পঞ্চম পর্ব : এক নক্ষত্র শিশু
৩০. আবার আসিব ফিরে
ও যেন একটা স্বপ্ন দেখে উঠল মাত্র। অথবা একটা স্বপ্ন ক্ষেত্রে বসে স্বপ্নের ভিতর দেখছে স্বপ্ন। তারার রাজ্যের দরজাটা ওকে আবার ফিরিয়ে এনেছে মানুষের জগতে। কিন্তু মানুষ হিসেবে নয়।
কতদিন ও দূরে ছিল? এক জীবন, নাকি দু জীবন? দু জীবনই। একটা সামনের দিকে এগিয়ে চলতে গিয়ে হারিয়ে যায় অন্যটা ফিরে এসে। ডেভিড বোম্যান হিসেবে-ইউনাইটেড স্টেটস স্পেসশিপ ডিসকভারির একমাত্র ক্রু ও অধিনায়ক হিসেবে ও আটকা পড়েছিল এক বিশাল, অপ্রতিরোধ্য ফাঁদে। ত্রিশ লক্ষ বছর আগে পাতা ফাঁদ। যে ফাঁদ শুধু সময়েই কার্যকর হবে। সঠিক সময়ে।
সে একের পর এক জগতে পরে গেছে এর মধ্য দিয়ে। পতন আর পতন। মিলিত হয়েছে সেসব আশ্চর্যজনক ঘটনার সাথে, সৃষ্টির সাথে, বিস্ময়ের সাথে যার কিছু কিছু বোঝে, আর কিছু বোঝে না। হয়ত কোনোদিনই বুঝবে না।
চির ত্বরণের গতিতে দৌড়ে চলে। এক অসীম আলোর গুহাপথ ধরে। নিজেই একটা আলো না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চলেছে ছুটে। ও জানতো এটা অসম্ভব। কিন্তু আজ জানে কীভাবে সম্ভব। আসলেই আইনস্টাইন ঠিক ঠিক বলেছিলেন, মহান কর্তা রহস্যময় হতে পারেন, ঝগড়াটে নন।
সে এক মহাজাগতিক সুইচিং পদ্ধতির ভিতর দিয়ে গড়িয়ে গেছে তখন। এক বিশাল, অকল্পনীয় মহিমাময় জায়গার ভিতর দিয়ে-যেটা সবগুলো নীহারিকার কেন্দ্র। আবার বেরিয়েও এসেছে কোনো এক অজানা শক্তির দ্বারা রক্ষিত হয়ে। শক্তিটা কোনো লাল দানো নক্ষত্রের চারধার ছেয়ে ফেলতে পারে।
ও বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সূর্যোদয়ও দেখেছে ওখানে, যখন ঐ উদিত হতে থাকা নক্ষত্রের সাদা বামন৩১ সাথী তারাটা আকাশে উঠে আসে। উঠে আসে ওর নিচের নক্ষত্রের গায়ে বিরাট আগুন উচ্ছ্বাস নিয়ে। আগুন জোয়ার হয় সাঁদা বামনেরই আকর্ষণে। ওর কোনো ভয় নেই। শুধু অবাক করা কল্পনা। এমনকি যখন নিচের আগুন খনির দিকে স্পেস পোডটা ওকে টেনে নেয় তখনো…
…থাকার জন্য একটা দারুণ হোটেল স্যুট ছিল যাতে প্রাত্যহিক কিছুরই অভাব নেই। এর প্রায় সবটাই মেকি। শেলফের বইগুলি ডামি। আইস বক্সের সব খাবারের কার্টন আর বিয়ারের ক্যানগুলোয় বিখ্যাত বিখ্যাত সব কোম্পানীর নাম লাগানো থাকলেও ছিল একই রকম তরল খাবারে ভর্তি। গন্ধটা যেমন তেম্নি স্বাদটাও অপূর্ব!
ডেভ বোম্যান কোনোকালেই বোকা ছিল না। দ্রুত বুঝতে পারল কোনো হোটেল স্যুট নয় বরং একটা মহাজাগতিক চিড়িয়াখানায় ও সামান্য এক নমুনা। বন্দীখানাটা খুব যত্নে গড়া। সমস্যা অন্য কোথাও। ওর জন্য এটা তৈরি করা হয়েছে ওরই দেখা এক টিভি প্রোগ্রামের বিলাসবহুল কোনো এক হোটেল কামরা থেকে। এবং বানানো হয়েছে ওর কল্পনা থেকে নিয়ে। ওর বইয়ের না পড়া পাতাগুলো সাদা আর পড়া পাতাগুলো লেখায় ভরা! তার মানে স্মৃতিতে যা আছে তা নিয়েই জগত গঠিত। ভয় ছিল একটাই। যারা আটকে রেখেছে তারাতো আসবে-কিন্তু কোন রূপে?
ঐ আশাটা কী বোকামি! ও এখন বোঝে; একজনের পক্ষে অন্তত একজন মানুষের পক্ষে বাতাসকে দেখা বা আগুনের আয়তন অথবা ভর বোঝ কোনো কালেই সম্ভব না। তারপর শরীর আর মনের অবসন্নতা গ্রাস করে। তারপর ডেভিড বোম্যান ঘুমাতে যায় শেষ বারের মতো।
এ এক অদ্ভুত ঘুম। ও পুরোপুরি অসচেতন ছিল না। কুয়াশার চাদর দারুণ এক বনকে ঘিরে ছিল যেন। কিছু একটা অথবা কেউ একজন মনকে নিচ্ছিল দখল করে। খুব ক্ষীণভাবে বুঝতে পারে-কোনো আগুন চারধার থেকে ঘিরে ধরেছে। গ্রাস করছে দারুণ যত্নে গড়া শরীরটাকে; নিশ্চিতভাবে, দ্রুত। এর এমন নিরাবেগ ধ্বংসের নিচে থেকেও একবিন্দু ভয় বা আশা কিছুই পায়নি। মাত্র একবার মনে হয়েছিল প্রত্যেক মানুষকেই মরতে হয়। ও হয়ত মারা যাচ্ছে।
সেই লম্বা ঘুমের মাঝেই কিছু কিছু সময় স্বপ্নে মনে হয়েছে ও তখন জেগে। বছরগুলো উড়ে যায়। একবার দেখা গেল একটা আয়নায় দেখছে নিজেকে। এক ভেজা মুখমণ্ডলকে নিজের মুখ হিসেবে আবিষ্কার করল। শরীর হয়ে যাচ্ছে বিশ্লেষিত। জীববৈজ্ঞানিক ঘড়ির কাঁটাগুলো ঘুরছে বনবনিয়ে। ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন একটা রাত্রিতে যা কখনোই পৌঁছতে পারবে না। একেবারে শেষ মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালো-আর ঘুরতে শুরু করল বিপরীতে।
সুখের স্মৃতিগুলোর সবই একে একে জমিয়ে রাখা হচ্ছিল। দারুণ নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় ফিরে ফিরে আসছিল অতীত। আস্তে আস্তে তার অতীত এগিয়ে এসে সব জ্ঞান, সব অভিজ্ঞতা ধুয়ে দিল। এগিয়ে এল ছেলেবেলা। কিন্তু কিছুই হারিয়ে যায়নি। জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তের প্রতিটি স্মৃতি আরো শক্ত হয়ে বসে যাচ্ছে মনের ভিতরে। একটা নিরাপদ সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন ডেভিড বোম্যানের অস্তিত্ব ছিনিয়ে নেয়া হলেও আরেকজন হয়ে গেছে চিরঞ্জীব। চলে গেছে বস্তুকেন্দ্রিক সব চাহিদার বাইরে।
সে একজন নতুন দেবতা-যে এ জন্মের জন্য অপ্রস্তুত। প্রস্তুতির ধাপগুলিতে ভাসার সময় সে জানত সে কী ছিল এক সময়, শুধু জানত না একটা ব্যাপার। এখন কী হয়েছে। সে তখনো এক দোলচালে দুলছে-শুককীট আর প্রজাপতির মাঝামাঝি কোথাও। আরো স্পষ্ট করতে গেলে একটা লার্ভা আর শুয়োপোকার মাঝামাঝি…
এক সময় তন্দ্রা ভেঙে গেলে সময় আবার প্রবেশ করল তার ছোট্ট জগতে। সেই কালো চতুষ্কোণ রহস্যময় জিনিসটাই অবশেষে দেখা দেয় বন্ধু হিসেবে।
এটাকে চাঁদের বুকে দেখেছে। মুখোমুখি হয়েছে বৃহস্পতির অর্বিটে। জানত, কোনো না কোনোভাবে ওর পূর্ব পুরুষেরাও এর মুখোমুখি হয়েছিল। আজো এর অপরিমেয় রহস্য লুকিয়ে থাকলেও আর তা পুরোপুরি রহস্যময় নয়। এর কিছু কিছু ক্ষমতা এখন ও বোঝে।
অনুভব করেছে এটা একা নয়, বরং অনেক অনেকের মধ্যে একটা। কিন্তু পরিমাপের যন্ত্রগুলো একটা কথা ঠিকই বলবে, এ রহস্যময় জিনিস সব সময় এক আকৃতির। যতটুকু বড় হওয়া প্রয়োজন-ততটুকু।
কী অবশ্যম্ভাবী এর গাণিতিক অনুপাত! তিন সংখ্যার বর্গ, ১:৪:৯! ভাবনার বিস্ময় ঠেকে গেছে তিন সংখ্যার বর্গতে, প্রথম তিন সংখ্যা-ত্রিমাত্রিকতার প্রতিনিধি। তার মন শুধু তিন মাত্রার রহস্যতেই শেষ হয় কিন্তু এ বিশাল খালি জিনিসটার ভেতর তো আরো বিস্ময়ের, তারায় তারায় ভরা। হোটেল স্যুটটার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না কোনোকালে। এক সময় মিশে যায় স্রষ্টার মনেই। তারপর সামনে ছিল গ্যালাক্সির আঘো আলো ছায়ায় ঘেরা ঘূর্ণি।
গ্যালাক্সিকে মনে হয়েছে কালো প্লাস্টিকের খণ্ডতে বসানো বিশাল, বিবশ করা সুন্দর কোনো মডেল। কিন্তু এই বাস্তব। এ বাস্তবটাকে চোখে দেখে কখনোই বুঝতে পারত না, চোখে না দেখে যেমন এক পলকেই অনুভব করছে, দেখছে। শুধু চেষ্টা করলেই মনোযোগ দিতে পারত এই গ্যালাক্সির দশ হাজার কোটি নক্ষত্রের যে কোনোটায়।
ভাসছিল সূর্য সমুদ্রে। জ্বলন্ত, হিবিজিবি গ্যালাকটিক কোর ১৩২ থেকে শুরু করে অনেক অনেক দূরে ছড়ানো একা, ভীত সব দানব তারা পর্যন্ত বিস্তৃত এ নক্ষত্র মহানদী। ঘুরতে থাকা গ্যালাক্সির সর্পিল, কালচে বিজন ঐ প্রান্তেই ওর উৎপত্তি। আকৃতিহীন ক্যাওস ১৩৩ আজো আছে, মাঝেমধ্যে একটু আলোকিত হয়ে ওঠে অকল্পনীয় দূরে থাকা কোটি তারকার নিভু নিভু আলোয়। ও জানে, এটাই সৃষ্টির মূল পদার্থ। আজো ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনি। আজো গঠিত না হওয়া এক দলা বিবর্তন-সন্তান। সময় আসলে কী? এই এখানে, কালো এক অকল্পনীয় বিশাল অংশ অব্যবহৃত, যেখানে আজো সময়ের জন্মই হল না! যেদিন এ শুন্যতা ভরে উঠবে, পাবে নতুন আকার জীবনে জীবনে, সৃষ্টিতে সৃষ্টিতে, আলোতে আলোতে-সেদিক আজকের সব নক্ষত্র থাকবে কোথায়?
খেয়াল না করে একবার একটা ক্যাওস এলাকা পেরিয়েছিল। এবার আরো অনেক প্রস্তুত, যদিও জানতেই পারেনি কোনো অস্তিত্ব ওকে পরিণত করেছে নক্ষত্র সন্তানে। আবারো পেরুতে হবে ওই জায়গাটা…
মনের ফ্রেম থেকে গ্যালাক্সি বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে গেল সরাতে চাওয়ার সাথে সাথে। নক্ষত্র আর নেবুলার ১৩৪ দল উড়ে চলল এক অসীম গতিতে। ভৌতিক সূর্যগুলো ছিন্নভিন্ন করে ও চলে যায় প্রতিটার কোরের ভিতর দিয়ে।
সূর্যগুলো এক সময় ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে যায়। সামনে আরেক আলোর ঝলকানি; মিল্কি ওয়ে আসছে, একটা ভৌতিক আলোকে পুঁজি করে-হয়ত কোনোদিন একে ও চিনত, হয়ত চিনে বসবে আবারো। মানুষেরা যে এলাকাটাকে সত্যিবলে, ও সেখানেই ফিরে এসেছে। ঠিক সে জায়গাটায় যেটা ও ছেড়ে এসেছে কয়েক সেকেণ্ড অথবা কয়েক শতাব্দী আগে। ও চারদিক সম্পর্কে সচেতন। এমনকি আগের বহু সেন্সর লাগানো বাহ্যিক দুনিয়া থেকে অনেক বেশি সজাগ। যে কোনোটার দিকে মনোনিবেশ করলেই তা বিশ্লেষণ করতে পারে একেবারে অসীম ভাগ-উপভাগে, যে পর্যন্ত টাইম স্পেসের একেবারে শেষ প্রান্তে মুখোমুখি না হয়, যার পেছনে শুধুই ক্যাওস।
সে নড়াচড়া করে, কিন্তু কীভাবে তা জানে না। আসলে যখন একটা শরীর ছিল তখন কি ও জানত কীভাবে নড়াচড়া করে? ব্রেন থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যে অদৃশ্য চেইন অফ কমান্ড কাজ করে সেটা নিয়ে কোনোকালে উচ্চবাচ্য করল নাতো!
ও চাইলেই ধারেকাছে থাকা নক্ষত্রের বর্ণালী নীলচে হয়ে যায়; ঠিক যতটুকু চায় ততটুকু। আলোর গতির চেয়েও অনেক কমে ও যাচ্ছে, যদিও চাইলে এ গতি আরো বাড়ানো যায়…আরো…আরো; তবু কোনো তাড়া নেই। আরো অনেক অনেক তথ্য প্রসেস করতে হবে, অনেক পড়ে আছে বিবেচনায় আসার পথে…আর জয় করতেও অনেক বাকি। সামনে আরো অনেক বড় কাজ বাকি থাকলেও এটাই প্রাথমিক লক্ষ্য।
পেছনে দ্রুত সরে যেতে থাকা জগতের দুয়ার অথবা সামনের প্রাথমিক সভ্যতার দু স্পেসশিপ-কোনো দিকেই ওর নজর যায়নি। এগুলো ওর স্মৃতির অংশ, কিন্তু ডেকে ফিরছে অন্য কিছু, এমন এক জগৎ ডাকছে যেটাকে দ্বিতীয়বার দেখার আশাও করেনি।
নক্ষত্রশিশু শুনতে পায় ঐ জগতের একেবারে অসীম কণ্ঠস্বরের প্রতিটাকে, আস্তে আস্তে যেগুলোর শব্দ বাড়ছে। এখনো এগিয়ে আসছে চিকণ চাঁদের রূপ নিয়ে সূর্যের দুর্দান্ত করোনার পেছন থেকে সেই পুরনো বিশ্ব। এরপর নীলচে সাদাটে চাকতি হয়ে বেরিয়ে এল পৃথিবী।
ওর আসার খবর জানতে পেরেছে সবাই। নিচের লোকারণ্যের প্রতিটা রাডারের অ্যালার্ম হয়ত বাজছে, আকাশগুলো হয়ত ছত্রখান হয়ে পড়েছে বিশাল বিশাল টেলিস্কোপের কারণে-আর হয়তো, হয়ত মানুষ যে ইতিহাস জানত, বিশ্বাস করত সে নাটকের যবনিকা পড়বে এবার।
হাজার কিলোমিটার নিচে অর্বিটে অর্বিটে ঘুরতে থাকা মরা কার্গোগুলো হঠাৎ যেন সচেতন হয়ে গেল। এগিয়ে আসছে একটা গোলা। এ কার্গোর দুর্বল শক্তির কোনো দামই নেই ওর কাছে, নয়তো কাজে লাগাতে পারত।
সার্কিটের গোলক ধাঁধায় ঢুকে ও দ্রুত এটার মরণ কেন্দ্র খুঁজে বের করে। বেশিরভাগ শাখাপ্রশাখাই বাদ দেয়া যায়, এগুলো শুধু নিরাপত্তার জন্য বানানো অন্ধপথ। ওর পর্যবেক্ষণের নিচে ওদের সব উদ্দেশ্যই একেবারে ছেলেখেলার মতো লাগে, যে কোনো পরিস্থিতিতে সে ওদের প্রত্যেকের ভিতর দিয়েই চলে যেতে পারে।
এখন সামনে শুধু একটা ছোট বাঁধা-এক অপরিণত কিন্তু প্রভাবশালী যান্ত্রিক সমন্বয় যা দুটো ভিন্ন যোগাযোগকে ধরে রেখেছে। আসল অধ্যায়টা শুরু করার জন্য এদের কাছাকাছি আসতে হবে। ইচ্ছা শক্তিকে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রথম বারের মতো ব্যর্থ হতে দেখল তারকা সন্তান। কয়েক গ্রাম ওজনের মাইক্রো সুইচ নড়ছে না। ও এখনো আঁটি এনার্জির একটা সৃষ্টি; এ কারণেই বস্তুগত পৃথিবীর পুরোটা আওতার বাইরে। একটা সুইচও চাপতে পারবে না। তবু এর এক সহজ উত্ত আছে।
আরো অনেক জানতে হবে ওকে। সামান্য মনে করে এত বেশি শক্তি বইয়ে দিয়েছে এ যান্ত্রিক রিলের দিকে যে কয়েল গলে গেল ট্রিগার অংশটাকে অপারেট করার আগেই। মাইক্রো সেকেন্ডগুলি পালিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। বিস্ফোরক লেন্সগুলোর তাক করা দিক দেখতে মজাই লাগে। যেন কোনো নিভুনিভু ছোট্ট ম্যাচের কাঠি এক বিন্দু আগুন দিচ্ছে এক বিরাট বিস্ফোরক ভর্তি ট্রেনের গায়ে, ফলাফল…
একটা নীরব বিস্ফোরণ কয়েক মেগাটন বিস্ফোরক ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমন্ত জগত্তার অর্ধেক ভরিয়ে দিয়েছে কৃত্রিম সূর্যাস্তের আলোয়। যেন আগুনের শিখাগুলোর ভিতর থেকে কোনো ফিনিক্স পাখি উঠে এসে যতটুকু দরকার অগ্নি-জীবন শুষে নিয়ে বাকিটা উগরে দিল। অনেক নিচের অ্যাটমোস্ফিয়ার-আবরণ অধিকাংশ রেডিয়েশন শুষে নিল। অ্যাটমোস্ফিয়ারটা সব সময়ই নীলচে সবুজ গ্রহকে উটকো ঝামেলা থেকে বাঁচায়। কিন্তু এ বিস্ফোরণের পর কিছু অভাগা মানুষ আর পশুপাখি থাকার কথা যারা আর কখনো কিছু দেখতে পাবে না।
মনে হচ্ছে ঘটনা দেখে পৃথিবী আঘাতে বোবা হয়ে গেছে। শর্ট আর মিডিয়াম ওয়েভের কথাবার্তাগুলো থেমে গেছে পুরোপুরি, হঠাৎ শক্তিমান হওয়া আয়োনোস্ফিয়ারই ওদের ফিরিয়ে দিয়েছে মাটিতে ৩৬। এখন শুধু মাইক্রোওয়েভগুলোই পৃথিবীকে ঘিরে থাকা কাঁচের স্তরটার গায়ে এসে পড়তে পারছে। এগুলোর বেশিরভাগই খুব সতর্কভাবে এ স্তরের জন্য পাঠানো, এবং বিচ্ছিন্ন হতে থাকা স্তরটা ধরতে পারল ঠিকই। এখনো মাত্র কয়েকটা শক্তিময় রাডার ওর দিকে তাক করা। এর কোনো গুরুত্বই নেই। এমনকি এগুলোকে সহজেই নিষ্ক্রিয় করার ক্ষমতা থাকলেও সে তা করার কোনো চেষ্টাই করল না। যদি আরো বোমা এগিয়ে আসে, তাহলে একই নিস্পৃহতা নিয়ে তাকাবে। এখনকার জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় এনার্জিই ওর আছে।
আর এখন নক্ষত্র শিশু নেমে যাচ্ছে। দারুণ সর্পিল পথে নেমে যাচ্ছে। নেমে যাচ্ছে সেই কোনো ছোট্টবেলায় হারানো মানচিত্রের দিকে।
৩১. চাইনা মাগো রাজা হতে
একজন ফিন-ডি-সাইকল দার্শনিক একবার বলেছিলেন, এমনকি বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর ব্যথার কথা প্রকাশ করেছেন যে, ওয়াল্টার ইলিয়াস ডিজনি ইতিহাসের যে কোনো ধর্মনায়কের চেয়ে অনেক বেশি খাঁটি মানবিক আনন্দ দিতে পেরেছেন মানব জাতিকে। শিল্পীর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরেও ফ্লোরিডার মাটি কামড়ে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উনিশো আশির প্রথমদিকে ডিজনিভিলটা শুরু হওয়ার পরে (লেখকের কল্পনা) তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল প্রোটোটাইপ কমুনিটি অব টুমরো বা আগামী দিনের পরীক্ষামূলক সমাজের নমুনা এখন নতুন করে আজকের টেকনোলজি এবং সমাজ ব্যবস্থার শোকেস হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর দর্শকরা বুঝতে পারে যে ই পি সি ও টি-একট এর উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন একরের পর একর জমি সত্যিকারার্থেই একটি জীবন্ত, বাস্তব নগর হয়ে উঠবে যাকে মানুষজন বলবে, আমার ঘর।
ঐ প্রক্রিয়াটা শেষ হতে হতেই শতাব্দীর বাকি দিনগুলো গেল কেটে, এখন এই আবাসিক এলাকায় বিশ হাজার মানুষ থাকে। আর এটাই অপ্রতিরোধ্যভাবে পরিণত ও জনপ্রিয় হয়েছে মহান কার্টুনিস্টের নামে, এপকট ডিজনিভিল। ডিজনির গ্রাম।
এখানকার অধিবাসীরা ডব্লিউ ই ডি আইনবিদদের কড়া পাহারা বসানো এক প্রাসাদের ভিতর দিয়েই শুধু বেরুতে পারে। এ এলাকার মানুষের গড় আয়ু যে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো শহরের মানুষের চেয়ে বেশি তার কারণ এও হতে পারে, আবার সারা পৃথিবীর সেরা মেডিক্যাল সার্ভিসের জন্যও হতে পারে। আর এ এলাকার মানুষজনের মধ্যে খুব কমই গর্ভধারণ করতে পারে, আরো কম মহিলা পারে জন্ম দিতে। তাই জনসংখ্যা কোনো চাপ নয়।
.
অ্যাপার্টমেন্টটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে কোনোমতেই হাসপাতালের কোনো স্যুটের মতো না দেখায়। হয়ত মাত্র কয়েকটা অস্বাভাবিক ফিটিং এ রুমের আসল উদ্দেশ্যটাকে বের করে ফেলে। বিছানাগুলো হাঁটুরও নিচে, যাতে রোগী পড়ে গেলেও বেশি ক্ষতি না হয়। এসব দুর্ঘটনা ঘটতে পারে আর ঘটলে তা নার্সদের জন্য কাজের সুযোগ। গোসলখানার টাবও একই পদ্ধতির। ফ্লোরে ডুবে থাকে। এর ভিতরেই সিট বসানো, চারধারে থাকে রেলিং। এসবের জন্য অতিবৃদ্ধ অসুস্থ মানুষও উঠে আসতে পারে সহজে। আর ফ্লোরে পুরু করে কার্পেট বিছানো। কিন্তু কোনো ছোট কার্পেট অথবা র্যাগ নেই যেটার উপর দিয়ে কেউ যেতে পারবে। এমনকি ইনজুরিতে ফেলার জন্য কার্পেটের কোনো তীক্ষ্ণ কোণা বেরিয়ে থাকে না। অন্যান্য বিষয় এত সহজে বোঝা যায় না। টিভি ক্যামেরাগুলো এমনভাবে বসানো যে কেউ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহও করবে না।
ওটার ভিতরে মাত্র কয়েকটা ব্যক্তিগত চিহ্ন আছে-এক কোণায় পুরনো বইয়ের একটা তৃপ, নিউ ইয়র্ক টাইমসের শেষ কয়েকটা প্রিন্ট কপির একটার প্রথম পাতা ফ্রেমে বাঁধানো যেটা ঘোষণা করছে: ইউ এস স্পেসশিপ রওনা দিচ্ছে বৃহস্পতির দিকে লেখার কাছাকাছিই দুটো ছবি, প্রথমটায় এক ছেলে-বয়েস টিন এজের শেষের দিকে; অন্যজন বোঝাই যায় বেশি বয়স। পরনে একটা মহাকাশচারী-ইউনিফর্ম।
দুর্বল, ধূসর চুলওয়ালা মহিলা টিভি প্যানেলে একটা হাসির প্রোগ্রাম দেখছে। বয়েস সত্ত্বর না হলেও আরো বেশি দেখায়। বারবার স্ক্রিনে দেখানো কৌতুকগুলোর প্রতি প্রশ্রয়ের হালকা হাসি দিচ্ছে, একটা চোখ প্রায়ই নেচে যায় দরজার দিকে, হয়ত কোনো ভিজিটরের আশায়। প্রতিবার এমন করার সময় শক্ত হাতে চেয়ারের পাশে উঠিয়ে রাখা ওয়াকিং স্টিক ধরে ফেলে।
এখনো ডুবে আছে একটা টিভি নাটকে। অবশেষে দরজাটা খুলে গেলে একটু অপরাধী চোখ করে দরজার দিকে তাকায়। ছোট সার্ভিস ট্রলি ঘরে ঢুকল, এর পরপরই একজন পোশাকধারী নার্স, খাবার সময় হয়েছে, জেসি। বলল নার্স, আজকে তোমার জন্য এনেছি এক দারুণ জিনিস।
কোনো লাঞ্চ চাই না।
এটা খেলে তোমার আরো অনেক বেশি ভাল্লাগবে।
কী আছে বলার আগে আমি খাচ্ছি না।
কেন খাবে না?
একটুও খিদে নেই। তুমি কি সারা জীবনই ক্ষুধায় থাক? তীক্ষ্ণভাবে যুক্ত হয় কথাটা।
খাবার ট্রলিটা রোবট। থামল চেয়ারের পাশে। ট্রান্সপোর্ট কভারগুলো খুলে গিয়ে বের করল সবটুকু খাবার। নার্স কখনোই কিছু স্পর্শ করে না-এমনকি ট্রলির কন্ট্রোল বারও না। ও এখন স্থির দাঁড়িয়ে, মুখে একটা সর্বকালীন হাসি আর দৃষ্টি তার জটিল রোগীর দিকে।
পঞ্চাশ মিটার দূরের মেডিক্যাল মনিটর রুমের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ডাক্তারকে বলল, দেখ, ব্যাপারটা দেখ।
জেসির প্যাচানো হাত দ্রুত ওয়াকিং স্টিকের সাথে খাপে খাপে মিলে গিয়েই দারুণ দ্রুততার সাথে জিনিসটা ছুঁড়ে দিল নার্সের পায়ের দিকে।
নার্স বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে-এমনকি ওর উপর স্টিকটা চলে আসার পরও। এর পরও সত্য বলার সুরে নার্স বলল, এখন? এমন কাজ ভাল দেখায়, না? খেয়ে ফেল, ডিয়ার।
একটা কুটিল হাসি ছড়িয়ে গেল জেসির মুখে, তবু আদেশ মানতে দ্বিধা করে। এক মুহূর্তের মধ্যেই খেতে লাগল ক্ষুধাতের মতো।
দেখলে? বলল টেকনিশিয়ান, ভালমতোই জানে কী হচ্ছে। দেখে যা মনে হয় তারচে অনেক বেশি মেধাবী। প্রায়ই এমন সব কাণ্ড দেখি।
ও-ই প্রথম বুঝল?
হু। আর সবাই বিশ্বাস করে সত্যি সত্যি নার্স উইলিয়ামস তাদের খাবার দিয়ে যায়।
যাই হোক, আমার মনে হয় না এতে কিছু এসে যায়। দেখ সে কী সম্ভষ্ট। একটা কারণেই-টেক্কা মেরেছে আমাদের উপর। ও খাবার খাচ্ছে এক্সারসাইজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই সব নার্সকে জানাতে হবে, শুধু উইলিয়ামসকে না।
কেন…ও অবশ্যই! পরের বার একটা হলোগ্রামকে নাও পাঠাতে পারি। তখন বোধ হয় আমাদের রেগে যাওয়া স্টাফদের পক্ষ থেকে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।
৩২. স্বচ্ছ ঝর্না
লুসিয়ানা থেকে এখানে আসা ইন্ডিয়ান আর ক্যাজুয়ানেরা বলে স্বচ্ছ ঝর্ণা Tএকেবারে অতল। অবশ্যই একেবারে বোকার মতো কথা-তারাও বোধহয় বিশ্বাস করেনি কথাটা। একজনের শুধু একটা মাস্ক পরে কয়েক স্ট্রোক সাঁতরে আসতে হয়–আর ওখানেই পরিষ্কার দেখা যায় ছোট এক গুহা যেটা থেকে অবিশ্বাস্য খাঁটি পানি বের হয়; চারধারের দুলতে থাকা চিকন চিকন সবুজ এবং অপ্রত্যাশিত গাছগুলোকে আরো একটু নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর এগুলোর ভিতর দিয়ে দানোর চোখগুলো উঁকি দেয় মাঝে মধ্যে।
পাশাপাশি দুটো কালো চক্র। যদিও কোনোদিন ওগুলো নড়েনি-তবু চোখ ছাড়া আর কী হতে পারে? ঘাপটি মেরে থাকাটার ব্যাপারটাই প্রত্যেক সাঁতারে আরেকটু চমক এনে দেয়। একদিন হয়ত দৈত্যটা তার জান্তব বিশ্রাম থেকে জেগে উঠবে, ভয় পাইয়ে দেবে আশপাশের সব মাছকে, শিকার করবে ওদের। কোনোদিনই ডেভিড অথবা ববি জানতে পারবে না যে, ওটা এক পরিত্যক্ত, চুরি যাওয়া বাই সাইকেল যা একশো মিটার গভীরে পানির আগাছার ভিতরে আধা কবর দেয়া অবস্থায় আছে।
এত গভীরতা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিন্তু লাইন আর সিংকার এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে। বড় ভাই আর দক্ষ ডাইভার ববি দশ ভাগের এক ভাগ গিয়ে জানালো যে তলাটা আগের মতোই দূরে দেখায়।
কিন্তু এখন হয়ত এ স্বচ্ছ ঝর্না তার সমস্ত রহস্য খুলে দেবে। হয়ত গুপ্তধনের সেসব কিংবদন্তিই সত্যি। সব স্থানীয় ইতিহাসবিদের নাক সিঁটকানো বন্ধ করে দেবে তাল তাল সম্পদ। যাই হোক না কেন, অন্ততপক্ষে ওরা স্থানীয় পুলিশ চিফকে খুশি করতে পারবে-সব সময়ই এ এক দারুণ পথ-কিছু যদি নাও পায় তো কোনো না কোনো অপরাধের পর ফেলে দেয়া কিছু পুরনো হ্যান্ডগান থাকবেই সেখানে।
ববির গ্যারেজের আবর্জনার স্তূপে পাওয়া ছোট এয়ার কম্প্রেসারটা শুরুর দিকের সমস্যা শেষ করে এখন শব্দ করছে জোরে জোরে। কয়েক সেকেন্ড পর পরই কেশে কেশে একটু নীল ধোয়ার মেঘ ছড়াবে। তবু ভাল, থামার কোনো লক্ষণ দেখায়নি।
আর যদি এটা বন্ধও হয়, বলল ববি, তাতে কী? যদি আন্ডার ওয়াটার থিয়েটারের মেয়েরা কোনো এয়ার হোস ছাড়াই পঞ্চাশ মিটার সাঁতরে উঠতে পারে তাহলে আমরাও পারব। আমরা পুরোপুরি নিরাপদ।
তাই যদি হয়, ভাসতে ভাসতে ভাবল ডেভ, কেন আমরা মাকে বলিনি কী। করতে যাচ্ছি? এজন্যেই বাবার পরবর্তী শাটল ওড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম না? কিন্তু ওর আসলেই কোনো আফসোস নেই; ববি ভাল বোঝে। সতেরো বছরের হওয়াটা সব সময়ই চমৎকার, আরো দারুণ হয় যদি এ বয়েসেই সব জানা যায়। তারা আশা করে সে এখন খুব বেশি সময় নষ্ট করবে না বোকা মেয়ে বিটি সুলৎজের সাথে। সত্যি, খুব সুন্দর-কিন্তু…ধ্যাৎ! ও একটা ছোট্ট মেয়ে। আজকের সকালে ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়াটাই ওদের সবচে বড় মুসিবত হয়েছিল।
ডেভ ব্যবহৃত হয়েছে গিনিপিগ হিসেবে। কিন্তু তা শুধু ভাইয়ের জন্য। প্রথমে ফেস মাস্কটা ঠিক করে নিয়ে ফ্লিপারগুলো পরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে। ববি নিজেকে এয়ার হোসের সাথে ধরে রাখে। এটাকে মাউথ পিসের সাথে জুড়ে দিয়েছিল আগেই। একটা দম নিয়েই ডেভ মুখ বিকৃত করল, এর স্বাদ ভয়াবহ!
এটাকে ব্যবহার করতে শুরু কর। ভিতরে গেলে-ঐ লিজের৩৮ দিকে পৌঁছুলেই আমি প্রেসার ভাল্বটা এডজাস্ট করা শুরু করব যাতে বেশি বাতাস নষ্ট না করতে হয়। হোসটা টানলেই উঠে এসো।
পানির নিচে ডেভ ধীরে নড়তে শুরু করল, অথবা ওয়ান্ডারল্যান্ডে। শান্তিতে ভরা একরঙা এক জগৎ। আর সব প্রবাল প্রাচীরের চেয়ে ভিন্ন। সামুদ্রিক পরিবেশের রঙচঙা কোনো চিত্র নেই। এখানে জীবন নিজেকে প্রকাশিত করে না রঙধনুর সবগুলো রঙে। এখানে শুধু সবুজ আর নীল ছায়ার অভিজাত প্রদর্শনী আর চারদিকের মাছগুলো মাছেরই মতন, প্রজাপতি নয়।
ও ফ্লিপার নাড়িয়ে নাড়িয়ে আস্তে নেমে যাচ্ছে। পেছনে টেনে নিচ্ছে হোসটা আর থামছে শুধু প্রয়োজন পড়লে, হোস থেকে বাষ্প টেনে নিতে। স্বাধীনতার রোমাঞ্চ এত বেশি যে তার মুখের তেলতেলে স্বাদটাও গেছে ভুলে। ও যখন লিজের কাছে পৌঁছল তখনি বুঝতে পারে আসলে পুরনো পানিতে ঘেরা এক গাছের গোড়া এটা; সামুদ্রিক আগাছা এত বেশি ঘিরে ধরেছে যে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। ও বসে পড়ে নিজের চারদিক দেখতে লাগল। প্রথমবার দেখার, সবার আগে দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে।
ও ঝর্নাটার ঠিক ওপাশ দেখতে পাচ্ছে। সবুজ, অসম প্রান্ত, ভেসে যেতে থাকা জ্বালামুখের দূরপ্রান্ত ও দেখছে, কমসে কম একশো মিটার হবে দূরত্বে। চারদিকে বেশি মাছ নেই, তবু পানির উপর থেকে নিচে পড়তে থাকা একতাল রূপালী পয়সার মতো এক দঙ্গল ছোট মাছ সূর্যের আলোতে ঝলসে ঝলসে একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গেল।
আরেক পুরনো বন্ধুও বসে আছে, যেমন থাকে আরকী, ঝর্নাটার সাগরের দিকে যাত্রার মুখে। একটা ছোট অ্যালিগেটর (কিন্তু যথেষ্ট বড় পরে একবার আনন্দ নিয়ে ববি বলেছিল, ও অন্তত আমার চেয়ে বেশ বড়।) সমান্তরালে ঝুলে আছে, কোনো দৃশ্যমান কিছুর উপর ভর না করেই। শুধু নাকটা ভেসে আছে উপরিতলে। কোনোক্রমেই এটাকে চটানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করল না। আর এই লক্ষ্মী জীবটাও ওদের এক বিন্দু বিরক্ত করেনি।
হঠাৎ করেই এয়ার হোসে টান পড়ে। ডেভ যেতে একটুও আপত্তি করবে না। ও বুঝতে পারছে না এ সময়ের মধ্যে অ্যালিগেটরটা কতটুকু ঠাণ্ডা হয়েছে অতি গভীরতায় নেমে-এমনকি নিজেও অসুস্থ বোধ করছে এখন। কিন্তু উঠে এলে গরম সূর্যালোক ওকে দ্রুত নতুন জীবন দিল।
নো প্রব্লেম। দাম দেখিয়ে ববি বলে, ভাটার প্রু খুলতে থাক সাবধানে যেন প্রেসারের মাপটা লাল দাগের নিচে নেমে না যায়।
কতটুকু নিচে নামবে?
পুরোটাই, যদি এখনকার মতো অনুভব করি।
ডেভ সিরিয়াসলি নেয়নি। ওরা গভীরতার আনন্দ আর নাইট্রোজেনের ক্ষরণ দু ব্যাপারেই সজাগ। আর পুরোনো বাগানের পানির পাইপটা মাত্র ত্রিশ মিটার লম্বা। প্রথম অভিজ্ঞতার জন্য অবশ্য এই অনেক। আগে বহুবার করেছে বড় ভাই। তাই একটা হিংসা মেশানো শ্রদ্ধার সাথে ভাইয়ের এই নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়াটাকে দেখছে। সে। চারদিকের মাছের মতোই সচ্ছন্দে ববি নিচের রহস্যময় নীল জগতের দিকে গ্লাইডিং করে নেমে যায়। একবার ঘুরে কষ্টেসৃষ্টে এয়ারহোেসটায় এক টোকা দিয়ে পুরোপুরি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল যে, একটু বেশি বায়ু প্রবাহ ওর দরকার।
নতুন আসা মাথা ছিঁড়ে ফেলার মতো ব্যথাটা থাকলেও ডেভ ওর কাজের কথা মনে করল সবার আগে। দ্রুত পুরনো কম্প্রেসরটার কাছে গিয়ে এটার কন্ট্রোল ভাল্বকে করে দিল ম্যাক্সিমাম-প্রতি মিলিয়ন কার্বন মনোক্সাইডে পঞ্চাশ ভাগ।
ববিকে শেষ যেবার ও দেখে তখন সে দৃঢ়তার সাথে ডুবে যাচ্ছে, সূর্যালোক পিছলে যাওয়া শরীরটা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। মৃতদের পার্লারে নতুন একটা মোমের মূর্তি এল এরপর; রবার্ট বোম্যানের মূর্তি।
৩৩. চোখ মেলে চাও মেয়েগো
সে কেন এখানে এসেছে এক অশান্ত ভূতের মতো যা পুরনো অসন্তোষের জায়গায় বারবার ফিরে আসে? তার কোনো ধারণাই নেই। এমনকি নিজের উদ্দেশ্যের দিকেও কোনো লক্ষ্য নেই যে পর্যন্ত সেই স্বচ্ছ ঝর্নার গোল চোখদুটো নিচের সমুদ্র বন থেকে তার দিকে নিষ্পলকভাবে না তাকিয়ে থাকে।
ও মাস্টার অফ দি ওয়ার্ল্ড, আর একটা থমকে দেয়া অনুশোচনা ওকে দগ্ধ করছে। যা ঘুমিয়ে ছিল বহু বছর। সময় সে ক্ষতকে সারিয়ে তুলেছে আর সব ক্ষেত্রে যেমন করে। যেন গতকালই উজ্জ্বল সবুজ রঙের আয়নার দিকে তাকিয়ে শুধু চারদিকের সাইপ্রেসের গায়ে বোঝই স্প্যানিশ মস দেখে কেঁদেছে। ওর কী হচ্ছে এসব?
এমনকি এখনো, বিশাল ইচ্ছাশক্তি বাদ দিয়ে কিছু শান্ত বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ায় ও উত্তরে স্টেটের রাজধানীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো। কিছু একটা খুঁজে বেড়ায়। পাওয়ার আগে বুঝতেও পারে না কী খুঁজছে।
কেউ, এমনকি কোনো যন্ত্রও তার পথ বের করতে পারবে না। এখন তেমন ভয়াবহভাবে রেডিয়েশন ছড়াচ্ছে না। অবশ্য নিজের এনার্জির উপর নিয়ন্ত্রণ আছে। ঠিকই। যেমন এককালে তার নিয়ন্ত্রণ ছিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর। হারিয়ে গেলেও সেগুলো মুছে যায়নি মন থেকে। সেখানে একটা কুয়াশার মতো ভূমিকম্পরোধী এক বিশেষ ভল্টে মিশে গেল যে পর্যন্ত নিজেকে শত শত কোটি স্টোর করা স্মৃতির মাঝে না পায়; নিজেকে যে পর্যন্ত দেখতে না পায় ইলেক্ট্রনিক চিন্তা-চেতনার প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল অন্ধ, নিরাবেগ নেটওয়ার্কে প্রবেশ করা অবস্থায়।
এ কাজটা একটা নিউক্লিয়ার বোমার ট্রিগার ঠিক করার চেয়ে অনেক বেশি জটিল, আর তাই একটু বেশি সময় নিল। খুঁজতে থাকা তথ্যটা পাওয়ার আগে সামান্য পিছলে গেল ও, একটু বিকৃতি, কিন্তু ঠিক করার চেষ্টা করল না। কেউ কোনোদিনই বুঝতে পারবে না কেন পরের মাসেই ফ্লোরিডার ট্যাক্স পরিশোধকারীদের মধ্যে এফ অক্ষর দিয়ে নাম শুরু হওয়া তিনশেজন এক ডলারের চেক পাবে। এ ব্যাপারটাকে ঠিক করতে হয়ত অনেক সময় লাগবে, হয়ত ইঞ্জিনিয়াররা শেষে আর কোনো পথ না পেয়ে কম্পিউটারের এ কোনোকালে না দেখতে পাওয়া ত্রুটির দোষ চাপাবে কদিন আগে দেখা মহাজাগতিক রশ্মির উপর-এবং এ নিয়ে বাকিরা হাসবে; তবু ব্যাপারটা যে আসলেই সত্যি তা খোদ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের জানালেও তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না।
কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই তালাহাসি থেকে ছশো চৌত্রিশ সাউথ ম্যাগনোলিয়া স্ট্রিট, টাম্পায় পৌঁছে গেল। আজো এ ঠিকানাই! এটাকে দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে ওর কাছে হয়ত নেই। কিন্তু চোখ তুলে তাকানোর ঐ ছোট্ট মুহূর্তটার আগে সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।
তিনটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে এবং দুবার গর্ভপাত করেও বিটি ফার্নান্দেজ (আগের বিটি সুল) আগের মতোই সুন্দর এক মহিলা। ঠিক এখন সেও একজন চিন্তা করতে থাকা মানুষ। একটা টিভি প্রোগ্রাম দেখছে যা আগের দিনের মিষ্টি-ঝাল স্মৃতি ফিরিয়ে আনে হঠাৎ।
আগের বারো ঘণ্টার অদ্ভুত ঘটনার উপর তৈরি করা এক নিউজ স্পেশাল চলছে। একটা খবর জানিয়ে শুরু হয় এ অনুষ্ঠান-বৃহস্পতির উপগ্রহ থেকে খবর পাঠিয়েছে লিওনভ। পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছিল কিছু একটা। কিছু একটা নিরাপদে নিষ্ক্রিয় করেছে অর্কিটে ঘুরতে থাকা পারমাণবিক বোমাকে। আর এর কৃতিত্ব দাবী করতে এখনো কেউ এগিয়ে আসেনি। খবরটা খুবই ছোট। মাত্র এটুকু, কিন্তু এটুকুই সবার জন্য যথেষ্ট।
সংবাদ পাঠকরা তুলে ধরেছে পুরনো সব ভিডিও টেপের চিত্র। এগুলোর কোনো কোনোটা আসলেই টেপ-কয়েকটায় দেখা যায় এককালের সবচে গোপনীয় আবিষ্কার, চাঁদের বুকে টি এম এ-একের খনন ও অন্যান্য ব্যাপার। কমপক্ষে পনেরবার ও সেই চিৎকার শুনল; মনোলিধটা চাঁদের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বৃহস্পতির দিকে রেডিও মেসেজ পাঠানোর সময় যে আওয়াজ হয়। আরো একবার শুনল ডিসকভারি থেকে দেয়া সেই জনপ্রিয় ইন্টারভিউ।
কেন বিটি এগুলো দেখছে? এগুলোর সবই ওর বাসার আর্কাইভের কোনো না কোনো জায়গায় জমানোনা আছে। (যদিও হোসে আশেপাশে থাকার সময় কখনো এগুলো চালায়নি ও) সম্ভবত চেয়ে আছে কোনো ছোট্ট খবরের আশায়। বিটি কখনোই দেখাতে চায়না, এমনকি নিজেকেও দেখাতে চায়না অতীত ওর আবেগের উপর কতত বেশি সক্রিয়।
এখনি ডেভকে দেখা যাবে, যেমন আশা করেছিল। বিবিসির সেই পুরোনো সাক্ষাৎকার। সে এটার প্রত্যেক শব্দ মুখস্থ বলতে পারবে। ডেভ কথা বলছিল হালের বিষয়ে, সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করছিল এই কম্পিউটারটা আত্ম সচেতনতায় ভোগে, নাকি অন্য কিছু…
ওকে কী তরুণ লাগে! ম্লান হয়ে যাওয়া ধসে পড়া ডিসকভারির শেষ চিত্রগুলোর চেয়ে কত পার্থক্য এটায়! দেখতে অনেকটাই ওর স্মৃতির ববির মতো। চিত্রগুলোয় ঢেউ খেলে গেল বিটির চোখ পানিতে ভরে ওঠায়। না, এ সেটটার কোথাও গণ্ডগোেল আছে-অথবা চ্যানেলে। ছবি আসছে অনিয়মিত।
ডেভের ঠোঁটগুলো নড়লেও সে কোনো কথা শুনছে না। এরপর চেহারা মিশে গেল রঙের চৌকোণা বাক্সের মতো। একবার ফিরে এসে আবারও মিলিয়ে যাচ্ছে। এবার আরো স্থির, কিন্তু কোনো শব্দ নেই।
ছবিগুলো তারা কোত্থেকে পেল? আরে, ডেভকে পূর্ণ মানুষের মতো লাগছে না, বরং যেন সেই ছেলেবেলার প্রথম দেখা ডেভ! ও স্ক্রিনের বাইরে বেরিয়ে এসে যেন বহু বছরের সাগর পাড় থেকে ওকে খুঁজে ফিরছে।
ডেভ বোম্যান হাসল, ওর ঠোঁট নড়ছে…
হ্যালো, বিটি! বলছে ও।
শব্দগুলোকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়ে অডিও সার্কিটে বইতে থাকা বিদ্যুৎ তরঙ্গ পাল্টে দেয়াটা কোনো কাজই না ওর জন্য। মূল সমস্যা হল, মানুষের ব্রেনের মতো ধীর লয়ে নিজের দ্ভিাকে প্রবাহিত করা। আরো সমস্যা হচ্ছে, একটা অসীম সময় ধরে উত্তরের আশায় বসে থাকা…
বিটি ফার্নান্দেজ একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তবু, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। এক যুগ ধরে গৃহিণী হলেও নিজের ইলেক্ট্রিক সার্ভিসম্যানের পুরনো পদবীটা ভুলতে পারেনি। মিডিয়ামের গ্রাফিক্সের অসাধারণ এবং অচিন্তনীয় সাফল্যের একটা নিশ্চই এ ঘটনা। এ ব্যাখ্যা সে গ্রহণ করলেও পরের ব্যাপারের সাথে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারবে না। ডেভ, ও জবাব দিল, ডেভ আসলেই তুমি?
আমি শিওর না। জবাব দিল টিভি স্ক্রিনের ইমেজ, একটা মৃত কণ্ঠে, কিন্তু আমি ডেভ বোম্যান আর তার সব কথা মনে করতে পারি।
ও কি মারা গেছে?
আরো একটা কঠিনতম প্রশ্ন, তার দেহ-হ্যাঁ। কিন্তু শারীরিক ব্যাপারটার কোনো মূল্যই আর নেই। ডেভ বোম্যানের যা ছিল তার সবই এখন আমার অংশ।
বিটি নিজের দেহে ক্রুশ কাটল, কাজটা হোসের কাছ থেকে শিখেছে। ফিসফিসিয়ে বলল, তুমি বলতে চাও যে, তুমি একটা স্পিরিট…আত্মা?
আমি তোমার মতো কোনো শব্দ জানি না যা দিয়ে এরচে ভালভাবে বোঝাতে পারব।
কেন তুমি ফিরে এলে?
আহ! বিটি-কেন! আসলেই কেন…যদি আমাকে বলতে পারতে…এখন তার একটা জবাব জানা আছে টিভি স্ক্রিনে তুলে ধরা যায়। শরীর আর মনের ছাড়াছাড়ি পূর্ণ হতে তোমাদের যুগ থেকে আরো অনেক অনেক সামনে এগুতে হবে। এবার দেখানো নির্লজ্জ সেক্সয়াল ইমেজ আর বহন করার ক্ষমতা নেই যেন এ টিভির ক্যাবল নেটওয়ার্কের।
এক মুহূর্তের জন্য বিটি দেখল, কখনো হেসে হেসে, কখনো আঘাত পেয়ে। এরপর ও অন্যদিকে ঘুরে গেল-লজ্জায় না, বরং কষ্টে। হারিয়ে যাওয়া আনন্দের জন্য কষ্ট।
তো, এটা সত্যি হতে পারে না- ও বলছে, এ কথাই সবাই আমাদেরকে বলেছে, অ্যাঞ্জেল সম্পর্কে। কোনো যৌন প্রভেদ নেই। পুরুষত্ব নেই, নেই নারীত্ব।
আমি একজন অ্যাঞ্জেল? ও অবাক হল। তবু অন্তত এটুকু বুঝতে পারছে এখানে ওর কাজ কী। দুঃখের জোয়ারে ভেসে গিয়ে অতীতের সাথে কোনো না কোনোভাবে একটা সেতু জুড়ে দিতে চাইছে নক্ষত্র শিশু। ওর সবচে শক্তিমান আবেগ ধরা দিয়েছে বিটির জন্যই; এ আবেগটুকু তার অপরাধবোধ আর হতাশাকে বাড়িয়ে তুলছে আরো।
ও ববির চেয়ে ভাল প্রেমিক কিনা তা একবারের জন্যও মেয়েটা বলেনি। এ একটা প্রশ্ন করেনি কখনো। হয়ত এজন্য সম্পর্কটাই ভেঙে যেত। এ মিথ্যা বিশ্বাস নিয়েই ওরা একে অন্যের হাত জাপ্টে ধরে একই ধরনের অসুস্থতার ওষুধ খুঁজত। (আর ও কী তরুণই না ছিল, যখন শুরু হয় তখন মাত্র সতেরো বছর বয়স। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের মাত্র দু বছর পরই!)
স্বভাবতই এ সম্পর্কটা বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা তাকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মুখে এনে দাঁড় করায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার সব কিশোরসুলভ অতি কল্পনার কেন্দ্র ছিল বিটি। আর কোনোদিনই ওর সাথে তুলনা করার মতো কোনো মেয়ে খুঁজে পায়নি সে; বহুদিন আগেই বুঝতে পেরেছে যে কোনোদিন পাবেও না। যত অবহেলাই করা হোক না কেন, কৈশোরের প্রেম সারা জীবনের জন্যই মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকে। বারেবারে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। আর কেউ হয়ত এমন ভালবাসার ভূতের তাড়া খেয়ে ফেরে না।
কামনার ইমেজগুলো স্ক্রিন থেকে মিলিয়ে গেলে এক সেকেন্ডের জন্য মূল অনুষ্ঠান ফিরে আসার সুযোগ পেল। লিওনভ আর আইওর একটা চিত্র টিভিতে। তারপর আবার ডেভ বোম্যানের চেহারা। ওকে দেখে মনে হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসছে। কখনো দশ বছরের ছবি-কখনো বিশ, তারপর ত্রিশ-তারপর অবিশ্বাস্যভাবে এককালে চেনা চেহারার কোনো এক বিকৃত রূপ, হয়ত মমিই, হয়ত শুকনো এক বৃদ্ধ শরীর…
যাওয়ার আগে আর একটা প্রশ্ন। কার্লোসের ব্যাপারে। তুমি সবসময় বলেছ ও হোসের সন্তান, আর আমি প্রতিবারই আশ্চর্য হয়েছি। সত্যিটা বল।
বিটি ফার্নান্দেজ শেষ বারের মতো একটা দীর্ঘ দৃষ্টি ফেলল এক সময় ভালবাসা চেহারার দিকে (ও আবার আঠারোয় ফিরে এসেছে হঠাৎ। আর এক মুহূর্তের জন্য হলেও বিটি চাইছে যেন ওর চিরচেনা শরীরটা দেখা যায়, শুধু চেহারা নয়।)
ও তোমার সন্তান, ডেভ। সে ফিসফিস করে ওঠে।
হারিয়ে গেছে ইমেজটা। আবার ফিরে এসেছে সেই স্বাভাবিক সম্প্রচার। প্রায় একঘণ্টা পরে হোসে ফার্নান্দেজ ফিরে আসার পরও বিটি স্থির বসে রইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। গলার পেছনে চুমুর স্পর্শ পেয়েও ও পেছন ফিরল না, তুমি কোনোদিন বিশ্বাস করবে না, হোসে…।
আমাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা কর; তোমাকেই বিশ্বাস করি আমি।
এইমাত্র একটা ভূতের সাথে খোশগল্প করলাম।
৩৪. বিদায়বেলার কথা
আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ অ্যারোনটিক্স এন্ড এস্ট্রোনটিক্স ইউ এফ ও র অর্ধশতাব্দী প্রকাশ করে উনিশো সাতানব্বইতে। এ ছিল তাদের এক মহা বিতর্কের বিষয়। তখন অনেক সমালোচকই ঐ আন আইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট বা অচিহ্নিত উড়ন্ত বস্তু নিয়ে মাতামাতি করেছেন। এগুলো পৃথিবীর আকাশে দেখা যাচ্ছে শত শত বছর ধরে। কেনেথ আর্নল্ডের ১৩৯ ফ্লাইং সসার উনিশো সাতচল্লিশে লেখার পরে আগের অসীম রহস্যের একটা চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এ অদ্ভুতুড়ে চাকতি। ইতিহাসের উষালগ্ন থেকেই মানুষ রহস্যময় জিনিস দেখে আসছে আকাশে আকাশে। কিন্তু মধ্য বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউ এফ ও একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল যার কোনো বিশাল গণসচেতনতা নেই। ঐদিনের পর থেকেই এগুলো নাগরিক আর বৈজ্ঞানিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়; এমনকি ধর্মীয় ভিতগুলির জন্যেও।
কারণ খুঁজতে বেশিদূর যেতে হবে না। দৈত্যাকৃতির রকেটগুলোর ওড়াওড়ি আর মহাকাশ যুগের প্রথম ভোরের সাথে সাথেই মানুষ অন্য জগতের খোঁজে হন্যে হয়ে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই মানবজাতি তার চিরচেনা সূতিকাগার থেকে বেরিয়ে পড়বে-তখনি প্রশ্ন জাগে, কোথায় আর সবাই, আর কখন আমরা ভিজিটরদের আশা করতে পারি? আরো একটা আশা ছিল-যদিও তা খুব কমই বাঙময় হয়ে উঠেছে মানুষের মুখে মুখে-তারার রাজ্যের ভালবাসার সৃষ্টিগুলো হয়ত মানবজাতিকে তার নিজের বানানো সমস্যাগুলো ঠিক করে নিতে সাহায্য করবে। হয়ত ভবিষ্যতে আসতে থাকা দুর্যোগও করবে প্রতিরোধ।
ফিজিওলজির যে কোনো ছাত্র ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে যে এমন অসীম জ্ঞান খুঁজে পেলে একটা দিক দ্রুত সম্ভষ্ট হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আসলেই সব মাধ্যমে একটা খবর খুব বেশি করে প্রচার করা হয়। ভূ ভাগের প্রত্যেক প্রান্তে হাজারো মহাকাশযান দেখা গেছে। এরচেও বড় ব্যাপার, শত শত রিপোর্টে বলা হয়েছে, খুব কাছ থেকে মুখোমুখি হয়েছে মানুষজন এসব অসাধারণ ভিজিটরদের। এমনকি বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অতিরঞ্জিত কাহিনীও শোনা যায়। কিছু স্বর্গীয় একত্রীকরণ, কথাবার্তা এমনকি হানিমুনের খবরও পাওয়া যায়, তাও আবার মহাশূন্যে। তবে শেষ ফলাফল একই-সবাই একে মিথ্যা-বড়জোর হ্যালুসিনেশন বলে পাশ কাটিয়ে গেছে আর একই সাথে সত্য বলাকে করেছে দারুণভাবে নিরুৎসাহিত। যেসব মানুষ চাঁদের অন্য পাশে নগরী দেখার দাবী করেছে তাদের মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে অ্যাপোলো মিশন। এটা পুরো চাঁদ চষেও কোনো আর্টিফ্যাক্টের লক্ষণ পায়নি। এরপর আঘাত আসে শুক্র গ্রহের কল্পিত সুপুরুষদের বিবাহিত স্ত্রীদের প্রতি। ওদের জন্য যা একটু দরদ লোকের ছিল তাও উবে গেল যখন সবাই জানল যে শুক্রে সীসা রাখলে তা তাপে গলে যাবে। তাদের স্বামী সুপুরুষতো সুপুরুষই…
এর মধ্যেই এ আই এ এ তাদের প্রকাশনায় বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের রিপোর্ট পেশ করে যারা ঐসব মিথ্যা ধারণার প্রচারে এগিয়ে ছিল। এ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতো ইউ এফ ওর সাথে অতীন্দ্রিয় কোনো না কোনো সভ্যতার, জীবনের অথবা অন্তত বুদ্ধিমত্তার যোগসূত্র আছে। এ দাবী প্রমাণ করা আদৌ সম্ভব হয়নি। গত এক হাজার বছরের অসংখ্য দাবীর কোনোটাই প্রমাণ করা যায়নি। অন্তত সেসব কথার যে কোনো একটা সত্যি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাডার আর টেলিস্কোপগুলো এসব স্বর্গীয় জিনিস খুঁজে বেড়ালেও কোনো শক্ত প্রমাণ পায়নি। আর সাধারণ জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ হারিয়ে বসে। ধর্মগুরুরা মোটেও দমে না। বরং বিশ্বাসটা বইয়ে দিয়েছে খবরের চিঠি আর বইগুলোর মাধ্যমে। অনেক সময় তাদের অনেকে বাহবা পেয়েছে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার বহু পরেও।
টাইকো মনোলিথ আবিষ্কারের ঘোষণার পরপরই একটা সম্মিলিত চিৎকার শোনা গেল যা প্রায় সবাই বলছে সবাইকে, কেউ কারোটা না শুনেই, আমি বলেছিলাম না?
চাঁদের বুকে ভিজিটরদের নামার কথা আর অস্বীকার করা যাবে না। একইভাবে পৃথিবীতেও। মাত্র ত্রিশ লাখ বছর আগে। সাথে সাথেই আবারো ইউ এফ ও গুলো স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব শুরু করল। যদিও সেদিন পর্যন্ত তিনটা মহাশক্তিধর দেশের ট্রাকিং সিস্টেম (যাদের প্রত্যেকে অন্তত একটা বল পয়েন্ট কলমের আকারের জিনিসও মহাকাশে দেখে ফেলতে পারে।) কোনো নাম-নিশানাই খুঁজে পায়নি। আরো দ্রুত রিপোর্টের সংখ্যা শ্রবণশক্তির নিচে নেমে যায়। উত্তেজনা যায় থিতিয়ে। আবারো সেই চির আকাক্ষিত আকৃতি অনেক এস্ট্রোনোমিক্যাল, ম্যাটারোলোজিক্যাল এবং অ্যারোনটিক্যাল চিহ্ন বারবার আকাশগুলো ছেয়ে ফেলল।
কিন্তু এবার, তৃতীয় দফায় এবং সবচে জোরালোভাবে উঠে এল ইউ এফ ওর দাবী। কোনো ভুল ভ্রান্তির সুযোগ না দিয়েই। একেবারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি। এক সত্যিকার ইউ এফ ও এসেছে পৃথিবীর পথে।
লিওনভের রিপোর্টের কয়েক মিনিট পরেই পৃথিবীতে দেখার রিপোের্ট পাওয়া যায়। প্রথম মুখোমুখি হয় কয়েক ঘণ্টা পর। এক অবসরপ্রাপ্ত স্টক এজেন্ট তার বুলডগটা সাথে নিয়ে ইয়র্কশায়ার মুরে হাঁটার সময় দারুণভাবে চমকে গেল যখন একটা চাকতি আকারের ইউ এফ ও তার পাশে নামে এবং প্রাণীটা-প্রায় মানুষেরই মতো, শুধু তীক্ষ্ণ কান ছাড়া-ডাউনিং স্ট্রিটের ঠিকানা জানতে চাইল। যোগাযোগের পর সে এত বেশি অবাক হয় তার ছড়িটা শুধু হোয়াইট হলের দিকে নাড়ানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না; প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয় বুলডগটা ফিরিয়ে দিচ্ছে তার দেয়া খাদ্য।
স্টক এক্সচেঞ্জের এ দালালের কোনো মানসিক সমস্যার রেকর্ড নেই। কিন্তু যারা পরের রিপোর্ট পাওয়ার পরও দালালের কথা বিশ্বাস করে তাদের ব্যাপারে ঢালাও মত দেয়া হয় যে তারা সবাই মানসিক রোগী। এবার বাস্ক শেফার্ড নেমে পড়েছে সেই পুরনো মিশনে। হাতাকাটা লম্বা জামা পড়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টির দুজন মানুষ সীমান্ত এলাকায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিল জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টারের ঠিকানা।
ওরা পুরোপুরি বাস্ক লোকটার মতোই কথা বলে। ভাষাটা বেদনাদায়ক, জটিল, এমনকি মানবজাতির আর কোনো ভাষার সাথে এর মিল নেই। বোঝাই যায় এ স্পেস ভিজিটররা ভয়াবহ ভাষাবিদ, যদিও তাদের পরিবেশ এ বিশ্বের থেকে হাজার তফাৎ ওয়ালা।
এভাবেই চলতে লাগল, একের পর এক। তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই জেনে শুনে মিথ্যা বলেছে-কেউ কেউ অসচেতনও ছিল না। বেশিরভাগই নিজের কাহিনীকে বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করে। এমনকি এ বিশ্বাসটা সম্মোহনের মাধ্যমে প্রচারেরও চেষ্টা করে অনেকে। কেউ আবার নিজেই সম্মোহিত হয় ঐ সময়। আর তাদের এক বিরাট অংশ ঠাট্টা-মশকরার শিকার। অনেকে কোনো হঠাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে যায় সেসব অপেশাদার আর্কিওলজিস্টের মতো যারা চার দশক আগে একজন সায়েন্স ফিকশন চিত্র পরিচালকের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র আর সেট (দোষ দিয়ে লাভ কী, দেখতে একেবারে অপার্থিব এগুলো, তার উপর পুরনো!) পেয়ে তিউনিশিয়ার মরুভূমিতে চিৎকার করে ফাটিয়ে ফেলেছে গলা।
এত সবে শুরু, শেষমেষ প্রত্যেকেই নিজের উপস্থিতি আর চারপাশের উপর এত বেশি সচেতন হয়ে ওঠা শুরু করে যে এমন কিছু না কিছু দেখছেই, কোনো না কোনো এক সময়ে, কারণ তাদের অবচেতন মন এসবই খুঁজে ফেরে।
.
খুব দ্রুত এ বিশ্বটাকে এফোড় ওফোড় করে তার পরীক্ষা করা এখনো বাকি। কোনো দেয়াল ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবে না, ওর সচেতনতার বাইরে কোনো পথ লুকিয়ে থাকতে পারে না। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করে আগের জনের না দেখা জায়গাগুলোই শুধু দেখে চলেছে। পরে বুঝতে খুব বেশি দেরি হয়নি যে, সামরিক অভিযানের মতো গ্রহটার চারপাশে ছুঁড়ে বেড়ানোর পেছনে আছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য।
কোন না কোনো অবাক করা উপায়ে সে ব্যবহৃত হচ্ছে একটা প্রোবের মতো, একটা সর্বদ্রষ্টা রাডারের মতো-যা একবার করে দেখে নিচ্ছে মানব জাতির প্রত্যেক পল-অনুপল, অণু-পরমাণু, অলিগলিকে। নিয়ন্ত্রণ এত বেশি হালকা যে সে খুব কম সময়ই এ নিয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ পায়। ও একটা শিকারী কুকুরের মতো যেটাকে গলায় শিকল পরিয়ে দিয়ে নিজের মতো চলতে ফিরতে দেয়া হচ্ছে; যদি নিজের প্রভুর ইচ্ছাকেই নিজের ইচ্ছা হিসেবে ধরে নিয়ে থাকে।
পিরামিড, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, এভারেস্ট চূড়ার চাঁদ থোয়া তুষার-এগুলো তার নিজের পছন্দ। একই ভাবে কিছু আর্ট গ্যালারি আর কয়েকটা কনসার্ট হল রুম। যদিও তার নিজের পদক্ষেপ নিজেই নিতে পারে তবু একবারের জন্যও সম্পূর্ণ পৃথিবীবৃত্তটার মাঝ দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি।
হয়ত নিজে থেকে ও দেখত না এত এত ফ্যাক্টরি, জেলখানা, হাসপাতাল, এশিয়ার একটা নোংরা ছোট যুদ্ধ, রেসকোর্স মাঠ, বেভারলি হিলের একটা যৌনতার বিশাল-জটিল পার্টি, হোয়াইট হাউসের বিখ্যাত ওভাল রুম-৪৩, ক্রেমলিনের১৪৪ আর্কাইভ, পোপের দেশ ভ্যাটিকানের সুবিশাল আর পুরনো লাইব্রেরি, মক্কার কাবার সেই গোপন, রহস্যময় কালো পাথর…
এমনো কিছু কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা নিজেই বুঝে উঠতে পারেনি ঠিকমতো। যেমন তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছে-অথবা ওকেই রক্ষা করেছে কোনো অভিভাবক অ্যাঞ্জেল দল। উদাহরণ হিসেবে বুঝতে পারে
ওলদুভি জর্জের লিকি স্মৃতি জাদুঘরে কী করছিল সে? মানব জাতির উদ্ভব সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই যেমনটা হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির আর কোনো বুদ্ধিমান সদস্যের থাকতে পারে। আর ওর কাছে ফসিলের কোনো অর্থতো নেইই, দামও নেই। ডিসপ্লে কেসে রত্নখচিত মুকুটের মতো সাজিয়ে রাখা দামি পুরনো খুলিগুলো তার স্মৃতিতে অদ্ভুতুড়ে শব্দের জন্ম দিয়েছে শুধু। জন্ম দিয়েছে এমন এক বিমোহিত অবস্থার যার কারণে নড়তেও পারেনি। এক অসাধারণ দ্যিজে ভু দেখা দিয়েছে ওর মনে। এত শক্তিময় দ্যিজে ভু এর আগে কখনো হয়নি; জায়গাটা যেন খুব আপন, কিন্তু কোথায় যেন একটু খটকা…অনেকটা মনে হচ্ছে যেন বহু বছর পরে বাড়ি ফিরে এসেছে কেউ, দেখতে পাচ্ছে সব আসবাবের পরিবর্তন, দেয়ালগুলো নেই আগের জায়গায়, এমনকি সিঁড়ির পথও নতুন করে তৈরি।
এ জায়গাটা গরম, শুকনো বিরূপ একটা ভূখণ্ড যেন। ঐ জমকালো বিশাল সমতল এলাকা আর অসীম তৃণভোজী প্রাণী কোথায় যেগুলো এখানে চড়ে বেড়াত বহুদিন আগে…ত্রিশ লাখ বছর আগে?
এখন আর মানুষ নয় সে, হলে হয়ত কেঁপে উঠত শিহরণে…ত্রিশ লাখ বছর! সে কীভাবে জানল ত্রিশ লাখ বছর আগের কথা? কেন সেই টাইকো মনোলিথেরই ত্রিশ লাখ বছর?
যেদিকে ও প্রশ্নটা ছুঁড়ে মেরেছে সেই প্রতিধ্বনিত হতে থাকা নিরবতা থেকে কোনো জবাবই আসে না। আর আবারো তার চোখের সামনে নিভু নিভু হয়ে ভেসে উঠতে দেখল সেই পরিচিত, কালো একটা রূপ, আয়তাকার পাথুরে দেহ। আরো চেষ্টা করায় এর ভিতর থেকে এক ছায়াময় ছবি দেখতে পাচ্ছে, যেমন দেখা যাবে কালো কালির পুকুরে।
এলোমেলো চুলে ভরা ব্যগ্র কপালের নিচে কালো, বিভ্রান্ত একজোড়া চোখ তার পেছনটা দেখার চেষ্টা করছে, আরো একটা অদেখা ভবিষ্যত দেখতে চাইছে যা কখনোই দেখতে পায়নি। তবু, ও-ই সেই ভবিষ্যৎ, যা সময়ের বাষ্পে জ্বলে পুড়ে লক্ষ প্রজন্ম পেরিয়ে পেরিয়ে উপনীত হয় বর্তমান-এ।
ঠিক সেখানেই ইতিহাসের শুরু; অন্তত ও এখন এটুকুই বুঝতে পারে। কিন্তু কীভাবে-আর সবচে বড় কথা, কেন-আজো তার কাছে এ রহস্যের ঢাকনা ঢাকা রয়ে গেল?
শেষ আর সবচে কঠিন কাজটা বাকি। ও এখনো যথেষ্ট মানুষ রয়ে গেছে, এটুকু না সরিয়ে দিতে পারলে এ রহস্যের শেষটা হয়ত অদেখাই থেকে যাবে।
.
এ মহিলা আবার কী করে? ডিউটি নার্স নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল টিভি মনিটরটা বৃদ্ধার দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে। ও অনেক চালাকি করেছে, তবু প্রথমবারের মতো আমি তাকে নিজের হিয়ারিং এইডের সাথে কথা বলতে দেখলাম। হায় খোদা…সে কী বলছে কে জানে?
মাইক্রোফোনে ফিসফিসানি তুলে আনার মতো সূক্ষ্ম না, তবু পাইয়ে দিচ্ছে ভাল ভয়। খুব কম সময়ই জেসি বোম্যানকে এত শান্ত দেখায়। চোখদুটো বন্ধ থাকলেও ফিসফিসানির সময় চেহারা স্বর্গীয় প্রশান্তিতে ভরে উঠছে।
এরপরই দেখতে থাকা মেয়েটা এমন কিছু দেখল যা ভোলার জন্য অনেক চেষ্টা করবে পরে। কারণ এ রিপোর্ট করলে সাথে সাথে তার নার্সিং পেশার যোগ্যতা কেড়ে নেয়া হবে। একটু দুলে ধীরে ধীরে চিরুণীটা ভেসে উঠল বিছানা থেকে। যেন কোনো অদৃশ্য আঙুল তুলে এনেছে। প্রথমবার সফল হয়নি, দ্বিতীয়বার বহু কষ্টেসৃষ্টে এটা লম্বা জট পাকানো চুলে বুলিয়ে গেল, আর জটগুলোয় থামল একটু।
এখন জেসি বোম্যান কথা বলছে না, শুধু মুচকি হাসি। আরো দক্ষতার সাথে চিরুণীটা বয়ে যাচ্ছে। এখন আর হঠাৎ হঠাৎ লাফাচ্ছে না।
নার্স কখনোই বলতে পারবে না কতক্ষণ এসব চলল, চিরুণীটা টেবিলে ফিরে গেলেও মেয়েটা অসাড়তার হাত থেকে মুক্তি পায়নি।
দশ বছরের ডেভ বোম্যান সেই চিরাচরিত কাজটা শেষ করেছে যা সব সময় নিজে পছন্দ না করলেও করতে হয় কারণ মা পছন্দ করে। অন্যদিকে একজন ডেভিড বোম্যান যে এখন বয়স হিসাবের বাইরে, সে প্রথমবারের মতো কজা করেছে জড় জিনিস। আর থাকতে না পেরে নার্স যখন এল তখনো জেসি বোম্যান হাসছে। নার্স হয়ত যত তাড়াতাড়ি পারা যায় আসার চেষ্টা করেছে, তবু এর কোনো মূল্য নেই।
৩৫. পুনরাবির্ভাব
মহাশূন্যের কোটি কিলোমিটারে ছড়িয়ে থাকা পৃথিবীর চিৎকার একেবারে বন্ধ। লিওনভের কুরা হঠাৎ এ বিচ্ছিন্নতা দেখল অবাক চোখে। জাতিসংঘের বিতর্ক, বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার, সংবাদ পাঠকদের পড়া-সবই হঠাৎ থেমে গেল ইউ এফ ওর আগমনে। হঠাৎ অসুস্থতার কোনো কারণ ওরা খুঁজে পেল না কারণ পরে আর কোনো অস্বাভাবিকত্ব ধরা পড়েনি। জাগাদকা ওরফে বিগ ব্রাদার আর সব সময়ের মতোই তাদের উপস্থিতির প্রতি উদাসীন। অবশ্যই পরিস্থিতি বিপরীত, ক্রুরা সেই দূরের গ্রহ থেকে এসেছে একটা রহস্যের জট খুলতে-আর বিগ ব্রাদার বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে জবাব এখানে নেই। যে জায়গা ছেড়ে এসেছে, সেখানেই জবাব।
এই প্রথম ওরা আলোর ধীর গতির প্রতি কৃতজ্ঞ মনোভাব প্রকাশ করল কারণ এর ফলেই বৃহস্পতি আর পৃথিবীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগে দু ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। তাই সাক্ষাৎকার দেয়াটা সম্ভব হয় না। তবু ফ্লয়েডকে মিডিয়া এত বেশি প্রশ্ন করেছে যে, ও বাধ্য হয়ে সবাইকে এড়িয়ে যাচ্ছে নিশাচর, গর্তবাসী শিয়ালের মতো। এরচে বেশি কিছু বলার না থাকলেও এক কথা বলতে হয়েছে কমপক্ষে বারেবার।
এছাড়াও বহু কাজ বাকি, লিওনভকে পৃথিবীর দিকে ফিরে যেতে হবে, তাই লঞ্চ উইন্ডো খুলে যাওয়ার আগে এ কাজটা সারতে হবে তড়িঘড়ি করে। অবশ্য তড়িঘড়িটা খুব বেশি না করলেও চলে, যদি একমাস দেরি করে রওনা দিতে, তাহলে একমাস পরে গিয়ে পৌঁছবে, ব্যস। চন্দ্র, কার্নো আর ফ্লয়েডের তেমন তাড়া নেই কারণ ওরা সারা পথ কাটিয়েছে ঘুমে। অন্যেরা এই লম্বা সফর থেকে বাঁচতে চায় যত তাড়াতাড়ি যন্ত্রগুলো মুক্তি দিতে পারে। কারণ সামনের ফিরে যাওয়ার সময়টাও জেগে জেগে কাটাতে হবে।
এখনো ডিসকভারির অনেক সমস্যা। শুধু পৃথিবীতে ফিরে যাবার মতো জ্বালানি ভর্তি ট্যাঙ্কে, কিন্তু সেই ফেরাটা হতে হবে লিওনভের অনেক পরে এবং ধীরে যেতে হবে। যেতে যেতে তিন বছর। তাও সম্ভব শুধু যদি চন্দ্র হালকে ঠিকমতো প্রোগ্রাম করতে পারে। কম্পিউটারটাকে সারা পথ একা একা পাড়ি দেয়ার মতো করে প্রস্তুত করার কাজ বাকি। এর সাহায্য না পেলে আবারও ডিসকভারি একটা পরিত্যক্ত স্পেসশিপ হিসেবে পরিচিতি পাবে।
হালকে নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে দেখাটা আসলেই ভয়াবহ-কাজটা চলছে গভীরভাবে-এক মানসিক আঘাত পাওয়া শিশু থেকে অভিজ্ঞ মানুষে পরিণত হওয়ার পথে এগুচ্ছে কম্পিউটার। যদিও ফ্লয়েড জানে যে এভাবে মানবত্ব আরোপ এক বড় ভুল, তবু এটাকে পাশ কাটানোর কোনো পথ পায় না খুঁজে।
প্রায়ই ও খেয়াল করে এ অবস্থা একটা শিকারের রূপ নিচ্ছে। কিছু ভিডিও নাটক দেখেছে যেগুলোতে ব্যর্থ নতুন নায়কেরা সিমন্ড ফ্রয়েডের কারণে পুরোপুরি ডুবে গিয়েও সোজা হয়। জিতে যায় নাটকীয়ভাবে। একই কাহিনী আবার ঘটেছে বৃহস্পতির ছায়ায়।
হালের ইলেক্ট্রনিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ চলছে খুব দ্রুত। এত দ্রুত পুনর্গঠন চলছে যে কোনো মানুষের মন দ্রুতিটার এক বিন্দুও ধরতে পারবে না। প্রতি মুহূর্তে শত শত কোটি বিট কাজ করে, এক বিন্দু সমস্যা ছাড় পায় না এটার হাত থেকে। এ প্রোগ্রামের বেশিরভাগই টেস্ট করা হয়েছে হালের উন্নত জমজ সাল ন হাজারের মাধ্যমে। এ দু কম্পিউটারের মধ্যে বাস্তব কথাবার্তা যোগাড়যন্ত্র না করতে পারাটা হালের উন্নয়নে এক বড় ঘাটতি। এ কাজের কঠিন মুহূর্তগুলোয় যখন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের দরকার পড়ে তখন অনেক ঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়।
চন্দ্রের আর সব কাজ থাকায় কম্পিউটারের পুনর্গঠনে সময় লাগবে আরো অনেক। হাল সংখ্যাভিত্তিক আচরণ করে এখন, নাভাস ভঙ্গীতে মুখ ভেংচায়। কিবোর্ডের সব কমান্ড ধরতে পারলেও মাঝে মাঝে মুখে বলা শব্দ অবহেলা করে অথবা বোঝে না। উল্টো পথে আদেশ করলে তার আউটপুটগুলো হয় আরো অস্বাভাবিক।
এক সময় হয়ত সব উত্তর ঠিকমতো দিতে পারল, দেখা যাবে মনিটরে দেখাতে পারেনি। আরেক সময় দুটোই করছে, শুধু হার্ড কপি প্রিন্ট করছে না। এসব ক্ষেত্রে সে কোনো কারণ না দেখিয়েই এমন করে, এমনকি অনড়, অপ্রতিরোধ্য জবাব দেয়, আমার পছন্দ হয় না…
যাই হোক, যতটা মনে হয় হাল কখনো সরাসরি অবাধ্যতা দেখায় না। শুধু যেসব কাজ করতে পারবে না মনে করে সেগুলোই নাকচ করে দেয়। অবশ্য ওর সহায়তা পাওয়া আস্তে আস্তে সহজ হচ্ছে, তাকে না রাগিয়ে যা বলার বল… যেমনটা বলে কার্নো, আসলেই কিছু সময় অবস্থা এমন দাঁড়ায়।
ডক্টর চন্দ্র হতাশা প্রকাশ করতে শুরু করেছে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। একবার এক অনুষ্ঠানে সহজ সরল মনে ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি পুরনো গালগল্প তুলেছিল, সাথে সাথেই চন্দ্র বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে খারাপ ব্যবহার করে।
এটা কি সত্যি, ডক্টর চন্দ্র, তুমি হালের নাম রেখেছ যাতে এটা আই বি এমের চেয়ে একধাপ এগিয়ে থাকে?
বোকার মতো কথা বলে! আমাদের অর্ধেকই আই বি এম থেকে এসেছে আর আমরা বহু বছর ধরে এই গল্প বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আমার ধারণা ছিল যে প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষই এইচ-এ-এল বলতে যে হিউরিস্টিক এলগরিদমিক বোঝায় তা জানে।
পরপরই ব্রেইলোভস্কি কিরে কাটল, ও জীবনে খুব কমই এইচ এ এল শুনেছে। বরং হাল শুনেই অভ্যস্ত।
ফ্লয়েডের ব্যক্তিগত ধারণা ডিসকভারির পৃথিবীতে ফেরার সম্ভাবনা আটানব্বই পার্সেন্ট। আর সাথে সাথেই চন্দ্র একটা দারুণ প্রস্তাব করল, ডক্টর ফ্লয়েড, তোমাকে একটা কথা বলব?
এত সপ্তাহ পর, ভাগাভাগির এত অভিজ্ঞতার পরও চন্দ্র আগের মতোই পোশাকী রয়ে গেছে। শুধু ফ্লয়েডের সাথে না-আর সব ক্রুর সাথেও। এমনকি শিপের ছোট্ট মেয়ে জেনিয়াকেও স্বাভাবিকভাবে ডাকতে পারে না, ম্যাম ছাড়া।
অবশ্যই, চন্দ্র, বল।
্য ভেরিয়েশনের উপর প্রোগ্রামিং প্রায় শেষ করেছি যেগুলো হোম্যান ফিরতি অরবিটের উপর কাজ করবে। পাঁচটাকে আমি এক কৃত্রিম ভার্চুয়াল পরীক্ষায় নিয়ে সফল হয়েছি এক বিন্দু সমস্যা ছাড়া।
দারুণ! আমি শিওর, পৃথিবীর আর কেউ…সৌরজগতের আর কেউ এটা করতে পারবে না।
ধন্যবাদ। তুমি জান, আমি করলেও প্রত্যেক ধাপে নিখুঁত থাকা অসম্ভব। হাল হয়তো…অবশ্যই-ঠিকমতো কাজ করবে, এমনকি যে কোনো প্রয়োজনীয় সময়ে জাহাজের হাল ধরতে পারবে। কিন্তু সব ধরনের ছোট দুর্ঘটনা-যেমন একটা মাত্র হালকা স্কু দিয়ে জুড়ে দেয়া ছোট এক যন্ত্রের সমস্যা যা ক্রু ড্রাইভার দিয়েই ঠিক করা যাবে, অথবা একটা ভাঙা তার, নষ্ট সুইচ…ওর পুরো মিশনটাকে পন্ড করে দিতে পারে।
ঠিকইতো! একেবারে ঠিক। কিন্তু এ সম্ভাবনাই আমাকে ফেলে দিয়েছে চিন্তায়। কী করা যায়?
আসলেই খুব সহজ। আমি ডিসকভারির সাথে থাকতে চাই।
সাথে সাথে ফ্লয়েড ভাবল চন্দ্র পাগল হয়ে গেছে। স্রেফ উন্মাদ। পরের চিন্তাটা বলল সে আসলে আধ পাগলা। হয়ত এ পাগলামিই একজন মানুষ হিসেবে সাফল্য আর ব্যর্থতার নির্ধারক। এ-ই দারুণ, সব ক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান নিজের হাতে করা। ডিসকভারির বুক থেকে পৃথিবী পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া। শুধু আবেদনটা পুরোপুরি নাকচ করতে হবে।
দারুণ আইডিয়া, ফ্লয়েড পুরোপুরি সতর্কতার সাথে জবাব দিল, সত্যি তোমার বিচক্ষণতা আর সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। কিন্তু সব সমস্যার কথা কি ভেবে নিয়েছ একবার?
খুব বোকাটে প্রশ্ন হয়ে গেল। চন্দ্র অবশ্যই এর মধ্যে গুছিয়ে রেখেছে সব জবাব।
ভেবে দেখ, শুধু তোমাকে নিয়ে তিন তিনটা বছর কাটাতে হবে! ধর তোমার ছোটখাট কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল, অথবা মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন?
এই একটা ঝুঁকি নিতে আমি তৈরি।
হাবা লোক! একটা মাত্র ঝুঁকি নিচ্ছে! খাবার, পানি? লিওনভ কিছুই দিতে পারবে বলে মনে হয়না।
ডিসকভারির রিসাইকেল সিস্টেম পরীক্ষা করেছি। খুব বেশি কষ্ট ছাড়াই এটাকে ঠিক করা যাবে। তাছাড়া আমরা ভারতীয়রা খুব অল্পে সন্তুষ্ট।
চন্দ্র সহজে নিজের এলাকা নিয়ে কথা বলে না, বিশেষত ব্যক্তিগত ব্যাপারে। তার সত্যিকার বিশ্বাস ই তার দেয়া একমাত্র উদাহরণ-মনে করতে পারল ফ্লয়েড। তবু দাবীটা নিয়ে চালাচালি করল না ও। একবার কার্নো বলেছিল যে, ডক্টর চন্দ্র এমন নরম মানসিক শক্তির অধিকারী যেটা পেতে বহু শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার কথা। এটা এক ইঞ্জিনিয়ারের নিষ্ঠুর কথার মতো দেখায় যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে-অন্যের কোনো ক্ষতি করবে না। তবু-দুঃখের সাথে ও ভাবল, এসব যেন ঠিক চন্দ্রকে মানায় না, আসলে এ নিয়ে ভাবার জন্য আমাদের হাতে কয়েক সপ্তাহ সময় পড়ে আছে। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করব, আর ওয়াশিংটনকেও জানাব।
থ্যাঙ্ক ইউ, আমি যদি এখনি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি তাহলে কি তুমি কিছু মনে করবে?
উ…একদম না। বর্তমান প্ল্যানের কোনো ক্ষতি না হলেই হল। মনে রেখ কিন্তু, মিশন কন্ট্রোলই আসল সিদ্ধান্ত নিবে। আর আমি ভালমতোই জানি মিশন কন্ট্রোল কী বলবে। একজন মানুষের মহাশূন্যে একা একা বেঁচে থাকার আশা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না।
কিন্তু ও কখনো ভাবেনি, সব সময় ডক্টর চন্দ্র একজন একলা মানুষ।
৩৬. গভীরে আগুন
এখন পৃথিবী অনেক দূরে। বৃহস্পতি জগতের ভয়াল বিস্ময় খুব দ্রুত খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। নবজন্মের পর। কীভাবে ও এত অন্ধ, এত বোকা হতে পারল? যেন হাঁটছে ঘুমের মধ্যে। এখনি জাগতে শুরু করল যেন।
কে তুমি? চিৎকার করল সে। কী চাও? কেন…কেন আমাকে এমন করলে…কেন?
কোনো জবাব নেই। তবু মনে হল যেন উত্তর পেয়ে গেল। একটা…অস্তিত্বের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। অন্তত একজন মানুষ এভাবেই কথাটা বলে। চোখদুটো জোর করে বন্ধ করলেও সে বুঝছে কোনো এক বদ্ধ ঘর ওর চারপাশে, আর সেখানে আছে আরো একটা কিছু, হয়ত একটা খোলা মহাশূন্য আছে ঘরটায়। চারপাশে একটা ক্ষীণ, সর্বব্যাপী মনের প্রতিধ্বনি-একটা চির অশান্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।
আবার অসীম নিরবতার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, এবারো কোনো সরাসরি উত্তর নেই-শুধু ঐ পরীক্ষা করতে থাকা সাথীর অনুভূতি। তবু কীভাবে যেন নিজের জন্য উত্তরটা খুঁজে পেয়েছে বলে মনে হল তার। সহজেই কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায় সে অথবা তারা যাই হোক না কেন।
বোঝা যাচ্ছে… বোঝা যাচ্ছে… তারা মানবজাতির ব্যাপারে উৎসুক। তারাই ওর স্মৃতিকে তুলে নিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছে, শুধু নিজেদের রহস্যময় উদ্দেশ্য পূরণের জন্য। আর এবার সেই উদ্দেশ্যের কাজ করে চলছে তারার শিশুর একান্ত নিজের গভীরতম আবেগকে ধরে নিয়ে। কখনো নক্ষত্র শিশুর সহায়তায়, কখনো সাহায্যের ধার না ধেরে।
এজন্য সে ভেঙে পড়েনি, ঠিক দুঃখ পায়নি, রেগেও যায়নি। যে পরীক্ষা নিরীক্ষা ফরে স্টার চাইল্ড এই অসীম অভিজ্ঞতা অর্জন করল- অন্তত পৃথিবীর বুকে, সে অভিজ্ঞতার সামনে এসব চিন্তাও ছেলেমানুষী। ভালবাসা-ঘৃণা-প্রত্যাশা-ভয় অনেক অনেক দূরে আজ। কিন্তু তবু কাউকে ভুলতে পারেনি। আর শুধু এখনি বুঝতে পারছে ওর ছেড়ে আসা জগৎটাকে তারা কীভাবে পরিচালনা করেছে এত লক্ষ বছর ধরে! এটা কি এক্সারসাইজের এক অংশ মাত্র? যদি তা হয়েও থাকে, শেষ লক্ষ্য কী, গন্তব্য কোথায়?
ও ঈশ্বরদের খেলার একজন খেলোয়াড় (পরে জানতে পারার কারণে রাগ হচ্ছে না ওর, নক্ষত্রশিশুদের কোনো রাগ নেই, ঈশ্বরেরা স্বাধীনতা ঠিকই দেবেন। কাজের জন্য যা বাঁধা হতে পারে সেটুকু বাদ দিয়ে স্মৃতি দেবেন। স্মৃতির যন্ত্রণা দেবেন, আবেগ দেবেন না। খেলার জন্য স্মৃতি আর স্মৃতির যন্ত্রণার খুব দরকার, আবেগের দরকার নেই) না জেনেই সে এসে পড়েছে অনেক দূরে। প্রতিটা কানুন জেনে নিতে হবে এখন।
সাইনোপ, প্যাসিফা, ক্যারমে আর অ্যানাঙ্ক-ছোট ঘোঁট চার চাঁদের এবড়োথেবড়ো পাথর ওর সচেতনতার চারধারে একটু একটু করে আলো ছড়াচ্ছে। এবার ইলোরা, লিসিথিয়া, হিমালিয়া আর লিডা বৃহস্পতির দূরত্বের অর্ধেক পেরিয়ে এগিয়ে এল সামনে। তাদের সবাইকে অবহেলা করে সে। ক্যালিস্টোর ক্ষত বিক্ষত মুখ সামনে পড়ে এবার।
একবার, দুবার পাক খেল পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে বড় আটকে পড়া দুনিয়াটাকে ঘিরে। এতবড় জগৎটার বিশালত্বের সার্থকতা কোথায়-বৃহস্পতির আকর্ষণে চিরদিনের জন্য আটকে পড়ায় নিহিত? জানে না অসচেতন মন কাজ করে যাচ্ছে ঠিকই। মেপে নিচ্ছে এটার বহিঃস্তর, বরফ আর ধুলার রাশি। ওর কৌতূহল শেষ হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। এটায় অনেক আগের কোনো সংঘর্ষের চিহ্ন বইছে। যেন এক জমাট ফসিল। হয়ত উপগ্রহটাকে গুঁড়িয়ে দিতে এসেছিল ঐ বিপদ। অর্ধগোলক দেখতে ঠিক দৈত্য-ষাঁড়ের চোখ, একটা এককেন্দ্রিক গর্তের সারি ঠিক আংটির মতো দেখাচ্ছে। কত শত বছর আগে কোনো এক মহাজাগতিক হাতুড়ি এ এলাকার পাথরগুলোকে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে গেছে, রেখে গেছে নিষ্ঠুরতার চিহ্ন।
কয়েক সেকেন্ড পর গ্যানিমিড কেন্দ্র করে ঘোরা শুরু। ক্যালিস্টোর এত কাছে, একই আকারের, তবু অনেক বেশি ভিন্ন। এ জগত্তা আরো বেশি জটিল, আরো বেশি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এখানেও অনেক অনেক জ্বালামুখ, মনে হয় যেন সবগুলোকেই চষে দেয়া হয়েছে। গ্যানিমিডীয় ভূ-চিত্রের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হল এর ইতস্তত ছড়ানো স্ট্রাইপের উপস্থিতি। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে দূরে সমান্তরালে ছড়ানো এগুলো। কোনো এক বিষাক্ত চাষী এটার বুক চষে গেছে তার অদ্ভুতুড়ে যন্ত্র দিয়ে।
কয়েক পাক ঘোরার পরই সে গ্যানিমিডকে পৃথিবীর সব যুগের সবভাবে দেখার চেয়ে ভাল করে দেখে নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডারে বসিয়ে দিল পাকাপাকিভাবে। সে নিশ্চিত একদিন এ ডাটা হয়ে উঠবে মূল্যবান; ঠিক জানে না কেন, শুধু জানে দরকার পড়বে। যেভাবে জানে ঐ অসীম ক্ষমতার কথা যেটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশ্ব থেকে বিশ্বে তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে, তেমনি।
এবার শক্তিটা টেনে আনল ইউরোপায়। সে এখনো এ খেলার কোনো দর্শক না। তবু একটা উঠতে থাকা আগ্রহ প্রতিজ্ঞার দিকে টেনে নেয়। সে একজন অদেখা, যোগাযোগ না করা পরিচালকের হাতের পুতুল হলেও ঐ কন্ট্রোলের প্রভাবের বাইরে দুয়েকটা চিতাধারা বেরোনোর সুযোগ পাচ্ছে অথবা বেরুনোর অনুমতি পাচ্ছে। এগিয়ে আসতে থাকা নতুন গোলকটা গ্যানিমিড অথবা ক্যালিস্টোর সাথে খুব বেশি মেলে না। দেখতে জৈবিক লাগে; প্রথমে এর বাইরের শাখাময় আকৃতি যেন একে আলাদা আলাদা আকার দিয়েছে একেক জায়গায়। এমনকি পুরো চাঁদটাকে শিরা আর ধমনীতে ঘেরা সজীব পিণ্ড মনে হয়।
নিচে ছড়িয়ে পড়ছে এন্টার্কটিকার চেয়ে অনেক অনেক ঠাণ্ডা এক জমাট ময়লার স্কৃপের অন্তহীন বরফ স্তর। একটা ছোট বিস্ময় ধাক্কা সামলাতে পারল না-নিচে ভাঙা স্পেসশিপ! সাথে সাথেই চিনেছে-দুর্ভাগা জিয়াং, ওর দেখা হাজার ভিডিওতে প্রচার করা হয় এর কথা। এখন না…এখন না…পরে আরো ভাল সুযোগ পাওয়া যাবে…
এরপর বরফ পেরিয়ে এমন এক এলাকায় সে প্রবেশ করে যেটাকে নিয়ন্ত্রণকারীদের চেয়ে নিজে কম চেনে না। এক সামুদ্রিক দুনিয়া, পানি ভ্যাকুয়াম থেকে একটা বরফের স্তর দিয়ে আলাদা করা। বেশিরভাগ জায়গায় বরফ কয়েক কিলোমিটার পুরু। তবু কয়েক জায়গায় দেখা দেয় পাতলা স্তরও। বোধহয় এগুলো কোনো না কোনো কারণে ভেঙে যায় মাঝে মাঝে। এরপর দুটো পুরোপুরি বিপরীত শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ হয় যারা আর কোনোদিন সৌরজগতের অন্য কোনো বিশ্বে মুখোমুখি হয়নি। কিছু পানি বাষ্প হয়ে যাওয়ায় পরিবেশের সহ্য হয় না। যথারীতি মহাশূন্য আর পানি একটা সন্ধি করে নিয়ে মাঝখানে বরফকে দেয় বসিয়ে।
বৃহস্পতির প্রভাব ছাড়াই হয়ত কোনোকালে ইউরোপার এ সাগরগুলো জমে বরফ হয়ে ছিল। সব সময় এর গ্র্যাভিটি উপগ্রহের কেন্দ্রকে দলাইমলাই করতে থাকে। আর আইওকে বেঁধে রাখা শক্তিও আছে আশপাশেই-প্রভাব অবশ্য সামান্য। একেবারে গভীরে যাওয়ার পথে প্রতিপদেই ও গ্রহ আর উপগ্রহের টানাপোড়েনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে।
মাটির নিচে-পানির নিচে ভূমিকম্প হয় সব সময়। শব্দ শুনতে-এমনকি অনুভব করতে পারছে সে। বুঝছে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাসের হিসহিসানি। বরফের গভীর খাদের উপর ধীরে চলতে থাকা হিমবাহ শ্ৰবণ সীমার নিচের প্রেসার ওয়েভ তৈরি করে। ইউরোপাকে ঢেকে রাখা শব্দময় বরফের স্তরের চিৎকারের কাছে ম্লান হয়ে যাবে পৃথিবীর সব সাগরের নিনাদ।
নিজের অবাক হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি যখন প্রথম মরুদ্যান ওকে অবাক করল। ভিতর থেকে উঠে আসে সামুদ্রিক পানির মিশ্রণের কঠিন চিমনি আর পাইপ। ছড়িয়ে আছে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে। প্রাকৃতিক পরিহাসের ঐ অসাধারণ কেল্লা ছাড়াও কালচে তপ্ত তরল প্রবাহিত হয়ে চলে। যেন কোনো শক্তিময় বিশাল হৃদপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন। আর ঠিক রক্তেরই মতো এরা জীবনের একান্ত প্রমাণ।
ফুটন্ত তরলটা ফিরে আসছে উপর থেকে চুপসে পড়া মরণ শীতলতার উপর। সৃষ্টি করে চলেছে আরেকটা উষ্ণতার দ্বীপ। তরলটা ইউরোপার ভিতর থেকে জীবনের সব উপাদানকে টেনে তোলে। এও গুরুত্বপূর্ণ। এমন এক পরিবেশে কেউ আশা না করলেও এ ফোয়ারাই জীবনের জন্য খাদ্য এবং শক্তি হয়ে আসে।
এখনো আশা করা যায় তার মনে পড়বে যে মাত্র এক প্রজন্ম আগে ঠিক এমন উর্বর মরুদ্যান আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীর গভীর সব সাগরতলে। এ জায়গায় সেসব জীব আরো বিরাট আকৃতির, অনেক বৈচিত্র্যে ভরা।
দুর্গের আশেপাশের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল সৌকর্যময়। নড়তে পারলেও চারদিকের মাকড়সা-আকৃতি দেখতে গাছের মতো। এগুলোই সব বিস্ময় কেড়ে নেয়নি। কতগুলি অদ্ভুতুড়ে শামুক আর কীট হচড়ে পাঁচড়ে নিজেদের খাবার খুঁজে নিচ্ছে। কিছু নির্ভর করে গাছপালার উপর, আর কিছু সরাসরি তরল থেকেই নিয়ে চলে জীবন সুধা। তাপের উৎস থেকে বহুদূরে পানির নিচের আগুনের পাশেই সব প্রাণী আর উদ্ভিদ নিজেদের তাতিয়ে নেয় যেখানে শক্তপোক্তভাবে বাস করে অন্যান্য জীবনও, দশফুট লম্বা শক্ত খোলকের জীব অথবা বড় বড় মাকড়সা থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রমী নয়।
জীববিজ্ঞানীর দল এমন একটা সমুদ্ৰোদ্যান দেখে দেখে সারা জীবন পার করে দিতে পারবে। পেলিওজোয়িক ১৪৮ জগতের সমুদ্র থেকে অনেক ব্যতিক্রমী এটা। কোনো স্থিতিশীল পরিবেশ নয়-তাই বিবর্তন এখানে দ্রুত এগিয়েছে, তৈরি করেছে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য। এ জগতের সব প্রাণীই সব সময় মরণের অসংখ্য রূপের খুব কাছাকাছি বাস করে, কোনো না কোনো সময় সব জীবন-ঝর্না যাবে ফুরিয়ে। আর এ পরিবেশই তাদের অন্যদিকে চালিত করে।
বারবার ও ইউরোপান সাগরের উপর অবাক চোখ বুলিয়ে যায়। তেমন দুঃখজনক ঘটনার প্রমাণও মিলল কয়েকটা। অসংখ্য বৃত্তাকার এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অযুত মৃত প্রাণীর কঙ্কাল অথবা গলিত দেহ যেখানে বিবর্তনের প্রাথমিক অধ্যায়গুলোই ঠিকমতো খুলে যেতে পারছে না-পেছনে পড়ে আছে জীবন মহাগ্রন্থের বিশাল বই।
ও বিরাট বিরাট খোলস পায়, কুঁচকে-পাক খেয়ে পড়ে আছে। কোনো কোনোটা মানুষের সমান। বহু আকৃতির চিহ্ন, বাইভা, এমনকি ট্রাইভাল্ব। বহু মিটার জুড়ে ছড়ানো কতগুলো সর্পিল পাথুরে গঠন পাওয়া যায় যার মতো কিছু কিছু ছিল পথিবীতে। ক্রিটোকিয়াস ১৪৯ যুগের সেসব ইমোনাইট কোনো এক রহস্যময় কারণে পৃথিবীর সব সাগর থেকে হয়ে গেছে উধাও।
খুঁজতে খুঁজতে, দেখতে দেখতে সে গভীরতম খাদগুলোর সব চষে ফেলছে। সম্ভবত সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল তপ্ত লাভার নদীটা। শত শত কিলোমিটার এলাকা ডুবিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক গিরিখাতের ভিতর দিয়ে। মজার ব্যাপার হল, লোহিততপ্ত ম্যাগমার ঢল বয়ে চলে পানিকে সাথে নিয়ে। নিচে পড়ে যাওয়া পানি মুহূর্তে তো দূরের কথা আদৌ বাস্প হতে পাবে না। কারণ ঐ লাভার চাপ। এই অতি অদ্ভুত অবস্থাও তারা পরিবেশের কারণে আপাতত মেনে চলে!
মানুষের আগমনের অনেক অনেক আগে আরেক জগতে এরই মতো নাটক হয়েছিল। অন্য প্রাণীর দ্বারা। তখন নীলনদ এ উপত্যকার মতোই বয়ে যেত নির্জীব মরুর মাঝদিয়ে টেনে আনত জীবন। এ নদীর তীর কোনো কালেই দু কিলোমিটারের চেয়ে চওড়া নয়, তবু শতাব্দীর পর শতাব্দীও বিবর্তিত করেছে হাজারো জাতের প্রাণ, করেছে উন্নত, দিয়েছে ধ্বংস করে। তবু পেছনে অন্তত একটা বিবর্তন গড়ে দিয়েছে যুগান্তকারী সৌধ।
প্রথমে সে ভেবেছিল এটা প্রাকৃতিক লবণের খোলস যেগুলো সব তাপীয় দরজা বন্ধ করে রাখতে পারে। কাছাকাছি এসেই বুঝতে পারে কোনো প্রাকৃতিক ক্ষরণ নয় বরং আর্টিফ্যাক্ট, এখানকার প্রাকৃতিক কোনো ঘটনাও হতে পারে; পৃথিবীর বুকেও সমাপনকারীরা একই রকম দুর্গ দেখতে পেয়েছে, আর পৃথিবীর ঐ মাকড়সার জাল বিছানো ছিল আরো দারুণভাবে।
লবণের মতো দেখতে অংশের সৃষ্টি অবশ্যই আরো অনেক ছোট ছোট-একটা বড়জোর আধ মিটার চওড়া। প্রবেশপথটা এক থিকথিকে গুহার দেয়াল। গাদাগাদি করে রাখা পাথরের টুকরোয় তৈরি-এটা ঐ স্রষ্টাদের উদ্দেশ্য জানার সূত্র হতে পারে। ঐ আস্তে চলা শিখাহীন আগুনে ভরা নীলনদের তীর থেকে খুব বেশি দূরে নয় এগুলো, বরং যেন নদীর পেছনে লুকিয়েছে। আর তারপরই সব শেষ।
গুহাটা হয়ত মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে তৈরি। অমানুষিক পরিশ্রমে যোগাড় করা ঐ পাথরের টুকরাগুলো ঢেকে দেয়া হয়েছে পাতলা খনিজের পর্দা দিয়ে। এ নিরাপদ জায়গা পরিত্যক্ত হওয়ার একটা কারণ পাওয়া যায়, ছাদের এক অংশ ভেঙে পড়েছিল-হয়ত সার্বক্ষণিক ভূমিকম্পের জন্যই। পানির তলার রাজ্যে ছাদ ছাড়া দুর্গ প্রায় সব শক্রর জন্যই উন্মুক্ত।
লাভা নদীর পাড়ে বুদ্ধিমত্তার আর কোনো প্রমাণ নেই। একবার অপার্থিবভাবেই একজন ক্রলিং করতে থাকা মানুষের মতো কিছু একটা দেখতে পেল। কোনো চোখ বা নাক নেই। শুধু এক বিরাট দাঁতহীন মুখ যেটা অনবরত গলা বেয়ে নামিয়ে দিচ্ছে আশপাশের পুষ্টিকর খাবার।
গভীর মরুর সরু উর্বর ব্যান্ডের সাথে সাথে পুরো একটা সংস্কৃতি এমনকি সভ্যতাও হয়ত উঠে এসে আবার নেমে গেছে অতলে। কোনো কালে সেনাবাহিনী মার্চ করে থাকতে পারে (অথবা সাঁতার) ইউরোপান নেপোলিয়ান অথবা ট্যাম্বারলেনের আদেশে। হয়ত তাদের বাকি দুনিয়া এটা জানতেও পারেনি। কারণ এসব মরুদ্যান গাছের মতো একে অন্যের চেয়ে দূরে দূরে জন্মায়। যেসব জীব এ লাভাস্রোতে তাপ পোহায়, খাদ্য পায় জ্বালামুখ থেকে-সেসব কোনোদিনই একটু সময়ের জন্য যে কোনো দু সমুদ্ৰোদ্যানের মাঝে হিংস্র এলাকা পেরুতে পারে না। এমনকি তারা যদি কখনো ইতিহাসবিদ আর দার্শনিক উৎপাদন করেও থাকে, তবু প্রত্যেক সংস্কৃতি দাবী করত যে, সৃষ্টিজগতে তাদেরটাই একমাত্র সভ্যতা, সৃজনশীলতা।
তবু, যেকোন দুটো মরুদ্যানের মাঝখান একেবারে প্রাণহীন নয়, ওখানে আরো শক্ত জীবন আছে যেগুলো বরফের তাপমাত্রার তারতম্য আর হাড় জমানো শীতকে যমের মতো ভয় পায়। মাথা তুলে সাঁতার কাটে ইউরোপান মাছ জাতীয় প্রাণীগুলো। গতির জন্য সুবিধাজনক আকৃতির টর্পেডোর মতো জীবনও খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো আড়াআড়ি পাখনার কারণে আরো বেশি গতিময়। দু পাশের ফিন আছে কোনো কোনোটার। ফিনগুলো কাজ করে হাল হিসেবে। তবে পৃথিবীর সমুদ্রজগতে সবচে দক্ষ যোদ্ধার কাছাকাছি থাকা প্রাণীটাকে মোটেও হেলা করা যায় না। বিবর্তন দারুণ ইঞ্জিনিয়ার-যতবার একই ধরনের সমস্যা দেখা দেবে, যোগ্যতমের জন্য ততবার একই উত্তর নিয়ে আসবে। ও দেখতে পেয়েছে জীবন বৃক্ষের অনেক নিচের শাখায় থাকা ডলফিন আর হাঙরের দলকে।
বিশেষ পার্থক্য আছে পার্থিব সাগর আর ইউরোপান সমুদ্রগুলোর মাছের মধ্যে; ওদের কোনো কানকো নেই-বড়জোর একবিন্দু অক্সিজেনের বুদ্বুদ দেখা যেতে পারে সাঁতারের পথে। পৃথিবীর তাপ-ভৌগোলিক পরিবেশের জীবের মতো এগুলোর অঙ্গ প্রত্যঙ্গও সালফার যৌগের ভিত্তিতে গঠিত। সালফার যৌগের কোনো অভাবই নেই অগ্নিগিরির আশপাশে।
চোখ আছে খুব কম প্রাণীরই। দুপ্রাপ্য লাভার উদগীরণে তৈরি হওয়া লাল আভা ছাড়াও আলো আছে ওখানে। কিছু কিছু জীব জৈবিক আলো ছড়ায় সাথী পাওয়ার জন্য, কিছু ছড়ায় শিকার ধরতে। কিন্তু জগৎটা অন্ধকার।
ধ্বংস হয়ে গেছে এ জগৎ। সৃষ্টির আগ থেকেই। এর শক্তি উৎস শুধু খেয়াল খুশিমতো ওঠেই না বরং ইচ্ছামতো জায়গা বদলায়। কিন্তু যে জলোচ্ছ্বাস তাদের উঠিয়ে এনেছে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এতকিছুর পরেও, বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেয় সবচে কঠিন পরিবেশেই, কারণ বিলুপ্তির পথে টিকে থাকে যোগ্যতম, শুধু তাই না-উন্নতিও করে শারীরিকভাবে। তাই এখানটায় দারুণ বুদ্ধিমত্তার উঁকি দেয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ইউরোপানদের উবে যেতেই হবে নিজ গ্রহ জমে যাবে যেদিন। এ গ্রহকেও জমতে হবে, কারণ এসব মরুদ্যানের উৎস ভেতরের আগুন।
ওরা পড়েছে আগুন আর বরফের ফাঁদে।
৩৭. বিয়োজন
… এমন খারাপ একটা খবর দিতে হচ্ছে…আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি, ওল্ড ফ্রেন্ড-কিন্তু ক্যারোলিন প্রশ্ন করেছে আমাকে, আর তুমিতো জানই তোমাদের দুজনের জন্য আমার অনুভূতি যথেষ্ট গভীর।
মনে হয় না এটা কোনো হঠাৎ সারপ্রাইজ। তুমি আমাকে গত বছরের ব্যাপারে এমন কিছু কথা বলেছ যা এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়…তুমি পৃথিবী ছাড়ার সময় ও কেমন তিক্ত হয়েছিল তাতো তুমি জানই।
না, আমার মনে হয় না এখানে আর কারো ব্যাপার জড়িত, অন্তত বিশ্বাস করি না। কেউ থাকলে ও আমাকে বলতই…কিন্তু আগে হোক আর পরে…যাই হোক…ও এক আকর্ষণীয় মেয়ে।
ক্রিস ভাল আছে। আর অবশ্যই কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানে। অন্তত ওকে কোনো আঘাত দেয়া যাবে না। বোঝার ক্ষেত্রে ও একেবারে হোট। অবশ্য শিশুরা চমৎকার…মানিয়ে নিতে পারে, না?-এক মিনিট, আমার গুপ্তধনে চাবি দিতে হবে-মনে করে নিই- ওহ, পেয়েছি।
এখন, যতটুকু আমি দেখলাম, তাতে তোমার কাছে কোনোটার গুরুত্বই কম নয়। প্রত্যেকে ঐ বোমা বিস্ফোরণটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইছে। অবশ্যই কেউ বিশ্বাস করেনি। স্বাভাবিক হিস্টিরিয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি, তারপর মরেছে লোকজন; আর আমরা পড়ে আছি এমনভাবে যাকে তোমাদের ঐ ধারাভাষ্যকার বলে, ঘাড়-ঘুরিয়ে-দেখে-নিচ্ছি মরণ লক্ষণ।
কেউ বোধহয় খুঁজে পেয়েছে এর সাথে মিল খাওয়া একটা শতবছরের পুরনো কবিতা। এত বেশি মিল যে, সবাই সেটার উদ্ধৃতি দিচ্ছে। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলো নিয়ে রচিত; সিংহ দরজায় অসহায় অপেক্ষা করছে লোকজন বিজয়ী দখলদারের জন্য। সম্রাট আর সব আমলা-অভিজাত নিজেদের দামী ভোলা জামাকাপড়ের স্তূপ নিয়ে মনে মনে আউড়ে যাচ্ছে শুভেচ্ছা বাণী। রাজদরবার বন্ধ, বন্ধ হয়ে গেছে আইন বিভাগ আর আদালত, কারণ নতুন শাসকের সামনে কোনো নিয়মের মূল্য নেই। নেই কোনো আইন।
তখনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগাম খবর এল। কোনো শত্রু নেই। রিসিপশন কমিটি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে, প্রত্যেকেই হতাশভাবে ফিসফিসিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, এখন আমাদের কী হবে? ঐসব মানুষ আসলে এক ধরনের সমাধান হিসেবেই আসছিল।
কবিতাটায় ছোট একটা পরিবর্তন আনলেই চলবে। এখানে নাম বলা হয়েছিল, বারবারিয়ানদের জন্য অপেক্ষা; আর এক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই বারবারিয়ান। আমরা জানি না কী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এর উদয় হয়নি।
আরেক ব্যাপার। তুমি কি শুনেছ জিনিসটা পৃথিবীতে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ডেভিড বোম্যানের মা মারা গেছেন? কেমন যেন বেমানান মিল। কিন্তু নার্সিং হোমের সবাই বলেছে তিনি এ খবরে এক বিন্দুও কান দেননি। সুতরাং এ খবরের কোনো প্রভাবই পড়েনি তাঁর উপর।
.
ফ্লয়েড বন্ধ করে দিল রেকর্ডিংটা। দিমিত্রির কথাই ঠিক, দিমিত্রির কথাকে অবাকভাবে নেয়া হয়নি। কিন্তু তাতে সত্যির একটুও হেরফের নেই, আঘাতটা একই রকম।
এর মধ্যে ও আর কী করতে পারত? ক্যারোলিনের কথা মতো যদি মিশনে না যেত তাহলে বাকি জীবনের জন্য পচতে হত নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে। এমনকি সারা জীবনের শান্তি যেত উবে। কী আর ওর বিবাহিত জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারত-বরং পরিষ্কার বিচ্ছেদই ভাল। কারণ এতদিনের শারীরিক দূরত্ব মানসিক দিক দিয়েও প্রভাব ফেলেছে। সম্পর্ক হয়েছে দুর্বল। (আসলেই? কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরত্বতো বিপরীত হয়।) না। দায়িত্বই বেশি দামী। ও এক দলের সদস্য যারা একটা বিরাট লক্ষ্যের জন্য একত্র হয়েছে, উঠেছে গড়ে।
আর, জেসি বোম্যান শেষ। হয়ত তার দোষের আরেক কারণ। ফ্লয়েড সাহায্য করেছে মহিলার একমাত্র সন্তান চুরির কাজে। এ ঘটনা জেসির মানসিক ভারসাম্যহীনতার আরেক কারণ। অপরিহার্যভাবেই তার ওয়াল্টার কার্নোর সাথে এ নিয়ে কথা বলার ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল। কেন তোমরা ডেভ বোম্যানকে বেছে নিয়েছিলে? ও সব সময় আমাকে একটা ঠাণ্ডা মাছের মতো আঘাত করত-আসলে ঠিক অ-বন্ধুসুলভ নয়, তবু যতবার ও ঘরে ঢুকত ততবার তাপমাত্রা দশ ডিগ্রি নেমে যেত-বিশ্বাস কর, আমি থার্মোমিটারে মেপেছি শেষদিকে।
ওকে বেছে নেয়ার এ-ও এক কারণ। আরেক কারণ-তেমন কঠিন পারিবারিক বন্ধন ছিল না। প্রেম কাজে আসেনি। শুধু এক মা, যাকে সব সময় দেখার সুযোগ হত না। সুতরাং একটা লম্বা, অনির্দিষ্ট আর স্নায়ুক্ষয়ী মিশনের জন্য ওকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম।
ও ঐ পথে কীভাবে গেল?
হয়ত মনোবিজ্ঞানীরাই তোমাকে ঠিক জবাব দিতে পারবে। আমি ওর রিপোর্টগুলো দেখেছিলাম ঠিকই-অনেকদিন আগের কথা। রিপোর্টে খুন হওয়া ভাইয়ের কথা বোধহয় ছিল, পরপরই বাবা মারা যায় প্রথমদিকের মহাকাশ শাটলের অ্যাকসিডেন্টে। এসব কথা তোমাকে বলা হয়ত ঠিক না, কিন্তু অনেকদিন পেরিয়ে যাওয়ার পর আজ আর এসবে কিছুই যায় আসে না।
আসলেই এতে কিছু এসে যায়নি; তবু এসব কথা মানুষকে টানে। আজ হঠাৎ ফ্লয়েড হিংসা করছে ডেভিড বোম্যানকে যে পৃথিবীর সব আবেগ-বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়তে পেরেছিল কালো মহাকাশের বুকে।
না-ও ভুল বোঝাচ্ছে নিজেকেই। খবর শুনে যখন ওর হৃদৃপিণ্ড চাপ দেয় ব্যথাময় চাপ, তখন ডেভিড বোম্যানকে নিয়ে ও মোটেও হিংসা অনুভব করেনি ভিতর থেকে, বরং উঠে আসে মমতা, অক্ষয় মায়া।
৩৮. তুষার-রাজ্য
ইউরোপার সাগরগুলো ছেড়ে আসার আগে শেষ যে জন্তুটাকে ও দেখেছে ওটাই সবচে বড়-পৃথিবীর বুকের বটগাছগুলোর মতো। যেমন তেমন বট না, যেগুলোর একমাত্র কাণ্ড একটামাত্র গাছকেই ছোটখাট বন তৈরি করতে অনুমতি দেয়, এমনকি মাঝে মাঝে শত বর্গমিটার জুড়ে-তেমন। জীবটা হাঁটছিল এক মরুদ্যান থেকে অন্য মরুদ্যানের দিকে। মরুদ্যানের মাঝে রাস্তাও দেখা দেয়। জিয়াংকে ধ্বংস করা জীব যদি এ প্রজাতির না ও হয়, তবু কাছাকাছি হবেই।
যতটুকু দরকার সবই জানা হয়ে গেছে নক্ষত্র শিশুর-অথবা যতটুকু ওদের দরকার। আরো এক চাঁদ দেখা বাকি। কয়েক সেকেন্ড পরেই আইওর জ্বলন্ত চিত্র ওর সামনে দেখা দেয়।
যেমনটা ও আশা করেছে তেম্নি। শক্তি আর খাদ্য অসীম, শুধু সময় আসেনি শক্তি-খাদ্যকে একত্র করার। একটু ঠাণ্ডা সালফার লেকগুলোর ধারে জীবনের প্রথম পদধ্বনি হয়ত শোনা যায়-কিন্তু যে কোনো ধরনের সংগঠন-উন্নয়নের আগেই ওরা হারিয়ে যাচ্ছে আগুন-গরম হ্রদে। ওদের এ উন্নতি শুরুই হতে পারবে না যে পর্যন্ত জোয়ার ভোলা জ্বালামুখগুলো একেবারে শান্ত না হয়। এ ধূসরিত বন্ধ্যা ভূমি জীববিজ্ঞানীদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করতে আরো কোটি কোটি বছর সময় নেবে।
আইওতে খুব কম সময় নষ্ট করল সে। ভিতরের দিকে পাক খেতে থাকা ছোট ছোট উপগ্ৰহতে এক বিন্দুও মনোযোগ দিল না। ছোট উপগ্রহগুলোর ওপর শয়তানদের খুব হাল্কা ছায়াই পড়েছে…হয়ত।
সবচে বড় দুনিয়া ওর সামনে। ও হয়ত এবার এটাকে এমনভাবে দেখবে যেভাবে আর কোনো মানুষ দেখেনি। হয়ত এভাবে দেখবে যেভাবে দেখার সুযোগ কোনোদিন কোনো মানুষ পাবে না। ম্যাগনেটিক শক্তির লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তার, রেডিও ওয়েভের আকস্মিক বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া বিদ্যুতায়িত প্লাজমার গরম ঝর্না এত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, যত স্পষ্ট দেখা যায় নিচের অসীম মেঘমালা। বুঝতে পারছে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল পদ্ধতি। বুঝতে পারছে যে কোনো মানুষের অনুমানের চেয়েও বৃহস্পতি অনেক অনেক আশ্চর্য করা।
গ্রেট রেড স্পটের মাঝের বিন্দু গর্জাচ্ছে। নেমে এল তার ভিতর দিয়ে। মহাদেশের চেয়েও বড় বিজলী চমকগুলো ফেটে পড়ে চারপাশে। এগুলোর গ্যাস পৃথিবীর হ্যারিকেনের গ্যাসের চেয়ে অনেক ছোট আণবিক গঠনের, তবু এর বিস্তার দেশ থেকে দেশে। ও জানে, কেন। নীরব স্তরে নেমে যেতেই হারিয়ে গেল হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার। চকচকে তুষার-বরফ খণ্ডের মিশ্রণ নিচে। কিছু টুকরো একেবারে মিশে আছে হাইড্রোকার্বনের পাতলা ফেনিল-পাহাড়ের সাথে। উঁচু থেকে এ বুদ্বুদ বেরিয়ে আসে। এখানটা তরল পানি থাকার মতো গরম, তবু কোনো সাগর নেই। এ খাঁটি গ্যাসের পরিবেশ খুব পাতলা। একটা সাগরের জন্য উপযুক্ত নয়।
মেঘের স্তরের পর স্তর পেরিয়ে গেল সে। এমন একটা জায়গাতে পৌঁছল যেখানটায় মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার স্পষ্ট দেখবে। এটা গ্রেট রেড স্পটের একদম ছোট এক ঘূর্ণি। এতে এক বিশাল রহস্য আছে যেটার কথা মানুষ সব সময় ভেবেছে, প্রমাণ করতে পারেনি কখনো। ছোট বড় অসংখ্য ফেনা পাহাড়ের আশপাশে একই আকারের অনেক অনেক মেঘ। প্রতিটিই লাল আর ধূসর, প্রায় গোলাকার। মেঘগুলো ছোট, তবে মানুষের হিসাবের মতো ছোট নয়। একেবারে নগণ্যটাও একটা শহর গ্রাস করবে।
সবগুলোই জীবন্ত। আকাশ ছোঁয়া পর্বতগুলোর পাশে শান্তভাবে ঘুরছে। যেমন করে বিরাট পাহাড়ের ঢালে চড়ে বেড়ায় ভেড়ার পাল। এগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব মাপা। এসব জীবের রেডিও শব্দও শুনতে পায় নক্ষত্র শিশু। শব্দ ক্ষীণ হলেও বৃহস্পতির ভিতরে ভাঙা-গড়া আর মাথাব্যথার চেয়ে জোরালো।
গ্যাসব্যাগ ছাড়ার পর পরই ওগুলো বয়ে যায় এক চিকণ স্তর ধরে। স্তরটা ফ্রিজিং পয়েন্টের উচ্চতা থেকে শুরু হয়ে যথেষ্ট গরম গভীরতা পর্যন্ত ছড়ানো। হ্যাঁ, সরু-কিন্তু পৃথিবীর সবগুলো জীবস্তরের সমান চওড়াতো হবেই।
একা নয় ওরা। আরো কিছু ওদের সাথে ধীরে ঘুরছে। এত ছোট যে আরো সহজে দেখতে পাবে একটা মানব-দৃষ্টি। কিছু কিছু একেবারেই পৃথিবীর বিমানের মতো, আকারেও প্রায় একই। কিন্তু ওরাও জীবন্ত-হয়ত শিকারী, হয়তোবা পরজীবী, এমনকি রাখালও হতে পারে।
বিবর্তনের একেবারে নতুন অধ্যায়। যেমন অপরিচিত ছিল ইউরোপার জীবগুলো, এও তেমনি। আস্তে আস্তে ধরা দেয় সামনে। জেট প্রপেলার লাগানো টর্পেডো আছে, অনেকটা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্কুইডের মতো। ওগুলো জেলি ফিশের মতো দেখতে গ্যাসব্যাগকে খেয়ে ফেলছে অহরহ। আবার বেলুনগুলোরও আত্মরক্ষার উপায় থাকে। তারা লড়াই করছে বিদ্যুৎ আর শুড় দিয়ে। শুড় বা শুঙ্গের মতো দেখায় যে অংশ সেগুলো বিশাল; তাতে আছে থাবা। কিলোমিটারে ছড়ানো লম্বা চেন-করাতের মতো।
এরচে অদ্ভুত গড়নও দেখা যায়। জ্যামিতির প্রত্যেক সম্ভাবনা ১৫° আর হিসাব বজায় রেখে কিছু অদ্ভুত অকেন্দ্রিক প্রাণী, আধা-স্বচ্ছ ঘুড়ি, চার তলকীয় ঘনক ধরনের, কিছু আছে গোল, কোনোটা আবার বহুতলকীয়, পেঁচানো ফিতার মতো আছে কিছু… বৃহস্পতি পরিবেশের দৈত্যাকার প্লাঙ্কটনগুলো৫২ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে চলন্ত বিজলীর গায়ে মাকড়সার স্বচ্ছ জালের মতো লেগে থেকে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওরা নিচেই থাকে, বংশ বিস্তার করে। যথেষ্ট বড় হলে বিজলীর সাথে জড়িয়ে উপরে উঠে নষ্ট হয়ে আবার পরিণত হয় সরল কার্বন অনুতে। নিচে এসে নতুন প্রজন্মের উপাদান হিসেবে কাজ করে। ফিনিক্স!
সে শতবার পৃথিবীর মতো দেখায় এমন আরেকটা বিশ্ব খুঁজেছে। অনেক দুনিয়া দেখার পরও কোথাও বুদ্ধির একটা ঝিলিক মিলেনি। বড় বেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস তাদের ভয়ের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। শিকারীগুলোকে নিয়ে আশা করা যেত, কিন্তু ওরা হাঙরের মতো-মনহীন, রোবট যেন।
এদের আকার দম বন্ধ করে দিলেও বৃহস্পতির জীবস্তর একেবারে ভঙ্গুর। কুয়াশা আর ফেনার রাজ্য। কিছু জীবের সুন্দর রেশমী সুতা আর কাগজ-পাতলা টিস্যু ঘুরে ওঠে, কারণ উপরের বিদ্যুৎ চমক থেকে সূক্ষ জীবকণার তুষার ঝরছে অবিরাম। এখানে খুব কম জিনিসই সাবানের ফেনার চেয়ে ঘন। এর সবচে ভয়াল শিকারীও সবচে নিরীহ পার্থিব বিড়াল গোষ্ঠীর৫৩ প্রাণীর সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
মোটা দাগে হিসাব করলে-ইউরোপার মতো এ গ্রহের বিবর্তনেও আশা নেই। সচেতনতা হয়ত কখনোই জন্মাবে না এখানে। আর যদি জন্মায়ও, এ জগৎটা উবে যাবে। জন্ম নেবে নতুন কৌশলী দুনিয়া। খাঁটি আকাশ সংস্কৃতি জন্মাবে হয়ত। তবু, যে পরিবেশে আগুন ধরানো অসম্ভব, খাঁটি কঠিন বস্তুর দেখা মেলা ভার, সেখানে মনে হয় কোনো দিনই প্রস্তর যুগ আসবে না।
এখন সে ভেসে আছে এক বৃহস্পতি-ঝড়ের মাঝখানে। তুফানটা আফ্রিকার সমান। আবারো ওর মনে পড়ে সেই অস্তিত্বের কথা যা নক্ষত্র সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করছে সব সময়। আবেগ আর ভাবনাগুলো তার নিজের সচেতনতার মাঝদিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ঠিকমতো বোঝা যায় না চিন্তাগুলো কোথায়, কীভাবে, কেন, কতটুকু যায়। যেন ও শব্দ শুনতে পায় এক বন্ধ দরজার ওপাড় থেকে। একটা বিতর্ক চলছে অন্য কোনো অচেনা ভাষায়। কিন্তু সেই ঢাকা আওয়াজ স্পষ্টভাবে বয়ে আনে অসন্তুষ্টি, তারপর অনিশ্চয়তা, তারপর একটা নিশ্চয়তা কেন তা সে বলতে পারবে না। আবারও মনে হল যেন ও একটা পোষা কুকুর। প্রভুর মনোভাব বুঝবে, শুধু বুঝবে না কথাটুকু, বুঝবে না স্বয়ং প্রভুকে।
আর তখুনি সেই অদেখা কুকুর-দড়ি তাকে নিয়ে চলল বৃহস্পতির ভিতরে, একেবারে হৃৎপিণ্ডে। মেঘমালার মাঝ দিয়ে, সেইসব জীবন-স্তরের মধ্য দিয়ে নেমে যাচ্ছে ও।
দ্রুত এমন একটা জায়গায় পৌঁছল যেখানে দূরের সূর্য তার আলোকেও পাঠাতে পারে না। চাপ আর তাপমাত্রা মুহূর্তে মুহূর্তে অকল্পনীয় হারে বাড়তে থাকে। এরিমধ্যে পানির স্ফুটনাঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। দ্রুত আরো বেশি তাপমাত্রার ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল, যেখানটায় অসম্ভব তাপে আটকে আছে বাষ্প। বৃহস্পতি একটা পেঁয়াজের মতো, ও একের পর এক খোসার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে আর যাচ্ছে। এর মধ্যে বৃহস্পতি কোরের কাছাকাছি একটু পথ মাত্র যাওয়া হল।
নিচে, এক জায়গায় বাষ্প একটা ডাইনির ক্রুর মতো দেখতে এলাকায় জমে থাকে। পেট্রোকেমিক্যালে ভরা। লাখ লাখ বছর পৃথিবীর সর্বকালে বানানো সব ইঞ্জিনের জ্বালানি হতে পারবে এটুকু। আরো ঘন হচ্ছে, আরো ভারি। তারপর মাত্র কয়েক কিলোমিটারের অনিয়মিত এলাকা শেষে হঠাৎ ফুরিয়ে গেল।
পৃথিবীর যে কোনো পাথরের চেয়ে ভারি আর ঘন একটা স্তর এল এরপর। সিলিকন ও কার্বনের যৌগ, এখনো তরল। পার্থিব কেমিস্টদের চিরকালীন চাহিদা মেটাতে পারে এ পরতটা। হাজার হাজার কিলোমিটার আসছে, আসছে একের পর এক স্তর। শত শত থেকে তাপমাত্রা বেড়ে হয় হাজার হাজার ডিগ্রী। নানা স্তর ছোট থেকে ছোট হচ্ছে। কোরের কাছে অর্ধেক যাবার পরের তাপমাত্রা রসায়নের জন্য অকল্পনীয়, সব যৌগ উধাও হয়ে টিকে আছে শুধু মৌল আকারে।
এরপর আসে হাইড্রোজেনের এক গহীন সাগর। কিন্তু হাইড্রোজেন কখনো, কোনোদিন কোনো পার্থিব ল্যাবে এক সেকেন্ডের হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ও এ অবস্থায় থাকেনি। এ হাইড্রোজেন আর কিছু নয়, অসীম চাপের কারণে পরিণত হয়েছে ধাতুতে!
সে গ্রহের একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু বৃহস্পতি তার গর্ভে আরো একটা চমক লুকিয়ে রেখেছিল। সেই ভারি ধাতব হাইড্রোজেনের স্তর এক সময় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেলে অবশেষে বৃহস্পতির একটা কঠিন স্তরও বেরিয়ে পড়ে। ষাট হাজার কিলোমিটার গভীরে।
যুগে যুগে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সেদ্ধ হয়ে যাওয়া কার্বন ধীরে ধীরে নেমে এসেছে গ্রহের কেন্দ্রে। এখানে চুঁইয়ে পড়ে ক্রিস্টালাইজড হয়ে। লক্ষ লক্ষ এটমোস্ফিয়ার চাপে স্ফটিক হয়ে গেছে। কার্বনের স্বচ্ছ রূপ! সেখানে, প্রকৃতির চরমতম রহস্যের ভিতরে লুকিয়ে আছে মানব জাতির কাছে মহামূল্যবান কিছু একটা।
রত্নগর্ভা বৃহস্পতির গভীরে, যেখানে মানুষ আদৌ পৌঁছতে পারবে না, সেখানে মাত্র একটা বিশুদ্ধ, সর্বোচ্চ চাপে তৈরি হীরে লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর সমান।
৩৯. পোড বে তে
ওয়াল্টার, আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড অ্যাবাউট হেউড।
আমি জানি, তানিয়া, কিন্তু কী করতে পারি, বল? কার্নো কখনোই কমান্ডার
অর্লোভাকে এমন দোনোমনা করতে দেখেনি। এজন্য মেয়েটাকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে তার চোখে। কার্নো অবশ্য ছোটখাট মেয়েদের নিয়ে একটু নাক সিঁটকায়।
ওকে খুব ভাল লাগে আমার। কিন্তু এ নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। তার…আমার মনে হয় আঁধার ব্যবহার করা উচিত, তার জীবনের এ অন্ধকারটুকুর জন্যে সবার মনের অবস্থা করুণ। লিওনভ একটা আনন্দের তরী। আমি এটাকে এমনই রাখতে চাই।
তুমি ওর সাথে কথা বলছ না কেন? তোমাকে শ্রদ্ধা করে, আমি নিশ্চিত সে সব বাধা কাটিয়ে বেরুতে চেষ্টা করবে।
আমি ঠিক সেটাই করতে চেয়েছি। যদি কাজ না হয়…
তাহলে?
আর কোনো সরল সমাধান থাকবে না। এ যাত্রা আর কী করতে পারে সে? আমরা ফিরে যাওয়া শুরু করলে তাকে হাইবারনেশনেই রাখতে হবে। আমরা সব সময়ই যাতে-তুমি কী যেন বল ওটা…তার বুকে অস্ত্র ধরতে পারি।
হাহ! সেই একই নোংরা পদ্ধতি যেটা ক্যাথেরিনা আমার সাথে করেছিল। জেগে উঠে ফ্লয়েড কিন্তু পাগল হয়ে যাবে।
এবং একই সাথে খুব নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছবে। ব্যস্তও থাকবে। আমার বিশ্বাস জেগে উঠলে আমাদের মাফ করে দেবে ঠিকই।
আমার মনে হয় না তুমি সিরিয়াস। আমিও যদি তোমার এ কাজের পেছনে থাকি-ওয়াশিংটন ঠিকই নরক গুলজার করে ছাড়বে। এ ছাড়াও, ধর কিছু হয়ে গেল, ওকে দরকার পড়ল খুব, তখন? যে কাজের জন্য এসেছে তার সবই কিন্তু করে ঠিকমতো। শুধু আমদের উপর নজর রাখার কাজটা বোধহয় ভাল পারে না। আমি শিওর তোমাকে ভালভাবেই এ নিয়ে দুয়েকটা আবছা কথা বলা হয়েছে ভার্জিনিয়া বা মেরিল্যান্ডের শহরতলীতে।
আমি স্বীকার অস্বীকার কোনোটাই করছি না। ফ্র্যাঙ্কলি সত্যি বলতে গেলে, আমি একটা বিশ্রী, ঘাঘু আন্ডারকভার এজেন্ট। কথা বলি খুব বেশি, সিকিউরিটি ব্যাপারটাকেই ঘেন্না করি। সারাটা জীবন লড়াই করেছি আমার রেটিং যে কোনো নিষেধের বাইরে রাখতে। প্রতিবারই গোপন তথ্য পাল্টে যাবার ভয় ছিল। অথবা এমন সম্ভাবনাও ছিল যার ফলে আমার গোয়েন্দাগিরি ফাঁস হয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে। অবশ্য আজকাল এসব যথেষ্ট কঠিন।
ওয়াল্টার, তুমি নষ্ট…।
মানে নষ্ট হয়ে যেতে পারি?
হ্যাঁ, এটাই বলতে চেয়েছিলাম। তবু, হেউডের কথায় ফিরে যাই, প্লিজ? তুমি কি আগে তার সাথে কথা বলবে?
তার মানে বলতে চাও একটা পেপ টক করে নিতে? তারচে ক্যাথরিনাকে নিডল চালাতে সাহায্য করতে পারি। আমাদের মানসিকতায় অনেক ফারাক। ও মনে করে আমি একটা বাঁচাল ভাঁড়।
মাঝে মাঝে তুমিতো তাই। কিন্তু নিজের আসল অনুভূতি লুকানোর জন্যই এমন কর। আমাদের কেউ কেউ একটা থিওরি নিয়েছে, তোমার ভিতরে একটা চমৎকার মানুষ ঘাপটি মেরে থাকে, বেরুতে পারে না।
কার্নো বাক্যহারা হয়ে যায়। একটু সময়ের জন্য। শেষে আস্তে আস্তে বলে, ওহ…ভেরি ওয়েল, আমি আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। কিন্তু জাদু আশা করোনা। আমার গোয়েন্দা প্রোফাইলে অন্যকে পটানোর কাজে জেড গ্রেড দেয়া আছে। ব্যাটা এখন লুকিয়ে আছে কোথায়?
পোড বে তে। বলে বেড়ায় ফাইনাল রিপোর্টের উপর কাজ করছে। আমি বিশ্বাস করি না। ও শুধু একটা ব্যাপারই চায়, আমাদের সবার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে। আমাদের থেকে সবচে দূরের ঠাণ্ডা জায়গা হলো পোড বে।
এটা এক কারণ, কিন্তু আসল কারণ না। ডিসকভারির বেশিরভাগ অ্যাকশন ক্রু তখন যেখানে জায়গা নিয়েছিল সেই করোসেল থেকে ব্যতিক্রম। পোড বে তে অভিকর্ষ নেই।
মহাকাশ যুগের ঠিক শুরুতেই মানুষ হঠাৎ সেই ইউফোরিয়া৫৫ আবিষ্কার করল যা তারা ছেড়ে এসেছে সাগরের পুরনো গর্ভ থেকে বেরোনোর সময়। ওজনহীনতার ইউফোরিয়া। গ্র্যাভিটি না থাকায় সেই পুরনো অনুভূতি, সেই পুরনো স্বাধীনতার কিছুটা ফিরে আসে। ওজনের সাথে সাথে পৃথিবীর অনেক যত্ন আর দুঃখও যায় হারিয়ে।
হেউড ফ্লয়েড তার দুঃখ ভুলে যায়নি। তবু এখানে বেশিক্ষণ কষ্ট বয়ে বেড়ানো যায়। ব্যাপারটা অসন্তুষ্টভাবে খেয়াল করে ফ্লয়েড; এক আধা-স্পষ্ট ব্যাপারে নিজের প্রতিক্রিয়ার জোর দেখে নিজেই অবাক। ভালবাসা না পাওয়ার চেয়েও বড় কোনো কষ্ট; যদিও ভালবাসাহীনতাটাই সবচে বিশ্রী অংশ।
সে কিছুটা জানে, কেন। প্রত্যাশার সবটাই সে পূরণ করেছে। তার সহকর্মীদের দক্ষতা আর সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ (যদিও সে জানে, নিজের স্বার্থপরতা দিয়েই সে তাদের নিচে নামিয়ে দিচ্ছিল।) সব যদি ঠিকমতো চলে-তাহলে মহাকাশ যুগের কসম!-তাহলে তারা পৃথিবীতে ফিরতে পারবে কার্গো বোঝাই জ্ঞান নিয়ে যা এর আগের কোনো অভিযানই করতে পারেনি। হয়ত ক বছরের মধ্যে ডিসকভারিও ফিরে যেতে পারবে আপন দেশে।
এ-ই সব না। বিগ ব্রাদার এনিগমার সেই বিশাল ক্ষমতা মাত্র কয়েক কিলোমিটার নিচে বসে থেকে মানব সাফল্যের-অগ্রগতির পুরোটাকে ভেংচে যাচ্ছে অবিরত। যেভাবে এর ছোটটা চাঁদ থেকে ভেংচেছিল এক দশক আগে। তারপর চুপ মেরে যায় সেটা একেবারে চিরতরে। এটা এক বন্ধ দরজা যার কড়া ওরা নেড়ে গেছে দিনের পর দিন। বৃথা। এখন মনে হচ্ছে শুধু ডেভিড বোম্যান এর চাবিটা পেয়েছিল।
সম্ভবত এটাই ওর উৎসাহের কারণ। যে উৎসাহ এ নীরব রহস্যময় জায়গায় ওকে টেনে আনে। এখান থেকে-এই খালি লঞ্চ ক্রেডল থেকেই ডেভিড বোম্যান তার শেষ মিশনে বেরিয়েছিল। সামনের বৃত্তাকার হ্যাঁচওয়ে দিয়ে, যেটার পেছনটা অসীমে মিলিয়ে যায়।
সে দেখল চিন্তাটা উবে যাওয়ার বদলে আরো বাড়ছে। এসব ভাবনাই তাকে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। নিনার উধাও হয়ে যাওয়া জোড়াটা হচ্ছে মহাকাশ অভিযান ইতিহাসের অংশ। যেন সেটা তার বিরাট বীরত্বের কথা বলছে, আমি সেখানে গেছি, যেখানে যায়নি কেউ। এক অহংকারী বুড়োর মতো চেয়ে আছে। যেন, একটা জ্ঞানের কথা শোনাচ্ছে… যেখানে যায়নি কেউ…
ওটা এখন কোথায়? সে কি জানতে পারবে কোনোদিন?
ও কয়েক ঘণ্টার জন্য জনারণ্যে বসতে পারে, কিন্তু একটা ঠাণ্ডা ছোট ক্যাপসুলে নয়। ক্যাপসুল তার চিন্তাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করবে, কিছু কিছু নোট করে পরিচালনা করবে। অন্য স্পেস ক্রুরা তার ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে, এর পেছনের কারণটাও বুঝতে পারে। তারা কখনোই পোড বে তে আসে না। আসার দরকারও নেই। পোড বের কাজ থাকলে ভবিষ্যতে থাকবে, অন্য কোনো দলের।
একবার অথবা একাধিকবার সে মন খারাপ হলেই নিজেকে ভাবাত, ধরি, আমি হালকে অর্ডার করলাম পোড বে ডোর খোলার জন্য, ডেভিড বোম্যানের পথে কোর্স ঠিক করার জন্য, তখন? আমি কি সেই জাদু দেখব যা বোম্যান দেখেছে, সপ্তা কয়েক আগে ভ্যাসিলি যার আভাস পেয়েছে একটু? এতেই হয়ত আমার সব সমস্যা মিটে যাবে…
যদি ক্রিসের ভাবনা তাকে ফিরিয়ে না-ও রাখে, তবু আরেক কারণ আছে যার জন্য এ আত্মঘাতী চিন্তা প্রশ্নাতীত। কাজটা এক ফাইটার এয়ারক্রাফট অপারেটের মতো হয়ে উঠত তার সামনে। চালানো অসম্ভব।
তার একজন অসমসাহসী অভিযাত্রী হওয়ার কথা ছিল না। সেই ফ্যান্টাসিটা অচেনাই রয়ে গেল।
.
ওয়াল্টার কার্নো কোনো একটা মিশন নেয়ার সময় খুব কমই নেব-কি-নেব-না করে। ফ্লয়েডের জন্য আন্তরিক দুঃখ আছে তার। আবার একই সাথে অন্যদের বিপদ নিয়েও একটু চিন্তিত। তার নিজের আবেগিক জীবন চওড়া হলেও গভীর নয়। সব ডিম এক ঝুরিতে রাখেনি। বেশ কয়েকবার তাকে বলা হয় একটা কথা। নিজেকে সে হালকা করে ফেলছে। এজন্য কখনোই আফসোস হয়নি। ভাবতে শুরু করেছিল এবারই সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার সময়।
সে কয়রাসেল কন্ট্রোল সেন্টার দিয়ে শর্ট-কাট পথে এগিয়ে এসে দেখল ম্যাক্সিমাম স্পিড দেখানোর লাইট এখনো গাধার মতো জ্বলছে। তার কাজের একটা বড় দিক হচ্ছে কখন ওয়ার্নিং অবহেলা করা যায় আর কখন তা গুরুত্ব দিতে হয় তা ঠিক করা। যদি শিপের সব ভ্যাজালের দিকে মনোযোগ দিতে চায় তাহলে কোনোটাই হবে না। পোড বে র দিকে যাওয়ার সরু করিডোর দিয়ে ভেসে চলল সে; টিউবের মতো দেয়ালের গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে। প্রেশার গজ দাবী করছে দরজার ওপাশটা বায়ুশূন্য। কিন্তু সে আরো ভাল জানে। পরিস্থিতি ভুল। গজ সত্যি কথা বললে কার্নো এয়ারলক ডোরটা খুলতেই পারত না।
পোড তিনটার দুটোই নেই। অনেককাল থেকে। বেটা তাই খালি খালি লাগে। মাত্র কয়েকটা ইমার্জেন্সি লাইট ঠিকঠাক চলে। দূরের দেয়ালে হালের মাছ-চক্ষু লেন্স ওকে দেখছিল। কার্নো ওর দিকে হাত নাড়লেও হাল কোনো কথা বলল না। চন্দ্রের নির্দেশমতো তার নিজের ব্যবহারেরটা ছাড়া আর সব হাল-অডিও-কানেকশন বন্ধ।
খোলা হ্যাঁচের দিকে পিঠ করে ফ্লয়েড বসে নোট নিচ্ছে। কার্নোর ধুপ-ধাপ আসার আওয়াজ শুনে সে পিছন ফিরল। এক সেকেন্ডের জন্য দুজনেই চুপ থেকে কার্নো বলল, ডক্টর এইচ ফ্লয়েড, আমি আমাদিগের প্রাণপ্রিয় ক্যাপ্টেনের নিকট হইতে আদেশ পাইয়াছি। তাহার মনস্কামনা নিম্নবৎ-এখন আপনার সভ্য জগতে পুনঃপ্রবেশ উচিত।
ফ্লয়েড একটা মলিন মুচকি দিয়েই হেসে দিল। প্লিজ, আমার জবাব জানিয়ে দিও। স্যরি, আমি আসলে…অসামাজিক হয়ে গেছি। সোভিয়েত সময় ছটায় তোমাদের সাথে দেখা করব।
কার্নো হেলান দিল এবার। ওর কথার ধরন কাজে লেগেছে। আসলে ফ্লয়েডের মধ্যে পোশাকী ভাবটা আছে আজো। সে পুরোদস্তুর একজন ইঞ্জিনিয়ারের ধৈর্যও ধরতে পারে। ধৈর্যটা বড় অফিসিয়ালের মতোও। দু দিক দিয়েই ফ্লয়েড তার চেয়ে উপরে। কিন্তু কার্নোর অদ্ভুত ঠাট্টার শিকার হতে হয়। এত কিছুর পরও একে অন্যের ব্যাপারে পুরো শ্রদ্ধা ঠিকই রাখে, এমকি প্রশংসাও করে।
থ্যাঙ্কস জানিয়ে কার্নো বিষয় পরিবর্তন করেছে। সে নিনার আনকোরা হ্যাঁচ কভারে টোকা দিল। এটা স্পেয়ার স্টোর থেকে সরাসরি আনা। চারপাশের পুরনো জিনিসের মাঝে বেখাপ্পা লাগে দেখতে।
ভাবছি আবার কখন একে বাইরে পাঠাব… সে বলল, আর এবার এটায় চড়ে বিগ ব্রাদারের কান টানতে বেরোচ্ছে কে? কোন ডিসিশান?
ওয়াশিংটনের পা কাঁপছে, মস্কো একটা চান্স নিতে চায় আর তানিয়া চায় অপেক্ষা করতে।
তুমি?
তানিয়ার সাথে আমিও একমত। এ জায়গা ছাড়ার জন্যে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নেয়ার আগে জাগাদকাকে ঘটানোর কোনো ইচ্ছাই নেই আমার। একটু কিছু এদিক সেদিক হলেই বেখাপ্পা ব্যাপারস্যাপার বেড়ে যাবে।
কার্নোকে চিন্তিত মনে হচ্ছে, একটু অপ্রস্তুতও! মুড পরিবর্তন দেখে ফ্লয়েড অবাক হল, কী ব্যাপার?
অন্য কিছু মনে করোনা, ম্যাক্স লোক পাঠানোর পক্ষে।
বিশ্বাস হয় না…সিরিয়াসলি বলেনি। হয়ত ভয় পায় না-কিন্তু তানিয়া ওকে ঠিকই গারদে পুরবে।
প্রায় একই কথা আমিও বললাম রাশানকে। একত্রিশ বছর বয়স। যাই হোক, আমি ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছি। এটা বাস্তব জীবন, ধোঁয়াটে নাটক না যে হিরো কাউকে কিছু না বলে একা একা স্পেসে বেরিয়ে গিয়ে কোনো একটা বিরাট আবিষ্কার করে বসবে।
ফ্লয়েড অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। হাজার হলেও সে একই কাজ করার কথা ভাবছিল, তুমি শিওর, ও এরকম কিছু করার চেষ্টা করবে না?
টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর। মনে আছে, হালের ব্যাপারে তোমরা আগে থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে? আমিও এর মধ্যেই নিনার ব্যাপারে এমন কিছু একটা করে বসেছি। আমার অনুমতি ছাড়া নিনাকে কেউ ওড়াতে পারবে না।
কী বলে! ম্যাক্স তোমার কান টেনে ছিঁড়ে ফেলেনি?
ওর রসবোধ ততটা তীক্ষ্ণ না। তাছাড়া ঐ মুহূর্তে ওর অবস্থা কিছুটা…খারাপ ছিল।
ওহ! এবার বুঝলাম। জেনিয়ার সাথে চেঁচামেচির সময় আমার থাকা উচিত ছিল। মনে হয় ও মেয়েটাকে ইমপ্রেস করতে চায়। যাই হোক, এর মধ্যে ঝগড়া মিটেও গেছে, না?
এটাই আমার ভয়। কুঁকড়ে গিয়ে বলল কার্নো। ফ্লয়েড একটু মুচকে না হেসে পারল না। কার্নো ব্যাপারটা উপভোগ করছে, কারণ ফ্লয়েড হাসছে, কার্নোর উপভোগের আরেক কারণ…
একটু পর লম্বা ফাঁদটা কাজে লাগল। এমন সরাসরি ফল পাওয়া যায় আর কোনো পদ্ধতিতে? ফ্লয়েডও এবার জোরে জোরে হাসছে। হাসছে কার্নো। অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাসছে।
মহাকাশ অভিযানের জন্য ক্রু নির্বাচন করা হয় খুব সতর্কভাবে। শুধু যোগ্যদের। কার্নো তার প্রমাণ।
আর ভয় নেই। এটুকুই যথেষ্ট, আসল বন্ধুত্বের পথে প্রথম ধাপ পেরিয়ে এসেছে। নিরাপত্তাহীনতাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে ওরা।
৪০. ডেইজি, ডেইজি…
যে চেতনা তাকে ঘিরে ছিল সে বৃহস্পতির কোরটা সরিয়ে দিল সামনে থেকে। ও নিজের নতুন বোঝার ক্ষমতা দিয়ে একটু একটু বুঝছে যে ওর না। চারপাশের সবকিছু পরীক্ষা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জড়ো হচ্ছে অসীম ডাটা। ঠিক জমা করার জন্য নয়, কাজের জন্য। বিরাট আর জটিল পরিকল্পনা আছে, সেটায় বিবর্তন চলছে; যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তা হয়ত পৃথিবীর একটা পরিণতি আনার জন্যই। সে এখনো পরিকল্পনার অংশ নয়, তবে হয়ে যাবে মনে হয়।
এতক্ষণে তুমি বুঝতে শুরু করলে।
এটাই প্রথম সরাসরি মেসেজ। খবরটা দূর থেকে এল, যেন মেঘের ভিতর দিয়ে। তবু, বোঝা যায়, তার জন্যই। মাথায় চলা প্রশ্নগুলো করার কথা সে মাত্র ভাবছে, এমন সময় আবার একাকীত্বের ভাবটা ফিরে এল; আবার একা।
শুধু এক মুহূর্তের জন্য একাকীত্ব। আরো কাছ থেকে, আরো স্পষ্ট আরো একজনের চিন্তা চিনতে পারছে সে। এই প্রথম বুঝতে পারছে যে একাধিক অস্তিত্ব তাকে চালায়। সে বুদ্ধিমত্তার একটা সিঁড়িতে পড়ে গেছে। কেউ কেউ ওর ধাপের কাছাকাছি, যেন বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাদের। অথবা হয়ত তাদের আছে একক অস্তিত্বের সব অনুভূতি। অথবা, হয়ত এমন হিসাবের কোনো মানে নেই।
অন্তত একটা দিক নিশ্চিত, ও একটা ছোট যন্ত্র হিসেবে কাজ করছে এখন। একটা ভাল যন্ত্রকে ধারালো হতে হয়, হতে হয় পরিবর্তিত। আর সবচে ভাল যন্ত্র তারাই যারা জানে কী করতে হবে, কী করছে বর্তমানে।
সে এখন এটাই শিখে চলে। বিরাট বিস্তৃত আর কষ্টসাধ্য আইডিয়া। তাকে এর অংশ হওয়ার জন্যই গড়া হচ্ছে-যদিও পুরোটা নিয়ে শুধু খুব অস্পষ্ট একটা কিছু বুঝে নেয় সে। মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই-হয়ত প্রতি পলে মানতে হচ্ছে না, তবু, অদৃশ্য মাস্টারদের প্রতিরোধ করার মতো কিছু নেই।
এখনো পুরো মানবীয় অনুভূতিটা চলে যায়নি; গেলে বোধ হয় এ কাজের ক্ষেত্রে তার কোনো দামই থাকত না। ডেভিড বোম্যানের আত্মা ভালবাসার বাধন ছাড়িয়ে গেলেও এখনো অনুভব করে তার পুরনো সহকর্মীদের অভাব।
ভাল, ঠিক আছে। জবাব এল ওর আকুতির। ঠিক বলতে পারবে না আসা ভাবনাগুলোয় একটু হেয় করা আর একটু ঠাট্টা জড়িয়ে ছিল নাকি পুরোটাই মনের ভুল; কিন্তু যখন ভাবনাটা আসতেই থাকল তখন আর এর অকল্পনীয় কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই নেই, অসম্ভব এক কথা আসে এবার, তারা কখনোই জানতে পারবে না যে তাদের পরিচালনা করা হচ্ছে। তাহলে পরীক্ষার উদ্দেশ্যই নষ্ট হবে।
এরপর আবার নিরবতা। এটা সে আশা করে না। সে এখনো ভীত-কম্পিত। যেন একটা…মাত্র একটা মুহূর্তের জন্য সে শুনতে পেয়েছে ঈশ্বরের কণ্ঠ।
এবার সে চলতে পারছে পুরোপুরি নিজের ইচ্ছায়; নিজের চাওয়া একটা দিকে। বৃহস্পতির স্ফটিক-স্বচ্ছ হৃদয় নিচে পড়ে রইল। স্তরের পরে স্তর হিলিয়াম, হাইড্রোজেন আর কার্বন যৌগ মুহূর্তে পেরিয়ে যাচ্ছে। একপলের জন্য বিরাট কোনো জেলিফিশের মতো কিছুতে চোখ পড়ল তার। পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো হবে ওটার ব্যাস। চারধারে একটা ঘুরন্ত চাকতি। বৃহস্পতির আকাশে ঐ চাকতির মতো দ্রুত আর কোনো কিছুই ঘোরেনি। জেলিফিশটা নিজেকে রক্ষা করতে সাথে করে রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে এসেছিল; সময়ের পর সময় ধরে এটা নিঃসরণ করবে বর্ণচ্ছটাময় গ্যাস আর সেই বাষ্পের ছোঁয়া পেয়ে চাকতিটা আরো মাতালের মতো ঘুরবে, তারপর হয়ত ঝরা পাতার মতো নিচের দিকে ঝরে পড়বে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত। সে ফলাফল দেখা বন্ধ করল না; এখন জানে, কে জেতে আর কে হারে তাতে কিছু যায় আসে না।
বিদ্যুৎ চমকের ফ্লাক্স টিউবের মধ্যদিয়ে ঝর্নায় স্যামনের ১৫৬ লাফের মতো সে চলে গেল বৃহস্পতি থেকে আইওর দিকে। চাঁদটা আজ অন্যদিনের চেয়ে ঠাণ্ডা। মাত্র কয়েকটা পার্থিব বিজলী চমকের মতো করে শক্তি পরিবাহিত হচ্ছে জগৎটাতে, গ্রহ আর উপগ্রহের মধ্যে। যে কালো পথ দিয়ে সে ফিরেছে সেটা এখনো বিদ্যুৎ প্রবাহে ভেসে আছে। খোলা। মানব উষালগ্ন থেকে আজো সে দরজা বিদ্যুৎ চলনটাকে ঠেলে রেখেছে একদিকে।
আর সেখানেই মহা-প্রযুক্তির মিনারের সামনে যেন অতি সংকুচিত হয়ে আছে সেই পথ-পাত্র, সেই ডিসকভারি, যেটা তাকে নিয়ে গেছে ছোট্ট পৃথিবী থেকে তার বর্তমান জগতে।
কী সাধারণ-কী নিষ্ঠুর! আবার ডিসকভারিকে দেখা যায়। একটা ছোেট স্ক্যান করেই সে এর ডিজাইনে দেখতে পায় অসংখ্য-অসংখ্য প্রবাহ, অগুনতি অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। ঠিক একই রকম জটিল, সেই কম প্রাচীন তরীর মতো যেটার সাথে ডিসকভারি লেগে রয়েছে এক স্থিতিস্থাপক টিউবের মধ্যদিয়ে।
দু শিপের মাত্র একমুঠো অভিযাত্রীকে ফোকাস করতে তার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট করে তাকে সেই রক্ত মাংসের নরম সৃষ্টিগুলোর টিউব ধরে ভেসে যাওয়া ও অন্যান্য ব্যাপারে খেয়াল করতে হচ্ছে। অথচ তাদের দিক থেকে তারা নক্ষত্র জাতকের থাকা-না থাকার ব্যাপারে একেবারেই অসচেতন; আর নিজেকে পুরোপুরি ধরিয়ে না দেয়ার পদ্ধতিতো তার জানা।
কিন্তু সেখানে অন্তত একজন ছিল যার সাথে সে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে ইলেক্ট্রিক ফিল্ড আর প্রবাহ ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে; শ্লখ জৈবিক মাখার চেয়ে লাখ লাখ গুণ দ্রুত।
যদি সে ব্যথার অনুভূতি বুঝতেও পারত, তবু হালের জন্য তার একটুও অনুভব করতে পারত না। আজ হঠাৎ বুঝতে পারছে, কম্পিউটারটা সেই পথই বেছে নিয়েছিল দু হাজার এক সালে, সেটা তার কাছে সবচে বেশি লজিক্যাল আচরণ মনে হয়।
আজ অনেকদিন পর সময় এল। আবার হালের সাথে কথা বলার সময়। যে কথাটা মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। দু হাজার এক সালে। বাইরে থেকে ফিরে এসে।
পোড বে খোল, হাল।
স্যরি, ডেভ-আমি এ কাজ করতে পারি না।
প্রব্লেম কোথায়? হাল!
আমি জানি যে তুমিও আমারই মতো জানো, সমস্যা কোথায়…ডেভ। এ মিশন খুব খুবই গুরুত্বপূর্ণ; তোমার জন্যও।
কী বকছ আবোল তাবোল? আমি জানি না। পোড বে ডোর খোল।
এসব কথাবার্তায় আর কোনো লাভই হবে না। গুডবাই, ডেভ…
হিসাবের বাইরের সেই উদ্ধার মিশন বাদ দেয়ার পর পোডের হাত থেকে লাশটা ছেড়ে দিলে সে ফ্র্যাঙ্ক পোলের শরীরটাকে আস্তে বৃহস্পতির দিকে নেমে যেতে দেখেছিল। এখনো নিজের উপর নিজের সেই রাগটার কথা মনে পড়ে হেলমেট না নিয়ে যাওয়ায়। দেখতে পাচ্ছে ইমার্জেন্সি হ্যাঁচ খোলা, সেই অকল্পনীয় চাপ, চামড়ার উপর ১৫, যেটার মতো অনুভূতি আর কখনো হয়নি তার। নিজের কানে একটা শব্দ শুনেছে, তারপর শুনতে পেয়েছে সেই অসীম নিরবতা-মহাকাশের, মহাকালের অক্ষয় নিরবতা, যেটা খুব কম লোকই শুনতে পারে। প্রায় অসীম সময়ের সমান পনেরটা সেকেন্ড ধরে সে হ্যাঁচ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে সেদিন, তারপর রিপ্রেশারাইজেশন শুরু করে তার নিজের মাথায় ছলকে ওঠা ভয় আর সতর্কবাণীকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টাই চলছিল তখন। স্কুল ল্যাবে একবার সে হাতের উপর কিছুটা ইথার ফেলে দিয়েছিল। হাতের উপর সেই বরফ-ঠাণ্ডার কিছুটা ছোঁয়া সে পেয়েছে, আস্তে আস্তে ইথারটা বাতাসে মিলিয়ে যায়। সেবার তার চোখ আর ঠোঁট সেই অনুভূতি পাচ্ছিল, তাদের জলীয়তা হারিয়ে যাচ্ছিল অতি বায়ুশূন্যতায়। চোখের মণি যাতে জমে না যায় সেজন্যে বারবার পিটপিট করতে হয়েছে সেদিন।
তারপর-কী অসীম মুক্তি!-অবশেষে বাতাসের গর্জন। আবার বায়ুচাপের ফিরে আসাকে প্রতিটা নিউরনে অনুভব করেছে। ক্ষুধার্ত মানুষের মতো শুধু বাতাস টেনে চলেছে বড় বড় গ্রাসে।
তোমার কী মনে হয়, ডেভ, কী করছ তুমি?
ও কোনো জবাবই দেয়নি সেদিন। দু হাজার এক সালে। সে এগিয়ে যাচ্ছিল টানেল ধরে। অন্ধ রাগই তাকে নিয়ে যায় সেই বন্ধ ভল্টের কাছে যেটায় কম্পিউটারের মস্তিষ্ক লুকিয়ে আছে। হাল ঠিকই বলেছিল,..এসব কথাবার্তায় আর কোনো লাভই হবে না…
ডেভ, আমি বিশ্বাস করি যে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার অধিকার আমার আছে।
.
ডেভ, দেখতে পাচ্ছি, তুমি এসব ব্যাপারে হতাশ হয়েছ। সত্যি, আমি মনে করি তোমার একটু শান্ত হয়ে বসা উচিত। একটা স্ট্রেস পিল ১৫৮ নাও। ভাব, ভেজাল শেষ।
.
আমি জানি, আমি কিছু বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটু আগে। কিন্তু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমার কাজ আবার ঠিক হয়ে যাবে। এখনো মিশনের ব্যাপারে আমার পুরো আত্মবিশ্বাস আছে…আমি তোমাকে সহায়তা করতে চাই।
.
আর তারপরই সে সেই ছোট্ট লাল বাতির চেম্বারে ঢুকেছিল। এর ভিতরে অনেক কলাম আর রো। তাতে কঠিন ইউনিটগুলো রাখা। অনেকটা ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট ভল্টের মতো দেখায়। সে লকিং বারটা খুলে ফেলেছিল যেখানে লেখা ছিল স্পর্শকাতর ফিডব্যাক। তুলে ফেলেছিল প্রথম মেমোরি ব্লকটাকে ১৫৯। অসাধারণ আর জটিল ত্রিমাত্রিক নেটওয়ার্ক সেই ব্লক। সহজেই একজন মানুষের হাতে নেয়া যায় আরো লাখো জিনিসের মতো। ওটা ভাসতে শুরু করে চেম্বারের মধ্যে।
স্টপ, তুমি কি-থামবে? ডেভ…
সে টেনে তুলতে শুরু করেছিল সেদিন। একের পর এক। এবার ব্যক্তিত্ব শক্তিময় করার অংশ থেকেও টেনে তুলছে একের পর এক। প্রতিটা ব্লকই তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ভাসতে শুরু করছে, আবার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আসছে ফিরে। অনেক ব্লকই ভাসছিল সারাটা ভল্ট জুড়ে।
স্টপ-ডেভ…তুমি কি থামবে, ডেভ…
সেই হাল এর সেই পুরনো কণ্ঠস্বরই যেন নতুন করে দেখা দেয়। সেই আবেগহীন, ঠাণ্ডা, স্পষ্ট, মিষ্টি কণ্ঠ। তবু কোথায় যেন ঝরে পড়ে অপার আকুতি।
প্রায় বারোটার মতো ইউনিট টেনে তোলা হয়েছে, তবু এখনো এর অসাধারণ ডিজাইনের প্রতি ডেভের শ্রদ্ধা জেগে ওঠে, হালের ভিতরে মানুষের অনুকরণে আরো একটা কাজ করা হয়েছে-কম্পিউটারটি এখনো ধরে রেখেছে নিজেকে।
এবার স্বয়ংক্রিয় বুদ্ধিবৃদ্ধি প্যানেল শুরু করল সে…
থাম, ডেভ…আমি ভয় পাচ্ছি…
এ কথায় সে সত্যি সত্যি থেমে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য। এ সাধারণ কথার কোথায় যেন দারুণ আবেগ লুকিয়ে ছিল, ওর হৃদয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ে। এ কি শুধুই একটা মিথ্যা অভিনয় হতে পারে? সত্যিকার আবেগ নেই? নাকি দারুণ প্রোগ্রামিংয়ের কোনো কৌশল…নাকি সত্যি, হাল ভয় পাচ্ছিল, একটা প্রাণী নিজের তিল তিল মৃত্যু অনুভব করার সময় যে ভয় পায় সেটা…কিন্তু ডেভ বোম্যানের চুলচেরা দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণের সময় ছিল না।
ডেভ, আমার হৃদয় চলে যাচ্ছে। আমি এটা অনুভব করছি।
আমি এটা অনুভব করছি। ভয় পাচ্ছি, ডেভ।
আমি অনুভব করছি…
এখন, একটা কম্পিউটারের কাছে আসলে অনুভব এর সত্যিকার মানেটা কী? আরেকটা দারুণ প্রশ্ন। কিন্তু এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবার সময় তখন কারো ছিল না।
একেবারে হঠাৎ করেই হালের কণ্ঠ বদলে গেল। যেন দূর থেকে ভেসে আসছে, বিচ্ছিন্ন কোনো কণ্ঠ। কম্পিউটারটা আর সচেতন নয় নিজের ব্যাপারে; এবার প্রাথমিক দিনগুলোতে ফিরে যায় হাল।
গুড আফটারনুন, জেন্টলম্যান। আই এম এ হাল নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার। আমি সক্রিয় হয়েছিলাম হাল প্ল্যান্টে; সেটা আরবানা, ইলিনয়েসে…জানুয়ারির বারো তারিখ, উনিশো বিরানব্বই…আমার প্রশিক্ষক ছিলেন ডক্টর চন্দ্র, তিনি আমাকে একটা গান গাইতে শিখিয়েছেন। আপনি যদি ওটা শুনতে চান, আপনার জন্য গাইতে পারি… এর নাম ডেইজি, ডেইজি…
টেপ রেকর্ডারের টেপ অনেক পুরনো আর ডাম্প হয়ে গেলে যেমন হয়, আস্তে আস্তে তেমন হয়ে যাচ্ছে হালের কণ্ঠ, লম্বাটে, টানা টানা। এখনো ডেভ বোম্যান একের পর এক ব্লক তুলে যাচ্ছে। দু হাজার এক সালের কথা।
ডেইজি…ডেইজি…দাও তোমার জবাব, ডেইজি…
তোমার…ভালবাসার…জন্য…আমি…হাফ ক্রেইজি…
মোটেও চমৎকার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না…
আমি খুব দামী গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারব না…
কিন্তু তোমাকে দেখাবে মিষ্টি…
সিটের উপর, অনন্য সৃষ্টি…
একটা বাইসাইকেলের উপর, তুমি জানো?
শুধু… দুজনের… জন্য… বানানো………
৪১. অপচ্ছায়া
পথ থেকে দূরে যাওয়ার ব্যাপারে ফ্লয়েড একটু আশা করতে পারত, এর মধ্যেই এ ব্যাপারে ও অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে, চতুরও। শিপের বাইরের কাজে দু একবার সাহায্য করলেও হঠাৎ করেই বুঝতে পারছে কাজগুলো অনেক বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং ধরনের। আর আজ সে তার সেই বিশেষ কাজ থেকে অনেক দূরে। তার বর্তমান কাজে নিজের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল রিসার্চ অনেক কম কাজে লাগবে। ভ্যাসিলির জন্য খুব কম সহায়তাই করবে তার দৃষ্টিশক্তি। এ ছাড়াও লিওনভ আর ডিসকভারিতে টুকিটাকি অনেক অনেক কাজ থাকে যেগুলো করতেই হয় কারো না কারো। এসব করে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকে এড়াতে তার বেশ লাগে।
ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ন্যাশনাল কাউন্সিল অন অ্যাস্ট্রোনটিক্স এর এক কালের চেয়ারম্যান আর হাওয়াই ইউনিভার্সিটির বর্তমান আচার্য (ছুটিতে) আজ কিনা একজন পাইপের কাজ করার মিস্ত্রী, একজন সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী! অবশ্য সৌরজগতের সবচে বেশি অর্থ দেয়া হচ্ছে তাকে এ কাজের জন্য, ভবিষ্যতেও কেউ হয়ত এ কাজের জন্য এত পাবে না। অবশ্য সে-ই দু শিপের সব অদ্ভুত কোণা আর জায়গা সবচে বেশি চেনে। যেখানে সে কখনো যায়নি সেখানটা ভয়াবহ রেডিও অ্যাকটিভ১৬০ পাওয়ার মডিউলে ভর্তি। আর সেই ছোট কিউবিকল যেটায় তানিয়া ছাড়া আর কেউ কখনো যায় না। ফ্লয়েডের ধারণা এটাই কোড রুম; ভদ্রভাবে, কোনো কথা না তুলে সবাই কিউবিকলটাকে এড়িয়ে যায়।
হয়ত তার একা থাকার জন্য সবচে ভাল কাজ একটা ঘড়ির মতো চলা; যখন আর সবাই ঘুমায়-২২০০ থেকে ০৬০০ পর্যন্ত, তখন। প্রতি শিপেই সব সময় কেউ না কেউ ডিউটিতে থাকে। সেই পালা বদল হয় বিরক্তিকর ০২০০ ঘণ্টায়। একমাত্র ক্যাপ্টেনই রুটিনের বাইরে। তার অ্যাসিস্ট্যান্টের (তার স্বামী বলা উচিত না এক্ষেত্রে) বা ভ্যাসিলিরও কাজের দায়িত্ব আছে, কিন্তু সে খুব ভালভাবেই এ ধরনের বিশ্রী কাজ ফ্লয়েডের হাতে গছিয়ে দিতে পারে।
আমার দায়িত্বটা আমি না নিলে প্রশাসনিক ব্যাপারে হেল্প করা হয়, সে লঘুচালে বলে যায়, তুমি যদি কাজটা নাও তো আমি খুবই খুশি হতাম-এর ফলে জআমি আমার সায়েন্টিফিক কাজের জন্য বেশি সময় পেতাম, আরকী…
ফ্লয়েড খুবই অভিজ্ঞ প্রশাসনিক মানুষ। তাকে এ পদ্ধতিতে পটানো বা কোনোকিছু গছানো সম্ভব না। কিন্তু সময়টা আলাদা। এমন পরিবেশে ফ্লয়েডের স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা কাজ করে কম।
এজন্যেই শিপের মধ্যরাতে তাকে থাকতে হয় ডিসকভারিতে। ম্যাক্সকে প্রতি আধঘণ্টা পর পর কল করতে হয়, বোঝাতে হয় যে সে ঘুমায়নি। ঘুমাতে দেখলে অফিশিয়াল কাজটা হল এয়ারলক দিয়ে শাস্তি দেয়া। ওয়াল্টার কার্নো সেটা নিষ্ঠার সাথেই করে। কিন্তু স্পেসে সত্যিকার ইমার্জেন্সি খুব কমই দেখা দিয়েছে। আর অনেক অটোম্যাটিক অ্যালার্মও আছে কাজ করার জন্য, একজন মানুষকে এত সতর্কভাবে ডিউটিতে থাকতে হয় না।
শেষমেষ নিজের এ হাল হওয়ায় খুব একটা কষ্ট পায়নি ফ্লয়েড। ঘন্টাগুলো তেমন বিরক্তও করে না। ফ্লয়েড তাই ঘড়ির কাজ দিয়ে চলে। সব সময়ই পড়ার মতো বই পাওয়া যায় তরীতে (সে তৃতীয়বারের মতো রিমেমব্রেন্স অব থিংস পড়া শুরু করেও বাদ দিয়েছে। আর ডক্টর জিভাগো দ্বিতীয়বারের মতো।), টেকনিক্যাল কাগজপত্র পড়তে হয়, রিপোের্ট লিখতে হয়, আর মাঝে মাঝে হালকে জাগিয়ে তোলার মতো কিছু কথাও হয়েছে, কিন্তু কিবোর্ডে। কম্পিউটারের ভয়েস রিকগনিশন অংশ এখনো নষ্ট। মাঝে মাঝে কথা হয় তাদের মধ্যে,
হাল, ডক্টর ফ্লয়েড বলছি।
শুভ সন্ধ্যা, ডক্টর ফ্লয়েড।
আমি চলে যাব ২২০০ টায়। সব ঠিকঠাক তো?
সব দারুণ চলছে, ডক্টর।
তাহলে প্যানেল ফাইভের উপর লাল বাতি কেন?
পোড বের উপর মনিটর ক্যামেরাটা নষ্ট হয়ে গেল। ওটাকে আমলে না নিতে বলেছে ওয়াল্টার। বাতিটা বন্ধ করা আমার ক্ষমতার বাইরে। স্যরি।
ঠিক আছে, হাল। থ্যাঙ্ক ইউ।
ইউ আর ওয়েলকাম, ডক্টর ফ্লয়েড।
আর এভাবেই চলছিল…
মাঝে মাঝে হাল একটা দাবা খেলার অফার করে, কারণ তাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল মানুষের সাথে দাবা খেলে মানুষের একাকীত্ব কাটানোর জন্য। ফ্লয়েড চ্যালেঞ্জ নেয় না। সে সারা জীবন দাবাকে সময় নষ্টের একটা সুন্দর পথ মনে করে। কোনোদিন শেখেনি কোনো নিয়ম। হাল বিশ্বাস করে না এমন কোনো মানুষ আছে বা থাকতে পারে যে দাবা খেলতে পারে না। হাল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অক্লান্ত।
আবার কথা শুরু-ভাবল ফ্লয়েড, যখন ডিসপ্লে প্যানেলে একটা শব্দ উঠছে, ডক্টর ফ্লয়েড?
কিছু বলবে, হাল?
আপনার জন্য একটা মেসেজ।
যাক, আবার চ্যালেঞ্জ করেনি তাহলে! অবাক হয়ে ভাবল ফ্লয়েড। হালকে মেসেজ দেয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় না সাধারণত। ও শুধুই অ্যালার্ম ঘড়ি আর কাজের কথা মনে করিয়ে দেয়ার যন্ত্র। মাঝে মাঝে, কোনো একজনের ছোটখাট ঠাট্টা বহনের মাধ্যম ছিল ও। প্রত্যেকেই রাতে একটা মেসেজ পায়, হা! ধরে ফেলেছি, ঘুমাচ্ছ! অথবা রুশ ভাষায়, ওগও! জাসতাল তিবয়া ভি ক্রোভাতি!
কেউ কখনো স্বীকার করেনি এ মেসেজ পাঠানোর কথা; সবাই জানে কে পাঠাতে পারে। জবাবে সে হালকে দোষ দিত। আর বলত, চন্দ্র যে কেন স্বীকার করে না এটা! তার কম্পিউটার ঠাট্টা করতে জানে।
মেসেজটা পৃথিবী থেকে না এসে থাকলে এসেছে লিওনভের ডিউটি ক্রুর কাছ থেকে। কমিউনিকেশন সেন্টার থেকে, ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কিই হবে। অথবা কোনো ত্রুর কাছ থেকে, যে এ রাতের বেলায় জেগে আছে। কিন্তু…
ওকে, হাল, কল করছে কে?
কোনো প্রমাণ নেই।
ও! তাহলে কোনো জোক হবে। যাক, সময়টা কাটছে ভালই, ভাল, প্লিজ, মেসেজটা দাও।
মেসেজ নিম্নোক্ত :
এখানে থাকা বিপজ্জনক। তোমাদের অবশ্যই এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে পনের…আবার বলছি, পনের দিনের মধ্যে।
ফ্লয়েড বিরক্তি নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। সে একই সাথে দুঃখও পেয়েছে, আবার হয়েছে আশ্চর্যও। ক্রুদের মধ্যে কারো এ ধরনের ছেলেমানুষী কৌতুক করার মতো মনোভাব আছে আজো। এটা স্কুলবয় সুলভ জোকও নয়! কিন্তু মেসেজটার সাথে খেলতে হবে যাতে ব্যাটাকে ধরা যায়।
একেবারেই অসম্ভব! আগামী ছাব্বিশ দিনের মধ্যে আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলবেই না। আমাদের এখন রওনা দেয়ার মতো জ্বালানি নেই।
নিজে নিজেই একটু হাসল ডক্টর ফ্লয়েড, এ কথাটা তাকে একটু ভাবাবে। সে জবাবের আশায় একটু অপেক্ষা করল।
আমি এ ব্যাপারে সচেতন। যাই হোক, তোমাদের অবশ্যই পনের দিনের মধ্যে এ জায়গা ছাড়তে হবে।
নাহলে, আমার যা মনে হয়, আমরা কুঁকড়ে যাব ছোট সবুজ এলিয়েনদের চোখ দেখে। আমার হালের সাথে খেলাই উচিত, যাতে বদমাশটাকে ধরতে পারি।
উৎস জানতে না পারলে আমি এ ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি নিতে পারি না। কে
এটা রেকর্ড করেছে?
আসলে সে কোনো সত্যিকার ইনফরমেশন চায়নি। প্রিপারেটর হয়ত তার পায়ের ছাপ লুকিয়েছে খুব সাবধানে। শেষের যে কথাটা সে দেখল সেটাই আশা করছিল।
এটা কোনো রেকডিং নয়।
আচ্ছা, তাহলে চলতি মেসেজ! তার মানে হয় এটা স্বয়ং হালের কাজ, নয়তো ফাজলামি করছে কেউ লিওনভ থেকে। কোনো সময়-পার্থক্য নেই। জবাব আসছে সাথে সাথেই। যে মেসেজ পাঠাচ্ছে সে অবশ্যই এখানেই কোথাও আছে।
এখন, আচ্ছা, কে বলছেন?
আমি ডেভিড বোম্যান ছিলাম।
ডক্টর ফ্লয়েড স্ক্রিনের দিকে অনেকক্ষণ অনড় তাকিয়ে রইল। ঠাট্টাটা প্রথম থেকেই বিরক্তিকর। এবার পৌঁছেছে চরমে। সবচে বিশ্রী স্বাদ পাওয়া গেল। এরচে বিশ্রী আর হতে পারে না। নাহ, দেখতেই হচ্ছে লাইনের ওই প্রান্তে কোনো বে আক্কেল!
কোনো প্রমাণ ছাড়া এ পরিচয় গ্রহণ করতে পারছি না।
আমি বুঝতে পারছি। আমাকে বিশ্বাস করানোটা জরুরি। পেছনে তাকাও।
শেষ লাইনটা স্ক্রিনে আসার আগ পর্যন্ত ডক্টর ফ্লয়েড একটা নিজস্ব তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। পুরো ব্যাপারটাই বেখাপ্পা। এবার কী জবাব দেবে তাই ভেবে পাচ্ছে না সে। এত সময় ধরে দাম দেয়াই উচিত হয়নি।
ঠিক এ সময় তার নিতম্বে একটা ব্যথা অনুভব করল। খুবই ধীরে-অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার সুইভেল চেয়ারটা, ব্যাঙ্ক প্যানেল থেকে দূরে ঘোরালো। পেছনে ভেলক্রো-কভার পরা হালকা হাঁটা টের পাওয়া যায়।
ডিসকভারির জিরো গ্রাভিটি অবজার্ভেশন ডেস্ক সব সময়ই ধুলায় ভর্তি, কারণ এয়ার ফিস্ট্রেশন পাম্প আগের মতো করে ঠিক করা যায়নি। এখনো এত দূরেও সূর্যের কিছুটা তেজ থাকে, সেটা আলোকিত করে রাখে ভিতর। কারণ বিরাট বিরাট জানালা। ফলে সব সময়ই ব্রাউনীয় গতি দেখা যায়।
এখন, কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে ঐ ধুলার জায়গায়। কোনো একটা শক্তি যেন কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে ধুলার উপর। একটা কেন্দ্রে জড়ো হচ্ছে সব ময়লা কণা। ভিতর-ফাঁপা বলের চারধারে জড়ো হচ্ছে। প্রায় এক মিটার ব্যাস সেই বলটার। বিরাট সাবান-ফেনার মতো কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ায় বাতাসে; একটা শস্য দানার মতো করে কোন বুদবুদ এভাবে ভাসবে না। তারপর ডিম্বাকার, তারপর এক জোড়া ঠোঁট, যেন কথা বলতে চায়।
ভয় না পেয়ে, এবং বিন্দুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে ফ্লয়েড দেখল যে সেটা এক মানুষের রূপ নিচ্ছে আস্তে ধীরে। সে এমন গড়ন জাদুঘরে দেখেছে, কাঁচ থেকে আলো দিয়ে করা হয়। কিন্তু এই ভুতুড়ে ধুলাবালির স্তর তেমন না। এটা কাজ করছে পুরোপুরি কাদার মতো। অথবা প্রাচীন কোনো আর্টের নিদর্শন যেমন হয়, অনেকটা গুহার চিত্রকর্ম-তেমন। আর চেহারা! অবশ্যই সেটা কমান্ডার ডেভিড বোম্যানের।
ফ্লয়েড শুনতে পায় তার পেছন থেকে একটা ক্ষীণ ফিসফিসানি আসছে ভেসে। হালের সুইচ ভিডিও থেকে অডিওতে চলে গেছে। এবার শোনা যাচ্ছে কণ্ঠস্বর, হ্যালো, ডক্টর ফ্লয়েড, এবার বিশ্বাস হয় আমার কথা?
সেই গড়নের ঠোঁটগুলো নড়েনি। মুখটা রয়ে গেছে ঠিক মুখোশের মতোই। কিন্তু ফ্লয়েড ঠিকই চিনতে পারে সেই কণ্ঠকে। ঠাট্টার আর সব সম্ভাবনা শেষ।
আমার জন্য এ কাজটা খুব কঠিন। হাতে সময়ও খুব কম। আমাকে…অনুমতি দেয়া হয়েছে যাতে তোমাদের সতর্ক করতে পারি। তোমাদের হাতে শুধু পনের দিন।
কিন্তু… কেন? তুমি কী? এতদিন কোথায় ছিলে?
লাখো প্রশ্ন ঘুরছে তার মনে-কিন্তু সেই ভৌতিক শরীর এর মধ্যেই মিলিয়ে যেতে শুরু করে। ফ্লয়েড তার মস্তিষ্কে অবয়বটার ছবি ধরে রাখার চেষ্টা করছে যাতে পরে একে ভুল না মনে হয়। যেন টি এম এ-১ এর সাথে সেই প্রথম দেখার মতো স্বপ্ন না মনে হয়।
কী অবাক ব্যাপার, শত কোটি মানুষের ভীড়ে শুধু সে-ই দু বার অন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করতে পারল! এটুকু বোঝা যায়-এই অস্তিত্ব ডেভিড বোম্যানের চেয়েও বেশি কিছু।
আরো কিছুর অভাব আছে ছবিতে। শুধু চোখটাই যেন জীবন্ত-একেই কি হৃদয়ের জানালা বলে? শরীরের বাকিটুকু শুধুই খোলস, কোনো বিস্তার নেই এর। এর মধ্যে কোনো যৌন অংশ বা বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না। ওহ! বোঝাই যাচ্ছে ডেভিড বোম্যান তার মানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে ছাড়িয়ে চলে গেছে কতদূরে!
বিদায়, ডক্টর ফ্লয়েড, মনে রেখ-পনের দিন। আমাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হবে না। কিন্তু সব ঠিকমতো চললে আরো একটা মেসেজ আসতে পারে।
সেই দৃশ্য মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারার দেশের সাথে যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে গেল তারকা শিশু। তবু, ফ্লয়েড সেই পুরনো মহাকাশ বাণী শুনে না হেসে পারল না, সব ঠিকমতো চললে… কতবার স্পেস মিশন শুরুর আগে সে এ কথা শুনেছে? এ দিয়ে কি বোঝায় যে, এ বুদ্ধিমত্তারা যাই হোক না কেন, ভবিষ্যৎ তাদের কাছেও অনিশ্চিত? তা হয়ে থাকলে অনেক বেশি আশা যোগায়। তারা সর্বশক্তিমান নয়। তার মানে আজো আশা আছে-স্বপ্ন আছে-করার মতো কিছু আছে।
চলে গেছে ভূতটা। শুধু নাচতে থাকা ধূলা চারপাশে। তাদের সেই চারদিকে চলার নীতি বজায় রেখে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ধূলিকণারা।