ছোটোবেলায় আমাদের পাড়ায় বাটা কোম্পানীর এক সেলসম্যান থাকতেন। তিনি পথে-ঘাটে হাটে-বাজারে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব দের বাড়িতে বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েও সব সময় সবার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতেন, কে কি জুতো পরেছেন।
পাড়ার সবাই ওকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন। কেউ বলতেন, শম্ভুদা নিশ্চয়ই শুভদৃষ্টির সময় বোদির মুখের দিকে না তাকিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ফোঁড়ন কেটে বলতেন, তার চাইতেও বড় কথা বৌদিকে খালি পায়ে দেখেই উনি বুঝেছিলেন, পাঁচ নম্বর লাগবে।
শম্ভুদা শুভদৃষ্টির সময় সত্যি সত্যি বৌদির পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিনা অথবা তাকে খালি পায়ে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন কিনা, তা আমি জানি না। তবে তার দৃষ্টি যে সর্বত্র সব সময় নিম্নগামী ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
তখন শম্ভুদাকে দেখে অবাক হতাম। মনে হত উনি কি অদ্ভুত মানুষ।
এখন জেনেছি, এই বিশ্ব-সংসারের অধিকাংশ মানুষই শম্ভুদা! কেউ পায়ের জুতো দেখেন, কেউ বা অন্যকিছু।
আমাদের মনোরঞ্জনবাবু মাস্টারমশাই সব সময় বলতেন, আমাদের দেশে মাস্টারদের সম্মান নেই বলেই তো দেশের এই দুর্গতি! ওরে বাপু, মাষ্টারমশাইরাই তো জাতিকে সত্যিকার উন্নত করতে পারেন। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট বা ব্যবসাদার দিয়ে কী দেশের সত্যিকার উন্নতি হয়?
দারোগাবাবুরা চব্বিশ ঘণ্টাই চোর-ডাকাত খুন-জখম-রাহাজানি লুঠপাট-বলাৎকার নিয়ে ব্যস্ত ও বিব্রত থাকেন বলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে বিশেষ খুঁজে পান না। ডাক্তারবাবুদের ধারণা, সবাই কোন না কোন রোগে ভুগছেন। উকিলবাবুরা ভাবতেই পারেন না, কোর্ট কাছারি না করেও সংসারে থাকা যায়। ডেনটিস্টদের একটাই দুঃখ, দেশের লোকজন দাঁতের যত্ন নিতে শিখল না। অর্থাৎ আমরা সবাই এক একজন শম্ভুদা! অনন্ত বৈচিত্র্যময় বিশ্ব-সংসারের মানুষও কম বৈচিত্র্যে ভরা নয় কিন্তু আমরা কজন সেই অজানা জগতের খবর রাখি?
একদিন কথায় কথায় শৈলেনদা বললেন, চাকরি পাবার পর প্রথম দিকে খুবই মন খারাপ লাগত।
কেন?
উনি একটু হেসে বললেন, এই মাটির পৃথিবীর উপর দিয়ে হাঁটা চলা করার সময় কি আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি, আমাদের পায়ের নিচের মাটিতেই সোনা রুপো হিরে ছড়িয়ে আছে?
আমি মাথা নেড়ে বলি, ঠিক বলেছেন।
নানা রকম হাতের লেখা পড়তে আমার ভাল লাগলেও প্রথম প্রথম এই একঘেয়েমির কথা ভেবেই বিরক্তবোধ করতাম।
উনি আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি ওঁকে বাধা দিয়ে বললাম, কিছুদিন পরে বুঝি বুঝলেন, ঐ অসংখ্য চিঠিপত্রের জঙ্গলের মধ্যেই বহু সম্পদ ছড়িয়ে আছে?
ঠিক বলেছ ভাই। উনি মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে কি যেন একটু ভাবেন। তারপর বলেন, এই চিঠিপত্র ঘাটাঘাটি করতে করতে কত মানুষের কত ভাল-মন্দ সুখ-দুঃখের কথা যে জানলাম তার হিসেব করতে গেলেও মাথা ঘুরে যায়।
তা তো বটেই। পিয়ন খটখট্ কড়া নেড়েই দরজার সামনে একটা চিঠি ফেলে দয়েই একটু জোর গলাই বললেন, চিঠি!
পিয়নের ঐ কড়া নাড়ার শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত। তাই তো
পিয়নের মুখের কথা বেরুতে না বেরুতেই ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই চিঠিটা হাতে তুলে নেন। কার চিঠি? অমল সান্যাল?
উনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে পাশের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে পিয়নের হাতে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বললেন, আমাদের বাড়িতে তো অমল সান্যাল বলে কেউ নেই।
পিয়ন ঠিকানাটা আরেকবার দেখে নিয়ে বললেন, কিন্তু ঠিকানা তো আপনাদের বাড়িরই দেখছি।
হ্যা ঠিকানা তো আমাদের বাড়িরই কিন্তু এ বাড়িতে তো শুধু আমরাই থাকি।
পিয়ন চিঠিটি ব্যাগের মধ্যে ভরে রেখে এগুতে এগুতেই বললেন তা তো জানি।
পনের-কুড়ি দিন পরের কথা। পিয়ন খট খট করে কড়া নেড়েই চিঠিটা দরজার সামনে ফেলে না দিয়ে শুধু বললেন, চিঠি!
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পিয়ন ওর হাতে আগের মতই একটা মোটা খাম দিয়ে বললেন, এ চিঠি কি রাখবেন?
ভদ্রমহিলা চিঠি হাতে নিয়ে প্রায় আপন মনেই বিড়বিড় করে বলেন, অমল ব্যানার্জী? চিঠিটা আবার পিয়নের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, না ভাই, এখানে অমল বলেও কেউ থাকে না।
কয়েকদিন পরে আবার একটা চিঠি। অশোক মুখার্জী। এবার ভদ্রমহিলা না হেসে পারেন না। বলেন, এ তো ভারী মজার ব্যাপার শুরু হয়েছে। যাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই কোনকালে যাদের নাম শুনিনি, শুধু তাদেরই চিঠি আসতে শুরু করেছে।
এবারও পিয়ন চিঠিটা ফেরত নেন কিন্তু অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করেন, এসব চিঠি চৌধুরীবাবুর বন্ধু-বান্ধবের না তো?
অপর্ণা এক গাল হাসি হেসে বলেন, অশেষ তো পাটনার ছেলে, চাকরি করে বোম্বের এক ফার্মে। তাছাড়া ওকে ঘুরে বেড়াতে হয় আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর-নাগাল্যাণ্ডে। পিয়নের মনে খটকা লাগলেও মুখে কিছু বলেন না। অন্য বাড়ির দিকে দুএক পা এগিয়ে উনি আবার পিছিয়ে এসে অপর্ণাকে বলেন, চিঠি তো কয়েকদিন পোস্টাফিসে পড়েই থাকবে, তাই একবার চৌধুরীবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, যদি চিঠিটা ওঁর বন্ধু-বান্ধবের হয়…
উনি তো কদিন আগেই গোহাটি গেলেন, দশ-বারো দিনের আগে কখনই ফিরবেন না।
সব চিঠিগুলো এসে হাজির হয় রিটার্ন লেটার অফিসে শৈলেনদার টেবিলে। যথারীতি চিঠি খুলেই পত্রদাতার ঠিকানা বের করার চেষ্টা করতে হয় ওঁকে।…
আমার অনেক অনেক আদরের তুমি, দার্জিলিং থেকে লেখা তোমার চিঠিখানা পেয়ে যে কি আনন্দ হল, তা লিখে জানাবার ভাষা আমার জানা নেই। সারাদিনে চার-পাঁচবার চিঠিটা পড়েও মন ভরল না বলে রাত্রে শুয়ে শুয়ে বহুবার চিঠিটা পড়লাম। তুমি যে আমাকে কত গভীর ভাবে ভালোবাসে, তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই চিঠি পড়ে।
মা মারা যাবার পর পরই দাদু-দিদা আমাকে ওদের কাছে নিয়ে এলেন। তখন ঠিক ছিল, আমি একটু বড় হয়ে বাবার কাছে ফিরে যাব কিন্তু মা মারা যাবার বছর খানেকের মধ্যেই বাবা আবার বিয়ে করায় আমাকে আর উনি নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারলেন না। তাছাড়া দাদু-দিদাও আমাকে ছাড়লেন না। দাদু-দিদার কাছে খুবই আদর-যত্নে মানুষ হয়েছি কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা শূন্যতার বেদনা-জ্বালা অনুভব করতাম। আমি দাদু-দিদার চোখের মণি ছিলাম ঠিকই কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মা-বাবা ভাই-বোনের সান্নিধ্য ভালবাসার জন্য মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠত। পাঁচজনের সংসারে মানুষ হইনি বলে আমি কোনদিনই বিশেষ কারুর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতাম না। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে আমার কোন বন্ধু ছিল না বললেই হয়। তবু পড়াশুনা আর দাদু-দিদার সঙ্গে হাসিঠাট্টা গল্পগুজব করে দিন বেশ কাটত। এম. এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার কদিন আগেই দাদু মারা গেলেন। দাদুর শরীর বরাবরই খারাপ ছিল তবু কখনও ওঁর শরীর একটু বেশি খারাপ হলেই দিদা খুবই অস্থির হয়ে উঠতে ও আমাদের ফ্যামিলী ফিজিসিয়ান ডাঃ বসুকে ডেকে পাঠাতেন ডাঃ বসুকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই দাদু একটু হেসে বলতেন, আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? এরকম শরীর খারাপ তো আমার প্রায়ই হয়। আবার দাদু একবার আড় চোখে আমাকে ও দিদাকে দেখে নিয়ে বলতেন, আমার বুড়ী বউ কিছুতেই বিশ্বাস করে না আমার যুবতী স্ত্রী এম. এ. পাস না করা পর্যন্ত আমার কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সত্যি, দাদু কথার খেলাপ করেননি।
যাইহোক দাদুর মৃত্যুর পর আমি জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, কাউকে ভাল না বেসে ভুল করেছি কিন্তু ভালবাসার মানুষ কী চাইলেই পাওয়া যায়?
