৫. প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিদ্রোহ
১৯৪৬ সালে বসুর রাজনৈতিক জীবনে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। বসু প্রথম এম. এল. এ. হলেন। বছরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত হল সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বিধানসভার নির্বাচন। এম. এল. এ. হবেন এমন কথা বসুর মনে কখনও আসেনি। কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেন। আসাম ছাড়া পুরো বি.এ. রেলপথ ছিল তাঁর নির্বাচন কেন্দ্র। বসুর সঙ্গে আরও কয়েকজনকে পার্টি দাঁড় করিয়েছিল—তাঁদের মধ্যে ছিলেন কলকাতা কেন্দ্র থেকে সোমনাথ লাহিড়ী, হাওড়া থেকে বঙ্কিম মুখার্জি, দার্জিলিং থেকে রতনলাল ব্রাহ্মণ, আসানসোল থেকে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এবং আরও অনেকে। বসুর লড়াইটা ছিল খুব কঠিন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন হুমায়ুন কবীর। কবীর সে সময় বি.এ.রেলওয়ে এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মৌলানা আজাদ এবং আরও কয়েকজন সর্বভারতীয় কংগ্রেসী নেতা কবীরের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের জন্য এসেছিলেন। বসু ছিলেন একেবারে নতুন, রেলশ্রমিকদের কাছে অচেনা অজানা না হলেও তাঁর বয়স ও অভিজ্ঞতা ছিল নেহাতই কম। কিন্তু তিনি তাঁর অফুরান কর্মশক্তি উজাড় করে দিয়েছিলেন—সর্বস্তরে যোগাযোগ করেছিলেন, সারা বাংলায় ঘোরাঘুরি করেছিলেন। বসু বললেন “সে সময় পার্টির কমরেডরা যা খেটেছিলেন তা আজও মনে আছে।”
যখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল, বসু জীবনে সেই প্রথম জানলেন বুর্জোয়া নির্বাচনের পেছনে নেপথ্যে কতই না ঘটনা ঘটতে থাকে। অন্য পার্টির কলাকৌশল, ব্যালটপেপার নিয়ে নানা জালিয়াতি, দুর্নীতিপরায়ণ, অসৎ প্রার্থী এবং সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী আমলাদের অসাধু যোগসাজস—সবই প্রত্যক্ষভাবে দেখলেন। দেখলেন, কিভাবে ভাড়া করা সমাজবিরোধিরা পার্টি কমরেডদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। একটা ঘটনা বসুর এখনও মনে আছে। ব্যারাকপুর কেন্দ্রের নির্বাচনের পরের দিন বসু কাঁচরাপাড়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে তখন পার্টিকর্মীদের ওপর কংগ্রেস নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছিল। বসু নিজের চোখে সেই ঘটনা দেখেন। কলকাতায় ফিরে পার্টির প্রাদেশিক দপ্তরে (১২১, লোয়ার সার্কুলার রোড) দেখেন অফিসের নিচের তলায় আহত কমরেডদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। বসু সেদিন বুঝেছিলেন বুর্জোয়া নির্বাচনে নিয়মনীতি সবই বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে। নির্বাচনের ফল বেরোবার পর তিনি আর একটা কথাও উপলব্ধি করেছিলেন—জনগণ যদি কোনও প্রার্থীকে প্রকৃত সমর্থন জানাবার সামান্যতম সুযোগও পায় এবং জনগণ যদি সঙ্গে থাকে তাহলে প্রার্থীর জয় হবেই। ১৯৪৬ সালে বসু জনগণের সমর্থনেই জয়লাভ করেছিলেন। মাত্র আট ভোটের ব্যবধানে বসু হুমায়ুন কবীরকে পরাজিত করলেন। কবীরের দিকে পেশীশক্তি, অর্থশক্তি থাকা সত্ত্বেও বসুর জয় হল। রতনলাল ব্রাহ্মণ জিতলেন দার্জিলিং থেকে এবং রূপনারায়ণ রায় জিতলেন দিনাজপুর থেকে বসু এম. এল. এ. হওয়াতে তাঁর বাবা ডাঃ নিশিকান্ত বসু খুব খুশী হলেন। শুরু হল বিধানসভায় ভেতরে এবং বাইরেকার পার্টি-জীবন। এম. এল. এ. হিসাবে বসু যা পেতেন তা পুরোটাই দিয়ে দিতেন পার্টিকে। পার্টির সামান্য ভাতাতে তাঁর চলে যেত।
এদিকে গণ-আন্দোলনও চলতে থাকে। ঐ বছর ১৮ই থেকে ২৩শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহ। কমিউনিস্ট পার্টি এই নৌ-বিদ্রোহকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। ২২ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি এই ঐতিহাসিক ঘটনার সমর্থনে প্রবল উদ্দীপনার সঙ্গে বম্বে ও কলকাতায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। নৌ-বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল ভারতীয় নৌ-সেনাদের চরমপত্র দেয়। এই চরমপত্রে বলা হয়েছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হবে। এই খবর পেয়েই বসু ২৪৯নং বহুবাজার স্ট্রীটে, বি.পি.টি.ইউ-র অফিসে ছুটে যান। সেখানে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৪ ঘণ্টার রেলওয়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হবে। ব্রিটিশ-বিরোধী একদিনের সাধারণ ধর্মঘট সে সময় ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেবার সময় বেশ অসুবিধা হয়েছিল। ধর্মঘটী শ্রমিকরা বিরোধীদের প্ররোচনায় কাজে যোগদান করতে অস্বীকার করে, তখন স্টেশনে গিয়ে তাদের রাজী করান বসু, মহম্মদ ইসমাইল এবং পূর্ণেন্দু দত্ত রায়।
১৯৪৬ সালে সুরাবর্দির নেতৃত্বে মুসলিমলীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে। সুরাবর্দি মুখ্যমন্ত্রী হলেন, নিজের হাতে রাখলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, নুরুল আমিন হলেন স্পীকার। মন্ত্রীসভায় সাতজন মন্ত্রী ছিলেন—মহম্মদ আলি, সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন, আহম্মদ হোসেন, আবদুল গফরাস, আবুল ফজল মহম্মদ, আব্দুর রহমান, সামসুদ্দিন আহমদ এবং যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। বিরোধী কংগ্রেস পার্টির নেতা ছিলেন কিরণশংকর রায়। জ্যোতি বসু এবং কমিউনিস্ট পার্টির অন্য দু’জন নির্বাচিত এম. এল. এ-কে নিয়ে তৈরি হল তৃতীয় একটি গ্রুপ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রায় সবাই ছিলেন ব্রিটিশদের তোষামোদী। কংগ্রেসের বিমলচন্দ্র সিন্হা, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার প্রমুখ নেতা ছাড়াও বিধানসভায় ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনকেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ছিলেন বরিশাল থেকে নির্বাচিত সদস্য কৃষক প্রজাপার্টির ফজলুল হক। ভারতীয় ছাড়াও ছিলেন বাংলার কয়েকজন ইংরেজ এবং অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ব্যবসায়ী। বিভাজনটা বেশ সুস্পষ্ট ছিল—মুসলীম লীগের সবাই মুসলিম সম্প্রদায়, কংগ্রেস সমর্থকরা ছিল হিন্দু এবং ইংরেজ ও অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সকলেই ছিল খ্রীষ্টান। এদের নিজেদের প্রত্যেকের স্বার্থরক্ষার বিষয়টাই প্রাধান্য পেত। বসু লক্ষ করতেন ব্রিটিশরা কিভাবে দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করছে।
সাধারণভাবে সারাদেশের পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ। ফেব্রুয়ারিতে রশিদ আলি দিবসে আই.এন.এ-এর সদস্যদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের হল। পুলিস গুলি চালাল। পুলিসের গুলিতে রামেশ্বর ও আবদুস সালাম নামে দুই ছাত্র নেতা মারা গেলেন। আই. এন. এ-র অফিসার রশিদ আলিকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিসের গুলিতে একত্রিশজনের মৃত্যু হয়। ২৯শে জুলাই ডাক ও তার কর্মীদের সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এছাড়া আন্দামানে নির্বাসিত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে পার্টির উদ্যোগে একটি বন্দীমুক্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন নিরঞ্জন সেনগুপ্ত।
নতুন আইনসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৪ই মে থেকে। প্রথম অধিবেশনের আগেই বাংলাদেশে খাদ্যসংকট গুরুতর আকার নিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টিকর্মীরা খাদ্য-আন্দোলন শুরু করেছেন, মজুতদারদের কাছ থেকে মজুত চাল ও খাদ্যশস্য উদ্ধার করে জনগণের মধ্যে বণ্টন করেছেন। বসু তখন আইনসভার কমিউনিস্ট গ্রুপের মুখপাত্র। এছাড়াও তিনি তখন বি. এ. রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ফলে রেলকর্মীদের আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকতে হয়েছে। তিনি তখন কখনও আসামে, কখনও বাঁকুড়ায়, কখনও খুলনায়, কখনও বা রংপুরে। আইনসভায় বসু বসতেন বিরোধীপক্ষের সারিতে এক আলাদা গ্রুপে। তখনকার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলি জনগণের পক্ষে সভায় সকলের বিবেচনার এবং সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তুলে ধরাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। “আমাদের কাছে তখন জ্বলন্ত সমস্যা ছিল বন্দীমুক্তি, পুলিসি নির্যাতন, খাদ্যসমস্যা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি”—বসু বললেন। অধিবেশনের প্রথমদিনই বসু পার্টির মুখপাত্র হিসাবে বন্দীমুক্তি বিষয়ে একটি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের চেষ্টা করেন কিন্তু গভর্নর নিযুক্ত অস্থায়ী স্পীকার তাঁকে সেই অনুমতি দেন নি।
২৪শে জুলাই দ্বিতীয় অধিবেশন। বন্দীমুক্তি কমিটির নেতৃত্বে পনের হাজার মানুষের এক মিছিল আইনসভা অভিযান করে। “রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই”, “অবিলম্বে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হোক”, “কেন রাজনৈতিক বন্দীদের এতদিন আটক করে রাখা হয়েছে, জবাব চাই”—এই ধরনের স্লোগানে আইনসভা প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে ওঠে। বসু আগেই মুলতুবি প্রস্তাব উত্থানের নোটিশ দিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু স্পীকার তা গ্রহণ করেন নি। প্রশ্নোত্তরের পর বসু উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চান কি কারণে বন্দীমুক্তির মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। “কারণ বিরোধীরা বৈধভাবে এই প্রশ্ন তুলতে পারেন না”—উত্তর দেন সুরাবর্দি। বসু বলেন তিনি নিশ্চয়ই স্পীকারের রুলিং গ্রহণ করবেন, মুখ্যমন্ত্রীর নয়। সভায় বাদানুবাদ চলতে থাকে, কংগ্রেস সদস্যরাও বসুকে সমর্থন করেন। তখন বসু সভাকক্ষ ছেড়ে বাইরে সমবেত জনতার কাছে চলে আসেন। ‘আমি বিষয়টি সভায় তুলেছি, সভায় এ নিয়ে এখন বিবাদবিতর্ক চলছে’—বসু ক্ষুদ্ধ জনতাকে এ কথা জানান। এরপর আবার দ্রুতপায়ে ফিরে যান সভায়, স্পীকারকে বলেন জনতার কাছে গিয়ে বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলতে। স্পীকার অসম্মত হন। স্পীকার বলেন বসু তাঁর চেম্বারে আসলে তিনি কোন্ বিধির কোন্ ধারা অনুযায়ী রুলিং দিয়েছেন তা তাঁকে দেখাতে পারেন। উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বসুরও জেদ চেপে যায়। তিনি বলেন “এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাজার হাজার মানুষ দলমত নির্বিশেষে বাইরে অপেক্ষা করছে। তারা জানতে চাইছে বন্দীদের কেন মুক্তি দেওয়া হবে না, এখান থেকেও তাদের স্লোগান শোনা যাচ্ছে। এই বন্দীরা ১২ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বন্দী-জীবন যাপন করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কি হল? আপনি আলোচনার অনুমতি দিন।” বসুর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও সরকার পক্ষের কয়েকজন এম. এল. এ-র বাকবিতণ্ডা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঐ দিন নিরঞ্জন সেনগুপ্তর নেতৃত্বে সর্বদলীয় বন্দীমুক্তি কমিটির এক প্রতিনিধি দল আইনসভায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর হাতে এক স্মারকলিপি তুলে দেন। শেষ পর্যন্ত সুরাবর্দি সমবেত জনতার সামনে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন তিনি—”আমি ফাইল কাগজপত্র দেখেছি, আবার ভাল করে দেখব”—”আমরা প্রতিশ্রুতি চাই না”, সুরাবর্দি গলার আওয়াজ জনতার স্লোগানে ডুবে যায়। “আমরা নির্দিষ্ট সময় জানতে চাই”—সুরাবর্দিকে বলতেই হয় “১৫ই আগষ্টের মধ্যে”। উত্তেজনা স্তিমিত হয়। শান্তিপূর্ণভাবে জনতা সভাপ্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে যায়। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রথম রাজনৈতিক যুদ্ধে, ন্যায়ের প্রশ্নে বসুর জয় হয়।
বন্দীমুক্তি প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা বসুর মনে আছে। এই সমাবেশের কয়েকদিন আগে বসু বঙ্কিম মুখার্জি ও ভূপেশ গুপ্তর সঙ্গে একটি স্মারকলিপি নিয়ে সুরাবর্দির সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংস্-এ দেখা করেছিলেন। সুরাবর্দি তাঁদের বসতে বলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এক ইংরেজ অফিসার পোর্টারকে ডেকে পাঠালেন। পোর্টারকে সুরাবর্দি স্মারকলিপিটি পড়ে শুনিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন;–পোর্টার বললেন, “বন্দীরা সব হত্যাকারী”। বসু এবং তাঁর কমরেডরা এই কথার ঘোরতর আপত্তি জানালেন, কথা কাটাকাটি শুরু হল—সুরাবর্দি পোর্টারকে তখন চলে যেতে বললেন, বসুদের বললেন বিষয়টি তিনি বিবেচনা করে দেখছেন। বসু সেদিন বুঝেছিলেন সুরাবর্দি নীতিগত সিদ্ধান্ত তখন নিয়ে ফেলেছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসাবে বসু ছিলেন নির্ভীক, ঋজু, ন্যায়নিষ্ঠ এবং স্পষ্ট বক্তা। বসুর জীবনে সম্ভবত এই বছরগুলিই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়—সফল রাজনৈতিক নেতা হিসাবে কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠার সময়। তাঁর বয়স তখন মাত্র বত্রিশ কিন্তু কোনও প্রতিকূল অবস্থাতেই তিনি দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। বয়ঃজ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে অনায়াসেই সমানস্তরে কথা বলতে পারতেন। তাঁর তেজ ছিল কিন্তু ঔদ্ধত্য ছিল না। সভার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি সদ্ব্যবহার করতেন। প্রত্যেক অধিবেশনে বিরোধীপক্ষকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতেন, অধিবেশনের বক্তৃতা, প্রশ্ন, বিষয় ইত্যাদি সম্বন্ধে বাড়িতে রীতিমত পড়াশোনা করতেন, তৈরী হয়ে আসতেন। পরের দিন ইংরেজি দৈনিকে নিজের নামের উল্লেখ থাকলে আরও প্রেরণা পেতেন। “তখন কয়েকটা কাগজ ছিল যারা বিধানসভার বিষয়গুলো ঠিকভাবে রিপোর্ট করত”–বসু বললেন। ঐ বছর ৬ই আগষ্ট আর একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে। বসু আইনসভায় ঢুকতে যাবেন এমন সময় দেখেন, প্রধান ফটকের তালা বন্ধ, বাইরে একটা ছোটখাট ভিড়। রতনলাল ব্রাহ্মণ, ধীরেন মুখার্জিসহ আরও অনেকে অপেক্ষা করছেন। ভিড় ঠেলে বসু এগোন, দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন ডেপুটি পুলিস কমিশনার সামসুদ্দোহার হুকুমে গেট বন্ধ করা হয়েছে। “কে এই দোহা? তার কি অধিকার আছে আইনসভার গেট বন্ধ করার?”—বসু প্রশ্ন করেন। সামসুদ্দোহা তখন সেখানেই তদারকিতে ব্যস্ত। বসু খোঁজখবর করতেই সামসুদ্দোহা তাঁকে ধাক্কা দিলেন, তাঁর জামা ছিঁড়ে গেল। এর পরই সামসুদ্দোহা চেঁচিয়ে বললেন “ওকে মার লাগাও”। সেই সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কংগ্রেস বিধায়ক ধীরেন মুখার্জি পুলিসকে বললেন, “এটা বেআইনী কাজ, কখনও এঁর গায়ে হাত দিও না, ইনি আইনসভার সদস্য”। তখন দোহা বসুকে গ্রেপ্তার করে পুলিস কমিশনারের হেফাজতে দিয়ে দিল। আইনসভার ভেতরে খবর পৌঁছল। নুরুল আমিন সেদিনকার অধিবেশন মুলতুবি করে দিলেন। সুরাবর্দি ঘটনাস্থলে ছুটে এলেন—জনতা তখন মারমুখী হয়ে উঠেছে। সুরাবর্দি বললেন : “জ্যোতি, এখানে এস।”। “কি করে যাব, আমাকে যে অ্যারেস্ট করে রাখা হয়েছে”–বসু জবাব দেন। “কেউ তোমাকে অ্যারেস্ট করেনি, চলে এস”—মুখ্যমন্ত্রী আদেশ দেন। পরিস্থিতি থমথমে। বসু বলেন : “দোহাকে ক্ষমা চাইতে হবে”। অন্য সদস্যরা বসুকে সমর্থন করেন। দোহার ক্ষমা চাওয়ার মোটেই ইচ্ছা ছিল না—মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নাটকীয় ভঙ্গীতে মাথার ওপর হাত দুটো তুলে বলল “আল্লার নামে শপথ করে বলছি। আমি কোনও অন্যায় করিনি, যাই হোক মুখ্যমন্ত্রীর কথামত আমি মাপ চাইছি।” ছেঁড়া জামা পরে নির্বিকার মুখে বসু আইনসভায় ঢুকলেন। মুখ্যমন্ত্রী সভায় জানালেন এটি একটি অপ্রীতিকর ঘটনা, তবে এর মীমাংসা হয়েছে, দোষী পুলিস অফিসার ক্ষমা চেয়েছেন, এর তদন্তও হবে। বসু জানতে চান কবে তদন্ত শেষ হবে। ‘এ মাসের ১৫ বা ১৭ তারিখের মধ্যেই’– আশ্বাস দেন সুরাবর্দি। সন্ধ্যাবেলা ছেঁড়া জামা পরে বসুকে বাড়ি ঢুকতে দেখে বাবা নিশিকান্ত বসু বিস্মিত হন। বসু বাবাকে আইনসভার ঘটনার বিবরণ দেন। ঘটনা শুনে তিনি মনে মনে উদ্বিগ্ন হলেও, অপ্রীতিকর উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতেও তাঁর পুত্র যে স্থির মস্তিষ্কে এবং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলায় সফল হয়েছে এ কথা ভেবে গর্বিতও বোধ করেন।
অধিবেশন চলার সময় বসুর আইনসভা আর পার্টির কাজের ব্যস্ততায় সারাদিন কেটে যেত, সন্ধ্যাবেলা চলে যেতেন পার্টি অফিসে, পরের দিনের বিতর্ক বিষয়, আলোচনার দিশা নির্ধারণের ব্যাপারে কমরেডদের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য যেতেন ইউনিয়ন অফিসে। তখন ইউনিয়ন অফিস ছিল কলেজ স্ট্রীট ও বহুবাজার স্ট্রীটের সংযোগস্থলে। আইনসভার অধিবেশন না থাকলে পার্টির কাজে ঘুরতে হত জেলায় জেলায়। কখনও কখনও ৮নং ডেকার্স লেনে পার্টির ষ্টেট হেড কোয়ার্টারের অফিসে কয়েকঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন নানা ধরনের রাজনৈতিক কাজকর্মে।
২
১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট শুরু হয় ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। হিন্দু মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে চাপা বিদ্বেষের সেদিন ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে। কলকাতার রাস্তায় কয়েকদিন ধরে শুধু আগুন, বারুদ আর রক্তের গন্ধ। আকাশ বাতাসে ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি। অগণ্য মানুষের মৃত্যু হয় মানুষেরই হাতে, শুধু ধর্মের নামে। প্রশাসনিক কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ফলে পরিস্থিতি দ্রুত আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। পুলিসও মোতায়েন করা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। গণহত্যা, লুটতরাজ চলেছিল অবাধ গতিতে। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না। “আসলে পুরো ব্যাপারটাই ছিল ইংরেজদের চক্রান্ত”–বসুর মতে, “দেশবিভাগের কাজটা আরও যেন ওরা এগিয়ে দিল।” বসুর দৃঢ় বিশ্বাস : “না হিন্দু, না মুসলমান—কেউই দেশ বিভাগ চায়নি, আসল কথা মানুষ হিংস্রতা, হানাহানি চায় না, তাদের ভুল বোঝানো হয়।” বসু মনে করেন এই দাঙ্গা ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচিত। এই দাঙ্গার অবশ্য একটা নেপথ্য ঘটনা ছিল। মুসলিম লীগ ১৬ই আগষ্টকে সারা দেশে “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” (ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে) পালন করার আহ্বান জানায়। সরকার ঐ দিন সরকারী ছুটিও ঘোষণা করে। আইনসভার অধিবেশনে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এবং বিরোধীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা চলে। বসু ঠিক করেছিলেন এই দিন ছুটির ঘোষণা সরকার প্রত্যাহার করে নিক—এই কথাই তিনি সভায় বলবেন। কারণ তাঁর মতে এই দিন পালন করলে অযথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হবে। সেটা কখনই কাম্য নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় বসু তাঁর মত জানাবার সুযোগ পান নি, কংগ্রেসের প্রতিবাদেও মুসলিম লীগ কান দেন নি।
পার্টি আশংকা করেছিল এরকমই অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা ঐ দিন ঘটবে। পার্টির নির্দেশ মত বসু সেদিন ছিলেন নারকেলডাঙায় শ্রমিক লাইনে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তখনকার রেলওয়ে ইউনিয়ন-নেতা কৃষ্ণমূর্তি আর নিখিল মৈত্র। বসু তখন রেলওয়ে ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁরা রেলওয়ে কলোনিতেই ছিলেন। মাঝে মাঝে মিছিলের স্বর কানে আসছে। রেলওয়ে শ্রমিকরা বার বার তাঁদের বাড়ি চলে যেতে বলছেন। বাইরে তখন বাড়িঘর জ্বলছে, ছোরা চলছে, চলছে লুঠতরাজ, হত্যা। সন্ধ্যার পর তাঁরা বেরোলেন। শিয়ালদহ স্টেশনে এলেন প্রথমে, তারপর লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগোতে থাকলেন, রাস্তার দু’ধারে তখন মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, ফুটপাতে ঘুরছে সশস্ত্র মানুষ, চারিধারে আগুন জ্বলছে। এইভাবেই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলেন ১২১নং লোয়ার সার্কুলার রোডে পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির অফিসে। রাত কাটালেন ঐ অফিসেই। রাতে ঘুম নেই। লাঠি নিয়ে পাহারা দিতে হল। বাড়িতে বা ডেকার্স লেনের অফিসে খবর দেবারও কোনও উপায় নেই। খাওয়াদাওয়ার তেমন কিছু নেই, আধপেটা বা না খেয়েই থাকতে হল। সৌভাগ্যক্রমে কিভাবে এক কমরেড মারফত প্রাদেশিক কমিটির অফিসে খবর পৌঁছে যায়। তখন পিপল্স রিলিফ কমিটির ভ্যানে করে নৃপেন সেন, সরোজ মুখোপাধ্যায় ও আর একজন কমরেড জেলা কমিটির অফিসে চলে আসেন। তাঁরা আসার সময় কয়েকজন আহত মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন। বসুরা ভ্যানে করে চলে এলেন প্রাদেশিক কমিটির অফিস ৮/২ ডেকার্স লেনে। সেখানে ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত, খোকা রায়, দীনেশ রায় ও আরও অনেকে। সেখানে এসে খবর পেলেন চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে, ইসলামিয়া হাসপাতালের পাশে, মোড়ের বাড়িতে হোটেলের ওপর তলায় আটকে আছেন বঙ্কিম মুখার্জি, নীরদ চক্রবর্তী আর সস্ত্রীক আবদুল মোমিন। বাড়িটা তখন দাঙ্গাকারীদের কবলে। ইতিমধ্যে স্নেহাংশু আচার্য বিপদসংকুল এলাকা থেকে অনেক মানুষকে উদ্ধার করেছেন।
তখন উদ্ধারকেন্দ্রের অফিস ছিল ময়দানে। সেখানে খবর গেছে। তবুও বসুকে পার্টি নির্দেশ দিল ঐ কমিউনে আটকে পড়া কমরেডদের উদ্ধার করার জন্য। পার্টির গাড়ি নিয়ে বসু চলে গেলেন ময়দানের অফিসে, ভারপ্রাপ্ত অফিসার রণু গুপ্ত তখন সেখানে ছিলেন না। বসুর সঙ্গে ছিলেন মহম্মদ ইসমাইল। উদ্ধারকেন্দ্র থেকে এক ইংরেজ সৈনিক লরিতে উঠলেন এবং বসুদের তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। বসু বিস্মিত হয়ে বললেন, সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক রয়েছে, এই যুবকটি একা কিভাবে পরিস্থিতি সামলাবে। “আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছি, জান?”—সপ্রতিভ জবাব দিল যুবকটি। গাড়ি আর লরি চলল উপদ্রুত এলাকার দিকে। ইংরেজ যুবক বাড়ির কাছে রিভলভার নিয়ে দাঁড়াতেই ভিড় সরে গেল। কমরেডদের উদ্ধার করে আনা হল। আর আধঘণ্টা দেরি হলে ওঁদের বাঁচানো যেত না। বসুর মতে— “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হয়েছিল।” সাধারণ মানুষের মনে ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যায় কাজ করার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। উদাহরণস্বরূপ তিনি দু’টি ঘটনার উল্লেখ করলেন। মোমিন সাহেবের কাছে শুনেছিলেন হামলাকারীরা যখন বার বার তাঁর ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল তখন তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন এক মুসলিম বৃদ্ধ দারোয়ান। ‘হিন্দু আছে, তালা খোলো’–বার বার বললেও সেই মুসলমান বৃদ্ধ কিছুতেই ফ্ল্যাটের তালা খোলেন নি। যেদিন মোমিনসাহেবকে উদ্ধার করা হল সেদিন বাড়ির সামনে উন্মত্ত জনতার ভিড়, মুসলিম বৃদ্ধ তা সত্ত্বেও এতটুকু বিচলিত হন নি। সেই বিপজ্জনক মুহূর্তে বসুদের উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। আর একটি ঘটনা বসুর খুব মনে পড়ে, “পার্টি নেতা কৃষ্ণবিনোদ রায় তখন পার্কসার্কাসে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। সেই বাড়ির মালিক ছিলেন একজন মুসলিম। তিনিও নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষ্ণবিনোদ রায়কে থানায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমন আরও কত ঘটনা আমাদের অজানা রয়েছে, মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে যায় না, বিরুদ্ধে যেতে তাদের উসকানো হয়”–বসু মন্তব্য করেন।
এই দাঙ্গার কারণে ১৯৪৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর বিধানসভায় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সুরাবর্দির মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। প্রস্তাবটি অবশ্য ১৩০-৮৫ ভোটে বাতিল হয়ে যায়। জ্যোতি বসু ও তাঁর দলের অন্য দুজন সদস্য প্রস্তাবটির পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট না দিয়ে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছিলেন। বসু অনাস্থা প্রস্তাবটির ওপর বিতর্কে অংশগ্রহণ করে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায়, প্রশাসন ও পুলিসের এবং মুসলিম লীগ সরকারের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তাঁর মতে এই দাঙ্গার পিছনে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য প্ররোচনা। বসু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন :
“আমি মনে করি, আমাকে একটি শ্রমিকশ্রেণীর নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে বলতে হবে—এই কেন্দ্র হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে গঠিত। কলকাতায় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা থেকে তুলনামূলকভাবে নিজেদের দূরে রাখার জন্য আমি কলকাতার ও শহরতলির শ্রমিকশ্রেণীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। কলকাতায় যে বর্বরতা, কাপুরুষতা, অমানুষিকতা দেখা গেছে, তার বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে আমি যাচ্ছি না। আপাতত এসব কথা ভুলে গিয়ে আসুন, আমরা হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাই। মন্ত্রিসভা অনেক অন্যায় কাজ করেছে—এই সব কাজের সমালোচনার আগে আসুন, আমাদের করণীয় প্রথম কাজটি প্রথমে করি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই যে আমাদের পয়লা নম্বরের শত্রু, একথা আমাদের বুঝতে হবে—সাম্রাজ্যবাদই আমাদের দমিত করে রেখেছে, বিভক্ত করে রেখেছে।
…এই যারা লণ্ডনের হোয়াইট হলে বা নয়াদিল্লীতে বা কলকাতার গভর্নর হাউসে বসে আছে, চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে তারাই প্রধান আসামী। আর আমাদের প্রদেশের রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা এদের ফাঁদে পা দিয়েছেন।
ভাইসরয়ের সভাপতিত্বে প্রদেশের গভর্নরদের সম্মেলনে কি গোপন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল? এই সম্মেলনের পর সিন্ধু প্রদেশের গভর্নর ১৬ই আগষ্ট প্রস্তাবিত ছুটি নাকচ করে দেন, কিন্তু বাংলার গভর্নর ছুটি মঞ্জুর করেন। এই দু’দিন কলকাতায় যেন বাংলার মন্ত্রিসভার অস্তিত্বই ছিল না। পুলিস রুটিনমাফিক কাজ ছেড়ে দিয়ে লুঠতরাজে অংশ নিয়েছে, সাহায্য করেছে। এটা কি করে সম্ভব হল? আমরা জানি কিভাবে ধর্মঘট ভাঙে। আমরা দেখেছি কিভাবে পুলিস রশিদ আলি দিবসে আমাদের বিপ্লবী যুবকদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য দমন পীড়ন চালিয়েছে। এইভাবেই তারা গণ আন্দোলন দমন করে থাকে।
….সাধারণ মানুষের কাছে, হিন্দু-মুসলিমদের কাছে আমাদের আবেদন —আপনারা আপনাদের শক্তি সমবেত করুন। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা সুনিশ্চিত করুন। এতে রুজিরুটির সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্রিটিশ শাসন শক্তিশালী হবে। এখন বলার সময় এসেছে : আমরা আর কখনও ভাইদের বিরুদ্ধে হাত তুলব না, যারা হিন্দু ও মুসলিমকে বিভক্ত করতে চায় তাদের কখনও বরদাস্ত করব না।”[১]
এই দাঙ্গার পর গড়ে উঠল শান্তিসেনাবাহিনী। পার্টি নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করার কথা ভাবছিলেন। ১৯৪৭ সালে গান্ধীজি যখন বেলেঘাটায় ক্যাম্প করে ছিলেন, তখন পার্টির নির্দেশে বসু ও ভূপেশ গুপ্ত তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর পরামর্শ চেয়েছিলেন। গান্ধীজি বললেন, একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করা, একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় মিছিল সংগঠিত করাই সেই মুহূর্তের কাজ। এ প্রসঙ্গে সরোজ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : “১৯৪৭ সালের ২৫শে আগষ্ট ঐক্য মিছিল কলকাতার রাস্তায় বের হল। হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান নরনারীর ঐক্য-মিছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে নারকেলডাঙা মাঠে সমবেত হয়। গান্ধীজি সেখানে ভাষণ দেন।…১৫ থেকে ৩০শে আগষ্ট ১৯৪৭, পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কলকাতায় যাঁরা শান্তিরক্ষা করেছেন, তাঁদের প্রতিনিধিদের সভা বসে বেলেঘাটায় গান্ধীজির শিবিরে ৩০শে আগষ্ট বেলা ২টা ২০মিনিটে। গান্ধীজি বলেন, শান্তিসেনাবাহিনীতে সমস্ত দলের কর্মীরা শান্তিরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে একমনে কাজ করবেন”।
১৯৪৬ সাল শেষ হল আর এক আন্দোলনের শুরু দিয়ে। নভেম্বর মাসে আরম্ভ হল ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন। তখন ঠিক ফসল কাটার শুরু। ‘তেভাগা’— অর্থাৎ বর্গাদার ও আধিয়ারদের উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। কৃষকরা চাইছিল সরকার আইন করে তেভাগার স্বীকৃতি দিক। ১৯৪০ সালের ভূমিরাজস্ব কমিশনের সুপারিশে অনেকটা কাজ এগিয়েছিল, একটি খসড়া বিলও করা হয়, কিন্তু পরে বিষয়টি নিয়ে আর কোনও আলোচনা সরকারীস্তরে হয়নি। বাংলাদেশের এগারটি জেলায় কৃষকরা তেভাগার দাবিতে অক্লান্ত সংগ্রাম করেন। খুব দ্রুত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে মৈমনসিং জেলার গারো পাহাড়ের হাজং এলাকায়, দিনাজপুরে, জলপাইগুড়ি, রংপুরের বিভিন্ন এলাকায়, ২৪ পরগণা, হুগলী, মেদিনীপুরে, যশোহরে ও কুমিল্লায়। কৃষকদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। বাংলাদেশ ছাড়া অন্ধ্র, কেরালা, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস মুসলিম লীগ একজোট হয়ে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে। ১৯৪৭ সালে গোড়ার দিকে পার্টির নির্দেশে বসু মৈমনসিং, খুলনা ও জলপাইগুড়ি জেলায় ব্যাপকভাবে ঘোরেন। রূপনারায়ণ রায়ের কাছ থেকে দিনাজপুরের রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। বসুর মতে কৃষকরা কোথাও হিংসার আশ্রয় নেন নি। ১৯৪৭ সালের ১২, ১৫, ২১ এবং ২৫শে মার্চ বসু বিধানসভায় তেভাগা আন্দোলনের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১২ই মার্চ বসু বিধানসভায় বলেছিলেন : “আমি নিজে খুলনা, জলপাইগুড়ি এবং মৈমনসিং-এ দেখেছি এবং দিনাজপুর থেকে রিপোর্ট পেয়েছি, কৃষকরা কোথাও হিংসাত্মক আচরণ করেনি।…আমি সুনিশ্চিত, দিনাজপুরে সমিরুদ্দিন ও শিবরামের মত যে সমস্ত কৃষক তেভাগার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাঁদের আত্মদান ব্যর্থ হবে না। পুলিসের বুলেটে বিদ্ধ হয়েও এই সব লোককে বলতে শোনা গেছে—’জান দেব, তবু ধান দেব না’। সে কারণেই আমি বলছি, সরকারই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভাঙছে, বর্গাদাররা নন।
১৫ই মার্চ বসু আরও তীব্র ভাষায় সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন : ‘আমি জিজ্ঞাসা করি—ক’জন জোতদার নিহত হয়েছে? তাদের কতগুলি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে? জোতদারদের কতজন স্ত্রী, ভগ্নী ইত্যাদির মর্যাদা হানি করেছেন কৃষকরা’, সুরাবর্দি সাহেবকে আমি এই প্রশ্নের জবাব দিতে বলছি”।
বসু যখন হাজং এলাকায় ঘুরছেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্নেহাংশু আচার্য। দুজন ব্রিটিশ অফিসার ব্রেনগান হাতে নিয়ে বসুকে পুলিস থানায় নিয়ে যায়। বসু তাদের জিজ্ঞাসা করলেন তারা এখানে কেন। তারা উত্তরে বলল হাজং এলাকায় কৃষকবিদ্রোহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বসু আরও জিজ্ঞাসা করে জানলেন এরা তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে রয়েছে কিন্তু তখনও পর্যন্ত বিদ্রোহের কোনও লক্ষণ দেখতে পায়নি। কিছুদিন পর এক কুখ্যাত ইংরেজ জেলা শাসক বাস্তিন বসুকে আর স্নেহাংশু আচার্যকে হাজং এলাকা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেন। “আমরা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত কৃষকদের কষ্ট চলতেই থাকে, বামফ্রন্ট সরকারের শাসনেই কৃষকদের দাবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়, আমরা জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ বন্ধ করি, বর্গাদারদের চাষের অধিকারও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই”–বসু বলেন।
৩
১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট। ব্রিটিশের ইউনিয়ন জ্যাক-এর জায়গায় উড়তে লাগল ভারত ও পাকিস্তান—এই দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজস্ব জাতীয় পতাকা। দেশবিভাগের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। দেশ ভাগ হল, দু’দেশে দুটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের গভর্নর জেনারেল হন মহম্মদ আলি জিন্না এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। প্রধানমন্ত্রী হন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং সহকারী প্রধানমন্ত্রী হন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। সংবিধান রচনাকারী কেন্দ্রীয় পরিষদ নির্বাচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টি দেশবিভাগের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু সে সময় পার্টি তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হলেও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের তুলনায় দুর্বল ছিল। সুরাবর্দিও বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ‘বৃহত্তর’ বাংলাদেশ। কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি বলেছিল, ‘বঙ্গভঙ্গ’ চাই না, সুরাবর্দি সাহেবের বৃহত্তর বঙ্গও চাই না। পার্টির মতে ‘বঙ্গভঙ্গের ফলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আরও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা। ভাঙা বাংলাদেশ ভারতে ব্রিটিশ ফৌজ; ব্রিটিশ মূলধন ও ব্রিটিশ শাসনকে স্থায়ী করবে এবং শ্রমিক আন্দোলনকে দুর্বল করবে।’ কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিল ‘(১) স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ বাংলা (২) বাংলাদেশ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেবে কিনা, প্রাপ্তবয়স্ক বাঙালীর ভোটে তার মীমাংসা (৩) প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার, যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং (৪) জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও ব্রিটিশ মূলধন বাজেয়াপ্ত করার কার্যক্রমের ভিত্তিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন।’
১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপকসভা ও ব্যবস্থা পরিষদের শেষ বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাংলাদেশকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। গণ-ভোট অনুযায়ী সিলেট পাকিস্তানের প্রদেশ বাংলাদেশের জেলা হিসাবে গণ্য হয়, সুরাবর্দি চলে যান বাংলাদেশে এবং নুরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্ৰী হন।
১৫ই আগষ্ট ভারতের জনগণ স্বাধীনতা উপলক্ষে উৎসব পালন করে। আকাশে বাতাসে আনন্দের ধুম লেগে যায়। বসুর মনে পড়ে সেদিন গভর্নর হাউস আপামর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিছুক্ষণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বসু নীরবে দেখছিলেন আনন্দোচ্ছল মানুষের স্রোত। আনন্দিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যেন চিন্তার ভার মন থেকে নামাতে পারছিলেন না—’ব্রিটিশরা তো দেশ ছেড়ে চলে গেল, পার্টির কলেবরও বেড়ে উঠছে, কিন্তু এর পর আমাদের কি করণীয়? এখনই তো আসল কাজ আমাদের সামনে।’
স্বাধীনতা লাভের উৎসব এক সময় শেষ হল। বসু আগের থেকেও যেন বেশি কর্মব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের কাজে সারা পশ্চিমবঙ্গ, আসামে সফর করে বেড়াচ্ছেন। কলকাতায় রেলওয়ে ইউনিয়ন অফিসে প্রতিদিন যাতায়াত করছেন। তাছাড়া অন্য কয়েকটি ট্রেডইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি তখন যুক্ত ছিলেন। বসু বুঝেছিলেন সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। তেলেঙ্গানা আন্দোলন তখনও চলছে এবং বসু জানতেন এবার আক্রমণ আসবে কংগ্রেসের দিক থেকে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থেকে নয়। বসুর দায়িত্বও আরও বেড়ে যায়, ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ডেকার্স লেনে অবস্থিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক অফিসের বিরাট ছাদে প্যাণ্ডেল বেঁধে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্মেলন এবং পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রথম সম্মেলন। এই সম্মেলনে পার্টির নতুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি বা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি নির্বাচিত হল। এই কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হলেন জ্যোতি বসু।
এই সময় বসুকে পার্টির কাজে প্রায়ই কলকাতার বাইরে যেতে হত। শহরের বাইরে যেতে বিশেষ করে ট্রেনযাত্রা বসুর বেশ লাগত। ফার্স্টক্লাস কামরায় ভ্রমণ করতেন, সেটা এম. এল. এ-দের বিশেষ সুবিধা ছিল, পরনে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। কামরায় বসে হয় বই পড়তেন নয়তো বাইরে গ্রামবাংলার শোভা দেখতেন। “ভালই লাগত”–বসু বলেন। সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ জমানো তাঁর ধাতে ছিল না। সাহেবদের বিশেষ করে সাহেবদের তোষামোদকারীদের একেবারেই পছন্দ ছিল না তাঁর। ট্রেনের কামরায় এইটুকু সময়েই তিনি মনটা তাজা করে নিতেন, তারপরে শুরু হত নিরলস, বিরামহীন একটার পর একটা কাজ।
পশ্চিমবঙ্গে নতুন আইনসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৮৩। রূপনারায়ণ রায়কে পূর্ব পাকিস্তান চলে যেত হয়েছিল কারণ তাঁর নির্বাচনকেন্দ্র পড়েছিল ঐ দেশে। মুসলিম লীগের যেসব সদস্য পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গেলেন তাঁরা একটা পৃথক গ্রুপ তৈরি করলেন। তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির অনেক প্রস্তাব সমর্থন করতেন। বসুর বিশেষ করে মনে আছে মুসলিম লীগের মহম্মদ খুদা বকস এবং আবুল হাসেমের কথা। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন দুজন, জ্যোতি বসু এবং রতনলাল ব্রাহ্মণ। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যপদ পাওয়ায়, তাঁর জায়গায় আসেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ।
স্বাধীনতার পর পুনর্গঠিত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৪৭ সালের ২১শে নভেম্বর। এই দিন ছিল ১৯৪৫ সালের ২১শে নভেম্বর আজাদ হিন্দ- বাহিনীর মুক্তির দাবিতে গণ আন্দোলনের দ্বিতীয় বার্ষিকী। এইদিন একটি ছাত্র ও কৃষক মিছিল স্বাধীন ভারতের নতুন বিধানসভাকে অভিনন্দন জানাতে বিধানসভা অভিমুখে রওনা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর আগেই এসপ্ল্যানেড ইষ্টে এই মিছিলের ওপর মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পুলিস লাঠি চালাল ও কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করল। বসু খবর পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়িয়ে এই নিন্দনীয় ঘটনার কারণ দর্শিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে অনুরোধ করেন। প্রফুল্লবাবুর বিবৃতি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বসু বিধানসভা ভবন থেকে রাস্তায় বেরোলেন। বেরিয়েই দেখেন পুলিস হাজার হাজার কৃষকের ওপর লাঠি চালাচ্ছে, কাঁদানে গ্যাস প্ৰয়োগ করছে। ভাল করে দেখার আগেই তাঁর নিজের চোখ অসম্ভব জ্বালা করতে লাগল আর চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়তে লাগল। রুমাল দিয়ে বার বার মুছেও কোনও লাভ হচ্ছে না। মুখটাও যেন মনে হচ্ছে জ্বলে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় হেঁটে চলে গেলেন রাইটার্স বিল্ডিংস্-এ। দেখা হল মুখ্যমন্ত্রী ও কালীপদ মুখার্জির সঙ্গে। তিনি প্ৰফুল্লবাবুকে ঘটনাস্থলে যেতে অনুরোধ করলেন কিন্তু প্রফুল্লবাবু ছিলেন কেমিষ্ট্রির ছাত্র, তিনি তখন কিভাবে কাঁদানে গ্যাস তৈরী হয়, কেন চোখ দিয়ে জল বেরোয় ইত্যাদি বোঝাতে শুরু করলেন। তাঁর দমদমে কাজ ছিল, তিনি বললেন তাঁর পক্ষে এসপ্ল্যানেডে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি কালীবাবুকে যেতে বললেন। কালীপদ মুখার্জির গাড়ীতে করে ঘটনার কাছাকাছি যেতেই বসু বুঝলেন জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কালীবাবুকে বিদ্রূপ করছে; পরিস্থিতি বিপজ্জনক দেখে বসু এক মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। কালীবাবুকে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। নিজে গাড়ি থেকে নেমে কৃষকদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বললেন, উত্তেজিত কৃষকরা শান্ত হল, আস্তে আস্তে ফিরে গেল। বাড়ি ফেরার আগে বসু পার্টি অফিসে গিয়ে ঘটনাটি রিপোর্ট করলেন। স্বাধীন ভারতের বিধানসভায় এম. এল. এ. হিসাবে বসুর রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিনটা ছিল এমনই ঘটনাবহুল।
নতুন বিধানসভায় বসুর প্রথম ও প্রধান জেহাদ ছিল কালা কানুনের বিরুদ্ধে। ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের মুখ্যমন্ত্রীত্বে কংগ্রেস সরকার ‘পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা’ আইন’ নামে এক আইন চালু করেছিল। পরে এর নাম হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন’। সুরাবর্দি মন্ত্রী থাকার সময় জারি করা হয়েছিল ‘বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স ১৯৪৬’। এটিই ডঃ ঘোষ ১৯৪৭ সালের ২৭শে নভেম্বর বিল আকারে বিধানসভায় পেশ করেছিলেন এবং বিবেচনার জন্য এই বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়েছিলেন। জ্যোতি বসু এই বিলের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিলেন। বিধানসভায় বিলটিকে বসু উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ ও ‘দমনমূলক’ বলে তীব্র নিন্দা করেন। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ মন্ত্রীসভা অবশ্য এই বিরোধিতা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছিল। বস্তুতপক্ষে বিলটি ছিল জনবিরোধী। ফলে এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন—তাঁদের মধ্যে শরৎচন্দ্র বসু, প্রখ্যাত আইনজীবী নির্মলচন্দ্র চ্যাটার্জি, কংগ্রেস নেতা অধ্যাপক ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, মৃণালকান্তি বসু প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখ্য। এঁদের বাড়িতে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা কমিটির একাধিক বৈঠক হত, বসুও সেখানে থাকতেন। তাছাড়া সারা কলকাতায় বিভিন্ন জনসভা হত, মিছিল বের হত। কংগ্রেস সরকার এই জনপ্রতিরোধ সহ্য করতে পারে না। ১৯৪৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। বিধানসভা ভবনের সামনে ছাত্রছাত্রীসহ বহু মানুষ এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। পুলিস তাঁদের প্রতিহত করার জন্য প্রথমে লাঠি চালায়, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে এবং পরে নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিসের গুলিতে মারা যান আর. ডাবলু. এ. সি-র (রিলিফ অ্যাণ্ড ওয়েলফেয়ার অ্যামবুল্যান্স কর্পস) ক্যাডেট শিশির মণ্ডল। বসু এই ঘটনা নিজে চোখে দেখেছিলেন। বিধানসভায় ঢুকতে গিয়ে সব গেট তালা বন্ধ দেখে চলে আসেন হাইকোর্ট ভবনের কাছে। সেখানে তখন নারকীয় তাণ্ডব চলছে। এ্যামবুলেন্স মার্কা গাড়িকেও পুলিস রেহাই দেয়নি, এই গাড়িতেই ছিলেন গুলিতে নিহত শিশির মণ্ডল। বসু দেখলেন পুলিস ইচ্ছা করে জনতাকে মারধোর করছে।
পরের দিন ১১ই ডিসেম্বর বসু বিধানসভায় একটি মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের নোটিশ দিলেন। স্পীকারের অনুমতি পাওয়া গেল। সেই দিনই বিরতির পর মুলতুবি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হল। মুলতুবি প্রস্তাবের সমর্থনে বসু জোরালো ভাষণ দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : “…ডঃ ঘোষ জনগণের বিরুদ্ধে অ্যাণ্ডারসন সন্ত্রাসের সময়কার দমনপীড়ন পদ্ধতিতে শিক্ষিত পুলিসবাহিনীকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কংগ্রেসের যে নেতৃবৃন্দ বিনা বিচারে আটকের সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাই এখন এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার অগ্রণী বাহিনী হিসাবে কাজ করছেন।”“ বসুর এই অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ সত্য। প্রফুল্ল- চন্দ্র ঘোষ-এর আগে এই অর্ডিন্যান্স বলে ২১শে নভেম্বর সি. পি. আই. নেতা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও ২৫জন সি. পি. আই. নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে বন্দী করে রেখেছিলেন।
এই বিল নিয়ে আন্দোলন ১৯৪৮ সালের ৫ই জানুয়ারি পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বসু এই বিলের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে সর্বতোভাবে জেহাদ চালিয়েছিলেন। প্রবল বাধা প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই বিল পাস হয় ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, চলে ১৯৬৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিল করে।
৪
১৯৪৮ সালের শুরু মোটেই তেমন প্রেরণাদায়ক ছিল না। বছরটা বসুকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানোর জন্যই যেন প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। ঘটনাগুলো যেন চলছিল উল্টোস্রোতে। বসু করে চলেছিলেন ঋজু করার প্রচেষ্টা। বছরের গোড়াতেই মেনে নিতে হল কালা কানুন বিষয়ে সরকারের কাছে পরাজয়। নিশ্চিত হয়ে গেল সংগ্রামী মানুষের অনিশ্চয়ের পথ। ৫ থেকে ১৫ই জানুয়ারি বসু বিধানসভায় বিলটির উপর আলোচনায় মুখর হয়েছিলেন। বিল পাস হয়ে যাওয়ার পর ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা অপসারিত হল। তার পরিবর্তে গঠিত হল ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় হলেন মুখ্যমন্ত্রী, কিরণশঙ্কর রায় হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নলিনীরঞ্জন সরকার হলেন অর্থমন্ত্রী। এছাড়াও ছিলেন হেমচন্দ্র নস্কর, নিকুঞ্জবিহারী মাইতি ও কালীপদ মুখার্জি।
১৯৪৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ই মার্চ কলকাতায় মহম্মদ আলি পার্কে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে পি. সি. যোশীর সময়কার ‘সংস্কারপন্থী’ ত্রুটিগুলি সংশোধিত করে যে নতুন নীতি নেওয়া হয় তাতে বামপন্থী হঠকারী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জ্যোতি বসু এবং আরও কয়েকজন পার্টি কমরেড মনে করেছিলেন এতে পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক দ্বিতীয়বার হলেন ভবানী সেন। তিনি পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের নীতির সমর্থক ছিলেন। জ্যোতি বসু ও অন্যান্য কয়েকজন কমরেডের ঐ রাজনৈতিক থিসিস সম্বন্ধে সংশয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পার্টি কংগ্রেসে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সভায় জ্যোতি বসু সহ অন্যান্য কমরেডদের দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা করা হয়েছিল। জ্যোতি বসুর মনের সংশয় গেল না, তবুও তিনি পার্টির শৃঙ্খলাপরায়ণ সদস্যের মত পার্টির নীতি অনুযায়ী কাজ করে যেতে লাগলেন। সেই সময় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কিছু গোপন দলিল পার্টির হাতে আসে। বোঝা যায় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সরকার পার্টি সম্বন্ধে কোনও চরম সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। এক উচ্চপদস্থ পুলিস অফিসার খবর দিয়েছিলেন ধরপাকড় হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে পার্টি বে-আইনি ঘোষিত হতে পারে। পার্টি নেতৃত্ব তখন এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বিধানসভার অধিবেশন চলার সময় একদিন বসুকে মন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্কর তাঁর ঘরে এনে একটি পান খেতে দিয়ে বলেছিলেন ‘জ্যোতিবাবু সাবধানে থাকবেন, পরে সব বলব’। বসুর সঙ্গে তারপর হেমবাবুর আর দেখা হয়নি।
দ্বিতীয় কংগ্রেস শেষ হল ৬ই মার্চ। তার ঠিক কুড়িদিনের মাথায় সরকারের নিদের্শে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনী ঘোষিত হল। ১৯৪৮ সালের ২৬শে মার্চ। ২৫শে মার্চ পার্টির সংবাদদাতা এ খবর দিয়েছিলেন, যাঁদের কাছে খবর পৌঁছনো সম্ভব তাঁদের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া হল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সবাই খবর পেলেন না, বসুও জানতেন না। ২৬শে মার্চ খুব ভোরে বসু তাঁর হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হলেন। বসুর মনে পড়ল হেমবাবুর সাবধানবাণীর কথা। সারা বাড়ি পুলিস ঘেরাও করল, সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিস অফিসার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখিয়ে বসুকে গ্রেপ্তার করল। বসুকে নিয়ে তারা গেল লর্ড সিন্হা রোডে পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখানে বসু তাঁর পরিচিত কমরেডদের অনেকেই দেখতে পেলেন। কমিউনিস্ট পার্টি অফিস সীল করে দেওয়া হল, পার্টির দৈনিক মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’র অফিস বন্ধ করে দেওয়া হল। সারা রাজ্য জুড়ে পার্টিকর্মীদের গ্রেপ্তার চলল। তখন স্বরাষ্ট্র (পুলিস) মন্ত্রী ছিলেন কিরণশঙ্কর রায়।
পুলিস যখন বসুকে গাড়ি করে লর্ড সিন্হা রোডের অফিসে নিয়ে যাচ্ছে তখন বসু দেখলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ গড়িয়াহাট রোড দিয়ে হাঁটছেন বসুর মনে পড়ে গেল তাঁর প্রণীত কালাকানুনের কথা, তাঁরই মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কথা। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গণআন্দোলনকর্মীদের ওপর এই আইন প্রয়োগ করা হবে না। বসুকে পাঠানো হল প্রেসিডেন্সি জেলে। বসুর এটাই ছিল প্রথম কারাবাস। জেলে একটা হলঘরে কমরেডরা সকলে থাকতেন। বসু সময় কাটাতেন বই পড়ে, খেলাধূলা করে। তিনি ক্রিকেট টীম তৈরি করেছিলেন, নানাধরনের বই পড়তেন, তাস খেলা জানতেন না, ফলে কমরেডদের সঙ্গে এই খেলায় যোগ দিতে পারতেন না। অম্বিকা চক্রবর্তী কমরেডদের সব রকম দেখাশোনা করতেন, তিনি জেলের মধ্যে যত্রতত্র যাতায়াত করতে পারতেন।
প্রতি তিন মাস অন্তর পর্যালোচনা কমিটি পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইনে আটক বন্দীদের বিষয় পর্যালোচনা করত। পর্যালোচনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি। বসুর বিরুদ্ধে পুলিসের কয়েকটি অভিযোগ ছিল—যেমন, তিনি ব্রহ্মদেশ কৃষক সংগঠনের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, এবং তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বলা বাহুল্য, অভিযোগগুলি সবই মিথ্যা। তিন মাস পর পর্যালোচনা কমিটি তাঁকে মুক্তি দেন।
জেল থেকে বেরিয়ে এসে বসু আবার রেলওয়ে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শুরু করেন। পার্টি তখনও বেআইনি। বসু বুঝতেন পুলিসের গোয়েন্দারা তাঁর ওপর কড়া নজর রাখছে। পুলিস তাঁর ওপর বাধানিষেধ আরোপ করে যে, পুলিসকে না জানিয়ে তিনি কোথাও যেতে পারবেন না, ঠিকানাও পালটাতে পারবেন না। তখন বম্বেতে অল ইণ্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস হবে, বসুরও সেখানে যাওয়ার কথা। বসু তাঁর ব্যারিস্টার বন্ধু নীরেন দে-র আইনি পরামর্শ নেন। মিঃ দে তাঁকে বলেন তিনি যেতে পারেন। বসু বম্বে যাবেন বলে যাত্রা করেন। কিন্তু বেশিদূর তাঁকে যেতে হয় না। খড়গপুর স্টেশনে ট্রেন থামতেই একদল পুলিস কামরায় উঠে ‘জ্যোতি বসু’র খোঁজ করতে থাকেন। একজন অফিসার বসুকে আই. জি-র আদেশ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করেন। ‘কেন আপনার আমাকে অ্যারেষ্ট করছেন?’—বসু প্ৰশ্ন করেন। ‘আমরা কিছুই জানি না, আমরা কলকাতার আই. জি-র কাছ থেকে তার পেয়েছি’—অফিসার জবাব দেন। বসুকে ট্রেন থেকে নামিয়ে অন্য ট্রেনে করে মেদিনীপুর নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে পুলিস তাঁকে নিয়ে গেল মেদিনীপুর কোর্টে। কোর্টে তাঁকে দেখে আইনজীবীরা রীতিমত বিস্মিত হলেন—তাঁদের প্রায় সকলেই বসুকে চিনতেন। বসু গ্রেপ্তার হলেন কেন তাঁরাও জানেন না, বসু নিজেও জানেন না। এমনকি যে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে তাঁকে উপস্থিত করা হল, তিনিও জানেন না কেন বসুকে মেদিনীপুরে আনা হয়েছে। তিনি বসুকে পাঠিয়ে দিলেন বার লাইব্রেরিতে। বসু সেখানে অনন্তকাল প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। অত্যন্ত বিরক্তবোধ করলেও তিনি ধৈর্য হারান নি। বহুক্ষণ পরে ম্যাজিষ্ট্রেট যখন তাঁকে ডেকে পাঠালেন তখন বসু ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। তাঁকে ম্যাজিষ্ট্রেট সরকারী এক আদেশ দেখিয়ে বললেন তিনি পুলিসের আইন অনুযায়ী কারণ না দেখিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেন না। পুলিসকে না জানিয়ে কলকাতা ছাড়াটাই তাঁর অপরাধ। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট বন্দীকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হলে সশস্ত্র পুলিসবাহিনী দরকার। অতএব বসুকে সেখানেই রাত কাটাতে হল। স্থির হল সকালের প্রথম ট্রেনেই তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কলকাতায় বসুকে সোজা আলিপুর কোর্টে নিয়ে যাওয়া হল। বসু বসলেন বার লাইব্রেরিতে। আইনজীবীরা বললেন, তাঁর জামিন পাবার কোনও আশা নেই। স্নেহাংশু আচার্যকে খবর পাঠানো হল। বসু জামিনের আবেদন করলেন। জামিন মিলল না। তখন বসুকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলে। বিচারক গুহরায়ের এজলাসে স্নেহাংশু আচার্য সওয়াল করলেন, জামিন পাওয়া গেল। আগেরবার বিচারক বসুর দিকে না তাকিয়েই জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছিলেন। এবার জামিন পাওয়া গেল, তবে একটা শর্ত আরোপ করা হল। বলা হল প্রতি সপ্তাহে বসুকে বেলতলা পুলিস থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। কোর্টে এই মামলা লড়লেন বসুর ব্যারিষ্টার বন্ধু মৃগেন সেন। বসু বেকসুর খালাস হলেন।
এর পর বসু আবার রেলওয়ে ট্রেড ইউনিয়নের কাজে মন দিলেন। পার্টির এই বে-আইনি যুগে তাঁর ওপর পুলিসের কড়া নজর ছিল। তিনি প্রকাশ্যে থাকার সময় বিধানসভায় বিতর্কে জনস্বার্থের পক্ষে বিভিন্ন বিষয় উত্থাপন করতেন। পার্টির হয়ে জোরদার ভাষায় সওয়াল করতেন, কংগ্রেস সরকারের দমন-পীড়ন নীতির তীব্র নিন্দা করতেন। ১৯৪৮ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর বিধানসভার অধিবেশনে পুলিসমন্ত্রী কিরণশঙ্কর রায় কালাকানুনের বিলটি উপস্থিত করেন। জ্যোতি বসু তখন ঐ বিলের তীব্র বিরোধিতা করেন।
বসুর বয়স তখন চৌত্রিশ। ডাঃ নিশিকান্ত বসু ঠিক করলেন এবার তাঁর ছোট ছেলের বিবাহ করা উচিত। বসু কিছুতেই রাজি হলেন না। বাবাও অনুরোধ উপরোধ করতে লাগলেন। অবশেষে বসু সম্মতি দিলেন। ৫ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে বসুর বিবাহ হল। এ প্রসঙ্গে ডাঃ বসু তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন :
“আমার ছোট পুত্র জ্যোতি বসু এম. এল. এ. এবং কমিউনিস্ট পার্টির লিডার আজ রেজিষ্ট্রি করিয়া ২বার বিবাহ করিল। তাহার শ্বশুরমহাশয় শ্রী বীরেন্দ্রনাথ বসু আলিপুরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। তাঁহার বাড়ি ঢাকার বহর গ্রামে। তাঁহারা সেখানে উচ্চবংশীয় কুলীন। তাঁহার দুই পুত্র ও দুই কন্যা। আমার পুত্র জ্যোতি তাঁহার বড় কন্যা শ্রীমতী কমল বসুকে বিবাহ করিল। সে বেথুন কলেজে বি. এ. পর্যন্ত পড়িয়াছে। আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলেই এই বিবাহে অত্যন্ত সুখী হইয়াছিল। বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাগণ বিবাহের রাত্রে বীরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইয়া বরকন্যাকে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন।”
এই ঘটনার পর পার্টির গোপন হেডকোয়ার্টার থেকে বসুকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয় তিনি বিবাহ করবার জন্য পার্টির অনুমতি কেন চান নি এবং তিনি সম্ভবত আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে ইচ্ছুক নন এ ইঙ্গিতই দেওয়া হয়। বসু এর উত্তর এক চিঠিতে পার্টিকে জানান, যদি এই মুহূর্তে তাঁকে পার্টি আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে বলে তিনি এখনই প্রস্তুত। বসু চেয়েছিলেন এই চিঠি পার্টির মধ্যে প্রচার করা হোক। বিবাহের পর বসু হিন্দুস্তান পার্কের তাঁর বাবার বাড়িতে সপরিবারে বাস করতেন।
বিবাহের পর বসুর কর্মজীবনের ব্যস্ততা একই রকম থেকে গেল। বিবাহের তিন মাস পুরো হবার আগেই তিনি গ্রেপ্তার হলেন। আত্মগোপন করে বসু কাজ করে যেতে লাগলেন। ৯ই মার্চ ১৯৪৯ কমিউনিস্ট পার্টি সারাভারত রেল ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নেয়। দানাপুরে এ. আই. আর. এফ-এর সম্মেলনে বসুর যাওয়ার কথা ছিল। যাবার আগে বসু স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর ফিরতে কিছুদিন দেরি হতে পারে। তিনি জানতে পেরেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বসু দানাপুরে যাবেন বলে ট্রেন ধরলেন কিন্তু নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে ছোট একটা গ্রামে নেমে পড়লেন। অধিবেশনের খবর দূর থেকেই নিতে লাগলেন। বসুর ব্যক্তিগত মত ছিল এই ধর্মঘটের জন্য শ্রমিকরা এখন প্রস্তুত নন, তবুও অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে তিনি পার্টির সিদ্ধান্ত (ধর্মঘটের পক্ষে) কার্যকর করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভোটাভুটি হয় এবং ধর্মঘট না করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই অধিবেশনেই বসু এ. আই. আর. এফ. থেকে বহিষ্কৃত হন। দানাপুর থেকে বসু সোজা কলকাতায় না এসে পাটনা থেকে পুলিসের চোখ এড়িয়ে কলকাতায় ফিরে আত্মগোপন করেন।
এ প্রসঙ্গে ডাঃ নিশিকান্ত বসু তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন : “বিবাহের কিছুদিন পরে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করিল। আমার বালিগঞ্জের বাড়িতে শেষরাত্র ৪টার সময় ১৯৪৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিসগণ আসিয়া আমার পুত্র জ্যোতি বসুর সমস্ত কাগজপত্র লইয়া গেল। জ্যোতি ‘অল ইণ্ডিয়া রেলওয়ে ফেডারেশনের’ এক বিরাট সভায় পাটনার নিকট রামগড়ে যোগদান করিবার জন্য গিয়াছিল। তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার মতলব করিয়া পুলিস আসিয়াছিল। তাহাকে না পাইয়া আমাকে অনেক প্রকার প্রশ্ন করিয়া বিফল মনোরথ হইয়া চলিয়া গেল। পুলিস রামগড়েও তাহার অনুসন্ধানে গিয়াছিল। সে অসীম সাহস করিয়া প্লেনে কলিকাতায় আসিয়া সব খবর জানিয়া পালাইয়া রহিল।”
কলকাতায় এসে বসু খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, তাঁর থাকার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রায়ই তিনি তখন বাসা পাল্টাছেন। মাঝে গিয়ে উঠলেন আব্দুল হালিমের গোপন ডেরায়, সেখান থেকে স্ত্রীকে চিঠি লিখে তিনি নিজের কুশল সংবাদ জানালেন, কয়েকদিন এই অবস্থায় আত্মগোপন করে থাকতে হবে একথাও লিখলেন। একবার তিনি এক আত্মীয়ের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য উঠেছিলেন—তাঁরা বসুকে দেখে রীতিমত অবাক—বসু যে এমন কষ্টের মধ্যে, অনিশ্চয়তার মধ্যে সাদাসিধেভাবে জীবনযাপন করছেন, সেটা তাঁরা ভাবতেই পারেন না। আত্মগোপন করে থাকার বিষয়ে বসু বললেন—”প্রথম প্রথম একটা অদ্ভুত অনুভূতি হত, আমি জ্যোতি বসু, অথচ জ্যোতি বসু নই, আমার নাম ছিল ‘বকুল’, জামাকাপড়ও অন্যরকম পরতে হত, চোখে চশমা, গোঁফদাড়ি রাখতে হয়েছিল।” গোপন আস্তানায় প্রত্যেককে ঘরের কাজ করতে হত। উনুন ধরানো, তরকারি কাটা, রান্নাবান্না, কাপড়কাচা, বাসন ধোয়া সবই করতে হত। সকালে ঘুম ভাঙত উনুনের ধোঁয়ার গন্ধে। রতন কমরেড উনুন ধরাতো। “উনুন ধরানোর ব্যাপারটা বেশ শক্ত”–বসু বললেন। রান্নাবান্নার দিকে বসু তেমন যেতেন না, তবে ঝাঁট দেওয়া, বাসনধোয়া এসব কাজ করতেন। আত্মগোপন অবস্থায় থেকে তিনি প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যান। তাঁর ছদ্মবেশ ছিল নিখুঁত, নিজের লোকেরাও তাঁকে সেই বেশে দেখলে চিনতে পারতেন না। একবার পুলিস এসেছে, ওয়াচার আসছে রব উঠতেই বসুকে ছাগল রাখার একটা ছোট ঘরে বেশ কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। সে সময় বসু স্ত্রীর সঙ্গে চিঠিতে খবর আদানপ্রদান করতেন ছোট শ্যালক মুকুলের মাধ্যমে। তাঁদের দেখা করার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। সন্ধ্যার পর তিনি বিভিন্ন গ্রুপে গোপন জায়গায় পার্টির বৈঠক করতে যেতেন। এর মধ্যে পড়াশোনাও করতেন।
১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চের দিন তিনেক আগে বসু আর ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত উত্তর কলকাতার একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। রেলওয়ে ধর্মঘট নিয়ে নানা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ধর্মঘট হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। জানা গেল পুলিসবাহিনী সব স্টেশনে টহল দিচ্ছে। পার্টির অনেক ইউনিয়নকর্মীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৯ই মার্চ ধর্মঘট সম্পূর্ণ অসফল হল। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিকই রইল। এই প্রসঙ্গে বসু লিখেছেন :
“এই ব্যর্থতা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। এটা যে ভ্রান্তপথ ছিল, তখন তা স্বীকার করা হয়নি। পুরাতন নীতিই বজায় রইল। শুধু তাই নয়, আমরা আরও হঠকারিতার রাস্তা গ্রহণ করলাম।”“
সেই সময় পলিটব্যুরোর মনে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক কমিটি পার্টির নীতি ঠিকমত কার্যকর করতে পারছে না। সেই কারণে পলিটব্যুরো সেই প্রাদেশিক কমিটি ভেঙে দিয়ে সাত সদস্যকে নিয়ে এক নতুন প্রাদেশিক কমিটি গঠন করে। এই কমিটির নতুন সম্পাদক হন মহম্মদ ইসমাইল। বাদ পড়েন ‘সংস্কারপন্থী’ বলে বর্ণিত জ্যোতি বসু, তাছাড়া ভূপেশ গুপ্ত, নিরঞ্জন সেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত, আব্দুল হালিম, সরোজ মুখার্জির মত নেতাও।
“কমিউনিস্ট পার্টির সেই বে-আইনি যুগ ছিল কঠিন সংগ্রামের যুগ”–বসু মন্তব্য করেন। ১৯৪৯ সালে তখন জোরদার কৃষক আন্দোলন চলছে—তেভাগা, তেলেঙ্গানা, কাকদ্বীপ, ডুবিরভেড়ি। ২৭শে এপ্রিল কলকাতায় বহুবাজারে এক মহিলা মিছিলের ওপর পুলিসের গুলি চালনায় প্রাণ হারান পার্টি কমরেড লতিকা সেন ও প্রতিভা গাঙ্গুলি। ৮ই জুন প্রেসিডেন্সি জেলে গুলি চলে। তার দু’দিন পরে আবার দমদম জেলে গুলি। ১১ই জুন থেকে শুরু হল জেলে অনশন ধর্মঘট। তখন মুজঃফর আহমেদও জেলে। শেষে মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ রায় ও ‘কাকাবাবু’র মধ্যে এক লিখিত চুক্তি হল এবং বন্দী কমরেডদের কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়ার পর অনশন ধর্মঘট তুলে নেওয়া হল।
ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যেই চলে যায় ১৯৪৯। বসুর মনে তখন অনেক প্রশ্ন, অনেক সংশয়। এই বামপন্থী ‘সংকীর্ণতাবাদী’ নীতির কি কোনও পরিবর্তন করা যায় না? তাহলে সঠিক নীতি কি হওয়া উচিত? এই ‘হঠকারিতা’র প্রতিকার কি?’— এমনতর হাজারটা প্রশ্ন মনে নিয়ে বসু শেষ করেন ১৯৪৯ সাল।