৫. নাইট শো

০৫.

অনেক রাতে নাইট শো ভাঙার একটু আগে গাড়িখানা দক্ষিণমুখখা করে দাঁড়িয়ে ছিল গৌরহরি। শশা ভাঙলে যদি গ্যারেজের দিকের সোয়ারি পায়। আসলে এখন অনেক রাতে একা একা গাড়িখানা চালিয়ে নির্জন ঘুমন্ত গ্যারেজটায় যাওয়ার সময়ে প্রায়ই গা ছমছম করে গৌরের। ওই ডেডবডিটা ম্যাক্সিমাম নড়াচড়া করতে থাকে। ও শালাকে ঢিট করার একমাত্র উপায় গাড়িতে সোয়ারি তোলা। তুললেই শালা চুপ। আর নড়াচড়া নেই। তাই অপেক্ষা করছে গৌর। তার রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। পাইস হোটেলে সে খেয়ে নেয়। একটা মিঠে পান খেয়েছে। তারপর রুখো-শুখো দু’খানা হাত-পা-ওলা দুঃখী গৌরহরি আরামে বসেছে স্টিয়ারিঙের পিছনে হেলান দিয়ে। অপেক্ষা করছে। বহু ট্যাক্সি ওইরকম দাঁড়িয়ে। শেষ ট্রিপ যদি পায়। গৌরহরির পয়সার লালচ নেই। গৌরা যেমন কারও সার্ভেন্ট না, তেমনি না পয়সারও স্লেভ! কেবল এক-আধজন সঙ্গী খোঁজে। নিশুত রাতে একটা ল্যান্ডমাস্টারে একা বসে থাকতে তার কেমন একটু লাগে ঠিকই। যখন শালা ডেডবডিটা সবসময়েই রয়েছে সঙ্গে, একটু সাবধান থাকা ভাল। বাঁ দিকে একটা অন্ধকার গলি। সেই গলি দিয়ে একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের হাফপ্যান্ট পরা ছেলে মুখ বাড়াল। চারদিক চেয়ে দেখছে। মুখখানা শুকনো। কেমন একটা অস্থির ভাব। পায়ে পায়ে সে গৌরের ট্যাক্সিটার কাছে আসছে। কিন্তু গৌর কারও সার্ভেন্ট নয়। আসুক যে কেউ। গ্যারেজের দিকের সোয়ারি না হলে নেবে না। গৌরহরি অর্থাৎ বগলুর ছাওয়াল গৌরা মনে মনে নিজেকে শক্ত করে রাখে। ছেলেটা ম্লান মুখে কাছে আসে।

ট্যাক্সি যাবে?

কোনদিকে?

ছেলেটা ইতস্তত করে বলে, সাউথে।

আমার গ্যারেজ যাদবপুরে। ওদিকে হয় তো যেতে পারি।

ছেলেটা শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল, ওদিকেই।

তবে উঠে পড়ে। গৌরহরি সরে গিয়ে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মিটার ডাউন করে।

ছেলেটা নরম গলায় বলে, ওই গলির মধ্যে একটু যেতে হবে। মেয়েছেলে রয়েছে।

 ঝামেলা! তবু তো সোয়ারি। নাইট শো ভাঙতে এখনও প্রায় আধঘণ্টা দেরি। তার আগেই যদি চলে যাওয়া মন্দ কী?

গলিতে গাড়ি ঢুকবে তো? ঘষা-ফষা লাগে যদি?

লাগবে না। গলি চওড়া।

সাবধানে গাড়িটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে গলিতে ঢোকে গৌরহরি। ছেলেটা পিছনের সিট থেকে সামনে ঝুঁকে বলে, আর একটু এগিয়ে।

কতদূর?

 এই সামনেই, কয়েকটা বাড়ি পর।

 বিরক্ত গৌরহরি ঘুমন্ত, অন্ধকার গলিটার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে এগোয়। বলে, গাড়ি ঘোরাব কী করে? ওদিকে বেরোবার রাস্তা আছে?

