দু দিন কেটে গিয়েছে। রাত্রি সাড়ে দশটা। আভা সোফার ওপর বসে টেলিফোনের দিকে উৎকণ্ঠিত একাগ্র চোখে তাকিয়ে আছে। বব ঘুমোচ্ছে ঘরের মধ্যে। মিঃ কাপুর একটু আগেই চলে গেল। সুবীর সুটকেস গুছিয়ে, সেটা একটা সোফার কাছে, কার্পেটের ওপর রাখল। আগামীকাল ভোরের প্লেনে সে দিল্লি যাবে। তারই প্রস্তুতি। বাড়িতে যেমন থাকে, তেমনি লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি চাপানো। সেন্টার টেবিলে হুইস্কির আর সোডার বোতল। একটা গেলাস শূন্য। ওটা মিঃ কাপুরের। সুবীরের গেলাসে এখনও কিছুটা রয়েছে। সে গেলাস তুলে চুমুক দিল। তাকাল আভার দিকে। নিজের কবজির ঘড়ি দেখল। সুকুমারের একটা টেলিফোন আসার কথা। একমাত্র তাকেই এই ফ্ল্যাটের টেলিফোন নাম্বার জানানো হয়েছে। সুবীরই মাথা খাঁটিয়ে একটা ব্যবস্থা করেছিল। সে মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলবার জন্য, সুকুমার দাশের নাম করেছিল। সুকুমারের সঙ্গে স্যার জে. সি-র যেমন বিজনেস রিলেশান আছে, মন্ত্রীমহলেও ভাল পরিচয় আছে। কলকাতার উচ্চমহলে তার যাতায়াত মেলামেশা–যাকে বলে ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক। তার বাড়িতে সশস্ত্র লোকের হানা এবং আভার ব্যাপার, দুটোই তার মিনিস্টারকে জানানো উচিত। সুবীর আভাকে এই কথা বলতে বলেছিল। অবিশ্যি, আভার কথাটা যেন বিশেষ ভাবে বিবেচনা করা হয়, সুকুমারকে সেই রকম অনুরোধ করতে বলা হয়েছিল।
আভা সুকুমারকে গতকাল রাত্রেই টেলিফোনে সে সব কথা বলেছে। সুকুমারের কথায় প্রথমে একটু যেন দ্বিধা ফুটেছিল। এই সুকুমারের স্ত্রী মঞ্জু আভার ইস্কুলের বন্ধু। সুকুমার জলির সঙ্গে আভার বিয়ের একজন সাক্ষী-সইদাতা। সেটা সে করেছিল, এমনকী স্যার জে. সি. চটে যাবেন ভেবেও। শেষপর্যন্ত সুকুমার আভাকে বলেছিল, মিনিস্টারদের মতিগতিও আমি ভাল বুঝি না। যেমন মিঃ দীপনারায়ণ বা থানার অ্যাটিচুড আমার কাছে কেমন ক্যালাস লেগেছে। সবাই বলছে, ব্যাপারটা গুরুতর, অথচ তাদের কথাবার্তা কাজে কর্মে সে রকম গুরুত্ব কিছুই দেখছি না। তবু তুমি যখন বলছ, আমি মিনিস্টারকে সবই বলব। বিশেষ করে তোমার এই ভয়ংকর বিপদের কথা। জানি না, কী বলবেন। জোজোকে নিয়ে গভর্নমেন্ট ভার্সাস স্যার জে. সি-দের কেসটার কথাও তো ভোলবার না। স্টিল, আমি কালই কথা বলার চেষ্টা করব। তোমাকে রাত্রি দশটা থেকে সাড়ে দশটা নাগাদ টেলিফোন করে জানাব। তুমি তোমার নাম্বারটা দাও।
নাম্বারটা দেবার ব্যাপারে আভার ভয় ও দ্বিধা ছিল। সুবীর তাকে ঘাড় কঁকিয়ে নাম্বার দিতে ইশারা করেছিল। আভা নাম্বার জানিয়ে বলেছিল, দেখো, এ নাম্বার যেন কাকপক্ষীও না জানতে পারে। তা হলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আফটার অল তুমি আমার কাছে সেই আভা, সেই বন্ধুই আছ। সে লাইন কেটে দিয়েছিল। সুকুমারের কথা শুনে আভার বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
আভা এখন দীর্ঘ সোফার ধারে, টেলিফোনের কাছে উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে। সুবীরও নিশ্চয় অস্থির। সে ঘন ঘন হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিচ্ছে। রাত্রি দশটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। টেলিফোন স্তব্ধ। আভা দু বার রিসিভার তুলে দেখেছে, ডায়াল টোন শোনা যাচ্ছে কি না। টেলিফোন ঠিক আছে। আভার উৎকণ্ঠিত অস্থিরতা বাড়ছে।
সুবীর একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছু বলতে গেল। টেলিফোন বেজে উঠল। আভা রিসিভার তোলবার আগেই সুবীর লাফ দিয়ে উঠে, আভার কাছে ছুটে গেল, ওয়েট। আপনি আগে ধরবেন না। কার টেলিফোন, দেখা যাক। সে রিসিভার নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়েস?’ ওপার থেকে জবাব এল, মিসেস মজুমদার আছেন? সুকুমার দাশ বলছি।
আছেন। সুবীর আভার হাতে রিসিভার তুলে দিল।
আভার হাত কাঁপছে। রিসিভার নিয়ে স্থলিত স্বরে বলল, হ্যালো?’…আমি সুকুমার বলছি আভা। একটু দেরি হয়ে গেল। মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলার জন্যই। এইমাত্র ফিরছি।তার কাশির শব্দ শোনা গেল। আভার নিশ্বাস আটকে আছে বুকের কাছে। সুকুমারের গলা আবার শোনা গেল, আভা, আয়া সরি, কোনও ভাল খবর তোমাকে দিতে পারছি না। মিনিস্টার সব শুনে বললেন, এটা তো পুলিশকে জানানোর কথা, আমি কী করতে পারি। যখন বললাম, পুলিশকে সবই জানানো হয়েছে, তখন তিনি বললেন, এর পরে আমার আর কী করার থাকতে পারে? আমিও তো পুলিশ আর গোয়েন্দা বিভাগকেই বলব। তা ছাড়া, আমি ব্যক্তিগত ভাবে, এ বিষয়ে মাথা গলাতে চাই না-স্পেশাল কোনও ইন্টারেস্ট নেওয়া সম্ভব না। এ সব হচ্ছে পচনশীল বুর্জোয়া সমাজের কেচ্ছা কাণ্ড–এ সবের মধ্যে আমি জড়িয়ে পড়তে কোনও রকমেই চাই না। বলতে পারেন, সামাজিক ভাবে স্যার জে. সি-র সঙ্গে— আমার কিছু মেলামেশা হয়–সেটা ডিফারেন্ট ব্যাপার। ও রকম অনেকের সঙ্গেই আমাকে মিশতে হয়। তার মানে এই নয়, তাদের কেচ্ছা কাণ্ডের মধ্যে মাথা গলাব। আর সেই মহিলা, যার কথা আপনি বলছেন, তার বিষয়ে তো আমি কখনও ভাল কিছু শুনিনি। একটা অপদার্থ জলি মজুমদারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সে ও বাড়িতে ঢুকেছিল।’…সুকুমার একটু থামল। আভার হাত স্থির হল, নিশ্বাস পড়ল আস্তে আস্তে। যে-উৎকণ্ঠিত উত্তেজনা ওর ছিল, সেই উৎকণ্ঠা থেকে গেল। উত্তেজনা নিঃশেষ হল। সুকুমারের গলা আবার শোনা গেল, আভা, শুনছ?’ বলল। আভা বলল। সুকুমার বলল, আমি তখন ওকে বললাম, কিন্তু এখন ব্যাপারটা আলাদা, একজন মহিলা আর শিশুর জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফর হিউম্যানিটি সেক, আপনি এ বিষয়ে কিছু করুন। উনি বললেন, আমি কী করতে পারি? পুলিশের টপর্যাংকে সবাইকে বলতে পারি, কিন্তু এ নিয়ে তো আমি কাগজে কোনও স্টেটমেন্ট দিতে পারি না। সেটা সম্ভবও না। আর এটা কোনও গরিব মহিলার ব্যাপারও না, যার জন্যে আমি খোলাখুলি। কিছু বলতে পারি। দেশে শাসন আছে, আইন আছে, মানুষের বেঁচে থাকার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। তাকে বলুন, সে সব সাহায্য নিতে। পুলিশের সাহায্য যদি না নিতে পারে, সরাসরি কোর্টে যেতে বলুন। ..আমি তবু বললাম, সে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কোথাও বেরোতে সাহস পাচ্ছে না, সবই তো বললাম কিন্তু উনি আমার কথা আর শুনতেই চাইলেন না। বললেন, মাফ করবেন মিঃ দাশ, আমার হাতে যা আছে, তাই করতে পারব। ব্যক্তিগত ভাবে, আর কিছুই করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ও সব সমাজের লোক নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোরও কিছু নেই। এ সব পাঁক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারব না। আপনার কারখানার প্রোডাকশনের ক্রাইসিস হলে… সুকুমার একটু থামল, যাক সে সব কথা, এই হল রেজাল্ট। এর থেকে যা বোঝবার বুঝে নাও। আমি বুঝতে পারছি না, তোমার জন্যে কী করা। যায়। তবু আমি ভাবব, মঞ্জুর সঙ্গে আলোচনা করব। কিন্তু সুকুমার আবার থেমে গেল। আভা বলল, ঠিক আছে সুকুমার, তুমি তবু অনেক করলে। নতুন কী ভাববে জানি না। বোধ হয় সব ভাবনার শেষ অবস্থা এখন। মঞ্জুকে বোলো, পারলে পরে যোগাযোগ করব। সুকুমার বলল, বলব। জানি না, ঈশ্বরের কী অভিপ্রায়। আপাতত গুডনাইট। লাইন কেটে গেল। আভা রিসিভার নামিয়ে দিল।
সুবীর আভার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। আভার মনে হল, ওর ভিতর থেকে একটা আর্ত অসহায় চিৎকার উঠে আসতে চাইছে। সেটাকে ও দমন করল। দাঁতে দাঁত চেপে, চোখ শুকনো রাখল। তাকাল সুবীরের ব্যাগ্র জিজ্ঞাসু চোখের দিকে। আভা তাকে পাশে বসতে ইঙ্গিত করল। সুবীর বসল। আভা সুকুমারের বয়ান সবই শোনাল।
সুবীর সব শুনল। গম্ভীর মুখে উঠে গিয়ে, আবার গেলাসে হুইস্কি ঢালল। আভা উঠে দাঁড়াল। আবার ঢালছেন? কাল ভোরে যাবেন। এ বার খেয়ে নিলে হত না?
হা খাব।’ সুবীর গেলাসে চুমুক দিল, আসুন খাবার নিয়ে বসি। সে উঠে খাবার টেবিলের দিকে গেল।
আভা কিচেনে গিয়ে, খাবার এনে রাখল টেবিলে। সুবীরকে খেতে দিল। নিজের জন্যও নিল। সুবীর খেতে আরম্ভ করল। আভার খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করা দেখেও কিছু বলল না। চুপচাপ সামান্য খেয়েই উঠে পড়ল। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে সিগারেট ধরাল। বলল, সবই বুঝলাম, তবে ভদ্রলোক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথাটা না বললেই পারতেন। আর আপনার ঘটনাটা যদি পলেটিকাল হত, অবিশ্যি তাতেই বা কী? সেই চোরাগোপ্তা খুনই বা কে রোধ করতে পারছে? আপনি একটু খেতে চেষ্টা করুন।
সুবীরের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় আভার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। কিন্তু নিজেকে সামলে ও খাবার মুখে দিল। দেরি করলে, শুতে যাওয়ায় দেরি হবে। যা পারল, তাই খেয়ে উঠে পড়ল। বাকি সব তুলে দিয়ে, হাত মুখ ধুয়ে নিল।
আপনার সঙ্গে হয়তো কাল ভোরে আমার দেখা হবে না। সুবীর বলল, আমি হয়তো দিন। সাতেকের মধ্যে ফিরব। কিংবা আরও দেরি হতে পারে। তার মধ্যে কী ঘটবে, কিছুই বলা যায় না। একটু থেমে আবার বলল, মিসেস মজুমদার, আমি ছিলাম সামান্য গরিব ঘরের ছেলে। লেখাপড়াও তেমন শেখার সুযোগ পাইনি। জীবনে অনেক উঞ্ছবৃত্তি করেছি, তবু চোখের সামনে বাবা মা ভাই বোন, কারোকে বাঁচাতে পারিনি। এমনকী বোনের মান ইজ্জতও রক্ষা করতে পারিনি। এখন আমার কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা। সুবীরের দু আঙুলের ফাঁকে সিগারেট কাঁপছে।
আভার মনে হল, ওর ভিতর থেকে যেন কেউ ঠেলে ওকে সুবীরের কাছে নিয়ে গেল। সুবীর বলল, আমি স্যার জে. সি-দের কী চোখে দেখি, বলে লাভ নেই। আপনার প্রতিও আমার সিমপ্যাথি থাকবার কথা ছিল না। কেবল এক সময়ে মনে হয়েছিল, জলির ব্লু ব্লাডে এ বার লাল রক্তের জন্ম হবে। হল, কিন্তু তার পরিণামও দেখছি। কোনও এক সময়ে আপনাকে দেখে, জলিকে হিংসাও করতাম কিন্তু।
সুবীর। আভা সুবীরের একটা হাত নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতে টেনে নিল। ওর রক্তশূন্য মুখে অপ্রতিরোধ্য আবেগের সঞ্চার হচ্ছে।
সুবীর আভার মুখের দিকে তাকাল, তার মুখেও আবেগের অভিব্যক্তি, কিন্তু সে সব আজ মিথ্যা হয়ে গেছে, আর্থিক নিরাপত্তা আর অসহায়তা এ দুটো দিকই আমার দেখা হয়েছে। মানুষকে মানুষের মতোই দেখতে চাই। আপনার সমস্ত সত্তা আমার কাছে বদলে গেছে। আপনার অবস্থা দেখে, করুণা দেখাব না, বড় উৎকণ্ঠা বোধ করছি। অথচ আমার ক্ষমতা কত সীমাবদ্ধ–আর কী আমাদের জীবনের অর্থ? আপনাকে দেখে আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
সুবীর। আভা সুবীরের কাঁধের ওপর অনায়াসে দু হাত তুলে দিল, ভালবাসা কী, আমি কোনও দিনই জানি না। আজও জানি না, আমার সন্তানদের ছাড়া। আমার জগৎ এত ছোট, আমি মানুষকেও চিনতে শিখিনি। মল্লিক মেলোমশায় আর তোমাকে ছাড়া আমি বোধ হয় আর কারোকে চিনতে পারিনি। মেয়েদের সম্মান কাকে বলে, তাও তোমার ফ্ল্যাটে থেকে এই প্রথম জানলাম। তোমাকে মনে রাখা ছাড়া, আর তো আমার কিছু করার নেই। মরার মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে।’ ওর গলা ডুবে গেল। চোখের দুই কোণ চিকচিক করে উঠল।
সুবীর ওর কাধ থেকে আভার দুই হাত নিজের হাতে নিল, মনে আমারও থাকবে, যদি আর দেখা নাও হয়। যত দিন সম্ভব, আপনি এখানে থাকুন। আমি আপনার ঘরের ড্রেসিং টেবিলে কিছু টাকা রেখেছি, দরকার হলে খরচ করবেন। আর একটা কথা, এর পরে, খবরের কাগজের সাহায্য যদি পাওয়া যায়, তবে হয়তো একটা কিছু হতে পারে, যদি কেউ সে রকম ইন্টারেস্ট নেন। কথাটা মনে এল, তাই বললাম, কিছু যে সুরাহা হবেই তা বলতে পারি না। সুবীর আভার দু হাতে একটু চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল।
এ বার তুমি শুতে যাও।আভা বলল, সত্যি যেন আবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়। সুবীর ওর ঘরের দরজায় গিয়ে, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল, বিপদ যে কত রকমে আসে। সংসার খুবই বিচিত্র। নিজেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করবেন। সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
আবার মনে একটা নতুন জিজ্ঞাসা জেগে উঠল। সুবীরের শেষের কথাটায় যেন একটা নতুন সুর। কী বলতে চাইল সে? আভা তো বাঁচবারই চেষ্টা করছে।
আভা বাইরের ঘরে লম্বা সোফায় শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। বেলা প্রায় দুটো। বব ভিতরের ঘরে ঘুমোচ্ছ। হঠাৎ খুট করে শব্দ হতেই, আভা চকিতে উঠে বসল। মিঃ কাপুর ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
ওহ আপনি। আভা রক্তশূন্য আতঙ্কিত চোখে তাকাল, তিন বার বেল বাজাননি তো?
মিঃ কাপুর হাসলেন, চাবি তো আমার কাছে রয়েছেই। কলিং বেল আর বাজালাম না। সে আভার দিকে এগিয়ে এল।
আভার বুক যেন ছ্যাত করে উঠল। কাপুরের মুখ চোখ যেন স্ফীত আর লাল দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো খোলা, হাসিটা বিশ্রী। আভা উঠে দাঁড়াতে গেল। কাপুর ওকে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় পড়ল, ডারলিং, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, আমি তোমার জন্য মরে যাচ্ছি। আমার সমস্ত জীবন দিয়ে তোমাকে রক্ষা করব, তুমি আমার।’…সে আভার ঠোঁটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আভা জোর করে ওঠবার চেষ্টা করল। পারল না, কথা বলার উপায় নেই, দুই ঠোঁট কাপুরের গ্রাসে। ওর গলা থেকে গোঙানো শব্দ বেরোচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কাপুরের এক হাত ওর সব লজ্জা টেনে খুলে ফেলেছে।
আভার চোখের সামনে জীবনে প্রথম ধর্ষণের ছবি ভেসে উঠল। কিন্তু সেই সময় সেই আভা, জলি আর কাপুরের, সবকিছুর মধ্যেই সময় একটা বিরাট পার্থক্য এনে দিয়েছে। আভা বাধা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করল। প্রতিরোধের সমস্ত পদ্ধতি শক্তি দিয়ে প্রয়োগ করল। কিন্তু কাপুরের শক্তির কাছে নিজেকে অত্যন্ত দুর্বল মনে হল। কাপুর পানমত্ত বটেই, শক্তিশালী, এবং তার সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত। সে প্রস্তুত হয়ে এসেছে। নিজেকে সে নিমেষেই বিবস্ত্র করল। আভার শাড়ির লজ্জা ঘুচিয়ে জামার গলা টেনে ছিঁড়ে দিল। আর তখনই কাপুরের গ্রাস থেকে মুক্তি পেয়ে, আতঙ্কিত বিস্ময়ে রুদ্ধ স্বরে ডেকে উঠল, মিঃ কাপুর, শুনুন, দয়া করে শুনুন।কাপুর তখন আভার নিম্নাঙ্গের মাঝখানে নিজেকে স্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে। আভা আর্তস্বরে বলল, মিঃ কাপুর, একটা কথা রাখুন, আমাকে গর্ভবতী করবেন না। আমাকে মুক্তি দিন। কাপুর হঠাৎ থমকে গেল। সে তৈরি হয়েই এসেছে। আভাকে উঠতে না দিয়ে, নিজের বুক পকেট থেকে সে জন্মনিয়ন্ত্রণের বস্তুটি বের করল, তুমি আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করো। না আভা, আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমার দায়িত্ব সব আমার।’ বলিষ্ঠ এক হাতে আভাকে আঁকড়ে ধরে রেখে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। তার গলার স্বর যেন গোঙানো ষণ্ডের মতো শোনাল।
আভার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। কান্নার উচ্ছ্বাসে। কাপুরের শরীরে হাত দিয়ে তাকে ওঠানো অসম্ভব। ও পিছন দিকে সরে যাবার চেষ্টা করল, পায়ে পড়ি মিঃ কাপুর, আমাকে বাঁচতে দিন।কাপুর আভাকে একটি ছোট নরম পুতুলের মতো নিজের বুকের তলায় গুটিয়ে নিয়ে এল, চাপা গোঙানো স্বরে বলল, তোমাকে আমি বাঁচিয়ে রাখতেই চাইছি।’ সে আভাকে তখন সম্পূর্ণ আয়ত্তে এনে দুর্বার হয়ে উঠেছে।
আভা দু হাতে মুখ ঢেকে, কান্নায় ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। আর সুবীরের শেষ কথাগুলো মনে পড়ল, বিপদ যে কত রকমের আছে…নিজেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করবেন।’ …..এই বিপদের সংকেতই কি সে দিতে চেয়েছিল? তা হলে সুবীর স্পষ্ট করে তাকে সাবধান করে দিয়ে যায়নি কেন? সে কি ভেবেছিল, তার সেই ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল? ধারণা করেছিল, আভা কাপুরকে চিনতে পেরেছিল? তা হলে, আভা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। আহ্, সুবীর কেন ওকে আরও স্পষ্ট করে বলে গেল না?…আভার সতীত্ব বোধের কোনও মহত্ত্ব নেই–কিন্তু শরীর ও মনের একটা শুদ্ধতা বোধ আছে। নিজের ইচ্ছা, রুচি আছে। যে কোনও বলপ্রয়োগের পিছনেই থাকে উকট বিকৃতি। ভবিষ্যতের জন্য থাকে বিকারের মাত্রাজ্ঞানহীন অত্যাচারের নিষ্ঠুরতা। আভার এই অভিজ্ঞতা ওকে দিয়েছে। আত্যন্তিক ঘৃণা। নিজেও স্বেচ্ছাচারের পথে পা বাড়ায়নি, এমন কথা কখনও বলা যাবে না। তাতে সুখ। ছিল না। ঘৃণার বদলে আকণ্ঠ বিষপান করেছে। সেই বিষ পানও এক রকমের প্রতিশোধের বিকৃত ঘোর। যে ঘোর, জীবনের বাস্তব আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছিল। স্বেচ্ছাচারের ক্লেদ আর গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করে, দেখেছিল, কখন ওর জীবনকে ঘিরে ঝড় উঠেছে। যে ঝড় ওর জীবনের অজ্ঞাত দিক উন্মোচিত করে দিয়েছিল। তাসের ঘর ভেঙে ছত্রখান করে, শূন্য অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। ও জানত, সেটা ওর স্বেচ্ছাচারের শাস্তি না। স্বেচ্ছাচারই সেখানে জীবনযাপনের নিরন্তর উপকরণ। আসলে, নীলরক্তের ঘুম ভেঙেছিল, তার বিষাক্ত থাবা ওকে সঁতে নখে প্রহারে জর্জরিত করছিল। ওকে নিশ্চিহ্ন করার পালা সেই থেকে শুরু। জোজো তার প্রথম বলি। ওর চোখের সামনে জোজোর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মুখ ভাসছে …একজনের সুখের মত্ত গ্রাসের গভীরে, ওর ধর্ষণজাত সেই প্রথম সন্তান জোজোর মুখ ভাসছে। জোজো… আমার জোজো….।
ঝড়ের মত্ততা থেমে এল। কাপুরের গোঙানিতে দূর মেঘের চাপা গর্জনঝড় থামার সংকেত। আভা নিজেকে মুক্ত করে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে, ঘরের মধ্যে ছুটে গেল। ববকে কোলে তুলে নিল। বুকে চেপে ধরল। এই মুহূর্তে ওর এই রক্তের পুতুলটিকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কিছু নেই। আয়নায় নিজেকে চোখে পড়ল। নিজেকে চিনতে পারছে না। মাথার চুল এলোমেলো, কপালে গালে ছড়ানো। ঠোঁটের কষে রক্ত। বুকের কাছে নখের রক্ত-রেখা। জামাটা ছিঁড়ে, বুকের একাংশ বেআবরু করে দিয়েছে। শাড়িটা দলামোচড়া করা।
আভা আমাকে ক্ষমা করো।’ কাপুর দরজার সামনে দাঁড়াল। এখনও তার পোশাক যথার্থ বিন্যস্ত না। গলার স্বরে ক্ষুধাতৃপ্ত পশুর গোঙানি।
আভার সমস্ত শরীরের যন্ত্রণা আর অপমান যেন মস্তিষ্কের অন্ধ কোষে ছুটে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছা করছে, সমস্ত পৃথিবী কাঁপিয়ে হিংস্র চিৎকারে ফেটে পড়ে। দানবীর মতো লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে। সে ইচ্ছা কেবল ওর বুকের মধ্যেই আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। মরণ ওকে ঘিরে অন্ধকূপের মধ্যে এনে ফেলেছে। অন্ধকূপে লালসা-অজগরের গ্রাস হাঁ করে আছে। আর অভিজ্ঞতা ওকে স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে, কাপুরের এটা কোনও মুহূর্তের দুর্বলতা না। এ আকাঙ্ক্ষা তার মনে কোনও এক সময়ে হঠাৎ ঝলকিয়ে উঠেছে। এবং তা স্থায়ী আগুনে রূপান্তরিত হয়েছে। কয়েক দিনে সেই আগুন লেলিহান হয়েছে। বাসনার বাতাসে ফুঁসেছে, আর সুযোগ পাওয়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আভা, তুমি আমার স্ত্রীকে দেখেছ। তৃপ্ত পশুটি যেন করুণ সুরে প্রার্থনা করছে, আমাকে ধরে রাখার মতো তার কিছু নেই। শরীরে না, মনেও না। আমার ভিতরটা মরুভূমির থেকেও শুকনো৷ আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।’
আভা জানে, এখানে প্রতিবাদ, যুক্তি সবই অর্থহীন। ক্ষুধিতের গ্রাসের কাছে যুক্তি অগ্রাহ্য। ও কোনও কথা বলল না। ববকে বুকে জড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেল। অতঃপর? এই চিন্তা ওকে। আচ্ছন্ন করল। শুনতে পেল, কাপুর বাইরের ঘরে বোতল গেলাস বের করে নিয়ে বসেছে। সুবীর মাত্র। গতকাল গিয়েছে। সাত দিন, অথবা কত দিন পরে সে ফিরে আসবে, কোনও স্থিরতা নেই।
.
সুবীর, তোমার এই স্বর্গ ছেড়ে আমাকে বড় যন্ত্রণায় চলে যেতে হচ্ছে। হয়তো তোমার শেষ কথার সংকেতটি আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। না হলেও কি মুক্তি ছিল? বোধ হয় না। তিন দিন ধরে কাপুরের কাছে আমি, দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টির পরে, বর্ষণসিক্ত ভূমি। সেই ভূমিটিকে সে দিনে রাত্রে সর্বগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কর্ষণ করে চলেছে। আমি বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছি। আর পারছি না। তোমাকে কি আর কোনও দিন দেখতে পাব? এখন জানি, পৃথিবীতে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। অতএব এই হয় তো শেষ বিদায়। তবু আশা করব। বেঁচে থাকলে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করব। তোমার রেখে যাওয়া টাকা নিয়ে গেলাম। তুমি আমার অকুণ্ঠিত ভালবাসা আর শ্রদ্ধা জেনো। ইতি, আভা।
আসন্ন সন্ধ্যায় চিঠিটি লিখে, ছোট ভাঁজ করে রেখে দিল সুবীরের রেজার বক্সের নীচে। কাপুর ঘণ্টা খানেক আগে বেরিয়েছে। আবার একটু পরেই ফিরে আসবে সারা রাত্রির জন্যে। আভা প্রস্তুত। ববকে খাওয়ানো হয়েছে। মালতীর দেওয়া সেই ফুডের বোতলটি নিল। আর ওর হাতব্যাগটা। ওর নিজের গায়ে সেই পুরনো পোশাক। ববকে কোলে নিয়ে, দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। দরজা টেনে, লিফটে নেমে, রাস্তায় এসে দাঁড়াল। কোনও দিকেই ও দেখছে না। সেই একই ছবি ওর চোখের সামনে। চারদিকে গভীর অন্ধকার জঙ্গল। একটা আলোর রেখা ধরে ও চলেছে। ট্যাক্সি চাই।
ট্যাক্সি পেল। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে রাস্তার নাম বলল। চৈত্রের সন্ধ্যায় কলকাতার রাস্তায় আলো জ্বলছে। দক্ষিণের বাতাসে যেন ঝড়ের বেগ। যানবাহন পথচারীর ভিড়ে কলকাতা মুখর। দেখে তো মনে হয় না, প্রাণঘাতী ঘাতকেরা এখানে হানা দিয়ে বেড়াচ্ছে। হত্যা তবু অনন্তের যাত্রী যেন।
ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল একটি গাছপালা-ঘেরা গেটের সামনে। জায়গাটা অন্ধকার। সেটা স্বস্তি। আকাশে মাথা তুলে আছে গির্জার চুড়ায় ক্রস। আভা ভাড়া মিটিয়ে নামল। মনে গভীর সংশয় আর। উদ্বেগ। তিনি আশ্রয় দেবেন তো? ও আলোকিত গির্জা প্রাঙ্গণ ঘোমটা টেনে পেরিয়ে গেল। কোনও এক সময়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। স্নেহ করতেন। পরে বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, একটা সময় জীবনটাকে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে, হাঁকিয়ে ছুটতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যথাসময়ে লাগাম টেনে ধরতে না পারলে, খাদে পড়ে যেতেই হয়। তোমার এই সৌন্দর্য, শরীরের সুষমা ঈশ্বরেরই দান। একে রক্ষা করো।তখন সেই বেপরোয়া অন্ধ বেগে ছুটে চলার দিনগুলো। আগে যেমন মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা হত, যেত। পরে আর তা করত না। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে, তিনি হাসতেন। বিষণ্ণ সেই হাসি। আভার ঈশ্বরানুভূতি তখনও ছিল না। এখনও নেই। এখন স্থির লক্ষ্য দুরন্ত শিকারির দ্বারা তাড়িত। বাঁচার পশু প্রবৃত্তি মাত্র।
আভা ডান দিকে পাঁচিল ঘেঁষে, গির্জার পিছনে গেল। তার ঘরে আলো জ্বলছে। কেউ নেই তো? কথাবার্তার কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। গাছপালা ঘেরা, তিনটি একতলা ছোট বাড়ি। দুটি কামরা, কিচেন আর বাথরুম। আভা খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তিনি সামনের ঘরেই বসে আছেন। চেয়ারে বসে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে কিছু লিখছেন। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। চওড়া মুখে ধূসর গোঁফ দাড়ি। একটু মোটা, কিন্তু চোখা নাক। চওড়া কপালে রেখার ভাজ। মাথায় পাতলা ধূসর চুল, সামনে টেনে আঁচড়ানো। গায়ে একটা গোল গলা, হাত কাটা পাতলা জামা। নিশ্চয়ই পায়জামা পরে আছেন। ঘরের বেশভূষায় সেই চেনা মানুষটি।
বব হঠাৎ গলা দিয়ে শব্দ করল। ফাদার আরনল্ড চমকে মুখ তুলে তাকালেন। তার মোটা লেন্সের চশমায় টেবিল ল্যাম্পের আলোর ঝলক। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে?’ আভা ঘরের ভিতরে এক পা ঢুকে দাঁড়াল। ফাদারের চোখে যেন কয়েক মুহূর্তের একটা স্বপ্নিল বিস্ময়। চকিতেই তা অপসারিত হল। হাতের কলম রেখে, উঠে দাঁড়ালেন, ওহ্ তুমি? হা ঈশ্বর! আমি যেন স্বপ্নের ঘোরে দেখলাম, যিশু কোলে মা মেরি এসে দাঁড়িয়েছেন। ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি। তার দৃষ্টিতে ও স্বরে গভীর উৎকণ্ঠা। টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপে নিভিয়ে দিলেন।
আভা ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ফাদার দ্রুত হাতে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলেন। পিছন ফিরে তাকালেন আভার দিকে, কী করে এখানে এলে? তোমাকে যারা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারা তো ভয়াবহ লোক!
আপনি কী করে জানলেন?’ আভা রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল। ফাদার সরে গিয়ে, জানালা বন্ধ করতে করতে বললেন, কী করে আবার? তারা তোমাকে আমার এখানে খুঁজতে এসেছিল, দু দিন দু বার।
এখানেও? আভার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল।
ফাদার আভাকে ভিতরের ঘরে যাবার ইঙ্গিত করলেন। নিজেও এলেন। আলো জ্বালিয়ে নিলেন, হ্যাঁ, এখানেও। তোমার প্রতিটি চেনা জায়গায় ওরা হন্যে হয়ে ঘুরছে। আমি খবর পেয়েছি। এমনকী আমার এখানেও বাদ দেয়নি। কোনও সম্ভাব্য জায়গাই বাদ দিচ্ছে না। আমার মনে হয়েছে, তাদের লক্ষ্য, দ্যাখ মার। তিনি ক্রস করলেন। দেওয়ালে খ্রিস্টের মূর্তির নীচে, তাঁর সাধারণ বিছানা দেখিয়ে বললেন, বসো৷ আভা বসল। তিনি দড়ি দিয়ে বোনা, একটা ছোট চারপায়া টেনে বসলেন। আমি রোজ খবরের কাগজ খুলে প্রথম দেখি, কোথাও কোনও মা ও শিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে কি না। কোথা থেকে এলে, আমাকে সব বলো।’
আভার মুখ খুলতে একটু সময় লাগল। তারপর সবিস্তারে সব কথা বলল। কোনও কথাই বাদ দিল না। এমনকী কাপুরের কথাও না। ফাদার আরনল্ড সমস্ত কথা শুনলেন। তার মুখে গভীর উৎকণ্ঠিত চিন্তার রেখা। বব খুঁতখুঁত করে কাঁদছে দেখে, তিনি প্রথমে ওকে খাইয়ে দিতে বললেন। ঘরের দরজা। বন্ধ করে দিয়ে, নিজে গেলেন বাইরের ঘরে। আবার কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এলেন। ববের খাওয়া তখন শেষ। ওর চোখে ঘুম নেমে এসেছে। ফাদার ওকে তার বিছানায় শুইয়ে দিতে বললেন। আভা ববকে শুইয়ে দিল। ফাদার উৎকণ্ঠিত দ্রুত স্বরে বললেন, প্রয়োজনীয় কথাগুলো আগে বলা দরকার। আমি তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না। বাইরে যাবার সময়, আমি স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যাব। তুমি বাইরের ঘরের কাচের জানালা দিয়ে, সামনের সবই দেখতে পাবে। তোমার একমাত্র পালাবার রাস্তা পেছনের রান্নাঘরের দরজা খুলে বাগানের পাঁচিলের গায়ে, সুইপারের যাওয়া-আসার দরজা দিয়ে। দক্ষিণের পাঁচিলের ও পাশে স্কুল, তুমি জান। সেদিকে কখনওই যাবে না। পেছনে একটা গলি রাস্তা। বাঁ দিকে গেলে বড় রাস্তা পাবে। আর আমার মনে হচ্ছে, সুবীর তোমাকে যা বলেছে, সেই দিকটা এক বার দেখতে হবে। জোজোর কেসটা যে খবরের কাগজে কভার করেছিল, তার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম বিক্রম ধর। তাকে আমি কালই ডেকে পাঠাব। আমি না থাকলেও, সে আসবে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
আভা কিছু বলতে গেল। তিনি বাধা দিলেন, জানি। আমি যাজক আর শিক্ষক হলেও, ক্ষেত্র বিশেষে অবস্থা বুঝতে পারি। বিক্রম একলা এলে, সে রান্নাঘরের দরজায় এসে তিন বার টোকা দেবে। সেই ভাবেই তাকে আমি বুঝিয়ে বলে দেব। আর বিশ্বাস? তার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, তুমি সে দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’ তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তুমি নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। রুটি আর কিছু সসেজ আছে, তুমি খেয়ে নাও।
আমি ক্ষুধার্ত নই ফাদার। আভা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
ফাদার বললেন, এখন না হলে পরে হবে। অনিবার্যতাকে উপেক্ষা করা চলে না। তুমি এ ঘরেই শোবে। আমি বাইরের ঘরে শোব।’ তিনি দেওয়ালে টাঙানো যিশুর কাঠের মূর্তির দিকে তাকালেন।
পরের দিন বেলা একটায় রান্নাঘরের দরজায় তিন বার শব্দ হল। আভা শুয়ে ছিল। ঝটিতি উঠে বসল। বুকেনাকাড়া বাজছে। রান্নাঘরের দরজায় শব্দ কি? ও অপেক্ষা করল। দ্রুত একবার ঘুমন্ত ববকে দেখল। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। আবার তিন বার ব্যস্ত ঠক ঠুক। তাঁ, রান্নাঘরের দরজায়। ফাদার এখন নেই। আভা রান্নাঘরে গিয়ে, নিশ্বাস বন্ধ করে দরজা খুলে দিল।
অনধিক চল্লিশ বছরের এক যুবা। ট্রাউজারের ওপর একটা হাওয়াই শার্ট। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, কোমল মুখ। মাথার চুল উলটে আঁচড়ানো। হাতে একটি ছোট ব্যাগ। বলল, আমার নাম বিক্রম ধর।
আমি–
জানি, আভা মজুমদার। বিক্রম ঘরের মধ্যে ঢুকে এল, দরজাটা বন্ধ করে দিন।
আভা দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল। বিক্রম নিজেই শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কোথায় বসবেন? বাইরের ঘরে, না এ ঘরে?
আভা যেন তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জবাব দিতে এক মুহূর্ত সময় লাগল, এ ঘরেই বসা যাক। ও দড়ি-বোনা ছোট চারপায়াটা টেনে আনল। ছোট ইজিচেয়ারটা দেখিয়ে বলল, আপনি ওটায় বসুন।
বিক্রম কোনও দ্বিরুক্তি না করে ইজিচেয়ারে বসল, ফাদারের কাছে আমার সব শোনা হয়ে গেছে। আর আশ্চর্য, এ খবর পত্রিকা জগতে এখনও অজানা। জানলে কী হত অবিশ্যি জানি না। অনেক খবরই ঠিক সময়মতো পৌঁছোয় না। যেমন–হ্যাঁ, আমি জোজোর কেসটা কভার করেছিলাম। আপনাকে সিটি সেসনস্ কোর্টে দেখেছি।
ফাদারের মুখে আমি শুনেছি। আভা বিক্রমের প্রাকুটি চোখের দিকে তাকাল। বিক্রমের ভ্রূকুটি চোখে অন্যমনস্কতা। অথচ ঠোঁটের কোণে যেন ঈষৎ ব্যঙ্গের হাসি, হ্যাঁ, যে কারণে বলছিলাম সব খবরই সবসময়ে জানা যায় না, কাগজে রিপোর্ট হয় না। সরকার যখন কেসটা নিলেন, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, তাদের আগ্রহ এত বেশি ছিল, আপনার জন্য তারা তিন তিন জন পাবলিক প্রসিকিউটরকে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের প্রথম সাক্ষীর দিনই, তিন পাবলিক প্রসিকিউটর জজকে বললেন, একটা জরুরি কেসের রায়ের জন্য, তাঁদের অন্য কোর্টে চলে যেতে হচ্ছে। অথচ তারা সেদিনের মতো কোর্ট অ্যাডজোর্নমেন্ট চাইলেন না। এই দিনটির খবর আমার জানা ছিল না। তা হলে রিপোর্ট করা যেত। পরে শুনেছি, জজ মন্তব্য করেছিলেন, আমি জীবনে এমন কথা শুনিনি, পাবলিক প্রসিকিউটরের অ্যাবসেন্সে, একজামিনেশন ইন-চিফের সাক্ষী নেওয়া যায়। তা হলে ইনভেস্টিগেটিং অফিসার যা পারেন তাই বলুন। আসামি পক্ষের উকিল নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন। আর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের নাম আপনাকে বলতে হবে না নিশ্চয়ই? তখনই আমার মনে হয়েছিল, কেস ইজ ফ্লপ।…’
আভার কানে মল্লিক মেলোমশায়ের কথাগুলো বাজতে লাগল। ঠিক এ রকম কথাই তিনিও বলেছিলেন। ও সে কথা বিক্রমকে বলল। বিক্রম ঘাড় বাঁকিয়ে আভার দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকাল, তিনি যখন এ কথা বলতে পেরেছিলেন, তখন নিশ্চয়ই এ পয়েন্টটাও বলেছিলেন, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর কী বলেছিলেন। তারই ভিত্তিতেই কি প্রথম দিন সরকার পক্ষ কেসের বিরোধিতা করেনি? কেস যেখানে ৩০২ ধারার, সেখানে আসামিদের বেইলের বিরোধিতা না করা একেবারে আশ্চর্যের। যেখানে এ রকম ক্ষেত্রে ভেহমেন্টলি বেইল অপোজ করা হয়। কিন্তু তদন্ত শুরু হবার আগেই, তিন দিনের মধ্যেই জলি আর জয়া জামিন পেয়ে গেল।
হ্যাঁ। এ কথাও মল্লিক মেলোমশায় বলেছিলেন, আর তিনি খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, স্ট্রেঞ্জ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ!’ আভা বলল।
বিক্রম মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, জোজোর মরার খবর কি আপনাকে স্যার জে. সি-র বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছিল? না থানা?
একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার দাদাকে প্রথম টেলিফোন করে জানিয়েছিল, জোজোর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, সে বাড়িতে পুলিশ এসেছে। তখন আমি থানায় যাই। আভা বলল, আমি শুনলাম, জোজো জলির উইঙের তিন তলার সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গিয়েছে। পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যু বলে ডেড বডি ময়না তদন্তে, পাঠিয়েছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছিল আনন্যাচারেল ডেথ সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবার জন্য। আমি ডেড বডি পেলাম, স্পষ্ট মনে হল, ওকে কেউ সিঁড়ি থেকে জোরে, ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। অবিশ্যি ময়না তদন্তেও বলা হয়েছিল, জোজো দু হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, বাঁচবার জন্য। জোজোর মুখে মাথায় দু হাতে আর তলপেটের কাছে আঘাতের চিহ্ন ছিল, যা দেখে বোঝা যায়, ওর জ্ঞান ছিল, সে অবস্থায় ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। ওর বাঁ দিকের কিডনি রাপচার হয়েছিল। অথচ জলিরা বলেছিল, জোজো ঘুমন্ত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়েছিল। অবিশ্যি, ওকে নাকি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। আমি পিটিশান করেছিলাম আগের কথা সব জানিয়ে। বলেছিলাম, এটা কেস্ অফ্ মার্ডার। পুলিশ কেস দিয়েছিল।
বিক্রম ঠোঁট উলটে তীক্ষ্ণ হেসে বলল, আর এখানেই সমস্ত ব্যাপারটা জট পাকিয়ে গেল। আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, জলি ও জয়া জামিন পাবার পরে, আপনাকে কেস না লড়ার জন্য কেউ কিছু বলেছিল?
হ্যাঁ, এমনকী ভয়ও দেখানো হয়েছিল। আভা বলল।
বিক্রম বলল, সেই জন্যেই আপনার মল্লিক মেলোমশায় মাত্র তিন দিনের মধ্যে জামিনের ব্যাপারে এত অবাক হয়েছিলেন। ৩০২ ধারার কোনও কেসেই এ রকম জামিন হয় না, তিনি জানতেন, আর তার কারণটাও বুঝেছিলেন৷
ওরা জামিন পাবার পরে মেলোমশায় বলেছিলেন, আভা এ বার তোমাকে কেস তুলে নেবার জন্য পেড়াপিড়ি করা হতে পারে, এমনকী ভয়ও। সবটাই মিলে গিয়েছিল। আভা বলল।
বিক্রম হতাশভাবে হাত নাড়ল, কিন্তু এ সব কথা আমরা রিপোর্ট করতে পারি না। পুলিশ আর কোর্ট যা বলবে, সেখানে যা ঘটবে, তাই একমাত্র রিপোর্ট করতে পারি। অবিশ্যি আমরা আপনার একটা স্টেটমেন্টও ছবিসহ ছেপেছিলাম। কিন্তু প্রমাণ আর ভিত্তিহীন কোনও সংবাদ ছাপার দায়িত্ব আছে। আপনি কি এখনও মনে করেন, জোজোকে মার্ডার করা হয়েছিল?
ডেলিবারেটলি৷’ আভা দৃঢ় স্বরে বলল।
বিক্রম মাথা ঝাঁকিয়ে আবার ব্যঙ্গের হাসি হাসল, রায়ের পরে এখন আর এ কথা পাবলিকলি বলতে পারবেন না। অথচ ঘটনাটা মার্ডার প্রমাণ হতে গিয়েও, পাবলিক প্রসিকিউটার আর সরকারি ডাক্তারের ময়না তদন্তেই বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এটাও খুব আশ্চর্যের। এ বিষয়ে আপনার উকিল মেলোমশায় কিছু বলেছিলেন?
বলেছিলেন। আভা বলল, তিনি কপাল চাপড়ে বলেছিলেন, পাবলিক প্রসিকিউটার ডাক্তারকে হোস্টাইল করে দিয়েছিল। তারা ময়না তদন্তকে নস্যাৎ করার জন্য, ঘুমের ড্রাগের ওপর জোর দিয়েছিল। অথচ ময়না তদন্তে, আর ফরেনসিক রিপোর্টে জোজোর লিভারে বা ভিসেরায় কোনও ড্রাগ বা পয়জন পাওয়া যায়নি।
বিক্রম বলল, অবিশ্যি এমন ড্রাগ বা পয়জনও আছে, যা একটা বিশেষ সময়ের পরে, তা আর ভিসেরায় পাওয়া যায় না। আর কনট্রাডিকশনটাও সেখানেই দেখা দিল। পাবলিক প্রসিকিউটার এক্সপ্লেন করলেন না, ওষুধ কতক্ষণ থাকতে পারে। কিন্তু ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, এটাই প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। ডাক্তারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট মানতে গেলে, মার্ডার প্রমাণ হবার যথেষ্ট চান্স ছিল। তার রিপোর্টে ছিল, জোজো সিঁড়ি থেকে পড়বার আগে সজ্ঞানে দু হাত স্ট্রেচ করে পড়েছিল। তার মানে ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে বা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
কোর্টের কাছে এটাই সব থেকে বড় কনট্রাডিকশান হয়ে দেখা দিয়েছিল। সরকার বলল, পরিষ্কার, জোজোকে বিষ বা ওই জাতীয় কিছু খাইয়ে পরে সিঁড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তা হলে লিভারে বা ভিসেরায় সেই ড্রাগ বা পয়জন কোথায়? এর কোনও এক্সপ্লানেশান হল না। বাড়ির ঝি চাকরকে দিয়ে ইনফ্যাক্ট কোনও কথাই বলানো হল না। রেজালটু কেস্ ওয়াজ ফ্লপ। ডাউট অফ বেনিফিটে জজ আসামিদের বেকসুর খালাস করে দিলেন। অবিশ্যি, রায় দেবার সময়, জজ সুপ্রিম কোর্টের একটা বয়ান। ও উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, মানুষের মন বোঝা অসম্ভব…মানুষ কেন খুন করল, এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব সরকার পক্ষের নেই। কিন্তু যদি পারে, তবে অবিশ্যিই রায় শাস্তির পক্ষে যাবে। এ কেসে তা হয়নি। অতএব– বিক্রম আভার দিকে তাকাল। তারপর ববের দিকে।
দুজনের কেউ, খানিকক্ষণ কোনও কথা বলল না। বেশ খানিকক্ষণ পরে বিক্রম বলল, ফাদার আরনল্ড-এর মুখ থেকে যা শুনেছি, আসল ঘটনাটা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। তবু আপনার মুখ থেকে শোনা যাক।
আভা আবার একজনকে সব কথা বলল। অবিশ্যি কেবল মাত্র সুবীরের আশ্রয় বাদ দিয়ে। সমস্ত শোনার পরে বিক্রম উঠে দাঁড়াল, আমি আগামীকাল এ সময়েই আসব। কী করতে পারি, আপনাকে জানাব। চলি।
বিক্রম চলে গেল। আভার মনে একটা ক্ষীণ আশা জাগল। কিন্তু মল্লিক মেলোমশায়ের কথাগুলোই। ওর কানে বাজতে লাগল, আমি একজন আইনজীবী। বিচার কী, আইন কী কিছু দেখেছি।…কিন্তু সদর্থে সুবিচার আর মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে তার যোগসূত্র কোথায়, আজ এ বয়সেও সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।’…
ফাদার ফিরে আসার পড়ে আভা বিক্রমের কথা বলল। তিনি যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলে। কিন্তু পরের দিন, বিক্রম এসে নিজেই হতাশ হয়ে জানাল, আপনার স্টোরি আমাদের সম্পাদক ছাপতে পারবেন না। তিনি লালবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। লালবাজার বলছে, এটা হবে প্রমাণ আর ভিত্তিহীন একটা খবর। আভা যাদের আশ্রয়ে লুকিয়েছিল বলে বলছে, আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখুন না, তারা কিছু স্বীকার করে কি না?’ বিক্রম আভার হতাশ ক্লিন্ন চোখের দিকে তাকাল, আপনার কী মনে হয়, স্বীকার করবে?
জানি না। আভা অন্যমনস্ক চোখে মাথা নাড়ল। বিক্রম বলল, তবে আপনি সম্পাদককে একটা চিঠি প্রকাশের জন্য দিতে পারেন, আপনি মনে করছেন, আপনাকে আর ববকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে।
তাতে কী ফল হবে? আভা জিজ্ঞেস করল।
বিক্রম আভার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, দু হাত দু দিকে ছড়িয়ে দিল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়ল। সে কিছুই বলতে পারে না। যুবক সাংবাদিকটির নিজের চোখেও বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।
.
ভোরবেলা। বাইরে গাছপালায় বাতাসের ঝরঝর শব্দ। আভার তন্দ্রার ঘোরটা হঠাই যেন কেটে গেল, আর অশুভ চিন্তায় মনটা কেমন করে উঠল। একটা অলৌকিক শিহরন যেন অনুভব করল। একে কি ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে? বিছানা থেকে নেমে দ্রুত সামনের ঘরের, মাঝখানের দরজায় দাঁড়াল। কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখল। চার্চের পিছনে, দক্ষিণের ফালি পথের কোণে দু জন লোক দাঁড়িয়ে। বর্ণনায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। রোগা লম্বা, মুখে হিজিবিজি দাগ, নীল পাতলা স্যুট। আর একজন বেঁটে ট্রাউজারের ওপরে হাওয়াই শার্ট গায়ে। দুজনেই ফাদার আরনন্ডের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। কী কথা হচ্ছিল দু জনের মধ্যে। বেঁটে লোকটি কোমরের ভিতরে হাত ঢোকাল। লম্বা লোকটা পা বাড়াল।
আভা নিমেষে ভিতরে ছুটে গিয়ে ঘুমন্ত ববকে বুকে টেনে নিল। নিদ্রিত ফাদারকে ডাকল না। রান্নাঘরের দরজা খুলে আবার টেনে বন্ধ করে বাগানের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল পাঁচিলের দরজার কাছে। বেরিয়ে এল গলি পথে। বেরিয়েই ওর মনে হল, গলিপথ কোথায়? এ যেন দু দিকে ঘন গাছপালার মাঝখান দিয়ে, এক বীথিপথ। নির্জন, একটি লোক নেই। বাতাসে গাছের পাতা ঝরছে, চৈত্রের পাতা। পাখি ডাকছে। কিন্তু ও কোথায় ছুটছে? কেন ছুটছে?…
ওর গতি কমে এল। ঝরা পাতা ওর আর ববের গায়ে জামায় ছড়িয়ে পড়ল। একটা গাছে, অজস্র লাল ফুল। রক্তের মতো টকটকে লাল, রেণুতে আগুনের আভাস। বাতাসের ঝাপটায় সেই ফুলের পাপড়ি ওর আর ববের গায়ে মাথায় মুখে বুকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। যেন সারা গায়ে রক্তের ছিটার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ কি কলকাতা? কোন কলকাতা? পিছনে কি শুকনো পাতায় কারোর পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে? আভা দেখবে না। ভোরের পাতা-ঝরা বাতাসে, এই ত্রাসপুরীর ওপর দিয়ে ও হেঁটে যাবে, যতক্ষণ পারে। এ কি পরভূমি? কী পরিচয় এই দেশের? যেন মনে হয়, এক রুদ্ধশ্বাস রিক্ত বিজন বির্ভুই। রক্তের মতো ফুলের পাপড়িগুলো ওকে যেন ঢেকে দিতে লাগল। ও থামল না।…