্গনার প্রতি আসক্তি ৷ নাটকের শুরুতে মোহনবাবুর বৈঠকখানায় তিন ইয়ার মোহনবাবু, হঠাৎবাবু ও মাখনবাবু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, কীভাবে এক গেরস্ত ভদ্রলোক নিজ পুত্রের বারফটকা স্বভাব পাল্টানোর জন্য পুত্রবধূকেও বেশ্যার মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে ছেলের সামনে পাঠাত ৷ হঠাৎবাবু আক্ষেপ করে, যদি সেও নিজের বাড়ীতে অমন ‘লেবর্টীহল’ পেত তবে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গদান করত ৷ ইতিমধ্যে রসিকবাবু বলে ওঠে :

ভাই ঘরে যে ঠাকরুণ আছেন তার না আছে কথার ছেনালি, না আছে পোষাকের বিউটি, না আছে গাওনা বাজনার টেস্ট ৷ আহা! তার কথার শ্রী শুনলে, মনের আমোদ হওয়া চুলোয় পড়ে থাকুক, ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বলে ওঠে, আড়াই গজের ঘোমটা সর্বদা মাথায় নরর নরর করছে! দেখ ভাই, আমরা সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে এসে চারদন্ড যে জুড়াবো, তাও যদি না পারবো তবে প্রাণ ধারণ করব কেমন করে?৭১

প্রত্যুত্তরে হঠাৎবাবু বলে : ‘ভাই আমরা কি সাধে আপনার ওয়াইফকে গচিনে? আপনার দশজন ফ্রেন্ড, যারা প্রাণের প্রাণ, ওয়াইফের সঙ্গে তাদের নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করা দূরে থাক, একবার দেখানোরও যো নাই ৷ একি এয়ারের প্রাণে সহ্য হয়?’

উল্টোদিকে, রসিকবাবুর অন্তঃপুরে স্ত্রী প্রমীলা ও সখী যামিনীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, তারাও তাদের স্বামীদের নিয়ে কতোখানি অতৃপ্ত ৷ যামিনী বলেছে :

বুন, ওদেরত তাই ইচ্ছে, তা তোমার কোন গন (গাউন) পরে গাড়ী চড়ে তাদের সাথে বাগানে ‘ বেড়িয়ে বেড়াতে পারবে আর সকল পুরুষদের সঙ্গে এয়ারকি দিতে পারবে? যদি এসব কত্তে পার তো ভাতারও গচে এখন, তা বাঙ্গালী মেয়েরা তো আর এসব কত্তে পারে না ৷

তীব্র প্রতিবাদ করে প্রমীলা ৷ সে বলে ওঠে :

আগে ওঁরা যথার্থ সাহেব হোন, তারপর যেন আমাদিগে বিবি করে তোলেন ৷ আপনারা সাহেবদের মত এমন কি কাজ করেছেন? বলে ‘কাজের মদ্যে দুই, খাই আর শুই’—কেবল পাতি সাহেবদের মতো মদ খাচ্ছেন, আর বেরেল্লামো করে ফিরছেন ৷… যথার্থ সাহেব হতে অনেক ডাল-চাল লাগে ৷

যামিনী বলে, কৌলিন্য প্রথা বজায় রাখতে গিয়ে পিতা অতি বাল্যবয়সে তার বিবাহ দিয়েছিলেন ৷ স্বামীর সঙ্গে তার কখনোই মনের মিল হয়নি ৷ তার কথায় : ‘ভাতার যদি মনের মত না হবে, তবে কুল দিয়ে কি ধুয়ে জল খাবে? … স্ত্রী-পুরুষের মনে-প্রাণে যে মেল সেই মেলই মেল ৷ কুল-শীল বাপের সাধ্যি নাই, যে সে মেল করে দিতে পারে ৷’—এখানে অখ্যাত প্রহসনকারের কলমেও নব্য দাম্পত্যের ডিসকোর্স কাজ করে যাচ্ছে ৷

নাটকের শেষে পৌঁছে দেখা যায়, প্রমীলা শ্বশুরবাড়ির যাবতীয় লাঞ্ছনা সহ্য করছে ৷ রসিকবাবুর পিতা ছেলের বিপথগামিতায় হা-হতোস্মি করছেন ৷ সে নিজের স্ত্রীর গয়না ছিনিয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে ৷ মাতাল অবস্থায় সারা গায়ে ময়লা মেখে থানায় আটক রয়েছে সে ৷ পুলিশের সার্জেন্ট তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে ৷ এর আগে বাড়িতে স্ত্রীকে মারধর করেছে সে ৷ পিতা মাধববাবুর মতে যৎসামান্য ইংরেজি শিক্ষা পেয়েই বিগড়েছে তার ছেলে ৷ শেষ দৃশ্যে নসীবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বেশ্যা বুঁচীর বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে রসিক ৷

হরিমোহন কর্ম্মকার রচিত মাগসর্বস্ব (১৮৭০) নাটকে রমাকান্ত মন্তব্য করেছিল: ‘এই পাড়ার কতকগুলো আহাম্মকদের কথা সর্ব্বদাই শুনতে পাই, যে তারা রাঁঢ় নিয়েই আমোদ প্রমোদ করে থাকেন, কিন্তু মেগের সঙ্গে ভাসুর ভাদ্রবৌ সম্পর্ক ৷… আরে ব্যাটারা বাইরে লোচ্চাম করতে যাস, সমস্ত রাত কাটিয়ে আসিস; বাড়িতে তোদের মাগকে ঠান্ডা করে কে? তারাও তো লোচ্চা খুঁজে বেড়ায়?৭২ মাগসর্বস্ব’-র রমাকান্ত বুড়ো বয়সে বিবাহ করে স্ত্রীর দাসানুদাস হয়ে পড়ে, নিজের মা এবং বিধবা বোনকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার উপক্রম করে, শেষাবধি স্ত্রীর হিরের গয়নার দাবি মেটাতে অফিসের ক্যাশবাক্স ভাঙার পরিকল্পনা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ৷ স্ত্রী রাজলক্ষ্মী তাকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাবার উপক্রম করলে স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন :

রমা : অ্যাঁ! বৌ তুমি বাপের বাড়ী যাবে ৷ তবে আমার উপায় কি হবে?

রাজলক্ষ্মী : কেন, যার অমন রাঁঢ় বোন বাড়ীতে, তার আবার ভাবনা?

রমা : বৌ, তবে বুঝি তোমার বাপের বাড়ীতে তোমার মাগ-মরা ভাই-টাই আছে?

প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু, অর্থাৎ পুরুষের দুর্বলচিত্ততা, স্ত্রী কাছে বশ্যতাস্বীকার ও সেই সুযোগে গৃহবধূদের ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া নিয়ে বেশ কিছু প্রহসন লেখা হয়েছিল উনিশ শতকে ৷ অম্বিকাচরণ গুপ্ত-র লেখা কলির মেয়ে ছোট বৌ ওরফে ঘোর মুর্খ নাটকেও স্বল্পশিক্ষিত অহংকারী স্ত্রী স্বামীকে বশ করে, পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হয় ৷ ছোটো বউ সারদা তার স্বামীকে ভেড়া বানিয়ে রেখেছে ৷ সোনাদাসীর সঙ্গে সারদার কথোপকথন :

সারদা : সোনা, কাল সন্ধ্যার সময় ছাতের উপর থেকে যে বাবুটিকে দেখলেম তাকে আনতে পাল্লিনি?

সোনা : সে কি দিদিঠাকরুণ—সবে কাল সন্ধ্যেবেলা দেখলে—পারবো না কেন? দেখ, তারা চাকরে বাকরে লোক—১০টা থেকে ৪টা আপিসে থাকে, তাদেরও পরিবার আছে, তাদেরও মন রাখে, আবার বাইরেও চড়ে বেড়ায় ৷

সাদরা : দেখ সোনা, সকল চেয়ে হেমবাবু সরেশ লোক—কেমন মিষ্টি কথাগুলি ৷

সোনা : সাধে রাগ হয়, বছর ফেরেনা, কত কাণ্ডই কল্লে, ভ্যালা মেয়ে যাহোক, ইরি মধ্যে কত লোকের যে সুখ্যাতি কল্লে, কত লোকের কথা বলতে মুখে যে লাল পড়ছে, আবার কত লোককে যে কাঁদাচ্চ, কত লোককে পথে পথে ফেরাচ্চ তা তো আমি গণে ঠিক কত্তে পাচ্চিনি ৷ আজ যাকে ভালো বলছো—কাল সে কুচ্ছিত হয়ে যাচ্ছে, আর তাকে মনে ধরচে না ৷ গেরস্ত ঘরের মেয়ে—সোয়ামীর মাগ হয়ে, কি সাহস ধর বল দেখি ৷৭৩

এই কথায় সারদার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সোনাদাসী যখন তাকে বলে ধর্মভয় না থাক, যে স্বামী খেতে পড়তে দেয় তার প্রতি একটু মুখ চেয়ে চলা স্ত্রীর কর্তব্য, তখন সারদা বলে ওঠে : ‘সে ত বিয়ের সময় দিব্বি গেলে নিয়েচে যদ্দিন বাঁচবে খেতে পত্তে দেবে ৷ আমি কিছু কি তা করেছি, তবে আমি যদি কিছু করি তা আমার বাড়ার ভাগ!’’ শেষদৃশ্যে সারদা নিজের ঘরে অবিনাশবাবু, গোপালবাবু, প্রিয়বাবুকে ঢোকায় ও বশ করে এবং স্বামীকে ভেড়ার পোষাক পরিয়ে নাচায় ও গান গায় :

নাচ নাচ নাচ

ভাল করে নাচরে রূপী! ভাল করে নাচ;

দেখা দেখি বৌড়িমেয়ের, খেমটা মারার ধাঁচ ৷ ৷

সোয়ামীর চোখে ধুলো দিয়ে বার-ফটকা মেয়ে ৷

কেমন করে মজায় দেখো, বোকা-পুরুষ পেয়ে ৷ ৷

আমরা আগেই বলেছি, উনিশ শতকীয় পরিসরে ব্যক্তি-দাম্পত্য-পরিবারকে কেন্দ্র করে যে যৌননৈতিকতা বিকশিত হচ্ছিল, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক ‘ক্ষমতা’ নিজের প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিল নারীর অস্তিত্ব ও নারীশরীরকে ৷ অসংখ্য পুস্তিকা, নাটক, প্রহসন লেখা হয়েছে নারীর ব্যভিচারকে কেন্দ্র করে ৷ যেহেতু নতুন পরিবার-ভাবনায় নারী-পুরুষের মানসিক নৈকট্য কাঙ্ক্ষিত হিসেবে দেখা হচ্ছিল, তাই রক্ষণশীল এবং আতঙ্কিত সমাজমন এই নারী-পুরুষ নৈকট্যকেই আলোচনার একটি বিশেষ ‘ক্ষেত্রে’ পরিণত করল ৷ এবং এক্ষেত্রে নারীই যে যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরায়, পুরুষকে পিতামাতার সান্নিধ্য থেকে সরিয়ে এনে নিজের বশ করে তুলতে চায়, এই ট্রাডিশনাল সামাজিক ভাবনার নতুন চেহারাই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম এই সব নাটক-প্রহসনে ৷ অর্থাৎ যৌননৈতিকতার উপাদানগুলি কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল নারীর এক কাম্য নৈতিক মানকে আশ্রয় করে ৷ এরকমই একটি চটি বই শ্রীমুন্সী নামদার রচিত ‘কলির বউ ঘরভাঙ্গানী’ (১৮৬৩) ৷ বিবাহের পর কলিযুগের নতুন বউ কীভাবে স্বামীকে নিজের বংশবদ করে এবং শ্বশুর-শাশুড়ীকে অবহেলা করে, পর করে দেয়, তারই চমকপ্রদ বিবরণ এই বই ৷ আখ্যান শুরু হয়েছে এই পয়ার দিয়ে :

অপূর্ব্ব কলির কথা শুন বন্ধুগণ ৷

কিঞ্চিৎ লিখিয়া যাই কলির বচন ৷ ৷

কলি হল কাল এবে বাঁশ গাছে নেবু ৷

ভদ্রের ভদ্রস্থ গেল ছুঁচো হল বাবু ৷ ৷

একিরে আশ্চর্য্য কথা শুনে হাসি পায় ৷

চামচিকা হইয়া রূমে রাজ্য নিতে চায় ৷ ৷

হাড়িতে উড়ায় শাল মেততে আতোর ৷

দিনেতে মোল্লাজি হন রাতে নেশাখোর ৷ ৷

সেসব লিখিতে গেলে ভারি হবে পুঁথি ৷

কলিকালে বয়েদের শুন রীতিনীতি ৷ ৷

খুবই রসালো গদ্যে একালের বাবু-বিবিদের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করেছেন নামদারসাহেব ৷ বলেছেন : ‘সকল বাবু ভেয়েরা ফুলবাবু হয়ে বেড়ান, কিন্তু স্ত্রীলোকের অনুমতি ভিন্ন চলে না ৷ পিতামাতার সেবা কিছুই করেন না, অত্যন্ত রমণী বশ হইয়া থাকেন ৷ সে কেমন? দেখ, যতোদিন পুত্র সন্তানাদি না হয় তত দিন পরমেশ্বরের নিকটে কত সেবা সাধনা করিতে ২ যদি একটি পুত্র সন্তান হয়, তবে কত দুঃখ ভোগ করিয়া লালন পালন করে এবং লেখাপড়া শেখায় কিছুকাল পরে কিঞ্চিৎ সেয়ানা হইলে পরকেটে উড়েন, আর পায় কে ৷ বিবাহ না দিলেই নয়, বাবু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারেন না কিন্তু মনে ২ মহা রাগ, একবার এদিগ পলায়ে জান, একবার উদিগ পলায়ে জান, ঘরের কর্ম্মকার্য্য কিছুই করেন না, মনে ২ করেন যে এ বুড়ো বুড়ি মলেই বাঁচি ৷ বাবুর এইরূপ চাল চুল দেখিয়া মায়ের তো প্রাণ, কাণে ২ কাণ ভারী হয়, মনে ভাবে কি জানি যদি আমার ছেলে কোন রাঁড় ভাঁড় লয়ে পলায়ে যায় তবে তো আমার সর্ব্বনাশ হবে… সুপরামর্শ এই যে একটি উত্তম কন্যা তত্ব করিয়া বিবাহ দেওয়া উচিত…?’’ কিন্তু, বিয়ের পর থেকেই পুরুষের মতিগতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হল কীভাবে, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন লেখক ৷ বিয়ের পর স্ত্রী তার যৌবনের জালে বেঁধে ফেলল আদরের সন্তানকে ৷ লেখকের ভাষায় :

পরে বউটি প্রায় যুবক হয়ে এলো, তখন বাবুকে ক্রমে ২ কাবু করিতে লাগিলেন, প্রায় উঠ বললে উঠে বস বললে বসেন, কখন হাস্য রূপে গালে একখানা ঠোনাই মেরে বসলেন, পরে কিছুদিন বাদে এমনি হলেন যে যুবতী যদি পৃষ্ঠে পালান দিয়া চড়িতে চান তো তাই স্বীকার, তার কথা কোন প্রকারে আর লঙ্ঘিত হওয়া অসাধ্য, যদি যুবতী বলেন হেদে মিনসে একখান ঢাকাই শাড়ি কিনে এনে দেতো, বাবু বলেন যে আজ্ঞা আনিতেছি, আর মা যদি একখান মাটাবালামের বস্ত্র চান তাও হওয়া অসাধ্য ৷

এরপর বউ স্বামীকে পৃথগন্ন হবার পরামর্শ দিতে থাকে ৷ মিথ্যে কথা বলে তার কান ভারী করতে থাকে ৷ বলে : ‘‘দেখ ২ প্রাণনাথ তোমার মা আজ আমায় খেতে দেয়নি এবং গালাগালি দেয় কেবল মারতেই বাকী, বলে ভাইখাগী বেরো… এও কী শাশুড়ী হয়ে বলতে পারে, কি করবো খালি তোমার মুখ চেয়ে এতোক্ষণ ছিলাম নতুবা গলে দড়ি দিতাম সেও ভালো ৷’’ ৷ এই ধরনের টেক্সটগুলিতে সবসময়ই নারীর যৌন অতিরেক এবং স্ত্রীর স্বামী-বশীকরণ শক্তির কথা প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে, যেন, যৌনতার ধ্বংসাত্মক শক্তিই পারিবারিক ও সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট করার পক্ষে বিঘ্নকর ৷

আবার পারিবারিক ঘেরাটোপের বাইরে পুরুষের পরনারীগমনকে ধিক্কার জানিয়েও অনেক চটি বই লেখা হয়েছে ৷ এই সব বইয়েরই মূল উদ্দেশ্য এক নতুন ‘মরাল স্ট্যান্ডার্ড’-কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা, যেখানে, যৌনতার উপযোগবাদী ভূমিকার বাইরে অন্য সব ধরনের ভূমিকাকেই অস্বীকার করা হয় ৷ বিশেষত, ‘উপভোগ’ এখানে ঘৃণিত একটি শব্দ ৷ ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের নাম ‘লম্পট-দমন’ ৷ লেখকের ছদ্মনাম ‘শাসন নিবাসী শ্রীমাদারদ্রুম ন্যায়পঞ্চানন’ ৷ বইয়ের ভূমিকায়, ‘গ্রন্থার্পণ’ অংশে বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘পরদার পরায়ণ শ্রীযুত বাবু বেহায়াচরণ বাগদী ও লম্পট চূড়ামণিগণ সমীপেষু’ ৷ এরপর লেখকের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা :

মহাশয়গণ! আপনাদের লাম্পট্যদোষে অনেক কুলকামিনী কুমার্গগামিনী হওয়াতে এই ‘‘লম্পট-দমন’’ কাব্যখানি মুদ্রিত ও প্রচারিত হইল ৷ ইহাতে লম্পটের অপবিত্র চরিত্র কি রূপ চিত্রিত হইয়াছে, ভরসা করি! এতৎ পাঠে আপনারা তাহা সমীচীনরূপেই বুঝিতে পারিবেন ৷ লম্পটের চরিত্র পবিত্র করাই পুস্তক প্রণয়নের প্রদান উদ্দেশ্য, অতএব আমার অপরাধ ক্ষমা করিয়া আপনাদিগের মানস-ভৃঙ্গ মকরন্দ বিরহিত কাব্যের প্রতি প্রীতি-দৃষ্টি করিলে, পরম উপকৃত হইব ৷

কবিতার আকারে রচিত সম্পূর্ণ বইটিই নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে চাপিয়ে দিতে চাইছে পাঠকের উপর ৷ সমাজের বিশিষ্ট সম্প্রদায়, বিশেষত ব্রাহ্মসমাজের ভণ্ডামির মুখোশও খুলে দিতে চেয়েছেন তিনি ৷ শুরুতে ‘আভাষ,’ শীর্ষক অংশে নৈতিকতার পাঠমালা :

অশেষ লম্পট লীলা দোষের আকর ৷

পরনারীচোরা নামে খ্যাত চরাচর ৷ ৷

প্রতিদিনি পরনারী করিতে হরণ ৷

গোয়ালে অর্চনা করে মকরকেতন ৷ ৷

দিবারাত্র কামরূপী বারুণি সেবনে ৷

কুলের কামিনী হয়ে কদলী-কাননে ৷ ৷

কামযজ্ঞে অকপট ভকতি যতন ৷

দেখি নাই দেখিব না লম্পট মতন ৷ ৷

জমাদারিনীর গৃহে কামযজ্ঞ করি ৷

আহুতি প্রদান করে হইলে শর্ব্বরী ৷ ৷

সতীর সতীত্বরত্ন করিতে হরণ ৷

লম্পট মতন চোর নাহি অন্যজন ৷ ৷

অসাড় প্রাণেশে কেহ তাড়াইয়া দিয়ে ৷

প্রেমসরোবরে ভাসে ভগিনী লইয়ে ৷ ৷

যাদুমণি কুলমণি সুকৌশলে হরি ৷

পাপরূপ দোলমঞ্চে দোলে নর-হরি ৷ ৷

উপনারী উপরসে সুরসিক যারা ৷

চষিয়াছে অনেকেরই কুলভূমি তারা ৷ ৷

লম্পট-দমন কাব্যে রস সুমধুর ৷

যেমন কুকুর তার তেমন মুগুর ৷ ৷

এই চটি বইয়ের দুটি অংশে সরাসরি ব্রাহ্মসমাজ এবং সমাজের কোনো এক সুপ্রতিষ্ঠিত চিকিৎসককে আক্রমণ করা হয়েছে ৷ অখ্যাত এই লেখকের বইতেও যে নৈতিকতার ডিসকার্সিভ প্যাটার্ন কাজ করে চলেছে, তাকেও উনিশ শতকের চেনা ভিক্টোরিয়ান মরালিটির ফ্রেমে ফেলেই দেখতে হবে ৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই নৈতিকতার বাউন্ডারি কেবল ইংরেজিশিক্ষিত এলিটকেই স্পর্শ করেনি, সমাজের সমস্ত স্তরেই, এমনকী, তথাকথিত ‘অনালোকিত’ স্তরেও একইভাবে কাজ করে গেছে ৷ তাই, বলাই যায় উনিশ শতকের ব্যক্তি-পরিবার-দাম্পত্যের ডিসকোর্স ‘এনলাইটেনড’ অংশের বাইরেও বিপুল প্রভাব ফেলেছিল ৷ ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে লেখক কী বলেছেন, তাদের নৈতিক ভাবল-স্ট্যান্ডার্ডকে কীভাবে আক্রমণ করছেন ও পারিবারিক সুস্থিতির চেনা ‘থাকবন্দ’-কেই কীভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, দেখা যাক :

সুশীল সুধীর কেহ সুসভ্য সুজন ৷

সুবিজ্ঞ সুবক্তা অতি সুখ্যাতিভাজন ৷ ৷

সাধু সহ সহবাস অহরহ করে ৷

‘‘একমেবা দ্বিতীয়ম’’ কহে প্রেম বারে ৷ ৷

বুধবার সমাজেতে করিয়া গমন ৷

নয়ন মুদিয়া ভাবে নিত্য নিরঞ্জন ৷ ৷

হাব ভাব সাধু সম দেখিতে সুন্দর ৷

সুপ্রেমিক সুরসিক বুদ্ধির সাগর ৷ ৷

কিন্তু তার আচরণ দেখে ভয় হয় ৷

পরনারীমনচোরা ভন্ডামী-নিলয় ৷ ৷

পরিহর পরকীয়া-অঙ্গ-আভরণ ৷

পরের রমণী দেখ জননী মতন ৷ ৷

এরপরই লেখক এক ধনী সুপ্রিতিষ্ঠিত চিকিৎসকের কথা বলেছেন, যার সমতুল্য ডাক্তার এই শহরে নেই ৷ লেখকের ভাষায় : ‘‘চিকিৎসা শাস্ত্রেতে কেহ সুনিপূণ অতি ৷/অব্যর্থ ঔষধ বলে খ্যাত মহামতি ৷ ৷/ অকাট্য ‘‘ব্যবস্থাপত্র’’ করিতে প্রদান ৷/এ নগরে নাহি কেহ তাহার সমান’’ ৷ ৷ কিন্তু এই ব্যক্তির যাবতীয় গুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাঁর লাম্পট্যের কারণে ৷ লেখক তাঁকে তিরস্কার করে বলেছেন : ‘‘সামান্য ইন্দ্রিয় সুখ সম্ভোগ কারণ ৷/ পরের রমণী কেহ করয়ে হরণ ৷ ৷/প্রাণাধিকা বিধুমুখী রমণী যাহার ৷/নিকটে থাকিতে কেন তার ব্যভিচার?/’’—এই উচ্চারণ বহুলাংশে উচ্চবর্গীয় ভিক্টোরীয় নৈতিক মরালিটির কোডকে মান্যতা দেয়, যেখানে, ‘ইন্দ্রিয় সুখ’ ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়ায় ‘সামান্য’ আর প্রাতিষ্ঠানিক দাম্পত্যের মরাল কোডটিকেই একমাত্রিকভাবে ন্যায্যতা দেওয়া হয়, বোঝা যায়, শরীর-যৌনতার ডিসকার্সিভ ব্যাখ্যা সেদিনের সামাজিক পরিসরে কতোখানি ভিতর অব্দি গেঁথে গিয়েছিল ৷

১৮৬৩ সালে প্রকাশিত শ্রীনন্দলাল দত্ত প্রণীত ‘আদ্যরসাশ্রিত কাব্য’ লুকয়ে পিরীত কি লাঞ্ছনা বইটি যেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘নববাবুবিলাস’-এরই সম্প্রসারণ ৷ আসলে এ ধরনের চালু ন্যারেটিভের একটি ধারা সেদিন বাংলা পপুলার লেখালেখির জগতে দীর্ঘদিন ধরে বহমান ছিলই, যেখানে, অবৈধ প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কের বিবরণ থাকত ৷ আর, সেই কাহিনির সমাপ্তি ঘটত ‘পাপের পরিণাম অশুভ’ জাতীয় নৈতিক সাবধানবাণীতে ৷ এই বইটিতেও এক বালবিধবা হেমলতার আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে, যে অবদমিত কামের জ্বালায় পাশের বাড়ির নবীন যুবকের প্রেমে পড়ে ও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে চায় ৷ পুরুষ-লম্পটটি হলেন পাশের বাড়ির ছোটোবাবু ভুবনমোহন, যিনি পরনারী-আসক্ত ৷ অত্যন্ত ট্রাডিশনাল বর্ণনায় হেমলতার যৌবনোন্মেষ ও মদনজ্বালার বর্ণনা :

বালিকা সময়ে বালা হারাইয়া পতি ৷

সদা রহে শূন্য মনে সকাতরা অতি ৷ ৷

বসন্তের আগমন দেখিয়া সুন্দরী ৷

নিয়ত কেবলি ওঠে শিহরি শিহরি ৷ ৷…

একাকিনী অভাগিনী পালঙ্ক উপরে ৷

বিকারের রোগী যেন ছটফট করে ৷ ৷

নিদ্রা নাহি নয়নে শয়নে মহাদুঃখ ৷

ফুল্ল নেত্র নলিন, মলিন চাঁদমুখ ৷ ৷…

আহা! যদি পাই কোনো রসিক রঞ্জনে ৷

ভজিব, মজিব প্রেমে, কি করে গঞ্জনে?

চন্দ্রাননী চিন্তি হেন ভ্রমে ইতস্তত ৷

কপোত বিহনে যেন কপোতী বিব্রত ৷ ৷

অতঃপর পাশের বাড়ির ধনীর সন্তানের সঙ্গে চোখে চোখে আলাপ, মিলনের ব্যাকুলতা ৷ পুরুষটি রঙ্গিনী নামক এক দাসীর সহায়তায় গোপনে ওই মেয়েটিকে মিলনপ্রস্তাব পাঠাল ৷ এই কাব্যে দাসী কর্তৃক হেমলতাকে ভুবনমোহনের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য রাজি করানোর দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে ৷ অবশেষে, এক রাতের অন্ধকারে চুপিসারে হেমলতা ভুবনমোহনের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য বাড়ির বাইরে পা রাখল ৷ উভয়ের পারস্পরিক সান্নিধ্যও ঘটল ৷ মিলনের দীর্ঘ বর্ণনা আছে এই বইতে ৷ নিঃসঙ্গ, উপোসী হেমলতা খুব সহজেই পুরুষের মোহন ছলাকলায় ভুলে গেল ৷ তার আকর্ষণ ক্রমেই বাড়তে লাগল ৷ কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, অথবা, লেখকের অভিপ্রায়েই, উভয়েই ধরা পড়ে গেল হেমলতার পিতার হাতে ৷ অতঃপর,

যখন আলাপ করে নায়িকা নায়ক ৷

গোপনে শুনিয়াছিল কন্যার জনক ৷ ৷

প্রতিহিংসা করনাশে প্রতীক্ষিয়া ছিল ৷

দেখিল উভয়ে পুরে প্রবেশ করিল ৷ ৷

অমনি করিয়া রুদ্ধ খিড়কির দ্বার ৷

‘‘চোর চোর’’ বলি মহা করিল চিৎকার ৷ ৷

শুনিয়া চোরের নাম যত পুর জনে ৷

আলো জ্বালি ছুটাছুটি আইল প্রাঙ্গণে ৷ ৷

ভুবনের শিরে বজ্র হইল পতন ৷

কোথা বা রহিল হায় প্রেম আলাপন… ৷ ৷

বিশিষ্ট সন্তান যুবা শিষ্ট শান্ত অতি ৷

এ কর্ম্মে হয়েছে মাত্র নতুন সে ব্রতী ৷ ৷

বিষম বিপদে পড়ি বুদ্ধি হারাইল ৷

দেখিতে দেখিতে আসি তাহারে ধরিল ৷ ৷

কামিনী কনক কায় হইল মলিন ৷

মহাতঙ্ক শুকাইল বদন নলিন ৷ ৷

কন্যা স্নেহে তারে কেহ কিছু না বলিল ৷

কেশে ধরি বাবুজিরে বাহির করিল ৷ ৷

‘‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’’ মন্ত্র উচ্চারিয়া ৷

করিল মৃতের মত মারিয়া মারিয়া ৷ ৷

ভদ্রের তনয়, কায় স্বভাবে কোমল ৷

অবসন্ন হয়ে শয্যা করিল ভূতল ৷ ৷

মৃতপ্রায় দেখি তারে ছাড়ি দিয়া ক্ষণ ৷

আছে কি মরেছে সবে করে নিরীক্ষণ ৷ ৷…

প্রভাতে পুলিশে আসি দিল দরশন ৷

নিবেদিল নিশাপাল নিশির ঘটন ৷ ৷

ধরেছে অর্ধ্বেক রাত্রে বাড়ীর ভিতরে ৷

সাক্ষী আর তাহাতে কি প্রয়োজন করে ৷ ৷

দাণ্ডাইতে দণ্ড আজ্ঞা হইল বিচারে ৷

মহা কষ্টে ছয় মাস বাস কারাগারে ৷ ৷

হায় রে ভদ্রের ছেলে মানে মানে ছিলি ৷

খানা কেটে লোনা জল কেন ঢুকাইলি ৷ ৷

করিতে এমন প্রেম কে তোরে বলিল ৷

লেখাপড়া শিখে এর ফল কি ফলিল ৷ ৷

কি বলে দেখাবি মুখ মানব সমাজে ৷

জনক জননী তোর মরিবে যে লাজে ৷ ৷

যার জন্য গিয়াছিলি কোথায় সে ধনী ৷

এখন করিবি নিজে ঝম ঝম ধ্বনি ৷ ৷

অকর্ম্ম কুকর্ম্ম করি সুখ যদি হবে ৷

ধর্ম্মের সাধনা আর কে করিত তবে ৷ ৷

এভাবেই পরিচিত নৈতিকতার থাকবন্দে এবং ঘেরাটোপে বেঁধে রেখে নীতিবোধের পাঠ দিলেন লেখক ৷ যৌনতা ও শরীর যেকোনো সমাজেই ক্ষমতার চোখে অস্বস্তির কারণ ৷ তাই, ‘প্লেজার’-কে একধরনের ‘লিমিটেড ইকোনমি’তে বেঁধে ফেলেই সমাজকাঠামোর নিশ্চিন্তি ৷ সেই সামাজিক ক্ষমতা প্রয়োগের প্রক্রিয়াই দেখতে পাই এই অখ্যাতনামা লেখকের বইতে ৷

উপরোক্ত টেক্সগুলিতে অতি ক্ষুদ্র পরিসরে দাম্পত্যহীনতা ও নারী-পুরুষের যৌন ব্যাভিচারের এক সংক্ষিপ্ত সামাজিক চিত্র পাওয়া গেল ৷ উনিশ শতকে এগুলি ছাড়াও আরো এক ধরনের টেক্সট রচিত হত, যেখানে বাস্তব সামাজিক ঘটনা অবলম্বনে রিপোর্টাজধর্মী কাহিনি পরিবেশিত হয়েছে ৷ এ ধরনের লেখাগুলির অধিকাংশেরই বিষয়বস্তু যৌনতা ও অপরাধমূলক কাজকর্মের আন্তঃসম্পর্ক ৷ তাই যৌন অপরাধমূলক ঘটনার বিশ্বাস্য চিত্রায়নে বারবার পুলিশ-প্রশাসন কীভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তা-ও দেখানো হয়েছে এখানে ৷ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দেশীয় সমাজে যৌন অপরাধের ঘটনায় ঔপনিবেশিক শক্তির অনুপ্রবেশের দিকটি দেখানো হয়েছে, অন্যদিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এক ধরনের সামাজিক সচেতনতা ৷ যেমন ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত নাপিতেশ্বর নাটক-এর বিষয়বস্তু হাওড়া জেলায় ঘটে যাওয়া একটি তৎকালীন বাস্তব ঘটনা, তা ভারতভৃত্য পত্রিকার ১৬ চৈত্র ১২৭৯ সংখ্যায় রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ নাটকের বিষযবস্তু একটি নাপিত পরিবারের বাল্যবিধবা কন্যা শামীর পারিবারিক বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছায় বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ এবং স্থানীয় থানার কনস্টেবল, বিলাস মোড়ল ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের শারীরিকভাবে প্রশ্রয়দান ৷ শেষ অব্দি পুলিশ এক গভীর যৌন দুর্নীতির চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, শামীর বাবা ভগবানকে কন্যা হত্যার মিথ্যা মামলা সাজিয়ে শামীকে ঘর থেকে বের করে আনে ৷ শেষে উচ্চ আদালতে শামীর বয়ানের জেরেই মুক্তি পায় ভগবান, অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হয় ৷৭৪ এছাড়াও ১৮৯২ সাল থেকে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রকাশ করতে থাকেন মাসিক দারোগার দপ্তর,  যেখানে প্রতি মাসে একটি করে বাস্তব/আধাবাস্তব অপরাধমূলক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডিটেক্টিভধর্মী গল্প প্রকাশিত হত ৷ যেমন, চৈত্র ১৩০০ সংখ্যায় প্রকাশিত আবীরজান (কামিনীর কুলচক্র ভেদ) কাহিনিটি ৷ আবার, জ্যৈষ্ঠ ১৩০১ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রমদা (কুলবধূ ব্যভিচারে ঘটায় প্রমাদ!) নামক রচনাটি, যেখানে সন্তোষপুর গ্রামের জনৈক গৃহবধূ প্রমদা তার প্রতিবেশী হরি ঘোষের সঙ্গে অবৈধ শারীরিক ও মানসিক সম্পর্ক চালিয়ে যাবার পথের কাঁটা দূর করতে প্রেমিকের সহায়তায় স্বামী নবকুমারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং সাধারণ হিন্দু নারীর পক্ষেও যা অভাবণীয়, এক মুহূর্তের জন্যও অনুশোচনা প্রকাশ না করে তদন্তকে বিপথে পরিচালিত করতে চায় ৷ যদিও, শেষরক্ষা হয় না ৷ হরি রাজসাক্ষী হিসেবে প্রমদাকে ধরিয়ে দেয় ও তার মৃত্যুদন্ড হয় ৷৭৫ এরকম আরো কয়েকটি যৌন অপরাধের কাহিনি মা, না রাক্ষসী? (অর্থাৎ, সতী, অসতী হইলে তার ফল ভয়ানক) (আশ্বিন ১৩০৬) এবং মিস মেরি (বৈশাখ, ১৩০৮) কাহিনি দুটি ৷৭৬এভাবেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শরীর/যৌনতা-দাম্পত্য বিষয়ক নতুন ডিসকোর্স বিকশিত হতে থাকলেও, সমাজের বৃহত্তর অংশ যে সেই ডিসকার্সিভ যৌনতাকে সর্বতোভাবে গ্রহণ করেনি, বরং বিচিত্র ও জটিল যৌনতার অভিব্যক্তি যে আমাদের উনিশ শতকীয় ‘আধুনিকতা’-র একটি বিশিষ্ট উপাদানে পরিণত হচ্ছিল, আলোচ্য টেক্সটগুলি তারই উদাহরণ বহন করে আনে ৷ পাশাপাশি একথাও উল্লেখ্য, কোনো টেক্সটই মান্য আচরণ থেকে ব্যক্তির বিচ্যুতিকে সমর্থন করেনি, তাই এগুলিকেও উনিশ শতকীয় ব্যক্তি-দাম্পত্য-যৌননৈতিকতা-সংক্রান্ত আধিপত্যমূলক ডিসকোর্সের অংশ হিসেবে পড়া যেতেই পারে ৷

উল্লেখপঞ্জি

১. ‘ভদ্রলোক’ কথাটি এখানে ব্যাপকতর অর্থে প্রযুক্ত ৷ উনিশ শতকে ব্রিটিশ পুঁজির সংস্পর্শে দেশীয় সমাজে যে নতুন সামাজিক ‘ক্ষমতা’সম্পন্ন বর্গটি গড়ে ওঠে, তাদেরই সামগ্রিকভাবে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে ৷ ছোটো-বড়ো সম্পত্তির মালিক, শিল্প কিংবা ব্যবসায়ে যুক্ত দেশীয় উচ্চবর্গ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝারি বা নীচুতলার কর্মচারী এবং এদের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য স্কুল বা কলেজশিক্ষক, আইনব্যবসায়ী, এমনকি ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, কম-বেশি ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আসা লোকজন এর অন্তর্ভুক্ত ৷ ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামোয় এদের খুব একটা জায়গা না থাকলেও মূলত ইংরেজিশিক্ষা, নতুন ধরনের কর্মে নিযুক্তি এবং বর্ণগত (caste) আধিপত্যের জোরেই এরা সমকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে অগ্রবর্তী অবস্থান গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন ৷ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন স্কুলশিক্ষক, পত্রিকা সম্পাদক, নীতিকবিতার রচয়িতা, অর্থাৎ, ‘আলোকপ্রাপ্ত’ সামাজিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত একজন মানুষ ৷

২. প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্র : ইতিবৃত্ত/শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার রচিত/ঢাকা বাঙ্গালা যন্ত্রে শ্রীপ্রসন্নকুমার ভৌমিক প্রিন্টার কর্তৃক মুদ্রিত/সন ১২৭৫ ৷ ১৯শে বৈশাখ ৷ মূল্য বারো আনা ৷ বর্তমান আলোচনায় যে পুনঃপ্রকাশিত মুদ্রণটি ব্যবহৃত: আত্মকথা (দ্বিতীয় খন্ড), সম্পা: ড. নরেশচন্দ্র জানা ও ড. মানু জানা, কলকাতা, ১৯৮২

৩. দ্র: পূর্বোক্ত আত্মকথা (দ্বিতীয় খন্ড), পৃ: ১৭-১৯

৪. ফুকো দেখিয়েছেন, আধুনিক ‘ক্ষমতা’ কীভাবে একদিকে ব্যক্তিক্ষমতার বিকাশ, অন্যদিকে সমাজ-অনুমোদিত আচরণের ‘স্বাভাবিকীকরণে’র তালিম—এই দুইয়ের যুগ্মধারায় মানুষকে ক্রমশ উদ্দীপ্ত করে ৷ আধুনিক ‘আত্মকথন’ ব্যক্তি-অনুশাসনেরই অঙ্গ, অতএব, আত্মকথনও সেই নতুন জ্ঞান-যুক্তি-ক্ষমতার অংশ, যা, ফুকোর ভাষায়: ‘gave rise to new orders of knowledge, new objects of intervention, and new forms of subjectivity’ ৷ দ্র: Governmentality; Michel Foucault. The Foucault Effect : Studies in Governmentality, ed, Graham Burchell, Colin Gordon and Peter Miller, Chicago, 1991, p. 87-104. ‘আধুনিক’ জীবনবৃত্তান্ত এই ‘new order of knowledge’ এবং ‘new forms of subjectivity’-র সার্থক দৃষ্টান্ত ৷ আলোচ্য উদাহরণেও কৃষ্ণচন্দ্র যৌন অসংযমের ছবি আঁকছেন নিছক ঘটনা হিসেবে নয়, কোনো এক ‘স্ট্যান্ডার্ডইজড’ মান্য নৈতিক কাঠামো থেকে বিচ্যুত হবার ফলে উদ্ভুত পাপবোধ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে ৷ কৃষ্ণচন্দ্রের সমগ্র আত্মজীবনী ওই স্খলন থেকে আদর্শ নৈতিক কাঠামোয় উত্তীর্ণ হবার বৃত্তান্ত, যা আসলে এক ধরনের ‘new form of subjectivity’-র ধারণাকেই পুষ্ট করে ৷

৫. দ্র: পূর্বোক্ত, আত্মকথা, পৃ: ১৯

৬. দ্র: আশীষ (কৃতজ্ঞতা, প্রার্থনা ও আত্মসমালোচনা), শ্রদ্ধাস্পদ ভাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, আত্মকথা (চতুর্থ খন্ড), সম্পা. ড. নরেশচন্দ্র জানা ও ড. মানু জানা, কলকাতা ১৯৮৬, পৃ: ৫৩

৭. দ্র: আশীষ, পৃ: ৬৩

৮. স্টিফেন গ্রিনব্লাটের ভাষায় : ‘a sense of personal order, a characteristic mode of address to the world, a structure of bounded desires and always some elements of deliberate shaping in the formation and expression of identity.’দ্র: Renaissance Self-fashioning, Stephen Greenblatt, লেখার বর্তমান অংশটি সংকলিত হয়েছে : Cultural Studies; ed. Nilanjana Gupta, New Delhi, 2004.

৯. আশিস নন্দীর ভাষায়: ‘as a state of mind, coloniaslism is an indigenous process released by external forces. It’s sources lie deep in the minds of the rulers and the ruled.’ দ্র: The Intimate Enermy: Loss and Recovery of Self Under Colonialism; Ashis Nandy, New Delhi, 1983, p. 3.

১০. দ্র: The History of Sexuality; Interview with Michel Foucault, Power Knowledge: Selected Interviews and Other Writings (1972–77), Edited by colin Gordon, Great Britain, 1980, p. 184.

১১. এক্ষেত্রে ফুকোর বক্তব্য কিছুটা বিশদভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে : power relations can naturally penetrate the body in depth, without depending even on the mediation of the subject’s represnetation. If power takes hold on the body, this is not through its having first be interiorised in people’s conciousness. There is a network or circuit of bio-power, or somatopower, which acts as the formative matrix of sexuality itself as the historical or cultural phenomenon within which we seem at once to recognize and lose ourselves … Between every point of a social body, between a man and a woman, betwen the members of a family, between a master and his pupil, between every one who knows and every one who does not, there exists relations of power which are not purely and simply a projection of the sovereign’s great power over the individual; they are rather the concrete, changing soil in which the sovereign’s power is grounded, the conditions that make it possible for it to function. The family, even now, is not a simple reflection or extension of the power or the State, it does not act as the act as its representative with respect to the female … there must be, between male and female or adult and child, quite specific relations which have their own configuration and relative autonomy. পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকার, p. 186–188.

১২. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্র: Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism; Benedict Anderson, London, 1983.

১৩. দ্র: The Concept of the Household-Family in Eighteenth Century England; Naomi Tadmor, Past and Presrnt, Number 151, 1996, p. 121–123, লেখিকার মতে : ‘there was a concept of ‘family’ in seventeechth and eighteenth-century England emanuating from relationship of blood and marriage … but, there was also a related yet different, and highly significant, concept of the family emanating from relationship of co-residence and authority. p. 113.

১৪. বিস্তারিত আলোচনা জন্য দ্র: ‘Marriage or Celibacy?’ The ‘Daily Telegraph’ on a Victorian Dilemmana; John M. Robson; Toronto, 1995.

১৫. মনোবিশ্লেষক আর্নেস্ট বোলস-এর মতে:: ‘All the symptoms are exaggerations or distortions of the normal physiological accompaniments of fear. The whole neurosis is a perversion of the fear instint.’ অর্থাৎ, বাসনার নিবৃত্তি না ঘটলে, ‘বাসনা’কে অবদমিত করলে, তা ঠিক বিপরীত উপাদান—‘ভয়’-এর জন্ম দেয় ৷ দ্র: Aids to Psychiatry; W. S. Dawson, 1924, উদ্ধৃত, The Worm in the Bud : The World of Victorian Sexuality; Ronald Pearsell, Great Britain, 1993, p. 416.

১৬. লেখকের ভাষায় : ‘fanaticism, love of tranquility, and dread of disease were, among men, considered as sufficient incitements or seize on the organs of their virility with hardy hands, and to destroy those very organs by a cruel and painful operation from which even death might result. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, p. 417.

১৭. The Tresury of Modern Biography, Robert Cochrane; 1878, উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, p. 417.

১৮. উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, p. 418.

১৯. উদ্ধৃত; পূর্বোক্ত, p. 419; রোনাল্ড পার্সেল এই অবদমনের মনস্তত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন : ‘The result was repression. Wishes of a sexual nature that was not acceptable to the conscious mind were pushed underground; it is in the nature of such wishes that they collect together and form a complex, and it is also in their nature to try and express themselves … the existence of a censor, the embodiment of high thinking and respectibility, which would prevent the nucleus of sexual wishes from appearing at a conscious level.’ দ্র: Worm in the Bud, p. 422.

২০. দ্র: দানবদলন কাব্য; বঙ্গদর্শন, জ্যৈষ্ঠ, ১২৮০

২১. দ্র: চিত্তশুদ্ধি; প্রচার, ফাল্গুন, ১২৯২

২২. দ্র: ধর্মতত্ব, ষষ্ঠ অধ্যায়, বঙ্কিম রচনাবলী (২য় খন্ড), কলকাতা ১৯৯৯, পৃ. ৫১০-৫১২

২৩. দ্র: বিষবৃক্ষ, ‘বাবু’ নামক দশম পরিচ্ছেদ, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১৯৭-১৯৮, এই লেখায় উদ্ধৃত ‘বিষবৃক্ষ’-র অন্যান্য অংশগুলিও আলোচ্য সংস্করণ থেকে গৃহীত হয়েছে ৷

২৪. উদ্ধৃত; ‘Marriage or Celibacy?’ : The ‘Daily Telegraph’ on a Victorian Dilemma, John. M. Robson, Toronto, p. 65.

২৫. ড: শিশিরকুমার দাস দেখিয়েছেন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব হল : ‘binary opposition between sensuousness and serenity, pleasure and happiness, passion and love’ দ্র: The Artist in Chains : The Life of Bankim Chandra Chatterjee; Sisir Kumar Das, New Delhi, 1984, p. 82–83.

২৬. দ্র: Gender, Space and Modernity in 18th Century England : A Place Called ‘Sex’; Karen Harvey; History Workhip Journal 51, 2001, p. 159–179.

২৭. রজতকান্ত রায়-এর মতে : ‘Brahmanical patriarchy had recognized in eros a potential threat and had made extensive arrangements for the repression of this powerful opponent. The orthodox code, attributed to the mythical Manu, devised in the caste system the most complete plan ever made to drive love from life and to exile it to religion and literature.’ দ্র: Man, Woman and the Novel : The Rise of a New consciouseness in Bengal; Exploring Emotional History : Mentality and Literature in the Indian Awakening; Rajatkanta Ray, New Delhi, 2003 p. 106.

২৮. দ্র: অন্নদামঙ্গল, তৃতীয় খন্ড; তৃতীয় খন্ড; ভারতচন্দ্র রচনাসমগ্র, সম্পা: ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, ড. বিষ্ণু বসু, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ১ ৩৬৬-৩৭০

২৯. উদ্ধৃত: Love in a Colonial Climate : Sex and Romance in Nineteenth Century Bengal; Tapan Roychowdhury; দ্র: Perceptions. Emotions, Sensibilities : Essays on India’s Colonial and Post-Colonial Experiences; New Delhi: 1999; . 66; তপন রায়চৌধুরী এবং জেরাল্ডিন ফোর্বসের যৌথ সম্পাদনায় হৈমবতী সেন-এর এই এ-যাবৎ অপ্রকাশিত স্মৃতিকথার ইংরেজি অনুবাদ কিছুদিন হল প্রকাশিত হয়েছে ৷

৩০. দ্র: পূর্ব্বকথা; প্রসন্নময়ী দেবী, কলকাতা, ১৯৮২

৩১. বিধবাবিবাহ; তত্ববোধিনী পত্রিকা, চৈত্র ১৭৭৬ শক; ১৪০ সংখ্যা; দ্র: সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ৪, সম্পা: বিনয় ঘোষ কলকাতা, ১৯৮০, পৃ: ১৬০

৩২. দ্র: চন্দ্রমুখীর উপাখ্যান; রেভারেল্ড লালবিহারী দে; সম্পা: দেবীপদ ভট্টাচার্য, প্রথম প্রকাশ ১৮৫৯, বাংলা আকাদেমি সংস্করণ, ২০০১, কলকাতা, পৃ: ৬৯

৩৩. দ্র: অযোগ্য পরিণয়; উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১২৮৬ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩৪; উদ্ধৃত; অন্দরে অন্তরে : উনিশ শতকে বাঙালি ভদ্রমহিলা; সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, কলকাতা, ১৯৯৮ পৃ. ৮৯

৩৪. বাল্যবিবাহের দোষ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা, ভাদ্র ১৮৫০, পৃ: ৬

৩৫. দ্র: সম্বাদ প্রভাকর, ১৫ জুন ১৮৪৯

৩৬. দ্র: বাঙালি জীবনে রমণী; শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, কলকাতা ১৯৬৮, পৃ: ৭৭

৩৭. দ্র: Handbook of Wives and Mothers in India, M. E. Staloy, Calcutta, 1908, p. 67. উদ্ধৃত, The Changing Role of Women in Bengal (1840–1905)\ Meredith Borthwick, Princeton, 1984, p. 111.

৩৮. মেরিডিথ বোর্থউইকের মতে : In a society where free expression of women’s sexuality in relation to men was heavily repressed, other outlets for such a powerful force were inevitable. Extreme repression seemed to result in a heightened conciousness of sex among Hindu women, rather than the culturally approved sexless opposite. For instance, at weddings the female customs of stri achar, with their profusion of sexual rites, allusions, and teasing, provided an opportunity for the repressed sexuality of women to find release in a socially sanctioned way … The release of sexual tension through female conversation were obliged to maintain extremely strict properity in front of males. দ্র: পূর্বোক্ত, p. 19.

৩৯. বঙ্গবিবাহ; চন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, কলকাতা, ১২৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ১ ৩৬-৩৭;

৪০. স্বামী ও স্ত্রী; দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী, নব্যভারত, চতুর্থ খণ্ড, অষ্টম সংখ্যা, আশ্বিন, ১২৯৩ বঙ্গাব্দ, পৃ: ২৬০;

৪১. দ্র: আমার জীবনের ইতিহাস; শ্যাম; আয্যাদর্শন, আষাঢ়, ১২৮৭, পৃ: ১৭১;

৪২. দ্র: হরিদাসের গুপ্তকথা; শ্রীভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রণীত, কলকাতা, ভাদ্র, ১৩৯৪, পৃ: ১৪৩

৪৩. দ্র: কুলীনকুলসর্ব্বস্ব নাটক, রামনারায়ণ তর্করত্ন; কলকাতা ১৮৫৪, পৃ: ৫২

৪৪. দ্র: বাল্যজীবন (স্বয়ং লিখিত); গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন; আত্মকথা; প্রথম খন্ড; সম্পা: নরেশচন্দ্র জানা, মানু জানা, কলকাতা, ১৯৮১, পৃ: ১৬

৪৫. দ্র: বিবাহিত জীবন; বিনোদিনী সেনগুপ্তা; বামাবোধিনী পত্রিকা; মাঘ-ফাল্গুন; ১৩০৭

৪৬. General Impressions of England and the English; Keshub Chandra Sen, 1870; উদ্ধৃত, The changing Role of Women in Bengal (1849–1905); Meredith Borthwick, Princetion, 1984, p. 118.

৪৭. ‘an educated Bengali, when he returns home, fagged and wearied by the day’s overwork, wishes very much to be refreshed … he very much feels the want of a help-mate. ‘Female Education’ Brahmo Public Opinion, 30 September, 1880; উদ্ধৃত; পূর্বোক্ত, p. 116.

৪৮. প্রদত্ত ভাষণে বলা হয়েছিল : There can be no real happiness in the family, no real home life, no real companionship between the two so unequally mated, the intellectual man and the unintellectual woman. The woman will be unable or share in the cultivated persuits and enjoyments of the man, or intelligently to divide with him the serious troubles of his life, and he will be compelled to seek outside his own home the true sympathy and companionship, which he ought to find, but misses within it; Address to the Indian Reform Association, 20 April 1879; Archdeacon Baly, উদ্ধৃত; পূর্বোক্ত, p. 116.

৪৯. মহিলা পত্রিকা; শ্রাবণ ১৩০৪ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৩;

৫০. দ্র: অবলাবান্ধব; শরচ্চন্দ্র ধর, কলকাতা, ১৯৪৯ সংবৎ, পৃ: ১২

৫১. রজতকান্ত রায়ের মতে : ‘When the desire is forced to substitute for its satisfaction the celebration of the longing itself, eros makes a critical transition from the sensual to the romantic. As Bengal borrowed the literary notion of courtship from Victorian Britain, love was stamped at birth as romantic.’ দ্র: Exploring Emotional History : Gender, Mentality and Literature in the Indian Awakening; Rajatkanta Roy, New Delhi, 2003, p. 106.

৫২. দ্র: পতিবতা ও পাতিব্রত্য; পরিচারিকা; শ্রাবণ, ১২৮৬ বঙ্গাব্দ

৫৩. দ্র: সহধর্ম্মিনী; বামাবোধিনী পত্রিকা, পৌষ ১৩০৩ বঙ্গাব্দ; সঙ্কলিত : নারী ও পরিবার (১২৭০-১২২৯ বঙ্গাব্দ) : বামাবোধিনী পত্রিকা, সম্পাদনা : ভারতী রায়, বকলকাতা, ২০০২, পৃ: ১৯১

৫৪. দ্র: সতী ও সতীত্ব; পরিচারিকা, আষাঢ় : ১২৯২, বঙ্গাব্দ, পৃ: ২৭

৫৫. দ্র: স্বামী বশীকরণ মন্ত্র; সাধারণী, ১৪ ভাদ্র, ১২৮৭ বঙ্গাব্দ, পৃ: ২৩২

৫৬. দ্র: হিন্দু মহিলা নাটক; বটুবিহারী মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৮৬৯, পৃ: ২১

৫৭. দ্র: সমাজ সংস্করণ; নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় কলকাতা, ১২৭৬ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৮২

৫৮. দ্র: অঘোরপ্রকাশ; প্রকাশচন্দ্র রায়, ১২৬৪ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৯৮-৯৯

৫৯. My Life’s Partner; Motilal Roy, Calcutta 1945, এই বইয়ের মূল বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে ৷ দ্র: পূর্বোক্ত, Meredith Borthwick, p. 137.

৬০. দ্র: নারীজীবনের উদ্দেশ্য; বামাগণের রচনা; বামাবোধিনী পত্রিকা, মাঘ, ১২৯০; সঙ্কলিত, পূর্বোক্ত, ভারতী রায়, পৃ: ৯৫

৬১. দ্র: গৃহিনীর কর্তব্য; আনন্দচন্দ্র সেনগুপ্ত, কলকাতা, ১২৯১ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৬৬-৬৮

৬২. দ্র: সঞ্জীবনী পত্রিকা, সম্পা : কৃষ্ণকুমার মিত্র, ১৭ জানুয়ারি, ১৮৯১

৬৩. এ ধরনের যুক্তিসম্বলিত একটি সমকালীন বই : আইন! আইন!! আইন!!!; মেয়ে কর্তৃক লিখিত, ঢাকা ১৮৯০; এতে বলা হয়েছে যৌন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মেয়েদের আঞ্চলিক কথ্যভাষায় ‘দামাইয়া’ বলে ডাকা হত ৷ উদ্ধৃত; পূর্বোক্ত; Meredith Borthwick; p. 127.

৬৪. সহবাস সম্মতি আইনবিরোধী আন্দোলন কীভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার অঙ্গীভূত হল, সে বিষয়ে বিস্তৃত, মনোজ্ঞ আলোচনার জন্য, দ্র: Conjugality and Hindu Nationalism : Resisting Colonial Reason and the Death of a Child-Wife; Tanika Sarkar; Hindu Wife, Hindu Nation : Community, Religion and Cultural Nationalism, New Delhi, 2003, p. 191–225; এবং The Nation and its Women; Partha Chatterjee, The Nation and its fragments : Colonial and Post-colonial Studies, New Delhi, 1999; p. 116–134

৬৫. দ্র: স্ত্রী শিক্ষা প্রথম কাঁটা, প্রিয়দাস সরকার, কলকাতা, ১৮৭৬, পৃ: ১১-১২; উদ্ধৃত; Meredith Borthwick; p. 134.

৬৬. কুমকুম সাংগারির মতে : ‘The formation of desired notions of spirituality and of womanhood is thus a part of the formation of the middle class itself, wherein hierarchies and patriarchies are sought to be maintained on both material and spiritual grounds : দ্র: An Introduction; Recasting Women : Essasys in Colonial History; ed. Kumkum Sangari, Sudesh Vaid, New Delhi, 2006, p. 10; এছাড়াও, নারীর যৌনতা কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গ নির্মাণ রাজনীতির ছাঁচে নিয়ন্ত্রিত হয় সে জন্য দ্র: Theorising Gender and Sexuality; Stevi Jackson; Contemporary Feminist Theories, ed : Stevi Jackson and Jackie Jones; Edinburgh University Press, 1998, p. 131–146.

৬৭. এই বিষয়ে কয়েকটি সাম্প্রতিক বই : অশ্রুত কণ্ঠস্বর : ঔপনিবেশিক বাংলায় বারবনিতা সংস্কৃতি; সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ২০০২; Race, Sex and Class Under the Raj: Imperial Attitudes and Policies and Their Critics (1793–1905)\ Kenneth Ballhatchet; New Delhi, 1979, এবং Dangerous Outcast : prostitute in Nineteenth Century Bengal; Sumanta Banerjee; Calcutta, 2000.

৬৮. দ্র: বিদ্যাদর্শন পত্রিকা, অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত, কার্ত্তিক, ১৭৬৪ শক, ১৮৪২ খ্রি: ৫ম সংখ্যা, ‘চিঠিপত্র’ স্তম্ভে প্রকাশিত ৷

৬৯. সপত্নী নাটক; তারকচন্দ্র চূড়ামণি, কলকাতা ১৮৫৮, পৃ: ১-১৪৮; আখ্যাপত্র নেই ৷

৭০. বেশ্যাসক্তিনিবর্ত্তক নাটক; শ্রীপ্রসন্নকুমার পাল কর্তৃক বিরচিত, কলিকাতা, প্রভাকর যন্ত্রে মুদ্রিত, ১৯৬০

৭১. ঘর থাক্তে বাবুই ভেজে; ব্যোমকেশ বাঙ্গাল (হরিশ্চন্দ্র মিত্র), ১৮৬৩, পৃ: ১-২৬

৭২. মাগসর্ব্বস্ব; হরিমোহন কর্ম্মকার, কলকাতা, ১৮৭০

৭৩. কলির মেয়ে ছোট বৌ ওরফে ঘোর মুর্খ; ভাঙামোড়া নিবাসী শ্রীঅম্বিকাচরণ গুপ্ত কর্তৃকপ্রণীত ও প্রকাশিত, কলিকাতা, ১২৮৮ বঙ্গাব্দ, (ইং ১৮৮১)

৭৪. নাপিতেশ্বর নাটক; কলকাতা, ১৮৭৩; এই নাটকটি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্র: সমাজচিত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা প্রহসন; ড: জয়ন্ত গোস্বামী, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ: ৩০০-৩০৫

৭৫. দুটি কাহিনিই সংকলিত হয়েছে : দারোগার দপ্তর, প্রথম খন্ড; রায়বাহাদুর শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত, সম্পাদনা: অরুণ মুখোপাধ্যায়, প্রথম খন্ড, কলকাতা ২০০৪, পৃ: ২০২ ও পৃ: ২৩৩

৭৬. এই দুটি কাহিনিই সঙ্কলিত : দারোগার দপ্তর, (দ্বিতীয় খন্ড), পূর্বোক্ত, পৃ: ১১৭ ও পৃ: ২৩৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *