তাপস
সকালটা শুরু করলাম একটা মারাত্মক ভুল দিয়ে। রোদ্দুরকে পাশে রেখে শুয়েছিলাম, যতক্ষণ শুয়ে থাকা চলে। ক্রমশ রোদ্দুরগুলি.খুব স্বাধীন হয়ে সারা বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল। তখন পায়ের ধাক্কায় অতি কষ্টে জানালাটা বন্ধ করতেই রামসদয়বাবু সহৃদয় গলায় আপত্তি জানালেন, সকালবেলা যতক্ষণ শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় শুয়ে থাকুন তাপসবাবু, কিন্তু সকালের রোদ ও হাওয়া লাগানো উচিত। এর উত্তরে আমি বললাম, আপনার কাছে একটা খুচরো টাকা হবে? কাল সন্ধে থেকে আমি দশ টাকার নোটটা ভাঙাতে পারছি না।
রামসদয় কাঁচি দিয়ে গোঁফ ছাঁটছিলেন ও আসন্ন বাথরুমের প্রস্তুতির জন্য পেটে থাপ্পড় মারছিলেন। পরের আওয়াজটা কেমন হয়, সেই অনুযায়ী তার মেজাজ নির্ভর করে। মনে হচ্ছে, আজ মেজাজটা ভাল আছে। অত্যন্ত বিব্রত মুখে জানালেন, ইস তাই তো, আমার কাছেও যে দশ টাকার নোট সব। চাকরটাকে দিন না, ভাঙিয়ে দেবে। আমি জানি রামসদয় মিথ্যে বলে না, ওর কাছে সত্যিই দশ টাকার নোট। হয়তো অনেকগুলোই দশ টাকার নোট থাকা সম্ভব। কেন চালাকি করতে গেলাম, পুরো একটা দশ টাকার নোট চাইলেই চমৎকার হত। আর কি শুধরে নেবার সময় আছে? এখন কি ওর হাত জড়িয়ে ধরে বলব, বুঝতেই তো পারছেন দাদা কথার কথা, পুরো দশটাই দিন। রামসদয় বাথরুমে ঢুকে পড়লেন, ওঁর প্রসন্ন মুখ দেখে বুঝলাম বেগ এসে গেছে। আজ রামসদয়ের মন ভাল ছিল, আজ দশ টাকা না চাওয়াটা চূড়ান্ত বোকামি হয়ে গেল। লোক ভাল রামসদয়, একমাত্র টাক ঢাকবার জন্য চুলগুলো সামনের দিকে টেনে আঁচড়ায়, এ ছাড়া ওর কোনও দোষ নেই। নিশ্চিত দিত। তার ওপর যদি বলতে পারতাম, কাল মায়ের চিঠি পেয়েছি (দীর্ঘশ্বাস) কিংবা বন্ধুর অসুখ, কুড়ি কী তিরিশ হয়ে যেতে পারত। ওঃ! সকালেই মোটা হরি শুনিয়ে গেছে, ঠাকুরের অসুখ, আজ সবাইকেইবাইরে খেতে হবে। তার মানে সারা দিন আজ কুহেলিকা। দুপুরবেলাটা শুয়ে শুয়ে কাটাব ভেবেছিলাম। ইচ্ছে হল, মোটা হরির মুণ্ডুটা চিবিয়ে খাই।
স্ট্রিম লন্ড্রিতে কাচানো এক পেয়ার শার্ট-প্যান্ট ছিল, এইটুকুই যা সৌভাগ্য। পকেটের মধ্যে পয়সা থাকলে জামা কাপড় নোংরা থাকা মানায় না। তাহলে সত্যিই ভিখিরি মনে হয়। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। সকাল ন’টা। সকালের চা-ও দেয়নি, এমন রাগ হচ্ছে যে, ইচ্ছে করছে, নাঃ, সকালবেলাতেই মুখ খারাপ করবনা। মুখে এখনও টুথপেস্টের বিচ্ছিরি স্বাদ লেগে আছে। পকেটে একটা নিঃসঙ্গ দশ নয়া পয়সা। এই দশ নয়া পয়সা নিয়ে পড়েছি মহা মুশকিল। কাল সন্ধে থেকে ভাবছি। এটাকে কোনও বাজেটে ফেলা যায় না। চায়ের কাপ দু’আনা। কলুটোলার মোড়ে ছ’পয়সায় পাওয়া যায়। কিন্তু এতদূর হেঁটে গিয়ে চা খেলে, সঙ্গে একটা টোস্ট না হলে –। সিগারেট কেনা যায়, কিন্তু সকালেই চা ছাড়া শুধু সিগারেট! চমৎকার হত, যদি এই দশ নয়া পয়সায় একটা পোচ, দুটো টোস্ট, এক কাপ ভাল চা ও সঙ্গে দুটো সিগারেট পাওয়া যেত। এইগুলো আমার বিষম দরকার এখন। এর একটাও হবে না। ইচ্ছে হল, পয়সাটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলি। কিংবা কোনও ভিখিরিকে দিয়ে দিই। হঠাৎ একটা মুচিকে দেখে জুতো পালিশ করিয়ে নিলাম দশ নয়াটা দিয়ে। ময়লা জুতোটা মানাচ্ছিল না। এবার শরীর ও মন বেশ ঝরঝরে হয়ে গেল। এখন অনায়াসে বিমলেন্দুর কাছে যাওয়া যায়। বিমলেন্দু সকালে কমার্স কলেজে পড়াচ্ছে। আর বিমলেন্দুর কাছেই যখন যাব, তখন ট্রামে যাওয়া যাক।
ট্রামটায় ভিড় ছিল না, জানলার কাছে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। কন্ডাকটরকে দেখে মাঝ পথে নেমে পড়া আমি মোটেই পছন্দ করি না। বসবার জায়গা পেয়ে বসে পড়া উচিত। সম্ভব হলে একটা বই খুলে পড়া। আমার কাছে বই ছিল না। কন্ডাকটবকে খুব ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলাম। খুব পছন্দসই লোকটি, বেশ অলস স্বভাবের, কারণ প্যান্টের সব ক’টা বোতাম আটকায়নি। নিশ্চয়ই কানে কম শোনে, কারণ লোকটার মুখে চোখে একটা এলোমেলো বোকামি আছে। অনেকটা ভবকেষ্টর মতো। ভবকেষ্টর মুখে অমন নিষ্পাপ বোকামির ছায়া কেন, তত দিনেও বুঝতে পারিনি, যত দিন না জানতে পেরেছি ও বদ্ধ কালা। ভবকেষ্টর বউ মালতী ওর ইয়ার ব্যান্ডের কাজ করে, সেই জন্য মালতীর মুখেও বোকামির স্বর্গীয় আলোছায়া খেলে। অনেকক্ষণ পর কন্ডাকটর আমার কাছে এল। আমি বাঁ-দিকের ঘাড়টা আলতো ভাবে বেঁকিয়ে অন্য মনস্ক ভাবে নরম গলায় বললাম, দি মানচ্ছি। লোকটা চলে গেল। যাক, একবারেই সাকসেসফুল! এই অর্ধসত্যগুলোতে আমি খুব উপকার পাই। ঘাড় হেলানো দেখে লোকটা নিশ্চিত হয়েছিল, আমার উচ্চারণ শুনে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চলে গেল। দিচ্ছি ও মান্থলি এই দুটি শব্দের সন্ধি করে আমি এই শব্দটি সৃষ্টি করেছি। এবং বার বার উচ্চারণ করে রপ্ত করেছি ধাঁধখানি। দিচ্ছি ও মান্থলি, দিমানচ্ছি। কোনও ত্রুটি নেই। সেই সঙ্গে আছে ঘাড় হেলানো। লোকটার কান যদি ভাল হত তাহলে ও মুশকিলে পড়ত। বুঝতেই পারত না আমার কাছে কী আছে–মান্থলি, না টিকিট কাটব। ও কী জিজ্ঞেস করত, দেখান? নাদিন? দেখান বললে, ধমকে উঠতাম, দেখাব কী, দিচ্ছি বললাম তো! যদি লোকটা লজ্জার মাথা খেয়ে বলত, দিন। তাহলে বলতাম, দশ টাকার খুচরো আছে ভাই? তখন যদি বলত, না, দশ টাকার খুচরো নেই, আমি আর বাক্যব্যয় না করে চুপ করে বসে থাকতাম। যদি মরীয়া হয়ে লোকটা দৈবাৎ বলেই ফেলত, হ্যাঁ দিন, ভাঙিয়ে দিচ্ছি, তবে ব্যঙ্গের সুরে জিজ্ঞেস করতাম, এই ট্রাম বেলগাছিয়া যাচ্ছে নিশ্চয়ই? না, গ্যালিফ? ওঃ গ্যালিফ, তাই বলল –এইটুকুই জানিয়ে লাফিয়ে উঠে ব্যস্তভাবে নেমে যেতাম। আমি টিকিট ফাঁকি দিচ্ছি না এ বিষয়ে দৃঢ় ধারণা করার মতো মুখ! বাপ-মা আমার জন্য টাকা-পয়সা, ভাড়াবাড়ি কিছুই রেখে যায়নি, শুধু দিয়ে গেছে ভদ্রলোকের মতো সুন্দর মুখখানি। এটাও মন্দ ক্যাপিটাল নয়, এতেও খুব অনেকটা কাজ হয়।
বিমলেন্দু ক্লাসে পড়াচ্ছিল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে চোখাচোখি করলাম। তারপর কলেজ ক্যান্টিনে গিয়ে ডবল টোস্ট, পোচ আর চায়ের অর্ডার করে বসলাম। চা শেষ হবার পর বিমলেন্দু এল হন্তদন্ত হয়ে, হাতে কয়েকখানা বই, টাইপ করা নোট। কী রে কী ব্যাপার, আমার যে আজ বিষম চাপ, পর পর তিনটে ক্লাস।
গুলি মেরে দে।
না ভাই, আজ পারব না, আজ ছেড়ে দে।
দ্যাখ বিমল, আমি না হয় বিএ পাশ! আমার কাছে প্রফেসারি দেখাসনি।
আস্তে বল, ছেলেরা শুনতে পাবে।
ক্লাসের পর কী করবি?
ড. মহালনবিশের বাড়ি যেতে হবে একবার।
কেন, তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে?
ধ্যাৎ, ড. মহালনবিশ আমার রিসার্চ গাইড। আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তাছাড়া ওর কোনও মেয়ে নেই। বিয়েই করেননি।
আজ সব ছেড়ে দে। আজ সারা দিন আমার কিছুই করার নেই। চল দুজনে মিলে একটা পার্টি অগানাইজ করি। অনেক দিন এক সঙ্গে বসা হয়নি।
আজ হবে না রে। আমার আজ উপায় নেই। তোরাই বেশ আছিস তাপস। চাকরি-বাকরি করতে হয় না, ইচ্ছেমতো দিন কাটাতে পারিস। আমাকে সব মিলে পাঁচটা চাকরি করতে হয়। আমার গলায় দড়ি বাঁধা, দড়ির বাইরে যেতে পারি না।
আচ্ছা, পাঁচটা টাকা ধার দে।
নেই। খুচরো পয়সা সম্বল।
পাঁচটা চাকরি করছিস, আর পাঁচটা টাকা ধার দিতে পারবিনা? একমুঠো খোল মানিক।
সত্যি পারি না।
কত আছে?
বিমলেন্দু পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করে গুনল। চোদ্দো আনা। আমি ওর থেকে সাত আনা নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোর ধারের সিগারেটের দোকান আছে?
আছে। চল।
আমাকে দু’প্যাকেট সিগারেট কিনে দে। আজ মেস বন্ধ। দুপুরে কোথায় খাব ঠিক নেই।
তুই আমার বাড়িতে আয়। দুপুরে আমার সঙ্গে খাবি।
দেখি।
ঘণ্টা পড়তে বিমলেন্দুকে ছেড়ে দিলাম। তারপর হঠাৎ আবার ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই রিসার্চ করছিস, আগে তো শুনিনি। ডক্টরেট হয়ে তোর কি মুকুট হবে? ছি ছি।
ডক্টরেট হলে মুকুট হবে না, কিন্তু মাইনে বাড়বে। বিমলেন্দু শুকনো মুখে জানাল। আমি ওর মুখের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে লক্ষ্য করবার চেষ্টা করলাম, সত্যি সত্যি ওর গলায় দড়ির দাগ দেখা যায় কিনা!
শীত নেই, বেশ ঝরঝরে রোদ, ভিড় শুরু হয়েছে। রাস্তার দুই বিপরীত মুখেই জনস্রোত, দু’দিকেই কেন লোক ছুটে যায় বুঝতে পারি না। চার দিকেই পরের বাড়ি জলের রেটে নিলাম হচ্ছে, কী করে ওরা টের পায় কে জানে। আমি কোনও দিন টের পেলাম না। পেলেই-বা কী। পকেটে নেই কানাকড়ি, দরজা খোলো বিদ্যেধরী। কোথায় যাই এখন? আশ্চর্য, কোনও জায়গা মনে পড়ে না। বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করা যেতে পারে। কী বিষম যাচ্ছেতাই জীবন। এক-এক সময় আমার মনে হয়, প্রতি দিন একই বন্ধু-বান্ধবের মুখ। আর কী সব মুখ, আহা! হাওড়া স্টেশনে যে-সব নিরুদ্দিষ্ট আসামির ছবি আছে, সবকটা এসে এখানে জুটেছে। হয় এর সঙ্গে দেখা, নয় ওর সঙ্গে আড্ডা, হই-হল্লা উত্তেজনা, ভাল লাগে না, সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগে। প্রতি দিন একই রকম কাটছে, এ-কথা ভাবলে বেঁচে থাকার আর কোনও পয়েন্ট থাকে না। মনে হল, বিমলেন্দু বোধহয় একা একা জীবন কাটাচ্ছে। আজকাল বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ওকে প্রায় দেখাই যায় না, চারটে চাকরি, রিসার্চ, খবরের কাগজে লেখা, সেই সঙ্গে কবিতা– যেন এসবের মধ্যে ও কী এক গভীর ষড়যন্ত্র করে চলেছে। সব সময় অনুত্তেজিত ওর মুখ, কিছুটা বিমর্ষ। কী জানি আমাকে দেখে ও খুশি হয়েছিল, না বিরক্ত। মনে হয়, কিছুদিন পর হেমকান্তির সঙ্গে বিমলেন্দুর কোনও তফাৎ খুঁজে পাব না।
মায়ের মৃত্যুর পর এক মাস অশৌচ করল হেমকান্তি, নেড়া মাথায় রোজ হবিষ্যি খেত। তারপর থেকে এখনও প্রায় মাথা কামাচ্ছে, মাছ-মাংস ছেড়েছে। এই রকমই না কি সারা জীবন চালাবে। ওই রকম ফর্সা, লম্বা চেহারা, মুণ্ডিত মাথা, হেমকান্তি যখন আমাদের মধ্যে এসে বসে, মনে হয় যেন অতীতের কোনও মর্মর মূর্তি। ও বোধহয় জানে না যে, মাথা কামিয়ে ফেলার পর ওকে বিষম অহঙ্কারী দেখাচ্ছে। সে-দিন যখন মায়ার দিকে হাত তুলে চায়ের কাপটা সরিয়ে দিল, অস্ফুট গলায় বলল, আমি চা খাই না আর –মায়া চকিতে কাপটা নিয়ে সরে গেল। আমার মনে হল, এ দৃশ্যটা আমি এর আগে কোথাও দেখেছি। কোনও ফিল্মে বা রূপকথায় বা উপন্যাসে, বা স্বপ্নে, যেন কোনও অহঙ্কারী রাজপুত্র, বা নবীন সন্ন্যাসী, ফিরিয়ে দিচ্ছে কোনও উপচিকাকে। যদিও জানি, হেমকান্তির ও-রকম কোনও সাহসই নেই, আর মায়াও হেমকান্তিকে মোটেই পছন্দ করে না। মায়াকে আমারও যেন কেমন লাগে, ওই কচি মেয়েটাকে আমি বড় ভয় করি। নইলে আমার সময় কাটাবার সমস্যা? অনায়াসেই মায়ার কাছে গিয়ে চমৎকার বসতে পারতাম, বলতাম, মায়ার তোমার হাত দেখি। ওর করতল দু’হাতে ধরে গন্ধ শুকতাম, সমস্ত শরীরে চাপ দিতাম, ওর শরীর উষ্ণ হলে অনায়াসে জানানো যেত, মায়া তোমার জন্য আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। আমি ওর সঙ্গী বিছানায় শুতাম না, ওকে নিয়ে বেড়াতে যেতাম কিংবা কানে কানে কথা বলতাম কিংবা চোখের দুটো পাতা আঙুলে তুলে ফুঁ দিতাম, আমি ওর কৈশোরের রহস্য নিয়ে খেলা করতাম। কিন্তু মায়া আমাকে তা দেবে না, আমি গেলে চা দৈবে, ইয়ার্কি করবে, তারপর এক সময় বলবে, দিদিকে ডেকে দিচ্ছি, গল্প করুন। দিদি যদিনা থাকে বাড়িতে, তাহলে বলবে, আসুন দাবা খেলি। খানিকটা বাদে নিশ্চিত জানিয়ে দেবে, এবার বাড়ি যান। বাঃ। আমি যদি ওর হাত চেপে ধরি, অন্য রকম ভাবেও হেসে উঠবে খিল খিল করে। যদি বালি, মায়া আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই, তাহলে ও হাসবে, বলবে, থাকুন না। যদি জোর করে চুমু খেতে যাই, ও হেসে মুখ সরিয়ে নেবে কিন্তু ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠবে না। ওর সঙ্গে জোর করা যাবে না। মায়ার সমস্ত হাসিই অভিমানের, আমার মনে হয়। বরং ছায়া ভাল, ছায়া দুঃখিত কিন্তু বোকা। লোভী কিন্তু ঘুমন্ত। ছায়াকে হয়তো আমি খানিকটা পছন্দ করি ঠিকই, কী জানি। অবিনাশের মত হাড়হারামজাদা ছেলেই মায়াকে ট্যাকল করতে পারে।
এখন আমি কোথায় যাই! কোনও মেয়ের সঙ্গেই প্রেম-টেমের সম্পর্ক নেই যে, হঠাৎ যেতে পারি। প্রথম কলেজ-জীবনে ও-সব চুকে গেছে। বাসন্তীর সঙ্গে কী গভীর ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, আর একটু হলেই ওকে বিয়ে করে ফেলতাম আর কী! সে-দিন বাসন্তীর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হল, নতুন বরের সঙ্গে চলেছে, খুশিতে মোটা হয়ে গেছে মেয়েটা, কিন্তু আশ্চর্য, আমার মধ্যে কোনও রকমঈর্ষা কিংবা দুঃখ নেই, কিংবা উদাসীনতাও জাগল না। খুবই সাধারণ ভাবে মাথা কঁকালাম, কী খবর, কেমন, ভাল, এই সব অনায়াসে বলাবলি করে চলে গেলাম। বাসন্তীও আমাকে মনে রাখেনি। মেয়েরা কেউ আমাকে মনে রাখে না। যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে আলাপ হবার পরই তার চোখে তাকিয়েছি, বলেছি, চলো, রেস্টুরেন্টের কেবিনে বা হোটেল রুমে। চলো, ট্রেনের নিরালা ফার্স্ট ক্লাস কামরায়। ব্লাউজে সেফটিপিন গেঁথো না, আমার আঙুলে ফুটে যায়, আর আঙুল বিষম স্পর্শকাতর এবংদামি, সেফটিপিন ফোঁটাবার জন্য নয়। কেউ বেশি দিন টেকেনি। দু-একজন শেষ পর্যন্ত এগিয়েছে, অনেকে গোড়া থেকেই কেটেছে। কেউ কেউ, বিয়ে করো বলে এমন বায়নাক্কা তুলেছে, ওফ! এক এক জনকে সামলাতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছে আমার! কত চোখের জল– টেলিফোনে চোখের জল, চিঠিতে চোখের জল। অথচ কেউই আমাকে কোনও অভিজ্ঞতা দেয়নি। উপন্যাসটা লিখলাম, সবাই বলল, খুব কর্কশ এবং নিষ্ঠুর হয়েছে। ভেবেছিলাম উনিশশো ষাট থেকে তেষট্টি সাল পর্যন্ত নিজে যা যা করেছি, সেই সবই লিখব। তাই লিখেছি অনেস্টলি, যা যা মনে পড়েছে। কোনও নরম মুখ মনে পড়েনি, চোখের জল মনে পড়েনি, ভালবাসা শব্দটাই মনে পড়েনি। জীবনে কখনও আমি ভালবাসা পাইনি বোধহয়। অথচ ভালবাসার জন্য ব্যগ্র হয়েছিলাম। স্ত্রীলোকদের কাছে তো কম অভিযান করিনি, কিছুই পাইনি, লোভ ছাড়া, অথবা হয়তো আমার বোধশক্তি নেই, যা পেয়েছি এখনও তা উপলব্ধি করতে পারছি না। পরীক্ষিৎ তা পেরেছে, মেয়েদের সামান্য স্পর্শও ওকে কবিতায় ভরিয়ে তোলে, ওর কবিতা ভালবাসার কথায় মুখর। আমি কিছুই পাইনি, লোভ ছাড়া। লোভ আমাকে বহু দূর নিয়ে গেছে, ভালবাসার চেয়েও বড় আসনে, ইচ্ছে করছে এখনই কোনও স্ত্রীলোকের কাছে গিয়ে শুই। এই লোভ আমার মধ্যে এনেছে অ্যাকশন, আমাকে তাড়িয়ে চলেছে। এই জন্য আমার শরীরে অসুখ নেই, আমার প্রত্যেকটি স্নায়ু সতেজ, ইন্দ্রিয় সূক্ষ্ম। আমি শিশিরের পতন শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাই।
ট্রামলাইনের পাশে বহুক্ষণ কাটল। রোদ্র বেশ চড় করছে। কোন দিকে যাব, এখনও দিকঠিক করতে পারিনি। মেসে ফিরে গিয়ে শুয়ে থাকা যেত। কিন্তু দুপুরে একটা খাওয়ার ব্যাপার আছে। কিন্তু না খেয়ে শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ দেখা কবিত্বময় না। আমার ঠিক পোয় না। যত রাজ্যের কুচিন্তা আসে মাথায়, ইচ্ছে হয়, কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করি, অথবা পিছন দিকের জানালার খড়খড়ি তুলে পাশের বাড়ির বাথরুমে উঁকি মারি। এ বয়সে আর ও-সব চলে না। আশ্চর্য, সকলেই দিব্যি চাকরি বাকরি করছে–আমি ছাড়া। এমনকী পরীক্ষিৎও খবরের কাগজের প্রুফ দেখে! স্কুলের মাস্টারিটা না ছাড়লেই হত, আরও কিছু দিন দাঁত কামড়ে লেগে থাকা উচিত ছিল। আসলে ওই স্কুলের হেডমাস্টারটার কান মুলে দেবার আন্তরিক ইচ্ছেটা আমি কিছুতেই চাপতে পারিনি। একেবারে জোচ্চরের ঘুঘু লোকটা। ও শালার উচিত, শ্মশানের পাশে গিয়ে ব্যবসা করা।
অনেকক্ষণ দাঁড়াবার পর খেয়াল হল, কেন দাঁড়িয়ে আছি। যদি ট্রামে বা বাসে যেতে যেতে কেউ আমাকে দেখে নেমে পড়ে, বস্তুত আমি সেই প্রতীক্ষা করছিলাম। আমি কারুর কাছে যাবার বদলে যদি কেউ আমার কাছে আসে। কেউ আসে না। মেয়ে কলেজ ছুটি হবার পর এই যে অসংখ্য লাল-নীল-হলুদেরা, এরা কেউ আমাকে চেনে না। কেউ আমার কাছে এসে বলবে না, আপনি কি তাপসবাবু? নিশ্চয়ই আপনি! আপনার ঊনত্রিশ দাঁতের লোকটা উপন্যাস তো আমাদের ক্লাসের সব মেয়েরা পড়েছে। বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে আপনার ছবি দেখেছি। এসব ভাবতে বেড়ে লাগে। কত লোকের উপন্যাস আরম্ভ হয় এ-রকম ভাবে! আমার বেলা শালা কিছু হল না! কোনও মেয়েই আমার বই পড়েনি। কোথাও কোনও মেয়ের সঙ্গে আলাপ হবার পর যদি শোনে, আমি এক জন লেখক, তখন সেই সব মেয়েরা আমসিপানা মুখ করে জিজ্ঞেস করে, আপনি লেখেন? তাই তো, আমি কী লিখি। কচুপোড়া লিখি, তাছাড়া আর কী!
কোথায় যাব? অম্লান! দো-তলার ছোট গুমোট ঘর, পাশের হোটেলের অ্যাকাউন্টে খাওয়া, হো হো করে হাসবে অম্লান, নার্ভাস গলায় নিজের কবিতা মুখস্থ বলবে, আর চুটিয়ে পরনিন্দা-পরচর্চা করে যাব। এখন বাড়িতে থাকলে হয়। হে ঈশ্বর, অম্লানের যেন টাইফয়েড কিংবা পক্স, অন্তত মামস হয়ে থাকে। যাতে বিছানায় শুয়ে থাকরে। নইলে ওকে বাড়িতে পাওয়া এ সময়, ঈশ্বর, তোমারও অসাধ্য। অম্লানের ঘরে বহু রাত কাটিয়েছি। যে-কোনও প্রোগ্রামে বেশি রাত হয়ে গেলেই অম্লানের বাড়িতে বারোটার পর-পরীক্ষিতের আবার বাস বন্ধ হয়ে যায়, দু’জনে কতবার এসেছি এখানে। ওর বাড়ির দরজার ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে খিল খোলা যায়। ঢুকে গেছি ভিতরে। ঘুম থেকে উঠে এসে অম্লান একটুও না চমকে আমাদের ঘরে ডেকেছে, হাসি-হাসি মুখ করে বলেছে, রাত্তিরে তো ঘুমোত দেবে না জানি, বেলেল্লা করবে, সকালবেলা চা, ডবল ওমলেট সাঁটাবে, সিগারেট ধ্বংস করবে, তারপর গাড়িভাড়াও চাইবে নিশ্চয়ই। ওঃ, পদ্য লেখা শুরু করে কি অন্যায়ই করেছি। তোদর মতো বন্ধু জুটিয়েছি, ভিখিরিরও অধম। তা জগাই, মাধাই, আর একটি কোথায়—কাঙাল হরিদাস?
পরীক্ষিৎ হাসতে হাসতে বলেছে, সে আবার কে রে?
কেন, শেখর? তিন জন না হলে তো তোমাদের চলে না। অবিনাশ তো শুনেছি কেটে গেছে, সে নাকি আজকাল ভাল ছেলে! হ্যাঁ রে, তোদের যে প্রতিভা আছে, ঠিক জানিস তো? নাকি এ-রকম বাওয়া হয়ে শিল্পী সেজে (অম্লান উচ্চারণ করে ‘silপি’) জীবনটা নষ্ট করবি। শেষ পর্যন্ত কিছু হবে না? আমি কিন্তু তোদের প্রতিভার এখনও কিছু টের পাইনি।
সারা ঘরে ছড়ানো বই ও পুরনো তিন বছরের খবরের কাগজ, মাটির খুরিতে চুরুটের ছাই, জীবনে একবারও না কাঁচা বেড শিট, খাটের শিয়রের বই-এর র্যাক থেকে শবের গন্ধ আসে। অম্লান আমাদের ঠাট্টা করে। অম্লানের ঠাট্টা শুনে পরীক্ষিৎ গম্ভীর হয়ে যায়। আমি হাসতে হাসতে বলি, অম্লান, আমি শিল্পীও সাজিনি, জীবনটাও নষ্ট করছি না। শিল্পীরা কী-রকম সাজে, কীভাবে জীবন নষ্ট করে কে জানে।
অম্লান বাড়িতে নেই।
তিন জায়গায় ব্যর্থ হয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এলাম। অম্লানের ঘরে তালা বন্ধ। অবিনাশের বাড়িতে গিয়ে শুনলাম অনিমেষ আর গায়ত্রী কলকাতায় এসেছে, আছে ছায়াদের বাড়িতে, অবিনাশ সেখানে। গগনকেও যদি অন্তত পাওয়া যেত। গগনকে পেলেই সব চেয়ে ভাল হত, ও নিশ্চিত আমার কথায় অফিস কাটতে রাজি হত। ওর কাছে সব সময় টাকা থাকে, ওর মতো ডেসপ্যারেট কেউ নেই, একটা কিছু ঘটে যেত। গগনকে গিয়ে ডাকলে বাড়ির দরজায় নেমে আসে গগন, কপালে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে আমার বিনীত প্রস্তাব শোনে। কিছুক্ষণ কী ভাবে, তখন ওর মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। বোঝাই যায় না, ও আমার কথা শুনছে, না অন্য কথা ভাবছে। রাজি হবে কি না সন্দেহ, তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে গগন বলে, চুপ, একমিনিট দাঁড়া, আসছি। ঠিক এক মিনিট বাদে গায়ে জামা দিয়ে বেরিয়ে আসেগগন, বাড়ি থেকে কুড়ি পা পর্যন্ত গম্ভীর মুখে আসে, তারপর এক টানে মুখোশটা খুলে বলে, মাইরি, চমৎকার দিনটা আজ, চুটিয়ে ফুর্তি করার মতো। চল, কোথায় যাবি বল।
গগন অফিসের কাজে এলাহাবাদে গেছে। খুব বেঁচে গেছি। মায়ার সঙ্গে প্রেম করার অছিলায় ওদের বাড়ি আজ যাইনি, ওখানে অত লোক দেখলে খুব খারাপ লাগত। তিনটে মেয়ে এক বাড়িতে– ছায়া, মায়া, গায়ত্রী। অনিমেষের মাসতুতো বোন গীতাও কি আর আসেনি! ওখানে গেলেই ভজরঙ গজরঙ করে সময় কাটাতে হত। এক সঙ্গে অত মেয়ে আমার সহ্য হয় না, বড্ড বাজে রসিকতা শুনে হাসতে হয়। আজ আমার সে-রকম মেজাজই নেই। অবিনাশটা ওখানে কী করছে, কে জানে!
অনেক দিন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আসিনি। সুন্দর নরম ঘাসে ভরে আছে এই দুপুরবেলা। ঘাস দেখে গোরুর মতো আনন্দ হচ্ছে আমার। কৃষ্ণচূড়া ফুল খসে খসে পড়েছে। ১৫ এপ্রিল সব গাছগুলো সম্পূর্ণ লাল হয়ে যায়, বহু বছর লক্ষ্য করেছি। ও-পাশের ওই হলদে ফুলগুলি নাকি রাধাচূড়া, একটি মেয়ে আমাকে বলেছিল। একসময় এই ঘাসের উপর বহুক্ষণ শুয়ে কাটাতাম। ছায়া আসত, ছায়াকে টোপ ফেলে অন্য দু-এক্টা মেয়েকেও টেনে আনা যেত। এক দিন মনে আছে, পুরাদুঘণ্টা ভিজেছিলাম এখানে বসে, ছায়ার সঙ্গে বাসন্তী আর নীলা বলে দুটি মেয়ে এসেছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টি, সবাই দৌড়ে দৌড়ে পালাল, আমরা বৃষ্টির মধ্যেই বসে রইলাম। দূরের বারান্দা থেকে সবাই আমাদের দেখতে লাগল। কেয়ারটেকার এসে বলল, আপনারা করছেন কী, নিউমোনিয়ায় মরবেন যে! আমরা অগ্রাহ্য করে তবু বসেছিলাম। মেয়ে দুটো হাসছিল খিল খিল করে। ভিজে ব্লাউজ-ব্রেসিয়ার ছুঁড়ে বুকের গোল স্পট হয়ে উঠল ওদের, আমি ওদের অশ্লীল গল্প শোনাতে লাগলাম। ক্রমশ আধোশায়া প্রত্যেকটি মেয়ের বুকে ও পিছনে চারটি বাটির মতো গোল দেখে উত্তেজিত হয়ে আমি নীলা বলে মেয়েটির পিছনে আস্তে আস্তে পা দিয়ে টোকা মেরেছিলাম, তারপর, বৃষ্টি শেষে নীলা কী-রকম চমৎকার আমার সঙ্গে একা বাড়ি ফিরতে রাজি হয়ে গেল। সেই নীলা এখন সর্বেশ্বরকে বিয়ে করে মেয়ে কলেজের অধ্যাপিকা হয়েছে। এক দিন দেখা হবার পর বলল, লেক টাউনে জমি কিনেছে, শিগগিরই বাড়ি তুলবে। একটিমাত্র ছেলে হয়েছে, তার কী নাম রাখবে– সেজন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছিল। বেশ সুখে আছে নীলা, এই তো জীবন, এই তো সুখ, সেই বৃষ্টি ভেজা মাঠে আবার কেউ ফিরে আসে না। আজকাল আর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আমাদের কেউ আসে না। সবাই পুরো সাহিত্যিক বা অধ্যাপক বা চাকরিতে ঢুকেছে। আমিই শুধু বোকা রয়ে গেলাম।
খুব খিদে পেয়েছে আমার। সত্যিকারের খিদে, বিমলেন্দুর সাত-আনা গাড়িভাড়াতেই হাওয়া। সিগারেটও ফুরিয়ে এল। দুপুরে যে-কোনও ভাবেই হোক, পুরো পেট খেতেই হবে, কোনও চালাকি নয়। না খেয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। আমার সুখের শরীর, খিদে একেবারে সহ্য হয় না। তাছাড়া দুপুরে আর সবাই খাবে, আমি একা কেন না খেয়ে থাকব? ইয়ার্কি নাকি? আজ বড় ইচ্ছে করছে মাংসের ঝোল দিয়ে লুচি খেতে। লুচির বদলে ভাত হলেও আমার বিশেষ আপত্তি নেই, কিন্তু মাংস আমার চাই-ই।
লাইব্রেরির দরজায় কার্ড চায়। কোথায় পাব? বহু দিন ও-সব চুকে গেছে। অনেক রকম বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ঘাড় মোটা নেপালি হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার হাত জড়িয়ে ধরে বললাম, দে ভাই, একটু ঢুকতে দে, বড় খিদে পেয়েছে। তবুও লোকটা শোনে না। তখন আমি বললাম, লাইবিরিমে হামারা লিখা একটা কেতাব হ্যায়, জানতা? হামসে কার্ড চাও, মাৎ, দু’দশ বরষ বাদ দিয়া পর হামারা ফটো ঝুলেগা, সমঝা? লোকটা বলল, নেই সাব, কার্ড দেখাইয়ে। তখন আমাকে নিজের ব্যবস্থা করতে হল। এই সব সরকারি বোকামির প্রতিষেধক আমি জানি। গেট থেকে কয়েক পা পিছিয়ে এলাম, বারান্দায়, যেখানে দু’পাশে ফুলের টব। এ-দিক ওদিক তাকালাম, আকাশের দিকে, নেপালিটা আমাকে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ আমি গণ্ডারের মতো খানিকটা মোশান নিয়ে প্রবল বেগে দৌড়ে নেপালিটাকে ভেদ করে গেট দিয়ে ঢুকে গেলাম। লোকটা আরে আরে বলে পেছনে পেছনে ছুটল। আমি তিন জনকে ধাক্কা মেরে, একটা মেয়েকে ধাক্কা বাঁচাতে গিয়ে পিছলে পড়তে অন্য একটা মেয়ের হাত থেকে সাতখানা বই ফেলে দিয়ে ক্যাটালগ কেবিনখানাকে বোঁ বোঁ করে তিনটে পাক দিয়ে –যতক্ষণে নেপালিটা আমাকে ছুঁয়ে ফেলল, ততক্ষণে আমি লেন্ডিং সেকশানের কাউন্টারে একটা লোকের হাত চেপে ধরেছি ও বলেছি, অশোক, অশোক, দেখ, এ কী উৎপাত। তার সঙ্গে দেখা করতে আসব, তবুকার্ড চাইছে! গোলমালে অনেক লোক পড়া থামিয়েছে ও মজাখোর লোকেরা ভিড় জমিয়েছে আমার চারপাশে, নেপালিটা হাত ধরে টানবার চেষ্টা ছাড়েনি। দীর্ঘ সবল কালো অশোক শান্ত চোখ তুলে বলল, কী, কার্ড আনেননি? ছেড়ে দেও দারোয়ান, হামারা চেনা আদমি হ্যাঁয়। আমি অশোকের ব্যবহারে থমকে গেলাম। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালাম অশোকের দিকে। আপনি’ বলে কথা বলছে আমার সঙ্গে, মাস দু’তিন আগেও তো ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অশোক বলল, কোনও বই দরকার থাকে যদি, একটু ঘুরে-টুরে দেখুন, আমি একটু ব্যস্ত এখন।
আমি তবু রাগ করলাম না, গোঁ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, তোর সঙ্গে একটু দরকার আছে, অশোক। এক মিনিট আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাউন্টারের দরজা খুলে বলল, ভেতরে আসুন।
অশোকের কাছে খেতে চাইব ভেবেছিলাম, কিন্তু ওবঅস্বাভাবিক ঠাণ্ডা ব্যবহারে কী রকমভ্যাবাচাকা মেরে গেলাম। কী ব্যাপার, অশোক আমার সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতে চাইছে? আমি বললাম, তোর কী ব্যাপার, তুই কেমন আছিস? আমি ওর কাঁধে চাপড় মারলাম।
ভালই! বিশেষ কিছু বলবেন? সেই রকম ঠাণ্ডা গলা অশোকের।
না বিশেষ কিছু না। এমনিই– ।
তাহলে– । এই বলে অশোক এমন ভাবে থেমে গেল যে, এখন যাও বলতে হল না। আমি আচ্ছা চলি বলে পিছন ফিরলাম। অশোক আমার কাছে এসে গলার আওয়াজ নিচু করে বলল, ওঃ, আপনাদের জানানো হয়নি, মাস খানেক আগে আমি বিয়ে করেছি। আচ্ছা পরে দেখা হবে। আমি স্তম্ভিত ভাবে অশোকের দিকে ফিরে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে করেছিস মানে? আমাদের খবর দিলি না? কী ব্যাপার তোর? অশোক আলগা ভাবে বলল, খুব ব্যস্ত ছিলাম, বেশি লোককে বলা হয়নি। বেশি লোক আর আমি? অশোক আর একটিও কথা না বলে কাজে মন দিয়েছে। আমি বেরিয়ে এলাম। এ-রকম আশ্চর্য আমি বহু দিন হইনি। এ কী রহস্য! খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে, অশোকের সঙ্গে জীবনে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। টাকা ধার নিয়ে মেরে দিইনি। বেশ চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল এক সময়। এক মেসে এক সঙ্গে দু’বছর কাটিয়েছি। হঠাৎ অশোক আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ পরিচয় অস্বীকার করতে চাইছে। কেন? কী জানি। বিয়ে করেছে, নেমন্তন্ন করেনি। এর কোনও রকম কারণই মনে পড়ে না। খানিকটা গিয়ে অশোকের দিকে ফিরে তাকালাম। মহাত্মা গান্ধীর ছবির নিচে অশোক মুখ নিচু করে কাজ করছে, এ-দিকে চেয়েও দেখছে না, সারা দিনে এই প্রথমআমার বিষম মন খারাপ লাগল। খালি পেট ও মন খারাপ এই দুটো এক সঙ্গে থাকা খুব বিচ্ছিরি। অশোকের কাছে খেতে চাইব ভেবেছিলাম, তা-ও হল না, অথচ অশোক আমার মন খারাপ করে দিল। মানুষ এত নিষ্ঠুর।
হলঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে গেলাম আস্তে আস্তে। নিওন আলোর নিচে ঝুঁকেপড়া মুখগুলি ভাল করে খুঁজে খুঁজে দেখলাম। না, আমার কেউ চেনা নেই। আমাকেও কেউ চেনে না। এক সময় প্রায় আদ্দেক লোক চেনা থাকত। শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে টেবিলে, দু’পাশের বুকে-পড়া পড়ুয়াদের দেখে হঠাৎ যেন মনে হল, লঙ্গরখানায় ভিখিরিরা খেতে বসেছে। লাইব্রেরি কোনও দিন আমার এত খারাপ লাগেনি। মহাপুরুষের উক্তি চারদিকে কোলাহল করে। অসহ্য কোলাহল।
উর্দু অ্যালকভে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক চিরঞ্জীব রায়চৌধুরী বসে আছেন। বুঝলাম, আর একখানা থান-ইট বাজারে ছাড়বার মতলব। আজকাল আবার নভেলের মধ্যে দু’খানা ইংরেজি কোটেশান ফোটেশান থাকলে লোকে খুব আধুনিক মনে করে, চিবঞ্জীব রায়চৌধুরীরাও এ-সব জেনে গেছেন। তাই বুঝি নাাশনাল লাইব্রেরিতে? তাছাড়া বিনা পয়সায় পাখার হাওয়া। আমি চিরঞ্জীব রায়চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললাম, কেমন আছেন! নতুন উপন্যাস বুঝি?
এই যে, কেমন আছ তপেশ? তারপর –(হাত দিয়ে যে-বইটা থেকে টুকছিলেন তার নাম আড়াল করে) হা, হা, তোমার বইটা পড়েছি, সবটা পড়েছি, বুঝলে, বেশ ভালই হয়েছে। প্রথম তো, খুবই ভাল হয়েছে। তোমার হাত আছে তপেশ, লিখে যাও, বুঝলে।
আমি গোল গোল চোখে মোলায়েম গলায় বললাম, আপনি কষ্ট করে সবটা পড়লেন?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলো কী, তরুণ লেখকদের লেখা না পড়লে কি আর সাহিত্যের পালস বোঝা যায়? ভদ্রলোক হাঃ হাঃ করে হাসলেন। এই নিয়ে সাতাশ বার এই অশ্লীলকে আমি বলেছি যে, আমার নাম তপেশ নয়, তাপস। নামটাই উচ্চারণ করতে শেখেনি, ও আমার বই পড়েছে? আমার বই পড়লে ও এইরকম নিশ্চিন্তে বসে লিখতে পারত কিংবা বোকার মতো হাসত? তাহলে এত দিনে ওর অম্বলেব অসুখ হত না? বস্তুত লোকটার ব্যবহারে আমি এমন অসম্ভব চটে গেলাম যে, ওকে কী শাস্তি দেব মনে মনে ভাবতে লাগলাম। এই মুহূর্তে ওর নাক মুলে দেবনা পকেট মারব এই নিয়ে দ্বিধা করলাম খানিকক্ষণ। পকেটে একটা পাঁচ পয়সা নিয়ে হেড-টেল করতে লাগলাম। হেড নাক মলা, টেল পকেটমারা। ওর সঙ্গে অন্যান্য কথা বলতে বলতে পয়সাটা বার করে দেখলাম। টেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এবার কী নিয়ে লিখছেন, স্যার? এক সময় উনি আমার অধ্যাপক ছিলেন।
এবার খুব বড় থিম ধরেছি ভাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ –সব মিলিয়ে বিরাট প্ল্যান। এব মধ্যে একটি নায়ক আর তিনটি নায়িকার জীবন-দর্শন। হাজার পাতার বই হবে অন্তত, স্মল পাইকা।
নায়ক কীসে মরছে এবার? ট্রেনের নিচে সুইসাইড?
না, হে, প্রত্যেক বার এক রকম হয় না। বন্যায় ভেসে যাবে।
ও, আমি অভিভূত গলায় বললাম, কতটা লিখলেন?
সাত দিনে প্রায় ওয়ান-ফিফথ লিখে ফেলেছি। এখন যুদ্ধের ব্যাপারে মুসোলিনির একটা স্পিচ ঢোকাব।
আপনাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে। চলুন, চা খেয়ে আসি।
চলো যাই, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ বসে আছি। খাটতে হয় হে, ফঁকি দিয়ে সাহিত্য হয় না। বিনা পরিশ্রমে ইতিহাসে আসন পাওয়া যায় না।
আপনার আগের বইটা কত এডিশন হল, তেরো না চোদ্দ?
একুশ চলছে। বম্বে থেকে কিনেছে শোনোনি? তেলেগু ভাষায় অনুবাদ বেরুচ্ছে এ মাসে।
ক্যান্টিনে খুব ভিড় ছিল, আমি ওঁকে চিড়িয়াখানার ভেতরের দোকানে নিয়ে এলাম। ঢুকেই আমি পাঁচ-সাত রকমের ঢালা অর্ডার দিয়ে দিলাম। কী, ও কী, ভদ্রলোক হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠলেন, অত খাবার কে খাবে? তুমি খেয়ে আসোনি নাকি?
আমি বিগলিত ভাবে বললাম, আপত্তি করবেন না আজ, অনেকদিন বাদে আপনাকে পেয়েছি। আজ আমি আপনাকে খাওয়াব। আপনি আমার বইটা পড়েছেন কষ্ট করে–
না, না, তা কী হয়, কী খাবে খাও না, পয়সার জন্য কী! আমি বয়োজ্যেষ্ঠ, তুমি পয়সা দেবে কেন? আমার আবার অম্বলের খানিকক্ষণ চুপচাপ প্লেট সাবাড় করার পর বললাম, আপনি তবুআমার বইটা পড়েছেন, ওমুক-ওমুক বিখ্যাত লেখকেরা তত উলটেও দেখেননি। সবশালা বিখ্যাত সাহিত্যিক।
প্রসন্ন মুখে চিরঞ্জীববাবু বললেন, তোমার আবার রাগলে ভাষাজ্ঞান থাকে না। বুঝলে, অনেকে বোঝেন না যে ইয়ং ব্লাডই হল সাহিত্যের–হঠাৎ চিরঞ্জীব রায়চৌধুরীর মুখের রেখা কোমল হয়ে এল। একটু আলতো ভাবে বললেন, পয়সার লোভটা বড় সাংঘাতিক, সবাই লোভ সামলাতে পারে না। আমিও যে ঠিক পেরেছি, তা বলতে পারি না। টাকার লোভে অনেক সময় হেলাফেলা করে বাজে লেখা লিখেছি। কিন্তু কি জানো, এখনও আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে তোমাদের বয়সটা, যখন সাহিত্যই ছিল ধ্যান-জ্ঞান, সাহিত্যের জন্য সাধনা করেছি। বুঝলে টাকা-পয়সা কিছুনা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, সে কী, টাকা-পয়সা কিছু না তো আপনি লেখেন কেন? আমি তোদু চারটে টাকা পাবার আশাতেই লিখি। নইলে আর লেখার কী দরকার?
যাঃ এটা তোমার বানানো কথা। তোমাদের এই বয়সে টাকা-পয়সা কিছুনা, সাহিত্যই হচ্ছে–
চিকেন-স্টু-টা কিন্তু চমৎকার করেছে, একটু খেয়ে দেখুন। আমি বললাম হাত মুছে কফিতে চুমুক দিতে দিতে। তিনি বললেন, সিগারেট আছে তোমার কাছে? ছিল। কী যেন ভেবে তবু বললাম, না তো। তিনি পকেট থেকে লাল দুটাকার নোট বার করে বেয়ারাকে ডাকতে যেতেই আমি বললাম, দিন, আমি নিয়ে আসছি। কী সিগারেট?
গোল্ডফ্লেক।
বসুন, এসে আপনার উপন্যাসের প্লটটা শুনব।
দোকান থেকে বেরিয়েই একটি অত্যন্ত সুন্দরী কিশোরী মেয়েকে দেখতে পেলাম। সাদা ফ্রক-পরা, রাজহংসীর মতো। মেয়েটার পেছন পেছন খানিকটা গেলাম। তিন-চার জন মহিলা, দু’টি বাচ্চা, দু’জন পুরুষের একটি দলের মধ্যে ওই মেয়েটি। মেয়েটি কী কারণে যেন অভিমান করেছে, মুখখানি তাই ঈষৎ থমথমে। ওই অভিমানের জন্যই ওর মুখখানা কী অপরূপ হয়ে উঠেছে। মেয়েটিকে মনে হয় ওই দলটা থেকে একেবারে আলাদা। বস্তুত সারা পৃথিবীর থেকেই ওকে আলাদা মনে হয়। মেয়েটি চুম্বকের মতো আমায় টানল। মেয়েটা গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আমিও বাইরে এলাম। বেরিয়েই দেখলাম, একটা বিরাট স্টেশন ওয়াগন, মেয়েটি দলবলের সঙ্গে সেটাতে উঠছে। মেয়েটির সঙ্গে একবারও আমার চোখাচোখি হয়নি। ও আমাকে দেখেনি। আমিও ইহজীবনে ওকে আর দেখব না। গাড়িটা চলে যেতেই আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তারপর চোখে পড়ল সামনেই একটা থ্রি বি বাস। এই বাস এমনই দুর্লভ যে, দেখামাত্র আর অন্য কোনও কথা আমার মনে হল না। বাসটা স্টার্ট দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে উঠে পড়লাম। এবার দু’টাকার নোটটা ভাঙিয়ে টিকিট কাটতে কোনও অসুবিধে হয় না, ফেরত খুচরোটা পকেটে রাখবার পর নিজেকে বেশ ধনী মনে হয়। একটা পাঁচ নয়া ছুঁড়ে সার্কুলার রোডের বুড়ি পাগলিটাকে দিলাম।
এবার? রোদ্দুর ও ছায়ার মধ্যে দিয়ে বাস ছুটে যায়। লোকজন ওঠে ও নামে। আমি কোথায় নামব জানি না। এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত টিকিট কেটেছি। এবার কোথায় যাব? এখনও দীর্ঘ সময় পড়ে আছে। আবার কি গোড়া থেকে খোঁজা শুরু করব? ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেই তো বিকেলটা কাটাতে পারতাম। কোনও রকমে ইংরেজিটা পড়তে পারি, অনিমেষ বা বিমলেন্দুর মতো না হলেও এক কালে তো কিছু ইংরেজি বইও পড়েছি। সিলিনের বইটা আকে পড়েছিলাম পাঁচ মাস আগে, সেটা শেষ করা যেত। কিংবা রিকুইজিশান স্লিপের গোছার উলটো পিঠে একটা ছোট গল্পও মশ করতে পারতাম, লিখলে দু-চারটে টাকাও কি আর পাওয়া যেত না, টাকার জন্য এরকম উঞ্ছবৃত্তি না করে। কিন্তু পড়তে বা লিখতে কিছুই ভাল লাগে না। যেন একটা বাঁশের খাঁচায় বন্দি আছি, দাঁত দিয়ে কেটে খাঁচা ভেঙে সহজেই বেরুতে পারি, বেরুতে ইচ্ছে করছে না বলেই আটকা রয়েছি। হঠাৎ একথাটা কেন মনে হল? খাঁচা-ফাঁচা আসলে বাজে হ্যাক। কিন্তু এ তো মহা মুশকিল, এখন কোথায় যাই? মহাশূন্যে রকেটে যারা যায়, পৌঁছুতে পারুক বানাই পারুক, তারাও জানে, তারা কোথায় যাবে। আমি জানিনি। মৃত্যুর পর শরীরের পঞ্চভূত জানে, তারা কোথায় যাবে। আমি জানি না। খুনি আসামিও জানে সে কোথায় যাবে, আমি নাঃ, এরকম ভাবে দিন কাটে না। এবার যার কাছে যাব, দেখা না পেলে আমি ভয়ঙ্কর চটে যাব তার ওপর, প্রতিশোধ নেব, দরকার হলে তার নামে থানায় ডায়েরি করে আসব। বাকি আছে শেখর। দেখি শেখরকে। কিছু পয়সাকড়ি পেলে পুরী কিংবা কাশীতে ঘুরে এলে বোধহয় ভাল লাগত। চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গে পরে যখন আবার দেখা হবে, প্রথমেই পায়ের ধুলো নিয়ে এমন ভুলিয়ে দেব।
শেখর বাড়িতেই। কারণ, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজায় টোকা মেরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর বিনা শব্দে দরজা খুলে গেল। খালি গায়ে শেখর, একটা ধুতি জড়িয়ে পরা, আমার দিকে ভুরু তুলে বলল, কী ব্যাপার, তুই?
একটু থতমত খেয়ে বললাম, এমনি এলাম।
হঠাৎ এ সময়?
আমি কি ভুল শুনছি, আমি বুঝতে পারলাম না। নাকি কোনও বিদেশে এসেছি, যেখানে কারুকে চিনি না? নাকি রিপ ভ্যানের মতো দীর্ঘকাল ঘুমিয়ে উঠে দেখছি হঠাৎ সব বদলে গেছে? নচেৎ, শেখর! শেখর বলছে, হঠাৎ এ সময়? যেন আমাকে চেনেই না, সেই শেখর, যে আমাকে আমি যাকে- যে আমাদের, আমরা যাকে । সেই শেখর যে সিনেমা দেখতে গিয়ে অবধারিত গণ্ডগোল বাধাবে, ও দাদা টাক চুলকুনো থামান, ও ডান দিকের মশাই, প্রেমালাপটা একটু আস্তে, কিংবা এই যে সিনেমাটা পিছনের দিকে নয়, সামনের দিকে-এইসব দিয়ে প্রত্যেক দিন ঝগড়া বাধাবে আর আমরা ওকে বাঁচাব, আর যে-শেখর মদ খেয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লে আমরা ওকে লরিচাপা থেকে বাঁচাতে যাই, যে-শেখর কবিতার জন্য বাড়ি পুড়িয়ে দিতে পারে, ছ’বছর ধরে যে কবিতার পত্রিকা বার করে বাপের টাকা ওড়াচ্ছে, পরশু দিনও যে-শেখরের সঙ্গে আমি তিন ঘণ্টা কাটিয়েছি। হঠাৎ কেন জানি না, আমার চোখে জল এসে গেল। সত্যিকারের কান্নার চোখ, আমি চোখ নিচু করলাম। অশোক প্রথম আঘাত দিয়েছিল, তারপর শেখর।
শেখরমুখ কালো করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, দাঁড়া, আমি আসছি, সিগারেট কিনতে বেরুব। শেখর আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে গেল! আমাকে ভেতরে যেতে বলল না। না বলুক, কিন্তু দরজাটা ভেজানো, আমি কি চলে যাব? কেন এবং কোথায় যাব? আমি শেখরের ওপর যথেষ্ট রেগে যেতেও পারছি না, তার বদলে আমার মন ভেঙে আসছে। শেখর চটি গলিয়ে চট করে ফিরে এল। কোনও কথা না বলে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। তারপর সদর পেরিয়ে আসার পর ও বোমার মতে ফেটে পড়ল :ইডিয়েট, রাস্কেল, অশ্লীল অশ্লীল, তোকে না অত করে বললাম সে-দিন দুপুরবেলা ভেতরে থেকে দরজা বন্ধ দেখলে খবরদার আমাকে ডাকবিনা।
কেন রে? আমি সম্পূর্ণ আকাশ থেকে নরকে পড়লাম।
ফের –মি, করছিস?
সত্যি, আমি কিছুই জানি না, বিশ্বাস কর।
বিশ্বাস করব, আমাকে ডোবাবার মতলব!
না না, সত্যি শেখর, বিশ্বাস কর, আমার কিছুই মনে নেই। শেখর বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমার গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে আসছিল।
সে-দিন বলিনি তোকে যে দুপুরবেলা একটা বিরাট বড়লোকের মেয়েকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি? মাসে আড়াইশো দেবে, তাছাড়া গেঁথে ফেলতে পারলে –।
একদম মনে ছিল না, সত্যিই।
মনে ছিল না? কেন ছিল না? যদি দেখে কতগুলো লোফার ছাবড়া সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব –শেখর এই কথাটা হেসে বলেছিল। আমি শেখরকে মোটে ঈর্ষা করলাম না। বরং খানিকটা যেন করুণা হল, বললাম, যাঃ, আমাকে মোটেই লোফার কিংবা ছ্যাবড়া সাহিত্যিকের মতো দেখতে নয়। প্রায় তোর মতোই ভাল চেহারা আমার।
এখন কেটে পড় ভাই। আমাকে চান্স দে।
আমি অন্য দিকে মুখটা ফিরিয়ে চোখ মুছে নিলাম। শেখরকে ছাড়তে কিছুতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। শেখর আমার শেষ আশ্রয়। একটা মেয়ের জন্য শেখর এমন চমৎকার দুপুরটা নষ্ট করছে। আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? আমি বললাম, শেখর। শেখর মুখ তুলে বলল, কী? আমি পুনরায় বললাম, শেখর–। শেখর বলল, কী ন্যাকামি করছিস! আমি বললাম, শেখর, সকালে থেকে খুব খারাপ লাগছে, মানে বিচ্ছিরি লাগছে, আর কী! খুব কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে, তাই তোর কাছে এলাম।
শেখর এতেও গলল না। বলল, কবিতা পড়ার ইচ্ছে? এই দুপুরবেলা? ন্যাকামির একটা সীমা আছে। তা তোর ইচ্ছে হয়েছে, তুই গঙ্গাব পাড়ে বসে দখিন হাওয়া খেতে খেতে কবিতা পড় গিয়ে। আমার এখন সময় নেই, তাই।
বিশ্বাস কর, আজ হঠাৎ খুব বিলকের কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে। তোর রিলকের কালেকশানটা দে। পার্কে বসে পড়ব।
কবিতা পড়বি, তা-ও আবার বিলকের কবিতা? শখ কম নয় তো!
তুই তো জানিস, আমি রিলকের কবিতা কত ভালবাসি। আমি রিলকের মূল্য বুঝি।
তুই কবিতা কিছুই বুঝিস না। বরং জা জেনের ‘আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’ পড়, তোর কাজে লাগবে।
না, আমি রিলকে চাই।
শেখর দাঁড়িয়ে রইল খানিকটা চুপ করে। সিগারেট টানল। বলল, আচ্ছা দাঁড়া, এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সন্ধের পর দেখা করব। আমি বললাম, কাপড়টা ফেরত দিয়ে পরে নে শেখর। জমিদারের মেয়ের সামনে অমন ভাবে বসতে নেই।
চামড়ায় বাঁধনো রিলকের কালেকশানটা পেয়ে আমি বুকে চেপে ধরে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। যেন মহামূল্যবান সম্পদ আমার বুকে। এতক্ষণে আমার অনিশ্চিত নিঃসঙ্গতার বোঝা কাটবে নিশ্চিত। আ, বিলকে, তোমাকে আমি কত ভালবাসি। সারা পৃথিবীর লোক তোমার ভক্ত, এখনও তরুণরা তোমার লেখা কিনে পড়ে। কত সাধনায় তোমাকে পেয়েছি, অথচ এক মিনিটে।
আমি জানি, তুমি কত বড় কবি, যদিও জীবনে এক লাইনও পড়িনি। পৃথিবীময় তোমার ভক্ত, তাই তোমার প্রতি আমার ভালবাসা এত প্রগাঢ়। তুমি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়, কারণ শতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের সুলভ গ্রন্থাবলী বেরিয়েছে, কিন্তু তোমার কোনও পেপারব্যাক এডিশন নেই, তুমি কি বাংলাদেশের কথা জানতে? বাংলাদেশেও এখন তোমার প্রতি ভক্তির ঢেউ বইছে। তোমার গোলাপের কাঁটায় বেঁধা বুকের রক্তের কবিতা। বইটার একটা পাতা ওলটাতেও আমার ভয় করল, যেন আমার চোখ আটকে যাবে। আমি সোজা বাসে চেপে এলাম কলেজ স্ট্রিটে ফুটপাতের পুরনোবইয়ের দোকানে। এসে বললাম, এই নাও, ভাল মাল এনেছি।
লোকটা লুঙ্গি তুলে ঊরু চুলকোচ্ছিল। বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে বললে, আজকাল তেমন চলে না এ বই।
ও-সব ফিকির ছাড়ো মিঞা, রিলকে চলে না তুমি আমাকে বোঝাবে?
না, একটু মারকেট পড়ে গেছে। সেদিন যে মারি স্টোপস এনেছিলেন—
ভাগ! সোনালি চশমা পরা মেয়েরা, লম্বাচুল বাবুরা কিংবা হাওয়াই কোর্তা-পরা ছোকরারা এই লুফে নেবে।
না, সত্যি বলছি, আজকাল– ।
যাঃ যাঃ, কালও আমি এখানে দাঁড়িয়ে শুনে গেছি একজোড়া ছোকরা-ছুকরি খোঁজ করে গেল। ব্রান্ড নিউ মাল, দেখো।
লোকটা একটু হেসে বলল, লেকিন নাম লেখা আছে, তুলতে হবে।
ও তো একটু ক্লোরিন ঘষার মামলা। ঝুট ঝামেলা করো না, কত দেবে বলে?
অনেক দরকষাকষির পর আট টাকা পাওয়া গেল। সারা দিনে এইটাই সব চেয়ে বড় সাকসেস। আর কিছু চাইনা। পরও পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। এখন একটু কফি খাওয়া যেতে পারে। এখন কারুর দেখা না পেলেও আমার আর একা লাগবে না। পকেটে আট টাকা আছে সঙ্গী! চিরঞ্জীবের টাকাটা দিয়েই কফি-টফি খাওয়া যাবে। ওই টাকায় এক প্যাকেট গোল্ডফ্লেক কিনলাম, কেন না উনি গোল্ডফ্লেক কিনতে বলেছিলেন। প্রায় বছর পাঁচেক বাদে আমি নিজের হাতে নিজের টাকায় গোল্ডফ্লেক কিনলাম। এত দাম বেড়ে গেছে জানতাম না। কারা খায় এ-সব!
কফি হাউসের জানালার পাশের টেবিলে একা পরীক্ষিৎ বসে ছিল। বিশাল লম্বা শরীরটা নিয়ে ঝুঁকে আছে পরীক্ষিৎ। একটা দু-বুক পকেটওয়ালা খাঁকির জামা পরেছে। পরীক্ষিৎ আমার চেয়ে প্রায় আধফুট লম্বা, স্পষ্ট, সত্যজিৎ রায়ের মতো চোয়াল, ওর শরীরটা আমি ঈর্ষা করি। আমি পাশে দাঁড়াতেই ও মুখ তুলল। পরীক্ষিতের চোখ দুটো অসম্ভব লাল। বলল, সারা দিন কোথায় ছিলি? তোর মেসে গিয়েছিলাম দুপুরে।
আমি যে সারা দিন যে-কোনও বন্ধুকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি সে-কথা ওকে জানালাম না। বললাম, অনিমেষ আর গায়ত্রী এসেছে, শুনেছিস?
শুনেছি।
দেখা হয়নি তোর সঙ্গে?
হু! ওরা ফিল্ম দেখতে গেল।
অবিনাশও?
না, অবিনাশ ওখানে নেই। ছিল, ছায়ার সঙ্গে কী যেন ঝগড়া করে চলে গেছে।
কীসের ঝগড়া?
কে জানে। ওর মতলব বোঝ আমার কম্ম নয়।
তোকে এ-রকম দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?
কাল জ্বর হয়েছিল রাত্রে। কুচ্ছিৎ স্বপ্ন দেখেছি। মাথার ঠিক মাঝখানে খুব ব্যথা হচ্ছে আজ। তোর কাছে টাকাকড়ি আছে কিছু?
কেন, ওষুধ কিনবি?
হ্যাঁ! অনেক দিন, দিন সাতেক খাইনি। একটা পয়সা নেই হাতে। দিন সাতেক অফিস-টফিস যাচ্ছি– ।
চল যাই। বাংলা-টাংলা হতে পারে, অল্প আছে। কিংবা কলাবাগানেও যেতে পারি। আমারও খুব ইচ্ছে করছে সারা দিন।
পরীক্ষিৎ হাত দিয়ে কপালটা টিপছিল। সত্যি খুব ব্যথা হচ্ছে বুঝতে পারলাম। ব্যথাটা কী রকম রে? ডাক্তার দেখাবি নাকি?
একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, জানিস তাপস। বছর খানেক আগে যে-অনিমেষের ওখানে ব্রিজ থেকে পড়ে মাথা ফেটেছিল, এত দিন পর আবার ঠিক সেইখানে ব্যথা হচ্ছে।
সেলাই গণ্ডগোল হয়েছিল নাকি? অনেক সময় ও-থেকে বিচ্ছিরি জিনিস হয়।
পরীক্ষিৎ আমার দিকে রক্তবর্ণ চোখ তুলে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল, আমি অবিনাশকে খুঁজছি। ওর কাছে একটা কথা জিজ্ঞেস না করলে, আমার ব্যথা কমবে না, আমি জানি।
অবিনাশ কী করবে?
এত দিন পর, জানিস, আমার মনে হচ্ছে, আমি কি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, না অবিনাশ আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল?
যাস শালা, তোর কি মাথা খারাপ! তুই এক-একবার এক-এক রকম বলিস।
কিন্তু অ্যাদ্দিন বাদে, এ-কথাটা আমার মনেই বা হল কেন? আর, মনে হওয়ার পর থেকেই মাথার যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে।
কিন্তু অবিনাশ যদি তোকে ফেলে দিয়ে থাকে, তবেঅবিনাশই আবার বাঁচিয়েছে –একথাটাও জেনে রাখিস। আমি ছিলাম সেখানে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস? অবিনাশ আমাকে কী-রকম এড়িয়ে এড়িয়ে পালাচ্ছে? বহু দিন ওর সঙ্গে ভাল করে কথাই হল না। দেখা হলেও ভিড়ের মধ্যে চালাকি করে অন্য কথায় চলে যায়।
অবিনাশ তো বলছে, ও সরল, স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চায়। লেখা-ফেখার ইচ্ছে নেই। বিয়ে করে দীর্ঘ সুখী জীবন কাটাবে।
কিন্তু যে-রকমভাবে দিন কাটাচ্ছে, সেটা কী?
ওটা একেবারে দাগি আসামি। সরলতা মানে যে ওর কাছে কী, তা বোঝা অসাধ্য। মায়াকে নিয়ে কী কাণ্ড করেছে, কে জানে!
মায়াকে নিয়ে।
তুই জানিস না, মায়াকে নিয়ে পুরী বেড়াতে যাবে ঠিক করেছিল। মায়া হঠাৎ হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত গিয়েও ফিরে আসে। তার পরেও অবশ্য মায়া ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়াকে নিয়ে সম্ভবত ও একটা গভীর গণ্ডগোল পাকাবে। (এ গল্পটা সম্পূর্ণ বানিয়ে বললাম পরীক্ষিতের কাছে। কেন বানালাম, কী জানি। সম্পূর্ণ অজান্তে অবিনাশ ও মায়া সম্বন্ধে এই কাহিনি আমার মুখ থেকে গড়গড় করে বেরিয়ে এল। )।
না, গণ্ডগোল মায়াকে নিয়ে না, অন্য এক জনের সঙ্গে। পরীক্ষিৎ বলল।
কে?
তোকে বলে লাভ নেই, তুই কোনও জিনিস ভাল করে ভেবে দেখতে চাস না। তোর কাছে জীবন মানে এই মুহূর্তে বসে থাকা, কাল কিংবা ভবিষ্যতে কী করবি, তোর কোনও ধারণাই নেই।
চল, উঠি।
অবিনাশকে তুই-ই বেশি পাত্তা দিয়েছিলি। ওকে হিরো বানিয়েছিস। ওর মধ্যে কী আছে? শুধুই স্টান্টবাজি। ওর সঙ্গে আমার আলাদা বোঝাঁপড়া আছে। কেন আমার মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, জানতে হবে।
জানতে হবে –এই কথাটা পরীক্ষিৎ সন্ত-পুরুষের মতো শান্ত গলায় বলল, যেন ওর মধ্যে দিব্যজ্ঞানের তৃষ্ণা। আমি বললাম, চল, কোনও ডাক্তারের কাছেই যাই। আমার কাছে গোটা আষ্টেক টাকা আছে।
থাক, কাল কি পরশু যাব। আজ চল কিছু খাই। ভাল লাগছে না। তবে ওই আট টাকাহ রচ করতে পারবি তো? আমার কাছে কিছু নেই কিন্তু।
চল, অন্য কেউ আসবার আগেই উঠে পড়ি।
পরীক্ষিৎ ক্ষেপে গিয়েছিল। ঘণ্টা খানেকেরমধ্যেই সব টাকা চেটেপুটে শেষ করে দিল। খালাসিটোলা বন্ধ হয়ে যেতে পরীক্ষিৎ বলল, চল, টালিগঞ্জে শশাঙ্কর কাছে যাই।
বেরিয়ে পরীক্ষিৎ তীরের মতো ছুটে রাস্তা পার হয়ে গেল, আবার লাফাতে লাফাতে ফিরে এসে বলল, আমার শরীর জ্বলছে, তাপস।
পরীক্ষিতের মাথার চুল খাড়া হয়ে গেছে, চোখ দুটি ছল ছল, সারা মুখে শুধু প্রহরীর তলোয়ারের মতো নাকটা জেগে আছে। বুঝলাম, ওকে শয়তান ভর করেছে। বললাম, শশাঙ্কর কাছে কেন?
শশাঙ্কর এক বন্ধুর দোকান আছে। মাঝে মাঝে ব্যবস্থা করে খাওযায়। চল না, আঃ, চল না, কেন দেরি করছিস?
শশাঙ্ক নিরীহ চেহারার একটি বদমাইসির ডিপো৷ কাতর মুখভঙ্গি করে দুনিয়ার যত খারাপ খারাপ কথা বলে। ভালই লেখে, কিন্তু ওর নভেল আজ পর্যন্ত পড়ে শেষ করতে পাবিনি। পরীক্ষিৎ বিকট মোটা গলায় শশাঙ্ককে ডেকে নামাল। স্পষ্ট বোঝা গেল, শশাঙ্ক লিখছিল। কারণ, ওর বিব্রত ও বোকামিভরা মুখখানা দেখেই মনে হল ওর সমস্ত বুদ্ধি এই মুহূর্তে ও ওর গল্পের নায়ককে ধার দিয়েছে।
অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে শশাঙ্ককে জড়িয়ে ধরে পরীক্ষিৎ বলল, তুই কেমন আছিস, শশাঙ্ক, কত দিন তোকে দেখিনি, হঠাৎ বড় দেখতে ইচ্ছে করল তোকে। এবং এই কথা বলার পর হুড় হুড় করে বমি করে দিল ওর গায়ে। পরীক্ষিৎকে শশাঙ্কর হাতে সঁপে দিয়ে আমি একা বেরিয়ে এলাম।
.
যত দূর সম্ভব মনে করে করে তেরোই এপ্রিল ১৯৬১-র কথা লিখছি। কিন্তু কী বাদ গেল? হ্যাঁ, ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে চিরঞ্জীব রায়চৌধুরীর সঙ্গে বেরিয়ে আসবার সময় আমি অশোকের দিকে বিস্মিত ভাবে আর একবার তাকিয়েছিলাম। চোখাচোখি হল, হঠাৎ মনে হল, অশোক কাঁদছে। হা ঈশ্বর, আজ পর্যন্ত অশোকের রহস্য জানা হল না। তারপর থেকে অশোকের সঙ্গে আজ পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। অশোক যে-মেয়েটিকে বিয়ে করেছে, তাকে আমি কস্মিনকালেও চিনতাম না। সুতরাং সে-দিক থেকেও কোনও গণ্ডগোলের কারণ নেই। অশোক, তোর কাছে করে কী অপরাধ করেছি, মনে পড়ে না, তবু কোনও এক দিন আমাকে ক্ষমা করিস।
তেরোই এপ্রিলের কথাই-বা কেন নিলাম, জানি না। কোনও নতুনত্ব নেই, তবু সে-দিন বাড়ি ফেরার পথে যে অনুভব হয়েছিল, সেই জন্যই দিনটা মনে আছে। মনে আছে মন্থর পায়ে মেসে ফিরছিলাম। মেসে কেন ফিরব, এর কোনও উত্তর জানা ছিল না। যেমন মেস থেকে বেরুবার সময় কোথায় যাচ্ছি জানতাম না। যেন পাশাপাশি দুটো ট্রেন ভয়ঙ্কর বেগে ছুটে চলেছে, যে-কোনও একটার জানালা থেকে সম্পূর্ণ গতিহীনতা কোটি কোটি মাইল দূরে যে-নক্ষত্রের আলো এখনও পৃথিবীতে পৌঁছায়নি, বা যে-নক্ষত্রের মৃত্যুসংবাদ এখনও পৃথিবীতে আসেনি, এখনও পরীর চোখের মতো জ্বলছে –যেন আমিও সেই রকম। আমি যে পৃথিবীতে আছি, কেউ জানে না। আমার মৃত্যুর পর জানা যাবে, আমি পৃথিবীতে একা হেঁটে গিয়েছিলাম। আমি এক গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করার সময় সেই গাছটাকে প্রণাম করেছিলাম। আমি একা অন্ধকারে, কেউ শ্রোতা নেই জেনেও আপন মনে একটা গান গেয়েছিলাম। আমার চটি ছিঁড়ে যেতে আমি চটিজোড়া কোলে নিয়ে খালিপায়ে মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলাম, আমি জানি, সব দৃশ্যই অদৃশ্য জগতের উলটো পিঠ। মনে পড়েছিল, আমি প্রত্যেক দিন মাথার বালিশ ছাড়া বিছানায় শুই।
মেসে ফেরার কথা মনে পড়লেই রামসদয়ের কথা মনে পড়ে। আমার রুমমেট রামসদয়। বড় ভাল লোকটা, কিন্তু এমন অপমান করেছিল এক দিন। এক দিন অনেক রাত্রে ফিরেছি, রামসদয় জেগে ছিল। আমাদের ঘরের পাশেই বাথরুম। বাথরুমে মুখ ধুতে গেছি। সেদিন আমার এমন কিছু নেশা ছিল না, শরীর সুস্থ ছিল, কিন্তু বাথরুমে ঢুকে আমি চিৎকার করে ভয়ে পিছন ফিরতে গিয়ে পড়ে গেলাম। আমি দেখলাম, বাথরুমে একটা মানুষের মুণ্ডু ঝোলানো রয়েছে, শরীরহীন একটা মুণ্ডু, অভিব্যক্তিহীন, ভাবলেশহীন চোখ। মুখখানা ও-রকম নিস্পৃহ বলেই বীভৎস। রামসদয় ছুটে এসে ঢোকার আগেই আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, ভয়ে আর মুখ ফেরাইনি, জিজ্ঞেস কবলাম, ওখানে কী, কী, কীসের মুখ ওটা? আমি এত স্পষ্ট দেখেছিলাম যে, সন্দেহ করিনি।
রামসদয় আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ওঃ এই, চলুন, শোবেন চলুন।
কার মুখ?
কিছু না, আমার দোষেই –।
আমি ফিরে তাকালাম, তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কেমন লজ্জা হল। রামসদয় দাড়ি কামাবার জন্য বড় আয়নাটা এনে ঝুলিয়েছিল, বদমাস টেকোটা আর আয়নাটা ঘরে নেয়নি। মাঝ রাতে মাতালকে ভয় দেখাবার জন্য বাথরুমে ফাঁদ পেতেছে। রামসদয় আমার হাত ধরে নিয়ে এল ঘরে, বিছানার চাদরটা ঝেড়ে আমাকে শুইয়ে দিল। আমি সাহিত্যিক বলে লোকটা আমাকে একটু খাতির করে। আলো নিভিয়ে দিই? রামসদয় জিজ্ঞেস করল, তারপর অল্প একটু হেসে বলল, শেষকালে নিজের মুখ দেখেই ভয় পেলেন?
শেষ কথাটাই মারাত্মক। দু’গালে পাঁচটা থাপ্পড়ের মতো। লজ্জায় কিংবা ভয়ে অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারিনি। নিজের মুখ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আমার নিজের মুখ সব চেয়ে চেনা। ঊনত্রিশ বছর ধরে যে মুখ দেখেছি। দাড়ি কামাবার সময় বা কতবার পানের দোকানের আয়নায় বা ট্যাকসির কাঁচে। গ্রুপ ফটোতে, লোকে যেমন বলে মেয়েদের চোখের মণিতে আমি এ মুখচ্ছবি আমি কতবার দেখেছি। তবু চিনতে পারলাম না। ভয় পেলাম, যদিও চোখে এমন কিছু রঙ ছিল না। এই রকম হেঁদো দার্শনিক হা হুতাশ কিছুক্ষণ করে আমার ভয় দেখানো মুখখানা বালিশে চেপে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর মাস দুয়েক কোনও স্বপ্ন দেখিনি পর্যন্ত।
নাঃ, এবার শেষ করা যাক। আর ভাল লাগছে না। তারপর কী হল সেই রাতে, পরীক্ষিৎকে ছেড়ে আসার পর? ওঃ সেই রাত, সেই –একা একা অনেকখানি হেঁটে এসেছিলাম, চৌরঙ্গীতে বড় রাস্তা ছেড়ে হেঁটে এলাম মাঠ দিয়ে। একবার পকেটে হাত দিলাম, সিগারেট নেই, কিছুই নেই, শুধু মাত্র একটি পাঁচ পয়সার ঢেলা পড়ে আছে। আবার সেই জঞ্জাল, কাল সকালে আবার ওই নিয়ে দুশ্চিন্তা। হাসি পেল, বুড়ো আঙুল ও মধ্যমার ওপর পয়সাটা বসিয়ে জোরে একটা টুসকি মেরে বললাম, যাও সখা, বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে। পয়সাটা ডানা মেলে অন্ধকারে উড়ে গেল। পরক্ষণে নিজের বোকামিতে নিজের আঙুল কামড়ালাম। পাঁচটা নয় পয়সা ওড়াব, এমন অবস্থা আছে নাকি আমার? সেটাকে খুঁজতে লাগলাম। জ্বালতে জ্বালতে এগোচ্ছি, খালি পা কাদায় বসে যাচ্ছে, করে বৃষ্টি হল কী জানি!
পয়সা খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূর চলে এসেছিলাম। হঠাৎ একটা পুকুর। বেশ বড় জলাশয়, চারদিকে মেহেদি গাছের বেড়া দেওয়া। পরিষ্কার জায়গাটা, অল্প জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে পরিষ্কার জল। এখানে এরকম পুকুর ছিল, কোনও দিন তা জানতাম না। চারদিকবাঁধানো, কোথাও এক ছিটে কাদা নেই, পুকুরের চার কোণে পাঁচটা গাছ, কোথা থেকে হাওয়া এসে ওদের পাতা দোলাচ্ছে। আহা, এমন সুন্দর জায়গা কলকাতায় আছে। কোনও দিন জানতে পারিনি। এমন পরিচ্ছন্ন পুষ্করিণী যেন বহুবার স্বপ্নে দেখেছি। হাত-পা এবং জামা-প্যান্ট, পয়সা খুঁজতে গিয়ে জল কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, ইচ্ছে হল, এই পুকুরে ভাল করে ধুয়ে নিই। এমনকী, এই পুকুরে স্নান করা যেতে পারে, একা একা অন্ধকারে সাঁতার কাটতে খুব ভাল লাগবে। এগুতে গিয়ে অদৃশ্য কোনও কিছুতে জোর ধাক্কা খেলাম। বেশ শক্ত কোনও কিছুতে মাথা ঠুকে গেল। কী? তাকিয়ে দেখলাম কিছু নেই। আশ্চর্য, তবে কি হাওয়ায় ধাক্কা লাগল! ভয় হল, মানুষের মৃত্যুকালে হাওয়া পর্যন্ত কঠিন হয়ে যায় শুনেছি। আবার সামনে হাত বাড়ালাম। দুই হাত, কোনও কঠিন অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা লাগল। নেশায় কিচুর হয়ে আছিনাকি? মাথা ঠাণ্ডা করে দাঁড়ালাম। আবার হাত বাড়ালাম। সেই অদৃশ্য কঠিন বাধা। এবার বুঝতে পারলাম, কাঁচ বা মাইকা বা শক্ত প্লাস্টিক বা ট্রান্সপারেন্ট কঠিন কিছু দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। কী অসম্ভব কাণ্ড! একটু পাশে সরে যেতেই একটা নোটিশ চোখে পড়ল।
রিজার্ভড পন্ড
পোহকিন্স ইনস্টিটিউট কর্তৃক সংরক্ষিত পুষ্করিণী
এই পুষ্করিণীর পাড়ে বা একশো গজের মধ্যে কাহারো বসা বা বিশ্রাম করা নিষেধ। বিষ প্রতিষেধক গবেষণার্থে এখানে জলজ সর্পের চাষ করা হয়। সাবধান! যদিচ এই সর্পগুলি বিষহীন, কিন্তু ইহাদের সন্ধানে দূর-দূরান্ত হইতে বিষধর সর্প আসিতে পারে। সম্ভব হইলে এই পথ পার হইবার সময় নিশ্বাস বন্ধ করিয়া যাইবেন। জনসাধারণের সহযোগিতা প্রার্থনীয়।
–অনুমত্যানুসারে
পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কোনও মাতাল বা গেঁজেলের দলবলের কাণ্ড এসব। বাংলাদেশে কী সাপের অভাব যে চাষ করতে হবে? এই রকম এত বড় একটা পুকুর-সাইজের কাচের জার বসিয়ে রেখেছে এখানে। কলকাতা শহরে প্রত্যেক দিন কেন অসংখ্য লোক সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছে, এবার বুঝলাম। খবরের কাগজে প্রত্যেক দিনই কলকাতায় সর্পাঘাতে মৃত্যুর খবর থাকে। তার মানে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সাপ আসে। কিংবা এমনও হতে পারে, পুরোটাই ধাপ্পা। পুকুরটাকে সুন্দর রাখবার জন্য এরকম একটা বাজে নোটিশ সটকেছে। আমি কাচের দেয়ালে দেয়ালে হাত দিয়ে পুকুরটার চারপাশে ঘুরে এলাম। কোথা দিয়েও ভেতরে যাওয়া যায় না, বেহুলার বাসরঘরের চেয়েও শক্ত। চার কোণে পাঁচটা গাছ হাওয়ায় দুলছে। সমান করে ছাঁটা বুক-সমান মেহেদির বেড়া। মার্বেল পাথরে বাঁধানো পাড়। পরিষ্কার জল। ঢেউহীন। মেঘ ভেঙে মাঝে মাঝে চাঁদের আলো। ওখানে অসংখ্য সাপ ও সাপিনি খেলা করছে। ভেতরে ঢোকার অসম্ভব ইচ্ছে হতে লাগল আমার। কাচের দেয়ালে গালটা ছোঁয়ালাম। সাপের গায়ের মতো ঠাণ্ডা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আমি জ্যোৎস্না ও সাপের খেলা দেখতে লাগলাম। অজান্তেই। অজান্তেই একবার যেন বিড় বিড় করে বললাম, দূর-দূরান্ত থেকে আর তো কেউ আসেনি। শুধু আমি একাই এসেছি। কাল অন্য সবাইকে ডেকে এনে দেখতে হবে, একথাও মনে পড়ল।