আছে। কোনও অসুবিধে নেই। আমরা তো আছি।

গৌরহরি এগোয়। পাকা হাত তার। আঁকাবাঁকা গলির মধ্যে ঘুরে ফিরে তার গাড়ি যায়।

আর কতদূরে?

আর একটু। বাঁ হাতে আর একটা গলি পড়বে, সেখানে।

ইস! বড় ঝামেলায় ফেললে।

এখন গৌরবাবুর বেড-টাইম নয় ঠিক। তবে মাঝে মাঝে হাই উঠছে। কেন গৌরবাবু নিজের ইচ্ছেমতো ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়বে না? বিশেষত সে যখন কারও চাকর নয়। কার ধার ধারে সে?

গাড়ি আর খানিকটা এগিয়ে বাঁ হাতের গলিটা পায়।

ওরেব্বাস! এ যে যম অন্ধকার। গলিটাও সরু।

গাড়ি যায়।

যায় যাক। আমি যাব না। এখানে দাঁড়াচ্ছি, তোমায় লোকজন ডেকে আনো। এইটুকু সবাই হেঁটে আসতে পারে।

এইটুকু নয়। গলিটা অনেক লম্বা। একদম ও-প্রান্তে যেতে হবে। তাছাড়া সঙ্গে খুচরো কিছু মালপত্র আছে। চলুন না, মিটারের বেশি দেব।

গৌরহরিকে পয়সা দেখাচ্ছে! অা। পয়সা দেখাচ্ছে বগলুর পোলা গৌরাকে! বগলাপতির আমলে পুরনো ডজ গাড়িটার ছোট আয়নায় গৌরহরি কি বিস্তর নম্বরি নোটের ছবি দেখেনি!

বেশি দিলেই কী! আমি যাব না।

ছেলেটা হঠাৎ অসহায় ভাবটা ঝেড়ে ফেলে হাসল, বেশ আত্মপ্রত্যয়ের হাসি। গৌর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল।

যাবেন না মানে! যাবেন, যাবেন। না গেলে কি চলে?

না গেলে কী করবে?

ছেলেটা, বাচ্চা মিষ্টি চেহারার ছেলেটা হঠাৎ ডান হাত বাড়িয়ে গৌরের ঘাড় ধরে একটা ঝাকুনি দিল, চল শালা, ফের মুখ খুলেছিস কি ভোঁতা করে দেব। ঢোক গলিতে।

গৌরহরি কোনওকালে মারপিট করেনি, মার খায়নি কখনও। বগলাপতি কচিৎ কখনও চড়টা চাপড়টা দিয়েছেন, তার বেশি কিছু নয়। ঘাড়ে ঝাকুনি খেয়ে হঠাৎ গৌরের বড় অপমান লাগল। সে কিনা গৌরহরি, টিকাটুলির বগুলার পোলা গৌরা, তার কিনা ঘাড়ে হাত! গৌর তার ভাল হাতখানা বাড়িয়ে ছেলেটার হাত চেপে ধরল, খুব সাহস যে খোকা! অ্যাঁ! শালা মারব এমন থাপ্পড়!

ছেলেটা অনায়াসে তার হাত ছাড়িয়ে নিল। ধুলো ময়লা ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ট্যাক্সির দুই জানালায় দু’জন ছায়ার মতো উটকো লোক এসে দাঁড়াল। তারা শুধু ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, হুজ্জত করছে নাকি রে?

একটু একটু।

বাইরে থেকে একজন হাত বাড়িয়ে গৌরের কলার চেপে ধরে গোটা দুই ঝাকুনি দিয়ে বলে, জান নিয়ে ফিরতে পারবে না, বুঝলে? গাড়ি জ্বালিয়ে দেব তোমাকে সুদ্ধ।

জ্বালিয়ে দেবে! মানে! জ্বালিয়ে দেবে ল্যান্ডমাস্টারখানা! বগলাপতি অর্থাৎ কিনা বাপ বগলুর দেওয়া একমাত্র নিজস্ব জিনিসখানা তার! এত আদরের গাড়িখানা, যেটা কখনও তার প্রাইভেট কখনও বা পাবলিক! গৌরের আপাদমস্তক চমকে যায়। চেয়ে থাকে।

যাবে কি না?

