৫. ডাইনিং রুমে

সুজিতকে ডাইনিং রুমে পৌঁছে দিয়েই দোলা পালাল। তার হাসির রেশ তখনও বাজছিল। কিরণ বসে ছিলেন একটা চেয়ারে, সুজিতকে বললেন, বসো।

সুজিত তখন বিরাট ডাইনিংরুম দেখছিল। মস্ত লম্বা টেবিল, সাদা ধবধবে কাপড় পাতা রয়েছে তাতে। মাঝখানে পিতলের মোরাদাবাদি ফুলদানিতে রং-বেরং-এর ফুল। পাত্রে ফুল সাজানো। যদিও গুটি চারেক মাত্র চেয়ার টেবিলের এক অংশে রয়েছে। ঘরের একপাশে বৃহদাকারের রেফ্রিজারেটার। দেওয়ালে নানান রকমের ছবি। সবই বিদেশি শিল্পীদের পেন্টিংয়ের প্রিন্ট।

সুজিত মুগ্ধস্বরে বলল, এটা আপনাদের খাবার ঘর বুঝি?

কিরণ বললেন, হ্যাঁ।

–বাঃ, সুন্দর। কিন্তু আমি যে শুনলাম, আপনারা মাত্র তিন জন লোক এ বাড়িতে থাকেন।

 –হ্যাঁ, তাতে কী?

–এত বড় ঘরে খেতে ফাঁকা লাগে না?

কিরণ হেসে ফেললেন। বললেন, ও, এই কথা। লোকজন অতিথিরা এলে তখন সবই ভরে যায়।

–তা বটে।

সে আবার ঘর দেখতে লাগল। কিরণ বললেন, বসো, তোমার তো খুব খিদে পেয়েছে বলছিলে।

হঠাৎ যেন মনে পড়ে গিয়েছে এমনিভাবে সুজিত বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব খিদে পেয়েছে। সে তাড়াতাড়ি এসে বলল। আর নানারকমের খাবার হাঁ করে দেখল। গন্ধে তার নাসারন্ধ্র স্ফীত হল। আঙুল দিয়ে একটা প্লেটের খাবার দেখিয়ে বলল, এটা কী, এগুলো?

কিরণ হেসে বললেন, এগুলো চিকেন স্যান্ডউইচ। তুমি মুরগি খাও তো? সুজিত ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ খাই। এতগুলো স্যান্ডউইচ, আবার এ সবও দিয়েছেন? এই বাঁধাকপি সেদ্ধ, ডিম, এতগুলো ফল!

-তোমার যা ইচ্ছে করে খাও।

–আচ্ছা। বলে একটু সলজ্জ হেসে আবার বলল, একেবারে দুপুরের খাবার দিয়ে দিয়েছেন, না?

কিরণ তাড়াতাড়ি বললেন, না, না, দুপুরে তুমি আবার খাবে। কাল বিকেল থেকে কিছুই খাওনি বলছিলে, এ সব তাই তাড়াতাড়ি করে–

–ও!

সুজিত ততক্ষণে খেতে শুরু করেছে। তার খাবার ভঙ্গির মধ্যে কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। কিন্তু তার সারা মুখে ক্ষুধার তৃপ্তি ফুটে উঠেছে। খেতে খেতেই, মাঝে মাঝে মুখ তুলে, কিরণময়ীর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। হয়তো কিছু বলতে চাইছে, মুখভরতি খাবারের জন্য পারছে না। কিরণময়ীও যেন এই খাওয়ার দৃশ্যটা উপভোগ করছিলেন। একটি করুণা মেশানো স্নেহ তাঁর চোখে। তিনি মাঝে মাঝে বলে উঠলেন, খাও, খেয়ে নাও, তারপরে কথা বলো।

সুজিত তার জবাবে এক বার বলে উঠল, হ্যাঁ, তা নইলে অসুবিধে হয়।

কিরণময়ী ঘাড় নাড়লেন। দোলা সামনে এল আবার। তার মুখ আরক্ত। বলল, আপনি চা খাবেন, না কফি?

সুজিতের খাবার চিবোনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এক বার কিরণময়ীর দিকে তাকাল। আবার দোলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ।

কোনও রকমে ঢোঁক গিলে খাবার গলাধঃকরণ করে বলল, চা।

মা ও কন্যার মধ্যে এক বার চোখাচোখি হল। দুজনের মুখেই হাসির ছটা। দোলা চলে গেল তাড়াতাড়ি, জালের দরজার পাল্লা ঠেলে। সুজিতের খাওয়াও ইতিমধ্যে শেষ হয়ে এল। দোলা নিজের হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সুজিতের কাছেই একটা চেয়ারে বসে চা তৈরি করতে লাগল।

সুজিত দুজনকেই দেখল, এবং আস্তে আস্তে তার মুখে একটি হাসি ফুটে উঠল। সে কিরণের দিকে ফিরে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আপনাকে আমি কী বলে ডাকব? মিসেস রায়চৌধুরী বলে ডাকতে আমার লজ্জা করছে।

কিরণ বললেন, যা তোমার ইচ্ছা। হিমানীদি আমাদেরও দিদির মতোই ছিলেন, সে হিসেবে তুমি আমাকে মাসিমা বলতে পার। অতীনদার বোন হিসেবে পিসিমাও বলতে পার।

সুজিত বার কয়েক উচ্চারণ করল, মাসিমা পিসিমা–মাসিমা পিসিনা, থাক, মাসিমাই বলব, অ্যাঁ?

দোলার আর চায়ের কাপ এগিয়ে দেওয়া সম্ভব হল না। তার আগেই হেসে উঠে পালিয়ে গেল সে।

কিরণ বললেন, বেশ তো।

 ঠিক সেই মূহুর্তেই একজন চাকরের আবির্ভাব হল। কিরণময়ীকে জানাল, আপনার টেলিফোন এসেছে, মিসেস গুহঠাকুরতা ডাকছেন।

–ও, আচ্ছা যাচ্ছি। তুমি দিদিমণিকে এখানে ডেকে দাও।

 চাকর চলে গেল। কিরণও উঠলেন। বললেন, তুমি চা খাও, আমি ফোনটা ধরে আসছি।

কিরণ চলে গেলেন। সুজিত সেই যাওয়ার পথের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। মনে মনে বলল, উনি কি হাসছিলেন? অসম্ভব নয়, আমাকে দেখে তো মানুষের হাসিই পায়। কিন্তু এঁকে দেখে আমার মনটা কেমন যেন টনটনিয়ে উঠছে। সত্যি, কী আশ্চর্য, এমন একজন মহিলা আমারও মা ছিলেন! মা তো নিশ্চয় ছিলেন, নইলে মানুষ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে কেমন করে!

অবশ্য এ কথা ঠিক, কয়েক বছর আগেও মানুষের জন্ম-রহস্য সুজিতের অজানা ছিল। মানসিক হাসপাতালের ডক্টর ঘোষ তার সামনে জীবনের অনেক রহস্য আস্তে আস্তে উন্মোচিত করেছেন। অনেক বই পড়িয়েছেন, বাংলা বই, ইংরেজি বই পড়ে তর্জমা করে শুনিয়েছেন। বই ছাড়াও অনেক সময় অনেক কথা আপন মনে বলে গিয়েছেন, সুজিত শুনেছে। তার মানসিক গঠনের অনেকখানিই সে জন্যে ডক্টর ঘোষের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। বিশ্বসংসার যে নিষ্করুণ, জটিল, অসহায়, এইসব ধারণাও তাঁর কাছ থেকেই এসেছে। এবং ডক্টর ঘোষ বলতেন, মানুষ যে প্রতিমুহূর্তে কষ্ট পায়, তার কারণ, ভালবাসা এবং ঈশ্বর, এই দুই বিষয়েই মানুষ অনবহিত। এই দুই বিষয়েই বিচিত্র সব ধারণা পোষণ করে মানুষ, যা মিথ্যা, আর তাই, তাদের অবিশ্বাসটাই মূলে থেকে যায়।  

এমনি অনেক কথা বলতেন তিনি, যদিও সব কথাই সুজিত বুঝত না। অথচ মনে হত, তার অনুভবের মধ্যে সব কথাই এক অস্পষ্ট অর্থময়তায় ভরে উঠছে।

অনেক ঘটনার ভিতর দিয়ে জীবনকে সে নানানভাবে দেখেছে। হাসপাতাল থেকে যখন সে বাইরে বেরুবার অনুমতি পেয়েছিল, তখন দূরের জঙ্গলের ধার থেকে একটি অসহায় বৃদ্ধাকে কাঁধে করে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু বৃদ্ধা যখন জানতে পেরেছিল, সে মানসিক হাসপাতালের লোক, তখন সে সুজিতের কাঁধ থেকে লাফিয়ে পড়ে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছিল। কিন্তু বুড়িটার অসহায় ভয় দেখে তার রাগ হয়নি। কারণ বুড়িটা ভেবেছিল সে পাগল।

আগে জানলে সে যে মানসিক হাসপাতালের লোক, এ কথাটা বলত না। ওখানকার স্থানীয় লোকদের ধারণা, হাসপাতালের সবাই পাগল, ওটা একটা পাগলাগারদ। আর পাগলকে মানুষ মাত্রেই ভয় পায়। সুজিত যে পাগল নয়, এ কথাটা তাদের কিছুতেই বোঝানো যায় না।

ফিরে গিয়ে সমস্ত কথা সে ডক্টর ঘোষকে বলেছিল। শুনে ডক্টর ঘোষ তাকে গায়ে মাথায় হাত দিয়ে খুব স্নেহ করেছিলেন। বলেছিলেন, তুমি তোমার কর্তব্য করেছ, তুমি ঠিকই করেছ। কিন্তু মানুষেরা ওই রকমই। তাদের বিচার-শক্তি নেই। তারা সত্যি মিথ্যে বুঝতে পারে না।

এ সব কথা তার মনে হচ্ছিল, তার কারণ, জীবনের সর্বত্রই সে এত দুঃখ দেখেছে ও পেয়েছে, এখানে এসে যেন সে সব কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে যেন সবাই সুখী, গভীর শান্তি এখানে যেন বিরাজ করছে।

এমন সময় জালের দরজা ফাঁক হল, দোলার মুখ দেখা গেল। সুজিত বুঝতে পারছে, দোলা তার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না, পাছে হেসে ফেলতে হয় বলে। দোলার মুখ রক্তাভ, কিন্তু গম্ভীর। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে বলল, এ কী, চা খাচ্ছেন না? ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে!

–এই যে খাই।

সুজিত তাড়াতাড়ি চায়ের কাপে চুমুক দিল। একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল, তাই এক চুমুকেই কাপ শেষ করে দিল। দোলা দেখবে না দেখবে না করেও আড়চোখে দেখল। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বলল, আর একটু চা ঢেলে দেব?

সুজিত বলল, দেবেন? দিন।

কিন্তু সে সন্দিগ্ধ চোখেই দোলার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছে, দোলা জোর করে ঠোঁট টিপে রয়েছে। দোলা হাত দিয়ে এক বার টি-পটের উষ্ণতা যাচাই করল। তারপর চা ঢালতে ঢালতে বলল, চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল কেন আপনার, কী করছিলেন?

এক বার ঢোঁক গিলল সুজিত। বলল, একটা কথা ভাবছিলাম।

দোলার হাতটা কেঁপে গেল, শরীরটাও দুলে উঠল এক বার। কিন্তু ঠোঁট খুলল না সহসা। একটু পরে বলল, ভাবতে ভাবতে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল?

সুজিত বিব্রত হয়ে বলল, হ্যাঁ। একটু থেমে আবার সুজিত বলল, আপনার হাসি পাচ্ছে না?

দোলা চকিতে এক বার তাকাল সুজিতের দিকে। মুখ আরও আরক্ত হয়ে উঠল। বলল, কই, না

টেবিলের দিকে আরও নেমে গেল দোলার মুখ। চা তৈরি করে কাপ এগিয়ে দিয়ে সুজিতের দিকে না তাকিয়েই বলল, হাসি পাবে কেন মিছিমিছি?

সুজিত বলল, আমাকে দেখে অনেকে হেসে ফেলে কিনা।

-কেন?

আমি জানি না।

বলে সে হেসে তাকাল দোলার দিকে। আবার বলল, কিন্তু আপনাকে হাসলে খুব সুন্দর দেখায়।

দোলা এবার প্রায় চমকে উঠে বলল, আমাকে?

সুজিত অসংকোচে বলল, হ্যাঁ। আপনি তো এমনিতেই খুব সুন্দর, হাসলে আরও সুন্দর লাগে। মনে হয়, আপনি-আপনি

—-আমি?

দোলা প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠল। সুজিত বলল, আপনি খুব সুখী। আমি আপনার মতো এমনি সুখী হাসিমুখ আরও দেখেছি কি না, মনে করতে পারি না।

দোলার বিস্ময়ের মধ্যে ভ্রূ কোঁচকাল। বলল, আমার মতো?

-হ্যাঁ, আপনার মতো। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে। অবিশ্যি তারা আপনাদের মতো এরকম শহরের বড়লোক নয়, লেখাপড়া জানে না। তারা কেউ রাখাল মেয়ে, গোরু-মোষ চরায়, মাঠে ধান কাটে। আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম, আপনাকে ঠিক যেন সেরকম লাগছিল। আসলে মানুষ পবিত্র হলে বোধ হয় এরকমই দেখায়, তাই না?

দোলা যে কী বলবে ভেবে পেল না। সে শুধু উচ্চারণ করল, পবিত্র!

সুজিত বলে উঠল, না না, পবিত্রতা খালি হাসি নয়, গম্ভীরও হয়, আমি দেখেছি। ডক্টর ঘোষ একজন পবিত্র মানুষ ছিলেন কিন্তু তিনি গম্ভীর ছিলেন। আচ্ছা, আপনি দেখেছেন, এক-একটা গম্ভীর মানুষকে কী রকম ভয় লাগে? যেমন আপনার বাবা।

বাবা!

–হ্যাঁ, আপনার বাবা তো গম্ভীর মানুষ, কিন্তু তাঁকে দেখেই আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল অথচ ডক্টর ঘোষকে আপনার ভয় করবে না।

দোলা হঠাৎ ঘাড় কাত করে বলল, তার মানে আপনি বলছেন আমার বাবা অপবিত্র লোক?

না না, মানে

কথার খেই হারিয়ে বিব্রত অস্বস্তিতে কী করবে সুজিত ভেবে পেল না। হাত নেড়ে বারে বারে বলল, আপনার বাবা, মানে উনি খুব ভাল মানুষ, উনি খুব চমৎকার লোক, উনি

কথাটা শেষ করবার আগেই, হাত নাড়তে গিয়ে চায়ের কাপে ধাক্কা লেগে গেল। চা চলকে পড়ল। কাপটা পড়বার আগে দোলা হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। সাদা ধবধবে টেবিল কলঙ্কিত হয়ে উঠল। সুজিত তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে লজ্জায় ও সংকোচে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ইস! কী হবে এখন?

দোলা যেন মূঢ় বিস্ময়েই তাকিয়েছিল, হঠাৎ তার সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল, এবং হাসির খিলখিল শব্দ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বলল, কী আবার হবে আপনি উঠলেন কেন, বসুন না।

সুজিত যেন স্বস্তি পেল দোলার হাসিতে। বলল, আমার হাতটা ঠিক

 দোলা বলে উঠল, কোনদিকে যাচ্ছে, লক্ষ করেননি।

–ঠিক তাই। আপনি আমার ওপর রাগ করছেন ভেবে এত ভয় পেয়েছিলাম…মানে, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না আপনাকে।

দোলা বলে উঠল, আপনাকে আর বোঝাতে হবে না, বসুন দেখি। আমি রাগ করলে আপনার কী হবে?

–কেউ রাগ করলে আমার যেন কী রকম লাগে।

দোলা ওর কালো আয়ত চোখ দুটি তুলে কয়েক মুহূর্ত যেন গভীর অভিনিবেশ সহকারে সুজিতের মুখের দিকে দেখল। এবং সহসা যেন লজ্জা করে উঠল ওর। বলল, আবার একটু চা ঢেলে দিই?

সুজিত দুহাত নেড়ে বলতে গেল, না না।

তার আগেই দোলা বলে উঠল, থাক থাক, এবার টি-পট পড়ে যাবে।

সুজিত যে ভাবে হাত নাড়ছিল, ঠিক সেভাবেই চকিতে প্রস্তরীভূত হয়ে গেল। স্বভাবতই, দুহাত তার দুদিকে বিস্তৃত। প্রায় সন্ত্রস্ত চোখে আস্তে আস্তে টেবিলের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখল, টি-পট পড়েনি। শিশুর মতো হেসে বলল, পড়েনি দেখেছেন?

–দেখেছি। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, আপনাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত সেখানে?

–কোথায়?

–যেখানে আপনি ছিলেন?

 –বেঁধে রাখবে কেন?

দোলা থতিয়ে গেল, এবার ওরই বিব্রত হওয়ার পালা। বলল, না মানে—

সুজিত বলল, বুঝেছি, আপনি বলছেন, পাগলদের যে রকম দুপায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। না, আমাকে সে রকম বেঁধে রাখবার দরকার হয়নি।

-খুব মারধোর করত?

দোলার চোখে উদ্বেগ ও উত্তেজনা। সুজিত হেসে বলল, না, আপনি যাদের কথা ভাবছেন, আমি সেরকম নই। আমি পাগল ছিলাম না আসলে, আমি ছিলাম, ওই যে আপনার বাবা তখন বললেন। আমার আসলে বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু ছিল না।

–কিন্তু আমার তো তা মনে হচ্ছে না।

–আমি যে এখন ভাল হয়ে গেছি।

দোলা তবু তাকিয়ে রইল সুজিতের দিকে। ঠিক যেন বুঝতে পারছে না সব। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আপনার সব কথা মনে আছে? ভাল হবার আগের কথা?

সুজিত বলল, আছে বইকী, কিছু কিছু মনে আছে, অবিশ্যি আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ ছিল, কিছুই প্রায় মনে থাকত না। যেমন ধরুন, বর্ধমানের গ্রামের কথা অস্পষ্ট মনে আছে। বাড়ির কাছে একটা বাঁশঝাড়, তার কাছেই ধান মরাইয়ের জায়গা। পুকুর, মন্দির, ঘর, বাড়ি সবই বহু দিনের দেখা ছবির মতো মনে পড়ে, কিন্তু কোনগুলো ঠিক কোথায় কোথায়, আমার মনে নেই। একটা পুকুরের কথা মনে আছে, ভীষণ ময়লা জল, তার মধ্যে একদিন কতগুলো ছেলে আমাকে ফেলে দিয়েছিল, দিয়ে ঢিল মেরেছিল–

-কেন?

–আমি যে পড়া করতে পারতাম না, খালি চুপচাপ বসে থাকতাম, খিদে পেলে খেতে চাইতাম আর কাঁদতাম।

-কেন?

দোলার উৎকণ্ঠিত কৌতূহলিত প্রশ্ন শেষ হতে চায় না। সুজিত বলল, কী জানি, ওইরকম ছিলাম, আর সবাইকেই খুব ভয় পেতাম, দেখতাম, আমাকে সবাই আলাদা করে রাখে। আমি যে মার খেতাম, এটা আমার মনে আছে। আমাকে কেউ না মেরে কথা বলত না। আমার মনে আছে, একজনকে আমি কাকিমা বলতাম, তিনি আমাকে সবসময় মারতেন, বলতেন, তুই কবে মরবি, এ সংসারের হাড় জুড়িয়ে তুই কবে মরবি বলতে পারিস? আমি বলতাম, না। অমনি উনি আমাকে আরও মারতেন। আর খুব খারাপ খারাপ গালাগাল দিতেন, আমার মায়ের নামে, বাবার নামে, যা-তা সব কথা বলতেন, আমার মনে আছে। কিন্তু তখন আমি জানতাম না, আমার মা কে, আমার বাবা কে, তাঁরা কেমন।…আমাকে অনেক কাজ করতে হত, পুকুরে কাপড় কাঁচা, গোরুকে জাব দেওয়া, কিন্তু কাজে ভুল হলে আমার বয়সি ছেলেরাও আমাকে এসে শাসন করত।

দোলা উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, কেন কেন? তখন আমার মামা প্রতাপবাবু কোথায় ছিলেন, তিনি তখনই আপনাকে নিয়ে যাননি কেন?

সুজিত বলল, এখন জানতে পেরেছি, উনি ও সব কিছুই জানতেন না। উনি আমার জন্যে টাকা পাঠাতেন সেই আত্মীয়দের বাড়িতে, আমার জন্যে নাকি কিছু জমিজমাও ছিল। তবু যে আত্মীয়রা কেন আমাকে ও-রকম করতেন, যেন আমি একটা বোঝা, আমি জানি না। একজন মাস্টার আসত পড়াতে, তার মুখটা আমার এখনও মনে আছে, মনে পড়লে এখনও ভয় হয়, এই বুঝি আমার চুলের মুঠি ধরবে এসে। সে আমার মুখের মধ্যে অনেকদিন গোবর পুরে দিয়েছে। তাই দেখে বাড়ির ছেলেরাও আমাকে গোবর ছুঁড়ে মারত। এমনি সব অস্পষ্ট ছবি, অস্পষ্ট মুখ আমার মনে আছে, যেমন ধরুন পচা ভেজা ভাতের গন্ধ–আমার খিদে পেলে এখনও ওই গন্ধটাই আগে মনে পড়ে। এ অবস্থায় আমি আস্তে আস্তে যেন কেমন হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক সময় কে কী বলছে, তাও বুঝতে পারতাম না, একেবারে জবুথবু, বোবা আর কালাদের মতো হয়ে গেছলাম। একটা ভীরু জানোয়ারের মতো…। সুজিত থামল। দোলা বলল, তারপর?

তারপর তো প্রতাপকাকা গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সে সব আমার আর ভাল মনে নেই। তখন আমার মস্তিষ্ক বলতে কিছুই ছিল না। প্রতাপকাকা আমাকে নিয়ে কোথায় ঘুরেছেন, সে সবও স্মরণ করতে পারি না। তারপর যখন ডক্টর ঘোষের কাছে গেলাম, আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠলাম।

দোলা বলে উঠল, কী করে? অনেক ওষুধ খেতেন বুঝি?

-না, শুধু ওষুধ নয়। ওষুধ তো খেতামই, আর ডক্টর ঘোষ আমাকে ব্যায়াম করাতেন, বেড়াতে নিয়ে যেতেন, আদর করতেন, অনেক কথা বলতেন, বলতেন, সব সময়ে বিশ্বাস করবে, তোমাকে সবাই চায়, কারণ সেটাই সত্যি। মানুষ সবাই ভাল, কিন্তু তারা অবস্থার গতিকে সকলেই অসহায়। কেউ কেউ ভয় পেয়ে বেয়াদব হয়ে ওঠে, যা উচিত নয় তাই করে। যখন বুঝতে পারে, তখন দুঃখ পায়। তোমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে, একদিন তারাও সে-কথা ভেবে দুঃখ পাবে।…কিন্তু আমি বোধ হয় যা-তা বলছি। আমি কথা বলতে আরম্ভ করলে খালি কথাই বলে যাই।

দোলার কৌতূহল মেটে না। বলে, ডক্টর ঘোষ যা বলেন, আপনি সব বিশ্বাস করেন?

সুজিত ঘাড় কাত করে বলল, হ্যাঁ করি, উনি তো কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। যা সত্যি, ঠিক তাই বলেন। বলেন, মানুষ দুঃখী আর অসহায়, মনুষ্যত্বকে এ সবই আচ্ছন্ন করে রেখেছে নানানভাবে। মানুষ যদি ঈশ্বরকে ঠিক বুঝতে পারে আর ভালবাসতে পারে, তবে সেটাই হল তার সবথেকে বড় বিদ্রোহ।

–বিদ্রোহ?

 –হ্যাঁ, বিদ্রোহ।

–আপনার ডক্টর ঘোষ বুঝি খুব পুজো-আহ্নিক করতেন?

কখনও না, এমনকী কোনও ঠাকুর-দেবতাকে কখনও হাত তুলে নমস্কার করতেও দেখিনি। ওঁর ঘরে কোনও ঠাকুর-দেবতার ছবিও দেখিনি।

তবে ওঁর ঈশ্বর কেমন?

ভালবাসা। উনি বলেন, ভালবাসা আর ঈশ্বর, একটা টাকার এপিঠ আর ওপিঠের মতন, কাজ তার একই।

–আপনি তা বুঝতে পারেন?

–ওঁর মতো করে পারি না। কিন্তু একদিন যখন ওঁকে আমি বললাম, স্যার, মানুষ হাসলেও অনেক সময় আমি তার চোখের মধ্যে দুঃখের আর কষ্টের ছায়া দেখতে পাই, মনে হয় হাসিটা সত্যি নয়, এরকম কেন হয়?

উনি তৎক্ষণাৎ আমার হাত ধরে বলে উঠতেন, সেই তো ঈশ্বরানুভূতি সুজিত! মানুষকে ঘৃণা করলে এ জিনিস দেখা যায় না। এটা প্রত্যক্ষ ভালবাসার কথা নয়, নির্বিকারভাবে যে সব কিছুকেই দেখতে চায়, সেই দেখতে চাওয়াটাই হল প্রেমিকের চরিত্র। আমি জানি না, উনি কী বলেন, সবসময়ে বুঝি না ঠিক, কিন্তু একটা কিছু অনুভব করি। আচ্ছা, আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন?

দোলা চোখ বড় বড় করে বলল, আমি? কিছুই না, একটা বর্ণও বুঝলাম না। আমার তো মনে হল, বই খুলে কেউ কতগুলো দুর্বোধ্য কথা আমাকে শোনাল।

সুজিত সরলভাবে একগাল হেসে বলল, তাই নাকি?

 দোলা ঘাড় দুলিয়ে বলল, হু। আচ্ছা, আপনি তা হলে সবাইকে ভালবাসেন?

 সুজিত বলল, তা কী করে জানব, আমি তো বুঝতে পারি না।

–আপনি তা হলে কী বোঝেন?

 দোলার ঘাড় ঈষৎ বেঁকে গেল, কালো চোখের দৃষ্টিও বঙ্কিম হল। রক্তাভ ঠোঁটের কোণ দুটি উঠল কুঁকড়ে। সুজিত হঠাৎ অসহায় হয়ে পড়ল। বলল, আমি? আমি যে কী বুঝি, তা আমি বুঝতে পারি না।

দোলা রুদ্ধ হাসির বেগে আবার আরক্ত হয়ে উঠল। সুজিত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, দেখুন মিস রায়–

দোলা বাধা দিয়ে বলে উঠল, আমার নাম দোলা, আপনি শোনেননি?

–হ্যাঁ, দেখুন দোলা, আপনার

আবার বাধা দিয়ে বলে উঠল দোলা, শুধু নাম বললে আবার আপনি বলে নাকি কেউ?

–তবে কি তুমি বলব নাকি!

 দোলা ভ্রূকুটি করে বলল, তা আমি কী জানি।

সুজিত আবার অসহায় হয়ে পড়ল। সে এক বার চারদিকে দেখল, চোখ ফিরিয়ে আবার দোলার দিকে ফিরল। দোলার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। কিন্তু দোলা তাকিয়ে থাকতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কী দেখছেন?

সুজিত বলল, দেখছি, মানে, দেখুন পরিবেশ মানুষকে বদলে দেয়। আপনাকে যদি আমি গুঁড়িয়াঁটাঁড়ের মাঠে গোরু চরাতে দেখতাম, তা হলে ঠিক তুমি বলতাম, আপনিও তুমি বলতেন। কিন্তু এখানে, এ বাড়িতে, এ বাড়ির মেয়েকে তুমি বলতে যেন মুখ সরে না।

ইতিমধ্যে কখন কিরণময়ী পিছন দিক দিয়ে এসেছেন, সুজিত দেখতে পায়নি। দোলা দেখতে পেয়েছিল, এবং মায়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখ নিঃশব্দ প্রগম্ভ হাসিতে ঝলকে উঠেছিল। সে বলল, আপনার মুখ না সরলে আমি কী করব বলুন?

সুজিতের মুখে বিব্রত হাসি। জিজ্ঞেস করল, আপনাকে তুমি বললে, আপনি–আপনি রাগ করবেন না?

দোলা বলল, না শুনলে কেমন করে বলব?

 বলতে বলতেই দোলার দুই চোখ চিকচিকিয়ে উঠল, হাসির তরঙ্গ উপচে পড়ল বলে।

 কিরণ আর চুপ করে থাকতে পারলে না। বললেন, কেন ওকে অমন করছিস দোলা? তুমি ওকে তুমি করেই বলো, আমি বলছি।

সুজিত তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে কিরণকে দেখে যেন স্বস্তি পেল। বলল, আপনি? জানেন মাসিমা, (এ সময়ে চকিতে এক বার দোলাকে দেখে নিল সে) আমার কিন্তু মনে হচ্ছিল, দোলাকে তুমি বললে ও রাগ করবে না।

কিরণ হেসে উঠলেন। দোলা ভ্রুকুটি করতে যাচ্ছিল। কিরণ বললেন, রাগ করবে কেন, তুমি তো ওর থেকে বড়। তুমি তো এখন চান করবে?

-হ্যাঁ।

দোলা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, কিন্তু কী বলতে যাচ্ছিলেন আমাকে, সেটাই তো বলা হল না।

সুজিত ফিরে বলল, ও হ্যাঁ, বলছিলাম, তোমার মুখের ছাঁদটা সত্যি আশ্চর্য। আর তোমার চোখ। আমি তোমার একটা পোর্ট্রেট আঁকব।

দোলা ঈষৎ লজ্জিত হল, খুশিতে চলকে উঠল। বলল, সত্যি! আমি আপনাকে বলব ভাবছিলাম। আচ্ছা, এ কথা তো বললেন না, আপনি আঁকতে শিখলেন কোথায়, কার কাছে?

সুজিত বলল, কোথাও নয় তো! কারুর কাছেও নয়। আপনি আপনিই শিখেছি। আঁকতে আমার খুব ভাল লাগে।

তারপরে সহসা যেন মনে পড়ে গিয়েছে, এমনিভাবে চকিত হয়ে বলল, ও হ্যাঁ, আর একটা কথা তোমাকে বলব ভাবলাম, ভুলেই গেছি। জান, কাল রাতে ট্রেনে আমি একটি মেয়েকে দেখেছি, তোমার থেকে কিছু বড় হবে সে। সঙ্গে একজন ভদ্রলোকও ছিলেন। মেয়েটি খুবই সুন্দর, যাকে বলে সত্যিকারের রূপসী। বোধ হয়, বড়লোকও বটে। আর তার জামাকাপড়, পোশাক-আশাক, প্রসাধন-সাজগোজ, যাকে বলে, সাংঘাতিক। কথায়-বার্তায় চাল-চলনে মনে হয়, খুব সাহসী আর অহংকারী। দেখলেই মনে হবে, মেয়েটির রূপেরও খুব অহংকার। সঙ্গী ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল যখন, তখন রাগে হাসিতে ওকে খুবই গর্বিত মনে হচ্ছিল। চোখ দুটো কী শাণিত আর ঝকঝকে। কিন্তু জান, আমি যেন দেখলাম, ভিতরে ভিতরে সে বড় দুঃখী মেয়ে, বড় অসহায়। একটা হরিণকে বাঘেরা ঘিরে ধরলে যেমন হয়, সে যেন তেমনি। আর হরিণটা যখন দ্যাখে, সে মরবেই, তখন সে যেমন ফোঁস ফোঁস করে, লাফায় দাপায়, ওকে আমার সেইরকম মনে হচ্ছিল। ওকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। তারপরে ওদের কথাবার্তা থেকেই বুঝলাম, মেয়েটির বাবা-মা কেউ নেই, অপরের কাছে থাকে, আর সেটা বোধ হয় খুব সম্মানজনকও নয়।

তার কথা শুনতে শুনতে, মা আর মেয়ে অবাক হয়ে চোখাচোখি করছিল।

দোলা বলে উঠল, কিন্তু আপনার ওরকম মনে হল কেন?

সুজিতের চোখের সামনে তখন সুনীতার মুখখানিই ভাসছে। সে যেন দূর থেকে বলল, তা জানি না। কিন্তু দুঃখকে আমি যেন দেখতে পাই, কষ্টকে চিনতে আমার ভুল হয় না। তা সে যতই হাসি দিয়ে খুশি দিয়ে ঢেকে রাখুক না। জানেন মাসিমা, আমার মনে হল, আহা, একে যদি কেউ একটু স্নেহ করার থাকত, একটু ভরসা দেবার থাকত। কিন্তু আমি দেখলাম, ওর চোখে যেন দুঃখ আর ভয়ের অসহায় ছায়া। আর তাই ভীষণ উগ্র, সবকিছুকেই যেন ঘৃণা করছে। আজ পর্যন্ত ও যেন ভাল কিছুই দেখতে পায়নি। হাওড়ায় নামবার সময় আমি ওকে সে কথা বলে ফেললাম।

দোলা বিস্ময়ে চমকে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, মেয়েটিকে? কী বললেন? আপনার সঙ্গে আলাপ ছিল নাকি?

না, আলাপ থাকবে কেন? এমনি জিনিসপত্র সরানো নিয়ে দু-একটা কথা হয়ে থাকবে। আমি বললাম, আপনাকে যেন দুঃখী আর অসহায় বলে মনে হল আমার।

দোলা উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে উঠল, কী সর্বনাশ। তারপর, রেগে গেল তো মেয়েটি?

না, চমকে উঠল। আমাকে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আমি কলকাতায় কোথায় যাব? আমি বললাম, জানি না। তারপরে আর কোনও কথা হয়নি। কুলিদের ধাক্কায় আমি বাইরে ছিটকে পড়েছিলাম।

দোলা হেসে ফেলল। বলল, কুলির ধাক্কায় বাইরে ছিটকে পড়লেন?

হ্যাঁ।

–কিন্তু আপনি যাই বুঝুন, মেয়েটিকে বলতে গেলেন কী বলে?

 সুজিত অসহায় ভঙ্গিতে বলল, না বলে পারলাম না যে?

দোলা মুখ গম্ভীর করে বলল, তা তো বটেই, আপনি যে আবার প্রেমিক।

সুজিত সরলভাবে হাসল। দোলা ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে আবার বলল, মানে মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছেন বলেই না বলে পারেননি।

সুজিত সহজ সরল ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ।

কিন্তু ততক্ষণে মায়ের দিকে তাকিয়ে দোলা খিলখিল করে হেসে উঠেছে।

সুজিত চমকে উঠে বলল, অ্যা, কী বললেন?

কিরণময়ী দোলাকে বলে উঠলেন, কেন ওকে ওরকম করছিস দোলু?

সুজিতকে বললেন, কিছু বলেনি, তুমি এবার চান করবে চলো শিবেন আবার তোমাকে নিতে আসবে।

সুজিত আবার সহজ হয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই যাই। কোনদিকে যাব?

 কিরণময়ী বললেন, আমার সঙ্গে এসো। দোলন, তুমি বাগানের দিকে ছোট ঘরটা একটু দেখে রাখতে বলল কাউকে। সুজিত স্নান করে সেখানেই একটু বিশ্রাম করবে।

সুজিত কিরণময়ীকে অনুসরণ করতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল এক বার। তারপর খুব আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল, সেই অসহায় চোখ দুটি এখনও আমার চোখে ভাসছে! কেন, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

দোলা বা কিরণময়ী কেউ তার কথা শুনতে পেলেন না। দোলা বলল, কী বলছেন?

সুজিত যেন চমকে উঠল। বলল, অ্যাঁ? না, কিছু না।

পরমুহূর্তেই তার মনে হল, সে মিথ্যে কথা বলছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার বলল, সেই মেয়েটির কথাই ভাবছিলাম।

কিরণময়ী হেসে বললেন, পাগল।

স্নানের পর সুজিত বাগানের দিকে ছোট ঘরে একলা বসে ছিল। ঘরটি দোলার পড়বার ঘর। টেবিলের ওপর মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেছিল সে। ঘরে একটি খাট এবং বিছানা ছিল। দোলা বলেছিল, ইচ্ছে হলে সুজিত সেখানে একটু গড়িয়েও নিতে পারে। সারারাত্রি সে গাড়িতে এসেছে। রান্না হয়ে গেলেই খাবার জন্য তাকে ডাকা হবে।

কিন্তু খাওয়ার কথা সুজিত আর চিন্তা করতে পারছিল না। ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়ে গিয়েছিল। ঘুমও তার চোখে ছিল না। চোখ বুজে সে টেবিলে মাথা পেতে বসে ছিল বটে, কিন্তু তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা অচেনা অস্বস্তি আবর্তিত হচ্ছিল। কিংবা সেটা অস্বস্তি নয়, আর কিছু। ঠিক কী হচ্ছে, বুঝতে পারছে না বলেই অস্বস্তি মনে করছে। তাও একরকমের অস্বস্তি। ভিতরে ভিতরে কী একটা খোঁচা যেন বিধে আছে। একটু পরেই, সহসা যেন চমকে সে মাথা তুলল এবং দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তার দুই চোখ বিস্ময়ে ভরে উঠল। সে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, আশ্চর্য!

তারপর ব্যস্ত অনুসন্ধিৎসু চোখে টেবিলের দিকে তাকাল। বলে উঠল, এই যে, পেয়েছি।

 হাত বাড়িয়ে সে রঙিন পেনসিলের বাক্সটা তুলে নিল। টেবিলের একপাশে ড্রইং পেপারের বড় একটা খাতা পড়েছিল। অসংকোচে তার থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিল। পেনসিলের বাক্সটা খুলে, প্রত্যেকটা পেনসিলে আঙুল বুলিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে একটা পেনসিল টেনে তুলে নিয়ে আপন মনেই আবার বলল, এই গাঢ় ধূসর রংটাই ঠিক হবে।

বলে আবার কয়েক মুহূর্ত শূন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কাগজের ওপর দাগ দিতে আরম্ভ করল। প্রত্যেকটি দাগের ভিতর দিয়ে একটি মুখ ফুটে উঠতে লাগল। মিনিট দশেকের মধ্যেই মুখটি একটি চেনা মুখের মতো দেখতে লাগল, এবং দেখতে দেখতে সেটি সুনীতার মুখ হয়ে উঠল। চোখ নাক ভুরু ঠোঁট, একেবারে নিখুঁত সুনীতা। গাড়িতে উঠেই প্রথমে সুনীতা যে ক্লান্ত ভাব নিয়ে বসে পড়েছিল, ঠিক সেই মুখ। ঠিক তেমনি করেই চুলের একটি গুচ্ছ কপালের পাশ দিয়ে গালের ওপর এসে পড়েছে। কেবল, অমিল দেখা গেল চোখের তারায়। দূরগামী চোখের তারায় একটু বেশি বিষাদ যেন ফুটে উঠল।

স্কেচটা শেষ হবার মুহূর্তেই দরজাটা খুলে গেল। দোলা বলে উঠল, এ কী, বসে আছেন? শোননি? তা হলে আসুন, খাবেন।

সুজিত যেন এক ভিন্ন জগৎ থেকে ফিরে তাকাল। বলল, অ্যাাঁ, যাব?

ততক্ষণে দোলার চোখে কৌতূহল নেমে এসেছে। বলল, কী করছেন আপনি? বলে দ্রুতপায়ে টেবিলের কাছে এসেই, প্রায় অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, এ কী, এ কার ছবি আঁকছেন আপনি? এ কার ছবি? এ যে সুনীতা, সুনীতা নাগ।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিন্তু তুমি ওরকম করে বলছ কেন?

দোলা সে কথার কোনও জবাব দিল না। তেমনি সুরেই বলল, একে আপনি আঁকলেন কেমন করে? কী দেখে আঁকলেন?

বলে সে যেন একটা অলৌকিক ভয়ে ঘরের চারদিকে তাকাল।

সুজিত বলে উঠল, না না, এখানে সে নেই, আমি মন থেকে এঁকেছি, মানে আমার স্মৃতি থেকে।

–স্মৃতি থেকে? স্মৃতিতে একে আপনি পেলেন কোথায়? দোলার গলায় তখনও উৎকণ্ঠিত উত্তেজনা। এই সময়ে কিরণময়ীও বলতে বলতে এলেন, খাবার যে দিয়ে দিয়েছে দোলা, তোরা দেরি করছিস কেন?

দোলা মায়ের দিকে ফিরে, ছবিটার দিকে এমনভাবে আঙুল দিয়ে দেখাল, যেন হঠাৎ সাপ দেখে ডেকে দেখাচ্ছে। বলল, মা, দেখো দেখো, এ কাকে এঁকেছে দেখো। কী ভীষণ চমকে গেছি আমি মুখটা দেখে।

কিরণময়ী কাছে এসে উঁকি দিতেই তাঁর মুখেও বিস্ময় এবং একটি যেন ঘৃণামিশ্রিত উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল। তিনিও বলে উঠলেন, একী, এ মুখ তুমি পেলে কোথায়, আঁকলে কী করে?

সুজিত অসহায় বিস্ময়ে হতবাক। ও যেন কোনও অপরাধ করে ফেলেছে, এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হল। অথচ অপরাধ কী করেছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। ছবিটা তো সত্যি সাপের ছবি নয়। তবে দুজনেরই এমন ভাবান্তর হল কেন?

দোলা ইতিমধ্যে কিরণময়ীর কথার জবাব দিল, সুজিতবাবু বলছেন, এটা নাকি উনি ওঁর স্মৃতি থেকে এঁকেছেন।

কিরণময়ী ভ্রূকুটি করে বললেন, স্মৃতি থেকে?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, স্মৃতি থেকে। আমি যে মেয়েটির কথা বলছিলাম, এই তো সেই। কাল রাত্রে ট্রেনে এই মেয়েটিকেই আমি দেখেছিলাম।

মা ও মেয়ের গলায় একসঙ্গেই উচ্চারিত হল, এই মেয়েটিই।

–হ্যাঁ।

কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতাকে সহসা চৌচির করে দিয়ে দোলা খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির ঝংকারের মধ্যেই বলে উঠল, এই নাকি সেই মেয়ে, সেই মুখ, সেই চোখ, যার মধ্যে আপনি দুঃখী আর অসহায়কে আবিষ্কার করেছেন?

কথার চেয়ে দোলা হাসল বেশি, এবং কথার শেষে আরও হেসে উঠল। সুজিত অবাক হয়ে দোলার ওপর থেকে কিরণময়ীর প্রতি চোখ ফেরাল। দেখল, হাসিটা অস্পষ্টভাবে তাঁর মুখেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবু এখনও পুরোপুরি সংশয় দূর করতে পারেননি বলে জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাত্রে ট্রেনেই একে প্রথম দেখেছ, না কি আগের থেকে চিনতে?

সুজিত বলল, না না, তার আগে তো আমি গুঁড়িয়াঁটাঁড় থেকে বহু বছর কোথাও যাইনি। একে আমি আর কখনওই দেখিনি।

–এর সঙ্গে ভাল করে পরিচয় হয়েছিল গাড়িতে?

–না। ঠিক পরিচয়ই হয়নি। গাড়ির গায়ে নাম লেখা ছিল, সে সুনীতা নাগ, তাইতে নামটা জানতে পেরেছি।

–কোথায় থাকে, কী করে, সে সব কিছু জান?

–কিছুই না। কেবল ওঁর সঙ্গে মিঃ পি. দাশ বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন—

কিরণময়ী দোলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, আমাদের প্রিয়নাথ দাশ।

 দোলা বলল, ওরা ট্রেনে করে কোথা থেকে আসছিল?

 কিরণময়ী বললেন, কী জানি। তোমার বাবা তো সব কথা বলতে চান না। তবে মিসেস লাহিড়ীর কাছে শুনছিলাম, সুনীতা নাকি কুবের সিংহের সঙ্গে কোথায় না বলে বেড়াতে চলে গেছিল। প্রিয়নাথ পেছন পেছন গেছে তাকে ধরে আনতে।

দোলা চোখ কপালে তুলে বলল, কুবের সিংহের সঙ্গে না বলে, সুনীতা নাগের এত সাহস?

কিরণময়ী গম্ভীর হয়ে বললেন, ওর আবার সাহস। যাও দোলা, তুমি এ সব কথার মধ্যে থেকো না। সুনীতা বলে গেছল ও নাকি একলাই যাচ্ছে। কিন্তু মিসেস লাহিড়ীরা জানতে পেরেছে, আসলে নাকি কুবের সিংহের সঙ্গে গেছল। এখন এর কথা শোনা যাক।

তিনি আবার সুজিতের দিকে ফিরলেন। বললেন, ওদের মধ্যে কী কী কথাবার্তা হয়েছিল, তুমি শুনেছিলে?

সুজিত অপ্রতিভ বিস্ময়ে বলল, হ্যাঁ, কিছু কিছু শুনেছি। মাঝরাত্রে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ওদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে আমার ঘুম ভেঙে গেছল।

-কী বলেছিল ওরা?

 সুজিত ওর স্মৃতি থেকে যতটা পারল, রাত্রের ঘটনার পুনরুক্তি করল। সুজিতের কথা শেষ হতেই দোলা বলে উঠল, তবু আপনার মনে হল, সুনীতা নাগ দুঃখী আর অসহায়! আরও যেন কী বলছিলেন, বাঘেরা যেমন হরিণকে ঘিরে ধরে, তেমনি

কথা শেষ করতে পারল না দোলা, খিলখিল করে হেসে উঠল। কিরণময়ী গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ওই মেয়ে বাঘে-ঘিরে-ধরা হরিণ? তা হলে আর বাঘিনী কে?

সুজিত এতক্ষণে চোপসানো গলায় বলল, কেন, এ কী করেছে?

দোলা বলে উঠল, দুদিন কলকাতায় থাকুন, তা হলেই সব শুনতে পাবেন। স্ক্যান্ডাল শুনলে কানে আঙুল দিয়ে পালাবেন।

-ও!

–হ্যাঁ, আর তার মধ্যেই আপনি দেখলেন দুঃখী, অসহায়, কত কী! আপনি সত্যি বোকা।

সুজিত যেন চমকে উঠে শব্দ করল, অ্যা?

 কিরণ বললেন, আহা, ওকে অমন করে বলছ কেন দোলু? সুনীতার ও কী দেখেছে, কতটুকু চেনে? মানুষকে ও কতটুকু দেখেছে?

সুজিত মনে মনে বলে উঠল, মানুষকে আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু সে মুখে উচ্চারণ করতে পারল না। সে অনুমান করছে, সুনীতা নাগ এদের কাছে ভয়ংকর কলঙ্কজনক। দোলার চোখমুখের ভাব দেখেই সে বুঝতে পেরেছে। সেই ভাবের মধ্যে দোলার কোনও ছল-চাতুরি বা ঈর্ষা ছিল না।

সুনীতাকে সে যেভাবে জানে, সে ভাবেই বলেছে। কিন্তু সুজিত কি সত্যি ভুল দেখেছিল? জীবনে দুঃখ এবং অসহায়তার গভীর জট তার রক্তের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে। যা আছে তার জন্মকালের সময় থেকে। এ দেখাটা তার প্রাণের মূল থেকে দেখা। এ দেখা, অনেকটা তার নিজেকেই আর এক রূপে দেখার মতো। কোনও সুখী মানুষকে চিনতে তার ভুল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কি এতটা ভুল দেখেছে সে?

তার চোখের সামনে সুনীতার সেই মুখ আবার ভেসে উঠল। সেই চোখ। যে চোখের ভিতরে সে দেখেছিল, একটা অসহায় ব্যথা আর কান্না যেন থমকে আছে। ঠিক প্রদীপের নীচেই অন্ধকারের মতো।

কিরণময়ী বললেন, হয়তো তুমিও আস্তে আস্তে শুনবে সুনীতার কথা। ও এক ভয়ংকর মেয়ে। শুধু খারাপ বললে তার তুলনা দেওয়া চলে না। জঘন্য চরিত্রের মেয়ে। ওকে কোনও ভদ্র বাড়িতে সহ্য করা যায় না। যে সমস্ত ছেলেরা ওর চারপাশে ঘোরে, মেয়েটার লজ্জা বলতেও কিছু নেই। তাই বা শুধু বলি কেন, হাই সোসাইটির অনেক নামকরা লোকেরাও ওর পিছনে ধাওয়া করে।

কিরণময়ীর মুখে বিক্ষোভের ছায়া ফুটে উঠল। এই সময় দরজার কাছে চাকর এসে জানাল, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিরণ ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, ও হো, তাই তো, তোমরা চলো চলো, খেয়ে নেবে চলো।

দোলা তখন সুনীতার ছবিটা হাতে ধরে গভীর অভিনিবেশ সহকারে দেখছিল। বলল, কিন্তু যা-ই বলো মা, মুখখানি সত্যি সুন্দর। কী বড় বড় চোখ, টিকোলো নাক, টানা ভুরু। একে চোখে দু-এক বার দেখেছি, গায়ের রংও টকটকে।

কিরণ বললেন, কিন্তু রূপ থাকলেই সব হয় না দোলন।

দোলা ছবির দিকে চোখ রেখেই বলল, তা জানি। কিন্তু এই ছবিটা দেখে সত্যি কোথাও খারাপ বলে মনে হয় না। এমন সুন্দর মুখ, তবু খারাপ কেন হয়। পরমুহূর্তেই সে সুজিতের দিকে চোখ তুলে বলল, কিন্তু আপনার এতখানি মনে ছিল মুখটা? আশ্চর্য তো!

কিরণ বললেন, আঁকাটাও চমৎকার হয়েছে। কিন্তু আর দেরি নয়, তাড়াতাড়ি খেতে এসো।

দোলা ছবিটা রেখে দিয়ে সুজিতকে বলল, আসুন।

সুজিতের আচ্ছন্নতা যেন কাটছিল না। বলল, অ্যাঁ? হ্যাঁ। কিন্তু আমার এখনও একদম খিদে পায়নি যে!

কিরণ বললেন, কেন, এমন তো কিছু খাওনি। বেলাও অনেক হয়েছে। তোমাকে তো শিবেন আবার নিতে আসবে এখুনি, যা ইচ্ছে হয়, তাই একটু মুখে দিও, এসো।

সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, ও, আচ্ছা। আমাকে তো আবার যেতে হবে।

 খাওয়ার সময়েই সংবাদ এল, শিবেন উপস্থিত, সুজিতের জন্যে অপেক্ষা করছে। যাবার সময় দোলা তাড়াতাড়ি সুনীতার স্কেচটা এনে দিল সুজিতকে। বলল, এটা নিয়ে যান, আমরা কী করব।

ইতিমধ্যে সুজিতের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গিয়েছিল। বলল, নিয়ে যাব? আচ্ছা নিয়ে যাই। কিন্তু জান দোলা, যে এত খারাপ তার মধ্যে আমি কেন যে অমন দুঃখকে দেখতে পেলাম জানি না।

ছেলেমানুষের মুখে গাম্ভীর্য দেখা দিলে যেমন হয়, সুজিতকে সেইরকম দেখল দোলা। হেসে বলল, আপনি যে প্রেমিক!

সুজিত বলল, ও!

দোলা হেসে ফেলল। কিরণময়ীর কাছ থেকে বিদায় নিল সুজিত। দোলা বলল, সময় পেলে আবার আসবেন।

–তোমার বাবা রাগ করবেন না?

–রাগ করবেন কেন?

–আমি তো এখন ওঁর কর্মচারী, বাড়িতে এলে উনি যদি রাগ করেন?

দোলা ওর বিস্মিত দৃষ্টি মায়ের সঙ্গে বিনিময় করল! কিরণ বললেন, আমি বলছি তোমাকে, মাঝে মধ্যে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেয়ো।

সুজিত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিরণময়ী পিছনেই ছিলেন। সুজিত বলল, মাসিমা, আপনাকে খুব ভাল লাগল। আপনি যেমন করে আমার মায়ের কথা বললেন, এরকম করে আর কখনও শুনিনি, তাই মনে হচ্ছে আপনি যেন আমার অনেক দিনের আপন।

কিরণময়ী জবাবে বললেন, সেইটি মনে করে তুমি আমার কাছে এসো।

নীচে যাবার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সুজিত বলল, আসব, এখানে আমার সবসময়ে আসতে ইচ্ছে করবে।

সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে আরম্ভ করল। দোলাও নামতে লাগল। সুজিত বলল, তুমি যাচ্ছ?

দোলা বলল, চলুন আপনাকে আরও এগিয়ে দিয়ে আসি। আমাকে যে আপনার ভাল লাগেনি সে তো বুঝতেই পারছি।

সিঁড়ির শেষ ধাপে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুজিত। দোলার দিকে তাকিয়ে বলল, সে কী, তোমাকে যে ভীষণ ভাল লেগেছে। ইচ্ছে হয়, তোমার মতো সুখী সুন্দর পবিত্র মেয়ের কাছে সবসময়ে থাকি।

দোলা যেন কেমন থতিয়ে গিয়ে, বিস্মিত অনুসন্ধিৎসায় সুজিতের চোখের দিকে তাকাল। পরমুহূর্তেই তার কালো আয়ত চোখ দুটি হাসিতে চিকচিক করে উঠল। বলল, কী করে সেটা বুঝব?

কী করে বোঝানো যায়, সেটা ব্যাখ্যা করার জন্যে ব্যস্ত বিব্রত হয়ে উঠল সুজিত। দোলা বলে উঠল, আচ্ছা থাক, আপনাকে আর বোঝাতে হবে না।

নীচের হলঘরের বাইরের দরজার কাছে শিবেনকে দেখা গেল। সে ডাক দিল সুজিতকে, আসুন।

সুজিত বীরেন্দ্রনারায়ণের বসবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দোলা বলল, ওখানে কী করবেন?

–ওখানে আমার জিনিসপত্র রয়েছে।

–ও, দাঁড়ান তা হলে বেয়ারাকে ডাকি, গাড়িতে তুলে দেবে।

 সুজিত বাধা দিয়ে বলল, না না, সেরকম কিছু নয়, একটা সামান্য বান্ডিল। বগলে করেই নিয়ে এসেছি, তাই নিয়ে যাব। তোমার বাবা ওটা একটা ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিয়েছেন।

দোলা অবাক হয়ে বলল, সেই বান্ডিলেই আপনার সব মালপত্র?

 সুজিত হেসে বলল, মালপত্র মানে দু-একটা জামাকাপড়, কিছু কাগজপত্র।

বীরেন্দ্রনারায়ণের ঘরে ঢোকবার আগে শিবেনের দিকে এক বার চোখ পড়ল সুজিতের। দেখল, শিবেন দোলার দিকে অনেকটা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে। যদি দোলা একটু চোখ তোলে, কথা বলে। কিন্তু সুজিত দোলার দিকে তাকিয়ে দেখল, দোলা গম্ভীর, মুখ অন্যদিকে ফেরানো। কেন? এদের কোনও ঝগড়া-বিবাদ আছে নাকি?

ঘরের মধ্যে ঢুকে সে তার প্যাকেটটা ড্রয়ার থেকে বের করে নিল। শিবেন গাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেটা বীরেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশ। সুজিত সোজা এগিয়ে গেল বাইরের দরজার দিকে। খেয়াল করল না, দোলা পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে শিবেনকেই দেখছিল, যে শিবেন তাকে দেখছিল না, দোলার দিকেই ঈষৎ আড়ষ্ট হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না।

প্রায় বাইরের দরজার কাছে গিয়ে সুজিতের মনে হল, দোলা সঙ্গে সঙ্গে আসছে না। সে পিছন ফিরে দেখল, দোলা অনেক দুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সুজিত তাড়াতাড়ি ফিরে গেল দোলার কাছে। বলল, আমার জ্ঞান হবার পর থেকে এরকম একটা বেলা কখনও কাটেনি দোলা।

দোলা বলল, তাই কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলেন?

না, আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমার সঙ্গেই আছ। রাগ করনি তো?

দোলা এক মুহূর্ত সুজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, না। কিন্তু আপনি মানুষটা যেন কেমন।

সুজিত আবার অপ্রতিভ হল। বলল, খুব খারাপ লাগে আমাকে, না? কী করব, আমি এখন তবু তো একটু ভাল হয়েছি, আগে হলে

দোলা বাধা দিয়ে বলে উঠল, কী সব বকছেন। আপনি একটা

–চালচুলোহীন—

 –তবু আপনাকে।

 –বোকা মনে হয়?

দোলা হেসে ফেলে বলল, যাচ্ছেতাই। মোট কথা আবার আসবেন।

ইতিমধ্যে শিবেন আবার ডাকল। বগলে পুঁটলিটা নিয়ে সুজিত দৌড় দিল, এবং প্রায় চকচকে মেঝেতে পিছলে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল।