নিধু সেরাত্রে বাড়ী আসিয়া একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিল৷
কোথায় যেন সে একটা পথ বাহিয়া চলিয়াছে—তাহার সামনে একটা বড় পুকুর—পুকুরে একরাশ পদ্মফুল ফুটিয়া আছে, পুকুরের পাড়ের ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর হইতে হাস্যমুখী মঞ্জু বাহির হইয়া আসিল, অথচ দুজনেই দুজনকে জানে ও চিনতে পারিয়াছে৷ মঞ্জু যেন দুলেবাড়ীর মেয়ে, ব্রাহ্মণের মেয়ে নয়, দুজনে অবাধে অসঙ্কোচে পুকুরপাড়ে বসিয়া জলে ঢিল ফেলিতেছে ও অনর্গল বকিয়া যাইতেছে—মঞ্জু জজের মেয়ে নয়, তাহার সঙ্গে মেশায় কোনো বাধা নাই যেন৷
স্বপ্নের মধ্যেই নিধুর মন আনন্দে ভরিয়া উঠিয়াছে যখন, ঠিক সেই সময় শাঁখের আওয়াজে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল৷ বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে সে বাহিরের রোয়াকে কালীকে দেখিয়া বলিল—কি রে কালী, শাঁখ বাজে কোথায়?
—পুকুরঘাটে৷ আজ যে ওদের ঠাকুর-পুজোর ঘট পাতা হচ্চে—মা গেল—
—কাদের ঘট পাতা হচ্চে?
—জজবাবুদের বাড়ীর দুর্গাপুজোর ঘট আজ পাততে হবে না! এয়োস্ত্রী মেয়ে চাই, মা গিয়েচে অনেকক্ষণ—
—আর কে কে এসেচে?
—কাকীমা তো আছেন, ওপাড়া থেকে হৈম-দিদি এসেচে—
পুকুরঘাট হইতে শাঁখের আওয়াজ যখন আবার পথের দিকে আসিল, তখন নিধু কিসের টানে উঠিয়া জানালা দিয়া চাহিয়া দেখিল আগে আগে মঞ্জুর মা, তাহার পিছনে মঞ্জু, তাহার মা, হৈম, ভুবন গাঙ্গুলির স্ত্রী, আরও পাড়ার দু-চারজন ঝি-বৌ জল লইয়া ফিরিতেছে৷ মঞ্জুর পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, অনাড়ম্বর সাজগোজ—এতগুলি মেয়ের মধ্যে তাহার দিকে চোখ পড়ে আগে, কি চমৎকার গতিভঙ্গি, কি সুন্দর মুখশ্রী, সারাদেহের কি অনবদ্য লাবণ্য—
নিধুর মনটা হঠাৎ বড় খারাপ হইয়া গেল৷
নিজেকে সে বুঝাইবার চেষ্টা করিল৷
কেন এমন হয়? কোনদিন কি সে ভাবিয়াছিল, মুন্সেফবাবু তাহার সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিবেন? তাহার মতো জুনিয়ার মোক্তারের সঙ্গে? গ্রামের মধ্যে যাহারা সব চেয়ে দরিদ্র, যাহার বাবা সর্বদা মুন্সেফবাবুদের বৈঠকখানায় বসিয়া তোষামোদ বর্ষণ করিয়া বড়লোকের মন রাখিতে চেষ্টা করেন—যাহার মা জজগিন্নি বলিতে ভয়ে সঙ্কোচে এতটুকু হইয়া যায়—মুখ তুলিয়া সমানে-সমানে কথা বলিতে ভরসা পায় না—এই বাড়ী, এই ঘর চোখে দেখিয়াও উহারা সে বাড়ীর ছেলের সঙ্গে অমন সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ের বিবাহ দিবে—এ কি কখনো সে ভাবিয়াছিল?
যদি এ আশা সে না করিয়া থাকে, তবে আজ তাহার দুঃখ পাইবার কি কারণ আছে?
মঞ্জু দু’দিনের জন্যে এ গ্রামে আসিয়াছে—বড়লোক পিতার খেয়াল এবার গ্রামে তিনি পূজা করিবেন, খেয়াল মিটিয়া গেলে হয়তো আর দশ বৎসর তিনি এদিকে মাড়াইবেন না—ততদিনে মঞ্জু কোথায়! তাহার বিবাহ হইয়া ছেলেপুলে বড় হইয়া স্কুলে পড়িবে৷ মিথ্যা আশার কুহক৷
সে উঠিয়া হাতমুখ ধুইয়া কালীকে বলিল—কালী, একটু তেল দে, নেয়ে আসি পুকুর থেকে—
—এত সকালে দাদা?
—তা হোক—দে তুই—
এমন সময় নিধুর মা বাড়ী ঢুকিয়া বলিলেন—নিধু, ওদের বাড়ী যা—দু’জন ব্রাহ্মণকে জল খাইয়ে দিতে হয় দুর্গাপুজোর পিঁড়ি পাতবার পরে৷ জজগিন্নি তোকে এখুনি যেতে বলে দিলেন৷
নিধু স্নান সারিয়া আসিয়া ও-বাড়ী গেল৷ মঞ্জুও ইতিমধ্যে স্নান সারিয়া খাবার সাজাইয়া বসিয়া আছে—একজন ব্রাহ্মণ সে, অপরজন ভুবন গাঙ্গুলি৷
ভুবন গাঙ্গুলি বলিলেন—এস বাবা, তোমার জন্যে বসে আছি—এঁরা ব্রাহ্মণকে না খাইয়ে কেউ জল খাবেন না কিনা৷
—কাকা বেশ ভালো আছেন? হৈম এসেচে দেখলাম, না?
—হৈম তো এ বাড়ীতেই আছে, বোধ হয়—
মঞ্জু বলিল—হৈমদি তো রান্নাঘরে, ডাকব নাকি? কাকাবাবুকে বলছিলাম হৈমদি আমাদের থিয়েটারে পার্ট করবে—
ভুবন গাঙ্গুলি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—করবে না কেন? আমি তো বলেচি৷ লালবিহারীদাদার বাড়ীতে মেয়েদের সঙ্গে থিয়েটার করবে, এ তো ওর ভাগ্যি! আমার আপত্তি নেই—ও হৈম, হৈম—
হৈম আসিয়া দোরের কাছে দাঁড়াইল৷ কুড়ি-একুশ বছর বয়েস, রঙ তত ফরসা না হইলেও দেহের গড়ন ও মুখশ্রী ভালো৷ সে যে বেশ সচ্ছল ঘরে পড়িয়াছে তাহার সিল্কের শাড়ি, দুহাতে মোটা সোনার বালা ও বাহুতে আড়াই পেঁচের তাগা দেখিলে তাহা বোঝা যায়—এ ছাড়া আছে কানে ইয়ারিং, গলায় মোটা শিকলি হার৷
নিধু বলিল—চিনতে পার হৈম?
হৈম হাসিয়া বলিল—কেন পারব না? এ গাঁয়ের মেয়ে নই?
—কবে এলে?
—মাসখানেক হল এসেচি৷ তুমি ভালো আছ নিধুদা?
—হ্যাঁ, এক রকম মন্দ নয়৷
মঞ্জু বলিল—আমি হৈমদিকে বলেচি আমাদের সঙ্গে থিয়েটার করতে৷
হৈম হাসিয়া বলিল—তা করব না কেন! বাবা তো বলেচেনই৷ নিধুদা, বই ঠিক করেচ?
—সে করবে মঞ্জু৷
মঞ্জু তাড়াতাড়ি বলিল—আমি পারব না নিধুদা, আপনি ঠিক করে দিন না৷ রবি ঠাকুরের ‘ফাল্গুনী’র কথা বড়দা বলেছিলেন—
হৈম দেখা গেল ‘ফাল্গুনী’র নামও শোনে নাই, সে বলিল—সে কি ভালো বই?
— সে খুব ভালো বই৷ এবার কলকাতায় হৈ-হৈ করে প্লে হয়ে গিয়েচে৷
—তা তোমরা যেমন বল৷ নিধুদা আমাদের শিখিয়ে দেবেন—
—আমি আর ক’দিন আছি? কাল তো সকালেই—
—দুদিন কেন ছুটি নাও না?
মঞ্জুও সঙ্গে-সঙ্গে বলিয়া উঠিল—তাই কেন করুন না নিধুদা?
—সে কি করে হয়? তোমরা বোঝ না, এ কি কারো চাকুরি যে ছুটি নিতে হবে? না গেলে আমারই লোকসান—
হৈম বলিল—তাহলে আজ ওবেলা বইটা দেখিয়ে একটু পড়ে দিয়ে যাও—
—মঞ্জু তো রয়েচে৷ ও সব পারে৷ ওর ‘কচ ও দেবযানী’ সেদিন শোনো নি হৈম, সে একটা শোনবার জিনিস!
মঞ্জু সলজ্জ সুরে বলিল—ছাই! নিধুদার যেমন কথা! না ভাই হৈমদি—
ভুবন গাঙ্গুলি জলযোগান্তে উঠিয়া বিদায় লইলেন৷ হৈম বলিল—বাবা, তুমি যাও—আমি এর পরে যাব৷ নিধুদা না হয় দিয়ে আসবে এখন৷
মঞ্জু বলিল—হৈমদি, আমার ভাইয়েরা আর নিধুদা কিন্তু পার্ট নেবে—
হৈম চিন্তিত মুখে বলিল—তাই তো ভাই, এ শুনলে আমায় কি বাড়ীতে প্লে করতে দেবে ভাই?
—কেন দেবে না?
—পাড়াগাঁয়ের গতিক তো জানো না—কে কি বলবে সেই ভয়ে বাড়ীর লোক যদি আপত্তি করে, তাই ভাবচি!
নিধু বলিল—তাতে কি? আমি না হয় না-ই করলাম—
মঞ্জু বলিল—তবে হবে কি করে? পুরুষমানুষের পার্ট মেয়েরা করতে গেলে অত মেয়ে কোথায় পাব এখানে?
—কেন, তোমাদের বাড়ীতে তো অনেকে আসবেন পুজোর সময়—
—তাদের সকলকে দিয়ে এ কাজ হবে না—দু-একজনকে দিয়ে হতে পারে৷ তাছাড়া রিহার্স্যাল দেওয়া না থাকলে তারা প্লে করবে কি করে? এ তো ছেলেখেলা নয়? তুমি ভাই হৈমদি, বাড়ীতে বলে এস ওবেলা—জিগগেস করে দেখ—
হৈম বলিল—এতে আমার ওপর যেন রাগ কোরো না নিধুদা, হয়তো ভাববে—
—আমি কিছু ভাবব না হৈম—মঞ্জু শহরে থাকে, ও পাড়াগাঁয়ের অনেক খবরই রাখে না—ওকে বরং বল—
মঞ্জু বলিল—চা হয়ে গিয়েচে—বসো হৈমদি—নিয়ে আসি—
মঞ্জুর কথা শেষ হইতেই মঞ্জুর বিধবা খুড়ীমা ট্রে-র উপর চায়ের পেয়ালা সাজাইয়া লইয়া ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন—এই নে চা, ওদের দে মঞ্জু—
—তিন পেয়ালা কেন কাকীমা, নিধুদা তো চা খায় না—
—নিধু, তুমি চা খাও না? আমি তা জানিনে বাবা—গরম দুধ খাবে? এখনি দুধ দিয়ে গেল—
—না কাকীমা—দুধ চুমুক দিয়ে খাব, ছেলেমানুষ নাকি? আমার দরকার নেই—ব্যস্ত হবেন না মিছিমিছি—
নৃপেন আসিয়া বলিল—বাবা একবার নিধুদাকে বাইরে ডাকচেন দিদি—
বাইরের বৈঠকখানায় লালবিহারীবাবু ও ভুবন গাঙ্গুলি বসিয়া৷ লালবিহারীবাবু প্রকাণ্ড গড়্গড়াতে তামাক টানিয়া বৈঠকখানা প্রায় অন্ধকার করিয়া ফেলিয়াছেন৷ তিনি সনাতন-পন্থী লোক—বাড়ীতে ন-হাত কাপড় পরিয়া থাকেন—গায়ে সব সময় জামা বা ফতুয়া থাকেও না৷ কোনো প্রকার বড়লোকী চালচলন বা সাহেবিয়ানা এ গ্রামের লোক দেখে নাই তাঁহার৷ সাধারণ লোকের সঙ্গে গ্রামের পাঁচজনের মতোই মেশেন৷
নিধু বলিল—আমায় ডাকচেন কাকাবাবু?
—হ্যাঁ হে, সুনীল কি সামনের শনিবারে আসবে না?
—আজ্ঞে না—চিঠি লিখেচেন তো সেই বলেই বোধহয়—পরের শনিবারে আসবার চেষ্টা করবেন—
—তুমি কি কাল যাচ্চ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ—
—তাহলে একবার বিশেষ করে অনুরোধ কোরো ওকে এখানে আসবার জন্যে—
—নিশ্চয়ই বলব—
—তুমি সুনীলের সঙ্গে মেশো তো?
—আজ্ঞে মিশি—তবে আমরা হলাম জুনিয়ার মোক্তার—আর তিনি হলেন আমাদের হাকিম—বুঝতেই তো পারেন—
—একখানা চিঠি দেব, নিয়ে গিয়ে ওর হাতে দিও—
—আজ্ঞে নিশ্চয়ই দেব—
নিধু পুনরায় বাড়ীর মধ্যে ফিরিয়া দেখিল হৈম ওরফে হেমপ্রভা দালানে বসিয়া নাই৷ মঞ্জু একা বসিয়া অনেকগুলো শিশিবোতল জড়ো করিয়া কি করিতেছে৷ মুখ তুলিয়া বলিল—আসুন নিধুদা, হৈমদি ওপরে গিয়েচে কাকীমার সঙ্গে কথা বলতে—বসুন—
—ওসব কি?
—মা’র কাণ্ড! আসবার সময় আচার এনেছিলেন, জ্যাম, জেলি—বর্ষায় সব নষ্ট হয়ে গিয়েচে—দু-একটা যা ভালো আছে, দেখে দেখে তুলচি—বাকি ফেলে দিতে হবে—খাবেন নিধুদা? এই একরকম জিনিস আছে—মাদ্রাজী জিনিস—একে বলে ম্যাঙ্গো পার্ল—চিনির মতো দেখতে৷ একটু খেয়ে দেখুন, ল্যাঙড়া আমের গন্ধ—আম খাচ্চি মনে হবে—
নিধু একটু চিনির মতো গুঁড়া হাতে লইয়া মুখে ফেলিয়া বলিল—বাঃ, সত্যিই তো আমের গন্ধ! আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক, এসব কোথায় পাব বল!
মঞ্জুর সুর হঠাৎ এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় মাখানো, এমন স্নেহপূর্ণ মনে হইল নিধুর—যে তাহার বুকের ভিতরটা যেন কেমন করিয়া উঠিল৷ নিজের অজ্ঞাতসারেই তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল যে কথা—তাহার জন্য সে সারাদিন অনুতাপ করিয়াছিল মনে মনে৷ দোষও নাই—নিধু তরুণ যুবক, এই তাহার জীবনে অনাত্মীয়া প্রথম নারী, যে তাহাকে স্নেহের ও প্রীতির চোখে দেখিয়াছে৷ জীবনের এক সম্পূর্ণ নূতন অভিজ্ঞতা তাহার৷ নিধু বলিয়া ফেলিল—আর আমার কষ্ট হয় না মঞ্জু? তোমার জন্যে আমার মন কাঁদে না বুঝি?
মঞ্জু পাথরের মূর্তির মতো অবাক ও নিশ্চেষ্ট ভাবে নিধুর দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল৷ নিধু আবার বলিল—আমি এখন দু-শনিবার আসব না—
—কেন নিধুদা?
—সামনের শনিবারে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসবেন—তার পরের শনিবারে তোমাদের এখানে সুনীলবাবু আসবেন—এইমাত্র কাকাবাবু ডেকে বললেন—
—কি বললেন?
—সেই শনিবারে আসবার জন্যে বললেন—আমি আর কক্ষনো আসব না মঞ্জু৷ আমার বুঝি মন বলে জিনিস নেই, না? আমি আসতে পারব না—তুমি কিছু মনে কোরো না৷
মঞ্জু অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিধুর মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া অন্যদিকে মুখ ফিরাইল৷ তাহার পদ্মের পাপড়ির মতো ডাগর চোখ দুটি বাহিয়া জল গড়াইয়া পড়িল৷ নিধুর কথার সে কোনো জবাব দিল না—হঠাৎ যেন সব কাজে সে উৎসাহ হারাইয়া ফেলিল—জ্যাম-জেলির শিশি-বোতল অগোছালো ভাবে ইতস্তত পড়িয়াই রহিল—তাহার মধ্যে ভরসা হারা ক্ষুদ্র বালিকার মতো মঞ্জু বসিয়া চোখের জল ফেলিতেছে—ছবিটা চিরকাল নিধুর মনে গাঁথিয়া গিয়াছিল৷
নিধু বলিল—ওঠ মঞ্জু, আমার ভুল হয়ে গিয়েচে—আর কিছু বলব না৷
মঞ্জু জলভরা চোখে তাহার দিকে চাহিয়া বলিল—আসবেন তো ওবেলা—এখানে কিন্তু খাবেন৷
—খাওয়ানোর লোভে তোমার নিধুদা ভুলবে ভেবেচ তুমি? অমন লোক পাও নি—
—আমি কি তাই ভাবচি? গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধান আপনি—
—আমি এখন আসি, ওবেলা আবার আসব—
—না বসুন, এখুনি গিয়ে কি করবেন? আপনাদের বন্ধ হবে কবে?
—এখনো চোদ্দ-দিন বাকি, মহালয়ার দিন থেকে বন্ধ হবে শুনচি—
—কোর্ট বন্ধ হলে এখানে চলে আসবেন তো?
—ঐ যে বললাম, নয় তো আর যাব কোথায়! বড়লোক নই যে হিল্লি-দিল্লি মক্কা যাব! এই বাঁশবনেই কাটল চিরকাল, এই বাঁশবনেই আসতে হবে৷
—এককালে বড়লোক হবেন তো, তখন কোথায় যাবেন?
—আমি হব বড়লোক! তবেই হয়েচে! তুমি হাসালে দেখচি মঞ্জু!
মঞ্জু গম্ভীর ভাবে বলিল—কে বলেচে আপনি বড়লোক হবেন না? আমি বলচি দেখবেন, আপনি খু—উ—ব বড়লোক হবেন৷
—তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক মঞ্জু—
—তা যদি হয়, আজকের দিনের কথা আপনার মনে থাকবে? দাঁড়ান, আজ কি তারিখ, ক্যালেন্ডারটা দেখে আসি ওঘর থেকে—
কথা শেষ করিয়াই মঞ্জু লঘুগতি হরিণীর মতো ত্রস্তভঙ্গিতে ছুটিয়া গেল পাশের ঘরে—এবং তখনি হাসিমুখে ফিরিয়া আসিয়া বলিল—আপনার ডায়েরী আছে? লিখে রাখবেন গিয়ে, সতেরোই সেপ্টেম্বর—আমি বলেছিলুম আপনি বড়লোক হবেন—আমি, মঞ্জুরী দেবী—
নিধু হাসিতে হাসিতে বলিল—বয়েস ষোলো, সাকিন কুড়ুলগাছি মহকুমা রামনগর—থানা ওই—পিতার নাম শ্রীযুক্ত বাবু লালবিহারী—
মঞ্জু খিল-খিল করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল—থাক, থাক—ওকি কাণ্ড! বাবারে, আপনি এতও জানেন! আমি ভাবি নিধুদা বড় ভালোমানুষ, নিধুদা আমাদের মোটে কথা বলতে জানে না—নিধুদা দেখচি কথার ঝুড়ি!