দরগায় শিন্নি, গির্জেয় মোমবাতি, বদর-বদর, যাব বই কী! রাস্তা দেখাও বাবাসকল। গৌরা যাবে। যদিও বগলুর পোলা গৌরা কারও চাকর না, তবু ল্যান্ডমাস্টারখানা গেলে গৌরের আর থাকে কী! আঁ। থাকে কী? থাকে শুধু দুটো রুখখা-শুখো হাত পা আর মগজের ঝমঝম শব্দ!

গৌর একটু দম নিয়ে বলে, যাব।

গাড়ি ঘোরান। বাঁ দিকে।

 গৌর গাড়ি ঘোরায়।

সেই দুটো লোক তার গাড়ির মধ্যে এসে বসেছে এখন। তাদের একজন তার বাঁ পাশে। তারা খুব চুপচাপ। কথা বলে না একটাও।

আর কতটা পথ?–পৌর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।

চালাও। আমরা বলব।

গলিটা অনেক লম্বা। লোকজন বড় একটা দেখা যায় না। বাঁ ধারে একটা জানালা দরজাহীন পাঁচিল চলেছে। ডান হাতে কয়েকটা ছুটকো-ছাটকা বাড়ি। এসব পার হল গৌরহরি। ল্যান্ডমাস্টারখানা শব্দ না করে যাচ্ছে। পুরনো আমলের ইঞ্জিন, তার ওপর যত্নে থাকে গৌরের কাছে।

ক্রমে ডানদিকের বাড়িঘর শেষ হয়ে গেল। একটা মাঠ। তাতে হেডলাইটের আভায় অনেক আগাছা দেখল গৌর। বাঁ দিকে একটা কারখানার মতো। সেটা অন্ধকার, নিপা কথা না বলে গৌর এগোল। আবার বাড়িঘর শুরু হচ্ছে। ছুটকো-ছাটকা। বাঁ দিকের লোকটা হাত বাড়িয়ে গৌরের হাতে চাপ দিল, চাপা গলায় বলল, এইখানে। বাতি নিভিয়ে দাও।

গৌর বাতি নেভাল। লোকগুলো কেউ নামল না। বসে রইল।

বড় ভয় করে গৌরের। বগলুর ছেলে গৌরাকে এ কোথায় নিয়ে এল অচেনা লোকেরা? ব্যাপারখানা কী। তার গাড়ির ডেডবডিটা নাছোড় বটে। কিন্তু কখনও তেমন কোনও বিপদে ফেলেনি তাকে। মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে। লেগে থাকে এই পর্যন্ত। তা ছাড়া ডেডবডিটার আর কোনও নিন্দে কেউ করতে পারবে না! এদের চেয়ে সেই ডেডবডিটা অনেক ভাল। তাকে নিয়েই তো এতকাল ল্যান্ডমাস্টারখানা দাবড়ে বেড়াচ্ছে বগলুর ছাওয়াল।

আরও তিনজন লোক অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তার মানে ছ’জন। গৌর বে-আইন দেখেও চুপ করে থাকে। লক্ষ করে যে তিনজন আসছে তাদের মধ্যে মাঝখানের জন নিজের ইচ্ছেয় বা শক্তিতে আসছে না। তাকে আনা হচ্ছে ধরে ধরে। বাঁ দিকের ছোট্ট জমিটুকু পার হয়ে তারা গাড়ির কাছে চলে এল। বাচ্চা ছেলেটা নেমে দাঁড়াল। নিঃশব্দে তিনজন উঠল পিছনের সিটে। আবছা মনে হল গৌরহরির, মাঝখানের লোকটার হাত বাঁধা। মুখে ন্যাকড়ার দলা ভরা আছে। লোকটা অস্পষ্ট একটু শব্দ করল। দু’ধারের দু’জন সিগারেট ধরাল। কথা বলল না। বাচ্চা ছেলেটা আর পিছনের সিটে আগে যারা উঠেছিল তারা নেমে গেল।

