৪১.
ফার স্টার দ্রুতগতিতে সেশেল গ্রহের মুখের দিকে এগুচ্ছে। পেলোরেট তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। এখানে মেঘের স্তর টার্মিনাসের চেয়েও অনেক বেশি পাতলা এবং ছড়ানো। মানচিত্রে যেমন দেখানো হয়েছে ল্যান্ড সারফেস ঠিক তেমনই নিবিড় এবং বিস্তৃত–মরিচা-রং দেখে মনে হচ্ছে মহাদেশের অধিকাংশই মরুভূমি।
জীবনের কোনো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ধূসর সমভূমি, সীমাহীন পর্বতশ্রেণী, মহাসাগর এবং নিষ্প্রাণ মরুভূমির গ্রহ।
প্রাণহীন মনে হচ্ছে, পেলোরেট ফিসফিস করে বলল।
এই উচ্চতা থেকে তুমি কোনো লাইফ-সাইন দেখতে পাবে না। ট্র্যাভিজ বলল। আরো নিচে নামলে সবুজের ছোঁয়া দেখতে পাবে। তার আগে তোমার চোখে পড়বে রাতের অংশের ঝলমলে ল্যান্ডস্কেপ। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে যখন অন্ধকার নামে, তখন নিজেদের দুনিয়াটাকে আলোকিত করে তোলা, এমন কোনো গ্রহ দেখিনি যেটা এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, জীবনের প্রথম উৎস হিসেবে তুমি কোনো মানুষকে দেখবে না বরং তোমার চোখে পড়বে টেকনোলজী।
পেলোরেট চিন্তিতস্বরে বলল, আমার মনে হয় কারিগরি উন্নয়নের সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে রাতকে দিনে রূপান্তরিত করা। যে কোনো গ্রহের অন্ধকার সারফেসে আলো বুদ্ধির পরিমাণ দ্বারা সেটার কারিগরি উন্নয়ন পরিমাপ করতে পারবে। তোমার কি মনে হয় অন্ধকার পুরোপুরি দূর করতে কত সময় লাগতে পারে।
ট্র্যাভিজ হাসল। তোমার চিন্তা ভাবনা বেশ অদ্ভুত, তবে আমার মনে হয় মিথলজিস্ট হওয়ার কারণেই এমন হয়েছে। আমার বিশ্বাস কোনো বিশ্বই আজ পর্যন্ত অন্ধকার পুরোপুরি দূর করতে পারে নি। আলোর ব্যাপারটা নির্ভর করে জনসংখ্যার ঘনত্বের উপর, সেই কারণেই মহাদেশগুলোকে তুমি কালো ফিতার মাঝে মাঝে উজ্জ্বল গিঠের মতো ঝলমল করতে দেখবে। এমন কি ট্র্যানটর যখন একটা বিশাল একক কাঠামো ছিল তখনো শুধু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আলোর বিস্তৃতি ছিল।
ট্র্যাভিজের কথামতো নিচে সবুজের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে, ভূ-গোলক শেষবার প্রদক্ষিণ করার সময় শহরগুলো পেলোরেটকে দেখিয়ে দিল। এই গ্রহ খুব একটা নগর কেন্দ্রিক না। সেশেল ইউনিয়নে আগে কখনো আসিনি, কিন্তু কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী এরা প্রাচীনপন্থী। গ্যালাক্সির চোখে টেকনোলজী শুধু ফাউণ্ডেশনের একক অধিকার এবং যেখানে ফাউণ্ডেশন জনপ্রিয় না, তাদের প্রবৃত্তি হচ্ছে অতীত আঁকড়ে রাখা–শুধু অস্ত্রের ব্যাপার বাদ দিয়ে। নিশ্চিত থাক সেশেলিয়ানরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট এগিয়ে আছে।
ডিয়ার মি, গোলান, ব্যাপারটা নিশ্চয়ই জটিল হয়ে উঠবে না, তাই না? যত যাই হোক, আমরা ফাউণ্ডেশনার এবং শত্রু এলাকায় রয়েছি।
এটা শত্রু এলাকা না, জেনভ। ফাউণ্ডেশন এখানে জনপ্রিয় না, ব্যাস এইটুকুই। সেশেল ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনে যোগ দেয়নি। নিজেদের স্বাধীনতা নিয়ে সেশেলিয়ানরা গর্বিত। তবে কখনোই মনে করতে চায় না যে ফাউণ্ডেশনের তুলনায় তারা অনেক দুর্বল এবং আমরা চেয়েছি বলেই এখনো স্বাধীন রয়েছে। এই কারণেই আমাদেরকে পছন্দ না করার বিলাসিতা তারা দেখাতেই পারে।
আমার এখনো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠবে, পেলোরেট অস্বস্তির সাথে বলল।
মোটেই না, ট্র্যাভিজ বলল। শোন, জেনভ। আমি বলছি সেশেল গভর্নমেন্টের অফিসিয়াল মনোভাবের কথা। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি সাধারণ। যদি তাদের সাথে ভদ্র আচরণ করি এবং ভাব না দেখাই যে আমরাই গ্যালাক্সির লর্ড, তাহলে ওরাও ভদ্র আচরণ করবে। সেশেলে আমরা ফাউণ্ডেশনের প্রভূত্ব বিস্তার করতে আসিনি। আমরা ট্যুরিস্ট। এমন সব প্রশ্ন করব যা যে কোনো ট্যুরিস্টই জিজ্ঞেস করতে পারে।
পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে, আমরা কিছু আইনগত সুবিধা পাব। কয়েকদিন থেকে এই গ্রহটার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে কোনো অসুবিধা নেই। তাদের হয়তো একটা আকর্ষণীয় সংস্কৃতি রয়েছে, রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য, মজাদার খাবার, আর এগুলো না থাকলেও সুন্দরী মেয়েতো থাকবেই। খরচ কোনো ব্যাপার না।
পেলোরেটের ভুরু কুঁচকে গেল, ওহ্, মাই ডিয়ার চ্যাপ।
কাম অন, ট্র্যাভিজ বলল। সে রকম বুড়ো তো হওনি। তোমার একটুও আগ্রহ হচ্ছে না?
একসময় যথাযথভাবে এই ভূমিকা পালন করেছিলাম, অস্বীকার করব না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি সেরকম নেই। আমাদের একটা মিশন রয়েছে। আমাদেরকে গায়াতে পৌঁছতে হবে। সময়টা আনন্দে কাটানোর বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই কিন্তু নিজেদেরকে অন্য বিষয়ের সাথে জড়িত করে ফেললে ফ্রিলি কাজ করতে পারব না। মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু গলায় বলল, আমার ধারণা তুমি ভয় পেয়েছিলে ট্রানটরের। গ্যালাকটিক লাইব্রেরিতে আমি ভালো সময় কাটাবো এবং সহজে নড়াচড়া করব না। অবশ্যই লাইব্রেরি আমার কাছে কালো চোখের কুমারী মেয়ের মতো তোমারও তাই মনে হতো।
আমি তো দুঃশ্চরিত্র লম্পট না, জেনভ, ট্র্যাভিজ বলল, কিন্তু সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছাও আমার নেই। ঠিক আছে কথা দিচ্ছি গায়ার ব্যাপারেই গুরুত্ব দেব, তবে, উপভোগ করার মতো কিছু যদি পেয়েই যাই, গ্যালাক্সিতে এমন কোনো কারণ নেই যে আমি স্বাভাবিক আচরণ করব না।
যদি তুমি গায়াকে প্রথম গুরুত্ব দাও।
দেব। যাইহোক, মনে রাখবে, কাউকে বলবে না আমরা ফাউণ্ডেশন থেকে এসেছি। ওরা জানবে ঠিকই, কারণ খরচ করার জন্য আমাদের হাতে রয়েছে ফাউণ্ডেশন ক্রেডিট এবং কথা বলছি টার্মিনাসের এ্যাকসেন্টে, কিন্তু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে, ওরা ধরে নেবে আমরা ভবঘুরে। তখন ভালো আচরণ। করবে। যদি বলি যে আমরা ফাউণ্ডেশনার, তাহলে ওরা আরো ভদ্র আচরণ করবে, কিন্তু কিছুই বলবে না, কিছুই দেখাবে না, কোথাও নিয়ে যাবে না। আমাদের একা ফেলে রাখবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পেলোরেট। মানুষকে আমি কখনো বুঝতে পারব না।
তেমন কঠিন কিছু না। নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে পারলে বাকী সবাইকে বুঝতে পারবে। আমাদের ভেতর খুব বেশি পার্থক্য নেই। মানুষকে বুঝতে না পারলে সেলডন কিভাবে তার প্ল্যান তৈরি করেছেন?
আমি আসলে এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। কারণ বেশ আত্মকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণ জীবন কাটিয়েছি। হয়তো কখনো নিজেকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করিনি। কাজেই তুমি হবে আমার পথপ্রদর্শক এবং পরামর্শদাতা।
চমৎকার। এখন আমার উপদেশ মতো বসে বসে বাইরের দৃশ্য দেখো। এখুনি ল্যান্ড করব কিন্তু বিশ্বাস করো কিছুই টের পাবে না। কম্পিউটার আর আমি পুরো ব্যাপারটা সামলাচ্ছি।
গোলান, কিছু মনে করো না। যদি কোনো তরুণী-
ভুলে যাও। আমাকে বরং ল্যান্ডিং এর ব্যাপারটা সামলাতে দাও।
পেলোরেট ঘুরে গ্রহটার দিকে তাকালো। এটাই প্রথম বিদেশী গ্রহ যার বুকে জীবনে প্রথমবারের মতো সে পা রাখবে। নিজের জন্য তার করুণা হলো, যদিও জানে যে গ্যালাক্সির কয়েক মিলিয়ন গ্রহে মানুষ বসতি স্থাপন করেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাতেই মানুষের জন্ম হয়নি।
শুধু একটা বাদে।
.
৪২.
ফাউণ্ডেশনের চেয়ে সেশেলের স্পেসপোর্ট অনেক বেশি ছোট, কিন্তু বেশ গোছানো এবং সুরক্ষিত। তাদের সামনেই মহাকাশযান একটা বার্থে ঢুকিয়ে জায়গামতো লক্ করা হয়েছে। তাদেরকে একটা বিস্তারিত কোড করা রিসিপ্ট দেয়া হলো।
পেলোরেট নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, এটাকে এখানেই রেখে যাবো?
মাথা নেড়ে আশ্বাসের ভঙ্গিতে অপরজনের কাঁধে হাত রাখল ট্র্যাভিজ। চিন্তা করোনা, সেও নিচু স্বরে কথা বলছে।
দুজন ভাড়া করা গ্রাউন্ড কারে উঠল। ট্র্যাভিজের হাতে শহরের একটা ম্যাপ। এখান থেকে শহরের উঁচু টাওয়ারগুলো দেখা যাচ্ছে।
সেশেল সিটি, সে নির্দেশ দিল, গ্রহের রাজধানী। শহর গ্রহ-নক্ষত্র–সবকিছুর নাম সেশেল।
মহাকাশযান নিয়ে আমার চিন্তা হচ্ছে, পেলোরেট আবারো বলল।
চিন্তার কিছু নেই। রাতেই আবার ফিরে আসছি যদি বেশি সময় থাকতে হয় তাহলে এখানেই ঘুমাতে হবে। একটা ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করো, স্পেসপোর্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা ইন্টারস্টেলার কোড রয়েছে। আমার জানামতে সেই কোড কেউ কখনো ভঙ্গ করেনি, এমনকি যুদ্ধের সময়েও না। যে মহাকাশযান শান্তি বজায় রাখবে তার কোনো ক্ষতি করা যাবে না। নইলে কেউ নিরাপদ বোধ করবে না, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো গ্রহ যদি নিয়মটা ভঙ্গ করে, গ্যালাক্সির সব মহাকাশযান চালক সেই গ্রহকে বয়কট করবে। বিশ্বাস করো এমন ঝুঁকি কেউ নেবে না। তাছাড়া-
তাছাড়া?
বেশ, তাছাড়া, আমি কম্পিউটারকে দিয়ে ব্যবস্থা করে এসেছি। আমাদের চেহারা এবং কণ্ঠস্বরের সাথে মেলে না এমন কেউ যদি যানে উঠার চেষ্টা করে সাথে সাথে মারা যাবে। স্পেসপোর্ট প্রধানকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলেছি। তাকে বলেছি যে নতুন মডেলের যান বলেই আমি জানিনা কিভাবে যন্ত্রটা বন্ধ করতে হয়।
নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেনি।
অবশ্যই না। কিন্তু ভাব দেখিয়েছে করেছে, অন্যথায় তার অপমানিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কাজেই আমাকে বিশ্বাস করার সহজ পথটাই সে বেছে নিয়েছে।
মানব চরিত্রের আরেকটা উদাহরণ?
হ্যাঁ।
গ্রাউন্ড-কারে কোনো ছাড়পোকা নেই, তুমি নিশ্চিত?
ব্যাপরটা নিয়ে ভেবেছি। তাই ওরা যখন একটা কার নিতে বলল, আমি সাথে সাথে অন্য আরেকটা বাছাই করি। যদি সবগুলোতেই ছারপোকা বসানো থাকে–বেশ, আমরা এমন কি ভয়ানক কথা বলে ফেলেছি?
পেলোরেটকে অখুশী মনে হলো। কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। অভিযোগ করা উচিত না, কিন্তু গন্ধটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
গ্রাউন্ড কারে?
স্পেসপোর্টেই গন্ধটা পেয়েছিলাম। তখন মনে করেছিলাম সব পোর্টেই বোধহয় এধরনের গন্ধ থাকে। কিন্তু এখন এখানেও পাচ্ছি। জানালাগুলো খুলে দেয়া যায় না?
ট্র্যাভিজ হাসল। হয়তো যায়, কিন্তু কোনো লাভ হবে না, গ্রহটা বেশ বিরক্তিকর। বেশি খারাপ গন্ধ?
জোরালো না, তবে টের পাওয়া যাচ্ছে বিরক্তিকর। পুরো গ্রহেই এমন গন্ধ রয়েছে?
আমার মনেই থাকে না যে এর আগে তুমি অন্য কোনো গ্রহে যাওনি। প্রতিটা বাসযোগ্য গ্রহের নিজস্ব গন্ধ রয়েছে। প্রধানত গাছপালার, তবে আমার ধারণা মানুষ এবং পশু পাখির কিছুটা অবদান রয়েছে। নতুন কোনো গ্রহে অবতরণ করার পর। প্রথম অবস্থায় কেউই গন্ধগুলো সহ্য করতে পারেনা। তবে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, জেনভ। কয়েক ঘণ্টা পর আর কিছুই টের পাবে না।
সব গ্রহে নিশ্চয় একরকম গন্ধ নেই।
না। প্রত্যেকের নিজস্ব গন্ধ রয়েছে। যদি একটু মনোযোগ দেই এবং নাক আরেকটু তীক্ষ্ণ হয় অনেকটা এনাক্রোনিয়ান কুকুরের মতো তাহলে গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারব কোন গ্রহে দাঁড়িয়ে আছি। নেভীতে যখন প্রথম ঢুকি, তখন নতুন কোনো গ্রহে নেমে প্রথমদিন খেতে পারতামনা। পরে বুড়ো স্পেসাররা আমাকে একটা কৌশল শেখায়। নতুন গ্রহে নামার আগে রুমালে সেই গ্রহের গন্ধ মিশিয়ে বারবার শুঁকতে হবে। মাটিতে নামার পর আর কিছুই টের পাবে না।–খারাপ দিকটা ছিল বাড়িতে ফেরা।
কেন?
তোমার ধারণা টার্মিনাসের কোনো গন্ধ নেই?
তুমি বলছ আছে?
অবশ্যই আছে। অন্য কোনো গন্ধের সাথে, মনে করো এই সেশেল-এর গন্ধের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর টার্মিনাসের কটু গন্ধে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
পেলোরেট অবাক হয়ে গেছে।
অনেক কাছে চলে এসেছে শহরের টাওয়ারগুলো, কিন্তু পেলোরেটের দৃষ্টি রয়েছে কাছাকাছি দৃশ্যের উপর। আরো অনেক গ্রাউন্ড-কার দুদিকে যাওয়া আসা করছে। উপরে মাঝে মাঝে এক আধটা বায়ুন চোখে পড়ছে, কিন্তু পেলোরেট দেখছে শুধু গাছপালা।
প্ল্যান্ট লাইফগুলো অদ্ভুত মনে হচ্ছে। তোমার কি মনে হয় কোনো স্থানীয় প্রজাতি রয়েছে এর মধ্যে?
আমার সন্দেহ আছে, ট্র্যাভিজ অন্যমনস্ক গলায় বলল। হাতের মানচিত্রের সাথে গ্রাউন্ড কারের কম্পিউটার প্রোগ্রাম ঠিক করার চেষ্টা করছে। মানুষ যেখানে বসতি স্থাপন করেছে সেখানে স্থানীয় প্রজাতির কোনো অস্তিত্ব রাখেনি। বসতিস্থাপনকারীরা নিজেদের উদ্ভিদ, প্রাণী সাথে করে নিয়ে এসেছে।
তারপরেও মনে হচ্ছে অদ্ভুত।
একই রকম প্রজাতি তুমি কোনো গ্রহেই দেখবে না। একবার শুনেছিলাম যে এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাকটিকা প্রস্তুতকারীরা বিভিন্ন প্রজাতির যে তালিকা তৈরি করেছিল তার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল সাতাশিটা মোটামোটা কম্পিউটার ডিস্ক–তালিকাটা যখন শেষ হয়, তখনই সেটা পুরনো হয়ে গেছে।
গ্রাউন্ড কার পৌঁছে গেছে শহরের সীমান্তে। ভাল কথা, আমরা যাচ্ছি কোথায়? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
বেশ, ট্র্যাভিজ বলল অধৈর্য স্বরে, আমি কম্পিউটারের সাহায্যে চেষ্টা করছি এই জিনিসটাকে কোনো ট্যুরিস্ট সেন্টারে নিয়ে যেতে। আশা করি কম্পিউটার রাস্ত ঘািট চেনে, ট্রাফিক আইনগুলো জানে।
সেখানে গিয়ে আমরা কি করব, গোলান?
প্রথম কথা, আমরা ট্যুরিস্ট, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেখানে যাব, নিজেদের যতদূর সম্ভব সন্দেহমুক্ত এবং স্বাভাবিক রাখতে চাই। দ্বিতীয়ত গায়ার ব্যাপারে তথ্য পেতে হলে তুমি কোথায় যাবে?
কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা কোনো এপলজিক্যাল সোসাইটিতে অথবা জাদুঘরে অবশ্যই ট্যুরিস্ট সেন্টারে যাবো না।
ভুল। ট্যুরিস্ট সেন্টারে গিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর বা অন্য কোনো কিছুর তালিকা চাইতে পারব। প্রথমে কোথায় যাবো সেটা আমরাই ঠিক করব এবং সেখানে হয়তো প্রাচীন ইতিহাস, গ্যালাকটোগ্রাফী, মিথলজী বা অন্য কোনো বিষয়ে জ্ঞান রাখে এমন কাউকে পাবো।–কিন্তু শুরু করতে হবে ট্যুরিস্ট সেন্টার থেকে।
পেলোরেট কোনো কথা বলল না। গ্রাউন্ড কার এঁকেবেঁকে এগুচ্ছে যেন ট্রাফিক প্যাটার্নে যুক্ত হয়ে গেছে। যে সাবরোড ধরে চলছে তার পাশে অনেক সাইনবোর্ড, হয়তো পথ নির্দেশ লেখা। কিন্তু বর্ণগুলো কঠিন, তাই পড়া যাচ্ছেনা।
তবে গ্রাউন্ডকার জানে কোথায় যেতে হবে, তাই যখন সেটা একটা পার্কিং স্পটে থামল, তার সামনে একটা সাইনবোর্ড দেখা গেল। সেখানে কঠিন বর্ণমালায় লেখা রয়েছে: সেশেল আউট ওয়ার্ল্ড মিলিউ, ঠিক তার নিচেই সরাসরি গ্যালাকটিক স্ট্যান্ডার্ড ভাষায় লেখা রয়েছে: সেশেল ট্যুরিস্ট সেন্টার।
দুজন হেঁটে বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকল, বাইরে থেকে যত বড় মনে হয়েছিল, তত বড় না বিল্ডিংটা। ভেতরে কোনো ব্যস্ততা নেই।
পাশাপাশি অনেকগুলো ওয়েটিং বুথ। তার প্রথমটাতে একজন লোক বসে ছোট ইজেক্টরে খবর দেখছে। আরেকটাতে দুজন মহিলা কার্ড এবং টাইলস দিয়ে জটিল কোনো গেম খেলছে। একটা বিশাল কাউন্টারের উপর জটিল ধরনের অনেকগুলো কম্পিউটার। কাউন্টারের পেছনে একঘেয়ে চেহারার একজন সেশেলিয়ান বসে আছে, পরনের পোশাক বহুরঙ্গা চেকারবোর্ডের মতো।
পেলোরেট ফিসফিস করে বলল, এই গ্রহ নিঃসন্দেহে বহির্জগতের দৃষ্টি কেড়ে নেবে।
হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ বলল, আমিও খেয়াল করেছি। আসলে বিভিন্ন গ্রহের ফ্যাশন বিভিন্ন রকম হয়, এমনকি একই গ্রহের বিভিন্ন অঞ্চলেও বিভিন্ন রকম হতে পারে। সময়ের সাথেও ফ্যাশনের পরিবর্তন হয়। পঞ্চাশ বছর আগে হয়তো সেশেলের সবাই কালো রং ব্যবহার করত। যেভাবে আছে সেভাবেই মেনে নাও।
মানতে তো হবেই। তবে নিজের ফ্যাশনটাই আমার বেশি পছন্দ। সেটা অন্তত চোখের জন্য পীড়াদায়ক হবে না।
আসলে, ফাউণ্ডেশনের বর্ণহীনতার কারণেই সম্ভবত এরা অতিরিক্ত রং ব্যবহার করে শুধু নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব দেখানোর জন্য, আর কিছু না। যাই হোক, এসো, জেনভ।
দুজন কাউন্টারের দিকে এগোতেই, যে লোকটা প্রথম বুথে বসে খবর পড়ছিল, সে খবর পড়া বাদ দিয়ে উঠে তাদের দিকে এগিয়ে এলো, মুখে হাসি। ধূসর রঙের পোশাক।
ট্র্যাভিজ প্রথমে লোকটাকে দেখেনি, কিন্তু যখন দেখল মরার মতো শক্ত হয়ে গেল।
বড় করে দম নিল সে, বাই দ্যা গ্যালাক্সি আমার বেঈমান দোস্ত!
.
এজেন্ট
৪৩.
মান-লি-কম্পর, টার্মিনাসের কাউন্সিলম্যান ট্র্যাভিজের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে অনিশ্চিতভাবে তাকিয়ে আছে।
ট্র্যাভিজ বাড়ানো হাতটা ধরলনা, যেন বাতাসের সাথে কথা বলছে এমনভাবে বলল, কোনো বিদেশী গ্রহের শান্তি নষ্ট করে জেলে যেতে চাইনা, তবে এই লোকটা যদি আর এক পাও এগোয়, আমি ঠিক তাই করব।
ব্রেক কষল কম্পর, ইতস্তত করছে, পেলোরেটের দিকে একবার অনিশ্চিতভাবে তাকিয়ে বলল, কথা বলার একটা সুযোগ পাবনা? ব্যাখ্যা করার জন্য? একটু শুনবে?
পেলোরেট বারবার দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপার কি, গোলান? এত দূর আসার পর হঠাৎ করেই পরিচিত কারো দেখা পেলে নাকি?
ট্র্যাভিজ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে কম্পরের দিকে, কিন্তু শরীরটা একটু ঘুরিয়ে নিল যেন পরিষ্কার বোঝা যায় সে পেলোরেটের সাথে কথা বলছে, এই যে।–আকার আকৃতিতে যাকে মানুষ বলে মনে হয় একসময় আমার বন্ধু ছিল। অভ্যাস মতো তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। নিজের মতামত তাকে জানিয়েছিলাম, যেগুলো জনসমক্ষে বলা সম্ভব ছিলনা। কর্তৃপক্ষকে সে সব জানিয়ে দেয়, কিন্তু কথাটা আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। সেই কারণে আমি সরাসরি একটা ফাঁদে পা দেই এবং নির্বাসিত হই। আর এখন সে চায় আমি তাকে বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেই।
এবার সে কম্পরের দিকে ঘুরল। আঙ্গুল চালিয়ে কোঁকড়ানো চুলগুলো আরো এলোমেলো করে ফেলল। শোন, তোমাকে একটা প্রশ্ন করছি। তুমি এখানে কি করছ? গ্যালাক্সির অন্য গ্রহগুলো বাদ দিয়ে এখানেই আসলে কেন? আর ঠিক এই সময়েই কেন?
কম্পর বাড়ানো হাতটা নামালো এতক্ষণে, হাসি মুছে গেছে। সহজাত আত্মবিশ্বাসী ভাবটা এখন আর নেই। ফলে আরো কমবয়সী এবং ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। সব বলব, সে বলল, কিন্তু একেবারে প্রথম থেকে!
চারপাশে তাকালো ট্র্যাভিজ। এখানে? সত্যি এখানে কথা বলতে চাও? এরকম খোলা জায়গায় যেন একগাদা মিথ্যা কথা শোনার পর সবার সামনে তোমাকে ঘুষি মেরে ফেলে দিতে পারি?
কম্পর এবার দুহাত তুলে বলল, জায়গাটা নিরাপদ, বিশ্বাস করো। তারপর দ্রুত যোগ করল, বিশ্বাস না করলেও কিছু যায় আসে না। আমি সত্যি কথা বলছি। আমি এসেছি তোমার অনেক আগেই, খোঁজখবর নিয়েছি। আজকে সেশেলের একটা বিশেষ দিন। কোনো কারণে তারা আজকের দিনটা মেডিটেশন করে কাটাবে। প্রায় সবাই ঘরের ভেতরে রয়েছে। জায়গাটা কেমন খালি। প্রতিদিন এমন থাকে না।
মাথা ঝাঁকিয়ে পেলোরেট বলল, আমিও অবাক হয়ে ভাবছিলাম চারপাশ এমন খালি কেন। তারপর ট্র্যাভিজের কানে ফিসফিস করে বলল ওকে কথা বলতে দিচ্ছনা কেন, গোলান? আমার খুব মায়া হচ্ছে। হয়তো সে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছে। একটা সুযোগ দেয়া উচিত।
ড, পেলোরেট তোমার কথা শুনতে আগ্রহী, ট্র্যাভিজ বলল। ঝামেলা করার জন্য আজকের দিনটা হয়তো ভালো। সবাই যেহেতু মেডিটেশন নিয়ে ব্যস্ত, আইনের রক্ষকরা হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ্য করবে না। আগামীকাল ভাগ্য ভালো নাও হতে পারে। সুযোগটা নষ্ট করব কেন?
কম্পর কাষ্ঠ গলায় বলল, দেখ যদি আমাকে মারতে চাও, মারো। বাধা দেব না। মারো–কিন্তু কথাগুলো শোন।
ঠিক আছে বল। কিছুক্ষণ তোমার কথা শোনা যাক।
প্রথম কথা, গোলান
দয়া করে আমাকে ট্র্যাভিজ, বলে ডাকবে। প্রথম নাম ধরে সম্বোধন করার অধিকার তোমার নেই।
প্রথম কথা, ট্র্যাভিজ তোমার মতামতগুলো আমাকে প্রায় বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছিলে-
ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছিলে বেশ ভালোভাবেই। হলফ করে বলতে পারি যে আমার কথা শুনে তুমি মজা পেতে।
চেষ্টা করেছি, অন্তত নিজের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি যে তুমি মানুষটা বেশ বিরক্তিকর।–চল দেয়ালের ওদিকটায় গিয়ে বসি। জায়গাটা খালি হলেও যে কোনো সময় যে কেউ চলে আসতে পারে। খামোখা কারো সন্দেহ। জাগিয়ে লাভ নেই।
তিনজন ধীরপায়ে হেঁটে লম্বা রুমের শেষ মাথায় পৌঁছল। কম্পর আবার হাসছে কিন্তু খেয়াল রাখছে যেন ট্র্যাভিজের হাতের বাইরে থাকে।
প্রত্যেকেই একটা করে আসনে বসল, সাথে সাথে আসনগুলো নিজে নিজেই রূপান্তরিত হলো তাদের কোমর এবং পশ্চাৎদেশের আকৃতিতে। পেলোরেট অবাক হয়ে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়ানোর।
রিল্যাক্স, প্রফেসর, কম্পর বলল। এরই মধ্যে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে, ছোটখাটো আরাম আয়েশের প্রতি বেশি নজর দেয়।
ট্র্যাভিজের দিকে ঘুরল। একটা হাত পেছনে চেয়ারের উপরে রেখেছে। কথা বলছে সহজ গলায়। তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছিলে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন টিকে আছে। যদি টিকে থাকত অবস্থাটা কি হতো চিন্তা করে দেখো। যেভাবেই হোক তারা তোমাকে থামাতো। আগাছার মতো উপড়ে ফেলত। আমি যদি ভাব দেখাতাম যে তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তাহলে আমাকেও সরিয়ে ফেলত। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ?
আমি একটা কাপুরুষকে দেখতে পাচ্ছি।
হিরো হওয়ার চেষ্টা করলে কোনো লাভ হতো? রেগে গেলো কম্পর, নীল চোখ দুটো জ্বলছে। তুমি বা আমি এমন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারতাম যারা অনায়াসে আমাদের মন এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। লড়াই করার একমাত্র উপায় হচ্ছে আমরা যা জানি সেটা গোপন রাখা।
কাজেই ব্যাপারটা গোপন রেখে নিজেকে বাঁচালে। কিন্তু মেয়র ব্র্যান্নোর কাছ থেকে গোপন করলে না, তাই না? ঝুঁকিতে থেকেই গেল।
হ্যাঁ। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এর প্রয়োজন আছে। নিজেদের ভেতর আলাপ করলে হয়তো তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। তুমি তো জানোই মেয়র আমার বাবাকে চিনতেন। আমরা স্মির্নো থেকে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এসেছিলাম আর মেয়রের এক দাদী
জানি, জানি, ট্র্যাভিজ অধৈর্য স্বরে বলল, আরো অনেক পুরুষ আগে তোমরা ছিলে সিরিয়াস সেক্টরের বাসিন্দা। পরিচিত সবাইকে তুমি বলেছ। তারপরে কি হলো বল, কম্প!
বেশ, আমি মেয়রের কানে কথাগুলো তুললাম। বিপদের কথাটা তাকে বুঝাতে পারলে ফেডারেশন হয়তো একটা পদক্ষেপ নিত। মিউলের সময় যতটা দুর্বল ছিলাম এখন আর আমরা ততটা দুর্বল নই–ব্যাপারটা সবাই জানে এবং আমরা হয়তো বিপদ এড়িয়ে যেতে পারতাম।
ফাউণ্ডেশনের বিপদ হয় তো হোক, নিজেরা নিরাপদ থাকলেই হলো। চমৎকার। দেশপ্রেম। ট্র্যাভিজের গলায় তিরস্কার।
খারাপ কিছু ঘটলে সেটাই ঘটত। কিন্তু আমি সবচেয়ে ভালটাই আশা করেছিলাম।
কম্পরের কপালে ভাঁজ পড়ল কয়েকটা। মনে হচ্ছে যেন ট্র্যাভিজের বাক্যবাণ ঠেকাতে ঠেকাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
আর তোমার এই চমৎকার পরিকল্পনার কথা আমাকে জানাওনি, তাই না?
না, সেজন্য আমি দুঃখিত। মেয়র নিষেধ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তুমি যা জানো তার সবটুকু জেনে নিতে। তুমি যেমন মানুষ, যদি টের পেতে যে তোমার কথা ফাস হয়ে গেছে তাহলে একেবারে চুপ মেরে যেতে।
আমার ব্যাপারে মেয়রের ধারণা কতখানি ঠিক ছিল?
আমি জানি না–অনুমান করতে পারিনি–ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি যে তিনি তোমাকে গ্রেফতার করে টার্মিনাস থেকে বের করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন।
তিনি সঠিক রাজনৈতিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যখন কাউন্সিলম্যান হিসেবে আমার মর্যাদা আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। তুমি ধরতে পারনি?
কি করে পারব? তুমি পেরেছিলে?
যদি জানতাম যে তিনি আমার সব কথা জেনে ফেলেছেন, তাহলে পারতাম।
কম্পর হঠাৎ উদ্ধত স্বরে বলল, বলাটা অনেক সহজ।
তুমি এখন আমার কাছে কি চাও? যা ঘটানোর সেটাতো ঘটিয়েছই।
সংশোধন করতে চাই। অনিচ্ছাকৃতভাবে তোমার যে ক্ষতি করেছি সেটার ক্ষতিপূরণ করতে চাই।
ভালো কথা, ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল। তোমার দয়া। কিন্তু এখনো আমার আসল প্রশ্নের উত্তর দাওনি। এখানে কিভাবে এলে, ঠিক আমি যে গ্রহে এসেছি সেখানে?
সোজা কথায় আমি তোমাকে অনুসরণ করেছি।
হাইপার স্পেসের মধ্যে? আমিতো মহাকাশযান নিয়ে পরপর অনেকগুলো জাম্প দিয়েছি?
মাথা নাড়ল কম্পর। এর মধ্যে কোনো রহস্য নেই। তোমার মতোই একটা মহাকাশযান এবং কম্পিউটার আমারও আছে। জানোইতো হাইপার জাম্প দিয়ে একটা যান কোথায় গিয়ে পৌঁছবে সেটা বের করার কৌশল আমি জানি। খুব ভালো কৌশল না। তিনবারের মধ্যে দুইবারই ভুল হয়। কিন্তু কম্পিউটারের সাহায্যে কাজটা সহজ হয়েছে। তাছাড়া শুরু করার আগে তুমি ছিলে একটু দ্বিধাগ্রস্ত। ফলে হাইপার স্পেসে ঢোকার আগে তোমার লক্ষ্য এবং গতি পরীক্ষা করার সুযোগ পাই। এই তথ্যগুলোর সাথে আমার নিজস্ব অনুমান কম্পিউটারে ঢোকাই। বাকী কাজটা কম্পিউটারই করেছে।
আসলেই তুমি আমার আগে শহরে পৌঁছেছ?
হা। তুমি গ্র্যাভিটিকস ব্যবহার করোনি, আমি করেছি। ধরে নিয়েছিলাম রাজধানী শহরে আসবে, আমি সরাসরি এখানেই নেমেছি আর সেসময় তুমি, কম্পর মাথার উপর আঙ্গুল ঘুরিয়ে ডাইরেকশনাল বীম অনুসরণ করে ট্র্যাভিজ যেভাবে মহাকাশযান নিয়ে অবতরণ করেছে তা নকল করে দেখাল।
সেশেলিয়ান অফিসিয়ালদের ব্যাপারে ঝুঁকি নিয়েছ।
বেশ, কম্পর এত সুন্দরভাবে হাসল যে ট্র্যাভিজ পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে গেল। সব ক্ষেত্রেই আমি কাপুরুষ না।
নিজেকে সামলে নিল ট্র্যাভিজ। আমারটার মতো একটা মহাকাশযান তুমি কিভাবে পেলে?
তুমি যেভাবে পেয়েছ, ঠিক সেভাবেই। ওল্ড লেডী–মেয়র ব্র্যান্নো জিনিসটা আমাকে দিয়েছেন।
কেন?
খোলাখুলিই সব বলছি। আমার দায়িত্ব হচ্ছে তোমাকে অনুসরণ করা। মেয়র জানতে চান তুমি কোথায় যাও, কি কর।
আর তুমি বিশ্বাসের সাথে তার কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছ।–নাকি মেয়রের সাথেও বেঈমানী করেছ?
আমি রিপোর্ট পাঠিয়েছি। উপায় ছিল না। মহাকাশযানে একটা হাইপার রিলে বসানো আছে, যে জিনিসটা আমার খুঁজে পাওয়ার কথা না, কিন্তু পেয়ে গেছি।
তো?
দুর্ভাগ্যবশত জিনিসটা এমনভাবে বসানো যে সেটা সরাতে গেলে আমার যান পুরোপুরি থেমে যাবে। অন্তত আমি সেটা সরানোর অন্য কোনো উপায় জানি না। ফলে মেয়র সবসময়ই জানবেন আমি কোথায় রয়েছি এবং জানবেন তুমি কোথায় রয়েছ।
ধরো তুমি আমাকে অনুসরণ করতে পারলে না। তাহলে তিনিও জানতেন না আমি কোথায় রয়েছি। ভেবে দেখেছিলে?
অবশ্যই ভেবেছি। মনে করেছিলাম যে জানিয়ে দেব তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু মেয়র সেটা বিশ্বাস করতেন না, করতেন? আমিও আর টার্মিনাসে ফিরতে পারতাম না। আমি তো তোমার মতো না, ট্র্যাভিজ। আমার অনেক দায়িত্ব আছে। টার্মিনাসে আমার স্ত্রী রয়েছে সন্তানসম্ভবা আমি তার কাছে ফিরতে চাই। তোমার শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলবে। কিন্তু আমার চলবে না। তাছাড়া আমি এসেছি তোমাকে সতর্ক করে দিতে। সেলডনের কসম, আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু তুমি কোনো কথাই শুনছ না।
হঠাৎ করে আমাকে এত দয়া দেখানোর কারণটা বুঝলাম না। কার কাছ থেকে তুমি আমাকে সতর্ক করে দেবে। আমার মনে হয় তোমার কাছ থেকেই আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। একবার বেঈমানী করেছ, পিছু নিয়ে এতদূর এসেছ আবার বেঈমানী করার জন্য। অন্য কেউ আমার কোনো ক্ষতি করবে না।
কম্পর আন্তরিক গলায় বলল, সেগুলো ভুলে যাও। ট্র্যাভিজ, তুমি এখন গরম লোহা! তোমাকে পাঠানো হয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য–যদি সেরকম কিছু সত্যিই থাকে। আমার অনুমান শক্তি বেশ ভালো। মেয়রের পরিকল্পনাও বুঝতে পারছি। যদি তুমি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন বের করার চেষ্টা কর তারাও তোমাকে বাধা দেবে। সেটা করতে গিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে ফেলবে। আর তখন মেয়র ব্র্যান্নো তাদেরকে ধরবেন।
ব্র্যান্নো যখন আমাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করেছিল তখন তোমার অনুমান শক্তি কাজ করে নি। দুঃখজনক।
কম্পর লজ্জা পেল। জানোই তো, সবসময় কাজ করে না।
আর এখন এই অনুমান শক্তি দিয়ে তুমি বলছ যে তিনি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছেন। ভয় পাচ্ছেন না।
আমার মতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু সেটা ব্যাপার না। আসল ব্যাপার হচ্ছে তোমাকে বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তো?
তো, মহাকাশের সব ব্ল্যাকহোলের কসম, দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন খোঁজার চেষ্টা করোনা। তুমি মরলে না বাঁচলে তাতে মেয়রের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার যায় আসে। এজন্য আমার নিজেকে দায়ী মনে হবে।
আমি কৃতজ্ঞ, ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল। আসলে আমার হাতে এই মুহূর্তে অন্য আরেকটা কাজ রয়েছে।
অন্য কাজ?
পেলোরেট এবং আমি পৃথিবী নামের গ্রহটা খুঁজছি, কারো মতে যে গ্রহ হিউম্যান রেস-এর আসল বাসস্থান। তাই না, জেনভ?
পেলোরেট মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, ব্যাপারটা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক এবং আমার অনেকদিনের গবেষণা ক্ষেত্র।
কম্পর হতভম্ব হয়ে গেল। পৃথিবী খুঁজছ? কিন্তু কেন?
