৫. প্রথম টেস্ট
অস্ট্রেলীয় টেস্ট দল গড়ার জন্য ১৯২৮-২৯ মরশুমের শুরুতেই যে ট্রায়াল খেলা হয়, তাতে ডন ব্র্যাডম্যানের রান দেখে সারা অস্ট্রেলিয়া হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়ে। ১৪ এবং ৫। সে-দেশের লোক বলাবলি করল, ট্রায়ালেই যদি সবথেকে সম্ভাবনাময় ছেলেটি এই রান করে তাহলে টেস্টে করবে কী?
এক সপ্তাহ পর কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ডন ১৩১ ও ১৩৩ নট আউট করায় অস্ট্রেলিয়া আবার মুখর হয়ে উঠল।
ইংরেজ খেলোয়াড়দের সঙ্গে ডন মুখোমুখি হল সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলস বনাম এমসিসি-র খেলায়। তাকে খেলতে হল টেট, হ্যামণ্ড, লারউড এবং ‘টিচ’ ফ্রিম্যানের বল। চার বছর পরই অবশ্য ব্র্যাডম্যান-লারউড নাম দুটি ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে বিশ্রী এক অধ্যায়ের সঙ্গে চিরকালের মতো যুক্ত হয়ে যায়।
ডন প্রথম ইনিংসে ৮৭ দ্বিতীয় ইনিংসে ১৩২নট আউট থাকে। তার খেলা হ্যামণ্ডকেও অবাক করে।
খেলাটি যখন আরম্ভ হচ্ছে হ্যামণ্ড তখনও ডি জি ব্র্যাডম্যানের নামটি পর্যন্ত শোনেনি। গেঁয়ো ধরনের ছেলেটি যখন বল করতে এল, উইকেটে হ্যামণ্ড ও হেনড্রেন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে মনস্থ করে ছোকরাকে কিছু ক্রিকেট শিক্ষা দেওয়া যাক। অনেকের মতে ফাস্ট বোলিংয়ে যত হুকার দেখা গেছে হেনড্রেন তাদের সেরা। ডনের বলে হেনড্রেন একটি চার ও দুটি ছয় মেরে আর একটি ছয় মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়।
পরের ওভারে হ্যামণ্ড ২৪ রান নিল ডনের বলে। বলা বাহুল্য, ডনকে আর বল করতে দেওয়া হয়নি। মরিস লেল্যাণ্ড মিড অফে বল মেরে রান নেওয়ার জন্য ডাক দেয়, হ্যামণ্ড দৌড়ে অপর প্রান্তে পৌঁছোনোর আগেই ব্র্যাডম্যান বিদ্যুৎগতিতে বল পাঠিয়ে দেয় উইকেটকিপার বার্টি ওল্ডফিল্ডের হাতে। হ্যামণ্ড রান আউট হয়ে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওর নাম কী?’
‘ডন ব্র্যাডম্যান’ কে একজন বলল।
‘মনে রাখব নামটা।’
হ্যামণ্ডকে মনে রাখতে হয়েছিল। যখন দুজনেই অধিনায়ক হয়েছিল নিজ নিজ দেশের তখন ডনের নাম এবং তার পারদর্শিতার কথা প্রতি মুহূর্তে হ্যামণ্ডকে স্মরণ করতে হয়েছে।
এই সময়ে ডন বল করা ছেড়ে দেয়। এমসিসি-র বিরুদ্ধে ডন আর একটি ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে। ডন প্রথম ইনিংসে ২০০ মিনিটে ৫৮ রান করে অপরাজিত থাকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮।
এরপর এল ভয়ংকর প্রতীক্ষার পালা। ডনের মনে একটিই চিন্তা, টেস্ট দলে সেআসতে পারবে কি পারবে না। প্রথমদিকে যে-সাফল্য সেদেখিয়েছে, পরের ব্যর্থতাকে তা কি ঢেকে দেবে না?
রাত্রে টেস্ট দলের নাম ঘোষণা হবে রেডিয়োয়। দেরি হচ্ছে ঘোষণা হতে, ডন রেডিয়ো নিয়ে বিছানায় শুয়ে। নাম ঘোষিত হবে বর্ণমালা অনুসারে। প্রথমেই শোনা গেল তার নাম। কুড়ি বছর বয়সে ডন অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলবে। অধিকাংশ ছেলের কাছে এটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষার চুড়োয় পৌঁছে যাওয়া। হয়তো ডনের নজর তখনই আরও উঁচুতে অধিনায়কত্বের ওপরে গিয়ে পড়েছিল।
প্রথম টেস্ট খেলা হল ব্রিসবেনে। অমন অকল্পনীয়ভাবে মার খাওয়া ডন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ৬৭৫ রানে ইংল্যাণ্ডের কাছে হার? এত রানে আগে অস্ট্রেলিয়া কখনো হারেনি। ইংল্যাণ্ড প্রথম ব্যাট করে তুলল ৫২১ রান। অস্ট্রেলিয়া জবাব দিল মাত্র ১২২ রান করে। তার মধ্যে ডনের রান মাত্র ১৮। টেটের একটা ধীর বলে সেএলবিডব্লু আউট হয়। ইংল্যাণ্ড ফলো অন না করিয়ে আবার ব্যাট করে দ্বিতীয় ইনিংস ছাড়ে ভিজে উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ৭৪১ রান তুলে জেতার সুযোগ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া তোলে ৬৬ রান। তার মধ্যে ডনের অবদান একটি মাত্র রান। কাদার আঠালো উইকেটে কীভাবে খেলতে হয় ডন তখনও তা জানে না।
এরপর ডন ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নির্মমতার সঙ্গে টেস্ট খেলেছে; এবং তার কারণ হয়তো প্রথম টেস্ট খেলাতেই এই অপমানকর পরাজয়ের জ্বালা সেকিছুতেই ভুলতে পারেনি। ইংল্যাণ্ডকে ক্ষমাহীন নিষ্ঠুরতায় হারানোর জন্য যখনই তার সমালোচনা হয়েছে সেসবসময়ই পালটা জবাবে বলেছে, ‘১৯২৮-এ চ্যাপম্যান কী করেছিল?’
ব্রিসবেন টেস্ট অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে ‘কালা টেস্ট’, ডনের পক্ষেও বিপর্যয়কর। ব্যাটে ব্যর্থ, সম্ভাব্য দুটি ক্যাচও ফেলেছে। ভবিষ্যতে যে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রান সংগ্রাহক হবে তার কোনো আভাস এ খেলায় নেই। সেব্যর্থ, তার ওপর ভরসা রাখা যায় না। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটভক্তরা বিরক্ত হয়ে উঠল।
এর ফলে সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন দ্বাদশ ব্যক্তি হল। ব্যাট করতে পারল না। কিন্তু প্রায় সারা ম্যাচে তাকে ফিল্ড করতে হল, লারউডের বলে পন্সফোর্ডের আঙুলের হাড় ভেঙে যাওয়ায়। টেটের ক্যাচ ধরা ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছুই সেকরেনি। এই খেলাতেও অস্ট্রেলিয়া ভালোভাবেই হারল, ৮ ইউকেটে।
মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ খেলা। পন্সফোর্ডের আঙুল তখনও সারেনি তাই ডনকে দলে নেওয়া হল। ডনের যা চরিত্র ব্যর্থতার পরই তার দ্বিগুণ বিক্রমে ফিরে আসা—এক্ষেত্রেও তাই ঘটল। রান করল ৭৯ ও ১১২। অবশ্য তা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া হারে ৩ উইকেটে। সেই সময়ে ডনই বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট শতরানকারীর সম্মান পায়। পাঁচ মিনিট ধরে দর্শকরা দাঁড়িয়ে থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ব্যর্থতার স্মৃতি আর কারুর মনে নেই। নতুন ছেলেটি তার নির্বাচনকে অবশেষে সার্থকতা দিয়েছে। এরপর ডন আর কখনো অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়েনি।
প্রথম শ্রেণির খেলায় ডনের প্রথম ত্রিশত রান হল এর পরের ম্যাচেই সিডনিতে ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে—৩৪০ নট আউট।
ব্র্যাডম্যানের প্রথম টেস্ট রেকর্ড—বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট শতরানকারীর খেতাবটি অ্যাডিলেডে চতুর্থ টেস্টেই তার মাথা থেকে তুলে নেয় ১৯ বছরের আর্চি জ্যাকসন ১৫৪ রান করে। এটি জ্যাকসনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলাও! এর চার বছর পরই সেটিবি রোগে মারা যায়।
অ্যাডিলেডে ইংল্যাণ্ড ১২ রানে জেতে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৮ রান করে ডন এক চুলের জন্য রান আউট না হলে এ খেলায় ইংল্যাণ্ড জিতত কি না সন্দেহ। প্রথম ইনিংসে সে৪০ করেছিল। ইংল্যাণ্ডের হ্যামণ্ড করে ১১৯ নট আউট ও ১৭৭।
মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ শুরু করে ০-৪ ম্যাচে পিছিয়ে থেকে। সিরিজে প্রথম জিত হল ৫ উইকেটে। ডনের রান ১২৩ ও ৩৭ নট আউট।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডনের প্রথম পুরো মরসুমটি যখন শেষ হল, দেখা গেল তার ১,৬৯০ রান হয়েছে। এক মরশুমে অস্ট্রেলিয়ায় আগে কেউ এত রান করেনি। আর ২৪ ইনিংসে সাতটি শতরান করে গড় দাঁড়িয়েছে ৯৩.৮৮; এটাও রেকর্ড। ডন নিজে না ভাঙা পর্যন্ত রেকর্ডটি অটুট ছিল।
এই এক বছরে ডন অনেক কিছু শিখে নেয়। শেখার এখনও অনেকই বাকি। ১৭ বছর বয়স হওয়ার আগে পর্যন্ত ডন কখনো ভিজে উইকেটে খেলেনি। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচে গভীর মনোযোগে সেহবস ও সাটক্লিফের ভিজে উইকেটে ব্যাট করার ওস্তাদি দেখে তাজ্জব বনে যায়। কিন্তু ডন এই একটা ব্যাপারে কোনোদিনই দক্ষতা দেখাতে পারেনি। অত বিরাট ব্যাটসম্যানের এই একটিই দুর্বলতা ছিল—ভিজে উইকেটে।
কিন্তু সারা সিডনি এখন মেতে উঠেছে আমাদের ডনকে নিয়ে। যেভাবে ওরা ‘আমাদের বন্দর’ ‘আমাদের ব্রিজ’ বলে গর্ব করে, ঠিক সেইভাবে তারা ‘আমাদের ডন’ কথাটি উচ্চারণ করতে শুরু করে। নিউ সাউথ ওয়েলসবাসীদের ধারণায় বিশ্বে যে ক-টি আধুনিক বিস্ময় আছে তার মধ্যে সিডনি বন্দরের ব্রিজটি অন্যতম। ডনও তাই।
ইংল্যাণ্ড ৪-১ ম্যাচে টেস্ট সিরিজটি জিতেছে। কিন্তু এরপর প্রধানত ডনের জন্যই ইংল্যাণ্ড পরবর্তী সিরিজটি জিতবে ডনের অবসর নেওয়ার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে।