৪১. বিষবৃক্ষ
গণভবনে বসেন শেখ মুজিব। ওখানে সর্বক্ষণ দলীয় লোকজন, আবেদন নিবেদনকারীদের ভিড়। কেউ তাকে ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছেন, পা ধরে ছালাম করছেন, কেউ গলা ধরে উচ্চস্বরে কাঁদছেন। শেখ মুজিবও তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এরই মধ্যে তিনি মন্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, আমলাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। শেখ মুজিব দেশবাসীকে বললেন ধৈর্য ধরতে হবে, তিন বছর তিনি কিছু দিতে পারবেন না
কিন্তু শেখ মুজিবের সিংহাসনের চারপাশে যেমন ফুলের বাগান তেমনি জন্ম নিয়েছে গোপন বিষবৃক্ষ।
এক এক করে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে নতুন সরকার।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দ্রুততম সময়ে তৈরি হয়ে যায় নতুন দেশের একটি সংবিধান।
ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে তৈরি হয় অনন্য শিক্ষা নীতি।
আশার সঞ্চার হয় যেন। কিন্তু ফুল যা ফোটে তার চেয়ে অনেক বেশি গজাতে থাকে বিষ বৃক্ষের পাতা।
মাওলানা ভাসানী প্রস্তাব দেন, আসুন যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এমন সব দল নিয়ে একটা সরকার গঠন করি। আওয়ামী লীগের সরকার নয়, জাতীয় সরকার। ন্যাপের মোজাফফর আহমদও সমর্থন করেন এ প্রস্তাব।
পাল্টা যুক্তিও দাঁড়ায়। জনগণ ১৯৭০রের ভোটে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে। সে সরকার পাকিস্তানিরা গঠন করতে দেয়নি। যুদ্ধের সময় যে প্রবাসী বাংলাদেশী সরকার বিবিধ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে সে সরকার আওয়ামী লীগেরই। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বভাবতই সরকার গঠন করবে আওয়ামী লীগ।
কিন্তু এই নয় মাসে হিসেব ওলটপালট হয়ে গেছে সব। লোকে বলে, এতবড় যে যুদ্ধজয় এতো শুধু একা আওয়ামী লীগের অবদান নয়। বরং লোকে যাদের ভোট দিয়েছিল তাদের অনেকেই এই নয় মাস ছিলেন রণক্ষেত্র থেকে, নেতৃত্ব থেকে নিরাপদ দূরত্বে। প্রশ্ন তোলেন অনেকে, একটা নতুন দেশগড়ার কঠিন এই যজ্ঞে দলমত নির্বিশেষে কেন সব মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না? কেন অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না সেইসব মানুষদের যারা কাগজের নৌকায় চড়ে পাড়ি দিয়েছে আগুনের নদী?
কোনো প্রশ্ন থোপে টেকে না। সরকার এককভাবে গঠন করে আওয়ামী লীগ। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন দলের সদস্য নিয়ে যে পরামর্শক কমিটি করা হয়ছিল বাতিল করা হয় তাও।
বঞ্চনার বীজ রোপিত হয়।
রাইফেল কাঁধে মনকাড়া পাহাড়ের গভীর অরণ্যে ক্যাস্ট্রোর সাথে যারা যুদ্ধ করেছেন তারাই পরবর্তীতে গ্রহণ করেছেন কিউবার শাসন ভার, ভিয়েতনামের চরাচরের কাদায় যে ভিয়েতকং গেরিলারা চালিয়েছে অ্যামবুশ, স্বাধীন দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন তারাই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনের দায়িত্ব নেন যারা তাদের অনেকের পাঞ্জাবিতেই কাদা লাগেনি একটুও।
কথামতো তৈরি হয় ত্রান কমিটি। দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ কোটি, উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসিত করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু যাদের হাত দিয়ে সেই ত্রান প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের অনেকের হাতেই কোনোদিন উঠেনি গ্রেনেড, রাইফেল। মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে সামিল হয়ে যে আঙ্গুল একবার ট্রিগার টেপে সে আঙ্গুল একটা অঙ্গীকারে বাধা পড়ে যায়। কিন্তু ত্রাণের অর্থ এসে পড়ে অনেক অঙ্গীকারবিহীন হাতে। বিপন্ন মানুষের কাছে না পৌঁছে সারা বিশ্বের মানুষের ভালোবাসার স্পর্শ লাগা বিপুল অর্থ, সম্পদ আঙ্গুল ফসকে পৌঁছাতে থাকে তাদের নিজস্ব ঝোলায়। শুধু দলীয় লোক নয় স্থানীয় বিত্তবানদের হাতে গিয়ে পড়ে যত ত্রাণের সম্পদ। গোপনে, প্রকাশ্যে শুরু হয় লুট। ঝরনার মতো বইছে ত্রাণের বহর কিন্তু কোন গরে তলিয়ে যাচ্ছে সব। খবর আসে ক্ষিপ্ত মানুষ হত্যা করছে ত্রাণ কমিটির কর্মকর্তাদের। শীতে শোনা যায় কোনো দূর দেশ থেকে কম্বল এসেছে আট কোটি। দেশে তখন মানুষই সাড়ে সাত কোটি। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের গা ঢেকে যাবার কথা সেই শীতে। তবু গ্রামে গঞ্জের মানুষ শীতে কাঁপে। একে অন্যের কাছে জানতে চায়, আমার কম্বলটা কোথায়? মওকা পেয়ে মার্কিন মন্ত্রী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেন তলাবিহীন ঝুড়ি।
মানুষের আশার পাহাড়ে একটু একটু করে ধস নামে।
আদর্শহীনতা ভর করে প্রশাসনেও। যে আমলা কিছুদিন আগেও ছিলেন শক্রর সঙ্গে, সহযোগিতা করে গেছেন পাকিস্তান সরকারকে, লোক না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সে রকম অনেক মানুষকেই বসাতে হয় প্রশাসনের দায়িত্বে। দলীয় বিবেচনাতেও যুদ্ধমাঠের বাইরের অনেক ব্যক্তিকে দেওয়া হয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিউবার মত ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে দেখা হলে শেখ মুজিবকে তিনি বলেন, যারা যুদ্ধে গেছে তাদেই প্রশাসনে বসাও, ওরা অদক্ষ হতে পারে কিন্তু ওদের মন ঠিক পথে আছে।
পরামর্শ কাজ হয় না, বেপথু মনের মানুষদের হাতেই থাকে প্রশাসন। দুর্বল প্রসাশনের সুযোগে কালোবাজারী, মজুদদারী আর চোরাচালানের এক স্বর্গে পরিণত হয় বাংলাদেশ। বড় বড় ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটতে থাকে অহর্নিশ। বন বড় সরকারি কেনা কাটার কমিশন নিয়ে রাতারাতি বড় লোক হয়ে যেতে থাকে কিছু মানুষ। শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করা হলেও তারা অসার মতো খসে পড়তে থাকে এক একটি শিল্প। কেবলই লোকসান। প্রায়ই শোনা যায় পাটের কারখানায় আর গুদামে আগুন লেগেছে। গুদামে আগুন লাগানো হয়ে দাঁড়ায় সোকসান ধামাচাপা দেবার কৌশল। উশৃঙ্খল, বেপরোয়া মনোভাব দেখা দেয় দলীয় এবং সরকারি লোকদের আচরণে। মনে হয় যেন কোনো জাতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে নয় একটা নির্বাচনে জিতে দেশ শাসনের ভার নিয়েছে সরকার। ধসে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুল, কলেজের পরীক্ষায় শুরু হয় নকলের অভূতপূর্ব মহোৎসব।
তার ছিঁড়তে থাকে একটু একটু।
স্বনামধন্য অর্ধনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত হয় পরিকল্পনা কমিশন। তারা যাবতীয় শোষণের পথ বন্ধ করার লক্ষ্যে প্রস্তাব করেন একটি সমাজতান্ত্রিক ধারার অর্থনীতির। রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় কল কারখানার। দেশবাসীকে কৃচ্ছতা সাধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ধনীদের আহ্বান জানান হয় সব রকম বিলাস ব্যাসন পরিত্যাগের। মন্ত্রী, সাংসদদের শহরে না থেকে গ্রামে গিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, ছাত্রদের স্বেচ্ছাশ্রমের সুপারিশ রাখা হয়। তবে এ সুপারিশ যারা বাস্ত বায়ন করবেন সেই আমলা আর রাজনীতিবিদরা পরিকল্পনা কমিশনের এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, ওসব হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড পড়া অধ্যাপকদের তাত্ত্বিক ভাবনা, এসব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
পরিকল্পনা কমিশনের পরিকল্পনার পরী উড়ে যায় পড়ে থাকে কল্পনা।
ঘোষণা মতে পাকিস্তানিদের সাথে যোগসাজশ করা দালালদের বিচার শুরু হয় ঠিকই কিন্তু জটিলতা দেখা দেয় এ বিচার প্রক্রিয়ায়। দেশ জুড়ে হাজার হাজার রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের ধরবার জন্য, বিচার করবার জন্য অত বিচারক, অত পুলিশ কোথায়? একই বাড়িতে ছেলে মুক্তিযোদ্ধা তো বাবা রাজাকার। ছেলে কি করে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ায়? অনেক দালাল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের এককালীন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আত্মীয়। তাদের নানা কৌশলে বিচার থেকে মুক্ত করে আনতে সচেষ্ট থাকেন আওয়ামী লীগেরই কর্মীরা। উল্টোটাও ঘটে, দালাল আইনের সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তদের হেনেস্তা শুরু করেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। অনেক ধার্মিক ধরনের লোক ছিলেন পাকিস্তানপন্থী, তাদের গ্রেফতার করা শুরু হয় বলে লোকে ভাবে এ বুঝি ভারতের চাল। জটিলতা সামাল দিতে না পেরে বিশেষ গুরুতর কিছু অপরাধকারী দালাল বাদে বাকিদের ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতাবিরোধী আর ঘাতকেরা সুযোগ পেয়ে যান দ্বিতীয়বার জন্ম নেবার।
মুক্তিযোদ্ধাদের নানা সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু কে মুক্তিযোদ্ধা সেটা নির্ণয়ই হয়ে উঠে কঠিন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেবার ক্ষমতা। স্বজন প্রীতি আর দুর্নীতিতে রাতারাতি তৈরি হয়ে যায় অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।
সৃষ্টি হয় মুক্তিযোদ্ধা অমুক্তিযোদ্ধার দ্বন্দ্ব।
.
ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানালেও শেখ মুজিব দৃঢ়তার সাথে বলেন, স্বাধীন দেশ থেকে অন্য দেশের সৈন্যকে সরে যেতে হবে দ্রুত। কথামতো প্রথম স্বাধীনতা দিবস আসবার আগেই বাংলাদেশ থেকে চলে যায় ভারতীয় সৈন্যরা। কিন্তু যাবার আগে এদেশের মানুষের মনে জাগিয়ে দিয়ে যায় নানারকম ক্ষোভ। অভিযোগ ওঠে যাবার সময় ভারতীয় সেনারা অবৈধভাবে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে বিশাল অস্ত্র ভান্ডার, বিবিধ সম্পদ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসে লেখেন : ‘ঢাকায় এতসব জিনিস পাওয়া যায়, এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রিফ্রেজারেটর, টিভি, টু ইন ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার, এইসব ভর্তি হতে লাগল ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে’।
লুটের জন্য কোনো কোনো ভারতীয় অফিসারের সে দেশে কোর্ট মার্শালও হয়। প্রতিবাদ ওঠে মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে। ভারতের সঙ্গে শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্পর্কে দেখা দেয় তিক্ততা। স্বাধীনতার পর পর চা স্টলে, ঘরে ঘরে পাশাপাশি ঝুলতে শেখ মুজিব আর ইন্দিরার ছবি।
বন্ধুত্বের এই মায়া দ্রুত পর্যবেশিত হয় বৈরিতায়।
.
হাঁটু গেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে কাদের সিদ্দিকী আর তার দল, মুজিববাহিনীর ছেলেরা শেখ মুজিবের কাছে অস্ত্র সমর্পন করে ঠিকই কিন্তু এর বাইরেও রয়ে যায় হাজার হাজার অস্ত্র। স্বাধীন দেশের পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় অসংখ্য তরুণ, তাদের হাতে গ্রেনেড, অটোমেটিক রাইফেল, লাইট মেশিন গান, রকেট লাঞ্চার। বলা হয় অস্ত্র জমা দিলে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে। কিন্তু নেহাত মিলিশিয়া বাহিনীতে একটা চাকরির জন্য তাদের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। তারা যেন আরও বড় কোনো কাজ, বড় কোনো দায়িত্ব প্রত্যাশা করে। একটি আদর্শের সংগ্রামে যারা জয়ী হয়েছে আরেকটি আদর্শের সংগ্রামে নিয়োজিত হতে উদ্গ্রীব তার একটা চাকরির বিনিময়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হাতছাড়া করতে আগ্রহী হয় না অনেকেই। ফলে দেশের আনাচে-কানাচে চোরাগোপ্তা রয়ে যায় অগণিত অস্ত্র। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসতে থাকে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির খবর। সব দোষ পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। শহরে ছিনতাই, লোকে বলে, এ মুক্তিযোদ্ধার কাজ। ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। অথচ যুদ্ধের দিনগুলিতে শত ভীতির মধ্যেও মুক্তিবাহিনীর একটি ছেলেকে আশ্রয় দিতে পারলে কৃতার্থ হতো মানুষ। সন্ধ্যা হলে গ্রামগুলো যেন হয়ে উঠত ভিয়েতনামের প্রস্তর। হঠাৎ কোথা থেকে এক এক করে ছেলেরা এসে জড়ো হতো। কারো গায়ে গেঞ্জি ফুলপ্যান্ট, কারো লুঙ্গি, হাওয়াই শার্ট, পিঠে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। আধো আঁধারে হেঁটে যেত তারা যেন দেবদূত। শংকা কেটে। গেছে মানুষের। অথচ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে উল্টো শঙ্কিত হয়ে পড়ে মানুষ।
শিশুর হাতের গ্যাস বেলুনের মতো সব কেমন যেন হাত ফসকে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। চারদিকে কেবলই স্বপ্নভাঙ্গার আওয়াজ। তবু টলটলায়মান মানুষ তাকিয়ে থাকে শেখ মুজিবের দিকে, আশায় বুক বাঁধে, তিনিই আনবেন মুক্তি। কবি নির্মলেন্দু গুণ লেখেন–
মুজিব
মানে আর কিছু না মুজিব মনে মুক্তি
পিতার সঙ্গে সন্তানের না লেখা প্রেম চুক্তি
.
কিন্তু সে প্রেম ফিকে হয়ে আসছে দ্রুত।
৪২ স্বপ্নের কারখানা
যুদ্ধের পর অনেকটাই বদলে গেছেন তাহের। তার শরীর আর মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যুদ্ধের ঝড় বদলে দিয়েছে তাকে। বদল শুধু ভেতরে নয়, অবয়বে, আচরণেও। ভাবনায় বিপ্লবী হলেও তাহের পোশাকে আসাকে সবসময় কেতাদুরস্তু। ফ্যাশনসচেতন বলে অফিসারদের মধ্যে তার একটা পরিচিতিও আছে। দামী জুতা ছিল তার ফ্যাশন, মদ্যপানও চলত হামেশাই। কিন্তু যুদ্ধের পর বদলে গেছে সেসব। পাই নেই জুতা আর পড়বেন কি? ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি অফিসে যান, খট খট শব্দ তুলে পায়চারী করেন ঘরময়। ইউনিফর্মের বাইরে তখন তার অতি সাধারণ দুতিনটি শার্ট। মদ ছেড়ে দিয়েছেন একদম। সিগারেট না ছাড়লেও আগে। তার ব্রান্ড ছিল বিদেশি এখন ধরেছেন দেশি স্টার। একটা কৃচ্ছতার প্রবণতা দেখা দেয় তার যুধ্যে। লুৎফাকে বলেন তাহের : এখন থেকে বছরে দুটোর বেশি শাড়ি কিন্তু পাবে না। সামনে অনেক কাজ আমাদের।
স্মিত হাসে লুৎফা: বলতে হবে না তোমাকে। আমার শখের কার্ডিগেন দুটা তো ফেলেই এসেছো জঙ্গলে।
চারপাশের স্বপ্নভাঙ্গার আওয়াজ তাহের টের পাচ্ছেন ঠিক। তবু আশায় বুক বাধছেন। শুধু সেনাবাহিনী নয় পুরো দেশ নিয়ে তাহেরের স্বপ্নগুলোর কথা শেখ মুজিবকে জানাবার ইচ্ছা থাকলেও সে সুযোগ আর হয়ে ওঠে না তাহেরের। সীমাহীন ব্যস্ত তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব। একজন সের কমান্ডারের স্বপ্নের কথা শুনবার সময় তার নেই।
কিন্তু নতুন দেশ নিয়ে তাহেরের মনে তখন স্বপ্নের কারখানা। তাহের সিদ্ধান্ত নেন তার ভাবনাগুলো লিখে ফেলবেন, হাপাবেন। লোকে জানুক, কে জানে হয়তো শেখ মুজিবেরও চোখে পড়বে। সারাদিনের কাজের শেষে রাতে ফিরে কখনো নিজে লিখতে বসেন তিনি, কখনো ডিকটেশন দেন লুৎফাকে। তার স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে একটি লেখা লিখে তাহের ছাপিয়ে দেন জনপ্রিয় পত্রিকা বিচিত্রায়। সোনার বাংলার এক রোমন্টিক ছবি আঁকেন তাহের।
আমি একটি সোনার বাংলার চিত্র দেখেছি। এ চির-কল্পনায় কেটেছে আমার বহু বিনিদ্র রাত। এ ছবি আমাকে রোমাঞ্চিত করেছে, উত্তেজিত করেছে। এর কল্পনায় বারবার আমার মনে হয়েছে জনগণের সঙ্গে একত্ম হয়ে আমি এক অসীম শক্তির অধিকারী। এই ছবিই আমাকে সাহস যুগিয়েছিল পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে আমি জনগণের সাথে একাত্ম হয়েছি। বাংলার মানুষের নিবিড় সংস্পর্শে এসে আমি দেখেছি তাদের উদ্যম, কষ্টসহিষ্ণুতা, শৃঙ্খলা আর দেশপ্রেম। আমি জেনেছি বাংলার এই অশিক্ষিত, প্রতারিত জনগণই হচ্ছে প্রকৃত প্রগতিশীল। তারাই বাংলার সুপ্ত শক্তি। বাংলার এই জনগণকে আমি আমার চিত্রকল্পনায় অংশীদার করতে চাই। আমি চাই তারা গভীরভাবে এই চিত্র উপলব্ধি করুক। রোমাঞ্চিত হোক, উত্তেজিত হোক। তাদের শক্তির পূর্ণ প্রকাশের মাধ্যমে ইতিহাসের জাদুঘরে বন্দি ধন ধান্যে পুষ্পেভরা সোনার বাংলাকে মুক্ত করুক …।
তাহেরের সোনার বাংলার ভিত্তি হচ্ছে নদী। তাহের লেখেন নদী আমাদের প্রাণ অথচ ক্রমাগত অবহেলা আর বিরুদ্ধাচরণে সেই নদীর চঞ্চল প্রবাহ আজ স্তি মিত। তাহের এমন একটি সোনার বাংলার কল্পনা করেন যেখানে এই নদীর দুপাশে বিস্তীর্ণ, উঁচু বাঁধ। সে বাঁধের উপর দিয়ে চলে গেছে মসৃণ সোজা সড়ক, রেলপথ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ লাইন। বাঁধের উভয় পাশে ইতস্ত ত বিক্ষিপ্ত গ্রাম। সেখানে নির্ধারিত দূরত্বে একই নকশার অনেক বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি জনপদ। প্রতিটি বাড়ির সামনে একটি সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রাঙ্গণ আর চারদিকে ফুল। বাড়ির পেছনে রকমারী সবজির সমারোহ। আছে খোলা মাঠ। বিকেল বেলা বুড়োরা এই মাঠের চারপাশে বসে গল্প করে। ছেলে মেয়েরা মেতে ওঠে নানা খেলায়। সকালবেলা সামনের সোজা সড়ক থেকে বাসের হর্ন শোনা যায়। হৈ চৈ করে ছেলে মেয়েরা যায় স্কুলে। এ জনপদে সন্ধ্যার পর নেমে আসে না বিভীষিকা। রাস্তায় বিজলী বাতি জ্বলে ওঠে। প্রতি গ্রামে আছে একটা মিলন কেন্দ্র। সন্ধ্যায় বয়স্করা সেখানে যায়। সারাদিনের কাজ পর্যালোচনা করে। আগামী দিনের পরিকল্পনা করে। সেখানে বসে তারা টেলিভিশন দেখে। জনপদের নানা অগ্রগতির খবর পায় টেলিভিশনে, নেতার নির্দেশ পায়। এ জনপদের বাধের দুপাশে বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত। বর্ষায় সুইস গেট দিয়ে বন্যার পানি ফসলের ক্ষেতগুলোকে করে প্রবিত,আবৃত করে পলিমাটিতে। এখানে স্বল্পকালীন স্বার্থে নদীর স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করার কোনো অপচেষ্টা নেই। প্রকৃতির সঙ্গে অপূর্ব সমঝোতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা এই জনপদ যেন প্রকৃতিরই আরেকটি প্রকাশ। এ জনপদের বাধের উপরই রয়েছে স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চিত্রশালা, নাট্যশালা, হাসপাতাল, শিল্প কারখানা, বিমানবন্দর। নদীর পাশে গড়ে উঠা এই জনপদের সুস্থ মানুষেরা হাসে, গান গায়।
এই স্বপ্নের জনপদ কি গড়া সম্ভব? তাহের লেখেন অবশ্যই সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন বিপ্লবী জনগণ। প্রয়োজন একটি বিপ্লবী জাতীয় পরিকল্পনার। বৈদেশিক সাহায্য, টাকা আর টেন্ডারের ভিত্তিতে পরিকল্পনায় নয়। একটা আদর্শগত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পরিকল্পনা।
তাহের বছরকে দুটো ভাগে ভাগ করবার পরামর্শ দেন। বর্ষা আর শীত। বর্ষায় হবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, পর্যালোচনা হবে আগের বছরের ভুলভ্রান্তির। আর শীতকালে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োগ করা হবে শ্রমশক্তি। সারাদেশে তখন হবে কর্মশিবির। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কর্মক্ষম সবাই ঐ কর্মশিবিরে যোগ দেবে। স্কুল কলেজ এ সময় বন্ধ থাকবে। ধনী গরিব সবাই একসঙ্গে কাজ করবে এই কর্মশিবিরে। আর্মি, বিডিআর, পুলিশও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলে এখানে কাজ করবে। এতে তাদেরও আত্মশুদ্ধি হবে। তারা পরিণত হবে জনগণের বাহিনীতে।
যুদ্ধের আগে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে তাহেরের বিপ্লবের পরিকল্পনা নষ্ট হয়েছিল অঙ্কুরেই। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশের বিপুল সাধারণ মানুষের শক্তি, স্বপ্ন, সম্ভাবনার সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে নতুনভাবে জারিত হয়েছেন তাহের। তার স্বপ্নের দেশ গড়বার সুযোগ এসেছে হাতের মুঠোয়। তবে সে মুহূর্তে খানিকটা দ্বিধাস্থিত তাহের। তাহের ভাবেন তিনি কি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকে, সেনাবাহিনীর মধ্যেই তার মেধা, শ্রম নিয়েজিত করবেন নাকি এ কাঠামো থেকে বেরিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করবেন বিপ্লবী রাজনীতিতে?
তাহের ভাবেন এই নতুন রাষ্ট্রটি এখনও একটা ফরমেটিভ, নির্মীয়মান অবস্থায় আছে। তিনি পুরোপুরি এর ওপর আস্থা হারান না। আরও একটু পর্যবেক্ষণে থাকতে চান। সিদ্ধান্ত নেন তার নিজের কাজের যে ক্ষেত্র সেনাবাহিনী, সেখানে থেকেই আপাতত তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবেন এবং সেখান থেকেই ক্রমশ জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবার চেষ্টা করবেন। শেখ মুজিবের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তাহের তার মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাবেন।
৪৩. গরুর দড়ি
আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তখন শেখ মুজিবের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। যুদ্ধের নয়টি মাস দেশজুড়ে মানুষকে যিনি ভুলিয়ে রেখেছিলেন শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি। কিন্তু স্বাধীনতার পর তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে শেখ মুজিবের। স্বাধীন দেশে শেখ মুজিব যেদিন ফিরলেন, বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নামলে তাকে প্রথম জড়িয়ে ধরেন তাজউদ্দীন। লক্ষ মানুষের ঢল ঠেলে মুজিব বাড়িতে পৌঁছালে তাজউদীন তাকে বিশ্রামের জন্য বাড়িতে রেখে ফিরে যান। বলেন আসবেন পরদিন সকালে। কিন্তু বাড়ি ফেরে না যুবরাজরা। শেখ মণি এবং তার সঙ্গী তরুণেরা সে রাতে শেখ মুজিবের ঘরে রুদ্ধদ্বার আলাপ করেন দীর্ঘক্ষণ। প্রথম রাতেই সেই তরুণদের কাছে শেখ মুজিব নেন দেশের নানা পাঠ। পাঠের অন্তর্ভুক্ত বিষয় তাজউদ্দীনও। শেখ মণিসহ তার সঙ্গীরা যুদ্ধের পুরোটা সময় বিরোধিতা করেছেন তাজউদ্দীনের। তাজউদ্দীন তাদের কাছে ক্ষমতালোভী একজন মানুষ যিনি স্বতোপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। এইসব কথার ধোঁয়ায় শেখ মুজিবের কান ভারী করেন তারা। বিড়াল মারা হয় প্রথম রাতেই। এর পরিণতি হয় সুদূর প্রসারী। পরদিন ভোরে তাজউদ্দীন দেখা করতে গেলে শেখ মুজিব থাকেন শীতল।
অতি উৎসাহে তাজউদ্দীন বলেনঃ মুজিব ভাই, ছেলেপেলেদের হাতে প্রচুর অস্ত্র, এগুলো ওদের হাত থেকে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
মুজিব বলেন : ও নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, আমি বললেই ওরা অস্ত্র সব জমা দিয়ে দিবে।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন তাজউদ্দীন।
তাজউদ্দীন উদগ্রীব হয়ে থাকেন কবে শেখ মুজিব তাকে ডাকবেন নয় মাস রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে তার ছুটে বেড়াবার অভিজ্ঞতা নিতে। কিন্তু সে ডাক আর আসে না।
সাহায্যের জন্য বাংলাদেশকে তখন হাত প্রসারিত করতে হচ্ছে চারদিকে। সবচাইতে ধনবান দেশ আমেরিকা এবং তার সহযোগী বিশ্ব ব্যাংকের দিকেও। কিন্তু তাজউদ্দীন বললেন না খেয়ে থাকব তবু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য নেব না। সবি তো গেছে এই অহংকারটুকুও বিসর্জন দিতে হবে আমাদের?
কিন্তু নিঃশ্বের অহংকারের জোর আর কতক্ষণ? ওয়ার্ডব্যাংকের প্রধান ম্যাকনামার একদিন বাংলাদেশে আসেন সাহায্যের ঝুলি নিয়ে। তাজউদ্দীন একটু যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেন। বলেন বিমানবন্দরে আমি তাকে রিসিভ করতে যাবে না। অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়মমাফিক তারই যাওয়ার কথা। শেখ মুজিব অনুরোধ করেন কিন্তু তাজউদ্দীন যাবেন না। শেখ মুজিব বলেন, তাহলে কি আমি যাবো?
না আপনিও যাবেন না : বলেন তাজউদ্দীন।
শেষে ম্যাকনামারাকে রিসিভ করতে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
ম্যাকনামারার ব্যাপারে তার এই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয়েছে আরও আগেই। ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে তাজউদ্দীন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিল্লিতে উপস্থিত ছিলেন। সে অনুষ্ঠানে আছেন ম্যকনামারও। ভারত সরকার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বসার যে ব্যবস্থা করেছিলেন তাতে তাজউদ্দীনকে বসতে হয় ম্যাকনামারার পাশে। সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো চলছে। তাজউদ্দীন এবং ম্যাকনামারা পাশাপাশি বসে আছেন। কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে সৌজন্যবশত হলেও তাজউদ্দীন একটি কথাও বলেননি ম্যাকনামারার সঙ্গে। যেন এক অভিমানী বালক।
কিন্তু বাংলাদেশে যখন এসে পড়েছেন ম্যাকনামারা, তখন অর্থমন্ত্রী হিসেবে শেষ পর্যন্ত তাকে তার সঙ্গে বৈঠকে বসতেই হয়। লাঞ্চে বসেন তার সঙ্গে। সাথে প্লানিং কমিশনের অন্যতম সদস্য নুরুল ইসলাম। সেখানে প্রায় পরাবাস্তব এক নাটকের অবতারণা করেন তাজউদ্দীন।
ম্যাকনামারা : মিস্টার মিনিস্টার আমাকে বলুন বাংলাদেশের কোথায় কি ধরনের সাহায্য দরকার।
তাজউদ্দীনঃ মিস্টার ম্যাকনামারা আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে।
ম্যকনামারাঃ মিস্টার মিনিস্টার আপনি বলুন আমরা চেষ্টা করব দিতে।
তাজউদ্দীন : মিস্টার ম্যাকনামারা আমার এখন অনেক গরু দরকার। যুদ্ধের সময় তো কৃষকদের সব গরু হারিয়ে গেছে। এখানে ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে চাষীয়া এদিক সেদিক পালিয়ে গেছে। সে সময়ই গরু সব হারিয়ে গেছে তাদের। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষী ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কিভাবে? তাই এখন আমাদের প্রথম দরকার গরু।
মাকনামারা অপ্রস্তুত। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
তাজউদ্দীন বলেনঃ আরও কথা আছে। গরুর পাশপাশি আমাদের অনেক দড়িও দরকার। আমাদের সব দড়ি তো পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে, পুড়িয়ে ফেলেছে। এখন শুধু গরু পেলে তো হবে না, গরুকে বাঁধতেও হবে। গরু আর দড়ি খুব তাড়াতাড়ি প্রয়োজন। তা না হলে সামনের মৌসুমে জমিতে চাষ হবে না।
অস্বস্তিতে নুরুল ইসলাম জানালা দিয়ে আকাশ দেখেন, এদিক ওদিক তাকান। শেষে বলেন : আমাদের এর পাশাপাশি আরও অন্যান্য প্রয়োজনও অবশ্য আছে।
মিটিং শেষে তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করেন নুরুল ইসলাম : আপনি এমন কেন করলেন?
তাজইদ্দীন ক্ষেপে যান : কেন ভুল কি বলেছি? গরু ছাড়া কি চাষ হবে? … আরে ঐ লোকটা তো আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদের স্যাবোটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদের ধ্বংস করে দিতে। ওদের সাহায্য ছাড়া চলা কি আমাদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব? হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি না?
কঠিন মানুষ তাজউদ্দীন।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হতো যদি তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটত তাজউদ্দীনের। সরকারের ভেতর তাজউদ্দীনই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবনার দিকে। কদাচিৎ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাত হলেও পরস্পরের ভাবনা সমবায় করবার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি তাদের।
৪৪. দু দিকে জ্বালানো মোমবাতি
ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকা স্বাধীনতার মাস কয়েকের মাথায় লেখে ধ্বংসের মুখে বাংলাদেশ।
তাজউদ্দীন যতই আস্ফালন করুন শেখ মুজিব টের পান বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তাকে দু হাত বাড়াতে হবে চারদিকে। খোলা রাখতে হবে সব কটা জানালা যাতে বিশ্বের যত শক্তিমান, সম্পদশালী দেশগুলোর হাওয়া আসে। পরাশক্তির একটি রাশিয়া, তাকে নিয়ে শেখ মুজিবের দুশ্চিন্তা কম। রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধে সব সময় পাশেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই শেখ মুজিবকে তাদের দেশে নিমন্ত্রণ করে রুশ সরকার। রুশরা ঐ নতুন দেশটি রাখতে চায় তাদের ছাতার তলে। ব্রেজনেভ তার ঘন জোড়া ভুরু স্থির রেখে পোলা হাতে সই করেন একাধিক চুক্তি বাংলাদেশ পেয়ে যায় তাদের অগঠিত বিমানবাহিনীর প্রথম বিমান আর হেলিকপ্টার, দলে দলে বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা পড়বার সুযোগ পায় কিয়েভ, তাসখন্দ আর মস্কোতে। আর কাটা বাছার মতো করে একটি একটি করে জলমাইন তুলে দিয়ে রুশ নাবিকরা অকেজো চট্টগ্রাম বন্দরকে মসৃণ করে দিলে রাজহাসের মতো আসতে থাকে দেশ-বিদেশের জাহাজ।
শেখ মুজিব আমেরিকাকে টানবার জন্যও তৎপর হন। তিনি বলেন, সন্দেহ নেই আমেরিকা বিরোধিতা করেছে মুক্তিযুদ্ধের। কিন্তু আমেরিকার মতো পরাক্রমশালী দেশটিকে উপেক্ষা করবার শক্তি আছে কি বাংলাদেশের? উপেক্ষা করে লাভ আছে কি? শেখ মুজিব তাই আমেরিকার দিকে হাত বাড়ান। দেখা করেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর কিসিঞ্জারের সঙ্গে, যারা ঘোর বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার। কিন্তু দেশের মাঠ, ফসল সব নিশ্চিহ্ন, খাদ্য সাহায্য দিতে পারে কেবল আমেরিকাই। দেশ বাঁচাতে শত্রুরও দ্বারস্থ হতে হয় শেখ মুজিবকে। মোটা চশমার নিচে কিসিঞ্জারের চোখ হাসে! শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন কিসিঞ্জার। মাত্র ১৯ ঘণ্টার জন্য। কিসিঞ্জার আসবার ঠিক আগে আগে পদত্যাগ করতে হয় তাজউদ্দীনকে। ম্যাকনামার সঙ্গে তাজউদ্দীন যেমন করেছিলেন তেমন কোনো নাটকের অবতারণা যেন না হয় তার ব্যবস্থা করা হয় আগে ভাগেই। কিসিঞ্জার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যান টাকা থেকে।
আর সম্পদ আছে তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোতে। খোঁজ পাওয়া যায়, সে দেশগুলো মিলিত হবে পাকিস্তানের লাহোরে ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশের কি উচিত সে সম্মেলনে যোগ দেওয়া? বাংলাদেশ কোনো ধর্মভিত্তিক দেশ নয়, সে কেন যাবে ইসলামী সম্মেলনে? তাছাড়া এ সম্মেলন হবে কিনা পরাজিত পাকিস্তানে। এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য হয়তো সমীচীন নয়। কিন্তু শেখ মুজিব তখন মরিয়া। এই সম্মেলনকে একটা সুযোগ হিসেবে দেখতে চান মুজিব। এখানে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। আটকে পড়া বাঙালি এবং বিহারীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো, যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাঠান, সম্পদের হিস্যা, সর্বোপরি স্বীকৃতি। সবকিছুর একটা সমাধান হতে পারে। তাছাড়া সেখানে জড়ো হবে ধনবান সব আরব দেশগুলোর প্রধান। তাদের সঙ্গেও প্রয়োজন বন্ধুত্ব। ফলে শেখ মুজিব লাহোরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কাজ হয় তাতে। স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক। মিসরের রাষ্ট্রনায়ক আনোয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার কিংবদন্তি নেতা হোয়ারী বুমেদীন আসেন ঢাকায়। আসেন ভুট্টোও। অবশ্য বাংলাদেশ নিয়ে ভুট্টোর প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা লুকানো থাকে না। বিচিত্র রঙের শার্ট, মাথায় ক্যাপ পড়ে হালকা চালে বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান ভুট্টো, যেন পিকনিকে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পেয়ে যায় জাতিসংঘের সদস্যপদ। জাতিসংঘের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন শেখ মুজিব।
ব্যক্তিত্বের ক্যারিশমাকে সম্বল করে, মোমবাতির ডান বাম দুদিকেই জ্বালিয়ে বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে চলেন শেখ মুজিব।
৪৫. লাঙ্গল ব্রিগেড
অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের পদ থেকে তাহেরকে বদলি করা হয় কুমিল্পা ক্যান্টনমেন্টের পুরো ব্রিগেডের দায়িত্ব দিয়ে। সুশিই হন তাহের। লুৎফাকে বলেন : ভালোই হলো, নিজের মতো করে একটা ব্রিগেড তৈরি করা যাবে। যে ধরনের আর্মির কথা আমি বলছি তার একটা মডেল করে আমি দেখাতে পারব।
কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্বে তখন ব্রিগেডিয়ার জিয়া। জিয়াকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় মেজর জেনারেল এবং তাকে উপ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে বদলি করা হয় ঢাকায়। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ শুরু থেকেই পালন করছেন সেনা প্রধানের দায়িত্ব।
তাহের দায়িত্ব বুঝে নেবার জন্য চলে যান কুমিল্লায়। জিয়ার কোয়ার্টারের লনে বিকালে বসে আড্ডা দেন। যুদ্ধের সময় তেলঢালা ক্যাম্পে বসে এমন আচ্ছা দেবার স্মৃতি মনে পড়ে তাদের। এসব আড্ডায় অধিকাংশ সময় তাহের বক্তা, জিয়া শ্রোতা। জিয়া স্বল্পৰাক এবং সাবধানী। অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, নিজের মতো সহজে জানান না। তাহের বলেন : স্যার, ঢাকায় যাচ্ছেন, ওখানে থিংকস আর পেটিং কম্লিকেটেড। দি লাইন বিটুইন পলিটিকস অ্যান্ড আর্মি ইজ গেটিং ব্লার্ড। অনেক আর্মি অফিসাররাই এজিটেটেড কারেন্ট পলিটিক্যাল সিচুয়েশন নিয়ে।
জিয়া মাথা নাড়েন : ইয়েস আই নো।
তাহের বলেন : আমার কথা হচ্ছে শুধু এজিটেটেড হলে তো হবে না। পুরো পলিটিকসের ডিনামিক্সটা বুঝতে হবে। আমি মনে করি, আর্মি শুড প্লে এ রোল ইন নেশন বিল্ডিং। কিন্তু সেটা একটা প্রপার ইডিওলজি দিয়ে গাইডেড হতে হবে। একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের আর্মিটি ফর্ম হয়েছে, সেই স্পিরিটটা রাখতে হবে। এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, সিরিয়া ঈজিপ্টে আর্মি কি একটা ন্যাশনালিস্ট রোল প্লে করছে না? আমি স্যার কুমিল্লায় কিছু জিনিস এক্সপেরিমেন্ট করব। আমি হোপ ইউ উইল সাপোর্ট মি এজ ইউ ডিড ডিউরিং ওয়ার।
জিয়া : শুরু করো অ্যান্ড কিপ ইন টাচ উইথ মী।
জিয়া আর তাহের যখন গল্প করছেন, তখন তাহেরের মেয়ে জয়া আর জিয়ার ছেলে কোকো দুজন ছোটাছুটি করে খেলে লনে। আর ঘরের ভেতর কথা বলেন লুৎফা আর খালেদা। সাদামাটা গৃহিণী খালেদা লুৎফার সঙ্গে আলাপ করেন সংসারের নানা টুকিটার্কি নিয়ে। ঢাকায় কোথায় জিনিস সস্তা পাওয়া যায় খোঁজ খবর নেন। সোয়ারী ঘাট থেকে কিনলে মাছ একটু কম দাম পড়ে কিনা জানতে হান। স্যার তখন জানবার কথা নয় যে একদিন এই গৃহবধূকে নিতে হবে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার ভার। তাহেরেরও জানার কথা নয় এই দুই পরিবারের যোগাযোগের এই নিরপদ্রুপ আবহ ক্রমশ ধাবিত হবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে।
জিয়া চলে গেলে তাহের পুরো ব্রিগেডের দায়িত্ব নেন এবং খোল নাচে পালটে ফেলেন ব্রিগেডের। তাহেরের মনে পিপলস আর্মির যে ধারণা রয়েছে তার পরীক্ষায় নেমে পড়েন তিনি।
পুরো ব্রিগেডকে ফল ইন করিয়ে তিনি বলেন : ক্যান্টনমেন্টে বসে শুধু পিটি, প্যারেড আর ভলিবল, ফুটবল খেললে চলবে না, মানুষের ভেতরে গিয়ে, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।
তিনি দায়িত্ব ভাগ করে দেন। ব্রিগেডের এডুকেশন কোরকে নির্দেশ দেন গ্রামে গিয়ে প্রাইমারি স্কুল আর বয়স্ক শিক্ষার অনানুষ্ঠানিক স্কুল খুলতে। তিনি বলেন এডুকেশন কোরের সিপাই, অফিসাররা দিনে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের পড়াবে, রাতে পড়াবে বুড়োদের। মেডিকেল কোরকে তিনি বলেন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান দিতে। উৎসাহে সৈনিকরা মিলে সব নেমে পড়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশের গ্রামে।
অন্য সিপাইদের জাহের লাগিয়ে দেন ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের পতিত জমিগুলোতে চাষ করতে। কাছেই কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা বার্ড। সেখান থেকে চাষাবাদ বিষয়ে নানা বই যোগাড় করা হয়। তাহের সব অফিসারদেরও বাধ্য করেন সকালে ক্ষেতে কাজ করতে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তাহেরের অধীনে কাজ করছেন মেজর ডালিম, জিয়াউদ্দীন প্রমুখেরা। তারা সবাই তখন সৈনিক কৃষক। লাঙ্গল কোদাল নিয়ে অন্যদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েন এক পা-হীন ব্রিগেড কমান্ডার তাহেরও। ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে লাগানো হয় প্রচুর আনারস, লেবু গাছ, সেইসঙ্গে শাল আর সেগুন গাছ। সবার মধ্যেই বেশ একটা উদ্দীপনা দেখা দেয়। সেবার ময়নামতির পাহাড়ি ঢালুতে আড়াই লাখ আনারস আবাদ করেন ব্রিগেডের সৈনিকরা। আনারস বিক্রী করে ক্যান্টনমেন্টের আয়ও হয় প্রচুর। তাহের তার ব্রিগেডের প্রতীক করেন লাঙ্গল।
তাহের লুৎফাকে বলেনঃ যুদ্ধের সময় অফিসার, সিপাইরা কি দুর্দান্তভাবে মিশে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে। আর যুদ্ধের পর তারা যেন হয়ে গেছে দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। আমি এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে চাই।
লুৎফাও সক্রিয়ভাবে লেগে পড়েন তাহেরের এই নতুন উদ্যোগে। আশপাশের গ্রামের যেসব মেয়েরা যুদ্ধের সময় ধর্ষিতা হয়েছেন, যাদের স্বামী মারা গেছেন তাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টের বাইরে তবু টেনে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লুৎফা এদের জন্য নানা রকম কাজের ব্যবস্থা করেন। তাদের সেলাই শেখানো হয়, শেখানো হয় নানা কুটির শিল্প। ঐ মেয়েদের বানানো কাপড় এবং অন্যান্য উপকরণ দিয়েই উদ্বোধন হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাশের খাদি দোকানগুলো, যা দাঁড়িয়ে আছে আজো।
তাহের সিপাই আর অফিসারদের ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবারও নানা উদ্যোগ নেন। অফিসারদের নিজস্ব ক্লাব থাকলেও সিপাইদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না তখন। তাহের সিপাই আর অফিসারদের পরিবার মিলিয়ে যৌথ পিকনিকের ব্যবস্থা করেন। সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এমনটি আর ঘটেনি আগে কখনো। সিপাইদের স্ত্রীদের জন্য করা হয় ক্লাবের ব্যবস্থা। সেখানে সিপাইদের বেস্ত্রীদের পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেন লুক্কাসহ অন্য অফিসারদের স্ত্রীরা। সিপাই, অফিসার মিলে আয়োজন করেন বিচিত্রা অনুষ্ঠান।
কুমিল্লা ব্রিগেডে ভিন্নতর এক আবহ। বিকেলের শেষ আলোয় সিপাইরা ফুটবল খেলে, দেখা যায় মাঠের মধ্যে ক্র্যাচ নিয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক খেলোয়াড়! যুদ্ধাহত অভিনব এক ব্রিগেড কমান্ডার।
সন্ধ্যায় অফিসারদের জন্য তাহের চালু করেন পলিটিক্যাল ক্লাস। কখনো ডিনারের আগে, কখনো পরে জুনিয়র অফিসারদের নিয়ে বসেন তাহের। ক্ৰাচটি দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে তাহের তাদের উদ্দেশে বলেন : আমাদের আর্মির হিস্ট্রিটাকে তোমাদের ক্রিটিক্যালি দেখতে হবে। পাকিস্তান আর্মি যাদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল এরা তো সব ব্রিটিশ আর্মিরই লোকজন। ব্রিটিশদের চাকরি করত, পরে পাকিস্তান হওয়াতে তারাই হয়েছে পাকিস্তান আর্মি। ব্রিটিশ আর্মিতে যে ইন্ডিয়ানরা চাকরি করত, হোয়াট ওয়াজ দেওয়ার রোল? ওরা ছিল একটা ভাড়াটে বাহিনী। লোকাল আপরাইজিংগুলোকে ঠেকানোর জন্য এই আর্মি ব্যবহার করা হতো। ঐ বাহিনীকেই তারা লেলিয়ে দিয়েছিল সিরাজদৌলার বিরুদ্ধে, টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে, বাহাদুর শাহ জাফরের বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়ান সোলজার, অফিসাররা তাদের দেশের মানুষের বিদ্রোহগুলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। এরা ছিল স্রেফ ব্রিটিশদের তাবেদার, ঠেঙ্গারে বাহিনী। একমাত্র মিউটিনির সময় প্রথম ব্রিটিশদের টনক নড়ে। ওরা তখন সাবধান হয়ে যায় সিপাই আর অফিসার রিক্রুট করার ব্যাপারে। বেছে বেছে শুধু গুর্খা, শিখ আর পাঞ্জাবিদের রিক্রুট করতে থাকে, কারণ তারা ছিল ব্রিটিশদের মোস্ট ট্রাস্টেট। পাকিস্তান আর্মি তো ঐ ধরনের ব্রিটিশ ভাড়াটে বাহিনীরই কন্টিনিউশন। তাদের মাইন্ড সেটটাও তো তাই, শুধু কারো না কারো তাবেদারি করা আর ঠেঙ্গানো।
কিন্তু আমরা বাংলাদেশ আর্মি তো গড়ে তুলেছি একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমরা কেন ঐ লেগাসি ক্যারি করব? আর্মি এদেশের মানুষ দিয়েই তৈরি কিছু এই অর্গানাইজেশনটাকে সমাজের সবরকম কাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা আছে সবসময়। আর্মির লোকের সাথে সাধারণ মানুষের মেলামেশার কোনো সুযোগ নাই। এতে করে একটা এলিটিস্ট মানসিকতা তৈরি হয়। যেন আর্মির কাজ হচ্ছে দেশের মানুষের উপর খবরদারী করা। এটা একটা তাবেদার আর্মির এজো হতে পারে। বাংলাদেশের আর্মির মাইন্ড সেটটা এমন হবে কেন, যার জন্ম হয়েছে একটা জনযুদ্ধের মধ্যে। আমাদের আর্মিকে হতে হবে পিপলস আর্মি।
তাহেরের নির্দেশে নতুন ধরনের আর্মির এই মডেলে কাজ করলেও সবাই যে তার সঙ্গে একমত হন তা নয়। গুটিকয় তরুণ অফিসার অপ্রাণিত হন তার মন্ত্রে। এর মধ্যে অন্যতম মেজর জিয়াউদ্দীন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সুন্দরবন এলাকায় যুদ্ধ করে জন্ম দিয়েছেন কিংবদন্তির। জিয়াউদ্দীন প্রায়শই পৃথকভাবে এসে দেখা করেন তাহেরের সঙ্গে বলেন; আমি স্যার আছি আপনার সঙ্গে।
ঢাকায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তাহেরের কাজকর্ম নিয়ে শুরু হয়ে যায় নানা কানাঘুষা। ব্রিগেড কমান্ডারদের মিটিং এ টিটকারী দিয়ে একজন বলেন : কুমিল্লায় লাঙ্গল ব্রিগেড চালু করে তাহের তো সবাইকে কমিউনিস্ট বানাচ্ছে।
৪৬. আনারসের চোখ
তাহের ক্যান্টনমেন্টের ভেতর যতই লাখ লাখ আনারসের চোখ ফুটিয়ে রাখুন না কেন, বাংলাদেশের নানা প্রান্তের মানুষের চোখে তখন সংকট আর দ্বিধার কুয়াশা। স্বাধীনতার পর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক রূপান্তরের যে জটিল, বিচিত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে অতিক্রম করা হয়ে উঠেছে দুরূহ।
দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কখনো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে, কখনো ঢাকায় নিয়মিত তাহেরের সঙ্গে আলাপ চলে ভাই ইউসুফ, আনোয়ারের সঙ্গে, সেখানে মাঝে মাঝে যোগ দেন তার পাকিস্তান পালানোর সঙ্গী কর্নেল জিয়াউদ্দীন। আর্মির ভেতরকার অবস্থা নিয়ে কথা হয়।
জিয়াউদ্দীন বলেন : আই থিংক শেখ মুজিব রিয়েলি মেইড এ মিসটেক বাই নট মেকিং জিয়া দি চিফ।
তাহের : ওসমানী ডাজ নট লাইক হিম। যুদ্ধের সময় তুমিও তো দেখেছ কিভাবে বেশ কবার তাদের মধ্যে কনফ্লিক্ট হয়েছে নানা পয়েন্টে।
জিয়াউদ্দীন : শফিউল্লাহ তার ব্যাচমেট হলেও তো সার্ভিস ওয়াইজ জিয়ার জুনিয়র। আই অ্যাম সিওর জিয়া ডিড নট টেক দিস অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইজিলি।
তাহের : অবশ্য জিয়া এমন একজন মানুষ, যিনি নাইদার হিয়ার নট দেওয়ার। বগুড়ায় বাড়ি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে হি ওয়াজ ব্ৰট আপ ইন করাচি। সারা জীবন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকলেও বাঙালি হওয়ার কারণে পশ্চিম পাকিস্ত নিরা তাকে অবিশ্বাস করেছে আবার সবসময় দেশে থাকেন না, ভালো বাংলা খাতে পারেন না বলে বাঙালিদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা কম।
জিয়াউদ্দীন : উনি কি ফার্স্ট টাইম আর্মিতে চান্স পান নাই।
ইউসুফ : তাই নাকি?
তাহের : হ্যাঁ, ওয়েট অনেক কম ছিল। তাকে বলা হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে অপটিমাম ওয়েট করতে পারলে নেওয়া হবে। তারপর তো তার মা খুব করে খাইয়ে ওজন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। উনি কিন্তু খুব ভালো হকি প্লেয়ার। ছিলেন। যাই হোক, আই এগ্রি উইথ ইউ যে জেনারেল শফিউল্লাহকে তার বস। বানিয়ে মুজিব একটা পটেলশিয়াল ক্রাইসিস আর্মির ভেতর তৈরি করেছেন।
জিয়াউদ্দীনঃ আর শেখ মুজিবের নেক্সট মিসটেক হচ্ছে রক্ষীবাহিনী তৈরি করা।
ইউসুফ : অবশ্য আওয়ামী লীগের ছয় দফাতে এমন একটা জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করার কথা আগেই ছিল। তাছাড়া ছেলেরা যেভাবে সব অস্ত্র নিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকম একটা প্যারা মিলিটারি টুপ বানিয়ে এদেরকে কন্ট্রোলে রাখার জন্য হয়তো এটা করেছেন।
জিয়াউদ্দীন : কিন্তু যে প্রসেসে করা হচ্ছে এটা তো খুব প্রবলেম্যাটিক। শুরুতেই কাঁদেরিয়া আর মুজিববাহিনীর এদের নেওয়া হলো পিলখানায়। বিডিমারের সাথে মার্জ করার কথা হলো। বিডিয়ারের লোকেরা এটা মানবে কেন? ট্রেইন আর্মির লোকরা কেন দুমাস স্টেনগান চালানো এসব কৃষক, শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে যাবে? কি প্রচণ্ড গণ্ডগোলটা হলো। শেখ মুজিব ওখানে না গেলে সিপাইরা তো রক্ষীবাহিনীর চিফ ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানকে পিটিয়েই শেষ করে দিত।
তাহের : তাছাড়া যেভাবে এক্সপান্ড করা হচ্ছে রক্ষীবাহিনীকে তাতে আর্মির ভেতর কনফ্লিক্টিং সিচুয়েশন তৈরি হবে।
জিয়াউদ্দীন : এক্সাক্টলি। অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে রক্ষীবাহিনীর স্ট্রেন্থ ৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর জন্য নানা নতুন সব অস্ত্র আসছে। অনেকেই মনে করছে রক্ষীবাহিনীকে আর্মির বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। মুজিববাহিনীকে ট্রেইন করেছে যে জেনারেল ওবান, তাকে করা হয়েছে রক্ষীবাহিনীর ট্রেইনার। রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারদের ইন্ডিয়ায় নিয়ে ট্রেইনিং দেওয়া হচ্ছে। তাদের ইউনিফর্মও ইন্ডিয়ার আর্মির মতো জলপাই রঙের। এসব কিসের আলামত? ইন্দিরা গান্ধী এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি করেছেন। কি আছে ঐ চুক্তিতে তা তো ভালোমতো আমরা জানিও না। রক্ষীবাহিনীর মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়া আমাদের ওপর তাদের একটা কন্ট্রোল রাখার চেষ্টা করছে কিনা কে জানে?
ইউসুফ : যদিও অবশ্য বলা হচ্ছে রক্ষীবাহিনীর মূল কাজ বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, কালোবাজারি, ছিনতাই দমন। কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে তাদের।
জিয়াউদ্দীন : সেটাই তো ডেঞ্জারাস। তাদের কাজ বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার হলেও তাদের টার্গেট তো দেখছি যারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছে তারা। কোনো গ্রামে রক্ষীবাহিনী তাবু ফেললে আতংক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
তাহের : আমি তো শুনছি রক্ষীবাহিনী মেইনলি ধরছে লেফট পার্টির ছেলেদের। পার্টিকুলারলি সিরাজ শিকদারের দলের লোকদের। সিরাজ শিকদারের কি খবর আনোয়ার?
আনোয়ার : এখন তো আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্ৰেট সিরাজ শিকদার। সিরাজ শিকদার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ হিসেবে দেখছেন। উনি এ ব্যাপারেও তার ঐ প্রধান দ্বন্দ্ব এবং অপ্রধান দ্বন্দ্বের তত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন ইন্ডিয়া আমাদের যুদ্ধে হেল্প করার পর এখন পলিটিক্যালি, ইকোনমিক্যালি আমাদের ওপর ডমিনেট করতে চাচ্ছে। তার মতে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দ্বন্দ্বই হচ্ছে এখন দেশের প্রধান দ্বন্দ্ব।
জিয়াউদ্দীন বলেন; আই থিঙ্ক হি ইজ রাইট।
আনোয়ারঃ তারা স্বাধীন বাংলাদেশে আর্মস স্ট্রাগল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার গেরিলা গ্রুপ দেশের নানা অঞ্চলে থানা পুলিশ ফাড়ি আক্রমণ করে, অস্ত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
তাহের : কিন্তু আমি মনে করি না দিস ইজ দি রাইট ওয়ে টু প্রটেষ্ট শেখ মুজিব রাইট নাও। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তো আমি কাজ করেছি। তার মধ্যে একটা রেডিক্যালিজম আছে। কিন্তু আই অ্যাম নট শিওর এটা এখন রাইট ওয়ে কিনা।
ইউসুফ : মাওলানা ভাসানীও তো দাঁড়িয়েছেন মুজিবের বিরুদ্ধে। হক কথা তে উনি দেদারেস মুজিবের ক্রিটিসিজম করছেন। অবশ্য জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে উনি যে ভুখা মিছিল করলেন সেটাকে অনেকেই জাস্টিফাইড মনে করছেন। দেশে একটা অপোজিশন তো থাকতে হবে। ইন্ডিয়ার এগেইন্সস্টে ভাসানীও খুব সোচ্চার। সেদিন বক্তৃতায় বললেন, না খাইয়া থাকমু তবু ইন্ডিয়ার ভিক্ষার চাল খামু না। কলা গাছের রস দিয়া কাপড় সাফ করমু তবু ইন্ডিয়ার পচা সাবান দিয়া না। শেখ মুজিব রিকোয়েস্ট করলেন তবু তো তিনি তার হাঙ্গার স্ট্রাইক ভাঙ্গলেন না, উল্টা হরতাল ডাকলেন।
তাহের : ভাসানী নিঃসন্দেহে একটা ভাইটাল ফ্যাক্টর কিন্তু তাকে সবসময় আমার ধর্ম এবং অতিবামের একটা বিপজ্জনক মিশ্রণ মনে হয়।
জিয়াউদ্দীন : সেদিক থেকে এনায়েতুল্লাহ খানের হলি ডেতেও যে লেখাগুলো ছাপ হচ্ছে সেগুলো অনেক খটফুল। সেদিন মোহাম্মদ তোয়াহার একটি লেখা পড়লাম। তিনি শেখ মুজিবের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কেন তার পক্ষে দেশের কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব না।
তাহের : কিন্তু এই চীনাপন্থীদের বুকিশ এনালাইসিসে আমি সবসময় কনভিন্সড না। দেখেন আব্দুল হক তো এখনও দলের নাম রেখেছেন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। উনি তো বাংলাদেশকেই মেনে নেননি। এটা অ্যাবসার্ড না? আসলে কারেন্ট গভর্নমেন্ট, কারেন্ট পলিটিক্যাল সিচুয়েশনকে যেভাবে এরা কাউন্টার করছে আমার কিন্তু কোনোটাকেই রাইট মনে হচ্ছে না।
ইউসুফ : বামদের মধ্যে শেখ মুজিবের একটা কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজম করতে পারত মস্কোপন্থীরা। বাংলাদেশের ক্যুনিস্ট পার্টি আর ম্যাপ মোজাফফর তো একরকম বিলীনই হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের মধ্যে। তারা বলেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একই সাথে তারা ঐক্য এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, ইউনিটি অ্যান্ড স্ট্রাগল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে তাদের যতটা ইউনিটি দেখছি, স্ট্রাগল তো দেখছি না।
জিয়াউদ্দীন : সেজন্যই বলছি যে একটা প্লাটফর্ম থাকা দরকার যেখান থেকে এই গভর্নমেন্টকে ক্রিটিসাইজ করা যায়। হলি ডে একটা প্লাটফর্ম দিয়েছে। আমি তো ভাবছি আমি একটা আর্টিকেল লিখব। তাহের আই নীড ইওর হেল্প ইন দিস রিগার্ড।
তাহেরঃ আমিও মনে করি লেখা উচিত। লেট আস টক এবাউট ইট মোর ইন ডেপথ।
পরিস্থিতি এমনই নাজুক যে দেশের সবচাইতে সুশৃঙ্খল সংগঠন সেনাবাহিনীর দুই অফিসার তখন প্রকাশ্যে সরকার বিরোধী নিবন্ধ লিখবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
৪৭. হিডেন প্রাইজ
নিবন্ধ লেখাকে কেন্দ্র করে তাহেরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কর্নেল জিয়াউদ্দীনের। তাহের বরাবরের মতো জিয়াউদ্দীনের ক্ষোভ এবং উত্তেজনাকে ধাবিত করতে চান দিন বদলের রাজনীতিতে এবং অবশ্যই তা সাম্যবাদী আদর্শে। তাহের তাকে নানাবিধ মার্ক্সবাদী বই সরবরাহ করেন পড়বার জন্য। তাহেরের সূত্রে জিয়াউদ্দীনের কমিউনিজম পাথ চলতে থাকে শনৈ শনৈ বেগে প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন জিয়াউদ্দীন।
এসময় তাহের লুৎফাকে একদিন বলেন : জিয়াউদ্দীন এতো বেশি বিপ্লবী হয়ে উঠেছে যে ওকে সামাল দেওয়া মুস্কিল হয়ে যাচ্ছে।
তাহেরের সঙ্গে পরামর্শ করেই ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন কর্নেল জিয়াউদ্দীন এবং তা হলি ডে পত্রিকাতে ছাপা হয় হিডেন প্রাইজ নামে। জিয়াউদ্দীন লেখেন–
‘এদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা আজ মস্তবড় এক পীড়নে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখুন উদ্দেশ্যহীন, গতিহীন, প্রাণহীন মুখগুলো জীবনের যান্ত্রিকতায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণত নবীন স্বাধীন একটা দেশে কি ঘটে? নতুন উদ্যম আর স্পৃহা নিয়ে জনগণ শূন্য অবস্থা থেকেই তাদের দেশ গড়ে তোলে। জীবন তখন তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এবং ভয়হীন চিত্তেই তারা তার মুখোমুখি হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আজ ঘটছে তার উল্টোটা। সমগ্র বাংলাদেশ যেন আজ ভিক্ষায় নেমেছে। তার কণ্ঠে কান্না। কেউ কেউ না বুঝেই চিৎকার করছে। দারিদ্রের জোয়ারে হারিয়ে যেতে বসেছে সবাই। লেখাটিতে ভারতের সঙ্গে চুক্তি বিষয়েও বিস্তর ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি এবং শেষে লেখেন : আমরা তাকে ছাড়াই যুদ্ধ করেছি এবং জয়ী হয়েছি। প্রয়োজনে আবার যুদ্ধ করব’।
স্পষ্টতই শেখ মুজিবকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এখানে। একজন কর্তব্যরত আর্মি অফিসারের জন্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ে এরকম মন্তব্য করা গুরুতর ধৃষ্টতা। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি তখন অনারকম। এ যেন ভয়ানক কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এমনকি শেখ মুজিবও ব্যাপারটিকে এতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। তিনি কর্নেল জিয়াউদ্দীনকে ডেকে পাঠান এবং বলেন ক্ষমা চাইতে। জিয়াউদ্দীন ক্ষমা না চেয়ে পদত্যাগ করেন আর্মি থেকে।
তাহেরকে এসে বলেন : নাউ আই এম এ ফ্রি বার্ড। পুরো দেশটাকে একবার ঘুরে দেখতে চাই।
কেতাদূরস্ত কর্নেল জিয়াউদ্দীন কাঁধে এক ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ঢাকা রেল স্টেশনে গিয়ে উঠে পড়েন দূর পাল্লার এক ট্রেনের থার্ডক্লাস বগিতে। স্টেশনে তাকে বিদায় দেন তাহের এবং আনোয়ার। বেশ কিছুদিন পর তাহেরকে চিঠি লিখে জিয়াউদ্দীন জানান-আমি সীমানা অতিক্রম করেছি। তারপর একদিন তাহের জানতে পারেন জিয়াউদ্দীন সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টিতে।
কোনো কোনো দিন বিহ্বল তাহের লুৎফাকে নিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে চলে যান দূরে ময়না মতির পাহাড়ে। শিশু জয়া আর লুৎফাকে নিয়ে বসেন ঘাসের উপর। হাওয়া বয় চারদিক। কণ্ঠে বিষণ্ণতা নিয়ে তাহের বলেন : জিয়াউদ্দীন চাকরিটা ছেড়েই দিল। ওর সঙ্গে পাকিস্তান পালানোর সেই এক্সাইটিং রাতটার কথা মনে পড়ে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। সিনসিয়ারলি যুদ্ধ করেছে। কিন্তু সব কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আমিও কতদিন আর্মিতে থাকতে পারি বুঝতে পারছি না।
উঠে দাঁড়ান তাহের। ক্র্যাচটা হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হেঁটে যান সামনের টিলাটার দিকে। উঠবার চেষ্টা করেন উপরে। পেছন থেকে লুৎফা বলেন : আর উঠার চেষ্টা করে না কিন্তু।
এক দৌড়ে যে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতেন তাহের, ক্রাচে ভর দিয়ে সেখানে সামান্য কয় ধাপ উঠতে পারেন শুধু। ফিরে আসেন, কোলে তুলে নেন জয়াকে। বলেন : বুঝলে লুৎফা পেইন্টার ভ্যানগগ প্রেমিকার জন্য তার একটা কান কেটে ফেলেছিল, আমি তো দেশের জন্য একটা পাই কেটে ফেললাম।
৪৮. নতুন জ্বালামুখ
বাঙালির একটি রাষ্ট্র হয়েছে, এবার দাবি একটি বৈষম্যহীন সমাজের। আকাক্ষা সমাজতন্ত্রের। শেখ মুজিব এবং তার সরকার সমাজতন্ত্রকে দেশের চার মূলনীতির হএকটি হিসেবে ঘোষণা করলেও মানুষ তার নমুনা দেখতে পাচ্ছে না? গোপনে সিরাজ শিকদার সহিংস, জঙ্গি প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রের দাবি তুলে যাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশে, ছোট জনপদে সমাজতন্ত্রের নিরীক্ষা করছেন তাহের। কিন্তু এবার শেখ মুজিবের নিজের দলের ভেতরেই সমাজতন্ত্রের তীব্র দাবি নিয়ে দেখা দেয় এক নতুন জ্বালামুখ। দাবি ওঠে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ভেতর থেকেই।
ছাত্রলীগের নেতা সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবকে গিয়ে বলেন : আপনি কিন্তু চার পায়ার টেবিলের কথা বলে এখন বানাচ্ছেন এক পায়ার টেবিল। বলেছিলেন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের কথা, এখন শুধু বাঙালি, বাঙালি বলছেন। জাতীয়তাবাদের এক পায়ার টেবিল হচ্ছে। দেশকে বাঁচাতে হলে সংসদ, মন্ত্রিসভা বাতিল করে, নতুন একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশে আনতে হবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।
শেখ মুজিব উত্তেজিত তরুণ নেতার কথা শোনেন।
শেখ মুজিবের কাছে যান তার ভাগনে তরুণ যুবনেতা, অনেকটা তারই কৃষকায় সংস্করণ শেখ মণি।
শেখ মণি বলেন : ওদের কথায় কান দেবেন না। ওসব বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আসলে প্রতিবিপ্লবী চিন্তা ভাবনা। আমরা দেশে প্রতিষ্ঠা করব নতুন মতবাদ, যার নাম হবে মুজিববাদ। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র, প্রাচ্যের সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার মিশ্রণে তৈরি এই হবে মুজিববাদ।
শেখ মুজিব তরুণ এই যুবনেতার কথাও শোনেন।
সিরাজুল আলম খান তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদকে সামনে রেখে এক সম্মেলন ডাকেন পল্টন ময়দানে। তার সঙ্গে আছেন আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখ ছাত্রনেতারা।
অন্যদিকে শেখ মণি তার মুজিববাদের মতবাদকে সামনে রেখে ঐ একই দিনে আরেকটি সম্মেলন ডাকেন রেসকোর্স ময়দানে। তার সঙ্গে আছেন ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদুস মাখন প্রমুখ।
দুটি সম্মেলনেরই প্রধান অতিথি হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয় শেখ মুজিবের। দুদলই চায় শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে থাকুন। চারদিকে টান টান উত্তেজনা। শেখ মুজিব কোন সভায় যাবেন?
সিরাজুর আলম খানের সভাতে শ্লোগান ‘বিপ্লব বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব’ ‘সংগ্রাম সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রাম’। তারা অপেক্ষা করেন শেখ মুজিবের জন্য।
শেখ মণির সভাতে স্লোগান ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ’। তারাও অপেক্ষা করেন শেখ মুজিবের জন্য।
শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত যান শেখ মণির সভাতেই।
স্পষ্ট হয়ে উঠে শেখ মুজিবের সমর্থক ছাত্র, যুব সংগঠনের ভাঙ্গন।
শেখ মুজিবের কাছে প্রত্যাখাত হয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীরা। এই সম্মেলনের কিছুদিন পরেই আসম আবদুর রব এক ভাষণে বলেন, মুজিব সরকার পাকিস্তানিদের চেয়েও অত্যাচারী হয়ে উঠেছে।
জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল। নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, জাসদ। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় দলের কমিটি। এ দলের প্রথম সারির নেতা আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ আর আর্মি থেকে অব্যাহতি পাওয়া সেক্টর কমান্ডার আবদুল জলিল। কিন্তু দলের মূল চিন্তক সিরাজুল আলম খান। দলে তার নাম উহ্য থাকে। তিনি বরাবরই নিজেকে আড়াল করে রাখেন রহস্যে।
জাসদের নামে শহরে ছাড়া হয় লিফলেট, যাতে লেখা–প্রচণ্ড বিপ্লবী শক্তির অধিকারী বাঙালি জাতি আজ এক মহা অগ্নি পরীক্ষার সন্মুখীন, বিপ্লবী চেতনা আজ সুপ্ত আগ্নেগিরির মতো স্তব্ধপ্রায়। এই স্তব্ধ অগ্নিগিরির জ্বালামুখ হিসেবে দেখা দেয় জাসদ।
আওয়ামী লীগের লড়াকু এবং জঙ্গি একটি অংশ বেরিয়েই জন্ম দেয় জাসদ। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে তারা। সাধারণভাবে লোকে জাসদকে আওয়ামী লীগবিরোধী একটি দল হিসেবে বিবেচনা করে। জাসদের মধ্যে মানুষ স্বাধীনতার পর তাদের হারাতে বসা স্বপ্ন খুঁজে পেতে থাকে। মশাল তাদের প্রতীক। হাজার হাজার তরুণ যারা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিল তাদের আকৃষ্ট করে জাসদ। দল হিসেবে জাসদ অতিদ্রুত বাড়তে থাকে। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক চমক সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে। আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে মানুষ বিবেচনা করতে শুরু করে জাসদকে। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও আকৃষ্ট হন জাসদের ব্যাপারে জাসদের দলীয় পত্রিকা গণকণ্ঠের দায়িত্ব নেন স্বনামধন্য কবি আল মাহমুদ। জাসদে যোগ দেন লেখক আহমদ ছফা। এছাড়াও নানা কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত, শেখ মুজিব বিরোধী, ভারতবিদ্বেষী মানুষেরা এসে ভিড় করেন জাসদে।
জাসদের এই উথানকে অনেকে সন্দেহের চোখেও দেখেন। এককালের মুজিব অনুসারী হঠাৎ এমন মুজিববিরোধী হওয়ার কারণ কি? জাসদ কি কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ? তারা কি সি আই এর দালাল? এদের এসব কি নেহাত রোমন্টিকতা উদ্ভূত বামপন্থী ঝোঁক?
নানা প্রশ্ন ঘিরে থাকে জাসদকে।
আওয়ামী লীগ জাসদকে স্বাধীনতা, উন্নয়নের শক্ত ঘোষণা করে।
৪৯. ব্যাংক ডাকাতির বিভ্রম আর একটি বিয়ের অনুষ্ঠান
শেখ মুজিব তার বিরোধিতাকে প্রাথমিকভাবে অনেকটা উদারভাবে গ্রহণ করেন। পত্রিকায় যে তার বিরুদ্ধে লিখছে, রাস্তায় যে তার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে তিনি। তাদের ডেকে পাঠান। ধমকের সুরে বলেন, কি চাস তোরা আমাকে বল।
যেন স্নেহময় পিতা শাসন করছেন তার দুরন্ত সন্তানকে।
কিন্তু এই ব্যক্তিগত ধাচের শাসন প্রক্রিয়া রাষ্ট্রীয় সংকট নিরসনে বিশেষ কার্যকরী হয় না। এমনকি তার নিজের সন্তানের ওপর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন তিনি।
তাঁর বড় ছেলে শেখ কামাল ছাত্ররাজনীতিতে বরাবর সক্রিয় ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। খেলাধুলা, সঙ্গীতে আগ্রহী সুবোধ ছেলে হিসেবেই পরিচিতি ছিল তার। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের নানা কর্মকাণ্ডে। ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিশেষ করে আওয়ামী বিরোধীদের ব্যাপারে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায় তাকে।
আওয়ামী লীগের অন্যতম হুমকি তখন সিরাজ শিকদার। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সিরাজ শিকদরের দল সারা ঢাকা শহরে শেখ মুজিববিরোধী পোস্টার, লিফলেট ছাড়ে। তারা ঘোষণা দেয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেও তারা নাশকতামূলক কাজ করবে। বিশেষ সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সার্জেন্ট কিবরিয়া তার দল নিয়ে সাদা পোশাকে একটি টয়োতা গাড়িতে করে বের হন শহর টহল দিতে। তাদের চোখ বিশেষভাবে খুঁজছে সিরাজ শিকদার এবং তার দলের কাউকে। ঐদিন গভীর রাতে একই সময় শেখ কামালও তার সঙ্গী সাথী নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে বের শহর প্রদক্ষিণে। তাদের হাতে স্টেনগান। তারাও খুঁজছেন সিরাজ শিকদারকে।
গভীর রাতে এক দল আরেক দলের মুখোমুখি হন বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। একদল জানেন না অন্য দলের খবর। দুদলই একে অপরকে ভাবে বুঝি এরা সিরাজ শিকদারের দল। গোলাগুলি শুরু হয় দু পক্ষের মধ্যে। গুলি লাগে শেখ কামালের শরীরে রক্তাক্ত অবস্থায় কামাল গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করে বলতে থাকেন : আমি শেখ কামাল।
দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। খুবই ভয় পেয়ে যান সার্জেন্ট কিবরিয়া। প্রধানমন্ত্রীর ছেলের গায়ে গুলি লাগার পরিণতি কি হবে ভেবে আতঙ্কিত তিনি। এদিকে পরদিন বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় যে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। শেখ মুজিবের দলের নানা বদনামের সঙ্গে যুক্ত হয় পারিবারিক বদনামও।
হতবিহ্বল সার্জেন্ট কিবরিয়া যান শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমা চাইতে। শেখ মুজিব সার্জেন্ট কিবরিয়াকে বলেন : তোমার ভয় পাওয়ার তো কিছু নাই। তুমি ঠিক কাজটাই করেছে। শেখ মুজিব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন কামালের উপর রাগ করে তিনি দুদিন কামালকে দেখতেও যান না হাসপাতালে। বলেন : মরতে দাও কামালকে।
পরে ক্ষুব্ধ মুজিব কামালকে বলেন : মোনেম খানের পোলার মতো হইস না। তার আগে আমারে গুলি কইরা মার। কপালে আঙ্গুল দিয়ে দেখান তিনি।
সে সময়কার আরেকটি ছোট্ট সামাজিক ঘটনাও দেশের রাজনীতিতে ফেলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। একটি বিয়ের অনুষ্ঠান। রেডক্রসের চেয়ারম্যান প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার এক আত্মীয়ের বিয়ে। আওয়ামী লীগের নানা নেতাকর্মীরা উপস্থিত। উপস্থিত অনেক সামরিক অফিসারও। বিয়েতে আমন্ত্রিত শেখ মুজিবের পরিবারের ঘনিষ্ঠ মেজর ডালিম। ডালিম তার আকর্ষণীয়া স্ত্রী নিম্মিকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে গাজী গোলাম মোস্তফারই ছোট ভাই নিম্মিকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে। গাজীর ছেলে নিম্মির প্রবাসী ভাইয়ের লম্বা চুল নিয়ে ঠাট্টা মসকারা করে, চুল ধরে টানে। ক্ষেপে যান ডালিম। তিনি চর মারেন গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলের গালে। ক্ষুব্ধ মারমুখী বাদানুবাদ হয় ডালিম আর গাজী গোলাম মোস্তফার ভাই এবং ছেলের সঙ্গে। গাজীর ভাইয়ের সমর্থনে বেশ কিছু গুণ্ডা এসময় যোগ দেয় বিতর্কে। এক পর্যায়ে তারা ডালিম আর নিম্মিকে জোর করে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে থাকেন অন্যত্র। এ খবর পেয়ে ডালিমের বন্ধু মেজর নুর, মেজর হুদা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রাক বোঝাই সৈন্য নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার নয়াপল্টনের বাড়ি তছনছ করে। পরে কিডন্যাপ করা ডালিম এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় শেখ মুজিবের কাছে। শেখ মুজিবের কাছে ডালিমের নামে মারামারি, হাতাহাতি করার অভিযোগ তোলেন তারা। ক্ষুব্ধ হন ডালিম। পাল্টা অভিযোগ করেন তার স্ত্রীকে অপমান করার। চিৎকার করে তিনি শেখ মুজিবকে বলেন : আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি তখন আপনার ঐ গুণ্ডারা কোথায় ছিল?
শেখ মুজিব আপাতত দুদলের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। পরবর্তীতে মেজর ডালিম, নুর, হুদাসহ আরও যারা এ ঘটনায় যুক্ত ছিলেন তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আর্মি থেকে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
চাকরিচ্যুতির নোটিস পাওয়া এই অফিসাররা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ডালিম আহত হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে, নুর ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর এডিসি, বাকিরাও নানা সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। এ সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া তরুণ এই আর্মি অফিসারদের আহত করে প্রচণ্ড। একে তারা ব্যক্তিগত অপমান বলে
বিবেচনা করেন। বিশেষ করে মেজর ডালিম ছিলেন শেখ মুজিবের পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। শেখ মুজিবের স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসাকে ডালিম মা বলেই ভাকতেন।
ব্যাপারটি একেবারে কাকতালীয় নয় যে, পরবর্তীতে শেখ মুজিবের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের খবর দেশবাসী প্রথম শুনবে মেজর ডালিমেরই কণ্ঠে।
৫০. খড়ির গণ্ডির বাইরে
নবগঠিত জাসদের অন্যতম নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিল একদিন দেখা করেন তাহেরের সঙ্গে যুদ্ধের পর পর শৃঙ্গলা ভঙ্গের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল মেজর জলিলকে, যিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। সে বিচারের দায়িত্ব পড়েছিল কর্নেল তাহেরের ওপর। তাহের তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল। সেটা ছিল অভিনব এক বিচার। এক সেক্টর কমান্ডার বিচার করছেন আরেক সেক্টর কমান্ডারের। যদিও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছিল মেজর জলিলের নামে কিন্তু তাহের খোঁজ পেয়েছিলেন যে স্বাধীনতার পর ঐ অঞ্চলে কিছু ভারতীয় সৈন্য যখন বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নিছিল খুব সোচ্চারভাবে তাতে বাধা দিয়েছেন জলিল। ঐ সময় তার এরকম ভারত বিরোধিতাকে সরকারের ভেতরে অপছন্দ করেছেন অনেকেই। মিত্র ভারতের বড় অফিসাররাও নাখোস হয়েছেন। জলিলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবার জন্য খুলনা জেলে আটক সেখানকার প্রাক্তন সরকারি এক কর্মকর্তাকে আনা হয়েছিল। এই কর্মকর্তা যুদ্ধের পুরোটা সময় সহায়তা করে গেছেন পাকিস্তানিদের। সাক্ষ্য দিতে এলে তাকে ঘর থেকে বের করে দেন তাহের। বলেন : দিস ইজ অ্যাবসার্ড। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের বিরুদ্ধে একজন যুদ্ধবিরোধী সাক্ষী দিতে পারে না। গেট আউট।
কোন অভিযোগ শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয় না জলিলের বিরুদ্ধে। তাকে বেকসুর খালাস দেন তাহের। মুক্ত জলিল অফিসার্স মেসে বসে আড্ডা দেন তাহেরের সঙ্গে। প্রাক্তন আসামি আর বিচারক একসাথে বসেন চা খেতে। তখনই জলিল তাহেরকে জানিয়েছিলেন তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে রাজনীতি শুরু করবেন। কিছুদিনের মধ্যেই জলিল যোগ দেন দেশের প্রথম বিরোধী দল জাসাদে। ইতোমধ্যে তাহেরের আরেক সহকর্মী কর্নেল জিয়াউদ্দীন যোগ দিয়েছেন সর্বহারা পার্টিতে।
তাহেরের সঙ্গে দেখা করে জলিল তার জাসদে যোগ দেওয়ার প্রেক্ষাপট তাকে জানান। তাহেরকে বলেন : স্যার, আপনিও চলে আসেন। আর্মিতে থেকে কি লাভ? বড়জোর জেনারেল হবেন।
তাহের বলেন : জলিল, হাউ ফার ডু ইউ নো অ্যাবাওট মি? সময় বলবে সব। আই স্টিল ওয়ান্ট টু ট্রাই উইদিন দিস সিস্টেম। আমি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওপর পুরো আস্থা হারাইনি। আরও কিছুদিন দেখতে চাই।
এসময় শেখ মুজিব তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর নুরুল ইসলামকে নিয়ে লন্ডনে তার গলব্লাডার পাথর অপারেশন করতে যাবার প্রস্তুতি নেন। ক্যান্টনমেন্টে গুজব শোনা যায়, শেখ মুজিব যখন লন্ডন থাকবেন তখন তার অনুপস্থিতিতে একটি অভূত্থান হতে পারে।
তাহের মনে করেন, এটি শেখ মুজিবকে জানানো তার দায়িত্ব। বিশেষ চেষ্টা চরিত্র করে বিদেশে যাবার আগে শেখ মুজিবের সঙ্গে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেন তাহের। শেখ মুজিবকে তাহের বলেন : খুব উঁচু লেবেলে একটা কন্সপিরেসি হচ্ছে আপনি কিন্তু সাবধান থাকবেন।
তাহেরকে হতাশ করে শেখ মুজিব বলেন : যাও তোমার জায়গায় কাজ করো, এসব তোমাকে ভাবতে হবে না।
কিছুদিন পর লন্ডন থেকে তাহেরের নামে শেখ মুজিবের বিশেষ বার্তা আসে। তাহেরকে জানানো হয় যে শেখ মুজিব তাকে পায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত লন্ডনে যেতে বলেছেন।
তাহের মোটেও উৎসাহ দেখান না। লুৎফাকে বলেন : উনাকে বললাম আর্মির ভেতরের কন্সপিরেসির কথা উনি বিশ্বাস করলেন না। বঙ্গবন্ধু আসলে সিচুয়েশনটা বুঝতেই পারছেন না। নানা চাটুকাররা ঘিরে রেখেছে তাকে। সঠিক পরিস্থিতি বুঝতে দিচ্ছে না। এখন আমার এখানে থাকা দরকার। পরিস্থিতি ওয়াচ করা দরকার। আমি রিফর্মের একতা প্ল্যান উনাকে দিলাম কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলার সময়ও হলো না উনার। লন্ডনে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।
শেখ মুজিবকে তিনি লিখে পাঠালেন; ব্যক্তিগত কারণে আমি এখন লন্ডন যেতে পারছি না। আমার চিকিৎসার জন্য যে টাকা খরচ হবে সেটা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দিয়ে দিলে বাধিত হব।
মাস কয়েক পর সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ডেকে পাঠান তাহেরকে। জানান যে, তাকে কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে বদলি করা হয়েছে ডিরেক্টর ডিফেন্স পারচেজ হিসেবে। ততদিনে শেখ মুজিব ফিরে এসেছেন। তাহের দেখা করেন শেখ মুজিবের সাথে। বলেন : আমি একটা অ্যাকটিভ কমান্ডে আছি, আমাকে কেন বদলি করা হলো?
শেখ মুজিব বলেন : ঐখানে একজন সৎ লোক দরকার। নানা চুরিচামারী হয়। তুমি গেলে ভালো হবে।
বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন তাহের। লুৎফাকে বলেন : ঐসব সৎ লোক টোক কোনো ব্যাপার না। আসলে কুমিল্লায় আমি যা করছি অধিকাংশ সিনিয়র আর্মি অফিসারদেরই সেসব পছন্দ না। চিফ অব স্টাফের তো আরও পছন্দ না। তারা আমাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে চায়। বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চয় তারা কনভিন্স করেছে। তাছাড়া আমি যে বঙ্গবন্ধুর কথায় লন্ডন যাওয়া রিফিউজ করেছি সেজন্যও সম্ভবত তিনি মাইন্ড করেছেন। আচ্ছা বলো ডিফেন্স পারচেজে গিয়ে এসব কেনাবেচা করা কি আমার কাজ? আমি এই ট্রান্সফার নেব না। আমার মনে হচ্ছে আমারও একটা ডিসিশন নেওয়ার সময় এসেছে। মাই ডেইজ ইন আর্মি ইজ নাম্বার্ড।
লুৎফা : চিন্তা ভাবনা করে দেখো। হুট করে কিছু সিদ্ধান্ত নিও না।
ভাবনার একটা সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছান তাহের। পাকিস্তান আমলে একটা লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে সেনাবাহিনীতে ঢুকেছিলেন তাহের, সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পাকিস্তান আমলেই সেনাবাহিনী ছেড়ে দেবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর মুক্তিযুদ্ধের উথাল পাথাল সময়ে তার সামরিক শিক্ষার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে, শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রেখে ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে যাবেন তার লক্ষ্যের দিকে, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের দিকে, এমনই প্রত্যাশা, এমনই পরিকল্পনায় অগ্রসর হচ্ছিলেন তিনি। ঘোরগ্রস্ত হয়ে একটি স্বপ্নের দ্বীপের মতো গড়ে তুলছিলেন তার ক্যান্টনমেন্টটিকে। কিন্তু তাতে হোঁচট খেলেন যে।ন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে তার স্বপ্নের কারখানা। শেখ মুজিবের প্রতিও ম্লান হয়ে আসছে তার আস্থা।
তাহের আলাপ করতে বসেন ইউসুফ আর আনোয়ারের সঙ্গে, তার ভাই রাজনৈতিক বন্ধু।
তাহের বলেন : ইউসুফ ভাই, ভাবছি রিজাইন করব আর্মি থেকে।
ইউসুফ : তোমার ট্রান্সফারতা কি ঠেকানো যায় না?
তাহের : মনে হয় না। তাছাড়া আমি চিন্তা করে দেখলাম, হোয়াই স্যুড আই ওয়েস্ট মাই টাইম ইন দি আর্মি এনি মোর? আমি তো আর্মিতে ঢুকেছিলাম ওয়ার ফেয়ারটা শেখার জন্য। আমার সেই নলেজের চূড়ান্ত ব্যবহার আমি করেছি। কুমিল্লায় পিপলস আর্মির একটা মডেল করতে চাইলাম, কেউ তো সাপোর্ট করছে না। আমি ভেবেছিলাম জেনারেল জিয়া এটাকে ব্যাক করবেন কিন্তু উনিও তো কোনো উচ্চবাচ্য করেন না।
ইউসুফ : বঙ্গবন্ধু যদি ইন্টারেস্ট নিতেন তাহলে হয়তো এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতে।
তাহের : এক্সাক্টলি। আমি তো সেই চেষ্টাই করলাম। ভেবেছিলাম আমার এই আর্মির মডেলটা অন্য ক্যান্টনমেন্টেও রেপ্লিকেট করা হবে। কতভাবে উনার এটেনশন ড্র করার চেষ্টা করলাম কিন্তু উনার তো সময়ই নাই। এখন আমাকে বলছেন অস্ত্র কেনাবেচা করতে। হোয়াই সুভ আই বি দুইং দ্যাট। দেখেন বঙ্গবন্ধুর মতো এমন জনপ্রিয়তা ইতিহাস খুব কম মানুষকেই দেয়। তিনি কি না করতে পারতেন এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে। কিন্তু সব ডিরেইলড হয়ে যাচ্ছে। এনি ওয়ে, আমি যে আর্মির কথা ভেবেছি সেটা যখন হচ্ছে না তখন এই ব্যারাক আর্মিতে থেকে আমার আর লাভ কি। আর্মি ছেড়ে দেব। মাইক্রো স্কেলে কাজ করে আর লাভ নাই।
আনোয়ার : কাদের সাথে কাজ করবেন কিছু ভেবেছেন?
তাহের : ভেবেছিলাম স্টেট স্ট্রাকচারের ভেতরে থেকে কাজ করব। সেটা যখন হলো না তখন এই স্টাকচারকেই আঘাত করতে হবে। পাটি পলিটিক্সে ইনভলব হতে হবে। জিয়াউদ্দীন সিরাজ শিকদারের সাথে গেছে। আমি মনে করি না তার সাথে আর কাজ করা হবে। তাছাড়া এ মুহূর্তে আমি তার অ্যাপ্রোচটাও ঠিক মনে করি না। কথা বলে দেখি না আরও কারো কারো সাথে জলিল এসেছিল। জাসদের সাথেও কথা বলে দেখতে পারি। তবে লেফটরা ইউনাইটেড হয়ে কিছু একটা করতে পারলে ভালো হবে।
ইউসুফঃ ছাড়বার আগে সিনিয়র দু-একজন অফিসারের সাথে কথা বলে দেখো। আর আমরা তো আছিই তোমার সাথে।
একদিন তাহের যান জেনারেল জিয়ার বাসায়। জিয়া তখন উপ সেনাপ্রধান। পারিবারিকভাবে আগেও যোগাযোগ রয়েছে তাদের। আর্মিতে তার অবস্থান নিয়ে তাহের কথা বলেন জেনারেল জিয়ার সঙ্গে।
তাহের বলেন : স্যার, আমার ট্রান্সফারটা মনে হচ্ছে পলিটিকালি মোটিভেটেড। আই অ্যাম সিওর, মোস্ট অব দি সিনিয়র অফিসারস ডোন্ট লাইক হোয়াট আই অ্যাম ডুইং ইন ৪৪ ব্রিগেড।
জিয়া বলেনঃ ইউ আর রাইট তাহের।
তাহের : আমি আপনার সাপোর্ট এক্সপেক্ট করেছিলাম।
জিয়া : বাট ইউ নো ইট ইজ দি চিফ হু মেকস অল দিজ ডিসিশনস।
তাহের বলেমঃ আমি প্রবাবলি আর্মি থেকে রিজাইন করব।
নীরব থাকেন জিয়া। বলেন, তুমিও কি জিয়াউদ্দীন আর জলিলের মতো পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার শুরু করবে?
তাহের : দেখা যাক।
জিয়া যথারীতি বলেন, কিন্তু সাবধানে ডিসিশন নাও।
শুভাকাক্ষী ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের সঙ্গেও কথা বলেন তাহের।
মঞ্জুর বলেন, মাথা গরম করো না তাহের। লুৎফাকে বলেন, ভাবী আপনি বুঝান। এখনই চাকরি ছাড়তে নিষেধ করেন।
তাহের পরে লুৎফাকে বলেন; ওদের লাইফে তো আর পলিটিক্যাল এজেন্ডা নাই। আর্মিতে ক্যারিয়ার করাই মূল ব্যাপার। আমার সাথে ওদের মিলবে না। আমি কিন্তু রিজাইন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি একটু কষ্ট হবে তোমার। এই লাইফে কি তোমার খুব মোহ জন্মেছে?
লুৎফা বলেন : মোটেও না। তোমার সাথে সাথেই তো আছি। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে, আমিও আছি তোমার সাথে।
সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক চিঠি তাহের জমা দেন ১৯৭২ এর ২২ সেপ্টেম্বর। তাহের চিঠিতে তার পদত্যাগপত্রের প্রেক্ষাপটটি বর্ণনা করে কি কি কারণে তিনি অব্যাহতি চান তার উলেখ করেন। শেষে লেখেন :
… প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য যাতে আমি বিদেশে
যাই। যখন আমি দেশের বাইরে
যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম তখন আমি জানতে পারি
যে, মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্যসহ
সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতির সুযোগে দেশের ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টা
করছে (সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন।) আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী
দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশ গমন স্থগিত রাখা উচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলোই না উপরন্তু সেনাবাহিনীর চিফ
অব স্টাফ আমাকে ৪৪ নং ব্রিগেড কমান্ড ত্যাগ করে ডিডিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করি ষড়যন্ত্র এখনও
চলছে এবং আরও অনেকে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এই ধরনের ক্ষমতা দখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা আকাঙক্ষার বিরুদ্ধে
যাওয়া এবং এতাকে অবশ্যই রুখতে হবে। যদি ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে সেনাবাহিনীর
যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে।
এধরনের সেনাবাহিনীতে আমার কাজ করা সম্ভব নয়। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক
বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই
আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি
সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই, যারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের বলব কি ধরনের বিপদ
তাদের দিকে আসছে।
আমার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব।
আপনার একান্ত বাধ্যগত।
লে. কর্নেল এম এ তাহের।
কমান্ডার, ৪৪ ব্রিগেড
কুমিল্লা সেনানিবাস।
লক্ষ্য করবার ব্যাপার যে তাহের স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় অনুমান। করছিলেন দৈত্যের মতো একটা বিপদ ধেয়ে আসছে দেশের মানুষের দিকে। কিন্তু সে দৈত্য যে এতটা নিকটবর্তী সেটা হয়তো টের পাননি তিনি নিজেও।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাহেরকে। বিদায় অনুষ্ঠানে তাহের বলেন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যে জনগণের সাথে ছিলাম আবার ফিরে যাচ্ছি তাদের মাঝেই।
এবার ক্যান্টনমেন্টের খড়ির গণ্ডির বাইরে এসে দাঁড়ান তাহের।