দেখার জন্য, পেলোরেট বলল। এই একটা গ্রহেই মানব প্রজাতির বিকাশ ঘটেছিল এখনকার মতো তৈরি অবস্থায় না, বরং খুব নীচু স্তরের জীবন থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করেছিল।
এবং, ট্র্যাভিজ বলল, এই গ্রহেই আমি হয়তো দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারব।
কিন্তু পৃথিবী নামের কোনো গ্রহ নেই, কম্পর বলল। তোমরা সেটা জান না?
পৃথিবী নেই? পেলোরেট আরো হতভম্ব হয়ে পড়েছে। তুমি বলছ যে এমন কোনো গ্রহ নেই, যার বুকে মানব প্রজাতির জন্ম হয়েছিল?
আরে না। পৃথিবী একটা সত্যিই ছিল, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন আর নেই। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
অনেকগুলো গল্প রয়েছে।
দাঁড়াও, জেনভ, ট্র্যাভিজ বলল। তুমি এতকিছু কিভাবে জানলে কম্পর?
কি বলতে চাও? ব্যাপারটা আমার বংশগত। আমার পূর্বপুরুষরা সিরিয়াস সেক্টরে বাস করত। সেখানে আমরা সবাই পৃথিবীর ব্যাপারে সব জানি। গ্রহটা ওই সেক্টরে অবস্থিত, তার মানে ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত না। সেকারণেই টার্মিনাস এটাকে নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে পৃথিবী ওখানেই।
এটা একটা যুক্তি, পেলোরেট বলল। সাম্রাজ্যের যুগে এটাকে বলা হতো সিরিয়াস অলটারনেটিভ।
কম্পরের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে, কিন্তু এটা কোনো অলটারনেটিভ না। প্রকৃত ঘটনা।
আমি তোমাকে গ্যালাক্সির এমন অনেক জায়গার নাম বলতে পারব যেখানকার অধিবাসীরা সেই জায়গাগুলোকে পৃথিবী নামে ডাকে বা ডাকত।
কিন্তু আসল ঘটনা তো এটাই, কম্পর বলল। সিরিয়াস সেক্টর গ্যালাক্সির সবচেয়ে প্রাচীন বসতি।
সিরিয়াস অবশ্য তেমন দাবী করে।
কম্পরকে হতাশ দেখাচ্ছে। আমি বলছি
ট্র্যাভিজ বাধা দিল, পৃথিবীর কি হয়েছে, সেটা বল। তুমি বলছ সেখানে এখন আর কেউ বাস করেনা। কেন?
রেডিওএকটিভিটি। প্ল্যানেটারি সারফেসের পুরোটাই রেডিও একটিভ হয়ে পড়েছে, পারমাণবিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে বা পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে ঠিক জানি না তবে এখন আর সেখানে জীবন ধারণ সম্ভব না।
তিনজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। কম্পর আবার মরিয়া হয়ে বলল, বিশ্বাস করো, পৃথিবী নেই। খুঁজে কোনো লাভ হবে না।
.
88.
এই প্রথমবারের মতো জেনভ পেলোরেটের মুখে কিছু ভাবের খেলা দেখা গেল। কোনো রাগ বা ঘৃণার ভাব না। শুধু তার চোখ দুটো একটু ছোট হয়ে গেল সেই সাথে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল একটা হিংস্রতা।
যখন কথা বলল, কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে, তুমি কিভাবে জানলে?
বলেছিই তো, কম্পর বলল, বিষয়টা আমার বংশগত।
বাজে কথা বলো না। তুমি একজন কাউন্সিলম্যান। তার মানে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত কোনো গ্রহে তোমার জন্ম হয়েছে। স্মির্নো, বোধহয় এই নামটাই একটু আগে বলেছিলে।
ঠিক।
বেশ, বংশগত বলতে কি বোঝাচ্ছ। তুমি বলতে চাও গায়ে সিরিয়ান রক্ত রয়েছে বলেই পৃথিবী সম্পর্কিত সমস্ত সিরিয়ান প্রাচীন কাহিনীগুলো তুমি জেনে ফেলেছ?
কম্পর একটু দমে গেল। না, অবশ্যই না।
তো, কি বলতে চাও?
কম্পর একটু থেমে নিজের ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিল। শান্তস্বরে বলল, সিরিয়ান ইতিহাসের কিছু প্রাচীন বই আমার পরিবারের কাছে ছিল। বাইরের কারো সাথে আমরা ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করিনা, বিশেষ করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য তো অবশ্যই না। বিশ্বাস করো ব্যাপারটা শুধু কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছি।
গলার স্বরে একটু তিক্ততা ছিল। তাত্ত্বিকভাবে ফাউণ্ডেশনের নাগরিকরা। একইরকম, কিন্তু ফেডারেশনের বাইরের গ্রহগুলোর সাথে কোনো মিল নেই। যাই হোক, বইয়ে পড়ার পর আমি একবার প্রাচীন গ্রহগুলো ভ্রমণ করেছিলাম। ট্র্যাভিজ–এই
ট্র্যাভিজ চলে গেছে ঘরের এক কোণায়, তিনকোণা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। জানালাটা এমনভাবে তৈরি যেন শহরের তুলনায় আকাশ বেশি দেখা যায়।–আলো বেশি এবং প্রাইভেসীও বেশি। উঁকি দিয়ে ট্র্যাভিজ নিচে দেখার চেষ্টা করল।
ফিরে আসতে আসতে বলল, জানালার ডিজাইনটা চমৎকার। আমাকে ডেকেছ, কাউন্সিলম্যান?
হ্যাঁ। কলেজ শেষ করে আমি একটা ট্যুরে গিয়েছিলাম, মনে আছে?
গ্র্যাজুয়েশনের পর? ভালই মনে আছে। তখন আমরা তরুণ। ফাউণ্ডেশনের প্রতি বিশ্বাসী। কোনো কিছুর পরোয়া নেই। তুমি ট্যুরে গেলে। আমি নেভীতে যোগ দিলাম। তোমার সাথে যাওয়ার কথা একবারও মনে হয়নি ভেতর থেকে কিছু একটা বাধা দিয়েছিল।
কম্পর অপমানটা গায়ে মাখলনা। আমি কম্পরেলনে গিয়েছিলাম। পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে জানি আমার পূর্বপুরুষরা সেখান থেকেই এসেছিলেন অন্তত আমার বাবার দিকের পূর্বপুরুষরা। সাম্রাজ্যের হাতে চলে যাওয়ার আগে প্রাচীন সময়ে আমরাই ছিলাম সেখানকার শাসক। কমপরেলন যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তার একটা চমৎকার পুরনো কাব্যিক নাম রয়েছে–এপসিলন ইরিনি।
অর্থটা কি? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল কম্পর। কোনো অর্থ আছে কিনা জানিনা। শুধুই ঐতিহ্য। সেখানকার সবাই ঐতিহ্য ভালবাসে। অনেক প্রাচীন গ্রহ। তাদের কাছে পৃথিবীর ইতিহাসের অনেক রেকর্ড রয়েছে, কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। যখনই শব্দটা উচ্চারণ করে দুহাত উপরে তুলে প্রথম ও দ্বিতীয় আঙ্গুল ক্রস করে দুর্ভাগ্যের চিহ্ন দেখায়।
ফিরে আসার পর কথাগুলো কাউকে বলেছিলে?
অবশ্যই না। কে শুনবে। জোর করে কাউকে শোনাতে চাইনি।
উপগ্রহের কি হলো? পৃথিবীর উপগ্রহের বর্ণনা দাও, পেলোরেট ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করল।
এ ব্যাপারে কিছুই জানি না, কম্পর অবাক হয়ে বলল।
কোনো উপগ্রহ আছে?
এ ব্যাপারে কিছু পড়েছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা। তবে কমপরেলনিয়ান রেকর্ড থেকে আমি নিশ্চিত তোমরা কিছু একটা পাবে।
তুমি কিছুই জান না?
উপগ্রহের ব্যাপারে কিছুই জানি না। মনে পড়ছে না।
হাহ! পৃথিবী কিভাবে রেডিও একটিভ হয়ে পড়ল?
কম্পর শুধু মাথা নাড়ল, কিছু বলল না।
ভেবে দেখ। কিছু একটা নিশ্চয়ই শুনেছ।
সাত বছর আগের ঘটনা, প্রফেসর। তখন জানতাম না আপনি আমাকে প্রশ্ন করবেন। একটা লোককাহিনীর কথা মনে পড়ছে–অবশ্য সেখানকার সবাই এটাকে বলে সত্যি ইতিহাস
কাহিনীটা কি?
পৃথিবী ছিল রেডিওএকটিভ–সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একঘরে। জনসংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল এবং সে কোনোভাবে সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল।
একটা মরণশীল গ্রহ পুরো সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। ট্র্যাভিজ বলল মাঝখানে।
আমিতো বলেছিই, এটা একটা লোককাহিনী, কম্পর আত্মরক্ষার সুরে বলল। বিস্তারিত কিছু জানি না। শুধু জানি কাহিনীর মূল চরিত্র বেল আর্ডারভান।
কে সে? জিজ্ঞেস করল ট্র্যাভিজ।
একটা ঐতিহাসিক চরিত্র। সাম্রাজ্যের প্রথম যুগের একজন সৎ আর্কিওলজিস্ট। তার মতে পৃথিবী সিরিয়াস সেক্টরে অবস্থিত।
নামটা শুনেছি। পেলোরেট বলল।
কমপরেলনের লোককাহিনীর একটা চরিত্র। দেখ, যদি আরো কিছু জানতে চাও–তোমরা কমপরেলনে চলে যাও। এখানে ঘোরাঘুরি করে লাভ হবে না।
পৃথিবী কিভাবে সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল?
জানিনা। কম্পরের গলায় চাপা ক্রোধ।
এর সাথে রেডিয়েশনের কোনো সম্পর্ক আছে?
জানি না। শোনা যায় পৃথিবীর বুকে মাইন্ড–এক্সপান্ডার-এর বিস্তৃতি ঘটেছিল সিন্যাপসিফায়ার বা সেধরনের কিছু।
তারা সুপারমাইন্ড তৈরি করতে পেরেছিল? পেলোরেটের গলায় স্পষ্ট অবিশ্বাস।
বোধহয় না। যতদূর মনে আছে এতে কোনো কাজ হয়নি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বেড়েছিল বহুগুণ, কিন্তু মারা যাচ্ছিল দ্রুত।
সম্ভবত মোরালিটি মিথ, ট্র্যাভিজ বলল। যত জানার চেষ্টা করবে ততই গুলিয়ে যাবে।
পেলোরেট বিরক্ত হয়ে ট্র্যাভিজের দিকে ঘুরল। মোরালিটি মিথ সম্পর্কে কি জানো?
ভুরু কপালে উঠে গেছে ট্র্যাভিজের। আমি তোমার মতো জ্ঞানী না, তাই বলে একেবারে মূর্খও না।
সিন্যাপসিফায়ার সম্বন্ধে তোমার কি মনে আছে, কাউন্সিলম্যান কম্পর? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
কিছুই না। আর কিছু বলতে পারব না। দেখ মেয়রের কথা মতো আমি তোমাদের অনুসরণ করে এসেছি। তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়নি। তবু করেছি, শুধু জানানোর জন্য যে তোমাদের অনুসরণ করা হচ্ছে এবং মেয়র তোমাদের ব্যবহার করছেন। আলোচনার কিছু ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করে পৃথিবীর কথা তুলে আমাকে অবাক করে দিয়েছ। আসলে যা ছিল সবই এখন অতীত–বেল। আর্ডারভান, সিন্যাপসিফায়ার এগুলোর সাথে বর্তমানের কোনো সম্পর্ক নেই। আবারো বলছিঃ পৃথিবী একটা মৃত গ্রহ। তোমরা কমপরেলনে চলে যাও, অনেক কিছু জানতে পারবে। শুধু এখান থেকে চলে যাও।
তারপর মেয়রকে জানাবে যে আমরা কমপরেলনে যাচ্ছি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তুমিও যাবে পেছন পেছন। হয়তো মেয়র এরই মধ্যে জেনে ফেলেছেন। আমার ধারণা তিনিই তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। ঠিক?
কম্পরের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। গলা স্বাভাবিক রাখার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শুনলে না। যাও গিয়ে ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দাও, ট্র্যাভিজ। তারপর দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, একবারও পিছনে তাকালো না।
পেলারেট থমকে গেছে। কাজটা বুদ্ধিমানের মতো হলো না, ট্র্যাভিজ। ওর কাছ থেকে আরো কিছু জানা যেত।
না, পারতেনা, ট্র্যাভিজ গম্ভীর গলায় বলল। সে না চাইলে তার কাছ থেকে তুমি কিছুই জানতে পারতে না। জেনভ, জান না সে কি আজকের আগে আমিও জানতাম না সে কি।
.
৪৫.
ট্র্যাভিজ গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। পেলোরেট আমতা আমতা করে শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল, আমরা কি সারারাত এখানেই বসে থাকব, গোলান?
না, ঠিকই বলেছ। মানুষের ভিড়েই আমরা ভালো থাকব। চল।
উঠে দাঁড়ালো পেলোরেট। চারপাশে কোনো মানুষজন নেই। কম্পর বলেছিল আজকে কোনো এক ধরনের মেডিটেশনের দিন।
সে তাই বলেছিল? আসার পথে রাস্তায় ট্রাফিক চোখে পড়েছে?
হ্যাঁ, সামান্য।
আমার মনে হয় বেশিই ছিল। তারপর, যখন শহরে ঢুকি, সেটা কি জনশূন্য ছিল?
পুরোপুরি না। তবে তোমাকে মানতেই হবে এই জায়গাটা একেবারে খালি।
হ্যাঁ, বিশেষ করে এই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েছে।–ঠিক আছে, চল। খিদে পেয়েছে। খাবার একটা জায়গা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। অন্তত এমন একটা জায়গা নিশ্চয়ই পাবো যেখানে সেশেলিয়ান আতিথেয়তার স্বাদ পাবো।–চলো, চারপাশে মানুষ থাকলে নিরাপদ বোধ করব, তখন তোমাকে বলতে পারব আসলে এখানে কি ঘটেছে।
.
৪৬.
রেস্টুরেন্টটা বেশি বড় না, তবে বেশ আরামদায়ক। ঘর গরম রাখার জন্য একপাশে আগুন জ্বলছে, সেই আগুনেই খাবার তৈরি করা হয়। ঝাল সসে মেশানো মাংসের ছোট ছোট টুকরো খেতে হয় হাত দিয়ে। হাতের আঙ্গুল তেল মসলা এবং গরমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য মাংসগুলো সবুজ ঠাণ্ডা পাতা দিয়ে ঢাকা। পাতাগুলোর স্বাদ ঝাঁঝালো।
প্রতিটা মাংসের টুকরা একটা করে পাতা দিয়ে ঢাকা, পুরোটা একসাথে মুখে দিতে হবে। ওয়েইটার যত্নের সাথে ব্যাপারটা ট্র্যাভিজ আর পেলোরেটকে দেখিয়ে দিল, বোঝাই যাচ্ছে বাইরের গ্রহের অতিথি সামলাতে অভ্যস্ত। দুজনের অবাক ভাব দেখে সে পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে হাসছে।
চমৎকার! ট্র্যাভিজ বলল। তারপর আবার অর্ডার দিল। পেলোরেটও দিল।
খাবার পরে হালকা মিষ্টি এবং এককাপ কফি নিয়ে বসল দুজন। কফির স্বাদে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল দুজন। তার সাথে সিরাপ মেশানোতে ওয়েইটারও সম্মতির সাথে মাথা নাড়ল।
এবার বল, ট্যুরিস্ট সেন্টারে কি ঘটেছিল? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
কম্পরের সাথে?
আর কেউ ছিল সেখানে?
ট্র্যাভিজ চারপাশে তাকালো। তারা বসেছে একদিকের বর্ধিত অংশে, প্রাইভেসী কম। রেস্টুরেন্টে যথেষ্ট ভিড়। তবে মানুষের স্বাভাবিক গুঞ্জনে স্বস্তি বোধ করছে।
নিচু স্বরে বলল, আমাদের পিছু নিয়ে কম্পর সেশেল পর্যন্ত এসেছে, অবাক ব্যাপার না?
বলেছেই তো, তার অনুমান শক্তি খুব ভালো।
হা, হাইপারট্র্যাকিং-এ সে ছিল আন্তকলেজ চ্যাম্পিয়ন। একটু দক্ষ হলে তুমিও করতে পারবে। কিন্তু বুঝতে পারছি না একজন অনুসরণকারী কিভাবে পরপর অনেকগুলো জাম্প ট্র্যাক করতে পারে। তুমি প্রথমটার জন্য তৈরি হলে; কম্পিউটার সব কাজ শেষ করল। অনুসরণকারী শুধু প্রথমটাই ধরতে পারবে, কিন্তু কোন যাদুমন্ত্রে সে সবগুলো ধরে ফেলল?
সে কিন্তু পেরেছে, গোলান।
অবশ্যই পেরেছে, ট্র্যাভিজ বলল। আমার ধারণা সে আগেই জানত আমরা কোথায় যাচ্ছি। অনুমানে না, জেনেই করেছে।
পেলোরেট কথাটা বিবেচনা করল। অসম্ভব, মাই বয়। কিভাবে জানবে। ফার স্টারে উঠার আগে তো আমরা ঠিক করিনি কোথায় যাবো।
ঠিক।–এই মেডিটেশনের ব্যাপারটা কি?
কম্পর মিথ্যে কথা বলেনি। ওয়েইটারও বলেছে, আজকে মেডিটেশন করার দিন।
হ্যাঁ, বলেছে, কিন্তু সে বলেছে যে রেস্টুরেন্ট খোলা থাকবে। সেশেল কোনোদিক থেকে পিছিয়ে নেই। লোকজন মেডিটেট করবে ছোট শহরগুলোতে, যেখানে অধিবাসীরা কিছুটা অশিক্ষিত। এই গ্রহে ছোট শহর নেই বললেই চলে। সে জন্যই রাস্তাঘাটে ট্রাফিক চোখে পড়েছে, ব্যস্ততা রয়েছে। অন্যান্য দিনের মতো না হলেও ব্যস্ততা ছিল।
কিন্তু গোলান, ট্যুরিস্ট সেন্টারে কেউ ঢোকেনি। আমি খেয়াল করেছি। একটা লোকও ঢোকেনি।
আমিও খেয়াল করেছি। কিন্তু জানালা দিয়ে যখন বাইরে তাকালাম, তখন দেখলাম যে সেন্টারের চারপাশের রাস্তায় প্রচুর লোকজন পায়ে হেঁটে বা যানবাহনে চলাচল করছে, কিন্তু কেউ ভিতরে ঢুকছে না। মেডিটেশন চমৎকার কভার তৈরি করেছে। আগে থেকে ঐ জারজটাকে অবিশ্বাস করার সিদ্ধান্ত না নিলে আমাদের মনে কোনো প্রশ্নই জাগত না।
ঘটনাগুলো থেকে তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে? পেলোলারেট জিজ্ঞেস করল।
খুব সহজ, জেনভ। আমাদের আশেপাশে এমন একজন আছে যে জেনে ফেলেছে আমরা কোথায় যাচ্ছি এবং সুবিধামতো কথা বলার জন্য চারপাশে প্রচুর মানুষ থাকার পরেও একটা পাবলিক বিল্ডিং খালি রাখতে পারে।
তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল যে সে অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পারে?
অবশ্যই। ব্যাপারটা সম্ভব হবে যদি কম্পর দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এজেন্ট হয় এবং মাইন্ড কন্ট্রোল করতে পারে; যদি আরেকটি মহাকাশযানে বসে সে তোমার আর আমার মাইন্ড ধরতে পারে; যদি কাস্টমস স্টেশনকে প্রভাবিত করে সে ভেতরে ঢুকতে পারে; বর্ডার পেট্রল ফাঁকি দিয়ে গ্র্যাভিটিক্যালি ল্যান্ড করতে পারে; এমন ভাবে মানুষের মাইন্ড প্রভাবিত করতে পারে যেন সে যেখানে চায়না সেখানে কেউ ঢোকে।
বাই অল দ্যা স্টারস, ট্র্যাভিজ করুণ স্বরে বলল, মনে হয় গ্র্যাজুয়েশনের সময় থেকেই সে বদলে গেছে। তার সাথে আমি ট্যুরে যাইনি। ইচ্ছা হয়নি। এটাও কি তার প্রভাব? সে একা যেতে চেয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল?
সামনের থালাবাসন ঠেলে সরিয়ে দিল পেলোরেট, যেন ভাবনা চিন্তা করার জন্য বেশি জায়গা প্রয়োজন। সংকেত পেয়ে একটা স্বয়ংচালিত টেবিল সামনে এসে দাঁড়ালো প্লেট চামচ নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আবার একা হওয়ার পর পেলোরেট বলল, পাগলামী। যা ঘটেছে সবই স্বাভাবিক। যদি একবার মাথায় ঢুকে যায় যে কেউ ঘটনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, তখন কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। কাম অন, ওল্ড ফেলো, তোমার নিজের ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। জটিলতা বাড়িয়ো না।
কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
বেশ, যুক্তি দিয়ে বিচার করা যাক। ধরো সে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এজেন্ট। ট্যুরিস্ট সেন্টার খালি রেখে কেন সে আমাদের সন্দেহ বাড়িয়ে তুলবে। আমাদের কি বলেছে সে যা অন্য কেউ শুনলে সমস্যা হবে?
সহজ উত্তর, জেনভ। আমাদের মাইন্ড সে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিল। চায়নি অন্য কোনো মাইন্ড বাধা দেয়। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
আবারো তোমার নিজের ব্যাখ্যা। আমাদের সাথে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছে সে? যে কেউ শুনলেই বলবে যে কম্পর এতদূর ছুটে এসেছে সে যা করেছে তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য এবং আমাদেরকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। এর বেশি ভাবার দরকার কি?
টেবিলের শেষ মাথায় কার্ড ঢোকানোর ছোট যন্ত্র বেরিয়ে এল, গায়ে খাওয়ার দাম জ্বলজ্বল করছে। স্যাশ-এর পকেট থেকে ট্র্যাভিজ ফাউণ্ডেশন ক্রেডিট কার্ড বের করল। গ্যালাক্সির যে কোনো জায়গায় এই কার্ড গ্রহণযোগ্য। বিল মিটিয়ে কার্ডটা পকেটে রাখার আগে ব্যালেন্সটাও একবার দেখে নিল।
রেস্টুরেন্টে অল্প কিছু লোক রয়ে গেছে। ট্র্যাভিজ একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল তার প্রতি কেউ অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখাচ্ছে কি না। তারপর বলল, এর বেশি ভাবার প্রয়োজন কি? সে তো শুধু এই কথাগুলোই বলেনি। পৃথিবী নিয়ে কথা বলেছে। জোর দিয়ে বলেছে আমরা যেন কমপরেলনে চলে যাই। যাবো আমরা?
সেটা নিয়ে আমিও ভাবছি গোলান, পেলোরেট স্বীকার করল।
এখান থেকে চলে যাবো?
সিরিয়াস সেক্টরে খোঁজ-খবর নিয়ে আবার এখানে ফিরে আসতে পারি।
তোমার মনে হয় না এত কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদেরকে সেশেল থেকে সরানো? যে কোনো জায়গায় যেতে পারব, কিন্তু সেশেলে থাকা যাবে না।
কেন?
জানিনা। দেখ, ওরা আশা করেছিল আমরা ট্র্যানটরে যাবো। তুমি যেতে চেয়েছিলে বলেই আমাদের ট্র্যানটরে যাওয়ার ব্যাপারটা ওরা হিসেবে রেখেছিল। সেশেলে এসে আমি তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছি, এটা তারা আশা করে নি। তাই এখন আমাদেরকে এখান থেকে সরাতে চাইছে।
পেলোরেটকে মনে হলো চরম অখুশী। কিন্তু, গোলান, তুমি শুধু মন্তব্য করে যাচ্ছ। কেন ওরা আমাদেরকে সরাতে চাইছে?
আমি বলতে পারব না, জেনভ। কিন্তু সরাতে চাইছে এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি এখানেই থাকছি। কোথাও যাচ্ছিনা।
কিন্তু-কিন্তু-দেখ গোলান, যদি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন আমাদেরকে এখান থেকে সরাতে চায়, তাহলে আমাদের মাইন্ড প্রভাবিত করেই সরাতে পারে। যুক্তি দিয়ে। বোঝাতে যাবে কেন?
এতক্ষণে আসল কথায় এসেছ, তোমার বেলায় সেরকম ঘটেছে কি না বল, প্রফেসর? হঠাৎ সন্দেহে ট্র্যাভিজের চোখ ছোট হয়ে গেছে। তুমি যেতে চাইছ, তাই না?
পেলোরেট অবাক হয়ে ট্র্যাভিজের দিকে তাকালো। আমার শুধু মনে হয়েছে এর পিছনে যুক্তি রয়েছে।
অবশ্যই তোমার তাই মনে হবে, যদি তুমি প্রভাবিত হয়ে থাকো।
কিন্তু আমি হইনি।
অবশ্যই তুমি হলফ করে বলতে পারবে যে তুমি প্রভাবিত হওনি।
আমাকে এভাবে ফাঁদে আটকে ফেললে তোমার অনুমানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না। তুমি কি করতে চাও?
আমি সেশেলে থাকব। তুমিও থাকবে। আমাকে ছাড়া তুমি মহাকাশযান চালাতে পারবে না। কাজেই কম্পর যদি তোমাকে প্রভাবিত করে, তাহলে ভুল লোককে করেছে।
বেশ ভালো, গোলান। স্বাধীন কোনো কারণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা সেশেলে থাকব। এর মধ্যে আমাদের কাছাকাছি থাকতে হবে। এস, এল্ড চ্যাপ। যদি আমি প্রভাবিত হই তাহলে কি স্বেচ্ছায় তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ক্ষমতা আমার থাকবে?
ট্র্যাভিজ একমুহূর্ত চিন্তা করে হাত বাড়িয়ে দিল। চল জেনভ, জাহাজে ফিরে যাই। আগামীকাল নতুন করে শুরু করব।–যদি বেঁচে থাকি।
.
৪৭.
মান লী কম্পরের মনে নেই কখন তাকে রিক্রুট করা হয়েছিল। এর একটা কারণ ঐ সময় সে ছিল একবারে শিশু; আরেকটা কারণ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের এজেন্টরা তাদের চিহ্ন যতদূর সম্ভব মুছে ফেলেছিল।
কম্পর একজন অবজারভার এবং দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের কাছে সে এভাবেই পরিচিত।
অর্থাৎ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের মেন্টালিকস ক্ষমতার কিছু কম্পরের রয়েছে, কিন্তু তার অবস্থান শিকলের সবচেয়ে নিচে। সে মাইন্ডের ঝলক ধরতে পারে, কিন্তু সেগুলোকে এডজাস্ট করতে পারে না। এতদূর শিক্ষা সে পায়নি। সে একজন অবজারভার, সক্রিয় কর্মী না।
এর ফলে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর সেরাতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো দুঃখ নেই। পুরো ব্যবস্থায় নিজের গুরুত্ব সে বোঝে।
দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের প্রথম কয়েক শতাব্দীতে এধরনের কাজগুলো অবহেলা করা হয়েছিল। ধারণা ছিল যে এর সদস্যরা গ্যালাক্সি মনিটর করতে পারবে এবং সেলডন প্ল্যান ফলপ্রসূ করতে পারবে, হয়তো এখানে সেখানে একটু সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে।
মিউল তাদের এই দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। অজানা কোনো স্থান থেকে এসে সে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরে ফেলে। প্রতিআক্রমণ করতে সময় লেগেছে পাঁচ বছর, সেটাও সম্ভব হয়েছে অনেকগুলো জীবনের বিনিময়ে।
চরম মূল্য দিয়ে পালভার তাদেরকে উদ্ধার করেন এবং তিনিই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কার্যক্রম আরো প্রসারিত করতে হবে, কিন্তু ধরা পড়া চলবে না। তাই তিনি একটা অবজার্ভার বাহিনী তৈরি করেন।
কম্পরের জানা নেই গ্যালাক্সিতে কতজন অবজারভার রয়েছে। এমনকি জানে না টার্মিনাসে কতজন রয়েছে। জানাটা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সাধারণত অবজারভাদের মধ্যে কখনো যোগাযোগ হয় না, যেন একজন ধরা পড়লে অন্যদের কোনো বিপদ না হয়। সমস্ত যোগাযোগ থাকে ট্র্যান্টরের উপর মহলের সাথে।
কম্পরের আশা একদিন সে ট্রানটরে যাবে। যদিও সে মনে করে সেটা অসম্ভব। জানে মাঝে মধ্যে একদুজন অবজারভারকে ট্র্যানটরে নিয়ে গিয়ে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু খুব কম। একজন ভালো অবজারভারের গুণাবলী টেবিলে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যথেষ্ট নয়।
জেনডিবলের কথা মনে হলো। তার চেয়ে চার বছরের বড়। নিশ্চয়ই তাকেও কম্পরের মতো বালক বয়সে রিক্রুট করা হয়, কিন্তু নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরাসরি ট্রানটরে। এখন সে একজন স্পিকার। এটা নিয়ে কম্পরের কোনো মাথা ব্যথা নেই। পরবর্তীকালে জেনডিবলের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছে এবং এই তরুণের মাইন্ডের ক্ষমতা সে দেখেছে। এক সেকেন্ডের জন্যও তার সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না।
নিজের নিচু পদ নিয়ে কম্পরের কোনো ভাবনা নেই। সুযোগও নেই। তাছাড়া ট্রানটরের মান অনুযায়ী তার অবস্থান অনেক নিচে। কিন্তু তাদের নন-ট্র্যানটোরিয়ান বিশ্বে, নন-মেন্টালিক সমাজে একজন অবজারভার সহজেই সমাজের উঁচুতলায়। উঠতে পারে।
যেমন ভালো স্কুল বা ভালো বন্ধু পেতে কম্পরের কখনো সমস্যা হয় নি। নিজের মেন্টালিক ব্যবহার করে সে তার স্বাভাবিক অনুমান ক্ষমতাকে (সম্ভবত এই অনুমান ক্ষমতার কারণেই তাকে রিক্রুট করা হয়) বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। এর সাহায্যেই। সে হাইপার স্পেসাল অনুসরণে দক্ষতা অর্জন করে, কলেজে হিরো হিসেবে পরিচিতি পায়। এ ব্যাপারটাই তার রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দেয়। বর্তমান সমস্যা সমাধানের পর সে আরো কত উপরে উঠবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
সমস্যাটা সফল সমাধানের পর, হবে তো নিশ্চয়ই, সবার অবশ্যই মনে পড়বে যে এই কম্পরই ট্র্যাভিজকে আবিষ্কার করেছিল হিউম্যান বিয়িং হিসেবে না (সেটা সবাই পারবে), একটা মাইন্ড হিসেবে।
কলেজে থাকতেই সে ট্র্যাভিজের ভেতর ঢুকেছিল। প্রথমে তাকে মনে হয়েছিল বেপরোয়া অস্থির মনের সঙ্গী হিসেবে। একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে জড়ানো নিদ্রালু চোখে সে তাকিয়েছিল ট্র্যাভিজের দিকে। সেই সময় অত্যন্ত সচেতনভাবেই সে বুঝতে পারে ট্র্যাভিজকে রিক্রুট না করে কি হারিয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন।
ট্র্যাভিজকে অবশ্য রিক্রুট করা যেতনা কারণ তার জন্ম টার্মিনাসে, কম্পরের মতো অন্য গ্রহের অধিবাসী সে। তাছাড়া অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। শুধু অল্প বয়সীরাই মেন্টালিকস শিক্ষা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট স্থিতিস্থাপক। এটা বিজ্ঞানের চেয়েও অনেক বড় কিছু। পূর্ণবয়স্ক ব্রেইনে এই শিল্পের যন্ত্রনাদায়ক প্রবেশন ফলপ্রসূ হতো না।
যদি তাকে দলে নাই নেয়া যায় তাহলে তার কোন ব্যাপারটা কম্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
পরের সাক্ষাতেই কম্পর ট্র্যাভিজের মাইন্ডে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করে বের করল কি তাকে বিরক্ত করছিল। ট্র্যাভিজের মাইন্ডের বৈশিষ্ট্য তার শেখা নিয়মের সাথে মেলে না। বার বার ব্যাপারটা তার চোখ এড়িয়ে যেতে লাগল। এর কাজের ধারা অনুসরণ করতে গিয়ে সে কিছু ফাঁক পেল না, সেগুলো ফাঁক হতে পারেনা–বরং অস্তিত্বহীনতা। ঠিক এই জায়গাগুলোতেই ট্র্যাভিজের মাইন্ডের আচরণ গভীর ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, ফলে অনুসরণ করা যাচ্ছেনা।
কম্পরের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো না। তবে যা পেয়েছে তার ভিত্তিতে সে ট্র্যাভিজের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তখন থেকেই তার সন্দেহ হয়, আপাতদৃষ্টিতে অপর্যাপ্ত তথ্য থেকে একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার একটা অস্বাভাবিক দুর্লভ ক্ষমতা ট্র্যাভিজের রয়েছে।
ফাঁকা জায়গাগুলোর সাথে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে? এ ধরনের মেন্টালিজম তার ক্ষমতার বাইরে হয়তো স্পিকারদেরও। অস্বস্তির সাথে বারবার মনে হতে লাগল, ট্র্যাভিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার কথা হয়তো কারো জানা নেই, ফলে সে হয়তো
কি করবে সে? কম্পরের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ট্র্যাভিজের যে গুণাবলী রয়েছে সেটার অর্থ সে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা বুঝতে পারছে। শুধু অনুমান করতে পারে যে ট্র্যাভিজ হয়তো একদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হবে।
এই অনুমানের উপর ভিত্তি করেই ঝুঁকি নিতে হবে। যদি সেটা ঠিক হয়েই যায়
পিছনের কথা চিন্তা করে সে এখনো বুঝতে পারে না এত সাহস কোথায় পেয়েছিল। টেবিলের প্রশাসনিক বাধা সে দূর করতে পারে নি। তার সুনাম নষ্ট হয়ে গেল। বেপরোয়া হয়ে সে সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের সাথে যোগাযোগ করল এবং শেষ পর্যন্ত স্টর জেনডিবল তার সাথে যোগাযোগ করে।
জেনডিবল ধৈর্য ধরে সব কথা শোনে। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। জেনডিবলের পরামর্শেই কম্পর ট্র্যাভিজের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে এবং এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেন ট্র্যাভিজকে নির্বাসন দেয়া হয়। এবং হয়তো জেনডিবলের মাধ্যমেই কম্পর স্বপ্নের ট্র্যানটরে পৌঁছতে পারবে।
সমস্ত পরিকল্পনা করা হয়েছিল ট্র্যাভিজকে ট্রানটরে টেনে আনার জন্য। কিন্তু সে আসেনি। কম্পর হতবাক হয়ে যায় এবং তার ধারণা জেনডিবলও ব্যাপারটা আগে বুঝতে পারে নি।
যাই হোক দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসছে জেনডিবল এবং কম্পরের মতে এতে পরিস্থিতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
কম্পর তার হাইপারসিগনাল পাঠালো।
.
৪৮.
মাইন্ডে স্পর্শ পেয়ে জেনডিবল ঘুম থেকে জেগে উঠল। ব্যাপারটা কার্যকরী কিন্তু বিরক্তিকর না। কারণ সেটা ঠিক জাগরণ কেন্দ্রে টোকা দেয়। সে সহজভাবে জেগে উঠল।
উঠে বসল বিছানায়, পাতলা চাদর তার পেশীবহুল শরীর বেয়ে পিছলে নেমে যাচ্ছে। চিনতে পারছে স্পর্শটা। মৌখিক শব্দ দ্বারা যারা যোগাযোগ করে তাদের দুজনের কণ্ঠে যেমন পার্থক্য, মেন্টালিস্টদের ক্ষেত্রেও তেমন পার্থক্য থাকে।
জেনডিবল একটা স্ট্যান্ডার্ড সিগন্যাল পাঠালো, জিজ্ঞেস করল একটু দেরী করা যাবে কি না, উত্তরে নো ইমার্জেন্সীকল আসল।
ধীরে সুস্থে সকালের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করল জেনডিবল। গোসলের জন্য শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো ব্যবহৃত পানিই আবার রিসাইকলড হয়ে নেমে আসছে। তখনই সে আবার যোগাযোগ করল।
কম্পর?
জি, স্পিকার।
ট্র্যাভিজ এবং অন্য লোকটার সাথে কথা বলেছ?
পেলোরেট, জেনভ পেলোরেট। জি স্পিকার।
পাঁচ মিনিট সময় দাও, তারপর ভিজুয়ালের ব্যবস্থা করছি।
কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার পথে সুরা নোভী প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিল তাকে। এখনো তার মাইন্ডের আবেগ এবং শ্রদ্ধা জেনডিবলকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, কিন্তু ব্যাপারটা ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে যাচ্ছে।
তার মাইন্ডের ছোট একটা ধারা সে নোভীর মাইন্ডের সাথে যুক্ত করে নিল। এখন আর মেয়েটার মাইন্ড না ছুঁয়ে তার মাইন্ড কেউ ছুঁতে পারবে না। তার অজান্তে অন্য কোনো বহিরাগত মাইন্ড ফিল্ড তাদের আশেপাশে ঢুকতে পারবেনা।
কম্পর? সে জিজ্ঞেস করল।
জি, স্পিকার।
শান্ত হও। তোমার মাইন্ড পরীক্ষা করতে হবে। বাধা দিওনা।
আপনি যা চান,স্পিকার। জিজ্ঞেস করতে পারি কেন?
নিশ্চিত হতে হবে যে তোমাকে কনভার্ট করা হয়নি।
আমি জানি টেবিলে আপনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই।
চিন্তা করোনা, কম্পর। রিল্যাক্স।–হ্যাঁ, তোমাকে কনভার্ট করা হয়নি। এখন তুমি একটু সহযোগিতা করলেই ভিজুয়াল কন্টাক্ট করা যায়।
এরপরে যা ঘটল, সাধারণ শব্দে সেটাকে বলা যায় মায়া বা ইন্দ্রজাল, কারণ সুপ্রশিক্ষিত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার ছাড়া আর কারো পক্ষে সেটা ধরা সম্ভব না। অনুভূতি দিয়ে তো নাই, অতি আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়েও ধরা যাবে না।
ব্যাপারটা হচ্ছে মুখের প্রতিচ্ছবি তৈরি করে মাইন্ডে সেটাকে ফুটিয়ে তোলা। এমনকি সবচেয়ে ভালো মেন্টালিস্টও ঝাপসা কাঁপাকাঁপা অবয়ব ছাড়া কিছু তৈরি করতে পারে না। কম্পরের মুখ মাঝখানে ভাসছে, যেন পাতলা কাঁপাকাঁপা রেশমের। পর্দার ওপাশ থেকে দেখা যাচ্ছে। জেনডিবল জানে তার নিজের চেহারাও কম্পরের সামনে ঠিক একইভাবে উপস্থিত হয়েছে।
হাইপারওয়েভে যোগাযোগ করলে, যোগাযোগকারী হাজার পারসেক দূরে থাকলেও মনে হবে যেন মুখোমুখি বসে কথা বলছে। জেনডিবলের জাহাজেও এই। সুযোগ রয়েছে।
মেন্টালিস্ট ভিশনের কিছু সুবিধা রয়েছে। প্রধান সুবিধা, প্রথম ফাউণ্ডেশন। কোনো যন্ত্র দিয়েই সেটা ধরতে পারবে না। আরেকজন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারও ধরতে পারবে না। মাইন্ডের ছুটাছুটি ধরতে পারবে, কিন্তু মুখভঙ্গির যে সূক্ষ্ম পরিবর্তন যোগাযোগ তৈরি করে সেটা ধরতে পারবে না।
এন্টি-মিউলের ব্যাপার–বেশ, নোভীর মাইন্ডের বিশুদ্ধতাই সেটা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট।
সংক্ষেপে বল, কম্পর, ট্র্যাভিজ এবং পেলোরেটের সাথে তোমার কি কথা হয়েছে। সংক্ষেপে, মাইন্ড লেভেল পর্যন্ত।
অবশ্যই, স্পিকার, কম্পর বলল।
বেশি সময় লাগল না। শব্দ, মুখের ভঙ্গি, মেন্টালিজম-এর সমন্বয় বিষয়টাকে যথেষ্ট সংকুচিত করেছে, অথচ সাধারণভাবে কথা বলার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য আদানপ্রদান হয়েছে।
গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে জেনডিবল। মেন্টালিস্ট ভিশনে কোনো বাহুল্য নেই। সত্যিকার দৃষ্টিক্ষেত্রে বা হাইপারভিশনের সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রচুর। ইনফরমেশন বিট চলাচল করে। ফলে যে কেউ ইচ্ছা করলে প্রচুর বিট মিস করতে পারে।
মেন্টালিস্ট ভিশনের রেশম পর্দার মধ্য দিয়ে নিখুঁত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়, তাই কোনো বিট মিস করা যায় না। প্রতিটা বিট গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রানটরে তরুণ শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকরা। নানা ধরনের গল্প বলতেন। সবচেয়ে বেশি যে গল্পটা বলা হতো সেটা ছিল অবিশ্বাস্য।
সেই গল্পে বলা হয়েছে, কালগান দখল করার আগে মিউলের অগ্রযাত্রার খবর একজন নিম্নপদস্থ অফিসারের হাতে পৌঁছায়। সেই লোকটার অনুভূতি ছিল ঘোড়ার মতো। কারণ রিপোর্টে ব্যক্তিগত নাম তরঙ্গটা তার চোখে পড়েনি। সে ধরে নেয় খবরটা ট্রানটরে পাঠানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এর মধ্যে দ্বিতীয় সংবাদ এসে পৌঁছায়, কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না, কাটাতে হয় তিক্ত পাঁচটা বছর।
ঘটনা অবশ্য সেভাবে ঘটেনি, কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার না। গল্পটা ছাত্রদের মনোসংযোগের অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রেরণা জুগিয়েছে। ছাত্রজীবনে জেনডিবল নিজেও একটা ভুল করেছিল। তখন তার শিক্ষক, বৃদ্ধ কেনডাস্ট অত্যন্ত কড়া ছিলেন বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ঘোড়ার মতো প্রাণী, তরুণ জেনডিবল? সেটাই তার জন্য যথেষ্ট ছিল।
কম্পর শেষ করল।
ট্র্যাভিজের আচরণ সম্পর্কে তোমার মতামত। তুমি তাকে আমাদের সবার চেয়ে ভালো চেন। জেনডিবল জিজ্ঞেস করল।
একেবারে পরিষ্কার, কম্পর বলল। মেন্টালিক ইন্ডিকেশন নিয়ে কোনো সন্দেহ। নেই। আমার কথা ও কাজে সে মনে করেছে আমি তাকে ট্র্যানটরে বা সিরিয়াস সেক্টরে সরিয়ে নিতে উদ্বিগ্ন। অর্থাৎ আমার মতে সে যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে। তার সরে যাওয়ার ব্যাপারে আমি যথেষ্ট জোর দিয়েছি, যখন সে বুঝতে পেরেছে তার আগ্রহ আমার আগ্রহের বিপরীত, তখন সে যা আমার ইচ্ছা বলে মনে করেছে তার বিপরীত কাজ করবে।
তুমি নিশ্চিত?
পুরোপুরি।
জেনডিবল বুঝতে পারছে কম্পরের কথা ঠিক। আমি সন্তুষ্ট। দারুণ কাজ দেখিয়েছ। পৃথিবীর রেডিও এক্টিভিটি নিয়ে তোমার গল্পটা আমাদেরকে সরাসরি মাইন্ড ম্যানিপুলেশন-এর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। চমৎকার!
মনে হলো কম্পর কষ্ট করে নিজেকে সামলাচ্ছে। স্পিকার সে বলল, আমি আপনার প্রশংসা গ্রহণ করতে পারছি না। গল্পটা আমি তৈরি করিনি। এটা সত্য। সিরিয়াস সেক্টরে সত্যিই পৃথিবী নামে একটা গ্রহ রয়েছে যাকে মানব সভ্যতার আসল জন্মস্থান হিসেবে ধরা হয়। হয়তো গ্রহটা প্রথম থেকেই রেডিও একটিভ ছিল, সেটা ধীরে ধীরে বেড়ে গিয়ে এর মৃত্যু হয়। আমার পূর্বপুরুষদের মাতৃগ্রহে এগুলো সবই বিবেচিত হয় প্রকৃত ইতিহাস হিসেবে।
তাই? বেশ মজার! জেনডিবল বলল নিরুৎসাহিত গলায়। খুশীর কথা হচ্ছে সত্য কথা বলা হয়েছে, যেখানে একটা অসত্যকে সমান গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা যায়। পালভার বলেছিলেন, সত্যের যত কাছাকাছি হবে, মিথ্যা তত শক্ত হবে, এবং সত্য নিজেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা।
আরেকটা কথা। আপনি আসার আগ পর্যন্ত ট্র্যাভিজকে সেশেলে রাখার জন্য। আমাকে সাধ্যের অতীত কাজ করতে হয়েছে। এতে সে সন্দেহ করে ফেলেছে আমি দ্বিতীয় ফাউন্ডেশনের অধীন।
জেনডিবল মাথা নাড়ল। আমার মতে সেটা বর্তমান পরিস্থিতিতে এড়ানো যেত না। তার মনের যে অবস্থা তাতে এখন সে সবখানেই দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনকে দেখবে।
স্পিকার, যদি আপনি আসার আগ পর্যন্ত ট্র্যাভিজকে এখানে আটকে রাখার প্রয়োজন হয় তাহলে আমি বরং আপনার কাছে আসি। আমার জাহাজে আপনাকে তুলে নেই। মাত্র একদিন লাগবে
না, অবজারভার, জেনডিবল ধারালো গলায় বলল। তুমি সেটা করবে না। তোমার জাহাজে একটা হাইপার রিলে রয়েছে, তুমি সেটা সরাতে পারবে না, তাই না?
হ্যাঁ স্পিকার।
যদি টার্মিনাস জানে যে তুমি সেশেলে ল্যান্ড করেছ, সেশেলে তাদের অ্যাম্বাসেডরও সেটা জানবে–অ্যাম্বাসেডর এটাও জানবে যে ট্র্যাভিজও এখানে ল্যান্ড করেছে। তোমার হাইপার রিলে টার্মিনাসকে জানাবে যে তুমি একশ পারসেকের নির্দিষ্ট বিন্দুতে গিয়ে ফিরে এসেছ; আর অ্যাম্বাসেডর জানাবে যে ট্র্যাভিজ কোথাও যায়নি। এর থেকে তারা কি অনুমান করবে? টার্মিনাসের মেয়র যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ, তাকে সতর্ক করে দিতে চাই না। চাইনা সে তার ফ্লীট নিয়ে এখানে চলে আসে।
উইথ রেসপেক্ট, স্পিকার–যদি একজন কমান্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে ভয় পাবার কি আছে?
হয়তো কারণটা খুব ছোট, আর যদি ফ্লীট না আসে তাহলে তো ভয়ের কোনো কারণ নেই। তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাকো, অবজারভার। আমি পৌঁছে তোমার সাথে যোগ দেব এবং তারপর-
এবং তারপর, স্পিকার?
কেন, তারপর আমি দায়িত্ব নেব।
.
৪৯.
মেন্টালিস্ট-ভিশন শেষ করে জেনডিবল অনেকক্ষণ সেখানেই বসে রইল–চিন্তিত।
তার মহাকাশযান ফাউণ্ডেশনের যানগুলোর মতো মোটেই আধুনিক না, পুরনো। সেশেলে আসার জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে লম্বা পথ। এই সময় সে ট্র্যাভিজের উপর সমস্ত রিপোের্ট পরীক্ষা করেছে, প্রায় দশ বছরের সমস্ত রিপোের্ট।
সামগ্রিক এবং বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি পালভার টার্মিনাসে জন্মগ্রহণকারীদের নিয়োগ বন্ধ না করতেন, তাহলে ট্র্যাভিজ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশেনের জন্য অসাধারণ একটা সম্পদ হতো।
শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন কতজন সেরা লোককে রিক্রুট করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেটা বলা অসম্ভব। গ্যালাক্সির কোয়াড্রিলিয়নস জনসংখ্যার প্রত্যেককে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কেউ হয়তো ট্র্যাভিজের চেয়েও সেরা, কেউ তার চেয়েও নিচু মানের।
জেনডিবল আস্তে করে মাথা নাড়ল। টার্মিনাস বা যেখানেই জন্ম হোক, ট্র্যাভিজের ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। সেটা দেখিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব অবজারভার কম্পরের।
ট্র্যাভিজকে অবশ্য এখন আর কাজে লাগানো যাবে না। গড়ে-পিটে নেয়ার জন্য বয়স বেশি হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো তার ভেতরে রয়ে গেছে জন্মগত অন্তৰ্জন, সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত তথ্য থেকে সমাধান বের করার দুর্লভ ক্ষমতা, এবং
বৃদ্ধ স্যান্ডেস বয়স হলেও এখনো ফার্স্ট স্পিকার এবং সেরাদের একজন।–কিছু একটা ধরতে পেরেছিলেন। এখানে আসার পথে জেনডিবল যে বিশ্লেষণ তৈরি করেছে সেটা না দেখেই তিনি বুঝেছিলেন, ট্র্যাভিজই হচ্ছে সমস্যার চাবি।
এবং তাকে স্পর্শ করা যাবে না। এই বিষয়ে জেনডিবল নিশ্চিত। যতক্ষণ না বোঝা যাচ্ছে ট্র্যাভিজের আসল ভূমিকা কি, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোনোভাবেই মডিফাই করা যাবে না। যেখানে এন্টি-মিউলরা রয়েছে, সেখানে একটা ভুল পদক্ষেপ তাদের মুখের উপর একটা মাইক্রো সূর্যের বিস্ফোরণ ঘটাবে।
তার মাইন্ডের ভেতর আরেকটা মাইন্ড ভেসে রয়েছে বুঝতে পারল। অন্যমনস্কভাবে সেটাকে একটা ঝাঁপটা দিল যেন ট্র্যানটোরিয়ান পোকামাকড় তাড়াচ্ছে–যদিও মাইন্ড দিয়ে, হাত দিয়েনা। অন্য দিকের ব্যথা বুঝতে পেরে তাকালো চোখ তুলে।
সুরা নোভী হাতের তালু দিয়ে কোঁচকানো ভুরু ডলছে। মাফ করবেন, মাস্টার, হঠাৎ করে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে।
জেনডিবল সাথে সাথে অনুতপ্ত হলো। দুঃখিত, নোভী। আমি কিছু ভাবছিলাম, খুব গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম। দ্রুত এবং আলতোভাবে সে মাইন্ডের মোড়ানো অংশ মসৃণ করে দিল।
হঠাৎ করেই হাসল নোভী। চলে গেছে। আপনার দয়ালু কথাবার্তা, মাস্টার, আমার উপর খুব ভালো কাজ করে।
ভালো! কি হয়েছে? তুমি এখানে কেন? নিজেই জানার জন্য সে তার মাইন্ডের আরো গভীরে ঢোকার উদ্যোগ নিল। কিন্তু বারবার মেয়েটার গোপনীয়তা ভাঙতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না।
নোভী আমতা আমতা করছে। জেনডিবলের দিকে একটু ঝুঁকে বলল, আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আপনি তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কিছু দেখছেন না, শব্দ করছেন, মুখ নড়ছে। ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম–ভয় পেয়েছিলাম, আপনার বোধহয় কিছু হয়েছে অসুস্থ বুঝতে পারছিলাম না কি করব।
তেমন কিছু না, নোভী। ভয় পেয়ো না। আলতোভাবে মেয়েটার একটা হাত ধরল সে। ভয়ের কিছু নেই। বুঝতে পেরেছ?।
ভয় নাকি শক্ত কোনো আবেগ–তার মাইন্ড এর ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। নোভীর মাইন্ড সে শান্ত করে তুলতে চায় কিন্তু বাইরের প্রভাবে সেটা এডজাষ্ট করতে হবে ভেবে তার দ্বিধা হচ্ছে। বরং শুধু কথা বলে দেখা যাক।
নোভী, আমি তোমাকে সুরা বলে ডাকতে পারি?
মুখটা মলিন হয়ে গেল নোভীর। ওহ, মাস্টার, এমন করবেন না।
কিন্তু রাফির্যান্ট সেদিন তোমাকে এভাবে ডেকেছিল। আমি জানি
হ্যাঁ, ডেকেছিল, মাস্টার। এভাবেই পুরুষরা একটা মেয়েকে ডাকে যার কোনো পুরুষ সঙ্গী নেই–যার বাগদান হয়নি পরিপূর্ণ হয়নি। আপনি আমাকে নোভী বলে ডাকলেই আমার সম্মান বাড়বে, আমি খুশী হবো। আশা করি নোভী ডাকতে কোনো সমস্যা হবে না।
অবশ্যই না, নোভী।
এই কথায় তার মাইন্ড একেবারে প্রশান্ত হয়ে গেল এবং এতে জেনডিবলও খুশী হলো, খুব বেশি খুশী। কেন সে এত খুশী হবে?
মিউল প্রথম ফাউণ্ডেশনের বেইটা ডেরিলকে না থামানোর কারণেই ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল তার পরিকল্পনা। কিন্তু এই ব্যাপারটা আলাদা। এই হ্যামিশ মহিলাকে সে এলিয়েন মাইন্ডের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করছে।
না, এটা সত্যি না–স্পিকার হিসেবে তার দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ সে নিজের মাইন্ড ভালোভাবে বুঝতে না পারছে বা সত্যকে এড়িয়ে যাবে। আসল সত্য হচ্ছে যখন মেয়েটা তার সাহায্য ছাড়াই আনন্দে এবং সুখে থাকে সেটা তাকেও আনন্দিত করে তোলে। এবং (তার মতে) এতে কোনো দোষ নেই।
বসো, নোভী।
রুমের শেষ মাথায় একটা চেয়ারে জড়োসড়ো হয়ে বসল সে। মাইল্ড শ্রদ্ধায় ভরপুর।
যখন দেখেছিলে আমি শব্দ করছিলাম, নোভী, সেই সময় আমি কথা বলছিলাম দূরের একজনের সাথে। স্পিকারদের নিয়মে।
চোখ নিচু করে করুণ সুরে নোভী বলল, মাস্টার, স্পিকারদের অনেক নিয়ম আমি বুঝতে পারছি না। কাজটা পাহাড়ে চড়ার মতো কঠিন। আপনার কাছে আসার জন্য আমার লজ্জা লাগছে। আপনি হাসছেন না তো, মাস্টার?
সবাই সবকিছু পারে না। এতে লজ্জার কিছু নেই। আমার মতো স্পিকার বানানোর জন্য তোমার বয়স বেশি। কিন্তু তুমি যা জানো বা করতে পারো তার চেয়ে বেশি কিছু জানার বা করার বয়স পার হয়ে যায়নি। আমি তোমাকে এই মহাকাশযানের ব্যাপারে শিখিয়ে দেব। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই অনেক কিছু শিখে ফেলবে।
নোভীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সব ভালোভাবে শেখার চেষ্টা করব, মাস্টার।
আমি জানি তুমি করবে, সে বলল–তারপর একটু দ্বিধা। তার মনে হচ্ছে। আলোচনার সময় কম্পর বুঝতে পারেনি সে একা না। সঙ্গীর ব্যাপারে কোনো আভাসই দেয়নি। সঙ্গে মহিলা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কম্পর এতে অবাক হবে না। কিন্তু হ্যামিশ মহিলা? তারপরই মনে পড়ল যে কম্পর কখনো ট্র্যানটরে যায়নি। কাজেই নোভীকে সে হ্যামিশ বলে চিনতে পারবে না।
মাথা নেড়ে চিন্তাটা দূর করে দিল। কম্পর জানুক বা না জানুক–কিছু যায় আসে না। জেনডিবল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের একজন স্পিকার। সেলডন প্ল্যানের ভিতরে থেকে সে যা খুশী তাই করতে পারে–কেউ বাধা দিতে পারবে না।
মাস্টার, গন্তব্যে পৌঁছার পর আমরা কি আলাদা হয়ে যাবো?
জেনডিবল মুখ তুলে প্রয়োজনের চেয়ে জোর দিয়ে বলল, আমরা কখনো আলাদা হবো না, নোভী।
নোভী লজ্জিত হয়ে হাসল ঠিক গ্যালাক্সির আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো।
.
বিশ্ববিদ্যালয়
৫০.
ফার স্টারে ঢোকার সময় নাক কুঁচকালো পেলোরেট।
ট্র্যাভিজ কাঁধ ঝাঁকালো। মানুষের শরীর কড়া গন্ধ তৈরি করে। রিসাইক্লিং তাৎক্ষণিক কাজ করে না। কৃত্রিম সুগন্ধী শুধু একটু প্রলেপ দেয়–গন্ধ পুরো দূর করতে পারে না।
আমার ধারণা, দুটো মহাকাশযানের গন্ধ কখনোই এক হবে না, যদি সেগুলোতে আলাদা মানুষ বাস করে।
ঠিক, প্রথম ঘণ্টার পর তুমি সেশেল গ্রহে কোনো গন্ধ পেয়েছ?
না, পেলোরেট স্বীকার করল।
বেশ, কিছুক্ষণ পরে এখানেও কোনো গন্ধ পাবে না। যদি অনেকদিন এই মহাকাশযানে বাস করো তাহলে গন্ধটা তোমাকে বাড়ি ফেরার অনুভূতি দেবে। একটা কথা এর পরে যদি গ্যালাকটিক ভবঘুরে হও, তোমাকে মনে রাখতে হবে যে কোনো মহাকাশযান বা গ্রহের গন্ধের ব্যাপারে সেই যান বা গ্রহের বাসিন্দার কাছে অনুযোগ করা অভদ্রতা। নিজেদের ভেতর সেটা কোনো ব্যাপার না।
সত্যি কথা বলতে কি, গোলান, ফার স্টারকে আমার নিজের বাড়ি মনে হয়। এটা অন্তত ফাউণ্ডেশনের তৈরি। পেলোরেট হাসল। নিজেকে আমার কখনো দেশপ্রেমিক মনে হয়নি। সবসময় ভেবেছি মানবতাই আমার দেশ, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ফাউণ্ডেশন থেকে দূরে এসে এর প্রতি আমার ভালোবাসা অনেক বেড়ে গেছে।
ট্র্যাভিজ নিজের বিছানা তৈরি করছে। ফাউণ্ডেশন থেকে তুমি দূরে না। সেশেল ইউনিয়নের চারপাশে রয়েছে ফাউণ্ডেশন টেরিটোরি। এখানে আমাদের অ্যাম্বাসেডর এবং যথেষ্ট উপস্থিতি রয়েছে। সেশেলিয়ানরা কথাবার্তায় আমাদের বিরোধিতা করে, কিন্তু আমাদের অখুশী করার মতো কোনো কাজ তারা সহজে করে না। জেনভ, বাতি নিভিয়ে দাও। আমরা আজকে কোথাও পৌঁছতে পারিনি। দেখা যাক আগামীকাল ভাগ্য খোলে কি না।
তারপরও দুই রুমে শব্দ পৌঁছতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ঘর অন্ধকার করে পেলোরেট এপাশ ওপাশ করছে। শেষ পর্যন্ত নিচু স্বরে ডাকল, গোলান?
হ্যাঁ।
তুমি ঘুমাচ্ছ না।
কথা বললে ঘুমাবো কেমন করে?
আজকে আমরা একটা কিছু অন্তত পেয়েছি। তোমার বন্ধু কম্পর
প্রাক্তন বন্ধু, ট্র্যাভিজ গজগজ করে বলল।
যাই হোক। সে পৃথিবীর কথা বলেছে। এমন কিছু বলেছে যা আমি গবেষণার সময় পাইনি। রেডিও একটিভিটি!
ট্র্যাভিজ কনুইতে ভর দিয়ে মাথা তুলল। দেখ, জেনভ, পৃথিবী যদি মৃত হয়ও তার মানে এই না যে আমরা ফিরে যাবো। আমি এখনো গায়া খুঁজে বের করতে চাই।
পেলোরেট মুখ দিয়ে এমনভাবে বাতাস ছাড়ল যেন পালক ওড়াচ্ছে। মাই ডিয়ার চ্যাপ, অবশ্যই। আমিও চাই। আমার মনে হয় না পৃথিবী মৃত। কম্পর যা সত্য মনে করেছে তাই বলেছে। গ্যালাক্সির অধিকাংশ সেক্টর মনে করে মানব প্রজাতির উৎস নিজেদের কোনো স্থানীয় গ্রহে হয়েছে এবং তারা সেটাকে পৃথিবী বা সমার্থক কোনো নামে ডাকে।
এনথ্রপলজীতে আমরা এটাকে বলি গ্লোবসেনট্রিজম। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যদের চেয়ে নিজেদের বড় বলে প্রচার করা; সবসময় জাহির করতে চায় যে নিজেদের সভ্যতা অন্য গ্রহের চেয়ে প্রাচীন ও উন্নত; অন্যগ্রহের ভালো সবকিছু তাদের কাছ থেকে ধার করা এবং খারাপগুলো অন্যরা বিকৃত করেছে। যদি নিজেদের গ্রহকে তারা পৃথিবী বা এর সমার্থক এবং সভ্যতার জন্মস্থান হিসেবে প্রচার। করতে না পারে তাহলে অন্তত চেষ্টা করে নিজেদের সেক্টরের কোনো গ্রহকে পৃথিবী হিসেবে প্রচার করতে।
তুমি বলতে চাও, কম্পর সাধারণ অভ্যাস অনুযায়ী কাজ করেছে? ট্র্যাভিজ বলল। তারপরও সিরিয়াস সেক্টরের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। কাজেই সেখানকার প্রতিটি গ্রহ সুপরিচিত এবং সেখানে না গিয়েই খোঁজখবর করা যাবে।
পেলোরেট ঠোঁট চাটল। সিরিয়াস সেক্টরে পৃথিবী না পেলেও কিছু আসে যায় না। তুমি জানো রহস্যময়তা কিভাবে যুক্তিবোধকে ঢেকে দেয়, গোলান। গ্যালাক্সির অন্তত আধ ডজন সেক্টরের পণ্ডিতরা মনে করেন পৃথিবী হাইপারস্পেসে হারিয়ে গেছে এবং দুর্ঘটনা ছাড়া সেখানে পৌঁছানো সম্ভব না।
দুর্ঘটনা ছাড়া সেখানে পৌঁছতে পেরেছিল?
গল্প শোনা যায়, তবে কেউ বিশ্বাস করে না।
তাহলে জেনভ, আমাদেরও বিশ্বাস করার দরকার নেই। বরং ঘুমানো যাক।
কিন্তু, গোলান, পৃথিবীর রেডিও একটিভিটির ব্যাপারটাই আমাকে আগ্রহী করে তুলেছে। আমার কাছে সত্য মনে হচ্ছে কিছুটা সত্য।
কিছুটা সত্য মানে?
বেশ, রেডিও একটিভ একটা গ্রহ অতিমাত্রায় তাপ বিকীরণ করবে। রূপান্তরের মাত্রা হবে খুব বেশি এবং দ্রুতবিবর্তন ঘটবে এবং বিচিত্রভাবে। একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে কিনা জানি না, প্রতিটি ক্ষেত্রেই গল্পগুলোর বিষয়বস্তু এক। সেটা হচ্ছে পৃথিবীতে প্রাণ ছিল অসম্ভব রকম বিচিত্র, মিলিয়ন মিলিয়ন বিচিত্র প্রাণের উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাণের এই বৈচিত্র্য বিস্ফোরক অগ্রগতির কারণেই পৃথিবীতে হয়তো বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছিল এবং তারপর ছড়িয়ে পড়েছিল গ্যালাক্সিতে। হয়তো কোনো কারণে সেটা রেডিও একটিভ হয়ে পড়ে। এর থেকে ধারণা করা যায় যে পৃথিবী হচ্ছে বা ছিল অনন্যসাধারণ বা ইউনিক।
ট্র্যাভিজ একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, প্রথমত কম্পকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আমাদেরকে সরানোর জন্য সে হয়তো মিথ্যা কথা বলেছে। আমার মনে হয় আসলেই মিথ্যা কথা বলেছে। আর সত্যি কথা বললেও সে বলেছে, রেডিও এক্টিভিটি এত বেশি যে সেখানে জীবন ধারণ অসম্ভব।
পেলোরেট আবারো পালক ওড়ানোর ভঙ্গি করল। পৃথিবীতে এত বেশি রেডিও এক্টিভিটি ছিল না যে প্রাণের বিকাশে বাধা দেবে। অথচ পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হয়েছে। কাজেই জীবনের সাথে রেডিও এক্টিভিটি সঙ্গতিপূর্ণ না হয়ে বরং কমবে। সেটা বাড়ানোর কোনো উপায় নেই।
পারমাণবিক বিস্ফোরণ? ট্র্যাভিজ বলল।
এই কথা আবার আসছে কেন?
বলতে চাইছি পৃথিবীতে হয়তো পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল?
পৃথিবীর সারফেসে? অসম্ভব। গ্যালাক্সির ইতিহাসে এমন কোনো রেকর্ড নেই। কোনো সমাজ কখনোই এত বোকা ছিলনা যে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ব্যবহার করবে। ট্রিগেলিয়ান প্রজা বিদ্রোহের সময় যখন দুপক্ষই খাদ্য পানি ছাড়া অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল, তখন জেনডিপুরাপ খোরাট ফিউশন বিক্রিয়ার পরামর্শ দেয়ায়
নিজের ফ্লীটের লোকেরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। গ্যালাক্সির ইতিহাস আমি জানি। আমি দুর্ঘটনার কথা ভাবছিলাম।
এমন কোনো দুর্ঘটনার রেকর্ড নেই যার ফলে কোনো গ্রহের রেডিও এক্টিভিটি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমার মনে হচ্ছে এখানে সময়। নষ্ট না করে সিরিয়াস সেক্টরে গিয়ে খোঁজ খবর করা উচিত।
হয়তো একদিন যাবো, কিন্তু এখন-
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি কথা বন্ধ করছি।
অন্ধকারে ট্র্যাভিজ আরো একঘণ্টা জেগে রইল। মনে হচ্ছে হয়তো সে যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। ভালো হবে সিরিয়াস সেক্টর ঘুরে গায়াতে ফিরে আসা যখন সবার মনোযোগ থাকবে অন্যদিকে।
কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। দুঃস্বপ্ন দেখল ঘুমের মধ্যে।