৫. বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ক্রমবিকাশ

বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ক্রমবিকাশ

উনিশ শতকের চতুর্থাংশে বাঙালি বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর সামাজিক রূপ খানিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রধানত কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই এই রূপায়ণ আরম্ভ হয়। স্বাভাবতই প্রথম পর্বের বুদ্ধিজীবীদের এই রূপায়ণ অনেকটা অস্পষ্ট, কিন্তু তা হলেও তার সামাজিক গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য তখনকার পরিবেশের মধ্যে কিছুটা ফুটে উঠবার সুযোগ পেয়েছিল। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা তখন প্রধানত দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। প্রথম গোষ্ঠীকে আমরা Traditionalist বা ঐতিহ্যপন্থী বলতে পারি, এবং দ্বিতীয় গোষ্ঠীকে বলতে পারি Anglicist বা পাশ্চাত্যপন্থী। দুই গোষ্ঠীকেই কতকটা ‘চরমপন্থী’ বলা যায়। ঐতিহ্যবাদীরা প্রাচীন দেশীয় ঐতিহ্যকে অনেকটা অন্ধের মতো আঁকড়ে? ধরে থাকতে চেয়েছিলেন, নূতন যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে তার পুনর্বিচার করতে চাননি পাশ্চাত্যবাদীরা ইয়োরোপীয় জ্ঞানবিদ্যার হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে এতদূর ধাঁধিয়ে গিয়েছিলেন যে দেশীয় ঐতিহ্যকে একনিশ্বাসে নস্যাৎ করতেও তাঁরা কুণ্ঠিত হননি। প্রথম পর্বের সংঘাত এক দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই তীব্র হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় এক গোষ্ঠীর বিকাশ এই সময় থেকে হতে থাকে—তাঁদেরই আমরা ‘Humanist’ বুদ্ধিজীবী বলতে পারি। এদেশের ক্ল্যাসিকাল ঐতিহ্য পুনরুর্দ্ধার করে, তার কালোপযোগিতা বিচার করে, বহমান কালগঙ্গার সঙ্গে তার মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের ‘হিউম্যানিস্ট’ বুদ্ধিজীবী বলতে বাধা নেই। পাশ্চাত্ত্যবাদীরাও হিউম্যানিস্ট ছিলেন, কিন্তু জীবনবোধ ও যুগাদর্শের দিক থেকে যতটা ছিলেন, নিজেদের ব্যক্তিগত সাংস্কৃতিক আচরণের দিক থেকে ততটা ছিলেন না। তবু তাঁরা যে ‘হিউম্যানিস্ট’ ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের দুটি গোষ্ঠীতে ভাগ করা যায় ‘ক্ল্যাসিক্যাল হিউম্যানিস্ট’।

কিন্তু হিউম্যানিস্ট কারা, এবং হিউম্যানিজম কী? সনাতন ঐতিহ্যবাদী বা traditionalist রা কেন হিউম্যানিস্ট নন? হিউম্যানিজম নবযুগের মানুষের এগিয়ে চলার পথের ideology বা জীবনদর্শন। ‘নবযুগ’ মানে অবশ্য ইতিহাসের দিক থেকে ধনতান্ত্রিক যুগ এবং নবযুগের মানুষ মানে সেইযুগে যাঁরা প্রধান হয়ে ওঠেন সেই ধনিকশ্রেণি। এই ধনিকশ্রেণির প্রথম অভ্যুদয়কালে এমন একটি জীবনদর্শনের প্রয়োজন তাঁদের ছিল যা মানুষকে পারত্রিক চিন্তা থেকে মুক্ত করে জাগতিক চিন্তায় আকৃষ্ট করবে, ঈশ্বর—মুখাপেক্ষী না হয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে উদ্বুদ্ধ করবে, এবং অতিপ্রাকৃত পরমার্থবোধের বদলে মানবমুখী জীবনবোধের বিকাশে সাহায্য করবে। এই আদর্শসংগ্রামে যেহেতু তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ‘চ্যালেঞ্জে’র সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেইজন্যই তাঁদের প্রাচীন ক্ল্যাসিকাল যুগ থেকে নূতন যুগপোযোগী আদর্শ ও নীতি পুনরনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়েছিল। সমাজচিন্তা ও মানবচিন্তার জন্য তাঁরা সেদিন সংগ্রাম করেছিলেন, নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য—আর্থিক মুনাফার চিন্তার চেয়ে পরমার্থ—চিন্তা তাঁদের অধিকতর কাব্য ছিল না, তাই মানুষকেও সেই চিন্তা থেকে তাঁরা মুক্ত করতে চেয়েছেন। তাঁদের কাম্য ছিল নগদ metallic অর্থচিন্তা, তাই ইহজগৎ ও ব্যক্তিসত্তার চিন্তার দিকে তাঁরা মানুষের মনকে আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধনিকশ্রেণি তাঁদের শ্রেণিস্বার্থের জন্য এই আদর্শ প্রচার করলেও, সাধারণভাবে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের ঐতিহাসিক অগ্রগতিতে সেই সময় এই আদর্শ খানিকটা সাহায্য করেছে। ধনিকশ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিশ্লেষণ—প্রসঙ্গে মার্কস এঙ্গেলসের বিখ্যাত উক্তির কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় :

The bourgeoisie, historically, has played a most revolutionary part. The bourgeoisie… has put and end to all feudal, partriarchal, idyllic relations. It has pitilessly torn as under the motley feudal ties that bound man to his natural superiors, and has left remaining no other nexus between man and man than naked self-interest, than callous cash payment. It has downed the most heavenly ecstasies of religious fervour, of chivalrous enthusiasm, of phillistine sentimentalism, in the icy water of egotistical calculation. It has resolved personal worth into exchange-value…

নবযুগের হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীরা ধনতন্ত্রের উন্মেষপর্বে ইয়োরোপে তাঁদের জাগতিক ও মানবমুখী আদর্শের জন্য সংগ্রাম করে এইজন্যই ইতিহাসের সম্মুখগতিতে সাহায্য করেছেন এবং এই কারণেই তাঁরা প্রগতিশীল। এইজন্যই দেখা যায়, নবযুগের সূচনাকালে নূতন বিত্তবানশ্রেণি ও বিদ্বানশ্রেণি, সমাজের প্রায় একই স্তর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীরা এই ঐতিহাসিক অর্থেই হিউম্যানিস্টদের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু আমাদের দেশের পাশ্চাত্যবাদীদের সাংস্কৃতিক আচরণের দিক থেকে এবং কিছুটা বিদ্যার দিক থেকেও, আদর্শ হিউম্যানিস্ট বলা যায় না। কারণটা অবশ্য আমাদের ইতিহাসের দিক থেকে করুণ। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের যুগে, ঐতিহাসিকরা একবাক্যে বলেছেন—‘‘Classical learning was endowed with magic qualities’’– কিন্তু আমাদের দেশে কি ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতবিদ্যা আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মনে সেইরকম জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল? তা পারেনি, এবং তার কারণ হল আমাদের পরাধীনতা। বাংলার নবযুগের বুদ্ধিজীবীদের বড় একটা অংশ ইংরেজদের, ইংরেজিবিদ্যার যতটা প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, নিজেদের দেশীয় বিদ্যায় তা হননি। বিশেষ করে অ্যাংলিসিস্ট বা পাশ্চাত্যবাদীরা তো হনইনি। নূতন ইংরেজ রাজার রাজভাষা ও রাজবিদ্যা উদীয়মান বাঙালি বিত্তবান ও বিদ্বান উভয়শ্রেণির মনে ঐন্দ্রজালিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারণ ইংরেজিবিদ্যা বিত্তলাভ ও সামাজিক মর্যাদালাভের সহায়ক। সে প্রভাব দু—এক পুরুষে নয়, আজকে প্রায় সাত পুরুষেও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম—তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, অর্থাৎ ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের সময় পর্যন্ত, এদেশে ব্রিটিশ শাসকদের শিক্ষানীতি ছিল, ক্ল্যাসিকাল প্রাচ্যবিদ্যার পোষকতা করা। সেজন্য কলকাতায় মাদ্রাসা এবং বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৮১১ সালে লর্ড মিণ্টো তাঁর শিক্ষাপ্রস্তাবে নবদ্বীপে ও ত্রিহুতে দুটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, এবং প্রসঙ্গত এদেশের প্রাচীন বিদ্বৎসমাজের ক্রমাবনতির কথা উল্লেখ করে মন্তব্য করেছিলেন :

The number of the learned is not only diminished, but the circle of learning even among those who still devote themselves to it appears to be considerable contracted.

কেবল বিদ্যারই যে অবনতি হয়েছিল তাই নয়, বিদ্বৎগোষ্ঠীর সংখ্যাও যে কত কমে এসেছিল, মিন্টো সেকথা ইঙ্গিত করেছেন। রাষ্ট্র—দুর্যোগ, অর্থনৈতিক কারণ, এবং প্রধানত সেকালের জমিদারশ্রেণির পোষকতার অভাব—এই কয়েকটি কারণে প্রাচীন বিদ্বৎসমাজের বিলোপ ঘটেছিল। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ (১৮০০) প্রতিষ্ঠার পর, এবং সুপ্রিম কোর্ট ও অন্যান্য জেলা আদালতে জজপণ্ডিত নিয়োগের ফলে, বিশেষ করে ইংরেজ শাসকদের প্রাচ্যবিদ্যার পোষকতার জন্য, কলকাতা শহরে সেকালের সংস্কৃতজ্ঞ বিদ্বৎসমাজের নূতন একটি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। পাদরি উইলিয়ম ওয়ার্ডের A View of the History, Literature and Mythology of the Hindoos গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডে ১৮২০ সালের কলকাতার টোল—চতুষ্পাঠীর একটি বিবরণ পাওয়া যায়। কলকাতায় তখন প্রায় ২৮ জন পণ্ডিতের টোল ছিল এবং তার ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭৩ জন। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, নূতন বিদ্যাকেন্দ্র কলকাতা শহরেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই traditionalist পণ্ডিতদের একটি সমাজ বা গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই বিদ্বৎগোষ্ঠীর অস্তিত্ব একেবারে লুপ্ত হবার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। কলকাতার সংস্কৃত কলেজকে কেন্দ্র করে সেকালের পণ্ডিতগোষ্ঠী একালের বিদ্বৎসমাজের নৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াবার সুযোগ পান।

কিন্তু ইংরেজরা যখন প্রত্যক্ষভাবে প্রাচীন ক্লাসিক্যালবিদ্যার পোষকতা করছিলেন, এবং ইংরেজি শিক্ষার ভালো প্রতিষ্ঠান যখন কিছুই ছিল না, তখন থেকেই দেখা যায়, ইংরেজি শিক্ষার প্রতি এদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণির আগ্রহ বাড়ছিল। রামকমল সেন ১৮৩৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ইংরেজি—বাংলা অভিধানের ভূমিকায় তার উল্লেখ করেছেন :

In 1774 the Supreme Court was established here, and from this period a knowledge of the English language appeared to be desirable and necessary.

তখন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাহেব অ্যাটর্নি ও অ্যাডভোকেটদের বাঙালি কেরানিরা। তাঁরা ইংরেজিতে আবেদনপত্রাদি লিখতে পারতেন, এবং কাজকর্ম চালানোর মতো yes no very well প্রভৃতি কিছু ইংরেজি শব্দের স্টকিস্ট ছিলেন। একটি নোটখাতার মধ্যে তাঁর ইংরেজি শব্দ লিখে—লিখে স্টক করে রাখতেন। যাঁর যত বেশি স্টক থাকত, তিনি তত বড় ইংরেজির পণ্ডিত বলে খাতির পেতেন। রামকমল সেন তাঁর অভিধানের ভূমিকায় কয়েকজনের নামও উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনি বলেছেন, যতদূর অনুসন্ধান করে জানা যায়, রামরাম মিশ্র নামে একজন ব্রাহ্মণ ‘‘was the first who made any considerable progress in the English language.’’ অনেক বাঙালিবাবু তখন তাঁর ছাত্র ছিলেন। রামরামের পর রামনারায়ণ মিশ্র, আনন্দীরাম দাস, রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু, এবং আরও পরে রামকমল বলেছেন, ভবানী দত্ত, শিবু দত্ত ও অন্য দু—একজন ‘‘were celebrated as complete English scholars.’’ ইংরেজির এই complete scholar-দের বিদ্যা তখন একখানি Spelling Book ও Word Book-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এঁরা নিজেরা স্কুল করে ইংরেজি শিক্ষা দিতেন এবং বাঙালি ছাত্রদের কাছ থেকে তারজন্য বেতন নিজের ৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত।*

বিবরণটি বাইরে থেকে কিছুটা লঘু মনে হলেও, সামাজিক ইতিহাসের দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আঠারো শতকের শেষপাদ থেকে উনিশ শতকের প্রথমপাদ পর্যন্ত, অন্তত ১৮১৭ সালে হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত, বাংলাদেশে নূতন ইংরেজি শিক্ষার বাস্তব চিত্রটি এর মধ্যে কয়েকটি রেখার আঁচড়ে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল নবযুগের বাংলায় নূতন বিদ্বৎসমাজের ঐতিহাসিক রূপের সমস্ত বৈশিষ্ট্যও এর মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তখনকার দিনে মাসিক চার টাকা থেকে ষোলো টাকা বেতন দিয়ে কারা তাঁদের ছেলেদের শিবু দত্ত—ভবানী দত্ত—রামলোচন নাপিত, অথবা তাঁদের সমসাময়িক ফিরিঙ্গি আরাতুন পিক্রুশ, শেরবোর্ন ড্রামন্ড হুটেম্যান প্রভৃতিদের স্কুলে ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠাতেন? কলকাতা শহরের নূতন মধ্যবিত্তসমাজের উচ্চশ্রেণির লোকেরা—দেওয়ান—মুনশি, বেনিয়ান—মুতসুদ্দি ব্যবসায়ীদের পরিবার নিয়ে গঠিত নূতন শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্তশ্রেণি। এই সমাজই তখন কলকাতা শহরে ‘বাবুসমাজ’ বলে পরিচিত ছিলেন। এই সব complete English scholar-দের স্কুলের ছাত্রসংখ্যা নেহাত অল্প ছিল না, কারণ এ—রকম স্কুল খুলে অনেকে তখন যথেষ্ট ধনোপার্জন করেছিলেন। চার টাকা থেকে ষোলো টাকা বেতন আদায়ের মনোভাবটিও কালোপযোগী, কারণ কার্ল মার্কসের ভাষায়, সবকিছুর value-ই তখন exchange-value-তে পরিণত হয়েছে, এবং সব মানবিক সম্পর্ক রূপান্তরিত হয়েছে ক্যাশ—টাকার সম্পর্কে (nexus-এ)। সেকালের টোল—চতুষ্পাঠীর গুরু ও পণ্ডিতদের নিঃস্বার্থ বিদ্যাদানের আদর্শ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে এবং সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বুর্জোয়াযুগের বুদ্ধিজীবী শিবু দত্ত—শেরবোর্ন—রাম নাপিতের নূতন বিদ্যাদর্শ টাকার ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই সঙ্গে ঘটে গেছে। ব্রাহ্মণের কুলগত বৃত্তি ছিল শাস্ত্রব্যবসা ও অধ্যাপনা। নবযুগের ধনতান্ত্রিক সমাজে তা একটি কোনো বিশেষ কুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো না। বিহারি ব্রাহ্মণ রামরাম মিশ্র থেকে ভবানী দত্ত, আনন্দী দাস, রামলোচন নাপিত, সকল কুলেরই বিদ্যাবৃত্তির অধিকার স্বীকৃত হল। সকল কুলের গুরুর কাছে সকল জাতের ছাত্র টাকার বিনিময়ে আধুনিক বিদ্যাশিক্ষা করতে আরম্ভ করল। যতই দান করা যাবে ততই বেড়ে যাবে, নবযুগে বিদ্যার এই আদর্শ আর রইল না। নবযুগের বিদ্যা হল বিত্তলোভী এবং তার বিত্তও হল খানিকটা বিদ্যাশ্রয়ী। বিদ্যা দান করলে বিদ্যা বাড়ে না, বিত্ত বাড়ে।

উনিশ শতকের প্রথম পর্বে, বাঙালি বুদ্ধিজীবীর বিকাশ আরম্ভ হয়েছিল দুটি স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট ধারায়—একটি ধারা দেশীয় ঐতিহ্যের, আর একটি ধারা পাশ্চাত্য আদর্শের অনুগামী। ১৮১৭ সালে হিন্দুকলেজ এবং ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই দুই বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর আরও দ্রুত বিকাশ হতে থাকে, এবং তাঁদের সামাজিক রূপটিও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। ইংরেজরা তখনও প্রকাশ্যে পাশ্চাত্যবিদ্যা বা ইংরেজিবিদ্যাকে তাঁদের শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করতে পারেননি। দেশীয় ঐতিহ্য ও প্রথাকে, নিজেদের শাসনস্বার্থেই, তাঁরা হঠাৎ আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করছিলেন। তাঁদের সিদ্ধান্তের অনেক আগেই এদেশের নূতন উচ্চশ্রেণির লোকেরাই ইংরেজি শিক্ষার তাৎকালিক শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিন্দুকলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁরা সকলেই নূতন উচ্চমধ্যবিত্তশ্রেণির লোক, এবং ইংরেজদের তুলনায় ইংরেজি শিক্ষার প্রতি এঁদের অনেক বেশি আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহের বশে, সরকারি পোষকতার মুখাপেক্ষী না হয়েই, তাঁরা হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আগ্রহের মূলে পাশ্চাত্য জীবনাদর্শের প্রেরণা বিশেষ ছিল বলে মনে হয় না, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রখর ছিল তাঁদের সজাগ বাস্তববুদ্ধি। নূতন সমাজে সচল বিত্ত যেমন মূলধন হতে পারে, তেমনই ইংরেজি বিদ্যাও যে নবযুগের অর্থনৈতিক মূলধনের পরিপূরক মূলধন হতে পারে, এ সত্য তাঁরা শ্রেণিগত চেতনা থেকেই অনেক আগে উপলব্ধি করেছিলেন। বর্ধমানের মহারাজা, শোভাবাজারের রাজপরিবারের গোপীমোহন দেব ও রাধাকান্ত দেব, ধনশালী রক্ষণশীল রাধামাধব অথবা রামকমল সেন ও রসময় দত্ত, এঁরা কেউ—ই নবযুগের হিউম্যানিস্ট আদর্শের সমর্থক ছিলেন না এবং তা উপলব্ধি করার মতো মানসিক গড়নও তাঁদের ছিল না। অথচ এঁরাই হিন্দুকলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। নূতন রাজার আমলে রাজবিদ্যাশিক্ষার আবশ্যকতা তাঁরা বণিকসুলভ স্বার্থবুদ্ধি থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন।

হিন্দুকলেজের ছাত্ররা কয়েকজন আদর্শবাদী বিদেশি শিক্ষকের সান্নিধ্যে শিক্ষা লাভ করে, নবযুগের বাংলার অগ্রগণ্য হিউম্যানিস্ট ইনটিলেকচুয়াল হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু এ কথা সত্য নয় যে, কোনো মহৎ জীবনাদর্শের বাস্তব রূপায়ণের জন্য হিন্দুকলেজের বাঙালি উদ্যোক্তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এই উক্তির সপক্ষে আরও একটি বড় প্রমাণ আছে, যা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। নবযুগের হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের দীক্ষাগুরু যিনি, সেই রামমোহন রায় হিন্দু কলেজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেননি, এবং তাঁর ব্রাহ্মধর্মচিন্তা ও সংস্কারমুখী সমাজচিন্তাই তার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দুকলেজের প্রতিষ্ঠাতারা রামমোহনের ধর্মমত সম্বন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এবং নিজেরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ ‘secular’ শিক্ষা—প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু তাঁদের এই প্রচারিত উদ্দেশ্য নিতান্তই হাস্যকর মনে হয়, কারণ হিন্দুকলেজের পূর্বোক্ত প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে সকলেই প্রায় রক্ষণশীল ধর্মসভার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং হিন্দুকলেজের চৌহদ্দির বাইরে তাঁরা ধর্মসভার আন্দোলনে ও ব্যবসাবাণিজ্যের ধান্ধাতেই কালাতিপাত করতেন। তবু তাঁরা ‘হিন্দুকলেজ’ নাম দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন কেন? Money Intellect—এর co-relation স্থাপনের জন্য। ধনতান্ত্রিক নবযুগের টাকা যেহেতু neutral, তাই নবযুগের বিদ্যাও neutral হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিমেলের (Simmel)-এর ভাষায় :

The Intellect as such is a-moral it is neutral like money which lends itself without protest to the most dastardly machinations.

রামমোহন রায় এই ধরনের amoral শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেননি, কিন্তু উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করে দেশের মধ্যে যে নূতন বিদ্বৎসমাজ গড়ে উঠবে, আদর্শ ও নীতির দিক থেকে সমাজে তাঁরা যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন, তা তিনি জানতেন। তাই তিনি দূরে থেকেও হিন্দুকলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা সমর্থন করেছিলেন।

নবযুগের হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম দীক্ষাগুরু ছিলেন রামমোহন। সরকারি অর্থে সংস্কৃত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হচ্ছিল যখন, রামমোহন রায় তখন বড়লাট আমহার্স্টকে প্রতিবাদ জানিয়ে একখানি পত্র লেখেন। এই পত্রে তিনি সরকারিনীতির সমালোচনা করে মন্তব্য করেন (১৮২৩) :

We now find that the Government are establishing a Sanskrit School under Hindoo Pundits to impart such knowledge as is already current in India. This seminary (similar in character to those which existed in Europe before the time of Lord Bacon) can only be expected to load the minds of youth with grammatical niceties and metaphysical distinctions of little or no practical use to the possessors or to society. The pupils will there acquire what was known 2000. years ago, with the addition of vain and empty subtleties since produced by speculative men, such as is already commonly taught in all parts of India.

সংস্কৃত শিক্ষার বদলে তিনি এদেশের লোককে আধুনিক ইউরোপের শিল্পকলা সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেবার জন্য আবেদন করেছিলেন। সংস্কৃত বিদ্যার চর্চা রামমোহন একেবারে বর্জন করতে চাননি, এবং এই পত্রে ঠিক সে কথা বলবার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। ইংরেজদের অত্যধিক প্রাচ্যবিদ্যাপ্রীতি তাঁকে উৎকণ্ঠিত করেছিল। তাই তিনি তাঁর পত্রে পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে ইংলন্ডে বেকনের জীবন—দর্শন প্রচার না করে যদি মধ্যযুগের ধর্মশিক্ষার গোঁড়ামিকে আঁকড়ে ধরে থাকা হত, তা হলে ব্রিটিশ জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি কি সম্ভব হত? রামমোহন নিজে ক্ল্যাসিক্যাল স্কলার ছিলেন, সংস্কৃত আরবি ফারসিতে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল, এবং সেই পাণ্ডিত্য তিনি বহু কষ্ট স্বীকার করে অর্জন করেছিলেন।

সুতরাং সংস্কৃতবিদ্যার প্রতি তাঁর বিশেষ কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না, এবং সেই অশ্রদ্ধার জন্য আমহার্স্টকে পত্র লেখেননি। তাঁর ভয় ছিল যে ইংরেজরা এদেশে আধুনিক ইয়োরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসার কামনা করেন না, তার বদলে সেকালের শাস্ত্রবিদ্যার পুনরুজ্জীবন কামনা করেন। এদেশের শিক্ষা সম্বন্ধে রামমোহনের এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর ঐতিহাসিক পত্রখানিতে ফুটে উঠেছে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষণীয় বিষয় ও শিক্ষাপদ্ধতি আমূল সংস্কার করার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং বারাণসী সংস্কৃত কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইনের সঙ্গে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর যে বাদানুবাদ হয়েছিল, তার মধ্যে এমন অনেক কথাই তিনি বলেছিলেন বা রামমোহনের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়। বোঝা যায়, শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহনের হিউম্যানিস্ট আদর্শের উত্তরসাধক ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহনকে যদি নবযুগের বাংলার হিউম্যানিস্ট—বুদ্ধিজীবীদের দীক্ষাগুরু বলা যায়, তা হলে বিদ্যাসাগরকে নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রেষ্ঠ উত্তরসাধক বলা যেতে পারে, যিনি হিউম্যানিস্ট বিদ্যাদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন, এবং যাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশে সত্যকার হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের একটা প্রভাবশালী গোষ্ঠী উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে গড়ে উঠেছে।

রামমোহনের আশঙ্কা যে ভিত্তিহীন ছিল না তা উনিশ শতকের দ্বিতীয়—তৃতীয় দশকে অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্ট, এই দুই গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীদের বাদানুবাদেই প্রমাণিত হয়েছিল। ১৮৩৫ সালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের শিক্ষাসংক্রান্ত বিখ্যাত ‘মিনিটে’ এই বাদানুবাদের অবসান হয়ে যায়। মেকলে স্পষ্ট ভাষায় বলেন :‘‘The literature of England is now more valuable than that of Classical antiquity.’’—এবং এদেশের ক্ল্যাসিক্যাল শাস্ত্রবিদ্যার প্রতি কটাক্ষ করে তিনি বলেন :

…can we reasonably or decently bride men, out of the revenues of the State, to waste their youth in learning how they are to purify themselves after touching an ass, or what texts of the Vedas they are to repeat to expiate the crime of killing a goat?

মেকলে ও বেন্টিঙ্কের প্রস্তাবে ১৮৩৫ সাল থেকে ইংরেজি শিক্ষা সরকারি নীতি হিসেবে গৃহীত হয়, এবং তার ফলে বাংলার সমাজে অ্যাংলিসিস্ট বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। কিন্তু সংখ্যাবৃদ্ধি যে খুব দ্রুতহারে হয়নি তা হিন্দু কলেজের ছাত্রসংখ্যার হারবৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়। ইংরেজি শিক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান তখন হিন্দুকলেজ, অতএব তার ছাত্রসংখ্যা থেকে এদেশের অ্যাংলিসিস্ট বুদ্ধিজীবীদের বিকাশের ধারা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। হিন্দুকলেজের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৮২৪—২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় আট বছর ছাত্রসংখ্যা গড়ে একশোর বেশি হয়নি। ১৮২৭—২৮ সাল থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ছাত্রসংখ্যা ৩৫০ থেকে ৫৫০ পর্যন্ত হয়েছিল, অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৪৫০ বলা যায়। এই ৪৫০ ছাত্রসংখ্যা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে সংগতিপন্ন মধ্যবিত্ত ও ধনিক পরিবারের সংখ্যা, উনিশশো শতকের মাঝামাঝি, কলকাতা শহরে খুব বেশি হয়নি। এই সংকীর্ণ ধনিক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের গণ্ডির মধ্যেই তখন আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালী বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর বিকাশ সীমাবদ্ধ ছিল বললে ভুল হয় না। ১৮৫৪ সালে Wood’s Despatch—এ যে শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়, তাতে এই কথা আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয় :

…By the division of University Degress and distinctions into difficult branches, the exertions of highly educated men will be directed to the studies, in future necessary to success in the various active professions of life. We shall therefore have done as much as a government can do to place the benefits of education plainly and practically before the higher classes of India.

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Degree’ ও ‘Distinction’-এর উদ্দেশ্য হল—‘success in the various active professions of life’। এই কথা জানিয়ে চার্লস উডের Despatch-এ পরিষ্কার ঘোষণা করা হল যে এই উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও উপকারিতা কেবল ভারতের উচ্চশ্রেণির লোকেরাই পাবেন অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য হল, এদেশে এমন একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী গড়ে তোলা যাঁরা প্রধানত তাঁদেরই আদর্শ ও নীতির সমর্থক হবেন। ব্রিটিশ শিক্ষানীতির ফলে, উনিশ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে তৃতীয় পাদের মধ্যে বাংলাদেশে একটা ‘Upper Class Intellectual Aristocracy’ গড়ে উঠেছিল এবং সেটা হিন্দুপ্রধান। এই অভিজাত এলিটশ্রেণির বংশধরেরাই স্কলার ও টিচার হয়েছেন, সিভিল সারভেন্ট, সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, স্কুল ইনস্পেক্টর, গ্রন্থকার ও সাংবাদিক হয়েছেন এবং তাঁরাই ক্রমবর্ধমান বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর ‘লীডার’ ও ‘গাইড’ হয়েছেন।

তা হলে এ যুগের বাঙালি বুদ্ধিজীবীশ্রেণির ক্রমবিকাশের ধারাটি, গোষ্ঠীবিন্যস্তরূপে, মোটামুটি এইভাবে নির্দেশ করা যেতে পারে :

প্রধান দুটি বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী হল : পাশ্চাত্যবাদী ও প্রাচ্যবাদী, যাঁদের সাধারণভাবে অ্যাংলিসিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্ট বলা হত। ওরিয়েন্টালিস্টদেরই আমরা ট্রেডিশনালিস্ট বলতে পারি। হিউম্যানিজম কথার পূর্বোক্ত ঐতিহাসিক অর্থে, এই দুই গোষ্ঠীতেই আধুনিক হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীর বিকাশ হয়েছিল। বাস্তববুদ্ধি ও মানবপ্রধান চিন্তার দিক থেকে পাশ্চাত্যবাদীদের যেমন হিউম্যানিস্ট’ বুদ্ধিজীবী বলা যায়—তেমনই এইদিক থেকে বিচার করে এদেশের অনেক ক্ল্যাসিক্যাল পণ্ডিতকেও ‘হিউম্যানিস্ট’ বুদ্ধিজীবী বলা যেতে পারে। তারাচাঁদ চক্রবর্তী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্র—এঁরা ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর অগ্রগণ্য। এঁদের হিউম্যানিজমের মধ্যে পাশ্চাত্য আদর্শের মিশ্রণ একটু বেশি ছিল। রামমোহন রায় ও তাঁর ‘আত্মীয় সভা’—গোষ্ঠী থেকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভার সদস্যগোষ্ঠী পর্যন্ত আরও একটি হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীর বিকাশের ধারা লক্ষ্য করা যায়, যাঁদের মধ্যে পাশ্চাত্ত্য হিউম্যানিজম ও আমাদের দেশীয় ক্ল্যাসিক্যাল হিউম্যানিজমের আনুপাতিক সংমিশ্রণ হয়েছিল, এবং সেইজন্য তাঁরা মডারেট (moderate) উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এদেশের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যেও একটি উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর বিকাশ হয়েছিল একই পথে। তাঁরা তাঁদের জীবনে ক্লাসিক্যালবিদ্যা ও পাশ্চাত্যবিদ্যার আদর্শের সমন্বয় ঘটাতে অনেকটা সক্ষম হয়েছিলেন। এই ক্লাসিক্যাল হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর মধ্যমণিস্বরূপ ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আরও যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, শিবনাথ শাস্ত্রী এবং আরও অনেকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শের দিক থেকে তো নিশ্চয়, প্রখর বাস্তববুদ্ধির দিক থেকেও, এদেশীয় এই সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগোষ্ঠী নবযুগের আদর্শ হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবী ছিলেন। এ ছাড়া আর একদল বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী বরাবরই ছিলেন যাঁরা অন্ধ ঐতিহ্যপন্থী। এঁরা আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধেও বলতেন যেসবই শাস্ত্রে আছে, এবং শাস্ত্রে যা নেই তা বুদ্ধি ও বিদ্যার বিচারবহির্ভূত।

মোটামুটি এই চারটি গোষ্ঠীতে বাংলার আধুনিক বিদ্বৎসমাজ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পাশ্চাত্ত্যবাদী বা ইংরেজিশিক্ষিত হিউম্যানিস্টদের মধ্যে দুটি গোষ্ঠী ছিল—একটিকে Radical এবং আর একটিকে Moderate-গোষ্ঠী বলা যায়। ডিরোজিয়ান বা ইয়ং বেঙ্গল ও তাঁদের অনুগামীরা Radical-গোষ্ঠী ছিলেন, এবং ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনীর দল Moderate-গোষ্ঠী ছিলেন। এদেশীয় ক্ল্যাসিকালবিদ্যার পণ্ডিতগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা হিউম্যানিস্ট ছিলেন তাঁরা সকলেই প্রায় মতামত ও আদর্শের দিক থেকে Moderate ছিলেন। তাই দেখা যায়, সমাজসংস্কার শিক্ষাসংস্কার প্রভৃতি আদর্শগত সংগ্রামের ব্যাপারে এই তিন গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী প্রায় সব সময়ই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন সামাজিক আদর্শগত ঐক্য ছিল, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও মিল ছিল। বিত্ত ও বিদ্যা দুটিকেই সকলে নবযুগের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদালাভের অপরিহার্য মানদণ্ডরূপে গ্রহণ করেছিলেন। রামমোহনপন্থী, ইয়ং বেঙ্গল ও ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে অনেকে বুদ্ধিজীবীসমাজে যতখানি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, বণিকসমাজেও তার চেয়ে বেশি ছাড়া কম প্রতিষ্ঠা পাননি। তারাচাঁদ চক্রবর্তী, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেক বেশ প্রতিপত্তিশালী স্বাধীন ব্যবসায়ী ও জমিদার ছিলেন। ক্ল্যাসিক্যাল হিউম্যানিস্ট বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তারানাথ তর্কবাচস্পতির মতো দু—একজন অবাধ বাণিজ্যের উৎসাহে বণিকশ্রেণির অনেককেই হার মানিয়ে দিয়েছিলেন। বাকি যাঁরা পণ্যের বাণিজ্য করেননি, তাঁরা কতকটা বণিকের মনোভাব নিয়ে নিজেদের অর্জিত বিদ্যাকে বাণিজ্যের পণ্যে পরিণত করতে কুন্ঠিত হননি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রমুখ কয়েকজন পণ্ডিত। বাংলাদেশে মুদ্রণ ও পুস্তক—প্রকাশনার ব্যবসায়ে এবং পত্রপত্রিকা পরিচালনায় এঁরা প্রথম যুগের উদযোগীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। এ ছাড়া সরকারী চাকরি অধ্যাপনা ইত্যাদি করে অনেকে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছেন, এবং সেই অর্থের জোরে সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত স্তরে উন্নীত হয়েছেন। এইভাবে নবযুগের বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবীরা বিদ্যা ও বাণিজ্যের দৌলতে নিজেদের আর্থিক অবস্থা উন্নত করে, সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণিতে পরিণত হয়েছিলেন।

হিউম্যানিজমের অন্তর্নিহিত সামাজিক ও নৈতিক আদর্শের গুরুত্ব এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের কাছে বড় ছিল বটে, কিন্তু মার্টিনের ভাষায় বলা যায় :

More and more it came to mean intellectual studium… signifying initiative and ability, and all forms of dynamic striving by the individual.

বিত্ত ও বিদ্যাই যে সমস্ত সামাজিক শক্তি ও প্রভাবপ্রতিপত্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল—বিত্তহীনের বিদ্যা নয়, বিত্তবানের বিদ্যা—তা পরিষ্কার বোঝা যায়। বিত্ত ও বিদ্যার মিলন সম্বন্ধে সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন বলেছেন :

It became more and more generally accepted that only their union within one man would allow, especially in politics, the most complete exploitation of all ways of using power.

বাংলার বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক সাংস্কৃতিক, এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক, কোনো ইতিহাসেই এই নিয়মের তেমন ব্যতিক্রম হয়নি। উনিশ শতকের গোড়া থেকে শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্ত বড় বড় বিদ্বৎ—সভাগুলির পরিচালক মণ্ডলীর সামাজিক শ্রেণিবিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যাঁরা বিদ্বান ও বিত্তবান দুই—ই, তাঁরাই প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। রামমোহনের আত্মীয়—সভা থেকে আরম্ভ করে গৌড়ীয় সমাজ, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন, ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভা, বেথুন সোসাইটি, সুহৃদ সমিতি, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বিদ্যোৎসাহিনী সভা, কেশবচন্দ্র সেনের Goodwill Fraternity ও সঙ্গত সভা প্রভৃতি সমস্ত বিদ্বৎসভায় এই উচ্চশ্রেণির বুদ্ধিজীবীরাই প্রাধান্য লাভ করেছেন। এই বিদ্বৎসভাগুলিই ছিল নবযুগের আদর্শ প্রচারের প্রধান প্রতিষ্ঠান ও মাধ্যম এবং এইগুলির ভিতর দিয়েই বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সর্বশ্রেণির মধ্যে তাঁদের নৈতিক প্রভাব বিস্তার করতেন।

উনিশ শতকের গোড়া থেকে শেষ দিকে বুদ্ধিজীবীদের এই উচ্চমধ্যবিত্ত সামাজিক ভিত্তি ক্রমে প্রসারিত হয়েছে বটে, কিন্তু সামাজিক ইনস্টিটিউশনের নেতৃত্ব প্রধানত বিত্তবান বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর হাতেই থেকেছে। সেইজন্য দেখা যায় বাংলার সমাজসংস্কার আন্দোলনের ধারা কোনোসময়ই একটা নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে তরঙ্গায়িত হয়ে যায়নি। রামমোহনের আন্দোলন, ইয়ং বেঙ্গল দলের আন্দোলন, দেবেন্দ্রনাথ ও তত্ত্ববোধিনী সভার আন্দোলন, বিদ্যাসাগরের আন্দোলন, কেশবচন্দ্র সেনের আন্দোলন এবং শিবনাথ শাস্ত্রী—আনন্দমোহন বসু—বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতির সংস্কার—আন্দোলন, প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত—সমাজের একটা স্তরের মধ্যেই সংকীর্ণ বৃত্তাকারে প্রসারলাভ করেছে। শিক্ষা—সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের উচ্চ—মধ্যবিত্তসুলভ মনোভাব যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে, তা আরও বিস্ময়কর মনে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো হৃদয়বান নির্ভীক সমাজসংস্কারকও মেকলের filtration policy-র অসহায় victim হয়ে, নিজের মধ্যবিত্তসুলভ মানসিক সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং জনশিক্ষা ও শ্রমিকশ্রেণির শিক্ষার নীতি প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। কেশবচন্দ্র সেনের মতো তেজস্বী সংস্কারক কতরকমের পরস্পরবিরোধী আদর্শের আবর্তে পড়ে শেষ পর্যন্ত দিকভ্রান্ত হয়েছিলেন তাও আমরা জানি। বিধবাবিবাহ ও বহুবিবাহের সমস্যার প্রবল আন্দোলন বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে উনিশ শতকের মধ্যভাগে হওয়া সত্ত্বেও, উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলার উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ কীভাবে তাঁর প্রেতাত্মা খুঁড়ে তুলে, তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে নিজেদের রক্ষণশীল হিন্দুভাবপ্রধান মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, তা ভাবলেও মাথা হেঁট হয়ে আসে। আর আদর্শের দিক থেকে যাঁরা হিন্দু অবতারবাদ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যাও অল্প নয়। রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসেও এই একই মনোভাব জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আগাগোড়া ব্যক্ত হয়েছে। এইভাবে দেখা যায়, নবযুগের বাংলার বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণিগত চরিত্র ও আদর্শের প্রভাব, বাংলার সমাজসংস্কার, শিক্ষাসংস্কার ও রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনের ধারাকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিয়ন্ত্রিত করেছে। এই নিয়ন্ত্রণ অবশ্য ঐতিহাসিক নিয়মানুগত, যদিও তার সংকীর্ণতা স্ববিরোধ ও সীমাবদ্ধতা আদৌ উপেক্ষণীয় নয়।

১৩৬৬ সন

….

* প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪—৮৩) হিন্দুকলেজের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন। তিনিও ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দলের একজন। তিনিও ‘আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থে ‘কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার বিবরণ শিশুশিক্ষার প্রসঙ্গ’—এ এদেশের ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ের কথা বলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *