৫. প্রতিরুদ্ধ ইসলাম
পশ্চিমের আবির্ভাব (১৭৫০-২০০০)
পাশ্চাত্যের উত্থান বিশ্বের ইতিহাসে নজীর বিহীন। আল্পসের উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলো শত শত বছর ধরে পশ্চাদপদ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছিল, দক্ষিণের গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত রেখেছিল নিজেদের। এবং ক্রমশ নিজস্ব ভিন্ন রূপের খ্রিস্টধর্ম এবং নিজস্ব ধরনের কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। পশ্চিম ইউরোপ ক্রিশ্চান বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল, ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্য ধসে পড়লেও সেখানে সেরকম ঘটেনি। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ পশ্চিম ইউরোপীয় এই দেশগুলো অন্যান্য প্রধান সংস্কৃতিক সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছিল মাত্র এবং ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এক ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে যা পাশ্চাত্যকে অবশিষ্ট বিশ্বকে আপন প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার যোগ্য করে তুলেছে। একটা আউটগ্রুপের পক্ষে এমন ঊর্ধ্বারোহণের সাফল্য অসাধারণ ব্যাপার ৷ সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী কালে আরব মুসলিমদের প্রধান পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। কিন্তু মুসলিমরা বিশ্ব শাসনের অধিকার অর্জন করতে পারেনি, বা নতুন ধরনের সভ্যতারও বিকাশ ঘটায়নি যেমনটি ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল।
অটোমানরা যখন ইউরোপের হুমকি মোকাবিলায় আবার তাদের সেনাবাহিনীকে পূর্নগঠনের প্রয়াস পেয়েছিল তখন তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার কারণ সেটা ছিল কেবল উপরিতলের পরিবর্তন। ইউরোপকে তার নিজের খেলায় হারানোর জন্যে প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজের আপাদমস্তক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল এর সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক এবং মননশীলতার গোটা কাঠামোর পুননির্মাণের এবং সেটা করা উচিত ছিল খুব দ্রুততার সঙ্গে; যা ছিল অসম্ভব একটা কাজ, কেননা এই পরিবর্তন অর্জনের পেছনে পাশ্চাত্যের তিনশো বছরেরও বেশী সময় লেগেছিল।
ইউরোপ এবং এর আমেরিকান কলোনিগুলোর নতুন সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপন্নের ওপর নির্ভর না করে বিশেষ প্রযুক্তি এবং পুঁজি বিনিয়োগের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল তা; পাশ্চাত্যকে যা এর সম্পদ সীমাহীন মাত্রায় পুনরুৎপাদনে সক্ষম করে তুলেছিল, যার ফলে পাশ্চাত্য সমাজ আর কৃষিভিত্তিক সমাজের সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতার ফাঁদে বাধা পড়েনি। বাস্তবিকপক্ষে এই প্রধান বিপ্লব দ্বিতীয়বারের মত অ্যাক্সিয়াল যুগের সৃষ্টি করেছিল, যার দাবী ছিল একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত রাতিনীতির ব্যাপক অদলবদল: রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। আগেভাগে চিন্তা করা হয়নি এসব বা কোনও পরিকল্পনাও ছিল না, বরং তা এক জটিল প্রক্রিয়ারই পরিণতি যার ফলে জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার সামাজিক কাঠামো। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব অর্জন করে ইউরোপীয়রা যা তাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম করে তোলে, এর আগে কেউ যা পারেনি। চিকিৎসাবিজ্ঞান, নৌযাত্রা, কৃষিক্ষেত্র আর শিল্পজগতে নতুন নতুন আবিষ্কার আর উদ্ভাবন ঘটে। এগুলোর কোনওটিই বিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তনে সক্ষম নয়, কিন্তু এগুলোর সমন্বিত ফলাফল ছিল মারাত্মক। ১৬০০ সাল নাগাদ উদ্ভাবনের মাত্রা এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে প্রগতিকে মনে হয়েছে অপ্রতিরোধ্য; কোনও একটি ক্ষেত্রে কোনও একটি আবিষ্কার অন্যক্ষেত্রে আনকোরা নতুন দর্শনের দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশ্বকে অপরিবর্তনীয় আইনের অধীন হিসাবে না দেখে ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করল যে তারা প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি-সৃষ্ট রক্ষণশীল সমাজের যেখানে এধরনের পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা ছিল না, ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ সেখানে আরও বেশী মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিল। তারা এবার অবিরাম প্রগতি আর বাণিজ্যের অব্যাহত উন্নয়নের দৃঢ় আশা নিয়ে পুঁজির বিনিয়োগ ও পুনঃবিনিয়োগের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। এই সময় নাগাদ সমাজের প্রযুক্তিকরণের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব জন্ম লাভ করে, পাশ্চাত্য এমনই আত্মবিশ্বাস বোধ করতে শুরু করে যে অনুপ্রেরণার আশায় তাদের আর অতীতের মুখাপেক্ষী থাকার প্রয়োজন পড়েনি –যেমনটি কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি বা ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়– বরং তারা তাকিয়েছে ভবিষ্যতের দিকে।
সমাজের আধুনিকীকরণের সঙ্গে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন জড়িত। দক্ষতাই হচ্ছে মূল কথা, যে কোনও উদ্ভাবন বা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় সংগঠন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে কিনা সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়। মানুষের ক্রমবর্ধমান হারে ব্যাপক ভিত্তিতে পরিচালিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও শিল্প প্রকল্পে অংশ নেয়ার প্রয়োজন পড়েছে- মুদ্রক, কেরানি, কারখানা শ্রমিক- আর নতুন মানদণ্ডের কিঞ্চিৎ অংশীদার হওয়ার জন্য তাদের কোনও না কোনও শিক্ষা গ্রহণ করার দরকার হয়েছে। ব্যাপক ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্য কেনার জন্যে অধিক সংখ্যক লোকের প্রয়োজন হয়েছে, তো অর্থনীতিকে চালু রাখার স্বার্থে মানুষজনকে ক্রমবর্ধমান হারে জীবনযাত্রার ন্যূনতম পর্যায়ের ঊর্ধ্বে থাকতে হয়েছে। শ্রমিরা অধিক সংখ্যায় শিক্ষিত হয়ে ওঠায় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের অধিকার দাবী করেছে। কোনও জাতি যদি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর মানবসম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার ঘটাতে চায়, তাহলে তাকে এতদিন পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা গ্রুপগুলোকে যেমন, ইহুদিদের, সাংস্কৃতির মূলধারার অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং আধ্যাত্মিক আদর্শসমূহকে অবশ্যই কোনওভাবেই সমাজের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে দেয়া যাবে না, তো বিজ্ঞানী, রাজা এবং সরকারী কর্মচারীগণ দাবী তুললেন যে তাঁদের গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে দিতে হবে। এভাবে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার আর সেক্যুলারিজমের আদর্শগুলো কেবল রাজনীতি-বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের সুন্দর সুন্দর আদর্শ স্বপ্নই ছিল না, বরং সেগুলো অন্তত: অংশতঃ আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনেরই প্রকাশ ছিল। দেখা গেছে যে দক্ষ এবং উৎপাদনশীল হওয়ার জন্যে আধুনিক কোনও জাতিকে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সংগঠিত করা দরকার। আবার এটাও দেখা গেছে যে, বিভিন্ন সমাজ যদি তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে নয়া যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক নিয়মানুসারে সংগঠিত করে, তাহলে সেগুলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে; প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো যার ধারে কাছে আসার যোগ্যতা রাখে না।
ইসলামী জগতের ওপর এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। আধুনিক সমাজের প্রগতিশীল প্রকৃতি আর শিল্পায়নকৃত অর্থনীতির মানে ছিল একে অবিরাম সম্প্রসারিত হতে হবে। নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজন ছিল এবং একবার অভ্যন্ত রীণ বাজারগুলো সম্পৃক্ত হয়ে গেলে বাইরে বাজার অনুসন্ধান করতে হয়েছে তাদের। সুতরাং পশ্চিমা দেশগুলো নানাভাবে আধুনিক ইউরোপের বাইরে কৃষিভিত্তিক দেশগুলোকে বাণিজ্যিক নেটওঅর্কের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে উপনিবেশে পরিণত করতে শুরু করে। এটাও বেশ জটিল প্রক্রিয়া ছিল। উপনিবেশাধীন দেশগুলো রপ্তানির জন্যে কাঁচামালের যোগান দিয়েছিল যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ইউরোপীয় শিল্পখাতে। বিনিময়ে সেই দেশ সস্তায় ইউরোপীয় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী লাভ করেছে, যার মানে ছিল সাধারণভাবে স্থানীয় শিল্পখাতের বিনাশ। উপনিবেশকে আবার ইউরোপীয় কায়দায় পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের প্রয়োজন ছিল, দরকার ছিল এর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনধারাকে যৌক্তিককরণের ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্য ব্যবস্থাধীনে আনার এবং অন্তত “নেটিভদের” একটা অংশের আধুনিক ধ্যান-ধারণা আর রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে হয়েছিল।
এই উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়া কৃষিভিত্তিক উপনিবেশগুলো আগ্রাসী, অস্বস্তিকর এবং অচেনা বলে মনে করেছে। আধুনিকীকরণের ব্যাপারটা অনিবার্যভাবে উপরিগত (Superficial) ছিল, কেননা যে প্রক্রিয়াটি ইউরোপে তিন শত বছর ধরে চলেছে- তা দ্রুত গতিতে অর্জন করা জরুরি ছিল। ইউরোপে আধুনিক ধারণাসমূহ যেখানে সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে আস্তে আস্তে পৌঁছানোর সময় পেয়েছিল, উপনিবেশগুলোয় সেখানে নগণ্য সংখ্যক মানুষ, যারা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সদস্য ছিল এবং- তাৎপর্যপূর্ণভাবে- সামরিক বাহিনী, পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে আর আধুনিকতার গতিশীলতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রয়োজনবোধেই প্রাচীন কৃষিভিত্তিক রীতিনীতিতে পচতে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে, ক্রমবর্ধমান হারে পরস্পরকে বুঝতে পারেনি। যাদের আধুনিকীকরণের বাইরে রেখে দেয়া হয়েছিল তারা অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে তাদের দেশ কেমন যেন একেবারেই অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যেন রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক কাঠামো বিকৃত হয়ে অপরিচিত হয়ে যাওয়া কোনও বন্ধু। বিদেশী সেক্যুলার আইন দ্বারা শাসিত হয়েছে তারা যেগুলো ছিল তাদের বোধের অতীত। তাদের শহরগুলো বদলে গিয়েছিল, পশ্চিমা দালানকোঠা শহরগুলোকে “আধুনিক করেছে”, প্রায়শ “পুরনো নগরী” গুলোকে রেখে দিয়েছে জাদুঘরের বিষয় হিসাবে, যেগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ-বস্তু বা ফেলে আসা সময়ের রেলিক। পশ্চিমা পর্যটকরা প্রায়ই ওরিয়েন্টাল নগরীর আঁকাবাঁকা গলিপথ আর আপাত কোলাহলে দিশাহারা এবং উন্মুল অনুভব করে: তারা এটা সবসময় বুঝতে পারে না যে, দেশীয় অনেকের চোখেও তাদের আধুনিককৃত রাজধানীগুলোকে একই রকম অচেনা মনে হয়। জনগণ নিজের দেশেই নিজেদের ঠিকানাবিহীন মনে করেছে। সর্বোপরি সমাজের সকল শ্রেণীর স্থানীয় জনগণ নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণের অধিকার হারিয়ে ফেলার কথাটা মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করেছে শেকড়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে, আত্মপরিচয় খোয়ানোর বোধ জেগেছিল তাদের মাঝে।
ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা যেখানে তাদের নিজস্ব গতিতে আধুনিকীকরণ এবং নিজস্ব কর্মসূচি স্থির করার সুযোগ পেয়েছিল, ঔপনিবেশিক দেশগুলোর অধিবাসীদের সেখানে অনেক বেশী দ্রুত আধুনিক হতে হয়েছে এবং তাদের ভিন্ন কারও কর্মসূচি পরিপালনে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এমনকি পাশ্চাত্যের জনগণের কাছেও তাদের সমাজের পরিবর্তন বেদনাদায়ক ছিল। প্রায় চারশো বছরব্যাপী রাজনৈতিক এবং প্রায়শ রক্তাক্ত অভ্যূত্থান, সন্ত্রাসের রাজত্ব, গণহত্যা, ধর্মীয় সহিংসতা, গ্রামাঞ্চলের লুণ্ঠন কার্যক্রম, ব্যাপক সামাজিক উত্থান-পতন, কলকারখানায় শোষণ, আধ্যাত্মিক অস্থিরতা আর নতুন মেগাসিটি সমূহের গভীর বৈরিতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল তাদের। আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনুরূপ সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, অভ্যত্থান এবং দিশাহারা অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, যা আধুনিককালে উত্তোরণের যাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। একথাও সত্যি যে, পাশ্চাত্যে বিকাশ লাভ করা আধুনিক চেতনা মৌলিকভাবে আলাদা। ইউরোপ এবং আমেরিকায় এর প্রধান দু’টি বৈশিষ্ট্য ছিল: উদ্ভাবন এবং স্বায়ত্তশাসন (ইউরোপ ও আমেরিকায় আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ফ্রন্টে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে)। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া স্বায়ত্ত শাসনের অনুগামী হয়নি বরং তা স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। উদ্ভাবনের পরিবর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলো কেবল পশ্চিমকে অনুকরণের মাধ্যমে আধুনিক হতে পারে, যা এত বেশী অগ্রসর ছিল যে নাগাল পাওয়ার কোনও আশাই তাদের ছিল না। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া যেহেতু এক ছিল না, সুতরাং ফলাফল যে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে যা প্রত্যাশিত-ধরণ সেকরম কিছু হবে, এমন সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। কেকের সঠিক উপাদানসমূহ যদি পাওয়া না যায়- যদি ময়দার বদলে চাল আর তাজা ডিমের বদলে পচা ডিম, চিনির জায়গায় মসলা ব্যবহার করা হয়- রান্নার বইতে দেয়া কেকের বর্ণনার সঙ্গে অনেক তফাৎ থাকবে ফলাফলের। ঔপনিবেশিক দেশগুলোর আধুনিক কেকে একেবারে ভিন্ন রকম উপাদান যোগ হয়েছিল; গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, বহুত্ববাদ এবং অন্যান্য ফলাফল পশ্চিমে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিল এই প্রক্রিয়ায় সেরকম কিছু বেরিয়ে আসার কথা নয়।
আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ইসলামী বিশ্ব প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে। বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম নেতৃত্বের আসন লাভ করার পরিবর্তে ইসলামী জগৎ দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর নির্ভরশীল বলয়ে পর্যবসিত হয়ে পড়েছিল। উপনিবেশবাদীদের অসন্তোষের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল মুসলিমরা। পশ্চিমারা আধুনিক রীতিনীতিতে এমনভাবে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল যে, প্রায়শ তারা তাদের চোখে মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা, অদক্ষতা, অদৃষ্টবাদ আর দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করে হতবাক হয়ে গেছে। তারা ধরে নিয়েছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি সবসময়ই প্রাগ্রসর ছিল, তাদের এটা বোঝার মত ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না যে, কেবল প্রাক-আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ দেখছে তারা এবং কয়েক শতাব্দী আগে ইউরোপও একই রকম “পশ্চাদপদ” ছিল। তারা এটা প্রায়ই নিশ্চিতভাবে ধরে নেয় যে, পশ্চিমারা উত্তরাধিকারসূত্রে এবং জাতিগতভাবে “ওরিয়েন্টালদের” তুলনায় উন্নত এবং নানাভাবে তারা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব অস্বাভাবিক ছিল না। পাশ্চাত্যের জনগণ প্রায়ই তাদের সংস্কৃতির প্রতি মুসলিমদের বৈরী অনুভূতি আর বিদ্বেষ লক্ষ্য করে হতবাক হয়ে যায়, যাকে তারা তাদের ভিন্নতর অভিজ্ঞতার কারণে খুবই উদারনৈতিক আর ক্ষমতাপ্রদানকারী বলে মনে করে। কিন্তু মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক নয়; কারণ ইসলামী বিশ্ব এমন সুবিস্তৃত আর কৌশলগতভাবে বিস্তৃত ছিল যে, এবারই প্রথম এক সমন্বিত, পদ্ধতিগত উপায়ে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, আরব, মালয় এবং আফ্রিকার উল্লেখযোগ্য অংশ উপনিবেশকরণের প্রক্রিয়ার অধীনে পড়েছিল। এসব অঞ্চলের মুসলিমরা এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার আক্রমণের প্রথম আঁচ টের পেয়েছে। তাদের প্রতিক্রিয়া নতুন পশ্চিমের প্রতি সামান্য সাড়ামাত্র ছিল না, বরং তা ছিল দৃষ্টান্তমূলক প্রতিক্রিয়া। তারা, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জাপানের মত সাফল্যের সঙ্গে বা মসৃণভাবে আধুনিক যুগে উঠে আসতে পারেনি–জাপান কখনও উপনিবেশে পরিণত হয়নি, জাপানের অর্থনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ অটুট রয়ে গিয়েছিল, যেগুলো শক্তি হারিয়ে পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়নি।
ইসলামী বিশ্বের ওপর ইউরোপীয় আগ্রাসন সবক্ষেত্রে একরকম ছিল না; কিন্তু সেটা ছিল সম্পূর্ণ এবং কার্যকর। সূচনা হয়েছিল মোঘুল ভারতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ বণিকের দল রেঙ্গুনে শেকড় গাড়ে এবং সেই সময়, আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া যখন শিশু অবস্থায়, ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলিম বণিকদের সমান পর্যায়েই বসবাস করেছে। কিন্তু ব্রিটিশদের এই কার্যকলাপ “বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া” হিসাবে পরিচিতি, কেননা এর ফলে স্থানীয় শিল্পক্ষেত্রগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষত্রিগ্রস্ত হয় আর কৃষিখাতকে এমনভাবে বদলে দেয় যে, বাঙালীরা তখন আর নিজেদের জন্যে শস্য উৎপাদন করছিল না, উৎপাদন করছিল শিল্পায়িত পশ্চিমা বাজারসমূহের কাঁচামাল। বিশ্বের অর্থনীতিতে বাংলার অবস্থান নেমে এসেছিল দ্বিতীয় কাতারে। আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা আরও “আধুনিক” হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে দক্ষ; তাদের হাবভাবে উন্নততর অভিব্যক্তি যোগ হয় এবং তারা ১৭৯৩-তে আগত প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সমর্থনে ভারতীয়দের “সভ্য” বানাতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু বাঙালীদের তাদের নিজস্ব সম্পূর্ণ শিল্পায়িত সমাজ গঠনে উৎসাহিত করা হয়নি; ব্রিটিশ প্রশাসকরা আধুনিক প্রযুক্তির কেবল সেইসব উপাদানগুলোই যোগ করেছিল, যাতে করে তাদের প্রাধান্য নিশ্চিত হয় এবং বাংলাকে পরিপূরকের ভূমিকায় রাখা যায়। ব্রিটিশদের দক্ষতা থেকে বাঙালীরা লাভবান হয়েছিল, যা রোগশোক, দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধের মত বিপর্যয়গুলোকে দূরে ঠেলে রেখেছিল, এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এতে করে জনসংখ্যাধিক্য ও দারিদ্র্যের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেহেতু পাশ্চাত্যের মত শহরে অভিবাসী হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, সবাইকে যার যার এলাকাতেই রয়ে যেতে হয়েছিল।
অর্থনৈতিকভাবে বাংলার লুণ্ঠন রাজনৈতিক প্রাধান্য ডেকে আনে। ১৭৯৮ এবং ১৮১৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে চুক্তি বা সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু উপত্যকা বাদে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৮৪৩ এবং ১৮৪৯ এর মধ্যবর্তী সময়ে পদানত হয় তা। ইতিমধ্যে ফ্রেঞ্চরা নিজস্ব সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়াস পেয়েছিল। ১৭৯৮তে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ব্রিটিশদের ভারতের সঙ্গে নৌযোগাযোগ ব্যাহত করার জন্য সুয়েযে একটা ঘাঁটি স্থাপনের আশায় মিশর দখল করে নেন। সঙ্গে করে পণ্ডিতদের একটা দল, আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যসমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, আরবী হরফসহ একখানা মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুরু থেকেই অগ্রসর ইউরোপীয় সংস্কৃতি এক অনন্যসাধারণ দক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হওয়াটা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের চোখে আঘাত বিশেষ। মিশর ও সিরিয়ায় নেপোলিয়নের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রাশিয়ার সহায়তায় উত্তর দিক থেকে ব্রিটিশভারতে হামলা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তিনি। এতে ইরান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী শতাব্দীতে ব্রিটিশরা দেশের দক্ষিণে একটা ঘাঁটি স্থাপন করে, অন্যদিকে রাশিয়া উত্তরের নিয়ন্ত্রণ লাভের প্রয়াস পায়। কেউই ইরানকে পুরোপুরি কলোনি প্রটেক্টরেট বানাতে চায়নি (বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তেল আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত), কিন্তু দুটো শক্তিই নয়া কাজার রাজবংশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, যাতে শাহগণ অন্তত যেকোনও একজনের সমর্থন ছাড়া আক্রমণ হানার সাহস না পান। বাংলার মত ব্রিটেন এবং রাশিয়া উভয়েই নিজেদের স্বার্থ হাসিল হবে এমন প্রযুক্তিরই বিকাশ ঘটিয়েছিল আর ইরানি জনগণের উপকারে আসতে পারে এমন ধরনের উদ্ভাবন, যেমন রেলওয়ে, রুদ্ধ করে রেখেছিল তাদের নিজস্ব কৌশলগত অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে যাবার আশঙ্কায়।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো একের পর এক ইসলামী দেশকে উপনিবেশে পরিণত করে। ১৮৩০-এ আলজেরিয়া দখল করে ফ্রান্স। এবং এর নয় বছর পর অ্যাডেন দখল করে ব্রিটেন। ১৮৮১ তে অধিকৃত হয় টিউনিসিয়া, ১৮৮২তে মিশর, ১৮৮৯তে সুদান এবং ১৯১২তে লিবিয়া ও মরোক্কো। ১৯১৫তে স্বাক্ষরিত সাইকস- পিকো (Sykes-Picot) চুক্তি অনুযায়ী মুমূর্ষু অটোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেছিল এরা) বিজয়ের প্রত্যাশায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স যথারীতি সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ইরাক ও ট্রান্সজর্ডানে প্রটেক্টরেট এবং ম্যান্ডেট স্থাপন করে। ব্যাপারটাকে ভয়াবহ বিদ্বেষমূলক হিসাবে দেখা হয়েছিল, কেননা ইউরোপীয় শক্তিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশগুলোকে স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অটোমান মূলভূমিতে মুস্তাফা কেমাল ( Mustafa Kemal ), যিনি আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) নামে খ্যাত, ইউরোপীয়দের প্রতিরোধে সক্ষম হন এবং স্বাধীন টার্কি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। বলকান এলাকা, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনাধীনে চলে আসে। এসব দেশের কোনও কোনওটিকে পরে স্বাধীনতা দেয়া হলেও পাশ্চাত্য প্রায়শই অর্থনীতি, তেল বা সুয়েয খালের মত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছিল। ইউরোপীয় দখলদারি প্রায়ই তিক্তবিরোধের উত্তরাধিকার রেখে গেছে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ যখন ভারত থেকে প্রত্যাহৃত হয়, ভারতীয় উপমহাদেশ হিন্দু ভারত ও মুসলিম পাকিস্তানের মাঝে ভাগ হয়ে যায়, যারা আজও মারাত্মক বৈরী মনোভাবাপন্ন রয়ে গেছে, পরস্পরের রাজধানীর দিকে পারমানবিক অস্ত্র তাক করে রেখেছে। ১৯৪৮-এ প্যালেস্টাইনের আরবরা যায়নিস্টদের কাছে তাদের আবাসভূমি হারিয়ে বসে। যায়নিস্টরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা করে। প্যালেস্টাইন হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর হাতে মুসলিম বিশ্বের অপমানিত হবার জ্বলজ্যান্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, ইউরোপীয় শক্তিগুলো যেন লাখ লাখ প্যালেস্টাইনির আশ্রয়হীন অবস্থা আর স্থায়ী নির্বাসনে এতটুকু বিবেকের তাড়না বোধ করছে না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গোড়ার দিকে মুসলিমদের কেউ কেউ পাশ্চাত্যের প্রতি বেশ দুর্বল ছিল। ইরানি বুদ্ধিজীবী মুলকুম খান (১৮৩৩-১৯০৮) এবং আকা খান কিরমানি (১৮৫৩-৯৬) ইরানিদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ এবং আধুনিক সেক্যুলার রীতিনীতি বেছে নিয়ে শরিয়াহ্ বাদ দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন এবং একেই প্রগতির পথে অগ্রসর হবার একমাত্র পথ বলে বিবেচনা করেছেন। এই গোষ্ঠীর সেক্যুলারিস্টরা ১৯০৬-এর সাংবিধানিক বিপ্লবে (Constitutional Revolution) অধিকতর উদারপন্থী উলেমাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কাজারদের একটি আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন, রাজার ক্ষমতা সীমিতকরণ এবং ইরানিদের সংসদে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। নাজাফের অধিকাংশ মুজতাহিদ সংবিধান সমর্থন করেন। শেখ মুহাম্মদ হুসেইন নাইনি তাঁর অ্যাডমোনিশন টু দ্য নেশন (Admonition to the Nation, ১৯০৯)-এ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যেখানে যুক্তি দেখান হয় যে এভাবে স্বেচ্ছাচারিতা সীমিত করা স্পষ্টতই শিয়াদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং পাশ্চাত্য ধাঁচের সাংবিধানিক সরকার গোপন ইমামের প্রত্যাবর্তনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ। মিশরীয় লেখক রিফাহ্ আল-তাতাওয়ি(১৮০১-৭৩) ইউরোপীয় আলোকনপর্বের (Enlightenment) ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, যাদের দর্শন তাঁকে ফালসাফার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। প্যারিসে সবকিছু যেভাবে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটা পছন্দ করেছেন তিনি। ফরাসি সংস্কৃতির যৌক্তিক নির্ভুলতা দেখে মোহিত হয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন সাধারণ মানুষের শিক্ষার হার দেখে, এবং উদ্ভাবনের প্রতি অদম্য আকর্ষণে আলোড়িত হয়েছেন। মিশরকে এই সাহসী নতুন জগতে প্রবেশে সাহায্য করার আশা করেছিলেন তিনি। ভারতে সাইয়ীদ আহমেদ খান (১৮১৭-৯৮) ইসলামকে আধুনিক পশ্চিমা উদারনৈতিকতাবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন, তিনি দাবী করেছেন যে, আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক আইনসমূহের সঙ্গে কুরান সম্পূর্ণই মানানসই। আলীগড়ে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যেখানে মুসলিমরা প্রচলিত ইসলামী বিষয়াদির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিমরা যেন নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে ব্রিটিশদের হুবহু অনুকৃতি না হয়ে একটা আধুনিক সমাজে বসবাস করতে পারে।
নিজ নিজ এলাকায় উপনিবেশ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে কোনও কোনও মুসলিম শাসক স্বেচ্ছায় আধুনিকীকরণের প্রয়াস পেয়েছিলেন। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ১৮২৬-এ জেনিসারিদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে এক টানযিমাট (বিধি) জারি করেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীকে আধুনিক করেন এবং কিছু নতুন প্রযুক্তি যোগ করেন। ১৮৩৯-এ সুলতান আবদুলহামিদ গুলহান (Gulhane) ডিক্রি জারি করেন, যার বলে তাঁর শাসন প্রজাদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক সম্পর্কে পরিণত হয় এবং তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কারের চিন্তা করেছিলেন। অবশ্য মিশরের আলবেনীয় পাশা মুহাম্মদ আলীর (১৭৬৯-১৮৪৯) আধুনিকীকরণ কর্মসূচি ছিল আরও বেশী গতিশীল, তিনি মিশরকে কার্যত ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে ফেলেন এবং বলতে গেলে একাকী এই পশ্চাদপদ প্রদেশটিকে আধুনিক বিশ্বে তুলে আনেন। কিন্তু তাঁর কৌশলের নিষ্ঠুরতা দেখায় যে, এত তীব্র গতিতে আধুনিকীকরণের প্রয়াস কতখানি অসুবিধাজনক। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেন তিনি; বলা হয়ে থাকে, মিশরের সেচ আর নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে বাধ্যতামূলক শ্রম দিয়ে তেইশ হাজার কৃষক প্রাণ দিয়েছিল; অন্য কৃষকরা মুহাম্মদ আলীর আধুনিক সেনাবাহিনীতে যোগদানের ভয়ে এতই শঙ্কিত ছিল যে, তারা নিজেরাই তাদের দেহ বিকৃত করেছে: কেউ হাতের আঙুল কেটেছে, কেউবা অন্ধ হয়ে গেছে। দেশকে সেক্যুলার করার জন্য মুহাম্মদ আলী স্রেফ ধর্মীয় কারণে প্রদত্ত জমিজমা রাজেয়াপ্ত করেন এবং পরিকল্পিতভাবে উলেমাদের ক্ষমতাহীন করে তোলেন, কোনও ক্ষমতাই আর তাদের রাখতে দেননি। ফলাফল, আধুনিকতাকে মারাত্মক আঘাত হিসাবে বিবেচনাকারী উলেমাগণ আরও বেশী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং স্বদেশে অস্তিত্বমান নতুন পৃথিবীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। মুহাম্মদ আলীর পৌত্র ইসমায়েল পাশা (১৮০৩-৯৫) ছিলেন আরও বেশী সফল: তিনি সুয়েয খালের নির্মাণ ব্যয় বহন করেন, নয়শো মাইল দীর্ঘ রেল পথ নির্মাণ করেন, এর আগে পর্যন্ত চাষাবাদ অযোগ্য ১৩,৭৩,০০০ একর জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেন, ছেলে এবং মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং কায়রোকে এক আধুনিক নগরীতে পরিবর্তন করেন। দুঃখজনকভাবে, উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি মিশরকে দেউলিয়া করে দেয়, দেশ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে বাধ্য হয় আর ইউরোপীয় শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৮৮২-তে সামরিক দখলদারি প্রতিষ্ঠার অজুহাত পায় ব্রিটেন। মুহাম্মদ আলী এবং ইসমায়েল মিশরকে আধুনিক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উল্টো, আধুনিকীকরণের পরিণামে এটা কাৰ্যত স্রেফ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল।
প্রাথমিক সময়ের এই সংস্কারকদের কেউই ইউরোপের পরিবর্তনের পেছনে ক্রিয়াশীল ধারণাসমূহ পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারেননি। সুতরাং তাঁদের সংস্কার প্রয়াস ছিল উপরিগত। কিন্তু সাদ্দাম হুসেইন পর্যন্ত পরবর্তীকালের সংস্কারকরা সবাই কেবল সামরিক প্রযুক্তি আর আধুনিক পশ্চিমের বাহ্যিক সৌন্দর্যই অর্জন করার প্রয়াস পেয়েছেন, সমাজের বাকি অংশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে একটুও চিন্তা করেননি। অবশ্য বেশ আগে থেকেই কোনও কোনও সংস্কারক এসব বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। প্রথম সতর্কবাণী উচ্চারণকারীদের অন্যতম হলেন ইরানি রাজনৈতিক কর্মী জামাল-আল-দিন (১৮৩৯-৯৭), নিজেকে যিনি “আল-আফগানি” (“আফগান”) বলে অভিহিত করেছিলেন; সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল ইরানি শিয়ার চেয়ে বরং আফগান সুন্নী হিসাবে মুসলিম বিশ্বে অনেক বেশী শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন তিনি। ১৮৫৭তে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু এবং মুসলিমদের মহাবিদ্রোহের সময় ভারতে অবস্থান করেছিলেন তিনি; আরব, মিশর, টার্কি, রাশিয়া কিংবা ইউরোপের যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই তিনি পশ্চিমের সর্বব্যাপী ক্ষমতার আঁচ পেয়েছেন এবং উপলব্ধি করেছেন যে, অচিরেই তা মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং ধ্বংস ডেকে আনবে। পাশ্চাত্য ধারার জীবনের অগভীর অনুকরণের বিপদ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি এবং ইসলামী বিশ্বের জনগণের প্রতি ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে একাত্ম হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন; তাদেরকে অবশ্যই নিজেদের মত করে নতুন বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে। সুতরাং তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অর্থাৎ ইসলামের বিকাশ ঘটাতে হবে। কিন্তু খোদ ইসলামকেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিয়ে আরও যৌক্তিক ও আধুনিক হয়ে উঠতে হবে। মুসলিমদের অবশ্যই দীর্ঘদিনব্যাপী “ইজতিহাদের রুদ্ধ দ্বারের” বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে, এবং স্বাধীন যুক্তির ব্যবহার করতে হবে, যেমনটি কুরান এবং পয়গম্বর নির্দেশ দিয়েছেন।
পাশ্চাত্যের দখলদারিত্ব রাজনীতিকে আবার ইসলামী অনুভূতির কেন্দ্রে নিয়ে আসে। পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) আমল থেকেই মুসলিমরা চলমান ঘটনাবলীকে থিওফ্যানি হিসাবে দেখে এসেছে; তারা এমন একজন ঈশ্বরকে দেখেছে যিনি ইতিহাসে উপস্থিত রয়েছেন এবং একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার স্থায়ী চ্যালেঞ্জ জারি করে রেখেছেন। মুসলিমরা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ঐশী তাৎপর্যের সন্ধান করেছে এবং তাদের ব্যর্থতা আর দুঃখজনক ঘটনাগুলো থিওলজি ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আব্বাসীয় খেলাফতের পতনের পর মুসলিমরা যখন কুরানের চেতনার অনেক কাছাকাছি এক ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল, তখন উম্মাহ্ রাজনৈতিক স্বাস্থ্য নিয়ে কম উদ্বিগ্ন ছিল তারা। অভ্যন্তরীণ ধার্মিকতার বিকাশ ঘটানোর স্বাধীনতা বোধ করেছিল। কিন্তু তাদের জীবনে পাশ্চাত্যের অনুপ্রবেশ জন্ম দিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় জিজ্ঞাসার। উম্মাহ্ অপদস্থ হওয়ার ব্যাপারটা কেবল রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়, বরং মুসলিমদের একেবারে আত্মায় আঘাত হেনেছিল। নতুন দুর্বলতা ইসলামের ইতিহাসে মারাত্মক কোনও বিচ্যুতি ঘটে যাবারই লক্ষণ। কুরানের প্রতিশ্রুতি ছিল যে ঈশ্বরের প্রকাশিত ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী কোনও সমাজ ব্যর্থ হতে পারে না। মুসলিম ইতিহাস এর সত্যতা প্রমাণ করে। বারবার, যখনই বিপদ নেমে এসেছে, ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে, ধর্মকে নতুন পরিস্থিতিতে বাঙময় করে তুলেছে এবং উম্মাহ্ কেবল পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেনি বরং সাধারণভাবে আরও ব্যাপক সাফল্যের পথে অগ্রসর হয়েছে। সেক্যুলার, ঈশ্বরহীন পাশ্চাত্যের প্রাধান্যে ইসলামী জগৎ কেমন করে ক্রমাগত পতিত হতে পারছে? এই সময় পর্ব হতে মুসলিমরা অধিক সংখ্যায় এইসব প্রশ্নে আলোড়িত হতে থাকে এবং মুসলিম ইতিহাসকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তাদের প্রয়াসকে কখনও কখনও মরিয়া এবং এমনকি হতাশাব্যঞ্জক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আত্মঘাতী বোমারু বিমান- ইসলামী ইতিহাসের প্রায় নজীরবিহীন ঘটনা– দেখায় যে কোনও কোনও মুসলিম ধরে নিয়েছিল যে তারা অনতিক্রম্য বাধার মুখোমুখি হয়েছে।
আল-আফগানির রাজনৈতিক প্রচারণাসমূহ, যেগুলো ছিল প্রায়শই উদ্ভট কিংবা একেবারেই অনৈতিক, এমনি হতাশায় পরিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৯৬-তে তাঁর একজন শিষ্য ইরানের শাহকে হত্যা করে। কিন্তু তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী মিশরীয় পণ্ডিত মুহাম্মদ আবদু (১৮৪৯-১৯০৫) ছিলেন অধিকতর গভীর এবং পরিমিতি বোধ সম্পন্ন চিন্তাবিদ। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিপ্লব নয়, বরং শিক্ষাই প্রকৃত সমাধান। মিশরে ব্রিটিশ দখলদারিত্বে চরম আঘাত পেয়েছিলেন আবদু, কিন্তু ইউরোপকে তিনি ভালোবাসতেন, ইউরোপীয়দের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, পশ্চিমা বিজ্ঞান ও দর্শনে প্রচুর লেখাপড়া ছিল তাঁর। আধুনিক পশ্চিমের রাজনৈতিক, আইনসংক্রান্ত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি, কিন্তু এটা মনে করেননি যে সেগুলোকে মিশরের মত গভীরভাবে ধর্মভিত্তিক দেশে পাইকারি হারে রোপণ করা সম্ভব– মিশরে আধুনিকীকরণের হার ছিল তীব্র এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পরিকল্পিতভাবেই এর বাইরে রাখা হয়েছিল। আধুনিক আইনগত এবং সাংবিধানিক উদ্ভাবন সমূহকে প্রচলিত ইসলামী ধ্যান ধারণার সঙ্গে এমনভাবে সংশ্লিষ্ট করা আবশ্যক যেন লোকে বুঝতে পারে। যে সমাজের মানুষ আইন বুঝতে পারে না কার্যত: সেটা আইনবিহীন দেশে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শুরাহ্ (পরামর্শ)র ইসলামী নীতি মুসলিমদের গণতন্ত্রের অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে পারে। শিক্ষারও সংস্কার প্রয়োজন। মাদ্রাসার ছাত্রদের আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ করতে হবে যাতে করে তারা ইসলামী প্রেক্ষিতে মুসলিমদের আধুনিক বিশ্বে প্রবেশে সাহায্য করতে পারে, যা তাদের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু শরিয়াহকে হালনাগাদ করে তুলতে হবে; এবং আবদু এবং তাঁর বয়কনিষ্ঠ সমসাময়িক সাংবাদিক রশিদ রিদা (১৮৬৫- ১৯৩৫) জানতেন এটা এক দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া। রিদা আরব বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের ক্রমবর্ধমান সেক্যুলারিজমে শঙ্কিত বোধ করেছিলেন। এঁরা মাঝে মাঝে ইসলামই জনগণকে পেছন দিকে টানছে মনে করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন। রিদা মনে করেছেন, এতে কেবল উম্মাহ্ আরও দুর্বল হয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সহজ শিকারে পরিণত হবে। রিদাই হচ্ছেন অন্যতম প্রধান মুসলিম যিনি সম্পূর্ণ আধুনিক অথচ সংস্কৃত শরিয়াভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি এমন একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে ছাত্ররা ফিক্হ শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন, সমাজবিজ্ঞান, বিশ্ব ইতিহাস, ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা এবং আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠতে পারবে। এর ফলে প্রকৃত আধুনিক প্রেক্ষিতে ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্স উন্নতি লাভ করবে যা পূর্ব ও পশ্চিমের ঐতিহ্যকে একসূত্রে গাঁথবে আর কৃষিভিত্তিক আইন- শরিয়াহকে পশ্চিমে বিকশিত নতুন ধরনের সমাজের সঙ্গে মানানসই করে তুলবে।
সংস্কারকগণ ক্রমাগত অনুভব করছিলেন যে ইসলামের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের সমালোচনার উত্তর দেয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিষয়ের মত ধর্মক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য মুসলিমদের এজেন্ডা স্থির করে দিচ্ছিল। ভারতে কবি-দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৬-১৩৩৮) জোর দিয়ে বললেন যে ইসলাম যেকোনও পশ্চিমা ব্যবস্থার মতই যুক্তিভিত্তিক। প্রকৃতপক্ষে, এটা প্রচলিত অন্যসব কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসের মাঝে সবচেয়ে যৌক্তিক এবং প্রাগ্রসর। এর কঠোর একেশ্বরবাদীতা মানব জাতিকে কিংবদন্তী হতে মুক্তি দিয়েছে আর কুরান মুসলিমদের তাগিদ দিয়েছে গভীরভাবে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে, পর্যবেক্ষণের ফল নিয়ে চিন্তা করতে বলেছে আর কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত করতে বলেছে। এভাবে আধুনিকতার জন্মদানকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেতনা আসলে ইসলাম থেকেই উদ্ভূত। এটা ছিল ইতিহাসের আংশিক এবং অযথার্থ ব্যাখ্যা, তবে এসময়ে খিষ্টধর্মকে উন্নত ধর্ম এবং ইউরোপকে প্রগতির চিরন্তন ধ্বজাধারী বলে মনে করার পাশ্চাত্য প্রবণতার চেয়ে খুব বেশী পক্ষপাতপূর্ণ নয় মোটেই। ইসলামের যৌক্তিক চেতনার প্রতি ইকবালের গুরুত্ব আরোপ তাঁকে সুফিবাদের নিন্দাবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। নতুন ধারাকে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে ভিন্ন হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন যা মুসলিম বিশ্বে ক্রমাগত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, আধুনিক যুক্তিবাদকেই যেহেতু সামনে এগোনোর একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছে। পশ্চিমা ধ্যান ধারণায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন ইকবাল, লন্ডনে পিএইচ.ডি. করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল যে পাশ্চাত্য ধারাবাহিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে অগ্রগতিকে বেগবান করেছে; এর সেক্যুলার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিত্বের ধারণাকে ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন করে একে বহুঈশ্বরবাদী এবং আশঙ্কাজনকভাবে অশুভ করে তুলেছে। পরিণামে পাশ্চাত্য শেষ পর্যন্ত আপন ধ্বংসকেই ডেকে আনবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটা উপলব্ধি করা কঠিন কিছু নয়, যাকে ইউরোপের সম্মিলিত আত্মহত্যা হিসাবে দেখা যেতে পারে। সুতরাং মুসলিমদের জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন ধ্যানে মগ্ন হয়ে নয় বরং শরিয়া আদর্শসমূহকে বাস্তবায়িত করতে পারবে এমন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে জীবনে ঐশ্বরিক মাত্রা লক্ষ্য করার এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন রয়েছে।
এতক্ষণ আমরা যেসব সংস্কারকদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি তাঁরা প্রধানত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর এবং মূলত: শিক্ষিত অভিজাতদের উদ্দেশ্যেই বক্তব্য রেখেছেন। মিশরে তরুণ স্কুলশিক্ষক হাসান আল-বান্না (১৯০৬-৪৯) এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা তাঁদের ধারণাসমূহকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। দ্য সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্স গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এক গণআন্দোলনের রূপ নেয় এবং সেটাই ছিল একমাত্র আদর্শবাদ যা সেই সময় সমাজের সকল ক্ষেত্রে আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। আল-বান্না জানতেন, মুসলিমদের পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োজন রয়েছে এবং তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান- সমূহের সংস্কার সাধন করতে হবে। কিন্তু অন্যান্য সমাজ সংস্কারকের মত তিনিও বিশ্বাস করেছেন যে একে অবশ্যই আধ্যাত্মিক সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি চলতে হবে। আল-বান্না যখন দেখেন যে ব্রিটিশরা সুয়েয খাল অঞ্চলে বিলাসী জীবনযাপন করছে, তখন মিশরীয় শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একে তিনি ধর্মীয় সমস্যা হিসাবে দেখেছেন যার ইসলামী সমাধান প্রয়োজন। ক্রিশ্চানরা যেখানে প্রায়শই মতবাদসমূহের পরিমার্জনার মাধ্যমে আধুনিকতার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে, মুসলিমরা সেটা করেছে সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রয়াসের (জিহাদ) মাধ্যমে! আল-বান্না জোর দিয়ে বলেছেন যে ইসলাম সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা; ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমিত রাখা যাবে না, পাশ্চাত্য যেমন চেষ্টা করেছে। তাঁর সোসায়েটি নতুন যুগের চেতনার উপযোগি হওয়ার জন্যে কুরানকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছে, চেষ্টা করেছে ইসলামী জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের; সামাজিক ন্যায়-বিচারের মান- উন্নয়ন, নিরক্ষরতা আর দারিদ্র্য বিমোচন এবং মুসলিমদের জমি বিদেশী আধিপত্যের কবল থেকে উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছে। উপনিবেশবাদীদের অধীনে মুসলিমরা হয়ে পড়েছিল উন্মুল। যতদিন তারা অন্যদের অনুকরণ করে চলবে ততদিন পর্যন্ত তারা সাংস্কৃতিক সংকর হয়ে থাকবে। ব্রাদার এবং সিস্টারদের আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা আর কুরান-অনুযায়ী জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি আল-বান্না স্কুল নির্মাণ করেছেন, আধুনিক স্কাউট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন, শ্রমিকদের জন্যে নৈশ স্কুল আর সরকারী চাকুরির উপযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে টিউটোরিয়াল কলেজ পরিচালনা করেছেন। দ্য ব্রাদার্স গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে; কারখানা নির্মাণ করেছে, যেখানে মুসলিমরা সরকারী খাতের তুলনায় বেশী হারে বেতন, স্বাস্থ্য বীমা আর ছুটি পেত; এবং মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে আধুনিক শ্রম আইন শিক্ষা দিয়েছে।
সোসায়েটির ত্রুটিও ছিল। ছোট একটা গ্রুপ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল যা এর বিলুপ্তি ডেকে এনেছিল প্রায় (যদিও ভিন্ন প্রয়াসের অধীনে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে)। কিন্তু অধিকাংশ সদস্য –১৯৪৮ নাগাদ যা কয়েক মিলিয়ন মুসলিমে দাঁড়িয়েছিল –এইসব অপকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানত না, তারা তাদের কল্যাণ ও ধর্মীয় কার্যক্রমকে প্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচনা করেছে। সোসায়েটির ত্বরিৎ সাফল্য দেখায় যে- যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল- সিংহভাগ জনগণ আধুনিক এবং ধার্মিক হতে চায়, বুদ্ধিজীবীগণ বা সেক্যুলার সরকারসমূহ যেমনটিই মনে করুক না কেন। এই ধরনের সামাজিক কার্যক্রম বহু আধুনিক ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যে পরণত হয়েছিল যার অন্যতম হচ্ছে গাযায় শেখ আহমেদ ইয়ামিন প্রতিষ্ঠিত মুজামাহ্ (ইসলামীক কংগ্রেস) যা ১৯৬৭-র জুন মাসে সংঘটিত যুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক দখল করে নেয়া অঞ্চলে প্যালেস্টাইনীদের কাছে আধুনিকতার সুবিধাদি পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইসলামী প্রেক্ষিতে একইরকম কল্যাণ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল।
আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র কী?
ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপের সঙ্গে সংঘাত ইসলামী সমাজকে স্থানচ্যুত করে দিয়েছিল। অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল পৃথিবী। পাশ্চাত্যের প্রতি কীভাবে সাড়া দেয়া উচিত মুসলিমদের পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কেননা চ্যালেঞ্জটা ছিল নজীরবিহীন। মুসলিমদের যদি আধুনিক বিশ্বের পূর্ণাঙ্গ অংশীদার হিসাবে অংশগ্রহণ করতে হয় সেক্ষেত্রে তাদের এসব পরিবর্তন আত্মস্থ করতে হত। বিশেষ করে, পাশ্চাত্য রক্ষণশীল ধর্মের প্রতিবদ্ধকতা হতে সরকার, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে রক্ষা করার জন্যে ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন বলে আবিষ্কার করেছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রতি আনুগত্যের স্থান দখল করেছিল, যা এর সমাজগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম করেছে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর এই নিরীক্ষা সমস্যাসঙ্কুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপের জাতি রাষ্ট্রগুলো ১৮৭০-এ এক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় যা শেষ পর্যন্ত দু-দুটো বিশ্ব- যুদ্ধ ডেকে আনে। সেক্যুলার আদর্শসমূহও পুরনো ধর্মীয় গোঁড়ামির মতই মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে, যা নাৎসি হলোকাস্ট আর সোভিয়েত গুলাগে (Gulag) স্পষ্ট হয়ে গেছে। আলোকনপর্বের ফিলোসোফদের (Philosophes) ধারণা ছিল যে মানুষ যত শিক্ষিত হয়ে উঠবে ততই তারা যুক্তিবাদী ও সহিষ্ণু হবে। এ আশা প্রাচীনকালের যেকোনও মেসিয়ানিক কল্পনার মতই শূন্যগর্ভ বলে প্রমাণিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আধুনিক সমাজ গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে এবং তা মোটামুটিভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণের জীবন অনেক বেশী ন্যায়ভিত্তিক এবং সাম্যবাদী করে তুলেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের জনগণ গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে শত শত বছর সময় পেয়েছিল। কিন্তু এখনও প্রবলভাবে কৃষিপ্ৰধান বা অপরিণত আধুনিক সমাজে আধুনিক পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হলে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আধুনিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সকে উপলব্ধির অতীত বলে মনে করে।
রাজনীতি কখনওই ক্রিশ্চান ধর্মীয়বোধের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। অন্তত জেসাস বলেছিলেন তাঁর রাজ্য-এ জগতের নয়। শত শত বছর ধরে ইউরোপের ইহুদিরা নীতিগতভাবে রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মুসলিমদের কাছে রাজনীতি গৌণ বিষয় নয়। আমরা দেখেছি বরং এটাই তাদের ধর্মীয় অনুসন্ধানের নাট্যশালা। মোক্ষলাভের অর্থ পাপের মোচন নয়, বরং ন্যায় বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা যেখানে ব্যক্তি অধিকতর সহজভাবে তার সমগ্র সত্তার অস্তিত্ব সমর্পণ করতে পারবে, যা পূর্ণতা বয়ে আনবে। সুতরাং রাজনীতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার এবং গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে একটা প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্রমাগত প্রয়াস চালানো হয়েছে। কাজটা সবসময়ই কঠিন ছিল। এটা এমন এক আকাঙ্ক্ষা যার জন্য প্রয়োজন জিহাদ-এই সংগ্রাম কোনও সাধারণ ফলাফল বয়ে আনে না।
তাওহীদের আদর্শকে যেন সেক্যুলারিজমের আদর্শের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে হয়েছে, অথচ অতীতে শিয়া ও সুন্নী উভয়েই ধর্ম ও রাজনীতিক পার্থক্য মেনে নিয়েছিল। বাস্তবভিত্তিক রাজনীতি গোলযোগপূর্ণ এবং প্রায়শই নিষ্ঠুর হয়ে থাকে; আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র অনায়াস প্রয়োগযোগ্য কোনও “সহজ বিষয়” নয় বরং রাজনীতির কঠোর বাস্তবতায় কুরানের সমতার আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৃজনশীল মেধা এবং শৃঙ্খলা প্রয়োজন। পশ্চিমারা যেমন কখনও কখনও মনে করে যে, ইসলামই একটি আধুনিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে মুসলিমদের পক্ষে অন্তরায়, কথাটা সত্যি নয়। এটাই বরং সত্যি যে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা মুসলিম বিশ্বে একেবারে ভিন্ন ধরনের ছিল। পাশ্চাত্যে এটা সাধারণভাবে কোমল হিসাবে দেখা বা অনুভূত হয়েছে। গোড়ার দিকে জন লকের (John Locke, ১৬৩২-১৭০৪) মত দার্শনিকগণ একে ধার্মিক হবার নতুন উন্নত পথ হিসাবে কল্পনা করেছিলেন, কেননা এতে করে ধর্ম নিপীড়ক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত হয়েছিল এবং ধর্মকে এর আধ্যাত্মিক আদর্শসমূহের প্রতি আরও বিশ্বস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম প্রায়শই ধর্ম এবং ধার্মিকের ওপর তীব্র কঠিন আক্রমণের সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, আতাতুর্ক সকল মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সুফি মতবাদ দমন করেছেন, এবং নারী ও পুরুষ উভয়কে বাধ্য করেছেন আধুনিক পোশাক পরার জন্যে। এ জাতীয় নিপীড়ন সবসময়ই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। টার্কিতে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, স্রেফ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। মুহাম্মদ আলীও মিশরীয় উলেমাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তাঁদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছেন এবং তাঁদেরকে প্রভাব বঞ্চিত করেছেন। পরে জামাল আবদ আল- নাসের (১৯১৮-৭০) কিছু সময়ের জন্যে পুরোদস্তুর জঙ্গিরূপে অ্যান্টি ইসলামীতে পরিণত হয়েছিলেন, দমন করেছেন মুসলিম ব্রাদারহুডকে। সোসায়েটির সন্ত্রাসী অংশের সঙ্গে জড়িত ব্রাদার্সের একজন সদস্য, নাসেরের জীবননাশের প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু ব্রাদার্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ হাজার হাজার সদস্য আল-নাসেরের নির্যাতন শিবিরে বছরের পর বছর নির্জীব হয়ে পড়লেও লিফলেট বণ্টন বা সভা আহবানের প্রয়াসের চেয়ে জ্বালাময়ী কিছু করতে যায়নি তারা। ইরানে পালভী রাজাগণও তাঁদের সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ছিলেন। রেযা শাহ্ পালভী (১৯২১-৪১ পর্যন্ত শাসন করেন) উলেমাদের তাঁদের বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং এক সিভিল ব্যবস্থাকে শরিয়া স্থলাভিষ্ণিক্ত করেছেন। হুসেইনের সম্মানে আশুরার উৎসব বাতিল ঘোষণা করেন তিনি এবং ইরানিদের জন্যে হজ্জে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইসলামী পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়: রেযার সৈন্যরা বেয়োনেট দিয়ে মহিলাদের বোরখা ছিঁড়ে ফেলত আর রাস্তায় ফেলে টুকরো টুকরো করত। ১৯৩৫-এ মাশাদে অষ্টম ইমামের সমাধিতে প্রতিবাদকারীরা পোশাক- আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গেলে সৈন্যরা নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি বর্ষণ করে, ফলে শত শত প্রাণহানি ঘটে। ইরানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার স্বাদ লাভকারী উলেমাগণ তাঁদের প্রভাব হ্রাস দেখতে বাধ্য হন। কিন্তু সংসদীয় সভায় রেযাকে আক্রমণকারী পুরোহিত আয়াতোল্লাহ্ মুদ্দারিস ১৯৩৭-এ শাসকদলের হাতে নিহত হন, ফলে উলেমাগণ প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। রেযার পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মুহাম্মদ রেযা শাহ্ (১৯৪৪-৭৯ পর্যন্ত শাসন করেন) ইসলামের প্রতি সমান বৈরী আর অসন্তুষ্ট বলে প্রমাণিত হন। শাসকের বিরুদ্ধে সাহস করে প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমে আসা শত শত মাদ্রাসা-ছাত্রকে রাজপথে গুলি করে মারা হয়, মাদ্রাসাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং উলেমাদের নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়, কারারুদ্ধ কিংবা নির্বাসনেও পাঠানো হয়েছিল তাঁদের। এই সেক্যুলার শাসনে গণতান্ত্রিক বলে কিছু ছিল না। শাহ্’র গুপ্তপুলিশ বাহিনী SAVAK বিনাবিচারে ইরানিদের কারারুদ্ধ করেছে, তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে, ভীতি প্রদর্শন করেছে এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোনও সম্ভাবনাই সেখানে ছিল না।
জাতীয়তাবাদ, বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে এসে খোদ ইউরোপীয়রাই যা থেকে সরে যেতে শুরু করেছিল, সেটাও সমস্যামূলক বলে দেখা গেছে। উম্মাহর ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে এক মূল্যবান আদর্শ ছিল; এবার মুসলিম বিশ্ব রাজ্য আর প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে গেল, যাদের সীমান্ত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো নিজেদের ইচ্ছা মাফিক স্থির করে দিয়েছিল। মুসলিমরা যেখানে নিজেদের অটোমান নাগরিক এবং দার আল- ইসলামের সদস্য বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল সেখানে একটা জাতীয় চেতনা গড়ে তোলা সহজ ছিল না। কখনও কখনও জাতীয়তাবাদ হিসাবে যা উপস্থাপিত হতে দেখা যায় সেটা একেবারেই নেতিবাচক একটা রূপ গ্রহণ করে, পাশ্চাত্যেকে বাতিল করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় তা। নতুন গড়ে ওঠা জাতিগুলোর কোনও কোনওটি গঠনই এমন ছিল যে নাগরিকদের মাঝে টানাপোড়েন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুদানের দক্ষিণ অংশ প্রধানত ক্রিশ্চান অধ্যুষিত এলাকা, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল মুসলিম প্রধান। নিজেদের পরিচয় ধর্মের ভিত্তিতে তুলে ধরায় অভ্যস্ত জাতির পক্ষে একটা সাধারণ সুদানিজ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা কঠিনই বটে। এ সমস্যা লেবাননে আরও প্রকট ছিল, এখানে দেশবাসী অন্তত: তিনটি ধর্মীয় গোষ্ঠী– সুন্নী, শিয়া এবং ম্যারোনাইট ক্রিশ্চান-তে বিভক্ত, যারা আবার আগে স্বায়ত্তশাসিত ছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগি অসম্ভব ব্যাপার বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডেমোগ্রাফিক টাইম বম্ব গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে (১৯৭৪-৯০), যার পরিণামে দেশটি দুঃখজনকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অন্যান্য দেশে, যেমন সিরিয়া, মিশর কিংবা ইরাকে, জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘু অভিজাতদের গৃহীত মতবাদ, অধিকতর রক্ষণশীল জনগণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি। ইরানে পালভীদের জাতীয়তাবাদ সরাসরি ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিল, কেননা তা শিয়া মতবাদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটিকে প্রাচীন প্রাক-ইসলামী প্যাগান সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চেয়েছে।
গণতন্ত্রও সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সংস্কারকদের মাঝে যাঁরা ইসলামী কাঠামোতে আধুনিকতাকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা তুলে ধরেছেন যে গণতন্ত্রের আদর্শ খোদ ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন নয়। ইসলামী আইন শুরাহ্ (পরামর্শ) এবং ইজমাকে উৎসাহিত করে, যেখানে আইন-কানুনকে অবশ্যই উম্মাহ্ জনপ্রতিনিধিশীল অংশের “ঐকমত্য” দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়। রাশিদুনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসবই গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে মানানসই। সমস্যার অংশ বিশেষ নিহিত রয়েছে পাশ্চাত্য প্রণীত গণতন্ত্রে যেখানে “সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যে”। ইসলামে জনগণ নয়, ঈশ্বর কোনও সরকারের বৈধতা দান করেন। মানুষের উন্নীত অবস্থান বহুঈশ্বরবাদ (শিরক) বলে মনে হতে পারে যেহেতু তা ঈশ্বরের সার্ভভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। কিন্তু পাশ্চাত্য স্লোগানের অনুসরণ না করেও মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়নি। তবে গণতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবক্ষেত্রে প্রায়শ অপব্যবহৃত হয়েছে। ১৯০৬-এ ইরানি জনগণ সাংবিধানেক বিপ্লবের পর মজলিস (সংসদ) গঠন করে, রাশানরা তা রদ করার বেলায় শাহকে সহযোগিতা দিয়েছিল। পরে, ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা যখন ইরানকে প্রটেক্টরেটে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পায়, আমেরিকানরা লক্ষ্য করে যে তারা প্রায়ই নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে ফলাফল টানার জন্যে কারচুপির আশ্রয় নিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে রেযা শাহ্ যখন তাঁর আধুনিকীকরণ কর্মসূচি কার্যকর করার জন্যে কেবল মজলিসই রদ করেননি, বরং ইরানের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তখন তাঁর প্রতি আমেরিকার সমর্থন এই ধারণা দিয়েছে যে গণতন্ত্রের মানবাধিকার নিশ্চিত করার বেলায় ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অনুসৃত হচ্ছে। পাশ্চাত্য এর জনগণের জন্যে সগর্বে গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু মুসলিমরা নিষ্ঠুর স্বৈরাচারদের কাছে মাথা নত করবে, এটাই আশা করা হয়েছে যেন। মিশরে ১৯২৩ থেকে ১৯৫২ সময়কালের মধ্যে সতেরটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রতিবারই জনপ্রিয় ওয়াফদ্ পার্টি জয় পেয়েছে, কিন্তু ওয়াফদ্ মাত্র পাঁচবার শাসন করার অনুমতি পেয়েছিল। ব্রিটিশ কিংবা মিশরের রাজা তাদের ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করেছিল।
সুতরাং ধর্মকে ব্যক্তিপর্যায়ে ঠেলে দেবে এমন গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গঠন মুসলিমদের জন্যে কঠিন। অন্য সমাধানগুলোকে খুব সুবিধাজনক মনে হয়নি। ১৯৩২-এ প্রতিষ্ঠিত কিংডম অভ সৌদি আরাবিয়া ওয়াহহাবি আদর্শে বিশ্বাসী। সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংবিধান অপ্রয়োজনীয়, কেননা সরকারের ভিত্তি হচ্ছে কুরানের আক্ষরিক পাঠ। কিন্তু কুরানে আইনের পরিমাণ খুবই কম এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এর পরিপূরক হিসাবে সব সময়ই জটিল জুরেসপ্রুডেন্স প্রয়োজন বলে দেখা গেছে। সৌদীরা দাবী করে যে তারা আরবীয় পেনিনসূলার আদি ইসলামের উত্তরাধিকারী এবং উলেমাগণও রাষ্ট্রের বৈধতা মেনে নিয়েছেন; বিনিময়ে রাজাগণ রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়েছেন। নারীদের বোরখার মাধ্যমে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে (যদিও পয়গম্বরের আমলে ব্যাপারটি এমন ছিল না), জুয়া ও অ্যালকোহল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, চুরির অপরাধে অপরাধীর অঙ্গচ্ছেদের মত ঐতিহ্যবাহী শাস্তি আইন ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত করা হয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র এবং সংগঠন মনে করে না যে কুরানের প্রতি আনুগত্য রক্ষার জন্যে এধরনের প্রাক-আধুনিক শাস্তি ব্যবস্থার জরুরিত্ব আছে। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ব্রাদারহুড একেবারে গোড়া থেকেই সৌদীদের ইসলামী শাস্তি প্রয়োগকে অযথার্থ আর সেকেলে বলে নিন্দা জানিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে শাসক গোষ্ঠীর বিপুল সম্পদ আর সম্পদের অসম বণ্টন কুরানের আরও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের বিপক্ষে দাঁড়ায়।
পাকিস্তান ছিল আরেকটি আধুনিক ইসলামী নিরীক্ষা। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ (১৮৭৬-১৯৪৮) আধুনিক সেক্যুলার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সেই আউরেঙজিবের আমল থেকেই ভারতের মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতার বোধে ভুগে আসছিল, অসন্তুষ্ট ছিল তারা: নিজেদের পরিচয় নিয়ে আতঙ্কে ছিল তারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ কর্তৃক উপমহাদেশ বিভক্ত হবার পর এ অবস্থা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয়, উভয় পক্ষেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। জিন্নাহ্ এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন মুসলিমরা যেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা পরিচিত হবে না বা বাধাগ্রস্থ হবে না। কিন্তু ইসলামী প্রতীক ব্যবহারকারী মুসলিম রাষ্ট্র যদি “সেক্যুলার” হতে চায় কী মানে দাঁড়ায় তাহলে? আবুল আলা মাওদুদি (১৯০৩-৭৯) প্রতিষ্ঠিত জামাত-ই ইসলামী শরিয়াহ্ বিধিমালার কঠোর প্রয়োগের জন্যে চাপ দিয়েছিল এবং ১৯৫৬-তে ঘোষিত সংবিধান পাকিস্তানকে অনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রিপাবলিক পরিচয় দেয়। এক আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছিল এটা, যাকে এবার দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ধারণ করতে হবে। জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের সরকার ছিল আমাদের ইতিমধ্যে আলোচিত আগ্রাসী সেক্যুলার মতবাদের একটা সাধারণ উদাহরণ। তিনি ধর্মীয় সম্পদ (ওয়াকফ) জাতীয়করণ করেন, মাদ্রাসা শিক্ষায় বাধানিষেধ আরোপ করেন এবং নিখাদ সেক্যুলার আইনী ব্যবস্থায় উৎসাহ যোগান। তাঁর লক্ষ্য ছিল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের উপযোগী সিভিল ধর্মে পরিণত করা, কিন্তু এতে অনিবার্যভাবে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে টানাপোড়নের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত খানের পতন ডেকে আনে।
১৯৭০-র দশকে ইসলামপন্থী শক্তিগুলো সরকারের প্রধান বিরোধী পক্ষে পরিণত হয় এবং বামপন্থী সেক্যুলারিস্ট প্রধানমন্ত্রী জুলফাঁকির আলী ভূট্টো (১৯৭১- ৭৭) অ্যালকোহল ও জুয়া নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের শান্ত করার প্রয়াস পান। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭৭-এর জুলাইয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মুহাম্মদ যিয়া আল-হক এক সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন এবং অধিকতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাক পুনর্বহাল করেন, ইসলামী ফোজদারি ও বাণিজ্যিক আইন ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যিয়াও এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে তাঁর নীতিমালা স্পষ্টতই সেক্যুলারিস্ট ছিল। ১৯৮৮-তে এক বিমান দুর্ঘটনার তাঁর মৃত্যুর পর থেকে পাকিস্তানি রাজনীতিতে জাতিগত বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে বৈরিতা আর দুর্নীতি দেখা দেয় এবং প্রভাব হারায় ইসলামপন্থীরা। পাকিস্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে, জনজীবনেও এর উপস্থিতি ব্যাপক; কিন্তু তারপরেও মূল রাজনীতিকে তা প্রভাবিত করতে পারছে না। আপোসের ব্যাপারটি আব্বাসীয় ও মঙ্গোলদের সমাধানেরই স্মারক, যারা ক্ষমতার অনুরূপ বিচ্ছিন্নতা প্রত্যক্ষ করেছিল। রাষ্ট্র যেন ইসলামী শক্তিগুলোকে পথে আনতে বাধ্য করেছে, কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম আদর্শের চেয়ে বহুদূর। ভারতের মত পারমাণবিক অস্ত্রখাতে বেহিসাবী অর্থ ব্যায়িত হচ্ছে যেখানে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ সীমাহীন দারিদ্র্যতায় শেষ হয়ে যাচ্ছে– এই পরিস্থিতি প্রকৃত মুসলিম অনুভূতির কাছে ঘৃণ্য। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতিত বোধকারী মুসলিমরা প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মৌলবাদী তালিবান সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
মুসলিমরা এখনও বিংশ শতাব্দীর উপযোগী আদর্শ রাজনীতির সন্ধান পায়নি বলে ইসলাম আধুনিকতার সঙ্গে মানানসই বলা যাবে না। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ইসলামী আদর্শকে স্থাপন করা এবং সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান মুসলিমদের গোটা ইতিহাস জুড়ে আলোড়িত করে এসেছে। কারণ যেকোনও ধর্মীয় মূল্যবোধের মত প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা দুয়ে, একে কখনও মানবীয় ভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ করা যাবে না এবং তা সবসময় মানুষের নাজুক ও ত্রুটিময় উপলব্ধির অতীত হয়ে যাবে। ধর্মীয় জীবন কঠিন, আধুনিক সংস্কৃতির সেক্যুলার যুক্তিবাদ অন্য সকল প্রধান ট্র্যাডিশনের মানুষের জন্যে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। রাজনীতির চেয়ে মতবাদসমূহের প্রতি অধিক মনোযোগী ক্রিশ্চানরাও আজকাল আধুনিক ভাবধারায় তাদের ধর্মবিশ্বাসকে বাঙ্ময় করে তোলার জন্যে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, তারা ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে, কেউ কেউ ধর্মের পুরনো নিয়মাচার আঁকড়ে ধরছে, অন্যরা আরও রেডিক্যাল সমাধান খুঁজে নিচ্ছে। কখনও কখনও এইসব আলোচনা যন্ত্রণাদায়ক এমনকি তিক্ততার জন্ম দেয়, কেননা এসব ইস্যু খ্রিস্টীয় দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ধার্মিকতার মর্মমূল স্পর্শ করে। আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে সংগ্রাম এই দোদুল্যমানতার মুসলিম সমরূপ। সকল ধার্মিক জাতিকে যেকোনও যুগে সেই সময়ের বিশেষ আধুনিকতার প্রতি সাড়া দেয়ার জন্যে তাদের ট্রাডিশনকে প্রস্তুত করতে হয়। একটি আদর্শ মুসলিম সরকারের অনুসন্ধানকে পথবিচ্যুতি হিসাবে দেখা উচিত হবে না বরং একে অত্যাবশ্যকীয় এবং যথার্থ ধর্মীয় কার্যক্রম বলেই ধরে নিতে হবে।
মৌলবাদ
পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায়শ “মৌলবাদ” হিসাবে পরিচিত যুদ্ধংদেহী এবং কখনও কখনও সহিংস ধার্মিকতাকে একেবারেই ইসলামী ব্যাপার বলে ধারণা দিয়ে থাকে। আসল ব্যাপার তা নয়। মৌলবাদ এক বিশ্বজনীন ব্যাপার এবং আমাদের আধুনিকতার সমস্যাদির প্রতি সাড়া হিসাবে সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই আবির্ভূত হয়েছে। মৌলবাদী জুডাইজম যেমন আছে, মৌলবাদী ক্রিশ্চানিটিও আছে, মৌলবাদী হিন্দুধর্মমত, মৌলবাদী বুদ্ধধর্ম, মৌলবাদী শিখধর্ম এবং এমনকি মৌলবাদী কনফুসিয়বাদ পর্যন্ত আছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিশ্চান জগতে প্রথম এধরনের ধর্মবিশ্বাস আবির্ভূত হয়েছিল। এটা কোনও ঘটনাচক্রের সংঘটন ছিল না। মৌলবাদ কোনও মনোলিথিক আন্দোলন নয়, মৌলবাদের প্রত্যেকটা রূপ (form), এমনকি একই ট্র্যাডিশনে হলেও, স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়, এর নিজস্ব প্রতীক ও উদ্দীপনা থাকে, কিন্তু এর ভিন্নতর প্রকাশগুলো এক পারিবারিক সাদৃশ্যতা বহন করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পশ্চিমা আধুনিকতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে চকিত প্রতিক্রিয়া হিসাবে কোনও মৌলবাদী আন্দোলন সূচিত হয় না, বরং আধুনিকতার ধারা বেশ খানিকটা অগ্রসর হওয়ার পরই কেবল একটা রূপ নিতে শুরু করে। শুরুতে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের ট্র্যাডিশনসমূহে সংস্কারের প্রয়াস পায়; আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে সেগুলোর সমন্বয় সাধন করতে চায়; যেমন মুসলিম সংস্কারবাদীদের করতে দেখেছি আমরা। কিন্তু যখন দেখা যায় যে এসব মধ্যপন্থী ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে, কেউ কেউ আরও চরম পন্থার আশ্রয় নেয় এবং এক মৌলবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। পেছনে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই যে আধুনিকতার শো-কেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৌলবাদ নিজের অস্তিত্ব প্রথম তুলে ধরবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল; এবং পরবর্তী সময়ে তা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে দেখা দিয়েছে। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের ভেতর প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই সবার শেষে মৌলবাদী ছোপ পড়েছে- ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে যখন মুসলিম বিশ্বে আধুনিক সংস্কৃতি শেকড় ছড়াতে শুরু করেছিল। এই সময়ের মধ্যে ক্রিশ্চান ও ইহুদিদের ভেতর মৌলবাদ বেশ ভালোভাবেই জাঁকিয়ে বসেছিল, যাদের আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ছিল দীর্ঘ সংস্রব।
সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদী আন্দোলনের কতগুলো সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষায় ব্যর্থ আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি গভীর নৈরাশ্য আর মোহমুক্তির প্রকাশ ঘটায়। এগুলো প্রকৃত আতঙ্কও তুলে ধরে। আমার পর্যালোচিত প্রতিটি মৌলবাদী আন্দোলন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সেক্যুলার প্রশাসন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। সবসময় এটা অমূলক প্রতিক্রিয়া নয়। আমরা দেখেছি যে মুসলিম বিশ্বে খুবই আক্রমণাত্মকভাবে সেক্যুলারিজম আরোপ করা হয়েছে। মৌলবাদীরা অনুপ্রেরণা পাবার জন্যে আধুনিকতার হামলা- পূর্ব কালীন এক “স্বর্ণযুগে”র শরণাপন্ন হয়ে থাকে, কিন্তু তারা পূর্বানুবৃত্তিমূলকভাবে (atavistically) মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন করে না। সবগুলোই সহজাতভাবেই আধুনিক আন্দোলন এবং আমাদের কাল ছাড়া অন্য কোনও যুগে আবির্ভূত হবার উপায় নেই তাদের। সবগুলোই উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন এবং ধর্মের পুন:ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রায়ই চরমপন্থী। সুতরাং মৌলবাদ আধুনিক প্রেক্ষাপটের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আধুনিকতা যখনই শেকড় ছড়ায়, একটা না একটা মৌলবাদী আন্দোলন তার সচেতন প্রতিক্রিয়া হিসাবেই পাশাপাশি উত্থিত হতে পারে। মৌলবাদীরা প্রায়ই তাদের ঐতিহ্যের সেইসব উপাদানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক কোনও পরিবর্তনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে যেগুলো এর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। এরা সবাই-এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও-গণতন্ত্র এবং সেক্যুলারিজমের তীব্র সমালোচক। নারী-মুক্তি যেহেতু আধুনিক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, মৌলবাদীরা প্রচলিত কৃষিভিত্তিক লিঙ্গ-ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে নারীদের অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঘরে আটকে রাখতে চায়। মৌলবাদী গোষ্ঠীকে এভাবে আধুনিকতার ছায়া হিসাবে দেখা যেতে পারে; আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও তুলে ধরতে পারে এটা।
সুতরাং মৌলবাদ এক প্রতীকী সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিপীড়ক সেক্যুলাজিমের সঙ্গে সহাবস্থান করে। মৌলবাদীরা সব সময়ই উদারনৈতিক বা আধুনিকীকরণ প্রশাসনের দ্বারা আক্রান্ত বোধ করে এবং পরিণামে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণ আরও চরম হয়ে ওঠে। টেনেসির বিখ্যাত স্কোপস ট্রায়ালের (১৯২৫) পর যখন প্রটোস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা সরকারী স্কুলগুলোয় বিবর্তনবাদ শিক্ষা দেয়া বন্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিল, সেক্যুলারিস্ট পত্রিকাগুলো তখন এমনভাবে তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুরু করে যে তাদের থিওলজি আরও প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রবলভাবে আক্ষরিক হয়ে ওঠে এবং তারা রাজনৈতিক বলয়ের চরম বামপন্থী থেকে চরম ডানপন্থী দিকে সরে যায়। সেক্যুলারিস্ট আক্রমণ যখন অধিকতর সহিংস হয়ে উঠেছে, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়ারও আরও তীব্র হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। মৌলবাদীরা, সুতরাং, সমাজের একটা ফাটল প্রকাশ করে, সেক্যুলার সংস্কৃতি উপভোগকারী এবং একে আতঙ্কের সঙ্গে বিবেচনাকারীদের মাঝখানে যা দেখা দেয়। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই শিবির ক্রমবর্ধমান হারে পরস্পরকে বুঝে উঠতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এভাবে মৌলবাদ অভ্যন্তরীণ বিরোধ হিসাবে সূচিত হয়- কারও নিজস্ব সংস্কৃতি বা জাতির মধ্যকার উদারপন্থী বা সেক্যুলারিস্টদের সঙ্গে। প্রথমটির উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম মৌলবাদীরা প্রায়শ পাশ্চাত্য বা ইসরায়েলের মত বহিঃশত্রুর বিরোধিতার চেয়ে স্বদেশবাসী বা সতীর্থ মুসলিমদের আধুনিকতা সম্পর্কে অধিকতর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের বিরোধিতা করবে। খাঁটি ধর্মবিশ্বাসের একটা ছিটমহল সৃষ্টির লক্ষ্যে মৌলবাদীরা প্রায়ই প্রথমে সংস্কৃতির মূলধারা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় (যেমন, উদাহরণস্বরূপ, জেরুজালেম বা নিউ ইয়র্কে আল্ট্রা-অর্থোডক্স ইহুদি জনগোষ্ঠীর ভেতর)। এরপর তারা কখনও কখনও মূলধারাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনে পুনঃপবিত্রকরণের লক্ষ্যে এমন এক আক্রমণ পরিচালনার প্রয়াস পায় যার রূপ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। মৌলবাদীদের সবার বিশ্বাস তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই লড়ছে। এবং তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে তারা মনে করতে পারে যে অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে লড়াই ছাড়া গত্যন্তর নেই তাদের। মানসিকতার এমন একটা পর্যায়ে, বিরল ক্ষেত্রে, কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে। অবশ্য সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় না, কিন্তু তারা অধিকতর প্রচলিত বৈধ উপায়ে ধর্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণের প্রয়াস পায় মাত্র।
ধর্মকে সাইডলাইন থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ঠেলে আনার ব্যাপারে সফল হয়েছে মৌলবাদ, যার ফলে এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রধান ভূমিকা পালন করছে এটা। এমন একটা অবস্থা বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ছিল অচিন্ত্যনীয়, যখন সেক্যুলারিজমকে অপ্রতিরোধ্য ঠেকেছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে ইসলামী বিশ্বে নিঃসন্দেহে এটাই ঘটেছে। কিন্তু মৌলবাদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে ধর্মকে “ব্যবহার” করার সামান্য উপায়মাত্র উপায়মাত্র নয়।
এগুলো অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সেক্যুলারিস্টদের দ্বারা মানুষের জীবন থেকে ঈশ্বরের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আধুনিক বিশ্বে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসমূহের প্রাধান্য বিস্তারের পৌনঃপুনিক মরিয়া প্রয়াস। কিন্তু মৌলবাদকে উস্কে দেয়া হতাশা আর আতঙ্ক ধর্মীয় ট্র্যাডিশনকেও বিকৃত করতে চায় এবং সহিষ্ণুতা এবং সমন্বয়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের বাদ দিয়ে অধিকতর আক্রমণাত্মক দিকগুলোকে উচ্চকিত করে তোলে।
মুসলিম মৌলবাদ এইসব সাধারণ বৈশিষ্টাবলীর সঙ্গে মিলে যায়। সুতরাং এটা কল্পনা করে নেয়া ঠিক হবে না যে ইসলামের অভ্যন্তরেই এক জঙ্গী ধর্মান্ধতার উপাদান রয়েছে মুসলিমদের যা আধুনিকতাকে প্রবল এবং সহিংসভাবে প্রত্যাখ্যানে প্ররোচিত করে। বিশ্বের অন্য সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীদের সঙ্গে মুসলিমদেরও মিল আছে, যারা আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রতি তাদের গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে। একথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুসলিমরা যে, মুসলিমরা মৌলবাদ (Fundamentalism) শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সঠিক যুক্তিতেই আপত্তি উত্থাপন করে থাকে যে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা গর্বের প্রতীক হিসাবে এর উৎপত্তি ঘটিয়েছিল এবং সাধারণভাবে এ শব্দের আরবী অনুবাদ করা যায় না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উসুল ইসলামী জুরেসপ্রুডেন্সের মৌলনীতিমালার কথা বলে এবং সকল মুসলিম এ ব্যাপারে একমত, সকল মুসলিমই উসুলিয়াহ্’য় (মৌলবাদ) বিশ্বাসী বলে মত দেয়া যেতে পারে। তা সত্ত্বেও, “মৌলবাদ”-এর সকল দুর্বলতা ছাপিয়ে এই শব্দটি প্রয়োগ করেই কেবল আমরা রণসজ্জিত ধর্মীয় আন্দোলনের সদস্যটির বর্ণনা দিতে পারি। এর চেয়ে সন্তোষজনক কোনও বিকল্প শব্দ উদ্ভাবন বেশ কঠিনই বটে।
মৌলবাদী আদর্শবাদীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন পাকিস্তানে জামাত-ই ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওদুদি। তিনি দেখেছেন পাশ্চাত্যের প্রবল শক্তি ইসলাম ধ্বংসের লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয় করছে। মুসলিমদের উচিত, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, এই আধিপত্যবাদী সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে অবশ্য অবশ্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা, যদি তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মুসলিমরা আগেও বৈরী সমাজের মোকাবিলা করেছে, ধ্বংসলীলা দেখেছে, কিন্তু আফগানির পর থেকে ইসলামী আলোচনায় (discourse) একটা নতুন সুর ঢুকে পড়েছিল। পাশ্চাত্যের হুমকি প্রথমবারের মত মুসলিমদের আত্মরক্ষার পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিল। মাওদুদি সব সেক্যুলারিস্ট নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করেছেন: একটা ইসলামী মুক্তির থিওলজির প্রস্তাবনা রাখছিলেন তিনি। একমাত্র ঈশ্বরই যেহেতু সার্বভৌম, সুতরাং মানুষের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে কেউই বাধ্য নয়। ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল অধিকার বা ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং তা অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। মাওদুদি এক বিশ্বজনীন জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঠিক পয়গম্বর যেমন করে জাহিলিয়ার (প্রাক-ইসলামী কালের “অজ্ঞতা” ও বর্বরতা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, মুসলিমদেরও ঠিক সেভাবে পাশ্চাত্যের আধুনিক জাহিলিয়াহ্ অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। মাওদুদি উল্লেখ করেছেন যে, জিহাদই ইসলামের মূলকথা (tenet)। এক নতুন উদ্ভাবন ছিল এটা। এর আগে কেউ কখনও দাবী করেনি যে জিহাদ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের সমতূল্য, কিন্তু মাওদুদি মনে করেছেন যে বর্তমান জরুরি অবস্থায় এই উদ্ভাবন যুক্তিসঙ্গত। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অস্তিত্বহীনতার চাপ ও আতঙ্ক ধর্মকে অধিকতর চরম এবং সহিংস বিকৃতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু সুন্নী বিশ্বে ইসলামী মৌলবাদের প্রকৃত জন্মদাতা হলেন সায়ীদ কুত্ব (১৯০৬-৬৬), তাঁর ওপর মাওদুদির সীমাহীন প্রভাব ছিল। কিন্তু আদিতে চরমপন্থী ছিলেন না তিনি বরং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং সেক্যুলার রাজনীতির প্রতি তীব্র অনুরাগ ছিল তাঁর। এমনকি ১৯৫৩তে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেয়ার পরেও একজন সংস্কারকই রয়ে গিয়েছিলেন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে ইসলামী রূপ দেয়ার আশা করেছিলেন যাতে পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারিস্ট আদর্শবাদের বাড়তি উপাদানগুলো এড়ানো যায়। কিন্তু ব্রাদারহুডের সদস্য হওয়ার কারণে ১৯৫৬তে আল-নাসের কর্তৃক কারারুদ্ধ হন তিনি; এরপর নির্যাতন শিবিরে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে যান যে ধার্মিক ব্যক্তি আর সেক্যুলারিস্টদের পক্ষে একই সমাজে বসবাস সম্ভব নয়। ব্রাদার্স-এর সদস্যদের ওপর চালানো নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড এবং মিশরে ধর্মকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়ার আল-নাসেরের অঙ্গীকার প্রত্যক্ষ করার সময় তিনি জাহিলিয়া সকল বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করেছেন, যাকে তিনি ধর্ম বিশ্বাসের চিরন্তন প্রতিপক্ষ বর্বরতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন; এজন্যে পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) অনুসরণে মুসলিমদের আমৃত্যু যুদ্ধ করা আবশ্যক। কুত্ব মাওদুদি থেকে আরও অগ্রসর হয়েছেন, কেবল অমুসলিম সমাজকেই জাহিলি হিসাবে দেখেছিলেন তিনি (মাওদুদি)। কুত্ব আরবের প্রাক- ইসলামী পর্যায়কে বর্ণনা করার জন্যে প্রচলিত মুসলিম ইতিহাস শাস্ত্রে ব্যবহৃত জাহিলিয়াহ্ শব্দকে সমসাময়িক মুসলিম সমাজে প্রয়োগ করেছেন। যদিও আল- নাসেরের মত একজন শাসক উপরে উপরে ইসলামের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর কথা এবং কাজে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি একজন ধর্মত্যাগী, এবং মুহাম্মদ(স:) যেভাবে মক্কার পৌত্তলিক প্রশাসনকে (তাঁর আমলের জাহিলিয়াহ্) পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন ঠিক সেভাবে এধরনের সরকারকে উচ্ছেদ করা মুসলিমদের অবশ্য কর্তব্য।
আল-নাসেরের সহিংস সেক্যুলারিজম কুত্বকে এমন এক ইসলাম প্রবর্তনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল যা কুরানের বাণী এবং পয়গম্বরের জীবন, উভয়কেই বিকৃত করেছে। কুত্ব মুসলিমদের মুহাম্মদের(স:) আদর্শে নিজেদের গড়ে তুলতে বলেছেন, নিজেদের সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়ার জন্যে বলেছেন { যেমন মুহাম্মদ(সঃ) করেছিলেন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরার মাধ্যমে } এবং তারপর প্রবল জিহাদে যোগ দিতে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ(স:) এক অনন্যসাধারণ অহিংস নীতি অনুসরণ করে বিজয় অর্জন করেছিলেন; ধর্মীয় ব্যাপারে বল প্রয়োগ এবং নিপীড়নের ঘোরতর বিরোধী কুরান এবং এর দর্শন- বিচ্ছিন্নতা ও বর্জনের শিক্ষা থেকে বহুদূরে- সহিষ্ণু ও গ্রহণের। কুত্ব জোর দিয়ে বলেছেন যে কেবল ইসলামের রাজনৈতিক বিজয় এবং প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই কুরান জারিকৃত সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি আসতে পরে। মৌলবাদী ধর্মের অন্তস্তলে বিরাজিত গভীর আতঙ্কে থেকেই নয়া নিরাপোস মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। কুত্ব রক্ষা পাননি। আল-নাসেরের ব্যক্তিগত জেদেই ১৯৬৬-তে তাঁর প্রাণ সংহার করা হয়।
প্রত্যেক সুন্নী মৌলবাদী আন্দোলনের ওপরই কুত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়ভাবে এটা মুসলিমদের আপন জাতির প্রতি নির্যাতনমূলক নীতিমালা প্রয়োগের কারণে জাহিলি শাসক হিসাবে আনোয়ার আল-সাদাঁতের মত শাসকদের হত্যায় অনুপ্রাণিত করেছে। ১৯৯৪-তে আফগানিস্তানে ক্ষমতা লাভকারী তালিবানরাও তাঁর আদর্শে প্রভাবিত। তাদের দৃষ্টিতে তারা ইসলামের মৌলরূপে প্রত্যাবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। উলেমারা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন, নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে আছে এবং পেশাগত জীবনে অংশ গ্রহণের অনুমোদন নেই তাদের। কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই প্রচারের অনুমোদন পাচ্ছে এবং পাথর ছোঁড়া ও অঙ্গচ্ছেদের মত ইসলামী শাস্তির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। পশ্চিমের কোনও কোনও বলয়ে তালিবানদের খাঁটি মুসলিম বলে মনে করা হয়, কিন্তু তাদের শাসনে অত্যাবশ্যকীয় ইসলামী নীতির লংঘন ঘটছে। তালিবানদের অধিকাংশ ( মাদ্রাসার “ছাত্র” এরা) পশতুন গোত্রের সদস্য এবং অ-পশতুনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে চায় তারা-যারা দেশের উত্তরাংশ থেকে শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এরকম জাতিগত শভ্যেনিজম পয়গম্বর এবং কুরান কর্তৃক নিষিদ্ধ। সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর ওপর তাদের নিষ্ঠুর আচরণও কুরানের নির্দেশের স্পষ্ট পরিপন্থী। নারীদের প্রতি প্রদর্শিত তালিবানদের বৈষম্যও পয়গম্বরের আচরণ এবং প্রথম উম্মাহর অনুশীলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশ্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের অতি বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তালিবানরা বৈশিষ্ট্যগতভাবে মৌলবাদী, (যা পাকিস্তানের কোনও কোনও মাদ্রাসায় তাদের সংকীর্ণ শিক্ষার প্রতিফলন দেখায়), ধর্মকে যা বিকৃত করে এবং প্রত্যাশিত পথের বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যায়। সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মত মুসলিম মৌলবাদীরা টিকে থাকার সংগ্রামে ধর্মকে নির্যাতন এমনকি সহিংসতার হাতিয়ারে পরিণত করে থাকে।
কিন্তু অধিকাংশ সুন্নী মৌলবাদীরা এধরনের চরম পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করেনি। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে জন্ম নেয়া মৌলবাদী আন্দোলনগুলোর সবক’টাই তাদের আশপাশের জগতকে অপেক্ষাকৃত কম ধ্বংসাত্মক অথচ কার্যকরভাবে বদলে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। ১৯৬৭তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের শোচনীয় পরাজয়বরণের পর গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। আল-নাসেরের মত চরম সেক্যুলারিস্ট শাসকদের পুরনো সেক্যুলার নীতি অকার্যকর বলে মনে হয়েছে। জনগণ মনে করেছে যে ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত না হওয়ার কারণেই ব্যর্থ হয়েছে তারা। তারা লক্ষ্য করেছিল যে সেক্যুলারিজম এবং গণতন্ত্র পশ্চিমে চমৎকারভাবে কাজ করলেও সেগুলো সাধারণ মুসলিমদের কোনও উপকারে আসে না, বরং ইসলামী জগতের সংখ্যালঘু অভিজাত শ্রেণীই লাভবান হয়। মৌলবাদকে “উত্তর-আধুনিক” আন্দোলন হিসাবে দেখা যেতে পারে, যা ঔপনিবেশিকতাবাদের মত আধুনিকতার কোনও কোনও বৈশিষ্ট্য এবং উদ্দীপনাকে অস্বীকার করে। সমগ্র ইসলামীবিশ্ব জুড়ে ছাত্র এবং শ্রমিকরা তাদের প্রত্যক্ষ পরিপার্শ্ব পরিবর্তনের কাজ শুরু করে। তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারখানাগুলোয় মসজিদ নির্মাণ করেছে যাতে সেখানে সালাত আদায় করতে পারে এবং বান্না-কায়দায় ইসলামী পরিচয় সমৃদ্ধ কল্যাণমূলক সোসায়েটি গঠন করেছে। সেক্যুলারিস্ট সরকারের চেয়ে জনগণের কল্যাণে ইসলামই যে অগ্রসর সেটা প্রদর্শন করেছে। ছাত্ররা যখন কোনও উঠানের ছায়াঢাকা অংশকে- কিংবা কোনও নোটিসবোর্ডকেও- একটা ইসলামী এলাকা হিসাবে ঘোষণা দেয় তখন তারা ধরে নেয় যে সেক্যুলারিস্ট সমাজে উপেক্ষিত এবং অবনমিত ইসলামকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ক্ষুদ্র হলেও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া গেছে এবং বিশ্বের একটা অংশকে- যত ক্ষুদ্রই হোক- ইসলামের অংশে পরিণত করা গেছে। তারা ইসরায়েলে ইহুদি মৌলবাদী, যারা অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করার মাধ্যমে আরবভূমি দখল করে নিয়ে একে জুডাইজমের অন্তর্ভুক্ত করছে ঠিক তাদের মত করেই পবিত্রতার সীমানা সামনে ঠেলে দিচ্ছে।
ইসলামী পোশাকে প্রত্যাবর্তনের পেছনেও একই নীতিমালা কাজ করছে। এটা যখন জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া হয় (তালিবানরা যেমন করেছে) তখন নির্যাতনমূলক হয়ে দাঁড়ায় এবং রেযা শাহ্ পাহলভীর আক্রমণাত্মক কৌশলগুলোর মত তীব্র পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বহু মুসলিম নারী মনে করে অবগুণ্ঠন হচ্ছে প্রাক-উপনিবেশ আমলে প্রতীকী প্রত্যাবর্তন- যখন তাদের সমাজ প্রকৃত গতিপথ থেকে বিচ্যুত এবং বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু তারা স্রেফ ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়নি। জরিপে দেখা গেছে পর্দাধারী নারীদের বিপুল অংশ লিঙ্গ প্রসঙ্গের মত বিষয়ে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। কোনও কোনও মহিলার ক্ষেত্রে–যারা গ্রামাঞ্চল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে এবং পরিবারের তারাই মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনের গণ্ডি পেরুনো প্রথম সদস্য- ইসলামী পোশাক ধারণ ধারাবাহিকতার অনুভূতি যোগায় এবং আধুনিকতায় উত্তোরণকে অনেক কম যন্ত্রণাময় করে, যা অন্যভাবে কঠিন হত। তারা আধুনিক বিশ্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তবে সেটা তাদের নিজস্ব কায়দায় এবং ইসলামী প্রেক্ষিতে যা একে পবিত্র অর্থ দেয়। অবগুণ্ঠনকে আধুনিকতার কম ইতিবাচক দিকগুলোর তীব্র সমালোচনা হিসাবেও দেখা যেতে পারে। এটা যৌনতার বিষয়ে পাশ্চাত্যের “সব প্রকাশ করে দেয়া”র অদ্ভুত বাধ্যবাধকতাকে অগ্রাহ্য করে। পশ্চিমে মানুষ প্রায়ই তাদের তামাটে সুগঠিত দেহ বিশেষ অধিকারের প্রতীক হিসাবে প্রদর্শন করে থাকে, তারা বয়সের লক্ষণের উল্টোধারায় চলায় প্রয়াস পায় এবং এই জীবন আঁকড়ে থাকতে চায়। অবগুণ্ঠিত ইসলামী দেহ দেখায় যে তা দুর্ভেয়মুখী; পোশাকের সমরূপতা শ্রেণী বৈষম্য দূর করে এবং পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের বিপরীতে গোষ্ঠী বা সমাজের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।
প্রায় সময়ই মানুষ আধুনিক ধ্যানধারণা ও উদ্দীপনাসমূহকে বোধগম্য করে তোলার কাজে ধর্মের ব্যবহার করে থাকে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, ১৭৭৬-এর আমেরিকান বিপ্লবের সময় সকল আমেরিকান ক্যালভিনিস্ট ফাউন্ডিং ফাদারদের সেক্যুলারিস্ট আদর্শ অনুসরণ বা এমনকি বুঝতও না। তারা সংগ্রামকে একটা খ্রিস্টীয় রঙ দিয়েছিল যাতে জনগণ সেক্যুলারিস্টদের পাশাপাশি একটা নতুন পৃথিবী সৃষ্টির লক্ষ্যে লড়তে পারে। শিয়া ও সুন্নী মৌলবাদীদের কেউ কেউও আধুনিক সংস্কৃতির অচেনা সুরকে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে ধর্মকে ব্যবহার করছে, একে আরও সুগম করে তোলার জন্যে অর্থের ও আধ্যাত্মিকতার একটা প্রেক্ষিত দিচ্ছে। আবার, তারা আভাসে জানিয়ে দিচ্ছে যে, পাশ্চাত্য নির্ধারিত শর্তের বাইরেও ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেও আধুনিক হওয়া সম্ভব। ১৯৭৮-৭৯’র ইরানি বিপ্লবকে এই আলোয় দেখা যেতে পারে। ১৯৬০-র দশকে আয়াতোল্লাহ্ রুহোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মুহাম্মদ রেযা শাহ্-র বর্বর এবং অসাংবিধানিক নীতিমালার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্যে ইরানের জনগণকে রাজপথে বের করে এনেছিলেন। রেযা শাহকে কারবালায় হুসেইনের মৃত্যুর জন্যে দায়ী উমাইয়াহ্ খলিফা ইয়াযিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি- শিয়া ইসলামে অন্যায়প্রবণ শাসকের উদাহরণ। এই ধরনের একনায়কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা মুসলিমদের দায়িত্ব। জনগণ, যারা হয়ত সোস্যালিস্টদের বিপ্লবের আহ্বানে আলোড়িত হত না, খোমিনির ডাকে সাড়া দিয়েছিল, যা তাদের গভীরতম ট্র্যাডিশনে অনুরণন তুলেছিল। শাহ্-র সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের শিয়া বিকল্পের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন খোমিনি। তাঁকে যেন বেশী বেশী করে একজন ইমামের মত মনে হচ্ছিল। সকল ইমামের মত আক্রান্ত হয়েছেন তিনি, কারারুদ্ধ হয়েছেন এবং অন্যায়কারী শাসকের হাতে নিহত হতে যাচ্ছিলেন প্রায়; কোনও কোনও ইমামের মত নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি এবং তাঁকে আপন অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়েছে; আলী এবং হুসেইনের মত সাহসিকতার সঙ্গে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তিনি এবং প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষ নিয়েছেন, সকল ইমামের মত সক্রিয় অতীন্দ্রিয়বাদী হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি; হুসেইনের মত, যাঁর পুত্রকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছিল, খোমিনির পুত্র মুস্তাফাঁকে শাহ্-র লোকেরা হত্যা করেছিল।
আধা সরকারী পত্রিকা এত্তেলাত-এ খোমিনির নামে বানোয়াট অপমানকর আক্রমণ এবং এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসা তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যার পর ১৯৭৮-এ বিপ্লবে সূচিত হলে খোমিনি যেন গোপন ইমামের মত দূর থেকে (তার নির্বাসন স্থান নাজাফ) আন্দোলন পরিচালনা করছেন বলে মনে হয়েছে। সেক্যুলারিস্ট আর বুদ্ধিজীবীরাও উলেমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন, কেননা তারা জানতেন যে খোমিনিই তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সমর্থন টানতে পারবেন। একমাত্র ইরানি বিপ্লবই বিংশ শতাব্দীর কোনও আদর্শবাদ অনুপ্রাণিত বিপ্লব (রাশিয়া ও চীনা বিপ্লব উভয়েই কাল মার্কস-এর ঊনবিংশ শতাব্দীর আদর্শবাদে অনুপ্রাণিত ছিল)। খোমিনি শিয়া মতবাদের একেবারে ভিন্নতর ব্যাখ্যা খাড়া করেছিলেন: গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে একমাত্র অতীন্দ্রিয়ভাবে অনুপ্রাণিত জুরিস্টই- যিনি পবিত্র আইন জানেন- বৈধভাবে জাতিকে পরিচালিত করতে পারেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বাদশবাদী শিয়ারা ধর্মীয় পুরহিতদের সরকারে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু বিপ্লবীরা (উলেমাদের বেশীসংখ্যক যদি নাও হয়) এই বেলায়েত-ই ফাকিহ্’র (জুরিস্ট-এর ম্যান্ডেট)’ তত্ত্ব গ্রহণে আগ্রহী ছিল। বিপ্লবের পুরো সময়টায় কারবালার প্রতীক ছিল প্রভাবশালী। মৃতের জন্যে প্রচলিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এবং হুসেইনের সম্মানে আশুরার উৎসব শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রূপ নেয়। কাররালার মিথ সাধারণ শিয়াদের শাহ্-র অস্ত্রকে অগ্রাহ্য করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং তারা শয়ে শয়ে প্রাণ দিয়েছে, কেউ কেউ শহীদের শাদা পোশাকে আবৃত ছিল। ধর্ম এমন এক শক্তিশালী শক্তি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে যা পাহলভী রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে, যাকে কিনা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু সকল মৌলবাদীর মত খোমিনির দর্শনও ছিল বিকৃতিপ্রবণ। তেহরানে আমেরিকানদের জিম্মি হিসাবে আটক (এবং পরে ইরানি উদাহরণে অনুপ্রাণিত লেবাননের শিয়া চরমপন্থীদের হাতে আমেরিকানদের বন্দীত্ব) বন্দীদের প্রতি আচরণের কুরান নির্দেশিত নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন: বন্দীদের সঙ্গে অবশ্যই মর্যাদা ও সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি দিতে হবে। আক্রমণকারী পক্ষটি নিজের হাত থেকেই মুক্তিপণের টাকা দিতেও বাধ্য থাকবে। প্রকৃতপক্ষে কুরান রীতিসিদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া অন্য সময়ে কাউকে আটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা নিশ্চিতভাবে বৈরী অবস্থার অনুপস্থিতিতে কাউকে জিম্মি করা অনুমোদন করে না।` বিপ্লবের পর খোমিনি তাঁর ভাষায় “অভিব্যক্তির ঐক্যে”র ওপর জোর দিয়ে সবরকম ভিন্নমত দমন করেন। বাকস্বাধীনতার প্রতি উদ্বেগ বিপ্লবের অন্যতম দাবীই কেবল ছিল না, কিন্তু ইসলাম কখনও আদর্শগত সমরূপতার ওপর জোর দেয়নি, জোর দিয়েছে কেবল চর্চার সমরূপতার ওপর। ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি কুরানে নিষিদ্ধ এবং খোমিনির আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা– শিক্ষক মোল্লা সদরাও একে ঘৃণা করতেন। ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৯৮৯তে খোমিনি যখন দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে মুহাম্মদের (স:) ব্লাসফেমাস বিবরণ তুলে ধরার অভিযোগে ঔপন্যাসিক সালমান রুশদির বিরুদ্ধে ফাতওয়াহ্ জারি করেন তখনও তিনি চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে সদরার আন্তরিক অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। আল-আয্হার এবং সৌদী আরবের এবং সৌদী আরবের উলেমাগণ ফাতওয়াকে অনৈসলামীক ঘোষণা করেন এবং এর পরের মাসে ইসলামী কনফারেন্সে ঊনচল্লিশটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে আটচল্লিশটি দেশ কর্তৃক নিন্দিত হয় ৷
কিন্তু এটা প্রতীয়মান হয় যে ইসলামী বিপ্লব হয়ত ইরানি জনগণকে তাদের মত করে আধুনিকতায় উত্তোরণে সাহায্য করেছে। পরলোকগমনের কিছুদিন আগে খোমিনি সংসদের কাছে আরও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়াস পান এবং তাঁর স্পষ্ট আশীর্বাদে মজলিসের স্পিকার হাশেম রাফসানজানি বেলায়েত-ই ফাকিহর এক গণতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেন। আধুনিক রাষ্ট্রের চাহিদাসমূহ শিয়াদের গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করেছে, কিন্তু এযাত্রায় সেটা এসেছে ইসলামী প্যাকেজ হিসাবে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে একে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। মে ২৩, ১৯৯৭তে হোজ্জাত ওল-ইসলাম সায়ীদ খাতামি ভূমিধস বিজয় অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। অবিলম্বে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আরও ইতিবাচক সম্পর্কে গড়ে তুলতে আগ্রহী তিনি এবং সেপ্টেম্বর ১৯৯৮তে রুশদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত ফাতওয়াহর সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্ক না থাকার ঘোষণা দেন যা পরে ইরানের প্রধান ফাকিহ্ আয়াতোল্লাহ আলী খামেনীর অনুমোদন লাভ করে। খাতামির নির্বাচন জনগণের এক বিপুল অংশের বহুত্ববাদ, ইসলামী আইন-কানুনের কোমল ব্যাখ্যা, অধিকতর গণতন্ত্র এবং নারীদের জন্যে আরও প্রগতিশীল নীতির পক্ষে জোরাল আকাঙ্ক্ষার সঙ্কেতবাহী ছিল। যুদ্ধে এখনও বিজয় অর্জিত হয়নি। খোমিনির বিরোধিতাকারী রক্ষণশীল পুরোহিত, যাদের প্রতি তিনি গুরুত্ব দেননি, এখনও খাতামির বহু সংস্কারকে রুখে দিতে সক্ষম, কিন্তু কুরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত অথচ বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম একটি টেকসই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ এখনও ইরানি জনগণের প্রধান অগ্রাধিকার রয়ে গেছে।
সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলিম
ইসলামী মৌলবাদের অপচ্ছায়া গোটা পাশ্চাত্য সমাজে কাঁপুনি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার্কে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের একই রকম প্রবল ও সহিংস মৌলবাদের দ্বারা ততটা শঙ্কিত বলে মনে হয় না। এটা নিশ্চিতভাবেই তাদের নিজের দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্যের জনগণের আচ প্রভাবিত করেছে। ইউরোপে পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন মুসলিম বাস করে, অ * থেকে আট মিলিয়নের অধিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জার্মান ও ফ্রান্সে এখন প্রায় হাজারখানেক মসজিদ আছে, যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা পাঁচ শত। পাশ্চাত্যবাসী মুসলিমদের অর্ধেকেরই জন্ম হয়েছে সেখানে, যাদের বাবা-মা ১৯৫০ ও ১৯৬০-র দশকে অভিবাসী হয়েছিল। তারা তাদের অভিভাবকদের নরম অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বৃহত্তর পরিসর ও স্বীকৃতির সন্ধান করছে। কখনও কখনও ভ্রান্ত পরামর্শে অগ্রসর হয় এরা, যেমন উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০-র দশকে যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের জন্য ডক্টর কলিম সিদ্দিকীর পৃথক পার্লামেন্ট গঠনের আহ্বান। এই প্রকল্প ব্রিটিশ মুসলিমদের খুব নগণ্য সমর্থন লাভ করেছিল, কিন্তু মুসলিমরা সমাজের মূলধারায় নিজেদের একীভূত করতে ইচ্ছুক নয় ভেবে শঙ্কিত বোধ করেছে লোকে। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’কে নিয়ে সঙ্কটকালেও মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ব্যাপক বৈরী আচরণ দেখা গেছে, মুসলিমরা যখন ব্র্যাডফোর্ডে গ্রন্থটি পুড়িয়েছিল। অধিকাংশ ব্রিটিশ মুসলিম হয়ত উপন্যাসটিকে অনুমোদন দেয়নি, কিন্তু রূশদীর মৃত্যু দেখারও ইচ্ছা ছিল না তাদের। ইউরোপীয়দের পক্ষে যেন স্বদেশী মুসলিমদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক নির্মাণ কঠিন ঠেকে। অভিবাসী টার্কিশ শ্রমিকরা জার্মানির বর্ণ-দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে আর হিজাব বেছে নেয়া স্কুলছাত্রীদের নিয়ে ফরাসি সংবাদপত্রসমূহে বৈরীভাবাপন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনে মুসলিমরা তাদের সন্তানদের জন্যে পৃথক স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ তুললে ক্ষোভ দেখা যায়, অথচ ইহুদি, রোমান ক্যাথলিক বা কুয়েকারদের জন্য বিশেষ স্কুলের বেলায় কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করে না। মুসলিমদের যেন পঞ্চম বাহিনী হিসেবে দেখা হয়, ব্রিটিশ সমাজকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে যেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের অবস্থান অনেকটা ভাল। মুসলিম অভিবাসীরা এখানে শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত পর্যায়ের। তারা চিকিৎসা, শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশায় নিয়েজিত, যেখানে ইউরোপে মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনও প্রবলভাবে শ্রমিক শ্রেণীর। আমেরিকান মুসলিমরা মনে করে তারা স্বেচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। তারা আমেরিকান হতে চায়। সংমিশ্রণের পরিবেশে ইউরোপের তুলনায় এখানে সে সম্ভাবনা অনেক বেশী। কোনও কোনও মুসলিম, যেমন ম্যালকম এক্স (১৯২৫-৬৫), দ্য নেশন অভ ইসলাম নামে পরিচিত কৃষাঙ্গ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের ক্যারিশম্যাটিক নেতা, মানবাধিকার আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন; কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলিম শক্তির এক প্রতাঁকে পরিণত হন তিনি; কিন্তু নেশন অভ ইসলাম একটা হিটারোডক্স পার্টি ছিল। ১৯৩০-এ ডেট্রয়টের এক পেডলার ওয়ালেস ফার্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৩৪-এ ফার্ডের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর, এলিজাহ্ মুহাম্মদের (১৮৯৭-১৯৭৫) নেতৃত্বাধীন এই দল দাবী করে যে ঈশ্বর ফার্ডের দেহ ধারণ করেছেন, শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই অশুভ এবং মৃত্যুর পরে অন্য কোনও জীবনের অস্তিত্ব নেই– এসবই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মদ্রোহী। দ্য নেশন অভ ইসলাম আফ্রিকান আমেরিকানদের বহু বছর ক্রীতদাস করে রাখার ক্ষতিপূরণ হিসাবে পৃথক রাষ্ট্রের দাবী করেছিল; পাশ্চাত্যের প্রতি প্রবল বৈরীভাবাপন্ন ছিল দলটি। অবশ্য এলিজাহ্ মুহাম্মদের নৈতিক স্খলন আবিষ্কার করে ম্যালকম এক্স দ্য নেশন অভ ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং অনুসারীদের নিয়ে সুন্নী ইসলামে যোগ দেন: এর দুবছর পরে, দল ত্যাগের অপরাধে নিহত হন তিনি। কিন্তু দ্য নেশন অভ ইসলাম আজও ম্যালকম-এক্স প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান মুসলিম মিশনের তুলনায় ঢের বেশী মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছে; আমেরিকান মুসলিম মিশন এখন পুরোপুরি অর্থোডক্স: শিক্ষালাভের জন্যে সদস্যদের আল-আয্হারে পাঠাচ্ছে এবং অধিকতর ন্যায়-বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের পাশাপাশি কাজ করার সম্ভাবনার অনুসন্ধান করছে। নেশনের অস্বাভাবিক ও প্রত্যাখ্যানমূলক অবস্থান ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে অসহিষ্ণু এবং গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্ম-বিশ্বাস কল্পনা করার পশ্চিমা স্টেরিওটাইপের নিকটবর্তী বলে মনে হতে পারে।
ভারতে ১৯৪৭-এ সেসব মুসলিম পাকিস্তানে অভিবাসী হয়নি তাদের বংশধরগণের সংখ্যা এখন ১১৫ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সংখ্যার বিশালত্ব সত্ত্বেও অনেকেই নিজেদের পাশ্চাত্যবাসী ভাই-বোনের চেয়ে বেশী দল-বিচ্ছিন্ন এবং বিপদাপন্ন বলে মনে করে। ভারতের হিন্দু ও মুসলিম জনগণ এখনও ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময়ে সংঘটিত দুঃখজনক সহিংসতার স্মৃতিতে তাড়িত হয়; এবং হিন্দুদের অনেকেই ভারতে মুসলিম অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও মুসলিমরা সংবাদপত্রের অপপ্রচারের শিকার হয়। তাদের বিরুদ্ধে সংকীর্ণ মানসিকতার অভিযোগ আনা হয়, মনে মনে পাকিস্তান বা কাশ্মীরের প্রতি আনুগত্য পোষণের অভিযোগ ওঠে; অধিক সন্তান ধারণের জন্যে দোষারোপ করা হয় তাদের, পশ্চাদপদ থাকার জন্যে নিন্দা কুড়োয় তারা। ভারতীয় মুসলিমদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সহজে ভাল চাকুরি জোগাড় করতে পারে না তারা এবং প্রায়ই শোভন বসবাসের অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। গৌরব-উজ্জ্বল মোঘল আমলের একমাত্র চিহ্ন হিসাবে রয়ে গেছে সুবিশাল দালান-কোঠাসমূহ: তাজ মহল, লাল কেল্লা আর জুনেহ্ মসজিদ, যেগুলো আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পদচারণাস্থলে পরিণত হয়েছে, যাদের দাবী: এগুলো আসলে হিন্দুরা নির্মাণ করেছিল আর মুসলিমরা ভারতের মন্দির ধ্বংস করে সেগুলোর জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করেছে। বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল বাবরী মসজিদ-মোঘুল অযোধ্যায় মোঘুল বংশের প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক নির্মিত মসজিদ-বিজেপি ১৯৯২-র ডিসেম্বরে মাত্র দশ ঘন্টার মধ্যে এটা ভূমিস্মাৎ করে, সংবোদিক আর সেনাবাহিনী নিশ্চল দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করে মাত্র। ভারতীয় মুসলিমদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ। তারা আতঙ্কিত বোধ করেছে একথা ভেবে যে এই প্রতীকী ধ্বংস আরও ব্যাপক ঝামেলার লক্ষণ মাত্র এবং অচিরেই তাদের স্মৃতিসমূহ ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এই শঙ্কা দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’র প্রবল বিরোধিতার পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল, যাকে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আরও একটি বড় ধরনের হুমকি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা ভারতীয় ইসলামের অত্যন্ত সহিষ্ণু এবং সভ্য ঐতিহ্যর পরিপন্থী। আতঙ্ক আর নিপীড়ন আরও একবার ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করেছে।
আগামীর সম্ভাবনা
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রাক্কালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে প্রায় তিরিশ হাজার ইহুদি এবং মুসলিমকে হত্যা করেছিল, প্রাণবন্ত ইসলামী পবিত্র নগরীকে পরিণত করেছিল গন্ধময় চারন্যাল হাউজে। অন্তত পাঁচ মাস ধরে নগরীর আশপাশের উপত্যকা আর খানাখন্দগুলো গলিত লাশে পরিপূর্ণ ছিল, অভিযানের পরবর্তী পর্যায়ে নগরীতে রয়ে যাওয়া ক্রুসেডারদের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় তাদের পক্ষে এসব লাশ সরিয়ে ফেলার কোনও উপায় ছিল না। গোটা জেরুজালেম হয়ে উঠেছিল দুর্গন্ধময়, যেখানে আব্রাহামের তিনটি ধর্মই ইসলামী শাসনের অধীনে প্রায় পাঁচ শত বছর অপেক্ষাকৃত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভেতর সহাবস্থান করছিল। এটাই ছিল ক্রিশ্চান-পশ্চিম সম্পর্কে মুসলিমদের প্রথম অভিজ্ঞতা। পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর নেমে আসা অন্ধকার যুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তখন বেরিয়ে এসেছিল পাশ্চাত্য, আবার উপস্থিত হয়েছিল বিশ্ব পরিমণ্ডলে। মুসলিমরা ক্রুসেডারদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু খুব বেশী দিন তাদের উপস্থিতির কারণে বাধা পড়ে থাকেনি। ১১৮৭-তে সালাদিন ইসলামের পক্ষে জেরুজালেমকে পুনর্দখল করতে সক্ষম হন এবং যদিও ক্রুসেডাররা আরও প্রায় শত বছর নিকটপ্রাচ্যে অবস্থান করেছে, কিন্তু এই অঞ্চলের দীর্ঘ ইসলামী ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তাদের একটা গুরুত্বহীন তুচ্ছ অধ্যায় বলে মনে হয়েছে। ইসলামী জগতের অধিকাংশ অধিবাসী ক্রুসেডের প্রভাব বলয়ের বাইরে রয়ে গিয়েছিল এবং পশ্চিম ইউরোপের প্রতি অনাগ্রহী রয়ে গেছে, যা ক্রুসেডীয় সময়ে নাটকীয় সংস্কৃতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশী পেছনে পড়েছিল।
কিন্তু ইউরোপীয়রা ক্রুসেডের কথা বিস্মৃত হয়নি, তারা দার আল-ইসলামকে অগ্রাহ্যও করতে পারেনি; যা কিনা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্ব শাসন করতে যাচ্ছে বলে প্রতিভাত হচ্ছিল। এমনকি ক্রুসেডের সময় থেকেই পশ্চিমা-ক্রিশ্চান জগতের মানুষ ইসলামের এক স্টেরিওটিপিক্যাল এবং বিকৃত ইমেজ সৃষ্টি করে নিয়েছিল যেখানে ইসলামকে সুশীল সভ্যতার প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা হয়। এই সংস্কার ক্রুসেডের অপর শিকার ইহুদিদের সম্পর্কে ইউরোপীয় কল্প কথার সঙ্গে মিশে গেছে এবং ক্রিশ্চানদের আচরণে প্রায়ই তা সুপ্ত উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটায়। যেমন উদাহরণস্বরূপ, ক্রুসেডের সময় ক্রিশ্চানরাই যেখানে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একাধিক নৃশংস পাবত্র যুদ্ধের সূচনা করেছিল, তখন ইউরোপের শিক্ষিত পণ্ডিত-মনস্করাই ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে সহিংস এবং অসহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাস হিসাবে বর্ণনা করেছে যা কিনা কেবল তরবারির সাহায্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের কল্পিত গোড়ামিপূর্ণ অসহিষ্ণুতার কিংবদন্তী পাশ্চাত্যের অন্যতম বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে।
অবশ্য সহস্রাব্দ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমদের কেউ কেউ যেন এই পাশ্চাত্য পূর্ব-ধারণার অনুসারী হয়ে ওঠে এবং প্রথমবারের মত পবিত্র সহিংসতাকে অত্যাবশ্যক ইসলামী কর্তব্যে রূপান্তরিত করে। এই মৌলবাদীরা প্রায়শ: পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও উত্তর-উপনিবেশিককালের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে আল- সালিবিয়াহ্: ক্রুসেড বলে অভিহিত করে থাকে। ঔপনিবেশিক ক্রুসেড অপেক্ষাকৃত কম সহিংস হলেও এর প্রভাব মধ্যযুগীয় পবিত্র যুদ্ধগুলোর চেয়ে অনেক ভয়াবহ। শক্তিশালী মুসলিম বিশ্বকে নির্ভরশীল ব্লকে পরিণত করা হয়েছে এবং এক ত্বরান্বিত আধুনিকীকরণ কর্মসূচির আওতায় মুসলিম সমাজকে স্থানচ্যুত করে ফেলা হয়েছে। আমরা যেমন দেখেছি, সারা বিশ্বে সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মানুষ পশ্চিমা আধুনিকতার প্রভাবের অধীনে বিচলিত হয়ে মৌলবাদ নামে অভিহিত যুদ্ধপ্রবণ এবং উপর্যুপরি অসহিষ্ণু ধার্মিকতার জন্ম দিয়েছে। আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাব হিসাবে বিবেচিত বিষয়াবলীর সংশোধনের প্রয়াস চালাতে গিয়ে মৌলবাদীরা পাল্টা লড়াই করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা সহানুভূতি ন্যায়বিচার আর মহানুভবতা যা ইসলামসহ সকল ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য– সেসব মৌলমূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যায়। মানুষের অন্য যেকোনও কর্মকাণ্ডের মত ধর্মও প্রায়শ অপব্যবহৃত হয়; কিন্তু নির্মলরূপে তা মানুষের মাঝে পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তার অনুভূতি জাগাতে সাহায্য করার মাধ্যমে আমাদের প্রজাতির সহিংস প্রবণতা দূর করে থাকে। অতীতে ধর্ম নৃশংসতার জন্ম দিয়েছে; কিন্তু সেক্যুলারিজমের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এর সহিংস হওয়ার ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা যেমন দেখেছি, সেক্যুলার আক্রমণ এবং নিপীড়ন প্রায়ই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
১৯৯২-তে আলজিরিয়ায় এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭০-র দশকের ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সময় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (FIS) সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী দল দ্য ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (FLN) স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। FLN ১৯৫৪-তে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় এবং ১৯৬২ তে দেশে একটি সমাজতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজিরিয়দের বিপ্লব ইউরোপ থেকে মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত আরব ও মুসলিমদের অনুপ্রেরণার কাজ করেছিল। FLN সেই সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সেক্যুলার ও সেক্যুলারিস্ট সরকারেরই অনুরূপ ছিল, যারা পশ্চিমা কায়দায় ইসলামকে ব্যক্তিপর্যায়ে অবনমিত করেছে। অবশ্য ১৯৭০-র দশক নাগাদ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জনগণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ এইসব সেক্যুলারিস্ট আদর্শবাদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে। FIS-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস মাদানি আধুনিক বিশ্বের উপযোগি একটা ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন: আলজিয়ার্সের দরিদ্র এলাকার এক মসজিদের ইমাম আলী ইবন হাজ্জ FIS-র অধিকতর চরমপন্থী অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধীরে ধীরে FIS সরকারের অনুমোদন না নিয়েই নিজস্ব মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিল; ফ্রান্সের মুসলিম জনগণের মাঝে এটা শেকড় গেড়ে বসে, শ্রমিকরা যেখানে কারখানা আর অফিসে প্রার্থনার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গার বরাদ্দের দাবী তুলে জাঁ-মেরি লে পেনের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থীদলের রোষের শিকারে পরিণত হচ্ছিল।
১৯৮০-র দশক নাগাদ অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হয় আলজিরিয়া। FLN দেশটিকে গণতান্ত্রিক পথে চালু করে রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, কিন্তু সময়ের প্রবাহে তা হয়ে উঠেছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। পুরনো ‘গার্ডে অধিকতর গণতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমে অনীহ ছিল। আলজিরিয়ায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটে, তিরিশ মিলিয়ন অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল অনুর্ধ্ব তিরিশ বছর বয়স্ক, অনেকেই ছিল বেকারত্বের শিকার, আবাসনের সঙ্কটও ছিল তীব্র। দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। অচলাবস্থা আর FLN-র অদক্ষতার কারণে হতাশ তরুণ প্রজন্ম নতুন কিছু চেয়েছিল এবং নজর দিয়েছে ইসলামী দলগুলোর দিকে। ১৯৯০-র জুনে FIS স্থানীয় নির্বাচনে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিপুল বিজয় অর্জন করে। অধিকাংশ FIS কর্মী ছিল তরুণ, আদর্শবাদী এবং সুশিক্ষিত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোঁড়া আর রক্ষণশীল হিসাবে গণ্য হলেও সরকারে তারা ছিল সৎ এবং দক্ষ। নারীদের জন্যে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ব্যাপারে জোর দিত তারা। কিন্তু FIS পাশ্চাত্য বিরোধী ছিল না। নেতৃবৃন্দ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও পশ্চিমা বিনিয়োগে উৎসাহ দানের কথা বলতেন। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী বিজয়ের পর ১৯৯২তে অনুষ্ঠেয় আইন পরিষদের নির্বাচনেরও নিশ্চিত জয়লাভের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছিল তাদের।
কিন্তু আলজিরিয়ায় কোনও ইসলামী সরকার আসতে পারেনি। সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান সংঘটিত করে উদাহরপন্থী FIS প্রেসিডেন্ট বেনিয়েদিদকে ( Beniedid) (যিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) উৎখাত এবং FIS-কে দমন এবং এর নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। পাকিস্তান বা ইরানে যদি এমন সহিংস এবং অসাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচন বানচাল করা হত, শোরগোল পড়ে যেত পশ্চিমে। এধরনের অভ্যূত্থানকে গণতন্ত্রের প্রতি ইসলামের জন্মগত বিরূপতা, আর আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার মৌলিক অযোগ্যতার উদাহরণ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু যেহেতু অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা ইসলামী সরকারকে বাদ দেয়া গেছে সেকারণে পশ্চিমা সংবাদপত্রে আনন্দের সুর ধ্বনিত হয়েছে। আলজিরিয়া ইসলামী ভীতি থেকে রক্ষা পেয়েছে; আলজিয়ার্সের বার, ক্যাবারে ডিসকোথেকগুলো বেঁচে গেছে; এবং কোনও রহস্যময় উপায়ে এই অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ আলজিরিয়াকে গণতন্ত্রের পক্ষে নিরাপদ করে তুলেছে। ফরাসি সরকার নতুন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট লিয়ামিন যেরোয়ালের (Liamine Zeroual) FLN-র প্রতি সমর্থন দেয় এবং FIS-র সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় অস্বীকৃতিকে জোরদার করে। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের এই নতুন নজীর দেখে প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল।
পরিণাম দুঃখজনকভাবে অনুমানযোগ্য ছিল। আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্ধ এবং ন্যায়বিচারের জন্যে মরিয়া FIS-র জঙ্গী সদস্যরা গেরিলা সংগঠন দ্য আমর্ড ইসলামিক গ্রুপ (GIA) গঠনের জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আলজিয়ার্সের দক্ষিণে পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। গণহত্যার একাধিক ঘটনায় কয়েকটি গ্রামের সকল অধিবাসীকে হত্যা করা হয়। সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী, সেক্যুলার ও ধার্মিকরাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে ইসলামপন্থীরাই এই নৃশংসতার জন্যে পুরোপুরি দায়ী, কিন্তু আস্তে আস্তে নানা প্রশ্ন উচ্চারিত হতে থাকে যার ফলে এসত্য বেরিয়ে আসে যে আলজিরিয়ান সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ কেবল এতে মৌন সম্মতিই দেয়নি বরং GIA কে দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ডেও অংশ নিয়েছিল। এখন সেখানে এক ভীতিকর অচলাবস্থা বিরাজ করছে। FLN এবং FIS উভয় পক্ষই সমাধানে আগ্রহী বাস্তববাদী আলোচনায় অনিচ্ছুক কট্টরপন্থীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রথম অভ্যূত্থানের সহিংসতা ধার্মিক-সেক্যুলারিস্টদের মাঝে পুরোদস্তুর সংঘাতের দিকে গড়িয়েছে। জানুয়ারি ১৯৯৫তে রোমান ক্যাথলিক চার্চ দুপক্ষকেই একত্রিত করার লক্ষ্যে রোমে এক সভার আয়োজন করে, কিন্তু যেরোয়ালের সরকার অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। একটা সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যায়। আরও ইসলামী সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে এবং এক সাংবিধানিক রেফারেন্ডামে সকল ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
আলজিরিয়ার দুঃখজনক ঘটনা অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্যে উদাহরণ হতে পারে না। দমন-পীড়ন হতাশ মুসলিম সংখ্যালঘু অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে যা ইসলামের প্রত্যেকটা মৌল উপাদানের পরিপন্থী। আগ্রাসী সেক্যুলারিজম এমন এক ধার্মিকতার জন্ম দিয়েছে যা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের অপমান। এ ঘটনা পাশ্চাত্য যে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করার জন্যে এত উদগ্রীব সেই গণতন্ত্রের ধারণাকে কলুষিত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হলেও যেন এর সীমাবদ্ধতা রয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দল আর গ্রুপের সম্পর্কে অজ্ঞ বলে দেখানো হয়েছে। মধ্যপন্থী FIS কে চরম সহিংস মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে এবং পশ্চিমা মনে সহিংসতা, বেআইনী তৎপরতা আর অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিভূ বলে স্থান পেয়েছে যা এ দফায় FLN-র সেক্যুলারিস্টরাই আসলে প্রকাশ করেছে।
কিন্তু পাশ্চাত্য পছন্দ করুক বা না করুক, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে FIS-এর প্রাথমিক সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণ কোনও না কোনও ধরনের ইসলামী সরকার দেখতে চায়। এ ঘটনা মিশর, মরক্কো এবং টিউনিসিয়ায় একটা স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ করেছে– যেখানে সেক্যুলারিস্ট সরকারগুলো দীর্ঘদিন ধরে তাদের দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মানুরাগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেক্যুলারিজমের প্রভাব ছিল প্রবল, ইসলাম চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনও সেক্যুলারিস্ট সরকার অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করছে যে যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ইসলামী সরকার ক্ষমতায় এসে যেতেও পারে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, মিশরে ১৯৫০-র দশকে নাসের-বাদ যেমন জনপ্রিয় ছিল এখন ইসলাম তেমন জনপ্রিয়। ইসলামী পোশাক এখন সর্বত্র দৃশ্যমান; মুবারকের সরকার যেহেতু সেক্যুলারিস্ট, স্পষ্টতই স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এটা। এমনকি সেক্যুলারিস্ট টার্কিতেও সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে যে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণ নিজেদের ধর্মপরায়ণ বলে দাবী করেছে এবং ২০ শতাংশ দৈনিক পাঁচ বার প্রার্থনা করার কথা জানিয়েছে। জর্ডানের জনগণ মুসলিম ব্রাদারহুডমুখী হচ্ছে আর প্যালেস্টাইনে নজর দিচ্ছে মুজামার দিকে, ওদিকে PLO ১৯৬০-র দশকে তুঙ্গে থাকলেও এখন একে অদ্ভুত, দুর্নীতিগ্রস্ত আর সেকেলে মনে হচ্ছে। মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোয় কয়েক দশকব্যাপী সোভিয়েত নিপীড়নের পর মুসলিমরা আবার তাদের ধর্মকে আবিষ্কার করছে। জনগণ সেক্যুলারিস্ট মতাদর্শগুলোর আশ্রয় নিয়ে দেখেছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় যা চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছে, আপন ভূমিতে ক্রিয়াশীল ছিল তা। মুসলিমরা বর্ধিত হারে চাইছে তাদের সরকার ইসলামী নিয়মকানুনের অনুসারী হোক।
এটা ঠিক কী রূপ নেবে এখনও তা পরিষ্কার নয়। মিশরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম শরিয়াহকে রাষ্ট্রীয় আইন হিসাবে দেখতে চায় বলে মনে হচ্ছে, অন্যদিকে টার্কিতে মাত্র ৩ শতাংশ লোকের এই প্রত্যাশা। কিন্তু এমনকি মিশরেও উলেমাদের কেউ কেউ কৃষিভিত্তিক আইনবিধি শরিয়াহ্কে আধুনিকতার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের সমস্যা যে চরম হতে বাধ্য সে ব্যাপারে সচেতন। একেবারে ১৯৩০-র দশকেই রাশিদ রিদা এব্যাপারে সজাগ ছিলেন। কিন্তু কাজটা করা অসম্ভব, একথা বলা যাবে না।
একথা সত্যি নয় যে সকল মসুলিমই একইরকমভাবে পাশ্চাত্যের প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ। আধুনিকীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় বহু চিন্তাবিদ ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি মোহাচ্ছন্ন ছিলেন এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রথম সারির প্রভাবশালী মুসলিম চিন্তাবিদদের কেউ কেউ আবার পশ্চিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট খাতামি এই প্রবণতার একজন নজীর মাত্র। ইরানি বুদ্ধিজীবী আবদোলকরিম সোরোশও তাই, খোমিনির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তিনি এবং যদিও প্রায়ই অধিকতর রক্ষণশীল মুজতাহিদদের কাছে অপদস্থ হয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁর। সোরোশ খোমিনিকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু তিনি তাঁর চেয়ে অনেক বেশী এগিয়েছেন। তাঁর মতে ইরানিরা এখন তিনটি পরিচয় বহন করে: প্রাক-ইসলামী, ইসলামী এবং পশ্চিমা, যার সঙ্গে অবশ্যই সমন্বয় সাধন করতে হবে। সোরোশ পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজম প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন চিরদিন মানুষের আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন হবে; তবে ইরানিদের তিনি শিয়া ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন। ইসলামকে অবশ্যই এর ফিক্হকে আধুনিক শিল্পনির্ভর বিশ্বকে ধারণ করার লক্ষ্যে বিকশিত করতে হবে এবং নাগরিক অধিকারের দর্শন সৃষ্টি আর একবিংশ শতাব্দীতে নিজের সম্পদ ধরে রাখার জন্যে অর্থনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভাবন ঘটাতে হবে।
সুন্নী চিন্তাবিদগণও অনুরূপ সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন। অজ্ঞতা থেকে ইসলামের প্রতি পাশ্চাত্যের বৈরিতা জন্ম নিয়েছে, একথা বিশ্বাস করেন টিউনিসিয়ার নির্বাসিত রেনেসাঁ পার্টির নেতা রশিদ আল-গানোচি (Rashid al-Ghannouchi)। খ্রিস্ট ধর্মের অশুভ অভিজ্ঞতা এর উদ্ভবের কারণ, যা চিন্তা আর সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করেছিল। নিজেকে তিনি “গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী” বলে বর্ণনা করেন এবং ইসলাম ও গণতন্ত্রের মাঝে কোনও অসামজ্ঞস্যতা লক্ষ্য করেননি; কিন্তু পশ্চিমের সেক্যুলারিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কেননা মানুষকে এভাবে বিভক্ত আর টুকরো করা যায় না। তাওহীদের মুসলিম আদর্শ দেহ এবং আত্মা, বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতা, নারী ও পুরুষ, নৈতিকতা ও অর্থনীতি, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বৈততা অস্বীকার করে। মুসলিমরা আধুনিকতা চায়, কিন্তু সেটা আমেরিকা, ব্রিটেইন বা ফ্রান্স কর্তৃক চাপিয়ে আধুনিকতা দেয়া নয়। মুসলিমরা পশ্চিমের দক্ষ ও চমৎকার প্রযুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল; রক্তপাত ছাড়াই পশ্চিমে সরকার পরিবর্তনের উপায় দেখে বিমোহিত হয় তারা। কিন্তু মুসলিমরা যখন পশ্চিমা সমাজের দিকে চোখ ফেরায়, কোনও আলো দেখতে পায় না, হৃদয় আর আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র চোখে পড়ে না। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও নৈতিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে চায় এবং একই সময়ে পাশ্চাত্য-সভ্যতার সেরা কিছু বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে চায়। আল-আযহারের ডিগ্রিধারী এবং মুসলিম ব্রাদার কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সুন্নাহ্ অ্যান্ড শরিয়াহ্র বর্তমান পরিচালক ইউসুফ আবদাল্লাহ্ আল-কারাদাওয়ি অনুরূপ চিন্তার অংশীদার। তিনি মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে মুসলিম বিশ্বে সম্প্রতি আবির্ভূত গোঁড়ামি মানুষকে অপরাপর মানুষের অন্তর্দৃষ্টি আর দর্শন থেকে বঞ্চিত করার ভেতর দিয়ে হীনতর করবে। পয়গম্বর মুহাম্মদ (স:) বলেছিলেন তিনি ধর্মীয় জীবনে চরমপন্থা পরিহারকারী “মধ্যপন্থা” আনার লক্ষ্যে এসেছেন এবং আল- কারাদাওয়ি মনে করেন যে ইসলামী বিশ্বের কোথাও কোথাও চলমান চরমপন্থা মুসলিম চেতনার দূরবর্তী এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, হুদাইবিয়ায় কুরাইশদের সঙ্গে এক অজনপ্রিয় সন্ধিতে উপনীত হয়ে পয়গম্বর যেমন দেখিয়েছেন। এ এমন এক কৃতিত্ব কুরান যাকে “মহাবিজয়” বলেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাশ্চাত্যকে অবশ্যই মুসলিমদের তাদের ধর্ম অনুসরণ করে জীবন যাপনের অধিকার এবং যদি চায় তাদের রাজনীতিতে ইসলামী আদর্শ যোগ করার অধিকার মেনে নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে জীবনযাপনের নানান উপায় আছে। বৈচিত্র্য গোটা বিশ্বকেই লাভবান করে। ঈশ্বর মানুষকে বেছে নেয়ার অধিকার এবং ক্ষমতা দিয়েছেন এবং কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্রসহ ধর্মীয় জীবনের পক্ষে মত দিতে পারে, অন্যরা যেখানে সেক্যুলার আদর্শের পক্ষপাতি।
“মুসলিমরা ধার্মিক হলে, পশ্চিমের জন্যে ভাল,” যুক্তি দেখিয়েছেন ক্বারাদাওয়ি, “তারা তাদের ধর্ম মেনে চলুক, আর নীতিবান হওয়ার প্রয়াস পাক।”[৪] একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন তিনি। বহু পশ্চিমাবাসী তাদের জীবনে আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতিতে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করেছে। তারা অবশ্যই প্রাক- আধুনিক ধর্মীয় জীবন ধারায় বা প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করতে চায় না। কিন্তু একটা উপলব্ধি ক্রমশ বেড়ে উঠছে যে, সর্বোত্তম অবস্থায় ধর্ম মানুষকে শুভ মূল্যবোধ বিকাশে সাহায্য করেছিল। শত শত বছর ধরে ইসলাম মুসলিম চেতনার সম্মুখ সারিতে সামাজিক ন্যায়-বিচার, সাম্য, সহিষ্ণুতা আর বাস্তব সহমর্মিতার ধারণাকে স্থান দিয়ে এসেছে। মুসলিমরা সবসময় এইসব আদর্শ অনুসরণ করতে পারেনি এবং বারবার এগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ধারণ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এগুলো অর্জনের সংগ্রাম শত শত বছর ধরে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার মুখ্য বিষয় রয়ে গেছে। পশ্চিমা জনগণকে অবশ্যই বুঝতে হবে, তাদের স্বার্থেও ইসলামের স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী থাকা প্রয়োজন। ইসলামের চরম ধরণগুলোর জন্যে পাশ্চাত্য পুরোপুরি দায়ী নয়, যা এমন এক সহিংসতার বিকাশ ঘটিয়েছে যার ফলে ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র অনুশাসন লঙ্ঘিত হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য নিশ্চিতভাবেই এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে; মৌলবাদী দর্শনের মূলে নিহিত ভীতি ও হতাশা প্রশমিত করার জন্যে তার উচিত তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে ইসলাম সম্পর্কে অধিকতর সঠিক উপলব্ধি গড়ে তোলা।
তথ্যসূত্র
৫. প্রতিরুদ্ধ ইসলাম (পৃষ্ঠা: ১৫৫-১৯৬)
১. বেলায়েত-ই ফাকিহ্’র তত্ত্ব আগে জুরিস্টগণ আলোচনা করেছেন, কিন্তু স্বল্প পরিচিত এবং বেশীরভাগ সময়ই বিদ্রোহী এমনকি ধর্ম বিরোধী বলেও বিবেচিত হয়েছে। খোমিনি একে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার মূল বিষয়ে পরিণত করেন এবং পরে তা ইরানে তাঁর শাসনের ভিত্তিতে পরিণত হয়।
২. কুরান ২:১৭৮; ৮:৬৮; 24:34; 47:5।
৩. কুরান ৪৮:১।
৪. জয়েস এম. ডেভিস, বিটুইন জিহাদ অ্যান্ড সালাম : প্রোফাইলস ইন ইসলাম (নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৭) ২৩১।