৫. প্রতিমা

প্রতিমা

ক্রমওয়েল রোডে সোম কদাচ যেত, কিন্তু যখনি যেত দেখত অত্যন্ত বেশিরকম সাহেব, অতীব নির্লজ্জ, একটি ছেলে অম্লানমুখে স্বদেশনিন্দা করছে। এই ভারতবর্ষীয় পুরুষ মিস মেয়োটির সঙ্গে কথা বলতে বা তর্ক করতে সোমের প্রবৃত্তি হত না, তবু কৌতূহলাপন্ন সোম তার নামটি জেনে রেখেছিল। বীরেন দত্ত।

এই মহাপ্রভুর সঙ্গে পরে যে ভারতবর্ষের কালোমাটিতে কোনো দিন সাক্ষাৎ হবে সোম তা কল্পনা করেনি। ইনি কেমন করে সোমের ঠিকানা পেলেন বলা যায় না, কিন্তু একদিন সকাল বেলা কুণালকে অকালে জাগিয়ে তুললেন ও পাছে সে ইংরেজি না বোঝে এইজন্যে তাকে হিন্দিতে সমঝিয়ে দিলেন যে সোম তাঁর আদ্যিকালের বন্ধু এবং সোমকে তিনি নিতে এসেছেন। বাড়ির মালিক যে কে তা তিনি জানতেও চাইলেন না, বাড়ির মালিকের অনুমতি চাওয়া তো দূরের কথা। সোজা হুকুম করলেন ‘ড্রাইভার, টুম যাকে সাবকা সব চিজ লে আও।’

কে একটা লোক তার শোবার ঘরে ঢুকে তার সুটকেস ইত্যাদি নিয়ে টানাটানি করছে দেখে সোমের চক্ষুঃস্থির। লোকটা একটা সেলাম ঠুকে বলল হিন্দিতে—‘হুজুরের এই ক-টা জিনিস না আরও আছে?’

যাক, চোর নয়। কিন্তু কে তাও বোঝা যায় না। সোম বাইরে গিয়ে কুণালের খোঁজ করল। শুনতে পেল সে নিজের শোবার ঘরে ললিতাকে বলছে, ‘কল্যাণের বড়োলোক বন্ধু বি আর ডাট, বার-অ্যাট-ল, তাকে নিতে এসেছেন। সেই ভালো। আমাদের মতো লোকের দ্বারা তার তেমন আদর আপ্যায়ন হচ্ছে না, হতে পারে না।’ ললিতা বলছে, ‘তুমি তাহলে যাও, কল্যাণকে জাগাও। ব্যারিস্টার সাহেবকে বসতে বলেছ তো?’ কুণাল বলছে, ‘তিনি তাঁর মোটরগাড়িতেই বসা পছন্দ করলেন।’

সোম তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে ভাবল, কে এই বি আর ডাট? কবে ইনি আমার এমন প্রবল প্রতাপ বন্ধু হলেন? কুণাল-ললিতাকে এখন কী বলে খুশি করা যায়?

এমন সময় কুণাল ডাকল, ‘কল্যাণ। ও কল্যাণ।’

‘ভিতরে এসো।’

‘মিস্টার বি আর ডাট, বার-অ্যাট-ল তোমাকে নিতে এসেছেন। শিগগির তৈরি হয়ে নাও। সায়েব গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন।’

‘কে এই ভদ্রলোক? তোমার কোনো মুরুব্বি বুঝি?’

‘সে কি হে! তোমার অত বড়ো বন্ধু, তাঁর লোক এসে তোমার জিনিসপত্র নামাচ্ছে দেখতে পেলুম,।’

‘তুমি তো ভারি সরলবিশ্বাসী হে! ভদ্রলোক যদি ছদ্মবেশী বাটপাড় হয়ে থাকেন? আমার জিনিসগুলো হয়তো ইতিমধ্যে মোটরস্থ করে সরে পড়েছেন।’

‘অ্যা! তোমার বন্ধু নেই ও নামের?’

‘কই? মনে তো পড়ছে না? অন্তত আমি তো তাঁকে খবর দিইনি যে আমি কলকাতা এসেছি ও এ বাড়িতে উঠেছি।’

কুণাল ছোট্ট মানুষটি। ঠুক ঠুক করে ছুটল। সোমও তৈরি হতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে কুণাল ফিরে এল। এক গাল হেসে বলল, ‘না, ভাগবেন কেন? দিব্যি পাইপ টানতে টানতে কী একটা বিলিতি সুর গুনগুন করছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘সোম সাবকো সেলাম দো।’ ‘ভেবেছেন আমি বাড়ির চাকর।’

সোম চটে বলল, ‘এত বড়ো আস্পর্ধা! তুমি তাকে দু-কথা শুনিয়ে দিলে না-কেন?’

‘চাকর বলে ভুল করা অসম্ভব নয়। বুঝলে হে? ওঁরা ইঙ্গবঙ্গ মানুষ, ওঁদের চাকরদের উর্দির বাহার আমার এই ছেঁড়া পাঞ্জাবির চেয়ে—বুঝলে হে! আর আমার এই বেমেরামত চটি। হাঁ করে ধুলো গিলে খায়!’

সোম তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে নেমে গিয়ে দেখল চেনা চেনা ঠেকছে। কিন্তু কোথায় কবে চেনা তা মনে পড়ছে না।

‘Hello, সোম! We meet after an age in a strange land, don’t we?’

সোম মনে মনে বলল, তুমি কে বট হে।

‘Well’, মহাপ্রভু বললেন, ‘for the life of me I can’t conceive of a filthier human habitat than North Calcutta. Ugh!’

তখন সোমের স্মরণ হল ইনি সেই পুরুষ মিস মেয়ো, ক্রমওয়েল রোডের বীরেন দত্ত। বালিকাবিবাহের এত বড়ো পুংশক্র কলিতে অবতীর্ণ হননি। চোদ্দো বছর বয়সের দুধের মেয়ের কাছে কী করে যে মানুষ একটু প্রেম বা একটু সাহচর্য আশা করতে পারে তা ইনি for the life of me বুঝতে পারতেন না। একেবারে পাশব না-হলে কেউ অমন মেয়ে বিয়ে করতে পারে? এঁর মতে মেয়ের বয়স পঁচিশ না-হলে তার বিয়ে বেআইনি হওয়া উচিত।

ইংরেজিতে বললেন, ‘তুমি এ পাড়ায় থাকলে আমাদের শুদ্ধ মান যায়। মা ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই আমি নিজেই চলে এলুম তোমাকে নিতে। For goodness’ sake আর দেরি কোরো না। Ugh!’ এই বলে তিনি বাঁহাতের আস্তিন থেকে রুমাল বের করে নাকে দিলেন।

পরের ছেলের জন্যে কোনো মা-র এতখানি উৎকন্ঠা পুরাণে অথবা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই। সোম এর মধ্যে একটা নতুন রোমান্সের ইঙ্গিত পেল। বলল, ‘তাহলে অবশ্য দেরি করা উচিত নয়। দাঁড়াবে এক মিনিট?’

ললিতাকে বলল, ‘বোধ হয় ওর বোন টোন কেউ আছে, তাই। তোমরা কিছু মনে কোরো না, ললিতা। আমি পুনর্মূষিক হয়ে দিন দু-তিনের মধ্যে ফিরব।’

ললিতা বলল, ‘প্রার্থনা করি যেন তোমাকে ফিরতে না-হয়। অনেক কান্ড করেছ, আর কেন? এবার ওই ভীষ্মের পণটি ভেঙে ভালোমানুষের মতো বিয়ে করো।’

‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমি যেখানে যাই সেখানে রোমাঞ্চ ঘটাই।’ জীবনটাতে একটু নুন মাখিয়ে না-দিলে ওই আলুনি তরকারিটা কার মুখে রোচে? জগতের boredom লাঘব করতে আমার জন্ম।’

‘যাক, তুমি এ বাড়ি থেকে গিয়ে আমাদের নির্ভাবনা করলে। ভবনাথবাবু ও দ্বিজদাসবাবু আজ তোমাকে আক্রমণ করতে আসবেন ভেবে কাল রাত্রে আমাদের ভালো ঘুম হয়নি কল্যাণদা।’

‘আমার ক্ষমতার উপর তোমাদের তেমন আস্থা নেই দেখছি। ভবনাথ ও দ্বিজদাস আজ এলে তাঁদের ঠ্যাঙানোর জন্যে আমি যে বৃহৎ লাঠিগাছটি কিনে এনেছি সেটি তাঁদের হাতে উপহার দিয়ে বোলো, পিঠে উপহার দেওয়ার সুযোগ হল না। যেন কিছু না মনে করেন।’

পথে যেতে যেতে বীরেন দত্ত বলল, ‘বন্ধুতা হয় সমানে সমানে। ওঁদের দেখে দেশি সাহেব বলেও তো বোধ হল না?’

‘তবু ওঁরা আমার মতো বেকার নন।’ বলল সোম। ‘বেকার-s must not be choosers.’

‘হা-হাআআ।’ ডাট বিলিতি ধরনে হাসল। ‘যা বলেছ। তোমার কথাগুলো এমন রসিকতাপূর্ণ।’

‘কাজগুলোও তেমনি।’

‘কিন্তু আমিও একরকম বেকার। তা বলে উত্তর কলকাতা! Ugh!’

‘তুমি দেখছি মরলেও নিমতলা ঘাটে আসবে না।’

‘ওকথা ভাবিনি,’ ডাট গম্ভীরভাবে বলল, ‘কিন্তু ভাবনার বিষয় বটে।’

মিসেস ডাটা এসে সোমকে অভ্যর্থনা করে ড্রইং রুমে বসালেন। ছেলের মতো তিনি দেশদ্বেষী নন। অন্তত একুশটা বুদ্ধমূর্তি ওই একটি ঘরে ধ্যানস্থ। দাম যে অনেক দিয়েছেন তার সন্দেহ নেই। তবে তাদের মধ্যে কোনটি আসল কোনটি নকল তার বিচার করেননি।

যদিও সোমের দৃষ্টি বুদ্ধিমূর্তির অন্তরালে কার অন্বেষণরত তবু মিসেস ডাট মনে করলেন সে দৃষ্টি বুদ্ধমূর্তির প্রতি প্রশংসমান।

বললেন, ‘বুডঢা দেখছেন?’

চমকে উঠে সোম বলল, ‘হাঁ।’ তারপর উচ্চারণটাতে অস্পষ্টতা এনে বলল, ‘বৃদ্ধা দেখছি।’

‘ভালো বুডঢা?’

‘শুধু বৃদ্ধা।’

ওই প্রশ্নের এই উত্তর মিসেস ডাটের বোধগম্য হল না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জিনিসপত্র সঙ্গে করে এনেছ তো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘এই তো ভালো ছেলের মতো। আমরা তোমার ধরতে গেলে আপনার লোক—আমাদের বাড়ি থাকতে অন্যত্র উঠবে কেন?’

‘ঠিক।’

‘তোমার কথা আমি বীরেনের কাছে অনেক শুনেছি। এতদিন পরে তোমাকে দেখে তাই তেমন নতুন ঠেকছে না, যেন চেনা মানুষের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হল। না? তোমার কী মনে হয়?’

‘আমারও অবিকল তাই মনে হচ্ছে।’

‘তুমি নাকি ওদেশে খুব খ্যাঁকশিয়াল শিকার করতে?’

‘আজ্ঞে, তা তো করতুমই।’

‘আর তোমার নাকি তিনটে কুকুর ছিল?’

‘ছিল—টম, ডিক ও হ্যারি।’

‘তুমি নাকি একবার বলেছিলে যে তুমি বন্যবরাহের মাংস খেতে ভালোবাসো?’

‘ভালোবাসি বই কী?’

‘আর হকি খেলতে খেলতে তোমার নাকি পা ভেঙেছিল?’

‘সে হাড় এখনও জোড়া লাগল না!’

এমনি করে মিসেস ডাট যত উদ্ভট প্রশ্ন করেন মুখে মুখে বানিয়ে সোমও তার প্রত্যেকটির উত্তর দেয় প্রত্যুৎপন্নমতির সহিত। উত্তর দেয় আর আড় চোখে দরজাগুলোর দিকে তাকায়। এ বাড়িতে কি তরুণী নেই? নিরস্তপাদপ দেশ থাকতে পারে, কিন্তু তরুণী-বর্জিত ইঙ্গবঙ্গ পরিবার আছে নাকি? কোথায় তুমি রমলা, না বেলা, না ভায়োলেট, না প্যানসি, না লীনা, না মিনা, না রিনা। দেখা দাও, দেখা দাও। অয়ি সেকণ্ডহ্যাণ্ড ইংরাজ ললনা, এই সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মে-ফেয়ারে এসেছি তোমারই দেখা পেতে।

বীরেন দত্ত উত্তর কলকাতা থেকে ফিরে বাথ নিতে গেছল। প্রবেশ করে বলল, ‘Do you know, Mummy, how awful the stench was।’

মা বললেন, ‘I know, I know, wasn’t it awful?’

সোম উশখুশ করছিল! তার মনে হচ্ছিল তারও আর একবার স্নান করা উচিত, নইলে এঁরা তাকে ধাঙড়ের মতো অশুচি জেনে অস্বস্তি বোধ করবেন। যেন সে নর্দমা থেকে এসে ড্রইং রুমে বসেছে।

ইংরেজিতে মাতাপুত্রে যেসব কথা হল তাতে সোমের মনোযোগ ছিল না। সে ক্রমে ক্রমে নিজের গায়ের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে লাগল। যেন সত্যিই তার গায়ে নর্দমার গন্ধ; এত দিন তার গন্ধবোধ সক্রিয় ছিল না বলে টের পায়নি, এখন দূরে এসে সুদে-আসলে টের পেয়েছে। লণ্ডনের East End থেকে West End-এ—Bow থেকে Mayfair-এ—এলে যেমন সভ্য জগতে ফিরেছি ভেবে হর্ষ হয় এবং সেই সঙ্গে সভ্যমানুষের সমাজে নিজেকে অসভ্য ভেবে লজ্জা করে, এও কতকটা তেমনি।

সোম চাইল স্নান করতে।

মিসেস ডাট বললেন, ‘কিন্তু বেশি দেরি কোরো না, কী তোমার খ্রিশ্চান নাম?’

‘কল্যাণ।’

‘বেশি দেরি কোরো না, কলিন। এখনি ব্রেকফাস্ট দেবে। বীরেনের আবার কোর্টে যেতে হবে কিনা।’

বীরেন বলল, ‘সোম, তুমি কেমন করে সময় হত্যা করবে?’

সোম নিরাশার সহিত বলল, ‘ঘুমিয়ে।’

মা বললেন, ‘না না, তা কেন? আমরা যাব দোকানে, কলিন যাবে আমাদের সঙ্গে। কোনো আপত্তি আছে?’

সোম ‘আমরা’ কথাটা শুনে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘কিছুমাত্র না।’

বীরেন পাইপ মুখে বলল, ‘Lucky fellow, খাটুনি যে কাকে বলে তা তুমি জানলে না।’

সোম বলল, ‘অর্থাৎ বার লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দেওয়া যে কাকে বলে তা আমি জানলুম না।’

‘Well! আমার মতো বাচ্চা ব্যারিস্টারের ও ছাড়া আর কী করবার আছে? বুড়োরা যতদিন না-মরছে আমরা ততদিন ব্রিফহীন থাকতে বাধ্য।’

‘অন্যের মোকদ্দমার শুনানির সময় উপস্থিত থাকলে তো হয়।’

‘Terribly boring! বিশ্রী একঘেয়ে। বড়ো বড়ো ব্যারিস্টারেরা আড্ডা দিয়েই বড়ো হয়েছেন, যেমন ভালো ভালো ছাত্রেরা না-পড়েই ফার্স্ট হয়।’

ঢং ঢং করে ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা বাজল।

টেবিলে সোমের ডান দিকে যিনি বসলেন মিসেস ডাট তাঁর পরিচয় দিলেন, ‘আমার ছোটো মেয়ে প্রতিমা, এই বছর সোসাইটিতে বেরিয়েছে।’

সম্ভাষণ বিনিময়ের পর প্রতিমা বললেন, ‘I’m so sorry I couldn’t meet you when you came along.’

প্রতিমার মা এর উপর টিপ্পনী কাটলেন, ‘Baby had such a beastly headache.’

প্রতিমাকে দেখে সোমের মনে যে বিপুল আশার উদ্রেক হয়েছিল তার বেবির মাথাব্যথার সংবাদে তা সম্পূর্ণ তিরোহিত হল। এ মেয়ে তাহলে বিবাহিতা।

কিন্তু দুই এক কথার পর জানা গেল এই বিশ-একুশ বছর বয়সের মেয়ের নিজেরই ডাকনাম বেবি। বাঁচা গেল।

সোম বেবির মাথাব্যথায় একান্ত ভাবনার ভাব দেখিয়ে সমবেদনা জানালে বেবি ইংরেজিতে বললেন, ‘সেরে গেছে।’

যাক, আবার বাঁচা গেল।

প্রতিমাকে বিধাতা সুন্দরী করে গড়েছিলেন, তাঁর অভিপ্রায় ছিল এ মেয়ে সুন্দরীই থাকে। কিন্তু পড়েছে শক্ত হাতে। স্মার্ট হওয়ার শিক্ষা পেয়ে স্মার্ট হওয়াকেই মোক্ষ জ্ঞান করেছে। যে হতে পারত সুকেশী তার কেশ তৎকালীন ফ্যাশন মেনে খর্ব হল ল্যাজকাটা কুকুরের মতো, তারপর ফ্যাশন বদলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বাড়ছে, মুরগির ছানার রোঁয়ার মতো। বাঙালির মেয়ের পক্ষে যে যারপরনাই ফর্সা তাকে নিষ্ঠার সহিত পাউডার মাখতেই হবে এবং ঘামে যদি তার খানিকটা ভেসে যায় তবে সঙের মতো দেখাতেই হবে। মেয়েটি রোগা। তার বুকের হাড়গুলো ফুটে বেরোচ্ছে। সেই দৃশ্য উদঘাটন না করলেই নয়। তাই ব্লাউজ হয়েছে বেহায়া।

আর কিবা ইংরাজি! অনর্গল বলতে পারে বটে, কিন্তু অর্গল থাকলে হয়তো বিশুদ্ধি থাকত। ‘Fell inside the water!’

কিন্তু তার কী দোষ! যেমন শিক্ষা তেমনি সংসর্গ। সোমের হাতে পড়লে দুদিনে ঠিক হয়ে যেত। সোম তাকে শাসাত না, শেখাত না, শুধু হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিত তার ভুল ইংরেজি, তার স্মার্ট আচরণ, তার নকলনবিশি। উপহাসই এই রোগের একমাত্র দাওয়াই। শুধু এই রোগের কেন সব রোগের। সেদিন রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে সোম লক্ষ করে এল পরমহংসদেবের প্রতিকৃতিকে মহাসমারোহে খাওয়ানো-শোওয়ানো হচ্ছে। যে মানুষ জীবনে কোনোদিন ঐশ্বর্যের-আরামের ভোগবিলাসের ছায়া দেখলেন না তিনি কায়াহীন হয়ে হঠাৎ বড়োলোক হয়েছেন, শোন মেঝের উপর মাদুর পেতে নয়, পালঙ্কের উপর ধবধবে তুলতুলে বিছানায়, খান যেদিন যা জোটে তা নয়, কিন্তু যাক সে কথা। সোম সেদিন একবার অট্টহাস্য করে ব্যাপারটাকে আগাগোড়া উড়িয়ে দিল।

তেমনি হাসি হাসতে হবে প্রতিমাকে যদি পত্নীরূপে লাভ করে। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা না-করে সোম আজকেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে হেসে ফেলল অন্যমনস্কভাবে। তার ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনি একটা হাসির কথা উঠেছিল। মিসেস ডাট আশা করেছিলেন যে সকলেই তাঁর কথায় হেসে সায় দেবে। কাজেই সোম ধরা পড়ে গেল না। মিসেস ডাট ভাবলেন ছেলেটার রসবোধ আছে। নইলে কেউ তো তাঁর হাসির কথায় এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না।

‘জানো, মা,’ বীরেন বলল, ‘সোম কত বড়ো একজন হাস্যরসিক?’

‘হাঁ, আমার মনে আছে। (সোমকে) তুমি নাকি Punch-এ লেখা দিতে?’

‘এবং সে-লেখা ছাপাও হতো।’

‘কই,’ প্রতিমা বলল, ‘নাম পড়েছি বলে তো স্মরণ হয় না?’

‘সেটা আপনার স্মরণের দোষ নয়। লেখাগুলো বেনামি।’

‘Wasn’t that cute?’ প্রতিমা বলল।

‘হাস্যরসিকের বন্ধু হয়ে বিপদ আছে।’ বীরেন বলল, ‘কোনদিন আমাকেই সকলের হাস্যাস্পদ করে আঁকবে।’

‘শুধু তোমাকে কেন,’ তার মা বললেন, ‘আমাকেও, বেবিকেও।’

প্রতিমা আতঙ্কের ভান করে বলল, ‘My goodness! Go away Mr Shome, go away!’

‘আপনাকে অভয় দিচ্ছি,’ সোম বলল, ‘আপনাকে দেখে নিজে হাসতে পারি, কিন্তু আপনাকে দেখিয়ে পরকে হাসাব না।’

প্রতিমা ক্ষুণ্ণ হল। কাগজে তার নাম উঠুক, সকলে তাই নিয়ে আলোচনা করুক, তার সখীরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরুক, এই ছিল তার মনোগত সাধ।

‘নিজে হাসবেন, কেউ জানতেও পারবে না, সে তো আরও ভয়ংকর। না, মা?’

‘ভয়ংকর বই কী। অতি ভয়ংকর। কলিন যাতে না-হাসে তোমাকে তেমনি ব্যবহার করতে হবে, বেবি।’

‘ইস। আমার খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই। I am not one of those goody goody girls; I am a bad girl.’

‘শোনো মেয়ের কথা।’ মিসেস ডাট নতুন মানুষের কাছে অমন দুষ্টুমির অনুমোদন করলেন না, তা ওঁর গলার স্বরে ব্যক্ত হল।

খাওয়া সারা হলে পাইপ মুখে পুরে বীরেন মোটরে উঠল। হাত উঁচিয়ে বলল, ‘Good-bye, Mummy. Good-bye, Baby. Cheerio, Shome.’

মা ও বোন সুর করে বললেন, ‘Bye-bye Biren’ সোম বলল, ‘Cheerio Dutt.’

ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষে, পায়ে হাইহিল জুতো পরে, হাতে ব্যাগ ধরে প্রতিমা চলল তার মার সঙ্গে সওদা করতে, Hall and Andersonএর দোকানে। সোম হল সাথি।

সাথির কর্তব্য এক্ষেত্রে মাত্র একটি—যে মেয়ে একদিন তার স্ত্রী হতে পারে সে মেয়ে কী কিনতে ভালোবাসে ও কত দাম দিয়ে। সোম তার এই কর্তব্যকে অতিমাত্রায়গুরুতর বলে গ্রহণ করল, রোমান্সের প্রভাবমুক্ত চক্ষুষ্মান পুরুষমাত্রই যা করে থাকে। নতুবা ঋণং কৃত্বা প্রাণং যাবেৎ।

Hall and Anderson-এর দোকানে ওঁরা যে সকল ব্যবহার্য ও প্রদর্শনীয় বস্তু মূল্য দিয়ে আহরণ করলেন ওসকল বহন করাও হল সোমের অতিরিক্ত কর্তব্য। সংখ্যায়বড়ো অল্প বা ভারে নিতান্ত লঘু নয় সেগুলি। একখানা এক-শো টাকার নোট ওঁরা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন, আর একখানারও প্রায় অন্তিম দশা উপনীত হল। যা প্রস্তুত পাওয়া গেল না তেমন দ্রব্যের অর্ডার দিয়ে ওঁরা সে যাত্রায় ক্ষান্ত হলেন এবং হলেন নিষ্ক্রান্ত।

তখন মিসেস ডাট বললেন, ‘চলো দেখি নতুন কোনো বুডঢা এসেছে কি না।’

মিস ডাট বললেন, ‘Oh, Buddha ! শুনবেন মিস্টার সোম, মা নাকি স্বপ্ন দেখেছেন যে তিনি শত বুদ্ধমূর্তি সংগ্রহ করলে বীরেন হাইকোর্টের জজ হবে।’—বড়ো ভাইকে এঁরা দাদা বলেন না। ওটা স্মার্ট নয়।

সোম বলল, ‘আপনি কি স্বপ্নে বিশ্বাস করেন, মিসেস ডাট?’

‘করি কলিন। তোমরা বলবে ওটা একটা কুসংস্কার, কিন্তু there are more things in Heaven and Earth—’

‘যা বলেছেন। চলুন তবে বুদ্ধের সন্ধানে।’

এবার কেনা হল স্ফটিকের বুদ্ধ। প্রতিমা বলল, ‘What a sweet little thing! এটি থাকবে আমার ড্রেসিং টেবিলের উপর।’

মা বললেন, ‘না, না। একালের মেয়েগুলোর ধর্মাধর্ম জ্ঞান নেই। এটি হচ্ছে কলিনের প্রতি তার বন্ধুর মায়ের প্রথম উপহার।’

সোম মুখে ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বলল, আশা করি দ্বিতীয় উপহার হবে বুডঢা নয় তরুণী।

‘Now,’ প্রতিমা বলল, ‘আপনাকে কি আমি হিংসে করব না, মিস্টার সোম?’

‘কে জানে,’ সোম কথাটাকে একটু রহস্যময় করে বলল, ‘এ জিনিস হয়তো একদিন আপনারও হবে।’

মিসেস ডাট বুঝলেন। প্রতিমাও। তার গালের রং ঠোঁটের রঙের সঙ্গে মিশ খেল। ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কী করে?’

‘বাঃ। কোহিনুর হিরে ইংল্যাণ্ডের রাজার হতে পারে আর এই স্ফটিক বুদ্ধ আপনার হতে পারে না? সুন্দর জিনিসমাত্রই হাত বদলায়।’ মনে মনে জুড়ে দিল, সুন্দরী নারীও।

অমন উত্তর অবশ্য মা বা মেয়ে প্রত্যাশা করেননি। ভাবলেন উত্তরটা অকপট। খিন্ন হলেন।

অগত্যা সোম একছড়া মালা কিনল—এক প্রকার সবুজ পাথরের; মালা সমেত হাত দুটিকে জোড় করে ও ভঙ্গিপূর্বক ঘুরিয়ে মুদ্রার মতো করে বলল, ‘অয়ি ঈর্ষান্বিতা, গ্রহণ করুন।’

প্রতিমা বিলোল কটাক্ষপাত করে চক্ষুতারকাকে ঊর্ধ্বচারী করল। তারপর নিম্নগামী করে মৌনের দ্বারা সম্মতিজ্ঞাপন করল।

‘আহা, কেন তুমি অত খরচ করে ওসব কিনছ, কলিন? বেবির জন্যে অমন অপব্যয় করা এই ডিপ্রেশানের দিনে সংগত নয়।’

‘আপনিও তো,’ সোম বলল, ‘আমার জন্যে কিছু কম খরচ করলেন না, মিসেস ডাট।’

‘সে-কথা স্বতন্ত্র। বুডঢা আমি কিনতুমই, যাকেই দিই না কেন।’

সোম মনে মনে বলল, তরুণীকে আমি দিতুমই, যাই কিনি না কেন।

মালা পরে প্রতিমা বলল, ‘Mummy, do I look too funny?’

মা বললেন, ‘No, darling, you don’t.’

তখন সোমকে প্রতিমা বলল, ‘Thank you ever so much.’

সোম রঙ্গ করে বলল, ‘Please.’ তারপর ব্যাখ্যা করে বলল, ‘জার্মানিতে সেবার গেছলুম। আমি যতবার বলি ‘Thanks’ ওরা ততবার বলে ‘Please’; আর আমি যতবার বলি ‘Please’ ওরা ততবার বলে, ‘Thanks’ ‘ভারি মজার। না?’

প্রতিমা মাথাটাকে চক্ষের নিমেষে তিনবার নেড়ে বলল, ‘সত্যি’।

মিসেস ডাট বললেন, ‘জার্মানরা ইংরেজি বলে তা হলে?’

‘বলে বটে, কিন্তু আমাদের মতো যত্নের সহিত নয়। ওদের এক ভয়ানক বদ দস্তুর নিজের ভাষাটাকেই সব আগে শেখে ও সবাইকে শেখাতে চায়। পরের ভাষাকে ভাবে পরের ভাষা। এরকম উল্লুক এদেশে বেশি নেই, এইজন্যে আমাদের এমন প্রগতি।’

মিসেস ডাটের সন্দেহ হল, সোম হয়তো পরিহাস করছে। কিন্তু বিলেতফেরত কি কখনো ও-নিয়ে পরিহাস করতে পারে?

প্রতিমা একটু ভাবুকের মতো ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, জার্মানরা একটু বোকা, না?’

‘একটু কেন, খুবই। এই দেখুন না, প্যারিস থেকে মেয়েদের ও লণ্ডন থেকে ছেলেদের পোশাক আনিয়ে নিতে কতই বা লাগে। তবু ওরা ভালো পোশাক পরবে না। পরবে স্বদেশি তৈরি খাদির মতো বিশ্রী কুরুচিকর বস্ত্র। আমরা কেমন বুদ্ধিমান, ল্যাঙ্কাশায়ারের লোককে তাঁতি বানিয়ে ছেড়েছি।’

প্রতিমা আগের মতো মাথা দুলিয়ে বলল, ‘বাস্তবিক।’

সোমের খাতিরে বীরেন সকাল সকাল ফিরল। টেনিসের চারজন যাতে হয় তার জন্যে সঙ্গে করে আনল যাঁকে তিনি তার বাগদত্তা, মিস কমলা সেন। কমলার উচ্চারণ কমলা। যেমন রমলার উচ্চারণ রমলা।

এদিকে কমলা ও বীরেন, অন্যদিকে প্রতিমা ও সোম। তুমুল সংগ্রাম। মান নিয়ে টানাটানি। সোম প্রতিমাকে বলে, ‘জিতিয়ে দেব।’ বীরেন কমলাকে বলে ‘জিতিয়ে দেব।’ শেষপর্যন্ত জয় হল সোমদেরই। তবে টায়টোয়। বীরেন শাসিয়ে বলল, ‘কাল দেখে নেব। প্রতিমা খিল খিল করে হেসে বলল, ‘Six to nil.’

কমলা দুষ্টুমি করে বলল, ‘তার মানে love set.’ সোম দুষ্টুমিতে যোগ দিয়ে বলল, ‘Let’s see whose love will set.’

পর পর তিনদিন টেনিস খেলায় জিতে সোম ও প্রতিমা পরস্পরের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল।

সোম হেসে বলল, ‘মিস ডাট, এবার আমরা টুর্নামেন্টে খেলব।’

প্রতিমা খুশি হয়ে বলল, ‘তা হলে তো এ জন্মে কোনো খেদ থাকে না।’

বীরেন এ কথা শুনে বলল, ‘অত গর্ব ভালো না। অতি দর্পে রাম মারা গেছলেন।’

কমলা শুধরে নিয়ে বলল, ‘রাম নয়, রাবণ।’

সোম বলল, ‘আপনি দেখছি রামায়ণখানা পড়ে মনে রেখেছেন, মিস সেন।’

মিস সেন বললেন, ‘হাঁ, রোমেশ ডাটের রামাইয়ানা ও মহাবারাটা আমি ধর্মগ্রন্থের মতো পাঠ করেছি।’

সোম বলল, ‘রামায়ণ ও মহাভারত ধন্য হল।’

তারপর কথা চলল টেনিসকে অবলম্বন করে। দেশি বিলাতি জাপানি খেলোয়াড়দের চুলচেরা সমালোচনা, তাদের ফর্ম, তাদের স্টাইল, তাদের ড্রাইভ, তাদের টিম-ওয়ার্ক, তারা কে কাকে হারাবে, কয় গেমে হারাবে ইত্যাদি। এরাই যে তাদের ভাগ্যবিধাতা সে বিষয়ে এদের কারুর সংশয় ছিল না। মিসেস ডাটও মাঝে মাঝে মন্তব্য পেশ করছিলেন। তিনি যে নিজে একজন টেনিস খেলোয়াড় তা নয়। তাঁর স্বামী বেঁচে থাকতে সামাজিকতার অঙ্গ হিসেবে টেনিস খেলাটাও তাঁর জানা ছিল। স্বামী গেছেন, কিন্তু ভড়ং যায়নি। রাখবার মধ্যে রেখে গেছেন একখানা বাড়ি, সেটার গুণ এই যে সেটা বন্ধকমুক্ত। তার একটা পাশে ভাড়াটে বসিয়ে ভাড়ার টাকায় কায়ক্লেশে এদের দিন গুজরান হয়। বীরেন যে বিয়ে করতে পারছে না ওই তার কারণ। আগে প্রতিমার বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর বীরেনের বিয়ে, সেইজন্যে প্রতিমার বিয়ের জন্যে বীরেনের এমন চাড়, এতটা গরজ। পাত্রের খোঁজে সে উত্তর কলকাতার মাটি মাড়ায়। নইলে প্রতিমার প্রতি যে তার বিশেষ স্নেহমমতা তার লক্ষণ দেখা যায় না। পরের বোনকে যত তোয়াজ করে নিজের বোনকে তার আধুলি, কি সিকি কি দুয়ানিও না। তার বেলায় করে সর্দারি, কমলার বেলায় করে খিদমদগারি।

একটি আমেরিকান মহিলার গল্প সোমের মনে পড়ছিল। বিধবা হয়ে তিনি তাঁর স্বামীর লাইফ ইনশিওরেন্সের টাকা যা পেলেন তাতে তাঁর ও তাঁর বিবাহযোগ্যা দুই মেয়ের অতি কষ্টে দু বছর চলতে পারে। তিনি করলেন কী, না শহরের সবচেয়ে বড়ো হোটেলে মাস দুয়েকের মধ্যে সমস্ত টাকাটা ফুঁকে দেওয়ার সংকল্প করলেন। আত্মীয়েরা বলল, ‘পাগল!’ বন্ধুরা বলল, ‘আমরা চাকরি জুটিয়ে দিচ্ছি, অমন করে আত্মহত্যা কোরো না।’ বিধবার কিন্তু এক কথা।

মাস দুয়েক যেতে-না-যেতে দেখা গেল বড়ো মেয়েটি বাগদত্তা হয়েছে—যার বাগদত্তা তিনি এক নিযুতপতি (অবশ্য নিযুত সংখ্যক নারীর না)। বড়ো মেয়ের চেষ্টায় ছোটো মেয়েও তেমনি পাত্রে পড়ল। তখন বিধবার আহ্লাদ দেখে কে? তিনি বছর দুয়েক চাকরি করলেন, কিন্তু নিযুতপতিদের শাশুড়ি কি সোসাইটি থেকে সরে গিয়ে বনবাস করতে পান? তাঁর উপর সমাজের তো একটা দাবি আছে? কে একজন লাখপতি তাঁকে বিয়ে করে জাতে উঠল। বন্ধুরা বলল, ‘সাবাস।’ আত্মীয়রা বলল, ‘এবার আমাদেরও একটা কিনারা করো।’ বিধবাটি—না, না, সধবাটি—বললেন, ‘আমি জানতুম যে আমার মেয়ে দুটি রূপসি, কেবল একবার নিযুতপতিদের চোখে পড়লে হয়। তাই সর্বস্ব পণ করে নিযুতপতিদের চোখের সুমুখে তুলে ধরলুম। যদি ব্যর্থ হতুম তবে ভিক্ষা ছাড়া আমাদের অন্য গতি ছিল না—অথবা ভিক্ষার শামিল চাকরি।’

হায়, দেশটা আমেরিকা নয়। তাই কোনো মাড়োয়াড়ি শেঠের বদলে বেকার সোমকে পাকড়াতে হয়। এঁরা আই সি এস, আই এম এস-এর আশায় আশায় থেকে নিরাশ হয়েছেন। একে তো তাদের সংখ্যা তাদের আশাপথবর্তিনীদের সংখ্যার অনুপাতে ক্ষীণাতিক্ষীণ, তার ওপর তারা আজকাল ডেপুটি মুনসেফের মেয়ে বিয়ে করে। (‘They deserve no better’) তাদের চেয়ে যেকোনো বেকার বিলেতফেরতা ভালো। অবশ্য যদি তার পৈত্রিক সম্পত্তি থাকে। সোমের বাবার বিজ্ঞাপনটা এরাঁ পড়েছিলেন। যে-কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল সে-কাগজ যদিও এঁদের চোখে পড়ে না তবু কে একজন হিতৈষী বন্ধু তার একটা কাটিং এঁদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপনে লিখেছে কায়স্থ পাত্রী চাই। মিসেস ডাটের মনে পড়ল তাঁর পিতৃকুল, মাতৃকুল ও শ্বশুরকুল তো কায়স্থ। অতএব তাঁর মেয়েও কায়স্থ। আর মেয়ে যে সুন্দরী, শিক্ষিতা ও কলাবতী এ বিষয়ে কোন জননীর দৃঢ় বিশ্বাসের অভাব ঘটে, অন্তত তার বিয়ের বেলায়? ‘You want the best brides? We have them.’ বিলাতি দোকানদারদের এই জাতীয় বিজ্ঞাপনের পশ্চাতে যে আত্মপ্রত্যয় ঊহ্য থাকে বিবাহযোগ্যা মেয়ের মা-দের মনেও থাকে তাই। তবে তাঁরা বিজ্ঞাপন নাও দিতে পারেন।

মিসেস ডাট একদিন আচমকা বললেন, ‘জাত জিনিসটা খুব যে বেশি খারাপ তা আমি মনে করিনে, যাই কেন বলুক না ওরা (অর্থাৎ ইউরোপীয়রা)।’

সোম একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কেন বলুন তো?’

‘জাত না থাকলে তার জায়গায় আর একটা কিছু থাকে, এই যেমন ক্লাস। আমরা ইঙ্গবঙ্গরা একটা ক্লাস হয়ে উঠেছি, সেটা ভালো নয়। আমি তো বলি, Back to the caste. তুমি শুনে সুখী হবে, কলিন, যে এ বাড়ির আমরা এখনও কায়স্থ আছি—রক্তে। এ বাড়ির আমরা পাশ্চাত্যকেও নিয়েছি, প্রাচ্যকেও ছাড়িনি।’

সোম মনে মনে বলল, প্রাচ্যকে যে ছাড়েননি তার প্রমাণ আপনার স্বপ্নে বিশ্বাস, আপনার বুডঢা, আপনার নিজের হাতের দেশি আমিষ রান্না। কিন্তু জাত? আপনার দুই মেয়ে কি অন্য জাতে পড়েনি? আপনার ছেলেও তো কায়স্থের মেয়ে ঘরে আনবে না। তা সত্ত্বেও আপনারা যদি কায়স্থ হন তো তাতে আমার সুখী হওয়ার কী আছে?

বলল, ‘হ্যাঁ। জাত জিনিসটা রেখে মস্ত সুবিধে। আমিও ওর চেয়ে সুবিধের কিছু না পেলে ওটা দিচ্ছিনে, মিসেস ডাট।’

এরপর মিসেস ডাট সোমের বাড়ির প্রসঙ্গ পাড়লেন এবং পৃষ্ঠপোষকীয়ভাবে মাথা নোয়ালেন ও তুললেন।

প্রতিমার সঙ্গে নিভৃত আলাপের সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে সোম একদিন তা পেল। বোকাটা জানল না যে সুযোগ সে দৈবক্রমে পেল না, পেল না তার পুরুষকারের দ্বারাও। পেল মিসেস ডাটের গোপন অনুগ্রহে তথা আগ্রহে। সিনেমার বক্সে।

‘মিস ডাট,’ সে ঘটা করে বলল, ‘আমি যে, এতদিন আপনাদের ওখানে থাকলুম সে কি শুধু টেনিস খেলবার জন্যে?’

মিস ডাট বিবাহ-প্রস্তাবের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আরম্ভের সুরে তাঁর হৃদয় নৃত্যের জন্যে চরণ তুলল। তিনি বিস্ময়ের ভান করে বললেন, ‘আপনার অন্যকোনো উদ্দেশ্য ছিল নাকি?’

‘ছিল না?’

‘ছিল?’

‘এত যে love game-এ আপনি ও আমি পার্টনার হলুম তা কি শুধু খেলাক্ষেত্রে আবদ্ধ রইবে?’

‘যান!’

‘যাবই তো, কিন্তু যাওয়ার সময় কি একলাটি যাব?’

‘আপনি ভা-রি দুষ্টু, মিস্টার ব্যাড ম্যান।’

‘আপনিও তো বলে থাকেন আপনি ব্যাড গার্ল।’

‘But fancy taking me away! O Mummy!’

‘থাক থাক, মা-কে ডাকবেন না। বড্ড বেরসিক তো।’

‘But do tell me, কোথায় আমাকে নিয়ে যাবেন?’

‘আপনার শ্বশুরবাড়ি।’

‘ও মা, সেই পুর্ণিয়া না পুরুলিয়া। কোথায় সেটা, মধ্যপ্রদেশে?’

‘বেশি দূর না, বেহারে।’

‘সেখানে কি সভ্য মানুষের বাসের সব সুবিধা আছে, দক্ষিণ কলকাতার মতো?’

‘না। কিন্তু কোনো সুবিধা না থাকলেই বা কী! সুবিধার চেয়ে যা বড়ো তা আছে—স্নেহ-মমতা।’

প্রতিমা ঠোঁট উলটিয়ে বলল, ‘যেখানে creature comforts নেই সেখানে বিংশ শতাব্দীই নেই। আমি সেই বর্বরযুগে ফিরে যেতে চাইনে, যে-যুগে মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ত, কেরোসিনের আলোতে পড়ত, কুয়োর জল খেত—যে-যুগে ছিল না টকি।’

সোম হতাশ হয়ে বলল, ‘তাহলে আমি আজ রাত্রেই চললুম।’

‘সে কি! কোথায়?’

‘জানিনে কোথায়,—কুস্তোড় কলিয়ারি, কি নান্দিয়ার পাড়া, কি ডুমরাওন।’

‘কেন, শিকার করতে?’

‘হ্যাঁ, শিকার করতে। তবে বাঘ শিকার নয়, বউ শিকার।’

প্রতিমা নির্বাক।

সোম বকে গেল, ‘হ্যাঁ। বউ শিকার। একটি বীণাপাণি, কি লক্ষ্মীরানি, কি জ্যোৎস্নাময়ী—বর্বর যুগের মানুষের বর্বরযুগীয় নাম—যদি পাই তবে আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক।’

‘মিস্টার সোম! মিস্টার সোম! কী আপনার রুচি। আপনার উচিত হচ্ছে না আমার পাশে বসা।’

‘তাই তো,’ সোম বলল, ‘আপনারা এ যুগের ব্রাহ্মণ, বর্বরের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলাই আপনাদের একমাত্র ভাবনা। আর আমি বর্বর বংশে জন্মেছি আমার বর্বর complex নেই। আমার খেদ কেবল এই যে, বর্বরের চেয়েও বর্বর আছে—যেমন সাঁওতাল—তাদের প্রতি আমার বন্ধুদের তেমনি অবজ্ঞা যেমন আমার বন্ধুদের প্রতি আপনাদের।’

প্রতিমা দেখল সোম ঠাট্টা করছে না। তখন বলল, ‘মিস্টার সোম, আপনি ঠাট্টাও বোঝেন না?’

‘কোনটা ঠাট্টা?’

‘যান! আমি বলব না।’

‘আপনি বর্বরদের দেশে যেতে প্রস্তুত আছেন?’

প্রতিমা চক্ষু নত করল। হঠাৎ তার ব্যাগটার প্রতি তার মনোযোগ একান্ত হল। সেটাকে নিয়ে সে লোফালুফি করতে থাকল।

‘আপনি সভ্যতার সব সুবিধা না-পেলে সেখানে টিঁকে থাকতে পারবেন?’

প্রতিমা একবার সোমের সঙ্গে চোখাচোখি করল। তারপর ব্যাগ নিয়ে তেমনি লোফালুফি।

সোম বলল, ‘খুব খুশি হলুম। কিন্তু—’

প্রতিমা চমকিয়ে উঠল।

‘কিন্তু,’ সোম বলল। ‘আমার পরিচয়ের এক স্থানে একটু কালিমা আছে।’

প্রতিমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।

‘ওটুকু,’ সোম বলল ‘আমার পরিচয়ের গায়ের আঁচিল। আমাকে গ্রহণ করলে ওটুকু স্বীকার করতে হয়।’

দৃশ্যের দিকে দুজনের কারুর লক্ষ্য ছিল না। গানের দিকে ছিল না কান। ওদের নিজেদেরই জীবনে এসেছে একটি সংকট মুহূর্ত। নায়ক-নায়িকার সংকটে তারা বিমনা হল না। প্রতিমা হল উন্মনা, সোম হল বাঙ্খয়।

‘মিস ডাট, যাকে বলে slip তা আমার জীবনে ঘটেছে।’

‘Eh?’

‘বললুম আমি সত্যিই ব্যাড ম্যান।’

‘You don’t mean it, do you?’

‘আমি যা বলছি তার মানে তাই।’

‘No. It can’t be. It can’t be.’

‘আপনি বিশ্বাস না-করলে আমি কী করব বলুন।’

‘I can’t believe it. Fancy—Oh!’ বলে প্রতিমা দুই হাতে মুখ ঢাকল ও মাথাটা নাড়তে থাকল! বলতে থাকল, ‘Oh! Oh! Oh!’

সোম তার কানে কানে বলল, ‘চুপ, চুপ। পাশের বক্সের ওরা কী ভাববে।’

প্রতিমা ক্ষিপ্তের মতো বলল, ‘You have broken my heart. You have. You have.’

সোমটা বোকা। যদি বলত, হ্যাঁ, আমি আপনার হৃদয়টিকে ভেঙে চুরমার করেছি তাহলে প্রতিমা গৌরব বোধ করত। ভগ্ন হৃদয় কার না গৌরবের সামগ্রী? ভ্রষ্ট কৌমার্য্যের মতো।

বলল, ‘কিন্তু, মিস ডাট, আপনিও তো ব্যাড গার্ল।’

‘না। আমি নই, আমি সে অর্থে নই।’

‘সে অর্থে হলেও কি আমি অপরাধ নিচ্ছিলুম? আমি তো সেই অর্থই বুঝেছিলুম।’

‘ভুল, ভুল, আপনার বোঝবার ভুল।’ প্রতিমা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘O Mummy!’

সোম চঞ্চল হয়ে বলল, ‘ছি, ছি, মা-কে এসব কথা বলবেন কেন? আপনি তো নাবালিকা নন।’

মাকেই যদি না-বলবে তবে তার নাম বেবি হল কেন?

সোম টের পেল যখন মিসেস ডাটের মুখমন্ডল বিষাদের ছায়াঙ্কিত দেখল। যেন মুখমন্ডল নয়, silhouette.

তিনি বললেন, ‘কলিন, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

সোম জানত কী সে কথা। ‘বলুন।’

‘কলিন, তুমি আমার ছেলের বন্ধু, ছেলের মতো। তোমাকে বিশ্বাস না-করলে বাড়িতে জায়গা দিতুম না। তুমি নিজেই বলো তুমি কি বিশ্বাসের যোগ্য?’

‘কেন, আমি কি কোনো জিনিস চুরি করেছি?’

‘না।’

‘কাউকে ঠকিয়ে কোনো জিনিস আত্মসাৎ করেছি?’

‘না।’

‘কারুর প্রতি গর্হিত আচরণ করেছি?’

‘না।’

‘তবে?’

‘তবে—তবে তুমি যে বেবির হৃদয়টিকে অমন কথা বলে smash করলে সেটা কি ভদ্রজনোচিত হল?’

‘যা সত্য তাই বলেছি, এখন না বললে পরে তো জানাজানি হত।’

‘তেমন জানাজানিতে,’ মিসেস ডাট বললেন, ‘কিছু এসে যেত না। বিয়ের আগে কার স্বামী কী করেছেন তা কি কোনো স্ত্রী ঘাঁটতে যায়? ওসব হয়তো তোমার ইউরোপে সম্ভব, কিন্তু আমরা ভারতীয় হিন্দু কায়স্থ, আমাদের আদর্শ সীটা ও সাবিট্রী।’

‘এতেই বা কী এসে যায়?’ সোম দুঃসাহসিক প্রশ্ন করল।

‘কী এসে যায়? কলিন, কী এসে যায়? How dare you ask that question? How dare you?’

সোম থতোমতো খেয়ে বলল, ‘আমি ভালো মনে করেই ও প্রশ্ন করেছি।’

‘না, না। অমন প্রশ্ন ভালো নয়। বিয়ের পরের কথা এক, বিয়ের আগের কথা অন্য। কোর্টশিপের সময় অমন কথা permissible নয়, ওতে একটা বিশ্বস্ত হৃদয় ভীত চকিত ভগ্ন হয়। ও কথা শুনলে যাদের হিস্টিরিয়া নেই তাদেরও হয় হিস্টিরিয়া, আর যাদের আছে তাদের নিয়ে তাদের মা-দের কী যন্ত্রণা!’

তিনি বলতে লাগলেন, ‘না, কলিন, না। তুমি বিলেতফেরত, you ought to know better. তুমি যে একটা বাবুর মতো ব্যবহার করবে তা আমরা কেউ কল্পনা করতে পারিনি—তুমি আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখলে না।’

‘তা হলে,’ সোম প্রস্তাব করল, ‘আমাকে বিদায় দিন, আমি আসি।’

‘সে কী?’

‘আমি যে ব্যবহার করেছি তার শাস্তি এ অঞ্চল থেকে নির্বাসন।’

‘না, না, তার দরকার নেই। তোমাকে আমরা তৈরি জিনিসটি ভেবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলুম! তুমি তা নও। এর প্রতিকার তোমাকে তৈরি করে নেওয়া।’

সোমের ধারণা ছিল সোমই প্রতিমাকে তৈরি করবে। তা নয়, প্রতিমা ও তার মা সোমকে তৈরি করতে উদ্যত। ইঙ্গ-বঙ্গ ফেরঙ্গের উপর সোমের উৎকট অবজ্ঞা অবশেষে শ্লাঘায় পরিণত হবে। বিচ্ছেদ ঘটবে তার পিতৃ-পিতামহের সমাজের সঙ্গে, সংস্কারের সঙ্গে। তার মাসিমা পিসিমারা তার স্ত্রীর ভাষা বোঝবার জন্যে বেণী গাঙ্গুলির ইঙ্গ-বঙ্গ অভিধান কিনবেন। ‘ভারতীয় হিন্দু কায়স্থ’ হয়ে সে ধুতি পরতে পাবে না, পাছে তার বাবুর্চি-খানসামা-মশালচি তাকে বাবু মনে করে ও নিজেদের মধ্যে বাবু বলে উল্লেখ করে। এ বাড়িতে ধুতি একটা ফ্যান্সি ড্রেস। অথচ সোম বিলেতেও ধুতি পরে এসেছে।

‘মিসেস ডাট’, সোম বলল, ‘একা আমাকে তৈরি করে আপনাদের কী হাতযশ হবে? যদি পারতেন আমার মা-বাবাকে, ভাই-বোনকে, কাকি-মামি-মাসি-পিসিকে কাকা-মামা-মেসো-পিসেকে তৈরি করতে তবেই জানতুম আপনাদের হাতের গুণ। আমাকে বিদায় দিন, আমি আসি।’

মিসেস ডাট কী ভাবলেন। বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি তুমি যা mean করছ। ওঁরা পৌত্তলিক, ওঁদেরকে তো সদলবলে দীক্ষিত করতে পারিনে, কাজেই একা তোমাকে দীক্ষিত করে কী হবে। কিন্তু ওসব আজকাল উঠে গেছে। চাও তো হিন্দু মতেই তোমাদের বিয়ে হবে, শালগ্রাম সাক্ষী করে।’

‘বিয়ের মত নিয়ে আমার মাথাব্যাথ্যা নেই’, সোম বলল। ‘আমি চাই বিয়েতে মত। আপনার মেয়ের কি তা আছে?’

‘নেই আবার,’ মিসেস ডাট এতক্ষণ বাদে হাসলেন।

‘আমি যা বলেছি তা সত্ত্বেও?’

‘তার জন্যে,’ মিসেস ডাট করুণার সহিত বললেন, ‘তোমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, কলিন?’

‘কেন?’

‘সেইটেই ফর্ম।’

‘আমি ফর্ম-এর চেয়ে সত্যকে বড়ো বলে জানি। তাই সত্যের বিরোধী হলে ফর্ম মানিনে।’

মিসেস ডাট জীবনে এত বড়ো শক পাননি! সোম যদি বলত, আমি নাস্তিক, ভগবান মানিনে, কিংবা আমি ফ্রি থিঙ্কার, ধর্ম মানিনে, কিংবা আমি স্বৈরাচারী, নীতি মানিনে, কিংবা আমি কমিউনিস্ট, পরের সম্পত্তিতে পরের অধিকার মানিনে, তাহলে তিনি হাসতেন, কিংবা অনুমোদন করতেন, কিংবা উপদেশ দিতেন, কিংবা চটতেন। কিন্তু ‘ফর্ম মানিনে!’ তার মানে জেন্টালম্যান নই, সভ্য মানুষ নই, উলঙ্গ নরখাদক।

মিসেস ডাট মূর্ছা যেতেন, কিন্তু এক বাড়িতে দু-জন মূর্ছারোগী হলে কাকে, কে দেখাশুনা করবে। তিনি আর একটি কথা না-বলে সোমের দিকে আর একটিবার না চেয়ে সোমকে cut করলেন (অর্থাৎ কাটলেন না, উপেক্ষা করলেন)।

বিদায় না নিয়ে চোরের মতো সরে পড়া যায় না! সোম বীরেনের প্রতীক্ষায় বসে বসে ‘Good Housekeeping’ পড়তে থাকল।

বীরেন এসেই বলল, ‘শুনবে একটা সুখবর? কমলাদের ওখানে তোমার আজ নিমন্ত্রণ।’

‘কিন্তু,’ সোম বলল, ‘আমি যে এখনি চলে যাচ্ছি।’

‘সে কী হে! কোথায়?’

‘জানিনে কোথায়। জানি যাচ্ছি।’

বীরেন মুখ ভার করে মা-র কাছে গেল। দেখল যে মা-ও মুখ ভার করে সেলাই করছেন। ‘মা, সোম কেন যাচ্ছে?’

মা জ্বলে উঠে বললেন, ‘He is no better than a cannibal.’

বীরেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। ‘No better than what?’

মা পুনরুক্তি করলেন। বীরেন ধপ করে বসে পড়ে ভাবল, সোম মানুষের মাংস খায়! এ কি কখনো হতে পারে! মা-কে কি রাঁচি পাঠানো আবশ্যক?

‘সে ফর্ম মানে না।’

‘কী—কী মানে না?’

‘ফর্মে বিশ্বাস করে না সে।’

‘ফর্মে বিশ্বাস করে না!’ বীরেন উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করল। ‘তবে ঠিকই বলেছ—নরখাদকের অধম।’

চলল সে সোমের কাছে কৈফিয়ত দাবি করতে। বলল, ‘তুমি নাকি ফর্মে বিশ্বাস করো না?’

‘সত্যের সঙ্গে সংঘর্ষ না-বাধলেই করি, বাধলে করিনে—’ এই হল সোমের কৈফিয়ত।

বীরেন ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তুমি দেখছি সাক্ষাৎ মহাত্মা গান্ধী। কেবল পোশাকটা অন্যরকম।’

‘তা হলে আসি?’

‘আরে থামো, থামো। ঠাট্টাও বোঝো না। বলছিলুম ওসব সত্য-টত্য আমাদের মুখে সাজে না, গান্ধীর মতো fanatic-দের দলে আমরা নেই। ফর্মটাকে সর্বদা সব অবস্থায় বাঁচিয়ে তারপরে অন্য কথা, সত্য বা শিব বা সৌন্দর্য।’

‘তোমার সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা নেই,’ সোম বলল, ‘আমাকে শুধু একবার সকলের কাছে বিদায় নিতে দাও।’

বীরেন গম্ভীরভাবে বলল, ‘বেশ।’ সোমকে উপরে নিয়ে ছেড়ে দিল ও নিজে কমলার বাড়ি গেল!

মিসেস ডাট বললেন, ‘যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হও তবে I shall be ever so happy.’

প্রতিমা বলল, ‘আমার নিজের বলবার কী থাকতে পারে? মা-র যা বক্তব্য আমারও তাই।’

‘আপনার স্বাধীনতা তাহলে চিন্তারও নয় বাক্যেরও নয়? কেবল চলাফেরার?’ বলল সোম।

প্রতিমা অপমানে কাঁপতে থাকল।

মিসেস ডাট বললেন, ‘তুমি তো অত্যন্ত বেয়াদব হে। তুমি কি মনে করো, যে তার মা-র অনুমতি না-নিয়ে সে চলাফেরাও করে?’

সোম অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘তাহলে তাঁর স্বাধীনতা কীসে? খিদে পেলে খাওয়াতে, না ঘুম পেলে শোওয়াতে? না শাড়ি দেখলে কেনাতে? না রেকর্ড বাজিয়ে শোনাতে?’

‘না, ওর সভ্য মানুষ হবার সত্যিই সম্ভাবনা নেই,’ মিসেস ডাট মেয়ের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ‘ও আর আসবে না।’

প্রতিমা বিচলিত হয়ে বলল, ‘Will you really never—’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।

সোম হেসে বলল, ‘কাঁদার স্বাধীনতা তো আছে বলে মনে হয়।’

প্রতিমা কাঁদতে কাঁদতে তর্জনী উঁচিয়ে কোপ ব্যঞ্জনা করল। তার মা বললেন, ‘তুমি এখন যেতে পারো।’

‘আপনারও কি সেই অভিলাষ?’ সোম শুধাল প্রতিমাকে।

‘ও ছাড়া আপনি আর কী প্রত্যাশা করেন?’ প্রতিমা বলল ঝাঁঝের সঙ্গে।

সোম অম্লানবদনে বলল, ‘আমি প্রত্যাশা করি যে আপনি আমার সঙ্গে আসবেন।’

‘কী? কী?’—মিসেস ডাট চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।

‘O my!’—প্রতিমাও দাঁড়াল।

‘কোই হ্যা—য়?’ মিসেস ডাট চিৎকার করলেন।

‘আবদু—ল!’ প্রতিমা ডাক দিল।

তিন তিনটে দাড়িওয়ালা ভৃত্য হুড়মুড়িয়ে এসে হাজির হল ও ‘হুজুর’ বলে সেলাম ঠুকে হাঁপাতে লাগল।

সোম বলল, ‘লোক জড় করবার কী দরকারটা ছিল? আমি তো এঁকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলুম না। ইনি আমাকে আশা দিয়েছিলেন।’

মিসেস ডাট বললেন, ‘চোপ। এখন মানে মানে বেরিয়ে যাও।’

‘যাবই তো। কিন্তু এতগুলো পার্শ্বরক্ষী তো আমি চাইনি, চেয়েছি একটিমাত্র পার্শ্ববর্তিনী।’

প্রতিমা গালে হাত দিয়ে বলল, ‘That beats me!’

মিসেস ডাট বললেন, ‘বীরেন থাকলে গলাধাক্কা দিয়ে নীচে রেখে আসত। আবদুল, আবু ও মামুদ সাহস করবে না। কিন্তু সাহস জোগাবে। আমিই ওকাজ করি।’—এই বলে তিনি সোমের ঘাড়ে হাত তুললেন।

সোম হেসে একটি bow করল—প্রতিমাকে। মিসেস ডাটের হাতটাকে নিজের হাত দিয়ে আস্তে হটিয়ে দিল।

বলল, ‘ফর্ম-এর চূড়ান্ত হয়েছে। এইটুকু চাক্ষুষ করবার জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করা। এখন তবে আসি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *