৫. দোলের ছুটির পরদিন

পাঁচ

         দোলের ছুটির পরদিন অফিসের গেটে পৌঁছে অতনু দেখল অফিস বন্ধ, লাল শালুতে লেখা তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ধর্মঘট । গেটের পাশে তাঁবুতে কম্বল-সতরঞ্চি পেতে লুঙ্গি গেঞ্জি খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে অনশন করছে ন্যাতানো সহকর্মীরা । তাস লুডো থান-ইঁট উপন্যাস রজনীশ রামচরিতমানস চলছে । তাঁবুর গায়ে লাল শালুর ওড়নায় লেখা “মানসী বর্মণ সংগ্রাম কমিটি” । ছাপানো হ্যাণ্ডবিলে ধর্মঘটের ইতিহাসের প্রশ্নোত্তর হিন্দিতে বিলোনো ।

           ননীদা-সুলতানার বাচ্চা হচ্ছিল না বলে গায়নাকের কারসাজিতে একজনের ধাতুতে আরেকজনের ডিম ফেটিয়ে নলখোকার জন্যে গর্ভের সসপ্যান দরকার পড়ে, কেননা সুলতানার বাচ্চাদানিটা অকেজো, তাঁবুর টুকরো-টাকরা গল্প জুড়ে-জুড়ে বুঝলো অতনু । ননীদা নাকি অনেক দৌড়ঝাঁপ খোঁজাখুঁজি নানা গৃহবধু কর্মীর হাতেপায়ে ধরে শেষে মানসী বর্মণকে রাজি করিয়ে ওর পেটে বাড়তে দিয়েছে বাচ্চাটা । স্হানীয় অফিস বলেছে তার জন্য মানসী বর্মণ ডাক্তার খরচ আর মেটারনিটির ছুটি পাবে না । অরিন্দম এমনভাবে কেস ঘুরিয়ে নোট আর চিঠির খসড়া লিখেছে যে হেড অফিসও বলেছে যে, পাবে না । মা হলেই হবে না ; বৈধ মা হতে হবে ।

ইউনিয়ান এখন দু’ভাগ ।

         বেচয়েন লাল দিনে কুড়িবার কমরেডি কাটিং চা খেয়ে-খেয়ে লিভার ক্যানসার নিয়ে হাসপাতালে, বাঁচবে না । ডাক্তাররা মার্কস লেনিন স্তালিন মাও সব বন্ধ করে দিয়েছে । বলেছে, চুপচাপ শুয়ে আরাম করুন । চন্দ্রকেতু সিং এই তালে ইউনিয়ান দখল নিতে না পেরে, গলায় রজনীশ লকেট ঝুলিয়ে ঘুরছে । মহাদলিত, দলিত, পিছড়াবর্গ আর মুসলমানদের জোট ননীদা আর মানসী পিছড়া জাত আর সুলতানা মুসলমান বলে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি । উঁচু জাত থেকে নিচু জাতের আওতায় চলে গেছে ইউনিয়ান ।

         বিহারের বাঙালিদের টিকে যাবার এটাও একটা প্রক্রিয়া হতে পারে, মনে হয় অতনুর ।

         প্রত্যেক চব্বিশ ঘন্টা পালা করে অনশন, রোজ দশজন, সিনিয়রিটি অনুযায়ী । অতনুকে দেখে শিবু পালিত রঙিন শর্টস সামলে রোমশ দাবনায় চাপড় মেরে উঠে বসে, ‘আপনাকে তো চেনাই দায়, ভেতো চেহারা পালটে শার্ট-প্যাণ্ট, গোঁফ কামিয়ে ফেলেছেন, আগেকার তেল-চুকচুকে চুলে শ্যাম্পু, চুল বাড়িয়ে পিগটেলে রাবার-বভাণ্ড , সেন্ট-পারফিউম কিছু একটা মেখেছেন । হলটিং থেকে বেশ সেভিং করেছেন মনে হচ্ছে । শিবু পালিতের সিগারেটের ফিকে নীল ধোঁয়ায়, এই বসন্তকালে, ছড়িয়ে পড়ছিল হেমন্তের শুকনো-হলুদ পাতা পোড়ানো আধভেজা গন্ধের আমেজ ।

         যারা তাস খেলছিল, নটা-দশটার অফিসমুখো সময়ের দ্রুতিকে জোর করে কুঁড়েমিতে ধরে রেখে, বোধহয় কম পয়সার জুয়া, অতনুর পরিবর্তনকে অনুমোদন জানালো ঠহাকার মাধ্যমে । অসাধারণ বিহারি অট্টহাসি এই ঠহাকা, শৈশব থেকে অমন করে হাসতে না শিখলে রপ্ত করা যায় না, অনেকটা ঠিঁউউউউ বা ফিঁউউউউউ আওয়াজ বেরোয়, যেন অবশ্যম্ভাবী ছিল অতনুর বদলে যাওয়া । শিবু পালিত কিন্তু বলল, যেন কিছু হয়নি, ‘সুশান্ত অবাক হয়ে যাবে ।’

         ‘সুশান্ত কোথায় ? আসে আপনাদের খোঁজ নিতে ?’

         পিপারিয়া বলে একটা জায়গায় ওদের অনেকটা জমিজমা আছে । সেই জমি হাতাবার জন্য ভাগলপুর গেছে ।

         ভাগলপুর ? পিপারিয়ে তো মুঙ্গেরে !

        ভাগলপুরের বাহুবলী গিরোহটার সাহায্য নিতে গেছে ।

        বাপরে ! কী বলছেন কি ? ওকে বাড়ি থেকে যেতে দিয়েছে কেমন করে ?

         বাড়িতে বলেনি কাউকে । মৌলিনাথকে বলেছিল ।

        ভাগলপুরের নাথনগর আর বিহপুর থানার কসমাবাদ, দুধলা, বৈকুণ্ঠপুর, তেতিস, অমরি, নকরটিয়া, অজমেরিপুর, ভগবতীপুর, দিলদারপুর, রত্তিপুর, ওদেদিয়া, কাহেওয়ারা, গিরিপুর, চোওহদ্দি, রাঘোপুর, গঙ্গাপুর, রসতপুর আর শাহপুর গ্রামগুলোতে রাজত্ব করে একদল খুংখার খুনি— তারিণী মণ্ডল, মলহোরিয়া মণ্ডল, ডুব্বা মণ্ডল আর সন্তান মণ্ডল । আধুনিক মানবসমাজের বাইরে ওই অঞ্চল । ইংরেজদের সময় থেকে কোনও তারতম্য হয়নি আজ ওব্দি এই গ্রামগুলোর মানুষদের জীবনধারায়, সংঘর্ষে, দারিদ্র্যে, শোষণে । যার যত পেশিশক্তি, তার ততো জমিন । ১৯৫৯ থেকে ভাগলপুরে গঙ্গানদীর তীরে একশো আটত্রিশটা গ্রামে ভূমি সংস্কারের চেষ্টা বারবার ভেস্তে গেছে । কাগজে-কলমে জমির মালিক যে-ই হোক না কেন, খুংখার গিরোহদের সমর্থনে দখল রাখতে হয় ছুঁচের ডগার সমান ভূখণ্ডও ।

         পিশাচদের অভয়ারণ্যে কত টাকা নিয়ে গেছে সুশান্ত ? এত দিনের ব্যবসা তাহলে এই টাকা তোলার জন্যে ? মলহোরিয়া মণ্ডলকে দিয়ে কাকে ঠ্যাঙাতে চায় ও ?

          শিবু পালিতকে অতনু বলল, ‘আপনার ভ্যানগার্ডদের দেখছি না ?’

         মামুদ জোহের তো প্রথম দিনেই দশজন মিলে ঢুকে গিসলো অনশনে । পিকনিকে বেরিয়ে গেছে । রাজগির । হরতালের ছুটিটা নষ্ট করে কী লাভ ? আমাকে কেউ খবরটা আগেভাগে দ্যায়নি । কিছুটা হেরো শোনালো শিবু পালিতের কন্ঠস্বর ।

         মানসী বর্মণেরবাড়ি জানেন ?

         কংকরবাগ কলোনি । কৃষিবিভাগের সিনিয়ার আগরওয়াল থাকে যে বিলডিংটায় । যাবেন নাকি ? যান, দেখা করে আসুন । একটা প্ল্যান আছে, ফিরে আসুন, তারপর বলছি ।

         রিকশয় চিড়াইয়াটাঁড় উড়ালপোল । এগজিবিশান রোড, রাজেন্দ্রপথের মোড়ে, ডাক্তার ভট্টাচার্যের কলইনিকের বাইরে রাস্তা ওব্দি উপচে পড়েছে শতছিন্ন শ’খানেক গরিব রোগির রোগাটে খ্যাংরাটে প্রায় খালিগা ভিড়ের ঠেসাঠেসি ।

          মোড়ের লাইট সিগনালগুলো মাঝরাতের মোদোমাতাল লরির ধাক্কায় দুমড়ে হেলে পড়ে দাঁড়িয়ে আবার কোনো কানা ট্রাকের ধাক্কা খাবার অপেক্ষায় আছে । বিজলি থাকে না বলে এমনিতেও দরকার নেই ওগুলোর । রিকশ থেকে নেমে পোলটা হেঁটে পার হয় অতনু । নামতে, চারিদিকে কাঁচা গু । লাফিয়ে লাফিয়ে পার হবার অভ্যাসে বাচ্চারা পোঁছে গেছে যৌবনে । ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে অনেকটা এগিয়ে আবার রিকশ নিল অতনু । রাস্তার দু’পাশে গোরু বাঁধা, নানা জাতের গোবরের ডাঁই । দেয়ালে ঘুঁটে ঠোকা একতলা বাড়ির মাথায় ডিশ অ্যানটেনা । তার পাশে-পাশে উঠেছে বহুতল, একের পর এক, বৈভবশালীরা দিল্লি থেকে টাকাকড়ি লুটে নিবেশ করছে ফ্ল্যাটে মালটিপ্লেক্সে মল নির্মাণে ।

         রাস্তার ওপর প্লাসটিকের ঝাঁপ ফেলে, তিসির তেলে পাম তেল মিশিয়ে কচরি-পকৌড়া ভাজছে খালিগা গামছাপরা ময়রামরদ । ধুলো ওড়ার ঋতু আরম্ভ হল।

          কলিং বেল টেপার কয়েক সেকেন্ডে সামান্য ফাঁক হয় চেনবাঁধা পাল্লা । টাঙাইল শাড়িতে মানসী বর্মণ, উদাসীন বহিরাবয়ব, সর্বতোমুখী পরিব্রাজক চাউনি, নিঃশব্দ উলুধ্বনির বলয়ে ঘেরা উচ্চারণ-উন্মুখ শরীর । দরোজা খুলে, ‘আরে, আপনি । চিনতে পারিনি প্রথমটা । চুল বাড়িয়ে রাবার বভাণ্ড বেঁধে পপস্টারদের মতন করে ফেলেছেন । অনেক দিন দেখিনি তো । কোথায় যেন গিয়েছিলেন । আসুননা, ভেতরে আসুন । বারমহল আর খাসমহল, আমার এই দুঘরের ফ্ল্যাট । ওপরের ফ্ল্যাটেই আগরওয়াল সায়েব থাকে । বড্ড ছ্যাঁচড়া । তাই চেন দিয়ে রাখি ।’

          অতনু আঁচ করেছিল অনেক লোকজন থাকবে মানসী বর্মণের বাসায়, থাকবে ধর্মঘটের রেশ, একাধজন নেতা সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্দু । পুরো ঘরটা আসবাব কার্পেট কিউরিওতে ঠাসা, সামলে চলাফেরার পরিসর । কোনও অজানা প্রতিপক্ষের কিংবা পরিচিত গোপন সঙ্গীর অনুপস্হিতির দুঃখ ছেয়ে আছে যেন । এই ঘরে একটা বাচ্চা খেলবে ভেবেই ভুল ভাঙে অতনুর । খেলতো ।

        দরোজা বন্ধ হবার আওয়াজ হতেই, ওপর থেকে নেমে এসেছে লুঙ্গিপরা সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত ছোঁকছোঁকে আগরওয়াল । ধর্মঘটের ছুটি লুটছে বাড়িতে বসে । মানসীর দরোজায় চাবির ফুটোয় চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে ভেতরে কী চলছে । কী করেই বা গর্ভবতী হল, সেই সন্দেহর নিরসন চায় আগরওয়াল । ঘরের দেয়ালঘড়িতে বাজনা বেজে ওঠে, যেন একাঙ্কের আরম্ভ । চাবির ফুটো থেকে অতনুর পাছা সরে গেলে পর্দা ওঠে ।

         মানসী : ( সোফায় বসতে বসতে ) আসুন না, ওখানটায় বসুন, জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসে । ধ্যাৎ, আপনি-আপনি করতে পারছি না । তোমাকে তুমিই বলছি । তুমি তো বেশ ছোটো আমার চে, তাই না ? ( ঘাম না থাকা সত্ত্বেও আঁচল দিয়ে কপাল মুছে ) তুমি তো কোথাও যাও না, কারোর সঙ্গে মেশো না বলে বদনাম । উন্নাসিক, না ? ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তরের উন্নাসিকতা, না ? কৌতূহল হলো বুঝি ? ইউনিয়ান এমন পাকিয়ে ফেলেছে ব্যাপারটা…

         অতনু : ( মানসীর পাশে ধপ করে বসে । পকেট থেকে পারফিউম বের করে এগিয়ে দ্যায় । মানসী হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে ) পুরো ঘটনাটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য । ননীদার বিয়ে তো রুপকথার গল্প । তারপর আপনার এই দুঃসাহসী কাজ । ইউনিয়ানও চাইছিল ম্যানেজমেন্টকে আক্রমণ করার ইশ্যু, পেয়ে গেল আপনাকে ।

         মানসী : ( মৃদু হাসি । মাথা নাড়িয়ে আলগা খোঁপার ঢল পড়ে যেতে দ্যায় কাঁধে পিঠে । ) ও বাবা, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানো । ( পারফিউমের ঢাকনি খুলে বাতাসে স্প্রে করে । ) আর কী হবে এসবে ? আমার গা থেকেই এখন মৃগনাভির গন্ধ বেরোয় । ( ডান হাতের তর্জনী রাখে হৃদয়ের জায়গায় ।) তোমার উচিত পারফিউম মাখা ; তোমার গা থেকে যৌবনগ্রন্হির গন্ধ বেরোচ্ছে । অবশ্য তোমার যদি প্রেমিকা থাকে সে অমন গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যাবে ।

         অতনু : আপনাকে দেখতে খুব ভালো, এত কাছ থেকেভ দেখিনি তো আগে, বলবে ভেবেও বলল না অতনু ।( তার বদলে ঝুঁকে পড়ে, মানসীর বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শোঁকে । ) হ্যাঁ, সত্যি, তালশাঁসের মতন গন্ধ ।

         মানসী : ( অতনুর চুলে আঙুল বুলিয়ে । ) দুর বোকা, তালশাঁসে কি মৃগনাভির গন্ধ হয় ? মাস্ক পারফিউমের নাম শোনোনি ?

         অতনু : ( আচমকা উদাসীন । ) কে জানে, গন্ধটা পেলে টের পাবো । কিন্তু আপনি এতো বড়ো ঝুঁকি নিলেন যে ! কিছু হয় যদি ? যদি কমপ্লিকেশান হয় ? ( সেই বুনো আর তেতো গন্ধের জন্যে আচমকা তীব্র হাহাকার হয় অতনুর । মনকেমন করে ওঠে । )

         মানসী : ( খরস্রোতা ভঙ্গীতে । ) কীইইই আবার হবে ! বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে আমার ছেলেমেয়ে ফোর-ফাইভে পড়ত এখন । ( চিন্তিত ভ্রুযুগল । )

         অতনু : ( মুখ ফসকে অথচ সরাসরি মানসীর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে । ) ছাড়লেন কেন ? সবাই বলে আপনি তালাক দিয়েছেন ।

         মানসী : হ্যাঁ, আমিই ছেড়েছিলুম । ( ক্ষুব্ধ ) হিজড়ে ছিল লোকটা ।

         অতনু : ( বিস্ময়ে ) হিজড়ে ? হিজড়েরা বিয়ে করে নাকি ! ( কথাগুলো বলে, মানসীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল, হয়তো মানসীর কথায় সত্যতার অভাব রয়েছে । )

         মানসী : ( পরাজিত হাসি ) সে হিজড়ে হতে যাবে কেন ! ছোটোবেলায় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিছু, তাইতে অ্যালিগো স্পারমিয়া হয়ে গিয়েছে । ডাক্তার দেখায়নি সময়মতো । পরে অ্যাজোস্পারমিয়া হয়ে গিয়েছে । ( উষ্মা ফুটে ওঠে । ) অমন বর থাকাও যা, না থাকাও তা । পোকাই নেই তো ডিম ফোটাবে কি দিয়ে ?

         অতনু : ( মানসীর মুখ আরও খুঁটিয়ে দেখতে-দেখতে । ) তাতে কী হয়েছে ! এখন যেমন করলেন, তখনও চুপিচুপি কারোর স্পার্ম নিয়ে নিতেন ।

         মানসী : ( অবাক । ) কী বলছ কি তুমি ! এখন ব্যাপারটা আলাদা । বর থাকতে ওসব করে কখনও কোনো বউ ? ঢি-ঢি পড়ে যেত । কেলেংকারির একশেষ । বরও মেনে নেবে কেন ? এখন যা করেছি তাতে কতো গর্ব বলো ইউনিয়ানের । টাইমস অফ ইনডিয়াতে বাংলা অ্যাকাডেমির জীবনময় দত্ত আমাকে নিয়ে ফিচার লিখেছেন, তা জানো ?

         অতনু : ছাড়াছাড়ির পর আবার বিয়ে করতে পারতেন ।

         মানসী : কুমারী মেয়েরাই বসে আছে, বিয়ে হচ্ছে না কতো মেয়ের, ডিভোর্সিকে কে বিয়ে করবে ?

         অতনু : কেন ? আমি ।

         মানসী : ( অতনুর চোখে চোখ মেলে, কিছুক্ষণ হতবাক ) তুমি ? পাগল নাকি ? ভেবেচিন্তে বলছ ? আগে বলোনি তো কখনও । ভালো করে কথাই বলতে না । বেশি-বেশি পড়াশুনো করো বলে একটা ভয়-ভয় ভাবও ছিল তোমার প্রতি । তোমার মা মেনে নেবেন কেন ?

         অতনু : ভেবেচিন্তে বলছি না । আবেগেও বলছি না । মাও মেনে নেবেন না, জানি । কিছুকাল আগে হলে আমিও এমন কথা বলতে পারতুম না । কীই বা এসে যায় তাতেও । কিছুই মানামানির দরকার হয় না মানুষের মতন থাকতে গেলে । জানেন, প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা শ্রদ্ধা লোভ সবকিছুই ক্ষণস্হায়ী । মুহূর্তটাকে ধরুন, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিন । বরকে যেমন ছেড়েছেন, পছন্দ না হলে আমাকেও ছেড়ে দিতেন । সিরিয়াসলি বলছি ।

         মানসী : ( বিস্ময় আর শ্রদ্ধা । ) কতো কথা বলতে পারো, সত্যি । তোমার চরিত্রের এই দিকটার সঙ্গে পরিচিত ছিলুম না ।

         অতনু : ( উঠে দাঁড়ায় । দরোজার দিকে এগোয় । ) কথায় আর কাজে মিল ঘটে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না ।

         মানসী : ( উঠে দাঁড়ায় । অতনুর হাত নিজের দুহাতে নিয়ে । ) আবার এসো, অ্যাঁ, আসবে তো ? চা-কফি কিচ্ছু খাওয়াতে পারলুম না ।

         অতনু : ( ম্লান হাসি । মাস ছয়েক আগে হলে মানসীর ঘর্মাক্ত স্পর্শে বজ্রপাত ঘটে যেতো স্নায়ুকেন্দ্রে । ) হ্যাঁ, আসবো ।

         দেয়াল ঘড়িতে পনেরো মিনিটের বাজনা বেজে ওঠে । অতনু দরোজার দিকে এগোলে, চাবির ফুটোয় একাঙ্কের যবনিকা । আগরওয়াল লুঙ্গি সামলে পা টিপে-টিপে ওপরে পালায়, আর মিসের আগরওয়ালকে হাঁপাতে-হাঁপাতে, ‘মওগিটা এবার একটা বাচ্চা ছোকরাকে ফাঁসিয়েছে।’

        বাইরে বেরিয়ে, ফ্ল্যাট-কলোনির গেটের কাছে, যেখানে বিষন্ন মুখটি নিচু করে বসে আছে করমচা-ঝোপ, রোদ্দুরকে আন্দাজমতন ধরে রেখেছে নরম সবুজ পাতা, সেখানে রিকশর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে অতনু ভাবছিল, মানসীর ছবিটা ছাড়তে চাইছিল না ওকে । মজুর আর কেরানির দোআঁশলা চাকরিতে গড়া এক চিন্ময়ী শরীরে কত অনায়াসে, সামান্য জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়, মাতৃত্বের সর্বব্যাপী প্রহেলিকা ঘিরে ধরেছে ।

         হাঁটল কিছুক্ষণ । যেতে চাইছে না কোনও রিকশ । হুড তুলে উর্দ্ধমুখী ঠ্যাঙে আরম্ভ হয়ে গেছে ভাতঘুম । পাতলা ডাল কাঁচা লঙ্কা সহযোগে প্রচুর সেদ্ধভাতের নেশাময় হামেজের ঘুম ।

         ওর নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে চায়ের ঝুপড়িটায় দু-জন অফিসারকে দেখতে পায় অতনু । অরুণ মুখোপাধ্যায় আর তার ভায়রাভাইয়ের ছোটোভাই মলয় রায়চৌধুরী । চায়ের এইসব ঠেকগুলোয় পোস্তফলের খোসা আর এলাচ দিয়ে চায়ের পাতা দুধে ফুটিয়ে চা হয়, কড়ক চা । চেনা খদ্দেররা গাঁজা ভাঙ চরস আফিম তাড়ি খায় ; ঝকঝকে রোদে এই সমস্ত নেশার আলাদা আমেজ হয় ।

         –মিস বর্মণের বাড়ি গিসলে ?

          –হ্যাঁ ।

         –রূপের খোলতাই কেমন দেখলে ?

         –আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিও সব মিটমাট হয়ে গেলে ।

         অনুনাসিক দোষে দুষ্ট এক মিনিবাস এসে দাঁড়াতে, এদের দুজনকে এড়াবার জন্যে, বাসটার গন্তব্য না জেনেই উঠে পড়ল অতনু । নামল গিয়ে পাটনা স্টেশানের স্টপেজে । দুপুর রোদ্দুরেও হনুমান মন্দিরে পূণ্যার্থীর কাতার, শালপাতায় প্যাঁড়া আর গাঁদাফুল । গাঁদাফুল বোধহয় সব ঋতুতেই হয় আজকাল ।

         রিকশ পেতে অসুবিধা হল না । ফ্রেজার রোড ধরে আকাশবাণী ক্লার্ক অবধ হোটেল হাথুয়াকোঠি সুলভ শৌচালয় পার হয়ে পৌঁছোয় ধর্মঘটিদের তাঁবুতে ।ঘুমোবার ভান করছে বা ঘুমিয়ে পড়েছে অভুক্ত হরতালিরা । রাস্তার উড়ন্ত ধুলো এসে সাঁতরাচ্ছে প্লাসটিক বালতির অলস জলে । একঘেয়েমি থেকে চাগিয়ে ওঠা ক্লান্তিতে ভরপুর তাঁবুর বসন্তকালীন বাতাস । নিস্তেজ সংঘর্ষের গতানুগতিক উদ্দেশ্যহীনতায় গন্তব্য খোঁজার জন্য পড়ে আছে এই একপাল মরদ । তাঁবু জুড়ে ঘামনিঃসৃত যৌবগ্রন্হীর গন্ধ ।

         শিবু পালিতের সতরঞ্চিতে বসল পা ছড়িয়ে অতনু । জুতো-মোজা খুলে রাখে একপাশে । তাঁবুর একটা ছ্যাঁদা দিয়ে রোদ্দুরের আনাগোনা এমন চলছিল যে সেটাকে এড়িয়ে অসুবিধে হচ্ছিল যুত করে বসতে। বিষুব রেখার এপারে আসছে বোধহয় বসন্তকালের সূর্য । সেই ঝোঁকে অতনুকে বিরক্ত করছে খানিক ।

         ঢুলতে আরম্ভ করেছিল অতনু, শিবু পালিত ভেঙে দিল তন্দ্রা, ‘আরে চক্রবর্তী, ফিরলেন কখন ? আঃ, প্যান্টের ক্রিজ খারাপ হয়ে গেল তো । এদের উচিত ছিল চেয়ার-ফেয়ারের ব্যবস্হা রাখা,’ দু কনুইতে ভর দিয়ে, বুক আর মুণ্ডু উঁচিয়ে শিবু পালিতের উক্তি ।

         –কখন থেকে না-খেয়ে আছেন ?

         –কাল সন্ধে থেকে । ছটা থেকে ছটার ডিউটি ।

         –খিদে পায়নি ?

          –রাত্তিরে আর সকালের দিকে তেড়ে পেয়েছিল ; দু’ফুঁক মেরে সামলে নিয়েছি ।

         –সিগারেট খেলে খিদে মরে যায় ? আমিও সকাল থেকে খাইনি কিছু । দিন তো একটা, দেখি টেনে ।

         –সিগ্রেট কে বললে ! চরস, হ্যাশিশ । বেশ মিষ্টি । মিষ্টিখোর বাঙালির জন্যে এরচে প্রিয় আইটেম নেই । শালা এখানকার লোক গাঁজা ভাঙ তাড়ির বাইরে বেরোতে পারল না ।

         –কই দেখি ।

         –নিন, আলতো টানবেন, নইলে কাশি পাবে ।

         নয়ানাভিরাম ধোঁয়া খায় অতনু, রসিয়ে । ক্রমশ চোখের ওপর থেকে কপালের দুপাশ ফাঁকা । জিভ আর মাড়ি সুকোয় । স্মৃতির টুকরো ভাসমান । একাধিক ইঁদুর বিষ খেয়ে মরে পড়ে আছে তবু তাদের ওপর গুলি চলছে । অবিস্মরণীয় স্মৃতিভ্রংশ । রাস্তার ওপারে টেলিফোনের তারের ওপর কাক-পরিবারের কুশীলবদের সমবেত অভিনয় ।

         অতনুর কানে তুলো গুঁজে দিয়েছে কেউ, ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম ঝিম । পেতলের খোকা কৃষ্ণের হামাগুড়ি, মানসী বর্মণের কাচের আলমারিতে । দু’কানের পাশে নাছোড় বাতাসের পীড়াপীড়ি । মাছি মূমাছি বোলতা ভ্রমর ভিমরুল গঙ্গাফড়িঙের ধাতব গুঞগজন । বিজ্ঞাপনের মডেল তারকা সাবান মাখতে মাখতে হাসছেন হোর্ডিং জুড়ে । বাহ্যজ্ঞানশূন্য আদুলগা । মানসী বর্মণ আদুল গা ! মাথা নাড়িয়ে ছবিটা মুছতে চেষ্টা করে অতনু । ঘাড় নিচু করে বসে থাকে কিছুক্ষণ

         –খিদে তো যায় না । শুধু নেশা হয় । স্মৃতিতে অদ্ভুত সব অবিশ্বাস্য ছবি ভেসে উঠছিল, বাকি অংশটা শিবু পালিতের হাতে দিয়ে বলল অতনু ।

         –ব্যাস । কাৎ হয়ে পড়ে থাকুন ; মাথা ঘুরতে দেবেন না, মাথা ঘুরতে দেবেন না,  ঘুমিয়ে পড়ুন চোখ বুজে, মৌতাত নিতে থাকুন, এনজয় করুন । মৌতাত কেটে গেলে বাড়ি যাবেন । আপনার অনশানের পালা কবে?

          –কে জানে ! খোঁজ নিইনি । আমার মাথা কিন্তু কোনো কারণেই ঘোরে না ।

          শৈবাল পালিত কন্ঠস্বর নামায়, প্রায় ফিসফিস, ‘চলুন না কালকে রাজগির, আমাকে নিতে ওরা ভ্যান পাঠাবে সকালে । আমার বাড়িন জানেন তো ? আশিয়ানা বিলডিং । এসে যান ভোর ছটা নাগাদ ।’

         –আচ্ছা, আপনারা ঠিক কী করেন ? ঠিক কী ধরণের ফুর্তিফার্তা ? নাচ-হইহল্লা, না কী ?

         –চলুন না । মানব জন্ম তো একবার ।  কিন্তু আমি তো আপনাদের মতন গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারি না ।

         –ওও, ডিয়ার, ইংরেজিতে কথাগুলো ভালগার মনে হয় না । হিন্দি-বাংলায় কেমন যেন ডার্টি আর অবসিন মনে হয় । বাংলায় ফাক কান্ট শিট বুলশিট আসহোল মাদারফাকার ফাকইউ বলা যায় ? ছি ছি । ইংরেজিতে মা আর দিদির সামনেও বলা যায় । আর আপনি তো শেক্সপিয়ার টিএস এলিয়ট আওড়াতে এক্সপার্ট । ঝেড়ে দেবেন দুচার লাইন কেউ ট্যাঁ-ফোঁ করলে ।

         –ঠিক আছে । পৌঁছে যাব ।

         মৌতাত কেটে গেলে অতনু বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুম থেকে উঠে চা তৈরি করে । অবাক মা ।

       –বিদেশ থেকে শিখে এলি বুঝি ? তোর বাবা তো সব পারত । বড়ি দিতে পারত, জানিস ?

        –তোমায় আর কিছু করতে হবে না । কালকে অবশ্য যাব এক জায়গায়, ফিরতে দিন দুয়েক লাগবে ।

      –হ্যাঁ, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটু মেলামেশা কর । আর কত দিন মুখে বই গুঁজে ঘরকুনো থাকবি !

         ম্যাটাডর ভ্যানটা পার্ক করা ছিল শিবু পালিতের ফ্ল্যাটবাড়ির রাস্তায় । গাড়িতে ঢুকে অতনু দ্যাখে শিবু আগে থাকতে ড্রাইভারের সিটে, ছিটের রঙচঙে বুশশার্ট আর জিনস-ছিঁড়ে হাফপ্যান্ট । ফর্সা উরুতে ঘন কোঁকযা চুল । কিছুক্ষণ পর গাড়ি গিয়ে ঢোকে গোলঘরের পেছনে এক ঘিঞ্জি গলিতে । ঘিঞ্জি বলতে কালচে কাঠ, ফ্যাকাশে প্লাস্টিক, ত্যাবড়ানো টিনের দেয়াল, বাঁশের নানা মাপের বেড়ের খুঁটি, আধপচা নারকেল দড়ি, হলুদ নাইলন দড়িতে বাঁধা, খরখরে চুনবালি, চটের পর্দা, উদাসীন বুড়ো, টিনের ডিবে হাতে গঙ্গার পাড়ে হাগতে যাচ্ছে গামছাপরা মাস্তান ছোকরা, দাঁতনরত ল্যাঙটপরা ষণ্ডা ।

           স্তুপের আকারে ১৭৮৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন জন গার্সটিনের পরিকল্পনায় তৈরি গোলঘরে এখনও চোদ্দ লক্ষ টন চাল বা গম মজুত রাখার ব্যবস্হা আছে ; ১৭৭৭ সালের বাংলা-বিহার দুর্ভিক্ষের পর তৈরি হয়েছিল ১৪৫টা পাকানো সিঁড়ির গোলঘর । তারই পেছন দিকে দারিদ্র্যের চূড়ান্ত ।

           ‘একজনকে পিক আপ করতে হবে,’ শিবু পালিত নেমে যায় আর মিনিট পনেরোর মধ্যে ফিরে আসে কালো কুচকুচে ছিপছিপে এক যুবতীকে সঙ্গে নিয়ে, দু’হাতে প্লাসটিকের আসমানি চুড়ি, নাকে ফিরোজা পাথরের নাকছাবি । কালো শিফনের শাড়ি, আসমানি ব্লাউজ, চুলে চাঁপাবেলির গোড়ে, চোখে আইলাইনার । এরকম একটা অখদ্যে জায়গায় থেকেও মেয়েটা কত টাটকা উচ্ছল প্রাণবন্ত সপ্রতিভ চনমনে । দারিদ্র্যের মধ্যে কোথায় অস্তিত্বের স্পন্দন তাও ঠিকমতন খুঁজে নিজেদের আনন্দকে প্রবাহিত রাখছে মানুষ ।

         ওদের দুজনের মাঝে ঝপাং বসে পড়ে মেয়েটি, তার ছোঁয়াচে প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে অতনুর দিকে অনুসন্ধিৎসু চাউনি ।

         ‘আপনাকে দেখিনি তো আগে কখনও,’ কোলের ওপর রাখে ওড়িশার পিপলি গ্রামের কাঁধ ব্যাগ, কথায় খাঁটি বিহারি টান ।

         –না, ও এই প্রথমবার আমাদের সঙ্গে । ওর নাম অতনু ।

         –আর আমার নাম শেফালি । সবাই আমাকে টু বলে ডাকে । আরে, তোমার হাত কত নরম, তোমার হাত কি ঘামে ?

         ‘তোমার কথায় অত হিন্দি টান কেন ?’ অতনু জানতে চাওয়ায় মেয়েটি জানায় তার বাবা বিহারি মা বাঙালি । কলকাতার কাছে চটকলে ওর বাবা মজুর ছিল । বাবার সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল মা । মা কিন্তু বামুন বাড়ির মেয়ে, হুঁ । বাবারা দেওঘরের বাউরি ।

         –দেওঘরের বাউরি ? ওরা তো বাঙালি । বলল অতনু ।

         শিবু পালিত বলল, ‘না হে, এ বাউরি সে বাউরি নয় । দেওঘরের বাউরিরা পাণ্ডাদের বাসন মাজত আর এঁটোকাঁটা খেত আগেকার দিনে ।

       –আর এখনকার দিনে তোমরা আমাদের খাও, তাই না ? শেফালি বলল সামনের আয়নায় দুজনের দিকে তাকিয়ে ।

         –পেলে খাই । শিবু পালিত বলল শেফালিকে ।

          –হুররররররেএএএএ । চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েটি আর দুহাত দুজনের কাঁধে রেখে নিজের দিকে টানে যার দরুণ গাড়িটা হঠাৎ মাঝরাস্তা থেকে বাঁদিকে প্রায় ঘাসের ওপর চলে যায় ।

         –এই টু, অ্যাকসিডেন্ট হবে রে !

         অতনু হিমশিম । কী ধরণের চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে জানে না । মুখে ধুলোমাখা রোদ-কণিকার দল হুড়মুড়িয়ে উঁকি মারে গাড়ির জানলায় । কিছুক্ষণেই নোংরা হয়ে যায় শার্শি ।

        ‘তোমার ভুরু, চোখের পাতা আর চুলে ধুলো জমছে,’ অতনুর বলা শেষ হবার আগেই মেয়েটি তার মুখ আর মাথা মুছে ফ্যালে অতনুর বুকে । শার্ট নোংরা হওয়া সত্ত্বেও অতনু স্পর্শমুগ্ধ । ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে পুরুষকে মুহূর্তে আড়ষ্ট করার নারী সুগন্ধ –এই নারী-সুগন্ধের সঙ্গে পরিচিত ছিল না অতনু, কাঁচা তারুণ্যের সন্মোহক গন্ধ ।

         ‘এবার তোমরা কতজন গো ?’ শিবুকে জিগ্যেস করে টু ।

        ‘ষোলোজন । অতনুকে নিয়ে সতেরো । কাহিল হয়ে যাবে না তো ?’

         ‘আমি ? তোমরাই ভিরমি খাবে একে-একে । সবাইকে জানি কার কত মুরোদ । একটুতেই জিব বেরিয়ে যায় । কত টাকা করে দিচ্ছে সবাই?’

          ‘পনেরোশো করে, সবসুদ্ধ চব্বিশ হাজার, অতনুকে ছেড়ে।’

          ‘আমার কাছে হাজার দুয়েক টাকা আছে।’ বলল অতনু, মেয়েটির দিকে আয়নায় তাকিয়ে ।

         ‘ও বাবা, নতুন হলে কি হবে ! এতো ডুবে-ডুবে জল খেতে চাইছে গো । আটঘাঁট বেঁধে বেরিয়েছে।’         অতনুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শেফালি, তারপর শিবুর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে, ‘কোথায় হবে ব্যাপারটা ?’ ছাড়ে না অতনুকে ।

         ‘নালান্দায়, ধ্বংসাবশেষে তোমাকে গড়ে তোলা হবে, বুঝলে ভিক্ষুণী।’

         অতনুকে ছেড়ে দিয়ে, ‘ঘরভাড়া নেয়া হয়ে গেছে ? খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্হা ? এবার কে তোমাদের নেতা গো ?’

       ‘এবার কো-অর্ডিনেটার রবীন দত্ত ।’

         ‘চশমা পরা, ঢ্যাঙা, সে ?’

         ‘হ্যাঁ।’

       ‘ওঃ, খুব জমবে ।’

        হকচকিয়ে অভিভূত অতনু । রাইখয়রার মতন এমন ফুরফুরে এক ছিপছিপে অপলকা শ্যামাঙ্গী, এক ঝটকায় এক হাতে তুলে নেবার মতন সুঠাম কোমর, ঝোটন বুলবুলির কোঁকড়াকুচি চুল, গলায় আসমানি পুঁতির মালা, কানে নকল মাকড়ি, পাতলা ঈষদুষ্ণ ঠোঁট, ফটিকজল চাউনি, এই অতি সাধারণ প্রাণচঞ্চল মেয়েটা মরে যাবে না তো, এতগুলো ভুখা জোয়ান মরদের ঝাপটায় ।

         ‘কি দেখছ গো অমন করে?’ মেয়েটি জিগ্যেস করে অতনুকে ।

         ‘তোমাকে ।

         ‘আমাকে ? এই নাও দ্যাখো, আমি আমার মায়ের কোল অন্ধকার করে জম্মেছিলুম তো, তাই সবাই আমাকে দেখতে চায় ।’

         আচমকা অতনুর নাকে নাক ঠেকিয়ে চোখে চোখ রাখে শেফালি । দৃষ্টি আর হাঁ-মুখের সোঁদা শ্বাসে, পলকে, বনসৃজন ঘটে যায় অতনুর অনুভূতিতে । পৃথিবীর অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে যাবে এই নারীর যৌবন ফুরিয়ে গেলে । জীবন তো কেবল একবার, কালকেই বলেছিল শিবু, যা যায় তা আর ফেরে না ।

        ‘তুমি প্রেম-টেম করোনি এখনও ?’ জানতে চায় শেফালি । নাক থেকে নাক তোলে না, চাউনিও বিঁধছে অতনুকে । নিজের হাঁ-মুখে মেয়েটির নিঃশ্বাসকে সেঁদিয়ে যেতে দেয় ও ;  শেফালি আবার অতনুর কোমর জড়িয়ে ধরে, বলে, ‘তোমার মতন ঝুঁটি-বাঁধা কারুর সঙ্গে এখনও প্রেম করিনি ; চুলের ওই ঝুঁটি খুলে দু’হাতে টেনে যা প্রেম হবে না, টেরটি পাবে কারে প্রেম কয় ।’

          ‘প্রেম করিনি, ট্রেম করেছিলুম । দুটো জাপানি পরির সঙ্গে । তারা উড়ে চলে গেছে আমায় ফেলে ।’ অতনু চুমু খাবার ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে নাক থেকে নাক সরিয়ে নিয়ে বলল ।

         ‘দু’জন ! হুঃঁ । একটাকেই সামলাতে পারবে না ওই নাদুস চেহারায়, তো দু’জন । দেখব অখন একদিন ; চোলো একদিন দেখব কে আগে দৌড়ে গোলঘরের ছাদে পৌঁছোয় ।’

         ‘তুমিই জিতবে, তোমাকে আমি জেতাবোই, গোলঘরের টঙে উঠতে হোক বা ট্রেমে।’

         ‘হারজিত ছাড়া আর ভাবতে পারো না তোমরা ? দুজনে হাত ধরে উঠব, দুজনেই জিতব ; ট্রেমেও হারজিত হয় না মোশাই, বুঝলে ? যেদিন আমার সঙ্গে ট্রেম করবে সেইদিন জানতে পারবে ; একসঙ্গে দুজনের আনন্দকে একই সময়ে মিশিয়ে ফেলতে হয়, তবে তো প্রেমের জয় ।’

          ধুলোবালি মেখে আত্মনিমগ্ন বিকেলে, বক্তিয়ারপুরে, ঢাবায় রুটি-তড়কা খাবার পর, রাজগিরে এক বাগান বাড়িতে পৌঁছোলে স্বাগতম জানায় দলের বর্তমান অভিভাবক রবীন দত্ত আর বাড়ির মালিকের ছেলে নোট পৃইক্ষক দু-নম্বর দেবেন্দর প্রসাদ । অতনুকে পেয়ে সকলের হই হই, নতুন মোরগ মুবারক । গেট দিয়ে ঢুকেই ভঠ্গীসর্বস্ব পাম গাছের সারি এগিয়েছে দু-দিক থেকে । পোর্টিকো ওব্দি । ইংরেজের তেলমারার খরচে তৈরি গথিকধাম জমিদারি একতলা।

         দেবেন্দর যখন ফার্স্ট ইয়ারে, ওর নাকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কন্যাপক্ষ ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়েছিল । সে বউকে আনেনি বাড়িতে । পাঁচশো বিঘে ধানক্ষেতের লোভে বিয়ে করেছে আবার । পালামৌ-এর বালুমঠ ব্লকে ওদের পুসতয়নি বাড়ি । বিনোবা ভাবেকে অনেক জমি বিলিয়ে ছিল দেবেন্দরের বাবা জ্যাঠা কাকা । লেঠেল লাগিয়ে কেড়ে নিয়েছে সে সব পাথুরে কাঁকুরে জমি বিরহোড় আদিবাসীদের থেকে । চাষিদের নিজের জমিও মেরে দিয়েছে এই তালে । ওদের গ্রামে রিলিফের টাকাটাই প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ফসল । ওদের এককালের জমিদারির প্রজা যারা এখনও প্রজাত্ব ছাড়িয়ে বেরোতে পারেনি, সেই বিরহোড় উপজাতিরা থাকে কুমভা নামের ঝুপড়িতে । বঁধুয়া মজুর সব ।

         এখন বনপার্টির জোয়ানরা উপজাতিদের জলপাই পোশাক আর বন্দুক হাতে দিয়ে ঘন জঙ্গলে প্রশিক্ষিত করে তুলছে ; এতকালের জমিদারির বদলা নিতে চাইছে তারা । দেবেন্দর জানে মারামারি-কাটাকাটি অনিবার্য । তার আগে বেঁচে থাকার যাবতীয় মজা লুটে নাও ।

         রাজগিরের এই বাড়িটার এখানে-সেখানে এখনও ল্যাংটো পাথরের এলিয়ে-পড়া বিদেশিনীরা । আম্রপালীর উরু আর নিতম্বে গড়া ভেনাস । উর্বশীর খোলা স্তন মেলে হেলে রয়েছেন হেলেন অফ ট্রয় । শকুন্তলার কটাক্ষ বিলোচ্ছেন মার্বেল পাথরের শীতল ক্লিওপ্যাট্রা । দেশ ছেড়ে যেতে পারেনি এ-সমস্ত জারজ মেমের দল ।

বাঘপায়া মেহগনি পালঙ্কের লাল হলুদ সবুজ কাঁচ জানলার বিশাল টিমটিমে ঘরে অতনুকে পৌঁছিয়ে রবীন দত্ত বলল, ‘রাত্তির সাড়ে আটটায় ডাইনিং হল ।’

         তৈরি হয়ে পৌঁছোয় অতনু । বিরাট লম্বাটে ডাইনিং টেবিল সাজানো কাচের প্লেট গেলাস স্টেনলেস স্টিলের ছুরি কাঁটা চামচ আর শাদা ভাঁজকরা রুমালে । দেবেন্দর প্রসাদ দুটো কাঁধ-উঁচু চেয়ার দেখিয়ে অতনুকে অবিশ্বাস যোগায়, ‘এইখানে বসেই এডউইনা মাউন্টব্যাটনকে প্রথম চুমু খান জোহারলাল নেহেরু।’

         ঠহাকা হাসির মাঝে কেউ বলে উঠল, ‘আর এডউইনা ওনাকে বলেন, মত ঘাবরাও, তুমহারা কাম হো জায়গা ।’

রবীন দত্ত তদারক করতে করতে জানায়, ‘ওকে বিশ্বাস করবেন না । গতবার আমাদের বেলেছিল এই ঘরে বসে হিন্দু কংগ্রেসিরা আবদুল বারিকে খুন করার প্ল্যান করেছিল ।’ রবীন দত্ত সবাইকে অনুরোধ করছিল, কেউ যেন মদ না খায়, নেশাভাঙ না করে,  আজেবাজে জিনিস না খায়, এমনকি এখানকার জলও নয় । খনিজ জলের বোতল রাখা আছে ঘরে ঘরে । খেয়েদেয়ে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন । শরীর খারাপ করলে চলবে না । কালকের জন্যে চাঙ্গা থাকতে হবে সবাইকে ।

         অতনু দেখল দূরে বসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাসছে শেফালি । বাতাসে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে ওর খোঁপার ফুলের সুগন্ধ । একেই বোধহয় মথিত হওয়া বলে ।

         কম মশলা দেয়া মাংস, সেদ্ধ সবুজ সব্জি, লেটুস বিট গাজরের স্যালাড, আটা আর বেসনের রুটি, ভাত আর পুডিং । পাশে-বসা অসীম পোদ্দারকে অতনু , ‘ওই তো একরত্তি মেয়ে’, বলে প্রশ্নবাচক হতে চাইলে, অসীম বলে উঠল, একরত্তিদের হ্যাণ্ডল করে বেশ তৃপ্তি ।’ তারপর অতনুকে দেখে বিস্মিত, আর গলা নামিয়ে, ‘কেমন আছে জুডি-জুলি ? সুখে আছে তো ওরা ?’

          পরিষ্কার হয়ে যায় এবার, কার নির্দেশে তাকে ইংচুগার খরিদনারীদের আড্ডায় তোলা হয়েছিল । অতনুর বুকের কাছে মাথা এনে আপ্রাণ ঘ্রাণের পর অসীম পোদ্দার, ‘এখনও স্বর্গের গন্ধ যায়নি আপনার গা থেকে । কোনোদিন যাবে না দেখবেন । ওটাই তো আনন্দ, কী বলেন !’

          অতনু থ । অভিজ্ঞতার অংশীদার আড়াল থেকে এভাবে বেরিয়ে এলে নিজের অভিমানবোধ ওকে খেলো করে । নানা উপাদেয় রান্নার স্মৃতির দরুণ সেদ্ধ খাবার মনে হচ্ছিল জোলো ।

কাল সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট আর ন’টায় সবাইকে গাড়িবারান্দায় পৌঁছতে হবে । জানিয়ে চলে গেল রবীন দত্ত । আঁচাবার সময় অশোক চোপড়াকে জিগ্যেস করেছিল অতনু, ‘আজকে কার ঘরে শোবে শেফালি ?’

           ‘আজকে ? কেন ? আজকে ও একলাই শোবে !’ অশোক চোপড়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সুশীল, সে জানিয়ে দিল ওপর-পড়া হয়ে ।

         বরাদ্দ ঘরটায় পৌঁছে অতনু নিজের অভিজ্ঞতার অভাবের সঙ্গে পরিচিত হয় আবার । একটা পায়জামা ধুতি বা লুঙ্গি আনা উচিত ছিল । আনেনি । জামা কাপড় খুলে উলঙ্গ শুয়ে পড়ল অগত্যা চাদর ঢাকা দিয়ে । শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল, এতো ফুর্তিফার্তা নেশাভাঙ হই-হুল্লোড়ের ঘন-ঘন খরচ কোথা থেকে জোগায় সবাই ! মাইনে কি বাড়িতে দিতে হয় না একটুও ?

          তন্দ্রার মধ্যে অতনু টের পাচ্ছিল, বাইরে, দ্রুতলয়ে ঝিঁঝির ডাক অন্ধকারকে ফেনিয়ে তুলছে ।

সকালে স্নান করে ডাইনিং হলে হ্যালো-হাই, ব্রেকফাস্ট করছে, নিজের সঙ্গে নিজে নিঃশব্দ মন্ত্রণা করতে-করতে চলে যাচ্ছে । টেবিলে তখন পুলক, মামুদ জোহের, কমলেশ আর দেবেন্দর । পোচ টোস্ট কলা কফি । টু বোধহয় খেয়ে চলে গেছে কিংবা আসেনি এখনও । ভিড়ে কথা বলাবলি কম । দু’একজন হলে কথা বলার সুবিধে । এতকাল ধরে বজায় রাখা দূরত্বে কী কথাই বা কার সঙ্গে বলবে ! কোন বিষয়ে ? খেলা ? বিহারের রাজনীতি ? বিজ্ঞান ? মেয়েমানুষ ? অফিস ? ইউনিয়ান ? মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ?

         খেয়ে নিল চুপচাপ, মুখ নিচু করে ।

         বাইরে, পোর্টিকো থেকে এগিয়ে, গেটের কাছে হলুদ কল্কে ফুলের ভেতরে সেঁদিয়ে কারিগর মৌমাছিরা তখন কারচুপির গুঞ্জন চালাচ্ছে । অতনু দেখল অ্যামবাসাডর গাড়িগুলো ভরে গেছে । ভ্যানে ড্রাইভারের সিটে আত্মমগ্ন মামুদ জোহের । অনেকে ম্যাটাডরের পেছনে ; অতনুও বসল তাতে । বাড়ির ভেতর থেকে রবীন দত্ত আর টু বেরিয়ে আসতে সবকটা গাড়ি থেকে শেফালিকে আবদার জানানো হল তাদের গাড়িতে বসার জন্য ।  শেফালি মামুদ জোহেরের পাশে গিয়ে বসতে, রবীন দত্তও উঠল তাতে । স্টার্ট দ্যায় গাড়িগুলো ।

         রাস্তার দু’পাশে কচিসবুজ কচিমেরুন পাতার ঠাণ্ডা বাতাস । একটু পরেই রোদের তাত আরম্ভ করবে ধুলো ওড়ানো । কচু খেতে জল দিচ্ছে কৃষক । ফসল কেটে তুলে নিয়ে যাবার পর সোনালি গোড়া । সেচের অভাবে মাঠের পার মাঠ তেপান্তর । বাবলা গাছের কাঁটাঢ্যাঙা ঝাঁকড়া । দূরে, পোড়ামাটির ছাপ্পর-ছাওয়া গ্রাম । সবকিছু কত উদাসীন, যেন গৌতম বুদ্ধের পরের সময়কার উদাসীনতা থেকে মুক্তি পায়নি উন্মুক্ত প্রান্তর ।  যৌথ সন্ত্রাস, জাত-ঘৃণা আর পার্থিব মালিকানার নিষ্ঠুর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কত চুপচাপ লুকিয়ে রেখেছে নিসর্গ । ঠাণ্ডা মাটির দেয়ালে অন্ধকারাচ্ছন্ন হেলান দিয়ে আছে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়ের মতন প্রায় সব বাড়িতেই দাঁড়িয়ে আছে তরতাজা ভালা বরছি গঁড়াসা কুঠার গাদাবন্দুক পেতলসোঁটা ।

         পৌঁছে গেল ওরা নালান্দার ধ্বংসাবশেষে । বোধের অতীত মনে হল অতনুর । যিশুখ্রিস্টের পাঁচশো বছর আগে জায়গাটা ছিল বৌদ্ধ মহাবিহার, চিন তিব্বত ইরাক সিরিয়া মধ্য এশিয়া থেকে দশ হাজার ছাত্র এসে পড়ত এখানে ; আর দু’হাজার শিক্ষক ছিল, বিশাল গ্রন্হাগার ছিল । জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, নাগার্জুন, কতো জ্ঞানীগুণী এসেছেন এখানে । জায়গাটাকে দুর্গ মনে করে বখতিয়ার খিলজি ধ্বংস করে দিয়েছিল, গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দিয়েছিল । বইয়ের ওপর শাসকদের এতো রাগ কেন কে জানে । বৌদ্ধধর্মের অবসানের সঙ্গে নালান্দার অবসান । আর আমরা তাদেরই উত্তরপুরুষ, শেফালিকে নিয়ে ফুর্তিফার্তা করব । অবিশ্বাস্য । কিন্তু কিছু করার নেই । দেখা যাক সবাই কী করে, ভাবল অতনু ।

         গাড়িগুলো থেকে সবাই নেমে গাছের ছায়ায় দাঁড়ালো । কালো চশমায় শেফালি । কচি কলাপাতা অরগ্যাণ্ডি । কাঁধে লাল-সবুজ ঝোলা । পিঠে ছড়ানো আধভিজে এলোচুল ।

        ‘আচ্ছা, যারা কালো, তারা বিদঘুটে পোশাক পরে কেন ?’ কন্ঠস্বর নামায় পুলক । আরও ফিসফিস কন্ঠে অশোক চোপড়া, ‘আমি আজ ওব্দি এত কালো মেয়েমানুষকে নেকেড দেখিনি। ওর মাইটা কেমন হবে, বোঁটা, তার চারিধারের গোল ? সেক্সের জন্যে নয়, জাস্ট দেখার জন্যে ।’

           সত্যি, জুলি-জুডির থেকে একেবারে আলাদা এই অজানা পৃথিবী । প্রেম আর পারভারশানে বোধহয় তফাত নেই । শেফালির ট্রেম ।

             সকলে রবীন দত্তকে ঘিরে ধরলে আরম্ভ করে ইউনিয়ান নেতার বাঁধাগৎ-বক্তৃতা । ‘ফ্রেণ্ডস রোমানস কান্ট্রিমেন, লেণ্ড মি ইয়োর ইয়ার্স । ও ! জাজমেন্ট, দাও আর্ট ফ্লেড টু ব্রুটিশনেস, অ্যান্ড মেন হ্যাভ লস্ট দেয়ার রিজনস…শেফালি পাবে পাঁচ হাজার…যে জিতবে সে পাবে শেফালিকে আর দশ হাজার…বাদবাকি রাহা-খাওয়া…দেবেন্দর ওর চাকর চাকরানিকে হুকুম দিয়ে এসেছে একটা ঘরে ফুলশয্যা তৈরি করে রাখতে…যে জিতবে তার জন্যে…খরচের অ্যাকাউন্ট অডিট করে প্রমাণপত্র দেবে অশোক চোপড়া…শেফালি নালান্দার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে চলে যাবার আধঘণ্টা পর যাবে বাকি সবাই…যে সবচেয়ে আগে শেফালিকে পাবে সে জিতবে…খুঁজে পেলে ওকে ধরে রাখতে হবে…এনে গাড়িতে অপেক্ষা করবে সবাই না ফেরা ওব্দি…ইচ্ছে করলে শেফালি যতবার ইচ্ছে হাত ছাড়িয়ে পালাতে পারে…যে একবার বাইরে বেরিয়ে আসবে সে ডিসকোয়ালিফায়েড…গুড লাক।’

         কেউ কেউ কাছ থেকে সত্যিই খুঁটিয়ে দেখল শেফালিকে । টু-ও ঠোঁটের কোণে হাসি । যৌনতার চিটফাণ্ড তাকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে । এক বৃদ্ধ ট্যুরিস্ট, গবেষকও হতে পারেন, দাঁড়িয়ে রবীন দত্তর বক্তৃতা শুনছিলেন, গজগজ করতে করতে চলে গেলেন সস্ত্রীক ।

         কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে শেফালিও চলে গেল বৌদ্ধ মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষে , প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ।

ভেতরে গিয়ে খিদে তেষ্টা পায় যদি, অনেকে কেনাকাটা করে নিচ্ছে । অতনু কিনল না কিছু । এতগুলো ছোকরা, কতক্ষণই বা লাগবে, ভিড়ও নেই বিশেষ । তার মানে শুধু একজনই পাচ্ছে মেয়েটাকে, বাদবাকি সকলের লোকসান । জিতলে অবশ্য যে জিতবে, তার অনেক । শেফালি বলেছিল হারজিত ছাড়া ভাবতে পারো না কিছু । হারজিত রয়েছে বলেই তো ভালো, মনে হল অতনুর, নয়তো এতগুলো ছেলে যদি একজন মেয়ের সঙ্গে সেক্স করে তাহলে তো মেয়েটা মারা পড়বে ।

         ঘড়ি দেখে আধঘণ্টা পরা অতনুও ঢুকল সবায়ের সঙ্গে । ঢুকেই নরেন একদিকে আর প্রতুল আরেকদিকে দৌড়োলো বোঁ বোঁ, হয়তো ষড় করে ষাঁড়াশি অভিযান, টাকাটা ভাগ করে নেবে, বা একজন টাকা, একজন শেফালি ।

         মামুদ জোহের শিবু পালিত দেবেন্দর প্রসাদ উঁচু জায়গাটায় বসল ঘাসের ওপর । বোধহয় ওদিক থেকে তাড়া খেয়ে এলে ধরবে এদিকে । কিংবা শেফালির সঙ্গে ট্রেম করা হয়ে গেছে বলে তেমন আগ্রহ নেই । বাকি সবাই গটগট, গুটিঘুটি, লম্বা পা ফেলে, এক-পা টগবগিয়ে, দুমদাম, হন্তদন্ত, হেলতে দুলতে, যে যেমন আঁক কষেছে গায়েব হয়ে গেল ।

          অতনু দোটানায়, এর আগে দেখা হয়নি নালান্দার ধ্বংসাবশেষ, মগজের ভেতরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চোরপুলিশ খেলছে শেফালির সঙ্গে । খেলতে খেলতে দেখতে হবে, দেখতে দেখতে খুঁজতে হবে । পাথরের বালিশে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ানো একটা কিশোরী-গাছের ছায়ায় অতনু দেখছিল প্রাচীন ইঁটের গাঁথুনি, ছাত্রদের যাতায়াতের পধ, ইসকুলের পরিসর, ভিক্ষুদের ঘর, ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সিঁড়ি — সবই কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন । ধ্বংসাবশেষের ঠিক কী উদ্দেশ্য হয় ? তারা কি জীবন পেয়ে যায় পর্যটকদের চাউনির মাধ্যমে, তাদের ছোঁয়ায় ! এখানকার বাতাসে, কই, তখনকার মহাজ্ঞানী শিক্ষকদের উপস্হিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না তো ! নালান্দা সম্পর্কে একটা ট্যুরিস্ট বুকলেট কিনে নিলে কাজের কাজ হতো । গাড়িতে বসে শেফালি বুকে মুখ আর মাথা ঘষে ভাবনা গণ্ডোগোল করে দিয়েছে ।

         কাছেপিঠে, দূরে, কোথাও কচি সবুজ শাড়িতে, দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কাউকে, না শেফালি, না বকুল রজনীগন্ধা বেলি চামেলি টগর যুঁই ।

         পর্যটক দলের তরুণীদের মুখের দিকে এভাবে তাকানো বেশ বিপজ্জনক ।

         শিক্ষিকার সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের দল চলে গেল, বিদেশিনীদের বোঝাতে ব্যস্ত গাইড, জাপানি চেহারার ভিক্ষু গোষ্ঠী । ঘণ্টাখানেক কেটেছে । ওই তো, এ সেকশানের অনিমেষ । খোঁজা এখনও চলছে তার মানে । ওপরে উঠে বিহঙ্গম দৃশ্য নেয়া যাক ভেবে অতনু সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেখল সুবীর জিরোচ্ছে । ‘আমার হাঁটু ব্যথা হয়ে গেছে, জল তেষ্টা পাচ্ছে, সারেনডার করে বসে আছি’, ভুরুর ওপরে বাঁ হাতের ছায়া ফেলে জানাল সুবীর ।

         এক পাক ঘোরা হয়ে গেছে অতনুর । অনেকের সঙ্গে দু-বার তিন বার সাক্ষাৎ, যেন কেউ চেনেই না কাউকে । গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সজল, চোখে বায়নাকুলার । কেয়ারি করা বেড়ার পাশে ঘাসে শুয়ে পুলক আর সুবীর । পাশ কাটিয়ে চলে গেল দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য কমলেশ । কেবল টু নামের কালো মেয়েটির দেখা নেই । দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না, ধরার, ধরে রাখার, ধরে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা তো পরে ।

         এই রোখটাই তাহলে নেশা, একজন যুবতীকে অন্য পুরুষের কাছে হারাবার ভয় । বাঘ সিংহ হরিণ জেব্রা জিরাফ বনমহিষ হলে পুরুষরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করত, লড়ে মরে যেত, তবু জিততে হবে, জিততে হবে, জিততে হবে । ঘুরন্ত মাছের চোখে তীর মারার খেলা ।

         এই নিয়ে অতনুর তিনবার পাক । রোদ্দুর তেজ দেখাচ্ছে । ক’টা বেজেছে কে জানে । বেশ খিদে । অবসন্ন অতনু খোঁজা ছেড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়া যায় । অনেকে বেরিয়ে এসেছে ওর মতন, ঢুলছে গাড়িতে বা ভ্যানে বসে, কানে গানের ঠুলি ।

         চারটে ডানা মেলে দেয়া অ্যামবাসাডর থেকে বেরিয়ে এলো রবীন দত্ত, ‘পেলে না তো ? ব্যাড লাক, বেটার নেক্সট টাইম । ও একেবারে খরগোশ, মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে পড়ে, তাই ওকে আমাদের এত পছন্দ । ডিকিতে লাঞ্চ প্যাকেট আর বিয়ার আছে।’ বেশ অপ্রস্তুত লাগছিল অতনুর । খেয়ে, ঘাসের ওপর চিৎ শুয়ে ঢুলতে মনোযোগ দ্যায় ।

          সাড়ে চারটে নাগাদ শেফালির হাত শক্ত করে ধরে বেরিয়ে আসে অভিজিৎ, চেঁচাচ্ছে, ‘পেয়ে গেছি আমার হেলেন অফ টার, আলকাৎরা-সুন্দরী, পেয়ে গেছি আমার হেলেন অফ টার, কোথায় একিলিস ইউলিসিস আগামেমনন !’ হতচকিত সবাই ।

         অতনু দেখল, শেফালির পরণে কমলা-হলুদ সিল্ক, খোঁপা বাঁধা মাথায় ঘোমটা, মোটা কালো ফ্রেমের বাইফোকাল, পাউডারে ফর্সা মুখ, হাতে প্লাসটিকের ব্যাগ । ওঃ, একে তো অতনু দেখেছিল, খটকা লাগেনি শাড়ি চশমা ব্যাগে ভোল পালটাবে । নিশ্চিত ছিল । পেল না । শেফালি কি টার শব্দটার মানে জানে ! আলকাৎরা-সুন্দরীতে সুন্দরী শব্দটার কারণে শেফালির ভালোই লেগে থাকবে ।

         ‘আরে, আমি ধরেছিলুম একবার ওকে, কিন্তু বোকা বানিয়ে ছাড়িয়ে পালিয়ে গেল । আমার কাছে জলের বোতল চেয়ে জল খাচ্ছিল, আমি ভাবলুম, আহা, তেষ্টা পেয়েছে মেয়েটার, ব্যাস পালালো’, বলতে বলতে গলা বুজে যাচ্ছিল কমলেশের ।

         শেফালির চোখে রাশছাড়া অবিমৃষ্যকারিণীর আনমনা কৌতুক ।’

        –কী করে পেলি তুই ?

        –মেয়েদের পেচ্ছাপখানায় নজর রেখেছিলুম । তা সত্ত্বেও ফেল করেছিলুম একবার । লাল শাড়িতে ছিল । লাল গিয়ে যখন কমলা-হলুদ শাড়ির বুড়ি বেরোল, অমনি পেছু নিয়েছি । কিছুটা ফলো করে বুঝলুম সঙ্গে ন্যাওটা নেই । ও তো দৌড় দিলে । ধরে ফেললুম । এক ব্যাটা শিখ সরদার আরেকটু হলেই প্যাঁদাত । টু বাঁচাল ।

বেশ জোরে জোরে সংক্রামক অন্তরঙ্গ হাসি খেলাচ্ছিল নিজের আগাপাশতলা জুড়ে সতেজ মেয়েটা ; সকলেই ক্লান্ত, অথচ শেফালি ক্লান্ত নয় ।

          ওর এই প্রাণপ্রাচুর্যের বখরা পাবার জন্যেই ওর ডাক পড়ে, তাহলে । অতনুর কাছে এসে, ‘কেমন হাঁদা গো তুমি, দু-বার তোমার সামনে দিয়ে এলুম গেলুম,’ বলতে-বলতে মুখমণ্ডলকে ম্লান করে ফ্যালে ও, অতনুর নতুনত্ব তাহলে কাম্য ছিল । হাতছাড়া হয়ে গেল অকপট স্ফূর্তির জীবন্ত গ্র্যানিট-প্রতিমা ।

         ফেরার পর, রাত্তিরে, জমজমাট হল বুফে ভোজ । পোলাও নান সসেজ মেটে চিংড়ি দইবড়া হুইস্কি রাম জিন । রইরই । তেড়ে বিলিতি বাজনার ছটফটে হুল্লোড় । যেমন ইচ্ছে নাচের বেহিসেবি আপ্রাণ । দেবেন্দরের গ্রাম থেকে আনা সাত-আটজন বরগার খাটছে । কমিঅওটি প্রথায় এরা বংশপরম্পরায় বঁধুয়া মজুর । নইলে এতজন যুবকের সাধ-আহ্লাদের খেয়াল কেই বা রাখবে ! দাড়িঅলা ছেঁড়া-লুঙ্গি লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল কমিঅওটির হিন্দু-মুসলমান হয় না ।

         অভিজিতের বগলদাবায় মেয়েটা । ঝাড়লন্ঠনে আন্তরিক নেশার ঝিকমিক । প্রত্যেকের খেয়াল নিজের হুঁশ নষ্ট করার দিকে, যেন কারোর আর কাউকে দরকার নেই । নাচবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় হাতে গেলাস নিয়ে আরেকটা চেয়ারে ঠ্যাং তুলে অতনু ।

          টেবিলে ফেলে-রাখা কারোর একটা ডায়েরি, অন্যমনস্ক কয়েকপাতা উল্টে চুপসে গেল । অসীম পোদ্দারের । সাংকেতিক রোজনামচার ফাঁকে-ফাঁকে, প্রতি পৃষ্ঠায় লাল কালিতে ঠাসা ‘ওঁ হ্রীং রামকৃষ্ণায় নমঃ,’ অগণন নিভৃত মুহূর্তের জমাট অন্তরাল ।

         অভিজিৎ-শেফালি এসে বসল অতনুর পাশে ।

          অতনু : একদিন লুট করে নিয়ে যাব তোমায়, তোমার বাবা যেমন করেছিল ।

        শেফালি : না বাবা, আমি অমন দারিদ্দির হতে চাই না । যদি অঢেল টাকা আনো তাহলে যাব ।

         অভিজিৎ : আরে, আমার বদলে তুমিই নিয়ে যাওনা হে । আমি টাকাটা পেয়েই খুশ ।

        শেফালি : এই অভিজিৎ লোকটা একদম ভেড়া । ওর কিসের ভয় জানো ? ও কোনও মেয়েমানুষের সঙ্গে এখনও ওইটা করেনি ।

         অতনু : টু, খেয়েদেয়ে একটু মোটা হও । তবে তো আমার সংসার চালাতে পারবে ।

       শেফালি : খাবার পয়সা কোথায় ! আনিসাবাদে এক কাঠা জমি কিনেছি । দুটো ঘর তুলতে হবে ।

       অভিজিৎ : বাড়ি-ফাড়ি অতনু বানিয়ে দেবে তোমায় । ওর বাবার পুরো টাকাটা তো রয়েছে ।

        শেফালি : সত্যি ?

       অতনু : তিন সত্যি ।

      মদের ভাসমান ঘোরে, হাতে গেলাস, কখন খালি হয়ে গেছে তার হুঁশ নেই, বিহ্বল সংবেদনে চুর অতনু, প্রচণ্ড ডি. জে. বাজনার উদ্দামের মাঝে ঝিম মেরে বসে থাকে, আনন্দ নিচ্ছিল টুকরো-টাকরা আদানপ্রদানের ।

         শেফালি : তোমার বাড়িটা কোন পাড়ায় গো ?

         অভিজিৎ : চালাকি নাকি । বলে দিই, তারপর তুমি এসে বাপ-মার হাটে হাঁড়ি ভেঙে ব্ল্যাকমেল করো । সেটি হচ্ছে না ।

        দেবেন্দর : একে তো শালা ধানে উপজ ভালো হয়নি, তার ওপর মাওওয়াদি নকসল্লিগুলো দিককরা আরম্ভ করেছে । নিচু জাতের লোকেদের ভুনে মাটিয়ামেট না করলে পুরো দেশ ডুবে যাবে । কাংরেস কিচ্ছু করবে না ।

         কমলেশ : আমি তো জানতুম শুধু অওরঙ্গাবাদ জেহানাবাদ নওয়াদা গয়াতেই দঙ্গাফসাদ । পলামুতেও পূঁছে গেছে?

          অশোক : চন্দ্রকেতু সিং দশ হাজার টাকা খরচ করে আমেরিকান মাগিদের ঠুকে আসছে রজনীশ আশ্রমে ফি বছর একবার । বলছিল যে পেন্টাগন সিআইএ এমএনসিদের ঠুকছে মনে করে চাপে ফর্সা মাগিগুলোর ওপর । চলুন না, আসছে শীতে এক ট্রিপ মারি ।

         সুশীল : তার চেয়ে ব্যাংকক চলুন না এল টি সি নিয়ে । থাইল্যাণ্ডের মতন ল্যাংটো কচি-কচি নধর মেয়েছেলের বাজার আর কোথাও নেই ।

         নরেশ : তোর জন্যেই মিস করলুম । স্ট্র্যাটেজিটা ভুল ছকে ফেললি ।

         প্রতুল : বা রে, আমি কী করব ! এমন বহুরূপী সাজবে তুই জানতিস ?

        সুবীর : জনি ওয়াকারের সঙ্গে চিড়াইয়াটারের ধেনো মিশিয়ে ককটেল করেছে দেবেন্দর । মজা কিরকিরা হয়ে গেল ।

       শিবু : মজফফরপুর থেকে লিচুর মদ আনিয়েছি । গন্ধেতেই আমেজ এসে যায় । আসুন না একদিন বিকেলে, আমার ফ্ল্যাট আশিয়ানায়, চেনেন তো ?

          নাচ-গান-হুল্লোড় তুমুল । বাঁ দিকের কোনের পেল্লাই দরোজার কাছে, পাঁচ-সাতজনের তক্কাতক্কি, প্রায় হাতাহাতি, হাত ঝাঁকানো, মুণ্ডু ঘাড় থেকে এগিয়ে জিরাফি বক্তব্য, মাথা ঝাঁকানো । জটলায় কোমর দুলিয়ে ফুট কাটতে কাটতে অটোমোবিল ইনজিনিয়ার আর জিওলজি স্নাতকের রাগি চাপান-উতোর । হঠাৎ তার মাঝ থেকে মামুদ জোহের দ্রুত এসে ফাঁকা চেয়ারে বাঁ পা রেখে ডাইনিং টেবিলে উঠে পড়ে, চেঁচামেচির বেড়া ডিঙিয়ে আচমকা, প্যান্টের চেনবোতাম বাঁ হাতে দিয়ে টেনে খুলেই ঝপ করে জাঙিয়াহীন চিৎকার, এই বে, কারা কারা জানতে চাইছিস মৌলবাদ কাকে বলে ।’

         নেশার গহীন মৌতাতে অতনু টের পায় বাজনা থেমে গেছে । নাচানাচি । স্তব্ধ । কথা কাটাকাটি কাহিল । পিনপতন স্তব্ধতায়, আরেকবার চেঁচিয়ে ওঠে কবেকার কোন পাঠানের বিহারি বংশধর, গয়া অওরঙ্গাবাদের মাঝামাঝি চালহো পাহাড়ার উপত্যকার ক্রুদ্ধ নগমাগড়ের মামুদ জোহের ।

          –উড়িশসাঁটা, এ তো জৌনপুরের লালমূলা । শেফালির আন্তরিক উদ্গীরণে কেটে যায় অস্বস্তিকর স্তব্ধতা, ফিরে আসে বাজনার স্বাভাবিকতা, কথা বলাবলি, পানীয়ে চুমুক ।

         মামুদ নামে টেবিল থেকে । একজন দু’জন করে নাচ আরম্ভ হয় আবার । যোগ দেয় অভিজিৎ শেফালি অতনু । চুর অতনু অবাক হয়, মেয়েটা বিদেশি নাচ জানে, নেচে দেখায় অতনু অভিজিৎকে । ডান হাত ধরে ঘুরে এসে ঝাপটে পড়ে অভিজিতের বুকে, আবার পাক খুলে ঘুরে দাঁড়ায় । অভিজিৎ ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে শেফালির সঙ্গে ।

          আবোল-তাবোল নাচতে নাচতে একা-একাই, অতনুর দৈহিক আড়ষ্টতা খসে পড়তে থাকে, শেফালির উদ্দেশে ওথেলোর সংলাপ আরম্ভ করে, “ও, বিওয়্যার, মধ লর্ড, ওফ জিলাসি ; ইট ইজ দি গ্রিন আইড মনস্টার, হুইচ ডথ মক দি মিট ইট ফিডস ওন…” আর অভিভূত শেফালি অতনুকে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলে,      রবীন দত্ত্ এসে ছাড়ায় ওদের দুজনকে, ‘স্টপ ওথেলোইং উইথ দিস গার্ল।’

           ভিরু অভিজিতের কাঁধে ভর দিয়ে বিড় বিড় করতে করতে খাবার ঘর থেকে শেফালি বেরিয়ে গেলে, রবীন দত্ত আলতো স্বরে বলে অতনুকে, ‘তোমার কি মেয়েমানুষ চাই ? দেবেন্দর ব্যবস্হা করেছে ।

         ‘মেয়েমানুষ ?’ কতবার কতজনের মুখে শোনা শব্দটা এই প্রথম সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হল অতনুর ।

         ‘হ্যাঁ, দশ-বারোজন কমিঅওটি মেয়েছেলে এনে রেখেছে ওর গ্রাম থেকে, আমাদের জন্যে ।’

        রবীন দত্তর পেছন-পেছন গিয়ে অনুসন্ধিৎসু অতনু দেখল, একটা ঘরের মেঝেতে বসে চারজন গ্রাম্য বিহারি যুবতী এঁটো থালাগুলো থেকে উচ্ছিষ্ট নিয়ে কাগজে রেখে বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে । ঘরের এক কোনে ঢাকা দেয়া কপমিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার । প্রিন্টআউট-নেয়া বাতিল কাগজে খাচ্ছে ওরা । এমন উদ্ভট জায়গায় কমপিউটার !

         –ওই মেয়েটাকে নিতে পারো, গা-গতর আর মুখচোখ ভালোই ।

         জীবনে হয়তো কয়েকবার চান করেছে, নোংরা জামাকাপড়, চুল আঁচড়ায়নি কোনোদিন, কটারঙের উস্কোখুস্কো চুল । এর হাতে এখনও হয়তো ধানকাটার বিচুলির গন্ধ । পায়ের গোছে ধান মাড়াইয়ের কুঁড়ো লেপ্টে আছে এখনও, চুলের ফাঁকে শালপাতার টুকরো ।

         একে ধর্ষণ করে থাকবে দেবেন্দরের পরিবারের সবকটা পুরুষ । এর মাকে কি দেবেন্দরের বাবা ধর্ষণ করেছিল ? কে জানে , হয়ত এই যুবতীই দেবেন্দরের বাবার ঔরসপ্রসূত ।

মেয়েটি অতনুর মুখের দিকে ম্লান চাহিদা নিয়ে তাকায় । পেট ভরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে নিয়ে যাবার অনুনয় । যেতে অনিচ্ছুক নয়, হয়তো নরম গদির বিছানায় শুতে পাবে রাতভর ।

         –এরকম নোংরা মেয়েমানুষ চলবে না । অতনু সত্যি কথা বলে । টলতে-টলতে নিজের বরাদ্দ ঘরে । মেয়েমানুষের সামনে তাহলে পুরুষের উদারতন্ত্র এভাবেই খসে পড়ে । মাতালেরও থাকে শ্রেণিচেতনা, অ্যাঁ ? এসব পালটাবে না কখনও । পালামৌয়ের লাতেহারে নকসল্লি মাও্ওয়াদিরা  বনপার্টি বানিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু এসব বোধহয় চলতে থাকবে, তাপ্পি-মারা আবহমান, সোভিয়েত দেশের মতন । নিজের সঙ্গে জোচ্চুরিও চলতে থাকবে প্রত্যেকের।

          পরের বারের খেলাটা হয়েছিল শোনপুর মেলার কার্তিক পূর্ণিমার দিন । পুরস্কার এক লাখ । যুবতীর প্রাপ্য পঞ্চাশ হাজার । রাজপুত বাড়ির বিবাহিতা তরুণী, ফর্সা, ভরাট বুক, ভারি পাছা– যৌনতা উদ্রেকের জন্যে নানা আঙ্গিকের রঙিন ফোটোর অ্যালবাম হাতে হাতে গোপনে ঘুরছিল অফিসের এ-বিভাগ সে-বিভাগ । রাজপুত বাড়ির বউ শুনে ভেঙে পড়েছিল তফসিলি যুবকের ভিড় এইবারের খেলায় ।

         কে একজন গ্রিক সেনাপতি মগধ রাজ্যকে এক হাজার গ্রিক যুবতী উপহার দিয়েছিল, নসল বদলের জন্য । খেলার যুবতীর গায়ে হয়তো সেই গ্রিক যুবতীদের কারোর রক্ত বইছে । জিতলে গ্রিসের প্রতিটি মহাকাব্যের নায়িকাদের পাওয়া যাবে ।

           মেলার হাজার হাজার মানুষের মধ্যে অফিসের বেশ কিছু উচ্চ-পদাধিকারীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে অতনুর । হাফ-কেরানি, কেরানি, ছোটো সায়েব, মেজো সায়েবের দল দাঁও লাগিয়েছিল, অথচ সকলেই সকলকে, হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে, বলেছে মেলা দেখতে এসেছিল, হাতি উট ঘোড়া মোষ বিক্রি, চটের পর্দা টাঙানো ল্যাঙটো ক্যাবারে, লোহার গোল অতিকায় নাগরদোলা, ছোটো কাঠের নাগরদোলা, সঙ, ম্যাজিক, নকল বিনুনি, চুড়ি, হিজড়ে, লউণ্ডা, ভুতঘর ।

          অতনু জিততে পারেনি । শেফালি হলে চেষ্টা করত ।

         জিতেছিল ডক্টর অসীম পোদ্দার ।

         ওদের ফুলশয্যার ব্যবস্হা ছিল খড়বোঝাই পালতোলা নৌকোয় । রাজপুত যুবতীর পাশ থেকে উঠে কখন যে জলেতে শব্দহীন নেমে গিয়েছিল মাঝরাতের গঙ্গার শীতল অতলে, মাঝিরাও টের পায়নি । সাঁতার না-জানার আমোদ ওর পেট ফোলা লাশের ঠোঁটে আবিষ্কার করে পুলিশ । নৌকোয়, মেয়েটির শিয়রে যে ডায়রিটা রেখে গিয়েছিল অসীম পোদ্দার, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে রেখেছে, নামসই আর তারিখসুদ্দু, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়।’

চন্দ্রকেতু সিং-এর দ্বিতীয় পক্ষের বউ ওই যুবতী পুরো দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে গিয়ে দিয়েছিল হাসিমুখ চন্দ্রকেতুকে । দিয়ে ফিরে গেছে বালিয়ায় নিজের ধুলোসুনিবিড় গ্রামে ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *