অধ্যায়: ৫
“ইলিনা ওর দাদুকে খুব ভালবাসত। দাদুই ছিল ওর সব, ওর মা-বাবা। আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম, ওর বাবার ছিল ট্যুর আর মিটিং। আমরা মেয়েকে সময় দিতে পারিনি। সারা দিন ইলিনা, সেই তিন বছর বয়স থেকেই দাদুর কাছে মানুষ। দাদুই খাইয়ে দিত, স্নান করাত, ঘুম পাড়াত, পটি পর্যন্ত করাত। একজন বেবিসিটারও ছিল, কিন্তু তাকে বেশি কিছু করতে হত না, ফাইফরমায়েশ খাটা ছাড়া। দাদু আর নাতনির বন্ডিং ছিল সাংঘাতিক। যখন স্কুলে যেত তখনও দাদুই চলনদার। আর দাদুও এমনই যে, নাতনির স্কুলের সময়টা ঠায় বসে থাকত স্কুলের বাইরে, গাছতলায় বা পার্কের বেঞ্চে। ছুটি হলে নিয়ে আসত। যখন স্কুলবাসে যাওয়া শুরু করল তখনও দাদুই বাসে তুলে দিত, নামিয়ে আনত। এত চোখে চোখে রাখত যে, ইলিনার দুর্ঘটনা খুব একটা ঘটেনি, পড়ে যাওয়া বা কেটেকুটে যাওয়া। অসুখবিসুখ হলে দাদু সারাক্ষণ ইলিনার পাশে, অতন্দ্র। আমাদের কখনও ইলিনার জন্য ভাবতেই হয়নি। তবে দাদুর অত ন্যাওটা হওয়ার ফলে আমাদের, অর্থাৎ মা-বাবার সঙ্গে ওর বন্ডিংটা ছিল একটু দুর্বল। দেখা হলে গ্রিট করত বটে, তবে যেন প্রতিবেশীর মতো। হাই মা, হাই বাবা বলে একটু ভদ্রতার হাসি হেসে নিজের পড়া বা খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। রাতে আমাদের কাছে শুতে চাইত না, জোর করে শোওয়ালেও মাঝরাতে উঠে কান্নাকাটি জুড়ে ঠিক দাদুর কাছে চলে যেত। ওর যখন সাত বছর বয়স তখন আচমকা সেরিব্রালে দাদু মারা যায়। মাত্র পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। মৃত্যু জিনিসটা কী সেটা আমরা কিছুতেই ইলিনাকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনি। দাদুর ডেডবডি কিছুতেই ছাড়তে চায় না। তারপর দাদু কোথায় গেল, কেন আসছে না, দাদুকে ফোন করো, এইসব বলে বলে আমাদের হয়রান করে মারত। তারপর হঠাৎ একদিন বেশ শান্ত হয়ে গেল এবং স্বাভাবিকও। আমরা ধরে নিলাম হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে এবং হয়তো দাদুকে একটু একটু করে ভুলে যাচ্ছে। ছুটির দিনে, সামার বা পুজো ভেকেশনে ইলিনাকে বেবিসিটারের কাছে রেখে আমরা বেরিয়ে যেতাম। একদিন আমি হঠাৎ আর্লি ফিরে এসে ডোরবেল বাজিয়ে কোনও সাড়া পাই না। অনেকক্ষণ বাদে ইলিনা দরজা খুলে দিতে ঘরে ঢুকে দেখি বেবিসিটার নেই, আর ইলিনার বিছানায় একটা দাবার বোর্ড পাতা, তাতে ঘুঁটিও সাজানো। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই দাবার বোর্ড পেলি কোথায় আর কার সঙ্গেই-বা খেলছিলি আর কুসুমই-বা কোথায় গেল। ইলিনা খুব বিরক্ত। বলল, কুসুমদি তো রোজই এ সময়ে কোথায় যেন চলে যায় আর আমি তো দাদুর কাছে বসে দাবা শিখছিলাম। তুমি এলে বলে দাদু চলে গেল। কে এটা বিশ্বাস করবে বলুন! আমি খুব বকলাম, তুমি আজকাল মিথ্যে কথা বলতে শিখেছ, দাদু মারা গেছেন, তিনি কী করে তোমাকে দাবা শেখাতে আসবেন। আর দাবার বোর্ড তো উড়ে আসেনি, কোথায় পেলি দাবার বোর্ড? ইলিনা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, দাবার বোর্ড তো ওই স্টিলের আলমারির ওপরে ছিল, আমি চেস শিখব বলে দাদুই বলল, আলমারির মাথা থেকে নামিয়ে আনতে। আমি চেয়ারে উঠে নামিয়ে আনলাম।
“পরে নীলাঞ্জন সব শুনে বলল, একটা দাবার বোর্ড নাকি সত্যিই আলমারির মাথায় রাখা ছিল। পরে কুসুমকে খুব বকলাম মেয়েকে একা রেখে চলে যাওয়ার জন্য। কুসুম বলল, আমি কী করব, ইলিনাই তো আমাকে বলে, তুমি কোথাও ঘুরে এসো, তুমি থাকলে দাদু আসবে না।
“ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়নি। ইলিনাকে স্কুলের পর বাস থেকে নামিয়ে আনতে যেত কুসুম। একদিন যেতে গিয়ে স্কুটারের ধাক্কায় পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। আনতে যেতে পারেনি। আমি অনেক পরে খবর পেয়ে পাগলের মতো বাড়ি ছুটে এসে দেখি ইলিনা বাড়িতে এসে গেছে। বলল, চিন্তা করছিলে কেন মা, আমাকে তো দাদুই বাস থেকে নামিয়ে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে নিয়ে এল। তারপর এতক্ষণ দাদুর সঙ্গেই তো কথা বলছিলাম। কত গল্প হল। কেমন যেন মনে হচ্ছিল, দাদুর শোকে বাচ্চাটা পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো! হোমটাস্ক করাতে গেলে রোজই বলত, হোমটাস্ক? সে তো কখন হয়ে গেছে, স্কুল থেকে ফেরার পরই তো দাদুর সঙ্গে একটু গল্প হল, তারপর দাদুই হোমটাস্ক করিয়ে দিল। বিশ্বাস করিনি, কিন্তু খাতা খুলে দেখলাম সত্যিই হোমটাস্ক করেছে এবং ভুল-টুলও নেই। কী হচ্ছে এসব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভয়-ভয় করত। একদিন বলল, আজ টিফিনে একটা ইঁদুরে খাওয়া কলা দিয়েছিলে কেন মা? কলাটা খেতে যাচ্ছিলাম তখন দাদু বলল, ওটা ইঁদুরে কেটেছে, খাস না, খেলে অসুখ করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, দাদু কি স্কুলেও তোর কাছে যায়! বলল, সব সময়ে যায় না, মুশকিল-টুশকিল হলে যায়। আমরা অনেক বারণ করা সত্ত্বেও ও কিন্তু ওর দাদুর ঘরেই থাকত। অন্য ঘরে যেতে চাইত না। প্রায়ই শুনতে পেতাম খুব ভোরবেলা কাকে যেন বলছে, ওঃ আর-একটু ঘুমোতে দাও না দাদু, প্লিজ! আচ্ছা, আর দশ মিনিট! শেষপর্যন্ত আমরা সাইকায়াট্রিস্টের কাছে যাইনি। আমি নিজেও খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ নই। আমার মা-বাবা বলত আমি নাকি খুব ভাবের ঘোরে চলি, চেনা রাস্তা ভুলে অচেনা রাস্তায় চলে যাই, সব সময়ে কী যে আবোল তাবোল ভাবি, যার কোনও মাথামুন্ডু নেই। বহুবার হয়েছে ঘরে চাবি রেখে দরজা টেনে দিয়ে চলে গেছি। পার্স ফেলে বেরিয়ে গেছি হয়তো কেনাকাটা করতে। আমাকে এর জন্য বহুবার অপ্রস্তুত হতে হয়েছে এবং এখনও হয়। নীলাঞ্জন আমাকে বুঝিয়েছিল, মেয়ে আমার মতোই ইমাজিনেশনের জগতে বাস করে, তাই এক ভারচুয়াল দাদুকে বানিয়ে নিয়েছে। আমার অবশ্য তা মনে হয়নি, কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম। একদিন আমার এক বান্ধবী তার বর আর ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল। ছেলেটার বয়স সতেরো-আঠারো, খুব স্মার্ট, ভাল ছাত্রও। দাবা বোর্ডটা দেখে বলল, দাবা কে খেলে? আমি বললাম আমার শ্বশুরমশাই ভাল দাবাড়ু ছিলেন বলে শুনেছি, এখন কেউ খেলে না। আমার মেয়ে ফোঁস করে উঠল, কেন, আমি তো খেলি। মেয়ের বয়স তখন আট সাড়ে আট। বান্ধবীর ছেলে শুনলাম আলেখিন চেস ক্লাবে দাবা খেলে এবং ভালই খেলে। দু’জনে দাবা খেলতে বসে গেল দিব্যি। আমরা গল্প করছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ছেলেটা অবাক গলায় বলল, আরে, তুমি তো প্রফেশনালদের মতো খেলো! শেষে হেরে গিয়ে ছেলেটা বলল, আন্টি, ইলিনাকে আমাদের ক্লাবে ভর্তি করে দিন। ও কিন্তু খুব ট্যালেন্টেড। আমি দাবার ঘুঁটিই চিনি না আর নীলাঞ্জন দাবা খেলার সময়ই পায় না, তা হলে ইলিনাকে দাবা শেখাচ্ছে কে! ইলিনা অবশ্য জিজ্ঞেস করলেই বলে, দাদুই তো শেখায়। কিন্তু সেটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার অবিশ্বাসই-বা করি কী করে বলুন! আমাদের এক প্রতিবেশী মিসেস গাঙ্গুলি আমাকে বলতেন, হ্যাঁ গো তামসী, তোমার মেয়েটাকে প্রায়ই দেখি রাস্তা দিয়ে একা-একা কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরে, তুই কার সঙ্গে কথা কইছিস? একগাল হেসে বলল, দাদুর সঙ্গে। কী ব্যাপার বলো তো! কী বলি বলুন তো, আমিই কি জানি! কিন্তু ফেজটা একদিন হঠাৎ করে কেটে গেল। যেদিন ওর মেনস্ট্রুয়াল ব্লিডিং শুরু হল সেদিন থেকেই দাদু আর আসত না। আর তখন থেকেই মেয়ে পাগল-পাগল। আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করত, দাদু আসছে না কেন বলো তো মা! দাদুর কী হল? আমি বুঝিয়ে বললাম, যতদিন তুমি ছোট ছিলে ততদিন দাদু তোমাকে গার্ড দিতেন, এখন তো তুমি অ্যাডাল্ট হয়েছ, তাই দাদু এবার একটু রেস্ট নিচ্ছেন। কিন্তু মেয়ে বুঝতে চাইত না। খুব কান্নাকাটি করত। তারপর কান্না থামল বটে, কিন্তু কেমন যেন মেলাংকলিক হয়ে গেল। হাসে না, কথা কম বলে, গুম হয়ে থাকে। আর শুরু হল আমাদেরও অধোগতি। নীলাঞ্জনের ব্যাবসা মার খাচ্ছিল, একজন পার্টনার ক্যাপিটাল তুলে গুটিয়ে নেয় আর আমার চাকরিও যায়। আমি টেনশন নিতে জানি না, অল্প বিপদেই ভীষণ আপসেট হয়ে পড়ি, আমার মনের কোনও জোরই নেই। আর একসঙ্গে এতগুলো খারাপ ঘটনা সহ্য করার ক্ষমতাই আমার নেই। আমার মেয়ের সামনেই ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, নীলাঞ্জনের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভাল ছিল না। নীলাঞ্জন প্রচণ্ড ড্রিংক করত, ভীষণ উওম্যানাইজ়ারও ছিল। বেশ কয়েকবার খবর পেয়েছি, অফিসের কোনও মহিলা এমপ্লয়ির সঙ্গে সিঙ্গাপুর বা হংকং-এ গেছে, আর কারও সঙ্গে হয়তো ব্যাংকক বা দুবাই। কিছু বলতে গেলে প্রচণ্ড ঝগড়া করত, গায়ে হাতও তুলত যখন-তখন। আমার উপায় থাকলে আমি হয়তো ডিভোর্সের চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমার বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না, আমার বিয়ের দু’বছর পরেই বাবা মারা যান। তাঁর প্রপার্টি তেমন কিছু ছিল না। একটা ফ্ল্যাট ছিল আর প্রভিডেন্ড ফান্ডের অল্প কিছু টাকা। ফ্ল্যাট বিক্রি করে সব টাকা নীলাঞ্জনের ব্যাবসায় লাগানো হয়েছিল, সঙ্গে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও। বদলে আমাকে কোম্পানির পার্টনার করা হয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু ওই ব্যাবসার কিছুই আমি বুঝতাম না। নীলাঞ্জন বোঝানোর চেষ্টাও করেনি। আমাকে যদি আপনার বোকা বলে মনে হয়ে থাকে, তা হলে আমি বলেই দিচ্ছি যে, আমি সত্যিই বোকা, খুব বোকা, যতটা আপনি ভাবছেন তার চেয়েও বেশি বোকা। নীলাঞ্জনের ওপর হান্ড্রেড পারসেন্ট নির্ভর করা ছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না। নীলাঞ্জন অবশ্য আমাদের জন্য প্রচুর খরচ করত একসময়ে। তখন সুখেই থেকেছি। ব্যাবসা যখন ডোবার মুখে, তখন হারাধন নায়েক অনেকটা ত্রাণকর্তার মতো এসেছিলেন। আগে থেকে চেনা ছিল। নীলাঞ্জনের বেশ ভাল বন্ধুই ছিলেন তিনি। বিপদের দিনেও তিনি এসে পাশে দাঁড়ালেন, বেশ অনেক টাকা ঢাললেন বলেও খবর পেলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল নীলাঞ্জন খুব খুশি নয়। বাড়িতে ফিরে মনখারাপ করে বসে থাকত আর বেসামাল ড্রিংক করে যেত। কানাঘুষো শুনেছি, কোম্পানি হাতবদল হয়ে গেছে। নীলাঞ্জন হয়ে গেছে কোম্পানির এক কর্মচারী মাত্র। তার বেশি কিছু নয়।
“নীলাঞ্জনের মৃত্যুটা নিয়ে একটু কানাঘুষো আছে। অনেকে বলে ওকে খুন করা হয়েছে। আমি জানি না ঠিক কী ঘটেছিল। তবে এটা জানি যে, ও ইদানীং এতটাই ড্রিংক করত যে, এরকম মৃত্যু হতেই পারে। আবার খুনও হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মোটিভ তো একটা থাকবে! ওর তো আর কিছুই ছিল না, না টাকা, না ক্ষমতা। ওকে মেরে কার কী লাভ! এক হতে পারে কারণটা আমি। মিস্টার নায়েক আমাকে দখল করার জন্য ওকে সরিয়ে দিয়েছেন, এমন সন্দেহ কারও-কারও আছে বলে শুনেছি। হতেও পারে, না-ও হতে পারে। পুলিশ কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে করেছিল। আমি মিস্টার নায়েকের প্রতি কোনও দুর্বলতা কখনও ফিল করিনি। তবে আমার দুঃসময়ে তিনি পাশে না দাঁড়ালে আমি হয়তো পাগল হয়ে যেতাম। শুধু আমি নয় আমার মেয়েটাও। ও আমার মতোই দুর্বল মনের মেয়ে, সহজেই ভেঙে পড়ে। তখন আমাদের টাকা নেই, শ্বশুরের তৈরি বাড়িটাও বাঁধা রেখেছিল নীলাঞ্জন, সুতরাং আমাদের আশ্রয়ও নেই। কোথায় যাব মেয়েটাকে নিয়ে, কী হবে আমাদের, এই চিন্তায় দিশাহারা, নীলাঞ্জনের জন্য শোকও একটু হয়েছিল, কিন্তু ও যেভাবে আমাদের দু’জনকে পথে বসিয়ে গেছে, তাতে শোকও তেমন উথলে ওঠেনি। মেয়েটা অবশ্য বাবার জন্য খুব কেঁদেছিল। মিস্টার নায়েক কিছুদিন ধরেই আমার কাছ এসে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম উনি ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন। কিন্তু তখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থা আমার নয়। একা হলে আমি হয়তো আত্মহত্যাই করতাম তখন, কিন্তু মেয়েটা তো রয়েছে, টিনএজার মেয়ে, তাকে তো ভাসিয়ে দিয়ে যেতে পারি না। মিস্টার নায়েকের ধৈর্য কম, কিছুদিন পরে একদিন এসে তিনি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। উনি ওঁর স্ত্রীকে ডিভোর্স করার মামলাও দায়ের করেছেন, এটা আমি জানতাম। আমি দেখলাম ভালবাসা-টাসা নিয়ে মাথা ঘামানোর আর মানে হয় না। রোমান্টিক হওয়ার বয়স বা পরিস্থিতিও আমার নয়। শুধু বেঁচে থাকা আর মেয়েটাকে রক্ষা করার জৈব তাগিদে আমি রাজি হতে দ্বিধা করিনি। স্বীকার করতে হবে মিস্টার নায়েক আমাকে ঠকাননি। এই ফ্ল্যাটটা উনি মিস্টার জানার কাছ থেকে কেনার জন্য ডিল করেছিলেন এবং সেটা আমার নামেই। তবে ঝানু লোকের সঙ্গে আমি তো বুদ্ধির লড়াইয়ে পারব না। কিন্তু মিস্টার নায়েকের সঙ্গে এই নতুন সম্পর্কের প্রস্তাবে আমার মেয়ে ভীষণ খেপে গিয়েছিল। অন্নজল বন্ধ করে ঘরে দোর দিয়ে, কেঁদে ভাসিয়ে দিত। পাগলের মতো চিৎকার করে বলত, তুমি কীভাবে এটা করতে পারো? আমি তোমাকে মা বলে মানতেই পারছি না আর। সে যে কী অশান্তি তা বোঝাতে পারব না। আমিও ভেঙে পড়েছিলাম খুব। আমাদের জীবনটা যে আর আগের মতো নেই, আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো যে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আর নেই, সেটা বুঝতে ওর সময় লাগল। এখন অন্যের ইচ্ছেতেই চলা ছাড়া আমাদের যে উপায় নেই সেটা জানান দিতে লাগল আমাদের খিদে, আমাদের নানা ছোট-বড় প্রয়োজন, আমাদের রকমারি অভাব, আর চারদিকের খাঁ খাঁ করা নেই-নেই শূন্যতা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নোটিস তো এলই, একদিন কয়েকটা গুন্ডা ছেলে এসে বলে গেল, মানে-মানে উঠে না গেলে তারা কী কী করতে পারে। তাতে রেপ করার হুমকিও ছিল। আরও অনেক খারাপ কথা, যা আমি জন্মেও শুনিনি। এরকম কথাও যে আছে বা হয় তাও জানা ছিল না। আমরা মা-মেয়ে ভয়ে যেন পুঁটুলি পাকিয়ে গেলাম। আমার মেয়ে একদম হতবাক হয়ে রইল কয়েকদিন। যেন বোবাকালা জড়বুদ্ধি। তারপরও যে মত দিল তা নয়। শুধু একদিন বলল, তুমি যা খুশি করতে পারো, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এক বন্ধুর বাড়িতে দু’দিন কাটিয়েও এল। অবশেষে মিস্টার নায়েকের সঙ্গে আমরা একদিন এই সুন্দর ফ্ল্যাটটায় চলেও এলাম। বলতে নেই, মিস্টার নায়েক আমাদের অ্যাফ্লুয়েন্সের মধ্যেই রেখেছেন। জিনিসপত্রের অভাব রাখেননি, ইচ্ছেমতো খরচ করার ব্যবস্থা করেছেন, মেয়ের স্কুলে যাওয়ার জন্য গাড়ি, আমার নামে ডেবিট কার্ড। বেড়াতে নিয়ে যেতেও চাইতেন। সব হল, কিন্তু অ্যাফ্লুয়েন্স উপভোগ করার জন্য একটা ইচ্ছুক মনও তো দরকার। আমাদের মা-মেয়ের তো সেটাই ছিল না। সম্পদের মধ্যে দুই বিষণ্ণ রমণী বাস করছি মাত্র। এলিয়েনের মতো। সমর বসুকে আমি মিস্টার নায়েকের লোক বলেই মনে করতাম। দু’জনে বাল্যবন্ধু, অনেক দিনের সম্পর্ক। দু’জনের মধ্যে খুব ভাব। সমরবাবু ডাকঘরের পিয়ন ছিলেন। সমরবাবু ওঁর বন্ধু হলেও মানুষটি এত নিরীহ আর ভদ্র যে, আমার ওঁকে বেশ ভাল লাগত। উনি এসে বন্ধুর সঙ্গেই কথাবার্তা বলতেন বটে, কিন্তু আমার সঙ্গেও যাওয়ার সময় খানিকক্ষণ গল্প করে যেতেন। আমি ওঁকে চা খাওয়াতাম। উনি যখন থাকতেন না, তখনও মাঝে-মাঝে এসে বসে গল্প করে যেতেন। একদিন হঠাৎ বললেন, হারুর ট্র্যাপে পড়েছেন, বুঝতে পারছি। পাওনাগন্ডা আদায় করে নেবেন কিন্তু। ও সোজা পাত্র নয়। আমি থতমত খেয়ে বললাম, ওসব তো আমি বুঝি না, কী করতে হবে তাও জানি না। আশ্রয়ে আছি, এইটুকু শুধু জানি। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনাকে দেখে সেটাই মনে হয় বটে। আপনি ওর সঙ্গে পারবেন না। আমি খুব সামান্য মানুষ, দুর্বলও বটে। আমার কোনও স্টেটাসও নেই, কিন্তু আমি কখনও আমার এই ধনী বন্ধুর কোনও অনুগ্রহ নিইনি। কোনও সুবিধে নেওয়ার চেষ্টাও করিনি কখনও, শত অভাবেও নয়। কাজেই ওর কাছে আমার কোনও দায় নেই। আপনার কোনও সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন। আমি ওর সব দোষ-দুর্বলতার খবর রাখি। সব রন্ধ্র জানি। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ওঁকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কি না তাও জানি না। আর-একদিন বললেন, ডিভোর্সের আইন মেয়েদের প্রতি সদয়, কমলিকা ডিভোর্স দিতে চায় না, ফলে মামলা অনন্তকাল গড়িয়ে যাবে, আপনি হারুর বউয়ের মর্যাদা হয়তো কোনওদিনই পাবেন না। ফলে ওর কোনও উত্তরাধিকারও নয়। ভেবে দেখেছেন? আমি মাথা নাড়া দিয়ে বললাম, ভেবে কী করব বলুন, এর সমাধান তো আমার হাতে নেই। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক কথা। কিন্তু আমাদের হাতে যেটুকু আছে সেটুকু তো কাজে লাগানো যায়। দাঁড়ান, আমিও একটু ভেবে দেখি।
“আমার আর মিস্টার নায়েকের সম্পর্ক মোটে চার মাসের। লোকটাকে আমি তখনও ঠিক চিনে উঠতে পারিনি। এমনিতে ঠিকই আছেন, একটু মদ খাওয়া বা পার্টি করাটা কিছু খারাপ ব্যাপারও নয়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ত উনি আমার মেয়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন, সেটা খাবার টেবিলেই হোক বা একসঙ্গে কোথাও যাওয়ার সময়েই হোক। পুরুষদের মনে দুষ্টুমি তৈরি হলে সেটা চোখেও উঠে আসে, আর মেয়েরা ওই চোখ খুব চেনে। আমার বুক দুরদুরুনির সেই শুরু। লোকটাকে শাসন করার সাধ্য তো আমার নেই। কী করব তবে? ভাবলাম কোনও হস্টেলে যদি পাঠিয়ে দিই! কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব! তার জন্যও তো মিস্টার নায়েকের সম্মতি চাই। তারপর দেখলাম উনি আমার মেয়ের সঙ্গে ভাব করার জন্য দামি উপহার দেওয়া শুরু করলেন, সিনেমা বা জলসা বা নিকো পার্কে নিয়ে যেতে চাইতেন। আমার মেয়ে রাজি হত না এবং উনি বেশ হতাশ হতেন, রেগেও যেতেন। তারপরই ক্রমে আবরু খসতে লাগল, একদিন লং ড্রাইভে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি। মেয়ে শক্ত হয়ে রইল, লোকটাকে ও আগাপাস্তলা ঘেন্না করত। সেদিনই রাতে মাতাল হয়ে ফিরে, আমাকে সোজা বললেন, তোমার মেয়েটাকে আমার কাছে আসতে বলো। আজ রাতে ও আমার কাছে থাকবে। রীতিমতো হুকুম। আমার ইচ্ছে হয়েছিল, লোকটাকে একটা থাপ্পড় মেরে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যাই। তাই যদি পারতাম, তা হলে আর এত ভোগান্তি কেন বলুন! মেয়ে সব সময় নিজের আলাদা ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকত। এই ব্যাপারটা শুনতে পায়নি। তা হলে ভয়ে বোধ হয় হার্টফেল করত। আমি রেগে গিয়ে সেদিন একটু ঝগড়া করেছিলাম, বোধ হয় বলেছিলাম পুলিশের কাছে যাব। তাতে একটু সামলে গেলেন। কিন্তু পুরুষের প্যাশন ভয়ংকর জিনিস। সেটার জন্য বহুদূর যেতে পারে। উনি এরপর থেকে নানা উৎপাত শুরু করেন, আমার মেয়ের ঘরের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দেওয়া, ভয় দেখানো, অনুনয়-বিনয় করা। তবে রক্ষা যে এটা শুধু মাতাল অবস্থাতেই করতেন, সোবার থাকলে নয়। তখন শুধু চোরা, লোভাতুর চাউনি। একদিন ব্যাপারটা আমি সমরবাবুকে বলে ফেলি। উনি খুব মন দিয়ে শুনলেন, তারপর বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। হারু তার সব সীমা লঙ্ঘন করেছে, এটা ঘোর অন্যায়। আমার কাছ থেকে টাকাপয়সার হিসেব চাইলেন, আমার কী কী আছে বা নেই। তারপর চলে গেলেন। আমার যে খুব একটা ভরসা হল তা নয়। রোগা ছোটখাটো চেহারার একজন মানুষ, সম্বলহীন, মিস্টার নায়েকের সঙ্গে পাল্লা দেবেন কী করে? দিন দুই পরে এলেন, যখন মিস্টার নায়েক বেরিয়ে গেছেন, মেয়েও স্কুলে। এসে বললেন, আমি সব খোঁজখবর নিয়েছি, এই ফ্ল্যাটটার জন্য হারু প্রায় সব টাকাই দিয়ে ফেলেছে, সামান্য কিছু বাকি আছে। আমার মনে হয় হারু ফ্ল্যাটটা দিতে দেরি করবে না। ওর স্বার্থ আছে। তখন ফ্ল্যাটের জন্য আমি চিন্তা করছিলাম না, আমি তখন আমার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভীষণ আপসেট। তাই বললাম, আমি ফ্ল্যাট চাই না, মেয়েকে নিয়ে পালাতে চাই। উনি খুব করুণ মুখে বললেন, কোথায় যাবেন? দেশে হারুর অভাব নেই। এক হারুর কাছ থেকে পালিয়ে আর এক হারুর পাল্লায় পড়ে যাবেন। আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারছেন না ঠিকই, কেউই করে না। আমি তো কোনও হিরো নই, তবে হারুর অন্ধিসন্ধি আমি জানি। এটুকুই যা ভরসা। আশ্চর্য ঘটনা হল, মিস্টার নায়ক মৃত্যুর তিনদিন আগে আমাকে নিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করিয়ে দিলেন। দলিলটা অবশ্য ওঁর কাছেই রেখে দিলেন। পরে সমরবাবু আমাকে বললেন, আপনি তো সোজা সরল মানুষ, হারুকেও চেনেন না, ফ্ল্যাটটা যে রেজিস্ট্রি করে দিল তার কারণ জানেন? এটা হল সাদা কথায় ঘুষ। আপনি তো নিশ্চই বোঝেন যে, ঘুষ মানুষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়, তার প্রতিরোধের শক্তি হরণ করে। আপনি দুর্বল হয়ে পড়লে আপনার কচি মেয়েটির দখল নেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। আমি ওর স্ট্র্যাটেজিগুলো জানি। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, কী সর্বনাশ ! আমি এই ফ্ল্যাট চাই না তো! আজই মিস্টার নায়েককে বলে দেব ফ্ল্যাট উনি ফিরিয়ে নিন। উনি হাত তুলে বললেন, আবার বলছি, আপনার আর আপনার মেয়েটির যাতে বিপদ না হয় তা আমি দেখব, আর-একটু সময় দিন। আমি দুর্বল মানুষ, একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমার তো একটু সময় লাগবেই। কথাটার মানে আমি বুঝলাম না, কী সিদ্ধান্ত, কেন সিদ্ধান্ত তা তো জানি না। ভরসাও হল না। তবে অপেক্ষা করা ছাড়া আমি আর কী-ই বা করতে পারি! যেদিন উনি মারা যান তার আগের দু’দিন উনি আমাদের সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন। বেশি মদ খাননি, অনেক গল্প-টল্প করেছেন। আমার মেয়েকে বললেন, ভাল করে লেখাপড়া করো, আমি তোমাকে বিদেশে লেখাপড়া করতে পাঠাব। সেটাও ওঁর স্ট্র্যাটেজি কি না কে জানে। আমাকে বললেন, তোমার ফ্ল্যাটটা এবার একজন ইন্টিরিয়র ডেকরেটরকে দিয়ে সাজিয়ে দেব। আমরা এসব মনভোলানো কথায় অবশ্য বিপদের আঁচই পাচ্ছিলাম। যেদিন মারা গেলেন সেদিন সারারাত ওঁর সাউন্ড স্লিপই হয়েছে। পাশে শুয়ে আমি তো অন্তত কোনও অস্বাভাবিকতা টের পাইনি। ভালই ছিলেন। সকালে আমি রোজই ওঁকে বেড-টি নিজেই করে দিতাম, সেদিনও দিয়েছি। উনি চা খেলেন, একটু হাসিঠাট্টাও করেছিলেন, মনে আছে। মুড বেশ ভাল ছিল। তারপর কাজের মেয়েরা এল আর আমিও গেরস্থালি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সমরবাবু সেদিন হঠাৎ সকালেই এসে হাজির। ওঁর অবশ্য আসার কোনও বাঁধা সময় ছিল না, তবে সকাল সাড়ে আটটা-ন’টায় কখনও আসেননি। সোজা বন্ধুর ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি চা পাঠিয়ে দিলাম, আর কিছু জানি না। বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন। কখন গেলেন তা জানি না। উনি একটু বেলায় ব্রেকফাস্ট খেতেন, সাড়ে দশটা-এগারোটা, লাঞ্চ করতেন না। ব্রেকফাস্ট রেডি করে আমি মিস্টার নায়েককে ডাকতে গিয়ে দেখি উনি তখনও শুয়ে, কাছে গিয়ে গায়ে নাড়া দিয়ে ডাকতে গিয়ে লক্ষ করলাম মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। জ্ঞান নেই বললেই হয়। অস্পষ্ট গলায় একবার যেন বললেন, সমরকে ডাকো। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। সমরবাবু যখন এলেন তখন উনি নিথর হয়ে গেছেন। সমরবাবু ওঁর নাড়ি দেখলেন, বুকে হাত দিয়ে দেখলেন, শ্বাসও চলছিল না। সমরবাবু একদম পাথরের মতো বসে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বিড়বিড় করে বারবার বলতে লাগলেন, একটু আগেও তো ছিল, একটু আগেও তো ছিল। এখানে আমরা নতুন। মিস্টার নায়েকের বাড়ি সল্ট লেকে। আমাদের বাড়ি ছিল বেলেঘাটা। এখানকার ডাক্তার-বদ্যি কাউকে চিনি না। সমরবাবুই একজন ডাক্তারকে ফোন করে আনালেন। তিনি এসে দেখে বললেন, উনি মারা গেছেন। আমি এতটাই বিভ্রান্ত ছিলাম কিছুই তেমন করে লক্ষ করিনি। কী যে সব হচ্ছিল, সমরবাবু না থাকলে আমি অথই জলে পড়তাম। বান্টিবাবু এখানকার নেতাগোছের লোক, মিস্টার নায়েকের বন্ধু, এই ফ্ল্যাটটাও ওঁরই জোগাড় করা। সমরবাবু তাঁকেও খবর দিয়ে আনালেন। মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, কী কারণে তাও আমি বলতে পারব না। মিস্টার নায়েকের সঙ্গে আমার তো সেরকম ঘনিষ্ঠতা নয় যে, ওঁর সব খবর রাখব! ওঁর কী অসুখ ছিল, কী ওষুধ খেতেন তাও আমি ভাল জানি না। ওঁর নিজের ওষুধের দোকান থেকেই ওষুধ আসত দেখেছি। মৃত্যুর পর ওঁর ঘরে গিয়ে দেখলাম সমরবাবু বন্ধুকে প্রায় আঁকড়ে বসে আছেন, খুব যত্ন করে তুলোর প্যাড দিয়ে মুখের গ্যাঁজলা মুছিয়ে দিচ্ছেন। মৃত্যুর পরবর্তী সিনারিওতে আমার বা আমার মেয়ের কোনও ভূমিকাই নেই। বান্টিবাবু আর সমরবাবুই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়েছিলেন। আমরা শুধু দর্শক। ওঁর স্ত্রী বা ছেলেদের কেন সময়মতো খবর দেওয়া হয়নি তাও আমি জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম ওঁর স্ত্রী আর ছেলেদের ওপর বান্টিবাবু বা সমরবাবু কেউই খুশি ছিলেন না। ওঁর স্ত্রী নাকি ওঁকে গুন্ডা লাগিয়ে খুন করারও চেষ্টা করেছিলেন। ছেলেরা ওঁর মুখদর্শন করত না। মিস্টার নায়েক নাকি বান্টিবাবুকে বলেছিলেন, আমার ভালমন্দ কিছু হলে আমার বউ-ছেলে কালীঘাটে পুজো দেবে। ওঁর ক্রিমেশন হয়ে গেল, আমরা ঘটনাটায় এত হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে, আমাদের কী করা উচিত তা বুঝতে পারছিলাম না। উনি আমাদের আত্মীয় নন, হৃদয়গত সম্পর্কও হয়ে ওঠেনি, ওঁর মৃত্যুতে আমাদের অশৌচও পালন করার নেই, শোকও হচ্ছে না, কিন্তু একটু ভয় হচ্ছিল। অজানা ভয়। এবার কী হবে, কিছু খারাপ ঘটবে না তো! আর সেটাই ঘটল। হঠাৎ খবর পেলাম ওঁর স্ত্রী খুনের মামলা করেছেন। আমি আর আমার মেয়ে মিলে নাকি ওঁকে খুন করেছি। তিন-চার দিন পরে সকালের দিকে দু’জন পুলিশ অফিসার এসে আমাদের অনেক জেরা করলেন। ওঁর মৃত্যুর খবর কেন ওঁর পরিবারকে জানানো হয়নি, মৃত্যু কীভাবে হল, কে সামনে ছিল, উনি কী কী ওষুধ খেয়েছিলেন, আমি ওঁর কে হই, কেন ওঁর সঙ্গে অবৈধভাবে থাকতাম, আমার স্টেটাস কী, ভাড়াটে মেয়েমানুষ কি না, ফ্ল্যাটটা কার নামে, ডাক্তার রায়কে কত টাকা দিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট আদায় করা হয়েছে, আমি ওঁকে ব্ল্যাকমেল করতাম কি না, ফ্ল্যাটটা আমার নামে রেজিস্ট্রি হওয়ার ঠিক পরেই ওঁর মৃত্যু হল কেন, হঠাৎ আমাদের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে এত টাকা জমা পড়ল কেন, শ্মশানবন্ধু কারা ছিল, আমি এ লাইনে কত দিন আছি, এর আগে আর কারও সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছি কি না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। একই প্রশ্ন একাধিকবার। তারপর তারা ওঁর ঘরে গিয়ে ওষুধপত্র দেখল, কাগজপত্র দেখল, ঘরটা সিল করে রেখে গেল। আমার মেয়েকেও বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করেছে, তার মধ্যে একটা ছিল, মিস্টার নায়েককে ও বাবা বলে ডাকত কি না, কী বলে ডাকত এবং রিলেশন কেমন ছিল। শেষে আমাকে বলল, আপনি নিজেকে যতটা ইনোসেন্ট দেখাতে চাইছেন, আপনি কিন্তু ততটা ইনোসেন্ট নন। আরও ইন্টারোগেশন হবে, তৈরি থাকবেন। পরশুদিন আবার এসেছিল। ফ্ল্যাটের কাগজপত্র দেখতে চাইল। আমি বললাম আমার কাছে কিছু নেই, সব ওঁর ঘরে। আমার স্বামী নীলাঞ্জন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল, সুইসাইড না মার্ডার, রিলেশন, লাভ ট্রায়াঙ্গাল কি না, অনেক কিছু। খেই হারিয়ে ফেলছিলাম, জীবনে এত কঠিন পরীক্ষা তো দিতে হয়নি। আর এত অপমান! তবে আমি যা করেছি, যে সব ভুল, তাতে আমার জীবন তো সুখের হওয়ার কথা নয়। অপমানের জন্য তৈরি থাকতেই হবে। মোটামুটি কলগার্ল বা বেশ্যার ছাপ্পা অলরেডি লেগেই গেছে গায়ে। এখন খুনির ছাপ্পাটাও বোধ হয় বাকি থাকবে না। আমার বয়স এখন একচল্লিশ, মনে হচ্ছে একাশি। নিজের যা হোক, আর ভাবছি না, শুধু মেয়েটার জন্যই যা কিছু চিন্তা। আমার জেল হলে ওর কী হবে। এই ফ্ল্যাটটাও নাকি ওরা দাবি করবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের আশ্রয়ও থাকবে না। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হবে বলে শুনছি। আমরা প্রায় রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। শুনলাম মিস্টার নায়েকের ঠোঁট নাকি নীল হয়ে গিয়েছিল আর মুখে বাবলও ছিল। আমি জানি না, ডেডবডি আমি ভাল করে দেখিনি। বিষ যদি উনি খেয়েও থাকেন সেটা আমার দেওয়া নয়। তবে আমার কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন। লোকের চোখে আমার আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কেন আপনাকে এত কথা বলছি জানি না। আপনাকে তো আমি একবার মাত্র দেখেছি, মিস্টার নায়েকের ডেডবডি ক্রিমেশনের জন্য নিতে এসেছিলেন, খুব লম্বা একটি ছেলে। নামও জানতাম না। সমরবাবু বললেন, আপনি একজন ভাল লোক। তাই হবে। আপনার মুখ দেখে ভালমানুষ বলে মনে হয়। আর তাই বোধ হয় অনর্গল এত কথা আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। আজকাল একজন ভাল লোকের দেখা পাওয়াটাও ভাগ্যের কথা। আমি আজকাল যার দিকে তাকাই তাকেই ভয় পাই। কারও চোখে রাগ, কারও চোখে ঘেন্না, কারও চোখে সন্দেহ, কারও চোখে কাম। এই যে আপনার সামনে বসে আছি, আমি আর আমার মেয়ে, আমার কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না। ইউ হ্যাভ আ গুড ভাইব্রেশন।”
আলুথালু দু’জন মহিলা ডিভানের ওপর গায়ে-গায়ে বসে আছে। মেয়েটার পরনে আজও সাদা একটা লম্বা নাইটির মতো কিছু, যেটা ময়লা হয়ে গেছে, ব্রাউনরঙা চুল এলোথেলো, কোনও সাজ নেই, দু’খানা নীলচে চোখে অতলান্ত ভয়, আর তামসীও একটা ইস্তিরিহীন ফ্যাকাসে গোলাপি রঙের হাউসকোট পরে আছেন, চিরুনিহীন চুল যথেচ্ছ প্রলম্বিত, চোখে এক অসহায় বৈরাগ্যের দৃশ্যহীন দৃষ্টি। ডান হাতটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে যক্ষিবুড়ির মতো। বাঁ হাত কোলের ওপর, শিথিল করতলে ধরে রাখা একটা নিশ্চুপ মোবাইল ফোন, যেটাতে গত চল্লিশ মিনিটেও কোনও কল আসেনি। মেয়েটি যৌবনের চৌকাঠে, তামসী যৌবনের প্রান্তিক রেখায়, তবু যেন মনে হচ্ছে দু’জনকেই ছেড়ে গেছে তাদের ফলন্ত বয়স। শীতের রিক্ততা তাদের সর্বাঙ্গে।
রজত কথা খুঁজে পাচ্ছিল না, যেমনটা তার প্রায়ই হয়ে থাকে। কথার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের আড়াআড়ি। এক-এক সময় তার মন বোবা হয়ে যায়, সেখানে কোনও কথার বুদ্বুদ ভুড়ভুড়িই কাটে না। ভিতর তখন সাইলেন্স জ়োন। একটা বাক্য তৈরি করার চেষ্টা করছিল সে, পুরনো দিনের টাইপ সেটিং কম্পোজ়িটারদের মতো, অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে, কিন্তু কোনও অর্থবহ বাক্য তৈরি হল না তো! মেয়েটা, ইলিনা, তার মধুরঙা চুল আর মায়ের কাঁধের আড়াল থেকে একটুখানি মুখ বের করে চেয়ে আছে তার দিকে, সেই কখন থেকে, একদৃষ্টে। একটাও কথা বলেনি।
অবশেষে তার মুখ দিয়ে যে বাক্যটা বেরোল সেটা তার বলার কথাই নয়, সেটা অনেকটাই অর্থহীন, তার ইচ্ছাকৃতও নয়। সে খুব মৃদু স্বরে বলল, “কিচ্ছু হবে না। দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তামসী করুণ, শুষ্ক ও সুন্দর মুখখানা তুলে বললেন, “আপনি বলছেন! জানি না কী করে এত সমস্যা মিটে যাবে! আপনি ভাল মনের মানুষ, তাই বললেন! এ কথাটাও তো কেউ বলে না!”
যখন উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে তখন হঠাৎ, আচমকা তার সরু পাখির মতো গলায় মেয়েটা, ইলিনা বলল, “তোমার ফোন নম্বরটা আমাকে দেবে?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!”
গুড্ডু বলে, “পলিটিশিয়ানদের মুখে কোনও এক্সপ্রেশন থাকে না, বুঝলি। প্র্যাকটিসের ব্যাপার। লোকে যদি তোর মুখ দেখে মনের ভাব বুঝেই যায়, তা হলে আর তুই কিসের ডিপ্লোম্যাট? বান্টি নস্করকে দেখ, বাড়িতে আগুন লাগলেও বান্টি নস্করের মুখে কোনও ভাবান্তর পাবি না।”
গুড্ডু ভাবী পলিটিশিয়ান, বান্টিদার চেলা এবং ভাবশিষ্য। পদে পদে বান্টি নস্করকে নকল করতে করতে গুড্ডুর হাঁটাচলা, কথার স্টাইল, মুদ্রাদোষ অবধি বান্টিদার মতো হয়ে যাচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক যে, বান্টি নস্করের মুখে কোনও এক্সপ্রেশন নেই। মুখটা থোম্বামতো, নাকটা ভুঁড়ো, পুরু ঠোঁট, চোখে কোনও ভাষা নেই। ভাবলেশহীন। পিকাসোর ছবি, লতা মঙ্গেশকরের গান, কেষ্টনগরের সরভাজা বা টাইগার হিলের সূর্যোদয় সবকিছুতেই সমান ডিটাচমেন্ট অতি বিরল গুণ, যা বান্টি নস্করের আছে। গুড্ডু ভুল বলে না।
সব শুনে গুড্ডু বলল, “সামনে বাই ইলেকশন, তারপর মিউনিসিপালিটির ভোট, পার্টির জ়োনাল কমিটির কনভেনশন, বান্টিদা এখন কি পুলিশ কেসে নাক গলাতে পারে, প্রোটোকল বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! পলিটিশিয়ানদের অনেক ক্যালকুলেশন করে পা ফেলতে হয়। তামসী ম্যাডাম বান্টিদাকেও ফোন করেছিল, বান্টিদা বলেছে, দেখছি কী করা যায়। চল, বান্টিদা কী বলে শুনে আসি।”
তাই আজ সকালে তারা বান্টি নস্করের অফিসে এসে বসে আছে। বান্টিদা সাইটে গেছে, এল বলে। পাশাপাশি দুটো প্লাস্টিকের চেয়ারে তারা বসা। গুড্ডু বলছিল, “এবার বান্টিদা আমাকে লোকাল কমিটিতে ঢুকিয়ে নিচ্ছে বুঝলি! সামনে অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব। দুঃখ কী জানিস, লাইফটা অন্যরকম হয়ে যাবে, আগের মতো আর কোয়ালিটি টাইমটা পাব না…”
দুঃখটা অবশ্য গুড্ডুর মুখভাবে ফুটে উঠছে না, বরং এই দিনেদুপুরেও ভাঙাচোরা নীরস মুখটা স্বপ্নাতুর হয়ে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে। গুড্ডু স্বপ্নই দেখছে বোধ হয়। এমএলএ হওয়ার স্বপ্ন। শুধু তারই কোনও স্বপ্ন নেই। কেন নেই তা সে বুঝতে পারে না। তার যেন কিছুই হওয়ার নেই, কিছুই অর্জন করার নেই, কিছুই পাওয়ার নেই। বাবা তাকে ইদানীং জোর করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে, ব্যাবসা বোঝানোর চেষ্টা করছে। বাবা বলছে, এটা তোর বাবারও ব্যাবসা, মনে রাখিস। মনে রাখার চেষ্টাও সে করে, হয় না। অচল গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে চালানোর মতো একটা কিছু হয় মাত্র। তার ভিতরে কোনও সেল্ফ স্টার্টার নেই।
বান্টি নস্কর এল। মোটা মানুষ, ঘেমে গেরুয়া পাঞ্জাবিটা গায়ে লেপটে আছে, তলার স্যান্ডো গেঞ্জি অবধি ফুটে উঠেছে, শ্বাস পড়ছে ফোঁস-ফোঁস করে। সঙ্গে দু’জন চেলা বা কর্মচারী কেউ হবে। তারা কিছু কাজের কথা বলে চলে যাওয়ার পর বান্টি তাদের দিকে চেয়ে বলে, “কী রে, তোরা এই সাতসকালে! কী ব্যাপার?”
গুড্ডুই বলল, “বান্টিদা, সেই হারাধন নায়েকের কেসটা নিয়ে কি কিছু হল?”
রিমোটে ঘরের এসিটা এক ঘাট বাড়িয়ে দিয়ে বান্টি বলে, “ও আর কী হবে। হারু বন্ধুমানুষ ছিল বলে যা করার করেছি। কিন্তু কাজটা তো হারু ভাল করেনি। একস্ট্রা ম্যারিট্যাল রিলেশনটা লোকে ভাল চোখে দেখে না। গ্রিন ভ্যালির কয়েকজন তো অলরেডি ওদের ওখানে থাকা নিয়ে আপত্তি তুলেছে। হারুর বউ বড় উকিল লাগিয়েছে বলে শুনছি, পুলিশকেও অ্যালার্ট করেছে। পুলিশ আমার কাছেও এসেছিল। আমি অবশ্য বলে দিয়েছি যে, ফাউল প্লে বলে আমার মনে হয়নি, ইট ওয়াজ় আ নর্মাল ডেথ। হারুর তো অনেকরকম অসুখ ছিল, গাদা-গাদা ওষুধ খেত। মার্ডার চার্জ হয়তো টিকবে না, কিন্তু বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হবেই, কমলিকা সোজা মেয়েছেলে নয়। হারুকে ভাজা-ভাজা করে ছেড়েছে। মরার পরেও শোধ তুলছে। আর হারুও বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। নব্বই লাখ টাকা দামের ফ্ল্যাট, এক কোটি টাকার অ্যাকাউন্ট ট্রানসফার! সোজা কথা! তোরা কি কিছু বলতে এসেছিস?”
গুড্ডু বলল, “না, তেমন কিছু না। পুলিশ কি আমাদেরও জেরা-টেরা করবে নাকি?”
“মনে তো হয় না। মার্ডার চার্জটা স্ট্রং নয়। তবে কিছুই বলা যায় না। জেরা করলে ওই কথাই বলতে হবে, নাথিং অ্যাবনর্মাল। রাজু, তুই কিছু বলতে চাস? শুনলাম, তুই গতকাল তামসীর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলি!”
“হ্যাঁ, বান্টিদা। আমি শ্মশানবন্ধু ছিলাম বলে উনি আমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছিলেন। উনি জানতে চেয়েছিলেন আমরা ডেডবডির কোনও অ্যাবনরম্যালিটি দেখেছি কি না। কারণ, পুলিশ খুন সন্দেহে ওঁদের হ্যারাস করছে। খুব ভয় পেয়েছেন দেখলাম। খুব হেলপলেস।”
বান্টি একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, “হেলপলেস তো বটেই। মেয়েটা হারুর ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিল তো! আমরা পলিটিক্স করি, মাঝে-মাঝে কিছু উলটোপালটা কাজও করতে হয়। কিন্তু হারু ছিল ক্রিমিনাল মাইন্ডেড। প্লেবয়, মেয়েবাজ। আমার সন্দেহ, তামসীর জন্য হারুই নীলাঞ্জনকে খুন করেছিল। এখন তো মেয়েটাকে সাফার করতেই হবে। আমাদের কিছু করার নেই। আর কিছু বলল?”
“না। উনি ধরেই নিয়েছেন যে, পুলিশ ওঁকে অ্যারেস্ট করবে এবং ওঁর মেয়েটা ভেসে যাবে। ওঁর ধারণা যে, ওঁকে সবাই ঘেন্না করছে, ওঁকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। তামসী ম্যাডাম কিন্তু আমার কাছে কোনওরকম হেলপ চাননি। ওঁদের কোনও বাড়িঘর বা সোর্স অফ ইনকাম নেই। ব্যাঙ্ক থেকেও টাকা তোলার উপায় নেই। কারণ, ওঁর কাছে চেকবই বা এটিএম কার্ড নেই। সেসব হারাধনবাবুর ঘরে, আর ঘরটা পুলিশ সিল করে গেছে। ওঁর মেয়েটার বয়স বোধ হয় ষোলো-সতেরো, আনপ্রোটেকটেড। আর ম্যাডামকে যে-কোনও সময়ে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারে। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টও ফ্রিজ হয়ে যেতে পারে। আমার মনে হল ম্যাডাম সব খেলায় হেরে বসে আছেন, টোটাল ডিফিট।”
বান্টিকে একটু চিন্তিত দেখাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ বলল, “রাজু, তুই কি কিছু সাজেস্ট করতে চাস?”
“না বান্টিদা, আপনি তো বলেই দিলেন যে, তামসী ম্যাডাম ওয়াজ় ট্র্যাপড। আমি আর কী বলব! আমার মনে হয়েছে উনি ইনোসেন্ট। তবে সেটা আমার মনের ভুলও হতে পারে।”
বান্টি উদ্গার আর দীর্ঘশ্বাসের মাঝামাঝি একটা শব্দ করল। তারপর বলল, “আবার নতুন করে একটা ফ্যাঁকড়া তুললি। তুই আর-পাঁচটা ছেলের মতো ফচকে নোস, কথাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমি এইসব নোংরামোতে জড়াতে চাইছিলাম না, কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে একবার বোধ হয় তামসীর কাছে যাওয়া উচিত। কী বলিস?”
রাজু বড়-বড় চোখ করে চেয়ে বলল, “যাবেন? গেলে হয়তো আপনার মনখারাপ হয়ে যাবে। আমিও ভাবছিলাম আর ওদের কাছে যাব না, কিছু যখন করতে পারব না, তখন গিয়ে কী লাভ! তা ছাড়া একটা টিনএজার মেয়ে আছে, ঘন-ঘন যাওয়াটা ভাল দেখাবে না।”
না, একথাটা ঠিক নয় যে, বান্টি নস্করের কোনো এক্সপ্রেশনই নেই। আছে। খুব রেয়ার যদিও, তবু বান্টিকে কখনও-কখনও গভীরভাবে চিন্তিত দেখায়। আর, আরও রেয়ার হল বান্টি মাঝে-মাঝে মুচকি হাসে। এই এখন যেমন। বান্টি হাসিটা ধরে রেখেই বলে, “তুই তো জানিস, তোর বাবা সত্যস্যার একসময়ে আমাকে প্রাইভেট পড়াতেন। ওরকম অনেস্ট আর ইমপারশিয়াল লোক বেশি দেখিনি। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তোকে তুলে নিয়ে এসে নিজের ছেলের মতো মানুষ তো করলেনই, যখন বাড়িটা প্রোমোট করার জন্য আমাকে ডেকে পাঠালেন তখন বললেন, রাজুর নামেও একটা ফ্ল্যাট হবে। শুনে আমি ওঁকে একটা প্রণাম করে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, স্যার, আজকালকার পক্ষে আপনি বড্ড বেমানান, তবু বলি, আশীর্বাদ করবেন যেন আপনার মতো এরকম একটা মন আমারও হয়। তুই স্যারের নিজের ছেলে নোস বটে, কিন্তু স্যারের ছায়া আছে তোর ওপর।”
এক সকালে সমর বসু আবার এলেন। সন্ধ্যা এসে খবর দিল, “ও দাদা, দ্যাখো গে সেই সেদিনকার মরকুটে লোকটা আবার এসেছে। ভিতরে আসতে বললুম, কিছুতেই এল না। বলল, ওঁর হয়তো ডিস্টার্ব হবে।”
রজত উঠে গেল। দেখল, সমরবাবু রোগার মধ্যেও আরও একটু রোগা হয়েছেন। সেটা যে সম্ভব সেটা কয়েকদিন আগেকার সমর বসুকে দেখে তার মনে হয়নি। আজ তাই ভারী অবাক হল সে। ভয় হল, আরও রোগা হলে সমর বসু হয়তো অদৃশ্য হয়ে যাবেন। রজত কারও চেহারা নিয়ে মন্তব্য করা পছন্দ করে না।
তাই শুধু বলল, “আসুন। কিছু বলবেন?”
সেই সেদিনকার মতোই ভারী বিগলিত হয়ে, সিঁড়ির গোড়ায় জুতোজোড়া ছেড়ে, তেমনই দু’ পায়ের ফাঁকে ছাতাটি দাঁড় করিয়ে, তাতে দু’টি হাতের ভর দিয়ে, অনুপ্রবেশকারীর মতো সসংকোচে সেই প্লাস্টিকের চেয়ারটাতেই বসলেন।
“আপনাকে নমস্কার জানাতে এলাম। আমার কথায় তো কেউ গুরুত্ব দেয় না, এই আপনি দিলেন, তামসী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করলেন। এ বড় ভাল হল। আপনার উদ্যোগেই বান্টিবাবু তামসীর সঙ্গে দেখা করেছেন, ওঁদের সংকটও হয়তো কিছুটা কেটেছে।”
“সেটা কীরকম?”
“আপনাকে বলেছিলাম, আমার স্ত্রী আমাকে মাঝে-মাঝে নেংটি ইঁদুর বলে উল্লেখ করেন। উপমাটি আমার যথার্থ বলেই মনে হয়। ইঁদুরের মতোই তুচ্ছ প্রাণী বলেই কেউ আমাকে লক্ষ করে না এবং আমি সর্বত্রগামী। তামসীর ওপর পুলিশের সন্দেহ দেখে আমার মনে হয়েছিল সত্যটা এবার উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। তাই মনস্থির করে নিজের অপরাধ কবুল করার জন্য আমি একদিন সকালেই থানায় গিয়ে হাজির হই। বড়বাবুর ঘরে ঢুকে নমস্কার করে আমি বললাম, “স্যার, আমি একটা এজাহার দিতে এসেছি।”
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কীসের এজাহার?”
আমি জোড়হাত করে বললাম, “আমি আমার বন্ধুকে খুন করেছি, স্বীকারোক্তি দিতে চাই।”
উনি বড়-বড় চোখ করে বললেন, “খুন! সে তো কার্ডিনাল অফেন্স! ঠিক আছে, আপনি বাইরের বেঞ্চে গিয়ে বসুন, মহীতোষবাবু এলে এজাহার নেবেন।”
আমি বাইরের বেঞ্চে বসে রইলাম। ঘণ্টা দুই পরে মহীতোষবাবু এলেন। একজন সেপাইকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, মোটাসোটা লোকটিই মহীতোষবাবু। তিনি বড়বাবুর ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ কথা-টথা কইলেন। বেরিয়ে আসতেই আমি দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললাম, “স্যার, আমি একটা খুন করেছি, কনফেশন দিতে চাই।”
উনি একটা ফাইল খুলে কী যেন দেখছিলেন। বললেন, “তাই নাকি! তা কাকে খুন করেছেন, বউকে নাকি!”
আমি বললাম, না স্যার, বন্ধুকে। উনি বললেন, ঠিক আছে, একটু বসুন। ডেকে পাঠানো হবে। আরও ঘণ্টা দুই বসে থাকার পর আমার খুবই খিদে পেয়ে গিয়েছিল। তাই গিয়ে মহীতোষবাবুর ঘরে ঢুকে হাতজোড় করে বললাম, “স্যার, আমার সেই খুনের এজাহারটা!”
উনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, “এজাহার লেখে কানাই। সে আসুক, তারপর দেখা যাবে। থানায় এলে হাতে সময় নিয়ে আসতে হয়, বুঝলেন। অপেক্ষা করুন।”
আরও ঘণ্টাখানেক পরে আমি আবার গিয়ে বড়বাবুর ঘরে ঢুকে বললাম, “স্যার, আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি তা হলে আসি?”
উনি হাতের একটা নাড়া দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন।”
আমিও চলে এলাম। ইনসিগনিফিক্যান্ট হওয়ার এই একটা সুবিধে। ওঁরা বিশ্বাসই করলেন না আমি একটা খুন করেও থাকতে পারি। পাগল-টাগল মনে করে খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন। খুবই মনোকষ্ট নিয়ে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখনই সেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। সোনার তরী হাউজ়িংয়ের রাঘব চাটুজ্জে একটি খবরের কাগজের ফিল্ম ক্রিটিক। পুলিশের বড়কর্তাদের সঙ্গে তাঁর খুবই দহরম-মহরম। একদিন দেখলাম বান্টিবাবু তাঁকে নিয়ে লালবাজারে গেলেন। বোধ হয় কিছু কলকাঠি নাড়াচাড়া হল। আর তার পরই তামসীর ওপর থেকে পুলিশের ছায়া সরে গেল, সিল করা ঘরটিও খুলে দেওয়া হয়েছে। তামসী আপনাকে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।”
রজত অবাক হয়ে বলে, “আমাকে! আমি তো কিছুই করিনি! তা হলে কৃতজ্ঞতা কিসের?”
“তা আমি জানি না। হয়তো ওঁর ধারণা হয়ে থাকবে যে, এই ঘটনাবলির পিছনে আপনার প্রচ্ছন্ন হাত আছে। থাকাই স্বাভাবিক। যাই হোক, তামসী এখন মাঝে-মাঝে একটু-আধটু ক্ষীণ হাসিও হাসেন। আমি গেলে চা করে দেন, সঙ্গে বিস্কুট। মেয়েটিও বিষণ্ণ মুখে স্কুলে যায়। ওরা চুলও আঁচড়াচ্ছেন, জামাকাপড়ও আগের চেয়ে পরিচ্ছন্ন। আমার মনে হল, এই সংবাদটুকু আপনাকে দেওয়া প্রয়োজন।”
রাজু অন্যমনস্ক গলায় বলে, “ওঁরা তো এখন অ্যাফ্লুয়েন্ট।”
তামসীকে আমি সেটাই বলতে চেয়েছিলাম। উনি বললেন, “আমি ওঁর স্ত্রী নই, উত্তরাধিকারীও নই, আমাদের বাঁচার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুর বেশি আমি কিছু নিতে পারি না। আমার মেয়ে তো এটুকুও নিতে আমাকে বারণ করছে। বাধ্য হয়ে নিচ্ছি।”
রাজু তেমনি আনমনে বলল, “হুঁ।”
“আপনার যদি অনুমতি হয় তা হলে আর দু’-চারটি কথা বলতে পারি কি?”
“বলুন না!”
“আমি বড়ই মনোকষ্টে আছি। এখন আমার আর কোনও বন্ধু নেই। আমি গেলে হারাধন বড় খুশি হত। বলত, “আয়, আয়, বোস। কেমন আছিস?” এখন আর আমাকে কুশল প্রশ্নটুকু করারও কেউ নেই। বড্ড একা লাগছে। যে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমাকে বাড়ি-বাড়ি যেতে হয়, সেটা হঠাৎ বড্ড ভারী-ভারী লাগে আজকাল, টানতে কষ্ট হয়। সাইকেলে প্যাডেল করতে গিয়ে যেন পায়ে আগেকার মতো জোর পাই না। এই আমার মতো যারা দুনিয়ার মার্জিনাল এনটিটি, বাহুল্য, বর্জ্য এবং অনভিপ্রেত, তাদের জন্যও ভগবান বা সৃষ্টিকর্তা, যাই বলুন, কিছু ছোট-ছোট আনন্দের উৎস এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রাখতেন। এই যেমন ধরুন, এক বাড়িতে একটা পার্সেল ডেলিভারি দিতে গেছি, এক বয়স্কা বিধবা মহিলা দরজা খুলে পার্সেলটা সই করে নিয়ে বললেন, “তুমি জুতো খুলে ঘরে এসে একটু বোসো তো বাছা, বড্ড কাহিল লাগছে তোমাকে।”
আপত্তি শুনলেন না, ঘরে গিয়ে বড় জড়সড় হয়ে বসলাম। এসি চলছিল। উনি যত্ন করে প্লেটে দুটো নাড়ু আর দুটো মোয়া আর একগ্লাস ঠান্ডা জল দিলেন। বললেন, “আমরা দেশগাঁয়ের মানুষ বাবা, বাড়িতে ডাকপিয়ন এলে বরাবর বসিয়ে জল-টল দিয়েছি, শহরে সেসব রেওয়াজই নেই। এখানে সব কেমনতরো যেন।”
আমার চোখ জলে ভরে গেল কেমন এক আবেগের ঠেলায়, আর সেই মোয়া আর নাড়ুর স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। সে তো আর শুধু খাদ্যবস্তুই ছিল না, তাতে মাখানো ছিল মহার্ঘ মায়া। তারপর ধরুন সলিলবাবুকে একটা মানিঅর্ডার দিয়ে চলে আসছি, উনি পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন, “ওহে সমর, তুমি তো আমাকে একশো টাকা বেশি দিয়েছ!” আমি আপাদমস্তক শিহরিত হয়ে গিয়েছিলাম ওঁর মুখে সমর ডাকটা শুনে। কবে কখন নামটা জেনেছেন এবং মনেও রেখেছেন! এটা আমাদের মতো মানুষের কাছে যে কত বড় রেকগনিশন, তা আপনি বুঝবেন না। একশো টাকা ফেরত পাওয়ার চেয়েও তা ঢের ঢের বেশি। এত আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম! কী বলব! তারপর ধরুন একদিন রাতে ভাত খেতে বসেছি, হঠাৎ আমার স্ত্রী আমার পাতে একটা পোস্তর বড়া দিলেন। পোস্ত আমাদের কাছে আকাশের চাঁদের মতোই দূরের জিনিস। আমি বিস্মিত, রোমাঞ্চিত। অশ্রদ্ধার সঙ্গেই দিলেন, কিন্তু দিলেন তো! অনেকে পোস্ত হয়তো রোজই খায়, কিন্তু সেই রাতে আমি পোস্তর ভিতরে যে অপার্থিব স্বাদ পেয়েছিলাম, তা আর ক’জন পায় বলুন! ভগবান বা সৃষ্টিকর্তা আমাদের মতো বাহুল্যদের জন্যও এরকম কিছু ছোট-ছোট আনন্দের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু কী বলব, এখন আমি সেই আনন্দগুলোও আর পাচ্ছি না। ব্যাগ বড় ভারী, সাইকেল গতিহীন, কুড়িয়ে পাওয়া আনন্দগুলো নিরুদ্দেশ। বড় মনোকষ্টে আছি, রাজুবাবু। আমার তো এসব কথা বলার জায়গা নেই, তাই ভাবলাম, রাজুবাবুকে বলি। তিনি ঠিক শুনবেন।”