শুনেছি, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের ব্যাপারে কেউ আগে থেকে কিছু বলতে পারে না। এভাবে হঠাৎ যে আমার বিয়ে হবে, তা আমি স্বপ্নে ভাবিনি। তোমাকে দিদার এত ভাল লেগেছে যে কি বলব। তাছাড়া দিদা বার বার আমাকে একটা কথা বলেছেন, দ্যাখ দিদিভাই, তোর মত অমল ভাইও বাপ-মায়ের আদর পায়নি জ্যেঠা-খুড়োর কাছে মানুষ হয়েছে। তাইতো বলছি, ও তোকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে। দিদিভাই, তুইও ওর জীবনের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দিস।
বিয়ের পর যে কদিনের জন্য আমরা একসঙ্গে থেকেছি, তার মধ্যেই আমি বুঝেছি, দিদা ঠিকই বলেছেন। সত্যি ঐ কটা দিন তুমি এমন আদর-ভালবাসায় আমাকে ভরিয়ে দিয়েছ যে তার স্বাদ, মধুর স্মৃতি আমি জীবনে কোন দিন ভুলতে পারব না।
তোমার কলকাতার কাজ কবে শেষ হবে? জানি, কাজ শেষ হবার পর এক মুহূর্তও তুমি ওখানে থাকবে না। তুমি আমার কাছে ছুটে আসবে। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত করছ তো? আর হ্যাঁ, দিদার পরামর্শ মত উকিল দাদু দুটি ব্যাঙ্ককেই জানিয়ে দিয়েছেন, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। ব্যাঙ্ক ও নানা জায়গায় তোমার আমার নতুন করে সই করতে হবে। তুমি এলেই সেসব কাজ সেরে ফেলতে হবে।
তুমি আমার অনেক আদর-ভালবাস-চুমু নাও। ইতি–
শুধু তোমারই শিখা
নিছক নববিবাহিতার প্রেমপত্র। পড়তে ভালই লাগত। মনে মনে দুজনের জন্যই সমবেদনা অনুভব কবেন শৈলেনদা কিন্তু পাটনার কোন ঠিকানায় এ চিঠি ফেরত পাঠাবেন?
চা-সিগারেট খেয়ে কিছুক্ষণ কাটাবার পর শৈলেনদা এবার অমল ব্যানার্জীর চিঠিটা খোলেন।…
আমার প্রিয়তম অমল রাজা! সত্যি বলছি, সব যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটে গেল। আমি এখনও সে স্বপ্নের নেশায় বিভোর হয়ে আছি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার কোন দিদির বিয়ে হয়নি। আমার দুই জামাইবাবু খুব ভাল হয়েছেন বলে মা সব সময় বাবাকে বলতেন, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছেলে-মেয়ে কখনই ভাল হয় না। আমার দিদিরাও সব সময় মার মত সমর্থন করেছে। তাই বাবা যখন আমার বিয়ের জন্য চারদিকে খোঁজখবর করেও পছন্দমত পাত্র পাচ্ছিলেন না, তখনও মা বাবাকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে দেননি। এমন সময় হঠাৎ ছোট কাকা তোমার বিজ্ঞাপনটি বাবাকে পাঠালেন। বাবা কোন মন্তব্য না করে ছোট কাকার চিঠি আর বিজ্ঞাপনটি মাকে দিলেন। সবকিছু কয়েকবার পড়ার পর মা বললেন, এত উচ্চশিক্ষিত ছেলে, তার উপর বিদেশে থাকে। একটা চিঠি লিখে তো দেখ।
ব্যস! পনেরো দিনের মধ্যে তোমার-আমার বিয়ে হয়ে গেল! এখন তোমার মত জামাই পেয়ে বাবা-মার গর্ব দেখে কে!
যাই হোক হানিমুনের দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আমি সারাজীবন রোমন্থন করব। সত্যি, তোমার ভালবাসায় আমিও এমন পাগল হয়ে উঠেছিলাম যে সে কথা মনে করলেও লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠছে? অবার ভাবি, পাগলামি করেছি তো বেশ করেছি। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই পাগলামি করব। তাছাড়া তুমিই তো আমাকে পাগল করে তুলেছিলে।
তুমি কলকাতার কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো। এখানে দুতিন দিন না থাকলে এত জিনিসপত্তর ঠিকঠাক করবে কে? তাছাড়া তুমি তো দিল্লী হয়ে বোম্বে যাবে। বোম্বেতে কী তোমার কোন কাজ আছে? ওখানে কোন কাজ না থাকলে বোম্বের বদলে দিল্লী থেকেই তো আমরা সোজা নিউইয়র্ক যেতে পারি। নিউইয়র্ক যাবার পথে আমরা দুটি দিন কি লণ্ডন আর প্যারিসে কাটাব না?
তুমি তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্তেও আমার ভাল লাগে না। তাছাড়া রাত্তিরে তোমার অভাব এত অনুভব করি যে কিছুতেই স্থির হয়ে ঘুমুতে পারি না। আমার অনেক আদর ও প্রণাম নাও।
–তোমার আদরের কৃষ্ণা
তৃতীয় চিঠিটার দুচার লাইন পড়েই শৈলেনদা সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁগো মানিকদা, এ তো ভারী মজার ব্যাপার দেখছি।
মানিকবাবু এই সেক্সেনের ইনচার্জ। উনি একটু মুখ তুলে বললেন, কী আবার মজার ব্যাপার হল?
শৈলেনদা হাসতে হাসতে বললেন, একই ঠিকানা থেকে তিনটে চিঠি ফেরত এসেছে। আর তিনটে চিঠিই সদ্য বিবাহিতা তিনটি মেয়ের লেখা।
একই লোককে লেখা?
দুটি চিঠিই অমল নামের দুজনকে লেখা আর
পাশ থেকে বলাই ঘোষাল জিজ্ঞেস করলেন, একই ঠিকানায় একই নামের দুজনকে লেখা মানে?
শৈলেনদা বললেন, শুধু উপাধি আলাদা।
মানিকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, থার্ড চিঠিটা কাকে লেখা?
অন্য নামের এক ভদ্রলোককে। কিন্তু তিনিও অন্য দুজনের মত বিয়ে করে কিছুদিন বউয়ের সঙ্গে ঘর করার পর কিছুদিনের জন্য কলকাতা এসেছেন।
তা কি করে হয়?
তাইতো আমার অদ্ভুত লাগছে।
দেখি তো চিঠিগুলো।
মানিকবাবু খুব মন দিয়ে তিনটে চিঠি দুতিনবার পড়লেন। কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, বুঝলে শৈলেন, ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।
শৈলেনদা সঙ্গে সঙ্গে ওকে সমর্থন করে বললেন আমারও ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।
মানিকবাবু বললেন, এ চিঠিগুলো ফেরত যাবে না।
অনেক বছর আগেকার কথা। তবু শৈলেনদার সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল।
আমি প্রশ্ন করি, তার মানে?
বেশীদিন না, দিন দশেকের মধ্যেই সব জানা গেল ও কেষ্টবাবু ধরা পড়লেন। কথাটা বলেই উনি একটু হাসলেন।
আমি জিজ্ঞেস করি, কী জানা গেল?
কেষ্টবাবুর কীর্তি-কাহিনী।
কেষ্টবাবু মানে?
ওরে বাপু, কলির কেষ্ট! হঠাং শৈলেনদার মুখ থেকে হাসির চিহ্ন উবে গেল। দুদিকের চোয়াল শক্ত হল। ওর চোখের দিকে তাকাতেও আমার ভয় হল। একটু পরে বললেন, ও হারামজাদা এক একটা শহরে এক একটা নাম-ধাম পরিচয় দিয়ে ভাল ভাল মেয়েদের বিয়ে করত।…
বলেন কী?
হ্যাঁ ভাই, তবে আর বলছি কি! কোথাও পরিচয় দিত আমেরিকায় থাকে ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, কোথাও বলত, বিলিতি কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার, কোথাও আবার অন্যকিছু বলত।
কী সর্বনাশ।
কটা মেয়ের সর্বনাশ করেছিল জানো?
কটা?
পাঁচটা।
ইস!
শৈলেনদা ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, ঐ জানোয়ারটা যেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ল, তার পরদিনই ওর আরও একটা বিয়ে হবার কথা ছিল। ওটাহলেই হাফ ডজন হয়ে যেত।
মেয়েটি খুব জোর বেঁচে গেছে।
কিন্তু ঐ পাঁচটা মেয়ের কথা ভাবতে গেলেই আমার মাথা ঘুরে ওঠে! একজন তো আত্মহত্যাই করেছিল।
তাই নাকি?
তবে কী? এ আঘাত সবাই সইতে পারে?
ঐ অপর্ণা কী পাঁচজনের একজন?
হ্যাঁ।