গৌরহরির বাঁ পাশের লোকটা বলল, চালাও। সোজা গিয়ে প্রথম ডান হাতে যে রাস্তা পাবে সেইটে ধরো। হেডলাইট জ্বেলল না, জ্যোৎস্না আছে।

তাই সই। গৌর গাড়ি ছাড়ে। কোথায় চলেছে বগলুর বাচ্চা কে জানে! ডান হাতের রাস্তাটা চওড়াই। আলো আছে। লোকজনও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ যেন চেনা কলকাতার কোনও রাস্তাই নয়। এ রাস্তা গৌরহরি তার বাপের, বগলাপতির আমলেও দেখেনি।

কোনদিকে যাব?

 চলো সোজা। আমরা বলে দেব।

 পিছনের সিটে ডেডবডিটা নেই বটে এখন, কিন্তু যা আছে তা জ্যান্ত বডি। হাত-পা বাঁধা লোকটা একটু পরেই ডেডবডি হয়ে যেতে পারে।

গৌর গাড়ি চালাতে থাকে। যেমন সে চালায় মন-প্রাণ দিয়ে তেমনই চালাচ্ছিল। তার হাত পা মগজ ধীরে ধীরে অধিকার করে নিচ্ছিল ল্যান্ডমাস্টারটার যন্ত্রপাতি।

আস্তে। বাঁ দিকের লোকটা বলে।

গাড়ি ধারে করে গৌর।

লোকটা পিছনের দিকে তাকায়। কী একটা ইঙ্গিত করে।

গৌর দেখে, রাস্তাটা বড় অন্ধকার। কোনওখানে আলো নেই। জ্যোৎস্নাও দেখতে পায় না গৌর। বোধহয় আকাশে মেঘ আছে, কিংবা নোকটা মিথ্যে বলল।

গাড়িটা আস্তে আস্তে যাচ্ছে। বাঁ দিকের লোকটা পিছন ফিরে কী দেখছে। গৌরের ঘাড় ঘোরাতে সাহস হয় না!

হঠাৎ কোঁক করে হেঁচকি তোলার মতো একটা আওয়াজ হয়। মাঝখানের লোকটাই শব্দ করল। অনিচ্ছাতেও উইন্ডস্ক্রিনের ওপর ছোট্ট আয়নাটায় চোখ গেল গৌরহরির। আবছায় তেমন কিছু বোঝা যায় না। তবু মনে হয়, ডানপাশের লোকটা একটা ছোরার হাতল মাঝখানের লোকটার পেট থেকে টেনে বার করল। সঙ্গে সঙ্গে একটু কী যেন ছিটকে এসে লাগল গৌরের বাঁ কানের পিঠে। শুখো হাতটা অবশ হয়ে আসছিল, কোনওক্রমে ঢাল সামলে নিল গৌরহরি।

বাঁ দিকের লোকটা তার হাত ছুঁয়ে বলল, ব্যস, আর না! গাড়ি থামাও।

খুব ম্লান জ্যোৎস্না ফুটেছে। অচেনা রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছে গৌরহরি। এ জায়গা সে চেনে না। কোনওকালে আসেনি।

তিনজন লোক তিনটে দরজা খুলে নেমে দাঁড়াল। একজন জানালায় ঝুকে বলল, একটা বডি রইল। যেখানে হয় ফেলে দিয়ো। পুলিশে যদি যাও, আমরা নম্বর টুকে রেখেছি।

বডি! গৌরহরির চোখ কপালে ওঠে। সত্যিই একটা বডি অবশেষে সামিল ল্যান্ডমাস্টারটায়! বগলুর দেওয়া গাড়িটাতে! ভয় না, ভারী অবাক হয় গৌর।

কী হে, শুনতে পাচ্ছ, যা বললাম?

গৌর মাথা নাড়ে।

যাও। লাইট না জ্বেলে যাও। এগিয়ে গড়িয়াহাটা রোড পাবে।

গৌর মাথা নাড়ে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। গড়িয়াহাটা রোডটা যে আসলে কোথায় তা তার মাথায় ঢোকেই না। সে মাথা নেড়ে গাড়িটা ছাড়ে।

.

তারপর বগলাপতির ছাওয়াল গৌরহরি, অর্থাৎ কিনা বগলুব পোলা গৌরা, তার অদ্ভুত সোয়ারিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। রাস্তাঘাট সে আর চিনতে পারে না। তার মাথার মধ্যে মল-পরা দুটি পা ঝমঝম শব্দ করে। সে শব্দে কেমন তালগোল পাকাতে থাকে রাস্তাগুলি। যেন তাকে ধরেছে কানাওলা। একই রাস্তায় তার গাড়ি ঘুরছে আর ঘুরছে।

কী করেছি আমি! অ্যাঁ! কী করেছি আমি। কী পাপ? কোন অপরাধ? কী করেছে হে বগলুর। ছাওয়াল, যার জন্য তার ল্যান্ডমাস্টারে ডেডবডি? তাকে কেন ধরেছে কানাওয়ালায়? কোন অপরাধ হে বগলুর ছাওয়ালের, যার জন্য তার দুটো হাত-পা শুখখা। আর মগজে ওই বেহদ্দ নাচের শব্দ? এইসব কাকে জিজ্ঞেস করব আমি? কে জবাব দেবে?

পিছনের সিটে ডেডবডিটা নড়ছে আর নড়ছে। একবার পিছন ফিরে তাকায় গৌর। দেখে, বডিটা ধীরে ধীরে কাত হয়ে জানালায় মাথা আটকে থেমে আছে। পেটে একটা হাঁ। রক্ত জমে গেছে। কে হে বাপু তুমি? কোত্থেকে এলে বগলুর ছাওয়ালের ল্যান্ডমাস্টারে! উড়ে এসে জুড়ে বসলে, কে হে তুমি?

গৌরহরির হাতে গাড়ি এই প্রথম টাল খাচ্ছে। নড়েচড়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে হাত সিধে রাখে গৌর। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ল্যান্ডমাস্টারে জীবন কাটে গৌরহরির, অর্থাৎ কিনা বগলুর ছাওয়ালের। তবু আজ তার গাড়ি এ কোন কলকাতা দিয়ে যাচ্ছে। মাইরি, এ সব গাছপালা, রাস্তা, আলো এসব যে গৌরবাবু কখনও দেখেনি! সোয়ারি যেমন বলে তেমনি চলে গৌর, কিন্তু আজকের সোয়ারি যে শালা কথাও বলে না! কেন শালা ভয় দেখাও গৌরবাবুকে! কোন অন্যায় করেছে গৌরা? হ্যাঁ, সত্যি বটে, মাঝে মাঝে সে সোয়ারি কাট মারে। কতবার কত বিপদে পড়া লোককে সে তুলে নেয়নি। মেডিক্যাল কলেজের সামনে এক নতুন পোয়াতি কোলে বাচ্চা নিয়ে রোগা শরীরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছিল, অনেকদিন আগেকার কথা, গৌর তাকে কাট মেরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর একবার দুটো কচি মেয়ে আর বউ নিয়ে একটা মফসলি হাবা তোক গাড়িতে উঠেছিল। মাঝপথে যখন গৌর বুঝতে পারল এরা হাওড়া স্টেশনে যাবে, হাওড়ায় যাওয়া মানে বিচ্ছিরি জ্যাম আর পুলিশের আওতায় যাওয়া, তখনই সে গাড়ির চাকায় হাওয়া নেই বলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে লোকদেখানো জ্যাক লাগিয়েছিল গাড়িতে। সেই বোকা লোকটা মাঝপথে কচি মেয়ে আর বউকে নিয়ে কী ভীষণ বিপদে পড়েছিল। এরকম আরও অপরাধ আছে তার। অনেক। কিন্তু কেউ কি গৌরের ল্যান্ডমাস্টারের জন্য ঠেকে ছিল? যে যার গন্তব্যে পৌঁছয়নি কি শেষ পর্যন্ত? পৌঁছেছে, গৌর জানে। তবে আর কী! তবে কেন গৌরের ল্যান্ডমাস্টারে ডেডবডি? বগলুর ছাওয়ালকে কেন ধরেছে কানাওলা?

ডেডবডিটা নড়ে আর নড়ে। রাস্তার টালে গাড়ি লাফায়, আর লটপটে মাথাটা জানালায় ঠুকে যায়। চমকে ওঠে গৌর। কে হে বাপু তুমি? অ্যাঁ! উটকো উঠে বসে আছে! কোথায়? কে হে?

নিঃশব্দ একরকম কথা আছে, সবাই শুনতে পায় না। গৌর শুনল।

ডেডবডিটা নিঃশব্দে বলল, আমি একজন, তুমি চিনবে না হে গৌরবাবু। কোটি কোটি মানুষের ক’জনকে তুমি চেনো? তবে আমি, বুঝলে, আমি এই সংসারের ভাল চেয়েছিলুম। ওইটুকুই আমার পরিচয়। তা দেখো গৌরবাবু, সংসারের ভালমন্দয় হাত দিলেই বিপদ। দিলেই তোমার ভালমন্দেও হাত পড়বে। তবু এই খেলার বড় মায়া। একবার শুরু করলে আর সহজে ছাড়া যায় না। শেষ পর্যন্ত যেতে হয়। আমিও শেষ পর্যন্ত গেছি। এই দেখো না, আমার পেটটা কেমন হা হয়ে আছে। কিন্তু তার জন্য আমার দুঃখ নেই গো, বেশ আরামই লাগছে। সব ভালমন্দ শেষ করেছি আমি। তোমার ল্যান্ডমাস্টারের চমৎকার গদিতে শুয়েছি আরামে, আর উঠব না হে। দিব্যি লাগছে। বলতে কী গৌরবাবু, গাড়ি চালানোর হাত তোমার ভালই। দুলুনি লাগছে, ঘুম আসছে, বাইরে জ্যোৎস্না, মোলায়েম বাতাস বইছে, এর মধ্যে অনন্ত ঘুম ছাড়া বেশি সুখ আর কীসে! চালাও গৌরবাবু, চালাও, থেমো না। আমরা দুজনে চলল, এই ল্যান্ডমাস্টারে সংসার ছেড়ে যাই, চলো হে বগলুর পোলা!

তা গৌর তার উইন্ডস্ক্রিন জুড়ে সত্যিই সংসারের বাইরের দৃশ্য দেখতে পায়। ঢাকার সেই কামান অবিরাম লাল নীল হলুদ গোলা ছুঁড়ছে। সেই গোলাগুলো ভাসতে ভাসতে চলেছে ফাদার ফ্রান্সিসের পিছু পিছু। ফাদার হেসে কুটিপাটি, ডেকে বলছে, হেই গৌরঅরি, ফ্যাস, ফ্যাস দি বল!

গাছের পাতায় পাতায় ডালে কুয়াশায় সাদা ফুল দোলে, দোলে চাঁদের মতো উজ্জ্বল ফল। রাস্তা হঠাৎ এঁকে-বেঁকে আকাশমুখো উঠতে থাকে। গৌরহরির ল্যান্ডমাস্টার রাস্তার তোয়াক্কা না করে হঠাৎ শুন্যে উঠে উড়তে থাকে। ভেসে ভেসে চলে।

অনন্ত যাত্রায় একটা ডেডবডি সহ গৌরের ল্যান্ডমাস্টার চলে যায়। যেতে থাকে। তার মিটারের টাকা-পয়সার অঙ্ক মুছে যায়। সেখানে পর পর ফুটে উঠতে থাকে, ভালবাসা..পরিপূর্ণতা…ঈশ্বর…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *