৫. তুলসীবাবুর বাড়ি

০৫.

পরের দিন কিকিরা এলেন তুলসীবাবুর বাড়ি। সঙ্গে তারাপদ। বিকেল শেষ করেই এসেছেন।

পটুয়াটোলা গলির যে বাড়িতে তুলসীবাবু থাকেন–তার চেহারা দেখলে মনে হয়, বাড়িটা এই বুঝি ভেঙে পড়বে। ওই বাড়িতেই তিন-চার ঘর ভাড়াটে। তুলসীবাবু থাকেন দোতলার একপাশে।

তুলসীবাবু যে-ঘরে থাকেন সেই ঘরেই কিকিরাদের বসতে হল। একটা খাট, টেবিল, চেয়ার আর বেতের মোড়া। কাঠের এক আলমারি একপাশে। ঘর ছোট, জানলা মাঝারি। দরজা-জানলার পাল্লায় রং বলে কিছু নেই আর। দেওয়ালে চুনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।

তুলসীবাবু কলঘরে গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন।

মানুষটির যত না বয়েস হয়েছে তার চেয়েও বুড়োটে দেখায়। রোগা চেহারা, মাথার চুল সাদা, চোখে গোল-গোল চশমা। পরনে ধুতি আর গায়ে ফতুয়া।

পাখা চলছিল, আলোও জ্বালা ছিল।

কিকিরারা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।

তুলসীবাবু ভাল দেখতে পান না। ছানিকাটানো চোখটা প্রায় অন্ধ। ঠাওর করে দেখতে-দেখতে বললেন, “কে আপনারা?”

কিকিরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। বললেন, লোচনবাবুর মুখ থেকে ওঁর কথা শুনে তাঁরা আসছেন।

তুলসীবাবু সরল মানুষ, ঘোর-পাঁচ বড় বোঝেন না। বললেন, “বড়দা পাঠিয়েছে?”

কিকিরা বললেন, “না, তিনি পাঠাননি। তাঁর মুখে আপনার কথা শুনে আসছি।”

“ও! তা আমি কী করতে পারি?”

“আপনি খবরের কাগজ দেখেন?”

“দেখি। পড়তে কষ্ট হয়। আতস কাঁচ চোখে লাগিয়ে পড়ি খানিকটা।”

কিকিরা কাগজের নাম বললেন। পকেটে ছিল একটা পুরনো কাগজ। বললেন, “লোচনবাবু কাগজে একটা নোটিস ছেপেছেন। জানেন আপনি? না, পড়ব! কাগজ সঙ্গে করে এনেছি।”

তুলসীবাবু মাথা নাড়লেন। “আমি দেখেছি। প্রাণকেষ্টও আমাকে বলেছে। “

“প্রাণকেষ্ট কে?”

“ছাপাখানায় কাজ করে। পিয়ন। সে কাছাকাছি থাকে। প্রায়ই আসে আমার কাছে। সে বলছিল।”

“তা হলে তো আপনি সবই জানেন।”

“ওটা জানি।”

“লোচনবাবু বলছিলেন, মোহন নাম নিয়ে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।

মাথা নাড়লেন তুলসীবাবু, “এসেছিল। আমি তো একটা চিঠি লিখে প্রাণকেষ্টর হাত দিয়ে বড়দাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“যে এসেছিল সে কি মোহন?”

তুলসীবাবু খাটের ওপর বসেছেন ততক্ষণে। ভদ্রলোকে অভ্যেস হল হাঁটু মুড়ে আসন করে বসা। সেইভাবেই বসেছেন। হাতে গামছা। ছোট। বোধ হয় ভিজে। পায়ের চেটো মোছাও তাঁর অভ্যাস। পা মুছতে মুছতে বললেন, “চোখে ভাল দেখি না। ঘরের বাতিটাও জোরালো নয়। যে-ছেলেটি এসেছিল তাকে দেখে ছোড়দা বলেই মনে হচ্ছিল। বুঝতে অসুবিধেই হয়। গালে দাড়ি রেখেছে। চোখে চশমা। ক’ বছর পরে আচমকা দেখা। ছোঁড়া নেই জানি, হঠাৎ তাকে দেখবই বা কেমন করে? ভূত বলে চমকে উঠতে হয়। যথার্থ কথা বলতে কী–আমি এমনই হকচকিয়ে গিগেছিলাম যে, ভাল করে কিছু বুঝিনি।”

তারাপদ কিকিরার মুখের দিকে তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে তুলসীবাবুর দিকে। “আপনার ভাইঝিও তো দেখেছেন।” তারাপদ বলল।

“মায়া! হ্যাঁ, মায়াও দেখেছে।”

“উনি কী বললেন?”

“ও বলল, মোহন।”

“উনি চিনলেন?”

 তুলসীবাবু বললেন, “এসেছিল আমার কাছে, আসা-যাওয়ার পথে মায়ার সঙ্গে দেখা। দেখেছে ঠিকই। তবে ভুল না ঠিক–আমি তো বলতে পারব না।”

তারাপদ ঘরের বাতিটা দেখছিল, সত্যিই বড় টিমটিমে, ষাট পাওয়ারের বা হবে বড়জোর। তার ওপর পুরনো। হলুদহলুদ দেখায়। বাইরের একফালি বারান্দায় যা আলো তা আরও কম। তুলসীবাবুর ভাইঝি ঠিক দেখেছে কি না কে জানে!

কিকিরা তুলসীবাবুকে দেখছিলেন। বললেন, “আপনার কি মনে হল, এখানে যে-লোকটি এসেছিল–সে মোহন হলেও হতে পারে?”

তুলসীবাবু যেন কিছু ভাবছিলেন; বললেন, “দেখুন, মরা মানুষ আর তো ফিরে আসে না। ছোড়দা ফিরে আসবে কে ভাবতে পারে! তবু ওরই মধ্যে যে-সময়টুকু ও ছিল–আমার মনে হচ্ছিল ছোড়দা হলেও হতে পারে।”

“কেন মনে হচ্ছিল?”

“কথা শুনে। আমাকে ওরা “কাকা বলে ডাকে। ছোড়দা বরাবর কাকাবাবু। বলত, বড়দা “কাকা’ বা “তুলসীকাকা বলে। দেখলাম ও আমাকে কাকাবাবুই বলছে। গলার স্বর আমি ঠিক বুঝিনি। ছেলেটি বড় কাশছিল। তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজে গলা বসে গিয়েছে।”

কিকিরা বললেন, “মাত্র এই, না আর কিছু আছে?”

“আছে।” তুলসীবাবু মাথা হেলিয়ে বললেন, “ছোড়দা থাকতে প্রেসে যারা কাজকর্ম করত তাদের সকলের নাম বলল ছেলেটি। কে কোথায় কাজ করত তাও বলল। ওদের কথা জিজ্ঞেস করল। “

“তারা সবাই এখনো আছে প্রেসে?”

না। একজন নিজেই চলে গিয়ে একটা ছোট ছাপাখানা খুলেছে। আর-একজন মারা গেছে।”

“অন্য কথা কী বলল!”

“রং-এর কাজের জন্যে একটা সেকেণ্ডহ্যান্ড মেশিন কেনা হয়েছিল। ছোড়দা মারা যাওয়ার আগে সেটা চালু করা যাচ্ছিল না। সেই মেশিনের কথা জিজ্ঞেস করল। “

“সবই ছাপাখানার কথা?”

“বাড়ির কথাও বলছিল।”

“কী কথা?”

“ছোড়দার শখ ছিল পাখি পোর। বাড়িতে মস্ত খাঁচা ছিল দুটো। পাখি রাখত। তা ছাড়া, ওর ঘর–যে-ঘরে ও থাকত–তার কথাও বলল।”

তারাপদ হঠাৎ বলল, “ও কি এ-ঘরে বসেনি?”

“না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।”

“আপনি বসতে বলেননি?”

“না বোধ হয়। আমি তখন নিজের হুঁশে ছিলাম না। কী দেখছি, কী শুনছি ভাল করে বুঝতেই পারছিলাম না। বিশ্বাসও হচ্ছিল না।”

তুলসীবাবু যে রীতিমতন বিভ্রমে পড়েছিলেন, তাঁর কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছিল।

কিকিরা বললেন, “মোহনের এমন কোনো চিহ্ন ছিল শরীরে, ধরুন মুখে, কপালে, গলায় বা অন্য কোথাও, যা চোখে দেখা যায়? আপনি কি সেরকম কিছু দেখেছিলেন?”

তুলসীবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “তখন এসব কথা মনে হয়নি। তবে মনে হচ্ছে, কপালের ডান পাশে বড় আঁচিলটা চোখে পড়েছিল। সঠিক করে কিছু বলতে পারব না মশাই।”

গামছাটা খাটের মাথায় রেখে দিলেন তুলসীবাবু। চোখের চশমার কাঁচ মুছলেন। ছানিকাটা চোখটার জন্য চশমার যে কাঁচ রয়েছে–সেটা যেমন মোটা তেমনই ঘোলাটে রঙের। চশমা চোখে দিলেন উনি।

কিকিরা বললেন, “আপনি দত্তদের প্রেসে কতদিন কাজ করেছেন?”

আঙুল দিয়ে মাথার সাদা চুল গুছিয়ে নিতে-নিতে তুলসীবাবু বললেন, “আটত্রিশ বছর’।”

“আটত্রিশ…।”

“যখন ঢুকছিলাম তখন ছেলে-ছোকরা ছিলাম। যখন চলে এলাম তখন বুড়ো। আমি ছাপাখানায় ঢুকেছিলাম বিল-কেরানি হয়ে। হিসাবপত্র লিখতাম খাতায়, বিল তৈরি করতাম, আদায় দেখতাম। ওইভাবেই ধীরে-ধীরে ছাপখানায় কাজকর্মের অনেক কিছু শিখলাম। বড়বাবু বেঁচে থাকতেই আমি ছোট ম্যানেজার। তখন বড় ম্যানেজার ছিলেন শচীনবাবু।”

“বড়বাবু মানে রামকৃষ্ণ দত্ত?”

“হ্যাঁ। বড় ভাই রামকৃষ্ণ, ছোট ভাই শ্যামকৃষ্ণ।”

“রামকৃষ্ণ কেমন মানুষ ছিলেন?”

“খুব ভাল মানুষ। সদাশিব। শ্যামকৃষ্ণ ছিলেন কাজের মানুষ। তাঁর কথামতনই প্রেস চলত। কাজ বুঝতেন। বড়বাবুর ছিল নানা জায়গায় জানাশোনা। তাঁর খাতির ছিল। সেই খাতিরে আমরা বড় বড় কাজ ধরতাম। মোদ্দা কথাটা কি জানেন বাবু, ছাপাখানা শুরু করেন বড়বাবুর বাবা তখন যা ছিল, ছেলেদের হাতে পড়ে তার দশগুণ বেড়ে যায়।”

কিকিরা বললেন, “রামকৃষ্ণ যে মোহনকে পোষ্য নিয়েছিলেন এ-কথা নিশ্চয়ই জানেন?”

“সে আর জানব না!”

“ভাইয়ে-ভাইয়ে সদ্ভাব ছিল?”

“ভালই ছিল। …তবে কী জানেন, নদীর ওপর দেখে তল বোঝা যায় না।”

“লোচনবাবু আর মোহনবাবুর মধ্যে…?”

কিকিরা তাকিয়ে থাকলেন তুলসীবাবুর মুখের দিকে। লক্ষ করছিলেন।

তুলসীবাবু বললেন, “এঁদের মধ্যেও ভাব ছিল। অন্তত বাইরের কথা বলতে পারি। ভেতরের কথা কেমন করে বলব? …দুজনে দু ধাতের। বড়দা ব্যবসা বুঝতেন, ছোড়দা ছিল খামখেয়ালি।”

কিকিরা বুঝতে পারলেন, তুলসীবাবু ভেতরের কথা গোপন করতে চাইছেন। এসময় ওঁকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই।

কিকিরা বললেন, “মোহনকে আপনি পছন্দ করতেন না?”

“সে কি! মালিক বলে কথা। ছোটবাবু খানিকটা ছেলেমানুষ ছিলেন। তবে ভালমানুষ।”

কিকিরা আবার কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা আপনি কী মনে করেন? মোহন নামে যে-লোকটি এসেছিল সে জাল জোচ্চোর? কোনো মতলব নিয়ে এসেছিল?”

তুলসীবাবু সঙ্গে-সঙ্গে কথার জবাব দিলেন না, পরে মাথা নেড়ে-নেড়ে বললেন, “মরা মানুষ কেমন করে ফিরে আসে?”

“তা হলে এই লোকটা জাল?”

তুলসীবাবু কিছুই বললেন না।

কিকিরাই আবার বললেন, “আপনার কি মনে হয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা এসেছিল? কিছু বলল সে?”

“না। সে আমায় একটা কথাই বারবার বলেছে। সে মোহন।”

 কিকিরা কথা ঘোরালেন। বললেন, “আচ্ছা তুলসীবাবু, একটা কথা। মোহনের বয়েস হয়েছিল। সে যদি বছর পাঁচেক আগে মারা গিয়ে থাকে, তার বয়েস তখন তিরিশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। দত্ত-পরিবারে এতদিন পর্যন্ত কোনো ছেলে কি আইবুড়ো থাকে? মোহনের বিয়ে হয়নি কেন?”

তুলসীবাবু বললেন, “কথাবার্তা হচ্ছিল। বড়দার ঠিক পছন্দ মতন মেয়ে জুটছিল না।”

কিকিরা এবার একটু হাসলেন। ইশারা করলেন তারাপদকে। উঠতে বললেন। নিজেও উঠে পড়েছিলেন। বললেন, “দত্তদের ছাপাখানার আয় কেমন?”

তুলসীবাবু বলব কি বলব-না করে বললেন, “কাজ ভালই হয়। হালে বছর কয়েক খানিকটা মন্দা যাচ্ছে। আজকাল সব পালটে যাচ্ছে মশাই। ছাপাখানাও ভাল-ভাল হচ্ছে। তা যাই হোক, পুরনোর খানিকটা কদর তো থাকেই। আমার মনে হয়, বছরে লাখখানেক টাকার বেশি বই কম আয় ছিল না। ছাপাখানা থেকে।”

“আয় তবে মন্দ কী!..আচ্ছা, ছাপাখানার ওপর-ওপর ভ্যালুয়েশন কত হবে?”

তুলসীবাবু মাথা নাড়লেন। “আমি বলতে পারব না।”

“মোহনের অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তির মালিক তো লোচনবাবুরা?”

মাথা নোয়ালেন তুলসীবাবু। “হ্যাঁ।”

“মোহন না থাকলে ষোলোআনা লাভটা তবে লোচনবাবুর?”

 তুলসীবাবু কিছু বললেন না।

কিকিরাও আর দাঁড়ালেন না ঘরে। তারাপদকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।