—কথার ঝুড়ি না হলে কি মোক্তার হয়, মঞ্জু? তবে আর ব্যবসাতে উন্নতি করব কি করে, বড়লোকই বা হব কি করে বল?
—আচ্ছা যদি বড়লোক হন, আমার কথা মনে থাকবে?
হঠাৎ তাহার মুখ হইতে তরল কৌতুকের হাসি অপসৃত হইল—চোখের কোণে বেদনার ছায়াপাতে মুখখানি অপরূপ ব্যথাভরা লাবণ্যে ও শ্রীতে মণ্ডিত হইয়া উঠিল—এক মুহূর্তে যেন মনে হইল এ মঞ্জু ষোড়শী বালিকা নয়, বহুযুগের প্রৌঢ়া জ্ঞানময়ী, বহু অভিজ্ঞতা ও বহু ক্ষয়-ক্ষতি দ্বারা লব্ধশক্তি পুরাতন নারী—বালিকা হইয়া আজ আসিয়াছে যে, সে ইহার নিতান্তই লীলা—আরও কতবার এইভাবে আসিয়াছে৷
নিধু মুগ্ধ হইয়া গেল, তাহার বুকের মধ্যে যেন কেমন করিয়া উঠিল৷ মঞ্জুকে সে আর খোঁচা দিয়া কথা বলিবে না, বালিকার মনে কেন সে মিছামিছি কষ্ট দিতে গিয়াছিল? মঞ্জু চপলা বটে, কিন্তু সে গভীর, সে ধীর বুদ্ধিমতী, অতলস্পর্শ তাহার মনের রহস্য৷ এতদিন সে মঞ্জুকে চিনিতে পারে নাই৷ নিধু কোনো কথা বলিতে পারিল না, কথার সে উত্তর দিতে পারিল না৷ জীবনে এমন সময় আসে, এমন মুহূর্তের সন্ধান মেলে—যখন কথা মুখ দিয়া বাহির হইলেই মনে হয় এই অপরূপ মুহূর্তটির জাদু কাটিয়া যাইবে, ইহার পবিত্রতায় ব্যাঘাত ঘটিবে৷ তাহার বুকের মধ্যে কিসের যেন ঢেউ উপরের দিকে ধাক্কা দিতেছিল—সেটাকে আর একটু প্রশ্রয় দিলেই সেটা কান্নারূপে চোখ দিয়া গড়াইয়া সব ভাসাইয়া ছুটিবে৷
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ—নিস্তব্ধতা যে একটা মনোরম মায়া সৃষ্টি করিয়াছে এই ঘরের মধ্যে—তা যত কম সময়ের জন্যেই হৌক না কেন, কেহ চাহে না যে আগে কথা বলিবার রূঢ় আঘাতে তাহা ভাঙিয়া দেয়৷
এমন সময় হঠাৎ ঘরে ঢুকিলেন নিধুর মা৷
—হ্যাঁরে ও নিধু—এখানে বসে? মঞ্জু মা কি করচ শিশি-বোতল নিয়ে? ওগুলো কি মা?
—আসুন, আসুন জ্যাঠাইমা—সকালে যে!
—তোমাদের পুজোর পাটা-পাতা দেখতে এলাম—তা এত সকালে পাটা পাতলে যে তোমরা! এখনো তো পুজোর সতেরো দিন বাকি—
—তা তো জানিনে জ্যাঠাইমা, পুরুতমশাই কাল নাকি কাকাকে বলে গিয়েচেন—
—দিদি কোথায় দেখচিনে যে?
—মা? ওপরের ঘরে পুজো করচেন বোধ হয়—ডাকব?
—না, না, মা পুজো করচেন, ডাকতে হবে কেন—থাক৷ আমি এমনি দেখতে এলাম—
—জ্যাঠাইমা, একটু চা খাবেন না?
—না মা, আমি এখনো নাই নি ধুই নি—বেলা হয়ে গেল৷ এইবার নাইতে যাব গিয়ে৷ নিধু থাকবি নাকি না আসবি?
মঞ্জু হাসিয়া বলিল—জ্যাঠাইমা, নিধুদা যেন আপনার ছোট্ট খোকাটি, ওকে কোথাও ছেড়ে দিয়ে ঠাণ্ডা থাকতে পারেন না, বাইরে কোথাও দেখলে সঙ্গে করে বাড়ী নিয়ে যেতে হবে!
নিধু সলজ্জমুখে বলিল—তুমি যাও না মা, আমি যাব এখন৷
নিধুর মা কিন্তু তখনি চলিয়া গেলেন না, তিনি আরও আগাইয়া আসিয়া বলিলেন—ওগুলো কিসের শিশি-বোতল, মা? খালি আছে?
—এগুলো জ্যাম-জেলি—ইয়ে—আচারের-মোরোব্বার শিশি—জ্যাঠাইমা, বর্ষায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই বেছে রাখছিলাম—
—আমি ভাবলাম বুঝি খালি আছে!
কি হবে খালি শিশি? দরকার জ্যাঠাইমা?
—এই জিনিসটা পত্তরটা রাখতে—এসব জায়গায় তো পাওয়া যায় না—বেশ শিশিগুলো—
নিধু সঙ্কোচে এতটুকু হইয়া গেল৷ সে বুঝিল রঙচঙওয়ালা শিশিগুলি দেখিয়া মা’র লোভ হইয়াছে—মেয়েমানুষের কাণ্ড! তা দরকার থাকে, এখানে চাহিবার দরকার কি? মাকে লইয়া আর পারা যায় না! ঘটে যদি কিছু বুদ্ধি থাকে এদের!
মঞ্জু শশব্যস্ত হইয়া বলিল—হ্যাঁ, হ্যাঁ, জ্যাঠাইমা—শিশির দরকার? আমি ভালো শিশি এনে দিচ্চি৷ বিলিতি জেলির খালি বোতল আছে মা’র ঘরে দোতলায়৷ আমি আসচি এখুনি—বসুন জ্যাঠাইমা৷
মঞ্জু ঘর হইতে ত্রস্তপদে বাহির হইয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই দুটি সুদৃশ্য লেবেল মারা খালি বোতল আনিয়া নিধুর মা’র হাতে দিয়া বলিল—এতে হবে জ্যাঠাইমা?
নিধুর মা বোতল দু’টি হাতে পাইয়া যেন স্বর্গ পাইলেন, এমন ভাব দেখাইয়া বলিলেন—খুব হবে মা, খুব হবে৷ আশীর্বাদ করি বেঁচে-বর্তে থাক—রাজরানী হও মা—আমি আসি তাহলে এবেলা—
নিধুও মায়ের পিছু-পিছু বাড়ী আসিল৷ বাড়ীতে পা দিয়াই সে একেবারে অগ্নিমূর্তি হইয়া মাকে বলিল—আচ্ছা মা, তোমার কি একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই? কি বলে দুটো খালি বোতল ভিক্ষে করতে গেলে ও-বাড়ী থেকে? তোমার এই মাগুনতুড়ে স্বভাবের জন্যে আমার মাথা হেঁট হয়, তোমার সে জ্ঞান আছে? ছিঃ ছিঃ—এতটুকু কি কাণ্ডজ্ঞান ভগবান দেন নি?
নিধুর মা বুঝিতে না পারিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—ওমা, তা তুই আবার বকিস কেন? কি করেচি আমি?
—তোমার মুণ্ডু করেচ, নেও—এখন শিশিবোতল সাজিয়ে রেখে ঘরে ধুনো দেও! ওতে তোমার কি মালমশলা, অপরূপ সম্পত্তি থাকবে শুনি?
—তুই তার কিছু বুঝবি? লবঙ্গ, ধনের চাল, হল গিয়ে গোটার গুঁড়ো—কত কি রাখা যায়! কেমন চমৎকার বোতল দুটো! এখানে কোথায় পাবি ওরকম?
নিধু আর কিছু বলিল না৷ মাকে বুঝাইয়া পারা যাইবে না—নিতান্ত সরলা, নিধুর লজ্জা যে কোথায়—তাহা তিনি বুঝিবেন না৷
জগোঠাকরুণ পুকুরঘাটে নিধুর মাকে বলিলেন—বলি বড়বাড়ীর পুজোর কতদূর, ও নিধুর মা?
—পিরতিমে গড়ানো হচ্ছে—আজ পাটা পাতা হল ওবেলা—
—পাটা এখন আবার কে পাতে? বিধেন দিলে কে গা?
—কি জানি—তবে মঞ্জু বলছিল ওদের ভটচায্যি দিয়েচেন৷ আমিও ওকথা বলেছিলাম ওবেলা৷
—হ্যাঁগো নিধুর মা, একটা কথা শুনলাম, তা কি সত্যি? নাকি মেয়ে-পুরুষে মিলে থিয়েটার করবে? ওদের বাড়ীর মেয়েরা আর ওই ভুবন গাঙ্গুলির মেয়ে হৈম—তোমাদের নিধু, আরও নাকি কে কে?
—তা তো দিদি বলতে পারলাম না—আমি কিছু শুনি নি—
বাস্তবিকই নিধুর মা একথার কিছুই জানিতেন না৷
জগোঠাকরুণ বলিতে লাগিলেন—আর কি সেদিন আছে গাঁয়ের! ছোটঠাকুরের প্রতাপে এক সময়ে এ গাঁয়ে যা খুশি করে পার পাবার উপায় ছিল না৷ তা সবাই গেল মরে হেজে—এখন টাকা যার, সমাজ তার৷ নইলে এসব খিরিস্টানি কাণ্ড কি হতে পারত কখনো এখানে! আমি ভুবনকে আচ্ছা করে শুনিয়ে দিইচি ওবেলা৷ বললাম—মেয়েকে যে থিয়েটার করতে দিচ্চ, ওরা না হয় জজ-মেজেস্টার লোক, টাকার জোরে তরে যাবে—তোমার মেয়ের কুচ্ছো রটলে যদি শ্বশুরবাড়ী থেকে না নেয়?
—ভুবন ঠাকুরপোকে বললেন?
—কেন বলব না শুনি? জগোঠাকরুণ কারো এক চালে বাসও করে না, কাউকে কুকুরের মতো খোশামোদও করে বেড়ায় না—কারো কাছে কোনো পিত্যেশ রাখি নে কোনোদিন—
শেষের কথাটা নিধুর মাকে লক্ষ্য করিয়াই বোধ হয় বলা৷ কিন্তু নিধুর মা তাহা বুঝিতে পারিলেন না—খুব সূক্ষ্ম উক্তি বা একটু বাঁকা ধরনের কথাবার্তা হইলে নিধুর মা তাহা আর বুঝিতে পারেন না৷
কথাটা তিনি নিধুকে আসিয়া বলিলেন৷ নিধু বৈকালের দিকে মঞ্জুদের বাড়ী গেল মঞ্জুর বাবাকে দেখিতে—কারণ তাঁহার রক্তের চাপ হঠাৎ বৃদ্ধি হওয়ায় দুপুরের পর হইতেই তিনি অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছেন৷ সেখানে গিয়া দেখিল মঞ্জু বাবার ঘরের বাহিরে দোতলার বারান্দাতে বসিয়া সেলাই করিতেছে৷ নিধুকে দেখিয়া বলিল—আস্তে আস্তে নিধুদা, বাবা এবার একটু ঘুমিয়েচেন৷ চলুন আমরা নিচে যাই বরং—
—একবার ওঁকে দেখে যাব না?
—এখন থাক৷ ঘুম যদি সন্দের আগে ভাঙে, তবে দেখতে আসবেন এখন৷ সিঁড়িতে নামিবার সময় নিধু মায়ের কাছে যাহা শুনিয়াছিল, সব বলিল৷ মঞ্জু শুনিয়া বিশেষ আশ্চর্য হইল না, বলিল—হৈমদি নিজেই একথা তো ওবেলা বলে গেল! আমরা যদি পুরুষ না নিই— তবুও তাঁরা বাড়ীতে করতে দেবেন না?
—তাও বলতে পারি নে—আপত্তি যদি করে তাতেও করতে পারে—
বলিতে বলিতে হৈমর গলা শোনা গেল, বাহির হইতে ডাকিতেছে—ও মঞ্জু, ও নৃপেন—
মঞ্জু ছুটিয়া আগাইয়া লইয়া আসিতে গেল৷ এবেলাও হৈম খুব সাজগোজ করিয়া মুখে ঘন করিয়া পাউডার মাখিয়া, চুলে ফ্যান্সি খোঁপা বাঁধিয়া ও ফুল গুঁজিয়া আসিয়াছে৷ বাড়ী ঢুকিয়াই সে বলিল—নিধুদা আসে নি?
—এসে বসে আছেন৷ এস দালানে হৈমদি—
—আজ অনেকক্ষণ পর্যন্ত রিহার্স্যাল দিতে হবে কিন্তু—
—শোনেন নি হৈমদি, বাবার বড় অসুখ যে—
হৈম বিস্ময়ের সুরে বলিল—জ্যাঠামশায়ের অসুখ? কি অসুখ?
—ব্লাডপ্রেসার বেড়েচে—ওই নিয়েই তো ভুগচেন৷ তাই আজ আর রিহার্স্যাল হবে না৷
—না, তা আর কি করে হবে! এখন কেমন আছেন উনি?
—এখন একটু ভালো৷ এসব কলকাতার রোগ হৈমদি, পাড়াগাঁয়ে এসব নেই বলে মনে হয় আমার৷
হৈম একটু পরেই বলিল—তাহলে আজ যাই মঞ্জু—আমি—
হঠাৎ মঞ্জুর মনে পড়িয়া গেল কথাটা৷ বলিল—হৈমদি, তোমার বাবা কিছু বলেচেন নাকি তোমায় এ বিষয়ে?
—কি বিষয়ে?
—এই থিয়েটার করা নিয়ে!
—তা তিনি বলতে পারেন না, আমার শ্বশুরবাড়ী থেকে আপত্তি না করলেই হল৷ আমি ওসব মানিনে—
—সে কথা নয় হৈমদি—গাঁয়ের কে এক বুড়ি (নিধু নাম বলিয়া দিল)—হ্যাঁ, সেই জগোঠাকরুণ আপনার বাবাকে কি সব বলেচেন৷ পুরুষের সঙ্গে মিশে থিয়েটার করলে বা এমনিই থিয়েটার করলে তোমার মেয়ের বদনাম রটবে৷
হৈম তাচ্ছিল্যের সুরে বলিল—ওঃ, এই কথা! ও আমি গ্রাহ্যি করি নে৷ আমি যা খুশি করব—তাতে বাবা পর্যন্ত কি বললে শুনচি নে তো জগোঠাকরুণ! আচ্ছা এখন তাহলে আসি—
—বা রে, চা খেয়ে যান হৈমদি—
—না ভাই, আর একদিন এসে খাব৷ নিধুদা, আমায় একটু এগিয়ে দাও না?
নিধু মঞ্জুকে বলিল—বস মঞ্জু, আমি ওই তেঁতুলতলার মোড় পর্যন্ত হৈমকে এগিয়ে দিয়ে আসচি—
পথে পড়িয়া হৈম বলিল—তুমি থিয়েটার করবে তো নিধুদা?
—আমার আর করা হয় হৈম! গাঁয়ের মধ্যে যদি কথা ওঠে এ নিয়ে—
—ওঃ, ভারি কথা! তুমি না করলে আমিও করব না নিধুদা, তুমি আছ তাই করচি৷
নিধু আশ্চর্য হইয়া হৈমর মুখের দিকে চাহিল৷ হৈম বলে কি!
হৈম পুনরায় বলিল—আমার কথা মনে হয় নিধুদা? বল না নিধুদা—
নিধু একটু বিব্রত হইয়া পড়িল৷ হৈমর এ সব কথায় সে কি উত্তর দিবে?
হৈম একটু গায়ে-পড়া-ধরনের মেয়ে তাহা সে পূর্বেই জানিত৷ ভাবিয়াছিল, আজকাল বিবাহ হইয়া ও বয়স হইয়া বোধ হয় সারিয়া গিয়াছে৷ এখন দেখা যাইতেছে—তা নয়৷
পরে মুখে বলিল—হ্যাঁ, তা মনে হ’ত না কি আর! গাঁয়ের মেয়ে—ছোটবেলা থেকে দেখে আসচি—
—আজ সন্দেবেলা আমাদের বাড়ী এস না কেন নিধুদা—ওখানে চা খাবে—বেশ গল্প করা যাবে এখন—
—আমি চা তো খাইনে হৈম—তা ছাড়া সন্দেবেলা মঞ্জুদের বাড়ী থিয়েটার সম্বন্ধে হেস্তনেস্ত একটা করে ফেলতে হবে, যাই কি করে?
—কাল আসবে? না—ও কাল তো তুমি চলেই যাবে! কাল দিনটা নাই বা গেলে নিধুদা?
কি বিপদ! ইহার এত জোর আসিল কোথা হইতে? নিধু বলিল—না গেলে চলে হৈম? কত দরকারী কেস সব হাতে রয়েচে—যেতেই হবে৷
হৈম অভিমানের সুরে বলিল—আমার কথা রাখবে কেন? মঞ্জুর কথা হ’ত তো রাখতে—
—আচ্ছা, সামনের শনিবার এসে তোমাদের ওখানে যাব হৈম৷
হৈম হাসিয়া নিধুর দিকে চাহিয়া বলিল—ঠিক যাবে তো? তাহলে কথা রইল কিন্তু৷ এ গাঁয়ে এসে আমার মন মোটে টেঁকে না নিধুদা—মোটে মিশবার মানুষ নেই—আমি চিরকাল গোয়াড়ী স্কুলে থেকে পড়েচি—জানো তো? আমি গাঁয়ে এসে যেন হাঁপিয়ে উঠি—একটু আমোদ নেই, আহ্লাদ নেই—অমন একটা লোক নেই, যার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলে সুখ হয়৷ তবুও মঞ্জুরা এসেছিল, ওরা শহরের মেয়ে, আমোদ করতে জানে৷ ও-ই বলচে থিয়েটার করবে—আমার ওতে ভারি উৎসাহ৷ সময়টা তো বেশ কাটবে৷ তাই আমি—তুমি থাক—আমার বেশ ভালো লাগে—হৈম নিধুর দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টিতে চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল৷ বলিল—সত্যি কিন্তু আসবে সামনের শনিবারে নিধুদা, আমার মাথার দিব্যি—সেদিন কিন্তু আমাদের বাড়ীতে চা খাবে—
—চা আমি খাই নে হৈম—
—চা না খাও, খাবার খেও৷ আর আমরা গল্প করব, ঠিক রইল কিন্তু—
—থিয়েটার তা হ’লে তুমি করবে? কিন্তু জগোঠাকরুণ কি বলেচে আজ মা’র কাছে, শুনেচ তো?
—বলুক গে৷ আমি ওসব মানি নে৷ আমার শ্বশুরবাড়ী তেমন নয়—কেউ কিছু বলবে না৷
—সে তুমি বোঝ, আমার কানে কথাটা উঠেচে যখন তোমাদের কাছে বলা আমার উচিত৷ মঞ্জুদের কেউ কোনো দোষ ধরবে না, কেননা ওরা হ’ল বড়লোক—ওরা এখানে থাকবেও না৷ ওদের কে কি করবে?
—আমারও কেউ কিছু করতে পারবে না৷ জীবনে দুদিন আমোদ করব না, আহ্লাদ করব না—মুখ বুজিয়ে বসে থাকব এই অজ পাড়াগাঁয়ের মধ্যে, সে আমার দ্বারা হবে না৷
—আচ্ছা, তুমি এস হৈম—
—কোথায় যাবে এখন? মঞ্জুদের বাড়ী?
—না, বেলা হয়েচে—এখন বাড়ী যাব৷
—ওবেলা যাবে ওখানে? তাহলে আমিও আসি!
নিধু মনে মনে বিরক্ত হইলেও বলিল—তার এখন কিছু ঠিক নেই—আসতেও পারি৷ এখন বলতে পারি নে—
বৈকালের দিকে নিধু ভাবিল, সে মঞ্জুদের বাড়ী যাইবে কিনা৷ মন সেখানে যাইবার জন্যই উন্মুখ হইয়া আছে যেন৷ অথচ বেশ বোঝা যাইতেছে সেখানে আর তাহার যাওয়া উচিত নয়৷ বেলা পড়িয়া আসিল—তবুও নিধু ইতস্তত করিতে লাগিল—এবং তারপরই সে হঠাৎ কিসের টানে সব কিছু দ্বিধা ভুলিয়া কখন উহাদের বাড়ীর দিকে রওনা হইল৷
মঞ্জুদের বৈঠকখানার কাছে গিয়া মনে হইল—আজ মঞ্জু তাহাকে ডাকিয়া পাঠায় নাই তো! অথচ রোজই ডাকিয়া পাঠায়—মনের মধ্যে কোথা হইতে অভিমান আসিয়া জুটিল৷ নিধু আর মঞ্জুদের বাড়ী না ঢুকিয়া গ্রামের বাহিরে রাস্তার দিকে বেড়াইতে গেল৷
পূজার আর বেশি দেরি নাই৷ আকাশে বাতাসে যেন আসন্ন শারদীয়া পূজার আভাস৷ আকাশ মেঘমুক্ত, সুনীল—পাকা রাস্তার ধারে ঝোপে ঝোপে মটরলতায় থোকা-থোকা ফল ধরিয়াছে—আউশ ধান কাটা হইয়া গিয়াছে—আমন ধানের নাবাল খেত ভিন্ন মাঠ প্রায় শূন্য৷ পনেরোদিন বৃষ্টি হয় নাই—গুমট গরম, কোনোদিকে একটু হাওয়া নাই৷
একটা সাঁকোর উপর বসিয়া নিধু ভাবিতে লাগিল—মঞ্জু আজ তাহাকে কেন ডাকিল না? ওবেলা তাহার কথাবার্তায় হয়তো মনে দুঃখ পাইয়াছে, শিশি-বোতলের মাঝখানে উপবিষ্ট মঞ্জুর ভরসাহারা করুণ মুখের ছবি মনে আসিল৷ মঞ্জুকে সে কোনো দুঃখ দিবে না৷ এ ব্যাপার লইয়া আর কোনো কথা সে মঞ্জুকে বলিবে না৷
কিন্তু রবিবার তো ফুরাইয়া আসিল৷ সন্ধ্যার দেরি নাই৷ আর কতক্ষণ? সত্যই কি সে মঞ্জুদের বাড়ী দেখা করিতে যাইবে না? তাহা হয় না, এখন গেলে তবুও রাত ন’টা পর্যন্ত থাকিতে পারিবে৷ নয়তো আবার সাতদিন অদর্শন৷ থাকা অসম্ভব তাহার পক্ষে৷
নিজের বাড়ীর সামনে আসিয়া নিধু ইতস্তত করিতেছে—এমন সময় সে দেখিল মঞ্জু এবং তাহার পিসতুতো বৌদিদি ওদিকের পথ দিয়া আসিতেছে৷ নিধুকে দূর হইতে দেখিয়া মঞ্জু বলিল—ও নিধুদা, দাঁড়ান—
নিধু বলিল—তোমরা কোথাও গিয়েছিলে নাকি, মঞ্জু?
—আমি আর বৌদি হৈমদির বাড়ী আর ওদের পাশে পরেশকাকাদের বাড়ী বেড়াতে গিয়েছিলাম যে৷ সেই কখন বেলা দুটোর সময় গিয়েছি—আসব-আসব করচি—কিন্তু হৈমদি’র মা চা-খাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না—তাই একেবারে সন্দে হয়ে গেল৷
—তা তো জানি নে—ও!
—আপনি গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ী?
—আমি একটু বেড়িয়ে ফিরচি—তোমাদের ওখানে যাওয়া হয় নি—
—আমিও ভাবচি নিধুদা এসে কি বসে আছে? আরও তাড়াতাড়ি করচি৷ জিগগেস করুন বৌদিকে—না বৌদি?
মঞ্জুর বৌদিদি বলিলেন—হ্যাঁ, ও তো অনেকক্ষণ থেকে আসবার ঝোঁক করচে—তা একজনের বাড়ী গেলে কি তক্ষুনি আসা ঘটে! বিশেষ কখনো যখন যাই নে—
মঞ্জু বলিল—আসুন নিধুদা, চলুন আমাদের বাড়ী—
নিধুর অভিমান অনেক আগেই কাটিয়া গিয়াছিল৷ মঞ্জু যে আজ তাহাকে ডাকিয়া পাঠায় নাই, তাহার সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান৷
বাড়ীতে পৌঁছিয়া মঞ্জু বলিল—কি খাবেন বলুন নিধুদা—
মঞ্জুকে আজ ভারি সুন্দর দেখাইতেছে৷ নিজের বাড়ীতে বসিয়া থাকে বলিয়া মঞ্জু কখনো সাজগোজ করে না—আজ পাড়ায় বেড়াইতে বাহির হইয়াছে বলিয়া সে চওড়া সাদা জরির পাড় বসানো চাঁপা রঙের ভালো সিল্কের শাড়ী ও ফিকে গোলাপী রঙের ব্লাউজ পরিয়াছে—কপালে টিপ, চমৎকার ঢিলে খোঁপা বাঁধিয়াছে—পায়ে মাদ্রাজী স্যান্ডেল—খুব মৃদু এসেন্সের সৌরভ তাহার চারিপাশের বাতাসে৷ মুখশ্রীতে প্রগলভতা নাই, অথচ বুদ্ধি ও আনন্দের দীপ্ত সজীব ভঙ্গি তাহার মুখে, হাত-পা নাড়ার ভঙ্গিতে, কথা বলিবার ধরনে৷
নিধু আমতা-আমতা করিয়া বলিল—তা—যা খাওয়াবে—
—আপনার জন্যে কি খাবার করে রেখেছিলাম, জানেন? বলুন তো?
নিধু বিস্মিত কণ্ঠে বলিল—আমার জন্যে?
—হ্যাঁ, আপনার জন্যেই৷ নিমকি ভেজেছিলুম নিজে বসে, দুপুরের পর একঘণ্টা ধরে৷ বৌদি বেলে দিলে, আমি ভাজলাম—গরম গরম দেব বলে আপনাকে ডাকতে পাঠাচ্ছি নৃপেনকে—এমন সময় হৈমদির মা, হৈমদি সবাই এলেন ওঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে—
—ও, ওঁরা এসেছিলেন বুঝি?
—তবে আর বলচি কি! এসে কিছুতেই ছাড়লেন না—যেতে হবে৷ মা বললেন—তবে তুই যা, আমি নিধুকে ডেকে খাওয়াব এখন৷ আমি বললাম—তা হবে না মা, আমি ফিরে এসে ডেকে পাঠাব৷
—এত কথা কিছুই জানি নে আমি৷
—কি করে জানবেন? একবার ভাবলাম আপনাদের বাড়ী হয়ে যাই—কিন্তু ওঁরা সব ছিলেন—হৈমদি কিন্তু বলেছিল—
—কি বলেছিল হৈম?
—হৈমদি বললে, নিধুদাকে ডেকে নিয়ে গেলে হত৷ ওর মা বারণ করলেন৷
—হৈমর মা বারণ করে ঠিকই করেচেন৷ হৈম শহরে-বাজারে কাটিয়েচে, পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার ও কিছু বোঝে না৷ মেয়েরা যাচ্ছে বেড়াতে, তার মধ্যে একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে যাওয়া—লোকে কি বলবে?
মঞ্জুর উপর অভিমানের বিন্দুমাত্রও এখন আর নিধুর মনে নাই, বরং মঞ্জুর স্নেহে ও প্রীতিতে অযথা সন্দেহ করার দরুন নিধু মনে মনে যথেষ্ট লজ্জিত ও দুঃখিত হইল৷ মঞ্জু বলিল—বসুন, নিমকি নিয়ে আসি গরম করে, ঠাণ্ডা হয়ে গেছে—খেতে পারবেন না৷
—শোনো শোনো, অত-শত করে কাজ নেই—যা আছে তাই ভালো৷
মঞ্জু কিন্তু কিছুক্ষণ বিলম্ব করিয়াই গরম-গরম নিমকি আনিয়া দিল নিধুকে৷ বলিল—আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল নিধুদা, আপনাকে না খাওয়াতে পেরে৷ ভাবলাম সন্দে হয়ে গেল—আপনার সঙ্গে আর কখনই বা দেখা হবে! সকালে উঠে তো চলেই যাবেন—
নিধু হাসিয়া বলিল—সত্যি বলতে গেলে আমার রাগ হয়েছিল তোমার ওপর—
—কেন, কি অপরাধ হল?
—রোজ বিকেলে ডাকতে পাঠাও, আজ কেউ গেল না ডাকতে৷ আমি বড় রাস্তার দিকে বেড়াতে বার হলাম—
মঞ্জু ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিল—ওইখানে আপনার দোষ৷ আমাদের পর ভাবেন কিনা, তাই না ডাকলে আসেন না—
—সে জন্য নয় মঞ্জু, তোমরা বড়লোক, যখন-তখন ঢুকতে ভয় করে—
—ওই ধরনের কথা শুনলে আমার কষ্ট হয় বলেচি না?
—মঞ্জু, তুমি আমায় ক্ষমা কর৷ ওবেলা তোমার মনে বড় কষ্ট দিয়েচি, চোখের জল ফেলিয়েচি৷ সেই থেকে আমার মন মোটেই ভালো নেই৷ তুমি ছিলে কোথায় আর আমি ছিলাম কোথায়, এতদিন তোমার নামও জানতাম না৷ কিন্তু আলাপ হয়ে পর্যন্ত তোমাকে আর পর বলে মনে হয় না৷ তাই এমন কথা বলে ফেলি যা হয়তো পরকে বলা যায় না৷ তুমি জজবাবুর মেয়ে বলে তোমায় সবাই সমীহ করে চলবে—কিন্তু আমি ভাবি ও তো মঞ্জু—
মঞ্জু চুপ করিয়া রহিল৷
সে কিছুক্ষণ যেন আপনমনে কি ভাবিল৷ পরে ধীরে ধীরে বলিল—কিছু মনে করি নি নিধুদা, আপনিও কিছু মনে করবেন না৷ ও কথা আর তুলবেন না৷
তাহার কণ্ঠস্বর ঈষৎ বেদনাক্লিষ্ট৷ অল্পক্ষণ পূর্বের সে হালকা সুর আর তাহার কথার মধ্যে নাই৷
নিধু অন্য কথা পাড়িবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল—তাহলে কি প্লে করা ঠিক করলে এবার?
মঞ্জু যেন নিধুর প্রশ্ন শুনিতে পাইল না—সে অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছে৷ তাহার পর হঠাৎ নিধুর মুখের দিকে ব্যথাম্লান ডাগর চোখের পূর্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল—নিধুদা, আমার কথা বিশ্বাস করবেন?
—কি, বল?
—আপনার জন্যে আমার মন-কেমন করে, আপনি এখান থেকে চলে গেলেই—
নিধু কি একটা বলিতে যাইতেছিল, মঞ্জু বাধা দিয়া বলিল—আরও জানেন, দু-শনিবার আপনি আসেন নি, ভেবেছিলুম আপনাকে চিঠি লিখে দিই আসবার জন্যে—কিন্তু বাড়ীর কেউ সেটা পছন্দ করত না বলে কিছু করি নি—
—আমার সৌভাগ্য মঞ্জু—কিন্তু সেই জন্যেই মনে হয়, আর তোমার সঙ্গে মেশা উচিত নয় আমার—
—কিছু ভাববেন না, নিধুদা৷ আমি ছেলেমানুষ নই—কষ্ট করতে পারব জীবনে৷ ও জিনিস কষ্টের জন্যেই হয়—আপনি আশীর্বাদ করবেন যেন সহ্য করতে পারি—
নিধুর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না৷ তেঁতুলগাছে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাদুড়দল ডানা ঝটপট করিতেছিল৷ সম্মুখে আঁধার রাত৷
.
বাড়ী হইতে ফিরিতে নিধুর দেরি হইয়াছিল৷ বাসায় তালা ঝুলিতেছে এমন সময় বিনোদ মুহুরী আসিয়া বলিল—বাবু, এত দেরি করে ফেললেন? প্রায় দশটা বাজে—কেস আছে৷
—মক্কেল কোথায়?
—কোর্টের অশত্থতলায় বসিয়ে রেখেছি—তা আপনি এত বেলা করে ফেললেন!
—চল যাই৷ এজাহার করিয়ে দিতে হবে?
—হ্যাঁ, বাবু৷ আমি তাহলে যাই—বেহাত হয়ে যাবে৷ হরিহর নন্দীর দালাল ঘুরচে৷ আমি ছুটে দেখতে এলাম, আপনি এলেন কিনা বাড়ী থেকে—
—টাকা দেবে?
—দু-টাকা দেবে কথা হয়েচে—
—তবে তো ভারি মক্কেল ধরেচ দেখছি! হরিহর নন্দী দু-টাকায় এজাহার করবে?
—বাবু এক টাকাতেও করবে৷ আপনি জানেন না—সাধনবাবু আট আনায় করবে৷ ওই নিরঞ্জন-মোক্তার আট আনায় করবে—আপনার একটু নাম বেরিয়ে গিয়েচে—তাই, আমি যাই বাবু, সামলাই গিয়ে আগে—
পথে নিরঞ্জন-মোক্তারের সঙ্গে দেখা৷ নিধু বলিল—শুনেচ হে, মক্কেল একে নেই—তার ওপর দালালে বোধ হয় ভাঙিয়ে নেয়—তাই ছুটচি—
নিরঞ্জন হাসিয়া বলিল—ছুটো না হে, বিনোদ যতটা বলেচে অতটা নয়৷ কেউ কারো মক্কেল ভাঙায় না ওভাবে৷
—কি করে জানব—বিনোদ বললে তাই শুনলাম—
—হরিহরবাবু দালাল লাগিয়ে তোমার-আমার দু-টাকার মক্কেল ভাঙিয়ে নেবেন—সে লোক তিনি নন৷ ছুটো না, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে—আস্তে আস্তে চল৷
—না ভাই, বিশ্বাস নেই কিছু৷ মক্কেল বেহাত হয়ে গেলে তখন কেউ দেখবে না—আমি এগুই—
—না, মক্কেল ঠিক হাতেই আছে, বিনোদ দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া জানাইল৷
নিরঞ্জন অল্পক্ষণ পরে কোর্টের প্রাঙ্গণে পৌঁছিয়া বলিল—কি হে, হাঁপাচ্চ যে! মক্কেল পেলে?
—হ্যাঁ ভাই—
—ওসব মুহুরীদের চালাকি৷ কোথায় যাবে মক্কেল? মুহুরীরা কাজ দেখাচ্চে তোমার কাছে৷ নিজের বাহাদুরি করবার সুযোগ কি কেউ ছাড়ে?
সাধন-মোক্তার দূর হইতে নিধুকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন—ও নিধিরাম, বাড়ী থেকে এলে কখন? ভালো সব? শোনো—
—কি বলুন সাধনবাবু—
—ওহে ইন্টারভিউ-লিস্টে তোমার নাম উঠেচে দেখলাম যে! কে নাম দিলে হে?
—তা তো জানিনে৷ তবে আমার মনে হয় সাবডেপুটিবাবু—উনিই এস. ডি. ও-কে বলে করিয়েছেন৷
—বেশ, বেশ—দেখে খুশি হলাম৷
বেলা তিনটার সময় নিরঞ্জন গোপনে নিধুকে বলিল—একটা কথা আছে, বেরুবার সময় আমার সঙ্গে একা যাবে৷ জরুরী কথা৷ কাউকে সঙ্গে নিও না৷
—কি এমন জরুরী কথা হে?
—এখন বলব না৷ কে শুনে ফেলবে৷
আরও আধঘণ্টা পরে দু’জনে বাহির হইয়া চলিয়া যাইতেছে—এমন সময় বার-লাইব্রেরীর চাকর ফিরিঙ্গি আসিয়া বলিল—বাবু, ছুটি তো এসে গেল—হামার বখশিশ? এবার পুজোতে নিধিরামবাবুর কাছে ধুতি-উতি-নিবো! ফিরিঙ্গির বাড়ী ছাপরা জেলায়—আজ প্রায় চল্লিশ বছর রামনগরে আছে—কথাবার্তায় ও চালচলনে যতদূর বাঙালী হওয়া তাহার পক্ষে সম্ভব তাহা সে হইয়াছে৷ ফিরিঙ্গির বাড়ীর ছেলে-মেয়ে ভালো বাংলা বলে৷
নিধিরাম বলিল—কেন, এত বড় বড় বাবু থাকতে আমার কাছে কেন রে?
—আপনিও একদিন বড় হবেন বাবু৷ বার-লাইব্রেরিতে হামি আজ তিশ বছর নোকরি করচি, কত বাবু এল, কত বাবু গেল! ওই হরিবাবু নেংটি পিনহে এসেছিল—আজকাল বড় সওয়াল-জবাব করনেওয়ালা! সব দেখনু, আপনারও হোবে নিধিরামবাবু৷ একটা ধুতি নিব আপনার কাছ থেকে—মেজিস্ট্রেটের সঙ্গে আপনার মোলাকাৎ হবে শুননু শনিবারে—
—তুই কোথা থেকে শুনলি রে ফিরিঙ্গি?
—সব কানে আসে বাবু, সব শুনতে পাই—
ফিরিঙ্গি হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেল৷ আর কিছু আগাইয়া নিরঞ্জন বলিল—তোমার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের ইন্টারভিউ আছে শনিবারে, তার জন্যে অনেকে তোমার ওপর বড় চটেছে হে—বিগ ফাইভদের মধ্যেও কেউ-কেউ আছেন৷ ওঁদের অনেকের নাম ইন্টারভিউ লিস্টে নেই—অথচ তুমি জুনিয়ার মোক্তার, তোমার নাম উঠল—ভয়ানক চটেচে অনেকে—
নিধু বিস্মিত হইয়া বলিল—তাতে আমার হাত কি হে! তা আমি কি করব?
—সবাই বলে, বড্ড হাকিমের খোশামোদ করে বেড়াও নাকি! চোখ টাটিয়েচে অনেকের৷ হাকিমে তোমার কথা বেশি শোনে আজকাল—এই সব৷ বিশেষ করে এই ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে, তুমি কি কারো কারো নাম দিতে বারণ করেছিলে? এ সম্বন্ধে কোনো কথা হয়েছিল তোমার সুনীলবাবুর সঙ্গে?
—আমি! আমার সঙ্গে পরামর্শ করবেন সাবডেপুটিবাবু! আমি বারণ করেছি নাম দিতে!
—অনেকের তাই ধারণা৷
—কার কার নাম দিতে বারণ করেচি?
—এই ধর হরিহর নন্দীর নাম নেই, শিববাবুর নাম নেই—বড়দের মধ্যে৷ আর ছোটদের মধ্যে তো কারো নাম নেই—এক তুমি ছাড়া!
—তুমি বিশ্বাস কর আমি বারণ করেচি?
—আমার কথা ছেড়ে দাও৷ আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু আসবে যাবে না—কিন্তু বার-লাইব্রেরীর সবাই তোমার ওপর একজোট হলে তোমার বড্ড অসুবিধা হবে৷ মক্কেলের কানে মন্ত্র ঝাড়বে, জামিন পাবে না—নানাদিক থেকে গোলমাল—
—যদুকাকাও কি এর মধ্যে আছেন নাকি?
নিরঞ্জন জিভ কাটিয়া বলিল—আরে রামোঃ—নাঃ! তা ছাড়া তিনি মানী লোক, তিনি ইন্টারভিউ-লিস্টে প্রথম দিকে আছেন—কোনো ছ্যাঁচড়া কাজে তিনি নেই৷
—আমি এর কিছুই জানি নে ভাই৷ সুনীলবাবু সেদিন বললেন, আপনার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের ইন্টারভিউ করিয়ে দেব—আমার ইচ্ছে ছিল না, উনি হাকিম মানুষ, অনুরোধ করলেন—কি করি বল! আর আমি দিয়েছি বারণ করে তাঁকে! নিজের জন্যেই বলি নি, অপরের জন্যে বারণ করতে গেলাম!
—আমায় বলে কি হবে ভাই? আমি তো চুনো-পুঁটির দলে৷ কথাটা কানে গেল তোমাকে বললাম৷ আমি বলেচি, কারো কাছে যেন বলো না হে—
সন্ধ্যার পর তাহার বাসায় হঠাৎ সাধন-মোক্তারকে আসিতে দেখিয়া নিধু একটু আশ্চর্য হইল৷ সাধন বলিলেন—এই যে বসে আছ নিধিরাম! বেড়াতে বার হওনি যে?
নিধু বুঝিল, ইহা ভূমিকা মাত্র৷ আসল কথা এখনও বলেন নাই সাধন৷ অবশ্য অল্প পরেই তিনি তাহা প্রকাশ করিলেন৷ ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত তাঁহার ইন্টারভিউ করাইয়া দিতে হইবে নিধিরামের৷ তাঁহার নামে যেন একখানা কার্ড আসে৷
নিধু অবাক হইয়া গেল৷ সে সাধনকে যথেষ্ট বুঝাইতে চেষ্টা করিল যে এ ব্যাপারের মধ্যে সে নাই৷ এ কি কখনো সম্ভব—সাধনবাবুর মতো প্রবীণ মোক্তার কি একথা ভাবিতে পারেন যে এস. ডি. ও. তাহার মতো একজন জুনিয়ার মোক্তারের পরামর্শ লইয়া লিস্ট তৈরি করিবেন? এসব কথা ভিত্তিহীন৷ তাহার কোনো হাত নাই, সে জানেও না কিছু৷
একথা সাধন কতদূর বিশ্বাস করিলেন তাহা বলা যায় না—বিদায় লইবার সময় বলিলেন—আর ভালো কথা, ওহে আমি আর একটা অনুরোধ তোমায় করচি, এই অঘ্রাণে এইবার শুভকাজটা হয়ে যাক—তোমার আশাতে বাড়ীসুদ্ধ বসে আছে৷ বাড়ীতে এদের তো তোমাকে বড্ড পছন্দ—আমায় কেবল খোঁচাচ্চে৷ কোর্ট বন্ধের দিন তোমায় যেতেই হবে৷
নিধু মনে মনে ভাবিল—বোধহয় তাহলে বড় ডাল আঁকড়াতে গিয়ে ফসকে গিয়েচে, তাই গরীবের ওপর কৃপাদৃষ্টি পড়েচে আবার৷ মুখে বলিল—আপনার বাড়ী যাব, সে আর বেশি কথা কি—বলব এখন পরে৷ তবে ইন্টারভিউর ব্যাপারে আপনি একেবারে সত্যি জেনে রাখুন সাধনবাবু, ধর্মত বলচি, এর বিন্দুবিসর্গের মধ্যে নেই আমি৷ বিশ্বাস করুন আমার কথা৷
সাধন-মোক্তার দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন৷
শুক্রবার রাত্রে সাবডেপুটির চাপরাশি আসিয়া নিধুকে ডাকিয়া লইয়া গেল সকাল-সকালই৷
সুনীলবাবু বলিলেন—খবর সব ভালো?
—আজ্ঞে হ্যাঁ—
—লালবিহারীবাবুদের বাড়ীর সব—চিঠি দিয়েছিলেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ৷
—কাল শনিবার যেতে পারব না—পরের শনিবারে যাব—আপনিও থাকবেন৷ এবার বোধ হয়, আপনাকে বলি—
সুনীলবাবু হঠাৎ সলজ্জকণ্ঠে বলিলেন—বাবা বোধ হয় আসবেন রবিবারে৷ উনিও মেয়ে দেখতে যাবেন—উনি লিখেচেন—আপনার শরীর অসুস্থ নাকি?
নিধু আড়ষ্ট সুরে বলিল—না, এই—আজকাল এই কাজের চাপ ছুটির আগে, তা ছাড়া মাঝে মাঝে ম্যালেরিয়াতে ভুগি—
—একটু গরম চা করে দেবে? ও আপনি চা খান না, ইয়ে—কোকো খাবেন?
—থাক গে৷ বরং জল এক গ্লাস—
—হ্যাঁ, হ্যাঁ—ওরে বাবুকে এক গ্লাস জল—তারপর শুনুন একটা কথা—
—আজ্ঞে বলুন—
—ভদ্রলোকের কাণ্ড! কি করি—সাধনবাবু সেদিন এসেছিলেন ওঁর বাড়ী আমাকে নিয়ে যেতে, মেয়ে দেখতে—শুনেচেন সেকথা? শোনেন নি?
—না৷ আপনি গিয়েছিলেন নাকি?
—যাই নি৷ আমি ওঁকে খুলে বললুম—কুড়ুলগাছির লালবিহারীবাবুদের সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েচে৷ বোধ হয় সেখানেই—বাবা নিজে আসচেন মেয়ে দেখতে৷ এ অবস্থায় অন্যত্র আর—
তাই! নিধু আগেই আন্দাজ করিয়াছিল সাধন বুড়োর দরদের আসল কারণ৷ কথাটা নিরঞ্জনকে বলিতে হইবে৷ ওই একজন সমবয়সী বন্ধু আছে রামনগরে—সুখদুঃখের কথা যাহার কাছে বলিয়া সুখ পাওয়া যায়৷ সে বুঝিতে পারে, দরদ দিয়া শোনে৷
.
শনিবার ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত ইন্টারভিউ-পর্ব বেলা দেড়টার মধ্যে মিটিয়া গেল৷ মহকুমার অনেক বিশিষ্ট লোক উপস্থিত৷ ভিড়ও খুব৷ এ যে সময়ের কথা বলা হইতেছে—তৎকালে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে করমর্দন করা সুখবিরল ও যশবিরল৷ পৃথিবীর একটা প্রধান সুখ, একটা প্রধান সম্মান৷ ম্যাজিস্ট্রেট আহেলা বিলাতী আই. সি. এস.৷ নাম রবিনসন—লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা৷ চেহারার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিতে ইচ্ছা করে৷
এস. ডি. ও. হাসিয়া নিধুকে আগাইয়া দিয়া বলিলেন—বাবু নিধিরাম চৌধুরী—মুকটিয়ার—
ঠিক পূর্বে সরিয়া গিয়াছেন লোকাল বোর্ডের মেম্বার শশিপদবাবু৷ সাহেব সহাস্যবদনে হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন—গুড আফটারনুন, বাবু৷ সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ—
নিধু ঘামিয়া উঠিয়াছে৷ সে হাত বাড়াইয়া ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে হাত দিবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করিয়া সেলাম ঠুকিল৷ মুখে বলিল—গুড আফটারনুন, স্যর—ইয়োর অনার—
ম্যাজিস্ট্রেট তাহার দিকে চাহিয়া ভদ্রতা-সূচক হাসিলেন৷ ইন্টারভিউ শেষ হইয়া গেল৷
আজ আর কাজকর্ম নাই৷
.
ডাকবাংলা হইতে বাসায় আসিবার পথে নিধু ভাবিয়া ঠিক করিল আজ সে কুড়ুলগাছি যাইবে৷ যদিও বলিয়া আসিয়াছিল যাইবে না, কিন্তু যখন সকাল-সকাল কাজ মিটিয়া গেল—তখন আজই এখনি বাহির হইয়া পড়িতে হইবে৷ সামনের শনিবারে বরং যাইবে না বাড়ী—সুনীলবাবু এবং তাহার বাবা সেদিন মেয়ে দেখিতে যাইবেন—সেদিন তাহার না থাকিলেও কোনো পক্ষের ক্ষতি নাই৷
আজ শরীরটা কিন্তু সকাল হইতেই ভালো নয়৷ জ্বরজাড়ি হইতে পারে৷ সারা গায়ে যেন বেদনা৷ তবুও বাড়ী আজ তাহার যাওয়া চাই-ই৷ আজ মঞ্জুকে সে পাইবে পুরানো দিনের মতো৷ বাড়ীতে ভাবী আত্মীয়-কুটুম্বেরা ভিড় করিবে না আজ৷
শরতের রৌদ্র নীল আকাশের পেয়ালা বাহিয়া উপচাইয়া পড়িতেছে৷ পথের ধারে ছায়া, ঝোপে সেইদিনের মতো মটরলতার দুলুনি৷ ছোট গোয়ালে-লতায় ফুল ধরিয়াছে৷ শালিক ও ছাতার পাখির কলরব মাথার উপরে৷
পথ হাঁটিতে আরম্ভ করিয়াই নিধু দেখিল তাহার শরীর যেন ক্রমশ খারাপ হইয়া আসিতেছে৷ শরতের ছায়াভরা বাতাস গায়ে লাগিলে যেন গা শিরশির করে৷ নিধু মাঝে মাঝে কেবলই বসিতে লাগিল—এ সাঁকোয় বসে, আবার ও সাঁকোয় বসে৷ সাঁকোর নিচেই গত বর্ষার বদ্ধ জল, অন্য সময় তাহার যে একটা গন্ধ আছে—ইহাই নিধুর নাকে লাগিত না—আজ গন্ধটায় তাহার শরীরের মধ্যে যেন পাক দিতেছিল৷ সাঁকোয় বসিয়া অন্যমনস্কভাবে বাঁশবনের মাথার উপরে মেঘমুক্ত নীল আকাশে শরতের শুভ্র মেঘের খেলা লক্ষ্য করিতেছিল৷ মেঘের দল লঘুগতিতে উড়িয়া চলিতে চলিতে কত কি জিনিস তৈরি করিতেছে—কখনো দুর্গ, কখনো পাহাড়, কখনো সিংহ, কখনো বহুদূরের কোন অজানা দেশ—উপরের বায়ুস্রোত আবার পরমুহূর্তে সেগুলোকে চূর্ণ করিয়া উড়াইয়া দিতেছে—এই আছে, এই নাই—আবার নব-নব শুভ্র মেঘসজ্জা, আবার কল্পনায় কত কি নতুনের সৃষ্টি! ভঙ্গুর মেঘের সৃষ্টি—সে আবার টেকে কতক্ষণ?
কে একজন ডাকিয়া বলিল—বাবু, আপনি এখানে শুয়ে আছেন সাঁকোর ওপর? কনে যাবেন?
পথ-চলতি চাষা লোক৷ নিধু বলিল—যাব কুড়ুলগাছি৷ জ্বর এসেচে তাই একটু শুয়ে আছি৷
—আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবানু, উঠুন আপনি—কতক্ষণ শুয়ে থাকবেন?
—না বাপু৷ আমি একটু জিরিয়ে নিলেই আবার ঠিক হাঁটব—তুমি যাও৷
লোকটা চলিয়া গেল—কিন্তু যাইবার সময় বার-বার পিছনে তাহার দিকে চাহিতে চাহিতে গেল৷ লোকটা ভালো৷ শরীর ভালো না থাকিলে কিছুই ভালো লাগে না৷ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ইন্টারভিউ হইল—কোথায় মন বেশ খুশি হইবে, গাঁয়ে গিয়া গল্প করিবার মতো একটা জিনিস হইল—তা না, সে যেন মনে কোনো দাগই দেয় নাই৷ কিন্তু এই জ্বরের ঘোরে মঞ্জু যেন কোন অপার্থিব দেশের দেবী হইয়া তাহার সম্মুখে আসিতেছে৷ মঞ্জুদের একদিন খাওয়ানো হইল না, পয়সা জমে না হাতে—তা কি করা যায়? সামনের শনিবারে তো বাড়ী যাইবে না—পরের শনিবারে হইবে৷ আচ্ছা বার-লাইব্রেরীর সকলে কি তাহাকে বয়কট করিবে? যদি করে সে তো নিরুপায়৷ তাহার কোনো দোষ নাই, আর কেউ না জানে, সে তো জানে৷ সে স্বেচ্ছায় কাহারো অনিষ্ট করিতে যাইবে না৷
অতি কষ্টে আরও কয়েক মাইল পথ সে অতিক্রম করিল৷
পথ তাহাকে যে করিয়াই হোক, অতিক্রম করিতেই হইবে৷ এই দীর্ঘ, ক্লান্ত পথের ওপ্রান্তে হাস্যমুখী মঞ্জু যেন কোথায় তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে৷ আজ না গেলে আর তাহার সহিত যেন দেখাই হইবে না৷ দুদিনের জন্য আসিয়াছিল—আবার বহু, বহু দূরে চলিয়া যাইবে৷
সন্ধ্যার আর দেরি নাই৷ ওই সন্দেশপুর—সেই মৌলবীসাহেবের পাঠশালা সন্দেশপুর বাঁওড়ের ধারে৷ বাঁওড়ের বর্ষার জল রাস্তার কিনারা ছুঁইয়াছে—ওদিকে গাছের গুঁড়ির সাঁকোর উপর দিয়া ধান-বোঝাই মহিষের গাড়ী পার হইতেছে৷
আর এতটুকু গেলেই তাহাদের গ্রাম৷ সন্ধ্যার শাঁখ বাজিবার সঙ্গে-সঙ্গেই গ্রামের পথে সে পা দিবে৷
অমনি মা আগাইয়া আসিয়া বলিবে—এই যে নিধু এলি বাবা! বলেছিলি আজ যে আসবি নে!
হয়তো সে বাড়ী পৌঁছিলে একথা তাহার মা তাহাকে বলিয়াও থাকিবেন—কিন্তু আচ্ছন্ন ঘোর-ঘোর ভাবে সন্ধ্যার অন্ধকারে কখন সে বাড়ী ঢুকিয়াছিল টলিতে-টলিতে—কখন বাড়ীর লোকে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিয়াছিল, এ সকল কথা তাহার মনে নাই৷
.
দুই মাস রোগের ঘোরে কখনও চেতন, কখনও অচেতন বা অর্ধচেতন ভাবে কাটিবার পর নিধুর জীবনের আশা হইল৷ ক্রমে সে বিছানার উপর উঠিয়া বসিতে পারিল৷ ডাক্তার বলিয়া গিয়াছে—আর ভয় নাই৷
নিধুর মা পুত্রের সেবা করিতে করিতে রোগা হইয়া পড়িয়াছেন৷ সে চেহারা আর নাই মায়ের৷
নিধুর সামনে সাবুর বাটি রাখিয়া বলিলেন—আঃ বাবা, রামগড় থেকে শশধরবাবু ডাক্তার পর্যন্ত এসেছিলেন দু’দিন—
নিধু ক্ষীণ স্বরে বলিল—শশধরবাবু! সে তো অনেক টাকার ব্যাপার!
—টাকা কি লেগেছে আমাদের? আহা, আর-জন্মে পেটের মেয়ে ছিল ওই মঞ্জু—দিন-রাতের মধ্যে যে কতবার আসত, বসে থাকত—সেই তো সব যোগাড়যন্ত্র করে দিলে জজবাবুকে বলে—জজবাবুও হামেশা আসতেন—গাঁয়ের সবাই আসত-যেত৷ সেদিনও জজগিন্নি বলে গেলেন—টাকা খরচ সার্থক হয়েছে, প্রাণ পাওয়া গেল এই বড় কথা৷ মিথ্যে কথা বলব কেন—সবাই দেখেচে, শুনেচে, করেচে৷ ভুবন গাঙ্গুলির মেয়ে হৈম পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার আগে রোজ একবার করে আসত৷ মা সিদ্ধেশ্বরী কালী মুখ তুলে চেয়েচেন৷ সকলে তো বলেছিল, এই বয়সের টাইফয়েড—
মঞ্জু! অনেকদিন পরে নিধুর রোগ-ক্ষীণ স্মৃতিপটে একখানি আনন্দময়ী বালিকামূর্তিও অস্পষ্ট ভাসিয়া উঠিল৷ অনেকদিন এ নাম কানে যায় নাই৷ কঠিন রোগ তাহাকে মৃত্যুর যে ঘনান্ধকার রহস্যের পথে বহুদূর টানিয়া লইয়া গিয়াছিল, হয়তো সে পথের কোথাও কোনোদিন চেতনাহীন মুহূর্তে সে একটি বালিকা-কণ্ঠের সহানুভূতিমাখা উৎসুক স্বর শুনিয়া থাকিবে, হয়তো তাহার দয়ালু হস্তের মৃদু পরশ অঙ্গে লাগিয়া থাকিবে—নিধু তাহা চিনিতে পারে নাই—ধারণাও করিতে পারে নাই৷
সে কিছু বলিবার আগেই তাহার মা বলিলেন—ও শনিবারে যাবার দিনটাতেও মঞ্জু এসে কতক্ষণ বসে রইল৷ বললে, বাবার ছুটি ফুরিয়ে গেল তাই যেতে হচ্চে জ্যাঠাইমা, নইলে নিধুদাকে এভাবে দেখে যেতে কি মন সরে! বাবার কোর্ট খুলবে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরে, আর থাকবার জো নেই৷ চোখের জল ফেললে সেদিন বাছা আমার! একেবারে যেন আমার পেটের মেয়ে—বললাম যে! অমন মেয়ে কি হয় আজকালকার বাজারে! তাই তো বলি—
মায়ের বাকি কথা নিধুর কানে গেল না৷
.
আরও দিন-পনেরো কাটিয়া গিয়াছে৷
নিধু এখন লাঠি ধরিয়া সকালে-বিকালে একটু করিয়া বাড়ীর কাছের পথে বেড়ায়৷
মঞ্জুদের বাড়ী তালাবন্ধ, কেহ কোথাও নাই৷
আগেও তো কেহ ছিল না এ বাড়ীতে, কখনো কেহ থাকিত না, এখনো কেহ নাই, ইহাতে নতুন কি আছে?
এই শেষ হেমন্তের ঈষৎ শীতল অপরাহ্নগুলিতে আগে আগে ঘন ছোট গোয়ালে-লতার জঙ্গলে জজবাবুদের বাড়ীর সদর-দরজা ঢাকিয়া থাকিত—সে আবাল্য দেখিয়া আসিতেছে—বছরের পর বছর কাটিবার সঙ্গে সঙ্গে সে বন আবার গজাইবে—মধ্যে যে আসিয়াছিল, সে তো দুদিনের স্বপ্ন৷
ছনুজেলে মাছের ডালা মাথায় করিয়া চলিয়াছে৷ তাহাকে দেখিয়া বলিল—এই যে দাদাঠাকুর, আজকাল একটু বল পাচ্ছেন?
—হ্যাঁ ছনু, ডাক্তার বলেচে একটু বেড়াতে সকাল-বিকেল৷
—তা যান, বেলা গিয়েচে, আর ঠাণ্ডা লাগাবেন না—কার্তিক-হিম—আপনার তো পুনরজন্ম গেল এবার৷
—কপালে ভোগ থাকলে—
—তাই দাদাঠাকুর তাই৷ কপালই সব৷ এমন পুজোডা গেল জজবাবুদের বাড়ী—কি খাওয়ান-দাওয়ান, আমাদের এস্তক হেল-ঢেল৷ জজবাবু নিজে সামনে দাঁড়িয়ে—ছনু, ভাল করে খাও বাবা, যা ভালো লাগে মুখে চেয়ে নিও৷ অমন মানুষ আর হয় না৷
নিধু বাড়ীর দিকে ফিরিবার আগে কেহ কোনোদিকে নাই দেখিয়া বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়া জজবাবুর বাড়ীর মধ্যে একবার উঁকি দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল৷
ভালো দেখা গেল না! হেমন্ত সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিয়াছে গাছপালায়৷