২১.
দিন কেটে গেল।
সুমিতা দেখলে। ঘরে বাইরে, ভয়ে-বিস্ময়ে, দিনগুলির চেহারা দেখলে। নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে, ফিরিয়ে রাখতে চেয়েছে মুখ। বাংলায় অনার্স নিয়েছে সুমিতা। দিবানিশি ঘাঁটছে বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ-নিবন্ধের তূপ। যেগুলিতে ওর হাত দেবার কথা নয়, সেগুলির ওপর দিয়েও চালিয়ে দিয়েছে পড়ার ঘোড়া। ঘোড়া-ই। এই ছোটার মধ্যে, পদাবলী বাউল-আখড়াই-পাঁচালি, কোনটা কোনখান দিয়ে কীভাবে এল গেল নিজেই ঠিক করতে পারল না। শুধু বাংলা দেশের একটি দিশেহারা বিস্তৃতি ওর সামনে। অচেনা, অজানা তার রূপ। তার মাঝে মিশে যায়নি সুমিতা। মিশে যাওয়ার উপায় ছিল না। শুধু ছুটছিল।
একদিন ও ডি বি এল-খানি হাতে দেখে সুগতা বললে, এর মধ্যেই ওটা ধরেছিস কেন রুমনি? ওটা তো পরে পড়লেও চলবে।
সুমিতা একটু সলজ্জ-গম্ভীর স্বরে বলেছে, দেখছি একটু।
সবসময়েই লেখা আর পড়া, কলেজে যাওয়া-আসা নিয়ে সময় কাটিয়ে দিতে চায়। এই যে দিন কেটে যায়, এর সবটুকুই যেন ও ভরে রাখতে চায় পড়া দিয়ে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় পড়াটা যে ওখানে নয়, সেইটি মর্মে মর্মে অনুভব করছিল সুমিতা। তাই আসলে ফাঁকি পড়ছিল পড়াটা। সব পড়েছিল অন্যদিকে।
যে দিনগুলি কেটে গেল, মন পড়েছিল সেইদিকে।
.
শীতের স্পর্শ লাগছে দিকে দিকে। শীত যেন কালো রাত্রি। হেমন্ত, তার রক্তাভ বিষণ্ণ সন্ধ্যা। সেই প্রাক্শীত বিষণ্ণতায় ধূসর হেমন্ত বিরাজ করছে কলকাতায়। গাছগুলি নিথর হয়েছে, শুকোচ্ছে পাতাগুলি। পথে জমেছে ধুলো, আবিরের মতো লাগছে দেয়ালে দেয়ালে, গাড়ি-তারে-পোস্টে।
আর চারিদিকে শুধু একটি কথা, ঐতিহাসিক। কাগজে, দেয়ালে, লোকের মুখে মুখে ওই একটি শব্দ, আর একটি দিন, পনেরোই আগস্ট। গত পনেরোই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে। নিশানে নিশানে গিয়েছিল দেশ ছেয়ে। গানে বক্তৃতায় হয়ে উঠেছিল মুখর। এখনও তার জের কাটেনি পুরো। রদবদলের ব্যাখ্যা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে থাকে প্রতিদিনের কাগজে। ঘোষিত হয় বেতারে। দেশ বিভাগ, গণপরিষদ, ডোমিনিয়ন পার্লামেন্ট, আর একটি নতুন বাহিনী, রেফিউজি।
ঐতিহাসিক দিন-মাস-বছর। ঐতিহাসিক কথা, ঐতিহাসিক পরিবর্তন।
ঐতিহাসিক, ঐতিহাসিক। সবই ঐতিহাসিক। এই বাড়ি, বাড়ির মানুষ, সুমিতার চোখে সবকিছুই ঐতিহাসিক। শুধু এর কোনও লেখা নেই, ঘোষণা নেই। লেখা যেটুকু, সেটুকু কখনও-সখনও সহসা দেখা যায় চোখে চোখে। ঘোষণা যেটুকু, সেটুকু পরস্পরের জীবনধারার ভঙ্গিতে।
সেই চার মাস আগে যেদিন রাত্রে সুজাতা ফিরল অনেক দেরিতে, মহীতোষ অপেক্ষা করেছিলেন, অন্ধকারে বাইরের ঘরে। সুগতা ভয়ংকর দুশ্চিন্তায় পড়ার ভান করে কান পেতে ছিল গেটের দিকে। শুধু যার কিছুই জানার কথা নয়, সেই সুমিতাই সমস্ত বিষয়টা দেখছিল। সুজাতা ফিরে আসার পর সবাই নিশ্চিন্ত হয়েছিল, কেঁদে বাঁচেনি সুমিতা। সারা রাত্রি কেটেছিল ভয়ে ভয়ে, রাত পোহালে না জানি কী ঘটবে।
কিন্তু আশ্চর্য! ঘটেনি কিছুই। শুধু তাই নয়। অন্তরে অন্তরে যত অসন্তোষ, যত অমিল বেড়েছে দিনে দিনে, ততই সবাই আরও শান্ত, আরও ভদ্র হয়ে উঠেছে। বড় বিচিত্র রীতিনীতি এই সমাজের, এই জীবনের। ভিতরে চাপা পড়ে রইল আগুন। সবাই কথা বলছে মিহিসুরে, হাসছে পরস্পর। বসে এক টেবিলে, কথা বলে নানারকম। যেন একই সূত্রে গাঁথা সবার প্রাণ। খাবার টেবিলে বসে নুনের পাত্রটি সুজাতার দিকে এগিয়ে দিতে পারলে যেন কৃতার্থ বোধ করে সুগতা। মহীতোষকে দুটি বেশি খাওয়ার জন্যে নিজের হাতে ভাত তুলে দিয়ে সুজাতা অনুরোধ করে।
বাইরের লোক এলেও বোধ হয় এত ভদ্রতা পোষায় না। সবাই নিখুঁতভাবে সকলের ভূমিকা পাঠ করে চলেছে। ভাল আছি, বেশ আছি, তুমি ভাল থাকো, সবাই ভাল থাকুক। কোথাও কোনও দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই। সবাই যেন কত কাছাকাছি। কত কাছাকাছি, কত মিষ্টি সুন্দর। পান থেকে চুনটুকুও খসবার জো নেই।
কে বলবে, এদের মধ্যে আছে কোনও বিরোধ।
সামনে থেকে সরে গিয়ে যে যার নিজের জীবনে যায় ফিরে। সুজাতা চলে যায়, আসে রাত্রে। সম্প্রতি তার উগ্র প্রসাধন ছাপিয়েও একটি অদ্ভুত দক্ষতা ফুটে বেরিয়েছে। চোখের কোলে পড়েছে কালি। কোনও কোনওদিন রাত্রে তাকে পৌঁছে দিয়ে যায় অমলার গাড়ি। দুদিন ফিরতে দেখা গেছে। শুভেনের সঙ্গে।
মহীতোষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ব্লাডপ্রেসার বেড়েছে। ডাক্তার এসেছেন দুদিন। কিন্তু সেটা যেন কিছুই নয়। বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার। সেদিকে কান দেন না একেবারে।
সুজাতা সুগতার সঙ্গে অসুখের কথাবার্তা হয়। কিন্তু মহীতোষ উড়িয়ে দেন। যার কাছে বিশেষ করে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল, সেই ছোট রুমনির কাছেই কেমন যেন বেকায়দায় পড়ে যান।
রুমনি স্থির চোখে মহীতোষের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখে বাবার প্রতি অনেক অভিমান ও অভিযোগ। একটু অপ্রতিভভাবে, স্নেহস্নিগ্ধ হেসে বলেন, কী বলছ রুমনো সাহেবা।
সুমিতা বলে, তোমার শরীর কিন্তু রোজ একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে বাবা।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর সুজাতা ঠিক এমনি করেই মহীতোষের কাছে কাছে থাকত, বলত এমনি করে। সুমিতার কথা শুনে বুকের মধ্যে টনটন করে ওঠে মহীতোষের। তখন সুজাতার নিজের জগৎ উন্মোচিত হয়নি। আজ হয়েছে। সে নিজেকে নিয়েই আজ বেসামাল। সুগতারও নিজের জীবন তার প্রবেশপথের দরজা খুলে দিয়েছে। সুমিতারও দেবে, সেদিন সে আর মহীতোষের কথা ভাববার অবসর পাবে না। বিশ্বসংসারের এইটিই বোধ হয় নিয়ম।
তাতে কোনও দুঃখ ছিল না মহীতোষের। মেয়েরা সবাই তাদের নিজের নিজের জীবনে ছড়িয়ে পড়বে ওঁকে ছেড়ে, তার মধ্যে বেদনা আছে। কিন্তু সুখ আছে অনেকখানি। সেই সুখটুকু থেকে বঞ্চিত শুধু হননি, ভয় হচ্ছে। প্রত্যেকের জীবন যখন স্বতন্ত্রভাবে তৈরি হচ্ছে, তখন আর তার মধ্যে নিজের কিছু করার খুঁজে পান না, সবটুকু বুঝতেও পারেন না, সেইটিই ভয়।
পাশের বাড়ির ডেপুটি মিত্ৰসাহেবের মতো একদিকে পালক, আর একদিকে শাসকপিতা তিনি হতে পারেননি। হলে বোধ হয় সকলের জীবনের প্রতি নিজের অনেকখানি হাত থাকত। সে আফসোসও আজ হয় মহীতোষের। অথচ যে স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, সেই জীবনে যে জটিলতার জট আছে, তার সূত্র খুঁজে পাওয়াও সাধ্যাতীত। আগে পিছে, সে সবই এখন যেন নিরর্থক মনে হয়। মনে মনে সন্দেহ হয়, ও সব কিছুই নয়, আসলে হয়তো মেয়েদের উনি সুখের সন্ধান করতেই শিখিয়েছেন চিরদিন। সমাজের আরও উঁচু তল্লাটে ওঠার একটি ভয়ংকর বেগ দিয়েছেন পুরে রক্তের মধ্যে।
ভাবতে নিজেরই কেমন লাগে, ভয় পান। কিন্তু সেইটিই তো ওঁর স্বধর্ম। মনের, চরিত্রের এবং যে সমাজে বাস করেন, সেখানকার। তার মধ্যে তো কোনও দুরভিসন্ধি ছিল না। আর যদি বাপ হিসেবে শুধুমাত্র এইটুকুই দিয়েছিলেন, তাতে এত যে তীব্র বিস্ময়কর যন্ত্রণা ছিল, তা কি জানতেন?
আজ শাসনের অধিকার গেছে ফুরিয়ে। পালনের সীমানায় ধরে রাখার উপায় নেই। সকলের আলাদা জীবনের মতো ওঁর নিজের জীবনও আলাদা-ই। তাই নিজেকে বড় একলা মনে হয়। অনেক কিছু মনে হয়। কয়েক দিন বাড়ি ফেরার পথে নেমে পড়েছেন পথে। চৌরঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নানারকম ভেবেছেন। বড় একলা মনে হয়েছে। একটি মানুষ চাই। একটি মানুষ। বার-এর দিকে তাকিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছেন। ফিরে এসেছেন আবার। লিন্ডসে স্ট্রিট ধরে এগিয়ে গেছেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো। অনেক দূর গেছেন। পথে পথে, মোড়ে মোড়ে মেয়েদের জটলা দেখেছেন। দলা দলা রুজ-লিপস্টিক ঘষা ফ্যাকাশে মেয়েগুলি। পুরনো গাউনগুলি ধুয়ে ভাঁজ করে কোনওরকমে রেখেছে টিকিয়ে। ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ চোখে এই দশাসই বয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়েছে ফিরে। আড়কাঠি এসেছে টিকটিকির মতো, কানের কাছে বিড় বিড় করেছে, ছোটিবালা মেমসাব হোজুর, কালিজ গার্ল।
ক্রমেই জীবনের এই সন্ধ্যা-রক্তে লেগেছে তীব্র কম্পন। স্রোত তার নীচ থেকে ওঠেনি ওপরে, বরং তরতর করে নেমেছে। মনে হয়েছে রক্ত পড়ছে গড়িয়ে পথে পথে। শরীরটা ভারী হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে, অসাড় অচৈতন্য হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বেন পথে।
এই শেষ জীবনে, নিজের মেয়ের সঙ্গে অমিল হল বলে পণ্যাঙ্গনার কাছে যেতে চেয়েছেন অবোধ একাকিত্ব ঘোচাবার আশায়। সারা জীবনে এ মোহ ছিল না কোনওকালেই। কিন্তু একী বিচিত্র মানুষ মহীতোষ। কোথায় এর যুক্তি, কোথায় এর কার্যকারণ। যতই ওই সর্বনাশা পথে গেছেন এগিয়ে, ততই ভাববার চেষ্টা করেছেন। আজ এই বুড়ো বয়সে একটি মনের মানুষের প্রয়োজন হয়েছে। মনের মানুষ, হাসি, আনন্দ প্রাণখোলা কথা। সেই আশায় শেষ পর্যন্ত ওই পথে।
লোক শুনলে কী ভাববে। যত মন্দই ভাবুক, এর মধ্যে নিজেকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনও তত্ত্ব নেই। লোকে কত কী ভাবে। সংসারে দুঃখ থাকলে মানুষ কত কী করে। যেটুকু মহীতোষের সংসার, যা নিয়ে সুখ দুঃখ, ভাঙন ধরেছে সেইখানে। তাই পাগলের মতো দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন।
কিন্তু মদও খেতে পারেননি, মনের মানুষের হাসির অছিলায় পারেননি কোনও মেয়ের কাছে যেতে। বোধ হয় ঠিক ওইটি চাননি। কী চেয়েছেন, ঠিক জানেন না বলেই গেছেন।
তারপর নিজের প্রকাণ্ড শরীরখানি কুঁজোর মতো নুইয়ে, দুহাতে মুখ ঢেকে পালিয়ে এসেছেন। ভিতরের পাশবিক চিৎকারটা কেউ শুনতে পায়নি। শুধু সারা মুখের ভাঁজে ভাঁজে লোনা জল পড়েছে গড়িয়ে।
মাঝখান থেকে লাভ হয়েছে ব্লাডপ্রেশারের আধিক্য। ছিলই, সেটুকু বাড়িয়েছেন রীতিমতো। আর বিস্ময়ে ভয়ে লজ্জায় ধিক্কারে গেছেন অসাড় হয়ে। হয়তো আর দশজন বাপের চেয়ে বিপত্নীক মহীতোষ একটু বেশি অনুরক্ত মেয়েদের প্রতি। সংসারে যেন দেখতেই পান না আর কাউকে। তা বলে কী ভয়াবহ পাগলামিই না গ্রাস করতে বসেছিল ওঁকে।
সুজাতা মেয়ে হয়েও যেন ওর মায়ের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। ওর দুঃখে, নিজেকে ধ্বংস করার বিচিত্র তাণ্ডবে, মহীতোষ বড় বেশি দিশেহারা হয়েছেন। কিন্তু সুজাতা! ভাবেন, উমনো আমার প্রাণে ব্যথার কাঁটা হয়ে রইল ফুটে। কিন্তু আমার ঝুমনো আছে, আছে রুমনো সাহেবা। সামনেই বড় আনন্দের দিন, ঝুমনোর বিয়ে। বুড়ো বয়সে একটি জীবন তো সবে শুরু হয়েছে। উমনো রইল, ঝুমনো-রুমনোর জীবনে প্রতিষ্ঠাটুকু দেখে যাবেন! করেও যাবেন, নিজের যতটুকু করার।
কিন্তু ব্যথা এমন জিনিস, যেখানে সে আছে, সেখানে সব আনন্দ ছাপিয়ে তার মেদুর বিষণ্ণতার আভাস ওঠে ফুটে। কাঁটা যদি থাকে বিধে, খচখচ তো সে করবেই।
এখন সুমিতার চোখের সামনে ওকে বেশি পড়তে হয়। একটু সংকুচিতও হন। ছোট মেয়েটার চোখে অনুসন্ধিৎসা বড় তীব্র। কখনও কখনও বিরক্ত হয়ে ওঠেন নিজেরই দুর্বলতায়। মন তিক্ত হয়ে ওঠে। উমনো ঝুমনোকে যা বলতে পারেন না, রুমনোকে সে কথা বলে ফেলেন। যখন ও অমনি করে বলে, তোমার শরীর বড় খারাপ হয়ে পড়ছে, তখন ঠোঁটের কোণে একটু বক্র হেসে বলেন, তোমার জগৎটা এখনও অনেক ছোট রুমনো সাহেবা। তাই এ সব সামান্য জিনিস তোমার চোখে পড়ে। এটা এমন কিছু নয়, সেরে যাবে।
সুমিতা বোঝে, বাবা কী বলতে চান। এক মুহূর্তের জন্যে বুকের মধ্যে টনটন করে। পরমুহূর্তেই বড় রাগ হয়। তীব্র গলায় কিছু বলে উঠতে ইচ্ছে করে। জানুক সবাই, এই বাড়িটার ছলনা সহ্য হচ্ছে না কিছুতেই। তারপরে শান্ত হয়ে যায়। শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
সংসারে সুমিতা দুটি লোককে বোধ হয় সবচেয়ে বেশি স্নেহ করে। একজন, বিমল আর একজন মহীতোষ। শিশু নয় দুজনের কেউই। কিন্তু ওর নারীত্ব এই দুজন সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করেছে।
তারপর আসে সুগতা আর মৃণালের কথা। কোনও-কোনওদিন মহীতোষের সঙ্গে মৃণালের দেখা হয়ে যায়। যেদিন না হয়, সেদিন জিজ্ঞেস করেন, মৃণাল এসেছিল?
এসেছিল।
সুগতার পরীক্ষার আগেও এসেছে নিয়মিত। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, এখন আসে আরও নিয়মিত। সারাদিন, রোজ আসে মৃণাল।
সারা বাড়িটাতে থাকে ওরা দুজনেই।
সংসারে কতইনা অদলবদল হয়। পরীক্ষার সময় সুগতার চোখে-মুখে যে ক্লিষ্টতা গিয়েছিল, তা মুছে গেছে। ওর সারা দেহে যেন ঝাঁপ দিয়েছে এক নতুন প্লাবন। বলিষ্ঠ শরীরখানি যেন কত হালকা। মুখ ভরে একটু রং-এর ছোপ ধরে আছে সর্বক্ষণ। ওর মতো গম্ভীর মেয়ের চোখের তারা দুটিতে এখন নিয়ত চকিত দীপ্তি। বেলা বারোটার ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পর, নিরালা বনের হরিণীর মতো থাকে উৎকর্ণ হয়ে, চঞ্চল হয়ে বার বার ফিরে ফিরে চায় দরজার দিকে। কখন মৃণাল আসবে।
মৃণালের আগের সেই অপ্রতিভ গেছে। কেমন একটি হারাবার ভয় ছিল কয়েক মাস আগেও। এখন অনেকখানি দৃঢ়তা পেয়েছে। চোখে-মুখে সতেজ দীপ্তি। কথা বলে রাশি রাশি, আসে সশব্দে। সুগতাকে উঠতে হাত বাড়ায়, বসতে হাত বাড়ায়। তবু মনের খুব গভীরে সে অনুভব করে, জীবনের এক অদৃশ্য ক্ষেত্রে সুগতা কোথায় যেন এক ধাপ বেশি উঠে আছে। সেটা যে কোথায়, সঠিক জানে না মৃণাল। বোধ হয় জীবনেরই সর্বাংশে। কোথায় যেন একটু খাটো, একটু বেশি কৃষ্ণ। তাই সুগতার প্রতি মনের সমীহটাও বেশি। এটা চরিত্রের মধ্যে এসে আপনি ভিড়েছে। মৃণালকে তৈরি করতে হয়নি।
এ সব কোনওদিন মন দিয়ে চেয়ে দেখেনি সুগতা। ওর গম্ভীর বলিষ্ঠ মূর্তিটির আড়ালে যে মেয়েটি আছে, সে দেখেছে পুরুষের ব্যাকুল প্রার্থনা। করুণভাবে ভালবেসেছে ও মৃণালকে। মৃণালকে সুগতা গ্রহণ করেছে, সঁপে দেয়নি নিজেকে। সেটাও ওর চরিত্রের গঠন।
তবু সুগতা মেয়ে। মৃণাল যতক্ষণ না আসে, চঞ্চল হয়ে ফেরে ঘরে ঘরে। এলেই আবার সেই মূর্তিতে ফিরে যায়, শান্ত হয়। ও ভালবেসেছে মৃণালকে।
কয়েক দিন গাড়ি নিয়ে এসেছে মৃণাল। সুমিতার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছে। কেবলি মনে পড়ে গেছে বড়দি আর গিরীনদার কথা।
সারাদিনে দুজনের কত কথা যে চলে। কত কথা, কত খুনসুটি। মেজদির মধ্যে যে এমনি একটি হাসিখুশি মেয়ে আছে, এতটা টেরও পাওয়া যেত না কোনওকালে। দুদিন সুমিতা মৃণালের বক্ষলগ্ন দেখেছে সুগতাকে।
এক দিন বাগানের পিছনে, সন্ধ্যার পরে মৃণাল ওর সুদীর্ঘ হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল মেজদিকে। ওরা দুজনেই দুজনকে চুম্বন করছিল। কাঁটা দিয়ে উঠেছিল সুমিতার সর্বাঙ্গ। মনে হয়েছিল, ওর বুকের কাপড়ে গেছে আগুন লেগে।
আর এক দিন বাইরের ঘরে। বাড়িতে বিলাসও ছিল না। অসময়ে কলেজ থেকে ফিরে দেখল, মেজদি কী যেন লিখছে চেয়ারে বসে। মৃণাল জড়িয়ে ধরে, গালে গাল ঠেকিয়ে কী যেন গুন গুন করছিল। চমকে উঠেছিল দুজনেই সুমিতাকে দেখে। মাঝখান থেকে সারা দিন বেরুতে পারেনি ওর সামনে। আর সুমিতা প্রতিজ্ঞা করে বসল, জীবনে কোনওদিন আর রবার সোলের অমন সর্বনেশে নিঃশব্দ জুতো পরবে না। কিন্তু মৃণাল একটুও লজ্জিত নয় সুমিতার সামনে। বরং কথার আড়ালে, হেসে হেসে জানান দিয়েছে, দেখেছ তো। বেশ করেছ।
দুজনে বসে বসে নানান আলোচনা করে। পরশুদিন সারা-ভারত ছাত্র-সম্মেলন শেষ হয়েছে। সুগতা কেন্দ্রীয় সংসদে হয়েছে নির্বাচিত। সংসদের সেক্রেটারি অমৃতলাল কারলেকার ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বোম্বেতে। যেতে পারেনি সুগতা। সামনের সপ্তাহে ওদের বিয়ে। তারপরে যাবে। জীবনে, কাজের ক্ষেত্রকে ও বিশ্বাস করে। জীবনে এইটি ওর বড় অঙ্গীকার–ছাত্র-আন্দোলন থেকে সরে যাবে না কখনও। মৃণাল কি কখনও তার স্ত্রীকে এ সব বিষয়ে নিরস্ত করতে চাইবে।
মৃণাল বলে, যেখানে দেখে তোমাকে চিনেছি, সঁপেছি নিজেকে, সেখান থেকে তোমাকে টেনে নামাবার সাধ্য আমার নেই, তেমন মতিও যেন না হয় কখনও। আমাকে তফাত করো না। আমার জীবনকে আমি উৎসর্গ করেছি তোমার জীবনের পথে। তুমি কাজ করবে দেশের, আমিও কাজে লাগব তোমার। এমনি করেই কাটুক আমার এই একটি জীবন।
সুখী সুগতা। টাবুটুকু ভরাট মনে হয় ওকে। প্রতি দিন দুজনে যায় ছাত্রসঙ্ঘের অফিসে। সেখানে সবাই মুগ্ধ সুগতাকে দেখে। রুক্ষমূর্তি, রূঢ়ভাষিণী ছাত্রনেত্রী নয় সুগতা। জীবনের অন্যান্য দিক এমন নিশ্চিন্ত ও স্বচ্ছন্দ করেছে ওকে, দিবানিশি রাজনীতির কঠোরতার মধ্যেও উল্লাসের জোয়ার বইে ওর চারপাশে। দেখে মনে হয়, ও যেন ছাত্রসমাজের রাজেন্দ্রাণী। একটু ঠাট্টা করে বললে, মক্ষীরানি। এ সব দেখে সুগতা আরও গভীরভাবে চিন্তা করবার চেষ্টা করে। ভাবে, নিজেকে সবটুকু দিতে হবে বিলিয়ে। রাজনীতির ক্লাসিক পড়ে আরও বেশি করে। দুজনেই পড়ে। ও আর মৃণাল। সম্প্রতি প্রবন্ধও লিখতে আরম্ভ করেছে সুগতা।
যেদিন মৃণাল গাড়ি নিয়ে আসে, সেদিন অন্য কোথাও যায় দুজনে। পোশাকেরও পরিবর্তন হয় মৃণালের পীড়াপীড়িতে। মনে মনে আত্মসমালোচনা করে সুগতা। মৃণালকে শুনিয়েই করে। যেন অহংকারের বশে, স্বাচ্ছন্দ্যের স্রোতে এ জীবনে বিচ্যুতি না ঘটে।
জীবনের ধ্রুবতারাটা দেখা গেছে, জানা গেছে তার অবস্থিতি। সেইখানে পৌঁছুতে হবে। দেখে সুমিতা। ভাল লাগে। ভাল লাগে, কিন্তু মেজদি যখন ওর ওই আসর থেকে ফিরে বাড়ির আসরে বসে, তখন বদলে যায়। বোঝা যায়, এখানে ওর জীবনের আলোছায়াটা ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। রং লেগেছে অন্যত্র।
এখন আর তেমন ভয় নেই। একদিন ড্রয়ার খুলে দেখে নিয়েছে, রাজেনের সেই চিঠিখানি আছে কি না। আছে। ঠিক যেমন, তেমনি আছে। যেন ভুলেই গেছে।
রাজেনের কথা মনে পড়ে হঠাৎ একটু অভিমান হয় সুমিতার। কথা দিয়েছিল, বাড়িতে আসবে। আসেনি। আজকাল সে ছাত্রসঙেঘর অফিসে আসাও দিয়েছে কমিয়ে। পনেরোই আগস্টের পর থেকে হাওড়ার শ্রমিক অঞ্চলেই কাটায় বেশি।
অনেকে বলেছে, সুগতা-মৃণালের সিদ্ধান্তের ওপরেই এই পরিবর্তনটি ঘটে গেছে রাজেনের। কিন্তু শুধু সুগতা-মৃণাল নয়, সুমিতাও জানে, ক্রমেই শহর আর ছাত্র ছেড়ে, শহরতলির শ্রমিকাঞ্চলে যাবার ইচ্ছে ছিল রাজেনের অনেক দিন। পনেরোই আগস্ট ছাত্রদের মধ্যে প্রায় সরকারিভাবেই ঘোষণা করেছে রাজেন। সুগতা জানে, সুমিতাও দেখেছে, রাজেনের মূর্তি ও চরিত্রের তীক্ষ্ণতার মধ্যে কোথাও সুগতার জন্যে দাগ পড়েনি। হয়তো বড় বেশি রূঢ় তীব্র বলেই দাগটি চোখে পড়ে না সহজে। কিন্তু এগুলি ওর জীবনের বাধাস্বরূপ নয় কখনও।
এখানে ওর তৃপ্তি ছিল না। সে কথা ও নিজেই বলেছে, এখানে আমার নিজেকে বড় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মনে হয়। বড় সংক্ষিপ্ত, অল্পায়ু এই শহরের গতি। জীবনটাকে চোখেই পড়ে না যেন। আমি নিজে ওই অঞ্চলের মানুষ। সেখানকার জীবনের কোনওকিছুর সঙ্গেই আমি কলকাতাকে পারিনে মেলাতে। ছোটবড়র বিচারের বিষয় এটা নয়। কিন্তু ওখানে গিয়ে কাজ করতে হলে মনে অনেক সাহস সঞ্চয়ের প্রয়োজন, অনেক ধৈর্য, অনেক গভীরতা দরকার। সেটা ওখানে না গেলে সম্ভব নয়। দূর থেকে বসে হবে না।
পনেরোই আগস্ট ছাত্রসভায় রাজেনের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিল সুমিতা। রাজেন বলেছে, এত দিন পরে এক নতুনতর সংগ্রামের পথ খুলে গেল। আরও দায়িত্ব, আরও বিস্তৃতির সময় এসেছে আজ। আমরা যে মুক্তি পেয়েছি, সেটা প্রমাণ করতে হবে গোটা জীবনের সব ভয় ও দুঃখকে হরণ করে।
সম্মেলনেও গেছল সুমিতা। প্রায় একই কথা সেদিন বলেছে রাজেন। ওর কথাগুলির নানারকম অর্থ করেছে অনেকে। কেউ বলেছে, পালাতে চাইছে। কেউ বলেছে, পনেরোই আগস্টের সাফল্যটাই বোঝেনি রাজেন।
হিরন্ময় রাজেনের শিষ্য। কিন্তু বড় রগচটা ছেলে। বলেছে, বিস্তৃতির মানে কী?
রাজেন বলেছে, সর্বাঙ্গীণতা। দেশ ও দশ সম্পর্কে আরও বেশি জানা, আরও বেশি শ্রদ্ধা, আর দেশসেবার নামে বিন্দুমাত্র ফাঁকিকেও নিরঙ্কুশ উপড়ে ফেলা।
–সেটা কি এত দিন হয়নি?
হয়েছে, অত্যন্ত হেলাফেলা ভরে। রাজনীতির জন্যে রাজনীতি নয়। ইংরেজের ইন্ডিয়া নয়, ভারতবর্ষ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি চাই, নইলে কিন্তু সব ভণ্ডুল হবে।
হিরন্ময় বোঝার চেয়ে অবুঝ রোষে উঠেছে ফুঁসে, এত দিন তা হলে আমরা সব ভণ্ডুল করছিলুম।
রাজেনকেও ভাল করে চেনে হিরন্ময়। চোখ তুলে তাকাতেই হিরন্ময়ের রুক্ষ দৃষ্টি থতিয়ে গেছে। বলেছে, ভণ্ডুল করোনি, ওপরে ভাসছিলে। এবার ডুব দিতে হবে।
এই কথাবার্তার সময় সামনেই দাঁড়িয়েছিল সুমিতা। রাজেন দেখতে পায়নি। চলে গেছে অন্যদিকে। ফিরে ডাকতে সাহস পায়নি সুমিতা। কী ভীষণ দপদপে মুখ রাজেনের। যেন একটি জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড।
কেবল সুমিতার সামনে ক্ষোভে ও লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠেছে হিরন্ময়। দূর থেকে দেখেছে সুমিতা, মেজদি আর মৃণালের সঙ্গে রাজেন ঘুরছে, হাসছে, কথা বলছে। কোথাও কোনও অসামঞ্জস্য পড়েনি চোখে। শুধু সুমিতাকেই চোখে পড়েনি রাজেনের।
.
আশীষ এল মৃণালের সঙ্গে বেলা চারটেয়।
জীবনের এই এক ঐতিহাসিক বিস্ময় সুমিতার। আশীষকে ওর বড় ভয়। প্রায়ই আসে আশীষ মৃণালের সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃণালের। কোথায় কোন এক অদৃশ্য স্থান থেকে যেন আশীষ পাকে পাকে জড়িয়ে ধরছে সুমিতাকে।
ওর নিজের মন ও নিজে বোঝে না। সেখানে দিবানিশি কে কার সঙ্গে তর্ক করছে। চলতে-ফিরতে, পড়তে-খেতে সর্বক্ষণ। মন ওর সুস্থির নয়। ও যে কারুর সঙ্গে প্রেম করছে, সেটা একেবারেই অনুভব করতে পারে না। অথচ মনে হয়, যেন বুকের মধ্যে কীসের বাতাস আলুথালু হচ্ছে অহর্নিশ। দোর খুলে কান পাতলে তো সেখানে প্রচণ্ড তাণ্ডব ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না। মাঝখান থেকে আশীষের কাছে কেমন যেন ভেঙে দুমড়ে পড়ছে।
আশীষের সঙ্গে চোখোচোখি হলে ওর বুকের রক্তধারা ছলাৎ করে উঠে। বিনয়ের ঠোঁটের ছোঁয়ালাগা জায়গাটুকু ঘাড়ের কাছে জ্বলে দপদপ করে। বিনয় ওর প্রেমিক নয়। কিন্তু ভুল করে বিনয় যেটুকু রেখে গেছে, তার একটা বিচিত্র প্রতিক্রিয়া ঘটেছে ওর রক্তশিরের সুগভীর রন্ধ্রে।
.
২২.
সুজাতার ঘর থেকেই শুনতে পেল সুমিতা, মৃণাল টক টক করে শব্দ করছে সুগতার দরজায়। তারপর খুশি উপচে পড়া জিজ্ঞাসা, আসতে পারি?
এক মুহূর্ত একটু ঠোঁট-টেপা হাসির নীরবতা। তারপর সংক্ষিপ্ত এবং পরিষ্কার ছোট্ট একটি, না।
ততক্ষণে পরদা সরিয়ে ঢুকে পড়েছে মৃণাল। চোখ পিটপিটিয়ে বলল একটি হাস্যকর ভঙ্গি করে, অপরাধ?
ভ্রু কুঁচকে অপাঙ্গে তাকাল সুগতা। তাম্বুলরঞ্জিত ঠোঁটের কোণে চমকাল এক বার চকিত বিদ্যুৎ। মাঝে মাঝে হঠাৎ ওর পান খাওয়ার শখ চাপে। মুখে বিস্বাদ কাটাতে গিয়ে পাতলা রক্তাভ ঠোঁট দুটি যে টকটকে হয়ে ওঠে, সেটা ও জানে কিনা কে জানে। নভেম্বরের শেষে এই শীতে কোঁকড়ানো ছোট দিন। ঘরের মাঝে ছায়া এসেছে ঘিরে। সুজাতার হাউসকোট এর মধ্যেই আলমারি থেকে বেরুলেও সুগতা এখনও ওর মাদ্রাজি তাঁতের লাল জামায় ফুটিয়ে রেখেছে সাদা ফুল। শুধু তাই নয়, অনভিজাত ঘটিহাতা পুরনো জামাটি অতি আয়াসে নাগাল পেয়েছে বোতামপটিতে। সেখানেও সাদা শাড়ির আঁচলখানি চূড়ার সীমায় ছিল বোধ হয় অকুলান। মৃণালকে দেখে, আঁচল টেনে কুল রাখতে গিয়ে মনে মনে কূল হারানোর আভাস দেখা গেল ওর চোখেমুখে। বলল, অপরাধ গুরুতর।
পায়ে পায়ে এগিয়ে বলল মৃণাল, যথা?
সুগতা বলল, প্রথম অপরাধ চাউনি।
এমনভাবে তাকাচ্ছ, আমার ভীষণ লজ্জা করছে।
মৃণালের দু চোখ নেশাগ্রস্ত হল আরও। নিশি-পাওয়া রাক্ষুসে চোখে দেখতে লাগল সুগতাকে। বলল, অপরাধ, কিন্তু নির্দোষ। তোমার প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে…
–থাক। আমার বই কোথা, যেগুলো নিয়ে আসার কথা ছিল আজ?
মৃণাল ঝুপ করে সুগতার পাশে বসে পড়ে অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, সত্যি কিছুতেই মনে থাকে না। কাল আনবই, আনবই।
–থাক, তিন সত্যি করতে হবে না। এখন কটা বেজেছে শুনি?
চারটে।
সুগতা গম্ভীর গলায় বলল, কাল থেকে আমি ঠিক বেরিয়ে যাব, তিনটের মধ্যে।
অপরাধটা মৃণালের। কথা দিয়ে কিছুতেই সময় রাখতে পারে না। হয় ঘুমিয়ে পড়বে দিনের বেলা, নয়তো দ্রুতগতি খরগোশের মতো, তাড়াতাড়ি করে ও জমে যাবে কোথাও। এটা ওর স্বভাব, আসলে দোষ নয়। পথে পথে কোণে কোণে এত আড্ডা ছড়ানো, হাজার তাড়া থাকলেও কাটিয়ে আসতে পারে না। শ্যাম রাখতে গিয়ে ওই কুলটা থাকবে না, ও বুঝেছে। জীবনের একটা দিক ভাঙবে, গড়বে নিশ্চয় আর এক দিক।
বলল, খুব রাগ করেছ, না?
মৃণালের দিকে এক বার চকিতে দেখে, মুখ নামিয়ে বলল সুগতা। রাগ কেন। সেই কখন থেকে বসে আছি। আসা আর হয় না। সত্যি, আমি কারুর জন্যে এমন করে কোনওদিন বসে থাকিনি।
এই সহজ কথায়, সহজ সুরে ও ভঙ্গিতে সুগতার বুদ্ধি ছাড়িয়ে মেয়ে-হৃদয়ের তাড়নাটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মৃণালের দুচোখের তরঙ্গে অস্পষ্ট হয়ে দেখা দিল খুশির ঝিলিক। ওর সমস্ত দৃঢ়তা যেন দাগ কাটে ইস্পাতে। বলল, ইচ্ছে করে নয়, বিশ্বাস করো। তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশি অসবুর হয়ে উঠেছি।
সুগতা লজ্জিত হয়ে উঠল। বলল, অ-সবুর আবার কী। শুধু শুধু অপেক্ষা করতে বড় বিশ্রী লাগে। ঠিক সময়ে বলে গেলে এরকম হয় না। তা হলে একটু কাজ হয়, পড়াও হয়। চলো বেরিয়ে পড়ি। সেই ব্রিটিশ সোস্যালিস্টের বক্তৃতা আছে আজ স্টুডেন্টস হলে।
ততক্ষণে মৃণালের মাথায় একটি বিচিত্র প্রসঙ্গ আপনি এসে বসেছে জুড়ে। ওর মনে পড়ে গেল, বছরখানেক আগের কথা। রাত্রি প্রায় দশটা পর্যন্ত সুগতা এক দিন না খেয়ে অপেক্ষা করেছিল রাজেনের জন্যে। কারুর জন্যে কোনও দিনও অপেক্ষা করেছে, সুগতা, এখন হয়তো ভুলে গেছে। ভাবতে ভাবতেই মৃণালের ঠোঁটের তটে উপছে এল একটি কথা। আশ্চর্য! কথাটা সত্যি নয় জেনেও না বলে পারল না।
বলল, জানো কাল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি।
সুগতা উঠে পড়ে বলল, বেশ করেছ। আমি জামাকাপড় পরে আসি।
মৃণাল বলল, না না, শোননই না, অদ্ভুত স্বপ্ন।
ঘরের মাঝে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল সুগতা। বলল, বলল তোমার অদ্ভুত স্বপ্ন।
মৃণাল হাসল, স্বপ্ন দেখলুম, তোমার বিয়ে হচ্ছে।
সুগতা ভ্রূ কোঁচকাতে গিয়ে হেসে ফেলল। সেই দমকে আবার তট হারাল আঁচল। বলল, সত্যি, নাকি। নিশ্চয় পাঁচুই ডিসেম্বর।
–হ্যাঁ, তারিখটা সেইরকমেরই।
নিশ্চয়ই এ বাড়িতে?
হ্যাঁ।
সুগতা হেসে উঠল খিলখিল করে। আঁচল উঁচিয়ে প্রায় মারতে উদ্যত হয়ে দু পা এগিয়ে এসে বলল, কার সঙ্গে?
মৃণাল বলল, রাজেনের সঙ্গে।
সুগতার উদ্যত আঁচল বসল চেপে নিজেরই উদগত হাসির মুখে। মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, ছি ছি, এ খুব ন্যায়।
মৃণাল তাকিয়েছিল সুগতার মুখের দিকে। বলল, অন্যায় হলে কী করব, দোষ তো আমার নয়, স্বপ্ন যিনি দেখান, তিনি
সুগতা গম্ভীর হয়েই বলল, কেন যে এরকম স্বপ্ন দেখতে হয় তোমাকে।
বাঃ। দেখে ফেললুম, তার কী করব। চকিতে এক বার চোখোচোখি হল দুজনার। সুগতা আবার ব, না, ছি! ও বেচারিকে নিয়ে টানাটানি করার কোনও মানে হয় না।
আশ্চর্য! রাজেনকে যে সুগতা বেচারি বলছে, সে কথাটি কানে ওর লাগছে না একটুও। ওই একটি কথায় কোথায় যেন ও রাজেনকেও করুণা করে ছেড়েছে। তা থেকে একটি কথা স্পষ্ট হয়ে গেল। রাজেনের দিকে থেকে মনকে একেবারে উজানে বইয়ে দিয়েছে সুগতা।
বোঝা গেল, মৃণালের নিঃসংশয়ের মধ্যে এখনও যেন সংশয়ের উঁকি ঝুঁকি।
পাশের ঘরে গোপন কৌতূহলবশে ন যযৌ ন তন্থৌ সুমিতা। মৃণালের স্বপ্ন-সংবাদে সবচেয়ে যেন বেশি বেজেছে ওরই। কিছু না ভেবে-চিন্তেও কুপিত হয়ে উঠল সুমিতার মন। যেন মৃণাল অকারণ খানিকটা গ্লানি চাপিয়ে দিতে চাইছে রাজেনের ওপর।
চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল সুমিতা।
মৃণাল বলল, আমি টানাটানি করিনি। আমার টান তো একদিকেই। হয়তো ওদিকে টানটা রয়েছে
-কোন দিকে?
আবার চোখাচোখি হল। সুগতা বলল, সারা দিন রাত এই সবই চিন্তা বুঝি? ভীষণ রাগ হয় আমার।
–কে বললে তোমাকে, আমি ও সব ভাবি।
তুমি ভাব, আমি জানি। তাতে আমার অহংকারে না হোক মনে বড় লাগে।
মৃণাল খানিকটা তটস্থ অসহায়ভাবে বলে উঠল, না, না, তোমাকে দুঃখ দেওয়ার জন্যে কিছু বলিনি, সত্যি। সামনে সাতটা দিন। এই সাতটা দিন দিনের জন্যে যত আবোল-তাবোল বকে চলেছি আমি। এ প্রসঙ্গ ইতি ইতি ইতি!
বলে একটুও সময় না দিয়ে দু হাতে টেনে আনল কাছে সুগতাকে।
সুগতা সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, যাঃ, রুমনিটা কোথায় আছে, দেখে ফেলবে এখুনি।
মৃণাল সুগতার ঘাড়ের কাছে নুয়ে বলল, কোথাও নেই।
না নেই। ছেলেরা এত কানা হয়ে যায়। যাও, তুমি বসোগে, আমি কাপড় পরে আসছি। আলিঙ্গনমুক্ত হতে গিয়ে বলল আবার, নিশ্চয় সঙ্গীটি এসেছে?
সঙ্গী অর্থে আশীষ।
মৃণাল বলল, সঙ্গী বলে শুধু শুধু আমায় খোঁটা দিয়ো না। আমার সঙ্গ ধরে আশীষ আর একজনের সঙ্গ লাভের জন্যে।
রুমনির তো?
নিশ্চয়ই। দ্যাখোগে হয়তো এতক্ষণ দুজনে জমে গেছে বাইরের ঘরে।
পাশের ঘরে দুরু দুরু করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। আরক্ত মুখে পালাতে গিয়ে মনে হল পা দুটি কে চেপে ধরে আছে।
সুগতা বলল, ওরা দুজনে কি সিরিয়স?
–ভাব-ভঙ্গি দেখে বুঝতে পার না?
এবার জোর করে পালাল সুমিতা। পালিয়ে গেল খাবার ঘরের কোল দিয়ে একেবারে বাগানে।
ভাব-ভঙ্গি! সিরিয়স। কত কথা উঠছে। কত দূর এগিয়ে গেছে ওর আর আশীষের আলোচনা। যাবেই তো। এর ওপরে সুমিতার নিজের কোনও জবাব নেই, কৈফিয়ত নেই, যত সংশয় আর জিজ্ঞাসা থাকুক মনের মাঝে, নিজের দিশেহারা তীব্র স্রোতধারাটিকে না পারছে চিনতে, না দেখতে পারছে তার গতিপথ।
এই সংশয়টাই তো ভয়। কী বিচিত্র ভয় ওর আশীষকে। গত চার মাসে আশীষ যেন কোন অন্ধকার থেকে চুপিসারে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে এসেছে সুমিতার চারপাশ ঘিরে। এত দিন আন্দাজ করেছে, এইবার পড়েছে লক্ষ্য। সুস্পষ্ট করে উঁকি দিচ্ছে আশীষ।
কিন্তু আন্দাজ আর লক্ষ্য নিয়ে কেন এত কূট তর্ক সুমিতার। ওরই অনুভূতির রক্ত-শিরা-উপশিরা বেয়ে এসেছে আশীষ। আসেনি তো না-জানান দিয়ে।
তবে কেন ভয় সুমিতার। যা সে চায়নি তবু পড়েছে স্রোতে, চলেছে তীব্র টানে।
অনেক দিন মনে হয়েছে, ছোট ছোট দুলু ঢুলু অপলক চোখে কী দেখে আশীষ চেয়ে চেয়ে। ওই চোখে তীক্ষ্ণতাও ছিল। ঠিক বাজপাখির তীক্ষ্ণতা নয়, নির্বাক বকের মতো। তনু শুধু নিবিষ্ট নয় অনুসন্ধিৎসু।
দেড়মাস আগে একদিন এমনি সময়ে প্রায় সুগতা মৃণাল গেল বেরিয়ে। সুমিতা জানতই না বাইরের ঘরে বসে আছে আশীষ। উদ্দেশ্যহীনভাবে বেরুতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল আশীষকে দেখে। মনের চমকানিটুকু চেপে অবাক হয়ে বলল সুমিতা, আপনি বেরোননি?
বলে দেখল আশীষের ঢুলু ঢুলু চোখে একটু অপ্রতিভ বিষণ্ণতা। চাপতে চাইছে নিজেকে। বলল, তুমি চলে গেলেই বেরিয়ে যাব।
চোখ নামায়নি আশীষ। সুমিতা ভীরু নম্র লতাটি যেন। মনে মনে অবাক হলেও আশীষের সোজা কথায় লজ্জায় নির্বাক রয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। চোখ নামিয়ে রাখতে হল ওকেই।
এর অনেক আগে থেকেই আশীষ যাতায়াত করছিল নিয়মিত। এই প্রথম একটা সরাসরি পদক্ষেপ করল। আশীষের সারা মুখে কেমন একটা করুণ ভাব বিরাজ করছিল, যেটা ঢেকে দিয়েছিল ওর মুখের নিয়ত-বিদ্রূপ বক্রতা। কেমন একটু ঝুঁকে পড়ল সুমিতার মন।
বলল, বেশ তো, না হয় না-ই বেরুলুম। গেলেও বাবা আসবার আগে আমি চলে আসতুম।
কিন্তু কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছিল সুমিতা আশীষের চোখের সামনে। বসে পড়ল ঝুপ করে একটি সোফায়।
আশীষ হাসল। হাসলেই তার মুখের বিদ্রূপটা ওঠে এঁকেবেঁকে। বলল, যেভাবে নুইয়ে রাখলে মাথা, মনে হচ্ছে অস্বস্তিবোধ করছ খুবই।
আবার একটু অবাক হওয়ার চেষ্টা করে সলজ্জ হেসে বলল সুমিতা, কই না তো।
কিন্তু তাই তো! আশীষ যে প্রত্যহের মাঝে নতুন করে দিলে ভাঙন এনে।
আশীষ বলল, নয়তো? যাক, আমি সেই ভেবে অপরাধী ভাবছি নিজেকে। ভাবি, রোজই বলব তোমাকে, একটু বসে যাও। পারিনে, কী একটা ভেবে বসবে হয়তো।
নিজেকে চোখ টিপে বলল সুমিতা, ওমা! কেন?
বলে হাসল। হাসিটিও যে একরকম ভয়ের, সেটাও বোধ হয় সুমিতার অজানা।
আশীষ চোখ সরাতে বোধ হয় জানে না। বলল, তা হলে ভুল করেছি এত দিন না বলে।
আশীষ হাসল। সুমিতাও হাসল বুকের দুরু দুরু তালে। বারবার মনে পড়তে লাগল, স্ট্র্যান্ড রোডের ধারে সেই সন্ধ্যারাতে আঠারো বছরের একজন সেদিন যত ভুল করে ফেলেছিল।
আশীষ আবার বলল, মাঝে মাঝে নিজেকে এত বন্ধুহীন মনে হয়, অথচ বন্ধুর ছড়াছড়ি চারদিকে। এত থেকেও এত একা লাগে, কোথাও যেতেই পারিনে।
যত শুনছিল, ততই শরতের ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে একটি নির্বোধ কাঁপুনি শীত ধরিয়ে দিচ্ছিল সুমিতাকে। সেই সঙ্গেই আশীষের একাকিত্বের বিষণ্ণতা ওর মনটাকেও তুলল মন্থর করে। সবচেয়ে আশ্চর্য! তখন থেকেই বিনয়ের ঠোঁট ছোঁয়ানো ঘাড়ের সেই একঠোঁট জায়গাটুকু জ্বলতে লাগল দপদপ করে। তখন থেকে, সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত।
এই কি ভালবাসা! জানে না সুমিতা।
জীবন নিয়ে কাব্য করার অবকাশ আসেনি সুমিতার। যেটুকু এসেছিল, সেটুকু নিয়ে তাপসীর মতো কাব্য করতে গিয়েও পারেনি। একজনকে কাঁদিয়ে, কেঁদে ফিরেছে নিজে। সেই দিন থেকেই বুঝেছিল, বয়স অল্প হলেও এক জন বন্ধুকে হারাল সুমিতা। ওর দোষে নয়, বিনয়ের নিজের ধিক্কারই নিজের কাছে থাকবে অপ্রতিহত ব্যারিকেড় হয়ে।
কিন্তু মর্মে মর্মে বুঝেছে সুমিতা, মানুষের আছে দুটি মন। পুরুষ এবং মেয়েমানুষ, উভয়েরই। দুটি ছাড়িয়ে আছে হয়তো আরও মন। ঘটনার ক্ষেত্রে এসে দল বেঁধে সব দাঁড়িয়ে যায় দুপাশে।
সুমিতার মনের দুপাশে চলেছে তেমনি দুয়ের লড়াই। আর ঠিক লড়ায়ের নিয়ম অনুযায়ী হারছে একপক্ষ, অপরপক্ষ জিতেছে। এই জেতাটাই সুমিতা প্রতিরোধ করতে চাইছে নিয়ত।
শিশুর মতো নির্বোধ সহাস রক্তের মধ্যে দুর্বোধ্য দুরন্ত যন্ত্রণা দিয়ে গেছে বিনয়। বিনয়ের অস্থির ব্যাকুল হাত দুটি প্রীতি সত্ত্বেও অসংশয়ে সরিয়ে দিতে পেরেছিল সুমিতা। যেন পাথর ভেঙে অতল গর্ভে পড়তে গিয়ে বেঁচে ফিরেছে। চলতে গিয়ে আবার খাদ। খাদ কী, কেমন তার বিভীষিকা, এবার সেটুকু দেখবার জন্যই যেন চাক্ষুষ টান ধরেছে প্রাণে, রক্ত-কোষে কোষে।
আশীষের উদ্যত হাতটি কিছুতেই সরাতে পারছেনা সুমিতা। যতক্ষণ থাকে দূরে দূরে ততক্ষণ ভাবে অনেক কিছু। ভাবতে ভাবতে একটা বোবা কান্না সশব্দে চিৎকার দিয়ে উঠতে চায় ভিতর থেকে। ও যে মেয়ে, বারবার নিজেকে এ কথাটি বুঝিয়েও পারছে না সামলাতে। যত সহজে সবকিছু পারে ছেলেরা, সুমিতা তা পারবে কেমন করে।
কিন্তু বিশ্বসংসারের সমগ্র রক্তধারার মধ্যেই বোধ হয় এই একই খেলা। বুদ্ধি দিয়ে তাকে সবসময় ধরে রাখা যায় না।
যদি বা রাখা যায়, আশীষ কাছে এলে যায় না আর। তখন প্রতি বিন্দু রক্ত বলে, আশীষকে আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।
বাগান দিয়ে ঘুরে গিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকল সুমিতা। দেখল, নিবিষ্ট চোখে গালে হাত দিয়ে আশীষ তাকিয়ে আছে ভিতর দরজার দিকে। কেমন যেন বিমর্ষ, ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল তার সর্পিল কপাল। সুমিতার দিকে চোখ পড়তে, নিয়ত সপ্রতিভ মুখ আশীষের চকিত হাসির দীপ্তিতে ছেলেমানুষের মতো মনে হল।
আশীষ বলল, কী ব্যাপার। ভাবছিলুম তুমি বাড়ি নেই।
সেই প্রথম দিনের মতো, আশীষের কাছে এলেই আজও দুরু দুরু করে বুকের মধ্যে। হেসে বলল, কেন?
-কোনও সাড়া শব্দই নেই তোমার। ওদিকে বুঝতে পারছি, মৃণালের কোনও খেয়ালই নেই। উঠে পড়তুম এখুনি।
বন্ধুকে খবর না দিয়েই?
কী করব। যার জন্যে আসা, সে যদি না থাকে…। আর বন্ধু নিশ্চয়ই খবরের প্রত্যাশা করছে না। সেই ভেবেই আরও রাগ হচ্ছিল মনে মনে।
-কার ওপর?
সবকিছুর ওপর, বন্ধুর ওপর, আর তোমাদের ওই ভয়ংকর দরজাটার ওপর।
বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বাড়ির ভিতরে যাওয়ার দরজাটি।
সুমিতা অবাক হয়ে বলল, কেন? দরজা কী করল?
কিছু করেনি বলেই তো। একেবারে বোবা আর শূন্য।
বলে, তাকাল সুমিতার দিকে। সর্বাঙ্গে সুমিতার ওর দুরু দুরু মনের ঢাকনা। কলেজে যায়নি আজ। আবাঁধা চুল শ্যাম্পুর ফাঁপানিতে আলুলায়িত ঘাড়ে পিঠে। বেগুনি রং শাড়ির আঁচল নেমেছে কাঁধ বেয়ে। মাঝখানে যেন দপ দপ করে জ্বলছে সুমিতার আরক্ত মুখ। টানা চোখ ঈষৎ রক্তিম। ঘুমভাঙার মতো।
এক মুহূর্ত তাকিয়ে আশীষ বলল, আমার মতো, দরজাটা একা।
সুমিতার বুকের রক্ত উঠেছে কলকল করে সেই ঘাড়ের কাছে। বলল, তোমরা ছেলেরা সবাই সবসময় কিছু না কিছু বলে একটু ফিলজফি করবে।
আশীষকে আজকাল তুমি বলে সুমিতা। আজকাল বলতে, দিন পনেরো ধরে।
আশীষ বলেছিল, কোনও উদ্দেশ্য-বিধেয় বাদ দিয়েই বলছি, খুব অসুবিধে না হলে আমাকে তুমি করে বোলো সুমিতা। কথা দিচ্ছি, তাতে আমার কোনও দাবি বাড়বে না, একটু অন্তরঙ্গতার লোভে।
যেন জাদু করেছে আশীষ। ওর কোনও কথাই ফেলতে পারে না সুমিতা। পারে না, পারবেও না কোনওদিন বোধ হয়। শুধু যেটা পারে না সুমিতা, সেটা কথা। আশীষের সামনে কথা ফুটতে চায় না সুমিতার মুখে। মাঝে মাঝে মুখর হয়ে ওঠে সহসা। সে মুখরতা তর্ক। আশীষের জীবনবোধ, সাহিত্য, রাজনীতি, বিশ্বাস নিয়ে তর্ক। তখন এই আশীষকে সুমিতা ভুলে যায়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, চাপা পড়ে যায় ক্ষণিকের জন্যে ওর রক্তকোষের তীব্রতা। আশীষ নীরব হয়ে টেনে নিয়ে যায় অন্য পথে, কথার মোড় দেয় ঘুরিয়ে। আবার ফিরে আসে আশীষের ব্যক্তি জীবনের একাকী বেদনার কথা। আশীষ বলে অনেক কথা, ও শুনে যায়।
মৃণাল এল ঘরে। বসেছিল এতক্ষণ। সুগতার অর্ধেক সাজটা হয়েছে বোধ হয় ওর চোখের সামনেই।
দুই বোন সহসা চোখখাচোখি করতে পারে না। সুগতাকে একটা কিছু না-জানা ছলনার ছায়া টানতে হয় মুখে। তবু চাপা যেন থাকে না কিছুই।
সুগতা বলল, রুমনি, তুই কি বেরুবি?
জবাব দিতে গিয়ে সুমিতার চোখোঁচাখি হল আশীষের সঙ্গে। আশীষের মুখে ফিরে এসেছে সেই বিদ্রূপবক্রতা। তাকিয়ে ছিল সুগতার দিকেই। সুমিতার আগেই বলে উঠল, ভাবছিলুম তোমার বোনকে নিয়ে আজ আমাদের বাড়ি যাব।
সুগতা বলল, তা যাক, কিন্তু তুই একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস রুমনি। আমার দেরি হলে সবাই খেয়ে নিস।
ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে মৃণাল বলে গেল, চলি আশীষ।
সুমিতা নিজেকে কেমন যেন অসহায় বোধ করছিল। মনে হচ্ছিল, অদ্ভুত নির্বোধের মতো, বোবার মতো, নিজের সমস্ত সত্তাটা হারিয়ে ফেলে দাঁড়িয়ে আছে সকলের সামনে।
আশীষ বলল, কী হল, কিছু মনে করলে নাকি?
একটুও অবাক না হয়ে যন্ত্রের মতো হেসে বলল সুমিতা, কেন?
বাড়ি যাওয়ার কথা বললুম বলে?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে চেষ্টা করে বলল সুমিতা, না তো। যেতে চাও তো, চলো যাই।
আশীষ এক মুহূর্ত নিবিষ্ট ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, চলো তবে।
.
২৩.
দেখতে দেখতে অগ্রহায়ণের বেলা গেল চলে। সুদূর পশ্চিমাকাশের কোথাও এখনও একটুখানি ঝুলে আছে সূর্য। প্রাসাদের ভিড়ে গেছে চাপা পড়ে। সংকেত তার রয়েছে ছড়িয়ে আরক্ত আকাশের মুখে। যেন কিছু লজ্জা কিছু ভয় রয়েছে ঘিরে এই গোধূলি রক্তে। শহরের যন্ত্রযান ও গানের শব্দ ছাপিয়েও কোথায় কোন বাড়িতে বাজছে ক্ষীণ শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টা বাজছে টিং টিং করে।
বেরিয়ে এল সুমিতা আশীষের সঙ্গে। খুব কম সেজেও অসামান্য সাজ হয়েছে ওর। সামনে থেকে চুল টেনে নিয়ে, ঘাড়ের কাছে বেঁধেছে লাল ফিতায়। গায়ের ওপর নিয়েছে জড়িয়ে সুতোর মাধবী রং চাদর। সাদা ফুলের পাড়খানি ঘাড় থেকে নেমে উঠেছে বুকে। আবার নেমে গেছে কোমরের পাশে, ওর চলার দোলনে দোলনে।
ঠোঁটের কোণে মিটমিট করছে একটু অস্পষ্ট হাসির আভাস। দৃষ্টি ওর সামনের পথের দিকে, কিন্তু চোখের ইন্দ্রিয় রয়েছে সজাগ, পাশে আশীষের প্রতি।
আশীষেরও তাই। শুধু ওর ঢুলুঢুলু চোখ চকচক করছে, যেন বহু শত্রু বিনাশী কৃপাণ। জয়ের চেয়েও বিদ্রুপের মাত্রাটাই তাতে ফুটেছে বেশি। সটান দোহারা শরীরটার প্রতি অঙ্গেও সেই বিদ্রুপের আভাস যেন হেলছে আর দুলছে। চলেছে সুমিতার গা ঘেঁষে। বলল, হেঁটে যাবে।
সুমিতা ওর সেই সত্তা হারানো প্রেমিকার নির্বোধ ভঙ্গিতেই বলল, যেমন খুশি।
পথে পথে বাতি জ্বলেছে। ভিড় চলেছে পথের দু পাশে। বিশ্বসংসারে মানুষের পথ চিরদিনই বড় তৃষ্ণার্ত। সবাই তৃষ্ণার্ত চোখে তাকাচ্ছে দুজনের দিকে। আশীষের চোখে মাতাল আবেশ। আবেশের পিছনে চাপা পড়ে আছে একটি বিচিত্র তীক্ষ্ণতা।
বলল, যেমন খুশি, আর যেখানে খুশি তো?
সুমিতা ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ।
তবে বাড়িতেই চলো।
ততক্ষণে সুমিতার বুকের কুণ্ডলী পাকানো সাপটা কিলবিল করে উঠে এসেছে গলার কাছে। ওর সবই ঠিক ছিল। ওর নির্বোধভাব, সত্তা-হারানো আবেশ হাসি। কিন্তু জড়বস্তুর ধীরগতি চৈতন্যের মতো একটি প্রশ্ন কিলবিল করে উঠে এল জিভে। বলল, আচ্ছা, সব কিছুতেই তোমার এত বিদ্রূপ কেন বলো তো?
চোখ যত ঢুলুঢুলু, কপাল তত বিস্ময়ে সর্পিল আশীষের। বলল, কেন, বিদ্রূপ কোথায় দেখলে?
সুমিতা বলল, মেজদি আর মৃণালকে দেখলেই তুমি এমন করে তাকাও। বিশেষ মেজদির দিকে। কেন বলল তো?
দুজনেই হেঁটে গেল খানিকটা কোনও কথা না বলে। আশীষ তাকিয়েছিল দূরের দিকে। পার্কটা পার হয়ে বলল আশীষ, তুমি তো জানো আমাকে সুমিতা। তবে কেন এ সব কথা বলছ?
ঠিক এই জবাবটাই শুনবে বলে ভাবছিল সুমিতা। তুমি তো আমাকে জানো। হ্যাঁ, জানে সুমিতা, সমাজের সমস্ত নীচতা, দীনতা, ভাঁড়ামি প্রতিনিয়ত খোঁচাচ্ছে আশীষকে। তাই সে দূরে সরে থাকতে চায়, অসহ্য ঘৃণা নিয়ে রাখতে চায় মুখ ফিরিয়ে। আর বিদ্রুপে হেসে দেখছে এই অনলস মিথ্যে-বোঝাই সংসারটাকে।
কিন্তু মেজদি। মেজদি কী করেছে। যদিও জিজ্ঞেস করতে বড় ভয় সুমিতার। কেননা, আশীষ তার প্রতিটি কথা যেন বিষের পাত্রে ডুবিয়ে ছোড়ে। তবু বলল, কিন্তু মেজদি! ওর মধ্যে তুমি কী দেখলে।
আশীষের সারা মুখে বিছের মতো বিদ্রুপের হাসি কিলবিলিয়ে উঠল। বলল, যা দেখি সারা সমাজে, সকলের আর আমার বাড়িতে। আমার বোনদের, বউদিদের, সবখানে সবাইকে। কেউই ব্যক্তি হিসেবে নিজের মতো করে সুখের সন্ধান করছে না, কেননা, তাতে অনেক শক্তির প্রয়োজন। এই সমাজের ছাঁচে ঢালা পুতুল সব। সবাই তাই এক ছাঁদে হাসছে, চাইছে, বলছে। চোখে যেটুকু পড়ে, সেটুকু ভড়ং-এর কম বেশি। আসলে সব এক একটি মিথ্যেবাদিনী।
বড় রাস্তা থেকে একটি ছোট রাস্তায় ঢুকল দুজনে। সেখানে গ্যাসের আলোয় সুমিতার অবাক জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল আশীষ। আবার বলল, তোমার মেজদির কথায় না হয় পরেই আসছি। নিজের বোনদেরই তো দেখলুম, ওদের ভালবাসার বড়াই, নারী প্রগতি, প্রেমের মুক্তি, যা কিছু, সবই শেষ পর্যন্ত সেই রাজবাড়ির খিলানগুলোর খোপের পায়রার বকবকম। উড়ে ওরা অন্য কোথাও যায় না। আকাশের একটি কোণে উঁকি মেরে আবার ফিরে আসে। সবাই মুগ্ধ হয়, হাততালিও দেয়। পায়রার মালিক থাকলে, সে বেচারি একটু ঘাবড়ে যায় হারাবার ভয়ে। কিন্তু ও তো হারাবার নয়। খোপ ছেড়ে যাবে কোথায়। বুলবুলির বরাদ্দ ধান ছড়ানো আছে সেখানে, আর আছে ভরা মদ্দা পায়রা। আকাশের ডাকে কখনও সে সাড়া দিতে পারে। আমার ভগ্নীপতিরা সব শাঁসালো ব্যক্তি, বোনেরা আছে বেশ সুখে। যত সাধ্যসাধন এত দিনের, সে তো ওই শাঁসটুকুর জন্যেই। পেয়ে গেছে, গেছে সব ফুরিয়ে।
বলে চাপা গলায় হেসে উঠল আশীষ। চাপা হলেও ভয়ংকর তীব্র সেই হাসি। অতৃপ্ত শ্লেষের জ্বালা আশীষের সারা চোখেমুখে। বলল, কী, তোমার খুব রাগ হচ্ছে নিশ্চয়ই সুমিতা।
সুমিতা বলল, না, রাগ নয়, ভয় হচ্ছে।
আশীষের সভয় হাত একবার প্রায় বেষ্টন করে, সুমিতার হাত স্পর্শ করে আবার সরে গেল। বলল, ভয় কেন?
কেন ভয় কেমন করে বলবে সুমিতা। কত ভয়। আশীষের কথার মধ্যে কোথায় একটি তীব্র সত্য রয়েছে। তবু সেই সত্যোপলব্ধির অনেকখানি যেন নির্দয় ঘৃণা শুধু। এই অর্ধেক বিশ্বাসের ভয় সুমিতার। ভয়, তবে কী চোখে ওকে দেখে আশীষ, কেমন মেয়ে ভাবে। ও যে এক গহীন জলস্রোতে ভাসছে। না পারে দাঁড়াতে নিজের শক্তিতে। ভয় শুধু ঠেকবে গিয়ে কোথায়। সব মিলিয়ে, আশীষের সবকিছুকেই তাই বড় ভয় সুমিতার। কেমন চোখে ওকে দেখে আশীষ, সে কথাও তাই জিজ্ঞেস করতে আটকে যাচ্ছে গলায়। শুধু এক রুদ্ধ ভয় ও বেদনা মনের মধ্যে। বলল, মেজদিকেও তুমি ওই দলেই। ফেলছ?
আশীষ বলল, নিশ্চয়ই। তোমার মনে কোনও সন্দেহ থাকুক, তা আমি চাইনে। সেই জন্যেই বলছি, জিজ্ঞেস করো মৃণালকে, এক বছর আগে আমি ওকে বলেছি, সুগতা যদি কাউকে বিয়ে করে, সে তুই। তোমার মেজদিকেও বলেছিলুম একদিন, সে নিশ্চয়ই মালা রেখেছে মৃণালের জন্যে। তার জন্যে সুগতা একটু রুষ্টও হয়েছিল আমার ওপর। ভয়ে ও বিস্ময়ে কেমন যেন শিরশির করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। গ্যাসের অস্পষ্ট আলোয় আশীষের তীক্ষ্ণ হাসিটি জ্বলছে গুপ্তির মতো।
আশীষ আবার বলল, আমি যে জানি, এ হতেই হবে। তা ছাড়া কী উপায় ছিল সুগতার বলল। ও তো অনেক দূর গিয়েছিল, অনেক সাহস দেখিয়েছিল, আর কত দেখাবে। তাই আমি শুধু দেখি আর হাসি। অবাক হইনে।
বলে হেসে উঠল। দাঁড়িয়ে বলল, আর যেয়ো না, এসে গেছি।
এই তো সেই বাড়ি। হঠাৎ চমকে উঠে, মুখে স্মিত হাসি টেনে আনল সুমিতা। মুখের ভয় আর বিস্ময়ের সমস্ত দাগগুলি অদৃশ্য হাতে খুঁটে খুঁটে তুলতে লাগল সন্ত্রস্তভাবে। বারে বারেই হাসবার চেষ্টা করতে লাগল। আশীষের গা ঘেঁষে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে! না না কীসের ভয় সুমিতার। বড় নির্দয় আর ভয়ংকর সত্য কথা বলে আশীষ। সেটা যখন অসহ্য মনে হয়। তখনই ভয়। এই সত্যের জন্যে আশীষ একাকী, বন্ধুহীন আত্মীয়হীন। সুমিতা আরও ঘন হয়ে এল আশীষের কাছে। ভাবে শত ভয়ের মধ্যেও নির্ভয় আমার আশীষ। আশীষের এই স্পর্শের মধ্যেই মনের সমস্ত কথা আপনি আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে মুখ গুঁজে ফেলে শান্তভাবে। ওর সঙ্গে সঙ্গে দেহের রক্তধারাও উঠতে থাকে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে। সেই তালে তালে বলতে থাকে সুমিতা, ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আর কিছুই নয়। শুধু ভালবাসা। ওর উনিশ বছরের এই সামান্য বাড়ন্ত সুন্দর দেহের রক্ত শুধু প্রেমলোলুপ, উন্মত্ত এক আসঙ্গ লিপ্সায়। কী হবে তর্কে ও কথায়। খালি দেখছে, উনিশ বছরটা আর সব দিকে বোবা ও বধির। এ জীবন যে এখন শুধু একটানা স্রোতে ভাসমান।
মস্ত বড় বাড়ি। একই পরিবার, তবু যেন সব আলাদা ভিন্ন ভিন্ন ফ্ল্যাটে। কারুর সঙ্গে কারুরই এমনিতে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার উপায় নেই। কে কখন আসে যায়, টের পাওয়া যায় না। আশীষের বাবা, দুই দাদা, সবাই বড় চাকুরে। সবচেয়ে ছোট আশীষ। লেখাপড়া সাঙ্গ হওয়ার কথা ছিল অনেক আগেই। মাঝখানে বন্ধ হয়েছিল ওর সেই সাহিত্য-অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য, নানান জায়গায় ঘুরে। আশীষের ঘরটা ওর মায়ের ঘরের পাশেই, যদিও দেখা সাক্ষাতের সম্ভাবনা কমই। বোধ হয়, ছোট ছেলে বলে মায়ের পাশের ঘরটি সাব্যস্ত হয়েছে ওর জন্য।
ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে, দরজাটা ভেজিয়ে দিল আশীষ। দোতলার নীচেই হেমন্তরাত্রির ফাঁকা গুলি একদিকে। বারান্দায় ফুলের টব কয়েকটা। ঘরে বোঝাই বই আলমারিতে। পল দ্য কক্, ডুমাস, হুগো থেকে বালজ্যাক-দাল-আরাগঁ। টমাস মান-টলস্টয় রলাঁ, নামকরা অসংখ্য বই, ঝকঝকে চকচকে আলমারিতে। সুমিতার মনে হয়, ঠিক আশীষের মতোই যেন সব বিদ্রূপ ও ঘৃণাভরে রয়েছে তাকিয়ে আলমারির কাঁচের আড়াল থেকে। হাসছে শ্লেষে। বিদ্রুপের মধ্যেও যেন আবেশে ঢুলুঢুলু চোখ, আশীষের জীবনজোড়া এই কেতাব-সংসারের। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপরে বই খাতা সাজানো। নেপালের তৈরি পিতলের মিনে করা নাগরা ছাইদানিটা যেন সোহাগি কুকুর ছানার মতো পেয়েছে ঠাঁই। এ ঘরে। তেমনি রকমেই ঠাঁই পেয়েছে দেয়ালে টাঙানো উত্তরবঙ্গের কালী-নাচের মুখোশ, পোড়ামাটির ছাইদানি, ছেলেভুলানো পুতুল। মনিবের হঠাৎ উদারতার দুর্বল ফাঁকে কিংবা দেশীয় সংস্কৃতিপিপাসার স্বাদ মেটাতে দিশি জিনিসগুলি ঢুকে পড়েছে এই আসরে। বিদেশের এই মহাকীর্তিখানায়, দিশি জিনিসগুলিও কেমন যেন ল্যাজ নেড়ে চাপা ক্রোধে গর্জায় গরগর করে। বাংলা দেশের কোন চার পয়সার মেলা থেকে এখানে এসে হঠাৎ যেন কেমন জাত বদলে বসেছে। দেশে ওরা এই মাটিতে গড়ে, এই মাটিতে মেশে। এখানে হালফ্যাশানের লাইটশেডের তলায়, বুকশেলফের কিনারে, মসৃণ সেক্রেটারিয়েট টেবিলে ওরা বিদ্রুপে হাসে মিটমিট করে।
একপাশে খাটে পাতা বিছানা। সবদিকেই সাজানো গোছানো।
দাঁড়িয়েছিল সুমিতা টেবিলের পাশে। আশীষ ওর পিঠে হাত দিয়ে বলল, বসো।
সুমিতার রক্তের মধ্যে দোলা লাগল। নির্বোধ হাসিটুকু ছটফটে চডুয়ের মতো নেচে বেড়াচ্ছে ঠোঁটে, চোখে, মুখে। চিনচিন করে জ্বলছে সেই চুলে ঢাকা ঘাড়ের কাছে।
বসল সুমিতা।
আশীষ বলল, তোমার মেজদির কথায় মনে মনে হয়তো খেপে উঠেছ আমার ওপর।
আবার! আবার ও সব কেন। বলল, না তো!
আশীষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকাল সুমিতার চোখের দিকে। বলল, সেজন্যেই অবাক হই তোমাকে দেখে। অথচ জানি আমি, এমন মেয়ে পাওয়া ভার, যে আমার কথায় চটবে না। আমি জানি সুমিতা, মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে তোমার মনে নানার কথার তোলপাড় হয়। এবার বুঝলে তো, সুগতাকে দেখলে আমি কেন অমন করে হাসি। বিশ্বাস কর, আমি হাসিনে, হাসি আমার আপনি আসে। যেদিকে তাকাই, সবখানে এক, একই ব্যাপার।
বলতে বলতে চোখের ঢুলুঢুলু ভাবটা আসে স্তিমিত হয়ে। সেখানে চিকচিকিয়ে ওঠে ক্ষুব্ধ হতাশা।
সুমিতার বুকের সুপ্ত সাপটা আবার কুণ্ডলমুক্ত হয় নানা প্রশ্নে। যত হয় তত আসে ভয় ঘিরে। কথা থাক, থাক না। সুমিতা তো জানে, আশীষ কত একাকী। সেজন্যে ওর অবুঝ মনের অজস্র জটার পাশ কাটিয়ে রয়েছে কাছে কাছে, ছেড়ে দিয়েছে নিজেকে আশীষের টানা স্রোতে। কিন্তু এখন আর না জিজ্ঞেস করে পারে না, সবই একরকম কেমন করে হয়? সবকিছুরই ভাল-মন্দ তো আছে।
আশীষ বলে উঠল, কোথায়, আমি তো দেখিনে সুমিতা। ছেলেদেরও দেখলুম কম নয়। অক্ষম অথচ অহংকারীর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে কাফে-রেস্তোরাঁয়, কলেজে-হোস্টেলে, বারে আর রাস্তায়। গরিব করছে বড়লোকের ভড়ং বড়লোক দারিদ্র্যের ভাঁড়ামি। স্থূলবুদ্ধি ছেলে শুধু মুখের দুটি কথাতেই আর পোশাকে-আশাকেই হতে চায় ইনটেলেকচুয়েল। বাদবাকি যাদের তুমি বাঙালি নওজোয়ান বলবে, তাকিয়ে দ্যাখো তাদের দিকে, রকবাজ, সস্তা সিনেমার কিউর পার্মানেন্ট বাসিন্দা, অসচ্চরিত্র, নোংরা।
গম্ভীর হয়ে শোনবার ভান করে সুমিতা। কিন্তু বুকের মধ্যে নিশ্বাস হয়ে ওঠে দ্রুত। কী এক ভয়ংকর বিতৃষ্ণার মদ খেয়ে আশীষ তিক্ত ও প্রজ্জ্বলিত। কত কথা সুমিতার মনের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু বলতে পারে না কিছুই। মনোযোগের সঙ্গে সুমিতা তাকিয়ে থাকে টেবিলের বই দুটির দিকে। আশীষের ছাপানো উপন্যাস। যে বই দুটি এ দেশের পাঠকেরা একেবারেই গ্রহণ করেনি। নিজের পয়সায় ছাপিয়েছে আশীষ, নিজের বুকেই রেখেছে কমিয়ে যন্ত্রণার পাহাড়ের মতো।
বলতে আরম্ভ করলে কিছুতেই থামতে পারে না আশীষ। একটা পেনসিল নিয়ে টেবিল ঠুকতে ঠুকতে বলল, কী দিয়ে, কত দিয়ে উদাহরণ দেব তোমাকে বলো। প্রেমের ব্যাপারে যে কোনও ছেলের দিকে দ্যাখো, প্রেমিক নয়, সব যেন চাকরের মতো বিদ্যেবুদ্ধি জাহির করছে প্রেমিকার কাছে, নয়তো টাকার জোরে চোখ রাঙাচ্ছে। শুধু প্রেমে পড়বার জন্যে যে কত ছলাকলা, দেখলে তুমি হেসে মরে যাবে। আর্টিস্টদের ছবি দেখে এসো একজিবিশনে, সেখানে হয় বিদেশের চুরি, নয় ভাঁড়ামি। সাহিত্য! কলেজ স্ট্রিট পাড়াটায় ঢুকতে তোমার গা ঘিন ঘিন করবে, যদি তুমি বইয়ের পাতা খুলে দেখা
সহসা যেন ভুল করে জিজ্ঞেস করে ফেলল সুমিতা, কেন?
আশীষ হেসে ফেলল। বলল, ও, তুমি আবার প্রচুর বাংলা বই পড়। কিছু মনে কোরো না, কী করে বোঝাব তোমাকে, প্রকৃত সাহিত্যের কাছে সেগুলো কত অন্তঃসারশূন্য। যে ইওরোপকে ওরা অণু-পরমাণুতে নকল করে, সেও যে কত অক্ষম নকলনবিশী। আর নয় তো, অবিদ্যার জয়ঢাক সব। ভীষণ হাসি পায়, যখন দেখি এদেশের লোক তা-ই গোগ্রাসে গিলছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে।
শুনতে শুনতে অস্থির বিস্ময়ে সুমিতা আঙুল ঘষতে লাগল টেবিলে। শুধু অবহেলা, শুধু ঘৃণা, শুধু অশ্রদ্ধা যেন ওকে রুদ্ধশ্বাস করে তুলল।
বলল, তুমি তো পড়ই না বাংলা বই, ভালমন্দ তুমি জানবে কেমন করে।
–অনেক পড়েছি একসময়ে। পড়ে পড়ে টায়ার্ড। আর পড়িনি। জানি, জানি আমি, ওদের সাধ কতখানি, সাধ্য কতটুকু।
ভ্রূজোড়া লতিয়ে উঠল সুমিতার। যে উনিশ বছরটাকে সে বোবা বধির করে রাখতে চেয়েছে, তাকেই খুঁচিয়ে দিচ্ছে আশীষ বারে বারে। বলল, সব কি তোমার জানা হয়ে গেছে!
এক মুহূর্ত সুমিতার দিকে তাকিয়ে নীরব রইল আশীষ। তারপর অনেকখানি শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল, এই যুগটাকে জেনেছি।
বলেই আশীষ দু হাতে মুখ ঢেকে এলিয়ে পড়ল চেয়ারে। তারপর ফিসফিস করে বলল, হীনতা, অক্ষমতা, কাঙালপনা ছাড়া আমি তো কিছু দেখতে পাইনি। রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, সব, সবকিছু। আমি ছাত্র-মজুর-নেতা-সাহিত্যিক সবাইকে দেখেছি, আন্দোলন আর কালচার, সবকিছুই করে দেখেছি।
মুখ থেকে হাত খুলতে দেখা গেল, যেন ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে আশীষ। কিন্তু শান্ত গলাতেই বলল, মাফ করো আমাকে সুমিতা, এদেশের কাছে আমার আর কিছু পাবার নেই, দেওয়ারও নেই।
সুমিতার ঠোঁটের কূলে কিলবিল করে উঠছে অনেক কথা। কিলবিল করছে সাপেরই মতো বিষাক্ত কূট প্রশ্ন। কিন্তু সহসা থেমে গেল ও। কত করুণ মনে হল আশীষকে। ওর বিদ্রূপ, বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্ষোভ, সবকিছু মিলিয়ে, বড় অসহায় আর করুণ আশীষ। ওর সাহিত্যে, বন্ধুত্বে, অনেক জায়গায় অনেক আঘাত পেয়েছে। আসল আঘাত কোথায় পেয়ে এমন করে ছিন্ন করেছে নিজেকে, সবখানি বুঝে উঠতে পারে না সুমিতা। শুধু বোঝে, একাকী, সত্যি বড় একাকী আশীষ।
সুমিতা স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার সব কথা আমি জানিনে, সবটুকু তাই বুঝিনে হয়তো।
আশীষ চোখ তুলে তাকাল। বলল, তাই সুমিতা, হয়তো সব বোঝাতে পারিনে। তাই কোথাও যেতে পারিনে, কারুর কাছেই নয়। শুধু তুমি ছাড়া।
সুমিতার একটি হাত টেনে নিল আশীষ। চোখ বুলাল সর্বাঙ্গে, আবার সেই ঢুলুঢুলু চোখ।
আনত হল সুমিতার দৃষ্টি। সহসা কী যেন শিরশির করে পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে এল ঘাড়ের কাছে। সেইখানে, যেখানে উনিশ বছরের সমস্ত দপদপানি এক-ঠোঁট জায়গা নিয়ে জ্বলছে। এখানে কোনও বিচার নেই মনের। বড় ভয়, তবু এক দুর্বার আকর্ষণ। কী করে গেছে বিনয়, কে জানে। কোথায় কোন অদৃশ্যে বাঁধা ডিঙির নোঙর দিয়ে গেছে ছিঁড়ে ওর খেলার পাগলামিতে। এখন আর সেই স্রোতে নিজেকে রাখতে পারছে না ধরে সুমিতা।
কত সংশয়, কত প্রশ্ন, কত জটলা মনে আশীষকে নিয়ে, তবু নয়। কেবলি ভাবছে, ভালবাসি। রক্তের মধ্যে একটা ভয়ংকর সর্বনাশ বলছে অহর্নিশ, ভালবাসি।
আশীষ দেখল, সুমিতার মাধবী রং চাদর লুটিয়ে গেছে চেয়ারে। দ্রুত নিশ্বাসে আঁচল কাঁপছে বুকে। বুকের কাছে জামার ফুলতলা বর্ডারটি যেন হাসছে টিপে টিপে। প্রাক ঝড় নিথরতা কোমর থেকে পা পর্যন্ত।
আশীষ কোনও কথা না বলে, ওর সবল হাতে সুমিতাকে সামনে টেনে চুম্বন করল। চকিতে যেন সারা শরীর পাথর হয়ে গেল সুমিতার। মনে হল বিদ্যুতাহত হয়েছে ওর শরীর। পরমুহূর্তেই আগুন লাগল সারা শরীরে।
ভাবল, এইটি অসহ্য আনন্দ, ভয়ংকর সুখ, অসীম লজ্জা, নিদারুণ ভয়। একটা রুদ্ধ হাসি না আর কিছু উঠতে চাইছে ওর বুকে ঠেলে। এর জন্যেই ওর মন বোধ হয় প্রস্তুত হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এটা আসলে কী! কী! না, কান্না তো পাচ্ছে না, দুঃখ হচ্ছে না। শুধু প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক তুমুল কাড়া নাকাড়া বাজছে।
আশীষের দিকে তাকাতে গিয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে চেপে রাখল টেবিলে। ফিতে বাঁধা চুল এলিয়ে পড়ল ঘাড়ের এক পাশে। আর ওর সুদীর্ঘ গ্রীবায় পিছলে পড়ছে আলো। যেন এই চেয়েছিল সুমিতা, ওর সেই এক-ঠোঁট জায়গাটুকু তুলে ধরবে আশীষের কাছে।
আশীষের সারা মুখ দপ দপ করছে। সুমিতার পিঠে হাত রেখে ডাকল, সুমিতা।
সুমিতা নিঃশব্দ।
সুমিতা।
যেন অনেক দূর থেকে বলল, উঁ!
–অন্যায় করিনি তো?
সুমিতা ঘাড় নাড়ল মুখ চেপে রেখেই। কিন্তু দেহের সমস্ত রক্ত ওর তরতর করে উঠেছে ঘাড়ে। আশীষ ওর ঘাড়ে বারে বারে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগল। তারপর জোর করে তুলে ধরল মুখ। মুখ একেবারে টকটকে হয়ে গেছে সুমিতার। চোখের দৃষ্টি বিহ্বল আরক্ত। হাসিটি কী বিচিত্রভাবে রয়েছে আড়ষ্ট হয়ে।
আশীষ ডাকল, সুমিতা!
অন্যদিকে চোখ রেখে ঘাড় নাড়ল সুমিতা।
আশীষ বলল, এই আমি চেয়েছিলুম। আমি তোমাকে চেয়েছিলুম। তোমার কথা একটু বলো।
সুমিতা বলল চাপা স্বরে, কী বলব।
–আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্যে।
সুমিতা যন্ত্রচালিতের মতো মুগ্ধ স্বরে বলল, আচ্ছা।
আশীষ ওকে দু হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেল আলমারির কাছে। বইগুলি এখনও যেন তেমনি বিদ্রূপ করেই রয়েছে তাকিয়ে। হাসছে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে। কালীনাচ মুখোশটা রক্তজিহ্বা মেলে রয়েছে করাল মুখে।
আশীষ মনে মনে একটু অবাক হল। সুমিতার চিবুক তুলে ধরে বলল, কী ভাবছ?
কী ভাবছে সুমিতা! কিছু না, কিছু না। একটা ভয়ংকর সর্বনাশ দাপাদাপি করছে ওর রক্তের মধ্যে।
আশীষ বলল, তোমার ভয় করছে না?
সুমিতা ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
তবে?
তবে কী?
অবাক হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, আশীষ সবলে আলিঙ্গন করল সুমিতাকে। একটুও বাধা দিল না সুমিতা।
.
অনেকক্ষণ পর সুমিতা চেয়ার ছেড়ে উঠল। বলল, রাত হল, এবার বাড়ি যাই।
আশীষ বলল, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
বাইরে তখন শীত নেমে পড়েছে। নক্ষত্র ঢাকা পড়েছে হেমন্তিকার আড়ালে। আলোছায়া সজীব হয়েছে রাত্রের নির্জনতায়।
সুমিতা কিছুই বলতে পারছে না। শুধু নির্বোধ হাসি একটু লেগে রয়েছে ঠোঁটে। কী বলা উচিত, কী করা উচিত, সব অনুভূতির অগম্য যেন। কেবলি নানান কথা মনে আসছে। আর যেন ভয়ে ভয়ে জপ করছে, এই তো ভালবাসা, আমি ভালবাসি।
সুমিতার কানের কাছে মুখ এনে বলল আশীষ, আশা করি রাজেন আর মৃণালের মতো আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
কথাটা শেষ হবার আগেই সুমিতা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। থমকে দাঁড়িয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, অ্যাঁ?
অবাক হয়ে আশীষ সুমিতার হাত ধরে বলল, কী হল? অমন করে উঠলে কেন? আমি তো এমন কিছু বলিনি।
পরমুহূর্তেই হেসে বলল সুমিতা, ও! না, আমি যেন কী ভাবছিলুম।
বলে দাঁড়িয়ে তাকাল এক বার আশীষের দিকে। বড় রাস্তা সামনেই। বলল, তুমি এবার যাও, আমি যেতে পারব।
না না, আমি বাড়ি অবধি যাব।
–কোনও দরকার নেই আশীষ।
আশ্চর্য! হাসিটুকু ঠোঁটের কোণে থাকা সত্ত্বেও কেমন গম্ভীর মনে হচ্ছে সুমিতাকে। বলল, কী আশ্চর্য! যেতে পারবে?
–হ্যাঁ। মাত্র তো নটা বাজে।
বলে হন হন করে বড় রাস্তায় এসে পড়ল সুমিতা। আশীষ বলল, কাল যাব।
–আচ্ছা।
হঠাৎ যেন পালাচ্ছে সুমিতা। এ কী এ! সেই সেদিনের স্ট্র্যান্ড রোডের গঙ্গার ধারের পুরনো অনুভূতিগুলি যেন আবার উঠছে কিলবিলিয়ে। এ কেমন প্রাণ ওর, কেমন মেয়ে! এই তো চেয়েছিল, এই তো চায় বুঝি এখনও। তবে কী ঠেলে উঠছে বুক থেকে। আঁচল চেপে ধরল মুখে। না, কিছুতেই চোখ ঝাপসা হতে দেবে না, হৃৎপিণ্ড বন্ধ হলেও কিছুতেই কোনও শব্দ দেবে না বেরুতে মুখ ফুটে। ঘাড়ের দপদপানি গেছে ওর সারা অঙ্গে ছড়িয়ে। জ্বলছে, পুড়ছে, সমস্ত বুকের মধ্যে কনকন করছে এক দুর্বোধ্য অসহ্য যন্ত্রণায়। করুক। এই তো চেয়েছিল সুমিতা। উনিশ বছরের যে মূক বধির অন্ধ বাঘিনীটা বসে আছে রক্তে, সে তো এই চায়, প্রাণভরে আরও চাইবে।
তবে কে এমন মিথ্যা কান্নায় টিপছে হৃৎপিণ্ডটাকে। অকারণ কতগুলি মনের তৈরি ফাঁকি বুঝি সেগুলি।
.
২৪.
জানে না সুমিতা কিছুই। জীবনের কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, জানে না। মতি কোনটি, কোনটি মন, জানে না তার কোনও হদিস। বুক ঠেলে, মাথার সমস্ত শিরা-উপশিরা টনটনিয়ে যে তপ্ত লবণাক্ত জল বিন্দু বিন্দু জমছে চোখের কোণে, সে কান্না নয়। কেনো, ওর কোনও বোধ নেই তৃপ্তি-অতৃপ্তির। যে বোধে মানুষ কাঁদে।
আছে শুধু দাহ। যত উন্মাদনা, যত উল্লাস সে শুধু বিধ্বংসী ভয়ংকরী আগুনের। উনিশ বছরের রক্তে-মাংসে প্রচণ্ড দাহ! এ আগুনের নাম বিদ্রোহ। আর এ বিদ্রোহের সবখানিই বড় অবুঝ। সে ছাড়াতে চায় নিজেকেও। খোদ যার বুকের ঘরে লেগেছে সেই আগুন। দহনেরও একটি ভয়ংকর সুখ আছে যে! বুকের ভিতর দুটি শীতল হাত তুলে যে অগ্নিনিরোধ করতে চাইছে, তাকে তাই আঁচল চাপা দিয়ে রাখতে চাইছে সুমিতা। এ কে, এ কী! এ যেন গুলিখোরের জলাতঙ্ক সুমিতার।
এ কী অবুঝ যন্ত্রণা ওর। এ যে সুমিতার ভালবাসা। কিন্তু কাকে বলবে সে কথা! বাইরের নয়, তোলপাড় সব যে ভিতরে। চোখের জলটা তাই আর কিছু নয়, ওটা অবুঝ মনের বিক্ষোভ।
অগ্রহায়ণের রাত্রি নটার স্বল্প-ভিড় রাস্তা প্রায় এক নিশ্বাসে পার হয়ে এল সুমিতা। চেয়ে দেখল না, রাস্তার মোড়ে আশীষের উদ্দীপ্ত ঢুলুঢুলু চোখ দুটিতে চিকচিক করে উঠছে ভীরু বিস্ময়। যে সব জায়গা থেকে অনেক বিতৃষ্ণায় ফিরে আসতে চেয়েছে এক জায়গায়।
বাড়ির কাছে এসে এক বার থমকে দাঁড়াল সুমিতা। অন্ধকার নিঝুম বাড়ি। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও স্পষ্ট দেখতে পেল সুমিতা বাবার ছায়া।
মিথ্যে নয়, বসে ছিলেন মহীতোষ। সারা বাড়িটার নির্জন নিঃশব্দ অন্ধকার গ্রাসের মধ্যে ছটফট করছিলেন বসে বসে। এসে কাউকে দেখেননি। জিজ্ঞেসও করেননি এক বার বিলাসকে। শুধু রুদ্ধ অভিমানে টনটন করেছে বুকের মধ্যে। জামাকাপড় ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে চা খেয়েছেন। তারপর ফিরেছেন পায়চারি করে, আর বারবার চোখ তুলে দেখেছেন দরজার দিকে। শুধু তাতে স্তিমিত হয়েছে দৃষ্টি ক্ষয়ে ক্ষয়ে। সারা জীবনের স্মৃতিভারে এক অসহনীয় একাকিত্ব ওঁকে কেবলি রুদ্ধশ্বাস করেছে। বার্ধক্যের ধীরগতি রক্তধারার মতো, সময়ও এখানে চলেছে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে।
কেউ আসেনি, কেউ না। তারপর রাগ হয়েছে অভিমান ছাড়িয়ে। দুমদাম করে নিজের ঘরে গিয়ে আবার জামাকাপড় পরেছেন। ফিটফাট হয়ে, ছড়িটি খটখটিয়ে জুতো মসমঁসিয়ে গেলেন বাইরের ঘরে। দূর থেকে এক বার বিলাস তাকিয়ে দেখেছে কাজের ফাঁকে। মহীতোষ বারান্দা দিয়ে নেমে চলে গেলেন বাইরে। ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছেন। হঠাৎ মনে হয়েছে, এর মধ্যেই হয়তো কেউ ফিরে থাকবে ওদের তিনজনের।
যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিলেন রাগ করে, তত তাড়াতাড়িই ফিরেছেন আবার। কান পেতে উঁকিঝুঁকি দিয়েছেন বারান্দায় উঠে। কেউ আসেনি।
সে অবস্থাতেই তখন থেকে বসে আছেন বারান্দায়। রাগ ছিল যতক্ষণ, ততক্ষণ কত কী ভেবেছেন। যেন ওঁকে কেউ শাস্তি দিচ্ছে অনর্থক। এখন কী করে তার শোধ নেওয়া যায়, সেই ভাবনা।
তারই ফাঁকে কখন স্ত্রীর কথা মনে পড়েছে। আর তিনটি মেয়ের জন্য স্নেহে, বেদনায়, আপ্লুত হয়ে উঠেছে মন। রাগ, অভিমান, সব মুছে দিয়ে অন্ধকারকেই বলেছেন বারবার, ওদের সুখ দাও, শান্তি দাও। আমার যত রাগ, যত অভিমান, সে শুধু ওদের ভবিষ্যতের অন্ধকারের প্রতি ওদের সুখ-শান্তির কথা ভেবেই।
কিন্তু সুমিতাকে দেখামাত্রই ছেলেমানুষের মতো আবার নিঃশব্দে ফোঁস করে উঠল অভিমান। ভাবলেন, এইবার বেরুব।
উঠে আলো জ্বেলে এগুতে গিয়ে থমকে গেলেন। বুকের মধ্যে চমকে উঠল রুমনিকে দেখে। ফিতের বাঁধন উপছে চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। কোলবসা চোখ যেন ভেজা আরক্ত। অথচ দৃষ্টি অস্থির। এসে দু হাতে জড়িয়ে ধরল মহীতোষের হাত।
মনের যত অবুঝ দাপাদাপি, তার নিরসনে যেন এইটুকু সুমিতার দরকার হয়ে পড়েছিল এখন।
বলল, কোথায় যাচ্ছ বাবা?
কোথাও নয়। অভিমান থেকে ছলনাটুকু মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, সুমিতাকে দেখে আর সেইটুকুও রইল না। বললেন, এই একটু এদিকে-ওদিকে।
–কেন?
–এমনি। তোমরা কেউ নেই, তাই।
বলে দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন, কোথায় গিয়েছিলে রুমনো সাহেবা।
মহীতোষের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে উঠল সুমিতার মন। বলল আশীষের বাড়িতে।
অমনি অজস্র প্রশ্নে আবর্তিত হতে লাগল মহীতোষের ভাবনা। সুমিতার হাতধরা হয়ে এসে বসলেন চেয়ারে। আর যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন, রুমনির জীবনেরও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা ভয় আসছে ঘিরে। বললেন, তোমাকে এত কাহিল দেখাচ্ছে কেন রুমনো।
সুমিতা মহীতোষের পাশে বসে, এক মুহূর্ত হঠাৎ কোনও কথা বলতে পারল না। কেমন যেন ভয় করতে লাগল ভিতরে ভিতরে। মনে হল, ওর রক্তের আগুনটা বুঝি দেখতে পাচ্ছেন মহীতোষ। তারপর বলল, কী জানি! আমার তো কিছু হয়নি।
তাতে ভয় দূর হল না মহীতোষের। কিন্তু এখানে অনর্থক প্রশ্ন করতে বাধল ওঁর। বললেন, একটু সাবধান থেকো রুমনো, শরীরটা খারাপ কোরো না। বলে নীরব হলেন। কিন্তু অনেক কথা পিলপিল করে উঠতে লাগল ওঁর ঠোঁটে। আশীষ, আশীষের বাবা-মা, বাড়ি, অনেক কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, পারলেন না। কিন্তু যত বারই চোখ পড়ল, তত বারই চমকে উঠলেন মনে মনে। সেই চমকের সঙ্গে টনটনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে। ছোট রুমনির এই আড়ষ্ট হাসি, লজ্জা দেখেছেন অনেক বার। কিন্তু চোখের তারায় এমন অসহায়তা দেখেননি তো কোনওদিন।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জন্মদিন না কবে রুমনো?
সুমিতা বলল, সামনের মাঘ মাসে। একুশে মাঘ।
ভুলে গেছেন মহীতোষ, কত বছর পূর্ণ হবে সেদিন সুমিতার। বললেন, কত বছর হবে তোমার সেদিন।
সহসা কণ্টকিত হল সুমিতা ভয়ে ও লজ্জায়। বলল, উনিশ বছর পূর্ণ হবে বাবা।
উনিশ বছর! অনেক বছর! অবুঝ, অহংকারী, বেহিসাবী, পবিত্র, সুন্দর ভয়ংকর ও অসীম। মহীতোষ সুমিতার পিঠে হাত রেখে বললেন, তবে তো তুমি অনেক বড় হলে রুমনো সাহেবা। জীবনের ভাল-মন্দ বোঝার বয়স তোমার হয়েছে এবার। ছেলেদের কাছে এ বয়সটা বোঝাবুঝির বয়স নয়, মেয়েদের কাছে অনেকখানি। বোঝাবুঝি পেরিয়ে, এটা মেয়েদের যোঝাবুঝির পালা। তোমার বয়সে, তোমার মায়ের কোলে উমনো এসে পড়েছিল।
সুমিতা কেমন একরকম বিস্মিত বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। মহীতোষের কথা শুনতে শুনতে কেন যেন কান্না উঠে আসতে চাইছিল ওর বুক মুচড়ে।
মহীতোষ হেসে সুমিতার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি যেন কী ভাবছ। দুর্ভাবনার কিছু নেই। রুমনো। এখন তোমার নিজের ভালমন্দ নিজে ভাববে, যা করবে, ভেবে করবে। এই আমি বলছি।
তারপর সুমিতার অবস্থা দেখে নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন। বললেন, আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছি রুমনো।
এতক্ষণে মনে পড়ল, মহীতোষকে ছুটি নেওয়ার তাড়া দিয়েছিল সুমিতা নিজেই। মেজদির বিয়ে। মার্কেটিং, নিমন্ত্রণ করা, ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনাই শুধু হয়েছে। কাজ আরম্ভ হয়নি।
সুমিতা বলল, তা হলে কালকেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব বাবা। তুমি আমাকে নিমন্ত্রিতদের লিস্ট তৈরি করতে বলেছিলে, আমি করে ফেলেছি। মেজদির সঙ্গেও একটু বসা দরকার। ওর বন্ধুবান্ধব সকলের নাম তো আমি জানিনে। আর বাবা
মহীতোষ ফিরে তাকিয়ে অবাক হলেন। সুমিতার মুখে গাঢ় ছায়া পড়েছে। বললেন, কী হল রুমনো।
সুমিতা বলল, সবাই আসবে, একজন আসবে না।
কে, সে কথা আর জিজ্ঞেস করবার দরকার হল না মহীতোষের। উনিও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন সুমিতার মতোই। তারপর বললেন, ঠিক বলেছ রুমনো। আমি তার বাড়ি গিয়েছি, কলেজে গিয়েছি তোমাদের না জানিয়ে। কোথাও গিয়ে রবিকে আমি ধরতে পারিনি।
সুমিতা বলল, আমি একদিন খুঁজে দেখব বাবা।
-দেখতে পারো।
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, নিজের দুঃখে যে রবি এ বাড়িতে আসা ছেড়েছে, সে কথা আমি ভাবতেও পারিনে। সে জাতের ছেলে সে নয়। আর কারুর দুঃখ যদি বড় হয়ে বেজে থাকে, তবে কি তাকে আনতে পারবে রুমনো।
আর কারুর বলতে মহীতোষ সুজাতার কথাই বলেছেন।
সুমিতা বলল, আমরা কি ওঁর কেউ নই।
মহীতোষ সুমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ধর যদি তোমার বড়দি তাড়িয়ে দিয়ে থাকে রবিকে।
বিস্মিত ব্যথায় পাংশু দেখাল সুমিতার মুখ। বলল, তা কেমন করে হয় বাবা।
–হয় কি না জানিনে! কিন্তু তোমার বড়দি এত অবুঝ হয়ে উঠেছে, তার পক্ষে সেটা বোধ হয় অসম্ভব নয়।
সুমিতা বারবার ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল, না, না, না, তা কখনও হতে পারে না বাবা। বড়দি কখনও রবিদাকে সে কথা বলতে পারে না।
মহীতোষ একটু অবাক হয়ে বললেন, না পারলেই ভাল। তুমি রবিকে নিয়ে এসো, যেখান থেকে পারো।
মৃণালের নিয়মিত যাতায়াতটা অনিয়মে দাঁড়াল কয়েক দিন। আশীষের অনিয়মটা দাঁড়াল নিয়মে।
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, মহীতোষের সঙ্গে বেশি ব্যস্ত সুগতা নিজেই। ব্যস্ততাটা অবশ্য ভিন্নরকমের। কেনাকাটার ব্যাপারে মহীতোষের হাত সামলানোর জন্যেই যত ব্যস্ততা। কী-ই বা করে সুগতা। ঘরে বসে আপন মনে হাসতে ওর বড় লজ্জা। আর, ঘুরে ফিরে মনটা সেই এক জায়গায় আসে ফিরে। তখন শত গম্ভীর হয়ে থাকতে চাইলেও, আপনি আসে হাসি। খিলখিল হাসি তো নয়, সে যেন কেমন একরকম নিঃশব্দ অথচ পরিস্ফুট। তাতে ওর অন্যমনস্কতা ধরা পড়ে যায় সুমিতার কাছে। মহীতোষের কাছে। জানে, এখন মৃণাল আসবে না কয়েক দিন। তাই মহীতোষের সঙ্গ ধরেছে। জুয়েলারির দোকানে, কাপড়ের রঙিন হাটে, সব জায়গায় যাচ্ছে। ধমকাচ্ছে মহীতোষকে, ধরছে হাত টেনে। কী হচ্ছে বাবা এ সব! না, এরকম করলে তোমার বিয়ে দিয়ে কাজ নেই বাপু।
সঙ্গে যদি সুমিতা থাকে, তবে ও আর মহীতোষ হেসে বাঁচে না। মাঝখান থেকে সুগতা-ই লজ্জায় পড়ে যায়। মহীতোষ যা প্রাণ চায়, তাই কেনেন।
সুগতা বলে গম্ভীর হয়ে, তুমি যে এ সব কিছ বাবা, কে পরবে শুনি?
মহীতোষ বলেন, কেন বল তো?
বৈরাগিনীর মতো উদাস গম্ভীর গলায় বলে সুগতা, তুমি তো জান বাবা, এসব নিয়ে কাটাবার মতো জীবন আমার নয়।
মহীতোষ বলেন, কিন্তু ঝুমনো, তোমাকে এ সব দেব বলে আমি যে এত দিন ধরে বেঁচে আছি। এগুলো আর যাই হোক, শুধু গয়না কাপড় খাট-আলমারি তো নয়। তোমার চোখের সামনে এগুলো আমাকে জিইয়ে রাখবে।
সুগতার গলা হঠাৎ বন্ধ হয়ে এসেছে। বলে, বাবা, এ ছাড়া বুঝি আমার কাছে তুমি জিইয়ে থাকবে না।
–থাকব বইকী! ওটা মানুষের আর এক মন ঝুমনো। বাবার মন। তুমি যখন পাশ করেছ, তোমাকে উপহার দিয়েছি। জন্মদিনে দিয়েছি। এবারের দেওয়া আমার সবার বড় দেওয়া। ঝুমনো, এবার তুই স্বামীর ঘরে চলে যাবি।
আর কেউ কথা বলতে পারেনি। দুজনেরই গলা বন্ধ হয়ে গেছে। চোখ ভিজে উঠেছে দুজনেরই। তার মধ্যেও একটি আনন্দের সুর বেজেছে নিয়ত।
কাজে যাওয়া, রাত্রে ফিরে আসার মধ্যে কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি সুজাতার। কথাবার্তা হয়তো একটু বেশি বলেছে। নিজে নিজেই বিয়ের জিনিসপত্র দেখেছে ঘেঁটে। বলেছে নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা।
চোখের কোণ হয়েছে আরও গভীর। ঠোঁটের রং হয়েছে আরও গাঢ়। মুখের রং আরও পুরু সুজাতার।
আর সুমিতা, সকলের সামনে, সকল কাজের মাঝেও যেন লুকিয়ে ফিরছে নিজেকে নিয়ে। যেন নিজের আগুন দিয়ে বাঁচিয়ে ফিরছে সবাইকে। কখন কোনদিকে সেই আগুন ঝলসে দেবে অপরের চোখ। আঁচ লাগবে কার গায়ে।
মহীতোষ হঠাৎ একটু সচেতন হয়ে উঠেছেন আশীষের সম্পর্কে। আশীষ এলেই ডেকে বসান। সেই ফাঁকে দুটি কথাও জিজ্ঞেস করে নেন। আশীষের বাবা, মা, ভাই, বোন নানারকম। আশীষেরও উৎসাহের অভাব নেই জবাব দিতে।
সুমিতা বেরুতে পারে না আশীষের সঙ্গে। বাড়িতেই কথাবার্তা হয়। আশীষ সাহিত্য আর জীবনের কথাটাই বলে বেশি করে। কিন্তু সে জীবনের সবটাই অন্য দেশের। কখনও তা মনের দৃষ্টিতে, কখনও ভাঁদালের আবিষ্কারে। নিজের চারপাশে শুধু সবই মন্দ, একটুখানি, প্রাণহীন। দুর দুর! ছি ছি! আশীষ দেখে এসেছে খনি-শ্রমিকদের। মাইকা-ম্যাঙ্গানিজ কয়লা। যে চিন্তার বশবর্তী হয়ে গিয়েছিল আশীষ, শ্রমিকদের মধ্যে তার কিছুই নেই। লোকগুলির কোনওকিছুকেই তার একটুও ভাল লাগেনি। দুর্বল, ভীরু, কাপুরুষ। তেমনি ওদের চারপাশের মানুষ। ওদের ট্রেড ইউনিয়ন, অর্গানাইজার, সবই একটা নিম্নমধ্যবিত্তসুলভ কেরানিগিরির কারখানা। তেমনি দেখেছে চটকল শ্রমিকদের। না আছে কোথাও হৃদয়ের আগুন, না বুদ্ধির তীব্রতা।
কিন্তু আশীষ কখনও ঢুলুঢুলু চোখ ফেরাতে পারে না সুমিতার দিক থেকে। সুযোগ পেলেই অগোছালো করবে, বেসামাল করবে দলিত মথিত করে। চুম্বনে আলিঙ্গনে বিস্রস্ত করবে।
সুগতার বিয়ের তিন দিন আগে মৃণাল এল হঠাৎ। মহীতোষ একলাই বেরিয়েছিলেন। বাইরের ঘরে সুগতা, সুমিতা, দুজনেই ছিল।
মৃণাল হাসল, সুগতা, বড় অঘটন ঘটে গেছে একটা।
বিমূঢ় ভয়ে সুগতা কেঁপে উঠল। ওকে কখনও কাঁপতে দেখা যায় না। বলল, কী ব্যাপার! মৃণাল বসে পড়ল সুগতার পাশে। বলল, ব্যাপারটা বিশ্রী। রাজেন হঠাৎ অজয়কে মেরেছে।
সুগতা অবাক হয়ে বলল, কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি অজয়?
–হ্যাঁ।
–কেন?
–সে অনেক ব্যাপার।
সুমিতা কাঠ হয়ে বসেছিল। ওর চোখের সামনে ভাসছিল রাজেনের রুদ্রমূর্তি। কিন্তু পায়ে যেন স্কু গেছে এঁটে। যত গোপন থোক, যত অভদ্রতাই হোক, কিছুতেই উঠতে পারল না।
মৃণাল বলল, সুমিতার সামনে বলতে আপত্তি নেই। ব্যাপারটা অবশ্য এখনও কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। রাজেন কলকাতায় আছে শুনে আমি গেছলুম নিমন্ত্রণ করতে। দেখলুম, অজয় তার জনদশেক বন্ধু নিয়ে সঙেঘর আফিসে, সিঁড়িতে ভিড় করে রয়েছে। রাজেনকে তারা বেরুতে দেবেনা।
সুমিতা অসহ্য বিস্ময়ে ভয়ে ও উত্তেজনায় আঁচল চাপল মুখে।
সুগতা বলল, সে কী, নিজেদের মধ্যে মারামারি। কী ব্যাপার, সেটা বলল।
বিজলীকে জান তো? প্রেসিডেন্সির সেই ফোর্থ ইয়ারের মেয়েটি খুব সুন্দরী বলে অনেকেই ওর প্রার্থী ছিল। এদিকে মেয়েটি ভাল অর্গানাইজারও বটে।
সুগতা বলল, সে সব জানি। খুব কাজের মেয়ে। কী হয়েছে, তাই বলল।
অজয় অনেক দিন থেকে বিজলীর পেছনে বোধ হয় লেগেছিল। কিন্তু বিজলীর সেটা পছন্দ ছিল না। যাই হোক, সম্মেলনের সময় যেদিন মূল প্রস্তাবের ওপর রাত্রি তিনটে অবধি সভা হয়, সেদিন বিজলী অজয়ও ছিল। তারপর ডেলিগেট ক্যাম্পের পেছনে সেইদিন রাত্রেই নাকি অজয় কীভাবে অপমান করেছিল বিজলীকে। বিজলী আর সেটা কাউকে বলতে পারেনি, রাজেনকে ছাড়া। রাজেন অজয়কে অনেক দিন ডেকে পাঠিয়েছে, সে আসেনি। কাল রাত্রে সঙেঘর অফিসে অজয়কে ধরেছিল রাজেন। জিজ্ঞেস করেছে সব কথা। অজয়ও বড় রোখা ছেলে। বলেছে, এ সব বিষয়ের কোনও কৈফিয়ত আপনাকে দিতে পারব না।
রাজেন বলেছে, তবে সঙেঘর সভ্যদের সামনেই দিও। একজন সভ্য যখন এরকম বিশ্রী একটা অভিযোগ করেছে, সত্য মিথ্যা প্রমাণের দায় তোমাদের দুজনেরই।
অজয় বলেছে, এ সব ব্যক্তিগত বিষয় আমি সঙ্ঘের সামনে আলোচনা করতে চাইনে।
রাজেন বলেছে, ছাত্রসঙঘ নাইট ক্লাব নয়, ন্যাড়ানেড়ির আখড়াও না। এখানে নিয়ম শৃঙ্খলার দায়িত্ব সকলের। না চাইলেও কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে।
অজয় বলেছে, ও সব আমার দেখা আছে। জানা আছে সবাইকে।
রাজেন তখন ফিরে বলেছে, তুমি বিজলীর আঁচল টেনে অপমান করেছিলে? সঙ্ঘ-টঘ না হয় রইল। আমি নিজেই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।
অজয় বলেছে, কেন জিজ্ঞেস করছেন?
তখন অজয়ের চুলের মুঠি ধরে রাজেন মেরেছে মুখে। বলেছে, এইজন্যে। আরও জানতে চাও?
সুমিতা পাথর হয়ে বসেছিল। সুগতা বলে উঠল, অজয় অন্যায় করেছে ঠিকই। কিন্তু রাজেন চিরকাল একরকম। ব্যাপারটা অন্যরকমভাবে তো ব্যবস্থা করা যেত। তারপর?
তারপর আর কী! সবচেয়ে আশ্চর্য! রাজেন কাল রাত্রে বাড়ি ফিরে যায়নি, অফিসেই ছিল। আজও আছে এখনও বসে।
সুমিতা ঢোঁক গিলে বলল, দরজা বন্ধ করে?
না। দরজা খোলাই।
–আর অজয়েরা?
অপেক্ষা করছে।
সুমিতার মনে হল, এখুনি চলে যায় ছুটে। কেন, তা নিজেই জানে না। শুধু ওর বুকের মধ্যে কাঁপছে থরথর করে।
সুগতা উঠে বলল, বসো তুমি, কাপড় বদলে আসছি।
সুমিতাও উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি যাব মেজদি।
এক মুহূর্ত বিস্মিত চিন্তিত দেখাল সুগতাকে। তারপর বলল, চল।
ওরা এসে দেখল সেই একই পরিস্থিতি। সিঁড়িতে অজয়েরা কয়েক জন। ঘরে ঢুকে দেখল, রাজেন একমনে বসে কী লিখছে। সামনে একরাশ ফাইল কাগজ।
স্নান করেনি, উশকোখুশকো চুল রাজেনের। কিন্তু কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ নেই সেখানে। কপালে ও চোখে নেই বিদ্যুতের ঝিকিমিকি। কেবল একটু বিষণ্ণতা রয়েছে চোখের গভীরে।
মুখ তুলে অবাক হেসে বলল, কী ব্যাপার! দল বেঁধে যে!
সুগতা গম্ভীর হয়ে বলল, অজয়েরা সিঁড়িতে বসে আছে, তা জান?
রাজেন গম্ভীর হেসে বলল, জানি। কিন্তু তুমি কেন? একেবারে ছোট বোনকে নিয়ে।
সুগতা বলল, ছোট বোন এসেছে তার ইচ্ছেয়। কিন্তু এবার কী হবে?
রাজেন বলল, কী আবার হবে।
–মারধোরটা না করলে চলত না?
রাজেন মুখ নামিয়ে বলল, চেষ্টা করেছিলুম, পারিনি। অন্যায় করেও এত উদ্ধত, তোমারো রাগ হত।
–ওকে এক্সপে করা যেত।
–তা অবশ্য ঠিকই। কিন্তু সেটা ওর কাছে কিছুই নয় সুগতা।
সুগতা আরও গম্ভীর হয়ে বলল, অজয় একটা অন্যায় করেছে। বদলে তুমিও একটা অন্যায় করেছ। সে সব তো পরে হবে। এখন তুমি বেরুবে কী করে এখান থেকে। ছাত্রসঙঘ কি এখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে?
রাজেন হাসল একটু বিদ্যুৎ চমকের মতো। বলল, মারামারি হবে কেন। তুমি এসে বরং ব্যাপারটাকে গম্ভীর করে ফেললে। মৃণাল নিশ্চয় তোমাকে ডেকে এনেছে।
–সেটা খুব অন্যায় করেছে বোধ হয়?
না, ওরা ভেবেছে, হয়তো আমি খবর দিয়েছি। যাই হোক, আমার কতগুলি রিপোর্ট লেখার ছিল। শেষ করেছি। বোধ হয়, ছাত্রসঙ্ঘের এই আমার শেষ রিপোর্ট। চলো, বেরুনো যাক এবার।
মৃণাল বলল, কী বলছ তুমি রাজেন। কী করে যাবে এখন। একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি হবে।
তিনজনেই দেখে এসেছে, কেমন ক্রুদ্ধ হিংস্র হয়ে ওরা বসে আছে সবাই।
রাজেন ফিরে দাঁড়াল মৃণালের দিকে। সারা মূর্খ ওর দপদপে অঙ্গারের মতো জ্বলছে। অবিন্যস্ত চুল। যেন আগুনের শিখা। তীব্র গম্ভীর গলায় বলল, হয়তো একটা আইন আমি ভঙ্গ করেছি। কিন্তু মানুষের আইনটা ভাঙিনি মৃণাল। রাস্তাঘাটে, আমার পাড়ায়, ঘরে এ ব্যাপার ঘটলেও আমি এই করতুম। আমার নিজের কাছে তো কোনও অন্যায় বোধ নেই। আমি তো অসাড় নই। এর পরে যদি কোনও কেলেঙ্কারি হয়, আমার কাছে তার কোনও দাম নেই। দেহে ওরা সবল হয়ে আসতে পারে, আমি তাতে ভীরু হব না। চলো।
নিজেরই অজান্তে সুমিতার গলা দিয়ে অপরিস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, না না।
রাজেন ফিরে তাকাল। মৃণাল সুগতাও তাকিয়েছিল। সুমিতার ভীরু চোখ সহসা ছলছলিয়ে উঠেছে। ভীত হয়ে উঠেছে মৃণাল সুগতাও।
রাজেন বলল সুমিতাকে, দেখছ তো, সত্যি আমি কতখানি গোঁয়ার। তোমরা এসে পড়েছ, আর বোধ হয় আমি গোঁয়ার হতে পারব না। ভদ্রলোকের মতো এবার মার খাব পড়ে পড়ে।
বলে হাসতে গিয়েও ঠিক হাসতে পারল না রাজেন। সুমিতার ভীরু ব্যাকুল চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মৃণালের দিকে ফিরে বলল, তবে তোমরা চলে যাও, আমি পরে যাচ্ছি।
সুগতা বলল, তা হয় না। তোমরা বসো, আমি অজয়কে ডাকছি এখানে।
বলেই, দরজার কাছে গিয়ে সুগতা ডাকল, অজয়, তুমি একটু ওপরে এসো ভাই।
অজয় এল। এখনও জ্বর পাশে নীল দাগ নিয়ে খানিকটা ফুলে আছে তার। কোটের বোতাম খোলা, রুক্ষ চুল। চোখে মুখে রাত্রি জাগরণের ছাপ। আরক্ত চোখ জ্বলছে ধকধক করে। দাঁড়াল এসে মাথা নিচু করে।
কেউ কিছু বলবার আগেই রাজেন দাঁড়াল অজয়ের সামনে। বলল, তোমরা কি আমাকে মারবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ অজয়?
সকলেরই বুকের মধ্যে কাঁপছে। সুগতা মৃণাল রাজেনের এক পাশে। আর এক পাশে সুমিতা।
অজয় প্রজ্জ্বলিত চোখ তুলে বলল, হ্যাঁ।
রাজেন বলল, মারো। বিজলীকে তুমি যদি অপমান না করে থাকো, তবে আমাকে মারো।
অজয় দু হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়াল এক পা পেছিয়ে। হাত দুটি নড়ছে। কী যেন বার করতে চাইছে পকেট থেকে। কিন্তু দৃষ্টি রাজেনের চোখের দিকে।
রাজেন আবার বলল, মারো।
অনুরোধ নয়, যেন দ্বন্দ্বে আহ্বান করছে রাজেন। গায়ের থেকে সুতোর গেরুয়া মোটা চাদরটা ঝুলে পড়েছে আলখাল্লার মতো। অজয়ের দৃষ্টিটা ফিরে গেছে অন্যদিকে। বাকি তিনজনের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নত করেছে মুখ।
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ। হঠাৎ অজয় মুখ তুলে বলল, কেন ডেকেছেন সুগতাদি।
সুগতা বলল, তোমরা বাড়ি যাও ভাই আজ। এ বিষয়ে আমরা সবাই একদিন বসব তাড়াতাড়ি।
অজয় তবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ সবাইকে রুদ্ধশ্বাস করে। তারপর বলল, বিজলীকে আমি অপমান করেছিলুম সুগতাদি।
বলেও কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে রাজেনের দিকে তাকাল অজয়। দৃষ্টি ওর আশ্চর্য শান্ত হয়ে এসেছে তখন। আর কোনও কথা না বলে পিছন ফিরে চলে গেল অজয়। সিঁড়িতে শোনা গেল সকলের চলে যাওয়ার মিলিত পদধ্বনি।
ওরা চারজনেই চুপচাপ নেমে এল রাস্তায়। চা খেল নিঃশব্দে একটি রেস্তোরাঁয় বসে।
সুমিতা একবারো চোখ নামাতে পারেনি রাজেনের মুখ থেকে। বারবার দেখেছে, চোখে তার কীসের ছায়া পড়ে মুখখানি বিষণ্ণ ব্যথিত হয়ে উঠেছে।
তারপর একসময় রাজেনই বলল, আজ চলি আমি।
সুগতাও আর পূর্ব প্রসঙ্গ টেনে আনল না। বলল, সাতাশ তারিখে আসছ তো আমাদের বাড়িতে।
নিশ্চয়ই আসব। মৃণালের নিমন্ত্রণ আগেই পেয়েছি। তোমাকে আর চিঠি ফিঠি দিতে হবে না।
–তা জানি। কিন্তু তার আগেই আবার যেন কিছু ঘটিয়ে বসোনা।
রাজেনের হাসিতে যত তীক্ষ্ণতা, বেদনাতেও ততখানি তীব্রতা। হেসে বলল, সত্যি, বড় খারাপ লাগে। তোমরা আমাকে ক্ষমা করো ভাই।
বলে সুমিতার দিকে ফিরে ওর কাঁধে একটি হাত রেখে বলল, তুমিও, বুঝলে?
ধক করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে। হঠাৎ যেন সমস্ত মুখটা ওর পুড়ে গেল, কাঁপতে লাগল বুকের মধ্যে। অস্ফুট গলায় বলল, আচ্ছা।
আবার চোখ তুলে বলল, আসবেন তো সত্যি?
রাজেন হেসে বলল, অনেক বার ফাঁকি দিয়েছি। এবার নিশ্চিত।
চাদর জড়িয়ে, বিকালের ভিড়ে হারিয়ে গেল রাজেন।
মৃণাল আর সুগতা অবাক হয়ে চোখাচোখি করল পরস্পর। সুগতা ডাকল, আয় রুমনি।
সুমিতা ফিরল।
.
২৫.
ফেরার পথে সুগতা বললে মৃণালকে, কোথায় একটা পিকিউলিয়ার চেঞ্জ হয়েছে রাজেনের। কেমন যেন রেস্টলেস।
সুগতার গলায় করুণার রেশ। ওর চোখে মুখে প্রতি অঙ্গে এক বিচিত্র দ্যুতি চমকাচ্ছে নিয়ত। সেটুকু ওর গহীন মনের উৎসবের ঝলকানি। তার মাঝে এই করুণ সুরটা ছেঁড়া তারের মতো বেসুরো। করুণা জিনিসটি বোধ হয় এমনি।
আর এই করুণার রেশটুকু মৃণালকেও যেন বিগলিত করে দিল। সুগতাকে মনে হচ্ছিল বিশাল-মনা দেবীর মতো। বলল, হ্যাঁ। কিছুদিন থেকেই আমি সেটা লক্ষ করে আসছি। ভাবি, হঠাৎ কেন এমন হল।
সুগতা বলল একটি চিন্তিত স্বরে, হঠাৎ নয়। রাজেন বোধ হয় এমনি। ব্যাপারটা রাজনীতিগত।
রাজনীতিগত?
–আমার মনে হয়। হয়তো নীতির পরিবর্তনটা ওর ধাতে সইছে না। তাই বা বলি কেন। সেটাকে মনে-প্রাণে মেনে নিয়েছে বলেই হয়তো নিজেকে ওর বড় তুচ্ছ মনে হচ্ছে, অকিঞ্চিৎ মনে হচ্ছে। মনে হয়, কী এক অদ্ভুত অদৃশ্য শক্তির পিছনে ফিরছে রাজেন। সেটা ও পাচ্ছে না বলে রেস্টলেস হয়ে উঠেছে। এটা বড় করুণ ব্যাপার। এ সব থেকেই তো মানুষের ইনস্যানিটি গ্রো করে যায়।
মৃণাল বলল, কোন শক্তির কথা বলছ তুমি?
পাতলা ঠোঁটে একটু বিষাদ-কৌতুক হাসি নিয়ে বলল সুগতা, তা তো আমিও জানিনে। আসলে সেটা কোনও শক্তিই কি না, তা-ই আমি বিশ্বাস করতে পারিনে। নিজেকে ছাড়িয়ে যাব, ছাপিয়ে উঠব,
সে। ত্যাগ করে, নিজেকে দুঃখ দিয়ে, ভেঙেচুরে? কী জানি! এ তো অ্যাবনর্মাল মানুষের লক্ষণ।
একদিন রাজেনের যে জীবনায়নকে সুগতার দুস্তর বিস্তৃত মনে হয়েছে, নিজেকে ভেবেছে ভীরু ও অক্ষম, আজ সন্দেহ সেখানে। আজ মনে হচ্ছে, কোথায় এর অস্বাভাবিকতা ও পাগলামি রয়েছে বাসা বেঁধে।
আবার বলল, আমার কী ভয় জানো মৃণাল। রাজেনের জীবনে এমনি বিপদ এখন ঘটবে বারেবারেই।
পাশে পাশে সুমিতা। সেই মাধবী-রং চাদরটাই গায়ে জড়িয়ে, মুঠি করে ধরে আছে বুকের ভিতরে। কোনও কথা জোগাচ্ছে না মুখে। কিন্তু বুকের মধ্যে অনেক কথার ঠেলাঠেলি। কিছুতেই ভাল লাগছে না, সায় দিতে পারছে না এই দুজনের কথায়। কিন্তু ওরাই রাজেনের বেশি কাছাকাছি, বেশি আপন। চেনে ওরাই ভাল। ভেবে পাচ্ছে না, কেন ওরা শুধু অঘটন দেখছে। ওদের কাছ থেকে ওদের চোখ দিয়েই দেখেছে সুমিতা রাজেনকে। তবে দুজনের কেন এত সংশয়। সন্দেহ, করুণা।
মৃণাল বলল, শুধু এইটুকু ছাড়া আরও কিছু আছে বলে আমার মনে হয়।
মনের দিকটাও ভেবে দেখতে হবে তোমাকে। সেদিক থেকেও রাজেন বোধ হয় ফ্রাসট্রেটেড।
চাপা অনুসন্ধিৎসার ভ্রূ কুঁচকে তাকাল সুগতা। বলল, বুঝলুম না।
মৃণাল সুগতার দিকে একটু ঢলে পড়ে নিচু গলায় বলল, তোমার কথা বলছি। সেটাও
কথাটা হেসে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতে গিয়েও সুগতার মুখে একটু রং ধরে গেল। সন্ধ্যার এই আবছায়াতে দূর আকাশে চাপা পড়া রক্তাভার মতো অদৃশ্য হয়ে রইল সেটা। আসলে ওই রংটুকুই সুগতার আত্মহারা মনের অনিয়ন্ত্রিত বিশ্বাস। উড়িয়ে দিতে কিংবা দুঃখ পেতে গিয়ে ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম অনেকখানি বিজয়িনী করল ওকে মৃণালের সামনে। এ যদি নিষ্ঠুরতা, তবে সেটা এই জটিল বিশ্বপ্রকৃতির হাত-ধরা।
অসংশয়ের মধ্যেও একটু সংশয়ের মিশেল দিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে বলল সুগতা, তা নাও হতে পারে।
মৃণাল বলল, আমার তাই মনে হয় সুগতা। হয়তো সেইটিই আসল।
সুগতা ওর মুখে হাসির শাণ চাপতে চাইল বিষণ্ণ হয়ে। মেয়ে মনের এটা একটা অমোঘ তত্ত্ব কিনা জানা নেই। কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সুমিতা। নিজের মনের কাছে কোনওই যুক্তি নেই। তবু একটি বিচিত্র বিক্ষুব্ধ বেদনা ওকে মারছে অন্তরে অন্তরে। উদগ্রীব হয়ে উঠল পালাবার জন্য।
সামনেই, স্টপেজ থেকে বাস ছেড়ে যাচ্ছিল। কন্ডাক্টরকে হাত দেখিয়ে সুগতাকে বলল, মেজদি তোমরা এসো, আমি যাই। আমি আর হাঁটতে পারিনে।
বলে বাসে উঠল গিয়ে চোখের পলকে। কী যে ঘটে গেল। ঘণ্টার দুটি টিং টিং, তারপর এক্সিলেটরের চাপে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে বাসটা বেরিয়ে গেল।
সুগতা একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল?
মৃণাল হাত ঘুরিয়ে বলল, দেবা না জানন্তি।
দুজনেই এক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে রইল। মৃণাল বলল, রমণীর মন, সহস্র বর্ষেরি সখা সাধনার ধন। কিছুই বোঝবার উপায় নেই। হয়তো মনে পড়ে গেছে, কোথাও অপেক্ষা করতে বলেছে আশীষকে। কিংবা রাজেনের কথা ভাবছিল।
সুগতার ভ্রূজোড়া ঢেউ দিয়ে উঠল পাখির পালকের মতো। বলল, রাজেনের কথা?
মৃণাল বলল, অসম্ভব কী? কেমন ত্রস্ত হয়ে ছুটে এসেছিল দেখলে তো।
–তাতে চলে যাবার কী আছে।
–ভাল লাগছিল না হয়তো আমাদের কথা।
সুগতা কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে হেঁটে যেতে যেতে বলল, কিন্তু রাজেনকে যে রুমনি খুব ভক্তি করে, সেটা বোঝা গেল।
মৃণাল নিচু গলায় বলল, তুমিও করতে।
হেসে বলল সুগতা, সবাই করত।
-তা ঠিক। কিন্তু ভক্তি জিনিসটা সাংঘাতিক। বড় ভয় করে। কোনদিক দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে কোথায় নিয়ে যাবে, কোনও ঠিক নেই।
নিশির ডাকের মতো, না?
–তার চেয়েও সাংঘাতিক। চোরাবালির মতো। পড়লে আর রেহাই নেই।
চোখের কোণে কটাক্ষ করে হেসে বলল সুগতা, ভয় হচ্ছে নাকি?
–তোমার বোনের জন্যে?
-বোনের জন্যে ভয় আর কী! সেদিকে তো আশীষ আছে। ভক্তি নিয়ে ওকে কেন ঘুলিয়ে দিচ্ছ। তোমার নিজের কথা বলো।
মৃণাল বলল, এখানে সুগতা আছে।
হেসে উঠে সুগতা ঘন হয়ে এল মৃণালের কাছে। বলল, খুব যে।
তারপর হঠাৎ শীতার্ত শব্দ করে বলল, ইস। বড় শীত করছে মৃণাল।
মৃণাল হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সুগতাকে। বলল, তেমন শীত কোথায়?
সুগতা লজ্জায় জড়সড় হয়ে উঠল এই জনারণ্যে। বলল, ও কী হচ্ছে। হাত ছাড়ো। এখুনি কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে হয়তো।
হলেও অন্যায় বলবে না। একটু বেহায়া বলবে হয়তো।
–সেটা বুঝি খুব ভাল।
চৌরঙ্গিতে এসে পড়েছে ওরা ততক্ষণে। মৃণালের নজরে পড়ল দুরের নিশি-পাওয়া অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মাঠটা। বলল, চলো একটু মাঠের দিকে ঘুরে আসি।
শীত লেগেছে সুগতার। তবু শহরের গরম ছেড়ে শীতার্ত মাঠের দিকেই গেল দুজনে। শীত ধরেছে বলে একটু ঘুরে যাবে শীত গুরগুরোনি মাঠে। এমনি বিচিত্র মানুষের মন, বিচিত্র সময়ে।
.
বাসে উঠে সহসা লজ্জায় একমুহূর্ত আড়ষ্ট হয়ে রইল সুমিতা। কিন্তু ওর মন মানেনি। কী করবে। রাজেন ওর কেউ নয়, কিছুই নয়। অনেক দিনের দেখা, অনেক দিনের বিশ্বাস, মানুষ হিসেবে রাজেনকে অনেকখানি বড় করে দেখেছে। বিশ্বাস দিয়ে হয়তো আরোপ করে বসেছে একটা অতি কিছু। সেই মানুষেরই দুর্ঘটনা শুনে এসেছিল ছুটে। আর কী। আর তো কিছু নয়।
কিন্তু মেজদি আর মৃণালের এই সন্ধ্যার পথে, গায়ে গায়ে, অমন মিঠে মিঠে কথায় রাজেনের বিচারে কনকনিয়ে উঠেছিল বুকের মধ্যে। ক্ষুব্ধ যন্ত্রণায় ভরে উঠেছিল মন। ওরা না শোনাতে চাইলেও কানে এসে ঢুকছিল ঠিকই। কী হবে অকারণ ও সব কথা শুনে। সুমিতার কী আসে যায়। বরং রাজেনের নির্ভীক মুখটি মনে করে, নিজেরই কেমন অপমান বোধ হচ্ছিল। রাজনীতি, শক্তি, ইনস্যানিটি, সহজে কেমন করে ধুলোয় লুটিয়ে দেবে ও একটি মানুষকে। রাজেনের সামনাসামনি তো ওদের এত কথার একটু ইশারাও দেখা যায়নি। নিজেই তো দেখেছে সুমিতা, অজয় পালিয়ে গেল। বারে বারে কেন এখন থেকে বিপদে পড়বে রাজেন। এ বিচার যুক্তি, কোথা থেকে পেল মেজদি।
আশ্চর্য! মেজদিও যেন কত বদলে যাচ্ছে। এ যেন সেই চেনা মেজদি নয়। অন্য কোনও মেয়ে। সেই দীপ্তিময়ীর সঙ্গে এই তরল প্রেমময়ীর কোনও মিল নেই যেন। তবে কি ওটা ফাঁকি।
নিজেকে ধমকে ধিক্কার দিয়ে উঠল সুমিতা। ওদের বন্ধুর বিচার ওরা করছে। সুমিতা এসেছে। পালিয়ে ওর ভাল লাগা না-লাগা নিয়ে। কী হবে তার এ সব ভেবে। এদিকে সন্ধ্যা যাচ্ছে গড়িয়ে। আশীষ বসে আছে হয়তো পথ চেয়ে।
তবু ওর বুকের মধ্যে ভার হয়ে উঠছে রাজেনের সেই চাদর জড়িয়ে চলে যাওয়ার ভঙ্গিটি মনে করে। তীক্ষ্ণ ঠোঁটে সেই সুদূর অস্পষ্ট হাসিটি স্মরণ করে। চকিত বিদ্যুৎ চমকে মনে হল, রাজেনেরও কি কোনও বন্ধু নেই। মনে মনে সেও কি নির্বান্ধব।
বাড়ি এসে দেখল সুমিতা, কেউ নেই। বিলাসকে জিজ্ঞেস করল, বাবা আসেননি? বিলাস পকেট থেকে একটি চিঠি বার করে বলল, না, আশীষবাবু এসেছিলেন। আপনাকে একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।
চিঠি নিয়ে পড়ল সুমিতা।শুনলুম বেরিয়ে গেছ; বোন ও ভাবী ভগ্নিপতির সঙ্গে। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে কোনও আশা পেলুম না। আজ তাই যাচ্ছি একটু আমাদের পুরনো আড্ডায়। যদিও মন ভরে না সেখানে, তবু নিরুপায়।…
জানে সুমিতা, খুব না হলেও এ বিশ্বসংসারে সেইটিই একমাত্র আড্ডা আশীষের। অধিকাংশই কবি ও সাহিত্যিক। ইংরেজি পত্রিকার অল্পবয়সি দু-একজন। শখ করে একটু আধটু বিয়ার খায়। তা ছাড়া চা সিগারেট পাইপ টোবাকো। ইয়েটস এলিয়ট থেকে কন্টিনেন্টের নতুন সাহিত্য কিংবা এরেনবুর্গের বিশালতা, হাওয়ার্ড ফাস্টের সুদুর ঐতিহাসিকতা পাক খায় টোবাকোর ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়। হাসিটা ফেটে পড়ে দেশের কবি ও সাহিত্যিকের প্রসঙ্গে। সকলেই যেন আশীষের এপিঠ-ওপিঠ। চরিত্রগত একটি আশ্চর্য মিল আছে সকলেরই।
কথাগুলি সুন্দর, যেন ধবধবে ফরসা। অনেক তথ্য আর তত্ত্ব নিখুঁত ছুচের কাজের মতো ফুটে থাকে ওদের কথায়। তবু টোবাকোর গন্ধে কিনা, কে জানে কথাগুলি ধীরে ধীরে কেমন যেন রুদ্ধশ্বাস করে তোলে। দিগন্ত এর সুদূর, কিন্তু এদের কথায় মনে হয়, সেটা নির্বাসনের অরণ্য।
সেখান থেকে বেরিয়েও আশীষ অতৃপ্ত। বলে, এখানেও আমার বড় বিশ্রী লাগে সুমিতা। সবাই এত বেশি জানার ভান করে। আসতে ইচ্ছে করে না।
সুমিতা স্পষ্ট দেখতে পেল, সেখান থেকে বেরিয়েও কেমন একা একা ফিরবে আশীষ। আড্ডাতে গিয়েও কথা বলবে, বসে থাকবে সেই একা মন নিয়ে, বিদ্রূপ-ঢুলুঢুলু চোখে।
বিলাস চলে গেছে ওর কাজে। ফাঁকা নিঃশব্দ বাড়ি। কলকাতাকে এত আশ্চর্য নিস্তব্ধ মনে হয় এক একসময়।
হঠাৎ মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে উঠল সুমিতার। টনটনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে আশীষের জন্যে। যেন দেখছে দিব্য চোখে, অস্থির ব্যাকুল হয়ে আশীষ তাকিয়ে আছে বাইরের দরজাটার দিকে। আশীষের ভাষায়, ভয়ংকর দরজা ফাঁকা, শব্দহীন, কেউ আসে না। তারপর উঠে চলে যাচ্ছে নিরাশ হয়ে। একা একা, লাইটপোস্টের ছায়ায়।
ছায়ায়, ছায়ায়, একা একা ভেসে উঠল একই সঙ্গে সেই চাদর জড়ানো মূর্তি। যেন সিনেমার পরদায় ডিসলভ করে আর একটি ভিন্ন ছবি দেখছে সুমিতা। এই দ্বিমুখী ভাবনায় কয়েক নিমেষ অর্থহীন স্তব্ধতায় ভরে গেল সুমিতার মন। তারপর নিজের মনেরই হঠাৎ ঝাঁকুনিতে চারদিকে তাকিয়ে অন্ধকার দেখতে লাগল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠল। একদিন ও ভাবত, মানুষের নিজের মধ্যে কতগুলি অসহজআর সর্বনাশ আছে জমে। জীবনকে সে কখনও সোজা পথে যেতে দিতে চায় না। এখন সে কথাটি মনে পড়ছে না। ভাবছে, কেন এক নিরর্থক অবোধ কষ্ট ওকে ঘিরে আসছে।
পট পট করে ঘরে বারান্দায় সব আলোগুলি জ্বেলে দিল সুমিতা। ছুটে আয়নার সামনে গিয়ে, কপালের চুল সরিয়ে আসতে গিয়ে আবার দাঁড়াল। রিবন বাঁধা বেণীটা বুকে ফেলে, চাঁদরের ভাঁজে ঢেকে তরতর করে চলে গেল বাইরের ঘরে। যেন একটি সাপের ফণা বুকে চেপে ধরে ছুটেছে। ঠিক। করেছে মনে মনে, যাবে আশীষের কাছে, সেই আড্ডায়। যাবেই, নইলে ও কিছুতেই পারবে না।
দরজার কাছে আসতেই দেখল সুজাতা ঢুকছে। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। চোখের কোলে গভীর খাদ। কিন্তু খাদ পেরিয়ে দু চোখের দৃষ্টি তীব্র ও তরল। সুমিতাকে বলল, কোথায় যাচ্ছিস।
কী মনে হল সুমিতার। একেবারে সরলভাবে বলল, যাব না কোথাও।
বলে ও যেন অবাক হয়ে দেখতে লাগল বড়দিকে। ঠোঁটের রং শুকিয়ে কালির আভাস ফুটেছে। লেডিজ কোটের বুকটা হা-হা করছে খোলা। শাড়ির আঁচল গেছে বুকের কোন সীমানায় হারিয়ে। স্তনান্তরের গভীর খাদে সোনার হারটা অনেকখানি দেখা যাচ্ছে মরা বিছের মতো।
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলল, বাড়িতে কেউ নেই বুঝি?
চেহারায় যত এলোমেলো, অবসন্ন, কণ্ঠে তত নয়। সুমিতা বলল, না। বাবা তো সেই অনেকক্ষণ বেরিয়েছেন, ফেরেননি।
জুতোর হিল টক টক শব্দে ধীরে ধীরে দরজার দিকে যেতে যেতে আবার বলল, ঝুমনো কোথায়?
শরীরের রেখায় রেখায় নিপাট বসা হালকা লাল কোটটা দুলছে বড়দির। সুমিতা বড়দির পিছন পিছন এগিয়ে বলল, মৃণালদার সঙ্গে বেরিয়েছে।
আর কোনও কথা নেই। সুজাতা পরদা সরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। সুমিতাও হাজির হল সেখানে।
সুজাতা পিছন ফিরে বলল, কীরে রুমনি? কিছু বলবি?
সুমিতা অসংকোচ হওয়ার চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ, বড়দি তোমার সঙ্গে কি রবিদার কখনও দেখা হয় না?
চমকে উঠল সুজাতা। সহসা যেন অর্থহীন শূন্যতায় অবাক হয়ে বলল, কে?
রবিদা।
সুপ্তোত্থিত বিস্ময়ে যেন জেগে উঠল সুজাতা ঘুমের ঘোরে। কোটের মুখ দুটো বন্ধ করে তাকাল এদিক-ওদিক। বলল, কোথায়? ভয় পেল সুমিতা। কেন মরতে এ প্রসঙ্গে ভেসে এল ও। বলল, কোথায় তা জানিনে। তোমার সঙ্গে দেখা হয় কি না, জিজ্ঞেস করছিলুম।
সুজাতা এক মুহূর্ত নির্বাক থেকে কোট ছেড়ে দিয়ে বলল, না তো! কেন?
কেনর ভয়টাই সুমিতার বেশি। কিন্তু একটা চাপা জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল সুড় সুড় করে বেড়াচ্ছে। কদিন মনের মধ্যে। এই ভাবনাই হঠাৎ ওকে বিপথগামী করেছে দরজা থেকে। বলল, মেজদির বিয়েতে রবিদাকে ডাকতে যাব ভাবছিলুম।
ততক্ষণে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছে সুজাতা। বলল, কেন, চিঠি দেওয়া হয়নি?
–তা তো হয়েইছে। কিন্তু বড়দি, রবিদা তো আর আসেন না আমাদের বাড়িতে। সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে কোট খুলল সুজাতা। পিঠে ছড়ানো কোঁচকানো আঁচলের ওপর পড়ে আছে রুক্ষ বেণী।
সুমিতা আবার বলল, কেন আসেন না, কে জানে। বাবা খোঁজ করেও দেখা পাননি। ভাবছি, আমি কাল যাব।
দূরাগত শব্দ এল সুজাতার, যাস।
মুরগির মতো পা টিপে টিপে এসে যেন অনেক সাহস সঞ্চয় হয়েছে সুমিতার, বলল, তুমি গেলে সবচেয়ে ভাল হয় বড়দি।
আবার চমকে উঠল সুজাতা। প্রায় রুদ্ধশ্বাস গলায় বলল, আমি?
সুমিতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, বলছিলুম তোমার যদি সময় থাকে।
সুমিতার এ ছলনার ধার দিয়েও গেল না সুজাতা। হঠাৎ বিনুনি খুলতে লাগল বেণীর, বুকের ওপর টেনে। সেদিকে চোখ রেখেই বলল, আমি গেলে রবি আসবে না কখনও। বরং তুই যাস।
বলতে বলতে চোখ দুটি জ্বালা করে উঠল সুজাতার। আসবে না, কে জানে। চোখের জ্বালাটা সেজন্যে নয়। ভাবল, একজন যখন আসে না, তখন অন্য কত জনে আসে।
.
আফিমের নেশার মতো বান্ধবী অমলা। সেও আজ কোন সর্বনাশের অপ্রতিরোধ্য চোরাপথে নিয়ে চলেছে টেনে। সে সৌরজগতের অনেকখানি জুড়ে কারদেজোর ম্যানেজার শুভেন্দু। বড় বিস্ময়, লজ্জা, অপমান সুজাতার, সেই মণ্ডলের একদিকে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে আজ গিরীন। দেহের সমস্ত রক্তবাহী শিরাগুলি অমলা তুলে নিয়েছে হাতে, ছুটেছে নিজের পথে। শুধু মন নিয়ে দাপাদাপি করছে সুজাতা। কিন্তু বিষ আছে রক্তের মধ্যে। সেই রক্তেরই কানে কানে অমলা বলছে দিবানিশি, রাক্ষুসী, কোনদিকে ফিরে তাকাচ্ছিস তুই। কার পরোয়া করছিস তুই। এইভাবেই সম্মান করতে হবে। পোষা জীবের মতো এমনি করেই ওদের রাখতে হবে পায়ে পায়ে।
অমলা বলল, ওরা বউকে চায় না। বউকে ওরা নাগরীর বেশে চায় পথের হুল্লোড়খানায়। ধরে বাঁধ। থেতলে মার।
ভয়ংকরী ক্রোধে জ্বলে অমলা লেলিহান হয়ে আগুনে। গলিত বিন্দু বিন্দু লোনা জলটুকু শুধু পায় না দেখতে। কিন্তু সুজাতা তো জানে, শুভেন্দুর কাছে অমলা ছিল একদিন একেশ্বরী। অস্পষ্টভাবে মনে হয়েছে, হয়তো মেশামিশি হয়েছে গিরীনের সঙ্গেও। বলে, ঘরে শোধ নেওয়া যায়নি, বাইরে ওরা সুদ সুদ্ধ শোধ দিতে পিলপিল করছে বাদলা পোকার মতো।
হয়তো ঠিক। রক্তের মধ্যে জ্বলে ধিকিয়ে ধিকিয়ে। কিন্তু অমলার মতো দিগন্ত দগ্ধানো ভয়ংকরী যে কিছুতেই হতে পারে না সুজাতা।
অবাক হয়ে দেখছিল সুমিতা, বড়দির মুখটা ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ছে। বিনুনি খুলতে গিয়ে হাত দুটি ক্রমে শিথিল হয়ে পড়ছে।
এমন সময় এলেন মহীতোষা-রুমনো, রুমনো সাহেবা।
বলতে বলতে এসে পড়লেন এই ঘরেই। বললেন, এই যে, উমনোও আছিস। দুজনেই সচেতন। হল। ফিরে তাকাল বাবার দিকে। সুজাতা নত চোখেই বলল, কী বলছ?
একটি জুয়েলারি বাক্স খুলে হেসে বললেন, দ্যাখ তো, ঝুমনোর জন্যে এই নেকলেসটা এনেছি। অর্ডার দিয়েছিলুম আগেই। লোকগুলি ভারী ফাঁকিবাজি। কাজটা শেষ করেও রাখেনি। বসে, শেষ করিয়ে নিয়ে এলুম। কেমন, ভাল?
সুমিতা বলল, বেশ সুন্দর হয়েছে বাবা। কিন্তু, সেই এক প্যাটার্ন। বড়দিকেও তুমি বিয়ের সময় ঠিক এমনি একটা নেকলেসই কিন্তু দিয়েছিলে, না বড়দি?
এক মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ কোন অদৃশ্যে এল একটু ছায়া ঘনিয়ে। তারপর আমতা আমতা করে, চোরা চোখে এক বার সুজাতার দিকে তাকিয়ে মহীতোষ বললেন, হ্যাঁ, মানে উমনো জানে, এই প্যাটার্নটা আমার বড় ভাল লাগে। তোদের তিন জনকেই এতে বেশ মানায়।
বলতে চাননি মহীতোষ। শুধু ভেবেছিলেন মনে মনে, একটা নেকলেস অশান্তি এনেছে। আর একটা সব অশুভ অশান্তিকে দেবে দূর করে। কোন সংস্কার বশে যে এমনটি ভেবেছিলেন, নিজেও জানেন না। সে বুঝি শুধু পিতৃস্নেহের একটি ইচ্ছে।
.
খুব সকালবেলা বেরিয়ে পড়ল সুমিতা। আজ আর শুধু সুগতার বিয়ের নিমন্ত্রণেই রবিদাকে চাইনে ওর। চাই অন্য কারণে। আর কোনও ফাঁকি নেই সুমিতার কাছে। একটি জিনিস আবিষ্কার করছে ও নিরঙ্কুশভাবে। কোনও সন্দেহ সংশয় নেই। তাই যত সংকোচের বালাই আজ ঝেড়ে ফেলেছে। কিছু না হোক সাহস করে আজ সেই কথাটিই বলতে হবে রবিদাকে।
বেরুবার আগেই স্থির করে নিয়েছে সুমিতা, এক বার দেখা করে যাবে আশীষের সঙ্গে। ডাকবে আশীষকে, সঙ্গে যদি যায়।
এর মধ্যেই পুব দিকের আকাশ গেছে সোনার পাতে মুড়ে। নবান্ন নেই কলকাতায়। তবু এই অ্যাসফল্টের রাস্তায়, ইট-কংক্রিটের রাজ্যে, বিদ্যুতের তারে বাঁধা নগরে, শেষ অগ্রহায়ণের রোদ নিয়ে এসেছে নতুন রং। বাতাসে বিচিত্র আমেজ।
শীতও মন্দ নয়। বাতাসটাও আজ হিম ঠোঁটে নিয়ে এসেছে গড়িয়ে উত্তর থেকে। অ্যাভিনুর গাছগুলি কেঁপে কেঁপে কুঁকড়ে উঠছে ঠাণ্ডা বাতাসে।
সাজবার অবকাশ হয়নি সুমিতার। জামাকাপড়টা বদলানো হয়েছে মাত্র। চোখে মুখে একটু জল দিয়ে কোনও রকমে একটু চিরুনি ঠেকানো। পাউডার পাফ বুলোনো হয়েছে। কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে ছোট ব্যাগ।
দরজা খোলা পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল সুমিতা। বারান্দায় দেখা হয়ে গেল আশীষের মায়ের সঙ্গে। উলের চাদর জড়িয়ে বসে ছিলেন একটি চেয়ারে। বয়সে বৃদ্ধা-ই। কপালে সিঁদুর নেই, সিঁথিতে আভাস। সিঁথি এখন টাক, সাদা চুল পাতা পেড়ে আঁচড়েছেন এই সকালেই। হাতে ছুরি, টেবিলের উপর প্লেটে বড় একখানি কেক।
সুমিতাকে দেখে প্রথমটা একটু অবাক হলেন। তারপর একটু হাসির আভাস ফুটিয়ে বললেন, সেন্টুর কাছে?
সুমিতা বলল, হ্যাঁ।
উনি কেক কাটতে লাগলেন। তারপর সুমিতার দৃষ্টি অনুসরণ করেই তাকালেন আশীষের বন্ধ দরজার দিকে। বললেন, ওর ঘুম ভাঙতে তো একটু দেরি হবে। ডাকলে বড় রেগে যায়।
তা হয়তো যায়। কিন্তু ডাকছে তো সুমিতা। সেটা উনি কি বোঝেন না। আড়ষ্ট হেসে, নখ দিয়ে ব্যাগ খুঁটে বলল সুমিতা, একটু দরকার ছিল।
আশীষের মা দেখলেন সুমিতাকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপর প্লেটসুদ্ধ কেকটি নিয়ে উঠে বললেন, বসো তুমি, আমি দেখছি।
বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন পরদা সরিয়ে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি লেগে ছিল। সেটুকু ভাল ভেবে কি মন্দ ভেবে, বোঝবার উপায় নেই। এর আগেও একই রকম মনে হয়েছে সুমিতার।
আশীষের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে অ-সবুর হয়ে উঠছিল মন। এ দরজাটাও ভয়ংকর। যেন কোনওদিন খুলবে না। ঠিক এমনি করেই কাল বসেছিল আশীষ। বৃথা তাড়া মনের। আজ একটু শোধ যাবে বইকী।
কিন্তু শোধ যাওয়ার অনেক আগেই দরজা খুলল আশীষ। বোঝা গেল, ঘুম থেকে উঠে কোনও রকমে চোখ ঘষে, জামা গায় দিয়ে বেরিয়েছে। হেসে ডাকল, এসো।
ঘরে গেল সুমিতা। দরজা ভেজিয়ে দিল আশীষ।
সদ্য ঘুমভাঙা ঘোট চোখ দুটি আশীষের টলটলে অথচ বোকার মতো দেখাচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে কেমন করে যেন আপনা-আপনি ঢুলুঢুলু হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে শুধু দেখতে লাগল সুমিতাকে।
সুমিতা ব্যাগটা বুকে চেপে বলল, কী দেখছ?
–তোমাকে। বাংলায় একটা কবিতা আছে জান, প্রভাতে উঠিয়া আজ দেখেছি তোমাকে, দিনটি–
সুমিতা হেসে উঠে বলল, কবিতা নয়, ওটা পদাবলী গান। প্রভাতে উঠিয়া যবে ও-মুখ দেখিনু, দিন যাবে আজি ভাল।
আশীষ ছলনা করেনি। জানে না সত্যি। বলল, ও-ই হল। এই সব লেখকের বেশ চুটিয়ে প্রেম করবার একটা ক্ষমতা ছিল।
সুমিতা বলল, আর এখন বুঝি তা কেউ পারে না। সে যাক, তুমি পড়াশুনা কর কখন? পরীক্ষা-টরিক্ষা দেবে না?
আশীষ বলল, ভেবে দেখতে হবে। জীবনে একটা মোেড় নিতে চাই। সে সব পরে আলোচনা হবে। তুমি বসো।
না, আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে। কালকে তুমি বাসা থেকে চলে এসেছ, তাই সকালবেলাই এসেছি।
–পুষিয়ে দিতে?
বলতে বলতেই বিদ্রুপে বেঁকে উঠল আশীষের ঠোঁট। বলল, সেজন্য আমি মোটেই কিছু ভাবিনি। কিন্তু যে জন্যে গেছলে, সেটা শুনেই খুব অবাক হলুম।
কেমন একটা অজানিত ভয়ে শিরশির করে উঠল সুমিতার বুকের মধ্যে, বলল, তুমি জান?
জানি বইকী। অজয়দের কথা আমি বাদই দিলুম। রাজেনের গেঁয়ো ভাঁড়ামিটা ভেবেই আমি হেসে বাঁচিনে।
সুমিতার বুকের ভয়টা হঠাৎ দূর-শব্দ পাওয়া সাপের মতো নড়ে চড়ে উঠল। বলল, কেন!
আশীষ বলল, এই তো আমাদের ছাত্র-আন্দোলনের নমুনা, এই সব নেতা। কেবল চোখে চোখে, ভাবে, কথায় ভঙ্গি সর্বস্বতা। আসলে এই সব মাল।
কিন্তু আশীষ সিরিয়স হয়ে উঠেছে। বলল, আমি জানি, অনেক দিন থেকে আছি সঙ্গে। শুধু একটা উচ্ছ্বাসের ফানুস, হয় রাগের, নয় আনন্দের, তারপর সবটা মিলিয়ে খানিকটা হুড়োহুড়ি দাপাদাপি। যন্ত্র ওদের একটাই। প্রাণ যা চায়। বিদ্যাবুদ্ধির কোনও দরকার নেই। কথা বলে দেখ, সবাই চিন্তিত, ব্যস্ত, না জানি কী ঘটিয়ে দেবে ওই নওজোয়ানেরা। এদের কাউকে তুমি ইউরোপে পাঠাতে পার তোমার প্রতিনিধি করে। হয়তো দু-এক বছরের মধ্যে তা-ও যাবে। সেই ভেবেই আমার বড় ঘৃণা। লজ্জাও বটে।
ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা। কথা বলবে না সুমিতা। কিছুতেই কোনও জবাব দেবে না। যত ব্যথা করুক ঠোঁট, ঠিক এমনি নিঃশব্দ স্মিতহাসিটুকু ধরে রাখবে প্রাণপণে।
আশীষ আবার বলল, শুনলে তুমি অবাক হবে সুমিতা। লন্ডনের পথে ইউরিনালের লক করা দরজায় এক আনার মতো কয়েন ঢুকিয়ে দিলে দরজাটা আপনি খুলে যায় একজনের জন্যে। বেরিয়ে এলে বন্ধ হয়ে যায়। শুনলুম, চারটি বাঙালি ছেলে ওই একটি কয়েন ঢুকিয়ে, দরজাটি ঠেলে রেখে একে একে কাজ সেরেছে। আর বোকা বলে ঠাট্টা করেছে সাহেবদের।
বুকের কুণ্ডলমুক্ত ফুঁসে-ওঠা সেই সাপটাকে পারছে না সুমিতা দাবিয়ে রাখতে। পারছে না, তবু ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, এ সবের অনেক জবাব আছে আশীষ। কয়েক জনের খেলা নিয়ে তুমি গোটা দেশের বিচার করতে চাও?
–এ কেমন খেলা? সভ্যতা নিয়ে খেলা?
না হয় গুটিকয়েক ছেলের অসভ্যতা-ই। তার চেয়েও খারাপ কাজ তো সাহেবরা করছে এদেশে।
–ভাল কাজ তার চেয়েও বেশি করেছে।
–সেটা বিচার সাপেক্ষ। কিন্তু ছাত্রদের ওইটাই একমাত্র পরিচয় নয়।
কিন্তু কিছুতেই বলতে ইচ্ছে করছে না এ সব কথা। কেন এ সব কথা তুলছে আশীষ।
থাক না এ সব। ও যে ব্যাকুল হয়ে এসেছিল ছুটে, আশীষকে কষ্ট দিয়েছে বলে। আশীষের একলা জীবনের কথা মনে করে এসেছিল। সুমিতার মুখ লাল হয়ে উঠেছে উত্তেজনায়। তবু মিনতি-ভরা হাসি নিয়ে বলল, থাক না আশীষ এ সব প্রসঙ্গ।
আশীষ বলল, হ্যাঁ থাক। আমি তোমাকে শুধু এদের মিথ্যে ফাঁকিবাজিগুলি বোঝাতে চাইছিলুম। এরা কী! তার মধ্যে রাজেনের মতো চণ্ডাল তো থাকবেই। শুনি এখন সে শ্রমিকদের কাছে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী জান, যুবক গরিব হলেই এদেশে রাজনীতি করতে আসে। যেন ওটা ওদেরই একচেটিয়া। গরিবের ছেলে, সে গুণ্ডা বদমাশ, মূর্খ, যা খুশি তাই হোক। রাজেন যদি অর্থবান হত…
শুনতে পেল না আর সুমিতা। যত রুষে উঠছে মনে, ততই কান্না পাচ্ছে। রাগ তো হচ্ছে না পুরো। শুধু অসীম করুণায় ও বেদনায় কান্না পাচ্ছে এখন। পাগলামি, ভয়াবহ একটা পাগলামি। কী দিয়ে তুষ্ট হবে এ-ছেলে। মানুষ যখন, তখন ক্ষোভের কারণ আছে নিশ্চয়। কিন্তু কোথাও তার তৃপ্তি থাকতে হবে, হাসতে হবে, বাঁচতে হবে।
কিন্তু তর্ক কিছুতেই আসছে না সুমিতার। ও শুধু চাপা গলায় ডাকল, আশীষ।
থামল আশীষ। হঠাৎ যেন ঘাবড়ে গেছে, একাকী করুণ বিষণ্ণ ভাবটা এসেছে ফিরে। দু হাতে জড়িয়ে ধরল সুমিতার একটি হাত।
শান্ত মমতায় হাসল সুমিতা। গ্রাস করতে চাইল সব ক্ষোভ যন্ত্রণা।
আশীষ বলল, তুমি রাগ করছ সুমিতা।
সুমিতা বলল, না। থাক ও সব কথা। তোমার কাছে এসেছি। আমি যাব এক্ষুনি। তুমি যাবে আমার সঙ্গে।
–কোথায়।
–রবিদার কাছে।
আশীষ এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, সেই একই মানুষের দল। আমার ভাল লাগে না সুমিতা। কেমন যেন গুরুগম্ভীর ক্লাউন মনে হয়–
থাক থাক।
সুমিতা ব্যাগটা বুকে চেপে বেরিয়ে যাবার উপক্রম করল।–থাক, জোর করছিনে তোমাকে।
–কিন্তু সুমিতা—
ফিরে তাকাল সুমিতা। আশীষ দু হাতে বেষ্টন করল ওকে। চোখে ওর নেশার রক্তাভা, অভুক্ত বিষণ্ণতা।
এই, শুধু এইটুকু ভালবাসে আশীষ, বাসুক। কোনও কথা বলে না। যা খুশি তাই করুক, যা খুশি। মুখ বাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল সুমিতা, কী বলছ?
আশীষ চুম্বন করল সুমিতাকে। গ্রীবাগ হাত ভরে দিল।
তারপর নিশ্বাস নিতে গিয়ে নিরস্ত হতেই সুমিতা বেরিয়ে এল। বাইরে এসে বলল, যাচ্ছি। এসো সন্ধ্যাবেলা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল, এখুনি ফেটে পড়বে হৃৎপিণ্ড। চিৎকার করে উঠবে হয়তো, একটা ভারী ইঞ্জিনের ব্রেক কষার মতো। যেন আগুন লেগেছে, গায়ে নয়, গভীর প্রদেশে। যত মন উথালিপাথালি, তত সে রাগছে। এমনি করে কি পালাতে হবে ওকে সবখান থেকে।